Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আ মরি
আজ বেশ জ্বর জ্বর ভাব ছিল দীপের। কিচ্ছু ভাল লাগছিল না, তাই পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে সারাদিন। মাঝে শুধু লাঞ্চ করতে উঠেছে, তার আগে একটু কাকস্নান মতো করে নিয়েছিল। আজ এতই কাহিল লাগছে যে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে রিলিজ হওয়া নতুন ছবিটাও দেখেনি ও, যে দীপ নাকি এইসবের পোকা!
তা বলতে নেই, সারাদিন রেস্ট নেবার পর সন্ধ্যের পরে শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছিল ওর। মায়ের করা এক কাপ কড়া কফি খেয়ে বেশ 'ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠ' টাইপ লাগছিল! তাই একটু সোস্যাল মিডিয়াটা খুলেছিল ও।
ফেসবুক খোলার সাথে সাথেই একের পর এক পোস্ট। বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস সম্পর্কে। তারমধ্যে একটা পোস্ট দেখল...কী সুন্দর ভাবে বিভিন্ন নাম দিয়ে বোঝানো হয়েছে বাংলা ভাষাকে ভাল না বেসে কেন পারা যায় না! ওর বাবা মা নিজেরা বাংলা মিডিয়াম ছিলেন, কিন্তু ওকে 'যুগের সাথে তাল মেলাবার জন্য' ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়েছিলেন । তবে তার জন্য সত্যজিৎ - স্বপন বুড়ো-সুনীল-শীর্ষেন্দু পড়ায় বাধা ছিল না কোনো। বরং শুকতারা আর আনন্দমেলা পড়েই তো বড় হয়েছে ও। আর সত্যিই তো, যে ভাষা এত সুন্দর, সেই ভাষাকে ভাল না বেসে পারা যায়! এই তো, ওর এক মারাঠি কলিগ, বিশাল গায়কোয়াড় কিছুদিন আগেই বলল "ইয়ার, বেঙ্গলি বহোৎ স্যুইট ল্যাঙ্গোয়েজ হ্যায়!" শুনে যে ওর কী গর্ব হচ্ছিল! এক বর্ণ বাংলা না বোঝা মানুষের কাছেও বাংলাকে মিষ্টি শোনায়। আহা! এজন্যই তো বলে "আ মরি বাংলা ভাষা!"
কথাটা ভাবতেই একটু থমকে গেল দীপ।
সেইদিনের কথাটা মনে পড়ে গেল। বিশালের কথা শুনে আনন্দে আটখানা হয়ে করে ফেলা একটা মন্তব্যের কথা মনে পড়ে গেল...
বুকের ভেতরটা কেমন ছ্যাঁত করে উঠল দীপের। নিজেকে কথায় কথায় 'রেসপনসিবল সিটিজেন' ভাবে, এমনকি 'ভালো মানুষ' ভাবে...আর সেই কিনা...অবলীলায়...ছিঃ! আর তখন...মনেও হয় নি কোন ভুল করছে বলে!
ভাবতে ভাবতেই ফোনটা তুলে নিল।
কন্টাক্ট লিস্ট খুলে বের করল একটা নাম্বার।
সরস্বতী স্বামীনাথন। ওর প্রজেক্ট টিমের একজন সদস্য...অত্যন্ত কর্মদক্ষ এই মেয়েটিকে আড়ালে ওরা 'ত্যান্ডাই ম্যান্ডাই' বলে ডাকে। আর সেদিন তো সবার সামনেই ও মন্তব্য করে ফেলেছিল দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলির দুর্বোধ্যতা নিয়ে... এমনকি জনপ্রিয় বলিউডি গানের আগের কিছু কথা নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়ে নি। সরস্বতী চুপ করে বসেছিল। কিছু বলেনি। কিন্তু...ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল নিশ্চয়ই। আহা রে...
ফোনের কল বাটনটা টিপে দিল দীপ।
আজ ওকে ক্ষমা চাইতে হবে সরস্বতীর কাছে সেদিনের জন্য। এতগুলো দিনের জন্য। আর কোনোদিন ও এমনি করবে না ও...বরং অন্য কেউ করলে তাকে আটকাবে...এটা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে নিল দীপ।
মাতৃভাষা দিবসে এরচেয়ে বড় উপহার, নিজেকে দেওয়া... নিজের ভাষাকে দেওয়া আর কি কিছু হতে পারে?
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
বাবা ,
হ্যাঁ বাবা-ই লিখলাম ড্যাড নয়।
তুমি হয়তো ভাবছো বাংলা অক্ষরগুলোকে আমি ভুলে গেছি, হয়তো ভাষাটাকেও। চমকে গেলে তো আমার চিঠি পেয়ে? হোয়াটসআপ কল নয়, রীতিমত চিঠি লিখছি দেখে নিশ্চয়ই ভাবছো
এ দেশে এসে অরিনের নিশ্চয়
মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে।
জানো বাবা কিছু কথা ফোনে নয় বাংলা শব্দে লিখে জানাতে চাই তোমায়।
জানি আমার বাংলা বড়ই দুর্বল
তবুও চেষ্টা করতে তো দোষ নেই।
তুমিই ছোটবেলায় বলতে,
চেষ্টা করলে সাফল্য পাবই।
আপাতত আমি ফিরে যেতে চাই আমাদের কলকাতার সেই ফ্ল্যাটে,
যে ফ্ল্যাটটা তোমার বড্ড অপছন্দের ছিল। তুমি মাঝে মাঝেই বলতে,
অক্সিজেনের বড় অভাব,
বুঝলি অরিন আমরা এই ফ্ল্যাটে শুধুই কার্বন ডাই অক্সাইড টানছি ফুসফুস ভরে। আমি অবাক হয়ে ভাবতাম,
বাতাসের আবার পার্থক্য কি!
তুমি বলতে, জানিস, আমার বীরভূমের একতলা বাড়িটার দক্ষিণদিকে ছিল সোনাঝুড়ির জঙ্গল।
সন্ধ্যেবেলা ওই বারান্দায় দাঁড়ালে আমি ওদের কথা শুনতে পেতাম।
ওরা শনশন আওয়াজে বলতো, আরো জোরে হাওয়া দে, যাতে রাঙা মাটি এসে লাগে আমাদের পাতায়।
তুমি বলতে, অরিন, তোর এক্সামের পরে একবার যাবি আমার সাথে বীরভূমে। তোকে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখাবো। রবীন্দ্রনাথ টেগরের পোয়েম পড়িস তো, ওনার আশ্রম দেখাবো, যাবি?
আমি ঘাড় নেড়ে বলতাম, যাবো।
ঠিক সেই সময় মা এসে বলতো,
না যাবে না। অরিন যাবে না।
সামার ভ্যাকেশনে আমরা সিঙ্গাপুর যাবো, নিদেন মানালী।
তোমার তো দার্জিলিং টুকুই দৌড়। টাকাগুলো তো তোমার বীরভূমের দুঃস্থ ছেলেদের পিছনেই খরচ করো।
আমাদের শখের কথা কবে আর ভাবলে তুমি! মায়ের গলায় ক্ষোভ থাকতো। আমার ছেলেটাকে একটু বড় স্বপ্ন দেখাতে পারো না তুমি, শুধু টেনে নিয়ে যেতে চাও গ্রামে।
তুমি চোখ নিচু করে বলতে, অরিন বীরভূম চিনবে না সুচেতনা? ও অয়ন মুখার্জীর ছেলে হয়ে বাবার ভিটে চিনবে না?
মা রাগী গলায় বলতো, অরিন পড়তে বসো।
জানো বাবা, আমারও ইচ্ছে করতো তোমার জন্মভূমিতে একবার অন্তত যাই।
তোমার চোখের দৃষ্টিতে বীরভূমকে আমি কল্পনা করতাম। যদিও ধীরে ধীরে আমি বুঝে গেলাম, আমাকে অনেক পড়তে হবে, আমাকে আমার জন্মভূমি ছেড়ে চলে যেতে হবে সাত সমুদ্র পাড়।
মা বলতো, বাবার মত দেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকার নাম বোকামি। আমি অনেক চেষ্টা করে ওকে কলকাতা নিয়ে এসেছি। তবুও দেখ, তোর বাবার গায়ে এখনো লালচে মাটি লেগে আছে। তোকে অনেক উঁচুতে উঠতে হবে, তোকে বিদেশে যেতে হবে। জানো বাবা, তখন থেকেই আমি বুঝতে শিখলাম, ইন্ডিয়াতে মানুষ থাকে না, বোকারা থাকে।
তুমি মাঝে মাঝে ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আমার পাশে এসে চুপটি করে বসতে। আমার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভয়ে ভয়ে বলতে, অরিন, বাংলা তো তোদের থার্ড ল্যাঙ্গুয়েজ তাই না? একটু আধটু পড়িস তো? আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, না ড্যাড, মাম্মি বলেছে ওতে ভালো না করলেও চলবে।
তুমি ম্রিয়মান মুখে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে বলেছিলে, মাতৃভাষাকে ভুলে যাবি?
আমি কিছু বলার আগেই মাম্মি এসে বলেছিল, হ্যাঁ যাবে।
তুমি তো বাংলার প্রফেসর হয়েছো, কজন জানে তোমার নাম?
জীবনে তো নন্দনে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারলে না।
আমার ছেলে বিদেশে যাবে, ওখানে বাংলা ওর কি কাজে লাগবে?
তুমি অস্ফুটে কিছু একটা বলতে চেষ্টা করেছিলে, কিন্তু আমি শুনতে পাইনি।
তবে আন্দাজ করেছিলাম, তুমি বলতে চেয়েছিলে, একটু শিখে রাখলে ক্ষতি কি!
জানো বাবা, আমার সেই সন্ধ্যের কথাটা খুব মনে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনের দিনে তুমি আমায় একটা কবিতা শিখিয়েছিলে।
বলেছিলে, অক্ষরগুলো তো চিনিস, দেখে দেখেই বলবি ওনার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে।
আমিও সকাল থেকে অনেকবার অভ্যেস করে নিয়েছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যেবেলা মা বললো, ওসব নাকি খুচরো সেন্টিমেন্ট, ওসবে গুরুত্ব না দিয়ে আমি যেন পড়তে বসি।
মায়ের সাথে ওয়েস্টার্ন ডান্স শিখতে যেতাম আমি, স্প্যানিশ গিটার শিখতাম আর তুমি মাঝে মাঝেই বলতে, অরিন রবীন্দ্র সংগীত শুনবি? গিটারে একটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর তোল না!
আমিও তখন শিখে গেছি, বাবা নামক মানুষটা আসলে বড্ড পুওর।
তাকে ড্যাড বলে ডাকলেও,
মানুষটা আসলে গুড ফর নাথিং।
তাই মায়ের মতোই আমি বলেছিলাম,
ড্যাড, আমাকে অনেক বড় হতে হবে। ইউনিভার্সিটির বাংলার প্রফেসর হয়ে থাকলে হবে না।
তুমি সেদিনও মাথা নিচু করে ফিরে এসেছিলে আমার ঘর থেকে।
আমার আর মায়ের জগতে তুমি ছিলে নিতান্তই ব্রাত্য।
বড্ড গেঁয়ো, স্রোতের উলটো দিকে চলা
পাবলিক। তাই আমি যতই বড় হচ্ছিলাম দূরত্ব বাড়ছিল তোমার সঙ্গে।
একই বাড়িতে বাস করেও তুমি ছিলে সম্পূর্ণ অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
মা বলতো, প্লিজ অরিন, বাবার মত হোস না তুই। তোর বাবার জন্য আমার কোনো সাধ পূরণ হয়নি। আমি আমেরিকা যেতে পারিনি, বাংলোর মত বাড়িতে থাকতে পারিনি, জাস্ট কিছু পারিনি। তোর বাবা সারাজীবন নিজের উপার্জনের টাকা চ্যারিটি করে গেছে।
আমি জানতাম, তুমি মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে পারোনি তাই তার দায়িত্বও আমাকেই নিতে হবে।
জানো বাবা, তুমি মানুষটাকে আমি ধীরে ধীরে এড়িয়ে যেতে লাগলাম।
চুপচাপ বই মুখে পড়ে থাকা একটা মানুষ। দিনরাত পেন নিয়ে সাদা কাগজে আঁকিবুকি কাটা মানুষটা একেবারেই সোশ্যাল নয়, মিশুকে নয়। কেমন যেন খোলসের মধ্যে বাস করা একটা প্রাণী। দশটা-পাঁচটা জীবন কাটাতে যে অভ্যস্ত। খুব বড় স্বপ্ন দেখতেও যে জানে না। মা বলতো জিততে শেখেনি তোর বাবা! লুজার, হেরে যাওয়া একটা মানুষ।
যদিও তোমার চোখে কখনো হারের গ্লানি দেখিনি আমি।
মায়ের স্বপ্ন মতোই আমি বড় হচ্ছিলাম। ভালো রেজাল্ট করতে করতে আমিও এক সময় বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম যে, যারা সত্যিই শিক্ষিত তারা কেউ ইন্ডিয়ার মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকে না।
মা ছোট মেসোমশাইকে দেখিয়ে বলতো, দেখ মেসোকে দেখে শেখ। তিনবার লন্ডন ঘুরে এলো। বেশিরভাগ সময় বাইরেই থাকে তোর মেসো।
আর তোর বাবাকে দেখ, বেড়াতে যাওয়া মানে হরিদ্বার, সিমলা....
ছোট মেসো ছিল আমার আইডল।
মাসিমনির বাড়িতে গিয়ে আমি মেসোর সাথে গল্প করতাম।
স্বপ্নের দেশের ছবি আঁকতাম মনে মনে।
না বাবা, সেখানে তোমার জন্মভূমির মত লালমাটি নেই, ওখানের বাতাসে ধুলো ওড়ে না।
মেসোর অ্যালবামে বিদেশের ছবি দেখতে দেখতে মনে হতো... মা ঠিক বলছে, ওটাই জীবন।
আত্মীয়-স্বজন সকলেই দেখতাম ছোটমেসোকে আলাদা সম্মান করতো। এমনকি মামার বাড়ি গেলে দাদু পর্যন্ত বলতো, ভালো করে পড়াশোনা কর অরিন, ছোটমেসোর মত হয়ে দেখা। কেউ কখনো বলতো না বাবার মত হয়ে দেখা।
ছোটমেসোর মত আমিও সব সময় ইংরেজিতে কথা বলার চেষ্টা করতাম।
ভুল করেও বাংলা বলতাম না।
তুমি একবার বলেছিলে, অরিন পারলে আমায় বাবা বলে ডাকিস।
ড্যাড শুনলেই কেমন হাঁসফাঁস করি।
আমি তখন সদ্য বি.টেক ভর্তি হয়েছি।
বিরক্ত হয়ে বলেছিলাম, তোমাকে না ডাকলেই বা তোমার কি আসে যায়!
তোমার গরিব ছাত্রদের বলো,
তোমায় বাবা বলে ডাকবে।
তোমার চোখে সেদিনও অসহায়তা দেখেছিলাম।
কিন্তু ডাল-ভাত খাওয়া ভেতো বাঙালি তখন আমার দুচোখের বিষ।
ছাত্র পড়ানো ছাড়া জীবনে যে আর কিছুই করতে পারেনি তাকে শ্রদ্ধা করতে আমার বয়েই গেছে।
কলেজে সবাই একটু সমীহ করেই বলতো, অরিন তোর বাবা প্রফেসর?
আমি বলতাম, হ্যাঁ বাংলার। আমার ড্যাড, বাংলা ছাড়া আর কিছুই জানে না।
জীবনে কোনোদিন ভুল করেও আমার বাবার মুখে কোনো ইংরেজি শুনিনি। এমনকি আমার বাবা ভুল করলে সরি বলতো না, দুঃখিত বলতো।
বন্ধুরা হেসে বলতো, ভেতো বাঙালী।
মাম্মি বলতো, অরিন , বন্ধুরা বাবা কি করেন জিজ্ঞেস করলে শুধু বলো, বাবা প্রফেসর, কোন সাবজেক্টের সেটা বলার দরকার নেই। লোকে শুনলে হাসবে।
একটা মানুষ ইংরেজীর ই না জেনেই
জীবন কাটাচ্ছে জানলে সভ্য মানুষরা হার্টফেল করবে।
তুমি মুচকি হেসে বলতে, সুচেতনা নিজের ভাষাকে অসম্মান করো না। অন্য ভাষা শেখ দোষ নেই, কিন্তু মাকে অপমান করো না।
মা ব্যঙ্গ করে বলতো, জানো অয়ন, মাঝে মাঝে তোমাকে দেখে করুণা হয়।
তোমার দেশ ভক্তি দেখে হাসি পায়।
আসলে কি বলতো, যারা জীবনে মারাত্মক ভাবে ব্যর্থ হয়, তারাই দেশের মাটি আগলে পড়ে থাকে আর নিজের ল্যাঙ্গুয়েজের প্রতি ভালোবাসা দেখায়।
এটাও একটা মুখোশ বুঝলে।
নিজের অক্ষমতা ঢাকার মুখোশ। দেশভক্তির মুখোশ পরে তুমি নিজের অক্ষমতা ঢাকছো নিজের সন্তানের কাছেও। হেরে যাওয়া মানুষরা এভাবেই নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দেয়।
রঞ্জনকে দেখে শেখ। সে কেমন বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করছে।
ওদেশে ওর কত সম্মান।
নামি কোম্পানিতে জব করছে।
এক গাদা স্যালারি পাচ্ছে।
বউ, মেয়েকে সুখে রেখেছে।
রঞ্জনের নাম করলেই আমার মনেও আলাদা শ্রদ্ধা কাজ করতো, কারণ ছোটমেসো ছিল আমার কাছে ভগবান।
মা বলেছিল, কতটা যোগ্যতা থাকলে এতগুলো দেশে সম্মান পাওয়া যায়!
মামাবাড়িতে গেলেও দেখতাম,
তোমাকে সবাই জিজ্ঞেস করতো,
অয়ন, সারাটা জীবন ইউনিভার্সিটি
আর বাড়ি করেই কাটিয়ে দিলে?
তুমি বলতে, ছাত্র তৈরি করলাম। ভবিষ্যতের মুখ গড়লাম।
ওরাই আমাদের দেশকে উজ্জ্বল করবে।
দাদু ব্যঙ্গ করে বলতো, আমারই ভুল। আমিই প্রফেসর দেখে সুচেতনার বিয়ে দিয়ে ফেললাম। আমার বোঝা উচিত ছিল অরিজিনটা সেই বীরভূমের।
সুচেতনা যতই চেষ্টা করুক, গা থেকে মাটির গন্ধ ধুয়ে ফেলতে পারেনি এখনো।
তুমি হেসে বলতে,
পুরো গন্ধ না ওঠাই ভালো বাবা,
আবার তো মাটিতেই মিশতে হবে।
আই টি জয়েন করার পরেই আমার প্রথম লক্ষ্য ছিল এদেশ ছেড়ে চলে যাওয়া।
মা বলতো, জীবনে তো তোর বাবাকে নিয়ে গর্ব করতে পারিনি,
এবারে তোকে নিয়ে করবো।
বেশিদিন সময় লাগেনি, আমার ইউ কে পাড়ি জমাতে।
প্রায় বছর খানেক হলো আমি বিদেশের মাটিতে।
একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, এদেশের কিছু মানুষ ইন্ডিয়ানদের দেখলে একটু যেন করুনার চোখেই তাকায়।
ভাবখানা এমন যেন, ওরা ছিল বলে আমরা করে খাচ্ছি।
অপমানিত বোধ করি মাঝে মাঝে।
মায়ের কথাই ঠিক, বাংলা আমার কোনো কাজেই লাগে না। সারাদিনে আমি একটাও বাংলায় কথা বলি না।
মা ফোনে সেদিন বললো, ভিডিও কল করতে। ছোটমাসি আর ছোটমেসোর অহংকার নাকি এতদিনে মা ভাঙতে পেরেছে।
মাকে জেতাতে পেরে আমিও জিতলাম।
জানো বাবা, তোমাকে তো তাও তোমার দুশো জন ছাত্র সম্মান করতো,
কিন্তু এদেশে আলাদা করে
আমাকে কেউ সম্মান করে না।
চাকরি করি, মাইনে পাই।
স্যালারিটাই যা আকর্ষণীয়।
তার মানে ছোটমেসোকেও এসব দেশে আলাদা করে কেউ সম্মান করতো না। কারণ ছোটমেসোও তো চাকুরীজীবীই ছিল।
মায়ের ধারণা ভুল ছিল। স্যালারির সাথে সম্মানের কোনো যোগসূত্র নেই।
এখানে আমার বেশ কিছু বন্ধু হয়েছে।
এরা অবশ্য ইন্ডিয়ান বলে আলাদা একটু সম্মান করে।
এরা বলে, আমি রবীন্দ্রনাথ টেগরের দেশের লোক।
আমি বিবেকানন্দের দেশের লোক, তাই ....
জানো বাবা, আমাদের অফিসে দুদিনের ছুটি ছিল, আমি আর আমার আরেক বন্ধু গিয়েছিলাম অক্সফোর্ড ঘুরতে।
ওখানে এক প্রফেসরের সাথে আমাদের পরিচয় হলো।
অভিক চক্রবর্তী। ও বাঙালী।
আমাদের যাদবপুরের ছেলে।
ওখান থেকে ফিরেই তোমায় লিখতে বসলাম।
ওখানে দেখা একটা অভিজ্ঞতার কথা তোমায় লিখতে ইচ্ছে হলো।
অভিক অক্সফোর্ডের প্রফেসর।
ও আমাদের ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিল ওদের লাইব্রেরিটা।
হঠাৎ অভিক বলে উঠলো, জানো অরিন,
আমাদের উনিভার্সিটিতে বাঙালি রাইটারের লেখা বই পড়ানো হয়।
ছাত্র- ছাত্রীদের উজ্জীবিত করার জন্য এই বইটা গত বছর থেকে পাঠ্য তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। আগ্রহের বশেই তাকালাম ওর হাতের বইটার দিকে।
কেন জানিনা বহুদিন পরে বাঙালি শব্দটা শুনে একাত্ম হয়ে যাচ্ছিলাম। বাঙালীর লেখা বই অক্সফোর্ডে পড়ানো হচ্ছে! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল শুনে।
The winner
Written by
Dr. Ayan mukharjee
নামটা তোমার সাথে মিল আছে বলেই বইটা হাতে নিলাম।
পাতা ওল্টাতেই দেখলাম, তোমার সেই সাদা আর আকাশি পাঞ্জাবী পরা ছবিটা।
তোমার মুখে সেই কিচ্ছু জানিনার বোকা বোকা হাসিটা।
যেটা দেখে মা বলতো, চূড়ান্ত আনস্মার্ট।
চারশো পাতার একটা বই জুড়ে তুমি বুঝিয়েছো, কাদের উইনার বলা হয়। জীবনে কারা জেতে। আর কারা হেরে গিয়েও জিতে গেছি ভেবে উল্লাস করে।
তুমি লিখেছো জিতে যাওয়া কার নাম! কি ভাবে হারতে হারতেও বিজয়ী হওয়া যায়। তোমার বইটা পড়তে পড়তে নিজেকে বড্ড লুজার মনে হচ্ছিল।
না বাবা, আমি উইনার নই।
এত সুন্দর ইংরেজী লেখো তুমি! সারাজীবন কনভেন্টে পড়েও তো আমি এমন একটা বাক্যও গঠন করতে পারবো না বাবা।
কাজ চালানো ইংরেজী আর অনুভূতি দিয়ে গড়া একটা বাক্যের মধ্যে কত পার্থক্য!
তবে আমরা যে জানতাম, তুমি বাংলা ছাড়া আর কিছুই পারো না?
তুমি অবশ্য মাঝে মাঝেই বলতে, জানিস অরিন, অনেকেই জানে না, গীতাঞ্জলির অনেক ইংরেজীই কিন্তু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি। পরে অবশ্য অনুবাদ করা হয়।
বাবা, তুমি কেন মামার বাড়িতে, রঞ্জন মেসোর সামনে এসব বলোনি?
মাকেও বলোনি কেন বাবা?
কেন সারাটা জীবন সব জেনেও
না জানার অভিনয় করে গেছো?
অবশ্য তোমার দ্য উইনার পড়তে পড়তে আমি বুঝেছি জয়ীর সংজ্ঞাটা কি! পার্সোনালিটি ডেভলপমেন্টের ওপরে তোমার লেখা এমন যে একটা বই থাকতে পারে আমি কখনো কল্পনাও করিনি।
অথচ মা সারাজীবন বললো,
তোর বাবার কোনো পার্সোনালিটি নেই।
বাবা, দেখো তো আমিও কিন্তু বাংলাটাকে ভুলিনি।
হয়তো তোমার মত অমন ভাষায় লিখতে পারলাম না, কিন্তু তুমিই তো বলেছো, যে জয় করতে পারে তার ভিতরের আনন্দটা কাউকে দেখানোর প্রয়োজন হয় না, একমাত্র সেই উপলব্ধি করতে পারে।
আজও বাংলায় চিঠি লিখে আর তোমাকে বাবা ডেকে আমি কিন্তু উইনার হলাম বাবা। আমার এতটাই আনন্দ হচ্ছে, যে আমার চোখ দিয়ে সে আনন্দ গাল বেয়ে চিবুক ছুঁতে যাচ্ছে।
একটা কথা সত্যি করে বলতো বাবা,
বছর দুই আগে দিন পনেরোর জন্য তুমি ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলে।
আমরা কেউ তোমায় ফোনে পাইনি।
ফিরে এসে তুমি বলেছিলে, ইউনিভার্সিটির কাজে গেছো।
আমার দৃঢ় ধারণা, তুমি তখন তোমার রাঙামাটির দেশে পালিয়েছিলে।
নিজের শিকড়ের সন্ধানে।
জানো বাবা, আমি অভিক চক্রবর্তীকে বললাম, এই অয়ন মুখার্জীই আমার বাবা।
দ্য উইনার।
খুব তাড়াতাড়ি ফিরছি বাবা।
ড্যাড নয়, বাবা বলেই ডাকবো তোমায়। বাবা, আমি খুব দুঃখিত,
তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
না, সরি নয়, দুঃখিত।
এবারে ফিরেই আমি তোমার সাথে বীরভূম যাবো।
নিয়ে যাবে তো?
দ্য লুজার
অরিন
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
অসাধারণ !!
মনপ্রাণ ছুঁয়ে গেলো !!
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
- একটা টিউশনি করবে?
- কোথায়?
- ভবানিপুরে।
- ছাত্র না ছাত্রী?
- ছাত্র। ক্লাস এইট।
- ছাত্র পড়াব না।
- পুলিশ অফিসারের ছেলে। বাবা ডিআইজি। ভালো মাইনে দেবে। ভালো খাবার পাবে। আরে এতো বড়ো পুলিশের ঝাড়ুদার হতে পারাও ভাগ্যের। সুপারিশে চাকরিও হয়ে যেতে পারে। দুদিন পর আইজি হবেন।
-------------------------
রাজি হয়ে যাই রাজীবের প্রস্তাবে।
রাজীব বলল, মাইনে মাসে আটশ টাকা।
সে সময় আটশ অনেক টাকা। কিন্তু টিউশনিটা রাজীব নিজে না করে কেন যে আমাকে দিচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না।
- তুমি করছ না কেন?
- আমার সময় নেই।
ডিআইজি সাহেবের ছেলের নাম অনি। ফর্সা, তবে ধবধবে নয় কিন্তু বেশ মায়াময়। বিশাল বাড়ি, বারান্দায় দামি ফুলের টব। চারিদিকে সমৃদ্ধির ছড়াছড়ি। রাজীব আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ছাত্রের মুখোমুখি হলাম।
- স্যার, বেড়াল প্রথম রাতেই মেরে ফেলা উচিত। আমার কথা নয়, আমার বাবার কথা, ঠিক না?
- ঠিক। কিন্তু বেড়াল কোথায়?
- আছে স্যার, আছে। অনেক বড়ো বেড়াল।
- আমি বেড়াল মারব কেন?
- একটা কথা বলব?
- বলো।
- আগের কথা আগে বলে দেওয়া ভালো। রাখলে আমারও লাভ আপনারও লাভ। নইলে দুজনেরই ক্ষতি। আমি চাই না আপনার ক্ষতি হোক।
- কী কথা বলে ফেল।
- আপনার মাইনের চল্লিশ পার্সেন্ট আমাকে দেবেন। আপনার মাইনে আটশ টাকা। চল্লিশ পার্সেন্টে হয় তিনশ কুড়ি টাকা। তবে আমাকে তিনশ দিলেই হবে, কুড়ি টাকা আপনার বখশিস। কী বলেন স্যার?
প্রথমে মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে। ইচ্ছে করছিল ঘুরিয়ে একটা চড় দিই। হাত এগিয়ে নিয়েই থামিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে স্বাভাবিক করে ফেলি আমাকে। তারপর সহজ গলায় আদর মেখে বললাম, কম নেবে কেন বাবা?
- এমনি।
- না, আমি পুরো তিনশ কুড়িই দেব।
- তাহলে স্যার খুচরো দিতে হবে। আমি একশ টাকার নিচে খুচরো রাখি না।
- তাই হবে।
বিচিত্র অভিজ্ঞতার আশায় আমার মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। মজার হবে টিউশনিটা, দেখি কতদূর যেতে পারে অনি। মাস শেষ হওয়ার কয়েক দিন আগে আমি একটি খামে করে তিনশ কুড়ি টাকা অনির হাতে তুলে দিই।
অনি যথাসময়ে টাকা পেয়ে খুশি।
হাসি মুখে বলল, স্যার, আপনি খুব ভালো মানুষ।
আমি বললাম, তুমি আমার কাছ থেকে শিখছ আর আমি শিখছি তোমার কাছ থেকে। দুজনের মাইনে ঠিক সময়ে দিয়ে দেওয়া উচিত। তাহলে শ্রমের মর্যাদা মাসের প্রথমদিকে হাসার সুযোগ পায়।
অনি বলল, থ্যাংক ইউ স্যার। সব মানুষ যদি আপনার মতো হতো!
চার মাস পর ডিআইজি সাহেব পড়ার রুমে এলেন। এতদিন তাকে একবারও দেখিনি, বেশ গম্ভীর চেহারা, দেখলে সমীহ আসে। চোখের চশমায়, দামটা পুলিশের পোশাকের মতো ঝিলিক মারছে, হাতের ঘড়িতে আরও বেশি।তিনি অনির একটি খাতা হাতে তুলে নিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, মাস্টার, আপনার মাইনে চারশ টাকা বাড়িয়ে দিলাম।
- কেন স্যার?
- আমরা পুলিশের লোক। গুণীর কদর করতে জানি। এ পর্যন্ত কোনো মাস্টার আমার ছেলের কাছে দুই মাসের বেশি টেকেনি। প্রত্যেকে আমার ছেলেকে বকা দিয়েছে, মেরেছে, অশ্রাব্য কথা বলেছে। ছেলে কেবল আপনারই প্রশংসা করেছে। আপনি নাকি ভালো পড়ান।
তিনি একটা কলম ও একটা ডায়েরি আমার হাতে দিয়ে বলেন, এগুলোর আপনার।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
কলমটা ছিল সম্ভবত পার্কার। তখন তো আর মোবাইল ছিল না, ওই সময় পার্কার ছিল আমাদের কাছে স্মার্ট ফোনের মতো লোভনীয়।
সাহেব চলে যেতে অনি বলল : স্যার।
- তুমি কী কলম আর ডায়েরি হতেও ভাগ চাইছ?
অনি হেসে বলল, না স্যার। ও সবে আমার আগ্রহ নেই। টাকা হলে সব পাওয়া যায়।
- তবে?
- আমার পাওনা এখন চারশ আশি টাকা। আমি আশি টাকা নেব না, একশ টাকা নেব। তার মানে পাঁচশ টাকা।
- ঠিক আছে। তুমি আমার টিচার, তোমাকে কুড়ি টাকা বেশি দিতে না পারলে আমার জ্ঞান অর্জন হবে কীভাবে?
অনির হাসিটা আরও বিস্তৃত হলো। কমিশন নিলেও পড়াপাড়ি বেশ ভালোই হচ্ছে। আরও তিন মাস কেটে যায়। এরমধ্যে, আমার মাইনে আরও দুশ টাকা বেড়ে গেছে। অনিকে এখন টাকা দিতে কষ্ট হচ্ছে না।
সেদিন বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। অনিকে অন্যদিনের চেয়ে বেশ আনমনা মনে হচ্ছে।
বললাম, কী হয়েছে?
- স্যার, আমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে।
- কী কাজ?
- একটা চিঠি লিখে দিতে হবে।
- চিঠি তো লিখেই দিই।
- কলেজের চিঠি নয়।
- কোন চিঠি?
- আমার প্রেমিকা, সরি স্যার বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য।
- কী লিখব?
- আপনার মতো করে আপনি লিখে দেবেন। আমি তাকে ভালোবাসি। তাকে না দেখলে বুকটা কেমন মোচড় খায়। কিছু ভালো লাগে না। সে খুব সুন্দর।
চিঠি লিখে দিলাম গভীর ভাষায়, প্রেমের মমতায়।
রাস্তায় এসে ইচ্ছেমতো হাসলাম। অনি আর রেহাই পাচ্ছে না।
-
খবর পাঠিয়েছে, শুক্রবার তাদের বাড়ি যেতে হবে। অনির জন্মদিন।
কী নিয়ে যাই?
অনেক চিন্তাভাবনা করে অনির বান্ধবীকে দেওয়ার জন্য একটা চিঠি লিখি।
অনি চিঠি পড়ে এত খুশি হয় যে, সে মাসের পুরো কমিশনটাই আমাকে ফেরত দিয়ে দেয়।
অবাক হয়ে বললাম, ফেরত দিলে যে?
অনি আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে বলল : আপনার লেখার সম্মানি। স্যার, চিঠিটা একদম ফাটাফাটি হয়েছে।
লেখার সম্মানি! আমি চমকে উঠি। লেখার প্রথম আয়, এ তো মস্ত ব্যাপার! তাহলে কেন এতদিন লিখিনি! অনির উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে পত্রিকায় লেখা শুরু করি। তারপর আস্তে আস্তে লেখা আমার নেশা হয়ে যায়।
-
যতই গল্প করি, যতই প্রেমপত্র লিখে দিই না কেন, লেখপড়ায় অনিকে এমন কৌশলে ব্যস্ত রাখি যে, সে ধীরে ধীরে বইয়ে ঝুঁকে পড়ে, তার সব আনন্দ অন্যান্য জায়গা থেকে বইয়ের পাতায় এসে ভীড় করতে শুরু করে। আগে তার বাবাকে বলত চকলেটের কথা, এখন বলে বইয়ের কথা। আগে ইলেকট্রনিক্স জিনিসে তার আলমারি ছিল ভর্তি; এখন সেখানে ঠাঁই পেয়েছে বই, পৃথিবীর বিখ্যাত লেখকদের নানা বই। আমার কাছ থেকে নাম নিয়ে যায় বইয়ের, নিয়ে আসে তার বাবাকে দিয়ে। দেশে না পেলে বিদেশ থেকে। কত দামি দামি বই, আমার কাছে মনে হতো, সামর্থ্যবানদের ইচ্ছাই প্রাপ্তি।
আরও তিন মাস পর আমার মাইনে হয় পনেরশ টাকা। অনেক সরকারি অফিসারও তখন এত মাইনে পেতেন না। এখন অনির পাওনা গিয়ে দাঁড়ায় ছয়শ টাকায়।
মাসের শেষদিন অনিকে ছয়শ টাকা দিতে যাই। লজ্জায় চোখটা নিচু করে ফেলে সে। আগের মতো দ্রুত হাত এগিয়ে দিচ্ছে না।
- সরি স্যার।
- নাও তোমার টাকা।
- লাগবে না স্যার।
- আরে নাও। আমি অত টাকা দিয়ে কী করব?
- স্যার, একমাসে যতটাকা আপনাকে দিই, আমি একদিনে তার চেয়ে অনেক বেশি দামের চকলেট খাই। একটা চকলেটের দাম একশ টাকা, দিনে কুড়িটা চকলেট আমি একাই খাই। বাবার হুকুমে সুইজারল্যান্ড থেকে আসে।
তারপরও আমি বললাম, নাও।
- লাগবে না স্যার।
- আগে লাগত কেন?
- তাস খেলতাম, ওকে দিতাম। এখন তাস খেলা সময় নষ্ট মনে হয়, বই পড়ি।
আমি সাফল্যের হাসি নিয়ে বের হয়ে আসি।
অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর অনির ওখানে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। সাহেব বলেছেন এক মাস পর থেকে আবার পড়ানো শুরু করতে। আমার মতো ভালো মাস্টারকে তিনি ছাড়বেন না। বদলি হলে সেখানে নিয়ে যাবেন।
পনের দিন পর দেখি আমার মেস বাড়ির সামনে একটা বিরাট গাড়ি দাঁড়িয়ে।
হন্তদন্ত হয়ে বের হয়ে আসি।
অনি আর তার বাবা নামছেন।
সাহেব বললেন, মাস্টার আমার ছেলে থার্ড হয়েছে। এর আগে কোনোদিন পঞ্চাশেও ছিল না। এক বছরের মধ্যে আপনি আমার ছেলেটাকে বদলে দিয়েছেন।
ডিআইজি সাহেব আমার হাতে একটা ঘড়ি তুলে দিয়ে বললেন, আমার ছোট ভাই আমার জন্য সুইজারল্যান্ড থেকে এনেছেন। আপনাকে দিলাম। এটি কোনো বিনিময় নয়, উপহার; ভালোবাসার নিদর্শন।
আনন্দে আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এমনভাবে কেউ আমাকে কোনোদিন এমন উপহার দেননি।
অনি আমায় প্রণাম করে বলল, স্যার, আপনি আমাকে বদলে দিয়েছেনে।
- মাস্টার, অনি আমাকেও পাত্তা দিত না। এ ছেলের কাছে আমি ছিলাম কেবল টাকার ঝুড়ি। আপনি তাকে মানুষ করে দিয়েছেন। বলুন কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
বললাম, ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
- আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?
- ভালোবাসা, শুধুই ভালোবাসা।
টিউশনি এবং ভালোবাসা
ঘটনার সময়কাল : জানুয়ারি ১৯৮৬।...
-
বিশিষ্ট লেখক ড. আমিন।
"ভালবাসা, শুধুই ভালবাসা'' গ্রন্থে তার জীবনের সত্য ঘটনার অবলম্বনে ।
Posts: 6,108
Threads: 41
Likes Received: 12,072 in 4,138 posts
Likes Given: 5,306
Joined: Jul 2019
Reputation:
3,734
28-02-2021, 11:59 AM
(This post was last modified: 28-02-2021, 12:07 PM by Baban. Edited 2 times in total. Edited 2 times in total.)
বিশিষ্ট লেখক ড. আমিন।
"ভালবাসা, শুধুই ভালবাসা'' গ্রন্থে তার জীবনের সত্য ঘটনার অবলম্বনে ।
অসাধারণ একটা গল্প সত্য ঘটনা অবলম্বনে ❤
শুধু শাস্তি বকা আর জোর খাটিয়ে কাউকে পাল্টানো যায়না...
অনেক সময় ধৈর্য আর ভালোবাসা দিয়েও একজন মানুষকে সম্পূর্ণ পাল্টে ফেলা সম্ভব. এরকম বিষয় নিয়ে তো ফিল্ম হওয়া উচিত. অন্তত শিক্ষণীয় কিছু তো বেরোক আর দর্শকের সামনে আসুক.
Like Reps added❤
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
মোম রঙের বাক্স
©ঐন্দ্রিল ভৌমিক
শীত অনেকেরই প্রিয় ঋতু। সকালের নরম কুয়াশা, খেজুর রস, বনভোজন, হাজার একটা মেলা। শীত আমাদের সরকারি চিকিৎসকদের কাছেও প্রিয়। তবে তার কারণটা অন্য।
শীতকালে আউটডোর আর ইন্ডোরে রোগীর ভিড় বেশ কমে। আউটডোর রোগী একধাক্কায় সাতশো- আটশো থেকে তিনশ- চারশোয় নেমে আসে। ফুরফুরে মেজাজে রোগী দেখা যায়। এমনকি নাইট ডিউটির সময়ে তিন-চার ঘন্টা ঘুমিয়েও নেওয়া যায়। রাত বারোটার পর খুব এমারজেন্সি ছাড়া রোগী আসে না।
এমনই এক শীতের সকালে আউটডোর করছিলাম মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম হাসপাতালে। বিশেষ তাড়া নেই। রোগী প্রায় শেষ করে এনেছি। সামনের রোববার হাসপাতালের সব স্টাফকে নিয়ে একটা পিকনিক করার পরিকল্পনা হচ্ছে। রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে তাই নিয়ে পীযূষদার সাথে আলোচনা করছি। পীযূষদা অর্থাৎ ডাঃ পীযূষ কান্তি পাল পাশের টেবিলে রোগী দেখছে। তার সামনেও রোগীর তেমন ভিড় নেই।
রোগীর লাইনে একটি তেরো- চৌদ্দ বছরের মেয়ে। অত্যন্ত রোগা অপুষ্টিতে ভোগা চেহারা। চোখের নীচে কালি। তবু মেয়েটিকে দেখতে ভালো লাগছে। তার একটাই কারণ মেয়েটির মুখে এখনও শৈশবের ছাপ রয়েছে।
জিজ্ঞসা করলাম, ‘কি হয়েছেরে মনা?’
মেয়েটি অত্যন্ত লাজুক ভাবে ফিসফিস করে বলল, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, আমার শরীর খারাপ হয়নি।’
‘শরীর খারাপ হয়নি তো হাসপাতালে এসেছিস কেন? যা... পালা।’
মেয়েটি চলে গেল না। দূরে দাঁড়িয়ে রইল। খানিকক্ষণ বাদে ডাকলাম, ‘কিছু বলবি? দাঁড়িয়ে রইলি যে বড়!’
মেয়েটি আবার বলল, ‘আজ্ঞে ডাক্তারবাবু, এমাসে আমার শরীর খারাপ হয়নি।’
এতক্ষণে মাথায় ঢুকল ব্যাপারটা। বললাম, ‘বয়স কত তোর?’
‘আজ্ঞে, চৌদ্দ।’
‘সঙ্গে কে এসেছে?’
‘একা এয়েচি।’
চোখের নীচের পাতা টেনে দেখলাম। ফ্যাকাশে। রক্ত কোথায় যে মাসিক হবে। বললাম, ‘শরীর খারাপ কতদিন শুরু হয়েছে?’
‘আজ্ঞে, বছর দুয়েক হবে।’
আমি বললাম, ‘প্রথম প্রথম এরকম একটু সমস্যা হয়। অতো টেনশন করিস না। এমাসে হয়নি পরের মাসে হবে।’
তবু মেয়েটি যায় না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু বলতে পারছে না।
ডাক্তারদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় অনেক সময় চিকিৎসককে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে সাহায্য করে। যদিও ক্রেতা সুরক্ষা আইন আর এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের যুগে আস্তে আস্তে আমাদের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দূর্বল হয়ে যাচ্ছে।
যাই হোক, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে উঠল কিছু একটা গন্ডোগোল আছে। একটা ছোটো কাগজে লিখলাম, “ইউরিন ফর প্রেগনেন্সি টেস্ট”। বললাম, ‘উপরের তলায় একদম মেয়েদের ওয়ার্ডে ঢুকে যাবি। ওখানে যে সিস্টার দিদি থাকবেন তাঁকে কাগজটা দেখাবি।’
কে জানে কোন সিস্টার ডিউটিতে আছেন? তেমন কেউ থাকলে এইটুকু মেয়ের প্রেগনেন্সি টেস্ট পাঠানোর জন্য ঝাড় খেতে হবে।
খানিকক্ষণ বাদে দেখি শিল্পীদি মেয়েটিকে নিয়ে আসছেন। আমি আতঙ্কিত হলাম। সর্বনাশ করেছে। ঐ টুকু মেয়ের সামনেই আমাকে না ঝাড় খেতে হয়!
শিল্পীদি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘ডাঃ ভৌমিক, একটু উঠে আসুন। এক্সরের ঘরে চলুন।’
এটা একদিক থেকে ভালো। ফিল্মের অভাবে আপাতত এক্স রে বন্ধ আছে। ঘরটা ফাঁকাই থাকে। অতএব ওই ঘরে ঝাড় খেলে কেউ জানতেও পারবে না।
এক্সরের ঘরে ঢুকে বললাম, ‘কি বলবেন, বলুন।’
দিদির গলায় অবিশ্বাস, ‘ডাঃ ভৌমিক আপনি কার্ডটা দেখুন।’
হাতে নিয়ে দেখলাম। দুটো দাগ। এই দুটো দাগ নবদম্পতির জীবনে সবচেয়ে খুশি নিয়ে আসে। আর এই বালিকার জীবনে ঝড় তুলবে।
আমি বললাম, ‘দেখেছেন কাণ্ড। আজকালকার মেয়েগুলো কি জিনিস। এখনও নাক টিপলে দুধ বেরোয়, ওদিকে...’
এইবার সত্যি সত্যি ঝাড় খেলাম। শিল্পীদি বললেন, ‘থামুন। যা জানেন না, তাই নিয়ে বড় বড় কথা বলবেন না। সব মেয়েদের দোষ, তাই না? আপনি জানেন ঘটনাটা কি?’
ঘাড় নাড়লাম। সত্যিই কিছু জানিনা।
দিদি বললেন, ‘দিনের পর দিন একটা নোংরা, কুৎসিত, মাঝ বয়সী লোক ঐ ছোট্ট মেয়েটাকে ;., করেছে। সম্পর্কে লোকটি ওর জামাইবাবু হয়। নিজের জামাইবাবু। মেয়েটির বাবা নেই। শুধু মা আর দুই মেয়ে। সকলে জামাইবাবুর কাছেই থাকে। মেয়েটা মা কে, দিদিকে অনেকবার বলেছে। কেউ বিশ্বাস করেনি। অথবা বিশ্বাস করলেও প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। দুবেলা দুমুঠো ভাতের দাম নিজের পেটের মেয়ের দামের থেকে বেশী।’
আমি ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েটিকে আবার দেখলাম। ওর দুচোখে গভীর আতঙ্ক। শরীর থেকে শৈশব যাওয়ার বহু আগেই ওর মন থেকে শৈশব বিদায় নিয়েছে।
শিল্পীদি বললেন, ‘আমি ওকে একটু উপরে নিয়ে যাচ্ছি। একটু কাউন্সিলিং করে দি। আর ওর মাকে বিকালে আপনার সাথে দেখা করতে বলছি।’
সেদিন বিকালেই মেয়েটির মা কোয়ার্টারে এলেন। চোখে দেখেই বোঝা যাচ্ছে এনার হিমোগ্লোবিন মেয়েটির চেয়েও কম। বয়স যাই হোক কৃশ শরীর থেকে নারীত্বের সব চিহ্নই অকালে বিদায় নিয়েছে।
আমার কাছে সব শুনে তিনি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন।
বললাম, ‘চুপ করে রইলেন কেন? কিছুতো করতেই হবে। তাড়াতাড়ি এবরশন না করলে পরে অসুবিধা হবে।’
মহিলা বললেন, ‘ওই হতভাগা মেয়ে মরলে আমার হাড় জুড়ায়।’
আমি ধমক দিলাম। বললাম, ‘উল্টোপাল্টা না বকে সমাধান নিয়ে চিন্তা ভাবনা করুন। কান্দিতে আমার চেনা একজন গাইনোকোলোজিস্ট আছেন। ডাঃ অর্জুন গুপ্ত। ওনাকে বলে দেব। আপনি গিয়ে সোজা হাসপাতালে যোগাযোগ করুন।’
‘হাসপাতালে ভর্তি হলে জানাজানি হবে। জামাই কিছুতেই তা করতে দেবে না।’
মনের রাগ চেপে রেখে বললাম, ‘তাহলে প্রাইভেটে ওনার সাথে যোগাযোগ করুন।’
‘প্রাইভেটে তো অনেক পয়সা লাগবে।’
বললাম, ‘আমার নাম বলবেন, কম পয়সা নেবেন। ঠিক আছে, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি।’
অর্জুনদাকে ফোন করলাম, ‘একটা এম টি পি করতে হবে। চৌদ্দ বছর বয়েসে এক্সিডেন্টাল প্রেগনেন্সি। বাড়ির লোক সরকারি জায়গায় লোক জানাজানির ভয়ে করতে চায়না। প্রাইভেটে করাবে। এদিকে আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ।’
‘আটশো টাকা দিতে পারবে?’
‘অ্যাঁ... কত?’
‘বলছি, আটশো টাকা খরচ করতে পারবে। আমার আর এনাস্থেটিক্সের খরচ লাগবে না। শুধু নার্সিং হোমের ওটির ভাড়া আর ওষুধপত্র। সকালে আনলে বিকেলেই ছেড়ে দেব। আর যদি তাও না পারে তাহলে আমার অ্যাডমিশান ডে’র দিন পাঠিয়ে দে। তুই একটা চিঠি লিখে দিস। আমি ডি সি করে সেদিনই ছেড়ে দেব।’
আমি বললাম, ‘আটশো টাকা জোগাড় করতে নিশ্চয়ই পারবে। মেয়েটার জীবন মরনের ব্যাপার। ঠিক আছে, আমি ওর মায়ের সাথে কথা বলছি।’
মেয়েটির মাকে সব বুঝিয়ে বললাম। অর্জুনদার কাছে একটা চিঠিও লিখে দিলাম। ওই অমানুষ জামাইকে ছেড়ে মা আর মেয়েদের কোনও আশ্রমে চলে যাওয়ার জন্য বলতে গেছিলাম। মহিলা এমন প্যানপ্যানে কান্না আরম্ভ করল যে সে চেষ্টায় বিরতি দিলাম। যাগগে, ওর মেয়ে। ও যা ভালো বোঝে করুক।
দুটোদিন কেটে গেছে। এক রাত্রিরে পীযূষদা আমায় ডেকে তুলল। বলল, ‘ঐন্দ্রিল, খুব বাজে পেশেন্ট এসেছে।’
আমি পাশ ফিরে শুলাম। বললাম, ‘তোমার নাইট ডিউটি। ভালো হোক, বাজে হোক, তোমার পেশেন্ট তুমি সামলাও। না সামলাতে পারলে কান্দি রেফার কর। আমাকে ডাকছ কেন?’
পীযুষদা বলল, ‘ঐন্দ্রিল, ওই মেয়েটাকে নিয়ে এসেছে। ওই যে চৌদ্দ বছরের প্রেগনেন্ট মেয়েটা। আজ সন্ধ্যে থেকে ব্লিডিং পার ভ্যাজাইনা হচ্ছে। ওর জামাইবাবু নাকি কি কবিরাজি ওষুধ এনে খাইয়েছে। যে ভ্যানে করে এনেছে, সেই ভ্যান রক্তে ভেসে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি চল।’
মুশকিলের ব্যাপার হল এই হাসপাতালে আমিই একমাত্র গাইনিতে হাউস স্টাফ শিপ করা লোক। পীযূষদা গাইনি রোগী নিয়ে সমস্যায় পড়লেই আমাকে ডেকে তোলে। আমিও অবশ্য কোনও বাচ্চা নিয়ে সমস্যায় পড়লে পীযূষদাকে ডাকতাম। যাইহোক গজ গজ করতে করতে হাসপাতালে ছুটলাম।
লেবার রুমে ঢুকে দেখি প্রকৃত অর্থেই রক্তারক্তি ব্যাপার। লেবার টেবিলে শুয়ে মেয়েটি ঠক ঠক করে কাঁপছে। আমি চোখ টেনে দেখলাম, একেবারে ফ্যাকাশে। নাড়ী অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলছে। বললাম, ‘সিস্টার শিগ্রী জেটে আরএল চালান।’
পীযুষদা বলল, ‘ঐন্দ্রিল, এখানে ডি সি করে দিবি?’
আমি বললাম, ‘তুমি কি পাগল! মেয়েটার কিছু হলে ঐ পাষণ্ড জামাই লোকজন নিয়ে আমার ছাল তুলে দেবে। জেটে ফ্লুইড চালিয়ে স্টেবেল করে একে কান্দি সাব ডিভিশানাল হাসপাতালে পাঠাও। রক্তেরও দরকার হতে পারে।’
মেয়েটির মা মাথা নিচু করে লেবার রুমের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। বলল, ‘আমি কোথাও নেবোনা। মেয়ে মরলে মরুক। ও মরলে ওর বড় দিদি আর আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।’
ইন্দ্রাণীদি ডিউটি করছিলেন। তিনি বললেন, ‘একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি আগে লেবার রুম থেকে বেরোও। বেরোও বলছি...।’ ইন্দ্রাণীদি প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিয়েই মেয়েটির মাকে ঘর থেকে বের করলেন।
আমার আর কিছু করার নেই। চোখের সামনে একটা মেয়েকে তো মরতে দেখা যায় না। শেষ চেষ্টা করে দেখি।
ওটি ড্রেস পরে নিলাম। ইন্দ্রাণীদি ডি সি সেট তৈরী করে ফেলেছেন। স্পেকুলাম ঢুকিয়ে ভলসেলাম দিয়ে সার্ভিক্স ধরতেই মেয়েটি ছট ফট করে উঠল। ইন্দ্রানীদি মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘পাঁচটা মিনিট সহ্য কর মা। এখুনি হয়ে যাবে।’
আমি পিযূষদাকে বললাম, ‘লিগনোকেন টানো। সার্ভিক্সে একটু লোকাল দিয়ে করে দি। পালসের যা অবস্থা ফোর্ট উইন, ক্যাম্পোজ দিতে সাহস হচ্ছে না।’
কিউরেটর দিয়ে অতি সাবধানে জরায়ুর দেওয়াল থেকে এক অমানুষের লালসা চেঁচে বার করছি। নিদারুণ যন্ত্রণায় মেয়েটি কঁকিয়ে উঠছে। লোকাল অ্যানাস্থেসিয়ার সাথে আমার ভোকাল অ্যানাস্থেসিয়াও চলছে।
‘এই মেয়ে, তোর কি খেতে ভালো লাগে? কালকে সকালে এই দিদি তোকে চপ আর মুড়ি খাওয়াবে। তুই একসাথে কটা চপ খেতে পারবি? আর একটু...। নড়িস না...। তোর কি লাগবে বল? তুই যা চাইবি, তাই দেবো।’
দূর্বল কন্ঠে মেয়েটি বলল, ‘সত্যিই দেবে?’
‘হ্যাঁ... হ্যাঁ। তুই বলেই দেখনা।’
‘আমাকে একটা রঙের বাক্স দেবে? ওই যেটাতে বারোটা মোম রঙ থাকে। আর একটা আঁকার খাতা। আঁকতে আমার খুব ভালো লাগে।’
ইন্দ্রাণীদির চোখের কোন থেকে জল গড়াচ্ছে। পীযূষদা লেবার রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আমার চোখ ঝাপসা হলে চলবে না। আর কয়েকটা মিনিট আবেগকে বাগে রাখতে হবে।
আমি পিছনে টর্চ ধরে দাঁড়ানো আয়া মাসীকে জোর ধমক দিলাম, ‘ঠিক করে আলো ফেলো। আলো এতো নড়ছে কেন!’
★★★★★★★★★★★★★★★
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(02-03-2021, 02:09 PM)dada_of_india Wrote: বাকি টা কোথায়?
বাকি কিছু নেই , এখানেই শেষ করেছিলেন লেখক
ঠিকই করেছিলেন , এর পরেও আর কি লিখবেন ... এতটা যে লিখতে পেরেছিলেন তাই যথেষ্ট ....
গল্পটা (সত্যি ঘটনা বলেই মনে হয়) প্রথম পড়েছিলাম বছরখানেক আগে , হোয়াটস্যাপ এ কেউ পাঠিয়েছিল ... শেষটা পড়তে পড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি , এখনো মনে আছে ...
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
(02-03-2021, 02:23 PM)ddey333 Wrote: বাকি কিছু নেই , এখানেই শেষ করেছিলেন লেখক
ঠিকই করেছিলেন , এর পরেও আর কি লিখবেন ... এতটা যে লিখতে পেরেছিলেন তাই যথেষ্ট ....
গল্পটা (সত্যি ঘটনা বলেই মনে হয়) প্রথম পড়েছিলাম বছরখানেক আগে , হোয়াটস্যাপ এ কেউ পাঠিয়েছিল ... শেষটা পড়তে পড়তে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি , এখনো মনে আছে ...
শেষটা আমি পরেছিলাম ! একটা মানবিক দিক ছিল সেখানে ! একজন ডাক্তার হিসাবে একটি অসহায় মেয়েকে নতুন জীবন দান এবং এক নতুন জীবন দেওয়ার ঘটনা ছিল সেখানে ! এতি একটি সত্য ঘটনা ! তার জামাইবাবু এখনও জেল খাটছে সাথে মেয়েতির মা ও !
Posts: 1,538
Threads: 5
Likes Received: 2,632 in 909 posts
Likes Given: 1,512
Joined: Dec 2018
Reputation:
578
History of South Calcutta .
মাত্র বছর দেড়েক হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেমেছে, বিনয় কৃষ্ণ বসুর বয়স বারো, সুভাষ চন্দ্র বসু তখনও কংগ্রেসে যোগ দেননি, মান্না দে-র বয়স সবে এক বছর, সত্যজিৎ রায়ের জন্ম হয়নি।
ভবানীপুরের দক্ষিণে সামান্য কিছু বসতি তৈরী হয়েছে। কালীঘাটে আগত দর্শনার্থীরা বলেন আদি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালে দূর থেকে নাকি বন্য জন্তুর হুঙ্কার শোনা যায় এখনও। অবশ্য ডাকাত আর এখন তেমন নেই। তবে শ্বাপদের ভারী দাপট।
কলকাতা শহর দিন দিন ঘিঞ্জি হয়ে উঠছে, তাই বন জঙ্গল কেটেই কলকাতার বসতি বাড়াতে হবে বলে সিদ্ধান্ত নিলেন বৃটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ কার্জন ওরফে লর্ড কার্জন। কলকাতার রাস্তাঘাট, জলের ব্যবস্থা, পয়ঃপ্রণালী বানানো এবং তা রক্ষণাবক্ষেণের জন্য ১৯১২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন ‘ক্যালকাটা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট’ বা সি.আই.টি.।
রক্ষণাবক্ষেণের পাশাপাশি চলতে থাকল কলকাতা সম্প্রসারণের কাজও। নতুন নতুন জমি খোঁজার কাজ, যেখানে বসতি গড়া যায়।
কালীঘাট মন্দিরের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে একটি ঘন জঙ্গল বেছে নেওয়া হল। এই জঙ্গলের পাশ থেকে চলে গেছে ইংরেজদের তৈরী ব্রডগেজ রেললাইন যা আরও দক্ষিণে বজবজে যায়। বৃটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিল এই অঞ্চলটাকেই কেটে সাফ করে বাসযোগী করে তুলতে হবে। কিন্তু সে-জঙ্গল এত গভীর, তা সাফ করতে গেলে বছরের পর বছর সময় লেগে যাবে।
তাহলে এখন কী করণীয়? ঐ জঙ্গলের দক্ষিণ দিকে, মানে রেল লাইনের অপরদিকে রয়েছে বিরাট বিরাট সব জলা। ঠিক হলো ঐ জলা ভরাট করেই বসতি হবে। জঙ্গল কেটে পরিস্কার করার থেকে মাটি ফেলে জলা ভরাট করা অনেক সহজ কাজ।
কিন্তু জলা ভর্তি করতে যত মাটি লাগবে তা পাওয়া যাবে কোত্থেকে? কেন, জঙ্গল থেকে! প্রথমে জঙ্গলের গাছ কেটে মাঠ বানানো হলো আর তারপর সেখান থেকে মাটি কেটে জলা ভর্তির কাজ চলল। মোট তিয়াত্তর একর জায়গা বেছে নেওয়া হলো কাটার জন্য।
মাটি কাটার দায়িত্ব দেওয়া হলো সি.আই.টি.-র এক পদস্থ কর্মচারী সেসিল হেনরি বমপাসকে। হাজার খানেকের ওপর লোক নিয়োগ করা হল মাটি খননের জন্য। এই রাজ্যের লোক তো বটেই, পাশের রাজ্য বিহার থেকেও লোক নিয়ে আসা হল দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য। এদিকে এই জঙ্গলের মাঝবরাবর একটি ছোট্ট মসজিদ ছিল। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই মসজিদটা তৈরি করা হয়েছিল ১৮৮৪ সালে। মসজিদটি অক্ষত রেখে তার চারিদিক থেকে মাটি কেটে নেওয়া হল। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে এই বিশাল জঙ্গলের মাঝে তৈরী হয়ে গেল মনুষ্য নির্মিত এক বিশাল জলাশয়। মাটি খুঁড়ে পাওয়া গেল অজস্র কঙ্কাল। কলকাতার ঠগি আর ডাকাতদের কথা কে আর না শুনেছেন। সঙ্গের জিনিসপত্র কেড়ে নিয়ে খুন করে জঙ্গলে লাশ পুঁতে দেওয়া ছিল তাদের বাঁ হাতের কাজ। আর পাওয়া গেল বেশ কয়েকটি কামান। আসছি পরে সে-কথায়।
যেহেতু সেসিল বমপাসের তত্বাবধানেই এই জলাশয় তৈরি হয়েছিল, তাই জলাশয়টির নাম দেওয়া হল বম্পাস লেক। ঠিক যেমন উইলিয়াম টলি নতুন করে আদি গঙ্গা সংস্কার করেন বলে তাঁর নামেই সেই স্থানের নামকরণ করা হয় টলিগঞ্জ। সে গল্পও শোনাব আরেকদিন। লেক সংলগ্ন অঞ্চল বলে মাটি বুজিয়ে রেল লাইনের পাশের যে জায়গাটা বাসযোগ্য করে তোলা হল তার নাম রাখা হলো লেক কলোনি। এখানে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকান সৈন্যদের একটি ছাঁউনি বা ব্যারাক বানানো হয়েছিল। তখন একে কলোনিই বলা হতো।
সিরাজ-উদ-দৌল্লার মৃত্যুর পরে, বাংলার নবাব মির-জাফরের কাছ থেকে পঞ্চান্নটি গ্রাম খুবই সামান্য অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। এই গ্রামগুলোকে বলা হত ডিহি পঞ্চান্নগ্রাম। এই পঞ্চান্নখানি গ্রামের তেত্রিশটি ছিল কলকাতায় আর বাকিগুলো হাওড়া এবং হুগলিতে। হাওড়ার বেতড়, সালকিয়া এসব জায়গা ছিল এই পঞ্চান্ন গ্রামের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসের ওপরে সেই পঞ্চান্নগ্রামের একটি ছোট্ট অংশ এখনও নাম অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গেছে।
যাকগে, ফিরি আসল কথায়। এই গ্রামগুলোর একটিতে ছিল বিরাট বালির বাজার। সেই বালি কোথা থেকে আসতো, তা লিখব অন্য একটি পর্বে। ‘মারাঠা ডিচ’ ভরাট করতে এখান থেকেই বালি নিয়ে যাওয়া হতো। ‘মারাঠা ডিচ’ নিয়েও দুলাইন বলতে হবে কি? আচ্ছা। বাংলার নবাব আলিবর্দি খাঁয়ের শাসনকালে বর্গী, অর্থাৎ মারাঠারা কলকাতা আক্রমণ করবে এইরকম একটা খবর রটে যায়। তাদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সেই ১৭৪২ সালে, কলকাতাকে কেন্দ্রে রেখে তার চারিধারে পরিখা তৈরির কাজ শুরু হয়। পরিখা কাটার কাজ শুরু হয়েছিল, কিন্তু মারাঠারা আর আসবে না জানার পরে এই কাজ আর শেষ করা হয়নি। ১৭৯৯ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আবার এই পরিখা বুজিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সময় পঞ্চান্নগ্রামের ওই বিশেষ গ্রাম থেকে বালি আনিয়ে মারাঠা ডিচ বুজিয়ে ফেলা হলো। সেই বুজিয়ে ফেলা পরিখা আজকের আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড এবং আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু রোড।
এদিকে বালি বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় গ্রামের বাসিন্দারা বেশ সমৃদ্ধ হয়ে উঠল। গ্রামে বেশ কিছু কোঠা বাড়ি উঠল। বালির সওদা হয় বলে গ্রামের নাম রাখা হয়েছিল বালিগঞ্জ (উচ্চারণ করা হত বালিগঞ্জো’)।
ইংরেজরা ১৮৬২ সালে শিয়ালদহ থেকে ক্যানিং অবধি রেল চলাচল ব্যবস্থা চালু করে দেয়। যাতায়াতের সুবিধার্থে সমৃদ্ধ গ্রাম বালিগঞ্জে একটি স্টেশন বানায় তারা। এরও আঠাশ বছর পরে ১৮৯০ সালে বালিগঞ্জ থেকে ডানদিকের জলা আর জঙ্গলের পাশ থেকে পাতা হলো নতুন ট্রেন লাইন, বজবজ পর্যন্ত। উল্লেখ্য এই রেলপথ দিয়েই স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৭ সালে আমেরিকা ভ্রমণ সেরে কলকাতা ফেরেন।
বালিগঞ্জ সমৃদ্ধ গ্রাম হওয়াতে সেখানে বড় বড় জমিদার, ধনী লোকেরা বিঘে বিঘে জমি কিনে তাঁদের বাগান বাড়ি তৈরি করতে শুরু করলেন। প্রমোদভবন আরকি। উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীরাও এখানে বাগানবাড়ির তৈরী করলেন। তাঁদের সেইসব বিরাট বিরাট বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর নামের সঙ্গে একখানা করে গার্ডেন জুড়ে দেওয়া হতো। এইরকমই একটি বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন তদানীন্তন জেলা শাসক জর্জ ম্যান্ডেভিলা। তাঁর বাগানবাড়ির নাম হলো জর্জ ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। আজকের ম্যান্ডেভিলা গার্ডেন। এরকম আরেকটি বাগানবাড়ি ছিল কর্ণেল গিলবার্ট আয়রনসাইডেরও। তবে আজ আর আয়রনসাইড গার্ডেন নেই, বর্তমান নাম আয়রনসাইড রোড।
এদিকে চারিদিকে এত ‘গার্ডেন গার্ডেন’ দেখে লেক কলোনির বাসিন্দারা বললো তারাও লেক কলোনি নাম নেবে না। কলোনি নাম তাদের পছন্দ নয়। তাদেরও ‘গার্ডেন’ নাম চাই। তখন লেক কলোনির পরিবর্তে স্থানটির নাম রাখা হল লেক গার্ডেন্স।
লেকগার্ডেন্সে ছোট্ট জনপদ তৈরী হতেই ইংরেজ সরকার তখনকার নামি ব্যবসায়ী মঙ্গনিরাম বাঙুরকে দায়িত্ব দিল সেই জনপদের আরও দক্ষিণ দিক বাসযোগ্য করে তোলার। মঙনিরাম তা-ই করলেন। সেই অঞ্চলেও গড়ে উঠল বসতি। টিপু সুলতানের পরিবারের সদস্যরাও সেখানে খাপছাড়া ভাবে বসবাস করতেন। মঙনিরাম সাজিয়ে তুললেন অঞ্চলটা। আজকের এম.আর. বাঙুর হাসপাতাল তাঁর নামেই।
আর সেই বমপাস লেকের নাম হয় ঢাকুরিয়া লেক, বর্তমানের রবীন্দ্র সরোবর। তাহলে কি বমপাসের নাম ইতিহাস থেকে পুরোপুরি মুছে গেল? না, লোকে তাঁকে মনে না রাখলেও একটি রাস্তা তাঁর নামে রয়ে গেছে। দেশপ্রাণ শাসমল রোড থেকে সাদার্ন এভিনিউতে ঢুকে একটু এগোলেই বাঁ-হাতে পেয়ে যাবেন বমপাস রোড। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে কিরণশঙ্কর রায় রোড দিয়ে আপনাকে নিয়ে যাবে লেক মার্কেট।
রবীন্দ্র সরোবর নিয়ে আরও দুটো কথা বলে রাখি। সেই যে মসজিদটির কথা বলেছিলাম, সেটি দ্বীপের মতো জলের মাঝখানে আজও আছে। ১৯২৬ সালে হাওড়ার বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড পাড় থেকে মসজিদ অবধি একটি ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করে দেয়। এর ঠিক পেছন দিকেই ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’। এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে। সিপাহি বিদ্রোহের পরেই, ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে বম্পাস লেকের কাজ শুরু হয় ১৯২০। তাহলে তো হিসেব মিলছে না! মিলে যাবে, পরের লাইনটি পড়লেই হিসেব মিলে যাবে। ১৮৫৮ সালে ‘ক্যালকাটা রোয়িং ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, স্ট্র্যান্ড রোডের পাড়ে গঙ্গার দিকে। পরে সরোবর তৈরি হলে পাকাপাকিভাবে এখানে উঠে আসে।
সব শেষে বলি, রবীন্দ্র সরোবরে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা দেখেছেন সরোবরের পশ্চিমপাড়ে বেশ কয়েকটা বড় বড় কামান রাখা আছে। এই কামানগুলো ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌল্লার ব্যবহৃত কামান। মাটি খোঁড়ার সময় এগুলো পাওয়া গিয়েছিল!
সংগৃহিত
Posts: 1,127
Threads: 3
Likes Received: 742 in 509 posts
Likes Given: 613
Joined: Feb 2020
Reputation:
29
darun golpo.
আসুন আমরা সবাই চটি গল্প উপভোগ করি।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
এক নিঃশ্বাসের গল্প
ওয়ালজ
“আমাদের প্রথম ওয়ালজের কথা মনে আছে?”
“হ্যাঁ, তুমি খুব নার্ভাস ছিলে, আমার পা মাড়িয়ে দিয়েছিলে।”
পরেশকে হুইল চেয়ার থেকে হাত ধরে তুলে, এক পা এক পা করে অপরেশন থিয়েটারের দরজার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল শিখা। তিন তিরিক্কে ন স্টেপ হাঁটা মাত্র। পরেশ বলল, “আজকেও আমার খুব নার্ভাস লাগছে। সেই প্রথম দিনের মতই...।”
সজনে ফুল
শহুরে ছেলে। বৌ মফসসলের। বিয়ের পর ছোটনাগপুরে বেড়াতে এসেছে। যায়গাটা এখনও গঞ্জ ধরণের। চারদিকে গাছগাছালি। সকালে ঘুম ভাঙতেই পাখিদের কিচির মিচির। বৌ শীত কাতুরে। লেপের মধ্যে গুটিসুটি। ছেলেটা বেরিয়ে পড়ল। এদিক সেদিক ঘুরে ফেরার সময় দেখল একটা গাছের নীচে সাদা ফুলে ঘাস ছেয়ে আছে। পায়ে ডিঙ্গি দিয়ে উঁচু ডালে ঝাঁকি দিতে আরও ফুল ঝরে পড়ল। দু হাত ভরে ফুল কুড়োল। রুমালেও কিছু বাঁধল। বাড়ি ফিরে মেয়েটার সামনে রাখতে মেয়েটা গালে হাত দিয়ে বলল – ওমা এতো সজনে ফুল। কোত্থেকে পেলে? কেটেকুটে আলু দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধল। ছেলেটার মন খারাপ হল। এমন সুন্দর ফুলগুলো! ভাতের সাথে মেখে এক গ্রাস মুখে তুলে দেখল স্বাদটা মন্দ না। বৌ রাঁধে ভালো।
চোরকাঁটা
শহরের প্রধান রাজপথ অবরোধ করে মিছিল বেরিয়েছে। মানুষের অনেক দাবী দাওয়া। না মানলে বিপত্তি। অ্যাম্বুলেন্স আটকে আছে। মৃত্যু নিঃশর্ত। মৃত্যুপথযাত্রীর কোনো দাবী থাকতে নেই। সে অ্যাম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে দেখল পাশেই ময়দান। হাওয়ায় পা ফেলে ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে সে হাসপাতালে পৌঁছে গেল। ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করার আগে দেখল তার পরণের কাপড়ে চোরকাঁটা বিঁধে আছে।
সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
বই কেনা
নির্মাল্য ব্যানার্জ্জী
উল্টোডাঙ্গার মোড়ে সোনি ওয়ার্ল্ডের সামনে ফুটপাথে সুনীলদার বইয়ের স্টল । সুনীলদা নেহাৎই সেলার নয় । বুক সেলার । বোধহয় মানুষটা বই ভালোও বাসে । দুপুরবেলা মাঝে মাঝে সুনীলদার বইয়ের দোকানে গিয়ে বসি । কিনি কম । নানান বই নাড়ি চাড়ি । নতুন বইয়ের মাদকতাময় গন্ধে দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় । সুনীলদা চা খাওয়ায়, মুড়ি মাখা নিয়ে আসে । মাঝে মাঝে আমিও ।
সেদিন দুপুরবেলা । সুনীলদা গেছে চা আনতে । একটা দামী গাড়ি থেকে নেমে এলেন সুবেশা ভদ্রমহিলা । দামী পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে দোকানে এসে দাঁড়ালেন । আহা, একেই বোধহয় বলে - এতো আগমন নয়, আবির্ভাব !
টপাটপ তিন চারটে নামি দামী বই পছন্দ করে ফেললেন । আমি দাম দেখে ১০% কমিশন দিয়ে যোগ করলাম । এমন সময় সুনীলদা ফিরে এলো । ১০% দিলেই হতো । ওমা, সুনীলদা বলে - না না, এগুলোতে বেশি কমিশন পাই । এ দুটো পঁচিশ পার্সেন্ট কমিশন । এ দুটোয় ১৫ ।
ভদ্রমহিলা হেলা ভরে একটা দুহাজারের নোট বার করে দিলেন ।
সুনীলদা ফেরৎ টাকা দিল । না গুনেই ভ্যানিটি ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেললেন । তারপর বললেন - আচ্ছা, সাদার ওপর নীল চোখ আঁকা কভারের কোন বই আছে ? দশ কপি নেবো ।
সুনীলদা অনেকক্ষণ ভাবলেন । আমাকে বললেন, জানেন নাকি, এরকম কোন বই ?
না বলতে কেমন লাগছিল । বললাম, আর কোন কিছু জানেন না ? লেখক, পাবলিশার কোন কিছু ?
ভদ্রমহিলা বললেন, না, সে সব জানিনা । আসলে -
আসলে কি ?
না, নতুন ফ্ল্যাটে কিছু নামকরা বই রাখবো । আর পর্দার রঙের সাথে মিলিয়ে কটা বই খুঁজছি । পারলে কাল পরশু আনিয়ে রাখবেন ।
কয়েক মুহূর্ত কোন সাড় ছিলনা । সুনীলদার ডাকে সম্বিৎ ফিরল - নিন, চা নিন, ঠান্ডা হয়ে গেল যে !
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
একটা ঝড়ের দরকার খুব !
বড্ডো বেশি ময়লা জমেছে মনে !
একটা শিলাবৃষ্টি আসুক এখুনি
প্রলয়ের সাথে নাচন বনে বনে !
সবাই এখানে স্বার্থপর !
মেকি হাসি দিয়ে ভোলায় মন !
মেকাপি মুখের মিষ্টি হাসি
জলের ধারায় ডরায় ভুবন ! (মেকআপ ধোয়ার পর ! )
আসুক ঝড় ! ভাঙুক ঘর
মারুক শত মলিন প্রাণ !
আসুক বৃষ্টি ঝরুক শিলা
বাজুক নতুন জীবনের গান !
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
#জীবননদী
জীবনের অর্ধেক পথ পেরিয়ে
এখন আমরা প্রায় সবাই
পূর্ব আর উত্তর পুরুষের
মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছি,
সেতুবন্ধ হয়ে ।
আমাদের কারো বাবা, কারো মা,
কারো বাবা ও মা দুজনেই
বৈতরণী পেরিয়ে এখন পরলোকে,
কেউ বা শেষ খেয়ার অপেক্ষায়,
নৈঃশব্দকে সাথে নিয়ে ।
কেউ বা জীবনের স্বাদ
নিচ্ছে চেটেপুটে ।
আমরা চাই এই স্বাদ
নেওয়া চলুক অনন্তকাল,
যতক্ষণ না অরুচি আসে ।
কিন্তু মহাকাল কি
সে আর্জি মানে ?
এখন আমরা উল্লাসে ফেটে পড়া
কিশোর-কিশোরী বা
তরুণ-তরুণী নই,
হতাশায় নুয়ে পড়া
বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও নই ।
মনের ঝাঁপি উথলানো
স্মৃতি আর অভিজ্ঞতা
আমাদের স্থিতধী করেছে ।
বিরাট দুঃখ আজকাল আর
আমাদের ভাঙ্গতে পারে না,
বাঁধভাঙা উচ্ছাসও
ভাসিয়ে নিতে পারে না ।
আমরা জেনেছি
সব মেঘই সিঁদুরে নয়,
সব পলাশেই
প্রেমের রঙ থাকে না,
সব চকচকে সোনালী
বস্তুই সোনা নয় ।
বুঝেছি, সব শুরুরই শেষ থাকে,
সব শেষের ভেতরে থাকে
আর একটা শুরু ।
আমরা কেউ কাউকে
হিংসে করি না এখন,
কেউ কারো প্রতিদ্বন্দ্বীও নই ।
শুধু অভিমানী মনটা
ঝলকে ওঠে কখনও সখনও,
আবার বন্ধুর ফোন
বা মেসেজ পেলেই
সব অভিমান উড়ে যায়
শরতের পেঁজা তুলোর মতো ।
মাঝে মাঝে আমরা
এক জায়গায় মিলি
শুধু মেলার আনন্দে ।
ভেসে যাই স্মৃতির সরণী বেয়ে,
হাসি, গল্পের পর আবার
হেঁটে যাই আগামীর দিকে,
বুকভরা অক্সিজেন নিয়ে ।
আমাদের পুত্রকন্যারা
কেউ পড়ুয়া, কেউ চাকুরে,
কেউ বিবাহযোগ্য বা যোগ্যা,
কেউ বা বিবাহিত ।
নাতি-নাতনির মুখও
দেখেছে কেউ কেউ ।
এখনও আমরা সন্তানকে
ভুবনগ্ৰামের পথ চেনাই
অভিজ্ঞতার আলো দিয়ে ।
যা একদিন আমাদের
মা-বাবারা করেছেন ।
এত সবের মধ্যেও
মনের ভেতরে নেচে চলে
ছন্দময় এক ইচ্ছেনদী ।
সে কি অপূর্ণ কোনও স্বপ্ন,
পরিণতি না পাওয়া প্রেম
নাকি লিখতে না পারা কবিতা ?
জানা নেই, জানা নেই, জানা নেই ।
Posts: 1,127
Threads: 3
Likes Received: 742 in 509 posts
Likes Given: 613
Joined: Feb 2020
Reputation:
29
দারুন ছন্দ লিখেন আপনি।
আসুন আমরা সবাই চটি গল্প উপভোগ করি।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
ধর্ম
গরমটা বেজায় পড়েছে। মাথার তালু পর্যন্ত তেতে যাচ্ছে যেন!
ঘাম মুছতে মুছতে সেকথাই ভাবছিলেন বিরিঞ্চিপুরের নির্বাচনের প্রার্থী অমিয়বাবু।
অবশ্য প্রার্থী উনি একেবারেই শেষ মুহূর্তে হয়েছেন। ওই অনাদিরা কিসব বোঝালো, উনি রাজি হয়ে গেলেন। নইলে ওনাকে আর কে চেনে! তবে, রাজি হয়ে পড়েছেন আসল বিপদে। রোজ সকাল থেকে রাত চরে বেড়াতে হচ্ছে নির্বাচন কেন্দ্রের এদিক থেকে ওদিকে। এই গরমে! আজ আবার প্রচার হবে লোকাল ট্রেনে। ওনার প্রচারের কাজ দেখে যে ছেলেটি, সে বুঝিয়েছে যে রাস্তায় ঘুরে প্রচারের থেকে লোকাল ট্রেনে একসাথে অনেক মানুষকে পাওয়া যাবে, আবার বেশ অভিনব ব্যাপার ও হবে, তাই মিডিয়াও সুন্দর করে কভারেজ দেবে। সাথে আজ বিশেষ কেউ নেই, শুধু আড়ালে একজন ফটোগ্রাফার আছে, যে কিনা সুযোগ বুঝে ফটো তুলে নেবে...বাকি সব প্রচারের ছেলেটিই করবে যা করার। যারা এখনও ওনাকে চেনে না, তারাও চিনে যাবে আজ ই।
ট্রেন আসছে। হাতের লস্যির প্যাকেটে শেষ চুমুকটা দিয়ে মুখটা হাসি হাসি করে ফেললেন অমিয়বাবু। বেড়ে বুদ্ধিটা দিয়েছে ছোকরা। প্রচার কে প্রচার, আবার উনি যে কত মাটির কাছাকাছি থাকা মানুষ, সেটাও বোঝা যাবে। নইলে ধর্ম, বর্ণ এসবের ভিত্তিতে ভোট আজকাল আর ভাগ হয় না। কম চেষ্টা তো আর করা হয়নি!
ভাবতে ভাবতেই ট্রেন এসে গেল। একটা জেনারেল কামরায় উঠে পড়লেন অমিয় বাবু। এবার আলাপ জমাবেন সবার সাথে। বুঝিয়ে দেবেন, উনি কত ভাল, যোগ্য।
ট্রেনে উঠে অভ্যাস মতো একটু দেঁতো হাসি দিলেন অমিয়বাবু। হাসি হাসি মুখে ফটো ভাল আসে! আর ওনাকে পইপই করে বলা হয়েছে কোনও বয়স্ক মানুষ, বা বাচ্চাদের সাথে ভাল করে কথা বলতে, যাতে সেই ছবি তোলা যায়। কিন্তু...এই কামরায় তো সেরকম কাউকে...
ভাবতে ভাবতে চোখ ঘুরিয়ে দেখেন একজন ভদ্রলোক বসে আছেন একটি সিটের তৃতীয় আসনে। হাতে একটা টুকরি। অনেকটা কালিঘাট বা দক্ষিনেশ্বরে পুজো দিলে যেরকম টুকরিতে প্রসাদ পাওয়া যায়, সেরকম। এই তো ভাল ছবি! ওনার কাছ থেকে প্রসাদ চেয়ে নিতে হবে, আর সেই ছবি উঠবে।
কয়েকজনকে টপকে সেইদিকে চলে এলেন অমিয় বাবু। এবার আবার মুখ হাসি হাসি করার পালা।
কিন্তু এ কি! এই লোক আগে থেকেই টুকরিটা খুলছে কেন? কিভাবে জানতে পারল যে উনি প্রসাদ চাইতেই যাচ্ছেন?
অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন অমিয় বাবু...হঠাৎ দেখলেন ভদ্রলোক টুকরি থেকে কয়েকটা মিষ্টি বের করে ওনার সামনে বসা দুটো বাচ্চাকে দিলেন...যাঁরা "ক্ষিধে পেয়েছে...ও আব্বু ক্ষিধে পেয়েছে..." বলে একটানা ঘ্যানঘেনে সুরে কাঁদছিল অনেকক্ষণ ধরে...আর, মলিন পোষাক পরা আব্বু বলছিলেন "চুপ যাও বা'জান! বাড়ি গিয়ে খাবা!" স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, কিছু কিনে দেবার পরসা নেই ওঁর কাছে। আর তাই, সামনের ভদ্রলোক মিষ্টি বাড়িয়ে দিলেন ওদের দিকে। আহা, এর পর জল খেয়ে পেটটা একটু ঠান্ডা হবে বাছাদের...। কিন্তু...চলন্ত ট্রেনে জল ই বা কোথায়...
বারবার করে পার্টির সবাই বলে দিয়েছে হাসি মুখে থাকতে, তাও যে কেন চোখ ঝাপসা হয়ে যায় ছাই! কেন যে গলার কাছটা ভারি হয়ে আসে...
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে অমিয় বাবু। তারপর পাঞ্জাবির পকেটে রাখা ছোট্ট জলের বোতল বের করে ওদের হাতে দিলেন।
বাচ্চা দুটো গোগ্রাসে মিষ্টি খাচ্ছে তখন।
বোতল দেখে ওঁর দিকে একবার তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।
আহা, কী ক্ষুধার আর্তি ভরা চোখ!
না জানি কত তৃষ্ণা জমে আছে ওই ছোট্ট বুকদুটিতে!
অবিকল যেন ওঁর নিজের মুখ... যখন দুবেলা ভাত খাওয়াই ছিল বড় লড়াই।
আর এই পোড়া দেশে তো খাবারের জন্য, জলের জন্যও...খুন করা যায় নির্বিচারে...
কী যে হলো অমিয়বাবুর...হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন ওদের সামনে। বিড়বিড় করে বলতে শুরু করলেন "আজ বুঝেছি বাবারা...পেটের আগুনের চেয়ে বড় ধর্ম আর কিচ্ছু নেই। আর কিচ্ছু লাগবে না...দুটো খেয়ে - পরে বাঁচুক সবাই...আর কিচ্ছু না... অনেক দেরিতে মনে পড়ল সব আবার, বা'জানেরা...ক্ষমা করে দে আমাকে..."
অন্য কোনো দিকে চোখ ছিল না অমিয়বাবুর... থাকলে দেখতে পারতেন কামরার সবাই ওঁর দিকেই তাকিয়ে আছে...আর তাদের দৃষ্টি দিয়ে ঝরে পড়ছে একজন ভালো মানুষকে কাছে পাবার আনন্দ...
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
-"হ্যালো?"
-"হ্যাঁ, এই নাম্বার থেকে একটা ফোন এসেছিল..."
-"এটা 'স্বাতীর রান্নাঘর' তো?"
-"হ্যাঁ, স্যার, বলুন!"
-"আচ্ছা, আমি একটু আগে একটা মাটন কষা, একপ্লেট লুচি আর নারকেল দিয়ে ছোলার ডালের অর্ডার দিয়েছিলাম.."
-"একমিনিট একটু হোল্ড করবেন প্লিজ?"
-"শিওর"
-'হ্যালো, স্যার, অর্ডার টা তো পৌঁছে গেছে।"
-"হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সেজন্য ফোন করিনি। আসলে একটা কথা বলার জন্য ফোন করলাম।"
-"ও..স্যরি...বলুন প্লিজ...খাবার ঠিক ছিল? কোন অসুবিধা হয়েছে?"
-"অ্যাকচুয়ালি ম্যাডাম, আমি কাল ও অর্ডার করেছিলাম। কাল বাসন্তী পোলাও আর চিকেন কষা.."
-"ওকে স্যার...আপনার কি ভালো লাগে নি? কোয়ালিটি বা কোয়ান্টিটি নিয়ে কোনো ইস্যু হয়েছে কি?"
-"না না, ইনফ্যাক্ট, আমি কাল থেকে আপনার ফেসবুক পেজ এই পড়ে আছি।"
-"এক্সকিউজ মি!"
-"না না, আমি স্টক করছিলাম না...আসলে...আমার মায়ের টেস্ট... অবিকল এক টেস্ট পেলাম আপনার রান্নায়, জানেন?"
-"ও...থ্যাংকইউ! "
-"হ্যাঁ, তবে রান্না এত ভালো, কিন্তু ফেসবুক পেজের অবস্থা খুব খারাপ আপনার। কোনো আপডেট নেই, সেইসব পুরোনো ছবি, কাস্টমার টেস্টিমনিয়াল নেই..."
-"আসলে আমি এসব বুঝিনা। রান্না করতে ভালো লাগে, তাই করি।"
-"মে বি আই ক্যান হেল্প?"
-"রিয়্যালি? কিভাবে?"
-"আমি আসলে এই বিষয়টাই জানি।"
-"কিন্তু আপনি আমাকে হেল্প কেন করবেন?"
-"কারণ, আমি আপনার পারসোনাল প্রোফাইলটাও দেখে ফেলেছি। আর জানি, আপনি স্ট্রং, ইন্ডিপেনডেন্ট, আর ইয়ে..."
-"ইয়ে?"
-"ইয়ে... সুন্দরী এবং সিঙ্গেল... মানে আমার মতোই!"
-"ও আপনিও 'সুন্দরী' বুঝি?"
-"হা হা! স্যরি! যাই হোক, মিট করবেন? না ভালো লাগলে আর কোনোদিন বলব না..."
-"আচ্ছা, শুনুন! ডিনার তো করে ফেলেছেন, মাটন, লুচি...অনেক কিছু খেয়েছেন...একটা ওয়াক নিয়ে আসবেন নাকি? ভালো ডেসার্ট খাওয়াব!"
-"রিয়্যালি!"
-"আর একটা কথা...ট্রু কলারে ছবি দেখেছিলাম আপনার কাল ই...যখন ডেলিভারিতে বেরোবার আগে আমাদের ছেলেটি আমার অন্য একটা নাম্বার থেকে ফোন করেছিল আপনাকে। আর হ্যাঁ, সেখানে আপনাকে ট্যাগ করা আছে 'অ্যাড-গুরু' নামে। মিট তো করতেই হতো!"
-"ভাল রান্নাও করেন, আবার এত ইন্টেলিজেন্ট ও! অ্যামেজিং!"
-"ভালো অ্যাড বানান, আবার ফ্লার্ট ও ভালো করেন! অ্যামেজিং!"
- "হা হা হা"
-"মালপোয়া ওয়েটিং..."
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
মেয়েদের গল্প (আমার সব বান্ধবী দের উৎসর্গ)
বিয়ের পরে মেয়েরা তাদের মেয়েলি স্বভাবটা আর ধরে রাখতে পারে না। তাকে এখন আর আট দশটা মেয়েদের মতো ন্যাকামো করা মানায় না। বিয়ের দিন থেকেই মেয়েগুলো আর মেয়ে থাকে না। তারা মা হয়ে যায়। আদর করে তাদের বৌ মা বলে ডাকা হয়।
সে ইচ্ছে করলেই আর আগের মতো আর দশটা বারোটা পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। তাকে খুব সকালে উঠতে হবে। বুড়ো বুড়ো সন্তানদের ঘুম ভেঙ্গেছে কিনা খোজ নিতে হবে। তাদের ঘরে গরম চায়ের কাপ পৌছে দিতে হবে।
প্রথম দু তিনদিন চায়ের জন্য প্রশংসা পেলেও কয়েকদিন পর থেকে কপালে আর প্রসংসাও জোটে না। সেটা তার কর্তব্যের খাতায় পড়ে যায়।
তারপর একদিন সকালে সে জ্ঞান ফিরে দেখতে পারে তার পাশে ফুটফুটে একটা নতুন অতিথি কাঁদছে। সেদিন সেই নতুন মানুষটার কান্না থামাতে থামাতেই তার কান্নাও শুরু হয়ে যায়। তার দায়িত্ব এখন কয়েকশো গুন বেড়ে গেছে। সে এখন দুটো মা হয়ে গেছে। " বৌ মা " আর " মা "।
মা এর এখন ফেসবুক করে সময় নষ্ট করা মানায় না। তিনবেলার খাবার , ঘর গুছানো, কাপড় চোপড় ধোয়া, বাচ্চাদের কলেজে পাঠানো, তাদের হোমওয়ার্ক করে দেওয়া, শ্বশুর শাশুড়ির যত্ন নেওয়া, স্বামীর কাজ করা, এতোসব সামলাতে সামলাতেই তার কালো চুলের দু একটা সাদা হয়ে যায়।
তোমার যাকে ভালোলাগতো সে ছিল ঘন কালো কেশী একটা সুন্দরী রমনী। পরিবারের চাপ সামলাতে সামলাতে সে এখন চুল সামলানোর সময় পায় না। সদ্যযুবতি দের মতো সেজে গুঁজে তোমার সাথে রোমান্স করার সুযোগ পায় না।
ফ্যামিলি নামক " ইরেজারটা " তার
সমস্ত সৌন্দর্য ডলে ডলে মুছে দিয়েছে। একটু পরেই তাকে চুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। বাবুদের পেটে টান পড়লেই ডাকাডাকি শুরু করে দেবে। চুলোর কালিতে মাখমাখি হয়ে তোমার সামনে যে পেত্নিটা হাজির হবে তাকে তোমার ভালো লাগে না।
তার কাছে তোমার অনেক চাওয়া পাওয়া থাকতেই পারে। কিন্তু একটা মেশিন কিভাবে তোমার সব চাওয়া পাওয়া পূরণ করতে পারে? মেশিনের মধ্য থেকে " অতিমাত্রার আবেগ " সরিয়ে অতিমাত্রায় "লজিকের " সার্কিট বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। আউটপুট হিসেবে তার শুধু ঘুরতেই হবে।
এই একটা কারনেই তার প্রতি তুমি নতুন করে মুগ্ধ হতে পারবে না। ইচ্ছেও করবে না তার প্রতি আর নতুন করে মুগ্ধ হতে। তার সাথে সামান্য সামান্য কারনেই ঝগড়া বাধবে। প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগলেও পরে এটা নিত্যদিনের বাজারের লিস্টের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
সে পারবে না কাউকে খুলে বলতে। না তোমাকে, না সন্তানকে, না তার বাবা মা'কে। বাবা মা এগুলো শুনলেই হার্ট অ্যাটাক করবে। দশটা না পাচটা না একটামাত্র মেয়ে। মেয়েটা কখনোই চাইবে না তার জন্য তার বাবা মার রাতের ঘুম নষ্ট হয়ে যাক।
এখন সে আর তাদের সেই উড়নচণ্ডী মেয়ে নেই যে মেয়ের জন্য বাবা মা'র ঘুম হারাম হয়ে যাবে। এখন সে দুই সন্তানের মা হয়ে গেছে। সব কিছু বুঝতে শিখেছে সে। সে জানে মায়েদের দুর্বল জায়গাটা আসলে কোথায়...
অনেক তো তাদের সাথে রেসলিং খেললে। অনেক তো হলো। এবার না হয় একটু রেস্ট নাও।
রান্নাঘরে চায়ের লিকার আছে। কাপে দু চামচ চিনি ঢেলে চামচ দিয়ে নেড়ে যাই হোক তাই নিয়েই বালিশের পাশে বসো। কাচা পাকা চুলে হাত বুলিয়ে সকালের ঘুমটা না হয় আজ তুমিই ভাঙ্গাও।
মাত্র একদিনের জন্য বদলে দেখো। মাত্র একদিন। পরেরটুকু আর লিখলাম না। তুমিই একদিন নাহয় বাকি গল্পটা পড়ে শোনাইয়ো।
পৃথিবীর সব চুল পাকা মায়েরাই একদিন সুন্দরী মেয়ে ছিল। তোমাদের জন্যই এই পরিবর্তন।
শুধু তোমাদের জন্যই।
.
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,429 in 27,679 posts
Likes Given: 23,741
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
অদ্ভুত সুন্দর , হৃদয় থেকে বেরোনো আর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া লেখা ...
•
|