16-05-2025, 03:36 PM
(This post was last modified: 16-05-2025, 03:40 PM by বহুরূপী. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পর্ব ৪
দশ-বার দিন যেতেই কুন্দনন্দিনী বুঝলো কিরণের এখানে আসা যাওয়া যখন তখন। মুখার্জি পরিবার ত বটেই, সুপ্রিয়ার সাথেও সর্ম্পক তার গাঢ়। অবশ্য সুপ্রিয়ার সহিত বাড়ির প্রায় সকলের সম্পর্কই গাঢ়। বোধকরি দৃষ্টি না থাকায় সকলকেই এই দৃষ্টিহীনা রমণী মনের দাড়িপাল্লায় এক ভাবেই ওজন করিয়া থাকে। তাছাড়া বিশেষ করে সিন্দু, ইন্দিরা ও কিরণ ছোট বেলা থেকে সুপ্রিয়ার কাছে মায়ের মতো আদর-স্নেহ পেয়ে এসেছে। সে ক্ষেত্রে আলাদা একটা মাতৃশক্তিও তাদের মধ্যে খাটে বৈ কি। কুন্দনন্দিনী এতে অবাক হয়না, কেন না সে নিজেও সুপ্রিয়ার মাতৃত্বে মুগ্ধ।
এছাড়া কিরণের বাড়ি খুব বেশি দূর নয়। এই বাড়ির সদর দুয়ার থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে বাগান পেরিয়ে পাঁচ-ছ মিনিটেই পৌঁছানো যায়। কিরণের বাবা মা কেউ নেই। এক কাকা আছে তার ছেলেপুলে হয়নি। কাকিমা'টি তার বছরের ছ'মাস নানান রোগব্যাধি নিয়ে বিছানাতেই পরিয়া থাকে। বাড়ির এই অবস্থায় কিরণ প্রায় সময় অবসর বিনোদন করতে আসে এ বাড়িতে। বোধকরি এই সূত্রেই সুপ্রিয়া দেবীর মাতৃস্নেহের আঁচলে কিরণ সহজেই এসেছিল। তবে স্নেহের বাঁধনে বাঁধলেও সুপ্রিয়া কিরণকে সম্পুর্ণ কাছে না পাওয়াতে শাসনের ভাগটায় কমতি রয়ে গেল। ওপর দিকে কিরণের কাকিমার অতিরিক্ত আদরে কিরণের লাগাম হীন জীবন যাত্রা হাটলো খানিক মন্দ পথে। এই ব্যাপারে আধুনিক কলকাতার দূষিত হাওয়াও খানিক দায়ি।
জমিদার বাড়ির পরে গ্রামের কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে পাশাপাশি বাসরত সমীর ও কিরণের পরিবার বিখ্যাত। এই খ্যাতি অবশ্য দুই পরিবারের দুই রকমের। গ্রামের লোকে বলিয়া থাকে সমীর মুখার্জি লোকের প্রাণ রক্ষা করে আর কেদার চাটুজ্যে গলা কাটেন! যদিও গলা কাটাকাটিতে তিনি ছুড়ি বা চাকুর ব্যবহার করেন না। এই বিষয়ে তার একমাত্র অস্ত্র অর্থ। সেই অর্থে তিনি দালালি ও মহাজনি কাজ কারবার চালান। সুদের কারবার তার চড়া দরের। তাছাড়া মেজাজ ও স্বভাবের দিক দিয়ে লোক সে সুবিধার নয়। তবে দাদা বৌদির মৃত্যুর পর কিরণের লালনপালনের দায়িত্ব কেদার চাটুজ্যে আগ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। হয়তো নিজের অপুত্রবতি রমণীর মন রাখতেই নিয়েছিলেন। কারণ কিরণের প্রতি তাহার কাকিমা গভীর ভালোবাসার কথা লোকের অজানা নয়। নিজের সন্তানআদি না থাকায় এই ভালোবাসা খানিক অতিরিক্ত।
তা সেই যাই হোক, এই বাড়িতে কিরণের ঘনঘন যাতায়াতে নন্দিনী হতো বিরক্ত। প্রথম প্রথম যদিও সে নিজেকে খানিক লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। তবে কিরণের এত ঘনঘন যাতায়াতে ও কাজ সম্ভব হবার নয়। অবশ্য সে এও ভাবলো, শুধু শুধু নিজেকে সে লুকিয়ে রাখবে কেন? কোন অপরাধ তো সে করেনি। দোষ যদি কিছু থাকে, সে কিরণের! বহু ঘাটের জল খেয়ে কুন্দনন্দিনীর কাছে প্রেম নিবেদন করার সাহস সে পায় কোথায় ? আমাদের কুন্দনন্দিনী মোটেও সহজ মেয়ে নয়। যদিও কিরণের বহু ঘাটে জল খাওয়া নিয়ে নন্দিনী নিশ্চিত নয়। বোধকরি এই কারণেই খানিক অনিশ্চয়তায় কিরণের সম্মুখে যেতে তার হতো অসস্থী। তবে কিরণের সস্থী বা অসস্থী কোনটাই হয় কি না— তা বোঝা যায় না। সে যথারীতি অন্দরে ঢুকে বৌরাণী বলে ডেকে উঠে জোর গলায়। ভাবটা এমন যে তার আগমণের খবর বাড়ির সবার কানে যাওয়া চাই। কিরণের এই অভ্যেসটা পুরাতন। তবে কুন্দনন্দিনী কিন্তু ভাবে এই রকম গলা ফাটিয়ে চিৎকার বুঝি তার জন্যে। এই ভেবে রাগে লাল হয় তার গাল। কিন্তু রাগ তো তার শুধু কিরণের উপরে নয়। দিন কয়েক সুপ্রিয়া স্বামী ভক্তি নিয়ে নন্দিনীকে জ্বালিয়ে মারছে। শান্ত অপরাহ্নে পুকুর ঘাটে বসে সুপ্রিয়া মাঝে মধ্যেই বলে,
– যা হয়ে গিয়েছে তা কি আর বদলানো যায় না বদলানো সম্ভব? শুধু শুধু সংসারে অশান্তি টেনে লাভ কি তুই বল?
কুন্দনন্দিনী সে কথা জানে না। তাই উত্তরও সে করলো না। তাকে চুপ দেখে সুপ্রিয়া বললো,
– গ্রামে থেকে অভ্যেস নেই ত তাই মন বসছে না। কদিন গেলে মন বসে যাবে দেখিস।
সুপ্রিয়া বলেছিল বটে। তবে সামান্য বৃষ্টিতেই যেখানে জল জমে হয় কাঁদা,গৃহবধূ বলে চার দেয়ালের মাঝে থাকতে হয় বন্দি, সেখানে এতো অল্পেই নন্দিনীর মতো অধুনিকার মন বসার কথা নয়। জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা তার ছিল ভিন্ন। বাবার পছন্দের বিয়ের করলেও বরেটির সাথে পরিচয় তার ছিল দীর্ঘদিনের। সে হয়তো সমীরের মতো বড় লোক ঘরের ডাক্তার সাহেব ছিল না, তবে দেখতে সে ছিল সুপুরুষ। সেই সাথে আধুনিকতার কোন কমতি তার মধ্যে ছিল কি না সন্দেহ। তার চাইতেও বড় কথা সে দূর্বল চিন্তা ভাবনার গ্রাম্য ভুত নয় মোটেও। সুতরাং ভাগ্যের ফেরে কালো মত এক পাড়াগাঁয়ের ডাক্তারের সাথে বিবাহে কুন্দনন্দিনী সুখী হবার কথা নয়। সে সুপ্রিয়ার মতো গ্রাম্য সাদাসিধে রমণী নয়। তাই আজীবন ঠাকুর পূজো আর স্বামীর সেবা করে সুপ্রিয়া সর্বদা হাসলেও নন্দিনী তা পারবে কেন?
অবশ্য মনে মনে এই সব ভাবলেও নন্দিনী কিন্তু চার দেওয়ালে বন্দিনী হয়ে থাকতো না। গ্রামের অনেক মেয়েরাই মুখার্জির বাড়ির পুকুরে স্নান করতে আসতো। নন্দিনীর কাজকর্মের বালায় ছিল না। কাজকর্ম বিশেষ সে পারতোও না। তাই সুপ্রিয়ার ময়না পাখিটার খাদ্যের যোগান দিয়ে অবসর সময়টা সে গ্রাম্য মেয়েদের সাথে খানিক কথা বলতে যেত পুকুর ঘাটে। যদিও নন্দিনীর সহিত তাদের কথাবার্তা সুপ্রিয়ার মতো জমতো না। তবে সময় কাটা নিয়ে কথা,সে তার ভালোই কাটতো। মাঝে মাঝে সুপ্রিয়া তাকে ডাকতো রান্না ঘরে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও রান্না না পারায় কুন্দনন্দিনী বিরক্তিতে ফেটে পরে বলতো,
– ও কাজ আমার দ্বারা হবে না দিদি।
এই শুনে কেঊ হাসতো, কেউ বা বলতো বাঁকা কথা। সবাই যে সম্মুখে বলতো তাও নয়, কেউ কেউ বলতো আড়ালে। নন্দিনী লজ্জা ত পেতোই, তবে রাগটাও তার কম হতো না। তখন কুন্দনন্দিনী রাগ দেখে সুপ্রিয়া হেসে বলতো,
– তা বললেই হলো? আচ্ছা, তুই যখন প্রথমবার নাচ শিখতে যাস তখন কি একদিনেই শেখা হয়েছিল?
নন্দিনী এবার মৃদু স্বরে বললে,
– না,সে একদিনে শেখার কর্ম নয় দিদি।
– তা রান্নাটাও ত একদিনে শেখার কর্ম নয় ভাই। ভালো নাচতে ও গাইতে শেখা যেমন সময়ের ব্যাপার,তেমনি রান্নাটাও।
– সে ত বুঝলাম। তবে দিদি, নাচ গানে নাম ডাক হয়, কিন্তু ভালো রাঁধতে শিখে কি হয় বল?
কুন্দনন্দিনীর কথায় সুপ্রিয়ার মুখখানি হাসিতে হয়েছিল উজ্জ্বল। তারপর এগিয়ে এসে দুহাতে নন্দিনীর গলা জড়িয়ে সে বলেছিল,
– লোকের মন পাওয়া হয় ভাই! নাচ- গান সে ত চোখের শান্তি। কিন্তু উদরের রাস্তায় লোকের হৃদয়ে পৌঁছানো সহজলভ্য। হাজার হোক চোখের চাইতে উদর আর হৃদয়ের দূরত্ব কম।
কথা খানিক জটিল। তবে সুপ্রিয়ার বলার ভঙ্গিতে কমবেশি সবারই পায় হাসি। ওটি সুপ্রিয়ার বিশেষত্ব। সে প্রাণ খুলে হাসতে ও হাসাতে জানে।তারপর আর একদিন নদীর ধারের কৃষ্ণ মন্দির ও নৌকা করে রাধাপুরের সরকার কলেজটাও নন্দিনী ঘুরে এলো। তবে ঘটনা এই দুখানাও সহজে ঘটলো না।
মন্দিরে যাবার দিন সমীর বাড়িতে ছিল না। একটু দূর হলেও বাড়ির অনেক মেয়েরাই গিয়েছিল পূজো দিতে। তবে রাধাপুরে যাবার সময় সুপ্রিয়া বেঁকে বসলো। রাধাপুরের কলেজ কাছে নয়। তাছাড়া স্বামীর অনুমতি না নিয়ে সে যেতেও রাজি নয়। বাড়ির অন্য মেয়েদেরও একই অবস্থা। যুক্তি দ্বারা ভাবলে নন্দিনী হয়তো সুপ্রিয়ার এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারতো। তবে কলেজ শাস্ত্রের শিক্ষা ছাড়া বাস্তবিক অর্থে অধিকাংশ সময়েই মানুষকে যুক্তি দ্বারা বুঝিয়ে নেওয়া যায় না, রাগিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। তাছাড়া সুপ্রিয়ার অতিরিক্ত স্বামী ভক্তিতে নন্দিনী ইতিমধ্যে বিরক্ত। তাই এই অন্ধ রমণীকে নিয়ে তার পক্ষে একা নৌকা ভ্রমণ যাওয়া কতটা সমস্যা জনক হতে পারতো, সেই কথা নন্দিনীর মাথায় এল না। তাছাড়া পল্লী সমাজ শহরের মতো আধুনিক নয়। এই কথা নন্দিনী না জানলেও বাড়ির বাকি মেয়েরা ভালোই জানতো। পল্লী অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত ঘরের রমণীদের নির্বিবাদে ঘোরা ফেরা দৃষ্টি কটুও বটে এবং বিপদজনকও বটে।
তাই এই বিষয়ে অল্প তর্কবিতর্কের পর সুপ্রিয়ার সঙ্গে নন্দিনীর কথা হলো বন্ধ। এরপর সমীর তাদের নৌকা ভ্রমণ করালেও নন্দিনীর অভিমান কাটলো না। তবে সে দু'দিন আগের কথা।আজ ভোরে সুপ্রিয়া উঠে পুকুর ঘাটে যাবার আগে নন্দিনীই কথা শুরু করলো। অবশ্য কথা বন্ধও সেই করেছিল। সুপ্রিয়ার ওসবের বালাই নেই। এই সব ছোটখাটো মনমালিন্য সে ভুবন ভোলানো হাসি হেসেই উড়িয়ে দিয়ে থাকে।
নন্দিনীর জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে ইতি মধ্যে। তবে সে মনমালিন্য হলেও সুপ্রিয়ার ঘরের শুয়েছিল। এতে অবশ্য সুপ্রিয়া কোন সমস্যা হয়নি। তার ছেলে মেয়ের কেউই তার সাথে শোয় না। বড় মেয়েটি কমলার সাথে আর ছেলে সঙ্গি করেছে তার দাদা মশাইকে। তবে সুপ্রিয়া ও নন্দিনীর অতিরিক্ত কাছে আসা সমীর জন্যে খানিক সমস্যার হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু এখন সে কথা থাক। আপাতত পুকুরের শীতল জলে মৃদুমন্দ ঢৈউ তুলে তিন স্নানরতা রমণীর মধ্যে কি করা হচ্ছে তাই শুনি বরং,
– উফ্! রাগ ভেঙেছে তবে ছোট বউয়ের।
– আহা, আবার ওকথা তুলিস কেন কমলা?
সুপ্রিয়া ও কমলা বুক জলে নেমে কথা বলছিল, তবে নন্দিনীর সেদিকে খেয়াল ছিল না। কোত্থেকে যেন চন্দ্রপ্রভা ফুলের মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। ফুলটি নন্দিনী নতুন চিনেছে কদিন আগে। তবে সে তার স্বামীর ডাক্তারী ঘরে সম্মুখে। সেই ঘ্রাণ ত এতটা ঘুরে বাঁশ আর কলা বাগানের দেওয়াল পেরিয়ে পুকুর ঘাটে পৌঁছানোর কথা নয়!
চন্দ্রপ্রভার সুঘ্রাণ ও ভোরবেলার হাওয়াতে নন্দিনী খানিক আনমনা হয়ে গিয়েছিল। একটু দৃষ্টি ঘোরাতেই ভোরের হালকা আলোতে পুকুরের ওপারে শিমুল গাছের পাশেই ফুট খানিক উচু হলদেটে ফুলের ঝাঁক তার চোখে পরলো। দুবার ডেকে সারা না পেয়ে কমলা এবার কথা বললো সুপ্রিয়ার কানে। শুনে সুপ্রিয়া ডাকলো তাকে,
– নন্দিনী! ওদিকে কি দেখছিস ওমন করে?
– হুম!
– বলছি এমন হা করে দেখছিস কী? স্নান করতে হবে না বুঝি?
চমক ভেঙে নন্দিনী এবার নামলো পুকুরে। শীতল জলের প্রথম ছোঁয়াতে সর্বাঙ্গের লোম দাঁড়িয়ে গেল তার। হঠাৎ মনে পড়লো গতকাল সন্ধ্যে বেলায় রোয়াকে বসে সুপ্রিয়া গল্প বলছিল মেছো ভূতের। সুপ্রিয়ার হাত মুখ নেড়েচেড়ে গল্প বলার পদ্ধতি অতি আকর্ষণীয়। বিশেষ করে সুপ্রিয়ার খোকাটি তখন কুন্দনন্দিনী কোলে বসে ভয়ে ছোট-মা'র বুকে মুখ সেঁধিয়ে দিয়েছিল, খুকি দুহাতে চেপে ধরেছিল পাশে বসা ইন্দিরার হাত। শহুরে মেয়ে নন্দিনীর ভুতের ভয় না থাকলেও ভোর সকালের শান্ত হাওয়া,ও পুকুরের শীতল জলের স্পর্শ দেহ কোন অনুভুতি জাগালো, তা আর বোঝা গেল না।
//////////
কিছুতেই কিন্তু কুন্দনন্দিনীর সহিত সমীরের কথাবার্তা সহজ হচ্ছিল না। সমীর অবশ্য কুন্দনন্দিনী সাথে কয়েকবার কথাবার্তা বলার চেষ্টা চালিয়ে ছিল। কিন্তু কুন্দনন্দিনীর পক্ষ থেকে কোন সারা শব্দ পাওয়া গেল না। সংসার জীবনে প্রথম স্ত্রী তার অন্ধ হলেও অশান্তি ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিবাহের পর কুন্দনন্দিনীর আচরণে সমীরের মনে অল্প হলেও অশান্তি বাসা বেঁধেছে। তাই নিয়ে বেচারার চিন্তা ভাবনার শেষ ছিল না।
বিবাহের পর নন্দিনীর সাথে প্রথম রাত্রি যাপনের দিনে ঘরে পা রেখেই সমীরের চোখে পরে ছিল;মেয়েটি গুটিসুটি মেরে সোফায় শুয়ে। এই বিবাহ নিয়ে সমীর নিজেও সন্তুষ্ট ছিল না। তথাপি কুন্দনন্দিনীকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে সে চুপ থাকতেও পারেনি। কারণ শুধু মন্ত্র পড়ে প্রতিজ্ঞা করে আর সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে স্বামী হাওয়া যায় না। একটা সম্পর্কে আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা না থাকলে তাকে আর দাম্পত্যে বলা চলে না। তবে সেদিন কুন্দনন্দিনীকে ডাকতে গিয়ে সমীর কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল। নন্দিনী তখন জেগেই ছিল। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন ঘুম তার চোখে আসেনি। সে যতই আধুনিক হোক না কেন বুকে তার রমণীর কোমল মন। সেই মন নিস্তব্ধ রাত্রিতে অজানা এক পুরুষের কাছে খানিক ভীতু হয়ে পরেছিল। অবশ্য মনবল ফিরে আসতে তার সময় লাগেনি বেশি। স্বামীর ডাকে সারা সে দিয়েছিল তীব্র স্বরে,
– আপনি এই বিয়ে কেন করলেন?
সমীর চমকে গিয়েছিল। সত্য বলতে এমন অভ্যর্থনা সে আশা করেনি মোটেও। বিশেষ করে কেউ তাকে বলেই নি কুন্দনন্দিনীর এই বিবাহে কোন আপত্তি আছে। তাই এই প্রশ্নের জবাবে খানিক হতবাক হয়ে সে জানতে চেয়েছিল, এবং জানার পর বলেছিল,
– মানে! তুমি এই বিয়েতে রাজি নয় এই কথা আগে বলনি কেন?
নন্দিনী বলেছিল বটে,একথা আমাদের অজানা নয়। তবে সবার বোঝানোর ধাক্কায় বেসামাল হয়ে বিয়ে সে বসলেও — একাকী এই ঘরে নিজের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কুন্দনন্দিনীর চোখে হয়ে উঠেছিল স্পষ্ট। শহরে অঞ্চলের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে তাকে যেতে হবে ঘুমট মারা শান্ত নিস্তেজ পাড়া গাঁয়ে! এটি তার মতো মেয়ের জন্যে মেনে নেওয়া সহজ কথা নয়। তাই হয়তো তার চোখের কোণে জমেছিল জল।নিজের ভাবনায় আনমনা কুন্দনন্দিনীর চোখের জল মুছিয়ে দিতে সমীর তখন বারিয়ে দিয়েছি তার হাত। তখন হঠাৎ সচেতন হয়ে তীব্র কন্ঠে নন্দিনী এক রকম চিৎকারই করেছিল বৈ কি। বলেছিল
– আপনি আমার গায়ে হাত দিলেই চিৎকার করবো। ধরুন একবার ধরে দেখুন।
মনে মনে সমীর ভেবে ছিল “কি ত্যাদর মেয়েরে বাবা!” তার পর নিজেই সিগারেট ধরিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। ভয় ছিল মেয়েটার চিৎকারে বাড়ির সবাই না দোতলায় উঠে আসে। তবে বোধকরি ভগবান প্রসন্ন ছিলেন সেদিন,তাই রক্ষা।
তা শহরে যাই হোক, পরে গ্রামে এসে কুন্দনন্দিনী এমন নিশ্চুপ অবহেলায় সমীরের মনে খানিক ভাবনা ঢুকিয়েছে। রাশভারী স্বভাব সমীরের নয়। তবে রঙ্গরসের মূল্য যে বোঝে না তার সহিত সে সব করে ভাব জমানো ত সহজ কথা নয়। কিন্তু আজীবন দূরত্ব ধরে রাখাও তো কাজের কথা নয়। বিবাহ যখন হয়েছে ভাব জমানোর চেষ্টা তো অল্প হলেও করা চাই । আর নয়তো যে সমাধানে যেতে হয় সেই উপায়ে পিতার বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশঙ্কাই বেশী। কিন্তু অমন রসকষহীন মেয়ের সাথে কি করে ভাব জমাবে সমীর তা ভেবে পায় না। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে সমীর যখন দু'চোখ বুঝে বসে ছিল নিজের ঘরে। তখন হঠাৎ কানের অতি নিকটে লাগলো সুপ্রিয়ার কন্ঠস্বরে গানের ছন্দ,
সমীর ভাবনায় খানিক বেশিই ডুবেছিল। নয়তো দুই রমণীর পায়ে থাকা ঝুমঝুম নূপুরে ধ্বনি তার কানে যেত। আজ দুপুরে খাবার সময় সমীর অনিহা প্রকাশ করায় সুপ্রিয়ার সাথে খাবার হাতে এসে ছিল নন্দিনী। স্বামীর সাথে সুপ্রিয়ার সম্পর্ক মুধুর। তবে গানের ছন্দে বোধহয় প্রকাশ পেল বিরহ। দূরত্বটা যে তারই জন্যে এটি নন্দিনীর অজানা ছিল না। তাই খাবার রেখে সে হয়তো চলেই যেতো, কিন্তু বাদ সাধল সুপ্রিয়া। যাই বলে পা বাড়াতেই সুপ্রিয়া প্রমাদ গোনে,
– ওকি লো! এমনি চলে গেল হবে কি করে?
– কিন্তু দিদি....
– উঁহু্, ওসব হবে না ভাই। রেধেছি আমি, এবার সামনে বসে খাওয়ানো দ্বায়িত্বও কি আমি নেব নাকি? বলি একটু হাঁফ ছাড়তেও দিবি না কি ছোট?
এরপর নন্দিনীর আর যাওয়া চলে না। অগত্যা মেঝেতে আসন পেতে স্বামীর খাওয়া-দাওয়ার তদারকি করতে বসলো সে। সুপ্রিয়া অবশ্য চলে গেল না। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকা শর্তেও একখানা হাতপাখা হাতে বিনা কারণে করতে লাগলো হাওয়া। সেই সাথে দুই বধূর মধ্যে চললো ভাঙা ভাঙা কথা বার্তা। সে সবে অবশ্য সমীরের যোগদানের প্রয়োজন ছিল না। সে খাবারের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছিল সুপ্রিয়া পানে।
সুপ্রিয়ার সহিত দাম্পত্য জীবনে তার দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের। ঐ রমণী দেহের প্রতি বাঁকের সাথে তার পরিচয় গাঢ়। তবুও আজ এই মেঘ ঘন পরিবেশে সুপ্রিয়াকে মনে হয় এক ছন্দময় গীতিকবিতা— যার প্রতিটি ভাঁজে, প্রতিটি রেখায় লুকিয়ে রয়েছে একেকটি অধ্যায়। কাজল রাঙা ওই দৃষ্টি হীন চোখে আছে যেন দিগন্তছোঁয়া গভীরতা, যেন সেখানে মিশে থাকে গোধূলির রঙ। তার পাতলা কোমল ওষ্ঠাধর যেন শব্দ না উচ্চারণ করেও বলে যেতে পারে শত গল্প—কখনো প্রেমের, কখনো প্রতিবাদের। এতো নারী দেহ নয়,যেন এক জীবন্ত কবিতা। কেবল মাত্র সাত দিনের দূরত্বে মনে যে এই রূপ ভাবনার ঘনঘটা তৈরি হতে পারে তা কে জানতো! কুন্দনন্দিনী তো পরের কথা– আজ রাত্রিতে এই নারী দেহ বুকে না জড়ালে সমীরের ঘুম আসবে কি না সন্দেহ.....
লিখতে লিখতে মাঝেমধ্যে আমি যৌনতা ভুলে যাই,তবে পরের পর্বে কিছু থাকবে, আপাতত এটুকুই চলুক। ও আর একটি কথা– গল্পটা খানিক স্লো চলছে এবং খুব সম্ভবত ঈদের শেষ হবার আগ পর্যন্ত এর গতি বাড়বে না- বড় আপডেট ত দূরের কথা। তবে আমি চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।❤️
দশ-বার দিন যেতেই কুন্দনন্দিনী বুঝলো কিরণের এখানে আসা যাওয়া যখন তখন। মুখার্জি পরিবার ত বটেই, সুপ্রিয়ার সাথেও সর্ম্পক তার গাঢ়। অবশ্য সুপ্রিয়ার সহিত বাড়ির প্রায় সকলের সম্পর্কই গাঢ়। বোধকরি দৃষ্টি না থাকায় সকলকেই এই দৃষ্টিহীনা রমণী মনের দাড়িপাল্লায় এক ভাবেই ওজন করিয়া থাকে। তাছাড়া বিশেষ করে সিন্দু, ইন্দিরা ও কিরণ ছোট বেলা থেকে সুপ্রিয়ার কাছে মায়ের মতো আদর-স্নেহ পেয়ে এসেছে। সে ক্ষেত্রে আলাদা একটা মাতৃশক্তিও তাদের মধ্যে খাটে বৈ কি। কুন্দনন্দিনী এতে অবাক হয়না, কেন না সে নিজেও সুপ্রিয়ার মাতৃত্বে মুগ্ধ।
এছাড়া কিরণের বাড়ি খুব বেশি দূর নয়। এই বাড়ির সদর দুয়ার থেকে বেরিয়ে পায়ে হেঁটে বাগান পেরিয়ে পাঁচ-ছ মিনিটেই পৌঁছানো যায়। কিরণের বাবা মা কেউ নেই। এক কাকা আছে তার ছেলেপুলে হয়নি। কাকিমা'টি তার বছরের ছ'মাস নানান রোগব্যাধি নিয়ে বিছানাতেই পরিয়া থাকে। বাড়ির এই অবস্থায় কিরণ প্রায় সময় অবসর বিনোদন করতে আসে এ বাড়িতে। বোধকরি এই সূত্রেই সুপ্রিয়া দেবীর মাতৃস্নেহের আঁচলে কিরণ সহজেই এসেছিল। তবে স্নেহের বাঁধনে বাঁধলেও সুপ্রিয়া কিরণকে সম্পুর্ণ কাছে না পাওয়াতে শাসনের ভাগটায় কমতি রয়ে গেল। ওপর দিকে কিরণের কাকিমার অতিরিক্ত আদরে কিরণের লাগাম হীন জীবন যাত্রা হাটলো খানিক মন্দ পথে। এই ব্যাপারে আধুনিক কলকাতার দূষিত হাওয়াও খানিক দায়ি।
জমিদার বাড়ির পরে গ্রামের কিছু সম্ভ্রান্ত পরিবারের মধ্যে পাশাপাশি বাসরত সমীর ও কিরণের পরিবার বিখ্যাত। এই খ্যাতি অবশ্য দুই পরিবারের দুই রকমের। গ্রামের লোকে বলিয়া থাকে সমীর মুখার্জি লোকের প্রাণ রক্ষা করে আর কেদার চাটুজ্যে গলা কাটেন! যদিও গলা কাটাকাটিতে তিনি ছুড়ি বা চাকুর ব্যবহার করেন না। এই বিষয়ে তার একমাত্র অস্ত্র অর্থ। সেই অর্থে তিনি দালালি ও মহাজনি কাজ কারবার চালান। সুদের কারবার তার চড়া দরের। তাছাড়া মেজাজ ও স্বভাবের দিক দিয়ে লোক সে সুবিধার নয়। তবে দাদা বৌদির মৃত্যুর পর কিরণের লালনপালনের দায়িত্ব কেদার চাটুজ্যে আগ বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। হয়তো নিজের অপুত্রবতি রমণীর মন রাখতেই নিয়েছিলেন। কারণ কিরণের প্রতি তাহার কাকিমা গভীর ভালোবাসার কথা লোকের অজানা নয়। নিজের সন্তানআদি না থাকায় এই ভালোবাসা খানিক অতিরিক্ত।
তা সেই যাই হোক, এই বাড়িতে কিরণের ঘনঘন যাতায়াতে নন্দিনী হতো বিরক্ত। প্রথম প্রথম যদিও সে নিজেকে খানিক লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিল। তবে কিরণের এত ঘনঘন যাতায়াতে ও কাজ সম্ভব হবার নয়। অবশ্য সে এও ভাবলো, শুধু শুধু নিজেকে সে লুকিয়ে রাখবে কেন? কোন অপরাধ তো সে করেনি। দোষ যদি কিছু থাকে, সে কিরণের! বহু ঘাটের জল খেয়ে কুন্দনন্দিনীর কাছে প্রেম নিবেদন করার সাহস সে পায় কোথায় ? আমাদের কুন্দনন্দিনী মোটেও সহজ মেয়ে নয়। যদিও কিরণের বহু ঘাটে জল খাওয়া নিয়ে নন্দিনী নিশ্চিত নয়। বোধকরি এই কারণেই খানিক অনিশ্চয়তায় কিরণের সম্মুখে যেতে তার হতো অসস্থী। তবে কিরণের সস্থী বা অসস্থী কোনটাই হয় কি না— তা বোঝা যায় না। সে যথারীতি অন্দরে ঢুকে বৌরাণী বলে ডেকে উঠে জোর গলায়। ভাবটা এমন যে তার আগমণের খবর বাড়ির সবার কানে যাওয়া চাই। কিরণের এই অভ্যেসটা পুরাতন। তবে কুন্দনন্দিনী কিন্তু ভাবে এই রকম গলা ফাটিয়ে চিৎকার বুঝি তার জন্যে। এই ভেবে রাগে লাল হয় তার গাল। কিন্তু রাগ তো তার শুধু কিরণের উপরে নয়। দিন কয়েক সুপ্রিয়া স্বামী ভক্তি নিয়ে নন্দিনীকে জ্বালিয়ে মারছে। শান্ত অপরাহ্নে পুকুর ঘাটে বসে সুপ্রিয়া মাঝে মধ্যেই বলে,
– যা হয়ে গিয়েছে তা কি আর বদলানো যায় না বদলানো সম্ভব? শুধু শুধু সংসারে অশান্তি টেনে লাভ কি তুই বল?
কুন্দনন্দিনী সে কথা জানে না। তাই উত্তরও সে করলো না। তাকে চুপ দেখে সুপ্রিয়া বললো,
– গ্রামে থেকে অভ্যেস নেই ত তাই মন বসছে না। কদিন গেলে মন বসে যাবে দেখিস।
সুপ্রিয়া বলেছিল বটে। তবে সামান্য বৃষ্টিতেই যেখানে জল জমে হয় কাঁদা,গৃহবধূ বলে চার দেয়ালের মাঝে থাকতে হয় বন্দি, সেখানে এতো অল্পেই নন্দিনীর মতো অধুনিকার মন বসার কথা নয়। জীবন নিয়ে চিন্তা ভাবনা তার ছিল ভিন্ন। বাবার পছন্দের বিয়ের করলেও বরেটির সাথে পরিচয় তার ছিল দীর্ঘদিনের। সে হয়তো সমীরের মতো বড় লোক ঘরের ডাক্তার সাহেব ছিল না, তবে দেখতে সে ছিল সুপুরুষ। সেই সাথে আধুনিকতার কোন কমতি তার মধ্যে ছিল কি না সন্দেহ। তার চাইতেও বড় কথা সে দূর্বল চিন্তা ভাবনার গ্রাম্য ভুত নয় মোটেও। সুতরাং ভাগ্যের ফেরে কালো মত এক পাড়াগাঁয়ের ডাক্তারের সাথে বিবাহে কুন্দনন্দিনী সুখী হবার কথা নয়। সে সুপ্রিয়ার মতো গ্রাম্য সাদাসিধে রমণী নয়। তাই আজীবন ঠাকুর পূজো আর স্বামীর সেবা করে সুপ্রিয়া সর্বদা হাসলেও নন্দিনী তা পারবে কেন?
অবশ্য মনে মনে এই সব ভাবলেও নন্দিনী কিন্তু চার দেওয়ালে বন্দিনী হয়ে থাকতো না। গ্রামের অনেক মেয়েরাই মুখার্জির বাড়ির পুকুরে স্নান করতে আসতো। নন্দিনীর কাজকর্মের বালায় ছিল না। কাজকর্ম বিশেষ সে পারতোও না। তাই সুপ্রিয়ার ময়না পাখিটার খাদ্যের যোগান দিয়ে অবসর সময়টা সে গ্রাম্য মেয়েদের সাথে খানিক কথা বলতে যেত পুকুর ঘাটে। যদিও নন্দিনীর সহিত তাদের কথাবার্তা সুপ্রিয়ার মতো জমতো না। তবে সময় কাটা নিয়ে কথা,সে তার ভালোই কাটতো। মাঝে মাঝে সুপ্রিয়া তাকে ডাকতো রান্না ঘরে। প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও রান্না না পারায় কুন্দনন্দিনী বিরক্তিতে ফেটে পরে বলতো,
– ও কাজ আমার দ্বারা হবে না দিদি।
এই শুনে কেঊ হাসতো, কেউ বা বলতো বাঁকা কথা। সবাই যে সম্মুখে বলতো তাও নয়, কেউ কেউ বলতো আড়ালে। নন্দিনী লজ্জা ত পেতোই, তবে রাগটাও তার কম হতো না। তখন কুন্দনন্দিনী রাগ দেখে সুপ্রিয়া হেসে বলতো,
– তা বললেই হলো? আচ্ছা, তুই যখন প্রথমবার নাচ শিখতে যাস তখন কি একদিনেই শেখা হয়েছিল?
নন্দিনী এবার মৃদু স্বরে বললে,
– না,সে একদিনে শেখার কর্ম নয় দিদি।
– তা রান্নাটাও ত একদিনে শেখার কর্ম নয় ভাই। ভালো নাচতে ও গাইতে শেখা যেমন সময়ের ব্যাপার,তেমনি রান্নাটাও।
– সে ত বুঝলাম। তবে দিদি, নাচ গানে নাম ডাক হয়, কিন্তু ভালো রাঁধতে শিখে কি হয় বল?
কুন্দনন্দিনীর কথায় সুপ্রিয়ার মুখখানি হাসিতে হয়েছিল উজ্জ্বল। তারপর এগিয়ে এসে দুহাতে নন্দিনীর গলা জড়িয়ে সে বলেছিল,
– লোকের মন পাওয়া হয় ভাই! নাচ- গান সে ত চোখের শান্তি। কিন্তু উদরের রাস্তায় লোকের হৃদয়ে পৌঁছানো সহজলভ্য। হাজার হোক চোখের চাইতে উদর আর হৃদয়ের দূরত্ব কম।
কথা খানিক জটিল। তবে সুপ্রিয়ার বলার ভঙ্গিতে কমবেশি সবারই পায় হাসি। ওটি সুপ্রিয়ার বিশেষত্ব। সে প্রাণ খুলে হাসতে ও হাসাতে জানে।তারপর আর একদিন নদীর ধারের কৃষ্ণ মন্দির ও নৌকা করে রাধাপুরের সরকার কলেজটাও নন্দিনী ঘুরে এলো। তবে ঘটনা এই দুখানাও সহজে ঘটলো না।
মন্দিরে যাবার দিন সমীর বাড়িতে ছিল না। একটু দূর হলেও বাড়ির অনেক মেয়েরাই গিয়েছিল পূজো দিতে। তবে রাধাপুরে যাবার সময় সুপ্রিয়া বেঁকে বসলো। রাধাপুরের কলেজ কাছে নয়। তাছাড়া স্বামীর অনুমতি না নিয়ে সে যেতেও রাজি নয়। বাড়ির অন্য মেয়েদেরও একই অবস্থা। যুক্তি দ্বারা ভাবলে নন্দিনী হয়তো সুপ্রিয়ার এমন আচরণের কারণ বুঝতে পারতো। তবে কলেজ শাস্ত্রের শিক্ষা ছাড়া বাস্তবিক অর্থে অধিকাংশ সময়েই মানুষকে যুক্তি দ্বারা বুঝিয়ে নেওয়া যায় না, রাগিয়ে দেওয়া যায় মাত্র। তাছাড়া সুপ্রিয়ার অতিরিক্ত স্বামী ভক্তিতে নন্দিনী ইতিমধ্যে বিরক্ত। তাই এই অন্ধ রমণীকে নিয়ে তার পক্ষে একা নৌকা ভ্রমণ যাওয়া কতটা সমস্যা জনক হতে পারতো, সেই কথা নন্দিনীর মাথায় এল না। তাছাড়া পল্লী সমাজ শহরের মতো আধুনিক নয়। এই কথা নন্দিনী না জানলেও বাড়ির বাকি মেয়েরা ভালোই জানতো। পল্লী অঞ্চলে সম্ভ্রান্ত ঘরের রমণীদের নির্বিবাদে ঘোরা ফেরা দৃষ্টি কটুও বটে এবং বিপদজনকও বটে।
তাই এই বিষয়ে অল্প তর্কবিতর্কের পর সুপ্রিয়ার সঙ্গে নন্দিনীর কথা হলো বন্ধ। এরপর সমীর তাদের নৌকা ভ্রমণ করালেও নন্দিনীর অভিমান কাটলো না। তবে সে দু'দিন আগের কথা।আজ ভোরে সুপ্রিয়া উঠে পুকুর ঘাটে যাবার আগে নন্দিনীই কথা শুরু করলো। অবশ্য কথা বন্ধও সেই করেছিল। সুপ্রিয়ার ওসবের বালাই নেই। এই সব ছোটখাটো মনমালিন্য সে ভুবন ভোলানো হাসি হেসেই উড়িয়ে দিয়ে থাকে।
নন্দিনীর জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে ইতি মধ্যে। তবে সে মনমালিন্য হলেও সুপ্রিয়ার ঘরের শুয়েছিল। এতে অবশ্য সুপ্রিয়া কোন সমস্যা হয়নি। তার ছেলে মেয়ের কেউই তার সাথে শোয় না। বড় মেয়েটি কমলার সাথে আর ছেলে সঙ্গি করেছে তার দাদা মশাইকে। তবে সুপ্রিয়া ও নন্দিনীর অতিরিক্ত কাছে আসা সমীর জন্যে খানিক সমস্যার হয়ে দাঁড়ালো। কিন্তু এখন সে কথা থাক। আপাতত পুকুরের শীতল জলে মৃদুমন্দ ঢৈউ তুলে তিন স্নানরতা রমণীর মধ্যে কি করা হচ্ছে তাই শুনি বরং,
– উফ্! রাগ ভেঙেছে তবে ছোট বউয়ের।
– আহা, আবার ওকথা তুলিস কেন কমলা?
সুপ্রিয়া ও কমলা বুক জলে নেমে কথা বলছিল, তবে নন্দিনীর সেদিকে খেয়াল ছিল না। কোত্থেকে যেন চন্দ্রপ্রভা ফুলের মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছিল। ফুলটি নন্দিনী নতুন চিনেছে কদিন আগে। তবে সে তার স্বামীর ডাক্তারী ঘরে সম্মুখে। সেই ঘ্রাণ ত এতটা ঘুরে বাঁশ আর কলা বাগানের দেওয়াল পেরিয়ে পুকুর ঘাটে পৌঁছানোর কথা নয়!
চন্দ্রপ্রভার সুঘ্রাণ ও ভোরবেলার হাওয়াতে নন্দিনী খানিক আনমনা হয়ে গিয়েছিল। একটু দৃষ্টি ঘোরাতেই ভোরের হালকা আলোতে পুকুরের ওপারে শিমুল গাছের পাশেই ফুট খানিক উচু হলদেটে ফুলের ঝাঁক তার চোখে পরলো। দুবার ডেকে সারা না পেয়ে কমলা এবার কথা বললো সুপ্রিয়ার কানে। শুনে সুপ্রিয়া ডাকলো তাকে,
– নন্দিনী! ওদিকে কি দেখছিস ওমন করে?
– হুম!
– বলছি এমন হা করে দেখছিস কী? স্নান করতে হবে না বুঝি?
চমক ভেঙে নন্দিনী এবার নামলো পুকুরে। শীতল জলের প্রথম ছোঁয়াতে সর্বাঙ্গের লোম দাঁড়িয়ে গেল তার। হঠাৎ মনে পড়লো গতকাল সন্ধ্যে বেলায় রোয়াকে বসে সুপ্রিয়া গল্প বলছিল মেছো ভূতের। সুপ্রিয়ার হাত মুখ নেড়েচেড়ে গল্প বলার পদ্ধতি অতি আকর্ষণীয়। বিশেষ করে সুপ্রিয়ার খোকাটি তখন কুন্দনন্দিনী কোলে বসে ভয়ে ছোট-মা'র বুকে মুখ সেঁধিয়ে দিয়েছিল, খুকি দুহাতে চেপে ধরেছিল পাশে বসা ইন্দিরার হাত। শহুরে মেয়ে নন্দিনীর ভুতের ভয় না থাকলেও ভোর সকালের শান্ত হাওয়া,ও পুকুরের শীতল জলের স্পর্শ দেহ কোন অনুভুতি জাগালো, তা আর বোঝা গেল না।
//////////
কিছুতেই কিন্তু কুন্দনন্দিনীর সহিত সমীরের কথাবার্তা সহজ হচ্ছিল না। সমীর অবশ্য কুন্দনন্দিনী সাথে কয়েকবার কথাবার্তা বলার চেষ্টা চালিয়ে ছিল। কিন্তু কুন্দনন্দিনীর পক্ষ থেকে কোন সারা শব্দ পাওয়া গেল না। সংসার জীবনে প্রথম স্ত্রী তার অন্ধ হলেও অশান্তি ছিল না। কিন্তু দ্বিতীয় বিবাহের পর কুন্দনন্দিনীর আচরণে সমীরের মনে অল্প হলেও অশান্তি বাসা বেঁধেছে। তাই নিয়ে বেচারার চিন্তা ভাবনার শেষ ছিল না।
বিবাহের পর নন্দিনীর সাথে প্রথম রাত্রি যাপনের দিনে ঘরে পা রেখেই সমীরের চোখে পরে ছিল;মেয়েটি গুটিসুটি মেরে সোফায় শুয়ে। এই বিবাহ নিয়ে সমীর নিজেও সন্তুষ্ট ছিল না। তথাপি কুন্দনন্দিনীকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে সে চুপ থাকতেও পারেনি। কারণ শুধু মন্ত্র পড়ে প্রতিজ্ঞা করে আর সিঁথিতে সিঁদুর রাঙিয়ে স্বামী হাওয়া যায় না। একটা সম্পর্কে আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা না থাকলে তাকে আর দাম্পত্যে বলা চলে না। তবে সেদিন কুন্দনন্দিনীকে ডাকতে গিয়ে সমীর কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিল। নন্দিনী তখন জেগেই ছিল। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন ঘুম তার চোখে আসেনি। সে যতই আধুনিক হোক না কেন বুকে তার রমণীর কোমল মন। সেই মন নিস্তব্ধ রাত্রিতে অজানা এক পুরুষের কাছে খানিক ভীতু হয়ে পরেছিল। অবশ্য মনবল ফিরে আসতে তার সময় লাগেনি বেশি। স্বামীর ডাকে সারা সে দিয়েছিল তীব্র স্বরে,
– আপনি এই বিয়ে কেন করলেন?
সমীর চমকে গিয়েছিল। সত্য বলতে এমন অভ্যর্থনা সে আশা করেনি মোটেও। বিশেষ করে কেউ তাকে বলেই নি কুন্দনন্দিনীর এই বিবাহে কোন আপত্তি আছে। তাই এই প্রশ্নের জবাবে খানিক হতবাক হয়ে সে জানতে চেয়েছিল, এবং জানার পর বলেছিল,
– মানে! তুমি এই বিয়েতে রাজি নয় এই কথা আগে বলনি কেন?
নন্দিনী বলেছিল বটে,একথা আমাদের অজানা নয়। তবে সবার বোঝানোর ধাক্কায় বেসামাল হয়ে বিয়ে সে বসলেও — একাকী এই ঘরে নিজের ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি কুন্দনন্দিনীর চোখে হয়ে উঠেছিল স্পষ্ট। শহরে অঞ্চলের জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশ ছেড়ে তাকে যেতে হবে ঘুমট মারা শান্ত নিস্তেজ পাড়া গাঁয়ে! এটি তার মতো মেয়ের জন্যে মেনে নেওয়া সহজ কথা নয়। তাই হয়তো তার চোখের কোণে জমেছিল জল।নিজের ভাবনায় আনমনা কুন্দনন্দিনীর চোখের জল মুছিয়ে দিতে সমীর তখন বারিয়ে দিয়েছি তার হাত। তখন হঠাৎ সচেতন হয়ে তীব্র কন্ঠে নন্দিনী এক রকম চিৎকারই করেছিল বৈ কি। বলেছিল
– আপনি আমার গায়ে হাত দিলেই চিৎকার করবো। ধরুন একবার ধরে দেখুন।
মনে মনে সমীর ভেবে ছিল “কি ত্যাদর মেয়েরে বাবা!” তার পর নিজেই সিগারেট ধরিয়ে বেরিয়ে এসেছিল বাইরে। ভয় ছিল মেয়েটার চিৎকারে বাড়ির সবাই না দোতলায় উঠে আসে। তবে বোধকরি ভগবান প্রসন্ন ছিলেন সেদিন,তাই রক্ষা।
তা শহরে যাই হোক, পরে গ্রামে এসে কুন্দনন্দিনী এমন নিশ্চুপ অবহেলায় সমীরের মনে খানিক ভাবনা ঢুকিয়েছে। রাশভারী স্বভাব সমীরের নয়। তবে রঙ্গরসের মূল্য যে বোঝে না তার সহিত সে সব করে ভাব জমানো ত সহজ কথা নয়। কিন্তু আজীবন দূরত্ব ধরে রাখাও তো কাজের কথা নয়। বিবাহ যখন হয়েছে ভাব জমানোর চেষ্টা তো অল্প হলেও করা চাই । আর নয়তো যে সমাধানে যেতে হয় সেই উপায়ে পিতার বন্ধুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হবার আশঙ্কাই বেশী। কিন্তু অমন রসকষহীন মেয়ের সাথে কি করে ভাব জমাবে সমীর তা ভেবে পায় না। এই ভাবনা মাথায় নিয়ে সমীর যখন দু'চোখ বুঝে বসে ছিল নিজের ঘরে। তখন হঠাৎ কানের অতি নিকটে লাগলো সুপ্রিয়ার কন্ঠস্বরে গানের ছন্দ,
“সখী কার বাঁশরি সুর তলেছে বদল ঘন এই দুপুরে”
“কোথায় গেলে পাইবো তারে, কোন বিজনে, কোন বা বনে”
সমীর ভাবনায় খানিক বেশিই ডুবেছিল। নয়তো দুই রমণীর পায়ে থাকা ঝুমঝুম নূপুরে ধ্বনি তার কানে যেত। আজ দুপুরে খাবার সময় সমীর অনিহা প্রকাশ করায় সুপ্রিয়ার সাথে খাবার হাতে এসে ছিল নন্দিনী। স্বামীর সাথে সুপ্রিয়ার সম্পর্ক মুধুর। তবে গানের ছন্দে বোধহয় প্রকাশ পেল বিরহ। দূরত্বটা যে তারই জন্যে এটি নন্দিনীর অজানা ছিল না। তাই খাবার রেখে সে হয়তো চলেই যেতো, কিন্তু বাদ সাধল সুপ্রিয়া। যাই বলে পা বাড়াতেই সুপ্রিয়া প্রমাদ গোনে,
– ওকি লো! এমনি চলে গেল হবে কি করে?
– কিন্তু দিদি....
– উঁহু্, ওসব হবে না ভাই। রেধেছি আমি, এবার সামনে বসে খাওয়ানো দ্বায়িত্বও কি আমি নেব নাকি? বলি একটু হাঁফ ছাড়তেও দিবি না কি ছোট?
এরপর নন্দিনীর আর যাওয়া চলে না। অগত্যা মেঝেতে আসন পেতে স্বামীর খাওয়া-দাওয়ার তদারকি করতে বসলো সে। সুপ্রিয়া অবশ্য চলে গেল না। আবহাওয়া ঠান্ডা থাকা শর্তেও একখানা হাতপাখা হাতে বিনা কারণে করতে লাগলো হাওয়া। সেই সাথে দুই বধূর মধ্যে চললো ভাঙা ভাঙা কথা বার্তা। সে সবে অবশ্য সমীরের যোগদানের প্রয়োজন ছিল না। সে খাবারের ফাঁকে ফাঁকে চোখ রাখছিল সুপ্রিয়া পানে।
সুপ্রিয়ার সহিত দাম্পত্য জীবনে তার দীর্ঘ চৌদ্দ বছরের। ঐ রমণী দেহের প্রতি বাঁকের সাথে তার পরিচয় গাঢ়। তবুও আজ এই মেঘ ঘন পরিবেশে সুপ্রিয়াকে মনে হয় এক ছন্দময় গীতিকবিতা— যার প্রতিটি ভাঁজে, প্রতিটি রেখায় লুকিয়ে রয়েছে একেকটি অধ্যায়। কাজল রাঙা ওই দৃষ্টি হীন চোখে আছে যেন দিগন্তছোঁয়া গভীরতা, যেন সেখানে মিশে থাকে গোধূলির রঙ। তার পাতলা কোমল ওষ্ঠাধর যেন শব্দ না উচ্চারণ করেও বলে যেতে পারে শত গল্প—কখনো প্রেমের, কখনো প্রতিবাদের। এতো নারী দেহ নয়,যেন এক জীবন্ত কবিতা। কেবল মাত্র সাত দিনের দূরত্বে মনে যে এই রূপ ভাবনার ঘনঘটা তৈরি হতে পারে তা কে জানতো! কুন্দনন্দিনী তো পরের কথা– আজ রাত্রিতে এই নারী দেহ বুকে না জড়ালে সমীরের ঘুম আসবে কি না সন্দেহ.....
লিখতে লিখতে মাঝেমধ্যে আমি যৌনতা ভুলে যাই,তবে পরের পর্বে কিছু থাকবে, আপাতত এটুকুই চলুক। ও আর একটি কথা– গল্পটা খানিক স্লো চলছে এবং খুব সম্ভবত ঈদের শেষ হবার আগ পর্যন্ত এর গতি বাড়বে না- বড় আপডেট ত দূরের কথা। তবে আমি চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।❤️