19-12-2022, 03:03 AM
পর্ব ৫
মনীষা তখন চুপচাপ সেখান থেকে ফিরে রান্নাঘরে চলে এলো। মনে মনে সে আত্মগ্লানিতে ভুগছিলো। সে যে রবিকে ভুল বুঝে তাকে অনেক কথা শুনিয়ে ফেলেছিলো। আসল কালপ্রিট তো অরুণ ছিল যে রবিকে একপ্রকার বাধ্য করেছিল এসব করতে।
যাই হোক, মনীষা তারপর অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ওদের কথোপকথন শেষ হবে , কখন রবি অরুণের ঘর থেকে বেড়োবে , তারপর মনীষা অরুণকে খাবার দিতে যাবে। অরুণ মনীষাকে নিয়ে যাই ভাবুক না কেন , মনীষা তো শুধু তাকেই মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে। তাই কষ্ট পেলেও , খারাপ লাগলেও , মনীষার নিজের কর্তব্য থেকে কখনও বিচ্যুতি ঘটবে না।
অরুণের সাথে কথা শেষ করে রবি ঘর থেকে বেড়োনোর পর , মনীষা গেলো খাবার নিয়ে অরুণের কাছে। মনীষাকে দেখে অরুণের অদ্ভুত এক তৃপ্তি ও গর্ব বোধ হলো। কারণ সে রবির কাছ থেকে শুনেছে যে মনীষা রবিকে তার কাছেই ঘেঁষতে দ্যায়নি। সে প্রমাণ করেছে তার স্বামী শয্যাশায়ী হওয়া সত্ত্বেও সে তার স্বামীর প্রতি কতোটা সৎ , প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অরুণের তখন কেন জানিনা মনে হলো যে সে এতোটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতো। যেখানে রবি তাকে কথা দিয়েছে অরুণের মৃত্যুর পরেও সে অরুণের পরিবারের যথাযত খেয়াল রাখবে , যখন তার স্ত্রী কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে ব্যাতিত অন্য কোনো পরপুরুষকে নিজের করে নিতে পারবে না , তখন এভাবে সেই পতিব্রতা স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে তার অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে দেওয়ার এই পুতুল খেলার মতো নাটকটা না করলেও পারতো সে।
এটা তো ছিল অরুণের পরিবর্তিত মনোভাব। কিন্তু ততক্ষণে মনীষার মনোভাব অরুণের প্রতি একটু হলেও পাল্টে গেছিলো। মনীষার মনে কিছুটা হলেও অরুণের প্রতি অশ্রদ্ধা জেগে উঠেছিল। কারণ সে জানতে পেরেছিলো, যে স্বামীকে সে এতোটা ভালোবাসে সেই স্বামী তার বন্ধুকে কাল রাতে তার কাছে পাঠিয়েছিল তার সতীত্ব নষ্ট করতে।
মনীষা অরুণের সাথে কোনো কথা না বলে চুপচাপ ওকে খাবার দিয়ে , পরীকে ঘুম থেকে তুলতে লাগলো। অরুণ ভালোবেসে মনীষাকে জিজ্ঞেস করলো , "তুমি খেয়েছো ?"
মনীষা কোনো উত্তর দিলো না। অরুণ ভাবলো কালকে রবির দুঃসাহসিক আচরণে মনীষা হয়তো দুঃখ পেয়েছে, তাই সে চুপচাপ রয়েছে । কিন্তু রবিরও তো এতে কোনো দোষ নেই, সেটা অরুণ জানতো। তাকে তো অরুণই বলেছিল এই পদক্ষেপটি নিতে। অরুণ আবার চেষ্টা করলো মনীষার সাথে কথা বলার। সে মনীষাকে বারবার পরীকে ঘুম থেকে তোলার জন্য ডাকতে দেখে বললো , "থাক না , ওকে একটু ঘুমোতে দাও। এতো তাড়াতাড়ি উঠে কি করবে মেয়েটা ?"
এবার মনীষা না পারতে গম্ভীর ভাবে জবাব দিলো , "ওর খাবার তৈরী হয়েগেছে। রবি ওর দুধ আগে থেকে গরম করে রেখেছে। "
মুখ ফসকে মনীষা রবির কথা তুলে ফেললো অরুণের সামনে। অরুণের ভেবে ভালো লাগলো যে রবি তার পরিবারের জন্য এতো কিছু করছে। সে মনীষার মতো একজন সতীলক্ষী বউ , ও রবির মতো পরোপকারী বন্ধু পেয়েছে। সত্যি এবার সে নিশ্চিন্ত মনে মরতে পারবে। অরুণ মনে মনে ভাবলো বেচারা রবি হয়তো কালকের রাতের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য মনীষাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করছে।
এসব ভাবতে ভাবতে অরুণ দেখলো পরী ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো , "গুড মর্নিং বাবা ", তারপর মায়ের দিকে তাকিয়েও গুড মর্নিং বললো। পরীর তো শিশু মন , সে এখনো সংসারের জাঁতাকলে পড়েনি। তাই সে এখনো মনীষা ও অরুণকেই নিজের অভিভাবক বলে মনে করে , আর রবি কে আংকেল। সে জানেনা , সরকারিভাবে তার বাবা পরিবর্তিত হয়েছে। তার মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে গ্যাছে। তার জন্মদাতা বাবাই তার মায়ের বিয়ে তার রবি আংকেলের সাথে দিয়েছে। রবি আংকেলই এখন তার লিগ্যাল বাবা। পরী ছোট বলে পরীকে এসব ব্যাপারে অবগত করা হয়নি। সে জানেও না তার জন্মদাতা বাবা আর বেশিদিন তার সাথে থাকবে না। সে শুধু জানে তার বাবার একটু শরীর খারাপ হয়েছে , আর সেই জন্য রবি আংকেল এখন তাদের বাড়িতে এসে থাকে।
যখন তার বাবা তার মা কে একা ফেলে তাকে নিয়ে পাশের ঘরে শিফট করলো, তখন সে সরল মনে জানতে চেয়েছিলো এর কারণ। তখন তার বাবা বলেছিলো যে রবি আংকেল তাদের অতিথি তাই রবি আংকেল কে বড়ো ঘরটা ছেড়ে দেওয়া তাদের উচিত। মা তাহলে কেন তাদের সাথে এলো না ? জবাবে বাবা উত্তর দিয়েছিলো , নতুন জায়গায় রবি আংকেল এর একা একা ঘুমোতে ভয় করে। তাই মা রবি আংকেল কে ঘুম পাড়ানোর জন্য রবি আংকেলের সাথে থাকে।
আর পরী তো খুব স্ট্রং এন্ড সাহসী মেয়ে, তাই পরীর মাকে দরকার পড়েনা , সে নিজে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারে। তাছাড়া তার বাবা তো আছে। এই ভাবে সেই শিশু মনকে ভুলিয়েছিলো অরুণ , মনীষা ও রবির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর। এছাড়াও যেদিন তার বাবা তার মায়ের সাথে রবি আংকেল এর বিয়ে দিয়েছিলো সেদিনও এরকমই কোনো এক বাহানা বানিয়ে পরীর মন ভুলিয়ে ছিল পরীর বায়োলজিক্যাল বাবা অরুণ।
অরুণ ও মনীষা দুজনেই পরীকে আদর করে গুড মর্নিং বললো। তারপর মনীষা অরুণের সাথে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে পরীকে নিয়ে চলে গেলো , ওর মুখ হাত ধুইয়ে ওকে খাওয়াতে। অরুণ ভাবছিলো মনীষার মুড অফ হয়েছে রবির জন্য। কিন্তু মনীষা তো রবিকে তখুনি ক্ষমা করে দিয়েছিলো যখন সে ভাগ্যবশত জানতে পারে এসবের পিছনে আসল মাস্টারমাইন্ডটা কে ছিল। এখন তার সব রাগ ছিল অরুণের প্রতি, সেটা অরুণ জানতো না।
এভাবে দেখতে দেখতে দিনটা কেটে গেলো। রাত হলো। রাতে খাওয়ার পর অরুণ নিজের মেয়েকে নিয়ে ঘরে চলে গেলো ঘুম পাড়াতে। মনীষা নিজের ঘরে ছিল। রবিকে মনীষার ঘরে ঢুকতে দেখে অরুণের বুকটা কিরকম চিঁন চিঁন করে উঠলো। সে মনে মনে ভাবছিলো এবার এই খেলাটা তাকে বন্ধ করতে হবে, যে খেলাটা সে নিজেই শুরু করেছিল, মনীষা ও রবির বিয়ে বিয়ে নামক খেলা। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে যায়নি তো ? নাকি এখনো হাতে সময় রয়েছে ? সেটা সময়ই বলবে।