06-05-2024, 05:28 AM
(This post was last modified: 18-05-2024, 09:14 AM by বহুরূপী. Edited 10 times in total. Edited 10 times in total.)
পর্ব ৮
সঞ্জয় সব কাজ সেরে যখন বাড়ি ফিরলো।তখন সূর্যিমামা পশ্চিমে হালকা ঢলে পড়েছে। তালতলার রাস্তায় তখন গাছের দীর্ঘ ছায়া। তবে এখনও সময় আছে অনেকটা।এটা ভেবেই শান্তি লাগছে তার। ভাগ্যিস নন্দলাল কে রেখে সে চলে এলো আগে।নয়তো আজ আর মেলায় যাওয়া হবে নাই ভেবেছিল সে।নন্দলালের ওপড়ে তার ভরসা আছে।লোকটা একটু মন্দ হলেও কাজে পাকা।তাই সে যখন বলেছে আজ সন্ধ্যের মধ্যেই তার দাদাকে ছাড়িয়ে আনবে,তখন সঞ্জয়ের আর চিন্তা নেই। তার চেয়ে বরং মেলায় না গেলে চিন্তার শেষ ছিল না।নিশ্চয়ই বাড়ির মেয়েরা সেজে বসে আছে।এখন না নিয়ে গেলে অভিমানের কি আর শেষ আছে....!
সঞ্জয়ের মটরসাইকেল টি যখন বাড়ির উঠনে ঢুকলো,ঠিক তখনই হেমলতা দৌড়ে এসে তাকে দুহাতে জড়িয়ে চোখের জলে গায়ের জড়ানো পাঞ্জাবী টা ভিজিয়ে দিতে লাগলো।কোন ভাবেই তার কান্না থামছে না দেখে,শেষমেষ সঞ্জয় কঠিন গলায় লাগালে এক ধমক।
– চুপ কর ফাজিল মেয়ে! উফফ্.. আমার কানটা গেলো একেবারে।
অবশ্য এতে কাজ হবে সে ভাবেনি।তবে সঞ্জয় না ভাবলেও এতে কাজ হলো।হেম কান্না থামিয়ে চুপচাপ তাকে দুহাতে জড়িয়ে রাখলো। সঞ্জয় আবাক হয় মেয়েটার এমন কান্ডে।তবে সে বোঝে খুব ভয় না পেলে হেম তাকে এভাবে বুকে জড়াতে পারতো না।এর আগেও দু একবার হয়েছে এমন।
সঞ্জয় হেমলতা কে দুই বাহুতে ধরে তোলে তার বুক থেকে।দুহাতে অশ্রু মুছে দিয়ে বলে। মহারানীর কি হয়েছে শুনি,এতো কান্না কেন? বৌদিমণি বকেছে বুঝি!
হেম না সূচক মা নাড়ে,বা হাতটি তুলে ইসারা করে বসার ঘরের দিকে।সঞ্জয় আর কিছু না বলে এগিয়ে যায় বসার ঘরের দিকে।হেমলতা এগোচ্ছে তার পেছন পেছন।
বসার ঘরে ঢুকেই সঞ্জয়ের চোখে পরে বসার আসনে বসে আছে ডাক্তার বাবু।তার হাতে চায়ের কাপ।আর তার পাশেই মেঝেতে বসে আছে দেবু।একটু দূরে মিনতী দেবীর ঘরের দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে নয়নতারা। সঞ্জয় সেদিকে চোখ ফেরাতেই চোখে চোখে মিলন হলো।সঞ্জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো। নয়নতারার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পরছে তার ফর্সা গাল বেয়ে। সঞ্জয়ের মনটি ছুটে যেতে চাইলো যেখানে। তবে নিজেকে সামলাতে হলো ডাক্তার বাবুর ডাকে।
– সঞ্জয় আমার সাথে একটু বাইরে এসো তো!
সঞ্জয় চিন্তিত মনে ডাক্তারের পেছন পেছন চললো ভেতরে উঠনের বারান্দার দিকে। তারপর বারান্দায় ছাড়িয়ে নেমেগিয়ে দাঁড়ালো রান্নাঘরে পাশে জাম গাছটার ছায়ায়। ডাক্তার একটি বার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল।তারপর নিচু স্বরে বলতে লাগলো।
– তোমার বৌদির বাবার অবস্থা তো খুব একটা ভালো বোধ হয় না,যত শিগরই সম্ভব শহরে নিয়ে যাওয়া দরকার। যদি সম্ভব হয় তো আগামীকালই..
বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তাদের মাঝে।আর এরমধ্যে বসার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নয়নতারা। আজ দুপুরের কিছু আগে থেকেই তার বাবার বুকে ব্যথা উঠলো।উপায় না দেখে মিনতী দেবী দেবুকে পাঠিয়ে ডাক্তার বাবুকে আনে।এখন অবস্থা শান্ত হলেও মনের ভেতরে যে ঝড় উঠেছে যেই ঝড়ে দাপটে মাঝে মাঝে ভাসিয়ে দিচ্ছে তার ডাগর নয়ন দুখানি।
ডাক্তার বাবু চলে গেল,দেবু গেল তার পেছন পেছন হাতে কালো ব্যাগটি নিয়ে। আর সঞ্জয় বসলো জাম গাছের ছায়ায়।ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করা যায়। টাকা সমস্যা নয় তার কাছে।যাওয়ার ব্যবস্থা একটু কঠিন হলেও সে জোয়ান পুরুষ মানুষ।তাই এই সব নিয়ে ভাবে না সে। তার ভাবনা বাড়ির মেয়েদের নিয়ে।সে না থাকলে এদের খেয়াল কে রাখবে....
////////
বাড়ি অবস্থা সামাল দিয়ে সঞ্জয় হেম ও নয়নতারাকে নিয়ে এলো নদীর ঘাটে।অবশ্য বাড়িতে এমন অসুস্থ বাবাকে রেখে হেম বা নয়নতারা কেউই আসতে রাজী ছিল না।এমনকি ছোট্ট মেয়ে মন্দিরাও কেমন গুটিসুটি মেরে বসে ছিল বারান্দার এক কোণে।অবশেষে সঞ্জয় আর মিনতী দেবীর ঠেলা ঠেলিতে আসতে রাজি হলো সবাই।
নৌকা ঠিক করে নদী পার হলো তারা।নদীর ও পাড়ে ঘাটে নামতেই পরে ছায়ামতির হাট।আজকে হাটবার বলে মেলা ও হাট বসেছে একসাথে। হাটের রাস্তা থেকে নেমে আলপথে কিছুটা এগুলেই পরে বিশাল মাঠ।মাটে শেষে গ্রামের পথ ও একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি চোখে পরে।ঐ বাড়িটাকে ঘিরেই মেলা বসে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
অনেক দূর থেকে লোকজন ছুটে আসে মেলায়।
মেলা যখন শুরু হয়, দূর থেকে মেলার গমগমে আওয়াজ শোনা যায়। সঞ্জয়ের এখনো মনে আছে মেলায় প্রতিবার একটি সার্কাসের দল আসে। সেই সার্কাসের দলে থাকে একটি বড় হাতি। থাকে নাগরদোলা। মেলার এক কোনায় দেখানো হয় পুতুল নাচ। আর এই পুতুল নাচ ও সার্কাস দেখাতে নয়নতারাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল সে।নয়নতারা মেলায় যতখান থাকতো, সঞ্জয়ের একটি হাত শক্ত করে ধরে রাখতো। অবশ্য এছাড়া উপায় কি! ভরা মেলায় মানুষের পা ফেলানোর জায়গা থাকে না। মানুষে গিজগিজ করে...
এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাচ্ছিল সঞ্জয়।হটাৎ অনুভব করলো তার ডান হাতটা কেউ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে। সেদিকে তাকিয়ে সঞ্জয় একটু মুচকি হাসলো সে। এতে হেমলতা সাহস পেল কি না বোঝা গেল না। তবে হেম সঞ্জয়ের আরো কাছে চলে এলো।
হেমলতা বরাবরই ভীতুদের কাতারে পরে।একজনের বদলে দুজন দেখলেই তার বুকখানি কেঁপে ওটে।এই মেলা সে প্রতিবার এসেছে তার বাবার সাথে।কিন্তু আজ এ কার সাথে এলো সে! কে হয় সঞ্জয় তার! আজকাল এইসব প্রশ্ন ঘোড়ে তার মাথায়।এই মানুষটির কাছাকাছি থাকলে নিজেকে নিরাপদ লাগে তার।যেমন দিনের শেষ সবাই ঘরে ফেরে।তেমনি বিধাতা যেন বারবারই হেমকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানুষটার দিকে।
হেমলতা নিজেও বোঝে সঞ্জয় এখন শুধু তার বলেই নয় পুরো পরিবারের শেষ ভরসা।কিন্তু তবুও বড্ড ভয় হয় তা। এই পাষাণ হৃদয়ের লোকটা যে সব জোর করে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার থেকে।হেম হয়েছে তার খেলার পুতুল।যখন খুশি যেভাবে খুশি সে খেলছে হেমলতাকে নিয়ে।প্রতিরাতেই লুকিয়ে সঞ্জয়ের ঘরে যেতে হয় হেমলতাকে।।তারপর অবশ্য আর কিছুই করতে হয়না তাকে। জোরকরে ছিনিয়ে নেয় তার যা প্রয়োজন,আগুন ধরিয়ে দেয় হেমলতার এই নিটোল দেহে। তবে নিভিয়ে দেয় না কখনোই।মাঝেমধ্যে সেই আগুনে দগ্ধ হয় হেমলতা সারা রাত ধরে। ছুটে যেতে মন চায় সঞ্জয়ের কাছে।মন চায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে তার পায়ে। কিন্তু হায় পোড়া কপাল তার,এমন কিছু করা সাহস যে তার নেই। তবে গতকাল সে যায়নি। কিন্তু তা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে......
– আআঃ...
ভাবতে ভাবতে চমকে ওঠে হেমলতা। সঞ্জয় বুকে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে।অস্থির হয়ে ওঠে সে।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে মাট ছাড়িয়ে সঞ্জয় তাকে নিয়ে এসেছে লোকজনের ভিড়ের বাইরে। হেমলতা ব্যাকুল হয়ে খোঁজ তার দিদিকে।তবে কোথায় কি,সঞ্জয় আর সে এখন একটা তাবুর আড়ালে।
- ছি মেলায় এসে এভাবে কাঁদে কেউ,বাবার জন্যে চিন্তা হচ্ছে বুঝি?
অবাক হয় হেম।গালে হাত বুলিয়ে দেখে সত্যিই তো,সে কাঁদছে কেন!দুহাতে চোখ মোছে সে।তারপর ঘাড় উচুঁ করে তাকায় সঞ্জয়ের মুখের দিকে।মনে মনে ভাবে এতো লম্বা কেন এই মানুষটি!ওভাবে ঘাড় বেকিয়ে কথা বলা যায় বুঝি!তবুও হেমলতা মৃদু স্বরে বলে।
– দিদি কোথায়!আমি দিদির কাছে যাবো।
– যাবেই তো,তার আগে ভালো ভাবে চোখ মোছো দেখি,তূমি কাঁদছো এটা দেখে বৌদিমণির মন খারাপ হয়ে যাবে না।
সঞ্চয় তার পাঞ্জাবীর পকেট হইতে একটি রুমাল বের করে। এবং তা দিয়ে হেমের চোখ মুছিয়ে দেয় সে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
– পাগলী একটা,আমাকে এত ভয় কেন শুনি!আমি কি খেয়ে ফেলছি তোমায়।
হেমলতা জবাব দেয় না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।হেমকে শান্ত করে নিয়ে সঞ্জয় আবার মিশলো নয়নতারার সাথে।নয়নতারা ছিল তালদিঘির আরো কয়েকটি মেয়ের বউয়ের সাথে। হেমলতাও মিশলো তাদে্য সাথে।আর সঞ্চয় মন্দিরাকে কোলে নিয়ে তাদের পাশাপাশি হাটতে লাগলো।
মন্দিরাকে নাগরদোলায় চড়িয়ে তার সার্কাস দেখতে ঢোকে। হেম ও মন্দিররা সার্কাসের অবাক কাণ্ড দেখে হাততালি দেয়। মঞ্চে বিশাল হাতি একটি বড় তিন চাকার সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেলে পা রাখতেই সব দর্শক আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
হেমলতা ও মন্দিরার মুখে হাসি দেখে সঞ্জয়ের মন পুলকিত হয়।তবে নয়নতারার মুখটি মলিন।সে জোর করে হাসার চেষ্টা করছে।এই ব্যাপারটা তার চোখ এড়িয়ে যায় না।এক ঘণ্টা পরই সার্কাস দেখানো শেষ হয়ে যায়। হুড়মুড় করে লোকজন বাইরে বের হতে শুরু করে। বের হওয়ার একটাই গেট। সঞ্জয় তাদের সামনে পাঠিয়ে পেছনের পথ আগলে দাঁড়ায়।মানুষের ঠেলাঠেলির ঝক্কি টা যায় তার ওপরে।
তারপর মেলায় নানাধরনের দোকান ঘুড়তে ঘুড়তে কিছু কেনাকাটা করে তারা। সঞ্জয় নিজেও সবার আড়ালে কিছু কিনে পাঞ্জাবী পকেটে ভরে নিল। এদিকে মন্দিরা একটি পুতুল বগলদাবা করে,একহাতে জিলেপি ও অন্য হাতে তার ছোট্ট ভাইয়ের জন্যে নেয়া বেলুন বাঁশিটিতে মাঝে মাঝেই ফুঁ দেয়। একই সঙ্গে তার গাল ও বেলুন দুটোই ফুলতে থাকে। পঁ পঁ শব্দ হয়। তবে ছোট্ট মেয়েটাকে কে বোঝাবে,তার ছোট্ট ভাইটি জন্যে এই বাঁশি বাজানো মুশকিল।
অবশেষে মাঠের এদিকে ধান ক্ষেতের পাশে একটা খালি জায়গায় বসে তারা একটু বিশ্রামের জন্যে।নয়নতারা ও হেমলতা গ্রামের কয়েকটি মেয়ের সাথে বসেছে।এবং এতোক্ষণ পরে নয়নতারার মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে।হটাৎ সঞ্জয়ের কি হলো বোঝে না সে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নয়নতারার দিকে। তার বৌদিমণির হাস্যজ্জল সুন্দর মুখটির থেকে চোখ সরাতে পারে না সে। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি নয়নতারার দেহে।মাথার কাপড়ের আড়ালে তার লম্বা কোকড়ানো চূলগুলো খোঁপায় করা।সঞ্জয়ের মন আনচান করে সেই খোঁপা খুলে দিতে,ফোলা ফোলা গাল দুটো টিপে দিতে। মনের ভাবনার ভিড় করে,বৌদিমণির গাল টিপলে বা ঐ লাল আভা ঠোঁটে চুমু খেলে কি হবে,সে কি হেমলতার মতোই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠবে! ভাবনার মাঝে দুই জোরা চোখের মিলন হয়।দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে এক পলকহীন দৃষ্টিতে। সঞ্জয় বোঝা না কি হয়েছে তার,বলা চলে বোঝার চেষ্টাও করে না সে। এদিকে নয়নতারা মুখমণ্ডল লাল করে চোখ নামিয়ে নেয়। বিধাতার এই অদ্ভুত রীতি, মেয়েরা যে বুঝতে পারে পুরুষদের কামনার দৃষ্টি! তাদের থেকে কি আর লুকানো যায়....
ফেরার সময় সার্কাসের প্যান্ডেলের কাছে মন্দিরা হাতি দেখে দাঁড়িয়ে পরে। হাতিটা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক হাতিটাকে কলাগাছের টুকরো খাওয়াচ্ছিল। সঞ্জয় মন্দিরার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে
– কি হাতিতে চড়ে বসে থাকতে পারবি তো?
মন্দিরা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেও নয়নতারা বেকে বসে।সে কোন ভাবেই মেয়েকে হাতির পিঠে ওঠাবে না।তবে সঞ্জয় কি আর সে কথা মানিবে!একটু কথা কাটাকাটির পরে ঠিক হয় সঞ্জয় মন্দিরাকে নিয়ে বসবে। তাই হাতির পিঠে ছড়ে জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে যায় তারা ঘাটের দিকে। আর এদিকে হেম ও কিছু গ্রামের মেয়ে বউকে নিয়ে আলপথে ঘাটে আসে নয়নতারা।মেলা ভাঙ্গছে এখন। আর তাই দেখে সূর্যটায় পা ডোবাচ্ছে পশ্চিমে। মনে হয় যেন এতখনে ছুটি পেয়েছে সূর্য টা।
ঘাটে এখন অনেক নৌকার ভিড়। তারা যে নৌকোয় এসেছিল সেটিও ঘাটের এপাশে বাঁধা। তারা সবাই নৌকায় ওঠার পরে। নৌকাটি ঘাট ছাড়ে আর ঠিক ওই সময়ই হাতিটা শুঁড় উপরে তুলে বিরাট একটা আওয়াজ করে।সঞ্জয় নৌকার ছইয়ের বাইরে বসে ভাবে। আজ কতদিন পরে সে পরিবার নিয়ে মেলায় এলো সে।আবারও একটি বছর ঘুরে এই মেলা আসবে।তখনকি তার পাশে থাকবে এই মুখগুলো! নাকি চলে আসবে নদীর এই পারে তাকে আবারও একা করে।
ভাবনায় টান পরে সঞ্জয়ের। মুখ তুলে তাকায় সে মাঝির দিকে।বইঠা হাতে মাঝি গাইছে.....
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি"
"কেমনে আসে যায়"
"তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি"
"দিতাম পাখির পায়ে।"
/////
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো।নয়নতারা বাড়ির দোরের সমুখে বসেছিল অনেকক্ষণ।তার স্বামী ফিরবে আজ।থানা থেকে ছাড়া পেয়ে একটি বার নিশ্চয়ই আসবে তার কাছে।কিন্তু রাত গভীর হতেই সে আশা ভাঙ্গলো তার। এখন নয়নতারা তার খাটে বসে,হাতে একটা চিরকুট।এটি সে পেয়েছে বিছানা ঝাড় দেবার সময়।চিরকুটে লেখা "রাতে আসবে কিন্তু,ক্ষতিপূরণ এখনো যে অনেক বাকি রয়েছে তোমার" চিরকুট টা দুই একবার পরলো সে। অবশেষে সব হিসেব মিলিয়ে নিয়ে ধিরে ধিরে ঘরের বাইড়ে এলো সে।বাবুর ঘুম খুব কাচাঁ।একবার উঠলে আবার ঘুম পাড়ানো মুশকিল।তাই এতো সতর্কতা।
কিছু দিন ধরে সে দেখছে তার বোনটির পরিবর্তন।কেমন আনমনা হয়ে থাকে,একা একা হাসে।আর সবচেয়ে বড় কথা তার থেকে কথা লুকোয়। তার বোনটি তো আগে এমনছিল না,তবে কি হলো তার।এতদিন ভেবে না পেলেও,আজকে সব হিসেব মিলে গেছে তার। নয়নতারা এক দুটো ঘর খুঁজে নিশ্চিত হলো আগে।তারপর দোতলার সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল। দোতলায় টানা বারান্দার শেষে সঞ্জয়ের ঘরে বাতি জ্বলছে এখনো। নয়নতারা ধিরে ধিরে এগিয়ে গিয়ে দরজার আড়াল থেকে উঁকি দেয় ঘরে। ঘরের ভেতর সে কি দেখবে তা সে আন্দাজ করেই এসেছিল। কিন্তু দৃষ্টি দেখার পরে সে আর থাকিতে পারিলো না। কোন এক কারণে তার নয়ন দুখানি জলে ভাসিলো। সে যে ভাবে আসিয়া ছিল সেই ভাবেই ধিরে ধিরে সরিয়া গেল।
সঞ্জয়ের ঘরে সঞ্জয় বেশ আরাম করে বসে ছিল খাটে পা ঝুলিয়ে। হেমলতা বসে তার পায়ের কাছে মেঝেতে। হেমের শাড়ির আঁচল খানি সঞ্জয়ের ডান হাতের কব্জি তে পেচানো। সুযোগে পেয়ে হেমলতা যেন পালাতে না পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।তবে হেমলতার পালানোর ইচ্ছে ছিল কি! অবশ্য তা বোঝা না গেলেও হেমলতার দেহের কাঁপুনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
তবে এই কাঁপুনির কারণটি মোটেই সহজ নয়।আজ সঞ্জয় মেলা থেকে দুই প্যাকেট কাঁচের চুড়ি নিয়ে এসেছিল।এখন তারই একটি খুলে হেমলতার হাতটি তার হাতে তুলে পরম আদরের সহিত পরিয়ে দিচ্ছিল হেমলতা কে।চুড়ি পড়ানো হলে,সে হেমলতাকে তুলে বসায় তার কোলে। হেমলতার একটি হাত তার হাতে তুলে চুমু খায় সে। তারপর কোমল স্বর বল
– কালকে শহরে যাবো তোমার বাবাকে নিয়ে,কিছু দেবে না আমায়?
হেমলতা তাটায় সঞ্জয়ের পানে,কিন্তু কি বলবে ভেবে পায় না। বলি এই অভাগিনীর কি বা আছে দেবার মত! কিছুই নে শুধুমাত্র চাটনির বয়াম দুখানি ছারা।তাও তো তরই কিনে দেয়া।সে কেন নেবে এগুলো।
– কি দেবে না বুঝি?
হেমলতা এবারে আর চুপ থাকতে পারলো না। মৃদু স্বরে বলল।
– কি দেব আমি,কিছুই যে নেই আমার।
– কিছুই না!
হেম মাথা নাড়িয়ে বলে না। সঞ্জয় কি যেন ভাবে।তার পর বলে।
– তবে একটি প্রতিজ্ঞা দাও আমায়। যাই হোক না কেন তুমি আমার ঘরে বউ হয়ে উঠবে, অন্য কারো নয়।
হেমলতা লাজ্জে রাঙা হলো এবারে। কিন্তু এ প্রতিজ্ঞা সে কিভাবে দেয়। বলি ভগ'বান তার কপালে কি লিখেছেন সেকি তা জানে।
তবে সঞ্জয় নাছোড়বান্দা। সে ছাড়বে কেন! অবশেষে হেমকে বাধ্য হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হলো। হায় কপাল!যদি এই অভাগী জানতো সঞ্জয় তাকে কোন বিপদের দিকে ঠেলে দিল তবে কি আর...।না সে যাক গে ওতো পরের কথা। এদিকে কথা বলতে বলতে সঞ্জয়ের হাত দুটো কখন যেন হেমলতার ব্লাউজের ওপড়ে এসে পরেছে। হেমলতা অনুভব করলেও সরে পরার উপায় নেই। সে জানে আর অল্প কিছুক্ষণ পরে তার আঁচল খানি মাটিতে লুটিয়ে পরবে।তারপর সঞ্জয়ের অবাধ্য ঠোঁট জোরা চোষে বেড়াবে তার উর্ধাঙ্গের প্রতিটি নিষিদ্ধ খাঁজে।সে যতোই ছটফট করুক না কেন সঞ্জয় তাহাকে ছাড়িবে না.....অনেক কিছুই তো হলো আজকে।তবে বলি কি যার জন্যে পড়তে আসা তা হতে একটু দেরি হবে আর কি।তো অবশেষে গল্প ভালো লাগলে বলি।গল্পটি চলবে তো?
সঞ্জয় সব কাজ সেরে যখন বাড়ি ফিরলো।তখন সূর্যিমামা পশ্চিমে হালকা ঢলে পড়েছে। তালতলার রাস্তায় তখন গাছের দীর্ঘ ছায়া। তবে এখনও সময় আছে অনেকটা।এটা ভেবেই শান্তি লাগছে তার। ভাগ্যিস নন্দলাল কে রেখে সে চলে এলো আগে।নয়তো আজ আর মেলায় যাওয়া হবে নাই ভেবেছিল সে।নন্দলালের ওপড়ে তার ভরসা আছে।লোকটা একটু মন্দ হলেও কাজে পাকা।তাই সে যখন বলেছে আজ সন্ধ্যের মধ্যেই তার দাদাকে ছাড়িয়ে আনবে,তখন সঞ্জয়ের আর চিন্তা নেই। তার চেয়ে বরং মেলায় না গেলে চিন্তার শেষ ছিল না।নিশ্চয়ই বাড়ির মেয়েরা সেজে বসে আছে।এখন না নিয়ে গেলে অভিমানের কি আর শেষ আছে....!
সঞ্জয়ের মটরসাইকেল টি যখন বাড়ির উঠনে ঢুকলো,ঠিক তখনই হেমলতা দৌড়ে এসে তাকে দুহাতে জড়িয়ে চোখের জলে গায়ের জড়ানো পাঞ্জাবী টা ভিজিয়ে দিতে লাগলো।কোন ভাবেই তার কান্না থামছে না দেখে,শেষমেষ সঞ্জয় কঠিন গলায় লাগালে এক ধমক।
– চুপ কর ফাজিল মেয়ে! উফফ্.. আমার কানটা গেলো একেবারে।
অবশ্য এতে কাজ হবে সে ভাবেনি।তবে সঞ্জয় না ভাবলেও এতে কাজ হলো।হেম কান্না থামিয়ে চুপচাপ তাকে দুহাতে জড়িয়ে রাখলো। সঞ্জয় আবাক হয় মেয়েটার এমন কান্ডে।তবে সে বোঝে খুব ভয় না পেলে হেম তাকে এভাবে বুকে জড়াতে পারতো না।এর আগেও দু একবার হয়েছে এমন।
সঞ্জয় হেমলতা কে দুই বাহুতে ধরে তোলে তার বুক থেকে।দুহাতে অশ্রু মুছে দিয়ে বলে। মহারানীর কি হয়েছে শুনি,এতো কান্না কেন? বৌদিমণি বকেছে বুঝি!
হেম না সূচক মা নাড়ে,বা হাতটি তুলে ইসারা করে বসার ঘরের দিকে।সঞ্জয় আর কিছু না বলে এগিয়ে যায় বসার ঘরের দিকে।হেমলতা এগোচ্ছে তার পেছন পেছন।
বসার ঘরে ঢুকেই সঞ্জয়ের চোখে পরে বসার আসনে বসে আছে ডাক্তার বাবু।তার হাতে চায়ের কাপ।আর তার পাশেই মেঝেতে বসে আছে দেবু।একটু দূরে মিনতী দেবীর ঘরের দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছে নয়নতারা। সঞ্জয় সেদিকে চোখ ফেরাতেই চোখে চোখে মিলন হলো।সঞ্জয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো। নয়নতারার চোখ থেকে মুক্তোর দানার মতো অশ্রু বিন্দু গড়িয়ে পরছে তার ফর্সা গাল বেয়ে। সঞ্জয়ের মনটি ছুটে যেতে চাইলো যেখানে। তবে নিজেকে সামলাতে হলো ডাক্তার বাবুর ডাকে।
– সঞ্জয় আমার সাথে একটু বাইরে এসো তো!
সঞ্জয় চিন্তিত মনে ডাক্তারের পেছন পেছন চললো ভেতরে উঠনের বারান্দার দিকে। তারপর বারান্দায় ছাড়িয়ে নেমেগিয়ে দাঁড়ালো রান্নাঘরে পাশে জাম গাছটার ছায়ায়। ডাক্তার একটি বার বারান্দার দিকে তাকিয়ে দেখে নিল।তারপর নিচু স্বরে বলতে লাগলো।
– তোমার বৌদির বাবার অবস্থা তো খুব একটা ভালো বোধ হয় না,যত শিগরই সম্ভব শহরে নিয়ে যাওয়া দরকার। যদি সম্ভব হয় তো আগামীকালই..
বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো তাদের মাঝে।আর এরমধ্যে বসার ঘরের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল নয়নতারা। আজ দুপুরের কিছু আগে থেকেই তার বাবার বুকে ব্যথা উঠলো।উপায় না দেখে মিনতী দেবী দেবুকে পাঠিয়ে ডাক্তার বাবুকে আনে।এখন অবস্থা শান্ত হলেও মনের ভেতরে যে ঝড় উঠেছে যেই ঝড়ে দাপটে মাঝে মাঝে ভাসিয়ে দিচ্ছে তার ডাগর নয়ন দুখানি।
ডাক্তার বাবু চলে গেল,দেবু গেল তার পেছন পেছন হাতে কালো ব্যাগটি নিয়ে। আর সঞ্জয় বসলো জাম গাছের ছায়ায়।ভাবতে লাগলো কিভাবে কি করা যায়। টাকা সমস্যা নয় তার কাছে।যাওয়ার ব্যবস্থা একটু কঠিন হলেও সে জোয়ান পুরুষ মানুষ।তাই এই সব নিয়ে ভাবে না সে। তার ভাবনা বাড়ির মেয়েদের নিয়ে।সে না থাকলে এদের খেয়াল কে রাখবে....
////////
বাড়ি অবস্থা সামাল দিয়ে সঞ্জয় হেম ও নয়নতারাকে নিয়ে এলো নদীর ঘাটে।অবশ্য বাড়িতে এমন অসুস্থ বাবাকে রেখে হেম বা নয়নতারা কেউই আসতে রাজী ছিল না।এমনকি ছোট্ট মেয়ে মন্দিরাও কেমন গুটিসুটি মেরে বসে ছিল বারান্দার এক কোণে।অবশেষে সঞ্জয় আর মিনতী দেবীর ঠেলা ঠেলিতে আসতে রাজি হলো সবাই।
নৌকা ঠিক করে নদী পার হলো তারা।নদীর ও পাড়ে ঘাটে নামতেই পরে ছায়ামতির হাট।আজকে হাটবার বলে মেলা ও হাট বসেছে একসাথে। হাটের রাস্তা থেকে নেমে আলপথে কিছুটা এগুলেই পরে বিশাল মাঠ।মাটে শেষে গ্রামের পথ ও একটা পুরোনো জমিদার বাড়ি চোখে পরে।ঐ বাড়িটাকে ঘিরেই মেলা বসে। চৈত্রসংক্রান্তির মেলা।
অনেক দূর থেকে লোকজন ছুটে আসে মেলায়।
মেলা যখন শুরু হয়, দূর থেকে মেলার গমগমে আওয়াজ শোনা যায়। সঞ্জয়ের এখনো মনে আছে মেলায় প্রতিবার একটি সার্কাসের দল আসে। সেই সার্কাসের দলে থাকে একটি বড় হাতি। থাকে নাগরদোলা। মেলার এক কোনায় দেখানো হয় পুতুল নাচ। আর এই পুতুল নাচ ও সার্কাস দেখাতে নয়নতারাকে লুকিয়ে নিয়ে এসেছিল সে।নয়নতারা মেলায় যতখান থাকতো, সঞ্জয়ের একটি হাত শক্ত করে ধরে রাখতো। অবশ্য এছাড়া উপায় কি! ভরা মেলায় মানুষের পা ফেলানোর জায়গা থাকে না। মানুষে গিজগিজ করে...
এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যাচ্ছিল সঞ্জয়।হটাৎ অনুভব করলো তার ডান হাতটা কেউ দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে। সেদিকে তাকিয়ে সঞ্জয় একটু মুচকি হাসলো সে। এতে হেমলতা সাহস পেল কি না বোঝা গেল না। তবে হেম সঞ্জয়ের আরো কাছে চলে এলো।
হেমলতা বরাবরই ভীতুদের কাতারে পরে।একজনের বদলে দুজন দেখলেই তার বুকখানি কেঁপে ওটে।এই মেলা সে প্রতিবার এসেছে তার বাবার সাথে।কিন্তু আজ এ কার সাথে এলো সে! কে হয় সঞ্জয় তার! আজকাল এইসব প্রশ্ন ঘোড়ে তার মাথায়।এই মানুষটির কাছাকাছি থাকলে নিজেকে নিরাপদ লাগে তার।যেমন দিনের শেষ সবাই ঘরে ফেরে।তেমনি বিধাতা যেন বারবারই হেমকে ঠেলে দিচ্ছে এই মানুষটার দিকে।
হেমলতা নিজেও বোঝে সঞ্জয় এখন শুধু তার বলেই নয় পুরো পরিবারের শেষ ভরসা।কিন্তু তবুও বড্ড ভয় হয় তা। এই পাষাণ হৃদয়ের লোকটা যে সব জোর করে ছিনিয়ে নিচ্ছে তার থেকে।হেম হয়েছে তার খেলার পুতুল।যখন খুশি যেভাবে খুশি সে খেলছে হেমলতাকে নিয়ে।প্রতিরাতেই লুকিয়ে সঞ্জয়ের ঘরে যেতে হয় হেমলতাকে।।তারপর অবশ্য আর কিছুই করতে হয়না তাকে। জোরকরে ছিনিয়ে নেয় তার যা প্রয়োজন,আগুন ধরিয়ে দেয় হেমলতার এই নিটোল দেহে। তবে নিভিয়ে দেয় না কখনোই।মাঝেমধ্যে সেই আগুনে দগ্ধ হয় হেমলতা সারা রাত ধরে। ছুটে যেতে মন চায় সঞ্জয়ের কাছে।মন চায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে তার পায়ে। কিন্তু হায় পোড়া কপাল তার,এমন কিছু করা সাহস যে তার নেই। তবে গতকাল সে যায়নি। কিন্তু তা নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে......
– আআঃ...
ভাবতে ভাবতে চমকে ওঠে হেমলতা। সঞ্জয় বুকে জড়িয়ে নিয়েছে তাকে।অস্থির হয়ে ওঠে সে।এদিকে ওদিকে তাকিয়ে দেখে মাট ছাড়িয়ে সঞ্জয় তাকে নিয়ে এসেছে লোকজনের ভিড়ের বাইরে। হেমলতা ব্যাকুল হয়ে খোঁজ তার দিদিকে।তবে কোথায় কি,সঞ্জয় আর সে এখন একটা তাবুর আড়ালে।
- ছি মেলায় এসে এভাবে কাঁদে কেউ,বাবার জন্যে চিন্তা হচ্ছে বুঝি?
অবাক হয় হেম।গালে হাত বুলিয়ে দেখে সত্যিই তো,সে কাঁদছে কেন!দুহাতে চোখ মোছে সে।তারপর ঘাড় উচুঁ করে তাকায় সঞ্জয়ের মুখের দিকে।মনে মনে ভাবে এতো লম্বা কেন এই মানুষটি!ওভাবে ঘাড় বেকিয়ে কথা বলা যায় বুঝি!তবুও হেমলতা মৃদু স্বরে বলে।
– দিদি কোথায়!আমি দিদির কাছে যাবো।
– যাবেই তো,তার আগে ভালো ভাবে চোখ মোছো দেখি,তূমি কাঁদছো এটা দেখে বৌদিমণির মন খারাপ হয়ে যাবে না।
সঞ্চয় তার পাঞ্জাবীর পকেট হইতে একটি রুমাল বের করে। এবং তা দিয়ে হেমের চোখ মুছিয়ে দেয় সে। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল।
– পাগলী একটা,আমাকে এত ভয় কেন শুনি!আমি কি খেয়ে ফেলছি তোমায়।
হেমলতা জবাব দেয় না। মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।হেমকে শান্ত করে নিয়ে সঞ্জয় আবার মিশলো নয়নতারার সাথে।নয়নতারা ছিল তালদিঘির আরো কয়েকটি মেয়ের বউয়ের সাথে। হেমলতাও মিশলো তাদে্য সাথে।আর সঞ্চয় মন্দিরাকে কোলে নিয়ে তাদের পাশাপাশি হাটতে লাগলো।
মন্দিরাকে নাগরদোলায় চড়িয়ে তার সার্কাস দেখতে ঢোকে। হেম ও মন্দিররা সার্কাসের অবাক কাণ্ড দেখে হাততালি দেয়। মঞ্চে বিশাল হাতি একটি বড় তিন চাকার সাইকেল চালাচ্ছে। সাইকেলে পা রাখতেই সব দর্শক আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
হেমলতা ও মন্দিরার মুখে হাসি দেখে সঞ্জয়ের মন পুলকিত হয়।তবে নয়নতারার মুখটি মলিন।সে জোর করে হাসার চেষ্টা করছে।এই ব্যাপারটা তার চোখ এড়িয়ে যায় না।এক ঘণ্টা পরই সার্কাস দেখানো শেষ হয়ে যায়। হুড়মুড় করে লোকজন বাইরে বের হতে শুরু করে। বের হওয়ার একটাই গেট। সঞ্জয় তাদের সামনে পাঠিয়ে পেছনের পথ আগলে দাঁড়ায়।মানুষের ঠেলাঠেলির ঝক্কি টা যায় তার ওপরে।
তারপর মেলায় নানাধরনের দোকান ঘুড়তে ঘুড়তে কিছু কেনাকাটা করে তারা। সঞ্জয় নিজেও সবার আড়ালে কিছু কিনে পাঞ্জাবী পকেটে ভরে নিল। এদিকে মন্দিরা একটি পুতুল বগলদাবা করে,একহাতে জিলেপি ও অন্য হাতে তার ছোট্ট ভাইয়ের জন্যে নেয়া বেলুন বাঁশিটিতে মাঝে মাঝেই ফুঁ দেয়। একই সঙ্গে তার গাল ও বেলুন দুটোই ফুলতে থাকে। পঁ পঁ শব্দ হয়। তবে ছোট্ট মেয়েটাকে কে বোঝাবে,তার ছোট্ট ভাইটি জন্যে এই বাঁশি বাজানো মুশকিল।
অবশেষে মাঠের এদিকে ধান ক্ষেতের পাশে একটা খালি জায়গায় বসে তারা একটু বিশ্রামের জন্যে।নয়নতারা ও হেমলতা গ্রামের কয়েকটি মেয়ের সাথে বসেছে।এবং এতোক্ষণ পরে নয়নতারার মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে।হটাৎ সঞ্জয়ের কি হলো বোঝে না সে।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নয়নতারার দিকে। তার বৌদিমণির হাস্যজ্জল সুন্দর মুখটির থেকে চোখ সরাতে পারে না সে। লাল টুকটুকে একটা শাড়ি নয়নতারার দেহে।মাথার কাপড়ের আড়ালে তার লম্বা কোকড়ানো চূলগুলো খোঁপায় করা।সঞ্জয়ের মন আনচান করে সেই খোঁপা খুলে দিতে,ফোলা ফোলা গাল দুটো টিপে দিতে। মনের ভাবনার ভিড় করে,বৌদিমণির গাল টিপলে বা ঐ লাল আভা ঠোঁটে চুমু খেলে কি হবে,সে কি হেমলতার মতোই লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠবে! ভাবনার মাঝে দুই জোরা চোখের মিলন হয়।দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে এক পলকহীন দৃষ্টিতে। সঞ্জয় বোঝা না কি হয়েছে তার,বলা চলে বোঝার চেষ্টাও করে না সে। এদিকে নয়নতারা মুখমণ্ডল লাল করে চোখ নামিয়ে নেয়। বিধাতার এই অদ্ভুত রীতি, মেয়েরা যে বুঝতে পারে পুরুষদের কামনার দৃষ্টি! তাদের থেকে কি আর লুকানো যায়....
ফেরার সময় সার্কাসের প্যান্ডেলের কাছে মন্দিরা হাতি দেখে দাঁড়িয়ে পরে। হাতিটা তখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। একটা লোক হাতিটাকে কলাগাছের টুকরো খাওয়াচ্ছিল। সঞ্জয় মন্দিরার কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে
– কি হাতিতে চড়ে বসে থাকতে পারবি তো?
মন্দিরা আনন্দে লাফিয়ে উঠলেও নয়নতারা বেকে বসে।সে কোন ভাবেই মেয়েকে হাতির পিঠে ওঠাবে না।তবে সঞ্জয় কি আর সে কথা মানিবে!একটু কথা কাটাকাটির পরে ঠিক হয় সঞ্জয় মন্দিরাকে নিয়ে বসবে। তাই হাতির পিঠে ছড়ে জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে এগিয়ে যায় তারা ঘাটের দিকে। আর এদিকে হেম ও কিছু গ্রামের মেয়ে বউকে নিয়ে আলপথে ঘাটে আসে নয়নতারা।মেলা ভাঙ্গছে এখন। আর তাই দেখে সূর্যটায় পা ডোবাচ্ছে পশ্চিমে। মনে হয় যেন এতখনে ছুটি পেয়েছে সূর্য টা।
ঘাটে এখন অনেক নৌকার ভিড়। তারা যে নৌকোয় এসেছিল সেটিও ঘাটের এপাশে বাঁধা। তারা সবাই নৌকায় ওঠার পরে। নৌকাটি ঘাট ছাড়ে আর ঠিক ওই সময়ই হাতিটা শুঁড় উপরে তুলে বিরাট একটা আওয়াজ করে।সঞ্জয় নৌকার ছইয়ের বাইরে বসে ভাবে। আজ কতদিন পরে সে পরিবার নিয়ে মেলায় এলো সে।আবারও একটি বছর ঘুরে এই মেলা আসবে।তখনকি তার পাশে থাকবে এই মুখগুলো! নাকি চলে আসবে নদীর এই পারে তাকে আবারও একা করে।
ভাবনায় টান পরে সঞ্জয়ের। মুখ তুলে তাকায় সে মাঝির দিকে।বইঠা হাতে মাঝি গাইছে.....
"খাঁচার ভিতর অচিন পাখি"
"কেমনে আসে যায়"
"তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি"
"দিতাম পাখির পায়ে।"
/////
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলো।নয়নতারা বাড়ির দোরের সমুখে বসেছিল অনেকক্ষণ।তার স্বামী ফিরবে আজ।থানা থেকে ছাড়া পেয়ে একটি বার নিশ্চয়ই আসবে তার কাছে।কিন্তু রাত গভীর হতেই সে আশা ভাঙ্গলো তার। এখন নয়নতারা তার খাটে বসে,হাতে একটা চিরকুট।এটি সে পেয়েছে বিছানা ঝাড় দেবার সময়।চিরকুটে লেখা "রাতে আসবে কিন্তু,ক্ষতিপূরণ এখনো যে অনেক বাকি রয়েছে তোমার" চিরকুট টা দুই একবার পরলো সে। অবশেষে সব হিসেব মিলিয়ে নিয়ে ধিরে ধিরে ঘরের বাইড়ে এলো সে।বাবুর ঘুম খুব কাচাঁ।একবার উঠলে আবার ঘুম পাড়ানো মুশকিল।তাই এতো সতর্কতা।
কিছু দিন ধরে সে দেখছে তার বোনটির পরিবর্তন।কেমন আনমনা হয়ে থাকে,একা একা হাসে।আর সবচেয়ে বড় কথা তার থেকে কথা লুকোয়। তার বোনটি তো আগে এমনছিল না,তবে কি হলো তার।এতদিন ভেবে না পেলেও,আজকে সব হিসেব মিলে গেছে তার। নয়নতারা এক দুটো ঘর খুঁজে নিশ্চিত হলো আগে।তারপর দোতলার সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠে গেল। দোতলায় টানা বারান্দার শেষে সঞ্জয়ের ঘরে বাতি জ্বলছে এখনো। নয়নতারা ধিরে ধিরে এগিয়ে গিয়ে দরজার আড়াল থেকে উঁকি দেয় ঘরে। ঘরের ভেতর সে কি দেখবে তা সে আন্দাজ করেই এসেছিল। কিন্তু দৃষ্টি দেখার পরে সে আর থাকিতে পারিলো না। কোন এক কারণে তার নয়ন দুখানি জলে ভাসিলো। সে যে ভাবে আসিয়া ছিল সেই ভাবেই ধিরে ধিরে সরিয়া গেল।
সঞ্জয়ের ঘরে সঞ্জয় বেশ আরাম করে বসে ছিল খাটে পা ঝুলিয়ে। হেমলতা বসে তার পায়ের কাছে মেঝেতে। হেমের শাড়ির আঁচল খানি সঞ্জয়ের ডান হাতের কব্জি তে পেচানো। সুযোগে পেয়ে হেমলতা যেন পালাতে না পারে তার জন্যেই এই ব্যবস্থা।তবে হেমলতার পালানোর ইচ্ছে ছিল কি! অবশ্য তা বোঝা না গেলেও হেমলতার দেহের কাঁপুনি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
তবে এই কাঁপুনির কারণটি মোটেই সহজ নয়।আজ সঞ্জয় মেলা থেকে দুই প্যাকেট কাঁচের চুড়ি নিয়ে এসেছিল।এখন তারই একটি খুলে হেমলতার হাতটি তার হাতে তুলে পরম আদরের সহিত পরিয়ে দিচ্ছিল হেমলতা কে।চুড়ি পড়ানো হলে,সে হেমলতাকে তুলে বসায় তার কোলে। হেমলতার একটি হাত তার হাতে তুলে চুমু খায় সে। তারপর কোমল স্বর বল
– কালকে শহরে যাবো তোমার বাবাকে নিয়ে,কিছু দেবে না আমায়?
হেমলতা তাটায় সঞ্জয়ের পানে,কিন্তু কি বলবে ভেবে পায় না। বলি এই অভাগিনীর কি বা আছে দেবার মত! কিছুই নে শুধুমাত্র চাটনির বয়াম দুখানি ছারা।তাও তো তরই কিনে দেয়া।সে কেন নেবে এগুলো।
– কি দেবে না বুঝি?
হেমলতা এবারে আর চুপ থাকতে পারলো না। মৃদু স্বরে বলল।
– কি দেব আমি,কিছুই যে নেই আমার।
– কিছুই না!
হেম মাথা নাড়িয়ে বলে না। সঞ্জয় কি যেন ভাবে।তার পর বলে।
– তবে একটি প্রতিজ্ঞা দাও আমায়। যাই হোক না কেন তুমি আমার ঘরে বউ হয়ে উঠবে, অন্য কারো নয়।
হেমলতা লাজ্জে রাঙা হলো এবারে। কিন্তু এ প্রতিজ্ঞা সে কিভাবে দেয়। বলি ভগ'বান তার কপালে কি লিখেছেন সেকি তা জানে।
তবে সঞ্জয় নাছোড়বান্দা। সে ছাড়বে কেন! অবশেষে হেমকে বাধ্য হয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হলো। হায় কপাল!যদি এই অভাগী জানতো সঞ্জয় তাকে কোন বিপদের দিকে ঠেলে দিল তবে কি আর...।না সে যাক গে ওতো পরের কথা। এদিকে কথা বলতে বলতে সঞ্জয়ের হাত দুটো কখন যেন হেমলতার ব্লাউজের ওপড়ে এসে পরেছে। হেমলতা অনুভব করলেও সরে পরার উপায় নেই। সে জানে আর অল্প কিছুক্ষণ পরে তার আঁচল খানি মাটিতে লুটিয়ে পরবে।তারপর সঞ্জয়ের অবাধ্য ঠোঁট জোরা চোষে বেড়াবে তার উর্ধাঙ্গের প্রতিটি নিষিদ্ধ খাঁজে।সে যতোই ছটফট করুক না কেন সঞ্জয় তাহাকে ছাড়িবে না.....অনেক কিছুই তো হলো আজকে।তবে বলি কি যার জন্যে পড়তে আসা তা হতে একটু দেরি হবে আর কি।তো অবশেষে গল্প ভালো লাগলে বলি।গল্পটি চলবে তো?