23-08-2024, 04:27 AM
(This post was last modified: 23-08-2024, 08:11 AM by বহুরূপী. Edited 8 times in total. Edited 8 times in total.)
পর্ব ২০
বোধকরি ভালবাসা মানুষের বোধ চিন্তাকে অচেতন করে দেয়।নিজের সত্ত্বা হারিয়ে যায়। এটি এই কদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নয়নতারার নীরবতাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। অবশ্য কথা যে হয়নি তাও ত নয়, কিন্ত খুব একটি জোরের সাথে যে হয়নি এটি কি আর তার অজানা।
তবে আর চুপ থাকলে চলে না। এই কদিনেই সঞ্জয় বড় অবাধ্য হয়ে গেছে। না, অবাধ্য বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু গত সন্ধ্যায় ঘটা ঘটনাটিয় নিতান্তই ছোটখাটো নয়।ওভাবে নয়নের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পায়ে চুমু খাওয়াটা সঞ্জয়ের ভাড়ি অন্যায় হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে! নাকি…
হঠাৎ ভাবনার পরিবর্তনে নয়নতারার সর্বাঙ্গে যেন কাটা দিয়ে উঠলো। সে খানিকক্ষণ বিছানার চাদর আঁকড়ে চোখ বুঝে বসে রইলো। গতরাতে কথা বলার সুযোগ না পাওয়ায়। আজ খুব ভোরে স্নান সেরে নয়নতারা দোতলায় উঠে আসে। তবে দোতলার ঘর খালি দেখে ,সঞ্জয়ের বিছানায় বসে খানিক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সঞ্জয়ের প্রতিক্ষায় থাকতে থাকতে কখন যে সে ভাবনার রাজ্যে প্রবেশ করে,সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি।
নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে, নয়নতারা উঠে দাঁড়ায় সঞ্জয়কে খুঁজতে। প্রথমে ছাদে ও তারপর নিচে নেমে এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে, অবশেষে বৈঠক ঘর পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে পা রাখে বাড়ির সামনের দিকের উঠনে।
বাড়িটার চার দিক পাচিল দিয়ে ঘেরা হলেও রাস্তার দিকটায় বেশ কিছু টা খোলা। কোন গেইট বসানো হয়নি। যদিও এদিকের রাস্তায় প্রয়োজন ছাড়া কারো আসার কথা নয়,তবুও নয়নতারা শাড়ির আঁচলটি মাথায় টেনে নিল। তারপর পা বাড়ালো পাচিলের বাম পাশের গোয়াল ঘরটির দিকে। যদিও গোয়াল ঘরে গরুর বদলে সঞ্জয়ের মোটরসাইকেলটি সোভা পায়। তবুও এই ঘরটি যে গোয়াল ঘর, এটি ঘরখানা দেখলেই বোঝা যায়।
ঘরে ঢুকেই কেমন একটা তেলের গন্ধ নাকে লাগলো নয়নতারার। বেশ কয়েদিন ধরে সঞ্জয় তার গাড়িটি কেন বের করেনি, তা এখন সঞ্জয়ের হাতে কালি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গাড়িটা নিশ্চয়ই কোন কারণে খারাপ হয়েছে।
নয়নতারা ঘরে পা রেখেই সঞ্জয়ের সামনে গতকালকের নুপুর দুটো ফেলে দিয়ে বলল,
– এমন কান্ড করলে আমি আজি চলে যাবো এই বাড়ি ছেড়ে! শুধু শুধু এতো গুলো টাকা জলে ফেললে কেন শুনি?
টাকা! নয়নতারা নিজের কথায় নিজেই চমকে উঠলো।সঞ্জয় কাজে মগ্ন ছিল। হঠাৎ নয়নতারার ঝাজালো গলার সুর শুনে প্রথমে বেশ চমকেই গিয়েছিল সে। তবে অল্প সময়ে নিজের মনভাব সামলে নিয়ে সে বলল,
– ও কি কথা, টাকা জলে ফেলবো কেন? টাকায় সোনার গহনা গড়িয়েছি এ বুঝি আমার অন্যায়! তা হো,কিন্তু আমার অন্যায়ের ভাগিদার তোমার রাঙা পায়ের সোনা কি করে হলো শুনি?
কথা শেষ করে সঞ্জয় বাঁ হাতে মেঝে থেকে নুপুর দুটি তুলে নিল। এদিকে নয়নতারার কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে এল।আর কথা বলার সামর্থ নেই তার। টাকার আলোচনা করতে সে এখানে আসেনি। কিন্তু যে কারনে আসা সেটি বলতে গিয়ে দেখলো তার মুখ দিয়ে যেন কথা বেরুছে না। এদিকে নয়নতারাকে নিশ্চুপ দেখে সঞ্জয় আবারও বলতে শুরু করলো,
– তা আমার টাকা না হয় আমিই জলে ফেললাম,কিন্তু তাই বলে আমার উপহার তুমি এভাবে ছুড়ে ফেলবে,আমিতো ভালোবেসে দিয়েছিলাম তোমায়। তাছাড়া এবাড়ির কোন গহনা তোমার গায়ে নে,তা দেখতেও কেমন যেন লাগে। মায়ের গয়না তো দাদা যাবার সময় নিয়ে গেছিল,নয়তো বাপের বাড়ির কোন গয়না তোমায় পড়তে দিতাম না।
ভালোবাসা কথাটি শোনা মাত্রই নয়নতারা মুখ তুলে সঞ্জয়ের চোখেরপানে চেয়ে রইলো। আর কোন কথা তার কানে গেল কিনা সন্দেহ। তবে সঞ্জয়ের চোখে কি ছিল তা আমরা না বুঝলেও বোধকরি নয়নতারার বোঝার বাকি রইলো না। তবে নয়নতারা নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন কিছু কথা বলতে প্রস্তুতি নিছিল। তবে সঞ্জয় নয়নতারাকে এই অবস্থার সামাল দেবার সময় না দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে। সঞ্জয়কে এগিয়ে আসার সময় তার হাতে মাখা কালি দেখে, ভয়ে নয়ন খানিকটা পেছনে সরে যেতেই দরজার কাছে দেয়ালে পিঠ ঠেকলো তার।
– ওকি হচ্ছে! মাথা খাও, ও হাতে গা ছুইয়ে দিও না যেন।
কিন্তু কে শুনবে তার কথা! সঞ্জয়ের থামবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সে নয়নতারার একদম গা ঘেঁষে প্রায় বুকে বুক লাগিলে দাঁড়ালো। আর সেই সাথে তার কালি মাখা ডান হাতটি তুলে আনলো তার বৌদিমণির মুখের কাছে। নয়নতারার এতো কাছে থাকায় গতকালকের সেই সুবাস নাকে লাগলো তার। অন্য দিকে নয়ন বেচারী একটু আগে স্নান সেরে এসেছে এখানে,এখন সঞ্জয়ের নোংরা হাতের স্পর্শ গায়ে লাগলে আর ঠাকুরের ঘরে ঢোকা হবে না তার। গা ঘিনিঘিন করবে আবারও স্নান না করলে।
সঞ্জয়কে এগিয়ে আসতে দেখেই নয়নতারা দেয়ালে সিটিয়ে গিয়ে দু'চোখ বুঝে নিয়েছিল। এখন তার বুকের ওপড়ে সঞ্জয়ের বুকের চাপ অনুভব করা মাত্র চোখ খুললো। কিন্তু না জানি কেন মুখ তুলে তাকাতে পারলো না। সঞ্জয়কে এত কাছাকাছি দেখে এক অজানা আশংকায় তার বুকের ভেতরে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গেছে। তারপরেও মনের জোড় একত্র করে নয়নতারা তির দুই হাত রাখলো সঞ্জয়ের বুকে; প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো তাকে। কিন্তু এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ল। সঞ্জয় তার কালি মাখা ডান হাত খানি দিয়ে নয়নতারার কোমড় পেচিয়ে তাকে আরো ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। সঞ্জয়ের হাতের স্পর্শ গায়ে লাগলেই নয়নতারার সর্বাঙ্গে যেন কম্পন ধরিয়ে দিল। সে ব্যাকুল নয়নে সঞ্জয়ের মুখের পানে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল
– ছিঃ ছিঃ এ তোমার ভারি অন্যায়! দোহাই লাগে ঠাকুরপো এই কলঙ্কেকের কালিমা আমার মুখে মাখিও না।
কথাগুলি বলেই নয়নতারা অনুভব করে তার কোমড়ে থাকা সঞ্জয়ের হাতের আঙ্গুল গুলি আরো নীবির ভাবে আঁকড়ে ধরছে তাকে। আর সেই সাথে ধিরে ধিরে অবশ করে দিচ্ছে নয়নতারার সর্বাঙ্গ।
– তুমি ছেলেমানুষ নয় বৌদিমণি! তাকাও তাকাও বলছি আমার দিকে। দশ-বার বছর হলো তোমার বিয়ে হয়েছে, এখন আর তুমি কচিখুকি নেই, আমার বয়সটিও এখন কাঁচা নয় মোটেও। তোমার মনে কি চলছে খুলে বল আমায়। কথা দিচ্ছি উত্তর না হলে আর এই কথা মুখেও আনবো না আমি।কিন্তু সব বুঝেশুনে চুপচাপ বসে রইলে নিরঘাত মারা পর...
নয়নতারার একটি হাত এসে চেপে বসলো সঞ্জয়ের মুখের ওপড়ে,তার অসমাপ্ত কথাগুলি মুখেই থেকে গেল। নয়ন মুখ তুলে তাকাতেই সঞ্জয়ের চোখে পরলো তার বৌদিমণির অশ্রুসিক্ত ছলছলে দুটি চোখ। সঞ্জয়ের কোন কথাই মিথ্যা ছিল না। যে দিন সঞ্জয়ের ঘরের মেঝে বসে হেমলতা সঞ্জয়ের কোলে হাতে রেখে বসেছিল। ওই দৃশ্য দেখামাত্র সেদিন নয়নতারার অনুভুতিই জানান দিয়েছিল স্বামীর সাথে তার সামাজিক ও সংসারের বাঁধন থাকলেও,তার মনের দখল ছিল সঞ্জয়ের। যে জায়গায় অন্যের হাত লাগলে নয়নতারার প্রাণ কাঁপে,তার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা কতদিনই বা সম্ভব। কিন্তু বুক ফাটলেও সবসময় কি আর সত্য প্রকাশ করা যায়! তাছাড়া হেমলতাই বা একথা সইবে কেন! সেই দিনে হেমের হাতে চুড়ি পড়ানো দেখে নয়নতারাও তো সইতে পাড়ে নি। তার চোখে অশ্রু নেমে এসেছিল সেদিন। তবে কেন হেমলতা তার ভালোবাসায় দিদির ভাগ বসানো মেনে নেবে!
নয়নতারা দু'হাতে সঞ্জয়কে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো আবারও। কিন্তু চাইলেই কি আর ওমন দেহের মানুষটিকে সরানো যায়! বোধকরি নয়নতারা কলকাতার ঘটনা ভুলে বসে আছে। নইলে বৃথাই এতো ঠেলাঠেলির সে করতো না। সঞ্জয় অবশ্য আর বাধা দিল না,সে নয়নতারাকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে হাটু গেরে বসতে বসতে বলল,
-তা ভালো না হয় নাই বাসলে,তাই বলে এমন সুন্দর নুপুর দুখানি ফেলে দিতে হবে কেন? এ তোমার ভারি অন্যায়। এ অন্যায় আমি কিছুতেই মেনছ নেব না ।
বলতে বলতে বলতেই সঞ্জয় তার কালি মাখা হাতে নয়নতারা ডান পা'টি টেনে এনে তার হাটুতে রেখে, নুপুর পরিরে দিতে লাগলো। আর নয়নতারা তার অশ্রুসিক্ত চোখে দেখছিল তার কালিমাখা পায়ের নুপুর দুখানি।
///////
সকালে জলখাবারের পরে সঞ্জয়ের তৈরি হলো হাটে যেতে।যদিও সে ভেবে রেখেছিল হেমে সমস্যার সমাধান না করে সে হাটের দিকে পা বারাবে না।কিন্তু তার গাড়িটি কিছুতেই তার দ্বারা ঠিক হবার নয়।সুতরাং মেকানিক আনতে হলে যেতে হবে সে মধুপুর রেলস্টেশন। তার ওপড়ে আজকে নৌকা পাবার সম্ভাবনা কম। যদিও সঞ্জয় দেবুকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে নৌকা ঠিক করতে। তবে দেবু সে কাজে বিফল হয়ে সঞ্জয়ের বন্ধু পুলককে খবর দিয়ে ফিরে এসেছে।
বেরুনোর সময় দোতলার বারান্দা থেকেই নজরে পড়লো, নয়নতারার তার নিজের তৈরি বাগানে গাছে জল দিচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দুজনের একবার চোখাচোখি হয়ে গেল।নয়নতারা চোখ ফিরিয়ে নিতেই সঞ্জয় এগিয়ে গেল নয়নতারার ঘরের দিকে। ইচ্ছে ছিল একবার বাবুকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। তার মধুপুর যাবার কথা নয়নতারা ইতি মধ্যেই অবগত।তবে নয়নতারার ঘরে বাবুকে দেখা গেল না। সঞ্জয় খানিক হতাশ হয়েই নয়নতারাকে বলে বেরিয়ে গেল।
পথে পা রাখতেই সঞ্জয় পরলো কয়েকটি মেয়ের সামনে,মেয়েদের দলটি নিজেদের মধ্যেই কি সব আলোচনা করতে করতে আসছিল এদিকে। তাকে পাশ কাটিয়ে দলটি যখন বাড়ির ভেতরে ডুকছে,তখন এগিয়ে যেতে যেতেই তাদের হাসাহাসির শব্দ কানে লাগলো সঞ্জয়ের।
তবে এটি নিয়ে সে বিশেষ না ভেবে বাড়ির পথ পেরিয়ে তালতলার পথে উঠে হাটের পথে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই তালতলার চায়ের দোকান থেকে শন্তু ডাক ছাড়লো,
– সঞ্জয়দা! চললে থোকায়?
সঞ্জয়ের যদিও হাটে পৌঁছনোর তারা ছিল,তবে দোকানে চরণ ঘোষ ও তার পাশেই হেমলতার পিতাকে দেখে সে এগিয়ে গেল।
চরণ ঘোষ চোখ বুঝে হুকো টানছিলেন। তার পাশেই নয়নতারার পিতা বাবুকে কোলে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। সঞ্জয় দোকানে ঢুকতেই এটি যুবক তার জন্যে জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তবে সঞ্জয়ের বসার ইচ্ছে না থাকা সে হাতের ইসারায় তাকে বসতে বলে,এগিয়ে গিয়ে চরণ ঘোষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
– গতকাল হাটে গিয়ে শুনলাম তুমি কিছুদিন যাবত হাটে যাচ্ছো না! ভাবলা কোন রোগ বাধিয়ে বসে আছো, তা এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
– এটু মধুপুর যাবো ভাবছিলাম,গাড়িটা খারাপ হয়ে পরে আছে। আপনি চিন্তা করবেন আমার শড়ীল সাস্থ্য ঠিকই আছে।
সঞ্জয়ের কথা শেষ হতেই নয়নতারার পিতা চায়ের কাপ রেখে বললেন,
– মধুপুর স্টেশন! সে তো দূরের পথ। যেতে আসতে বিকেল পেরুবে। তা আজকে তো হাটবার ওদিকটায় নৌকা যাবে আজ?
সঞ্জয় দূরের যাত্রা করবে শুনে ঘোষবাবু আর কথা বাড়ালেন না। সঞ্জয় বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে রাস্তায়।আর সেই সময়েই সাইকেলে করে তাদের গ্রামের ডাক্তার বাবু এসে থামলেন দোকানের সামনে।
দেখা গেল ডাক্তারবাবু নিজেও হাটে যাবার জন্যেই বেরিয়েছেন।তবে যাবার আগে এক কাপ গরম গরম চা পেটে পরা চাই। তাই অগত্যা সঞ্জয়কে আবারও ঢুকতে হল দোকানে। চা পান করতে করতে চরণ ঘোষ ডাক্তারের সাথে গ্রামের মানুষের শড়ীল সাস্থ্য নিয়ে আলোচনায় বসলেন।তারপর কাপ খালি হলেই সঞ্জয় তারা দিয়ে ডাক্তারকে সাইকেলের পেছনে তুলে, হাটের পথে সাইকেল ছুটালো।
নদীর ঘাটের কিছুটা দূর থেকেই হাট বসতে শুরু করে। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল,ছায়ামতি নদীর ঘাটে আজ বড় বড় নৌকার ভিড়। বেশিরভাগই মালবাহী ও জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। ঘাটের রাস্তায় লোক সমাগম অন্যদিনের থেকে এই দিনটিতে অনেক বেশি। হাজার হোক আজ হাটবার বলে কথা। আশেপাশের প্রায় দশগ্রামের মধ্যে তালদিঘীর হাটের মত হাট বসে না আর কোথায়। সুতরাং বলা বাহুল্য আজ গঞ্জে লোক সমাগম মোটেও কম নয়।
সঞ্জয় নদী ঘাটের সামনে এসেই সাইকেল থেকে নেমে ডাক্তারকে বিদায় দিল।তারপরবড় বটগাছটি পেরিয়ে সোজা হাটের ভেতরের দিকে হাঁটা লাগালো।
দোকানের সামনে এসেই সঞ্জয় দেখলো দোকানের আবহাওয়া বেশ জমজমাট,সবাই বেশ ব্যস্ত। তবে সঞ্জয়ের একটি দোকানে তালা পরার কারণে বাকি দোকান দুটোতে কর্মচারীদের বারতি সাহায্য মিলছিল। আসলে সব খারাপের একটা ভালো দিক থাকে, যেটি অধিকাংশ সময়ে আমাদের নজর এরিয়ে যায়।
ব্যস্ততা খানিকটা কমে এলে পুলক বেরিয়ে এলো। তারপর দুই বন্ধু দোকানের পেছনের পথ দিয়ে বেরিয়ে গেল হাটের লোক সমাগমের বাইরে। সরু মাটির পথটি দিয়ে নদীর তিরের দিকে হাটতে হাটতে পুলক বলল,
– বড় নৌকায় গেলে সুবিধা হতো,তারাতারি পৌঁছে যেতিস।
– ওই অপেক্ষায় বসে থাকলে দুপুর গড়িয়ে যাবে। তাছাড়া ওরা মধুপুরের আমার জন্যে বসে থাকবে ভেবেছিস! তখন হলে ফিরবো কি উপায়ে?
– আচ্ছা বাদ দে ও কথা। তারপর ওদিকটার খবর কি,হেমের ব্যাপারে কি করলি?
– হেমের ব্যপারে অত ভাবাভাবির কিছু নেই। ভালোয় ভালোয় হলে ভালো,নইলে উঠিয়ে এনে মায়ের মন্দিরে তুলবো।তারপর শুভকার্য সম্পূর্ণ করে সোজা বাড়িতে বৌদিমণির চরণতলে পড়লেই হলো। আমি ভাবছি অন্য কথা।
পুলক ভ্রু কুঁচকে সঞ্জয়কে খানিক দিখে নিয়ে বলল,
- তাহলে এই শুভ কর্মটি কবে সম্পূর্ণ হচ্ছে শুনি? গ্রামের বাতাসে কিন্তু ইতিমধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়ে গেছে। যেমন বূঝছি, ও কথা অতি অল্পদিনেই বাড়িয়ে-ছরিয়ে খোড়া গোবিন্দের কানে উপন্যাস হয়ে পৌঁছাবে। তখন কিন্তু কপালে ভোগান্তির শেষ থাকবে না,যি করার আগে ভাগেই সেরে ফেল।
সঞ্জয় এই বিষয়ে কোন কথা বলল না। আসলে সে নিজেও বুঝেছে,ওইদিন মন্দিরে ওভাবে হেমকে টেনে নেওয়াটা ঠিক হয়নি। তবে ঘটনা ঘটানোর পরে এখন আর ভেবে লাভ কি।
– জলদি পা চালা,তোকে উঠিয়ে দিয়ে আমাকে ফিরতে হবে। আর শোন! মাঝি এই গ্রামের নয়....
দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে নদীর এসে পরলো। তারপর মাঝির সাথে পরিচিত হয়ে সে নৌকায় উঠে বসলো। মধুপুরের যাত্রা মোটেও কম পথের নয়।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। তাই সঞ্জয় সময় নষ্ট না করে, নৌকার মাঝিকে নৌকা ছেড়ে দিতে বলল।
নৌকাটি যখন ছায়ামতির ঘাটের কাছদিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক তখনই বিপরীত মুখে অন্য একটি নৌকা সঞ্জয়ের নৌকার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। নৌকায় চেনা কয়েকটি মুখ দেখে সঞ্জয় কৌতূহল বশত পেছন ফিরল।দ্বিতীয় নৌকায় ছইয়ের ভেতরে জমিদার বাড়ির খোড়া গোবিন্দ ও সঞ্জয়ের দাদা সোহম বসে আছে।
ওই খোড়া গোবিন্দের মুখ দেখেই সঞ্জয়ের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সঞ্জয় ভেবে উঠতে পারলো না তার দাদা জেল থেকে বেড়িয়ে,আবার এদের সাথে মিশলো কেন। তার ওপড়ে হেমের সাথে ওই ব্যাটা ল্যাংড়ার বিয়ে কেন দিতে চাইছে।মনে মনে এই সব ভাবতে ভাবতে সঞ্জয় যাত্রাপথের দিকে চেয়ে রইল।
//////
আজ সকালে সঞ্জয়ের কথা শোনার পর থেকে নয়নতারার কোন কাজে বিশেষ মন বসছিল না। সে বারান্দায় একটি পিলারে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের পানে তাকিয়েছিল। দূর আকাশে কিছু মেঘের সারি ভেসে যাচ্ছে,নয়নতারার দৃষ্টি সেদিকেই।
ডান পাশে খানিক দূরে তিনটি মেয়ে বাবুকে মাঝে বসিয়ে কিসব কথা বলছে।আর নয়নতারার বা দিকে লতা নামে একটী মেয়ে বটিতে সবজি কুটতে কুটতে কথা বলছে,
– আমি ত আগের জানতাম বৌদি, দাদাবাবুর সাথে সইয়ের কিছু একটা চলছে। যাবার দিন আমাকে জড়িয়ে সেকি কান্না! তুমি ত দে....
– লতা! ওসব রেখে তুই বাড়ি যা তো। তোকে আর কিছু করতে হবে না, যা।
লতা হটাৎ ধমক শুনে থতমত খেয়ে কিছু বলতে পারলো না।তবে সে চুপ করলেও উঠে গেল না, নিঃশব্দে কাজে মন দিল।
নয়নতারা মুখ ঘুরিয়ে আবারো আকাশের পানে চেয়ে রইলো, আর কথি বাড়ালো না।
সঞ্জয় বেরুনোর ঘন্টা খানিক পরেই নয়নের বাবাও হাটবার বলে দেবুকে সাথে নিয়ে গঞ্জে চলে গেছে।অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কলকাতা থেকে ফিরে, সে নয়নতারার জন্যেই এ বাড়িতে পরে আছে। আজ হাটবার,তাই নদীর ওপাড়ের অনেকেই হাটে আসবে। সুতরাং নয়নতারার বুঝতে বাকি নেই তার বাবা হাটে কেন গেল।
তবে নয়নতারার চিন্তা সেটা ছিল না।আজ নয়নতারার মনের ভেতরে আড়াল করে রাখা অতি গোপনীয় কথাটি সঞ্জয়ের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে,এরপর কি হবে সেটাই ছিল তার ভাবনা।
কারণ সঞ্জয়ের আর বুঝতে বাকি নেই এতোকিছুর মধ্যেও নয়নতারা কেন এতো নীরব। কেনই বা তাদের ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়াছে বুঝেও নয়নতারা কিছুই বলেনি। তবে ভেবে লাভ কি আর!সে তো নিজের অজান্তেই নিজেকে সঞ্জয়ের সামনে মেলে ধরে ঘনিষ্ঠতা বাড়বার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এই দোষ কি শুধুমাত্র তার একার!
যদিওবা কলকাতায় সেই জ্যোৎস্না মাখা রাতে সঞ্জয়ের হাতের উষ্ণ স্পর্শ এখনো ছড়িয়ে আছে তার সারা শরীরে। নয়নতারা যে অনুভতি কে দুচোখ বুঝলেই অনুভব করতে পারে, তাকে অস্বীকার করবে কি উপায়ে?
না নয়নতারার পক্ষে একথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।কারণ সে রাতের কথা ভাবলেই তার শরীর পিপসায় ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। এই সংসার, এই পরিবেশ যার সান্নিধ্যে এতদিন ধরে নয়নতারার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কাটিয়েছে, তাকে অস্বীকার করে সে বেশ কয়েকবার সঞ্জয়ের সেই স্পর্শ পেতে ব্যাকুল হয়ে নিদ্রাহীন রাত্রী যাপন করেছে।একথা নয়নতারার অজানা নেই। এখন ভাবলেও অবাক লাগে,সে যে বিবাহিত সেটি ভুলে যেতেও তার মনটি দ্বিধাবোধ করে নি। একি শুধুমাত্র শরীরী আকর্ষণ! নাকি এতদিন সংসারের বাঁধনে আটকা পরে যে ভালোবাসাকে শুধুই নভেলে পরে অনুভব করেছিল। সেই ভালোবাসার শূন্যতা আজ অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে আঁকড়ে ধরতে চাইছে তাকে। সঞ্জয়ের মাঝে তার মনটি খুঁজে নিতে চাইছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। নয়নতারা নিজেও বুঝতে পারছে তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, নীরবতার কাছে আশ্রয় নিয়ে কোন রকম স্বস্তি ফিরে পাবে না সে। কিন্তু তাই বলে স্বামীর সাথে প্রতারণা, ছিঃছিঃ এত বড় পাপাচার সে.....
নয়নতারা নিজের মনে ভাবছিল।এমন সময় তার শাড়ির আঁচলে টান পরতেই,নয়নতারা মারাত্মক রেগে গিয়ে পেছনে মুখ ফেরালো। এবার অবশ্য লতা কিছুই করেনি। লতা একমনে সবজি কুটছিল,আর নয়নের পেছনে বাবু হামাগুড়ি দিয়ে এসে মায়ের আঁচল আঁকড়ে টানছিল।
/////
দুপুরের রান্নার কাজ যখন প্রায়ই শেষের দিকে, হঠাৎ পায়ের শব্দে শুনে নয়নতারা উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলো কে এসেছে।তখন ভেতরের বারান্দায় স্বামীকে দেখে খানিকটা অবাক হলো নয়নতারা।
সে উনুনের আগুন নিভিয়ে রান্নাঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। এবং স্বামী কাছে আসতেই নয়নতারা গলায় আঁচল জড়িয়ে স্বামীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– মেয়েটাকে নিয়ে এলে না কেন? পরের বার ওকে নিয়ে এসো, এখানে থাকবে না হয় কদিন।
সোহম নয়নতারাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গম্ভীর সরে বলল,
– নয়ন! আমি তোমায় নিতে এসেছি,বাবুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এসো,বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
কথা গুলো বলেই সোহম পেছন ফিরে বৈঠক ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। তখনি পেছন থেকে নয়নতারার প্রায় অস্ফুট গলা শোনা গেল।
– তোমাকে কতবার বলেছি,যদদিন না এবাড়ির জিনিস এবাড়িতে ফিরে আসছে, আমি এবাড়ি ছাড়ছি না।
সোহম তৎক্ষণাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে আগের মতোই গম্ভীর সরে বলল,
– তা কি জিনিস ফিরে আসার কথা হচ্ছে শুনি! বারবার এই তোমার ঐ এক কথা শুনতে শুনতে আমার...
নয়নতারা হঠাৎ কথার মাঝেই রান্নাঘরে ঢুকে পরলো। এই ঘটনায় সোহম নিজেও হতবাক হয়ে গেল। আসলে নয়নতারা স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময়,বৈঠক ঘরের দরজা গোবিন্দ লাল দাঁড়িয়ে লোলুপ নেত্রে নয়নতারার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল। এই দৃশ্য চোখে পরার সাথে সাথেই নয়নতারা সরে পরে। তবে সোহম তা বুঝতে পারার আগেই গোবিন্দ লাল সরে পরলো।
দুপুরের খাবার সময় নয়নতারা আর তাদের সামনে এলো না। সে আঁড়ালে থেকে দেবুকে পাঠালো তাদের খাওয়া- দাওয়ার তদারকি করতে।
খাবার পর্ব শেষে বৈঠক ঘরে তাদের আলোচনা সভা বসায়, নয়নতারা তার ঘরে এসে খাটে আধশোয়া হয়ে একটা বই খুলে পড়তে লাগলো।
প্রায় আধঘণ্টা পার করে সোহম ঢুকলো নয়নতারার ঘরে। নয়নতারা বিষয়টি লক্ষ্য করলেও, বই থেকে মুখ তুললো না। এদিকে সোহম এসেই বইটা নয়নতারার হাত থেকে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিল।
নয়নতারা স্বামীর মুখের পানে চাইলো এবার।সোহমের মুখে রাগান্বিত একটা ভাব ফুটে উঠেছে। তার দৃষ্টি এখন নয়নতারার পায়ের দিকে। সোহম শান্ত গলায় জিগ্যেস করলো,
– তখন কথার মাঝে অমন করলে কেন?
– এটি আমায় না বলে তোমার বন্ধুটিকে জিগ্যেস কর,সে ভালো বলতে পারবে।
– বাজে কথা বল না নয়ন,এই সব হেয়ালী না করে সহজ করে কথা বললে কি খুব ক্ষতি হয় তোমার?
– সে লাভ ক্ষতি আমার থেকে তুমিই ভালো জানো,অত বুঝিয়ে বলার কোন কারণ ত দেখি না। তুমি নিজে যেমন তেমনি হয়েছে তোমার সাঙ্গপাঙ্গরা।
সোহম নয়নতারার কথায় খানিক রেগে গিয়ে বলল,
– এই নয়ন, এই তুমি একদম বাজে কথা বলবে না বোলে দিলাম।
নয়নতারা টেবিল থেকে বইটি তুলে নিয়ে আগের মতোই শান্ত স্বরে বলল,
– বাজে কথা হবে কেন? সেদিন মন্দিরে অতগুলো লোকের সামনে তুমি আমায় কথা শোনালে কলকাতায় গিয়েছি বলে। তা বলি, আমি কি ঘুরতে গিয়েছিলাম কলকাতায়? বল ওগুলো বাজে কথা ছিল না? কই তখন তো আমি কিছু বলি নি। শোন!ওসব বাজে লোক নিয়ে এবাড়িতে আসবে না।
সোহম এতখন ধরে শান্ত থাকলেও এবার রেগেমেগে বলল,
– আমি বাজে লোক তাই তো! আর সঞ্জয় তো সাধু পুরুষ! তার সাথে কলকাতায় বাপের অসুখের নাটক করে রঙ্গ করা যায়, তা দেওয়া নুপুর পরে বেশ্যাদের মতো নাচলেন গায়ে দোষ লাগে না।
স্বামীর কথা শুনে নয়নতারার হাতের বই মেঝেতে পরে গেল। সে কম্পিত কন্ঠে বলল,
– ছিঃ! নিজের ভাই আর স্ত্রীকে নিয়ে তোমার এমন ভাবনা! তুমি কি নোরা ব্যাটাছেলে। তোমার মুখটা এত বাজে আগে জানতাম না। এখনো বলছি সময় থাকতে নিজের ভাইয়ে সাথে যা অন্যায় করছ তা বন্ধ কর..
সোহম এবার রিতিমত চিৎকার করে উঠলো,
– এই নয়ন!! তুমি আবার বাজে কথা বলছ! বলেছি না, তুমি একদম বাজে কথা বলবে না। আমাকে দেখে কি তোমার চোর মনে হয় নাকি?
নয়নতারা স্বামীর রাগান্বিত মূর্তি দেখে খানিকটা ভয়ে পেছনে সরে গেল। তবে এ ঘরে চিৎকার শুনে বাকিরা জলদিই এই ঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়ালো। নয়নতারার ভারাক্রান্ত মুখ দেখে দেবু সোজা ভেতরে ঢুকে সোহমকে ঠেলে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। তখনকার মত গোবিন্দ লাল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সোহমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
//////
স্বামীর মুখে অমন কথা শোনার পর নয়নতারা ভেবেই নিয়েছিল,সঞ্জয়ের সাথে সে মেলামেশা কমিয়ে দেবে। আজ সঞ্জয় বাড়ি এলে সকালের ঘটনার জন্যে দুকথা শুনিয়ে এক্কেবারে ঠান্ডা করে দেব,যেন আর কোন দিন গায়ে হাত না দেয়।
কিন্ত হয়! সন্ধ্যার পর যখন অন্ধকার হচ্ছিলো তালতলার পথে। জোনাকি জ্বলছিল ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে রাস্তার নিবিড়তার মধ্যে। কোন এক অচেনা বন্য ফুলের গন্ধ ভেসে আসচে বনের দিক থেকে। তখন নয়নতারাকে দেখা গেল,একটি প্রদীপ হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
সঞ্জয়ের বাড়িতে ফেরার কথা সাজের বেলা। কিন্তু এখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল,কিন্তু সঞ্জয় এখনো এলো না। এমন সময় অধিকার রাস্তায় কাকে যেন দেখা গেল। নয়নতারা মনে মৃদু শান্তির একটা ভাব ফুটে উঠতেই, দেবুকে দেখে শান্তভাবে কেটে গিয়ে বিরক্তি ফুঠে উঠলো তার মুখেপানে।
নয়নতারা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। বৈঠকঘরেই তার পিতা সকালের খবরের কাগজখানা নিয়ে বসে ছিলেন। নিচে মেঝেতে বাবু হামাগুড়ি দিয়ে একবার এদিক ত একবার ওদিক করছিল। নয়নতারা তাকে কোলে নিয়ে পিতির কাছে একটা আসনে বসে পরলো।
নয়নতারা যদিওবা জানতো আজ তার স্বামীর এখানে আসার পেছনে, শুধুমাত্র তাকে নিয়ে যাবার অনুরোধ ছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। তবে বিরক্ত থাকায় সেই কারণ জানার ইচ্ছে তার ছিল না।
আর খানিকটা সময় খবরের কাগজ ঘেটে নয়নতারা পিতা বেরিয়ে গেলেন তালতলার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে। সুস্থ হয়ে এখানে ফেরার পর থেকে তিনি প্রায় রোজ সকাল সন্ধ্যা নিয়ম করে তালতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। তিনি ফিরলেন সঞ্জয়কে সাথে করে। সঞ্জয়ের সাথে দু'ব্যাগ ভরতি কিসব জিনিস।
নয়নতারার মন থেকে তখন বিরক্ত ভাবটা কেটে গিয়ে হাসি ফুটেছে। সে রাতের খাবার পর্ব সেরে,নয়নতারা সঞ্জয়ের পেছন পেছন বাবুকে কোলে করে দোতলা উঠে গেল।ঘরে ঢুকে খাটে বাবুকে নামিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলো,
– এতো দেরি কেন হল? সকালে বলে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরবে,বাড়ির লোকের চিন্তা হয়না বুঝি।
সঞ্জয় তার ব্যাগ থেকে দুটি শাড়ি বের করে নয়নতারার সামনে মেঝেতে বসে নয়নের কোলে হাত দুটি রেখে বলল
– আমি কি সাধ করে দেরি করেছি, বিপাকে পরে দেরি হয়ে গেল। সে কথা থাক, এই শাড়ি দুখানা দেখ দেখি পছন্দ হয় কিনা।
নয়নতারা শাড়ি হাতে নিয়ে একপাশে রেখে বলল,
– বড্ড ছাড়া হাত তোমার, এত খরচ কেন কর? দুদিন পরেই তো চলে যাব তখন..
নয়নতারার মুখের কথা শেষ হল না,তার আগে সঞ্জয় হাত বাড়িয়ে নয়নতারার মুখ বন্ধ করে দিয়ে বলল,
– আর কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। ওকথা আর যেন তোমার মুখে না শুনি। আর খরচের কথা উঠছে কেন? মাত্র দুখানা শাড়িই ত আনলাম, ওতে তোমার হবে কেন?
নয়নতারা নিজের মুখ সঞ্জয়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
– তুমি ত দিয়েই খালাস,এর জন্যে কতজনের কত কথা শুনতে হয় তা যদি জানতে তবে ওকথা বলতে না।
কথা শুনেই সঞ্জয়ের চোখ দুটি হটাৎ জ্বলে উঠলো যেন। তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল এক মুহূর্তে।সে বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
– কে কথা শোনায়? বল দেখি!
সঞ্জয়ের হঠাৎ রাগান্বিত ভাবমূর্তি দেখে নয়নতারার খানিক হেসে বলল,
– তোমার দাদা এসে ছিল আজ সেই কথা শুনিয়ে গেছে,এখন কি করবে বল!
একথায় সঞ্জয় শান্ত হলেও মনে চিন্তা ঢুকে গেল,তার যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই সে একা আসে নি। সে খানিক কৌতুহলী হয়েই জিগ্যেস করলো,
– দাদা এসেছিল নাকি! তা কি বলল?
নয়নতারা সঞ্জয়ের মুখেরপানে তাকিয়ে বলল,
– তোমার দাদা বলল আমি বাজে মেয়েছেলে, তোমার দেওয়া নুপুর পরে বেশ্যাদের মত নেচে বেড়াছি।
এই কথায় সঞ্জয় খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে নয়নতারার দিকে চেয়ে রইল। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো বোধকরি। তারপর ডান হাতে নয়নতারার চিবুক ধরে বলল,
– তা, ঘরে ভেতরে নিজের লোকের সামনে নাচাতে ক্ষতি কি! এত বাড়ির পুরুষ বাইরে নজর দেবে না,সে ত ভালো কথা। তাই নয় কি?
– ইসস্... এসব বলতে লজ্জা করে না! এত নাচ দেখার শখ জাগলে, বিয়ে করে এনে সে মাগীর পায়ে ঘুঙুর দিয়ে নাচ দেখ।
কথাটা বলেই নয়ন উঠে দাড়িয়ে বাবু কোলে নিতে গেল। তবে সে কার্যে সফল হবার আগেই সঞ্জয় তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
– এতোদিন অপেক্ষা আমার সইবে না। তাছাড়া কে জানে, যাকে আনবো সে যদি নাচতে না পারে তখন! তার চেয়ে আমার এই ভালো.বিশ্বাস কর বৌদিমণি। এখন উপায় থাকলে আমি তোমাকেই ঘরে তুলতাম।
নয়নতারার এমন ঘটনার জন্যে তৈরী ছিল না। সে বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু আশ্চর্য নারীর মন! কথাটা শুনেই কোথা থেকে যেন আশার দীপ্তি জ্বলে উঠল বুকে। কে এক কুহকিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে ভালোবাসা আর সেবা করা নারীর ধর্ম। ঘেন্নাপিত্তি ভুলে, চোখ-কান বুজে তার কাছে নিজেকে সপে দে, এত ওত ভাববার কি আছে।ধন্য আশা কুহকিনী। ধন্য পুরুষের প্রতি নারীর আকর্ষণ!
নয়নতারা তার কামনার এই মায়াজালে নিজেকে হয়তোবা ছেড়েই দিত। তবে তার মাতৃত্বকে কে ঠেকাবে! খাটের ওপড়ে বাবু তখন তার মায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এসে হাজির।আর সেদিকে দৃষ্টি পরতেই নয়নতারা যেন চেতনা ফিরে পেল। সে নিজেকে সঞ্জয় হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে।বাবুকে কোলে তুলে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো।
এরপরে আপাতত আর কিছু নেই। আবার ফিরবো পরের পর্বে,তার আগে দেখি এটা চলবে কি না…!!!
বোধকরি ভালবাসা মানুষের বোধ চিন্তাকে অচেতন করে দেয়।নিজের সত্ত্বা হারিয়ে যায়। এটি এই কদিনে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নয়নতারার নীরবতাই তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। অবশ্য কথা যে হয়নি তাও ত নয়, কিন্ত খুব একটি জোরের সাথে যে হয়নি এটি কি আর তার অজানা।
তবে আর চুপ থাকলে চলে না। এই কদিনেই সঞ্জয় বড় অবাধ্য হয়ে গেছে। না, অবাধ্য বলা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু গত সন্ধ্যায় ঘটা ঘটনাটিয় নিতান্তই ছোটখাটো নয়।ওভাবে নয়নের ইচ্ছের বিরুদ্ধে পায়ে চুমু খাওয়াটা সঞ্জয়ের ভাড়ি অন্যায় হয়েছে। কিন্তু সত্যিই কি ইচ্ছের বিরুদ্ধে! নাকি…
হঠাৎ ভাবনার পরিবর্তনে নয়নতারার সর্বাঙ্গে যেন কাটা দিয়ে উঠলো। সে খানিকক্ষণ বিছানার চাদর আঁকড়ে চোখ বুঝে বসে রইলো। গতরাতে কথা বলার সুযোগ না পাওয়ায়। আজ খুব ভোরে স্নান সেরে নয়নতারা দোতলায় উঠে আসে। তবে দোতলার ঘর খালি দেখে ,সঞ্জয়ের বিছানায় বসে খানিক অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সঞ্জয়ের প্রতিক্ষায় থাকতে থাকতে কখন যে সে ভাবনার রাজ্যে প্রবেশ করে,সে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি।
নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে, নয়নতারা উঠে দাঁড়ায় সঞ্জয়কে খুঁজতে। প্রথমে ছাদে ও তারপর নিচে নেমে এদিক-ওদিক খুঁজে না পেয়ে, অবশেষে বৈঠক ঘর পেরিয়ে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে পা রাখে বাড়ির সামনের দিকের উঠনে।
বাড়িটার চার দিক পাচিল দিয়ে ঘেরা হলেও রাস্তার দিকটায় বেশ কিছু টা খোলা। কোন গেইট বসানো হয়নি। যদিও এদিকের রাস্তায় প্রয়োজন ছাড়া কারো আসার কথা নয়,তবুও নয়নতারা শাড়ির আঁচলটি মাথায় টেনে নিল। তারপর পা বাড়ালো পাচিলের বাম পাশের গোয়াল ঘরটির দিকে। যদিও গোয়াল ঘরে গরুর বদলে সঞ্জয়ের মোটরসাইকেলটি সোভা পায়। তবুও এই ঘরটি যে গোয়াল ঘর, এটি ঘরখানা দেখলেই বোঝা যায়।
ঘরে ঢুকেই কেমন একটা তেলের গন্ধ নাকে লাগলো নয়নতারার। বেশ কয়েদিন ধরে সঞ্জয় তার গাড়িটি কেন বের করেনি, তা এখন সঞ্জয়ের হাতে কালি দেখেই বোঝা যাচ্ছে। গাড়িটা নিশ্চয়ই কোন কারণে খারাপ হয়েছে।
নয়নতারা ঘরে পা রেখেই সঞ্জয়ের সামনে গতকালকের নুপুর দুটো ফেলে দিয়ে বলল,
– এমন কান্ড করলে আমি আজি চলে যাবো এই বাড়ি ছেড়ে! শুধু শুধু এতো গুলো টাকা জলে ফেললে কেন শুনি?
টাকা! নয়নতারা নিজের কথায় নিজেই চমকে উঠলো।সঞ্জয় কাজে মগ্ন ছিল। হঠাৎ নয়নতারার ঝাজালো গলার সুর শুনে প্রথমে বেশ চমকেই গিয়েছিল সে। তবে অল্প সময়ে নিজের মনভাব সামলে নিয়ে সে বলল,
– ও কি কথা, টাকা জলে ফেলবো কেন? টাকায় সোনার গহনা গড়িয়েছি এ বুঝি আমার অন্যায়! তা হো,কিন্তু আমার অন্যায়ের ভাগিদার তোমার রাঙা পায়ের সোনা কি করে হলো শুনি?
কথা শেষ করে সঞ্জয় বাঁ হাতে মেঝে থেকে নুপুর দুটি তুলে নিল। এদিকে নয়নতারার কণ্ঠ অবরুদ্ধ হয়ে এল।আর কথা বলার সামর্থ নেই তার। টাকার আলোচনা করতে সে এখানে আসেনি। কিন্তু যে কারনে আসা সেটি বলতে গিয়ে দেখলো তার মুখ দিয়ে যেন কথা বেরুছে না। এদিকে নয়নতারাকে নিশ্চুপ দেখে সঞ্জয় আবারও বলতে শুরু করলো,
– তা আমার টাকা না হয় আমিই জলে ফেললাম,কিন্তু তাই বলে আমার উপহার তুমি এভাবে ছুড়ে ফেলবে,আমিতো ভালোবেসে দিয়েছিলাম তোমায়। তাছাড়া এবাড়ির কোন গহনা তোমার গায়ে নে,তা দেখতেও কেমন যেন লাগে। মায়ের গয়না তো দাদা যাবার সময় নিয়ে গেছিল,নয়তো বাপের বাড়ির কোন গয়না তোমায় পড়তে দিতাম না।
ভালোবাসা কথাটি শোনা মাত্রই নয়নতারা মুখ তুলে সঞ্জয়ের চোখেরপানে চেয়ে রইলো। আর কোন কথা তার কানে গেল কিনা সন্দেহ। তবে সঞ্জয়ের চোখে কি ছিল তা আমরা না বুঝলেও বোধকরি নয়নতারার বোঝার বাকি রইলো না। তবে নয়নতারা নিজেকে সামলে নিয়ে কঠিন কিছু কথা বলতে প্রস্তুতি নিছিল। তবে সঞ্জয় নয়নতারাকে এই অবস্থার সামাল দেবার সময় না দিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে। সঞ্জয়কে এগিয়ে আসার সময় তার হাতে মাখা কালি দেখে, ভয়ে নয়ন খানিকটা পেছনে সরে যেতেই দরজার কাছে দেয়ালে পিঠ ঠেকলো তার।
– ওকি হচ্ছে! মাথা খাও, ও হাতে গা ছুইয়ে দিও না যেন।
কিন্তু কে শুনবে তার কথা! সঞ্জয়ের থামবার কোন লক্ষণ দেখা গেল না। সে নয়নতারার একদম গা ঘেঁষে প্রায় বুকে বুক লাগিলে দাঁড়ালো। আর সেই সাথে তার কালি মাখা ডান হাতটি তুলে আনলো তার বৌদিমণির মুখের কাছে। নয়নতারার এতো কাছে থাকায় গতকালকের সেই সুবাস নাকে লাগলো তার। অন্য দিকে নয়ন বেচারী একটু আগে স্নান সেরে এসেছে এখানে,এখন সঞ্জয়ের নোংরা হাতের স্পর্শ গায়ে লাগলে আর ঠাকুরের ঘরে ঢোকা হবে না তার। গা ঘিনিঘিন করবে আবারও স্নান না করলে।
সঞ্জয়কে এগিয়ে আসতে দেখেই নয়নতারা দেয়ালে সিটিয়ে গিয়ে দু'চোখ বুঝে নিয়েছিল। এখন তার বুকের ওপড়ে সঞ্জয়ের বুকের চাপ অনুভব করা মাত্র চোখ খুললো। কিন্তু না জানি কেন মুখ তুলে তাকাতে পারলো না। সঞ্জয়কে এত কাছাকাছি দেখে এক অজানা আশংকায় তার বুকের ভেতরে ঘোড়দৌড় শুরু হয়ে গেছে। তারপরেও মনের জোড় একত্র করে নয়নতারা তির দুই হাত রাখলো সঞ্জয়ের বুকে; প্রাণপণে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো তাকে। কিন্তু এতে লাভের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বাড়ল। সঞ্জয় তার কালি মাখা ডান হাত খানি দিয়ে নয়নতারার কোমড় পেচিয়ে তাকে আরো ঘনিষ্ঠ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিল। সঞ্জয়ের হাতের স্পর্শ গায়ে লাগলেই নয়নতারার সর্বাঙ্গে যেন কম্পন ধরিয়ে দিল। সে ব্যাকুল নয়নে সঞ্জয়ের মুখের পানে একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে কম্পিত কন্ঠে বলল
– ছিঃ ছিঃ এ তোমার ভারি অন্যায়! দোহাই লাগে ঠাকুরপো এই কলঙ্কেকের কালিমা আমার মুখে মাখিও না।
কথাগুলি বলেই নয়নতারা অনুভব করে তার কোমড়ে থাকা সঞ্জয়ের হাতের আঙ্গুল গুলি আরো নীবির ভাবে আঁকড়ে ধরছে তাকে। আর সেই সাথে ধিরে ধিরে অবশ করে দিচ্ছে নয়নতারার সর্বাঙ্গ।
– তুমি ছেলেমানুষ নয় বৌদিমণি! তাকাও তাকাও বলছি আমার দিকে। দশ-বার বছর হলো তোমার বিয়ে হয়েছে, এখন আর তুমি কচিখুকি নেই, আমার বয়সটিও এখন কাঁচা নয় মোটেও। তোমার মনে কি চলছে খুলে বল আমায়। কথা দিচ্ছি উত্তর না হলে আর এই কথা মুখেও আনবো না আমি।কিন্তু সব বুঝেশুনে চুপচাপ বসে রইলে নিরঘাত মারা পর...
নয়নতারার একটি হাত এসে চেপে বসলো সঞ্জয়ের মুখের ওপড়ে,তার অসমাপ্ত কথাগুলি মুখেই থেকে গেল। নয়ন মুখ তুলে তাকাতেই সঞ্জয়ের চোখে পরলো তার বৌদিমণির অশ্রুসিক্ত ছলছলে দুটি চোখ। সঞ্জয়ের কোন কথাই মিথ্যা ছিল না। যে দিন সঞ্জয়ের ঘরের মেঝে বসে হেমলতা সঞ্জয়ের কোলে হাতে রেখে বসেছিল। ওই দৃশ্য দেখামাত্র সেদিন নয়নতারার অনুভুতিই জানান দিয়েছিল স্বামীর সাথে তার সামাজিক ও সংসারের বাঁধন থাকলেও,তার মনের দখল ছিল সঞ্জয়ের। যে জায়গায় অন্যের হাত লাগলে নয়নতারার প্রাণ কাঁপে,তার থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখা কতদিনই বা সম্ভব। কিন্তু বুক ফাটলেও সবসময় কি আর সত্য প্রকাশ করা যায়! তাছাড়া হেমলতাই বা একথা সইবে কেন! সেই দিনে হেমের হাতে চুড়ি পড়ানো দেখে নয়নতারাও তো সইতে পাড়ে নি। তার চোখে অশ্রু নেমে এসেছিল সেদিন। তবে কেন হেমলতা তার ভালোবাসায় দিদির ভাগ বসানো মেনে নেবে!
নয়নতারা দু'হাতে সঞ্জয়কে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো আবারও। কিন্তু চাইলেই কি আর ওমন দেহের মানুষটিকে সরানো যায়! বোধকরি নয়নতারা কলকাতার ঘটনা ভুলে বসে আছে। নইলে বৃথাই এতো ঠেলাঠেলির সে করতো না। সঞ্জয় অবশ্য আর বাধা দিল না,সে নয়নতারাকে ছেড়ে দিয়ে তার সামনে হাটু গেরে বসতে বসতে বলল,
-তা ভালো না হয় নাই বাসলে,তাই বলে এমন সুন্দর নুপুর দুখানি ফেলে দিতে হবে কেন? এ তোমার ভারি অন্যায়। এ অন্যায় আমি কিছুতেই মেনছ নেব না ।
বলতে বলতে বলতেই সঞ্জয় তার কালি মাখা হাতে নয়নতারা ডান পা'টি টেনে এনে তার হাটুতে রেখে, নুপুর পরিরে দিতে লাগলো। আর নয়নতারা তার অশ্রুসিক্ত চোখে দেখছিল তার কালিমাখা পায়ের নুপুর দুখানি।
///////
সকালে জলখাবারের পরে সঞ্জয়ের তৈরি হলো হাটে যেতে।যদিও সে ভেবে রেখেছিল হেমে সমস্যার সমাধান না করে সে হাটের দিকে পা বারাবে না।কিন্তু তার গাড়িটি কিছুতেই তার দ্বারা ঠিক হবার নয়।সুতরাং মেকানিক আনতে হলে যেতে হবে সে মধুপুর রেলস্টেশন। তার ওপড়ে আজকে নৌকা পাবার সম্ভাবনা কম। যদিও সঞ্জয় দেবুকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছে নৌকা ঠিক করতে। তবে দেবু সে কাজে বিফল হয়ে সঞ্জয়ের বন্ধু পুলককে খবর দিয়ে ফিরে এসেছে।
বেরুনোর সময় দোতলার বারান্দা থেকেই নজরে পড়লো, নয়নতারার তার নিজের তৈরি বাগানে গাছে জল দিচ্ছে। সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতেই দুজনের একবার চোখাচোখি হয়ে গেল।নয়নতারা চোখ ফিরিয়ে নিতেই সঞ্জয় এগিয়ে গেল নয়নতারার ঘরের দিকে। ইচ্ছে ছিল একবার বাবুকে দেখে নিয়ে বেরিয়ে যাবে। তার মধুপুর যাবার কথা নয়নতারা ইতি মধ্যেই অবগত।তবে নয়নতারার ঘরে বাবুকে দেখা গেল না। সঞ্জয় খানিক হতাশ হয়েই নয়নতারাকে বলে বেরিয়ে গেল।
পথে পা রাখতেই সঞ্জয় পরলো কয়েকটি মেয়ের সামনে,মেয়েদের দলটি নিজেদের মধ্যেই কি সব আলোচনা করতে করতে আসছিল এদিকে। তাকে পাশ কাটিয়ে দলটি যখন বাড়ির ভেতরে ডুকছে,তখন এগিয়ে যেতে যেতেই তাদের হাসাহাসির শব্দ কানে লাগলো সঞ্জয়ের।
তবে এটি নিয়ে সে বিশেষ না ভেবে বাড়ির পথ পেরিয়ে তালতলার পথে উঠে হাটের পথে হাঁটা শুরু করলো। কিন্তু খানিকটা এগিয়েই তালতলার চায়ের দোকান থেকে শন্তু ডাক ছাড়লো,
– সঞ্জয়দা! চললে থোকায়?
সঞ্জয়ের যদিও হাটে পৌঁছনোর তারা ছিল,তবে দোকানে চরণ ঘোষ ও তার পাশেই হেমলতার পিতাকে দেখে সে এগিয়ে গেল।
চরণ ঘোষ চোখ বুঝে হুকো টানছিলেন। তার পাশেই নয়নতারার পিতা বাবুকে কোলে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। সঞ্জয় দোকানে ঢুকতেই এটি যুবক তার জন্যে জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। তবে সঞ্জয়ের বসার ইচ্ছে না থাকা সে হাতের ইসারায় তাকে বসতে বলে,এগিয়ে গিয়ে চরণ ঘোষের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
– গতকাল হাটে গিয়ে শুনলাম তুমি কিছুদিন যাবত হাটে যাচ্ছো না! ভাবলা কোন রোগ বাধিয়ে বসে আছো, তা এখন কোথায় যাওয়া হচ্ছে?
– এটু মধুপুর যাবো ভাবছিলাম,গাড়িটা খারাপ হয়ে পরে আছে। আপনি চিন্তা করবেন আমার শড়ীল সাস্থ্য ঠিকই আছে।
সঞ্জয়ের কথা শেষ হতেই নয়নতারার পিতা চায়ের কাপ রেখে বললেন,
– মধুপুর স্টেশন! সে তো দূরের পথ। যেতে আসতে বিকেল পেরুবে। তা আজকে তো হাটবার ওদিকটায় নৌকা যাবে আজ?
সঞ্জয় দূরের যাত্রা করবে শুনে ঘোষবাবু আর কথা বাড়ালেন না। সঞ্জয় বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো দোকান থেকে রাস্তায়।আর সেই সময়েই সাইকেলে করে তাদের গ্রামের ডাক্তার বাবু এসে থামলেন দোকানের সামনে।
দেখা গেল ডাক্তারবাবু নিজেও হাটে যাবার জন্যেই বেরিয়েছেন।তবে যাবার আগে এক কাপ গরম গরম চা পেটে পরা চাই। তাই অগত্যা সঞ্জয়কে আবারও ঢুকতে হল দোকানে। চা পান করতে করতে চরণ ঘোষ ডাক্তারের সাথে গ্রামের মানুষের শড়ীল সাস্থ্য নিয়ে আলোচনায় বসলেন।তারপর কাপ খালি হলেই সঞ্জয় তারা দিয়ে ডাক্তারকে সাইকেলের পেছনে তুলে, হাটের পথে সাইকেল ছুটালো।
নদীর ঘাটের কিছুটা দূর থেকেই হাট বসতে শুরু করে। ঘাটের কাছাকাছি আসতেই দেখা গেল,ছায়ামতি নদীর ঘাটে আজ বড় বড় নৌকার ভিড়। বেশিরভাগই মালবাহী ও জেলেদের মাছ ধরার নৌকা। ঘাটের রাস্তায় লোক সমাগম অন্যদিনের থেকে এই দিনটিতে অনেক বেশি। হাজার হোক আজ হাটবার বলে কথা। আশেপাশের প্রায় দশগ্রামের মধ্যে তালদিঘীর হাটের মত হাট বসে না আর কোথায়। সুতরাং বলা বাহুল্য আজ গঞ্জে লোক সমাগম মোটেও কম নয়।
সঞ্জয় নদী ঘাটের সামনে এসেই সাইকেল থেকে নেমে ডাক্তারকে বিদায় দিল।তারপরবড় বটগাছটি পেরিয়ে সোজা হাটের ভেতরের দিকে হাঁটা লাগালো।
দোকানের সামনে এসেই সঞ্জয় দেখলো দোকানের আবহাওয়া বেশ জমজমাট,সবাই বেশ ব্যস্ত। তবে সঞ্জয়ের একটি দোকানে তালা পরার কারণে বাকি দোকান দুটোতে কর্মচারীদের বারতি সাহায্য মিলছিল। আসলে সব খারাপের একটা ভালো দিক থাকে, যেটি অধিকাংশ সময়ে আমাদের নজর এরিয়ে যায়।
ব্যস্ততা খানিকটা কমে এলে পুলক বেরিয়ে এলো। তারপর দুই বন্ধু দোকানের পেছনের পথ দিয়ে বেরিয়ে গেল হাটের লোক সমাগমের বাইরে। সরু মাটির পথটি দিয়ে নদীর তিরের দিকে হাটতে হাটতে পুলক বলল,
– বড় নৌকায় গেলে সুবিধা হতো,তারাতারি পৌঁছে যেতিস।
– ওই অপেক্ষায় বসে থাকলে দুপুর গড়িয়ে যাবে। তাছাড়া ওরা মধুপুরের আমার জন্যে বসে থাকবে ভেবেছিস! তখন হলে ফিরবো কি উপায়ে?
– আচ্ছা বাদ দে ও কথা। তারপর ওদিকটার খবর কি,হেমের ব্যাপারে কি করলি?
– হেমের ব্যপারে অত ভাবাভাবির কিছু নেই। ভালোয় ভালোয় হলে ভালো,নইলে উঠিয়ে এনে মায়ের মন্দিরে তুলবো।তারপর শুভকার্য সম্পূর্ণ করে সোজা বাড়িতে বৌদিমণির চরণতলে পড়লেই হলো। আমি ভাবছি অন্য কথা।
পুলক ভ্রু কুঁচকে সঞ্জয়কে খানিক দিখে নিয়ে বলল,
- তাহলে এই শুভ কর্মটি কবে সম্পূর্ণ হচ্ছে শুনি? গ্রামের বাতাসে কিন্তু ইতিমধ্যে কিছু গুজব ছড়িয়ে গেছে। যেমন বূঝছি, ও কথা অতি অল্পদিনেই বাড়িয়ে-ছরিয়ে খোড়া গোবিন্দের কানে উপন্যাস হয়ে পৌঁছাবে। তখন কিন্তু কপালে ভোগান্তির শেষ থাকবে না,যি করার আগে ভাগেই সেরে ফেল।
সঞ্জয় এই বিষয়ে কোন কথা বলল না। আসলে সে নিজেও বুঝেছে,ওইদিন মন্দিরে ওভাবে হেমকে টেনে নেওয়াটা ঠিক হয়নি। তবে ঘটনা ঘটানোর পরে এখন আর ভেবে লাভ কি।
– জলদি পা চালা,তোকে উঠিয়ে দিয়ে আমাকে ফিরতে হবে। আর শোন! মাঝি এই গ্রামের নয়....
দুই বন্ধু কথা বলতে বলতে নদীর এসে পরলো। তারপর মাঝির সাথে পরিচিত হয়ে সে নৌকায় উঠে বসলো। মধুপুরের যাত্রা মোটেও কম পথের নয়।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। তাই সঞ্জয় সময় নষ্ট না করে, নৌকার মাঝিকে নৌকা ছেড়ে দিতে বলল।
নৌকাটি যখন ছায়ামতির ঘাটের কাছদিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক তখনই বিপরীত মুখে অন্য একটি নৌকা সঞ্জয়ের নৌকার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল। নৌকায় চেনা কয়েকটি মুখ দেখে সঞ্জয় কৌতূহল বশত পেছন ফিরল।দ্বিতীয় নৌকায় ছইয়ের ভেতরে জমিদার বাড়ির খোড়া গোবিন্দ ও সঞ্জয়ের দাদা সোহম বসে আছে।
ওই খোড়া গোবিন্দের মুখ দেখেই সঞ্জয়ের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল। সঞ্জয় ভেবে উঠতে পারলো না তার দাদা জেল থেকে বেড়িয়ে,আবার এদের সাথে মিশলো কেন। তার ওপড়ে হেমের সাথে ওই ব্যাটা ল্যাংড়ার বিয়ে কেন দিতে চাইছে।মনে মনে এই সব ভাবতে ভাবতে সঞ্জয় যাত্রাপথের দিকে চেয়ে রইল।
//////
আজ সকালে সঞ্জয়ের কথা শোনার পর থেকে নয়নতারার কোন কাজে বিশেষ মন বসছিল না। সে বারান্দায় একটি পিলারে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের পানে তাকিয়েছিল। দূর আকাশে কিছু মেঘের সারি ভেসে যাচ্ছে,নয়নতারার দৃষ্টি সেদিকেই।
ডান পাশে খানিক দূরে তিনটি মেয়ে বাবুকে মাঝে বসিয়ে কিসব কথা বলছে।আর নয়নতারার বা দিকে লতা নামে একটী মেয়ে বটিতে সবজি কুটতে কুটতে কথা বলছে,
– আমি ত আগের জানতাম বৌদি, দাদাবাবুর সাথে সইয়ের কিছু একটা চলছে। যাবার দিন আমাকে জড়িয়ে সেকি কান্না! তুমি ত দে....
– লতা! ওসব রেখে তুই বাড়ি যা তো। তোকে আর কিছু করতে হবে না, যা।
লতা হটাৎ ধমক শুনে থতমত খেয়ে কিছু বলতে পারলো না।তবে সে চুপ করলেও উঠে গেল না, নিঃশব্দে কাজে মন দিল।
নয়নতারা মুখ ঘুরিয়ে আবারো আকাশের পানে চেয়ে রইলো, আর কথি বাড়ালো না।
সঞ্জয় বেরুনোর ঘন্টা খানিক পরেই নয়নের বাবাও হাটবার বলে দেবুকে সাথে নিয়ে গঞ্জে চলে গেছে।অবশ্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কলকাতা থেকে ফিরে, সে নয়নতারার জন্যেই এ বাড়িতে পরে আছে। আজ হাটবার,তাই নদীর ওপাড়ের অনেকেই হাটে আসবে। সুতরাং নয়নতারার বুঝতে বাকি নেই তার বাবা হাটে কেন গেল।
তবে নয়নতারার চিন্তা সেটা ছিল না।আজ নয়নতারার মনের ভেতরে আড়াল করে রাখা অতি গোপনীয় কথাটি সঞ্জয়ের সামনে উন্মোচিত হয়ে গেছে,এরপর কি হবে সেটাই ছিল তার ভাবনা।
কারণ সঞ্জয়ের আর বুঝতে বাকি নেই এতোকিছুর মধ্যেও নয়নতারা কেন এতো নীরব। কেনই বা তাদের ঘনিষ্ঠতা ধীরে ধীরে বাড়াছে বুঝেও নয়নতারা কিছুই বলেনি। তবে ভেবে লাভ কি আর!সে তো নিজের অজান্তেই নিজেকে সঞ্জয়ের সামনে মেলে ধরে ঘনিষ্ঠতা বাড়বার সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু এই দোষ কি শুধুমাত্র তার একার!
যদিওবা কলকাতায় সেই জ্যোৎস্না মাখা রাতে সঞ্জয়ের হাতের উষ্ণ স্পর্শ এখনো ছড়িয়ে আছে তার সারা শরীরে। নয়নতারা যে অনুভতি কে দুচোখ বুঝলেই অনুভব করতে পারে, তাকে অস্বীকার করবে কি উপায়ে?
না নয়নতারার পক্ষে একথা অস্বীকার করা সম্ভব নয়।কারণ সে রাতের কথা ভাবলেই তার শরীর পিপসায় ক্ষুধার্ত হয়ে ওঠে। এই সংসার, এই পরিবেশ যার সান্নিধ্যে এতদিন ধরে নয়নতারার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কাটিয়েছে, তাকে অস্বীকার করে সে বেশ কয়েকবার সঞ্জয়ের সেই স্পর্শ পেতে ব্যাকুল হয়ে নিদ্রাহীন রাত্রী যাপন করেছে।একথা নয়নতারার অজানা নেই। এখন ভাবলেও অবাক লাগে,সে যে বিবাহিত সেটি ভুলে যেতেও তার মনটি দ্বিধাবোধ করে নি। একি শুধুমাত্র শরীরী আকর্ষণ! নাকি এতদিন সংসারের বাঁধনে আটকা পরে যে ভালোবাসাকে শুধুই নভেলে পরে অনুভব করেছিল। সেই ভালোবাসার শূন্যতা আজ অত্যন্ত প্রবল হয়ে উঠে আঁকড়ে ধরতে চাইছে তাকে। সঞ্জয়ের মাঝে তার মনটি খুঁজে নিতে চাইছে তার ভালোবাসার মানুষটিকে। নয়নতারা নিজেও বুঝতে পারছে তার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, নীরবতার কাছে আশ্রয় নিয়ে কোন রকম স্বস্তি ফিরে পাবে না সে। কিন্তু তাই বলে স্বামীর সাথে প্রতারণা, ছিঃছিঃ এত বড় পাপাচার সে.....
নয়নতারা নিজের মনে ভাবছিল।এমন সময় তার শাড়ির আঁচলে টান পরতেই,নয়নতারা মারাত্মক রেগে গিয়ে পেছনে মুখ ফেরালো। এবার অবশ্য লতা কিছুই করেনি। লতা একমনে সবজি কুটছিল,আর নয়নের পেছনে বাবু হামাগুড়ি দিয়ে এসে মায়ের আঁচল আঁকড়ে টানছিল।
/////
দুপুরের রান্নার কাজ যখন প্রায়ই শেষের দিকে, হঠাৎ পায়ের শব্দে শুনে নয়নতারা উঁকি দিয়ে দেখতে চাইলো কে এসেছে।তখন ভেতরের বারান্দায় স্বামীকে দেখে খানিকটা অবাক হলো নয়নতারা।
সে উনুনের আগুন নিভিয়ে রান্নাঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। এবং স্বামী কাছে আসতেই নয়নতারা গলায় আঁচল জড়িয়ে স্বামীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
– মেয়েটাকে নিয়ে এলে না কেন? পরের বার ওকে নিয়ে এসো, এখানে থাকবে না হয় কদিন।
সোহম নয়নতারাকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিয়ে গম্ভীর সরে বলল,
– নয়ন! আমি তোমায় নিতে এসেছি,বাবুকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এসো,বাইরে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
কথা গুলো বলেই সোহম পেছন ফিরে বৈঠক ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছিল। তখনি পেছন থেকে নয়নতারার প্রায় অস্ফুট গলা শোনা গেল।
– তোমাকে কতবার বলেছি,যদদিন না এবাড়ির জিনিস এবাড়িতে ফিরে আসছে, আমি এবাড়ি ছাড়ছি না।
সোহম তৎক্ষণাৎ ফিরে দাঁড়িয়ে আগের মতোই গম্ভীর সরে বলল,
– তা কি জিনিস ফিরে আসার কথা হচ্ছে শুনি! বারবার এই তোমার ঐ এক কথা শুনতে শুনতে আমার...
নয়নতারা হঠাৎ কথার মাঝেই রান্নাঘরে ঢুকে পরলো। এই ঘটনায় সোহম নিজেও হতবাক হয়ে গেল। আসলে নয়নতারা স্বামীর সঙ্গে কথা বলার সময়,বৈঠক ঘরের দরজা গোবিন্দ লাল দাঁড়িয়ে লোলুপ নেত্রে নয়নতারার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল। এই দৃশ্য চোখে পরার সাথে সাথেই নয়নতারা সরে পরে। তবে সোহম তা বুঝতে পারার আগেই গোবিন্দ লাল সরে পরলো।
দুপুরের খাবার সময় নয়নতারা আর তাদের সামনে এলো না। সে আঁড়ালে থেকে দেবুকে পাঠালো তাদের খাওয়া- দাওয়ার তদারকি করতে।
খাবার পর্ব শেষে বৈঠক ঘরে তাদের আলোচনা সভা বসায়, নয়নতারা তার ঘরে এসে খাটে আধশোয়া হয়ে একটা বই খুলে পড়তে লাগলো।
প্রায় আধঘণ্টা পার করে সোহম ঢুকলো নয়নতারার ঘরে। নয়নতারা বিষয়টি লক্ষ্য করলেও, বই থেকে মুখ তুললো না। এদিকে সোহম এসেই বইটা নয়নতারার হাত থেকে নিয়ে পাশের টেবিলে রেখে দিল।
নয়নতারা স্বামীর মুখের পানে চাইলো এবার।সোহমের মুখে রাগান্বিত একটা ভাব ফুটে উঠেছে। তার দৃষ্টি এখন নয়নতারার পায়ের দিকে। সোহম শান্ত গলায় জিগ্যেস করলো,
– তখন কথার মাঝে অমন করলে কেন?
– এটি আমায় না বলে তোমার বন্ধুটিকে জিগ্যেস কর,সে ভালো বলতে পারবে।
– বাজে কথা বল না নয়ন,এই সব হেয়ালী না করে সহজ করে কথা বললে কি খুব ক্ষতি হয় তোমার?
– সে লাভ ক্ষতি আমার থেকে তুমিই ভালো জানো,অত বুঝিয়ে বলার কোন কারণ ত দেখি না। তুমি নিজে যেমন তেমনি হয়েছে তোমার সাঙ্গপাঙ্গরা।
সোহম নয়নতারার কথায় খানিক রেগে গিয়ে বলল,
– এই নয়ন, এই তুমি একদম বাজে কথা বলবে না বোলে দিলাম।
নয়নতারা টেবিল থেকে বইটি তুলে নিয়ে আগের মতোই শান্ত স্বরে বলল,
– বাজে কথা হবে কেন? সেদিন মন্দিরে অতগুলো লোকের সামনে তুমি আমায় কথা শোনালে কলকাতায় গিয়েছি বলে। তা বলি, আমি কি ঘুরতে গিয়েছিলাম কলকাতায়? বল ওগুলো বাজে কথা ছিল না? কই তখন তো আমি কিছু বলি নি। শোন!ওসব বাজে লোক নিয়ে এবাড়িতে আসবে না।
সোহম এতখন ধরে শান্ত থাকলেও এবার রেগেমেগে বলল,
– আমি বাজে লোক তাই তো! আর সঞ্জয় তো সাধু পুরুষ! তার সাথে কলকাতায় বাপের অসুখের নাটক করে রঙ্গ করা যায়, তা দেওয়া নুপুর পরে বেশ্যাদের মতো নাচলেন গায়ে দোষ লাগে না।
স্বামীর কথা শুনে নয়নতারার হাতের বই মেঝেতে পরে গেল। সে কম্পিত কন্ঠে বলল,
– ছিঃ! নিজের ভাই আর স্ত্রীকে নিয়ে তোমার এমন ভাবনা! তুমি কি নোরা ব্যাটাছেলে। তোমার মুখটা এত বাজে আগে জানতাম না। এখনো বলছি সময় থাকতে নিজের ভাইয়ে সাথে যা অন্যায় করছ তা বন্ধ কর..
সোহম এবার রিতিমত চিৎকার করে উঠলো,
– এই নয়ন!! তুমি আবার বাজে কথা বলছ! বলেছি না, তুমি একদম বাজে কথা বলবে না। আমাকে দেখে কি তোমার চোর মনে হয় নাকি?
নয়নতারা স্বামীর রাগান্বিত মূর্তি দেখে খানিকটা ভয়ে পেছনে সরে গেল। তবে এ ঘরে চিৎকার শুনে বাকিরা জলদিই এই ঘরের দরজার মুখে এসে দাঁড়ালো। নয়নতারার ভারাক্রান্ত মুখ দেখে দেবু সোজা ভেতরে ঢুকে সোহমকে ঠেলে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। তখনকার মত গোবিন্দ লাল পরিস্থিতি সামাল দিয়ে সোহমকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
//////
স্বামীর মুখে অমন কথা শোনার পর নয়নতারা ভেবেই নিয়েছিল,সঞ্জয়ের সাথে সে মেলামেশা কমিয়ে দেবে। আজ সঞ্জয় বাড়ি এলে সকালের ঘটনার জন্যে দুকথা শুনিয়ে এক্কেবারে ঠান্ডা করে দেব,যেন আর কোন দিন গায়ে হাত না দেয়।
কিন্ত হয়! সন্ধ্যার পর যখন অন্ধকার হচ্ছিলো তালতলার পথে। জোনাকি জ্বলছিল ছোট ছোট ঝোপঝাড়ে রাস্তার নিবিড়তার মধ্যে। কোন এক অচেনা বন্য ফুলের গন্ধ ভেসে আসচে বনের দিক থেকে। তখন নয়নতারাকে দেখা গেল,একটি প্রদীপ হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে।
সঞ্জয়ের বাড়িতে ফেরার কথা সাজের বেলা। কিন্তু এখন সন্ধ্যে পেরিয়ে গেল,কিন্তু সঞ্জয় এখনো এলো না। এমন সময় অধিকার রাস্তায় কাকে যেন দেখা গেল। নয়নতারা মনে মৃদু শান্তির একটা ভাব ফুটে উঠতেই, দেবুকে দেখে শান্তভাবে কেটে গিয়ে বিরক্তি ফুঠে উঠলো তার মুখেপানে।
নয়নতারা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে ভেতরে চলে গেল। বৈঠকঘরেই তার পিতা সকালের খবরের কাগজখানা নিয়ে বসে ছিলেন। নিচে মেঝেতে বাবু হামাগুড়ি দিয়ে একবার এদিক ত একবার ওদিক করছিল। নয়নতারা তাকে কোলে নিয়ে পিতির কাছে একটা আসনে বসে পরলো।
নয়নতারা যদিওবা জানতো আজ তার স্বামীর এখানে আসার পেছনে, শুধুমাত্র তাকে নিয়ে যাবার অনুরোধ ছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে। তবে বিরক্ত থাকায় সেই কারণ জানার ইচ্ছে তার ছিল না।
আর খানিকটা সময় খবরের কাগজ ঘেটে নয়নতারা পিতা বেরিয়ে গেলেন তালতলার চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে। সুস্থ হয়ে এখানে ফেরার পর থেকে তিনি প্রায় রোজ সকাল সন্ধ্যা নিয়ম করে তালতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসেন। তিনি ফিরলেন সঞ্জয়কে সাথে করে। সঞ্জয়ের সাথে দু'ব্যাগ ভরতি কিসব জিনিস।
নয়নতারার মন থেকে তখন বিরক্ত ভাবটা কেটে গিয়ে হাসি ফুটেছে। সে রাতের খাবার পর্ব সেরে,নয়নতারা সঞ্জয়ের পেছন পেছন বাবুকে কোলে করে দোতলা উঠে গেল।ঘরে ঢুকে খাটে বাবুকে নামিয়ে দিয়ে জিগ্যেস করলো,
– এতো দেরি কেন হল? সকালে বলে গেলে সন্ধ্যার আগেই ফিরবে,বাড়ির লোকের চিন্তা হয়না বুঝি।
সঞ্জয় তার ব্যাগ থেকে দুটি শাড়ি বের করে নয়নতারার সামনে মেঝেতে বসে নয়নের কোলে হাত দুটি রেখে বলল
– আমি কি সাধ করে দেরি করেছি, বিপাকে পরে দেরি হয়ে গেল। সে কথা থাক, এই শাড়ি দুখানা দেখ দেখি পছন্দ হয় কিনা।
নয়নতারা শাড়ি হাতে নিয়ে একপাশে রেখে বলল,
– বড্ড ছাড়া হাত তোমার, এত খরচ কেন কর? দুদিন পরেই তো চলে যাব তখন..
নয়নতারার মুখের কথা শেষ হল না,তার আগে সঞ্জয় হাত বাড়িয়ে নয়নতারার মুখ বন্ধ করে দিয়ে বলল,
– আর কোথাও যাওয়া হবে না তোমার। ওকথা আর যেন তোমার মুখে না শুনি। আর খরচের কথা উঠছে কেন? মাত্র দুখানা শাড়িই ত আনলাম, ওতে তোমার হবে কেন?
নয়নতারা নিজের মুখ সঞ্জয়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,
– তুমি ত দিয়েই খালাস,এর জন্যে কতজনের কত কথা শুনতে হয় তা যদি জানতে তবে ওকথা বলতে না।
কথা শুনেই সঞ্জয়ের চোখ দুটি হটাৎ জ্বলে উঠলো যেন। তার মুখের ভাব পরিবর্তন হয়ে গেল এক মুহূর্তে।সে বেশ গম্ভীর গলায় বলল,
– কে কথা শোনায়? বল দেখি!
সঞ্জয়ের হঠাৎ রাগান্বিত ভাবমূর্তি দেখে নয়নতারার খানিক হেসে বলল,
– তোমার দাদা এসে ছিল আজ সেই কথা শুনিয়ে গেছে,এখন কি করবে বল!
একথায় সঞ্জয় শান্ত হলেও মনে চিন্তা ঢুকে গেল,তার যখন এসেছে তখন নিশ্চয়ই সে একা আসে নি। সে খানিক কৌতুহলী হয়েই জিগ্যেস করলো,
– দাদা এসেছিল নাকি! তা কি বলল?
নয়নতারা সঞ্জয়ের মুখেরপানে তাকিয়ে বলল,
– তোমার দাদা বলল আমি বাজে মেয়েছেলে, তোমার দেওয়া নুপুর পরে বেশ্যাদের মত নেচে বেড়াছি।
এই কথায় সঞ্জয় খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে নয়নতারার দিকে চেয়ে রইল। কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করলো বোধকরি। তারপর ডান হাতে নয়নতারার চিবুক ধরে বলল,
– তা, ঘরে ভেতরে নিজের লোকের সামনে নাচাতে ক্ষতি কি! এত বাড়ির পুরুষ বাইরে নজর দেবে না,সে ত ভালো কথা। তাই নয় কি?
– ইসস্... এসব বলতে লজ্জা করে না! এত নাচ দেখার শখ জাগলে, বিয়ে করে এনে সে মাগীর পায়ে ঘুঙুর দিয়ে নাচ দেখ।
কথাটা বলেই নয়ন উঠে দাড়িয়ে বাবু কোলে নিতে গেল। তবে সে কার্যে সফল হবার আগেই সঞ্জয় তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বলল,
– এতোদিন অপেক্ষা আমার সইবে না। তাছাড়া কে জানে, যাকে আনবো সে যদি নাচতে না পারে তখন! তার চেয়ে আমার এই ভালো.বিশ্বাস কর বৌদিমণি। এখন উপায় থাকলে আমি তোমাকেই ঘরে তুলতাম।
নয়নতারার এমন ঘটনার জন্যে তৈরী ছিল না। সে বাবুকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে ভেবেছিল। কিন্তু আশ্চর্য নারীর মন! কথাটা শুনেই কোথা থেকে যেন আশার দীপ্তি জ্বলে উঠল বুকে। কে এক কুহকিনী কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে ভালোবাসা আর সেবা করা নারীর ধর্ম। ঘেন্নাপিত্তি ভুলে, চোখ-কান বুজে তার কাছে নিজেকে সপে দে, এত ওত ভাববার কি আছে।ধন্য আশা কুহকিনী। ধন্য পুরুষের প্রতি নারীর আকর্ষণ!
নয়নতারা তার কামনার এই মায়াজালে নিজেকে হয়তোবা ছেড়েই দিত। তবে তার মাতৃত্বকে কে ঠেকাবে! খাটের ওপড়ে বাবু তখন তার মায়ের কাছে হামাগুড়ি দিয়ে এসে হাজির।আর সেদিকে দৃষ্টি পরতেই নয়নতারা যেন চেতনা ফিরে পেল। সে নিজেকে সঞ্জয় হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে।বাবুকে কোলে তুলে সরে গিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, ঘনঘন নিশ্বাস নিতে লাগলো।
এরপরে আপাতত আর কিছু নেই। আবার ফিরবো পরের পর্বে,তার আগে দেখি এটা চলবে কি না…!!!