26-09-2025, 11:42 AM
নিয়োগ পর্ব ১৪
গাড়িতে যাওয়ার সময় বিমল ও মাধবীর মধ্যে কোনো কথা হচ্ছিল না। মাধবীর চোখ ছিল জানলার বাইরে। বিমলের হাত ছিল স্টিয়ারিংয়ে, নজর সামনে। মাঝে মাঝে লুকিং গ্লাসে মাধবীকে দেখছিল, কিন্তু মাধবী একবারও তার দিকে তাকাচ্ছিল না, সে তখন মনে মনে সমরেশের কথা ভাবছিল।
শোভাবাজার থেকে বড়বাজারের দূরত্ব বেশি নয়। কিছু সময়ের মধ্যেই তারা বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। গাড়ি থেকে নামলো মাধবী। পিছনে না তাকিয়ে গেট খুলে সটান ভেতরে প্রবেশ করলো সে, তার চিরাচরিত ঠিকানায়। গাড়িতে বসে বিমল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বোধহয় সে না চাইতেও মাধবীকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছে!
গাড়ি বাড়ির গ্যারাজে ঢোকালো। ঠিকমতো সব কলকব্জা রুটিনমাফিক চেক করে বাইরে থেকে পুরো লক মেরে ঢাকা দিয়ে দিল গাড়িটা। শাটার নামিয়ে আনলো। এসব করতে বিমলের বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। ততক্ষণে মাধবী অন্দরে ঢুকে পড়েছে, এবং শাশুড়ি মায়ের রক্তচক্ষুর সামনে পড়ে গেছে।
"তা এতক্ষণে আসা হল? যেখানে গেছিলে সেখানেই তো রাতটা কাটিয়ে আসতে পারতে! শুধু শুধু কষ্ট করে রাত্রিযাপন করতে শোউর বাড়িতে পদধূলি দিলে কেন বাছা?"
"সেটা আপনি আপনার ছেলেকে শুধোন। সেই তো আমায় সেখানে নিয়ে গেছিল। তারই দায়িত্ব ছিল আপনার রাগ বুঝে সময়জ্ঞান রাখার, তাই নয় কি?"
এই প্রথম মাধবী তার শাশুড়ির মুখের উপর উচিত জবাব দিল। তা দেখে ব্রজবালা দেবীর চোখ কপালে উঠলো। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম। রে রে করে উঠলেন তিনি, "কিই?? আমার মুখে মুখে কথা কইছ তুমি? দিন দিন তোমার সাহস তো দেখছি বেড়েই চলেছে! তাও যদি দেখতাম একটা নাতি বা নাতনির মুখ দেখাতে পেরেছো আমায়, সেই বেলায় তো ভাঁড়ে মা ভবানী! হুঁহ!!"
"তা দোষটা কি শুধু আমার একার মা? আপনার ছেলের মধ্যে যে কোনো খামতি নেই সেটা এতটা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারছেন কি করে?"
শাশুড়ি মায়ের পাশে উস্কানি দেওয়ার জন্য তৈরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধবীর ছোট জা রুক্মিণী, "দেখছেন মা, এখন দিদি নিজের অক্ষমতা ঢাকতে আমার অমন দেবতার মতো ভাসুর ঠাকুরের উপর দোষ চাপাচ্ছে।"
পাশ থেকে ফোড়ন কেটে শাশুড়ি মায়ের কান ভারী করলো রুক্মিণী। এতে মাধবী আরো চটে গেল। নিজের অপমানের সপাটে জবাব দিল, "আমি কিসে অক্ষম, কিসে নই, সেটা তোকে বিচার করতে হবেনা রে ছোটো। আমি বয়সে এবং সম্পর্কে দুইয়েই তোর চেয়ে বড় হই। আর বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, সেই শিক্ষাটা আশা করি বাড়ি থেকে পেয়ে এসেছিস? আমি এখনো মা হতে না পারলেও তুই তো হয়েছিস, দুই বাচ্চার। তাহলে কি শিক্ষা দিবি তুই রূপা আর রূপককে, যদি নিজেই বড়দের সম্মান করতে না পারিস? ওই ছোট ছোট বাচ্চা দুটো কি শিখবে তোর থেকে?"
রুক্মিণী ইচ্ছে করে তখন কাঁদো কাঁদো মুখে শাশুড়িকে বললো, "দেখছেন মা, দিদিভাই আমার পরিবার তুলে কথা বলছে! আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে! আপনি এর একটা বিহিত করুন। আমি রূপকের মা। এই বসু মল্লিক পরিবারের আগামী বংশপ্রদীপকে জন্ম দিয়েছি। আমাকে করা অপমান আপনি সইবেন তো?"
"কক্ষনোই না ছোট বউমা! তোমার ভাসুর ঠাকুর আসুক, তাকে বলবো, কালকেই যেন এই বাঁজাকে তার বাপেরবাড়িতে দিয়ে আসে সে। তার কুনজর যেন আমার রূপক দাদুভাইয়ের উপর না পরে। আমি আমার বিলুর আবার বিয়ে দেব।"
"আমি বাঁজা? আমি আমার দেওরপো-র খারাপ চাইবো?", মাধবী রাগে দুঃখে অভিমানে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে আর্তনাদ করে বলে উঠলো, "দিন না, আবার বিয়ে দিন। যতবার ইচ্ছে দিন। কিন্তু তারপরেও আপনি নিশ্চিত তো আপনার বড়ো ছেলের থেকে পৌত্র সুখ পাবেনই?"
"কি বলতে চাইছো তুমি, আমার ছেলের ক্ষমতা নেই বাবা হওয়ার? শোনো, সে হল এই মধ্য-কলকাতার বসু মল্লিক বাড়ির ছেলে। তার গায়ে বনেদি রক্ত বইছে, তার মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকতে পারেনা।"
"সেই! সব ত্রুটি বিচ্যুতি, খামতি, দোষ, ভুল তো শুধু আমার। আর সবচেয়ে বড় ভুল হল আপনার ছেলেকে বিয়ে করে এই তথাকথিত বনেদি বাড়িতে বউ হয়ে আসা। এখানে শিক্ষা শুধু কাগজে কলমে রয়েছে, মননে নেই..", বলেই আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে নিজের ঘরে চলে গেল মাধবী। বিমল এল ঠিক তার পরেই। অন্দরে ঢুকে দেখে মা আর রুক্মিণী অগ্নিশর্মা হয়ে তার দিকে চেয়ে রয়েছে। মাধবীর সাথে কি ফের কোনো কথা কাটাকাটি হয়েছে দুজনের?
এসব তো আকছার লেগেই থাকে। প্রায়ই মা, রুক্মিণীর সামনে মাধবীকে মা না হতে পারা নিয়ে খোঁটা দেয়, আর মাধবী অসহায় হয়ে কোনো প্রতিবাদ না করতে পেরে ঘরে এসে মুখ ফুলিয়ে কাঁদে। পরে তা নিয়ে বিমলের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগও জানায়। কিন্তু বিমল তাকে শান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেনা।.. সেই বা কি করবে? সত্যি কথাটা মান সম্মানের দায়ে মুখ ফুটে স্বীকার করার জো নেই। তাই বেচারি বউটাকেই সমাজের কাছে বলির পাঁঠা বানাতে হয় বারবার।
ওদিকে সান্যাল বাড়িতে দোতলার সেই ঘরে একা সমরেশ নিজের প্রেমিকার অন্তর্বাস মুখের উপর চাপা দিয়ে গভীর ভাবনায় মত্ত হয়ে বিছানায় পড়ে ছিল। সে জানেনা তার প্রতীক্ষার প্রহর গোনা কবে শেষ হবে? বা আদেও শেষ হবে কিনা? তাহলে কি জন্ম জন্মান্তর ধরে সে শুধু অপেক্ষাই করে যাবে তার মাধবীর জন্য?
মাধবীও নিজের ঘরে গিয়ে ভগ্ন হৃদয়ে কাহিল হয়ে শয্যা নিয়েছিল। সে জানে বিমল কিচ্ছু করতে পারবে না তার জন্য। মা হওয়ার সুখ দেওয়া তো দূরের কথা, নিজের মায়ের সামনে প্রতিবাদ টুকু করে তার হয়ে কথা বলার সাহসও নেই। উল্টে সে আসবে নিজের স্ত্রীকে বোঝাতে, মানিয়ে নিতে, আপোষ করতে, কখনো নিজের সম্মানের সাথে, কখনো শরীরের সাথে।
-- তবে তাই হোক! এবার যখন সে আসবে কিছু বলতে তখন জানিয়ে দেব, আমায় যেন সে রেখে আসে। বাপের বাড়িতে নয়, সমরেশের কাছে। এখন মনে হচ্ছে সেখানে গেলেই শান্তি। সত্যি এখানে আমার বাগান নিরাপদ নয়, একদমই নয়। --
মায়ের কাছ থেকে হাজারটা কথা গিলে বিমল ঢুকলো শোয়ার ঘরে। দেখলো মাধবী মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে আছে। তার কাছে যাওয়ার সাহস হচ্ছিলো না বিমলের। কারণ সে তো জানে, মাধবীর উপর যা হচ্ছে তা এক কথায় অন্যায়! তাকে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে বিমলের অকর্মণ্যতার দায় মাথায় নিতে হচ্ছে।..
বিমল কাছে না ঘেঁষলেও মাধবী টের পেল ঘরে তার উপস্থিতি। চোখের জল মুছে উঠে এল বিছানা থেকে। বিমলের সামনে চোখে চোখ রেখে বললো, "নিশ্চই শুনে এসছো তোমার মা কি চায়? সেই মতো একজন আজ্ঞাবহ সন্তান হিসেবে তাঁর আদেশ মেনে তোমার উচিত আমাকে কাল দিয়ে আসা।"
বিমল লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। কিন্তু মাধবী থামলো না। সে বললো, "না তোমায় আমি আমাকে বাপের বাড়িতে দিয়ে আসতে বলছি না।"
"তাহলে?? কোথায়??", হতচকিত হয়ে বিমল জিজ্ঞেস করলো।
"কোথায় আবার, যেখানে আজকে দিয়ে এসছিলে...."
"মাধবী....!!"
"হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এতে এক কর্মে তোমার দুটো মাতৃ আদেশ পালন করা হবে। প্রথম, যেটা আজকে পেলে, আমাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার। অপরটা তোমার পিতৃত্ব লাভের জন্য আমার মা হওয়ার।"
"কিন্তু বাড়িতে কি বলবো?"
বিমলকে দেখে মাধবী অবাক হয়েগেল। একটা পুরুষ এতটা মেরুদন্ডহীন কি করে হতে পারে? তার মাথায় এখন ঘুরছে সে বাড়িতে কি অজুহাত দিয়ে তার স্ত্রীকে পরপুরুষের কাছে পাঠাবে! একবারো এই প্রশ্নটা তুলছে না যে কেন তার স্ত্রী আবার যাবে অন্যের আস্তানায়! সে তো বলতে পারতো যে, না মাধবী, আমি তোমাকে আর সমরেশের কাছে পাঠাবো না। আজকের মিলনে মা হলে হবে নাহলে বাকিটা আমি সামলে নেব। তোমাকে কারোর সাথে ভাগ করে নিতে দেব না। তুমিই আমার, শুধুই আমার। বা রাগ দেখাতেও তো পারতো মাধবীর উপর, সমরেশের বাড়ি যাওয়া নিয়ে ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য। দু' একটা কটু কথা শোনালেও সেটা মাধবী সহ্য করে নিত এইভেবে যে বিমল তার প্রতি কতটা পোজেসিভ! কিন্তু বিমল তার একটাও করলো না। উল্টে এই চিন্তায় নিমজ্জিত হল যে বাড়িতে সে কি বলে তাকে বের করে আনবে? এমন স্বামীর ক্যাতায় আগুন!
মাধবীকে নির্বাক অথচ রাগান্বিত হয়ে থাকতে দেখে বিমল আবার ঘাবড়ে গেল। তবুও সাহস জুগিয়ে ফের একই ভুল করার মাধ্যমে জিজ্ঞেস করে বসলো, "সমরেশের বাড়ি কি বলে যাবে?"
মাধবী বুঝলো যে বিমলের জন্য সযত্নে সাজিয়ে রাখা ভালোবাসার বাগানটা আজ বিমল নিজের হাতেই নষ্ট করে দিয়েছে। এখন আর এই মানুষটাকে ভালোবেসে লাভ নেই, যথেষ্ট বেসেছিল ভালো, কিন্তু তার মর্যাদা না বিমল দিল, না তার পরিবার। এবার পালা নতুন একজনকে নিজের মনের মানুষ হিসেবে বেছে নেওয়ার, এবং তাকেই নিজের ভালোবাসার উদ্যান উৎসর্গ করার। আর সে হল none other than Mr. Samaresh Sanyal....