29-05-2024, 10:44 PM
(This post was last modified: 24-06-2024, 10:57 PM by কাদের. Edited 3 times in total. Edited 3 times in total.)
চ
সাফিনা রাতে শোবার আগে ভাবছেন আজকে দিনটার কথা। অন্য সব দিনের মত তবে অনেক আলাদা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। মিজবাহ বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। প্রতিদিন এটাই ওদের রুটিন। খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুইজন। এরপর শোয়ার সময় মিজবাহ বিছানায় এসে ফেসবুক চালায়। সাফিনা হাতে পায়ে নাইট ক্রিম মাখে। চুল আচড়ায়। এই সময় হয়ত দুইজনে টুকটাক কথা বলে। আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ কথা গুলো কি মিজবাহ এর সাথে শেয়ার করবে? আবার ভাবে আরেকটু শিওর হয়ে নেই। দিনের শুরুটাই হল সাবরিনার ফোন দিয়ে। সাবরিনা ফোন দিয়ে অল্প কথার পর শুরু করল মা আমার মনে হয় সিনথিয়ার ঐ জায়গায় বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুমি বললে ছেলেটা পলিটিক্স করে। আমাদের ফ্যামিলির সাথে পলিটিক্স করা ছেলে যায় না। আর সিনথিয়া এখন বিদেশে ভাল ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করছে। আর ছেলে পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তোমার কি মনে হয় চাচারা শুনলে কি বলবে? সাবরিনার এই প্রতিক্রিয়া আসবে এটা আগেই ভেবেছিল সাফিনা। তবে অবাক হল অন্য কারণে। কারণ সাবরিনা কে মাহফুজের কথা সাফিনা বলেছিল দুই তিন দিন আগে। সেদিন যখন ছেলে কি করে কেমন এইসব বলছিল তখন হু হা ছাড়া তেমন কোন উত্তর দেয় নি সাবরিনা। অবাক করার বিষয় ছিল সেটা। সাফিনা ভেবেছিল সিনথিয়া হয়ত তলে তলে বোন কে রাজি করিয়েছে। আবার আজকে ফোন দিয়ে এত তীব্রভাবে মানা করছে তাই হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারছে না সাফিনা। সাবরিনা বলল আমি এক সাপ্তাহের মধ্যে দেশে আসছি। আমার কাজ শেষ এখানে। তখন আসলে আর বিস্তারিত কথা হবে। তবে তুমি কিন্তু রাজি হয়ো না। সিনথিয়া সব সময় হুজুগে। কতগুলা প্রেম করেছে তুমি জান? সাফিনা অল্প একটু বলার চেষ্টা করেন যে সিনথিয়া কলেজ থেকে প্রেম করে এইটা তিনি অল্প বিস্তর জানতেন যদিও সরাসরি কখনো সেটা প্রকাশ করেন নি। তবে সাবরিনা তাহলে তুমি তো দেখলেই সিনথিয়া কেমন হুজুগে। এমন হুজুগে কোথাকার কোন ছেলে কে ধরে নিয়ে আসবে আর আমাদের রাজি হতে হবে। ফ্যামিলি হিসেবে তো আমাদের দ্বায়িত্ব আছে। আর ওর ঐখানে বিয়ে হলে সোসাইটিতে কি বলবে তুমি? মেয়ে জামাই পলিটিক্স করে? চাদা তুলে খায়? সাফিনা বলার চেষ্টা করেন যে ছেলের ব্যবসা আছে। সাবরিনা বলে দেখ গিয়ে এই ব্যবসা আসলে চাদা তোলার একটা অযুহাত। আর সিনথিয়া কে তুমি বুঝাও। যেখানে সেখানে বিয়ে করা যায় না। বিয়ে একটা লং টার্ম সম্পর্ক। প্রেম না যে চাইলাম করলাম আর চাইলাম ফেলে দিলাম। তুমি আর আব্বুর সম্পর্ক দেখে কিছু শিখছে না গাধী টা। প্রায় ২৭ বছরের সম্পর্ক তোমাদের। ফুফু কে দেখুক? বিশ বছরের সম্পর্ক তাদের। আর সিনথিয়া কিনা হঠাত হুজুগে মেতে একটা বিয়ে করতে চাইছে। ছয় মাস টিকবে না এটা আমি বলে রাখলাম। সাবরিনার এত তীব্র বাধা দেখে একটু অবাক হল সাফিনা। বলল তুই আমাকে যেগুলো বললি সেগুলো সিনথিয়া কে বল। সাবরিনা বলল মা তুমি জান আমি যদি এইগুলা ওকে বলি তাহলে প্রচন্ড ঝগড়া বাঝবে। সাফিনা জানেন কথা সত্য। দুই মেয়ের মধ্যে প্রচন্ড ভালবাসা থাকলেও তাদের মধ্যে রাগারাগি হয় প্রচুর। আর সিনথিয়ার মত জেদি মেয়ে সাবরিনার এইসব কথা মানবে না মোটেই বরং সেটাতে সিনথিয়ার জেদ বাড়বে আর। শেষে তাই বললেন ঠিক আছে তুই দেশে আয় তারপর কথা হবে। সিনথিয়ার বিয়ে নিয়ে ঝামেলা যে বাধবে এটা বুঝতে পারছিলেন। সাবরিনার মতামত সেই ঝড়ের ইংগিত দিল।
এরপর দুপুরের দিক এল মায়ের ফোন। সাফিনার মা থাকেন ময়মনসিংহ। মায়ের সাথে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক সাফিনা করিমের। এক সময় মা কে প্রচন্ড ভয় পেতেন। তবে সময়ের সাথে নিজেই এখন মধ্য বয়সে সাফিনা করিম। তাই সময়ের সাথে সাথে সেই ভয় কেটে গেছে আগেই। এক সময়ের দোদান্ড প্রতাপশালী আসমা বেগম সময়ে সাথে নরম হয়েছেন অনেক। নিজের মেয়েদের সাথে বা ভাইদের ছেলে মেয়েদের সাথে তার মা কে যখন দেখেন তখন অনেক সময় সাফিনা ভাবেন যে এই মা কি সেই রাগী মা। নাতী নাতনিদের অনেক দাবি দাওয়া বাবা মায়ের কাছ থেকে আদায় করে দেওয়ার হাতিয়ার আসমা বেগম। আর সাফিনা বা তার ভাইয়েরা যখন ছোট ছিল তখন কত ভয়টা না পেত মা কে। যদিও বাবা কে ভয় পেত আর বেশি। সেই মা আজকাল অনেক নরম। এইজন্য আজকে সকালে ফোনে কুশলাদী বিনিময়ের পর আসমা বেগম যখন সিনথিয়ার বিয়ে প্রসংগ টানলেন তখন মনে মনে হাসলেন সাফিনা করিম। সিনথিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে। এর আগের বার বাসায় প্রেমের প্রসংগ তুলে যেভাবে সবার কাছে বাধার মুখে পড়েছিল এইবার সেইভাবে কাজ করছে না। এক এক করে সবাই কে রাজি করাচ্ছে। আসমা বেগম এই প্রসংগ তুলেছেন মানে সিনথিয়া তার নানীকে অলরেডি রাজি করিয়ে রেখেছে। সাফিনা তাও না জানার ভান করে বললেন তোমার কাছে কোন ভাল পাত্র আছে নাকি নাত জামাই করার জন্য। আসমা বেগম বলেন দেখ, সিনথিয়া হয়ত তোকে বলবে তবে তার আগে আমি বলছি। ও একটা ছেলে কে ভালবাসে। আমি ছেলেটার সাথে কথা বলেছি। ভাল ছেলে। অত বড় ফ্যামিলি না তবে ওর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে ফ্যামিলি ভাল শিক্ষা দিয়েছে ছেলেটাকে। আর ব্যবসাও আছে। আমার মনে হয়েছে একদিন এই ছেলে ঠিক বড় কিছু করবে। সাফিনা হাসতে হাসতে বললেন তাহলে সিনথিয়া তোমাকে পটিয়ে ফেলেছে। আর মায়ের সাথে দেখা করানোর আগে প্রেমিক কে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছে। আসমা বললেন, তোদের তো আগেই বলেছে। আমাকে অনেক আগে দেখা করিয়েছিল। যখন তোরা বাধা দিচ্ছিলি। আমি তখন ভেবেছিলাম যাই নাতনির মন রক্ষা করি কিছুটা হলেও। আর সিনথিয়া যেমন করে উডনচন্ডী মেয়ে ছিল আমি ভেবেছিলাম এই ছেলে হয়ত দুই তিন মাস পর এমনিতে হাওয়া হয়ে যাবে নাহয় সিনথিয়া বাদ দিয়ে দিবে। তোরা সবাই তখন সিনথিয়া কে বকাঝকা করছিলি তাই আমি একটু ওকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য মাহফুজের সাথে দেখা করেছিলাম। সাফিনা হেসে বলেন তাহলে নামও জান। আসমা বললেন নাম জানব না কেন, নাতনীর পেয়ারের লোক। মা মেয়ে দুইজনে হাসেন একটু।
সাফিনা বলেন মা তুমি তো জান অনেক সমস্যা এই রকম সম্পর্কে। এই ছেলের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আমাদের থেকে কত আলাদা। আর মিজবাহ এর মতামত দরকার আছে ওর ফ্যামিলির বাকিদের মতামত নিতে হবে। সিনথিয়া এখনো ছোট, ওর সব কিছু ভালমন্দ যাচাই করার বয়স হয় নি। তাই আমাদের ভাল করে ভেবে দেখা উচিত না। আসমা বলেন মা বাবা হিসেবে তোরা সব যাচাই বাছাই করবি সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার তোর মা হিসেবে একটা কথা বলব। ছেলেটার সাথে ভালভাবে কথা না বলে ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোজ না নিয়ে খালি পলিটিক্স করে বা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড অত উচু না এইসব ভেবে আগেই না করে দিস না। আমার ধারণা ওর সাথে কথা বললে তোদের ভাল লাগবে। সাফিনা বলেলেন মা তোমারা আরেক নাতনী তো এমন না, সিনথিয়া এমন হল কিভাবে। সাবরিনা যখন সারাজীবন পড়াশুনা করল, আমাদের কথা মানল। এমন ছেলে কে বিয়ে করল যাতে আমাদের সাথে সব কিছু মিলে। আর সিনথিয়া করল সাবরিনার সব উলটো। এখন বিয়ের সময় এমন এক ছেলে কে নিয়ে আসল যার সাথে আমাদের মিল অনেক কম। দুই বোন এত আলাদা মাঝে মাঝে মনে হয় এরা আসলেই দুই বোন তো। আসমা বললেন সাবরিনা সিনথিয়া দুই বোন এটাতে ডাউট দেবার কিছু নেই। ওদের দিতে তাকালে আমার তোর কথা মনে হয়। সাফিনা বলল কিভাবে মা? আসমা বেগম বললেন, দেখ সাবরিনা তোর মত সব সময় পড়াশুনায় মনযোগী, বাসার কথা শুনছে। সাবরিনা হল তোর প্রকাশ্য ব্যক্তিত্ব। তবে তোর আরেকটা দিক আছে যেটা হয়ত আমি মা বলে জানি বা খেয়াল করি সেটার সাথে সিনথিয়ার মিল আছে অনেক। সাফিনা অবাক হন, এরকম ব্যাখ্যা আগে কখনো শুনেন নি তার মায়ের কাছ থেকে। তাই জিজ্ঞেস করলেন কিরকম মিল সিনথিয়ার সাথে মা। আমার তো মনে হয় আমার সাথে ওর কোন মিল নেই। আসমা হাসতে হাসতে বললেন তোরা খালি ওর পড়াশুনায় মনযোগের অভাব বা চঞ্চল মনটা দেখলি কিন্তু খেয়াল করে দেখ সিনথিয়া যখন ভালবাসে তখন প্রচন্ড আবেগের সাথে ভালবাসে। মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে। সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারে তখন। হয়ত ভাল ছেলের সাথে মিলেনি এর আগে তাই কোন সম্পর্ক অত দীর্ঘ হয় নি। তবে যতদিন ওর ভালবাসা ছিল প্রতিটা সম্পর্কে ততদিন কিন্তু পাগলের মত ভালবেসেছে। তুইও অনেকটা অমন। তুই যাকে ভালবাসিস তাকে মন খুলে ভালবাসিস। সিনথিয়ার মত তুইও প্রচন্ড আবেগী। আসমা বেগম সব সময় সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন কিন্তু আজকে এইভাবে নিজের দুই নাতনীর সাথে তার মেয়ের যেভাবে তুলনা করলেন তাতে মুগ্ধ হয়ে গেল সাফিনা। তার মনে হতে লাগল আসলেই সাবরিনা আর সিনথিয়া তার দুই রূপ। সাবরিনা তার প্রকাশ্য ব্যক্তিত্ব আর সিনথিয়া তার গোপন আবেগী ব্যক্তিত্ব। সাফিনা বললেন আমি আবার কবে ভালবাসলাম আবার এমন করে। আসমা বেগম বললেন কেন আমাদের জামাই বাবাজী কে তুই কি কম ভালবাসিস? আমি জানি গত দশ এগার বছর ধরে জামাই বাবাজী অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু তুই কি এতে ভালবাসা কমিয়েছিস। তোকে অত সময় দিতে পারে না সব সময় তবু তুই কিভাবে সব সামলে রাখছিস। মিজবাহ ছেলে ভাল তবে তোর বাবার মত ওর একটা খারাপ দিক আছে। বাইরের জগত নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে ঘরের ভিতর থাকা মনটা যে শুকিয়ে যায় অনেক সময় ভালবাসার অভাবে সেটা টের পায় না। সাফিনা আবার অবাক হন অনেক। তার মা যে এত ভাল করে তাকে আর মিজবাহ কে খেয়াল করে সেটা আগে কখনো বুঝে নি সাফিনা। তারপর আসমা বেগম আবার বলেন, তুইও এক সময় কিশোরী ছিলি। কেন পাড়ার নাটকের প্রাকটিসে যাবার জন্য মুখিয়ে থাকতি, রাস্তায় কে গেলে জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখতি সেটা কিন্তু আমি জানি। সাফিনার সব সময় মনে হত কাজল’দার প্রতি ওর গোপন ভালবাসা মা জানে কিন্তু সেটা কখনো নিশ্চিত হতে পারে নি। আজকে এত বছর পর তার মেয়ের কথা প্রসংগে সেটাই যেন উঠে আসল আবার। ফোনের ভিতরেও সাফিনা যেন বিস্ময় লুকাতে পারলেন না। বলে উঠলেন, মা তুমি জানতে এতদিন? আসমা বেগম খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন আন্দাজ করতে পারতাম। আমি নিজেও কিশোরী ছিলাম এক সময়, কিশোরী মনের চঞ্চলতা আর কিশোরী চোখের দৃষ্টি পড়তে পারা তাই আমার জন্য খুব কঠিন ছিল না। আর কাজল মারা যাবার পর বাসার ছাদে উঠে যে কাদতি সেটা আমি বুঝেছিলাম। আসলে তখন আমার হয়ত মা হিসেবে তোর কাছে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তোকে সান্তনা দেওয়া উচিত ছিল। তবে সমাজ আমাদের কিছু নিয়ম শিখিয়েছে তাই আমি সেই নিয়মের ভয়ে এগিয়ে যেতে পারি নি। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারি নি সব ঠিক হয়ে যাবে মা। আমার মনে হয়েছিল এইবার তোকে সান্তনা দিলে পরের বার আবার কোন প্রেমে পড়বি তখন আমি কিভাবে ঠেকাব তোকে। তোর বাবা কে তো চিনিস মরে গেলেও প্রেম মেনে নিত না কোন। তবে আমি যে ভুল করেছি নিজের মেয়ের সময় সেই ভুল আর করিস না নিজের মেয়ের সাথে। তোর মেয়ে যদি সুখী হয় তাহলে তোর উচিত সেই সুখী হওয়ার রাস্তায় তোর মেয়ে কে সাহায্য করা। আর মনে রাখিস তোর দুই মেয়ে তোর দুই দিক পেয়েছে। সাবরিনার সব কথা মানা যেমন তোর গুণ ঠিক সিনথিয়ার অন্ধ ভালবাসাও তোর থেকে পাওয়া। তাই সাবরিনার ভাল মেয়ের গুণগুলো কে যেমন সব সময় দাম দিয়েছিস ঠিক তেমন সিনথিয়ার ভালবাসাকেও গুরুত্ব দিস।
সাফিনা রাতে শোবার আগে ভাবছেন আজকে দিনটার কথা। অন্য সব দিনের মত তবে অনেক আলাদা। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসে চুল আচড়াচ্ছে। মিজবাহ বিছানায় আধশোয়া হয়ে মোবাইলে কিছু একটা দেখছে। প্রতিদিন এটাই ওদের রুটিন। খাওয়া দাওয়া শেষে কিছুক্ষণ টিভি দেখে দুইজন। এরপর শোয়ার সময় মিজবাহ বিছানায় এসে ফেসবুক চালায়। সাফিনা হাতে পায়ে নাইট ক্রিম মাখে। চুল আচড়ায়। এই সময় হয়ত দুইজনে টুকটাক কথা বলে। আজকের দিনের গুরুত্বপূর্ণ কথা গুলো কি মিজবাহ এর সাথে শেয়ার করবে? আবার ভাবে আরেকটু শিওর হয়ে নেই। দিনের শুরুটাই হল সাবরিনার ফোন দিয়ে। সাবরিনা ফোন দিয়ে অল্প কথার পর শুরু করল মা আমার মনে হয় সিনথিয়ার ঐ জায়গায় বিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। তুমি বললে ছেলেটা পলিটিক্স করে। আমাদের ফ্যামিলির সাথে পলিটিক্স করা ছেলে যায় না। আর সিনথিয়া এখন বিদেশে ভাল ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করছে। আর ছেলে পড়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তোমার কি মনে হয় চাচারা শুনলে কি বলবে? সাবরিনার এই প্রতিক্রিয়া আসবে এটা আগেই ভেবেছিল সাফিনা। তবে অবাক হল অন্য কারণে। কারণ সাবরিনা কে মাহফুজের কথা সাফিনা বলেছিল দুই তিন দিন আগে। সেদিন যখন ছেলে কি করে কেমন এইসব বলছিল তখন হু হা ছাড়া তেমন কোন উত্তর দেয় নি সাবরিনা। অবাক করার বিষয় ছিল সেটা। সাফিনা ভেবেছিল সিনথিয়া হয়ত তলে তলে বোন কে রাজি করিয়েছে। আবার আজকে ফোন দিয়ে এত তীব্রভাবে মানা করছে তাই হিসাবটা ঠিক মিলাতে পারছে না সাফিনা। সাবরিনা বলল আমি এক সাপ্তাহের মধ্যে দেশে আসছি। আমার কাজ শেষ এখানে। তখন আসলে আর বিস্তারিত কথা হবে। তবে তুমি কিন্তু রাজি হয়ো না। সিনথিয়া সব সময় হুজুগে। কতগুলা প্রেম করেছে তুমি জান? সাফিনা অল্প একটু বলার চেষ্টা করেন যে সিনথিয়া কলেজ থেকে প্রেম করে এইটা তিনি অল্প বিস্তর জানতেন যদিও সরাসরি কখনো সেটা প্রকাশ করেন নি। তবে সাবরিনা তাহলে তুমি তো দেখলেই সিনথিয়া কেমন হুজুগে। এমন হুজুগে কোথাকার কোন ছেলে কে ধরে নিয়ে আসবে আর আমাদের রাজি হতে হবে। ফ্যামিলি হিসেবে তো আমাদের দ্বায়িত্ব আছে। আর ওর ঐখানে বিয়ে হলে সোসাইটিতে কি বলবে তুমি? মেয়ে জামাই পলিটিক্স করে? চাদা তুলে খায়? সাফিনা বলার চেষ্টা করেন যে ছেলের ব্যবসা আছে। সাবরিনা বলে দেখ গিয়ে এই ব্যবসা আসলে চাদা তোলার একটা অযুহাত। আর সিনথিয়া কে তুমি বুঝাও। যেখানে সেখানে বিয়ে করা যায় না। বিয়ে একটা লং টার্ম সম্পর্ক। প্রেম না যে চাইলাম করলাম আর চাইলাম ফেলে দিলাম। তুমি আর আব্বুর সম্পর্ক দেখে কিছু শিখছে না গাধী টা। প্রায় ২৭ বছরের সম্পর্ক তোমাদের। ফুফু কে দেখুক? বিশ বছরের সম্পর্ক তাদের। আর সিনথিয়া কিনা হঠাত হুজুগে মেতে একটা বিয়ে করতে চাইছে। ছয় মাস টিকবে না এটা আমি বলে রাখলাম। সাবরিনার এত তীব্র বাধা দেখে একটু অবাক হল সাফিনা। বলল তুই আমাকে যেগুলো বললি সেগুলো সিনথিয়া কে বল। সাবরিনা বলল মা তুমি জান আমি যদি এইগুলা ওকে বলি তাহলে প্রচন্ড ঝগড়া বাঝবে। সাফিনা জানেন কথা সত্য। দুই মেয়ের মধ্যে প্রচন্ড ভালবাসা থাকলেও তাদের মধ্যে রাগারাগি হয় প্রচুর। আর সিনথিয়ার মত জেদি মেয়ে সাবরিনার এইসব কথা মানবে না মোটেই বরং সেটাতে সিনথিয়ার জেদ বাড়বে আর। শেষে তাই বললেন ঠিক আছে তুই দেশে আয় তারপর কথা হবে। সিনথিয়ার বিয়ে নিয়ে ঝামেলা যে বাধবে এটা বুঝতে পারছিলেন। সাবরিনার মতামত সেই ঝড়ের ইংগিত দিল।
এরপর দুপুরের দিক এল মায়ের ফোন। সাফিনার মা থাকেন ময়মনসিংহ। মায়ের সাথে যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক সাফিনা করিমের। এক সময় মা কে প্রচন্ড ভয় পেতেন। তবে সময়ের সাথে নিজেই এখন মধ্য বয়সে সাফিনা করিম। তাই সময়ের সাথে সাথে সেই ভয় কেটে গেছে আগেই। এক সময়ের দোদান্ড প্রতাপশালী আসমা বেগম সময়ে সাথে নরম হয়েছেন অনেক। নিজের মেয়েদের সাথে বা ভাইদের ছেলে মেয়েদের সাথে তার মা কে যখন দেখেন তখন অনেক সময় সাফিনা ভাবেন যে এই মা কি সেই রাগী মা। নাতী নাতনিদের অনেক দাবি দাওয়া বাবা মায়ের কাছ থেকে আদায় করে দেওয়ার হাতিয়ার আসমা বেগম। আর সাফিনা বা তার ভাইয়েরা যখন ছোট ছিল তখন কত ভয়টা না পেত মা কে। যদিও বাবা কে ভয় পেত আর বেশি। সেই মা আজকাল অনেক নরম। এইজন্য আজকে সকালে ফোনে কুশলাদী বিনিময়ের পর আসমা বেগম যখন সিনথিয়ার বিয়ে প্রসংগ টানলেন তখন মনে মনে হাসলেন সাফিনা করিম। সিনথিয়া বুদ্ধিমতী মেয়ে। এর আগের বার বাসায় প্রেমের প্রসংগ তুলে যেভাবে সবার কাছে বাধার মুখে পড়েছিল এইবার সেইভাবে কাজ করছে না। এক এক করে সবাই কে রাজি করাচ্ছে। আসমা বেগম এই প্রসংগ তুলেছেন মানে সিনথিয়া তার নানীকে অলরেডি রাজি করিয়ে রেখেছে। সাফিনা তাও না জানার ভান করে বললেন তোমার কাছে কোন ভাল পাত্র আছে নাকি নাত জামাই করার জন্য। আসমা বেগম বলেন দেখ, সিনথিয়া হয়ত তোকে বলবে তবে তার আগে আমি বলছি। ও একটা ছেলে কে ভালবাসে। আমি ছেলেটার সাথে কথা বলেছি। ভাল ছেলে। অত বড় ফ্যামিলি না তবে ওর সাথে কথা বলে মনে হয়েছে ফ্যামিলি ভাল শিক্ষা দিয়েছে ছেলেটাকে। আর ব্যবসাও আছে। আমার মনে হয়েছে একদিন এই ছেলে ঠিক বড় কিছু করবে। সাফিনা হাসতে হাসতে বললেন তাহলে সিনথিয়া তোমাকে পটিয়ে ফেলেছে। আর মায়ের সাথে দেখা করানোর আগে প্রেমিক কে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিয়েছে। আসমা বললেন, তোদের তো আগেই বলেছে। আমাকে অনেক আগে দেখা করিয়েছিল। যখন তোরা বাধা দিচ্ছিলি। আমি তখন ভেবেছিলাম যাই নাতনির মন রক্ষা করি কিছুটা হলেও। আর সিনথিয়া যেমন করে উডনচন্ডী মেয়ে ছিল আমি ভেবেছিলাম এই ছেলে হয়ত দুই তিন মাস পর এমনিতে হাওয়া হয়ে যাবে নাহয় সিনথিয়া বাদ দিয়ে দিবে। তোরা সবাই তখন সিনথিয়া কে বকাঝকা করছিলি তাই আমি একটু ওকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য মাহফুজের সাথে দেখা করেছিলাম। সাফিনা হেসে বলেন তাহলে নামও জান। আসমা বললেন নাম জানব না কেন, নাতনীর পেয়ারের লোক। মা মেয়ে দুইজনে হাসেন একটু।
সাফিনা বলেন মা তুমি তো জান অনেক সমস্যা এই রকম সম্পর্কে। এই ছেলের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড আমাদের থেকে কত আলাদা। আর মিজবাহ এর মতামত দরকার আছে ওর ফ্যামিলির বাকিদের মতামত নিতে হবে। সিনথিয়া এখনো ছোট, ওর সব কিছু ভালমন্দ যাচাই করার বয়স হয় নি। তাই আমাদের ভাল করে ভেবে দেখা উচিত না। আসমা বলেন মা বাবা হিসেবে তোরা সব যাচাই বাছাই করবি সেটাই স্বাভাবিক। তবে আমার তোর মা হিসেবে একটা কথা বলব। ছেলেটার সাথে ভালভাবে কথা না বলে ওর ফ্যামিলি সম্পর্কে খোজ না নিয়ে খালি পলিটিক্স করে বা ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড অত উচু না এইসব ভেবে আগেই না করে দিস না। আমার ধারণা ওর সাথে কথা বললে তোদের ভাল লাগবে। সাফিনা বলেলেন মা তোমারা আরেক নাতনী তো এমন না, সিনথিয়া এমন হল কিভাবে। সাবরিনা যখন সারাজীবন পড়াশুনা করল, আমাদের কথা মানল। এমন ছেলে কে বিয়ে করল যাতে আমাদের সাথে সব কিছু মিলে। আর সিনথিয়া করল সাবরিনার সব উলটো। এখন বিয়ের সময় এমন এক ছেলে কে নিয়ে আসল যার সাথে আমাদের মিল অনেক কম। দুই বোন এত আলাদা মাঝে মাঝে মনে হয় এরা আসলেই দুই বোন তো। আসমা বললেন সাবরিনা সিনথিয়া দুই বোন এটাতে ডাউট দেবার কিছু নেই। ওদের দিতে তাকালে আমার তোর কথা মনে হয়। সাফিনা বলল কিভাবে মা? আসমা বেগম বললেন, দেখ সাবরিনা তোর মত সব সময় পড়াশুনায় মনযোগী, বাসার কথা শুনছে। সাবরিনা হল তোর প্রকাশ্য ব্যক্তিত্ব। তবে তোর আরেকটা দিক আছে যেটা হয়ত আমি মা বলে জানি বা খেয়াল করি সেটার সাথে সিনথিয়ার মিল আছে অনেক। সাফিনা অবাক হন, এরকম ব্যাখ্যা আগে কখনো শুনেন নি তার মায়ের কাছ থেকে। তাই জিজ্ঞেস করলেন কিরকম মিল সিনথিয়ার সাথে মা। আমার তো মনে হয় আমার সাথে ওর কোন মিল নেই। আসমা হাসতে হাসতে বললেন তোরা খালি ওর পড়াশুনায় মনযোগের অভাব বা চঞ্চল মনটা দেখলি কিন্তু খেয়াল করে দেখ সিনথিয়া যখন ভালবাসে তখন প্রচন্ড আবেগের সাথে ভালবাসে। মনপ্রাণ দিয়ে ভালবাসে। সব কিছু বিলিয়ে দিতে পারে তখন। হয়ত ভাল ছেলের সাথে মিলেনি এর আগে তাই কোন সম্পর্ক অত দীর্ঘ হয় নি। তবে যতদিন ওর ভালবাসা ছিল প্রতিটা সম্পর্কে ততদিন কিন্তু পাগলের মত ভালবেসেছে। তুইও অনেকটা অমন। তুই যাকে ভালবাসিস তাকে মন খুলে ভালবাসিস। সিনথিয়ার মত তুইও প্রচন্ড আবেগী। আসমা বেগম সব সময় সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন কিন্তু আজকে এইভাবে নিজের দুই নাতনীর সাথে তার মেয়ের যেভাবে তুলনা করলেন তাতে মুগ্ধ হয়ে গেল সাফিনা। তার মনে হতে লাগল আসলেই সাবরিনা আর সিনথিয়া তার দুই রূপ। সাবরিনা তার প্রকাশ্য ব্যক্তিত্ব আর সিনথিয়া তার গোপন আবেগী ব্যক্তিত্ব। সাফিনা বললেন আমি আবার কবে ভালবাসলাম আবার এমন করে। আসমা বেগম বললেন কেন আমাদের জামাই বাবাজী কে তুই কি কম ভালবাসিস? আমি জানি গত দশ এগার বছর ধরে জামাই বাবাজী অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কিন্তু তুই কি এতে ভালবাসা কমিয়েছিস। তোকে অত সময় দিতে পারে না সব সময় তবু তুই কিভাবে সব সামলে রাখছিস। মিজবাহ ছেলে ভাল তবে তোর বাবার মত ওর একটা খারাপ দিক আছে। বাইরের জগত নিয়ে এত ব্যস্ত থাকে ঘরের ভিতর থাকা মনটা যে শুকিয়ে যায় অনেক সময় ভালবাসার অভাবে সেটা টের পায় না। সাফিনা আবার অবাক হন অনেক। তার মা যে এত ভাল করে তাকে আর মিজবাহ কে খেয়াল করে সেটা আগে কখনো বুঝে নি সাফিনা। তারপর আসমা বেগম আবার বলেন, তুইও এক সময় কিশোরী ছিলি। কেন পাড়ার নাটকের প্রাকটিসে যাবার জন্য মুখিয়ে থাকতি, রাস্তায় কে গেলে জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখতি সেটা কিন্তু আমি জানি। সাফিনার সব সময় মনে হত কাজল’দার প্রতি ওর গোপন ভালবাসা মা জানে কিন্তু সেটা কখনো নিশ্চিত হতে পারে নি। আজকে এত বছর পর তার মেয়ের কথা প্রসংগে সেটাই যেন উঠে আসল আবার। ফোনের ভিতরেও সাফিনা যেন বিস্ময় লুকাতে পারলেন না। বলে উঠলেন, মা তুমি জানতে এতদিন? আসমা বেগম খানিকটা চুপ করে থেকে বললেন আন্দাজ করতে পারতাম। আমি নিজেও কিশোরী ছিলাম এক সময়, কিশোরী মনের চঞ্চলতা আর কিশোরী চোখের দৃষ্টি পড়তে পারা তাই আমার জন্য খুব কঠিন ছিল না। আর কাজল মারা যাবার পর বাসার ছাদে উঠে যে কাদতি সেটা আমি বুঝেছিলাম। আসলে তখন আমার হয়ত মা হিসেবে তোর কাছে এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল। তোকে সান্তনা দেওয়া উচিত ছিল। তবে সমাজ আমাদের কিছু নিয়ম শিখিয়েছে তাই আমি সেই নিয়মের ভয়ে এগিয়ে যেতে পারি নি। তোর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে পারি নি সব ঠিক হয়ে যাবে মা। আমার মনে হয়েছিল এইবার তোকে সান্তনা দিলে পরের বার আবার কোন প্রেমে পড়বি তখন আমি কিভাবে ঠেকাব তোকে। তোর বাবা কে তো চিনিস মরে গেলেও প্রেম মেনে নিত না কোন। তবে আমি যে ভুল করেছি নিজের মেয়ের সময় সেই ভুল আর করিস না নিজের মেয়ের সাথে। তোর মেয়ে যদি সুখী হয় তাহলে তোর উচিত সেই সুখী হওয়ার রাস্তায় তোর মেয়ে কে সাহায্য করা। আর মনে রাখিস তোর দুই মেয়ে তোর দুই দিক পেয়েছে। সাবরিনার সব কথা মানা যেমন তোর গুণ ঠিক সিনথিয়ার অন্ধ ভালবাসাও তোর থেকে পাওয়া। তাই সাবরিনার ভাল মেয়ের গুণগুলো কে যেমন সব সময় দাম দিয়েছিস ঠিক তেমন সিনথিয়ার ভালবাসাকেও গুরুত্ব দিস।