13-05-2024, 05:56 AM
(This post was last modified: 13-05-2024, 10:03 PM by বহুরূপী. Edited 5 times in total. Edited 5 times in total.)
পর্ব ৯
– ..... এতকিছুর পরেও আবারও ওই লোকগুলোর সাথেই......
মেয়েটির মুখের কথা শেষ হলো না।তার আগেই মেয়েটির বলা সংবাদের ধকল সামলাতে সামলাতে নয়নতারা রান্নাঘরের দরজার পাশে "ধপ" করে বসে পরলো।তাই দেখে মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে বলল
– কি হলো দিদি!
অবশ্য মেয়েটি যদিও জানে কি হয়েছে,তবুও কৌতুক করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে কে!এতদিন ধরে স্বামীর করা অপরাধের নয়নতারাকে পাড়ার কিছু ছেলে বউরে হাস্যরশিকের পাত্রী হতে হয়েছিল।এখন সোহম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজেন্দ্র রায়ের সাথে গেছে বাইজি খানায়। এই কথা শুনে বুকের ভেতরে কোন এক নরম জায়গায় আঘাত লাগলো নয়নতারার। যেন একটি ত্রিশুল তার বুকখানি এফোর ওফোর করে বিধিয়ে দিল কেউ। এই ব্যথা কেহ বুঝিবে আর কেহ আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসিবে,এই কথা নয়নতারার জানতে বাকি নেই। তবে অশ্রু! না অশ্রু বেরোয়নি। কি করেই বা বেরুবে! এই অভাগীনি যে সারাটা রাত কাঁদলো; তার খবর কেইবা রাখে!
পুরো ঘটনা না জানলেও, সোহম যে বাইজি খানায় গেছে,এই কথা গ্রামে রটেছে দ্রুতবেগে। এই লজ্জা কোথায় আর লুকাবে সে! কয়েকদিন আগে সে বড় মুখ করে পাড়ার মেয়েদের বলত স্বামীর তার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা। কিন্তু এবার! কোথায় মুখ লুকাবি রে তুই পোড়ামুখি! বলি সব দোষ কি আর মিথ্যা ভালোবাসার পর্দায় ঢাকা পরে রে পাগলী।
হেমলতা এতখন বসার ঘরের দরজার আড়ালে দরজার ছিল।আর কেহ না জানলেও তোমরা নিশ্চয়ই জানো, মেয়েটা কেমন মুখচোরা ও ভীতু স্বভাবের।কিন্তু এইবার দিদির এই হাল দেখে ছুটে এলো সে।তবে বলাই বাহুল্য দিদির দুঃখে হেমলতা কি বলে শান্তনা দেবে তা ভেবে পেল না। তার বদলে দুই হাতে দিদির গলা জরিয়ে দিদির কাঁধে মাথাটা নামিয়ে দিল সে....
/////
সঞ্জয় ছিল গঞ্জে। ওখানে থেকে মাঝি পাড়ার এক চেনা নৌকার ব্যবস্থা করে। তবে সে একটা গরুর গাড়ি নিয়ে ফিরলো বাড়িতে।
আজ তালতলার চায়ের দোকানটি কোন কারণে বন্ধ। দুই তিনটি ছেলে-মেয়ে দোকানের বাইরের দিকটায় বসে কি যেন করছিল । রাস্তায় বিশেষ কারো সাথে দেখা না হওয়ার কারণে তার দাদার খবর খানি সে শুনলো হেমলতার মুখে। এর সাথে আরো শুনলো নয়নতারা তার সাথে যেতে চাইছে শহরে।
সঞ্জয় এতখন হেমলতাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রান্নাঘরের পাশে জাম গাছটির আড়ালে।সুর্য মাথার ওপড়ে উঠছে ধিরে ধিরে।অন্য সব দিনে এই সময়ে নয়নতারার থাকে রান্নাঘরে,সে উনুন জ্বেলে রান্নার বন্দোবস্ত করে।তবে আজ রান্নাঘরটি ফাঁকা।তা কেন বা কি কারণে তা আমরা সবাই ইতি মধ্যেই অবগত।তবে সঞ্জয় শুধু দাঁড়িয়ে ছিল তা ঠিক নয়। সঞ্জয় পাকা খেলোয়াড় বা ব্যবসায়ীও বলা চলে। তাই দখল বসিয়ে ভোগ করবে না এমন দয়ালু হলে তার চলবে কেন! অন্তত লাভ টা তো বুঝে নেওয়া চাই।
তাই তো বিচ্ছেদের আগে ভালো মত হাতের ও মুখের সুখখানি করে নিতে ভোলেনি একদমই।পাছে ধরা যেন না পরে সেই জন্যে আজ হেমলতার শাড়ি ও ব্লাউজের ওপড় দিয়েই দুহাতে দুই মাই টেপন এবং সেই সাথে ঠোঁটে, গালে ,গলায় অজস্র চুম্বন শ্রাবণের বারিধারার মতোই যেন আছড়ে পরছিল। এদিকে বেচারী হেমলতা ভয়ে সরা। সে একবার এদিকে পানে চায় তো আর একবার ওদিক পানে।তবে এতে তার বিশেষ লাভের কিছুই হচ্ছে না। কারণ তার চোখের নজরে একদিকে পরছে রান্নাঘরে দেয়াল ও অন্য দিকে তার দিদির বানানো ছোট বাগান টি।তার ওপড়ে সঞ্জয়ের প্রশ্নের জবাবে কথাও ঠিক মত বলতে পারছে না।ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে মনে সে যে কোন দেব,তার কাছে প্রনাম ঠুকল। তা বোঝা না গেলেও, সঞ্জয়ের এবারের মতো তাকে ছাড়লো খুব সহজেই। এবং হেমের লজ্জায় রাঙ্গা দুই গালে দুহাত রেখে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল।
– বৌদিমণির সাথে কথা বলছি আমি।বলেইতো আর যাওয়া হয় না।বাবু, মন্দিরা ওরা আছে তো,সে কথা ভেবে দেখবে না।
এই বলে সে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা খাম হাতে নিল সে। সেই সাথে হেমলতার শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল এক ঝটকায়। হেমলতা দুপা পেছনে সরতে গিয়ে পিঠ ঠেকলো তার গাছে। বোধকরি ছুটে পালাতে মনস্থির করেই পাশ কাটাতে চাইছিল সে। তবে সম্ভব হলো না।সঞ্জয়ের হাতের বিশাল থাবায় আটকে গেল সে। এতক্ষণ ও দুটো টিপে যেন শান্তি হয়নি সঞ্জয়ের।তাই বুঝি শক্ত হাতে আলতো ভাবে আবারও টিপতে লাগলো সে। দুইতিন বার টিপেদিয়ে চারটে আঙ্গুল দিয়ে ব্লাউজের গলায় ধরে কাছে টেনে আনলো হেমকে। বাঁ হাতে খামটা ঢুকিয়ে দিল ব্লাউজের গলার ফাঁক দিয়ে।ঠিক বাম পাশেটায়। এরপর হেমলতার কম্পিত ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে দুই হাত হেমের বুকে রেখে বলল।
– ফিরে আসা পর্যন্ত সামলে রেখো এই দুটি,যত্নের যেন কমতি না হয়।এই দুটি আমার খুবই শখের খেলনা মনে থাকে যেন।
হেমলতা তার লজ্জায় আরক্ত মুখখানি আরো নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সঞ্জয় চোখের পলকে তাহা লক্ষ্য করিয়া বোধকরি একটু হাসিলো এবং এগিয়ে গেল নয়নতারার ঘরের দিকে....
/////
নয়নতারার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র সঞ্জয় দেখলো।নয়নতারা ইতি মধ্যে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস একটা কাপড়ে বেধে নিয়ে বসে আছে। তার ভাবখানা এমন যে সে এখনি বেরোয় আরকি। সঞ্জয় অনেকখন বুঝিয়ে অবশেষে নিজেই দমিয়া গেল। নয়নতারার এই রূপ নারী মূর্তিকে টলানো তাহার সাধের বাইরে বলিয়াই মনে হয়।
অবশেষে যখন সবাই দেখলো নয়নতারাকে টলানো রিতিমত অসম্ভব।সেই মুহূর্তে মিনতী দেবী সঞ্জয়কেই বোঝাতে বসিলেন।
– দেখ একটা মেয়ে মানুষ না থাকলেই বা চলবে কেন! আমি তো আর অত ধকল নিয়ে যেতে পারবো না।জানোই তো আমার দূর্বল শরীর। তা বলি কি নয়না না হয় গেল তোমার সাথে।অসুস্থ রোগিটা একটু যত্নআত্তি পাবে।তাছাড়া ওখানে রান্নাবান্নার ব্যপার টাও তো দেখতে হবে নাকি!
এই প্রস্তাবে সঞ্জয়কে খুব একটা প্রসন্ন না দেখা গেলেও, নয়নতারা তার পিছু ছাড়লো না।এদিকে দুপুরের ট্রেন মিস হবে বলেই মনে হয় এবং আরো বেশি দেরি করলে রাতের ট্রেন হাতছাড়া হবার ভয় তো আছেই। সুতরাং অবশেষে সঞ্জয়,নয়নতারার বাবা ও নয়নতারা বাবুকে কোলে নিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ে বসলো।গাড়িটা চলতে শুরু করা মাত্র নয়নতারা একটি বার পেছন ফিরে দেখলো,তাদের বাড়ির ছাদের দিকে।হেমলতা মন্দিরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকখানি কেমন করে উঠলো তার।তবে মন্দিরা মুখে দুঃখের কোন ভাব দেখা গেল না। বোধকরি মন্দিরার মায়ের থেকে মাসির টানেই বেশি। তবে হেমলতা কাঁদছে।মন্দিরা তার ছোট ছোট হাতে বুঝেই তার মাসি চোখের অশ্রু মুছে দিচ্ছে। এই দৃশ্য কিছুটা অবাক করলো তাকে।তার মনটি ভাবতে বসলো,বড় হয়ে তার ছোট্ট মেয়ে ঠিক কার মতো হবে।
তালদিঘি গ্রামটি থেকে শহর অঞ্চলে যাত্রা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। নৌকায় দুই গ্রাম পেরিয়ে তবে মধুপুরের মাঠ—একটা ছোট স্টেশন। ট্রেন দাঁড়ায় কি দাঁড়ায় না। সকালে-বিকেলে দুই চারজন মানুষকে উঠতে-নামতে দেখা গেলেও দুপুরে প্রায়ই অকারণে ট্রেন ক্যাঁচ শব্দে দাঁড়ায়; তারপর ক্যাঁচকোচ শব্দে লোহায় লোহায় ঘষাঘষির আওয়াজ করতে করতে ছাড়ে। তবে ভাগ্য খারাপ, এখন আর দূপুরের ট্রেনটি আর পাওয়ার উপায় নেই।পরের ট্রেনের খবর হতে হতে সন্ধ্যে। এদিকে সঞ্জয়ের চিন্তা সময় মত স্টেশনে পৌঁছালে তবে শেষ হয় আর কি।
////////
ছায়ামতির জলে দুটো নৌকা এক সাথে ভাসছে। তীরের পাশে একটা গাছের শেকড়ে নৌকা দুটো বাঁধা।একটি সঞ্জয়ের ও অপরটির অচেনা।তবে একে নৌকা না বলে ডিক্তি বলা ভালাে। আকারে তেমন বড় নয়। চার-পাঁচজন আরােহী বসতে পারে মাত্র।তবে নৌকা টি দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না মোটেও। জলতরঙ্গগুলাে ছলাৎ ছলাৎ করে তীরভূমিতে আছড়ে পড়ছে। আছড়ে পড়ার শব্দ ঈষদুচ্চকিত। মৃদু তরঙ্গাঘাতেই নৌকাটি অল্প অল্প দুলছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি ভেঙ্গে পরে নৌকাটি।
নৌকা থেকে একটু দূরে মাঠে বসে রান্না ব্যস্ত দুই রমণী। একজন নয়নতারার ও অন্য জন্য অপর নৌকার আরোহী। দুই রমণীর সকল রমণীয়তা তাদের সর্বাঙ্গ জুড়ে। নয়নতারার কথা তোমাদের জানা কথা তবে রমণীটি অতিশয় সুন্দরী। মানুষ যে অর্থে সুন্দরী নারী বােঝে, এই নারী সে অর্থে সুন্দরী নয়। তার শরীরে গৌরবর্ণের আভাসটুকুও নেই। গৌরবর্ণীয় দুর্বলতাটুকু সৌন্দর্য নির্ধারণের মাপকাটি হতে পারে না। যুবতিটির গায়ের রং ঘাের কৃষ্ণবর্ণ। সৌন্দর্য সম্পর্কে আদি বিশ্বাসটুকু মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এই রমণীর দিকে তাকালে যেকোনাে বয়সের পুরুষের দৃষ্টি আটকে থাকবে ওই নারীর দেহে। তাকে দেখে মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ চঞ্চল হয়ে উঠবেই। তবে সে যাই হোক কথা হল আমরা এখানে কেন! নদীর এই অংশটি কিঞ্চিৎ সংকুচিত। জলধারা কম স্রোতময়। নর্দীর বুকজুড়ে এখানে ওখানে চর। দূরের একটা চর বৃক্ষময়। ওই চরের পাশ ঘেঁষেই ওপারে যেতে হবে। এই অঞ্চল দিয়ে নদী পারাপারের জন্য লােক আসে। এদিক দিয়ে পারাপারে সময় লাগে কম, তাই নদীর এই অংশটিই পারর্থীদের পছন্দ। পরিশ্রম কম লাগে বলে নৌবাহকেরও পছন্দ এই অঞ্চলটি। তবে অপর নৌকার আরোহী বিপদে পরে নৌকা থামিয়েছে এখানে।তাদের নৌকার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।এটি অবশ্য এক নজর তাকালেই বোঝা যায়। সঞ্জয় ও মেয়েটির স্বামীএকটি গাছের তলায় বসে কথা বলছিল।
– নতুন বৌ নিয়ে শহরে ঘুরতে যাচ্ছেন বুঝি?
– না না দাদা ঘুরতে নয়,আমি কাজের সূত্রে কলকাতায় থাকি,তাই আরকি।
সঞ্জয় ভালো ভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিল লোকটার ওপরে। বেশ শান্ত ও হাসি খুশি মুখ ছেলেটার। বয়স কম। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলেই দেখতে বেশ।গায়ের রং শ্যামলা।
– দাদা আপনাকে বড্ড অসুবিধায় ফেললাম...
ছেলেটার কথা শেষ হবার আগে সঞ্জয় তাকে থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
– অসুবিধায় ফেলেছো কি না তা মধুমতি পৌঁছনোর আগে বোঝা যাচ্ছে না।
ছেলেটি হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছিল।কিন্তু সঞ্জয় না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল নয়নতারার দিকে। নয়নতারার ও মেয়েটি কি নিয়ে যেন কথা বলছিল।সঞ্জয়কে আসতে দেখে কথা থেমে গেল তাদের।এই পর্যন্ত সারাটা পথ নয়নতারা মুখ ভার করে বসে ছিল।এখন তাকে যেন বেশ হাসিখুশী লাগছে।
– বৌদিমণি তোমাদের হলো,ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
কথাটা বলেই সঞ্জয় লক্ষ্য করলো মেয়েটা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল।সেই সাথে নয়নতারার মুখখানি কোন কারণে লাল হয়ে উঠেছে।নয়নতারা মৃদু স্বরে বলল।
– আর একটু সময় লাগবে।
সঞ্জয় রিতিমত অবাক হল।নয়নতারা তার সাথে এমন সংকোচের সাথে কথা বলছে কেন বুঝতে পারলো না।তবে সে আর কথা না বারিয়ে সরে পড়লো।
অবশেষে রান্না শেষ হলে সঞ্জয় তারা দিল সবাইকে। তাই নৌকা জলে ভাসিয়ে তারা খেতে বসলো নৌকার ছইয়ের ভেতরে। নতুন বিবাহিত দম্পতিয় এবার তাদের সাথে যাত্রা করলো। নয়নতারা পাশে বসে হাতপাখার বাতাস করছিল।একটু দূরে মেয়েটি বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে।
– কলকাতায় কিসের কাজ করেন আপনি?
– দাদা কাপড়ের কারখানায়,এই বছর দুই এক ধরে করছি।এবারের ছুটি নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম।
– বিয়ের জন্যে বুঝি?
সঞ্জয়ের প্রশ্নে ছেলেটা কি একটা ভেবে তারপর বলল।
– ঠিক তা নয়....আসলে দাদা হয়েছে কি...আসলে..
– বলতে না চাইলে থাক। বৌদিমণি তোমার খেতে বসলে না যে!
– তোমরা খেয়ে নাও আগে। আমি বাবাকে খাইয়ে পরে বসছি।
– দিদি এদিকে এসো তো একটু।
মেয়েটির ডাকে নয়নতারার উঠে গেল যেদিকে।আর একটু পরেই মেয়েটি একহাত ঘোমটা টেনে এসে বসলো নয়নতারার জায়গায়।আর নয়নতারা বাবুকে দুধ খাওয়াতে বসলো ছইয়ের এক কোণে।
– দূরের যাত্রা কেউ এমন ভাঙ্গা নৌকার করে! কি বুঝে ওই নৌকায় উঠেছিলে বলোতো।
সঞ্জয়ের প্রশ্নে ছেলে বেশ লজ্জিত হলো।এবং একটু পরে বলতে লাগলো।
– দাদা কিছু করার ছিল না,আগামীকাল আমার ছুটি শেষ।তার ওপড় বজ্জাত মাঝি আগে বলেনি নৌকার এই অবস্থা।কি করে বুঝবো বলুন তো
সঞ্জয় লক্ষ্য করলো।স্বামীর অপটুতায় কথা বোধ করি তার নববধূর মনে লাগলো।তার হাতপাখার গতি কমতে লাগলো।তাই এই আলোচনা আর এগিয়ে না নেওয়াই ভালো ভেবে সঞ্জয় খাবারের মনোনিবেশ করলো।
তারা যখন স্টেশনে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা নামছে।ট্রেন এখনো আসনি।তাই টিকিট করে বসে থাকা ছাড়া তাহাদের আর বিশেষ কিছুই করার নেই বলেই চলে।তবে নয়নতারার মনটি এখনো ফুরফুরে।সে নতুন সঙ্গী পেয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত।
– দাদা!
হঠাৎ ডাকে পাশ ফিরে দেখলো ছেলেটা হাতে সিগারেট লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঞ্জয়কে দেবে কি দেবে না বা দিলে সঞ্জয় রাগান্বিত হবে কি না,তা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ডাকে বসেছে সে।সঞ্জয় ধূমপান যে একদমই করে না তা নয়।শখের বশে শন্তুর চায়ের দোকানে বসে একদুবার টেনে দেখেছে সে।তবে তার ওসব পোষায় না। তবুও সে সিগারেট নিল ছেলেটার হাত থেকে।একটা দুটো টানে আর কিইবা ক্ষতি হবে।
কিছুক্ষণ পরেই দূরথেকে ট্রেনের শব্দ কানে এলো। আর একটু পরেই যাত্রা শুরু হবে গ্রাম ছেরে দূরে।কবে ফিরবে তাও বলা যায়না। হেমলতার কথা হঠাৎ মনে পরলো তার।মেয়েটি নিরীহ।ঠিক লতা গাছের মত।যা পায় তাই আঁকড়ে ধরতে চায়। কিছু বছর আগে যখন বৌদিমণির সাথে দেখা করার অপরাধে হেমলতা তাকে ধরিয়ে দিল।সেদিন দাদা হাতে মার খেতে খেতে সে হেমের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিল।তোকেই আমি আমার ঘরে তুলবো,তারপর বোঝাবো মজা,মনে রাখিস এই কথা। হেমলতা তার সেই চোখের ভাষা ঠিক কতটুকু বুঝেছিল তা বলা মুশকিল।তবে ঐদিনের পর তাকে দেখলেই হেমের ছুটে পালানো কি আর কম উপভোগের জিনিস।
– দাদা! ট্রেন চলে এলো যে
ছেলেটির কথায় সঞ্জয় মুখ ফিরিয়ে দেখলো নয়নতারাকে। একটু দূরে নয়নতারা তার বাবাকে জল খাওয়াছিল।সে এগিয়ে গেল সেদিকে।.....গল্পের নায়িকা চললো কলকাতার উদ্দেশ্যে।তবে আমার গল্প চলবে কি না সেই প্রশ্ন রইলো পাঠক পাঠিকাদের কাছে!?
– ..... এতকিছুর পরেও আবারও ওই লোকগুলোর সাথেই......
মেয়েটির মুখের কথা শেষ হলো না।তার আগেই মেয়েটির বলা সংবাদের ধকল সামলাতে সামলাতে নয়নতারা রান্নাঘরের দরজার পাশে "ধপ" করে বসে পরলো।তাই দেখে মেয়েটি ব্যস্ত হয়ে বলল
– কি হলো দিদি!
অবশ্য মেয়েটি যদিও জানে কি হয়েছে,তবুও কৌতুক করবার সুযোগ পেলে ছাড়ে কে!এতদিন ধরে স্বামীর করা অপরাধের নয়নতারাকে পাড়ার কিছু ছেলে বউরে হাস্যরশিকের পাত্রী হতে হয়েছিল।এখন সোহম জেল থেকে ছাড়া পেয়ে রাজেন্দ্র রায়ের সাথে গেছে বাইজি খানায়। এই কথা শুনে বুকের ভেতরে কোন এক নরম জায়গায় আঘাত লাগলো নয়নতারার। যেন একটি ত্রিশুল তার বুকখানি এফোর ওফোর করে বিধিয়ে দিল কেউ। এই ব্যথা কেহ বুঝিবে আর কেহ আড়ালে মুখ লুকিয়ে হাসিবে,এই কথা নয়নতারার জানতে বাকি নেই। তবে অশ্রু! না অশ্রু বেরোয়নি। কি করেই বা বেরুবে! এই অভাগীনি যে সারাটা রাত কাঁদলো; তার খবর কেইবা রাখে!
পুরো ঘটনা না জানলেও, সোহম যে বাইজি খানায় গেছে,এই কথা গ্রামে রটেছে দ্রুতবেগে। এই লজ্জা কোথায় আর লুকাবে সে! কয়েকদিন আগে সে বড় মুখ করে পাড়ার মেয়েদের বলত স্বামীর তার প্রতি অগাধ ভালোবাসার কথা। কিন্তু এবার! কোথায় মুখ লুকাবি রে তুই পোড়ামুখি! বলি সব দোষ কি আর মিথ্যা ভালোবাসার পর্দায় ঢাকা পরে রে পাগলী।
হেমলতা এতখন বসার ঘরের দরজার আড়ালে দরজার ছিল।আর কেহ না জানলেও তোমরা নিশ্চয়ই জানো, মেয়েটা কেমন মুখচোরা ও ভীতু স্বভাবের।কিন্তু এইবার দিদির এই হাল দেখে ছুটে এলো সে।তবে বলাই বাহুল্য দিদির দুঃখে হেমলতা কি বলে শান্তনা দেবে তা ভেবে পেল না। তার বদলে দুই হাতে দিদির গলা জরিয়ে দিদির কাঁধে মাথাটা নামিয়ে দিল সে....
/////
সঞ্জয় ছিল গঞ্জে। ওখানে থেকে মাঝি পাড়ার এক চেনা নৌকার ব্যবস্থা করে। তবে সে একটা গরুর গাড়ি নিয়ে ফিরলো বাড়িতে।
আজ তালতলার চায়ের দোকানটি কোন কারণে বন্ধ। দুই তিনটি ছেলে-মেয়ে দোকানের বাইরের দিকটায় বসে কি যেন করছিল । রাস্তায় বিশেষ কারো সাথে দেখা না হওয়ার কারণে তার দাদার খবর খানি সে শুনলো হেমলতার মুখে। এর সাথে আরো শুনলো নয়নতারা তার সাথে যেতে চাইছে শহরে।
সঞ্জয় এতখন হেমলতাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রান্নাঘরের পাশে জাম গাছটির আড়ালে।সুর্য মাথার ওপড়ে উঠছে ধিরে ধিরে।অন্য সব দিনে এই সময়ে নয়নতারার থাকে রান্নাঘরে,সে উনুন জ্বেলে রান্নার বন্দোবস্ত করে।তবে আজ রান্নাঘরটি ফাঁকা।তা কেন বা কি কারণে তা আমরা সবাই ইতি মধ্যেই অবগত।তবে সঞ্জয় শুধু দাঁড়িয়ে ছিল তা ঠিক নয়। সঞ্জয় পাকা খেলোয়াড় বা ব্যবসায়ীও বলা চলে। তাই দখল বসিয়ে ভোগ করবে না এমন দয়ালু হলে তার চলবে কেন! অন্তত লাভ টা তো বুঝে নেওয়া চাই।
তাই তো বিচ্ছেদের আগে ভালো মত হাতের ও মুখের সুখখানি করে নিতে ভোলেনি একদমই।পাছে ধরা যেন না পরে সেই জন্যে আজ হেমলতার শাড়ি ও ব্লাউজের ওপড় দিয়েই দুহাতে দুই মাই টেপন এবং সেই সাথে ঠোঁটে, গালে ,গলায় অজস্র চুম্বন শ্রাবণের বারিধারার মতোই যেন আছড়ে পরছিল। এদিকে বেচারী হেমলতা ভয়ে সরা। সে একবার এদিকে পানে চায় তো আর একবার ওদিক পানে।তবে এতে তার বিশেষ লাভের কিছুই হচ্ছে না। কারণ তার চোখের নজরে একদিকে পরছে রান্নাঘরে দেয়াল ও অন্য দিকে তার দিদির বানানো ছোট বাগান টি।তার ওপড়ে সঞ্জয়ের প্রশ্নের জবাবে কথাও ঠিক মত বলতে পারছে না।ভয়ে তাঁর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। মনে মনে সে যে কোন দেব,তার কাছে প্রনাম ঠুকল। তা বোঝা না গেলেও, সঞ্জয়ের এবারের মতো তাকে ছাড়লো খুব সহজেই। এবং হেমের লজ্জায় রাঙ্গা দুই গালে দুহাত রেখে কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল।
– বৌদিমণির সাথে কথা বলছি আমি।বলেইতো আর যাওয়া হয় না।বাবু, মন্দিরা ওরা আছে তো,সে কথা ভেবে দেখবে না।
এই বলে সে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা খাম হাতে নিল সে। সেই সাথে হেমলতার শাড়ির আঁচল সরিয়ে দিল এক ঝটকায়। হেমলতা দুপা পেছনে সরতে গিয়ে পিঠ ঠেকলো তার গাছে। বোধকরি ছুটে পালাতে মনস্থির করেই পাশ কাটাতে চাইছিল সে। তবে সম্ভব হলো না।সঞ্জয়ের হাতের বিশাল থাবায় আটকে গেল সে। এতক্ষণ ও দুটো টিপে যেন শান্তি হয়নি সঞ্জয়ের।তাই বুঝি শক্ত হাতে আলতো ভাবে আবারও টিপতে লাগলো সে। দুইতিন বার টিপেদিয়ে চারটে আঙ্গুল দিয়ে ব্লাউজের গলায় ধরে কাছে টেনে আনলো হেমকে। বাঁ হাতে খামটা ঢুকিয়ে দিল ব্লাউজের গলার ফাঁক দিয়ে।ঠিক বাম পাশেটায়। এরপর হেমলতার কম্পিত ঠোঁটে একটা চুমু খেয়ে দুই হাত হেমের বুকে রেখে বলল।
– ফিরে আসা পর্যন্ত সামলে রেখো এই দুটি,যত্নের যেন কমতি না হয়।এই দুটি আমার খুবই শখের খেলনা মনে থাকে যেন।
হেমলতা তার লজ্জায় আরক্ত মুখখানি আরো নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। সঞ্জয় চোখের পলকে তাহা লক্ষ্য করিয়া বোধকরি একটু হাসিলো এবং এগিয়ে গেল নয়নতারার ঘরের দিকে....
/////
নয়নতারার ঘরে প্রবেশ করা মাত্র সঞ্জয় দেখলো।নয়নতারা ইতি মধ্যে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস একটা কাপড়ে বেধে নিয়ে বসে আছে। তার ভাবখানা এমন যে সে এখনি বেরোয় আরকি। সঞ্জয় অনেকখন বুঝিয়ে অবশেষে নিজেই দমিয়া গেল। নয়নতারার এই রূপ নারী মূর্তিকে টলানো তাহার সাধের বাইরে বলিয়াই মনে হয়।
অবশেষে যখন সবাই দেখলো নয়নতারাকে টলানো রিতিমত অসম্ভব।সেই মুহূর্তে মিনতী দেবী সঞ্জয়কেই বোঝাতে বসিলেন।
– দেখ একটা মেয়ে মানুষ না থাকলেই বা চলবে কেন! আমি তো আর অত ধকল নিয়ে যেতে পারবো না।জানোই তো আমার দূর্বল শরীর। তা বলি কি নয়না না হয় গেল তোমার সাথে।অসুস্থ রোগিটা একটু যত্নআত্তি পাবে।তাছাড়া ওখানে রান্নাবান্নার ব্যপার টাও তো দেখতে হবে নাকি!
এই প্রস্তাবে সঞ্জয়কে খুব একটা প্রসন্ন না দেখা গেলেও, নয়নতারা তার পিছু ছাড়লো না।এদিকে দুপুরের ট্রেন মিস হবে বলেই মনে হয় এবং আরো বেশি দেরি করলে রাতের ট্রেন হাতছাড়া হবার ভয় তো আছেই। সুতরাং অবশেষে সঞ্জয়,নয়নতারার বাবা ও নয়নতারা বাবুকে কোলে নিয়ে গরুর গাড়িতে চড়ে বসলো।গাড়িটা চলতে শুরু করা মাত্র নয়নতারা একটি বার পেছন ফিরে দেখলো,তাদের বাড়ির ছাদের দিকে।হেমলতা মন্দিরাকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকখানি কেমন করে উঠলো তার।তবে মন্দিরা মুখে দুঃখের কোন ভাব দেখা গেল না। বোধকরি মন্দিরার মায়ের থেকে মাসির টানেই বেশি। তবে হেমলতা কাঁদছে।মন্দিরা তার ছোট ছোট হাতে বুঝেই তার মাসি চোখের অশ্রু মুছে দিচ্ছে। এই দৃশ্য কিছুটা অবাক করলো তাকে।তার মনটি ভাবতে বসলো,বড় হয়ে তার ছোট্ট মেয়ে ঠিক কার মতো হবে।
তালদিঘি গ্রামটি থেকে শহর অঞ্চলে যাত্রা মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। নৌকায় দুই গ্রাম পেরিয়ে তবে মধুপুরের মাঠ—একটা ছোট স্টেশন। ট্রেন দাঁড়ায় কি দাঁড়ায় না। সকালে-বিকেলে দুই চারজন মানুষকে উঠতে-নামতে দেখা গেলেও দুপুরে প্রায়ই অকারণে ট্রেন ক্যাঁচ শব্দে দাঁড়ায়; তারপর ক্যাঁচকোচ শব্দে লোহায় লোহায় ঘষাঘষির আওয়াজ করতে করতে ছাড়ে। তবে ভাগ্য খারাপ, এখন আর দূপুরের ট্রেনটি আর পাওয়ার উপায় নেই।পরের ট্রেনের খবর হতে হতে সন্ধ্যে। এদিকে সঞ্জয়ের চিন্তা সময় মত স্টেশনে পৌঁছালে তবে শেষ হয় আর কি।
////////
ছায়ামতির জলে দুটো নৌকা এক সাথে ভাসছে। তীরের পাশে একটা গাছের শেকড়ে নৌকা দুটো বাঁধা।একটি সঞ্জয়ের ও অপরটির অচেনা।তবে একে নৌকা না বলে ডিক্তি বলা ভালাে। আকারে তেমন বড় নয়। চার-পাঁচজন আরােহী বসতে পারে মাত্র।তবে নৌকা টি দেখে সুবিধার মনে হচ্ছে না মোটেও। জলতরঙ্গগুলাে ছলাৎ ছলাৎ করে তীরভূমিতে আছড়ে পড়ছে। আছড়ে পড়ার শব্দ ঈষদুচ্চকিত। মৃদু তরঙ্গাঘাতেই নৌকাটি অল্প অল্প দুলছে।মনে হচ্ছে এই বুঝি ভেঙ্গে পরে নৌকাটি।
নৌকা থেকে একটু দূরে মাঠে বসে রান্না ব্যস্ত দুই রমণী। একজন নয়নতারার ও অন্য জন্য অপর নৌকার আরোহী। দুই রমণীর সকল রমণীয়তা তাদের সর্বাঙ্গ জুড়ে। নয়নতারার কথা তোমাদের জানা কথা তবে রমণীটি অতিশয় সুন্দরী। মানুষ যে অর্থে সুন্দরী নারী বােঝে, এই নারী সে অর্থে সুন্দরী নয়। তার শরীরে গৌরবর্ণের আভাসটুকুও নেই। গৌরবর্ণীয় দুর্বলতাটুকু সৌন্দর্য নির্ধারণের মাপকাটি হতে পারে না। যুবতিটির গায়ের রং ঘাের কৃষ্ণবর্ণ। সৌন্দর্য সম্পর্কে আদি বিশ্বাসটুকু মন থেকে ঝেড়ে ফেলে এই রমণীর দিকে তাকালে যেকোনাে বয়সের পুরুষের দৃষ্টি আটকে থাকবে ওই নারীর দেহে। তাকে দেখে মানুষের ইন্দ্রিয়সমূহ চঞ্চল হয়ে উঠবেই। তবে সে যাই হোক কথা হল আমরা এখানে কেন! নদীর এই অংশটি কিঞ্চিৎ সংকুচিত। জলধারা কম স্রোতময়। নর্দীর বুকজুড়ে এখানে ওখানে চর। দূরের একটা চর বৃক্ষময়। ওই চরের পাশ ঘেঁষেই ওপারে যেতে হবে। এই অঞ্চল দিয়ে নদী পারাপারের জন্য লােক আসে। এদিক দিয়ে পারাপারে সময় লাগে কম, তাই নদীর এই অংশটিই পারর্থীদের পছন্দ। পরিশ্রম কম লাগে বলে নৌবাহকেরও পছন্দ এই অঞ্চলটি। তবে অপর নৌকার আরোহী বিপদে পরে নৌকা থামিয়েছে এখানে।তাদের নৌকার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়।এটি অবশ্য এক নজর তাকালেই বোঝা যায়। সঞ্জয় ও মেয়েটির স্বামীএকটি গাছের তলায় বসে কথা বলছিল।
– নতুন বৌ নিয়ে শহরে ঘুরতে যাচ্ছেন বুঝি?
– না না দাদা ঘুরতে নয়,আমি কাজের সূত্রে কলকাতায় থাকি,তাই আরকি।
সঞ্জয় ভালো ভাবে একবার চোখ বুলিয়ে নিল লোকটার ওপরে। বেশ শান্ত ও হাসি খুশি মুখ ছেলেটার। বয়স কম। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী না হলেই দেখতে বেশ।গায়ের রং শ্যামলা।
– দাদা আপনাকে বড্ড অসুবিধায় ফেললাম...
ছেলেটার কথা শেষ হবার আগে সঞ্জয় তাকে থামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
– অসুবিধায় ফেলেছো কি না তা মধুমতি পৌঁছনোর আগে বোঝা যাচ্ছে না।
ছেলেটি হয়তো কিছু একটা বলতে চাইছিল।কিন্তু সঞ্জয় না দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেল নয়নতারার দিকে। নয়নতারার ও মেয়েটি কি নিয়ে যেন কথা বলছিল।সঞ্জয়কে আসতে দেখে কথা থেমে গেল তাদের।এই পর্যন্ত সারাটা পথ নয়নতারা মুখ ভার করে বসে ছিল।এখন তাকে যেন বেশ হাসিখুশী লাগছে।
– বৌদিমণি তোমাদের হলো,ওদিকে দেরি হয়ে যাচ্ছে যে।
কথাটা বলেই সঞ্জয় লক্ষ্য করলো মেয়েটা কেমন অপ্রস্তুত হয়ে গেল।সেই সাথে নয়নতারার মুখখানি কোন কারণে লাল হয়ে উঠেছে।নয়নতারা মৃদু স্বরে বলল।
– আর একটু সময় লাগবে।
সঞ্জয় রিতিমত অবাক হল।নয়নতারা তার সাথে এমন সংকোচের সাথে কথা বলছে কেন বুঝতে পারলো না।তবে সে আর কথা না বারিয়ে সরে পড়লো।
অবশেষে রান্না শেষ হলে সঞ্জয় তারা দিল সবাইকে। তাই নৌকা জলে ভাসিয়ে তারা খেতে বসলো নৌকার ছইয়ের ভেতরে। নতুন বিবাহিত দম্পতিয় এবার তাদের সাথে যাত্রা করলো। নয়নতারা পাশে বসে হাতপাখার বাতাস করছিল।একটু দূরে মেয়েটি বাবুকে কোলে নিয়ে বসে আছে।
– কলকাতায় কিসের কাজ করেন আপনি?
– দাদা কাপড়ের কারখানায়,এই বছর দুই এক ধরে করছি।এবারের ছুটি নিয়ে গ্রামে গিয়েছিলাম।
– বিয়ের জন্যে বুঝি?
সঞ্জয়ের প্রশ্নে ছেলেটা কি একটা ভেবে তারপর বলল।
– ঠিক তা নয়....আসলে দাদা হয়েছে কি...আসলে..
– বলতে না চাইলে থাক। বৌদিমণি তোমার খেতে বসলে না যে!
– তোমরা খেয়ে নাও আগে। আমি বাবাকে খাইয়ে পরে বসছি।
– দিদি এদিকে এসো তো একটু।
মেয়েটির ডাকে নয়নতারার উঠে গেল যেদিকে।আর একটু পরেই মেয়েটি একহাত ঘোমটা টেনে এসে বসলো নয়নতারার জায়গায়।আর নয়নতারা বাবুকে দুধ খাওয়াতে বসলো ছইয়ের এক কোণে।
– দূরের যাত্রা কেউ এমন ভাঙ্গা নৌকার করে! কি বুঝে ওই নৌকায় উঠেছিলে বলোতো।
সঞ্জয়ের প্রশ্নে ছেলে বেশ লজ্জিত হলো।এবং একটু পরে বলতে লাগলো।
– দাদা কিছু করার ছিল না,আগামীকাল আমার ছুটি শেষ।তার ওপড় বজ্জাত মাঝি আগে বলেনি নৌকার এই অবস্থা।কি করে বুঝবো বলুন তো
সঞ্জয় লক্ষ্য করলো।স্বামীর অপটুতায় কথা বোধ করি তার নববধূর মনে লাগলো।তার হাতপাখার গতি কমতে লাগলো।তাই এই আলোচনা আর এগিয়ে না নেওয়াই ভালো ভেবে সঞ্জয় খাবারের মনোনিবেশ করলো।
তারা যখন স্টেশনে পৌঁছলো তখন সন্ধ্যা নামছে।ট্রেন এখনো আসনি।তাই টিকিট করে বসে থাকা ছাড়া তাহাদের আর বিশেষ কিছুই করার নেই বলেই চলে।তবে নয়নতারার মনটি এখনো ফুরফুরে।সে নতুন সঙ্গী পেয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত।
– দাদা!
হঠাৎ ডাকে পাশ ফিরে দেখলো ছেলেটা হাতে সিগারেট লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সঞ্জয়কে দেবে কি দেবে না বা দিলে সঞ্জয় রাগান্বিত হবে কি না,তা ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই ডাকে বসেছে সে।সঞ্জয় ধূমপান যে একদমই করে না তা নয়।শখের বশে শন্তুর চায়ের দোকানে বসে একদুবার টেনে দেখেছে সে।তবে তার ওসব পোষায় না। তবুও সে সিগারেট নিল ছেলেটার হাত থেকে।একটা দুটো টানে আর কিইবা ক্ষতি হবে।
কিছুক্ষণ পরেই দূরথেকে ট্রেনের শব্দ কানে এলো। আর একটু পরেই যাত্রা শুরু হবে গ্রাম ছেরে দূরে।কবে ফিরবে তাও বলা যায়না। হেমলতার কথা হঠাৎ মনে পরলো তার।মেয়েটি নিরীহ।ঠিক লতা গাছের মত।যা পায় তাই আঁকড়ে ধরতে চায়। কিছু বছর আগে যখন বৌদিমণির সাথে দেখা করার অপরাধে হেমলতা তাকে ধরিয়ে দিল।সেদিন দাদা হাতে মার খেতে খেতে সে হেমের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছিল।তোকেই আমি আমার ঘরে তুলবো,তারপর বোঝাবো মজা,মনে রাখিস এই কথা। হেমলতা তার সেই চোখের ভাষা ঠিক কতটুকু বুঝেছিল তা বলা মুশকিল।তবে ঐদিনের পর তাকে দেখলেই হেমের ছুটে পালানো কি আর কম উপভোগের জিনিস।
– দাদা! ট্রেন চলে এলো যে
ছেলেটির কথায় সঞ্জয় মুখ ফিরিয়ে দেখলো নয়নতারাকে। একটু দূরে নয়নতারা তার বাবাকে জল খাওয়াছিল।সে এগিয়ে গেল সেদিকে।.....গল্পের নায়িকা চললো কলকাতার উদ্দেশ্যে।তবে আমার গল্প চলবে কি না সেই প্রশ্ন রইলো পাঠক পাঠিকাদের কাছে!?