29-09-2021, 10:31 PM
যাই হোক, একটা ব্যাপার আমাকে ভীষণ আঘাত করেছিল ওই ছোট বেলায়- ওই ব্যাগেজ। ওই আনকালচারড লোক আমাকে ব্যাগেজ বলেই মায়ের সাথে কথা বলতেন। আমার অপমান হতো কিন্তু কি করতে পারে এক ৭-৮ বছরের বালক! ৯ বছর বয়েসে কালীপূজোর বাজি ফাটানো হচ্ছে। মিনি ছুটে বেড়াচ্ছে। সবার সামনে কি করে যেন মিনির ফ্রকে আগুন লেগে যায়, আমি সবার আগে এসে হাত দিয়ে সেই আগুন নেভাই। মিনির পায়ে বেশ ফোস্কা পড়ে গেছিল। মিনিকে মা আর তার স্বামী হাসপাতালে নিয়ে গেল। অনেক সময় পর বাড়ি এসে ওই আনকালচারড লোক আমার দিকে যে চোখে তাকিয়েছিল আজও আমার মনে আছে । বলতে চাইছেন যে আমি দায়ী। আমার সহ্য শক্তি ওই বয়েস থেকেই একটু বেশি। আমার ডান হাতে কবজি অবধি বড় বড় ফোস্কা,শুধু জল ভর্তি বালতিতে হাত চুবিয়েছি, কেউ খোঁজ নেয় নি। খাবার সময় বা হাতে খেতে দেখে মা “ তুমি বা হাতে খাচ্ছ কেন?” এই বলে আমার ডান হাত দেখে তক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করেন। কিন্তু দেরি হয়ে যাবার ফলে আমার ডান হাত ভুগিয়েছিল। প্রায় ৬ মাস কোন কিছু করতে পারিনি। সব বাঁ হাতে করতাম। বল করা, বক্সিং এ স্তান্স নেওয়া, ক্যারাটে ক্লাসেও তাই। এই করে আমি সত্যি সব্যসাচী হয়ে উঠলাম। ৬ মাস পর আমি দু হাতে সমান পারদর্শী। এইসব কিছু না, ওই বয়েসেই আমার সব থেকে অপমান বা মায়ের প্রতি অভিমান ছিল যে মা কেন প্রতিবাদ করতেন না। কেন? চেচিয়ে উঠল ওজু
………কেন মা ওকে বলেনি যে ওজু আমার ব্যাগেজ নয়, ও আমার ছেলে, প্রথম সন্তান,কেন মা বুঝতে চায় নি যে এক বালকেরও সম্মান বোধ থাকতে পারে, মন থাকতে পারে…… ওজুর চোখে জল, গলা রীতিমত চড়া। সিরাজ হাসি মুখে হাতের ইশারায় চুপ করতে বলল
……… ক্ষমা কর ওজু, ক্ষমা কর। অনেক খুজেছি তোকে অনেক। দিনের পর দিন খুজেছি, ক্ষমা কর……চুপ করে ওজু। কুন্তি আর মিনি সান্ত্বনা দিচ্ছে হাতে হাত রেখে। ঘরে শুধু এসি র মৃদু শব্দ
………বোধ হয় মা ওনাকে ভয় পেতেন অথবা ওনার ওই বিশাল সম্পদ তার জন্য।আর একটা কারন হতে পারে। আমার নাকের ওপর ওই বিশ্রী আব আর সামনের বেরিয়ে আসা দাঁত, আমাকে দেখতে খারাপ করে দিয়েছিলো। তাই মা হতে পারে মনে মনে লজ্জিত ছিলেন
………না ওজু না না। ভুল ভুল ওজু ভুল
………কিন্তু তিনি ভাবেননি যে তার ছেলের মনে কি হচ্ছে। মা তার স্বামী আর মিনি প্রতি বছর বেড়াতে যেতেন আর আমি একা একা ওই বাড়িতে থাকতাম। ওই বাড়িতে থাকাকালিন সময়ে আমি মিনি মা ওই লোকের সাথে কোথাও গেছি, মনে পড়ে না। আমি ছিলাম ওই বাড়িতে উঁচু ধরনের আশ্রিত। লেখাপড়া এই নানা কারনে ভালো লাগতনা। ফেল না করে ক্লাসে উঠতাম। ভালো লাগত ফুটবল আর ক্যারাটে। কলেজে বক্সিং শেখাত, বাড়িতে না জানিয়েই আমি রোজ লড়তাম।গান করতাম ছাদে উঠে। ১০ বছর পার হয়েছে, এক বিকালে আমি আর মিনি সামনের বাগানে খেলছি। মিনি আমার হাত ধরে জোরে ঘুরছে। মোমেনটাম বেড়ে যাচ্ছে, থামতে বললেও থামছে না, আমার আঙুল ঘামে পিছলে যাচ্ছে। প্রানপনে চেষ্টা করছি মিনিকে ধরে থাকতে, কিন্তু মিনি মনের আনন্দে আরও জোরে, দু পা তুলে ঘুরছে। হঠাৎ আঙুল ছেড়ে ছিটকে পড়ে কপাল লাগলো পাথরের সিঁড়িতে আর ফিনকি দিয়ে রক্ত। সঙ্গে সঙ্গে মিনির পাপা আর মা হাসপাতালে নিয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছি আজ আমার কপালে কিছু ঘটবে। রাতে দুজনের ঝগড়া শুনছি “ না না ওকে এখানে রাখা চলবে না। হি ইস ইওর ব্যাগেজ। “ মা বলছেন “ জানি ও আমার ব্যাগেজ, কিন্তু তুমি বিয়ের আগেই জানতে। লুকাইনি কিছু”। মা একটু পর বেরিয়ে এসে আমাকে কঠিন ভাবে বললেন “ তুমি কাল মুন্সিজির সাথে দেহরাদুন যাবে। ওখানকার কলেজে পড়বে যতদিন খুশি, যা খুশি। কিন্তু এই বাড়িতে তুমি আর আসবে না। ছুটিতে তোমার বাবা তোমায় নিয়ে ষাবে কলকাতায়, বুঝেছ”। যখন মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিলেন আমাকে, তখন আমি সাড়ে ১০ বছরের। আর ষাইনি, ষাবও না এমন কি মিনির বিয়ে হলেও যাব না ওই আনকালচারড লোক এর বাড়ি।
কলেজে আমার ভিতরে সব সময় রাগ আর অভিমান জমে থাকত আর সেইটা আমি উগড়ে দিতাম বক্সিং এর রিঙে। ওই বয়েসেই আমি আমার থেকে ৩-৪ বছরের বড় ছেলেদের সাথে লড়তাম।মার খেতাম প্রচুর, দিতামও প্রচুর। বক্সিং এর মাস্টার বলতেন যে আমার ভিতর এক খুনি আছে তাই রিঙে আমি ওতো আগ্রাসী। দু বছরের ভিতর কলেজের বড় বড় ছেলেরা পর্যন্ত সমীহ করে চলতো।কলেজে গানের মাস্টার খুব খুব যত্ন করে গান শেখাতেন কেননা আর কেউ ওই ক্লাসিকাল সঙ্গীতে আগ্রহী ছিল না। আমাকে আগ্রহী করেছিলেন ঠাম্মা। তবে ছেলেবেলা থেকে শুধু অপমান আর অবহেলা, তার প্রভাভ পড়ে লেখাপড়ায়। ভালো লাগত না। ছুটিতে বাবা নিয়ে যেতেন কলকাতায়। একবার বাবা এক মহিলাকে নিয়ে এসে বললেন” ওজু ইনি তোমার নতুন মা”। দেখলাম তেনার আহ্বান ও নেই বিসর্জন ও নেই। তবে একটা ব্যাপার নিয়ম মেনে মা করতেন। প্রতি বছর মিনিকে নিয়ে আসতেন ভাইফোঁটা দিতে, ৫-৬ দিন থাকতেন।সারা বছর ওই ৫-৬ দিনের জন্য অপেক্ষা করে মিনির জন্য কিছু বানাতাম। কিছুই না, একটা ছোট ফুল রাখার ঝুড়ি, অথবা পাহাড়ি মহিলাদের থেকে কেনা হার মাথায় বাধার স্কার্ফ , এইসব। আমি মিনিকে নিয়ে ঘুড়তাম ওই পাহাড়ে।মিনিও আমাকে মিস করত ওর বাড়িতে ভীষণ, বলতো আমাকে
ক্লাস ১০ এর ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কলকাতায় এসে ছিলাম অনেকদিন।এখনও জানি না পাশ করেছি কিনা। হাসনু আর আমি বহুত ঘুরেছি, সিনেমা দেখেছি এসপ্লানেডে, খেয়েছি মোগলাই। হাসনু সব জানত কোথায় ভালো খাবার পাওয়া যায়। রয়্যাল এ খেয়েছি, মিত্র কাফে, রাধু বাবুর দোকান লেক মার্কেটে, বসন্ত কেবিন, গোল বাড়ি, সব মুখরোচক রেস্তোরাঁয়। কিন্তু আমার কপালে ভালো যা কিছু লেখা ছিল, সাথে করে নিয়ে গেছে ঠাম্মা ………বেদনার হাসি ওজুর মুখে
………… একদিন বিকালে বাড়ি ফিরেছি, এমনিতে ৭-৮ টায় ফিরি , সেইদিন ফিরেছি ৬টায়। দেখি নতুন মা সাথে এক যুবক। ঠিক বলার মতো না, এইরকম অবস্থায়। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ষাই। রাত ৯ টা নাগাধ ফিরতেই বাবা , মদ খেয়ে ছিলেন। বিশ্রী ভাবে মারলেন। নতুন মা নালিশ করেছেন যে আমি নাকি তার শ্লীলতা হানি করেছি। বাবা মারতে মারতে বের করে ব্যাগ ছুড়ে দিয়ে “ জোনাকি এক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে”। আবারও সেই বোঝা। কিন্তু স্যার আমি ভগবানের কাছে দরখাস্ত কোনোদিন করিনি যে আমকে শঙ্কর বসু আর জোনাকির সন্তান করে পাঠাও। চোখের জল সেই শেষবার বেরিয়েছিল অপমানে। মনে মনে বললাম “ গুড বাই। আর কাউর বোঝা হয়ে বাঁচব না”। তখন ১৬ বছর ৭ মাস বয়েস। পকেটে ছিল ১৩৪ টাকা, হাওড়া ষ্টেশনে এসে প্রথম যে ট্রেন চোখে পড়ল উঠে পড়লাম। শুরু হোল আমার সমাজ বিরোধী হওয়ার প্রথম পদক্ষেপ।
সেইটাই আমার জীবনে বিরাট ভুল। উচিৎ ছিল ফুলের কাছে যাওয়া, তা হলে আজ আমি টেবিলের উল্টো দিকে বসতাম
………ওজু, নমিতা ক্যানসারে মারা গেছে। তোর কাছে ক্ষমা চেয়ে গেছে। স্বীকার করেছিল মরার আগে আমার কাছে
কোন পরিবর্তন হোল না ওজুর মুখে। এখনও পর্যন্ত, ওজু একবারের জন্য জোনাকি বা শঙ্করের দিকে তাকায় নি, এমনকি তারা জড়িয়ে ধরলেও না। জলের গ্লাস নিয়ে আবারও ঢোঁক ঢোঁক করে গলায় ঢেলে
………চেকার উঠে টিকেট চাইতে যথারীতি না। ধানবাদ ষ্টেশনে নামিয়ে দিল। থানায় নিল না কি কারনে কে জানে। ষ্টেশনে থাকতে শুরু করলাম। ওখানকার কিছু ছেলের সাথে ছুটক ছাটকা মারপিট চলতো। এই করে ১৩৪ টাকা শেষ। কিন্তু আমার কোন ভয় হয়নি, জানতাম চলে যাবে। চলে ষেতেও। গাড়ি ধোয়া দু একটা, কারো গাড়ি ধরে দেওয়া। বাসের হেল্পারি , এই ভাবে মাস খানেক চলার পর একদিন ওখানকার স্ট্রিট আরচিন দের একটা গ্যাং আমাকে এট্যাক করে। ৮-৯ জন হবে। একজনের হাতে ছুরি ছিল। আমি মারলাম। হ্যাঁ ঘাবড়াবেন না, ওই ৮-৯ জনকে পেটালাম। হাপিয়ে গেছিলাম। বসে হাফ নিচ্ছি, এক বয়েসে বেশ বড় লোক এসে
………তোর নাম কি রে?
......কি মনে হোল বলে দিলাম, বাচুয়া
………যাবি আমার সাথে, জি টি রোডে এক ধাবায়
………হ্যাঁ চল্ ………নিয়ে এলো এক ধাবার মালিকের কাছে। নাম কেদার নাথ সিং। ধাবায় থাকতে হবে,গাড়ি আর বাস দাড়ালে খদ্দের ধরতে হবে , এইসব কাজ। ঠিক আছে , চলবে। এক মাস পর মাটিতে না শুয়ে এক চার পাইয়ে মানে খাটিয়া তে ঘুমালাম সেই রাতে। সত্যি বলছি আমি ওই জীবন বেশ এনজয় করতাম, ওই বোহেমিয়ান লাইফে এক রোমান্স আছে। বেশ লাগত। খাওয়া শোয়া কোন কিছুই নিয়ম মেনে করতে হয় না কিন্তু ভালো লাগত। মনে হতো হঠাৎ বড় হয়ে গেছি। যা খুশি করতে পারি। হিপিরা শুনেছি ওই “ ডোন্ট কেয়ার” জীবন কাটাত। খারাপ না ওই জীবন, এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। তবে রোগা হয়ে গেছিলাম। দেখতে একেবারে ওই রাস্তার ছেলে। মাস তিন পর একদিন ধাবায় এক জনের কাগজে দেখলাম মা ছবি দিয়ে ৪০০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। সেইদিন থেকে মুখে গামছা বাঁধা শুরু হোল। কিছুদিন যাবার পর ভাগ্য খেলল আমার সাথে। কেদার সিং এর দুই মেয়ে মঞ্জু আর অঞ্জু। মঞ্জুদিদির বিয়ে হয়ে গেছে, ৪-৫ কিমি দূরে থাকে। অঞ্জু দিদি আমার থেকে ৪ বছরের মতো বড়। বিয়ে হয়নি, প্রেম করে আলাম বলে এক '. ছেলের সাথে আর আমি অঞ্জুদিদির বন্ধু যে চিঠি আদান প্রদান করে আলম আর অঞ্জুদিদির। কিন্তু সিংজি বিয়ে দেবে না। যাই হোক, এক বিকালে আমি চা আর সামোসা খাচ্ছি। এক গাড়ি করে ৪ জন ছেলে নামল। চা সামোসা আর কি কি নিয়ে খেতে খেতে অঞ্জুদিদিকে নিয়ে খুব বাজে বাজে কথা বলছে, ইঙ্গিত করছে ইংরাজিতে। ওরা ভাবতে পারেনি যে ওই খানে ইংরাজি জানা কেউ থাকতে পারে। আমি উঠে হাত ধুয়ে কনফ্রন্ট করি। মানতে চায়না তারপর ইংরাজিতে সুরু করলাম- ইংরাজি শুরু করতে ওরা তর্ক শুরু করে পাত্তা না দেওয়ার ভাব। মারলাম ৪ জনকে, হ্যাঁ একাই। ও আমার কাছে তখন কিছুই না। সিংজির স্ত্রী মাইজি এসে ছাড়িয়ে আমাকে খুব বকা দিয়ে
………তুই কেন মারপিট করলি?
……ওরা অঞ্জুদিদিকে নোংরা কথা বলছিল ইংরাজিতে
………তুই অঞ্জুর জন্য মারপিট করলি?
……বা আমি দিদি বলি। তাহলে আমি ভাই হলাম, ভাইয়ের কর্তব্য বোনকে রক্ষা করা
……শুরু হোল আমার সুখের সময়। ওই ঘটনার পর মাইজি আমাকে বাড়ির একজন করে নিলেন। আর এই সিংজির মতো লোক আমি আর দেখিনি। কোন নেশা নেই। এমনকি চা পর্যন্ত পেলে ভালো না পেলেও চলে। কিন্তু আছে টাকার নেশা। কয়লার চোরাকারবারি করে। কাছে গ্রামে বাড়ি আছে, সেখানে অস্ত্র মজুত করে আর চালান দেয়। বিশেষ করে ভোটের সময়। ওই ঘটনার পর আমাকে সিংজি নিজের বাড়িতে রাখল। ধাবার পিছনে এই ৫০০ গজ দূরে গ্রামে। অঞ্জুদিদির মা যত্ন শুরু করলো আর আমি অঞ্জু দিদিকে ইংরাজি শেখানো। সিংজি আমাকে ১৫-২০ দিন পর কাছের গ্রামের বাড়িতে রেখে খুলে বলল সব। আমাকে ওই চোরাই কয়লার গাড়ি চালিয়ে বা গার্ড দিয়ে নিয়ে যেতে হবে আর ওই বাড়িতে অস্ত্র মজুত থাকে, তা পাহারা দিতে হবে। ৩ মাসের মধ্যে শিখে গেলাম ট্রাক চালান আর বন্দুক চালান। ওই বাড়িতে গুলি বানাত লুকিয়ে। আমি সিংজিকে বলে প্রাকটিস শুরু করলাম গুলি চালানোর। প্রথমে এক হাতে , তারপর দু হাতে। অল্প সময়ে হয়ে উঠলো আমার নিশানা অভ্রান্ত। যখন খুশি যেখান থেকে খুশি চালাতে পারতাম নিখুঁত ভাবে। ওই খানেই সময় কাটানোর জন্য ছুরি ছুরতাম এক গাছ লক্ষ করে সারা দিন দু হাতে। এক বছরের ভিতর আমি নিজেই নিজেকে তারিফ করতাম। ভাগ্য ভালো কোনোদিন কাউকে মারতে হয়নি।