14-08-2023, 10:53 AM
(This post was last modified: 14-08-2023, 10:54 AM by কাদের. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
আপডেট ২৩
ক
নুসাইবার চোখে ঘুম নেই। গত দুই রাত ধরে নুসাইবা ঘুমাতে পারছে না। শেষ রাতে একটু ঘুম আসে চোখে কিন্তু দুঃস্বপ্নে আবার ভেংগে যায়। নুসাইবার চোখ লেগে আসলেই দেখতে পায় আরশাদ একটা জুয়ার টেবিলে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা হলুদ বালব জ্বলছে আর সারা রুমে কোন আলো নেই। নুসাইবা যেন সেই রুমে উপস্থিত কিন্তু আরশাদ বা অন্য কেউ ওকে দেখতে পারছে না। জুয়ারে প্রতি দানে আরশাদ হারছে কিন্তু খেলা থেকে উঠছে না একবারের জন্য। নুসাইবা ওকে আড়াল থেকে ডাকছে ফিরে আসবার জন্য কিন্তু আরশাদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আরশাদের মনযোগ তখন খালি জুয়ার টেবিলে। প্রতিদানে হারছে আর আরশাদের মাথার চুল কমছে, পেটে ভুড়ি বাড়ছে, মুখে বয়সের ছাপ পড়ছে। নুসাইবা সারা জীবন ঘুষখোর সরকারী অফিসারদের যে চেহারা কল্পনায় দেখেছে আরশাদ যেন প্রতিটা হারের পর ঠিক সেই চেহারার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। নুসাইবা ডাক, পরের বার পরাজয়ের হাতছানি কিছুই আরশাদ কে থামিয়ে রাখতে পারছে না। এই নেশায় এমন মোহগ্রস্ত হয়ে আরশাদ যে আর কোন কিছু সেখানে মূখ্য না। সেই দুনিয়ায় নুসাইবার কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে নুসাইবা আছে খালে ছায়া হয়ে। এই স্বপ্ন শুরু হলে একটু পরেই নুসাইবা আর ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। জেগে উঠে বসে। ঘুমের মাঝে আরশাদ কে এভাবে তিলেতিলে ধবংস হয়ে যেতে দেখতে নুসাইবার কষ্ট হয়। জেগে বসে পাশে তাকালে দেখে আরশাদ ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। নুসাইবা আরশাদ কে দেখে আর ভাবে কিভাবে এত কিছু গোপন করে দিনের পর দিন শান্তিতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে আরশাদ। কিভাবে নুসাইবার সাথে যখন কথা হয় তখন নীতি নৈতিকতার ব্যাপারে সায় দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আরশাদের অভিনয় ক্ষমতা আসলে কত শক্তিশালী?
সেদিন আরশাদ কে ঐ ক্লাবে ঢুকতে দেখার পর থেকে কিছু আর তেমন মনে নেই নুসাইবার। স্মৃতিতে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। সারাজীবন নুসাইবা ভেবে এসেছে আরশাদ অন্য সবার মত না, ভিন্ন মানুষ। পত্রিকার রিপোর্ট সেখানে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। তবে আরশাদের কথা বিশ্বাস করেছিল যে অফিসের শত্রুরা কেউ এই রিপোর্ট করিয়েছে। তবে তারপরেও কিছু হিসাব তো মিলছিল না। সেই হিসাব মিলাতে আরশাদের পিছু নিয়েছিল নুসাইবা এই শুক্রবার। আরশাদ কে জুয়ার ক্লাবে ঢুকতে দেখেই নুসাইবা বুঝে গিয়েছিল আরশাদ ওকে পত্রিকার রিপোর্টের ব্যাপারে যা যা বলেছিল সব মিথ্যা। আর সারা জীবন অন্যদের সামনে গ্যাম্বলিং কত খারাপ এই উপদেস ঝেড়ে নিজেই যখন জুয়ার ক্লাবে ঢুকছে তখন নুসাইবার মনে হতে থাকে সারা জীবন ওকে বলা আরশাদের আর কত গুলো কথা আসলে মিথ্যা। এইটা যখন মাথার ভিতর ঢুকেছে তখন থেকে আর কিছু মনে নেই। এরপর কত সময় গেল, ঘন্টা না মিনিট সেটাও মনে করতে পারে না নুসাইবা। নুসাইবার খালি মনে আছে মাহফুজ ওকে ধরে ঝাকি দিচ্ছে আর বলছে ফুফু, ফুফু। নুসাইবা তখন খেয়াল করে দেখে মাহফুজ কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেদেই যাচ্ছে ও। মাহফুজ বলে ফুফু আমরা বাসায় পৌছে গেছি। নুসাইবা দেখে সিএনজি ওদের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গ্যারেজের ভিতর। নুসাইবার শরীরে তখন কোন শক্তি নেই। মাহফুজ তখন ওকে হাত ধরে উপরে তুলে নিয়ে এসেছে। উপরে আসার পর নুসাইবা যেন পায়ে শক্তি পাচ্ছিল না। তখন ওকে সোফায় বসিয়ে পানি এনে খাইয়েছে। চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়েছে। নুসাইবা এক রকম স্থবির জড় পদার্থের মত বসে ছিল। সব কিছু মনেও নেই। এরপর নুসাইবার কিচেনে গিয়ে নিজে থেকে জিনিস পত্র খুজে বের করে নুসাইবা কে কফি করে খাইয়েছে। এক দেড় ঘন্টা পর নুসাইবা যেন আস্তে আস্তে করে সব আবার ফিল করা শুরু করল। ঠিক তখন যেন আবার বুকের ভিতর একটা মোচড় দেওয়া কষ্ট ফিরে আসল। নুসাইবা সেই দিনের কথা ভাবতে গিয়ে অবাক হয়। মানুষ কি ভাবে আর কি হয়। এই ড্রইংরুমে সাতদিনে মাহফুজ কে ডেকে আনা হয়েছিল যাতে মাহফুজ অযাচিত ভাবে আফসানার প্রেমে পড়ে। সিনথিয়ার জীবন থেকে সরে দাঁড়ায়। সোজা কথায় মাহফুজ কে একটা ফাদে ফেলার জন্য নুসাইবা ডেকে এনেছিল। আর ঠিক তার সাতদিন পর আরেক শুক্রবার মাহফুজ নুসাইবা কে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের সময় সংগ দিচ্ছে। পৃথিবীতে আর কেউ জানে নুসাইবা এখন কি বড় একটা সংকটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে মাহফুজ ছাড়া। ঠিক এই কারণে মাহফুজের প্রতি নুসাইবার দৃষ্টি ভংগী যেন অনেক বদলে গেছে গত ৪৮ ঘন্টায়। সিনথিয়া যদিও সরাসরি নুসাইবা কে বলে নি ও মাহফুজ কে ভালবাসে কিন্তু কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছিল। তখন একদিন বলেছিল ফুফু তুমি একবার ওর সাথে ভাল করে মিশে দেখ ওর মত ভাল ছেলে তুমি কম পাবে। আর ওর মত যোগ্য ছেলেও কম পাবে তুমি। যে কোন সমস্যা ওকে সমাধান করতে দাও। একটা না একটা সলুশন ওর কাছে আছে। নুসাইবা তখন সিনথিয়ার এই সব কথা কে প্রেমে পড়া মানুষের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে এখন মনে হচ্ছে খুব একটা মিথ্যা বলে নি সিনথিয়া।
নুসাইবা গত ৪৮ ঘন্টা ধরে ভেবে যাচ্ছে ওর কি করা উচিত। গত শুক্রবার নতুন করে আরশাদের গোপন জগত আবিষ্কারের আগে যেমন ছিল ঠিক তেমন করে আচরণ করে যাচ্ছে নুসাইবা। এখনো শীতল আচরণ করছে আরশাদের সাথে তবে ওকে বুঝতে দেয় নি নুসাইবা যে ওর জুয়ার আড্ডা নুসাইবা আবিষ্কার করে ফেলেছে। নুসাইবা সব সময় মাথা গরম বলে বিখ্যাত তবে এইবার অনেক কষ্ট করে হলেও নুসাইবা মাথা ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করছে। আসলে এরকম কোন সংকটে আগে কখনো পড়ে নি। তাই এই অবস্থায় কি করতে হবে সেটাও জানা নেই ওর। এটাও একটা কারণ যে জন্য নুসাইবা রাগে ফেটে পড়ে নি। কিন্তু কার কাছে এই ব্যাপারে বুদ্ধি চাওয়া যায়? নুসাইবা আর আরশাদের সুখের সংসারের যে ইমেজ গত পনের বছর ধরে গড়ে তুলেছে তিলে তিলে সেটার ফাপা অংশটা কাউকে এখনি দেখতে দিতে চায় না নুসাইবা। অন্তত যতক্ষণ না নিজে শিওর হচ্ছে ও কি চায় এই ব্যাপারে। অবশ্য নুসাইবা নিজেই জানত না ওর সুখের সংসারের ভিতরে ভিতরে একটা অংশ ফাপা হয়ে পড়েছে। জুয়া খেলাটা কে কি দৃষ্টিতে দেখবে ও। খুব বড় কিছু নাকি সিগারেট খাওয়ার মত ক্ষতিকর কিন্তু সহ্য করা যায় এমন কিছু। কড়া পরিবারে বড় হয়েছে নুসাইবা। বাবা সত্তর আর আশির দশকের বড় সরকারী কর্মকর্তা। মা গৃহিনী। ভাল কলেজ, কলেজ আর ভার্সিটিতে পড়েছে। সমাজের হাইক্লাসের সাথে উঠা বসা ছিল সেই শিশুকাল থেকে কিন্তু ওর বাবা মা উচ্চ মধ্যবিত্তের সেই কনজারভেটিভ অংশ যারা হাইক্লাস সোসাইটির সুযোগ টা নিলেও সন্তানদের এর খারাপ প্রাকটিস গুলো থেকে দূরে রেখেছেন সযতনে। তাই ছোটকাল থেকেই মদ জুয়া এইসব কে খারাপ দৃষ্টিতে দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর বন্ধুদের সাথে ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে ইন্ডিয়া গিয়ে প্রথমবারের মত মদ খেয়েছিল। সেটা যতটা না মদের প্রতি আগ্রহে তার থেকে বেশি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহে। কড়া পরিবেশ বড় হওয়া সব মানুষের মত নুসাইবার তখন মনে হয়েছিল পর্দার ঐপাড়ে কি আছে দেখার। ট্যুরের ঐ অংশে তখন ওরা দার্জিলিং। হিলের কাছে একটা হোটেলে উঠেছে ব্যাচের ৪৯ জন। ২০ জন মেয়ে আর ২৯ জন ছেলে। রাতে সাথে আসা তিন জন স্যার ম্যাডাম যখন যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন সবাই মিলে ছেলেদের এক রুমে জমা হয়েছিল। সেখানেই দুই বা তিন সিপ খেয়েছিল। কি মদ অত নাম মনে নেই। খালি মনে আছে গলার ভিতর দিয়ে যখন নিচে যাচ্ছিল তখন যেন জ্বলে যাচ্ছিল গলার ভিতরটা। কি স্বাদ পায় লোকে এটা খেয়ে। এরপর আর খায় নি অনেক বছর। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিল কক্সবাজার। সেখানেই আরশাদের জোরাজুরিতে খেয়েছিল দ্বিতীয়বার। এইবার নাম মনে আছে ভদকা। বিদেশী কোন কোম্পানির। আরশাদের কোন এক বন্ধু করপোরেটে চাকরি করে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ওরা উঠেছিল হোটেল সিগালে। এখনকার মত পড়তি অবস্থা ছিল না সেই হোটেলের। তখন কক্সবাজারে সেটাই বেস্ট হোটেল। হোটেলের লবিতে হাটলে প্রচুর সাদা চামড়ার বিদেশী চোখে পড়ে। সেই সময় আরশাদের জোরাজুরিতে জীবনে দ্বিতীয়বার মদ খায় নুসাইবা। তখন আরশাদের প্রেমে মাতাল নুসাইবা। আরশাদ যা বলবে তাই শুনতে যেন বসে আছে। সেই সময় নুসাইবা আরশাদের জোরাজুরিতে মদ খেয়েছিল এক রাতে হোটেলে তবে বেশিক্ষণ পেটে রাখতে পারে নি। হড় হড় করে বমি করে হোটেলের মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেটাই শেষবার। আরশাদ নুসাইবার অবস্থা দেখে এরপরে আর কোন দিন মদ খাবার কথা বলে নি। তবে নুসাইবা জানত মাঝে মাঝে আরশাদ মদ খায়। তবে নুসাইবার কড়া নির্দেশ ছিল যেদিন মদ খাবে সেদিন যেন নুসাইবা কে স্পর্শ না করে। বড় হওয়ার সময় মদ কে ঘৃণা করতে শিখলেও এটাও বুঝেছে এই জিনিসটা পৃথিবী থেকে চাইলেও সে দূর করতে পারবে না। আর ছেলেদের মাঝে মাঝে কিছু বদ অভ্যাস থাকে। যেমন ওর বাবার ছিল সিগারেটের অভ্যাস। নুসাইবা সারাজীবন দেখে এসেছে তার মা সিগারেট সহ্য করতে পারে না। সিগারেট নিয়ে অনেক কথা বলেছে কিন্তু ওর বাবাকে তেমন কিছু বলে নি সিগারেট খাওয়ার জন্য। মা কে এইসব নিয়ে নুসাইবা একবার জিজ্ঞেস করেছিল বড় হওয়ার পর তখন নুসাইবার মা উত্তর দিয়েছিল এইটা কম ক্ষতিকর অভ্যাস। এই একটা অভ্যাসে ছাড় দিয়ে রাখি বলে তোর বাপ অন্য সব সময় আমার কথা শুনে চলে। সেই পরামর্শটা নুসাইবার মাথায় গেথে ছিল। তাই মদ কে পছন্দ না করলেও আরশাদ কে মাঝে মধ্যে খেতে দিত। কারণ এই কারণে বাকি সময় আরশাদ ওর বাধ্য হয়ে থাকত। দেনা পাওনার এই দুনিয়ায় ভালবাসাতেও দেনা পাওনা আছে এটা নুসাইবা বুঝত। তবে মদ খেতে পারমিশন দিলেও পুরোপুরি মন থেকে মেনে নিতে পারে নি তাই তো যেই রাতে আরশাদ মদ খেয়ে আসত সেই রাতে নুসাইবা কে স্পর্শ করতে পারত না। এমন না যে আরশাদ পাড় মাতাল হয়ে ফিরে আসত। আরশাদের এই গুণটা মনে মনে প্রশংসা করত নুসাইবা। কখনো পাড় মাতাল হতে দেখে নি নুসাইবা আরশাদ কে। কখনো মদ খেয়ে মাতলামি করতে দেখে নি। বরং মদ খেয়ে যখন বাসায় ফেরত আসত তখন কেমন জানি একটা চোর চোর ভাব থাকত চেহারায়। এরপরের দুই তিন দিন একদম সব সময় খুব ভালবাসা দেখায় আরশাদ। তবে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে জুয়া। এটাকেও কি মদের মত মাইনর নুইসেন্স বলে মেনে নিবে নাকি আরশাদ কে কিছু বলবে। আর আরশাদ এই জুয়ার ব্যাপারটা কেন লুকিয়েছে ওর কাছে থেকে? হয়ত জুয়া কে নুসাইবা কত টা ঘৃণা করে সেটা আরশাদ কে বিভিন্ন সময় বলেছে দেখে। তবে মনের ভিতর আরেকটা অংশ এতটা সহানুভূতিশীল হতে পারে না। সেই অংশটা জিজ্ঞেস করে কিভাবে এত টাকা পাচ্ছে আরশাদ। কে দিচ্ছে। ওকে বিভিন্ন সময় জমি বা এপার্টমেন্ট কিনা অথবা ইউরোপ ট্যুরের সময় শেয়ার বাজারের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটা এখন আর বিশ্বাস হচ্ছে না। মাহফুজ বলেছে এখানে জুয়া খেলতে কত টাকা লাগে। এটা শুধু পাড়ার দুই তিন জুয়াড়ির হাজার পাচশ টাকার জুয়ার ঠেক না। এটা বড়লোকদের জুয়ার আড্ডা। অল্প যে কিছুক্ষণ উত্তরা রেস্টহাউজের সামনে ছিল ততক্ষণ একের থেকে এক দামী গাড়ি ঢুকেছে সেখানে। এইখানে মাসে দুই তিনবার জুয়া খেললে কত টাকা খরচ হবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে না নুসাইবা। মাহফুজ কে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল দশলাখের কমে মাসে এখানে দুই তিনবার খেলা সম্ভব না। দশ লাঘ? প্রতি মাসে? নুসাইবা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ সেকশনে কাজ করে। ওর বাংলাদেশের অর্থনীতি, মানুষের গড় আয়, আরশাদের সরকারি চাকরির বেতন সব সম্পর্কে আইডিয়া আছে। কোন হিসাবে এটা মিলছে না। মাসে দশ লাখ মানে বছরে এক কোটি বিশ লাখ মিনিমাম। কোথা থেকে আসছে এই টাকা। হারাম টাকায় কি গড়ে উঠেছে ওর এই সাজানো সুখের সংসার।
এইসব চিন্তা ওকে গত আটচল্লিশ ঘন্টা ঘুমাতে দিচ্ছে না, স্থির হয়ে কোন কিছুতে মন দিতে দিচ্ছে না। খালি এই চিন্তা না আরেকটা চিন্তাও মনে মনে ঘুরছে। এটা মাহফুজকেও জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছে। যদিও শুরুতে মাহফুজ কে জিজ্ঞেস করেছিল, মাহফুজ নিজেও জানে না। বলেছিল খোজ বের করার চেষ্টা করবে। তবে এই খোজ আসলেই মাহফুজ বের করুক সেটা কি নুসাইবা চায়। একবার মনে হয় মাহফুজ কে মানা করে দিই আবার মনে হয় মাহফুজ কে বলি যে কোন মূল্যে খবরটা বের করুক। বনানীর সেই বাসায় কেন গিয়েছিল আরশাদ। কি করেছে ঐ কয়েক ঘন্টা। মনের ভিতর একটা অশুভ চিন্তা আসছে কিন্তু সেটা মনে ঠাই দিতে ইচ্ছা করছে না। আরশাদ মদ খেতে পারে জুয়া খেলতে পারে কিন্তু এটা করতে পারে সেটা কোন ভাবেই এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। নুসাইবার দাদী সব সময় বলত পুরুষ মানুষের ধবংস লিখা থাকে তিন জিনিসে। মদ, জুয়া এবং নারী। দাদী বলত যখন এই তিন জিনিসে যখন কোন পুরুষ আসক্ত হয়ে পড়ে তার ধবংস অনিবার্য। নুসাইবা ভাবে, আরশাদ কি আসলেই এই তিন জিনিসে আসক্ত হয়ে পড়েছে ওর অজান্তে। কি আছে বনানীর সেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। এটা না জানতে পারলে শান্ত হতে পারছে না আবার ওর আশংকা যদি সত্য হয় তাহলে কি করবে সেটাও জানে না নুসাইবা। বাংলাদেশের পুরুষরা সব সময় বাচ্চা না হলে মেয়েদের দোষারাপ করে এমনকি যখন ছেলেদের দোষ তখনো। গরীব থেকে বড়লোক সবখানে এটা সমান। আরশাদ সব সময় ওকে এই জায়গায় যেমন করে প্রটেক্ট করেছে সেটা কিভাবে ভুলবে নুসাইবা। ডাক্টার যখন রিপোর্ট দেখে বলল আপনি মা হতে পারবেন না তখন আরশাদ যেভাবে প্রাচীরের মত সব সমালোচনা সামলে নুসাইবা কে রক্ষা করেছে সেটা কি ভুলা সম্ভব না। ওকে যদি এতই ভালবাসে তাহলে কেন ওকে গোপন করে এইসব জুয়া খেলছে। ছেড়ে দিচ্ছে না। আর বনানীর ঐ বাসায় কি করেছে ঐ কয় ঘন্টা? সব ওকে জানতেই হবে। তাহলে হয়ত পরের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ওর ভিতরে যে কষ্ট, রাগ, অভিমান জমা হচ্ছে সেটা হয়ত তখন বের হয়ে আসতে পারবে। নুসাইবা জানে ওর রাগ কত ভয়ংকর। যেদিন বের হবে ও কি করবে সেটা ও নিজেও জানে না। নুসাইবা কি নিজে কে নিজেই ধবংস করে দিবে নাকি আরশাদ কে ধবংস করে দিবে সেই জমে থাকা অনুভূতিগুলোর বিস্ফোরণে?
ক
নুসাইবার চোখে ঘুম নেই। গত দুই রাত ধরে নুসাইবা ঘুমাতে পারছে না। শেষ রাতে একটু ঘুম আসে চোখে কিন্তু দুঃস্বপ্নে আবার ভেংগে যায়। নুসাইবার চোখ লেগে আসলেই দেখতে পায় আরশাদ একটা জুয়ার টেবিলে বসে আছে। টেবিলের উপর একটা হলুদ বালব জ্বলছে আর সারা রুমে কোন আলো নেই। নুসাইবা যেন সেই রুমে উপস্থিত কিন্তু আরশাদ বা অন্য কেউ ওকে দেখতে পারছে না। জুয়ারে প্রতি দানে আরশাদ হারছে কিন্তু খেলা থেকে উঠছে না একবারের জন্য। নুসাইবা ওকে আড়াল থেকে ডাকছে ফিরে আসবার জন্য কিন্তু আরশাদের সেদিকে কোন খেয়াল নেই। আরশাদের মনযোগ তখন খালি জুয়ার টেবিলে। প্রতিদানে হারছে আর আরশাদের মাথার চুল কমছে, পেটে ভুড়ি বাড়ছে, মুখে বয়সের ছাপ পড়ছে। নুসাইবা সারা জীবন ঘুষখোর সরকারী অফিসারদের যে চেহারা কল্পনায় দেখেছে আরশাদ যেন প্রতিটা হারের পর ঠিক সেই চেহারার কাছাকাছি চলে যাচ্ছে। নুসাইবা ডাক, পরের বার পরাজয়ের হাতছানি কিছুই আরশাদ কে থামিয়ে রাখতে পারছে না। এই নেশায় এমন মোহগ্রস্ত হয়ে আরশাদ যে আর কোন কিছু সেখানে মূখ্য না। সেই দুনিয়ায় নুসাইবার কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানে নুসাইবা আছে খালে ছায়া হয়ে। এই স্বপ্ন শুরু হলে একটু পরেই নুসাইবা আর ঘুমিয়ে থাকতে পারে না। জেগে উঠে বসে। ঘুমের মাঝে আরশাদ কে এভাবে তিলেতিলে ধবংস হয়ে যেতে দেখতে নুসাইবার কষ্ট হয়। জেগে বসে পাশে তাকালে দেখে আরশাদ ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। নুসাইবা আরশাদ কে দেখে আর ভাবে কিভাবে এত কিছু গোপন করে দিনের পর দিন শান্তিতে ঘুমিয়ে যাচ্ছে আরশাদ। কিভাবে নুসাইবার সাথে যখন কথা হয় তখন নীতি নৈতিকতার ব্যাপারে সায় দিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আরশাদের অভিনয় ক্ষমতা আসলে কত শক্তিশালী?
সেদিন আরশাদ কে ঐ ক্লাবে ঢুকতে দেখার পর থেকে কিছু আর তেমন মনে নেই নুসাইবার। স্মৃতিতে সব ঝাপসা হয়ে গেছে। সারাজীবন নুসাইবা ভেবে এসেছে আরশাদ অন্য সবার মত না, ভিন্ন মানুষ। পত্রিকার রিপোর্ট সেখানে একটা ধাক্কা দিয়েছিল। তবে আরশাদের কথা বিশ্বাস করেছিল যে অফিসের শত্রুরা কেউ এই রিপোর্ট করিয়েছে। তবে তারপরেও কিছু হিসাব তো মিলছিল না। সেই হিসাব মিলাতে আরশাদের পিছু নিয়েছিল নুসাইবা এই শুক্রবার। আরশাদ কে জুয়ার ক্লাবে ঢুকতে দেখেই নুসাইবা বুঝে গিয়েছিল আরশাদ ওকে পত্রিকার রিপোর্টের ব্যাপারে যা যা বলেছিল সব মিথ্যা। আর সারা জীবন অন্যদের সামনে গ্যাম্বলিং কত খারাপ এই উপদেস ঝেড়ে নিজেই যখন জুয়ার ক্লাবে ঢুকছে তখন নুসাইবার মনে হতে থাকে সারা জীবন ওকে বলা আরশাদের আর কত গুলো কথা আসলে মিথ্যা। এইটা যখন মাথার ভিতর ঢুকেছে তখন থেকে আর কিছু মনে নেই। এরপর কত সময় গেল, ঘন্টা না মিনিট সেটাও মনে করতে পারে না নুসাইবা। নুসাইবার খালি মনে আছে মাহফুজ ওকে ধরে ঝাকি দিচ্ছে আর বলছে ফুফু, ফুফু। নুসাইবা তখন খেয়াল করে দেখে মাহফুজ কে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেদেই যাচ্ছে ও। মাহফুজ বলে ফুফু আমরা বাসায় পৌছে গেছি। নুসাইবা দেখে সিএনজি ওদের এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গ্যারেজের ভিতর। নুসাইবার শরীরে তখন কোন শক্তি নেই। মাহফুজ তখন ওকে হাত ধরে উপরে তুলে নিয়ে এসেছে। উপরে আসার পর নুসাইবা যেন পায়ে শক্তি পাচ্ছিল না। তখন ওকে সোফায় বসিয়ে পানি এনে খাইয়েছে। চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়েছে। নুসাইবা এক রকম স্থবির জড় পদার্থের মত বসে ছিল। সব কিছু মনেও নেই। এরপর নুসাইবার কিচেনে গিয়ে নিজে থেকে জিনিস পত্র খুজে বের করে নুসাইবা কে কফি করে খাইয়েছে। এক দেড় ঘন্টা পর নুসাইবা যেন আস্তে আস্তে করে সব আবার ফিল করা শুরু করল। ঠিক তখন যেন আবার বুকের ভিতর একটা মোচড় দেওয়া কষ্ট ফিরে আসল। নুসাইবা সেই দিনের কথা ভাবতে গিয়ে অবাক হয়। মানুষ কি ভাবে আর কি হয়। এই ড্রইংরুমে সাতদিনে মাহফুজ কে ডেকে আনা হয়েছিল যাতে মাহফুজ অযাচিত ভাবে আফসানার প্রেমে পড়ে। সিনথিয়ার জীবন থেকে সরে দাঁড়ায়। সোজা কথায় মাহফুজ কে একটা ফাদে ফেলার জন্য নুসাইবা ডেকে এনেছিল। আর ঠিক তার সাতদিন পর আরেক শুক্রবার মাহফুজ নুসাইবা কে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের সময় সংগ দিচ্ছে। পৃথিবীতে আর কেউ জানে নুসাইবা এখন কি বড় একটা সংকটের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে মাহফুজ ছাড়া। ঠিক এই কারণে মাহফুজের প্রতি নুসাইবার দৃষ্টি ভংগী যেন অনেক বদলে গেছে গত ৪৮ ঘন্টায়। সিনথিয়া যদিও সরাসরি নুসাইবা কে বলে নি ও মাহফুজ কে ভালবাসে কিন্তু কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিয়েছিল। তখন একদিন বলেছিল ফুফু তুমি একবার ওর সাথে ভাল করে মিশে দেখ ওর মত ভাল ছেলে তুমি কম পাবে। আর ওর মত যোগ্য ছেলেও কম পাবে তুমি। যে কোন সমস্যা ওকে সমাধান করতে দাও। একটা না একটা সলুশন ওর কাছে আছে। নুসাইবা তখন সিনথিয়ার এই সব কথা কে প্রেমে পড়া মানুষের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দিয়েছিল। তবে এখন মনে হচ্ছে খুব একটা মিথ্যা বলে নি সিনথিয়া।
নুসাইবা গত ৪৮ ঘন্টা ধরে ভেবে যাচ্ছে ওর কি করা উচিত। গত শুক্রবার নতুন করে আরশাদের গোপন জগত আবিষ্কারের আগে যেমন ছিল ঠিক তেমন করে আচরণ করে যাচ্ছে নুসাইবা। এখনো শীতল আচরণ করছে আরশাদের সাথে তবে ওকে বুঝতে দেয় নি নুসাইবা যে ওর জুয়ার আড্ডা নুসাইবা আবিষ্কার করে ফেলেছে। নুসাইবা সব সময় মাথা গরম বলে বিখ্যাত তবে এইবার অনেক কষ্ট করে হলেও নুসাইবা মাথা ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা করছে। আসলে এরকম কোন সংকটে আগে কখনো পড়ে নি। তাই এই অবস্থায় কি করতে হবে সেটাও জানা নেই ওর। এটাও একটা কারণ যে জন্য নুসাইবা রাগে ফেটে পড়ে নি। কিন্তু কার কাছে এই ব্যাপারে বুদ্ধি চাওয়া যায়? নুসাইবা আর আরশাদের সুখের সংসারের যে ইমেজ গত পনের বছর ধরে গড়ে তুলেছে তিলে তিলে সেটার ফাপা অংশটা কাউকে এখনি দেখতে দিতে চায় না নুসাইবা। অন্তত যতক্ষণ না নিজে শিওর হচ্ছে ও কি চায় এই ব্যাপারে। অবশ্য নুসাইবা নিজেই জানত না ওর সুখের সংসারের ভিতরে ভিতরে একটা অংশ ফাপা হয়ে পড়েছে। জুয়া খেলাটা কে কি দৃষ্টিতে দেখবে ও। খুব বড় কিছু নাকি সিগারেট খাওয়ার মত ক্ষতিকর কিন্তু সহ্য করা যায় এমন কিছু। কড়া পরিবারে বড় হয়েছে নুসাইবা। বাবা সত্তর আর আশির দশকের বড় সরকারী কর্মকর্তা। মা গৃহিনী। ভাল কলেজ, কলেজ আর ভার্সিটিতে পড়েছে। সমাজের হাইক্লাসের সাথে উঠা বসা ছিল সেই শিশুকাল থেকে কিন্তু ওর বাবা মা উচ্চ মধ্যবিত্তের সেই কনজারভেটিভ অংশ যারা হাইক্লাস সোসাইটির সুযোগ টা নিলেও সন্তানদের এর খারাপ প্রাকটিস গুলো থেকে দূরে রেখেছেন সযতনে। তাই ছোটকাল থেকেই মদ জুয়া এইসব কে খারাপ দৃষ্টিতে দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর বন্ধুদের সাথে ডিপার্টমেন্টের ট্যুরে ইন্ডিয়া গিয়ে প্রথমবারের মত মদ খেয়েছিল। সেটা যতটা না মদের প্রতি আগ্রহে তার থেকে বেশি নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আগ্রহে। কড়া পরিবেশ বড় হওয়া সব মানুষের মত নুসাইবার তখন মনে হয়েছিল পর্দার ঐপাড়ে কি আছে দেখার। ট্যুরের ঐ অংশে তখন ওরা দার্জিলিং। হিলের কাছে একটা হোটেলে উঠেছে ব্যাচের ৪৯ জন। ২০ জন মেয়ে আর ২৯ জন ছেলে। রাতে সাথে আসা তিন জন স্যার ম্যাডাম যখন যার যার রুমে ঘুমিয়ে পড়েছিল তখন সবাই মিলে ছেলেদের এক রুমে জমা হয়েছিল। সেখানেই দুই বা তিন সিপ খেয়েছিল। কি মদ অত নাম মনে নেই। খালি মনে আছে গলার ভিতর দিয়ে যখন নিচে যাচ্ছিল তখন যেন জ্বলে যাচ্ছিল গলার ভিতরটা। কি স্বাদ পায় লোকে এটা খেয়ে। এরপর আর খায় নি অনেক বছর। বিয়ের পর হানিমুনে গিয়েছিল কক্সবাজার। সেখানেই আরশাদের জোরাজুরিতে খেয়েছিল দ্বিতীয়বার। এইবার নাম মনে আছে ভদকা। বিদেশী কোন কোম্পানির। আরশাদের কোন এক বন্ধু করপোরেটে চাকরি করে সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ওরা উঠেছিল হোটেল সিগালে। এখনকার মত পড়তি অবস্থা ছিল না সেই হোটেলের। তখন কক্সবাজারে সেটাই বেস্ট হোটেল। হোটেলের লবিতে হাটলে প্রচুর সাদা চামড়ার বিদেশী চোখে পড়ে। সেই সময় আরশাদের জোরাজুরিতে জীবনে দ্বিতীয়বার মদ খায় নুসাইবা। তখন আরশাদের প্রেমে মাতাল নুসাইবা। আরশাদ যা বলবে তাই শুনতে যেন বসে আছে। সেই সময় নুসাইবা আরশাদের জোরাজুরিতে মদ খেয়েছিল এক রাতে হোটেলে তবে বেশিক্ষণ পেটে রাখতে পারে নি। হড় হড় করে বমি করে হোটেলের মেঝে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সেটাই শেষবার। আরশাদ নুসাইবার অবস্থা দেখে এরপরে আর কোন দিন মদ খাবার কথা বলে নি। তবে নুসাইবা জানত মাঝে মাঝে আরশাদ মদ খায়। তবে নুসাইবার কড়া নির্দেশ ছিল যেদিন মদ খাবে সেদিন যেন নুসাইবা কে স্পর্শ না করে। বড় হওয়ার সময় মদ কে ঘৃণা করতে শিখলেও এটাও বুঝেছে এই জিনিসটা পৃথিবী থেকে চাইলেও সে দূর করতে পারবে না। আর ছেলেদের মাঝে মাঝে কিছু বদ অভ্যাস থাকে। যেমন ওর বাবার ছিল সিগারেটের অভ্যাস। নুসাইবা সারাজীবন দেখে এসেছে তার মা সিগারেট সহ্য করতে পারে না। সিগারেট নিয়ে অনেক কথা বলেছে কিন্তু ওর বাবাকে তেমন কিছু বলে নি সিগারেট খাওয়ার জন্য। মা কে এইসব নিয়ে নুসাইবা একবার জিজ্ঞেস করেছিল বড় হওয়ার পর তখন নুসাইবার মা উত্তর দিয়েছিল এইটা কম ক্ষতিকর অভ্যাস। এই একটা অভ্যাসে ছাড় দিয়ে রাখি বলে তোর বাপ অন্য সব সময় আমার কথা শুনে চলে। সেই পরামর্শটা নুসাইবার মাথায় গেথে ছিল। তাই মদ কে পছন্দ না করলেও আরশাদ কে মাঝে মধ্যে খেতে দিত। কারণ এই কারণে বাকি সময় আরশাদ ওর বাধ্য হয়ে থাকত। দেনা পাওনার এই দুনিয়ায় ভালবাসাতেও দেনা পাওনা আছে এটা নুসাইবা বুঝত। তবে মদ খেতে পারমিশন দিলেও পুরোপুরি মন থেকে মেনে নিতে পারে নি তাই তো যেই রাতে আরশাদ মদ খেয়ে আসত সেই রাতে নুসাইবা কে স্পর্শ করতে পারত না। এমন না যে আরশাদ পাড় মাতাল হয়ে ফিরে আসত। আরশাদের এই গুণটা মনে মনে প্রশংসা করত নুসাইবা। কখনো পাড় মাতাল হতে দেখে নি নুসাইবা আরশাদ কে। কখনো মদ খেয়ে মাতলামি করতে দেখে নি। বরং মদ খেয়ে যখন বাসায় ফেরত আসত তখন কেমন জানি একটা চোর চোর ভাব থাকত চেহারায়। এরপরের দুই তিন দিন একদম সব সময় খুব ভালবাসা দেখায় আরশাদ। তবে এখন নতুন করে যোগ হয়েছে জুয়া। এটাকেও কি মদের মত মাইনর নুইসেন্স বলে মেনে নিবে নাকি আরশাদ কে কিছু বলবে। আর আরশাদ এই জুয়ার ব্যাপারটা কেন লুকিয়েছে ওর কাছে থেকে? হয়ত জুয়া কে নুসাইবা কত টা ঘৃণা করে সেটা আরশাদ কে বিভিন্ন সময় বলেছে দেখে। তবে মনের ভিতর আরেকটা অংশ এতটা সহানুভূতিশীল হতে পারে না। সেই অংশটা জিজ্ঞেস করে কিভাবে এত টাকা পাচ্ছে আরশাদ। কে দিচ্ছে। ওকে বিভিন্ন সময় জমি বা এপার্টমেন্ট কিনা অথবা ইউরোপ ট্যুরের সময় শেয়ার বাজারের যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটা এখন আর বিশ্বাস হচ্ছে না। মাহফুজ বলেছে এখানে জুয়া খেলতে কত টাকা লাগে। এটা শুধু পাড়ার দুই তিন জুয়াড়ির হাজার পাচশ টাকার জুয়ার ঠেক না। এটা বড়লোকদের জুয়ার আড্ডা। অল্প যে কিছুক্ষণ উত্তরা রেস্টহাউজের সামনে ছিল ততক্ষণ একের থেকে এক দামী গাড়ি ঢুকেছে সেখানে। এইখানে মাসে দুই তিনবার জুয়া খেললে কত টাকা খরচ হবে সেটা আন্দাজ করতে পারছে না নুসাইবা। মাহফুজ কে জিজ্ঞেস করায় বলেছিল দশলাখের কমে মাসে এখানে দুই তিনবার খেলা সম্ভব না। দশ লাঘ? প্রতি মাসে? নুসাইবা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিসার্চ সেকশনে কাজ করে। ওর বাংলাদেশের অর্থনীতি, মানুষের গড় আয়, আরশাদের সরকারি চাকরির বেতন সব সম্পর্কে আইডিয়া আছে। কোন হিসাবে এটা মিলছে না। মাসে দশ লাখ মানে বছরে এক কোটি বিশ লাখ মিনিমাম। কোথা থেকে আসছে এই টাকা। হারাম টাকায় কি গড়ে উঠেছে ওর এই সাজানো সুখের সংসার।
এইসব চিন্তা ওকে গত আটচল্লিশ ঘন্টা ঘুমাতে দিচ্ছে না, স্থির হয়ে কোন কিছুতে মন দিতে দিচ্ছে না। খালি এই চিন্তা না আরেকটা চিন্তাও মনে মনে ঘুরছে। এটা মাহফুজকেও জিজ্ঞেস করতে ভয় পাচ্ছে। যদিও শুরুতে মাহফুজ কে জিজ্ঞেস করেছিল, মাহফুজ নিজেও জানে না। বলেছিল খোজ বের করার চেষ্টা করবে। তবে এই খোজ আসলেই মাহফুজ বের করুক সেটা কি নুসাইবা চায়। একবার মনে হয় মাহফুজ কে মানা করে দিই আবার মনে হয় মাহফুজ কে বলি যে কোন মূল্যে খবরটা বের করুক। বনানীর সেই বাসায় কেন গিয়েছিল আরশাদ। কি করেছে ঐ কয়েক ঘন্টা। মনের ভিতর একটা অশুভ চিন্তা আসছে কিন্তু সেটা মনে ঠাই দিতে ইচ্ছা করছে না। আরশাদ মদ খেতে পারে জুয়া খেলতে পারে কিন্তু এটা করতে পারে সেটা কোন ভাবেই এখনো মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। নুসাইবার দাদী সব সময় বলত পুরুষ মানুষের ধবংস লিখা থাকে তিন জিনিসে। মদ, জুয়া এবং নারী। দাদী বলত যখন এই তিন জিনিসে যখন কোন পুরুষ আসক্ত হয়ে পড়ে তার ধবংস অনিবার্য। নুসাইবা ভাবে, আরশাদ কি আসলেই এই তিন জিনিসে আসক্ত হয়ে পড়েছে ওর অজান্তে। কি আছে বনানীর সেই এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে। এটা না জানতে পারলে শান্ত হতে পারছে না আবার ওর আশংকা যদি সত্য হয় তাহলে কি করবে সেটাও জানে না নুসাইবা। বাংলাদেশের পুরুষরা সব সময় বাচ্চা না হলে মেয়েদের দোষারাপ করে এমনকি যখন ছেলেদের দোষ তখনো। গরীব থেকে বড়লোক সবখানে এটা সমান। আরশাদ সব সময় ওকে এই জায়গায় যেমন করে প্রটেক্ট করেছে সেটা কিভাবে ভুলবে নুসাইবা। ডাক্টার যখন রিপোর্ট দেখে বলল আপনি মা হতে পারবেন না তখন আরশাদ যেভাবে প্রাচীরের মত সব সমালোচনা সামলে নুসাইবা কে রক্ষা করেছে সেটা কি ভুলা সম্ভব না। ওকে যদি এতই ভালবাসে তাহলে কেন ওকে গোপন করে এইসব জুয়া খেলছে। ছেড়ে দিচ্ছে না। আর বনানীর ঐ বাসায় কি করেছে ঐ কয় ঘন্টা? সব ওকে জানতেই হবে। তাহলে হয়ত পরের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। ওর ভিতরে যে কষ্ট, রাগ, অভিমান জমা হচ্ছে সেটা হয়ত তখন বের হয়ে আসতে পারবে। নুসাইবা জানে ওর রাগ কত ভয়ংকর। যেদিন বের হবে ও কি করবে সেটা ও নিজেও জানে না। নুসাইবা কি নিজে কে নিজেই ধবংস করে দিবে নাকি আরশাদ কে ধবংস করে দিবে সেই জমে থাকা অনুভূতিগুলোর বিস্ফোরণে?