Thread Rating:
  • 36 Vote(s) - 2.97 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Misc. Erotica তার ছিঁড়ে গেছে কবে
(08-05-2025, 03:46 PM)Mohomoy Wrote: যারা সমালোচনা নিতে অক্ষম তারা সবদিক থেকেই অক্ষম।

কথাটা ভালো লাগলো। তবে এখন সমালোচনা অধিকাংশ লোকেই পছন্দ করে না,শক্ত হাতে সামাল দেবে এই আশাও রাখা যায় না।
তবে মনে হয় কাদের ভাই আর মাগিখোর দাদা বেশ চালাচ্ছেন। Big Grin
যাই হোক,সমস্যা শুধু এখানে নয়, সব জায়গায় একই সমস্যা।

INKITT:– ☛inkitt☚   / ছোট গল্প:–গল্পের খাতা 

[Image: IMG-20241001-072115.jpg]

[+] 2 users Like বহুরূপী's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
(08-05-2025, 07:15 PM)বহুরূপী Wrote: কথাটা ভালো লাগলো। তবে এখন সমালোচনা অধিকাংশ লোকেই পছন্দ করে না,শক্ত হাতে সামাল দেবে এই আশাও রাখা যায় না।
তবে মনে হয় কাদের ভাই আর মাগিখোর দাদা বেশ চালাচ্ছেন। Big Grin
যাই হোক,সমস্যা শুধু এখানে নয়, সব জায়গায় একই সমস্যা।

বিদগ্ধ পাঠকের মন্তব্যে, নিজের নাম দেখতে পেলে; গর্বে, ২৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ৫৬ ইঞ্চি হয়ে যায়। আমারও তাই। 

তবে, একটা কথা; সমালোচনা, মানে সম্যক রুপে আলোচনা; সেটা এখানে কমই হয়। এখানে মন্তব্য মানেই, পরবর্তী পর্বের জন্য তাড়া দেওয়া। গল্পের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা, কমই পাওয়া যায়।

Tongue





গঠনমূলক মন্তব্য আমার অনুপ্রেরণা।

[+] 1 user Likes মাগিখোর's post
Like Reply
(08-05-2025, 07:15 PM)বহুরূপী Wrote: কথাটা ভালো লাগলো। তবে এখন সমালোচনা অধিকাংশ লোকেই পছন্দ করে না,শক্ত হাতে সামাল দেবে এই আশাও রাখা যায় না।
তবে মনে হয় কাদের ভাই আর মাগিখোর দাদা বেশ চালাচ্ছেন। Big Grin
যাই হোক,সমস্যা শুধু এখানে নয়, সব জায়গায় একই সমস্যা।

ধন্যবাদ বহুরুপী দাদা। অল্প কথায় সাবলীল মন্তব্য করার জন্যে।
[+] 1 user Likes Mohomoy's post
Like Reply
(৩৮)


এ বছর শান্তিনিকেতনের বসন্ত উৎসব একেবারে জলে গেছে। কলকাতা থেকে আসা বড়লোক বাবু-বিবি এবং তাদের নেকা ও বখাটে মেয়েবাজ ছেলেদের নানা হইচই, গোলমাল মদ খাওয়া নিয়ে মারামারি, মেয়েদের হাত ধরে টানাটানি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি— গত কয়েক বছরে বহু গুণ বেড়েছে। তাতে উৎসবের নিজস্বতা হারিয়েছে পুরোপুরি। এ বার সে সব সীমাও ছাড়িয়ে যাওয়ায় একাধিক অনুষ্ঠান পন্ড করতে হয়েছে, বেশ কিছু অনুষ্ঠান নানা ভবনের নিজস্ব ঘরে হয়েছে। তাই পৌষমেলা নিয়ে আগে থেকে সতর্ক সবাই। ঈশিতার উপরে বড় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। মেলাপ্রাঙ্গনে একটা বড় জায়গা চাঁদোয়া দিয়ে ঢেকে মঞ্চ বেঁধে সেখানে কিছু নাচ-গান ইত্যাদির অনুষ্ঠান করা হবে বলে ঠিক হয়েছে, সেটা ওকেই পরিচালনা করতে হবে। আলতু-ফালতু লোক যেন ঢুকতে না পারে, সেদিকে যতটা সম্ভব নজর রাখা হবে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টা নিয়ে স্থানীয় থানা, এমএলএ সবার সঙ্গেই কথা বলেছেন।

ঈশিতার বয়স মেঘে মেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে। গুঞ্জার মেয়ের বয়সই হতে চলল সাত। এইবার গুঞ্জা পড়ল ছোড়দির বিয়ে নিয়ে। ও একজনের খোঁজ আনল। তিনি পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। তা ছাড়া অন্যান্য নানা ব্যবসাও আছে। বিপুল টাকার মালিক। একাধিক কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিপুল টাকা দেওয়া এবং কেন্দ্রের শাসক দলকে বিপুল টাকা দিয়ে এখন উচ্চশিক্ষায় একজন কর্তাও বটে। বাঙালি না হলেও বহু বছর বাংলায় থেকে অনেকের চেয়ে ভাল বাংলা বলেন। তাঁকেই মন ধরল গুঞ্জার। এমনিই ১৭ বছর কেটে গেছে, আট বছর আগে বিয়ের বেশ কয়েক মাস পরে শেষবার সৌমাভর চিঠি পেয়েছিল ও। ফলে সে যে আর ফিরবে না, ও বুঝে গেছে। তাই দিদির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অবশ্য ওর একটা বড় স্বার্থও আছে। এই লোকটিকে ধরলে ডিপার্টমেন্টে নিজের অবস্থান পাকা করতে ওর সুবিধা হবে। চাইকি কয়েক বছর পরে হেডডিপ পদটাও পেয়ে যাতে পারে। সব দিক ভেবে বহু বছর ধরে ঈশিতাকে ঘৃণা করা গুঞ্জা এ বারে ওর বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ল! ঈশিতা প্রথমে ভাগিয়ে দিলেও পরে গুঞ্জার কথা নিমরাজি হয়ে মেনে নিল। তা ছাড়া ওরও মেঘেমেঘে ৩৬ পেরিয়ে গেছে ক’দিন আগে। ও জানাল, পুজোর পরে এ নিয়ে কথা হবে। এমনিই তখন গানের ক্লাস কয়েক দিন বন্ধ থাকবে, ফলে তখন কথা বলে দেখা যাবে।

ভাইফোঁটার পরের দিন সেই লোকটিকে নিয়ে ঈশিতার বাড়িতে এল গুঞ্জা ও তার বর। সঙ্গে ওর মেয়ে এবং ওদের সর্বক্ষণের কাজের বউটি। লোকটির বয়স প্রায় ৪০। নাম শুভম। দেখতে শুনতে মন্দ না। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন ক্যান্সারে। সন্তানাদি নেই। লোকটির শুধু একটিই বদঅভ্যাস, গুটখা আর পানমশলার নেশা প্রচন্ড। ছেলের নেশার বহর দেখে ঈশিতার কানেকানে গুঞ্জা বলল, ‘‘বিয়ের পরে তুই ছাড়িয়ে দিস এ সব নেশা। এগুলো ভাল না রে।’’ শুভম জানাল, গড়িয়ায় নিজেদের বাড়ি ছেড়ে উত্তর কলকাতায় একটা একটা বড় বাড়ি খুঁজছে, সেখানেই বিয়ের পরে ঈশিতাকে নিয়ে উঠবে। ঈশিতা চাইলে যাদবপুরে ইউনিভার্সিটিতে যোগ দিতে পারে। ও ব্যবস্থা করে দেবে। বড়দি এবং মেজদিও এসেছিলেন দু’জনের স্বামী-সন্তান নিয়ে। গুঞ্জার আগ্রহ দেখে কেউই কিছু বললেন না, মুখে বললেন, ভালই। ঈশিতা কিছুই বলল না। শুভমকে ভাল করে লক্ষ্যও করল না। ওর যেন কেমন লাগছে এই পুরো ব্যাপারটা। ও কড়া ভাবেই জানিয়ে দিল, পৌষমেলা অবধি ও কিছু করতে পারবে না, বিয়ে তো নয়ই। তার পরে গুঞ্জার বিস্তর অনুরোধ-আব্দারে ঠিক হল, নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা কথা হবে। সব ঠিক থাকলে অঘ্রানের শেষ দিকে আঙটি বদলটা করে নেবে দু’জনে। জানুয়ারিতে বিশ্বভারতীর চাকরি ছেড়ে কলকাতায় মেজদির কাছে চলে যাবে ঈশিতা। এই বাড়িটা গুঞ্জাকে দিয়ে দেবে।

নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে পাকা দেখা হল। গুঞ্জাই কর্ত্রী হয়ে বিরাজ করল। ডিসেম্বরে আঙটি বদলও হল গুঞ্জা এবং ওর বরের উপস্থিতিতেই। কারণ দুই দিদি বা তাঁদের পরিবারের কেউ আসতে পারলেন না নানা কারণে। তবে এ সবে একদমই মন ছিল না ঈশিতার। ওর মন পড়ে অনুষ্ঠানের দিকে। ও ঠিক করে নিয়েছে, শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে এমন অনুষ্ঠান করবে, যার সুখ্যাতি বহু দিন ধরে করতে বাধ্য হবে সবাই।

পৌষমেলা শুরুর ঠিক তিনদিন আগে ‘মুকুট্টি’ বলে একটা ছোট গ্রুপের চিঠি এল ঈশিতার ডেস্কে। তারা অনুষ্ঠান করতে চায় বলে অনেক অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের দাবি, এমন অনুষ্ঠান করবে, লোকে চমকে যাবে। কথা দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের গানের বাইরে কিছু করবে না, বড়জোড় একটা কি দুটো কবিতা বলতে পারে। তাও বাংলা কবিতা। তবে সেটা রবীন্দ্রনাথের নাও হতে পারে। সবই চিঠিতে লেখা। ও কী করবে, সেটা নিয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। এমনিই অনেক নামকরা লোক আসবেন, তার মধ্যে গ্রুপটার নাম কেমন যেন, তামিল ঘেঁষা! কী করবে ভেবে কূল পেল না। এমনিই নিয়মের কড়াকড়ি দেখে বেশ কয়েকটা কলকাতার দল জানিয়ে দিয়েছে, তারা ওই মঞ্চে অনুষ্ঠান করবে না। ফলে সময় ভরাটের জন্য এদের নেবে কি না, নিলে মুখ পুড়বে কি না, এ সব নিয়ে চিন্তায় ওর মাথা পাগল দশা তখন। তার মধ্যেই মোবাইলে ফোন করে গুঞ্জা জানাল, শুভম এই ক’দিন থাকবে বলে এসেছে। তবে  ডিসেম্বরের শেষ দিকে কলকাতায় যাবে, আবার ঈশিতা রেজিগনেশন দিলে শান্তিনিকেতনে একেবারে গাড়ি নিয়ে এসে মালপত্র সব তুলে ওকে মেজদির বাড়ি পৌঁছে দেবে। জানুয়ারির মাঝামাঝি কোনও একটা শুভ দিন দেখে রেজিস্ট্রি হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ে কেউই করতে রাজি নয় এই বয়সে। সেদিন তাড়াতাড়ি ক্লাস শেষ হওয়ায় বেড়িয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রিক্সায় উঠতে যাবে, হঠাৎ দুটো ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এসে ওকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বসল। দেখে মনে হল বছর কুড়ি-বাইশ হবে দু’জনের বয়স। ও কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘‘আপনারা কারা? কী ব্যাপার? আমি চিনতে পারছি না।’’ জিনস-পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি বলল, ‘‘ম্যাম, আমরাই মুকুট্টি থেকে চিঠি দিয়েছিলাম। প্যাডে আমাদের দু’জনেরই মোবাইল নম্বর আছে। যদি দেখেন, কথা দিতে পারি, ডোবাব না।’’ ঈশিতা ওদের মুখে স্পষ্ট বাংলা এবং অত্যন্ত মার্জিত ব্যবহারে খুশি হল। বলল, ‘‘কাল সকালে ফোনে জানিয়ে দেব। দেখি, আপনারা কেমন পারফর্ম করেন।’’ বলে রিক্সায় উঠে কিছু দূর যেতেই দেখল শুভম রাস্তায় দাঁড়িয়ে। ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। দু’জনে মিলে একটা চায়ের দোকানে বসে কিছুক্ষণ কথা বলে শুভম নিজের হোটেলে চলে গেল। ওখানেই ওর তিন বন্ধুও এসে উঠেছে।

এমনিই পৌষমেলা উপলক্ষে শান্তিনিকেতন জুড়ে যেন ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই’ দশা। সঙ্গে গাড়ি-বাইকের উৎপাত। একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে প্রায় গাড়ি চাপা পড়ছিল ঈশিতা। ভাগ্যিস এক বয়স্ক ভদ্রলোক ওর হাত ধরে টেনে সময় মতো সরিয়ে নিয়েছিলেন, না হলে আজ ওখানেই গাড়ি চাপা পড়ত ছাত্রছাত্রীদের প্রিয় ‘আইআরসি’ ম্যাডাম। সম্বিত ফিরে পেয়ে কী হত ভেবে কেঁপে উঠল ঈশিতা। ওই বয়স্ক ভদ্রলোকই ওকে হাত ধরে একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে দিলেন। সেখানে চেয়ে এক বোতল জলও এনে দিলেন। জল খেয়ে একটু সুস্থ বোধ করল ঈশিতা। এর মধ্যে ওর কয়েক জন সহকর্মী খবরটা পেয়ে দৌড়ে এসে বিষয়টা বুঝে ওকে তড়িঘড়ি রিক্সা করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। রাতে গুঞ্জা এসে এ নিয়ে বকাবকি করার পাশাপাশি একটু মশকরাও করে নিল। ঈশিতা কিছুই বলল না।
Like Reply
(৩৯)


মোহ-মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না




অনুষ্ঠানের দিন দুপুর গড়াতেই বিপত্তি। মেঘ জমল আকাশে। ঘন মেঘ। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। তবে স্টেজে তো সমস্যা হবেই না, দর্শকদেরও তত সমস্যা হবে না। বড় করে ত্রিপল টাঙ্গানো থাকায় বহু লোক একসঙ্গে অনুষ্ঠান দেখতে পারবেন বলে আগেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পৌষের বৃষ্টিতে ভেজার ভয়ে ততক্ষণে বহু লোক জড়ো হয়েছে ত্রিপলের নীচে। বেশির ভাগই কলকাত্তাইয়া ছেলেমেয়ে। এছাড়া আরও বহু লোক, যাঁরা প্রায় প্রতি বছরই আসেন। ঈশিতার পরিচিত বেশ কয়েক জন প্রাক্তনীও এসেছে। তবে তারা অনুষ্ঠান করবে না, নতুন কনসেপ্ট কেমন হয় দেখবে শুধু। এদিকে বিকেল পাঁচটার মধ্যে স্টেজ ছেড়ে দিতে হবে, সন্ধ্যায় ওখানে অন্য অনুষ্ঠান আছে। ঈশিতা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। মনে হচ্ছে মানসম্মান ডুববে এ বার। কী করা যায় ভাবতে ভাবতেই নামল অঝোর বৃষ্টি। সূর্য ডোবার আগেই যেন অকাল সন্ধ্যা! ও কোনও উপায় না দেখে ‘মুকুট্টি’র ছেলেটিকে ফোন করে একটু অসহিষ্ণু গলায় বলল, ‘‘তোমরা ঘন্টাখানেক সময় পাবে এখন থেকে। পারবে?’’ ছেলেটি খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নরম গলায় বলল, ‘‘পাঁচ মিনিটে পিছন দিক থেকে স্টেজে উঠব, আপনি ঘোষণা করে দিন ম্যাডাম।’’ ঈশিতা নিজের মতো করে মাইক হাতে জানিয়ে দিল, ‘মুকুট্টি’ নামের একটি গ্রুপ এবার পারফর্ম করবে। নতুন গ্রুপ, আশা করি আপনাদের ভাল লাগবে। একটু ওদের উৎসাহ দেবেন।’’ ও এর মধ্যে ভিতরে ঢুকে নিজে পরীক্ষা করে দেখে নিয়েছে, মাইক এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থা করা আছে ঠিকঠাক মতো। ওর ঘোষণা শুনে উপস্থিত দর্শকদের অনেকেই হাততালি দিল। কয়েকজন সিটিও মেরে দিল! প্রচন্ড বিরক্ত হলেও ঈশিতা কিছু বলল না। দেখল, ত্রিপলের নিচটা লোকে ঠাসাঠাসি। বেশির ভাগই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ঢুকে পড়েছে, বুঝতে পারল। প্রায় সবাই দাঁড়িয়ে শুধু চেনাজানা, প্রাক্তনী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকা-সহ বিশিষ্টদের জন্য সামনের চেয়ারগুলোর চারপাশে ভিড়টা একটু কম। চেয়ারে অন্যদের মধ্যেই আলো করে বসে গুঞ্জা, ওর বর, মেয়ে এমনকি শুভমও!

এর মধ্যেই মোবাইলে ফোন করে মুকুট্টির ছেলেটি বলল, ‘‘স্টেজের আলো নিভিয়ে দিন, তবে ড্রপটা তুলতে বলবেন না এখনই। একটু পরে আমি মেসেজ দিলে তুলতে বলবেন ধীরে ধীরে।’’ ও সেই রকমই নির্দেশ পাঠিয়ে দিল। স্টেজের আলো নিভে গেল। একটা সুরেলা মেয়ের গলা ভেসে এল, ‘‘নমস্কার, পৌষমেলায় সবাইকে স্বাগত। ভেবেছিলাম ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে বলে’ গানটা দিয়ে শুরু করব, কিন্তু এমন বৃষ্টিতে সেই আমেজটাই আসবে না কারও মধ্যে। তার বদলে রবীন্দ্রনাথেরই অন্য একটা গান করি, কেমন?’’ বলে খালি গলাতেই গোটা মঞ্চ, গোটা মাঠ যেন আর একবার বৃষ্টিতে ভিজিয়ে মার্জিত এবং সুরেলা গলায় গেয়ে উঠল,

‘‘দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার--
জগতে কেহ যেন নাহি আর॥
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব--
আঁধারে মিশে গেছে আর সব॥

তাহাতে এ জগতে ক্ষতি কার
নামাতে পারি যদি মনোভার।
শ্রাবণবরিষনে একদা গৃহকোণে
দু’কথা বলি যদি কাছে তার
তাহাতে আসে যাবে কিবা কার।’’

এতক্ষণের সব গুঞ্জন, কোলাহল থেমে গেল। মেয়েটির গলায় যেন জাদু আছে! নিখুঁত সুর, উচ্চারণ। শুধু কয়েক সেকেন্ডের একটা বিরতি দিয়ে আবার আগের মতোই একই ভঙ্গিতে গেয়ে উঠল, তবে এবার গানের শুরুটায় ফিরে গেল—

‘‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়।
এমন দিনে মন খোলা যায়--
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরোঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়॥
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারি ধার।’’


মেলার মাঠের গুঞ্জন, বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ত্রিপলের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া লোকেদের ফিসফাস, সব থেমে তখন চারদিকে এক আশ্চর্য মুগ্ধতা। ঈশিতা নিজেও যেন কেমন হয়ে গেছে। ওর কেমন যেন লাগছে। এর মধ্যেই মোবাইলে একটা মেসেজ দেখে ঈশিতার ইশারায় আস্তে আস্তে উঠতে শুরু করে দিয়েছে ড্রপ। পর্দা পুরো উঠে গেলে মঞ্চের জোরালো আলোয় দেখা গেল, লালপাড় সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়ে মাইক হাতে দাঁড়িয়ে গাইছে আর তার পাশে একটি ছেলে পিছন ফিরে বসে পাশাপাপাশি দুটো বিরাট ক্যানভ্যাসে কী যেন আঁকছে। হাত চলছে যেন মেশিনের মতো!

মেয়েটির গান শেষ হওয়ার একটু আগেই ছেলেটি ওই অবস্থায় একটা ক্যানভাস একা একাই তুলে দর্শকদের দিকে ঘুরিয়ে দিল। সবাই অবাক হয়ে দেখল ক্যানভাস জুড়ে বিরাট একটা জলছবি। তুলির টানে স্পষ্ট সে ছবির বিষয়বস্তু — আকাশে ঘন মেঘ, বৃষ্টিতে প্রায় সাদা চারদিক, প্রচুর বড়ছোট গাছপালা আর সে সবের মধ্যে একটা নারী অবয়ব যেন বৃ্ষ্টিতে ভিজছে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে মেয়েটির গান শেষ। সে মাইকটা বাড়িয়ে দিল ছেলেটির দিকে। ছেলেটি তার হাতের তুলিটি বাড়িয়ে দিল মেয়েটির দিকে। তার পরে হাতের ইশারায় স্টেজের আলো কমিয়ে দিতে বলল। ততক্ষণে মেয়েটি অন্য ক্যানভাসটিতে একটু টাচ দিয়ে সেটাকে ঘুরিয়ে আগের ক্যানভাসটির পাশে দাঁড় করিয়ে দিল। সেখানে বৃষ্টির ধারার মধ্যে একটা লোকের অবয়ব শুধু, যেন হেঁটে আসছে। এই বারে পাশাপাশি দুটো ক্যানভাস দেখে বোঝা যাচ্ছে, একটা লোক অসীম শূন্যতার দিকে আসতে আসতে যেন দাঁড়িয়ে পড়েছে। তার থেকে একটু দূরে গাছপালার মধ্যে সেই মেয়েটি একটি গাছের নীচে বৃষ্টিতে ভিজছে।

এ কেমন ছবি? ভাবতে ভাবতেই আলো অনেকটা কমে গেল স্টেজে। কোনও রকম আনুষ্ঠানিকতার পরোয়া না করে মায়াবী এবং ভরাট গলায় ছেলেটির ভরাট গলা থেকে বেরিয়ে এল—  

‘‘বৃষ্টি নামলো যখন আমি উঠোন-পানে একা
দৌড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম তোমার পাবো দেখা
হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে
আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছো আকাশ-ছেঁচা জলে
কিন্তু তুমি নেই বাহিরে- অন্তরে মেঘ করে
ভারি ব্যাপক বৃষ্টি আমার বুকের মধ্যে ঝরে!’’

তার পরে ওই রকম নরম গলাতেই বলল, ‘‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার প্রথম অংশটুকু এমনিই আর বললাম না, আপনারা সবাই জানেন নিশ্চয়ই।’’ বলে নমস্কার করল সামনের দিকে তাকিয়ে। তার পর মেয়েটির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাতে নিজের মাইকটা ধরিয়ে আর একটা হ্যান্ডমাইক টেনে নিল স্ট্যান্ড থেকে

সবাই মন্ত্রমুগ্ধ। ঈশিতার ভিতরে একটা যেন তোলপাড় হচ্ছে। বাকিরা সবাই হাততালি দিতেও যেন ভুলে গেছে। সে সবের পরোয়া না করে এবার ছেলেটি এবং মেয়েটি একসঙ্গে মাইক হাতে নিল। ছেলেটি একই রকম ভরাট গলায় বলল, ‘‘রবীন্দ্রনাথের একাধিক গানের দুটো করে ভার্সান আছে। কোনওটা ছোট, কোনওটি আবার একটু বড়। সেগুলির স্বরলিপিও সেই রকম ভাবেই করা। সেই রকমই একটা গান এ বারে গাইব।’’ বলে খালি গলাতেই দু’জনে গেয়ে উঠল এবং সেটাও মাঝখান থেকে,

‘‘ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে,
ওহে হারাই হারাই সদা হয় ভয়
হারাই হারাই সদা হয় ভয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে

আশ না মিটিতে হারাইয়া
পলক না পড়িতে হারাইয়া,
হৃদয় না জুড়াতে হারাইয়া,
ফেলি চকিতে।

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই,
চিরদিন কেন পাই না,
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাই না।।’’

দু’জনেরই ভরাট, উদাত্ত এবং অসম্ভব সুরেলা গলা, স্পষ্ট উচ্চারণ আর সেই সঙ্গে পরিমিত আবেগ। হাজারখানেক লোকের শ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না তখন। সবাই যেন মন্ত্রমুগ্ধ। তার মধ্যেই গানের ফাঁকে হাতের ইশারায় স্টেজের ড্রপ ফেলে দিতে বলল ছেলেটি। ঈশিতা উঁকি মেরে শুধু দেখতে পেল, শেষ প্যারাটা গেয়ে হাতের মাইক দুটো নামিয়ে সবাইকে নমস্কার করে ক্যানভাস দুটো বগলে তুলে হাতে হাত ধরে স্টেজ থেকে নেমে গেল ছেলেমেয়ে দুটি। নিজেদের নাম, নিজেদের গ্রুপের নাম— কোনওটা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করল না। এক ঘন্টাও হয়নি, তাতেই কয়েক মিনিটের গান, কবিতা, ছবিতে আবিষ্ট করে ফেলল হাজার খানেক লোককে। কয়েক বছর আগে এই শান্তিনিকেতনের সবার প্রিয় বিক্রম সিং মারা গেছে অতি অল্প বয়সে। তার কথা, তার গায়কী এখনও রবীন্দ্র সঙ্গীতপ্রেমীদের মুখে মুখে ফেরে। বিক্রমের গলায় এই গানটা একটা অন্য মাত্রা পেয়েছে, সেটা সবাই এককথায় মেনে নেয়। এই দুই ছেলেমেয়ের গলায় যেন বিক্রম সিং আবার জীবিত হয়ে ফিরে এল পৌষমেলার মাঠে, ওই গানটার মধ্যে দিয়ে। ওইটুকু শুনেই অনেকের চোখে জল এসে গেল। সম্বিত ফিরতেই হাততালিতে যেন ফেটে পড়ল চারদিক। সামনের সারিতে বসে থাকা প্রাক্তনী, ইউনিভার্সিটির অনেক সিনিয়র স্যার-ম্যাডাম, এমনকি ভিআইপিরা পর্যন্ত প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন ঈশিতাকে। যে ‘মুকুট্টি’কে সুযোগ দেবে কি না, সেটা নিয়েই দু’দিন আগে পর্যন্ত ধন্দে ছিল ঈশিতা, তারাই আজ ওকে শুধু উদ্ধার করল না, বহু বহু বছর পরে শান্তিনিকেতনে একটা অন্য আবেশ এনে দিল। ও প্রায় কেঁদে ফেলল সবার প্রশংসায়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো গুঞ্জা এসে ওকে জড়িয়ে ধরল।

সফল অনুষ্ঠানের আনন্দে ঈশিতা তখন আত্মহারা। গুঞ্জা, তার বর এমনকি শুভমকেও নিয়ে গেল একটা দোকানে। সেখানে কফি আর পকোড়া খেতে খেতে গুঞ্জাকে গল্পটা বলল। গুঞ্জা বলল, ‘‘ভাগ্যিস ওরা যেচে নিজেরা এসে এটা করল। না হলে আজ তোর দুঃখ ছিল। এবার এটাকে ভাঙিয়ে ওরা অনেক জায়গায় ডাক পাবে, দেখিস।’’ ঈশিতা কিছু বলল না। শুভম বলল, ও আগে কখনও আসেনি পৌষমেলায়, এমনকি শান্তিনিকেতনেও। খুব ভাল লেগেছে ওর। পরের বার ঈশিতাকে নিয়ে আবার আসবে এই রকম অনুষ্ঠান দেখতে। তার পরেই ঈশিতার কানে কানে বলল, ‘‘আপনাকে নিয়ে শান্তিনিকেতন ছাড়ার আগে একটা সারপ্রাইজ দেব’’, বলে একটু হেসে ওর বন্ধুদের নিয়ে অন্য দিকে ঘোরাতে চলে গেল। ঈশিতা-গুঞ্জা মিলে খুশি মনে মেলায় অনেক রাত অবধি ঘুরে বাড়ির পথ ধরল। বাড়ি ফেরার পথে দেখল একটা মারামারি হচ্ছে। জনাতিনেক ছেলে মাতাল অবস্থায় একটা মেয়ের হাত ধরে টানছে। এই সব পার্বনে শান্তিনিকেতনে যেন এসব নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে গেছে, বিরক্তিকর। একটা বাইক পাশে পড়ে আছে। দেখেই বিরক্ত লাগল ওদের। হঠাৎ চোখে পড়ল, মেয়েটাকে বাঁচাতে একটা ছেলে শুধু আপ্রাণ লড়ছে নয়, দুটোকে মেরে শুইয়েও দিয়েছে ততক্ষণে। তিন নম্বরটাকে কলার ধরে অন্ধের মতো মেরে চলেছে। দেখেই মাথায় রাগ উঠে গেল ওদের। দৌড়ে গিয়ে ছেলেটার কলার ধরে ধমক দিতে গিয়ে দেখল, আরে ‘মুকুট্টি’ গ্রুপের সেই দুটো ছেলেমেয়ে না? যা শুনল, ওরা অনুষ্ঠান শেষে নিজেদের মতো একটু ঘুরে খাওয়াদাওয়া সেরে হোটেলে ফিরছিল, তার মধ্যেই এই বিপত্তি। মেয়েটির শাড়ি বেশ কয়েক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। তার কাঁধের ব্যাগটা মাটিতে পড়ে আছে। সেই ক্যানভাস দুটোও। ছেলেটির বেশ কয়েক জায়গায় কেটেছড়ে গেছে। মাথাও বোধহয় ফেটেছে। রক্ত বেরোচ্ছে, তবে অল্প। ঈশিতা গলায় প্রবল গাম্ভীর্য নিয়ে রীতিমতো ধমক দিয়ে বলল, ‘‘এত রাতে হোটেলে ফিরতে হবে না, সামনেই আমার বাড়ি। রাতে সেখানে থেকে কাল যেও।’’ ছেলেটি কিছুতেই রাজি হল না, ওর বাড়ির ঠিকানা নিয়ে নিজের হোটেলেই চলে গেল। মেয়েটিকে নিয়ে ঈশিতা বাড়ি ফিরল। গুঞ্জা ওর বরের বাইকে চলে গেল। কাজের বউটি আগেই মেয়েকি নিয়ে চলে গেছে, তাই ও আর দেরি করল না। এই ওয়েদারে বরকে ছাড়া.....উফফফফ। ও ভাবতেই পারে না।

ঘরে ঢুকে ঈশিতা মেয়েটিকে দোতলার ঘরটা দেখিয়ে বলল, ‘‘তুমি ড্রেসটা চেঞ্জ করে নাও।’’ বলে কাজের দিদিকে ডেকে একটু চা করতে বলল আর জানিয়ে দিল, ডিনার পরে করবে। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি একটা টিশার্ট আর স্কার্ট পরে চোখেমুখে জল দিয়ে এসে নীচে বসার ঘরে সোফায় বসল। এই বার ওকে ভাল করে দেখল ঈশিতা। কী সুন্দর দেখতে! পাকা গমের মতো গায়ের রং, একঢাল চুল কোমর অবধি, টানা চোখ, পাতলা ঠোঁট। শরীরের গড়নটাও অসাধারণ। সব মিলিয়ে সত্যিকারের সুন্দরী। শুধু চোখদুটোয় যেন একটু হাল্কা বিষন্নতা। হতে পারে একটু আগের ঘটনাটার ধাক্কা লেগেছে। এই সব ভাবতে ভাবতে মেয়েটিকে নাম জিজ্ঞাসা করল ঈশিতা। মেয়েটি মুচকি হেসে বলল, ‘‘আমার নাম মৃত্তিকা।’’ ছেলেটির কথা জিজ্ঞাসা করায় একই রকম ভঙ্গিতে বলল, ‘‘ওর নাম অরণ্য। আমার দাদা।’’ এরা দু’জন ভাইবোন! ইশশশ! এতক্ষণ ওদের প্রেমিক-প্রেমিকা ভাবছিল ঈশিতা। নিজের ভাবনার নিজেরই লজ্জা লাগল। টুকটাক কথার মধ্যে কোথায় থাকে জানতে চাইলে মেয়েটি বলল, আমরা নিউটাউনে থাকি। তার পরে একথা সেকথা পরে ঈশিতাকে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে, অনেক ভোরে উঠি তো, তাই। যদি বলেন, আমি শুয়ে পড়ি আজকে।’’ ঈশিতা ওকে খাওয়ার কথা বলতেই বলল, একটু আগেই ডিনার করে নিয়েছি। ফলে এখন আর কিছু খাব না।’’ বলে শুতে গেলে চায়ের কাপ নিয়ে বসল। উফ সারাদিন যা টেনশন গেল! কাজের দিদি ততক্ষণে খাবার গুছিয়ে রেখে চলে গেছেন। কাল আবার সাতসকালে আসবেন তিনি।
Like Reply
(৪০)

ধরা যে সে দেয় নাই


ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে গেল ঈশিতার। কাল বিকেল থেকে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে যেন ওর। রাতে ঘুমটাও ঠিকমতো হয়নি। কেন এমন হচ্ছে, ও বুঝতে পারছে না। কাল রাতে ঘুমের মধ্যে বারবার ঘুরেফিরে বিকেলবেলার অনুষ্ঠান, ছবি, গান এমন নানা হাবিজাবি ছবি মাথায় ঘুরেছে। সকালে ঘুম ভেঙে বিছানায় বসে বসেই শুনতে পেল একটা মিষ্টি গলা গুনগুন করে কী যেন গাইছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝতে পারল, দোতলা থেকে গানটা ভেসে আসছে। তাহলে কি ওই মেয়েটা গাইছে, কী যেন নাম? মৃত্তিকা। বাবাহ! নামেরও বলিহারি। ও জানে গানটা— ‘অধরং মধুরং, বদনং মধুরং, নয়নং মধুরং, হসিতং মধুরং....। সকালেই গানটা শুনে ওর মনটা যেন ভাল হয়ে গেল।

ও ফ্রেস হয়ে আসতে আসতেই গুঞ্জা ওর বরের বাইকে চলে এল। এখন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা ডকে, সেই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের পরে আবার শুরু হবে। ততদিন মেলার আমেজ। এই সময়গুলোয় ও সকালেই দিদির কাছে চলে আসে। ইদানিং একটু বেশি আসছে। মেয়েকে নিয়ে কাজের দিদি আসবে একটু পরে। এর মধ্যে মৃত্তিকা নামের মেয়েটি নেমে এল। গায়ে এখনও কাল রাতের সেই টি-শার্ট আর স্কার্ট। নীচে এসে খুব কুন্ঠিত ভাবে ঈশিতাকে বলল, আমার ফোনটায় কাল চার্জ দেওয়া হয়নি, এখন দেখছি ফোনটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। আপনার এখানে একটু চার্জে বসাব? ঈশিতা ওর কুন্ঠিত ভাব দেখে হেসে বলল, ‘‘এত কিন্তু কিন্তু কোরো না। ফ্রেস হয়ে এসো, জলখাবার খাব একসঙ্গে। তুমি লুচি খাও তো সকালে?’’ এর মধ্যে মেয়েটি ফোন চার্জে বসাতেই সেটা চালু হল দেখে ও হেসে বলল, ‘‘আমার কিন্তু একটু সময় লাগবে, প্লিজ এক্সকিউজ মি’’, বলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেল।

ঈশিতা সবাইকার জন্য চা করে গুঞ্জা আর ওর বরের হাতে দিয়ে বসল। তার পর মেয়েটির নামধাম বলল। গুঞ্জা কিছু বলল না। কী বলার আছে। এর মধ্যেই মেয়েটির ফোন বেজে উঠল। গুঞ্জার বর উঠে গিয়ে দেখে এসে বলল, ‘‘কে একটা গার্ডি বলে কেউ ফোন করেছে! কী সব নাম এখন! গার্ডি? বিদেশি কিনা কে জানে?’’ ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। মিনিট চারেক পরে আবার ফোন। এবারে গুঞ্জা উঠে দেখল, সেই গার্ডি বলে নামটা। ও এসে চেয়ারে বসল। তিন-চার মিনিট পরে মিনিট পরে আবার ফোন। এবারে গুঞ্জা উঠে দেখল দাদাই লেখা একটা নাম। সেটা বলতেই ঈশিতা বলল, কাল ওই ছেলেটা নাকি ওর দাদা। সে হয়তো বোনের খবর নিতে ফোন করেছে। ওদের কথার মধ্যে বেশ কয়েকবার কখনও গার্ডি, কখনও দাদাইয়ের ফোন এল মৃত্তিকার ফোনে। এর মধ্যে গুঞ্জার কাজের দিদি এসে গেছে। গুঞ্জার বাচ্চাটাকে তার বাবার কোলে দিয়ে তিনি রান্নাঘরে ডুকলেন ময়দা মাখতে। তাঁর পিছন পিছনই ঈশিতার কাজের মহিলাও এসে গেলে ঈশিতা তাঁকে বলল, আগে উপরের ঘরগুলো ঝাঁট দিয়ে দিতে। মিনিট দশেক পরে মৃত্তিকা একেবারে স্নান করে নীচে নামল। গায়ে সেই পোশাকই। ও এসে সবাইকে একগাল হেসে মিষ্টি করে ‘গুডমর্নিং’ বলতেই গুঞ্জা তড়বড় করে ওকে থামিয়ে বলে উঠল, ‘‘তোমার অনেকগুলো ফোন এসেছিল। কে একজন গার্ডি, তার পর দাদাই বেশ কয়েকবার কল করেছে। তুমি বরং একবার ফোন করো।’’ মেয়েটার মুখটা হঠাৎ যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেল! ও চার্জ থেকে ফোন খুলে বাইরে গিয়ে ফোনটা কানে দিল। তার একটু পরেই, ‘ও মাই গড’ বলে দৌড়ে ভিতরে ঢুকে সোজা উপরে চলে গেল!

কী হল! ঈশিতা তো বটেই গুঞ্জা এবং ওর বরও অবাক হয়ে গেল। গুঞ্জা দৌড়ে দোতলায় মেয়েটার ঘরের দিকে গেল। একটু পরে ঈশিতা দেখল মেয়েটা গত কালের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গত কালের মতোই পাঞ্জাবি আর জিনস চাপিয়ে তরতর করে নীচে নামছে। নীচে এসেই খুব অসহায় গলায় ঈশিতাকে বলল, ‘‘দাদাই বাড়িটা খুঁজে পাচ্ছে না, একটু বলে দেবেন লোকেশনটা? ও আমাকে নিতে আসছে, খুব জরুরি দরকার।’’ ঈশিতার বদলে গুঞ্জার বর ফোনটা কানে নিয়ে বাইরে গেল, পিছনে মৃত্তিকা নামের মেয়েটিও। একটু পরে গুঞ্জার বর ঘরে এসে বলল, ‘‘এসে যাবে, দুতিন মিনিটের মধ্যে। মেয়েটি বাইরেই দাঁডিয়ে আছে। বললাম, তাও এল না। খুব ছটপট করছে। কী হল কে জানে রে বাবা।’’ এর মধ্যে ঈশিতার কাজের মহিলা নীচে এসে বকবক করতে শুরু করল। মেয়েটা নাকি খুব বেহায়া। দৌড়ে ঘরে ঢুকে সব খুলে কোনও রকমে প্যান্টটা পরেই টিশার্ট খুলে উদোম গায়ে ব্রা পরছিল। তখন ও দেখেছে কী সুন্দর চামড়া! পিঠের ঠিক মাঝখানে একটা তিলও আছে, তাতে যেন আরও সুন্দর লাগছে। এই বকবকানির মধ্যেই বাইরে ভটভট করে একটা বাইক এসে থামল। ঈশিতা দেখল, গত কালের সেই ছেলেটা। উস্কোকুস্কো চুল, পিঠে একটা ব্যাগ। বাইকের মুখটা ঘোরাতে ঘোরাতে ওর দিকে তাকিয়ে কেমন করে যেন হাসল ছেলেটা। সেই হাসিটা গুঞ্জারও চোখে পড়ল। এর মধ্যেই মৃত্তিকা বলে মেয়েটা প্রায় লাফিয়ে বাইকে উঠে ছেলেটির মতো করেই একটু মুচকি হেসে টাটা করল ওদের। বাইক স্টার্ট নিল

বাইকটা চোখের আড়াল হতেই ঈশিতার মনের মধ্যে গত কাল থেকে চলা অস্বস্তিটা বহুগুণ বেড়ে গেল যেন। কাজের দিদির বলা মেয়েটার পিঠের মাঝখানে তিল, ছেলেমেয়ে দুটোর হাসি— কী যেন হয়ে গেল ওর। ঘরে পরা শাড়িটাই ঠিক করতে করতে গুঞ্জার বরকে বলল, ‘‘এক্ষুনি তোমার বাইক স্টার্ট করো, ওদের ধরতেই হবে।’’ গুঞ্জার বর ভ্যাবাচাকা খেয়ে নিজের বাইকে উঠে বসল। ঈশিতাকে অবাক করে গুঞ্জাও চড়ল, তার পিছনে কোনও রকমে নিজেকে সেট করে ঈশিতা প্রায় ধমকের গলায় বলল, ‘‘দেরি কোরো না, ওদের দেখ ধরতে পারো কি না। যত জোরে পারবে চালাও।’’ গুঞ্জা দিদির আচরণে অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল, ‘‘তোর হঠাৎ আবার কী হল? কী করেছে ওরা?’’ ঈশিতা ওর সঙ্গে একটাও কথা না বলে ওর বরকে ধমকে বলল, ‘‘আরে তাড়াতাড়ি চলো!’’ গুঞ্জার বর বাইকে স্পিড বাড়াল।

রতনপল্লী ছাড়িয়ে মিনিটখানেক এগোতেই চোখে পড়ল, ওদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে সেই বাইকটা। যেন উড়ে যাচ্ছে। ও গুঞ্জার বরের পিঠে টোকা মেরে বাইকটা দেখাল। ওর ভিতরে কেমন একটা অস্থির ভাব। কী একটা যেন চোখের সামনে অথচ ও ধরতেই পারছে না। গুঞ্জার বর যতটা সম্ভব দ্রুত চালালেও ওই বাইকটাকে ধরতে পারছে না। ঈশিতা ছটপট করে যাচ্ছে সমানে। এর মধ্যে ওর হাতের ফোনটা বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখল, মেজদির ফোন। ও জানে মেজদি ফোন করলে বকবক করেই যাবে। ও তবু ফোনটা ধরে শুধু বলল, ‘‘পরে তোকে ফোন করছি।’’ বলেই কেটে দিয়ে সাউন্ড অফ করে দিল। ও জানে, মেজদি আবার ফোন করবে।

এর মধ্যে ওরা রজতপুর বলে একটা জায়গা ক্রস করল। এ দিকে কখনও আসেনি ঈশিতা। তবে গুঞ্জার বর এদিকগুলো বেশ চেনে। গাড়িতে স্পিড আরও বাড়াতে বাড়াতেই ও বলল, ‘‘সামনেই অজয়ের ব্রিজ। তার পরেই বর্ধমান। কোথায় যাচ্ছে এরা? এই দিক দিয়ে কলকাতায় ফেরে নাকি কেউ?’’ একটা কথাও কানে যাচ্ছে না ঈশিতার। শীতে শীর্ণ অজয়ের ব্রিজ টপকানোর সময় দুটো গাড়ির মধ্যে দূরত্ব একটু কমলেও ব্রিজ থেকে নামতেই ফের গতি বাড়াল সামনের বাইকটা। বোঝাই যাচ্ছে, ওরা এই রাস্তা দারুণ ভাল চেনে। তা হলে কাল যে বলল, ওরা নাকি কলকাতায় নিউটাউনে থাকে? কিচ্ছু মাথায় আসছে না ঈশিতার। গুঞ্জার অবস্থা ওর থেকেও খারাপ। ও শুধু ভাবছে, দিদির কী হল হঠাৎ। সামনে বিয়ে, এখন এই পাগলামি!

এর মধ্যে আরও কিছুটা পথ পেরিয়ে ওদের সামনে দিয়ে বাইকটা একটা সরু মাটির রাস্তা ধরল। এবড়ো খেবড়ো রাস্তা বলে দুটো বাইকেরই গতি কমে গেল। তার মধ্যেই ওরা দেখল বাইকটা আরও একটা সরু মাটির রাস্তা দিয়ে ঢালু পথে নেমে কিছুটা দূরে একটা বড় বড় গাছে ঘেরা জায়গায় ঢুকে পড়ল। গুঞ্জার বরও কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে পৌঁছে গেল। প্রথমে বাইকটা না দেখতে পেলেও একটু এগোতেই চোখে পড়ল সেটা। ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় কে জানে!

ঈশিতা বাইক থেকে নেমে ধীর পায়ে একটা কঞ্চির বেড়ার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকল। পিছনে গুঞ্জাও। এর মধ্যেই গুঞ্জার বরের ফোনটা বেজে উঠল। ও ফোনটা কানে নিয়ে দু’একটা কথা বলেই যেদিক থেকে ওরা এই জায়গাটায় ঢুকেছিল, সেদিকে এগিয়ে দ্রুত বাইক নিয়ে চলে গেল কোথায় যেন। ঈশিতারা ভিতরে ঢুকে একটু দূরে একটা ছোট মাটির বাড়ি, চারদিকে শুধু বড় বড় গাছ। একটা ছোট পুকুর। অসাধারণ পরিবেশ। কিন্তু এখানে কেন এল ওরা? ভাবতে ভাবতেই এগিয়ে দেখল একটা খড়ের ছাউনি দেওয়া বসার জায়গা। সামনে আবার মাটির টেবিলের মতো করা। একদম বসার জায়গাই এটা। বাইকের পিছনে কোনওরকমে পাছা ঠেকিয়ে এতখানি পথ এসে ক্লান্ত লাগছিল ঈশিতার। ও সেখানেই বসে পড়ল। চারদিক কী নিস্তব্ধ! খুব মন ভাল করা একটা পরিবেশ। তার মধ্যেই কাদের বাড়ি থেকে যেন মাছভাজার সুন্দর গন্ধ আসছে। ততক্ষণে গুঞ্জাও এসে পড়েছে। দু’জনে মিলে ওখানে কিছুক্ষণ জিরোল। তার পর জায়গাটা ঘুরে দেখবে বলে উঠতে যাচ্ছে, দেখল একজন মহিলা গ্রাম্যরীতিতে মাথায় অনেকটা ঘোমটা, হাতে একটা চুবড়ি ঢাকা বড় থালায় করে কী যেন নিয়ে আসছে ওদের দিকে। তার পিছনে একটি ছোট মেয়ের হাতে আবার একটা কেটলি এবং একটা জলের বোতলও! ওদের কাছে এসে মহিলা চুবড়িটা তুলতেই দেখল, থালায় অনেকগুলো রুই বা কাতলা জাতীয় মাছ ভাজা আর কয়েকটা সন্দেশ। আর একটা বড় বাটি ভর্তি মুড়ি। এত খাবার দেখে ওরা চমকে গেল! তার পরেই মনে পড়ল, সকালে জলখাবার না খেয়েই উদভ্রান্তের মতো বেড়িয়ে এসেছে সকলে। খিদে পেয়েছে অনেকক্ষণই, কিন্তু কী একটা উত্তেজনায় খিদের ভাবটাই চলে গিয়েছিল সবার। এখন সামনে খাবার দেখে খিদেটা মাথাচাড়া দিল সবারই। ওদের একেবারে সামনে এসে মহিলাটি বললেন, ‘‘আমনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন, এটুকখানি খেয়ে নেন।’’ বলেই পিছন ফিরে ছেলেটার থেকে জলের বোতল নিয়ে গুঞ্জার বরের হাতে দিল। ঈশিতা মৃদু গলায় মহিলাটিকে বলল, ‘‘আপনি আমাদের জন্য খাবার আনলেন কেন? কেউ বলেছে?’’ মহিলা মাথা নেড়ে বললেন, ‘‘আমনারা ওই ইস্কুটারটার পিছনে এলেন না, তখনই দেখেছি। তার পরেই ভাবলাম, ঘরে অতিথ এসেছে, কিছু দিই। আর কিছু ছিল না গো।’’ ওরা কথা বাড়াল না। ঠিক করল, খেয়ে নিয়ে ছেলেমেয়েগুলোর সম্পর্কে জানতে চাইবে। মহিলা কিছু তো বলতে পারবে নিশ্চয়ই। এই সব ভাবতে ভাবতে ওরা খাওয়া শুরু করল। অদ্ভুত খাবার— মুড়ি আর মাছভাজা। খিদের মুখে তাই অমৃত। ওরা খেতে শুরু করেছে দেখে মহিলা একটু হেসে কেটলিটা নামিয়ে কয়েকটা স্টিলের গ্লাসও পাশে বসিয়ে দিয়ে একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘‘এতে চা আছে। যদি খান আমনারা, তাই নিয়ে এসেচি।’’ এর পরে আবার চা? ওরা যেন হাতে চাঁদ পেল। প্রায় গোগ্রাসে সব ভুলে খেতে শুরু করল। খাওয়া শেষে স্টিলের গ্লাসে চা ঢেলে নিতেই মহিলা সব বাসন তুলে চলে গেলেন।

ঈশিতা আর গুঞ্জা চা খেতে খেতে পায়ে পায়ে বাড়িটার দিকে এগোল। ওদের কানে এল, এক মহিলা প্রায় চিৎকার করে কিছু বলছে কাউকে। যেন বকছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না, তবে দূরের ওই বাড়িটা থেকে চিৎকারটা আসছে, এটা ঠিক। ওরা কী করবে বুঝতে না পেরে দূরের বড় বড় গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। ততক্ষণে চা শেষ, তাই সেটা ওই বসার জায়গায় রেখে ফিরতে ফিরতে দেখল, মৃত্তিকার সেই দাদাটা ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। ওরা বুঝল, মৃত্তিকাও তার মানে এখানেই এসেছে। কিন্তু এটা কি ওদের কোনও আত্মীয়ের বাড়ি? এই সব ভাবতে ভাবতেই ছেলেটা ওদের সামনে এল। মুখটা কেমন যেন শুকনো। তবু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘‘বুড়িদিদি আপনাদের খেতে দিয়েছে?’’ ওরা বুঝল, তা হলে ওই মহিলাই হয়তো বুড়িদিদি। ওরা মাথা নাড়ল। ছেলেটি বলল, ‘‘আপনারা জায়গাটা ঘুরে দেখুন, আমি আসছি একটু।’’ বলে আবার বাড়িটার দিকে গেল। একটু পরে মৃত্তিকা বেরিয়ে এল। ওকে দেখে চমকে গেল ঈশিতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এতক্ষণ কাঁদছিল মেয়েটা। ও এগিয়ে গেল। মেয়েটা চোখ মুছে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘‘আসলে বাবার শরীরটা খারাপ হয়েছে হঠাৎ, তাই ও ভাবে চলে এসেছি। আপনারা আসুন।’’ বলে একটু জোরে হেঁটে কয়েকটা বড় বড় গাছ পেরিয়ে বাড়িটার দাওয়ায় উঠল। ওদের বাইরে মোড়া পেতে বসিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে গেল।

কেমন একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ। ভিতর থেকে এক মহিলার গোঙ্গানি মেশানো কান্নার আওয়াজ আসছে যেন। আর একটা মহিলা কন্ঠ খুব আস্তে আস্তে কিছু বলছে। বাইরে দাওয়ায় বসে একটা কথাও বোঝা যাচ্ছে না। ওদের অস্বস্তিটা বাড়ল। ওরা উঠে নিঃশব্দে দাওয়া থেকে নেমে একটু দূরে একটা বড় গাছের নীচে বসল। এমনিই শীতকাল, তার উপরে গাছের ছায়ায় চারদিক ঢাকা। বেশ শীতশীত করছে। এমন সময় একটা তারস্বর চিৎকারে ওরা চমকে উঠল, ‘‘নিজের মাকে দেখবি বলে পাঁচ দিন ধরে ওখানে পড়ে রইলি? চিনল তোদের? হুঁ! এদিকে বাবা যে হার্ট অ্যাটাক করে হাসপাতালের মেঝেয় পড়েছিল, সে খবরটাও পাসনি! মরণ আমার। মাকে দেখতে গিয়ে বাবাটাকে শেষ করে এলি শয়তানগুলো!’’ বলেই ঠাস ঠাস করে পরপর কয়েকটা চড় মারার আওয়াজ। ওরা হতভম্ব হয়ে গেল! এ কী রে বাবা! ছেলেমেয়েদুটো ওদের মাকে খুঁজতে গেছিল মানে? এই সব ভাবতে ভাবতেই দুই ভাইবোন এসে বাইরে দাওয়ায় ওদের দেখতে না পেয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে যেখানে ওরা বসেছিল, সেদিকে এগিয়ে গেল। কাছে আসতেই দেখল, দু’জনের গালে হাতের ছাপ পড়ে গেছে, এত জোরে চড় খেয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে কী হয়েছে জিজ্ঞাসা করার আগেই গেটে একটা বাইক থামার আওয়াজ। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, গুঞ্জার বরের পিছনে আরও দুটো বাইক থেকে নামছে গুঞ্জাদের বড়দি, মেজদি আর তাদের দুই বর। ওরা চমকে গেল! এমনকি ছেলেমেয়েদুটোও। ঈশিতার মনে পড়ল, সকালে এখানে আসার পথে মেজদি ফোন করেছিল বটে, কিন্তু কি এমন হল যে এই অবধি ধেয়ে আসতে গেল? ও প্রশ্নটা করার আগেই সেই বাড়িটা থেকে একটা প্রাণফাটানো চিৎকার এল, ‘‘কুট্টি-মুট্টি শিগগির আয়।’’ চিৎকারটা শুনেই দুই ছেলেমেয়ে উর্ধ্বশ্বাসে বাড়ির দিকে দৌড়ল।

আর তখনই ঈশিতার এতক্ষণের অন্ধকারটা পুরোপুরি কেটে গেল! গত কাল বিকেল থেকে ঘিরে থাকা অস্বস্তিটা ওর নিজের কাছেই স্পষ্ট হয়ে গেল। এই ছেলেমেয়ে দুটোর নাম কুট্টি-মুট্টি? তার মানে কি ওরা ওর নিজের ছেলেমেয়ে? ওর কুকীর্তি সহ্য করতে না পেরে যাদের নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিল সৌমাভ? ও কিছু না ভাবতে পারছিল না। অন্যমনস্ক ভাবেই বাড়িটার দিকে দৌড়ল। পিছনে গুঞ্জা এবং বাকি সবাই। দাওয়ায় উঠতে উঠতেই শুনল ভিতর থেকে এক মহিলার বুকফাটা আর্তনাদ, ‘‘ওগো, কিছু বল। দেখো, তোমার ছেলেমেয়েরা এসেছে। কিগো!’’ সঙ্গে দুই ছেলেমেয়ের কান্নাজড়ানো আর্তনাদ, ‘‘বাবা, কিছু বলবে? বলো না? এই তো আমরা। জল? ও পিসি, শিগগির এসো।’’ তার পরেই একটু স্তব্ধতা এবং এবার চিৎকার করে একসঙ্গে অনেকগুলো গলা কেঁদে উঠল। ছেলেটা বলে উঠল, ‘‘ও বাবা কথা বলছো না কেন? বাবা প্লিজ, এই ভাবে চলে যেও না। প্লিজ।’’ আর কথা বলতে পারল না, ডুকড়ে কেঁদে উঠল ছেলেটা। মেয়েটাও হাউহাউ করে কেঁদে উঠল। সেই সঙ্গে এক অদেখা মহিলার বুকভাঙা কান্নার আওয়াজ গোটা চত্বরটা যেন কাঁপিয়ে দিল, ‘‘চলে গেল রে! ধরে রাখতে পারলাম না। তোদের বাবা চলে গেল। আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না! কেন তুমি এমন করলে আমাদের সঙ্গে? আমরা তোমার কেউ নই? সব তোমার বউ?’’
Like Reply
(৪১)

মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই



ঈশিতার পা কাঁপছে থরথর করে। কুট্টি-মুট্টির বাবা মানে কি সৌমাভ? ওর স্বামী? ও কিছু ভাবতে পারছিল না। দাওয়া থেকে হেঁটে ঘরটার মধ্যে ঢুকতে যাবে, সেই সময় খুব চেনা একটা গলা ওকে যেন পাথর করে দিল। জয়তীদি? এখানে? জয়তী তখন বলে যাচ্ছে আপন মনেই যেন, ‘‘সেদিন ঈশিতাকে রাস্তায় একটা অ্যাক্সিডেন্ট থেকে বাঁচানোর জন্য হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনেছিল। তার পরে ওর হাত ধরেই ওকে একটা দোকানে নিয়ে বসিয়েছিল। জলও দিয়েছিল। কিন্তু ঈশিতা ওকে চিনতেই পারেনি বুঝে ওখান থেকে সরে এসে একটু পরে আমাকে ফোন করে বলল, জয়তী, আমি একটা প্রতিজ্ঞা রাখতে পারলাম না। আমি ঈশিতাকে আজ স্পর্শ করে ফেলেছি। আমি এই বার হেরে গেলাম গো। তার পরেই ফোনটা কেটে দেয়। আমি আর ফোনে পাই না। কুট্টিকে ফোন করি, নট রিচেবল। মুট্টির ফোনও তাই। একদিন পরে হাসপাতাল থেকে বন্ড দিয়ে নার্সিংহোমে ভর্তি করলেও ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। পরে শুনলাম, আমাকে ফোনের একটু পরেই রাস্তার মধ্যে হার্টঅ্যাটাক হয়। ম্যাসিভ। ঠিক সময়ে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যেত। কিন্তু ওখানকার লোকজন লোকাল হেল্থসেন্টার ঘুরে যখন হাসপাতালে নিয়ে গেল, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। ঈশিতা যে ওকে চিনতেই পারেনি, ওর স্পর্শও চিনতে পারেনি, এটা মেনে নিতে পারেনি সৌমদা। সে কারণেই এতবড় ধাক্কাটা আর সামলাতে পারল না।’’ তার পরেই গলায় একরাশ ব্যঙ্গ মেশানো জয়তীর গলা ঘরের ভিতর থেকে বাইরে এল আবার, ‘‘কীরে! গিয়ে তো পেন্নাম করলি, প্রোগ্রামের মান বাঁচাতে বাপের ঢঙে গান করলি, বাপের ঢঙে গানের ইতিহাস বললি, কবিতা বললি, এমনকি মুট্টি তো প্রায় ১২ ঘন্টা এক ছাদের নীচেই রইল। কিন্তু সে কি তোদের চিনতে পারল? পারেনি। যে তোদের জন্মের পর থেকে সেভাবে ছুঁতই না, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকত, তোদের জন্মের পর থেকে ভাল করে কোলে পর্যন্ত নিত না, নিজের ফিগার ঠিক রাখার জন্য বুকের দুধের বদলে তোদের কৌটোর দুধ খাওয়াত, সে তোদের ১৮ বছর পরে চিনতে পারবে, এমন পাগলামি তোদের মাথায় এল কী করে? কেন করতে গেলি এ সব ন্যাকামো? জানোয়ার কোথাকার! মাঝখান থেকে...’’ কথাটা শেষ করতে পারল না জয়তী। ওর কথাগুলো এবং এবারে ডুকড়ে ওঠা কান্না ততক্ষণে দাওয়ায় দাঁড়ানো ঈশিতা, গুঞ্জা, তার দুই দিদি-জামাইবাবু, এমনকি গুঞ্জার বরকেও যেন পাথর করে দিয়েছে।

ঈশিতা আর পারল না, ও এই বারে সব বুঝে গেছে। ওর চোখের সামনে যেন ১৮ বছর আগের সেই দিনটা ফিরে এল। সেদিনও সব শেষ হওয়ার পরে ও বুঝেছিল কী সর্বনাশ হয়ে গেছে! আজ তো সত্যি করেই সব শেষ হয়ে গেল! আজ ও সত্যি করে স্বামীহারা হল। ও নিজের ছেলেমেয়েকে চিনতে পর্যন্ত পারেনি? এমনকি ১৮ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া স্বামী ওর হাত ধরলেও ও বুঝতেই পারেনি? সেবারে ছিল কলেজের প্রোগ্রাম, এবারে নিজের কাজের জায়গার প্রোগ্রাম। সেবারে ছিল রাহুলের শরীরে শরীর মেলানোর উন্মত্ত কামনা, এবারে আবার বিয়ে করে শরীরের খিদে মেটানো এবং নতুন করে সংসারের চিন্তা— কি অদ্ভুত মিল! ও আর ভাবতে পারছিল না। চোখ দুটো ব্যথা করছে, অথচ কাঁদতেও পারছে না! ঈশিতা ওখানেই ধপ করে বসে পড়ল, তার পরে মাটিতে মাথা রেখে শুয়ে জ্ঞান হারাল।

এই সময় ঘরের মধ্যে কিছু ফিসফাস, গুঞ্জন কানে এল বাকিদের। সেটা থেমেও গেল। একটু পরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বাইরে এল জয়তী। এসেই ওদের সবাইকে দেখে এবং ঈশিতাকে মাটিতে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠল। তার পর দ্রুত কুট্টি-মুট্টিকে ডেকে চোখেমুখে জলের ছিটে দিয়ে তুলে বসাল ঈশিতাকে। তার পর কুট্টি-মুট্টিকে ঘরে পাঠিয়ে দরজা বন্ধ করে বাবার কাছে থাকতে বলে ভাল করে ঈশিতার দিকে তাকিয়ে তীব্র ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলল, ‘‘হাজরায় আমার ফ্ল্যাটে পরপর দু’দিন তুই এসেছিলি। প্রথমদিন এদের সবাইকে নিয়ে। দ্বিতীয়দিন একা। সেদিন তোকে অনেক কথা বলেছিলাম। মনে কর, তোকে সেদিনই বলেছিলাম, কলকাতায় পা রেখে অবধি সৌমাভদাকে তুই এত অবহেলা আর উপেক্ষা করেছিস যে, সৌমাভদা ফিরে এসে তোকে কোনওদিন রাস্তায় হাত ধরলেও তুই বুঝতেই পারবি না। এমনকি নিজের ছেলেমেয়ের স্পর্শও তুই বুঝতে পারবি না। চলে যাওয়ার আগে তুই প্রায় চ্যালেঞ্জ করে আমাকে বলেছিলি, সারা জীবন অপেক্ষা করব ওদের জন্য! পেরেছিস তো সফল হতে? না পারিসনি? এবার বুঝতে পারছিস ঈশিতা, তোর ভালবাসা আসলে কতটা নাটক ছিল? কতটা নকল ছিল? যাক শুনলাম, তোর বোন, গুঞ্জা, যাকে সৌমাভ নিজের বোনের মতো ভালবাসত, সবচেয়ে বেশি বন্ধু ভাবত, সে তোর বিয়ে ঠিক করেছে? বাহ! গুড! কনগ্র্যাচুলেশনস। আর তো বিয়ে করার সমস্যা রইল না। এই ভয়ও রইল না যে সৌমাভদা হঠাৎ এসে হাজির হয়ে যাবে তোর বিয়ের আসরে বা তোর বিয়ের পরের সংসারে! এবার বিয়ে করে ফেল তোর ছোট বোনের অনেক খুঁজে আনা পাত্রকে। নেমন্তন্ন করিস কিন্তু। কুট্টি-মুট্টিকেও করিস। ওরা অন্তত মায়ের বিয়ে খেতে যাবে। অবশ্য মা ঠিক না, জন্ম দিয়েছিল যে মহিলা, তার বিয়ে। ওদের মা আলাদা।’’ প্রতিটি কথায় তীক্ষ্ণ শ্লেষ আর বিদ্রুপ মিশিয়ে একই সঙ্গে ঈশিতা ও গুঞ্জাকে বিঁধেই চলেছে জয়তী। একসময় চোখের কোন থেকে জলটা মুছে পাশ ফিরে হতভম্ব হয়ে থাকা গুঞ্জার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কীরে ঐশী, ওরফে গুঞ্জা, সৌমাভ সরকার তো মরে গেল, এবার তো দিদির বিয়ে দিতে তোর আর সমস্যা রইল না। আঙটি বদলও তো শুনলাম হয়ে গেছে তোর উদ্যোগে। তা দিদির বিয়েতে নেমন্তন্ন করবি তো আমাদের?’’

গুঞ্জা মুখ খোলার আগেই ওর গালে ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ল। মেজদি। দুচোখে আগুন আগুন জ্বলছে যেন। মেজদির এই চোখমুখ কোনওদিন দেখেনি গুঞ্জা। ১৭ বছর আগের এক রাতে ঈশিতা দেখেছিল। সেই গুঞ্জা বিয়ের এত বছর পরে বয়সে দ্বিগুণ বড় মেজদির চড় খেয়ে থমকে গেল। মেজদি থামল না। গনগনে গলায় বলে উঠল, ‘‘মিতুনের বিয়ে ঠিক করেছিস এমন ছেলের সঙ্গে যার মাসতুতো ভাইয়ের নাম রাহুল দুবে? বাহ। আর খুব অঙ্ক কষে দিনগুলো বেছেছিলি না তুই? কালীপুজো, অর্থাৎ সৌমাভর জন্মদিনের ঠিক দু’দিন পরে, ভাইফোটার পরের দিনটায়। মিতুন ছাড়া সৌমাভ তোকেই একমাত্র বিশ্বাস করত, পরের দিকে মিতুনের থেকেও বেশি। তাই তোকে অনেক কিছু দিয়েছিল। এমনকি বিয়ের পরেও। তার পর থেকে আর দেয়নি। ও বুঝে গেছিল, তুইও মিতুনের মতোই হয়ে গেছিস। ও তোকে বোনের মতো দেখত। যদিও ওকে কোনওদিন ফোঁটা তো দিসইনি, জন্মদিনটাও মনে রাখিসনি ইচ্ছে করেই। তাই রাহুল দুবের সম্পর্কে ভাইয়ের সঙ্গেই মিতুনের বিয়ের পাকাদেখা করালি সেই দিনে, যেদিন সৌমাভ বরাবরের মতো সংসার ছেড়েছিল তোর দিদির নোংরামি দেখে! তোর সেদিনের জেদ আর ইচ্ছে দেখে আমার আর দিদির পাশাপাশি দুই জামাইবাবুরও খারাপ লেগেছিল। আমরা কেউ ভাবিনি তুই এমন করবি। মিতুন ওকে বিয়ের একমাস পরে পিঠে ছুরি মেরেছিল। তবু ও মরেনি। সেটা দেখে তুই মিতুনের মতই একই ভাবে একটু কায়দা করেই ওর পিঠে আরও একটা ছুরি মারলি, তাও ১৮ বছর অপেক্ষা করে? ভেবেছিলি সবাই ভুলে যাবে? সৌমাভর সেদিনের লেখা চিঠি আজও আমার আলমারিতে যত্ন করে রাখা আছে। সে কারণেই তোর সব চালাকি ধরা পড়ে গেছে আমাদের চার জনের কাছে।’’ গুঞ্জা এই সময় কিছু একটা বলতে যেতেই ফের একটা ঠাটিয়ে চড় মেরে মেজদি বলল, ‘‘ওহ, মিতুনের জন্য যে পাত্রকে দেখেছিস, সে যে একটা বাড়ির উপরতলা কিনেছে, সেটা তো জানিস। যদিও ঠিক কেনেনি, ওকে ১ টাকার বিনিময়ে ৩৩ মাসের জন্য ভাড়া দিয়েছে বাড়ির মালিক। তবে জানিয়েছে, চাবিটা পরে দেবে ওর হাতে। মালিকের নামটা না জানলেও ও যে সেটায় থাকবে পরের প্রায় তিন বছর, সেটা তো জানিস? আবার মিথ্যে বলিস না যে জানি না। কারণ ও নিজেই বলেছে, ব্যাপারটা একমাত্র তোকেই বলেছে। তবে বাড়িটা ভাল, জানিস। বিশেষ করে মিতুনের খুব চেনা বাড়ি ওটা।’’

ঈশিতা এতক্ষণ চুপ করে কথাগুলো শুনছিল আর গুঞ্জার কথা ভাবছিল। সৌমাভ ওকে কী প্রচন্ড বিশ্বাস করত, ভালবাসত। অবশ্য ঈশিতাকেও বাসত। ঈশিতাই তার মর্যাদা দেয়নি, সেটা ও নিজে সবচেয়ে বেশি জানে। যদিও গত কয়েক বছরে ও প্রায় ভুলেই গেছিল, সৌমাভর সঙ্গে ও কি রকম বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা করেছিল। কিন্তু গুঞ্জা? যে গুঞ্জা সৌমাভ চলে যাওয়ার পরে বহুদিন ওর সঙ্গে কথাই বলেনি, ওকে ঘেন্না করত রীতিমতো। একঘরে শুত পর্যন্ত না। তবে এখানে এসে বিয়ে করার পরে সেই তিক্ততাটা রাখেনি আর। সেই গুঞ্জা যে রাহুল দুবের সম্পর্কিত ভাইকে ওর জন্য পাত্র হিসেবে বেছেছে, এটা জেনে স্তম্ভিত হতেও ভুলে গেছিল ও। সেই রাহুল দুবে, যার জন্য ওর সংসার, সন্তান, স্বামী সব হারিয়ে গেছে বরাবরের মতো! কিন্তু কোন বাড়ির কথা বলছে মেজদি? ওর বুকটা কাঁপতে লাগল। এর মধ্যেই ওকে চমকে দিয়ে মেজদি বলল, ‘‘প্রথম দিন থেকেই তোর উৎসাহ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। পরে খোঁজখবর করে জানতে পারি, এই ছেলের প্রচুর পয়সা। এডুকেশন ডিপার্টমেন্টে ভাল যোগাযোগ। একে ধরতে পারলে ডিপার্টমেন্টে উঁচু পদ পাবি, তাই একটুও দেরি করতে চাসনি, তাই না? শুধু তাই নয়, ও যে ফ্ল্যাটটা কিনেছে, সেটা কাল দেখে এলাম জানিস? ও প্রথমে রাজি হচ্ছিল না, আসলে চাবিটা হাতে পায়নি তো। ওর ইচ্ছে ছিল, মিতুনকে বিয়ে করে একেবারে ওই ফ্ল্যাটটায় ঢুকবে, ওই বিছানায় ফুলশয্যাও করবে! কী ভাল বল! তা গিয়ে দেখি ফ্ল্যাটটায় তালা। তালা মানে একেবারে সিল করা যাকে বলে। ডাবল ইয়েল লক, কোলাপসিবল গেট, সেটাতেও তালা। কোন বাড়িটা, কোন ফ্ল্যাটটা সেটাও বোধহয় তুই জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারবি। যে ফ্ল্যাটে মিতুনকে নিয়ে কলকাতায় এসে প্রথম উঠেছিল আর এগারো মাস ধরে অনেক কিছু সহ্য করে শেষে নিজের বিছানায় মিতুনকে রাহুলের সঙ্গে চূড়ান্ত নোংরামি করা অবস্থায় ধরে ফেলে বরাবরের মতো ছেড়ে চলে গিয়েছিল সৌমাভ, সেই বাড়িটার সেই নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটটাই তিন বছরের জন্য ও লিজ নিয়েছে, তাও সৌমাভরই কাছ থেকে! ওকে নিশ্চয়ই রাহুল দুবে ওই বাড়িটা দেখিয়ে ওটা কেনার বুদ্ধিটা দিয়েছিল। কিন্তু তোর দেখা পাত্র তো জানত না যে, চলে যাওয়ার পরের মাসেই ছেলেমেয়ের মুখেভাত দিতে কলকাতায় এসে ফ্ল্যাটটা সমেত গোটা বাড়িটা কিনে নিয়েছিল সৌমাভ। তার পরে তিনতলার ওই ফ্ল্যাটটা পুরো সিল করে দিয়েছিল। তাই সৌমাভ যেদিন শুনেছিল মিতুন আবার বিয়ে করতে চলেছে, সেদিনই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। পরে যখন ছেলের পরিচয় জানতে পেরেছিল নানা উপায়ে, তখন ওকে বাড়িটা না, শুধু ওই ফ্ল্যাটটা ১ টাকার বিনিময়ে ৩৩ মাসের জন্য লিজ দিয়েছে। ভাল না?’’ বলেই জয়তীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘সৌমাভ তো তোকে সবই বলেছে, তাই চাবিটা গুঞ্জাকেই দিয়ে দে। তুই তো জানিস, ওই ফ্ল্যাটের একটা কুটোও নাড়ায়নি সৌমাভ, সেই একই অবস্থায় পড়ে আছে। এমনকি সেই খাটের চাদরটাও আছে, সেই ম্যাক্সিটাও আছে, এমনকি সোফাটাও নাড়ায়নি। দুধের বাটি, ছোট গ্যাস, ফ্রিজ, খাবার টেবিল— সব ক’টা জিনিস তেমনই আছে। সেই খাটেই মিতুন আবার শোবে, তবে এবার অন্য আর একটা ছেলের সঙ্গে! কী কপাল বল তো জয়ী?’’ বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল মেজদি। বড়দিও। দুই জামাইবাবু থমথমে মুখে বসে। আর সব কথা শুনতে শুনতে গুঞ্জার বরের চোখমুখ যে প্রচন্ড ভাবে বদলে গেছে, সেটা কেউই খেয়াল করেনি।
Like Reply
সমাপ্ত নাকি আরো আপডট আছে?
Like Reply
(09-05-2025, 01:54 AM)মাগিখোর Wrote: বিদগ্ধ পাঠকের মন্তব্যে, নিজের নাম দেখতে পেলে; গর্বে, ২৬ ইঞ্চি ছাতি ফুলে ৫৬ ইঞ্চি হয়ে যায়। আমারও তাই। 
তবে, একটা কথা; সমালোচনা, মানে সম্যক রুপে আলোচনা; সেটা এখানে কমই হয়। এখানে মন্তব্য মানেই, পরবর্তী পর্বের জন্য তাড়া দেওয়া। গল্পের ভালো-মন্দ নিয়ে আলোচনা, কমই পাওয়া যায়।

এই সমস্যাটা শুধু এখানের নয়,সব জায়গায়। অপনি পড়েছেন কি না জানি না— অনেক দিন আগে কাজল দীঘী নামে একটা গল্প ছিল।
সেটার জন্যে লেখককে আলাদা সাইট তৈরি করতে হয়েছিল। তিনি প্রতিদিন আপডেট দিতেন,কিন্তু তার পরেও পাঠকের জ্বালাতন লেখক অস্থির।  Big Grin (পরবর্তীতে লেখক বই বের করেছিলেন,তিনটি খন্ডে,ওটা নিয়ে একই কান্ড) তাই এখন উনি লেখাই ছেরে দিয়েছেন। আসলে এখানে অধিকাংশ পাঠক-পাঠিকা আমার মতে শিশু বিশেষ– চকটেল হাতে না পেলেই কান্না কাটি শুরু। Big Grin
এই ক্ষেত্রে লেখকদের একটু শক্ত পোক্ত হওয়া দরকার। কারণ গল্পের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলার মতো লোক খুব কম।( আমি নিজেই তেলেগু ফোরামে গল্পের ভালোমন্দ আলোচনা করে সমস্যায় পরে গিয়েছি)
সত্যকথা একটু তেতোই হয়,তা সবার কানে সয় না।

INKITT:– ☛inkitt☚   / ছোট গল্প:–গল্পের খাতা 

[Image: IMG-20241001-072115.jpg]

[+] 3 users Like বহুরূপী's post
Like Reply
Ami bakko hara, ki bhabe prosongsha korbo jani na, Porte Porte mone hocche jeno amio nijei kono ak character ae golper, shamne darea dekhchi jeno shob.
Simply Extraordinary lekha, atulonio.
Golpo ta shesher dike jani tobuo adhir apekkhae achi j shesh ta kemon hoe.
Many many Thanks to the writer for providing us with such an exemplary story. Porer update er roilam, akta khub sundor update ba ending er jonno.
[+] 2 users Like New Avatar's post
Like Reply
APONAR PROTYEKTI EPISODER KONO TULONA EI SITE E NEI. OSADHARON.
Like Reply
Xossipy ফোরামে লেখা সর্বকালের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ গল্প (ইফ নট দি শ্রেষ্ঠ গল্প)। একটা 'হল অফ ফেম' সেকশান বানিয়ে সেখানে এই গল্পটাকে স্থান দেওয়া উচিৎ xossipy কর্তৃপক্ষের। এক কথায় বললে 'অল টাইম ক্লাসিক'। গল্প আর লেখককে কি বলে প্রসংশা করব তার ভাষা খুজে পাচ্ছি না। আমরা যেসব পাঠক/পাঠিকারা এই গল্পটা পড়ছি তারা অত্যন্ত ভাগ্যবান/ভাগ্যবতী যে আমরা একটা ক্লাসিক রচনা হওয়ার স্বাক্ষী হিসেবে থেকে গেলাম। 

গল্প একদম ক্লাইমাক্স পর্যায়ে এসে গেছে এবং আমি আশা করি ক্লাইম্যাক্সটা এমন একটা ধামাকাযুক্ত হবে যা দুবে বংশকে ধ্বংস করবে। 
[+] 6 users Like prshma's post
Like Reply
এই ফোরামের সকল পাঠক/পাঠিকা (যারা এই উপন্যাসটি এখনও পড়েন নি) তাদের কে উদ্দেশ্য করে বলছি _____

আসুন সবাই এসে একবার পড়ে দেখুন, এটা কোন গল্প নয় এটা বাস্তবিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। এটাই আসলে জীবন।

ছোটন দাদা, তুমি সেরা....তুমি সেরা....তুমি সেরা....
[+] 2 users Like Mohomoy's post
Like Reply
Very nice
Like Reply
Vhai.thriller uponnash keo charia gelo.osomvob Valo golpo.
Like Reply
Ei story te valo Ending den vai
Like Reply
Ai story ta erotic story na but khub valo story.
"A good story in wrong place"
Like Reply
(৪২)

প্রেম বলে যে যুগে যুগে


মেজদির কথাগুলো শুনতে শুনতে গুঞ্জা সেই যে মাথা নামিয়েছে, আর তোলেনি। ঈশিতাও চুপ করেই বসে আছে। শূন্য দৃষ্টি। ও ভেবে যাচ্ছে, কত কথা। ওর চোখে যেন ভাসছে— ওর সঙ্গে সৌমাভর বিয়ে, সেই বালির উপর বসে গান শুনতে শুনতে জীবনের প্রথম মিলন, তার পর থেকে একমাসেরও বেশি কয়েকটা দিন সৌমাভর আদরে, ভালবাসায় ভেসে যাওয়া। তার পর? ও মনে করার চেষ্টা করতে গেল, তখনই চটকটা ভাঙল একটা চাবির গোছা সামনে পড়ার আওয়াজে। ও চমকে মুখ খুলে দেখল, জয়তী একটা চাবির গোছা গুঞ্জার পায়ের কাছে ফেলে দিয়ে বলছে, ‘‘এই নে, এটা তোর নতুন শুভাকাঙ্খী কাম নতুন ছোট জামাইবাবুর ফ্ল্যাটের চাবি। যদিও ভাড়ার ফ্ল্যাট, তবু বিয়ের পরে তোর ছোড়দিকে নিয়ে তোর নতুন ছোট জামাইবাবু সেখানেই উঠবে তো! তাই তুই সব দেখে নে বাবা। ওদের বুঝিয়ে দিস। অবশ্য ঈশিতা এর সবগুলোই চেনে, জানে। তবু তুই দেখে নে বাবা। এই দুটো চাবি বাইরের কোলাপসিবল গেটে লাগানো দুটো তালার। এর আরও দুটো চাবি তোর ছোড়দির কাছেই আছে। অন্তত সৌমদা মরার আগে অবধি আমাকে আর সুভদ্রাকে সেটাই বলে রেখেছিল। তার একটা ওর ব্যাগে বা অন্য কোথাও, আর অন্যটা তোর ছোড়দির জামাকাপড়ের আলমারির লকারে আছে। তোরা দু’জনে মিলে খুঁজে নিস, কেমন? আর এই দুটো বড় চাবি মেন গেটের দুটো ইয়েল লকের। এদুটো সৌমদার কাছে থাকত। একটা অফিসের ব্যাগে, অন্যটা সৌমদার অফিসের ড্রয়ারে। এই রকম আরও দুটো চাবি আছে। তার একটা তোর ছোড়দির ব্যাগে আছে, আর একটা তোর ছোড়দির বেডরুমের বেডসাইড ড্রয়ারে থাকার কথা। সৌমদাই বলেছিল রাখতে।’’ তার পরেই বিদ্রুপের হাসি হেসে বলল, ‘‘অবশ্য জানি না, চাবিগুলো সেখানেই রাখা আছে না অন্য কোথাও বা অন্য কারও কাছে আছে। আর এই দুটো চাবির কোনও ডুপ্লিকেট নেই। যেবার বাড়িটা কিনে ফ্ল্যাটটা সিল করেছিল, সেবার মেন গেটে আলাদা করে লাগিয়েছিল। যাতে অন্য তালাগুলোর চাবি হাতবদল হয়ে কারও কাছে গেলেও পরে সে আর ঢুকতে না পারে।’’ কথা থামিয়ে মেজদি-বড়দির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘কী কপাল দেখ লোকটার! যাকে ভালবেসে, যার সেফটির কথা ভেবে এতকিছু করেছিল, সে নিজেই ঘরে নিজের ভালবাসার লোক ঢুকিয়ে বিছানায় ফূর্তি করত, ফূর্তি করার কথা ভাবত! আর ওই লোকটা? সব হারিয়ে একা একা ভিতরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিজেকে শেষ করে ফেলল! জানো মেজদি, কুট্টি-মুট্টির দশ বছরের জন্মদিনের দু’দিন আগে কলকাতায় চলে এসেছিল। তখন সুভদ্রা চাকরি পেয়ে গেছে। ফলে ভীষণ একা ফিল করত। আমাকে বলেছিল, এবার যদি পারি ঈশিতার কাছে ছেলেমেয়েকে দিয়ে দেব। পরে না হয় নিজের কথা ভাবব। আমার তখনও ডিভোর্স হয়নি, তবে হবে হবে করছে। আমি তখন বলেছিলাম, ছেলেমেয়ের সঙ্গে তুমিও যাও না বাবা তার কাছে। আর এত অভিমান কেন? জানো, চুপ করে সব শুনেছিল। ওই সুন্দর চেহারাটা ভাঙতে ভাঙতে যেন কঙ্কাল হয়ে গিয়েছিল গত কয়েক মাসে। আমি বুঝে গেছিলাম, সৌমদা এবার চলে যাবে। সুভদ্রাকেও ইঙ্গিতে বলেছিলাম, তৈরি হ। আমি থাকলেও তোকেই দেখতে হবে কুট্টি-মুট্টিকে। এই ক’দিন আগে ওই ঘটনার পরে যেদিন প্রথম ঈশিতার হাত ধরল, সেদিন থরথর করে কাঁপছিল আমার সঙ্গে কথা বলতে বলতে। আসলে ওর আশা ছিল, ঈশিতা ওকে ভালবাসে। সেটা আবারও মিথ্যে বুঝেই হার্টঅ্যাটাক করে রাস্তায় পড়ে যায়। আজ সকালেও ফিসফিস করে আমাকে বলেছে, ‘আচ্ছা ও খবর পেলে আসবে আমাকে দেখতে? অবশ্য দেখলেও তো চিনতে পারবে না! তার উপর সামনে বিয়ে। যাক ভাল থাকুক’। তার পর আর দুটো কথা শুধু আজ সকাল থেকে বলেছে। আমাকে, সুভদ্রাকে গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ভাল থাকতে বলেছে বারবার। আর ছেলেমেয়েকে বুকের উপর টেনে বলেছে, নিজেরা সৎ থেকো, অন্যের কাছেও সৎ থাকার চেষ্টা কোরো। আর পিসি ও মামনকে দেখো। আর কিছু বলতে পারেনি। ওরা মুখে জল দিল, ব্যাস! দ্যাখো, সুভদ্রা তো কেউ না ওদের। সুভদ্রা ছিল আমার বাড়ির কাজের মেয়ে। ওকে রাস্তা থেকে তুলে এনেছিলাম চিল-শকুনের হাত থেকে বাঁচাতে। সেই সুভদ্রা ওদের চার মাস বয়স থেকে নিজের বুকে টেনে বড় করেছে। ওরা সুভদ্রার বুকে লেপ্টেই বড় হয়েছে। সৌমদাই শিখিয়েছিল, ওকে মামন বলে ডাকতে। অথচ নিজে সুভদ্রাকে কোনওদিন খারাপ ভাবে ছুঁয়েও দেখেনি। সুভদ্রা কতদিন কেঁদেছে এ নিয়ে আমার কাছে। আবার দেখো, সুভদ্রা লেখাপড়া শিখে চাকরি পাওয়ার পরে সৌমদা কী খুশি! বলল, আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। আর একজনের জন্যও চেয়েছিলাম, সে পিঠে ছুরি মেরে দিয়েছে। সুবি মনে হয় তা করবে না। করলেও আর নতুন করে কষ্ট পাব না। সুভদ্রা কিন্তু ছুরি মারেনি সৌমদাকে। বরং মাসে দুবার কলকাতা থেকে বম্বে ছুটত ওদের দেখবে বলে, তাও প্লেনে! ভাবতে পারো? এই একঘন্টা আগে এত বড় বড় দুই ছেলেমেয়েকে চড় মেরে গাল লাল করে দিয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। ওরা কিন্তু রাগ করেনি। বরং মামনকে জড়িয়ে পাল্টা কেঁদেছে। একটা কোথাকার অচেনা, আদিবাসী মেয়ে, যার সঙ্গে ওদের রক্তের সম্পর্কও নেই, তার কতটা ভালবাসা, সততা থাকলে এটা করতে পারে? অথচ নিজের মতো আলাদা সংসার করতে পারত না সুভদ্রা? আজও চাইলে ও বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু ও করবে না। কি বলব বলো!’’ কথাগুলো শেষ করে দুহাতে চোখ ঢাকল জয়তী।

এই বার মুখ তুলে জয়তীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল ঈশিতা। এতক্ষণ ধরে, এতদিন ধরে ও অনেক কথা শুনেছে। কিন্তু সৌমাভ যে ওর কাছে ফিরতে চেয়েছিল, সে কথা তো জয়তী কখনও বলেনি ওকে? প্রশ্নটা করতেই পাল্টা ঝাঁঝিয়ে উঠল জয়তী। বলল, ‘‘প্রথম কয়েকটা বছর তুই যোগাযোগ রাখতিস, আমিও রাখতাম। তোদের বাবা মারা যাওয়ার পরে তোদের মাকে নিয়ে বড়দি নিজের কাছে রাখেন, তোরা বাড়িটা প্রোমোটারকে দিস। বড়দির বাড়িতেই তোদের মা মারা যান। আমি খবর পেয়ে গেছিলাম। সেদিন সৌমদা অনেক টাকার মিষ্টি আর প্রচুর ফুল আমার হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল, তোদের বলিনি। তার পরে তোরা নিজেরা দুটো করে ফ্ল্যাট পেয়েছিস, টাকা পেয়েছিস। সেটা অবধি আমাকে বলেছিলি। তার পর তুই শান্তিনিকেতনে চাকরি নিয়ে আসার পর থেকে এই আট-নয় বছরে একটা ফোনও করেছিলি? তার আগের তিন বছরেও একটা ফোনও করিসনি। প্রথম প্রথম শুধু দু’একটা মেসেজ করতিস বিজয়ায় আর ইংরেজি নতুন বছরে। ব্যাস! স্বামী-সন্তানের খবর নেওয়ার দায়িত্ব শেষ? সৌমদা গত আট বছর কলকাতায় চাকরি করেছে, জানতিস? আমাদের অফিস হাজরা থেকে সল্টলেকে সরে গেছে, জানিস? কাকে বলব? তোর ফোন নম্বর যে বদলেছিস, সেটা জানানোর ভদ্রতাও দেখাসনি তুই! আজ আমাকে বলছিস? আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে, জানিস? তোর কাছে ফেরার কথা ভেবে সৌমদা এই কয়েক মাস আগে চাকরি পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল, জানিস? আর তুই? বিয়ে করে নতুন সংসার পাতার আনন্দে মশগুল থেকেছিস। তোকে বলেছিলাম না, নিজের সংসার-স্বামী-সন্তানকে কোনওদিন তুই ভালই বাসিসনি, ভান করে গেছিস। আবারও সেই কথাই বলছি। তাই ছেলেমেয়ের প্রণাম না হয় বুঝিসনি, ধরে নিলাম, ১৭-১৮ বছরে সে স্পর্শ মনে রাখা কঠিন। ‘মুকুট্টি’ নামটা দেখে কিছু মনে হয়নি? মুট্টি-কুট্টির কথা মনে পড়েনি? মুট্টি প্রথম যে গানটা গেয়েছিল, সেটা আন্দামানে থাকতে একবার তোরা দু’জনে গলা মিলিয়ে গেয়েছিলি, তোর মনে আছে আজ? তার পরে তোরা যেদিন সবাই আমার ফ্ল্যাটে গেলি সৌমদাকে খোঁজার নাটক করতে, সেদিন আমি এই গানটাই গেয়েছিলাম, তোর মনে আছে? সেদিন তুই কেঁদেছিলি? কই কাল মুট্টির গলায় সৌমদার অবিকল নিজস্ব ভঙ্গিতে গানটা শুনে তো কাঁদিসনি? নাকি মনেই পড়েনি গানটার কথা? বাদ দে! কুট্টি যে গানটা গেয়েছিল, সেটা গাওয়ার আগে দুলাইনে তার সম্পর্কে কিছু বলেছিল। এটা সৌমদা বরাবর করত, বহু গানের ক্ষেত্রে।  কুট্টি কথাগুলো বলার সময় তোর কিছু মনে হয়নি? ওই ছবি আর কবিতাটা শুনেও না? ওরা স্টেজ থেকে নেমে আমাকে ফোন করেছিল। কাঁদছিল দামড়া দামড়া ছেলেমেয়ে দুটো। ওদের ১৮ বছরের জন্মদিন গেছে কয়েক মাস আগে, মনে আছে তোর? মনে নেই জানি, এখন মিথ্যে বলবি যে মনে আছে। ওদের সেদিন সব কথা জানানো হয়েছিল। ওরা সৌমদার সঙ্গেও কথা বলেছিল। অনেক কান্নাকাটি, রাগারাগি, ঝগড়া করেছিল। তার পর থেকে ওরা তোকে দেখবে বলে ছটপট করত। তোদের বাড়ি থেকে দেওয়া দুটো নাম সৌমদা বদলে অরণ্য আর মৃত্তিকা করে দিয়েছিল। আমিও জেনেছি পরে। কিছু বলিনি। কিন্তু ওদের ডাকনাম বদলায়নি সৌমদা। আশা ছিল, একটু আনকমন নাম তো, তাই তুই যদি কোনওদিন অন্তত ডাক নাম শুনেও ওদের চিনতে পারিস। তুই চিনতে পারলে ওরা তোকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, এই আশায় গত একমাস ধরে লেখাপড়া, কলেজ সব চুলোয় দিয়ে এখানে পড়ে থেকেছে। আর তুই? আরও একটা নতুন লোককে বিয়ে করে স্বামী বলে পরিচয় দিয়ে তার সঙ্গে শোয়ার চিন্তায় মশগুল হয়ে তার দেওয়া হীরের আঙটি পরে গর্ব করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস! ছিঃ।’’

ঈশিতা জানে ওর কিচ্ছু বলার নেই। একটা কথারও প্রতিবাদের কোনও জায়গাই নেই। জয়তীদি প্রথম দিন থেকে ওকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ও কি, ও কি রকম! চুপ করে মাথা নিচু করে বসে রইল। তার পর হঠাৎ যেন কী মনে পড়েছে, এই রকম করে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল। দুই দিদি, দুই জামাইবাবু, ছোট বোন, ছোট বোনের স্বামী— কারও উপস্থিতির তোয়াক্কা না করে নিজের একটা হাত জয়তীর দিকে বাড়িয়ে বলল, ‘‘আমি একটা বেশ্যা। নিজের স্বামী, সন্তানদের ছেড়ে অন্য লোকের বিছানায় শুয়ে বেড়াই। আমি নোংরা মেয়ে। তোমাদের সব কথা মানছি। কিন্তু দেখ, এই আঙটিটা আমি কোন আঙুলে পরেছি? জানি বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমার কেমন যেন একটা লাগছিল। কালও খুব অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই আজ সকালে ওরা বেরোতেই গুঞ্জার বরের বাইকে চেপে এখানে এসেছি ওদের পিছনে পিছনে।’’ বলে আঙটিটা খুলে মাথা নিচু করে বসে থাকা গুঞ্জার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে খুব শান্ত গলায় বলল, ‘‘নিজের প্রমোশনের জন্য রাহুলের ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে শোশয়াতে চেয়েছিলি তো? আমি বেশ্যা, যা বলবি করব। তুই বললে, ওই বিছানাতেই আবার রাহুলের সঙ্গেও শোব। কিন্তু আমাকে বিয়ে করতে বলিস না, কেমন? জানিস না, বেশ্যাদের বিয়ে করতে নেই, সংসার থাকতে নেই! তুই কি রে? এই আঙটিটা তুই রেখে দে, তোর কাজে লাগতে পারে।’’ বলে নিচু হয়ে গুঞ্জার সামনে পড়ে থাকা জয়তীর দেওয়া চাবির গোছাটা তুলে নিল সযত্নে। তার পরে জয়তীর দিকে হাতজোড় করে বলল, ‘‘জানি আমি বেশ্যা, তাও একবার তোমায় অনুরোধ করছি, আমি কি শেষবারের মতো ওকে একটু ছুঁতে পারি? ও বলেছিল, জীবিত অবস্থায় যাতে আমি ছুঁতে না পারি। তার পরে নিজেই ছুঁয়েছিল, কিন্তু আমার মতো নোংরা মেয়ে, হাজার লোকের সঙ্গে শোয়া বেশ্যা তো, তাই ওর ছোঁয়া টের পাইনি গো! বলো না, প্লিজ, একটু ছোঁব ওকে?’’

ঈশিতার ধড়মড় করে উঠে বসা থেকে পরপর সব কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল জয়তী এবং বাকিরা। জয়তী বুঝতে পারল, ঈশিতা উল্টোপাল্টা বকছে, মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছে খুব আস্তে আস্তে। ও দ্রুত সামনে গিয়ে ঈশিতার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেই সঙ্গে সঙ্গে নিজের বুকে মধ্যে জোর করে টেনে নিয়ে কান্না আর মমতা মাখানো একটা গলায় বলল, ‘‘কেন তুই নিজেকে সবার কাছে ছোট করছিস এ ভাবে? তুই সৌমাভদার বিয়ে করা স্ত্রী। তুই কুট্টি-মুট্টির মা। ভুল করেছিলি, তার শাস্তিও পেয়েছিস। কিন্তু আজ যে কথাগুলো বলছিস, সেটা সৌমাভদার থেকেও বেশি তোর নিজের ছেলেমেয়ের জন্য কষ্টের, খারাপ, অপমানের। মা হয়ে এটা বোঝ! তোকে বকেছি মানে এই নয়, তুই যা খুশি ভেবে নিবি নিজেকে।’’ বলে হুহু করে কেঁদে ফেলল এতক্ষণ ধরে শক্ত থাকা জয়তী। আর ওর বুকের মধ্যে ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল ঈশিতা।

সেই যে জয়তীর কথায় সুভদ্রা ও কুট্টি-মুট্টি ঘরে ঢুকেছিল, তার পর থেকে তাদের দেখা যায়নি। ঈশিতা জ্ঞান হারিয়েছে বুঝেই ওর বড়দি ও মেজদিকে ডেকে জয়তী বলল, ‘‘তোমরা একটু ধরে ওকে শুইয়ে দাও। চোখেমুখে জল দাও।’’ বলেই সুবি সুবি বলে ডাকল। ওর ডাক শুনে সুভদ্রা ও মুট্টি প্রায় একসঙ্গেই বাইরে এল। ও ইশারায় কাছে আসতে বলল। সুভদ্রা আসতেই ও কানে কানে কিছু একটা বলল। তার পর মুট্টিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই ঘরটায় ঢুকল, যেখানে এখনও শুয়ে সৌমাভ, তবে মৃত।

ঈশিতার জ্ঞান ফিরতে দেখল, কার একটা কোলের মধ্যে ওর মাথাটা রাখা। চুলগুলো ভিজে, গায়ের কাপড়টাও কিছুটা ভিজে ভিজে। মুখটা তুলে দেখল, একটা অচেনা মেয়ে। প্রায় ওরই বয়সী। গায়ের রঙটা তত ফর্সা নয়, তবে চোখমুখ খুব শার্প। মুখটা ভারী মিষ্টি, তবে চোখের কোনে এখনও জল। মেয়েটি এতক্ষণ চুপ করে বসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর ঘুরেঘুরে দেখাটা শেষ হতেই একটু হেসে বলল, ‘‘আমাকে দেখা শেষ হলে এবার ওঠ। ও ঘরে যেতে হবে। তোমার অনেক কাজ।’’ কথাটা শুনে একটু চমকে গেল ঈশিতা। কি নরম গলা মেয়েটার? এই তাহলে সুভদ্রা? কুট্টি-মুট্টিকে মায়ের যত্ন নিয়ে সেই চার মাস বয়স থেকে এত বড় করেছে একার হাতে? ও নিজে জানে, সৌমাভর স্ত্রী হিসেবে তো বটেই, দুটো ছেলেমেয়ের শুধু জন্ম দেওয়া ছাড়া মায়ের কোনও দায়িত্বও ও পালন করেনি। উল্টে শেষদিন বেওয়ারিশের মতো ওদের বাইরের কটে রেখে ঘরে...। ওর মাথায় বারবার সেদিনের ছবিটা ঘুরে আসে আর বোঝে কী করেছিল সেদিন ও! কিন্তু ওকে কোথায় যেতে হবে? কী কাজ? মেয়েটা যেন ওর মনের কথা পড়ে ফেলল। ওর মাথাটা কোল থেকে তুলে নিজে উঠে দাঁড়িয়ে ওর একটা হাত ধরে টেনে তুলল। তার পরে প্রায় জড়িয়ে ধরে নিয়ে ঢুকল সেই ঘরটায়, যে ঘরটা থেকে ঘন্টা দেড়েক আগেই ভেসে এসেছিল সৌমাভর মৃত্যুর খবর আর কান্না।
Like Reply
(৪৩)


সেকি কেবলি চোখের জল



ঘরে ঢুকে দেখল, দুই ভাইবোন তখনও সৌমাভর বুকে মাথা রেখে শুয়ে। নিঃশব্দে কাঁদছে। সুভদ্রা ওদের উঠতে বলল, ওরা উঠে বাইরে চলে গেল একটা কথাও না বলে। বিছানার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠল ঈশিতা! এ কাকে দেখছে ও। সেই পেটানো, ছিপছিপে চেহারা, ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, মাথাভর্তি চুল, মুখে সব সময় হাসি— কিচ্ছু নেই! একটা রোগা, বুড়োটে চেহারা বিছানায় ঘুমোচ্ছে যেন! চোখেমুখে কষ্টার ছাপ, তবু ঠোঁটের কোনে যেন একটু হাসি মাখানো। ওর আবছা মনে পড়ল, এই রকম দেখতে একটা লোকই সেদিন ওকে অ্যাক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়ে হাত ধরে একটা দোকানে বসিয়ে ওর হাতে জলের বোতল তুলে দিয়েছিল। সেটা এই লোকটাই? এটা সেই সৌমাভ? ১৯ বছর আগের এক নভেম্বরে আগুনের সামনে বসে যার সঙ্গে জীবন কাটানোর কয়েকটা মন্ত্র পড়েছিল কিচ্ছু না বুঝে! যদিও পরে মনে মনে হাজারবার বলেছিল, ওর স্বামীর মতো স্বামী হয় না। এটা সেই লোকটা? এ কোন সৌমাভ? ঈশিতার মনে পড়ল, বহু বহু বছর আগে, ও বাপের বাড়ি চলে আসার কয়েক মাস পর থেকেই সৌমাভর শরীর খারাপ হচ্ছে দেখেও কিছু করা তো দূর, জিজ্ঞাসাও করেনি। আর তারও অনেক মাস পরে বেলেঘাটার সেই বাসায় ফিরেও তো ও নিজেকে বিশেষ বদলায়নি। প্রথমে কলেজের অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত হল, তখন সৌমাভ এলেও ব্যস্ততার দোহাই দিয়ে পাশের ঘরে চলে যেত। তার পর তো সেই শুক্রবারের সকালটা...। নিজের শরীরের একটু সুখের জন্য সব হারিয়েছে তো বটেই, এই লোকটাকেও যে ও নিজেই তিলে তিলে শেষ করে ফেলেছে, ওর জন্যই যে লোকটাই আজ এই পরিণতি, তা এমনিতেও সবাই জানে। তবে সবচেয়ে বেশি জানে ঈশিতা নিজে। কারণ সৌমাভর শরীর খারাপ হচ্ছে দেখেও অত বছর আগেও ও কিছুই করেনি। ততক্ষণে গুঞ্জা বাদে বাকিরা সবাই এসে ওই ঘরে ঢুকেছে। ঈশিতা আর থাকতে পারল না। সুভদ্রার হাত ছাড়িয়ে ঝাঁপ দিল সৌমাভর উপরে। ওর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া দেহটার মুখে বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে কেঁদে উঠল পাগলের মতো হাউহাউ করে। একটু আগের কুট্টি-মুট্টির মতোই বারবার ‘‘একবার চোখ খুলে দেখ, আমি এসেছি গো...’’ বলতে বলতে ডুকরে উঠতে লাগল বারবার।

এসে অবধি চুপ করে ছিলেন ঈশিতার বড় দুই জামাইবাবু। এবার ওই কান্না শুনতে শুনতে জয়তীর দিকে তাকিয়ে বড় জামাইবাবু বললেন, ‘‘সেবার কালীপুজোয় ওর জ্বর হয়েছিল। চার দিন পরে গিয়ে দেখেছিলাম শরীরটা প্রচন্ড ভেঙেছে। ওর ন্যাচারাল লুকটাই উধাও। খুব খারাপ লেগেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম, নিজের যত্ন নেয় না। কিন্তু ও বলতে বারণ করেছিল কাউকে বলে আর বলিনি। তখন তো জানতাম না এই দিনটা দেখতে হবে!’’ বলে দুহাতে চোখ ঢাকলেন। ঘরের অন্যরাও কেঁদে উঠল, শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল জয়তী আর সুভদ্রা।

এরমধ্যেই কুট্টি-মুট্টির সঙ্গে এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। গলায় স্টেথো দেখে বোঝা গেল ডাক্তার। তিনি মৃত্যুর সময়টা নোট করে খসখস করে একটা প্যাডে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিলেন। তার পর ঘর ছেড়ে বেরনোর আগে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘ওঁর এত আত্মীয়-স্বজন আপনারা, তবু লোকটা ঠিকমতো খেত না, চিকিৎসা করাত না, এত সিগারেট খেত আর আপনারা কেউ কিছু করেননি? আশ্চর্য! যাক, পঞ্চায়েতের চিঠিটাও আমার লোকটা এসে দিয়ে যাবে। ওঁর দাহ তো এখানেই হবে শুনলাম। যাক, আপনারা ভাল থাকবেন, আমি আসি,’’ বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই গটগট করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ডাক্তার বেরিয়ে যেতেই জয়তী বলে উঠল, ‘‘এত সিগারেট খেত কী বলব! বম্বেতে থাকতে একবার হার্টঅ্যাটাক হল, সেটাও কত বছর পরে জানাল আমাদের! ওষুধ ওই প্রথম কয়েক মাস খেল, ব্যাস! এখানে আসার পরে যখনই বলেছি ডাক্তার দেখাও, তখনই খিঁচিয়ে উঠত। কি রাগ! ছেলেমেয়ের কথাও শুনত না। সৌমদা বলতে গেলে সুইসাইড করল!’’ ঘরের বাকিরা তো বটেই, ঠান্ডা হয়ে যাওয়া সৌমাভর পায়ে মাথা রেখে চোখের জল ফেলতে ফেলতে কথাটা মনে মনে মেনে নিল ঈশিতা নিজেও। তার পরেই দেখল দুই ভাইবোন সুভদ্রা আর জয়তীর কানে কানে কিছু বলে ঘরের বাইরে চলে গেল।

একটু পরে সবাইকে ঘর থেকে বের করে দিল জয়তী, শুধু ঈশিতা আর সুভদ্রাকে রেখে। দরজা বন্ধ করার আগে বলল, ‘‘ওকে সাজিয়ে দে, শেষবারের মতো। আমি থাকতে পারব না। তোরাই কর।’’ বলে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সুভদ্রা একটা নতুন ধুতি এনে ঈশিতাকে বলল, ‘‘ওকে পরিয়ে দাও, আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। কুট্টি-মুট্টিকে বড় করে তুললেও ওদের আসল মা তো আমি নই। আর স্ত্রীও ছিলাম না ওর কোনও দিন। স্ত্রী হিসেবে ওর শরীরে তোমারই অধিকার সবচেয়ে বেশি, তাই তুমিই ওটা কর।’’ বলে মাথা নিচু করে ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা টেনে দিল।

মৃত শরীরের পরনের লুঙ্গিটা আস্তে আস্তে খুলে নিল ঈশিতা। এই শরীরটা শুধুই ওর ছিল, আজও ওরই আছে। মাঝে কেটে গেছে উনিশ বছর। এই শরীরটা ওকে অনেক সুখ দিয়েছে, কিন্তু ও কিছুই ফিরিয়ে দেয়নি, উল্টে ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছে। ভাবতে ভাবতে নগ্ন দেহটায় অসংখ্য চুমু খেল। ঠান্ডা ঠোঁটে, চোখের পাতায়, গালে, কপালে, বুকে, পেটে। তার পরে লিঙ্গটা হাতে ধরে একটা চুমু খেয়ে বলল, ‘‘এই জন্মে তোমায় পেয়েও নিজের পাপে হারিয়েছি। পরের জন্মে যেন তোমাকেই স্বামী হিসেবে পাই, প্লিজ আজ এটুকু আশীর্বাদ করো আমায়। আজ তোমায় আমি ছুঁতে পারলেও তুমি বুঝতে পারবে না, প্লিজ এটুকু ভিক্ষা দাও’’, বলে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল সৌমাভর কোমরে মাথা রেখে। ওর কান্নার আওয়াজে সুভদ্রা ঘরে ঢুকে বলল, ‘‘কেঁদো না, আর এই ভাবে রেখো না। ওনার শরীরে ধুতিটা পরিয়ে দাও। এখনও অনেক কাজ বাকি। সাজাতে হবে তো!’’ ঈশিতা চোখ মুছে ধুতিটা কোমরে লুঙ্গির মত করে বেঁধে দিল। সুভদ্রা ঘরেই ছিল। ওর সামনেই করল সবটা। তার পর একটা নতুন পাঞ্জাবি এনে পিছনটা কেটে সেটা শক্ত হয়ে যাওয়া দেহটা দুজনে মিলে তুলে হাত গলিয়ে কোনও রকমে পরাল। তার পর কপালে চন্দনের ফোঁটা দিল দুজনে মিলে। ওদের দুজনের চোখের জলে সৌমাভর পাঞ্জাবি, ধুতির কত জায়গায় জলের দাগ বসে গেল। চন্দন ধুয়ে গেল কতবার! ওরা সাজানো শেষ করে বাইরে আসার পরে সবাই ভিতরে ঢুকল। সৌমাভকে ঘিরে বসল। শুধু কুট্টিকে চোখে পড়ল না, মুট্টিকেও। সুভদ্রা বাড়ির দাওয়া থেকে নেমে সামনের দিকে চলে গেল, কী করবে কে জানে!

জয়তী ঈশিতার সঙ্গেই সঙ্গেই এল। ঈশিতা ঘরের বাইরে আসতেই এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকা গুঞ্জা উঠে এল। কিন্তু গুঞ্জা কিছু বলার আগেই ওকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে হাতের ফোনটা নিয়ে দ্রুত একটা নম্বর খুঁজতে লাগল ঈশিতা। তার পর ফোনটা কানে নিল। কিছুক্ষণ পরে খুব শান্ত এবং নরম গলায় ওপাশের কাউকে বলল, ‘‘আপনি শুভম বলছেন? হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ঈশিতা সরকার বলছি। মানে ঐশী রায়চৌধুরীর দিদি বলে চিনত আমাকে অনেকে, আপনিও। ও আমার বোন ছিল একসময়। হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি শান্তিনিকেতনে পড়াই। এই তো চিনতে পেরেছেন। যাক শুনুন, কাজের কথা বলি। আমার স্বামী সৌমাভ সরকার একটু আগে মারা গেছেন। আমার দুই ছেলেমেয়ে কুট্টি আর মুট্টি মানে অরণ্য আর মৃত্তিকা তাদের বাবার কাছে বসে আছে। আমার দিদি-জামাইবাবুরাও। আপনি আগে আমার কথাটা শুনুন। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের একটা কথা হয়েছিল। সেটা মিথ্যে নাটক ছিল, বুঝলেন। তখন আপনাকে আমার ব্যাপারে মিথ্যে বলা হয়েছিল। আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ১৯ বছর আগে। আমার দুই যমজ ছেলেমেয়ে এবার জুলাইয়ে ১৮-য় পা দিয়েছে। কয়েক বছর পরে ওদের বিয়ে দিতে হবে, এই অবস্থায় আমি নিজে কি করে বিয়ে করব বলুন তো? বুঝতেই পারছেন। আমিও তখন সবটা বলিনি, সরি। আর আপনার আঙটিটা ঐশী রায়চৌধুরীর কাছে ফেরত দিয়ে দিয়েছি। ভাল থাকবেন, আর পারলে বিয়ে করে ফেলুন এবার। তবে আমার মতো ৩৭ বছরের বিধবা এবং দুই বড় বড় ছেলেমেয়ের মা কোনও বুড়িকে নয়, অন্য কাউকে। কেমন? রাখছি।’’ বলে ফোনটা কেটে ঐশীর দিকে তাকিয়ে একই রকম শান্ত কিন্তু দৃঢ় গলায় বলল, ‘‘আপনি প্লিজ ওই আঙটিটা শুভমবাবুকে ফেরত দিয়ে দেবেন, কেমন? আর আজ থেকে আমাকে দিদি বলে আত্মীয়তা করতে আসবেন না। নমস্কার’’, বলেই হতভম্ব ঐশীকে কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জয়তীর হাত ধরে দাওয়া থেকে নেমে সামনের দিকে গাছগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।
Like Reply
(৪৪)


প্রেম বলে যে যুগে যুগে    


জয়তী বুঝল, ঈশিতা নিজেকে ফের সৌমাভ সরকারের স্ত্রী এবং কুট্টি-মুট্টির মা হিসেবেই পরিচিত করে তুলতে চাইছে। যেটা এত বছরে করেনি। ও চুপ করে পাশাপাশি কিছুক্ষণ হেঁটে বলল, ‘‘ওদিকে চল, তোকে কয়েকটা জিনিস দেখাই।’’ বলে একটু এগিয়ে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাশাপাশি বিরাট তিনটে নিমগাছের একটার নিচে দাঁড়িয়ে ঈশিতাকে বলল, ‘‘উপরে গাছটার নাম লেখা আছে, পড়।’’ ঈশিতা উপরে তাকিয়ে ধাক্কা খেল, গাছটার গায়ে একটা টিনের বোর্ড তার দিয়ে আটকানো, তাতে লাল কালিতে লেখা ‘ঈশিতা’। চমকে উঠে জয়তীর দিকে তাকাতেই বলল, ‘‘এবার পাশের গাছ দুটো দেখ। পরপর গাছগুলো দেখ, বুঝতে পারবি।’’ ঈশিতা দেখল পাশাপাশি অন্য দুটো নিমগাছের গায়ে একই ভাবে তারে বাঁধা টিনের বোর্ডে ‘অরণ্য (কুট্টি), এবং মৃত্তিকা (মিট্টি) লেখা আছে। তার পরের দুটো আমগাছে সুভদ্রা এবং জয়তীর নাম লেখা। ও অবাক হয়ে তাকাতেই জয়তী একটু হেসে বলল, ‘‘ওই বাড়িটা সৌমদার পৈত্রিক বাড়ি। লাগোয়া কিছুটা জমিও। সৌমদা সেই চলে যাওয়ার পরের বছর জানুয়ারিতে ছেলেমেয়ের অন্নপ্রাশনের সময় কলকাতায় এসে কাজ মিটিয়ে ওদের আমার ফ্ল্যাটে আমার আর সুভদ্রার কাছে রেখে এখানে এসে বাড়িটা উদ্ধার করে। সারায়। সেই সঙ্গে আরও জমি কিনে পরপর পাঁচটা গাছ লাগায়। তখনই নামগুলো লিখে রেখেছিল। পরে যখনই আসত অনেক গাছ লাগাত। ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নেওয়ার পরে এখানে প্রায়ই আসত। এবার নভেম্বরে এসে আর কলকাতায় ফেরেনি। একাই থাকত বেশির ভাগ সময় গাছগুলোকে নিয়ে। আমাদের অফিস, ছেলেমেয়ের কলেজ, আমার ছেলেটার কলেজ। সব মিলিয়ে আমরা বেশি আসতে পারতাম না। তবে ডিসেম্বরের ছুটিতে যখন সবাই মিলে আসি, তখন সৌমদা বোধহয় বুঝেছিল, সময় এসে গেছে। তখনই পঞ্চায়েত থেকে পার্মিশন করিয়ে নেয়, এই জমিতেই ওর দাহ হবে। আর একটা কথা বলেছিল, কষ্ট পাস না। ও গাছগুলো লাগানোর সময়েই ঠিক করে নিয়েছিল, ওর চিতা সাজানো হবে তোর নাম লেখা গাছটার কাঠ দিয়ে! সেই তখন থেকে ওই গাছটার শুকনো ডাল, ঝড়ে ভেঙে পড়া ডাল, পাতা, সব একজায়গায় রাখা আছে ওদিকে। আর এদিক ওদিক অন্য গাছগুলোর ডাল, পাতাও জড়ো করা আছে অন্য একটা জায়গায়। আর ওর ছাই কোথাও ভাসানো হবে না, এটা সবাইকে বলেছিল। তার বদলে তোর নাম লেখা গাছটার নিচে একটা বেদি মতো করে সব রাখা থাকবে। সৌমদা বলত, ‘‘মরার পরে অন্তত ঈশিতার কোলে শুয়ে থাকতে পারব, তাই এরকম ব্যবস্থা করে রেখেছি’’।’’

একটু পরে সৌমাভকে ঘর থেকে খুব যত্ন করে বাইরে আনল কুট্টি-মুট্টি-সুভদ্রা আর ঈশিতার দুই জামাইবাবু। যত্ন করেই শুইয়ে দেওয়া হল কাছের বিছানায়। গুঞ্জা বা তার বরকে কোথাও দেখা গেল না। সৌমাভর দেহটা বের করে আনার পরে ওর বিছানাটা তুলতে গিয়ে প্রচন্ড ধাক্কা খেল ঈশিতা। ওর আর সৌমাভর একটা বিরাট ছবি। ল্যামিনেট করা! ওর মনে পড়ল, আন্দামানের একজন পরিচিত লোককে দিয়ে এই ছবিটা তুলিয়েছিল সৌমাভ। তখন ওদের প্রতিদিন সুখের ভেলা ভাসত। সেই ছবি? তাও সৌমাভর বিছানার নিচে? ও চোখ তুলতেই জয়তী একটু হেসে বলল, ‘‘সৌমাভদা বারিপদায় থাকতে থাকতে যখন তোর সব ছবি কেটে তোকে পাঠাতে ব্যস্ত, তখন এই ছবিটা আমি টুক করে সরিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম। এটার কথা তোর অবশ্য মনেই নেই। সৌমদা অনেকদিন পর্যন্ত ছবিটার কথা বলত। ও ভেবেছিল ছবিটা ওই বেলেঘাটার ফ্ল্যাটেই কোথাও তাড়াহুড়োয় পড়ে গেছে। কলকাতায় আসার পরে একদিন ছবিটা দেখিয়ে বলি, এটার অনেকগুলো প্রিন্ট আমার কাছে আছে, ফলে নষ্ট কোরো না। ও যে ছবিটা এনলার্জ করিয়ে ল্যামিনেট করিয়ে নিজের বিছানার নীচে রেখেছিল, বিশ্বাস কর জানতাম না। সুভদ্রা হয়তো জানত। যাক চল, ওই কাঠের বিছানায় লোকটা শুয়ে। ওর পিঠের নিচে এই বিছানাটা দিয়ে দিই। তা হলে আর কষ্ট পাবে না বোধহয়’’, বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার পর একাই বিছানাটা গুটিয়ে  বেরিয়ে গেল। ১৯ বছর আগের একটা ছবি হাতে নিয়ে ঘরে তখন চিত্রার্পিতের মত দাঁড়িয়ে ঈশিতা। হাসি হাসি মুখের ছবিটায় তখনও যেন জীবন্ত সৌমাভ, ওর দিকেই তাকিয়ে হাসছে! ওর প্রতি সৌমাভর ভালবাসা কতটা ছিল, ছবিটা আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল ঈশিতাকে।

একটু পরে দুচোখে জল নিয়েই কুট্টি-মুট্টি দু’জনে হাত মিলিয়ে বাবার মুখাগ্নি করল। ঈশিতার নাম লেখা নিম গাছের কাঠের চিতায় জ্বলে উঠল সৌমাভ সরকারের শরীর। তার পরেই কাঁদতে কাঁদতে সুভদ্রাকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল, ‘‘মামন, তুমি আমাদের এই ভাবে ছেড়ে যেও না, বলে আঁকড়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদল দু’জনেই অনেকক্ষণ ধরে। ওদের কান্না দেখে সুভদ্রাও খানিক কাঁদল, তার পর বলল, ‘‘তোদের ছেড়ে চলে যেতে গেলে তো আমাকেও মরে যেতে হয়। তাহলে মরে যাই?’’ বলে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল দু’জনকেই। একটু পরে সুভদ্রাকে ছেড়ে জয়তীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘‘তুমি ওই সল্টলেকের বাড়িটা বিক্রি করে এবাড়িতে চলে এস ভাইকে নিয়ে। কোনও কথা শুনব না, বলে দিলাম।’’ বলে জয়তীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঈশিতা, ওর দুই জামাইবাবু, বড়দি-মেজদির দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বলল, আপনারা একটু চা-মিষ্টি খান। ঈশিতাকে বলল, ‘‘ম্যাডাম, আপনারা সেই সকালে একটু মুড়ি খেয়েছেন। এবারে একটু চা-মিষ্টি খান ততক্ষণ’’, বলেই বুড়িদিদি বলে হাঁক পেরে ওদিকে চলে গেল।

ম্যাডাম? নিজের মা জানতে পেরেও এখনও ম্যাডাম বলেই ডাকল? ঈশিতার আর সহ্য হল না। দৌড়ে দিয়ে জয়তীর বুকে আছড়ে পড়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘‘ওদের বল না জয়তীদি, একবার আমাকে মা বলে ডাকতে। আমি তো ওদের মা। আমি খারাপ, নষ্ট মেয়ে, তবু তো ওদের মা, বলো। একবার বলুক আমাকে মা বলে ডেকে। প্লিজ বলো না ওদের।’’ ঈশিতার আকুলতা বুঝল জয়তী, সুভদ্রাও। জয়তী ঈশিতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘‘একদিনে বা একবারে হবে না। সময় লাগবে। ওরা দু’জনেই বিশেষ করে কুট্টি বাপের স্বভাব পেয়েছে। মুট্টিও অনেকটা তাই। ফলে সময় লাগবে। শান্তিনিকেতনে থেকে কলকাতায় কোনওদিন না দেখা ছেলেমেয়ের মুখে মা ডাক শোনা অসম্ভব। তোকে চাকরি তো ছাড়তেই হবে, সেই সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে সুভদ্রার ফ্ল্যাটে ওদের সঙ্গে ২৪ ঘন্টা থাকতে হবে। কী খায়, কী পরে, কখন খায়, কতটা খায়, কখন কলেজ যা, কী রং পছন্দ, কেমন খাবার ভালবাসে, কখন কলেজ থেকে ফেরে— সব জানতে হবে, শিখতে হবে, করতেও হবে। সুভদ্রাকেও সেই জমিটা ছাড়তে হবে তোকে, সেটা তোরা দু’জনে মিলে ঠিক করে নিস। তবে আবার বলছি, এতবছর যাকে মা হিসেবে জেনে মামন বলে ডেকেছে, যার কাছে কয়েক ঘন্টা আগেও চড় খেয়ে একটা শব্দও বলেনি, তাকে ওদের থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করিস না। সেটা করলে বরাবরের মতো হারাবি ওদের। সুভদ্রাকে বোন বল, সতীন বল, বন্ধু বল, যে ভাবে হোক মেনে নিয়েই তোকে ওর সঙ্গে একবাড়িতে থাকতে হবে। সেটা যদি পারিস, ওরা একসময় তোকে মা বলেই ডাকবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু যে ভুল, অন্যায় ওদের সঙ্গে এবং ওদের বাবার সঙ্গে এত বছর করেছিস, সেটা শোধরাতে গেলে এটুকু তোকে করতেই হবে। না হলে আশা ছেড়ে দে।’’

জয়তীর বুকে মাথা গুঁজে ঈশিতা বুঝল, একটুও ভুল বলছে না জয়তীদি। ও এবার জয়তীকে ছেড়ে সুভদ্রাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে বলল, ‘‘তুমিই ওদের মা, মামন, ওদের সব কিছু। তুমি আমাকে একবার সুযোগ দাও। যদি কোনওদিনও নিজের থেকে ওরা মা বলে ডাকে আমাকে, আমি মরেও শান্তি পাব। তুমি যা বলবে, করব, দেখে নিও। প্লিজ, বলে নিচু হয়ে ওর পা ধরতে গেল। সুভদ্রা তাড়াতাড়ি ওকে তুলে ধরে বুকে জড়িয়ে বলল, ‘‘এখন কটা দিন এখানেই আমরা থাকব। কাজকর্ম মিটলে কলকাতায় ফিরব। তার মধ্যে তুমি সব গুছিয়ে নিয়ে কলকাতায় চলো। কুট্টিমুট্টির বাবা বিরাট বাড়ি করে দিয়েছে, ফলে থাকার সমস্যা নেই। শুধু এই বারে ওদের মা হওয়ার চেষ্টা করো। আমি কথা দিলাম, তোমাকে সবরকম ভাবে হেল্প করব। তবে সত্যিই অনেক সময় লাগবে। অনেক কথা শোনাবে তোমাকে, সব সহ্য করেই ওদের বুকে টেনে নিতে হবে তোমাকেই। আর চার মাস থেকে বুকে ধরে এত বড় করার পরে আমার পক্ষে ওদের ছেড়ে থাকা কঠিন নয়, অসম্ভব। তাই আমি ওদের কাছেই থাকব। তোমার ভয় নেই, আমি ওদের বা তোমাকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাব না। এবার তুমি ঠিক কর। আমাকে ওদের সঙ্গেও কথা বলতে হবে, দিদিও বলবে।’’

সৌমাভর দেহটা ছাই হয়ে গেলে কুট্টি এবং আরও কয়েকজন স্থানীয় লোক মিলে আগে থেকে খুঁড়ে রাখা একটা ৬ ফুট বাই ৩ ফুট অগভীর গর্তে সব ঢেলে দিয়ে মাটি চাপা দিল। তার পর সেখানে অনেকগুলো ধুপ আর মোমবাতি জ্বালিয়ে কুট্টি পুকুরে নেমে স্নান করে নিল। মুট্টি বাথরুমে স্নান সেরে নতুন কাপড় পরে এসে বসল বাবার ঘরটায় তখন প্রায় সন্ধ্যা নেমে গেছে। দিদি-জামাইবাবুরা বললেন, ওঁরা আজ আর ফিরবেন না, কাল কালে চলে যাবেন, কাজের দিনে ফিরবেন। গুঞ্জাদের এর মধ্যে খোঁজ মিলল না। ওরা বুঝল, গুঞ্জারা ফিরে গেছে শান্তিনিকেতনে।
Like Reply




Users browsing this thread: 2 Guest(s)