29-09-2021, 10:28 PM
সিরাজ আলি মণ্ডল এইরকম কেস পায়নি তার সারা চাকরি জীবনে। ফাগুকে নিজেদের হেপাজতে পেয়েছে ২৮ দিন পর। হাসপাতালে ২৮ দিন কাটিয়ে, তার ভিতর আইসিউ তে ৫ দিন, ছেলেটি মোটা মুটি বিপদ মুক্ত। তার পর থেকে দফায় দফায় কত ঘণ্টা যে তাকে জিজ্ঞাসা করেছে সূর্য আর বাকি অফিসাররা তার হিসাব নেই। নতুন টাউনের ঘটনার পর ১ মাস ৯ দিন কেটেছে কিছুতেই ফাগু মুখ খুলছে না। প্রশ্ন করলে ঘাড় নিছু করে থাকে। মারধর করতে সিরাজ অনুমতি দেয়নি।কেমন এক অনুভুতি ভিতরে ভিতরে অনুভব করে সিরাজ। “কু কু মম” কি বলতে চেয়ে ছেলেটি সিরাজের চোখে চোখ রেখে বুকে লুটিয়ে পরেছিল তা জানতে প্রবল আগ্রহী সিরাজ। কু মানে বোঝা গেল কুন্তি, ওর বৌ। কিন্তু ওর নাম কি, ওর কি পরিচয়,কোথায় বাড়ি, কিছুই জানা যায়নি। কুন্তিও জানে না। সিরাজকে দু হাতে জড়িয়ে রক্তাক্ত ফাগু কিছু বলতে চেয়েছিল ফাগুর সেই চোখ তাড়া করে বেরাচ্ছে ঘাগু পুলিশ অফিসার সিরাজকে। “ নিজের হাতে রক্তাক্ত ফাগুকে বাঁচিয়েছি,আমাকে জড়িয়ে কি বলতে চেয়েছিল ও, আশ্রয় চাইছিল কি আমার কাছে? কি ভাবে ওকে মারতে পারি?আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি তাই থার্ড ডিগ্রি তে মন সায় দেয় না?”
সকালে চা খাচ্ছে মেয়ে হাসনুহানা আর স্ত্রী জুঁই এর সাথে। মেয়ে হাসনুহানা এসেছে ৩ দিন।বর্ধমানের দিকে এক কলেজে পড়ায়। সবে ৭ টা বাজে। বাড়িতে থাকলে এর আগেই হাসনুহানার চা খাওয়া হয়ে যায় তবে বাপের বাড়ি বলে কথা, একটু আদর আলসেমি জড়িয়ে থাকে দিনভর। সকালে বাবার পাশে বসে চা খাচ্ছে , মেয়ে জুইএর কোলে।
……… তা বাবা তোমার সেন্সেসনাল ক্রিমিনালের কি খবর, কোথাকার ছেলে?
………ছেলেটা কিচ্ছু বলছে না, স্পিক টি নট
……কেন তোমার খাস কনস্টেবল অনাদি, সেও পারেনি কোন কথা বার করতে?
……না না একে অনাদির হাতে দেওয়া যাবে না। ওই গুলি খেয়ে রক্তাত অবস্থায় আমাকে জড়িয়ে কিছু বলতে চেয়েছিল। আমি ওকে আলাদা সেলে রেখেছি, একটু আলো আসে এইরকম। একা থাকে। ভীষণ মায়া লেগেছিল, ভীষণ, যখন ও আমায় জড়িয়ে ধরে কিছু বলতে চাইছিল। রক্তে শরীর ভেসে গেছে যন্ত্রণায় কথা বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে সেই অবস্থায় আমার দু হাতে নিজেকে ছেড়ে প্রানপন চেষ্টা এক গভীর গোপন কথা বলার, কি করে ভুলি বল হাসনু। নিজের কেউ না, চেনে না, তবু নিজে ৩ টে গুলি খেয়ে একটি বিশাল বড়োলোকের মেয়েকে কেন বাঁচাল, সেইটা জানা খুব জরুরি। পুলিশের খাতায় ওর নামে কোন অপরাধ নেই কিন্তু এই রিস্ক কেন নিল, জানতে হবে।
…… খুব সুন্দর দেখতেরে হাসনু। সিনেমায় নামতে পারে। এদিকে আবার দুর্দান্ত গান গায় । কাল সকালে এসআই উপাধ্যায় বলল “ স্যার, এ বিলকুল বিন্দাস ছেলে। আজ সকালে গান গাইছিল ‘সাগর রেন মে ভাগে ’, আপনি শুনলে অবাক হতেন, শুধু গান গেয়ে এই ছেলে দিন কাটাতে পারে, এই ছেলে খুন করলো?.... মৃদু হেঁসে উঠে হাসনু।
……… ওটা ‘সাগারি রেইন কে জাগে’, ভীমসেন ষোশির বিখ্যাত গান রামকেলি রাগে। ওই খুনি এইটি গাইছিল? বাপ রে বাপ। দাড়াও একে নিয়ে গল্প লিখবো, একবার দেখাবে তোমার হ্যান্ডসাম সমাজ বিরোধীকে সিনেমায় নামার আগে একবার দেখি আমরা, দেখাও না বাবা ? তবে বাবা, এর অতীত খারাপ না। কেননা ওই গান কোন সাধারন লোক গাইবে না।
………ধুর ছাড় তো, যতো সব গুন্ডা বদমাশ। দ্যাখ কত খুন করেছে, আর কত মেয়ের সর্বনাশ……জুঁই মেয়েকে বলল
………না জুঁই, ফাগু সেইরকম ছেলে না
………ফাগু? বাবা, সম্পূর্ণ নাম কি?
………ফাল্গুনি।
………ফাল্গুনি, তৃতীয় পাণ্ডব। তা কোন শ্রীকৃষ্ণ বাঁচাল? ৩ টে গুলি , বাবা রে বাবা
…………দুটো গুলি সেরকম না ……ডান কাঁধে, বাঁ বগলের পাশে তবে পেটের গুলি মারাত্মক হতে পারত। বাঁচিয়ে দিয়েছে ওর তাবিজ………হাতের কাপ নামিয়ে হাসনু, চোখ মুখ সিরিয়াস
………তাবিজ? কিসের তাবিজ?
………পেটে একটা বড় রুপোর তাবিজ লাগান ছিল। গুলি লেগেছে তাবিজে, তাই বেঁচে গেছে…… প্রায় ভরা কাপ রাখতে গিয়ে উত্তেজনায় কাপ উল্টে চা টেবিলে আর টেবিল ক্লথে,
উঠে দাঁড়িয়েছে হাসনুহানা চোখ মুখে উজ্জ্বল হাসি
………কি বললে, পেটে তাবিজ, তুমি ঠিক বলছ? মা তুমি কিছু বুঝতে পারছ? ক্লাসিক্যাল গান গায় .....চেয়ার ছেড়ে উঠে দু হাত আকাশে তুলে, “ ইহাআআআআআ” …… পাশের বাড়ির লোক হোক চকিয়ে উঠলো, “ কি হোল” হাসনুর প্রান খোলা উচ্ছাস
.........…বাবা, তুমি কি বুড়ো হয়ে গেছ?.........হাসনুর আচমকা ওই উত্তেজিত চিৎকারে সিরাজ দেখে খুশি উপচে পড়ছে হাসনুর মুখে
……”কি হয়েছে, হাসনু তুই উত্তেজিত কেন”?
...... জিতে রহ বেটা। জিতে রহ, তুই বাবাকে ফাকি দিতে পারিস কিন্তু হাসনুহানা কে ন………………য়
হেড অফিসে গাড়ী থেকে নেমে ,সিরাজ প্রথমেই কমিশনারের ঘরে। বাইরে লাল আলো জ্বলছে
………অনুপ, কতক্ষন চলবে? আমার ভীষণ জরুরি……বাইরে বসা পিএ কে প্রশ্ন সিরাজের
……… স্যার, একটু বসুন। এর পর একটা মিটিং আছে, আমি তার আগে বড় সাহেব কে বলছি
………আগে বল, আগে। খুব জরুরি……বলতে বলতে ভিতর থেকে এক অপরিচিত ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন…সিরাজ কোন চান্স না নিয়ে সোজা
……।।স্যার ক্ষমা চাইছি, এই ভাবে আসার জন্য
…… ঠিক আছে বল। কি ব্যাপার
………স্যার অনেক ভাবে আমি আর সূর্য চেষ্টা করেছি ফাগুর মুখ খোলাতে পারিনি। মারধর করে এই ক্ষেত্রে লাভ নেই আর আমার মন সায় দিচ্ছে না, তাই আমি চাই আজ দুপুরে ৬ জন পুরুষ আর মহিলার সামনে ওকে প্রশ্ন করতে। স্যার আমি নিশ্চিত আমি জানি ও কে। কিন্তু ফাগু স্বীকার না করলে কিছু করার নেই। এই একটা উপায়। এদের সামনে ফাগু ঘাড় গুজে থাকতে পারবে না
……ঠিক আগে ডাক । তবে বেশি সময় কিন্তু নেবে না। আর তুমি শিওর?
………১০০০% স্যার।
দুপুর ২টো। লাঞ্চ এর পর এক বড় ঘরে বিরাট টেবিলের মাঝখানে কমিশনার সাহেব। তার ডান পাশে সিরাজ। সূর্য সিরাজের পিছনে দেয়ালের ধারে চেয়ারে। কমিশনারের সামনে চেয়ার খালি। বাঁ দিকে জোনাকি, মেয়ে তিতলি আর স্বামী। আর সিরাজের ডান দিকে জোনাকির আগের স্বামী শঙ্কর, আর পাশে রোম , কুন্তি। সূর্য আর একজন পুলিশের সাথে ঘরে ঢুকল ফাগু কে নিয়ে। অন্য পুলিশ অফিসার বেরিয়ে গেলেন ইশারাতে । ফাগুর চুল নেমে এসেছে ঘাড় ছাপিয়ে, কপাল ঢেকে গেছে চুলে , কানের দুই পাশ দিয়ে আগোছাল চুল নেমে এসেছে কিছু কানে কিছু গালে।চুল আঁচড়েছে, পরনে পাজামা আর পাঞ্জাবি। একেবারে ছবিতে দেখা বিপ্লবী “ চে গেভারা”। শতকরা ৯০ টি কলেজ পড়ুয়া মেয়ে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়বে। ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে ফাগু, কুন্তি কে দেখে সূর্য কে “ একটু কথা বলতে পারি, এদের সাথে?” কুন্তি আজ সেজে এসেছে। দামি শিফনের শাড়ি ম্যাচিং ব্লাউস। আর রোমের সেই হিরের গয়না অঙ্গে। দেখে থমকে দাড়াতেই হবে। ফাগুর প্রস্নে ঘাড় নারিয়ে সায় দিলেন সিরাজ। এগিয়ে গিয়ে কুন্তির সামনে একটু হেঁসে
………সরি কুন্তি, তোমার এই অবস্থায় পাশে থাকতে পারলাম না। কুন্তি ইনি রোম। রোম, সম্ভব হলে কুন্তিকে সাহায্য করবেন প্লিস
………‘সম্ভব হলে সাহায্য করবেন’ ভেঙ্গিয়ে উঠলো রোম। … কে তোমাকে ওখানে গিয়ে ওইসব করতে বলেছিল হ্যাঁ? দিগ্বিজয় করতে বেড়িয়েছে,। চেনে না জানে না, নিজের জীবন দিয়ে প্রান বাঁচাবে। এখন কে দেখবে তোমায়। একে বারে বুদ্ধু, আর কুন্তি তুই এই বুদ্ধুর প্রেমে পড়লি। খালি ফুচ ফুচ কান্না। ‘ একটু দেখবেন রোম’ যেন উনি বলবেন তারপর যা হবার হবে। গাধা…………রোম বলে যাচ্ছে কিন্তু কথায় প্রানের ছোঁয়া সবাই বুঝতে পারছে। “ কুন্তি কে নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে। দিগ্বিজয় করবেন, লোকে বাহবা দেবে, ছবি তুলবে, বুদ্ধু” ……মুখ টিপে হাসি মুখে ফাগু তাকিয়ে
……ফাগু তুমি চিন্তা করো না। আমি দিদির ওখানেই আছি। হাসপাতালের সব খরচ দিদি দিয়েছেন। উকিলের খরচাও দেবেন। পিউ ফোন করে আমাকে। ওর বন্ধুদের এনে তোমার জন্য ৫ বোতল রক্ত দিয়েছে। তুমি ভেবনা সব ঠিক হয়ে যাবে। ………গলা খাখারি দিলেন সিরাজ। চোখের ইশারায় চেয়ারে বসতে বললেন। ফাগু চেয়ারে বসে ডান দিকে চোখ ঘুরিয়ে আবার বাঁ দিকে দেখে নিল। ফের ডান দিকে তিতলির দিকে অল্প হাসি।
………ফাগু, এই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া ছবিটি কার? তোমার ব্যাগে পেয়েছি, ইনি তোমার কে হন? ঘাড় গুজে ফাগু, সিরাজের প্রস্নে……
এইবার খুব কোমল স্নেহের স্বরে
……..ফাগু। এইখানে তোমার স্ত্রী আছেন, তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী রঙ্গনা ম্যাডাম আছেন, তিতলি আছে যার জন্য তুমি ‘জান কবুল করেছিলে, তবুও তুমি বলবে না, ইনি কে? তোমার মা, তাই না?.... চুপ থেকে ফাগু একটু সময়
…হ্যাঁ।
……কি নাম তোমার মায়ের ?....চুপ ফাগু, উশখুশ করছে তিতলি
………স্যার, প্লিস আমাকে একটা কথা বলার অনুমতি দেবেন………তিতলি উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোর করে কমিশনার কে অনুরোধ জানাল……” হ্যাঁ বল” ।
………আমি এনাকে একবার প্রনাম করতে চাই, ইনি আমার প্রান বাঁচিয়েছেন……গলা ধরে এসেছে তিতলির। নড়েচড়ে বসলো ফাগু, একটু অপ্রস্তুত, হাত নেড়ে
……ধ্যাত, প্রনাম। এদিকে আয়, আয় আয় আয় এদিকে ……তিতলি আসতে তার হাত নিয়ে নিজের দু হাতে ধরে চুমু খেয়ে কমিশনারের দিকে তাকিয়ে উপহার দিল তার বিখ্যাত মন ভোলান হাসি
………একটা কথার ঠিক ঠিক উত্তর দাও ফাগু। তোমার এই শীভালরির কারন কি? তোমাকে পুলিশ খোজে নি? পুলিশ জানেই না তুমি কে তবু তুমি নিজের থেকে কেন ধরা দিলে একে বাঁচাতে? পুলিশের খাতায় কোন কেস নেই, তবুও, কেন, কি কারন?......চুপ করে ফাগু একটু সময়। ঘরের সবাইকে দেখে নিল আরও একবার, আবারও তার ভুবন ভোলান হাসি
……… আমি ছাড়া একে কে বাঁচাবে? একে বাঁচানো আমার কর্তব্য। এর নাম মীনাক্ষী বা তিতলি, এ ছাড়া একটা নাম আছে, মিনি। সেই নামে একে ডাকে শুধু একজন।……একটু চুপ কয়েক সেকেন্ড
……… আমার আর মিনির জন্ম একই গর্ভে, মিনি আমার ছোট বোন। আমার কলেজের নাম অর্জুন বাসু।
চুপ। নিঃশ্বাস পড়ছে না কারো। পৃথিবীর গতি কি থেমে গেছে, কয়েক সেকেন্ডের জন্য? তার পরই ঘর কাপিয়ে খুঁজে পাওয়ার চিৎকার “ দাদাই, ওজু ”। মুখ ঢেকে কাঁদছে জোনাকি আর শঙ্কর। তিতলি দু হাতে ফাগুকে জড়িয়ে ‘দাদাই, দাদাই ‘ আর কান্না । ফাগু মিনিকে জড়িয়ে রোম আর কুন্তির দিকে তাকিয়ে দেখে রোমের চোখ ছিটকে বেরোবে। ফিচকে হাসি হেঁসে, চোখ মেরে দিল ফাগু রোমকে ওই অবস্থায়। শুধু সিরাজের মুখে তৃপ্তির হাসি। হাসি মুখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল সূর্য কে। চোখের জলে ভাসতে ভাসতে জোনাকি উঠে এসে অজুর মাথা ধরে চুমু খেল গালে, শঙ্কর এসে মাথায় হাত বুলিয়ে চিপে নিল বুকে। জোনাকি ভেজা চোখে অজুকে ধরে
সিরাজ ইঙ্গিত করতে সবাই যায়গায় বসলো মিনি বাদে
………স্যার আমাকে প্লিস দাদাইএর পাশে বসতে দিন……কমিশনার মৃদু হাসলেন। প্রমান করলেন যে পুলিশ ও মানুষ।
……স্যার কুন্তি আমার পাশে বসতে পারে? শুধু হাত ধরে থ………আবার সেই এক ইঙ্গিত। ওজু বা ফাগুর দুই পাশে তার দুই প্রিয়জন , কুন্তি আর মিনি। দু হাতে দুজনকে ধরে
……মিনি এ তোর বৌদি কুন্তি……তারপর চোখ বড় করে কড়া গলায় “ একে কিন্তু প্রনাম করবি”……বলার ভঙ্গিতে না হেঁসে পাড়া যায়না
………স্যার, ওই তাবিজটা কি ফিরত পাওয়া যাবে? আর কিছু না ওইটি আমার ছেলেবেলা। ঠাম্মার দেওয়া। ওতে জড়িয়ে আছে তার স্মৃতি আর ভালোবাসা, তাই চাইছি………”দেখব চেষ্টা করে” সিরাজ উত্তর দিলেন।
………তা ওজু, এইবার বল মায়ের ছবি বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ কিন্তু তাকে দেখেও নিজেকে লুকিয়ে রাখছ কেন? ইচ্ছা করলেই তো দেখা করতে পারতিস
………সে অনেক কথা। কি হবে দেখা করে?
………ছবি রেখেই বা কি হবে?
চুপ করে ফাগু, একটু সময় নিল ভাবতে তারপর মৃদু হেঁসে ফাগু …’তা হলে শুনুন, সব বলব এই কারনে যে আর আমায় কোন আলাদা আইডেনটিটি নিয়ে বাঁচতে হবে না, আর ছদ্মবেশ লাগবে না ।
……… আমার ৫ বছর অবধি আমি ছিলাম বাড়ির মধ্যমণি। সংসার ঘুরত আমাকে নিয়ে। বাবা মা দুজনেই আমাকে ভালবাসতেন সময় দিতেন। দুজনেই চাকরি করতেন তাই খুব বেশি সময় ছিল না তাদের। আমি থাকতাম ঠাম্মা কে নিয়ে আর খেলতাম আমার হিরো গব্বর সিং এর মেয়ে হাসনুহানার সাথে। হাসনুর মা কে আমি ফুল বলে ডাকতাম। ফুল আমাকে ভালবাসতেন নিজের সন্তানের মতো।ঠাম্মা আমায় গল্প শোনাত, আলিবাবার গল্প, মহাভারত, রামায়ণ টুনটুনির গল্প। রাতে শুয়ে শুয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে গল্প বলতেন। বাবা ক্লাসিক্যাল গান শিখেছেন, তাই ঠাম্মা আমায় নাড়া বাঁধিয়েছিলেন একজনের কাছে ৫ বছর বয়েসে, নিজেও গান গাইতে পারতেন। সব ঠিকঠাক। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগত যখন মা ঠাম্মার সাথে চেঁচিয়ে খারাপ ভাবে কথা বলতো। ঠাম্মা খুব নিরীহ মানুষ ছিলেন,বাবা রোজ রাতে মদ খেয়ে এসে প্রথমে মায়ের সাথে ঝগড়া করতেন তারপর ঠাম্মাকে যা খুশি তাই বলতেন। ঠাম্মা বলতেন আমাকে “ দাদুভাই তুমি ওই সব কথা শুন না, রেগে আছে তাই বলে”। কিন্তু কেন বলবে, কেন কেন…কেন বলবে… উত্তেজিত অজু চুপ করে নিজেকে সামলে নিচ্ছে ……ঠাম্মা আমাকে জড়িয়ে কাদতেন আমি ঠিক বুঝতে পারতাম। কেন বাবা আর মা ঠাম্মার সাথে খারাপ ব্যাবহার করতেন জানি না , বুড়ি মানুষ ,খুব ভালো ছিলেন ঠাম্মা। মনে হতো চেঁচিয়ে উঠে মাকে বলি “ তুমি বলবে না ওই ভাবে ঠাম্মা কে, বলবে না” ……চুপ করে ওজু মাথা নিচু করে চোখে জল, মিনি সামনের জলের গ্লাস দিতে ঢোঁক ঢোঁক করে খেয়ে চুপ
………কেন বলিসনি ওজু , কেন বলিসনি বাবা ? একবার যদি বলতিস, এখন আর বলিস না প্লিস, প্লিস ওজু…মুখ না তুলে বললেন জোনাকি ধিরে ধিরে
……আমার ৫ বছরের জন্মদিনের কিছুদিন পর একদিন সকালে মা আমায় খুব আদর করে বললেন “ ওজু আমি আজ বোম্বে চলে যাচ্ছি কাজে। তোকে কয়েকদিন পর এসে নিয়ে যাব। কেমন?তুই ঠাম্মার সাথে শান্ত হয়ে থাকবি”। আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি, কেননা ঠাম্মা আমাকে বলেছিলেন মা বাইরে যাবে কাজে, । এরপর আমার জীবনে নেমে এলো একের পর এক খারাপ সময়। একদিন ঠাম্মা মারা গেলেন। আমি একেবারে একা হয়ে গেলাম। যে বাড়িতে সবসময় কেউ না কেউ আমার জন্য ব্যাস্ত থাকত সেই বাড়িতে আমি আর এক কাজের লোক। বাবা সকালে অফিস চলে গেলে সেই কাজের লোক আমাকে পাহারা দিত। আমি সুযোগ পেলেই চলে ষেতাম ফুলের কাছে ,মাঝে মাঝে থেকেও যেতাম রাতে। আমার খুব মন খারাপ করত, খুব। ফুলকে বলতাম, হাসনুকে বলতাম। এর কিছুদিন পর এক সকালে আমার হিরো গব্বর শিং আমাকে নিয়ে গেল প্লেনে করে বোম্বেতে মায়ের কাছে। বাবা আমাকে জড়িয়ে কেদেছিলেন , আমারও খারাপ লেগেছিল তবুও মা কে ফিরে পাব এই আনন্দে আমি বোম্বে গিয়ে জীবনের সবথেকে বড় ধাক্কা খেলাম। মা হারিয়ে গেছেন, তার যায়গায় খুব বড়লোক একজন মহিলা অনেক গয়না গায়ে, চুল কাঁটা, শাড়ি খুব দামি মতো, আমি অবাক হয়ে গেলাম। কোলে এক পুঁচকে বাচ্চা নিয়ে “ ওজু এই দেখ এ তোমার বোন”। মা আমাকে তুমি করে বলছে? জীবনে প্রথম মা তুমি করে বলছেন। আমার ডান পাশে যে একজন লোক বসে আছে ওনাকে দেখিয়ে “ ওজু ইনি তোমার পাপা, এনাকে তুমি আজ থেকে পাপা বলে ডাকবে”। উনি ঠোঁট আধ ইঞ্চি ফাক করে হাঁসার মতো করেছিলেন। আমার বয়েস তখন ৬, তারপর আমি প্রায় ৫ বছর মায়ের সাথে ছিলাম। কিন্তু মায়ের স্বামী কোনোদিন আমাকে ভালভাবে ডেকে কথা বলেছেন বা হেসেছেন মনে পড়ে না। বিরাট বাড়ি, অনেক কাজের লোক, বড় বড় ঘর সব কিছুই বড় বড়। আমার ঘর বড় ছিল। ওই বাড়িতে আমার খাবার, থাকার, কাপড়, জামা,খেলার সরঞ্জাম কোন কিছু অভাব ছিল না। বম্বেতেও এক পণ্ডিতের কাছে গান শেখার ব্যাবস্থা করে দিয়েছিলেন মা। শুধু অভাব ছিল একটু স্নেহ ভালবাসার। একটা কথা বললে বুঝবেন। আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিলো যে মায়ের ঘরে ঢুকতে হলে বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করতে হবে “ঢুকব?” । বুঝুন স্যার এক ৬ বছরের বাচ্চা সে নিজের মায়ের ঘরে ঢুকবে পারমিশন নিয়ে। প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা বলছি, কোন কারনে আমি মায়ের ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে মাকে কিছু বলব, ওই লোক আমাকে চোখের ভাষায় বিছানায় বসতে না করে মাকে বললেন “ জোনাকি, তুমি ওকে বুঝিয়ে দাও এই ভাবে যেন না ঢোকে আর বসে। হি ইস ইওর ব্যাগেজ”। সেই প্রথম আমি শুনলাম যে আমি শ্রীমতী জোনাকি দেবীর ব্যাগেজ- বোঝা। বুঝি নি ওই আনকালচারড লোকটি ঠিক কি বলতে চাইছে। ……মিনিকে উদ্দেশ্য করে “ মিনি সরি। তোর খারাপ লাগছে। কিন্তু আমায় আজ বলতে হবে
……দাদাই ইটস ওকে……গলা জড়িয়ে।“ দাদাই তুমি বল। পাপা ওইখানে থাকলে নিজের জীবনের ঝুকি নিতেন কিনা আমার সন্দেহ আছে, তাই ইটস ওকে”……
“মাফ কর দে বেটা, মাফ কর দে। বহুত বুরা কিয়া তেরে সাথ বেটা”…… ওজুর মুখে কোন ভাব প্রকাশ পেল না।
……মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “ কি হয়েছে ওজু, তুমি এখানে কেন এসেছ?”
……… বুঝুন, কিছু না হলে ছেলে মায়ের কাছে যেতে পারেনা। কিন্তু একটি প্রাণী ওই ৪-৫ মাস বয়েস থেকে আমাকে দেখলেই ঝাপিয়ে আসতো আমার কোলে। যখন একেবারে ছোট, বসতে পারেনা তখনো দু হাত বাড়িয়ে পা ছুড়ে মুখে হাসি, আমাকে দেখলেই, এই মিনির। যখন খুশি আবদার করত গান শুনবে, গাইতে হতো আমায়। ওই বাড়িতে আমি ছিলাম ৫ বছরের মতো এই সম্পূর্ণ সময়ে মিনি আমাকে পেলে আর কারো কাছে যেত না। এক মধুর বন্ধন তৈরি হয়েছিলো দুজনের অজান্তে। মা আমাকে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন সাথে খেলার সব কিছু। আর আমার দাঁত উঁচু ছিল তাই দাঁতের ডাক্তার এর কাছে নিয়ে গিয়ে ক্লিপ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এইটি আমার পরের জীবনে বিরাট উপকার হয়েছিলো।