গুজরানওয়ালার আকাশে সেদিন সকাল থেকেই যেন অস্বাভাবিক কিছু জমে ছিল। মেঘ এমনভাবে জড়ো হচ্ছিল যে দিনদুপুরেও আলো মলিন লাগছিল। বিকেলের দিকে দোকানপাট একে একে বন্ধ হয়ে যায়, ভয়ানক বজ্রপাত আর শিস দেওয়া বাতাসে মানুষজন দ্রুত ঘরে ফিরতে বাধ্য হয়। কিন্তু রাত যত গভীর হতে থাকে, বৃষ্টি যেন প্রতিশোধের মতো নেমে আসে—অবিরাম, ভারী, চারপাশ ভাসিয়ে দেওয়া এক অদ্ভুত রাগে।
রাত তখন প্রায় দশটা। হোসেন বাড়ির ভেতর নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। এমন নিস্তব্ধতা, যেখানে ঘরের ভেতরের প্রতিটি ছোট শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়—ঘড়ির টিকটিক, জানালার কাঁচে বাতাসের ধাক্কা, কাঠের মেঝের হালকা শব্দ। দুইতলা এই বাড়িটা বছরের বেশিরভাগ সময়ই এমন শান্ত থাকে। নিচতলায় থাকে জেরিন, তার আব্বু–আম্মু আর ছোট্ট মেয়ে শাইরিন। উপরের তলাটা খালি পড়ে থাকে, কেবল অতিথি এলেই সেখানে আলো জ্বলে।
সন্ধ্যার পর থেকেই বিদ্যুৎ নেই। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ডুবে আছে। বসার ঘরে একটি মোমবাতির হলদে আলো দুলছে, দেয়ালের ছায়াগুলোকে অস্বস্তিকরভাবে নড়াচড়া করাচ্ছে। আব্বু, আম্মু আর শাইরিন অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু জেরিনই জেগে আছে। সামনে টেবিলে বসে সে শাইরিনের কলেজের খাতা উল্টে দেখছিল। মোমবাতির আলোয় পাতাগুলোতে অদ্ভুত ছায়া পড়ছে। মাঝে মাঝে সে থামে, হিসেব করে দেখে, আবার পাতা ওল্টায়। মায়ের মন—মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে ভাবনা থামে না।
হঠাৎ হাওয়ার ঝাপটায় জানালাটা একটু খুলে যায়। জেরিন মাথা তুলে বাইরে তাকায়। বৃষ্টি টুপটাপ করে পড়ছে, দূরে কোথাও বজ্রপাতের শব্দ। সে আবার খাতার দিকে মন ফেরায়। ঠিক সেই মুহূর্তে হঠাৎ এক কণ্ঠ ভেসে আসে—“ঘরে কেউ আছেন?” শব্দটা এত কাছ থেকে, এত স্পষ্টভাবে আসে যে জেরিন চমকে ওঠে। মনে হয় যেন বারান্দার ঠিক পাশ থেকেই কেউ ডেকেছে।
মোমবাতিটা হাতে নিয়ে সে ধীরে ধীরে বারান্দার দিকে এগোয়। বুকের ভেতর অজানা ধুকপুকানি—এই গভীর রাতে কে ডাকে? রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকাতেই সে দেখে গেটের পাশে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে। অচেনা, ভিজে, ক্লান্ত। দাড়ি গজানো মুখ, ভেজা চাদর কাঁধে ঝুলছে, চোখ নামানো। বৃষ্টির ফোঁটা তার শরীরে পড়ছে টুপটাপ শব্দ তুলে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট মেয়ে। ঠাণ্ডায় কাঁপছে সে, ভেজা জামাকাপড় শরীরে লেপ্টে আছে, দু’হাতে লোকটার পোশাক শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে।
লোকটি আবার ডাকে, “কেউ আছেন ভেতরে?” জেরিনের কয়েক সেকেন্ড শ্বাস আটকে থাকে। এই রাতের বেলা, অচেনা একজন মানুষ, সঙ্গে একটা বাচ্চা—সব মিলিয়ে তার ভেতরে ভয় আর দ্বিধা একসঙ্গে জেগে ওঠে। প্রথমেই তার মনে পড়ে আম্মুর কথা। অচেনা লোক দেখলেই যিনি কত প্রশ্ন করেন, কত সন্দেহ। আজ যদি জানেন, জেরিন বৃষ্টির রাতে কাউকে ঘরে ঢুকিয়েছে, তাহলে সংসারে অশান্তি নিশ্চিত।
এক মুহূর্তের জন্য সে ভাবে, উত্তর না দিলেই হয়। চুপচাপ ভেতরে ফিরে গেলে হয়তো লোকটা চলে যাবে। কিন্তু চোখের সামনে ভেসে ওঠে মেয়েটার কাঁপতে থাকা শরীর, যেভাবে সে লোকটার কাপড় আঁকড়ে ধরে আছে। মেয়েটা তো শাইরিনের বয়সী। যদি তার নিজের মেয়েটা এমন বৃষ্টির রাতে রাস্তায় থাকত? সেই ভাবনাটা বুকের ভেতর তীব্রভাবে বিঁধে যায়। অপরাধবোধে জেরিনের মন কেঁপে ওঠে। বিপদে পড়া মানুষকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়া কি ঠিক? কয়েক সেকেন্ড দ্বিধায় দাঁড়িয়ে থেকে সে সিদ্ধান্ত নেয়—কিছুক্ষণ আশ্রয় দিলে ক্ষতি নেই। বৃষ্টি থামলেই তারা চলে যাবে। হালকা শ্বাস ফেলে সে মোমবাতি নিয়ে মেইন দরজার দিকে এগোয়। দরজা অল্প করে খুলতেই আলো গেটের দিকে পড়ে। যুবকটির মুখ আরও স্পষ্ট হয়—ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, চোখে এক ধরনের শূন্যতা। সে হাত তুলে সালাম দেয়। কণ্ঠে কাঁপুনি, “ভাবি, একটু আশ্রয় দেবেন? বৃষ্টি থামলেই আমরা চলে যাব।”
জেরিন লক্ষ্য করে, কথা বলতে লোকটার যেন কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা তখনও তাকে শক্ত করে ধরে আছে। জেরিন নরম গলায় বলে ওঠে, “ভেতরে আসুন।” লোকটি প্রথমে আপত্তি করে বলে, মেয়েটা ঢুকুক, সে বাইরে থাকবে। কিন্তু মেয়েটা তাকে ছাড়ে না। তখন জেরিন বুঝতে পারে, শুধু বাচ্চাকে ভেতরে নেওয়াটা অস্বাভাবিক দেখাবে। সে দৃঢ়ভাবে বলে, “দুজনেই আসুন।”
তারা ধীরে ধীরে ভেতরে ঢোকে। ভেজা কাপড় থেকে মেঝেতে পানি পড়তে থাকে। জেরিন তাদের একপাশে দাঁড়াতে বলে, যেন ঘর নোংরা না হয়। তারপর তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে গামছা আনে, আর শাইরিনের একটা পুরোনো জামা বের করে মেয়েটার জন্য। যুবকটির জন্য কিছু আনতে গিয়ে সে থেমে যায়। হাতে পড়ে শুধু নিজের ব্যবহৃত গামছা। এক মুহূর্ত দ্বিধা—অচেনা একজন পরপুরুষকে নিজের ব্যবহার করা গামছা দেওয়া কি ঠিক? বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি, ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকা ভিজে মেয়েটা আর ক্লান্ত লোকটা, আর মাঝখানে সে নিজে—লাজ, ভয়, দায়িত্ববোধ আর দয়ার টানাপোড়েনে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী।
ঠিক তখনই জেরিন টের পায়—লোকটার চোখে হঠাৎ এক ঝলক অদ্ভুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। কিন্তু মোমবাতির আলো কেঁপে ওঠায় সে নিজেকেই বোঝায়, হয়তো আলোতেই ভুল দেখেছে। সে গামছাটা হাতে নিয়ে ফিরে আসে, আর নিঃশব্দ বাড়ির ভেতরে অজান্তেই ঢুকে পড়ে এক অচেনা উপস্থিতি।
ভেজা মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা দু’জন মানুষকে পাশের দিকে বসিয়ে জেরিন যখন দরজাটা আবার ভেজিয়ে নেয়, তখনই সে টের পায়—ঘরের ভেতরের নীরবতা বদলে গেছে। যেন মোমবাতির আলোটাও আগের মতো শান্ত নেই, শিখাটা একটু বেশিই কাঁপছে। সে মেয়েটার গায়ে শাইরিনের পুরোনো জামাটা জড়িয়ে দেয়, আর গামছাটা এগিয়ে দেয় লোকটার দিকে। যুবকটি গামছা নিতে গিয়ে এক মুহূর্ত থেমে যায়, তারপর মাথা নিচু করে নেয়। সেই সামান্য নড়াচড়ায় জেরিনের চোখে পড়ে তার কাঁধের শক্ত রেখা, ভেজা কাপড়ের নিচে জমে থাকা ক্লান্তি, আর চোখের কোণে চাপা এক অচেনা স্থিরতা। অজান্তেই জেরিন নিজের চোখ সরিয়ে নেয়, বুকের ভেতর হালকা অস্বস্তি জাগে—এমন অনুভূতি সে নিজের কাছে স্বীকার করতেও চায় না।
মেয়েটা তখনও লোকটার খুব কাছে বসে আছে। সে ছোট্ট কণ্ঠে কিছু একটা বলে, জেরিন ঠিক শুনতে পায় না, কিন্তু লোকটার মুখে সেই মুহূর্তে যে কোমলতা ফুটে ওঠে, তা জেরিনের নজর এড়ায় না। সেই দৃশ্যটা তাকে অস্বস্তিতে ফেলে। অচেনা একজন মানুষ, অথচ মেয়েটার কাছে তার উপস্থিতি যেন আশ্রয়ের মতো। জেরিন নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করে—এটা শুধু বিপদের মুহূর্তের নির্ভরতা। তবু কোথাও একটা প্রশ্ন মাথা তুলতে চায়, যেটাকে সে শক্ত করে চেপে রাখে। সে ভাবে, উপরের তলায় তাদের উঠিয়ে দেবে। সেখানে খালি ঘর আছে, দরজাটা বন্ধ থাকলে আম্মুর ঘুম ভাঙার সম্ভাবনাও কম। এই সিদ্ধান্তটা যুক্তির বলে নেয়া, কিন্তু কেন যেন বুকের ভেতর হালকা টান লাগে। মোমবাতি হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে সে অনুভব করে, লোকটার দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্য তার পিঠে এসে থামে। কোনো শব্দ নেই, কোনো স্পর্শ নেই—তবু সেই নীরব উপস্থিতি তাকে সচেতন করে তোলে নিজের শরীর, নিজের চলাফেরা নিয়ে। সে নিজের ওপরই বিরক্ত হয়। এমন ভাবনা কেন আসছে?
উপরের তলায় ঘর খুলে দেয়ার সময় জেরিন দ্রুত কথা বলে, প্রয়োজনের বেশি কিছু না। লোকটা মাথা নেড়ে কৃতজ্ঞতা জানায়, “ভাবি, বেশি ঝামেলা দিলাম।” তার কণ্ঠে ক্লান্তি, কিন্তু কোথাও এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত দৃঢ়তা। জেরিন শুধু বলে, বৃষ্টি থামলে যেন জানায়। কথাগুলো বলার সময় সে চোখ তোলে না। নিজের চোখের দিকে তাকাতে ভয় লাগে—কেন লাগে, সে নিজেই জানে না।
নিচে নেমে এসে দরজা বন্ধ করতেই জেরিন দেয়ালে হেলান দেয়। বুকের ভেতর হালকা চাপ। এটা ভয় নয়, করুণা নয়—এই অনুভূতির নাম খুঁজে পায় না সে। স্বামী বিদেশে, সংসারের সব দায়িত্ব তার কাঁধে, প্রতিদিনের একঘেয়েমি আর নীরবতার ভেতর হঠাৎ এই অচেনা উপস্থিতি যেন ভেতরের কোথাও একটা সুপ্ত দরজায় হালকা টোকা দিয়েছে। সে নিজেকে শক্ত করে বোঝায়—এটা শুধু পরিস্থিতির প্রভাব। ভোর হলে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
কিন্তু রাতে শুয়ে পড়ার পরও তার ঘুম আসে না। বৃষ্টির শব্দের ফাঁকে ফাঁকে উপরের তলার মৃদু নড়াচড়ার আভাস পায় সে। নিজের অজান্তেই সে ভাবে—ওরা ঠিক আছে তো? পরক্ষণেই নিজের ওপর রাগ হয়। কেন এত ভাবনা? চোখ বন্ধ করলেও সেই অচেনা চোখের তীক্ষ্ণ ঝলকটা মনে পড়ে যায়। জেরিন পাশ ফিরে শোয়, মনে মনে প্রার্থনা করে—এই রাতটা যেন দ্রুত শেষ হয়। সে জানে না, এই নিঃশব্দ বাড়ির ভেতরে আজই এক নিষিদ্ধ দ্বন্দ্বের বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গেছে, যাকে আর পুরোপুরি উপেক্ষা করা সহজ হবে না।
ক্রমশঃ প্রকাশ্য....