Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
15-08-2023, 09:50 AM
(This post was last modified: 15-08-2023, 09:52 AM by Sanjay Sen. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
|| সহদেবপুরের বিভীষিকা ||
লেখায় :- চন্দ্ররূপ ব্যানার্জী
ইদানিং সহদেবপুরে পাঁচ-পাঁচটা খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। সব কটা খুনই খুব নৃশংস ভাবে করা হয়েছে। প্রত্যেকটা লাশই আধ খাওয়া, দেখে মনে হচ্ছে কোনো হিংস্র প্রাণীর কাজ। তাই গোটা এলাকায় একটা আতঙ্কের বাতাবরণ ছড়িয়ে আছে। প্রত্যেকটি খুনের ঘটনাই ঘটেছে রাত ১২টার পর। তাই পুলিশ সারা এলাকা বাসী দের রাত ন'টার পর বাড়ির বাইরে না বেরোনোর নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো যে গ্ৰাম থেকে প্রায় ৩০০ কি.মি -এর মধ্যে কোনো জঙ্গল নেই যে সেখান থেকে কোনো হিংস্র প্রাণী আসবে, এছাড়া পুলিশ গোটা এলাকা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোনো হিংস্র পশুর সন্ধান পায়নি।
সুমন্ত অফিসের কাজে কিছু দিনের জন্য গ্ৰামের বাইরে গেছিল। তাই সে গ্ৰামে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর বিষয়ে জানতো না। সুমন্ত গভীর রাতে গ্ৰামের আলপথ দিয়ে একা একাই হেঁটে বাড়ি ফিরছিল । এমনিতেই ট্রেন লেট করার জন্য মেজাজ খিঁচড়ে ছিল। গভীর রাত হওয়ায় রাস্তা শুনশান ছিল।কেউ কোথাও নেই। পথের দুপাশে থাকা চাষের জমি থেকে একটানা ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। আকাশে গোল থালার মতো পূর্ণিমার চাঁদ ওঠায় রাস্তা-ঘাট পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাল গাছ গুলো আঁধো-অন্ধকারে এক একটা দৈত্য মনে হচ্ছে। রাত বেশি হওয়ায় সুমন্ত তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছিল । এমন সময় পিছনে একটা খস্ খস্ শব্দে সুমন্ত দাঁড়িয়ে পড়লো।পিছন ফিরে তাকাতে কোনো কিছুই চোখে পড়লো না। মনের ভুল ভেবে আবার হাঁটতে লাগলো। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আবার খস্ খস্ শব্দের সাথে চাপা গর্জন শুনতে পেল সুমন্ত। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল সুমন্তর ।
চাঁদের আলোয় আশপাশের এলাকা মোটামুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল। তাই হাত পাঁচেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাণী টাকে বেশ স্পষ্টই দেখতে পেল সুমন্ত। এরকম বীভৎস পশু বা প্রাণী সে আগে কোনদিন দেখেনি। প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা সামনের দিকে একটু ঝুঁকে আছে বলে, কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ালে ছ-ফুট ছাড়িয়ে যাবে। সারা দেহ কালো লোম দ্বারা আবৃত, মুখের আদল টা অনেক টাই নেকড়ের মতো। চোয়ালের ফাঁক দিয়ে ধব্ ধবে সাদা দুটো শ্বদন্ত বেড়িয়ে রয়েছে। চোখ দুটো আগুনের ভাঁটার মতো জ্বলছে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমান বিভীষিকা কে দেখে সুমন্ত কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেল। তারপরই আশপাশ থেকে একটা অজানা আতঙ্ক তাকে চেপে ধরল। কিছুক্ষণের জন্য মা-বাবার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। বড়ো ইচ্ছে করল বাড়ি ফিরে আবার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে, বাবার সাথে একসাথে খেতে বসে হাসাহাসি করতে। জন্তুটা আস্তে আস্তে সুমন্ত র দিকে এগিয়ে আসছে , সুমন্ত প্রাণ বাঁচাবার একটা শেষ চেষ্টা করল। সামনে পড়ে থাকা একটা লাঠির টুকরো সজোরে ছুঁড়ে মারলো জন্তুটার দিকে। লাঠির টুকরোটা জন্তুটা কে লক্ষ্য করে ছুঁড়লেও সেটা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। না: আর সময় নেই জন্তুটা প্রায় চলেই এসেছে, সুমন্ত আর কিছু করার আগেই সে সুমন্তর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। একটা আর্তনাদ শুধু বেড়িয়ে এলো সুমন্তর গলা দিয়ে, যা রাত্রির অন্ধকারের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে দিলো। জন্তুটা আরেক টা নতুন শিকার পাওয়ার উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে তার তীব্র ধারালো নখের দ্বারা দেহটাকে ছিন্নভিন্ন করতে লাগলো। জনশূন্য রাত্রে এই বীভৎসতার সাক্ষী রইলো কেবলমাত্র প্রকৃতি।
গত রাত্রের আরও একটা খুন পুলিশের দুঃশ্চিন্তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই একই রকম পদ্ধতিতে খুন করা হয়েছে। এই নিয়ে দু'সপ্তাহে ছটা একই ঘটনা ঘটে গেলো, আর পুলিশ এখনও পর্যন্ত কিছুই করতে পারলো না। এ নিয়ে গ্ৰামবাসীরা থানার সামনে বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে, তাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে।থানার ভেতরে ও.সি সুভাষ বাবু মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তিনিও তার প্রায় ২৪ বছরের দীর্ঘ কেরিয়ারে এতটা হতাশ হন নি। এতগুলো খুন হয়ে গেল, কিন্তু তিনি কিছুই করতে পারলেন না। একটা প্যারালাইসিস রুগীর মত তাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে। এমন সময় একটা লোক দৌড়ে এসে ও.সি র সামনে এসে দাঁড়ালো। পিছন পিছন কনস্টেবলও এলো। ও.সি কনস্টেবল এর দিকে তাকিয়ে বেশ রাগত স্বরে বললেন,‘ আমি কাউকে আমার কাছে আসতে দিতে মানা করেছিলাম, তবুও এই লোকটি কি করে এলো?’ কনস্টেবল আমতা আমতা করে বলল আজ্ঞে স্যার আমরা অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু আমাদের হাত ছাড়িয়ে আপনার কাছে ছুটে চলে এলো, বলল খুব জরুরি দরকার আছে। সুভাষ বাবু আড়চোখে একবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে ইশারায় বসতে বললেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন,‘ তা আপনার কী এমন জরুরি দরকার?’ ভদ্রলোক হাতজোড় করে নমস্কার করলেন তারপর বললেন, ‘আজ্ঞে আমার নাম অব্যয় বিশ্বাস। থাকি কলকাতায়। পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। গ্ৰামে ইদানিং ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো সম্পর্কে পেপারে পড়ে আপনার কাছে ছুটে এলাম , যদি কোনো সাহায্য করতে পারি।’ সুভাষ বাবু তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, ‘তা কী রকম সাহায্য করবেন আপনি?’ অব্যয় বিশ্বাস অল্প হেসে বলল ,‘বড়বাবু কাউকে কোনো দিন ছোটো মনে করবেন না। আমি-ই একমাত্র এই রহস্যের সমাধান জানি’। সুভাষ বাবু এবার রেগে উঠে বললেন,‘ কি তখন থেকে আজেবাজে কথা বলে যাচ্ছেন , আসল কথা বললে বলুন নইলে প্লিজ এবার আসুন।আপনার ফালতু কথা শোনার মতো সময় আমার নেই’।
‘আহা: রেগে যাচ্ছেন কেন আমি সত্যিই বলছি রহস্যভেদ করার ক্ষমতা একমাত্র আমারই আছে।’
বড়বাবু বললেন,‘ কেমন?’
অব্যয় বিশ্বাস বলল তবে শুনুন. ‘আচ্ছা আপনারা কি প্রত্যেকটা ডেডবডির আশপাশ টা ভালো করে লক্ষ্য করেছেন?’
—‘হ্যাঁ অবশ্যই, কেন বলুন তো’
—‘পায়ের ছাপ বা লোম পেয়েছেন?’
–‘আপনি যে দুটি জিনিসের কথা জিজ্ঞেস করলেন সেই দুটি জিনিসেরই সন্ধান আমরা পেয়েছি। এমনকি লোমের ডি.এন.এ টেস্ট করে দেখা গেছে যে সেটা পুরোপুরি নেকড়ের গায়ের লোমের সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে আশ্চর্যের বিষয় পায়ের ছাপ কিন্তু অনেক টা মানুষের আদলের আর এখান থেকে প্রায় ৩০০ কি.মির মধ্যে এমন কোনো জায়গা নেই যে সেখান থেকে কোনো নেকড়ে আসতে পারে।’ অব্যয় বিশ্বাস তার রহস্যময় হাসি হেসে বলল,‘ এটা কোনো নেকড়ের কম্মো নয় যে আপনারা তাকে খুঁজে পাবেন।তবে হ্যাঁ আবার নেকড়ের ই কাজ বলতে পারেন।’
‘মানে? আপনি কী বলছেন এসব আমি বুঝতে পারছি না। নেকড়ের কাজ নয় আবার নেকড়ের ই কাজ।কী বলতে চান পরিস্কার করে বলুন না।’
–‘আচ্ছা আপনি কি ছোটো বেলায় ওয়্যারউলফ্ এর গল্প পড়েছেন বা সিনেমা দেখেছেন?’
–‘হ্যাঁ অবশ্যই, কিন্তু কেন?’
–‘এটা ওরই কাজ।’
–‘আপনি কী আমার সাথে মজা করছেন?’
–‘মজা?’ হা:হা: করে হেসে উঠলো অব্যয় বিশ্বাস। তারপর ই মাথাটা বড়বাবুর মুখের সামনে নামিয়ে এনে বলল,‘ আপনার কি মনে হয় আমি সুদূর কলকাতা থেকে এখানে মজা করতে এসেছি।’
‘কিন্তু এখন কার যুগে এও কি সম্ভব?’
‘ সম্ভব সম্ভব সবই সম্ভব । ও আসলে অভিশপ্ত এক জানোয়ার, বহু বছর পর ওর ঘুম ভেঙেছে। আস্তে আস্তে ও ওর খিদে মেটাবে।’
‘কী বলছেন ! আচ্ছা কোনো কি পথ নেই এই ধ্বংসলীলা বন্ধ করার?’
‘আছে আছে, আর সেই পথ একমাত্র আমিই জানি। ’
‘কী রকম?’
–তবে শুনুন..
‘আপনাকে তো আমি আগেই বলেছি যে আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। কিন্তু আমার পূর্বপুরুষরা ছিলেন জমিদার। তাদের অনেকেই শখের শিকারি ছিলেন। বিশেষ করে আমার ঠাকুরদা তার অব্যর্থ লক্ষ্যভেদের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। জমিদার হওয়া সত্ত্বেও বহুবার তিনি তার প্রজাদের রক্ষার উদ্দেশ্যে নিজের জীবন বাজি রেখে হিংস্র প্রাণীদের মোকাবিলা করেছেন।
একবার গ্ৰামে এক অদ্ভুত কান্ড ঘটতে থাকে। কোনো এক হিংস্র প্রাণীর উপদ্রবে বহু নিরীহ মানুষের মৃত্যু ঘটতে থাকে। প্রজাদের অনুরোধে ঠাকুরদা প্রাণী টিকে হত্যার তোরজোড় শুরু করেন। অবশেষে একদিন জঙ্গলে গাছের উপর মাঁচা বেঁধে শুরু করলেন প্রতীক্ষা। নীচে টোপ হিসেবে দিলেন একটি জ্যান্ত ছাগল। গভীর রাতে সে এলো। ঠাকুরদার মতে তিনি এমন ভয়াবহ প্রাণী জীবনে কখনও দেখেননি। ঠাকুরদা প্রাণী টির মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালালেন। গুলিটা গিয়ে মাথায় লাগলোও, কিন্তু প্রাণীটির কিছুই হলো না। সে চকিতে গাছের উপর মাঁচায় বসে থাকা ঠাকুরদার দিকে লাফ দিলো কিন্তু ভাগ্য ভালো থাকায় বাঁ হাতে একটা আঁচড় দেওয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুরদা কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচেন। পরদিন সকালে তিনি তার গুরুদেবের আশ্রমে গিয়ে সব কথা খুলে বলেন এবং এর প্রতিকার চান । তাঁর গুরুদেব ছিলেন অত্যন্ত ক্ষমতাশালী একজন সাধু। গুরুদেব তাকে বলেন ও এক অভিশপ্ত দানব, যদি ওকে আটকানো না যায় তবে ও গ্ৰাম কে গ্ৰাম উজাড় করে দেবে। তিনি ঠাকুরদার হাতে একটি পবিত্র ছুরি তুলে দেন এবং বলেন ছুরিটি একমাত্র দানবটির বুকে হৃদপিন্ড বরাবর গেঁথে দিতে পারলেই সে আবার বহুবছরের জন্য ঘুমিয়ে পড়বে। আর হ্যাঁ ছুরিটা মাত্র পাঁচ বারই ব্যবহার করা যাবে। তারপর তার ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে । আমার কাছে ঐ ছুরিটা এখনও রয়েছে।’
‘ কিন্তু সবচেয়ে সমস্যার কথা যে ঐ হিংস্র প্রাণী কে কীভাবে একটা ছুরি দিয়ে মারা সম্ভব। কে এই রিক্স টা নেবে।’ চিন্তিত গলায় বলে উঠলেন বড়বাবু।
‘আমি মারব ঐ দানবকে। আমার কোনো পিছুটান নেই বড়বাবু, যদি আমি মারাও যাই চোখের জল ফেলার মতো তিন কুলে আমার কেউ নেই।’
‘না না একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আমি আপনাকে এই কাজ করতে দিতে পারি না।’
‘কিন্তু বড়বাবু, আপনার সংসার যে আছে । তাই বলছি প্লিজ আমাকেই যেতে দিন।’
‘না অব্যয়বাবু প্লিজ বাচ্চা ছেলের মতন আবদার করবেন না।’
‘ঠিক আছে আমি আর কোনো কথা বলবো না।’
তারপর অব্যয় বিশ্বাস কাঁধের ঝোলা থেকে একটা বড়ো ছুরি বের করে বড়বাবুর টেবিলে রাখল। বলল,‘ ভালো করে শুনুন বড়বাবু, এই ছুরিটা দিয়ে কিন্তু দু'বারই আঘাত করতে পারবেন।কারণ ঠাকুরদা তৃতীয়বারের আঘাতের পর সফল হয়েছিলেন। এই ছুরিটা সোজাসুজি ওর হৃৎপিণ্ডে ঢোকাতে হবে অন্যথায় ও কিন্তু মরবে না। আর হ্যাঁ বারবার কিন্তু বলছি মাত্র দু'বার-ই এই ছুরি ব্যবহারযোগ্য। আচ্ছা নমস্কার, আমি আসি তাহলে বড়বাবু। এই বলে গট্ গট্ করে অব্যয় বেড়িয়ে গেল। ’
বড়বাবু হাঁক পেড়ে কনস্টেবল কে ডেকে নির্দেশ দিলেন তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে যেতে। আজ রাতেই তারা অভিযানে বেরোবেন।
ঘড়ির কাঁটা ১২টার ঘর অনেকক্ষণ পেরিয়েছে। চারিদিক শুনশান। গ্ৰামে এমনিতেই মানুষ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। তারমধ্যে আবার ইদানিং মানুষখেকোর আবির্ভাবে মানুষ রাত্রিবেলা আর ঘর থেকেই বেরোচ্ছে না। যার ফলে রাস্তা ঘাট জনশূন্য হয়ে পড়েছে এর মধ্যেই। সুভাষ তার বাহিনীকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে। এমন সময় পিছন থেকে একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়ে সবাই ঘুরে দাঁড়ালো। না: কিছু ই তো নেই, তবে কে এরকম আর্তনাদ করল। এমন সময় কনস্টেবল রহিমের কথায় সবার সম্বিত ফিরল , স্যার, রামচরণকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তাই তো সে কোথায় গেল ? মাথায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো সুভাষের। এমন সময় আরেক কনস্টেবলের কথায় তারা ধানক্ষেতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল একটা কালো লোমশ কোনো জন্তু ধানক্ষেতের অন্ধকারে মিশে গেল। সুভাষ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ ক্যুইক সবাই রেডি হয়ে নাও।’ কিন্তু তার আগেই চকিতে আরেক জন কনস্টেবলের ঘাড় ভেঙে দিলো প্রাণীটা। সবাই চারিদিকে গুলি ছুড়তে লাগল। গোটা বাতাস বারুদের গন্ধে ভরে উঠেছে। সুভাষ হাত দেখিয়ে গুলি ছুড়তে নিষেধ করলেন। ধানক্ষেতের একদিক থেকে খস্ খস্ আওয়াজ পেয়ে সাব ইন্সপেক্টর সুমন সেদিকে গিয়ে দেখতে যেতেই দুটো লোমশ ধারালো নখর যুক্ত হাত তাকে সেদিকে টেনে নিল। মরণের আগের মুহূর্তের চিৎকার করে উঠল সে। সুভাষ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ঠক্ ঠক্ করে ভয়ে কাঁপছেন, তার পরনের উর্দি ঘামে ভিজে সপ্ সপ্ করছে। এবার দানবটা আস্তে আস্তে রাস্তায় উঠে এলো। অনেক দিন পর এতগুলো মানুষ একসাথে পাবার উল্লাসে একটা হাড়হিম করা হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। এরপর একে একে নিজের ধারালো দাঁত আর নখের দ্বারা সবাই কে ছিন্নভিন্ন করতে করতে সে এগিয়ে আসতে লাগলো বড়বাবুর দিকে।প্রাণীটাকে লক্ষ্য করে অবিরাম গুলি ছোড়া হচ্ছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আস্তে আস্তে সে সুভাষের সামনে এসে দাঁড়াল। সত্যিই এমন বীভৎস প্রাণী তিনি আগে কোনোদিন দেখেননি। মুখের আদলটা অনেকটাই নেকড়ের মতো, সারা শরীর কালো কর্কশ লোমাবৃত। চোয়ালের দু-পাশ বেয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। চোখদুটো যেন আগুনের ভাঁটা। সামনে নিজের মৃত্যুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হঠাৎ ছুরিটার কথা মনে পড়তেই সেটা কোমড় থেকে বের করে সোজা দানব টার পেটে ঢুকিয়ে দিলেন সুভাষ বাবু। কিন্তু নাঃ একটা ভুল হয়ে গেছে। ভুলবশত ছুরিটা বুকে না ঢুকিয়ে তিনি পেটে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। প্রবল আক্রোশে দানব টা সুভাষকে এক ধাক্কায় ছিটকে দূরে ফেলে দিল। ছুরিটাও কিছুটা দূরে ছিটকে পড়লো। তারপর দানবটা এক লাফে সুভাষের কাছে গিয়ে তাকে হত্যা করতে উদ্যত হতেই, পিছন থেকে কে যেন বলে উঠলো, ‘ ওরে শয়তান, নরকের কীট, তোর খেলা এইবার শেষ ’... প্রাণীটা পিছন ফিরতেই অব্যয় বিশ্বাস নিখুঁত ভাবে ছুরিটা দানবটার বুকের বাঁদিকে হৃৎপিণ্ড বরাবর গেঁথে দিলো। কিন্তু মৃত্যুর আগেও একটা চরম ক্ষতি করে দিয়ে গেল সে। ধারালো নখের আঘাতে অব্যয় বিশ্বাসের গলার নলিটা ছিঁড়ে দিল । অব্যয় প্রচন্ড যন্ত্রণায় দূরে ছিটকে পড়লো। এদিকে একটা হাড় হিম করা গর্জন করে দানবটা নিস্তেজ হয়ে গেল।সারা দেহটা আস্তে আস্তে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। সুভাষ বাবু অদূরে শেষ নিঃশ্বাস নিতে থাকা অব্যয়ের দিকে ছুটে গেলেন। সুভাষকে দেখে প্রচন্ড কষ্টের মধ্যেও অব্যয় বিশ্বাসের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে তার মাথাটা একদিকে হেলে পড়লো। সুভাষ বাবুর দু'চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা গরম জল নেমে এলো। একজন অচেনা, অজানা মানুষ শুধু তাকে নয় এই সমস্ত সহদেবপুরের মানুষকে রক্ষা করলেন। আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়িয়ে থানার পথ ধরলেন তিনি। জনহীন প্রান্তরে কতগুলো মৃতদেহ পড়ে রইল শুধু।
নাঃ এখন অনেক বছরের জন্য শান্তি। নিশ্চিন্তে বাঁচবে সহদেবপুরের মানুষ, যতদিন না দানবের ঘুম আবার ভাঙছে , ততদিন।
|| সমাপ্ত ||
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
Posts: 1,403
Threads: 2
Likes Received: 1,422 in 982 posts
Likes Given: 1,750
Joined: Mar 2022
Reputation:
82
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(15-08-2023, 02:49 PM)Bumba_1 Wrote: ভালো লাগলো
(15-08-2023, 07:36 PM)Somnaath Wrote: খারাপ নয়, ঠিকঠাক।
•
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
|| পালঙ্ক ||
লেখায় :- পার্থ মুখার্জী
ট্রেন থেকে ফুলডিঙা স্টেশনে যে কজন নামলো তার মধ্যে অশোকের পোশাকেই একমাত্র বাবুয়ানির ছাপ বর্তমান। তাই অখ্যাত এই স্টেশনে ইতি উতি ছড়িয়ে থাকা গ্রাম্য মানুষ গুলোর প্রত্যেকেরই নজর গেল অশোকের দিকে। আকাশের মুখ সকাল থেকেই ভার। ফোটা ফোটা জল পরে চলেছে একনাগাড়ে। এ অঞ্চলে অশোকের প্রথম আসা। ছাতা টা মাথায় দিয়ে পকেট থেকে একটা চিরকুট বার করে স্টেশনের কোনে এক চা দোকানিকে দেখিয়ে ঠিকানাটা জেনে নিলো সে ।কিছু কথা বলে সামনের রিকশা স্ট্যান্ড থেকে একটা রিকশা নিয়ে গ্রামের পথ ধরে পৌঁছে গেল মানিকপুর। বেশ গ্রাম্য পরিবেশ। তার ওপর বৃষ্টির কৃপায় সবুজে সবুজ চারিদিক। বৃষ্টির জল আর চোখের জলের মধ্যে এই কিছু দিন কোনটা বেশি তাকে ভিজিয়েছে তা বলা কঠিন।মানিকপুরের চৌমাথায় নেমে সে যখন নদীর ঘাটে যাওয়ার পথ ধরলো তখন বিকালের আলোয় সন্ধ্যার অন্ধকার ভাগ বসাতে শুরু করেছে।কিছুটা পায়ে হেঁটেই ভাঙা চোরা নদী ঘাটে এসে এক জাল গোটাতে থাকা জেলেকে সে ভুবন মজুমদারের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলো। উত্তরে জেলে হাত তুলে নদীর ধারে এক আধ ভাঙা বেশ বড়ো একটা বাড়ি ইশারায় দেখিয়ে দিলো।
তাহলে এসেই পরেছি! কিছুটা নিশ্চিন্ত হোলো অশোক। দ্রুতপায়ে ভাঙা রাস্তাটা পেরিয়ে বাড়ির গন্ডির মধ্যে প্রবেশ করলো সে। নদীর পারে এমন প্রকান্ড বাড়ি সে শুধু টিভিতেই দেখেছে। মোটা মোটা থাম আর কারুকার্য করা দেয়াল গুলোই বলে দিচ্ছে যে এককালে বাড়ির মালিক বেশ অবস্থাপন্ন ছিলেন। বৃষ্টির ঝাপ্টা আর নদীর হাওয়ায় চোখ খুলে রাখাই দায়। তাড়াতাড়ি সে উঠে এলো দালানে। আলো আঁধারি মাখা পরিবেশ ভালোই লাগছে তবে মনে শান্তি না থাকলে এসব পরিবেশে কাব্য আসে না তা অশোক বিলক্ষন জানে।দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির শেষ অবস্থা চলছে, কিছুটা তার মতোই। তার ও যেমন বাঁচার ইচ্ছা দিন দিন কমে আসছে বাড়িটা দেখেও যেন মনে হচ্ছে ভেঙে পরতে পারলে বেঁচে যায়। রুমালে মুখটা মুছে নিয়ে দরজায় কয়েকবার কড়া নাড়লো সে। ভিতরে কয়েকটা শব্দ জানান দিলো একটু সবুর করলেই দরজা খুলবে। হলোও তাই। এক বয়স্ক বৃদ্ধ কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুলেই অশোক কে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঝাপসা চশমার ফাঁক দিয়ে যাচাই করে নিলো। ভাঙা গলায় প্রশ্ন এলো...
কি দরকার ?
ভুবন বাবু আছেন?
আমিই ভুবন।
ও আচ্ছা। নমস্কার।একটা জরুরী দরকারে এসেছি।একটু কথা বলা যাবে ?
হ্যা বলুন।
আসলে অনেক কথা। একটু বসলে ভালো হয়।
নদীর ঘাটে বসবেন?
অশোক সম্মতি জানায়।বৃষ্টিও থেমেছে।
আপনি চলুন আমি আলো টা জেলে আসছি।
অশোক নদীর ঘাটে এসে বসে।মাঝ নদী তে তখন জেলে নৌকা গুলোর লণ্ঠণের আলো জোনাকির মতো লাগছে।
দলছুট পাখী গুলো বাসায় ফেরার নেশায় মত্ত।
বলুন।
চমকে ওঠে অশোক। বৃদ্ধ কখন তার পাশে এসে বসেছে খেয়াল করেনি সে।
শুরু থেকেই বলি।আমার নাম অশোক রায়। বাড়ি মুকুন্দ নগরে। পেশায় একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির সেলস ম্যানেজার ছিলাম। চাকরী ছেড়ে ছোটো একটা ওষুধের দোকান করেছিলাম ।স্ত্রী মায়া ও পুত্র বিট্টুকে নিয়ে দিব্যি সংসার জীবন কাটছিলো।কিন্তু কয়েক মাস আগেই একটা দুর্ঘটনায় ছেলেটা মারা গেলো মাত্র ষোলো বছর বয়সে।
দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো অশোকের।
মাফ করবেন।বলে জল মুছে নিলো সে।
কাঁধে হাত রেখে শান্তনা দেয় বৃদ্ধ।
বলে চলে অশোক। আসলে দোষ টা আমাদেরই ছিলো।আমরা স্বামী স্ত্রী একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ওকে ঘরে রেখে। যদিও আমাদের কাজের মহিলা কমলাদি বাড়ি ছিলো তবুও সন্ধ্যে বেলা কিভাবে ও গ্যাস জেলে ম্যাগি করতে যায় আর সিলেন্ডার বাস্ট করে। কমলাদি তখন পাশের দোকানে কিছু কিনতে গেসলেন। মুহূর্তে সব শেষ হয়ে যায়। এই দুঃখ বয়ে বেরাতে পারছি না আর।
চাকরীটা ছেড়ে ছিলেন কেন ?
অপ্রস্তুত হয়ে পরে অশোক। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে.. আসলে শুনে থাকবেন কয়েক বছর আগেই কিছু জাল ওষুধ বিক্রির অভিযোগে বন্ধ হয়ে যায় একটা নামি কোম্পানি। সেই কোম্পানির সাথেই যুক্ত ছিলাম আমি। এক প্রকার কোম্পানির চাপে জোর করেই কিছু টাকার লোভে ওষুধ গুলো বাজারে ছেড়েছিলাম। কিন্তু কিছু মানুষ অসুস্থ হয়ে পরে, শুনেছিলাম মারাও গেসলো একজন। তার পরেই বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশ কে টাকা খাইয়ে অবশ্য সব ধামা চাপা দেয়া হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে । তার পর থেকেই নিজে ব্যবসা শুরু করি। ছেলেটাকে দেখা শোনা করতে কমলাদি কে রাখি, যদিও উনি নিজেই কাজ চাইতে এসেছিলেন। বেচারির কেউ নেই।কিন্তু আমার পাপে কেন আমার ছেলেটাকে ভুগতে হোলো বলবেন ? আমার স্ত্রী তো শোকে পাথর হয়ে গেছে। বলতে পারেন ওর দোষ কোথায় ? কি নিয়ে বাঁচবো আমরা ?
বুঝলাম,কিন্তু আপনার জাল ওষুধে একজনের প্রাণ গেল, আপনারা দুঃখ হয় না ?
বেশি টাকার লোভে হয়ে গেসলো। সে ঘটনা চাপা পরে গেছে আর কি হবে ভেবে !
এখন আমার কাছে কি চান ?
ছেলেটা মারা যাওয়ার কিছু দিন পর থেকেই বাড়িতে রাতের দিকে নানা আওয়াজ হতে থাকে। বেশির ভাগই ওর ঘর থেকে। ওর মা কয়েকবার স্বপ্নেও ওকে দেখেছে। কিছু বলতে চায় ও।ওর দেখা পেতে অস্থির হয়ে থাকি। কিন্ত কিছুই দেখতে পাই না। ওর আত্মা অতৃপ্ত। কমলাদি তো একদিন রাতে খুব ভয় পেয়েছিলো। ওর মাথার পাশে নাকি কে এসে দাড়িয়ে ছিলো অন্ধকারে। পর দিন সকালেই উনি কাজ ছেড়ে চলে যান আর যাবার আগে আমাকে ওনার বাপের বাড়ির পাড়ায় আপনার ঠিকানা দেন । বলেন আপনি না কি আত্মার সাথে যোগাযোগ ঘটাতে পারেন।আমার সমস্যা একমাত্র আপনি মেটাতে পারবেন। আমি আমার মৃত ছেলের সাথে যোগাযোগ করে জানতে চাই ওর কি কষ্ট, কি বলতে চায় ও!
বুঝলাম সব। কিন্তু ওসব তো বহু বছর বন্ধ করে দিয়েছি।এই শরীরে আর পেরে উঠি না।বলে ওঠে বৃদ্ধ।
দয়া করে না বলবেন না। অনেক আশা নিয়ে দূর থেকে আসছি।ওর মার অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। বৃদ্ধের হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেলে অশোক।
আহা! নিজেকে শক্ত করুন। দেখছি কি করা যায়।এ কাজে বেশ ঝুঁকি।তার আগে আপনাকে ভেবে দেখতে হবে পারবেন কি না।
নিশ্চই পারবো। আপনি শুধু বলুন কি করতে হবে আমায়।
আসলে আত্মার সাথে যোগাযোগ আমি ঘটাই না ঘটায় আমার বাড়ির একটা পুরানো পালঙ্ক।
শুনে আশ্চর্য হয় অশোক। পালঙ্ক মানে খাট ?
আজ্ঞে হ্যা। প্রথমে কেউ বিশ্বাস করে না। অবশ্য না করারই কথা। কিন্তু একবার ওতে শুলেই সব অবিশ্বাস - বিশ্বাস এর গণ্ডী মিলে মিশে এক হয়ে যাবে।
ব্যাপারটা একটু খুলেই বলি.. আমার পিতামহ হরিদেব মজুমদার তার কনিষ্ঠ কন্যাকে কলেরায় হারিয়ে পুরোপুরি ভেঙে পরেন। জমিদারীতে আর মন ছিলো না তার। আমার বাবার উপর সব দায়িত্ব অর্পণ করে শান্তির খোঁজে এক সন্ন্যাসী সাধুর আশ্রমে চলে যান । নিজের মেয়ের মৃত্যুর দুঃখ ভুলতে দিনরাত সাধুর সেবার কাজে মন দেন।বহুবছর তার সেবা, ভক্তি দেখে সন্ন্যাসী খুব খুশি হয়ে হরিদেব বাবুকে কিছু চাইতে বলেন। কিন্তু তখনও সেই মেয়ের কথাই তার মাথায় চলছে। তিনি তার মৃত মেয়ে কে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। সাধু কিছু ভেবেই পিতামহ কে ডেকে আশ্রমের পিছনের জঙ্গলে নিয়ে যান। মন্ত্র উচ্চারণ করে নিজের হাত দুটো একটা সেগুন গাছে রেখে তাতে কিসব চিহ্ন এঁকে দেন আর বলেন...
এই গাছ কেটে তার কাঠ দিয়ে একটা পালঙ্ক বানাবি। অতি সাধারণ একটা পালঙ্ক। তাতে গদি পেতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবি। তবে রোজ শুবি না। যেদিন মেয়ে কে দেখতে ইচ্ছা হবে শুবি। শুয়ে ঘুম আসবেই,আর এলেই পরলোকের দরজা খুলে যাবে তোর সামনে। এক অন্ধকার জগতে প্রবেশ করবি ঘুমের মধ্যেই। অনেক চেনা পরিচিতর আত্মা দেখতে পাবি এদিক ওদিক কিন্তু ঘুমের আগে যার কথা মনে করে শুবি তাকেই খুজবি। ঠিক দেখতে পাবি। তার চোখমুখ তোকে বলে দেবে সে ওই জগতে কেমন আছে। তাকে স্পর্শ করার চেষ্টা করবি না। দূরে দূরে থাকবি।দেখা হয়ে গেলেই বেরিয়ে আসবি ওই জগৎ থেকে। ঘুম ও ভেঙে যাবে সঙ্গে সঙ্গেই। কিন্তু কিছু বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। পালঙ্কের ঘরে কেউ থাকবে না শোবার সময়।রোজ ব্যবহার করবি না। মানুষের শরীরে এতো চাপ নেয়ার ক্ষমতা নেই তাই কয়েকমাসেই শরীর ভেঙে পরবে। মৃত্যু অবধারিত। আর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ওতে শুলে তোর নিজের আত্মা ওই জগতে হারিয়ে যাবার খুব সম্ভাবনা থাকবে। শরীর নিথর হয়ে পরে থাকবে আর ঘুম ভাঙবে না। সবচেয়ে যেটা ভয়ের সেটা হোলো কিছু খারাপ আত্মা থাকবে এই সুযোগে তোর অনিষ্ট করার, তারা ভয় দেখাবে, এ জগতে ঢুকতে চাইবে কিন্তু শুধু তোর মেয়ের কথাই ভাবতে থাকবি তাহলে ঠিক এসব এড়িয়ে যেতে পারবি।কি রে খুশি তো ?
হরিদেব বাবু আনন্দে আত্মহারা হয়ে ফিরে আসেন এখানে। তারপর লোক নিয়ে গিয়ে গাছ কাটিয়ে শহরে নিয়ে গিয়ে সেই পালঙ্ক বানিয়ে আনেন।
তার পর ?অশোকের কৌতূহল বাঁধ মানছে না।
তারপর থেকেই শুরু হয় আমাদের বংশের করুন পরিণতি। পিতামহ মেয়ে কে দেখতে প্রায় রোজই ওতে শুতে থাকেন। কারোর সাথে এই বিষয়ে কোনো আলোচনাই তিনি করতেন না।ওই ঘরে ঢোকার অনুমতি কারোর ছিলো না। ক্রমে তার শরীর ভাঙতে থাকে। ছয় মাসের মধ্যেই তিনি ঘুমের মধ্যেই মেয়ের কাছে চলে যান।এর পর বহু বছর ওটা পরেই ছিলো। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থাও খারাপ হতে শুরু করে। বাবা তখন প্রিয়জন হারাদের ওতে শুতে দেবার জন্য টাকা নিতে শুরু করেন। আমি তখন কলকাতায় মামার বাড়িতে থাকতাম। শুনে ছিলাম বাবা ও নাকি ওতে ঘুমাতে শুরু করে। কিছু দিন পর তিনি ও আর ওঠেন নি। যারা শুতো তারা বার বার ওটাতে শুতে চাইতো। তাই আমিও এক কালে অর্থের বিনিময়ে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছিলাম। কিন্তু দিনকাল পরিবর্তন হোলো। বিয়ে করে সংসারী হলাম। মফস্বলে একটা কাজ করতে শুরু করলাম। ওটাকে ভুলেই গেলাম।মেয়ে হোলো।মেয়ের বিয়ে হয়েছিল শহরে । শহরেই কাজ কম্মো করে। হপ্তায় কয়েকদিন এসে রান্না বান্না, কেনা কাটা করে দিয়ে যায়।আজ সকালেও রান্না করে দিয়ে গেছে।বৌ মারা গেলেন সিঁড়ি থেকে পরে। যদিও আমার সন্দেহ ওকে কেউ ঠেলে দিয়েছিলো। কারন ওই পালঙ্ক কে ভর করে কিছু অশুভ আত্মা এ জগতে ঢুকতে চাইতো। যারা ঢুকে পরতো তারা এখানেই আসে পাশে অনিষ্ট করতো। রাতের বেলা ওই ঘরে কতো শব্দ শুনতে পাই।
এখনো ? প্রশ্ন করে অশোক।
হ্যা। বাড়ির চারিদিকেই তাঁদের উপস্থিতি টের পাই। গোটা বাড়ি ঠান্ডা হাওয়াতে সির সির করে। অন্ধকারগুলো ধোঁয়াটে লাগে। ছাড়ুন,ভয় পাচ্ছেন না তো?
অশোক ঘাড় নারে।তবে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে কপালে।
এবার বুঝলেন তো কেন আপনাকে সাবধান করছিলাম। অন্ধকার হয়ে গেছে ঘরে চলুন।
বৃদ্ধকে অনুসরণ করে অশোক ঘরে প্রবেশ করে। বেশ ঠান্ডা লাগছে। সারাদিন বৃষ্টিতে প্রকৃতি যেন চারিদিকে ঘুম জড়ানো মায়া সৃষ্টি করেছে।আসে পাশে একটা আওয়াজ নেই। নদীর ওপারে কয়েকটা টিমটিমে আলো মানুষের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।
পুরানো আমলের বাড়ি। ভিতরটা বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে তৈরী ।টিম টিম করে কয়েকটা আলো জ্বলছে। সেই আলোতে অন্ধকার যতটা না দূর হচ্ছে তার চেয়ে বেশি আলো আঁধারি পরিবেশ তৈরী হচ্ছে।নিজের ছায়াতেই চমকে ওঠে অশোক।
আসলে কারেন্টের বিল বাঁচাতে আলো বেশি জ্বালাই না।অসুবিধা হচ্ছে না তো ?
না না, কোনো সমস্যা নেই। আপনাকে কিছু আর্থিক সাহায্য করে যেতে চাই। অনুরোধ করে অশোক।
না না। আপনার সাহায্য হলেই খুশি হবো।আসুন এই ঘরে। দালানের একবারে শেষ ঘর টা খোলে বৃদ্ধ। ওই যে সেই পালঙ্ক।
উঁকি মেরে অশোক দেখার চেষ্টা করে।অল্প আলোতে পালঙ্কটাকে যেন চারপেয়ে কোনো দানব মনে হয় তার।এক দৃষ্টিতে ওটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
এই ঘরে আসুন। বৃদ্ধর ডাকে হুঁশ ফেরে অশোকের। পাশের ঘরে গিয়ে একটা পুরানো কাঠের চেয়ারে বসে সে।
কিছু খেয়ে নিন। দূর্বল শরীর নিয়ে এসব কাজ হয় না। একটা থালায় দুটো রুটি আর একটু তরকারি বাড়িয়ে দেয় বৃদ্ধ।
এসবের কি দরকার ছিলো ? আমাকে দিলে আপনি কি খাবেন রাতে ?
সে চিন্তা নেই মেয়ে বেশি করেই রেঁধে রেখে যায়।খেয়ে নিন দেরী না করাই ভালো।
হুম। যা হোক করে দুটো রুটি খেয়ে নেয় অশোক।
খাবার ঠিক ছিলো তো ?জল খেলেন না ?
সাথে জল ছিলো। তবে খাবার বেশ ভালো। মনে হোলো নিজের ঘরেই খাচ্ছি।
তা ভালো।
এবার একটু জিরিয়ে নিন। নটা নাগাদ ওই ঘরে যাবো। আমি কয়েকটা জিনিস গুছিয়ে আসছি। ঘরেই থাকবেন। কোনো আওয়াজ এলে ভয় পাবেন না।বৃদ্ধ বেরিয়ে যায়।
শীত শীত করতে থাকে অশোকের। চোখ জুড়ে আসে ঘুমে। বিট্টুর কথা ভাবতে থাকে সে। হঠাৎ দরজার বাইরে তাকাতেই কে যেন সরে যায়। তার দিকে কি কেউ এতক্ষন তাকিয়ে ছিলো ? দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। দালানের কোনে আবছা ধোঁয়ার মতো কি একটা কুন্ডলী পাকিয়ে রয়েছে।গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে অশোকের। ঘরে ঢুকে আসে সে।বাইরে ঠক ঠক করে দেয়ালে মাথা ঠোকার মতন আওয়াজ আসতে থাকে। ঠান্ডা আবহাওয়া তেও ঘেমে ওঠে অশোক। বৃদ্ধের আগমনে স্বস্তি পায় সে।
আসুন। ভয় লাগে নি তো?
না না। চলুন।পালঙ্কের ঘরে প্রবেশ করে ওরা।
দেখুন ওটাতে শুয়ে নিজের মৃত ছেলের কথা ভাবতে থাকবেন। ওর নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘুম এসে যাবে ঠিক। তার পর যা দেখবেন সব ঘুম ভাঙার পর মনে রাখার চেষ্টা করবেন। পুরোটাই স্বপ্নের মতো লাগবে, তবে ভয় পেয়ে ছটফট করলে আগেই ঘুম ভেঙে যাবে। আমি সেই ভোরে আসবো। আগে ঘুম ভেঙে গেলে উঠে পাশের ঘরে চলে আসবেন, আমি থাকবো। ঠিক আছে, আমি চলি।
বৃদ্ধ চলে গেলে অশোক আলো নিভিয়ে পালঙ্কে উঠে শুয়ে পরে। অন্ধকার ঘরে নিজের বুকের ধুকপুকুনি নিজেই শুনতে পায় সে। জালনার বাইরে তখন ঝিঁ ঝিঁ পোকাদের সমবেত সংগীত পরিবেশন চলছে। ব্যাং ডাকছে ঠিক তার ই সাথে তাল মিলিয়ে। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যই ঘুমে আছন্ন হয়ে পরে অশোক।
এখন সে একটা অন্ধকার বাড়ির ভিতর দাড়িয়ে আছে। চারিদিকে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছে সে। একটু এগোতেই বাড়িটা তার চেনা ঠেকলো। আরে! এটা তো তার নিজের বাড়ি। সে এখানে কি করছে ? রান্না ঘরে দাড়িয়ে আছে সে। ঝাঁঝালো গন্ধটাও চিনতে পেরেছে সে। রান্নার গ্যাস এর গন্ধ। বড়ো তীব্র। রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল সে। কেউ নেই সেখানে। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো । পাশের বাড়ির ছাদে কেউ একটা পা ঝুলিয়ে বসে আছে মনে হোলো। আরে ওটা তো কালিপদদা। গত বছরেই গলায় দড়ি দিয়েছিলো পারিবারিক অশান্তি তে। অশোককে দেখতে পেয়েছে সে। বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। পছন্দ করেনি তার অনধিকার প্রবেশ। চোখ সরিয়ে নেয় অশোক। ছেলের ঘরের দিকে যায় সে।ঘরের কোনে দাড়িয়ে আছে বিট্টু। ছেলেটার চোখ মুখ বিদ্ধস্ত।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না অশোক।ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরতে মন চায়। বিট্টু হঠাৎ হাত টা তুলে অশোকের দিকে কিছু একটা দেখাতে চাইছে।কিছুই বুঝছে না অশোক।ওর ইঙ্গিত অশোকের দিকেই। অশোকের বুকের দিকে কিছু একটা দেখাতে চাইছিলো সে।হঠাৎ ছেলের পিছনে আর একটা ছেলের মুখ আবছা মতো দেখতে পায় সে।এক অদ্ভুত অস্বস্তি অনুভূত হয় তার। পায়ে ঠান্ডা কিছু একটার স্পর্শে ঘুম ভেঙে যায় অশোকের। ঘেমে চান করে গেছে সে। ঘড়ি তে তখন রাত তিন টে। ভোর হতে বাকি। আর একটু যদি ছেলেটাকে দেখতে পেতাম। কিন্তু পায়ে কি ঠেকলো ?পায়ের দিকে তাকায় সে আর তৎক্ষণাৎ একটা কালো হাত যেন পালঙ্কের তলায় ঢুকে যায়।কেউ কি ছিলো ওখানে ?তাহলে কি বৃদ্ধের কথা অনুযায়ী কোনো অশুভ আত্মা রয়েছে এই ঘরে। সাহস সঞ্চয় করে ঝুঁকে পরে পালঙ্কের তলায় তাকায় সে। অন্ধকার কাটাতে মোবাইলের আলো জ্বালে।চমকে ওঠে অশোক। একটা কালো ছায়া ঠিক যেন মানুষের আকৃতির,তার মুখের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখ দুটো যেন প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে।ছেলের আত্মার পিছনে যে ছেলেটাকে দেখেছিলো সে একবারে তার মতোই। গুটি সুটি মেরে রয়েছে খাটের তলায়।যেন শিকার ধরার অপেক্ষা।পালঙ্ক থেকে নামার সাহস সঞ্চয় করতে সময় নেয় সে। একপ্রকার দৌড়েই পাশের ঘরে ঢুকে পরে অশোক । বৃদ্ধ চমকে ওঠে।
কি হোলো আপনার ?
পালঙ্কের নিচে কে একটা...
ওহ! আপনাকে আগেই সাবধান করেছিলাম। আসলে ওই আত্মা টা বোধহয় এই জগতে এসে পরেছে। কদিন হোলো ওই ঘর থেকে টুক টাক আওয়াজ আসতেই থাকে। আপনার কার্য সিদ্ধি হয়েছে তো ?
হা, তা হয়েছে।
যাক নিশ্চিন্ত।
ভোর হতেই অশোক বিদায় নেয়। বাড়ি ফিরে স্ত্রী মায়া কে সব বলে।বিট্টু কি বোঝাতে চাইছিলো কিছুই বুঝতে পারে না দুজনেই। সন্ধ্যে বেলা চা খেতে খেতে হঠাৎ অশোক ভাবে বিট্টু কি তার বুকের দিকে ইঙ্গিত করছিলো না জামার পকেটের দিকে । কিছু একটা মাথায় আসে তার।
মায়া কে ডেকে কালকের জামা টা আনতে বলে। এটা তার পুরানো ওষুধ কোম্পানির জামা। পকেটের ওপর কোম্পানির লোগো আর ছোটো করে কোম্পানির নাম লেখা রয়েছে।
তাহলে কি তোমার পুরানো কোম্পানির সাথে বিট্টুর মৃত্যু জড়িয়ে রয়েছে? প্রশ্ন করে মায়া।
সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। বিট্টুর মৃত্যুটা তো দুর্ঘটনা ছিলো। দাড়াও দাড়াও। অশোক মাথা নাড়তে নাড়তে বলে.. কিছু গোলমাল আছে। আমি কাল ওই পালঙ্কে শুয়ে বিট্টুর কাছে যেতে গিয়ে রান্না ঘরে গ্যাস এর গন্ধ পেয়েছিলাম।তাহলে কি ও গ্যাস জ্বালার সময় সিলিন্ডার এর মুখ খোলা ছিলো?বিট্টু কিছু বোঝাতে চাইছে। চট করে ল্যাপটপের সামনে বসে পরে অশোক।
কি হোলো ? ওটা নিয়ে বসলে কেন এখন ?
দেখছি খারাপ ওষুধের জন্য মৃত ছেলেটার ডিটেলস কোথাও পাই কি না।
তোমার ওই সাংবাদিক বন্ধু তপন কে ফোন করো না...
ঠিক বলেছো।
তপন কে ফোন করে অশোক।ছেলেটা সম্পর্কে জানতে চায়।
কিচ্ছুক্ষন পরেই তপনের ফোন আসে।সে জানায়.. ছেলেটা ছাত্রাবাসে থাকতো। হঠাৎ প্রচন্ড জ্বর আর বমি শুরু হয়। তার পর ওই ওষুধ খেয়ে জ্বর আরও বেরে যায় আর পর দিন রাতেই মারা যায়। ছেলেটার মা সম্পর্কে কিছু তথ্য সে পেয়েছে। ছবিটা অশোককে পাঠাচ্ছে।
কিচ্ছুক্ষন পরে হোয়াটস্যাপে যে ছবিটা আসে তা দেখে হা হয়ে যায় অশোক। এতো কমলা দি। তাহলে কমলা দি কি ছেলের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে তার বাড়িতে পরিচারিকার কাজ নিয়েছিল। ইচ্ছা করে গ্যাস খুলে রেখে দোকানে গেসলো সে।মাথা কাজ করে না অশোকের।নিজের অপরাধের এতো বড়ো দাম দিতে হবে ভাবতে পারে নি অশোক।
পরদিন সকালেই থানায় গিয়ে কমলার নামে অভিযোগ জানায় অশোক। নিজের অপরাধ আর পালঙ্কের ব্যাপারটা সন্তর্পনে এড়িয়ে যায়। তার পর সোজা ফুলডিঙ্গার উদ্দেশ্যে রওনা হয় সে।আজ ও সে শোবে ওই পালঙ্ক তে। ছেলেটা আরও কিছু বলতে চায় কি না জানতে হবে তাকে। বৃদ্ধ ঠিক ই বলেছিলো, ওতে একবার শুলেই বার বার শুতে ইচ্ছা হয়।আসলে মানুষ বিদায় নেয়ার সময় অনেক না বলা কথা থেকে যায়। সে গুলো জানতে বার বার মন চায় শুধু সুযোগ আর আসে না। ওই পালঙ্কের কল্যানে তার সেই সুযোগ এসেছে। বিট্টুর খুনি ধরা পরলে ওর আত্মা শান্তি পাবে।এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যে বেলা মজুমদার বাড়িতে পৌঁছে যায় অশোক।বৃদ্ধ অশোককে দেখে আশ্চর্য হয় না।
জানতাম আপনি আসবেন। যে একবার ওটায় শুতে যায় সে আবার আসে।
শোবার জন্য ছটফট করছে অশোক। বৃদ্ধ বুঝতে পারে।
তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আগে একটু বসুন। এই নিন জল খান। জলের গ্লাস এগিয়ে দেয় বৃদ্ধ। তাড়াহুড়ো তে আজ আর জল নিয়ে আসে নি অশোক। এক নিঃশ্বাসে জল খেতে খেতে সব কথা বলে সে বৃদ্ধ কে।বৃদ্ধর অভিব্যক্তি দেখে মনে হয় এ সব হবে সে যেন আগে থেকেই জানতো।
বসুন আমি কাজ সেরে আসছি। বৃদ্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। কাল থেকেই আর একটা খটকা লাগছিলো অশোকের। সেই দিনের রাতের বৃদ্ধের দেয়া রুটি তরকারির স্বাদ তার খুব চেনা চেনা লাগছিলো।কোথায় যেন খেয়েছিলো !দেয়ালের কোনের তাকে একটা ছবির দিকে নজর গেলো অশোকের। সেই দিন রাতে উত্তেজনায় খেয়াল করে নি সে। মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট অন করে সেটার দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায় অশোক।ছবিটি সম্ভবত মা আর ছেলের। মহিলাটি কমলা আর ছেলেটা সেই যাকে সে বিট্টুর পিছনে আর পালঙ্কের নিচে দেখে ছিলো। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে অশোকের। চোখ বুজে আসছে। এমনটা কেন হচ্ছে ?
চিনতে পারছেন ওদের কে ? বৃদ্ধ এসে দাড়িয়েছে দরজায়। মেয়েটা আমার না মরে বেঁচে আছে শুধু আপনার জন্য। জামাই টা দুঃখ না সইতে পেরে আত্মহত্যা করে। মেয়েটাও করতো হয়তো এই বুড়োর মুখ চেয়েই করে নি।টাকার লোভে জাল ওষুধ গুলো বাজারে ছাড়লেন আর ভাবলেন না তার কি পরিণতি হতে পারে। নাতিটা মুখে রক্ত তুলে যেদিন মরলো সেদিনই আমার মেয়ে ঠিক করেছিলো এর প্রতিশোধ সে নেবে। পুত্র হারানোর কষ্ট কি তা বোঝাবে আপনাকে। তবে মেয়েটা আপনাকে মারতে চায় নি,চেয়েছিলো আপনি যাতে ছেলের আত্মার সাথে দেখা করতে পারেন তাই এখানে পাঠিয়েছিল। আমিও ভেবেছিলাম আপনার অনুশোচনা আছে নিজের পাপ নিয়ে , কিন্তু দেখলাম আমি ভুল। তাই ভাবলাম আপনার মতো মানুষের ওপর দয়া করা চলে না।সে দিন রাতেও আজকের মতো জলে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছিলাম কিন্তু আপনি জল খান নি। কিন্তু আজ! হো হো করে হেঁসে ওঠে বৃদ্ধ। ফাঁকা বাড়িতে সেই আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে।নাতিটা বড়ো ভালো ছিলো পড়াশোনায়।ভালোবাসতো আমায়। ওর আত্মা কষ্টে কষ্টে এবাড়িটায় ঘুরে বেরায়। বুকটা ফেটে যায় আমার। ঘুমে আর দাড়িয়ে থাকতে পারছে না অশোক।চলুন ওই ঘরে যাওয়া যাক।পালঙ্কের সঠিক ব্যবহার আজ হবে।
অশোক কে এক প্রকার ধরে ধরেই পাশের ঘরে নিয়ে যায় বৃদ্ধ। যত্ন করে পালঙ্কে শুইয়ে দেয়। ঘরের দরজা বন্ধ করে। অশোক শত চেষ্টাতেও পালঙ্ক থেকে উঠতে পারে না। একটা কালো ছায়া তার পালঙ্কের চারপাশে পায়েচারী করে চলেছে।চোখ গুলো তার প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে।ঘুমের মেঘ তার চেতনার আকাশ কালো করে তুলছে একটু একটু করে। শেষ ঘুম অশোকের। একটু একটু করে অন্য জগতে প্রবেশ করলো সে। অন্ধকার থেকে ফেরার রাস্তা নেই। শরীরটা পরে রইলো পালঙ্কে। ভোরের আলো ফোটার আগেই বৃদ্ধ তার মেয়ের গোপন ঠিকানায় গা ঢাকা দিলো।সে বিলক্ষন জানতো অশোকের খোঁজে দু একদিনেই পুলিশ এ বাড়িতে আসবে।হলোও তাই। দু দিন পরেই অশোকের বডি পাওয়া গেল পালঙ্কে। বাড়ি পরে রইলো। পরে রইলো পালঙ্ক। তবে বেশি দিন নয় পাড়ার কয়েকটা বকাটে চোখরা নেশার টাকা জোগাড়ের জন্য বাড়ির আসবাব একে একে বেঁচতে শুরু করলো। শেষে খাট টা বিক্রির ব্যবস্থা হোলো। এক কাঠগোলা অল্প টাকায় ভালো খাট হাতছাড়া করলো না। পালিশ করে ভালো দামেই বেচলো শহরের এক দম্পতি কে। নতুন বিয়ে করে শহরে ভাড়া এসেছে তারা। বেজায় খুশি ভালো পালঙ্কটা পেয়ে। রাত গুলো দারুন কাটতে চলেছে তাদের।
|| সমাপ্ত ||
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
দারুন লাগলো আমার 
Posts: 1,403
Threads: 2
Likes Received: 1,422 in 982 posts
Likes Given: 1,750
Joined: Mar 2022
Reputation:
82
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(17-08-2023, 05:09 PM)Bumba_1 Wrote: দারুন লাগলো আমার 
(17-08-2023, 10:14 PM)Somnaath Wrote: ভালো না
আচ্ছা
•
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,202 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,738
বিভীষিকা টা আরেকটু ভালো হতে পারতো কিন্তু পালঙ্কটা জব্বর লাগলো। ❤❤
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
|| ককটেল ||
লেখা :- নির্মাল্য দেবনাথ
-“একে এক করে দুই পেগ হয়ে গেলো। এবারে অন্য কিছু”। কোণের টেবিলটাতে বসা কাস্টমারটা বলে উঠলো।
- “মানে”? অর্ডার কাগজে টুকতে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো নীরজ।
- “যখনই নেশা করতে বসি এক এক করে দুই পেগ ভদকা দিয়ে শুরু করি। তার পরেই অন্যকিছু”। বললো টেবিলটাতে এসে বসা আগন্তুক।
- “এবারে কি দেবো স্যার তাহলে? হুইস্কি ?" বললো নীরজ।
- “দিতে পারো। স্কচ হুইস্কি। স্মোকি ফিলিংসটা যেন থাকে”। লোকটা বললো।
- “সঙ্গে কি দেবো স্যার? সোডাই দেবো তো”? নীরজ প্রশ্ন করলো।
- “না:। সোডা দিয়ে কেউ স্কচ খায়? নিট দেবে আইস কিউব দিয়ে”। মৃদু ধমক দিয়ে বললো লোকটা।
- “ফুড আর কি কিছু দেবো স্যার? লোকটার ধমককে উপেক্ষা করে হাসি মুখে বললো নীরজ।
- “ফিশ ফ্রাইটা আরেকখানা দাও, অরিজিনাল ভেটকিই মনে হলো খেয়ে”। লোকটা বললো উত্তরে।
-“ওকে স্যার”। বলে হুকুম তালিম করতে চললো নীরজ।
লোকটা বেশ অদ্ভুত। এরকম পাল্টে পাল্টে মদ খেতে কাওকে খুব একটা দেখা যায় না বারে। তবে মনে হচ্ছে বেশ রইস, আজ মনে হয় ভালোই টিপস্ লেখা আছে কপালে।
এসিটা বাড়িয়ে দিলো নীরজ। সুন্দর একটা ইংরেজি গান বাজছে মৃদু শব্দে। লাল নীল সবুজ আলো ঘুরে ঘুরে ছটা ছড়িয়ে দিচ্ছে চৌকোনো টেবিলগুলোতে।
পেগটা শেষ হওয়া মাত্র আবার একটা পেগ অর্ডার করলো লোকটা। এই পেগটাও শেষ হবার আগেই পাশে এসে দাড়ালো নীরজ, বললো, “স্যার এবারে তাহলে হোয়াইট রাম ঢালি? বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তোড়ে, বেরোতেই পারবেন না এখন”।
- “বেশ, তবে দাও। তবে বৃষ্টি বন্ধ হলে বোলো কিন্তু”।
- “নিশ্চয়ই স্যার”। বলে এবারে গ্লাসে সাদা পানীয় ঢেলে দিলো নীরজ।
কিন্তু বাইরে আজ অবিশ্রান্ত ধারাপাত চলেছে শ্রাবণের। তা থামার কোন লক্ষণ দেখা গেলো না। ফলে আরো এক পেগ রাম গ্লাসটাতে ঢালতে হলো নীরজকে।
রামের পরে ওয়াইন অর্ডার করলো লোকটা। ওয়াইন খেতে খেতে নীরজকে টেবিলে ডাকলো সে। নীরজকে একান্তে বললো, “ভাই রাস্তায় নিয়ে গিয়ে ট্যাক্সি ধরিয়ে দিতে পারবে ?”
কথাটা শুনে মুচকি হেসে বললো নীরজ, “চড়ে গেছে নাকি স্যার? চড়ারই তো কথা। আট পেগ এত অল্প সময়ে খেয়েছেন স্যার আপনি। তবে আপনার কিন্তু এলেম আছে। কথায় কোন জড়তা নেই। হাত কাঁপা পা টলা এসব কিছুই দেখছি না আপনার মধ্যে”।
“আট পেগ খেয়ে কিভাবে নর্মাল আছি ভাবছো? আসলে আমাদের চুক্তিটাই এরকম। আমি মদ খাব আর সে বমি করবে। আমি নেশা করবো আর তার পা টলবে”। ঈষৎ রহস্য করে বললো লোকটা।
“কার সাথে চুক্তি! কোন চুক্তি?”
এবারে অবাক হয়ে কথাটা বললো নীরজ।
লোকটা এবারে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে এলো। তারপর বললো, “আমি যেমন এই টেবিল দখল করে নেশা করছি তেমনি আমার শরীর দখল করে আরেকজন নেশা করে। আমি এক আর সে এক। একে একে মিলে দুই হয়ে যাই আমরা। বিল কিন্তু আমিই পে করি। শর্ত শুধু একটাই, আমি নেশা করবো আর সে অসুস্থ হবে”।
“এইসব কি বলছেন স্যার? আপনার মনে হচ্ছে সত্যিই খুব বেশি চড়ে গেছে”। মহা আশ্চর্য হয়ে বলে উঠলো নীরজ।
কিন্তু ওর কথা শেষ হবার আগেই বাথরুম থেকে ভেসে এলো বিশ্রী গাগুলোনো একটা শব্দ। শব্দটা শুনে অস্বস্তিতে আর ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো নীরজের। কারণ বাথরুমটা তালা দিয়ে বন্ধ। আর আজ আবহাওয়া খুব খারাপ বলে সেরকম ভীড়ও হয়নি বারে। কাজেই বাথরুমটা খোলাই হয়নি আজ। অথচ ওটার ভেতর থেকেই ভেসে এলো বেসিন খুলে হড় হড় করে বমি করার শব্দ।
ও কিছু বলার আগেই টেবিলে বসা রহস্যময় লোকটা এবারে টেবিল ছেড়ে উঠে পড়লো। বললো, “আমি বিল মিটিয়ে বেরোচ্ছি তুমি ট্যাক্সি অবধি পৌছে দাও ওকে”।
নীরজের শরীরে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা দিলো। এসি চলছে তা সত্বেও। উজ্জ্বল ঝাড়বাতির আলো সত্ত্বেও চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে লাগলো নীরজ। কারণ ও স্পষ্ট অনুভব করলো
ওর হাতটাকে সজোড়ে চেপে ধরেছে অন্য একটা হাত।
নেশাগ্রস্তের মতোই টলমল করছে সেই হাত। কিন্তু জীবন্ত মানুষের মতো তা উষ্ণ নয়, বরফের চেয়েও অনেক বেশি শীতল সেই হাতের স্পর্শ।
হাতটার স্পর্শ সহ্য করে দরজা অবধি পৌছতে পারলো না নীরজ, তার আগেই নিজেই নেশাগ্রস্তের মতো টলতে টলতে বসে পড়লো মাটিতে।
|| সমাপ্ত ||
Posts: 839
Threads: 3
Likes Received: 672 in 435 posts
Likes Given: 1,421
Joined: Dec 2022
Reputation:
51
Posts: 1,403
Threads: 2
Likes Received: 1,422 in 982 posts
Likes Given: 1,750
Joined: Mar 2022
Reputation:
82
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(19-08-2023, 10:34 AM)Chandan Wrote: good one
(19-08-2023, 11:28 AM)Somnaath Wrote: ছোটোর মধ্যে মন্দ নয়
•
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
|| চামড়ির বিল ||
কাহিনি: ত্রিজিৎ কর
-" আস্তে আস্তে উঠুন...এদিকটা বড্ড কাদা।"- লোকটার ফ্যাসফাসে কণ্ঠস্বরে কিঞ্চিৎ চমকেই উঠল হৃষিতা। একে তো শীতকালের এমন নিশুতি রাত, তার মধ্যে চারিদিকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।
হাতে ধরা টর্চের আলোয় সামনেটা আরেকবার ভালো করে দেখল সে। যত দূর চোখ যায় আলকাতরার মতন কালো জল টলটল করছে। শীতকাল বলেই খুব সম্ভবত বিলটা মজে গেছে। জল খুব বেশি হলে কোমর অবধি হবে।
বিলের মাঝে মাঝে এখানে ওখানে জলজ আগাছা ভূতের মতন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। আর বিলের মাথার উপর স্বচ্ছ মেঘ ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে আছে কুমড়োর ফালির মতন চাঁদ।
-" আপনি কি প্রতি রাতেই এখানে থাকেন? কী করে বুঝলেন আমি আসব আজ?"- হৃষিতা কাঁদার উপর অতি সাবধানে পা ফেলে ডিঙির উপর গিয়ে উঠল।
লোকটা এইবার হাতের লন্ঠনটাকে সামলে ধীর পায়ে কাঁদা ডিঙিয়ে একেবারে ডিঙির সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর লন্ঠনখানা ডিঙির উপর রেখেই বলল, " আজ্ঞে, বছরের এ সময়টা অনেকেই এখানে ছুটে আসে। আমরা এদিককার লোকেরা যারা ডিঙি করে এই চামড়ির বিলে শাপলা তুলতে আসি, মাছ ধরতে আসি, তাদের কাছে এসব নতুন না।"
লোকটা একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে এইবার ডিঙিতে উঠে পড়ে। তারপর ধীরে ধীরে ডিঙি বাইতে শুরু করে দেয়। ছোট্ট ডিঙিটা অগভীর জলের উপর দিয়েই দুলতে দুলতে এগিয়ে চলে সামনের দিকে।
প্রথমটা ডিঙির উপর বসে সারা শরীরে কেমন শিহরণ খেলে যায় হৃষিতার। ডিসেম্বর মাসের শেষ দিক। একেই জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পড়েছে। তারমধ্যে এখন প্রায় মধ্যরাত। হাত ঘড়ির রেডিয়ামের ডায়াল জানান দিচ্ছে সময় রাত তিনটে বেজে পাঁচ মিনিট। জলের মধ্যে ছপাত ছপাত শব্দ করে ধীর লয়ে ডিঙি এগিয়ে যাচ্ছে বিলের আরও গভীরে।
-" এই বিলের ব্যাপারে কোথা থেকে জানলেন?"- ডিঙি বাইতে বাইতেই লোকটা ফের প্রশ্ন করল।
হাতে ধরা টর্চের আলোয় এই প্রথমবার লোকটার মুখটা ভালো করে দেখল হৃষিতা। কাঁচা পাকা দাড়ির আড়ালে দুখানা তীক্ষ্ণ গভীর চোখ উঁকি মারছে। ভদ্রলোকের বয়স পঞ্চাশ তো হবেই। পরনে আধ ময়লা নোংরা জামা আর লুঙ্গি। মাথায় বড়সড় টাক।
প্রথমটা একটু ইতস্তত করল হৃষিতা। তারপর বলল, " অনলাইনে। একটা ফেসবুক গ্রুপ থেকে জানতে পেরেছিলাম।"
-" অনলাইন মানে ওই মোবাইল থেকে জানতে পেরেছেন তাই তো!"
লোকটা যে ফেসবুক, গ্রুপ এসব বুঝবে না সেটা বোঝা উচিৎ ছিল হৃষিতার। সংক্ষেপেই সে উত্তর দিল, " হ্যাঁ, তাই।"
-" ওই মোবাইল আর কি বললেন যেন হ্যাঁ ফেইসবুক, ঐটে হওয়ার পর থেকেই এখানে লোকের আনাগোনা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে। নইলে সুদূর কলকেতা থেকে অ্যাদ্দুরে এই গণ্ড গ্রামের এক প্রান্তে চামড়ির বিলের কতা কজনই বা জানত! এই তো গত হপ্তা এক মহিলা এসেছিলেন নিজের ছেলের সঙ্গে দেখা করবেন বলে। সে কি তার আকুল কান্না! ফেসবুকে কী একটা পোস্ট না ফোস্ট দেখে এসেছিলেন..."
হৃষিতা এইবার একটু নড়ে চড়ে বসল। বলাই বাহুল্য সেও এখানে এসেছে এরকমই একটি পোস্ট পড়েই। অকাল্ট চর্চা সম্পর্কিত একটা অত্যন্ত গোপনীয় ' প্রাইভেট গ্রুপে ' এই চামড়ির বিলের কথা সে প্রথম জানতে পারে। এমনিতে কখনই এসব বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ ছিল না। কিন্তু মাস ছয়েক আগে ওই ঘটনার পর থেকেই...
পোস্টটা পড়ে প্রথমটা আজগুবি মনে হলেও কমেন্টগুলো পড়ে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল হৃষিতা। অনেকেই লিখেছে ঘটনাটা নাকি সত্যি। তারা নিজেরা এই বিলে এসে নিজেদের কাছের মানুষদের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। কখন কিভাবে আসতে হবে সেসব ব্যাপারেও বেশ কিছু কমেন্ট ছিল।
এরপরেই কৌতূহলবশত গুগল ম্যাপে জায়গাটা সত্যি আছে কিনা দেখতে গিয়ে চমকে ওঠে হৃষিতা। সত্যিই এই চামড়ির বিল নামে একটা জায়গা আছে! আর সেই পোস্টে উল্লিখিত ঠিকানার সঙ্গে ম্যাপে দেখানো ঠিকানাটাও হুবহু এক...
-" যার সঙ্গে দেখা করতে চাইছেন তার ব্যবহার করা কোনো একখানা বস্তু সঙ্গে এনেছেন তো?"- লোকটা কিঞ্চিৎ রহস্যময় কণ্ঠেই কথাটা জিজ্ঞেস করে।
হৃষিতা সম্মতি জানায়। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটার প্রথম খোপ থেকে সে এবার একটা ছোট্ট জিনিস বের করে আনে। টর্চের আলো পড়তেই জিনিসটা চকচক করে ওঠে। একটা আংটি।
-" বেশ বেশ। এতেই হবে। যেমন যেমনটা বলে দেব তেমন তেমনটা করবেন তাহলেই এই আংটি যার তাকে ঠিক দেখতে পাবেন।"- ডিঙি বাইতে বাইতেই লোকটির মুখে আবারও একটা রহস্যময় হাসি ফুটে ওঠে।
-" তা আংটিখানা কার জানতে পারি? কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন এখানে? খুব কাছের মানুষ বুঝি...মনে হচ্ছে যেন অপঘাতে মৃত্যু!"
হৃষিতা এইবার যেন চমকে ওঠে। তারপর হাতে ধরা আংটিটার দিকে তাকিয়েই কোনোমতে উত্তর দেয়, " হ্যাঁ, খুব কাছের বন্ধু। ছয় মাস আগে সুইসাইড করেছিল। আপনি কি করে বুঝলেন?"
লোকটা এইবার হাসল শুধু, " কম তো লোক নিয়ে আসলাম না। মুখ দেখলেই এখন কিছু কিছু আন্দাজ করতে পারি। তবে একটা কথা বলি শুনুন..."
লোকটার গলার স্বর আচমকাই যেন গম্ভীর হয়ে ওঠে, " অপঘাতের মরা তো। খুব সাবধান থাকবেন কেমন! আগের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি যারা অপঘাতে মরে তারা কিন্তু একা ফিরতে চায় না। ওদের একরকম টান থাকে...বুঝলেন..."
লোকটা কি বোঝাতে চাইল কে জানে, কিন্তু কথাটা শুনেই হৃষিতার সারা শরীরে কেমন যেন চোরা শিহরণ খেলে গেল।
টান...সত্যিই তার প্রতি একটা টান তো আছেই...যেই টানে এত দুর হৃষিতা ছুটে এসেছে! একবার শুধুমাত্র একবার ওকে দেখবে বলে।
ও মানে হৃষিতার সবচাইতে কাছের বন্ধু, পিউ! ওর এত দূর ছুটে আসা আজ রাতে সার্থক হবে তো?
ডিঙিটা প্রায় বিলের মাঝামাঝি চলে এসেছে। এদিকটা জল যে কিঞ্চিৎ বেশি গভীর তা একটু ঠাওর করলেই বোঝা যায়। যতই বিলের ভেতরের দিকে নৌকা এগোচ্ছে ততই চারিদিকে কুয়াশার আস্তরণ ক্রমশ যেন ঘন হচ্ছে। টর্চের আলোতেও সেই কুয়াশা ভেদ করে বেশি দুর দেখা যায় না। জায়গাটা অদ্ভুত ঠাণ্ডা। সারা শরীরে কেমন যেন কাঁপুনি দিচ্ছে হৃষিতার।
-" এই বিলের এমন অদ্ভুত নাম কেন?"- এক মনে চারিদিকটা দেখছিল হৃষিতা। আচমকাই নিজের মনে প্রশ্নটা করে বসল ও।
ডিঙির লোকটা এই প্রশ্ন শুনে আগের মতোই মৃদু হাসল। তারপর বলল, " আজ্ঞে, এ প্রশ্নের উত্তর আমারও ঠিক ঠিক জানা নেই। তবে বাপ ঠাকুরদার কাছে শুনেছি কোন এক সময়ে নাকি এই বিলের জলে মানুষের চামড়া ভেসে থাকতে দেখা যেত।
বহু বচ্ছর আগে এখানে এই অঞ্চলেই নাকি কোনো এক মহা পাষণ্ড জমিদারের রাজ ছিল। সে সময় কেউ জমিদারের আদেশ অমান্য করলে কিংবা খাজনা না দিলে নাকি গরম লোহার শিক দিয়ে তার চামড়া ছাড়িয়ে এই বিলের জলে ফেলা হত। সেই ভাবে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে। ওই থেকেই এই বিলের নাম চামড়ির বিল।"
লোকটা চুপ করতেই হৃষিতার সারা শরীরটা যেন শিউরে উঠল। সত্যিই কি এই বিলের জলে এক সময়ে মানুষের চামড়া ভাসতে দেখা যেত! কথাগুলো ভাবতেই সারা শরীরে যেন অস্বস্তি হচ্ছে হৃষিতার।
বহু দূরে ঠিক এই সময়ে কোথাও একটা শেয়াল ডেকে উঠল। গভীর রাতের নিস্তব্ধতা ছিন্ন ভিন্ন করা সেই ডাক এই জনমানবহীন মজা খালের বুকে যেন সাবধান বানীর মতন শোনাল।
ঠিক এমনি সময়েই বিলের একেবারে মাঝামাঝি এসে ডিঙিটা স্থির হয়ে গেল। ডিঙ্গির লোকটা এইবার দাড় রেখে অতি সাবধানে হৃষিতার সামনে এগিয়ে এল। তার সামনে আসাতে ডিঙিটা এমনিভাবে দুলে উঠল যেন এক্ষুনি হৃষিতাকে নিয়েই উল্টে পড়বে জলের মধ্যে।
-" চিন্তা নেই। চিন্তা নেই। ডিঙি উল্টাবে না। রাকিব মিঞার ডিঙি এত সহজে উল্টাবে না।" ডিঙির একেবারে মাঝামাঝি এসে লোকটা হৃষিতার মুখোমুখি বসল। লোকটার গায়ে কেমন একটা বুনো গন্ধ।
-" আসল জায়গায় আমরা চলে এসেছি। এইবার আপনাকে নামতে হবে।"- লোকটা শীতল কণ্ঠে এমনভাবেই কথাটা বলল যে হৃষিতার বুকটা এক মুহূর্তের জন্য ছ্যাৎ করে উঠল।
চারিদিকটা আবারও ভালো করে চেয়ে দেখল সে। যত দূর চোখ যায় এখন চারিদিকে কুয়াশা আর কুয়াশা। আর সেই কুয়াশার আস্তরণের নিচে টলটলে কালো জল। এরমধ্যে এই রাতের বেলায় নামতে হবে হৃষিতাকে?
-" এখানে নামব?"
-" হ্যাঁ নামবেন। না নামলে আপনার বন্ধুর দেখা পাবেন কী করে!" - লোকটা যেন কিঞ্চিৎ ক্ষেপে ওঠে, " শুনুন যেমনটা বলছি তেমনটা করবেন। এইটা দুই হাত দিয়ে ধরুন।"
এইবার হৃষিতাকে অবাক করে দিয়েই ডিঙির এক প্রান্তে থাকা একটা ছোট্ট ঝুড়ি সামনে নিয়ে এল লোকটা। ঝুড়িখানা খুলতেই একখানা ছোট্ট পাখির ছানা বাইরে মুখ বের করল। হৃষিতা যদি খুব ভুল না করে তবে এটা ডাহুক পাখির বাচ্চা। এসব জল জায়গায় থাকে এগুলো।
লোকটা এইবার পাখিটাকে বের করে হৃষিতার সামনেই একটা অদ্ভুত কাণ্ড করল। নিজের বুক পকেট থেকে একটা লাল সুতো মতন বের করে কী একটা মন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে সেই পাখিটার গলায় সুতোটা বেধে দিল সে। পাখির বাচ্চাটা এতক্ষণ যেন একপ্রকার ঝিমিয়ে ছিল। এইবার যেন সে চনমনে হয়ে জেগে উঠল। ঠিক যেন কিছু একটা ভিতরে ঢুকেছে তার।
-" সাবধানে ধরুন! হাত থেকে যেন না পালায় এখন।"- লোকটা এইবার পাখির ছানাটা এগিয়ে দেয় হৃষিতার দিকে। হৃষিতাও কোনরকম প্রশ্ন না করে পাখিটাকে হাতে নেয়।
-" কী হবে এটা দিয়ে?"- এইবার হৃষিতা প্রশ্ন করে।
-" এই পাখিই আপনাকে পথ দেখাবে। ওই আপনাকে আপনার বন্ধুর কাছে নিয়ে যাবে বুঝলেন। " লোকটার মুখে একটা রহস্যময় হাসি।
-" মানে?"
-" বলছি শুনুন। আপনি এখন এই ডিঙি থেকে নিচে জলে নামবেন। তারপর আপনার বন্ধুর ওই আংটিটা জলে ফেলে তিনবার তার নাম ধরে ডাকবেন। তারপর ওই পাখিটাকে জলের মধ্যে ছেড়ে দেবেন। তারপর ওই পাখি যেদিকে যাবে, আপনিও তার পিছু পিছু যাবেন। ওই পাখিই আপনাকে আপনার মৃত বন্ধুর কাছে নিয়ে যাবে।"
কথাগুলো দিনের আলোয় শুনলে হয়তো এতটা ভয় লাগত না হৃষিতার। কিন্তু এই মাঝরাতে এই গা ছমছমে ভয়ংকর পরিবেশে কথাগুলো শুনে একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছে ওর বুকে। কোনোমতে ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল হৃষিতা।
-" তবে একটা কথা মনে রাখবেন। আপনি যার সঙ্গে দেখা করবেন সে কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ জগতে আসছে। ওই নির্দিষ্ট সময়ের বেশি তাকে এখানে আটকে রাখা যাবে না।" লোকটার কণ্ঠস্বর ক্রমশ যেন গম্ভীর হচ্ছে।
-" আপনি আপনার বন্ধুর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর কথা বলবেন কিন্তু নিজের কানটাকেও খোলা রাখবেন। এই ডাহুকের বাচ্চা আপনার প্রহরী। ও আপনাকে প্রহরা দেবে। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন ওই পাখি তিনবার মরণ চিৎকার করে উঠবে। ঠিক ওই সময়ে...ওই সময়ে যেই দিকে পাখি ডেকেছিল সেইদিকে আপনাকে ছুটে আসতে হবে। কোনরকম দেরি করা চলবে না। বুঝেছেন?"
হৃষিতা আবারও নিঃশব্দে ঘাড় নাড়াল। ওর হাতে ধরা পাখিটা পাগলের মতন ছটফট করছে। ঠোঁট দিয়ে ঠোক্কর দিচ্ছে হাতে। যেন নিজেকে ছাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে।
-" মনে থাকে যেন। ওই ডাক শুনে ঠিক সময়ে না ফিরতে পারলে কিন্তু মহা অনর্থ হবে। আমি কিন্তু ফিরে যাব এই বিল থেকে। তারপর যা হবে তার কোনো দায় আমার নয়। আপনি বুঝবেন।"
কথাগুলো বলতে বলতেই লোকটা কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে। তারপর বলে, " এক মাত্র এই সময়ে চামড়ির বিলে এলেই ওদের সঙ্গে দেখা করা যায়। যারা এই দুনিয়ার মায়া কাটিয়ে অন্য দুনিয়ায় চলে গেছে..." - লণ্ঠনের মৃদু আলোয় ডিঙিতে বসা লোকটার মুখ আরও যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে।
- " আপনি ঠিক বলছেন তো? সত্যিই আমি চাইলেই যোগাযোগ করতে পারব? সত্যিই মৃত মানুষ ফিরে আসবে!"- হৃষিতার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠা।
-" আসবে! আসবে! এসময় যে বিল জেগে ওঠে...আপনি যার দেখা করতে চাইছেন সে ঠিক ফিরে আসবেই। শুধু যেটা বললাম মনে থাকে যেন...তিনবার...তিনবার ওই ডাহুকের ডাক শোনার পরেই আপনাকে ফিরে আসতে হবে...নইলে..."
-" নইলে?"
জলের মধ্যে পা রাখতেই সারা শরীরটা শিউরে উঠল হৃষিতার। উফ কি প্রচন্ড ঠাণ্ডা! যেন বরফের চাই ভাসছে জলের মধ্যে।
বিলের প্রায় মাঝামাঝি হলেও জায়গাটায় বেশি জল নেই। মোটে হাঁটুর একটু উপর অবধি জল উঠেছে হৃষিতার। কোনোমতে ধীর পায়ে জলের মধ্যে দিয়ে সামনে এগোচ্ছে ও। দুইহাতে ধরা পাখিটা প্রচন্ড ছটফট করছে। টর্চটা ও ধরে রেখেছে কোনোমতে বগলদাবা করে।
হৃষিতাকে বিলের মধ্যে নামিয়ে ডিঙিখানা কোথায় যে অদৃশ্য হয়ে গেল কে জানে। এখন চারিদিকে যত দূর চোখ পড়ছে কেবল কুয়াশা আর কুয়াশা। এখানে ওখানে জলজ আগাছার ঝোপ। মনে মনে একবার জোরে শ্বাস নেয় হৃষিতা।
তারপর পাখিটাকে কোনোমতে ধরে প্যান্টের পকেট থেকে বের করে আনে আংটিটা। কে জানে আদৌ কোনো কাজ হবে কিনা! সত্যিই কি পিউ ফিরে আসবে? সত্যিই কি আবার এতদিন পর দেখা হবে ওদের?
দেখাই যাক না কী হয়! আংটিটা জলের মধ্যে ছুঁড়ে গেলেই তিনবার সজোরে চিৎকার করে ওঠে হৃষিতা।
-" পিউ....পিউ....পিউ....!"- হৃষিতার চিৎকার নিঃশব্দ রাতের বুক চিড়ে দুর দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে। তারপর বিকট রূপে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার ফিরে আসে হৃষিতার কাছেই,
" পিউ... পিউ... পিউ..."
এইবার হাতে ধরা পাখিটা প্রচন্ড ছটফট করতে শুরু করে। হৃষিতা নিচু হয়ে ওটাকে ছাড়তেই প্রচন্ড চিৎকার করে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা। পরক্ষণেই তীরের বেগে জলের মধ্যে দৌড় দেয়।
হৃষিতাও তার পিছন পিছন দৌড়াতে থাকে জলের মধ্যে। একবার ডাইনে একবার বায়ে, কুয়াশার মধ্যে পাখিটার পিছনে দৌড়াতে দৌড়াতে কতদূর যে চলে এসেছে হৃষিতা তার খেয়াল নেই। আচমকাই একটা জায়গায় এসে পাখিটা সামনের দিকে তাকিয়ে বিকট স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। তারপরেই সেটা স্থির হয়ে যায়।
প্রথমটা কিছু বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই ব্যাপারটা খেয়াল করে হৃষিতা। টর্চের আলোয় ও স্পষ্ট দেখে জলের ভিতর কিছু একটা নড়চড় করছে না? হ্যাঁ ঐতো স্পষ্ট মনে হচ্ছে জলের ভিতর কিছু একটা যেন আছে। ওই তো ওর থেকে কয় হাত দূরেই কিছু একটা যেন ক্রমশ জলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে...
এইবার প্রচন্ড আতঙ্কে হৃষিতার সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে ওঠে। টর্চের আলোয় ও দেখে জলের ভিতর থেকে ক্রমশ মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে আর কেউ নয়, ছয় মাস আগে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করা ওর বান্ধবী, পিউ স্বয়ং!
পিউয়ের সারা মুখ ভয়ংকর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, গলায় মোটা দড়ির দাগ, ঠোঁটগুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে...অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে হৃষিতার দিকে...
হৃষিতা কিছু বলতে যাবে তার আগেই পিউ এক অদ্ভুত হিম শীতল কণ্ঠে বলে উঠল, " এতদিনে তোর আসার সময় হল হৃষু! তোর জন্যই তো সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি..."
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
20-08-2023, 11:21 AM
(This post was last modified: 20-08-2023, 11:24 AM by Sanjay Sen. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
পিউর কণ্ঠস্বর শুনেই সারা শরীরে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে গেল হৃষিতার। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় কুয়াশা মাখা নিঃশব্দ অন্ধকার। বিলের হিমশীতল জল কামড় বসাচ্ছে ওর পায়ে।
আর ওর সামনে কয়েক হাত দূরত্বে দাড়িয়ে আছে আজ ছয় মাস আগে আত্ম হত্যা করা ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু! হৃষিতার হাতে ধরা টর্চের আলোটা ওর হৃদপিণ্ডের মতন মুহুর্মুহু স্পন্দিত হচ্ছে। সেই কেঁপে কেঁপে ওঠা আলো কুয়াশার স্তর ভেদ করে গিয়ে পড়ছে পিউর শরীরে!
হ্যাঁ কোনো ভুল নেই, এই তো পিউ। ওর সারা শরীর বেয়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। ভেজা চুলগুলো ঢেকে রেখেছে মুখের বা দিকটা। আর চোখদুটো...চোখ তো কখনও মিথ্যে বলে না! এ তো সেই চোখ যা দেখতে দেখতে বড় হয়েছে হৃষিতা, শুধু আজ চোখদুটোয় এক অদ্ভুত গা শিরশিরে দৃষ্টি।
-" হৃষু! আমায় দেখে ভয় পাচ্ছিস?" - জলের উপর ছপাত ছপাত শব্দ করে পিউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে হৃষিতার দিকে।
-" না, ভয় না...কিন্তু তুই সত্যি ফিরে এসেছিস! আ...আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।"- বিলের উপর দিয়ে অতি ধীর লয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। সেই শিরশিরে হাওয়া যেন হৃষিতার ঘাড়ের কাছটায় আঙুল বুলিয়ে দিয়ে গেল। সারা শরীরটা এক লহমায় কেঁপে উঠল ওর।
-" হ্যাঁ, খুব কষ্ট হয়েছে বিশ্বাস কর ফিরে আসতে...তবু তুই ডাকলি বলেই আসতে হল। তোর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারি বল। তুই আমার সেই কবেকার বন্ধু।"- পিউ এগোতে এগোতে হৃষিতার খুব কাছে এসে দাঁড়াল।
ওর শরীর থেকে একটা অদ্ভুত ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে। গলার কণ্ঠস্বরটাও মাঝে মধ্যে কেমন যেন ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে যাচ্ছে, যেন কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। হৃষিতাই এইবার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, " পিউ বল দেখি তোর আমার যেদিন প্রথম দেখা সেদিন কী হয়েছিল?"
-" ঝগড়া হয়েছিল। ক্লাস ওয়ান। সেন্ট নিনিয়ানস। তোর হাত লেগে আমার টিফিন পড়ে গেছিল মাটিতে। খুব ঝগড়া হয়েছিল সেইদিন। আমাদের বন্ধুত্ব ঝগড়া দিয়েই শুরু!"- পিউর কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে যেন ধাতস্থ হচ্ছে।
-" ক্লাস টেনে যে অঙ্কে বেশি পেয়েছিল? তুই না আমি?"
-" কেউ না। দুজনেই এক। উন আশি। এক নম্বরের জন্য লেটার হয়নি বলে দুজনেই মুখ গোমড়া করে বসেছিলাম সারাদিন।"
হৃষিতা টর্চের আলোয় আবারও ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে পিউকে। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় শেষ প্রশ্ন করে, " তিন তিন শূন্য মানে কী বল?"
পিউ যেন বহু কষ্টে মলিন হাসি হাসে। তারপর বলে, " ওটা অরিন্দমের কোড নেম। ওর ফোনের লাস্ট তিনটে ডিজিট। অরিন্দম তোর প্রথম প্রেমিক যে তোকে ঠকিয়েছিল বলে ক সারারাত আমার বাড়ি বসে কেঁদেছিলি।"
-" পিউ তুই সত্যি ফিরে এসেছিস!"- এইবার নিজের চোখের জল আর ধরে রাখতে পারল না হৃষিতা। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল, " পিউ তুই এমন কেন করলি! সেই ক্লাস ওয়ান থেকে আমরা দুজন বন্ধু। একসঙ্গে ওঠা বসা খাওয়া সমস্ত কিছু। তুই একবারও আমাকে বললি না!"
পিউ নিশ্চুপ। কোনো কথা নেই। চামড়ির বিলে মৃদু মন্দ গতিতে বয়ে যাচ্ছে শীতল হাওয়া। হৃষিতা আবারও ডুকরে উঠল, " পিউ একবার...একবার আমাকে তোর সমস্ত সমস্যার কথা বলতে পারতিস। আমি আমার সবটা দিয়ে চেষ্টা করতাম তোকে বের করে আনতে!"
-" সম্ভব ছিল না রে...আমি একটা চোরাবালিতে আটকে গেছিলাম। সেখান থেকে বেরোনো এতটা সহজ ছিল না। বাদ দে না সেসব কথা...যা হয়ে গেছে তা তো আর বদলানো যাবে না..."- পিউর কথায় এক রকম হতাশার সুর।
আচমকাই পিউর সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল যেন। পরক্ষণেই ও বলল, " খুব খিদে পাচ্ছে রে হৃষু, আমার জন্য কিছু খাবার এনেছিস? ওই দুনিয়া থেকে এই দুনিয়ায় আসতে বড় কষ্ট..."
-" খাবার! না খাবার তো কিছু..."- হৃষিতার বুকটা কেমন কেঁপে উঠল পিউর জন্য। ওর কী সত্যিই প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে?
-" মনে আছে হৃষু, কাকীর হাতের পায়েস খেতে কী ভালোবাসতাম আমি। তোর জন্মদিনের আগের দিন থেকে তোদের বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ থাকত। কাকিমা কত ভালো ভালো রান্না করত..."
-" মা খুব ভেঙে পড়েছিল পিউ।"- হৃষিতার গলাটা কেঁপে ওঠে। " তোর চলে যাওয়াটা মা একদম মেনে নিতে পারেনি। সেই ছোট থেকে আমাদের বাড়িতে তোর আসা যাওয়া। মা তোকে আমার বোনের মতই দেখত। সেই তোর খবরটা যখন এল...মা দুদিন কিছু খায়নি জানিস। শুধু বলত মেয়েটা অমন করে চলে গেল...একবারও কাউকে বলল না!"
হৃষিতার দুই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের ধারা। ইতিমধ্যেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিউর শরীরটা আরেকবার যেন ঝাকুনি দিয়ে উঠল, " খুব খিদে পাচ্ছে... খুব তেষ্টা পাচ্ছে...এখানে আসলে এতটা কষ্ট হবে বুঝিনি।"
-" সত্যিই তোর খুব কষ্ট হচ্ছে?" -" হৃষিতা খেয়াল করল সত্যিই পিউর শরীরে একটা চাপা অস্বস্তি যেন জমাট বেঁধে উঠছে।
-" হ্যাঁ হচ্ছে কিন্তু ঠিকাছে। তোর জন্য এটুকু করতেই পারি। এমনিও আজকের রাতটাই তো শেষ রাত।"
-" কিসের শেষ রাত?"- হৃষিতা যেন অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
-" তোর আর আমার দেখা হওয়ার বুদ্ধু! আর কখনও কী তোর আমার এভাবে দেখা হবে?"- পিউর কিছু একটা যে সমস্যা হচ্ছে সেটা হৃষিতা বেশ বুঝতে পারছে। কথাগুলো বলতে বলতে কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠছে ও। মাঝে মাঝে গলার স্বর ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে যাচ্ছে।
-" আমাদের ছোটবেলার দিনগুলোর কথা মনে পড়ে হৃষু? এক সঙ্গে সেই কলেজে যাওয়া, গল্প করা, আড্ডা দেওয়া। একসাথে দেখতে দেখতে বড় হয়ে ওঠা। ক্লাস নাইনে প্রথম প্রেমে পড়া। তোর প্রেমিকের চিঠিগুলো আমি এনে দিতাম তোকে..."
পিউর কথাগুলো শুনতে শুনতে অতীতের রঙিন দিনগুলোর ছবি উড়ে উড়ে আসছিল হৃষিতার চোখের সামনে। সেই ছোটবেলা, সেই বন্ধুত্ব, একে অপরকে একদিনও না দেখতে পেলে হাফিয়ে ওঠা। পিউর সঙ্গে একসঙ্গে কাটানো ওর কিশোরী জীবনের হাজারও স্মৃতি...
এসব কথাই ভাবতে ভাবতে আর পিউর কথা শুনতে শুনে কোথায় যেন হারিয়ে গেছিল হৃষিতা। আচমকা ওর সম্বিৎ ফিরল একটা পাখির তীব্র চিৎকারে। এটা সেই ডাহুক পাখির ডাক না? একবার...দুবার...তিনবার!
হৃষিতার সারা শরীরে যেন শীতল শিহরণ খেলে গেল। এই পাখি তিনবার ডাক দিলেই তো ওর ফিরে যাওয়ার কথা। তেমনটাই তো বলেছিল ডিঙির লোকটা। তাহলে...
-" পিউ আমায় এবার যেতে হবে রে...তুই ভালো থাকিস..."- হৃষিতা আরও কিছু বলবার আগেই পিউ এইবার এগিয়ে এসে ওর হাতটা চেপে ধরল, " এত তাড়াতাড়ি চলে যাবি হৃষু? আমি এত কষ্ট করে তোর জন্য এলাম। আর কিছুক্ষণ দাড়িয়ে যা প্লিজ..."
পিউর কণ্ঠে এমন এক করুণ আর্তি ফুটে ওঠে যে তাকে না করতে পারে না হৃষিতা। আমতা আমতা করেই ও বলে, " কিন্তু ডিঙি ফিরে গেলে আমি যে আর পৌঁছতে পারব না!"
-" কেন পারবি না?"- পিউর গলায় একটা ছদ্ম রাগ ফুটে ওঠে, যেমন রাগ খুব কাছের বন্ধুকে না ছাড়তে চাইলে মানুষ দেখায়, তেমনটাই, " আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তো ভোরের আলো ফুটে যাবে। এখানে অনেক ডিঙি আসে শাপলা ফুল তুলতে। যে কোনো একটা ডিঙ্গিতে উঠে পড়বি।"
পিউর গলা এইবার আগের থেকে আরও বেশি ঘ্যাসঘ্যাসে শোনায়, " আর কিছুক্ষণ থাক না হৃষু, এই তো শেষবার। আর তো কখনও কিছু চাইতে পারব না তোর কাছে। ভোর হলেই আমায় ফিরে যেতে হবে।"
হৃষিতা কী করবে কিছুই ভেবে পায় না। একদিকে পিউর করুণ আর্তি অন্য দিকে ডিঙির সেই লোকটার বলা কথাগুলো। কী করা উচিৎ ওর? সময় যে চলে যাচ্ছে...
-" আমায় ছেড়ে যাস না হৃষু, আর কিছুক্ষণ থাক প্লিজ, খুব কথা বলতে ইচ্ছে করছে তোর সাথে..."- পিউ আগের থেকে অনেকটা সামনে এগিয়ে এসেছে। ওর হাতদুটো বরফের মতন ঠাণ্ডা।
পিউর করুণ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে শেষমেশ হার মানে হৃষিতা। নৌকা ফিরেই যাক বরং। আর কিছুক্ষণ ও না হয় এখানেই থাকল। সত্যিই তো আর তো কোনদিন পিউর সঙ্গে দেখা হবে না। আর এ তো মজা বিল। ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনাও নেই অগত্যা....
ঘন কুয়াশার মধ্যেই একটা টিমটিমে লণ্ঠনের আলোকে ক্রমশ ছোট থেকে ছোট হতে দেখল হৃষিতা। তারপর একসময় ওর চোখের সামনেই ধোঁয়াটে কুয়াশার পেটের ভেতর কোথায় যেন সেই আলো অদৃশ্য হয়ে গেল। পড়ে রইল শুধু অন্ধকার আর অন্ধকার।
-" খুব খিদে পাচ্ছে...উফ কি প্রচন্ড তেষ্টা...তোর কাছে কী কিছু নেই হৃষু?"- পিউর শরীরটা এইবার আগের থেকে যেন বেশি ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ঠিক যেন ওর শরীরের ভেতর একরকম প্রলয় কাণ্ড চলছে।
-" না কিছু তো আনিনি...তোর যদি খুব কষ্ট হয় তুই ফিরে যেতে পারিস। তোর শেষবারের মত দেখতে পেয়েছি এই অনেক।"- হৃষিতার এইবার সত্যি কষ্ট হচ্ছে পিউর জন্য।
-" ফিরব! ফিরব বলে তো আসিনি। তোর কাছে এসেছি তোকে নিতে..."- আচমকাই পিউর কণ্ঠ স্বরটা কেমন যেন বদলে গেল। এক মুহূর্তের জন্য মনে হল খুব কর্কশ স্বরে কথাগুলো বলে উঠল কেউ।
-" কী বলছিস পিউ? আ...আ...আমি নিবি বলে এসেছিস মানে?"
পিউ এইবার মাথাটা পাগলের মত দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর আচরণে একটা অস্বাভাবিকতা আসছে আস্তে আস্তে। তাই না?
-" ভয় পাচ্ছিস? নিজের বন্ধুকে ভয় পাচ্ছিস! আমি তো মজা করছিলাম।"- আবারও খিলখিল করে হেসে ওঠে পিউ, পরক্ষণেই আবার বলে, " উফ! গা হাত পা কী চুলকাচ্ছে, কেমন জ্বালা করছে শরীরটা। মনে গায়ের চামড়া ছিঁড়ে উপড়ে ফেলি... এই বিলে এমনিতেও মানুষের চামড়ার তো অভাব নেই।"
কে জানে কেন হৃষিতার বুকের ভেতরটা কেমন অস্বস্তি জমাট বেঁধে উঠছে। ওর কী ফিরে যাওয়া উচিৎ ছিল। ও কী ফিরে যাওয়ার ডাক উপেক্ষা করে ভুল করল? পিউর কথাবার্তাও আস্তে আস্তে কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে ওর।
-" পিউ...এমন অদ্ভুত কথা বলছিস কেন তুই! আমার খুব ভয় লাগছে..."
হৃষিতাকে চমকে দিয়েই পিউ সারা শরীর দুলিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই কেমন যেন উন্মাদ গ্রস্তের মত বলল, " আসলে খুব খিদে পাচ্ছে রে হৃষু, প্রচন্ড খিদে। কতদিন খাই না...রক্ত রক্ত রক্ত...তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেল।"
-" রক্ত! তেষ্টা! এসব কি বলছিস তুই পিউ! কী হয়েছে তোর?"- হৃষিতার বুকের ভিতর এইবার একটা অজানা আশঙ্কা ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।
-" পিউ? এই পিউ? তুই..."
-" হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ...আমি পিউ...আমি আমিই পিউ...এতকিছু বললাম তাও বিশ্বাস হল না আমিই পিউ!"- প্রচন্ড কর্কশ স্বরে চিৎকার করে উঠল পিউ। সেই ঘ্যাসঘ্যাসে কণ্ঠস্বরে কোনো কোমলতার ছাপ নেই। তার বদলে এক অদ্ভুত হিংস্রতা!
পিউর কথা শুনে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল হৃষিতার। ওর মনে একটু আগেও যেই আশঙ্কাটা উঁকি দিচ্ছিল, এইবার ক্রমশ সেটা জোরালো হচ্ছে যেন।
-" না না মনে মনে তুই য়া ভাবছিস সেটা সত্যিই না। আমি পিউ! আমি সত্যিই পিউ!"- জলের উপর ঝপাং ঝপাং করে পা ফেলে উন্মাদ গ্রস্তের মত হৃষিতার দিকে কেমনভাবে এগিয়ে আসছে পিউ।
কেন হৃষিতার ভয় লাগছে? কেন এই মুহূর্তে হৃষিতার বারবার মনে হচ্ছে ওর সামনে যে দাড়িয়ে তাকে হুবহু পিউর মত দেখতে হলেও...
-" হৃষু...ভয় করছে? আমায় তোর ভয় করছে?"- একটা জায়গাতেই দাড়িয়েই এইবার সারা শরীরটা প্রচন্ড জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল পিউর। পরক্ষণেই হৃষিতাকে চমকে দিয়ে নিজের ডান হাতের চামড়ার উপর সজোরে নিজেই নিজের নখ গেঁথে দিল পিউ।
কী অদ্ভুত! পিউর নখ গুলো এত বড় বড় আর ধারালো হল কখন? দেখে মনে হচ্ছে কোনো ভয়ংকর হিংস্র জন্তর নখ। কিন্তু একটু আগেও তো।
-" উফ! চামড়া চামড়া...অন্যের চামড়া গায়ে জড়িয়ে রাখতে বড় কষ্ট...বিশেষ করে খিদের সময়!"
এরপর পিউ যা করল তাতে প্রচন্ড আতঙ্কে সারা শরীরটা থরথর করে কেঁপে উঠল হৃষিতার। ও দেখল ওর চোখের সামনেই পিউ তার নিজের শরীরের চামড়াগুলো টেনে টেনে একটু একটু করে তুলে ফেলছে। আর সেই চামড়ার নিচ থেকে বেরিয়ে আসছে এক ভয়ংকর কুৎসিৎ অবয়ব!
-" পিউ! এ...এসব তুই কী করছিস...তুই সত্যিই পিউ নাকি..."
-" নাকি?"- সেই কর্কশ স্বর আবার ফিরে এসেছে, " নাকি অন্য কেউ?"
চামড়ির বিলের নিঃস্তব্ধতাকে খান খান করে একটা শীতল হাসির রেশ ছড়িয়ে পড়ল কুয়াশার বুকে। তারই সঙ্গে বিলের জল টলটল করে উঠল। জলজ গাছেরা মাথা নাড়িয়ে উঠল। দূরে আবার শেয়াল ডেকে উঠল।
আর এর সঙ্গে সঙ্গেই হৃষিতা বুঝল ও কত বড় ভুল করেছে! উহু, এ পিউ না! ওর সামনে যে দাড়িয়ে আছে...সে পিউ না...সে পিউ হতেই পারে না...একটু আগেও হুবহু পিউর মত যে দাড়িয়েছিল তার শরীর থেকে চামড়া এখন গলে গলে পড়ছে।
ঠিক যেমন সাপ খোলস ছাড়ে তেমনই ওর সামনে দাড়ানো অবয়বটাও আস্তে আস্তে খোলস ছাড়ছে। পিউর খোলস। অবশ্য খোলস তো নয়, বলা ভালো চামড়া। পিউর চামড়া। সেই চামড়ার তলা থেকে বেরিয়ে আসছে এক বিভৎস পৈশাচিক জীব। তার দুই চোখে তীব্র হিংসা, সারা মুখে ভয়ংকর ক্ষুধা। হে ঈশ্বর! এ কিসের সামনে দাড়িয়ে আছে হৃষিতা!
-" খিদে...বড় খিদে পেয়েছে... কতদিন পর আবার এমন খাবার এসেছে...রক্ত... মাংস..."
জন্তুটার কর্কশ কণ্ঠস্বরে সারা শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে হৃষিতার। সামান্য পালানোর শক্তিটুকু হারিয়ে ফেলছে ও। চারিদিক ভরে উঠছে ঝাঁঝালো গন্ধে। এইবার হৃষিতা স্পষ্ট বুঝতে পারছে এইসব আসলে একটা ফাঁদ।
উহু পিউ আসেনি। পিউ কখনও ফিরে আসেনি এখানে। বরং পিউর রূপ ধরে এসেছিল অন্য কেউ। যে কোনোভাবে পিউ আর ওর সমস্ত স্মৃতিকে আহরণ করেছে। হয়তো ওই আংটিটা থেকেই।
এই চামড়ির বিলে কোনো প্রেতাত্মা কখনও ফিরে আসে না! আসলে এই চামড়ির বিল অভিশপ্ত। এই বিল এক ভয়ংকর অপশক্তির আস্তানা...যেই অপশক্তি মৃত মানুষদের রূপ ধরে আসে। মৃত মানুষদের ব্যবহার করা বস্তু থেকে সে সংগ্রহ করে সমস্ত স্মৃতি আর তারপর...তারপর নিপুণ ভাবে তৈরি করে এই মারণখেলা যতক্ষণ না শিকার ফাঁদে পড়ছে...
আর কোনো কিছু না ভেবেই হৃষিতা এইবার পালাতে যায়। কিন্তু কোথায় পালাবে সে! চারিদিকে যে শুধু কুয়াশা আর কুয়াশা। কোথাও কোনো আলো নেই, দুর দূরান্ত যত দূর চোখ যায় শুধু জল আর জল...
ও কী! জলে ওগুলো কি ভাসছে? টর্চের আলোয় জিনিসগুলো দেখে সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে ওঠে হৃষিতার। চামড়া! মানুষের চামড়া...বিশ্রী ঝাঁঝালো গন্ধে চারিদিক ভরে উঠছে ক্রমশ।
ওই তো পিছনে জলের মধ্যে ছপাং ছপাং শব্দে ও এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে। কোনোমতে পালাতে গিয়েই জলের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ল হৃষিতা। ঠাণ্ডা জলে ওর মাথাটা একবার ডুবে গেল পুরো। হাতের টর্চ ছিটকে পড়ল বহু দূরে। জলের বাইরে মাথা তুলে চাইতেই ও দেখল অন্ধকারের মধ্যে সেই ভয়ংকর পৈশাচিক অবয়ব ঠিক ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
এইবার ওটা ওর ঠাণ্ডা হাত দিয়ে হৃষিতার হাতটা চেপে ধরল। হৃষিতা স্পষ্ট টের পেল জলের নিচেই অনেকগুলো ধারালো নখর ওর চামড়া ভেদ করে মাংসের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে ক্রমশ।
এইবার ও স্পষ্ট শুনল সেই পৈশাচিক জীবটা ঘ্যাসঘ্যাসে হিম শীতল কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে উঠল, " খিদে... বড় খিদে লেগেছে রে... মানুষের গায়ে চামড়া গায়ে থাকলে যে খেতে পারি না..."
মধ্যরাতে নিঃস্তব্ধতাকে খানখান করে দিয়ে একটি নারীকন্ঠের ভয়ংকর চিৎকার শোনা গেল। সমগ্র চামড়ির বিল যেন থরথর করে কেঁপে উঠল সেই শব্দে। তারপর সব চুপচাপ।
রজনী ঢলে পড়ল নৈঃশব্দের কোলে। কেবল বহুদূরে কোথাও একটা মধ্যরাতের শেয়াল ডেকে উঠল।
// উপসংহার //
-" আর বলবেন না! ওই ফেইসবুক হওয়ার পর থেকেই এখেনে লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছে। এই তো গত হপ্তায় একটা অল্প বয়েসী মেয়ে এসেছিল। একা একা। ছয় মাস আগে তার কোন বান্ধবী গলায় দড়ি দিয়েছে, তার সঙ্গে দেখা করতে!"
লণ্ঠনের আলোয় ডিঙিতে বসা লোকটাকে বেশ রহস্যময় লাগছিল অতনুর। একটা চাপা উৎকণ্ঠা নিয়েই ও জিজ্ঞেস করল, " দেখা পেয়েছিল?"
-" পাবে না মানে! আলবাত পেয়েছিল। এই সময় এই চামড়ির বিল যে জেগে ওঠে। এখনই তো ওরা ফিরে আসে। চিন্তা নেই আপনার বাবাকেও আপনি দেখতে পাবেন। কেবল যেমন যেমনটা বললাম জলে নেমে তেমন তেমনটা করবেন। আর..."
কথাটা বলতে বলতেই লোকটা থেমে গেল। ওর মুখে জমাট বেধে উঠেছে নিগূঢ় রহস্যময়তা।
-" আর?"- অতনু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। ওর হাতে ধরা ডাহুক পাখির ছানাটা রীতিমত ছটফট করছে এইবার।
-" আর যেইটা বললাম সেটা মনে থাকে যেন। তিনবার। ওই ডাহুক পাখির ডাক ঠিক তিনবার শোনার পরেই আপনাকে ফিরে আসতে হবে কিন্তু। এক মুহুর্তও দেরি করলে চলবে না। নইলে..."
-" নইলে?"
|| সমাপ্ত ||
Posts: 104
Threads: 3
Likes Received: 199 in 70 posts
Likes Given: 152
Joined: Jul 2022
Reputation:
26
পিলে কাঁপানো গল্প নেহাত সকাল বেলা তাই ভয়টা পেয়ে বাথরুম যেতে সমস্যা হবে না। রাতের জিনিসের বিষয় সকালে দেয়ার জন্য ভেবেছিলাম আপনাকে কথা শোনাবো কিন্তু গল্প পড়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটা রাতে পড়লে মুশকিল হত ঘুমানো।
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(20-08-2023, 11:31 AM)Akash23 Wrote: পিলে কাঁপানো গল্প নেহাত সকাল বেলা তাই ভয়টা পেয়ে বাথরুম যেতে সমস্যা হবে না। রাতের জিনিসের বিষয় সকালে দেয়ার জন্য ভেবেছিলাম আপনাকে কথা শোনাবো কিন্তু গল্প পড়ে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটা রাতে পড়লে মুশকিল হত ঘুমানো।
তাহলে, আপনাকে একটা কথা বলছি চুপিচুপি। কাউকে বলবেন না। গল্পগুলো পোস্ট করার আগে আমিও তো পড়ি! রাতের বেলায় পড়তে আমিও ভীষণ ভয় পাই। তাই সকাল বেলা পড়ে, সকালবেলাতেই পোস্ট করি গল্পগুলো।
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,202 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,738
ককটেল টা ছোটোর মধ্যে বেশ ক্রিপি!
আর চামড়ির বিল শুরুতেই আকর্ষণ না কাড়লেও যত শেষের দিকে এগিয়েছে, ততই সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। ব্যাপক গল্প!
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
দারুন লাগলো দ্বিতীয় গল্পটা 
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(20-08-2023, 12:24 PM)Baban Wrote: ককটেল টা ছোটোর মধ্যে বেশ ক্রিপি!
আর চামড়ির বিল শুরুতেই আকর্ষণ না কাড়লেও যত শেষের দিকে এগিয়েছে, ততই সাংঘাতিক হয়ে উঠেছে। ব্যাপক গল্প!
আমারও তাই মনে হয়েছে
(20-08-2023, 01:50 PM)Bumba_1 Wrote: দারুন লাগলো দ্বিতীয় গল্পটা  থ্যাঙ্ক ইউ 
•
|