Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
09-08-2023, 11:09 PM
(This post was last modified: 10-08-2023, 09:55 AM by Sanjay Sen. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
গল্প - ভয়
লেখক- বাবান
ফোনটা কাট করতেই আমি বললাম - কি ব্যাপার বলোতো সুভাষ দা? কদিন ধরে দেখছি তুমি একটু কেমন যেন সিরিয়াস মার্কা হয়ে গেছো, তারপরে ঘন ঘন বৌদিকে ফোন করছো? কি ব্যাপারটা কি?
সুভাষ দা কথাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে শুনলেও উত্তর দেবার সময় চোখ সরিয়ে নিয়ে চশমাটা মুছতে মুছতে হেসে বা বলা উচিত হাসার নকল অভিনয় করে বললেন - নানা... কিছু না... ওই আরকি
- উহু.... কিছু তো একটা ব্যাপার আছেই... নইলে তোমার মতো একটা মানুষ হটাৎ এতো চুপচাপ..... তারওপর বৌদিকে বার বার ফোন.... বার বার সব ঠিকাছে তো জিজ্ঞেস করছো... ব্যাপারটা কি? দেখো যদি ব্যাক্তিগত বা ফ্যামিলির কোনো ব্যাপার হয় আমি জানতে চাইবোনা কিন্তু কিছু যে হয়েছে সেটা বেশ বুঝতে পারছি........ দেখো তুমি চাইলে আমায় বলতে পারো.. যদি আমি.....
একটানা কথাগুলি বলে থামলাম আমি। দেখি সুভাষ দা আমার দিকে তাকিয়ে। মুখে একটা হালকা হাসি.... ওটা কি আশ্বাস নাকি বিদ্রুপ? ঠিক বুঝলাম না। তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন - থাঙ্কস রে.... কিন্তু তোর মনে হয় কিছু করার নেই।
- আহা বলোই না.... যদি আপত্তি না থাকে
- না.. আপত্তি... অমন কিছু ব্যাপার নয়
- তাহলে বলো তো.. বলো
সুভাষ দা আমার দিকে তাকিয়ে বললো - শুনবি? তাহলে চল বাইরে যাই... এখানে একটানা বসে বেঁকে গেলাম মাইরি।
ব্রেক টাইম তখন। আমরা দুজন নিজের খাবার হাতে বাইরে এসে ছাদে গেলাম। সুভাষদা আর আমি খেতে খেতেই কথা বলছিলাম। তবে যতই শুনছিলাম আমার খাওয়ার দিকে নজর কমে যাচ্ছিলো আর সুভাষদার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছিলাম।
- তুই তো জানিস.... আমাদের বাড়িটা ফ্লাট হচ্ছে। বহু ঝামেলা পেরিয়ে জেঠুরা রাজি হয়েছে। সে যাই হোক..... কাজ শুরুর আগে আমাদের তো শিফটিং এর প্রয়োজন ছিল। জেঠুদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দিদি মানে জেঠুর মেয়ে স্নেহাদির এক বান্ধবী খুব কাছেই থাকেন। ওদের নিজেদের তলাটার জন্য ওরাও ভাড়াটে খুঁজছে... তাই খুব সহজেই দুইয়ে দুইয়ে চার হয়ে গেলো, ঝামেলায় পড়লাম আমরা। আমরা কোথায় যাবো?
প্রোমোটার নিজেই আমাদের এই ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। ওনার কেনা একটা বাড়ি যেটার কাজ শুরু হবে আমাদেরটার পরেই সেটায় যদি আমরা চাই থাকতে পারি। আমি আর বাবা গিয়ে সে বাড়ি একদিন দেখেও এসেছিলাম। খুব একটা যে ভক্তি এসেছিলো বলবনা। দোতলা বাড়ি কিন্তু একেবারে শেষ অবস্থা তার... ওতে থাকা কতোটা রিস্কি হতে পারে সেটাই ভাবছিলাম। ওপর থেকে ভেঙে টেঙে না পড়ে কারোর মাথায় সেই ভয় আর ওই বাড়িতে থাকার ইচ্ছা আর হলোনা। কিন্তু একটা বাড়ি তো প্রয়োজন। এ ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন বাবার এক পরিচিত মানুষ কাল্টু বাবু। উনি আবার এই সব কাজই করে কমিশান পেয়ে থাকেন।
ওনাদের বাড়ির খুব কাছেই একটা দোতলা বাড়ির খোঁজ উনি এনে দিলেন আমাদের। আবার আমি আর বাবা গেলাম একদিন। এই বাড়িটা আমাদের বেশ পছন্দ হলো। তবে বাড়িটা সামনে থেকে বিশাল কিছু না লাগলেও বেশ ভালোই বড়ো। পেছনে একটা বাগানও আছে... যদিও সেটাকে আজ আর বাগান বলা উচিত নয়... ঝোপ ঝাড় আর একটা পুরানো কুয়ো যেটাও আর ব্যবহার হয়না। ওপরে টিন দিয়ে ঢেকে রাখা যাতে বিড়াল কুকুর আবার ভেতরে পড়ে না যায়। বাড়ির মালিক অনিমেষ কাকু নিজেই আমাদের সাথে সব ঘুরিয়ে দেখালেন। মানুষটা বেশ ভদ্র আর শান্ত স্বভাবের. ভালো লাগলো ওনার সাথে কথা বলে। একতলার একটা ভাগ উনি ভাড়া দেবেন। সেটাও আমরা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বেশ পুরানো বাড়ি এটাও কিন্তু ওই বাড়ির মতো ভগ্নদশা নয় মটেও এর। বেশ ভালো বড়ো দুটো শোবার ঘর। একটাই বাথরুম আর রান্নাঘর ছোট্ট হলেও আমাদের বেশ পছন্দ হলো। বাবা আমি আর অনিমেষ কাকু আলোচনার পর ঠিক করলাম এটাই হবে আমাদের কিছু সময়ের বাসস্থান।
এরপর একদিন তোর বৌদিকেও এসে দেখিয়ে গেলাম বাড়িটা। তারও বেশ পছন্দ হলো। এরপর একজন ইলেকট্রিশান কে ডেকে কয়েকটা কাজ করাতে হলো.... আর ঘরটা বাড়ির মালিক নিজেই নিজের বাড়ির কাজের লোক দিয়ে একেবারে পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছিলেন। আগেরবার এসে যে ধুলো মাখা দেখেছিলাম পরে স্ত্রীয়ের সঙ্গে এসে দেখি একেবারে পরিষ্কার। ব্যাস... তোমার বৌদির থেকেও গ্রিন সিগন্যাল পেয়ে সব গুছানোর কাজ শুরু হলো।
এক বাড়ি থেকে আরেকবাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যে কি তার আর বিবরণ দিয়ে লাভ নেই। উফফফফ পাগল পাগল অবস্থা ছিল। বড়ো বড়ো আসবাবপত্র তো লোকেরাই নিয়ে এসেছিলো... ভাগ্গিস... একতলা বাড়ি...... কিন্তু ভাবছি এবারে যখন আবার এখান থেকে নিজেদের ফ্ল্যাটে ৫ তলায় যাবো তখন কি অবস্থা হবে!! যাকগে..... আবার ঘটনায় ফিরি। সব ঝামেলা মিটিয়ে চলে এলাম এই বর্তমানের বাসস্থানে। নিজের এতদিনের বাড়ি ছেড়ে আসার সময় বুকটা যে একটুও কেমন কেমন করেনি বলবোনা কিন্তু আমার থেকেও বেশি করেছিল আমার ছেলেটার। একটু গোমড়া মুখ ছিল এক দুদিন ওর কিন্তু তারপরে সেও মানিয়েনিয়েছিল। আমরাও হয়তো মানিয়ে নিতাম কিন্তু.........
বাবা আর মায়ের বারান্দার দিকের বড়ো ঘরটায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘর ভর্তি নানান রকমের পুটলি, ব্যাগ, বাক্স ভর্তি জিনিসপত্র এক এক করে খোলা হচ্ছে... খাট বিছানা সেট করা, আসলে শান্ত কে অশান্ত করে আবার শান্ত করা তো সোজা ব্যাপার নয়.. তাই তার ঝক্কি তো পাওয়াতেই হবে। আমরাও এই নতুন বাড়িতে এক এক করে সব গোছগাছ করতে করতেই দিনটা পার হয়ে গেছিলো। ক্লান্তিতে যে যার মতন বিছানায় পড়তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
পরের দিন আমি নিজের কাজে বেরিয়ে গেলাম। দুই ছেলের মায়েরা নিজের মতো একরাতেই রান্নাঘর গুছিয়ে নিয়েছিল। আমার ছেলেটাকে নিয়ে ওর দাদুই কলেজ নিয়ে যাওয়া আসা করেন। তারাও আমার মতোই বেরিয়ে গেলেন। নিজের এলাকা পাল্টালে একটা অসুবিধা তো হয়ই কিন্তু যেহেতু আমাদের বাড়ি থেকে এই এলাকা ভয়ানক কিছু দূরে নয় তাই খুব একটা অসুবিধায় পড়তে হয়নি....... অসুবিধা তো অন্য জায়গায় ছিল।
কি অসুবিধার কথা বলছো তুমি? পাড়ার লাফাঙ্গা মানে বাজে ছেলেদের আড্ডা ফাড্ডা আছে নাকি ওদিকে? আমি সিগারেটটা ধরিয়ে সুভাষদা কে একটা অফার করে জিজ্ঞেস করলাম। দাদা সিগারেটটা ধরিয়ে একটা টান দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললেন - নারে ভাই....... ওসব কিছু নয়... এ ঝামেলা অন্যরকম। অন্য লেভেলে।
মানে?
সুভাষদা আরেকটা ধোয়া ছেড়ে আমায় বললেন - ভুত ফুত মানিস?
সুভাষদা আরেকটা ধোয়া ছেড়ে আমায় বললেন - ভুত ফুত মানিস?
আমি একটা টান দিতে যাচ্ছিলাম। সুভাষদার প্রশ্ন শুনে তাকালাম ওর দিকে।
- কি? ভুত?
- হুমমম.... মানিস?
- হ্যা..... মানে.... ওই আরকি ভয় লাগে গপ্পো শুনলে ওই অব্দি আরকি
- আর গপ্পো যদি সত্যি হয় তখন?
- ধুর.... ওসব ভয় দেখানোর ফন্দি ফিকির... তাছাড়া গল্প তো গল্পই.... এক মিনিট........ তুমি কি বলতে চাইছো যে তোমার এই ঝামেলাটা....... ভৌতিক কিছু?
- তাইতো মনে হচ্ছে।
খুব চিন্তিত মুখে ভুরু কুঁচকে একটা টান ছেড়ে বললেন সুভাষ দা। আমি হা করে তাকিয়ে দাদার দিকে। উনি আবার বলতে শুরু করলেন -
- দু তিনদিন কিন্তু নরমাল ভালোই কেটেছে... বলতে নেই..... আস্তে আস্তে সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম নিজেদের মতন করে... কিন্তু মঙ্গলবার থেকে যে কি শুরু হলো.....
- কি? কি শুরু হলো মঙ্গলবার থেকে? আমি ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
সুভাষ দা একবার পকেট থেকে ফোনটা বার করে বোধহয় কল এসেছে কিনা চেক করে নিয়ে আবার ওটা পকেটে চালান করে বলতে শুরু করলেন -
- তোকে তো বললাম বাড়িটা বেশ ভালোই বড়ো.... একতলার একটা ভাগ আমাদের থাকতে দেওয়া হয়েছে আর ওপাশেও একটা ভাগ আছে। আমাদের শোবার ঘরের পাশেই সেই বাড়ির একটা ঘর আছে। যেটা পুরো বন্ধ থাকে। এটা মঙ্গলবারের আগেরদিনের ঘটনা.. মানে সোমবার। আমি ঘুমিয়ে আছি হটাৎ একটা ঠেলায় ঘুমটা ভেঙে গেলো। আধো চোখে তাকিয়ে দেখি ছন্দা আমায় ডাকছে।
এই শুনছো? ওঠো... ওঠোনা.... এই
- হুমমম কি হলো ডাকছো কেন.. কি হলোটা কি?
- একটা আওয়াজ পাচ্ছ?
- আওয়াজ? মানে? এতো রাতে কিসের আওয়াজ? কিসব বলছো কি?
- উফফফ এতো কথা না বলে চুপ করে শোনো...
আমি চোখটা ডলে একবার দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকালাম দেখি আড়াইটে বাজে। চারিদিক নিস্তব্ধ খালি ঝিঁঝিঁর আওয়াজ আসছে। না....... ভুল বললাম.... আরও কিছু একটা আওয়াজ কানে আসছে না? ভালো করে কান পাতলাম। কোথাও থেকে কি একটা আওয়াজ আসছে? তাইতো মনে হচ্ছে। কিছু টানার শব্দ... ভারী কিছু কেউ যেন টেনে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
- শুনলে?
- হুমমম.... কিছু টানার শব্দ...... চেয়ার টেবিল টানাটানি করছে.... এতো রাতে এসব কি উটকো ঝামেলা ভাই? ঘর সাজানোর আর টাইম পেলোনা নাকি?
- ধ্যাৎতারিকা..... ভালো করে শোনো.... ওটা ছাড়াও একটা আওয়াজ.....
আরেকবার চোখ ডলে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। একটু অপেক্ষা করতেই.... হ্যা.....আমি আরেকটা আওয়াজ পেলাম। একটা হালকা হাসি। যতটা কানে এলো মনে হলো নারীর সেটি। তারপরে আবার ক্যাচ করে কিছু টানার শব্দ। কিন্তু এমন সময় কে কি টানাটানি করছে রে ভাই? আবার কে হাসাহাসি করছে।
আমি তোর বৌদিকে বললাম - ও ওপরে ওদের কেউ হবে... হয়তো রাত অব্দি জেগে থাকে ওরা.... ও ছাড়ো
- হ্যাগো? তোমার কি কান পুরো গেছে? এটা ওপরের ফ্লোর থেকে আসছে? এটা ওখান থেকে আসছে.
এই বলে ছন্দা নিজের হাতটা সামনের দিকের দেয়ালে দেখালো। মানে এই দেয়ালের ওপাশ থেকে। যদিও সেটা আমারও মনে হয়েছে..... কিন্তু ওপাশের ঘর তো বন্ধ থাকে.... ওখানে কেউ থাকেনা তো। সেটা ওকে জানাতেই ও বললো -
- জানিতো আমিও.... ওটা পুরো লক থাকে। ওটায় বাড়ির মালিকদের সব ভাঙা জিনিসপত্র আছে। তাইতো বলছি.. এতরাতে ওই ঘরে কিসের আওয়াজ?
- তুমি কি এই আওয়াজেই জেগে গেছিলে নাকি?
- নানা.... আমি তো বাথরুমে যাবো বলে উঠেছিলাম। রান্না ঘরটা ক্রস করে ঐদিকে যাচ্ছিলাম.. তখনি কানে এলো এই আওয়াজ... কিন্তু তখন.....
- তখন কি?
- না মানে তখন আওয়াজটা ওদিক থেকে আসছিলো না
- তাহলে কোনদিক থেকে আসছিলো?
- বাইরের ওই.... ওই দরজার দিক থেকে
- কি? ওই পেছনের ওই বন্ধ দরজাটার দিক থেকে? ওটার বাইরে থেকে?
- হ্যাগো...... আমি তো হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেছিলাম। আমার তখন মনে হলো ওপাশের ওই অন্য বাড়িতে কেউ হয়তো জেগে আছে তাই রান্নাঘরের আলোটা জ্বেলেই বাথরুমে গেছিলাম। আর তখন শুনতে পাইনি। এই এখন আলো নিভিয়ে বিছানায় উঠতে গিয়ে শুনি আবার সেই হাসি... ওদিক থেকে।
আমি আবার কান খাড়া করে শুনলাম। এবারে আওয়াজটা আর আগের মতো নেই কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি। হাসিটা থামলেও মাঝে মাঝে ওই টানার শব্দ আসছে। আমি আর কানে দিলাম না। নিশ্চই অন্য কোথাও থেকে আসছে ভেবে ছন্দাকে বোঝালাম। ও যদিও একটু কিন্তু কিন্তু করছিলো শেষে নিজেও অতটা পাত্তা না দিয়ে ছেলের পাশে শুয়ে পড়লো। আমিও শুয়ে পড়লাম। কেটে গেলো ঐরাত টুকু।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরে টিভির সামনে বসে আমরা চা খাচ্ছি, ছেলে দাদুর সাথেই বসে কমিক্স পড়ছিলো। হটাৎ মা বললো - এই সুবু..... কালকে কি তোরা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলি?
আমি তো অবাক, সাথে ছন্দাও। মা হটাৎ এই প্রশ্ন করলো কেন? ওই মাকে জিজ্ঞেস করলো - কই নাতো মা? যেমন রোজ শুই তেমনি তো শুয়ে পড়েছিলাম.....কেন মা? কি হয়েছ?
মা বললো - না বৌমা..... কাল রাতে আমি কেমন যেন একটা হাসির শব্দ পেয়েছিলাম। কেউ যেন হাসছিলো..... কোনো মেয়ে..... একবার ভাবলাম তুমি নাকি কিন্তু......
- কিন্তু কি মা?
হাসিটা.... মানে হাসিটা কেমন যেন..... মানে..... স্বাভাবিক না..... মানে.... একটু অন্যরকম
আমি এবারে বললাম মাকে - তুমি ঠিক কখন শুনেছ বলোতো?
- আমি কি ওতো ঘড়ি দেখেছি.... ওই তাও ধরনা তিনটের মতো হবে...... বারান্দার বাইরে থেকে হটাৎ শুনি হিহিহিহি হাসি..... আজব
এইবার আমি আর ছন্দা দুজনেই ঘাবড়ে গেলাম। প্রথমে ছন্দা আওয়াজটা শুনেছিলো বাথরুমে যেতে গিয়ে রান্নাঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওই দরজার দিক থেকে, আর আমার মা শুনলো বারান্দার দিক থেকে....... আর দুটো...... সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। একটা ঐদিকের কোনে তো আরেকটা সামনের দিকে। এ কিকরে হলো? আমি আর ছন্দা মুখ চাওয়া চাই করলাম।
বাবা বলল - তুমি ও ভুলভাল শুনেছ কিছু।
মা কটমট করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো - ভুলভাল? মানে বললেই হলো ভুলভাল? আরে স্পষ্ট শুনলাম কেউ বারান্দার দিক থেকে হাসছে..... হ্যা মানে অতটা স্পষ্ট নয় কিন্তু ওটা যে ওদিক থেকেই তাতে সন্দেহ নেই, আর ইনি বলেন ভুলভাল। জানিস সুবু... তোর বাবাকেও একবার ডাকলাম.... সে তো এমন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছেন যে উঠলোই না.... তোমার এই নাক ডাকার জ্বালাতেই তো ঘুমটা ভাঙলো। বাপরে বাপ উফফফ যেন রেলগাড়ি ছোটাচ্ছে......
বাবা আর মায়ের মিষ্টি ঝগড়াটা বেশ উপভোগ্য.... কিন্তু সেটা মোটেও আমরা উপভোগ করতে পারলাম না। একে অপরকে দেখছি। একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় আসছিলো বার বার।
- হুমমম..... এই শুরু তাহলে? কি তাইতো?
সিগারেটের টান দিতে দিতে মাথা নাড়লো সুভাষ দা। তারপরে ধোয়া ছেড়ে আবার বলতে শুরু করলো -
- সেদিন ফেরার সময় একটু মাংস কিনে এনেছিলাম। ছেলেটা পছন্দ করে..... বৌয়ের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে আমি ব্যাগটা সোফায় রেখে গেলাম হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম। ফিরে এসে দেখি ব্যাগটা মাটিতে পড়ে গেছে..... যা বাবা.... ভালো করেই রেখেছিলাম... পড়ে গেল কিকরে? যাইহোক আবার তুলে ওখানে রেখে জামাটা খুলছি... আমার সামনে আবার ব্যাগটা পড়ে গেলো মাইরি!
- কি বলছো গো?
- হারে ভাই..... এবার তো আমি একদম দেখে সোফায় ঠেসে সাইড করে রেখেছিলাম আর হালকা ব্যাগ, একদিকে তো ভারীও হয়ে ছিলোনা যে বারবার একদিকে উল্টে যাবে। তখনই ছেলে এ ঘরে আসছিলো.... ওকে বললাম ওটা তুলে রাখতে। ও আবার ব্যাগটা তুলে একেবারে ধারে রেখে মায়ের কাছে চলে গেলো। আমি ভাবলাম আবার... আবার পড়লো রে। কিন্তু আজব ব্যাপার.... আর পড়লোনা... ওতো ধারে থাকা সত্ত্বেও না... কিন্তু তখন কিকরে? সে যাইহোক.. আমি আর ওতো পাত্তা না দিয়ে বাবার ঘরে গেলাম। তাকে আবার একটা স্মার্টফোন কিনে দিয়েছি সে তাতে খবর দেখছে আর মা আমার বৌয়ের সাথে মিলে মাংস রাঁধতে ব্যাস্ত। আমি বাবার সাথে বসে গল্প করছি, একটু পরেই ছেলে এসে বললো ঠাম্মি ডাকছে আমায়. গেলাম রান্নাঘরে। যেতেই মা যেটা বললো সেটা.... সেটা..... আজব
- কি... কি বললো কাকিমা?
- যেতেই মা আমায় বললো তুই কি একটু আগে দরজার আড়ালে লুকিয়ে বিট্টুর সাথে খেলছিলি নাকি?
আমি তো আকাশ থেকে পরলুম। মা কি সব বলছে?
আমি - মানে?
- তুই ছিলিনা?
- আমি তো বাবার ঘরে ছিলাম
- ওমা.... আমি যে দেখলাম মনে হলো কেউ দরজার ধারে দাঁড়িয়ে... দরজার সাথে একদম লেগে দাঁড়িয়ে কিন্তু বোঝা যাচ্ছিলো কেউ দাঁড়িয়ে।
- সে হয়তো তোমার নাতি বল নিয়ে খেলছিল
- ধ্যাৎ..... ওর হাইট কত? আমি তো যাকে দেখলাম সে লম্বা মতো...হুমম তোর মতোই...
- মা তুমি চশমা না পরেই কাজ করছো তাইতো?
- হ্যা তো কি? আমি কি অতটা অসহায় নাকি যে ওটা ছাড়া একেবারে অন্ধ? এইতো তোকে ভালোই দেখতে পাচ্ছি..... ওরে আমি দেখলাম তো কেউ...
আমি মাকে থামিয়ে ছন্দাকে জিজ্ঞেস করলাম - তুমি কিছু দেখেছো?
- আমি তো পেঁয়াজ কাটছিলাম... মা বললো ওই দেখো তুমি নাকি দাঁড়িয়ে আছো...আমি অবশ্য তাকালাম কিন্তু কই কিচ্ছু পাইনি দেখতে
- দেখলে মা... তোমার পাশে দাঁড়িয়ে তোমার বৌমা পর্যন্ত কিছু দেখেনি
- ততক্ষনে সরে গেছিলি হয়তো....
- আরে এতো আজব ঝামেলা.... বলছি বাবার ঘরে ছিলাম
- ওমা..... তাহলে? এতটা ভুল দেখলাম?
আমি মায়ের কথায় হয়তো সেইভাবে পাত্তা দিতাম না কিন্তু মা এতবার করে বলছিলো... আর মাকে দেখে মনেও হচ্ছিলো মা কিছু একটা দেখেছে.... তাই আমি ঘর থেকে টর্চ এনে সবকটা ঘর ভালো করে চেক করলাম বিশেষ করে খাটের নিচে... যদি কোনো চোর টোর হয়। কিন্তু কই? ধুর কিস্সু নেই। শেষে মাকে সব বললাম। মা হয়তো ওই দরজার ওই সাদা পর্দা দেখে ভেবেছিলো আমি দাঁড়িয়ে। যাইহোক রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে যে যার মতন ঘুমোতে চলে আসলাম।
ও..... ভুলেই গেছিলাম.. এরমধ্যে আরেকটা ব্যাপার হয়েছিল। আমার ছেলে আবার মাংস হবার পর বায়না করেছিল একটু টেস্ট করবে তাই ওর মা একটা পিস ওকে খেতে দিয়েছিলো। খাওয়া হয়ে গেলে ও সেই বাটি রান্না ঘরে রেখে লাইট নিভিয়ে ফিরে আসার সময় নাকি রান্নাঘর থেকে টং করে একটা আওয়াজ পায়.. ওটা ও পরে আমায় বলে.....যেন বাটিতে কিছু ঠোকা লাগলো। ও আর অবশ্য দেখতে যায়নি। রাতে যখন খাবার সময় মা আর ছন্দা রান্নাঘরে যায় তখন দেখে ছেলের বাটিটা সামনেই রাখা। কিন্তু তাতে কোনো ঝোল টোল কিস্সু লেগে নেই...বিট্টু নাকি একেবারে চেটেপুটে খেয়েছে। এতো ভালো হয়েছিল নাকি রান্না। কিন্তু বিট্টুর সেটা শুনে একবার ভুরু কুঁচকে গেছিলো তারপরে আবার নরমাল হয়ে গেছিলো সেটা আমি লক্ষ করেছিলাম।
এবারে আসি রাতের ঘটনায়। সেদিন একটা ফিল্ম দেখছিলাম ফোনে তাই কানে হেডফোন লাগানো ছিল। বেশ ভালো লাগছিলো বইটা তাই আর বন্ধ করতে ইচ্ছা করছিলোনা। শেষ হতেই ফোন রেখে কান থেকে হেডফোন সরাতেই একটা আওয়াজ কানে এলো। কটমট করমর জাতীয় ... যেন কেউ শক্ত কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এ আওয়াজ তো আমার... শুধু আমার কেন সবার জানা। মাংসর হাড় চেবালে এমন আওয়াজ আসে।
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
এবারে আসি রাতের ঘটনায়। সেদিন একটা ফিল্ম দেখছিলাম ফোনে তাই কানে হেডফোন লাগানো ছিল। বেশ ভালো লাগছিলো বইটা তাই আর বন্ধ করতে ইচ্ছা করছিলোনা। শেষ হতেই ফোন রেখে কান থেকে হেডফোন সরাতেই একটা আওয়াজ কানে এলো। কটমট করমর জাতীয় ... যেন কেউ শক্ত কিছু চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। এ আওয়াজ তো আমার... শুধু আমার কেন সবার জানা। মাংসর হাড় চেবালে এমন আওয়াজ আসে।
- কি বলছো গো? মাংস চেবানোর আওয়াজ?
আর নাতো কি? কিন্তু আমি প্রথমে ঠিক করে না বুঝলেও ভালো করে সুনি.... হ্যা... এতো একদম মাংসর হাড় চেবানোর আওয়াজ। এই আওয়াজ শুনে যতটা না ঘাবড়ালাম তার থেকে বেশি ঘাবড়ালাম এটা ভেবে যে ঐ আওয়াজ যেন আসছে...... রান্নাঘর থেকে!
আমি ভীতু মানুষ নই আবার সতর্কও বটে । তেমন একটা বড়ো ব্যাপার না জানি ......তাও কেমন যেন বুকটা হটাৎ কেমন করে উঠলো। একটা ভয় কি পেয়ে বসছে আমাকে? নানা.... তা হলে চলবেনা। আমি তাকালাম একবার পাশে। ছেলে আর বৌ ঘুমিয়ে আছে নিশ্চিন্তে। ওই আবার.... কটমট আওয়াজ। আমি একবার ভাবলাম ধুর হবে কিছু শুয়ে পড়ি.... কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারছিনা আমি। ভয়টা কেমন চেপে বসছে। সেটা হতে দেওয়া উচিত হবেনা। একবার পেয়ে বসলে রাতে একা বাথরুমে যেতেও ভয় লাগবে। সেটা বিট্টুকে মানায়, বিট্টুর বাবাকে নয়।
উঠে পড়লাম আমি। যাই একবার দেখে আসি... বাথরুমও করে আসবো। সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। খুব সাবধানে ছিটকিনিটা খুলছিলাম যাতে আওয়াজ না হয়। কিন্তু কি হলো জানিনা..... হটাৎ সব থেমে গেলো। একদম নিস্তব্ধ.... শান্ত। যেন কেউ একজন বুঝে গেছে এবারে ওই দরজা খুলে কেউ এদিকে আসবে।
তুই বিশ্বাস করবিনা.... দরজা খুলে ওপাশে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়লাম। যেন ভেতর থেকে কেউ মানা করছে সামনে যেতে। হয়তো ভয় এর কারণ। জোরে একটা শ্বাস ছেড়ে খুলে দিলাম দরজা। কই? কোথায় কি? একদম শান্ত আর অন্ধকার। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে দিলাম আলো জ্বালিয়ে। অন্ধকার কেটে গেলো। সাথে ভয়টাও। আলোর সামনে যেন মানুষ সাহস ফিরে পায়। তাই আমিও একটুও না ঘাবড়ে এগিয়ে গেলাম সামনে। এদিক ওদিক দেখলাম। না.... কিচ্ছু নেই... শুধু ডাস্টবিনের ঢাকনাটা একটু সরানো। ভেতরে একটা প্লাস্টিক... ওতেই আজকের সব এঁটো গুলো ফেলা হয়েছে।
ও... তাহলে ইঁদুর.... ওই ব্যাটাদের কাজ। এখানে আসার পর পর আমিও দেখেছিলাম কয়েকবার। এ কাজ ওদেরই।
আমি অবাক হয়ে বললাম - ইঁদুর? কিন্তু... ইঁদুর ঢাকনা খুললো কিকরে?। সুভাষ দা দু আঙুলের মাঝে সিগারেটের শেষটুকু ধরে বুড়ো আঙুলের সাহায্য নিয়ে ওটা দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো - আমি ওতো ভাবিনি.... বা বলা উচিত ভাবতে চাইনি রে.... ব্রেন হয়তো তখন একটা লজিক খুঁজে পেয়ে আর অন্য কিছু ভাবতেই চাইছিলো না। হয়তো একটু ফাক করাই ছিল... ইঁদুর ওটায় উঠে আরও ফাঁক করে ভেতরে ঢুকে খাচ্ছিলো... দরজা খোলার হালকা আওয়াজই কেটে পরে। যাইহোক....শেষমেষ বাথরুম করে আবার ফিরে আসলাম. লাইট নিভিয়ে দরজা লাগিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম।
সকালে যখন অফিসের জন্য বেরোচ্ছি তখন বাড়ির মালিক অনিমেষ কাকুর সাথে দেখা। উনি বোধহয় বাজারে যাচ্ছেন। আমায় দেখে হেসে এগিয়ে এসে বললেন - কি সব ঠিকঠাক আছে তো? কোনো অসুবিধা নেই তো.... কিচ্ছু হলে বলবেন কিন্তু। আমিও ভদ্রতার খাতিরে দাঁত কেলিয়ে হেসে নানা কাকু সব ঠিকাছে.... এতো সুন্দর একটা বাড়ি পেয়েছি... অসুবিধা কেন হবে? এসব বলে ওনার সাথেই গল্প করতে করতে বেরিয়ে গেলাম। তোর মনে আছে? সেদিন আমাদের মালের পারচেস নিয়ে মিটিং শেষ করে আমরা কজন ওখানেই কিছুক্ষন বসে গল্প করছিলাম আর আমার একটা ফোন আসাতে বেরিয়ে গেলাম... মনে আছে তোর?
- হ্যা হ্যা.... তুমি একটু পরেই ফিরে এলে..... আমি তো জিজ্ঞেস করেছিলাম বাড়ি থেকে? তুমি জাস্ট হ্যা বলেছিলে। সেদিন আমার তেমন কিছু মনে না হলেও ভেবেছিলাম বৌদি তো এখন ফোন করেনা তাহলে হটাৎ? অবশ্য তুমি এসে আবার আমাদের জয়েন করায় ভেবেছিলাম এমনিই ফোন করেছিল.... সিরিয়াস কিছু নয়।
সুভাষ দা বললো - চল নিচে যাই.... বাকিটা নিচে যেতে যেতে বলি।
আমরা নেমে আসতে লাগলাম। হাত ধুয়ে এসে নিজের জায়গায় এসে আবার বসলাম আমরা। সুভাষ দা মাউস টা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতেই বললো -
- সিরিয়াস বলতে তুই যা ভাবিস তেমন কিছু না হলেও.... যা হবার শুরু হয়ে গেছিলো।
- কি দাদা?
- সেদিন বাবা ব্যাংকে গেছিল। বেশ লাইন ছিল বলে ফিরতে কিছুটা দেরী হয়। বাবা ফিরে এসে স্নান করতে যাচ্ছিলো। তোকে তো বললামই যে রান্না ঘর ক্রস করে ওদিকে যেতে হয়। বাবা লাইট না জ্বালিয়েই সোজা বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলো। সেই সময়ই কি একটা কাজে ছন্দা ওদিকে যাচ্ছিলো। ওর সামনেই বাবা নাকি প্রায় ছিটকে সামনের দিকে পড়তে যাচ্ছিলো। বাবা ভাগ্গিস হাত বাড়িয়ে সামনের দেয়ালে হাত রেখেছিল নইলে ভালোই লাগতো হয়তো। ছন্দা তো দৌড়ে যায় বাবার দিকে। বাবাকে এনে বসায় ঘরে। বৌমার চিৎকার শুনে তার শাশুড়িও আসে ছুটে। কিন্তু বাবা ব্যাপারটা সামলে নেয়। নইলে মা আবার একটুতেই চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু আবার যখন বাবা স্নান করার জন্য যাচ্ছিলো তখন বাবা ছন্দাকে বলেছিলো যে সে পায়ে পা লেগে পড়ছিলোনা... আর ওদিকে কোনো কাপড়ও পড়ে নেই যে ওতে পা আটকে বা স্লিপ খাবে.... বাবার মনে হল একটা পা কে যেন..... হটাৎ মনে হলো কেউ যেন বাঁ পাটা ধরে নিয়েছিল তাই সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে সামনের দিকে এগিয়ে গেছিলো বাবা। সেটা ছন্দাও দেখেছে কিন্তু ওতো তখন ওর মাথাতেই আসেনি। সেটাই ও তখন ফোনে জানায়। আমিও তখন অফিসে.... তাই ওকে যতটা সামলানোর জন্য বলা যায় সেই আশ্বাস দিয়ে ব্যাপারটা এড়িয়ে গেছিলাম... বলতে পারিস হয়তো নিজেও ঠিক মানতে চাইছিলাম না ওসব। বাড়ি ফিরে আমিও বাবাকে সব জিজ্ঞাসা করি.... ওই একই কথা বাবা বলে... তার মনে হয়েছিল কেউ যেন পা ধরে নিয়েছিল।
- কি বলছো গো? একটা বড়ো দুর্ঘটনা হয়ে যেতে পারতো সেদিন! ভাগ্গিস ওনার হাত দেয়ালে ঠেকেছিল আর বৌদিও ধরে ফেলেছিলো।
- হুমমমম... জানিস এর আগেও একবার আমাদের নিজেদের বাড়িতে বাবা একবার পড়ে গেছিলো.... সেটায় বাবার পায়ে একটু লেগেছিলো কিন্তু সেটা স্লিপ খেয়ে পড়েছিল বাবা.... ওটাও দুর্ঘটনা... কিন্তু ওটা ন্যাচারাল ছিল.... হতেই পারে সেটা কিন্তু...... কিন্তু এটা যেন কেমন অদ্ভুত তাইনা? অবশ্য পা কোনো কারণে ফলস হতেই পারে... কিন্তু তাও.....সে যাইহোক সেই ঝামেলা তো কাটলো। এরপর ঘটলো মায়ের সাথে আরেক কান্ড।
- কাকিমার আবার কিছু......!!
সুভাষ দা হালকা হেসে বললো - আরে নানা... ওসব তুই যা ভাবছিস তেমন কিছু নয়, এটা পরশুর ঘটনা। মায়ের আবার একটু পেটের প্রব্লেম আছে... ওই যা হয় আরকি.. মাঝে মাঝেই যেতে হয় বাথরুমে। তো পরশু সন্ধ্যাবেলায় ওই মায়ের ফেভারিট সিরিয়াল শুরুর আগের ব্যাপার এটা। মা গেছিলো টয়লেটে। আমি ছেলেকে নিয়ে আমাদের ঘরে, ছন্দা বোধহয় টিভির ঘরেই ছিল আর বাবা বেরিয়েছিল..... জেঠুর বাড়ি গেছিলো।
ছেলেকে অংক করাচ্ছি এমন সময় সুনি মায়ের আওয়াজ বাথরুম থেকে। মা কি কিছু বলছে? আমাদের কাউকে ডাকছে? বিট্টু ঠাম্মির ডাক শুনে অমনি নেমে দৌড়ে গেলো বাথরুমের দিকে। আমিও গেলাম তখনই। কদিন আগেই বাবার সাথে যা হল তাই একটা ভয় তো ছিলই..... আমিও এগিয়ে গেলাম ঐদিকে। দেখি বিট্টু বাইরে থেকে চিল্লিয়ে বলছে - কি হলো ঠাম্মি? কিছু বলছো?
মা ভেতর থেকে বলছে - এই দুস্টু ছেলে.... বারবার দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিলি কেন?
ছেলে তো অবাক, সাথে আমিও। মা আবার বলল - আমি ইয়েতে এসেছি আর তুই দরজায় হালকা হালকা ধাক্কা দিচ্ছিস? দুস্টু... ঠাম্মিকে ভয় দেখানো?
মা বলে কি? এবারে আমি চিল্লিয়ে বললাম - কি হয়েছে মা? কি বলছো?
তোর ছেলে ঠাম্মিকে ভয় দেখাচ্ছে... উফফফ আমি কাজ করছি আর উনি দরজায় খসখস করে আওয়াজ করছে, ধাক্কা দিচ্ছে.... আমাকে ভয় দেখাচ্ছে দুস্টুটা।
মা ইয়ার্কি মেরে এসব বললেও আমার মুখে হাসি ফুটলোনা। কারণ সেই যখন মা বাথরুম গেছে তার আগে থেকেই আমি ওকে পড়াচ্ছি আর একবারের জন্যও বিট্টু উঠে কোথাও যায়নি আর বিট্টুর মাও তো টিভির ঘরে। তাহলে মা এসব কি বলছে? যদিও আমি তখন কিচ্ছু বলিনি আর বিট্টুকেও কিছু বলতে বারণ করেছিলাম। আমিই পরে মাকে বুঝিয়ে বলি। মা তো অবাক.... সে নাকি স্পষ্ট শুনেছে বাইরে থেকে কেউ হালকা করে ধাক্কা দিচ্ছে আর দরজায় যেন নখ ঘষছে। তাই তো তখন মা বিট্টু ভেবে ঐভাবে উচ্চস্বরে বলছিল যেটা আমরা আমাদের ঘর থেকে শুনতে পেয়েছিলাম। মা ভাবছিল নিজের নাতিকে বলছে..... কিন্তু বাইরে তো তখন কেউ ছিলোনা।
- কিন্তু তুমি যেদিন এসেছিলে সেদিন কিচ্ছু ফিল করোনি এসব?
- নারে.... প্রথম দুদিন ভালোই কেটেছে..... তিনদিনও ধরতে পারিস.... কিন্তু তারপর থেকেই... কেমন যেন.... আর ব্যাপারটা এমন যে.... মানতেও মন চায়না আবার এড়াতেও পারছিনা। মালিক অনিমেষ কাকুর সাথে কথা বলার ফাঁকে চালাকি করে অনেক কিছু জানার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু সেইভাবে কিছুই জানতে পারিনি। আর উনি যে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছেন সেটাও তো মনে হলোনা। একা মানুষ, স্ত্রী বেশ অনেকদিন হলো নেই... ছেলেও কলকাতায় থাকেন, মাঝে মাঝে আসেন... এক কাজের লোক আর রান্নার লোক অবশ্য আছেন... এই নিয়েই থাকেন তিনি। পাড়ায় আড্ডা দেন, বাবার সাথেও দু একবার আড্ডা দিয়ে গেছেন... আমার তো বেশ ভালোই লেগেছে ওনাকে।
- আহা ভদ্র মনে হয়েছে মানেই যে...... যাইহোক... আমি তো আর দেখিনি... তাই বলাটা উচিত নয়.... তো তারপরে?
- ছোটবেলায় গল্পে পড়েছি, ঠাকুমার কাছেও শুনেছিলাম জন্তু জানোয়ার নাকি আমাদের থেকে একটু বেশিই দেখতে পায়.. ওদের ইন্দ্রিয় অনেক শক্তিশালী।
আমি জিজ্ঞেস করলাম - হ্যা সেতো জানি... কুকুরের ঘ্রান শক্তি তো সবাই জানি.... কিন্তু হটাৎ এই কথা বলছো কেন?
সুভাষ দা একবার আমার দিকে তাকিয়ে নিয়ে আবার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে অমনোযোগ মনে বললো -
- কারণ আছে বলেই তো বললাম... কালকে রাতের দিকে জানিস একটা বেড়াল ওই সামনের গ্রিলের গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এসেছিলো কিন্তু মা ওটাকে হ্যাট হ্যাট করাতেই আবার বেরিয়ে যায়। বোধহয় বাড়িতে খাবারের গন্ধ পেয়ে ঢুকে পড়েছিল। আমি কালকের ওই মিটিং এর ব্যাপারেই একবার তোকে ফোন করার পর রাজীবকে ফোন করছিলাম... ওর সাথে কথা বলতে বলতে আমি হাঁটতে হাঁটতে বাইরে আমাদের বারান্দার দিকে চলে আসি। দেখি ছেলে ওখানে নিচু হয়ে বসে কি যেন করছে। আমি কথা বলা শেষে এগিয়ে গিয়ে সামনে যেতেই দেখি বিট্টুর সামনেই একটা বিড়াল.... হয়তো ওটাই যেটা ঘরে ঢুকে পড়েছিল আর ওটার সামনে কয়েকটা বিস্কুট ভাঙা.... ওটা চিবিয়ে খাচ্ছে।
আমার ছেলেটা আবার বিড়াল কুকুর খুব ভালোবাসে..... তাই ঠাম্মি তাড়িয়ে দিলেও ও আবার ওটাকে ডেকে এনে খাওয়াচ্ছে। আর বেড়ালটাও দেখি নিশ্চিন্তে ওর একদমই সামনে বসে খেতে ব্যাস্ত। ওরাও বোধহয় মানুষ চিনতে পারে। আমি এগিয়ে যেতে ওটা কয়েক পা পিছিয়ে গেল কিন্তু আবার সাহস করে এগিয়ে এসে বিস্কুট খেতে লাগলো। আমি ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে ওটার বিস্কুট খাওয়া দেখছি। বিট্টুটা আমার মতোই হয়েছে... আমিও আগে এদেরকে খাওয়াতাম.... আমি যখন বিট্টুর বয়সী ছিলাম বাড়িতে রোজ কয়েকটা বিড়াল আসতো, ঘরে ঢুকে বসে থাকতো.... পোষা হয়ে গেছিলো। মা আবার এসব পছন্দ না করলেও আমার জন্য তাড়াতেও পারতোনা। সে যাই হোক..... নিজের অতীত বলে আর লাভ নেই... যেটা বলছিলাম....... বিট্টু বেড়ালটার সামনে বসে ওটাকে আরেকটা বিস্কুট দিতে যাচ্ছিলো কিন্তু তখনি ওর মা ওকে ডাক দিলো... পড়তে বসার জন্য হয়তো.... বিট্টু উঠে দাঁড়িয়ে ওই বিস্কুটটা আমার হাতে দিয়ে বললো আমি যেন ছোট ছোট করে ভেঙে বেড়ালটাকে দিয়ে দি....এইবলেই সে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। আমিও মুচকি হেসে ওটার সামনে ঝুঁকে বিস্কুটটা ভেঙে ওর সামনে ফেলতে যাবো এমন সময় দেখি...... বেড়ালটা আমায় দেখছে.... একদম একদৃষ্টিতে.... চোখ দুটো চেরা আর নেই... পুরো গোল হয়ে গেছে...... আমায় অমন বড়ো বড়ো চোখ করে দেখছে কেন বেড়ালটা বুঝলাম না ঠিক..... এইতো একটু আগেও আমায় পাত্তাই না দিয়ে বিস্কুট খাচ্ছিলো। তাহলে কি আমি ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলাম বলে ও ভাবছে ওকে মারতে গেছি?
আমি - আহা.... এ একটা জংলী বিড়াল... এ কি পোষা নাকি যে পায়ে নিজের গা ঘষে মিউ মিউ করবে? ওটা তোমাকেই ভয় পেয়ে হয়তো.......
আমি আরও কিছু হয়তো বলতাম কিন্তু সুভাষ দা মাথা নাড়িয়ে বললো - উহু..... তা নয় রে.... ব্যাপারটা ঠিক অতটাও সরল নয়। আমার একটা ভুল হয়েছিল...
- ভুল? কি ভুল?
- আমিও তখন তোর মতোই ভাবছিলাম যে রাস্তার বেড়াল... খুবই সতর্ক এরা..... তাই আমাকেই হয়তো ভয় পাচ্ছে কিন্তু..... কিন্তু আমি তখন ভালো করে একটা জিনিস লক্ষ করলাম। বারান্দায় আলো ছিলোনা ঠিকই কিন্তু বাইরের ওই ল্যাম্পপোস্ট এর আলো কিছুটা বারান্দায় পড়েছিল.... তাতেই ভালো করে লক্ষ করলাম বেড়ালটার দিকে। এতক্ষন যে ভাবছিলাম ওটা আমার দিকে ঐভাবে তাকিয়ে...... সেটা ঠিক নয়, ওটা আমার দিকে তাকিয়ে নেই..... বরং ওর নজর ঠিক আমার কাঁধ বরাবর পেছনে!
তাহলে কি... কেউ এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে? এইভাবে আমি পেছনে তাকাতেই...... কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। ঐ একটু দূরেই খোলা দরজা দুই আলো এসে সামনেটায় পড়েছে, পর্দাটা হালকা উড়ছে.. ব্যাস। আমি আবার তাকালাম বেড়ালটার দিকে কিন্তু ওটার নজর সেই একদিকে... আমার ঠিক পেছনে... তবে এবারে বেড়ালটা আর আগের জায়গায় নেই... কিছু পিছিয়ে গ্রিলের কাছে চলে গেছে.. আর ওখান থেকে দেখছে সে। আমি আয় আয় করে ডেকে এগিয়ে গিয়ে ওটার সামনে একটা বিস্কুটের টুকরো ফেললাম... কিন্তু বেড়ালটা সেটা পুরোপুরি অগ্ৰাহ করে ওই একভাবে তাকিয়ে রইলো... না শুধু তাকিয়েই রইলো না.. এবার সে মুখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই একটা গোঁ গোঁ করে হুঙ্কার দিতে লাগলো যেন কিছু একটা জিনিসকে সতর্ক করছে সে.. হুমকি দিচ্ছে.. ঠিক যেমন একটা হুলো আরেকটাকে দেখলে দেয়।
আমি আবার তাকালাম পেছনে... কই? কি দেখছে বেড়ালটা? পেছনের দেয়ালে একটা টিকটিকি থাকলেও হয়তো ভাবতাম ওটাকে দেখে অমন করছে বেড়ালটা... জানি সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয় কিন্তু তাওতো কিছু একটা দেখতে পেতাম আমি..... কিন্তু কিছুই তো নেই। আমি এবারে সামনে তাকিয়ে দেখি.... বেড়ালটা আর ঘরের ভেতরেই নেই... গ্রিল টপকে বাইরে গিয়ে রাস্তার সামনে থেকে সেই একভাবে তাকিয়ে... কিন্তু এবারে ওটার নজর ঠিক আমার মাথার ওপর.... সেটা থেমে নেই... বরং বেড়ালটা আরও মাথা তুলছে ওপরের দিকে.... অর্থাৎ কিছু একটা কি তাহলে আমার মাথার ওপরের দেয়ালে অনবরত উঠে যাচ্ছে?
উফফফফফ.... সেদিন আমি ফিল করেছিলাম ভাই ভয় কি জিনিস..... আমার মতো একটা মানুষ... এক ছেলের বাবা আমি.... সেই আমি কিনা সেদিন নিজেই ঘোল খেয়ে গেছি। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি ওখানে.... বিস্কুটের বাকিটা দূরে বেড়ালটার দিকে ছুঁড়ে আমি ঐভাবেই পেছন না ফিরে হাঁটতে হাঁটতে ঘরে এসেছিলাম.... কেন জানিনা মনে হচ্ছিলো আমার এই সময় আর পেছনে ফেরা বা ওপরের দিকে তাকানো উচিত হবেনা... তাই ঐভাবেই ফিরে আসি। পরে অবশ্য রাতে দরজা লাগানোর সময় ভালো করে বারান্দা চেক করে ছিলাম... না... আমাদের আনা পেটি আর কয়েকটা কয়েকটা জিনিস বাদে কিছুই চোখে পড়েনি। কিন্তু তাহলে বেড়ালটা.... কি দেখছিলো আমার পেছনে?
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
সেদিনের মতো সুভাষ দার থেকে ঐটুকুই শুনে কাজে মনোযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু মাথায় যেন সুভাষদার কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছিলো। গল্পে পড়া বা ভিডিও তে দেখা এক ব্যাপার কিন্তু পাশের চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা যাকে এতদিন চিনি তার মুখ থেকে শোনা আরেক ব্যাপার। এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। এর মধ্যে আরও কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিলো। সেটাই এখন তুলে ধরছি আমার মতো করে।
সুভাষদার সাথে এর মধ্যে তেমন আর কিছু না ঘটে থাকলেও ওনার নাকি মনে হতে মাঝে মাঝে কেউ যেন ওনার গায়ে একদমই গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে.... কিন্তু পাশের স্থান শুন্য। এটা নাকি বিট্টুর সাথে কয়েকবার হয়েছে। সেই ঘটনাই বলি।
একদিন বিট্টু নিজের টেবলে বসে কলেজের হোমওয়ার্ক করছিলো। ছন্দা বৌদি নাকি ওকে নিজের কাজ করতে বলে চা বানাতে গেছেন। যাবার সময় সুভাষ দা কে ওর কাছে বসতে বলে গেছিলেন। উনিও বসার ঘর থেকে উঠে শোবার ঘরে (বেডরুমের বিছানার মাথার দিকের দেয়ালের সাথেই সেই টেবিল) এসে বিছানায় বসে ফোনে হয়তো কিছু দেখছিলেন। উনি হয়তো সেটা দেখতে ব্যাস্ত ছিলেন, একটু পরেই মুখ তুলে ছেলে কেমন পড়া করছে দেখার জন্য সেদিকে তাকাতেই দেখেন বিট্টু ওপাশে অর্থাৎ খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে.... তারপরে মাথাটা নামিয়ে টেবিলের নিচে কিছু দেখছে।
- কিরে? কি খুজছিস তুই? কিছু পড়ে গেছে?
সুভাষ দার প্রশ্নে বিট্টু বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও যেন থেমে গেলো তারপরে আবার হাতের দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে বাবার দিকে তাকালো।
- কি? কি হয়েছে.. ঐভাবে হাত দিয়ে অন্য হাতে হাত বোলাচ্ছিস কেন? ব্যাথা করছে নাকি?
বিট্টু না সূচক মাথা নেড়ে ওর বাবাকে বললো - না বাবা.... মনে হলো..... মানে....
- কি? কি মনে হলো?
- না মানে মনে হলো হাতের ওপর কিছু একটা....
ছেলের কথা শুনে সুভাষদা ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন ব্যাপারটা কি? তাতে বিট্টু জানায় ও একটা লেখা লিখছিলো তখন ওর ডানহাতের কনুইয়ের কাছে নাকি একবার মনে হয়েছিল কিছু ঠেকলো। ও একবার তাকিয়ে কিছু নেই দেখে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দেয়। কিন্তু একটু পরে আবার ওর মনে হয় ওর কনুই এর কাছে আবার নরম কি যেন ঠেকলো। যেন কিছু ছিল ওখানে... আর একি সাথে চেয়ারে বসা অবস্থায় টেবিলের তলায় ওর ঝুলন্ত পায়ের পাতার ওপর কিছু যেন স্পর্শ হলো। বিট্টু প্রথমে ভেবেছিলো ওই বেড়ালটা বোধহয় আবার ঢুকে পড়েছে। কিন্তু কই? নিচু হয়ে দেখে কিছুই নেই। আর এক পলকের জন্য ওর মনে হয়েছিল কে যেন খোলা দরজা দিয়ে সট করে অন্য দিকের ওই বসার ঘরে চলে গেলো। বিট্টু সেই জন্যই খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে ছিল আর তখনি সেটা দেখে সুভাষ দা ওকে ওই প্রশ্ন করেছিল।
এর পরের ঘটনাটাও বড়ো অদ্ভুত। এটা আবার কয়েকদিন পরের ঘটনা। তখন কটা রাত বেজেছিল খেয়াল করেনি সুভাষ দা। ঘুমটা যে ভেঙে কেন গেছিলো বোঝেনি দাদা। সচরাচর এমন হয়না ওর। আধ বোজা চোখেই ও সামনে তাকায়। ঘরে একটা সবুজ নাইট ল্যাম্প জ্বলছিল। তারই হালকা আলোয় দাদা দেখে বৌদি শুয়ে। মুখ বোঝা যাচ্ছেনা কিন্তু বৌদি বা বিট্টু ছাড়া আর কে হবে? উনি আবার চোখ বুজে ফেললো আর একটু পরে ওপাশ ফিরে শোবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই মতো দাদা ওপাশ ফিরতেই অবাক। একি? দাদা ধারে শোয় আর বৌদি ওপাশের দেয়ালের দিকে আর মাঝে বিট্টু। দাদা এপাশে ফিরতেই দেখলেন এদিকেও কেউ শুয়ে! তবে এদিকে দুটো মাথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারমানে এটাই দেয়ালের দিক অর্থাৎ বাঁ দিক। ঘুমের ঘরে তখন দাদা ডান বাম গুলিয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু এটা যদি বাঁ দিক হয় তাহলে তখন যে ঐপাশে মনে হলো কেউ শুয়ে? একদম মাথা বরাবর? ওপাশে কেউ কিকরে শুতে পারে? ওই জায়গা টুকু সুভাষদার প্রায় একারই লাগে। ওখানে আরেকজনের শোবার কোনো জায়গাই নেই.... তাহলে?
দাদা চট করে ওপাশ ফিরে দেখেন ওনার কোলবালিশ টা ওনার মাথার একদমই মাথার বালিশের ওপর উঠে গেছে। তাহলে কি এটাকেই উনি ভুল করে.....? তা নয়তো আর কি হবে এই ভেবে উনি আবার শুয়ে পরে। কিন্তু তার একটু পরেই অনেকটা দূর থেকে যেন যেন ভেসে এলো একটা হালকা হাসি..... কেউ কি হাসলো? কেউ কি এখনো জেগে কারোর সাথে গল্প হাসি, ঠাট্টা করছে? সেই হাসিই কি এতদূর বয়ে নিয়ে আসলো বাতাস? জানেনা সুভাষ দা...... উনি আবার নিদ্রায় মন দেন।
এইসব শুনে একদিন আমিও এক শনিবার রাতে গেছিলাম সুভাষ দার বাড়িতে। যদিও এর আগে একবার দাদার বাড়িতে গেছিলাম তবে সেটা ছিল ওনাদের নিজের বাড়ি। এই নতুন ভাড়া বাড়িটা ওনাদের বাড়ি থেকে খুব দূরে না হলেও বেশ ভেতরের দিকে। রাস্তা চেনা না থাকলে ভুল করে অন্য জায়গায় চলে যাবার সম্ভাবনা অনেক। তাই *****মিষ্টির দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে দাদাকে আরেকবার ফোন করায় দাদা রাস্তা বলে দিয়েছিলো। সুভাষদাদার বাড়ির লোকও আমায় চিনতেন তাই নতুন করে পরিচয় পর্ব সারার প্রয়োজন পড়েনি।
আমি যদিও বলেছিলাম অনেকদিন আসা হয়নি বলে বেড়াতে এসেছি কিন্তু দাদা মনেহয় ধরতে পেরেছিলো আমার আসার আসল কারণ। সত্যিই... দাদার কাছ থেকে এসব ঘটনা শোনার পর আমারও কেমন মনে হচ্ছিলো একবার বাড়িটা দেখতে হবে, কেমন যেন একটা আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম বাড়িটার প্রতি। যে এলাকায় এই বাড়ি সে নিজেই এতো নিস্তব্ধ যে কেমন কেমন লাগে..... ওই গলিতে ঢোকার চারটে বাড়ির পরে এই বাড়িটা. আর তার উল্টোদিকে আরেকটু এগিয়ে একটা পুকুর। গলিতে ঢোকার পর থেকেই আমার হটাৎই কেমন কেমন যেন লাগছিলো। যেন অচেনা কেউ এসে পড়েছে অন্য কারোর জায়গায়... যেন কেউ পছন্দ করছেনা সেইটা.... যদিও আমার এই অনুভূতির কারণ হতে পারে দাদার মুখ থেকে ঐসব ঘটনা। যা আমি যত ওই বাড়ির কাছে পৌঁছচ্ছিলাম ততই যেন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছিল।
দাদার পুরো পরিবারের সাথে কিছুক্ষন গল্প করার পর আমরা দুজন একান্তে বসে কিছুক্ষন গল্প করেছিলাম। বিট্টুর জন্য একটা বড়ো চকলেট এনেছিলাম সেটা পেয়ে সেও খুশি হয়ে তখনি খেতে খেতে মায়ের সাথে নিজের ঘরে চলে গেছিল। আমি আর সুভাষ দা দুজনে বারান্দায় দুটো চেয়ারে বসে। কিছুক্ষন যেন কোনো কথা নেই দুজনের মুখে। যেন আমরা দুজনেই কিছু অনুভব করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই নিরাবতা বেশিক্ষন টানতে না পেরে আমিই কথা বলা শুরু করি
- তো... বাড়িটা তো বেশ ভালোই.... পুরোনো দিনের বাড়ি কিন্তু বেশ ভালোই কন্ডিশনে আছে.... এমন একটা বাড়িতে.......
দাদা নিজের চোখ দুটো একদম ছোট করে কি একটা ভেবে বললো - আমার কি মনে হয় জানিস? প্রব্লেমটা এই বাড়ির... মানে আমরা যে পোরশনে থাকি তার নয়..... প্রব্লেমটা ওই অন্য পাশের।
- মানে যেটা বন্ধ থাকে?
- হুমম
- কেন এমন বলছো? তুমি কি কিছু জানতে পেড়েছো?
- না...... আমি কিছু জানতে পারিনি... তবে আমি এইটুকু বলতে পারি এই ব্যাপারের সাথে বাড়ির মালিকের সরাসরি কোনো যোগ নেই.... উনি সত্যিই একজন ভালো মানুষ..... বাড়ির মালিক মানেই যে একটা ধারণা হয় তার ধারেকাছ দিয়েও উনি যাননা..... নিপাট শান্ত স্বভাবের ভদ্রলোক...আমি ভাবি ওনার দোতলাতেও কি সমস্যা হয়?
- সেটা হলেও কি উনি বলে বেড়াবেন? তবে তুমি বলছো... এতে ওনার কোনো হাত নেই..... তাহলে কি হতে পারে ভাবছো?
- আমার নিজের এক কলেজের ফ্রেন্ড বুঝলি..... এই এলাকাতে আগে থাকতো....এখন ব্যারাকপুরের দিকে নতুন ফ্ল্যাটে উঠে গেছে। কিন্তু সেদিন বাজারে দেখা। সেও বাজার করতেই এসেছিলো। তো ওর সাথে দেখা হবার পর আর কিছুক্ষন গপ্পো মারার পর ওকে জানাই যে আমাদের বাড়ি ফ্লাট হচ্ছে.... আর এটাও যে আমরা কোথায় উঠেছি । বলতেই চিনতে পারলো ও বাড়িটা। নিজেই বাড়ির মালিকের নাম বললো। একবার দুবার নাকি কলেজে পড়ার সময় ওদিকের পেছনের রাস্তা দিয়ে শর্টকাটে মাঠে খেলতে যেত। কিন্তু ওর কথা শুনে এই বাড়ি সম্পর্কে কোনো অন্য রকম ব্যাপার ও জানেনা বা শোনেনি। কারণ ও কিছু জানলে নিশ্চই আমায় বলতো এই বাড়ি সম্পর্কে। আমায় সতর্ক করতো। কিন্তু সেসব কিছুই বল্লোনা সে..... শুধু একটা কথা ছাড়া..... এই বাড়িতে নাকি এককালে এই বাড়ির কেউ একজন গলায় দড়ি দিয়েছিলো...... এটা আমার বন্ধুও নাকি ওর বাবার থেকে ছোটবেলায় শুনেছিলো। এই বাড়ির কেউ একজন নাকি উন্মাদ হয়ে যান.... সে মহিলা কিনা পুরুষ ছিল জানিনা.... ও নিজেও জানেনা। সে যে কোথায় এই কান্ড ঘটিয়েছিল.. একতলা নাকি দোতলা... আমাদের এইদিকের অংশে নাকি ওদিকের অংশে কিছুই জানেনা ও..... কিন্তু আমি ভাবছিলাম তাহলে কি সেটার সাথেই কি এর কোনো যোগাযোগ আছে কিনা...... এমনিতে কিন্তু এমন একটা বাড়ি ভাড়া হিসেবে পাওয়াও ভাগ্যের ব্যাপার... তুই তো দেখলি কেমন বড়ো বড়ো ঘর।
সুভাষ দা আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তখন ভেতর থেকে বৌদি দাদাকে ডাকেন। দাদাও আমাকে 'তুই বস.. আমি আসছি' বলে ভেতরে চলে গেলেন। আমি বসে এদিক ওদিক দেখতে লাগলাম। সত্যি বেশ ভালো বাড়ি পেয়েছে সুভাষ দা রা। আমি ভাবছিলাম একটা টান দেবো কিন্তু অন্যের বাড়িতে... বিশেষ করে যেখানে দুজন গুরুজন আছেন সেখানে সেটা করা উচিত হবেনা। তাই বসে নিজের পায়ের ওপর পা তুলে নাড়তে নাড়তে আনমনে একটা গুনগুন করছিলাম। পেছন থেকে খালি পায়ের এগিয়ে আসার শব্দ কানে আসতেই আমি বললাম - সত্যি দাদা.... বাড়িটা কিন্তু দারুন পেয়েছো.... তাও.. কতটা জায়গা নিয়ে এই বাড়িটা? জানো?
কোনো উত্তর না পেয়ে আমি মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকালাম। আমার পেছনে........... কেউ নেই। কিন্তু আমি যে পায়ের শব্দ পেয়েছিলাম..... এদিকেই এগিয়ে আসছিলো মনে হলোতো। গা টা কেমন ছ্যাত করে উঠলো। একটা কেমন শিহরণ খেলে গেল শরীরে। আমি মোটেও ভীতু মানুষ নই... নইলে সুভাষ দাদার কথা শুনে ইন্টারেস্টেড হয়ে এখানে আসতামই না। কিন্তু এখন... এই মুহূর্তে আমার ভেতর থেকে একটাই অনুভূতির জাগরণ হচ্ছিলো... সেটা কি ভয় বলা উচিত নাকি সংশয় জানিনা। কিন্তু আমি যে পায়ের আওয়াজ পেয়েছি তাতে ভুল নেই। আমি আবার সামনে তাকালাম। বারান্দায় টিউব লাইট জ্বলছে। বাইরে ওই ল্যাম্প পোস্টার আলোটা দেখতে পাচ্ছি আর বাঁ দিকের কোনে তাকে ওই পুকুরের জলও দেখা যাচ্ছে.. মাঝে ঝোপঝার আর দু তিনটে নারকেল গাছ। হটাৎ কেন জানি ওই মুহূর্তেই মনে পড়লো দাদার সাথে ঘটে যাওয়া ওই বেড়ালের ঘটনাটা... এখানেই তো!!....... উফফফ! এখনি এসব মনে পড়তে হলো?
আমি কেন জানি একা ঠিক বসে থাকতে পারছিলাম না। কেমন জানি লাগছিলো। ভাবছি উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াবো... তখনি দেখলাম সুভাষ দা এলো আবার বারান্দায়। উফফফ যেন একটা চাপ হালকা হয়ে গেলো। দাদা এসে বলেছিলো বৌদি নাকি বলেছে আমাকে খেয়ে যেতে কিন্তু আমি বারণ করে দিয়েছিলাম। জাস্ট এমনি বেড়াতে এসেছি... ওটা ঠিক মানায় না। দাদাও জোর করেছিল কিন্তু আমি রাজি হইনি... আগের থেকে ঠিক করে আসলে অন্য ব্যাপার হতো। যাইহোক দাদা বৌদিকে আরেকবার চা করতে বলে আমার পাশে এসে বসলো। হাতের ইশারায় আমাকে বোঝাল - সিগারেট এনেছি কিনা?
আমি - কিন্তু.. কাকু কাকিমা.....
দাদা বলল - নানা... ওরা আসবেনা। তুই দে না.. আমারটা আনতে আবার ঘরে যেতে হবে।
আমি দুটো বার করে একসাথেই দুটো ধরিয়ে একটা দাদাকে দিলাম। সুখটান দিয়ে দাদা হেলান দিয়ে বসে সামনে তাকিয়ে রইলো। আমিও ধোয়া ছেড়ে তাকিয়ে রইলাম সামনে। দাদা বললো -
- পরশু... নাকি তার আগের দিন? কবে যেন? হ্যা হ্যা মনে পড়েছে দুদিন আগে..... কারেন্ট অফ হয়েছিল এদিকে।
- কখন অনেক রাতে?
- উহু..... ওই আটটা নাগাদ.... এলো সেই সাড়ে নটা নাগাদ.... একেই এই অসাধারণ আবহাওয়া তো দেখছিস..... তার মধ্যে কারেন্ট মায়ের ভোগে.... আমাদের আবার শালা হাতপাখা গুলোও নেই.... কি আর করার আমি বাবা মা ছন্দা বিট্টু সবাই সেদিন এই এখানেই এসে চেয়ার নিয়ে বসে ছিলাম। মাঝে মাঝে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়লে যেমন রাগ হয়, তেমনি সেই পরিস্থিতি মেনে নিয়ে একসাথে বসে আড্ডা দিতেও হেব্বি লাগে... আমরাও সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছি। ছেলেটা আমার কোলে বসে গেম খেলছে। আমরা আমাদের মতন নানা কথা বলছি..... পুরোনো কিছু কথা... ওই কিছু পি এন পি সি ও ছিল তার মধ্যে... সে যাই হোক.... বেশ জমে উঠেছিল আড্ডাটা অন্ধকারে মোমবাতির আলোয়।
বেশ কিছুক্ষন এই পারিবারিক আড্ডা চলার পর আমরা একটু নিস্তব্ধ মানে সাইলেন্ট মোডে গিয়ে বাইরের অন্ধকার আকাশ দেখছি। মাঝে মাঝে একটা বাতাস এসে আমাদের একটু হলেও ঠান্ডার অনুভূতি দিচ্ছে। আমার হটাৎ একবার বাথরুমে যাবার প্রয়োজন মনে হতে - তোমরা বসো আমি আসছি বলে উঠতে যাবো তখন বাবাও বলল সে সেও যাবে একই কাজে। আমরা দুজন উঠে ঘরের দিকে আসতে লাগলাম। ছেলেকে গেমটা পস করতে বলে ওটা সাথে নিয়ে নিলাম ফ্ল্যাশ লাইটের জন্য। মা, ছন্দা আর বিট্টু ওখানেই বসে রইলো।
সুভাষ দার কথার মাঝেই বৌদি চা নিয়ে এলেন। তিনিও আরেকবার বললেন খেয়ে যেতে কিন্তু আমি হেসে বললাম পরেরবার নিশ্চই খেয়ে যাবো। আজকে একটু পরেই ফিরতে হবে আমায়। বৌদি চলে গেলেন। আমরাও আবার দুদিন আগের মুহূর্তে ফিরে গেলাম।
- বাবা আর আমি রান্নাঘর ক্রস করে বাথরুমের সামনে পৌঁছে গেলাম। বাবার হাতে ফোনটা ধরিয়ে বাবাকে আগে পাঠিয়ে দিলাম। বললাম দরজা বন্ধ করতে হবেনা..... তুমি করে নাও।আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। বাবা ফোনটা নিয়ে বাথরুমে যেতেই এতক্ষণের ছড়িয়ে থাকা আলোর যতটুকু দৃঢ়তা ছিল প্রায় পুরোটাই হ্রাস পেলো। প্রায় সবটাই হারিয়ে গিয়ে আবার জমাট অন্ধকার ঘিরে ধরলো আমায়। বাথরুমের বাইরেটায় আমি দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। দরজাটা খোলা থাকায় ভেতর থেকে হালকা আলোর অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম কিন্তু আমার চারিপাশে কালো।
হটাৎ আবার কেমন যেন করে উঠল শরীরটা। এই একটু আগে পর্যন্ত কোনো ভয় বা অন্য অনুভূতি ছিলোনা আমার। কিন্তু এবারে হটাৎ একটা গা শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছিল। না চাইতেও অতীতের ঘটনাগুলো মনে পড়ছিলো। উফফফ এতো রাগ হচ্ছিলনা নিজের ওপর... ওগুলো মনে পড়ার আর সময় পেলাম না? এখনই মনে পড়তে হবে? কিন্তু কি করার? ওটা যে আমার হাতে নেই। বার বার চোখটা খোলা দরজার দিকে চলে যাচ্ছে। সেই দরজা বরাবর ভেতরের ঘরের ওপাশের দেয়ালের জানলা। খোলা সেটি। ঘর অন্ধকার কিন্তু বাইরে অতটাও অন্ধকার কার নয় চাঁদের জন্য। তাই হালকা আলো ঢুকছে ওই জানলা দিয়ে। আর আমার চোখ বার বার সেদিকেই যাচ্ছে। আমি জানি জানলার ওপাশে কিচ্ছু নেই, থাকতে পারেনা... কিন্তু ভয় নানারকম মুখ ফুটিয়ে তুলছে আমার সামনে। এই যেন কেউ জানলা দিয়ে উঁকি দিলো, এই বুঝি কেউ জানলার সামনে থেকে সরে গেল. উফফফ অসহ্য!
বাথরুমের আওয়াজ বন্ধ হতেই বুঝলাম এবার বাবা বেরোবে... ঐযে আলোটার জোর বাড়ছে... বাবা বেরিয়ে আসছে। আবার একটু একটু করে অন্ধকার কেটে হালকা অল্প আলোয় ভোরে উঠল বাথরুমের বাইরেটা। বাবা বেরিয়ে ফোনটা আমায় ধরিয়ে দিলো। আমি বাবাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বললাম। অন্ধকারে ফিরতে গিয়ে আবার না কিছু ঘটে তাই আমি আগে আসি তারপরে একসাথে ফিরবো। আমি এবারে ঢুকলাম ভেতরে। বাবা বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো।
আমি আমার কাজ সারতে লাগলাম ... মানে হালকা হচ্ছি। আমার হাতে আমার ফোন। তার থেকে বেরোনো আলোয় আমার সামনের দেয়ালে ফুটে উঠেছে আমার ইয়া বড়ো একটা ছায়া। টয়লেট করতে করতে কি জানি কি ভেবে একবার আমি পেছন ফিরে তাকালাম আর তখনি মনে হলে বাথরুমের খোলা দরজাটার সামনে থেকে কেউ স্যাট করে সরে গেলো। এক মুহূর্তের জন্য চমকে উঠেছিলাম। বুকটা ছ্যাত করে উঠেছিল মাইরি। মানে আমি এই যতটুকু সময় ইয়ে করছিলাম ততক্ষন কি আমার পেছনে ওই দরজার কাছে কেউ দাঁড়িয়ে আমায় দেখছিলো? উফফফফফ এমন একটা ভাবনা ওই মুহূর্তে আসা যে নিজের জন্য কি সাংঘাতিক বুঝতেই পারছিস?
আমি আমার হাতের আলোটা আমার দিক থেকে সরিয়ে দরজার দিকে ফেললাম আর ওই ভাবেই ধরে বাকি কাজ সারতে লাগলাম। একবার ভাবছি ওটা কি বাবা ছিল? কিন্তু বাবা হটাৎ এমন করবে কেন? তাহলে কি আমার মতো বাবাও অন্ধকারে ভয় পেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিল? কিন্তু বাবা তো অমন ভীতু মানুষ নয়। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি.... বাবার মতো প্রাকটিকাল আর সাহসী মানুষ খুব কম হয়। বাবাও নাকি নিজের ছোট বয়সে ওসবের সাক্ষী হয়েছিল... সে অন্য ঘটনা... পরে একদিন বলবো.... যাইহোক সেকারণে ভুত টুতে বাবার পুরো বিশ্বাস আছে কিন্তু তাবলে ভীতু বাবা কোনোদিন ছিলোনা..... আর আজ কিনা সেই মানুষ ভয় পেয়ে... নানা বিশ্বাস হলোনা লজিকটা।
আমি সোজা তাকিয়ে ছিলাম দরজার দিকে। আলোয় আলোকিত ওই জায়গাটা। এর মাঝে আরেকটা ব্যাপার হয়েছিলো.... দুমদুম করে দুটো চাপা আওয়াজও শুনতে পেয়েছিলাম। কাজ সেরে আবার ঠিকঠাক হয়ে হাত ধুয়ে বেরিয়ে এসে দেখি বাবা ওই দূরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখলাম বাবার মুখে ভয়ের কোনো ছাপ টাপ নেই। সে অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে আছে বেশ। আমি এগিয়ে গিয়ে বাবাকে বললাম - তোমায় তো সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছিলাম... আবার খালি খালি এতটা হেঁটে এগিয়ে গেছিলে কেন?
বাবা বললো সে নাকি দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু আমি ভেতরে যাবার জাস্ট একটু পরেই নাকি পেছনে রান্না ঘরের থেকে বাসনের হালকা আওয়াজ পায় বাবা। একবার না তিন চার বার। বাবা ইঁদুর ভেবে ওপাশের দেয়ালে দুম দুম করে দুটো ধাক্কা মারে। তাতেই আওয়াজ পুরো থেমে যায়। আর তখনি বাবা এগিয়ে গিয়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। তারমানে বাবা বাথরুমের দিকে আসা তো দূরের কথা বরং ওখান থেকেই সরে গেছিলো.... তাহলে আমি যেটা দেখলাম সেটা কি? চোখের ভুল? আবারো চোখ এই ভাবে ধোঁকা দিলো? আসলে হতেও পারে... একবার একটা ব্যাপারে নেগেটিভ চিন্তা মাথায় ঢুকে গেলে ওতো সহজে বেরিয়ে আসা যায়না.. আর এতো সেরার সেরা চিন্তা... কি বলিস?
আমি একটু হেসে চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম - তোমরা তো দেখলাম ওই কাকু কাকিমার ঘরের বাইরে ওই দেয়ালটায় ঠাকুরের ছবি লাগিয়েছো.... মানে.... তার পরেও.....?
সুভাষ দা চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন - মা রোজ পুজো করে, ধুপ দেয়... ওসব তো আছেই.... আর সেইজন্যই কিনা জানিনা.... মায়েদের ঐদিকের বড়ো ঘরটায় এই এতদিনে একটাও প্রব্লেম হয়নি.... মায়ের সাথেও যা হলো সেই বাথরুমের দিকে, বাবাও হোঁচট খেলো ওই বাথরুমের দিকে, আমি ভয় পেলাম সেদিন এই বারান্দাতে..... কিন্তু ঐদিকের ঘরে নো ডিস্টার্বেন্স। আমি জানিনা এর জন্য ভগবানের ছবির করিশমা আছে কিনা কিন্তু আমাদের এই দিকের ভাগটায় ওসব যেন বেশি হয়। বিশেষ করে বাথরুমের দিকটায়। এবার সেটা বাথরুম বলে... নাকি অন্য কোনো ব্যাপার জানিনা ভাই।
আমি জিজ্ঞেস করলাম - আচ্ছা তুমি কি ওই পেছনের দিকের যে দরজাটার কথা বললে....মানে ওই রান্না ঘরের সঙ্গে লাগোয়া... ওটা কি খুলেছিলে?
হুমমম খুলেছিলাম তো - দাদা বললো।
তারপরে চায়ে চুমুক দিয়ে আবার বললো - আসার পরের দিনই খুলেছিলাম। তাছাড়া প্রথম যেদিন বাড়ি দেখতে এসেছিলাম সেদিনও তো বাড়ির মালিক ওই দরজা খুলে পেছনে কি আছে দেখিয়েছিল। আর আমরা আসার পর ওদিকে দুবার মতো গেছিলাম। তোকে বলেছিলাম না আগে বাগান মতো ছিল... এখন পুরো ঝোপঝার আর একটা কুয়ো। আর পুরো পেছনটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। ঐদিক দিয়েই ইঁদুর গুলো ঢুকে আসে ভেবে ওই দরজা বন্ধ করে দরজার নিচে কাপড় দিয়ে টাইট করে গুঁজে দিয়েছি । তবে ওই পেছনের অংশতে গেলে ওই পাশের যে ঘরটা আছে ওটা দেখাও যায়। একটা জানলা তাও আবার ভেজানো। খুলে দেখেওছিলাম.... ওই ভাঙা চেয়ার টেবিল আলনা অনেক কাঠ আরও কয়েকটা জিনিস ছাড়া কিস্সু নেই।
- ওগুলোই কি রাতে আপনাআপনি নড়াচড়া করে নাকি গো?
দাদা মুচকি হেসে বললো - কে জানে ভাই.....তবে ওই আওয়াজ আর কিন্তু পাইনি জানিস... জানিনা আবার কোনোদিন পেতেও পারি। আমার কি মনে হয় জানিস..... কেউ যেন চাইছেনা আমরা এখানে থাকি..... অথবা এমনও হতে পারে কিছু হয়তো বলতে চাইছে কিন্তু পারছেনা.....
আমি ভুরু কুঁচকে দাদাকে জিগ্যেস করেছিলাম - তাহলে কি তুমি ধরেই নিচ্ছ এটা প্যারানরমাল কিছু? এমনও তো হতে পারে পুরোটা আমাদের একটা ভুল ধারণা..... মানে এমনই কিছু পরিস্থিতির সামনে পরে গেছো যে পুরোটা মিলেমিশে জগাখিচুড়ি কেস হয়ে গেছে... হতেও তো পারে?
দাদাও চিন্তিত মুখে ভেবে বললেন - আমি তো সেটাই ভাবি.. সেটাই ভাবতে চাই... কারণ ওসব ভেবে তো আর এখন পট করে এ বাড়ি ছাড়তেও পারবোনা... আর বাড়ি তো আর বাজারে কিলো দরে বিক্রি হয়না যে আরেকটাতে গিয়ে ঢুকবো। সত্যিই.... আজ ভাবি যদি সেদিন প্রোমোটারের ওই ভাঙা বাড়িতেই গিয়ে উঠতাম ভালো হতো..... আবার এটাও ভাবি.... সে বাড়িতে গিয়ে যদি এর থেকেও বাড়াবাড়ি হতো? এমন একটা গোছানো বাড়িতেই এমন কান্ড... তাহলে ভাব ওই বাড়িতে কিছু থাকলে সে কি খেল দেখাতো?
দাদা কথাটা হাসির ছলে বললেও আমি বুঝেছিলাম দাদা নিজেকে হালকা করার চেষ্টা অনবরত করে চলেছে। আমি নিজেই একটু আগে দাদাকে বলেছিলাম পুরোটা হয়তো কয়েনসিডেন্স... কিন্তু এতবার এতগুলো ভুল ধারণা কিকরে হতে পারে সেটা আমি নিজেই গুছিয়ে উঠতে পারিনি আজও... আর তাছাড়া আমার নিজের সাথেও যেটা হয়েছিল ওই বারান্দায় একা থাকাকালীন... সেটাও কি তবে আমার ভুল ধারণা? এরপর আমি একটু পরেই বেরিয়ে পড়েছিলাম ওই বাড়ি থেকে। শুধু আসার আগে দাদাকে বলেছিলাম একটি হনুমানজির ফটো কিনে এনে তাদের ঘরে রাখতে। তাতে কোনো ফল হোক বা নাই হোক অন্তত মনের একটা জোর একটু হলেও বাড়বে। আমি যখন বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে দাদার সাথেই বাইরে এসে এই হনুমান জির ছবির কথাটা বলছিলাম ঠিক তার পরেই দাদা বলেছিল ওপাশের বাড়ির পাঁচিলে তাকাতে... আমি তাকিয়ে দেখি একটা তাগড়াই হুলো বেড়াল... গায়ে সাদা কালো ছপ আয়েস করে বসে গা চাটছে। সেটা দেখে দাদার দিকে প্রশ্নসূচক চাহুনিতে তাকাতেই দাদা হেসে বলেছিল ওটাই নাকি সেই বেড়ালটা। এরপর আমি বিদায় নিয়ে চলে আসি।
এই কাহিনীর সমাপ্তি আমার আজও জানা নেই... কারণ ইহা আজও বর্তমান... বা বলা উচিত চলমান। যদিও আগের থেকে ওসবের পরিমান অনেক হ্রাস পেয়েছে কিন্তু থেমে পুরোপুরি যায়নি। ওই ভুল ধারণা গুলো আজও ওই বাড়ির প্রত্যেককে নিজেদের ভুল ধরিয়ে দিতে যেন মরিয়া... ভ্রান্তি আর বাস্তবের লড়াই আজও হয়ে চলেছে ওই বাড়িতে। হয়তো সে আগের মতো আর ভয় দেখাচ্ছে না... হয়তো সেও মেনে নিয়েছে দাদার পরিবারকে.... কি জানি? পুরোটাই কি একটা ভুল? নাকি এই ধরণের ব্যাপার নিয়ে সাধারণত যেটা আমরা ভেবে থাকি সেটাই ঠিক? উত্তর আমার জানা নেই।
||সমাপ্ত||
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
গল্প - ভয় ২
লেখক ও প্রচ্ছদ - বাবান
মানব জীবনকে নানান সব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে পার করতে হয় প্রতিটা দিন। কোনোটা গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা আবার কোনোটা হয়তো না চাইতেও কর্তব্য পালনের উদ্দেশে দিতেই হয় পরীক্ষা গৃহে গিয়ে। সে কক্ষ বিলাসবহুল হোক, বা ছোট্ট কামরা। যাইহোক এসব ফিলোসফিকাল জ্ঞানের কথা বলে আমি বেশি সময় নস্ট করবোনা। তার চেয়ে আসল ঘটনায় আসি। আসলে উপরের ওই কথা গুলি বলার কারণ হলো এই প্রতিদিনের কর্ম ব্যাস্ততায় ঘেরা চেনা জীবনেও হয়তো মাঝে মাঝে এমন কিছু দিনের সাক্ষী হতে হয় মানুষকে যা হয়তো সত্যিই অস্বাভাবিক, অবর্ণনীয়। যার সাক্ষী কেউ হয়তো হতে চায়না কিন্তু সেই অন্ধকার ঠিক নিজের রাস্তা খুঁজে নিয়ে ঢুকে পড়বে ঘরে..... আর তারপর.....!!
ঘুমটা হটাৎই ভেঙে গেছিলো সেদিন রাতে। এমন হওয়াটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়। এর আগেও আমার সাথে এমন হয়েছে। উঠে বসলাম বিছানায়। পাশের টেবিলে রাখা ঘড়িটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলাম রাত আড়াইটে। একবার ওপাশ ফিরে তাকালাম। বাবা ছেলে দুজনেই একেবারে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আস্তে করে উঠে ঘড়িটা আবার টেবিলে রেখে আমার পাশবালিশটা ছেলের পাশে দিলাম। উনি আবার ঘুমের মধ্যে মাঝে মধ্যেই গড়াগড়ি খান। একবার তো সকালে একা ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় বিছানা থেকে পড়েই যাচ্ছিলো সে। ঐটুকু বয়স ওর। পড়ে গেলে খুবই লাগতো। সেই থেকে নজর রাখি আমি। যাইহোক উঠে আরমোড়া ভেঙে এগিয়ে গেলাম বাথরুমের দিকে। আমাদের বাড়ি একতলা। কিন্তু বেশ বড়ো। আসলে পুরানো দিনের বাড়ি বলেই প্রতিটা ঘর বড়ো। এমনকি বাথরুমটাও বিশাল। শুধু সমস্যা একটাই....... ঘরের সঙ্গে সরাসরি যোগ নেই। তাই সোজা ভাষায় বাথরুম না বলে কলঘর বলাই উচিত হবে হয়তো। ঘরের দরজা খুলে বাইরে গিয়ে সেই কলঘরে যেতে হয়। যদিও পুরো জায়গাটাই উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। আর ওপর দিয়েও চাল করা আছে। তাই চোর ঢোকার কোনো ভয় টয় নেই।
মিথ্যে বলবোনা.... এতো রকম প্রটেকশন থাকা সত্ত্বেও শুরুর দিকে রাতে একা একা টয়লেটে যেতে একটু কেমন যেন লাগতো। কয়েকবার তো ওকে জোর করে তুলে নিয়ে গেছি। কিন্তু ধীরে ধীরে সেসব ভয় গায়েব হয়ে যায়। এখন তো কোনো ব্যাপারই নয়। তাই সেদিনও কোনো কিছু না ভেবে আমি সোজা গিয়ে দরজা খুলে কলঘরের দিকে চলে যাই। নিজের কাজ সারতে যাবার জন্য এগিয়ে যাচ্ছি এমন সময় যেন অদ্ভুত একরকমের আওয়াজ শুনতে পেলাম। একটু অন্যরকম আওয়াজ। কেউ বমি করলে যেমন তার মুখ থেকে ওয়াক ওয়াক জাতীয় আওয়াজ বেরিয়ে আসে অনেকটা তেমনি। একবার যেন কেউ চিল্লিয়ে কিছু বলার মতোও হালকা আওয়াজ পেলাম, কাউকে ডাকছে যেন,তারপরে আবার সেই বমির মতো আওয়াজ। কিন্তু শুধুই যেন ঠিক বমির আওয়াজ নয়। যেন কাশির আওয়াজও পেলাম যেন। যদিও দূর থেকে আসছে তাই হয়তো ভুলই শুনছি ভাবলাম। সত্যিই হয়তো কেউ বমি করছে বা চেষ্টা করছে কোনো বাড়িতে। কারো শরীর খারাপ হয়তো। কিছু পরে আর কিছু শুনতে পেলাম না। আমি আর কিছু না ভেবে নিজের কাজে চলে গেলাম।এমনিতেই এমন রাতে পুরো পাড়া স্তব্ধ ছিল। সেই শান্তি সাময়িক ভঙ্গ করে ওই আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছিলো, এখন আবার সব শান্ত। ঝিঁঝিঁর ডাক স্পষ্ট কানে আসছে। পাড়ার ভেতর বাড়ি বলে সেইভাবে গাড়ি ঘোরার শব্দ দূষণের ঝামেলা নেই। নয়তো মেন রোডের ওপর হলে দিন রাত নির্বিশেষে প্যা পু করে কান ঝালাপালা করে দিতো যেমনটা আমার বাপের বাড়িতে শুনে বড়ো হয়েছি। আমি আমার কাজ সেরে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলাম। দড়িতে টাঙানো গামছায় হাত মুচ্ছি এমন সময় হটাৎ কেন জানি শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠলো! কেন জানিনা! কিন্তু কেমন যেন কেঁপে উঠলাম আমি। ঘাড়ের পেছনটায় কেমন শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। কিন্তু এমন হবার কারণ কি? আজ এতদিন ধরে এই বাথরুমে রাতে আসছি, এমন কি এর থেকেও বেশি রাতে আমি একা এসেছি কলঘরে। কই? কোনোদিন তো এমন হয়নি। হ্যা শুরুতে এমন হতো ঠিকই।
এদিকে দরজার সামনে আলো জ্বলছে তাতে পুরো উঠোনের জায়গাটা আলোকিত। কিন্তু তাও আজ এই এতদিন পর কেন হটাৎ আমার এমন অনুভব হচ্ছে? জানিনা। কিন্তু এই মুহূর্তে অনুভব করলাম আমার এই অজানা ভয় যেন তিনগুন বেড়ে গেলো হটাৎ করেই। যেন কিছু একটা কারণে আমার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে হটাৎ। গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠা যাকে বলে সেই ভয়। যেন এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক নয়। আমি.... যে কিনা এই বাড়িতে এতোদিন রয়েছি সেই আমি টয়লেটের দরজা লাগিয়ে আলো নিভিয়ে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে দরজার দিকে এগোতে লাগলাম। আর ঠিক তখনি দরজার পাশে ঝুলন্ত বাল্বটা কেঁপে উঠলো। একবার, দুবার, তিনবার। ব্যাস আর আমি সেখানে চতুর্থ বার কম্পন দেখার জন্য অপেক্ষা করিনি। জীবনে প্রথম বার নিজের বাড়িতে দৌড়ে ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি দেবার কথা ভুলে ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম। এতটাই ভয় হচ্ছিলো আমার! আর বেডরুমে ঢুকে ছেলের পাশে শুয়ে পড়েছিলাম। ওদিকে বর ছেলে দুজনেই আগের মতোই ঘুমিয়ে। কিন্তু আমি যেন ঘুমোতে পারছিনা। চুপচাপ শুয়ে রয়েছি। কি হলো হটাৎ করে? কেন অমন ভয় পেয়ে গেলাম আমি? কিসেরই বা ভয়? এই আমি যে কিনা কলেজে পড়ার সময় বাপের বাড়িতে রাতে জেদ করে ছাদে গরমের সময় শুতাম। যদিও একা নয় বাবার সাথেই, তাছাড়া একা একা ফাঁকা জঙ্গলের রাস্তা ধরে শর্টকাটে কলেজ থেকে ফিরতাম, এমন কি কোচিং থেকে ফেরার সময় একটা শর্ট অন্ধকার গলি ধরে ফিরতাম, জোজো হবার পর কত রাত ওকে বার বার ওই কলঘরে নিয়ে যাওয়া আসা করেছি..... সেই আমি কিনা নিজের ঘরেই ঘাবড়ে গেলাম? আর এমন ভাবে পালিয়ে এলাম?
নিজের এমন একটা কাণ্ডে নিজের ওপরেই রাগ হলো ভীষণ। উঠে পড়লাম আবারো। কয়েক সেকেন্ড থেমে নিজেকে তৈরী করে আবারো এগিয়ে গেলাম আমার চেনা কলঘরের দিকে। যত এগোচ্ছে আমার পাদুটো ততই সাহসের সাথে মিশে যাচ্ছে ভয় আবারো। ওই যে রান্না ঘরের দিকটায় হালকা আলো দেখা যাচ্ছে। আচ্ছা? আমি দরজা ভিজিয়ে ছিলাম না? তাহলে আলো আসছে কিকরে? তারপরে মনে পড়লো আমি তো ছিটকিনিই দিইনি। হাওয়ায় খুলে গেছে। আবারো দাঁড়িয়ে পড়লাম। আগে হাত বাড়িয়ে ডাইনিং রুমের আলো জ্বালালাম। চোখের সামনে থেকে অন্ধকার কেটে যেতেই সাহস অনেকটা বেড়ে গেলো। আবারো এগিয়ে গিয়ে রান্নাঘরের আলো জ্বালালাম। তারপরে ওই খোলা দরজার কাছে গিয়ে বাইরেটা দেখলাম। হ্যা..... এখনো আলোটা কাঁপছে। এখন যেন আরও বেশি বেশি করে কাঁপছে। আশ্চর্য! এই রাতে ঘুমাতে যাবার আগেও ওটা একদম ঠিক ছিল। হলোটা কি হটাৎ করে? তারপরে ভাবলাম এইসব আলো ও এমন হটাৎ করেই যায়। আমি সুইচ টিপে ওটা নিভিয়ে দিলাম। ঘন অন্ধকার এসে জড়ো হলো কলঘরে। আমি ইচ্ছে করেই ওখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। দু পা এগিয়ে গেলাম। এই ভয়টা কিছুতেই চেপে বসতে দেওয়া যাবেনা। আমি কোনো ছোট বাচ্চা মেয়ে নই যে এমন সিলি একটা ব্যাপারে ভয় পাবো। আমি আজ নিজেই একজন মা। আমার ভয় পাওয়া মানায়না। যদিও এতো সাহসের কথা ভাবতে পারছিলাম কারণ পেছনে রান্নাঘরের আলোটা এসে কিছুটা সামনে পড়ছিলো। নয়তো এই এতো সাহসী কথা মাথাতে আসতো কিনা সন্দেহ। তবু অনেকটা ভয় কমেছে বুঝলাম। পুরোটাই একটা ফালতু ম্যাটার ছিল। এই ঠান্ডায় শীতল বাতাস ভেজা হাতে গায়ে লাগতেই ওই শিহরণ অনুভব। আর আমি কিনা আবোলতাবোল ভেবে...... যত্তসব!
ফিরে এসে দরজা এবার ভালো করে লাগিয়ে সব লাইট নিভিয়ে আবার ওদের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেকটা রিলিফ লাগছিলো। কিন্তু আমি তো জানতাম না যে ওই সামান্য ভয়ের থেকেও বেশি কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য!
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
খবরটা যখন পরেরদিন পেয়েছিলাম.... সত্যি বলছি প্রথমে হা করে সুপ্রিয়া বৌদির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিলো না পল্লবী আর নেই! এই তো কয়েক মাস আগেই কথা হয়েছিল আমার সাথে রাস্তায়। আমার জোজোকে আদর করে গাল টিপে দিয়েছিলো, কোলে নিয়েছিল। অবাঙালি হলেও বেশ ভালোই বাংলা জানে সে। যদিও হিন্দির টান থাকতো কথায়। এমনকি এই পরশু সকালেও যখন ছেলেকে নিয়ে ছাদে গেছিলাম তখন দেখা পেয়েছিলাম ওর। দূর থেকে যতদূর বুঝে ছিলাম ফোনে কারোর সাথে উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলো হয়তো। একবার এদিকে তাকিয়ে আমাদের দেখে ছিল। তারপরে আবার ছাদের অন্য প্রান্তে চলে গেছিলো। আজ কিনা সে আর নেই! এমন একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো এক রাতের মধ্যে! অরিন্দম অর্থাৎ আমার স্বামী খবরটা পেয়ে ওদের বাড়ির কাছে গেছিলো সকালে কাজে বেরোনোর সময়। আমরা কয়েকজন আমার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন। ফিরে এসে ও জানায় খুব কান্নাকাটি চলছে। আমার না যাওয়াই ভালো। এই বলে সে বেরিয়ে যায় কাজে। আমিও আর যাইনি ওদিকে। এইটুকু ছেলেটাকে সাথে নিয়ে ওসব জায়গায় না যাওয়াই ভালো। আর নিজেও একা যেতে কেমন যেন ইচ্ছে করছিলো না। সুপ্রিয়া বৌদি আর তানিয়া বৌদির সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন কথা বলে ফিরে এলাম নিজের ঘরে। একরাশ মিশ্রিত অনুভূতি নিয়ে। আমার তার সাথে সেইভাবে ভাব বা বন্ধুত্ব কিছুই কোনোদিন ছিলোনা, ঠিকমতো চেনাও হয়নি তাকে। কিন্তু যে মানুষটা একবার আমার ছেলেটাকে কোলে নিয়ে আদর করেছিল, আমার সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করেছে...... সে কাল রাতে নিজেকে শেষ করে দিলো ঐভাবে!
কাল রাত!! তাহলে কি আমি......... ওই যে আওয়াজটা পেয়েছিলাম.... ওটা কি কোনোভাবে তাহলে !!
এই দিনের আলোতেও ছ্যাত করে উঠলো আমার গা টা। পল্লবীদের বাড়ি আমাদের বাড়ি থেকে খুব একটা কাছে না হলেও দূরেও নয়। আমাদের ছাদ থেকে সহজেই ওদের বাড়ির তিনতলা বাড়িটার ছাদ দেখা যায়। অনেকবার ছাদে কাপড় দিতে গিয়ে দেখেছি মেয়েটাকে ওর বোনের সাথে ছাদে। দুই বোনে বয়সের বেশ তফাৎ। ছোটটা আজও বাবা মায়ের সাথে ঘুমায়। পল্লবী মেয়েটা বেশ তো ছিল হাসিখুশি। কি হলো হটাৎ করে? তাহলে কি প্রেম ঘটিত কিছু? আমি কোনোদিন কিছু না দেখলেও পাশের বাড়ির তানিয়া বৌদি নাকি ওকে দেখেছে এক দুবার একটা ছেলের সাথে। তাহলে কি সেই ব্যাপার কেন্দ্র করেই এমন কান্ড ঘটালো? নাকি বাবা মায়ের ওপর কোনো রাগ? আমার কোনোদিনই ওর সাথে খুব একটা মেলামেশা হয়নি। যতবারই দেখা হয়েছে ওই কেমন আছো আর ভালো আছোতো এর ওপর দিয়েই গেছে। কিন্তু ও বাচ্চা খুব পছন্দ করতো সেটা বুঝতাম। কারণ আমাদের ওই অল্প পরিচয়ের মধ্যেই সে একবার আমার জোজোকে এমন ভাবে আদর করেছিল যেন কতদিনের চেনা। আমার কোল থেকে নিজের কোলে নিয়ে ওকে আর তারপরে কত কথা তার সাথে। আমিও বাঁধা দিইনি । বুঝতাম মেয়েটা বড্ড বাচ্চা ভালোবাসে। সেই মেয়েটা কিনা শেষপর্যন্ত!
উফফফফ যতবার ওই শেষ কথাটা মনে পড়ছে, ততবার কেমন কেঁপে উঠছি। এদিকে সারা বাড়িতে এখন আমি একা। শশুর শাশুড়ি গেছেন নিজের ছোট মেয়ের বাড়িতে কদিন হলো। কদিন কাটিয়ে ফিরবে। ওনারা থাকলে তাও একটা আলাদা জাঁকজমক থাকে। এখন সারাদিন আমায় একা থাকতে হচ্ছে আমার জোজোকে নিয়ে। কাল পর্যন্ত এই বিষয়টা নিয়ে আমাকে এক মুহূর্ত ভাবতে হয়নি কিন্তু রাতের ওই ভয় আর আজকের এই দুসংবাদ মিলে গিয়ে এই আজকের এই শ্রেয়াকে ভাবতে ও দুশ্চিন্তা করতে বাধ্য করছে।
প্রতিদিনের মতো আজকেও একসময় দিন শেষে সন্ধে নামলো। আমিও এতো কিছুর মধ্যেই আমার প্রতিদিনের কাজ সেরেছি। মুন্নিদি এসে বাসন মেজে,ঘর ঝাড় দিয়ে গেছে। তার সাথেও কিছুক্ষন গল্প করে যেন কিছুটা শান্তি পেয়েছি। মুন্নিদি বহুদিন হলো এ বাড়িতে কাজ করে। তাই তাকে কাজের লোক ভাবাটা কবেই ভুলে গেছি। সে যতক্ষণ থাকে, বাড়িরই একজন হয়ে থাকে। শাশুড়ি মা ও আমরা একসাথে বসে চা খাই, টিভি দেখি তারপরে উনি চলে জান। অনেক সময় শাশুড়ি মায়ের পাড়ার এক বন্ধু সুজাতা কাকিমাও এসে আড্ডা দিয়ে জান আমাদের সাথে। এই কদিন আগে এসেও গল্প করে গেছেন আমাদের সাথে। আজ দুদিন হলো আমি আর মুন্নিদিই একসাথে গল্প করছি। ওনার সাথেও ওই বাড়ির দুর্ঘটনা নিয়ে কিছুক্ষন কথা বলি। যদিও নিজের সাথে ঘটা রাতের ব্যাপারে কাউকে কিচ্ছুটি বলিনি। ছেলের বাবাকেও নয়।বাড়ির কাজ সেরে কিছুক্ষন গল্প করে একসময় মুন্নিদিও চলে যায়। আবার আমি একা হয়ে যাই। একাকিত্ব কাটাতে কিছুক্ষন টিভিতে এদিক ওদিক দেখি। ছেলে তখনো ঘুমিয়ে আমাদের বেডরুমে।ওকে জাগাইনি। এইবার জাগাবো ভেবে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে যাবো ভাবছি হটাৎ রান্না ঘরে কিছু পড়ার শব্দ পেলাম। যেন কৌটো জাতীয় কিছু পড়লো। আমি উঠে গিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সত্যিই চাপাতার কৌটোটা পড়ে। হয়তো আমারই ভুল। অসাবধানে রেখে দিয়েছিলাম। ওটাকে তুলে যথাস্থানে রেখে দিলাম। তারপরে মনে পড়লো আমার শাড়িটা যে দুপুরে রোদে দিয়েছিলাম ছাদে, তোলা হয়নি। সেটা আনতে গেলাম আমাদের ছাদে। তখনও আলো কিছুটা আছে। যদিও অনেকটা কমে এসেছে। তাই আলো জ্বালার প্রয়োজন হলোনা। শাড়ীটা তুলে নিয়ে ফিরে আসবো.....কি মনে হতে একবার পশ্চিমের দিকে তাকালাম। ওদিকেই ওদের বাড়িটা। ঐযে দেখা যাচ্ছে। একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে বাড়িটায় কালকে রাতে। অন্ধকার আর শান্ত বাড়িটা দেখে আবার কেমন করে উঠলো আমার ভেতরটা। চোখ সরিয়ে নিলাম। তাড়াতাড়ি শাড়ীটা নিয়ে ছাদের দরজা বন্ধ করে ফিরে এলাম। এসে দেখি জোজো উঠে পড়েছে। চোখ ডলছে। ওকে কমপ্লান করে দিলাম। একটু পরেই জোজোর বাবা ফিরে এলো। আমারও একাকিত্ব সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে গেলো। বুঝলাম এটা সাময়িক একটা সমস্যা। আসলে এমন একটা খবর প্লাস রাতের ওই ভুলভাল ভয় মিলেমিশেই এই একটা অনুভূতির জাগরণ। এটা খুব শীঘ্রই কেটে যাবে। এই প্রথম কি আমি সারাদিন একা থেকেছি নাকি? জোজো যখন হয়নি তখনও তো একবার শশুর শাশুড়ি মেয়ের বাড়ি গেছিলো। সারা বাড়িতে একা কাটিয়েছিলাম এমনই। পাঁচ দিন। এক বিন্দুও ভয় লাগেনি।
-------------------------------------
রান্না ঘরে রান্না করছিলাম আর আমার মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। মায়ের শরীরটা কদিন একটু খারাপ যাচ্ছে। ঠান্ডা গরমের ফল আরকি। আমি আর ওর জামাই অরিন্দম অনেকবার বাবা মাকে বলেছি কটা দিন আমাদের এখানে এসে থেকে যেতে। শাশুড়ি মাও কতবার এসে থেকে যেতে বলেছেন। কিন্তু আসবো আসবো করেও ওদের আসা হলোনা। কিন্তু এবার ভাবলাম মাকে কদিন আমার কাছে এনে রাখবো। সেই নিয়েই কথা বলছিলাম মায়ের সাথে ভিডিও কলে। আমিই মাকে শিখিয়েছিলাম এসব চালানো। কি প্যাড চালাতে অভ্যস্ত মায়ের একটু সময় লাগলেও বেশ তাড়াতাড়ি শিখে ফেলেছিলো স্মার্টফোন চালানো। ওনার জামাই ভালোবেসে কিনে দিয়েছিলো মাকে একটা স্মার্ট ফোন। মাকেও জানালাম আজ যা ঘটেছে। সেও দুঃখ প্রকাশ করলো। সাথে যুব সমাজের এই ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকেই দু কথা শুনিয়ে দিলো। আমরা নাকি সত্যিই ভয়ানক চঞ্চল আর অদ্ভুত।কথা বলার মাঝেই মা মা হটাৎ বলে উঠলো -
- এই তিন্নি? তোর পেছনে কে রে? অরিন্দম?
তিন্নি আমার ডাক নাম। বাড়িতে আমায় বাবা মা এমনকি আমার বরটাও ওই নামেই ডাকে। মায়ের প্রশ্ন শুনে আমি তখনি পেছনে ফিরে তাকালাম। কই? কোথায় কে? পুরো গলিটা ফাঁকা। দূরের ডাইনিং রুমটা অন্ধকার। আর পাশের বেডরুমে আলো জ্বলছে। আমি আবার ফোনে মাকে বললাম - কই? কে মা? কেউ নেই তো?
- কিন্তু....... মনে হলো যে......
- কি?
- কেউ ছিল না তোর পেছনে?
- কোথায়? তুমিই দেখো? কোথায় কে?
- ওমা! তাইতো! ভুলভাল দেখছি নাকি? তিন্নি তোর বাবার মতো আমার চোখটাও গেলো মনেহয় বুঝলি..... পুরো মনে হলো তোর পেছনেই কেউ ছিল। তুই ওই কি একটা নিতে হাত বারালি না..... তখন তুই তো ফোনের ক্যামেরার বাইরে বেরিয়ে গেছিলি..... মনে হলো কেউ একজন তোর সঙ্গে সঙ্গেই তোর পেছনে সেও ক্যামেরার বাইরে চলে গেলো.....মানে সরে গেলো যেন।
মায়ের কথাটা শুনে কি ভেবে আবারো তাকালাম পেছনে। ছোট্ট রান্নাঘর। আর তার বাইরে ফাঁকা লম্বা গলি। আর রান্না ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ওই কলঘরের দরজা। সেটা এখন খোলা! আর আমি সেই দরজার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে গপ্পো করছি। এতক্ষন এটা নিয়ে ভাবিনি। কিন্তু এখন সেটা ভাবতেই আবারো কেমন করে উঠলো আমার ভেতরটা যেন । একবার রান্নাঘরের থেকে সরে এসে ওই খোলা দরজার বাইরে তাকালাম। বাল্বটা আজ আগের মতোই জ্বলছে। তাতে ভালো করে দেখে নিলাম পুরো জায়গাটা। ফাঁকা উঠোনের মতো খোলা জায়গাটা আর একধারে কলঘর। সেখানে কোনো আলো জ্বলছেনা তাই অন্ধকার। কিন্তু টয়লেটের দরজার নিচের ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ভেতরের দিকে চোখ পড়তে মনে হলো যেন কিছু নড়ে উঠলো। হালকা আলোছায়ার মাঝে স্পষ্ট মনে হলো একটা কিছু যেন টয়লেটে রয়েছে! কি ওটা? সত্যিই কি কিছু আছে নাকি চোখের ভুল? আমি ভ্রূকুটি নিয়ে হালকা ঝুঁকে নিচে আবার তাকালাম। না আর কিছু দেখলাম না। শুধুই অন্ধকার।
- কিরে? কি হলো? কোথায় গেলি?
কানে লাগানো ইয়ারফোনে মায়ের গলা পেয়ে ফোনটা আবার সামনে এনে ধরলাম। মা কি হয়েছে জিজ্ঞাস করায় বললাম কিছুই নয়। তারপরে আবার মায়ের সাথে অন্য বিষয় গল্প করতে লাগলাম। এর মধ্যেই জোজোর বাবাও এসে একবার কলঘরে গেছিলো। আমি মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে সেইদিকেই চেয়ে ছিলাম তখন। যেন একবার মনে হচ্ছিলো ও ঠিক আছে তো ওখানে? কেন এমন একটা খেয়াল এসেছিলো নিজেই জানিনা আমি। নিজের বাড়ির বাথরুমে গেছে মানুষটা, তাতে দুশ্চিন্তার কি আছে? হয়তো ওই একটু আগের ব্যাপারটার জন্য অমন মনে হচ্ছিলো। আমার সামনেই জোজোর বাবা বাথরুম করে বেরিয়ে এসে আবারো ঘরে চলে গেলো। যেন কিছুই হয়নি। আর সত্যিই তো! কি হবার কথা? কেন আমি একটা সাধারণ ব্যাপার নিয়ে এতো ভেবে ফেলছি?
রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে আমি ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছি আর ওর বাবা নিজের বাবা মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছে। শুনলাম ও পল্লবীর সাথে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছে ওদের সাথে। ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে আমিও উঠে লাইটটা নিভিয়ে নাইট ল্যাম্পটা জ্বেলে বারান্দায় অরিন্দমের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে বারান্দায় বসে সে চেয়ারে বসে কথা বলছে। বাইরের চাঁদের আলোয় জায়গাটাতে বেশ আলো আছে বলেই হয়তো আর আলো জ্বালায়নি ও। ওর কথা হলে গেলে আমিও শাশুড়ি মায়ের সাথে কথা বললাম কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে। ওরা জানালো দুদিন পরেই ফিরে আসছে। বুঝলাম দাদুভাইকে ছাড়া আর বয়স্ক দুজন থাকতে পারেনা। জোজোই এখন ওদের প্রাণ। মেয়ের কন্যাও ততোধিক প্রিয় কিন্তু সে তো অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। কিছুক্ষন কথা বলে ওই দুর্ঘটনা নিয়ে দুঃখপ্রকাশ করে শেষে শুভরাত্রি বলে কলটা কেটে দিলাম। ফোনটা ওকে দিয়ে শুতে আসার জন্য বলে আমি আবার বেরিয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময় ও বলে উঠলো -
- অমন উঁকি দিয়ে দেখছিলে কেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম - মানে? কিসের উঁকি?
অরিন্দম উঠে দাঁড়িয়ে আঙ্গুল মটাকাতে মটকাতে বললো - এই যে একটু আগে কথা বলার সময়। অমন লুকিয়ে তখন মুখ বাড়িয়ে দেখছিলে কেন? কি ভাবছিলে? আমি কি অন্য করো সাথে কথা বলছিলাম নাকি হুম? হেহে হেহে
মানুষটা বলে কি? আমি আবার কখন উঁকি মেরে ওকে দেখলাম। আর অমন করে দেখবোই বা কেন ? সেটা জানাতেই সে দৃঢ় কণ্ঠে বললো সে যখন সবে শশুর মশাইয়ের সাথে ওনার ওষুধ নিয়ে কথা বলছিলো তখন নাকি একবার। চোখ যায় ডান পাশে দূরের দরজার দিকে। হালকা আলোয় নাকি সে স্পষ্ট দেখেছে আমি উঁকি দিয়ে দেখছি ওকে। সে হাত নেড়ে ইশারায় জিজ্ঞেসও করে কি ব্যাপার? আমি নাকি কোনো জবাব না দিয়ে ওই একি ভাবে মাথাটা বাড়িয়ে ওর দিকে চেয়ে। ছিলাম। কিন্তু ওই সময় তো আমি....... আমি নিজের ঘরে জোজোকে ঘুম পাড়াচ্ছিলাম। হ্যা আমিও ওর কথা সব শুনতে পাচ্ছিলাম যে ও বাবাকে ঠিক সময় ওষুধ খেতে বলছে, তারপরে নিজের মাকে জানালো ওই পল্লবীর ব্যাপারটা কিন্তু তার আগে পর্যন্ত তো আমি ছেলের সাথেই ছিলাম।
আমার কথা শুনে ও অবাক হয়ে বললো - আমি যে দেখলাম তোমাকে? যাচ্চোলে! এতো বড়ো ভুল হলো আমার? তুমি ছিলেনা?
হটাৎ করেই আমার ভেতরটা আবার কেমন করে উঠলো। আমি ঘুরে তাকালাম আমার পেছনে। আমার ঘর পেরিয়ে ড্রইং রুম আর তার দক্ষিণ দিকে এই বারান্দা। এখন আমি ঠিক বারান্দা আর বসার ঘরের মাঝে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে। পেছনে পুরোটাই অন্ধকার। কারণ আমি নিজে একটু আগেই ঘরের আলো নিভিয়ে এসেছি। আর ঘরে আমার ছেলে ঘুমিয়ে। আমাকে পাশ কাটিয়ে অরিন্দম চলে গেলো ঘরের দিকে। আমিও ঘরে ঢুকে দরজা বারান্দার দরজা বন্ধ করতে গেলাম। স্বাভাবিক ভাবেই চোখ গেলো সামনের দিকে। এদিকটায় বেশ অনেকগুলো সুপারি গাছ আছে আর একটা পাঁচিল আছে। আমাদের বাড়িরই উঁচু পাঁচিল। অন্ধকারে যেন একবার মনে হলো! .......... নানা.......ওসব চোখের ভুল। কি যে হচ্ছে আমার সাথে ধুর! আমি দরজা লাগিয়ে ফিরে এলাম। অরিন্দম কলঘর থেকে ঘুরে আসতে আমিও শেষবারের মতো কাজ সেরে সব আলো নিভিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লাম। না..... একটুও কোনো ভয় পেলাম না এবারে। আশ্চর্য! তাহলে ওই মায়ের সাথে কথা বলার সময় কেন অমন হলো?
আমি শুয়ে পড়েছিলাম। অরিন্দম একটু কিছুক্ষন ফোনে খবর বা ইউটিউবে অ্যাকশন ফিল্মের ভিডিও দেখার নেশা ধরিয়েছে। আগে ওসব কিছুক্ষন দেখে সময় নস্ট করবে তারপরে ঘুমোবে। আজকেও তাই হলো। আমি ওকে তাড়াতাড়ি ওসব রেখে শুয়ে পড়তে বলে জোজোকে জড়িয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কখন যেন হালকা তন্দ্রায় ডুবেও গেছিলাম। হটাৎ বিছানাটা হালকা নড়ে ওঠার কম্পনে সেটা যেন কেটে গেলো। চোখ খুলে মাথাটা তুলে দেখি জোজোর বাবা কান থেকে হেডফোন খুলে স্থির হয়ে বসে। তারপরেই ও হটাৎ টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে ভুরু কুঁচকে ওপরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আমি ঘুমের ঘোরেই জড়ানো গলায় বললাম - কি হয়েছে? আবার আলো জ্বালালে কেন? ছেলেটা জেগে যাবে তো। নেভাও।
- একটা আওয়াজ পাচ্ছ?
ওর প্রশ্নে সামান্য অবাক হয়ে হয়তো উল্টে ওকে জিজ্ঞেস করতেই যাবো কিসের আওয়াজ তার আগেই কান পর্যন্ত পৌঁছে গেলো সেই ধ্বনি। হ্যা প্রাথমিক তন্দ্রার কারণে আমি নজর না দিলেও এবার সত্যিই শুনতে পাচ্ছি আওয়াজটা।
- কেউ কাঁদছেনা? অমনই না আওয়াজটা?
আমি ওর প্রশ্নে আমিও ভালো করে কিছুক্ষন শুনে ওর দিকে তাকিয়ে হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। কেউ যেন সত্যিই কাঁদছে। আর সে কান্নাটা যেন বড়ো বেদনাময়। আর সেটাই এতো রাতে ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ঠিক এর সাথেই সামান্য পরেই শুরু হলো কুকুরদের আউউউউউ জাতীয় আওয়াজটা। ও গুলো ঘেউ ঘেউ করছে না। বরং যেন ওদের ওই আওয়াজেও কিছু মিশে। আর এই দুই মিলে কি যে সাংঘাতিক এক মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলেছে সেটা ভালোই টের পাচ্ছি। আমাদের যে ঘরে আমরা শুই অর্থাৎ সেই বেডরুমের বাইরের দিকেই ওই সুপারি গাছ গুলো আছে। জানলা খুললেই ওগুলো দেখা যায়। আর তার পাশে একটা জামরুল গাছ। সেটা আমার শশুর মশাই নিজের যুবা বয়সে রোপন করেছিলেন। আর তার থেকে কয়েক পা এগোলেই অক্ষয় জেঠুর দোতলা বাড়ি। বাড়িতে বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা এই দুজনেই থাকে। আর এক তলায় থাকে ওদের এক কাজের মেয়ে। ওনাদের মেয়ের আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। আমার মনে হলো আওয়াজটা যেন ঠিক ওদিক থেকেই আসছে।
এরই মধ্যেই একটা কুকুর শুনলাম ঠিক আমাদের এই শোবার ঘরের বাইরে পাঁচিলের ওপাশের জায়গাটা দিয়েই অমন করুন সুরে আউউউউউ করতে করতে জায়গাটা ক্রস করলো। মিথ্যে বলবোনা এমন একটা পরিবেশে গা টা ছম ছম করে উঠলো একবার। ওদিকে কান্নার আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি দুজনেই। এতক্ষন একটানা কাঁদছিলো, এবার ফুপিয়ে কাঁদছে। আর ওটা যে কোনো মেয়ের গলা আর তাও কম বয়সী কেউ সেটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা।
- কে রে ভাই? এতো রাতে কাঁদে? আজব তো?
অরিন্দমের প্রশ্নে কোনো জবাব আমি দিলাম না। শুধু ইশারায় বললাম শুয়ে পড়তে। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ও কি বুঝলো জানিনা কিন্তু আর কিচ্ছু না বলে ফোনটা পাশের টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লো আলোটা নিভিয়ে। প্রায় অন্ধকার ঘর, বাইরেও রাতের অন্ধকার, সারা পাড়া নিঝুম। আর শান্ত পরিবেশ কে চঞ্চল করে তোলা ওই মিশ্রিত নারী পশুর কান্না। এ যে না শুনেছে সে বোধহয় অনুধাবন করতে পারবেনা কতটা অদ্ভুতুরে! চুপচাপ দুজন শুয়ে শুনে চলেছি ওই কান্না। হটাৎ করেই এর মাঝে আরও কিছু গলার শব্দ শুনতে পেলাম আমরা দুজন। খুব ক্ষীণ হলেও বুঝতে পারলাম কোনো বাড়ির থেকে কেউ বা কারা যেন কিছু বলাবলি করছে। মাঝে একবার 'কে রে?' বলে কেউ চিল্লিয়ে উঠলো, তারপরে 'এই হ্যাট হ্যাট ' জাতীয় কিছু শুনলাম। তখনো কিন্তু কান্না থামেনি বরং আর আরও বড়ো ব্যাপার হলো এবার সেই কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অর্থাৎ..... এবার সেই আওয়াজ এগিয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে!
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
- দিদি গো! কাল যে কি গেছে আমাদের ওপর দিয়ে আমরাই জানি উফফফফফ!.
সান্তার মুখে পুরোটা শুনে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই যেন করার ছিলোনা। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক পা এগোলেই একটা মুদির দোকান। কিছু একটা কম পড়লেই কিনে নিয়ে আসি ওখান থেকে। বেশ ভালোই চলে সেটি। আজ চা বানিয়ে দেখি বিস্কুট শেষ। যেকটা ছিল সবটা অরিন্দমকেই দিয়ে দিয়েছিলাম। একটু পরেই ও বেরিয়ে যায়। আমিও ঘরের গেটে তালা লাগিয়ে হাঁটা লাগাই। যেহেতু একদমই কাছে তাই চিন্তার কোনো ব্যাপারই নেই। জোজো বাবুও বাবাকে টাটা বাই বাই করে দিয়ে টিভির সামনে বসে পড়েছে। পড়াশুনা শুরু না হলেও এই বদ অভ্যাসটা আগেই রপ্ত করে ফেলেছে সে। না চালালে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলবে।
দোকানে পৌঁছেই দেখি কয়েক জনের সাথে দাঁড়িয়ে সান্তা। ওই অক্ষয় জ্যাঠার বাড়ির কাজের মেয়েটি। ওর মা এই বাড়িতে আগে কাজ করতো কিন্তু এখন সান্তাই সব করে আর এবাড়িতে থাকেও। এতে অনেকটা সুবিধাই হয়েছে ওনাদের। মোটামুটি ঘরের কাজ ও টুকটাক বাইরের বাজারের কাজ সান্তাই করে দেয়। পাশের বাড়ি বলে আমাদেরর সাথে পরিচয় হতে খুব একটা সময় লাগেনি। আমি গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াতেই আমাকে দেখে হেসে উঠলো সে। কিন্তু হাসিটা বড্ড নকল লাগলো আমার। যেন ভদ্রতার খাতিরে হাসলো সে। আমাকে ওর আগে গিয়ে দাঁড়াতে বললেও আমি বারণ করলাম। ও আগে এসে দাঁড়িয়েছে এখানে, কেন শুধু শুধু আমার জন্য নিজের জায়গা ছাড়বে ও? তাই ওর পেছনে দাঁড়িয়ে ওর সাথে সাধারণ বিষয় কথা বলতে লাগলাম যেমন ওর মা কেমন আছে, ওর ছোট বোনটা কি করছে এইসব। হটাৎই আমার মনে পড়ে গেলো আগের রাত্রের ব্যাপারটা। জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে কি হবেনা ভেবে শেষমেষ জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ওকে
- কাল। রাতে কি তোদের ওই বাড়ির দিকে কুকুর ডাকছিলো অনেকগুলো? আমি শুনছিলাম কেঁদেই চলেছে। তুই শুনেছিস?
আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বড়ো বড়ো চোখ করে সে বললো - কুকুর? শুধু কুকুর? কাল যা গেছে দিদি উফফফফফ! আমি তোমায় বলবো কিনা ভাবছিলাম। তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করলে যখন ভালোই হলো। দিদি কাল যে কি গেছে আমাদের ওপর দিয়ে উফফফফ তুমি কিছু শোনোনি?
- হ্যা ওই কুকুরের আওয়াজ পেয়েছি তো..... তাইতো জিজ্ঞেস করলাম
- আরে নিকুচি করেছে কুকুরের! ও তো হামেশাই চেল্লায় রাতে। আমি আসল আওয়াজের কথা বলছি। ওই জিনিসের আওয়াজ বুঝেছো? উফফফফফ এতদিন এ বাড়িতে রয়েছি দিদি এমন জিনিসের পাল্লায় পড়বো কোনোদিন ভাবিনি।
আমি বুঝলাম তাহলে ব্যাপারটা শুধুই আমরা নয়, এ বাড়ির মানুষও টের পেয়েছে। কাল রাতে যে ব্যাপারটা আমি ও আমার হাসবেন্ড ফিল করেছি তা এরাও হয়তো করেছে। এখানে আমি ফিরে যাবো কাল রাতের সেই বিশেষ মুহূর্তে। আমি ও অরিন্দম ততক্ষনে শুয়ে পড়লেও ঘুমটা আসেনি। বাইরের ওই কুকুরের করুন সুরে ডাক কানে আসছে। আর তার সাথে আসছে সেই কান্নার আওয়াজ। একে আগের রাতের ওই অদ্ভুত বমি জাতীয় আওয়াজ, সকালে ওই দুঃখজনক বাজে খবর, আবার এই রাতে এই কান্না! সব মিলে মিশে পুরো যাচ্ছেতাই অবস্থা। আর তারই মধ্যে শুনছি সেই কান্নার স্বর হালকা থেকে যেন জোর বাড়ছে। অর্থাৎ সে আওয়াজ অন্য দিক থেকে আরও এদিকে আসছে! তার মাঝেই শুনলাম কোনো বাড়ির মানুষদের আওয়াজ সাথে 'হ্যাট হ্যাট' জাতীয় শব্দ।
ওদিকে শুনছি এসব আর এদিকে ওই কান্না মিশ্রিত ফোঁপানি এবার অনেক কাছে চলে এসেছে। ঠিক যেন আমাদের জানলার বাইরে ওই সুপারি গাছ গুলোর কাছে। বালিশ আঁকড়ে শুয়ে আছি আমি। কোনো নরণ চরণ নেই। ঘরের দেয়াল ঘড়ির টিকটক আওয়াজ পর্যন্ত কানে আসছে।
- কি গো? এই? দেখবো নাকি একবার জানলাটা খুলে?
জোজোর বাবার মুখের ফিসফিস করে বলা এই কথা শুনে তখনি ইশারায় বারণ করলাম বা বলা চলে একপ্রকার আদেশ দিলাম কোনো মতে বিছানা ছেড়ে না উঠতে। নিজের বাড়িতে, নিজের ঘরে শুয়ে যেন উচ্চ কণ্ঠে কিছু বলার ক্ষমতা নেই, সাহস নেই আমাদের। যদি কেউ শুনে ফেলে? যদি জেনে যায় আমরা জেগে আছি! আমার কথামতো সেও চুপটি করে শুয়ে রইলো। ও ভীতু মানুষ নয়। এসব নিয়ে কোনোদিন ব্যাস্ত হতে বা ভয় পেতে দেখিনি আমি ওকে। ভুতের ফিল্ম চললে অনেকবার রাতে একা ওই বসার ঘরে বসে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে দেখেছে সে আর তারপরে একাই কলঘরে গিয়েছে। সেই আজ ওকে পর্যন্ত ভাবতে বাধ্য করলো এই ঘটনা। ততক্ষনে সে আওয়াজ আমাদের ঘর ক্রস করে আরও এগিয়ে গেছে। এখনো শুনতে পাচ্ছি কিন্তু আবারো ক্ষীণ হয়ে আসছে সেটি। বরং এখন কুকুর গুলোর ওই আওয়াজ বেশি কানে আসছে।
- কি হলো বলোতো ব্যাপারটা?
ওর প্রশ্নে কোনো উত্তর না দিয়ে উল্টে আমি ওকে প্রশ্ন করে বসলাম - তুমি কি সত্যি তখন আমাকে দেখেছিলে?
- কখন?
- ঐযে তখন বললে না আমি নাকি উঁকি দিচ্ছিলাম?
- ওহ হ্যা! না মানে মুখ তো বোঝা যাচ্ছিলো না..... তবে তুমি ছাড়া আর কে হবে আর? আমি তো ওই ভেবেই ইঙ্গিতে বললাম কি ব্যাপার? তুমি দেখি অমন করেই দাঁড়িয়ে। তারপরে সরে গেলে ওখান থেকে। আমি ভাবলাম ছেলের কাছে চলে গেলে। তারপরে তো দেখি ঢুকে এলে একটু পরে। শালা এতটা ভুল দেখলাম আমি? তুমি....... ছিলেনা? এমন চোখের ভুল হলো?
- আমার কেমন যেন লাগছে গো! কিছু যেন একটা খারাপ হচ্ছে! আমি কাল রাতেও টয়লেট করতে গেছিলাম তখনও কেমন ভয় লাগছিলো। আর আজ তো! এই! কি ব্যাপার হচ্ছে গো এসব!
- আরে ধুর! ভয় পাবার কিচ্ছু নেই। আমি আছি তো। আর তুমি যে ভয় পাচ্ছ ওসব নিয়ে বেশি ভেবোনা তো। মাথা থেকে ফালতু চিন্তা বার করে ঘুমাও। ও কে না কে পাগলী ফাগলী হবে যত্তসব! এই তো দুদিন আগেই আমাদের ওই ওই বাড়ির থেকে এগিয়ে অপোজিটে নতুন ফ্ল্যাটটার নিচে দেখলাম একটা পাগলী। আগেও এক দুবার মেন রোড এর দিকে ওকে দেখেছি। ওই ওটাই হবে। ওই কুত্তা গুলো নিশ্চই তাড়া করেছে তাই ওসব কান্নাকাটি..... কিংবা হয়তো কোনো বেড়ালও হতে পারে। জানোতো ওরা অনেক সময় এমন ভাবে কাঁদে যেন মনে হয় মানুষের বাচ্চা কাঁদছে.......ছাড়তো! কিস্সু না এসব! শান্ত মাথাকে কষ্ট দেওয়া খালি খালি। কিচ্ছু হয়নি। ঘুমাও তো। আমি আছি না! ঘুমাও তিন্নি।
ওর বলা কথাগুলোয় যেন কিছুটা সাহস ফিরে পেলাম। সাথে কেউ একজন সাহসী থাকলে আর তার সাহস দেখলে যেন নিজের ভেতরের ভয়টা কেটে যায়। আমাকে একটু চিন্তিত দেখে পরিস্থিতির মূল্য বুঝে আমাকে সাহস জোগাতেই হোক বা সত্যিই হোক..... ওর বলা কথাগুলোয় অনেকটা হালকা হয়ে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওকে আবারো সাবধান করেদিলাম ও যেন একটুও বাড়াবাড়ি না করে। অর্থাৎ আবারো আওয়াজ পেলে যেন উৎস খুঁজতে না যায়। রাতের মতো আর কোনো অসুবিধা হয়নি বা হয়ে থাকলেও আর আমরা কেউ টের পাইনি। সকালে আবারো
এইবার আবারো ফিরে আসি সকালের সময়ে। সান্তার মুখে সামান্য ঐটুকু শুনেই বুঝেছিলাম কাল রাতের ব্যাপারটাকে যতটা হালকা ভাবে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম...... হয়তো ততটাও সোজা নয় ব্যাপারটা। কিন্তু পরে পুরোটা যা শুনেছিলাম তা শুনে ওই দিনের বেলাতেও ওই পাঁচিলের পাশে গলিটা দিয়ে ফিরতে কেমন লাগছিলো।
- বৌদি এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলা যাবেনা। দাঁড়াও আগে জিনিস কটা কিনেনি তারপরে ফিরতে ফিরতে সব বলছি।
হাতে ওই বাজার নিয়ে ফিরতে ফিরতে সান্তা বলতে শুরু করলো - তুমি তো জানো আমি ওই এক তোলাতে পেছনের দিকে যে ঘরটা আছে.... ওই গো রান্নাঘরের উল্টোদিকে যেটা... ঐটায় ঘুমাই রাতে। দোতলা বাড়িতে তো এই আমরা তিনটে প্রাণী ছাড়া আর কেউই থাকেনা। রাতে ওই আমার..... মানে ওই ইয়ের সাথে আরকি..... ফোনে কথা বলে সবে শুয়েছি এমন সময় শুনি ওই রান্নাঘরের পেছনের দিক থেকে আউউউউউউউউ। প্রথমে একটা, তারপরে দুটো, তিনটে। আমি তখনো অতটা কিছু ভাবিনি। এ তো হয়েই থাকে। কিন্তু একটু ভালো করে কান দিতেই মনে হলো কুকুর গুলোর চেল্লানির পাশাপাশি আরও যেন কিছু একটা শোনা যাচ্ছে। অমন টেনে টেনে। ভালো করে শুনতে পাক্কা শিওর হলে ওটা কান্নার আওয়াজ! কেউ কাঁদছে! তাও আবার এতো রাতে, এই ঠান্ডায় বাইরে! আমাদের বাড়ির ওই রান্নাঘরের বাইরে!
- কি বলছিস!?
- হ্যাগো বৌদি! তুমি ভাবো একবার আমার অবস্থাটা। স্পষ্ট শুনছি বৌদি কেউ কাঁদছে! টেনে টেনে কাঁদছে। একেবারে ওই রান্নাঘরের বাইরে থেকে আসছে আওয়াজটা। আমি তো উঠেই ঘরেই লাইট জালতে যাবো এমন সময় একটা আওয়াজ পেলাম.... ওই গ্রিলে ধাক্কা লাগলে যেমন একটা আওয়াজ হয়না অমন পুরো। যেন কেউ আমাদের ওই বাইরের গ্রিলে সজোরে এসে ধাক্কা মারলো। ঢং করে আওয়াজটা হলো। গ্রিল কেঁপে উঠলো যেন। ওদিকে কুকুর গুলোর চেল্লানি চলছে। কিন্তু ওগুলোর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম রান্না ঘরের দিক থেকে আর গ্রিলের আওয়াজটা পেলাম আমি আমাদের ওই বারান্দার দিক থেকে। বৌদি কি বলবো তোমায় আমি ধরেই নিয়েছি এ চোর.... একদম শিওর! কিন্তু আমি একা তো কিছু করতে পারবোনা না। অন্তত যেটা আমার হাতে আছে সেটাই করি। চট করে উঠে আগে নিজের ঘরের আলো জ্বালালাল। তারপরে দৌড়ে বেরিয়ে রান্নাঘর, বাথরুমের, বসার ঘরের সব আলো জেলে দিলাম। কিন্তু বারান্দারটা পারলাম না। কারণ ওটা জ্বালাতে গেলেতো আমাকে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে তবে সুইচ টিপতে হবে। ও আমার দ্বারা তখন সম্ভব ছিলোনা বাবা! শুধু ইচ্ছে করে বন্ধ দরজায় দুম দুম করে ধাক্কা মেরে একবার কেশে উঠলাম। যাতে বাইরে চোর থাকলে কেটে পরে। তাই হলোও গো বৌদি। কিছুক্ষন অপেক্ষা করে শুনলাম না আর কোনো আওয়াজ নেই। চোর ব্যাটা কেটে পড়েছে। আমি আবার আলো নিভিয়ে ফিরে আসবো ভাবছি এমন সময়......!
- এমন সময়? কি... কি হলো? আবার আওয়াজ?
- হ্যা বৌদি! আবার ধাক্কা গ্রিলে! কিন্তু এবার আর নিচের তলায় নয়গো! আওয়াজটা পেলাম দোতলা থেকে! আর বেশ জোরেই হয়েছে আওয়াজটা। চোর কি কোনোভাবে ওপরে উঠে গেলো নাকি? আমার তখন আর ভাবার সময় নেই! ওই কান্না ফান্না সব ভুলে দিলাম ওপরে দৌড়। সিঁড়ি দিয়ে উঠছি আবার এলো কানে আওয়াজটা। কিন্তু চোর যদি হবে তবে সে এমন জোরে আওয়াজ করবে কেন? কিন্তু সেসব নিয়ে ভাবার সময় নেই তখন। সিঁড়ির আলোটা সারারাত জ্বলে। দাদুর তো হাই সুগার আছে। অনেকবার নামতে হয় তাই জ্বেলেই রাখে আলো। আমি দৌড়ে ওপর পৌঁছে বসার ঘরটা পার করে দাদুর ঘরের কাছে গিয়ে দরজায় ধাক্কাতে লাগলাম। একটু ধাক্কাতেই ওপাশ থেকে দুজনের আওয়াজ শুনতে পেলাম। তারপরেই দরজা খুলে দিলো দাদু। আমায় ঐভাবে দেখে কি হয়েছে জিজ্ঞেস করাতে সব বললাম। ঠাকুমা তো শুনেই ঘাবড়ে গেলো কিন্তু দাদু বললো কোথায় আওয়াজ চলতো দেখি? দাদুর সাহস দেখে আমারও একটু সাহস আসলো। আমি দাদুর সাথে ওদের ঘর থেকে বেরিয়ে সবে বেরিয়ে ওই বসার ঘরটায় এসেছি এমন সময় আবার ঢং! কেউ যেন সজোরে গ্রিলে কিছু দিয়ে ধাক্কা মারলো। এবার এই আওয়াজটা এলো দাদুর পাশের ঘর মানে রুমকি দিদিমনির ঘরের দিক থেকে । উনি তো শশুর বাড়িতে থাকেন। তাই ও ঘরে কেউ থাকেনা। ফাঁকাই থাকে।
আওয়াজটা পেতেই আমি আর ঠাকুমা তো আবার ঘাবড়ে গেছি। কিন্তু দাদু সাহস করে ঢুকলো মেয়ের ঘরে। আলো জেলে চারিদিক দেখলো। সব যেমন থাকার কথা তেমনি আছে। কোনো গন্ডগোল নেই। কিন্তু আওয়াজটা এদিক থেকেই এসেছে সেটা আমরা সবাই শিওর। দাদু অমনি এগিয়ে গেলো জানলার দিকে। ঠাকুমা দাদুর গেঞ্জি চেপে ধরে একবার বারণ করলো। কিন্তু দাদু উল্টে ওকেই বকে এগিয়ে গেলো জানলার দিকে। আমিও গেলাম এগিয়ে। যা হবে হোক। দাদুকে একা যেতে দেওয়া ঠিক না ভেবে আমি পাশে পাশে গেলাম। দাদু গিয়ে জানলা খুলে দিলো! কিন্তু কোথায় কি? কিস্সু নেই সামনে। ওই দূরে সুপারি গাছ গুলো দেখা যাচ্ছে আর নিচে চোখ দিতে দেখলাম ওই দু তিনটে কুকুর ওপরের দিকে তাকিয়েই লেজ নাড়ছে আর আউউউউউউ করে চেল্লাছে! কিন্তু আর কিছু নেই। আমি আর দাদু এপাশ ওপাশ তাকিয়ে দেখে নিলাম। না আর কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। কিন্তু আবারো শুনতে পেলাম ওই কান্না। কেউ একজন কাঁদছে সুর টেনে। এবারে আমরা তিনজনেই শুনেছিলাম ওই আওয়াজ। ঠাকুমা তো ভয় পেয়ে ওমা গো! এসব আবার কি শুরু হলো? কে কাঁদে এতো রাতে বলে ঠাকুরের নাম নিতে শুরু করলো কিন্তু দাদু ওতো ভীতু নয়। সে চেঁচিয়ে বলেই ফেললো -এই কে বাইরে? কে? কিন্তু কোনো কিছু দেখা যাচ্ছে না। আওয়াজটাও এবার দেখলাম কমে গেলো। যেন কেউ চলে গেলো। তখনো কুত্তা গুলো অমন করেই ডেকে চলেছে। দাদু ওগুলোকেও হ্যাট হ্যাট করে জানলা লাগিয়ে দিলো। তারপরে আমরা সবাই একবার নিচে নেমে পুরো ঘরটা ঘুরে দেখে নিলাম। দাদু তো বারান্দায় গিয়ে আলো জ্বালিয়ে বাইরেটা দেখলো। ততক্ষনে ওই কুকুর গুলোও কেটে পড়েছে। ঠাকুমা এতটাই ভয় পেয়ে গেছিলো যে ওই বাতের ব্যাথা নিয়ে পর্যন্ত ওপর নিচ করলো কিন্তু একা থাকলোনা। মিথ্যে বলবোনা বৌদি.... এতো কিছুর পরে আমারও আর সেই সাহস ছিলোনা। কাল রাতে বালিশ নিয়ে দোতলায় ওদের ঘরের নিচে শুয়েছিলাম। একা শোবার সাহস আর ছিলোনা।
পুরোটা শোনার পর বুঝলাম যে রাতের ওই 'হ্যাট হ্যাট' তাহলে অক্ষয় দাদুই করেছিল। তারমানে এতকিছু আগেই হয়ে গেছে যখন আমরা শুয়ে ছিলাম। কিন্তু ওই জানলায় ধাক্কার ব্যাপারটা কি? সেটা সান্তাকে জিজ্ঞেস করতে সে বলেছিলো -
- আমিও জানিনা বৌদি। উফফফফফ পুরো গ্রিল কেঁপে উঠছিলো এতো জোরে আওয়াজ হচ্ছিলো গো। কেউ যদি চুরি করতে আসেও সে অমন ঢং ঢং করে জোরে আওয়াজ করবে কেন? আর ওই কান্নাটা? বাপরে উফফফ। সাথে ওই আওয়াজ। কেউ হাত দিয়ে ঘুসি মারলে তবে অমন আওয়াজ হবে..... নয়তো ...
- নয়তো? নয়তো কি?
- কেউ যদি সজোরে নিজের মাথা গ্রিলে ঠোকে তবেই.....!
ধক করে উঠলো বুকটা ওর বলা কথাটা কল্পনা করে। কিন্তু কোনোমতে সেটা ওকে বুঝতে দিলাম না। চুপচাপ হাঁটতে লাগলাম ওর সাথে। কিছুটা হাঁটার পর যখন ওদের বাড়ির কাছে পৌঁছে গেছি তখন ও বললো - আমার কি মনে হয় বলোতো বৌদি?
- কি?
আড় চোখে দূরের ওই নির্দিষ্ট একটা দিক দেখিয়ে বললো - ঐযে! ও বাড়ি! যা কান্ড করলো! নিশ্চই কোনো গন্ডগোল ছিল.... নইলে অমন কাজ করবে কেন? ওরই প্রভাব। নইলে এতদিন এখানে আছি কিচ্ছু হয়নি। এখন তো সন্ধে নামলেই কেমন পাড়াটা শান্ত হয়ে যায় দেখেছো? যেন চারিদিকে নিস্তব্ধ। পরশুদিন ছাদে গেছিলাম একটু হাঁটতে। ওপর থেকে নিচে দেখছিলাম। সন্ধে ৭টার সময় সব শান্ত। কেউ নেই। যেন মাঝরাত। একটাও লোক দেখতে পেলাম না যতক্ষণ ছিলাম।আমিও বেশিক্ষন থাকিনি। চলে এসেছিলাম। আর কাল তো যা হলো! এ কদিন জ্বালাবে দেখো। যতদিন না সব কাজ টাজ হচ্ছে। তোমরা সামলে থেকো গো বৌদি। বাড়িতে ধুপ টুপ জ্বালিয়ে রাখো। দাদাকে বলো বেশি দেরী করে না ফিরতে। আর ছেলেটাকে সামলে রেখো। ছোট বাচ্চাদের ওপর শুনেছি নাকি....... যাই হোক গেলাম হ্যা।
ও চলে গেলো অক্ষয় জেঠুর বাড়ির দিকে। আর আমি এগিয়ে হয়ে ধরলাম ওই গলি। দ্রুত পায়ে হাটছি। তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ছেলেটা বাড়িতে একা।
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
দরজা খুলতেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকে এলো জোজোর বাবা। আমি তো অবাক। ঢোকার সময় একবার পিছনে ফিরে কি যেন দেখার চেষ্টা করছিলো সে তারপরে সামনে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করে কি যেন ভাবলো। ওকে অমন অবস্থায় দেখে আমিও ঘাবড়ে গেছিলাম। যদিও ওর মধ্যে বিশাল ভয়ের সেইভাবে কোনো ছাপ ছিলোনা কিন্তু ওকে দেখেই বুঝেছিলাম কিছু একটা হয়েছে নিশ্চই। ছেলেটার পাশে বসে পড়লো সে। আমি গ্লাসে করে জল এনে ধরতেই ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলো।
- কি? হয়েছে টা কি? এমন লাগছে কেন তোমায়?
আমার প্রশ্নে সেইভাবে জবাব না দিতে চাইলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ব্যার্থ অভিনয় করে নকল হাসি হেসে বললো - আরে কিছুনা। ও..... ও মনের ভুল আরকি ছাড়োতো। দাও চা দাও।
- চা পরে হবে! আগে বলোতো কি হয়েছে? কিছুতো একটা হয়েছে। অতবার বেল টিপলে। টিপেই যাচ্ছিলে। তারপরে দরজা খুলতে অমন ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়লে । উহু হয়েছে শিওর কিছু একটা। বলো আগে!
আমার প্রশ্নের চাপে শেষমেষ হার মেনে ও যা বললো তা হলো এই -
ওর আজকে কাজের চাপ বেশি ছিল তাই ফিরতে দেরী হয়েছে। যদিও সেটা ও আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো। এমন ওর লেগেই থাকে। কাজ শেষে বেরোতে সাড়ে সাতটা হয়ে গেছিলো। আজ আবার নাকি বেরিয়ে এসে একটাও যানবাহনের খোঁজ মেলেনি। অন্য সময় খুব সহজেই অটো পেয়ে যায়। আজ একটাও পায়নি। আর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করা মানে আরও সময় নষ্ট। তাই কিছুটা হেঁটে মেন রোড থেকে অটো ধরতে হয়। সেও আবার যতক্ষণ না আরও কাস্টমার আসে ততক্ষন দাঁড়িয়ে এসে আরও দুজনকে তুলে স্টার্ট দেয়। থানার কাছে এসে ভাড়া মিটিয়ে যখন সে বাড়ির রাস্তা ধরেছে তখন নাকি অক্ষয় জ্যাঠার সাথে দেখাও হয়েছিল। উনি তখন কি একটা কাজে যাচ্ছেন। ওনার সাথে দেখা হওয়ায় দুপক্ষই সামান্য হেসে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়েছে জান নিজ নিজ উদ্দেশে। কিন্তু আরেকটু এগিয়ে ওই xerox এর দোকানটা পার করে এগোনোর পর থেকে আর নাকি কারো দেখা পায়নি। মিষ্টির দোকানটাও নাকি আজ বন্ধ কি কারণে। সেখান থেকে দুটো রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। যে রাস্তাটা বাঁ দিকে বেঁকে গেছে সেটা ধরে কয়েক মিনিট এগিয়েই ডানদিকে একটা লম্বা গলি পড়ে। সেটা ধরে এগিয়ে কয়েকটা বাড়ি পেরিয়েই আমাদের বাড়ি। মিষ্টির দোকান পার করে রাস্তা ধরে কয়েক পা এগোতেই ও দেখে একজন মেয়ে ওপারে অর্থাৎ মিষ্টির দোকানের দিক থেকে হেঁটে আসছে। ওর থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে সে। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ও ওতো নজর দেয়নি কিন্তু কি মনে হতে আবার পেছনে ফিরে ওপারে তাকাতেই মনে হলো সেই মহিলাও যেন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল যেই ও ওনার দিকে তাকিয়েছে সেও অমনি মুখ নামিয়ে হাঁটতে লাগলো। পরনে তার বাড়িতে পড়ার নাইটি। কিন্তু মুখটা দেখা যাচ্ছেনা কারণ সে মুখ নামিয়ে হাঁটছে। ও আবার এগোতে শুরু করলো। আশ্চর্য যে রাস্তায় আগে এই সময় বেশ কয়েকজনকে দেখা যেত আজ যেন কেউ নেই। পুরো ফাঁকা রাস্তা। যেন সবাই যে যার বাড়িতে ঢুকে বসে আছে। শুধু কোনো কোনো বাড়ির ভেতর থেকে কারো কথা বা টিভির আওয়াজ ভেসে আসছে কানে। আরও কিছুটা এগোনোর পর কি মনে হতে ও আবারো ওই রাস্তার উল্টোদিকে তাকায়। কিন্তু সেখানে আর মেয়েটি নেই দেখে আবার সামনে ফিরতে যাবে এমন সময় তার চোখ স্বাভাবিক ভাবেই গিয়ে পড়ে নিজের একেবারে পেছনে আর তখনি চমকে ওঠে সে। মেয়েটি এবার এপারে! একেবারে তার পেছনে! হাত বাড়ালেই হয়তো ছুঁয়ে ফেলবে ওকে! আর সবচেয়ে আজব ব্যাপার তখনো সে মাথা নামিয়েই হাঁটছে। যেন নিচে কিছু খুঁজছে।
আশ্চর্য! কখন এলো মেয়েটা এপারে? আর চলেও যদি আসে এতটা কাছে এগিয়ে এলো অথচ কোনো আওয়াজ পেলোনা ও? নিজের জুতোর মচমচ আর শুকনো পাতা মারানোর আওয়াজ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো অথচ পেছনে থাকা মানুষটার পায়ের কোনো শব্দই কানে আসছেনা ওর। অজান্তেই এবার ওর কেমন জানি একটা হতে শুরু করছিলো ওর ভেতর। অরিন্দম মোটেই ভীতু মানুষ নয়। সহজে সে ঘাবড়ে যায়না। কিন্তু আজ এই সামান্য একটা ব্যাপারেও কেমন যেন বুকটা কেঁপে উঠলো ওর। যেন কিছু একটা ঠিক হচ্ছেনা বা বলা উচিত কিছু একটা খারাপ হবে এখুনি ওর সাথে এমন ভয় পেয়ে বসছে ওর মধ্যে। ও তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করে। আর একটু দূরে এগোলেই আমাদের বাড়ি। কিন্তু যেন মনে হচ্ছে পথ শেষই হচ্ছেনা। স্পষ্ট দূরে নিজের বাড়ি যাবার গলিটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে কিন্তু যতই হাঁটছে দূরত্ব যেন একই রয়ে যাচ্ছে! শেষে কোনোরকমে আরও দ্রুত হেঁটে আর একবারও পেছনে না তাকিয়ে ও গলি ধরে এগোতে শুরু করে আর পৌঁছে যায় নিজের গেটের কাছে। তারপরে সেই বেল বাজানো। কিন্তু কি অদ্ভুত ব্যাপার বাড়ির কাছে পৌঁছানোর পর আর দেখা পায়নি সে ওই মহিলার। কিন্তু সে কোনো বাড়িতে ঢোকেনি কারণ কোনো গেট খোলার বা দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকার আওয়াজ পেছন থেকে আসেনি। সে পেছনেই আসছিলো আর তাকে যেতে গেলে এই গলি পার করেই সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু আর কেউ নেই। তাই তখন অরিন্দম ঘরে ঢুকেও বাইরেটা দেখছিলো।
পুরোটা শুনে এবার আমিও বরের পাশে বসে পড়লাম। হচ্ছেটা কি এসব? রাতের ওই কান্ড। তাও আবার শুধু আমাদের সাথেই নয়, অক্ষয় জেঠুদের বাড়িতেও। তারপরে আবার আজ সন্ধেবেলায় যেটা হলো আমার সাথে ওটাও তো আজব ব্যাপার। আমাকে অমন বসে পড়তে দেখে জোজোর বাবাও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো যে আমার আবার কি হলো? তাতে আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম সকালে সান্তার মুখে শোনা পুরোটা ওকে বললাম। শুনে এবার ও ভ্রূকুটি করে কি যেন ভাবলো। এখন সময় জোজো বলে উঠলো 'জানো বাবা মা আমায় বকেছে আজ।' যদিও এমন স্পষ্ট ভাবে নয়। এখনো ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারেনা ও।
- ওমা সেকি কেন? কিগো? বকেছো কেন ছেলেকে?
আমি যদিও ওকে এই ব্যাপারটা বলতে চাইনি। কাজের থেকে ফিরেছে মানুষটা। তার ওপর আবার এমন আজব ব্যাপারের সাক্ষী হয়েছে। তাই এই সামান্য ব্যাপারটা বলে আরও চিন্তায় ফেলতে চাইনি। কিন্তু আমি নিজে তো জানি যে আমার কোনো ভুল হয়নি। শেষমেষ জোজোর বাবাকে জানাতেই হলো কেন বকেছি ছেলেকে ভুল করে। যদিও ওটাকে বকুনি বলেনা। সকালে ওই সান্তার মুখে ওসব শুনে এমনিতেই সব গুলিয়ে গেছিলো। কিন্তু সারাদিন কিন্তু কোনো ঝামেলা হয়নি। বেশ আরামে কেটেছে। স্নান, খাওয়া দাওয়া তারপরে দুপুরে একটু হালকা করে ঘুম। শশুর শাশুড়ি নেই তাই সেইভাবে আলাদা পরিশ্রমের কিছুই নেই। সন্ধে নাগাদ মুন্নিদি এলো প্রতিদিনের মতোই। আমাদের বেসিনটা ছোট তাই সে সব থালা বাসন একটা গামলায় নিয়ে কলঘরে গিয়ে ভালো করে পরিষ্কার করে। আজও ওগুলো নিয়ে সে চলে গেলো আর আমিও পুজো দেবার জন্য মায়ের অর্থাৎ শাশুড়ি মায়ের ঘরে গেলাম। আমাদের ঠাকুরঘর ওই ঘরেই। আমি প্রদীপ জ্বালিয়ে ধুপ জ্বালাতে যাচ্ছি এমন সময় মনে হলো পেছনে দরজায় আওয়াজ হলো। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি জোজো। ও দাঁড়িয়ে আমাকেই দেখছে। আমিও আবার মুখ ফিরিয়ে ধুপ জ্বালাতে জ্বালাতে বললাম 'আয় ভেতরে' কিন্তু ওর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার ঘুরে তাকিয়ে দেখি বাবু ততক্ষনে সরে পড়েছেন। তার নতুন কিনে দেওয়া ফুটবলের লাফানোর আওয়াজ পাচ্ছি। মানে সে খেলছে এখন আসবেনা। আমিও শঙ্খ বাজিয়ে প্রণাম করছি এমন সময় আবারো দরজায় টোকা। একবার, দুবার, তিনবার। এবারে একটু ভুরু কুঁচকে ওদিকে তাকাই। ভেবেছিলাম আমায় এভাবে দেখে জোজোর শয়তানি বন্ধ হবে। যদিও এমন ও করেনা। কিন্তু কই? কোথায় জোজো? আমি তো আমাদের ঘর থেকে ওই বলের লাফানোর আওয়াজ পাচ্ছি। তারমানে ও আমাদের ঘরে। এর মধ্যে ও দৌড়ে ওই ঘরে চলে গেলো? এতো বড়োও সে হয়নি। আমি নিজে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। তারপর ঘরের বাইরের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। এতক্ষন সেটা নেভানো ছিল, শুধু ভেতরের আলো জ্বলছিল। নিজের ঘরে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম হ্যা ঠিক। ছেলে আপন মনে খেলছে বল নিয়ে। আমি ওই একটু দৃঢ় কণ্ঠে জিজ্ঞেস করি ওকে যে সে কেন এমন দুস্টুমি করছিলো। ওটাকেই ও বকুনি ভেবেছে। জোজো একবার আমার দিকে তাকিয়ে আবারো নিজের ফুটবলে মনোযোগ দিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললো সে অমন কিছুই করেনি। আমি তাকিয়ে রইলাম ছেলের দিকে। বল হাতের থেকে বেরিয়ে দূরে চলে গেলে ওটা নিয়ে আসতেই যার একটু হলেও সময় লাগছে, সে কিকরে ওতো দ্রুত দরজায় টোকা দিয়ে পালিয়ে যাবে? নানা ও মনের ভুল। আমি তখনো হাতে ধুপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমাদের ঘরে কৃষ্ণ ঠাকুরের একটা ছবি আছে সেটাতে ধুপ দিয়ে বেরিয়ে এসে আবারো শাশুড়ি মায়ের ঘরে গিয়ে সব ঠাকুরকে ধুপ দিচ্ছি এমন সময় মুন্নিদি আসলো এ ঘরে। তাকে একটু কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে যেন। আমি কি হয়েছে জিজ্ঞাস করাতে সেই উল্টে আমায় জিজ্ঞেস করলো আমি একটু আগে কলঘরের দিকে গেছিলাম কিনা? আমি না বলতে সে অবাক হয়ে জানালো সে এতক্ষন বাসন মাজছিলো। হাঁটুমুড়ে একটা ছোট টেবিলে বসে সে একমনে নিজের কাজ করছিলো। বাইরের ওই বাল্ব আর ভেতরের একটা বাল্ব জ্বলছিল। কিন্তু তিনবার নাকি সেই লাইট কেঁপে ওঠে। একবার তো পুরো নিভে গিয়ে সামান্য পরে জ্বলে ওঠে। কারেন্টঅফ হতে পারে ভেবে মুন্নিদি একবার ভাবে যে আমায় ডাকবে কিন্তু আর ওসব কিছু না হতে দেখে সে আবার বসে কাজে মন দেয়। একটু পরে তার মনে হয় কেউ হেঁটে এসে ভেতরে ঢুকে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। মুন্নিদি ভাবে বোধহয় আমি এসেছি। কারণ এমন আমি কয়েকবার এসে কথা বলেছি কিংবা ছেলেকে হিসু করাতে নিয়ে এসেছি। আজও তাই ভেবেছিলো সে। কিন্তু আমি কিছুই বলছিনা বা করছিনা দেখে সে পেছন ফিরে তাকায় কিন্তু কাউকে দেখতে পায়না। অথচ সে স্পষ্ট শুনেছে দরজা দিয়ে বেরিয়ে কেউ হেঁটে ওই ছোট উঠোন পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলো আর পেছনে এসে সেই পায়ের আওয়াজ থামলো অথচ কেউ কোথাও নেই! ঠিক তখনি নাকি ঘরের ভেতর থেকে শঙ্খধ্বনি ভেসে আসে। তাই সে নিশ্চিত হতে উঠে এসেছিলো যে আমি গেছিলাম কিনা ওখানে কিন্তু আমি তো একটিবারের জন্যও ওদিক মারাইনি! আর ওই দরজায় তিনবার টোকা..... ওটাও কি তাহলে মনের ভুল ছিল? সব শুনে অরিন্দম কিছুই বল্লোনা। শুধু ভ্রূকুটি করে আবারো গ্লাসে চুমুক দিলো।
সেদিন রাতে আর কিছু আলোচনা করলাম না আমরা এসব নিয়ে। জোজোর বাবা নিজের বাবাকে যেমন ফোন করে তেমনি ফোন করে কথা বললো। যদিও এসব অদ্ভুত ব্যাপার নিয়ে কিছুই জানালো না তাদের। সেটা একদিকে ভালোই করেছে সে। শাশুড়ি মা আবার একটুতেই দুশ্চিন্তায় পড়ে জান। সামান্য ব্যাপারে দিশেহারা হয়ে পড়েন। তাই তাকে এসব না জানানোই ভালো। কিন্তু আমি পরের দিন নিজের মাকে ফোনে সবটাই জানাই। সবটা শুনে প্রথমে মা কিছুক্ষন চুপ করে রইলো, তারপরে বললেন - আচ্ছা আমি কাল একবার তারক জেঠুর সাথে কথা বলবো। দেখি উনি কি বলেন। তুই বেশি এসব ভাবিসনা। হয়তো ব্যাপারটা কিছুই নয়। পুজো ঠিক মতো দিয়ে যা মন প্রাণ দিয়ে। আর ধুপ প্রতি ঘরে দেখাবি। নিজের ঘর শুদ্ধ থাকলে কোনো খারাপ কিছু সহজে ক্ষতি করতে পারেনা। আর একদম এসব নিয়ে ভাববিনা, কিছুই নয়..... হয়তো অরিন্দম ঠিকই বলেছে....তুই বেশি ভেবে ফেলছিস। আমি দেখছি কথা বলছি হ্যা? একদম চিন্তা করবিনা।
আমিও আর বেশি কথা বাড়াইনি। কারণ আমি নিজেই যেন মানতে চাইছিনা এসব। ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত যতই ভুতের গল্প শুনিনা কেন বা হরর মুভি দেখিনা কেন বাস্তবে এমন কিছু যেন ব্রেন সহজে মেনে নিতে চায়না। কারণ সে এতদিন ধরে চলে আসা জীবনে হটাৎ করে পরিবর্তন মেনে নিতে পারেনা। তাই সবকিছু বৈজ্ঞানিক পথে পর্যবেক্ষণ করে তবে সিধান্ত নেয়। কুন এই কদিনে যা হলো সেটা তাহলে কি? আর সবচেয়ে বড়ো কথা এখনই কেন? পুরোটা শুরু হলো মেয়েটা চলে যাবার পর থেকে.... এটাও তো অদ্ভুত। তবে সবচেয়ে অদ্ভুতকথা হলো ব্যাপারটা যে সবসময় ঘটে চলেছে তাও নয়। যেমন কাল রাত্রে একটুও কোনো অসুবিধা হয়নি। একদম স্বাভাবিক ছিল সবকিছু। রাতে নাকি জোজোর বাবা একা উঠে বাথরুমেও গেছিলো। সে কিছুই অনুভব করেনি। সেটাই তো স্বাভাবিক। তাহলে তার আগে পর্যন্ত যেটা হল সেটাকে কি বলা যায়? আমিও আর এসব বেশি কিছু না ভেবে নিজের বাড়ির কাজে মন দিলাম। তাও ভালো শাশুড়ি মা এখন নেই। নইলে আবার সে আমার থেকেও বেশি ভাবতে শুরু করতো। কদিন মেয়ের বাড়িতে শান্তিতে কাটাক।
আজ পুরো দিন বেশ ভালো ভাবেই কাটলো। কোনো অস্বাভাবিক কিছুই আর হলোনা। আমি ছেলের সাথেই সময় কাটিয়ে দিলাম। বিকালে কিছুক্ষন ছাদে হাঁটাহাঁটিও করেছি। যদিও একবার মনে হয়েছিল সিঁড়িতে ধুপ ধুপ করে কিছুর আওয়াজ পেয়েছিলাম। তারপরে আর কিছুই শুনিনি। সন্ধে নাগাদ মুন্নিদি কাজে এসে সব কাজ মিটিয়ে কিছুক্ষন গল্প করে চলে গেলো। আজ আর কাজ করার সময় কিছুই মনে হয়নি তার। একসময় জোজোর বাবাও ফিরে আসলো। আজ আবার কিছু হয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করায় সে হেসে বলে না...আর কোনো কিছু দেখেনি রাস্তায়। আমি যদিও ওকে বলেছিলাম একটা ঠাকুরের ফুল আজ থেকে ব্যাগে রেখে দিতে। সেও আমার কথা মেনে নিয়েছিল। বেশি কথা বাড়ায়নি। কিন্তু আসল কথা হলো সব আগের মতো স্বাভাবিক চলছিল। আমার মাথা থেকেও যেন একটা সময় ওসব চিন্তা বেরিয়ে গিয়ে গেছিলো। হয়তো ভেতর থেকে এটাই ভাবতে চাইছিলাম সব ঠিক আছে।
রাত সাড়ে দশটা বাজে। আমরা সবাই বসার ঘরে বসে সূর্যবংশ দেখছিলাম। ফিল্মটা এতবার দেখা তাও যেন বার বার দেখতে ভালো লাগে। এখনো মনে আছে তখন ওই ক্ষীরের মধ্যে বিষ মেশানোর সিনটা চলছিল। আমি ওই সময় রান্না ঘরে গেছিলাম কি একটা কাজে। ঠিক এমন সময় গেলো কারেন্ট অফ হয়ে। আলোতে এতক্ষন থাকার পর হটাৎ করে অন্ধকার ঘিরে ধরলো। মাথাটা গেলো গরম হয়ে। ওখান থেকে জোজোর বাবাও চিল্লিয়ে উঠলো ধ্যাৎতারিকা বলে। তারপরেই শুনলাম সে চেঁচিয়ে আমায় জিজ্ঞেস করছে আমি কোথায় আছি। আমিও চেঁচিয়ে উত্তর দিলাম আমি রান্নাঘরে। সে আবারো জিজ্ঞেস করলো সে আসবে কিনা আমার কাছে। আমি বললাম কোনো দরকার নেই। সে যেন জোজোর কাছেই থাকে। ওকে ছেড়ে আসতে হবেনা। আমি মোমবাতি নিয়ে আসছি। এই বলে আমি দেয়াল ধরে ধরে বেরিয়ে আসতে লাগলাম। রান্না ঘরের খোলা জানলা দিয়ে হালকা আলো আসছিলো। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতেই কিছুটা হলেও দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের আগে দুটো এমার্জীন্সি লাইট ছিল কিন্তু দুটোই গেছে খারাপ হয়ে। কিনবো কিনবো করেও আর নতুন কেনা গোয়েন্দা ওঠেনি। তাছাড়া অনেকদিন লাইট অফ হয়েওনি। আমি বেরিয়ে এসে এগিয়ে যাচ্ছিলাম শাশুড়ি মায়ের ঘরের দিকে। ঠাকুর ঘরের পাশেই দুটো বড়ো মোমবাতি আছে। আমি আমার ফোনটাও আনিনি। নইলে ওটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়েই সহজে কাজ করে নিতাম। আমার মাথায় তখন একটাই ভাবনা যেন কোথাও ধাক্কা খেয়ে না যাই। আমি এইভাবে এগিয়ে সবে আমাদের সিঁড়ির কাছে পর্যন্ত পৌঁছেছি। হটাৎ কারোর সাথে যেন হালকা ধাক্কা লাগলো বাঁ হাতে। আমি তো রেগে গিয়ে বলেই ফেললাম - আরে বললাম তো আসতে হবেনা তোমায়! কথা শোনোনা কেন তুমি? কিন্তু ওপাশ থেকে দেখি কোনো উত্তর নেই। আমি আবারো জিজ্ঞাস করলাম - কি হলো কি? কিন্তু আবারো সব শান্ত। কি ভেবে আমি দুই হাত বাড়িয়ে এদিক ওদিক খুঁজলাম.....কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকলোনা। কিন্তু এই কয়েক মুহূর্ত আগেও তো আমার বাঁ হাতে আমি কিছুর ধাক্কা অনুভব করেছি। দুটো মানুষ খুব পাশাপাশি গেলে যেমন বাহু স্পর্শ হয়ে যায় ঠিক তেমনি। আজ! এতক্ষন পর! আবারো আমার ভেতরের সেই অনুভূতিটা ফিরে এলো। সারাদিনের স্বাভাবিকতা এবং টিভি দেখতে দেখতে এতটাই নরমাল হয়ে গেছিলাম যে এসব অনেক্ষন মাথাতেও আসেনি কিন্তু এই আবার ঘিরে ধরলো আমায়। অন্ধকারের থেকেও ঘন যে অনুভূতি... ভয়!
- কি গো? কি হলো? কিছু বললে?
আমার আওয়াজ হয়তো একটু জোরেই ছিল বলে জোজোর বাবা বলে উঠলো। কিন্তু সেই ডাক এলো দূরে বসার ঘর থেকে। তারমানে সে নিজের ঘরেই ছিল। কিন্তু আমি যে এক্ষুনি......! আমি হয়তো একাই চলে যেতে পারতাম বাকি পথ টুকু। কারণ শাশুড়ি মায়ের ঘরের জানলা আর দরজা খোলা আর সেখান থেকেও কিছুটা আলো এসে মেঝেতে পড়েছে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু এখন আর যেন সাহস নেই একা একা বাকি টুকু যাবার। রান্নাঘরের গলিটার দিকে যে ঘুরে তাকাবো সেটাও আর পারলাম না। শেষে ওকে ডাকতেই হলো আমায়। সেও দেখি ফোনের লাইট জ্বালিয়ে এগিয়ে এলো,সাথে ছেলেও। ওর সাথেই গেলাম শশুর শাশুড়ি মায়ের ঘরে আর ঠাকুরের আসনের পাশেই দেয়ালে টাঙানো দুটো নতুন মোমবাতি তুলে সেখানেই একটা জ্বালিয়ে ফিরে এলাম নিজেদের বেডরুমে। ছেলেকে জড়িয়ে আমি বসে রইলাম চুপ করে। নানান সব মিশ্র অনুভূতি। যেন নিজের সাথেই নিজের লড়াই চলছে ভেতরের। বিশ্বাসের সাথে অবিশ্বাস এর, যুক্তির সাথে সম্ভাবনার। সাথে হচ্ছে রাগ। নিজের আপন বাড়িতে কিনা আমি ভয় পাচ্ছি? এই বাড়িতে আজ এতগুলো দিন পার করে ফেললাম, ছেলে একটু করে বড়ো হচ্ছে আর এই সময় এসে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যেতে স্বামীকে ডাকতে হলো? ইচ্ছে করছে এক্ষুনি আবার এগিয়ে যাই রান্না ঘরের দিকে, গিয়ে দেখি কে আছে? তারপরে ভাবছি যদি সত্যিই কেউ থাকে? আমার শান্ত ভাব দেখে অরিন্দম একবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে? তারপরে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে নিজেই বললো - ভয় পেয়েছো? আমি যদিও ভেবেছিলাম এসব বলে আবার ওর মধ্যে দুশ্চিন্তা জাগরণ করার কি মানে? কিন্তু তারপরে কি ভেবে বলেই ফেললাম হযেটার সাক্ষী হয়েছি আমি। শুনে যদিও ও বললো ওসব কিছুই নয় কিন্তু তারপরে নিজেই বললো আমি ঘুরে দেখে আসছি একবার। আমি ওকে বাঁধা দিয়ে বললাম যে যেতে হবেনা কিন্তু ও হেসে বললো - আরে ধুর তুমিও না! এমনিতেও তো বাথরুমে যাবোই। যেতেই হবে ওদিকে। তুমি এসব ভাবা বন্ধ করো তো। যত ভুলভাল ভাববে ততই এসব ফিল করবে। তারপরে নিজেই উঠে আরেকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে উঠে চলে গেলো বাইরে। আমি দরজার বাইরে তাকিয়ে রইলাম। হলদে আলোটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেলো। আবারো বাইরেটা অন্ধকার। শুধুই ঘরের মোমবাতির আলোয় দরজার সামনে টুকু আলোকিত কিন্তু রান্নাঘরের ঐদিকটা পুরো অন্ধকার। কিন্তু আমার ছেলের বাবার এই সাহস যেন আমাকেও সাহস জুগিয়েছে মানুষটা কেমন একাই চলে গেলো ওই বাথরুমের দিকে। ভাবলাম ও ফিরলে এবার আমিও একা যাবো। ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে আমি উঠে গেলাম বাইরে। শুনতে পেলাম বাথরুমের দরজা বন্ধ করার শব্দ। কয়েক পা এগিয়ে শাশুড়ির ঘরের ভেতরটা দেখলাম। আগের মতোই অন্ধকার। খোলা জানলা আর পর্দাটা একটু উড়ছে। এগিয়ে গিয়ে ঘরে ঢুকে বিছানায় উঠে জানলাটা বন্ধ করে পুনরায় ফিরে এলাম নিজের ঘরে। এসেই দেখি আমার ছেলে ওটা স্পাইডারম্যান এর পুতুলটা ধরে ঘরের দরজার দিকেই তাকিয়ে। আমি ভাবলাম ও আমার পায়ের আওয়াজ পেয়ে এদিকে তাকিয়েছে। কিন্তু আমি ঢোকার পরেও ওর দৃষ্টি আমার দিকে নয়। দরজার সামনে আমার দাঁড়ানোয় বাইরের অনেকটা অংশ ঢাকা পড়ে গেছে। আর জোজো মাথা নিচু করে আবার বেঁকিয়ে বাইরের সেই দিকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে। আমি ওর দেখাদেখি নিজেও ঘুরে তাকালাম। কই? কিছুই তো নেই। আমি আবার তাকালাম সামনে। ও তখনো দেখছে সেদিকে। আমি আবার তাকালাম। কি দেখছে ছেলেটা? তারপরে আবার তাকালাম সামনে। তখন দেখি জোজো আর বাইরের দিকে দেখছেনা বরং খেলনাটা নিয়ে খেলছে।
- কিরে জোজো? কি দেখছিলি বাবু? জিজ্ঞেস করলাম আমি। কিন্তু ছেলে খেলনা থেকে মুখ না সরিয়ে মাথা নাড়লো না সূচক। বাচ্চাদের মাথায় কত কি চলে। এর আগেও ওকে অনেকবার খেলতে খেলতে থেমে জানলার বাইরের কিংবা আমি কোনো কাজে ব্যাস্ত থাকলে সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি। আজকেরটাও তেমন কিছুই ভাবতে ইচ্ছে করছিলো কিন্তু অতটাও যেন স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছিলাম না। যতবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি এসব কিছুই নয় ততবার অসফল হয়েছি। আমি আবার শুনলাম বাথরুমের দরজার আওয়াজ। মানে ও এবার ফিরবে। সামান্য পরেই ওর বাবা ফিরেও এলো। ছেলের ওপাশে গিয়ে বসে আমার দিকে তাকিয়ে আমায় ইশারায় আশ্বাস দিলো কিচ্ছু অসুবিধা হয়নি সব ঠিকাছে। ও ফিরতে টর্চটা নিয়ে আমি গেলাম এবার। হ্যা একাই। মিথ্যে বলবোনা..... আবারো ওই সিঁড়ির জায়গাটা পেরিয়ে তারপরে রান্নাঘরে যাওয়ার লম্বা গলি পার করে এগিয়ে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে বাথরুমে যাবার পথ টুকুতে দুবার থেমে ভাবতে হয়েছে ফিরে যাবো কিনা কিন্তু আমি এগিয়ে গেছি। কারণ মনে হয়েছে এই তো এক্ষুনি এই রাস্তা দিয়েই অরিন্দম একা গেলো আর ফিরে এলো। আমার মনে আছে এমনই রাতে আগেও একবার কারেন্ট গেছিলো আর আমাকে কলঘরে যেতে হয়েছিল। সেটা আরও রাতের দিকে। তখন অবশ্য জোজো হয়নি। সেদিনের পর এই আজ।
একসময় আমিও ফিরে এলাম। না কেউ বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দেয়নি বা নাকি গলায় হাসেনি। ছোটবেলা থেকে পড়ে আসা ও পরবর্তী সময় শোনা যত ভৌতিক গল্প কাহিনী শুনেছিলাম সব যেন ওই সময়তেই মনে পড়তে হবে। লজ্জার মাথা খেয়ে একবার ভেবেওছিলাম ওকে বাইরে দাঁড়াতে বলবো যতক্ষণ না আমি ভেতর থেকে বেরোই কিন্তু সেটা কি আর এখন এই সময় এসে মানায়? আমি তো আর জোজো নয়, ওর মা। ভাবতেও লজ্জা করে এসব। যত আমি নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততো যেন একটু একটু করে ভয়টা কমছিল। হাতে ধরা টর্চের আলোয় সামনেটা হলুদ আভায় আলোকিত কিন্তু আমার পাশে ও পিছনটা সেই আগের মতোই অন্ধকার। কেন জানি একবার পেছনে টর্চ ফেলে দেখলাম। কিছুই তো নেই। কিছু থাকার কথাও নয়। কিন্তু তাও আমি এমন কেন করলাম? আমি কি তাহলে চাইছিলাম ওখানে কিছু দেখতে পাই? কিসের এতো কৌতূহল আমার? নিজেও জানিনা আমি। সিঁড়ির কাছটায় পৌঁছে গেছি। ওখান থেকে ডাইনিং টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যায়। আমি আলো হাতে দেখলাম ওখানে দাঁড়িয়ে জোজো আর জোজোর হাতে ওর ফুটবল। মেঝেতে বসে আছে ও। আর বলটা ও গড়িয়ে দিলো সামনের অন্ধকারে। আমার টর্চের আলো জোজোর পিঠে তাই বলটা যতক্ষণ ওর হাতে ছিল আমি দেখতে পেয়েছি কিন্তু সেটা সামনে এগিয়ে যাবার পরে আর আমি দেখতে পেলাম না। ঠান্ডায় মেঝেতে বসে আছে বলে এগিয়ে গিয়ে ওকে বকতে যাবো তার আগেই আমায় দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। এটা কি দেখলাম আমি? আমার চোখের সামনে ওই বলটা আবার গড়িয়ে ফিরে এলো জোজোর পায়ের কাছে। জোজো আবার ওটা তুলে ওর গায়ের জোরে ওটা ছুঁড়ে দিলো আবারো সামনের দিকে। বলটার লাফানোর শব্দও কানে পাচ্ছি। কিন্তু ওকি? সামান্য পরেই বলটা আবার অন্ধকার থেকে ওর কাছে ওই একই গতিতে জাম্প করতে করতে ফিরে এলো। আমি সঙ্গে সঙ্গে হাতের টর্চটার আলো সামনের দিকে ফেললাম। বসার ঘরের দরজাটা আগের মতোই খোলা। ভেতরে সোফা আর টিভি সেট সব দেখতে পেলাম। কিন্তু আর কিছুই নেই তো। আলোটা ঘরের ভেতর পড়াতে আর সেটা জোজো দেখতে পেয়ে ঘুরে আমার দিকে তাকালো আর হেসে আবার সামনে ঘুরে বলটা নিয়ে ছুঁড়ে দিলো সামনে। এইবার টর্চের আলোয় দেখলাম বলটা লাফাতে লাফাতে সোজা ঢুকে গেলো বসার ঘরে। আর সেই যে ঢুকলো আর বেরোলোনা। সোফার কাছে গিয়ে ঐভাবেই পড়ে রইলো। আমি এগিয়ে গেলাম ড্রইং রুমের দিকে। চারিদিকে আলো ফেলে দেখলাম একবার। সব একদম শান্ত। বড়ো ঘড়িটার টিকটক টিকটক শুনতে পাচ্ছি। নিচে তাকিয়ে দেখলাম বলটা স্থির হয়ে সোফার কাছে পড়ে। একটু আগেও এটা এই ঘরে ঢুকে পুনরায় ফিরে গেছিলো ছেলের কাছে। হয়তো এই সোফায় ধাক্কা লেগেই সেটা ফিরে গেছিলো। কিন্তু এইবারে আর তা হয়নি। কিন্তু এই সোফা আর ওই বাইরে যে জায়গায় জোজো ছিল মাঝে দূরত্ব অনেকটাই। জোজোর গায়ে এখনো ওতো জোর কি হয়েছে যে এতটা দূরে বলটা ছুঁড়ে দেবে আর সেটা দ্রুত গতিবেগে এগিয়ে এই সোফায় ধাক্কা লেগে পুনরায় ফিরে যাবে ওর কাছে? ও তো বড্ড হালকা ভাবেই ওটা ছুঁড়ে দিচ্ছিলো আর ড্রপ খেতে খেতে ওটা এগিয়ে যাচ্ছিলো। নিজেকে ওই সব অস্বাভাবিক অনুভূতি গুলো থেকে বাঁচাতে যে যুক্তির সাহায্য বারবার নিচ্ছিলাম এলং দেখি সেই যুক্তিই আমায় বাধ্য করছে আরও ভয় পেতে! এমন সব ভাবছি ঠিক তখনি আমার ডান হাতটা কে যেন হটাৎ চেপে ধরলো!
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
আমি রান্না ঘরে চা করছি আর ওরা ঘরে রয়েছে। জোজো ওর বাবার সাথে খেলছে। ছোট মানুষটা কিছুই বুঝছেনা যে বাবা মায়ের মুখের হাসিটা আজ বড্ড নকল। একটু পরেই শুনলাম আমার ফোন বেজে উঠলো ঘরে। কাজ বন্ধ রেখে দৌড়ে এলাম ঘরে। বাবা ফোন করেছে। রিসিভ করতেই বাবা বললো যে জেঠু নাকি কথা বলতে চায় আমার সাথে। ওনার বাড়িতেই বাবা রয়েছে। পরোক্ষনেই একটা অন্য গলার স্বর কানে ভেসে আসলো। চিনতে অসুবিধা হলোনা আজও। শুধু একটু জড়িয়ে যায় এখন মানুষটার কথাগুলো। আমি ও আমরা কেমন আছি জানার পরে সে জিজ্ঞেস করলো কি অসুবিধা হয়েছে। যা যা হয়েছে সব খুলে বলতে। আমি সেই শুরু থেকে কাল রাত পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সব বললাম। এমন কি পল্লবীর ব্যাপারটাও বলতে ভুললাম না। সব শুনে উনি আমায় কয়েকটা প্রশ্ন করোছিলেন। সেগুলো এবার জানাচ্ছি-
১ আমি এর মধ্যে কোনো খারাপ বিশ্রী পোড়া গন্ধ বা নতুন ধরণের কোনো পেয়েছিলাম কিনা
২ আমার কি বিনা কারণে হটাৎ করে প্রচন্ড ঠান্ডা লাগতো কিনা অর্থাৎ হটাৎ করে কম্পন।
৩ একা হলেই আমার কখনো মনে হয়েছে কিনা যে আসে পাশে কেউ আছে
৪ বমি বমি ভাব কখনো হয়েছে কিনা
৫ বিনা কারণে খুব রেগে যাচ্ছি কিনা। অর্থাৎ স্বামী বাঁ বাচ্চার ওপর অকারণে রাগ বাঁ ঝগড়া হয়েছে কিনা।
৬ রোজ পূজা করার সময় কোনো বাঁধা আসছে কিনা বা পুজো দিতে গিয়ে অনীহা।
৭ ধুপ জ্বালানোর সময় তার সুগন্ধ আগের মতোই পাচ্ছি কিনা
এর মধ্যে হালকা রেগে যাওয়া আর ওই অন্ধকারে কারোর স্পর্শ অনুভব ছাড়া বাকি কোনোটাই আমার সাথে হয়নি। রেগে যাওয়াটা তাও মেনে নেওয়া যায় কিন্তু রাতে ওই স্পর্শ! ওটা যে আমি অনুভব করেছি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর তখন জোজো আর ওর বাবা বসার ঘরে ছিল। শুনে উনি যেটা বললেন সেটা শোনার পরে কিছুটা যেন আশার আলো দেখলাম। উনি বললেন যতটা উনি বুঝেছেন তাতে বিশাল ভয়ের কিছু নেই। আর তাছাড়া উনি নিজেই এ বাড়িতে আসবেন আমাদের সাথে দেখা করতে। এটা একদিকে ভালোই হলো। উনি নিজে এসে সব দেখে বুঝুন। উনি জানান আজ সন্ধের দিকে উনি আসবেন আমাদের বাড়ি। বাবাই নিয়ে আসবেন ওনাকে। আমি বাবাকে জানালাম মাকেও নিয়ে আসতে। তবে আমার সাথে ফোনে কথা বলার শেষে উনি এটাও জানিয়ে ছিলেন আমি যেন আজ রান্নাঘরে সামলে সকল কাজ করি। অর্থাৎ রান্না করার সময় যেন সাবধানে থাকি। এটা উনি কেন বলেন সেটা বুঝলাম না কিন্তু উনি যখন বলেছেন আমি আচ্ছা ঠিকাছে ছাড়া আর কি বা বলতাম। হয়তো উনি কিছু একটা আন্দাজ করেছেন। তবে এসবের মাঝেও একটা ভালো লাগায় মনটা অনেক ভালো লাগছিলো। বাবা মা আজ অনেকদিন পরে আসছে আমার কাছে। সাথে তারক জ্যাঠু নিজে আসছেন। দেখা যাক কি হয়। এইসব অদ্ভুতুরে সমস্যার মাঝেও জোজোর বাবা বাজারে গেলো। মাছ কিনে আনলো, সাথে মিষ্টির দোকান থেকে সন্দেশ আর স্পঞ্জ রসগোল্লা (বাবার প্রিয়) । আজ এতদিন পরে বাবা মা আসছে। ওদের আসার অপেক্ষায় আর আশার আলোয় সময় কখন যেন পার হয়ে গেলো। নিজের মধ্যে কয়েকবার হালকা ভয় জাগলেও সত্যি বলছি র কিচ্ছুটি অনুভব করিনি। আমি বা অরিন্দম। ভালো করে রান্না করে খাওয়া দাওয়া করে একসাথে তিনজনে সময় কাটালাম। হ্যা অবশ্যই রান্নার সময় কেয়ারফুল ছিলাম। আমি সবসময়ই থাকি। এর মাঝেই শশুর মশাই এর ফোন এসেছিলো। অরিন্দম কথা বললো কিন্তু আমি আগেই বারণ করে রেখেছিলাম যেন রাতের ব্যাপার ওদের না জানাতে। মানুষ গুলো চিন্তায় পড়ে যাবে। নিজের বাড়ির আর বাড়ির ছেলে বৌয়ের এমন সমস্যা শুনলে বয়স্কা শাশুড়ি মায়ের আবার কি হয় কে জানে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছটা নাগাদ ওরা সবাই এলো। তার আগেই মাসি এসে সব কাজ করে গেছে। আমারও পূজা দেওয়া হয়ে গেছে। ট্যাক্সি থেমে নেমে এলো বাবা মা আর রোগা করে একজন বয়স্ক মানুষ। আমাকে দেখেই বাবা মায়ের মতো তার মুখেও একটা হাসি ফুটে উঠলো। বয়সের কারণে মুখে অনেকটা পরিবর্তন আসলেও জ্যাঠার হাসিটা আজও বড্ড চেনা, বড্ড মিষ্টি। সাদা পাঞ্জাবী আর ধুতি আর কাঁধে একটা ঝোলা। জোজোর বাবা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওদের নিয়ে এলো ঘরে। আমিও ছেলের হাত ধরে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করলাম বড়োদের। জোজো বাবুকে তো বাবা কোলেই তুলে নিলো। বড্ড ভালো লাগছিলো এতদিন পরে বাবা মাকে কাছে পেয়ে। আমরা সবাই আবার ঘরে প্রবেশ করলাম। বাবা মা জোজোকে নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে গেলেও অরিন্দম আর আমি দেখলাম তারক জ্যাঠা দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছেন। বিশেষ করে ওই সুপারি গাছ আর জামরুল গাছটার দিকে। তারপরে কিছুই যেন হয়নি এমন ভাব নিয়ে সোজা ঢুকে গেলেন ঘরে। সোফায় সবাই বসতে না বসতেই মা চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো - কিরে? আবার কিছু হয়েছে নাকি এর মধ্যে? আমি হেসে মাথা নেড়ে না জানালাম।
- সত্যিই মানে কি বলবো.... তোমাদের ডেকে আনলাম তাও আবার কিনা এসব ঝামেলায় পড়ে। অদ্ভুত যে কি সব শুরু হলো। নিজের বাড়িতে এই ভাবে যে......
- আচ্ছা মা কাল রাতে ঠিক কি হয়েছিল আরেকবার বলতো?
আমার কথার মাঝেই জ্যাঠা জিজ্ঞেস করলো আমায় কথাটা। আমি পুনরায় রাতের ঘটনাটা খুলে বললাম। ফোনে তাড়াতাড়ি করে বলা একরকম ছিল কিন্তু এখন মানুষটাকে সামনে পেয়ে সবটা গুছিয়ে বললাম যে রাতে যা যা হয়েছে। সবটা শুনে বাবা মাও অবাক হয়ে গেলো। সত্যি তো এ কি হচ্ছে? মা তো ভয়ে পেয়ে বলেই ফেললো - ও দাদা? কি হচ্ছে এসব মেয়েটার সাথে আমার? এ কি নজর পড়েছে নাকি আমার মেয়েটার ওপর। মরলো ওই বাড়িতে আর কিনা আমার মেয়েটার ওপর নজর দিলো।
তারক জ্যাঠা হালকা হাসি হেসে মাকে সান্তনা দিয়ে বললো - আপনি চিন্তা করবেন না। আমার কিন্তু মনে হয় তেমন কিছু নয়। তিন্নি মা ভয় পাবার কিছু নেই। একটা কথা মনে রাখবি.... যত ভয় পাবি ততো বিপদ। তুই তো আর কোনো খারাপ কাজ করিসনি তাহলে কিসের ভয়? মনের জোর থাকলে কোনো কিছু সহজে ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু আমরা কিন্তু ভয় পেয়ে নিজের ক্ষতি করে দিতে পারি। তবে এটাও ঠিক কোনো ব্যাপারে অতি সাহস দেখানো উচিত নয়। মানুষের কৌতূহল অনেক সময় তার বিপদ ডেকে আনে। আজকাল তো এসব নিয়েও নাকি মজার খেলা শুরু হয়েছে। ভূত প্রেত নিয়েও খেলা। প্ল্যানচেট তাও একটা অন্য জিনিস ছিল এসব তো আরও সাংঘাতিক। ওই আমার ছোট নাতিটা সেদিন দেখাচ্ছিল ফোনে কি সব যেন বেরিয়েছে.... আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনবার একটা নাম নিতে হয়, আবার চার্লি চার্লি না কি যেন একটা খেলা। এসব কি টাইম পাসের মতো জিনিস? এসব নিয়ে মজা করতে নেই। যত্তসব! তা যা হোক আমি কিন্তু এ বাড়িতে খারাপ কিছু বুঝতে পারছিনা। তবে অরিন্দম বাবার সাথে যেটা হয়েছে ওটা আমায় বেশি ভাবিয়েছে। আর কাল রাতের ঘটনাটা। হটাৎ করে............আচ্ছা অরিন্দম? আমি একটু তোমাদের সব ঘর গুলো ঘুরে দেখবো বাবা। তিন্নি তুই এখানেই থাক।
জোজোর বাবা আর জ্যাঠা বসার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মায়ের পাশে বসে এইসব নিয়েই আলোচনা করতে লাগলাম। জোজো নিজের দাদুর সাথে কথা বলতে ব্যাস্ত। কিছুক্ষন পরে আমি সবার জন্য চা বানাতে যাবো এমন সময় দেখি অরিন্দম ফিরে এলো। উনি কোথায় জিজ্ঞেস করাতে সে বললো উনি ছাদে গেছেন। একটু ঘুরে দেখবেন একা। প্রথমে উনি গেছিলেন বাবা মায়ের ঘরে। ঠাকুর এর মন্দিরের কাছে গিয়ে আগে কালী মায়ের ছবির সামনে বসে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করেন। তারপরে ঘরটায় চোখ বুলিয়ে পাশের ঘরে অর্থাৎ আমাদের বেডরুমে যান। সেটা দেখে অরিন্দম তাকে নিয়ে যায় রান্নাঘর আর কলঘরটা দেখাতে। কিন্তু ফেরত আসার সময় উনি সিঁড়ির সামনে পৌঁছে নাকি দাঁড়িয়ে পড়েন। তারপরে অরিন্দমকে বলেন উনি ছাদে যাবেন। সে বলে চলুন কিন্তু উনি বলেন উনি একাই যাবেন। জোজোর বাবা যেন সিঁড়ির আলোটুকু জ্বালিয়ে ফিরে যায়। সবটা শুনে আমি রান্না ঘরে গেলাম সকলের জন্য চা বানাতে। মাও এলো সাথে। আমি আর মা ওখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছি, সেদিন মা আমার পেছনে যে কিছু একটা দেখেছিলো সেটা নিয়ে মা আর আমি কথা বলছিলাম। আমরা শুনতে পেলাম ওপর থেকে যেন জোরে জোরে তিনবার হাততালি দেবার মতো আওয়াজ এলো। একেবারে পরপর। এমন ভাবে ছয় বার উনি করলেন এটি। আমি আর মা মুখ চাওয়াচায়ী করলাম। উনি হটাৎ এমন করলেন কেন বুঝলাম না। একটু পরেই শুনতে পেলাম সিঁড়িতে পায়ের শব্দ। উনি নামছেন। ওনাকে নামতে দেখে মা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ওনার কাছে গিয়ে কথা বলতে লাগলো। আমি রান্নাঘর থেকে শুনতে পাচ্ছি মা বলছে-
- দাদা? কি কিছু সমস্যা আছে নাকি? কি বুঝলেন?
- আমি কি বললাম তখন? ভয় পাবেন না। ভয়ের কিছুই নেই। আর তিন্নি মায়ের কোনো বিপদ হবেনা আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন তো। তিন্নি মা? ও কোথায়?
- রান্না ঘরে... চা বানাচ্ছে।
- আচ্ছা আচ্ছা। আমি কিন্তু কিচ্ছু খাবোনা চা ছাড়া। আমায় ফিরে যেতে হবে একটু পরেই। এতো ভাববেন না। তখন গাড়িতেও দেখছিলাম আপনাকে চিন্তিত ছিলেন।আমি বুঝতে পারছি আপনার দিকটা। আমি আবারো বলছি ভয়ের কিচ্ছু নেই। আসলে ওই ওর রাশিটা হালকা তো। তাই একটু ঝামেলা আরকি। আপনি ভাববেন না। কিচ্ছু নেই এই বাড়িতে আপনি যা ভাবছেন। হ্যা একটা হাওয়া হয়তো লেগেছে কিন্তু সেটাও হয়তো কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। ওই যে তখন গাড়িতে বললাম না আপনাদের....আসলে ওই সময় অমন একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়া আর ঠিক ওই সময়তেই আপনার মেয়ের বাথরুমে যাওয়া এই দুই সময় মিলে গিয়েই এইটা হলেও হতে পারে। কিন্তু শুধুই তিন্নির ওপর যে কোনো কু-দৃষ্টি পড়েছে সেটা বোধহয় নয়।যদি তাই হতো তাহলে এতক্ষনে অনেক বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যেতে পারতো। সেতো আবার নাকি আসে পাশের বাড়িতেও জানান দিয়েছে। আমার কেমন যেন খটকা লাগছে।
- কেমন খটকা দাদা?
- যদি সে.... কি যেন নাম? পল্লবী হ্যা পল্লবী..... তা সে যদি আত্মহত্যাই করে তবে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা তো ওর নিজের বাড়িতে হবে। সে এইভাবে সারা পাড়া ঘুরে ভয় দেখাবে কেন? আচ্ছা সেই মেয়ের নিজের বাড়িতে কি কিছু এমন ঘটেছে? কিছু জানেন?
- না তিন্নি তো তেমন কিছু বলেনি। ওদের সঙ্গে তেমন খুব একটা যোগাযোগ ছিলোনা। ওই টুকটাক।
- হুমমমম..... আমার মনে হয় আসলে মেয়েটি যখন কাজটি করে তখন হয়তো সে কোনো একটা দোষ পেয়েছে। তাই সে এতটা প্রকাশ করছে নিজেকে। হয়তো কষ্ট পাচ্ছে তাই...... কিন্তু এটা বেশিদিন হবেনা। বাড়ির লোকেরা সব ব্যবস্থা নিলেই সব শান্ত হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুদিন এই ব্যাপারটা থাকবে। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বাড়াবাড়ির দিকে যাচ্ছে। কিন্তু যা বুঝলাম সেরকম কিছু না।
- কিন্তু দাদা! কাল রাতে যে ওই যেটা হলো সেটা? মেয়ে নাকি আমার হেঁটে হেঁটে ঘুমের মধ্যে বাইরে বেরিয়ে.....
- আপনি আপনি ভয় পাবেন না। আমি বলছি তো কিচ্ছু ভয় নেই। ঝামেলাটা থাকবে। কিন্তু সেটা বেশিদিন থাকবেনা। আমি এসেছি তো। সব ঠিক হয়ে যাবে। চা হোক আমি বরং একবার বাড়িটা বাইরে থেকে ঘুরে দেখে আসছি ততক্ষনে। আমি বলি কি বৌদি? আপনি কদিন মেয়ের সাথে এখানেই থাকুন। এতে ওর মনটাও ভালো থাকবে আর একা একা লাগবেনা। ভয় টয় আর লাগবেনা ওর। আচ্ছা আমি বরং যাই বাইরেটা একটু দেখে আসি।
------------------------------------------
আমরা সবাই বসার ঘরে অপেক্ষা করছি ওনার। একটু পরেই আবারো হাজির হলেন তারক জ্যাঠা। এবারও তিনি একাই কাজটা করতে গেছিলেন। জোজোর বাবা সঙ্গে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তিনি বললেন কাজটা তাকে একাই করতে হবে। ওর প্রয়োজন নেই। অরিন্দম দাঁড়িয়ে দেখেছিলো ভদ্রলোক মাথায় দু হাত ঠেকিয়ে চোখ বুজে কি একটা বলে বাইরে চলে যায়। গেট পার করে যখন উনি বাইরে গেলেন তখন জোজোর বাবাও দেখেছিলো উনি হাতের সাথে অন্য হাত ঘষছেন। যেমন খুব ঠান্ডায় আমরা হাতে হাত ঘসি অনেকটা এরকম। কিন্তু কয়েকবার এমন করার পরেই উনি সেই একই কাজ করলেন। সজোরে হাতে পরপর তিনবার তালি বাজিয়ে আবার হাতে হাত ঘষতে ঘষতে বাইরে চলে গেলেন। জোজোর বাবা ব্যাপারটা দেখে অবাক হয়েছিল বটে। আমরাও ওর মুখে শুনে একটু অবাক হয়েছিলাম। কিছু সময় পর ওনার আসার পরে দেখলাম ওনার ঠোঁটে হালকা হাসি। এসেই বললেন - ওহ চা হয়ে গেছে না। এহে হে আমার জন্য অপেক্ষায় না থেকে আপনারা শুরু করেননি কেন?
- কি বুঝলেন তারক দা? চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করলো বাবা। তাতে উনি আগের মতোই মিষ্টি করে হেসে মাথা নাড়িয়ে নিজের থলিতে হাত ঢুকিয়ে একটা লাল জবা ফুল বার করে এনে সবার আগে এগিয়ে এলেন জোজোর কাছে। জোজোও তাকিয়ে ছিল যতীন দাদুর দিকে। ওর মাথায় ফুলটা ঠেকিয়ে তারপরে বুকে ঠেকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করে বললেন। তারপরে জোজোকে বাঁ দিকের খোলা জানলার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে তাকাতে বললেন। জোজো তাকাতেই উনি আদর করে ওর পেটে কাতুকুতু দিতেই জোজো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তারপরে ওর গাল দুটো টিপে আদর করে জ্যাঠা আমাদের দুজনকে অর্থাৎ আমাকে আর জোজোর বাবাকে ওনার কাছে যেতে বললেন। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই উনি সেই একই কাজ আমাদের সাথেও করলেন। ফুলটা আমাদের মাথায় ধরে চোখ বুজে কিছু বললেন। তারপরে আমাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। যেন আশীর্বাদ করলেন মনে হলো। তারপরে আমার হাতে ফুলটা দিয়ে বললেন আমি যেন এটা ঠাকুর ঘরে মায়ের পায়ের কাছে রেখে আসি।
- এই নে মা ধর। দু হাত জড়ো কর আগে.... হ্যা নে এবার ধর। এটা তোদের ঠাকুর ঘরের মায়ের পায়ের কাছে রেখে আয় তো। মায়ের ফুল মায়ের কাছেই থাকুক। শুধু এক স্থান থেকে আরেক স্থানে এলো আরকি হাহাহা। নে মা রেখে আয়। আর হ্যা প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিস। কিছুক্ষন জ্বলুক পরে নিভিয়ে দিস।
ঠাকুরের পায়ের কাছে ওটা রেখে প্রদীপ জ্বালিয়ে আবারো প্রণাম করে ফিরে এলাম ঘরে। কিন্তু একটা জিনিস অবাক লাগলো। আমি যখন কাজটা করতে যাচ্ছিলাম তখন জোজো আমার পিছনে পিছনে আসছিলো। তখনি জ্যাঠা ওকে হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে ওনার কাছে থাকতে বলে আমাকে একাই যেতে বলেছিলো। কেন জানিনা। কিন্তু কাজটা করে ভক্তি ভোরে মাকে প্রণাম করার পরে যেন সত্যিই মনে হচ্ছিলো এবার আর কিচ্ছু হবেনা হয়তো। যেন একটা অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করছিলো ভেতরে। যেন একটা শান্তি পেলাম আমি হটাৎ করেই। প্রদীপের আলোয় মায়ের মুখটা যেন জ্বলজ্বল করছে। কি সুন্দর লাগছে মায়ের মুখটা। এ মুখ তো আমি রোজ দেখি। রোজ পূজা করি কিন্তু এতো ভালোলাগা আগে অনুভব হয়েছিল কি? জানিনা। ফিরে আসি আবারো বসার ঘরে। আমায় দেখেই ওনার মুখে ওই মিষ্টি হাসিটা আবার ফুটে উঠলো। আমার মুখেও একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কেন? নিজেই জানিনা।
- শোন মা! তুই একেবারে নিশ্চিন্ত থাক। তোর সাহস অনেক। তাই সহজে তোকে কেউ কিচ্ছু করতে পারেনি, পারবেও না। শুধু ওই সময় তোর ওই বাইরে বেরোনোটা সেদিন উচিত হয়নি। কিন্তু তুইও বা বুঝবি কিকরে। তোর দোষ নেই....ওটা হবার ছিল হয়ে গেছে। কিন্তু তোকে তোর সাহস আর মা রক্ষা করেছে। কালকে যা হয়েছে ওসব ভুলে যা। কিচ্ছু হয়নি তোর সাথে। ওই একটা হয়তো কিছু ছিল.......সেটা কেটে যাবে। তুই ভগবানের ওপর এই ভাবেই বিশ্বাস রাখ। যেমন পূজা করছিস করে যা। শুধু দুটো জিনিস কর। এই আসন্ন এক সপ্তাহ রোজ বাড়িতে ধুনো দিবি। জানি একটু চোখ জ্বালা করবে কিন্তু তাও করবি। আর হ্যা এই কদিন তোরা তোদের ঘরে ঘুমাবিনা। তোর শশুর শাশুড়ির ঘরটায় ঘুমাবি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে তারা এখন এখানে নেই। তাই কোনো অসুবিধা নেই। আর বাড়ির দরজায় দরজায় গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিবি প্রতিদিন। ব্যাস....দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। কিচ্ছু চিন্তার ব্যাপার নেই। আর অরিন্দম বাবা তুমি প্রতিদিন কাজে যাবার আগে একবার করে ঠাকুর ঘরে গিয়ে মাথা ঠেকিয়ে পেন্নাম করে তবে বেরোবে। আর এই হনুমানজির ছবিটা সাথে রাখো। এটা সবসময় সাথে রেখো। ব্যাস আর কিচ্ছু চিন্তা নেই। এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। আশা করি আর কোনো ঝামেলা হবেনা। আর কিছু হলে আমি তো আছিই। আর হ্যা মা আরেকটা কথা। প্রতিদিন ওই ফুলটায় একটু জলের ছিটে দিস। যতদিন না শুকিয়ে যাচ্ছে। শুকিয়ে যাবার পরে ওটাকে আর মায়ের পায়ের কাছে রাখতে হবেনা। কিন্তু জলে দিবিনা। ওটাকে একটা কাগজে মুড়ে ওখানেই কোথাও রেখে দিবি। আমি জানিয়ে দেবো একদিন যে কবে ওটাকে জলে দিবি কেমন? আচ্ছা নে আমার যাবার সময় হয়ে গেলো। চাটা খেয়ে নি।
-------------------------------------
উনি আর বেশিক্ষন থাকেননি আমাদেরর বাড়িতে। চা পান করেই উনি কিছুক্ষন গল্প করে চলে যান। বাবা মা আমাদের সাথেই থেকে যান। কটা দিন না হয় মেয়ের কাছেই কাটিয়ে গেলো দুজনে। এরপর সেই রাত আর তারপরে আরও অনেক গুলো রাত কেটে গেছে। কিন্তু আর কোনো অস্বাভাবিক কিছুর সাক্ষী হতে হয়নি আমাকে বা আমাদেরকে। কিন্তু এর পরে নাকি আমাদের বাড়ির বাইরের ঐ রাস্তায় রাতে দু জনের এক্সিডেন্ট হয়েছিল। একজন সাইকেল থেকে পড়ে যান। আর একজন নিজের বাড়ির গেট থেকে বেরিয়ে দুপা এগোতে না এগোতেই কিসে ধাক্কা খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েন। দুটোই ঘটেছে রাত নটা থেকে নটা দশ পনেরোর মধ্যে। আর দুটো জায়গাই একবারে কাছাকাছি। ওই মিষ্টির দোকানের রাস্তায়। ঠিক যেখানে একদিন জোজোর বাবা দেখে ছিল কে যেন ওর পেছনে আসছে। এছাড়া আমার শাশুড়ি মায়ের যে বন্ধু সুজাতা কাকিমা মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতো তিনি আর ওনার বড়ো ছেলে নাকি একদিন রাত করে কোথা থেকে ফিরছিলেন বাইকে। বাড়ি পৌঁছে বাইক থেকে উনি যখন নামতে যান তখন উনি পড়তে পড়তে বাঁচেন। পরে উনি একদিন আমাদের বলেছিলেন ওনার নাকি মনে হয়েছিল ওনার শাড়িটায় নাকি উনি টান অনুভব করেছিলেন জোরে। এতটাই জোরে যে পেছনের দিকে কয়েক পা পিছিয়ে যান। যদিও নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন। তবে এই ঘটনার সাথে ওই ব্যাপারটার কোনো যোগাযোগ ছিল কিনা জানিনা। কারণ ওনার বাড়ি অনেক ভেতরের দিকে। তবে আমাদের আর কোনো অসুবিধা হয়নি এই যা শান্তি। কিন্তু আজও কিছু প্রশ্ন যেন আমায় ভাবতে বাধ্য করে। আজও আমার মনে হয় তারক জ্যাঠা সেদিন কিছু একটা বুঝেছিলেন যেটা তিনি প্রকাশ করেন নি। তাছাড়া ছাদে তিনি একা ছিলেন আর একা বেরিয়ে আমাদের বাড়িটা ঘুরে দেখেছিলেন। ওই সময় টুকুতে কি হয়েছিল আমাদের জানা নেই। ফিরে আসার সময় ওনার মুখে হাসি ছিল কেন? আচ্ছা সবকিছু জানার পরেও উনি এতটা নিশ্চিন্ত ছিলেন কিকরে? ঐভাবে তালি বাজানোর মানে কি? উনি বারবার বলছিলেন যে বেশি দুশ্চিন্তা না করতে। সব ঠিক আছে। এতটা শিওর উনি কিকরে ছিলেন। নাকি আমরা যাতে প্যানিক না করি সেই জন্য সান্তনা? রাতে ওই ভাবে আমার ঘুমের মধ্যে একা বেরিয়ে যাওয়া শুনে ওনার ভ্রূকুটির মানে কি? আর তার চেয়েও বড়ো কথাটা আজও সবচেয়ে বেশি ভাবায় আমায়। বিদায় নেবার সময় উনি আলাদা করে আমায় ডেকে আমার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন আমি যেন কোনো ভয় না পাই। আর বাচ্চাকে সামলে রাখি, খেয়াল রাখি। আমি হেসে বলেছিলাম হ্যা জোজোর খেয়াল তো আগে রাখবো। সেটা শুনে উনি মিষ্টি করে হেসে মাথা নেড়ে বলেছিলেন - "আমি জোজোর কথা বলছিনা, যে আসবে তার কথা বললাম, আসি হ্যা কেমন। ভালো থাকিস মা। কোনো ভয় নেই "
এই বলার পর আর দাঁড়াননি তিনি। বেরিয়ে যান। অরিন্দম ওনাকে ছাড়তে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু উনিই বারণ করেন। আমি শুধু ওনার বিদায় দেখা ছাড়া কিছুই করতে পারিনি। আজও জানলাম না উনি কিকরে জানলেন যে আমার আর জোজোর বাবার ভালোবাসা আবারো একটু একটু করে বাস্তবের রূপ নিচ্ছে আমার অন্তরে? কিন্তু তারপরেই কেঁপে উঠি একটা কথা ভেবে........ যে এতদিন আশেপাশে ছিল সেও কি একই ভাবে এই কথাটা জানতে পেরেছিলো? সেই জন্যই কি আমার সাথে ঐসব ঘটেছে? সেই জন্যই কি আমাকে কোনোভাবে টেনে নিয়ে গেছিলো সিঁড়ির কাছে? কি উদ্দেশ্য ছিল তার? তাহলে কি......!!
আজও যখন এই শেষ কথাটা ভাবি আমায় ঘিরে ধরে ভয়!
|| সমাপ্ত ||
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
বাবানের যে কোনো গল্প বারবার পড়তে ভালো লাগে
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(10-08-2023, 10:47 AM)Bumba_1 Wrote: বাবানের যে কোনো গল্প বারবার পড়তে ভালো লাগে 
ঠিকই
•
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,202 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,738
অনেক ধন্যবাদ সঞ্জয় দা গল্প দুটোকে এখানে স্থান দেবার জন্য ♥️
আশা রাখি কোনোদিন ভয় ৩ আসবে। নতুন চরিত্র, নতুন ভয়!
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
(10-08-2023, 02:03 PM)Baban Wrote: অনেক ধন্যবাদ সঞ্জয় দা গল্প দুটোকে এখানে স্থান দেবার জন্য ♥️
আশা রাখি কোনোদিন ভয় ৩ আসবে। নতুন চরিত্র, নতুন ভয়!
অবশ্যই আসবে, সেই অপেক্ষাতেই তো রয়েছি।
•
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
|| প্রান ||
লেখা :- আমি সৌম্য
প্রতি মুহুর্তে পৃথিবীতে ঘটে চলে এমন কিছু ঘটনা যার কোন ব্যাখ্যা যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো আছে তার কারন, কিন্তু সেটা মানুষের সীমিত জ্ঞানের দ্বারা নাগাল পাওয়া যাবে না। এরকম ব্যাখ্যাহীন রহস্যাবৃত ঘটনাকে বোঝানোর জন্য "অলৌকিক" কথাটার ব্যবহার করা হয়। খুঁজে দেখলে হয়তো পাওয়া যাবে প্রায় সবার জীবনেই কখনো না কখনো ঘটেছে এমন কিছু যা তাঁর নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য হয়ে থেকে গেছে।
নিপাট সাদামাটা গৃহবধূ সুমিত্রা তরফদারও কোনদিন ভাবেননি যে এরকম কিছু ঘটবে তাঁদের স্বামী স্ত্রী আর দুই সন্তানের নিস্তরঙ্গ সুখী জীবনে। তাপস তরফদারের জীবনে আমৃত্যু সঙ্গ দিতে এসেছিলেন ছাব্বিশ পুরোতে না পুরোতেই। বছর দশেক কাটিয়ে ছত্রিশে পৌঁছে সুমিত্রা দুই সন্তানের মা এবং একনিষ্ঠ গৃহবধূ হয়ে খুশিই ছিলেন। তাপস ভালো কাজ করেন সরকারি দপ্তরে। মাইনে যথেষ্ট ভালো, ভবিষ্যত তুলনামূলক ভাবে সুরক্ষিত। তাই একটু জেদ করেই দ্বিতীয় সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন সুমিত্রা। স্বামী যদিও একটি সন্তানকে নিয়েই বড় করার পক্ষপাতী ছিলেন।
প্রথমটি ছেলে, পরেরটি মেয়ে। বিয়ের দুবছরের মাথায় অনির্বান বা অনি হয়ে গেছিল। ছত্রিশে এলো সোমশুক্লা। আট বছরের ছোট বড় দু ভাইবোন।
অনি একটু বড় হয়েছে, নিজের প্রয়োজনীয় কাজ বুঝে নিয়ে করতে শিখেছে দেখেই সময়টা বেছেছিলেন তিনি। ছেলে এমনিতেই যথেষ্ট বোঝদার তার বয়সী অন্য বাচ্চাদের থেকে।
কিন্তু মানুষ যা চায় সেভাবে জীবন চলে না। জীবনের চলার একটা নির্দিষ্ট ধারা আছে যেখানে ছন্দপতনটাই নিয়ম। হয়তো সবার ক্ষেত্রে নয়, কিন্তু অনেকের জন্যই এই নিয়ম প্রযোজ্য। সুমিত্রা এবং তাপস সেই নির্দিষ্ট অনিশ্চয়তার দোলাচলের খবরটা রাখতেন না। ফলে প্রথম দুলুনিটা তাঁরা ধরতেই পারলেন না।
সোমশুক্লার তিন মাস বয়সে এসেছিল সেটা। ছেলেকে জন্মের পর থেকেই দুজনের মাঝখানে নিয়ে শুতেন স্বামী স্ত্রী। মেয়ে হতে তাকেও যথারীতি নিজের আরেকপাশে নিয়ে শোওয়া শুরু করলেন তাঁরা।
কচি বাচ্চা মাঝরাতে উঠে কাঁদতো খিদেতে বা কাঁথা ভিজিয়ে ঠান্ডা লাগতো বলে। স্বামী স্ত্রী দুজনেই ভাগাভাগি করে খেয়াল রাখতেন। কিন্তু সমস্যা হলো অনিও উঠে পড়তে লাগলো কাঁচা ঘুম ভেঙে। আর তার একটা স্বভাব আছে ছোট থেকেই যে একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর ঘুম আসেনা তার। স্বাভাবিক ভাবেই পরেরদিন কলেজে গিয়ে ঢুলতো, পড়া ভুলে যেতো ঘুমের ঘোরে।
এরকম দিন কয়েক চলার পর তাপস পাশের একটা ছোট ঘর একদম নতুন করে সাজিয়ে একটা ছোট খাট পাতলেন। অনিকে সেখানে শুয়ে ঘুমানোর অভ্যেস করানো হলো অনেক কাঠখড় পুরিয়ে। সেও যথেষ্ট ছোট এবং এর আগে বাবা মাকে ছেড়ে একলা শোয়নি। ফলে প্রায় মাস কয়েক চেষ্টা করেও সম্পুর্ন সফলতা এলো না।
অনেক দিনই রাতে আচমকা ঘুম ভেঙে উঠে সুমিত্রা দেখেছেন তাঁর পায়ের কাছে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমোচ্ছে অনি। কখন উঠে চলে এসেছে নিজের বিছানা ছেড়ে কেউ জানে না। কিন্তু তিনি নিয়ম পাল্টাতে দিলেন না। বাচ্চা থেকে অভ্যেস করাতে করাতেই ঠিক হয়ে যাবে।
অনি একটু চুপচাপ হয়ে গেল হঠাৎ করেই। কিছুদিন পরে এক বিকেলে পাড়ার মাঠ থেকে খেলার পর বাড়ি ফিরে ছেলে পা দেখিয়ে বলল -' দ্যাখো মা, কতটা কেটে গেছে। একটু ওষুধ লাগিয়ে দেবে গো?'
সুমিত্রা বললেন -' আগে ভালো করে পা ধুয়ে আয় বাথরুম থেকে। হাত মুখ ভালো করে ধুবি। বাইরের হাতে বোনকে ধরিস না যেন।'
অনি বাথরুমে যেতেই মেয়ে উঠে পড়ে তেড়ে কাঁদতে শুরু করলো। সুমিত্রা সন্ধ্যার জলখাবার বানাচ্ছিলেন, সব ওইভাবে ফেলে রেখে ছুটলেন মেয়ে সামলাতে। একটু পরেই অনি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল -' ও মা, ওষুধটা লাগিয়ে দাও।' সুমিত্রা কিছু বলার জন্য মুখ ঘোরাতেই নাকে পোড়া গন্ধ পেলেন। তিনি পড়িমড়ি করে ছুটলেন মেয়েকে কোলে নিয়েই। দুধ ফোটাতে দিয়ে গ্যাস নেভাতে ভুলে গেছেন মেয়ের কান্নায়। সেটা সামলানোর আগেই দরজায় বেল বাজলো।
কোনমতে গ্যাসটা নিভিয়ে দরজা খুলে দেখলেন তাপস এসে গেছেন অফিস থেকে।
বরাবরই স্বামী ফিরলে হাতে ব্যাগটা নিয়ে নেওয়া, ফ্যানটা চালিয়ে দেওয়া প্রভৃতি করেন তিনি। সেসব মিটলে তাপস ছেলেকে প্রাইভেট কোচিং সেন্টারে দিয়ে আসলেন। পরেরদিন মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার একটা পরিকল্পনা করা ছিল সেটা নিয়ে কিছু আলোচনা হলো নিজেদের মধ্যে।
রাতে খাওয়ার পর অনি সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিজের ঘরে ঢুকছে দেখে তাঁর মনে পড়লো ছেলে বার দুয়েক বলা সত্ত্বেও পায়ের ক্ষতে ওষুধটা লাগিয়ে দিতে মনে নেই।
নিজের ওপরেই একটু লজ্জিত হয়ে তিনি খাওয়ার পর হাতে ওষুধটা নিয়ে ছেলের ঘরে গেলেন। অনি ঘুমিয়ে পড়েছিল। সাবধানে তার পায়ের কাটা জায়গায় মলম লাগিয়ে দিতে সামান্য নড়ে উঠল ব্যাথায় কিন্তু ঘুমটা পুরো ভাঙলো না। ছেলের কপালে একটা চুমু খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। ঘুমটা ভেঙে গেলে মুশকিল হবে।
তবে চুমুটা খেলেই ভালো করতেন সুমিত্রা। কারন তাহলে তাঁর চোখে পড়তো ছেলের চোখের কোন বেয়ে নেমে গেছে আধশুকনো জলের ধারা। অনি একদম শামুকের মতো গুটিয়ে নিল নিজেকে এরপর থেকে। এতোটাই চুপচাপ হয়ে গেল যে সুমিত্রা মাঝেমধ্যে ভুলেই যেতেন যে বাড়িতে ছেলেটা আছে। মনে হতো কলেজে গেছে বা খেলতে গেছে।
মাসখানেক পর প্রতিবেশী আরেকটি বাচ্চার মায়ের কাছে সুমিত্রা খবর পেলেন অনি ইদানিং মাঠে গিয়ে বসে থাকে বেঞ্চিতে একা। বাকি বাচ্চাদের খেলা দেখে, হাততালি দেয় কিন্তু নিজে খেলতে নামে না। ব্যাপারটা দেখে সেই ভদ্রমহিলা কারন জানতে চেয়েছিলেন। তাতে অনি তাঁকে বলেছে যে আগেরবার তার পা কেটে অনেকদিন ধরে ব্যাথা ছিল, তাই আর ভয়ের চোটে খেলে না সে।'
সুমিত্রার সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো না যে সেই রাতের পর অনির পায়ে ওষুধ তিনি লাগিয়ে দিয়েছিলেন কি না। তবে যতদুর মনে হয় তিনি ভুলে গেছিলেন সাত সতেরো কাজের মধ্যে। রাতে ভাবলেন ছেলের সঙ্গে কথা বলবেন কিন্তু খাওয়া দাওয়ার পর ছেলের ঘরে গিয়ে দেখলেন সে অকাতরে ঘুমিয়ে পড়েছে। পরেরদিন বলবেন মনে করে ছেলের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে বেরিয়ে এলেন সুমিত্রা। আর মনে পড়েনি তাঁর আগামী কয়েক মাসের মধ্যে।
ভালো করে মাথা মুছতে পারতো না অনি, কিন্তু হঠাৎই সে শিখে নিল নিজের মতো করে। সেটাও সুমিত্রার খেয়াল হলো কলেজবাসে ছেলেকে তোলার সময় তার উল্টোদিকে এবড়ো খেবড়ো অপটু হাতে সিঁথি করে চুল আঁচড়ানো দেখে। কলেজবাসটার মিলিয়ে যাওয়া দেখতে দেখতে বড় কান্না পাচ্ছিল তাঁর। মেয়েটাকে জেদ করে না নিলেই বোধহয় ভালো হতো। ছেলেটার অযত্ন হচ্ছে। ঠিক করলেন সামনের রবিবার ছেলেটাকে নিয়ে বেড়াতে যাবেন কোথাও। এতো ছোট মেয়েকে নিয়ে বেরোতে অসুবিধা হয় বলে নিতান্ত দরকার না হলে কোথাও যান নি এই কিছু মাসের মধ্যে। নয়তো মাসে দুয়েকবার ছেলেকে নিয়ে তাঁরা স্বামী স্ত্রী বেড়াতে যেতেন।
সুমিত্রার মাথাতেও এলো না যে অনি ওইভাবে চুল আঁচড়ে কলেজে যাচ্ছে বলে সহপাঠীদের কাছে বিভিন্ন ঠাট্টা তামাশার শিকার হচ্ছে এবং অসহায় ভাবে মুখ বুজে সহ্যও করছে চোখে জল নিয়ে। এই ঘটনার দিন কয়েক বাদেই ছিল রবিবার। সেদিন সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার কথা থাকলেও উঠতে পারলেন না সুমিত্রা। মেয়েটা আগের রাতে খুব জ্বালিয়েছে। তাপস এমনিতেই ছুটির দিনে একটু বেলা অবধি ঘুমোন।
প্রায় দশটা নাগাদ ঘুম ভাঙলো সুমিত্রার, তাও একটা বাজে স্বপ্ন দেখে। ঠাকুরের নাম নিয়ে বিছানা ছাড়লেন তিনি। পাশেই ছেলের ঘর। তড়িঘড়ি আগে সেখানে ঢুকলেন। ঘরে ছেলে নেই। এত সকালে ছেলে কোথায় গেল? বাকি ঘরগুলো খুঁজলেন তিনি। কোথাও নেই অনি।
তাপস কে ধাক্কা মেরে তুললেন সুমিত্রা। ঘুমচোখে টলমল করতে করতে তিনিও খুঁজতে শুরু করলেন। অবশেষে দেখা গেল ছাতের দরজা খোলা। ছাতেও নেই ছেলে। কিন্তু আচমকাই কু ডাকলো মায়ের মন। সুমিত্রা বাগানের পেছনের দিকের আলসের কাছে পায়ে পায়ে এগোতে লাগলেন। প্রায় কুড়ি পঁচিশ ফুট নিচে খানিকটা ডাঁই করা ইঁট, মাটি আর রাবিশের ওপরে হাত পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ছেলের রক্তাক্ত শরীরটা দেখে তিনি ধীরে ধীরে বসে পড়লেন ওখানেই।
পা পিছলে পড়েছে না আত্মহত্যা তার উত্তর আর পাওয়া গেল না। তরফদার পরিবারের কাছে পৃথিবীর গতিবেগ থেমে গেল সেই মুহুর্ত থেকেই। সুমিত্রাকে বাঁচানো যেত না যদি মেয়েটা না থাকতো। অনির জামা কাপড় জাপটে ধরে কিছুদিন কাটলো। ছেলের ঘরটা থেকে তাঁকে বের করার জন্য বহু সাধ্যসাধনা করেও লাভ হলো না। পা গুটিয়ে মেয়েকে নিয়ে ওই খাটেই শোওয়া শুরু করলেন তিনি।
সবথেকে শ্রেষ্ঠ ওষুধের নাম সময়। মানুষের মন কোনকিছুই একটানা একভাবে ধরে রাখতে না পারার একটা সুবিধা হচ্ছে দুঃখ বা যন্ত্রনার অনুভূতিগুলোও সে ধরে রাখতে পারে না চিরদিনের মতো।
একটা গোটা বছর ঘুরে গেল নিজের নিয়মে। অশ্রুও জমাট বাঁধে প্রকৃতির সেই নিয়মেই। সুমিত্রাও মেনে নিতে বাধ্য হলেন যে হারিয়ে ফেলাটাও একটা ঘটনা মাত্র।
এইসময় তাপসকে তাঁর অফিসের কলিগদের মধ্যে কেউ বুদ্ধি দিলেন যে মেয়েকে নিয়ে একবার কালীঘাট মন্দিরে গিয়ে মায়ের পায়ে ছুঁইয়ে আনতে। ছেলেটার যা হবার তো হয়েছে, তা আর ফেরানো যাবে না। অন্তত মেয়েটা যেন মায়ের কৃপায় টিঁকে থাকে। কথাটা খারাপ লাগলো না, তাই এক সুন্দর সকালে তরফদার পরিবার বেরোলেন কালীঘাট মন্দিরের উদ্দেশ্যে।
কলকাতার এই তীর্থস্থান মহাপীঠ হিসেবে প্রসিদ্ধ হবার জন্য কখনোই ফাঁকা থাকে না। বেলা নটার সময় মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিলেন দুজনে শতাব্দী প্রাচীন অথচ চিরনতুন মাতৃ মন্দিরের উত্তুঙ্গ চূড়ার দিকে।
অগনিত ভক্ত সমাগম, জবার মালায় ঢেকে যাওয়া অগনিত ছোট্ট দোকান থেকে ডাকাডাকি সব ছাপিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে একটা অদ্ভুত মন ভালো করে দেওয়া ভাব। কয়েক গুন বেড়ে যায় অন্তরের জোর এই পবিত্র ভূমিতে পা দিলেই। দুজনেরই একসঙ্গে মনে হলো এতদিন কেন আসেননি তাঁরা এখানে। এখানে এমন একটা নির্ভরতা আছে যে নিজের থেকে মনের মধ্যে বলে "সব ঠিক হয়ে যাবে"। কি এমন আছে পৃথিবীতে যা এখানে শুদ্ধমনে চাইলে পাওয়া যায় না! আক্ষরিক অর্থেই সবকিছু পাওয়া যায় এই মহাতীর্থে মা কালিকার রাজসভায়।
আগে কোনদিন আসেন নি কেউই, তবু একটিবারের জন্যও মনে হলো না অচেনা। একজন মধ্যবয়সী সেবায়েতের সাহায্য নিলেন তাঁরা। বললেন নিজেদের প্রার্থনার কথা। মানুষটিরও চোখের কোনটা চিকচিক করে উঠলো যেন। তিনি বললেন, 'আপনি নিজের হাতে মেয়েকে মায়ের রাঙা চরনে শুইয়ে দেবেন মা, আমি ব্যবস্থা করে দেবো। এই মেয়েকে যমেও ছুঁতে সাহস পাবে না আর। আর যদি তেমন করে চাইতে পারেন তাহলে যে গেছে সেও ফেরত আসবে ফের আপনার কোলেই। কত দেখলাম এমন।'
সুমিত্রা কম্পিত গলায় বললেন, 'ফেরত আসবে .. সে আমার কোলে! আপনি বলছেন বাবা, সত্যি বলছেন?'
মধ্যবয়সী মানুষটির চোখে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল একঝলক। তিনি হুঙ্কার দিয়ে বললেন -' আলবত ফেরত আসবে, যদি মায়ের কাছে বলতে পারেন। সে তো জগতের মা। মা হয়ে নিজে অন্য মায়ের সন্তান শোক বুঝবে না তো কে বুঝবে?'
সকালের মঙ্গলারতি শেষ হয়েছে অনেক আগেই। এতো সকালে খুব একটা বাইরের পূন্যার্থী যাত্রী নেই। কিছু স্থানীয় মানুষ আছেন। ভিড় বেশি ঠেলতে হলো না তাঁদের। গর্ভগৃহের সিঁড়ি দিয়ে নামতেই সুমিত্রার মনে হলো এরকম নিশ্চিন্ততা তিনি নিজের ছোটবেলায় মায়ের বুকে মুখ গুঁজে পেতেন। সিংহাসনের পেছন দিক থেকে ঘুরছে অল্প কিছু মানুষের সারি। পায়ে পায়ে এগোতে লাগলেন তিনি। যত সামনের দিকে আসছেন তত মাথার মধ্যে কেমন যেন একটা ঘোরের মতো তৈরি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি মা উঁকি দেবেন সিংহাসন থেকে মুখ বারিয়ে। বড় পাত্রে কর্পূর জ্বালিয়ে আরতি করছেন এক ভক্ত।
বিহ্বল বোবা চোখে তাকিয়ে আছেন তাপস সেদিকে। কর্পূরের কালো ধোঁয়াটা যেন আবছা একটা খাঁড়ার মতো আকার নিচ্ছে মনে হচ্ছে। অবশেষে দুজনে এসে দাঁড়ালেন সামনে কোলে মেয়েকে নিয়ে। প্রায় দেড় মানুষ সমান উঁচু থেকে রাজ রাজেশ্বরী মুখে হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছেন তাঁদের দিকেই তিনটে বিশাল মাপের টানাটানা কমলা রঙের আলো ঝলমলে চোখে। চোখ থেকে যেন উপচে পড়ছে স্নেহ, ভালোবাসা আর শান্তি। একবার সেই চোখের দিকে তাকালেই মন থেকে মুছে যায় যাবতীয় অপ্রাপ্তির বেদনা। কালো মুখে গড়িয়ে পড়ছে এক বিন্দু জলের ফোঁটা মাথার চুল থেকে। যেন সদ্যস্নাত মা বেরিয়েছেন আটপৌরে শাড়ি পরে। একটা জবার মালার সাথে মিশে যাওয়া রঙের বেনারসি জড়ানো শরীরে আটপৌরে ভাবেই। সিঁথিতে সোনার টিকলি নেই, সেখানে টকটক করছে এয়ো স্ত্রীর মতো নতুন সিঁদুর। মেয়েকে হাত বাড়িয়ে মায়ের চরনে ছোঁয়ালেন তাপস। সুমিত্রা আর এই সন্তানের জন্য কিছু চাইলেন না। তাঁর অন্তর বলে দিচ্ছিল মেয়ের জন্য কিছু চাইতে হবে না আর। তিনি মায়ের চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুধু বললেন -' যাকে তোমার কাছে নিয়েছো, তাকে ফিরিয়ে দাও মা। আমি যে তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।'
জবাব এলো না কিছু শুধু তিনটে চোখে আরেকবার আলো ঝলমলিয়ে উঠলো আর মৃদু দুলে গেল বিশাল সোনার নথটা। এক মায়ের কথা আরেক মা বোঝে। এখানেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। সুমিত্রা নিঃসন্দেহে বুঝলেন যে তাঁর প্রার্থনা শুনেছেন মা।
বেরিয়ে এলেন দম্পতি মেয়েকে নিয়ে। তার ছোট্ট মুঠোয় চেপে ধরা একটা টাটকা জবা। মায়ের পায়ের কাছে ঠেকানোর সময় ওটাই মুঠো করে ধরেছে সে।
ঠিক একটা বছর পরে কোলজুড়ে এলো সে। আবার ছেলে হয়েছে। দেখতে একদম একই নয়। কিন্তু সুমিত্রা জানেন এ সেই ছেলেই, যাকে তিনি একবার পেয়েও হারিয়ে ফেলেছিলেন। তবে এবার আর হারানোর গল্প নেই। জন্মের সময় কালীঘাটের প্রসাদী ফুল ছিল মাথার কাছে। ছেলেকে নিয়ে মায়ের চরনে ছুঁইয়েও গেছেন।
বগলামুখী মায়ের সামনে বসে ঘটনাটা শুনছিলাম এতক্ষন। নাটমন্দির বন্ধ আজ দেড় বছর ধরে। কালীঘাটের সর্বত্রই মায়ের অবস্থান বিভিন্ন রূপে। আদি গঙ্গার ঘাটের সামনে বগলামুখী মায়ের সামনেটা যেমন পরিস্কার তেমনি শান্ত। হাঁকডাক, ভিড়, ঠ্যালাঠেলি কিছুই নেই। তাই গত দেড় বছর ধরে যখনই আসি এখানেই আসন পাতি। ভদ্রমহিলা বেশ কিছুদিন ধরেই যোগাযোগ করেছিলেন তাঁর জীবনের এই কাহিনীটা শোনানোর জন্যই। শুনছিলাম সেটাই মন দিয়ে। এবার বললাম- ' কিন্তু আপনি বুঝলেন কি করে যে এই আপনার "অনি"।
মৃদু হেসে সুমিত্রা ঘাড় ফিরিয়ে ডাকলেন ছেলেকে -' এই অনি, একবার এদিকে আয় তো বাবা।'
একটি বছর বারোর মেয়ের সঙ্গে উদ্দাম ছুটোছুটি করে খেলছিল দশ বছরের ছেলেটি। মায়ের ডাক শুনে দিদি তাকে চেপে ধরে টেনে আনলো। সুন্দর চেহারা, চোখে মুখে দুষ্টুমি মাখানো। কপালে আর মুখে দু তিন জায়গায় সামান্য গর্ত মতো। খুব ভালো করে তাকালে চোখে পড়ে সেটা।
মা ছেলেকে মৃদু ধমক দিয়ে ব্যাগ থেকে একটা জামা বের করে আগের ঘামে ভিজে যাওয়া জামাটা ছাড়িয়ে দিতে শুরু করলেন। জামাটা খুলতেই চোখ আটকে গেল আমার। বাচ্চাটার বুক আর পেটের কাছে বেশ গভীর ভাবে কিছুটা চামড়া এবড়ো খেবড়ো ভাবে ঢুকে গেছে ভেতর দিকে। বিস্মিত হয়েই বললাম - ' কি হয়েছে ওর এরকম?'
জামা পাল্টানো হয়ে যেতে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে তিনি স্থির চোখে তাকালেন আমার দিকে, তারপর মৃদু স্বরে বললেন -' জন্মদাগ। ওভাবেই এসেছে।' তাকিয়ে থাকলাম তাঁর দিকে। আমার মন বলছে আরো কিছু শোনা বাকি আছে।
সুমিত্রা এবার বগলা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন -' আগের বার ছাত থেকে পড়ে শরীরের ওই জায়গাগুলোতেই ইঁট আর রাবিশ ফুটো হয়ে ঢুকে থেঁৎলে গেছিল। মা ওইটুকু দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে চিনতে পারি আর আগের মতো ভুল না করি সেই জন্য। তাই নামটাও আর অন্য দিই নি। "অনির্বান" কথাটার মানেই তো যা নিভে যায় না।'
এবার আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতক্ষন যা শুনছিলাম সেটা ভালো লাগলেও খুব একটা অচেনা কিছু ছিল না। মায়ের কাছে এরকম সন্তান হারা অনেক মানুষই সন্তান পেয়েছেন। কিন্তু যে গেছে সেই এসেছে এটা আগে কোথাও শুনিনি। এরকম নির্দিষ্ট প্রমান নিয়ে যে কেউ আসে তাও জানা ছিল না আমার।
এক মা চলে গেলেন তাঁর ছেলে মেয়েকে নিয়ে, আরেক মায়ের সামনে শুধু আমি বসে রইলাম সীমাহীন বিস্ময় আঁকড়ে। যদিও ভেতর থেকে কেউ বলে দিচ্ছিল যে এখানে বিস্মিত হবার মতো কিছু নেই। মানুষের সামান্য বুদ্ধিতে আমরা কতটুকু আর জানি। স্বয়ং মহাকাল যাঁর স্বরূপ জানতে পারেন নি সেখানে আমাদের ক্ষমতা কোথায় যে তাঁর মাহাত্ম্যের কার্য কারন ব্যাখ্যা করবো।
বগলামুখী মায়ের দিকে তাকাতেই তাঁর পীত স্মিত মুখে পলকের জন্য যেন ফুটে উঠলো তিনটে বড় বড় কমলা রঙের চোখ। চমকে তাকালাম আবার সেদিকে। কিছু নেই আর। মা বগলামুখী তাকিয়ে আছেন স্বাভাবিক ভাবে। শুধু সামনের বড় প্রদীপের শিখাটা গঙ্গার হাওয়ায় একবার নিভু নিভু হয়েও ফের সতেজে জ্বলতে লাগলো অনির্বান শিখায়।
|| সমাপ্ত ||
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
অসাধারণ 
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
|| একাদশী ||
লেখায় :- সৌমেন ঠাকুর
সকাল থেকেই ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি পড়ছিল | এখন সবে বৃষ্টিটা ধরে এসেছে | সনাতন দুটো বড়ো বড়ো কাতলা মাছ এনে রান্না ঘরের সামনে মাটির উঠনে ফেললো | মাছ দুটো এখনো থেকে থেকে নড়ছে | মুখ দিয়ে খাবি খাচ্ছে | কত্তা মশাই দিতে বললে --- বলে হাত জোড় করে পেন্নাম করে সনাতন চলে গেল |
বিভাবতী রান্না ঘরের দাওয়াতে অন্য দুই জা ছেলের বৌ ছোটো খুড়ি শাশুড়ির সঙ্গে বসে রান্নার কাজে ব্যস্ত | কাজের মেয়ে গোপলার মা বসে কুটনো কুটছিল | গালে হাত দিয়ে বিভাবতী বললো -- ওমা বাসি মাছ প্রায় সের দুয়েক তো ছিল , এতো বেলায় আবার মাছ আনা কেন ?
ছোটো জা মনোরমা বলে --- করো আবার মাছের ঝোল | একে প্রতিদিনই এই যজ্ঞি বাড়ির রান্না , তার উপর আবার এখন মাছ নিয়ে এলো ..... ও গোপলার মা মাছটা একটু কুটে ধুয়ে এনে দাও না | আমি নাহয় ওইকটা আনাজ কুটে নিচ্ছি | আর দিদি তুমি ভাতের হাড়িটা একটু নামিয়ে নাও | বিভাবতী ভাত নামাতে চলে যায় |
উল্টো দিকের বারান্দায় বসে বিভাবতীর শাশুড়ি আনন্দময়ী ঠাকুরুণ হরিনামের মালা জপছিলেন | তিনি বিধবা | মাথার চুল কদম ছাঁট করে কাটা । পড়নে সাদা থান , গলায় তুলসী কাঠের মালা কপালে চন্দনের ফোটা | তিনি একা নন | তার পাশে তার মেজ জা ভবতারিণী , সতীন দয়াময়ী ও ভবতারিণীর বড়ো বৌমা স্বর্ণময়ী | এরা সকলেই বিধবা | আমিষ হেঁসেলের ছোঁয়া বাঁচিয়ে এবাড়ির বিধবাদের হেঁসেল আলাদা | তবে আজ বিধবাদের হেঁসেলে হাড়ি চাপবে না কারন আজ একাদশীর নির্জলা উপবাস | তাই সকলেই আনন্দময়ীর মতো মালা জপছিল |
গোপলার মা উঠনে বসে মাছ কুটছিল আপন মনে | হঠাৎ কখন কুমুদিনী এসে গোপলার মায়ের পিছনে দাঁড়িয়েছে কেও খেয়াল করে নি | কুমুদিনী বিভাবতীর দুই ছেলের পর একমাত্র মেয়ে | ন'বছর বয়স | মাস পাঁচেক আগে হাটখোলায় বিয়ে হয়েছিল | কিন্তু সেই সুখ ও মেয়ের কপালে সইলো না | দুমাস যেতে না যেতে বিধবা হয়ে আবার বাপের বাড়ি হালিশহরে ফিরে এলো | রাজকুমারীর মতো দেখতে মেয়েটা নেড়া মাথায় সাদা থান পড়ে ঘুরে বেরাচ্ছে । এ দৃশ্য দেখলে বিভাবতীর বুকটা হু হু করে ওঠে | রাত্রে ঠিক করে ঘুম হয় না | চোখের জলে বালিশ ভিজে যায় এই ভেবে , যে , সারাটা জীবন মেয়েটা কীভাবে কাটাবে | ওভাবে বেঁচে না থেকে মেয়েটা যদি মরে যেত | আর তখনি মাথা চাপড়ায় বিভাবতী , মা হয়ে এসব কি ভাবছে সে |
কুমুদিনী কোমড়ে হাত দিয়ে শুধায় --- আজ মাছের ঝোল রাঁধবে বুঝি ? তা কে রাঁধবে ? ছোট ঠাকুমা না মেজ খুড়ি ? আনন্দময়ী মালা জপা থামিয়ে বলে --- তা সে খোঁজে তোমার কি হবে বাছা | বিধবা হয়ে খালি মাছে নজর দেওয়া | কতবার বলেছি আর পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে বেরাবি নি | আয় আমার কাছে বসে একটু ঠাকুরের নাম জপ কর |
কুমুদিনী ঠাকুমার দিকে ঘুরে বলে --- বা রে তা বলে আমি পুতুল খেলতে যাব না | জানতো মৃণাল বাপের বাড়ি এসেছে কাল বিকাল বেলায় |
বিভাবতী দাওয়ায় বেরিয়ে এসে বলেন -- হে রে কুমু .. বলি সকাল থেকে কোথায় গিয়েছিলি ? বৃষ্টিতে তো ভিজে গিয়েছিস পুরো | আয় মাথাটা মুছিয়ে দিই | তারপর কাপড়টা পাল্টে নিস |
কুমুদিনী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার শুধালো --- আজ কে মাছের ঝোল রাঁধবে গো মা ? ছোট ঠাকুমা না মেজো খুড়ি ? ছোট ঠাকুমার রান্নাটা খেতে বেশ সোয়াদ হয় |
এবার আনন্দময়ী চিৎকার করে উঠল --- হরি হরি .... হরি হরি.... ঠাকুর পাপ দিওনি ক্ষেমা করে দাও |
তারপর কুমুদিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন --- এই.... এই মেয়ে , কথা কানে যায় না | তোকে বললাম না আজ একাদশী আজ ওসবের নাম করতে নেই | বিধবা মাগী নোলা টস টস করছে |
কুমুদিনী ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো --- বা রে আমি কি মাছ খাবো বলেছি ? না বললে তোমরা মাছ খেতে দেবে ? আমি তো কেবল জিজ্ঞেসা করেছি |
বিভাবতী ধমক দিয়ে বলেন ---আহ্ , চুপ কর তো যা গিয়ে বস গে | কুমুদিনী মায়ের কাছে ছুটে এসে বলে -- ওমা মা দুটো কলা দাও না আর কটা নাড়ু .... খুব খিদে লেগেছে |
বিভাবতীর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে | কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলে কিন্তু তা মুখ দিয়ে বেরোয় না |
আনন্দময়ী বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠেন --- হতোভাগী .... জলজ্যান্ত সোয়ামীকে খেয়ে আর খিদে কিসের | বিধবা মাগী একাদশীর দিন খাব খাব করলে সংসার বলে কিছু থাকবে | বলি সংসারের কল্যান অকল্যান বলে তো একটা জিনিস আছে |
কুমুদিনী ফিক করে হেসে ফেলে বলে -- বা রে আমি তো ছোটো , আমি কি অতো বড়ো লোকটাকে খেতে পারি ..... আমার সোয়ামী তো জ্বর হয়ে মরেছিল | তুমি তো বড়ো .... হি.... হি.... তুমি বুঝি তোমার সোয়ামীকে খেয়ে ফেলেছো ?
রাগে গজগজ করতে করতে আনন্দময়ী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই বিভাবতী বলে উঠে --- আহ্ কুমু কতোবার তোকে বলেছি না মুখে মুখে তক্ক করবি না |
তারপর ঘোমটার আড়াল থেকে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে --- ও ভাবে কেন বলছেন মা ..... ও তো ছোটো .... আতো সতো বোঝে না , না হয় খেতেই চেয়েছে ... এখন আমাকে তোমার কাছে শিক্ষে নিতে হবে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক |
ছোটো ..... ছোটো ..... ন 'য় বছর পেরিয়ে দশে পড়লো ওবয়সে আমি হেঁসেলে রান্না করেছি | তিন সের চালের ভাতের হাড়ি নামাতাম , কৈ মাছ কুটতাম আর তোমার মেয়ে .... সে তো বিধবা হয়ে ফিরে এলো তাও হুস নেই ধেই ধেই করে পাড়া বেরিয়ে এসে মহারানী একাদশীর দিনে গিলতে বসবেন | বলি সংসারের আচার নিয়ম কি কিছু মানবে না | সংসার যে রসাতলে যাবে | সংসারে মেয়েরা যতো উপোস বার করবে সংসারের ততো উন্নতি হবে ছিবিদ্ধি ( শ্রীবৃদ্ধি ) হবে আর মেয়েরা খাবো খাবো করলে সংসার ছারখার হবে , তিনকাল তো একথাই শুনে এলুম | এখন যদি বলো তোমার মেয়ে ছোটো তোমার মেয়ে বিধেন মানবে না , তাহলে তাই করো | আমি বিধবা মাগী ..... সংসারের বোঝা , আমাকে বাবা বিশ্বনাথের থানে পাঠিয়ে দাও | ঠাকুর এই দিনও আমাকে দেখতে হলো --- বলে কাঁদতে লাগেন আনন্দময়ী |
এদিকে বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আনন্দময়ীর ছেলে বিভাবতীর স্বামী রামকিঙ্কর বাইরের ঘর থেকে এখানে এসে উপস্থিত হয় --- আহ্ !! বলি একটু কাজ করতে পারবো না তোমাদের জন্য | এটা বাড়ি না মাছ বাজার |
--- সেটা তোমার বৌ আর মেয়েকে শুধাও বাবা | আমি সংসারের বোঝা , তুমি বরং আমাকে কাশী পাঠাবার ব্যবস্থা করো |
--- আহ্ !! মা তুমি আমার মা এ সংসারের কর্ত্রী | এসব কী বলছো | কী হয়েছে বলো তো |
আনন্দময়ীর মুখে সব শুনে রামকিঙ্কর বলে --- এবাড়িতে মায়ের কথাই শেষ কথা | এবাড়ি যে সে বাড়ি নয় , এ হলো হালিশহরের ভট্টাচার্য্য বাড়ি .... আমার ঠাকুমা সতী হয়ে সহমরণে গিয়েছেন | তার পুণ্যে আজ আমাদের এই বাড়বাড়ন্ত |
তারপর কুমুদিনীর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন --- কুমু মা আজকের এই একটা দিন তো....... দেখবে ঠিক কেটে যাবে , কাল সকালে উঠে চান করেই তো খাবে | ঠিক আছে তো |
বলে চাদরে চোখ মুছতে মুছতে আবার চলে যান |
কুমু মায়ের পানে তাকিয়ে বলে --- দুটো কলা আর নাড়ু খেলে কি এমন হবে ? বেশ তবে কলা দিতে হবে না দুটো নাড়ু দাও |
বিভাবতী মেয়ের হাতটা ধরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে --- হতোভাগী তুই মরলি না কেন | তাহলে তো সব আপদ জুড়োতো | চল আজ তোকে আমি চিলেকোঠার ঘরে বন্দী করে রাখবো |
তারপর ছোট জা মনোরমাকে বলেন --- ছোটো আজ আর আমাকে খেতে ডাকিস না আমার খুব মাথা যন্ত্রনা করছে ..... ঘরে একটু শুই গে |
বলে কুমুদিনীর হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দেয় | তারপর ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে গিয়ে খাটের উপর উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগে বিভাবতী |
দুপুর থেকে আবার ঝিমঝিম করে বৃষ্টি নামে | বিকালে একবার চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বিভাবতী দেখে কুমু কাঁদতে কাঁদতে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে | বিভাবতী আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার শিকল লাগিয়ে নিচে নেমে আসেন | আজ একাদশী সন্ধ্যে জ্বালার আগে সব বৌ দের আলতা পড়তে হবে | সন্ধ্যে বেলায় বিভাবতী যখন শাশুড়ির পায়ে তেল দিয়ে মালিশ করছেন তখন আনন্দময়ী বলেন --- আমার ওপর রাগ করো না | সংসারের যেটা নিয়ম সেটা তো মানতেই হবে | মেয়েকে দেখে এসেছো ? বিভাবতী আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে |
কুমুদিনী বুঝতেই পারে না তার কি দোষ ? মায়ের উপরেও রাগ হচ্ছিল , মা কেন তাকে বকা দিল ? মাও আর সবার মতো খারাপ হয়ে গেছে | বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে | তখনি মাথায় পিঠে একটা ঠান্ডা কাঁপা কাঁপা হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে কুমুদিনী --- পিসিঠাম্মা তুমি ..... তুমি যে মরে গেছিলে তবে যে সবাই বলে তুমি আর আসবে না | তোমার ছেরাদ্দ হলো | ভোজ হলো...
--- ওলো থাম থাম... বাবা কতো পেশ্ন করে | বলি আমি তো বুড়ি মানুষ নাকি | আমি অতো জবাব দিতে পারবো নিকো হ্যাঁ | আয় দেকি আমার কোলে বস তো |
কুমুদিনী খিক খিক করে হেসে ওঠে --- তুমি আমাকে কোলে নিতে পারবে ? আমি ভারী না |
--- তাও তো বটে ..... বাবালো কতো বুদ্ধি হয়েছে তোর | এই দেখ তোর জন্য কি এনেছি | নারকেল নাড়ু , তক্তি , চাঁচি , কলা |
আনন্দে চোখ দুটো চকচক করে উঠে কুমুদিনীর --- এই সব আমার ..... কি মজা .... তুমি খুব ভালো ..... জানো সবাই আমাকে বকেছে | মা আমাকে মরতে বলেছে |
--- মায়ের ওপর রাগ করে না দিদিভাই | মা কি করবে বলো ..... সবই হলো নিয়তি |
কুমু নারকেল নাড়ু খেতে খেতে বলে --- তুমি আর চলে যাবে না তো পিসিঠাম্মা | আবার আগের মতো থাকবে ... খুব মজা হবে , কেউ আমাকে বকতে পারবে না ..... কেউ কিছু বললেই আমি ছুটে তোমার কোলে লুকোবো |
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পিসি ঠাম্মা বলেন --- না রে দিদি ..... তবে একাদশীর দিনে দিনে তুই এঘরে চলে আসবি আমি খাবার নিয়ে আসবো | তুই খাবি আর আমি দুচোখ ভরে তোকে দেখবো | তবে একথা কাওকে বলিস নি যেন ..... শুধু তুই জানবি আর আমি জানবো |
কুমুদিনী রহস্যের হাসি হেসে বলে --- তুমি কিচ্ছু জানো না | আমি আর এসব একাদশী করবো না | এই পচা সাদা কাপড়ও পড়বো না মায়ের মতো বৌদিদির মতো লাল নীল কাপড় পড়বো |
পিসি ঠাম্মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে --- তাইতো দিদি ..... তোর কি এসব নিয়ম পালন করার বয়স হয়েছে ..... কিন্তু কি করবি বল পোড়া সংসারের নিয়ম | যা তোর মতো দুধের শিশুকেও ছাড়ে না |
কুমুদিনী অধৈর্য হয়ে বললো --- ওহো তোমাকে বললাম না আমি এসব করবো না | তুমিও করবে না | রতনদাদা বলেছে ....
--- রতন বলেছে .... কি বলেছে রতন ?
--- রতনদাদা বলেছে , রতন দাদা ....ইস... ইস... ইস... ধূর পাঠশালায় শুনে এসেছে .... রতনদাদার পন্ডিতমশাই বলেছে কে একজন লোক কি যেন সাগর সে বলেছে .... হ্যাঁ , মনে পড়েছে বিদ্যেসাগর সে বিধবাদের কষ্ট দূর করবে ....
হো হো করে হেসে ওঠেন পিসিঠাম্মা --- ওরে সে সাগরই হোক আর সমুদ্দুরই হোক সে তো ব্যাটাছেলে | বিধবার জ্বালা মেয়েরাই বোঝে না তো কোন ব্যাটাছেলে তা বুঝবে | আয় দেখি আমার কোলে মাথা দিয়ে শো |
কুমুদিনী শুয়ে শুয়ে বলে --- না গো রতনদাদা বলেছে বিদ্যেসাগর সব ঠিক করে দেবে ..... তুমি কিচ্ছু জানো না |
ঠান্ডা হিম শীতল হাতটা কুমুদিনীর মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন --- ঠিক করলেই ভালো .... তাহলে তোর মতো বাংলার মেয়েগুলো বেঁচে যাবে এই যন্ত্রনার হাত থেকে |
কুমুদিনী ঘুমিয়ে গেছে | এখনো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে | পিসি ঠাম্মা আস্তে আস্তে কুমুর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ান | কে এই বিদ্যেসাগর ? যে নিজে একজন ব্যাটা ছেলে হয়েও মেয়েদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা ভাবে | এ যেন রূপকথার গপ্প | তার সম্পর্কে আরো জানতে ইচ্ছে করছে , মনে মনে হাসে পিসিঠাম্মা পরের একাদশীতে কুমুর কাছে বাকীটা জেনে নেবে | মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে এখন দুটো মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে | আহা রে!! সবই অদৃষ্ট । রাতের অন্ধকার একটু একটু করে ফিকে হচ্ছে দিনের আলো ফুটতে চলেছে | মেঘও কেটে যাচ্ছে | আগামীতে রোদ ঝলমলে দিন অপেক্ষা করছে | পিসিঠাম্মা কুমুর মাথায় একটু চুমু খেয়ে হাওয়াতে মিলিয়ে যান।
|| সমাপ্ত ||
Posts: 1,403
Threads: 2
Likes Received: 1,422 in 982 posts
Likes Given: 1,750
Joined: Mar 2022
Reputation:
82
(12-08-2023, 06:10 PM)Sanjay Sen Wrote:
|| একাদশী ||
লেখায় :- সৌমেন ঠাকুর
সকাল থেকেই ঝিম ঝিম করে বৃষ্টি পড়ছিল | এখন সবে বৃষ্টিটা ধরে এসেছে | সনাতন দুটো বড়ো বড়ো কাতলা মাছ এনে রান্না ঘরের সামনে মাটির উঠনে ফেললো | মাছ দুটো এখনো থেকে থেকে নড়ছে | মুখ দিয়ে খাবি খাচ্ছে | কত্তা মশাই দিতে বললে --- বলে হাত জোড় করে পেন্নাম করে সনাতন চলে গেল |
বিভাবতী রান্না ঘরের দাওয়াতে অন্য দুই জা ছেলের বৌ ছোটো খুড়ি শাশুড়ির সঙ্গে বসে রান্নার কাজে ব্যস্ত | কাজের মেয়ে গোপলার মা বসে কুটনো কুটছিল | গালে হাত দিয়ে বিভাবতী বললো -- ওমা বাসি মাছ প্রায় সের দুয়েক তো ছিল , এতো বেলায় আবার মাছ আনা কেন ?
ছোটো জা মনোরমা বলে --- করো আবার মাছের ঝোল | একে প্রতিদিনই এই যজ্ঞি বাড়ির রান্না , তার উপর আবার এখন মাছ নিয়ে এলো ..... ও গোপলার মা মাছটা একটু কুটে ধুয়ে এনে দাও না | আমি নাহয় ওইকটা আনাজ কুটে নিচ্ছি | আর দিদি তুমি ভাতের হাড়িটা একটু নামিয়ে নাও | বিভাবতী ভাত নামাতে চলে যায় |
উল্টো দিকের বারান্দায় বসে বিভাবতীর শাশুড়ি আনন্দময়ী ঠাকুরুণ হরিনামের মালা জপছিলেন | তিনি বিধবা | মাথার চুল কদম ছাঁট করে কাটা । পড়নে সাদা থান , গলায় তুলসী কাঠের মালা কপালে চন্দনের ফোটা | তিনি একা নন | তার পাশে তার মেজ জা ভবতারিণী , সতীন দয়াময়ী ও ভবতারিণীর বড়ো বৌমা স্বর্ণময়ী | এরা সকলেই বিধবা | আমিষ হেঁসেলের ছোঁয়া বাঁচিয়ে এবাড়ির বিধবাদের হেঁসেল আলাদা | তবে আজ বিধবাদের হেঁসেলে হাড়ি চাপবে না কারন আজ একাদশীর নির্জলা উপবাস | তাই সকলেই আনন্দময়ীর মতো মালা জপছিল |
গোপলার মা উঠনে বসে মাছ কুটছিল আপন মনে | হঠাৎ কখন কুমুদিনী এসে গোপলার মায়ের পিছনে দাঁড়িয়েছে কেও খেয়াল করে নি | কুমুদিনী বিভাবতীর দুই ছেলের পর একমাত্র মেয়ে | ন'বছর বয়স | মাস পাঁচেক আগে হাটখোলায় বিয়ে হয়েছিল | কিন্তু সেই সুখ ও মেয়ের কপালে সইলো না | দুমাস যেতে না যেতে বিধবা হয়ে আবার বাপের বাড়ি হালিশহরে ফিরে এলো | রাজকুমারীর মতো দেখতে মেয়েটা নেড়া মাথায় সাদা থান পড়ে ঘুরে বেরাচ্ছে । এ দৃশ্য দেখলে বিভাবতীর বুকটা হু হু করে ওঠে | রাত্রে ঠিক করে ঘুম হয় না | চোখের জলে বালিশ ভিজে যায় এই ভেবে , যে , সারাটা জীবন মেয়েটা কীভাবে কাটাবে | ওভাবে বেঁচে না থেকে মেয়েটা যদি মরে যেত | আর তখনি মাথা চাপড়ায় বিভাবতী , মা হয়ে এসব কি ভাবছে সে |
কুমুদিনী কোমড়ে হাত দিয়ে শুধায় --- আজ মাছের ঝোল রাঁধবে বুঝি ? তা কে রাঁধবে ? ছোট ঠাকুমা না মেজ খুড়ি ? আনন্দময়ী মালা জপা থামিয়ে বলে --- তা সে খোঁজে তোমার কি হবে বাছা | বিধবা হয়ে খালি মাছে নজর দেওয়া | কতবার বলেছি আর পাড়ায় পাড়ায় টো টো করে বেরাবি নি | আয় আমার কাছে বসে একটু ঠাকুরের নাম জপ কর |
কুমুদিনী ঠাকুমার দিকে ঘুরে বলে --- বা রে তা বলে আমি পুতুল খেলতে যাব না | জানতো মৃণাল বাপের বাড়ি এসেছে কাল বিকাল বেলায় |
বিভাবতী দাওয়ায় বেরিয়ে এসে বলেন -- হে রে কুমু .. বলি সকাল থেকে কোথায় গিয়েছিলি ? বৃষ্টিতে তো ভিজে গিয়েছিস পুরো | আয় মাথাটা মুছিয়ে দিই | তারপর কাপড়টা পাল্টে নিস |
কুমুদিনী সে কথায় পাত্তা না দিয়ে আবার শুধালো --- আজ কে মাছের ঝোল রাঁধবে গো মা ? ছোট ঠাকুমা না মেজো খুড়ি ? ছোট ঠাকুমার রান্নাটা খেতে বেশ সোয়াদ হয় |
এবার আনন্দময়ী চিৎকার করে উঠল --- হরি হরি .... হরি হরি.... ঠাকুর পাপ দিওনি ক্ষেমা করে দাও |
তারপর কুমুদিনীকে উদ্দেশ্য করে বলেন --- এই.... এই মেয়ে , কথা কানে যায় না | তোকে বললাম না আজ একাদশী আজ ওসবের নাম করতে নেই | বিধবা মাগী নোলা টস টস করছে |
কুমুদিনী ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো --- বা রে আমি কি মাছ খাবো বলেছি ? না বললে তোমরা মাছ খেতে দেবে ? আমি তো কেবল জিজ্ঞেসা করেছি |
বিভাবতী ধমক দিয়ে বলেন ---আহ্ , চুপ কর তো যা গিয়ে বস গে | কুমুদিনী মায়ের কাছে ছুটে এসে বলে -- ওমা মা দুটো কলা দাও না আর কটা নাড়ু .... খুব খিদে লেগেছে |
বিভাবতীর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে | কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে কিছু বলে কিন্তু তা মুখ দিয়ে বেরোয় না |
আনন্দময়ী বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে উঠেন --- হতোভাগী .... জলজ্যান্ত সোয়ামীকে খেয়ে আর খিদে কিসের | বিধবা মাগী একাদশীর দিন খাব খাব করলে সংসার বলে কিছু থাকবে | বলি সংসারের কল্যান অকল্যান বলে তো একটা জিনিস আছে |
কুমুদিনী ফিক করে হেসে ফেলে বলে -- বা রে আমি তো ছোটো , আমি কি অতো বড়ো লোকটাকে খেতে পারি ..... আমার সোয়ামী তো জ্বর হয়ে মরেছিল | তুমি তো বড়ো .... হি.... হি.... তুমি বুঝি তোমার সোয়ামীকে খেয়ে ফেলেছো ?
রাগে গজগজ করতে করতে আনন্দময়ী কিছু বলতে যাবেন তার আগেই বিভাবতী বলে উঠে --- আহ্ কুমু কতোবার তোকে বলেছি না মুখে মুখে তক্ক করবি না |
তারপর ঘোমটার আড়াল থেকে শাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে বলে --- ও ভাবে কেন বলছেন মা ..... ও তো ছোটো .... আতো সতো বোঝে না , না হয় খেতেই চেয়েছে ... এখন আমাকে তোমার কাছে শিক্ষে নিতে হবে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক |
ছোটো ..... ছোটো ..... ন 'য় বছর পেরিয়ে দশে পড়লো ওবয়সে আমি হেঁসেলে রান্না করেছি | তিন সের চালের ভাতের হাড়ি নামাতাম , কৈ মাছ কুটতাম আর তোমার মেয়ে .... সে তো বিধবা হয়ে ফিরে এলো তাও হুস নেই ধেই ধেই করে পাড়া বেরিয়ে এসে মহারানী একাদশীর দিনে গিলতে বসবেন | বলি সংসারের আচার নিয়ম কি কিছু মানবে না | সংসার যে রসাতলে যাবে | সংসারে মেয়েরা যতো উপোস বার করবে সংসারের ততো উন্নতি হবে ছিবিদ্ধি ( শ্রীবৃদ্ধি ) হবে আর মেয়েরা খাবো খাবো করলে সংসার ছারখার হবে , তিনকাল তো একথাই শুনে এলুম | এখন যদি বলো তোমার মেয়ে ছোটো তোমার মেয়ে বিধেন মানবে না , তাহলে তাই করো | আমি বিধবা মাগী ..... সংসারের বোঝা , আমাকে বাবা বিশ্বনাথের থানে পাঠিয়ে দাও | ঠাকুর এই দিনও আমাকে দেখতে হলো --- বলে কাঁদতে লাগেন আনন্দময়ী |
এদিকে বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আনন্দময়ীর ছেলে বিভাবতীর স্বামী রামকিঙ্কর বাইরের ঘর থেকে এখানে এসে উপস্থিত হয় --- আহ্ !! বলি একটু কাজ করতে পারবো না তোমাদের জন্য | এটা বাড়ি না মাছ বাজার |
--- সেটা তোমার বৌ আর মেয়েকে শুধাও বাবা | আমি সংসারের বোঝা , তুমি বরং আমাকে কাশী পাঠাবার ব্যবস্থা করো |
--- আহ্ !! মা তুমি আমার মা এ সংসারের কর্ত্রী | এসব কী বলছো | কী হয়েছে বলো তো |
আনন্দময়ীর মুখে সব শুনে রামকিঙ্কর বলে --- এবাড়িতে মায়ের কথাই শেষ কথা | এবাড়ি যে সে বাড়ি নয় , এ হলো হালিশহরের ভট্টাচার্য্য বাড়ি .... আমার ঠাকুমা সতী হয়ে সহমরণে গিয়েছেন | তার পুণ্যে আজ আমাদের এই বাড়বাড়ন্ত |
তারপর কুমুদিনীর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন --- কুমু মা আজকের এই একটা দিন তো....... দেখবে ঠিক কেটে যাবে , কাল সকালে উঠে চান করেই তো খাবে | ঠিক আছে তো |
বলে চাদরে চোখ মুছতে মুছতে আবার চলে যান |
কুমু মায়ের পানে তাকিয়ে বলে --- দুটো কলা আর নাড়ু খেলে কি এমন হবে ? বেশ তবে কলা দিতে হবে না দুটো নাড়ু দাও |
বিভাবতী মেয়ের হাতটা ধরে ঝাঁঝিয়ে ওঠে --- হতোভাগী তুই মরলি না কেন | তাহলে তো সব আপদ জুড়োতো | চল আজ তোকে আমি চিলেকোঠার ঘরে বন্দী করে রাখবো |
তারপর ছোট জা মনোরমাকে বলেন --- ছোটো আজ আর আমাকে খেতে ডাকিস না আমার খুব মাথা যন্ত্রনা করছে ..... ঘরে একটু শুই গে |
বলে কুমুদিনীর হাত ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে চিলেকোঠার ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দেয় | তারপর ছুটতে ছুটতে নিজের ঘরে গিয়ে খাটের উপর উপুর হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগে বিভাবতী |
দুপুর থেকে আবার ঝিমঝিম করে বৃষ্টি নামে | বিকালে একবার চিলেকোঠার ঘরে গিয়ে বিভাবতী দেখে কুমু কাঁদতে কাঁদতে এখন ঘুমিয়ে পড়েছে | বিভাবতী আস্তে আস্তে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে আবার শিকল লাগিয়ে নিচে নেমে আসেন | আজ একাদশী সন্ধ্যে জ্বালার আগে সব বৌ দের আলতা পড়তে হবে | সন্ধ্যে বেলায় বিভাবতী যখন শাশুড়ির পায়ে তেল দিয়ে মালিশ করছেন তখন আনন্দময়ী বলেন --- আমার ওপর রাগ করো না | সংসারের যেটা নিয়ম সেটা তো মানতেই হবে | মেয়েকে দেখে এসেছো ? বিভাবতী আস্তে আস্তে ঘাড় নাড়ে |
কুমুদিনী বুঝতেই পারে না তার কি দোষ ? মায়ের উপরেও রাগ হচ্ছিল , মা কেন তাকে বকা দিল ? মাও আর সবার মতো খারাপ হয়ে গেছে | বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে | তখনি মাথায় পিঠে একটা ঠান্ডা কাঁপা কাঁপা হাতের স্পর্শ পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আনন্দে লাফিয়ে ওঠে কুমুদিনী --- পিসিঠাম্মা তুমি ..... তুমি যে মরে গেছিলে তবে যে সবাই বলে তুমি আর আসবে না | তোমার ছেরাদ্দ হলো | ভোজ হলো...
--- ওলো থাম থাম... বাবা কতো পেশ্ন করে | বলি আমি তো বুড়ি মানুষ নাকি | আমি অতো জবাব দিতে পারবো নিকো হ্যাঁ | আয় দেকি আমার কোলে বস তো |
কুমুদিনী খিক খিক করে হেসে ওঠে --- তুমি আমাকে কোলে নিতে পারবে ? আমি ভারী না |
--- তাও তো বটে ..... বাবালো কতো বুদ্ধি হয়েছে তোর | এই দেখ তোর জন্য কি এনেছি | নারকেল নাড়ু , তক্তি , চাঁচি , কলা |
আনন্দে চোখ দুটো চকচক করে উঠে কুমুদিনীর --- এই সব আমার ..... কি মজা .... তুমি খুব ভালো ..... জানো সবাই আমাকে বকেছে | মা আমাকে মরতে বলেছে |
--- মায়ের ওপর রাগ করে না দিদিভাই | মা কি করবে বলো ..... সবই হলো নিয়তি |
কুমু নারকেল নাড়ু খেতে খেতে বলে --- তুমি আর চলে যাবে না তো পিসিঠাম্মা | আবার আগের মতো থাকবে ... খুব মজা হবে , কেউ আমাকে বকতে পারবে না ..... কেউ কিছু বললেই আমি ছুটে তোমার কোলে লুকোবো |
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে পিসি ঠাম্মা বলেন --- না রে দিদি ..... তবে একাদশীর দিনে দিনে তুই এঘরে চলে আসবি আমি খাবার নিয়ে আসবো | তুই খাবি আর আমি দুচোখ ভরে তোকে দেখবো | তবে একথা কাওকে বলিস নি যেন ..... শুধু তুই জানবি আর আমি জানবো |
কুমুদিনী রহস্যের হাসি হেসে বলে --- তুমি কিচ্ছু জানো না | আমি আর এসব একাদশী করবো না | এই পচা সাদা কাপড়ও পড়বো না মায়ের মতো বৌদিদির মতো লাল নীল কাপড় পড়বো |
পিসি ঠাম্মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে --- তাইতো দিদি ..... তোর কি এসব নিয়ম পালন করার বয়স হয়েছে ..... কিন্তু কি করবি বল পোড়া সংসারের নিয়ম | যা তোর মতো দুধের শিশুকেও ছাড়ে না |
কুমুদিনী অধৈর্য হয়ে বললো --- ওহো তোমাকে বললাম না আমি এসব করবো না | তুমিও করবে না | রতনদাদা বলেছে ....
--- রতন বলেছে .... কি বলেছে রতন ?
--- রতনদাদা বলেছে , রতন দাদা ....ইস... ইস... ইস... ধূর পাঠশালায় শুনে এসেছে .... রতনদাদার পন্ডিতমশাই বলেছে কে একজন লোক কি যেন সাগর সে বলেছে .... হ্যাঁ , মনে পড়েছে বিদ্যেসাগর সে বিধবাদের কষ্ট দূর করবে ....
হো হো করে হেসে ওঠেন পিসিঠাম্মা --- ওরে সে সাগরই হোক আর সমুদ্দুরই হোক সে তো ব্যাটাছেলে | বিধবার জ্বালা মেয়েরাই বোঝে না তো কোন ব্যাটাছেলে তা বুঝবে | আয় দেখি আমার কোলে মাথা দিয়ে শো |
কুমুদিনী শুয়ে শুয়ে বলে --- না গো রতনদাদা বলেছে বিদ্যেসাগর সব ঠিক করে দেবে ..... তুমি কিচ্ছু জানো না |
ঠান্ডা হিম শীতল হাতটা কুমুদিনীর মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলেন --- ঠিক করলেই ভালো .... তাহলে তোর মতো বাংলার মেয়েগুলো বেঁচে যাবে এই যন্ত্রনার হাত থেকে |
কুমুদিনী ঘুমিয়ে গেছে | এখনো বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে | পিসি ঠাম্মা আস্তে আস্তে কুমুর মাথাটা কোল থেকে নামিয়ে উঠে দাঁড়ান | কে এই বিদ্যেসাগর ? যে নিজে একজন ব্যাটা ছেলে হয়েও মেয়েদের দুঃখ যন্ত্রণার কথা ভাবে | এ যেন রূপকথার গপ্প | তার সম্পর্কে আরো জানতে ইচ্ছে করছে , মনে মনে হাসে পিসিঠাম্মা পরের একাদশীতে কুমুর কাছে বাকীটা জেনে নেবে | মেয়েটা সারাদিন না খেয়ে এখন দুটো মুখে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে | আহা রে!! সবই অদৃষ্ট । রাতের অন্ধকার একটু একটু করে ফিকে হচ্ছে দিনের আলো ফুটতে চলেছে | মেঘও কেটে যাচ্ছে | আগামীতে রোদ ঝলমলে দিন অপেক্ষা করছে | পিসিঠাম্মা কুমুর মাথায় একটু চুমু খেয়ে হাওয়াতে মিলিয়ে যান।
|| সমাপ্ত ||
সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল। একেই বলেে পাকা হাতের লেখা।
Posts: 839
Threads: 3
Likes Received: 672 in 435 posts
Likes Given: 1,421
Joined: Dec 2022
Reputation:
51
good one
Posts: 4,427
Threads: 6
Likes Received: 9,307 in 2,849 posts
Likes Given: 4,330
Joined: Oct 2019
Reputation:
3,226
একাদশী গল্পটা সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মতো একটি গল্প। লেখককে কুর্নিশ জানাই।
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,202 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,738
প্রাণ ও একাদশী পরপর পড়লাম। গায়ে কাঁটা দেবার মতো কাহিনী দুটোই। শুধুই যে ভয় কাঁটা দেয় তা কে বললো? এমন সব লেখা পড়লেও ওই একই অবস্থা হয়। অসাধারণ!
প্রথমটা পড়ে একবার ভেবেছিলাম এটা এখানে কেন? মানে ভয়ের কি আছে? কিন্তু পরে ভাবলাম একজন মায়ের সামনে ছেলের ওই অবস্থা দেখার চেয়ে বড়ো আতঙ্ক আর কিচ্ছু হতে পারেনা। আর শেষে তার ফিরে আসা!
আর দ্বিতীয় গল্পের ওই শেষের লাইন গুলো!! দুর্দান্ত!! এসব পড়লে মনে হয় লেখার জগতে কতটুকুই বা জ্ঞান অর্জন করেছি? পুরোটাই বোধহয় জানা বাকি।
ধন্যবাদ এমন সৃষ্টি এখানে তুলে ধরার জন্য ♥️
Posts: 1,253
Threads: 2
Likes Received: 2,235 in 1,021 posts
Likes Given: 1,627
Joined: Jul 2021
Reputation:
658
•
|