Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
এরকম একটা জায়গাতে তিন বছর আগে এরকম একটা অদ্ভুত থ্রেড খুলে বসেছিলাম , জীবনেও ভাবিনি যে এটা কোনোদিন পঞ্চাশ হাজার ভিউ পাবে।

সবই জোগাড় করা জিনিস এখান ওখান থেকে , কিন্তু কল্পনার বাইরে ছিল যে কিছু এখানকার  বন্ধুদের এসব পড়তেও কখনো কখনো ভালো লাগে।  

Namaskar Heart thanks
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#কথোপকথন

 
-"হাই"
-"ও তুই! হাই!"
-"ব্যস্ত আছিস নাকি?"
-"নাহ্, তেমন না। বল।"
-"এমনিই পিং করলাম। অনেকদিন তোকে খোঁচানো হয়নি।"
-"হা হা! তাই বুঝি? কেমন আছিস?"
-"আমি তো সবসময় ভাল থাকি।"
-"তা বটে! তুই সবসময় ভাল থাকিস। এটা সত্যি দারুণ ব্যাপার।"
-"তুই কেমন আছিস?"
"আমিও ভাল থাকি। নিজের মতো করে।"
-"সত্যি?"
-"একদম, তিন সত্যি!"
-"কোনো কষ্ট টষ্ট নেই বলছিস?"
-"কষ্ট ছাড়া কি জীবন হয়?"
-"তাও ঠিক। তা, এখন কি নিয়ে কষ্ট পাচ্ছিস?"
-"তেমন কিছু না।"
-"আরে বল ই না! তুই কি আমাকে বন্ধু ভাবিস না?"
-"তোকে বন্ধু ভাবি না! কী যে বলিস!"
-"তাহলে বল? কি হয়েছে?"
-"নিজেকে খুব ফেইলিওর মনে হয় আজকাল, জানিস। মানে, তেমন কিছুই যেন করতে পারিনি। সারাজীবন সংসার করলাম, তাও লোকের মন পেলাম না। চাকরি করলাম, সেখানেও খুব বেশি কিছু করতে পারলাম না। এসব নিয়েই ভাবি আর কি "
-"বুঝি রে! তারমধ্যে তো সেরকম কোথাও ঘোরাও হয়নি তোর। অফিস টু বাড়ি, বাড়ি টু অফিস - ব্যাস।"
-"তবেই বোঝ! এভাবে বাঁচা যায়?"
-"কি করবি তাহলে?"
-"জানি না রে, ক্লান্ত লাগছে খুব! মনে হয়, যদি কাল সকালটা দেখতে না হতো…"
-"হুম! আমি রিলেট করতে পারছি। আমার ও মনে হতো তো…"
-"তোর ও? বলিস কি রে! যাহ্! তুই কত খুশি থাকিস সবসময়!"
-"তাতেই বা কি হয়েছে? জানিস, সেবার গানের কম্পিটিশানটায় ফার্স্ট হতে পারলাম না বলে মনে হচ্ছিল গলায় দড়ি দিই।"
-"গানের কম্পিটিশানে ফার্স্ট না হবার জন্য গলায় দড়ি! কী বলিস তুই! পাগল নাকি?"
-"আরও আছে। তুই তো জানিস মহুয়া আমার সঙ্গে কেমন বিট্রে করল। আমার বেস্টফ্রেন্ড হয়ে আমার পছন্দের মানুষকেই.."
-"হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে আছে ঘটনাটা।"
-"সেবারও তো ভেবেছিলাম হাতের কাছে যা যা ওষুধ পাই সব খেয়ে নেব।"
-"কপাল আমার! এসব কেউ ভাবে!"
-"ভেবেছিলাম তো।"
-"আর দ্যাখ, সেদিন তুই একটা খালি গলায় গান গেয়ে ফেসবুকে দিলি, তাতেই কত লোকের লাইক আর ভাল ভাল কমেন্ট।"
-"হ্যাঁ রে, ওই একটা কম্পিটিশান হেরে খুব ক্ষতি কিছু হয়নি।"
-"তবে? আর তোর বরটাও কত ভাল।মানুষ হিসেবে। দুজনে মিলে কি খুব খারাপ আছিস?"
-"স্বীকার করতেই হবে সেটা। খারাপ নেই। শান্তিতে আছি। ভাল আছি।"
-"তাহলেই ভেবে দ্যাখ! ভাগ্যিস কোনো বোকামি করে ফেলিসনি তখন ঝোঁকের মাথায়।"
-"আমিও তোকে সেটাই বলতে যাচ্ছিলাম। তখনকার কষ্ট মারাত্মক ছিল। দমবন্ধ লাগত। তাও, হাল ছাড়িনি। লড়ে গেছি। এখন নিজেকে দেখে ভাল লাগে!"
-"দ্যাটস দ্যা স্পিরিট! আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ।"
-"থ্যাংকইউ। আমিও এটাই বলতে চাই।"
-"কি? যে তুই আমাকে নিয়ে গর্বিত?"
-"হ্যাঁ, কারণ আমি যেমন লড়াই করেছিলাম, তুই ও করছিস। সময়, পরিস্থিতি আলাদা। কিন্তু তোকে তো চিনি হাড়ে হাড়ে, তুই ছাড়ার পাত্রী না! বুক চিতিয়ে লড়ে যাচ্ছিস, যাবি। "
-"থ্যাংকইউ। "
-"একটা প্রমিস করবি?"
-"কি?"
-"আজ কুড়ি বছর পরে আঠেরোর আমাকে নিয়ে যেমন গর্ব হচ্ছে তোর, কুড়ি বছর পরে আজকের আটতিরিশের মেয়েটিকে দেখেও যেন আটান্নের গর্ব হয়। করবি, প্রমিস?"
-"উফ! এত্তটুকু বাচ্চা মেয়ে, মাত্র আঠেরো, এত জ্ঞান শিখলি কোথা থেকে রে?"
-"তোর থেকেই তো! আঠেরোর আমি পেরেছিলাম তাই তো জানি তুই ও পারবি। নিজের মতো করে জয়ী হতে। আবার আটান্নতেও…"
-"আবার আটান্ন? তখন তো বুড়ি হয়ে যাব, কোমরে, হাঁটুতে বাত.."
-"দাঁতও হয়ত সব পড়ে যাবে… চুল তো উঠে যাবেই!"
-"হ্যাঁ… তবু…"
-"লড়াই ছাড়িস না, প্লিজ।"
-"প্রমিস।"
-" Heart "

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
অণুগল্প

 
সপ্তাহ কয়েক ধরেই চোখে একটা সমস্যা হয়েছে বিজন বাবুর। চোখ থেকে জল পড়ছে… লেখা পড়তেও একটু কষ্ট হচ্ছে। আবার মনে হয় পাওয়ার বাড়ল।
মাসের শেষ… আবার খরচের ধাক্কা!
আর কি… যেমন কপাল!
বেজার মুখে চশমাটা খুলে একটু চোখ বুজলেন বিজন বাবু। নাহ্, একবার বাড়ির কাছের চশমার দোকানটায় যেতেই হবে। চোখ বলে কথা… অবহেলা করা উচিৎ হবে না। কি থেকে কী হয়ে যায়!
এখনও অনেক দায়িত্ব পূরণ বাকি…
রুমাল দিয়ে চোখটা মুছে নিয়ে আবার কম্পিউটারের দিকে তাকালেন উনি। এক্সেল শীটে অনেক রকম হিসেব। প্রতিটাই ক্যালকুলেটারে একবার করে মিলিয়ে দেখে নেন উনি। এত লাখ লাখ, কোটি কোটি টাকার ব্যাপার… যদি একটুও ভুল হয়ে যায়, কোম্পানির ক্ষতি হয়ে যাবে। তাই, সময় লাগে লাগুক, কিন্তু বারবার মিলিয়ে দেখেন হিসেব বিজন বাবুর।
সত্যি বলতে কি, এই অতি খুঁতখুঁতে স্বভাবের জন্য কেউ সেভাবে ওঁকে পছন্দ করেন না,বোঝেন বিজন বাবু। ওঁর কাজে বেশি সময় লাগে, পেটি ক্যাশ থেকে পাঁচ টাকা দিতে হলেও দুটো কাগজে সই করান - নিপুন ভাবে ফাইলিং করেন… বিল পেমেন্টের সময় তো এতবার চেক করেন যেন কেউ ওঁকে না বলে কিডনিটাই কেটে নেবে…
শুনেছেন এসব অভিযোগ বিজন বাবু। কিন্তু তাতে কিছু মনে করেননি উনি। উলটে মজা পেয়েছেন কিডনির কথা শুনে।।কিডনি দেওয়া যদি অতই সোজা হতো… মিনুকে দিয়ে দিতেন না উনি? এভাবে অকালে চলে যেতে দিতেন?
এত লোক ব্যঙ্গ করে, তবু নিজের স্বভাব পাল্টাতে পারেন না বিজনবাবু। নিজে যেমন খুঁটিনাটির দিকে নজর দিয়ে কাজ করতে ভালবাসেন, তেমনি আশেপাশের কেউ ফাঁকি দিলেও খুব রেগে যান উনি। মাঝেমাঝেই মালিকদের চেনা লোকজন কাজ শিখতে, যার পোষাকী নাম 'ইন্টার্নশিপ', সেটা করতে অফিসে আসে - তিন মাস বা ছ'মাসের জন্য। তাদেরকেও বকে দেন উনি। এজন্য আবার অনেকে 'খ্যাঁকানি বুড়ো' বলে ডাকে। তা ডাকুক গে…
মাথাটার যন্ত্রণা করছে এবার। আবার চোখে জল আসছে। এই হতভাগা চোখের জন্য কি কাজটা আজ শেষ হবে না নাকি? যেদিনের কাজ সেদিন শেষ না হলে ভাল লাগে না একদম…
চশমাটা খুলে টেবিলের ওপর রেখে চোখটা বন্ধ করলেন বিজনবাবু। মাথার যন্ত্রণাটা বাড়ছে…
"স্যার! আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?" একটা গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন বিজনবাবু।
"অ্যাঁ?" তারপর চশমাটা পরে বুঝলেন বছর দুয়েক আগে তিনমাসের জন্য ইন্টার্নশিপ করেছিল এই ছেলেটি। কোম্পানির মালিকের বন্ধুর ছেলে। লন্ডন না আমেরিকা কোথা থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্ট পড়ে হাতেকলমে কাজ শিখতে এসেছিল এই অফিসে। বড্ড অমনযোগী ছিল। একদিন সামান্য একটা পারচেজের বিলে মেটিরিয়ালের নামেই বানান ভুল দেখে খুব রেগে গেছিলেন বিজনবাবু। বকেও দিয়েছিলেন ছেলেটিকে। সেলসের অখিলেশ বলেছিল "দাদা, মালিকের খুব ক্লোজ ফ্রেন্ডের ছেলে… এভাবে ঝাড় দিলে? কিছু যদি বলে তোমাকে?"
"যদির কথা নদীতে! বললেই হলো? আরে, ছোটখাটো ব্যাপারে নজর দেবে না? এখানে তো শিখতেই এসেছে…" বলেছিলেন বিজন বাবু।
না, ওঁকে কেউ কিছু বলেনি। তবে ছেলেটি তার দিন সাতেক পর থেকেই আসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
কিন্তু, সে এখন, এইখানে?
"আকাশ? ভাল তো? " জিজ্ঞেস করেন বিজনবাবু।
"হ্যাঁ স্যার ভাল আছি। আপনি ঠিক আছেন তো?"
"হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও ভাল।"
"কিজন্য এসেছেন শুনি?" এভাবে তো বলা যায় না, তাই জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন বিজনবাবু।
"স্যার, কাল 'বাংলার সময়' পত্রিকা থেকে একটা অ্যাওয়ার্ড দিয়েছে আমাকে। 'রাইজিং ইয়ং অন্ত্রপ্রেনারের'। তাই সামান্য মিষ্টি নিয়ে এসেছি। " মোলায়েম গলায় বলল ছেলেটি।
"বাহ! তুমি ব্যবসা করছ? খুব খুশি হলাম।" অকৃত্রিম হাসেন বিজন বাবু।
"হ্যাঁ, স্যার। করছি ছোটখাটো একটা।… মনে আছে স্যার, একবার আপনি আমাকে কত বকা দিয়েছিলেন? একটা ছোট ভুলের জন্য? সেদিন আমি প্রায় কেঁদেই ফেলেছিলাম…" বলে ওঠে ছেলেটি।
ম্লান হাসেন বিজন বাবু। হ্যাঁ, বকেছিলেন তো! ছেলেটি এখনও সেটা মনে রেখে দিয়েছে!
"কাল অনুষ্ঠানের পর থেকেই খুব আপনার কথা মনে পড়ছে স্যার।"
"আমার কথা?" ছেলেটির মনে বোধহয় খুব আঘাত লেগেছিল… তাই কথা শোনাতে এসেছে…
"হ্যাঁ স্যার, আপনার কথা। আপনি না থাকলে… আজকের এই জায়গায়… আসতে পারতাম না স্যার…। সেদিন আপনার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছিলাম। আপনি বারবার বলছিলেন কাজ করতে গেলে ডিটেইলিং এ ও নজর দিতে হবে বাকি সবকিছুর মতো। খুব রেগেও গেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার বাবার অত বড় ব্যবসা, আপনার মতো দশজন আমার জন্যে কাজ করতে পারে।"
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিজনবাবু। ছোকরা বুঝল না…
"কিন্তু স্যার, নিজের ব্যবসা শুরু করে বুঝলাম আপনি কত ঠিক ছিলেন। ছোট্ট ছোট্ট জিনিস ঠিকভাবে দেখলে তবেই বড় কিছু হতে পারে। যেমন বিন্দু বিন্দু মিলে সাগর তৈরি হয়? তাই আজ আপনাকে 'থ্যাংকইউ' বলতে এসেছি স্যার…। আজ বিদেশে সবাই সবাইকে ধন্যবাদ জানায়। আজ 'থ্যাংকস গিভিং ডে।' কিন্তু আমার কাছে প্রতিদিনই আপনাকে ধন্যবাদ জানানোর দিন…" একটা বড় মিষ্টির প্যাকেট আর একটা চকোলেটের বাক্স ওঁর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল ছেলেটি।
চোখ বুজে ফেললেন বিজনবাবু!
নাহ্, চোখটা দেখাতেই হবে। এভাবে গাল বেয়ে হড়পা বাণ নামলে হয় যখন তখন?
ধ্যাত!

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
এর পরের গল্পটা আমার এক প্রতিবেশিনী বান্ধবীর বয়স্কা মায়ের লেখা ,  ভালো লাগলো তাই ওকে না বলেই এখানে দিলাম। 


Smile
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
প্রতিবিম্ব

রুচিস্মিতা ঘোষ

বিভু রোদের দিকে পিঠ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। ওর হাতে একটা বই। শীতের সজীব সকাল। ওর মুখের একপাশটা দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে।  রোদের মিষ্টি আভা ছড়িয়ে পড়ছে ওর নিখুঁত কামানো গালে। কদিন ওর অশৌচ চলছিল। গালে না- কামানো দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো।  বিভু মাথা কামাতে চায়নি। আমি বাধা দিইনি। আজ চুল আঁচড়েছে পরিপাটি। 
 
  শীতের এই শান্ত সকালে ওকে ঠিক দেবদূতের মত লাগছে। কালই চলে যাবে বিভু। বুক ভাঙছে আমার। ওকে তো ছেড়েছি কবেই। ওর সেই আঠারো বছর বয়সে। পড়াশোনা শেষ করে আজ কয়েক বছর চাকরি করছে ব্যাঙ্গালোরে।  ' দিনের ছুটি নিয়ে আসে আবার চলেও যায়। অভ্যেস হয়ে গেছে। কিন্তু এবারের চলে যাওয়া এত নিঃস্ব করছে কেন আমাকে? বিভুর বাবা চলে গেল বলে? হয়তো তাই। হঠাৎই চলে গেল বিজন। কোনো আয়োজন ছাড়াই। ঘুমের মধ্যেই হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেল।  আমি তখন স্থবির।  বাকরুদ্ধ।  অশ্রুহীন। কাকে দোষ দেব? সময়! হ্যাঁ, এখন সময়কেই প্রতারক মনে হচ্ছে।  ভেতরের হু-হু কান্না চেপে রেখে ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরব বুকের মধ্যে? পারছি না। হয়তো বড় হয়ে গেছে বলে। 
'দিন আলো নিভিয়ে শুয়েছিলাম শুধু। দিনের বেলাটা লোকজনের আসা-যাওয়া। অনিবার্য কাজের ভিড়। রাতের বেলায় শুয়ে থাকতাম মন শিথিল করে। গ্রামের শান্ত পুকুরের মত ঠান্ডা হয়ে আসত ভেতরের অস্থিরতা।  কাল রাতে সেই শান্তিটুকু পাইনি। স্নায়ুর উপর অদম্য চাপ তার অত্যাচার জারি রেখেছিল।
  কাল রাতে বিভু এসে বসেছিল আমার পাশে।  আমার হাতে ওর হাতের উষ্ণ স্পর্শ পেয়েছিলাম। আমার চোখ ছাপিয়ে জল আসছিল। আসতে দিইনি।  বিভু বিস্ময়ে দেখছিল তার স্থির শান্ত মা- কে। স্থির-- অবিচল এক নিস্তরঙ্গ দিঘি। সেই দিঘির তল খুঁজতে চেষ্টা করছিল। পারেনি। বিভু আর আমার মধ্যে শান্ত দুপুর বসেছিল ধ্যানমগ্ন ঋষির মত। বিভুর হাতের উষ্ণতাটুকু আমার হাতের আঙুলে সংক্রামিত হচ্ছিল। একসময় ভাঙা গলায় বলে উঠল -- ' মা, ব্যাঙ্গালোরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেব এবার। তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব।' আমি ওকে বলতে পারিনি, আজ তুমি একা। কাল তোমার বৌ আসবে। তোমাদের দুজনের মাঝখানে তৃতীয় ব্যক্তির অস্তিত্ব না থাকাই উচিত।
  বিভু কি বুঝতে পেরে গিয়েছিল আমার মনের কথা? ওর চোখে, স্পর্শে সেই একই উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়ল মরা বিকেলের মত -- একই অস্তিত্বের দুটো মানুষের মধ্যে অনেক কথা হয়ে গেল নিরুচ্চারে।
  বিভু তো জানে আমার সবটুকু মিশে রয়েছে ওরই মধ্যে। সে আমার বিজনের মাঝখানে এক সেতু ছিল। আমার জীবনের এক টুকরো মরুদ্যান। তা বলে বিজনকে নিয়ে আমি কি কোনোদিন ভাবিনি? বিজনও জানত, সে আমার সবটুকু হতে পারে না।
  হঠাৎ বাসন্তীর পায়ের আওয়াজে এলোমেলো হয়ে গেল আমার সমস্ত ভাবনা। 'দিন ধরে - তো এই সংসারের সর্বময়ী কর্ত্রী হয়ে উঠেছে। তবুও সে তো কাজের লোকই। পেছন থেকে সে বলে উঠল --' বৌদি, আর কতদিন এমনভাবে চলবে বলুন তো? এবার কাজে মন দিন। আমি কি ছাই এই সংসারের সবকিছু জানি?
  তার গলার স্বরে বিরক্তির সঙ্গে এক টুকরো মায়াও জড়িয়ে ছিল। আমি জানালা ধরে দাঁড়িয়েই রইলাম। ওর দিকে না ফিরে প্রত্যুত্তরে বললাম -- ' আর কয়েকটা দিন চালিয়ে দাও বাসন্তী। ' সে নির্বোধ নয়। কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালো সংসারের প্রাত্যহিক কাজে।
  জানালা দিয়ে উড়ন্ত আঁচলের মত হাওয়া ভেসে আসছে। আমি গায়ের চাদরটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলাম। পাশের বাড়িতে জোরদমে টিভি চলছে। বিজ্ঞাপনের বকবকম। ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ওদের বাড়ি গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দিই। বারান্দায় একঝাঁক শালিক আর চড়ুই হুটোপুটি বাঁধিয়েছে। ইচ্ছে করছে না ওদের প্রাপ্য খাবারটুকু ছড়িয়ে দিই। আমার উদাসী মন শরীরটাকেও অবাধ্য করে তুলেছে।  সংসার, সমস্যা, বাস্তব, পরিপার্শ্ব কিছুই আমার চেতনা স্পর্শ করছে না। মাথার পিছনদিকটায় একটা চাপ ব্যথা। প্রেসারটা কি একটু বাড়ল? বিস্মৃত অবহেলার ঝোপঝাড় থেকে উড়ে আসছে একঝাঁক স্মৃতি।  আমার বিয়ের দিনটা কেন যে বড় কাছ ঘেঁষে দাঁড়াচ্ছে! মনে পড়ছে সব কথা।
  বিভুর মনে কি একটুও অস্থিরতা নেই? কী নিবিষ্ট মনে পড়ে চলেছে বইটা। আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছে বিভুর দিকে। একেবারে সেই এক চেহারা।  বিজনের সেই এক বয়স। বিভুর এখন তিরিশ।  বিজনও তিরিশেই বিয়ে করেছিল। মনে পড়ে যাচ্ছে বৃহদারণ্যক আর কৌষিতকির দ্বিতীয় অধ্যায়ে উপনিষদের সেই লাইনগুলো -- " পিতার মৃত্যুকাল আসন্ন হলে তিনি পুত্রকে ডেকে পাঠান, মাল্য নববস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পুত্র এসে পিতার উপর শুয়ে পড়ে।  ইন্দ্রিয় দ্বারা ইন্দ্রিয় স্পর্শ করে। পিতা বলেন, -- " বাচং মে ত্বয়ি দধানি, চক্ষুর্মে ত্বয়ি দধানি, শ্রোত্রং মে ত্বয়ি দধানি -- ' আমার বচন তোমার মধ্যে দিয়ে গেলাম,  আমার দেখার দৃষ্টিও তোমাকে দিয়ে গেলাম,  আমার শ্রবণ তাও তোমাকে দিলাম' এমনিভাবে কাম, কর্ম, সুখ, দুঃখ, অন্ন, প্রজ্ঞা পর্যন্ত।  আর পুত্র উত্তরে বলে যায় তোমার বাক, চক্ষু, শ্রবণ...  প্রজ্ঞা আমি ধারণ করি।" কখন নীরবে আমার অগোচরে ঘটে গেল এত আয়োজন আর আমি জানতেও পারলাম না! বিভুকে এখন যত দেখছি,  তত অবাক হচ্ছি। বিজনের সেই চোখ, নাক, কপাল এমন কি চিবুকের ডৌলটিরও কী অদ্ভুত সাদৃশ্য! যেন ঠিক তিরিশ বছরের বিজন।
 
পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি, ছিপছিপে, ঝকঝকে চোখ। কেমিষ্ট্রির রিসার্চ ফেলো। সম্বন্ধটা এনেছিল বাবার বন্ধু অজিতকাকু। প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গিয়েছিল বিজনকে। তবু বিয়েতে রাজি হতে পারিনি প্রথমে। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করা আমার একটা অভ্যাস।  আসলে মনের মধ্যে লালন করতাম একজনকে নয়, দুজনকে।
 
তমাল-- লম্বা একহারা চেহারা। এলোমেলো ঝাঁকড়া চুল। অযত্নে বেড়ে ওঠা দাড়ি। কবি তমাল। সে- আমার প্রথম প্রেম।  ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি তখন। আমার আর তমালের উচ্ছল সেই দিনগুলো! পাতায় পাতায় অজস্র কবিতা। সবুজ কালি দিয়ে লেখা। আমি বলতাম সবুজ কবিতা। সেই কবিতার খাতা এখনো যত্ন করে রেখে দিয়েছি।  পদ্মপাতার মোড়কে জলের গভীরে লুকিয়ে রেখেছি সেই প্রেম। তমাল আমার জীবনে এলো না। বাউন্ডুলে বেপরোয়া তমাল কলেজের পড়াশোনা শেষ না করেই হারিয়ে গেল আমার জীবনে ক্ষত- উল্কি এঁকে। 
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
যখন এম পড়ছি, তখন আমার দ্বিতীয় প্রেম।  প্রবুদ্ধ গুহ। সাহিত্যের অধ্যাপক।  কালো ফ্রেমের চশমার আড়ালে তাঁর চোখ দুটো এক অদ্ভুত আলো ছড়াত। মুখ গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ।  সহজ অনাড়ম্বর তাঁর সাজপোশাক। পরতেন সুতির হাওয়াই শার্ট। ছিপছিপে চেহারা। সেই বয়সে একটুও মেদ জমেনি। চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ চোখ দুটো আমাকে বার্তা পাঠাত। মনে হত অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমার ভেতরটা যেন তিনি দেখতে পাচ্ছেন। আমি আকৃষ্ট হয়েছিলাম তাঁর প্রজ্ঞায়। বয়সে আমার থেকে অনেক বড়। বিবাহিত। তবু প্রেমে পড়লাম। যৌবনের স্বপ্নের কাজল আমার চোখ থেকে হয়তো মোছেনি। মোছেনি তমালের স্মৃতি।  তবুও।
   মনের সঙ্গে অনেক বোঝাপড়া করলাম।  কী যেন একটা অনুভব চরার মত বুকে জন্ম নিল। ভাবলাম সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেবে। জীবনের অনিবার্য পরিবর্তনগুলো মেনে নিতে হয়। বদলে যায় জীবনের মানে। এক অদৃশ্য ঘুণপোকা জীবনকে কাটতে কাটতে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তাই বিজনকেও মেনে নিলাম। বিয়েতে মত দিলাম। তাকে ভালবাসলাম।  বিজনকে ভালবাসার ঘনিষ্ট মুহূর্তগুলোতে তমাল এলো তার এলোমেলো চুল আর একগাল দাড়ি নিয়ে। ভেসে এল সবুজ কবিতা। এলেন প্রবুদ্ধ গুহও তাঁর নিটোল গাম্ভীর্য  -- তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি নিয়ে। ওদের দুজনের মুখ সরিয়ে দিয়ে আমি বিজনের মুখের দিকে ঝুঁকে পড়তে চাইলাম। বিজনের চোখ, ঠোঁটের উষ্ণতা আদর হয়ে শরীরে নেমে এলেও মনের ভেতর মনে হল ঝাড়লন্ঠন ভেঙে পড়েছে - ছিন্নভিন্ন কাচের টুকরোগুলো ঝরাচ্ছে রক্তপাত।
   বিয়ের দু- বছরের মধ্যেই বিভু এলো। বিজন ওর নাম রাখল বিভাস। আদর করে 'বিভু' বিভু যখন বড় হচ্ছে, যখন ওর চোদ্দ- পনের বছর বয়স, ওর পড়ার টেবিল গোছাতে গিয়ে দেখি একটি খোলা খাতা। তার পাতায় পাতায় কবিতা। চমকে উঠলাম। নিজেকে প্রশ্ন করলাম। কোথা থেকে পেল এই প্রতিভা? বিজন তো কবিতা লেখে না। এমন কি সাহিত্যে ওর রুচিও নেই। আমি সাহিত্যের ছাত্রী হলেও কবিতা কোনোদিন লিখিনি। চেষ্টা করেছি, তবু পারিনি। তবে? তবে কি মনের গোপন অন্দরে তমালের কবিতারা বয়ে যাচ্ছিল? মিশে গিয়েছিল আমার রক্তস্রোতে? যে রক্ত বিভুর ধমনীতেও বয়ে চলেছে? কেমন করে সম্ভব? বুঝতে পারিনি।
   বিভু ভালবাসল একটি মেয়েকে। একদিন বিভু আর মধুশ্রী গল্প করছে বিভুর ঘরে। টেবিলে ছড়ানো বই খাতা। মধুশ্রী প্রশ্ন করছে বিভুকে -" এই তুমি সবুজ কালি দিয়ে কবিতা লেখো কেন?" আমার হাত থেকে কফির মগ মেঝেতে পড়ে ভেঙে খানখান। ওদের জন্য নিয়ে যাচ্ছিলাম। ওরা দুজনে ছুটে এসে  জড়ো করছে কাচের টুকরো।  কান্না গোপন করতে আমি রান্নাঘরে। 
   তারপর বিভু আরও বড় হল। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম বদলে যাচ্ছে ওর চোখের দৃষ্টি। ওর মধ্যে আমি দেখতে পাচ্ছি প্রবুদ্ধকে। সেই তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি। যেন আমার ভিতরটা পড়ে নিচ্ছে।
   কেন? কেন? কেন? নিজেকে আবার প্রশ্ন। বিজনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে ওদের দুজনকে ভুলতে পারিনি,  তাই?
উত্তুরে হাওয়ায় শুকনো পাতারা ঝরে পড়ছে চারদিকে। বিন্দু বিন্দু রিক্ততা এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি করছে।  আমি প্রবল আবেগে কাউকে জড়িয়ে ধরতে চাইছি। বিভু চেয়ার টেনে যেখানে বসেছিল, সেখানটায় রোদ সরে গেছে। ওর বোধহয় শীত করছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঠিক মনে হল যেন বিজন উঠে দাঁড়াল।  সেই এক ভঙ্গি। আমিও জানালা ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। ঘরের চারদিকে চোখ চলে গেল। কেমন যেন একটা শীতলতা ছেয়ে যাচ্ছে আমার শরীরে।  ডাক্তার যখন বিজনকে দেখে বলল, 'হি ইজ নো মোর' চারপাশটা ফাঁকা হয়ে গেল। মনে হল আমার পৃথিবীটা আচমকা আলো- বাতাসহীন। কোথাও আর কোনো শব্দ নেই। আমার বিভুর কথা মনে হল। ওকে একটা খবর দিতে হবে। মধুশ্রীর কথাও মনে হল। সে এই শহরেই থাকে।  ডাক্তারকে সেসময় কী বলেছিলাম খেয়াল নেই। শুধু মনে পড়ছে মাথার উপর তীব্র আলোটা নেভানো হয়নি। আলোটা ঘিরে একটা মথ ঘুরছে। মুহূর্তের মধ্যে একটা টিকটিকি দেয়াল বেয়ে মথটাকে গিলে নিল। আমার শ্রবণ তখন বধির। ডাক্তার যে কী বলছে, কাকে ফোন করছে, কোনো কথা কানে ঢুকছে না।
নির্বাক বসেছিলাম।  সকালের ফ্লাইটে বিভু এলো। মধুশ্রী এসেছিল তারও আগে। আমার হাত ধরে বসেছিল অনেকক্ষণ। 
 
আমি ঘরের সমস্ত আসবাবে হাত বোলালাম। বিজনের চেয়ারে টেবিলে -- যেখানে বসে পড়াশোনা করত। সেই গন্ধ -- সেই উষ্ণতা।  বিজন তার সমস্ত চিহ্ন মুছে চলে গেছে দীর্ঘ প্রবাসে। অথচ ঘরের আসবাবপত্র বলছে, আছে, সে আছে। মনে হল চেয়ারটায় বিজন বসে আছে। আমি চেয়ার ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
 বিভু এসে দাঁড়াল ঘরের সামনে। বুঝতে পারল, এই ঘর এখন মা- খেলাঘর। বাবার স্মৃতি নিয়ে খেলা।  মধুশ্রী বলেছিল, ' বিভু, আন্টিকে নিয়ে এখন ভীষণ ওয়ারিড আমি। একা একা কিভাবে দিন কাটাবে?' আমার কানে গিয়েছিল কথাটা। বিভু বলল,'মা-কে আমার কাছে নিয়ে যাব।' মধুশ্রী বলল, 'তাই কর। আগে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নাও। তারপর আন্টিকে নিয়ে যাও। এক বছর কেটে গেলে আমরা বিয়ে করব। এক বছর তো আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে।'
 ওদের কথোপকথনে আমারও চিন্তা হচ্ছে। আমি কি ওদের সঙ্গে থাকতে পারব? মাতৃত্বের অধিকারবোধ হয়তো বিঘ্ন ঘটাবে ওদের একান্ত জীবনে।  আমি ওদের কিছু বলিনি।
  বিভু দরজা ছেড়ে ঘরে ঢুকে আমার কাছ ঘেঁষে দাঁড়াল। বলল, 'বাসন্তীমাসি রান্নাবান্না সেরে কখন চলে গেছে।  চল মা, কিছু খেয়ে নেবে। আমারও খুব খিদে পেয়েছে। '
  নিঃশব্দে আমি আর বিভু অনেক না- বলা কথা চেপে রেখে খেয়ে নিলাম। আমাদের মাঝখানে নীরবতা নিয়ে নিঃস্তব্ধ দুপুর সঙ্গী হয়ে রইল।
  শূন্য বিছানা আমাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু ঘুম যে আসে না। শুধুই ঘুমের আয়োজন। বিছানায় শরীর এলিয়ে দেবার আগে পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ চলে গেল।  কী চেহারা হয়েছে আমার! ' দিনেই বয়স যেন বেড়ে গেছে।  গলার চামড়া কি কুঁচকে গেল? বলিরেখা?  এখন কথা ভেবে কী হবে? আয়নার কাছ থেকে সরে এলাম।
  বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজতেই কেমন যেন একটা তন্দ্রার ঘোর।  মনে পড়ল কাল রাত্রিতে একটুও ঘুমোইনি। একটা দীর্ঘঘুমের আশায় পাশবালিশটাকে চেপে ধরলাম বুকে। 
   হালকা তন্দ্রায় মনে হল যেন পাশে কেউ শুয়ে আছে। আমার হাত স্পর্শ করল তাকে। চমকে উঠলাম।  বিজন! চোখ কচলে উঠে বসলাম।  দেখি, বিজনের শূন্য জায়গায় বিভু শুয়ে আছে। অবিকল সেই একই ভঙ্গি। ঘুমিয়ে পড়েছে।  ওর নরম গাল বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। 
   বিজন চলে গেছে শরীর ছেড়ে। রেখে গেছে একটি গভীর সম্পর্ক।  বিভুর মধ্যে এখন তমাল নয় -- প্রবুদ্ধ নয় -- বিজনকেই দেখতে পেলাম আমি।
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
[Image: IMG-20220105-WA0000.jpg]

অভিষঙ্গ || অনন্যা দাশ ||
 
রমাদিকে আমাদের এখানে সবাই মনে প্রাণে ঘৃণা করত। সবাই মানে এখানকার যতজন বাঙালি আছে আমরা শুধু আমার স্ত্রী দিশা ছাড়া। দিশা কেবল বলত যেটা ঘটেছে তাতে রমাদির তো কোনও দোষ নেই।   
আসল ঘটনাটা বলি তাহলে। আমাদের মার্কিন মুলুকের এই ছোটো জায়গায় বাঙালির সংখ্যা বেশ কম। সারা এলাকা মিলে হয়তো তিরিশ ঘর হবে। তার মধ্যে বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বহুদিন আগে এখানে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন, অনেকদিন মানে সত্যিই অনেকদিন, সেই আশির দশকে। সেই রকম একটা পরিবার তন্দ্রাদি  তাঁর স্বামী ললিতদা। দুটো ছেলেকে নিয়ে ভরপুর সংসার তাদের। ললিতদার নিজের ব্যবসা। তা সেই ললিতদার একদিন কী ভিমরতি ধরল ষাট বছর বয়সে ‘আমি আটচল্লিশ বছরের বিপত্নিক মানুষ’ বলে ম্যাট্রিমনিয়াল বিজ্ঞাপন দিয়ে দিলেন। তারপর চুপি চুপি দেশে গিয়ে আরেকটা বিয়ে করে চলে এলেন। সেই দ্বিতীয় স্ত্রীই হলেন রমাদি। ললিতদা এই ভয়ঙ্কর কাজটি করার পর এখানকার বাঙালিরা ললিতদা আর তাঁর নতুন স্ত্রীর সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করল। সবাই হাপুস নয়নে কেঁদে পৃথিবী ভাসিয়ে দেওয়া তন্দ্রাদি আর তাঁর দুই পুত্রের পক্ষ নিল। ললিতদা আর রমাদির নামে চারিদিকে ঢি ঢি, সমস্ত বাঙালি অনুষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়া হল তাঁদের।      
দিশা শুধু বলেছিল, আচ্ছা রমাদির দোষটা কোথায় বলতে পারো? উনি তো ভেবেছিলেন একজন আটচল্লিশ বছরের বিপত্নিক মানুষকে বিয়ে করছেন। ওঁর তো জানার কথা নয় যে ললিতদার বউ আর দুই ছেলে এখানে মার্কিন দেশে পড়ে আছে।
এদিকে তন্দ্রাদি চাকরি করেন না। ছেলেরা যে যার মতন আলাদা হয়ে গেছে। ললিতদা তাই নিজের ব্যবসার আয় দিয়ে দুই স্ত্রীকে সামলাতে লাগলেন। থাকতেন অবশ্য রমাদির সঙ্গেই আলাদা একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে। ওঁর আগের কেনা বাড়িটাতে তন্দ্রাদি রইলেন।  
ক্রমে লোকে ভুলে যেতে লাগল। সাধারণ মানুষের এই সব ব্যাপারে স্মৃতিশক্তি বেজায় কম। আমিও ভুলে যেতে লাগলাম। দিশা কিন্তু ভুলল না। একদিন হঠাৎ বলল, এই জানো রমাদি কিন্তু বেশ পড়াশোনা জানা মহিলা। দেশে একটা কলেজে পড়াতেন। এখন ললিতদার ব্যবসার সব কাজ শিখে ফেলেছেন।
আমি শুনে জিজ্ঞেস করলাম, এত সব তুমি কী করে জানলে?
ইন্ডিয়ান দোকানে দেখা হয়েছিল। তখন আলাপ করলাম। আমি তো আর বাঙালি নই তাই আমার আলাপ করতে দোষ নেই!” বলে নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলল দিশা।   
দিশারা আসলে বাঙালি নয় ঠিকই। ওরা রাজস্থানের, কিন্তু ওদের পরিবার তিন পুরুষ ধরে কলকাতায় বাস করছে। দিশা জলের মতন বাংলা বলতে পারে!
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কী দরকার ওঁর সঙ্গে ভাবটাব করার?
দিশা কিছু বলল না। পরে জেনেছিলাম  আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে রমাদির সঙ্গে কথা বলত।  
তারপর একদিন ললিতদা দুম করে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন। কোনও উইল তিনি করে যাননি আর তন্দ্রাদির সঙ্গে আইনি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়নি তাই সেই দিন এক ঝটকায় তন্দ্রাদি ললিতদার সব সম্পত্তি পেয়ে গেলেন আর রমাদি পথে বসলেন।
অফিস থেকে ফিরে দেখলাম দিশার ছটপটে ভাবটা। আমাকে বলল, একবার রমাদির বাড়িতে নিয়ে যাবে আমাকে?
আমি রেগে গিয়ে বললাম, কী দরকার? ওঁর সঙ্গে ললিতদার বিয়েটা তো বিয়েই নয়। উনি তো আইনের চোখে ললিতদার স্ত্রী নন। ডিভোর্স যখন হয়নি তখন তন্দ্রাদিই আসল স্ত্রী। বাকি সব এক্সট্রা ম্যারিটাল লিভ টুগেদার ছাড়া কিছুই নয়।”  
রাখ তো তোমার আইন! স্ত্রী না হোক মানুষ তো? যে মানুষটার সঙ্গে এত বছর এক ছাদের নিচে রইলেন সে একদিন দুম করে মরে গেল তাতে তাঁর কষ্ট হবে না? আমরা মানুষ হিসেবে তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না একটু ক্ষণের জন্যে?
 কথার কোনও উত্তর ছিল না আমার কাছে তাই আমি দিশাকে নিয়ে গেলাম। নিজের বড়ো বাড়িটা তন্দ্রাদিকে থাকতে দিয়ে রমাদিকে নিয়ে ছোটো একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে থাকতেন ললিতদা। কাপড় কাচার মেশিনও ছিল না। বাইরের লন্ড্রিতে গিয়ে কাপড় কাচতে হত নাকি।
রমাদি দিশাকে জড়িয়ে ধরে খুব কাঁদলেন। আমি বোকার মতন বসে রইলাম। ঘরে একটা খাঁচায় দুটো সান কনিওর পাখি। হলুদ কমলা রঙ। দেখতে ভারি সুন্দর। তবে কিছু একটা হয়েছে আন্দাজ করে তারাও চুপ করে রয়েছে। পরে জেনেছিলাম ওদের নাম রোমিও আর জুলিয়েট।
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
একটু শান্ত হয়ে রমাদি বললেন, আমি এখান থেকে চলে যাব। এখানে আমাকে সবাই চেনে। সবাই ঘৃণার চোখে দ্যাখে। ললিতের কল্যাণে আমার ভিসার ঝামেলা তো নেই তাই এখানেই অন্য কোন জায়গায় চলে যাব যেখানে আমাকে কেউ চিনবে না। আমার যা বিদ্যে বুদ্ধি আছে তাতে আমি চালিয়ে নিতে পারব আশা করছি। ভয় নেই। আমি তোমাদের তন্দ্রাদির কাছ থেকে কোন কিছুই কেড়ে নেব না। শুধু রোমিও আর জুলিয়েটকে সঙ্গে নিয়ে যাব। এদেরও আমার মতন কেউ নেই।“   
দিশা নিজের জমানো কিছু ডলার এনেছিল, সেগুলো রমাদির হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, এটা তুমি রাখো রমাদি। তোমার লাগবে।
রমাদি নিতে চাইছিলেন না কিন্তু আমরাই জোর করলাম।  
ললিতদার সব জিনিসপত্র, জামাকাপড় দান করে দিয়ে রমাদি আমাদের ওখান থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছি্লেন। আর কারো সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেননি। দিশার সঙ্গেও না।
এর পর কেটে গেল আরো কয়েক বছর। রমাদির কথা আমি অন্তত ভুলতে বসেছিলাম।  
সেদিন রাতে শোওয়ার তোড়জোড় করছি এমন সময় দিশার ফোনটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলে ওকে তুলতে বারণ করি তাও সেদিন  তুলে বসল। হুঁ, হাঁ করে কয়েকটা কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিয়ে বলল, আমাদের হ্যারিসবার্গে যেতে হবে। রমাদি মারা গেছেন।
রমাদি? মানে সেই রমাদি? কার ফোন ছিল?
পুলিশের। উনি দরজা খুলছিলেন না বলে প্রতিবেশীরা পুলিশ ডাকে। তারা এসে ভিতরে ঢুকে মৃতদেহ পেয়েছে। আমার ফোন নম্বর নাকি ওখানে ছিল তাই আমাকে ফোন করেছে। আমাদের পদবি এক বলে আত্মীয় মনে করেছে।
তোমার নম্বর?
হ্যাঁ, তাই তো বলল। বলল বডি ওরা মর্গে নিয়ে যাচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক কিনা সেটা কনফার্ম করবে। তবে আমাদের যেতে হবে।
এবার আমি বেঁকে বসলাম। রেগে গিয়ে বললাম, কোনও দরকার নেই। এখান থেকে যখন চলে গেছেন তখন আমাদের দায়িত্ব শেষ। ওই দু ঘন্টা পথ ঠেঙিয়ে  আমরা কিছু করতে পারব না। উনি কে হন আমাদের? তাছাড়া এখানে সৎকার খুব খরচ সাপেক্ষ।
দিশার চোয়াল শক্ত হল, উনি একজন মানুষ। একজন মানুষ যাঁকে আমরা চিনতাম। মৃত্যুর পর সৎকারটুকু নিশ্চয়ই একজন মানুষ হিসেবে আমরা তাঁকে দিতে পারি! তুমি না গেলে আমি একাই বাস ধরে চলে যাব। খরচ যা লাগে তার ব্যবস্থাও আমি করে নিতে পারব। কাল তো শনিবার কোনও অসুবিধা হবে না। ছুটিও নিতে হবে না।
দিশা জানে আমি কিছুতেই ওকে একা ছেড়ে দিতে পারি না ওই রকম একটা কাজের জন্যে তাই আমরা দুজনেই গেলাম। পাড়াটাতে ঢুকেই চমকে উঠলাম আমরা দুজনেই। রমাদি এখানে থাকতেন? খুবই নিম্নবিত্ত গরিব একটা পাড়া। পাড়ার বেশিরভাগ বাসিন্দাই কালো। ঘরবাড়িগুলোর অবস্থা অতিশয় জীর্ণ। পাড়াটা বেশ নোংরাই বলা যায়। আমি কোনমতে একটা জায়গা খুঁজে বার করে গাড়িটা পার্ক করলাম। তাও খুব ভয় হচ্ছিল,  যা পাড়া সেখানে গাড়ি চুরিটা অপরাধের পর্যায়ও পড়ে না!  
গাড়ি থেকে নেমে আমরা কী করব ভাবছিকোন দিকে এগোবো কিন্তু এর মধ্যেই ওখানে ভিড় লেগে গেল। আমাদের ঘিরে ধরল বেশ কিছু পুরুষমহিলা এবং শিশু। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের চোখে জল। তারা সবাই বুঝতে পেরেছে আমরা রমাদির জন্যে এসেছি।
একজন আমাদের জিগ্যেস করল, উনি তোমাদের কে ছিলেন?
দিশা এক মুহূর্ত না ভেবে বলল, আমার দিদি।
ভীষণ ভালো মানুষ ছিলেন। আমাদের, আমাদের বাচ্চাদের সবাইকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন।
ওরা সবাই পথ দেখিয়ে আমাদের রমাদির বাড়ি অবধি নিয়ে গেল। যিনি বাড়িওয়ালা তাঁর কাছে চাবি ছিল। তিনিই খুলে দিলেন। বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী ছাড়া সবাই বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। আমরা দুজন ওঁদের সঙ্গে ভিতরে ঢুকলাম। এক চিলতে একটা ঘর, সেটাই বসবার ঘর শোবার ঘর সব কিছু আর একটা খুব ছোটো রান্নাঘর আর বাথরুম। এক পাশে একটা টেবিলে রমাদির প্রিয় দুই সান কনিওর পাখি দুটো। তাদের খাঁচার সামনেই টেবিলে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে ‘আমার কিছু হলে আমার বোন দিশাকে এই নম্বরে ফোন করা হয় যেন। সে আমার পাখিদের নিয়ে যাবে।‘ ওই পাখিদুটো ছাড়া যেন আর ওঁর কোন প্রিয় জিনিস ছিল না।  
দিশার চোখে জল।  
আমি দিশাকে বললাম, যে কাজের জন্যে এসেছো সেটা করতে হবে। শেষকৃত্য তো হয়নি। দেহ তো এখনও মর্গে।
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক বললেন, “আমরা জানি। কিন্তু আমরা কেউ তো আত্মীয় নই তাই পুলিশ আমাদের হাতে বডি ছাড়ছে না। ওদের কী সব ব্যাপার আছে কাগজপত্রের। আপনি শুধু আমাদের সঙ্গে চলুন। আমরাই সব করব।“
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
তারপর আমরা অবাক হয়ে দেখেছিলাম এক নিস্বার্থ মানুষের ভালবাসার দাম। রমাদি যাদের পড়াতেন তাদের ভালবাসতেন তাই ওরাও ওঁর জন্যে প্রাণ দিতেও রাজি! এদেশেও এইরকম হতে পারে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।   
যখন বাড়ি থেকে এসেছিলাম তখন মনে করেছিলাম আমাদের অনেক অর্থ খরচ করতে হবে কিন্তু আমাদের পকেট থেকে একটা আধলাও খরচ করতে হয়নিসব ওরাই করেছিল। ওদের কারো অবস্থা তেমন ভালো নয়। বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ছে কারো কারো কিন্তু সে সবের ভ্রুক্ষেপ না করে যার পকেটে যা ছিল সব বার করে দিল ওরা কেউ কেউ গিয়ে  টি এম থেকে তুলে নিয়ে এল। ফিউনারাল হোমের লম্বা কালো গাড়িতে করে রমাদির দেহটাকে মর্গ থেকে ক্রিমেটোরিয়ামে নিয়ে আসা হল। চুল্লির গনগনে আগুনে ছাই হয়ে গেলেন রমাদি।     
সব শেষ হতে বাড়িওয়ালাকে রমাদির সব জিনিস দান করে দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে বাড়ি থেকে রোমিও আর জুলিয়েটকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম। আমার ভয় অমূলক ছিলআমার গাড়িতে একটা আঁচড়ও লাগেনি।
সূর্য তখন অস্তাচলে যাচ্ছে। কমলা সোনালি আভায় ঢেকে গেছে চারিদিক। আকাশে রঙিন মেঘেদের অপূর্ব কারুকার্য।
দিশা পাশ থেকে অস্ফুট স্বরে বলে উঠল, “ভালো থেকো রমাদি!”   
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
**ফুটন্ত ভাতের গন্ধ!**

 
     "রণেন বসু"
 
    "নুতন বউ, ও নুতন বউ -উ -উ-উ। ও-ও নুতন  বউ-উ-উ-উ!" স্নান করে ভিজে শাড়িতে সবে উঠোনে এসে দাঁড়াতেই নুতন বউ লাবণ্য শুনতে পেল, খুড়ি শাশুড়ির ক্ষীণ কণ্ঠে ডাক। "ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ।"
     "যাই খুড়িমা।" হাতের ভিজে কাপড়গুলো বারান্দায় রেখে, লাবণ্য ভ‍্যারাণ্ডার ভাঙা বেড়া ডিঙিয়ে ছোট তরফের উঠানে ঢোকে। ছোট তরফ মানে, একই বাড়ির খুড়ো শ্বশুরের অংশ। দুই তরফের বাড়িই আজ ভগ্নদশা।
     কুড়ি বছর আগে, লাবণ্য যখন বউ হয়ে এই বাড়িতে ঢুকেছিল তখন তরফের অবস্থাই বেশ ভালো ছিলো। এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন। নিজের শাশুড়ি তখন শয‍্যাশায়ী। ভিন্ন শরিক হলেও সম্পর্ক বেশ ভালোই ছিল। সেই থেকে খুড়ি শাশুড়ি তাকে 'নুতন বউ' বলেই ডাকেন! আজ কুড়ি বছর পরেও, সে খুড়ি শাশুড়ির কাছে নতুন বউ-ই রয়ে গেছে! যদিও এই দীর্ঘ সময়ে দুই তরফেই ঘটেছে বিরাট পরিবর্তন! নিজের শক্তিতে। শ্বশুর- শাশুড়ি দু'জনেই মারা গেছেন আর ওই তরফের খুড়ো শ্বশুরও।  মারা গেছেন ওদের একমাত্র ছেলে। দুই তরফেই আজ রিক্ত-নিঃস্ব! দুই অংশই আজ রূপ নিয়েছে ধ্বংসস্তূপের!
    " ও-ও নু-ত-ন ব-উ-উ-উ!"
     "এই তো খুড়ি-মা, আমি এসে গেছি। বলুন, কী বলবেন? বলবেন বলুন।" লাবণ্য খুড়ি-শাশুড়ির দীর্ণ-শীর্ণ শয‍্যার পাশে এসে দাঁড়ায়। গায়ে তখনও ভিজে শাড়ি জড়ানো।
     "আমার যে একমুঠো গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে নুতন বউ। সঙ্গে সর্ষের তেল, কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুনপোড়া! তোমাদের উঠানে সেদিন দেখলাম ক'টা বেগুন হয়েছে। একমুঠো গরম ভাত আর একটু বেগুন পোড়া করে দেবে নুতন বউ?" খুড়ি-শাশুড়ির গলায় অনুনয় শুনেও লাবণ্য কোনো কথা বলতে পারছে না। স্থির চোখে অসুস্থ খুড়ি শাশুড়ির দিকে চেয়ে থাকে। বহুদিন বাদে যেন ওঁকে নতুন করে দেখছে!
     সেই কুড়ি বছর আগে, এই খুড়ি শাশুড়িই তাকে বরণ করে ঘরে তুলেছিলেন, নতুন বউ হয়েও অপলক চোখে চেয়ছিল ওঁর মুখের দিকে। যদিও অবস্থাপন্ন চাষী তবুও তাদের ঘরে এমন সুন্দরী মহিলা দেখবে তা সে কল্পনাও করতে পারেনি! পরে জেনেছিল, ওঁর সৌন্দর্য ও গুনের খ‍্যাতি সারা গ্রামে ছড়িয়ে আছে!
     "কী হল, নুতন বউ, একমুঠো গরম ভাত রেঁধে দিতে পারবা না! দু'দিন শুধু মুড়ি খেয়ে আছি! আজ আর উঠতে পারছি না। একমুঠো গরম ভাত না খেলে তো আর উঠতে পারব না, নুতন বউ।"
    লাবণ্য এতক্ষণ ঠোঁট কামড়ে ছিল কিন্তু আর পারলো না। "কিন্তু খুড়ি-মা, আমাদের ঘরে তো চাল বাড়ন্ত। ক'দিন ধরে আমরা শুধু রুটি খাচ্ছি। করায় দেশটা জ্বলে গাচ্ছে! মাঠে কাজ নেই। আপনাদের ছেলেও কাজ পাচ্ছে না। চাল কেনার ক্ষমতাও নেই। একটু আটা আছে, রুটি খাবেন? গরম গরম রুটি সেঁকে দিচ্ছি, সঙ্গে কাঁচা লঙ্কা ও তেলে মাখা বেগুন পোড়া।" ও উৎসাহ দেখায়।
     "না-না, নুতন বউ, আজকে আমার খুব গরম ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।" গলায় মিনতি ও আবদারের সুর!
     " কিন্তু।"
     "আমার খাটের নিচে দেখো তো, লক্ষ্মীর ঝাঁপিয়ে হয়তো এখনও একমুঠো চাল আছে। আগে তো রাখতাম।"
     "দেখছি।" লাবণ্য নীচু হয়ে খাটের তলায় পুরনো আমলের টিন-কৌটা নাড়তে-নাড়তে ঝাঁপিটা পেয়ে গেল। ভিতরে একমুঠো চালও পেয়ে গেল। নীচ থেকেই বলে, "পেয়েছি, খুড়ি-মা।" তারপর বেরিয়ে এসে চালটুকু দেখায়।
     বৃদ্ধার দারিদ্র্য-জীর্ণ মুখে ফুটে ওঠে খুশির ঝলক! "আজ তা'লে একমুঠো গরম ভাত পাবো! তেল আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মাখা বেগুন পোড়ার কথা যেন ভুলো না, নুতুন বউ। তোমার শাশুড়ি খুব ভালো খেতো।"
     "ঘরে ভাত ফুটছে!" বুক ভরে ফুটন্ত ভাতের গন্ধের শ্বাস টেনে, খুশী মনে লাবণ্যের স্বামী বংশী মাটির দাওয়ায় এসে বসে বুক ভরে আবার শ্বাস টেনে, "পুরাণো চাল ফোটার গন্ধ! চাল কোথায় পেলি? বউ?"
     লাবণ্য উনানে কাঠ-কুটো গুঁজতে-গুঁজতে, "এ আমাদের নয়।"
     "ফুটছে আমাদের উনানে আর তুই বলছিস, আমাদের নয়!" বংশীর গলায় রসিকতা!
     "খুড়ি-মা ক'দিন ধরেই বিছানায় পড়ে আছেন। উঠবার ক্ষমতা নেই। তাই ওঁর চালটুকু আমি ফুটিয়ে দিচ্ছি।"কথগুলো যেন বংশীর মুখের ওপর এক দোয়াত কালি ঢেলে দিল!
     মুখ চুন করে ,  "ও।" গামছা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাওয়া খেতে খেতে, বুক ভরে ভাতের গন্ধ টেনে, "ফ‍্যানটুকু আবার ফেলে দিসনে আবার।" 
     তারপর কিছুক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে, "আজও কোনো কাজ পেলাম না বউ। খরায় সব জ্বলছে! কারোরই কাজ দেবার ক্ষমতা নেই। কাজই নেই! এভাবে তো চলছে না বউ! তার চেয়ে চল, শহরে যাই। ওখানে তাও টুকটাক কাজ পাওয়া যাবে।" ওর কথায় লাবণ্যর সারা না পেয়ে, গামছার দুই প্রান্ত দুই মুঠোয় ধরে তা দিয়ে পিঠ ঘষতে ঘষতে, "আগে তাও একশো দিনের কাজের দু'এক দিন কাজ পেতাম, এখন তাও পঞ্চায়েতের নতুন মেম্বারেরা দিতে চায় না! বলে, "তোর কাকি যখন মেম্বার ছিল, তখন তো তোরাই তো লুটেপুটে খেয়েছিস। এখন অন‍্যদের খেতে দে। আচ্ছা তুমিই বলো, প্রথম যখন পঞ্চায়েতে মেয়েদের কোটা চালু হলো, চাষীর ঘরে লিখতে-পড়তে জানা মেয়ে খুঁজতে গিয়ে এক কাকিকেই পার্টির বাবুরা খুঁজে পেলো। কাকি তো নামেই মেম্বার ছিল! না ছিল ক্ষমতা,  না ছিল গুছিয়ে নেবার ধান্দা! আর সেও তো বহু বছর আগে! আর কাকি যদি গুছিয়েও নিতো, তা হলে তাকে কী আজ পরের বাড়িতে গায়ে খেটে দিন গুজরাণ করতে হতো! এরা সব নতুন এসেছে। এখন এদের কী চোটপাট!  বউ-এ্রর সারা না পেয়ে, হাত বাড়িয়ে তেলের শিশিটা নিয়ে হাতের চেটোয় একটু তেল নিয়ে মাথায় ঘষতে ঘষতে পুকুরে গেল। যাবার সময় লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, "ফ‍্যানটুকু আবার দিসনে বলে বোউ।" বলে ভাতের হাঁড়ি দিকে শেষ বারের মত তাকায়!
     লাবণ্য ধীরে-সুস্থে বেগুনের আনলা পুড়িয়ে তেল-কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে, থালায় সাজিয়ে , ভ‍্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে, খুড়ি-শাশুড়ির ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল, উনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। 
     "খুড়ি মা, উঠুন ভাত এনেছি।" কিন্তু কোন সারা পেল না! নীচের মেঝেতে থালা রেখে, খুড়ি-শাশুড়ীকে একটু ঠেলা দিতেই তেলচিতে বালিশ থেকে মাথাটা গড়িয়ে পড়ল! 
     মুহূর্তের মধ্যেই একটা অনুভুতি , লাবণ‍্যের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো! ও বুঝতে পারে উনি আর নেই! ও ছুটে যায় বংশীকে ডাকার জন‍্য। পুকুর ঘাটেই পেয়ে গেল। ঘাটে ও একাই ছিল।শুনেই ছুটে আসে। এসেই বূঝতে পারে, মারাই গেছেন। সেও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!
     হঠাৎ তার নাকে আসে পুরাণো চালের গরম ভাতের গন্ধ সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে! মেঝেতে রাখা আছে ভাতের থালা। গরম ভাত থেকে তখনও  উঠছে ধোঁয়া। বংশী  বুক ভরে শ্বাস টেনে গরম ভাতের গন্ধে বুক ভরিয়ে নেয়। তার চোখ একবার মৃতা  খুড়ি-মা, একবার লাবণ‍্যের দিকে তো একবার ভাতের থালার দিকে চলাফেরা করতে থাকে!
     আজ কতদিন সে ভাতের স্বাদ পায়নি! তার মনে নেই! এবার সে লাবণ‍্যের তাকায়। লাবণ‍্য জীর্ণ দরজার পাল্লায় মাথা চেপে সজল চোখে মৃতার দিকে চেয়ে আছে। তার মনের স্মৃতিতে দীর্ঘ কুড়ি বছরের টুকরো টুকরো ঘটনা একের পর এক ভেসে চলেছে!অন্য দিকে তার খেয়াল নেই।
     বংশী একবার মৃতা খুড়ি মা একবার লাবণ‍্যের দিকে চোখ ফেরায়, পরমুহূর্তে ভাতের থালার দিকে। তার বুক ভরে ওঠে গ‍রম ভাতের গন্ধে।
     ও সামান‍্য ঝুঁকে নিঃশব্দে ভাতের থালাটা তুলে নিয়ে, চোরের মত ভ‍্যারাণ্ডার বেড়া ডিঙিয়ে নিজেদের ঘরের দাওয়ায় এসে বসে।
     একমুঠো ভাত কেটে বেগুনপোড়া দিয়ে মেখে একগ্রাস ভাত হবে মূখে তুলতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে খুড়িমার ক্ষুধার্ত, মৃত মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গ্রাস সমেত হাতটা থালায় নেমে আসে। মুখ নীচু করে আঙুলের ডগা দিয়ে ভাত ক'টা নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎই ভাতের থালা হাতে উঠানে মাঝে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিক তাকিয়ে মুঠো মুঠো ভাত ছড়িয়ে দিতে থাকে! ছড়িয়ে পড়া ভাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এক ঝাঁক কাক!
     বাবা মারা যাবার পর, খুড়িমাই বলেছিলেন, "মৃত‍্যুর পর আত্মারা কাকের রূপ নিয়ে আসেন, সন্তানের হাতে হবিষ‍্যির অন্ন পাওয়ার জন‍্য।" ওদের দিকে তাকিয়ে ও খুঁজতে থাকে, কোন কাকের মধ‍্যে লুকিয়ে আছে খুড়িমার আত্মা, ওর হাতের অন্ন পাওয়ার জন‍্য!

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#বার্তাকু_ভক্ষণ_বিল

 
তারাপদ রায়।
 
সপ্তাহ কয়েক আগে কাশী থেকে ফিরে এই বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলাম। লাউ সদৃশ, অতিকায় এবং অতিবিখ্যাত রামনগরের বেগুন, যার কয়েকটি আমি কলকাতায় এনে ভাগাভাগি করে আত্মীয়-বান্ধবদের মধ্যে বিলি করেছিলাম।
 
এসব কথা লেখার কোনও মানে হয় না। ভুল করে লিখে ফেলেছিলাম।
 
লেখা বেরনোর পর থেকে যার সঙ্গে দেখা হয় সেই বলে, ‘অমন আশ্চর্য বেগুন, আমাদেরও একটু দিলে পারতেন।’ শুধু এই নয়, টেলিফোনে এবং চিঠিতেও অনুযোগ-অভিযোগ পেলাম।
 
কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঘাত পেয়েছি যাদের বেগুনের ভাগ দিয়েছি তাদেরই একজনের কাছ থেকে।
 
বেগুন বণ্টনের দিন কয়েক পরে আমার প্রতিবেশিনীর কাছ থেকে একটা টেলিফোন পেলাম।
 
টেলিফোনটা খুবই রহস্যময়। কারণ যাঁর সঙ্গে দু’বেলা মুখোমুখি দেখা হচ্ছে তিনি হঠাৎ টেলিফোনে কথা বলছেন। আর যা বলছেন, সেটাও গোলমেলে, ‘দাদা, একটা বিল পাঠিয়ে দিলাম। টাকাটা একটু তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দেবেন।’
 
কীসের বিল, কেন বিল কিছুই বুঝতে পারলাম না। একটু পরে ওঁদের কাজের মেয়ে এসে আমার হাতে একটা খাম দিয়ে গেল।
 
খাম খুলে দেখলাম, মুদি দোকানের ফর্দ যেমন হয়, তেমনই একটা লম্বা কাগজ। কাগজের মাথায় তারিখ দেওয়া, তার নীচে গোটা গোটা মেয়েলি হরফে লেখা,
 
বার্তাকু ভক্ষণ বিল
 
ছোট বয়সে ঠাকুমা, পিসিমার জন্যে পঞ্জিকা দেখা অভ্যেস হয়েছিল। সেখানে তিথি বিশেষে লেখা থাকত, ‘বার্তাকু ভক্ষণ নিষেধ।’ সেই তখন থেকেই জানি যে বার্তাকু মানে হল বেগুন। সুতরাং মুদিখানার ফর্দ সদৃশ লম্বা কাগজখানা যে বেগুন খাওয়ার বিল সেটা অনুমান করতে অসুবিধে হল না।
 
দেখলাম লম্বা বিল। দিন তারিখ দিয়ে চারদিনের বিল করা হয়েছে।
 
প্রথম দিনের বিল মোটামুটি বোধগম্য হল।
 
সোমবার ১৩ জানুয়ারি
 
সরষের তেল ৫০০ গ্রাম ২০ টাকা
বেসন ২৫০ গ্রাম ১১ টাকা
চালের গুঁড়ো ১০০ গ্রাম ১.৫০ টাকা
নুন মশলা(আনুমানিক) ২.০০ টাকা
জ্বালানি (আনুমানিক)   ৪.০০ টাকা
                          মোট ৩৮.৫০ টাকা
 
প্রথম দিনের বিল দেখে যেটা বোঝা গেল তা হল যে-পরিমাণ বেগুন দিয়েছিলাম প্রতিবেশিনী সবটাই বেসন দিয়ে ভেজে খেয়েছেন। সংসারে তিনটি মাত্র প্রাণী, প্রতিবেশিনী এবং স্বামী ও পুত্র; তিনজনের পক্ষে এতখানি পরিমাণ বেসন-মণ্ডিত বেগুন ভাজা হজম করা কঠিন।
 
এবং সত্যিই তাই হয়েছে। পরের তিন দিনের বিলে তারই প্রতিফলন। প্রথম দিন রোগমুক্ত হওয়ার স্বচেষ্টা। সেদিনের হিসেবে রয়েছে এক বোতল জোয়ানের আরক। কুড়িটা অম্লবিনাশক ট্যাবলেটের দাম। মোট চুয়াল্লিশ টাকা।
 
কিন্তু এত সহজে অসুখ সারেনি। বোধহয় তিনজনই অসুখে পড়েছিল। পরের দিন ডাক্তারের ভিজিট বাবদ পঞ্চাশ টাকা লেখা আছে বিলে, সেই সঙ্গে নানারকম ওষুধ বাবদ পঁচাশি টাকা। বিলের শেষ দিনেও প্রায় অনুরূপ। ডাক্তারের ভিজিট লাগেনি, তবে ওষুধের দাম লেগেছে নব্বুই টাকা।
 
বার্তাকু ভক্ষণের বিলটি পেয়ে বেশ কিছুক্ষণ বিবেচনা করে দেখলাম এবং সিদ্ধান্ত করলাম যে, বিলটি পাঠিয়ে প্রতিবেশিনী মোটেই দোষের কাজ করেননি, বিশেষ করে আমারই দেওয়া বেগুন খেয়ে যখন তাঁদের এই বিপত্তি।
 
প্রতিবেশিনীকে ফোন করে নিজের দায় স্বীকার করলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখন কেমন আছেন?’
 
প্রতিবেশিনী বললেন, ‘আজকে মোটামুটি ভাল। আজকে আমরা সবাই ভাত খেয়েছি। তিনদিন বাদে আজ প্রথম।’
 
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এই তিনদিন তা হলে কী খেয়েছেন?’
 
প্রতিবেশিনী বললেন, ‘কী আর খাব? দুয়েকটা বিস্কুট, লেবুজল, টক দই, চিঁড়ের মণ্ড, মুড়ি ভেজানো, সাবু, বার্লি এই সব খেয়েছি।’
 
আমি শুনে বললাম, ‘আপনার বিল আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।’ প্রতিবেশিনী কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই ফোনটা নামিয়ে রেখে বিল নিয়ে বসলাম।
 
যোগ দিয়ে দেখলাম, প্রতিবেশিনীর বার্তাকু ভক্ষণ বিল সাকুল্যে আড়াইশো টাকার কিছু বেশি হয়েছে॥
 
বিলের নীচে বেশ কিছুটা সাদা কাগজ রয়েছে সেখানে চারদিনের যোগফল দুইশো সাতান্ন টাকা পঞ্চাশ পয়সা বসিয়ে তার নীচে পরিষ্কার করে লিখলাম, ‘তিনদিনের দুই বেলা করে তিনজনের মোট আঠারোটি মিল বাদ। প্রতিটি মিল বাবদ গড় ব্যায় পঁচিশ টাকা ধরলে মোট সাশ্রয় সাড়ে চারশো টাকা। এর থেকে তিনদিনের পথ্য বাবদ খুব বেশি হলে একশো টাকা এবং পূর্বোক্ত বিলের দুশো সাড়ে সাতান্ন টাকা বাদ দিলে এখন আপনার কাছে আমার প্রাপ্য সাড়ে বিরানব্বই টাকা। অনুগ্রহ করিয়া দ্রুত মিটাইয়া দিবেন। মনে রাখিবেন, ইহার মধ্যে বেগুনের দাম ধরি নাই।’
Big Grin Big Grin

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
#মিলন_হবে_কত_দিনে


 #সরজিৎ_ঘোষ
 
আমার এক বন্ধু মিলন একবার এক সুন্দরী বৌদির প্রেমে পড়েছিল।আমরা যে মেসে থাকতাম তার উল্টোদিকের বাড়িটাতেই ওই বৌদি থাকত।যখন তখন দেখতাম বারান্দায় দাঁড়িয়ে মিলন কী যেন দেখে।তারপর বুঝেছিলাম ওই বাড়ির বৌদিকে দেখার জন্যই মিলন বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে‌।আমরা সেই নিয়ে মিলনের সাথে মজা করতাম।আমরা মিলনকে বলতাম, 
 
--বৌদির সাথে তো কথা বলার সুযোগ হলো না কোনোদিন।কারণ তোর সে সাহস নেই।
 
---ও কোনো ব্যাপার নয়।আমি ইচ্ছে করলেই আলাপ করে নেব একদিন। 
 
তবে হ্যাঁ মিলন যে কোনো কারো সাথেই সহজে ভাব জমিয়ে নিতে পারতো।মিলন সত্যিই  একদিন বৌদির সাথে আলাপ করে নিল। তারপর থেকে মিলন সুযোগ পেলেই বৌদির সাথে গল্প করত।বৌদি ব্যালকনিতে এলেই মিলন দৌড়তো। বৌদি ছাদে গেলেই মিলন ছাদে চলে যেত।এই ভাবে বেশ কয়েক দিনের মধ্যেই মিলন বৌদির সাথে ভালোই ভাব জমিয়ে ফেললো।আমরা এই ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করতাম। 
 
কিছুদিন পর একদিন সকালে দেখলাম লাগেজ পত্র নিয়ে দাদা গাড়ি করে বেরিয়ে গেল।যাবার সময় বৌদিকে বলতে শুনলাম, 
 
--সাবধানে যেও।আর পৌঁছে ফোনটা করতে মনে থাকে যেন।
 
--হ্যাঁ গো।তুমি সাবধানে থাকবে।এক সপ্তাহর তো ব্যাপার।
 
আমরা বুঝে গেলাম দাদা কিছু দিন থাকছে না।মিলনকে এবার পায় কে।দাদা নেই মানে এখন সব দায়িত্ব যেন মিলনের।দাদা চলে যাবার পর বৌদি ব্যালকনিতে আসতেই মিলন জিজ্ঞেস করলো, 
 
--দাদা কোথাও গেল নাকি?
 
--আর বলো না।অফিসের জরুরী কাজে বম্বেতে যেতে হলো সাত দিনের জন্য।
 
---কোনো অসুবিধে হলে বলো।
 
---হ্যাঁ নিশ্চয়ই।তা তোমার কলেজ নেই আজ? 
 
--না না এই সপ্তাহটা আমিও কলেজ যাব না।মেসেই থাকব।দরকার পড়লে আমাকে বলো কিন্তু।আমি মেসেই থাকব। 
 
দাদা সাতদিন থাকবে না।আর মিলনও দেখলাম বলে দিল সাত দিন কলেজ নেই ওর।আমাদের এক বন্ধু মিলনকে বলল,
 
---মিলন এমন দিন আর পাবি না।দাদা এখন থাকবে না সাতদিন।
 
তারপর থেকে মিলন যখনই সময় পাচ্ছে বৌদির সাথে কথা বলছে। মিলনের ভীষণ ইচ্ছে বৌদি যদি কোনো একটা কাজ  দেয় সেই সুযোগে বৌদির বাড়ির মধ্যে যাওয়া যাবে।কিন্তু বৌদি কিছুই বলছে না।মিলন তবুও বলছে, 
 
--বৌদি কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো।আমাকে বলতে পারো।
 
--না না। ঠিক আছে। অসুবিধে হলে বলব।। 
 
আমরা মজা করে বলতাম, 
 
--তোকে আর  এ জীবনে ডাকল না‌।তিনদিন হয়ে গেল।গল্প করে করেই সময় কেটে যাবে তোর। 
 
যাইহোক পরের দিন সকালে দেখি বৌদি ব্যালকনি থেকে মিলনের নাম ধরে ডাকছে। মিলন তখন বাথরুমে। আমি বলি, 
 
---তুই বাথরুমে ঢুকে বসে আছিস। এদিকে বৌদি তোকে ডেকে যাচ্ছে। 
 
আমার কথা শুনে পরি মরি করে বাথরুম থেকে দৌড়ে বেরিয়ে বারমুডাটা পরে  বারান্দায় গিয়ে বলে, 
 
--বৌদি ডাকছো? 
 
--শোনো না তুমি ফ্রি আছো। 
 
--হ্যাঁ  আমি  তো অলটাইম ফ্রি। 
 
বৌদি একটু আসতে করে বলে, 
 
---আজ আসতে পারবে একবার?
 
মিলন এপাশ ওপাশ দেখে নিয়ে বলে, 
 
--যখন ডাকবে তখনই চলে যাব।কখন যেতে হবে বলো?
 
আমরা তো আড়াল থেকে দেখছি বৌদি কী যেন একটা ভেবে নিয়ে বলে,
 
---শোনো তাহলে রাতে ওই আটটার দিকে চলে এসো।তোমার অসুবিধা নেই তো? 
 
--না না আমার আবার কী অসুবিধা?ও হ্যাঁ!বৌদি তুমি কী খেতে ভালোবাসো?যতই হোক তোমার বাড়িতে প্রথম যাচ্ছি। 
 
--আরে ধুরর্। ওসব কিছু আনতে হবে না।তুমি আসলেই হবে।
 
কথা গুলো বলে বৌদি ভিতরে চলে যায়। মিলন রুমের মধ্যে দৌড়ে এসে ইয়া বলে চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে।গোপাল বলে, 
 
--শোন ভাই ট্রিট চাই। সন্ধ্যে বেলা দিশি মুরগীর মাংস আর ভাত। মেসে এখন বেশি কেউ নেই। ছজন আছি।একটা দুকেজি সাইজের মুরগী আনলেই হবে। 
 
---আরে ভাই ঠিক আছে হবে হবে। 
 
---আরে ঠিক নেই।তুই আগে মাল ছাড়। 
 
মিলন তিনশো টাকা বের করে গোপালের হাতে দিয়ে বলে,
 
---মাংস নিয়ে যে টাকাটা থাকবে মিষ্টি নিয়ে নিস কিছু।
 
মিলন তো সেই মেজাজে আছে।ক্লিনিক প্লাস শ্যাম্পু,ডাভ সাবান দিয়ে স্নান।সন্ধ্যের পর ফিটফাট হয়ে আমার ডেনিমের বডি স্প্রে টা ফুস  ফুস করে সারা গায়ে মেখে আটটার সময় চলে গেল‌।এদিকে আমরা দিশি মুরগী রান্নার তোড়জোড় চালাচ্ছি।মিলন চলে যাবার পর রান্না শুরু হয়েছে। আর আমরা কয়েকজন মিলে বারান্দায় এসে দাঁড়াচ্ছি।দেখি বৌদির বাড়ির ব্যালকনির দিকে জানালা গুলো বন্ধ করা।আমরা মিলনকে নিয়ে যা ভাবার ভাবছি।কিছুক্ষণ  পর বৌদির ঘর থেকে হুপ হুপ হুপ করে আওয়াজ আসছে।দেবা বলছে, 
 
---আরে এটা তো মিলনের গলা।এদিকে মাংস রান্নার গন্ধে পুরো মেসটা ম ম করছে। 
 
যাইহোক নটা বাজতে না বাজতেই দেখি মিলন চলে  এলো।মিলনের সার্টের ওপরের দুটো বোতাম তখনও খোলা।চুল গুলো এলো মেলো।গায়ে হাত দেখি ঘেমে ভিজে গেছে।গোপাল তো বলে উঠল, 
 
--এত তাড়াতাড়ি চলে এলি? তোর দ্বারা কিছু হবে না।যাই হোক বল কী সব হলো? 
 
--আগে জলের বোতলটা দে পরে সব বলছি। 
 
মিলনের থেকে সব শুনতে হবে।দেবা একবাটি মাংস নিয়ে এসে হাজির। কষা মাংস আর মিলনের গল্প। পুরো জমে যাবে।মিলন বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে এক বোতল জল শেষ করে জামাটা খুলে  হাতে নিয়ে বসেছে।আমি মাংসের একটা হাড় নিয়ে চিবোতে চিবোতে বলি, 
 
--বল আর কত ওয়েট করব। 
 
মিলন গামছা দিয়ে ঘামটা মুছে নিয়ে বলতে শুরু করলো।
 
আমি যেতেই  বৌদি আমাকে বললো, 
 
--বা দারুণ তো বডিস্প্রের গন্ধটা। তোমার দাদার সঙ্গে যখন প্রেম করতাম তোমার দাদাও এটাই ইউজ করত।আমার খুব প্রিয়। 
 
--আমারও ভীষণ প্রিয়। 
 
---আরে আস্তে কথা বলো।কোনো আওয়াজ না হয়। আর পা টিপে টিপে এসো।আমার ছেলে না বুঝতে পারে। 
 
তারপর আমি পা টিপে টিপে গেলাম।আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল।ঘরটা অন্ধকার।আমার হাতটা ধরে বললো,
 
---এই শোনো না তুমি ওই খাটের উপর উঠে পড়ো।আমি একটু পর আসছি। 
 
জীবনে এই প্রথম কোনো মেয়ে আমরা হাতটা ধরে খাটে উঠতে বললো।রোমান্টিক পরিবেশ।আমিও খাটের উপর উঠে পড়লাম।খাটে উঠে বসে আছি।অন্ধকার ঘরে আমি তখন রোমাঞ্চ অনুভব করছি। 
 
মিনিট পাঁচেক পর বৌদি এসে বলে গেল, 
 
---তুমি  তাড়াতাড়ি জামাটা খুলে ফেলো।
 
তখন তো ভীষণ লজ্জা করছে।তবুও আমি জামা খুলে ফেললাম।বৌদি তারপর এসে বললো, 
 
--আমি রেডি।এবার তুমি রেডি হয়ে নাও।তোমার দাদার এই মাটি কালারের পাঞ্জাবিটা পরার পর মুখোশটা পরে নাও।আমি যখনই বলব ওই আসছে ওই আসছে  তুমি তখন জোরে  জোরে হুপ হুপ করবে আর এমন লাফাবে যেন খুব আওয়াজ হয়।
 
আমি বলি,
 
--মানে?
 
তখন বৌদি বলে,
 
--আরে আমার ছেলেটাকে দিনের বেলা যাইহোক করে খাওয়াতে পারি।আর দেখো না রাতের বেলা তিনদিন খাচ্ছে না।দিনের বেলা পাখি দেখাই। মাঝে মধ্যে হনুমান গুলোও আসে হুপ হুপ আওয়াজ করে।ওই সব দেখিয়ে ভয় পাইয়ে খাইয়ে দিই।কিন্তু রাতের বেলায় ওসব কোথায় পাব বল তো। তোমার দাদাও নেই। তিনদিন কিছুতেই খাওয়াতে পারি নি। বেশি দেরি করো না একটু তাড়াতাড়ি নাও। 
 
তারপর বৌদি ছেলেকে খাওয়ালো। আমি ওই আধঘণ্টা ধরে মুখোশ আর পাঞ্জাবি পরে লাফিয়েছি আর হুপ হুপ করে আওয়াজ করে গেছি। তাতেই আমার অবস্থা।ভাই পা গুলো ভীষণ ব্যথা করছে। 
 
সব কিছু শুনে তো আমরা থ।সেই সঙ্গে বিরাট হাসির রোল।গোপাল আর দেবা দেখি হনুমানের মতো ডাকতে শুরু করলো, হুপ হুপ।
 
মনটা ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা মিলনের। মিলন বলে, 
 
--খিদে পেয়েছে ভাই। একটু মাংস নিয়ে আয়। 
 
গোপাল তখন গান ধরেছে ,"মিলন হবে কত দিনে।" তারপর হাসতে হাসতে বলে, 
 
--তোকে মাংস খেতে হবে না।দুটো সিঙ্গাপুরি কলা পড়ে আছে।ওগুলোই তোকে এনে দিচ্ছি‌।খেয়ে ঘুমিয়ে পড়‌।হনুমান আবার কি মাংস খাবে! 
 
:সমাপ্ত:

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
ফেব্রুয়ারি এসে গেল। দেবী পূজার আর মাত্র ক'দিন বাকি।

 
 ।। প্রেম সপ্তাহের র্নিঘন্ট ।। 
 
7th Feb প্রতিপদ -  দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি( Rose Day)
8th Feb দ্বিতীয়া - দেবীর কাছে সংকল্প ( Propose Day)
9th Feb তৃতীয়া -  দেবীকে প্রসাদ নিবেদন ( Chocolate Day)
10th Feb চতুর্থী - দেবীর সামনে ভালুকের বলিদান ( Teddy Day)
11th Feb পঞ্চমী - দেবী পুজোর নামে শপথ গ্রহণ
( Promise Day)
12th Feb ষষ্ঠী -   দেবীকে প্রসাদ চড়ানো ( Kiss Day)
13th Feb সপ্তমী - দেবীকে নিজের অন্তরে আসার আহ্বান (Hug Day)
 14th February মহাষ্টমী - মহা আরতি, রাত্রি জাগরণ ও কঠোর সাধনা (Valentines Day)
 
15th Feb নবমী -  জাগ্রতা দেবীর রুদ্র মূর্তি ধারণ (slap day)
16th Feb দশমী - ক্রুদ্ধ দেবী দ্বারা পদাঘাত ( kick day)
17th Feb একাদশী - সুগন্ধি ছড়িয়ে দেবীর ক্রোধ সংবরণ (perfume day)
18th Feb দ্বাদশী - শান্ত দেবীর সামনে টুস্কি মারা 
(Flirting day)
19th Feb ত্রয়োদশী - দেবীর কাছে সমস্ত দোষ স্বীকার
(confession day)
20th Feb চতুর্দশী - দেবী কর্তৃক বিতাড়নের পর দেখতে না পেয়ে তাঁকে অনুভবের চেষ্টা (missing day)
21th Feb অমাবস্যা - দেবী বিসর্জন। (break up day) দেবীপক্ষ সমাপ্ত।
 
#সংগৃহীত ও জনস্বার্থে বিতরিত

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
#শিক্ষা

 
#চ্যাটার্জী_শঙ্খদীপ
 
আজ দুপুরে গোলপার্ক থেকে বাসে করে বেহালায় আমার কর্মস্থলে আসছিলাম।
আসার সময় বাসের ভেতরে আমার মন কেড়ে নেওয়া পর পর দুটে ঘটনা ঘটে গেল !
লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
 
বাসে কিছু সিট ফাঁকা। বয়স্ক কন্ডাক্টর এদিক ওদিকে ভাড়া নিয়ে টিকিট দিচ্ছিল।
দেশপ্রিয় পার্ক মোড় থেকে নীল জিন্সের প্যান্ট আর গুঁজে সাদা সার্ট পরিহিতা একটি কুড়ি বাইশ বছরের মেয়ে বাসে উঠলো।
বাসের পিছন দিকে এগোতে গিয়ে বয়স্ক কন্ডাকটরের পা মাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি " আহা " বলে নীচে ঝুঁকে কন্ডাকটরের পায়ে হাত দিয়ে প্রনাম করলো।
তারপর পাশের সীটে গিয়ে বসলো।
এমন অপ্রত্যাশিত এবং অকল্পনীয় ঘটনায় বাস কন্ডাকটর থতমত খেয়ে কি করবে বা বলবে বুঝতে না পেরে মেয়েটির দিকে কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তারপর নীচু স্বরে বললো, " অনেক বড় হও মা।  "
মেয়েটি কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকলো।
দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো আমার।
উল্টো দিকের সীটে বসে থাকা আমার মনে হোল, বর্তমান অত্যাধুনিক সময়ে আপাদ মস্তক সাহেবি শিক্ষার ঢেউয়েও আমাদের সনাতন * শিক্ষা এবং উপদেশ একদম হারিয়ে যায়নি। এখনও কিছু মানুষের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে।
 
টালিগঞ্জ ফাঁড়ি থেকে বাসটা ডাইনে নিউ আলিপুরের দিকে বাঁক নিয়ে দাঁড়ালো।
বাসের ভেতরে সব সীটেই মহিলা পুরুষ বসে। কয়েকজন দাঁড়িয়েও আছে। 
দরজার ঠিক উল্টোদিকে লম্বা সীটে তিনটে কলেজ ফেরত ছেলে বসে আছে। সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীর ছাত্র।
সেনাবাহিনীর পোষাক পরা এক জাওয়ান বাসে উঠে পিছনদিকে তাকিয়ে খালি সীট আছে কিনা দেখার চেষ্টা করছিল।
বসে থাকা তিনজন কলেজ ফেরত ছেলের মধ্যে একটি ছেলে উঠে দাঁড়িয়ে জাওয়ানের বাঁ হাতটা ধরে হিন্দি ভাষায় ওর সীটে বসতে বললো।
জাওয়ানটি কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে ছেলেটির হাতটা ধরে হেসে চোখ নাচিয়ে হিন্দি ভাষাতেই ওকেই বসতে বললো।
ছেলেটি এবার হিন্দিতে জাওয়ানকে বললো, - " আমার বাবা বলে আপনারা আছেন বলেই তো আমরা এত নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারি। তাই বাসে উঠে সীটে বসার অধিকার আগে আপনার। "
জাওয়ানের চোখ দুটো খুশীতে চকচক্ করে উঠলো।
এত কম বয়সী এক কিশোরের মুখে এমন কথা শুনে জাওয়ান বেশ মজা পেল।
এবার একহাতে বাসের রড ধরে রেখে আরেক হাতে ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে হেসে বললো, - " তুম বৈঠো। মুঝে আদত হ্যায় খাড়া রহেনেকা। "
ছেলেটি বসে পড়লো। সবাই ছেলেটিকে আর জাওয়ানকে দেখছে। আমিও দেখছিলাম। অদ্ভুত একটা মানসিক আনন্দ পাচ্ছিলাম।
ভাবছিলাম, এদেশের অতীতের আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের রেখে যাওয়া দেশভক্তি এবং দেশপ্রেম সবার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়েনি। শুধুই লোক দেখানো আর মুখে নয়, কিছু মানুষের অন্তরে সত্যিকারের দেশপ্রেম আজও জেগে আছে। 
মনে হোল, এই কিশোরটি আজ এই মুহূর্তে যেন তার নিজস্বার্থের সীটে দেশপ্রেমকেই বসার জন্য অনুরোধ করলো !
 
উপরোক্ত দুটো ঘটনায় মেয়ে এবং ছেলেটির মনের শিক্ষা, মানুষ হবার বিদ্যা সম্পূর্ণতার দিকেই এগিয়ে চলেছে। হয়তোবা পূর্ণ হয়েই গেছে।
এরা দু'জন আমার ছেলে মেয়ের থেকেও বয়সে ছোট, তবুও এদের প্রাপ্ত শিক্ষাকে সম্মান, শ্রদ্ধা এবং ধন্যবাদ জানাই। 
একই সাথে এদের বাড়ির বাবা মা এবং গুরুজনদেরও একই কথা জানাই এবং বাহবা দিই। Namaskar

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
*"বার্ধক্য" একটি শিল্প!!* 

 
বার্ধক্যে পৌঁছানোর প্রক্রিয়াটি বিষণ্ণতার কিছুই নয়, এটি আনন্দময় উদযাপন।
 
বার্ধক্য, দীর্ঘ পরিশ্রমী সফল একটি গৌরবান্বিত পথপরিক্রমার অর্জন।
 
*অধিকাংশই এখানে পৌঁছুতে পারেনি। বাকি অল্প কয়েকজনের তুমি একজন। এই টিকে থাকাটি, একমাত্র তোমারই অর্জন।*
 
 বার্ধক্যের প্রত্যেকটি ক্ষত, সাক্ষ্য দিচ্ছে একেকটি সূর্যালোকিত দিনের, যে-আলো তোমাকে পরিপক্ব করেছিলো, ক্ষতের সাথে লড়াইয়ের আমন্ত্রণে।
 
বার্ধক্যে তুমি রূপ হারিয়ে ফেলেছ? কী হাস্যকর এ-ভাবনা! 
_যৌবনের রূপ একটি প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা মাত্র, যা তুমি অর্জন করোনি; অন্যদিকে, বার্ধক্যের রূপ- সে এক পরিপূর্ণ শিল্প, প্রতিটি রোমকূপ যার, অর্জিত।_
 
জাপানে, একটি রীতি প্রচলিত আছে: কোনোকিছু ভেঙে গেলেই, ওটা ফেলে দেয় না তারা। এর প্রত্যেকটি টুকরা তারা জোড়া লাগিয়ে পুনরায় তৈরি করে ফেলে সেই বস্তুটি। জোড়া কী দিয়ে লাগায়? স্বর্ণ-মিশ্রিত আঠা দিয়ে; এবং, জোড়াগুলো ঢেকে দেওয়ার কোনো চেষ্টাই করে না ওরা। 
*তাদের সংস্কৃতি মতে- যা ভেঙেছে, সেটি আসলে তার রূপের আরেকটি ভিন্ন জীবনে প্রবেশ করেছে;* এবং এই নতুন রূপ-জন্মের উদযাপন হতে হবে একটি নতুন প্রাণ সৃষ্টির মতোই; এই নবজন্মকে সাজিয়ে দিতে হবে আমাদের, একে ত্যাগের প্রশ্নই আসে না। 
প্রতিটি ভাঙনই একেকটি নবজীবনে প্রবেশ; রূপান্তর। *বার্ধক্যও ঠিক এমনই। রূপও ঠিক এমনই।*
 
তুমি কে? তোমার জন্মের উদ্দেশ্য কী? এর উত্তর তুমি শৈশব, কৈশোর, যৌবনে পাবে না। এই তিন পর্যায় পেরিয়ে এসেই, বার্ধক্যেই তুমি উপলব্ধি করতে পারবে- তোমার জীবনের মূল অর্থ। হ্যাঁ, বার্ধক্যই তুমি। 
*বার্ধক্যই তোমার জীবন, বাকিটুকু জীবনটির ভূমিকা মাত্র।*
 না, বার্ধক্য উপসংহার নয়, উপসংহার হলো তোমার রেখে যাওয়া কীর্তির প্রভাবটুকুই। বার্ধক্য হলো- পরিপূর্ণ তুমি।
 
জন্মের মুহূর্তটি থেকে, মৃত্যুর মুহূর্তটি পর্যন্ত, তোমার দেহের প্রতিটি অণুপরমাণু পরিবর্তিত হয়ে চলেছে। 
এর একেকটি পর্যায়কে একেক নামে অভিহিত করেছ, তুমিই।  এ-ই, একমাত্র সত্য।
 
বয়সের পিঠে চড়ে বসো নির্ভয়ে।
বয়সকে আলিঙ্গন করো বন্ধুতায়।
চমৎকৃত হও প্রতিটি আসন্ন মুহূর্তের বিস্ময়ে, চমৎকৃত করে দাও তোমার বয়সকেই।
 
তোমার চেহারাকে, তোমার জীবনসংগ্রামের প্রতিনিধি হতে দাও।
চেহারাটির বার্ধক্যছাপকে, বয়সের উপরে তোমার আধিপত্যের প্রমাণ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দাও।
লুকিয়ো না, প্রকাশ করো গর্বে।
 
তোমার প্রতিটি গল্পের সাক্ষী এই চেহারা।
তোমার প্রতিটি সঙ্কট জিতে আসার সাক্ষী এই চেহারাটিই।
তোমার চেহারার মলিনতাই, দাগই, তোমার জীবনের শ্রেষ্ঠতমতার সিলমোহর।
 
যৌবনের দিকে ছোটার কোনোই কারণ নেই। *যৌবন পাঠশালা মাত্র, বার্ধক্য শিক্ষক।*
 
জগতের সমস্ত জীবিত প্রাণের তুমিই সম্রাট, তুমিই সম্রাজ্ঞী, বার্ধক্যের অভিজ্ঞতায় ও জ্ঞানে; বার্ধক্যের দুর্লভ রূপময়তায়।
 
*বার্ধক্য একটি শিল্প!* শৈল্পিক পথে প্রৌঢ় হওয়ার, প্রৌঢ়া হওয়ার, সুন্দরতম পদ্ধতিটি হচ্ছে: বয়সকে পাত্তাই না-দেওয়া!!
 
(সংগৃহীত)

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
বাবার ঘাটকাজ ছিল সেদিন। সকাল ছ'টায় আমরা হাজির হলাম ঘাটে। গঙ্গা খুব দূরে নয়, তাই খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। মা, আমার বড়মামা আর কাছা গলায় আমি। আমাদের দেখেই এগিয়ে এলেন টি'শার্ট আর লুঙ্গি পরিহিত মাঝবয়সী এক ভদ্রলোক। 

 
” কাজ করবেন তো?” 
” হ্যাঁ। বাবার ঘাটকাজ।“ 
” পুরুত ঠিক করা আছে? না থাকলে কোন চিন্তা নেই, আমি আছি।“
” আপনি পুরুতমশাই?”
” আজ্ঞে না। আমি সব ব্যবস্থা করে দিতে পারি”
” না। আমাদের পুরোহিত মশাই ঠিক করাই আছে। এসে পড়বেন যেকোনো সময়ে।“
” ঠিক আছে স্যার। আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন। আমি সমস্ত ব্যবস্থা করে দেব।“
 
সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম আমি। লোকটি বেশ করিতকর্মা। প্রথমে গঙ্গা থেকে এক বালতি জল তুলে নিয়ে এলেন। অনেকটা কাঠখড় পোড়াতে হল তার জন্য, কারন তখন ভাটার টান চলছে। গঙ্গা সরে গিয়েছে অনেকটা দুরে। তারপর নিয়ে এলেন কেজিখানেক গঙ্গামাটি। অত্যন্ত যত্ন করে একটা চৌকো বেদী মত বানালেন, যার উপর কাজ হবে। কোসা-কুসি নিয়ে গিয়েছিলাম আমরাই। আমাদের অনুমতি নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে আনলেন সেগুলো। 
 
ইতিমধ্যে পুরোহিত এসে পড়েছেন। হেসে বললেন, “ বাহহ। খাসা ব্যবস্থা”।
 
হাসিমুখে নমস্কার করে একপাশে সরে দাঁড়ালেন সেই ভদ্রলোক, “আপনারা কাজ করুন, আমি আছি।“
 
হাতে কুশের আঙটি পরে নিলাম। কাজ শুরু হল। ঝাপসা ঝাপসা লাগছিল মাঝে মাঝে। চোখের পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়, ডাক্তার দেখাতে হবে। 
 
পূজাপাঠ চলল ঘন্টাখানেক, তারপর বাবাকে স্মরণ করে প্রার্থনা, অতঃপর পিণ্ডগুলো সাজিয়ে দিলাম একটার পর একটা। রোদের তেজ বাড়ছে। 
 
“নিন, এবার কাছা ছেড়ে, স্নান করে নতুন বস্ত্র পরে নিন।” বললেন পুরোহিত।
 
এইবার এগিয়ে এলেন সেই লোকটি, আবার। 
 
“ভাটার সময়ে স্নান করতে পারবেন?”
“না পারলে উপায়?” আমার মামা প্রশ্ন করলেন। 
ঠিক যে উত্তরটা আশা করেছিলাম, সেটাই এল, “আমি আছি তো।”
 
“অনুমতি করলে আমি দুই বালতি গঙ্গাজল তুলে এনে দেব, স্নান করবেন তাতেই। ঈশ্বর সব জায়গাতেই আছেন। সর্বভুতেষু সংস্থিতা।“
 
শেষ অংশটা আশা করিনি। যাইহোক। ঠিক হল আমি একটু গভীরে গিয়ে হাল্কা ডুব দিয়ে আসব, আর তারপর ওনার তুলে দেওয়া গঙ্গাজলে স্নান করে নেব ভাল করে। 
 
ডুব দেওয়ার জন্য আমি যেখানে গেলাম, তার থেকে আরও দুশো মিটার গভীরে গিয়ে জল তুলে আনলেন উনি। ক্লেদমুক্ত, পরিস্কার জল। 
 
ডাঙ্গায় উঠে এলাম। আমার পায়ে লেগে থাকা পলিমাটি ধুয়ে দিলেন জল ঢেলে। অতঃপর, দু বালতি গঙ্গাজলে জলে বেশ করে স্নান সারলাম।
 
ভেজা ন্যাড়া মাথায় বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছিল। ফেরার সময় হয়েছে। সেই ভদ্রলোকটিকে কাছে ডাকলাম। টাকার ব্যাগ মামার কাছে। দুটো একশো টাকার নোট বাড়িয়ে দিলাম, “অনেক উপকার করেছেন, রাখুন এটা।“ 
 
” ধন্যবাদ স্যার। আমি এখানেই থাকি। যেকোনো কাজ - পুজা পাব্বনে আমাকে পাবেন।“ নমস্কার করেন আবার।
“ কি নাম আপনার?” 
 
এইবার একটু কুঁকড়ে গেলেন মনে হল, “নাম থাক না বাবু। আমাকে সবাই কাকা বলেই চেনে।“
 
অবাক হলাম, “ নাম বলতে আপত্তি কিসের ?” মুচকি হেসে বললাম।
 
এইবার আমার একদম কাছে সরে এলেন উনি। আমার হাতটা ধরলেন। কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে ফিসফিস করে বললেন, “আমার নাম আসগার। আসগার আলি।“ হাতটা আলগা না করেই বললেন, “কাউকে বলার দরকার নেই বাবু। আপনি জানলেন, ব্যস। চিন্তা করবেন না বাবু, আমি গীতা, কথামৃত সবই পড়েছি। নিরামিষ খাই। জন্ম '. ঘরে হয়েছে, এই যা। আপনার কোনো পাপ লাগেনি বাবু। নিশ্চিন্তে বাড়ি যান।“
 
ফেরার সময় হয়েছে। পিণ্ডের দিকে পিছু ফিরে তাকাতে নেই, তবু, চোখ চলেই গেল। কাকেদের ভিড়। চাবি ঘুরিয়ে গাড়ি স্টার্ট করেছে ড্রাইভার। পিছনে পড়ে রইল এক মুক্তমনা মানুষের বিদেহী আত্মার প্রতীক্ষায় রাখা তেরটি পিণ্ড, পারলৌকিক ক্রিয়ার কিছু অবসম্ভাবি অবশেষ, শান্ত গঙ্গা, পলিমাটির গন্ধ আর আসগার আলি। 
 
বুক ভরে টেনে নিলাম পলিমাটির গন্ধ। আআহহ। এইতো ভারতবর্ষ, আমার ভারতবর্ষ।
 
।। সংগৃহীত ।।

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
পঁচিশ হাজার লাইক ,

কোথায় রাখবো।
কেউ কি বলে দেবে ...

Namaskar thanks

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
Heart Heart
Like Reply
[Image: 20230209-230744.jpg]
                            Namaskar
[Image: 20230923-133529.png]
Like Reply
(09-02-2023, 11:10 PM)মহাবীর্য্য দেবশর্ম্মা Wrote: [Image: 20230209-230744.jpg]

ধন্যবাদ মহাবীর্য দাদা। Namaskar
Like Reply




Users browsing this thread: 24 Guest(s)