পর্ব ৫: মর্গ
ঢাকা মেডিকেল। মর্গের মধ্যে সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ। ডক্টর সুমন রায় তত্ত্বাবধায়নে ডক্টর মাহি ও ডক্টর বিজয় ময়না তদন্তের রিপোর্ট শেষ করেছেন। এখন শুধু ডক্টর সুমনের একটা সিগনেচার আর পুলিশ হাতে তুলে দিলেই সব কাজ শেষ।
বিজয়- স্যার আসবো?
সুমন- কে! ও বিজয় এসো। রিপোর্ট এনেছো?
বিজয়- আপনি একবার দেখে সিগনেচার করে দিন। বাইরে ওয়ারী থানার এসপি সাহেব দাঁড়িয়ে আছে।
সুমন- আরে তুমি তো একবার দেখেই দিয়েছো। তাতেই হবে। আফটার অল তুমি তোমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ব্রাইট স্টুডেন্ট।
(একটা বোকা বোকা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করে বিজয় চৌধুরী)
সুমন- আচ্ছা শোনো আমার ক্লিনিকে যাওয়ার টাইম হয়ে গেছে। দাও সিগনেচার করে দিচ্ছি। এসপি
কে রিপোর্ট টা দিয়ে দিও আর আমার কথা বলে দিও। আর যদি মর্গে লাশ টা নেওয়ার জন্য কিছু দরকার হয় তাহলে, তুমি অথবা মাহি কাউকে সিগনেচার করে দিতে।
চলে যেতে যেতে হটাৎ থেমে, আচ্ছা বিজয় তোমার কি মনে হয়?
বিজয়- কিসের কথা বলছেন স্যার? মাহির সাথে আমার রিলেশন অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। আফটার অল ধর্ম আলাদা আর ও নিজেও মেনে নিতে পারছিল না। তবে ফ্রেন্ডশিপ টা কিরকম আছে।
সুমন- তোমাদের বিষয়টা আমি জানি। আসলে এই চতুর্থ প্রজন্মে এসেও মাহি যে কেন সেকেলে কে জানে। বাদ দাও। আমি রতনের কেস টা শুনছিলাম। কি মনে হয় তোমার?
বিজয়- স্যার এদের মত মত জানোয়ারদের না, এমনই শাস্তি হওয়া উচিত।
(পাশাপাশি কয়েকটি প্রদীপকে দূর থেকে যেমন একটি প্রদীপ বলে মনে হয়, তেমনি বিজয়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও কয়েক আলোকবর্ষ দূরে থাকা ডক্টর সুমন বুঝতে পারেনা, কি চলছে বিজয়ের মনে)
***
মানুষ এত ভয়ানক হতে পারে! লাশ আর রিপোর্ট দুটো একসাথেই হাতে পায় সেলিম। পরিবারের হাতে বুঝিয়ে দেওয়ার আগে একবার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট টা খুলেছিল। ব্যাস। হাজী সাহেবকে আর পড়ে শোনানোর মত অবস্থা ছিল না তাঁর। কোনরকমে রিপোর্ট আর লাশটা হাজী সাহেবের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে থানায় চলে আসে সে। কিন্তু এখন? রহমতউল্লাহ সার্কিত আরো হাজী সাহেবের মতো ফাঁকি দেওয়া যাবে না। স্যারের আদেশ। পড়ে শোনাতেই হবে। আদেশ না মানলেও কিছু এসে যায় না। কিন্তু যত যাই হোক ক্যারিয়ারে কোনো লাল দেখতে চাই না সেলিম। হাত পা কাঁপছে। চোখের সামনে যেন রতনের উপর অত্যাচার গুলো দেখতে পাচ্ছে। পুলিশের চাকরি করেও সে এতটা ভিতু? নাহ্! আর দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। অনুমতি না নিয়েই চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল সেলিম। চোখ মুখ ঘেমে উঠছে।
রহমতুল্লা- কি ব্যাপার? শরীর খারাপ নাকি?
সেলিম- না স্যার, আসলে... মানে, এই রিপোর্টটা দ্বিতীয়বার পড়ার মতো অবস্থায় নেই আমি।
রহমতুল্লা- কেন? কি এমন আছে রিপোর্ট টা তে? অত্যাচার করে মারা হয়েছে সেটা আমিও জান। কিন্তু কতটা?
সেলিম- না স্যার আমি পড়তে পারব না। সরি ফর ড্যাট।
রহমতুল্লা- আচ্ছা ঠিক আছে। তোমাকে পড়তে হবে না তুমি একবার পড়েছ না, সেটা আমাকে একটু মুখে বল।
সেলিম- তাহলে স্যার আমি সংক্ষেপে বলে যাচ্ছি।
রহমতুল্লা- হুম, বলো।
সেলিম- রিপোর্ট অনুসারে রতন নিখোঁজ হওয়ার ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ওর শরীরে অত্যাচার শুরু হয়।
রহমতুল্লা- মানে প্রথম ২ দিন মোটামুটি এরকম বলা যায় যে রতন পালিয়ে ছিল পুলিশের চোখ থেকে। তারপর?
সেলিম- স্যার প্রথমেই ওর শরীরের বাম অংশে বা বংশ বলতে স্যার, ওর সারা শরীরে গরম পেট্রোলিয়াম জাতীয় কিছু ঢেলে সমস্ত লোম তুলে ফেলা হয়। শুধু চুল, দাড়ি আর ভ্রু এগুলো ছিল। সম্ভবত কোনো ভিডিও রেকর্ড করা হয়েছিল। সেই কারণে, মুখমন্ডল টা ঠিক রাখা হয়েছিল।
রহমতুল্লা- আচ্ছা ঠিক আছে বুঝলাম। কিন্তু তারপর? আর কোন ভিডিও পাওয়া গেছে কি?
সেলিম- না স্যার। তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। আর এরপরের অংশগুলো আর বলার মত না। অত্যধিক রকম ভয়ানক।
রহমতুল্লা- কেন কেন?
(চোখে মুখে আগ্রহ ফুটে উঠলো)
সেলিম- রতনের ডান হাতের সবগুলো আঙ্গুলের নখ উপড়ে ফেলা হয় এবং মধ্যমা কেটে ফেলা হয়। আর সম্ভবত এক ধরনের পেইনকিলার ইউজ করে ওর বাম হাত কোন মেশিনে ঢুকিয়ে সমস্ত হাড় গুঁড়ো করে ফেলা হয়। তবে প্রসেসটা ছিল খুবই ধীর গতির সম্ভবত ৭ থেকে ৮ ঘন্টা লাগে ওর হাতের পাঞ্জার হাড় ভাঙ্গতে।
রহমতুল্লা- বাট এটা ডাক্তাররা কিভাবে বুঝল?
সেলিম- স্যার একজন স্বাভাবিক মানুষের ব্যথা সহ্য ক্ষমতা ৪৫ ডলরিমিটারের উপরে উঠে না। আর এতগুলো হার একসাথে ভাঙার ব্যথা সহ্য করবে রতনের মত একটা লোক। এটা কল্পনার বাইরে।
রহমতুল্লা- বুঝলাম। কিন্তু তুমি যেই স্বীকারোক্তির ভিডিওর কথা বলছো, তেমন হলে তো রতন সর্বোচ্চ হলে প্রথম দুই ধাপেই সবকিছু স্বীকার করে নেবে। তাহলে এত অত্যাচার কেন করা হলো?
সেলিম- হয়তো স্বীকারোক্তি তা প্রধান কারণ নয়। তেমন হলে রতনকে তো আর খুন করা হতো না।
রহমতুল্লা- বলতে চাচ্ছ ব্যক্তিগত কারণ?
সেলিম- আমার তোমনটা মনে হয় না স্যার। ব্যক্তিগত কারণ হলো সরাসরি কোন করে ফেলত।
রহমতুল্লা- ইয়েস, ইয়েস। ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট।
সেলিম- একটা মজার কথা শুনবেন?
রহমতুল্লা- একটা ভয়ানক ভাবে একজন খুন হয়েছে। এরমধ্যেও তুমি মজা খুজছো?
সেলিম- না স্যার, তেমন কিছু নয়। মনের লাশের মধ্যে একটা প্যাকেট পাওয়া গেছে। সেটার মধ্যে ওর ডান হাতের মধ্যমা আর একটা অন্ডকোষ পাওয়া গেছে।
রহমতুল্লা- ভালো। ওয়েট ওয়েট। কি বললে? অন্ডকোষ? মানে বিচি কেটে ফেলছে?
সেলিম- হ্যা স্যার। মারা যাবার ৭ থেকে ৮ দিন আগে কেটে ফেলা হয়।
রহমতুল্লা- তুমি যেভাবে বলছো যন্ত্রনাতে তো মনে হচ্ছে আমি মরে যাবো। ওই রতন বাঁচলো কেমনে?
সেলিম- আসলে ছাড়া ওর শরীরে এমন কিছু মেডিসিন পাওয়া গেছে যেগুলো প্রফেশনাল ডাক্তার ছাড়া কেউ দিতে পারে না।
রহমতুল্লা- মানে বলতে চাচ্ছো খুনি একজন ডাক্তার।
সেলিম- স্যার খুনি ডাক্তার কিনা বলতে পারবো না। তবে খুনিদের একজন ডাক্তার।
রহমতুল্লা- আবার টুইস্ট! বলি খুনি মোট কয়জন?
সেলিম- সেটা ঠিকঠাক বলতে পারব না। একজন ডাক্তার আছে এটা শিওর। আর রতনকে যেসকল যন্ত্র দিয়ে অত্যাচার করা হয়েছে সেগুলো বানানোর জন্য একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার দরকার।
রহমতুল্লা- আর কেউ আছে?
সেলিম- ওর স্তনে ক্লিপ লাগিয়ে কারেন্টের শট দেওয়া হয়েছিল। সম্ভবত ডিসি কারেন্ট। কারণ ওর বুকের এক দিকেই পুড়ে গেছে বুক। অথবা অন্য কোন উপায় হতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় একজন ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার ছিল।
রহমতুল্লা- মারাত্মক কম্বিনেশন।
সেলিম- যদি আমরা ওর খুনের দিকে তাকাই, মানে ওর লাশের দিকে, তবে দেখবো খুনিদের মধ্যে একজন কেমিস্ট অবশ্যই ছিল। যেভাবে গরম পেট্রোলিয়াম দেহ পোড়ানো হয়েছে, ওর চোখ দুইটাকে এসিড দিয়ে গলিয়ে ফেলা হয়েছে, আর মৃত্যু তো আরো ভয়ানক।
রহমতুল্লা- কি দিয়ে মারা হয়েছে?
সেলিম- পার হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড। সাধারণভাবে বাজারে এটা পাওয়া যাবেই না। এটা ল্যাবে বসে তৈরি করা হয়েছিল।
রহমতুল্লা- আচ্ছা খুনের লাস্ট স্টেপটা কি ছিল? আই মিন কিভাবে মারা হয়?
সেলিম- শিশ্নোর মুখে যে ছিদ্র আছে, ওর মধ্যে সিরিঞ্জ দিয়ে পার হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড পুশ করা হয়।
রহমতুল্লা- আল্লাহর কাছে হাজার বার দোয়া করি আমার শত্রুরও যেন কেউই এভাবে না মারে।
সেলিম- আমার কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে এটাই শেষ না। এরা হয়তো সিরিয়াল কিলার নয়তো সাইকো কিলার। এবং এই ধরনের লাশ আরো আমাদের হাতে আসবে...
চলবে...