Thread Rating:
  • 6 Vote(s) - 3.5 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
HORROR কালো কুয়াশার ছায়া
#7
রাতের আঁধার গ্রাস করেছিল জমিদার বাড়ির প্রাচীন দেয়ালগুলো। চাঁদের ক্ষীণ আলো মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছিল, আর বাতাসে ভেসে আসছিল একটা অস্বাভাবিক ঠান্ডা, যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তাদের চারপাশে ঘুরছে। জমিদার বাড়ির বিশাল প্রাঙ্গণে পুরনো বটগাছের ডালপালা বাতাসে দুলছিল, আর তাদের ছায়া মাটিতে এমনভাবে নড়ছিল যেন কোনো প্রাচীন আত্মা নিঃশব্দে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
রুদ্রনাথের হাতে একটা মশাল জ্বলছিল, কিন্তু তার আলো যেন অন্ধকারের সাথে লড়াই করে হেরে যাচ্ছিল। মশালের আগুনের কম্পমান আলোয় জমিদার বাড়ির ভাঙাচোরা দেয়ালে অদ্ভুত ছায়া পড়ছিল—কখনো মনে হচ্ছিল কোনো নারীমূর্তি হেসে উঠছে, কখনো মনে হচ্ছিল কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। 
বাতাসে একটা মিষ্টি, কিন্তু বিষাক্ত গন্ধ ভেসে আসছিল, যেন কামিনীর উপস্থিতি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে।মালতীর পায়ের নূপুর নিঃশব্দে বেজে উঠছিল, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছিল। তার মুখে দৃঢ়তা ছিল, কিন্তু চোখে একটা অজানা ভয়ের ছায়া। সে রুদ্রনাথের পাশে হাঁটছিল, কিন্তু তার হাত শক্ত করে ধরা ছিল একটা তাবিজ, যেন সেটাই তার শেষ আশ্রয়। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই তাদের পায়ের নিচে মেঝের পুরনো কাঠ ক্যাঁচ করে উঠল, আর কোথাও দূরে একটা অস্পষ্ট হাসির শব্দ ভেসে এল—মিষ্টি, কিন্তু হৃৎকম্পনকারী।
গোপন কুঠুরির দিকে যাওয়ার পথে সিঁড়িগুলো যেন অন্ধকারের গর্ভে হারিয়ে গিয়েছিল। প্রতিটি ধাপে ধুলো আর মাকড়সার জাল জমে ছিল, আর দেয়ালে খোদাই করা অদ্ভুত মূর্তিগুলো মশালের আলোয় যেন জীবন্ত হয়ে উঠছিল।

 কুঠুরির দরজায় পৌঁছতেই একটা তীব্র ঠান্ডা বাতাস তাদের গায়ে আছড়ে পড়ল, আর মালতী অস্ফুরিত স্বরে বলে উঠল, “সে এখানে আছে... আমি তার চোখ অনুভব করছি।”দরজার ওপারে কামিনীর উপস্থিতি যেন আরো তীব্র হয়ে উঠল। অন্ধকারে একটা অস্পষ্ট নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল—তার চোখে অমানুষিক লাল আভা, আর ঠোঁটে একটা ক্রুর হাসি। তার শাড়ির প্রান্ত মাটি স্পর্শ করছিল না, যেন সে ভেসে আছে। তার কণ্ঠস্বর, মধুর কিন্তু বিষাক্ত, অন্ধকারে প্রতিধ্বনিত হল, “তোমরা আমার কাছে এসেছ... কিন্তু কেউ এখান থেকে ফিরে যায় না।”রুদ্রনাথের হাতের মশাল কাঁপছিল, কিন্তু সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “তোর শক্তির উৎস আমি ধ্বংস করব, কামিনী।” কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই কুঠুরির ভেতর থেকে একটা অমানুষিক চিৎকার ভেসে এল, আর মাটি কেঁপে উঠল, যেন কামিনীর ক্রোধ পুরো বাড়িটাকে গ্রাস করতে চায়।


কিন্তু তারা কঙ্কালের কাছে যেতেই কামিনীর হাসি ঘরে গুঞ্জে উঠল। "তোরা আমার কাছে এসেছিস?" তার সাত ফুটের রূপ ঘরে ফুটে উঠল। এবার তার শরীর আরো প্রলোভনময়—তার শাড়ি প্রায় খসে পড়ছিল, আর তার চোখে একটা জ্বলন্ত কামনা। মালতী পিছিয়ে গেল, কিন্তু রুদ্রনাথ তার ত্রিশূল তুলে ধরল। "তোর শেষ এখানেই, কামিনী!"কিন্তু কামিনী হাসল। "তোর ত্রিশূল আমাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আমি এখন শুধু আত্মা নই, আমি একটা শক্তি!" 

জমিদার বাড়ির গোপন কুঠুরির অন্ধকার যেন আরও গাঢ় হয়ে উঠল। লণ্ঠনের ক্ষীণ আলো কাঁপছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে গ্রাস করতে চায়। কুঠুরির পাথরের বেদি থেকে উঠে আসা কুয়াশার মধ্যে কামিনীর রূপ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। তার চোখে জ্বলছিল এক অমানুষিক আগুন, আর তার ঠোঁটে ফুটে ছিল এক মায়াময়, কিন্তু হিমশীতল হাসি। বাতাসে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি ভেসে আসছিল, যেন সে কুঠুরির প্রতিটি কণায় ছড়িয়ে আছে।হঠাৎ কামিনী তার হাত তুলল। তার আঙুলের একটি সূক্ষ্ম নড়াচড়ায় কুঠুরির দেয়ালগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠল। দেয়াল থেকে কালো, তরলের মতো ছায়া গড়িয়ে পড়তে শুরু করল, যেন অন্ধকার নিজেই রূপ নিচ্ছে। ছায়াগুলো ধীরে ধীরে আকৃতি পেল—শ্যামল, বিকাশ, আর অন্যান্যদের বিকৃত, ভয়ঙ্কর রূপ। তাদের মুখে আর মানুষের কোনো চিহ্ন ছিল না; চোখের জায়গায় ছিল গভীর, কালো গর্ত, আর তাদের শরীর বিকৃতভাবে মুচড়ে গিয়েছিল। তাদের হাতের নখ লম্বা, ধারালো, যেন কোনো হিংস্র প্রাণীর। তাদের নড়াচড়ায় ছিল একটা অস্বাভাবিক জড়তা, কিন্তু তবু তারা রুদ্রনাথ আর মালতীর দিকে এগিয়ে আসছিল।“তোরা আমার হবে,” কামিনীর কণ্ঠ কুঠুরিতে গর্জনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। “তোদের শরীর, তোদের আত্মা... আমার!” তার হাসি আরও জোরালো হলো, যেন সে তার শিকারের ভয়ে আনন্দ পাচ্ছে। তার হাসির শব্দ কুঠুরির দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো, আর প্রতিটি প্রতিধ্বনি যেন রুদ্রনাথ আর মালতীর হৃৎপিণ্ডে ছুরির মতো বিঁধছিল।

রুদ্রনাথের হাতে ধরা তাবিজটা কাঁপছিল। তার চোখে ভয় ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে ছিল এক অদম্য জেদ। সে পিছিয়ে গেল, তার পিঠ দেয়ালে ঠেকল। ছায়ার আকৃতিগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, তাদের কালো গর্তের মতো চোখে কোনো আবেগ ছিল না—শুধু ছিল এক অতৃপ্ত ক্ষুধা। রুদ্রনাথের মনে হলো, যেন তার শরীরের সমস্ত শক্তি কেউ চুষে নিচ্ছে। তার চোখ কামিনীর দিকে ঘুরল। কামিনীর সৌন্দর্য এখনো মুগ্ধ করার মতো ছিল, কিন্তু সেই সৌন্দর্যের পিছনে লুকিয়ে ছিল এক অন্ধকার, যা যেন তার আত্মাকে গ্রাস করতে চায়।“তুই আমাদের পাবি না!” রুদ্রনাথ চিৎকার করে উঠল, তার কণ্ঠে মরিয়া সংকল্প। সে তাবিজটা শক্ত করে ধরে একটা প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল। তার কণ্ঠ কাঁপছিল, কিন্তু সে থামল না। তাবিজ থেকে একটা ক্ষীণ আলো ফুটে উঠল, যেন অন্ধকারের বিরুদ্ধে একমাত্র আশা।
মালতী রুদ্রনাথের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, তার শরীর কাঁপছিল। ছায়ার আকৃতিগুলো যখন তাদের দিকে এগিয়ে এল, তখন তার মনে পড়ে গেল কামিনীর সঙ্গে তার আগের মুখোমুখি হওয়ার কথা। সেই রাতে কামিনীর চোখ তার মনের গভীরে ঢুকে পড়েছিল, তার দুর্বলতা খুঁজে বের করেছিল। মালতীর হাত অজান্তেই তার গলায় ঝোলানো একটা পুঁতির মালায় গেল। সে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে প্রার্থনা করতে লাগল। তার কণ্ঠে ভয় ছিল, কিন্তু সেই ভয়ের মধ্যেও ছিল এক অদ্ভুত সাহস।
হঠাৎ একটা ছায়া—শ্যামলের বিকৃত রূপ—মালতীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার ধারালো নখ মালতীর মুখের কাছে এসে থামল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে দিয়েছে। মালতীর প্রার্থনার শব্দ আরও জোরালো হলো। ছায়াটি পিছিয়ে গেল, তার মুখ থেকে একটা অমানুষিক চিৎকার বেরিয়ে এলো।
কামিনী এই সব দেখছিল, তার হাসি অটুট। “তোদের সাহস আমাকে মুগ্ধ করে,” সে বলল, তার কণ্ঠে একটা বিদ্রূপের সুর। “কিন্তু এই কুঠুরি আমার। এখানে আমিই শক্তি, আমিই সত্য।” সে তার হাত বাড়াল, আর ছায়ার আকৃতিগুলো আরও দ্রুত এগিয়ে এল। বাতাসে একটা তীব্র ঠাণ্ডা ছড়িয়ে পড়ল, যেন সমস্ত জীবনশক্তি শুষে নেওয়া হচ্ছে। লণ্ঠনের আলো পুরোপুরি নিভে গেল, আর কুঠুরি অন্ধকারে ডুবে গেল।
কিন্তু অন্ধকারের মধ্যেও রুদ্রনাথের তাবিজের আলো জ্বলছিল। সেই আলো ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ল, আর ছায়ার আকৃতিগুলো পিছিয়ে গেল। কামিনীর মুখে প্রথমবারের মতো একটা ক্ষণিকের অস্বস্তি ফুটে উঠল। “এটা শেষ নয়,” সে ফিসফিস করে বলল। “আমি ফিরব, রুদ্রনাথ। আর তখন তুই আমার কাছে হাঁটু গেড়ে বসবি।” তার কথা শেষ হতেই তার রূপ কুয়াশার মতো মিলিয়ে গেল, আর ছায়ার আকৃতিগুলো দেয়ালে গলে গেল।
ঘরটা ভেঙে পড়তে শুরু করল। রুদ্রনাথ আর মালতী দৌড়ে বেরিয়ে এল। বাইরে এসে তারা দেখল, জমিদার বাড়ি পুরো ধসে গেছে। কিন্তু দূর থেকে একটা ফিসফিস ভেসে এল—"মালতী... রুদ্রনাথ... আমি তোদের ছাড়ব না..."

কুঠুরি আবার নিস্তব্ধ হলো, কিন্তু বাতাসে এখনো কামিনীর হাসির একটা ক্ষীণ প্রতিধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছিল। রুদ্রনাথ আর মালতী হাঁপাচ্ছিল, তাদের শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছিল। তারা জানত, এই যুদ্ধ এখানে শেষ হয়নি। কামিনী ফিরবে, আর তখন তাদের আরও বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবে।
।।।।।
[+] 1 user Likes Abirkkz's post
Like Reply


Messages In This Thread
RE: কালো কুয়াশার ছায়া - by Abirkkz - 04-05-2025, 11:11 AM



Users browsing this thread: 1 Guest(s)