Thread Rating:
  • 114 Vote(s) - 2.66 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
কিছু মনের সত্যি কথা
স্যারের কথা মনে পড়ে খুব একদিন ক্লাসে তিনি বলেছিলেন : ' মেধা, শ্রম আর আত্মবিশ্বাস থাকলে একজন পঙ্গুও এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে পারে ... মনে রেখো, ঝড়ে-বাতাসে লতা নুয়ে পড়ে, কিন্তু পাহাড় থাকে অবিচল... চোখের জল দিয়ে কিছু হয় না ওটা জলের অপচয়'

 
অনেকটা নীচে নেমে এসেছি পথে কোনো অন্ধ রেপিস্ট চোখে পড়েনি কেবল দুটি একটি টালমাটাল মদ্যপের সঙ্গে দেখা হয়েছে এখানকার পাহাড়, নদী, ঝর্ণা সারি সারি পাইনগাছের মতো এইসব মদ্যপ যুবা বৃদ্ধেরাও আমাকে চেনে আমার চোখের ভাষা জানে আমার শরীরের গন্ধকে ওরা সমীহ করে, ভালোবাসে
 
অন্ধকারে হঠাৎ চোখে পড়ে একটা আলো পাহাড় বেয়ে দ্রুত উঠে আসছে উপরের দিকে হ্যারিকেনের আলো লোকটার হাতে ভোজালির মতো কী একটা অস্ত্র আলোটা একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো  অর্জুন!  
 
ভাইটা আমার দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল এই অন্ধকারে ভোজালি আর লন্ঠন নিয়ে এতটা পথ চলে এসেছে সে পাছে দিদির কিছু হয়ে যায়! ওর এই ভালোবাসার কাছে পাহাড়ি চিতাও থাবা গুটিয়ে নেয় 
 
মনে পড়ে, বাড়িতে কেরোসিন বা মোমবাতি না থাকলে অর্জুন মাটির উনুনে একটা করে শুকনো ঝাউপাতা গুঁজে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে রাখত, যতক্ষণ না আমার পড়া শেষ হয় সেই আগুনের আলোয় আমি পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করতাম আর ভাই চুপটি করে বসে থাকত আমার পাশে বাবা মা দুজনেই তখন সারাদিনের পরিশ্রমের পর ঘুমিয়ে পড়ত কিন্তু আমার অনার্স পরীক্ষার  আগে অর্জুনের চোখে কোনো ঘুম থাকত না কখনো জল এনে দিত, কখনো দু একটি কলা, কখনো মুরগির ডিম সেদ্ধ কিন্তু একটিও শব্দ করত না, পাছে আমার মনোযোগ নষ্ট হয়
 
ভাই বলল, বাড়িতে কে একজন এসেছে সাহেব সাহেব দেখতে আমার সঙ্গে দেখা করবে বলে সন্ধে থেকে বসে আসে  অনেক বড়ো বড়ো বই এনেছে মা তাকে চা আর ভুট্টাপোড়া খেতে দিয়েছে
 
শুনে খুব অবাক হলাম আমি মাথার মধ্যে নানা সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছে স্থানীয় পঞ্চায়েতের কেউ নয়ত? কোনো কাগজের রিপোর্টার এসেছে কি? আগে যেমন দু'একবার এসেছিল! হঠাৎ মাথার মধ্যে অন্য এক বিদ্যুৎ চমকালো অসম্ভবের বিদ্যুৎ   সাহেব সাহেব দেখতে যখন বলছে ভাই ... স্যার নয়ত? কিন্তু স্যার কেনই বা আসবেন? কালই তো দেখা হল কথাও হল তাছাড়া বি এম স্যার আমার এই বস্তির বাড়ির ঠিকানাও জানেন না তাহলে কে হতে পারে
 
খুব দ্রুত পা চালিয়ে ঘরে ঘরে ফিরতেই দরজার বাইরে চোখে পড়ল একজোড়া ঝকঝকে ডিপ ব্রাউন কালারের শ্যু খুব চেনা আমার কালই তো এই জুতোয় আমার দুহাতের দশ আঙুল ছুঁইয়ে প্রণাম করেছি 
 
ঘরে ঢুকে দেখলাম, আমাদের দড়ির খাটিয়ায় স্যার বসে আছেন মা-বাবার সঙ্গে কথা বলছেন যেন কতকালের চেনা পাশে একটা বড় ব্যাগে অনেকগুলো বই 
 
স্যার এবার উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন
'যাক তুমি এসে গেছ! আমি তো ভাবলাম দেখাই হবে না তোমার বাবা-মা আর ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে অনেক গল্প হল অনেককিছু জানা হল খুব ভালো লাগল মনে হল, আমরা প্রত্যেকেই অন্য মানুষ সম্পর্কে কত কম জানি, অথচ পাশাপাশি রয়েছি দীর্ঘকাল'
 
আমার তখন বুকের ভিতরে তোলপাড় চলছে যেন  ডিসেম্বরের সমস্ত পাহাড় জুড়ে তুষার-ঝড় শুরু হয়ে গেছে আমি যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না স্যার নিজে এসেছেন আমাদের এই বিষণ্ণ-মলিন ভাঙাচোরা পাহাড়ি বস্তির ঘরে
 
স্যার তাঁর বইভর্তি ব্যাগ থেকে প্রায় একই আকৃতির সমস্ত বই একে একে বের করে আমাকে দেখিয়ে বললেন :
' শোনো জাগরী, আমার এই রবীন্দ্ররচনাবলীর পুরো সেটটা তোমাকে দিয়ে গেলাম.... আর একটা কথা, সেটা অবশ্য তোমাকে কালই বলতে পারতাম... আমি আগামী সপ্তাহেই তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাচ্ছি দিল্লিতে ওখানকার একটা ইউনিভার্সিটি থেকে ডাক এসেছে ওটা আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয় Alma mater. অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডায়াসে দাঁড়িয়ে পড়াব.... 
 
তোমার বাবার কাছে আমার সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর দিয়ে গেলাম প্রয়োজন হলে ফোন কোরো কোনো অসুবিধে হলে জানিও আমি যতটা সম্ভব সলভ করার চেষ্টা করব... 
 
আমার ধারণা যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে, তুমি ফাইনাল পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস পাচ্ছো আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখো'
 
স্যার স্বাভাবিক স্বরেই কথা বলছিলেন কিন্তু আমি আর নিজেকে সংযত করে রাখতে পারছিলাম না বুকের ভিতর থেকে পুঞ্জীভূত আবেগের বাষ্প আমার চোখের সমস্ত কূল ছাপিয়ে নোনা জল হয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল বুকের জামায় স্যার সস্নেহে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললেন : ' বোকা মেয়ে, তুমি তো এত দুর্বল নও কাঁদছ কেন এভাবেমনকে শক্ত করো জীবনে এখনো অনেক পরীক্ষা বাকি তোমার অনেক হার্ডলস সব বাধা পার হতে হবে তোমাকে অনেক বড় হতে হবে অনেক উপরে উঠবে তুমি আর সেটাই হবে তোমার সমস্ত অপমানের জবাব'
 
সেই মুহূর্তে আমি মনে মনে বলছিলাম : 'আমি আর কোনো পরীক্ষায় বসব না স্যার আমি আর বড় হতে চাই না আপনি কেন চলে যাবেন আমাদের ছেড়ে... আমাকে ছেড়ে?'
 
কিন্তু স্যারকে এসব কিছুই বলতে পারিনি আমি কী করে বলবআপনি আমার সেই দেবতা, যিনি ঘন অন্ধকারের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে এসে আমার হাত ধরেছেন আমাদের নিভে যাওয়া লন্ঠনে নতুন করে আলো জ্বেলে দিয়েছেন নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন  
 
ততক্ষণে বাবা-মাকে নমস্কার জানিয়ে অন্ধকার পাহাড়ি রাস্তায় উঠে আমাদের দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছেন তিনি আমি কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি সেই হিমার্ত অন্ধকারের দিকে তারপর ঝিম মেরে বসে থাকি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রবীন্দ্ররচনাবলীর মাঝখানে 
 
আরো গভীর রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আমি মোমবাতির আলোর সামনে এক এক করে উল্টে যাই রচনাবলীর প্রতিটি খণ্ড রাজর্ষি, গোরা, চার অধ্যায়, শেষের কবিতা, শ্যামা, চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, সোনার তরী, মহুয়া, সভ্যতার সংকট... আহা কত প্রিয় সব লেখা 
 
কত কষ্ট করে এতদিন লাইব্রেরি থেকে চেয়েচিন্তে, স্যারদের কাছ থেকে ধার চেয়ে এসব বই পড়েছি আমি আর আজ মেঘ না চাইতেই বন্যা আজ সম্পূর্ণ রবীন্দ্রনাথ আমার হাতের মুঠোয় আমার বুকের পাঁজরে, মনের মণিহর্ম্যে এসে ধরা দিয়েছেন সেই  অচিন পাখির মতো, যাঁকে কখনো পুরোপুরি ধরা যায় না...  এই বইগুলোয় স্যারের সোনালি আঙুলের স্পর্শ লেগে আছে তাঁর দু'চোখের নরম দৃষ্টি লেগে আছে 

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
কোথাও কোথাও দেখছি পেজমার্কার দেওয়া আছে কোথাও আবার বিশেষ কিছু পঙক্তির নীচে সবুজ কালি দিয়ে দাগ দেওয়া সেগুলো পড়তে পড়তে ক্রমে রাত বাড়ে দূরে কোথাও সমবেত আর্তনাদের মতো শেয়ালের ডাক শোনা যাচ্ছে সেই ডাক শুনে লাইলং নামের মা-মুরগিটা একবার বিপদ-সংকেতের মতো আওয়াজ করে পরক্ষণেই চুপ করে যায়

 
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটা জায়গায় এসে আমি আদিগন্ত চমকে উঠি সবুজ কালি দিয়ে স্যার চিহ্নিত করে রেখেছেন খুব পরিচিত একটি রচনার কয়েকটি লাইন যেন আমাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছেন কিছু :
 
'আমি চিত্রাঙ্গদা
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী
পূজা করি রাখিবে মাথায়, সেও আমি
নই; অবহেলা করি পুষিয়া রাখিবে
পিছে, সেও আমি নহি যদি পার্শ্বে রাখ
মোরে সংকটের পথে, দুরূহ চিন্তার
যদি অংশ দাও, যদি অনুমতি কর
কঠিন ব্রতের তব সহায় হইতে,
যদি সুখে দুঃখে মোরে কর সহচরী 
আমার পাইবে তবে পরিচয়'
 
চেনা লাইনগুলো হঠাৎ এই মধ্যরাতে এক নতুন আলোর বার্তা নিয়ে আমার মর্মে, আমার সমস্ত স্নায়ুতে, আমার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ল... প্রণাম.... শতকোটি প্রণাম আপনাকে স্যার,... হে আমার অপার্থিব আলোর দেবতা!
 
রাত প্রায় শেষ হয়ে এল একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে  ভূতগ্রস্তের মতো কেটে গেল বিনিদ্র প্রহরগুলি আজ আর ঘুম আসবে না উঠে বসলাম বিছানা থেকে ব্ল্যাংকেটটা গায়ে জড়িয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে জলের গেলাসটা নিতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল ভেরোনিকার দেওয়া রঙিন কাগজে মোড়া রিটার্ন গিফটটা খুলেই দেখা হয়নি ওটা মন এত খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, খুলে দেখতেও ইচ্ছে করেনি ফেরার পথে 
 
সামান্য কৌতূহল হল কী আছে ওতে? খুলেই দেখা যাক না সমস্ত সেলোটেপ খুলতে সময় লাগল কিছুটা কিন্তু এটা কী? টকটকে রক্তের মতো লাল একটা ব্রা! প্যাডেড! খুব দামি মনে হল 
 
আমার মাথা চোখ কান সব আকস্মিক রাগে আর উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠল সমস্ত স্নায়ু বিদ্রোহ করে উঠল আমি কখনো ব্রা পরি না, সবাই জানে ফার্স্ট ইয়ার অনার্সে পরার সময় একদিন ক্লাসের টমবয় মেয়েরা সমস্ত ছেলেকে রুম থেকে বের করে দিয়ে নিজেদের ব্রেস্ট ওপেন করে প্রমাণ করতে চাইছিল কারটা জেনুইন, আর কারটা আর্টিফিসিয়াল! যেসব মেয়ে নিজেদের ব্রেস্ট শো করতে সঙ্কোচ বোধ করছিল টমবয়রা ফোর্স করে তাদের টি শার্ট ওপেন করে দিয়েছিল হাসতে হাসতে আমি তখন ক্লাসের এক কোণে বন্য শেয়ালের তাড়া খাওয়া রোগা কালো ছাগলছানার মতো প্রাণভয়ে সিঁটকে রয়েছি লম্বা চওড়া স্বাস্থ্যের মস্তান টাইপ একটি মেয়েএসে একটানে আমার ওড়না ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দুহাতে বুক চেপে ধরে অবাক হয়ে বলেছিল :
 
 'যাহসালা! তুই ব্রা পরিস না? তোর ব্রেস্ট জিরো? কী করে হলো এটা! মাই গড!.... এই তোরা দেখেছিস? এই মেয়েটার ব্রেস্ট নেই প্যাডেড ব্রা- পরে না
 
সবাই তখন আমাকে গোল করে ঘিরে ধরেছে যেন স্টেশনের প্লাটফর্মে ধরা পড়েছে কোনো পকেটমার, যাকে চুরির দায়ে ধরা হয়েছে, কিন্তু সারা শরীর ঘেঁটেও কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না চুরি-যাওয়া বস্তুটি
আর আমি তখন দুহাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম
 
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও দেখেছি মেয়েরা মাঝে মাঝেই ব্রা নিয়ে নানা ফ্যান্টাসি করত কার বয়ফ্রেন্ড কাকে জন্মদিনে ইমপোর্টেড ব্রা গিফট করেছে, কার জামাইবাবু কাকে পুজোতে একডজন ব্রা উপহার দিয়েছে....এইসব নিয়ে হাসি তামাশা হত আমি মুখ কালো করে ওদের একপাশে একটা বই নিয়ে বসে থাকতাম 
 
কত রকমের যে ব্রা- ডিজাইনের কথা কানে ভেসে আসত : টি শার্ট ব্রা, স্পোর্টস ব্রা, বেবি ডল ব্রা, ক্যামিসোল ব্রা, প্যাডেড ব্রা, স্ট্র্যাপলেস ব্রা, স্টিকি ব্রা, করসেট ব্রা, মিনিমাইজ ব্রা, নার্সিং ব্রা, পয়েন্টেড ব্রা.... আমি এগুলো একটাও চিনি না শুধু নামই শুনেছি চেনার চেষ্টাও করিনি কখনো 
 
ভেরোনিকার দেওয়া লাল রঙের ব্রা-টিকে দেখে প্রথমে মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল পরে মনে হল, হয়ত ভালোবেসেই এটা দিয়েছে আমাকে যাতে বাইরের লোকের কাছে আর অপ্রস্তুত না হই! যাতে মানুষের কাছে নিজের শরীরের ত্রুটি গোপন করার জন্য সবসময় বুকে ভারী ওড়না জড়িয়ে রাখতে না হয়
 
একবার ইচ্ছে হলো, ওটা পরে দেখি কেমন দেখায় আমাকে? কেউ তো আর দেখছে না এই শেষরাতের আধো অন্ধকারে 
 
এত দামি ব্রা কেনার সামর্থ্যও আমার নেই কখনো কিনব বলে ভাবিওনি অফ-ক্লাসে দুধের মতো ফর্সা আর সেক্সি চেহারার ইলোরা চৌধুরী একদিন বলছিল : 'আমার গ্রোথ বেশি ছিল বলে মা আমাকে ক্লাস সিক্সেই ব্রা কিনে দিয়েছিল আর সবাই সেটা হাঁ করে দেখত এইটুকু মেয়ে এই বয়সে....'
 
আমার মা অবশ্য এসব নিয়ে কখনো ভাবেইনি আমিও ক্রমশ না ভাবতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম  কিন্তু আজ হঠাৎ মনে হলো... 
 
কেন মনে হলো? মুহূর্তেই সমস্ত মন, সমস্ত সত্তা বিদ্রোহ করে উঠল নাহ, জিনিস আমি পরব না কক্ষনও না জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষায় নকল করে পাস করিনি চিরকাল নিজের মেধার উপরে আস্থা রেখে উদাসীন মেঘ থেকে বৃষ্টি নামিয়েছি ফসল তুলেছি ঘরে 
 
আজ কেন তবে মুহূর্তের দুর্বলতায় একটা দামি প্যাডেড ব্রা পরে নিজেকে কৃত্রিমভাবে অন্যের চোখে আকর্ষণীয় করে তুলতে চাইছি
 
কিছু কামুক আর লম্পট পুরুষকে নিজের বানানো ব্রেস্ট দেখিয়ে প্রলুব্ধ করা কি খুব প্রয়োজন? ছিঃ, ছিঃ জাগরী, এসব বিকৃত ভাবনা মাথায় ঢোকার আগে তোমার আরো একবার আগুনে পুড়ে মরা উচিত ছিল 
এতকালের সমস্ত লড়াই, সমস্ত চোখের জল, তোমার উজ্জ্বল সমস্ত মার্কশিট জলে ভাসিয়ে দাও মরো তুমি 

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
মোরগঝুঁটির মতো টকটকে লাল ব্রা-টাকে প্যাকেটসহ দুমড়ে মুচড়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে বাইরে এলাম  ছোটোবেলায় যে উনুনটায় আমি উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, সেটার সামনে এসে দাঁড়ালাম উনুনের গর্তের ভিতরে একমুঠো শুকনো ঝাউপাতা ফেলে দিয়ে দেশলাই জ্বেলে আগুন ধরিয়ে দিলাম সেই লেলিহান আগুনের শিখায় সজোরে ছুঁড়ে দিলাম ভেরোনিকার সেই রিটার্ন গিফট 

 
সিন্থেটিক স্ট্রাইপ আর স্পঞ্জ-পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের বাতাসে পুড়ে যাচ্ছে ইমপোর্টেড ব্রেসিয়ারের অসভ্য রক্তিম হাতছানি পুড়ে যাচ্ছে আমার কয়েক মুহূর্তের লোভ, পাপ আত্মপ্রতারণা..... 
 
উনুনে জল ঢেলে একসময় নিজেই নিবিয়ে দিলাম আমার ক্ষণকালের দুর্বাসনার চিতা তারপর এক অদ্ভুত নির্বেদ, সকালের আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ল আমার ক্লান্ত শরীরে.... মনে.... আমার সমতল  বুকের পাঁজরে যেন বোবা হয়ে গেছি ভূতে পাওয়া মানুষের মতো 
 
শান্ত পায়ে ঘরে ফিরে আসি পড়ার টেবিলের উপরে, বিছানায়, তখনো ছড়িয়ে আছে খণ্ড খণ্ড রচনাবলী আমার দুচোখে পলক পড়ছে না নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে তখনো চোখের পাতা-পুড়ে-যাওয়া মানুষের মতো ষোলো খণ্ড রবীন্দ্ররচনাবলীর মধ্যে চুপ করে বসে থাকি আমি...
 
*একইসঙ্গে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোধা সম্প্রদায়ের আত্মঘাতী ছাত্রী চুনি কোটাল (১৯৯২) এবং হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অপমানিত আত্মঘাতী গবেষক-ছাত্র রোহিত ভেমুলার (২০১৬) স্মৃতির প্রতিও সম্মান জানাই*


Namaskar
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
# অণুগল্প

 
শাশুড়ি মায়ের ফোনটা রাখার পর থেকেই মনটা খুব খারাপ লাগছে অমৃতার।
শনি-রবি তো ছুটিই, আর মঙ্গলবার মানে আজ, ঈদ উপলক্ষ্যে ওর আর সুমিতের অফিস ছুটি ছিল। তাই সোমবারটা ছুটি নিয়ে একটা 'এক্সটেন্ডেড উইকএন্ড' বানিয়ে ওরা দুজন একটু ঘুরতে গেছিল। আজ দুপুরে ফিরেছে। ঘরে পা দিয়েই সুমিত ঢুকে গেল বাথরুমে। সেই ফাঁকে বাবা-মা কে ফোন করে পৌঁছনোর খবর দিয়ে শাশুড়ি মাকেও ফোন করেছিল অমৃতা। উনি "যাক বাবা, ঠিক মতো ঘুরেছিস তো?" জিজ্ঞেস - টিজ্ঞেস করে বললেন "আজ কিন্তু অক্ষয় তৃতীয়া, এতদিন বাড়ির বাইরে, একটু পুজো করিস... পারলে একটু মিষ্টান্ন ভোগ দিস ঠাকুরকে।" "হ্যাঁ" বলে ফোন রেখে দিয়েছে, কিন্তু তারপরেই মনটা কেমন খচখচ করছে!
মা কে হ্যাঁ তো বলে দিল, কিন্তু এই এতদিন পরে বাড়িতে এসেছে... জানলা - দরজা সব বন্ধ ছিল, তাও কিভাবে যেন ধুলো ঢুকেছে ঘরে। ঝাঁট -টাঁট দিয়ে ঘর মুছে স্নানে যাবে ভেবেছিল - সুমিত সেই ফাঁকে সিদ্ধভাত বসিয়ে দেবে, এমনটাই প্ল্যান করেছিল। 'দিন ধরে বাইরে খেয়ে খেয়ে আর ভাল লাগছে না কিছু। আবার খিদেও পেয়ে গেছে খুব - কিন্তু এখন ভোগ যে কি দেবে! এদিকে দুপুরবেলা - দোকানও তো কিছু খোলা নেই সামনা সামনি। সেই মোড়ের দিকের দোকানগুলো খোলা থাকতে পারে, কিন্তু একদম যেতে ইচ্ছে করছে না।
এদিকে মা বললেন... ওর নিজেরও ইচ্ছে করছে... আজ একটা শুভদিন...
ভাবতে ভাবতেই কলিংবেলের শব্দ।
"এই ভরদুপুরে আবার কে এলো!" ভাবতে ভাবতে দরজা খুলল অমৃতা। আর, অবাক হয়ে দেখে ওদের ফ্ল্যাটের সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ওসমান চাচা এসেছেন, হাতে একটা ছোট্ট টিফিনবাক্স!
"দিদি, আপনারা আজ ফিরবেন মনে হচ্ছিল... তাই এলাম। এই এতে একটু চালের রুটি আর শেমাই আছে... আপনার আর দাদার জন্য।"
"আমাদের জন্য! কী মজা! থ্যাংকইউ চাচা!" পিছন থেকে বলে উঠল সুমিত।
"চাচা, আপনি আমাদের থেকে অনেক বড়, কদমবুশি তো করতে জানি না, এমনিই নমস্কার করছি আপনাকে। আচ্ছা চাচা, এই শেমাই আমরা ঠাকুরকে নিবেদন করতে পারব?" জিজ্ঞেস করে অমৃতা।
"ঠাকুরকে? তা তো জানি না দিদি, তবে আমরা বুড়ো-বুড়ি গোস্ত খাই না। তাই মাংসের ছোঁওয়া নেই এই শেমাইতে..." একটু হেসে বলেন চাচা।
"ব্যস, তাহলেই হবে। চাচা, আমার কিন্তু ঈদের উপহার চাই... আপনি আমাকে আর 'আপনি' করে বলবেন না! খুব রেগে যাব কিন্তু তবে!" বলে ওঠে অমৃতা।
"তাহলে আমাকেও 'তুমি' করেই ডাকতে হবে চাচা" বলে ওঠে সুমিত
"আচ্ছা, আচ্ছা... বেশ বেশ " বলে হাসেন চাচা। চোখটা একটু জ্বালা জ্বালা করছে যেন...
একটু পরে, যখন শেমাই প্রসাদ খাচ্ছিল সুমিত আর অমৃতা - ওদের মনে হচ্ছিল সাকার আর নিরাকার স্রষ্টা যেন এভাবেই মিলেমিশে গেলেন ওদের মধ্যে। যেভাবে খুশির ঈদ আর পবিত্র অক্ষয় তৃতীয়া মিলে যায়... আর ভরিয়ে দেয় অপার শান্তিতে আর ভালবাসায়...
 

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
# অণুগল্প

 
হ্যাঁ, লাজবন্তী জানে খিটখিটে।
কারণে অকারণে ওর মেজাজ গরম হয়ে যায়। অফিসে অনেকে ওকে 'মর্জিনা' বলে ডাকে জানে। সবসময় মর্জি মতো কিছু না হলেই রাগ হয় বলেই এই নাম! নামটার মধ্যে ক্রিয়েটিভিটি আছে বলে একটু হাসি পেয়েছিল ওর। কিন্তু তারপরেই মনে হয়েছে "শয়তান এক একটা! সিনিয়রদের সঙ্গে কিভাবে ব্যবহার করতে হয় জানে না!"
আর, সবসময় মাথাগরম থাকবে না বা কেন? যার কেউ নেই, তার তো কাউকে তুষ্ট করে চলারও দায় নেই! পনেরো সালে বাবা আর আঠেরোয় মা চলে গেছেন। দাদা ভিন রাজ্যে থাকে। একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল, প্রেমের বেলায় ছিল, বিয়ের কথা ওঠার পরেই সুড়সুড় করে বাবা-মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে নিল! ওর এখন কেউ নেই জাস্ট! শুধু নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে, ভাল চাকরি করে, কাউকে পাত্তা দেয় না ও। হুঁহ!
আর কাকেই বা দেবে? দাদা মাঝেমাঝে ফোন করে, ওইটুকুই। কখনও বলে নি "আমার কাছে চলে আয়। এখানে চাকরি পেয়ে যাবি। তোর যোগ্যতা আছে, ভাবনা কি..."
এই বাইরে প্রচন্ড গরম আর অফিসে, বাড়িতে এসির ঠান্ডা - দুয়ে মিলে জ্বর এসে গেছে লাজবন্তীর। তাই অফিসে যেতে পারেনি বুধবার থেকে। ফেব্রুয়ারি মাসে ওদের 'ওয়ার্ক ফ্রম অফিস' চালু হবার পরে এই প্রথম ছুটি নিল ও।
দুদিন মাথা তুলতে পারছিল না ও। আজ একটু সুস্থ লাগছে। এই দুদিন বাড়ির যে কাজ করে, সেই শাবানাকে আসতে বারণ করেছিল ও। আবার কোভিড বাড়ছে - বলা তো যায় না! ওর তো একটা দায়িত্ব আছে! শাবানা শুনে "দিদি, আমি না গেলে তুমি কি খাবে? কিছু হবে না, আমি চলে যাব!" বলেছিল। কিন্তু রাজি হয়নি। নিজেই ভাতেভাত করে খেয়ে নিয়েছে। আর বাইরে থেকে খাবার অর্ডারও করেছে। কিন্তু আজ শরীর বেশ ভাল। ডাক্তারবাবুও বললেন কোভিড না, এমনিই গরম-ঠান্ডা থেকে জ্বর হয়েছে। তাই শাবানাকে ফোন করে বলে দিল "তুমি চাইলে আসতে পারো।" শাবানা একটু চুপ করে ছিল। তারপর বলল "আচ্ছা দিদি, আমি বাড়ির কাছেই আছি, আসছি।"
তা, মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই চলে এসেছিল শাবানা। সঙ্গে ওর ছেলে। বছর পাঁচেক বয়স, রোগা টিংটিঙে চেহারা। তবে আজ বেশ বাহারের কুর্তা - প্যান্ট পরা। এর আগে যতবার এসেছে আদুল গায়ে এসেছে! আজ শাবানাও একটা ঝলমলে চুড়িদার পরে আছে।
"এত সেজেগুজে?" জিজ্ঞেস করল লাজবন্তী।
"ওই যে, ওকে নিয়ে একটু ডানলপের রথের মেলায় যাব দিদি। এদিক পানেই আসছিলাম, তাই তো তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারলাম গো" বকবক করে বলে ওঠে শাবানা।
রথের মেলায় শাবানা!
এই ভিড়ে!
খুব অবাক লাগে ওর। তারপর জিজ্ঞেস করেই ফেলে "রথের মেলা তো থাকবে কয়েকদিন। পরে যেতে পারতে!"
"কি বলব দিদি, ছেলে শুনবেই না। ওর জগন্নাথ ঠাকুরকে খুব পছন্দ। আমাদের পাশের ঘরের ওরা তো উড়িয়া! ওরা পুরী গেছল, প্রসাদ দিয়েছে। ব্যস, ছেলে তারপর থেকে ঠাকুরের নামে পাগল!"
"তোমার জগন্নাথ ঠাকুরকে ভাল লাগে?" জিজ্ঞেস করল লাজবন্তী বাচ্চাটিকে।
"হ্যাঁ, উনি কেমন হাত বাড়িয়ে রাখেন জড়িয়ে ধরবেন বলে। আব্বাও বাড়ি এলে ওমনি করে হাত ছড়ায়ে রাখে, আমি গিয়ে জড়িয়ে ধরি!"
শুনতে শুনতে চোখে জল আসছিল লাজবন্তীর।
"হাত কাটা জগন্নাথ", 'ঠুঁটো জগন্নাথ' বলে অনেকে। একটা খারাপ ইঙ্গিত দিয়েও কথা বলে অনেকে। কিন্তু... কখনও তো মনে হয়নি, আসলে ওটা কাটা হাত না, মেলে থাকা হাত! বুকে নেবার অপেক্ষায়!
কথাটা ভেবেও যে কী শান্তি! আহ্!
আচ্ছা, যে ভাবে, ওর কেউ নেই - নেই কি আসলে? উনিই তো আছেন! আলিঙ্গনের অপেক্ষায়...
আর কিনা... অভিমান, অতিমান থেকে মেজাজ গরম করে রাখে সবসময়! ধ্যাত!
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা সাদেকের চুলটা একটু ঘেঁটে দেয় লাজবন্তী।
এখন শরীরটা বেশ ভাল লাগছে।
অনেকবছর যায় নি, আজ একটু মেলায় গেলে কেমন হয়?
একটু পাঁপরভাজা - জিলিপি কিনলে কেমন হয়?
ভাবতেই ভাল লাগছিল লাজবন্তীর।
না, না - লাজুর! জগন্নাথদেবের লাজু! একজন তো আছেনই, ওকে 'লাজু' ভাবার!
 

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
রি- উইনিয়ন

(এক গরীব ভাই এর জীবনের সত্যি ঘটনা অবলম্বনে লেখা)
   "বাবাআআআ ,ও বাবা---দেখোনা একটু বাইরে এসে। এই কাকু টা তোমাকে খুঁজছে।"
       ফুচকা গুলো ভেজে ভেজে ঝুড়ির মধ্যে সাজিয়ে রাখছিলো সুবল। এই সময়ে তার আর মলিনার নাওয়া খাওয়ার সময় থাকে না। দেড়টার মধ্যে দুপুরের খাওয়ার পাট চুকিয়ে দুজনে মিলে বেছে নিয়েছে এই ঘন্টা তিনেক সময়। 
       মলিনা একদিকে বেলতে থাকে ---আর চটপট ভেজে ফেলে সুবল। তারপর আবার আছে পুর তৈরি করার হ্যাপা। ওটা অবশ্য পুরোপুরি মলিনার ডিপার্টমেন্ট। সুবল ঐ ব্যাপারে মাথা ঘামায় না। আলুসেদ্ধ, কুঁচোনো পেঁয়াজ, সেদ্ধ মটর, লঙ্কাকুচি, ধনেপাতা, নারকেলের টুকরো দিয়ে মলিনা এমন অসাধারণ একটা পুর তৈরি করে যে ছোট ছোট মেয়েগুলো একটু বেশী করে পুর দেওয়ার কথা বারবার বলতে থাকে। বলতে গেলে এই স্পেশাল পুরের জন্যই সুবলের ফুচকার এ তল্লাটে এতো নাম ডাক।
       তাও তো মাঝ দিয়ে এই ফুচকার ভ্যান লাগানো বন্ধ হয়েই গেছিলো। 2020- র এপ্রিল থেকে পুরো বছরটা যে কিভাবে কেটেছে, ভাবতে গেলে শিউরে উঠতে হয়। তাও এই আনলক শুরু হওয়ার পর ভগবান আবার একটু মুখ তুলে তাকিয়েছেন। সাড়ে পাঁচটার মধ্যে তে- মাথার মোড়ে ফুচকার ঠেলাটা নিয়ে যে করেই হোক পৌঁছতে হয়। বারবার মলিনাকে তাড়া দিতে থাকে সুবল। কিন্তু এই সময়ে মেয়েটা আবার চীৎকার করে কেন?----"কি রে মা? ডাকছিস কেন? কে খুঁজছে আমাকে?"
   "নিজে এসেই দেখে যাও না বাপু। আমি এখন খেলা ছেড়ে ভেতরে যেতে পারবো না"----চটপট জবাব ভেসে আসে পিঙ্কির।
অগত্যা উঠতেই হয় সুবল কে। তারে মেলা গামছা টা গায়ে জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়--"দেখি ভর দুপুরে কোন সুমুদ্দির পো আমাকে খুঁজতে এলো।"
    কিন্তু বাইরে এসে সুবলের অবাক হবার পালা। পোস্ট অফিসের পিয়ন বাবু দাঁড়িয়ে আছেন চিঠির ব্যাগ হাতে নিয়ে---"আপনিই তো সুবল ব্যানার্জি? আপনার নামে একটা রেজিস্ট্রি চিঠি আছে। আপনার ঘর খুঁজে বের করতেই আমার আধঘণ্টা চলে গেল। নিন, তাড়াতাড়ি সই করুন দেখি।"
অবাক হয় সুবল। ইহলোকে এমন কে মানুষ আছে, যে তাকে রেজিস্ট্রি ডাকে চিঠি পাঠাবে? আত্মীয় স্বজন,না না  তারা তো গরীব সুবলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেনি। থাকার মধ্যে আছে তো এক দিদি। সে অবশ্য মাঝে মধ্যে ফোনে খবর টবর নেয়। আর আছে মলিনার বাপের বাড়ির লোকজন। তারা অন্তত এমন খরচ করে চিঠি পাঠানোর কথা মাথাতেও আনবে না।
    চিন্তা গুলো মাথায় ঘুরপাক খাওয়াতে খাওয়াতেই সই করে চিঠিটা হাতে নিলো সুবল।
   বেশ লম্বা সুদৃশ্য একটা খাম। বাঁ দিকে মনোগ্রাম করে লেখা---" পুনর্মিলন উৎসব কমিটি, 1990 হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচ, ভুবনডাঙা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মেমারি, বর্ধমান। ডান দিকে গোটা গোটা হরফে তো তারই নাম লেখা। 
    "চশমা টা দাও তো দেখি "----চিঠিখানার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো সুবল। বাংলায় টাইপ করে পুরো চিঠিটা লেখা। আগামী সতেরো ই জানুয়ারি ( রবিবার) কলকাতার ইকো পার্কে 1990 এর হায়ার সেকেন্ডারি ব্যাচের সমস্ত ছাত্র ছাত্রীদের পুনর্মিলন উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। সে এবং তার পরিবারের সদস্যরা যেন অতি অবশ্যই আসে। মাস্ক এবং স্যানিটাইজার সঙ্গে আনা বাধ্যতামূলক।
   এক ধাক্কায় পিছোতে পিছোতে একেবারে 1983/84 তে পৌঁছে গেলো সুবল। মনে পড়ে গেল, কলেজের গেটের পাশে সেই বাহারি ঝুমকোলতা গাছ। ওপরে সাদা বোর্ডের ওপর নীল হরফে লেখা----
   "ভুবনডাঙা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, Estd--1942।
পঞ্চাশ বছরের বিবর্ণ, মরচে পড়া সুবল হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলো সেই বারো তেরো বছরের কিশোর সুবলকে। সেই রংচটা একটা কলেজ ব্যাগ আর হাফ দাম দিয়ে কেনা বই নিয়ে টিকে তো ঐ কলেজে---সাত আট বছর। বাবার হাত ধরে যেদিন প্রথম এসেছিলো কলেজে সেই দিনের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেলো সুবলের। কেমন যেন চোরের মতো মুখ করে গেট পর্যন্ত এসেছিলো বাবা। ছেলের শত কাকুতি মিনতিতেও ভেতরে যাওয়ার স্পর্ধা দেখায়নি। 
একটু উঁচুতে উঠে বুঝেছিল সুবল--কেন বাবা ভেতরে ঢুকতে চায় নি। ভ্যান চালক বাবাদের কি আর ভেতরে ঢোকা মানায়? ওখানে তো ঢুকবে কেউকেটা গার্জেন রা। 
চুপচাপ ক্লাস ফাইভের রুমে ঢুকে পেছনের বেঞ্চে বসে পড়েছিলো সুবল। প্রথম ক্লাস শুরু হতে ব্যাগ থেকে ধীরে ধীরে বের করেছিল খাতা আর পেন।
পাশ থেকে একটা মুচকি হাসি ভেসে এসেছিলো। সাথে একটা কথা---" বাঁধানো খাতা কিনতে পারিস না? এইসব কাগজ সেলাই করা খাতা আজকাল কেউ আনে?
    সুবল কোন উত্তর দেয়নি। উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিলোও না তার হাতে। ক্লাসে পড়ানোর দিকে মন দিতে চেয়েছিলো।
   হঠাৎই বাংলার স্যার একটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে ছিলেন ক্লাসের দিকে---"শর শব্দটা নিশ্চয়ই শোনা আছে তোমাদের। বলোতো এর মানে কি? পুরো ক্লাস নিশ্চুপ। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে। সামনের বেঞ্চে বসা বৃত্তি পাওয়া ছেলে-- কিংশুক, শৌভিক----সবাই চুপ। হঠাৎই পেছনের বেঞ্চে বসা সুবল উঠে দাঁড়ালো ধীরে ধীরে---"স্যার, শর মানে হলো তীর।
   ক্লাসের সব চোখগুলো ঘুরে গেল সুবলের দিকে। লজ্জায় মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো সুবল।
তারিফ ঝরে পড়লো বাংলা শিক্ষকের গলায়----
---"বাহহহ, ভেরি গুড। আচ্ছা এই একই উচ্চারণে ভিন্ন শব্দ, এবং তাদের অর্থ-- তোমার জানা আছে কি?"
" হ্যাঁ স্যার "----ধীর গলায় উত্তর দিয়েছিলো সুবল---" স্বর মানে গলার আওয়াজ আর সর মানে দুধের সর।"
"বাহহহ, দারুণ উত্তর দিয়েছো বাবা, কি নাম তোমার?"---অমল বাবুর গলায় তারিফ ঝরে পড়ে।
"তুই তো ছুপা রুস্তম রে"---পাশ থেকে আবার আওয়াজ ভেসে এসেছিলো---" আজ থেকে আমি তোর বন্ধু হয়ে গেলাম। আমার নাম মিহির সরখেল। অবশ্য সব টীচাররা আমাকে "পুরোনো পাপী" বলে ডাকেন। কারণ এই ক্লাসেই তো দু বছর ধরে রয়ে গেছি। একটা ভালোবাসা জন্মে গেছে বুঝলি? এবার অবশ্য তোর সাথে ঝুলে পড়লাম। পারলে একটু উতরে দিস ভাই।"
পাশ ফিরে দেখেছিলো সুবল। একটা বেশ ষন্ডা মার্কা ছেলে বসে আছে।গলার স্বরে বেশ একটা ভাঙা ভাঙা ভাব। বন্ধুত্ব হতে দেরী হয়নি। টিফিন পিরিয়ডে এগিয়ে এসেছিলো চশমা পরা একটা ছেলে---" আমাকে চিনে রাখ, আমার নাম কিংশুক মজুমদার। তুই যতই আজ টপাটপ উত্তর দিস--ফার্স্ট কিন্তু আমিই হবো। এই সব বই খাতা নিয়ে তুই আমাদের সাথে কম্পিটিশন করার চেষ্টা করিস না।"
   মুখ না তুলেই উত্তর দিয়েছিলো সুবল--" না না,
আমি কখনোই তোমাদের সাথে পারবো না। আজ হঠাৎ উত্তর গুলো জানা ছিল বলে বলতে পারলাম। তোমরাও নিশ্চয়ই পারতে।"
   কিন্তু ছাই দিয়ে কখনোই আগুন কে চেপে রাখা যায় না। ফাঁক ফোকর দিয়ে সে মাথা তোলার চেষ্টা করবেই। তাই সবাইকে অবাক করেই কলেজের অ্যানুয়াল পরীক্ষায় সুবল হলো সেকেন্ড। কিংশুক অবশ্য এগারো নাম্বার বেশী পেয়ে ফার্স্ট হলো।
সারা কলেজে ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক হইচই পড়ে গেলো। কোথাকার কোন অখ্যাত ছেলে---যে কিনা টিফিনে লুকিয়ে লুকিয়ে গুড় দিয়ে শুকনো রুটি খায়, যার কিনা নতুন বই কেনার সামর্থ্য নেই---সে হবে সেকেন্ড!! ক্লাসের এলিট সম্প্রদায়ের ছেলেরা সেটা মানবে কেন? তাই প্রতিটি ক্লাসেই নানাভাবে তাকে টেনে নামানোর চেষ্টা শুরু হলো।
   কোন কথাই অবশ্য গায়ে মাখতো না সুবল। তার একটাই অস্ত্র ছিলো----নীরবতা। শত উপহাসের জবাব সে তার এই অস্ত্র দিয়েই প্রতিরোধ করার চেষ্টা করতো। পাশে পেয়েছিলো মিহির কে। দুজনে ছিল ছায়াসঙ্গী। একটা ভালো ছেলের সান্নিধ্যে এসে মিহির ও আপ্রাণ চেষ্টা করছিলো নিজেকে বদলে ফেলতে।
ক্লাস এইটের শুরুতেই মিহির একদিন সকালেই সুবলের বাড়িতে হাজির। হাতে বেশ বড়সড় একটা ব্যাগ। একগাদা দামী খাতা আর সব নতুন নতুন সিলেবাসের বই নিয়ে এসেছিল সুবলের জন্য-----------" নে রে সুবলা, ভাবিস না এগুলো তোকে দান করলাম। খাতাগুলো অবশ্য আমার টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে কেনা। বইগুলো কিন্তু আমার। আমার কাছে থাকলে তো শুধু শুধু ধূলো জমবে। তার থেকে তুইই রাখ। তুই পড়লেই আমার পড়া।
      কোন আপত্তিই শোনেনি মিহির। একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলো সুবলের বাবা আর মা। সামনে আসার মতো সামর্থ্য ছিলো না।
    তখন ক্লাস নাইন। সেবারের হাফ--ইয়ার্লি পরীক্ষায় সুবল থার্ড হয়েছে। খুব কষ্ট পেয়েছিলো মিহির---" কি রে সুবলা? বড্ড অহংকার হয়ে গেলো নাকি তোর? আর যাই হোক--ঐ কিংশুক, শৌভিক দের মতো হোস না রে। ওরা ভালো স্টুডেন্ট--কিন্তু ভালো মানুষ নয়। আমাকে বড্ড হ্যাটা করতো ওরা। কথায় কথায় ফেলটু বলে প্যাঁক দিতো। তুই ওদের মুখের ওপর ঝামা ঘষে দিয়েছিস। তোর ওপর আমার বড্ড আশা রে। এখন তুই যদি এভাবে পিছিয়ে পড়িস, আমি কাকে নিয়ে ফাইট করবো রে?
সেদিন অঙ্ক ক্লাস চলছে। পাটিগণিতের একটা অঙ্ক বোর্ডে দিয়ে অসিত বাবু ডেকে নিলেন কিংশুক কে----" এসো তুমি, চটপট অঙ্কটা সল্ভ করো দেখি।"
সারা শরীরে অহংকার জড়িয়ে দীপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেলো কিংশুক।ফিরেও এলো তাড়াতাড়ি মুখ চুন করে।
অসিতবাবু অবাক---" এটা তোমার পারা উচিত ছিল কিংশুক। আর কি কেউ আসতে চাও বোর্ডে?"
চট করে উঠে দাঁড়ালো শৌভিক--" স্যার, সুবল অবশ্যই পারবে। ও এখন দারুণ অঙ্ক করে।"
    "তুমি পারবে কি?"---অসিতবাবুর গম্ভীর মুখ-----
"অন্যের কাছা ধরে না টেনে, নিজের ওপর নজর দাও শৌভিক।"
   মিহির পাশ দিয়ে ঠেলেই চলেছে সুবলকে---"যা না তুই। আমি জানি ওটা তুই পারবি।"
   উঠলো সুবল। বোর্ডের কাছে গিয়ে অঙ্কটার দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে রইলো। তারপর তুলে নিলো চকটা। অঙ্কটা শেষ করে সুবল যখন ফিরছে,
অসিতবাবু তার পিঠ চাপড়ে দিলেন---" ভগবান তোমার ভালো করুক বাবা, একটা ভালো ভবিষ্যত অবশ্যই পাবে তুমি।"
কিন্তু ভালো ভবিষ্যত অপেক্ষা করে ছিল না সুবলের জন্য। মাধ্যমিক আর উচ্চ মাধ্যমিকে কলেজ থেকে প্রথম হয়েছিলো সে। কলেজ থেকে যেদিন আউট গোয়িং ছাত্রদের ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়, সেদিন ছাত্রদের তরফে কিংশুক বলতে উঠেছিলো। উঠে প্রথমেই সে ডেকে নিয়েছিলো সুবলকে--" বলতে দ্বিধা নেই যে এই ছেলেটাকে আমি প্রথম দিন থেকেই তাচ্ছিল্য করে এসেছি। কিন্তু আজ সব কিছুতেই ও আমাকে হারিয়ে দিয়েছে। তবে এই হেরে গিয়ে আমি বড্ড আনন্দ পেয়েছি। মানুষ হিসেবে আমি যে কতোটা পিছনে ছিলাম সেটা সুবল আমাকে বুঝতে শিখিয়েছে। এরপর আমরা ছড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন দিকে। আমি আশা করবো আমাদের সবার আগামী জীবন খুব সুন্দর হোক।"
কিন্তু সুবলের আগামী জীবন সুন্দর হয়নি। 
অঙ্কে অনার্স নিয়ে বর্ধমান রাজ কলেজে ভর্তি হয়েছিলো সে। খরচা বাঁচানোর জন্য হস্টেল নেয়নি--রোজ যাতায়াত করতো। কিন্তু তার বাবার শরীর তখন ভেঙ্গে পড়েছে। পাঁজরা গুলো গোণা যায় বাইরে থেকে। ঘরে দুবেলা খাওয়া দাওয়ার যোগান দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়লো। সুবল একবার ভেবেছিল মিহিরের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেও তখন ফার্মাসি নিয়ে পড়তে চলে গেছে বাইরে। তাই একদিন সকালে আর বর্ধমানের উদ্দেশ্যে রওনা হলোনা সুবল। 
ভুবনডাঙা হাইকলেজের ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র সুবলের পড়াশোনায় এখানেই ইতি। নিজের ভবিষ্যত কে গলা টিপে মেরে সুবল সংসারের জোয়াল কাঁধে তুলে নিলো। তার বাবা লজ্জায় একমাস তার সামনে আসতে পারেনি। 
পড়ায় ইতি টানলেও চেষ্টায় ইতি টানলো না সুবল। আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলো একটা চাকরি পেতে। কিন্তু চাকরি পাওয়ার জন্য শুধু মেধা থাকলেই হয়না। প্রোপার গাইডেন্স থাকা দরকার, পকেটের জোর থাকা দরকার। এগুলো সুবলের কোনটাই ছিলো না। তিন চার বছর লড়াই করে হতোদ্যম হয়ে পড়েছিল সুবল। বাবা তখন শয্যাশায়ী। রাস্তায় বাটি নিয়ে বসার মতো অবস্থা। 
টিউশনি শুরু করলো সুবল। পসার ও জমিয়ে ফেললো কিছুদিনে। মাধ্যমিক পর্যন্ত সায়েন্স গ্রুপ আর হায়ার সেকেন্ডারির অঙ্ক----- টিউশনের বাজারে সুবল মাস্টার ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ হয়ে উঠলো। এরপর দু বছরের মধ্যে এক এক করে চলে গেলো বাবা আর মা।
সুবল তখন পুরোপুরি একা। নিজের এক পছন্দের ছাত্রী কে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো সুবল। 
মলিনার মা বাবা আপত্তি করেনি। ঘরে এসেছিলো মলিনা। সেও ছিলো নিতান্তই এক গরীবের মেয়ে। তাই আর এক গরীব মানুষের সাথে মানিয়ে নিতে তার কোন অসুবিধা হয়নি। মেয়ে জন্মানোর পর দায়িত্ব আর চাপ দুটোই বাড়লো সুবলের। কিন্তু টিউশনের বাজার চিরদিন এক রকম চলে না। নতুন মুখ উঠে আসে। পুরোনো কে ধীরে ধীরে জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে যেতে হয়। আস্তে আস্তে পসার কমতে থাকলো সুবলের। দিশেহারা হয়ে পড়লো সুবল। শেষমেশ মলিনাই বুদ্ধিটা দিলো, কোন একটা ব্যাবসা করার। কিন্তু অতো মূলধন কোথায় সুবলের? এমন একটা ব্যাবসার কথা চিন্তা করতে শুরু করলো দুজনে--যাতে মূলধন কম লাগে, কিন্তু পসার জমতে দেরী হয়না। 
সমাধান করে দিলো সুবলের মেয়ে। তার তখন সবে আধো আধো বোল ফুটেছে। সে একদিন বাপের গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় আবদার করে বসলো যে সে ফুক্কা খাবে।
    সুবল পড়লো আকাশ থেকে। সে অনেক খাবারের নাম শুনেছে।কিন্তু ফুক্কার নাম জীবনে শোনেনি। শেষে মলিনাই সমাধান করলো সমস্যার---" 
    ও মনেহয় ফুচকার কথা বলছে গো।সেদিন ওকে নিয়ে বিকেলে একটু বেরিয়েছিলাম। পাড়ার মোড়ে কয়েকজন কে ফুচকা খেতে দেখেছে।সেই থেকে ও ক্রমাগত ফুচকার বায়না ধরেছে।"
   আলো দেখতে পেলো সুবল---" তোকে নিজের হাতেই ফুচকা তৈরি করে খাওয়াবো রে মা "--বলেই লেগে পড়লো দুজনে। সেই থেকে সুবল মাস্টার হয়ে গেলো স্বাধীন ব্যবসায়ী।
   প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো। তার নিজের পরিচিত রা যখন তার দোকানে এসে দাঁড়াতো---লজ্জায় কুঁকড়ে যেতো সুবল। সেই সময় তার পাশে ছায়ার মত সেঁটে ছিলো মলিনা। মানসিক জোর দিয়ে গেছিলো সবসময়। সুবলও বুঝেছিল--পেটের জ্বালা লজ্জা শরম মানে না।
    "কার চিঠি গো? হঠাৎ এমন চুপ মেরে গেলে কেন?"---মলিনার কথায় আবার বর্তমানে ফিরে এলো সুবল।
   "ছাড়ো তো চিঠির কথা। ও কিছু না। ওই চিঠি নিয়ে পড়ে থাকলে পেট চলবে না। তুমি বরং কাজে মন দাও। এদিকে সাড়ে তিনটে বাজতে চললো।"
   কিন্তু মলিনার জেদাজেদি তে সব খুলে বলতেই হলো সুবলকে। তাদের ভুবনডাঙা কলেজের কথা। তার ছাত্রজীবনের কথা। এই পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের কথা..
......কিচ্ছু বাদ গেল না।
  সব শোনার পর মলিনা শুধু একটা কথাই বলেছিলো---" আমরা যাবো। আজ বারো তারিখ। তুমি এরমধ্যে কিভাবে যেতে হবে তার খোঁজ নাও।"
হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলো সুবল---" পাগল হয়েছো নাকি মলিনা? ওরা মেধাবী ছাত্র সুবলকে ডেকেছে। ফুচকা ব্যবসায়ী সুবলকে তো ওরা চেনে না। টুকটাক যা খবর পাই তাতে আমার ব্যাচের সবাই ভালো ভালো জায়গায় প্রতিষ্ঠিত। কিংশুক তো শুনেছি কোন নামী কলেজের প্রফেসর। শৌভিক ডাক্তারিতে ভালো নাম করেছে। আমিও দারুণ নাম করেছি মলিনা, তাই না?? আমার তৈরি ফুচকা খেয়ে লোকে বাহবা দেয় "---হঠাৎই হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সুবল---" ওদের মাঝে তুমি আমাকে যেতে বোলোনা গো। এই বিবর্ণ, ফ্যাকাশে সুবলকে দেখে ওরা অপ্রস্তুত হয়ে যাবে। হয়তো ওদের আনন্দ অনুষ্ঠানটাই মাটি হয়ে যাবে। তার থেকে এই আমরা বেশ ভাল আছি মলিনা। ভগবানের দয়ায় দুবেলা দু মুঠো তো জুটে যাচ্ছে।"
কিন্তু যেতেই হলো সুবলকে। মলিনা কোন কথা শোনেনি। তার স্বামীর অতীতকে ফিরে দেখার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায়নি। হাওড়া স্টেশনে নেমে একটু চিন্তায় পড়ে গেছিলো মলিনা। এই প্রথম তার কপালেও একটু ভাঁজ পড়লো। যাচ্ছে তো বটে, কিন্তু এই চেহারা নিয়ে ওইসব বড়লোক গিন্নিদের সামনে দাঁড়াতে পারবে? পাশের বাড়ির বউটার থেকে কিছু মানানসই গয়না যদিও নিয়েছে, কিন্তু গয়না পরার জন্য যে ঝকমকে চেহারা দরকার সেটা তার কোথায়?চোখের নীচে কালো দাগ। গালে মেচেতার ছোপ। চিন্তায় ঘামতে লাগলো মলিনা।
   নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেটের মুখে দাঁড়িয়ে পড়লো সুবল। তিরিশ বছর আগের মুখগুলো কে কি আর চিনতে পারবে? ধীর পদক্ষেপে ভেতরে ঢুকলো তিনজনে।
বেশ বড় করে একটা ব্যানার টাঙানো হয়েছে যাতে তাদের কলেজের নাম লেখা। অনেক চেয়ার এখানে ওখানে পাতা। বড় বড় শতরঞ্চিতে সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে। ভালো ভালো খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে। সাউন্ডবক্সে মৃদু লয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত বাজছে।
খুব বেশি অপ্রস্তুত লাগছিল সুবলের। হঠাৎ চমক ভাঙলো হইহই চীৎকারে---" বার করুন তো দেখি সুবলদা আপনার সেই বিখ্যাত ফুচকা।"
সুবল তাকিয়ে দেখে তিন চারজন ভদ্রমহিলা একসাথে দৌড়ে আসছে তার দিকে। হঠাৎ তার মধ্যে একজন হাত ধরে টেনে নিলো মলিনা কে তাদের মধ্যে। একজন তাদের মেয়েকে কোলে তুলে নিলো।
আমতা আমতা করছিলো সুবল। কি বলবে সে?
ফুচকা তো সে আনেনি।
এগিয়ে এলো এক ঝকঝকে মহিলা--" অদ্ভুত মানুষ তো আপনি সুবলদা। আপনি তো জানতেন যে এখানে আপনার সব বন্ধুদের বউই থাকবে। আর মহিলাদের ফুচকা প্রেম সম্পর্কে নিশ্চয়ই আপনার জানা আছে? তাও আপনি আমাদের জন্য ফুচকা আনেন নি? সেই সকাল থেকে আমরা বসে আছি আপনার হাতের ফুচকা খাবো বলে। আপনি না একটা যাচ্ছেতাই মানুষ।"
অবাক হচ্ছিল সুবল। মলিনাও বুঝতে পারছিলো না কিছুই। সে যে ফুচকার ব্যাবসা করে তা এরা জানলো কি করে? মুখে কোনো কথা আসছিলো না তার।
এগিয়ে এসেছিলো একটা হারিয়ে যাওয়া মুখ--
--- " কি রে সুবলা?  চিনতে পারছিস আমাকে? শৌভিক রে আমি।"---বলেই বুকে টেনে নিয়েছিলো সুবলকে---" আজ যার জন্য তোকে খুঁজে পেলাম তাকে আগে ডেকে নিতে দে। কি রে মিহির? এবার তো কাছে আয় বাপ।"
এরপর শৌভিকের থেকেই সব শুনেছিলো সুবল---" পুনর্মিলন অনুষ্ঠানের চিন্তা ভাবনা শুরু হওয়ার পর প্রথমেই আমরা কলেজের রেজিস্টার থেকে সবার নাম আর ঠিকানা জোগাড় করি। কিন্তু তোর কোন স্থায়ী ঠিকানা পাচ্ছিলাম না। এখানেই অসাধ্য সাধন করে মিহির। অনেক খেটেখুটে ওই তোর ঠিকানা জোগাড় করে। তুই এখন কি করিস তাও ওর কাছেই শোনা।এমনকি ও একদিন লুকিয়ে তোর দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরেও এসেছে। আর ওর মোবাইল ফোনে তোর ছবিও তুলে এনেছে। তাই পুরো ধন্যবাদ টা মিহিরের প্রাপ্য।
   কেমন যেন মিশে যাচ্ছিলো সুবল ওদের সাথে। কোন জড়তা খুঁজে পাচ্ছিলো না নিজের মধ্যে। মলিনাও হারিয়ে গেছিলো মহিলাদের দঙ্গলে। খাওয়ার সময় কথাটা তুলেছিলো কিংশুক। প্রফেসর সুলভ গাম্ভীর্য পূর্ণ কথা---" সুবল,আজ কিছু কথা আমি তোকে বলতে চাই। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার পর যখন তোর সব খবর শুনলাম, তখনই আমরা কয়েকজন মিলে এই সিদ্ধান্ত নি। এই সিদ্ধান্তটাই আজ তোকে শোনাবো। আর এতে তোর বা তোর বউয়ের কোন বারণ আমরা শুনবো না। প্রথমেই তোকে বলি যে কোন কাজই ছোট নয়। তাই তোর এই বর্তমান অবস্থা নিয়ে কখনোই তুই ভেঙ্গে পড়িস না। সবাই সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় না রে। ভেবে নে তুই সেই দুর্ভাগ্যের শিকার। কিন্তু এতগুলো আঙ্কেল থাকতে তোর মেয়েকে তো আর আমরা দুর্ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না। তাই আমরা কজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে এরপর থেকে তোর মেয়ের সব পড়াশোনার দায়িত্ব আমাদের। ও যতদূর পড়তে চায় নিশ্চিন্তে পড়বে। তোদের দুজনকে নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু মেয়েটা তো আমাদের সেই সুবলার, তাই না? প্লিজ এই ব্যাপারে তুই কোন মতামত দিস না। আর দিলেও অবশ্য আমরা শুনবো না। কলেজ লাইফে অনেক হেরেছি রে তোর কাছে। আজ এই বন্ধুদের একবার অন্তত জিততে দে।"
   কিছুই বলতে পারছিলো না সুবল। শুধু তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের ফোঁটা গুলো খাবারের সাথে মিশে, খাবারের স্বাদটা কেমন নোনতা করে দিচ্ছিলো ............
[+] 3 users Like আমিও_মানুষ's post
Like Reply
একটাই কথা বলবো , অসাধারণ। clps
[+] 1 user Likes kublai's post
Like Reply
অসাধারণ !!!

স্তব্ধ হয়ে হয়ে গেলাম .... Namaskar
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
পড়তে পড়তে চোখ গুলো ভিজে যাচ্ছিলো বারবার...
এমন অনবদ্য লেখায় মন গলে যায়, ভেতরের মানুষটা চিৎকার করে একটু কাঁদতে চায়।
[+] 3 users Like nextpage's post
Like Reply
# অণুগল্প

 
মায়ের সাথে আজ 'কাজের বাড়ি' এসেছে পিউ। অন্যদিন ওদের পাশের ঘরের কমলা পিসিদের ঘরে থাকে ও। মা সকালে দুই বাড়ি ঠিকে কাজ করে, ততক্ষণ কমলা পিসিদের ঘরে বসে দিদার সঙ্গে গপ্পো করে। কিন্তু এই 'দিন হল কমলা পিসিদের বাড়িশুদ্ধু সবার জ্বর। তাই মা আজ আর ওখানে রাখতে পারেন নি। অবশ্য মা যে দুই বাড়ি কাজ করেন, তারমধ্যেও এক বাড়ির দাদু-দিদা তাঁদের মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গেছেন, তাই শুধু একটা বাড়িতেই কাজ আছে মায়ের। নিজের লাল ফ্রক পরে বেশ আনন্দ করেই মায়ের সঙ্গে এই 'জ্যেঠিমা' দের বাড়িতে এসেছে ও।
"আরে শিবানী, এসে গেছিস এত তাড়াতাড়ি? যাক, আমার ভালোই হলো, আজ শ্রাবণ মাসের প্রথম সোমবার। আমি বুড়োশিবতলায় যাব একটু। আমিও তাড়াহুড়ো করছি।" দরজা খুলেই বলে উঠেছিলেন ওই জ্যেঠিমা। আর অবাক হয়ে দেখছিল ওঁকে পিউ। কী সুন্দর দেখতে! আর লাল ফ্রক পরে আছে, এই জ্যেঠিমাটাও লাল নাইটি জামা পরে আছেন!
"ওমা, এটা তোর মেয়ে বুঝি?" ওকে দেখেই জিজ্ঞেস করেছিলেন জ্যেঠিমা।
"হ্যাঁ গো, বৌদি, ওকে পাশের যে ঘরে রাখি, তাদের সবার জ্বর। তাই নিয়ে এলাম। এমনিতেই সময় খারাপ।" কিন্তু কিন্তু করে বলে উঠেছিলেন মা।
"তা ভাল করেছিস। ওকে কিছু খেতে দে আগে। আমি তাহলে স্নানে যাই? মন্দিরে একটু আগে যেতে পারলে ভাল হয়।"
"হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, আমি সব কাজ সেরে নিচ্ছি। তুমি ভেবো না। আজ প্রথম সোমবার, ভিড় হবে এমনিতেই।" বলে কাজে চলে গেলেন পিউয়ের মা। ওকে একটা চেয়ারে বসতে বলে।
চেয়ারে বসে ঘরটা দেখছিল পিউ মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কী সুন্দর করে সাজানো! ওদের তো একটা ছোট্ট ঘর - বারান্দাতে মা রান্না করে। কমলা পিসি আর ওরা একটাই বাথরুম ব্যবহার করে। আর এই বাড়িটা কী সুন্দর! এক একটা দেওয়ালে এক একরকম রং! আবার কত্ত বড় একটা টিভি! কত বই! আচ্ছা, বড় হলে এরকম অনেক বই পড়তে পারবে? ওর মা তো সবসময় বলেন "তোকে অনেক লেখাপড়া করতে হবে রে মা। আমাদের সময়ে এত কিছু ছিল না। পেট চালাব না লেখাপড়া করব! বাবা ইকলেজ ছাড়িয়ে দিলেন। কত কাঁদাকাটা করেছি। তুই কিন্তু অনেক পড়বি। আমি আরও চারবাড়ি কাজ ধরব দরকার হলে।" তা, পিউ এখনও অনেক ছোট, তাই এত কিছু বোঝে না ও।
মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘরে রাখা খাবার টেবিলের দিকে নজর গেল। টেবিলের ওপর একটা ঝুড়ি মতো আছে, সেখানে অনেক গুলো ফল রাখা। আর পাশেই মিষ্টির প্যাকেট। এই বাড়ির জ্যেঠিমা যে ওকে কিছু খেতে দিতে বলেছিলেন, কই মা দিলেন না তো! মা ভুলে গেলেন দিতে? সকালে দুটো বিস্কুট খেয়েছে মাত্র, এখন খিদে পাচ্ছে তো... মায়ের ওপর অভিমান হচ্ছে খুব পিউয়ের। মা বলেছেন অন্য কারো খাবারে আর জিনিসে লোভ না করতে, তাই মনে মনে অন্য কথা ভাবতে শুরু করে পিউ।
"বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগি, মহাদেব! মা, কিছু হবে?" ডাক শুনে তাকায় পিউ। ঘরের পাশেই বারান্দা, সেখান থেকে আওয়াজ আসছে। চুপি চুপি উঁকি মেরে দেখে একজন বয়স্ক দাদু দাঁড়িয়ে আছেন। নোংরা একটা জামা পরা, হাতে একটা লাঠি, আর একটা ছোট্ট বাটি। দাদুটা কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
দেখে বুকটা টনটন করে উঠল পিউয়ের। ওদের বাড়িতে এমনি কেউ এলে মা ফেরাতে বারণ করেন। ওদের অভাবের সংসারেও মা কিছু খুচরো কয়েন পয়সা রেখে দেন ভিক্ষে দেবার জন্য। তবে ওকে বলা আছে জানলা দিয়েই পয়সা দিয়ে দেবার জন্য। ভুলেও যেন দরজা না খোলে। অনেকে নাকি ছেলেধরা হয়। ওকে নিয়ে গিয়ে বিক্কিরি করে দেবে, আর মায়ের দেখা পাবে না!
কিন্তু এই দাদুটার কি হবে! উনি যে কিছু চাইছেন! মা যে ওকে বসিয়ে দিয়ে কোথায় চলে গেলেন ভগবান জানে! মা থাকলে মা ঠিক কিছু না কিছু দিতেন দাদুটাকে।
" মা, কিছু হবে না?" বলে ঘুরে দাঁড়ালেন দাদুটা।
আহা, এত রোদ, আবার মাঝে মাঝে বিষ্টি পড়ছে - দাদুটা ছাতা নেন নি কেন? আচ্ছা, দাদুর কি বাড়িতে কেউ নেই? ওর মায়ের মতো? না না, ওর মায়ের তো আছে - এই দাদুটার কি কেউ নেই? তাই কি এভাবে ভিক্ষে করেন?
আহা রে!
চোখে জল আসছিল পিউয়ের।
দাদুটা বোধহয় কিচ্ছু খাননি। ওর তো খিদে পেয়েছে। তাহলে দাদুটার কত কষ্ট হচ্ছে!
তাড়াতাড়ি করে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে চোখ পড়ল ফলের ঝুড়ির ওপর। এই তো, মিষ্টি - দই সব আছে। এই বাড়ির জ্যেঠিমাটা এত ভাল, কিছু মনে করবেন না নিশ্চয়ই! হয়ত ভাববেন পিউই খেয়ে নিয়েছে। উনি তো কত সুন্দর করে মা কে বললেন "ওকে কিছু খেতে দে আগে!" উনি কিছু মনে করতেই পারেন না!
যেমন ভাবা তেমন কাজ! তাড়াতাড়ি করে মিষ্টি আর দইটা দিয়ে দিল বারান্দার গ্রিল দিয়ে। আর তক্ষুণিই "পিউউউউউ এটা কি করলি তুই?" শুনে চমকে গেল ও।
মা এসেছেন। হাতে একটা ছোট্ট প্লেটে কি যেন খাবার।
"কে ওখানে? কি দিলি তুই?" মা খুব রেগে গেছেন।
"মা একজন দাদু... খাবার চাইছিলেন তাই আমি... এখানে মিষ্টি ছিল..." ভয়ে ভয়ে বলল পিউ।
"এখান থেকে নিয়ে দিয়ে দিলি? ওটা পুজোর জন্য রাখা ছিল। ওফ! তোকে নিয়ে যে আমি কি করি!" মা প্রচন্ড চিৎকার করছেন।
"তুমি তো আমাকে কিছু খেতে দাও নি, যে সেখান থেকে ওনাকে দেব। তাই..."
"তাবলে তুই ঠাকুরের জন্য রাখা প্রসাদ দিয়ে দিবি? ওফ! এটা আমার কাজের বাড়ি। এখানে কাজ করে আমি টাকা পাই, আমাদের খাওয়া - পরা চলে। একটা দিন তোকে নিয়ে এলাম, আর সেইদিনই সর্বনাশ করলি তুই আমার..." মা এগিয়ে আসছেন এবার মারার জন্য!
চোখ বন্ধ করে ফেলে পিউ!
"কি হয়েছে রে শিবানী? ওকে মারছিস কেন? " হঠাৎ বলে ওঠেন জ্যেঠিমাটা।
কান্নাভেজা চোখে সেদিকে তাকায় পিউ। স্নান করে এসেছেন উনি। মাখন মাখন লাগছে দেখতে! কান্নাও যেন ভুলে যায় ও।
"কী বলি বৌদি। কে এক 'দাদু' এসেছিল ভিক্ষা নিতে। আর কিছু না পেয়ে টেবিলে মিষ্টির প্যাকেট, দইয়ের ভাঁড় দেখে সেটাই দিয়ে দিয়েছে আবার উলটে আমাকে বলছে তুমি ওকে খেতে দিতে বলেছিলে, আমি দিই নি, আমার দোষ, তাই যা হাতের সামনে পেয়েছে দিয়ে দিয়েছে। এরপরেও মারব না?" বলে উঠলেন মা।
"তাই, পিউ? " জিজ্ঞেস করলেন জ্যেঠিমা।
"হ্যাঁ... মা আমাকে বলেছেন কাউকে না ফেরাতে। আর এই দাদুটার অনেক বয়েস। লাঠি নিয়ে হাঁটেন। আর কিছু দেখতে পাইনি গো... তাই দিয়ে দিছি..." কাঁদতে কাঁদতে বলে পিউ। বুঝে গেছে আজ আরও মার আছে কপালে!
একটু চুপ করে থাকেন জ্যেঠিমা।
তারপর বলেন "শিবানী, তুই ওকে বকিস না। ওর মধ্যেও শিশু ভোলানাথ আছেন। আর বুড়োশিবতলায় যাঁর কাছে আমি যেতাম, তিনিও যে ভিখারী! তিনি সর্বশক্তিমান তবু ভিক্ষুক! তিনি দেবাদিদেব, আবার অন্নপূর্ণা মায়ের অন্নভোগ প্রার্থী! তাই পিউ ওর 'দাদু'কে মিষ্টি দিয়ে কোনো অন্যায় করে নি... বরং আমার চোখ খুলে দিয়েছে। শুধু শ্রাবণ মাসের সোমবার কেন... যদি রোজ একজনকেও সামান্য কিছুও দেওয়া যায়... "
নিজের মনেই বিড়বিড় করে কথা বলছিলেন জ্যেঠিমা। চোখে জল। মা শুনতে শুনতে কাঁদছিলেন।
শুধু পিউ আর কাঁদছিল না। ওর মনে পড়ছিল মিষ্টির প্যাকেটটা দেখে ওই দাদুটা কেমন সুন্দর করে ফোকলা দাঁতে হেসে উঠেছিলেন! উনি এবার মজা করে দই-মিষ্টি খাবেন। তারপর জল। পেট ভরবে ওনার। কী মজা!
এই বাড়ি থেকে বুড়োশিবতলা বেশ দূরে... নইলে পিউ দেখতে পেত ত্রিভুবনেশ্বর আজ হাসছেন খুব। অবিকল সেই 'দাদু' মতো হাসি!

[+] 3 users Like ddey333's post
Like Reply
*******প্রত্যাবর্তন*******

কিছুটা বাধ্য হয়েই প্রতুল আজ তার মাকে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাড়ি ফিরিয়ে এনেছে। আজ প্রায় পাঁচ বছর পর বিমলাদেবী ফিরেছেন নিজের বাড়ি----- ছেলে আর বৌমার বাড়িতে। সোহিনী অবশ্য এতে মোটেই খুশি নয়। কিন্তু ওই যে বললাম কিছুটা বাধ্য হয়েই শাশুড়িকে মেনে নিতে হবে আজ। প্রতুল আর সোহিনীর ছেলে অর্ক যখন দু মাসের তখন ছেলে আর বৌমার সাথেই থাকতেন বিমলা দেবী । সোহিনী কর্পোরেট সেক্টরে চাকরি করে, তাই আবার বড়লোক বাবার একমাত্র মেয়ে। তাই প্রতুল নিজেই গরজ করে একটা রান্নার লোক রেখে দিয়েছিল। তাছাড়া বাসন মাজা ,কাপড় কাঁচা, ঘর দুয়ার পরিষ্কার করা এসবের জন্যও আলাদা লোক রাখা আছে। কিন্তু কথায় বলে মায়ের মন। প্রতুল ছোটবেলা থেকেই মোচার ঘন্ট, চুনো মাছের চচ্চড়ি ,কুমড়া ফুলের বড়া এসব পছন্দ করে। কিন্তু রান্নার মাসি এত কিছু ঝামেলা নিতে নারাজ। তাছাড়া সোহিনী এখনকার দিনের মেয়ে। অয়েলি ফুড তার মোটেই পছন্দ নয় । তাই বিমলা দেবী নিজের হাতেই সেগুলো বানাতেন ছেলের জন্য। প্রতুলের জন্য বিভিন্ন রকম আচার বানানো, ছাদে বরি দেওয়া এসব করেই সময় কাটতো তার। সোহিনীর  সাথে শাশুড়ির সম্পর্ক কোনদিনই মধুর নয় । তবুও সুখী সংসারের তকমা এঁটে সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল । অশান্তি চরণে পৌঁছালো অর্ক হবার পর। বিমলা দেবী তার সারাদিনের কাজের ফাঁকে ফাঁকেই ছুটে আসেন নাতিকে কোলে নেবার জন্য। নিজের হাতে খাইয়েও দেন। যদিও এসব কাজের জন্য সোহিনী একজন আয়া ঠিক করেছে। তবুও বিমলাদেবী আগেকার দিনের মানুষ । নাতিকে নিজে হাতে খাইয়ে ,স্নান করিয়ে ,ঘুম পাড়িয়ে তৃপ্তি পান। ছেলে আর নাতির প্রতি এই অপত্য স্নেহই তার বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার কারণ। আজ কিন্তু সেই নাতির কারণেই তার আবার ফিরে আসা। হ্যাঁ,শুনতে অবাক লাগলেও অর্কই বাধ্য করেছে তার ঠাম্মিকে ফিরে আসতে।
মা বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাওয়ার পর থেকে বেশ আনন্দে কাটতে থাকে দিনগুলো। প্রতুল আর সোহিনীর ক্যারিয়ারে ও রং লেগেছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রমোশন পেয়েছে প্রতুল। শ্যাম্পেনের বোতল খুলে সোহিনীকে নিয়ে সেলিব্রেটও করেছে । শুধু মাকেই কিছু জানানো হয়নি। এদিকে অর্ক বড় হতে থাকে। প্রতুল আর সোহিনীও সময়ের সাথে সাথে ব্যস্ত থেকে ব্যস্ততর হয়ে উঠতে থাকে দৈনন্দিন জীবনে। অর্ক এখন আর রাতের বেলা সোহিনীর সাথে ঘুমায় না । ছোট বাচ্চা তারও ইচ্ছে করে সারাদিন পর মাকে কাছে পেয়ে মায়ের বুকে মুখ বুজে ঘুমোতে। ফলে সোহিনীর রাতে ঠিক ঘুম হয় না । চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। অফিসে কলিগরা হাসাহাসি করে তাকে নিয়ে। তাই অর্ক আজকাল আয়া মাসির কাছেই ঘুমোয়।ঘুমোয় বললে ভুল হবে ঘুমের ভান করে পেছনে ঘুরে পড়ে থাকে। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে। মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু উপায় তো নেই। আর আয়ামাসি, তারো কি সময় আছে নাকি? ফেসবুকে কত বন্ধু তার। আচ্ছা ঠাম্মি কি এখনো জেগে আছে ?সেও কি অর্কর মত রাতের বেলা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদে? তারও কি অর্কর মত মায়ের কাছে যেতে ইচ্ছা করে? ঠাম্মির কথা অবশ্য খুব বেশি মনে নেই অর্কর। ঠাম্মিকে যখন সে শেষ বার দেখে তখন তার বয়স এই বছরখানেক হবে। সকালে ঢুলুঢুলু চোখে সে যখন প্রতুল বা সোহিনীর গা ঘেসে গিয়ে দাঁড়ায় তখন কাছে টেনে নেওয়া তো দূরের কথা প্রতুল বলে ওঠে-- গুড মর্নিং মাই সান। যাও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তুমি না গুড বয়। আয়াকে ডেকে অর্ককে নিয়ে যেতে বলে। আচ্ছা গুড বয়রা না হয় সকালে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। কিন্তু গুড বাবা মায়েরা কি করে বলুন তো? কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতায় মন দেয় ,নাকি খুব টায়ার্ড লাগছিল বলে কাল রাতের ইনকমপ্লিট চ্যাটিং গুলো কমপ্লিট করে।
প্রতিদিন প্রতুল আর সোহিনী যখন অফিসে বেরিয়ে যায় অর্ক উপরের ব্যালকনি থেকে তাকিয়ে থাকে। সারাদিন যে কতবার ব্যালকনিতে এসে বাড়ির গেটের দিকে তাকায়! ওই নিষ্পাপ মায়া ভরা চোখ দুটো কাকে খুঁজে বেড়ায় সারাদিন কে জানে !এই ভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস। আস্তে আস্তে অর্কর মধ্যেও বদল আসে। এখন সে আর ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায় না ,রাতে মায়ের কাছে শোয়ার জন্য বায়নাও করে না ,হঠাৎ কেমন যেন বড় হয়ে গেছে ছেলেটা। প্রতুল আর সোহিনী অফিস থেকে ফিরলে ছুটে আসে না । এর আগে ওরা ফিরলে কথার পাহাড় নিয়ে বসতো অর্ক। দুপুরে বৃষ্টির ফোঁটা গুলো কেমন করে জালনার গ্রিলে আটকে থাকে, পাশের বাড়ির টাবলু দাদা কেমন করে জমা জলে কাগজের নৌকা বানিয়ে ছাড়ে, কেমন করে দুপুরে বুলু পিসি কাকের ডিম- বকের ডিম বানিয়ে ভাত খাওয়ায়, ডোরেমন কেমন করে কথা বলে, ছোটা ভীম কেমন করে ফাইট করে আরো কত কিছু। আজকাল কেমন যেন গুম মেরে গেছে ছেলেটা। সব সময় ঘরের কোন কোনায় চুপ করে বসে থাকে। কোন কিছু নিয়ে বায়না করে না। যে যা বলে তাই শোনে। এখন আর বুলু মাসিকে কাকের ডিম বানিয়ে খাওয়াতে হয় না। চুল আচড়ানোর জন্য চিরুনি হাতে বা দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে ছুটতেও হয় না। এতদিনে যেন একটু স্বস্তি পেয়েছে  প্রতুল আর সোহিনী। ছেলের এই রিসার্ভ মুডটা বেশ ভালো লাগে ওদের ।হাই ক্লাস আর সফিস্টিকেটেড ছেলেদের তো এটাই লক্ষণ। তারা জানতেও পারে না বা হয়তো কোনদিন জানতে চায়নি তাদের ব্যস্ততাময় জীবনে সন্তানের প্রতি অবহেলা অর্ককে কোন অন্ধকার জীবনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একদিন বুলু মাসি প্রতুলকে অফিসে ফোন করে জানায় অর্ক আজ সকাল থেকে কোন কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞাসা করলে শুধু ঘাড় নেড়ে বা চোখের ইশারায় উত্তর দিচ্ছে। প্রথমে প্রতুল বা সোহিনী কেউই ব্যাপারটাকে সেরকম গুরুত্ব দেয়নি। বাচ্চাদের মন কখন কেমন খেয়ালে মাতে তা ওরাই জানে। কিন্তু বেশ কিছুদিন হলো একই অবস্থা। সোহিনী বকাবকিও করে দেখেছে কিন্তু কোন ফল হয়নি। ইদানিং আরো একটা ব্যাপার তারা লক্ষ্য করেছে ছেলের মধ্যে। ঘরে কারো সাথে কথা না বললেও যখন একা থাকে তখন যেন কারো সাথে কথা বলে অর্ক, খেলে, গল্প করে। আজ শনিবার তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে ছেলেকে নিয়ে ওরা দুজন গেছে একজন নামকরা চাইল্ড স্পেশালিস্ট এর কাছে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সব বলতে উনি যা বললেন তা শুধু প্রতুল বা সোহিনীর নয়, আমাদের মত সমস্ত আধুনিক বাবা-মায়ের জানা উচিত। তিনি বললেন অর্কর আজকের পরিস্থিতির জন্য দায়ী তার একাকীত্ব। বাচ্চারা যখন কথা বলার জন্য বা খেলার জন্য মনের মত কাউকে পায় না, যখন তাদের শিশু মন কাউকে বারবার আঁকড়ে ধরতে চেয়েও বিফল হয় তখন নিরুপায় হয়ে তারা নিজেদের একটা কল্পনার জগত তৈরি করে। সেখানেই তৈরি হয় বন্ধু আর তখন তার সাথেই শুরু হয় কথাবার্তা খেলাধুলা সবকিছু। এতে বাচ্চা বাস্তব জগত থেকে সরে গিয়ে কল্পনার জগতে বাঁচতে শুরু করে। গোড়া থেকেই এর প্রতিকার না হলে শেষে কি হবে কেউ জানে না।
আজ ঘরের ছবিটা যেন একটু অন্যরকম লাগছে । সোহিনী বাড়ি ফিরে নিজেই খাওয়াতে বসেছে ছেলেকে। প্রতুল পাশে বসে টিভিতে ডোরেমন চালিয়ে ইচ্ছা করেই যেন একটু বেশি মজা পাওয়ার অভিনয় করছে। কিন্তু এভাবে কতদিন ?অফিস থেকেও বেশি দিনের ছুটি নেওয়া যাবে না। দুজনে মিলে চাকরি না করলে ফ্ল্যাটের ইএমআই, এতগুলো পলিসি, কারলোন সব চালাবে কেমন করে ?অথচ ডাক্তার বলেছে অর্ক নর্মাল অবস্থায় ফিরতে সময় লাগবে। যেটা তিল তিল করে শেষ হয়ে গেছে সেটাকে তিল তিল করেই গড়ে তুলতে হবে। যে ভালোবাসার অভাবে তার এই অবস্থা, কোন মেডিসিন নয় একমাত্র কোন আপন জনের মমতাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে। বড় দোটানায় পড়েছে প্রতুল আর সোহিনী। হঠাৎ প্রতুলের মনে পড়ে যায় মায়ের কথা, একমাত্র উনিই পারেন তাদের এই ভয়ানক পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করতে। অথচ এতদিন সেটা মাথাতেই আসেনি। আসলে মাকে বাতিল করে রাখাটা যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কথাটা সোহিনীকে বলতেই প্রথমে কিছুটা আপত্তি করলেও পরে নিরুপায় হয়েই রাজি হয়ে যায়। বাড়ি ফিরে আসেন বিমল দেবী, অর্ক কিন্তু খুব সহজভাবেই মিশে যায় ওনার সাথে। যেন কত দিনের চেনা। ধীরে ধীরে অর্ক ফিরতে থাকে স্বাভাবিক অবস্থায়। বিমলা দেবী নাতিকে রামায়ণ -মহাভারতের গল্প শোনান, নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে নাতির ভেজা মাথা মুছিয়ে দেন, সন্ধ্যেবেলায় নাতি সাথে বসে ছোটা ভীম দেখেন, বিকেলে পার্কে গিয়ে আইসক্রিম খান। অর্কও কম যায় না। সেও ঠাম্মীর দেওয়া গোপালের ভোগ চুরি করে খায় ,রাক্ষসের মুখোশ পরে ঠাম্মিকে ভয় দেখায়, চশমা লুকিয়ে রাখে আরো কত কি। রাতে যখন নাতিকে বুকে নিয়ে ঘুমান বিমলা দেবী ,তখন ওদের দেখলে মনে হয় কত সুখ কত শান্তি ঘিরে আছে ওদের। কোন একাকীত্বই আজ আর ছুঁতে পারে না ঠাম্মি আর অর্ককে।
[Image: 270d.png] পারমিতাচ্যাটার্জী
[+] 1 user Likes আমিও_মানুষ's post
Like Reply
বিবাহিত পুরুষরা সংসারে না হতে পারে মায়ের ছেলে..না হতে পারে বউয়ের স্বামী..আবার না হতে পারে মেয়ের বাবা...না ঘরকা, না ঘাটকা...তাদের জীবনের প্রতি মূহুর্ত ঝটকা আর খটকা নির্ভর..দুটো ব্যাপারের দিকে আপনাকে খেয়াল রাখতে হবে..এই জগৎ সংসারে নারীদের নাড়ির গতি প্রকৃতি বুঝতে হবে আর না বুঝলে মাড়ি বের করে দাঁত ক্যালাতে হবে...

আজ..রবিবারের সকাল, ভাবছি আজ এক ঢিলে দু পাখি কি করে মারবো..!! বউমা-শাশুড়ী সংবাদ না লিখলে প্রেস্টিজে পুরো গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে...!!!সামান্য শীতের আমেজ এসে গেছে, বারান্দায় বসে মিঠে রোদ্দুরে পিঠ দিয়ে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছি..আর গান গাইছি.. বারান্দায়..রোদ্দুর..আমি খবর কাগজ নিয়ে বসে পাতা ওল্টাই রেএএএ....আর ভাবছি..কি লেখা যায়..!! নাহ্...কিচ্ছু মাথায় আসছে না...এখন একটু গরম চায়ের খুব দরকার ছিলো..বুদ্ধিটা খোলতাই হতো...ঠকাস্..!! আওয়াজ শুনে চোখ তুলে দেখলাম টেবিলের ওপর ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ..!!
বউ ‎---নাও..চা টা গিলে আমায় উদ্ধার করো..সকাল থেকে উঠে কুটো নেড়ে দুটো করতেও ইচ্ছে করে না..তাই না..?? আর এদিকে সংসারের গাধার খাটুনি খাটতে খাটতে আমার জিভ হাঁটুতে ঠেকার উপক্রম..
‎আমি বউয়ের হাঁটুর দিকে চেয়ে দেখলাম..তেমন কিছুই দেখলাম না...!! বরং দুরে কারোর বাড়ি থেকে ঐ সময়ই ভেসে এলো "বসন্ত বিলাপ" ছায়াছবির গান...আগুউউউন..লেগেছে লেগেছে লেগেছে লেগেছে আগুন...এটা কি সতর্কবার্তা..!!!
যাইহোক..আমি কানে দিয়েছি তুলো, আর পিঠে বেঁধেছি কুলো...চায়ে চুমুক দিলাম..মরুক গে..যা বলছে বলে যাক...কিন্তু বাজার তো যেতেই হবে..!! বিরক্তিকর কাজ...কলেজ-কলেজ লাইফ পর্যন্ত ঠিকই ছিলো..বাজারের পয়সা ঝেড়ে টু পাইস রোজগার ছিলো..নাহ্.. বাজারের থলে দিতে বলি...ঠিক তখনই..!!
বউ---‎ধরো, দয়া করে দেহটা তোল..বাজারটা অন্তত করো...সারা সপ্তাহে ঐ একটাই তো কাজ আছে...গতর নেড়ে থলেটা পর্যন্ত রান্নাঘর থেকে নিয়ে আসতে পারো না...বলিহারি..!!!
(আমি--উফ্..সকাল থেকে শুরু হলো..!!)
বউ---আমি কিছু বললেই অমনি শুরু হলো..!! তাই না..?? এই শয়তান লোকটাকে বিয়ে করে আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল..!! হাড়-মাস কালি হয়ে গেলো..!! দিনরাত শুধু ফেসবুক..কিছু পারুক ছাই না পারুক রসিয়ে রসিয়ে বাক্যি ঝাড়ার বেলায় তো উনি ওস্তাদ..আর তাই পড়ে সবাই লাইক মারে..আর উনি..!!! গদগদ মুখে সে গুলো উপভোগ করেন..যত্ত সব..!!
(আমি--জীবনে তো ফেসবুক করলে না..মর্ম কি বুঝবে..!!)
বউ---আমি যদি ফেসবুক করতাম..তোমার স্বরূপটা সবার সামনে তুলে ধরতাম..লাইক মারা ঘুচিয়ে দিতাম জম্মের মতো...
(আমি---উফ্..!! কি অ-মাইক আওয়াজ রে বাবা..!!)
ঠাকুর ঘর থেকে মা---বৌমা..!! তোমার ঐ লাউডস্পিকার মার্কা গলায় কি একটু সাইলেন্সর লাগাবে..?? এই শুরু হলো সকাল থেকে কাঁই-ক্যাঁচর..একটু শান্তিতে ঠাকুরের নাম করবো..!! তার কি জো আছে..!!!
(আমি--নারদ..নারদ..)
বউ---আহা..কি ঠাকুরের নাম করার ছিরি..!! মন পড়ে আছে এই দিকে..মনটা ঠাকুরের দিকে থাকলে কি আর এসব কথা কানে ঢোকে..
মা--তা কি করে মন বসবে মা..!! তোমার পাঁচালী থামলে তবেই না একটু লোকনাথের পাঁচালীটা পড়তে পারি...!!
বউ---হুঃ..!! লোকনাথের পাঁচালী..!! ওসব না করে যদি ছেলেকে ঠিক করে মানুষ করতেন তাহলে অন্তত আমায় এই অবস্থায় দিন কাটাতে হতো না..
মা--আমার ছেলে তোমার কিসের অভাব রেখেছে মা..!!
বউ--মানে..!!! কি পেয়েছি..!! কি দিয়েছে আপনার ছেলে..!!! বছরে খান দশেক শাড়ী..মাঝে মধ্যে কিছু গয়না..আর একটা ফুটফুটে মেয়ে..
(আমি--ঐ ফুটফুটে মেয়ে আর ঘুটঘুটে বউয়েতেই তো চেটেপুটে সাফাচাট করে দিলে..!!)
বউ---আমি কালো বলে অনেক শুনেছি..বিয়ের আগে দেখতে পাননি..?? চোখে কি ন্যাবা হয়েছিলো তখন..!! আনতে পারতেন তো একটা ফরসা টুকটুকে বউ...দেখতেন কত ধানে কত চাল..
(আমি---এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে..!!)
মা---বলি, তোমার মুখে কি কোন লাগাম নেই গো..!! ছেলেটা সারা সপ্তাহ সারাদিন বাইরে থাকে..তার মঙ্গল চেয়ে যে ঠাকুরকে বলবো..তার জো আছে..!!!
বউ---শুধু মঙ্গল কেন..!! বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র আর যা যা আছে সব চেয়ে যান..তার সাথে এটাও বলুন যে আমার ছেলের ঘাড় থেকে ঐ ফেসবুক শনিটাও যেন নামে...
(আমি---ধুত্তোর..!! এটা কি সংসার..!!)
বউ---কে যে মাথার দোহাই দিয়েছিলো সংসার পাতার..!!! বিয়ের আগে কত মন ভোলানো কথা..!! ওগো..!! তোমায় রাজরানী করে রাখবো..রাজরানী না ছাই..!!! রাজচাকরানীও বোধহয় আমার থেকে ভালো থাকে..!!
মা---তোমাকেও বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছিলো মা, যে আমার ছেলেকেই বিয়ে করো..!!! ঘরে এসে কিছু পারো ছাই না পারো আমার অমন ছেলেটাকে তো নিজের আঁচলে বেঁধে ফেলেছো..!!!
বউ---কে মানা করেছিলো..!! দামড়া ছেলেকে নিজের আঁচলেই তো আজীবন বেঁধে রাখতে পারতেন মা..
(আমি--ব্যাস..!!! শুরু হয়ে গেলো শাশুড়ী-বউয়ের তু তু ম্যায় ম্যায়...)
মা---খোকা, বাজার থেকে ঠাকুরের ফুল আনিস...আর তোর বউকে বলে দে যে ঠাকুর মোছার জন্য একটু পুরোনো কাপড় যেন ঠাকুর ঘরে দিয়ে যায়...
বউ--এই যে..!! শোন.. তোমার মাকেও বলে দাও যে আমি আগেই বলে দিয়েছি ফুল আনার কথা...আর ঠাকুর মোছার ন্যাকড়াও ঠাকুর ঘরের টেবিলে রাখা আছে..
মা---ও..বলে দিয়েছো বউমা...?? ন্যাকড়াও রেখে গেছো..!!
বউ---হ্যাঁ মা..আমি কালকেই রেখে এসেছি..আর ফুল আনার কথা তো প্রতি সপ্তাহেই বলে দি মা..কিন্তু আপনার ছেলের কি আর সে সব মাথায় থাকে...!!
মা---ঠিক বলেছো..সারাদিন বসে মোবাইল ঘাটলে কি আর কাজের কথা মাথায় থাকে...!!! কি যে আছে ঐ মোবাইলে..!! একদিন হাত থেকে কেড়ে আছাড় মেরে ভেঙ্গে দিও তো বউমা...

কি আজব এই সংসার..আমি এগোলে সর্ব্বনাশীর বেটা আর পেছলে নির্বংশীর বেটা..শাশুড়ী-বউয়ে ঝগড়া হলে মা হয়ে যায় "তোমার মা" আর বউমা হয়ে যায় "তোর বউ"..আর ভাব হলে..!! সেই আমিই বলির পাঁঠা ..আরও একটা মজার ব্যাপার...এখানে আমার মুখে যত কথা সবগুলো কিন্তু বলতে চেয়েছিলাম..বলিনি..!!! তাহলেই বুঝুন..বউ আর মা কি করে যেন আগেই টের পেয়ে যায় যে আমি কি বলতে পারি..!!  কি আশ্চর্য টেলিপ্যাথি মাইরি..!!!
[Image: 270d.png] শিলাদিত্য
[+] 2 users Like আমিও_মানুষ's post
Like Reply
# কথোপকথন

 
-"উফ! একটু তর সয় না! বেল বাজিয়েই যাচ্ছে! একটুও সিভিক সেন্স নেই... কেএএএএএ?"
-"এত দেরি হল কেন? "
-"তুই? হঠাৎ?"
-"আগে বল, এত দেরি কেন হল?"
-"তুই কে রে? যে তোকে এত উত্তর দেব?"
-"সেই এক দোষ তোর! প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করতে নেই, জানিস না?"
-" আকার..."
-"! হ্যাঁ, বানান টা জানিস, আমি জানি।"
-"কি চাই তোর?"
-"তোর কি চাই?"
-'মানেটা কি? আমার বাড়ির নিচে এসে ট্যাঁ ট্যাঁ করে বেল বাজাচ্ছিস, আবার আমাকে বলছিস আমার কি চাই?"
-"হ্যাঁ বলছি। বাজার-হাট, ওষুধপত্র - চাই কিছু?"
-"মানে?"
-"উফ, মানে মানে আর মানে! মানেবই একটা! ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছিস না যে আবার 'তাঁর' কৃপা হয়েছে, তাই জিজ্ঞেস করছি। লাগবে কিছু? এনে দেব?"
-'উমম... না সব আছে।"
-"পাক্কা?"
-"হ্যাঁ রে বাবা। অনলাইন আনিয়েছি সব। এখন দশ মিনিটেই পৌঁছে যায় সব।"
-"সেই... সব অনলাইন হয়ে গেছে এখন। যাই হোক, ঠিক আছিস এখন? অক্সিজেন লেভেল চেক করেছিস?"
-"হ্যাঁ... পঁচানব্বই আছে।"
-"আর জ্বর কত?"
-"এখন নেই। প্রথম দু'দিন ছিল।"
-"মাথার যন্ত্রণা? সর্দি -কাশি? উইকনেস?"
-"উফ! কত্ত প্রশ্ন!"
-"চিন্তা হয় না বুঝি? গতবার তো খুব খারাপ অবস্থা হয়েছিল তোর।"
-"তা যতই চিন্তা হোক, ব্রেক আপ হয়েছে একমাস হয়নি, তোর আসার কি দরকার ছিল?"
-"হুঁহ! আমার জায়গায় থাকলে বুঝতিস!"
-"তোর জায়গা মানে?"
-"মানে আমি তোকে যতটা ভালবেসেছি, তুই যদি আমাকে ততটা ভালবাসতিস তবে বুঝতিস।"
-"মরণ!"
-"মরণ নয়, মোরোন! আমি এক্কেবারে ইডিয়ট একটা। গাধা। ছাগল। গরু।"
-"এই গরু না... গরু খুব কিউট হয়। বাকিগুলো সব ঠিক। আমি কয়েকটা যোগ করতে পারি।"
-"তোর জন্য ছুটে ছুটে এলাম, স্টেটাস দেখে - এরকম বলছিস ভাই!"
-"আসতে কে বলেছিল? তোর না 'স্পেস' দরকার ছিল?"
-"স্টেটাসটা দেখে থাকতে পারছিলাম না তো। পারা যায়, বল?"
-"বাবা!"
-"ওই যে বললাম, আমার মতো ভালবাসলে বুঝতিস।"
-"তা তোর কি মনে হয়, ব্রেক আপ, আনফ্রেন্ড করা... সবকিছুর পরেও আমি পোস্ট টা 'পাবলিক' কেন করেছিলাম?"
-"ওরে শয়তান।"
-"আমি তো জানিই রোজ রোজ স্টক করিস তুই আমাকে।"
-"হুম।"
-"শোন, তোকে ভুল বলেছি। আমার একটা জিনিস চাই।"
-"দেখেছিস? আমি জানতাম! কিছু না কিছু তোর লাগবেই। বল, আমি এক্ষুণি এনে দিচ্ছি। আচ্ছা, তুই কি খাচ্ছিস? তোর রজনীদি আসছে? আমি খাবার পৌঁছে দেব? উফ! এসময় প্রোটিন খেতে হয় বেশি করে..."
-"সাহিল! চুপ। আমাকে বলতে দে প্লিজ, আমার কি চাই?"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ বল..."
-"ক্যান আই গেট হাগ, প্লিজ?"
-"বাবু..."
-"হুম..."
-"আই মিসড ইউ সো মাচ! অ্যান্ড আই লাভ ইউ। কোনো স্পেস চাই না আমার। একটা পাশবালিশের মতো স্পেস না..."
-"সত্যি?"
-"তিন সত্যি..."
-" Heart Heart "
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
মুক্তি

 
কাল রাত্তিরে বাড়ি ফিরেই শুয়ে পড়েছিলেন শামিমা।
খুব টায়ারিং একটা দিন গেছে কাল!
সকালে বাড়িতে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন - সাদা সালোয়ার কামিজ পরে। ওঁর সোশ্যাল মিডিয়া টিম ভিডিও বানিয়েছে যত্ন করে। তারপর মানানসই গান বসিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে আপলোড করেছে। পতাকা উত্তোলনের মতো আবেগপূর্ণ কাজ হলেও প্রায় শ্যুট করার মতো করেই হয়েছে - তিনবার রিটেকও করতে হয়েছে। বেস্ট অফ থ্রি! যে ভিডিওতে এক্সপ্রেশান সবচেয়ে ভাল এসেছে, সেটাকেই আরও একটু এডিট, কালার কারেকশান করতে হয়েছে টিমকে।
এরপরে একটা রেস্তোরাঁয় যেতে হয়েছিল, গেস্ট হিসেবে। সেখানে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে ফুড ফেস্টিভ্যাল শুরু হয়েছে - সেখানে স্পেশ্যাল অ্যাপিয়ারেন্স। সন্ধ্যেবেলা সরকারের পক্ষ থেকে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল, সেখানে যেতে হয়েছিল।
ক্লান্ত লাগে আজকাল শামিমার। কিন্তু... কিছু যে করার নেই!
কোনো একটা অনুষ্ঠানে না গেলেই পিছিয়ে পড়তে হবে ইঁদুর দৌড়ে। এমনিতেই এখন একঝাঁক নতুন ছেলেমেয়ে এসে গেছে অভিনয় জগতে। সিনেমা থেকে ওয়েবসিরিজ - দাপিয়ে অভিনয় করছে তারা। এরমধ্যে শামিমার মতো অভিনেত্রীরা টিকে আছেন বেশিরভাগই এন্ডোর্সমেন্ট, অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের জেরে। আর বিজ্ঞাপন করতে গেলে দরকার পাবলিক, সাধারণ মানুষের চোখের সামনে থাকা। তারজন্য চাই জনসংযোগ। সেজন্যই ছোট ছোট ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেওয়া... বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া... যাতে প্রেস কভারেজ পাওয়া যায়...
তবে, বয়স হচ্ছে - আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে শামিমার!
মেঘে মেঘে তো কম বেলা হল না! মাত্র আঠেরো বছর বয়সেই প্রথম সুযোগ মিলেছিল, একটি বাংলা ছবিতে, নায়িকার বোন হিসেবে। নাচের ওপর ছিল ছবিটি। ছোটবেলা থেকেই নাচের তালিম নেবার সূত্রে নাচ এবং অভিব্যক্তি - দুইই ভাল লেগেছিল দর্শকদের। তারপর আরেকটি বাংলা ছবি করে পাড়ি দিয়েছিলেন মুম্বাইতে। মা খুব উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন, সবসময় বলতেন "তোকে পারতেই হবে। রূপ-গুন সবার থাকে না। তোর আছে, পারবি তুই।"
তা, মায়ের কথাতেই হোক, বা ভাগ্যের জেরে, বিখ্যাত বিনায়ক ফিল্মসের চোখে পড়ে গেছিলেন উনি। তারপর... লম্বা পথ। কখনও চড়াই, কখনও বা শুধুই হতাশা। এভাবেই যে কিভাবে এতগুলো বছর কেটে গেল...
আঠেরোয় শুরু করেছিলেন 'নর্তকী' দিয়ে, তারপর হিন্দিতে প্রথম সুপারহিট 'ঝুটি মনজিল' 'দেশভক্ত', 'খিলোনা' 'নদীয়া পার' 'মোহে রং দে' - মাঝের বাইশ বছরে হিট ছবি ঝুলিতে কম নেই ওঁর। তবে এখন... ক্লান্ত লাগে মাঝেমাঝেই। বাইশ বছর ধরে একটানা চলছে তো চলছেই। তবে কাজ না থাকার থেকে কাজ করে ক্লান্ত হওয়া ভাল। নইলে যে কি হবে...
আগেকার দিনে নাকি নায়িকারা নিজেদের আসল বয়স বলতেন না কিছুতেই। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের যুগ - কিছুই লুকোনো থাকে না। তাই বছর পাঁচেক আগে ওঁর পি আর টিমের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ওঁকে 'এভারগ্রীন বিউটি' হিসেবে প্রোজেক্ট করা হবে। বলা হবে স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, যোগব্যায়াম - এসব করেই তরতাজা আছেন উনি। চল্লিশ ছুঁইছুঁই চেহারাতেও তারুণ্যের ঝলক। মোমমসৃন ত্বক। ক্ষীনকটি। এভাবে প্রোজেক্ট করার সুফলও পাওয়া গেছিল অচিরেই। এখন নিজের পোষাক লাইন, মেকআপ সামগ্রী এবং যোগব্যায়াম শেখানোর অ্যাপ - সবই আছে ওঁর।
সবই আছে - তাও যেন কিছুই নেই!
বিছানা থেকে উঠে একটু স্ট্রেচিং করলেন শামিমা। একটু স্পট জাম্পিং। অন্যান্যদিন মুখ হাত ধুয়ে যোগব্যায়াম করেন বা জিমে যান উনি। সেখানেও ফটো শুট হয়। যেমন আজ বাড়ির লনে ম্যাট পেতে ব্যায়াম করার পালা। ওঁর টিমের একজন তার ভিডিও করবে। সেটা পার্ট করে করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়া হবে। এসবই প্ল্যানের অঙ্গ। কোনও কোনওদিন জিমে যাবার সময় পাপারাৎজিরা দাঁড়িয়ে থাকেন, সেদিন ইচ্ছে করেই একটু অন্যরকম জামা-কাপড় পরতে হয়। সবই নিউজে থাকার জন্য...
অথচ আজকাল সত্যি একটু অন্যভাবে জীবন কাটাতে ইচ্ছে করে ওঁর। মনে হয় কদিনের জন্য সাধারণ একটা মেয়ে হয়ে ঘুরে বেড়াতে। বেশ একটা পাহাড়ি এলাকায় ছোট্ট হোমস্টে হবে... কাছেই কোথাও কুলুকুলু বয়ে যাবে নদী। কাঠের বারান্দায় বসে পাহাড়ের রংবদল দেখতে দেখতেই সময় কেটে যাবে। মাঝে মাঝে কফির কাপে চুমুক। ইচ্ছে হলে যে বইটা লেখার ইচ্ছে অনেকদিন - সেই বইটার দুটো একটা পরিচ্ছদ লেখা... আর ইচ্ছেমত খাবার, দেদার ঘুম!
গত কয়েকবছর ধরেই এরকম ইচ্ছে করে, কিন্তু হয় আর কোথায়!
মাকে বললেই বলবেন "বেশ তো, ইউরোপে হলিডে করে এসো।" পি আর টিম টাই-আপ প্রোপোজাল নিয়ে আসবে। বেড়াতে গিয়েও সেইসব প্রোডাক্টকে প্রোমোট করতে হবে। সেইসব হোটেলেই থাকতে হবে। ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতে হবে। নিজের মতো করে নিজের জীবন কাটানোর স্বাধীনতা একেবারেই নেই ওঁর। এমনকি কিছু লিখতে চান, এমনটা মা কে বলার পরে মা বলেছিলেন "বেশ বেশ - হেলদি ফুড হ্যাবিট আর লাইফস্টাইলের ওপর লেখ। বা ওয়েট লস। পাবলিক এগুলোই চায়।" ওঁর টিমও সহমত হয়েছিল সঙ্গে সঙ্গেই। 'ডিভা' লেখা 'বেঙ্গলি' উপন্যাসের থেকে এইধরণের বইয়ের বাজার অনেক ভাল। পেপারব্যাক আর কিন্ডল এডিশান বের করা হবে... ব্র্যান্ডিং আরও ভাল হবে।
আর শামিমার চাওয়া? নাহ্, সে তো সব বন্ধক রেখেছে...
ষাট পেরিয়েও মা প্রবল ব্যক্তিত্বময়ী এখনও। উঠতে বসতে বুঝিয়ে দিতে কসুর করেন না শামিমা 'শামিমা' হয়েছেন ওঁর জন্য। মাঝেমাঝে যে শামিমা প্রতিবাদ করেননি তা না। বলে উঠেছেন "আর আমার ট্যালেন্ট, আম্মি? সেটা কিছু না?" মা হাত নেড়ে বলে উঠেছেন "ওরকম ট্যালেন্ট কতলোকের থাকে! সবাই কি তোর মতো হতে পারে? দেখ মেয়ে, টাকা- টাকা! টাকার চেয়ে বড় দোস্ত -ইয়ার কেউ নয়। আর এটাই খাটার বয়স! খেটে যা।" আবার কখনও চোখে জল এনে বলেছেন "কার জন্য বলি এসব? তোর জন্যই তো... আজ তোর আব্বু থাকলে..." কথা শেষ হবার আগেই হার মেনে নেন শামিমা। কুমাতা যে কেউ হতে পারেন না!
এভাবেই চলে এসেছে জীবন। কখনও পচা শামুকে পা কেটেছে। কখনও বা হৃদয় ভেঙেছে। হ্যাঁ, কাকে ভালবাসবে, কাকে না - মা নির্ধারণ করে দিয়েছেন সবটাই। তাই বিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও সাহিলের সাথে ফ্লার্ট করতে হয়েছে শামিমাকে, যাতে ওঁর ছবির লিড রোল পাওয়া যায়। আবার 'মিডিওকার' অভিজিৎকে - বলা হয়নি, বলতে পারা যায় নি কিছুই... অথচ, সেই গভীর বাঙ্ময় চোখদুটি... ভুলতে পারেননি আজও।
এখন অবশ্য মেনেই নিয়েছেন উনি। প্রেমহীন একটা জীবন কাটাতে হবে। অর্থসর্বস্ব এবং অর্থহীন একটি জীবন! তবে, সেই জীবনও এখন ব্র্যান্ডিং হবার অপেক্ষায়। এভারগ্রিন এবং লোনলি বিউটি। নিঃসঙ্গ সুন্দরী!
ব্রাশ করে চোখে মুখে জল দিতে দিতে নিজেকে দেখছিলেন শামিমা। চোখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। আর... কিছু ফাইন লাইনস! চল্লিশ আসছে যে!
'চল্লিশ' শব্দটি মনে পড়তেই গতকালের সন্ধ্যা মনে পড়ে গেল শামিমার। ঝাঁ চকচকে হলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। অনেকদিন পরে দেখা হয়েছিল সেতারবাদক পন্ডিত আজহার খাঁ সাহেবের সঙ্গে। উনি প্রায় চল্লিশবছর ধরে বাজাচ্ছেন! তবে এখন আর অনুষ্ঠানে বাজান না। কাল বলছিলেন "কোনো দুঃখ নেই আমার জানো! নো রিগ্রেট অ্যাট অল! আই লিভড মাই লাইফ অ্যাজ পার মাই উইশ! যতদিন ইচ্ছে হয়েছে সবার জন্য বাজিয়েছি। এখন নিজের জন্য বাজাই...একা... কাউকে অ্যালাও করি না। পরিবারকে যা দেবার, সব দেওয়া হয়ে গেছে।" বলতে বলতে হাসছিলেন উনি। চোখে মুখে কত বলিরেখা - তবু সে হাসি তারার মতো উজ্জ্বল!
একটু হাসলেন শামিমা।
তারপর সিদ্ধান্ত নিলেন।
অনেকটাই তো করেছেন উনিও। অভিনয় কমে এলেও ব্যবসা থেকে আয় মন্দ না। এবার থেকে অন্তত নিজের জীবনের রাশটা নিজের হাতে নিলে হয় না? চলে যাবে ঠিকই, বরং আজকাল যে নিজেকে পন্য মনে হয় - সেটা থেকে মুক্ত হবে।
মা! আম্মি!
হ্যাঁ, আম্মি সত্যিই অনেক করেছেন। নইলে এতদিন হয়ত কোথায় কোন মাঝবয়সী লোকের বিবি হয়ে সংসার সামলাতে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু সেজন্য তো এতগুলো বছর কেটে গেল! বাইশ বছর! দ্য গোল্ডেন ইয়ার্স!
মুখটা ভাল করে মুছে বাইরে এলেন শামিমা। ব্যায়ামের পোষাক পরলেন। এইসময়েও ওঁকে হাল্কা মেক আপ করতে হয়। চোখের কালি, স্পট ঢাকার জন্য কনসিলার... গালে রক্তিম আভার জন্য চিক টিন্ট! ভিডিওতে যাতে সুন্দর লাগে। অথচ আর পাঁচজন কি ব্যায়াম করার আগে সাজগোজ করেন?
এক্কেবারে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এলেন উনি ঘর থেকে। মা দেখে অবাক হয়ে বললেন "কেমন একটা লাগছে আজ তোকে! গালটা শুকনো?"
"তাই? আসলে আজ মুখে কিছু লাগাইনি... তাই হয়ত।" হেসে বলে ওঠে ও।
"ওমা! কেন? তাই তো কেমন একটা লাগছে।" বলেন মা।
"কেমন লাগছে আম্মি?"
"কেমন আর... একটু বুড়োটে..." মা বরাবরই স্ট্রেট ফরোয়ার্ড!
"তা তো হবেই আম্মি! আমি কি আর ইয়াং আছি! বয়স বাড়ছে না আমার? " খুব মজা হচ্ছে আজ শামিমার।
"এভাবে কেউ দেখে ফেললে?" যেন শিউরে ওঠেন মা।
"বাহ্, তাতে কি হয়েছে? আমিই না ইন্টারভিউতে বলি আত্মবিশ্বাসের চেয়ে বেশি কিচ্ছু হয় না! কনফিডেন্স ইজ দ্যা বেস্ট মেক আপ? তা আমি তো কনফিডেন্ট, তাহলে আর কিসের সমস্যা?"
"হায় আল্লা! পাগল হয়ে গেছিস নাকি তুই?"
"না মা, পাগল ছিলাম... গোলাপী চশমা পরা পাগল... এখন সুস্থ হচ্ছি..." হাসতে হাসতে বলেন শামিমা।
সামনে অনেক কাজ...
বেড়াতে যাবেন খুব শিগগিরি... নিজের পছন্দের জায়গায়... একা! কোনো ছবি থাকবে না সেখানে - শুধুই ছবির মতো কিছু দিন...
একটা কবিতার বই...
সাদা খাতা একটা...
আর... অভিজিৎ কে একবার ফোন করা... কোনো কিছুর আশা না করে... শুধু নিজের কথাটা বলার জন্য....
চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেন শামিমা...
বাতাসে স্বাধীনতার গন্ধ...

Like Reply
#কথোপকথন

 
-"শুনছ? সিমি?"
-"..."
-"কোথায় যে সব রাখো? দরকারের সময় খুঁজে পাই না কিছু। সিমি?"
-"উফ! কি খুঁজে পাচ্ছ না তুমি?"
-"এদিকে এসো, বলছি।"
-"কাজ করছি, এখন যাবার উপায় আছে কি?"
-"আরে দরকারি জিনিস! এসোদু মিনিট!"
-"নিজের জিনিস কেন রাখো না? এখন করবে খিটখিট! "
-"উফ! আজব পাবলিক! এসো বলছি।"
-"আশ্চর্য! আসছিইই!"
-"..."
-"কি পাচ্ছ না? বলো?"
-"বলছি। কিন্তু তার আগে, মুখটা খোলো…"
-"মুখটা? এই না না, আজ না লক্ষ্মীপুজো?"
-"তারজন্য কি পশ্চিমে উঠেছে সূর্য?"
-"আরে! আজ আমার উপোস!"
-"না খেয়ে থাকার মেয়ে তো তুই নোস!"
-"এই, আবার তুইতোকারি? মা বকা দেবেন।"
-"ওসব পরে হবে। আপনি এখন চুপচাপ খাবেন।"
-"রাতুল, এটা কি ঠিক হবে?"
-"খাওয়াটা বেঠিক হল কবে?"
-"না, বিয়ের পরে প্রথম লক্ষ্মীপুজো…"
-"না খাবার অন্য অজুহাত খুঁজো।"
-"আরে, বাড়ির বৌ আমি এখন।"
-"তাতে কি পালটে গেছে তোমার হরমোন?"
-"মানে?"
-"না খেয়ে থাকলে তোমার শরীর খারাপ হয় এটা কে না জানে?"
-"তাও…"
-"প্লিজ কথা শোনো। খাও।"
-"মা লক্ষ্মী যদি রাগ করেন?"
-"মা? মা তো তোমারআমাদের? তবে খুশিই হবেন।"
-"তোমার যুক্তির কাছে আমি বারবার হেরে যাই!"
-"আর প্রশংসা করো না,আই অ্যাম ফিলিং শাই!"
-"শোনোতোমার মনে আছে প্রথমবার তোমাকে দেওয়া আমার কম্পলিমেন্ট?"
-"হা হা হা! তা আবার থাকবে না? আমি নাকি ডানদিক থেকে হৃত্বিক রোশন ফিফটি পারসেন্ট?"
-"কথাটা পাল্টাতে চাই, বুঝলি?"
-"এবার কে 'তুই' বলছে? আচ্ছা, কি পাল্টাবি?"
-"আই লাভ ইউ অ্যান্ড ইউ আর বেটার দ্যান রোশন!"
-"আই ব্বাস! কি শুনলাম! থ্যাংকইউ! জানেমন!"
 
Like Reply
নষ্টা

 
ঘুম থেকে উঠেই অভ্র দেখল দয়িতার স্নান সারা হয়ে গেছে। একটা নীল রঙা কুর্তি আর ঢোলা পালাজো পরেছে। ভেজা চুল। চোখে ওর ট্রেড মার্ক, গাঢ় কাজল ড্রয়িংরুমের মেঝেতে বসে জামা-কাপড় ভাঁজ করছে।
ওর জামা-কাপড়!
দয়িতা চলেই যাবে, তাহলে?
কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেল অভ্র। দাঁত মাজতে মাজতে সামনের ছোট্ট আয়নায় চোখ গেল। আর নিজেকে নয়, অবিকল যেন একটা 'গাধা' প্রতিবিম্ব দেখছে বলে মনে হল। এমন একটা গাধা, যে এতদিন এক ছাদের নিচে থেকেও বুঝতে পারেনি তার বিয়ে করা বৌ আসলে কি! "নষ্ট মেয়েছেলে, শা লী!" দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠল অভ্র। "আউচ" - অসাবধানে ব্রাশের খোঁচা লেগে গেছে মুখের ভেতর দিকে!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে দুটো বড় বড় ট্রলি রাখা আছে একচিলতে রান্নাঘরের সামনে। শা লী বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য তৈরি তবে! যাক, বাঁচা যাবে! নষ্ট মেয়েছেলে কোথাকার!
সেদিনের কথাটা ভাবতেই ঘেন্নায় গা টা যেন গুলিয়ে উঠল অভ্রর। দয়িতা স্নানে গেছিল। ফোনটা রাখা ছিল ডাইনিং টেবিলের ওপর। হঠাৎ করেই চোখে পড়েছিল ফেসবুকের মেসেঞ্জারে আসা একটা মেসেজের নোটিফিকেশন - "গুড মর্নিং! ঘুমিয়েছিলে রাতে? আমার তো একটুও ঘুম হয়নি! খালি মনে হচ্ছিল, আমাদের 'আমরা' হতে আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে? আর যে পারছি না আমি!"
অবাক হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিয়েছিল অভ্র। দয়িতার ফোনের পাসওয়ার্ড জানে না ও। তাই ফোন খুলে পুরো মেসেজটা, বা তার আগের কোনো মেসেজ দেখতে পায়নি। শুধু সেন্ডারের নামটাই চোখে পড়েছিল। সোমনাথ সেনগুপ্ত
কিন্তু কে এই সোমনাথ সেনগুপ্ত? আর দয়িতাকে এরকম "ঘুমোতে পারছি না" মার্কা গদগদ মেসেজ কেন পাঠিয়েছে? স্নানঘরের দিকে একনজর দেখে নিজের ফোনটা হাতে তুলে নিয়েছিল অভ্র। দয়িতার ফেসবুক প্রোফাইল খুলেছিল। গত জুনে পুরী গেছিল দয়িতা, সেইসময় সমুদ্র সৈকতে তোলা একটা ছবি আছে প্রোফাইলে। কভার ফটোতে সমুদ্রের সূর্যাস্ত। আগে নজরে পড়েনি, হলুদ লম্বা জামায় বেশ ভাল লাগছে দয়িতাকে! মানে, এমনি যা লাগে, তার চেয়ে অনেক ভাল! নইলে প্রায় নব্বই কেজি ওজন, হাতির মতোই লাগে তো ওকে! চুল স্ট্রেট করিয়েছিল একবার, এখন ঝাঁটার কাঠির মতো লাগে। চোখের কোণে ফাইন লাইনস এসে গেছে। বুকও আর আগের মতো নেই! ঝুলে টুলে একশা! আর সেই মেয়েকে নিয়ে নাকি কেউ 'আমরা' হবার স্বপ্ন দেখে! হুহ্! ভেবেই হাসি পাচ্ছিল অভ্রর।
তবে সারাদিন ধরে ভাবার পরে কিন্তু আর হাসি পায়নি একটুও। খালি মনে হচ্ছিল, এটাই তো একমাত্র মেসেজ না! এর আগেও কত কথা হয়েছে দুজনের মধ্যে। আরও কত কি হয়েছে কে জানে! ইআর মেসেজটা দেখে তো মনেই হচ্ছে দুজন অনেক কিছু প্ল্যান সেরে ফেলেছে! বা ! অত যেন সোজা! দয়িতা মিত্র অভ্রাংশু মিত্রের ওয়াইফ! রীতিমতো আইনি বিয়ে। অত সোজা! আর মেসেঞ্জারে ন্যাকামি করে চ্যাট করা যায়, কিন্তু বাড়িতে একসঙ্গে থাকতে গেলেই বোঝা যায় কত ধানে কত চাল!
দিন গড়াতে গড়াতেই সকালের পরিহাস যেন একটা অক্ষম রাগে পালটে গেল অভ্রর। এই মুহূর্তে অভ্র অফিসে, দয়িতাও কলেজে। কিন্তু হয়ত এখনও চ্যাট করছে দুজনে। 'আমরা' হবে! কত সখ!
আরেকবার ফেসবুক খুলে দয়িতার প্রোফাইল খুলল অভ্র। সেখান থেকে সোমনাথ সেনগুপ্তর প্রোফাইল। "দেখি বদনখানা একবার!" একটাই সোমনাথ আছে দয়িতার প্রোফাইলে। এইই সে! কিন্তু মা তো প্রোফাইল লক করে রেখেছে। কিছুই দেখা গেল না। না ছবি, না ফ্রেন্ডলিস্ট। এই হয়েছে এক নতুন ন্যাকামি! প্রোফাইল লক করে রাখা! শা লা জুকের বার্গ!
রাগে দাঁত কিড়মিড় করছিল অভ্রর। অফিস থেকে বেরিয়ে কোনোদিকে না তাকিয়েই চলে এসেছিল বাড়িতে। দয়িতা তখন বই পড়ছিল টেবিলে বসে। নেকি! নাগ রের সাথে লটরপটর করে আবার বই পড়া! এই নাকি টিচার! আবার সে নাকি স্পিরিচুয়াল! ঘটা করে পুজো করে! সোমবার করে নিরামিষ খায়!
কোনোরকম ভনিতা না করে চেঁচিয়ে উঠেছিল অভ্র। "সোমনাথ কে?"
"কে সোমনাথ?" চমকে তাকিয়েছিল দয়িতা। একটু যেন ভয় পেয়েছিল প্রশ্নটা শুনে।
"ন্যাকামি করো না তো। আমি সব জানি। কে এই সোমনাথ?" সারাদিন পরে ফেটে পড়েছিল অভ্র।
বেশি কিছু বলে নি দয়িতা। চুপ করেই ছিল। তারপর বলে উঠেছিল "শোনো, স্যরি... আসলে... তুমি আমাকে একদম সময় দাও না... একা লাগত খুব... এইভাবেই... একদিন ওঁর মেসেজ এলো..."
"আর অমনি ভুলে গেলে তুমি একটা বাড়ির বৌ? লদকা লদকি চালু করে দিলে? আবার ঘটা করে পুজো করে! উপোস করে! নষ্ট মেয়েছেলে কোথাকার!" অভ্রর মাথায় আগুন জ্বলছিল যেন।
"আমি স্যরি। তোমাকে এভাবে... কিন্তু তুমি তো জানোই মাঝেমাঝে আমাদের নিজেদের ওপর কন্ট্রোল থাকে না!"
"শা লী মা গী! এত কথা তোর বেরোয় কি করে?" চিৎকার করছিল অভ্র।
"বললাম তো, স্যরি!"
"কু ত্তী! বাবা মায়ের এই তো শিক্ষা.."
"তুমি আমাদের মধ্যে বাবা মা কে কেন টানছ? "
"কেন টানব না? শিক্ষা দিতে পেরেছে নাকি তোকে ওরা? বিবাহিতা মহিলা হয়ে পিরীত মা রাচ্ছে!" রাগলে অভ্র 'বাপের কুপুত্তুর'!
"প্লিজ, বাবা মা কে নিয়ে কিছু বলো না। যা হয়েছে তার দায় আমার একার।" দয়িতা তখনও বলে যাচ্ছিল।
আর সহ্য হয়নি অভ্রর। চুলের মুঠি ধরেছিল দয়িতার। "শা লী!"
"গালাগাল দিও না এভাবে প্লিজ। তুমি তো সবসময় আজেবাজে কথা বলো আমাকে। আমি নাকি হাতি! আলুর বস্তা! আমাকে নিয়ে বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া যায় না! শেষ কবে একটু আদর করেছ, ভাল করে কথা বলেছ মনে আছে তোমার?" কঁকিয়ে উঠেছিল দয়িতা।
"ভাল করে কথা! আদর! তুই তার যোগ্য! তুই কাছে এলেই আমার গা বমি করে। সত্যিই তো তুই আলুর বস্তা!"
আর কথা বাড়ায় নি দয়িতা। শুধু বলেছিল "আমার গায়ে হাত দিও না। আইন তো জানোই। ফেঁসে যাবে কিন্তু।"
চুপ করে গেছিল অভ্র। ওর বন্ধু চঞ্চল মাস কয়েক খুব ভুগেছে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স কেসে। প্রায় জেল হয় হয় অবস্থা ছিল। জলের মতো টাকা খরচ হয়েছিল। সবই শুনেছে অভ্র। তাই বাধ্য হয়েই চুপ করে গেছিল।
তবে, 'চুপ' করেনি। দয়িতার বাবা নেই, মা আছেন। সেই মানুষটিকে জানিয়েছে সব। দয়িতার বেশ কয়েকজন 'নেকি' বন্ধু আছে। তাদের সাথে বিশাল হা হা হি হি চলে দয়িতার। তাদেরকেও জানিয়েছে সবটা। নিজের দিকের সব আত্মীয় স্বজনদেরকেও জানাতে ছাড়েনি। আর এরমধ্যেই আরও একবার একটা মেসেজ চোখে পড়েছিল "বেবি, আর ইউ ওকে? প্লিজ লেট মি নো হোয়েন ক্যান উই টক টুডে। কান্ট ওয়েট টু স্পিক। লাভ!" লেখা একটা মেসেজ।
তার মানে এতকিছুর মধ্যেও সব চলছে!
আরেকপ্রস্থ ঝামেলা লেগেছিল ওদের মাঝে। দয়িতার মাকে ফোন করেছিল। বলে উঠেছিল "আপনার নষ্ট, ক্যারেকটার লেস মেয়েকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলুন। আমাদের বাড়িতে থেকে এমনি করা যাবে না। কী কী সব করেছে ভগবান জানে! নোংরা মেয়েছেলে"
কেঁদে উঠেছিল মুটকিটা! ফোন ছাড়ার পর বলে উঠেছিল "তুমি নিজে কোন মুখে কথা বলো? মৌসুমীর কথা ভুলে গেলে? কিসব মেসেজ করতে তুমি ওকে... সব তো ছিল আমার কাছে। আমিও তো তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম।"
"চোপ! মৌসুমীর সঙ্গে তোর তুলনা? ৩৬-৩২-৩৬! আর তুই? ৪০-৪০-৪০ - সব সমান, শুয়োয়ের মতো!"
সেই শেষ! সেইদিনই দয়িতা বলে দিয়েছিল আর এই বাড়িতে থাকবে না। সামনের রবিবার চলে যাবে। পরে ডিভোর্সের নোটিস পাঠিয়ে দেবে।
আজ সেই রবিবার। আর সত্যিই দয়িতা চলে যাচ্ছে!
ওই সোমনাথ সেনগুপ্তের ভরসায়! ফেসবুক থেকে এত কিছু!
ওকে দেখে উঠে দাঁড়ায় দয়িতা। পা মুড়ে বসতে পারে না, উঠতে বেশ কষ্টই হল। উঠে বলল, "আমার বাড়ি থেকে দেওয়া গয়না গুলোই শুধু নিলাম, যদিও সব গয়নাই আইনত আমার প্রাপ্য, তাও তোমাদের দিকের গুলো রেখে যাচ্ছি। দেখে নাও আর এই কাগজটায় সই করে দাও।" একটা ফোর কাগজ ওর হাতে।
"চলেই যাচ্ছ তুমি? এত পিরীত? সে দুদিন পরেই ছেড়ে দেবে তোমাকে। তখন বুঝবে। কাছে গেলেই বুঝবে কোন মা লের পেছনে পড়েছে!" হাত দিয়ে অশ্লীল একটা ইঙ্গিত করল অভ্র।
আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দয়িতার হাতের ফোনটা বেজে উঠল।
"হ্যালো? হ্যাঁ দাদা, আমি লোকেশানেই আছি, দু মিনিটে আসছি।" বলে ফোনটা কাটল ও। দু এক সেকেন্ড চুপ করে রইল। তারপর অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল "আসছি। ভাল থেকো, অভ্রাংশু!"
নাহ্, একবারও পিছনে ফিরে তাকায় নি মেয়েটা।
চোখের জলটুকু দেখাতে চায় নি!
অনেক স্বপ্ন নিয়েই তো সংসার করতে এসেছিল আর পাঁচটা মেয়ের মতো। কী যে হয়ে গেল!
সব কষ্ট একদিকে... আর একজন চেনা মানুষ অচেনা হয়ে যাবার শূন্যতা... অন্যদিকে। তার গভীরতা আরও অসহনীয়!
গাড়িতে বসে ফোনটা ব্যাগে ঢোকায় দয়িতা।
এখন আর ফোনটার দরকার নেই। আগে তো ইচ্ছে করেই এদিক সেদিক ফেলে রাখত... যাতে 'সোমনাথে' মেসেজ গুলো অভ্রর চোখে পড়ে। ভেবেছিল যদি... যদি কিছু পালটায়! যদি ওকে এখনও ভালবাসে অভ্র! যদি বলে "এসো আবার শুরু করি!" কিন্তু না... সে পাল্টাবার না!
বড্ড একা লাগছে ওর। বড্ড খালি।
শুধু অভ্রই না, সোমনাথের যে আর প্রয়োজন নেই! এবার অ্যাকাউন্টটা ডিঅ্যাকটিভেট করে দিতে হবে...
বেচারা অভ্র! ভাবতেও পারল না - সোমনাথ আর কেউ না... স্বয়ং ওর আরাধ্য, মহাদেবের আরেক নাম!
গাড়ি চলছে হু হু করে।
দয়িতা কাঁদছে।
তা কাঁদুক। সব জল না হয় শেষ হয়ে মরুভূমি হয়ে যাক...
তারপরেই তো মরুদ্যান আসবে....
 
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
কি ভালো স্বামী। নিজের বৌকে ভুলের জন্য বকাবকি করছে। শুধু ওই সময় আয়নার দিকে একবারও মনে হয় তাকায়নি। নইলে তখন শেয়াল গাধা হায়না সব জন্তু দেখতো আবারো
[+] 1 user Likes Baban's post
Like Reply
বৃত্ত

 
মা চলে যাবার পর থেকেই আগের ফ্ল্যাটটা একদম ভাল লাগছিল না ঈশানের। সারাদিন অফিসে কাটিয়ে বাড়িতে ফিরলেই মনে হতো ঘরটা এক্কেবারে খাঁ খাঁ করছে যেন! বাবা তো অনেক ছোটবেলা থেকেই নেই, দিম্মা আর মা ছিলেন ঈশানের সবকিছু। দিম্মা তবু বয়সের জ্বালায়, আর বেশ একটু ভুগেই মারা গেছিলেন, তাই সেটা মেনে নিতে পেরেছিল ঈশান। কিন্তু... মা? নাহ্! সবকিছু আরেকদিকে... আর নিজের হাতে প্রিয়তম মানুষটির দাহ করার যে অসহায়ত্ব... তা অন্যদিকে।
একা হয়ে গেলেও মানিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল ঈশান আপ্রাণ। এমনকি অফিসে বেশি বেশি করে সময় কাটিয়েছে। ডেডলাইনের আগেই অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে দিয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য ক্লান্ত শরীরে পার্কিং লটে এসেই মনে পড়েছে বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করে নেই! সেই হোম ডেলিভারির ঠান্ডা খাবার... আর বিছানায় শুয়ে এদিক ওদিক করে রাত্তিরটুকু কাটানো...
আর উইকেন্ডগুলো তো আরও খারাপ! দেরী করে ঘুম থেকে ওঠাই সার... তারপরেই মনে হতো কি হবে সারাটা দিন! মন ঠিক করার জন্য সিনেমা দেখেছে, মদ টদ খেয়েছে উইকএন্ডে... কিন্তু মনের গভীরে ঢুকে থাকা একাকীত্ব কাটেনি।
তাই শেষমেষ বাড়িটা বিক্রিই করে দিল। এমনিতেই একতলায় ফ্ল্যাটটা ছিল, একটু বৃষ্টিতেই রাস্তায় জল জমে যায়। মাকে অনেকবার বলেওছিল ঈশান, নতুন কোথাও শিফট করতে, কিন্তু মা রাজি হননি। খালি বলতেন "এই একতলাই আমার ভাল... হাঁটুতে যে ব্যথা..."
এখন যে ফ্ল্যাটটা নিয়েছে ঈশান, সেটা ওয়ান বি এইচ কে হলেও খোলামেলা বেশ। একটা ছোট্ট বারান্দা আছে। ছুটির দিনগুলোতে ওখানে বসে বসে নিউজপেপার পড়তে, চা-সিগারেট খেতে খুব ভাল লাগে ওর। নতুন বাড়ি বলেই হয়ত এখন আর খুব একটা একা লাগে না। না, মায়ের অভাব, মায়ের গায়ের গন্ধ, মায়ের রান্না, মায়ের বকাঝকা, আবার রাতে ঘুমের মধ্যেই মা ঘরে এসে যেভাবে গায়ে চাদর দিয়ে যেতেন, ফ্যান আর এসি একসঙ্গে চলছে দেখে, সবটাই খুব মিস করে ঈশান। কিন্তু, এখন মেনে নিয়েছে "আছে দুঃখ আছে মৃত্যু।" ওর থেরাপিস্ট, মানে যাঁর কাছে কিছুদিন কাউন্সেলিং করেছিল উনিও ওর ইম্প্রুভমেন্ট দেখে খুব খুশি। তবে সবচেয়ে বেশি খুশি বোধহয় অফিসে ওর টিম লিডার। সেদিনই হাসতে হাসতে বলছিলেন "ঈশান রে, তুই যে হারে তড়িঘড়ি অ্যাসাইনমেন্ট কমপ্লিট করছিলি, আমি তো টেনশানে পড়ে যাচ্ছিলাম যে তোকে এরপরে কি কাজ দেব!"
তবে, মোটামুটি অবস্থাটা শুধরে এলেও এই পাড়ায় সেভাবে কারো সাথে আলাপ নেই... ফ্ল্যাটেও চেনা কেউ নেই... এটাই অস্বস্তির। একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে, যেখানে মেইনটেনেন্স সংক্রান্ত আলোচনা হয়, কার বাড়ির সামনে নোংরা পড়ে আছে, কে জানলা দিয়ে রাস্তার কুকুরকে বিস্কুট ছুঁড়তে গিয়ে কার মাথায় পড়েছে... কে লিফটের দরজা ঠিক করে আটকায় না... এইসব নিয়ে ঝগড়া হয় দিনভর। ঈশান ভয়ে ভয়েই ওই গ্রুপটা এড়িয়ে চলে। মাত্র আঠেরোটা ফ্ল্যাট নিয়ে বাড়ি, কিন্তু মতামত আঠেরো হাজার রকম!
আজ বিশ্বকর্মা পুজো। শনিবার, তাই অফিসও ছুটি। বেশ ফুরফুরে মনে ঘুম থেকে উঠল ঈশান। দুদিন ধরেই আকাশের মুখ ভার। পুজোটা বোধহয় এবারও গেল! একটু মনটা খারাপই হয়ে গেল ওর। একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল ঈশান। ধোঁয়া ছাড়ল... আহ... শান্তি!
আর প্রায় তক্ষুণি, চোখ পড়ে গেল পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দার দিকে। ওদের এই বাড়িটা জি প্লাস সিক্স। তার ওপরে ছাদ। একেকটা ফ্লোরে তিনটে করে ফ্ল্যাট, একটা ওয়ান, একটা টু আর একটা থ্রি বি এইচ কে। আর তিনটে ফ্ল্যাটেরই বারান্দাগুলো মোটামুটি একই লাইনে তৈরি, তাই পাশের ব্যালকনির দিকে চোখ চলেই যায়।
থ্রি বি এইচ কে তে একজন ভদ্রলোক থাকেন, তিনিই আবার এই ফ্ল্যাটের সেক্রেটারি। বেশ ব্যস্ত মানুষ। ফোনে থাকতেই বেশিরভাগ সময় দেখেছে ঈশান ওঁকে।
আর টু বিএইচকেটায় একজন ভদ্রমহিলা থাকেন। ঈশানের থেকে কয়েক বছরের বড়ই হবেন। বাড়িতে আর কে আছে জানে না, তবে মহিলা সারা শনি-রবিবার জুড়ে "বাবাই,,বাবাই" বলে ছেলেকে ডাকতে থাকেন। ছেলেটির সাড়া পায়নি এখনও ঈশান, তবে খুব শান্ত ছেলে নিশ্চয়ই। আর, উনি বোধহয় সিঙ্গল মাদার। ওর মায়েরই মতো,,প্রায়। নইলে আর কারো আওয়াজ কেন পাওয়া যায় না বাড়িতে। যদিও মাত্রই মাস তিনেক হয়েছে ঈশান এসেছে এই ফ্ল্যাটে। কারো সাথেই আলাপ পরিচয়টুকুও হয়নি, সেক্রেটারি ভদ্রলোক ছাড়া।
"সাত সমুন্দর পার... তেরে পিছে পিছে গ্যায়ি" গান শুরু হয়ে গেল হঠাৎ করেই। আর একটা ইয়াব্বড় হাসি এসে গেল ঈশানের মুখে। এই গানটাকে ওর এই বিশেষ দিনটার 'অ্যান্থেম' মনে হয়!এই তো, এবার বেশ পুজো পুজো ভাব আসছে। পরের সপ্তাহে মহালয়া... তারপরেই তো... যদিও ঈশান এবার কলকাতা থাকবে না, আগে থেকেই টিকিট কেটে রেখেছিল, পঞ্চমীর রাতেই পাড়ি দিচ্ছে নর্থবেঙ্গল।
কিন্তু পুজোর শুরু হয়ে গেল... আজ একটু স্পেশ্যাল কিছু খেলে কেমন হয়? আগে, ওই বাড়িতে থাকাকালীন রোজ হোম ডেলিভারির খাবার খেত, পেট খারাপ হয়ে যেত প্রায়ই। এখন নিজেই কিছুকিছু রান্না শিখেছে। সামান্যই... ডাল সেদ্ধ করে ফোড়ন দেওয়া, ভাত বানানো, ডিম ভাজা এইসব তবু এখন অনেকটা ভাল আছে। ইউটিউবের একটা রান্নার চ্যানেল দেখেই শিখেছে , আর মনে মনে ভেবেছে "মা এতবার করে বলতেন আগে, কেন যে কিছু শিখিনি!"
সে যাই হোক, কিছুদিন আগেই ওই চ্যানেলটায় 'চিকেন পিসপাস' নামের একটি ওয়ান পট মিল শিখেছে ঈশান। খুব সোজা রান্না। আজ নাহয় সেটাই বানাবে। স্পেশ্যাল আর হেলদি, দুটোই হবে।
রেসিপি মেনে সবকিছু দিয়ে গ্যাসটা জ্বালিয়ে দিল ও। ব্যাস! এবার একটুখানির অপেক্ষা, তারপরেই এক্কেবারে ব্রাঞ্চ। এই ফাঁকে স্নানটা সেরে নিলে কেমন হয়?
স্নানের পরে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল... এদিকে প্রেশার কুকারে সিটি আর পড়ে না! খিদেও পেয়েছে জব্বর! কি হল রে বাবা!
তড়িঘড়ি একচিলতে রান্নাঘরটায় গিয়ে দেখে গ্যাস অন, কিন্তু আগুন জ্বলছে না... গ্যাস শেষ!
বাড়ি চেঞ্জের সময়ে মায়ের নাম থেকে নিজের নামে ট্রান্সফার করেছিল গ্যাস ঈশান। তখনই একেবারে দুটো গ্যাসই রিফিল হয়ে গেছিল। এতদিন প্রথম গ্যাসটাই চলেছে... আজ শেষ হল... কিন্তু যে গ্যাস সিলিন্ডার লাগাতে পারে না! কি হবে! এদিকে এত খাবার... সব প্রেশার কুকারে বসানো... নষ্ট হবে? খিদেও পেয়েছে খুব... এখন অর্ডার দিলে আসতে আসতেই জাস্ট মরে যাবে ঈশান...
কেন যে এটুকুও শেখেনি ! মা কতবার বলেছেন...
বাধ্য হয়েই পাশের ফ্ল্যাটে গেল ঈশান। সেক্রেটারি কাকু বলেছিলেন "কোনোরকম দরকারে বলো"... আর আজ তো মহা দরকার... এক্কেবারে পেটের দায়!
"সান্যালদারা কেউ নেই..." আওয়াজ শুনে চমকে উঠল ঈশান।
টু বিএইচকের মেয়েটি।
"নেই? তাহলে কি হবে?" বোকার মতো বলে উঠল ও।
মেয়েটিও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল যেন। তারপর বলল "কিছু দরকার ছিল...মানে যদি আমার সাধ্যের মধ্যে থাকে..."
"ইয়ে... আসলে আমার গ্যাস শেষ হয়ে গেছে..."
" হো! আমাদের এখানের ডিষ্ট্রিবিউটারের নাম্বার নেই আপনার কাছে? যদিও আজ তো পাওয়া যাবে না... পুজোর দিন... কাল হয়ত..." বলে ওঠে মেয়েটি।
"না না, আমার আছে... মানে আরেকটা সিলিন্ডার আছে। কিন্তু আমি লাগাতে পারি না..." অসহায় গলায় বলল ঈশান।
"আচ্ছা... আমি লাগিয়ে দেব? আমি পারি।"
"দেবেন?"
"শিওর!" বলেই ঘরের ভিতরে তাকিয়ে মেয়েটি বলে ওঠে "বাবাই, আমি এক্ষুণি আসছি, এই আঙ্কেলের বাড়ি থেকে, কেমন?"
"আপনার ছেলে কিন্তু খুব শান্ত, কোনো আওয়াজই করে না। খুব লক্ষ্মী ছেলে।" সিলিন্ডার পাল্টানোর পরে বলল ঈশান।
"হ্যাঁ, খুব শান্ত! আসলে রেসকিউড বাচ্চা তো! এখনও ট্রমার মধ্যে থাকে। আমি কাছে বেশিক্ষণ না থাকলেই ভয় পায়, ভাবে আমিও যদি ছেড়ে যাই! "
"রেসকিউড বাচ্চা?"
"হ্যাঁ... ওর আগের মালিক একটা চায়ের দোকানে ফেলে রেখে গেছিল... সেই থেকেই আমার কাছে... যদিও আমাকেই একরকম রেসকিউ করেছে ও।"
"মালিক মানে?"
"মানে... ওহ্, আপনি বোঝেননি না? আসলে বার্ক করে না খুব একটা তো... তো আমার চারপেয়ে সন্তান... বয়স হয়ে গেছিল, ওর আগের মালিক... জাস্ট ফেলে গেছিল ওকে, জানেন? সারা গায়ে পোকা... কিছু খেত না... সেই থেকে আমার কাছে... আমার সবটা জুড়ে আছে ..."
" হো... না আমি জানতাম না..."
"আসুন না, আলাপ করবেন। যদিও এখনও আমাকে আর আমার যে দিদি আসেন, সারাদিন থাকেন, সেই রীতাদি ছাড়া কাউকে এখনও ভরসা করতে পারে না... ভয় পায়..."
"আর আপনার বাড়ির অন্য লোকজনেদের?" অভদ্রতা জেনেও জিজ্ঞেস করে ফেলে ঈশান।
খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা তো!
"অন্য আর কেউ নেই আসলে আমার। মা -বাবা কেউ নেই। আর একজন ছিল, কিন্তু ছিলও না... তাই তাকেও মুক্তি দিয়েছি।" হাসতে হাসতেই বলল মেয়েটি। কিন্তু চোখে যেন গভীর বিষাদ!
"আই অ্যাম স্যরি।" মাথা নাড়ে ঈশান।
"প্লিজ ডোন্ট বী! আই অ্যাম নট স্যরি। ভুল সময়ে, একজন ভুল মানুষকে ভালবেসেছিলাম বড্ড। সংসার পেতেছিলাম অনেক স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সে আমাকে আমার এই মোটাসোটা শরীরটার বাইরে আর কিছুই ভাবতে পারেনি। তাই আমার একটা সামান্য পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারেনি। তা... আগে কষ্ট ছিল একটা... এখন আর নেই! এভাবেই ভাল আছি আমি। আর, আমার ছোট্ট বাবাই সোনা তো আছেই..."
"দেখুন, আত্মসম্মানের চেয়ে বড় আর কিছু হয় না। আর... আপনি মোটাসোটা না... আমার এভাবে বলা ঠিক হচ্ছে না... কিন্তু না বলে থাকতেও পারছি না... আপনি বিখ্যাত পেইন্টার রুবেনের পেইন্টিং এর মতো... আপনি... আপনি 'রুবেনেস্ক'..."
"রুবেনেস্ক মানে?" অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মেয়েটি।
"প্লিজ, গুগলে দেখে নেবেন। আর যেভাবে আমাকে হেল্প করলেন, অযাচিতভাবে... তাতে বোঝা যায়, ইউ আর ভেরী কাইন্ড লেডি। ইউ আর ্যাদার এনচ্যানটিং!" এভাবে... কতবছর কাউকে বলেনি কিছু ঈশান...
"আপনার নামটাই তো জানা হলো না" বলে উঠল মেয়েটি। একটু একটু ব্লাশ করছে যেন!
"আমার নাম ঈশান। মা অবশ্য 'ভোলা' বলে ডাকতেন, শিবের নাম বলে" আগে ভোলা নামটায় লজ্জা পেত ঈশান, এখন ভাল লাগে!
"ঈশান! খুব সুন্দর নাম।"
"আর আপনি?" বড্ড ইচ্ছে করছে নামটা জানতে...
"দয়িতা। দয়িতা সেন। মাঝে কিছুদিন 'মিত্র' হয়েছিলাম যদিও।"
দয়িতার দিকে ভাল করে একবার তাকাল ঈশান।
তারপর এক পা এগিয়ে গেল।
বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে...
তারপর যদি কিছু... কখনও কিছু....
দুজনেই যে বড় একা!
আর ভালবাসা না পাওয়া, ভালবাসা না দেওয়া - দুইইই যে বড় কষ্টের...
পাড়ায় তখনই কারা যেন চেঁচিয়ে বলে উঠল "ভোওওওকাট্টা....!"
 
Like Reply
বরাভয়

 
কদিন ধরেই মিমি যেন ঠিক নিজের মধ্যে নেই, লক্ষ্য করছেন সুমনা। ছটফটে মেয়ে, কিন্তু কথাই বলছে না তেমন করে। খুব চুপচাপ। বারবার জিজ্ঞেস করেছেন "কি হয়েছে?" কিন্তু প্রতিবারই উত্তর এসেছে "কিচ্ছু না, মা।" বা "কি আবার হবে!" কিন্তু কিছু একটা হয়েছে, এক্কেবারে সিওর! নইলে যে মেয়ে মোবাইল ছেড়ে থাকে না, সে মোবাইল হাতে নিচ্ছে না। বরং চুপচাপ বসে আছে পড়ার বই খুলে! তাও পুজো মিটতে না মিটতেই! আবার চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে এই কদিনেই। মানে ঘুম ঠিক মতো হচ্ছে না।
ভোগ রান্না শেষ, এবার আলপনা দিতে হবে। অন্যান্যবার মিমি আলপনা দেয়। কিন্তু এবার সকালেই বলে দিয়েছে ওর নাকি খুব শরীর খারাপ, তাই শুয়ে থাকবে। উনি জিজ্ঞেস করেছিলেন "পিরিয়ডস হয়েছে তোর? সেঁক দিবি গরম জলের?" কিন্তু মাথা নেড়ে "না" বলেছে। পিরিয়ডস হয়নি। যদিও জানে, রজঃস্বলা হলেও পুজোর কাজে বাধা দেন না উনি কোনোদিনই,কারণ মায়েরা নিজেরাও তো 'মা' তাই এসব নিছক কুসংস্কার ছাড়া আর কিচ্ছু না।
আজ কোমরে বেশ ব্যথা করছে। তাই আর সিঁড়িতে আলপনা দিলেন না সুমনা। এই ঘটের সামনের অংশটুকু, আর ঘরের সামনে, চালের ড্রামের ওপরএইইই যথেষ্ট। মিমি একটু সাহায্য করলে ভাল হতো
প্রতিবারের মতোই নিজেই পুজো করে নিলেন উনি। মায়ের হাসি হাসি মুখ দেখে মন ভুলে যায় এক্কেবারে। "মা গো, তুমি আমার ঘরে অচলা হও মা। আমার কর্মে আর বাক্যে তোমার অধিষ্ঠান হোন। ইহ গচ্ছ ইহ গচ্ছ, ইহ তিষ্ঠ ইহ তিষ্ঠ। আমার পুজো গ্রহণ করো। আমার মেয়ে আর মেয়ের বাবা যেন সুস্থ থাকে।" পুজো শেষ করে একমনে বলে যাচ্ছিলেন সুমনা।
পুজোর সময় মিমি এসে বসেছিল পাশে। তারপর হাতে হাতে সাহায্য করেছে প্রসাদ এক জায়গায় করতে। কিন্তু কিছুতেই আশেপাশের ফ্ল্যাটে প্রসাদ দিতে যেতে চায়নি। অথচ অন্যান্যবার উনি বাকি কাজ গুলো সামলান আর মিমিই যায় প্রসাদ বিতরণ করতে। কী যে হয়েছে মেয়েটার! আর বয়সটাও ভাল না… 'আঠেরো বছর বয়স কী দুঃসহ স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলনার দাবী" দিনকাল ভাল না, মনে যে কি চলছে মেয়েটার কে জানে!
মেয়ের বাবাকে প্রসাদ দিয়ে কয়েকটা নাড়ু নিয়ে মিমির ঘরে এলেন সুমনা।।মেয়ে নাড়ু বড় ভালবাসে। বিশেষ করে চিনির নাড়ু। 'টা যদি খাওয়াতে পারা যায় এখন। দুপুরেও সেরকম কিছু খায়নি, ফ্রিজে পরশুদিনের পিৎজা রাখা ছিল সেটা খেয়েছে। বারণ শোনেনি।
"মিমি, নাড়ু খাবি? চিনির নাড়ু?" পুজোর দিনেও মেয়েটা ঘরের লাইট বন্ধ রেখেছে! তাড়াতাড়ি স্যুইচ টিপে লাইট জ্বালালেন উনি।
"না না এখন খাব না, পরে খাব।" বলে উঠল মিমি। শুয়ে আছে এই ভর সন্ধ্যেবেলায়!
আর, গালে যেন শুকিয়ে আসা জলের দাগ! কাঁদছে কেন মেয়ে? লক্ষ্মীপুজোর দিনে একি!
"কাঁদছিস কেন মা? কি হয়েছে? আমাকে বলবি না?" খুব নরম গলায় বলেন সুমনা।
"কিছু হয়নি মা। বললাম তো?"
"হ্যাঁ রে, তুই আমার মা না আমি তোর মা? আমি সব বুঝি। কি হয়েছে বল।"
"ওফ, তুমি যাও তো! বলছি কিছু হয়নি।" বিরক্ত, অধৈর্য্য গলা মিমির।
"তা বললে তো হবে না! নবমীর দিন বন্ধুদের সঙ্গে বেরোলি, আর ফেরার পর থেকেই দেখছি তুই একদম চুপ করে আছিস। এবার আমার সঙ্গে বরণের সময়েও যেতে চাইছিলি না, অথচ প্রত্যেকবার বায়না করিস। কি হয়েছে বল আগে, নইলে কিন্তুআমি এখনও উপোস ভঙ্গ করিনি মিমি। তুই বল আগে, তারপর জল খাব।"
"আমি খুব খারাপ মা। খুব খুব খারাপ। খুব বিপদে পড়েছি তাই।" চোখ থেকে অঝোরে জল পড়ছে মিমির।
বুকটা কেঁপে উঠল সুমনার।
কি বিপদ হলো মেয়ের? যার জন্য এতটা বিচলিত ?
"মাআমার সাথে সোশ্যাল মিডিয়ায় রণ ছিল। টুকটাক চ্যাট হতো। তারপর আমাকে প্রপোজ করল।"
"রণ টা আবার কে?"
"আরে বি ব্লকের রণজয়।"
"আচ্ছা, বেশ। তারপর?"
"পুজোর আগে আগেই প্রপোজ করেছিল। বলেছিল আমাকে ওর ভাল লাগে, এইসব। আমারও ওকে ভাল লাগত। "
"সে তো হতেই পারে" একবুক ভয় নিয়েই বললেন সুমনা। দুজনেরই উঠতি বয়স। মিমি আঠেরো, রণ বোধহয় বাইশ তেইশ হবে। বখাটে ছেলে, সারাদিন বাইক নিয়ে ঘোরে।
"মা, নবমীতে ওর সাথেই দেখা করেছিলাম। বাগবাজারে গেলাম, ঠাকুর দেখলাম। রোল খেলাম। আমি বাড়ি ফিরে আসতে চেয়েছিলাম, বলল এত তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে কি হবে লেটস হ্যাভ ফান।"
"ফান?" উফ, কী যে ভয় করছে সুমনার!
"মাহি ওয়ান্টেড মি টু টেক ইন হোটেলআমি যাই নি মা। ওকে না বলে চলে এসেছি বাড়িতে।"
"ভাল করেছিস মিমি। কিছু কিছু জিনিসপ্রাকৃতিক। কিন্তু তাও সঠিক সময়ে আর সঠিক মানুষের সঙ্গে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।" কী যে বলবেন সুমনা ভেবে পাচ্ছিলেন না।
"উফ মা! আমি জানি সেটা। কিন্তু মা, এখন রণ বলছে সবাইকে বলবে যেআমি ওকে ন্যুডস পাঠিয়েছি। কিছু ছবি ডাউনলোড করে রেখে বলছে ওগুলো নাকি আমার ছবি। নাকি সবাইকে দেখিয়ে দেবে।"
"সেকি? তুই ওকে কিছু পাঠাসনি তো?"
"না মা, কক্ষণও না। কিন্তু যদি সবাইকে পাঠিয়ে দেয়? সবাই তো ভাববে ওটা আমি। আর তারপর?" অঝোরে কাঁদছে মিমি।
"শোন, কাঁদিস না প্লিজ। তুই তো জানিস তুই কিছু করিস নি। কাউকে ভাললাগা অন্যায় নয়। তবে হ্যাঁ, খুব পারসোনাল হবার আগে অনেক ধাপ পেরোতে হয়।" হাতে হাত রাখলেন মেয়ের সুমনা।
"মা, তুমি বিশ্বাস করো, আমি কোনো ছবি পাঠাইনি। শুধু অষ্টমীর দিনে অঞ্জলি দিতে গিয়ে ওই সকালবেলার ছবিটা পাঠিয়েছিলাম। আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে ভালবাসে। এরকম বলবে কিভাবে বুঝব?"
"শোন মামণি, রণ যেটা করছে সেটা অন্যায়। তোর কাছে ওর বলা এই কথাগুলোর কোনো চ্যাটের রেকর্ড আছে?"
"মানেহ্যাঁ, দু একটা কথার আছেযে আমার ছবি বলে ছড়িয়ে দেবে, পাড়ায় বদনাম করে দেবে, এইসব।" কাঁপতে কাঁপতে বলে মিমি।
"বেশ। তুই রেডি হ। আমিও হচ্ছি। থানায় যাই চল। সাইবার ক্রাইম অনুযায়ী এগুলো সব ঘৃন্য অপরাধ। আমরা অভিযোগ জানাব।"
"কিন্তু মাসবাই জেনে গেলে কি হবে?"
"তা বলে অন্যায়টা মেনে নেব? চুপ করে থাকব? কভি নেহি! আর সবাই যদি এরকম কোনো ছবিকে ভেবে নেয় সেটা তোর ছবিতাহলে সেই মানুষগুলো কি আদৌ আমাদের কাছে ম্যাটার করে? এভাবে কেউ ছবি দেখালে তো প্রথমেই সেই ছেলেটিকেই ভুল বোঝা উচিত। পারসোনাল স্পেস কে,,ব্যক্তিগত আধারকে পাবলিক করা কারা? ছিঃ!" রাগে গা জ্বলছ সুমনার।
মিমিও অবাক হয়ে দেখছে মা কে আজ।
তার শান্তশিষ্ট মায়ের মধ্যে যেন অন্য এক রূপ!
"মা, থানায় যাব? ভয় লাগছে।"
"ভয়ের কিচ্ছু নেই, ওঁরা সাহায্য করবেন নিশ্চয়ই। তুই যদি অন্যায় না করিস তবে দোষী সাজা পাবেই। আর হ্যাঁনাড়ু খেয়ে জল টা খা।"
"তুমি তো শান্ত মানুষ মাএত জেদ কিভাবে এলো?" মা কে নতুন রূপে দেখছে আজ মিমি।
একটু হাসলেন সুমনা। তারপর বললেন "দশভূজা মা যেমন মহিষাসুরকে বধ করেন, তেমনি বরাভয় প্রদান করেন। তিনি যেমন লক্ষ্মী, তেমনি কালের অধিকারিণী, কালী! আর আমি তো মা দুর্গার অংশ, সব মেয়েদের মতো! তাই আমিও পারবচল এখন…"
মা - মেয়ে বেরিয়ে গেল একটু পরেই থানার উদ্দেশ্যে।
নজর করে দেখলে বুঝতে পারত বরাভয়দাত্রী মা লক্ষ্মীর মুখে তখন অনাবিল হাসি। শক্তি আর সাহসের প্রতিচ্ছবি যে উনিও

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
আপেক্ষিক

 
আজ খুব, খুব ক্লান্ত লাগছে তিস্তার। অবশ্য ক্লান্তির কি দোষ? বয়স তো বাড়ছে? তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ওজন, পায়ে ব্যথা, ব্যাক পেইন! মাঝে মাঝে এত্ত বিরক্ত লাগে! আজ তো অত রোদের মধ্যে সকালে অফিসে পৌঁছে একটু জল খাচ্ছে, বোতলের ঢাকনাটা পড়ে গেল নীচে। চেয়ারে বসা অবস্থাতে নিচু হয়ে সেটা তুলতে গিয়ে কোমরে লাগল। ছোট্ট জিনিস, কিন্তু ব্যথা ছিল যথেষ্ট। তাই ব্যাগ থেকে ব্যথা কমার স্প্রে টা বের করে লাগাচ্ছিল, ঝাঁঝালো গন্ধ পেয়ে অণিমেষদা ওর দিকে তাকালেন, আর কিছু না জেনে, না শুনেই বলে উঠলেন "আবার লাগল নাকি? উফ! পারো বটে! ওজন কমাও, এই বয়সেই এই অবস্থা, পরে যে কি হবে!"
হ্যাঁ, তিস্তা জানে ওর সেডেন্টারি জীবনযাত্রা, খাওয়ার অনিয়ম, পি সি ডি - সবমিলিয়ে ওর ওজন বেড়ে গেছে অনেকটাই। তাই বলে এই ভাবে লোকে বলবে? খুব রাগ হয়েছিল ওর।
সারাদিন ধরে চলতে চলতে সেই রাগটাই বিরক্তিতে পরিণত হয়ে গেল।
ওদের সি ফার্মে একটা মেইল পাঠানোর ছিল, পাঠিয়ে দেখে, ফাইলটা অ্যাটাচ করতে ভুলে গেছে! আবার 'প্লিজ ইগনোর দ্যা প্রিভিয়াস মেইল' পাঠালেও শর্মা ম্যামের কাছে ঝাড় খেতে হল। তারপর অফিস থেকে বেরিয়ে মনে পড়ল জলের মেশিনটা খারাপ হয়ে আছে, কেনা মিনারেল ওয়াটার খেতে হচ্ছে, তবু একবার হেল্পলাইনে ফোন করা হল না আজও। অথচ একটা ফোন করার মতোও কি সময় ছিল না? ইডিয়ট একটা !
তবু ভাল, আজ বাসে বসার সিট পাওয়া গেছিল কসবা থেকে। বাসে বসে জলের বোতল বের করে এক ঢোঁক জল খেল তিস্তা। উফ, শান্তি! বাড়ির স্টপেজ আসতে এখনও আধ ঘন্টা, একটু ফেসবুকটা খোলা যাক।
ফেসবুক খুলে একটু স্ক্রল করতে করতেই বুঝতে পারল আসলে কি! সেইজন্যই সবকিছু শুধু আজ নাএত দিন ধরে উল্টোপাল্টা!
বাড়ির স্টপেজে নেমে চোখের জল যেন বাঁধ মানছিল না। বাসে কোনোরকমে আটকেছে, এত লোকের সামনে চোখে জল এলে কী বিচ্ছিরি ব্যাপার হতো! কিন্তু এখন তো অনর্গল হতে পারে!
আজ যেন পা চলছিলই না তিস্তার। বাড়িতেই বা এত তাড়াতাড়ি যাবার কী আছে! তারচেয়ে বাড়ির কাছেই পুকুরপাড়ে একটা ছোট্ট পার্ক মতো হয়েছে। দু'চারটে লোহার বেঞ্চ, একটা করে স্লিপ আর দোলনা, বাচ্চাদের জন্য। ভালোই লাগে।
একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল তিস্তা। ব্যাগটা তো ভারী ছিলই, জলের বোতল থাকে। বৃষ্টির কোনো স্থিরতা নেই বলে ছাতা থাকে। টিফিনবাক্স থাকে। আজ আবার বাজারও করতে হয়েছে। অনেকগুলো মুখ অপেক্ষায় থাকে। তাই হাতের ব্যাগও ভারী হয়েছে বেশ। পাশে নামিয়ে রেখে আরাম লাগছিল তিস্তার।
কদিন আগেই কোজাগরী পূর্ণিমা গেছে। আকাশে বেশ বড় চাঁদ আজ। বেশ লাগছে দেখতে।
তন্ময় হয়ে চাঁদ দেখছিল তিস্তা, হঠাৎ কানে এলো "আজ আকাশটা কী সুন্দর তাই না?"
একটু চমকে গেল ও। তাকিয়ে দেখে একটি ছায়ামূর্তি। "হুম" বলে ও।
"আচ্ছা, আপনার কি মনখারাপ কোনো কারণে?"
"আমার? না তো?"
"আহা, বলুন না!"
"আশ্চর্য তো! আপনি কে? আর আপনার সাথে কথাই বা বলব কেন?"
"বলবেন না বা কেন? আচ্ছা, আমাকে চেনেন না বলে? আমার নাম বিবেক। বাবা স্বামীজির ভক্ত ছিলেন, তাই এই নাম। এবার বলুন দেখি ম্যাডাম, মন খারাপ, আপনার?"
ইচ্ছে ছিল না কথা বলার। তাও বাড়ি যেতেও ইচ্ছে করছে না। আরবিবেকবাবুর গা থেকে বেশ সুন্দর একটা গন্ধ ভেসে আসছে। ভিক্স, ধুনো আর সিন্থল সাবান মেশানো গন্ধ যেন!
"একটু মনখারাপ। কিন্তু সে ঠিক আছে।"
"কেন মনখারাপ, বলা যাবে? দেখুন, ওই সুন্দর চাঁদের দিব্যি, আমি আপনাকে 'জাজ' করব না। ভাবব না যে আপনি খারাপ, আপনি ঠিক না…"
" আপনিও বুঝে গেছেন, তাই না?" একেই অপরিচিত মানুষ,,তারপরে খারাপ টারাপ বলছে ঘুরিয়ে
"কি বুঝে গেছি বলুন তো?"
"যে আজ আমার দিন।"
"আপনার দিন মানে? জন্মদিন নাকি? আরে, হ্যাপ.."
"না না, জন্মদিন না। আজ তো ১৩ অক্টোবর, ফেসবুকে দেখলাম আজ নাকি 'ইন্টারন্যাশনাল ফেইলিওরস ডে' সব ব্যর্থ, হেরে যাওয়া মানুষদের দিন।"
"ওমা, তাই নাকি! নতুন তথ্য তো! তা, আপনার দিন কেন বলছেন বলুন তো? কমবেশি আমরা সবাই তো ফেইলিওর, তাই না?"
"অন্যের কথা জানি না। আমি তো বটেই।" ফাঁকা গলায় বলে ওঠে তিস্তা।
"কেন বলছেন বলুন তো? নিজেকে ফেইলিওর ভাবার কারণ কি?"
"অনেক কারণ আছে।"
"যেমন? একটু এক্সপ্লেইন করুন! দেখুন আমি আপনাকে চিনি না, তাই অসুবিধা নেই।"
"হুম! এত কথা কেন আপনাকে বলছি জানি না। আসলেআমার কথা শোনার মতো কেউ নেই, জানেন?"
"কেউ নেই?"
"না, ডিভোর্স হয়ে গেছে, শুধু মা আর আমি থাকি। কে আর আমার মনের কথাসব শুনবে। মায়ের বয়স হয়েছে, এমনিতেই আমার জন্য কষ্টে থাকেন, আর নতুন করে বোঝা বাড়াতে চাই না। তাই মায়ের কাছে এমন ভান করি যেন খুব ভাল আছি। আর অফিসে কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকি। তাহলে আর কাকে বলব?"
"হুম! ডিভোর্স হয়ে গেছে আপনার?"
"হ্যাঁ, ধরে রাখতে পারলাম না যে তাকে। তলে তলে সে অন্যান্য মেয়েদের সাথে সম্পর্ক রেখেছিল। জানেন, বেশিরভাগ আত্মীয় আমার দোষ দিয়েছিল। আমি নাকি মোটা হয়ে গেছি বলে পরনারী আসক্ত হয়েছিল। আচ্ছা, ওর যে চুল উঠে উঠে মাথার সামনে টাক, গায়ে বনমানুষের মতো লোম ছিলকথা বলার কায়দা ভাল ছিল নাআমিও কি পারতাম না অন্যকিছু ভাবতে?"
"তাই তো।"
"তবু ভাল, চাকরি করতাম, নইলে যে কি হতো! ওই অ্যালিমনির জন্য টাকা নেওয়া - না না সে সম্ভব হতো না আমার।"
" আপনি চাকরি করেন? স্যরি, আপনার ব্যাগ গুলো দেখেই আমার বোঝা উচিত ছিল।"
"করি ঠিকই,,তবে তেমন ভাল কিছু না। একটা মনের মতো চাকরিও পাইনি। ছোট কোম্পানিতে কেরানিগিরি করেই কাটিয়ে দিলাম।এখানেও আমি ফেইলিওর, জানেন। বসদের 'বাটারিং' করতে পারি না, তাই মাইনেও সেভাবে বাড়ে না।"
"হুম, বুঝলাম। এইসব কারণেই আপনি ব্যর্থ, তাই তো? নাকি আরও কারণ আছে?"
"এতেও হব না? আরও চাই?" রাগ হচ্ছে আবার হাসিও পাচ্ছে তিস্তার। আরও চাই কারণ!
"না না, এই যথেষ্ট। তা, ম্যাডাম, এই ব্যাগটা তো বেশ ভারী মনে হচ্ছে। বাজার করে ফিরছেন নাকি?"
"হ্যাঁ, ওই একটু।"
"এটা একটু!"

Like Reply




Users browsing this thread: 7 Guest(s)