31-03-2025, 05:19 AM
(This post was last modified: 31-03-2025, 07:23 PM by বহুরূপী. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
স্বপ্ন যাবে বাড়ি
নন ইরোটিক
– অ্যাই শুনছো! মা বলছিল তুমি নাকি এবার ঈদেও বাড়ি আসবা না?
ফোনের ওপাশ থেকে কান্না চাপা একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল। সুমন না শোনার ভান করে বললে,
– হ্যালো! হ্যালো! অ্যাই আরুসী শোন! শব্দ অনেক,কথা শোনা যাচ্ছে না! পরে কল দেবো......
তারপর ইচ্ছে করেই কল কেটে দিল সুমন। আসলে শব্দের দোষ ছিল না। সে সব শুনেছে স্পষ্টই। বুঝেছে ফোনের অন্য পাশের মিষ্টি কোমল গলার মালকিনটির দুই চোখ টলমল করে উঠেছে জলে।
“ তুমি নাকি এবার ঈদেও বাড়ি আসবা না?” কথাটা বিশেষ বড় নয় যদিও। সুমনের কাছে এটি অচেনা কোন কথাও তো নয় মোটেও। তবুও কথাটা শোনার পর চোখের কোণে জল চলে এসেছে, আর গলাটা মনে হলো কেউ যেন চেপে ধরেছে। সুমনের খুব ইচ্ছা করছিল চিৎকার করে বলে,
– আমি বাড়ি যাবো লক্ষ্মীটি। তোমার সাথে ঈদ করবো এবার, তুমি কেঁদো না!
কিন্তু চাইলেই কি সব হয়? নাকি ইচ্ছে করছে বলেই সে সব ফেলে ছুটে যেতে পারে? না! এবার ঈদেও সুমনে পক্ষে বাড়ি যাওয়াটা সম্ভব নয়। কারণ ঈদে ছুটি পাইনি সে। এই গল্পটা কোনো একজনের নয়। এটা লাখো মানুষের গল্প। আমাদের দেখা না দেখার মধ্যে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা দুই ঈদের একটায় ছুটি পায়, আরেক ঈদ কাটে কর্মস্থলের দায়িত্বে। কখনো বা তাও জোটেনা তাদের কপালে।
আমরা সবাই যখন পরিবারের সঙ্গে ঈদের খুশি ভাগ করে নিতে ব্যস্ত সময় কাটাই। তখন কারখানার কোনো এক কোণে,পাওয়ার প্ল্যান্টের কোনো কন্ট্রোল রুমে, রাস্তায় ট্রাফিক কিংবা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে,অথবা হাস্পাতালের ওয়ার্ডে শিফট ডিউটিতে থাকা কোনো একজন নিঃশব্দে নিজের আবেগ চেপে রাখে।
আমাদের সুমনও তাঁদেরই মতোই একজন। তবে এবারের ঈদে তার ছুটি পাবার কথা ছিল। গত বছর সে দুই ঈদের কোনটাতেই বাড়ি যায়নি। তাই এবার পুরো রমজানে কাজের ফাঁকে ফাঁকে সে মনের মাঝে নানান কল্পনার জাল বুনেছে। বাড়ির সকলের জন্যে কিনে বেরিয়েছে উপহার। থেকে থেকে মনে পরেছে বাবা- মায়ের মুখ,মনে পরেছে ছোট ভাইয়ের অভিযোগ আর স্ত্রী আরুসীর আবদার,
– অ্যাই শোন না! এবার ঈদে আমার বেগুন রঙের শাড়ি চাই কিন্তু! মনে থাকে যেন।
– শুধু শাড়ি! আর কিছুই লাগবে না বুঝি?
– হুম! লাগবে।
– কি লাগবে শুনি?
– তোমায়!
ঈদ মানে খুশি,ঈদ মানে একসঙ্গে আনন্দ উপভোগ করা। কিন্তু কিছু মানুষের ভাগ্যে এই খুশির পরিমাণটা অধিকাংশ সময়েই শূন্য। কখনো তারা এক ঈদে মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, ভাইবোনের হাসিমুখ দেখে, কিন্তু আরেক ঈদ কাটে কর্মস্থলে। চাকরির সুবাদে বেশিরভাগ ঈদেই ছুটি মেলে না সুমনের। মিললেও এক ঈদে ছুটি পেলে আরেক ঈদে পাওয়া যায় না। ব্যপারটা অবশ্যই খুব কষ্টদায়ক। একটা পরিবারের জন্য, একটা দায়িত্বের জন্য,এ কষ্টটুকু হাসিমুখেই মেনে নেয় সুমন। এবারেও হয়তো নিত। কিন্তু গত বছর সে নতুন বিয়ে করেছে। বিয়ে করেছে পছন্দের মানুষটিকে। প্রাণ প্রিয়া আরুসী। তিন বছরের প্রেমময় মিষ্টি মধুর বিরহের পর মিলন। কিন্তু বিয়ের পর গতবার ঈদ উদযাপন করা হয়নি তার সাথে। খুব সম্ভবত এবারেও হবে না। ছুটি পাবে না শুনে সুমন আবেদন করে ছুটি নেবার চেষ্টা করেছে,মরিয়ার চেষ্টা। তবে যত সময় যাচ্ছে ততই তাঁর আশার আলো যাচ্ছে নিভে। হাতে আছে আর দিন কয়েক। তাই থেকে থেকে মনে পরে কদিন আগেই সুমনের বাবা বলেছিল,
– সবাই বাড়ি চলে আসছে তুই না আসলে কিভাবে হয়।
– এবারেও মনে হয় ছুটি পাবো না বাবা। মা'কে বুঝিয়ে বলো তুমি।
কিংবা ছোট ভাইটির অভিযোগ,
– ভাইয়া, তুই আসলে জমতো! কোন ভাবে ছুটি নেওয়া যায় না? গত বারেও ত.....
– ধুর পাগল! আমি না থাকলেও জমবে। তাছাড়া পরের ঈদে তো থাকবো!
পরের ঈদে থাকবে এই কথা নিশ্চিত করে বলা চলে না। তবুও আপন জনের মন রাখা। হয়তো মিথ্যে আশা ছাড়া অন্য কিছুই নয়, তবুও খনিকের শান্তি। তাঁদের এই ত্যাগের গল্প কেউ লেখে না, হয়তো অনেকে জানেই না কিংবা চোখে পরলেও নিজেদের ব্যস্ততায় সেই মানুষগুলো কে নিয়ে ভেবে দেখবার সুযোগ পায় না। তবুও সুমনের মতো হাজারো মানুষ শ্রম দেয় যেন ইন্ডাস্ট্রি চলে, যেন অর্থনীতি সচল থাকে, যেন অসুস্থ মানুষটা সঠিকভাবে চিকিৎসা পায়, যেন সাধারণ জনগণ নিরাপদে আনন্দ উপভোগ করতে পারে,থাকতে পারে স্বস্তিতে। শহরের রাজপথে, হাসপাতালে কিংবা রেলস্টেশনে যে লোক গুলো আর সকল মানুষের ঠিকভাবে বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে শ্রম দেয়। তাঁদের ত্যাগ কেই বা মনে রাখে?
ইফতারের পর সুমন সংবাদটা পায়,কথাটা যেন বিশ্বাস হয় না তাঁর। আগামী ৩১ মার্চ থেকে ঈদের ছুটি মঞ্জুর হয়েছে সুমনের। রোজা ২৯টি হলে ওইদিনই ঈদ হওয়ার কথা। অবশ্য এ নিয়ে আক্ষেপ নেই তার। ঈদে বাড়ি ফিরতে পারবে, পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে পারবে, এটাই আনন্দের। স্বপ্ন বাড়ি যাবে এবার। বাসের জানালায় মুখ ঠেকিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকাবে প্রবল আকুলতায়, অনুভব খরবে সে "আর কতো দেরি? মা যে আছে অপেক্ষায়!" বাড়ির উঠোনে পা রাখার মুহূর্তে জানালায় পর্দার ফাঁকে অপেক্ষা রত প্রিয়ার মুখ দেখার আনন্দ, বাবার চোখের জল, মায়ের কাছে ফিরে আসার সেই প্রশান্তি—এসব অনুভূতি কোনো শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ঈদের ছুটিতে সুমন বাড়ি ফিরে বহুদিন পর আবারও মায়ের কোলে মাথা রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস নেয় বুক ভরে। কৈশোরের চিরচেনা প্রকৃতির প্রতিচ্ছবি দেখে জুড়ায় তাঁর দুই চোখ। ঐ যেখানে তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার দুই ধারে। যেখানে সূর্যের আলোর তীব্রতা থেকে মানুষকে আড়াল করে প্রকৃতি মা। দুই পাশে গাছ আর মাঝখানে পিচঢালা রাস্তা, সত্যি চমৎকার জায়গাটি। সুমন আজ অনেক দিন হাঁটেছে সেই রাস্তায়। বাড়ি ফিরে স্ত্রীর হাতে তাঁর আদর আবদারের বেগুনি শাড়িখানা তুলে দিয়ে খুশীর অশ্রুভেজা কোমল গাল দুটো টিপে দিয়ে বলেছে,
– আবার কান্না কেন? সব ঠিকঠাক নেই বুঝি? নাকি শাড়ি পছন্দ হয়নি?
তখন আরুসী মিষ্টি হেসে নরম হাতে আলতো কিল বসার স্বামীর বুকে। সুমন তাঁকে টেনে নেয় কাছে। প্রিয়ার লজ্জা রাঙা মুখখানা চিবুক ধরে সস্নেহে একটু তুলে চুমু খায় কপালে। আরুসী তখন জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। সুমন অনুভব করে দামি ব্লাউজের তলায় প্রিয়ার হৃদস্পন্দন তখন স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। এই তো চাওয়া মানুষের। সারা বছর ধরে দেখা ছোট ছোট স্বপ্নের পূর্ণতা।বেশি কিছু নয়। অল্পক্ষণের আনন্দ আর সারা জীবনের স্মৃতি । এবার ঈদে স্বপ্ন গুলো পূর্ণতা পাক সবার,.......ঈদ মোবারক সবাইকে,ভালো থাকুন, সুস্থ্য থাকুন,আপন জনের কাছে থাকুন,এই কামনা করি......।
সমাপ্ত