27-09-2024, 04:34 AM
(This post was last modified: 27-09-2024, 02:21 PM by বহুরূপী. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
//////
– ছি একদমই না। অসভ্য কোথাকার! দাও ওটা দাও বলছি!
রান্না শেষে সঞ্জয় নয়নতারার কাঁচুলি খুলে পকেটস্থ করেছে। এবং তার দাবী নয়নতারার আর বাড়ির ভেতরে কাঁচুলি পড়া চলবে না। কারণটি সঞ্জয় সকাল-বিকেল যেন বাধাহীন ভাবে ও দুটিতে চুমু খেতে পারে। কিন্তু নয়নতারা এমন প্রস্তাবে মোটেও রাজি নয়। অবশেষে সঞ্জয় তার বৌদিমণিকে বুকে টেনে তার ফোলা গাল দুটো টিপে দিয় বলে,
– শুধু শুধু এই উটকো ঝামেলার দরকার কি বল? এই এক টুকরো কাপড় নাই বা পড়লে,এমন কি ক্ষতি হবে তাতে!
– সে ঝামেলায় হোক বা না হোক, আমার জিনিস আমি পড়বো তাতে তোমার কি? ওসব অসভ্যের মত আবদার আমি মানতে রাজি নোই মোঠেও।
সঞ্জয় নয়নতারার কথা শুনে এক মুহূর্ত কি ভেবে বলল,
– আচ্ছা চল বাজি ধরি।
– বাজি!
– হুম বাজি, বাজিতে আমি জিতলে আজ থেকে বাড়িতে তোমার কাচুলি পরা বন্ধ।
– আর যদি আমি জিতি তবে?
– তবে তোমার কাঁচুলি আমি ফেরত দেব,সেই সাথে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।
– সত্যিই! যা চাইবো তাই দেবে?
সঞ্জয় নয়নতারার রাঙা ঠোটে চুমু খেয়ে নাকে নাক ঘষে বলল,
– যা চাইবে তাই দেব লক্ষ্মীটি,তবে মনে রেখো আমি জিতলে কিন্তু..
বলতে বলতে সঞ্জয় ডান হাতে নয়নতারার শাড়ির ওপড় দিয়ে উন্মুক্ত স্তনের একটি টিপতে লাগলো। নয়নতারা খানিকক্ষণ কি ভেবে নিয়ে বলল,
– কিন্তু বাজি কি নিয়ে ধরবে সেটা আগে শোনা চাই। নয়নো আমি আগেই আমি রাজি হচ্ছি না।
– ও চিন্তা তোমার ভগ'বানের ওপরে,একটু আকাশ পানে তাকায় আর বল আজ বৃষ্টি হবে কি না?
নয়নতারা আকিশের পানে চাইলো। সকালের পরিস্কার আকাশ এখন খানিকটা মেঘলা। সে আকাশের পানে তাকিয়েই বলল,
– হবে না।
শুনেই সঞ্জয়ের মুখটি হাসি হাসি হয়ে গেল। সে নয়নতারাকে কোলে তুলে বলল,
– তবে এই ঠিক রইলো,আজ বৃষ্টি হলে আমি জিতব আর না হলে তুমি। রাজি!
এবার নয়নতারাও মুখে হাসি ফুটিয়ে সঞ্জয়ের মাথার আঘাতে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে বলল,
– রাজি!তবে কি কথা দিয়েছো তা মনে থাকে যেন। এখন নামাও কোল থেকে।
সঞ্জয়ের আর কোন কথা না বলে নয়নতারাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।এবং দ্রুত পদে রান্নাঘর থেকে বেরুতে পা বাড়ালো। নয়নতারা তার একটি হাত ধরে বলল,
– ওকি হচ্ছে! আমার কাঁচুলিটার কি হবে?
সঞ্জয় এক হাতে তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে লাল কাঁচুলিটা বের করে আনলো।তারপর নাকের কাছে নিয়ে একবার লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
– ও কথা ভুলে যাওয়া ভালো,কারণ আজকের পর থেকে তোমার আর ও ঝামেলায় পরতে হবে না বৌদিমণি।
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সঞ্জয় দোতলায় উঠে গেল।তার মুখের ভাবখানা এমন যে বাজি সে জিতেই গিয়েছে। কে জানে হয়তো ভগ'বান কোন কারণ বশত তার ওপড়ে বিশেষ ভাবে প্রসন্ন।
নয়নতারা অবশ্য তার ঠাকুরপোর ইচ্ছে পূরণ করলো। পরনের শাড়িটা ঠিকঠাক করে গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘর গোছাতে লাগলো। এবং খাবার সময় নগ্ন বুকের ওপড়ে শাড়ির আঁচল এমনই ভাবে ফেললো,যাতে দেখা ও না দেখার মাঝে এক অদম্য আকর্ষণ তৈরি করে।
খেতে খেতে এক সময় সঞ্জয় নয়নতারার মুখে খাবার তুলে দিতে চাইলো। নয়নতারা তখন সমুখে বসে ডান হাতে তালপাখার বাতাস করছে। সে মাথা নেড়ে মানা করার পরেও সঞ্জয় নয়নের মুখে খাবার তুলে দিল। সুতরাং এমনই ভাবে দু'তিন বার বাধ্য হয়ে খেতে নয়নতারাকে।
সঞ্জয়ের খাওয়া-দাওয়ার পর যখন নয়নতারা স্নান করতে তৈরি হয়ে কলঘরে ঢুকলো। তখন কলঘরের বেতের দরজাটা লাগালোর আগে সঞ্জয় এসে থাকিয়ে দিয়ে বলল,
– শুধু শুধু আড়ালা করে কি হবে,তার চেয়ে ভালো তুমি গায়ে জল ঢাল আর আমি তা দেখে দুই চোখ সার্থক করি।
– উফ্...তুমি জ্বালিয়ে মারলে আমায়।
– ইসস্...এতো লজ্জা কিসের শুনি,এমন তো নয় যে তোমার স্নান করা আমি আগে দে....
কথাটা বলেই সঞ্জয়ের দাতে জিভ কামড়ে দিল,বলা ভালো একটু জোড়েই কামড় দিল,ব্যথায় মুখের ভাবভঙ্গি বিগড়ে গেল তার। নয়নতারা তৎক্ষণাৎ বাইরে এসে সঞ্জয়ের গালে হাত দিই বলল,
– কি হল! হঠাৎ ওমনি ভাবে...দেখি কি হয়েছে।
সঞ্জয়ের বিশেষ কিছু তো হয়নি,তবুও সে দুহাতে নয়নতারার কোমড় জড়িয়ে বলল,
– জিভে কামড় মেরেছি,জ্বলছে খুব। এ তোমার দোষ বৌদিমণি। এখন আদর না করলে ছাড়ছি না আমি।
এমন ছেলেমানুষি দোষারোপে নয়নতারার হেসে ওঠা উচিৎ বোধকরি! কিন্তু কই তার রাঙা ওষ্ঠাধরের মুক্ত ঝরানো হাসি? এক মূহুর্তে নয়নতারার মুখমন্ডল যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। তার মুখখানি নত হয়ে দৃষ্টি চলেগেল পায়ের কাছে। তবে নয়নতারার এমন মনভাবের কারণ জানা হলো না। তার আগেই বাইরে থেকে কে যেন সঞ্জয়দা বলে জোরে দুরার ডেকে উঠলো।
/////
মিনতী দেবী বেরুতেই ধপ করে মেঝেতে বসে পরে হেমলতা। স্বভাবতই হেমলতা কঠিন মনের অধিকারীণি নয় এটি আমাদের জানা কথা। অল্প হাওয়াতে যার প্রাণ কাঁপে,সে যদি ঝড়ের সমুখে পরে তবে তার হাল ঠিক কি রূপ হইতে পারে তা বোঝা নিশ্চয়ই খুব একটা শক্ত নয়। তেমনি আজ মায়ের মুখে তার বিয়ের খবর শোনার পর প্রথম ধাক্কায় হেমলতা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। অবশ্য বৈঠকঘরে গোবিন্দ লালকে দেখার পর তার আর কিছুই বোঝার বাকি ছিল না।
আজ সকালের পর থেকে যা কিছু ঘটছে তা পর্যালোচনা করতে পারলে হয় তো হেমলতার মনস্তত্ত্বের নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত।কিন্তু সব কেমন ঝাপসা লাগছে। এ সব কি সত্য? এই ঘর, এই বিছানা, ওই জানলা আর জানলার বাইরের মেঘলা আকাশ, এ সব কি বাস্তব, না স্বপ্ন?আর সে নিজেই বা কি? এমন খবর শুনিবার পর হেমলতার জগত সংসার সব গুলিয়ে গেছে। হেমলতার মায়ের মতে আগামী তিন দিনের পরেই তার হেমের বিবাহ। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কবে কজনের ভাগ্যে ঘটে? হেমলতার মনে পরে এই দুদিন আগে সেই একই বৈঠকঘরে কয়েকজন বৃদ্ধ লোকের আলোচনা, সেই আলোচনাও তার বিবাহের ব্যপারে। তবে হেমলতা তার মায়ের মুখ দেখেই আন্দাজ করিতে পারে যে সেই দিনকার প্রস্তাবের চেয়ে আজকের জমিদার বাড়ির প্রস্তাবের গুরুত্ব বেশি। বিশেষ করিয়া যখন সয়ং হেমলতার মাতা ও জামাইবাবু এই প্রস্তাবে রাজি, সেখানে তার পিতার মত ঘোরানো হেমলতার মাতার পক্ষে খুব একটা কঠিন কর্ম নয়।
হেমলতা যখন শয্যার একপাশে মেঝেতে বসিয়া নীরবে অশ্রু পাত করতেছিল। তখন কোথা থেকে মন্দিরা তার ছোট ছোট পায়ে ছুটে এসে মাসি কোলে বসলো। বালিকার স্নেহকাঙাল মুখের দিকে তাকিয়েই হেমলতা তার চাহুনির তাৎপর্য বুঝে নেয়। পরক্ষণেই নিজের চোখ দুখানির অশ্রু শাড়ি আঁচলে মুছে মন্দিরাকে কোলে তুলে নেয় সে। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই পিতামাতার কয়েকটি কথা কানে লাগে তার।
– তুমি এমটিই বা ভাবছো কেন? সঞ্জয় ছেলেটি খারাপ কিসে,দিব্যি কাজকর্ম করছে। আর নদীর এপাড় ওপাড় কতটুকুই বা দূরে যে মেয়ের জন্যে এত চিন্তা?
– সে তুমি যাই বল,আমি দুই মেয়েকেই আমার চোখের সামনে সামনেই রাখতে চাই।
– কি দরকার চোখের সামনে রাখার যদি মেয়ের কপালে সুখ না থাকে? এক জামাইকে তো দেখছি,ব্যবসায় লোকসান করিয়ে শেষ এখন মাতাল। এখন কিনা আর এক মাতালের হাতে ছোট মেয়েটাকেও....
হেমলতা আর দাড়ায় না। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। এই আলোচনার শেষ পরিনতি তার অজানা নয়। সে মনে মনে কদিন আগে সঞ্জয়ের দেওয়া পত্রের কথাগুলি একে একে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে তৈরী করতে থাকে। সিদ্ধান্ত সহজ নয়,কিন্তু আজীবন অশ্রু পাতে করার চেয়ে এই কি ভালো নয়!
/////
শাখা-সিঁদুর আর গলার মঙ্গলসূত্র ব্যতীত নয়নতারা সম্পূর্ণ নিরাভরণ।আর কাপড় বলতে গায়ে হলুদ একটি শাড়ি জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। গতরাতে ঠাকুরপোর কামনা নিবারণের ক্রিয়া করতে গিয়ে নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন হয়েছে তার। তাই দুপুরের খাবার পর হাতের কাজ সেরে একটু চোখ দুটি লেগে এসেছিল নয়নতারা। কিন্তু বেচারীর কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে দরজায় কড়া নাড়া ও কয়েকটি মেয়ের সম্মিলিত ডাক। অগত্যা পড়নের কাপড় ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে ঘরে থেকে বেরোয় নয়নতারা।
রান্নাঘরের পাশে জামগাছটার নিচে মেয়েদের আসর বসলো বটে,তবে আসরের নয়নমণি আমাদের নয়নতারা ঘুমে কাতর। সে খানিক পর পর জাম গাছে হেলান দিয়ে ঝিমিয়ে পরছে দেখে পাড়ার মেয়েদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
– আজ কি হোল তোমার বৌদি,শরীর খারাপ করলো নাকি?
নয়নতারা ঝিমিয়ে পরেছিল।একথায় চোখ খুলে চারপাশ দেখে বলল,
– উঁহু.গত রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো..একি ঠাকুমাকে দেখছি না যে?
– বুড়ি রেগে আছে বৌদি,ডাকতে গিয়ে ছিলুম উল্টে চব্বিশ ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিলে আমায়।
– সেকি! শুধু শুধু তোকে কথা শোনাল?
– কি জানি বাবা! পোড়ার মুখো বুড়ির মুখে কোনো দিন সুবাক্যি আছে! ঠিক বুড়ো ওপড়ে রাগ আমায় পেয়ে যেরে দিয়েছে।
কথাটার স্রোত আরো কত দূর গড়াত বলা যায় না, কিন্তু সঞ্জয় আর দেবু হঠাৎ বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরাতে নয়নতারাকে আসর ফেলে উঠতে হলো। সব গুছিয়ে রেখে আধঘণ্টা পরে নয়নতারা যখন বৈঠকঘরে এলো,তখন নয়নতারার ঝিমুনি ভাবটা সঞ্জয়ের চোখে পরে। তৎক্ষণাৎ সে নয়নকে পাঁজাকোলে করে সিঁড়ি ভেঙে তার শয্যাকক্ষে উপস্থিত হলো। নয়নতারা অবশ্য বাঁধা দেয়নি,বেচারী সারাদিনের কাজকর্মের পর বেশ ক্লান্ত। সে বাঁ হাতে সঞ্জয়ের গলা জড়িয়ে দুচোখ বুঝে ডান হাতটি মেলে ধরে সঞ্জয়ের বুকে।
বিছানায় শোয়াবার আগে ঘুমন্ত রমণী মুখপানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সঞ্জয়। নয়নতারার দেহে বৈবাহিক জীবনের চিহ্ন ছাড়া আর কোন অলঙ্কার ছিল না। কানেও দুল পরেনি, নরম কানের লতি দুটো ফাকা থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে, গলায় শুধু একটা সরু সােনার মঙ্গলসূত্র। নগ্ন পা দুখানিতে নূপুর নেই,কোমড় ছাড়ানো কাজলকালো কেশরাশি খোলা কোন বাধন নেই তাতে। এই রূপ দেখে ধাধা লাগা স্বাভাবিক। যেন স্বর্গরাজ্যের কোন দেবী পথ ভুলে মর্ত্যে এসে তার ঘর আলোকিত করে আছে। অবশ্য স্বর্গরাজ্যে দেবীরা কিরূপে বিচরণ করে ,ইহা সঞ্জয় জানিতো না।
নয়নতারাকে খাটে শুইয়ে সঞ্জয় নিচে নামে বাবুকে নিয়ে যেতে। এরপর মাতা ও পুত্রকে পাশাপাশি শোয়ানো সময় চোখে পরে ঘুমের ঘোরে আঁচল সরে নয়নতারার বুকের খানিকটা উঁকি দিচ্ছে। হলদেটে শাড়িটা নয়নের গায়ের সঙ্গে মিশে আছে প্রায়।
সঞ্জয় কতখন এঈ দৃশ্য উপভোগ করলো তার হিসেবে কে রাখে! অবশেষে যখন হুশ ফিরলো। তখন নয়নের অধরের পাশ থেকে এলোমেলো কয়েক গাছি চুলে আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে কপালে চুমু খেল। তারপর টেবিল থেকে খাতা-কলম নিয়ে বসলো শয্যার পাশে মেঝেতে।
সন্ধ্যার আগে আগেই ঘুম ভাঙলো নয়নতারার। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বৈঠক ঘরে ঢুকতে গিয়ে চমকে দুপা পিছিয়ে এলো সে। বৈঠকঘরে সঞ্জয়ের বাবুকে কোলে করে তার বন্ধু ও একজন কালোমত অচেনা লোকের সাথে আলোচনা করছিল। নয়নতারা সরে পরতো,কিন্তু হেমলতার নাম ওঠায় তার দেহে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কথাগুলো তার খুব একটা অপরিচিত না হলেও বুকের মাঝে ভয় সঞ্চারিত হতে শুরু করলো তার।
– বিবাহের ব্যবস্থা এক মতো পাকাপোক্ত বললেই চলে। যা অবস্থা দেখছি ওরা হঠাৎ একদিন এই কান্ড ঘটিয়ে দিলে আর আটকায় কে, জলদিই কিছু না করলে খোড়া গোবিন্দ অতি শিগ্রই হেমকে পালকিতে তোলার তোরজোর করবে।
– হুম..এ ব্যাটা তো দেখছি জ্বালিয়ে মারলো কোথায় আমি ভাবছিলাম আষাঢ়ের প্রথমে শুভদিনে মায়ের মন্দিরে হেমকে হাজির করবো। না আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা উচিৎ বলে তো মনে হয় না।
– বলিকি আর একবার কথা বলে দেখলে হতো না? মানে ঝামেলা না করে যদি কোন ব্যবস্থা হয় আর কি।
– সে গুড়েবালি, জমিদার পুত্র রাজেন্দ্র আমার ওপড়ে আগে থেকেই চড়াও হয়ে আছে, হেনস্থা করার সুযোগ ছাড়বে কেন?
– তবে আর কি কাল সন্ধ্যায় নদী ঘাটে...
– আরে না না,এতো জলদি কিসের, তুই এখন বাড়ি যা,সেই ফাঁকে আমি ভেবে সবটা একটু সাজিয়ে নিই তারপর যা হবার তা কাল বলছি।
আলোচনা শেষে সঞ্জয় বেরিয়ে এলে, দুই চোখে একরাশ ভয় নিয়ে নয়নতারা তাকায় সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয় অবস্থা বুঝে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বুকে টানে নয়নতারাকে।
সন্ধ্যা আরতি সেরে নয়নতারা দোতলায় সঞ্জয়ের ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। সঞ্জয় তখন চেয়ারে গা এলিয়ে টেবিলে দুই পা তুলে বসে আছে। নয়নতারা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে চৌকির একপাশে বসে। সঞ্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে একবার দেখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নয়নতারার পাশে বসে দুহাতে তার গলা জরিয়ে বলে,
– এখনও ওমন মুখ ভোতা করে বসে কেন?
নয়নতারা বোধকরি আর নিজেকে সামলাতে না পেরেগ দুই চোখ জলে ভাসিয়ে ব্যাকুল কন্ঠস্বরে বলে,
– এসব না করলে হয় না? আমাকে না হয় একবার ও বাড়িতে...
– পাগলো হয়েছো তুমি!আর এতো চিন্তা কিসের তোমার? তাছাড়া তুমি ওবাড়িতে গেলে দাদা তোমায় আর ফিরতে দেবে ভেবেছো?
– সে না দিলে নাই বা দেবে, কিন্তু আমি বাবাকে বললে বাবা ঠিক রাজি হবে দেখো।
সঞ্জয় নয়নতারার চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
– সত্যি বলতে বৌদিমণি, তোমার মাতা শ্রীমতী মিনতী দেবীকে চিনতে বড্ডো দেরি করে ফেলেছি আমি।
– ছিঃ...গুরুজনদের ওসব বলতে আছে! তুমি নিয়েই চল না,দেখবে বাবা ঠিক রাজি হবে,আমি বলছি রাজি হবে তুমি দেখো।
– আর যদি না হয় তবে? একথা গোবিন্দর কানে গেলে তবে কি হবে বল?
নয়নতারা কিছু একটা বলতে গিয়েও মুখ নামিয়ে নেয়। তাই দেখে সঞ্জয় বাঁ হাতে নয়নের চিবুক ঠেলে ঠোটে আলতো একটা চুমু খেয়ে বলল,
– এখন কিছু না করলে কদিন বাদেই হেমকে পালকি করে জমিদার বাড়ির পথে দেখা যাবে।আর যদি এমনটি হয়,তবে কিন্তু দাদাকে ছেড়ে তোমায় আমার ঘরে উঠতে হবে। বাবুকে যেমন কোলে নিয়ে ঘুরছো এমনি আর একটি কোলে তুলবো তোমার....
কান্নার মাঝেও এমন কথা শুনে নয়নতারা ফর্সা মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে ওঠে। সে সঞ্জয় কে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সঞ্জয়ের হাতের টানে সে আছড়ে পরে বিছানায়।তৎক্ষণাৎ নয়নতারার হাত দুটি মাথার ওপড় টেনে নিয়ে শক্ত করে বাঁ হাতে বিছানায় চেপেধরে সঞ্জয়। তারপর ডান হাতের মাঝে আঙুল দুটি নয়নতারা রাঙা ওষ্ঠাধরে বুলিয়ে আদর মাখা কন্ঠে বলে,
– ছুটে পালানো বুঝি এতো সোজা? আমার প্রশ্ন উত্তর কে করবে শুনি?
সঞ্জয় একথা বলে ঠোঁট থেকে হাত নামিয়ে আনে নয়নতারার বগলের পাতলা কেশরাশি কাছে।সেখানে আঙুল ছোয়াতেই সর্বাঙ্গে মুচড়ে ওঠে নয়নতারা। সঞ্জয় ছেড়ে দেয় না আলতো ভাবে আঙুল দিয়ে বগলের চুলে বিলি কাটে। নয়নতারা হাত মুচড়ে ছাড়া পাবার আশা না দেখে নয়নতারা গাল ফুলিয়ে অভিমানী সুরে বলে,
– এমন জ্বালাতন করলে আমি সত্যিই তোমার দাদা খবর পাঠাবো আমায় নিয়ে যেতে।
সঞ্জয় কোন উত্তর না করে নয়নতারা হাতদুটো ছেড়ে শাড়ির আঁচল নিয়ে পরে। নয়নতারাও একহাতে সঞ্জয়ের মাথাটা তার বুকে টেনে, অন্য হাতে নিজের মুখখানি চেপেধরে...
আপাতত এটুকু চলুক,বাকিটুকু হবে আবার আগামী পর্বে......
– ছি একদমই না। অসভ্য কোথাকার! দাও ওটা দাও বলছি!
রান্না শেষে সঞ্জয় নয়নতারার কাঁচুলি খুলে পকেটস্থ করেছে। এবং তার দাবী নয়নতারার আর বাড়ির ভেতরে কাঁচুলি পড়া চলবে না। কারণটি সঞ্জয় সকাল-বিকেল যেন বাধাহীন ভাবে ও দুটিতে চুমু খেতে পারে। কিন্তু নয়নতারা এমন প্রস্তাবে মোটেও রাজি নয়। অবশেষে সঞ্জয় তার বৌদিমণিকে বুকে টেনে তার ফোলা গাল দুটো টিপে দিয় বলে,
– শুধু শুধু এই উটকো ঝামেলার দরকার কি বল? এই এক টুকরো কাপড় নাই বা পড়লে,এমন কি ক্ষতি হবে তাতে!
– সে ঝামেলায় হোক বা না হোক, আমার জিনিস আমি পড়বো তাতে তোমার কি? ওসব অসভ্যের মত আবদার আমি মানতে রাজি নোই মোঠেও।
সঞ্জয় নয়নতারার কথা শুনে এক মুহূর্ত কি ভেবে বলল,
– আচ্ছা চল বাজি ধরি।
– বাজি!
– হুম বাজি, বাজিতে আমি জিতলে আজ থেকে বাড়িতে তোমার কাচুলি পরা বন্ধ।
– আর যদি আমি জিতি তবে?
– তবে তোমার কাঁচুলি আমি ফেরত দেব,সেই সাথে তুমি যা চাইবে তাই পাবে।
– সত্যিই! যা চাইবো তাই দেবে?
সঞ্জয় নয়নতারার রাঙা ঠোটে চুমু খেয়ে নাকে নাক ঘষে বলল,
– যা চাইবে তাই দেব লক্ষ্মীটি,তবে মনে রেখো আমি জিতলে কিন্তু..
বলতে বলতে সঞ্জয় ডান হাতে নয়নতারার শাড়ির ওপড় দিয়ে উন্মুক্ত স্তনের একটি টিপতে লাগলো। নয়নতারা খানিকক্ষণ কি ভেবে নিয়ে বলল,
– কিন্তু বাজি কি নিয়ে ধরবে সেটা আগে শোনা চাই। নয়নো আমি আগেই আমি রাজি হচ্ছি না।
– ও চিন্তা তোমার ভগ'বানের ওপরে,একটু আকাশ পানে তাকায় আর বল আজ বৃষ্টি হবে কি না?
নয়নতারা আকিশের পানে চাইলো। সকালের পরিস্কার আকাশ এখন খানিকটা মেঘলা। সে আকাশের পানে তাকিয়েই বলল,
– হবে না।
শুনেই সঞ্জয়ের মুখটি হাসি হাসি হয়ে গেল। সে নয়নতারাকে কোলে তুলে বলল,
– তবে এই ঠিক রইলো,আজ বৃষ্টি হলে আমি জিতব আর না হলে তুমি। রাজি!
এবার নয়নতারাও মুখে হাসি ফুটিয়ে সঞ্জয়ের মাথার আঘাতে আলতো ভাবে হাত বুলিয়ে বলল,
– রাজি!তবে কি কথা দিয়েছো তা মনে থাকে যেন। এখন নামাও কোল থেকে।
সঞ্জয়ের আর কোন কথা না বলে নয়নতারাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।এবং দ্রুত পদে রান্নাঘর থেকে বেরুতে পা বাড়ালো। নয়নতারা তার একটি হাত ধরে বলল,
– ওকি হচ্ছে! আমার কাঁচুলিটার কি হবে?
সঞ্জয় এক হাতে তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে লাল কাঁচুলিটা বের করে আনলো।তারপর নাকের কাছে নিয়ে একবার লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল,
– ও কথা ভুলে যাওয়া ভালো,কারণ আজকের পর থেকে তোমার আর ও ঝামেলায় পরতে হবে না বৌদিমণি।
রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে সঞ্জয় দোতলায় উঠে গেল।তার মুখের ভাবখানা এমন যে বাজি সে জিতেই গিয়েছে। কে জানে হয়তো ভগ'বান কোন কারণ বশত তার ওপড়ে বিশেষ ভাবে প্রসন্ন।
নয়নতারা অবশ্য তার ঠাকুরপোর ইচ্ছে পূরণ করলো। পরনের শাড়িটা ঠিকঠাক করে গায়ে জড়িয়ে রান্নাঘর গোছাতে লাগলো। এবং খাবার সময় নগ্ন বুকের ওপড়ে শাড়ির আঁচল এমনই ভাবে ফেললো,যাতে দেখা ও না দেখার মাঝে এক অদম্য আকর্ষণ তৈরি করে।
খেতে খেতে এক সময় সঞ্জয় নয়নতারার মুখে খাবার তুলে দিতে চাইলো। নয়নতারা তখন সমুখে বসে ডান হাতে তালপাখার বাতাস করছে। সে মাথা নেড়ে মানা করার পরেও সঞ্জয় নয়নের মুখে খাবার তুলে দিল। সুতরাং এমনই ভাবে দু'তিন বার বাধ্য হয়ে খেতে নয়নতারাকে।
সঞ্জয়ের খাওয়া-দাওয়ার পর যখন নয়নতারা স্নান করতে তৈরি হয়ে কলঘরে ঢুকলো। তখন কলঘরের বেতের দরজাটা লাগালোর আগে সঞ্জয় এসে থাকিয়ে দিয়ে বলল,
– শুধু শুধু আড়ালা করে কি হবে,তার চেয়ে ভালো তুমি গায়ে জল ঢাল আর আমি তা দেখে দুই চোখ সার্থক করি।
– উফ্...তুমি জ্বালিয়ে মারলে আমায়।
– ইসস্...এতো লজ্জা কিসের শুনি,এমন তো নয় যে তোমার স্নান করা আমি আগে দে....
কথাটা বলেই সঞ্জয়ের দাতে জিভ কামড়ে দিল,বলা ভালো একটু জোড়েই কামড় দিল,ব্যথায় মুখের ভাবভঙ্গি বিগড়ে গেল তার। নয়নতারা তৎক্ষণাৎ বাইরে এসে সঞ্জয়ের গালে হাত দিই বলল,
– কি হল! হঠাৎ ওমনি ভাবে...দেখি কি হয়েছে।
সঞ্জয়ের বিশেষ কিছু তো হয়নি,তবুও সে দুহাতে নয়নতারার কোমড় জড়িয়ে বলল,
– জিভে কামড় মেরেছি,জ্বলছে খুব। এ তোমার দোষ বৌদিমণি। এখন আদর না করলে ছাড়ছি না আমি।
এমন ছেলেমানুষি দোষারোপে নয়নতারার হেসে ওঠা উচিৎ বোধকরি! কিন্তু কই তার রাঙা ওষ্ঠাধরের মুক্ত ঝরানো হাসি? এক মূহুর্তে নয়নতারার মুখমন্ডল যেন কালো মেঘে ঢেকে গেল। তার মুখখানি নত হয়ে দৃষ্টি চলেগেল পায়ের কাছে। তবে নয়নতারার এমন মনভাবের কারণ জানা হলো না। তার আগেই বাইরে থেকে কে যেন সঞ্জয়দা বলে জোরে দুরার ডেকে উঠলো।
/////
মিনতী দেবী বেরুতেই ধপ করে মেঝেতে বসে পরে হেমলতা। স্বভাবতই হেমলতা কঠিন মনের অধিকারীণি নয় এটি আমাদের জানা কথা। অল্প হাওয়াতে যার প্রাণ কাঁপে,সে যদি ঝড়ের সমুখে পরে তবে তার হাল ঠিক কি রূপ হইতে পারে তা বোঝা নিশ্চয়ই খুব একটা শক্ত নয়। তেমনি আজ মায়ের মুখে তার বিয়ের খবর শোনার পর প্রথম ধাক্কায় হেমলতা কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। অবশ্য বৈঠকঘরে গোবিন্দ লালকে দেখার পর তার আর কিছুই বোঝার বাকি ছিল না।
আজ সকালের পর থেকে যা কিছু ঘটছে তা পর্যালোচনা করতে পারলে হয় তো হেমলতার মনস্তত্ত্বের নতুন কোন তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারত।কিন্তু সব কেমন ঝাপসা লাগছে। এ সব কি সত্য? এই ঘর, এই বিছানা, ওই জানলা আর জানলার বাইরের মেঘলা আকাশ, এ সব কি বাস্তব, না স্বপ্ন?আর সে নিজেই বা কি? এমন খবর শুনিবার পর হেমলতার জগত সংসার সব গুলিয়ে গেছে। হেমলতার মায়ের মতে আগামী তিন দিনের পরেই তার হেমের বিবাহ। এমন অদ্ভুত পরিস্থিতি কবে কজনের ভাগ্যে ঘটে? হেমলতার মনে পরে এই দুদিন আগে সেই একই বৈঠকঘরে কয়েকজন বৃদ্ধ লোকের আলোচনা, সেই আলোচনাও তার বিবাহের ব্যপারে। তবে হেমলতা তার মায়ের মুখ দেখেই আন্দাজ করিতে পারে যে সেই দিনকার প্রস্তাবের চেয়ে আজকের জমিদার বাড়ির প্রস্তাবের গুরুত্ব বেশি। বিশেষ করিয়া যখন সয়ং হেমলতার মাতা ও জামাইবাবু এই প্রস্তাবে রাজি, সেখানে তার পিতার মত ঘোরানো হেমলতার মাতার পক্ষে খুব একটা কঠিন কর্ম নয়।
হেমলতা যখন শয্যার একপাশে মেঝেতে বসিয়া নীরবে অশ্রু পাত করতেছিল। তখন কোথা থেকে মন্দিরা তার ছোট ছোট পায়ে ছুটে এসে মাসি কোলে বসলো। বালিকার স্নেহকাঙাল মুখের দিকে তাকিয়েই হেমলতা তার চাহুনির তাৎপর্য বুঝে নেয়। পরক্ষণেই নিজের চোখ দুখানির অশ্রু শাড়ি আঁচলে মুছে মন্দিরাকে কোলে তুলে নেয় সে। দোতলার সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই পিতামাতার কয়েকটি কথা কানে লাগে তার।
– তুমি এমটিই বা ভাবছো কেন? সঞ্জয় ছেলেটি খারাপ কিসে,দিব্যি কাজকর্ম করছে। আর নদীর এপাড় ওপাড় কতটুকুই বা দূরে যে মেয়ের জন্যে এত চিন্তা?
– সে তুমি যাই বল,আমি দুই মেয়েকেই আমার চোখের সামনে সামনেই রাখতে চাই।
– কি দরকার চোখের সামনে রাখার যদি মেয়ের কপালে সুখ না থাকে? এক জামাইকে তো দেখছি,ব্যবসায় লোকসান করিয়ে শেষ এখন মাতাল। এখন কিনা আর এক মাতালের হাতে ছোট মেয়েটাকেও....
হেমলতা আর দাড়ায় না। রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। এই আলোচনার শেষ পরিনতি তার অজানা নয়। সে মনে মনে কদিন আগে সঞ্জয়ের দেওয়া পত্রের কথাগুলি একে একে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে তৈরী করতে থাকে। সিদ্ধান্ত সহজ নয়,কিন্তু আজীবন অশ্রু পাতে করার চেয়ে এই কি ভালো নয়!
/////
শাখা-সিঁদুর আর গলার মঙ্গলসূত্র ব্যতীত নয়নতারা সম্পূর্ণ নিরাভরণ।আর কাপড় বলতে গায়ে হলুদ একটি শাড়ি জড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। গতরাতে ঠাকুরপোর কামনা নিবারণের ক্রিয়া করতে গিয়ে নিদ্রাহীন রাত্রি যাপন হয়েছে তার। তাই দুপুরের খাবার পর হাতের কাজ সেরে একটু চোখ দুটি লেগে এসেছিল নয়নতারা। কিন্তু বেচারীর কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে বাইরে দরজায় কড়া নাড়া ও কয়েকটি মেয়ের সম্মিলিত ডাক। অগত্যা পড়নের কাপড় ভালো মতো গায়ে জড়িয়ে ঘরে থেকে বেরোয় নয়নতারা।
রান্নাঘরের পাশে জামগাছটার নিচে মেয়েদের আসর বসলো বটে,তবে আসরের নয়নমণি আমাদের নয়নতারা ঘুমে কাতর। সে খানিক পর পর জাম গাছে হেলান দিয়ে ঝিমিয়ে পরছে দেখে পাড়ার মেয়েদের মধ্যে একজন বলে উঠলো,
– আজ কি হোল তোমার বৌদি,শরীর খারাপ করলো নাকি?
নয়নতারা ঝিমিয়ে পরেছিল।একথায় চোখ খুলে চারপাশ দেখে বলল,
– উঁহু.গত রাতে ঘুম হয়নি ঠিক মতো..একি ঠাকুমাকে দেখছি না যে?
– বুড়ি রেগে আছে বৌদি,ডাকতে গিয়ে ছিলুম উল্টে চব্বিশ ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিলে আমায়।
– সেকি! শুধু শুধু তোকে কথা শোনাল?
– কি জানি বাবা! পোড়ার মুখো বুড়ির মুখে কোনো দিন সুবাক্যি আছে! ঠিক বুড়ো ওপড়ে রাগ আমায় পেয়ে যেরে দিয়েছে।
কথাটার স্রোত আরো কত দূর গড়াত বলা যায় না, কিন্তু সঞ্জয় আর দেবু হঠাৎ বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরাতে নয়নতারাকে আসর ফেলে উঠতে হলো। সব গুছিয়ে রেখে আধঘণ্টা পরে নয়নতারা যখন বৈঠকঘরে এলো,তখন নয়নতারার ঝিমুনি ভাবটা সঞ্জয়ের চোখে পরে। তৎক্ষণাৎ সে নয়নকে পাঁজাকোলে করে সিঁড়ি ভেঙে তার শয্যাকক্ষে উপস্থিত হলো। নয়নতারা অবশ্য বাঁধা দেয়নি,বেচারী সারাদিনের কাজকর্মের পর বেশ ক্লান্ত। সে বাঁ হাতে সঞ্জয়ের গলা জড়িয়ে দুচোখ বুঝে ডান হাতটি মেলে ধরে সঞ্জয়ের বুকে।
বিছানায় শোয়াবার আগে ঘুমন্ত রমণী মুখপানে একবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সঞ্জয়। নয়নতারার দেহে বৈবাহিক জীবনের চিহ্ন ছাড়া আর কোন অলঙ্কার ছিল না। কানেও দুল পরেনি, নরম কানের লতি দুটো ফাকা থেকেও সুন্দর দেখাচ্ছে, গলায় শুধু একটা সরু সােনার মঙ্গলসূত্র। নগ্ন পা দুখানিতে নূপুর নেই,কোমড় ছাড়ানো কাজলকালো কেশরাশি খোলা কোন বাধন নেই তাতে। এই রূপ দেখে ধাধা লাগা স্বাভাবিক। যেন স্বর্গরাজ্যের কোন দেবী পথ ভুলে মর্ত্যে এসে তার ঘর আলোকিত করে আছে। অবশ্য স্বর্গরাজ্যে দেবীরা কিরূপে বিচরণ করে ,ইহা সঞ্জয় জানিতো না।
নয়নতারাকে খাটে শুইয়ে সঞ্জয় নিচে নামে বাবুকে নিয়ে যেতে। এরপর মাতা ও পুত্রকে পাশাপাশি শোয়ানো সময় চোখে পরে ঘুমের ঘোরে আঁচল সরে নয়নতারার বুকের খানিকটা উঁকি দিচ্ছে। হলদেটে শাড়িটা নয়নের গায়ের সঙ্গে মিশে আছে প্রায়।
সঞ্জয় কতখন এঈ দৃশ্য উপভোগ করলো তার হিসেবে কে রাখে! অবশেষে যখন হুশ ফিরলো। তখন নয়নের অধরের পাশ থেকে এলোমেলো কয়েক গাছি চুলে আঙ্গুল দিয়ে সরিয়ে কপালে চুমু খেল। তারপর টেবিল থেকে খাতা-কলম নিয়ে বসলো শয্যার পাশে মেঝেতে।
সন্ধ্যার আগে আগেই ঘুম ভাঙলো নয়নতারার। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে বৈঠক ঘরে ঢুকতে গিয়ে চমকে দুপা পিছিয়ে এলো সে। বৈঠকঘরে সঞ্জয়ের বাবুকে কোলে করে তার বন্ধু ও একজন কালোমত অচেনা লোকের সাথে আলোচনা করছিল। নয়নতারা সরে পরতো,কিন্তু হেমলতার নাম ওঠায় তার দেহে আড়ষ্ট হয়ে গেল। কথাগুলো তার খুব একটা অপরিচিত না হলেও বুকের মাঝে ভয় সঞ্চারিত হতে শুরু করলো তার।
– বিবাহের ব্যবস্থা এক মতো পাকাপোক্ত বললেই চলে। যা অবস্থা দেখছি ওরা হঠাৎ একদিন এই কান্ড ঘটিয়ে দিলে আর আটকায় কে, জলদিই কিছু না করলে খোড়া গোবিন্দ অতি শিগ্রই হেমকে পালকিতে তোলার তোরজোর করবে।
– হুম..এ ব্যাটা তো দেখছি জ্বালিয়ে মারলো কোথায় আমি ভাবছিলাম আষাঢ়ের প্রথমে শুভদিনে মায়ের মন্দিরে হেমকে হাজির করবো। না আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা উচিৎ বলে তো মনে হয় না।
– বলিকি আর একবার কথা বলে দেখলে হতো না? মানে ঝামেলা না করে যদি কোন ব্যবস্থা হয় আর কি।
– সে গুড়েবালি, জমিদার পুত্র রাজেন্দ্র আমার ওপড়ে আগে থেকেই চড়াও হয়ে আছে, হেনস্থা করার সুযোগ ছাড়বে কেন?
– তবে আর কি কাল সন্ধ্যায় নদী ঘাটে...
– আরে না না,এতো জলদি কিসের, তুই এখন বাড়ি যা,সেই ফাঁকে আমি ভেবে সবটা একটু সাজিয়ে নিই তারপর যা হবার তা কাল বলছি।
আলোচনা শেষে সঞ্জয় বেরিয়ে এলে, দুই চোখে একরাশ ভয় নিয়ে নয়নতারা তাকায় সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয় অবস্থা বুঝে নিয়ে হাত বাড়িয়ে বুকে টানে নয়নতারাকে।
সন্ধ্যা আরতি সেরে নয়নতারা দোতলায় সঞ্জয়ের ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। সঞ্জয় তখন চেয়ারে গা এলিয়ে টেবিলে দুই পা তুলে বসে আছে। নয়নতারা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে এসে চৌকির একপাশে বসে। সঞ্জয় ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে একবার দেখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। নয়নতারার পাশে বসে দুহাতে তার গলা জরিয়ে বলে,
– এখনও ওমন মুখ ভোতা করে বসে কেন?
নয়নতারা বোধকরি আর নিজেকে সামলাতে না পেরেগ দুই চোখ জলে ভাসিয়ে ব্যাকুল কন্ঠস্বরে বলে,
– এসব না করলে হয় না? আমাকে না হয় একবার ও বাড়িতে...
– পাগলো হয়েছো তুমি!আর এতো চিন্তা কিসের তোমার? তাছাড়া তুমি ওবাড়িতে গেলে দাদা তোমায় আর ফিরতে দেবে ভেবেছো?
– সে না দিলে নাই বা দেবে, কিন্তু আমি বাবাকে বললে বাবা ঠিক রাজি হবে দেখো।
সঞ্জয় নয়নতারার চোখের অশ্রু মুছে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল,
– সত্যি বলতে বৌদিমণি, তোমার মাতা শ্রীমতী মিনতী দেবীকে চিনতে বড্ডো দেরি করে ফেলেছি আমি।
– ছিঃ...গুরুজনদের ওসব বলতে আছে! তুমি নিয়েই চল না,দেখবে বাবা ঠিক রাজি হবে,আমি বলছি রাজি হবে তুমি দেখো।
– আর যদি না হয় তবে? একথা গোবিন্দর কানে গেলে তবে কি হবে বল?
নয়নতারা কিছু একটা বলতে গিয়েও মুখ নামিয়ে নেয়। তাই দেখে সঞ্জয় বাঁ হাতে নয়নের চিবুক ঠেলে ঠোটে আলতো একটা চুমু খেয়ে বলল,
– এখন কিছু না করলে কদিন বাদেই হেমকে পালকি করে জমিদার বাড়ির পথে দেখা যাবে।আর যদি এমনটি হয়,তবে কিন্তু দাদাকে ছেড়ে তোমায় আমার ঘরে উঠতে হবে। বাবুকে যেমন কোলে নিয়ে ঘুরছো এমনি আর একটি কোলে তুলবো তোমার....
কান্নার মাঝেও এমন কথা শুনে নয়নতারা ফর্সা মুখমণ্ডল রাঙা হয়ে ওঠে। সে সঞ্জয় কে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সঞ্জয়ের হাতের টানে সে আছড়ে পরে বিছানায়।তৎক্ষণাৎ নয়নতারার হাত দুটি মাথার ওপড় টেনে নিয়ে শক্ত করে বাঁ হাতে বিছানায় চেপেধরে সঞ্জয়। তারপর ডান হাতের মাঝে আঙুল দুটি নয়নতারা রাঙা ওষ্ঠাধরে বুলিয়ে আদর মাখা কন্ঠে বলে,
– ছুটে পালানো বুঝি এতো সোজা? আমার প্রশ্ন উত্তর কে করবে শুনি?
সঞ্জয় একথা বলে ঠোঁট থেকে হাত নামিয়ে আনে নয়নতারার বগলের পাতলা কেশরাশি কাছে।সেখানে আঙুল ছোয়াতেই সর্বাঙ্গে মুচড়ে ওঠে নয়নতারা। সঞ্জয় ছেড়ে দেয় না আলতো ভাবে আঙুল দিয়ে বগলের চুলে বিলি কাটে। নয়নতারা হাত মুচড়ে ছাড়া পাবার আশা না দেখে নয়নতারা গাল ফুলিয়ে অভিমানী সুরে বলে,
– এমন জ্বালাতন করলে আমি সত্যিই তোমার দাদা খবর পাঠাবো আমায় নিয়ে যেতে।
সঞ্জয় কোন উত্তর না করে নয়নতারা হাতদুটো ছেড়ে শাড়ির আঁচল নিয়ে পরে। নয়নতারাও একহাতে সঞ্জয়ের মাথাটা তার বুকে টেনে, অন্য হাতে নিজের মুখখানি চেপেধরে...
আপাতত এটুকু চলুক,বাকিটুকু হবে আবার আগামী পর্বে......