08-01-2022, 11:30 AM
"বৃষ্টি" আমার ভালোবাসা
কিছু কিছু গল্প আছে যেগুলো পড়লেই মন ভাল হয়ে যায়, অনেক কিছুই মিলে যায় নিজের সাথে।গল্পটি পড়ে দেখুন ভাল লাগবে, কিছুটা প্রেম আর বাকীটা ভালোবাসা …
মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো বৃষ্টি।আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললো , ” আমি তোমাকে ভালোবাসি” ; ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ততক্ষনে বোকা বনে গেছি।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখছে নাকি।কোনভাবে বৃষ্টির বাহুবন্ধন ছাড়িয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে আম্মুর কাছে গেলাম।সেখানে আম্মু আর বৃষ্টির মা গল্প করছিলেন।আমি আম্মুর কোলে যেয়ে কাঁদো কাদোঁ হয়ে বলে দিলাম, “আম্মু বৃষ্টি বলে ও নাকি আমাকে ভালোবাসে।আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না। আমার এখন কি হবে আম্মু।ও কত পঁচা মেয়ে।” আমি হাউ মাউ করে কেঁদেই ফেললাম।আমার কান্না না থামিয়ে দুই মহিয়সী নারী তখন আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ব্যাস্ত। আমার বয়স তখন সাত কি আট বছর আর বৃষ্টি পাঁচের আশেপাশে। সেই বয়সে আমি সুকুমার রায় কিংবা তিন গোয়েন্দা পড়ে বিশাল জ্ঞানী আর বৃষ্টি সারাদিন বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখে ভীষন রোমান্টিক মেয়ে।আমাকে দেখলেই গান শুরু করতো, ” তুম পাস আয়ে, ইউ মুজকো রায়ে…” বৃষ্টির আচার আচরন তেমন পছন্দ না করলেও বৃষ্টিকে ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।চার দেয়ালের বন্দী জীবনে বৃষ্টিই ছিল আমার খেলার সাথী অথবা বলা যেতে পারে সবথেকে ভালো বন্ধু।আমি যখন ওকে হারকিউলিসের অভিযানের গল্প শোনাতে চাইতাম ও উল্টা আমাকে হিন্দী মুভির রিভিউ শুনিয়ে দিতো। খুব ভালো নাচতে পারতো, হাত পা কোমর দুলিয়ে নেচেও দেখাতো। মাঝে মাঝে গলার ওড়না ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কি এক রকমের নাচ দিত যা সেই বয়সে আমার জ্ঞানের বাইরে ছিল। দু একবার সর্পনাগিনের নাচ দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমার সুহৃদয়সম্পন্না আম্মাজান বৃষ্টিকে অতিশয় পছন্দ করতেন।বৃষ্টিকে ঘরে তোলার বেশ ইচ্ছেও তার মাঝে দেখা যেতো। হয়ত নিজের মেয়ে ছিল না বিধায় এই দুষ্ট মেয়েটিকে অনেক বেশি আদর করতেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বৃষ্টি ওদের বাসায় না থেকে আমাদের বাসাতেই থাকতো বেশি। বৃষ্টির বাবা মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলতেন, “এখন থেকেই এই বাড়িতে ঘর সংসার বেঁধে ফেলেছো, যখন একেবারে তোমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়ে দেব তখনতো বাবা মা কে চিনবে না।” এই কথায় বৃষ্টি লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে আমার দিকে তাকিয়ে হাফ ইঞ্চির ঠোট দুই ইঞ্চি করে একটা হাসি দিতো। ওর সেই হাসির রহস্য উদঘাটনের কোন আভাস আমি তখনো টিনটিন সিরিজে পাইনি। এভাবেই দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে যায়।আমি তখন দশম শ্রেনীতে পড়ি আর ও ক্লাস সেভেনে।তখনো আমাকে জ্বালাতন করা থামেনি। ও যখন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, ওকে দেখতে আমার কেমন যেন কার্টুন কার্টুন মনে হতো।হাতে পায়ে লম্বা হলেও দুষ্টামি কমেনি ওর। একদিন পরীক্ষার আগে আমি কোচিং এ। ও কখন যে একটা লাভলেটার লিখে আমার টেবিলে রেখে গেছে আমি জানতামই না। আমার বাবা কখনো আমার খোঁজ খবর না নিলেও সেদিন কি মনে করে আমার ঘরে যেয়ে এই ভয়ংকর মেয়ের লাভলেটার উদ্ধার করে। আমি যখন বাসায় ফিরলাম দেখি যে দুই ফ্যামিলি একত্র হয়ে বসে আছে। আম্মু আমার দিকে লাভলেটারটা বাড়িয়ে দিলেন। চিঠির শেষে ছোট্ট করে প্যাচের হাতে লেখা, ” ইতি , তোমার ভালোবাসার বৃষ্টি।” আমি এবারও ঘটনার কিছু বুঝতে না পেরে কেঁদেই ফেললাম, একটু পরে দেখি বৃষ্টিও আমার সাথে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।দুজনকে কান্না করতে দেখে দুজন বাবা আর দুজন মা কিভাবে এত হাসতে পারে সেটাও আমি এখনো বুঝতে পারি না। এরই মাঝে বছর দুয়েক পেরিয়ে যায়।
আমি কলেজে তখন ভবিষ্যত গড়ায় ব্যাস্ত। নিক্তি আর ক্যালভিন স্কেলের সুক্ষ রিড খাতায় টুকে স্যারকে দেখিয়ে মার্ক বাড়ানো ছাড়া তখন আর কোন লক্ষ্য স্থির করতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই একদিন আমার জন্মদিনে বৃষ্টির দেয়া গিফট দেখে ওর কথা মনে পড়ে গেলো।কিছুদিন থেকে যে ও আমাকে জ্বালাতন করছে না সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। কেন যেন ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে হলো সেদিন। আর সেদিন বিকেলেই আমার জীবনের সব থেকে বড় হৃদকম্প হয়েছিল, রিকটার স্কেলে পরিমাপ করলে যার মাত্রা নয় ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন বিকেলে ছাদে বসে আমি ভাবছিলাম বৃষ্টির আবার অসুখ করলো নাকি।নইলে যে মেয়ে সারাদিন আমার পাশে ঘুর ঘুর করে সে হঠাৎ করে কোথায় চলে যাবে? হঠাৎ করেই দেখি কোন একটা মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি যেদিকটায় তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে লাল পাড়ের শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, চোখে বেশ করে কাজল দেয়া, চুল ছেড়ে দেয়াতে মেয়েটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এইটা বৃষ্টি।আমি পুরাই আহাম্মক হয়ে গেলাম। এই কয়দিনে বৃষ্টি কত বড় হয়ে গেছে,আবার তার উপরে পুরাই অপ্সরী ছাড়িয়ে গেছে!আমি কাছে যেয়ে আস্তে করে বললাম,” বৃষ্টি, তোকে আজ দেখতে খুব সুন্দর লাগছে রে, মনে হচ্ছে আধো নীল আর আধো গোধূলীর আকাশ থেকে কোন রাজকন্যা নেমে এসেছে” ; লজ্জায় টমেটোর মত মুখ করে দৌড়ে পালিয়ে যায় বৃষ্টি। এরপর আমার ধারে কাছেও ভিড়তো না বৃষ্টি। কোন কারনে ভুল করে যদি আমি ওর সামনে পড়ে যেতাম লজ্জায় মাথা নীচু করে রাখতো।আমি এক সময় অনুভব করলাম এই মেয়েটার সাথে আমার হৃদয়ের কোন সম্পর্ক আছে।আমি ঘুমাতে গেলে ঘুমাতে পারি না, রাস্তায় হাটার সময় বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকি, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বৃষ্টিদের বাসায় উঁকিঝুকি মারি ওকে একটু দেখার আশায়। বুঝলাম আমি শেষ । এরই মধ্যে আমি চুয়েটে চান্স পেয়ে যাই। ঢাকায় হয়নি বলে মনে তখন বিশাল ক্ষত। সবচেয়ে বেশি কস্ট হচ্ছিল বৃষ্টিকে দেখতে পারব না ভেবে।ইচ্ছে ছিলো যাওয়ার আগে বৃষ্টিকে ভালোবাসার কথা বলবো, কিন্তু আমার হৃদয়ের অপারেটিং সিস্টেম থেকে বলতে লাগলো, ” আপনার বুকে যথেষ্ঠ পরিমান সাহস জমা নেই, অনুগ্রহপূর্বক রিচার্জ করে আবার আসুন, ধন্যবাদ।” প্রতি সেমিস্টার শেষ করে সোজা ঢাকায় চলে যেতাম, কিন্তু তখনো আমি সাহসের ফার্স্ট লেভেল পার করতে পারিনি।টুকটাক কথা চলতো আমাদের, কিন্তু সাহস করে ভালোবাসি শব্দটা বলতে পারতাম না। আমি তখন বুঝতে পারি যারা সত্যিকারের ভালোবাসে , ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রথমবার এই শব্দটি বলা কত বড় দুষ্কর কাজ। কনকনে শীতের মাঝেও ওকে দেখলে আমি ঘামিয়ে যেতাম। এভাবেই লুকোচুরিতে চলতে থাকে দুটি মনের নিরন্তর ভালো লাগার খেলা। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি তখন ফাইনাল দিয়েছি।দুইদিন পরে রেজাল্ট আসবে।আর মাত্র দুইদিন পরে আমি গ্রাজুয়েট হতে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন যেন শিহরন জাগে গায়ে। এরই মধ্যে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিলো, “কাল আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা করবে।যদি ভালোবাসো ফিরে এসো; বৃষ্টি।” আমি স্তদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।পাশে থেকে বন্ধু ইমন ঝুকে পরে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কিরে খিজ খাইলি কেন? কি হইছে?” আমি অস্ফুস্ট স্বরে শুধু বললাম ,”বৃষ্টির বিয়ে।” বন্ধু যে কত মহান হতে পারে আমি সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম। রাত সাড়ে চারটায় ইমন আমাকে নিয়ে মোটর সাইকেল হাকিয়ে রওনা দিলো বাস কাউন্টারে।যেয়ে দেখি লাস্ট বাস ছেড়ে গেছে। সকাল ছাড়া উপায় নাই। কি আর করা, দুই বন্ধু মোটর সাইকেল নিয়েই রওনা দিলাম ঢাকায়। আমি কিছুতেই বৃষ্টিকে হারাতে চাই না।ছোট বেলার ছোট ছোট সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল।কেউ যদি আমাকে রচনা লিখতে বলে চাইল্ডহুড মেমরী নিয়ে তাহলে সাতপৃষ্টা জুড়েই থাকবে বৃষ্টির কথা। সেই বৃষ্টিকে আমি হারাতে বসেছি ! সন্ধ্যায় ঠিক আগে আগে আমার বাসার কাছেই পৌছলাম।দৌড়ে আমাদের বাসায় না যেয়ে সোজা বৃষ্টিদের বাসায় ঢুকলাম।বাসা ভর্তি মেহমান। কিছু অচেনা লোক। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য।হাপাতে হাপাতে মুরব্বিদের সামনে যেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে সিনেমার স্টাইলে বলে ফেললাম,” এই বিয়ে হতে পারে না। I Love Her From Childhood !” পাশে তাকিয়ে দেখি আমার বাবাও বসে আছে।মুরুব্বিরা সব একে অপরের দিকে তাকাতে শুরু করেছে।আমি পাগলের মত কিসব বলে ফেলেছি। আজ এখানে নির্ঘাত কোন লঙ্কাকান্ড না হয়ে যায় না।কিন্তু হঠাৎ করেই ঘরে হাসির রোল পরে গেলো।কেউ হাসি থামাতে পারছে না। আমি ভাবলাম লং জার্নিতে গায়ে মুখে কালি লেগেছে তাই হয়ত হাসছে, হাত দিয়ে গাল ঘষতে লাগলাম।পরে যেয়ে জানতে পারলাম সেদিন বৃষ্টির সাথে আমারই বিয়ের কথা হচ্ছিল। পাশের ঘরের জানালায় বৃষ্টি তাকিয়ে ছিল।পা টিপে পেছন থেকে যেয়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখলাম। বৃষ্টি মৃদু কেঁপে উঠলো। আজ ওকে অপ্সরীর মত দেখাচ্ছে।ওর গাল টিপে দিয়ে বললাম,” এখনো দুষ্টুমী কমেনি তোমার ?” লজ্জা রাঙা মুখ ঢাকতে আমার বাহুডোরে এসে ধরা দিলো আমার স্বপ্নের অপ্সরী।দুহাতে জড়িয়ে নিলাম সারা জীবনের জন্য। আজও দুষ্টুমী কমেনি ওর বরং ভালোবাসা বেড়েছে।
কিছু কিছু গল্প আছে যেগুলো পড়লেই মন ভাল হয়ে যায়, অনেক কিছুই মিলে যায় নিজের সাথে।গল্পটি পড়ে দেখুন ভাল লাগবে, কিছুটা প্রেম আর বাকীটা ভালোবাসা …
মুখ ভার করে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো বৃষ্টি।আমাকে চমকে দিয়ে হঠাৎ আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেই ফেললো , ” আমি তোমাকে ভালোবাসি” ; ঘটনার আকস্মিকতায় আমি ততক্ষনে বোকা বনে গেছি।চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম কেউ দেখছে নাকি।কোনভাবে বৃষ্টির বাহুবন্ধন ছাড়িয়ে দৌড়ে পাশের ঘরে আম্মুর কাছে গেলাম।সেখানে আম্মু আর বৃষ্টির মা গল্প করছিলেন।আমি আম্মুর কোলে যেয়ে কাঁদো কাদোঁ হয়ে বলে দিলাম, “আম্মু বৃষ্টি বলে ও নাকি আমাকে ভালোবাসে।আমাকে ছাড়া নাকি বাঁচবে না। আমার এখন কি হবে আম্মু।ও কত পঁচা মেয়ে।” আমি হাউ মাউ করে কেঁদেই ফেললাম।আমার কান্না না থামিয়ে দুই মহিয়সী নারী তখন আমার কথা শুনে অট্টহাসিতে ব্যাস্ত। আমার বয়স তখন সাত কি আট বছর আর বৃষ্টি পাঁচের আশেপাশে। সেই বয়সে আমি সুকুমার রায় কিংবা তিন গোয়েন্দা পড়ে বিশাল জ্ঞানী আর বৃষ্টি সারাদিন বাংলা আর হিন্দি সিনেমা দেখে ভীষন রোমান্টিক মেয়ে।আমাকে দেখলেই গান শুরু করতো, ” তুম পাস আয়ে, ইউ মুজকো রায়ে…” বৃষ্টির আচার আচরন তেমন পছন্দ না করলেও বৃষ্টিকে ছাড়া আমার কোন উপায় ছিল না।চার দেয়ালের বন্দী জীবনে বৃষ্টিই ছিল আমার খেলার সাথী অথবা বলা যেতে পারে সবথেকে ভালো বন্ধু।আমি যখন ওকে হারকিউলিসের অভিযানের গল্প শোনাতে চাইতাম ও উল্টা আমাকে হিন্দী মুভির রিভিউ শুনিয়ে দিতো। খুব ভালো নাচতে পারতো, হাত পা কোমর দুলিয়ে নেচেও দেখাতো। মাঝে মাঝে গলার ওড়না ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কি এক রকমের নাচ দিত যা সেই বয়সে আমার জ্ঞানের বাইরে ছিল। দু একবার সর্পনাগিনের নাচ দেখার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিল। আমার সুহৃদয়সম্পন্না আম্মাজান বৃষ্টিকে অতিশয় পছন্দ করতেন।বৃষ্টিকে ঘরে তোলার বেশ ইচ্ছেও তার মাঝে দেখা যেতো। হয়ত নিজের মেয়ে ছিল না বিধায় এই দুষ্ট মেয়েটিকে অনেক বেশি আদর করতেন। ছোটবেলা থেকে দেখেছি বৃষ্টি ওদের বাসায় না থেকে আমাদের বাসাতেই থাকতো বেশি। বৃষ্টির বাবা মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলতেন, “এখন থেকেই এই বাড়িতে ঘর সংসার বেঁধে ফেলেছো, যখন একেবারে তোমাকে এই বাড়িতে পাঠিয়ে দেব তখনতো বাবা মা কে চিনবে না।” এই কথায় বৃষ্টি লজ্জিত হওয়ার পরিবর্তে আমার দিকে তাকিয়ে হাফ ইঞ্চির ঠোট দুই ইঞ্চি করে একটা হাসি দিতো। ওর সেই হাসির রহস্য উদঘাটনের কোন আভাস আমি তখনো টিনটিন সিরিজে পাইনি। এভাবেই দেখতে দেখতে বেশ কিছু বছর কেটে যায়।আমি তখন দশম শ্রেনীতে পড়ি আর ও ক্লাস সেভেনে।তখনো আমাকে জ্বালাতন করা থামেনি। ও যখন আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো, ওকে দেখতে আমার কেমন যেন কার্টুন কার্টুন মনে হতো।হাতে পায়ে লম্বা হলেও দুষ্টামি কমেনি ওর। একদিন পরীক্ষার আগে আমি কোচিং এ। ও কখন যে একটা লাভলেটার লিখে আমার টেবিলে রেখে গেছে আমি জানতামই না। আমার বাবা কখনো আমার খোঁজ খবর না নিলেও সেদিন কি মনে করে আমার ঘরে যেয়ে এই ভয়ংকর মেয়ের লাভলেটার উদ্ধার করে। আমি যখন বাসায় ফিরলাম দেখি যে দুই ফ্যামিলি একত্র হয়ে বসে আছে। আম্মু আমার দিকে লাভলেটারটা বাড়িয়ে দিলেন। চিঠির শেষে ছোট্ট করে প্যাচের হাতে লেখা, ” ইতি , তোমার ভালোবাসার বৃষ্টি।” আমি এবারও ঘটনার কিছু বুঝতে না পেরে কেঁদেই ফেললাম, একটু পরে দেখি বৃষ্টিও আমার সাথে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছে।দুজনকে কান্না করতে দেখে দুজন বাবা আর দুজন মা কিভাবে এত হাসতে পারে সেটাও আমি এখনো বুঝতে পারি না। এরই মাঝে বছর দুয়েক পেরিয়ে যায়।
আমি কলেজে তখন ভবিষ্যত গড়ায় ব্যাস্ত। নিক্তি আর ক্যালভিন স্কেলের সুক্ষ রিড খাতায় টুকে স্যারকে দেখিয়ে মার্ক বাড়ানো ছাড়া তখন আর কোন লক্ষ্য স্থির করতে পারছিলাম না। হঠাৎ করেই একদিন আমার জন্মদিনে বৃষ্টির দেয়া গিফট দেখে ওর কথা মনে পড়ে গেলো।কিছুদিন থেকে যে ও আমাকে জ্বালাতন করছে না সেটা আমি বুঝতেই পারিনি। কেন যেন ওকে দেখতে খুব ইচ্ছে হলো সেদিন। আর সেদিন বিকেলেই আমার জীবনের সব থেকে বড় হৃদকম্প হয়েছিল, রিকটার স্কেলে পরিমাপ করলে যার মাত্রা নয় ছাড়িয়ে যাবে। সেদিন বিকেলে ছাদে বসে আমি ভাবছিলাম বৃষ্টির আবার অসুখ করলো নাকি।নইলে যে মেয়ে সারাদিন আমার পাশে ঘুর ঘুর করে সে হঠাৎ করে কোথায় চলে যাবে? হঠাৎ করেই দেখি কোন একটা মেয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমি যেদিকটায় তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে তাকিয়ে আছে। পড়নে লাল পাড়ের শাড়ি, ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক, চোখে বেশ করে কাজল দেয়া, চুল ছেড়ে দেয়াতে মেয়েটাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এইটা বৃষ্টি।আমি পুরাই আহাম্মক হয়ে গেলাম। এই কয়দিনে বৃষ্টি কত বড় হয়ে গেছে,আবার তার উপরে পুরাই অপ্সরী ছাড়িয়ে গেছে!আমি কাছে যেয়ে আস্তে করে বললাম,” বৃষ্টি, তোকে আজ দেখতে খুব সুন্দর লাগছে রে, মনে হচ্ছে আধো নীল আর আধো গোধূলীর আকাশ থেকে কোন রাজকন্যা নেমে এসেছে” ; লজ্জায় টমেটোর মত মুখ করে দৌড়ে পালিয়ে যায় বৃষ্টি। এরপর আমার ধারে কাছেও ভিড়তো না বৃষ্টি। কোন কারনে ভুল করে যদি আমি ওর সামনে পড়ে যেতাম লজ্জায় মাথা নীচু করে রাখতো।আমি এক সময় অনুভব করলাম এই মেয়েটার সাথে আমার হৃদয়ের কোন সম্পর্ক আছে।আমি ঘুমাতে গেলে ঘুমাতে পারি না, রাস্তায় হাটার সময় বিড়বিড় করে কি যেন বলতে থাকি, বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বৃষ্টিদের বাসায় উঁকিঝুকি মারি ওকে একটু দেখার আশায়। বুঝলাম আমি শেষ । এরই মধ্যে আমি চুয়েটে চান্স পেয়ে যাই। ঢাকায় হয়নি বলে মনে তখন বিশাল ক্ষত। সবচেয়ে বেশি কস্ট হচ্ছিল বৃষ্টিকে দেখতে পারব না ভেবে।ইচ্ছে ছিলো যাওয়ার আগে বৃষ্টিকে ভালোবাসার কথা বলবো, কিন্তু আমার হৃদয়ের অপারেটিং সিস্টেম থেকে বলতে লাগলো, ” আপনার বুকে যথেষ্ঠ পরিমান সাহস জমা নেই, অনুগ্রহপূর্বক রিচার্জ করে আবার আসুন, ধন্যবাদ।” প্রতি সেমিস্টার শেষ করে সোজা ঢাকায় চলে যেতাম, কিন্তু তখনো আমি সাহসের ফার্স্ট লেভেল পার করতে পারিনি।টুকটাক কথা চলতো আমাদের, কিন্তু সাহস করে ভালোবাসি শব্দটা বলতে পারতাম না। আমি তখন বুঝতে পারি যারা সত্যিকারের ভালোবাসে , ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রথমবার এই শব্দটি বলা কত বড় দুষ্কর কাজ। কনকনে শীতের মাঝেও ওকে দেখলে আমি ঘামিয়ে যেতাম। এভাবেই লুকোচুরিতে চলতে থাকে দুটি মনের নিরন্তর ভালো লাগার খেলা। কিন্তু হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেলো। আমি তখন ফাইনাল দিয়েছি।দুইদিন পরে রেজাল্ট আসবে।আর মাত্র দুইদিন পরে আমি গ্রাজুয়েট হতে যাচ্ছি ভাবতেই কেমন যেন শিহরন জাগে গায়ে। এরই মধ্যে আমার মোবাইলে একটা মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিলো, “কাল আমার বিয়ের কথাবার্তা পাকা করবে।যদি ভালোবাসো ফিরে এসো; বৃষ্টি।” আমি স্তদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।পাশে থেকে বন্ধু ইমন ঝুকে পরে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,” কিরে খিজ খাইলি কেন? কি হইছে?” আমি অস্ফুস্ট স্বরে শুধু বললাম ,”বৃষ্টির বিয়ে।” বন্ধু যে কত মহান হতে পারে আমি সেদিন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম। রাত সাড়ে চারটায় ইমন আমাকে নিয়ে মোটর সাইকেল হাকিয়ে রওনা দিলো বাস কাউন্টারে।যেয়ে দেখি লাস্ট বাস ছেড়ে গেছে। সকাল ছাড়া উপায় নাই। কি আর করা, দুই বন্ধু মোটর সাইকেল নিয়েই রওনা দিলাম ঢাকায়। আমি কিছুতেই বৃষ্টিকে হারাতে চাই না।ছোট বেলার ছোট ছোট সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল।কেউ যদি আমাকে রচনা লিখতে বলে চাইল্ডহুড মেমরী নিয়ে তাহলে সাতপৃষ্টা জুড়েই থাকবে বৃষ্টির কথা। সেই বৃষ্টিকে আমি হারাতে বসেছি ! সন্ধ্যায় ঠিক আগে আগে আমার বাসার কাছেই পৌছলাম।দৌড়ে আমাদের বাসায় না যেয়ে সোজা বৃষ্টিদের বাসায় ঢুকলাম।বাসা ভর্তি মেহমান। কিছু অচেনা লোক। আমি তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য।হাপাতে হাপাতে মুরব্বিদের সামনে যেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে সিনেমার স্টাইলে বলে ফেললাম,” এই বিয়ে হতে পারে না। I Love Her From Childhood !” পাশে তাকিয়ে দেখি আমার বাবাও বসে আছে।মুরুব্বিরা সব একে অপরের দিকে তাকাতে শুরু করেছে।আমি পাগলের মত কিসব বলে ফেলেছি। আজ এখানে নির্ঘাত কোন লঙ্কাকান্ড না হয়ে যায় না।কিন্তু হঠাৎ করেই ঘরে হাসির রোল পরে গেলো।কেউ হাসি থামাতে পারছে না। আমি ভাবলাম লং জার্নিতে গায়ে মুখে কালি লেগেছে তাই হয়ত হাসছে, হাত দিয়ে গাল ঘষতে লাগলাম।পরে যেয়ে জানতে পারলাম সেদিন বৃষ্টির সাথে আমারই বিয়ের কথা হচ্ছিল। পাশের ঘরের জানালায় বৃষ্টি তাকিয়ে ছিল।পা টিপে পেছন থেকে যেয়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখলাম। বৃষ্টি মৃদু কেঁপে উঠলো। আজ ওকে অপ্সরীর মত দেখাচ্ছে।ওর গাল টিপে দিয়ে বললাম,” এখনো দুষ্টুমী কমেনি তোমার ?” লজ্জা রাঙা মুখ ঢাকতে আমার বাহুডোরে এসে ধরা দিলো আমার স্বপ্নের অপ্সরী।দুহাতে জড়িয়ে নিলাম সারা জীবনের জন্য। আজও দুষ্টুমী কমেনি ওর বরং ভালোবাসা বেড়েছে।