27-05-2024, 05:03 PM
পর্ব ১২
সন্ধ্যায় উদাস সজল চোখদুখানি মেলে,নয়নতারার জানালার গরাদের বাহিরে পথের পানে চেয়ে কি যেন দেখছিল। অন্ধকার গলিটি বাড়ি পেছন দিকে। গলিটির আয়তন সরু হলেও তার আয়োজন বিশাল ।কত দোকান, কত ঘর ও কত রকম মানুষের আনাগোনা।এতকিছুর মধ্যেও নয়নতারার চোখ দুখানি সামনের দোতলা বাড়িটির দিকে নিবদ্ধ।
এপাশের জানালা খোলা বারণ।তবুও কোন এক অবেধ্য কৌতুহলের বশে নয়নতারা প্রতিদিন নিয়ম করিয়া বসে এখানে।নিষিদ্ধ কাজে উত্তেজনা বেশি; বোধকরি লোকে কিছু ভুল বলে নাই। কথাটি নিতান্তই সত্য বলিয়াই মনে হয়।
ঘটনাটি ছোট। যে দিন প্রথম সে এখানে এলো,সেদিনের পরেই এমনি সন্ধ্যায় নয়নতারা জানালা খুলে একটি বার বাইরে চোখ বুলায়। আর সেই এক নজরে যা তার চোখে পড়ে তা সংক্ষেপে বলতে গেলে এই রুপ যে; এক মাতাল পুরুষের হাত ধরে একটি রমনী এই বাড়িটা থেকে টানতে টানতে বেড়িয়ে আসছে,রমনীর কোল এক শিশু সন্তান। ঘটনাটি প্রথমে না বুঝলেও পরে একজনের কাছে জানলো ওবাড়িতে খারাপ মেয়েছেলে থাকে।ঘটনা শোনার পর নয়নতারার চোখের সামনেই তার স্বামীর মুখখানি যেন বেসে ওঠে একবার। সন্ধ্যায় দেখা মেয়েটির সাথে তার কি কোন মিল আছে! তার ভালোবাসার মানুটিও যে একি অবস্থা। যে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে সে পালিয়ে এলে এতো দূরে,তা যেন চোখের সামনে তুলে ধরে নিষ্ঠুর সৃষ্টিকর্তা অট্টহাসি হাসছে।থেকে থেকে কেউ যে বলে উঠছে,"দেখ পোড়ামুখি দ্যাখ এই তোর পরিনতি,কি হবে ওত রূপ দিয়ে!" তখন এই অভাগীনির বালিশে মুখ লুকাইয়া খাটে এক কোণায় পরিয়া থাকে। প্রশ্নের উত্তর মিলাইয়া লইতে অক্ষম বলিয়াই হয়তোবা কাঁদে।
প্রতি দিন খাবার সময় নয়নতারা সঞ্জয়ের পাশে বসে ।তবে খাবার খাওয়ার জন্যে নয়, সঞ্জয়ের খাওয়া কোন ত্রুটি হচ্ছে কি না তার তদারকি করতেই তার আসন গ্রহণ। এটা নয়নতারা কাছে স্বাভাবিক হলেও সঞ্জয়ের কাছে একদম নতুন। বাড়ি থাকতে এই ব্যপারখানা সে একদমই লক্ষ্য করেনি।এখন নতুন জায়গায় আসিয়া এ যেন তার নতুন আবিষ্কার।
বাড়িতে বেশিরভাগ সময় হেমলতাই পাখা হাতে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো।প্রথম প্রথম কাছে আসার সাহস না করলেও,পরে ব্যপারখানা স্বাভাবিক হয়ে গেছিল এক রকম।তবে নয়নতারা বিষয়টি ভিন্ন।
ঠিক কি কারণে এই ভিন্ন অনুভূতি তা বোঝানো মুশকিল। সে ছোটবেলা থেকেই একা মানুষ। এই সব সেবা-যত্ন থেকে সে সম্পূর্ণই বঞ্ছিত। তাই ব্যপারখানা ঠিক হজম করাও মুশকিল। তার ওপড়ে অভিনাথ ও তার বৌ রিতিমত আপদ হয়ে তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। আগে জানলে এদের সে নৌকায় তোলে! জ্বালানি মারলে একেবারে।
কলকাতা যাত্রার সঞ্জয়ের ভাবনা ছিল সরল।নৌকায় স্টেশন, ট্রেনে কলকাতা। তারপর সোজা তার বন্ধুর বাড়িতে ওঠা। তার বন্ধুর বাবা কলকাতা বড় উকিল।সঞ্জয়কে তাহারা বিশেষ চোখে দেখে ও খুব স্নেহ করে।তাছাড়া সে আগে থেকেই চিঠি লিখে দিয়েছিল। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব,কাকা-কাকিমার স্নেহ, তাই চিঠির উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোজাসুজি চলে আসা। কিন্তু হায় কপাল! এসে দেখে তার বন্ধু মাসখানেক হলো দেশের বাইরে। অবশ্য এতেও উপায় করে নিতে তার সমস্যা হতো না।যদি সে সাথে করে আপদগুলোকে বয়ে না আনতো। নয়নতারা তার নতুন সই ও তার স্বামীর কথায় সঞ্জয়কে এক রকম জোর করিতে লাগলো। অবশেষে হাসপাতালের কাজ শেষে শ্যামবাজারে পৌঁছতেই সন্ধ্যা। আর তখনই জানা গেল, অভিনাথ যে বাড়িতে থাকে সে বাড়িটিতে সব ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েগেছে। অবশেষে ঘন্টা খানেক পরে থাকার ব্যবস্থা হইলো। আবারও যাত্রা করিয়া এক তেতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিলো। তেতলা বাড়িটির দুটি ঘর খালি আছে,তার মধ্যে একটি থাকার উপযোগী। আর একটিতে মানুষ থাকিতে পারে ইহা নয়নতারার মনে হইলো না।
সুতরাং থাকতে হইলে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে থাকা ছাড়া উপায় নাই। নয়নতারার ইহাতে সমস্যা না থাকিলেও সঞ্জয় সম্মতি পোষণ করিতে পারিলো না। যদিও নয়নতারা তাকে খুব করিয়া বুঝাইতে লাগিলো এই যে। কি এমন ক্ষতি হইবে, সে তো নয়নতারার সহিত আগেও এক ঘরে অনেকবার থাকিয়াছে।অবশ্য তখন সে একটু কাঁচা বয়সের ছিল বটে। তবুও সে সেকথা ভুলিয়া যাইবে তা কি হয়। মাঝেমধ্যে সে যখন সকাল হইতে না খাইয়া, শেষে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হইয়া রাতের আঁধারে লুকাইয়া তার বৌদিমণির সরনাপন্ন হইতো। নয়নতারা তখন বুকে জড়াইয়া তার মুখে ভাত তুলিয়া দিত। তার দাদা না থাকিলে বৌদিমণির সাথে ঘুমাইতে বা ঘুম কামাই করিয়া গল্প করিতে তার বাধাঁ ছিল না কখনোই। কিন্তু আজ। হায়! আজ সে কথা মনে আনিতেই তার হৃদয়খানি ঘ্রাণায় পরিপূর্ণ হইতে দেরি করিলো না। এক সময়ের সেই সরল ভালোবাসা যে এত দ্রুত পরিবর্তিত হইতে পারে এই কি তার জানা ছিল। নিজেকে নিজেই ঠিক বিশ্বাস করার সাহস হলো না।এই কয়েকদিনের ব্যবধানে তার হৃদয়ে পরিবর্তনের কথা বৌদিমণি না জানলেও তার নিজের তো অজানা নয়। অবশ্য নয়নতারা যদিও এই ব্যপারখানা একদমই যে লক্ষ্য করে নাই, তাও নয়। তবে সচরাচর পুরুষের মনের গতিবিধি দ্রুতগামী। তাই নয়নতারার ভাবনার সীমানা সঞ্জয় যে কখন পার হয়ে গেছে তা বোঝার মতো অবসর সে পায় নাই।
তবে ভাড়া বাড়ির সবাই তাদে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জানিলেও,সঞ্জয় রাত্রি কালে হাসপাতালে থাকা শুরু করলো। যদিও হাসপাতাল বেশি দূরে ছিল না। কিন্তু ভাড়াবাড়িতে এই খবর ছড়িয়ে পরেতেও খুব বেশি দেরি হলো না। বেচারী নয়নতারা!একদিকে স্বামীর লাঞ্ছনা বুকে লইয়া দেশ ছাড়া,তারপর গ্রাম।এখন এই কলকাতাতেও তাই হইবে। সঞ্জয় স্বামী না হইয়াও লোকের কথায় মনের অজান্তেই নয়নতারার মনে আঘাত দিতে লাগিলো। অবশ্য লোকের দোষ কি আর! নয়নতারা নিজে যখন দেবরকে স্বামী বলিয়া মিথ্যা প্রসংশায় মিথ্যা হাসি হাসিয়া ছিল।সঞ্জয়ের আচরণ, কথাবার্তায় ও কাজে মুগ্ধ দুএকটি রমনীর ইর্ষান্বিত চক্ষু দেখিয়া মৃদু অহংকারে বুক যে তাহার কিছুটা ফুলিয়া ওঠে নাই ,এ কথায় বা বলিবে কি করিয়া। তোমরা হয়তো ভাবিতেছো, লেখক মহাশয় তোমাদের সরল পাইয়া গুল মারিতেছে। উহাদের স্বামী-স্ত্রী বলিয়া কে মানিবে! তবে বলি শোন,
নয়নতারা বিবাহ যগন হয় তখন তার বয়স ১৫।তাছাড়াও নয়নতারাকে দেখিলে তার বয়স আন্দাজ করিয়া লওয়া রিতিমত মুশকিল। নয়নতারার সর্বাঙ্গের গড়নটিও কিন্তু চমৎকার।বাঙালি গৃহস্থ সংসারের মেয়েদের সচরাচর এমন গড়ন দেখা যায় না। সে হিসাবে নয়নতারা বাস্তবিকই অসাধারণ।
আর সেই সাথে তার সুন্দর মুখশ্রী ও চারিত্রিক গুনাবলীর দারা যে কোন কবিকে সে অনায়াসে মুগ্ধ করিতে পারে। তবে ঘটনাটা নিছক মাতৃমূলক। নয়নতারার মার অনেক বয়স হইয়াছে,কিন্তু এখনও তার শরীরের বাঁধুনি দেখিলে অনেক রমনীর ইর্ষা বোধ হয়। সেই হিসাবে তার দুই কন্যা যে কেমন তা আপাততঃ পাঠক-পাঠিকা দের আন্দাজ করিয়া লইতে অসুবিধা হাইবে না বলিয়াই আশা করি। আর এদিকে সঞ্জয়ের লম্বা চওড়া এহাড়া বলিষ্ঠ দেহ দিখিয়া কাহারও অনুমানে সন্দেহ হয় না যে ইহা নয়নতারার স্বামী নহে। বরং আকার আয়তনে সকল দিক হইতে যেখানে নয়নতারা সঙ্গে খাপ খায়,সেখানে বয়সে তারতম্য ঠিক চোখে পরে না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও আড়ালে লোকের মুখে তাহাকে এই রুপ শুনিতে হয়,
– গতরখানি দেখেছ মাগীর,দেখলেই দুচোখ জলে আমার। ওদিকে স্বামীটাকে একদিনও ঘরে থাকতে দেখলাম না দিদি। কি হবে ওত রূপ দিয়ে।
– শুধু গতরখানি থাকলেই তো আর হয় না, ওবাড়ির বউটিকে দেখ না। ও কি দেখতে খারাপ নাকি! তার পরেও স্বামী মদ খেয়ে বেশ্যাখানা পরে থাকে। বলি সবার কপালে কি আর স্বামী সুখ হয়। আগের জন্মে নির্ঘাত খুব বড়ো ধরনের পাপ করছিল, তাই এই অবস্থা।
পাপ! পাপ বটে!”নয়নতারা শুনিলেও,যেন শুনিতে পায়নায় এমন ভাব করিয়া নতমস্তকে আপনার কাজ করিয়া যায়।
//////
দুদিনের মধ্যেই পত্র আসিলো। চিঠি পড়িয়া হেমলতা তার উত্তর করিলেও, চিঠি পড়িতে পড়িতে তার মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। যদিও তাহার পিতার সুস্থতায় তার এই রূপ ব্যবহারে সে ক্ষণে ক্ষণে আপন মনে নিজেকেই ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। যদিও তাহার অপরাধ খানির ওজন খুব বেশি নহে।
তার পরেও এই অবুঝ তরুণী কিছুতেই বুঝিতে পারে না তার পত্রখানি সঞ্জয় কেন পায় নাই।সঞ্জয় চিঠিতে লিখিয়াছে তাহাদের ফিরিতে আর কিছু দিন বিলম্ব আছে। তাই সে আবারও পত্র লিখিয়া পাঠাইলো।আর তিনদিন পরেই কলকাতার চিঠি আসিলো।এবারের চিঠিখানা সে সকাল হইতেই পড়িবে পড়িবে করিয়াও পড়িতে পারে নাই। তাই এই গভীর রাত্রে জানালার পাশে দাঁড়াইয়া পত্রখানি খুলিয়া চোখের সামনে মেলিয়া পড়তে আরম্ভ করিল,
“প্রিয়তমা,
তুমি আমার কোন চিঠিরই উত্তর দিলে না? ভালোই করিয়াছ। ঠিক কথা তো লেখা যায় না, তোমার যা জবাব, সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম। তবে আশা করিতেছি এই আনমনা অংশুমালীর, এই নিভৃত বেদন জর্জরিত অবজ্ঞা চিত্তচারীর দেওয়া, সুনিবিড় মায়া সঞ্চিত অমৃতধারা টুকু, অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করিয়া, তোমার সপ্রভ হৃদয় নিকুঞ্জ নিকেতনে স্থান দিয়া, ধন্য করিবে।
হয়তো তোমার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র লিপিখানি যথেষ্ট নয়, তবুও পীনোন্নত প্রতিচ্ছবি হইয়া তোমাকে অনুরোধ করিতেছি, তুমি আমার উপড় রাগ বা অভিমান করিও না। বিলম্ব করিয়া হইলেও যে প্রত্যাশা মনের ভিতর প্রতিভাত করিয়া দুটি কথা তোমাকে লিখিতেছি, তার কতটুকু মূল্য তোমার নিকট হইতে পাইবো জানিনা। তবে এই চিঠিখানি পাইবার পর যদি অতি সামান্যতম রাগ, বিরাগ, ব্যথা, বিরহ, টান, কষ্ট, ভালবাসা ইত্যাদির যেকোন একটি তোমার মনে অনুভূত হইয়া থাকে তবে আমার এই লেখা স্বার্থক হইবে।
তবে অনাদিকালের রূপ-লাবণ্য সমাহিত, এই সুন্দরী কল্লোলিনী ধরনী পারে আমার এমন কোন সুদীপ্ত-চন্দ্র উপহার বলি নাই, যাহা উৎসর্গিত করিয়া তোমাকে সুখের চূঁড়াতে ফুল দিতে বলিব। তবুও আমার মনের চির ঝংকৃত অলঙ্কার হইতে, যে ঝলমল সুতীব্র ভালবাসা তোমার জন্য অবিরাম দোলায়িত হয় মাধুকরী ছন্দে, সেই ভালবাসা, নিতান্ত তোমার জন্যই যে গভীর কোমল টান, সেই টান, সেই ভালবাসা তোমার নিষ্পাপ মন মন্দির পিঞ্জরে সমাধি করিয়া আমাকে ঋণী করিও....”
হেমলতা এইটুকুই পড়িয়া চিঠিখানা বুকে জড়াইয়া কাঁদিয়ে লাগিল। কোন চিঠিই তার কাছে পৌঁছায় নাই!কিন্তু কি করিয়া ইহা সম্ভব! সেই প্রতেকটি পত্রের জবাব দিয়াছে,তবে!
রাত্রি গভীর। শুক্লপক্ষের কয়েকটা রাত্রিতে আকাশের ওই পুরোনো চাঁদটির কাছ হইতে এমন জ্যোৎস্নাই পৃথিবীতে ভাসিয়া আসে যে দেখিলে মানুষের মন কেমন করে।এমনই জ্যোৎস্নায় অনেক রাত্রে হেমকে ছাদে উঠিতে দেখা গেল। রাতে আধাঁরে ইহা দেখিয়া নিস্তব্ধ প্রকৃতি শন শন শব্দ জানাইয়া দিলে যে সে একা জাগিয়া নাই। সেই সাথে উজ্জ্বল নক্ষত্র পুঞ্জ যেন একত্র হইয়া নিঃশব্দে জানাইয়া দিল ভয় কিসে তাহারা পাহারায় বসিয়াছে।
প্রথম প্রথম আলিসা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া হেম সঞ্জয়ের কথা ভাবিতো। চোখের পাতা বন্ধ করিলেই সামনে ভাসিয়া আসিতো এমন এক নিঝুম রাতের কথা। মনে পরিতো তাহাকে বুকে জড়াইয়া আলিঙ্গন তরে এক সুপুরুষের কথা। তার শ্বাসরোধী প্রেমকে অনুভব করিয়া হেমের হৃদয় অধীর আগ্রহে স্পন্দিত হইতে থাকিত। আজ হেমলতা তার খোঁপা খুলিয়া, বাহুতে হাত বুলাইয়া সেই স্পর্শ, সেই অনুভূতি অনুবভ করিতে গিয়ে ব্যর্থ হইলো। তারপর সে নিঝুম হইয়া দাঁড়াইয়া আকাশপাতাল কি ভাবিয়া এই সময় চঞ্চল পদক্ষেপে ছাদ হইতে নামিয়ে সঞ্জয়ের ঘরে ঢুকিলো। পরক্ষণেই আলো জ্বালাইয়া বুকে ওতি যত্নে রাখা চিঠিগুলো বাহির করিয়া এখানি বালিশ বুকে নিচে পিষ্ট করিয়া মাথা কেশরাশি পিঠে ছড়াইয়া চিঠিতে চোখ বুলাইতে বুলাইতে ক্ষণে ক্ষণে লজ্জায় বালিশে মুখ লুকাইতে লাগিলো।
/////
আজ হাসপাতালে নয়নতারা যখন রাত্রি যাপন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলো,তখন সঞ্জয় ব্যস্ত হইয়া কহিল,
– শুধু শুধু কি দরকার এই সবের। সারাদিন থাকলে, এখন খেয়ে দেয়ে একটু চোখ না বুঝলে শরীর ভালো থাকে কি করে
সঞ্জয় অনেক কথায় বুঝাইয়া যখন দেখিল নয়নতারার চোখদুখানি ছলছল করিতেছে। তখন ইহার কারণ সে কোন মতেই বুঝিতে পারিলো না। এদিকে কন্যার চোখে জল দেখিয়া পিতা কিছুটা উত্তেজিত হইলেন। এবং অবশেষে দুই পক্ষের কথা শুনিয়া তিনি ডাক্তার ডাকিয়া দুজন কেই হাসপাতাল হইতে বিদায় করিলেন।
নয়নতারার পিতা আগে কখনোই সঞ্জয়কে ভালো চোখে না দিখিলেও এই কয়েকদিনের সেবা যত্ন, ও তার সুন্দর ব্যবহারে সহিত পরিচিত হইয়া, স্ত্রীর কথায় অকারণেই উহাকে এতদিন ভালো চোখে দেখেন নাই বলিয়া লজ্জিত ছিলেন। এমন সুশ্রী ছেলেটাকে এতোদিন খারাপ ভাবিয়া কত কটুক্তি করিয়াছেন। যদিও তিনি এখনও জানিতেন না যে লাঠি বাগাইয়া মারামারির কথাটি যে শুনিয়াছিলেন তা সত্য কি না। তবে লাঠি হাতে দল বাধিয়া হাঙ্গামা করিবে ইহা সঞ্জয়ের আচরণ দেখিয়া তো বোঝা যায় না। তা সে যাই হোক,একবার যখন সত্য উন্মোচন হইয়াছে তবে বাকি কথা জানিয়া লইতে কতখন।
হাসপাতালের পথে ফিরিবার সময় সঞ্জয় রাগ করিয়া নয়নতারা সাথে কোন কথা কহিল না। ঘর ফিরিয়া খাটে বসিয়া সমুখে একটা পত্রিকা তুলিয়া পড়িতে লাগিলো। নয়নতারা ধীরে ধীরে আসিয়া সঞ্জয়ের হাতে কাগজ খানা টানিয়া লইয়া বলিল,
– এমন রাগ করছো কেন শুনো,আমি বুঝি একদিন আমার বাবার কাছে থাকতে পারি না!
সঞ্জয় এই কথার কোন জবাব দিল না। জবাব নাই বলিয়াই দিল না। সে তার বাবার কাছে থাকবে এতে তার অনুমতি আবশ্যক হবে কেন। বরং এ যে তার অধিকার।একথায় সঞ্জয় না বলিবে কি করিয়া। তবে নয়নতারা আর এ বিষয়ে কথা না আগাইয়া বলিল,
– বাড়ির কোন খবর পেলাম না যে....
নয়নতারার মুখের কথা টানিয়া লইয়া সঞ্জয় বলিল,
– খবর দিলে তবে তো পাবে, কাগজখানি নিলে কেন, দাও ওটা।
বলিয়া সঞ্জয় নয়নতারার হাত হইতে কাগজখানি তার হাতে টানিয়া লইলো। নয়নতারা ভ্রু সংকোচিত করিয়া একবার সঞ্জয়কে দিখিয়া তার পাশেই মেঝেতে বসিয়া বলিল,
– বুঝেছি! সব চিঠি হেমের কাছে গেছে,তবে সে চিঠির উত্তরের আশা করা অনর্থক।
কথাটা শুনিতেই সঞ্জয় খবরের কাগজ খানি নামাই নয়নতারার পানে দেখিল।নয়নতারা তখন মেঝেতে পেছন ফিরিয়া পা দুখানি সমূখে বারাইয়া বাবুকে কোলে করিয়া বসিয়াছিল। সেদিকে দেখিয়া সঞ্জয়ের মনটি কেমন যেন করিতেছিল, তবে খুব বেশি ব্যাকুল হইবার অবসর হইলো না। তার আগেই এক নারী কন্ঠের ডাকে মুখ তুলিয়া দেখিলো দোরের সমূখে অভিনাথে স্ত্রী, হাতে খাবারের টিফিন বক্স। প্রথম দিকে মানা করিলেও এখন ইহা স্বাভাবিক,নয়নতারা নিজে ব্যপারখানা উপভোগ করে বলিয়া সঞ্জয়ও আর কিছুই বলে না।শুধু সকালে খাবার বাদে দুপুর ও রাতের খাবার অভিনাথ নিজ হাতে আনে। মাঝে মাঝে কমলাও আসে। অবশ্য তার প্রয়োজন যদিও বা তার সইয়ের কাছে।
/////
মোটামুটি মাঝ রাত্রিতে সঞ্জয়ের ঘুম ভাঙ্গলো।সে মেঝেতে শুইয়া ছিল,এখন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিলো। কি মনে হইতেই একবার খাটে শয়নরত নয়নতারা পানে মুখ ফিরাইয়া দেখিলো। বোধকরি না দেখিলেই ভালো ছিল। গভীর ঘুমে আছন্ন অসতর্ক রমনী।এমনতর অবস্থায় খোলা জানালার গরাদের ফাঁক গলিয়া চাঁদের আলো রমনীর সর্বাঙ্গে মায়া ছড়াইয়া সঞ্জয়কে কাছে টানিতেছে। সেই প্রবল টানে সঞ্জয় উঠিলো,কাছে গেল,নয়নতারার মাথার পাশে বসিয়া ডান হস্তে ওষ্ঠের নিকটে হইতে কিছু অবাধ্য চুল কানের পেছনে গুজিয়া দিয়ে সে উঠিলো। কিছু মুহূর্ত ঘরে পায়চারী করিরা আবার আগের স্থানেই বসিলো।এবং নয়নতারার চুলে অঙ্গুলি ডুবাইয়া,মনে মনে বিধাতার নিকট বলিলো,নয়নতারার ঘুম ভাঙ্গাইয়া এই মায়ার বাঁধন হইতে মুক্তি দিতে,নচেৎ কামনার বশবর্তী হইয়া সে যাহা করিবে.....উঁহু্ঃ এই পর্ব তা হচ্ছে না,প্রশ্ন থাকছে গল্প চলবে কি না?
সন্ধ্যায় উদাস সজল চোখদুখানি মেলে,নয়নতারার জানালার গরাদের বাহিরে পথের পানে চেয়ে কি যেন দেখছিল। অন্ধকার গলিটি বাড়ি পেছন দিকে। গলিটির আয়তন সরু হলেও তার আয়োজন বিশাল ।কত দোকান, কত ঘর ও কত রকম মানুষের আনাগোনা।এতকিছুর মধ্যেও নয়নতারার চোখ দুখানি সামনের দোতলা বাড়িটির দিকে নিবদ্ধ।
এপাশের জানালা খোলা বারণ।তবুও কোন এক অবেধ্য কৌতুহলের বশে নয়নতারা প্রতিদিন নিয়ম করিয়া বসে এখানে।নিষিদ্ধ কাজে উত্তেজনা বেশি; বোধকরি লোকে কিছু ভুল বলে নাই। কথাটি নিতান্তই সত্য বলিয়াই মনে হয়।
ঘটনাটি ছোট। যে দিন প্রথম সে এখানে এলো,সেদিনের পরেই এমনি সন্ধ্যায় নয়নতারা জানালা খুলে একটি বার বাইরে চোখ বুলায়। আর সেই এক নজরে যা তার চোখে পড়ে তা সংক্ষেপে বলতে গেলে এই রুপ যে; এক মাতাল পুরুষের হাত ধরে একটি রমনী এই বাড়িটা থেকে টানতে টানতে বেড়িয়ে আসছে,রমনীর কোল এক শিশু সন্তান। ঘটনাটি প্রথমে না বুঝলেও পরে একজনের কাছে জানলো ওবাড়িতে খারাপ মেয়েছেলে থাকে।ঘটনা শোনার পর নয়নতারার চোখের সামনেই তার স্বামীর মুখখানি যেন বেসে ওঠে একবার। সন্ধ্যায় দেখা মেয়েটির সাথে তার কি কোন মিল আছে! তার ভালোবাসার মানুটিও যে একি অবস্থা। যে নিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে সে পালিয়ে এলে এতো দূরে,তা যেন চোখের সামনে তুলে ধরে নিষ্ঠুর সৃষ্টিকর্তা অট্টহাসি হাসছে।থেকে থেকে কেউ যে বলে উঠছে,"দেখ পোড়ামুখি দ্যাখ এই তোর পরিনতি,কি হবে ওত রূপ দিয়ে!" তখন এই অভাগীনির বালিশে মুখ লুকাইয়া খাটে এক কোণায় পরিয়া থাকে। প্রশ্নের উত্তর মিলাইয়া লইতে অক্ষম বলিয়াই হয়তোবা কাঁদে।
প্রতি দিন খাবার সময় নয়নতারা সঞ্জয়ের পাশে বসে ।তবে খাবার খাওয়ার জন্যে নয়, সঞ্জয়ের খাওয়া কোন ত্রুটি হচ্ছে কি না তার তদারকি করতেই তার আসন গ্রহণ। এটা নয়নতারা কাছে স্বাভাবিক হলেও সঞ্জয়ের কাছে একদম নতুন। বাড়ি থাকতে এই ব্যপারখানা সে একদমই লক্ষ্য করেনি।এখন নতুন জায়গায় আসিয়া এ যেন তার নতুন আবিষ্কার।
বাড়িতে বেশিরভাগ সময় হেমলতাই পাখা হাতে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকতো।প্রথম প্রথম কাছে আসার সাহস না করলেও,পরে ব্যপারখানা স্বাভাবিক হয়ে গেছিল এক রকম।তবে নয়নতারা বিষয়টি ভিন্ন।
ঠিক কি কারণে এই ভিন্ন অনুভূতি তা বোঝানো মুশকিল। সে ছোটবেলা থেকেই একা মানুষ। এই সব সেবা-যত্ন থেকে সে সম্পূর্ণই বঞ্ছিত। তাই ব্যপারখানা ঠিক হজম করাও মুশকিল। তার ওপড়ে অভিনাথ ও তার বৌ রিতিমত আপদ হয়ে তার ঘাড়ে চেপে বসেছে। আগে জানলে এদের সে নৌকায় তোলে! জ্বালানি মারলে একেবারে।
কলকাতা যাত্রার সঞ্জয়ের ভাবনা ছিল সরল।নৌকায় স্টেশন, ট্রেনে কলকাতা। তারপর সোজা তার বন্ধুর বাড়িতে ওঠা। তার বন্ধুর বাবা কলকাতা বড় উকিল।সঞ্জয়কে তাহারা বিশেষ চোখে দেখে ও খুব স্নেহ করে।তাছাড়া সে আগে থেকেই চিঠি লিখে দিয়েছিল। ছেলেবেলার বন্ধুত্ব,কাকা-কাকিমার স্নেহ, তাই চিঠির উত্তরের অপেক্ষা না করেই সোজাসুজি চলে আসা। কিন্তু হায় কপাল! এসে দেখে তার বন্ধু মাসখানেক হলো দেশের বাইরে। অবশ্য এতেও উপায় করে নিতে তার সমস্যা হতো না।যদি সে সাথে করে আপদগুলোকে বয়ে না আনতো। নয়নতারা তার নতুন সই ও তার স্বামীর কথায় সঞ্জয়কে এক রকম জোর করিতে লাগলো। অবশেষে হাসপাতালের কাজ শেষে শ্যামবাজারে পৌঁছতেই সন্ধ্যা। আর তখনই জানা গেল, অভিনাথ যে বাড়িতে থাকে সে বাড়িটিতে সব ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েগেছে। অবশেষে ঘন্টা খানেক পরে থাকার ব্যবস্থা হইলো। আবারও যাত্রা করিয়া এক তেতলা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিলো। তেতলা বাড়িটির দুটি ঘর খালি আছে,তার মধ্যে একটি থাকার উপযোগী। আর একটিতে মানুষ থাকিতে পারে ইহা নয়নতারার মনে হইলো না।
সুতরাং থাকতে হইলে স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে থাকা ছাড়া উপায় নাই। নয়নতারার ইহাতে সমস্যা না থাকিলেও সঞ্জয় সম্মতি পোষণ করিতে পারিলো না। যদিও নয়নতারা তাকে খুব করিয়া বুঝাইতে লাগিলো এই যে। কি এমন ক্ষতি হইবে, সে তো নয়নতারার সহিত আগেও এক ঘরে অনেকবার থাকিয়াছে।অবশ্য তখন সে একটু কাঁচা বয়সের ছিল বটে। তবুও সে সেকথা ভুলিয়া যাইবে তা কি হয়। মাঝেমধ্যে সে যখন সকাল হইতে না খাইয়া, শেষে ক্ষুধার জ্বালায় কাতর হইয়া রাতের আঁধারে লুকাইয়া তার বৌদিমণির সরনাপন্ন হইতো। নয়নতারা তখন বুকে জড়াইয়া তার মুখে ভাত তুলিয়া দিত। তার দাদা না থাকিলে বৌদিমণির সাথে ঘুমাইতে বা ঘুম কামাই করিয়া গল্প করিতে তার বাধাঁ ছিল না কখনোই। কিন্তু আজ। হায়! আজ সে কথা মনে আনিতেই তার হৃদয়খানি ঘ্রাণায় পরিপূর্ণ হইতে দেরি করিলো না। এক সময়ের সেই সরল ভালোবাসা যে এত দ্রুত পরিবর্তিত হইতে পারে এই কি তার জানা ছিল। নিজেকে নিজেই ঠিক বিশ্বাস করার সাহস হলো না।এই কয়েকদিনের ব্যবধানে তার হৃদয়ে পরিবর্তনের কথা বৌদিমণি না জানলেও তার নিজের তো অজানা নয়। অবশ্য নয়নতারা যদিও এই ব্যপারখানা একদমই যে লক্ষ্য করে নাই, তাও নয়। তবে সচরাচর পুরুষের মনের গতিবিধি দ্রুতগামী। তাই নয়নতারার ভাবনার সীমানা সঞ্জয় যে কখন পার হয়ে গেছে তা বোঝার মতো অবসর সে পায় নাই।
তবে ভাড়া বাড়ির সবাই তাদে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে জানিলেও,সঞ্জয় রাত্রি কালে হাসপাতালে থাকা শুরু করলো। যদিও হাসপাতাল বেশি দূরে ছিল না। কিন্তু ভাড়াবাড়িতে এই খবর ছড়িয়ে পরেতেও খুব বেশি দেরি হলো না। বেচারী নয়নতারা!একদিকে স্বামীর লাঞ্ছনা বুকে লইয়া দেশ ছাড়া,তারপর গ্রাম।এখন এই কলকাতাতেও তাই হইবে। সঞ্জয় স্বামী না হইয়াও লোকের কথায় মনের অজান্তেই নয়নতারার মনে আঘাত দিতে লাগিলো। অবশ্য লোকের দোষ কি আর! নয়নতারা নিজে যখন দেবরকে স্বামী বলিয়া মিথ্যা প্রসংশায় মিথ্যা হাসি হাসিয়া ছিল।সঞ্জয়ের আচরণ, কথাবার্তায় ও কাজে মুগ্ধ দুএকটি রমনীর ইর্ষান্বিত চক্ষু দেখিয়া মৃদু অহংকারে বুক যে তাহার কিছুটা ফুলিয়া ওঠে নাই ,এ কথায় বা বলিবে কি করিয়া। তোমরা হয়তো ভাবিতেছো, লেখক মহাশয় তোমাদের সরল পাইয়া গুল মারিতেছে। উহাদের স্বামী-স্ত্রী বলিয়া কে মানিবে! তবে বলি শোন,
নয়নতারা বিবাহ যগন হয় তখন তার বয়স ১৫।তাছাড়াও নয়নতারাকে দেখিলে তার বয়স আন্দাজ করিয়া লওয়া রিতিমত মুশকিল। নয়নতারার সর্বাঙ্গের গড়নটিও কিন্তু চমৎকার।বাঙালি গৃহস্থ সংসারের মেয়েদের সচরাচর এমন গড়ন দেখা যায় না। সে হিসাবে নয়নতারা বাস্তবিকই অসাধারণ।
আর সেই সাথে তার সুন্দর মুখশ্রী ও চারিত্রিক গুনাবলীর দারা যে কোন কবিকে সে অনায়াসে মুগ্ধ করিতে পারে। তবে ঘটনাটা নিছক মাতৃমূলক। নয়নতারার মার অনেক বয়স হইয়াছে,কিন্তু এখনও তার শরীরের বাঁধুনি দেখিলে অনেক রমনীর ইর্ষা বোধ হয়। সেই হিসাবে তার দুই কন্যা যে কেমন তা আপাততঃ পাঠক-পাঠিকা দের আন্দাজ করিয়া লইতে অসুবিধা হাইবে না বলিয়াই আশা করি। আর এদিকে সঞ্জয়ের লম্বা চওড়া এহাড়া বলিষ্ঠ দেহ দিখিয়া কাহারও অনুমানে সন্দেহ হয় না যে ইহা নয়নতারার স্বামী নহে। বরং আকার আয়তনে সকল দিক হইতে যেখানে নয়নতারা সঙ্গে খাপ খায়,সেখানে বয়সে তারতম্য ঠিক চোখে পরে না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও আড়ালে লোকের মুখে তাহাকে এই রুপ শুনিতে হয়,
– গতরখানি দেখেছ মাগীর,দেখলেই দুচোখ জলে আমার। ওদিকে স্বামীটাকে একদিনও ঘরে থাকতে দেখলাম না দিদি। কি হবে ওত রূপ দিয়ে।
– শুধু গতরখানি থাকলেই তো আর হয় না, ওবাড়ির বউটিকে দেখ না। ও কি দেখতে খারাপ নাকি! তার পরেও স্বামী মদ খেয়ে বেশ্যাখানা পরে থাকে। বলি সবার কপালে কি আর স্বামী সুখ হয়। আগের জন্মে নির্ঘাত খুব বড়ো ধরনের পাপ করছিল, তাই এই অবস্থা।
পাপ! পাপ বটে!”নয়নতারা শুনিলেও,যেন শুনিতে পায়নায় এমন ভাব করিয়া নতমস্তকে আপনার কাজ করিয়া যায়।
//////
দুদিনের মধ্যেই পত্র আসিলো। চিঠি পড়িয়া হেমলতা তার উত্তর করিলেও, চিঠি পড়িতে পড়িতে তার মন ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। যদিও তাহার পিতার সুস্থতায় তার এই রূপ ব্যবহারে সে ক্ষণে ক্ষণে আপন মনে নিজেকেই ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। যদিও তাহার অপরাধ খানির ওজন খুব বেশি নহে।
তার পরেও এই অবুঝ তরুণী কিছুতেই বুঝিতে পারে না তার পত্রখানি সঞ্জয় কেন পায় নাই।সঞ্জয় চিঠিতে লিখিয়াছে তাহাদের ফিরিতে আর কিছু দিন বিলম্ব আছে। তাই সে আবারও পত্র লিখিয়া পাঠাইলো।আর তিনদিন পরেই কলকাতার চিঠি আসিলো।এবারের চিঠিখানা সে সকাল হইতেই পড়িবে পড়িবে করিয়াও পড়িতে পারে নাই। তাই এই গভীর রাত্রে জানালার পাশে দাঁড়াইয়া পত্রখানি খুলিয়া চোখের সামনে মেলিয়া পড়তে আরম্ভ করিল,
“প্রিয়তমা,
তুমি আমার কোন চিঠিরই উত্তর দিলে না? ভালোই করিয়াছ। ঠিক কথা তো লেখা যায় না, তোমার যা জবাব, সে আমি মনে মনে বুঝিয়া লইলাম। তবে আশা করিতেছি এই আনমনা অংশুমালীর, এই নিভৃত বেদন জর্জরিত অবজ্ঞা চিত্তচারীর দেওয়া, সুনিবিড় মায়া সঞ্চিত অমৃতধারা টুকু, অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করিয়া, তোমার সপ্রভ হৃদয় নিকুঞ্জ নিকেতনে স্থান দিয়া, ধন্য করিবে।
হয়তো তোমার জন্য আমার এই ক্ষুদ্র লিপিখানি যথেষ্ট নয়, তবুও পীনোন্নত প্রতিচ্ছবি হইয়া তোমাকে অনুরোধ করিতেছি, তুমি আমার উপড় রাগ বা অভিমান করিও না। বিলম্ব করিয়া হইলেও যে প্রত্যাশা মনের ভিতর প্রতিভাত করিয়া দুটি কথা তোমাকে লিখিতেছি, তার কতটুকু মূল্য তোমার নিকট হইতে পাইবো জানিনা। তবে এই চিঠিখানি পাইবার পর যদি অতি সামান্যতম রাগ, বিরাগ, ব্যথা, বিরহ, টান, কষ্ট, ভালবাসা ইত্যাদির যেকোন একটি তোমার মনে অনুভূত হইয়া থাকে তবে আমার এই লেখা স্বার্থক হইবে।
তবে অনাদিকালের রূপ-লাবণ্য সমাহিত, এই সুন্দরী কল্লোলিনী ধরনী পারে আমার এমন কোন সুদীপ্ত-চন্দ্র উপহার বলি নাই, যাহা উৎসর্গিত করিয়া তোমাকে সুখের চূঁড়াতে ফুল দিতে বলিব। তবুও আমার মনের চির ঝংকৃত অলঙ্কার হইতে, যে ঝলমল সুতীব্র ভালবাসা তোমার জন্য অবিরাম দোলায়িত হয় মাধুকরী ছন্দে, সেই ভালবাসা, নিতান্ত তোমার জন্যই যে গভীর কোমল টান, সেই টান, সেই ভালবাসা তোমার নিষ্পাপ মন মন্দির পিঞ্জরে সমাধি করিয়া আমাকে ঋণী করিও....”
হেমলতা এইটুকুই পড়িয়া চিঠিখানা বুকে জড়াইয়া কাঁদিয়ে লাগিল। কোন চিঠিই তার কাছে পৌঁছায় নাই!কিন্তু কি করিয়া ইহা সম্ভব! সেই প্রতেকটি পত্রের জবাব দিয়াছে,তবে!
রাত্রি গভীর। শুক্লপক্ষের কয়েকটা রাত্রিতে আকাশের ওই পুরোনো চাঁদটির কাছ হইতে এমন জ্যোৎস্নাই পৃথিবীতে ভাসিয়া আসে যে দেখিলে মানুষের মন কেমন করে।এমনই জ্যোৎস্নায় অনেক রাত্রে হেমকে ছাদে উঠিতে দেখা গেল। রাতে আধাঁরে ইহা দেখিয়া নিস্তব্ধ প্রকৃতি শন শন শব্দ জানাইয়া দিলে যে সে একা জাগিয়া নাই। সেই সাথে উজ্জ্বল নক্ষত্র পুঞ্জ যেন একত্র হইয়া নিঃশব্দে জানাইয়া দিল ভয় কিসে তাহারা পাহারায় বসিয়াছে।
প্রথম প্রথম আলিসা ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া হেম সঞ্জয়ের কথা ভাবিতো। চোখের পাতা বন্ধ করিলেই সামনে ভাসিয়া আসিতো এমন এক নিঝুম রাতের কথা। মনে পরিতো তাহাকে বুকে জড়াইয়া আলিঙ্গন তরে এক সুপুরুষের কথা। তার শ্বাসরোধী প্রেমকে অনুভব করিয়া হেমের হৃদয় অধীর আগ্রহে স্পন্দিত হইতে থাকিত। আজ হেমলতা তার খোঁপা খুলিয়া, বাহুতে হাত বুলাইয়া সেই স্পর্শ, সেই অনুভূতি অনুবভ করিতে গিয়ে ব্যর্থ হইলো। তারপর সে নিঝুম হইয়া দাঁড়াইয়া আকাশপাতাল কি ভাবিয়া এই সময় চঞ্চল পদক্ষেপে ছাদ হইতে নামিয়ে সঞ্জয়ের ঘরে ঢুকিলো। পরক্ষণেই আলো জ্বালাইয়া বুকে ওতি যত্নে রাখা চিঠিগুলো বাহির করিয়া এখানি বালিশ বুকে নিচে পিষ্ট করিয়া মাথা কেশরাশি পিঠে ছড়াইয়া চিঠিতে চোখ বুলাইতে বুলাইতে ক্ষণে ক্ষণে লজ্জায় বালিশে মুখ লুকাইতে লাগিলো।
/////
আজ হাসপাতালে নয়নতারা যখন রাত্রি যাপন করিবার ইচ্ছা প্রকাশ করিলো,তখন সঞ্জয় ব্যস্ত হইয়া কহিল,
– শুধু শুধু কি দরকার এই সবের। সারাদিন থাকলে, এখন খেয়ে দেয়ে একটু চোখ না বুঝলে শরীর ভালো থাকে কি করে
সঞ্জয় অনেক কথায় বুঝাইয়া যখন দেখিল নয়নতারার চোখদুখানি ছলছল করিতেছে। তখন ইহার কারণ সে কোন মতেই বুঝিতে পারিলো না। এদিকে কন্যার চোখে জল দেখিয়া পিতা কিছুটা উত্তেজিত হইলেন। এবং অবশেষে দুই পক্ষের কথা শুনিয়া তিনি ডাক্তার ডাকিয়া দুজন কেই হাসপাতাল হইতে বিদায় করিলেন।
নয়নতারার পিতা আগে কখনোই সঞ্জয়কে ভালো চোখে না দিখিলেও এই কয়েকদিনের সেবা যত্ন, ও তার সুন্দর ব্যবহারে সহিত পরিচিত হইয়া, স্ত্রীর কথায় অকারণেই উহাকে এতদিন ভালো চোখে দেখেন নাই বলিয়া লজ্জিত ছিলেন। এমন সুশ্রী ছেলেটাকে এতোদিন খারাপ ভাবিয়া কত কটুক্তি করিয়াছেন। যদিও তিনি এখনও জানিতেন না যে লাঠি বাগাইয়া মারামারির কথাটি যে শুনিয়াছিলেন তা সত্য কি না। তবে লাঠি হাতে দল বাধিয়া হাঙ্গামা করিবে ইহা সঞ্জয়ের আচরণ দেখিয়া তো বোঝা যায় না। তা সে যাই হোক,একবার যখন সত্য উন্মোচন হইয়াছে তবে বাকি কথা জানিয়া লইতে কতখন।
হাসপাতালের পথে ফিরিবার সময় সঞ্জয় রাগ করিয়া নয়নতারা সাথে কোন কথা কহিল না। ঘর ফিরিয়া খাটে বসিয়া সমুখে একটা পত্রিকা তুলিয়া পড়িতে লাগিলো। নয়নতারা ধীরে ধীরে আসিয়া সঞ্জয়ের হাতে কাগজ খানা টানিয়া লইয়া বলিল,
– এমন রাগ করছো কেন শুনো,আমি বুঝি একদিন আমার বাবার কাছে থাকতে পারি না!
সঞ্জয় এই কথার কোন জবাব দিল না। জবাব নাই বলিয়াই দিল না। সে তার বাবার কাছে থাকবে এতে তার অনুমতি আবশ্যক হবে কেন। বরং এ যে তার অধিকার।একথায় সঞ্জয় না বলিবে কি করিয়া। তবে নয়নতারা আর এ বিষয়ে কথা না আগাইয়া বলিল,
– বাড়ির কোন খবর পেলাম না যে....
নয়নতারার মুখের কথা টানিয়া লইয়া সঞ্জয় বলিল,
– খবর দিলে তবে তো পাবে, কাগজখানি নিলে কেন, দাও ওটা।
বলিয়া সঞ্জয় নয়নতারার হাত হইতে কাগজখানি তার হাতে টানিয়া লইলো। নয়নতারা ভ্রু সংকোচিত করিয়া একবার সঞ্জয়কে দিখিয়া তার পাশেই মেঝেতে বসিয়া বলিল,
– বুঝেছি! সব চিঠি হেমের কাছে গেছে,তবে সে চিঠির উত্তরের আশা করা অনর্থক।
কথাটা শুনিতেই সঞ্জয় খবরের কাগজ খানি নামাই নয়নতারার পানে দেখিল।নয়নতারা তখন মেঝেতে পেছন ফিরিয়া পা দুখানি সমূখে বারাইয়া বাবুকে কোলে করিয়া বসিয়াছিল। সেদিকে দেখিয়া সঞ্জয়ের মনটি কেমন যেন করিতেছিল, তবে খুব বেশি ব্যাকুল হইবার অবসর হইলো না। তার আগেই এক নারী কন্ঠের ডাকে মুখ তুলিয়া দেখিলো দোরের সমূখে অভিনাথে স্ত্রী, হাতে খাবারের টিফিন বক্স। প্রথম দিকে মানা করিলেও এখন ইহা স্বাভাবিক,নয়নতারা নিজে ব্যপারখানা উপভোগ করে বলিয়া সঞ্জয়ও আর কিছুই বলে না।শুধু সকালে খাবার বাদে দুপুর ও রাতের খাবার অভিনাথ নিজ হাতে আনে। মাঝে মাঝে কমলাও আসে। অবশ্য তার প্রয়োজন যদিও বা তার সইয়ের কাছে।
/////
মোটামুটি মাঝ রাত্রিতে সঞ্জয়ের ঘুম ভাঙ্গলো।সে মেঝেতে শুইয়া ছিল,এখন ঘুম ভাঙ্গিয়া উঠিয়া বসিলো। কি মনে হইতেই একবার খাটে শয়নরত নয়নতারা পানে মুখ ফিরাইয়া দেখিলো। বোধকরি না দেখিলেই ভালো ছিল। গভীর ঘুমে আছন্ন অসতর্ক রমনী।এমনতর অবস্থায় খোলা জানালার গরাদের ফাঁক গলিয়া চাঁদের আলো রমনীর সর্বাঙ্গে মায়া ছড়াইয়া সঞ্জয়কে কাছে টানিতেছে। সেই প্রবল টানে সঞ্জয় উঠিলো,কাছে গেল,নয়নতারার মাথার পাশে বসিয়া ডান হস্তে ওষ্ঠের নিকটে হইতে কিছু অবাধ্য চুল কানের পেছনে গুজিয়া দিয়ে সে উঠিলো। কিছু মুহূর্ত ঘরে পায়চারী করিরা আবার আগের স্থানেই বসিলো।এবং নয়নতারার চুলে অঙ্গুলি ডুবাইয়া,মনে মনে বিধাতার নিকট বলিলো,নয়নতারার ঘুম ভাঙ্গাইয়া এই মায়ার বাঁধন হইতে মুক্তি দিতে,নচেৎ কামনার বশবর্তী হইয়া সে যাহা করিবে.....উঁহু্ঃ এই পর্ব তা হচ্ছে না,প্রশ্ন থাকছে গল্প চলবে কি না?