05-07-2021, 05:19 PM
Khub bhalo bhabe start korlen
Romance জীবন যে রকম ( সম্পূর্ণ ধারাবাহিক উপন্যাস) By Lekhak
|
05-07-2021, 05:19 PM
Khub bhalo bhabe start korlen
05-07-2021, 08:19 PM
05-07-2021, 09:13 PM
Bidisha r point of view thekeo ki apni likhben ? Khub jante iche korche.....age apnar sathe kotha bolar kono scope cholo na.....akhon jakhon peyechi takhon plz or dik thekeo kichu likhun....
05-07-2021, 09:31 PM
05-07-2021, 10:57 PM
অসাধারণ দাদা, চালিয়ে যান
05-07-2021, 11:55 PM
06-07-2021, 12:33 AM
(This post was last modified: 06-07-2021, 12:34 AM by raja05. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
06-07-2021, 08:16 AM
06-07-2021, 11:09 PM
তেরো
গানটা শুনতে শুনতে শুভেন্দু যেন দোলায় দুলছে। গান পাগল নয় আমার গলা পাগল। হঠাৎ একটা আবদার করে বসল, ‘এই দেব একটা রিকোয়েস্ট করব, রাখবি? তোকে এটা করতেই হবে।’
আমি বললাম, কি?
শুভেন্দু বলল, ‘এবারের পূজোতে বিরাট ফাংশন হচ্ছে আমাদের পাড়াতে। তোকে গাইতে হবে।’
আমি বললাম, ‘পাড়ার জলসা?’
শুভেন্দু বলল, ‘কেন, তুই তো গেয়েছিস বেশ কয়েকবার। তোদের পাড়ার ফাংশনেই গেয়েছিস। এবার না হয় আমাদের ওখানে গাইবি।’
আমি বললাম, ‘সে তো দেরী আছে এখনও। তখন যদি শরীর সুস্থ থাকে নিশ্চই গাইব। আর তুই রিকোয়েস্ট করছিস, তোর অনুরোধ কি আমি ফেলতে পারি?’
দাঁত বার করে একটু ফিক ফিক করে হাসল শুভেন্দু। শুক্লা বলল, ‘আচ্ছা দেব, আমিও যদি তোকে একটা রিকোয়েস্ট করি রাখবি?’
শুভেন্দু শুক্লার পুরো কথাটা শেষ না হতে দিয়েই শুক্লাকে বলল, ‘তুইও কি ওকে জলসায় গাওয়াবি নাকি? কি প্ল্যান মতলব?’
শুক্লা বলল, ‘এই চুপ কর। তুই যা করবি, আমাকেও তাই করতে হবে নাকি? আমি দেবকে দিয়ে গাওয়াব না। আমি গান শিখব।’
শুভেন্দু শুক্লার কথা শুনে হেসেই লুটোপুটি। হাসতে হাসতে বলল, ‘তুই? গান শিখবি? এই বয়সে?’
শুক্লা বলল, ‘কেন? আমি কি বুড়ী হয়ে গেছি নাকি? যে বয়সের খোটা দিচ্ছিস?’
আমি মাঝখানে বাঁধা দিয়ে শুক্লার তারিফ করে শুভেন্দুকে বললাম, ‘জানিস তো শুভেন্দু। শুক্লা কিন্তু দারুন ছবি আঁকে। এক একটা ছবি যেন মাষ্টার পিস। চোখ জুড়িয়ে যায়। আমি ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে ওর আঁকা ছবি দেখেছি।’
শুভেন্দু বলল, ‘সত্যি তোদের কত গুণ। এই ‘দেব’ কি সুন্দর গান গায়, আবার গল্পটল্পও লেখে শুনেছি। তুই খুব ভাল ছবি আঁকিস। আর আমি হলাম যে পুরোপুরি কোয়ালিটি লেস। আমার কোন গুন নেই।’ বলেই মুখটা এমন ব্যাজার মত করল, যেন নিজের ওপরেই খুব আফসোস হয়েছে ব্যাচারার।
মা সেই সময়ে আর একবার ঘরে ঢুকল। শুভেন্দুর কথাটা শুনতে পেয়েছে। ওকে বলল, ‘কার গুণ নেই বলছ শুভেন্দু? তোমার? তুমি বললেই আমি বিশ্বাস করব? তোমার মত ছেলে হয় না। আমি নিজে তার প্রমাণ পেয়েছি। এমন ছেলে লাখে একটা।’
মা কাছে এসে শুভেন্দুর থুতনিটা ধরে একটু আদর করে দিল। শুভেন্দু তাড়াতাড়ি মা’র পা ধরে প্রনাম করে বলল, ‘মাসীমা আরও আশীর্ব্বাদ করুন। আমি যেন আপনাদের সেবায় আরও নিমজ্জিত হতে পারি। এবার আপনি বললেন, আমার দূঃখটা দূর হল। আর আমাকে কেউ বেগুন বললেও আমি মানব না।’
আমি আর শুক্লা দুজনেই হাসছি, শুভেন্দুর রকম দেখে। শুক্লা হাসতে হাসতে বলল, ‘যাক, মাসীমার কাছ থেকে সার্টিফিকেটটা পেয়ে গেলি। এর থেকে বড় সার্টিফিকেট পৃথিবীতে আর নেই।’মা বলল, ‘সত্যি গো, ছেলেটার মনটা এত ভাল। আমার তো খুব ভাল লাগে ওকে। দেব বারেবারে ওর কথা বলে। এখন মনে হয়, সত্যি এমন বন্ধু আর কে আছে? ক জনের ভাগ্যে জোটে। ‘দেব’ আমি দুজনেই খুব ভাগ্যবান।’
মা কথাগুলো খুব আবেগ নিয়ে বলছে, আর শুভেন্দু চেয়ারে বসে বসে বুকের ছাতি চওড়া করছে। শুক্লা হাসতে হাসতে আমাকে বলল, ‘দেখ, দেখ। মাসীমার কথাগুলো শুনে ও কেমন করছে? শুভেন্দুর রকমটা দেখ।’
আমিও শুয়ে শুয়ে হাসতে লাগলাম। মা হঠাৎই সেইসময় বলে বসল, ‘আমার কিন্তু একটা কথা আছে বাবা? এটা কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে।’
কথাটা শুভেন্দুকে উদ্দেশ্য করেই বলেছে। শুভেন্দু প্রথমে বুঝতে পারেনি। ভ্যাবাচাকা খেয়ে ওর মুখের আদলটাই পাল্টে গেল। মা কি আদেশ করবে ও জানে না। মুখটা একটু করুন মত করে বলল, ‘বলুন মাসীমা।’
মা বলল, ‘এবার কিন্তু তোমাকেও বিয়ে করতে হবে বাবা, আমি কোন কথা শুনছি না।’
শুভেন্দু আঁতকে ওঠার মতন করে বলল, ‘বিয়ে?’
মা বলল, ‘হ্যাঁ বিয়ে। তুমি শুনে অমন চমকে উঠলে?’
আমি আর শুক্লা দুজনেই মুখ টিপে হাসছি, শুভেন্দু বলল, ‘আপনি বলছেন যখন মাসীমা। করে ফেলব। এ আর কি এমন কঠিন কাজ? কবে করতে হবে বলুন? আপনি শুধু হুকুম করুন।’
বাধ্য ছেলের রকম দেখে আমার আর শুক্লার দুজনেরই খুব মজা লাগছে। মা বলল, ‘বিয়েটা করবে কাকে? একটা মেয়ে তো দরকার। মেয়ে দেখা শুরু করেছ?’
শুভেন্দু বলল, ‘ওটাই তো মাসীমা। সমস্যা তো ওখানেই হয়েছে। কিছুতেই মেয়ে খুঁজে পাচ্ছি না। অনেক চেষ্টা করলাম। সব বৃথা গেল।’
মা বলল, ‘সত্যি তুমি মনের মতন মেয়ে খুঁজে পাচ্ছো না? এও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?
আমি বিছানায় শুয়েই ওকে বললাম, কটা মেয়ে খুঁজেছিস তুই? মাকে খুব ম্যানেজ করছিস। ব্যাটা গুলবাজ।’
শুক্লা কান্ডকারখানা আর রকম দেখছে শুভেন্দুর। শুভেন্দু বলল, ‘ভাবছিস আমি সত্যি গুল মারছি। আরে তোদের কাছে আমি অনেক কিছুই লুকোতে পারি। তা বলে মাসীমার কাছে কি লুকোব? এই তো গত মাসেই আমি ছটা মেয়েকে দেখলাম। আরে আমার মেজবৌদিও খুব উঠে পড়ে লেগেছে আমার জন্য। তাছাড়া মাধুরীও চেষ্টা চরিত্র করছে। জানি একদিন না একদিন আমাকে বিয়ে করতেই হবে। তাই তো সত্যি কথাটাই বললাম।’
শুক্লা বলল, ‘ছটা মেয়ে কে দেখলি, তারমধ্যে একটাকেও তোর পছন্দ হল না? তোর ব্যাপারটা কি বলতো?’ সর্বগুণে গুণান্বিত আবার অপূর্ব সুন্দরী। দুটো কিন্তু একসাথে হবে না। ও আশা ছেড়ে দাও।
শুভেন্দু বলল, আমার কাছে সুন্দরীটা ফ্যাক্টর নয়। কিন্তু একটা জিনিষ বুঝিস তো? জয়েন্ট ফ্যামিলি আমাদের। আমাদের চার ভাইয়ের নিজেদের মধ্যে খুব ভাব। বিয়ের পরও সেই বন্ধনটা অটুট রয়ে গেছে। আমার বৌদিরাও সব মানিয়ে নিয়েছে। আজকালকার মেয়েরা, তারা সব আলাদা থাকতে চায়। আলাদা সংসার হবে। ছোট্ট সংসার। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে তারা থাকতে চায় না। এই ব্যাপারগুলো বুঝে শুনে,তবেই তো বিয়েটা করতে হবে। বিয়ের পরে কোন ঝেমেলা বহন করতে আমি রাজী নই।মা শুভেন্দুর কথাটা শুনে ঘাড় নাড়ল। বলল, হ্যাঁ বাবা, তুমি ঠিকই বলেছ। সেরকম মেয়ে খুঁজেই তবে তাকে বিয়ে কর। তবে পাবে নিশ্চই। আমার মন বলছে।’
শুভেন্দু বলল, ‘চেষ্টায় তো লেগে আছি। দেখি-
মা এরপর পাশের ঘরে চলে গেল। শুভেন্দু আমার আর শুক্লার দিকে তাকিয়ে মিচকি মিচকি হেসে বলল, ‘কোনরকমে ম্যানেজ করেছি বল? নইলে মাসীমা এখুনি চেপে ধরত আমায়।
শুক্লা ওর কথা শুনে প্রথমে চোখটা বড় করেছে। তারপর হাসতে হাসতে আমাকে বলল, ‘দেখেছিস ব্যাটা কেমন পাজী। মাসীমাকে দিব্যি কেমন বানিয়ে বানিয়ে কথাগুলো বলে গেল।’
শুভেন্দু একটু সিরিয়াস হয়ে বলল, ‘দেখ শুক্লা, এখন আমার বিয়ের থেকেও সবথেকে বড় ইমপরট্যান্ট জিনিষটা হচ্ছে দেব আর বিদিশার আবার মিল হয়ে যাওয়া। আরে আপন কা ক্যায়া? কিসিকো ভী শাদী করলেগা ইয়ার। লেকিন এ যো পড়া হ্যায় না বিস্তার মে। তেরে সামনে? পহেলে ইসকা জিন্দেগী বস জানে দে ইয়ার। বহূত ইন্তেজার কিয়া। অব আয়া ও শুভঘড়ি। এ মেরে সবসে প্যায়ারা দোস্ত। জিসকা শাদী মে ম্যায় জবরদস্ত নাচুঙ্গা। আরে ইয়ে মেরে ইয়ার কি শাদী হ্যায়। এ মেরে ইয়ার কি শাদী হ্যায়।’
শুভেন্দু একটু এগিয়ে এসে আমার হাতটা ধরে গান গাইতে শুরু করল, ‘এ দোস্তী। হাম নেহী তোরেঙ্গে। তেরা সাথ না ছোড়েঙ্গে। ‘
আমিও ওর সাথে গলা মেলাতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে নিজেই খেই হারিয়ে, হাত ছেড়ে দিল। তারপর আক্ষেপের সুরে বলল, না, এই হেঁড়ে গলায় আমার দ্বারা আর গান হবে না। নারে শুক্লা, তোর মত আমাকেও গানটা শিখতে হবে দেখছি দেবের কাছে।’
মা হঠাৎই ঘরে ঢুকেছে আবার। যেন মা’রও বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চাইছে না। বহুদিন পরে খুব চেনা, কাছের জনকে দেখলে যেমন মনটা আকুলতায় ভরে যায়, নিজের চোখকেও অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমি যা দেখছি, সত্যি দেখছি তো? নাকি ভুল দেখলাম? মা সেভাবেই ঘরে ঢুকে বলল, ‘বারান্দা থেকে দেখলাম বিদিশা ট্যাক্সি থেকে নামছে। কতদিন পরে ওকে আবার দেখছি। হ্যারে দেব? সত্যি আমি ওকে দেখলাম তো? না, বিদিশার মত দেখতে অন্য কোন মেয়ে? কিন্তু আমার চোখ কি এতটাইই ভুল হবে?
শুভেন্দু বলল, ‘না মাসীমা। আপনি ঠিকই দেখেছেন। বিদিশাই এসেছে। ও সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসুক। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিচ্ছি।’
পরবর্তী আপডেট একটু পরেই
06-07-2021, 11:17 PM
বিদিশা এসেছে। মা’র মুখ থেকে বিদিশার নামটা শুনেই, আমার ভেতরটা কেমন যেন হয়ে গেল। শুভেন্দু তখন উঠে গেছে দরজা খুলে বিদিশাকে ফ্ল্যাটে ঢোকাবে বলে। আমি শুক্লার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শুক্লাও আমার দিকে। কিছুক্ষণ চুপচাপ, দুজনের মুখেই কোন কথা নেই। শুক্লা বলল, ‘কি রে দেব? এবারে তুই খুশি তো? বিদিশা তো এসেছে।’
আমি বললাম ‘হ্যাঁ। এসেছে। এই হতভাগাটাকে দেখতে এসেছে।’
শুক্লা বলল, ‘নিজেকে হতভাগা বলছিস? আরে তুই তো খুব ভাগ্যবান। নইলে যে মেয়েটা কবে তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আবার তার তোর কাছেই ফিরে আসা, এগুলো সব গল্পে হয়। কিন্তু বাস্তবে? আমি তো ভাবতেই পারি না। মনে কর, আজ থেকে তুই পৃথিবীর সব থেকে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি। যার জীবনে দূঃখ বলে কিছু নেই।’
আমি কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শুক্লাকে বললাম, ‘সময়টা মনে হচ্ছে আবার ভাল হয়ে গেল। তাই নারে শুক্লা?’
শুক্লা বলল, ‘ভালো মানে? মনে কর, এটাই তোর জীবনের সেরা সময়। তাছাড়া তুই তো কোন অন্যায় করিস নি। ভগবান তোকে শুধু শুধু কষ্ট দিতে যাবে কেন?’
আমি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। শুক্লাকে বললাম, ‘হ্যাঁ। ঠিক তাই। ভগবান অকারনে কাউকে কষ্ট দেয় না।’
শুক্লা একটু খুনসুটি মেরে আমাকে বলল, ‘এই দেব, আমি কিন্তু একটু মজা করব। তুই কিন্তু চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকবি। বিদিশা ঘরে ঢুকবে। আমি বলব, দেব এখন ঘুমোচ্ছে। ডাক্তার বলে গেছে ওর ঘুম না ভাঙাতে। তারপর ওর সাথেও খুনসুটি করব। তুই চোখ বন্ধ করে সব শুনবি।’
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। শুক্লা আমাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘না, না, আজ কোন কথা আর শুনছি না। আরে বাবা আমরাও তো একটু আনন্দ করব, তাই নয় কি? তোর আনন্দ মানে তো আমাদেরও আনন্দ।’
আমি বললাম, ‘সে ঠিক আছে। কিন্তু শুভেন্দু তো জানে। ওই দেখবি, বিদিশাকে সব বলে দেবে। দেব ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। তুই তখন খারাপ হবি, আর সেই সাথে আমিও।’
শুক্লার কি খেয়াল হল, হঠাৎই উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। শুভেন্দু তখন আমাদের ফ্ল্যাটের মেন দরজাটা খুলে ওয়েট করছে বিদিশার জন্য। বিদিশা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসছে। শুক্লা শুভেন্দুর কাছে গিয়ে কানে কানে কিসব বলে এল। মা’কেও বলেদিল খুনসুটি করবার ফন্দীটা। ঘরে ঢুকে বলল, ‘শুভেন্দুকে বলে দিয়েছি, সেই সাথে মাসীমাকেও। বিদিশা কিছু বুঝতেই পারবে না।’
আমি বললাম, ‘দেখিস, বিদিশাও কিন্তু খুব ঝেমেলায় আছে। মজা করতে গিয়ে শেষকালে আবার ও যেন কোন ব্যাথা না পায়।’
শুক্লা বলল, ‘আরে না না, ওটাতো পাঁচ মিনিট থেকে দশমিনিটের জন্য। তারপর তুই নিজেই চোখ খুলবি। যেন তোর ঘুম ভেঙেছে, এইভাবে। চোখ খুলেই বিদিশাকে বলবি, ও বিদিশা? তুমি এসেছো? কখন এলে? তার আগের কোন কথাই তুই শুনতে পাসনি।’
ফন্দীটা উগড়ে দিয়ে শুক্লা খিলখিল করে হাসতে লাগল। তারপর নিজেই আবার চুপ হয়ে বলল, ‘এই এই এই বিদিশা এসে গেছে। আমি ওর গলার আওয়াজ পাচ্ছি। তুই চোখ বন্ধ কর, আমি মুখটা গম্ভীর করে নিচ্ছি।’
আমি বললাম, ‘আরে তোরা জোরে জোরে কথা বললে তো আমার এমনিই ঘুম ভেঙে যাবে। তখন?- শুক্লা বলল, ‘আরে না না। আমরা আসতে আসতেই কথা বলব। যাতে তোর ঘুম না ভাঙে। তুই চিন্তা করিস না। এবার চোখটা বন্ধ করো তো। বাবা লক্ষ্নী ছেলে।’ লক্ষ্নী ছেলের মতন আমিও চোখটা বন্ধ করে নিলাম। শুক্লা আমার মাথার কাছেই সেই ঠাই বসে রইল। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলাম। বিদিশা ঘরে ঢুকে আমাকে দেখবে, অথচ আমি ওকে দেখতে পাব না। আমার মুখের দিকে হয়তো কিছুক্ষণ তাকিয়েও থাকবে। কিন্তু আমি ওর মুখের অভিব্যক্তিটা বুঝতেই পারব না। বিদিশা হয়তো আমার মাথার কাছে এসে বসতে চাইবে। আমার মাথায় হাত বুলোতে চাইবে। কিন্তু আমি ওর হাতের স্পর্ষ পাব না। ইস কি জ্বালায় পড়েছি। শুক্লার মন রাখতে গিয়ে আমাকে এখন ঘুমোবার অ্যাকটিং করতে হচ্ছে। আমি চোখটা পুরোপুরি বন্ধ করে ফেলেছি। আমাকে অবাক করে শুক্লা বলল, ‘চিন্তা করিস না। আমি এখন যেখানে বসে আছি। বিদিশা ঘরে ঢুকলে ঠিক তোর মাথার কাছটাতেই ওকে বসাব। যাতে চোখ খুলে তুই প্রথম ওকেই দেখতে পাস।’ শুক্লা যেন আমার মনের ইচ্ছাটা আগে থেকেই বুঝতে পারে। চোখ বন্ধ করে ওকে বললাম, ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই বসে থাকনা এখন। কে তোকে মানা করছে?’ শুক্লা হাসতে লাগল, খুব আস্তে আস্তে। যেন খুব মজা পেয়েছে। তারপরেই চুপ করে গেল। কারণ বিদিশা তখন শুভেন্দুর পেছন পেছন ঘরে ঢুকেছে। আমি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ওর উপস্থিতি টের পাচ্ছি। ঘরে ঢোকার পরে শুক্লা প্রথম যে কথাটা বিদিশাকে বলল, শুনে আমার মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গেল। শুক্লা ওকে বলল, ‘একিরে বিদিশা? কি চেহারা করেছিস। কেমন উসখো খুসকো দেখাচ্ছে তোকে। তোরও কি শরীর খারাপ নাকি?’ বিদিশা কোন জবাব দিল না। মনে হল আমার খাটের উল্টোদিকের চেয়ারটায় বসল বিদিশা। যেখানটায় শুভেন্দু এতক্ষণ বসেছিল। শুক্লা বলল, ‘আয় আয় আয়। তুই বরং এখানে এসে বস। দেবের মাথার কাছে। তবে হ্যাঁ। দেব এখন ঘুমোচ্ছে। আমি এসেছি, সেই থেকে দেখছি ঘুমোচ্ছে। ডাক্তার বলে গেছে একটু রেস্ট দরকার। আমি আর শুভেন্দু আসতে আসতে কথা বলছিলাম। দেবকে সেভাবে ডিস্টার্ব করিনি।’ বিদিশাও বলল খুব আসতে আসতে। ‘এখন কেমন আছে ও?’ শুক্লা বলল, ‘ভালো। এই তো ঘুমের মধ্যেই এতক্ষণ বিড় বিড় করছিল। তোর নাম করছিল। তুই যে এখানে আসছিস ও জানে না।’ মনে হল বিদিশা শুভেন্দুকে কিছু বলতে চাইছে। শুভেন্দুও নিজে থেকে বলল, ‘হ্যাঁ আমিও কিছু বলিনি। ব্যাপারটা সারপ্রাইজ থাক। ও চোখ খুলে তোকে দেখুক। কি বল শুক্লা?’ শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ তাই তো। দেব কিন্তু চোখ খুলে তোকে দেখলে খুব খুশি হবে। বিদিশা ছাড়া দেব যেন কত মনমরা হয়েছিল এতদিন। রাধা ছাড়া কৃষ্ণের বাঁশি শুনতে কি আর ভাল লাগে? এত দরাজ কন্ঠ, এত মিষ্টি গান। এ গান কার জন্য? একজনই তো আছে দেবের একমাত্র প্রেমিকা।’ শুভেন্দু সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘ঠিকই বলেছিস। আর আমরা হলাম সব ফেউ। যত উলুখাগড়ার দল। না আমরা দেবের কোন উপকারে আসব, না বিদিশার জায়গাটা কোনদিন নিতে পারব।’ শুক্লা শুভেন্দুকে বলল, ‘না না তুই ও কথা বলিস না। তুই দেবের জন্য অনেক করিস। দেব নিজেও সেটা স্বীকার করে। তোর মতন বন্ধু হয় না।’ শুভেন্দু আবার হেঁড়ে গলায় গান শুরু করল, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে? আমার মত মিষ্টার?’ শুক্লা সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘এই এই এই। দেবের ঘুম ভেঙে যাবে। অত জোরে চিল্লাস না।’ শুভেন্দু বলল, ‘জাগা না ওকে। বিদিশা এসেছে। একবার চোখ খুলে, নয়ন মেলে দেখুক। আহা কি আনন্দ আজ আকাশে বাতাসে।’ বিদিশাও বলল, ‘না না ও ঘুমোচ্ছে। ওকে জাগাতে হবে না। এই তো আমি ওর কথা সব তোদের কাছে শুনছি।’ মা সেই সময় ঢুকলো ঘরে। শুভেন্দু নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে নিল। ঘরে ঢুকেই বিদিশার দিকে তাকিয়ে মা বলল, ‘ভালো আছো বিদিশা? কতদিন পরে তোমায় দেখলাম।’ বিদিশাও এই প্রথম এতদিন পরে মাকে দেখল। চেয়ার ছেড়ে উঠে মা’কে প্রনাম করল পা ছুঁয়ে। মা বলল, ‘থাক থাক। ভালো থাকো মা। আশীর্ব্বাদ করি।’ শুক্লা তখন বুড়ো আঙুল দিয়ে আমার গায়ে একটু ঠেলা মেরে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে, মায়ের চরণ ছুঁয়েছে বিদিশা। কিন্তু আমি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই সব বুঝতে পারছি। একটু চোখটা অল্প বিস্তর ফাঁক করে পিট পিট মতন করে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখছি, সত্যি বিদিশার মুখ যেন কত বিষাদে ভরা। যেন চিন্তায় চিন্তায় সারা রাত ঘুম হচ্ছে না ব্যাচারার। তার ওপর আমার শরীর খারাপের খবরটা পেয়েছে। দৌড়ে চলে এসেছে আমার কাছে। মনে মনে বললাম, ‘বিদিশা তুমি এসো কাছে। পারলে এখুনি শুক্লার জায়গাটা দখল করো। এই শুক্লা, তুই উঠে যা না? বিদিশাকে আমার মাথার কাছে বসতে দে না? কেন কেন শুধু শুধু তোরা ওকে বুঝতে দিচ্ছিস না? আমিতো জেগেই আছি। মিছি মিছি ঘুমোবার ভাণ করে তোদের সব কথা শুনছি। শুক্লা? তুই কি এভাবেই আমার মাথার কাছে বসে থাকবি? তাহলে বিদিশা এখানে এসে বসবে কি করে? শুভেন্দু সেই সময় বলল, ‘আচ্ছা শুক্লা এমন তো নয়? দেব হয়তো জেগেই আছে। আমাদের সবকথা শুনছে? ওর গায়ে একবার ঠেলা মেরে দেখ না? সত্যি ঘুমোচ্ছে কিনা?’ শুক্লাও তেমনি। জবাবে বলল, ‘ না না। দেব এখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। এইসময় জাগানোটা ঠিক হবে না। এত ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? বিদিশা তো এই সবে এল। ও কি পালিয়ে যাচ্ছে না কি?’ আমার শুক্লার উপর খুব রাগ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল এই দশ মিনিট সময়টাই যেন অনেক লম্বা সময়। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। এই মেয়েরা কেন এত অবুঝ হয় বুঝি না। পুরুষের মন বোঝে না। দূঃখ কষ্ট বোঝে না? ব্যাচারা এল এত কষ্ট করে, আমার শরীর খারাপের খবর পেয়ে। তাকে আর আমাকে নিয়ে এখন শুক্লার মজা। মজা আমি বার করছি।
06-07-2021, 11:22 PM
মনে মনে এটাও ভাবলাম, শুক্লার উপরই বা কেন চটছি? চোখ খোলার দায়িত্বটাও তো আমারই হাতে। আমি যদি এখন জোর করেই চোখটা খুলে ফেলি, তাহলে বিদিশাকে দেখব, সরাসরি চোখটা যাবে বিদিশার মুখের দিকে। আর শুক্লা মনে মনে গজরাবে, ব্যাটাকে এত করে বললাম, তাও আমার কথা রাখল না? ঠিক চোখ খুলে ফেললো? কি না ওর রাধা এসেছে কৃষ্ণের বাঁশি শুনবে বলে? শুভেন্দুর কথাটাই তাহলে ঠিক। বিদিশা কাছে থাকলে দেবের কাছে সবাই ফেউ। বন্ধু হিসেবে আমাদের সত্যি কোন মূল্য নেই।
মা বলল, ‘বিদিশা চা খাবে তো?’
বিদিশা লজ্জায় কিছু বলতে পারছে না যেন। শুভেন্দু ফোড়ন কেটে বলল, ‘মাসীমা এই নিয়ে আপনার এটা কত নম্বর চা বানানো হচ্ছে? দেবের কথাটা খেয়াল আছে তো?’
শুক্লা বলল, এই যাহ্। পাজী কোথাকার। মাসীমার সাথেও ইয়ার্কি? বিদিশাও কি ভাবছে বলতো?
শুভেন্দু সঙ্গে সঙ্গে বলল, ‘সেটাই তো বলছি। সাধে কি আর বলছি? মাসীমার দশা দেখে বলছি। এটাই লাস্ট। কারণ এতদিন পরে বিদিশা এসেছে বলে। এরপর যেগুলো আসছে, সেগুলো সব ফেউ মাল। ওদেরকে চা করে খাওয়াতে খাওয়াতে মাসীমার আরও কষ্ট হবে।
বিদিশা বলল, ‘কেন? কারা আসছে এরপরে?’
শুভেন্দু বলল, ‘ওই যে পুঁচকে দম্পতি। মাধুরী আর রনি। যাদেরকে তুই দেখলি সেদিন। আমাদের বাড়ীতে।’
বিদিশা বলল, ‘ওহ্। তা বলে ওরা কি পুঁচকে নাকি? ছেলে হয়ে গেছে যার, সে আবার পুঁচকে হয় কি করে? তাছাড়া রনি তো তোদেরই বন্ধু। মাধুরী শুধু আমাদের থেকে ছোট।’
শুভেন্দু বলল, ‘তোদের কাছে পুঁচকে না হলেও। আমার কাছে ওরা পুঁচকেই। তাছাড়া আমি তো তোদের সবার থেকে বড়। এখানে যারা বসে আছে, সবাই আমার থেকে ছোট। এমন কি দেবও।’
শুক্লা বলল, ‘ইস অত সস্তা? বুড়ো খোকা, তোমার এই গুল মারাটা এবার বন্ধ কর।’
শুভেন্দু বলল, শোন বুড়ো হলেও তোদের থেকে আমি অনেক বেশি চনমনে। বরঞ্চ তোরা আমার থেকে ছোট হয়ে বেশি বুড়িয়ে গেছিস।’
বিদিশা বলল, আমি অবশ্য দু ক্লাস জুনিয়র ছিলাম তোদের থেকে। তুই তোয়ার্ক্কিটা হয়ে গিয়েছিল কলেজে পড়ার সময় থেকেই। কিন্তু একজনকে বরাবরই আমি তুমি বলে এসেছি। সেই শুরু থেকেই।’
শুক্লা বোকার মতন বলে বসল, ‘কে সে?’
শুভেন্দু শুক্লাকে ধমক লাগিয়ে বলল, সে কী রে? সাতকান্ড রামায়ণ পড়ে এখন সীতা কার বাপ? বিদিশা কার কথা বলছে তুই এখনও বুঝলি না?’ যার মাথার কাছে তুই বসে আছিস, সেই লোকটা রে-’
শুক্লা যেই বলেছে, ‘ওহ্ তাইতো, ঠিকই তো।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছে করেই ঘুমের ঘোরে একটু কেশে উঠলাম। শুভেন্দু বলে উঠল, নিদ্রাভঙ্গ করে দিলি তো ব্যাচারার? এখন বিদিশাকে দেখেই যদি ব্যাচারার ঘুম ভাঙাবার কষ্টটা দূর হয়।’
শুক্লাকে বলল, ‘তুই ওঠ ওঠ। ওখান থেকে উঠে পড়। বিদিশাকে দেবের মাথার কাছে বসতে দে। কৃষ্ণ এবার তার রাধাকে দর্শন করুক।’
আমি চোখ বন্ধ অবস্থাতেই ভালো মতন বুঝতে পারছি। শুক্লা আমার মাথার কাছ থেকে এবার উঠে গেল।
বিদিশাকে যেন জোর করেই বসিয়ে দিল ঠিক ওই জায়গাতে। বিদিশা আমার মাথার কাছটায় বসেছে। আমি ভাবছি চোখ খুলেই আমি বিদিশাকে এবার দেখব। ও আমাকে এখনও স্পর্ষ করেনি। কিন্তু অনুভূত হচ্ছে মাথার কাছে ওর উপস্থিতি। না ছুঁয়েই এমন? ছুঁলে না জানি কি হবে। আমার অসুস্থ শরীরটার মধ্যে কে যেন আনন্দের বীজ পুতে দিল। একাকীত্বের বেদনা ঘুচিয়ে আমার স্নায়ুতন্ত্র এখন বেশ সবল। ঠিক এই মূহূর্তে বিদিশার মুখটা দেখাটাও বড় প্রয়োজন আমার কাছে। কিন্তু বিদিশাও কি আমার মতন মানসিক অস্থিরতা আর দূর্বলতা কাটিয়ে উঠেছে? ওর ওই উদাস, করুন মুখটা দেখে আমারও যদি আবার মন খারাপ হয়ে যায়? বিদিশা তুমি আমার ভালবাসার টানে আমার কাছে এসেছো। আমিও চেষ্টা করব বিদিশা, তোমাকে যতটা পারি শান্তনা দেবার। আমাকে একবার শুধু চোখটা খুলতে দাও-চোখটা খোলার আগেই শেষবারের মতন শুভেন্দু বলল, ‘এই দেব, চোখটা খোল না। এত ড্রামা করিস কেন? আমরা তো আগেই জানি তুই জেগে আছিস। নে চোখ খুলে এবার তোর দেবীকে দর্শন কর।’
ক্রমশঃ-
06-07-2021, 11:54 PM
Uff.....sei ebar wait korte hobe......ekta besh misti prem kahini.....khub bhalo bhabe likhchen.......eagerly waiting for next
07-07-2021, 09:12 AM
(This post was last modified: 07-07-2021, 09:13 AM by Lekhak is back. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
07-07-2021, 10:46 AM
কালজয়ী একটা উপন্যাস !!!
সাধারণ ভাষায় জীবনের অসাধারণ অনুভূতিগুলো কি স্বাভাবিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে প্রত্যেকটা পাতায় পাতায় ....
07-07-2021, 10:50 AM
(04-07-2021, 07:24 PM)Lekhak is back Wrote: অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। অবশ্যই সিরিজা শেষ করবার পরিকল্পনা আছে। আমি আরো 5টি উপন্যাস লিখেছি, এক) নিষিদ্ধ স্বাদ, দুই) কামাগ্নি রেশমা, তিন) আমার একমাত্র শালী, চার) কামপুরুষ ও পাঁচ) রেবতী। যেগুলো অসমাপ্ত রয়ে গেছে। ইচ্ছা আছে পোস্ট করবার। উত্তর দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আপনার সব গল্পই আমার পড়া। যেখানে যে সাইটে পেয়েছি পড়েছি। সবকটাই দারুন। এই গল্পটা আগে পড়িনি। আপনার লেখার অদ্ভুত এক মায়া আছে. যত পড়ি মনে হয় আরো একটু পেলে ভালো হতো। . চালিয়ে যান.দাদা ।
07-07-2021, 12:40 PM
(This post was last modified: 07-07-2021, 12:42 PM by Lekhak is back. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
07-07-2021, 12:41 PM
07-07-2021, 02:12 PM
চোদ্দো
শেষপর্যন্ত শুভেন্দু যে হঠাৎই পাল্টি খেয়ে বসবে, না ওটা আমি আশা করেছিলাম, না শুক্লাও। এমন ভাবে বলল কথাটা, আমি শেষ পর্যন্ত চোখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারলাম না। বিদিশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে শুভেন্দুর দিকে। একটু আগে শুক্লা যে কথাগুলো ওকে বলেছে, ডাক্তার বলেছে ঘুমোতে, রেস্ট নিতে। ওকে ডিসটার্ব করা বারণ, তাহলে ওগুলো সব শুক্লার মন গড়া কথা? পুরো বেইজ্জ্বতের মত অবস্থায় পড়ে শুক্লাও মুখটাকে কাচুমুচু করে নিয়েছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুভেন্দুকে গাল পাড়ছি, শালা ঢ্যামনা। দিলি তো সব ফাঁশ করে। এখন বিদিশা কি ভাবছে?
আমাকে চোখ খুলতে না দেখে, শুভেন্দু ম্যানেজ করে নিল। শুক্লাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শুভেন্দু বলল, ‘নারে শুক্লা, আমার মনে হল দেব যেন জেগে আছে। এখন দেখছি সত্যিই ও ঘুমোচ্ছে। আসলে মালটা এমনই ঘুমের ঘোরেও সব শুনতে পায়। দেখবি ঘুম থেকে উঠে বলবে, ‘তোরা এই বলছিলিস, ওই বলছিলিস। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব শুনতে পেয়েছি।’
বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এক কাজ কর বিদিশা, তুই দেবের মাথায় হাত বুলিয়ে দে। দেখ ও ঘুমের ঘোরে কেমন ফিক ফিক করে হাসবে। আসলে দিবারাত্রি তোরই তো স্বপ্ন দেখে সারাক্ষণ। তুই হাত বোলাবি, ও ধরেই নেবে, বিদিশাই হাত বোলাচ্ছে আমার মাথায়।’
শুক্লা বলল, ‘হ্যাঁ শুভেন্দু ঠিকই বলেছে। আমিও তো একটু আগেই হাত বোলাচ্ছিলাম। দেখলাম ঘুমের ঘোরে দুবার বলে উঠল, বিদিশা, বিদিশা, তুমি এসেছ? আমি তখুনি হাতটা তুলে নিলাম। কি জানি চোখ খুলে বিদিশার বদলে আমাকে দেখে যদি মন খারাপ করে বসে?’ এখন আসল লোক এসেছে, সেই হাত বোলাবে।
শুভেন্দুও তাল দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ একদম ঠিক। শুক্লা ঠিক কথাই বলেছে। নে শুরু কর বিদিশা। দেখ ঘুমের ঘোরে ‘দেব’ তোর কেমন নাম নেয়। এখুনি প্রমান পেয়ে যাবি।’
শুভেন্দু আর শুক্লা এমন ভাবে আমাকে চালনা করছে, আমিও মনে মনে প্রস্তুত হয়ে নিচ্ছি। বিদিশা যেই কপালে হাতটা ঠেকাবে, আমিও ওর নামটা নেব। যেন সবকিছু সত্যি সত্যি সফল হয়ে যায়।
অনুভব করলাম একটা নরম হাত স্পর্ষ করেছে আমার কপালে। আমার কপালটা যেন ধন্য হয়ে গেল বিদিশার হাতের স্পর্ষে। শুভেন্দু ফোড়ণ কেটে বলল, ভালো করে বোলা, তবে তো ও বুঝবে, কেউ এসেছে ঘরে। এ মেয়ে বিদিশা না হয়ে যায়ই না। দেখবি ও দুতিনবার ওর নাম নেবে। অবধারিত।’
যেন শুয়ে শুয়ে যাত্রাপালার অভিনয় হচ্ছে। আমি নায়ক, বিদিশা আমার নায়িকা। আর শুভেন্দু হলেন পরিচালক মশাই, তিনি দুজনকেই পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, শিখিয়ে দিচ্ছেন।
বিদিশা এবার আমার কপালে হাত বোলাতে লাগল। চুলেও হাত বুলিয়ে দিল। নরম আঙুলগুলো কতদিন পর এই মাথায় খেলা করছে। সখিকে পেয়ে সখা আনন্দিত, আপ্লুত অভিভূত।
আমি প্রথমে বিদিশার নামটা আর উচ্চারণ করলাম না। একটু চোখ পিট পিট করতে লাগলাম। আর মুখে একটু অল্প হাসি দিলাম। যেন ঘুমের ঘোরেই আমি হাসছি।
বিদিশা এবার বুঝতে পেরে, চোখ বড় বড় করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওমা তুমি তো জেগেই আছ। চোখ বন্ধ করে ঘুমোবার ভাণ করছিলে এতক্ষণ?’আমি ধরা পড়ে গেছি। বেগতিক দেখে শুক্লা, শুভেন্দু দুজনেই চুপ। বিদিশা মাথার ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে আমাকে বলল, ‘চোখটা পুরো খোলো। পিট পিট করছ কেন?’
শুভেন্দু আমার দিকে একটু এগিয়ে এসে শরীরটা ঝুঁকে আমাকে দেখে বিদিশাকে বলল, ‘সত্যি ও জেগে আছে?’
বিদিশা বলল, ‘হ্যাঁ একটু আগে হাসছিল। আমি তো তাই দেখলাম।’
শুভেন্দু বলল, ‘ওটাই তো দেবের স্টাইল। ও যখন ঘুমিয়ে থাকে। তোর স্বপ্ন দেখে, তখন হাসে। দেখ এখন হয়তো তোরই স্বপ্ন দেখছে, আর হাসছে। তা তুই ওর কপালের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিলি কেন? বোলা, যেমন বোলাচ্ছিলিস একটু আগে।’
বিদিশা আবার কপাল স্পর্ষ করছে না দেখে আমিও বললাম, ‘বোলাও না বিদিশা। সরিয়ে নিলে কেন?’
বিদিশা এবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। -তুই বন্ধুতে মিলে ভালই শুরু করেছ। নাও এবার চোখ খোল দেখি। আর অ্যাকটিং করতে হবে না।’
আমি শেষপর্যন্ত চোখ খুললাম। বিদিশার মুখের এই হাসিটাই এতক্ষণ দেখতে চেয়েছিলাম। চোখ খুলে ওকে বললাম, কখন এসেছ?’
আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বিদিশা বলল, ‘তুমি পারো। শরীর খারাপের মধ্যেও কি অদম্য উৎসাহ, কি অফুরন্ত এনার্জ্জী।’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘শরীর তো আমার তোমরাই এসে ভাল করে দিয়েছ। আমার কিচ্ছু হয় নি। দিব্যি ভাল আছি।’
শুভেন্দু বলল, ‘তোমরা নয়, বল তুমি। বিদিশাই তোর শরীর ভাল করে দিয়েছে।’
আমি জোর করে একটু উঠে বসার চেষ্টা করছি। বিদিশা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘থাক থাক, উঠতে হবে না। আবার পেটে যদি চাপ পড়ে। তুমি বরং শুয়েই থাকো।’
শুভেন্দু শুক্লাকে বলল, ‘দেখলি তো শুক্লা। যেই বিদিশা এল আমরা কেমন ফেকলু হয়ে গেলাম। আর আমাদের দুজনের দিকে এরা দুজনের কেউ তাকাবে না। চল চল আমরা বরং পাশের ঘরে গিয়ে বসি।’
বিদিশা বলল, ‘এই ইয়ার্ক্কী হচ্ছে? বস বলছি। মাসীমা এক্ষুনি ঘরে ঢুকবে। কি ভাববে বল দেখি।’
শুভেন্দু বলল, ‘মাসীমা অত বোকা নয়। তোকে আর দেবকে এই ঘরে একা দেখলে থোড়াই ঢুকবে? উনি যেন কিছু বোঝেন না?’
বিদিশা বলল, ‘না তাও। তোরা যাবি না। বস এখানে।’
শুক্লা অবাক হয়ে বিদিশাকে দেখছিল। ওর চোখের কোনায় একটু জল। রুমাল দিয়ে চোখটা মুছে বিদিশা আর আমাদের সবাইকে বলল, ‘এতদিন বাদে বিদিশাকে দেখছি, আমার মনটা যেন সেই অতীতে ফিরে যাচ্ছে। দেবের ভালবাসার প্রতিদান এখন কানায় কানায় পূর্ণ। এই পৃথিবীতে বালি, সাহারার মরুভূমি বলে কিছু নেই।
আস্ত পৃথিবীটাই শস্য শ্যামলে ভরা ক্ষেত। এই পৃথিবীটা হল কোমল,সজীব, সবুজ পৃথিবী।’শুভেন্দু বলল, ‘সহজ করে বল, সহজ করে বল, বাংলায় আমি আবার অগা মূর্খ কিনা? তুই কি শুধু দেবের পৃথিবীর কথাটাই বলছিস, না গোটা পৃথিবীর কথা বলছিস?’
শুক্লা একটু ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলল, তার মানে?
শুভেন্দু বলল, ‘শোন তাহলে। দেবের পৃথিবীটার সাথে কিন্তু গোটা পৃথিবীটাকে তুই মেলাতে পারবি না। ওরটা হল এক্সেপসনাল। এই যেমন তুই আর আমি, তোর আর আমার জন্ম হয়েছে মরুভূমিতে। ওখানেই মরব, ওখানেই সারাজীবন কাটাব। আর দেব বিদিশাকে এতদিন বাদে পেয়েছে। ও ধানক্ষেতে বিদিশাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে। আর গুন গুন করে গান গাইবে। চিরদিনই তুমি যে আমার। যুগে যুগে আমি তোমারই। আমি কি গো? তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব কোনদিন? সঙ্গী। সঙ্গী। আমরা অমর সঙ্গী।’
শুক্লা হেসে বলল, সত্যিরে তুই? কি করে পারিস এত? অমন ভাবে বলছিস, ওরা কি করে প্রেমটা করবে বল দেখি? দেখ বিদিশা কেমন লজ্জ্বায় পড়ে যাচ্ছে।’
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি তাই। বিদিশা মাথাটা একটু নিচু করে নিয়েছে। শুভেন্দু চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘একশবার বলব। হাজার বার বলব। দরকার হলে লাখোবার কোটিবার বলব। কে আছে পৃথিবীতে এমন জোড়িদার? একটা সঙ্গী তুই খুঁজে দেখাতে পারবি? ভালবাসা কি ফেলনা নাকি? যে করলাম আর ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। সত্যিকারের ভালবাসার কোন দাম নেই? বিশ্বাসের কোন দাম নেই? আমার ভালবাসা কি আমাকে প্রেমিকের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারে না? যে বন্ধন অটুট। তা কখনও ভেঙে যায় না। যদি একবার ভাঙে, শুনেছি তা নাকি চেষ্টা করেও জোড়া দেওয়া যায় না। কোথায় তারা? যারা বলেছিল, ভাঙা প্রেম নাকি সহজে জোড়া লাগে না। আমার তাদেরকে বলতে ইচ্ছ করে। এই বিদিশা আর দেবের উদাহরণটাই তুলে ধরতে ইচ্ছে করে। দেখ তোরা রোমিও জুলিয়েটের দল। প্রেম কাকে বলে, দেব আর বিদিশাকে দেখে তোরা শেখ।’
শুভেন্দু এমন ভাবে উত্তেজিত হয়ে কথাগুলো বলেছে, শুক্লা কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। দেখলাম বিদিশার চোখেও জল। হঠাৎ দেখলাম শুভেন্দুর চোখেও জল। চট করে চোখটা মুছে নিয়ে শুভেন্দু বলল, ‘একটু বেশি বলে ফেললাম না? না আমিও আজকাল বড্ড ইমোশোনাল হয়ে পড়ছি।’
07-07-2021, 02:16 PM
মা ঢুকেছে এবার বিদিশার জন্য চা বানিয়ে। শুভেন্দু উত্তেজিত হয়ে এতক্ষণ প্রেমের বানী শোনাচ্ছিল। মা বলল, ‘একি শুভেন্দু? তুমি কাঁদছ?’
শুভেন্দু বলল, ‘না মাসীমা। আমি আবার মেয়েদের কান্না দেখলে কান্না চেপে রাখতে পারি না।’
মা তাকাচ্ছে একবার বিদিশার দিকে, একবার শুক্লার মুখের দিকে। কি হয়েছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। শুক্লাকেই প্রথমে বলল, ‘কি হয়েছে গো, তোমাদের। হঠাৎই শুভেন্দু এই কথা বলছে?’
শুক্লা বলল, ‘মাসীমা শুভেন্দু যা হাসায়, আপনি তো জানেন। হাসতে হাসতে পেট ফেটে এখন চোখে জল চলে এসেছে।’
মা বিদিশার দিকে চায়ের কাপটা বাড়িয়ে বলল, ‘ওহ্ তাই বুঝি? আমি ভাবলাম কি না কি হয়েছে।’
বিদিশা মা’কে দেখেই আমার মাথার কাছ থেকে উঠে পড়ল। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপটা নিল। মা বলল, ‘দেখলে তো দেবকে। মাঝে মধ্যেই এই রোগটা বাঁধায়, আর আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাই।’
বিদিশা একবার মুখ ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। মায়ের দিকে ফিরে বলল, ‘ভাল হয়ে গেছে ও এখন। আর কোন চিন্তা নেই।’
মা বলল, ‘তোমরা সবাই মিলে আমার এই ছেলেটাকে একটু বোঝাও তো। কিছুতেই কথা শুনবে না। হাবিজাবি সব খাবে। আর থেকে থেকেই পেটের রোগ বাঁধাবে।’
মা’কে আমি বললাম, ‘মা এটা তো পেটের রোগ নয়, এটা হল আলসার কোলাইটিস। প্রবলেমটা ইনটেনস্টাইনে হয়।’
মা বলল, ‘ওই হল। রোগ মানেই রোগ। নিজেকে সাবধানে রাখতে হবে তো?
আমি চুপ করে গেলাম। বিদিশা আমার দিকে ঘুরে বলল, ‘শুনেছ তো মা কি বলছে? এবার থেকে নিজের শরীর নিয়ে আর ছেলেখেলা কোরো না। সবসময় তো আর শুভেন্দুকেও পাবে না। মা তখন একা কি করবে বলোতো?’
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে বিদিশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। শুভেন্দু শুক্লাকে বলল, এই বিদিশা দেবকে ধমকাচ্ছে রে। দেখ ‘দেব’ কেমন চুপ। যেন শান্ত শিষ্ট বালক। আর আমরা যদি বলতাম, এক্ষুনি দেব, তেড়েমেড়ে উঠত।’
শুক্লা এবার হাসতে শুরু করেছে। মা’ও একটু হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি যেন বকা খেয়েছি, এইভাবেই বিছানায় করুন মুখটা করে শুয়ে রয়েছি।’
বিদিশা বলল, ‘না না। ধমক কোথায়? নিজের শরীরের দিকে আগে খেয়াল রাখতে হবে তো? তারপরে তো সব। ও নিশ্চই খাওয়াদাওয়াতেও অনিয়ম করে, তাই এরকম হয়। আমি জানি নিজের শরীরের দিকে ও একদমই তাকায় না।’
শুক্লা বলল, ‘এক কাজ করবি। তুই এবার এসেগেছিস। দেবকে নিজের হাতে তুই খাইয়ে দিবি। দেব তোর হাতের ছোঁয়া ছাড়া জলস্পর্ষও করবে না।’
বিদিশা বলল, ‘ইস। ও যেন বাচ্চা ছেলে।
শুভেন্দু বলল, ‘শোন বিদিশা, বাচ্চা হয়ে যতদিন থাকা যায় ততই ভাল। বুড়ো হলেই যত বিপত্তি। এই দ্যাখ, আমিও কেমন দেবের মতন। শান্ত শিশু। দেব শুধু বিছানায় শুয়ে আছে, আর আমি বসে আছি, এই যা তফাত।’বিদিশা বলল, ‘তুমি আর কথা বোলো না। বাচ্চা হয়েই থাক চিরকাল। বিয়ে থা আর কোরো না। তোমাকে খাওয়াবারো কেউ নেই।’
শুভেন্দু বিদিশাকে বাঁধা দিয়ে বলল, ‘কে বলছে তোকে? আমার বউদিরা সব আছে না? ওরাই তো আমাকে খাইয়ে দেয়।’
শুক্লা এবার হাসতে শুরু করেছে। ফোড়ন কেটে বলল, ’এই শুরু হল শুভেন্দুর আবার ফাজলামী। সত্যি পারে ও।’
বিদিশা চায়ের কাপটা নিয়ে আবার আমার মাথার কাছটায় বসেছে। একনাগাড়ে শুয়ে থাকতে আমারও ভাল লাগছে না। দেহটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতেই বিদিশা বাঁধা দিয়ে বলল, ‘হু হু। একদম নয়। ওঠার চেষ্টা একদম করবে না। তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি।’
আমি যাও বা শরীরটাকে নিয়ে একটু কসরত করে নিজেকে ঠেলা মেরে ওঠবার চেষ্টা করছিলাম, বিদিশার বকানির ঠেলায় আমার প্রত্যাশা আর পূর্ণ হল না। শুভেন্দু ঠিক বুঝে নিয়েছে ব্যাপারটা। শুক্লাকে বলল, ‘আজ দেবের কপাল সত্যি খারাপ। দিদিমনি এসে গেছেন। ছাত্রকে থেকে থেকেই বকা দিচ্ছেন।’
আমি হাসব না কাঁদব, তাই বুঝতে পারছি না। বিদিশা বলল, দেখ কোনো মানে হয়। ডাক্তার মানা করে দিয়ে গেছে। তাও ও জোর করে ওঠবার চেষ্টা করছে। আবার যদি পেটে ব্যাথা শুরু হয়?’
শুক্লাও সায় দিয়ে বলল, ‘হ্যা রে দেব। তুই জোর করিস না। অন্তত আজকের দিনটা একটু রেস্ট নে।’
শুভেন্দু বলল, ‘শুধু আজকের দিনটা কি? ডাক্তার তো বলেছে ওকে সাতদিন রেস্ট নিতে।’
আমি বললাম, ‘তাহলে আমি মরে যাব। এভাবে বিছানায় মরার মতন পড়ে থাকতে আমি পারব না। তোরা এসেছিস, আমি উঠে বসতে পারছি না। ভীষন বিরক্তি কর।’
আমার কাছে এগিয়ে এসে শুভেন্দু বলল, ‘এই সিরিয়াস বলছি, পাশের ঘরে যাব? তোদের একটু নিরিবিলিতে ছেড়ে দিই কি বল?’
বিদিশা চা খেতে খেতেই বলল, ‘এই যে পাশের ঘরে যাবার কিছু হয় নি। অত উদারতা দেখাতে হবে না। আমি যেন এখুনি চলে যাচ্ছি।’
আমি শুয়ে শুয়ে অতি উৎফুল্ল হয়ে বিদিশাকে বললাম, ‘তুমি থাকবে বিদিশা?’
বিদিশা বলল, ‘কেন? থাকলে তুমি খুশি হবে না?’
আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলছে বিদিশা। সেই চেনাপরিচিত মুখদৃষ্টি। বিদিশার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি, মনের মধ্যে যে ঝড়টা উঠেছিল, সেটা যেন ও অনেক কাটিয়ে উঠেছে। এখন আর দ্বিধা নেই। বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা, এগুলোকে কাটিয়ে ওঠবার মানসিকতা নিয়ে ফেলেছে ও। ওর চোখের পরিভাষা সেই কথাটাই বলছে।
আমাকে থ মেরে শুয়ে থাকতে দেখে, শুভেন্দু বলল, একিরে দেব? স্ট্যাচু হয়ে গেলি কেন? বিদিশার কথার জবাব দে।’শুক্লা বলল, ‘দেব মনে হয় এখনও বিশ্বাস করতে পারছে না যে বিদিশা ওর কাছে থাকবার জন্যই এসেছে।’
আমার যেন খানিকের ঘোরটা একটু কাটল। শুভেন্দু আর শুক্লা দুজনকেই বললাম, ‘আমি জীবনে অনেক কঠিন জিনিষটা খুব সহজ ভাবে বিশ্বাস করে এসেছি। অথচ কত সহজ, কত সরল, মনের কথাটা কেউ মন থেকে বললে, কেন মনে হয় আমার বিশ্বাস করতে কেন এত কষ্ট হচ্ছে। বিদিশা এতদিন পরে আমার বাড়ী এসেছে, ওকে সেই আগের মতন দেখছি বলেই আনন্দে বিশ্বাস করতে পারছি না।’
বিদিশাকে বললাম, ‘বাড়ীতে বলে এসেছো? তোমার মা’ বাবাকে?’
বিদিশা বলল, ‘বলেছি, আজ আর বাড়ী ফিরব না। তোমার এখানে থাকব। কাল সকালে আমি চলে যাব।’
শুভেন্দু এবার চোখটা বড় করে ফেলেছে। গোল গোল করে বিদিশার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এবার আমার মতই শুভেন্দুর অবস্থা। এ যেন আশাতীত। বেশ বড়সড় একটা ঢোঁক গিলে শুভেন্দু বলল, ‘ওরে তুই তো ষোল আনা দেবের আকাঙ্খা পূর্ণ করলি। দেবের এখানে থাকবি বলে তুই বাড়ীতে বলে এসেছিস? গ্রেট। এইজন্যই প্রাইভেসির ব্যাপারটা তখন পাত্তা দিচ্ছিলি না। আমি আর শুক্লা যখন বাড়ী ফিরে যাব, তখন তোরা মনের আনন্দে প্রেম সারবি?’
আমার কেমন মনে হল, শরীরের মধ্যে আনন্দশ্রোতগুলো সব বইতে শুরু করেছে। কে বলবে আমি একজন অসুস্থ রুগী। আমার শিরা উপশিরাগুলো সব আনন্দে ধেই ধেই করে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। রক্ত চলাচল স্বাভাবিক। পেটের ব্যাথা অদ্ভূত ভাবে পুরোপুরি গায়েব। আমি একজন পুরোনো হারিয়ে যাওয়া প্রেম ফিরে পাওয়া ভাগ্যবান প্রেমিক। আমার মনের মধ্যে আর কোন কষ্ট নেই। আমার জীবনে কোন একাকীত্ব নেই। আমি এখন নাচতে পারি, গাইতে পারি। বিদিশাকে নিয়ে কত কি করতে পারি।
শুভেন্দু দেখলাম হেঁড়ে গলায় আবার গাইতে শুরু করেছে, আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। শাখে শাখে পাখী ডাকে। কত শোভা চারিপাশে। আহা কি আনন্দ-
শুক্লা বলল, ‘তুই থামবি। তখন থেকে কিশোরকুমার, মহম্মদ রফি হবার চেষ্টা করছিস। দেখ বিদিশা আরো কিছু বলবে। আমরা ওর কথাটা বরং শুনি মন দিয়ে।’
শুভেন্দু গান গাওয়াটা বন্ধ করে দিল। বিদিশা তখন চা খাওয়াটা সবেমাত্র শেষ করেছে। শুক্লা আর শুভেন্দুর দিকে তাকিয়ে বিদিশা বলল, ‘এই মাঝখানে একটা দিন, অনেক ভেবেছি, নিজের মনের সাথে শুধু লড়াই করেছি। একবার শুধু ভাবছি, আমি দেবকে সত্যি কথাটা বলতে গিয়েও কেন পারলাম না? আমার নিজের সততাটা কেন এখানে জাহির করতে পারলাম না? আমি কি দেবের কাছে ছোট হয়ে যাব বলেই সত্যি কথাটা বলতে ইতস্তত করে ফেললাম? বললাম যখন পুরোটা কেন বললাম না? দেবকে একদিন বিশ্বাস না করে আমি চলে গিয়েছিলাম। আবার যখন ফিরে এলাম, বিশ্বাসটা কেন পুরোপুরি ফিরিয়ে আনতে পারলাম না? আমার মনে হয়েছিল আমি হয়তো ছোট হয়ে যাব দেবের কাছে। ভুল আমি করেছি, দেবের তো কোন ভুল নেই। কিন্তু ভুলের প্রায়শ্চিত্ত যখন করতে চাইছি, তখন আমার অনেক জ্বালা, আমার অনেক বাঁধা আর প্রতিবন্ধকতা। বারে বারেই আমার মনকে শুধু পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। দেবের জীবনের অনেকটা সময় নষ্ট করেছি আমি। আমার জন্যই শুধু শুধু ও কেন এত কষ্ট সহ্য করবে? আজ যে আমার ওখান থেকে ফিরে এসেও এত সমস্যা। কে আছে এমন? এত কিছু ঝেমেলা সত্ত্বেও আমাকে-
07-07-2021, 02:18 PM
বিদিশা পুরো কথাটা বলতে গিয়েও পারল না। হু হু করতে কাঁদতে লাগল অঝোরে।
আমি ওকে শুয়ে শুয়ে সান্তনা দেবার চেষ্টা করছি। শুক্লা বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, এই পাগলি মেয়ে। তাকা আমার দিকে। দ্যাখ, একবার।
বিদিশা মুখ তুলে তাকালো। ওর চোখে তখন জল ছলছল করছে।
শুক্লা হাসিমুখে বলল, ‘প্যায়ার করনে ওয়ালে কভি ডরতে নেহী। যো ডরতে হ্যায়। ও প্যায়ার করতে নেহী। গানটা শুনিস নি।?’
বিদিশা বলল, ‘সব শুনেছি, সব শুনেছি। কিন্তু কোথাও যেন- মনের ভেতরে খুব কষ্ট হয় রে। তাই তো ভাবি, না বুঝে শুনে কাউকে কখনও কষ্ট দিতে নেই। কাউকে দূঃখ দিতে নেই। ভগবান তাকে সুখী করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কি? আমিও কি জীবনে সুখী হতে পারলাম? বিয়ে করলাম যাকে একপ্রকার জোর করেই, নিজের প্রেমের সাথে প্রতারণা করে। এতদিন শুধু বিভীষিকার মতন কাটিয়েছি। দম বন্ধ হয়ে মরে যাচ্ছিলাম। একটা মানুষ যখন মনের কোনায় ছবির মতন এঁকে যায়, তার মুখটাই শুধু ভেসে ওঠে। আমার কেন জানি না ওই অবস্থার মধ্যে আমি শুধু দেবের কথাই চিন্তা করে গেছি। শুধু ভেবেছি, আমার জীবনে কি ঘটবে, আগাম ভবিষ্যত আমি জানি না। কিন্তু দেব কাউকে বিয়ে করে সুখী হোক। হয়তো আমার থেকে অনেক ভাল মেয়ে পাবে ও। আমি তো পোড়ামুখি। সুন্দরী শুধু। আমার রূপটাই আছে। আর কিছু নেই।’
শুক্লা বিদিশাকে শান্তনা দেবার চেষ্টা করছে। উঠে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বলল, ‘ছিঃ। অমন করে বলতে আছে? ভুল তো মানুষ মাত্রই হয়। আমার হয় নি? আমিও জীবনে অনেক ভুল করেছি। তারজন্য নিজেকে কষ্ট দিয়ে কোন লাভ আছে বিদিশা? যা হয়েছে ভুলে যা। মনে কর ওগুলো তোদের জীবনে কিছুই ঘটেনি। তাহলেই হল। তোরা আবার নতুন করে জীবন শুরু কর।’
বিদিশা তবু কান্না থামাচ্ছে না। ওকে এভাবে চোখের সামনে চোখের জল ফেলতে দেখছি, আমার ভেতরে আনন্দশ্রোতটা আবার কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। অস্বস্তিও হচ্ছে, আবার ভাবছি, মা যদি আবার এখুনি ঘরে ঢুকে পড়ে, তাহলে আরও মুশকিল হবে। ওর পিঠে একটা হাত রেখে বললাম, ‘বিদিশা কেঁদো না অত। সব ঠিক হয়ে যাবে। এতদিন বাদে তুমি এসেছ। আজ শুধু আনন্দ করো।’
বিদিশা এবার শুভেন্দুর দিকে তাকাল। শুক্লাকে বলল, ‘এই লোকটা, জানিসরে শুক্লা, সব বলেছি ওকে। শেষ পর্যন্ত ফোনে আমাকে একটা কথাই বলল, ‘বাড়ীর গোটা ছাদটাই তোদের দুজনকে দিয়ে দিয়েছিলাম। সব বললি, আর নিজের কষ্টটা দেবকে খুলে বলতে পারলি না? দেব কি তোকে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিত? তুই এখনও দেবকে বুঝতে ভুল করছিস বিদিশা। এরজন্য তুই নিজেই পরে আফশোস করে মরবি। আমারও তখন আর কিছু করার থাকবে না।’
আমি সব জানি, তবুও নির্বাক হয়ে চেয়ে রয়েছি ওদের দুজনের দিকে। শুভেন্দু বিদিশাকে এবার ধমক দিল।
ওকে বলল, ‘থামবি তুই? তখন থেকে প্যান প্যান প্যান। কি হয়েছে? কি দোষ করেছিস তুই? কিছু দোষ করিসনি। কিছু হয় নি। সব ঠিক আছে। এবার হাস তো?’ঠিক ওই অবস্থায় বিদিশার মনকে সান্তনা দেবার মত যেন আমি ছাড়া আর কেউ নেই। এক প্রকার জোর করেই উঠে বসলাম বিছানার ওপরে। শুভেন্দু আর শুক্লা দুজনেই আমাকে উঠে বসতে দেখে চমকে গেছে। বিদিশাও প্রথমে খেয়াল করেনি। উঠে বসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বিদিশার মাথাটাই তখন আমার বুকে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। শুভেন্দু আর শুক্লার সামনেই বিদিশার কপালে একটা চুমু খেলাম। চোখে চোখে চোখ রেখে বললাম, ‘কান্না থামাবে তুমি? তুমি কি চাও আমি আবার অসুস্থ হয়ে যাই? না সুস্থ হয়ে তোমার সাথে আগের মত প্রেম শুরু করি।’
বিদিশা আমাকে ঠেলা দিয়ে বলল, ‘ধ্যাত। ছাড়ো বলছি। কে তোমাকে উঠে বসতে বলেছে?’
শুভেন্দু আর শুক্লা তখন দুজনেই জোর হাসা হাসছে। হাসতে হাসতেই শুভেন্দু বলল, ’ঠিক এই সময়ে মাসীমা যদি আবার ঘরে ঢোকে না? ঢুকে তোদের দুজনকে দেখলে, পিলে একেবারে চমকে যাবে।’
ক্রমশঃ-
|
« Next Oldest | Next Newest »
|