25-07-2025, 04:15 PM
(This post was last modified: 25-07-2025, 04:39 PM by কাদের. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
গ
সাবরিনা সিনথিয়া কে কথা দিয়ে মাহফুজ দ্রুত বের হয়ে পড়ল। যতদ্রু সম্ভব বাইক চালাচ্ছে। যাবার পথে দ্রুত সেই এলাকার পরিচতি পলিটিক্যাল নেতাদের ফোন দেওয়া শুরু করল। ওদের যুব সংগঠনের স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী কে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে বলল মাহফুজ। কারণ মাহুফুজ জানে মারামারির সময় কেউ কাউকে গুণতে চায় না। ফলে ওর নিজস্ব লোক লাগবে, যারা স্থানীয়। তাদের হেল্প ছাড়া সাফিনা কে বের করা সহজ হবে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাইক ছোটাচ্ছে মাহফুজ। ঢাকা শহরের কোন এলাকায় গন্ডগোল লাগলে তার প্রভাব অন্য এলাকাতেও পড়ে। একটা বড় সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে মারামারির কারণে। সে কারণ আজকে পুরো শহর জুড়ে জ্যাম। মাহফুজ যানজটের মাঝে কখনো ফুটপাত, কখনো গলি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে। পাচ মিনিট পর পর সাবরিনা বা সিনথিয়ার ফোন আসছে। এখনো কি কোন খোজ বের করতে পারল কিনা। মাহফুজ তার লোকাল সোর্স দিয়ে সিওর হয়েছে অলরেডি যে কলেজে আটকা পড়া টিচারদের মাঝে সাফিনা করিম আছেন। আর মাঝে দুই পক্ষের মারামারি মধ্যস্থতা নাকি উনি করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে আবার আরেক দফা মারামারি শুরু হয়েছে। এরপর থেকে কেউ আর সাফিনা করিমের খোজ দিতে পারছে না। মাহফুজের একটু ভয় ভয় করছে। ওর মা মারা গেছে বেশ অনেক দিন। ওদের বিয়ের মাত্র কিছুদিন আগে সিনথিয়া সাবরিনা কেউ মা হারা হোক এটা চায় না ও। সাফিনা করিমের সাথে অল্প যেটুকু কথা হয়েছে তাতে তার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছে মাহফুজ। এমন একজন মানুষের সাথে ভাল ভাবে পরিচয় হবার আগে কিছু একটা ঘটবে এটা মানতেও পারছে না মাহফুজ। নিজে কে নিজে বলে মাহফুজ, কাম অন মাহফুজ। ফাইন্ড সাম ওয়ে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মাহফুজ তার বাইক গাড়ির ফাকে, মানুষের ভীড়ে ছুটিয়ে চলে।
সাফিনা করিম তার এত বছরের চাকরি জীবনে এরকম পরিস্থিতির আর কখনো স্বীকার হন নি। সরকারি কলেজে পড়াশোনার চাইতে রাজনীতি সব সময় বেশি ছিল। প্রতি বছর নিয়ম করে দুই তিন বার কোন না কোন বাহানাতে কলেজ গুলোতে মারামারি হবে। তবে আজকের মত এমন ভয়ংকর কিছু উনি আর সারাজীবনে দেখেন নি। যুদ্ধক্ষেত্র চারিদিকে। পুলিশের টিয়ার শেলে চারিদিক ধোয়া ধোয়া, চোখ জ্বলছে প্রচন্ড, কাশি হচ্ছে। শাড়ির আচল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। বিবাদমান দুই পক্ষ দুই দিকে অবস্থান নিয়েছে কলেজের। একে অন্যের দিকে ইট, কলেজের আসবাবের ভাংগা অংশ ছুড়ে মারছে। দুই পক্ষ নিজেদের সামনে টায়ার পুড়িয়ে ধোয়া আর আগুনের একটা ব্যারিকেড দেবার চেষ্টা করছে। এই মূহুর্তে সাফিনা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার অভাব বোধ করছেন সেটা হল তার মোবাইল ফোন। তার সাথে আর চার পাচজন শিক্ষক ছিলেন তবে শুরুর দিকে তারা সবাই মিলে দুই পক্ষ কে শান্ত করার চেষ্টা করলেও পরে পরিস্থিতি আর খারাপ হয়। তখন বাকি শিক্ষকরা কলেজের ভিতরে একটা রুমে দরজা বন্ধ করে আশ্রয় নিয়েছেন। সাফিনা কে তারা বলেছিলেন আসেন ম্যাডাম এখানে আমাদের শিক্ষক হিসেবে আর কিছু করার নেই। যা করার পুলিশ করবে। কিন্তু সাফিনা সরে আসতে পারেন নি। শিক্ষক হিসবে তার দ্বায়বদ্ধতা আছে। আজকে এই পরিস্থিতিতে যদি একটা লাশ পড়ে এবং সেই সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য কলেজের কোন রুমে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন তাহলে সারাজীবন অপরাধবোধ থেকে তার মুক্তি হবে না। কলেজের সব শিক্ষকরা চলে গেলেও কয়েকজন কর্মচারী তাকে আগলে রেখেছে। তার সাথে সাথে চলছে। সাফিনা একটা জিনিস খেয়াল করেছেন সাহস এবং আনুগত্য বড় শিক্ষিত লোকদের থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে বেশি থাকে। আর কলেজের কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা সব সময় কেউ যদি কলেজের জন্য জীবনবাজি রেখে কিছু করে তাহলে সব বিপদের মাঝেও তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার এতদিনের অবজার্ভেশনে যে ভুল নেই আজকের ঘটনা আবার তা প্রমাণ করে দিল। কলেজের সুইপার মজিদ বলল, ম্যাডাম আপনি প্রিন্সিপাল অফিসের দুই তালায় গিয়ে দাড়ান। একটু আগে গুলি হইছে দুই পক্ষের থেকে। আবার হইতে পারে। ম্যাডাম গুলি মানুষ চিনে না, টিচার ছাত্র চিনে না। হঠাত করে আপনার গায়ে লেগে যেতে পারে। ধোয়ার মাঝে টায়ার পোড়ার গন্ধটা গলায় জ্বলা ধরাচ্ছে আর টিয়ার গ্যাস চোখে। কাশতে কাশতে সাফিনা বলেন, মজিদ আমি মাঝখানে দাড়ালে কেউ আর গুলি করবে না। আমার ছাত্রদের উপর আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সাথে থাকা কয়েকজন কর্মচারী অবাক হয়ে গেল সাফিনার সাহসে। ভয়ে ভয়ে যখন তারা পিছনে হটে যাবার কথা ভাবছে তখন কলেজের সবচেয়ে সিনিয়র টিচারদের একজন সব ভয় তুচ্ছ করে দুই দলের মারামারির মাঝে এসে দাড়াতে চাইছেন। যাতে একজন শিক্ষক কে দেখে দুই পক্ষ গুলি না চালায়। জীবন বাচাতে শিক্ষকের এই সাহস তাদের অবাক করে। সাহস সব সময় সাহসের জন্ম দেয়। তাই সাফিনার পিছনে পিছনে কয়েকজন কর্মচারী হেটে হেটে ধোয়ার মাঝ দিয়ে সামনে যায়।
মাহফুজ পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। কি হচ্ছে। চারিদিকে একটা ক্যাওয়াস। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এই কলেজের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুইজনে তার পরিচিত। দুইজনকেই ফোন দিয়েছে। সরাসরি বলে দিয়েছে তার হবু শ্বাশুড়ি কলেজের টিচার। উনি ভিতরে আটকা পড়েছেন। যেভাবেই হোক তাকে উদ্ধার করে দিতে হবে। মাহফুজ উপরের কয়েকজন নেতা কে দিয়েও ফোন দিয়েছেন সেইম রিকোয়েস্ট করে। স্থানীয় কয়েকজন যুব সংগঠনের নেতা হাজির হয়েছে তার শ্বাশুড়ি ভিতরে আটকা পড়েছে শুনে। পুলিশ আর আধা ঘন্টা পর একশনে যাবে। তখন আর খারাপ হবে পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুইজনে তাকে বলেছে সাফিনা ম্যাডাম কে তার সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। উনি মাঝে দুই দলের মধ্যে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তখন হঠাত করে হঠকারী একটা ঘটনায় সেইটা সম্ভব হয় নি। তবে এই মূহুর্তে উনি কোথায় আছে কেউ জানে না। তবে তারা কথা দিচ্ছে ম্যাডাম কে তারা উদ্ধার করে দিবে আর যাই হোক। তবে কোন ভরসা পাচ্ছে না মাহফুজ। কারণ জানে মারামারির শুরুটা নেতারা করে দিতে পারে তবে একবার শুরু হয়ে গেলে মারামারির কন্ট্রোল আর কার হাতে থাকে না। তখন যে দলের পক্ষে বেশি জোশওয়ালা পাবলিক থাকবে তাদের চান্স বেশি। আর একটু পর পুলিশ নাকি রবার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে ভিতরে যাবে। মাহফুজ জানে পুলিশের একশনের সময় রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে সাথে নিরীহ মানুষজন অনেক সময় আহত নিহত হয়। এদিকে মাহফুজ কে তার হবু শ্বশুড় সরাসরি ফোন দিয়েছে। সাবরিনা সিনথিয়া থেকে মিজবাহ খবর পেয়েছেন তার হবু জামাই গেছে তার বউ কে উদ্ধার করতে। মিজবাহ এর কন্ঠে উদবিগ্নতা। মাহফুজ যতটা পারা যায় আশ্বাস দিয়েছে। তবে নিজেই বুঝতে পারছে না এই মূহুর্তে ঠিক কি করা উচিত। কারণ সাফিনা করিমের ফোন বন্ধ। কলেজের ভিতরের কার সাথে ঠিক যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সমানে ইটপাটকেল আর কাচের বোতল ছোড়াছুড়ি চলছে। দূর থেকে সব দেখছে মাহফুজ। বেশ দূরে দাঁড়ানো। দুই পক্ষ টায়ার পুড়িয়ে একটা ধোয়ার ক্যামোফ্লেজ তৈরি করেছে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। পুলিশ যদিও লাস্ট টিয়ার শেল ছুড়েছে প্রায় এক ঘন্টা হল। তাও বাতাসে ঝাঝালো গন্ধ। সিনেমার কোন দৃশ্য মনে হচ্ছে সামনের জায়গাটা। অপেক্ষা করতে করতে মাহফুজ ঘড়ি দেখে। আর দশ মিনিট বাকি আছে। পুলিশের একশনের। মাহফুজ ঠিক করে ভিতরে যাবে। যাই হোক এইভাবে বাইরে দাড়িয়ে কিছুই করতে পারবে না। একটা হ্যালমেট যোগাড় করে মাহফুজ। তবে ওর সাথে থাকা সবাই মানা করে ভিতরে যেতে। কারণ যারা মারামারি করছে তারা কেউ মাহফুজ কে চিনে না। ফলে মাঝে পড়লে দুই পক্ষ ওকে প্রতিপক্ষ ভেবে মার দিতে পারে। অনেক রিস্কি ব্যাপার। মাহফুজ ভিতরে যেতে জেদ করছে দেখে ওর যুব সংগঠনের স্থানীয় একটা ছেলে ওর সাথে ভিতরে যাবে বলে। ছেলেটা আগে এই কলেজে পড়ত এক সময়। ফলে কলেজের ভিতর বাহির ওর চেনা। এই ধোয়ায় ঢাকা যুদ্ধবস্থার কলেজের ঢুকলে কিছু চিনা সম্ভব না আর নতুন কেউ হলে তো পথ হারিয়ে ফেলবে। মাহফুজের সাথে তাই ছেলেটা যাবে ঠিক হয়। আর ছেলেটা স্থানীয় ফলে ছাত্র সংগঠনের অনেকেই তাকে চিনে। সেটাও একটা ব্যাপার।
বৃষ্টির মত ইটপাটকেল পড়ছে মাঝে। কে কাকে মারছে কেউ জানে না। দুই দিক থেকে লাঠিসোঠা নিয়ে অশ্রাব্য সব গালি গালাজ করতে করতে দুই পক্ষ ইট মেরে যাচ্ছে। টায়ার পোড়া গন্ধে নাক জ্বলছে। ইটপাটকেল বাচিয়ে মাহফুজ আর সাথের ছেলেটা ভিতরে ঢুকেছে। অনেক বড় কলেজ। পুরাতন কলেজ, অনেক বড় জায়গা নিয়ে তৈরি। আসার আগে পকেটের রুমাল পানিতে ভিজিয়ে এনেছে দুইজন। সেই ভেজা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সামনে আগাচ্ছে মাহফুজ আর সাথে ছেলেটা। এরমধ্যে পুলিশের বাশির শব্দ শোনা গেল হঠাত। পুলিশ তাদের লাঠিচার্জের আগে বাশি ফুকতে ফুকতে সামনে আগায়। বাশির প্রচন্ড শব্দ, টিয়ার শেল আর রবার বুলেট মিলে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। ফলে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ করে তার আগেই মানুষজন মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে। এর মাঝে হঠাত করে একজন কে খোড়াতে খোড়াতে আসতে দেখে ওরা। সাথের ছেলেটা লোকটা দেখে ধরে, বলে মজিদ ভাই না। লোকটা মাথা নাড়ায়। ছেলেটা বলে আমরা সাফিনা ম্যাডামের জন্য আসছি, উনি সাফিনা ম্যাডামের মেয়ের জামাই। ম্যাডাম কই? লোকটা উত্তর দেয় ম্যাডাম সামনে বটতলার কোণায়। দুই দল বটতলার দুই দিকে আছে। ম্যাডাম একা মাঝে দাড়ায়ে সবাই কে শান্ত করতে চেষ্টা করতেছে। আমি অনেকক্ষণ সাথে ছিলাম। ছেলেরা ম্যাডামের জন্য এখনো এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর ঝাপায়ে পড়ে নাই। কিন্তু পুলিশের বাশির শব্দ শুনে আমি আর থাকতে পারি নাইরে ভাই। বুড়া মানুষ আমি। পুলিশ আসলে দৌড়ায়ে পালাতে পারব না। আর পুলিশ মার শুরু করলে কে অপরাধী আর কে নিরাপরাধ তা বিচার করে না। মানুষ দেখলে মারে। মাহফুজ আর ছেলেটা মজিদের দেখিয়ে দেওয়া বটতলার দিকে তাকায়। ধোয়ার কারণে ঐখানে কি হচ্ছে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। তবে প্রচন্ড শব্দ। ককটেল ফুটছে। মাহফুজ খেয়াল করে দেখে পুলিশের বাশির শব্দ সেই বটতলার দিকে যাচ্ছে। এর মানে পুলিশের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হল বটতলা। মাহফুজ তাই সামনে এগোতে থাকে। সাথে থাকা ছেলেটা এইবার একটু ভয় পায়। সে বলে মাহফুজ ভাই আর সামনে আগাবেন? পুলিশ আর দুই এক মিনিটের মাঝে এসে পড়বে। তখন কিন্তু কারো রক্ষা নাই। মাহফুজ বলে ভাই থ্যাংকিউ, তুমি আর যেতে না পারলেও আমাকে যেতে হবে। এই বলে মাহফুজ ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকে। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল গুলো এক এক করে এসে পড়ছে। প্রচন্ড ঝাঝালো গন্ধ, চোখ জ্বলছে। ভেজা রুমালটা দিয়ে চোখ মুচছে। সামনে আগাতে আগাতে দেখে পুলিশের লাঠিপেটা এক দিক থেকে শুরু হয়ে গেছে। প্রচন্ড এক বিশৃংখল অবস্থা। কে কোন দলের বুঝা যাচ্ছে না। সবাই দৌড়াচ্ছে। এর মাঝেও ইট পাটকেল ছুড়ছে পুলিশের দিকে। আরাজক অবস্থা। মাহফুজ এর মাঝে সাফিনা কে খোজার চেষ্টা করছে। বেশি খুজতে হল না। প্রচুর ছেলের মাঝে একজন মহিলা, শাড়ি পড়া। সাফিনা কে দূর থেকে দেখে মাহফুজ। অবাক হয়ে যায়। সিনথিয়ার প্রচন্ড সাহসের অনেক উদাহারণ নিজে দেখেছে মাহফুজ। তবে আজকে সাফিনা করিমের সাহসের নমুনা দেখে মাহফুজ অবাক হয়ে গেল। পুলিশ এক পাশ থেকে মারতে মারতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সাফিনা মাঝে দাঁড়িয়ে চিতকার করছে, ছেলেরা তোমরা সবাই সবার ভাই। সবাই সবার বন্ধু। কেউ কাউকে মেরো না। আল্লাহর দোহাই তোমরা সবাই ফিরে যাও। পুলিশ মারতে মারতে সামনে আসছে তাও সাফিনার ভয় নেই। চারিদিকে টিয়ার শেলের আর টায়ার পোড়া ধোয়া। তার মাঝে দাঁড়িয়ে চিতকার করতে থাকা সাফিনা কে মনে হয় সিনেমার কোন চরিত্র। অকুতোভয়। আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে যেন কিছু আসে যায় না। নিজের ছাত্রদের জীবনের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন হলেও ভয় করে না সাফিনা করিম। সাফিনা লাঠিচার্চ করতে থাকা পুলিশদের উদ্দ্যেশে এইবার চিতকার শুর করেন। এরা বাচ্চা। প্লিজ এভাবে এদের কে মারবেন না। মারতে মারতে সামনে এগিয়ে আসা এক পুলিশ থতমত খেয়ে যায়। কে এই মহিলা বিবাদমান দুই পক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে পাগলের মত চিতকার করে যাচ্ছে। মাহফুজের যেন তন্দ্রা ভেংগে যায়। প্রচন্ড একটা শ্রদ্ধা এসে বুকে ভর করে। মাহফুজ টের পায় সিনথিয়ার পাগল সাহসের উতস কোথায়। সাফিনার ফর্সা মুখে ঘাম, কালি। কোমড়ে শাড়ির আচল গোজা। রণদেহী মূর্তি তবে যুদ্ধের জন্য নয় শান্তির জন্য। মাহফুজের মনে হয় ওর স্বপ্নে দেখা কোন চরিত্র বুঝি সাফিনা। মানুষের ভিতরের সৌন্দর্য নাকি আসল সৌন্দর্য। এই সব ক্যাওয়াসের মাঝে সাফিনার সুন্দর মুখখানি যেন আর সুন্দর হয়ে ধরা দেয় ওর চোখে। নিজের জীবন বিপন্ন করে ছাত্রদের জীবন যে শিক্ষিকা বাচাতে চান তার থেকে তেজদীপ্ত সুন্দর আর কি বা আছে।
সাফিনা দেখেন পুলিশের সদস্যারা লাঠিচার্জ করতে করতে এগিইয়ে আসছে। শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই তার। তবু শেষ শক্তি দিয়ে চিতকার করতে থাকেন। আমাদের বাচ্চাদের মারবেন না। মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ জ্বলছে। ঝাপসা চোখে সব অস্পষ্ট লাগছে। গলা শুকিয়ে গেছে। কতক্ষণ পানি খান না। বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত। তবে উপায় নেই। সেই সময় পুলিশে বাশি। লোকজনের চিতকার। মারামারির শব্দ। এই সব ঝাপিয়ে প্রচন্ড জোরে এক বজ্রকন্ঠ কানে আসল সাফিনার। উনি ম্যাডাম। উনি এই কলেজের ম্যাডাম। উনার নাম সাফিনা করিম। কেউ উনার গায়ে হাত দিবেন না। নিজের নাম শুনে ঘুরে তাকায় সাফিনা করিম। ধোয়ার মাঝ দিয়ে লম্বা দেহী একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মাথায় হেলমেট। কে বুঝা যাচ্ছে না। চিতকার করে যাচ্ছে ছেলেটা। ম্যাডামের যেন কোন ক্ষতি না হয়। প্রচন্ড জোরে চিতকার করছে ছেলেটা। ভারী পুরুষালী কন্ঠ। ছেলেটা হেলমেটের সামনের ঢাকনা টা উপরে তুলে দেয়। ধোয়ার কারণে তাও ছেলেটার মুখ স্পষ্ট না। এত মারামারির ভীড়ে হঠাত করে এত বছর পর সাফিনার কাজল দা এর কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক এই ভাবে দুই পক্ষের মারামারির মাঝে মারামারি থামাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল কাজল দা। ঠিক সেই রকম লম্বা ছেলেটা। সেই রকম ভারী পুরুষালী কন্ঠ। সাফিনা অবাক হয়ে যান। হেলুশিনেসন হচ্ছে কি তার? এত বছর পর কাজল দা কিভাবে ফিরে আসবে জীবিতদের মাঝে? ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দুই পাশে হাত ছড়িয়ে একটা আড়াল তৈরি করে। চিতকার দিয়ে বলতে থাকে সাবধান উনি কলেজের ম্যাডাম। কেউ উনাকে আঘাত করবেন না। সাফিনা বুঝতে পারেন এটা মাহফুজ। হঠাত করে উনার শরীর ছেড়ে দেয়। বসে পড়েন উনি। আর চিন্তা নেই। এখন আর কেউ তাকে আঘাত করতে পারবে না। মাহফুজ সর্বশক্তি দিয়ে চিতকার করে যাচ্ছে। সাফিনার মনে হয় আর ভয় নেই কাজল দা বুঝি আবার অন্য মানুষের রূপ ধরে তাকে রক্ষ করতে ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে।
সাবরিনা সিনথিয়া কে কথা দিয়ে মাহফুজ দ্রুত বের হয়ে পড়ল। যতদ্রু সম্ভব বাইক চালাচ্ছে। যাবার পথে দ্রুত সেই এলাকার পরিচতি পলিটিক্যাল নেতাদের ফোন দেওয়া শুরু করল। ওদের যুব সংগঠনের স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী কে ফোন দিয়ে ঘটনাস্থলে যেতে বলল মাহফুজ। কারণ মাহুফুজ জানে মারামারির সময় কেউ কাউকে গুণতে চায় না। ফলে ওর নিজস্ব লোক লাগবে, যারা স্থানীয়। তাদের হেল্প ছাড়া সাফিনা কে বের করা সহজ হবে না। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাইক ছোটাচ্ছে মাহফুজ। ঢাকা শহরের কোন এলাকায় গন্ডগোল লাগলে তার প্রভাব অন্য এলাকাতেও পড়ে। একটা বড় সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে মারামারির কারণে। সে কারণ আজকে পুরো শহর জুড়ে জ্যাম। মাহফুজ যানজটের মাঝে কখনো ফুটপাত, কখনো গলি রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে। পাচ মিনিট পর পর সাবরিনা বা সিনথিয়ার ফোন আসছে। এখনো কি কোন খোজ বের করতে পারল কিনা। মাহফুজ তার লোকাল সোর্স দিয়ে সিওর হয়েছে অলরেডি যে কলেজে আটকা পড়া টিচারদের মাঝে সাফিনা করিম আছেন। আর মাঝে দুই পক্ষের মারামারি মধ্যস্থতা নাকি উনি করার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর সেখান থেকে আবার আরেক দফা মারামারি শুরু হয়েছে। এরপর থেকে কেউ আর সাফিনা করিমের খোজ দিতে পারছে না। মাহফুজের একটু ভয় ভয় করছে। ওর মা মারা গেছে বেশ অনেক দিন। ওদের বিয়ের মাত্র কিছুদিন আগে সিনথিয়া সাবরিনা কেউ মা হারা হোক এটা চায় না ও। সাফিনা করিমের সাথে অল্প যেটুকু কথা হয়েছে তাতে তার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হয়েছে মাহফুজ। এমন একজন মানুষের সাথে ভাল ভাবে পরিচয় হবার আগে কিছু একটা ঘটবে এটা মানতেও পারছে না মাহফুজ। নিজে কে নিজে বলে মাহফুজ, কাম অন মাহফুজ। ফাইন্ড সাম ওয়ে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মাহফুজ তার বাইক গাড়ির ফাকে, মানুষের ভীড়ে ছুটিয়ে চলে।
সাফিনা করিম তার এত বছরের চাকরি জীবনে এরকম পরিস্থিতির আর কখনো স্বীকার হন নি। সরকারি কলেজে পড়াশোনার চাইতে রাজনীতি সব সময় বেশি ছিল। প্রতি বছর নিয়ম করে দুই তিন বার কোন না কোন বাহানাতে কলেজ গুলোতে মারামারি হবে। তবে আজকের মত এমন ভয়ংকর কিছু উনি আর সারাজীবনে দেখেন নি। যুদ্ধক্ষেত্র চারিদিকে। পুলিশের টিয়ার শেলে চারিদিক ধোয়া ধোয়া, চোখ জ্বলছে প্রচন্ড, কাশি হচ্ছে। শাড়ির আচল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখার চেষ্টা করেও লাভ হচ্ছে না। বিবাদমান দুই পক্ষ দুই দিকে অবস্থান নিয়েছে কলেজের। একে অন্যের দিকে ইট, কলেজের আসবাবের ভাংগা অংশ ছুড়ে মারছে। দুই পক্ষ নিজেদের সামনে টায়ার পুড়িয়ে ধোয়া আর আগুনের একটা ব্যারিকেড দেবার চেষ্টা করছে। এই মূহুর্তে সাফিনা সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটার অভাব বোধ করছেন সেটা হল তার মোবাইল ফোন। তার সাথে আর চার পাচজন শিক্ষক ছিলেন তবে শুরুর দিকে তারা সবাই মিলে দুই পক্ষ কে শান্ত করার চেষ্টা করলেও পরে পরিস্থিতি আর খারাপ হয়। তখন বাকি শিক্ষকরা কলেজের ভিতরে একটা রুমে দরজা বন্ধ করে আশ্রয় নিয়েছেন। সাফিনা কে তারা বলেছিলেন আসেন ম্যাডাম এখানে আমাদের শিক্ষক হিসেবে আর কিছু করার নেই। যা করার পুলিশ করবে। কিন্তু সাফিনা সরে আসতে পারেন নি। শিক্ষক হিসবে তার দ্বায়বদ্ধতা আছে। আজকে এই পরিস্থিতিতে যদি একটা লাশ পড়ে এবং সেই সময় নিজের নিরাপত্তার জন্য কলেজের কোন রুমে নিজেকে লুকিয়ে রাখেন তাহলে সারাজীবন অপরাধবোধ থেকে তার মুক্তি হবে না। কলেজের সব শিক্ষকরা চলে গেলেও কয়েকজন কর্মচারী তাকে আগলে রেখেছে। তার সাথে সাথে চলছে। সাফিনা একটা জিনিস খেয়াল করেছেন সাহস এবং আনুগত্য বড় শিক্ষিত লোকদের থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে বেশি থাকে। আর কলেজের কর্মকর্তা আর কর্মচারীরা সব সময় কেউ যদি কলেজের জন্য জীবনবাজি রেখে কিছু করে তাহলে সব বিপদের মাঝেও তার পিছনে এসে দাঁড়ায়। তার এতদিনের অবজার্ভেশনে যে ভুল নেই আজকের ঘটনা আবার তা প্রমাণ করে দিল। কলেজের সুইপার মজিদ বলল, ম্যাডাম আপনি প্রিন্সিপাল অফিসের দুই তালায় গিয়ে দাড়ান। একটু আগে গুলি হইছে দুই পক্ষের থেকে। আবার হইতে পারে। ম্যাডাম গুলি মানুষ চিনে না, টিচার ছাত্র চিনে না। হঠাত করে আপনার গায়ে লেগে যেতে পারে। ধোয়ার মাঝে টায়ার পোড়ার গন্ধটা গলায় জ্বলা ধরাচ্ছে আর টিয়ার গ্যাস চোখে। কাশতে কাশতে সাফিনা বলেন, মজিদ আমি মাঝখানে দাড়ালে কেউ আর গুলি করবে না। আমার ছাত্রদের উপর আমার এতটুকু বিশ্বাস আছে। আমি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সাথে থাকা কয়েকজন কর্মচারী অবাক হয়ে গেল সাফিনার সাহসে। ভয়ে ভয়ে যখন তারা পিছনে হটে যাবার কথা ভাবছে তখন কলেজের সবচেয়ে সিনিয়র টিচারদের একজন সব ভয় তুচ্ছ করে দুই দলের মারামারির মাঝে এসে দাড়াতে চাইছেন। যাতে একজন শিক্ষক কে দেখে দুই পক্ষ গুলি না চালায়। জীবন বাচাতে শিক্ষকের এই সাহস তাদের অবাক করে। সাহস সব সময় সাহসের জন্ম দেয়। তাই সাফিনার পিছনে পিছনে কয়েকজন কর্মচারী হেটে হেটে ধোয়ার মাঝ দিয়ে সামনে যায়।
মাহফুজ পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করছে। কি হচ্ছে। চারিদিকে একটা ক্যাওয়াস। কেউ কিছু বলতে পারছে না। এই কলেজের প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুইজনে তার পরিচিত। দুইজনকেই ফোন দিয়েছে। সরাসরি বলে দিয়েছে তার হবু শ্বাশুড়ি কলেজের টিচার। উনি ভিতরে আটকা পড়েছেন। যেভাবেই হোক তাকে উদ্ধার করে দিতে হবে। মাহফুজ উপরের কয়েকজন নেতা কে দিয়েও ফোন দিয়েছেন সেইম রিকোয়েস্ট করে। স্থানীয় কয়েকজন যুব সংগঠনের নেতা হাজির হয়েছে তার শ্বাশুড়ি ভিতরে আটকা পড়েছে শুনে। পুলিশ আর আধা ঘন্টা পর একশনে যাবে। তখন আর খারাপ হবে পরিস্থিতি। প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারি দুইজনে তাকে বলেছে সাফিনা ম্যাডাম কে তার সবাই খুব শ্রদ্ধা করে। উনি মাঝে দুই দলের মধ্যে একটা সমঝোতার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু তখন হঠাত করে হঠকারী একটা ঘটনায় সেইটা সম্ভব হয় নি। তবে এই মূহুর্তে উনি কোথায় আছে কেউ জানে না। তবে তারা কথা দিচ্ছে ম্যাডাম কে তারা উদ্ধার করে দিবে আর যাই হোক। তবে কোন ভরসা পাচ্ছে না মাহফুজ। কারণ জানে মারামারির শুরুটা নেতারা করে দিতে পারে তবে একবার শুরু হয়ে গেলে মারামারির কন্ট্রোল আর কার হাতে থাকে না। তখন যে দলের পক্ষে বেশি জোশওয়ালা পাবলিক থাকবে তাদের চান্স বেশি। আর একটু পর পুলিশ নাকি রবার বুলেট ছুড়তে ছুড়তে ভিতরে যাবে। মাহফুজ জানে পুলিশের একশনের সময় রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে সাথে নিরীহ মানুষজন অনেক সময় আহত নিহত হয়। এদিকে মাহফুজ কে তার হবু শ্বশুড় সরাসরি ফোন দিয়েছে। সাবরিনা সিনথিয়া থেকে মিজবাহ খবর পেয়েছেন তার হবু জামাই গেছে তার বউ কে উদ্ধার করতে। মিজবাহ এর কন্ঠে উদবিগ্নতা। মাহফুজ যতটা পারা যায় আশ্বাস দিয়েছে। তবে নিজেই বুঝতে পারছে না এই মূহুর্তে ঠিক কি করা উচিত। কারণ সাফিনা করিমের ফোন বন্ধ। কলেজের ভিতরের কার সাথে ঠিক যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। সমানে ইটপাটকেল আর কাচের বোতল ছোড়াছুড়ি চলছে। দূর থেকে সব দেখছে মাহফুজ। বেশ দূরে দাঁড়ানো। দুই পক্ষ টায়ার পুড়িয়ে একটা ধোয়ার ক্যামোফ্লেজ তৈরি করেছে নিজেদের নিরাপত্তার জন্য। পুলিশ যদিও লাস্ট টিয়ার শেল ছুড়েছে প্রায় এক ঘন্টা হল। তাও বাতাসে ঝাঝালো গন্ধ। সিনেমার কোন দৃশ্য মনে হচ্ছে সামনের জায়গাটা। অপেক্ষা করতে করতে মাহফুজ ঘড়ি দেখে। আর দশ মিনিট বাকি আছে। পুলিশের একশনের। মাহফুজ ঠিক করে ভিতরে যাবে। যাই হোক এইভাবে বাইরে দাড়িয়ে কিছুই করতে পারবে না। একটা হ্যালমেট যোগাড় করে মাহফুজ। তবে ওর সাথে থাকা সবাই মানা করে ভিতরে যেতে। কারণ যারা মারামারি করছে তারা কেউ মাহফুজ কে চিনে না। ফলে মাঝে পড়লে দুই পক্ষ ওকে প্রতিপক্ষ ভেবে মার দিতে পারে। অনেক রিস্কি ব্যাপার। মাহফুজ ভিতরে যেতে জেদ করছে দেখে ওর যুব সংগঠনের স্থানীয় একটা ছেলে ওর সাথে ভিতরে যাবে বলে। ছেলেটা আগে এই কলেজে পড়ত এক সময়। ফলে কলেজের ভিতর বাহির ওর চেনা। এই ধোয়ায় ঢাকা যুদ্ধবস্থার কলেজের ঢুকলে কিছু চিনা সম্ভব না আর নতুন কেউ হলে তো পথ হারিয়ে ফেলবে। মাহফুজের সাথে তাই ছেলেটা যাবে ঠিক হয়। আর ছেলেটা স্থানীয় ফলে ছাত্র সংগঠনের অনেকেই তাকে চিনে। সেটাও একটা ব্যাপার।
বৃষ্টির মত ইটপাটকেল পড়ছে মাঝে। কে কাকে মারছে কেউ জানে না। দুই দিক থেকে লাঠিসোঠা নিয়ে অশ্রাব্য সব গালি গালাজ করতে করতে দুই পক্ষ ইট মেরে যাচ্ছে। টায়ার পোড়া গন্ধে নাক জ্বলছে। ইটপাটকেল বাচিয়ে মাহফুজ আর সাথের ছেলেটা ভিতরে ঢুকেছে। অনেক বড় কলেজ। পুরাতন কলেজ, অনেক বড় জায়গা নিয়ে তৈরি। আসার আগে পকেটের রুমাল পানিতে ভিজিয়ে এনেছে দুইজন। সেই ভেজা রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে সামনে আগাচ্ছে মাহফুজ আর সাথে ছেলেটা। এরমধ্যে পুলিশের বাশির শব্দ শোনা গেল হঠাত। পুলিশ তাদের লাঠিচার্জের আগে বাশি ফুকতে ফুকতে সামনে আগায়। বাশির প্রচন্ড শব্দ, টিয়ার শেল আর রবার বুলেট মিলে একটা ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়। ফলে পুলিশ যখন লাঠিচার্জ করে তার আগেই মানুষজন মানসিক ভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে। এর মাঝে হঠাত করে একজন কে খোড়াতে খোড়াতে আসতে দেখে ওরা। সাথের ছেলেটা লোকটা দেখে ধরে, বলে মজিদ ভাই না। লোকটা মাথা নাড়ায়। ছেলেটা বলে আমরা সাফিনা ম্যাডামের জন্য আসছি, উনি সাফিনা ম্যাডামের মেয়ের জামাই। ম্যাডাম কই? লোকটা উত্তর দেয় ম্যাডাম সামনে বটতলার কোণায়। দুই দল বটতলার দুই দিকে আছে। ম্যাডাম একা মাঝে দাড়ায়ে সবাই কে শান্ত করতে চেষ্টা করতেছে। আমি অনেকক্ষণ সাথে ছিলাম। ছেলেরা ম্যাডামের জন্য এখনো এক পক্ষ অন্য পক্ষের উপর ঝাপায়ে পড়ে নাই। কিন্তু পুলিশের বাশির শব্দ শুনে আমি আর থাকতে পারি নাইরে ভাই। বুড়া মানুষ আমি। পুলিশ আসলে দৌড়ায়ে পালাতে পারব না। আর পুলিশ মার শুরু করলে কে অপরাধী আর কে নিরাপরাধ তা বিচার করে না। মানুষ দেখলে মারে। মাহফুজ আর ছেলেটা মজিদের দেখিয়ে দেওয়া বটতলার দিকে তাকায়। ধোয়ার কারণে ঐখানে কি হচ্ছে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে না। তবে প্রচন্ড শব্দ। ককটেল ফুটছে। মাহফুজ খেয়াল করে দেখে পুলিশের বাশির শব্দ সেই বটতলার দিকে যাচ্ছে। এর মানে পুলিশের আক্রমণের মূল লক্ষ্য হল বটতলা। মাহফুজ তাই সামনে এগোতে থাকে। সাথে থাকা ছেলেটা এইবার একটু ভয় পায়। সে বলে মাহফুজ ভাই আর সামনে আগাবেন? পুলিশ আর দুই এক মিনিটের মাঝে এসে পড়বে। তখন কিন্তু কারো রক্ষা নাই। মাহফুজ বলে ভাই থ্যাংকিউ, তুমি আর যেতে না পারলেও আমাকে যেতে হবে। এই বলে মাহফুজ ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকে। পুলিশের টিয়ার গ্যাসের শেল গুলো এক এক করে এসে পড়ছে। প্রচন্ড ঝাঝালো গন্ধ, চোখ জ্বলছে। ভেজা রুমালটা দিয়ে চোখ মুচছে। সামনে আগাতে আগাতে দেখে পুলিশের লাঠিপেটা এক দিক থেকে শুরু হয়ে গেছে। প্রচন্ড এক বিশৃংখল অবস্থা। কে কোন দলের বুঝা যাচ্ছে না। সবাই দৌড়াচ্ছে। এর মাঝেও ইট পাটকেল ছুড়ছে পুলিশের দিকে। আরাজক অবস্থা। মাহফুজ এর মাঝে সাফিনা কে খোজার চেষ্টা করছে। বেশি খুজতে হল না। প্রচুর ছেলের মাঝে একজন মহিলা, শাড়ি পড়া। সাফিনা কে দূর থেকে দেখে মাহফুজ। অবাক হয়ে যায়। সিনথিয়ার প্রচন্ড সাহসের অনেক উদাহারণ নিজে দেখেছে মাহফুজ। তবে আজকে সাফিনা করিমের সাহসের নমুনা দেখে মাহফুজ অবাক হয়ে গেল। পুলিশ এক পাশ থেকে মারতে মারতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। আর সাফিনা মাঝে দাঁড়িয়ে চিতকার করছে, ছেলেরা তোমরা সবাই সবার ভাই। সবাই সবার বন্ধু। কেউ কাউকে মেরো না। আল্লাহর দোহাই তোমরা সবাই ফিরে যাও। পুলিশ মারতে মারতে সামনে আসছে তাও সাফিনার ভয় নেই। চারিদিকে টিয়ার শেলের আর টায়ার পোড়া ধোয়া। তার মাঝে দাঁড়িয়ে চিতকার করতে থাকা সাফিনা কে মনে হয় সিনেমার কোন চরিত্র। অকুতোভয়। আশেপাশে কি হচ্ছে তাতে যেন কিছু আসে যায় না। নিজের ছাত্রদের জীবনের জন্য নিজের জীবন বিপন্ন হলেও ভয় করে না সাফিনা করিম। সাফিনা লাঠিচার্চ করতে থাকা পুলিশদের উদ্দ্যেশে এইবার চিতকার শুর করেন। এরা বাচ্চা। প্লিজ এভাবে এদের কে মারবেন না। মারতে মারতে সামনে এগিয়ে আসা এক পুলিশ থতমত খেয়ে যায়। কে এই মহিলা বিবাদমান দুই পক্ষের মাঝে দাঁড়িয়ে পাগলের মত চিতকার করে যাচ্ছে। মাহফুজের যেন তন্দ্রা ভেংগে যায়। প্রচন্ড একটা শ্রদ্ধা এসে বুকে ভর করে। মাহফুজ টের পায় সিনথিয়ার পাগল সাহসের উতস কোথায়। সাফিনার ফর্সা মুখে ঘাম, কালি। কোমড়ে শাড়ির আচল গোজা। রণদেহী মূর্তি তবে যুদ্ধের জন্য নয় শান্তির জন্য। মাহফুজের মনে হয় ওর স্বপ্নে দেখা কোন চরিত্র বুঝি সাফিনা। মানুষের ভিতরের সৌন্দর্য নাকি আসল সৌন্দর্য। এই সব ক্যাওয়াসের মাঝে সাফিনার সুন্দর মুখখানি যেন আর সুন্দর হয়ে ধরা দেয় ওর চোখে। নিজের জীবন বিপন্ন করে ছাত্রদের জীবন যে শিক্ষিকা বাচাতে চান তার থেকে তেজদীপ্ত সুন্দর আর কি বা আছে।
সাফিনা দেখেন পুলিশের সদস্যারা লাঠিচার্জ করতে করতে এগিইয়ে আসছে। শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই তার। তবু শেষ শক্তি দিয়ে চিতকার করতে থাকেন। আমাদের বাচ্চাদের মারবেন না। মাথা ঘুরাচ্ছে। চোখ জ্বলছে। ঝাপসা চোখে সব অস্পষ্ট লাগছে। গলা শুকিয়ে গেছে। কতক্ষণ পানি খান না। বসে একটু বিশ্রাম নিতে পারলে ভাল হত। তবে উপায় নেই। সেই সময় পুলিশে বাশি। লোকজনের চিতকার। মারামারির শব্দ। এই সব ঝাপিয়ে প্রচন্ড জোরে এক বজ্রকন্ঠ কানে আসল সাফিনার। উনি ম্যাডাম। উনি এই কলেজের ম্যাডাম। উনার নাম সাফিনা করিম। কেউ উনার গায়ে হাত দিবেন না। নিজের নাম শুনে ঘুরে তাকায় সাফিনা করিম। ধোয়ার মাঝ দিয়ে লম্বা দেহী একটা ছেলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। মাথায় হেলমেট। কে বুঝা যাচ্ছে না। চিতকার করে যাচ্ছে ছেলেটা। ম্যাডামের যেন কোন ক্ষতি না হয়। প্রচন্ড জোরে চিতকার করছে ছেলেটা। ভারী পুরুষালী কন্ঠ। ছেলেটা হেলমেটের সামনের ঢাকনা টা উপরে তুলে দেয়। ধোয়ার কারণে তাও ছেলেটার মুখ স্পষ্ট না। এত মারামারির ভীড়ে হঠাত করে এত বছর পর সাফিনার কাজল দা এর কথা মনে পড়ে যায়। ঠিক এই ভাবে দুই পক্ষের মারামারির মাঝে মারামারি থামাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল কাজল দা। ঠিক সেই রকম লম্বা ছেলেটা। সেই রকম ভারী পুরুষালী কন্ঠ। সাফিনা অবাক হয়ে যান। হেলুশিনেসন হচ্ছে কি তার? এত বছর পর কাজল দা কিভাবে ফিরে আসবে জীবিতদের মাঝে? ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ায়। তার দুই পাশে হাত ছড়িয়ে একটা আড়াল তৈরি করে। চিতকার দিয়ে বলতে থাকে সাবধান উনি কলেজের ম্যাডাম। কেউ উনাকে আঘাত করবেন না। সাফিনা বুঝতে পারেন এটা মাহফুজ। হঠাত করে উনার শরীর ছেড়ে দেয়। বসে পড়েন উনি। আর চিন্তা নেই। এখন আর কেউ তাকে আঘাত করতে পারবে না। মাহফুজ সর্বশক্তি দিয়ে চিতকার করে যাচ্ছে। সাফিনার মনে হয় আর ভয় নেই কাজল দা বুঝি আবার অন্য মানুষের রূপ ধরে তাকে রক্ষ করতে ফিরে এসেছে এই পৃথিবীতে।