11-08-2024, 07:01 AM
পর্ব ১৮
আজকে আবারও, আর একটি নিদ্রাহীন রাত্রি নয়নতারার। তবে কক্ষের ভেতরে বিছানায় বসসে থাকা নয়নতারার মনের অবস্থা আজ একটু ভিন্ন।
রাতে খাবারের পর আজ নয়নতারার পিতা, বৈঠক ঘরে সঞ্জয়ের সাথে আলোচনা করিতেছিল।
আড়ি পেতে কিছু শোনার মত মানসিকতা, নয়নতারার নেই। তাই একে আড়িপাতা বলা বোধকরি ঠিক হচ্ছে না। সে বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে বৈঠক ঘরেই আসছিল। দরজার কাছাকাছি আসতেই স্বামীর নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। এখন তোমরাই বল একে আড়ি পাতা কি করে বলি?
তা সে যাই হোক, বৈঠক ঘরের আলোচনার প্রধান বিষয় বস্তুটি এই যে, তার স্বামীদেবটিকে কি করিয়া এই বাড়িতে ভাইয়ে সাথে মিলেমিশে থাকবার জন্যে রাজি করানো যায়।
এই প্রস্তাবে সঞ্জয় কোন আপত্তি নেই। অবশ্য থাকবার কথায় নয়। আমরা সবাই এই কথা বেশ ভালো ভাবেই জানি যে,নয়নতারাকে পাকাপোক্ত ভাবে এই বাড়ীতে রাখতে পারলে, সঞ্জয়ের থেকে বেশি খুশিআর কেউ হবে না।
তবে পিতা ও দেবরের কথা বার্তা শুনিবার পর, নিজের ঘরে আসিয়া বাড়ির চাবির গোছাটি তার আঁচলে সযত্নে বাধিবার পর,নয়নতারার মুখে হাসির রেখে ফুটে উঠলো।
যদিও নয়নতারা তার বোনটিকে বিশেষ আদরের চোখেই দেখে। কিন্তু তার কি আর অজানা, হেমলতার মত বোকাসোকা মেয়ে এই তলাটে দ্বিতীয় টি নেই বললেই চলে। তাছাড়া বাড়ির বড় বৌয়ের হাতে চাবি থাকবে না তো কার হাতে থাকবে শুনি? সুতরাং নয়নতারাকে সার্থপর ও বলা চলে না।
কিন্তু তার স্বামী কে এ বাড়িতে থাকতে রাজি করানো হবে কি উপায়ে! যাহোক, সে কথা এখন ভাবিয়া কাজ কি তার! যাদের ভাবনা তারা ভাবুক গে।
অবশ্য একথা ভাববার সময় সে পেল না। তার আগেই সঞ্জয়কে তার ঘরের দরজার মুখে দেখে খানিক লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠলো তার। সে আঁচলে বাধা চাবির গোছাটি আঁড়াল করে চোখ ফিরিয়ে নিল অন্য দিকে।
এটি বোঝার পরেও সঞ্জয় কিন্তু সরে গেল না। সঞ্জয় এগিয়ে এসে নয়নতারার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে, নয়নতারার পা ধরতে হাত বাড়িয়ে দিল। এটি দেখে নয়নতারা চমকে গিয়ে পা গুটিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয় বলল,
– ও করছো! পায়ে ধারা হচ্ছে কেন?
সঞ্জয় সে কথায় কান না দিয়ে নয়নতারার ডান পা'টি হাতে নিয়ে দেখল, গোড়ালির কাছটা খানিক লাল হয়ে আছে। রাতের খাবার সময় নয়নতারার অস্বাভাবিক হাঁটা দেখে সঞ্জয়ের যা সন্দেহ হয়েছিল তাই সত্যি|আজ ঘরের কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত নয়নতারার পা মচকেছে। তবে এই সাধারণ ব্য্য্যপারে সে বাড়ির পুরুষদের বিরক্ত করতে অনইচ্ছুক। রাত পোহালেই এর ব্যবস্থা নয়নতারা নিজেই করে নিতে পারে। নয়নতারা জলদি পা টেনে খাটের ওপড়ে উঠিয়ে নিল।
– কি করে হল এমন? বলনি কেন?
– ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না,কাল সকালে দেখে নেব,অনেক রাত হয়েছে এখনো জেগে কেন? রাত জেগে জেগে শেষ শরীর খারাপ করার মতলব করেছো বুঝি?
এতখন নয়নতারার মুখপানে চেয়েছিল। নয়নতারার লাজুক মুখের থেকে চোখ ফেরাতে তার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। তবে কি না,সত্যিই অনেক রাত হয়েছে।
সঞ্জয় মেঝে ছেড়ে ওঠার সময় তার চোখে পড়লো বালিশের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা খাতা ও চিঠির খামের খানিক অংশ। তার মধ্যে কলকাতা লেখাটা তার চোখে পড়ায় তার একটু অবাক লাগলো। তবে এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে কি না, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।
এদিকে পা মচকালে ঠিক কি করা উচিত, এই জ্ঞানও সঞ্জয়ের বিশেষ নেই। নিজের অজ্ঞতায় লজ্জিত হয়ে, সে খানিকক্ষণ নয়নতারা খাটের এক কোণে মাথা নত করে কী সব ভাবতে বসলো।
নয়নতারা এত কাছে থেকেও দুবার ডেকে যখন সারা পেল না, তখন এগিয়ে এসে সঞ্জয়ের কাধে হাত ছোঁয়াতেই সঞ্জয় চমকে উঠলো। নয়নতারা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
– ওমন চমকে উঠলে কেন? কি হয়েছে! শড়ীল খারাপ লাগছে কি?
সঞ্জয় নিজেকে সামলে নিয়ে নয়নতারার হাত তার দুই হাতের মাঝে চেপেধরে বলল,
– কাল তোমায় নিয়ে একটু বেরুব বৌদিমণি,মানা করলে শুনবো না। এখন ঘুমোও কাল বলবো।
সঞ্জয় কথা গুলো এত জলদি বলে বেরিয়ে গেল,যে নয়নতারা উত্তরে কিছু বলার সময় পেল না। পায়ের কারণে জলদি উঠে এগিয়েও যেতে পাড়লো না।
/////
গভীর রাত হওয়া সত্ত্বেও জানালার কাছে মেঝেতে উবু হয়ে হাটুতে চিবুক ঠেকিয়ে হেমলতা বসে আছে।কিছুক্ষণ আগে অবধি সে কাঁদছিল,কিন্ত এখন জনালার বাইরে আকাশের পানে তাকিয়ে সে ঠিক কি দেখছে বোঝা মুশকিল।
আজ সন্ধ্যার কিছু আগে, সে আম বাগানে গিয়েছিল মন্দিরাকে খুঁজতে। মেয়েটি বড্ড ডানপিটে হয়ে উঠছে কি না। তা না হলে এই সন্ধ্যায় বাগানে কে আসে? যেমন মা তেমনি হচ্ছে মেয়েটিও!
মনে মনে মন্দিরাকে বকাঝকা করতে করতে যখন সে বাগানের খানিকটা ভেতরে পা রাখল। তখনি চেনা কয়েকটি গলার আওয়াজে সে থমকে দাড়িয়েছিল।
বাগানের একপাশে একটি বড় গাছের তলায় তিনজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। হেমলতার থেকে কিছুটা দূরেই।তাদের মধ্যে খোঁড়া গোবিন্দ কে দেখেই হেমলতার বুকের ধুকপুকানি উঠে গেছে,সে একটি গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের উদ্বেগ সামাল দিতে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছিল। সেই সময় কিছুদূরের আলোচনা হেমের কানা স্পষ্ট ভাবেই এসে লাগলো।
– এতো ঝামেলা কেন করছিস বলতো? তোকে আগেও বলেছি আমার সাথে চালাকি করলে ভালো হবে না কিন্তু! ভালোই ভালোই আমার পাওনাটা চুকিয়ে না দিলে কি করতে পারি তা তুই ভালো ভাবেই জানিস।
– দেব না তা ত বলিনি। তবে নয়ন যতখন ওখানে আছে আমি ওগুলো দেব না।
– দ্যাখ সোহম! আমার সাথে কোন রকম চালাকি করলে তোর ভাইয়ের সাথে ওই হারামজাদীও....
– আহা, মাথা গরম কর কেন! আর তোকেও বলি সোহম! ওই ছোড়ার সাথে তোর বউয়ের এত মাখামাখিটা কিসের শুনি? কোন খোঁজখবর রাখিস ও বাড়িতে কি হয়!এখনো সময় আছে মাস্টার মশাইকে গিয়ে ধর,দেখবি বাপ চলে এলে মেয়ে এমনি চলে আসবে।
– ও বাড়িতে খোঁজ খবর নেব মানে! নয়নের নামে আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বললে...আঃ...
সোহমের কথা শেষ হবার আগেই রাজেন্দ্রের একটা লাথি খেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো সে। হেমলতা গাছের পেছন থেকে উঁকি মেরে এই দৃশ্য দেখে দুহাতে তার মুখ চেপে ধরলো,একটু মৃদু গোঙানিতেই তার আর্তচিৎকার চাপা পরে গেল।
– হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা! কি করবি তুই...
– আরে-রে কর কি ছাড় ছাড় দেখি
রাজেন্দ্রের আরও কিছু করার ইচ্ছে ছিল বোধকরি,কিন্তু গোবিন্দ তাকে ঢেলে সরিয়ে দিয়ে সোহমকে টেনে তুলতে তুলতে বলল
– শোন সোহম! এই গোবিন্দ লাল, না যেনেশুনে কিছু বলে না। কলকাতায় তোর ভাই আর তোর আদরের নয়ন কি করে বেরিয়েছে সেই খবর আমার কাছে আছে। বিশ্বাস না হলে ঠিকানা দিচ্ছি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখ...
এরপর একে একে সৌদামিনী ও দলিল চুরির ঘটনাও হেমের অজানা রইলো না। তবে সব কথা যে হেম বিশ্বাস করলো তাও নয়।
তবে নয়নতারার সাথে কলকাতায় সঞ্জয়ের একঘরে থাকার ব্যপারটা মেনে নেওয়া কঠিন। একথা তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। অবশ্য সঞ্জয় যদিওবা আগেও নয়নতারার সাথে থেকেছে। তবুও, তখন সঞ্জয়ের কাঁচা বয়স। তাছাড়া তখন আমাদের হেমলতা ঐ ছোড়াকে ভীষণভাবে ভয় করিতো, কিন্তু এখন যে ভালোবাসে।
সুতরাং এখন দ্বিতীয় কোন নারীরা সাথে হেসে কথা বললেও হেমের গাঁ জ্বালা করে। তা হোক না সে নয়নতারাই, তার বৌদিমণি বলে ওত মাখামাখি কিসের শুনি!
তবে কাঁন্নার কারণটি ভিন্ন, দিদির সাথে মাখামাখির থেকেও বড় কথা চুরির ব্যপারখানা! ছোট ভাইয়ে অকল্যাণ ঘটাতে সঞ্জয়ের দাদা এতটা নিচে নামতে পারে? সেই সাথে আবার কলকাতার কোন মেম নাকি সঞ্জয়ের গলায় ঝুলছে!
হেমলতা সাহসী না হলেও বোধকরি এই মুহুর্তে সৌদামিনী সমুখে থাকলে সে ছেড়ে কথা বলতো না। তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে এতো কিসের টানাটানি? বলি কলকাতায় কি পুরুষ মানুষের আকাল পড়লো নাকি! নইলে অত বড় কলকাতায় ওই রাক্ষুসীর চোখ সঞ্জয়ের ওপড়েই কেন পরতে গেল।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হেমলতার দুর্বল মনটি বেশিখন চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না।
//////
সকালে ঘুম ভাঙতে বড্ড দেরি হলো সঞ্জয়ের। আড়মোড়া ভেঙে সে যখন দোতলার বারান্দায়। তখন সূর্যদেব তালতলার শন্তুর দোকানের পাশে দাঁড়ানো সর্বোচ্চ লম্বা তালগাছটির মাথার ওপরে।
এতখনে নয়নতারার রান্নাঘরের কাজ শেষ।সে এখন নিচে বারান্দায় কয়েটি মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে। একটু অবাকই লাগলো তার। উঠতে দেরি হলে নয়নতারা বা দেবূ তার ঘুম ভাঙায়,কিন্তু আজ এমনটা কেন হল বুঝতে পারলো না।
সে নিচে নেমে দেখলো নয়নতারার সাথে বারান্দায় তিনটি মেয়ে কথা বলছে। সঞ্জয় কে দেখা মাত্র তাদের কথা থেমে গেল। অবশ্য মেয়েলি কথাবার্তা শুনে সঞ্জয়ের বিশেষ লাভের কিছু ছিল না। তার চোখ গেল নয়নতারার পায়ের দিকে।
তার ভাবনা ছিল আজ সকালে নয়নতারাকে নিয়ে মন্দির দেখিয়ে আনবে,কিন্তু নয়নতারার হাটতে এখন অসুবিধা হচ্ছে দেখে ইচ্ছেটা বাদ দিতে হল।
জলখাবারের পর্ব শেষ হবার পরে সঞ্জয় খানিকটা বিরক্ত মনেই বাড়ির ছাদে উঠে পায়চারী করছিল।হঠাৎ নয়নতারা দেবুকে ডাকছে শুনে সঞ্জয় নিচে নেমে এল,এবং দেবুকে যেতে বলে সে নিজেই ঢুকলো নয়নতারার কক্ষে।
কক্ষের ভেতরে নয়নতারা বাবুকে বিছানায় শুইয়ে তার মুখের ওপড়ে ঝুঁকে পরে "মা" "মা" বলে কথা বলানোর চেষ্টা করছে, আর বাবু শুধু হাত-পা ছুড়ে হাসছে। এই দৃশ্য দেখে সঞ্জয় দরজার কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
বাবুর বয়স ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দাঁত ওঠা বা কথা বলার কোন সম্ভাবনাই তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। তাই বলে নয়নতারার চেষ্টার শেষ নেই। সে সুযোগ পেলেই বাবুকে কথা বলানোর চেষ্টা করছ। নিজের পায়ের ব্যথা কথাও খুব সম্ভব তার মনে নেই এখন। আর কিছুক্ষণ মা ও শিশুর হাসাহাসি দেখে সঞ্জয় একটু গলা ঝেড়ে তার অস্তিত্ব জানান দিল। নয়নতারার তার দিকে তাকাতেই সে জিগ্যেস করলো,
– দেবুকে ডাকছিলে কেন বৌদিমণি?
নয়নতারা বালিশের তলা থেকে একটা খাম বন্ধ চিঠি বের করে,সেটি সঞ্জয়ের দিকে বায়িরে দিয়ে বলল,
– চিঠিটা ডাকে পাঠাবো তাই ডেকেছিলাম,গেল কোথায় ছেলেটা?
সঞ্জয় এগিয়ে এসে নয়নতারার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো। তার চমক লাগা মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নতারার বলল,
– কি হল? ওমন চমকে উঠলে যে!
– ও কিছু না,দেবুকে বলতে হবে না আমি নিজেই ডাকে পাঠিয়ে দেব না হয়।
বলতে বলতে সঞ্জয় চিঠিটা তার পকেটে ঢুকিয়ে নয়নতারার সমুখে বসলো। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিল সে,নয়নতারার শিশুপুত্রটির অবশ্য কারো কোলে উঠতেই আপত্তি নেই। তবে কিনা বাবুকে কোলে নিতেই সে ক্ষুদ্র হাতে সঞ্জয়ের কানে ধরে টানতে লাগলো।এতে সঞ্জয় ভারি বিরক্ত হলেও নয়নতারা নিজের হাসি সামলাতে পারলো না। বেশিক্ষণ বাবুকে সে কোলে রাখতে পারলো না। নয়নতারা হাত বারিয়ে বাবুকে তার কোলে টেনে নিল। মায়ের কোলে গিয়ে বাবু কানের মায়া ছেড়ে নয়নতারার গলার হার নিয়ে খেলতে লাগলো।মা ও শিশুর উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে সঞ্জয়ের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বাবুর কপালে একটি চুমু খেয়ে নয়নতারা সঞ্জয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
– মেয়েটার কথা মনে পরছে বার বার। জানো,গতরাতে স্বপ্ন দেখলাম মা মা বলে ডাকছে। শেষ রাতে আর ঘুম হলো না,ওবেলা একটি বার দেখে আসবে মেয়েটাকে?
সঞ্জয় নয়নতারার মুখপানে চেয়ে ভাবতে লাগলো কি বলবে।সত্য বলতে যতবার মন্দিরার সাথে দেখা হয়েছে,মন্দিরা কিন্তু মায়ের কথা একবারও জিগ্যেস করে নি। বরং মায়ের থেকে মুখরোচক খাবারের দিকে মন্দিরার টান বেশি। অবশ্য এর জন্যে নয়নতারা নিজেই বেশ খানিকটা দায়ী।
সঞ্জয়ের এখন মনে আছে নয়নতারার প্রথম আঁতুড় ঘরে ঢোকা থেকে মন্দিরার জন্ম পর্যন্ত, সে অনেকবার লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল।
মাঝে মাঝে দেখার সুযোগ হলেও সবসময় হতো না। সেদিন হেমলতা ধারেকাছে থাকতো না, সেদিন ওপাড়ের ভোলার ঠাকুরমাকে এক খিলি পান খাওয়ালেই জানলা দিয়ে নয়নতারার মুখ দেখা সম্ভব হোত। আর নয়তো মশার কামোড় খেয়ে আম বাগানে সময় কাটিয়ে ফিরতে হতো।
একদিন রাতের কথা,সেদিন আম বাগানে জ্যোৎস্না পড়ছিল। নদীর জলে ভিজে আম বাগানের ঠান্ডা হাওয়াতে দাঁতে দাঁত লাগা অবস্থায় সঞ্জয় নয়নতারার বাড়িতে গিয়েছিল।
রাত আন্দাজ আট'টার বেশি নয়। অশান্ত আবহাওয়াতে বাঁশ ও আম বনে হাওয়া লেগে শির্শির শব্দ তুলছে,দূরে আঁতুড় ঘরের সামনে আলো জ্বলছে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলে সঞ্জয়ের দাদা বাইরে বারান্দায় বসে ঘন ঘন সিগারেট টানছে,ঘরের ভেতরে কথাবার্তা অস্পষ্ট। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দুইবার ডাকার পড়েও সারা পেল না, সেদিন তার বাড়ি ফেরা হয়নি,জানলার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কতখন কাটলো কে জানে,তখন হঠাৎ গোলমাল শুনে সঞ্জয় অস্থির হয়ে উঠেছিল।
আঁতুড় ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই কেমন গলার আওয়াজ বারবার তার বুকের ধুকপুকানি বারিয়ে দিচ্ছিল।গলার আওয়াজটি যে নয়নতারার তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার।
কিন্তু তার কিছুই করারছিল না। এক অজানা ভয়ের মাঝে সময় যে কি করে পার হয়েছিল তা সে আজও জানে না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছিল হয়তো। তারপর শেষ রাতের দিকে হঠাৎ যেন কোথা থেকে বিড়াল ছানার ডাকে তার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর চারদিকের অন্ধকার কাটিয়ে দিতে ধিরে ধিরে গগনে সূর্যদেব দেখা দিলেন, সেই সাথে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আম বাগানের গাছে থাকা শত শত বাসিন্দাদের একসাথে কিচিরমিচির ডাক।
ভোরের আলো ফুটতেই সঞ্জয় ফিরবে কিনা ভাবছিল,তখনি জানালা খুলে দিতেই ভেতরে উঁকি মেরে দেখলো ঘুমন্ত নয়নতারার পাশে হেমলতা বসে আছে। তার কোলে একটি টুকটুকে অসম্ভব রকমের ছোট্ট জীব কাঁথার মধ্যে,সেটিও ঘুমন্ত। খানিকক্ষণ পড়েই জীবটা চোখ মেলে মিট্মিট্ করে তার অসম্ভব রকমের ছোট্ট হাত দুটি নাড়তে নাড়তে নিতান্ত দুর্বলভাবে অতি ক্ষীণ সুরে কেঁদে উঠছিল,সেই ছিল মন্দিরাকে প্রথম দেখা। তারপর থেকে মন্দিরাকে নয়নতারার থেকে হেমের কাছেই বেশি দেখা গেছে। তাই মন্দিরা বড় হয়ে যদি মাসির অনুগত হয়, তাতে আর দোষ কি! অবশ্য বাবুর জন্মের খবর সে দোকানে বসে শুনেছিল,তারপর দেখতে গিয়ে কেলেঙ্কারি কান্ড.….ভাবনার মাঝে নয়নতারা সঞ্জয়ের গালে হাত দিয়ে বলল,
– কি ভাবছো এত?
সঞ্জয় নয়নতারা হাত ধরে একটু হেসে বলল,
- কিছু হয়নি,আমি চিঠিটা ডাকে দিয়ে ওদিকটা ঘুরে মন্দিরাকে দেখে আসবো, তারপর বিকেলে বেরুব তোমায় নিয়ে।
এই বলে সঞ্জয় উঠে দাঁড়ালো। সঞ্জয় বেরিয়ে গেলে নয়নতারা তার পেছন পেছন এগিয়ে এসে, বাড়ির বাইরে রাস্তার সমুখে বাবুকে কোলে নিয়ে পথের পানে চেয়ে রইলো।
সঞ্জয় চোখের আড়াল হতেই নয়নতারা নিজের ঘরে এসে বাবুকে বিছানায় নামিয়ে দিল।
তারপর মাথার আঁচল কাঁধে ফেলে আয়নার সামনে এসে নিজেকে দেখতে লাগলো সে। ডান হাতে খোঁপা করা চুলগুলোকে মুক্ত করে,কাঁধের ডান পাশদিয়ে নিয়ে এল সামনে।
সংসারের বিভিন্ন দায়িত্বের মাঝে নিজেকে এমন ভাবে খুব কমই দেখেছে সে। দিনে সাংসারিক কাজ-কর্ম ও রাতে স্বামী সোহাগে তার দিন মন্দ না কাটলেও,বড্ড একঘেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে। এখন হঠাৎ আসা এই পরিবর্তনটি ধীরে ধীরে কেমন যেন করে দিচ্ছে তাকে। বলতে বাধা নে সোহম নয়নকে ভালোবাসলেও,সে প্রেমিক পুরুষ নয়। তার ওপড়ে মন্দিরা হবার পর থেকে সোহম হঠাৎ জুয়া ও নেশায় আসক্ত হওয়াতে, স্বামীর ভালোবাসা শুধুমাত্র রাতের অন্ধকারে খাটের মধ্যেই সীমিত ছিল। অবশ্য এতে তার বিশেষ আপত্তি ছিল না। সংসারের কাজকর্ম, পাড়ার মেয়েদের আসরে সময় কাটতো তার। তাই বলি স্বামী অবহেলা আর স্বামী ঘরজামাই বলে পাড়ার মেয়েদের আসরের খোঁচা, তার মনে যে কাটার বিধিত এও সত্য। তবে সেই কাটার আঘাত মাঝেমধ্যে সঞ্জয়ের ও বাড়িতে লুকিয়ে আসা যাওয়া পুসিয়ে দিত। তবে সঞ্জয়ের ব্যপারে ইদানিং যত ভাবনা তার মনে আসছে,কিছুদিন আগে অবধি এতটা সে ভাবে নাই। নিজের অজান্তেই তার মাঝে যে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটছে তা বুঝতে পেরে নয়নতারার একবার শিওরে উঠলো। ভাবনার মাঝে হঠাৎ খেয়াল করলো আনমনা মনে কাঁধের আঁচলটি খসে পড়েছে, তার বুক ও গলার মাঝামাঝি খেলা করছে তার নিজেই একটি হাত। ধিরে ধিরে সেই নিচে নেমে আসছে। চোখ বুঝে তার হাতের স্পর্শে এক অন্য অনুভূতি খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে নয়নতারা।
//////
অল্প পথ হলেও নয়নতারার পায়ে অবস্থা ভালো না থাকায় গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে হলো।মন্দির ঠিকঠাক করার পর আজ প্রথম পূজো দেওয়া হয়েছে। পূজোর সময় আসতে না পাড়লেও মন্দির দেখানই ছিল প্রধান উদেশ্য, সুতরাং কোন অসুবিধাই ছিল না।
তালতলার পথ ধরে যেতে যেতে নয়নতারা আরো দুই'একজন মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিল। তারা চেনাজানা, এই গ্রামেরই মেয়ে'বউ আর কি। সঞ্জয় ও নয়নতারার বাবা গাড়ির একটু পেছনেই আলোচনা করতে করতে এগুছিল।
কিছু দূর যেতেই গাছের আঁড়াল থেকে দিঘী ওপাড়ে লাল ইটের মন্দিরটি দেখা গেল। চারদিকে মাঠ,জঙ্গল ও খানিক দূরে দূরে একটা দুটো ঘরবাড়ি। তার মাঝেই তালগাছে ঘেরা বিশাল একটি দীঘির পাশদিয়ে মাটির রাস্তাটি সোজা মন্দিরের পেছনে বাঁ দিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়েছে।
তঘলদীঘির নামেই যে গ্রামের নাম হয়েছিল তালদিঘী এতে কারো মতভেদ নেই। তবে মন্দিরের বিশেষ কোন নামকরণ হয়নি,এমনকি এই মন্দিরটি এতটাই প্রাচীন যে এর প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে অনেকের বিতর্ক রয়েছে। তবে মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংষ্কার করা হলেও মন্দিরের কোন রকম পরিবর্তন করা হয়নি।
রাস্তার দু'পাশে সারি বাধা তালগাছকে পেছনে ফেলে বাঁদিকে ঘুরে গাড়িটি এগিয়ে গিয়ে দিঘির ঘাটের কাছে থামলো। সঞ্জয় গাড়ির কাছাকাছি আসতেই দীঘির ঘাটের কাছে বড়দা,হেমলতা ও মন্দিরাকে দেখা খানিক চমক লাগলো তার। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে।
আসলে নদীর ওপারে নতুন মন্দির হলেও আশেপাশের গ্রামের মানুষের বিশ্বাস তালদিঘীর মন্দির বড় জাগ্রত মন্দির। সুতরাং ওপারে মানুষ মন্দির দেখতে ও পুজো দিতে আসতেই পাড়ে। কিন্তু হেমলতা যখন সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল,তখন হেমলতার চোখের পানে একবার দেখেই গন্ডগোলের আভাস বুঝতে সঞ্জয়ের বেশী সময় লাগলো না।
গাড়ি থেকে নয়নতারাকে নামিয়ে দিয়ে সঞ্জয় তাদের বাইরে রেখেই মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে ওপড়ে উঠতে লাগলো। সঞ্জয় ভালো ভাবেই জানে সে কাছে থাকলে তার দাদা নয়নতারার কাছে আসবে না। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় একবার পেছন ফিরে দেখলো নয়নতারার নিচু হয়ে মন্দিরাকে বুকে টেনে নিয়েছে,আর একটু দূরেই বাকিরা হেমলতাকে নিয়ে মেতেছে।
পূজো শেষ হলেও অনেকেই এখনো মন্দিরে। সঞ্জয় চুপচাপ মন্দিরের ঢোকার মুখে দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনেকখন। তার হাবভাব মোটেও সুবিধের নয়।
আরো খানিক অপেক্ষার পর প্রথমেই মন্দিরার হাত ধরে মন্দিরে ঢুকে এল নয়নতারা,তার পেছনে বাবুকে কোলে করে সঞ্জয়ের বড়দা ও নয়নতারার বাবা। সবশেষে যখন পাড়ার মেয়েদের সাথে হেমলতা মন্দিরের ভেতরে ঢুকলো,ঠিক তখনই সঞ্জয় দরজার পাশ থেকে হেমলতার একটা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে সরে পরলো মন্দিরে বাইরে।
মন্দিরের ডানপাশে খানিকটা এগিয়ে লোকচক্ষুর আঁড়ালে এনে হেমের হাত ছাড়লো সঞ্জয়। খানিক আগেও সঞ্জয়ের ওপড়ে হেমলতার অভিমান ও অভিযোগ দুই ছিলে। কিন্তু এই মুহুর্তে অভিমান কেটে গিয়ে মনে ভয়ের সঞ্চার হওয়ায়,সে ছাড়া পাওয়া মাত্র পালাতে উদ্যত হল। তবে তার পলায়নের পথ আটকে দিল সঞ্জয়।
অতিরিক্ত ভয়ের কারণে হেমলতার ওষ্ঠাধর সহ সর্বাঙ্গে কম্পন শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। তবে ভয়টি সঞ্জয়ের নয়, সে ভয় হেমে কেটেগিয়েছে অনেকটাই। ভয়টির কারণ হেমকে নিয়ে আসার সময় আর কেউ যদি নাও দেখে, তবুও হেমের পাশে থাকা মেয়ে দুটির চোখে এই কান্ড অবশ্যই ধরা পরেছে। এবার এই ঘটনাটি লোকমুখে রটনা হতে হতে নদীর ওপাড়ে অবধি পৌঁছনোর পড় কি কেলেঙ্কারি ঘটবে! তা ভেবেই হেমলতার মূর্জা যাবার অবস্থা।
বেশিকিছু বলার নেই,,গল্পটি চলবে কি না সেই প্রশ্নই রইলো…!!
আজকে আবারও, আর একটি নিদ্রাহীন রাত্রি নয়নতারার। তবে কক্ষের ভেতরে বিছানায় বসসে থাকা নয়নতারার মনের অবস্থা আজ একটু ভিন্ন।
রাতে খাবারের পর আজ নয়নতারার পিতা, বৈঠক ঘরে সঞ্জয়ের সাথে আলোচনা করিতেছিল।
আড়ি পেতে কিছু শোনার মত মানসিকতা, নয়নতারার নেই। তাই একে আড়িপাতা বলা বোধকরি ঠিক হচ্ছে না। সে বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে বৈঠক ঘরেই আসছিল। দরজার কাছাকাছি আসতেই স্বামীর নাম শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। এখন তোমরাই বল একে আড়ি পাতা কি করে বলি?
তা সে যাই হোক, বৈঠক ঘরের আলোচনার প্রধান বিষয় বস্তুটি এই যে, তার স্বামীদেবটিকে কি করিয়া এই বাড়িতে ভাইয়ে সাথে মিলেমিশে থাকবার জন্যে রাজি করানো যায়।
এই প্রস্তাবে সঞ্জয় কোন আপত্তি নেই। অবশ্য থাকবার কথায় নয়। আমরা সবাই এই কথা বেশ ভালো ভাবেই জানি যে,নয়নতারাকে পাকাপোক্ত ভাবে এই বাড়ীতে রাখতে পারলে, সঞ্জয়ের থেকে বেশি খুশিআর কেউ হবে না।
তবে পিতা ও দেবরের কথা বার্তা শুনিবার পর, নিজের ঘরে আসিয়া বাড়ির চাবির গোছাটি তার আঁচলে সযত্নে বাধিবার পর,নয়নতারার মুখে হাসির রেখে ফুটে উঠলো।
যদিও নয়নতারা তার বোনটিকে বিশেষ আদরের চোখেই দেখে। কিন্তু তার কি আর অজানা, হেমলতার মত বোকাসোকা মেয়ে এই তলাটে দ্বিতীয় টি নেই বললেই চলে। তাছাড়া বাড়ির বড় বৌয়ের হাতে চাবি থাকবে না তো কার হাতে থাকবে শুনি? সুতরাং নয়নতারাকে সার্থপর ও বলা চলে না।
কিন্তু তার স্বামী কে এ বাড়িতে থাকতে রাজি করানো হবে কি উপায়ে! যাহোক, সে কথা এখন ভাবিয়া কাজ কি তার! যাদের ভাবনা তারা ভাবুক গে।
অবশ্য একথা ভাববার সময় সে পেল না। তার আগেই সঞ্জয়কে তার ঘরের দরজার মুখে দেখে খানিক লজ্জায় মুখ রাঙা হয়ে উঠলো তার। সে আঁচলে বাধা চাবির গোছাটি আঁড়াল করে চোখ ফিরিয়ে নিল অন্য দিকে।
এটি বোঝার পরেও সঞ্জয় কিন্তু সরে গেল না। সঞ্জয় এগিয়ে এসে নয়নতারার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে, নয়নতারার পা ধরতে হাত বাড়িয়ে দিল। এটি দেখে নয়নতারা চমকে গিয়ে পা গুটিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয় বলল,
– ও করছো! পায়ে ধারা হচ্ছে কেন?
সঞ্জয় সে কথায় কান না দিয়ে নয়নতারার ডান পা'টি হাতে নিয়ে দেখল, গোড়ালির কাছটা খানিক লাল হয়ে আছে। রাতের খাবার সময় নয়নতারার অস্বাভাবিক হাঁটা দেখে সঞ্জয়ের যা সন্দেহ হয়েছিল তাই সত্যি|আজ ঘরের কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতা বশত নয়নতারার পা মচকেছে। তবে এই সাধারণ ব্য্য্যপারে সে বাড়ির পুরুষদের বিরক্ত করতে অনইচ্ছুক। রাত পোহালেই এর ব্যবস্থা নয়নতারা নিজেই করে নিতে পারে। নয়নতারা জলদি পা টেনে খাটের ওপড়ে উঠিয়ে নিল।
– কি করে হল এমন? বলনি কেন?
– ও নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না,কাল সকালে দেখে নেব,অনেক রাত হয়েছে এখনো জেগে কেন? রাত জেগে জেগে শেষ শরীর খারাপ করার মতলব করেছো বুঝি?
এতখন নয়নতারার মুখপানে চেয়েছিল। নয়নতারার লাজুক মুখের থেকে চোখ ফেরাতে তার মোটেও ইচ্ছে ছিল না। তবে কি না,সত্যিই অনেক রাত হয়েছে।
সঞ্জয় মেঝে ছেড়ে ওঠার সময় তার চোখে পড়লো বালিশের নিচ থেকে বেরিয়ে থাকা খাতা ও চিঠির খামের খানিক অংশ। তার মধ্যে কলকাতা লেখাটা তার চোখে পড়ায় তার একটু অবাক লাগলো। তবে এই বিষয়ে কথা বলা ঠিক হবে কি না, তা ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না।
এদিকে পা মচকালে ঠিক কি করা উচিত, এই জ্ঞানও সঞ্জয়ের বিশেষ নেই। নিজের অজ্ঞতায় লজ্জিত হয়ে, সে খানিকক্ষণ নয়নতারা খাটের এক কোণে মাথা নত করে কী সব ভাবতে বসলো।
নয়নতারা এত কাছে থেকেও দুবার ডেকে যখন সারা পেল না, তখন এগিয়ে এসে সঞ্জয়ের কাধে হাত ছোঁয়াতেই সঞ্জয় চমকে উঠলো। নয়নতারা উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
– ওমন চমকে উঠলে কেন? কি হয়েছে! শড়ীল খারাপ লাগছে কি?
সঞ্জয় নিজেকে সামলে নিয়ে নয়নতারার হাত তার দুই হাতের মাঝে চেপেধরে বলল,
– কাল তোমায় নিয়ে একটু বেরুব বৌদিমণি,মানা করলে শুনবো না। এখন ঘুমোও কাল বলবো।
সঞ্জয় কথা গুলো এত জলদি বলে বেরিয়ে গেল,যে নয়নতারা উত্তরে কিছু বলার সময় পেল না। পায়ের কারণে জলদি উঠে এগিয়েও যেতে পাড়লো না।
/////
গভীর রাত হওয়া সত্ত্বেও জানালার কাছে মেঝেতে উবু হয়ে হাটুতে চিবুক ঠেকিয়ে হেমলতা বসে আছে।কিছুক্ষণ আগে অবধি সে কাঁদছিল,কিন্ত এখন জনালার বাইরে আকাশের পানে তাকিয়ে সে ঠিক কি দেখছে বোঝা মুশকিল।
আজ সন্ধ্যার কিছু আগে, সে আম বাগানে গিয়েছিল মন্দিরাকে খুঁজতে। মেয়েটি বড্ড ডানপিটে হয়ে উঠছে কি না। তা না হলে এই সন্ধ্যায় বাগানে কে আসে? যেমন মা তেমনি হচ্ছে মেয়েটিও!
মনে মনে মন্দিরাকে বকাঝকা করতে করতে যখন সে বাগানের খানিকটা ভেতরে পা রাখল। তখনি চেনা কয়েকটি গলার আওয়াজে সে থমকে দাড়িয়েছিল।
বাগানের একপাশে একটি বড় গাছের তলায় তিনজন দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। হেমলতার থেকে কিছুটা দূরেই।তাদের মধ্যে খোঁড়া গোবিন্দ কে দেখেই হেমলতার বুকের ধুকপুকানি উঠে গেছে,সে একটি গাছের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে নিজের উদ্বেগ সামাল দিতে ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছিল। সেই সময় কিছুদূরের আলোচনা হেমের কানা স্পষ্ট ভাবেই এসে লাগলো।
– এতো ঝামেলা কেন করছিস বলতো? তোকে আগেও বলেছি আমার সাথে চালাকি করলে ভালো হবে না কিন্তু! ভালোই ভালোই আমার পাওনাটা চুকিয়ে না দিলে কি করতে পারি তা তুই ভালো ভাবেই জানিস।
– দেব না তা ত বলিনি। তবে নয়ন যতখন ওখানে আছে আমি ওগুলো দেব না।
– দ্যাখ সোহম! আমার সাথে কোন রকম চালাকি করলে তোর ভাইয়ের সাথে ওই হারামজাদীও....
– আহা, মাথা গরম কর কেন! আর তোকেও বলি সোহম! ওই ছোড়ার সাথে তোর বউয়ের এত মাখামাখিটা কিসের শুনি? কোন খোঁজখবর রাখিস ও বাড়িতে কি হয়!এখনো সময় আছে মাস্টার মশাইকে গিয়ে ধর,দেখবি বাপ চলে এলে মেয়ে এমনি চলে আসবে।
– ও বাড়িতে খোঁজ খবর নেব মানে! নয়নের নামে আর একটা উল্টোপাল্টা কথা বললে...আঃ...
সোহমের কথা শেষ হবার আগেই রাজেন্দ্রের একটা লাথি খেয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়লো সে। হেমলতা গাছের পেছন থেকে উঁকি মেরে এই দৃশ্য দেখে দুহাতে তার মুখ চেপে ধরলো,একটু মৃদু গোঙানিতেই তার আর্তচিৎকার চাপা পরে গেল।
– হারামজাদা শুয়োরের বাচ্চা! কি করবি তুই...
– আরে-রে কর কি ছাড় ছাড় দেখি
রাজেন্দ্রের আরও কিছু করার ইচ্ছে ছিল বোধকরি,কিন্তু গোবিন্দ তাকে ঢেলে সরিয়ে দিয়ে সোহমকে টেনে তুলতে তুলতে বলল
– শোন সোহম! এই গোবিন্দ লাল, না যেনেশুনে কিছু বলে না। কলকাতায় তোর ভাই আর তোর আদরের নয়ন কি করে বেরিয়েছে সেই খবর আমার কাছে আছে। বিশ্বাস না হলে ঠিকানা দিচ্ছি নিজে খোঁজ নিয়ে দেখ...
এরপর একে একে সৌদামিনী ও দলিল চুরির ঘটনাও হেমের অজানা রইলো না। তবে সব কথা যে হেম বিশ্বাস করলো তাও নয়।
তবে নয়নতারার সাথে কলকাতায় সঞ্জয়ের একঘরে থাকার ব্যপারটা মেনে নেওয়া কঠিন। একথা তার বিশ্বাস হতে চাইছে না। অবশ্য সঞ্জয় যদিওবা আগেও নয়নতারার সাথে থেকেছে। তবুও, তখন সঞ্জয়ের কাঁচা বয়স। তাছাড়া তখন আমাদের হেমলতা ঐ ছোড়াকে ভীষণভাবে ভয় করিতো, কিন্তু এখন যে ভালোবাসে।
সুতরাং এখন দ্বিতীয় কোন নারীরা সাথে হেসে কথা বললেও হেমের গাঁ জ্বালা করে। তা হোক না সে নয়নতারাই, তার বৌদিমণি বলে ওত মাখামাখি কিসের শুনি!
তবে কাঁন্নার কারণটি ভিন্ন, দিদির সাথে মাখামাখির থেকেও বড় কথা চুরির ব্যপারখানা! ছোট ভাইয়ে অকল্যাণ ঘটাতে সঞ্জয়ের দাদা এতটা নিচে নামতে পারে? সেই সাথে আবার কলকাতার কোন মেম নাকি সঞ্জয়ের গলায় ঝুলছে!
হেমলতা সাহসী না হলেও বোধকরি এই মুহুর্তে সৌদামিনী সমুখে থাকলে সে ছেড়ে কথা বলতো না। তার ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে এতো কিসের টানাটানি? বলি কলকাতায় কি পুরুষ মানুষের আকাল পড়লো নাকি! নইলে অত বড় কলকাতায় ওই রাক্ষুসীর চোখ সঞ্জয়ের ওপড়েই কেন পরতে গেল।
এইসব ভাবতে ভাবতেই হেমলতার দুর্বল মনটি বেশিখন চোখের জল ধরে রাখতে পারলো না।
//////
সকালে ঘুম ভাঙতে বড্ড দেরি হলো সঞ্জয়ের। আড়মোড়া ভেঙে সে যখন দোতলার বারান্দায়। তখন সূর্যদেব তালতলার শন্তুর দোকানের পাশে দাঁড়ানো সর্বোচ্চ লম্বা তালগাছটির মাথার ওপরে।
এতখনে নয়নতারার রান্নাঘরের কাজ শেষ।সে এখন নিচে বারান্দায় কয়েটি মেয়ের সাথে বসে কথা বলছে। একটু অবাকই লাগলো তার। উঠতে দেরি হলে নয়নতারা বা দেবূ তার ঘুম ভাঙায়,কিন্তু আজ এমনটা কেন হল বুঝতে পারলো না।
সে নিচে নেমে দেখলো নয়নতারার সাথে বারান্দায় তিনটি মেয়ে কথা বলছে। সঞ্জয় কে দেখা মাত্র তাদের কথা থেমে গেল। অবশ্য মেয়েলি কথাবার্তা শুনে সঞ্জয়ের বিশেষ লাভের কিছু ছিল না। তার চোখ গেল নয়নতারার পায়ের দিকে।
তার ভাবনা ছিল আজ সকালে নয়নতারাকে নিয়ে মন্দির দেখিয়ে আনবে,কিন্তু নয়নতারার হাটতে এখন অসুবিধা হচ্ছে দেখে ইচ্ছেটা বাদ দিতে হল।
জলখাবারের পর্ব শেষ হবার পরে সঞ্জয় খানিকটা বিরক্ত মনেই বাড়ির ছাদে উঠে পায়চারী করছিল।হঠাৎ নয়নতারা দেবুকে ডাকছে শুনে সঞ্জয় নিচে নেমে এল,এবং দেবুকে যেতে বলে সে নিজেই ঢুকলো নয়নতারার কক্ষে।
কক্ষের ভেতরে নয়নতারা বাবুকে বিছানায় শুইয়ে তার মুখের ওপড়ে ঝুঁকে পরে "মা" "মা" বলে কথা বলানোর চেষ্টা করছে, আর বাবু শুধু হাত-পা ছুড়ে হাসছে। এই দৃশ্য দেখে সঞ্জয় দরজার কাঁধ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো।
বাবুর বয়স ছয়মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো দাঁত ওঠা বা কথা বলার কোন সম্ভাবনাই তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। তাই বলে নয়নতারার চেষ্টার শেষ নেই। সে সুযোগ পেলেই বাবুকে কথা বলানোর চেষ্টা করছ। নিজের পায়ের ব্যথা কথাও খুব সম্ভব তার মনে নেই এখন। আর কিছুক্ষণ মা ও শিশুর হাসাহাসি দেখে সঞ্জয় একটু গলা ঝেড়ে তার অস্তিত্ব জানান দিল। নয়নতারার তার দিকে তাকাতেই সে জিগ্যেস করলো,
– দেবুকে ডাকছিলে কেন বৌদিমণি?
নয়নতারা বালিশের তলা থেকে একটা খাম বন্ধ চিঠি বের করে,সেটি সঞ্জয়ের দিকে বায়িরে দিয়ে বলল,
– চিঠিটা ডাকে পাঠাবো তাই ডেকেছিলাম,গেল কোথায় ছেলেটা?
সঞ্জয় এগিয়ে এসে নয়নতারার পাশে দাঁড়িয়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে চমকে উঠলো। তার চমক লাগা মুখের দিকে তাকিয়ে নয়নতারার বলল,
– কি হল? ওমন চমকে উঠলে যে!
– ও কিছু না,দেবুকে বলতে হবে না আমি নিজেই ডাকে পাঠিয়ে দেব না হয়।
বলতে বলতে সঞ্জয় চিঠিটা তার পকেটে ঢুকিয়ে নয়নতারার সমুখে বসলো। দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বাবুকে কোলে তুলে নিল সে,নয়নতারার শিশুপুত্রটির অবশ্য কারো কোলে উঠতেই আপত্তি নেই। তবে কিনা বাবুকে কোলে নিতেই সে ক্ষুদ্র হাতে সঞ্জয়ের কানে ধরে টানতে লাগলো।এতে সঞ্জয় ভারি বিরক্ত হলেও নয়নতারা নিজের হাসি সামলাতে পারলো না। বেশিক্ষণ বাবুকে সে কোলে রাখতে পারলো না। নয়নতারা হাত বারিয়ে বাবুকে তার কোলে টেনে নিল। মায়ের কোলে গিয়ে বাবু কানের মায়া ছেড়ে নয়নতারার গলার হার নিয়ে খেলতে লাগলো।মা ও শিশুর উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে সঞ্জয়ের ঠোঁটের কোণেও হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বাবুর কপালে একটি চুমু খেয়ে নয়নতারা সঞ্জয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,
– মেয়েটার কথা মনে পরছে বার বার। জানো,গতরাতে স্বপ্ন দেখলাম মা মা বলে ডাকছে। শেষ রাতে আর ঘুম হলো না,ওবেলা একটি বার দেখে আসবে মেয়েটাকে?
সঞ্জয় নয়নতারার মুখপানে চেয়ে ভাবতে লাগলো কি বলবে।সত্য বলতে যতবার মন্দিরার সাথে দেখা হয়েছে,মন্দিরা কিন্তু মায়ের কথা একবারও জিগ্যেস করে নি। বরং মায়ের থেকে মুখরোচক খাবারের দিকে মন্দিরার টান বেশি। অবশ্য এর জন্যে নয়নতারা নিজেই বেশ খানিকটা দায়ী।
সঞ্জয়ের এখন মনে আছে নয়নতারার প্রথম আঁতুড় ঘরে ঢোকা থেকে মন্দিরার জন্ম পর্যন্ত, সে অনেকবার লুকিয়ে দেখতে গিয়েছিল।
মাঝে মাঝে দেখার সুযোগ হলেও সবসময় হতো না। সেদিন হেমলতা ধারেকাছে থাকতো না, সেদিন ওপাড়ের ভোলার ঠাকুরমাকে এক খিলি পান খাওয়ালেই জানলা দিয়ে নয়নতারার মুখ দেখা সম্ভব হোত। আর নয়তো মশার কামোড় খেয়ে আম বাগানে সময় কাটিয়ে ফিরতে হতো।
একদিন রাতের কথা,সেদিন আম বাগানে জ্যোৎস্না পড়ছিল। নদীর জলে ভিজে আম বাগানের ঠান্ডা হাওয়াতে দাঁতে দাঁত লাগা অবস্থায় সঞ্জয় নয়নতারার বাড়িতে গিয়েছিল।
রাত আন্দাজ আট'টার বেশি নয়। অশান্ত আবহাওয়াতে বাঁশ ও আম বনে হাওয়া লেগে শির্শির শব্দ তুলছে,দূরে আঁতুড় ঘরের সামনে আলো জ্বলছে। কাছাকাছি আসতেই দেখা গেলে সঞ্জয়ের দাদা বাইরে বারান্দায় বসে ঘন ঘন সিগারেট টানছে,ঘরের ভেতরে কথাবার্তা অস্পষ্ট। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দুইবার ডাকার পড়েও সারা পেল না, সেদিন তার বাড়ি ফেরা হয়নি,জানলার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল।
কতখন কাটলো কে জানে,তখন হঠাৎ গোলমাল শুনে সঞ্জয় অস্থির হয়ে উঠেছিল।
আঁতুড় ঘরের ভিতর থেকে মাঝে মাঝেই কেমন গলার আওয়াজ বারবার তার বুকের ধুকপুকানি বারিয়ে দিচ্ছিল।গলার আওয়াজটি যে নয়নতারার তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার।
কিন্তু তার কিছুই করারছিল না। এক অজানা ভয়ের মাঝে সময় যে কি করে পার হয়েছিল তা সে আজও জানে না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে গেছিল হয়তো। তারপর শেষ রাতের দিকে হঠাৎ যেন কোথা থেকে বিড়াল ছানার ডাকে তার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর চারদিকের অন্ধকার কাটিয়ে দিতে ধিরে ধিরে গগনে সূর্যদেব দেখা দিলেন, সেই সাথে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে আম বাগানের গাছে থাকা শত শত বাসিন্দাদের একসাথে কিচিরমিচির ডাক।
ভোরের আলো ফুটতেই সঞ্জয় ফিরবে কিনা ভাবছিল,তখনি জানালা খুলে দিতেই ভেতরে উঁকি মেরে দেখলো ঘুমন্ত নয়নতারার পাশে হেমলতা বসে আছে। তার কোলে একটি টুকটুকে অসম্ভব রকমের ছোট্ট জীব কাঁথার মধ্যে,সেটিও ঘুমন্ত। খানিকক্ষণ পড়েই জীবটা চোখ মেলে মিট্মিট্ করে তার অসম্ভব রকমের ছোট্ট হাত দুটি নাড়তে নাড়তে নিতান্ত দুর্বলভাবে অতি ক্ষীণ সুরে কেঁদে উঠছিল,সেই ছিল মন্দিরাকে প্রথম দেখা। তারপর থেকে মন্দিরাকে নয়নতারার থেকে হেমের কাছেই বেশি দেখা গেছে। তাই মন্দিরা বড় হয়ে যদি মাসির অনুগত হয়, তাতে আর দোষ কি! অবশ্য বাবুর জন্মের খবর সে দোকানে বসে শুনেছিল,তারপর দেখতে গিয়ে কেলেঙ্কারি কান্ড.….ভাবনার মাঝে নয়নতারা সঞ্জয়ের গালে হাত দিয়ে বলল,
– কি ভাবছো এত?
সঞ্জয় নয়নতারা হাত ধরে একটু হেসে বলল,
- কিছু হয়নি,আমি চিঠিটা ডাকে দিয়ে ওদিকটা ঘুরে মন্দিরাকে দেখে আসবো, তারপর বিকেলে বেরুব তোমায় নিয়ে।
এই বলে সঞ্জয় উঠে দাঁড়ালো। সঞ্জয় বেরিয়ে গেলে নয়নতারা তার পেছন পেছন এগিয়ে এসে, বাড়ির বাইরে রাস্তার সমুখে বাবুকে কোলে নিয়ে পথের পানে চেয়ে রইলো।
সঞ্জয় চোখের আড়াল হতেই নয়নতারা নিজের ঘরে এসে বাবুকে বিছানায় নামিয়ে দিল।
তারপর মাথার আঁচল কাঁধে ফেলে আয়নার সামনে এসে নিজেকে দেখতে লাগলো সে। ডান হাতে খোঁপা করা চুলগুলোকে মুক্ত করে,কাঁধের ডান পাশদিয়ে নিয়ে এল সামনে।
সংসারের বিভিন্ন দায়িত্বের মাঝে নিজেকে এমন ভাবে খুব কমই দেখেছে সে। দিনে সাংসারিক কাজ-কর্ম ও রাতে স্বামী সোহাগে তার দিন মন্দ না কাটলেও,বড্ড একঘেয়ে জীবন কাটাতে হয়েছে তাকে। এখন হঠাৎ আসা এই পরিবর্তনটি ধীরে ধীরে কেমন যেন করে দিচ্ছে তাকে। বলতে বাধা নে সোহম নয়নকে ভালোবাসলেও,সে প্রেমিক পুরুষ নয়। তার ওপড়ে মন্দিরা হবার পর থেকে সোহম হঠাৎ জুয়া ও নেশায় আসক্ত হওয়াতে, স্বামীর ভালোবাসা শুধুমাত্র রাতের অন্ধকারে খাটের মধ্যেই সীমিত ছিল। অবশ্য এতে তার বিশেষ আপত্তি ছিল না। সংসারের কাজকর্ম, পাড়ার মেয়েদের আসরে সময় কাটতো তার। তাই বলি স্বামী অবহেলা আর স্বামী ঘরজামাই বলে পাড়ার মেয়েদের আসরের খোঁচা, তার মনে যে কাটার বিধিত এও সত্য। তবে সেই কাটার আঘাত মাঝেমধ্যে সঞ্জয়ের ও বাড়িতে লুকিয়ে আসা যাওয়া পুসিয়ে দিত। তবে সঞ্জয়ের ব্যপারে ইদানিং যত ভাবনা তার মনে আসছে,কিছুদিন আগে অবধি এতটা সে ভাবে নাই। নিজের অজান্তেই তার মাঝে যে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটছে তা বুঝতে পেরে নয়নতারার একবার শিওরে উঠলো। ভাবনার মাঝে হঠাৎ খেয়াল করলো আনমনা মনে কাঁধের আঁচলটি খসে পড়েছে, তার বুক ও গলার মাঝামাঝি খেলা করছে তার নিজেই একটি হাত। ধিরে ধিরে সেই নিচে নেমে আসছে। চোখ বুঝে তার হাতের স্পর্শে এক অন্য অনুভূতি খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে নয়নতারা।
//////
অল্প পথ হলেও নয়নতারার পায়ে অবস্থা ভালো না থাকায় গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে হলো।মন্দির ঠিকঠাক করার পর আজ প্রথম পূজো দেওয়া হয়েছে। পূজোর সময় আসতে না পাড়লেও মন্দির দেখানই ছিল প্রধান উদেশ্য, সুতরাং কোন অসুবিধাই ছিল না।
তালতলার পথ ধরে যেতে যেতে নয়নতারা আরো দুই'একজন মেয়েকে গাড়িতে তুলে নিল। তারা চেনাজানা, এই গ্রামেরই মেয়ে'বউ আর কি। সঞ্জয় ও নয়নতারার বাবা গাড়ির একটু পেছনেই আলোচনা করতে করতে এগুছিল।
কিছু দূর যেতেই গাছের আঁড়াল থেকে দিঘী ওপাড়ে লাল ইটের মন্দিরটি দেখা গেল। চারদিকে মাঠ,জঙ্গল ও খানিক দূরে দূরে একটা দুটো ঘরবাড়ি। তার মাঝেই তালগাছে ঘেরা বিশাল একটি দীঘির পাশদিয়ে মাটির রাস্তাটি সোজা মন্দিরের পেছনে বাঁ দিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়েছে।
তঘলদীঘির নামেই যে গ্রামের নাম হয়েছিল তালদিঘী এতে কারো মতভেদ নেই। তবে মন্দিরের বিশেষ কোন নামকরণ হয়নি,এমনকি এই মন্দিরটি এতটাই প্রাচীন যে এর প্রতিষ্ঠার সময় নিয়ে অনেকের বিতর্ক রয়েছে। তবে মন্দিরটি বেশ কয়েকবার সংষ্কার করা হলেও মন্দিরের কোন রকম পরিবর্তন করা হয়নি।
রাস্তার দু'পাশে সারি বাধা তালগাছকে পেছনে ফেলে বাঁদিকে ঘুরে গাড়িটি এগিয়ে গিয়ে দিঘির ঘাটের কাছে থামলো। সঞ্জয় গাড়ির কাছাকাছি আসতেই দীঘির ঘাটের কাছে বড়দা,হেমলতা ও মন্দিরাকে দেখা খানিক চমক লাগলো তার। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে।
আসলে নদীর ওপারে নতুন মন্দির হলেও আশেপাশের গ্রামের মানুষের বিশ্বাস তালদিঘীর মন্দির বড় জাগ্রত মন্দির। সুতরাং ওপারে মানুষ মন্দির দেখতে ও পুজো দিতে আসতেই পাড়ে। কিন্তু হেমলতা যখন সঞ্জয়ের দিকে একবার তাকিয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল,তখন হেমলতার চোখের পানে একবার দেখেই গন্ডগোলের আভাস বুঝতে সঞ্জয়ের বেশী সময় লাগলো না।
গাড়ি থেকে নয়নতারাকে নামিয়ে দিয়ে সঞ্জয় তাদের বাইরে রেখেই মন্দিরের সিঁড়ি ভেঙে ওপড়ে উঠতে লাগলো। সঞ্জয় ভালো ভাবেই জানে সে কাছে থাকলে তার দাদা নয়নতারার কাছে আসবে না। সিঁড়ি ভেঙে ওঠার সময় একবার পেছন ফিরে দেখলো নয়নতারার নিচু হয়ে মন্দিরাকে বুকে টেনে নিয়েছে,আর একটু দূরেই বাকিরা হেমলতাকে নিয়ে মেতেছে।
পূজো শেষ হলেও অনেকেই এখনো মন্দিরে। সঞ্জয় চুপচাপ মন্দিরের ঢোকার মুখে দরজার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে অনেকখন। তার হাবভাব মোটেও সুবিধের নয়।
আরো খানিক অপেক্ষার পর প্রথমেই মন্দিরার হাত ধরে মন্দিরে ঢুকে এল নয়নতারা,তার পেছনে বাবুকে কোলে করে সঞ্জয়ের বড়দা ও নয়নতারার বাবা। সবশেষে যখন পাড়ার মেয়েদের সাথে হেমলতা মন্দিরের ভেতরে ঢুকলো,ঠিক তখনই সঞ্জয় দরজার পাশ থেকে হেমলতার একটা হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে সরে পরলো মন্দিরে বাইরে।
মন্দিরের ডানপাশে খানিকটা এগিয়ে লোকচক্ষুর আঁড়ালে এনে হেমের হাত ছাড়লো সঞ্জয়। খানিক আগেও সঞ্জয়ের ওপড়ে হেমলতার অভিমান ও অভিযোগ দুই ছিলে। কিন্তু এই মুহুর্তে অভিমান কেটে গিয়ে মনে ভয়ের সঞ্চার হওয়ায়,সে ছাড়া পাওয়া মাত্র পালাতে উদ্যত হল। তবে তার পলায়নের পথ আটকে দিল সঞ্জয়।
অতিরিক্ত ভয়ের কারণে হেমলতার ওষ্ঠাধর সহ সর্বাঙ্গে কম্পন শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। তবে ভয়টি সঞ্জয়ের নয়, সে ভয় হেমে কেটেগিয়েছে অনেকটাই। ভয়টির কারণ হেমকে নিয়ে আসার সময় আর কেউ যদি নাও দেখে, তবুও হেমের পাশে থাকা মেয়ে দুটির চোখে এই কান্ড অবশ্যই ধরা পরেছে। এবার এই ঘটনাটি লোকমুখে রটনা হতে হতে নদীর ওপাড়ে অবধি পৌঁছনোর পড় কি কেলেঙ্কারি ঘটবে! তা ভেবেই হেমলতার মূর্জা যাবার অবস্থা।
বেশিকিছু বলার নেই,,গল্পটি চলবে কি না সেই প্রশ্নই রইলো…!!