17-01-2025, 12:13 PM
(This post was last modified: 17-01-2025, 03:59 PM by বহুরূপী. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
দাসী কমলিনী
তুষের আগুন যেমন প্রথমে ধিক-ধিক, শেষে হঠাৎ ধূ-ধূ করে জ্বলে ওঠে। তেমনি সমুখে একটি ক্ষুদ্র গ্রামের ঘর গুলো এভাবেই জ্বলে শেষ হলো সারা রাত ধরে।
যুদ্ধ ময়দানে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে গতকাল। শত্রুদের পরাস্ত করে আহত রাজকুমারের যাত্রা পথে এই ক্ষুদ্র গ্রামটি পরলেও বিশেষ কিছু করা সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের পৌঁছনোর কিছু আগেই এই গ্রামে লুটপাট করে বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়ে গিয়েছে। দুর্বৃত্তরা কে বা কারা ছিল তা জানার অবকাশ মেলেনি। কারণ, জ্বলন্ত ঘরে গুলোতে তখনো অনেকেই আটকা। তার মধ্যে একটি ঘর থেকে এক যুবতীর প্রাণ রক্ষা করতে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে কুমার জ্ঞান হারায়। কুমারের সেনাদল ও গ্রামবাসীর চেষ্টায় পরিস্থিতি সামাল দিলেও কয়েকজন ইতিমধ্যে নিহত হয়েছে।
যুদ্ধের সময় কুমার আগে থেকেই আহত ছিল। এবার দ্বিতীয় আঘাতে কুমার অজ্ঞান হওয়াতে ভীত হয়ে সৈনিকেরা তাকে গ্রামের পাশে নদীর ধারে মন্দিরে নিয়ে তোলে। এরপর দুটি রমণীকে মন্দিরের ভেতরে কুমারের সেবায় রেখে তারা বাহিরে আলোচনা করতে বসে।
আলোচনা বিশেষ কিছু নয়,কৌতূহলী সৈনিকদের কয়েকজন এই কথাটি বোঝার চেষ্টায় ছিল যে― কুমার যুদ্ধের পর পর বিশজন সৈনিককে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে কোথায় নিয়ে চলেছিলেন? এমন আহত অবস্থায় কুমারের আগে চিকিৎসা নেওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে মুল সেনাদল থেকে আলাদা হওয়ার কারণ কুমার ছাড়া আর কারোই জখনা নেই। তবে এও ঠিক, যদি তাঁরা এই পথে না আসতো তবে হয়তো আরও গ্রামবাসীর প্রাণনাশ হত।
অন্যদিকে মন্দিরের ভেতরে আহত রাজকুমার বিজয় প্রতাপ শুয়ে। তাঁর পা ও ডান বাহুর আঘাতে এক নব যৌবনা কিশোরী ঔষধ লাগানোর কার্যে মগ্ন ছিল। কুমারের বুকে এই মুহুর্তে লোহার বা কাপড়ের কোন রকম আড়ালই নেই। তাই এই কথা বললে অত্যুক্তি হয় না যে; আঘাতে ঔষধ লেপনের ফাঁকে ফাঁকে এই সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে নব যৌবনা কিশোরীর মন উদ্বিগ্ন ও চোখে খানিকটা কম্পন ধরে গিয়েছে। সে সাথে কিশোরীর সোনা বর্ণ মুখখানি খানিক লজ্জায় রক্তিম হয়ে আছে ।যদিও লজ্জার কারণটি বোঝা যাচ্ছে না।
এবার আহত কুমারের খানিক বর্ণনা বলা ভালো। রাজকুমারের দেহাকৃতি দীর্ঘকায়। গাত্রবর্ণ একসময় হাতির দাঁতের মতোই ছিল তার এখনো বোঝা যায়,তবে রোদে পুরো মুখানি তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তার বলিষ্ঠ দেহে পুরনো ও নতুন কিছু আঘাতের চিহ্ন সুস্পষ্ট। কুমারের পেশিবহুল বলিষ্ঠ দেহটি দেখলেই তার সম্পর্কে এতো আজগুবি গুজব কেন রটে,তা খানিক অনুমান করা চলে। এই কিশোরী কোন একদিন কার কাছে যেন শুনেছিল, এই রাজকুমারটি যুদ্ধের ময়দানে খোলা তরবারী হাতে সৈন সকলের প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে লড়াই করে। বিশেষ প্রয়োজন না হলে হাতির পিঠে চড়ে দূর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে সে নারাজ। এর প্রমাণ সরুপ কুমারের দড়ির মতো শিরা বহুল হাতে ও পাথরের ন্যায় কঠিন বুকে বহু আঘাতের দাগ অংকিত।
তবে সে যাই হোক, রাজ পরিবারে পরে ফিরছি।আপাতত সেবারত এই কিশোরীর নামটি বলা প্রয়োজন। তবে নামটি ছাড়া বাকি পরিচয় আপাতত গোপনীয়।
সেবারত এই কিশোরী নাম কমলিনী। এই মুহূর্তে সে দুয়ারের বাইরে দূরবর্তী কিছু পোড়া ঘরবাড়ির ওপড়ে উদিয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে। সকালের প্রথম সুর্য কিরণের সিগ্ধ আলোকরশ্মি এসে পরেছে তাঁদের ওপরে। এতে কুমার চক্ষুরশ্নীলন করতেই সর্বপ্রথম তাঁর দৃষ্টি পরে সমুখের বসা কমলিনীর মুখপানে। তবে দৃষ্টি স্পষ্ট নয়, তাই কিশোরীকে দেখার সুবিধা হয় নাই।
এদিকে রাজকুমারের দৃষ্টি স্পষ্ট হবার আগেই যুবতী সরে গিয়ে তার জায়গায় এক মধ্য বয়স্ক রমণী আসন গ্রহণ করলো। আর কুমার চারধারে দৃষ্টি পাত কর বোঝার চেষ্টা করলো সে কোথায়। এবং তার পরমুহূর্তেই সে উঠে বসার উদ্দোগ করছে দেখে পাশে বসা রমণীটি অতি মৃদু কিন্তু বীণাবৎ মধুর স্বরে বললে,
– স্থির থাকুন,আপনি আহত।
রাজপুত্র ক্ষীণস্বরে জিগ্যেস করলো,
– আমি কোথায়?
– আপনি উত্তম স্থানেই আছেন,দয়া করে স্থির থাকুন।
এই কথায় কুমার শান্ত হয়ে সেবারত রমণীর মুখপানে দৃষ্টি রাখতেই দেখলে― এক অতি সুন্দরী গৌরবর্ণ রমণী তার পাশে বসে অঙ্গের ক্ষতসকলে সাবধান হাতে কি একটা ঔষধ লেপনে করছে। তবে হাত পায়ের ব্যথার চেয়ে অসহ্য ব্যথা অনুভব হয়ে কুমারের মাথায়। তাই গত রাতে ঠিক কি হয়েছিল তা সে এই মূহুর্তে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। ওদিকে দূরে হতে ভেসে আসা রোদন ও হাহাকারে মাঝেও এই রমণীটি কিন্তু শান্ত। তবে রমণীর মুখভঙ্গি পর্যবেক্ষণে করে এই কথা বলা যায় না যে, সে আনন্দে আছে। বোধকরি নিস্ফল ক্রন্দনে বিশেষ লাভ নাই বলিয়াই তার এইরূই শান্ত ভাব। অথবা এই শান্ত ভাবভঙ্গিই এই রমণীর স্বভাব।
মন্দিরের বাহিরে বাঁ পাশে সারিবদ্ধ বহৎ বৃক্ষের তলায় কিছু রাজ সৈনিক বিশ্রাম করছিল। তাদের মধ্যে কিছু সৈনিক ক্রন্দনরত গ্রামবাসীর মধ্যে খাদ্য বিতরণে ও কিছু সৈনিক তাদেরই আহত সহচরের ও গ্রামবাসীর সেবায় ব্যস্ত ছিল। এইরূপ পরিস্থিতি তেও কিছু বালক-বালিকা তাদের চঞ্চল স্বভাবের দরুণ ছুটোছুটি করতে এবং কিছু বাকপটু গ্রাম বাসি আলোচনা করতে ব্যস্ত ছিল। আলোচনা বিষয়বস্তু তাদের দূর্গতি থেকে ক্রমশ বর্তমান পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কুমারের জন্ম ইতিহাস এসে পৌঁছলো। তাই শুনে কিছু রাজ সৈনিক স্বভাবসিদ্ধ কারণেই সেই আলোচনায় যোগ দিল । বোধকরি তাদের এই আলোচনার ফাঁকে পাঠকদের কেউ খানিক রাজ ইতিহাস বলা আবশ্যক।
উত্তরঞ্চলের শৈলবন্ধুর অধিত্যকার একপ্রান্তে কন্টকমণি নামক এক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজধানী কঙ্কনপুর। শুরুতেই বলে রাখা ভালো যে― আমার এই ইতিহাসে দেশ কাল এবং পাত্র সম্পর্কে যে সকল স্পষ্ট উল্লেখ থাকবে, তার সবগুলোই সুস্পষ্ট মিথ্যা। সুতরাং যে সকল পাঠক-পাঠিকাদের রসবোধের চেয়ে কৌতূহল বোধ বেশি তাদের বোধকরি ঠকতে হবে। যাহোক, কন্টকমণি রাজ্যের রাজা চন্দ্রপ্রতাব যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন না। এমনকি যুদ্ধে তিনি কতটা পারদর্শী ছিলেন তাও সন্দেহ জনক। তাছাড়া রাজা চন্দ্রপ্রতাবের শত্রুদের চাইতে মিত্রদের সংখ্যা ছিল বেশি। হয়তো সেই কারণেই রাজা চন্দ্রপ্রতাব যুদ্ধের কথা কখনো ভাবতেই পারতেন না। কিন্তু তিনি না ভাবলেও শত্রুপক্ষ আঘাত আনলো হঠাৎ। তবে এমন আক্রমণ কেউ যে আশা করে নি এমনটাও নয়। এই আক্রমণের পূর্বাভাস কন্টকমণি রাজ্যের পার্শ্ববর্তী দুই মিত্ররাজ্য আগেই অনুমান করে। এবং মহারাণী গীতমাধুরী দেবীর কাছে গোপনে পত্র আদানপ্রদান করে। কিন্তু যখন আঘাত আসে হঠাৎ! তখন আর কিছুই করার থাকে না।
রাজা চন্দ্রপ্রতাব বীর ছিলেন না। দীর্ঘ সময় যুদ্ধের প্রয়োজন পরে নাই বলিয়া হোক বা রাজার সৈনিকদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি নাই বলিয়াই হোক। শত্রুপক্ষের হঠাৎ আক্রমণে কন্টকমণি রাজ্যের রাজা চন্দ্রপ্রতাব বন্দী হলেন। তবে কঙ্কনপুর নগরী শত্রু পক্ষের রাজা অর্জুন সিংহের দখলে বেশিক্ষণ ছিল না। কেন না, রাজা চন্দ্র প্রতাব মিত্র রাজ্যের পাঠানো পত্র পাঠে বিশেষ মনোযোগ না দিলেও― গীতমাধুরী দেবীর অনুরোধে ও নিজ উদ্যোগে সেনাদল গঠন করে দুই রাজ্যের রাজাই গিরিপথে এগিয়ে ছিলেন আক্রমণ প্রতিরোধ করতে। সুতরাং পার্শ্ববর্তী দুই মিত্র রাজ্যের জোটে চন্দ্রপ্রতাব অতি শিগ্রই মুক্ত হন। তবে ততক্ষণে এক মর্মান্তিক দূর্ঘটনা রাজ-অন্তঃপুরে রচনা হয়ে গিয়েছে।
অন্তঃপুরে শত্রু সৈন্যদের আক্রমণের সমুখে বালক রাজকুমারের প্রাণ রক্ষার্থে মহারাণী হাতে অস্ত্র তুলেছিলেন। এখানে বলা আবশ্যক যে রাণী পরমা সুন্দরী নারী হলেও তিনি অসিবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। লোক মুখে এও শোনা যায় যে― মহারাণী গীতমাধুরী দেবীর মতো অসিবিদ্যায় পারদর্শী দ্বিতীয় কেউ কন্টকমণি এমনকি তার আশপাশের রাজ্যের মধ্যেও ছিল না।কেন না, মহারাণীর দুই হাতেই তরবারী সমান কথা বলতো। কিন্তু তারপরেও একজনের পক্ষে শত্রুদের বিপুল সেনাদল সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং রাজপুত্রের প্রাণ রক্ষা হলেও মিত্রবাহিনীর অন্তঃপুরে পৌঁছনোর আগেই মহারাণী প্রাণ ত্যাগ করেন। তার ওপড় আরো দুঃখের বিষয় এই যে; এই মর্মান্তিক ঘটনাটি বালক রাজকুমারের চক্ষু সম্মুখেই ঘটিয়াছিল।
মাতার মৃত্যু বালক কুমারের মনে গভীরভাবে আঘাত আনে। এরপর কালে কালে মাতৃ হত্যার স্মৃতি ভুলতে কুমারের বাল্যকাল অতিবাহিত হয় অশ্বারোহণ, অসি ও নানা বিধি অস্ত্রবিদ্যা শেখার মধ্যে দিয়ে। এর ফল সরূপ কুমার অতি শীগ্রই অল্প বয়সেই অস্ত্র বিদ্যায় তার মাতার মতোই পারদর্শী হয়ে উঠছিল।
রাজা চন্দ্রপ্রতাব যুদ্ধ পরিচালনায় যেমন অক্ষম ছিলেন, তেমনি তিনি রাজ্য পরিচালনাতেও বিশেষ ভালো ছিলেন না। মহারাণীর মৃত্যুর পর পর এই কথা রাজসচিবেরা অল্প দিনেই বুঝে নিলেন। অন্য দিকে কুমার বিজয়প্রতাবের অসামান্য রণপণ্ডিত্ব ও রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল চোখে পড়ার মতোই। এটি রাজা চন্দ্রপ্রতাবের জন্যে আনন্দের বিষয় হলেও তিনি আনন্দিত হলেন না। তার কারণ, কিশোর বয়সেই কুমার রাজ অন্তঃপুর ত্যাগ করে রাজপুরির সেনানিবাস ও যুদ্ধের ময়দানে সময় অতিবাহিত করতে শুরু করেছিল।
তবে কুমারের অসাধারণ গুণগুলো প্রতি শুধু সে রাজসচিব দের দৃষ্টিই পরেছিল, এমনটা নয়। তার এই সকল গুণের কারনেই কুমারের নেতৃত্বে কন্টকমণি রাজ্যের সাথে পাশ্ববর্তী দুই মিত্র রাজ্য জোট বেধেঁ প্রায় দশ হাজার সৈন্যদের একটি দল গঠন হয়। এতে দিনে দিনে কুমার বিজয়প্রতাবের বিজয়গাথা দিকে দিকে প্রসিদ্ধী লাভ করতে শুরু করে। সেই সাথে বাড়তে থাকে তার সেনাদল। এতে করে উত্তরঞ্চলের শৈলমালার জটিল আবর্তের মধ্যে যত ছোট ছোট রাজ্যের রাজা ছিল। বিজয় প্রতাবের তরবারীর ধারের কাছে তাদের সকলের মাথানত করা ছাড়া দ্বিতীয় উপায় ছিল না। এতে রাজা চন্দ্রপ্রতাবের রাজ্য কন্টকমণির সীমানা ছাড়িয়ে সুদূর প্রসারিত হতে শুরু করলেও রাজা সুখী ছিলেন না।
কেন না,এই সকল ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি একত্রে কন্টকমণি রাজ্যের অধীনে আনলেও কুমার বিজয় প্রতাবের ভোগে মন ছিল না। সেই সাথে রাজ সিংহাসনে কুমারের কতটা আকর্ষণ ছিল,তাও বলা যায় না। সে শুধুমাত্র সকল রাজ্যে মধ্যে যুদ্ধ-বিদ্রোহ থামানো উদ্দেশ্যে এই উদ্যোগ নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। কিন্তু এমনই করে ত আর রাজ্য চলে না। তাই মাঝে মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে রাজার সহিত সভা সচিবদের আলোচনা হতে লাগলো।
এই রূপ আরো কিছু কাল আলোচনা চলার পর সভা সচিব ও রাজপুরোহীতের পরামর্শে রাজা চন্দ্রপ্রতাব দ্বিতীয় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন। রাজার দ্বিতীয় রাণী প্রভা দেবী রাজার প্রথম স্ত্রীরই বোন। কিন্তু যেই কারণে রাজ অন্তঃপুরে প্রভাদেবীর আগমন, যেই কার্য সম্পূর্ণ করতে প্রভাদেবী ব্যর্থ হলেন। মাতার মৃত্যুর পর কুমারের জীবনযাত্রা যুদ্ধের ময়দান ও সৈন্য শিবিরের বৃত্তে এক উন্মাদ ঘোড়ার ন্যায় ঘুরছিল; যার লাগাম টেনে ধরা প্রভাদেবীর মতো শান্ত স্বভাব রমণীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে রাজা চন্দপ্রতাবের দুঃখ খানিক লঘু হয় প্রভাদেবীর কোলে শিশু রাজকুমারীর ক্রন্দনে।
কুমারীর নামকরণের উপলক্ষে দীর্ঘ দশ বছর পরে কুমার বিজয় প্রতাব রাজ -অন্তঃপুরে প্রবেশ করে। এবং কুমার অন্তঃপুরে প্রবেশের পর পর প্রভাদেবী রাজকুমার কোলে কুমারীকে তুলে কান্নায় ভেঙে পরে। কান্নার কারণটি এই যে― কুমারকে অন্তঃপুরে ফেরাতে ব্যর্থ নিরপরাধ এই রমণীর কলঙ্কের শেষ ছিল না। অথচ প্রভাদেবীর চেষ্টার কোন ত্রুটি করেননি। কিন্তু অসহায় নারী কথা কে শোনে!
সেদিন রাজা ও রাণীর অনুমতিতে কুমার তার একমাত্র ভগিনীর নামকরণ করলো উল্কা। একমাত্র হবার কারণ এই যে― পরবর্তী সতেরো বছরের মধ্যে কোন এক আশ্চর্য কারণ বশত প্রভাদেবীর আর কোন সন্তানাদি হয় নাই । কিন্তু কুমারী উল্কার প্রভাবে বিজয় প্রতাবের লাগামছাড়া জীবনযাত্রার গতি অনেকটাই মন্দ হয়েছে একথা সত্য।
কুমারীর জন্মের পর কুমারের অন্তঃপুরে আসা যাওয়া অনেকটাই স্বাভাবিক হয়। এবং বয়স বৃদ্ধির সাথে ধীরে ধীরে কুমারের সংস্পর্শে বালিকা কুমারী ভাইয়ে মতোই অস্ত্রবিদ্যা ও অশ্বিচালনা শিখতে মনোনিবেশ করে। রাজা বা রাণী এই দুই ভাই বোনের মধ্যে কখনোই আসতেন না। তবে রাজপ্রাসাদে দাস-দাসীদের জটলা ও সৈন্যদের মদিরার আসরে কুমারের গোপন অভিসন্ধির কথা নিয়মিত আলোচনা হতে লাগলো। সুতরাং এক পর্যায়ে এ কথা মহারাণী প্রভাদেবীর কানেও পৌঁছালো। এবং শোনা মাত্রই তিনি বিচলিত হয়ে পরলেন। কেন না কথাটি এই যে― কুমারী উল্কাকে বিজয় প্রতাব সিংহাসনের উপযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে নিজ হাতে গড়ে তুলছে। তবে এ তো গেল অতীতের কথা, এবার বর্তমানে ফিরি তবে।
প্রভাতের সূর্যদেব আত্মপ্রকাশ করেছেন বহুক্ষণ আগেই। বেলা গড়িয়ে প্রায় দুপুর হয় হয়। রাজকুমারের সহিত কমলিনীর যাত্রা পথে আজ তৃতীয় দিন। ঘোড়ার পিঠে বসে ফেলে আসা বনাঞ্চলের মাঝে যে পথটি! সেদিকে একবার তাকিয়েই কমলিনী পুনরায় মস্তিষ্ক নত করে। বোধকরি এই অভাগী কঙ্কনপুর নগরীতে নিজের ভবিষ্যত কি হবে সেই কথাই ভাবছে মনে মনে।
খানিক দূরে চারিপাশের পাহাড় ও উঁচুনিচু টিলার মধ্যে এক সর্বোচ্চ পাহাড়ি সমভূমি তে কঙ্কনপুর নগরীটি উজ্জ্বল নক্ষত্র মতোই চোখে পরে। নগরের পথগুলি আঁকাবাঁকা, দুই পার্শ্বে পাষাণনির্মিত হর্ম্য।আর তার মাঝে কোথাও কোথাও ক্ষুদ্র ও স্বচ্ছ জলাশয়ের সংলগ্ন নানাবিধ ফুলের বাগান। কঙ্কনপুরের রাজ প্রাসাদ নগরীর প্রবেশ পথে দাঁড়িয় স্পষ্ট চোখে পরে। নগরের থেকে বেশ উঁচুতে এক টিলায় রাজপ্রাসাদ অবস্থিত। রাজপ্রাসাদে ওঠার পথটির বাঁ পাশ দিয়ে সাপের মত আঁকাবাঁকা হয়ে খানিক দূরের আর একটি টিলায় উঠেছে। সেখানে চারপাশে পাতলা বনে ঘেরা এক সমতল ভুমিতে কন্টকমণি রাজ্যের সেনানিবাস।
বিজয় প্রতাব যখন সেনানিবাসে পৌঁছলো; তখন মাঠে কিছু নতুন সৈনিক অশ্বারোহণ শিখতে ও কিছু সৈনিক একধারে জটলা করে নতুন সৈনিকদের অসি চালনা পরখ করছিল। জটলা পেরিয়ে দেখা গেল এক সুদর্শন কিশোর খোলা তরবারী হাতে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। তার তরবারীর ডগাখানি ভূলুণ্ঠিত এক সৈনিকের গলার কাছে স্থির। বলা বাহুল্য এই দৃশ্য অভিজ্ঞ সৈনিকদের জন্যে বিশেষ প্রীতকর কিছু নয়। বরং বেশ লজ্জা জনক দৃশ্য। তার ওপরে নতুন আগত এই কিশোর ইতি মধ্যে তিনজন অভিজ্ঞ সৈনিককে পরাস্ত করেছে। সুতরাং সকলের মুখমণ্ডলে এই মুহূর্তে রাগান্বিত এক ভাবমূর্তি অতি স্পষ্ট ভাবে ফুটেছে। এমন অবস্থায় সকলের চুপসে যাওয়া মুখমণ্ডলের দিকে একবার দৃষ্টি পাত করে সৈনিকের বেশধারী এই কিশোর উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠলো,
– এই কঙ্কনপুর নগরীর সৈনিকদের মধ্যে এমন কেউ কি নেই? যে আমার তরবারী আঘাত সাইতে পারে! নাকি বীর পুরুষের বেশে সকলে ভেড়া........
সৈনিকের বেশধারী কিশোর অপমান সূচক কিছু বলার আগেই সেখানে ঘোড়ার পিঠে চড়ে কুমার বিজয় প্রতাবের আগমন। সুতরাং সকলেই তখন কিশোরের থেকে মনযোগ সরিয়ে কুমারের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঘোড়া থেকে নেমে কুমার এগিয়ে এলো একা দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরটির দিকে। এবং কাছাকাছি পৌঁছেই কুমার শান্ত স্বরে বললে,
– এই কঙ্কনপুর রাজ্যের সম্মান রক্ষার্থে কুমার বিজয় প্রতাব তোমার সমুখে দাঁড়িয়ে। এখনও সময় আছে, যদি নিজে সম্মান রক্ষা করতে চাও তবে নিজের আচরণের জন্যে ক্ষমা চাও।
কুমারের কথায় কিশোরের আচরণের কোন পরিবর্তন ঘটলো না। তার বদলে মুখি অবজ্ঞা সূচক হাসি ফুটিয়ে সে তরবারী উচিয়ে ধরলো লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে। এতে সোনাদলের অনেকই অবাক এবং আরো অনেকেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলো। তার মধ্যে থেকে কুমারের এক সহচর উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,
– আজ্ঞা করুন কুমার! আমি নিজ হাতে এই বেয়াদপের মুন্ডচ্ছেদ করবো।
তার হাতে তরবারি উঠেছিল, কিন্তু কুমার হাত উচিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে সৈনিকের বেশধারী কিশোরটি উদ্দেশ্যে বলল,
– লড়াই! বেশ তবে তাই হোক!
কথা শেষেই কুমারের তরবারী খাপ থেকে উন্মুক্ত হয়ে তার হাতে উঠলো। এবং সঙ্গে সঙ্গেই সমুখের কিশোরটি তরবারী উচিয়ে লড়াইয়ে নামলো। তবে সবার পেছনে ঘোড়ার পিঠে বসে কমলিনী দেখল লড়াই খুব বেশিক্ষণ চললো না। দুই একবার তরবারী ঠোকাঠুকির পর এক জোড়ালো আঘাতে কিশোরের তরবারী হাত থেকে ছিটকে গেল দূরে। তার পরমুহূর্তেই দ্বিতীয় আঘাতে ছিটকে গেল কিশোরের মাথায় বাঁধা পাগড়ীটি। এতে করে সঙ্গে সঙ্গেই সৈনিকের বেশধারী কিশোরের আসল পরিচয় সর্বসম্মুখে উন্মুক্ত হয়ে পরলো। পাগড়ী সরতেই কিশোরের মাথা থেকে বিসর্পিল এক বেণী লুটিয়ে তার কোমড় ছাড়িয়ে গেল। বলা বাহুল্য এই দৃশ্য দেখা মাত্র কমলিনী অবাক হয়ে এক দৃষ্টিতে সেদিকেই চেয়ে রইল। তবে তখন সেখানকার কারোরই সৈনিকের বেশধারী রাজকুমারী উল্কাকে চিনতে অসুবিধা হলো না। তবে পরিচয় প্রকাশ পেলেও কুমারীকে বিচলিত হতে দেখা গেল না। সে তখনও এক দৃষ্টিতে হাসি মুখে কুমার বিজয় প্রতাবের মুখপানে তাকিয়ে ।
কমলিনী একটু দূরে ঘোড়ার পিঠে বসেই এতখনের সকল দৃশ্য সচোখে দেখছিল। তাকে ঘোড়া থেকে নামাতে এতখন সকলেই ভুলে গিয়েছিল । লড়াই শেষ হতেই একজন এগিয়ে এসে তাকে ঘোড়া থেকে নামিয়ে দিল। তখন কমলিনী ধীরপদে কুমারের পেছন দিয়ে সেনা নিবাসে ঢোকার সময় শুনলো,
– আপাতত রাজকুমারীকে আমার শয়নকক্ষে বন্দী করা হোক.....
এরপর কি হল সে জানে না। কারণ, দুটি মেয়ে তাকে নিয়ে তখন সেনানিবাসের ওপড় তলায় উঠলো তারপর স্নান সেরে নতুন কাপড়ে সে যখন বাকিদের সাথে বাইরে বেরুল, তখন রাজ কুমারী উল্কাকে সে প্রথম নারী বেশে কুমারের শয়নকক্ষের প্রবেশ করতে দেখলো।
এদিকটার ওপর তলার পূর্ব পাশের শেষটায় কুমারের শয়নকক্ষ। কমলিনী দোতলা ওঠার আগেই দেখেছিল দুজন পরিচারিকার সাথে উল্কা এদিকটায় এগিয়ে আসছে। গ্রামে থাকতে কমলিনী এক গুজব শুনেছিল যে― কুমারের সেনানিবাস সুন্দরী দাসীদের আড্ডা খানা। এখন সচোখে সত্যই সে দেখলো কুমারের শয়নকক্ষের পাশের ঘরগুলিতে কম করে হলেও প্রায় ১৫ কি ২০ জন রমণীর বাস। এবং তাদের মধ্যে অনেকেই অসামান্যা সুন্দরী।
কিন্তু কমলিনীর মনে পরে তার আগের প্রভুপত্নী বলেছিল কুমারের নারীদের প্রতি আকর্ষণ নেই। এমনকি ৪২ বছর পার হতে চলেছে কিন্তু কুমার এখনো বিবাহের নাম মুখেও তোলেনি। পুরো ব্যাপারখানা তার বোধের বাইরে থাকায় সে বেচারী অবাক হয়ে শুধুই চারপাশ দেখতে লাগলো।
এর বেশি লেখা যেত,তবে এটি পরিচয় পর্ব। যদিও কমলিনীর পরিচয় এখনো দেওয়া হয়নি। তবে তা ধাপে ধাপে দেওয়া হবে নিশ্চয়ই।