03-10-2025, 10:32 PM
পর্ব ১৪
পড়ন্ত বিকেলে রঘুনাথ চায়ের দোকানে,আজ আড্ডার শুরু তেনাদের স্মরণে। জনাপাচেক বয়োজ্যেষ্ঠ মিলে তামাকের ধোঁয়া আর “খুক্ক” “খুক্ক” কাশি উঠিয়ে যা কথা বলছিলেন, সেগুলি কিরণের ঠিক হজম হচ্ছিল না।
— এই ত ক'মাস আগেই, গদাই ঘোষের গোয়ালে রাত্রিকালে কি একটা দেখলে হেমন্ত! তা সে তো দেখতেই চোখ উল্টে অজ্ঞান হবার যোগাড়।
শহর অঞ্চলের চাকচিককে ভূতের গল্প লোকে পড়ে বটে, কিন্তু বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ। বিশ্বাসের পার্সেন্টেজ তাই সেই তুলনায় অল্পই। তবে এই গ্রাম্য পরিবেশে, আম- কাঁঠালের বাগান আর শাল সেগুনে জঙ্গলে আজগুবি গল্পের আলাদা একটা টান আছে। বোধকরি সেই টানেই মোহিত হয়ে— সেন মশাইয়ের কথায় রঘুনাথ চা দিতে এসে দাড়িয়ে গেল কাছ ঘেঁষে। চোখেমুখে প্রকাশ্য কৌতুহল নিয়ে সে কি একটা বলতে গিয়েও শেষটায় সামলে নিলে।
এদিকে দোকানের ভেতরটায়, কিরণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুরুব্বীদের কথা শুনছিল আর বেজায় বিরক্ত হচ্ছিল।
তা গ্রাম্য আসরে আলোকিতা! সে তো মাঝে মাঝে উঠবেই। মানে তামাক বা চায়ের সহযোগে আজগুবি গল্পে আসর জমে ভালো। তবে সেই আসরে গুল তাপ্পি মারতেও গাঁয়ে বুড়োরাই সেরা। এই যখন সে ভাবছে মনে মনে, তখনি আর একজন বলে উঠলো,
— তা আর এমনকি! সেই যে মহেশখালীর লুটের ঘটনার সময়—সে আমার শ্বশুর বাড়িতে....
কিরণ চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললে,
– সে কাহিনী পুরোনো হয়ে গেছে মাস্টারমশাই! এবার নতুন একটা গল্প ফাদুন শুনি।
বলেই সে চালা ছাড়িয়ে পথে পা রাখলো। তার পেছন কি হলো, সেদিকে আর সে নজর দিল না। আজকের দিনটি সে আছে গ্রামে। কাল সকালেই আবার যাত্রা শুরু কলকাতার। সে তরিঘড়ি বাড়ি ফিরে দোতলার নিজের ঘরে ঢোকার মুখেই পড়লো সমীরের সামনে। সমীর এসেছিল কিরণের কাকিমার স্বাস্থ্যের অবস্থা পরীক্ষা করতে।এমনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা এই বাড়িতে প্রায় নিত্যদিনের হাঙ্গামা। চিকিৎসা যতোই হোক আর যত ভালোই ওষুধপত্র হোক না কেন, ককিমার বছরের ছ মাস বিছানার দখলদারী চলছেই।
সমীর যদিও বলেছিল, এই চিকিৎসায় যখন কিছু হবার নয় ,তখন টাকা থাকতে শহরে চিকিৎসা করাতে অসুবিধা কি? এখনো সে বলে কথা। কিন্তু রোগী যদি রোগ সারাতে না যায়, তখন আর সবাই কি বা করে? কেন না গৃহকর্তির ধারণা এই বাড়ির চৌকাঠ একবার পেরুলে, জীবিত অবস্থায় আর ফেরা হবে না গ্রামে! যদিও ভাবনাটা মনগড়া, ভিত্তিহীন কল্পনা মাত্র। কিন্তু এই ভাবনায় রমণীর অগাদ বিশ্বাস। সেই সাথে তার এক কথা,
– ভালো যদি হয় আমি, তবে বাবা তুই পারবি আমার রোগ সারাতে। ওই কলকাতার বড় ডাক্তার না ছাই- ও আমার ধাতে সইবে না।
এই কথা শুনতে শুনতে বছর চারেক পেরুলো। আজকের অবস্থাও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কিরণকে পেয়ে সমীর তাকে নিয়ে বসলো বৈঠক ঘরে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
– পুরাতন গ্রামোফোনটার হলো কি বলতো? তাছাড়া নতুন যে একটা কিনে আনলি,অতগুলো টাকা পেলি কোথায়?
এমন প্রশ্নের মুখে কিরণকে সুপ্রিয়ার সম্মুখেই পরতে হয়েছে একবার। উত্তরও সে দিয়েছে। সুতরাং এই কথা নিয়ে দ্বিতীয় বার আলোচনা সভা বসানোর তার ইচ্ছে হলো না। তার ওপড়ে সকাল থেকেই মন মেজাজের অবস্থা তার বেজায় মন্দ। মুখে একটু অপ্রসন্ন ভাব নিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে সে বললে,
– দ্যাখ দাদা,যা বলার সবটা বৌরাণী কে বলেছি। এখন এইসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া কাকাবাবুর আসার সময় হয়েছে। এখন এই সব কানে গেলে শুধু শুধু কাকিমাকে কথা শোনাবেন।
– তা এমন কাজ করিস কেন যাতে কাকিমা কথা শোনে? সমস্যা হয়েছিল তো আমায় বললি না কেন? তাছাড়া আসল কি হয়েছে তাও তো জানলাম!
প্রশ্নের ধাক্কায় ধাক্কায় বেচারার যখন ঘাম ছুটে যাবার অবস্থা। এমন সময় নন্দিনী,ইন্দিরা ও কমলা ঢুকল সদর দরজা দিয়ে। এবার পুজোতে ইন্দিরার স্বামী আসেনি। তবে আর কদিন পরেই সে আসবে বলে চিঠি দিয়েছে। চিঠি যদি সত্য হয়, তবে ইন্দিরার এবার যাবার সময় হয়েছে। তাই ত মন তার আপাতত বাপের বাড়ির সব আত্মীয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফিরে বেরাছে। তার সাথে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াছে বাকিদের কেও।
তো তাদের আসার উপলক্ষে কিরণ কায়দা করে সরে গেল। নন্দিনী কিরণের কলকাতা ফেরার খবর জানতো, শুধু জানতো না সে যাত্রা করবে কবে। তার সাথে কিরণের সম্পর্ক মোটের উপরে মন্দ ছিল না। তবে সেদিন কার অন্ধকারে,বাঁশ বাগানে যা হয়েছিলো! সেই ভেবে কিরণকে আড়ালে ডেকে কথা বলবার আগ্রহ তার মোটেই হয়ে উঠছিল না। তাই দোতলায় ওঠার আগে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে ইশারায় স্বামীকে আড়ালে ডেকলে। কমলা যদিওবা দেখলো,তবে সে দাদা বৌদির আলোচনায় বাগড়া না দিয়ে উঠে গেল দোতলায়।
এদিকে সমীর ও নন্দিনী বৈঠক ঘরের ডান পাশে, খোলা জানালার সম্মুখে এসে দাড়ালো। অপরাহ্নের কোমল রোদে কুন্দনন্দিনীকে দেখতে মন্দ নয়; বিশেষ ভালো লাগলো ডাক্তার মশাইয়ের। ইদানিং নন্দিনীর চালচলনে কিঞ্চিৎ গ্রাম্য ছোঁয়া লেগেছে। শাড়িটা ধরণে ও তার আচরণে শহুরে ভাব এখনো তেমনি আছে বটে। তবে মনের অনুভূতি গুলো সামলে নিয়ে নিজেকে মেলে ধরছে সে ধীরে ধীরে।
ডাক্তারের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দেখে নন্দিনীর একটু যেন অস্বস্তি লাগলো। যদিও এই দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছাড়া কামনা বলতে কিছুই ছিল। তবুও কটাক্ষের সহিস আঁচল টেনে নন্দিনী নিঃশব্দে স্বামীকে বুঝিয়ে দিলে। সমীর মৃদু হেসে দৃষ্টি ফেরালো বটে,তবে মনে মনে নন্দিনীর বর্তমান রূপটিকে সুপ্রিয়ার সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলো।
যদিও সুপ্রিয়ার সাজসজ্জার ও জাঁকজমকের কিছুই নন্দিনীর মধ্যে ছিল না। সাধারণ গাঢ় সবুজ শাড়ি পরনে তার কেশরাশি এই মুহূর্তে আঁট করে খোঁপায় আঁটা। কালো ব্লাউজের আড়ালে নিঃশ্বাসের তালে তালে বুকের ওঠানামা অল্পেই চোখেপরে। প্রশ্ন জাগে এত্ত অস্থিরতার কি তার কারণেই?
তা হোক, সেদিন ভোরে হাতের তালুতে সেই ফুলে ওঠা মাংসপিণ্ডর অনুভূতি— সমীর এখন মনে লেগে আছে।সেই কথা ভাবতেই চোখের মুগ্ধতা তার কামনায় ছেয়ে গেল। জানালার গরাদ পাশ কাটিয়ে বিকেলের হালকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছিল নন্দিনীর কানের সোনার দুল।সেই সাথে ঠোঁটের আদ্রতা ও আয়াত চোখের কাজল পড়া দৃষ্টি খনিকের জন্যে হলেও সমীর মনকে ও মনযোগকে একদম পথভ্রষ্ট করে দিলে......
////////
বাঁশঝাড় আর নানান গাছপালা ঘেরা কাঁচা পথ পেরোলে মুখুজ্জেদের পুরোনো বসতভিটে চোখে পড়ে। ভেতর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের পর্ব চুকেছে অনেক আগেই। কেউ কেউ এই মুহূর্তে দিবানিদ্রায় শুয়ে আছে নিজের ঘরে, আবার কেউ বা অলস ভঙ্গিতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। বাড়ির মেয়েরা পুকুরঘাট থেকে ফিরছিল হাসি-গল্প করতে করতে—সেখানে খানিক আগেই তাদের আড্ডা জমেছিল। তবে সেই আসরে সুপ্রিয়া ছিল না।
সে এই সময়ে রোয়াকে বসে খোকাকে কোলে চাপিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছিলো। তার হাতে ভাতের মুঠো নিয়ছ স্নেহমাখা কণ্ঠে সে ছেলেকে বললে—
– দ্যাখ তো সোনা আমার, অমন জেদ কোরো না। একবার খেয়ে দেখো দেখি, কত মিষ্টি আলুভাজা করেছি তোমার জন্য!
কিন্তু খোকার তাতে মোটেও আগ্রহ জাগলো না। জাগবেই বা কী করে—খেলার ঘোরে ডুবে থাকা বালকের কাছে মা-জননীর এমন আটকানো আদর বড়ো বিরক্তিকরই ঠেকে। তার ইচ্ছে করছিল ছুটে যায় মায়ের লাগালের বাইরে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সব সময় সবকিছু কি আর করা চলে? বিশেষ করে খোকা ভালো মতোই জানে তার মায়ের পক্ষে সম্ভব নয় তার পেছনে ছোটা, তবুও চেষ্টায় সে ত্রুটি রাখবে না।
কদিন আগে যখন তারা ওবাড়িতে ছিল। এমনি এক দুপুরে বকুলতলায় বাঁদর নাচ দেখবে বলে সে মায়ের থেকে ছুটে পালায়। কিন্তু একটু যেতেই পেছনে মায়ের আর্তনাদে থমকে দাঁড়ায় সে। সেদিন ছেলেকে ধরতে গিয়ে সুপ্রিয়া উঠনে পরে হাটুটে ব্যথা পেয়েছিল। ওই কথা মনে করে মায়ের থেকে পালাতে ভয় হয় তার। কেন না মায়ের পেঠে তার ছোট্ট একটা বোন আছে যে! মায়ের খুব লাগলে বোনরও লাগবে নিশ্চয়ই। এই কথা তার দাদা মশাই খুব করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। খুকির সাথে আর একটি মেয়ে এসে সুপ্রিয়া কে বললে,
— মা… মা… এদিকে দেখো… সন্ন্যাসী ঠাকুর এসেছে। সাথে একটা ছোট্ট ছেলে! আর এত্ত বড় একটা ঝোলা!
তা এসেছিল বটে। কাকিমা খবর পেয়ে গিয়েছিলেন প্রথমেই। বেরিয়ে তিনি দেখেছিলেন, গেরুয়া বসনে এক সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে বাঁশ ঝাড়ে ছায়াতে। তার সাথে বাদামি রঙের মোটা চাদর গায়ে জড়ানো ছোট্ট একটি ছেলে—হাতে মাটির কুম্ভ আর কাঁধে ঝোলানো ঝোলা। তিনি মাথার আঁচল টেনে মুখ ঢেকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন,
— আসুন ঠাকুর! দয়া করে পথ ছেড়ে একটু ভিতরে আসুন,পায়ের ধুলো দিন..
কাকিমা বললেন বটে, তবে বাড়িতে ঢোকার ইচ্ছে ঠাকুরের মধ্যে দেখা গেল না। তারা এসেছিল ভিক্ষা নিতে। তবে দুপুর রোদে হেঁটে হেঁটে ছোট্ট ছেলেটির হাল বেগতিক। কাকিমা ফিরে এই কথা বলতেই এবার সুপ্রিয়া গলায় আঁচলটা টেনে বেরিয়ে এল। খুকিকে সাথে নিয়ে সে এসে দাড়ালো তাদের কাছে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বোধ করি একটু আরাম বোধ করছিল। পথ ক্লান্তি শুধু তার মুখে নয় নিঃশ্বাসের শব্দের অনুভব হচ্ছিল স্পষ্ট।
মেয়ের হাত ধরে সুপ্রিয়া বসলো ছেলেটির সম্মুখে হাঁটু গেড়ে। তারপর সন্ন্যাসী বাবার কথার তোয়াক্কা না করে, ছেলেটিকে আদরের সহিত কোলে তুলে নিয়ে গেল ভেতরে। অগত্যা সন্ন্যাসী দ্বিতীয় উপায় না দেখে মৃদু হেসে সেখানেই বসলেন।
খুকির খানিক ভয় লাগলো মাতার কান্ড দেখে।মনে হলো পুজোতে দেখা সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের মত,যদি রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বসেন! অবশ্য তেমন কিছুই হলো না। খুকির মন শান্ত হল বাবা ঠাকুরের হাসিমুখ দেখে।
সমীর বাড়িতে ঢোকার মুখে কাকিমাকে দেখলে আসন পেতে বাহির বারান্দায় সন্ন্যাসী বাবাকে খেতে বসিয়েছে। এক নজর দেখেই সে তার ঘরে ঢুকলো। খবর শুনে বাইরে থেকে দু- এক জন রমণী এল উঁকি মারতে মুখুজ্জে বাড়িতে…! তখন সন্ন্যাসী শান্তভাবে আহার শুরু করেছে মাত্র। এদিকে ভেতর বাড়িতে ছেলেটিকে কোলে বসিয়ে, মুখে ভাত তুলে দিয়ে হেসে বলল—
— মাসির কাছে লজ্জা করতে নেই, দেখি ভাত দুটো মুখে তোল দেখি।
সুপ্রিয়া বললেও ছেলেটি কিন্তু লজ্জায় প্রথমটা মুখ খুললো না। খানিক বাদে সে একটু সহজ হয়ে এলে পাশে বসা মেয়েটি জানতে চাইলে,
– তোমার নাম কি হে?”
ছেলেটি কুণ্ঠিত স্বরে নাম বলে। তবে প্রশ্নের এখানেই শেষ হয় না। কেন না সাধু বাবার আগমনে মুখার্জি বাড়িতে পাড়ার মেয়ে বৌদের ছোটখাটো একটা ভিড় লেগেছে। আগে যারা ছিল তারা তো আছেই, সাথে আরো নতুন কিছুও জুটেছে। তাদের মধ্যে আরেকজনের প্রশ্ন এল নিতান্ত কৌতূহলের বশেই
—সন্ন্যাসীর সাথে ঘুরছ? তোমার বাড়িঘর নেই নাকি?
ছেলেটি মাথা নিচু করে থাকে। বৌটির দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হয়। সে যেন একটু মজা করার ঢঙে আবার বলে—
—তুমি কি তবে সত্যিই সন্ন্যাসী হ’তে চাইছ? ওই রকম ঝোলা কাঁধে নিয়ে গাঁ-গঞ্জ ঘুরে বেড়াবে বুঝি?
ছেলেটি চুপ করে থাকে, তবে চোখে একটা কৌতূহল খেলা করে তার। এদিকে বৌটি মুখ টিপে হেসে ছেলেটির চিবুক ধরে বলে,
—“আহারে, এত সুন্দর ছেলেটি কি না সন্ন্যাসী? জান সন্ন্যাসী হ’লে আমার মতো বৌ জুটবে না কপালে! তখন কেমন করে বৌ পাবে? বৌ ছাড়া.....
ছেলেটি কি বুঝলে বোঝা গেল না,তবে লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললে। বৌটি হেসে উঠে আরো কিছু হয়তো বলতো, তবে এবার সুপ্রিয়া তাকে ধমক লাগিয়ে ছেলেটির মুখে ভাত তুলে দিয়ে বললে,
— ও সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী কিছু হবে না, জানিস তো। বড় হ’লে মেয়েরা তোকে দেখলেই মুগ্ধ হয়ে যাবে। তখন গেরুয়া ছেড়ে দিবি, বুঝলি?
এইসব কথাবার্তার মাঝে বিশেষ কিছু জানা গেল না। রহস্য অবশ্য উদঘাটন হল শেষে। তবে ছেলেটির কাছে নয়। আহারের শেষে সন্ন্যাসী যখন গাছের ছায়াতে একটু বিশ্রাম নেবেন বলে বসে ছিলেন,তখন সুপ্রিয়াই ছেলেটিকে নিয়ে এসে জানতে চাইলে। তখন সাধুর কথায় বোঝা গেল, তাদের যাত্রা পথ নদী ঘাট হয়ে নৌকা করে রেল পথের দিকে। ছেলটি অনাথ নয়, তবে মাতৃহীন। সাধু বাবার গাঁয়ের ছেলে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাধু সন্ন্যাসী তো আর আকাশ ফুরে বেরোয় না। তবে সেকথা থাক এখন। সুপ্রিয়ার প্রশ্নোত্তরে জানাগেল তার চলেছে কাশ্মীরে পথে। সুপ্রিয়া যদিও চাইছিল ছেলেটিকে কাছে রাখতে। তবে মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠল না। মানব জীবনে এমন অনেক কথাই মুখেতে বলা হয় না, থেকে যায় মনের গভীরে। তারপর অবশ্যই ধীরে ধীরে হারিয়েও যায়। বিদায় বেলা সুপ্রিয়া যখন হাতজোড় করে বললে,
— বাবা… আশীর্বাদ করবেন যেন সংসারটা ভালো চলে। সিঁথির সিঁদুর বজায় রেখে যেন মরতে পারি।
সন্ন্যাসী ঠাকুর তখন সুপ্রিয়ার মাথাহাত বুলিয়ে অনেক কিছু বললেও, তার কোনটাই সুপ্রিয়ার বোধগম্য হলো না। তবে শেষটায় সন্ন্যাসী হালকা হেসে সুপ্রিয়ার তালুর ওপর রেখে দিলেন একটা ভাজ করা লাল কাপড়। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– ওকে আবার নিয়ে আসবো মা, দুঃখ করিস নে।
কথা শেষ তিনি ছেলেটিকে সাথে নিয়ে পথে পা বাড়ালেন। আর ঠিক তখনই বাগানের ভেতর দিয়ে ইন্দিরা ও কমলা ফিরলো বাড়িতে। সুপ্রিয়া তখনো দাঁড়িয়ে ছিল কাঠাল তলায়। সেখান থেকে সুপ্রিয়াকে টেনে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে চাইলেও, সুপ্রিয়া কিন্তু গেল স্বামীর কাছে। সমীর তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজে মনে দিয়েছে। সুপ্রিয়া ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকলেও নূপুরের আওয়াজ ঠিকই গেল তার কানে। সে উঠে বসতেই সুপ্রিয়া এসে বসলে তার পায়ের কাছে মেঝে। হাত দুখানি বারিয়ে বললে,
– সাধু সন্ন্যাসী দান! দেখ তো কি এতে?
সুপ্রিয়ার মনের চাপা কৌতুহল ফুটে উঠছিল তার কথায় ও মুখভঙ্গিতে। সমীর তখন বিছানা ছেড়ে সুপ্রিয়ার পাশে বসে হাত বাড়িয়ে কাপড়টির ভাজ খুললো। দেখা গেল ভেতরে এক ছড়া শুকনো ফুল। পাপড়িগুলো যেন বহু বছর আগের রোদ আর হিমেল বাতাসে রঙ হারিয়েছে। তবুও কোথাও কোথাও একটু হালকা বেগুনি আভা এখনো রয়ে গেছে। প্রতি পাপড়ির কিনারায় সোনালি ধুলোর মত সূক্ষ্ম কণা জমে আছে। যেন কেউ মন্ত্রপাঠ করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, মন্ত্রশক্তির রেস কাটলে জীবন্ত হয়ে উঠবে এখনি। সমীর ফুল চেনে। সে একবার দেখেই বললে
– জানিনা তোমার সন্ন্যাসী বাবা এই বঙ্গদেশ এটি পেলেন কোথায়! এতো পশ্চিমা পর্বতমালায় ফোটে। এত দূরের বঙ্গদেশে তো এটি তো থাকার কথা নয়।
সুপ্রিয়া এই শুনে খানিক কি ভাবলে। কিন্তু আর কিছুই সে জানতে চাইলে না। সে ফুলের কথা শুনে ভেবেই নিয়েছে এটি তার ঠাকুরের পায়ে যাবে। তবে কি না সন্যাসীর দেওয়া ফুল! এটি তো আর পূজো শেষে ফেলে দেওয়া যায় না।
তা সমস্যা একটা তৈরি হলো বটে। অবশ্য সমাধান হল তৎক্ষণা। সে ভাবলে, কেন না কাপড়ে মুরেই ঠাকুরের পায়ের কাছে রেখে দেয় সেটি! এর থেকে ভালো আর তো কিছু হয় না।
তবে আপাতত সুপ্রিয়া সব ভুলে স্বামীর কোলে মাথা রাখলো। এই সময়ে গৃহকর্মের কিছুই তার করার ছিল না। ওদিকে সুপ্রিয়ার উঠেছে না দেখে সমীর এবার সংবাদপত্র একটু জোরেই পড়তে লাগলো। গ্রাম্য মেয়েছেলে হয়েছে বলি ঘরের রমণীদের কি দেশের খবর রাখতে নেই?
///////////
রাত্রিকালে বসারঘরে বাড়ির পুরুষদের আলোচনা সভা বসেছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রথমে কালীপুজো, তারপর জমির বেচাকেনার খবর এবং ধীরে ধীরে জয়নগরের চুরি থেকে কলিকাতার আন্দোলনে এসে পৌঁছালো..... এদিকে এসব আলোচনা যখন তুঙ্গে। ওদিকে সিঁদুরে আঁচে উষ্ণ রান্নাঘরের দুই রমণী—সুপ্রিয়া ও কুন্দনন্দিনী একটু ফাঁকা পেয়ে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করছিল।
– ঘুমানো আর সজাগ থাকার মাঝেও একটা সময় থাকে ভাই! সে কথা কি আর লোক সম্মুখে বলা যায়?
কুন্দনন্দিনীর এই কথায় চুপ হয়ে যায়। বুকের ভেতর যেন কিসের ঢেউ নামে, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ পায় না। শুধু উনুনের আঁচে তার ঘামে ভেজা গাল চকচক করে ওঠে। বাড়ির অন্দরে, বিশেষ করে স্নানঘর ও রান্নাঘরে রমণীগণের পরিধানের কাপড় অনেক সময় থাকে স্খলিত। এই অবস্থায় রান্নাঘরে ঘামে ভেজা শুভ্র নিটলো দেহ বড়ই কামনীও হয়ে ওঠে। সুতরাং এই দৃশ্য পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ যদি ডাক্তারের চোখে পরে। তবে দু'দন্ড দাঁড়ালে তাকে নিশ্চয়ই দোষের কিছু বলা যায় না!
অবশ্য এই সময়ে অনুভূতি চাপা পড়লোও,শোবার পর ডাক্তারের একটি হাত হঠাৎ নন্দিনীর শাড়ির ফাঁক দিয়ে নগ্ন কোমড় স্পর্শ করলো। কুন্দনন্দিনীর চোখেও ঘুম ছিল না তখন। সুতরাং শাড়ির ফাঁক দিয়ে নগ্ন কটিদেশে, হঠাৎ এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে সহজেই অপরাধী ধরা পড়ে। মনে যদিওবা খানিক দোলাচল ছিল, কিন্তু প্রথম কথা সমীরের দিক থেকেই এলো,
– কুন্দ!
কুন্দনন্দিনী চমকালো না,কেন না স্বামীর স্পর্শ আজ অনিচ্ছায় নয়। লাজে চোখ নামিয়ে আনলো সে,সাড়া দিতে পারলো না। সমীরের হাত ওপরে উঠলো। ব্লাউজে ঢাকা বাম বুকে আলতোভাবে চেপে বসলো। কুন্দনন্দিনীর শরীর কেঁপে উঠল, তবুও সে প্রতিরোধ করলো না। সমীর এবার অন্য হাতে তার আঁচল সরিয়ে দিল। নগ্ন পিঠ ঘামে ভিজে চকচক করছিল। সেখানে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেলো সে।আর তখনই নন্দিনীর মৃদু কন্ঠস্বর শোনা গেল,
– কি হচ্ছে এসব?
ফিসফিস করল কুন্দনন্দিনী, অথচ তার গলায় কোনো দৃঢ়তা ছিল না,বোধকরি লজ্জায়। সমীর আলতো করে তার কানের কাছে মুখ এনে বললে,
– তা বললে হয়? আমি ত শুধু একটু দেখতে চাইছি মাত্র!
কথা শেষ করে সমীর কুন্দনন্দিনীকে পেছন থেকেই
বুকের মধ্যে চেপে ধরল। আলিঙ্গনটা নরম নয়, কষে ধরা, যেন একবার আঁকড়ে ধরলে আর ছাড়বার নয়।কঠিন দুই বাহুতে কুন্দনন্দিনীর কোমর জড়িয়ে এমন শক্ত করে চেপে ধরল যেন নিঃশ্বাস তার আটকে এল। পরক্ষণেই স্বামীর ঠোঁটের গরম নিঃশ্বাস পিঠে পরতেই শরীর কেঁপে উঠল তার। মুখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে উঠল সে,
— লজ্জা করেনা আপনার, এভাবে জোর করে…
কথা শেষে যেন কেঁপে উঠল নিজেরই কণ্ঠ। সমীর কোনো জবাব দিল না। শুধু তাকে সমুখে ঘুরিয়ে এক হাতে তার আঁচল সরিয়ে দিল সম্পূর্ণ, অন্য হাতে চেপে ধরল বক্ষদেশ। মৃদু চুমু বসাল কানের পাশে, গলার বাঁকে। ডান হাতের আঙুলগুলো আলতো করে ঘোরাফেরা করতে লাগলে ব্লাউজের ওপরে।
কি হবে বুঝতে না পেরে,অজানা আতঙ্কে নন্দিনীর বুক ওঠানামা করছে দ্রুত,শরীর কাঁপছে দ্বিধা আর গোপন আগ্রহে। মাঝে মাঝেই কথায় প্রতিবাদ করলেও—আলিঙ্গনের ভেতরে সে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিল। মুহূর্তে যেন বোঝা গেল,কথায় না হোক,দেহের ভাষায় সে আত্মসমর্পণ করেই ফেলেছে।
পড়ন্ত বিকেলে রঘুনাথ চায়ের দোকানে,আজ আড্ডার শুরু তেনাদের স্মরণে। জনাপাচেক বয়োজ্যেষ্ঠ মিলে তামাকের ধোঁয়া আর “খুক্ক” “খুক্ক” কাশি উঠিয়ে যা কথা বলছিলেন, সেগুলি কিরণের ঠিক হজম হচ্ছিল না।
— এই ত ক'মাস আগেই, গদাই ঘোষের গোয়ালে রাত্রিকালে কি একটা দেখলে হেমন্ত! তা সে তো দেখতেই চোখ উল্টে অজ্ঞান হবার যোগাড়।
শহর অঞ্চলের চাকচিককে ভূতের গল্প লোকে পড়ে বটে, কিন্তু বিশ্বাস করে কিনা সন্দেহ। বিশ্বাসের পার্সেন্টেজ তাই সেই তুলনায় অল্পই। তবে এই গ্রাম্য পরিবেশে, আম- কাঁঠালের বাগান আর শাল সেগুনে জঙ্গলে আজগুবি গল্পের আলাদা একটা টান আছে। বোধকরি সেই টানেই মোহিত হয়ে— সেন মশাইয়ের কথায় রঘুনাথ চা দিতে এসে দাড়িয়ে গেল কাছ ঘেঁষে। চোখেমুখে প্রকাশ্য কৌতুহল নিয়ে সে কি একটা বলতে গিয়েও শেষটায় সামলে নিলে।
এদিকে দোকানের ভেতরটায়, কিরণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মুরুব্বীদের কথা শুনছিল আর বেজায় বিরক্ত হচ্ছিল।
তা গ্রাম্য আসরে আলোকিতা! সে তো মাঝে মাঝে উঠবেই। মানে তামাক বা চায়ের সহযোগে আজগুবি গল্পে আসর জমে ভালো। তবে সেই আসরে গুল তাপ্পি মারতেও গাঁয়ে বুড়োরাই সেরা। এই যখন সে ভাবছে মনে মনে, তখনি আর একজন বলে উঠলো,
— তা আর এমনকি! সেই যে মহেশখালীর লুটের ঘটনার সময়—সে আমার শ্বশুর বাড়িতে....
কিরণ চা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললে,
– সে কাহিনী পুরোনো হয়ে গেছে মাস্টারমশাই! এবার নতুন একটা গল্প ফাদুন শুনি।
বলেই সে চালা ছাড়িয়ে পথে পা রাখলো। তার পেছন কি হলো, সেদিকে আর সে নজর দিল না। আজকের দিনটি সে আছে গ্রামে। কাল সকালেই আবার যাত্রা শুরু কলকাতার। সে তরিঘড়ি বাড়ি ফিরে দোতলার নিজের ঘরে ঢোকার মুখেই পড়লো সমীরের সামনে। সমীর এসেছিল কিরণের কাকিমার স্বাস্থ্যের অবস্থা পরীক্ষা করতে।এমনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা এই বাড়িতে প্রায় নিত্যদিনের হাঙ্গামা। চিকিৎসা যতোই হোক আর যত ভালোই ওষুধপত্র হোক না কেন, ককিমার বছরের ছ মাস বিছানার দখলদারী চলছেই।
সমীর যদিও বলেছিল, এই চিকিৎসায় যখন কিছু হবার নয় ,তখন টাকা থাকতে শহরে চিকিৎসা করাতে অসুবিধা কি? এখনো সে বলে কথা। কিন্তু রোগী যদি রোগ সারাতে না যায়, তখন আর সবাই কি বা করে? কেন না গৃহকর্তির ধারণা এই বাড়ির চৌকাঠ একবার পেরুলে, জীবিত অবস্থায় আর ফেরা হবে না গ্রামে! যদিও ভাবনাটা মনগড়া, ভিত্তিহীন কল্পনা মাত্র। কিন্তু এই ভাবনায় রমণীর অগাদ বিশ্বাস। সেই সাথে তার এক কথা,
– ভালো যদি হয় আমি, তবে বাবা তুই পারবি আমার রোগ সারাতে। ওই কলকাতার বড় ডাক্তার না ছাই- ও আমার ধাতে সইবে না।
এই কথা শুনতে শুনতে বছর চারেক পেরুলো। আজকের অবস্থাও তার ব্যতিক্রম হলো না। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে কিরণকে পেয়ে সমীর তাকে নিয়ে বসলো বৈঠক ঘরে। গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
– পুরাতন গ্রামোফোনটার হলো কি বলতো? তাছাড়া নতুন যে একটা কিনে আনলি,অতগুলো টাকা পেলি কোথায়?
এমন প্রশ্নের মুখে কিরণকে সুপ্রিয়ার সম্মুখেই পরতে হয়েছে একবার। উত্তরও সে দিয়েছে। সুতরাং এই কথা নিয়ে দ্বিতীয় বার আলোচনা সভা বসানোর তার ইচ্ছে হলো না। তার ওপড়ে সকাল থেকেই মন মেজাজের অবস্থা তার বেজায় মন্দ। মুখে একটু অপ্রসন্ন ভাব নিয়ে কথা এড়িয়ে যেতে সে বললে,
– দ্যাখ দাদা,যা বলার সবটা বৌরাণী কে বলেছি। এখন এইসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া কাকাবাবুর আসার সময় হয়েছে। এখন এই সব কানে গেলে শুধু শুধু কাকিমাকে কথা শোনাবেন।
– তা এমন কাজ করিস কেন যাতে কাকিমা কথা শোনে? সমস্যা হয়েছিল তো আমায় বললি না কেন? তাছাড়া আসল কি হয়েছে তাও তো জানলাম!
প্রশ্নের ধাক্কায় ধাক্কায় বেচারার যখন ঘাম ছুটে যাবার অবস্থা। এমন সময় নন্দিনী,ইন্দিরা ও কমলা ঢুকল সদর দরজা দিয়ে। এবার পুজোতে ইন্দিরার স্বামী আসেনি। তবে আর কদিন পরেই সে আসবে বলে চিঠি দিয়েছে। চিঠি যদি সত্য হয়, তবে ইন্দিরার এবার যাবার সময় হয়েছে। তাই ত মন তার আপাতত বাপের বাড়ির সব আত্মীয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরে ফিরে বেরাছে। তার সাথে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াছে বাকিদের কেও।
তো তাদের আসার উপলক্ষে কিরণ কায়দা করে সরে গেল। নন্দিনী কিরণের কলকাতা ফেরার খবর জানতো, শুধু জানতো না সে যাত্রা করবে কবে। তার সাথে কিরণের সম্পর্ক মোটের উপরে মন্দ ছিল না। তবে সেদিন কার অন্ধকারে,বাঁশ বাগানে যা হয়েছিলো! সেই ভেবে কিরণকে আড়ালে ডেকে কথা বলবার আগ্রহ তার মোটেই হয়ে উঠছিল না। তাই দোতলায় ওঠার আগে, সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সে ইশারায় স্বামীকে আড়ালে ডেকলে। কমলা যদিওবা দেখলো,তবে সে দাদা বৌদির আলোচনায় বাগড়া না দিয়ে উঠে গেল দোতলায়।
এদিকে সমীর ও নন্দিনী বৈঠক ঘরের ডান পাশে, খোলা জানালার সম্মুখে এসে দাড়ালো। অপরাহ্নের কোমল রোদে কুন্দনন্দিনীকে দেখতে মন্দ নয়; বিশেষ ভালো লাগলো ডাক্তার মশাইয়ের। ইদানিং নন্দিনীর চালচলনে কিঞ্চিৎ গ্রাম্য ছোঁয়া লেগেছে। শাড়িটা ধরণে ও তার আচরণে শহুরে ভাব এখনো তেমনি আছে বটে। তবে মনের অনুভূতি গুলো সামলে নিয়ে নিজেকে মেলে ধরছে সে ধীরে ধীরে।
ডাক্তারের একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা দেখে নন্দিনীর একটু যেন অস্বস্তি লাগলো। যদিও এই দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ছাড়া কামনা বলতে কিছুই ছিল। তবুও কটাক্ষের সহিস আঁচল টেনে নন্দিনী নিঃশব্দে স্বামীকে বুঝিয়ে দিলে। সমীর মৃদু হেসে দৃষ্টি ফেরালো বটে,তবে মনে মনে নন্দিনীর বর্তমান রূপটিকে সুপ্রিয়ার সাথে মিলিয়ে দেখতে লাগলো।
যদিও সুপ্রিয়ার সাজসজ্জার ও জাঁকজমকের কিছুই নন্দিনীর মধ্যে ছিল না। সাধারণ গাঢ় সবুজ শাড়ি পরনে তার কেশরাশি এই মুহূর্তে আঁট করে খোঁপায় আঁটা। কালো ব্লাউজের আড়ালে নিঃশ্বাসের তালে তালে বুকের ওঠানামা অল্পেই চোখেপরে। প্রশ্ন জাগে এত্ত অস্থিরতার কি তার কারণেই?
তা হোক, সেদিন ভোরে হাতের তালুতে সেই ফুলে ওঠা মাংসপিণ্ডর অনুভূতি— সমীর এখন মনে লেগে আছে।সেই কথা ভাবতেই চোখের মুগ্ধতা তার কামনায় ছেয়ে গেল। জানালার গরাদ পাশ কাটিয়ে বিকেলের হালকা বাতাস এসে নাড়িয়ে দিচ্ছিল নন্দিনীর কানের সোনার দুল।সেই সাথে ঠোঁটের আদ্রতা ও আয়াত চোখের কাজল পড়া দৃষ্টি খনিকের জন্যে হলেও সমীর মনকে ও মনযোগকে একদম পথভ্রষ্ট করে দিলে......
////////
বাঁশঝাড় আর নানান গাছপালা ঘেরা কাঁচা পথ পেরোলে মুখুজ্জেদের পুরোনো বসতভিটে চোখে পড়ে। ভেতর বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের পর্ব চুকেছে অনেক আগেই। কেউ কেউ এই মুহূর্তে দিবানিদ্রায় শুয়ে আছে নিজের ঘরে, আবার কেউ বা অলস ভঙ্গিতে দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। বাড়ির মেয়েরা পুকুরঘাট থেকে ফিরছিল হাসি-গল্প করতে করতে—সেখানে খানিক আগেই তাদের আড্ডা জমেছিল। তবে সেই আসরে সুপ্রিয়া ছিল না।
সে এই সময়ে রোয়াকে বসে খোকাকে কোলে চাপিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছিলো। তার হাতে ভাতের মুঠো নিয়ছ স্নেহমাখা কণ্ঠে সে ছেলেকে বললে—
– দ্যাখ তো সোনা আমার, অমন জেদ কোরো না। একবার খেয়ে দেখো দেখি, কত মিষ্টি আলুভাজা করেছি তোমার জন্য!
কিন্তু খোকার তাতে মোটেও আগ্রহ জাগলো না। জাগবেই বা কী করে—খেলার ঘোরে ডুবে থাকা বালকের কাছে মা-জননীর এমন আটকানো আদর বড়ো বিরক্তিকরই ঠেকে। তার ইচ্ছে করছিল ছুটে যায় মায়ের লাগালের বাইরে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও সব সময় সবকিছু কি আর করা চলে? বিশেষ করে খোকা ভালো মতোই জানে তার মায়ের পক্ষে সম্ভব নয় তার পেছনে ছোটা, তবুও চেষ্টায় সে ত্রুটি রাখবে না।
কদিন আগে যখন তারা ওবাড়িতে ছিল। এমনি এক দুপুরে বকুলতলায় বাঁদর নাচ দেখবে বলে সে মায়ের থেকে ছুটে পালায়। কিন্তু একটু যেতেই পেছনে মায়ের আর্তনাদে থমকে দাঁড়ায় সে। সেদিন ছেলেকে ধরতে গিয়ে সুপ্রিয়া উঠনে পরে হাটুটে ব্যথা পেয়েছিল। ওই কথা মনে করে মায়ের থেকে পালাতে ভয় হয় তার। কেন না মায়ের পেঠে তার ছোট্ট একটা বোন আছে যে! মায়ের খুব লাগলে বোনরও লাগবে নিশ্চয়ই। এই কথা তার দাদা মশাই খুব করে বুঝিয়ে দিয়েছে তাকে। কিন্তু তাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। খুকির সাথে আর একটি মেয়ে এসে সুপ্রিয়া কে বললে,
— মা… মা… এদিকে দেখো… সন্ন্যাসী ঠাকুর এসেছে। সাথে একটা ছোট্ট ছেলে! আর এত্ত বড় একটা ঝোলা!
তা এসেছিল বটে। কাকিমা খবর পেয়ে গিয়েছিলেন প্রথমেই। বেরিয়ে তিনি দেখেছিলেন, গেরুয়া বসনে এক সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে আছে পথের পাশে বাঁশ ঝাড়ে ছায়াতে। তার সাথে বাদামি রঙের মোটা চাদর গায়ে জড়ানো ছোট্ট একটি ছেলে—হাতে মাটির কুম্ভ আর কাঁধে ঝোলানো ঝোলা। তিনি মাথার আঁচল টেনে মুখ ঢেকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন,
— আসুন ঠাকুর! দয়া করে পথ ছেড়ে একটু ভিতরে আসুন,পায়ের ধুলো দিন..
কাকিমা বললেন বটে, তবে বাড়িতে ঢোকার ইচ্ছে ঠাকুরের মধ্যে দেখা গেল না। তারা এসেছিল ভিক্ষা নিতে। তবে দুপুর রোদে হেঁটে হেঁটে ছোট্ট ছেলেটির হাল বেগতিক। কাকিমা ফিরে এই কথা বলতেই এবার সুপ্রিয়া গলায় আঁচলটা টেনে বেরিয়ে এল। খুকিকে সাথে নিয়ে সে এসে দাড়ালো তাদের কাছে। পাশে দাঁড়ানো ছেলেটি গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে বোধ করি একটু আরাম বোধ করছিল। পথ ক্লান্তি শুধু তার মুখে নয় নিঃশ্বাসের শব্দের অনুভব হচ্ছিল স্পষ্ট।
মেয়ের হাত ধরে সুপ্রিয়া বসলো ছেলেটির সম্মুখে হাঁটু গেড়ে। তারপর সন্ন্যাসী বাবার কথার তোয়াক্কা না করে, ছেলেটিকে আদরের সহিত কোলে তুলে নিয়ে গেল ভেতরে। অগত্যা সন্ন্যাসী দ্বিতীয় উপায় না দেখে মৃদু হেসে সেখানেই বসলেন।
খুকির খানিক ভয় লাগলো মাতার কান্ড দেখে।মনে হলো পুজোতে দেখা সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের মত,যদি রেগে গিয়ে ধমক দিয়ে বসেন! অবশ্য তেমন কিছুই হলো না। খুকির মন শান্ত হল বাবা ঠাকুরের হাসিমুখ দেখে।
সমীর বাড়িতে ঢোকার মুখে কাকিমাকে দেখলে আসন পেতে বাহির বারান্দায় সন্ন্যাসী বাবাকে খেতে বসিয়েছে। এক নজর দেখেই সে তার ঘরে ঢুকলো। খবর শুনে বাইরে থেকে দু- এক জন রমণী এল উঁকি মারতে মুখুজ্জে বাড়িতে…! তখন সন্ন্যাসী শান্তভাবে আহার শুরু করেছে মাত্র। এদিকে ভেতর বাড়িতে ছেলেটিকে কোলে বসিয়ে, মুখে ভাত তুলে দিয়ে হেসে বলল—
— মাসির কাছে লজ্জা করতে নেই, দেখি ভাত দুটো মুখে তোল দেখি।
সুপ্রিয়া বললেও ছেলেটি কিন্তু লজ্জায় প্রথমটা মুখ খুললো না। খানিক বাদে সে একটু সহজ হয়ে এলে পাশে বসা মেয়েটি জানতে চাইলে,
– তোমার নাম কি হে?”
ছেলেটি কুণ্ঠিত স্বরে নাম বলে। তবে প্রশ্নের এখানেই শেষ হয় না। কেন না সাধু বাবার আগমনে মুখার্জি বাড়িতে পাড়ার মেয়ে বৌদের ছোটখাটো একটা ভিড় লেগেছে। আগে যারা ছিল তারা তো আছেই, সাথে আরো নতুন কিছুও জুটেছে। তাদের মধ্যে আরেকজনের প্রশ্ন এল নিতান্ত কৌতূহলের বশেই
—সন্ন্যাসীর সাথে ঘুরছ? তোমার বাড়িঘর নেই নাকি?
ছেলেটি মাথা নিচু করে থাকে। বৌটির দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ হয়। সে যেন একটু মজা করার ঢঙে আবার বলে—
—তুমি কি তবে সত্যিই সন্ন্যাসী হ’তে চাইছ? ওই রকম ঝোলা কাঁধে নিয়ে গাঁ-গঞ্জ ঘুরে বেড়াবে বুঝি?
ছেলেটি চুপ করে থাকে, তবে চোখে একটা কৌতূহল খেলা করে তার। এদিকে বৌটি মুখ টিপে হেসে ছেলেটির চিবুক ধরে বলে,
—“আহারে, এত সুন্দর ছেলেটি কি না সন্ন্যাসী? জান সন্ন্যাসী হ’লে আমার মতো বৌ জুটবে না কপালে! তখন কেমন করে বৌ পাবে? বৌ ছাড়া.....
ছেলেটি কি বুঝলে বোঝা গেল না,তবে লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেললে। বৌটি হেসে উঠে আরো কিছু হয়তো বলতো, তবে এবার সুপ্রিয়া তাকে ধমক লাগিয়ে ছেলেটির মুখে ভাত তুলে দিয়ে বললে,
— ও সন্ন্যাসী-টন্ন্যাসী কিছু হবে না, জানিস তো। বড় হ’লে মেয়েরা তোকে দেখলেই মুগ্ধ হয়ে যাবে। তখন গেরুয়া ছেড়ে দিবি, বুঝলি?
এইসব কথাবার্তার মাঝে বিশেষ কিছু জানা গেল না। রহস্য অবশ্য উদঘাটন হল শেষে। তবে ছেলেটির কাছে নয়। আহারের শেষে সন্ন্যাসী যখন গাছের ছায়াতে একটু বিশ্রাম নেবেন বলে বসে ছিলেন,তখন সুপ্রিয়াই ছেলেটিকে নিয়ে এসে জানতে চাইলে। তখন সাধুর কথায় বোঝা গেল, তাদের যাত্রা পথ নদী ঘাট হয়ে নৌকা করে রেল পথের দিকে। ছেলটি অনাথ নয়, তবে মাতৃহীন। সাধু বাবার গাঁয়ের ছেলে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সাধু সন্ন্যাসী তো আর আকাশ ফুরে বেরোয় না। তবে সেকথা থাক এখন। সুপ্রিয়ার প্রশ্নোত্তরে জানাগেল তার চলেছে কাশ্মীরে পথে। সুপ্রিয়া যদিও চাইছিল ছেলেটিকে কাছে রাখতে। তবে মুখ ফুটে বলা হয়ে উঠল না। মানব জীবনে এমন অনেক কথাই মুখেতে বলা হয় না, থেকে যায় মনের গভীরে। তারপর অবশ্যই ধীরে ধীরে হারিয়েও যায়। বিদায় বেলা সুপ্রিয়া যখন হাতজোড় করে বললে,
— বাবা… আশীর্বাদ করবেন যেন সংসারটা ভালো চলে। সিঁথির সিঁদুর বজায় রেখে যেন মরতে পারি।
সন্ন্যাসী ঠাকুর তখন সুপ্রিয়ার মাথাহাত বুলিয়ে অনেক কিছু বললেও, তার কোনটাই সুপ্রিয়ার বোধগম্য হলো না। তবে শেষটায় সন্ন্যাসী হালকা হেসে সুপ্রিয়ার তালুর ওপর রেখে দিলেন একটা ভাজ করা লাল কাপড়। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
– ওকে আবার নিয়ে আসবো মা, দুঃখ করিস নে।
কথা শেষ তিনি ছেলেটিকে সাথে নিয়ে পথে পা বাড়ালেন। আর ঠিক তখনই বাগানের ভেতর দিয়ে ইন্দিরা ও কমলা ফিরলো বাড়িতে। সুপ্রিয়া তখনো দাঁড়িয়ে ছিল কাঠাল তলায়। সেখান থেকে সুপ্রিয়াকে টেনে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতে চাইলেও, সুপ্রিয়া কিন্তু গেল স্বামীর কাছে। সমীর তখন বিছানায় আধশোয়া হয়ে খবরের কাগজে মনে দিয়েছে। সুপ্রিয়া ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকলেও নূপুরের আওয়াজ ঠিকই গেল তার কানে। সে উঠে বসতেই সুপ্রিয়া এসে বসলে তার পায়ের কাছে মেঝে। হাত দুখানি বারিয়ে বললে,
– সাধু সন্ন্যাসী দান! দেখ তো কি এতে?
সুপ্রিয়ার মনের চাপা কৌতুহল ফুটে উঠছিল তার কথায় ও মুখভঙ্গিতে। সমীর তখন বিছানা ছেড়ে সুপ্রিয়ার পাশে বসে হাত বাড়িয়ে কাপড়টির ভাজ খুললো। দেখা গেল ভেতরে এক ছড়া শুকনো ফুল। পাপড়িগুলো যেন বহু বছর আগের রোদ আর হিমেল বাতাসে রঙ হারিয়েছে। তবুও কোথাও কোথাও একটু হালকা বেগুনি আভা এখনো রয়ে গেছে। প্রতি পাপড়ির কিনারায় সোনালি ধুলোর মত সূক্ষ্ম কণা জমে আছে। যেন কেউ মন্ত্রপাঠ করে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, মন্ত্রশক্তির রেস কাটলে জীবন্ত হয়ে উঠবে এখনি। সমীর ফুল চেনে। সে একবার দেখেই বললে
– জানিনা তোমার সন্ন্যাসী বাবা এই বঙ্গদেশ এটি পেলেন কোথায়! এতো পশ্চিমা পর্বতমালায় ফোটে। এত দূরের বঙ্গদেশে তো এটি তো থাকার কথা নয়।
সুপ্রিয়া এই শুনে খানিক কি ভাবলে। কিন্তু আর কিছুই সে জানতে চাইলে না। সে ফুলের কথা শুনে ভেবেই নিয়েছে এটি তার ঠাকুরের পায়ে যাবে। তবে কি না সন্যাসীর দেওয়া ফুল! এটি তো আর পূজো শেষে ফেলে দেওয়া যায় না।
তা সমস্যা একটা তৈরি হলো বটে। অবশ্য সমাধান হল তৎক্ষণা। সে ভাবলে, কেন না কাপড়ে মুরেই ঠাকুরের পায়ের কাছে রেখে দেয় সেটি! এর থেকে ভালো আর তো কিছু হয় না।
তবে আপাতত সুপ্রিয়া সব ভুলে স্বামীর কোলে মাথা রাখলো। এই সময়ে গৃহকর্মের কিছুই তার করার ছিল না। ওদিকে সুপ্রিয়ার উঠেছে না দেখে সমীর এবার সংবাদপত্র একটু জোরেই পড়তে লাগলো। গ্রাম্য মেয়েছেলে হয়েছে বলি ঘরের রমণীদের কি দেশের খবর রাখতে নেই?
///////////
রাত্রিকালে বসারঘরে বাড়ির পুরুষদের আলোচনা সভা বসেছিল। আলোচনার বিষয়বস্তু প্রথমে কালীপুজো, তারপর জমির বেচাকেনার খবর এবং ধীরে ধীরে জয়নগরের চুরি থেকে কলিকাতার আন্দোলনে এসে পৌঁছালো..... এদিকে এসব আলোচনা যখন তুঙ্গে। ওদিকে সিঁদুরে আঁচে উষ্ণ রান্নাঘরের দুই রমণী—সুপ্রিয়া ও কুন্দনন্দিনী একটু ফাঁকা পেয়ে নিজেদের মধ্যে ভাব বিনিময় করছিল।
– ঘুমানো আর সজাগ থাকার মাঝেও একটা সময় থাকে ভাই! সে কথা কি আর লোক সম্মুখে বলা যায়?
কুন্দনন্দিনীর এই কথায় চুপ হয়ে যায়। বুকের ভেতর যেন কিসের ঢেউ নামে, কিন্তু মুখে তা প্রকাশ পায় না। শুধু উনুনের আঁচে তার ঘামে ভেজা গাল চকচক করে ওঠে। বাড়ির অন্দরে, বিশেষ করে স্নানঘর ও রান্নাঘরে রমণীগণের পরিধানের কাপড় অনেক সময় থাকে স্খলিত। এই অবস্থায় রান্নাঘরে ঘামে ভেজা শুভ্র নিটলো দেহ বড়ই কামনীও হয়ে ওঠে। সুতরাং এই দৃশ্য পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ যদি ডাক্তারের চোখে পরে। তবে দু'দন্ড দাঁড়ালে তাকে নিশ্চয়ই দোষের কিছু বলা যায় না!
অবশ্য এই সময়ে অনুভূতি চাপা পড়লোও,শোবার পর ডাক্তারের একটি হাত হঠাৎ নন্দিনীর শাড়ির ফাঁক দিয়ে নগ্ন কোমড় স্পর্শ করলো। কুন্দনন্দিনীর চোখেও ঘুম ছিল না তখন। সুতরাং শাড়ির ফাঁক দিয়ে নগ্ন কটিদেশে, হঠাৎ এই অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শে সহজেই অপরাধী ধরা পড়ে। মনে যদিওবা খানিক দোলাচল ছিল, কিন্তু প্রথম কথা সমীরের দিক থেকেই এলো,
– কুন্দ!
কুন্দনন্দিনী চমকালো না,কেন না স্বামীর স্পর্শ আজ অনিচ্ছায় নয়। লাজে চোখ নামিয়ে আনলো সে,সাড়া দিতে পারলো না। সমীরের হাত ওপরে উঠলো। ব্লাউজে ঢাকা বাম বুকে আলতোভাবে চেপে বসলো। কুন্দনন্দিনীর শরীর কেঁপে উঠল, তবুও সে প্রতিরোধ করলো না। সমীর এবার অন্য হাতে তার আঁচল সরিয়ে দিল। নগ্ন পিঠ ঘামে ভিজে চকচক করছিল। সেখানে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেলো সে।আর তখনই নন্দিনীর মৃদু কন্ঠস্বর শোনা গেল,
– কি হচ্ছে এসব?
ফিসফিস করল কুন্দনন্দিনী, অথচ তার গলায় কোনো দৃঢ়তা ছিল না,বোধকরি লজ্জায়। সমীর আলতো করে তার কানের কাছে মুখ এনে বললে,
– তা বললে হয়? আমি ত শুধু একটু দেখতে চাইছি মাত্র!
কথা শেষ করে সমীর কুন্দনন্দিনীকে পেছন থেকেই
বুকের মধ্যে চেপে ধরল। আলিঙ্গনটা নরম নয়, কষে ধরা, যেন একবার আঁকড়ে ধরলে আর ছাড়বার নয়।কঠিন দুই বাহুতে কুন্দনন্দিনীর কোমর জড়িয়ে এমন শক্ত করে চেপে ধরল যেন নিঃশ্বাস তার আটকে এল। পরক্ষণেই স্বামীর ঠোঁটের গরম নিঃশ্বাস পিঠে পরতেই শরীর কেঁপে উঠল তার। মুখ ঘুরিয়ে ফিসফিস করে উঠল সে,
— লজ্জা করেনা আপনার, এভাবে জোর করে…
কথা শেষে যেন কেঁপে উঠল নিজেরই কণ্ঠ। সমীর কোনো জবাব দিল না। শুধু তাকে সমুখে ঘুরিয়ে এক হাতে তার আঁচল সরিয়ে দিল সম্পূর্ণ, অন্য হাতে চেপে ধরল বক্ষদেশ। মৃদু চুমু বসাল কানের পাশে, গলার বাঁকে। ডান হাতের আঙুলগুলো আলতো করে ঘোরাফেরা করতে লাগলে ব্লাউজের ওপরে।
কি হবে বুঝতে না পেরে,অজানা আতঙ্কে নন্দিনীর বুক ওঠানামা করছে দ্রুত,শরীর কাঁপছে দ্বিধা আর গোপন আগ্রহে। মাঝে মাঝেই কথায় প্রতিবাদ করলেও—আলিঙ্গনের ভেতরে সে ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছিল। মুহূর্তে যেন বোঝা গেল,কথায় না হোক,দেহের ভাষায় সে আত্মসমর্পণ করেই ফেলেছে।