Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
একটা ব্যক্তিগত কাজে গত সপ্তাহে ব্যান্ডেল স্টেশনে বসে ছিলাম দুপুরবেলা। ট্রেনের খবর হতেই হেলতে দুলতে গিয়ে ট্রেনে উঠলাম। দুপুরবেলার ডাউন ট্রেন। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বেশ ফাঁকা। পুরো কম্পার্টমেন্ট জুড়ে আমি; আর দুজন মাঝবয়সী ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোক। খুব সম্ভবত তারা একই ফ্যামিলির। চুপ করে জানলা দিয়ে বাইরে দেখছি। ট্রেন হুগলি ঢুকতে একটি স্বল্প বয়স্কা এবং স্বল্পবসনা তরুণী উঠলো ট্রেনে। কানে ইয়া গাবদা একটা মাথাজোড়া হেডফোন; চোখে মার গঙ্গা ঝিলিক ঝিলিক সানগ্লাস; পরনে টি'শার্ট-শর্টস আর টি'শার্টের বুকে লেখা- "Hi! I am dangerous."
মনে মনে ভাবলাম- খারাপ কিছু লেখা নেই।
এবার আমাদের মতো কিছু কিছু মানুষের যেমন মুরগির লেগ পিস; পাঁঠার লেগ পিস পছন্দ হয়! আমরা তা নিয়ে ফ্যাসানাইজেশন করি.. ঠিক তেমনি কিছু কিছু মানুষের মহিলাদের 'লেগ পিস' বড় পছন্দের। তারা তা দেখেই দিন গুজরান করে। কখনো বেশি ফ্যাসনাইজেশন করে ফেললে অল্প আধটু; ছোট খাটো রেপ-টেপ হয়! অবশ্য তাদের দোষ কি? মেয়েরা অভাবে লেগ পিস দেখাবেই বা কেন? এই যদি কেএফসি'র মালিকের কাছে গিয়ে কোনো মুরগি নিজের লেগ পিস দেখায়! সে কি আর বেঁচে ফিরবে? এই জন্যেই বলে মেয়েদের কমন সেন্স কম। বিশেষ করে আমাদের জেনারেশনের। তো পাশের কাকু মেয়েটির পা জেরক্স করতে ব্যস্ত! ঠিক সেই সময় চন্দননগর থেকে উঠলো এক কমলা-কালো লজেন্স বিক্রেতা দাদু। পরনে আধ ময়লা সাদা জামা; নিচে আধ ময়লা ধুতি। পায়ে একটা শতচ্ছিন্ন হাওয়াই চপ্পল। দাদু উঠতে গিয়েই গেটের সামনে রাখা কিছু ঝুড়ির সাথে ধাক্কা খেয়ে লজেন্সের প্যাকেট'টা হাত থেকে ছিটকে গিয়ে সব পড়ে একাকার অবস্থা। নিজেই কুড়োলেন সব; দিয়ে 'আই লজেন, আই লজেন' করতে করতে ওপার থেকে ঘুরে আমাদের দিক'টা এসে বসলেন।
দাদুর পায়ের দিকে চোখ পড়তে চমকে উঠলাম! সাদা হাওয়াই চপ্পল'টা রক্তে ভিজে পুরো লাল! দাদু নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে; চটি'টা খোলবার চেষ্টা করছেন। আমি আর থাকতে পারিনি। পকেটে রুমাল ছিল; ব্যাগ থেকে জলের বোতল'টা বের করে সোজা দাদুর পায়ের কাছে বসে গেছি; ট্রেনের তলাতেই! দাদু অপ্রস্তুতে। মুখে খালি বলছেন- "আমায় দাও। আমায় দাও। বাবা তুমি বসো। পায়ে হাত দিও না।" দেখলাম শীর্ণ পায়ের দুটো আঙুলের মাঝে চামড়া'টা 'হাঁ' হয়ে আছে। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে.. বেরিয়েই যাচ্ছে!
ঠিক সেই সময় পিছন থেকে অবাক করা মেয়েলি কণ্ঠস্বর- "দাদা! তুমি রুমাল দিয়ে চেপে রাখো। আমার ব্যাগে ব্যান্ড এইড থাকে। বার করছি। একটু চেপে রাখো।" আমি একবার মেয়েটা'কে দেখলাম; একবার দাদু'কে। পাশের যে মাঝ বয়সী লোকটি এতক্ষন বুভুক্ষু আরশোলার মতো মুখ করে মেয়েটির পা প্রদক্ষিণ করছিল সূর্যের মতো; তিনিই প্রেগন্যান্ট তিমির মতো মুখটা করে বললেন- "বয়স হয়েছে। এখনো ট্রেনে ট্রেনে ঘুরে বেড়াও কেন। চোখের মাথাটা তো এক্কেবারে খেয়েছো।"
খিস্তি আমি দি না। তখনও তাই মুখ দিয়ে বেরোয় নি।
মেয়েটি ব্যাগ ওল-ঢাল করে তিনখানা ব্যান্ড এইড খুঁজে আমার পাশেই বসে পড়লো নোংরা ট্রেনের তলায়! সেই ভদ্রলোক এবার মজা পেয়েছেন! যতই হোক শর্টস পরা মেয়ে বসলে কি লোভনীয় দেখতে লাগে বলুন দিকি? এই লোভ যদি আপনার না থাকে; আপনি মাইরি পুরুষই নন! তো আমি দাদুর দুটো আঙ্গুল ধরেছি; মেয়েটি জল দিয়ে ধুচ্ছে। ধুয়ে ক্রস করে ব্যান্ড এইড লাগাচ্ছে। পরপর তিনটে। বেশ বুঝতে পারছি শরীরের জোর না থাকায় দাদু একটু একটু কাঁপছেন। আমার ব্যাগে কোনো খাবার ছিল না। এ'দিকে দাদু নামবেন বেলুড়। এই অবস্থায় নামবেন কি করে? মেয়েটি ব্যাগ থেকে একটা কেক বার করে দাদু'কে দিল। দাদুও খাবে না; মেয়েটিও ছাড়বে না। বেলুড় আসতে আমি দাদু'কে ধরে গেটের সামনে নিয়ে গেলাম। জিগ্গেস করলাম- "স্টেশন থেকে কদ্দুর যাবে জেঠু?" দাদুর একগাল হেসে উত্তর- "এই পাশেই। অন্যদিন হেঁটে যাই। আজ টোটো করে নেব। তোমরা না থাকলে না.. লজেন খাবে? একটা খাও?" মেয়েটি শুনেই পাশ থেকে- "দাদা। আপনি নামবেন না। আমার লিলুয়ায় বাড়ি। আমি দাদুকে বেলুড়ে নেমে টোটো করে দিয়ে পরের ট্রেন ধরে নেব।"
দাদু হাঁ হাঁ করে উঠল- "না না। শোনো; আমি এবার পারবো। তোমরা আর কষ্ট করো না।"
মেয়েটি শুনলে তো?
বেলুড় স্টেশন যখন ট্রেনটা ছাড়ছে..
পরিষ্কার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি- একটা জেনারেশন 'Z'; আর একটা প্রায় ভেঙে পড়া বিস্মৃত হতে চলা জেনারেশনের হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে; খুব আস্তে আস্তে।
যেন "আমি আছি তো! আমায় ভরসা করো একটু। তোমার কিচ্ছু হবে না" গোছের ঠেকনা দেওয়া ভালোবাসা; জড়িয়ে ধরা শ্রদ্ধা; নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
আমরা আজকালকার জেনারেশন'কে বড্ড শেখাই জানেন তো? অহেতুক তাদের খরচের খাতায় ফেলে দি; অহেতুক।
তারা যে কিছুই পারে না তা নয়; তারা 'গুড ফর নাথিং' নয়..
তারা 'বেস্ট ফর এভরিথিং'। তারা সব পারেনা; কিন্তু যেটা পারে সেটা মন দিয়ে পারে। স্বার্থত্যাগ করে পারে।
আজও বাসে অসুস্থ বোধ করলে এই জেনারেশন'ই জায়গা ছেড়ে দেবে।
আজও এই জেনারেশনের তৈরি করা মিম দেখেই আপনি হো হো করে হাসবেন।
আজও ফেসবুকে আপনি মন খারাপের কথা লিখলে; এই জেনারেশনের কেউ এসেই জিজ্ঞেস করবে- "কি হয়েছে দি?"
সেক্স চ্যাট; দু-চার লাইন সাহিত্য লিখে ইনবক্সে মেয়েদের খোঁচানো; বডি শেমিং- এসবের বাইরেও কিন্তু একটা জেনারেশন তৈরি হয়ে আসছে...
সবসময়েই কি সবকিছু খুঁজে পেতে গেলে একজোড়া চোখ লাগে? একটা মনও লাগে; অল্প বিবেক লাগে।
তাই না?
" ধন্য তোমার স্বার্থপরতা, ব্যস্ত তুমি তোমাকে ঘিরেই;
নাম না জানা 'তুমি' গল্পে; পার্শ্বচরিত্র আমি অগোচরেই। "
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
প্রায় এক বছরের বেশি হয়ে গেছে , কি জানি কি মাথায় ভূত চেপেছিল একদিন এই থ্রেড খুলেছিলাম , আমার প্রথম ...
কে তখন জানতো যে একদিন কত বিশাল বিশাল মহারথী আর নতুন যুগের লেখকেরা এসে এখানে আড্ডা মারবে আর তাদের লেখা পাঠাবে ... ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না , ভালোবাসা রইলো সবার জন্য ..
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
Posts: 446
Threads: 3
Likes Received: 11,694 in 2,466 posts
Likes Given: 4,988
Joined: Jan 2019
Reputation:
2,925
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,072 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,734
(16-11-2021, 11:26 PM)ddey333 Wrote: প্রায় এক বছরের বেশি হয়ে গেছে , কি জানি কি মাথায় ভূত চেপেছিল একদিন এই থ্রেড খুলেছিলাম , আমার প্রথম ...
কে তখন জানতো যে একদিন কত বিশাল বিশাল মহারথী আর নতুন যুগের লেখকেরা এসে এখানে আড্ডা মারবে আর তাদের লেখা পাঠাবে ... ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবো না , ভালোবাসা রইলো সবার জন্য ..
এই লেখার অর্থ কি? তুমিও কি কাটার মতলব করছো নাকি দাদা?
আমি বুঝছি যে তোমার মতো মানুষের এতো চেষ্টা করে সংগ্রহ করা গল্পের মূল্য বেশিরভাগ মানুষ দিচ্ছেনা, অনেকেই ফ্রিতে পড়ে কেটে পড়ে. এসব সংগ্রহ করা হাতের মোয়া নয় সেটা আমি বুঝি. আর সেই চেষ্টার দাম না পেলে কেমন লাগে সেটাও বুঝি.
তাহলে একবার ভাবতো.... এতো কষ্ট করে আমি মাথা খাটিয়ে নন-ইরোটিক গুলো লিখি.... তোমরা কয়েকজন বাদে আর কজন মন্তব্য করে? তাও কি আমি থেমে গেছি? কেন সময় দিয়ে নতুন আইডিয়া ভাবি?
তুমিই না আমায় বলেছিলে আমি ছোট গল্পের স্পেশালিস্ট? আমিও যদি এটা ভাবতাম ধুর দু চারজন ছাড়া কেউ মন্তব্য করেনা তাহলে কেন লিখবো তাহলে সময় নষ্ট করে? তাহলে বুম্বাদা, বিচিত্র, তুমি, জুপিটার দা, সঞ্জয় বাবু এই নতুন গপ্পো গুলো পেতে? ফান্টু বাবু, পিনুদা বৌর্সেস দাও আর আসেনা.... কত চেনা পাঠক কমে গেছে আমার... তাও তো লিখছি. তোমাদের কজনের জন্যই. তাই বলছি তুমি ছেড়ে যাবার কথা ভেবোনা. দরকার হলে সময় নাও..... শুধু পাঠক হয়ে কিছুদিন থাকো... কিন্তু বিদায় জানিনা যেন ❤
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
#হিসেব_না_মেলা_অঙ্ক( নতুন গল্প)
#অর্পিতা_সরকার
মা শুনেছো আল্পনা কাকিমা তো মারা গেছে! আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনে এলাম। আমায় অনুপমদা বললো। ওরা বোধহয় কাল রাতে বুকে ব্যথা ওঠায় নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল, স্ট্রোক নাকি কে জানে? মা অনুপমদা এখন কোথায় খাবে?
হাতের কাজ সারতে সারতে রেবতী বললো, তুই হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস টুয়া। আল্পনাকে এনেছে নাকি বাড়িতে?
অনুপমের ওপরে সব দায়িত্ব পড়বে। তোর থেকে বছর খানেকের তো বড়। কথাটা বলতে বলতেই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো রেবতী। সারাটা জীবন মানুষের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখতে দেখতে ইদানিং আর অবাক হয় না। ওটির নার্স হওয়ার সুবাদে জন্ম আর মৃত্যুকে পাল্লা দিয়ে উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন ভগবান। তাই জন্মের সময় যেমন সদ্যোজাতের চিল-চিৎকারের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চারে নরম হাসি ফোটে ঠোঁটে তেমনই অনেকক্ষণ লড়াই করার পরে যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দৃশ্যটা দেখে রেবতী তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ইদানিং আর কিছুই হয় না। হতো এককালে। যখন মাত্র চব্বিশ বছরে হসপিটালে ঢুকেছিলো নার্স হিসাবে তখন কারোর মৃত্যু দেখলেই কেঁদে ফেলতো ও। মনের মত চোখের ভিতরের শিরাগুলোও তখন ছিল বড্ড স্পর্শকাতর।
টুয়া খেতে খেতেই বললো, জানো মা সুদীপকাকু পরশু রাতেও মদ খেয়ে এসে চেঁচাচ্ছিলো। আল্পনা কাকিমা তাড়াতাড়ি ওদের বাড়ির দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিল। যাতে বাইরে আওয়াজ না বেরোয়। কেন মা? আল্পনা কাকিমা কেন এত কষ্ট সহ্য করে ছিলো?
সুদীপকাকুর অসভ্যতামি লোককে লুকিয়ে কি লাভ হতো? রেবতী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের ঘরের আওয়াজ অনেকে বাড়ির বাইরে চর্চা করতে পছন্দ করে না রে। সবাই তো আর পা ছড়িয়ে নিজের দুর্দশার কথা লোককে বলে বেড়াতে পারে না! আল্পনাও চাইত না, পাড়ার লোক ওদের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে অভাবের কারণটাও জানুক। টুয়া বলল, মা আল্পনা কাকিমার সেলাই করে রোজগার করা সব টাকায় সুদীপকাকু মদ খেতো জানো?
রেবতী কাজ সারতে সারতে বলল, জানি। আল্পনা মরেছে বেঁচে গেছে। কিছু কিছু জীবন বয়ে চলা বড্ড কষ্টকর। মুক্তি পেয়েছে।
সন্ধের দিকে সৈকত অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই রেবতী বললো, সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী মারা গেছে জানো তো?
সৈকত ক্লান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ শুনলাম অনুপমের মা মারা গেছে। ওদের বাড়ির সামনে জটলা রয়েছে।
রেবতী বলল, তুমি খেয়ে রেস্ট নিয়ে নাও। যাবে তো শ্মশানে নাকি?
সৈকত একটু ইতস্তত করে বলল, আমি? আমি কেন যাবো? আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। তাই শ্মশানে যাবো না ভাবছি। অনুপমের বন্ধুরা, পাড়ার ছেলেরা সব এসেছে তো।
রেবতী ফোনে কাউকে বলছিলো, নীলিমা আজ নাইট ডিউটিটা একটু ম্যানেজ করে নেবে গো? আজ আমার পাড়ায় একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। তাই যেতে পারবো না ডিউটিতে।
সৈকত নিজের মনেই হাসলো। মনে পড়ে গেলো আগেকার একটা কথা। যখন এই রেবতীই সৈকতকে বলেছিলো আল্পনাদের গলির রাস্তাটা না ধরে ও যেন প্রাইমারি কলেজের পাশের রাস্তাটা ধরে যায়।
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর ধরে আল্পনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে যায় না সৈকত। হাজার তাড়াহুড়ো থাকলেও নয়।
আজ মোড়ের মাথায় আসতেই চায়ের দোকানের শিবু জানালো, দাদা তোমাদের পাড়ার সুদীপ মিস্ত্রির বউটা মারা গেছে তো দুপুরবেলা। নার্সিংহোমে না হসপিটালে জানি না। তবে শুনলাম সুদীপ মানে ওর মাতাল বরটা নাকি খুব কাঁদছিলো। সৈকত শুধু অস্ফুটে বলেছিল, ওর নাম আল্পনা, আল্পনা শীল।
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর পরে আল্পনাদের বাড়ির গেটের সামনে একটুখানি দাঁড়িয়ে ছিলো সৈকত। ভিতরে ঢোকেনি অবশ্য।
রেবতী বিয়ের চারমাসের মধ্যেই বলেছিল, সৈকত আমার একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আমি তোমার মায়ের দেখাশোনা করি। তোমার সবকিছু করে দিই, এর বিনিময়েই ধরো একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও সৈকত এই কয়েকমাসে বেশ বুঝেছিল রেবতী অত্যন্ত শান্ত ভদ্র মেয়ে। চাঁদ চাইবে না এটুকু বুঝেই নির্দ্বিধায় কথা দিয়েছিল, হ্যাঁ রাখবো।
রেবতী সুন্দরী শিক্ষিতা, চাকুরীরতা মেয়ে। অত্যন্ত শিক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছে। কথা বলার ভঙ্গিমাটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রেবতী দৃঢ় অথচ অনুনয়ের ভঙ্গিমায় বলেছিল, তুমি সুদীপ মিস্ত্রীদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে অফিস যেও না আজ থেকে। প্রাইমারি কলেজের সামনে রাস্তা দিয়ে স্টেশন চলে যেও। হয়তো মিনিট দুয়েক ঘুরপথ হবে। সে হোক, ওখান দিয়েই যেও।
সৈকত অবাক হয়ে বলেছিল, কারণটা জানতে পারি?
রেবতী অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, শুনেছি ওর স্ত্রী নাকি দুশ্চরিত্রা। আল্পনার নাকি স্বভাব খারাপ। আমি চাই না, তুমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাও। সৈকত নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আমার স্বভাব তো খারাপ নয় রেবতী, তাহলে?
রেবতী হেসে বলেছিল, তুমি কথা দিয়েছিলে রাখবে। যদি না রাখো তাহলে জোর করবো না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়েছিল রেবতী। আর কখনও কিছু বলেনি, এদিকে সৈকতও রেবতীর কথা মত নিজের রাস্তা পাল্টে নিয়েছিল।
আল্পনার ছেলে হয়েছে শুনেছিলো রেবতীর মুখেই। টুয়ার থেকে বছর খানেকের বড় হবে অনুপম। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে রাস্তার মোড়ে দেখেওছে সুদীপের সঙ্গে।
সুদীপের হাতের কাঠের কাজ দেখার মত। মোড়ের মাথায় চালু দোকান ছিল ফার্নিচারের। বিয়ের অর্ডার পেতো খুব। সুদীপ এমনিতে ছেলে খারাপ ছিল না, কিন্তু অল্প বয়েস থেকে মদের নেশায় পড়ে টাকা পয়সা পকেটে টিকতো না মোটেও।
ছেলেটার মুখটা আল্পনা বসানো ছিল। ছেলেটা লেখাপড়া তেও খুব ভালো শুনেছে লোকমুখে।
সৈকতের মা যতদিন বেঁচেছিলো ততদিন পর্যন্ত এ বাড়ির সমস্ত কিছু মায়ের নির্দেশ মতোই হতো।
রেবতীকে হসপিটাল থেকে ফিরে শুধু স্নান করলেই চলতো না, গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো। নাহলেই মা অশান্তির চূড়ান্ত করতো।
নীচু জাত, ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল মায়ের মারাত্মক। মা মারা যেতে সংসারের হাল ধরেছিল রেবতী। তখন টুয়ার বয়েস বছর ছয়েক।
তখনই একদিন অফিস বেরোনোর আগে দেখেছিলো, টুয়া আর অনুপম ওদের উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলছে। আর রেবতী রান্নাঘর থেকে হাঁক পারছে, তোদের দুটোকে কি কান ধরে টেনে আনতে হবে ...নাকি এসে জলখাবার খাবি?
আল্পনার বাড়ির রাস্তায় যাওয়া নিষেধ ছিল সৈকতের অথচ আল্পনার ছেলেকে এবাড়িতে ডেকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় রেবতী? অদ্ভুত তো। রেবতী অবশ্য সত্যিই বড্ড অদ্ভুত। ওর মুখ দেখে আজ অবধি মনের গভীরের তল খুঁজে পেলো না সৈকত। এক সঙ্গে ছাব্বিশ বছর একই ছাদের নিচে কাটিয়েও ঠিক চিনতে পারলো না রেবতীকে।
অনুপম ছেলেটিকে সৈকতের বেশ ভালো লাগতো। বাবার মত রগচটা নয়। অত্যন্ত ভদ্র, মিশুকে ছেলে। পাড়ার কারোর কিছু প্রয়োজনে দাঁড়াতেও দেখেছে অনুপমকে। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। বাবার ওই চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেই এত ভালো রেজাল্ট করেছে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলো সৈকত। রেবতী যদি কিছু ভাবে বলেই খুব ইচ্ছে থাকলেও অনুপমের হাতে কখনও একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলতে পারেনি, মিষ্টি খেও। আবার যদি রেবতী ভাবে আল্পনার ছেলের সঙ্গে অত গল্প করার দরকার নেই, বড্ড মানে লাগবে সৈকতের। তাই ওই কখনও মুখোমুখি হলে, পড়াশোনা কেমন চলছে... এর বাইরে কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। চোখের সামনে অনুপমকে অভাব অনটন আর নোংরা পরিবেশের মধ্যেই বড় হতে দেখলো সৈকত। টুয়ার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব বলেই হয়তো টুয়া এখনও ওকে দরকারে অদরকারে ডাকে। কিন্তু দুজনেই আর ছোট নেই। টুয়ার কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, অনুপমও থার্ড ইয়ারে পড়ে। এখনও কেন মাঝে মাঝেই অনুপমকে এ বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে সৈকত কে জানে! রেবতীকে একদিন নিজের আশঙ্কার কথা বলেছিলো সৈকত, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে? পাড়া প্রতিবেশী আবার কিছু যদি বলে?
রেবতী অজানার ভান করে বলেছিল ঠিক কি বিষয়ে বলতো? অনুপম আর টুয়ার মেশা নিয়ে? ওরা তো ছোট থেকে বন্ধু। আজ আবার নতুন করে লোকে কি দেখবে? না পাত্তা দেয়নি সৈকতের কথায়। সৈকত মনে মনে ভেবেছিল, তাহলে ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে বারণ করে অপমান শুধু ওকেই করেছে রেবতী!
যদিও এই নিয়ে কথা বলা হয়নি কখনও সৈকতের। এরমধ্যে কারণ একটা অবশ্যই আছে। সেটা অবশ্য রেবতীর জানার কথা নয়।
ইজি চেয়ারে বসে বাঁশিটাতে একবার হাত বোলালো সৈকত। বাজানো হয় না বহুদিন। রেবতী বিয়ের পর উৎসাহের সঙ্গেই বলেছিল, তুমি বাজাতে পারো? তাহলে বাজাও না কেন? বাজাও আমি শুনবো। না ইচ্ছে করেনি সৈকতের। বাঁশি বাজানোর অনুপ্রেরণা রেবতী কোনদিনই হতে পারেনি হয়তো। অথবা সৈকতেরই আর সুর তুলতে ইচ্ছে করেনি। কিছু জিনিস ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কষ্টর সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা তৃপ্তিও কাজ করে। মনে হয় থাকুক না। ঠিক যেমন মা মারা যাবার পরে বারো দিন হবিশ্যি করার সময়। আমিষ ছাড়া যার মুখে ভাত ওঠে না সেই সৈকতের একদিনের জন্যও মাছ-মাংস খেতে ইচ্ছে করেনি। বারবার মনে হচ্ছিল, মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এটুকু ত্যাগস্বীকার করার মধ্যে অনেকটা তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে।
মনে হয় মানুষটা তো অনেক করেছে একদিন আমার জন্য, সে চলে যাবার পরে এটুকু নাহয় করলাম তার জন্য। বাঁশিটাও কি এমনই একটা ত্যাগ সৈকতের কাছে?
রেবতীর গলা শোনা যাচ্ছে। টুয়া, ছুটে গিয়ে একবার অনুপমকে ডেকে নিয়ে আয় তো। না খেয়েই বেরিয়ে গেল নাকি কে জানে? আর আল্পনাকে আনা হলো কিনা দেখে আয়। আমার কয়েকটা কাজ আছে, যেতে হবে আল্পনার বাড়ি।
সৈকত অবাক হয়ে শুনছিলো রেবতীর বলা কথাগুলো। আচমকা রেবতীর এত আল্পনা প্রীতি হলো কেন? মারা গেছে বলে? বেঁচে থাকতে তো তাকে দুশ্চরিত্রা বলতে মুখে বাঁধেনি। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তো বদনাম দিয়ে দিয়েছিল। আল্পনা তো কোনদিনই পাড়ায় চড়ে বেড়ানো মেয়েও ছিল না, গৃহবন্ধি রাখতেই পছন্দ করতো নিজেকে।
তারপরেও তার নামে এমন একটা বদনাম দিয়েছিল রেবতী।
টুয়া এসে খবর দিলো মা, আল্পনা কাকিমাকে নিয়ে এসেছে এই মাত্র। আর অনুপমদা আসছে এখুনি।
সৈকত কানটা খাড়া করে রেখেছে। এই রেবতীকে ও চেনে না। অদ্ভুত রকমের আচরণ করছে রেবতী আজকে। অনুপম আসতেই সৈকত নিজের ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ও পাচ্ছে সবাইকে।
রেবতী খুব অভ্যস্ত ঢঙে বলল, আগে খেতে বস। সারারাত খাওয়া হবে না। অনুপমের মুখটা থমথম করছে। ধরা গলায় বলল, কাকিমা মাকে বাঁচাতে পারলাম না। রেবতী অনুপমের সামনে খাবার ধরে দিয়ে বলল, তোর মা বাঁচতে চায়নি যে। দিনের পর দিন বারণ সত্ত্বেও মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়েছে হতভাগী। তাতেও কি চোখে ঘুম নেমেছিল নাকি? ধীরে ধীরে হার্টে এফেক্ট হলো। শোন, বাবার ওপরে এখন চেঁচাস না। পাঁচটা লোক আছে দেখবে। তাছাড়া তোর মা বাড়ির অশান্তির কথা সবসময় ঢেকে রাখতে চেয়েছিল।
অনুপমের খাওয়া শেষ হবার আগেই রেবতী এদিকওদিক তাকিয়ে ওর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ঘাট খরচ ভালো করে করবি। আমি তোর কাকুকে পাঠাচ্ছি। তোর পাশে থাকবে। অনুপম জল খেতে খেতে বলল, তুমি আর কত দেবে বলতো? আমার পড়ার খরচও তো তুমিই দিয়ে আসছো সেই কবে থেকে। রেবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই আর টুয়া কি আলাদা আমার কাছে? আল্পনা না থাকলে টুয়াকে হয়তো বাঁচাতেই পারতাম না রে। তোর মায়ের কাছে আমার ঋণ কি কিছু কম?
সৈকত চমকে যাচ্ছে রেবতী কথা শুনে। ঋণ? আল্পনা না থাকলে টুয়া বাঁচতো না? অনুপমের পড়াশোনার খরচ রেবতী দেয়? ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে একই বাড়িতে থেকে এত কিছু জানে না ও! আশ্চর্য লাগছে।
অনুপমকে টুয়া বলল, অনুপমদা আমি বিকাশদাকে বলে দিয়েছি রে তোর কাছা কিনে রাখতে। গঙ্গায় স্নান করে ওটা পরতে হয়। টুয়ার দিকে তাকিয়ে অনুপম বলল, তুইও কত বড় হয়ে গেলি।
সৈকত নিজের ঘরে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। এ রহস্যের সমাধান করতে পারছে না কিছুতেই। রেবতী যদি আল্পনাকে ঘৃণাই না করবে তাহলে ঐ পথ দিয়ে ওর যাওয়া-আসা বন্ধ করেছিল কেন?
প্রশ্নগুলো আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
রেবতী ঘরে এসে বিছানায় একটা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর তোয়ালে রেখে বলল, রেডি হয়ে নাও। অনুপমের সঙ্গে শ্মশানে যাবে।
সৈকতের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমনিতেই মনটা ভালো নেই। তারপর রেবতীর এত গোপন তথ্য জেনে মেজাজটাই খিঁচিয়ে গেছে।
একটু গলাটা চড়িয়েই বলল, তোমার কথা মত আমায় চলতে হবে নাকি? আল্পনাদের সঙ্গে যখন এতই ভাব রেখেছিলে তখন আমায় কেন বলেছিলে ও পথ যেন না মাড়াই? মানুষ যে কি করে এত হিপোক্রিট হতে পারে কে জানে!
রেবতী হিমশীতল গলায় বলল, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে যদি এভাবে গলা তুলে কথা বলতে পারতে সৈকত তাহলে আজ মিসেস সৈকত মুখার্জী বোধহয় আল্পনা হতো তাই না। তুমি ওকে আল্পনা নয় বরং সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী বলে ডাকো। আল্পনা ডাকার অধিকার তুমি সেদিন হারিয়ে ফেলেছিলে, যেদিন একটা মেয়ের স্বপ্নকে দু পায়ে থেঁতলে দিয়ে মায়ের কথায় ', মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। তুমি আল্পনা ডাকার অধিকার সেদিন হারিয়ে ফেলেছো যেদিন তোমার সামনে দিয়ে ওর বাবা ওর মতের বিরুদ্ধে মদ্যপ সুদীপের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল আর তুমি ঘরের মধ্যে লাইট নিভিয়ে বসে ছিলে। তাই চিৎকার করে কথা বলো না সৈকত। চিৎকারটা সেদিন করা উচিত ছিল।
সৈকত বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়ে বলেছিল, তুমি কি করে জানলে আমার আর আল্পনার কথা?
রেবতী নরম হেসে বলল, বিয়ের পর পর তুমি বেরিয়ে গেলেই আমি ছাদে উঠতাম জানো। যতদূর তোমায় দেখা যায় দেখবো বলে। সৈকত আনমনে কেমন হাঁটে দেখতে ইচ্ছে করতো তখন। তুমি আস্তে আস্তে দূরে চলে যেতে ছোট হয়ে যেতো তোমার অবয়ব, আমিও চলে যেতাম ডিউটিতে। একদিন দেখলাম, আমি যেমন তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরে হাত জোর করে দুগ্গা দুগ্গা বলি, আরেকজনও গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে। না, তুমি তাকে দেখতে পাও না। কিন্তু সে তোমার উদ্দেশ্যেই ঈশ্বরকে ডাকে। রোজই দেখছিলাম ব্যাপারটা। একদিন তুমিও বেরোলে আমিও প্রায় তোমার পিছু পিছুই গেলাম।
দেখলাম, শ্যামলা রোগা রোগা মিষ্টি মুখের মেয়েটা একটা নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে অগোছালো চুলেই সংসারের যাবতীয় কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে পড়িমরি করে বেরিয়ে এসেছে তোমায় পিছন থেকে এক পলক দেখবে বলে। মেয়েটা বাড়িতে ঢুকতেই তার স্বামী চিৎকার করে বলছে, দুশ্চরিত্রা, লজ্জা করে না তোর। রোজ এ সময় ছুটে কেন দরজায় গিয়ে দাঁড়াস আমি জানি না বুঝি? ওকেই যদি এত ভালোবাসিস তাহলে বিয়ে কেন করেছিলিস আমায়? দু চার ঘা পড়লোও হয়তো পিঠে। মেয়েটা তাড়াতাড়ি দরজা, জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত। সে যে অত্যাচারিত হয় স্বামীর হাতে, এ কথা যেন পাড়ার লোক টের না পায়। আরও দু এক দিন দেখার পরে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওই বাড়িটা কাদের? ওখানে যে বউটা থাকে তার নাম কী?
তোমার মা অত্যন্ত অশ্রদ্ধা আর বিরক্তি মিশিয়ে বলেছিলেন, ওর নাম আল্পনা। অল্পবয়েসে মাকে খেয়েছে। পাশের পাড়ায় বাড়ি ছিল। মরতে এখন এ পাড়ার চোখের সামনে বিয়ে করে এসেছে। বাচাল অসভ্য মেয়ে। চাঁদ ছোঁয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, আমার ছেলের দিকে নজর দিয়েছিল। তারপর দিলাম ওর বাপটাকে বলে। সুদীপ মিস্ত্রির সঙ্গে বিয়ে হলো।
জানো সৈকত খুব ইচ্ছে হয়েছিল মেয়েটার সঙ্গে একদিন পরিচয় করতে। মেয়েটা কি একাই ভালোবেসেছিল নাকি তুমিও....
একদিন গেলাম আল্পনার বাড়িতে। সে তো অবাক। আমায় কোথায় বসাবে ঠিক করতে পারছে না। পারলে মাথায় বসায় যেন। সম্ভ্রমের গলায় বলল, বৌদি আপনি যদি ভেবে থাকেন সৈকতদার দোষ তাহলে ভুল ভাবছেন। আমিই বোকার মত এমন অবাস্তব কল্পনা করেছিলাম। সৈকতদা খুব ভালোমানুষ। অবাক হয়েছিলাম জানো! এমন মেয়েও আছে? নিজের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবার পরেও এমনভাবে তোমার সম্মান রক্ষা করতে ব্যস্ত? ভারী লক্ষ্মীশ্রী মুখ আল্পনার।
আস্তে আস্তে সব জানলাম। তোমাদের প্রেম, তোমার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া, তারপর তোমার মায়ের অমত। ওর বাবাকে ধমকি...পাড়া ছাড়া করার, সব শুনলাম আমি। তোমাদের চৈত্রমাসের মেলা থেকে ও তোমায় একটা বাঁশি কিনে দিয়েছিল। তুমি ভাল বাঁশি বাজাও বলে। আল্পনাই ছিল তোমার একনিষ্ঠ শ্রোতা। কথা বলতে বলতে দু চোখ জলে ভরে গিয়েছিল আল্পনার। তবুও সে হতভাগী বলে কিনা, সৈকতদা নির্দোষ। মায়ের অমতে ও কি করে বিয়ে করবে বলো বৌদি? তাছাড়া তুমিই ওই বাড়ির যোগ্য বউ। আমি তোমায় রোজ দেখি। কী সুন্দরী তুমি, কত শিক্ষিতা, চাকরি করো, তুমি খুব ভালো।
আমি অবাক হয়েছিলাম সৈকত। যে ওর ভালোবাসাকে কেড়ে নিলো, যে ওর স্থান দখল করে নিলো তার প্রতি ওর রাগ নেই। বরং ও আমায় ভালোবেসে দেখে। আল্পনারা শুধু ভালোবাসতে জানে জানো। নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে ভালোবাসতে জানে।
আমি বলেছিলাম, তুমি যে রোজ সৈকত অফিস যাওয়ার সময় বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, তোমার বর তো মারে। কেন যাও?
বোকার মত হেসে বলেছিল, হ্যাঁ ও বলে আমি নাকি দুশ্চরিত্রা। ধুর, সৈকতদা ছাড়া আমি কোনদিন কারোর দিকে তাকালামই না।
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাকে সম্মান দিয়ে ঘরে আনোনি তাকে রোজ রোজ তোমার কারণে মার খেতে দেব না। তাই তোমায় ও পথ দিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি হয়তো ভাবছো আমি নিষ্ঠুর। অভাগীর একপলক দেখার সৌভাগ্যটুকুও কেড়ে নিলাম। কিন্তু কি বলতো সৈকত, এতে সুদীপ মিস্ত্রি ওকে মারত, আর পাড়ার লোকে খারাপ বলতো, লাভ কিছুই হতো না।
কি করে যেন ওই অল্পশিক্ষিতা, অত্যন্ত সাধাসিধে মেয়েটা আমার বন্ধু হয়ে গেলো। অনুপম জন্মানোর আগে আমায় বলছিল, বৌদি আমার খুব ভয় করছে। যদি আমার সন্তান সুদীপের মতোই রগচটা মদ্যপ হয়? আমি বলেছিলাম, ধুর বোকা, মায়ের মত হবে। আমিই ওকে আমার হসপিটালের আউটডোরে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। অনুপম জন্মের সময় আমিই ছিলাম ওটিতে। আল্পনা নয় আমিই অনুপমকে প্রথম ছুঁয়েছি।
সৈকত দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বলল, তুমি যে বললে আল্পনা ছাড়া টুয়াকে বাঁচাতে পারতে না, কেন?
রেবতী ধরা গলায় বলল, মনে আছে টুয়া জন্মাবার পরেই জন্ডিস হয়েছিল। অথচ আমার ব্রেস্টমিল্ক ছিল না। তখন টানা দু মাস আমি ডিউটিতে যাবার সময় আল্পনার কাছে টুয়াকে দিয়ে যেতাম। ওই বুকের দুধ খাইয়ে টুয়াকে বড় করেছে। অনুপম যে বছর দুয়েক পর্যন্ত ব্রেস্টমিল্ক খেয়েছিল, তাই টুয়াকে খাওয়াতে ওর অসুবিধা হয়নি।
দুদিন ফল, দুধ কিনে দিয়েছিলাম বলে বলেছিল, বৌদি বুকের দুধের দাম দিও না এভাবে, নিতে পারবো না। তোমার মা জানতেন আমি টুয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সুদীপ মিস্ত্রি একটু ভয় পেতো আমায়। আমি বলেছিলাম, আর যদি কখনও আল্পনাকে মারতে দেখেছি তাহলে পুলিশে খবর দেব। তারপর থেকেই মারের মাত্রা কমেছিলো।
টুয়া আর অনুপমকে ঘিরে আমাদের অনেক কথা হতো। আল্পনা বলেছিল, ওরা যেন দুই ভাইবোন। আমিই অনুপমের লেখাপড়ার ভার নিয়েছিলাম।
দেরি হচ্ছে সৈকত, রেডি হয়ে নাও। একসঙ্গেই যাবো আল্পনাদের বাড়ি।
সৈকত রেবতীর হাত দুটো ধরে বলল, সময়ে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারিনি গো। আমার জন্যই হয়তো আল্পনাকে আজীবন এত কষ্ট পেতে হলো। তাড়াহুড়ো করে ওর বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো সুদীপের সঙ্গে। আল্পনা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর ওর বাবাটাই আর পড়ালো না।
রেবতী বলল, আল্পনার অনেক গুন ছিল জানো। সে ভালো রান্না করতে পারতো। সে ভালো সেলাই জানতো। সব থেকে বড় গুন ছিল, ও কখনও কারোর নিন্দে করতে জানতো না। যেন পৃথিবীর সবাই ভালো ছিলো ওর চোখে। সৈকত, আল্পনার মত মেয়েরা নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে পারে। অনুপম হয়েছে মায়ের মতোই ধৈর্য্যশীল ছেলে। এত কম বয়েসের ছেলে যে এত দায়িত্ববান ভাবা যায় না।
বেরোনোর আগে আলমারি খুলে একটা গোলাপি রঙের নতুন শাড়ি বের করলো রেবতী।
সৈকত বলল, এটা কি?
রেবতী হেসে বলল, তোমার গোলাপি রং পছন্দ ছিল বলে বাবার কাছে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি কেনার জন্য বায়না করেছিল ও। ওর বাবা রেগে গিয়ে পিঠে খুন্তি দিয়ে মেরেছিলো জানো। সে দাগ এখনও ছিল। হেসে বলেছিল, এটা বায়না করার দাগ। মেয়েটার যেন অদ্ভুত এক শক্তি ছিল। সব সহ্য করার শক্তি। নিজেকে ক্ষয় করে হাসি মুখে থাকার শক্তি।
এটা আজ পরিয়ে দেব ওকে।
আল্পনা ঘুমাচ্ছে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রায় বছর ছাব্বিশ, সাতাশ পরে আবার ওকে দেখলো সৈকত। এত রোগা হয়ে গিয়েছিল?
মেলা থেকে বাঁশিটা কিনে এনে বলেছিল, এই নাও সৈকতদা তুমি বাজাবে। কেউ যদি না শোনে আমি শুনবো। তুমি একদন সন্ধেবেলা তোমাদের ছাদে বাজাচ্ছিলে আমি শুনেছি।
সৈকতকে দেখলেই লজ্জা পেতো ও। সৈকত বলেছিল, ভালোবাসো আমায় আল্পনা?
আল্পনা চোখ নামিয়ে বলেছিল, শুধু তোমাকেই বাসি। তোমায় আমায় ভালোবাসতে হবে না, আমি একলাই বাসবো। সৈকত বলেছিল, বিয়ে করবে আমায়?
আল্পনা মুখ নীচু করে বলেছিল, করবো। সৈকত ওর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, ওর শ্যামলা রঙে একমুঠো আবীর রঙের মাখামাখি।
সৈকত প্রথম চাকরি পেয়ে ওকে একটা হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বলেছিল, সময়টা খেয়াল রেখো। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে যখন ফিরবো তখন যেন রাস্তার মোড়ে তোমায় দেখি। আল্পনার বাড়িতে যত কাজই থাক, ও ঠিক সৈকতের জন্য অপেক্ষা করতো রাস্তার মোড়ে। ওই দূর থেকে একটু দেখা এটুকুই প্রাপ্তি ছিল। তখনও আল্পনারা এ পাড়ার বাসিন্দা ছিল না।
রেবতী আল্পনার গায়ের ওপরে গোলাপি শাড়িটা দিয়ে ঢেকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, দেখো তোমার সৈকতদা এসেছে। সৈকত কাঁদছে আল্পনা তোমার জন্য। চিন্তা করো না, আজ থেকে আমি অনুপমের মা। ওর সব দায়িত্ব আমার।
অনুপম, সৈকত আর পাড়ার দুজনের কাঁধে চেপে আল্পনা চললো স্বর্গের পথে।
ফিরে আসছিল রেবতী, সুদীপ আস্তে করে বলল, এত মেরেছি তবুও কোনোদিন বলাতে পারিনি সৈকত মুখার্জী খুব খারাপ লোক। মার সহ্য করেছে তবুও বলেছে, সৈকত ভালো লোক। আমার ওপরে কর্তব্যের কখনও ত্রুটি করেনি। তবুও কোথায় যেন .....
সুদীপের কথাগুলো আর না শুনেই বাড়ি ফিরে এলো রেবতী। ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সৈকতের কাঁধে চেপে আল্পনা চলেছে স্বর্গযাত্রায়। কিছু কিছু হিসাব এমন অমিলই রয়ে যায় জীবনে। যেমন আল্পনার একনিষ্ঠ ভালোবাসা, যেমন সৈকতের ভীরু স্বভাব, যেমন সুদীপের অকারণ আক্রোশ, যেমন রেবতীর প্রতি আল্পনার টান আর আল্পনার সঙ্গে রেবতীর লুকানো বন্ধুত্ব.... এমন কত হিসেব মেলে না কিছুতেই..মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেও কিছু হিসেব কোনোদিন মেলাতে পারলো না রেবতী।
কলমে- অর্পিতা সরকার
সমাপ্ত
Posts: 446
Threads: 3
Likes Received: 11,694 in 2,466 posts
Likes Given: 4,988
Joined: Jan 2019
Reputation:
2,925
(17-11-2021, 11:09 AM)dada_of_india Wrote: #হিসেব_না_মেলা_অঙ্ক( নতুন গল্প)
#অর্পিতা_সরকার
মা শুনেছো আল্পনা কাকিমা তো মারা গেছে! আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে শুনে এলাম। আমায় অনুপমদা বললো। ওরা বোধহয় কাল রাতে বুকে ব্যথা ওঠায় নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়েছিল, স্ট্রোক নাকি কে জানে? মা অনুপমদা এখন কোথায় খাবে?
হাতের কাজ সারতে সারতে রেবতী বললো, তুই হাত মুখ ধুয়ে খেতে বস টুয়া। আল্পনাকে এনেছে নাকি বাড়িতে?
অনুপমের ওপরে সব দায়িত্ব পড়বে। তোর থেকে বছর খানেকের তো বড়। কথাটা বলতে বলতেই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো রেবতী। সারাটা জীবন মানুষের মৃত্যু স্বচক্ষে দেখতে দেখতে ইদানিং আর অবাক হয় না। ওটির নার্স হওয়ার সুবাদে জন্ম আর মৃত্যুকে পাল্লা দিয়ে উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছেন ভগবান। তাই জন্মের সময় যেমন সদ্যোজাতের চিল-চিৎকারের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চারে নরম হাসি ফোটে ঠোঁটে তেমনই অনেকক্ষণ লড়াই করার পরে যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের দৃশ্যটা দেখে রেবতী তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ইদানিং আর কিছুই হয় না। হতো এককালে। যখন মাত্র চব্বিশ বছরে হসপিটালে ঢুকেছিলো নার্স হিসাবে তখন কারোর মৃত্যু দেখলেই কেঁদে ফেলতো ও। মনের মত চোখের ভিতরের শিরাগুলোও তখন ছিল বড্ড স্পর্শকাতর।
টুয়া খেতে খেতেই বললো, জানো মা সুদীপকাকু পরশু রাতেও মদ খেয়ে এসে চেঁচাচ্ছিলো। আল্পনা কাকিমা তাড়াতাড়ি ওদের বাড়ির দরজা-জানালাগুলো বন্ধ করতে ব্যস্ত ছিল। যাতে বাইরে আওয়াজ না বেরোয়। কেন মা? আল্পনা কাকিমা কেন এত কষ্ট সহ্য করে ছিলো?
সুদীপকাকুর অসভ্যতামি লোককে লুকিয়ে কি লাভ হতো? রেবতী মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, নিজের ঘরের আওয়াজ অনেকে বাড়ির বাইরে চর্চা করতে পছন্দ করে না রে। সবাই তো আর পা ছড়িয়ে নিজের দুর্দশার কথা লোককে বলে বেড়াতে পারে না! আল্পনাও চাইত না, পাড়ার লোক ওদের অভাবের সঙ্গে সঙ্গে অভাবের কারণটাও জানুক। টুয়া বলল, মা আল্পনা কাকিমার সেলাই করে রোজগার করা সব টাকায় সুদীপকাকু মদ খেতো জানো?
রেবতী কাজ সারতে সারতে বলল, জানি। আল্পনা মরেছে বেঁচে গেছে। কিছু কিছু জীবন বয়ে চলা বড্ড কষ্টকর। মুক্তি পেয়েছে।
সন্ধের দিকে সৈকত অফিস থেকে বাড়ি ফিরতেই রেবতী বললো, সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী মারা গেছে জানো তো?
সৈকত ক্লান্ত স্বরে বলল, হ্যাঁ শুনলাম অনুপমের মা মারা গেছে। ওদের বাড়ির সামনে জটলা রয়েছে।
রেবতী বলল, তুমি খেয়ে রেস্ট নিয়ে নাও। যাবে তো শ্মশানে নাকি?
সৈকত একটু ইতস্তত করে বলল, আমি? আমি কেন যাবো? আমার শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। তাই শ্মশানে যাবো না ভাবছি। অনুপমের বন্ধুরা, পাড়ার ছেলেরা সব এসেছে তো।
রেবতী ফোনে কাউকে বলছিলো, নীলিমা আজ নাইট ডিউটিটা একটু ম্যানেজ করে নেবে গো? আজ আমার পাড়ায় একটা মিসহ্যাপ হয়েছে। তাই যেতে পারবো না ডিউটিতে।
সৈকত নিজের মনেই হাসলো। মনে পড়ে গেলো আগেকার একটা কথা। যখন এই রেবতীই সৈকতকে বলেছিলো আল্পনাদের গলির রাস্তাটা না ধরে ও যেন প্রাইমারি কলেজের পাশের রাস্তাটা ধরে যায়।
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর ধরে আল্পনাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা ধরে যায় না সৈকত। হাজার তাড়াহুড়ো থাকলেও নয়।
আজ মোড়ের মাথায় আসতেই চায়ের দোকানের শিবু জানালো, দাদা তোমাদের পাড়ার সুদীপ মিস্ত্রির বউটা মারা গেছে তো দুপুরবেলা। নার্সিংহোমে না হসপিটালে জানি না। তবে শুনলাম সুদীপ মানে ওর মাতাল বরটা নাকি খুব কাঁদছিলো। সৈকত শুধু অস্ফুটে বলেছিল, ওর নাম আল্পনা, আল্পনা শীল।
আজ প্রায় ছাব্বিশ বছর পরে আল্পনাদের বাড়ির গেটের সামনে একটুখানি দাঁড়িয়ে ছিলো সৈকত। ভিতরে ঢোকেনি অবশ্য।
রেবতী বিয়ের চারমাসের মধ্যেই বলেছিল, সৈকত আমার একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আমি তোমার মায়ের দেখাশোনা করি। তোমার সবকিছু করে দিই, এর বিনিময়েই ধরো একটা কথা তোমায় রাখতে হবে। আরেঞ্জড ম্যারেজ হলেও সৈকত এই কয়েকমাসে বেশ বুঝেছিল রেবতী অত্যন্ত শান্ত ভদ্র মেয়ে। চাঁদ চাইবে না এটুকু বুঝেই নির্দ্বিধায় কথা দিয়েছিল, হ্যাঁ রাখবো।
রেবতী সুন্দরী শিক্ষিতা, চাকুরীরতা মেয়ে। অত্যন্ত শিক্ষিত পরিবেশে বড় হয়েছে। কথা বলার ভঙ্গিমাটিও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। রেবতী দৃঢ় অথচ অনুনয়ের ভঙ্গিমায় বলেছিল, তুমি সুদীপ মিস্ত্রীদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দিয়ে অফিস যেও না আজ থেকে। প্রাইমারি কলেজের সামনে রাস্তা দিয়ে স্টেশন চলে যেও। হয়তো মিনিট দুয়েক ঘুরপথ হবে। সে হোক, ওখান দিয়েই যেও।
সৈকত অবাক হয়ে বলেছিল, কারণটা জানতে পারি?
রেবতী অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, শুনেছি ওর স্ত্রী নাকি দুশ্চরিত্রা। আল্পনার নাকি স্বভাব খারাপ। আমি চাই না, তুমি ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাও। সৈকত নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, আমার স্বভাব তো খারাপ নয় রেবতী, তাহলে?
রেবতী হেসে বলেছিল, তুমি কথা দিয়েছিলে রাখবে। যদি না রাখো তাহলে জোর করবো না। নিঃশব্দে ঘর ছেড়েছিল রেবতী। আর কখনও কিছু বলেনি, এদিকে সৈকতও রেবতীর কথা মত নিজের রাস্তা পাল্টে নিয়েছিল।
আল্পনার ছেলে হয়েছে শুনেছিলো রেবতীর মুখেই। টুয়ার থেকে বছর খানেকের বড় হবে অনুপম। ছেলেটাকে মাঝে মাঝে রাস্তার মোড়ে দেখেওছে সুদীপের সঙ্গে।
সুদীপের হাতের কাঠের কাজ দেখার মত। মোড়ের মাথায় চালু দোকান ছিল ফার্নিচারের। বিয়ের অর্ডার পেতো খুব। সুদীপ এমনিতে ছেলে খারাপ ছিল না, কিন্তু অল্প বয়েস থেকে মদের নেশায় পড়ে টাকা পয়সা পকেটে টিকতো না মোটেও।
ছেলেটার মুখটা আল্পনা বসানো ছিল। ছেলেটা লেখাপড়া তেও খুব ভালো শুনেছে লোকমুখে।
সৈকতের মা যতদিন বেঁচেছিলো ততদিন পর্যন্ত এ বাড়ির সমস্ত কিছু মায়ের নির্দেশ মতোই হতো।
রেবতীকে হসপিটাল থেকে ফিরে শুধু স্নান করলেই চলতো না, গায়ে গঙ্গাজল ছেটাতে হতো। নাহলেই মা অশান্তির চূড়ান্ত করতো।
নীচু জাত, ছোঁয়াছুঁয়ির বিচার ছিল মায়ের মারাত্মক। মা মারা যেতে সংসারের হাল ধরেছিল রেবতী। তখন টুয়ার বয়েস বছর ছয়েক।
তখনই একদিন অফিস বেরোনোর আগে দেখেছিলো, টুয়া আর অনুপম ওদের উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলছে। আর রেবতী রান্নাঘর থেকে হাঁক পারছে, তোদের দুটোকে কি কান ধরে টেনে আনতে হবে ...নাকি এসে জলখাবার খাবি?
আল্পনার বাড়ির রাস্তায় যাওয়া নিষেধ ছিল সৈকতের অথচ আল্পনার ছেলেকে এবাড়িতে ডেকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ায় রেবতী? অদ্ভুত তো। রেবতী অবশ্য সত্যিই বড্ড অদ্ভুত। ওর মুখ দেখে আজ অবধি মনের গভীরের তল খুঁজে পেলো না সৈকত। এক সঙ্গে ছাব্বিশ বছর একই ছাদের নিচে কাটিয়েও ঠিক চিনতে পারলো না রেবতীকে।
অনুপম ছেলেটিকে সৈকতের বেশ ভালো লাগতো। বাবার মত রগচটা নয়। অত্যন্ত ভদ্র, মিশুকে ছেলে। পাড়ার কারোর কিছু প্রয়োজনে দাঁড়াতেও দেখেছে অনুপমকে। পড়াশোনাতেও খুব ভালো। বাবার ওই চিৎকার চেঁচামেচির মাঝেই এত ভালো রেজাল্ট করেছে দেখে সত্যিই অবাক হয়েছিলো সৈকত। রেবতী যদি কিছু ভাবে বলেই খুব ইচ্ছে থাকলেও অনুপমের হাতে কখনও একশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলতে পারেনি, মিষ্টি খেও। আবার যদি রেবতী ভাবে আল্পনার ছেলের সঙ্গে অত গল্প করার দরকার নেই, বড্ড মানে লাগবে সৈকতের। তাই ওই কখনও মুখোমুখি হলে, পড়াশোনা কেমন চলছে... এর বাইরে কিছু বলা হয়ে ওঠেনি। চোখের সামনে অনুপমকে অভাব অনটন আর নোংরা পরিবেশের মধ্যেই বড় হতে দেখলো সৈকত। টুয়ার সঙ্গে সেই ছোটবেলা থেকে বন্ধুত্ব বলেই হয়তো টুয়া এখনও ওকে দরকারে অদরকারে ডাকে। কিন্তু দুজনেই আর ছোট নেই। টুয়ার কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, অনুপমও থার্ড ইয়ারে পড়ে। এখনও কেন মাঝে মাঝেই অনুপমকে এ বাড়ি থেকে বেরোতে দেখে সৈকত কে জানে! রেবতীকে একদিন নিজের আশঙ্কার কথা বলেছিলো সৈকত, মেয়েটা তো বড় হচ্ছে? পাড়া প্রতিবেশী আবার কিছু যদি বলে?
রেবতী অজানার ভান করে বলেছিল ঠিক কি বিষয়ে বলতো? অনুপম আর টুয়ার মেশা নিয়ে? ওরা তো ছোট থেকে বন্ধু। আজ আবার নতুন করে লোকে কি দেখবে? না পাত্তা দেয়নি সৈকতের কথায়। সৈকত মনে মনে ভেবেছিল, তাহলে ঐ বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে বারণ করে অপমান শুধু ওকেই করেছে রেবতী!
যদিও এই নিয়ে কথা বলা হয়নি কখনও সৈকতের। এরমধ্যে কারণ একটা অবশ্যই আছে। সেটা অবশ্য রেবতীর জানার কথা নয়।
ইজি চেয়ারে বসে বাঁশিটাতে একবার হাত বোলালো সৈকত। বাজানো হয় না বহুদিন। রেবতী বিয়ের পর উৎসাহের সঙ্গেই বলেছিল, তুমি বাজাতে পারো? তাহলে বাজাও না কেন? বাজাও আমি শুনবো। না ইচ্ছে করেনি সৈকতের। বাঁশি বাজানোর অনুপ্রেরণা রেবতী কোনদিনই হতে পারেনি হয়তো। অথবা সৈকতেরই আর সুর তুলতে ইচ্ছে করেনি। কিছু জিনিস ছেড়ে দেওয়ার মধ্যে কষ্টর সঙ্গে সঙ্গে অন্য একটা তৃপ্তিও কাজ করে। মনে হয় থাকুক না। ঠিক যেমন মা মারা যাবার পরে বারো দিন হবিশ্যি করার সময়। আমিষ ছাড়া যার মুখে ভাত ওঠে না সেই সৈকতের একদিনের জন্যও মাছ-মাংস খেতে ইচ্ছে করেনি। বারবার মনে হচ্ছিল, মাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এটুকু ত্যাগস্বীকার করার মধ্যে অনেকটা তৃপ্তি লুকিয়ে থাকে।
মনে হয় মানুষটা তো অনেক করেছে একদিন আমার জন্য, সে চলে যাবার পরে এটুকু নাহয় করলাম তার জন্য। বাঁশিটাও কি এমনই একটা ত্যাগ সৈকতের কাছে?
রেবতীর গলা শোনা যাচ্ছে। টুয়া, ছুটে গিয়ে একবার অনুপমকে ডেকে নিয়ে আয় তো। না খেয়েই বেরিয়ে গেল নাকি কে জানে? আর আল্পনাকে আনা হলো কিনা দেখে আয়। আমার কয়েকটা কাজ আছে, যেতে হবে আল্পনার বাড়ি।
সৈকত অবাক হয়ে শুনছিলো রেবতীর বলা কথাগুলো। আচমকা রেবতীর এত আল্পনা প্রীতি হলো কেন? মারা গেছে বলে? বেঁচে থাকতে তো তাকে দুশ্চরিত্রা বলতে মুখে বাঁধেনি। কোনো প্রমাণ ছাড়াই তো বদনাম দিয়ে দিয়েছিল। আল্পনা তো কোনদিনই পাড়ায় চড়ে বেড়ানো মেয়েও ছিল না, গৃহবন্ধি রাখতেই পছন্দ করতো নিজেকে।
তারপরেও তার নামে এমন একটা বদনাম দিয়েছিল রেবতী।
টুয়া এসে খবর দিলো মা, আল্পনা কাকিমাকে নিয়ে এসেছে এই মাত্র। আর অনুপমদা আসছে এখুনি।
সৈকত কানটা খাড়া করে রেখেছে। এই রেবতীকে ও চেনে না। অদ্ভুত রকমের আচরণ করছে রেবতী আজকে। অনুপম আসতেই সৈকত নিজের ঘরের লাইট নিভিয়ে দরজার পাশে এসে দাঁড়ালো। ওকে কেউ দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু ও পাচ্ছে সবাইকে।
রেবতী খুব অভ্যস্ত ঢঙে বলল, আগে খেতে বস। সারারাত খাওয়া হবে না। অনুপমের মুখটা থমথম করছে। ধরা গলায় বলল, কাকিমা মাকে বাঁচাতে পারলাম না। রেবতী অনুপমের সামনে খাবার ধরে দিয়ে বলল, তোর মা বাঁচতে চায়নি যে। দিনের পর দিন বারণ সত্ত্বেও মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খেয়েছে হতভাগী। তাতেও কি চোখে ঘুম নেমেছিল নাকি? ধীরে ধীরে হার্টে এফেক্ট হলো। শোন, বাবার ওপরে এখন চেঁচাস না। পাঁচটা লোক আছে দেখবে। তাছাড়া তোর মা বাড়ির অশান্তির কথা সবসময় ঢেকে রাখতে চেয়েছিল।
অনুপমের খাওয়া শেষ হবার আগেই রেবতী এদিকওদিক তাকিয়ে ওর হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, ঘাট খরচ ভালো করে করবি। আমি তোর কাকুকে পাঠাচ্ছি। তোর পাশে থাকবে। অনুপম জল খেতে খেতে বলল, তুমি আর কত দেবে বলতো? আমার পড়ার খরচও তো তুমিই দিয়ে আসছো সেই কবে থেকে। রেবতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুই আর টুয়া কি আলাদা আমার কাছে? আল্পনা না থাকলে টুয়াকে হয়তো বাঁচাতেই পারতাম না রে। তোর মায়ের কাছে আমার ঋণ কি কিছু কম?
সৈকত চমকে যাচ্ছে রেবতী কথা শুনে। ঋণ? আল্পনা না থাকলে টুয়া বাঁচতো না? অনুপমের পড়াশোনার খরচ রেবতী দেয়? ছাব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে একই বাড়িতে থেকে এত কিছু জানে না ও! আশ্চর্য লাগছে।
অনুপমকে টুয়া বলল, অনুপমদা আমি বিকাশদাকে বলে দিয়েছি রে তোর কাছা কিনে রাখতে। গঙ্গায় স্নান করে ওটা পরতে হয়। টুয়ার দিকে তাকিয়ে অনুপম বলল, তুইও কত বড় হয়ে গেলি।
সৈকত নিজের ঘরে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। এ রহস্যের সমাধান করতে পারছে না কিছুতেই। রেবতী যদি আল্পনাকে ঘৃণাই না করবে তাহলে ঐ পথ দিয়ে ওর যাওয়া-আসা বন্ধ করেছিল কেন?
প্রশ্নগুলো আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে যাচ্ছে।
রেবতী ঘরে এসে বিছানায় একটা সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি আর তোয়ালে রেখে বলল, রেডি হয়ে নাও। অনুপমের সঙ্গে শ্মশানে যাবে।
সৈকতের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমনিতেই মনটা ভালো নেই। তারপর রেবতীর এত গোপন তথ্য জেনে মেজাজটাই খিঁচিয়ে গেছে।
একটু গলাটা চড়িয়েই বলল, তোমার কথা মত আমায় চলতে হবে নাকি? আল্পনাদের সঙ্গে যখন এতই ভাব রেখেছিলে তখন আমায় কেন বলেছিলে ও পথ যেন না মাড়াই? মানুষ যে কি করে এত হিপোক্রিট হতে পারে কে জানে!
রেবতী হিমশীতল গলায় বলল, আজ থেকে ছাব্বিশ বছর আগে যদি এভাবে গলা তুলে কথা বলতে পারতে সৈকত তাহলে আজ মিসেস সৈকত মুখার্জী বোধহয় আল্পনা হতো তাই না। তুমি ওকে আল্পনা নয় বরং সুদীপ মিস্ত্রির স্ত্রী বলে ডাকো। আল্পনা ডাকার অধিকার তুমি সেদিন হারিয়ে ফেলেছিলে, যেদিন একটা মেয়ের স্বপ্নকে দু পায়ে থেঁতলে দিয়ে মায়ের কথায় ', মেয়ে দেখতে গিয়েছিলে। তুমি আল্পনা ডাকার অধিকার সেদিন হারিয়ে ফেলেছো যেদিন তোমার সামনে দিয়ে ওর বাবা ওর মতের বিরুদ্ধে মদ্যপ সুদীপের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছিল আর তুমি ঘরের মধ্যে লাইট নিভিয়ে বসে ছিলে। তাই চিৎকার করে কথা বলো না সৈকত। চিৎকারটা সেদিন করা উচিত ছিল।
সৈকত বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়ে বলেছিল, তুমি কি করে জানলে আমার আর আল্পনার কথা?
রেবতী নরম হেসে বলল, বিয়ের পর পর তুমি বেরিয়ে গেলেই আমি ছাদে উঠতাম জানো। যতদূর তোমায় দেখা যায় দেখবো বলে। সৈকত আনমনে কেমন হাঁটে দেখতে ইচ্ছে করতো তখন। তুমি আস্তে আস্তে দূরে চলে যেতে ছোট হয়ে যেতো তোমার অবয়ব, আমিও চলে যেতাম ডিউটিতে। একদিন দেখলাম, আমি যেমন তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পরে হাত জোর করে দুগ্গা দুগ্গা বলি, আরেকজনও গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দুগ্গা দুগ্গা বলে। না, তুমি তাকে দেখতে পাও না। কিন্তু সে তোমার উদ্দেশ্যেই ঈশ্বরকে ডাকে। রোজই দেখছিলাম ব্যাপারটা। একদিন তুমিও বেরোলে আমিও প্রায় তোমার পিছু পিছুই গেলাম।
দেখলাম, শ্যামলা রোগা রোগা মিষ্টি মুখের মেয়েটা একটা নিতান্ত সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পরে অগোছালো চুলেই সংসারের যাবতীয় কাজ অর্ধসমাপ্ত রেখে পড়িমরি করে বেরিয়ে এসেছে তোমায় পিছন থেকে এক পলক দেখবে বলে। মেয়েটা বাড়িতে ঢুকতেই তার স্বামী চিৎকার করে বলছে, দুশ্চরিত্রা, লজ্জা করে না তোর। রোজ এ সময় ছুটে কেন দরজায় গিয়ে দাঁড়াস আমি জানি না বুঝি? ওকেই যদি এত ভালোবাসিস তাহলে বিয়ে কেন করেছিলিস আমায়? দু চার ঘা পড়লোও হয়তো পিঠে। মেয়েটা তাড়াতাড়ি দরজা, জানালা বন্ধ করতে ব্যস্ত। সে যে অত্যাচারিত হয় স্বামীর হাতে, এ কথা যেন পাড়ার লোক টের না পায়। আরও দু এক দিন দেখার পরে তোমার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওই বাড়িটা কাদের? ওখানে যে বউটা থাকে তার নাম কী?
তোমার মা অত্যন্ত অশ্রদ্ধা আর বিরক্তি মিশিয়ে বলেছিলেন, ওর নাম আল্পনা। অল্পবয়েসে মাকে খেয়েছে। পাশের পাড়ায় বাড়ি ছিল। মরতে এখন এ পাড়ার চোখের সামনে বিয়ে করে এসেছে। বাচাল অসভ্য মেয়ে। চাঁদ ছোঁয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, আমার ছেলের দিকে নজর দিয়েছিল। তারপর দিলাম ওর বাপটাকে বলে। সুদীপ মিস্ত্রির সঙ্গে বিয়ে হলো।
জানো সৈকত খুব ইচ্ছে হয়েছিল মেয়েটার সঙ্গে একদিন পরিচয় করতে। মেয়েটা কি একাই ভালোবেসেছিল নাকি তুমিও....
একদিন গেলাম আল্পনার বাড়িতে। সে তো অবাক। আমায় কোথায় বসাবে ঠিক করতে পারছে না। পারলে মাথায় বসায় যেন। সম্ভ্রমের গলায় বলল, বৌদি আপনি যদি ভেবে থাকেন সৈকতদার দোষ তাহলে ভুল ভাবছেন। আমিই বোকার মত এমন অবাস্তব কল্পনা করেছিলাম। সৈকতদা খুব ভালোমানুষ। অবাক হয়েছিলাম জানো! এমন মেয়েও আছে? নিজের সব স্বপ্ন চুরমার হয়ে যাবার পরেও এমনভাবে তোমার সম্মান রক্ষা করতে ব্যস্ত? ভারী লক্ষ্মীশ্রী মুখ আল্পনার।
আস্তে আস্তে সব জানলাম। তোমাদের প্রেম, তোমার বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়া, তারপর তোমার মায়ের অমত। ওর বাবাকে ধমকি...পাড়া ছাড়া করার, সব শুনলাম আমি। তোমাদের চৈত্রমাসের মেলা থেকে ও তোমায় একটা বাঁশি কিনে দিয়েছিল। তুমি ভাল বাঁশি বাজাও বলে। আল্পনাই ছিল তোমার একনিষ্ঠ শ্রোতা। কথা বলতে বলতে দু চোখ জলে ভরে গিয়েছিল আল্পনার। তবুও সে হতভাগী বলে কিনা, সৈকতদা নির্দোষ। মায়ের অমতে ও কি করে বিয়ে করবে বলো বৌদি? তাছাড়া তুমিই ওই বাড়ির যোগ্য বউ। আমি তোমায় রোজ দেখি। কী সুন্দরী তুমি, কত শিক্ষিতা, চাকরি করো, তুমি খুব ভালো।
আমি অবাক হয়েছিলাম সৈকত। যে ওর ভালোবাসাকে কেড়ে নিলো, যে ওর স্থান দখল করে নিলো তার প্রতি ওর রাগ নেই। বরং ও আমায় ভালোবেসে দেখে। আল্পনারা শুধু ভালোবাসতে জানে জানো। নিজেকে নিঃস্ব করে দিয়ে ভালোবাসতে জানে।
আমি বলেছিলাম, তুমি যে রোজ সৈকত অফিস যাওয়ার সময় বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, তোমার বর তো মারে। কেন যাও?
বোকার মত হেসে বলেছিল, হ্যাঁ ও বলে আমি নাকি দুশ্চরিত্রা। ধুর, সৈকতদা ছাড়া আমি কোনদিন কারোর দিকে তাকালামই না।
সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাকে সম্মান দিয়ে ঘরে আনোনি তাকে রোজ রোজ তোমার কারণে মার খেতে দেব না। তাই তোমায় ও পথ দিয়ে যেতে নিষেধ করেছিলাম। তুমি হয়তো ভাবছো আমি নিষ্ঠুর। অভাগীর একপলক দেখার সৌভাগ্যটুকুও কেড়ে নিলাম। কিন্তু কি বলতো সৈকত, এতে সুদীপ মিস্ত্রি ওকে মারত, আর পাড়ার লোকে খারাপ বলতো, লাভ কিছুই হতো না।
কি করে যেন ওই অল্পশিক্ষিতা, অত্যন্ত সাধাসিধে মেয়েটা আমার বন্ধু হয়ে গেলো। অনুপম জন্মানোর আগে আমায় বলছিল, বৌদি আমার খুব ভয় করছে। যদি আমার সন্তান সুদীপের মতোই রগচটা মদ্যপ হয়? আমি বলেছিলাম, ধুর বোকা, মায়ের মত হবে। আমিই ওকে আমার হসপিটালের আউটডোরে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। অনুপম জন্মের সময় আমিই ছিলাম ওটিতে। আল্পনা নয় আমিই অনুপমকে প্রথম ছুঁয়েছি।
সৈকত দীর্ঘশ্বাস গোপন না করেই বলল, তুমি যে বললে আল্পনা ছাড়া টুয়াকে বাঁচাতে পারতে না, কেন?
রেবতী ধরা গলায় বলল, মনে আছে টুয়া জন্মাবার পরেই জন্ডিস হয়েছিল। অথচ আমার ব্রেস্টমিল্ক ছিল না। তখন টানা দু মাস আমি ডিউটিতে যাবার সময় আল্পনার কাছে টুয়াকে দিয়ে যেতাম। ওই বুকের দুধ খাইয়ে টুয়াকে বড় করেছে। অনুপম যে বছর দুয়েক পর্যন্ত ব্রেস্টমিল্ক খেয়েছিল, তাই টুয়াকে খাওয়াতে ওর অসুবিধা হয়নি।
দুদিন ফল, দুধ কিনে দিয়েছিলাম বলে বলেছিল, বৌদি বুকের দুধের দাম দিও না এভাবে, নিতে পারবো না। তোমার মা জানতেন আমি টুয়াকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। সুদীপ মিস্ত্রি একটু ভয় পেতো আমায়। আমি বলেছিলাম, আর যদি কখনও আল্পনাকে মারতে দেখেছি তাহলে পুলিশে খবর দেব। তারপর থেকেই মারের মাত্রা কমেছিলো।
টুয়া আর অনুপমকে ঘিরে আমাদের অনেক কথা হতো। আল্পনা বলেছিল, ওরা যেন দুই ভাইবোন। আমিই অনুপমের লেখাপড়ার ভার নিয়েছিলাম।
দেরি হচ্ছে সৈকত, রেডি হয়ে নাও। একসঙ্গেই যাবো আল্পনাদের বাড়ি।
সৈকত রেবতীর হাত দুটো ধরে বলল, সময়ে সাহস জুগিয়ে উঠতে পারিনি গো। আমার জন্যই হয়তো আল্পনাকে আজীবন এত কষ্ট পেতে হলো। তাড়াহুড়ো করে ওর বাবা বিয়ে দিয়ে দিলো সুদীপের সঙ্গে। আল্পনা লেখাপড়ায় খারাপ ছিল না। উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর ওর বাবাটাই আর পড়ালো না।
রেবতী বলল, আল্পনার অনেক গুন ছিল জানো। সে ভালো রান্না করতে পারতো। সে ভালো সেলাই জানতো। সব থেকে বড় গুন ছিল, ও কখনও কারোর নিন্দে করতে জানতো না। যেন পৃথিবীর সবাই ভালো ছিলো ওর চোখে। সৈকত, আল্পনার মত মেয়েরা নিঃস্বার্থে ভালোবাসতে পারে। অনুপম হয়েছে মায়ের মতোই ধৈর্য্যশীল ছেলে। এত কম বয়েসের ছেলে যে এত দায়িত্ববান ভাবা যায় না।
বেরোনোর আগে আলমারি খুলে একটা গোলাপি রঙের নতুন শাড়ি বের করলো রেবতী।
সৈকত বলল, এটা কি?
রেবতী হেসে বলল, তোমার গোলাপি রং পছন্দ ছিল বলে বাবার কাছে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি কেনার জন্য বায়না করেছিল ও। ওর বাবা রেগে গিয়ে পিঠে খুন্তি দিয়ে মেরেছিলো জানো। সে দাগ এখনও ছিল। হেসে বলেছিল, এটা বায়না করার দাগ। মেয়েটার যেন অদ্ভুত এক শক্তি ছিল। সব সহ্য করার শক্তি। নিজেকে ক্ষয় করে হাসি মুখে থাকার শক্তি।
এটা আজ পরিয়ে দেব ওকে।
আল্পনা ঘুমাচ্ছে। নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। প্রায় বছর ছাব্বিশ, সাতাশ পরে আবার ওকে দেখলো সৈকত। এত রোগা হয়ে গিয়েছিল?
মেলা থেকে বাঁশিটা কিনে এনে বলেছিল, এই নাও সৈকতদা তুমি বাজাবে। কেউ যদি না শোনে আমি শুনবো। তুমি একদন সন্ধেবেলা তোমাদের ছাদে বাজাচ্ছিলে আমি শুনেছি।
সৈকতকে দেখলেই লজ্জা পেতো ও। সৈকত বলেছিল, ভালোবাসো আমায় আল্পনা?
আল্পনা চোখ নামিয়ে বলেছিল, শুধু তোমাকেই বাসি। তোমায় আমায় ভালোবাসতে হবে না, আমি একলাই বাসবো। সৈকত বলেছিল, বিয়ে করবে আমায়?
আল্পনা মুখ নীচু করে বলেছিল, করবো। সৈকত ওর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল, ওর শ্যামলা রঙে একমুঠো আবীর রঙের মাখামাখি।
সৈকত প্রথম চাকরি পেয়ে ওকে একটা হাতঘড়ি উপহার দিয়ে বলেছিল, সময়টা খেয়াল রেখো। বিকেল পাঁচটায় অফিস থেকে যখন ফিরবো তখন যেন রাস্তার মোড়ে তোমায় দেখি। আল্পনার বাড়িতে যত কাজই থাক, ও ঠিক সৈকতের জন্য অপেক্ষা করতো রাস্তার মোড়ে। ওই দূর থেকে একটু দেখা এটুকুই প্রাপ্তি ছিল। তখনও আল্পনারা এ পাড়ার বাসিন্দা ছিল না।
রেবতী আল্পনার গায়ের ওপরে গোলাপি শাড়িটা দিয়ে ঢেকে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, দেখো তোমার সৈকতদা এসেছে। সৈকত কাঁদছে আল্পনা তোমার জন্য। চিন্তা করো না, আজ থেকে আমি অনুপমের মা। ওর সব দায়িত্ব আমার।
অনুপম, সৈকত আর পাড়ার দুজনের কাঁধে চেপে আল্পনা চললো স্বর্গের পথে।
ফিরে আসছিল রেবতী, সুদীপ আস্তে করে বলল, এত মেরেছি তবুও কোনোদিন বলাতে পারিনি সৈকত মুখার্জী খুব খারাপ লোক। মার সহ্য করেছে তবুও বলেছে, সৈকত ভালো লোক। আমার ওপরে কর্তব্যের কখনও ত্রুটি করেনি। তবুও কোথায় যেন .....
সুদীপের কথাগুলো আর না শুনেই বাড়ি ফিরে এলো রেবতী। ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিল, সৈকতের কাঁধে চেপে আল্পনা চলেছে স্বর্গযাত্রায়। কিছু কিছু হিসাব এমন অমিলই রয়ে যায় জীবনে। যেমন আল্পনার একনিষ্ঠ ভালোবাসা, যেমন সৈকতের ভীরু স্বভাব, যেমন সুদীপের অকারণ আক্রোশ, যেমন রেবতীর প্রতি আল্পনার টান আর আল্পনার সঙ্গে রেবতীর লুকানো বন্ধুত্ব.... এমন কত হিসেব মেলে না কিছুতেই..মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেও কিছু হিসেব কোনোদিন মেলাতে পারলো না রেবতী।
কলমে- অর্পিতা সরকার
সমাপ্ত
এক নাগাড়ে পুরোটা পড়া যায় না এই গল্প! এতোই হৃদয়বিদারক। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের এই গল্প। চোখে জল চলে এলো। ধন্যবাদ লেখিকা অর্পিতা সরকার কে এবং যিনি আমাদের পড়ার সুযোগ দিয়েছেন! দাদা অফ ইন্ডিয়া কে।
•
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,072 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,734
কি বলবো বুঝতেই পারছিনা....... জীবন কি অদ্ভুত. কখনো সুখ দুঃখ সমান ভারসাম্য মেনে চলে, আবার কখনো সব কেমন মিলেমিশে এক হয়ে যায়. হাসি মুখেও কান্না লুকিয়ে থাকে, আবার কান্নাতেও লুকোনো হাসি. লেখিকা কে ধন্যবাদ এমন অসাধারণ সৃষ্টির জন্য. ওনার লেখনীতে বাস্তব অসাধারণ ভাবে ফুটে উঠেছে আর দাদাকেও যিনি আমাদের সামনে এই লেখা নিয়ে এলেন ❤
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
দাদা আজ কাঁদিয়ে ছাড়লো সবাইকে।
Posts: 446
Threads: 3
Likes Received: 11,694 in 2,466 posts
Likes Given: 4,988
Joined: Jan 2019
Reputation:
2,925
(17-11-2021, 02:26 PM)ddey333 Wrote: দাদা আজ কাঁদিয়ে ছাড়লো সবাইকে।
কাঁদিয়েছেন এবং বুঝিয়েও ছেন মনের ভালোলাগা দমন করতে নেই। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে হয়, "আমি তোমাকে ভালোবাসি"! ভালোবাসার মাঝখানে কোন কিছুই বাধা হতে পারে না। তুচ্ছ সব জাতপাত ধর্ম বর্ণ। শেষে আফসোস করার চেয়ে হেসে জীবন পার করে দেওয়া অনেক ভালো।
Posts: 3,682
Threads: 14
Likes Received: 2,558 in 1,403 posts
Likes Given: 2,044
Joined: Apr 2021
Reputation:
530
একটু বেশি একপেশে লাগল গল্পটা
❤❤❤
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
প্লেনে উঠেই গার্লফ্রেন্ড বলল, “তুমি নাকি আমার জন্য সব করতে পারবে ? আমি বললাম “অবশ্যই”।
গার্লফ্রেন্ড বলল, ” তাহলে এই প্লেনের মধ্যে হকারি করো দেখি।”
গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে বেলুনের মতন গর্বে যেমন বুক ফুলে উঠেছিলো, প্লেনে হকারির কথা শুনে ঠিক সেইভাবেই চুপসে গেলাম।
জীবনে কেউ শুনেছেন, প্লেনে হকারি করা যায়?
গার্লফ্রেন্ডকে বললাম ” ইয়ে মানে এর থেকে কঠিন কিছু থাকলে বলো( ভাব নিয়ে)। এটা তো খুব সহজ কাজ”।
গার্লফ্রেন্ড বলল ” আগে এটাই করে দেখাও।
যতো সুন্দর করে করবে ততোই বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় এগিয়ে আসবে।
নাহলে কিন্তু অন্য কাউকে নিয়ে গিয়ে বাবার সাথে পরিচিত করিয়ে দিবো”।
সম্রাট শাহজাহান যদি প্রেমের জন্য তাজমহল বানাতে পারে। আমি প্রেমের জন্য হকারি করলে কি মহাভারত অসুদ্ধ হবে ?
এছাড়া গার্লফ্রেন্ড সরাসরি কলিজাতে হাত দিয়েছে। নিজের সম্মান বাঁচাতে সীট থেকে উঠে হকারি করতে যাবো….,
এমন সময় মনে হলো কলকাতার বাসে যারা হকারি করে তারা নানা রকম জিনিস বিক্রি করে।
কিন্তু এই প্লেনে আমি কি বিক্রি করবো। গার্লফ্রেন্ড কে বললাম ” ইয়ে মানে হকারি করতে তো জিনিসপাতি লাগে।
আমার কাছে তো কিছুই নেই”।
গার্লফ্রেন্ড আমার কথা শুনে ওর হাতের ব্যাগটা থেকে একটা ব্রাশের পাতা বের করে দিলো। গুণে দেখলাম সেখানে ১২ টা ব্রাশ।
ব্রাশ গুলো হাতে নিয়ে উঠে যেই দাঁড়াতে যাবো ঠিক তখনি গার্লফ্রেন্ড বলল …
” যদি ঠিকমতন হকারি না করতে পারো কি হবে বলেছি ,মনে আছে” তো?
আমি হকারদের মতন হাতে ব্রাশের পাতা পেঁচিয়ে বললাম “হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে”।
কিছুটা সময় নিয়ে ভাবতে লাগলাম কিভাবে লোকাল বাসে হকাররা হকারি শুরু করে।
তারপর ব্রাশ গুলো হাতে নিয়ে হকারি শুরু করে দিলাম।
” ডিয়ার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের কি দাঁতের সমস্যা? ঠিকমতন দাঁত ব্রাশ করেন না বলে দাঁতে ময়লা জমে গেছে?
দাঁতের গোড়ায় পোকা হয়ে দিন দিন দাঁত নষ্ট হয়ে যাচ্ছে?
মুখের দুর্গন্ধে চারপাশের মানুষের সাথে ঠিকমতন কথা বলতে পারছেন না?
তাহলে এক্ষুনী সংগ্রহ করুন * স্থান লিভারের এই মূল্যবান ব্রাশ।
সকালবিকাল দুবার এই ব্রাশ করে দাঁত মাজলে আপনার দাঁত হবে চকচকে ফকফকে”।
তারপর ব্রাশের পাতা থেকে একটা ব্রাশ বের করে হাত উঁচু করে সবাইকে দেখিয়ে বললাম “দাম মাত্র দশ টাকা, দশ টাকা”।
প্লেনের মানুষজন আমার দিকে এলিয়েন দেখার মতন করে তাকিয়ে আছে।
গার্লফ্রেন্ডের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে আবার বলা শুরু করলাম।
“আমার দাদা ছিলেন বিখ্যাত হকার কালু দালাল, তিনি সারাজীবন ট্রেনে হকারি করেছেন।
তারপর তার ছেলে লাল দালাল ছিল আমার বাবা।উনি সারাজীবন বাসে হকারি করছে।
আমি লাল শেখের ছেলে ধলা দালাল তাই প্লেনে হকারি করি।”
দেখি পিছন থেকে একটা বয়স্ক মহিলা আমাকে ডাকছে।
কাছে যাবার সাথে সাথে উনি আমাকে দশ টাকা দিয়ে হাতের ব্রাশ টা নিয়ে নিলো।
তারপর এক বয়স্ক সাদা লোক আমাকে ডাকলো।
উনার কাছে এগিয়ে যেতেই উনি বলল ” হ্যালো মিঃ ধলা দালাল ( ইংরেজরা বাংলা উচ্চারণ করলে যেমন হয়)।
আমি বললাম ” ইয়েস স্যার”। উনি বললেন ” টোমার আইডিয়া আমার খুব পছন্দ হইয়াছে।
টুমি একমাত্র হকার যে প্লেনে হকারি সূচনা করিয়াছ। যদি নোবেল কমিটি এইরকম মানব সেবায় নোবেল দিতো।
টাহলে আমি টোমার নামে ওদের কাচে সুপারিশ করতাম “। আমি খুশিতে বললাম ” থ্যাংকইউ স্যার”।
তারপর উনি বললেন ” আমাকে দুইটা * স্থান কোম্পানির ব্রাশ দাও”তো ?
সাথে সাথে ব্রাশের পাতা থেকে দুইটা ব্রাশ খুলে উনার হাতে দিয়ে দিলাম।
এরমধ্যে দেখি দুইজন এয়ার হোস্টেজ আমার দিকে দৌড়ে আসছে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে গেলো।
ভগবান! আজ নিশ্চিত ওরা আমাকে প্লেন থেকে নিচে ফেলে দেবে।
ঠিক তখনি হঠাৎ করে আমার গার্লফ্রেন্ড এগিয়ে এসে ছোট বাচ্চার মতন করে আমাকে বলল ” লক্ষী সোনা এমন করে না,
চলো চলো সীটে বসো। মানুষ খারাপ বলবে বাবু”। গার্লফ্রেন্ডের এতো সুন্দর ব্যবহার দেখে অবাক হয়ে গেলাম।
কিন্তু সেই অবাক আর বেশিক্ষণ থাকলো না যখন সে প্লেনের সবাইকে উদ্দেশ্য করে ইংরেজিতে বলল …
” আপনারা সবাই ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। আমার স্বামী একজন মানসিক রোগী।
উন্নত চিকিৎসার জন্য ওকে আমেরিকা নিয়ে যাচ্ছি”।
এবার দেখি প্লেনের সবাই আমার দিকে মায়ার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এয়ার হোস্টেজ গুলার মুখ ও দেখার মতন ছিল।
একজন এয়ার হোস্টেজ এগিয়ে এসে আমার হাতে একটা ললিপপ দিয়ে বলল, “এটা খাও, অনেক মিষ্টি।”
তারপর প্লেনে আমার আর কোনো সমস্যা হয়নি। গার্লফ্রেন্ড ও খুশি আমিও খুশি।
কিন্তু কোলকাতায় ফিরবার পর এয়ারপোর্টে বিশাল ভিড় দেখে ভয় পেয়ে গেলাম।
পাশের একজন কে বললাম ভাই এতো ভিড় কিসের?
লোকটি বলল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাকি কোন দেশ থেকে কোলকাতায় সরাসরি আসছে, তাই এতো ভিড়।
আমি নিজের মতন একা একা হেঁটে যেইনা এয়ারপোর্ট থেকে বের হচ্ছি। দেখি সবার হাতে আমার ছবি।
কেউ কেউ আমার ছবিতে মালা দিয়েছে। কেউ কেউ আমার ছবির নিচে লেখেছে দেশের গর্ব, জাতীর গর্ব মিঃ ধলা হকার।
চোরের মতন এয়ারপোর্ট থেকে পালিয়ে বাসায় এসে শুনি কোন হারামজাদা যেন আমার প্লেনে হকারির ভিডিও নেটে ছেড়ে দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের হকাররা আমাকে স্বাগতম জানাতে এয়ারপোর্ট গিয়েছিল।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
Lessons of life-মন্দিরে আসো কেন?
বুড়ি কলে মুখ ধুয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বোঁচকাটা বগলদাবা করে। পুরোহিত আটকালো। বলল, বুড়ি এই যে তুমি মন্দিরে রোজ দুপুরে আসো, ভোগ খাও, চলে যাও...
বুড়ি তাকে থামিয়ে বলল, কেন? আমি তো দশটাকা দিয়ে কুপোন কাটি। অবশ্য রোজ কাটতে হয় না। এক একদিন এমনি এমনিও ভোগ দেয়....কিন্তু কেন জিজ্ঞাসা করছেন?
পুরোহিত বলল, না, মানে তোমায় তো আরতির সময় দেখি না, সকালে পুজোর সময় দেখি না....বছরে একদিনও তোমায় মন্দিরে অন্য সময় দেখি না...সারাদিন করো কি?
বুড়ি বলল, কেন, ভিক্ষা? রাতে স্টেশানে শুই....আবার সকাল থেকে ভিক্ষা..
পুরোহিত বলল, তোমার কিছু চাওয়ার নেই মায়ের কাছে?...এই যে এত দূর দূর থেকে সব আসে মায়ের কাছে এটা-সেটা চাইতে....তোমার কিচ্ছু চাওয়ার নেই?...
বুড়ি বলল, নেই গো। ছেলে বার করে দিল। বলল শুতে দেওয়ার জায়গা নেই। খেতে দেওয়ার ভাত নেই। তাদের পরিবার বড় হচ্ছে। তা ছেলে যখন বার করে দিল তখন তোমার ও কালী আমার কি করবে? তাকে তো আমি পেটে ধরিনি রে বাবা...তার কি দায়?..
তবে মন্দিরে আসো কেন?....
মাকে বলতে যেন ছেলেটার অমঙ্গল না করে। সেও মা তো। বুঝবে। তারও তো কেউ নেই, নইলে তোমাদের মন্দিরে পড়ে থাকে? সারারাত তালা লাগিয়ে, দরজা জানলা লাগিয়ে চলে যাও...সে একগ্লাস জল চাইলে পাবে কিনা কে জানে... ও সবার ভাগ্যই এক...দেখো না এই দুর্গাপুজো আসছে.... নর্দমার উপরে, এখানে সেখানে প্যাণ্ডেল করে চার পাঁচ দিন ঠায় দাঁড় করিয়ে রাখবে..কান মাথা খাওয়া গান চালাবে...মদ গিলে রাতে নেত্ত করবে...কুটকাচালি করবে সব সেজেগুজে বসে...মা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন...তারপর মন ভরে গেলে টান মেরে জলে ফেলে দিয়ে আসবে নাচতে নাচতে....ওর কাছে আমি আমার জন্যে আর কি চাইব বলো...আমি আসি...টাকা দিই...কুপোন নিই.. ভোগ খাই...আর মাকে বলি তুই তো সব জানিস ছেলেটার যেন অমঙ্গল না হয় দেখিস...এই তো...আসি?
পুরোহিত স্তব্ধবাক। সত্যিই তো মন্দিরে তালা দেওয়া এখন। পাখা লাইট নেভানো। কর্তৃপক্ষ অত টাকা লাইটের বিল দিতে পারে না। বুড়ি চলে যাচ্ছে। ময়লা শাড়ি। বগলে বোঁচকা। চলায় না আছে কোনো তাড়া, বলায় না আছে কোনো ক্ষোভ। এত শান্ত কি করে হলে বুড়িমা! বুড়ি ফিরে তাকালো.. হাসল...সামনের উপরের পাটিতে দাঁত নেই দুটো কি তিনটে...এমন নিরুদ্বেগ, অমলিন হাসি একমাত্র মায়েরাই হাসতে পারে...
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
বইমেলা থেকে ফিরে ঝুমুর মাকে জড়িয়ে ধরল। ভ্রমর বেশ অবাকই হলেন, “কী ব্যাপার ঝুমুর, এত খুশি কেন?”
বইমেলায় গেলে ঝুমুর মায়ের লিস্টের সঙ্গে নিজের পছন্দেরও প্রচুর বই কিনে বাড়ি ফেরে। ভ্রমর নিজেও বইয়ের পোকা। মেয়ের মধ্যেও বই পড়ার নেশা ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন। ঝুমুর এখন বি এ ফার্স্ট ইয়ার। ক্লাস ফাইভে সে বাবাকে হারিয়েছে। তার পর উইডো পেনশনটুকু সম্বল করে অনেক কষ্টে ঝুমুরকে বড় করেছেন ভ্রমর। তবু তার মধ্যেও বইয়ের নেশাকে কখনও জীবন থেকে দূরে সরে যেতে দেননি। মেয়েও মায়ের মতোই হয়েছে।
উচ্ছ্বসিত ঝুমুর দেখায়, “দেখো মা, তোমার ফেভারিট রাইটারের নতুন তিনটে বই। এই বইটার ভেতর উনি নিজে তোমার নাম লিখে সই করে দিয়েছেন। এই বই আর সইয়ের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার পায়ের বারোটা বেজে গেছে!”
মায়ের মুখে হাজার ওয়াটের আলো। বইয়ের ভেতর পাতায় মুক্তোর মতো হাতের লেখায় লেখা—
‘ভ্রমর চট্টোপাধ্যায়কে শুভেচ্ছা, আন্তরিক বসু।’
মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন ভ্রমর।
আন্তরিক বসু যে মায়ের সবচেয়ে প্রিয় লেখক, এটা মেয়ে ছোট থেকেই জানে। ওঁর সব বই-ই ভ্রমরের পড়া, নতুন বই বেরোলে ঝুমুরকে দিয়ে কিনিয়ে আনেন।
“জানো মা, এই প্রথম ওঁকে সামনে থেকে দেখলাম। তোমাদেরই বয়সি, কি একটু বড় হবেন হয়তো। কী সুন্দর দেখতে! ডেনিম জিনসের ওপর একটা দুধসাদা হাফশার্ট পরেছেন, গা থেকে সুন্দর একটা পারফিউমের গন্ধ আসছিল। বাঁ হাতে দারুণ একটা ঘড়ি। পরিপাটি একজন মানুষ।”
মেয়ের উচ্ছ্বাস দেখে হেসে ফেললেন মা। বইয়ের পিছনে দেওয়া লেখকের সংক্ষিপ্ত বায়োডেটা থেকে ঝুমুর জানে, এই লেখক আর মায়ের জন্মস্থান একই জায়গায়। তাই অন্যদের চেয়ে মা যেন এই লেখকের ব্যাপারে একটু বেশি দুর্বল। হৃদয়পুর নামের একটা ছোট্ট শহরের কেউ আজ বাংলা সাহিত্যের স্টার, সেটা নিয়ে মায়ের গর্বের শেষ নেই।
ভদ্রলোক ভালবাসার গল্পই বেশি লেখেন। তাঁর বিপুল ভক্তসংখ্যা। অল্প সময়ে সাহিত্যের বহু পুরস্কারই তাঁর ঝুলিতে। এমন এক জন সুদর্শন ব্যাচেলর সফল লেখককে নিয়ে মিডিয়া বা অনুরাগিণীদের আগ্রহ যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়, সেটা যেন ভ্রমরের সহ্য হয় না। টিভি চ্যানেলে নববর্ষের আড্ডায় এক উঠতি কমবয়সি নায়িকা যখন আন্তরিকের সামনেই বলে বসল যে, আন্তরিক রাজি থাকলে তা হলে এই স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়েই সে তাকে বিয়ে করতে রাজি, তখন ঝুমুর শুনেছে, মা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলেছিল— আদিখ্যেতার শেষ নেই!
ঝুমুর বলেছিল, “মা, কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।”
“না, না, এই মেয়েরা যদি ওঁকে সব সময় জ্বালায়, তা হলে উনি লিখবেন কখন?”
“তা বললে হয়! এঁরাও তো তোমার মতো ওঁর ডাইহার্ড ফ্যান!”
রেডিয়োয় ‘তুই ফেলে এসেছিস কারে মন, মন রে আমার’ রবীন্দ্রসঙ্গীতটা বাজছিল। এ গান শুনলেই চোখ জলে ভরে যায় ভ্রমরের। চুপি চুপি পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে ঝুমুর, “আমার সুন্দরী মা, কেন মন খারাপ? আচ্ছা মা, আমার সেই সিম্পল কোশ্চেনের আনসারটা তুমি এত বছরেও কেন দিলে না। এটাতেই আমি অবাক হয়ে যাই!”
“তুই দিন দিন বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস ঝুমুর!”
“না মা, তোমার মতো সুন্দরী গুণবতী এক জনের কোনও দেবদাস থাকবে না, তা কি হয়?”
“না রে ঝুমুর, তুই যা ভাবছিস সে রকম কিছু ছিল না আমার। আমাদের সময়টা অন্য রকম ছিল। এতটা ফাস্ট ছিল না। তবে...”
“তবে, তবে কী?”
“ঠিক আছে, আজ দুপুরে শুয়ে শুয়ে বলব।”
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
মন কেমন করা গ্রীষ্মের দুপুরে পাশাপাশি মা-মেয়ে শুয়ে।
“ঝুমুর, তুই তো শুধু আমার মেয়ে নোস, তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও বটে। তোকে না বলার মতো কিছু নেই আমার। তবু কোনও বিষয় মনের মণিকোঠায় রেখে দিতেই বেশি ভাল লাগে। তবুও তোকে যা বলব সেটা যেন শুধু তোর মনের লকারেই থেকে যায়। এটা শুধু তিতিরমাসি জানে, আর কেউ নয়, এ বার তুই জানবি!”
তিতিরমাসি মায়ের কলেজের বেস্ট ফ্রেন্ড, ঝুমুর জানে।
একটু থেমে ভ্রমর শুরু করে, “আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমাদের পুরনো বাড়িটার নাম ছিল শিশিরকুঞ্জ। আমাদের ঘরগুলো ছিল রাস্তার দিকে, যেখানে একটা ব্যালকনি ছিল। এখন প্রোমোটারের হাতে পড়ে ফ্ল্যাট হয়ে গেছে।
“সেখানে আমি কলেজ থেকে ফিরে কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতাম। এক দিন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই দেখি, রোগা চেহারার ফর্সা একটা ছেলে আমাদের বাড়ির কিছুটা আগে সাইকেল থেকে নেমে পড়ে, তার পর ব্যালকনির দিকে তাকাতে তাকাতে সাইকেল নিয়ে হেঁটে চলে যায়, তার পর একটু দূরে গিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে। পরে বুঝলাম, আমাকে বেশি ক্ষণ দেখার জন্যই এই ব্যবস্থা। শুধু তাকিয়ে দেখা ছাড়া কোনও দিনই সে কিছু করেনি।
“প্রথম দিকে চোখে চোখ পড়লে ভয় পেয়ে ভেতরে চলে যেতাম। কিন্তু কিছু দিন পর ভয় কেটে গেল। লজ্জা পেয়ে ব্যালকনি থেকে চলে গেলেও আবার কিছু ক্ষণ পর ব্যালকনিতে আসতাম। দেখতাম সে চলে গেছে। এক অদ্ভুত শূন্যতা আমায় গ্রাস করত। ছেলেটাকে বেশ দেখতে ছিল, জানিস। চোখ দুটো খুব গভীর।
“বুঝতে পারছিলাম, আমি একটা বাঁধনে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি। এক দিন তিতিরকে সব বললাম। মজার ব্যাপার হল, তিতির বা অন্য কেউ যখন আমার সঙ্গে থাকত, তখন ও আর এ দিকে তাকাতই না।
“এক দিন সে বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেলটা নিয়ে আমার দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে, হঠাৎ একটা রিকশা এসে হুড়মুড়িয়ে ওর গায়ে পড়ল, ও বেচারা তো সাইকেল নিয়ে চিৎপটাং। আমি তো হেসে উঠেছিলাম। পরে অবশ্য মনে হয়েছিল, হাসাটা ঠিক হয়নি। বেচারা কোনওক্রমে উঠে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল। পরের দু’দিন পাত্তা নেই। দু’দিন পর দেখলাম, অন্য একটা ছেলে ওকে সামনের রডে বসিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল। বুঝলাম, হিরোর চোট লেগেছে। যাকে আমি ভাল করে চিনি না, তার জন্য কষ্ট হচ্ছিল! ঠাকুরকে বললাম, ওকে ভাল করে দাও।
“আমি তো বাইরে খুব একটা বেরোতে পারতাম না, বাবা পছন্দ করতেন না। ওই বিকেল পাঁচটা ছিল এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়। প্রায় দু’বছর আমাদের নির্বাক সিনেমা চলল। নাইন, টেন, মাধ্যমিক সব শেষ হয়ে গেল। হঠাৎ কী হল কে জানে, ওর আর কোনও পাত্তা নেই। আমার তখন দিশেহারা অবস্থা।
“জেঠু-কাকুদের সঙ্গে বাবার বনিবনা হচ্ছিল না, তা ছাড়া বাবার চাকরির জায়গাটা ছিল বেশ দূরে। তাই বাবা চাকরির জায়গার কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট কিনে পেললেন। এর পর বাবা যে দিন বললেন, সামনের সপ্তাহে আমরা এখান থেকে চলে যাব, সে দিন মনে হচ্ছিল নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। বাড়িটা, বিকেল পাঁচটা, এই ব্যালকনিটা আর সেই ছেলেটা... সব কিছু চিরতরে হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি, এটা ভাবলেই কান্না সামলাতে পারছিলাম না। খুব চাইছিলাম জানিস, যাওয়ার আগে এক বার অন্তত ওর সঙ্গে যেন দেখা হয়, তা হলে ওর নামটা যে ভাবেই হোক জেনে যাব।
“সে সুযোগ আর পাইনি। ও আর ফিরে এল না। কী যে ঠিক হল সেটা জানতে না পারার জন্যই দুঃখটা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছিল। বার বার মনে হচ্ছিল, বড় অসুখ বা দুর্ঘটনা হয়নি তো?”
বাচ্চা মেয়ের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন ভ্রমর। নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছিল ঝুমুরের। পঁচিশ বছর আগের অচেনা অপরিচিত এক জনের জন্য এত মায়া, এত কষ্ট! কে এই ছেলেটি! ভ্রমর আর কিছু বলেননি, ঝুমুরও প্রশ্ন করেনি।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
ঝুমুর ভাবতেও পারেনি, গল্পের দ্বিতীয়ার্ধ এত দ্রুত তার সামনে এসে যাবে। জীবন মাঝে মাঝে এমন সব সমাপতন সাজিয়ে দেয় যে কল্পনাও হার মেনে যায়।
মাসখানেক পরের কথা।
সন্ধেবেলা ঝুমুর টিভি দেখছিল, হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “মা, মা, এই দেখো, কাল সন্ধেয় টিভিতে আন্তরিক বসুর ইন্টারভিউ। এই প্রথম উনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন।”
শুনে ভ্রমর বলেন, “বাঃ, তা হলে তো ভালই হয়, এই যে উনি ওঁর সমস্ত বই হৃদয়বতী নামের কোনও এক জনকে উৎসর্গ করেন, তার কারণটাও হয়তো জানা যাবে।”
আন্তরিক বসুর সমস্ত বইয়ের ভেতরে উৎসর্গপত্রে লেখা থাকে ‘হৃদয়বতীকে’। উনি কি হৃদয়বতীকে নিয়ে সত্যিই কিছু বলবেন? আচ্ছা, কে ইনি? হৃদয়বতী দেখতে কেমন? তিনি ওঁর কে হন?
পরের দিন সন্ধে হতে না হতেই মা, মেয়ে টিভির সামনে বসে পড়ল। ঝুমুর দেখল, মাকে যেন একটু ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।
যথাসময়ে দেখা গেল, আন্তরিক আর এই সময়ের ছোট পর্দার জনপ্রিয় নায়িকা শাওন মুখোমুখি বসে। ফেডেড জিনসের উপর একটা আকাশি পাঞ্জাবি পরেছে আন্তরিক।
শাওন শুরু করে, “আন্তরিকদা, চ্যানেল থেকে যখন আমায় এই ইন্টারভিউটা নিতে বলা হল, আমি আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট শুটিং ক্যানসেল করে দিয়েছি। অনেকের মতো আমিও আপনার বিগ ফ্যান।”
“ধন্যবাদ শাওন, তোমাদের মতো যারা আমার লেখা পছন্দ করে, তাদের কাছে আমি গভীর ভাবে কৃতজ্ঞ,” মৃদু হেসে বলে আন্তরিক।
“আন্তরিকদা, আজ আমি কিছুই আপনাকে জিজ্ঞেস করব না। এই প্রথম আপনি ইন্টারভিউ দিতে রাজি হয়েছেন, আপনিই শুরু করুন...”
“শাওন, তোমরা দেখেছ যে, আমার প্রত্যেকটা বই আমি ‘হৃদয়বতী’কে উৎসর্গ করি। এটা নিয়ে পাঠকদের মনে প্রচণ্ড কৌতূহল। মনে হল এ বার সব কিছু সকলকে পরিষ্কার করে বলা দরকার। হৃদয়বতী কে, সেটা আমারও জানা নেই। আমিও তাকে খুঁজি। সে কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র নয়, বাস্তবের এক ফ্রক করা কিশোরী। আমার জন্ম হৃদয়পুর নামের এক মফস্সলে। গল্পের বই পড়ার নেশা আমার চিরকালের। আর সেই কারণেই ওখানকার পাবলিক লাইব্রেরির মেম্বার হয়েছিলাম। যে রাস্তা দিয়ে রোজ বিকেলে লাইব্রেরি যেতাম, সেই রাস্তার পাশেই শিশিরকুঞ্জ নামে একটি বাড়ি ছিল, সেই বাড়ির ব্যালকনিতেই...”
ঝুমুর দেখল, হঠাৎ করেই মায়ের মুখটা কেমন বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। কপালে একটু একটু ঘাম জমেছে। শক্ত করে মায়ের হাত দুটো চেপে ধরল ঝুমুর।
আন্তরিক বলে চলে, “সেই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকত ফ্রক পরা এক কিশোরী। প্রথম যে দিন আমি ওকে দেখি, আমার চোখে কেমন যেন একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল। আমি তখন ক্লাস টুয়েলভ। খুব ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম। কোনও দিন মুখ ফুটে তাকে কিছু বলতে পারিনি। টানা দু’বছর ওই রাস্তা দিয়ে আমি গেছি। এক পলকের একটু দেখাই আমার সারা দিনের এনার্জি বাড়িয়ে দিত। বারো ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হওয়ার দু’দিন পরই বাবা হঠাৎ স্ট্রোকে মারা গেলেন। দাদু-দিদিমাকে, আমাকে আর মাকে তাঁদের কাছে নিয়ে গেলেন। আমাদের হৃদয়পুরের বাড়িটা তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। কলকাতায় এসে মা এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে প্রায় মাসছয়েক আমি আর হৃদয়পুরে যেতে পারিনি। যখন সেখানে ফিরে গেলাম, তখন শূন্য ব্যালকনি। প্রথম কয়েক দিন বুঝতে পারিনি, ভেবেছিলাম শরীর খারাপ বা কোথাও ঘুরতে গেছে। তার পর খবর নিয়ে জানলাম, ওরা আর এখানে থাকে না। ওকে আর ওই ব্যালকনিটায় দেখতে পাব না এই চিন্তাটা যখন আমার মাথায় ঢুকে গেল, আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল যে দিন দেখলাম, ওই বাড়িটা ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ব্যালকনিটাও আর রইল না।
“ওই দিকে কোথাও গেলে এখনও আমি গাড়িটাকে ওই রাস্তার সামনে দিয়ে নিয়ে যাই। খুব মিস করি ব্যালকনিটাকে, এক ধরনের বিষণ্ণতা এত বছর বাদেও গ্রাস করে আমাকে।
“এত বছর তাকে দেখিনি ঠিকই, কিন্তু মনে তার একটা জায়গা রয়ে গেছে। অনেকের কাছে ছেলেমানুষি মনে হতে পারে। এত দিনে সে হয়তো কোনও জমজমাট সংসারের অলরাউন্ডার গিন্নি, বা বড় চাকরি করছে। কিন্তু মনে হয়, এক বার অন্তত তার সঙ্গে দেখা হলে খুব ভাল হত। তার নামটা মনে মনে ‘হৃদয়বতী’ রেখেছিলাম এই কারণেই যে, মনে হয়েছিল তার হৃদয়টা খুব সুন্দর।
“জানি না, হৃদয়বতী বই পড়তে ভালবাসে কি না, কিংবা আজকের এই ইন্টারভিউটা যে আদৌ দেখছে কি না, তবুও আপনাদের চ্যানেলে যদি সে যোগাযোগ করে, তা হলে আমি তার সঙ্গে এক বার দেখা করতে চাই। একটাই তো জীবন, কোনও অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে চলে যেতে চাই না।”
আন্তরিকের গলাটা ধরে এল। শাওনকেও ছুঁয়ে গিয়েছিল লেখকের আবেগ। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে অনুষ্ঠানকে সমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে গেল।মাথাটা কেমন ঘুরছিল ভ্রমরের। ঝুমুরের সপ্রশ্ন দৃষ্টির সামনে বিষণ্ণ গলায় শুধু বললেন, “বইয়ে ছবি দেখে প্রথম থেকেই ওকে আমি চিনতে পেরেছিলাম। চেহারা একটু বদলেছে, কিন্তু ওর গভীর সমুদ্রের মতো চোখ দুটো আজও একই রকম।”
মায়ের দু’হাত শক্ত করে চেপে ধরে ঝুমুর বলে, “আমি কিন্তু চ্যানেলের ফোন নম্বরটা লিখে রেখেছি মা...”
Posts: 446
Threads: 3
Likes Received: 11,694 in 2,466 posts
Likes Given: 4,988
Joined: Jan 2019
Reputation:
2,925
তখনকার দিনে চোখে চোখে প্রেম হতো দে বাবু।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(22-11-2021, 09:42 PM)Jupiter10 Wrote: তখনকার দিনে চোখে চোখে প্রেম হতো দে বাবু।
কখনকার দিনের কথা বলছেন !!
আমি তো মনে করি চোখে চোখে প্রেম একশো বছর আগেও হতো , আজও হয় ... একশো বছর পরেও হবে ...
হতেই থাকবে ...
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
?**** টান *****?
ড্রাইভার মিলন এসে বলল: বৌদি একটা বুড়ো এসেছে।বলছে দাদাবাবুর সাথে দরকার আছে।
কে? নাম কি? কোথা থেকে এসেছে?
বলছে তো দাদাবাবুর গ্রামের লোক।খুব দরকার।
দরকার তো আমি জানি।যত হাভাতে লোকগুলো আসে এ'ভাবে যখন তখন।তোদের দাদাবাবুকে ইনিয়ে বিনিয়ে দুঃখের কথা বলবে।সেও গলে যাবে আর কিছু টাকা খসবে আমাদের।ডিসগাস্টিং!বিদায় কর এক্ষুণি।
আর শোন তোর দাদাবাবুর কানে যেন এ'সব কথা না যায়।
আজ আমার একমাত্র ছেলে অত্রির জন্মদিন।সব নিমন্ত্রিতরা এসে যাবে একটু পরেই।এর মধ্যে একফাঁকে পার্লারে গিয়ে একটু তৈরী হয়ে আসব ভাবছি, তার মধ্যে এই উটকো আপদ এসে জুটল।
একটু পরেই মিলন ফিরে এল আবার;পিছন পিছন এক হাড় - হাভাতে চেহারার গেঁয়ো বুড়ো।
আচ্ছা ঝামেলায় পড়েছি বৌদি.. মিলন মুখ খুলতে না খুলতেই শুনি: বৌমা... বুড়োটা বলছে...আমাকে তুমি চিনবে না মা, আমি বিশুর...
কথাটা শেষ করতে দিলাম না। হাত তুলে বললাম:দেখুন, আপনি কে তা আমি জানতে চাইনা,আমার বাড়ীতে আজ একটা অনুষ্ঠান আছে, আমার সময় নেই আপনার বাজে কথা শোনার।টাকা চাইতে এসেছেন তো!ঐরকম অনেকেই আসে আমার স্বামীর গ্রামতুত সম্পর্ক ধরে; আপনি এখন আসুন।আমার স্বামী বাড়ীতে নেই।
অনেকদূর থেকে এসেছি মা।আমার বিশেষ দরকার। তাছাড়া বুড়ো হয়েছি, পথঘাট ঠাহর করতে পারব না রাতে।বিশুর সাথে কাজের কথা সেরে , কাল সকাল সকাল চলে যাব।
নাছোড়বান্দা বুড়ো তো! মিলনকে বললাম: একটা কাজ করো।সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে আজকের রাতটা থাকতে দাও একে।কাল দেখা যাবে।
দারুণ হৈ- হুল্লোড় হ'ল পার্টিতে।আমার আর বিশ্বদীপের সব কলিগ, ওর বস, অত্রির বন্ধুরা ...সবাই এসেছিলেন।অনেক দামী দামী গিফট পেল অত্রি।
সকালে ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরীই হয়ে গেল।অবশ্য অসুবিধে নেই তাতে।আজ সেকেন্ড স্যাটারডে।আমাদের তিনজনেরই ছুটি।
মিনু চা নিয়ে এল, আর,আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা খাম।
কি এটা?
ঐ বুড়ো ভদ্রলোক দিয়ে গেছেন বৌদি।বলেছেন, এটা আপনাকে দিয়ে দিতে।
বাব্বা! ভদ্রলোক! মিনুর আদিখ্যেতা দ্যাখো একবার!!
কি আছে এতে? দেখি তো খুলে।
স্নেহের বৌমা
তুমি আমার স্বর্গীয় দাদা -বৌদি রত্নদীপ আর তৃপ্তি ভট্টাচার্যের একমাত্র ছেলে বিশ্বদীপের বৌ।দাদা- বৌদি যখন গ্রামে এক অজানা রোগে মারা গেলেন, বিশুর তখন ছ'মাস বয়স।আমার স্ত্রী সুধা ওকে বুকে তুলে নিল।আমি নিঃসন্তান।বিশুকেই নিজের ছেলের মত বড় করলাম আমরা।
গ্রামের পড়া শেষ করার পর, কলকাতায় হস্টেলে রেখে ওকে পড়ালাম।তখন থেকেই ও বিশেষ যেত না গ্রামে।আমি আসতাম।দরকার মত টাকা- পয়সা দিয়ে যেতাম।
ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হ'ল বিশু।আমি আর তেমন আসা যাওয়া করতে পারতাম না। মানি অর্ডার করতাম দরকার মত।
বাইরে পড়তে গেল ও।তারপর ফিরে এসে জয়েন করল বিশাল চাকুরিতে।আমার দশটা চিঠির উত্তরে একটা উত্তর দিত ।বুঝতাম , কাজের চাপ।তাও আশায় ছিলাম, একবারের জন্যও যদি বুড়ো কাকা - কাকীমাকে এসে দেখে যায়!
একদিন একটা পোস্টকার্ড পাঠাল বিশু, তোমাদের বিয়ের খবর জানিয়ে।মনকে সান্ত্বনা দিলাম, অন্তত খবরটুকু তো দিয়েছে।তারপর আর কোন খবর পাইনি।
সুধা শয্যাশায়ী। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন।আজকাল বাচ্চাদের মত বায়না করে, বিশুকে দেখবে বলে।কি করে পাই বিশুর ঠিকানা! কপাল ঠুকে ঐ অফিসের ঠিকানায় চলে এলাম।ওখানে গিয়ে শুনি আজ বিশু অফিসেই আসেনি।বাড়ীতে নাকি অনুষ্ঠান।
রিসেপশনিস্ট মেয়েটিকে অনেক অনুরোধ করায়, আমাকে এই ঠিকানাটা দিল।
কিন্তু শুধুমাত্র সুধার কথা ভেবেই আসিনি আমি।
আমার আর দাদার দশ বিঘা জমি ছিল গ্রামে। যা ফসল আর ফল পাকুড় হত, তা বিক্রীর পয়সা ব্যাঙ্কে জমা করতাম আমি।এখন বয়স হয়েছে।আর চাষবাসের দেখাশুনো করত পারিনা ঠিকমত।তাই বসত- বাড়ীটুকু রেখে, বাকী জমি বিক্রী করে দিলাম।
ফসল বিক্রীর আর জমি বিক্রী বাবদ ত্রিশ লাখ টাকার চেক আমি দিয়ে গেলাম।দায়মুক্ত হ'লাম আমি আজ।
তোমরা ভাল থেকো।নাতিবাবুকে আমার আশীর্বাদ জানিও।
ফিরে গিয়ে সুধাকে বলব যে, তোমরা বিদেশে আছ।আমি তোমাদের খুঁজে পাইনি।কাঁদবে জানি খুব।
আমি চললাম।আর কোনদিন আসব না বিরক্ত করতে।
*চিত্রদীপ ভট্টাচার্য*
... ... বড় অহংকার ছিল আমার।সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা, বর সুচাকুরে।পার্টিতে গেলে আমার সান্নিধ্য পেতে কত পুরুষ লালায়িত থাকে।..আজ ঐ বৃদ্ধ মানুষটি এক লহমায় আমার সব অহংকারকে গুঁড়িয়ে দিয়ে গেলেন.....
|