Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আলোর দিকে
রোজকার মতোই চোখ রোদ পড়ে ঘুম ভেঙে গেল বিপিনবাবুর।
আরও একটা সকাল! আরও একবার বিরক্তিকর ভাবে ঘুম ভাঙা। জানেন, চোখে সামান্যতম আলো এলেও ঘুমোতে পারেন না উনি, তাও জানলার পর্দাটা টানটান করার কথা মনেই থাকে না রাত্তিরবেলা। অবশ্য জানলা বন্ধ করছেন আজকাল, এই না কত! অবশ্য জানলা বন্ধ না করে উপায়ই বা কি! সন্ধ্যে থেকেই মশা আসে বড্ড। আর বাকি সব কিছু সহ্য করা যায়, কিন্তু মশা - ওই ছোট্ট ছোট্ট জীব - ওদের কামড় - উফ অসহ্য এক্কেবারে! তাই এখন বিকেল হতেই ঘরের সবকটা জানলা বন্ধ করে দেন। তবে ওই, পর্দাটা টেনে দেবার কথা মনেই থাকে না।
আরও অনেক কিছুই মনে থাকে না। ওষুধ খাবার কথা, পাম্প চালাবার পরে বন্ধ করার কথা।
মানসী মনে রাখত সব! তখন মনে হতো না এসব খুব বড় কোনো কাজ। মনে হতো "এসব আর এমন কি, সবাই পারে"। কিন্তু আটমাস আগে বলা নেই কওয়া নেই মানসী ড্যাং ড্যাং করে চলে যাবার পর থেকেই মনে হচ্ছে "তাই তো, এসব ও তো কাজ - করতে হয়।"
কথায় বলে "ভাগ্যবানের বৌ মরে"। এতদিন এইসব প্রবাদ - ট্রবাদ নিয়ে মাথা ঘামাননি বিপিনবাবু। প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করতেন, সংসার নিয়ে ভাবার সময় আর দরকার, কোনোটাই হয়নি। মাসের শুরুতে, স্যালারি হলেই সংসার খরচের টাকা দিয়ে দিতেন মানসীকে। কিভাবে সংসার চলে, মেয়ের পড়াশোনা, নাচের ইকলেজ, কোনোকিছু নিয়েই ভাবতে হয়নি কখনও। ভাবার কথা মাথাতেও আসেনি। এমনকি মেয়ের যে কিভাবে বিয়েটাও হয়ে গেল, সেটা নিয়েও ভাবতে হয়নি। অনির্বাণ রিমির এম বি এ ক্লাসের বন্ধু ছিল। সেখানেই আলাপ হয়েছিল দুজনের। মেয়ের ফোনে কথা বলার বহর আর ধরণ দেখে বুঝে গেছিলেন 'ডাল মে কুছ কালা হ্যায়'! তার কিছুদিন পরেই অর্নিবাণ আর রিমি দুজনেই দুটো ভাল ভাল কোম্পানিতে প্লেসমেন্ট পেয়ে গেল। আর চারহাত এক হয়ে গেল। মানসীর জন্যে বুঝতেও হয়নি মেয়ের বিয়ের ঝক্কি কাকে বলে! এখন তাই যেন আরও বেশি একা লাগে! মনে হয়, সারাটা জীবন কিছুই করেন নি, এক্কেবারে স্বার্থপরের মতো জীবন কাটানো ছাড়া। সকালবেলা অফিস যাওয়া, মুখ বুজে কাজ করা, দুপুরে টিফিন, সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে খবর দেখতে দেখতে চা - খানিক টিভি দেখা তারপর রাতের খাবার সেরে ঘুম - এই চক্রব্যূহেই কেটেছে এত্তগুলো বছর। রিটায়ার করার পরও প্রায় সেভাবেই জীবন কাটছিল। রিমিরা এখন ব্যাঙ্গালুরুতে থাকে। অনেকবার বলেছিল ওর কাছে যেতে। ম্মানসী যেতেও চেয়েছিলেন। কিন্তু, তার আগেই…
এখন মনে হয়, কেন যে একটু অন্যভাবে জীবনটা কাটালেন না! মেয়েটার বেড়ে ওঠাটাই দেখা হল না। এখন খুব একা লাগে। খুব বড় না হলেও এই দোতলা বাড়ি, ছাদ - খাঁ খাঁ করে যেন খালি বাড়িটা।
আজকাল রাতে ঘুমও আসতে চায় না। আগে শুনেছিলেন বিপিনবাবু, বয়স হলে নাকি ঘুম কমে যায়। এখন নিজে হাড়ে হাড়ে বুঝছেন সেটা। শুয়ে পড়েন বেশ তাড়াতাড়ি, কিন্তু এপাশ ওপাশ করেই কাটে অনেকটা সময়। কত যে চিন্তা আসে মাথায়! রিমিরা ভাল আছে তো? রিমি আর অনির্বাণ অনেকদিন একসঙ্গে ফোন করে না… কোনো সমস্যা হয়নি তো ওদের মধ্যে? অর্থহীন ভাবনা, তাও একটার পর একটা চিন্তা মাথায় এসেই যায়। ঠিক যেন একটা 'চেইন অফ থটস'! আর রাতের ঘুমটা গাঢ় হয়ে আসে ভোরের দিকে। সেই ঘুমটা যদি এভাবে চোখে রোদ পড়ে ভেঙে যায় - দিনের শুরুটাই কেমন একটা হয়ে যায়! জোর করে কালমেঘ পাতার রস খাওয়ার মতো…
মানসী জোর করে খাওয়াত কালমেঘ!
মানসী! সারাজীবন পাশে থাকার কথা বলে কেমন চলে গেল! একবারও ভাবলো না উনি একা একা কিভাবে থাকবেন? মৃত্যুর ওপর কারো হাত নেই - তবু মাঝে মাঝেই মনে হয়, মানসী যেন ইচ্ছে করে নিজেকে কষ্ট দেবার জন্য রোগ বাঁধিয়েছিল। এমনকি কখনও মুখ ফুটে বলেওনি। বুঝতেও দেয়নি। আর তাই…
যতবার এইকথাটা ভাবেন - বুকটা ভারী হয়ে আসে বিপিনবাবুর। বরাবরের বেখেয়ালি মানুষ উনি - তাও সবচেয়ে কাছের মানুষটার শরীরের অবস্থা চোখেও পড়ল না? এটা কি স্বার্থপরতা না? এখন যে এক্কেবারে একা হয়ে গেলেন? একা এবং অর্থহীন একজন মানুষ!
রিমি অনেকবার ওর কাছে পাকাপাকি চলে যেতে বলেছে। কিন্তু, মন চায় না। এই বয়সে কলকাতা ছেড়ে নতুন করে জীবন শুরু - তাও ওরা দুজনেই সারাদিন ব্যস্ত থাকবে… নতুন শহরে তা আরও অসহ্য লাগবে না?
তারচেয়ে যদি এখানেই, এখনই মৃত্যু হতো? চুপিসারে… কাউকে কিচ্ছুটি জানতে না দিয়ে? আহ্! শান্তি হতো! "মরণ রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান"।
টলমলে পায়ে উঠে বাথরুমে গেলেন বিপিনবাবু। একচিলতে বাথরুমে বেসিনের সামনে আয়না। পরিষ্কার হয়না অনেকদিন, তাই ঘষা ঘষা লাগে। ওপারের মানুষতা যেন বিপিনবাবু না, অন্য কেউ। দাঁত মাজার পেস্ট মুখে নিয়ে কেমন বীভৎস লাগছে!
ঠিক ওঁর জীবনের মতোই।
তারচেয়ে যদি শেষ করে দেওয়া যেত!
নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়েই হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। "মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান!" মরতে হবে! এই একা একার জীবন আর মানা যাচ্ছে না। হ্যাঁ, মেয়ে, হয়ত জামাই ও কষ্ট পাবে। তবে ভুলেও যাবে শিগগিরিই। জীবন থেমে থাকবে না ওদেরও। আর হয়ত উনি না থাকলে রিমি আর অনির্বাণের মধ্যে কোনো যদি সমস্যা হয়েও থাকে, মিটে যাবে… দুজন দুজনের কাছাকাছি চলে আসবে। অনেকসময় অনেক বড় শোক দুজন মানুষকে কাছে টেনে আনে…
কি যে হচ্ছে আজ বিপিনবাবুর, বারবার মনে হচ্ছে এই সেই দিন! আজ একটা কিছু করতে হবে! একটা কিছু… অন্যরকম কিছু…
আর উনি চলে গেলে কারো কিছু যায় আসবে না। হয়ত ঘর- ঝাঁট মোছা আর বাসন মাজার ঠিকে কাজ করে যে আরতি, সে ভাববে আরেক বাড়ি কাজ ধরতে হবে। আর হোম ডেলিভারিতে দুপুর আর রাতের খাবার দেয় যারা, তারাও বিরক্ত হবে। কিন্তু, থেমে থাকবে না কিছুই। তাই…
কিন্তু কি ভাবে?
ভাল সাঁতার জানতেন, ছোটবেলায় গ্রামের পুকুরে সাঁতার কেটেছেন বিস্তর। তাই জলে ডুববেন না। গলায় দড়ি? তারপর ফ্যান ভেঙে পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে? তখন তো বেশি সমস্যা। মরে যাওয়া এক, আর শয্যাশায়ী হওয়া আরেক।
ভাবতে ভাবতেই মাথায় এলো। নোয়াপাড়া মেট্রো স্টেশানের কাছেই একটি নতুন ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হচ্ছে। তার ছাদ থেকে ঝাঁপ দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ, এটাই, এটাই ভাল!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে পরণের লুঙ্গিটা খুলে একটা পাজামা আর ফতুয়া পরে নিলেন বিপিনবাবু। আর কিছুক্ষণ - তারপরেই…
বাড়িতে তালা লাগিয়ে রাস্তায় বেরোলেন বিপিনবাবু। মোড়ের মিষ্টির দোকানে জিলিপি ভাজা হচ্ছে। দাঁড়িয়ে দুটো গরম গরম জিলিপি খেলে কেমন হয়? আর তো মাত্তর কিছুক্ষণ! একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। শুধু জিলিপি না, দুটো কচুরিও খাবেন।
বেঞ্চে বসে অর্ডার দিয়েছেন, চোখে পড়ল একটি বেঞ্চের ধারেই গুটিসুটি মেরে বসা একটি কুকুরের দিকে। ভাল জাতের কুকুর, কিন্তু বড্ড রোগা! মাথা নিচু করে শুয়ে আছে। মাঝে মাঝে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। যেন খুঁজছে কাউকে… এতটাই প্রতীক্ষা মেশানো সেই চাউনি!
অনেকবছর আগে, তখন পড়াশোনা করতে কলকাতায় এসেছিলেন, শিয়ালদার কাছে একটা মেসে থাকতেন বিপিনবাবু। একটা কুকুরকে রোজ খেতে দিতেন। বেশ বন্ধু হয়ে গেছিলেন দুজনে। তার কথা মনে পড়ে গেল বিপিনবাবুর। সে যদিও রাস্তার 'নেড়ি' ছিল। কিন্তু এত ভাল জাতের কুকুর এভাবে কেন?
"এটা কার কুকুর?" শালপাতার বাটিতে কচুরি দিতে আসা ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন উনি।
"আর বলবেন না দাদু। কেউ একটা ফেলে রেখে গেছে। আর এ ও সেই থেকে এখানেই আছে। যত্তসব।" গজগজ করে বলে ওঠেন দোকানি।
"কি খায়?" কেমন মায়া মায়া চোখে তাকিয়েছে কুকুরটা ওঁর দিকে। অপরাধীর মতো দৃষ্টি চোখে। যেন খুব একটা অন্যায় করে ফেলেছে…
"কি আবার খাবে! বিস্কুট টিস্কুট দিই দু চারটে। "
"আহা রে, কত রোগা। ঠিক মতো খেতে পায় না…" নিজের মনেই বলে উঠলেন উনি।
বয়স হয়েছে কুকুরটির। স্থবির একটা ভাব দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
কেউ কিভাবে এভাবে একজনকে ফেলে দিতে পারে?
"কি আর বলব দাদু। এইভাবে একটা জীবনকে মিত্যুর মুখে ফেলে দিতে হয়? জীবন তো ভগমানের দান! নিজেরা তো সিষ্টি করতে পারিনা আমরা। তাহলে কেড়ে নেবার সাহস দেখাই কিভাবে? পাপ! পাপ! মহাপাপ!" কচুরির লেচি বানাতে বানাতেই বলেন দোকানি।
"আমাদের তো খাবারের দোকান, এখানে ঢোকাতে সাহস পাই না। যদি খাবারে কোনোমতে চুল টুল পড়ে! লোকে আর আসবেই না। এই ডিসেম্বর মাসে… এভাবে কেউ একটা প্রাণ ফেলে দিতে পারে? শাল্লা!"
জীবন তো সত্যিই নিজেদের সৃষ্টি না! তাহলে কেড়ে নেবার অধিকারও তো নিজের না…
কথাগুলো মনে মনে আওড়ান বিপিনবাবু।
ঠিক! ঠিকই তো!
বাবা মা জীবনদান করেন ঠিকই, কিন্তু শুধুই কি বাবা মা? নাকি ইলেকট্রন-প্রোটনের আড়ালে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা অন্য কেউ? আর সেই জীবন এইভাবে নিয়ে নেওয়া যায়?
পাপ! পাপ! মহাপাপ!
আর উনিও যে সেটাই করতে যাচ্ছিলেন!
পলকে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন বিপিনবাবু। আজ, হ্যাঁ, আজ একটা ভাল দিন হোক।
জীবন ফিরিয়ে দেবার দিন হোক।
"আমি ওকে নিয়ে যাব আমার বাড়ি? এভাবে ঠান্ডায় কষ্ট পাবার থেকে আমার সঙ্গে থাকুক? ডাক্তারও দেখিয়ে নেব একবার।" বলে ওঠেন উনি।
"নিয়ে যাবেন দাদু? খুব ভাল হয় তবে! বেঁচে যাবে ও।" একগাল হেসে বলেন দোকানি।
হেসে ওঠেন বিপিনবাবুও। তারপর কুকুরটার কাছে গিয়ে বলে ওঠেন "আয়, আয়, তোর নতুন বাড়িতে যাবি আয়।"
কুকুরটাও উঠে বসে…
ব্যস্ত রাস্তার দিকে একবার তাকান বিপিনবাবু। এই তো, আর নিজেকে একা, অসহায়, কর্মহীন লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে আবার একজন সঙ্গী পেলেন। বাড়িটা আর খাঁ খাঁ করবে না…
আচ্ছা, একজন লোক যদি রাখা যায়, যে ওকে দেখাশোনা করবে? আর ওর মতো আরও যদি কেউ বৃদ্ধ হয়ে, স্থবির হয়ে যায়, বাড়ির লোকেরা অবহেলা করে রাস্তায় রেখে যায়, তাদেরও যদি নিয়ে আসা যায়?
হ্যাঁ, প্রথম প্রথম অসুবিধা হবে ঠিকই। এতবছর সংসারের তো কিছুই দেখেন নি উনি। কিন্তু তাও, পারবেন উনি ঠিক…
আহ্! কী শান্তি এই ভাবনাতেই।
"আয় বাবা, চল" বলার সাথে সাথেই 'বাবা' উঠে ওঁর কাছে এসে দাঁড়ায়। যেন যাবার জন্য তৈরি!
একটু হেসে আবার বাড়ির পথ ধরেন বিপিনবাবু।
ঝোঁকের মাথায় কি করতে যাচ্ছিলেন... ভাগ্যিস চৈতন্যোদয় হলো!
সামান্য পরে মানুষ এবং না - মানুষের জুটি পাশাপাশি হাঁটছিল। আলোর দিকে। আলো মেখে...
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
রথের পরদিন হোস্টেলের মাঠে সকল ছাত্ররা খেলিতেছিল — বড় গোলযোগ। কোনও কিছুতে মন দেওয়া দায়। মৌলবি সাহেব দু’বার আসিয়া ধমকাইয়াছেন, তাঁহার নামাজে মনোসংযোগে ব্যাঘাত ঘটিতেছে বলিয়া। পণ্ডিতমশাই বলিয়াছেন যেন এইসব গোলযোগ সন্ধ্যারতির পূর্বে থামিয়া যায়, নতুবা তিনি ব্যবস্থা নিবেন।
এই গোলযোগের মাঝে ফটিক গণেশকে লইয়া যখন পণ্ডিতমশাই সমীপে আসিয়া একখানি কাপড় চাহিল,
পণ্ডিতমশাই অবাক হইয়া বলিলেন, “কাপড়ে কী করবি?”
ফটিক বলিল, “পূজা করিব মাস্টারমশাই।”
পণ্ডিতমশাই বিস্মিত হইলেন। তবে একখানি ধুতি দিয়া বলিলেন, “আমার পূজার কাপড়, নোংরা করিস না কিন্তু।” মনে ভাবিলেন, যদি পূজা-পূজা খেলাতে এই গোলযোগ কিঞ্চিৎ কমে, মন্দ কী। মৌলবি সাহেবও একই আশাতে তাঁহার নামাজের আসনখানি দিলেন। একই কথা বলিলেন, “নোংরা করিস না কিন্তু।”
অন্য মাস্টারমশাইদের এবং ছাত্রদের কাছে ফটিক আর গণেশ গিয়া বিবিধ সামগ্রী একত্র করিল, খাবার সামগ্রী ব্যতীত আর সকল কিছু ফেরত দিতে হইবে। তা অনেক কিছু জোগাড় হইয়াছে — বাতাসা, নকুলদানা, আধখানা আপেল, খানতিনেক পেয়ারা। মালীকে বুঝাইয়া কিছু ফুলেরও জোগাড় হইয়াছে।
ছাত্রদের কোলাহল যখন হঠাৎ করিয়া থামিয়া গেল, তখন সকল মাস্টারমশাইরা ভাবিলেন, যাক তাঁহাদের অনুমান সঠিক। তাঁহারা ভাবিতেও পারেন নাই কী অপেক্ষা করিয়া আছে দৈবে।
যখন বুঝিলেন, তখন সকলে স্বীয় কর্ম ছাড়িয়া দৌড়াইলেন মাঠের অভিমুখে কী হইয়াছে বুঝিবার নিমিত্ত। এমন কী হইতে পারে পূজাতে যে, সকল ছাত্ররা একযোগে চিৎকার করিয়া উঠিবে! সে কোলাহলের এত তীব্রতা যে, তাহাতে আরও গোলযোগ করা অসম্ভব।
মাস্টারমশাইরা বাহিরে আসিয়া যাহা দেখিলেন, তাহাতে তাঁহাদের হতভম্ব ভাব কাহারও নিকট লুকাইয়া থাকিল না।
কলেজের জলের বালতি বা চালের বস্তা জাতীয় ভারী সামগ্রী টানিবার নিমিত্ত যে চাকাওয়ালা কাঠের পাটাতন আছে, সেই পাটাতনখানিকে সুন্দরভাবে সাজানো হইয়াছে। তাহার চতুর্দিক মুড়িয়া দেওয়া হইয়াছে রঙিন কাগজ দিয়া, তাহার উপর পাতা হইয়াছে মৌলবি সাহেবের নামাজের আসন। আর তাহার উপর পণ্ডিতমশাইয়ের পূজার ধুতি পরিয়া বসিয়া আছে রামা মেথরের তিন বছরের পুত্র ডাকুয়া।
রামা মেথর হোস্টেলের একপ্রান্তে থাকে, আর ডাকুয়া কলেজের সকলের পরিচিত। ডাকুয়া কী একখানি রোগে আক্রান্ত হইয়া আপন হাত-পা চালাইতে পারে না — তাহাকে কেহ কখনও হাসিতে দ্যাখে নাই। সকল সময় নাক ফুলাইয়া কাঁদিতে থাকে। আপন হাতে খাইতে পারে না বলিয়া কেহ তাহাকে কিছু খাইতেও দেয় না। দিতে হইলে রামাকে দিয়া দেয়, সে খাওয়াইয়া দেয়।
সেই ডাকুয়া বসিয়া আছে পাটাতনের উপর, তাহাতে লাগানো একখানি দড়ি ধরিয়া ছাত্ররা শোরগোল করিয়া টানিতেছে আর মাঝে মাঝে ধ্বনি উঠিতেছে — “জয় জগন্নাথ।” ছাত্ররা রথযাত্রা খেলিতেছে। আর সেই রথে আসীন ডাকুয়া একগাল হাসিয়া বসিয়া আছে, আর সকলে আসিয়া তাহাকে এটা-সেটা খাওয়াইয়া দিতেছে আর তীব্র স্বরে বলিতেছে — “জয় জগন্নাথ।”
শোর করিয়া ছাত্ররা রথ টানিতেছে। গড় গড় করিয়া সেই রথ ঘুরিতেছে মাঠময়। যে সকল স্থানে ডাকুয়া কখনও যাইতে পারে নাই, আজ রথের উপর বসিয়া সেই সকল স্থান সে ঘুরিতেছে। যাহারা তাহাকে কখনও স্পর্শ করে নাই, তাহারা আসিয়া খাবার খাওয়াইতেছে — ডাকুয়া অনর্গল হাসিতেছে।
পণ্ডিতমশাই আর অন্যান্য মাস্টারমশাইদের দেখিয়া ছাত্ররা থামিয়া গেল, কেবল ফটিক দেখে নাই। সে রথ টানিয়া বেড়াইতে থাকিল মাঠময়। পণ্ডিতমশাই একবার অস্ফুটে বলিলেন, “আমার ধুতি।”
হোস্টেলের সুপার পণ্ডিতমশাইয়ের চেহারা দেখিয়া তাড়াতাড়ি বলিলেন, “ভাবিবেন না, আমি এখনই থামাইতেছি আর আপনার ধুতি ধোপাবাড়ি পাঠাইতেছি। আপনার নামাজের আসনও আনিতেছি মৌলবি সাহেব।”
তিনি বারান্দা হইতে নামিতে যাইবেন, কিন্তু পণ্ডিতমশাই তাঁহার হাত ধরিলেন। বলিলেন “সুপারমশাই, আমি সারাজীবন পূজা করিয়া যাহাকে পাইলাম না, ওই একরত্তি হতভাগা কেমন করিয়া জানিল তিনি কোথায় থাকেন?”
মৌলবি সাহেব আপন মনে বিড় বিড় করিতেছিলেন। “তোমাকে খুশি রাখিবার চেষ্টাতে কোনও ফাঁকি দিই নাই, কিন্তু এতদিনে জানিলাম তুমি খুশি হও কীসে।”
ছাত্ররা আবার সাহস পাইয়া রথ টানা শুরু করিল ফটিকের পিছু পিছু। সেদিন ফটিককে কেহ তিরস্কার করে নাই।
***
লেখক - আরিফ আহমেদ,
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনী, কলকাতা
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
কখনও কখনও, চোখের ব্যথার ক্ষেত্রে মা তার আঁচলকে গোল করে পাকিয়ে তাতে ফুঁ মেরে , গরম করে চোখের উপর রাখতেন, সমস্ত ব্যথা তখন অদৃশ্য হয়ে যেত ।
মায়ের কোলে ঘুমন্ত বাচ্চার জন্য কোলটি গদি এবং মায়ের আঁচল ঢাকার চাদর হিসাবে কাজ করত ।
যখনই কোনও অচেনা লোক বাড়ীতে আসত, শিশুটি মায়ের আঁচলের একটি আড়াল নিয়ে তাকে দেখত। শিশু যখনই কোনও বিষয়ে লজ্জা বোধ করত, তখন সে ঐ আঁচল দিয়ে মুখটি ঢেকে রাখত এবং আঁচলের ভেতর লুকিয়ে পড়ত ।
যখন বাচ্চাদের মায়ের সাথে বাইরে যেতে হত , তখন মায়ের আঁচল গাইড হিসাবে কাজ করেত । যতক্ষণ শিশুটির হাত আঁচল ধরে থাকত পুরো জগৎ তার মুঠোয় থাকত ।
শীতকালে যখন আবহাওয়া ঠান্ডা থাকত , তখন মা তাকে আঁচল দিয়ে চারপাশে জড়িয়ে শীত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।
আঁচল এপ্রোন হিসাবেও কাজ করত। আঁচল গাছ থেকে পড়া আম, জাম, খেজুর এবং মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত ফুল কুড়িয়ে আনতেও ব্যবহৃত হত। আঁচল, ঘরে রাখা জিনিস থেকে ধুলো মুছে ফেলতেও খুব সহায়ক ছিল।
আঁচলে একটি গিঁট দিয়ে, মা একটি চলন্ত ব্যাঙ্ক সঙ্গে রাখতেন এবং যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকত তবে মাঝে মাঝে তিনি সেই ব্যাঙ্ক থেকে কিছু পয়সা দিতেন ।
আমার মনে হয় না বিজ্ঞান এত উন্নতি করার পরেও আঁচলের বিকল্প কিছু খুঁজে পেতে সক্ষম হয়েছে।
*মায়ের আঁচল এক মায়াবী অনুভূতি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি পুরানো প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত এবং সর্বদা আমার মায়ের ভালবাসা এবং স্নেহ অনুভব করি, যা আজকের প্রজন্মের সম্ভবত বোঝার বাইরে*।
সমস্ত নারী জাতি কি অনুরোধ জানাই পোস্ট টা নিয়ে একটু ভাববেন!!! সত্যিই কি পোষ্ট টি সময়োপোযোগী নয়??
সংগৃহীত
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
12-09-2024, 12:56 PM
(This post was last modified: 13-09-2024, 12:18 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
বিশ্বাস করুন,
উৎসবেই আছি...
সেদিনের কথাই বলি,
খুব জোরে চিৎকার করে বলছিলাম
জাস্টিস! জাস্টিস! বিচার চাই!"
অনভ্যাসের জোর, কাশি হচ্ছিল খুব।
পাশে দাঁড়ানো সহযোদ্ধা পকেট থেকে
"এই যে, এটা মুখে রাখুন" বলে,
বাড়িয়ে দিলেন লজেন্স।
তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন
"জাস্টিস! জাস্টিস!"
মানবতায় বেঁধে থাকার উৎসব - টের পেলাম।
আরেকদিন।
মহামিছিলের পরে শ্রান্ত পায়ে বাড়ি ফিরছিলাম।
সেও, অনভ্যাসের হাঁটা
ব্যথায় কাতর ছিলাম।
একটা টোটো দেখলাম রাস্তায়।
"ঘরে ঢুকে যাচ্ছিলাম দিদি,
আপনাকে দেখে বুঝলাম কষ্ট হচ্ছে।
পৌঁছে দিচ্ছি"।
সম্পর্ক উদযাপনের উৎসব - বুঝলাম।
আর এই তো, গত পরশু।
মানব বন্ধন করে স্তব্ধ থাকার দিনে।
আঁকুপাঁকু করা কণ্ঠ এলো কানে -
"মা, আপনার হাতটা একটু ধরব?"
খেটে খাওয়া চেহারার বৃদ্ধ।
"দোকান বন্ধ করে দৌড়ে এলাম"।
"কিসের দোকান?"
"কলমী, পুঁই, বড়ি, নারকেল। দমদম বাজারে বসি।"
পাশে দাঁড়ানোর উৎসব - মানলাম।
আসলে এও এক পরিচয়ের উৎসব।
মানুষ কে, না মানুষকে...
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
13-09-2024, 12:19 PM
(This post was last modified: 13-09-2024, 04:17 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
উৎসব করো মেয়ে
যাক না তোমার মান,
মাথার উপর আমিতো আছি
দেবোই তো অনুদান।
ভাইয়েরা আমার দুষ্টু দামাল
দুষ্টুমি জারি থাক,
তার জন্য রাজকোষ থেকে
দিতে পারি দশ লাখ।
উৎসব করো মেয়ে
ভাইয়েরা আমার পিঠে ভালোবাসে
রাত বিরেতে খেতে,
করোনা দ্বিধা দুঃস্বপ্নে
তাদের সঙ্গে যেতে
উৎসব করো মেয়ে
নইলে কিন্তু বলবো আমি
ছিলে তো গর্ভবতী,
বদনাম করে ভাইদের মোর
সাজছো এখন সতী।
উৎসব করো মেয়ে
আমার রাজ্যে তোষামোদী করে
কামাও অর্থ, মান,
বিরোধীতায় জীবন দিয়ে
চুকাতে হবে দাম।
উৎসব করো মেয়ে
ছোট খাটো সব ঘটনা নিয়ে
ভাবছো তোমরা মিছে,
ভয় কি করেনা ? ঘাড় ঘুরিয়ে
দেখে নাও শুধু পিছে!
উৎসব করো মেয়ে
রঞ্জন কুমার বেরা
১১/৯/২৪
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
মধুরেণ
আজকাল পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে ছবি দেবার চল হয়েছে। তেমনি একটা বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে গেল কাবেরীর।
"৫'৫", ৩৫, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা, শিক্ষিকা পাত্রীর জন্য সুপ্রতিষ্ঠিত, শিক্ষিত, উদার মনের ও পরিবারের পাত্র চাই। মো- ৯৮৩১০০০০০০"
আর পাঁচটা রবিবারের মতোই 'পাত্র-পাত্রী চাই' এর পাতাটা মন দিয়ে পড়ছিলেন কাবেরী।
বাবুর জন্য যদি একটা মনের মতো পাত্রী পাওয়া যায়। যদি জীবনটা একটু নতুন করে শুরু করতে পারে!
ছেলের মতিগতি নইলে ভাল নয় একদম। খালি অফিস আর বাড়ি করেই কাটায়। অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছেন, কাউকে ভাল লাগে কিনা - কিন্তু প্রত্যেকবারেই 'না' শুনতে হয়েছে।
মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে কাবেরীর।
কলেজ জীবনে বাবু একটি মেয়েকে পছন্দ করেছিল। মেয়েটি বয়সে খানিকটা বড় ছিল। কাবেরীর আপত্তি ছিল পুরোমাত্রায়। অশান্তি-ঝগড়াও করেছিলেন ছেলের সঙ্গে। আত্মহত্যার হুমকিও দিয়েছিলেন তখন। কিন্তু ছেলে শোনে নি। তবে, সম্পর্কটা টেকেও নি। বছর খানেকের মধ্যেই ব্রেক আপ হয়ে গেছিল। সেই থেকে বাবু আর কোনো সম্পর্কে যায় নি। আর তাই, বাধ্য হয়েই এখন নিজেই পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখেন উনি। বিয়ে থা হলো জীবনের ধর্ম, না করলে হয়?
হ্যাঁ, ছেলে এখন তো বুঝছে না, পরে বুঝবে! একা একা থাকা যে কত কষ্টের, যন্ত্রণার, সেটা কাবেরী হাড়ে হাড়ে বুঝেছেন, নিজের জীবন দিয়ে।
তবে, মনের মতো পাত্রীও তো পেতে হবে। এখন, এই বয়সে এসে কাবেরী বুঝেছেন, আসল হলো আপব্রিঙ্গিং, অর্থাৎ মেয়েটির বেড়ে ওঠার শিক্ষা আর মূল্যবোধ। কারো মূল্যবোধ যদি ঠিক থাকে, তাহলেই সবকিছু ঠিক থাকবে। বয়স, শারীরিক গঠন, আরও বাকি যা কিছু - কিস্যু থাকে না শেষ পর্যন্ত।
ভাবতে ভাবতেই বিজ্ঞাপন গুলো দেখছিলেন উনি। আর চোখে পড়ল এই বিজ্ঞাপনটি।
বাবুর ১৯৮৫ তে জন্ম, মানে আটত্রিশ চলছে এখন। এই মেয়েটির ৩৫। যতই বয়স না মানুন, একটা 'মানানোর' ব্যাপার আছে না! আটত্রিশ বছরের বাবুর সঙ্গে কী তেইশের মেয়ে মানাবে! ভাবনাটা মনে আসতেই হেসে ওঠেন উনি। এই না ভাবতেন, আসল হলো মানুষের বেড়ে ওঠা আর মূল্যবোধ - এখন পাত্রীর বিজ্ঞাপন দেখতে গিয়েই সেই রক্ষণশীল হয়ে পড়ছিলেন উনি!
সাধারণ একটি বিজ্ঞাপন, তবু 'উদার' শব্দটাতে চোখ আটকে গেল। তাই এই বিজ্ঞাপনটিতে 'টিক' চিহ্ন দিয়ে রাখলেন উনি। প্রতি সপ্তাহেই এরকম বেশ কয়েকটি মনের মতো বিজ্ঞাপন বেছে রাখেন আর ছেলের দেখা পেলেই বলতে থাকেন "আজ কিন্তু বেশ কয়েকটা মেয়ে পছন্দ করেছি। কাল ফোন করব" বলেন। ছেলের মনমেজাজ ভাল থাকলে সেটা নিয়েই একটু 'লেগপুল' করে মায়ের। আর নইলে বেশিরভাগ দিনেই "মা, আজ খুব টায়ার্ড, পরে কথা বলব এই নিয়ে, ওকে?" বলে চুপ করিয়ে দেয়।
অবশ্য ছেলেকে আর হাতের কাছে পান কতক্ষণ! সে তো সারাক্ষণ চোর ডাকাতদের পিছনে দৌড়তেই ব্যস্ত! ছেলে যখন পুলিশে জয়েন করেছিল, তখন থেকে এই এত বছরে - মা ছেলের মনের কথা হওয়াও কমে গেছে একদম। অথচ আগে তো…
তবে, আজ কাবেরীর কপাল ভাল। সাড়ে সাতটার মধ্যেই আজ ফিরে গেছে বাবু। তাই, ছেলের পছন্দ মতো একটু আদা চা নিয়ে কাবেরী বসলেন ছেলের কাছে।
"বাবু?"
"হ্যাঁ মা, বলো - কয়েকজনকে পছন্দ হয়েছে তোমার তাই তো?"
"কি করে জানলি?" অবাক কাবেরী।
"এটাই তো আমাদের রবিবারের রিচ্যুয়াল" হেসে বলে ছেলে।
"দেখবি একটু? তোর মত পেলে ফোন করি?"
"করবে খন! তাড়া কিসের?"
"বাহ্, এখন সবে আটটা বাজে - আজ রবিবার, মেয়ের বাড়ির লোকজন হয়ত ফ্রি থাকবেন। আজই তো ভাল।"
"আচ্ছা, বেশ, করো ফোন, আমি আর কী বলব!"
"এই যে দ্যাখ, তিনজনকে আমার পছন্দ হয়েছে। একজন আবার পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি, বেশ লম্বা…" হাতের কাগজটা নিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলেন কাবেরী।
এক ঝলক তাকায় বাবু। তারপর হাতে নেয় কাগজটা।
ভাল করে দেখে।
তারপর একটু হেসে বলে "এঁর সঙ্গেই কথা বলো মা। যদি উনি চান তাহলে একদিন গিয়ে কথা বলতে পারি।"
হঠাৎ শুনে বিশ্বাস হয় না কাবেরীর।
বাবু… যাবে বলছে, দেখা করতে!
কিন্তু জিজ্ঞেস করার আগেই উঠে যায় ছেলে। বাথরুমে ঢুকে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তির পরে অনেকক্ষণ ধরে স্নান করে বাড়ি ফিরে। বরাবরের অভ্যাস।
ছেলের মর্জি পাল্টাবার আগেই তড়িঘড়ি ফোন করেন কাবেরী।
"হ্যালো?" ওদিক থেকে পরিশীলিত কন্ঠ ভেসে আসে।
"হ্যালো… আজ পেপারে একটা বিজ্ঞাপন দেখে ফোন করছি…"
"হ্যাঁ, বলুন.."
"আমার ছেলের ব্যাপারে কথা বলতে চাই।"
"সে তো বুঝতেই পারছি কাকিমা। মেয়ের ব্যাপারে তো কথা বলবেন না।" একটু হাসতে হাসতেই বললেন অপর পক্ষ।
হাসি পেল কাবেরীর ও।
"আমি আসলে সেভাবে গুছিয়ে কথা বলতে পারছি না দিদি। আমার ছেলের জন্য বিজ্ঞাপন খুঁজছিলাম, আপনাদের বিজ্ঞাপনটা ভাল লাগল…"
"এমা, কাকিমা! আমি তো 'কাকিমা' বললাম আপনাকে, আর আপনি আমাকে 'দিদি' বলছেন!" আবার হাসি, ওইদিক থেকে!
এবার অপ্রতিভ হলেন কাবেরী।
"তাই তো মা! ভুল হয়ে গেছে। তা, তুমি পাত্রীর কে,মা? বোন? না দিদি?"
"না কাকিমা, আমিই… মানে… আমার জন্যই বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল।" এবার ব্রীড়া!
"ও আচ্ছা… বাহ্, ভালোই হলো, তোমার সঙ্গেই কথা হয়ে গেল। আমার ছেলে পুলিশে আছে, খুব ব্যস্ত থাকে। তাই আমিই ফোন করছি।"
"পুলিশ!" এবার নীরবতা।
তাড়াতাড়ি যোগ করেন কাবেরী "আসলে সব কথা তো ফোনে হয় না, তাই ভাবছিলাম একদিন সামনাসামনি বসলে ভাল হতো। যদি তোমার বাবা মায়ের আপত্তি না থাকে।"
"কাকিমা, আপনি ঠিক বলেছেন। তবে, আমার বাবা নেই। মা আছেন, তবে মায়ের শরীরটাও ভাল নেই। আর আমি তো জানেনই কলেজে পড়াই। রবিবার ছাড়া ছুটিও নেই।"
"আমাদের পরিবারও তাই। ছেলে আর আমি। ওর বাবা… অনেকবছর হলো…। তা, পরের রবিবার হবে?"
"আমার হবে… কিন্তু আপনার ছেলে… তাঁর হবে কি? আসলে ওঁদের রুটিন কেমন তো জানি না।"
"হ্যাঁ, সেটা একটা সমস্যা বটে! তবে আমি বলে দেখব।"
"আচ্ছা কাকিমা, আমাকে এই নাম্বারে শুক্রবারের মধ্যে জানিয়ে দিলে ভাল হয়।"
"আচ্ছা আচ্ছা… ভাল থেকো।" বলে ফোন রেখে দিয়েছিলেন কাবেরী।
আজ সেই রবিবার। 'মেয়ে দেখার' কথা শুনে ভেবেছিলেন বাবু বেঁকে বসবে। কিন্তু একবার বলতেই রাজি হয়ে গেছিল। এমনকি, সেদিন দুপুরেই ফিরে এসেছিল বাড়িতে।
"কি রে তুই, এই সময়ে?"
"ওই… মধ্যমগ্রামে যাবার কথা বলেছিলে না?" একটু লজ্জা লজ্জা গলায় বলেছিল বাবু।
"ও বাবা… সে তো সন্ধ্যেবেলা, লেকটাউন থেকে মধ্যমগ্রাম কতটুকুই বা… তাই তুই চলে এলি?" সুযোগ পেয়ে ছেলের লেগপুলিং করে নিলেন কাবেরী। তবে বেশি কিছু বললেন না। যদি যেতে না চায়!
পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছ'টার মধ্যেই পৌঁছে গেলেন কাবেরীরা। মেয়েটি ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছিল। অ্যাপ থেকে গাড়ি বুক করে খুব অল্প সময়ই লাগল - রাস্তা ফাঁকাই ছিল।
ছোট্ট একতলা বাড়ি। কলিংবেল বাজতেই দরজা খুলে দিলেন একজন ভদ্রমহিলা। কাবেরীর বয়সীই হবেন।
"আসুন আসুন দিদি।" বলে হাসলেন উনি।
"ভাল আছেন তো?" জিজ্ঞেস করলেন কাবেরী। এইপ্রথম ছেলের জন্য পাত্রী দেখতে আসা… কী যে বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না।
একচিলতে ঘর। একটা দুজনের বসার মতো সোফা, আর একটা ছোট্ট ডাইনিং টেবিল। সোফার পিছনে বইয়ের আলমারী ভর্তি বই।
বাবু ঘরে ঢুকেই বই দেখতে ব্যস্ত হয়ে গেল। সোফায় বসলেন কাবেরী।
"আপনারা চা খাবেন তো?" জিজ্ঞেস করলেন উনি।
"হ্যাঁ, তবে শুধু চা ই কিন্তু। আর কিচ্ছু না।" হেসে বলেন কাবেরী।
একসময় এই মেয়ের বাড়ি আসা মানেই ছিল আতঙ্ক! পাত্রীপক্ষদের অনেক খাবার আয়োজন করতে হতো, আর পাত্রপক্ষেরা পাহাড়প্রমান খাবার খেয়ে, প্রায় ধন্য করে দেবার ভঙ্গিতে বলতেন "আচ্ছা, পরে জানাব!"
সবাই এমনি ছিলেন না অবশ্যই। তবে, কাবেরী নিজেই দেখেছিলেন এরকম। তাই ঠিক করেই রেখেছিলেন সুযোগ পেলে এই আচরণ করবেন না কোনোদিন।
"আমিও চা খাব, তবে চিনি ছাড়া হলে ভাল হয়।" ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল বাবু। তারপর সোফায় এসে বসল।
"আচ্ছা, আমি আনছি। তিন্নি… মানে ওকেও ডাকি" বলে চলে গেলেন উনি।
মিনিট পাঁচেক পরেই চা এবং আরেকটি ট্রে তো পরিপাটি করে সাজানো বিস্কুট আর কুচো নিমকি নিয়ে এলেন দুজন।
ডাইনিং টেবিলের সামনের একটি চেয়ার টেনে বসল মেয়েটি।
একটা সাদা রঙের সালোয়ার - কামিজ পরা। শান্ত, প্রসাধনবর্জিত মুখ। টেনে বাঁধা চুল।
"দু'বার কথা হলো, তোমার নামটাই জানা হয়নি…" কথা শুরু করার জন্যই বললেন কাবেরী।
একনজরে দেখে নিয়েছেন, ছেলে তাকিয়ে আছে মেয়েটির দিকে। একটু মুগ্ধতাও কী লেগে আছে তাতে!
"ওঁর নাম সংযুক্তা বসু, মা। আমি ঠিক বলছি তো?" একটু হেসে বলল বাবু।
প্রত্যয়ী চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটিও।
"হ্যাঁ স্যার। আপনার মনে আছে আমার নাম - দেখে ভাল লাগল।"
"আমাকে স্যার বলার কোনো কারণ নেই।"
"আগেও তো বলেছি।" ঠোঁট কামড়ে বলে সংযুক্তা।
"তখন অফিসিয়াল পারপাস ছিল। এখন পারসোনাল পারপাস।" শান্তগলায় বলে বাবু।
শাটল ককের মতো দু জোড়া মায়ের চার জোড়া চোখ ঘুরছিল দুজনের দিকে।
একটু বিবর্ণ হয়ে গেছেন যেন মেয়ের মা।
"কাকিমা, চা খাবেন না?" একটু হাসে এবার সংযুক্তা।
"হ্যাঁ… খাব…" বাবু আর মেয়েটি দুজন দুজনকে চেনে… এই অভিঘাত থেকেই বেরোতে পারেন নি কাবেরী এখনও।
"আপনারা তো সবই জানেন দিদি… তাও যে আপনারা এসেছেন…" এবার কথা শুরু করেন মিসেস বসু।
"কি জানি… মানে কি জানার কথা বলছেন বুঝতে পারছি না…" সত্যিই বুঝতে পারছেন না কাবেরী।
বাবু আর সংযুক্তা - দুজনেই দুজনকে চেনে! কোনো কাজের জন্যেই চেনে!
তাই কী বাবু ছবি দেখেই ফোন করতে বলেছিল!
আর যে ছেলের টিকিও দেখা যায় না, সে আজ এত তাড়াতাড়ি বাড়ি ঢুকে গেছিল!
তবে কী… বাবু… পছন্দ করে মেয়েটিকে!
কিন্তু কি জানার কথা বলছিলেন ওর মা?
"কাকিমা, স্যার… মানে মি. মিত্র জানেন সবটা। কিন্তু উনি হয়ত আপনাকে বলেননি কিছু, তাই আমিই বলছি।
আমি… চার বছর আগে… রেপড হয়েছিলাম… আমার এক বন্ধুর বাড়িতে, ওর জন্মদিনে গিয়ে…আমাকে ঘুমের ওষুধ মেশানো কোল্ডড্রিংক খাওয়ানো হয়েছিল।"
থেমে থেমে বলে মেয়েটি।
আর, পাথর হয়ে যান কাবেরী।
"পরেরদিন আমি থানার কমপ্লেন করেছিলাম। উনিই কেসটা হ্যান্ডেল করেছিলেন। তাই, আমাকে ভালোই চেনেন উনি।"
বাবুর মুখে মৃদু হাসি এখনও!
"আমি কিন্তু আমার কাজটা করেছিলাম ম্যাডাম। আপনার সেই তিন 'বন্ধু'এখন জেলে।"
"আপনাকে থ্যাংকইউ ও বলেছিলাম স্যার।"
যাক বাবু কাজটা ঠিক ভাবে করেছিল! স্বস্তি পান কাবেরী।
"কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল দিদি! আমার সুস্থ, হাসিখুশি মেয়ে…" কান্নায় বুজে এলো মায়ের কণ্ঠ!
"মা… প্লিজ…" অসহায় গলায় বলে মেয়ে।
"কাকিমা, একটা কথা বলব? সেইসময় ওঁর শরীর মনে আঘাত লেগেছিল খুবই, কিন্তু এখন তো উনি মনে হয় সুস্থই আছেন, তাই না?" বাবু বলে।
"সুস্থ আছে, তবে মনের খবর কি জানি! এতবছর ধরে তো নিজেকে খাঁচায় বন্দী করে রেখেছিল। আমারও তো বলার কিছু ছিল না! যা হয়ে গেছে… কে আর বিয়ে করবে! তাই ভাবিও নি… তাও… মেয়ে নিজেই বলল, বিজ্ঞাপন দেবে…"
"আসলে, আমার বরাবর খুব সংসার করার ইচ্ছে ছিল কাকিমা। যেমন আর পাঁচটা মেয়ের থাকে। কিন্তু…। গতবছর মায়ের কোভিড হয়েছিল… তখনই ভয় লাগার শুরু… কালের নিয়মেই তো মা চলে যাবেন একসময়, তখন… একা…" শান্তগলা মেয়ের, অথচ কিছুটা যেন অসহায়ও সে গলা।
বাবু তাকাল মায়ের দিকে।
চোখাচোখি হল দুজনের।
আজ এই সন্ধ্যেবেলা দুটি প্রাপ্তি হলো।
বাবু জেনে বুঝেই মেয়েটিকে দেখতে এসেছে। অর্থাৎ ছেলের মত আছে। একবার ছেলের পছন্দকে নিজের অপছন্দ করেছিলেন, ঠুনকো কারণে, আর এখনও একটা অন্য কারণ আছে যদিও… তাও…
আর, ছেলে নিজের কাজটা করেছে! বন্ধুর ছদ্মবেশে মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছে যে পাপীগুলো, সেগুলোর শাস্তি হয়েছে।
"কাকিমা, আপনি চা টা ও খেলেন না। রেপ ভিক্টিমের বাড়ি বলেই কি?" একটু শ্লেষ নিয়েই বলল মেয়েটি।
রেপ ভিক্টিম!
কটমট করে মেয়েটির দিকে তাকালেন কাবেরী।
কত মেয়েই যে ধর্ষিতা হয়, আর বুকে, মনের গভীরে সে ক্ষত নিয়ে চলেন, জীবন দিয়ে জানেন কাবেরী।
"আহা রে মেয়ে, ধর্ষিতা হয়েছিলি তুই?
তাও বন্ধুরা মিলে? যারা নাকি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য হয়!"
তবে, এই কথাটা… কানে লাগল!
চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি আছে তো মেয়ের!
বাবুও ওঁর দিকে তাকিয়ে আছে।
একটু কৌতুহল লেগে আছে যেন সে মুখে!
"শোনো মেয়ে, চা টা খাচ্ছি না, তার কারণ তুমি আমার চায়েও চিনি দাও নি। ইন্সপেক্টর স্যার চিনি খান না, আমি বাপু চিনি ছাড়া চা খেতে পারি না।"
"ও…স্যরি স্যরি কাকিমা… আসলে…" লজ্জায় লাল মুখে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটি।
"থাক, চিনি আনতে হবে না এখন। মিষ্টি মুখ এখন করতে চাই না আমি।"
চমকে তাকায় মা - মেয়ে দুজন।
"নিজেকে রেপ ভিক্টিম বলবে না আর, কেমন? তোমার মা কি নিজেকে কোভিড ভিক্টিম বলেন? রেপ সারভাইভার, বলতে পারো। জানি না এরকম কোনো ইংরিজি আছে কিনা, তবে তুমিই শুরু করতে পারো। রাজি থাকলে… চিনি দাও… আর পারলে চা টা একটু গরম ও করে আনো, জুড়িয়ে গেছে।"
এবার হাসিমুখে বলেন কাবেরী।
হুঁ হুঁ বাবা, ইন্সপেক্টর শুভদীপ মিত্রের মা উনি, একটু আধটু 'গুগলি' তো উনিও দিতে পারেন!
"মা… তুমি…" কিছু বলতে যায় বাবু।
"তুমিও সংযুক্তার সঙ্গে যেতে পারো… জীবনে তো মা কে সাহা্য্য করলে না বাড়িতে, নতুন জীবন শুরু করতে চাইলে বাড়িতে একটু কাজে হেল্প করতে হবে।" মুচকি হেসে বলেন কাবেরী।
আহা, যাক, ওরা দুজনে একটু কথা বলে নিক। দুজনেই যে হারে 'স্যার' আর 'ম্যাডাম' শুরু করেছিল… উফ!
সোফায় হেলান দিয়ে হাসেন কাবেরী।
মনে হচ্ছে বাড়িতে সানাইয়ের সুর বাজবে শিগগিরিই…
•
Posts: 80
Threads: 0
Likes Received: 40 in 36 posts
Likes Given: 38
Joined: Jan 2024
Reputation:
2
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
25-10-2024, 09:40 AM
(This post was last modified: 25-10-2024, 12:54 PM by ddey333. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
একটা সময়ের পর আর শরীর ছুঁতে ইচ্ছে করে না প্রিয়জনের! যৌনতা, সেক্স শব্দগুলো বড্ড ক্লিশে লাগে তখন শুনতে.....
এমনকি কাছের মানুষটার শরীরটার প্রতিও সমস্ত মোহ ফুরিয়ে যায়....
শরীরের প্রতি সমস্ত মোহ ফুরিয়ে এলেই মানুষের প্রতি মায়া জন্মাতে শুরু করে, আমরা তখন প্রিয় মানুষটার ছায়ায় মাথা পেতে শুতে চাই...
একটা সময়ের পর যে কোনো মানুষের কাছে রাতগুলো বড় দুর্বল হয়, বড় ভয়ঙ্কর, একা একা শুতে আর ইচ্ছে করে না, আনচান করে বুকটা মাঝরাতে। আয়না দেখলেও কেঁপে ওঠে হাত, হাতের মুঠোয় চাদর শক্ত করে ধরে বালিশে মাথা গুঁজে কাঁদতে ইচ্ছে করে...
চোখের ক্লান্তি আসে ভোর রাতে, চোখ গুলো শিশিরের জল মেখে ঝিমিয়ে পড়ে। তখন স্রেফ একটা মানুষের দরকার পড়ে, অগোছালো একটা মানুষের, যে আমাদের নিজের বুকে জাপটে ধরে নিজের মতো করে গুছিয়ে নেবে। ডাঁসা, কচি তুলতুলে শরীরের আর দরকার পড়ে না....
তখন একটা মানুষ লাগে, যার গায়ের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়, যার জামার বোতাম নিয়ে কাটাকুটি খেলতে ইচ্ছে করে....
শীতকালেও হালকা করে ফ্যান চালিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে তার গলার আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করে....
সবার একটা মানুষ লাগে, যার সাথে গোটা জীবনে যা কিছু ঘটেছে! সবটা শেয়ার করতে ইচ্ছে হয় সারারাত ধরে....
পাগলের মতো তার সাথে ইচ্ছে করেই ঝগড়া বাঁধাতে মন চায়। ভোরের বেলায় তার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে নামে...
একটা বয়সের পর সবার একটা মানুষ লাগে, যার উপর অধিকার ফলানো যায়, যার কাছে বকা খেতেও তৃপ্তি লাগে।ওই বকা খাওয়ার ভেতর শান্তি আছে যেন বৃষ্টি মাখা সন্ধে বেলায় দু কাপ চা মাটির ভাঁড়ে....
একটা সময়ের পর সবার একটা মানুষ লাগে, যার খেয়াল রাখতে ভালো লাগে। যার যত্ন নিতে ভালো লাগে, যার সাথে কোনো এক মেঘলা দুপুরবেলায় হুট করেই শহরের বাইরে ঘুরতে চলে যাওয়া যায়....
আর ঠিক এভাবেই আবার নতুন করে আর একটা ব্যথা পাওয়ার আয়োজন শুরু হয় সেদিন থেকে। মানুষটা কোনো একদিন মারা গেলে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ার ভয় পাওয়ার আয়োজন শুরু হয় সেদিন থেকে.....
(কলমে : কৃপা বসু)
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
জানেন তো ছোটবেলায় আমিও না অনেক ধনী ছিলাম।
বৃষ্টির জমে থাকা জলে, আমারও
তিন-চারটে নৌকা, জাহাজ জলে ভেসে বেড়াতো।
কাগজের হলে কি হবে?
আবার আকাশে আমার বিমানও উড়ে বেড়াতো।
ছোটখাটো দূরত্বে যাবার জন্য সুপারি, নারকেল পাতার তৈরি দুটো গাড়িও ছিলো।
একজন ড্রাইভার টেনে টেনে গন্তব্যস্থলে নিয়ে যেতো।
প্রাসাদ,অট্টালিকা আমিও বানিয়েছিলাম।
সম্পূর্ণ নিজের হাতের তৈরি ছিলো।
হোকনা সেগুলো মাটি বা পাটকাঠি দিয়ে তৈরি । কিন্তু একেবারেই আমার ছিল।
ব্যবসা আমারও ছিল। বাড়ির উঠানে পাট কাঠি বা বাশের কঞ্চি দিয়ে খাম গেরে,উপরে মায়ের কাপড় দিয়ে ঢেকে মুদি দোকান বসাতাম।
মাটি দিয়ে বাসন,কই মাছ,হাড়ি পাতিল বানিয়ে রোদে শুকাতাম।
সুইমিংপুলও ছিলো আমাদের ।
বিশাল আকারের, বড়ো ঘাট বাধানো পুকুর।
আমাদের সুইমিং পুলে মাছও থাকতো।
তখন, আমিও বিজ্ঞানীও ছিলাম। ফেলে দেওয়া পুরনো ইনজেকশনের সিরিঞ্জে জল ভরে বিভিন্ন গাছের শাখা-প্রশাখায় , ফের ভেতরে ইনজেকশন দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতাম।
দুপুরে খাবার পর আমি সাদাকালো টিভিতে নানা রকমের অনুষ্ঠান দেখতাম ডি, ডি, বাংলায়।
গোলাকার লোহার রিং আর টায়ার গুলো চালিয়ে পিছে পিছে দৌড়ে বেড়াতাম সারা গ্রামে।
শপিংয়ে আমিও যেতাম, মেলা থেকে এটা ওটা কত রকমের খেলনা,কাচের ঝিলিমিলি রকেট,ডুগডুগি,মুড়ি মুড়কি, ছোলা,বাদামভাজা ,জিলিপি আরো কতো কি সপিং করে আনতাম !
পয়সা রাখার জন্য আস্ত ব্যাংকটাই তুলে নিয়ে আসতাম।
সেটা মাটির তৈরি ছিলো। মাঝেমধ্যে হাতে তুলে তার ওজন দেখে অনুমান করতাম। মানে আপডেট করতাম কতোর মতো জমা পড়েছে।
কিন্তু ওটা একান্তই আমার ব্যাঙ্ক ছিলো।
এখন আর কোথায় পাব সেই বড়লোকী চাল?
শৈশবটাকে বড্ড বেহিসেবি খরচা করে ফেলেছিলাম।
তাই আজ কাঙ্গাল।
******************************************
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
অণুগল্প
'দাদু, আমাকে পাঁচপাতা সেফটিপিন, পাঁচ প্যাকেট ন্যাপথলিন আর পাঁচটা চিরুনি দিন না..'
'সব পাঁচটা করে?'
'হ্যাঁ দাদু, বড্ড হারায় যে..' বলে, হরলিক্সের শিশির মতো মোটা কাঁচের চশমা পরা 'দাদু' কে টাকা দিয়ে রওনা হয় তৃণা।
ভেবেছিল আজ মেট্রো থেকে নেমে অটো নেবে, কিন্তু বাস ই নিতে হবে..। টাকা কম আছে।
কি করবে? হাজরা মোড়ে মাটিতে কাগজ বিছিয়ে জিনিস বিক্রি করা বয়স্ক মানুষ টাকে দেখেই মনে হচ্ছিল সকাল থেকে কিচ্ছু বিক্রি হয়নি ওঁর।
আহা, বাসে আর কত ভিড় হবে! মানুষ টা যে একটু খুশি হলেন!
জ্বলে উঠল লাল সবুজ টুনির রোশনাই।
**************************
মাথা নিচু করে চেয়ারে বসেছিল শরণ্যা।
ছোটকাকু টা যে কি!
বলা নেই, কওয়া নেই, অফিসের কোন জুনিয়ারের বাবা মা কে এনে হাজির। ওনারা নাকি কাকুর মোবাইলে ওর ছবি দেখে 'আলাপ' করতে এসেছেন।আরে আলাপ না ছাতার মাথা! আসলে বিয়ের সম্বন্ধ।
ওর মতো 'একদা ধর্ষিতা' মেয়ের এভাবে বিয়ে হওয়া সম্ভব?
'দাদা, আপনার মেয়ে কে বড্ড মনে ধরেছে আমাদের...' বাবা কে বললেন ছেলের মা।
'কিন্তু..আপনি কি জানেন..'
'দাদা, প্লিজ, রেপ সারভাইভার ও। একজন যোদ্ধা। ওকে আমরা সসম্ভ্রমে নিজের করে নেব।' এবার মুখ খুললেন ছেলের বাবা।
অবাক চোখে তাকানো শরণ্যা আর হাসি হাসি মুখে, স্মিত চোখে ওর দিকে তাকানো ছেলেটির চোখে তখন ভাললাগার, ভালোবাসার তুবড়ি।
**************************
'কালু আঃ আঃ' পাড়ার ছেলেদের মুখে ডাক শুনে
ডাক শুনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসে কালু।
কদিন আগের টানা বৃষ্টিতে একটা বাড়ির সিঁড়িতে বসেছিল বলে মার খেতে হয়েছে ওকে।
'কালু, তোর খুব লেগেছে না? স্যরি। এই পাড়ার সবাই মিলে আমরা ঠিক করেছি এবার কোনো শব্দবাজি ফাটাবো না, যাতে তোদের কারো অসুবিধা না হয়..' বলল ছেলেগুলো। কালুর গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে।
কালু ভালবাসার স্পর্শ বোঝে, তাই লেজ নাড়িয়ে দিল।
দু পেয়ে আর চার পেয়ে দের ভালবাসায় জ্বলে উঠল তারাবাজির ঝিকিমিকি।
**************************
'দাদা ওই মিষ্টির দোকানে দাঁড় করান তো' বিপুল বপু ভদ্রমহিলা রিক্সা থেকে নেমে ঢোকেন দোকানে।
আজ বেজায় ভিড়। ভাইফোঁটা বলে কথা।
আর রোদ ও উঠেছে বেশ কড়া আজ।
গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে ভাবছিলেন রিক্সাচালক শম্ভু।
হঠাৎ দেখেন, সওয়ারি ভদ্রমহিলা এলেন, হাতে বড় একটা হাঁড়ি, দুটো প্লাস্টিকের প্যাকেট।
তাড়াতাড়ি সিট থেকে নেমে ওনাকে সাহায্য করতে যায় শম্ভু।
'থ্যাংকইউ দাদা' মিষ্টি হেসে বলেন উনি।
তারপর একটা প্লাস্টিকের প্যাকেট ওনার হাতে তুলে দিয়ে বলেন 'এই যে দাদা, এটা আপনার...এত গরম, তার মধ্যে সকালে বেরিয়েছেন নিশ্চয়ই। খেয়ে নেবেন, কেমন?'
'না না দিদি লাগবে না' লজ্জা পেয়ে বলে শম্ভু।
'দিদি বললে তো? তবে তো আজকের দিনে দিদির কথা শুনতেই হবে'! হাসতে হাসতে বলেন উনি।
শম্ভু তাকায় ওনার দিকে।
ভাইবোনের ভালবাসার চিরন্তন চরকি দুজনের মুখে।
**************************
'এই যে, কি যেন নাম তোমার? বাসনা?' গিন্নিমার মুখে নিজের নাম শুনে দুরু দুরু বুকে এগিয়ে আসে বাসনা।
রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য আজ ও এসেছে এই বাড়িতে। সেন্টার থেকে একজনের বদলি হিসেবে।
'এই যে এই ডিব্বাটা বাড়ি নিয়ে যাও। কাল আসার সময় আনবে কিন্তু মনে করে।
'কিন্তু মাসিমা..'
'শোনো মেয়ে, আমার বাড়িতে হেল্প করলে তুমি, নিজের বাড়িতে নিশ্চয়ই রান্না করার সময় পাও নি? যাও, নিয়ে যাও...'
তাকিয়ে থাকে বাসনা, অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে যাওয়া 'মাসিমা'র দিকে।
মানুষটা সারাদিন ওকে কাজ করিয়েছেন, বকাঝকাও করেছেন, কিন্তু মন টা যে মাটির প্রদীপের মতো!
**************************
সম্পর্কের এই রোশনাই থাকুক সবার জীবনে প্রতিক্ষণ।
ভাল থাকুন সক্কলে।
শুভ দীপাবলি এবং ভাতৃদ্বিতীয়ার শুভেচ্ছা...।।
•
|