18-03-2022, 10:12 PM
পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক দিন আছে, রাত জেগে পড়ছি এমন সময় মা আমার ঘরে এলো।
-অনেক রাত হয়েছে শুয়ে যাও সকালে পড়ো।
-হ্যাঁ শুয়ে যাবো। বাবা আজ আর এলো না মনে হয়?
-হ্যাঁ, বলে তো গেছিলো চলে আসবে, মনে হয় তোমার বড় ফুফু আসতে দেই নি।
-হঠাৎ কি হলো বড় ফুফুর?
-যে লোক খবর দিয়ে গেলো, সে বলছিলো পড়ে গিয়ে কোমরে ব্যাথা পেয়েছে।
-ওহ, হেলেনা ঘুমিয়ে গেছে?
-হ্যাঁ, সে তো অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।
মনে মনে ভাবলাম, আজ তো মাস্টার মশাই নেই, চান্স একটা নিয়ে দেখি, যদি লেগে যায় তাহলে তো সোনায় সোহাগা।
আমি পানি খাওয়ার ভান করে মা’র পিছনে গিয়ে পিছন থেকে বগলের তলা দিয়ে হাত ভরে হঠাৎ জাপ্টে ধরলাম।
সে তো আমার হঠাৎ এমন ব্যবহারে চমকে গিয়েছে
-এই রেজা কি করছো? ছাড়ো বলছি।
-না ছাড়বো না, তুমি আমাদের এখানে আসার পর থেকেই আমি তোমার জন্য পাগল হয়ে আছি। এই বলে দুধে হাত দিতে গেলে খপ করে হাত ধরে ফেললো। মা তো আমার দু’হাতের মধ্যে মোচড়ামুচড়ি করছে আর হাতের বাঁধন খুলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছে।
-পাগল হলে না-কি? আমি তোমার মা তা কি ভুলে গেছো? তাড়াতাড়ি ছাড়ো বলছি, নাহলে কিন্তু পরে পস্তাবে বলে দিলাম।
-অনেক পস্তাইছি আর না। আজ আমি তোমাকে আপন করে নিবোই।
-এতোটা খারাপ তুমি ছি? এই বলে এক ঝটকাতে আমার বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ঠাস করে চড় মারলো।
-তোমার অনেক নোংরামি সহ্য করেছি আর না। তুমি কি মনে করেছো আমি বুঝি না তোমার মতলব। বুঝিনা কেন যখন তখন না বলে আমাদের ঘরে ঢুকে যাও? বুঝিনা আমার দিকে কেমন হা করে চেয়ে থাকো? আবার আমাকে দেখানোর জন্য ইচ্ছে করে বিছানার নিচে খারাপ খারাপ বই ঢুকিয়ে রাখো। আর কতোটা নিচ তুমি, আমার কাপড়ে –ছি! এতোদিন কেন এসব দেখেও মুখ বুঝে আছি জানো? কারণ এ নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আমার ঘৃণা হয়। আর তোমার বাবাকে বলিনি কারণ সে হয়তো মনে কষ্ট পাবে, আর মানুষে শুনলে বলবে সৎ ছেলে তো তাই দেখতে পারে না। কিন্তু আজ তুমি সব সীমা অতিক্রম করে ফেলেছো। আসুক তোমার বাবা, সেই তোমার বিচার করবে….
এই বলে হন হন করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না।
তার দরজার সামনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম, অনেক রিকুয়েষ্ট করলাম কথা শুনার জন্য, বুঝানোর জন্য কিছুতেই কিছু হলো না। দরজাতো সে খুললোই না, উল্টো ভিতর থেকে ভিষণ নোংরা নোংরা গালাগালি দিলো।
সকালে ঘুমিয়ে আছি, এমন সময় প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় খেয়ে ঘুম ভাংলো। দেখি বাবা চলে এসেছে, রাগের চোটে তার চোখ মুখ লাল হয়ে আছে (তারমানে মা তাহলে সব বলে দিয়েছে?)
বাবা আমাকে বিছানা থেকে নামিয়ে আরো কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিয়ে বললো-
-এই মুহূর্তে বাড়ী থেকে বেরিয়ে যা, জীবনে যেন তোর মতো কুলাঙ্গারের মুখ না দেখি। আর, হ্যাঁ পরিচিত মানুষদের থেকে অনেক দূরে চলে যাবি। আজ থেকে ভাববো আমার কোন ছেলে ছিলো না। এই বলে ধাক্কা দিতে দিতে মেইন দরজার বাইরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো—
আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো। কোথায় যাবো? কিভাবে যাবো? কি করবো? গ্রামে যে আর থাকা যাবে না তা হান্ড্রেড পারসেন্ট শিওর। এরপরও আমাকে গ্রামে দেখলে বাবা বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন করবে। আর গ্রামে যদি জানাজানি হয় তাহলে মুখ দেখাবো কি করে? এটাতো ছোট খাটো বিষয় নয়, অনেক বড় কিছু। না, থাকা যাবে না।
বেলা হলে কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে বাহানা করে কিছু টাকা পয়সা ম্যানেজ করে বেরিয়ে পড়লাম অজানার উদ্দেশ্যে। সঙ্গী হলো পাসপোর্ট সাইজের সৎ মা’র ছবি, যা আমার পকেটে থাকে সব সময়, লেমেনেটিং করা। আজও সেই অজানায় ঘুরছি।
এতো কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে স্টিয়ারিং এ বসেই ঘুমিয়ে গেছি তা আর বলতে পারবো না। ঘুম ভাংলো গ্লাসে খটখট শব্দে। চোখ মেলতেই দিনের আলো চোখে এসে লাগলো। ভোরের সোনা রোদ এনে দিলো নতুন দিনের নতুন সকাল। সামনে তাকাতে দেখলাম বড় দরজা খুলে দিয়ে আমার সৎ মা পিচ্চি একটা ছেলে কোলে নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
ইস! কি হাল হয়েছে আমার সৎ মা’র। জরাজীর্ণ একপেড়ে বিধবাদের শাড়ী পরে আছে। সাদা নয় তবে বাদামি এক কালারের, অনেক পুরোনো।
গাড়ীর চারিপাশে বাচ্চা কাচ্চাই ভরপুর। তারা সবাই অবাক হয়ে এতো সুন্দর লাল টকটকে গাড়ীটাকে দেখছে, হাত বুলাচ্ছে, উপরে উঠার চেষ্টা করছে।
পায়ে পায়ে মা আমার পাশে এসে দাঁড়ালো। গ্লাস নামিয়ে দিলাম। মাথা নিচু করে বসে রইলাম, কি বলবো? কথা যে হারিয়ে যাচ্ছে। মা’র চোখ দিয়ে জল ঝরছে দুগাল বেয়ে
-এসো রেজা ভেতরে এসো।
আমি গাড়ী স্টার্ট দিয়ে ভিতরে ঢুকালাম।
গাড়ী থেকে নামতেই সব ছেলে মেয়ে মহিলারা ঘিরে ধরলো। তাদের কিচির মিচির কথা-বার্তাই কান ঝালাপালা হয়ে গেলো।
মা তাদের ঠেলে আমার সামনে এসে পিচ্চিকে আমার কোলে তুলে দিলো, বললো তোমার ভাই রনি।
আমি ছোট ভাইকে কোলে নিয়ে আদর করতে লাগলাম। মা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো। আমার সেই পুরনো ঘরের সামনে নিয়ে এসে দরজা খুলে দিলো। আমি ঘরে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলালাম। সেই আগের মতোই রয়েছে, ঠিক যেমন রেখে গেছিলাম।
ঘুরে দরজার দিকে তাকাতে দেখলাম, মা’র পাশে বারো তেরো বছরের একটা কিশোরী মেয়ে ফ্রক পরে দাঁড়িয়ে আছে। মা তাকে ঠেলে আমার দিকে পাঠিয়ে দিলো, তোমার বোন হেলেনা।
আমি তাকে দু-হাত দিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলাম
-কতো বড় হয়ে গেছো তুমি হেলেনা।
-ভাইয়া –বলে কেঁদে উঠলো।
-না না কাঁদিস না, আমি তো এসে গেছি।
-এতোদিন কেন আসো নি ভাইয়া, আমরা বাবা কে হারিয়ে কতো কষ্টে আছি জানো?
-আর বলিস না রে, চুপ কর চুপ কর।
-আমি হেলেনা কে বসিয়ে খুটিয়ে খুটিয়ে সব কিছু জেনে নিলাম। সব চেয়ে বেশি অত্যাচার করেছে চাচা চাচিরা।
মা চা বিস্কুট এনে দিলো, চুপচাপ খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
-কোথায় যাচ্ছো?
-একটু বাজারের দিক থেকে ঘুরে আসি।
-আমি তো রুটি বেলেছি।
-এসে খাচ্ছি।
-তাড়াতাড়ি চলে এসো।
পারিবারিক গোরস্থানে গিয়ে বাবার কবর জিয়ারত করলাম।