07-06-2024, 02:38 PM
(This post was last modified: 08-06-2024, 07:20 AM by বহুরূপী. Edited 5 times in total. Edited 5 times in total.)
পর্ব ১৪
– হারামজাদা রাতে কোথায় থাকিস! এদিকে এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল আর উনি বলছেন কিছুই জানিনে!নচ্ছার, পাজী, গাঁজা.....
খুব ভোরে মিনতী দেবীর চেঁচামেচিতে হেমলতার ঘুম ছুটিয়া গেল। কক্ষের ভেতর হইতেই সে শুনিতে পাইলো, তাহার মাতা দেবুদাকে যা তা বলিয়া গালিগালাজ করেতেছে। ইহাতে সে বড় আশ্চর্য হইল। সে এইখানে আসিয়া অবধি এই নিরিহ ও শান্তিপূর্ণ লোকটিকে দেখিয়া অনেক বার ভাবিয়াছে,উহাকে কেউ কটুক্তি করিয়া কিছু বলিতে পারিবে না। কাহারও সাতে পাঁচে সে থাকে না।এমন কি দেবু যে এই বাড়িতেই থাকে চোখকান খোলা না রাখিলে বুঝিতে বুঝিতে পারা মুসকিল। সে রাতে বাড়িতে থাকে,সকালে সঞ্জয়ের সাথেই গঞ্জে যায়।এছাড়া একবার দূপুরে বাড়ি আসে। তাহাকে হুকুম করিলে তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করিতে সে ব্যস্ত হইয়া পরে। কাহারও সহিত উচ্চস্বরে কথাবার্তা সে করিতে পারে না। এমন লোকটিকে হেমের মাতা বলিতেছে গাঁজাখোর!
এই সব ভাবিতে ভাবিতে বাহিরে আসিয়া হেম যখন ঘটনা শুনিলো, তখন সে সিঁড়ি বাহিয়া এক ছুটে দোতলায় উঠিয়া, সঞ্জয়ের কক্ষের খোলা দোরের সম্মুখে আসিয়া ঘটনা জানা শর্তেও অবাক হইলো। তারপর খালি সিন্দুকখানি নিজের চোখে দেখিয়া তার পক্ষে আর দাঁড়াইয়া থাকা সম্ভব হইলো না। তাহার পা দুখানি কাঁপিতে লাগিলো,এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মেঝেত বসিয়া পড়িলো।
ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে তাহা মোটেই ছোট নহে। রাতে বাড়িতে চুরি হইয়া গিয়াছে। বেলা খুব বেশি বারিবার আগেই গ্রামের সকলেরই ঘটনা জানা হইয়া গেল।তবে যার ক্ষতি হইলো তাহাকে জানাইবার কোন উদ্যোগ নেওয়া হইলো না। অবশ্য ক্ষতি যে কতখানি হইয়াছে তাহা হেম নিজেও জানে না। তাহার দিদি কলিকাতায় যাত্রা করিবার আগে তাহার হাতে সিন্দুকের চাবিখানি দিয়া বলিয়াছিল,
–চাবিখানি তোর কাছেই রইলো,সবসময় সাথে রাখবি আর যা লাগে খরচ করিস,নিজের জিনিসটা নিজেই বুঝে নে এখন ....
ইত্যাদি আর কিছু সাংসারিক কথা তাহাকে এমন ভাবেই বলিয়াছে, যে হেম সব ঠিকঠাক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। তবে সংসারের খরচ মিটাইতে সিন্দুক খুলিবার প্রয়োজন হেমলতার পরে নাই।তার জন্যে সঞ্জয় যা রাখিয়া গিয়াছিল, তা দিয়াই এতো দিন চলিয়াছে। হেমলতা টাকা দিয়া কি করিবে তাই ইহা হইতেই সকল খরচ করিয়াছে সংসারে। সুতরাং সিন্দুকে ঠিক কত টাকা ছিল, তাহা হেমের ধারণার বাইরে। এই কারণেই তার চিন্তা আর বেশি, সে ঠিক কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইলো না। তার ক্রমেই মনে হইতেছে এই দ্বায়িত্ব টি লইয়া সে বড় ভুল করিয়াছে। দিদি তাহাকে বিশ্বাস করিয়া চাবিখানি তার কাছেই রাখিয়া গেল,নয়নতারা বলিয়াছিল চাবির গোছা সবসময় সাথে রাখতে। হেমলতা হারাইয়া ফেলিতে পারে ভাবিয়া বালিশের তলায় সে চাবি গোছাটি রাখিতো। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় চাবির গোছাটি সারা ঘর এমনকি সারা বাড়ি খুঁজিয়াও আর পাওয়া গেল না।
অনেকেই আসিলো এবং দেখিলো এবং সবার পক্ষ হইতে বেচারা দেবু যে পরিমাণ ভর্ৎসনা ও গালিগালাজ শুনিলো, তা ঠিক তার পাওনা ছিল কি না তাহাতে সন্দেহ আছে।
দেবু সিঁড়ির কোণার দিকে একটি ঘরে থাকে।রাত্রি কালীন কোন ঘটনাই তাহার কান এরায় না। তবে সে জানে কোন কথাটি লুকাইতে হইবে আর কোন কথাটি বলিতে হইবে। চোর আসিলে তাহার কানে লাগিবে না ইহা কি করিয়া হয়! সে যে প্রতি রাতে অনেকটা সময় জাগিয়া থাকে। কিন্তু গতরাতে খাওয়া দাওয়ার পরে মিনতী দেবীর দেওয়া একগ্লাস দুধ পান করিয়া না জানি কেন সে মরার মত ঘুমাইলো।এখন বেচারা সবার কথা শুনিয়া সংকোচে কোন কথা বলিতেই পারিতেছে না।
চোর নিঃশঙ্কচিত্তে সিন্দুক চাবির ধারা খুলিয়া নগদ টাকা গহনাপত্র যাহাই ছিল সব বাহির করিয়া লইল, ইহার প্রতিক্রিয়া যেমন বিশেষ দেখা গেল না,তেমনি ইহার প্রতিকারটিও ঠিকঠাক হইলো না। হেমলতা ভাবিয়া ভাবিয়া কিছু বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া, শেষে বুকে বালিশ চাপিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিলো। এদিকে মিনতী দেবী তাহার কাজ সন্তর্পণে করিতে লাগিলেন। বেলা ঘুরিবার আগেই বাড়ির সামনে একখানি গরুর গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ দাড়াইয়া এক সময় মাতা আগে আগে ও কন্যা মন্দিরার হাত ধরিয়া পেছনে পেছনে কাঁদিতে কাঁদিতে গাড়িতে উঠিলো। এই ঘটনায় রাস্তায় থাকা সকলেই দেখিলো,কয়েকজন আগাইয়া কৌতুহল প্রকাশ করিলো। মিনতী দেবী তখন অকারণে উচ্চস্বরে এই বলিয়া বুঝাইলেন, জঙ্গলার ধারে বাড়ি,চোর- ডাকাত পড়িলে কেহ দেখিবার নাই। তিনটি মেয়ে মানুষ একা কি করিবে, তাছাড়া তার....ইত্যাদি বলিয়া স্পষ্ট বুঝাইলেন এই বাড়িতে থাকিলে তাহার ক্ষতির পরিমাণ কতখানি।
এক সময় গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি রওনা হইল। আজ সকালের দিকে সূর্য দেব ভীষণ খেপিয়া ছিলেন।রৌদ্র গাছেপালায় পথে মাঠে যেন অগ্নিবৃষ্টি করিতছিল। কিন্তু বেলা ঘুরিয়া দুপুর হইতেই একটু একটু মেঘ জমিতে লাগিলো। গাড়ি ছাড়িবার আগে লতা নামের মেয়েটির সাথে হেমের দেখা হইয়া ছিল।লতা অনেক কথা বলিলেও হেম কিছুই বলিতে পাড়িল না। ধীরে ধীরে সঞ্জয়ের বাড়ি,ক্ষেতের মধ্যে কৃষকের ঘরগুলি ও তালদিঘির তালগাছের সারি পেছনে ফেলিয়া গাড়ি নদী ঘাটের দিকে চলিতে লাগিলো। হেমলতা পেছনে ফিরিয়া দেখিতে দেখিতে ভাবিতেছিল সেই পুকুর ঘাটের কথা,বা সন্ধ্যার কিছু আগে রান্না ঘরের পাশে জাম গাছটার ডালে যে ময়না পাখি দুটি বসিতো তাদের কথা। এই কথা তোমাদের বলা হয়নাই।তা না হোক, সব কথা জানিবার কি প্রয়োজন তোমাদের। ও বাড়িতে এই কদিনে যা কিছু ঘটিয়াছে তাহার সকল ঘটনা বলিবার সময় হেমের নাই।তবে এটুকুই জানিয়া রাখো ও বাড়ি হেম এত সহজে ভুলিতে পারিবে না।ভগবান তাহার কপালে ঠিক কি রাখিয়াছে সে তাহা জানে না। কিন্তু ও বাড়ি পেছনে ফেলিয়া যাইতে হেমলতার কেবলই মনে হইতেছে সে যেন তার নিরাপদ আশ্রয় হইতে অনেক দূরে চলিয়া যাইতেছে।সেখানে তাহাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই...
/////
কলিকাতায় প্রথম আসিয়া একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিবার ইচ্ছে নয়নতারার থাকিলেও,উপায় ছিল না। পিতার অসুস্থতা ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া ভাবিয়া সেই ইচ্ছা তাহার প্রায় মরিয়া গিয়াছিল। তবে পিতার সুস্থতার কারণেই হোক বা স্বামীর কথা ভাবিয়া ভাবিয়া মন শ্রান্ত হইবার কারণেই হোক,সেই মরিতে থাকা ইচ্ছাখানি আবার নবোদ্যমে জাগিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু হঠাৎ এই কি হইয়া গেল।
রাত্রিতে নয়নতারার ঘুম হয় নাই। দুপুরে হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া সে চুপচাপ জানালার পাশে বসিয়া কি ভাবিতেছিল।এমন সময় কমলার ডাকে নিচে নামিতেই দেখিল লাল রঙের পাগড়ী মাথায় দুইটি অচেনা দোরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আর বসিবার জায়গায় এক সাহেবের বেশে বাঙ্গালী বাবু বসিয়া। উহার সহিত কমলার স্বামীর কি কথা হইলো নয়নতারা তা শুনিতে পায় নাই। কিন্তু আলোচনা করিয়া কমলার স্বামী যখন বেশ ব্যস্ত হইয়া পরিলো, তখন এই উৎকণ্ঠার হেতু নয়নতারা বুঝিল না। কিন্তু সঞ্জয়ের নাম শুনিয়া আর আপত্তিও করিল না,নীরব হইয়া রহিল। তবে কিছুক্ষণ পরেই বাবুকে কোলে লইয়া তাহারা তিনজন বাড়ির বাইয়ে একটি গাড়ীতে উঠিলো।
যতখন গাড়ি চলিল নয়নতারা নিঃশব্দে দুচোখ বুঝিয়া বসিয়া রহিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে একখানা লোহার গেইট পেছনে ফেলিয়া একটা বৃহৎ বাটীর সম্মুখে আসিয়া তাহাদের গাড়ি থামিল।
তাহারা বাড়ির সম্মুখের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়া একটু দূরেই ডান পাশের সিঁড়ি বাহিয়া সোজা দোতলায় উঠিতে লাগিলো। সিঁড়ি বাহিয়া উঠিবার সময় নিচের কোন এক কক্ষ হইতে তখন সঙ্গীতের ও হাস্য-কলরবের ধ্বনি নয়নতারার কানে আসিলো।
দোতলায় যে দরজার সামনে নয়নতারা উপস্থিত হইল, সেই সাজানো কক্ষটির ভেতরে খাটের এক পাশে চেয়ারে বসিয়া টেবিলে মাথা রাখিয়া, সঞ্জয় চোখ বুঝিয়া আছে বা ঘুমাইতেছে। তাহার মাথার কাছেই একখানা খাবারে তালায় খাবার ঢাকা দেওয়া। এটুকু ছাড়া কক্ষের সাজসজ্জা নয়নতারার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিলো না। নয়নতারার পেছনে কমলাও কক্ষের ভেতর অগ্রসর হইত, কিন্তু তার স্বামী তাহার হাত ধরিয়া নিচে নামিয়া গেল।
নয়নতারা সঞ্জয়ের কাছে আসিয়া দেখিল,সঞ্জয় টেবিলে হাত রাখিয়া তার ওপরে মাথাটি দেওয়ালের পাশে রূপলী ফ্রেমের বৃহত দর্পণের দিকে মুখ করিয়া ঘুমাইতেছে। একটা লোক রাত্রের অতৃপ্ত নিদ্রা এইভাবে পোষাইয়া লইতেছে, সংসারে ইহা একান্ত অদ্ভুত নহে, কিন্তু ইহা দেখিয়া নয়নতারার বুকের ভেতর কেমন যেন করিতে লাগিলো। নয়নতারা পা টিপিয়া ঘরে ঢুকিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া ছিল। সম্মুখের খোলা জানাল দিয়া দুপুরের অপৰ্যাপ্ত আলোক সেই নিদ্রামগ্ন মুখের উপর পড়িয়াছিল। আজ অকস্মাৎ এতদিন পরে তাহার মনে সঞ্জয়কে দেখিয়া,এমন এক অনুভূতির সঞ্চার হইলো যাহা ইতিপূৰ্ব্বে কোনদিন সে অনুভব করে নাই। সেই সাথে সঞ্জয়ের নিচের ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়া সেই রাতের কথাটি মনে পড়িয়া গেল। নয়নতারার দুই চোখ বন্ধ করিল নিজেকে খানিক সামলাইবে বলিয়া। তার পর জানালার পর্দা টানিয়া দিল।
দ্বিতীয় বার সঞ্জয়ের পানে চাহিয়া তার ডান হস্তের নিচে একখানি পত্র দেখিল। যদিও পত্রে কাহারও নাম উল্লেখ নাই,তার পরেও চিঠি পড়িয়া সে বুঝিল ইহা তার ছোট বোনটির জন্যেই লেখা হইতেছিল। হইতেছিল বলিবার কারণ, তা এখনো সম্পূর্ণ লেখা হয় নাই। চিঠি হইতে মুখ উঠাইয়া যখন সে সঞ্জয়কে ডাকিবে বলিয়া ঠিক করিলো,তখন তার চোখে পরিলো দরজার মুখে একটি সুশ্রী সুন্দর বালিকা খাবারের পাত্র হাতে দাঁড়াইয়া। বোধকরি কক্ষে অচেনা কাহারও উপস্থিত সে আশা করে না। তাই এখন কি করিবে চুপ করিয়া তাহাই ভাবিতেছিল। নয়নতারা যখন তাহাকে ডাকিলো তখন সে ভেতরে আসিয়া হাতে থালাটা টেবিলে একপাশে রাখিয়া আগের খাবারপাত্র হাতে তুলিয়া লইল। নয়নতারা বুঝিল বালিকাটি কোন মতে কাজ সারিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচে। ইহার কান্ড দেখিয়া তাহার ছোট বোন হেমলতার কথা মনে পড়িলো,আর বালিকা পালাইবার পূর্বেই সে উহার একহাতে ধরিয়া বন্দী করিল। না করিয়াই বা উপায় কি!এইসবের অর্থ বুঝিতে হইলে ইহাকে তাহার প্রয়োজন।
সঞ্জয় সারাদিন কিছুই মুখে তোলে নাই।রাত্রিতে ও সকালে দামিনী নিজে খাবার লইয়া দোতলায় সঞ্জয়ের ঘরে গিয়াছিল। কিন্তু সুবিধা কিছুই হয় নাই। অবশেষে উপায় না দেখিয়া লোক পাঠাইয়া নয়নতারাকে খবর দিয়াছে। নয়নতারা বালিকার মুখ হইতে ইহার বেশি কিছুই বাহির করিয়া লাইতে পারিলো না। তবে ইহা জানিলো যে দামিনী এই এই বাড়ির মালকিনের নাম।
সঞ্জয়ের ঘুম ভাঙিতে পারে বলিয়া নয়নতারার বালিকাটি সাথে নিচে নামিয়া আসিয়া ছিল। কথা শেষ হইতেই বালিকাটি নয়নতারার হাত হইতে ছুটি লইয়া পালাইয়া বাঁচিল। নয়নতারা সেখানেই বসিয়া চারিধারে চোখ বুলাইতেছিল। বাড়িতে কোন উৎসবের আয়োজন করা হইতেছে। বাড়িতে অনেক মহিলাদের সমাগম,কিন্তু পুরুষ বলতে কিছু বাড়ির কর্মকর্তা ও কাজের লোক ছাড়া আর বিশেষ কাহাকেও দেখা যাইতেছে না। নয়নতারা কমলা ও তার স্বামী কে খুঁজিয়া পাইলো না। তাহার ভাবসাব লক্ষ্য করিয়া দুই একজন মহিলা কথা বলিতে আসিয়াছিল।নয়নতারার ঘটনা সংক্ষেপে শুনিবার পরে তাহারা তাকে লইয়া আলোচনা করিতে বসিলো। নয়নতারা খুব জলদিই বুঝিলো ইহারা তাহাকে সরল ভাবিয়া আমোদ করিবার উপলক্ষে বসাইয়াছে,এছাড়া সঞ্জয় কে, তাহা ইহাদের জানা নাই। ব্যপারখানা বুঝিয়া নয়নতারা উহাদিগের সহিত আলোচনা জমজমাট করিয়া তুলিলো, এবং তাহাদের ছোট্ট সভাটির সকলেই অল্প সময়েই বুঝিয়া লইলো ইহাকে হাসির পাত্র বানাইতে গেলে চাল উল্টা পরিতে পারে।
সময় কাটিতে কাটিতে একসময় বেলা পরিয়া গেল।নয়নতারা দেখিলো কমলা ও তার স্বামী তাহাকে কিছু না বলিয়াই বিদায় হইয়াছে। এর মধ্যে সেই বালিকাটি নয়নতারার খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছে এবং নয়নতারা তাহাকে লইয়া একটু কষ্ট করিয়া হইলেও সঞ্জয়কে খাটে শোয়ানোর ব্যবস্থা করিয়াছে। তারপর দোতলায় ঘুরিতে ঘুরিতে বাবুকে ঘুম পারাইতে ব্যস্ত হইয়াছে।
যখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়,তখন হইতেই নিমন্ত্রিত মহিলাদের গাড়ি পিছনের গেটে আসিতে শুরু করিল। সারা বাড়িটা আলোয় জলমল করিতেছিল। যদিও এখন পুরো বাড়িটা সাজানো সম্পূর্ণ হয় নাই,তবুও এইসব দেখিয়া নয়নতারার অবাক হওয়া ছাড়া উপায় কি। এত সাজসজ্জা ত দূরের কথা এত বড় বাড়িই তো সে কখনো দেখে নাই। নয়নতারার মনে হইলো বাড়িখানা তার গ্রামের যে বড় জমিদার বাড়িটি আছে তার চাইতেও বড়। সাদা রঙের বাড়ির দেওয়ালে অনেক বড় বড় ছবি লাগানো। তার মধ্যে সিঁড়ির মুখেই একটি ছবিতে একটি পারিবারিক ছবি। ছবিতে এক বাঙ্গালী রমনী আর এক পুরুষ সাহেবের পোশাক পড়া, সাথে একটি ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে।
দোতলার বারান্দায় উঠিবার মুখে বড় ঝাড় জ্বলিতেছে। বাড়ির মেয়েরা অভ্যর্থনা করিয়া সকলকে উপরে পাঠাইয়া দিতেছিলেন। নিমন্ত্রিতা মেয়েরা কেহ মুচকি হাসিয়া, কেহ হাসির লহর তুলিয়া কেহ ধীর, কেহ ক্ষিপ্র, কেহ সুন্দর অপূর্ব গতি-ভঙ্গিতে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেছেন। নয়নতারা দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ হইতে এইসব দেখিতেছিল। ওপড়ে বারান্দায় হইতে নিচের সিঁড়ি সহ সব দেখা যায়। এতো লোকজনের সমাগম আর তাহাদের সাজসজ্জা এ ধরনের দৃশ্য জীবনে সে এই প্রথম দেখিল। দেখিতে দেখিতে এক সময় সিঁড়ির নিচের ধাপে এক রমণীর দিকে নয়নতারার চোখ পরিলো। বয়স নয়নতারার মতো বা একটু বেশিও হইতে পারে,তবে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলে। গায়ে চওড়া লালপাড় রেশমী শাড়ির সাথে তার দেহের রঙ মিলিয়া তার দেহের দুধে আলতা রং-এর আভা অপূর্ব ফুটিয়াছে। মাথার চুলে একখানি সোনার কাটায় আঁটা, সিঁড়ির বড় ঝাড়ের আলোয় গলার সরু সোনার চেন চিক চিক্ করিতেছিল, সুন্দর গড়ন তার,নয়নতারা মনে মনে ভাবিলো রমনীটি ঠিক কে হইতে পারে!
মেয়েটি নয়নতারার পাশ দিয়া সোজা সঞ্জয়ের ঘরের দিকে চলিল,এবং কক্ষের সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া ভেতরে দেখিবার পরূ আবারও তাহাকে পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতে ছিল। নয়নতারা অবাক হইয়া তা দেখিল,একবার ডাকিতেও ইচ্ছা করিয়াছিল।তবে ডাকিতে গিয়াও কথাগুলো গলায় দলা পাকাইয়া গেল,আর ডাকা হইলো। পরে অবশ্য জানিয়াছে উহার নামটিই সৌদামিনী তবে সকলেই তাহাকে দামিনী বলিয়া ডাকে।
সঞ্জয়ের ঘুম সন্ধ্যার আগে ভাঙ্গিয়া গেল। এবং ঘুম ভাঙ্গিতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করিয়া একটু অবাক বোধকরি হইয়াছিল।তবে পরক্ষণেই বাবুকে তার পাশে দেখিয়া তার গলা শুকাইয়া গেল।নয়নতারার সহিত দেখা করিবার মত মানসিক অবস্থা তাহার ছিল না,এই মুহুর্তে নয়নতারার সহিত সাক্ষাৎ হইলে সে লজ্জায় কথা বলিতেই পারিবে না। ঐদিন রাত্রিতে সে নিজেকে কেন আকাইতে ব্যর্থ হইলো সে এখনও বুঝিয়া উঠতে পারে নাই। সে যাহা করিয়াছে উহা যে শুধুমাত্র নয়নতারার উপরে অন্যায় তা নয়, সে যে হেমলতার কাছেও দোষী হইয়াছে।
নয়নতারার সঙ্গে দেখা হইতে পারে বলিয়া সে উঠিয়া বাহিরে না গিয়া আগের চিঠিখানা শেষ করিতে বসিয়াছিল। চিঠি লেখা শেষ করিয়া যখন সে উঠিলো,দেখিল নয়নতারা দোরের মুখে দাঁড়িয়ে। সঞ্জয় তার বৌদিমণি কে দেখিয়া মাথা নত করিয়া দাড়াইয়া রহিলো। কিন্তু নয়নতারা কিছুই বলিল না।সে আগাইয়া সঞ্জয়ের হাতখানি ধরিয়া খাটে বসাইয়া সে নিজে খাবারের থালাখানি হাতে তুলিয়াই লইল।সঞ্জয়ের খাইবার ইচ্ছে না থাকিলেও নয়নতারা যখন নিজ হস্তে তার মুখে খাবার তুলিয়া ধরিলো,তখন তাহাকে না বলিবার সাহস সঞ্জয়ের হইলো না ।
////
তিন-চারদিন পরের ঘটনা, তালদিঘির ঘাটে একটি বড় নৌকা আসিয়া থামিল। এবং ছইয়ের ভেতর হইতে নয়নতারা ,তার পিতা ও সঞ্জয় ঘাটে নামিল। এই কদিন ঠিক কি হইয়াছে ইহা জানিতে বাটী অবধি যাইবার অপেক্ষা রাখিল না। তাহারা আনন্দে সহিত ফিরিলেও বাড়ি পৌঁছনোর আগেই সকলের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল। বাড়িতে আসিয়া সব দেখিবার পর সঞ্জয়ের মুখের ভাব যাহা হইলো একবার দেখিয়াই নয়নতারার বুকের ভেতরে ধক করিয়া উঠিলো। দেখাগেল শুধু টাকা পয়সা নয়,টাকা পয়সার সাথে সঞ্জয়ের বাড়ি ও গঞ্জের দোকানের দলিলপত্র যা ছিল সব গেছে। ইহার পর হইতে সঞ্জয় ঠিক মতো বাড়িতে থাকে না। সকালে চিন্তিত মুখে বাহির হইয়া রাত্রিতে যে আর চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরিত।
বাড়ি অবস্থা যখন এইরুপ, তখন নয়নতারার মা তাহাদের বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছে ইহাতে নয়নতারার লজ্জার শেষছিল না। সেই লজ্জা ক্রোধে পরিনত হইলো, যখন তাহাদের আসিবার খবরে তার স্বামী আসিয়া কহিল নয়নতারাকে সে বাড়িতে ফিরাইয়া নিতে আসিয়াছে। নয়নতারা তার স্বামী সাথে দেখা করিবে না বলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দোরে খিল আটিলো। নয়নতারার পিতা তখন ঘুমাইতেছে,সঞ্জয়ও বাড়িতে ছিল না।সুতরাং সোহমকে একাই আবার ফিরিয়া যাইতে হইল।
ইহার একদিন পরেই দুপুরে হঠাৎ সঞ্জয় আসিয়া রান্নাঘরের দোরের সম্মুখে দাঁড়াইল। নয়নতারার রান্নার কাজ তখন প্রায় শেষ। সঞ্জয়কে দেখিয়া নয়নতারার মুখে হাসি ফুটিলও তার কথা শুনিয়া নয়নতারার মুখখানি কঠিন ও গম্ভীর হইয়া গেল....
– বৌদিমণি! আমি ভেবে দেখলাম, দাদা ও বাড়িটা যখন ছাড়িয়ে এনেছে ত তোমাদের ওবাড়িতে ফিরে যাওয়া....
সঞ্জয় কথা শেষকরিবার আগেই নয়নতারার তার মুখের পানে চাহিয়া অতি সহজ স্বরে বলিল,
-আর যদি না যাই? কি করবে তুমি? জোর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে ত?
সঞ্জয় নয়নতারার মুখের দিকে দেখিয়া আর কিছুই বলিতে সাহস করিল না। নয়নতারার আবারও তার হাতের কাজে মনোনিবেশ করি বলিল,
– এই রোদুরে দাঁড়িয়ে না থেকে স্নান করে এসো যাও,
সঞ্জয় চুপচাপ দাঁড়াইয়া কি যেন ভাবতেছিল,এমন সময় দেবু বাবুকে কোলে লইয়া রান্নাঘর দিকে আসিতেছে দেখিয়াই সঞ্জয় আগাইয়া বাবুকে কোলে লইতে গেল। তখনই নয়নতারা রান্নাঘর হইতে বলিল,
– বাবুকে আমার কাছে দে, কি হল! তোমায় না স্নান করতে বললাম..
এবার নয়নতারার চোখের কড়া দৃষ্টি সঞ্জয় দেখিতে পাইয়া আর দেরি না করিয়া সিঁড়ির দিকে পা বারাইলো।
দুপুরের সূর্য রুদ্র রূপ ধারণ করিয়াছিল।কিন্তু বিকেলের দিকে উত্তাপ অনেকটা কমিয়া আসিলো। নয়নতারার মন খুব একটা ভালো না থাকিলেও,সে ভাবিয়াছিল এক দুজন আসিলে একটু আলাপ করিয়া সময় কাটাইবে। কিন্তু কেহই আসিলো না। অবশেষে বসিয়া বসিয়া সে বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলো।
তারপরে রোদ্রের তাপ যখন একদমই কমিয়া আসিলো,তখন সে তার শিশু পুত্রটিকে কোলে লইয়া সিঁড়ি বাহিয়া ছাদে উঠিবার উদ্যোগ নিল। তবে দোতলায় উঠিতেই তার চোখে পড়িলো; সঞ্জয় বারান্দায় এক গাছি চুড়ি হাতে লইয়া দেওয়ালে পিঠ দিয়া দাঁড়াইয়া। নয়নতারা একটু অবাক হইলো।এই সময় সঞ্জয়ের বাড়িতে থাকিবার কথা নয়। কৌতূহল নিবৃত্ত করিতে না পারিয়া নয়নতারা ধির পদক্ষেপে সঞ্জয়ের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
সঞ্জয় চোখ বুঝিয়া ছিল এবং নিজের ভাবনার মাঝে এত মশগুল ছিল যে নয়নতারার পায়ের আওয়াজও তার কানে লাগিল না। সঞ্জয়ের হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো দেখিয়া নয়নতারা ভাবিল ইহা বুঝি হেমলতা রাখিয়া গিয়াছে।সঞ্জয় ও তার বোনটির প্রণয়ের কথা নয়নতারার অনেক আগেই জানিয়াছিল। এই মুহুর্তে সঞ্জয়ের মলিন মুখখানি দেখিয়া তার মায়া হইল, সে হাত উঠাইয়া সঞ্জয়ের কাঁধে স্পর্শ করিতেই,হঠাৎ সঞ্জয় খপ্প করিয়া নয়নতারার হাতখানি তার বাঁ হাতের মুঠায় শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিল। এত জোরে ধরিল যে নয়নতারা ব্যথা পাইয়া "আঃ" বলিল মৃদু আর্তনাদ করিয়া উঠিলো। পরক্ষণেই নয়নতারাকে দেখিয়া হাতখানি ছাড়িয়া দিল।নয়নতারা এই ঘটনায় অবাক হইয়া গেল। সে সঞ্জয়ের মুখপানে চাহিয়া এক প্রকার অস্থিরতার ছাপ দেখিয়া ব্যাকুল কন্ঠে বলিল,
– কী হয়েছে?
সঞ্জয় কিছু বলিতে পারিলো না। তার মুখ দেখিয়া নয়নতারা বুঝিবার চেষ্টা করিলো, কিন্তু কিছুই সে বুঝিল না। একটা সন্দেহ করিয়া পরম স্নেহে আবার জিজ্ঞাসা করিল,
—কী হয়েছে তোমার? অসুখ বোধ করছ?
ততখনে সঞ্জয় নিজেকে সামলাইয়া গলার স্বর সহজ করিয়া বলিল,
–কিছুই হয়নি, তুমি এগুলি দেখ ত পছন্দ হয় কিনা। গত মেলায় কিনেছিলাম। হেমকে দিয়েছি, তোমারটা দেওয়া হয়নি।
নয়নতারা কিছু বলিল না,সে সঞ্জয়ের মুখের দিকেই চাহিয়া তার ডান হাতখানি আগাইয়া দিল।সঞ্জয় হাতখানি দিকে চোখ বুলাইয়া দেখিল কব্জি খানিকটা জায়গা লাল হইয়া গিয়াছে। সে কিছুটা লজ্জিত হইল। তার পর সস্নেহে হাতখানি তার বাঁ হাতে ধরিয়া,ডান হাতের থাকা, নীল রঙের সরু চুড়ি গুলি পরাইয়া দিতে লাগিল....... বেশি কিছু বলবো না,শুধু বলবো গল্প চলবে কি না!?
– হারামজাদা রাতে কোথায় থাকিস! এদিকে এতবড় সর্বনাশ হয়ে গেল আর উনি বলছেন কিছুই জানিনে!নচ্ছার, পাজী, গাঁজা.....
খুব ভোরে মিনতী দেবীর চেঁচামেচিতে হেমলতার ঘুম ছুটিয়া গেল। কক্ষের ভেতর হইতেই সে শুনিতে পাইলো, তাহার মাতা দেবুদাকে যা তা বলিয়া গালিগালাজ করেতেছে। ইহাতে সে বড় আশ্চর্য হইল। সে এইখানে আসিয়া অবধি এই নিরিহ ও শান্তিপূর্ণ লোকটিকে দেখিয়া অনেক বার ভাবিয়াছে,উহাকে কেউ কটুক্তি করিয়া কিছু বলিতে পারিবে না। কাহারও সাতে পাঁচে সে থাকে না।এমন কি দেবু যে এই বাড়িতেই থাকে চোখকান খোলা না রাখিলে বুঝিতে বুঝিতে পারা মুসকিল। সে রাতে বাড়িতে থাকে,সকালে সঞ্জয়ের সাথেই গঞ্জে যায়।এছাড়া একবার দূপুরে বাড়ি আসে। তাহাকে হুকুম করিলে তা সঙ্গে সঙ্গে পালন করিতে সে ব্যস্ত হইয়া পরে। কাহারও সহিত উচ্চস্বরে কথাবার্তা সে করিতে পারে না। এমন লোকটিকে হেমের মাতা বলিতেছে গাঁজাখোর!
এই সব ভাবিতে ভাবিতে বাহিরে আসিয়া হেম যখন ঘটনা শুনিলো, তখন সে সিঁড়ি বাহিয়া এক ছুটে দোতলায় উঠিয়া, সঞ্জয়ের কক্ষের খোলা দোরের সম্মুখে আসিয়া ঘটনা জানা শর্তেও অবাক হইলো। তারপর খালি সিন্দুকখানি নিজের চোখে দেখিয়া তার পক্ষে আর দাঁড়াইয়া থাকা সম্ভব হইলো না। তাহার পা দুখানি কাঁপিতে লাগিলো,এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মেঝেত বসিয়া পড়িলো।
ঘটনা যাহা ঘটিয়াছে তাহা মোটেই ছোট নহে। রাতে বাড়িতে চুরি হইয়া গিয়াছে। বেলা খুব বেশি বারিবার আগেই গ্রামের সকলেরই ঘটনা জানা হইয়া গেল।তবে যার ক্ষতি হইলো তাহাকে জানাইবার কোন উদ্যোগ নেওয়া হইলো না। অবশ্য ক্ষতি যে কতখানি হইয়াছে তাহা হেম নিজেও জানে না। তাহার দিদি কলিকাতায় যাত্রা করিবার আগে তাহার হাতে সিন্দুকের চাবিখানি দিয়া বলিয়াছিল,
–চাবিখানি তোর কাছেই রইলো,সবসময় সাথে রাখবি আর যা লাগে খরচ করিস,নিজের জিনিসটা নিজেই বুঝে নে এখন ....
ইত্যাদি আর কিছু সাংসারিক কথা তাহাকে এমন ভাবেই বলিয়াছে, যে হেম সব ঠিকঠাক বুঝিয়া উঠিতে পারে নাই। তবে সংসারের খরচ মিটাইতে সিন্দুক খুলিবার প্রয়োজন হেমলতার পরে নাই।তার জন্যে সঞ্জয় যা রাখিয়া গিয়াছিল, তা দিয়াই এতো দিন চলিয়াছে। হেমলতা টাকা দিয়া কি করিবে তাই ইহা হইতেই সকল খরচ করিয়াছে সংসারে। সুতরাং সিন্দুকে ঠিক কত টাকা ছিল, তাহা হেমের ধারণার বাইরে। এই কারণেই তার চিন্তা আর বেশি, সে ঠিক কি করিবে কিছুই ভাবিয়া পাইলো না। তার ক্রমেই মনে হইতেছে এই দ্বায়িত্ব টি লইয়া সে বড় ভুল করিয়াছে। দিদি তাহাকে বিশ্বাস করিয়া চাবিখানি তার কাছেই রাখিয়া গেল,নয়নতারা বলিয়াছিল চাবির গোছা সবসময় সাথে রাখতে। হেমলতা হারাইয়া ফেলিতে পারে ভাবিয়া বালিশের তলায় সে চাবি গোছাটি রাখিতো। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় চাবির গোছাটি সারা ঘর এমনকি সারা বাড়ি খুঁজিয়াও আর পাওয়া গেল না।
অনেকেই আসিলো এবং দেখিলো এবং সবার পক্ষ হইতে বেচারা দেবু যে পরিমাণ ভর্ৎসনা ও গালিগালাজ শুনিলো, তা ঠিক তার পাওনা ছিল কি না তাহাতে সন্দেহ আছে।
দেবু সিঁড়ির কোণার দিকে একটি ঘরে থাকে।রাত্রি কালীন কোন ঘটনাই তাহার কান এরায় না। তবে সে জানে কোন কথাটি লুকাইতে হইবে আর কোন কথাটি বলিতে হইবে। চোর আসিলে তাহার কানে লাগিবে না ইহা কি করিয়া হয়! সে যে প্রতি রাতে অনেকটা সময় জাগিয়া থাকে। কিন্তু গতরাতে খাওয়া দাওয়ার পরে মিনতী দেবীর দেওয়া একগ্লাস দুধ পান করিয়া না জানি কেন সে মরার মত ঘুমাইলো।এখন বেচারা সবার কথা শুনিয়া সংকোচে কোন কথা বলিতেই পারিতেছে না।
চোর নিঃশঙ্কচিত্তে সিন্দুক চাবির ধারা খুলিয়া নগদ টাকা গহনাপত্র যাহাই ছিল সব বাহির করিয়া লইল, ইহার প্রতিক্রিয়া যেমন বিশেষ দেখা গেল না,তেমনি ইহার প্রতিকারটিও ঠিকঠাক হইলো না। হেমলতা ভাবিয়া ভাবিয়া কিছু বুঝিয়া উঠিতে না পারিয়া, শেষে বুকে বালিশ চাপিয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিলো। এদিকে মিনতী দেবী তাহার কাজ সন্তর্পণে করিতে লাগিলেন। বেলা ঘুরিবার আগেই বাড়ির সামনে একখানি গরুর গাড়ি বেশ কিছুক্ষণ দাড়াইয়া এক সময় মাতা আগে আগে ও কন্যা মন্দিরার হাত ধরিয়া পেছনে পেছনে কাঁদিতে কাঁদিতে গাড়িতে উঠিলো। এই ঘটনায় রাস্তায় থাকা সকলেই দেখিলো,কয়েকজন আগাইয়া কৌতুহল প্রকাশ করিলো। মিনতী দেবী তখন অকারণে উচ্চস্বরে এই বলিয়া বুঝাইলেন, জঙ্গলার ধারে বাড়ি,চোর- ডাকাত পড়িলে কেহ দেখিবার নাই। তিনটি মেয়ে মানুষ একা কি করিবে, তাছাড়া তার....ইত্যাদি বলিয়া স্পষ্ট বুঝাইলেন এই বাড়িতে থাকিলে তাহার ক্ষতির পরিমাণ কতখানি।
এক সময় গাড়োয়ানের গরুর গাড়ি রওনা হইল। আজ সকালের দিকে সূর্য দেব ভীষণ খেপিয়া ছিলেন।রৌদ্র গাছেপালায় পথে মাঠে যেন অগ্নিবৃষ্টি করিতছিল। কিন্তু বেলা ঘুরিয়া দুপুর হইতেই একটু একটু মেঘ জমিতে লাগিলো। গাড়ি ছাড়িবার আগে লতা নামের মেয়েটির সাথে হেমের দেখা হইয়া ছিল।লতা অনেক কথা বলিলেও হেম কিছুই বলিতে পাড়িল না। ধীরে ধীরে সঞ্জয়ের বাড়ি,ক্ষেতের মধ্যে কৃষকের ঘরগুলি ও তালদিঘির তালগাছের সারি পেছনে ফেলিয়া গাড়ি নদী ঘাটের দিকে চলিতে লাগিলো। হেমলতা পেছনে ফিরিয়া দেখিতে দেখিতে ভাবিতেছিল সেই পুকুর ঘাটের কথা,বা সন্ধ্যার কিছু আগে রান্না ঘরের পাশে জাম গাছটার ডালে যে ময়না পাখি দুটি বসিতো তাদের কথা। এই কথা তোমাদের বলা হয়নাই।তা না হোক, সব কথা জানিবার কি প্রয়োজন তোমাদের। ও বাড়িতে এই কদিনে যা কিছু ঘটিয়াছে তাহার সকল ঘটনা বলিবার সময় হেমের নাই।তবে এটুকুই জানিয়া রাখো ও বাড়ি হেম এত সহজে ভুলিতে পারিবে না।ভগবান তাহার কপালে ঠিক কি রাখিয়াছে সে তাহা জানে না। কিন্তু ও বাড়ি পেছনে ফেলিয়া যাইতে হেমলতার কেবলই মনে হইতেছে সে যেন তার নিরাপদ আশ্রয় হইতে অনেক দূরে চলিয়া যাইতেছে।সেখানে তাহাকে রক্ষা করিবার কেহই নাই...
/////
কলিকাতায় প্রথম আসিয়া একটু ঘুরিয়া ফিরিয়া দেখিবার ইচ্ছে নয়নতারার থাকিলেও,উপায় ছিল না। পিতার অসুস্থতা ও নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবিয়া ভাবিয়া সেই ইচ্ছা তাহার প্রায় মরিয়া গিয়াছিল। তবে পিতার সুস্থতার কারণেই হোক বা স্বামীর কথা ভাবিয়া ভাবিয়া মন শ্রান্ত হইবার কারণেই হোক,সেই মরিতে থাকা ইচ্ছাখানি আবার নবোদ্যমে জাগিয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু হঠাৎ এই কি হইয়া গেল।
রাত্রিতে নয়নতারার ঘুম হয় নাই। দুপুরে হাসপাতাল হইতে ফিরিয়া সে চুপচাপ জানালার পাশে বসিয়া কি ভাবিতেছিল।এমন সময় কমলার ডাকে নিচে নামিতেই দেখিল লাল রঙের পাগড়ী মাথায় দুইটি অচেনা দোরের সম্মুখে দাঁড়াইয়া আর বসিবার জায়গায় এক সাহেবের বেশে বাঙ্গালী বাবু বসিয়া। উহার সহিত কমলার স্বামীর কি কথা হইলো নয়নতারা তা শুনিতে পায় নাই। কিন্তু আলোচনা করিয়া কমলার স্বামী যখন বেশ ব্যস্ত হইয়া পরিলো, তখন এই উৎকণ্ঠার হেতু নয়নতারা বুঝিল না। কিন্তু সঞ্জয়ের নাম শুনিয়া আর আপত্তিও করিল না,নীরব হইয়া রহিল। তবে কিছুক্ষণ পরেই বাবুকে কোলে লইয়া তাহারা তিনজন বাড়ির বাইয়ে একটি গাড়ীতে উঠিলো।
যতখন গাড়ি চলিল নয়নতারা নিঃশব্দে দুচোখ বুঝিয়া বসিয়া রহিল। বেশ কিছুক্ষণ পরে একখানা লোহার গেইট পেছনে ফেলিয়া একটা বৃহৎ বাটীর সম্মুখে আসিয়া তাহাদের গাড়ি থামিল।
তাহারা বাড়ির সম্মুখের দরজা দিয়া প্রবেশ করিয়া একটু দূরেই ডান পাশের সিঁড়ি বাহিয়া সোজা দোতলায় উঠিতে লাগিলো। সিঁড়ি বাহিয়া উঠিবার সময় নিচের কোন এক কক্ষ হইতে তখন সঙ্গীতের ও হাস্য-কলরবের ধ্বনি নয়নতারার কানে আসিলো।
দোতলায় যে দরজার সামনে নয়নতারা উপস্থিত হইল, সেই সাজানো কক্ষটির ভেতরে খাটের এক পাশে চেয়ারে বসিয়া টেবিলে মাথা রাখিয়া, সঞ্জয় চোখ বুঝিয়া আছে বা ঘুমাইতেছে। তাহার মাথার কাছেই একখানা খাবারে তালায় খাবার ঢাকা দেওয়া। এটুকু ছাড়া কক্ষের সাজসজ্জা নয়নতারার দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে পারিলো না। নয়নতারার পেছনে কমলাও কক্ষের ভেতর অগ্রসর হইত, কিন্তু তার স্বামী তাহার হাত ধরিয়া নিচে নামিয়া গেল।
নয়নতারা সঞ্জয়ের কাছে আসিয়া দেখিল,সঞ্জয় টেবিলে হাত রাখিয়া তার ওপরে মাথাটি দেওয়ালের পাশে রূপলী ফ্রেমের বৃহত দর্পণের দিকে মুখ করিয়া ঘুমাইতেছে। একটা লোক রাত্রের অতৃপ্ত নিদ্রা এইভাবে পোষাইয়া লইতেছে, সংসারে ইহা একান্ত অদ্ভুত নহে, কিন্তু ইহা দেখিয়া নয়নতারার বুকের ভেতর কেমন যেন করিতে লাগিলো। নয়নতারা পা টিপিয়া ঘরে ঢুকিয়া চুপ করিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া ছিল। সম্মুখের খোলা জানাল দিয়া দুপুরের অপৰ্যাপ্ত আলোক সেই নিদ্রামগ্ন মুখের উপর পড়িয়াছিল। আজ অকস্মাৎ এতদিন পরে তাহার মনে সঞ্জয়কে দেখিয়া,এমন এক অনুভূতির সঞ্চার হইলো যাহা ইতিপূৰ্ব্বে কোনদিন সে অনুভব করে নাই। সেই সাথে সঞ্জয়ের নিচের ঠোঁটে আঘাতের চিহ্ন দেখিয়া সেই রাতের কথাটি মনে পড়িয়া গেল। নয়নতারার দুই চোখ বন্ধ করিল নিজেকে খানিক সামলাইবে বলিয়া। তার পর জানালার পর্দা টানিয়া দিল।
দ্বিতীয় বার সঞ্জয়ের পানে চাহিয়া তার ডান হস্তের নিচে একখানি পত্র দেখিল। যদিও পত্রে কাহারও নাম উল্লেখ নাই,তার পরেও চিঠি পড়িয়া সে বুঝিল ইহা তার ছোট বোনটির জন্যেই লেখা হইতেছিল। হইতেছিল বলিবার কারণ, তা এখনো সম্পূর্ণ লেখা হয় নাই। চিঠি হইতে মুখ উঠাইয়া যখন সে সঞ্জয়কে ডাকিবে বলিয়া ঠিক করিলো,তখন তার চোখে পরিলো দরজার মুখে একটি সুশ্রী সুন্দর বালিকা খাবারের পাত্র হাতে দাঁড়াইয়া। বোধকরি কক্ষে অচেনা কাহারও উপস্থিত সে আশা করে না। তাই এখন কি করিবে চুপ করিয়া তাহাই ভাবিতেছিল। নয়নতারা যখন তাহাকে ডাকিলো তখন সে ভেতরে আসিয়া হাতে থালাটা টেবিলে একপাশে রাখিয়া আগের খাবারপাত্র হাতে তুলিয়া লইল। নয়নতারা বুঝিল বালিকাটি কোন মতে কাজ সারিয়া পালাইতে পারিলে বাঁচে। ইহার কান্ড দেখিয়া তাহার ছোট বোন হেমলতার কথা মনে পড়িলো,আর বালিকা পালাইবার পূর্বেই সে উহার একহাতে ধরিয়া বন্দী করিল। না করিয়াই বা উপায় কি!এইসবের অর্থ বুঝিতে হইলে ইহাকে তাহার প্রয়োজন।
সঞ্জয় সারাদিন কিছুই মুখে তোলে নাই।রাত্রিতে ও সকালে দামিনী নিজে খাবার লইয়া দোতলায় সঞ্জয়ের ঘরে গিয়াছিল। কিন্তু সুবিধা কিছুই হয় নাই। অবশেষে উপায় না দেখিয়া লোক পাঠাইয়া নয়নতারাকে খবর দিয়াছে। নয়নতারা বালিকার মুখ হইতে ইহার বেশি কিছুই বাহির করিয়া লাইতে পারিলো না। তবে ইহা জানিলো যে দামিনী এই এই বাড়ির মালকিনের নাম।
সঞ্জয়ের ঘুম ভাঙিতে পারে বলিয়া নয়নতারার বালিকাটি সাথে নিচে নামিয়া আসিয়া ছিল। কথা শেষ হইতেই বালিকাটি নয়নতারার হাত হইতে ছুটি লইয়া পালাইয়া বাঁচিল। নয়নতারা সেখানেই বসিয়া চারিধারে চোখ বুলাইতেছিল। বাড়িতে কোন উৎসবের আয়োজন করা হইতেছে। বাড়িতে অনেক মহিলাদের সমাগম,কিন্তু পুরুষ বলতে কিছু বাড়ির কর্মকর্তা ও কাজের লোক ছাড়া আর বিশেষ কাহাকেও দেখা যাইতেছে না। নয়নতারা কমলা ও তার স্বামী কে খুঁজিয়া পাইলো না। তাহার ভাবসাব লক্ষ্য করিয়া দুই একজন মহিলা কথা বলিতে আসিয়াছিল।নয়নতারার ঘটনা সংক্ষেপে শুনিবার পরে তাহারা তাকে লইয়া আলোচনা করিতে বসিলো। নয়নতারা খুব জলদিই বুঝিলো ইহারা তাহাকে সরল ভাবিয়া আমোদ করিবার উপলক্ষে বসাইয়াছে,এছাড়া সঞ্জয় কে, তাহা ইহাদের জানা নাই। ব্যপারখানা বুঝিয়া নয়নতারা উহাদিগের সহিত আলোচনা জমজমাট করিয়া তুলিলো, এবং তাহাদের ছোট্ট সভাটির সকলেই অল্প সময়েই বুঝিয়া লইলো ইহাকে হাসির পাত্র বানাইতে গেলে চাল উল্টা পরিতে পারে।
সময় কাটিতে কাটিতে একসময় বেলা পরিয়া গেল।নয়নতারা দেখিলো কমলা ও তার স্বামী তাহাকে কিছু না বলিয়াই বিদায় হইয়াছে। এর মধ্যে সেই বালিকাটি নয়নতারার খাওয়ার ব্যবস্থা করিয়াছে এবং নয়নতারা তাহাকে লইয়া একটু কষ্ট করিয়া হইলেও সঞ্জয়কে খাটে শোয়ানোর ব্যবস্থা করিয়াছে। তারপর দোতলায় ঘুরিতে ঘুরিতে বাবুকে ঘুম পারাইতে ব্যস্ত হইয়াছে।
যখন সন্ধ্যা প্রায় হয় হয়,তখন হইতেই নিমন্ত্রিত মহিলাদের গাড়ি পিছনের গেটে আসিতে শুরু করিল। সারা বাড়িটা আলোয় জলমল করিতেছিল। যদিও এখন পুরো বাড়িটা সাজানো সম্পূর্ণ হয় নাই,তবুও এইসব দেখিয়া নয়নতারার অবাক হওয়া ছাড়া উপায় কি। এত সাজসজ্জা ত দূরের কথা এত বড় বাড়িই তো সে কখনো দেখে নাই। নয়নতারার মনে হইলো বাড়িখানা তার গ্রামের যে বড় জমিদার বাড়িটি আছে তার চাইতেও বড়। সাদা রঙের বাড়ির দেওয়ালে অনেক বড় বড় ছবি লাগানো। তার মধ্যে সিঁড়ির মুখেই একটি ছবিতে একটি পারিবারিক ছবি। ছবিতে এক বাঙ্গালী রমনী আর এক পুরুষ সাহেবের পোশাক পড়া, সাথে একটি ফুটফুটে ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে।
দোতলার বারান্দায় উঠিবার মুখে বড় ঝাড় জ্বলিতেছে। বাড়ির মেয়েরা অভ্যর্থনা করিয়া সকলকে উপরে পাঠাইয়া দিতেছিলেন। নিমন্ত্রিতা মেয়েরা কেহ মুচকি হাসিয়া, কেহ হাসির লহর তুলিয়া কেহ ধীর, কেহ ক্ষিপ্র, কেহ সুন্দর অপূর্ব গতি-ভঙ্গিতে সিঁড়ি বাহিয়া উপরে উঠিতেছেন। নয়নতারা দোতলার বারান্দায় দাঁড়াইয়া অনেকক্ষণ হইতে এইসব দেখিতেছিল। ওপড়ে বারান্দায় হইতে নিচের সিঁড়ি সহ সব দেখা যায়। এতো লোকজনের সমাগম আর তাহাদের সাজসজ্জা এ ধরনের দৃশ্য জীবনে সে এই প্রথম দেখিল। দেখিতে দেখিতে এক সময় সিঁড়ির নিচের ধাপে এক রমণীর দিকে নয়নতারার চোখ পরিলো। বয়স নয়নতারার মতো বা একটু বেশিও হইতে পারে,তবে অপূর্ব সুন্দরী বলা চলে। গায়ে চওড়া লালপাড় রেশমী শাড়ির সাথে তার দেহের রঙ মিলিয়া তার দেহের দুধে আলতা রং-এর আভা অপূর্ব ফুটিয়াছে। মাথার চুলে একখানি সোনার কাটায় আঁটা, সিঁড়ির বড় ঝাড়ের আলোয় গলার সরু সোনার চেন চিক চিক্ করিতেছিল, সুন্দর গড়ন তার,নয়নতারা মনে মনে ভাবিলো রমনীটি ঠিক কে হইতে পারে!
মেয়েটি নয়নতারার পাশ দিয়া সোজা সঞ্জয়ের ঘরের দিকে চলিল,এবং কক্ষের সম্মুখে একটু দাঁড়াইয়া ভেতরে দেখিবার পরূ আবারও তাহাকে পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতে ছিল। নয়নতারা অবাক হইয়া তা দেখিল,একবার ডাকিতেও ইচ্ছা করিয়াছিল।তবে ডাকিতে গিয়াও কথাগুলো গলায় দলা পাকাইয়া গেল,আর ডাকা হইলো। পরে অবশ্য জানিয়াছে উহার নামটিই সৌদামিনী তবে সকলেই তাহাকে দামিনী বলিয়া ডাকে।
সঞ্জয়ের ঘুম সন্ধ্যার আগে ভাঙ্গিয়া গেল। এবং ঘুম ভাঙ্গিতেই নিজেকে খাটে আবিষ্কার করিয়া একটু অবাক বোধকরি হইয়াছিল।তবে পরক্ষণেই বাবুকে তার পাশে দেখিয়া তার গলা শুকাইয়া গেল।নয়নতারার সহিত দেখা করিবার মত মানসিক অবস্থা তাহার ছিল না,এই মুহুর্তে নয়নতারার সহিত সাক্ষাৎ হইলে সে লজ্জায় কথা বলিতেই পারিবে না। ঐদিন রাত্রিতে সে নিজেকে কেন আকাইতে ব্যর্থ হইলো সে এখনও বুঝিয়া উঠতে পারে নাই। সে যাহা করিয়াছে উহা যে শুধুমাত্র নয়নতারার উপরে অন্যায় তা নয়, সে যে হেমলতার কাছেও দোষী হইয়াছে।
নয়নতারার সঙ্গে দেখা হইতে পারে বলিয়া সে উঠিয়া বাহিরে না গিয়া আগের চিঠিখানা শেষ করিতে বসিয়াছিল। চিঠি লেখা শেষ করিয়া যখন সে উঠিলো,দেখিল নয়নতারা দোরের মুখে দাঁড়িয়ে। সঞ্জয় তার বৌদিমণি কে দেখিয়া মাথা নত করিয়া দাড়াইয়া রহিলো। কিন্তু নয়নতারা কিছুই বলিল না।সে আগাইয়া সঞ্জয়ের হাতখানি ধরিয়া খাটে বসাইয়া সে নিজে খাবারের থালাখানি হাতে তুলিয়াই লইল।সঞ্জয়ের খাইবার ইচ্ছে না থাকিলেও নয়নতারা যখন নিজ হস্তে তার মুখে খাবার তুলিয়া ধরিলো,তখন তাহাকে না বলিবার সাহস সঞ্জয়ের হইলো না ।
////
তিন-চারদিন পরের ঘটনা, তালদিঘির ঘাটে একটি বড় নৌকা আসিয়া থামিল। এবং ছইয়ের ভেতর হইতে নয়নতারা ,তার পিতা ও সঞ্জয় ঘাটে নামিল। এই কদিন ঠিক কি হইয়াছে ইহা জানিতে বাটী অবধি যাইবার অপেক্ষা রাখিল না। তাহারা আনন্দে সহিত ফিরিলেও বাড়ি পৌঁছনোর আগেই সকলের মুখ গম্ভীর হইয়া গেল। বাড়িতে আসিয়া সব দেখিবার পর সঞ্জয়ের মুখের ভাব যাহা হইলো একবার দেখিয়াই নয়নতারার বুকের ভেতরে ধক করিয়া উঠিলো। দেখাগেল শুধু টাকা পয়সা নয়,টাকা পয়সার সাথে সঞ্জয়ের বাড়ি ও গঞ্জের দোকানের দলিলপত্র যা ছিল সব গেছে। ইহার পর হইতে সঞ্জয় ঠিক মতো বাড়িতে থাকে না। সকালে চিন্তিত মুখে বাহির হইয়া রাত্রিতে যে আর চিন্তিত মুখে বাড়ি ফিরিত।
বাড়ি অবস্থা যখন এইরুপ, তখন নয়নতারার মা তাহাদের বাড়ি ফিরিয়া গিয়াছে ইহাতে নয়নতারার লজ্জার শেষছিল না। সেই লজ্জা ক্রোধে পরিনত হইলো, যখন তাহাদের আসিবার খবরে তার স্বামী আসিয়া কহিল নয়নতারাকে সে বাড়িতে ফিরাইয়া নিতে আসিয়াছে। নয়নতারা তার স্বামী সাথে দেখা করিবে না বলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দোরে খিল আটিলো। নয়নতারার পিতা তখন ঘুমাইতেছে,সঞ্জয়ও বাড়িতে ছিল না।সুতরাং সোহমকে একাই আবার ফিরিয়া যাইতে হইল।
ইহার একদিন পরেই দুপুরে হঠাৎ সঞ্জয় আসিয়া রান্নাঘরের দোরের সম্মুখে দাঁড়াইল। নয়নতারার রান্নার কাজ তখন প্রায় শেষ। সঞ্জয়কে দেখিয়া নয়নতারার মুখে হাসি ফুটিলও তার কথা শুনিয়া নয়নতারার মুখখানি কঠিন ও গম্ভীর হইয়া গেল....
– বৌদিমণি! আমি ভেবে দেখলাম, দাদা ও বাড়িটা যখন ছাড়িয়ে এনেছে ত তোমাদের ওবাড়িতে ফিরে যাওয়া....
সঞ্জয় কথা শেষকরিবার আগেই নয়নতারার তার মুখের পানে চাহিয়া অতি সহজ স্বরে বলিল,
-আর যদি না যাই? কি করবে তুমি? জোর করে তাড়িয়ে দিতে পারবে ত?
সঞ্জয় নয়নতারার মুখের দিকে দেখিয়া আর কিছুই বলিতে সাহস করিল না। নয়নতারার আবারও তার হাতের কাজে মনোনিবেশ করি বলিল,
– এই রোদুরে দাঁড়িয়ে না থেকে স্নান করে এসো যাও,
সঞ্জয় চুপচাপ দাঁড়াইয়া কি যেন ভাবতেছিল,এমন সময় দেবু বাবুকে কোলে লইয়া রান্নাঘর দিকে আসিতেছে দেখিয়াই সঞ্জয় আগাইয়া বাবুকে কোলে লইতে গেল। তখনই নয়নতারা রান্নাঘর হইতে বলিল,
– বাবুকে আমার কাছে দে, কি হল! তোমায় না স্নান করতে বললাম..
এবার নয়নতারার চোখের কড়া দৃষ্টি সঞ্জয় দেখিতে পাইয়া আর দেরি না করিয়া সিঁড়ির দিকে পা বারাইলো।
দুপুরের সূর্য রুদ্র রূপ ধারণ করিয়াছিল।কিন্তু বিকেলের দিকে উত্তাপ অনেকটা কমিয়া আসিলো। নয়নতারার মন খুব একটা ভালো না থাকিলেও,সে ভাবিয়াছিল এক দুজন আসিলে একটু আলাপ করিয়া সময় কাটাইবে। কিন্তু কেহই আসিলো না। অবশেষে বসিয়া বসিয়া সে বড় বিরক্ত হইয়া উঠিলো।
তারপরে রোদ্রের তাপ যখন একদমই কমিয়া আসিলো,তখন সে তার শিশু পুত্রটিকে কোলে লইয়া সিঁড়ি বাহিয়া ছাদে উঠিবার উদ্যোগ নিল। তবে দোতলায় উঠিতেই তার চোখে পড়িলো; সঞ্জয় বারান্দায় এক গাছি চুড়ি হাতে লইয়া দেওয়ালে পিঠ দিয়া দাঁড়াইয়া। নয়নতারা একটু অবাক হইলো।এই সময় সঞ্জয়ের বাড়িতে থাকিবার কথা নয়। কৌতূহল নিবৃত্ত করিতে না পারিয়া নয়নতারা ধির পদক্ষেপে সঞ্জয়ের নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল।
সঞ্জয় চোখ বুঝিয়া ছিল এবং নিজের ভাবনার মাঝে এত মশগুল ছিল যে নয়নতারার পায়ের আওয়াজও তার কানে লাগিল না। সঞ্জয়ের হাতের কাঁচের চুড়ি গুলো দেখিয়া নয়নতারা ভাবিল ইহা বুঝি হেমলতা রাখিয়া গিয়াছে।সঞ্জয় ও তার বোনটির প্রণয়ের কথা নয়নতারার অনেক আগেই জানিয়াছিল। এই মুহুর্তে সঞ্জয়ের মলিন মুখখানি দেখিয়া তার মায়া হইল, সে হাত উঠাইয়া সঞ্জয়ের কাঁধে স্পর্শ করিতেই,হঠাৎ সঞ্জয় খপ্প করিয়া নয়নতারার হাতখানি তার বাঁ হাতের মুঠায় শক্ত করিয়া চাপিয়া ধরিল। এত জোরে ধরিল যে নয়নতারা ব্যথা পাইয়া "আঃ" বলিল মৃদু আর্তনাদ করিয়া উঠিলো। পরক্ষণেই নয়নতারাকে দেখিয়া হাতখানি ছাড়িয়া দিল।নয়নতারা এই ঘটনায় অবাক হইয়া গেল। সে সঞ্জয়ের মুখপানে চাহিয়া এক প্রকার অস্থিরতার ছাপ দেখিয়া ব্যাকুল কন্ঠে বলিল,
– কী হয়েছে?
সঞ্জয় কিছু বলিতে পারিলো না। তার মুখ দেখিয়া নয়নতারা বুঝিবার চেষ্টা করিলো, কিন্তু কিছুই সে বুঝিল না। একটা সন্দেহ করিয়া পরম স্নেহে আবার জিজ্ঞাসা করিল,
—কী হয়েছে তোমার? অসুখ বোধ করছ?
ততখনে সঞ্জয় নিজেকে সামলাইয়া গলার স্বর সহজ করিয়া বলিল,
–কিছুই হয়নি, তুমি এগুলি দেখ ত পছন্দ হয় কিনা। গত মেলায় কিনেছিলাম। হেমকে দিয়েছি, তোমারটা দেওয়া হয়নি।
নয়নতারা কিছু বলিল না,সে সঞ্জয়ের মুখের দিকেই চাহিয়া তার ডান হাতখানি আগাইয়া দিল।সঞ্জয় হাতখানি দিকে চোখ বুলাইয়া দেখিল কব্জি খানিকটা জায়গা লাল হইয়া গিয়াছে। সে কিছুটা লজ্জিত হইল। তার পর সস্নেহে হাতখানি তার বাঁ হাতে ধরিয়া,ডান হাতের থাকা, নীল রঙের সরু চুড়ি গুলি পরাইয়া দিতে লাগিল....... বেশি কিছু বলবো না,শুধু বলবো গল্প চলবে কি না!?