Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 245)

এমন সময় লক্ষ্মীকে সাথে করে হাতে শাঁখ নিয়ে নবনীতা ঘরে ঢুকে শাঁখে ফুঁ দিল। আর লক্ষ্মী উলু দিতে শুরু করল। তিনবার শঙ্খধ্বনি আর উলু দেবার পর লক্ষ্মী মিষ্টির থালা হাতে করে প্রথমে নিরঞ্জনবাবুর দিকে এগিয়ে গেল। নিচু হয়ে তাকে প্রণাম করে বলল, “পিসেমশাই, আপনারা যে আমাদের অভাগী বোনটাকে আপনাদের পায়ে ঠাঁই দিলেন, এতে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। নিন, একটু মিষ্টিমুখ করুন সকলে মিলে”।
 

অর্চনা আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে হৈমবতীদেবীকে বলল, “পিসি, তুমি পরিকে খবরটা জানিয়ে দাও। বেচারা বিকেল থেকে খুব টেনশনে আছে। আমাকে বারবার করে বলেছে যে তোমরা এখানে কী উদ্দেশ্যে এসেছ সেটা জানতে পারলেই যেন আমরা ওকে ফোন করি। তবে আমার মনে হয়, আমি বা নীতার বদলে তুমি নিজেই যদি কথাটা ওকে বলো, তাহলে ও বেশী খুশী হবে” বলে নিজের মোবাইল থেকেই পরির নাম্বার ডায়াল করে ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিল।
 

হৈমবতীদেবী ফোন কানে লাগাতেই ও’দিক থেকে পরিতোষ ব্যগ্র কন্ঠে বলল, “হ্যাঁ মন্তি বলো। ওদিকের কী খবর”?

হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি নয়। আমি বলছি রে, তোর পিসি”?

পরিতোষ একটু হতাশ হয়ে থতমত খেয়ে বলল, ‘ও পিসি, তুমি? হ্যাঁ বলো”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “আমরা তোর বিয়ে ঠিক করে ফেললুম রে বাবা। তুই আবার বেঁকে বসবি না তো”?

পরিতোষ মনে মনে ভাবল, তার মনের ভেতরের ভয়টাই তাহলে সত্যি হল! এখন সে সীমন্তিনী আর নবনীতাকে কী জবাব দেবে! সে কোন মুখে ওদের মুখোমুখি হবে এরপর। পরিতোষকে চুপ করে থাকতে দেখে হৈমবতীদেবী আবার জিজ্ঞেস করলেন, “কিরে, কি হল? কোন জবাব দিচ্ছিস না যে? আমাদের পছন্দ করা মেয়েকে তুই বিয়ে করবি না”? বলে তার পাশে বসা সুলোচনাকে ঈশারায় ফোনের স্পীকার অন করে দিতে বললেন। সুলোচনাও মজা পেয়ে ফোনের স্পীকার অন করে দিলেন।
 

সবাই শুনল পরিতোষ ভাঙা ভাঙা গলায় বলছে, “কি বলব পিসি। এতটা বছর থেকে নিজেকে তো অনাথই ভেবে এসেছি আমি। নাগরাকাটা যাবার পর কোন ভাগ্যে অর্চনার মুখে ওর বাবার নামটা শুনেই আমার ভেতরটা যেন কেমন করে উঠেছিল। সেই সূত্র ধরেই প্রথমে বিধুকাকু আর পরে তোমাকে খুঁজে পেলাম। তুমিই তো এখন আমার সব। তোমার কথার অন্যথা করা কি আর আমার পক্ষে সম্ভব। তুমি নিশ্চয়ই আমার ভালোর কথা ভেবেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ। কিন্তু পিসি, আমি তো তোমাকে আগেই বলেছিলাম, আমি নীতা আর মন্তিকে কথা দিয়েছিলাম যে ওদের পছন্দ করা পাত্রীকেই আমি বিয়ে করব। যতদুর জানি, তোমার সাথে আমার দেখা হবার আগেই ওরা একটা পাত্রী পছন্দও করেছিল আমার জন্যে। ওখানে যাবার দিন পনের আগে থেকে আমি কাজে অসম্ভব ব্যস্ত ছিলাম বলে ওদের সাথে নিয়মিত ভাবে ফোনে যোগাযোগও করতে পারিনি। তাই ব্যাপারটা আর এগোয় নি। নইলে এতদিনে হয়ত ওরা বিয়েটা পাকা করে ফেলত। এখন আমি ওদের কী বলব, সেটাই ভাবছি”।

হৈমবতীদেবী সীমন্তিনী আর নবনীতার দিকে দেখতে দেখতে বললেন, “আরে ওরা তো কেউ আর অবুঝ বা অবিবেচক নয়। সত্যি কথাটাই ওদের কাছে খুলে বলবি। ওদের দুটিকেই তো আমার বেশ ভাল লেগেছে। খুব ভাল মেয়ে ওরা। আর আমরা এখানে এসেছিলুম ওদের দু’জনের কাউকে বলে কয়ে তোকে বিয়ে করতে রাজী করাবো বলে। কিন্তু ওরা দু’জনেই আমাদের বিমুখ করল। তাই তো আমাদের বাড়ির সকলে মিলে যে মেয়েটাকে তোর জন্যে পছন্দ করেছিলুম তার সাথেই তোর বিয়ে ঠিক করলুম। আর তুই তো বলেছিলি যে মন্তি আর নীতা রাজী না হলে তুই বিয়ে করবি না। এখন মন্তি আর নীতা দু’জনেই আমাদের পছন্দ করা মেয়েটিকে পছন্দ করেছে। তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে ..........”

তার কথার মাঝেই বাধা দিয়ে পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “ওরা তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটার সাথে আমার বিয়ের ব্যাপারে রাজী আছে? সত্যি বলছ তুমি পিসি”?
 

হৈমবতীদেবী একটু অবাক হবার ভাণ করে বললেন, “ওমা, তোকে আমি মিথ্যে কথা বলতে যাব কেন? আচ্ছা এই নে, আমি নীতাকে ফোন দিচ্ছি। তুই ওর সাথে কথা বল” বলে ফোনটা নবনীতার দিকে এগিয়ে দিলেন।
 

হৈমবতীদেবীর হাতে ধরা ফোনের কাছে মুখ এনে নবনীতা বলল, “হ্যাঁ পরি। পিসি একদম সত্যি কথাই বলছেন। পিসিরা যে মেয়েটিকে পছন্দ করেছেন তাকে আমার আর দিদির দু’জনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদেরও মনে হচ্ছে মেয়েটা তোমার উপযুক্ত। তবে একদিক দিয়ে বিচার করলে বলা যায় তোমার ভাগ্যটাই অমন। নইলে কি আর এমন হত”?

পরিতোষ কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “এমন হত মানে? কী হত? একটু খুলে বলছ না কেন তুমি”?

নবনীতার মুখে চোখে কৌতুক ভরা দুষ্টুমির ভাব থাকলেও স্বাভাবিক গলায় বলল, “না তেমন কিছু না। আসলে আমরা তোমার জন্য যে মেয়েটা পছন্দ করেছিলাম সেই গরীব ঘরের মেয়েটা তো লেখাপড়ায় মাত্র মাধ্যমিক পাশ ছিল। তার আগে একটা বিয়েও হয়েছিল। পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘরও করেছিল। ওর স্বামী বছর দুয়েক আগে মারা গেছে। অন্যান্য আর সব দিক থেকে ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু পিসি যখন তোমার জন্যে নিজেই একটা ভাল মেয়ে পছন্দ করেছেন, তখন ওই মেয়ের ব্যাপারে তো আর কোন কথাবার্তা বলছি না আমরা। কিন্তু পিসিরা সকলে মিলে তোমার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তার ব্যাপারেও আমরা আজ তাদের মুখ থেকে সবটা শুনলাম। দেখলাম যে এ মেয়েটাও তোমার উপযুক্তই হবে। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখো পরি। এ মেয়েটাও বিধবা। তাই তো বলছি যে তোমার ভাগ্যটাই বুঝি অমন। তোমার কপালে বিধাতা বিধবা মেয়ে বিয়ে করবার কথাই লিখে দিয়েছেন বোধহয়”।
 

পরিতোষ সাথে সাথে বলল, “আরে মেয়েটা বিধবা না সধবা এ’সব কথা ছাড়ো তো। তুমি বা মন্তি কি সেই মেয়েটাকে দেখেছ? আচ্ছা মন্তি কোথায়? কলটা তো ওরই ফোন থেকে এসেছে। সে কোথায়? আমি মন্তির সাথে কথা বলতে চাই। ফোনটা ওকে দাও দেখি”।

নবনীতা আরও মজা পেয়ে বলল, “দিদি তো এখানেই আছে। আমার পাশেই আছে। এখানে ফোনের স্পীকার অন করা আছে। আর এ’ঘরে দিদি, অর্চু, পিসি, পিসো, বৌদি আমরা সকলেই আছি। এমন কি লক্ষ্মীদি পর্যন্ত আছে। আমরা সকলেই তোমার কথা শুনছি তো। তুমি দিদিকে কি জিজ্ঞেস করতে চাও, করো না”।

সীমন্তিনীও খানিকটা ফোনের কাছাকাছি এসে বলল, “হ্যাঁ পরি, নীতা ঠিক বলছে। আমরা সবাই এখন গেস্টরুমে আছি। সকলেই তোমার কথা শুনছেন। এবার বলো দেখি, আমাকে কী বলতে চাইছ”?

পরিতোষ এবার বেশ কয়েক মূহুর্ত চুপ করে রইল। অর্চনা ছাড়া গেস্টরুমের সকলের মুখেই কৌতুকের ছোঁয়া তখন। কিছুক্ষণ পর পরি জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মন্তি, তোমার কি মনে হয়? আমি কি মেয়েটাকে কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় তোমার”?
 

সীমন্তিনী ঠোঁট টিপে হেসে ছোট্ট করে জবাব দিল, “হ্যাঁ”।
 

অর্চনা লজ্জায় মাথা নুইয়ে আছে। একবার সে ঘর থেকে চলেও যেতে চেয়েছিল। কিন্তু সুলোচনা ওর হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন বলে সে আর বেরিয়ে যেতে পারেনি। ও’পাশ থেকে অনেকক্ষণ পরিতোষের সাড়া না পেয়ে এবার সুলোচনা একটু উঁচু গলায় বললেন, “কি হল ভাইদা? চুপ করে আছ যে বড়? কিছু বলবে না”?

এবার পরিতোষ অনেকটা সহজ গলায় জবাব দিল, “বড়বৌদি, আর কিচ্ছু বলার নেই আমার। তোমরা যা ভাল বোঝ, তাই করো। তবে এ’সময় ফোনটা করেছ বলে তোমাদের সব্বাইকে আমার মন থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। দুপুর বেলা থেকেই ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলাম। মনে হচ্ছিল একটা ধর্ম সঙ্কটে পড়েছি। কোন একটা সমাধানও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভেবেছিলাম আজ রাতে বোধহয় ঘুমোতেও পারব না। এবার সে চিন্তাটা দুর হল। তোমাদের সাথে পরে আবার কথা হবে। এখন রাখছি” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

পরিতোষ এভাবে ফোন কেটে দিতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “ওমা! ফোনটা কেটে দিল? অনেক কথা তো আমার বলার ছিল আরও”।

সীমন্তিনী ফোনটা ফিরিয়ে নিতে নিতে বলল, “পিসি, পরি সবটাই বুঝে গেছে। ওকে আর কিচ্ছু না বললেও চলবে। ভুলে যেও না তোমার ভাইপো একজন সিনিয়র আইপিএস অফিসার। অস্বাভাবিক বুদ্ধিমান ও। গোটা বাংলার সমস্ত পুলিশ ডিপার্টমেন্টের লোকেরা ওর বুদ্ধির তারিফ করে। চাক্ষুস যারা ওকে দেখেনি তারাও পরিতোষ সান্যাল নামটার সাথে পরিচিত। আমি ওর মনের ভেতরের কথাও বুঝতে পারি। তাই আমি বলছি, ও এ বিয়েতে রাজী আছে। এবার তোমরা নিশ্চিন্তে ওদের বিয়ের আয়োজন করতে পারো”।

এবার হৈমবতীদেবী বা আর কেউ কিছু বলবার আগেই লক্ষ্মী বলে উঠল, “আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তা আমি তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না গো দিদিমণি। ধেই ধেই করে নাচতে ইচ্ছে করছে আমার” বলতে বলতে অর্চনার কপালে একটু চুমু খেয়ে বলল, “দিদিমণি যেদিন সোনাদিকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, সেই দিনটি থেকে রোজ ভগবানের কাছে তার জন্যে প্রার্থনা করতুম আমি। গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ আমি। আমার তো আর সামর্থ্য ছিল না তার জন্যে কিছু করবার। সোনাদি এখানে আসবার পর তাকে দেখবার পর থেকে আমার মনটা আবার কেঁদে উঠেছিল। উচিৎ অনুচিত না ভেবে মনে মনে ভগবানকে কোষতুম। এমন সুন্দর মিষ্টি ফুলের মত মেয়েটার কপালে তিনি এত কষ্ট লিখে দিয়েছিলেন বলে। আজ ভগবানের কাছে আমি ক্ষমা চাইব” বলতে বলতে কেঁদে ফেলল।

সীমন্তিনী লক্ষ্মীর একটা হাত ধরে তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, “তোমার প্রার্থনার জোরেই হয়ত এমনটা হল লক্ষ্মীদি। নইলে পিসিরাও যে পরির জন্য অর্চুকেই পছন্দ করবেন এ কি আমরা কেউ ভাবতেও পারতুম? এবার কান্না থামাও। আর এক কাজ করো। রাত তো প্রায় সাড়ে ন’টা হতে চলল। তুমি খাবার আয়োজন করো। বেশী দেরী করে খেলে পিসি পিসোর অসুবিধে হতে পারে”।

লক্ষ্মী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ দিদিমণি, করছি” বলে শাঁখ আর খালি মিষ্টির থালাটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সীমন্তিনী এবার অর্চনাকে বলল, “অর্চু, তোর ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে। যা, ট্যাবলেটটা খেয়ে আয়”।

অর্চনা বেরিয়ে যেতেই সুলোচনা জিজ্ঞেস করলেন, “কিসের ট্যাবলেট খাচ্ছে ও”?

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “বৌদি, ওর ওই দুর্ঘটণাটার পর কালচিনি হাসপাতালের ডক্টর সোম ওকে প্রায় মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলেন। দিনের পর দিন অনাহারে অনিদ্রায় থাকতে থাকতে ওর ওনেক ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল। তিনদিন যমে মানুষে টানাটানি করে ডক্টর সোম ওকে মোটামুটি সুস্থ করে তুলে ওর মা বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু ওকে পুরোপুরি সুস্থ হতে মাস তিনেক সময় লাগবে বলেছিলেন ডাক্তার। আর এই তিন মাস ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধগুলো খেয়ে যেতে হবে। দু’মাস পেরিয়ে গেছে। আমার এখানে ওকে নিয়ে আসবার পর ও খুব তাড়াতাড়ি রিকভার করেছে। এখন ওকে আর অসুস্থ বলে মনেই হয় না। কিন্তু ওষুধের কোর্সটা পুরো হয়নি এখনও। অক্টোবর মাস অব্দি সেটা চলবে। ডাক্তার বারবার করে বলে দিয়েছেন কোর্সটা যেন পুরো করা হয়। কোর্স পুরো হবার আগেই ওষুধ বন্ধ করে দিলে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা দেখা দিতে পারে। আরও মাসখানেক পর কোর্সটা শেষ হবে”।

সুলোচনা তার শাশুড়ির দিকে চেয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মা, ডক্টর সোম তো আমাদেরকেও সে কথাটা বলেছিলেন, তাই না”?
 

হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ, বলেছিলেন তো”।

এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “মন্তি মা। আমরা ওদের বিয়েটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে দিতে চাই। কিন্তু এ ব্যাপারে আমরা তোমার কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য চাই মা”।

সীমন্তিনী আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “পিসো, এমন করে বোল না প্লীজ। এ বিয়েতে আমাদের অবস্থা তো কনের ঘরের পিসি আর বরের ঘরের মাসির মত। দু’তরফেই আমাদের আপনার জন। কাউকে কি আর আমরা এড়িয়ে যেতে পারব? তবে পিসো, আমি তো যখন তখন ছুটি ছাটা নিতে পারি না। তাই যখন যেখানে যেমন প্রয়োজন হবে সেভাবেই ছুটে যেতে পারব না কোথাও। তবে ফোনের মাধ্যমেই যতটুকু সম্ভব করবো। শারিরীকভাবে হয়ত সব সময় সব জায়গায় উপস্থিত থাকা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তবু বলছি, আমার কাছ থেকে তোমাদের যখন যেমন সাহায্যের প্রয়োজন হবে আমাকে নির্দ্বিধায় জানিও। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব সেটা সমাধা করতে”।
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “ভগবানের আশীর্বাদে লোকবল আর অর্থবলের অভাব নেই আমাদের মা। তুমি শুধু তোমার বুদ্ধি আর বিবেচনা দিয়ে আমাদের সাহায্য কোর মা”।
 

সীমন্তিনী এবার বলল, “পিসো, এ ব্যাপারে আমার কাছ থেকে তোমরা সব রকম সাহায্য পাবে। তবে আগে তো আমরা ধরেই নিয়েছিলুম যে ওদের বিয়ের সমস্ত আয়োজন আমাদেরকেই করতে হবে, আর পরি যখন রাজী ছিল তখন ধরেই নিয়েছিলুম যে বিয়েটা হচ্ছেই। তাই বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিলুম আমরা। সে’সব জানতে চাইলে আমি সব কথাই তোমাদের খুলে বলব। কিন্তু সে’সব কথা বলবার আগে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে পরির জন্যে তোমরা কবে অর্চুকে পছন্দ করলে? আমার মন কেন জানিনা বলছে যে আমি আর নীতা ওকে পছন্দ করেছি বলেই তোমরাও সেটাই চাইছ? তোমাদের পছন্দ অন্য কেউ ছিল”।

এবার হৈমবতীদেবী বললেন, “না মা, তা নয়। আমরা আগে যা বলেছি সেটাই সত্যি। মাস দুয়েক আগে যেদিন বিধুর সাথে আমার চুয়াল্লিশ বছর পর দেখা হল, সেদিনই ওর সাথে কথায় কথায় ওর পরিবারের সকলের কথা শুনেছিলুম। তুমি যে তার অন্নপূর্ণা মা সে তো সেদিনই জানতে পেরেছি। বিধুর ছোটমেয়ের বিয়ে তুমিই দিয়েছ। বরের বোন হয়েও মেয়ের বাড়ির সমস্ত দায়িত্ব তুমি নিজের হাতে সম্পন্ন করেছিলে। কিন্তু এক ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে একটা ভুল পাত্রের সাথে ওর বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছিল বলে বিধুর পরিতাপের শেষ ছিল না। পাশের গ্রামে বিয়ে দিলেও মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি যাবার পর থেকে সাতটা বছরের মধ্যে বিধুরা কেউ তার মেয়ের মুখটি পর্যন্ত একটি বারের জন্যেও দেখতে পারেনি। সাতবছর পর তার মা অন্নপূর্ণার দৌলতেই সে তার বড় মেয়েকে হাসপাতালের বেডে ফিরে পেয়েছিল। অতটুকু কচি একটা মেয়ের জীবনে এমন সর্বনাশের কথা শুনে আমার কান্না পেয়ে গিয়েছিল সেদিন। সেদিনই মনে মনে ভেবেছিলুম যে আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, আর বিধু যদি জাতপাতের গোঁড়ামি ছেড়ে আমার সেই ছেলের সাথে ওর বড়মেয়েটার বিয়ে দিতে রাজী হত, তাহলে আমি মেয়েটাকে আমার ঘরের বৌ করে এনে তুলতুম। কিন্তু আমারও ঘরে আর অবিবাহিত কোন ছেলে ছিল না। তাছাড়া বিধুদের মত গোঁড়া ', পরিবারের কেউই যে তাদের বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে চাইবে না, এটাও মোটামুটি ধরেই নিয়েছিলুম। তাই সে ভাবনা আমাদের মনেই চেপে রেখেছিলুম। পরিকে ফিরে পাবার পরের দিনই ওর তিন বৌদি আর আমার বারংবার চাপের ফলে ও তোমার আর নীতার সব কথা বলল। তারপর আমরা যখন বললুম যে এবার আমরা ওর বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগব, তখন ও বলল যে, ও আগেই এ দায়িত্বটা তোমাদের দু’জনের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। সে’কথা শুনে আমরা ওকে বলেছিলুম যে তোমাদের সাথে শলা পরামর্শ করেই আমরা এগোব এ ব্যাপারে। তখনও অবশ্য বিধুর এই মেয়ের কথাটা আমার মাথায় ছিল। কিন্তু বিধু যে তার বিধবা মেয়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিতে চাইবে না, এ ধারনাই আমাদের মনে তখনও বদ্ধমূল ছিল। ওদিকে পরির মুখে যখন শুনলুম তোমরাও ওর জন্যে একটা বিধবা অথচ কূমারী মেয়েকে পছন্দ করেছ, আর পরি নিজেও যখন তোমাদের পছন্দকেই মেনে নিয়েছে, তখন আমরা ভেবেছিলুম তবে আমরাও তো বিধুর মেয়ের ব্যাপারেও ভাবতে পারি। অবশ্য তখনও আমরা কেউ অর্চুকে দেখিনি। তবু পরের দিন আমার নির্দেশে বিধু যখন বিভা আর কিংশুককে নিয়ে আমাদের বাড়ি এল, তখন আমরা সকলেই ভেবেছিলুম যে ওর স্ত্রী বিভা যখন এত সুন্দরী তাহলে ওর মেয়েরাও নিশ্চয়ই সুন্দরী হবে। আর সেদিনই আমাদের ছোট বৌমা প্রথম সন্দেহটা করেছিল। ও বলেছিল যে তুমি যখন বিধুদের সাথে এতটাই ঘনিষ্ঠ, বিধু তোমাকে নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করে, তুমিও বিধুর ছোটমেয়েকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাস, অর্চুকেও ওই চরম বিপদ থেকে মুক্ত করে আনবার পেছনেও তোমারই হাত ছিল আর তোমাদের পছন্দ করা মেয়েটাও যখন বিধবা, তাহলে সেই মেয়েটা অর্চুই হবে হয়তো। ওর সন্দেহটা আমাদের কারো কাছেই একেবারে অমূলক বলে মনে হয়নি। অর্চনার চিকিৎসা যে কালচিনি হাসপাতালের এক ডাক্তার করেছিলেন, সেটা আমরা আগেই বিধুর মুখেই শুনেছিলুম। তাই ছোটবৌমার কথা শুনেই তোমার পিসো আমাদের ফ্যামিলী ডাক্তার ডঃ বিশ্বাসের সাথে কথা বলতেই ভাগ্যক্রমে আমরা ওই ডাক্তার সোমের ফোন নাম্বারটা জানতে পেরেছিলুম। সেদিন রাতেই তোমার পিসো ওই ডাক্তার সোমের সাথে কথা বলে জানতে পারলেন যে পাঁচ বছর স্বামীর সঙ্গে সংসার করবার পরেও অর্চু এখনও একটা কূমারীই আছে। ওর সঙ্গে যে ওর স্বামীর একবারও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি এটা উনি জোর দিয়েই বললেন। অবশ্য প্রথমেই উনি তার কোন পেশেন্টের ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমাদের কাছে কিছু বলতে রাজী ছিলেন না। ভদ্রলোক সত্যিই খুব সজ্জন। আমরা আমাদের বাড়ির ডাক্তারের নাম করে বলতেও উনি রাজী হচ্ছিলেন না। তখন তোমার পিসো একটু ছলনার আশ্রয় নিয়েই ডাক্তার সোমকে তোমার নাম করে বলেছিলেন যে তিনি তোমার বিশেষ পরিচিত। আর আমরা আমাদের ভাইপো কলকাতার এক আইপিএস অফিসার পরিতোষ সান্যালের সাথে অর্চনার বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। আর সে ব্যাপারেই কথাগুলো জানা আমাদের প্রয়োজন। তোমার আর পরির নাম শুনেই ডক্টর সোম ওই কথাগুলো আমাদের বলেছিলেন। আরও বলেছিলেন যে পরিতোষও নাকি দু’দিন আগেই তার হাসপাতালে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছিল। ওই ডাক্তারের এক বোন নাকি কলকাতায় থাকে এবং পরি নাকি তাকে বৌদি বলে ডাকে। সে’কথা শুনেই আমাদের মনে আর কোন সন্দেহ রইল না যে তোমরাও পরির জন্যে বিধুর ওই মেয়েটাকেই পছন্দ করেছ। আর তোমাদের পছন্দ আর আমাদের পছন্দ যে একই, এটা উপলব্ধি করেই আমরা সকলেই যে কতটা আনন্দিত হয়েছিলুম, সে’কথা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না মা। কিন্তু মনের ভেতর ওই দুশ্চিন্তাটা কিন্তু থেকেই গিয়েছিল। বিধু তার বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দিতে রাজী হবে কি না। তখন একবার ভেবেছিলুম যে কালচিনি গিয়ে বিধু আর বিভার সাথে সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলেই দেখা যাক, ওরা কী বলে। কিন্তু ... ওহ, এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়। পরির ফোনেই প্রথম দিন সন্ধ্যেয় আমি রচনার সাথে কথা বলেছিলুম। কিন্তু সেদিন রাতে আমার ফোন থেকে ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলুম আমি। তখনই শুনেছিলুম যে বিধুর পরিবারের সকলের কাছে তুমি কী, আর কতখানি। তোমার কোন কথাই নাকি ও বাড়ির ছেলেমেয়েরা তো দুর, বিধু আর বিভাও অবহেলা করতে পারে না। সে’কথা মনে হতেই আমরা সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নিলুম যে এ ব্যাপারে সরাসরি বিধুর সাথে আলাপ করবার আগে তোমার শরণাপন্ন হলেই হয়ত আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধি হবে। তাই আজ এভাবে তোমাদের কাছে এসেছি আমরা। কিন্তু তবু বলছি মা, আমাদের পছন্দের তালিকায় অর্চুর ওপরে কিন্তু তোমার আর নীতার নামই ছিল। কারণ পরি তোমাদের দু’জনকেই কোন না কোন সময় ভালবেসেছিল। তাই আমরা এখানে আসবার আগে থেকেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে স্থির করেছিলুম যে আমাদের প্রথম পছন্দ হবে তোমরা দু’জনই। আর পরি যেমনটা বলেছিল, তোমরা এখনও যদি সেই একই কথা বল, তবেই আমরা অর্চুর ব্যাপারে কথা তুলব। আর আমাদের বিশ্বাস ছিল যে অর্চুই আমাদের তোমাদের দু’তরফেরই পছন্দ। তাই অর্চুকে বা বিধু বিভাকে তুমি নিশ্চয়ই রাজী করাতে পারবে”।


______________________________
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
(Update No. 246)

এতগুলো কথা একসাথে বলে হৈমবতীদেবী থামতেই নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এই হল আসল কথা। এমন সুন্দর করে সব কিছু তোমাদের গুছিয়ে বলতে পারতুম না আমি। এবার মন্তি মা, তুমি এবার আমায় বলো, তুমি আগে যেমন বললে, সেভাবে কি সত্যিই বিধু আর বিভাকে এ বিয়েতে রাজী করাতে পেরেছ? ওরা এ বিয়েতে সত্যি রাজী হয়েছে মা”?

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “একটু বোঝাতে হয়েছে তাদের অবশ্যই। প্রথম কথাতেই তারা রাজী হননি বটে। তবে হ্যাঁ পিসো, মাসি মেসোই শুধু নন, অর্চুর ভাইবোনেরাও সকলেই এ বিয়েতে রাজী আছে। আর বিয়েটা নিয়ে আমরা কিভাবে ভাবনা চিন্তা করতে শুরু করেছিলাম, তোমরা জানতে চাইলে সে’সবও আমি খুলে বলব তোমাদের। কিন্তু আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়া উচিৎ। রাত দশটা তো পেরিয়ে গেল। খাবার পর তোমাদের পক্ষে যদি না ঘুমিয়ে সে’সব শোনা সম্ভব হয় তাহলে আজ রাতেই কথাগুলো বলব। কিন্তু আমার মনে হয় পিসির ওপর খুব চাপ পড়বে। সেটা একটু ভেবে দেখো। পিসি যদি চান তাহলে আমি সারা রাত জেগেও সে’সব কথা বলতে রাজী আছি। নইলে কাল সকালেই না হয় শুনো সে’সব।”

এবার সুলোচনা বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ মন্তি। মা বাড়িতে রোজ রাত সাড়ে ন’টায় ডিনার করেন। তাই আমার মনে হয় এখন ডিনারটা সেরে নেওয়াই উচিৎ। বাকি আলোচনার ব্যাপারটা না হয় পরে ভেবে দেখা যাবে”।

অর্চনা সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওমা, পিসির তো তাহলে অনিয়ম হয়ে গেল আজ। আমি দেখছি ওদিকে লক্ষ্মীদি একা একা ......”

তার কথার মাঝেই দড়জার কাছ থেকে লক্ষ্মী বলে উঠল, “দিদিমণি, খাবার তৈরী হয়ে গেছে। ওনাদের সবাইকে নিয়ে এসো”।


******************

পরিতোষের বৌদিরা মিলে অনেক রকমের খাবার বানিয়ে পাঠিয়েছিল। সঙ্গে চাটনি, দই ছানার পায়েস আর ভাত অব্দি বানিয়ে পাঠিয়েছিল। বাইরে থেকে শুধু মিষ্টির হাড়িটাই কিনে পাঠিয়েছিল। খাবার খেয়ে অর্চনা, নবনীতা, সীমন্তিনী এবং লক্ষ্মীও প্রচুর প্রশংসা করল রান্নার।
 

খেতে খেতেই হৈমবতীদেবী তার স্বামীকে বললেন, “শোনো না, বলছিলুম কি। খাবার পর তো আমি আধ ঘন্টা না ঘুমিয়েই থাকি। আজ আধ ঘন্টার বদলে এক ঘন্টা পর ঘুমোলে কি আর এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে বলো”?

নিরঞ্জনবাবু খেতে খেতেই বললেন, “তোমার মানসিক অবস্থাটা আমি বেশ ভালই বুঝতে পারছি হিমু। তোমার মনের অনেক কৌতূহল মিটে গেলেও এখনও অনেক কৌতুহলের নিবৃত্তি হয় নি জানি। অবশ্য এটা আমিও অস্বীকার করব না যে আমার মনেও আর কোন কৌতূহল বাকি নেই। বড়বৌমার মনেও যে আছে তাও জানি। কিন্তু আমার আর বড়বৌমার তো কোন অসুবিধে নেই। তোমার যদি মনে হয় আরও একটা ঘন্টা জেগে থাকলে তোমার কোন কষ্ট হবে না, তাহলে আমি তোমায় বাধা দেব না। কিন্তু দু’ আড়াই ঘন্টা জার্নি করে এসেছ, তারপর এতখানি সময় কত উদ্বেগ আর উত্তেজনায় কাটল। এখনও আরও এক ঘন্টা তুমি জেগে থাকবে? তোমার শরীরের কণ্ডিশন কেমন সেটা তুমি ভেবে দেখো”।

সুলোচনা বললেন, “হ্যাঁ মা, আগ্রহ কৌতূহল আছে বলেই শারীরিক অবস্থাটা তো ভুলে গেলে চলবে না। আমারও তো ইচ্ছে করছে আজ সারাটা রাত জেগে মন্তি, অর্চু আর নীতার সাথে কথা বলে যাই। বিশেষ করে মন্তি বিধুমামুকে আর মামীকে কিভাবে রাজী করিয়েছিল সেটা না শোনা অব্দি মনটা পুরোপুরি শান্ত হবে না। কিন্তু শুধু আমার চাওয়াটাকেই বড় করে দেখলে তো চলবে না। আমরা যেমন উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় এতক্ষণ কাটিয়েছি, অর্চু আর মন্তিও তো একই সমান উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটিয়েছে। ওরাও তো ক্লান্ত হতে পারে। মন্তি সারাটা দিন অফিস করেছে। আবার কাল সকাল ন’টার দিকেই হয়ত আবার বেরিয়ে যাবে। আলোচনার তো এখনও অনেক কিছুই বাকি আছে। কিন্তু তবু বলছি, আজ রাতে শুধু নিজেদের কৌতূহল মেটাব বলে ওদের সবাইকে আর কষ্ট দেওয়া বোধহয় ঠিক হবে না”।

এবার নবনীতা বলল, “আমি তো আজ সারা রাত জেগে কাটাতেও রাজী আছি। কাল রবিবার। আমার ডিউটিতে যেতে হবে না। আর কতদিন পর আমার জীবনে এমন একটা খুশীর দিন এসেছে”।

সীমন্তিনী সকলের কথা শুনে বলল, “পিসো, বড়বৌদি কিন্তু ঠিক কথাই বলেছেন। সত্যি বলতে এখন অব্দি শুধু পাত্র-পাত্রী পছন্দই হল। বিয়ের আলোচনা তো এখনও সেভাবে শুরুই হয় নি। অনেক কিছুই আছে আলোচনা করবার। অবশ্য এটাও ঠিক যে সব আলোচনাই তো আজ রাতেই আর শেষ করে ফেলা সম্ভব নয়। তবু পিসির যদি শরীর ঠিক থাকে তাহলে আরও একটা ঘন্টা আমরা কথা বলতে পারি। আমি তোমাদের মনের বাকি কৌতুহলটুকুর কিছুটা নিবৃত্তি করবার চেষ্টা করতে পারি”।

নিরঞ্জনবাবু তাতে সম্মতি দিলে সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনাকে বলল, “নীতা, অর্চু, তোরা তাহলে একটা কাজ কর। তোদের খাওয়া শেষ হলে চটপট উঠে পড়িস। গেস্টরুমের বিছানাটা ঠিকঠাক করে মশারীটা টাঙিয়ে, তোদের ঘরের বিছানাও তৈরী করে ফেলিস। খাবার পর আমার ঘরেই সকলে মিলে বিছানার ওপর বসেই কথা বলব। আলোচনা শেষ হলে আমার বিছানাটা না হয় পরে আমিই পেতে দেব বড়বৌদির জন্য। গল্পে বসবার আগেই তোরা চটপট অন্যান্য বিছানাগুলো রেডি করে ফেলিস”।
 

খাবার পর নিরঞ্জনবাবুরা সকলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে বিছানার ওপর বসলেন। সীমন্তিনী ঘরে এসেই নিজের মোবাইল থেকে রচনার মোবাইলে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল “দুশ্চিন্তা করিস না সোনা। আজ আর তোর সাথে কথা বলতে পাচ্ছি না। এখানে সব ঠিক আছে। কাল সকালে হয়ত আমি ব্যস্ত থাকব। তুই আমাদের ফোন না পেলে, সকাল দশটা নাগাদ নীতা বা অর্চুকে ফোন করিস। সু-খবর পাবি। গুড নাইট”।

মিনিট দশেক বাদেই নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর ঘরে চলে আসবার পর সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী বলল, “পিসি, শোনো এবার। তোমরা যে ভেবেছিলে মাসি মেসোরা তাদের বিধবা মেয়ের দ্বিতীয় বিবাহ দিতে চাইবেন না কিছুতেই, সে ধারণা একদম সঠিক ছিল। আমিও আগে থেকেই জানতুম, তারা এমন আপত্তি তুলবেনই। কিন্তু সেটা নিয়ে আমি অতটা চিন্তিত ছিলুম না কোনদিনই। আমি চিন্তিত ছিলুম শুধু অর্চুকে নিয়ে আর পরিকে নিয়ে। আমি যেদিন অর্চুকে কালচিনির হাসপাতালে প্রথম দেখেছিলুম সেদিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম এমন নিষ্পাপ আর এমন ফুলের কুঁড়ির মত ফুটফুটে একটা মেয়ের জীবন আমি এভাবে কিছুতেই নষ্ট হতে দেব না। কিন্তু পরে মনে হল, আমি একা চাইলেই সেটা সম্ভব হবে না। অর্চু নিজে সেটা চায় কি না, সেটাই আগে বুঝতে হবে। আর ওর মত কোমল মনের একটা মেয়ে অমন বিভীষিকাময় সাতটা বছর কাটিয়ে শারীরিক ও মানসিক ভাবে যেভাবে ক্ষত বিক্ষত আর বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিল, তার পক্ষে চট করেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ভেবেছিলুম আগে ওকে সকারাত্মক চিন্তা ভাবনা করবার জন্যে তৈরী করতে হবে। ওকে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলবার পাশাপাশি খুব কাছে থেকে ওকে কিছুটা গ্রুমিং করতে হবে। তাই হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে বাড়িতে কিছুদিন থাকার পর ওর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে আমি ডক্টর সোমের সাথে পরামর্শ করেই ওকে আমার এখানে নিয়ে আসি। ডক্টর সোম সত্যি খুব ভাল একজন ডাক্তার, আবার তার পাশাপাশি খুব ভাল মনের একজন মানুষও। তার সঠিক উপদেশেই অর্চু এত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠেছে। তবে ওকে আমার এখানে আনবার আসল উদ্দেশ্যটা আজ অব্দি কেউ জানে না। এমন কি ডক্টর সোমও জানতেন না। আজ প্রথম তোমাদের সকলের কাছে আমি সেটা প্রকাশ করছি। আমার মনে হয়েছিল ওকে আমার এখানে নিয়ে এলে আমি নীতা আর লক্ষ্মীদি, তিনজনে মিলে খুব তাড়াতাড়ি ওকে শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে সুস্থ করে তুলতে পারব। মৌখিকভাবে এটাই সকলকে বলেছিলুম। আর সেটা হয়েছেও। লক্ষ্মীদি, নীতা আর আমার সাহচর্যে থাকতে থাকতে ঠাকুরের আশীর্বাদে ও দু’তিন সপ্তাহের মধ্যেই অনেক চনমনে হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমার গোপন ইচ্ছেটা ছিল ওর অতীতের সব কথা ওর স্মৃতি থেকে মুছে দিতে না পারলেও ওকে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শেখানো। আর সেটা যখন ও করতে শুরু করবে তখন ওকে বোঝাবো যে ওর আরেকটা ভাল ছেলের সাথে বিয়ে করা উচিৎ। আমি মনে মনে ওকে আর পরিকে নিয়ে তো আগে থেকেই ভাবতে শুরু করেছিলুম। কিন্তু সে’কথাটা তখন অব্দি নিজের মনে মনেই রেখেছিলুম। কিন্তু ভাল তো ওকে আরও অনেক আগে থেকেই বাসতুম আমি। ওকে দেখবার আগে থেকেই, যেদিন থেকে রচু, আর মাসি মেসোদের সাথে আমার হৃদ্যতা হয়েছিল সেদিন থেকেই ওকে আমি ভালবাসি। কিন্তু ওকে আমার এখানে নিয়ে আসবার খুব অল্পদিনের মধ্যেই ওকে ভালভাবে কাছ থেকে দেখে নবনীতা আর লক্ষ্মীদিও ওকে ভালবেসে ফেলল। তারপর আমাদের সকলের প্রচেষ্টায় অর্চু আবার বিয়ে করতে রাজী হল। সেটা খুব সম্ভবতঃ এ মাসেরই পাঁচ বা ছ’ তারিখের কথা। তার পরেই প্রথমে আমি রচুর সাথে আলোচনা করি। রচু আমার সঙ্গে একমত হতেই দু’ তিনদিন বাদেই আমি কালচিনি গিয়ে অনেকভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাসি মেসোকে রাজী করাই। ভাই তো প্রথম থেকেই আমাকে সাপোর্ট করেছিল”।

এতটা বলে একটু দম নিয়ে আবার বলল, “প্রায় দু’মাসের চেষ্টায় অর্চুকে আর ওদের পরিবারের বাকি সকলকে রাজি করাবার পর আমি পরির সাথে ওর বিয়ে নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে লাগলুম। সবদিক দিয়ে ভেবে মনে হল অর্চু বিধবা বলে পরির মনে কোনরকম দ্বিধা না থাকলে ওরা একে অপরের যোগ্যই হবে। পরি একটা সময় নীতাকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসত। সাত বছর পর নীতাকে ফিরে পেয়ে নীতার সব কথা শুনেও ও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু নীতা আমার আর রচুর সামনেই পরির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছিল। আর আমি ঠিক ওই দিনটা থেকেই অর্চু আর পরিতোষের দু’জনের বিয়ে দেবার কথা মনে মনে ভাবছিলুম। কিন্তু নীতাও যে মনে মনে পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দেবার কথা ভাবছিল, সেটা আমিও বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমি পরির কাছে অর্চুর জন্য প্রস্তাব দেবার আগে আর একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতে চাইছিলাম যে নীতা এখন নিজের মন পরিবর্তন করে আবার পরিকে বিয়ে করতে চায় কি না। কিন্তু বাড়িতে অর্চুর সামনে নীতার সাথে ওই বিষয়ে কথা বলা সম্ভব ছিল না। তাই একদিন রাতে বাড়ির বাইরে একটা রেস্টুরেন্টে বসে ওর সাথে কথা বলি। ও সেদিনও পরিস্কার ভাবে একই কথা বলে যে পরিকে ও বিয়ে করবে না। সেই সাথে এ’কথাও বলে যে ও চায় পরি অর্চুকে বিয়ে করুক”।

এমন সময় নবনীতা আদুরে গলায় বলে উঠল, “ও দিদি, ওই দিনের কথাটা আমাকে বলতে দাও না প্লীজ”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ, বল”।

নবনীতা সাথে সাথে বলল, “বৌদি, সেদিন যা একটা কাণ্ড হয়েছিল না কী বলব তোমাদের। তখন আমরা একটা রেস্টুরেন্টে। দিদি তখন বলছিল যে পরির জন্যে সে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। আমি তার কথা শুনে মন খারাপ করে বলেছিলাম যে আমিও পরির জন্য মনে মনে একটা মেয়েকে পছন্দ করেছি। দিদির মুখে তখন একটা এগরোলের গ্রাস। তখন দিদি প্রথমে আমার পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি অর্চুর নাম বলতেই সে এমন বিষম খেয়েছিল যে রেস্টুরেন্টের সমস্ত লোক দৌড়ে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল। বিষম খেয়ে কাশতে কাশতে দিদির প্রায় দম বন্ধ হবার জো হয়েছিল। আর অমন মূহুর্তেই অর্চু দিদির ফোনে তখন ফোন করেছিল। দিদির তো তখন কাশতে কাশতে চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমিই ফোনটা ধরে অর্চুর সাথে কথা বললাম। আর দিদিভাই নিজেকে সামলে নেবার পর যখন বলল যে সেও পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দিতে চায়, সে’কথা শুনে তখন আমার বিষম খাবার উপক্রম হয়েছিল। আমি তো আনন্দে নাচতে শুরু করে দিয়েছিলাম। তখনই সবাইকে কথাটা জানাতেই চাইছিলাম। কিন্তু দিদিই তখন আমাকে বোঝাল যে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে গেলে সব বানচাল হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের ভাল করে ভেবে চিন্তে সকলের মনের ইচ্ছেটা জানতে হবে। তারপরই পরির কাছে আর অর্চুর কাছে সব কিছু খুলে বলতে হবে। তারপর দিদি প্রথমে অর্চুকে আমার আর পরিতোষের মধ্যে আগে কেমন সম্পর্ক ছিল সেটা জানায়। পরি যে দিদিকেও একসময় বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল সেটাও ওকে জানালাম। তারপর ঠাট্টার ছলে আমরা অর্চুর সামনেই ওদের দু’জনের বিয়ের কথা ওঠাতে শুরু করলাম। আমাদের কথায় ও লজ্জা পেত। আমাদের থামতে বলত। কিন্তু আমরা প্রায় রোজই পরিকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলাম। আর ওদিকে রচনা বৌদির সাথেও পরির পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। রচনা বৌদিও পরিকে নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছিল। আর অর্চুর সাথে কথা বলবার সময় রচনা বৌদিও পরির খুব প্রশংসা করত। সে তারিখটা আমি বোধহয় কোনদিন ভুলব না। এ মাসেরই তেরো তারিখ। সেদিন আমি আর দিদি মিলে ওকে এমনভাবে চেপে ধরেছিলাম যে আমাদের কথায় সেদিন ও পরিকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল। মাসি মেসোকে দিদি তার আগেই পরি আর ওর বিয়ের ব্যাপারে রাজী করিয়েছিল। অবশ্য সে’কথাটা কালচিনির বাড়ির সবাই, এখানে আমরা আর কলকাতার রতুদা আর রচনাবৌদি জানলেও, দিদি সকলকেই কড়া নির্দেশ দিয়ে রেখেছিল যে অর্চু বা পরিকে এ’সব কথা কেউ যেন না জানায়। আর দিদির কথা তো কেউই ফেলতে পারে না। দিদির বাপের বাড়ির লোকজনদের সাথে তার যে যোগাযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, সে বাড়ির কেউও দিদির কোন কথা অমান্য করেন না। তা সে যাই হোক, ততদিনে অর্চুর নাম উল্লেখ না করেই দিদি পরিকে জানায় যে আমরা পরির জন্য এমন এমন একটা মেয়ে পছন্দ করেছি। অর্চুর অতীতের বিয়ের ব্যাপারে আর ওর রূপগুণ স্বভাব চরিত্রের কথা সবকিছু জানিয়ে দিদি পরির মতামত জানতে চেয়েছিল। পরি ঠিক আগের মতই দিদিকে বলেছিল যে ও’সব ব্যাপারে দেখবার বা ভাববার দায়িত্ব তার নয়, সে দায়িত্ব আমাদের দু’জনের। আমাদের পছন্দ হলে ওর কোনও আপত্তি নেই”।

এতখানি বলে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “এর পরের ঘটণাগুলো সবটা আমিও পুরোপুরি জানিনা দিদি। তাই পরের টুকু এবার তুমিই বলো”।
 

সীমন্তিনী তখন বলল, “পরের সময়টুকু আমাদের যত উদ্বেগ চিন্তা দুর্ভাবনা আর বিস্ময়ের সাথে কেটেছে তাতে সব কথা তোকে বলবার সুযোগও পাইনি রে নীতা। তবে পিসি, আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছিলুম এটা না জেনেও পরি যখন বিয়েতে রাজী হল তখন আমি বিয়ের আয়োজন নিয়ে ভাবতে শুরু করলুম। কিন্তু একই সাথে কালচিনির মেসোদের বাড়ি তৈরী, ভাইয়ের পরীক্ষা, কলকাতায় আমার পরিচিত আরেকজনের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাবার ব্যাপার নিয়ে আমাকে খুব চিন্তা ভাবনা করতে হয়েছিল। তার ওপর অফিসের ঝামেলা তো ছিলই। তাই নিজে আর কালচিনি যেতে পারিনি। কিন্তু মেসোর সাথে বেশ কয়েকবার আলোচনা করে জানতে পারলুম যে তাদের বাড়ি তৈরীর গৃহারম্ভ করতে হচ্ছে সামনের মাসের ১৮ তারিখে। বাংলার পয়লা কার্তিক। দুর্গাপূজো পড়েছে ২১ তারিখে, আর লক্ষ্মীপূজো ২৯ তারিখে। আর ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখের পর পরের মাস তিনেকের মধ্যে গৃহপ্রবেশের আর কোনও দিন নেই। গৃহারম্ভের আগেই বাড়ির পুরোন জর্জর ঘরগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। তখন টেম্পোরারি একটা কাঁচা ঘর বানিয়ে তাতে মাসি মেসোদের থাকবার বন্দোবস্ত করতে হবে। তাই নতুন ঘর তৈরী সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত আর তাতে গৃহপ্রবেশের অনুষ্ঠান না হওয়া পর্যন্ত ও বাড়িতে কোনও বিয়ের আয়োজন করা মোটেই সম্ভব হবে না। কিন্তু অক্টোবরের ১৮ তারিখে গৃহারম্ভ হলে দু’মাসের মধ্যেই নতুন বাড়ি তৈরী করে ফেলা হয়ত সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে গৃহপ্রবেশ পিছিয়ে যাবে আরো তিন চার মাসের মত। তাই ভেবে দেখলুম যে কালচিনির বাড়িতেই যদি বিয়ের আয়োজন করি তাহলে সামনের বৈশাখের আগে সেটা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু এতটা দেরী আমি ঠিক মানতে পারছিলুম না। তাই মাসি মেসোকে সেভাবে না জানিয়েই আমি প্রথমে আমার কাকু আর বড়মার সাথে ফোনে কথা বললুম। রাজগঞ্জের বাড়ির ওই দু’জনই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। তাদের দু’জনকেই অর্চুর বিয়ের কথা বলতেই তারাও খুব খুশী হলেন। অবশ্য বড়মা খুব অভিমান করে ছিলেন। কিন্তু আমি যখন জানতে চাইলুম যে রাজগঞ্জের বাড়িতে ওদের বিয়ের আয়োজন করা আদৌ সম্ভব কিনা, তখন বড়মা পরিস্কার ভাবে আমাকে জানিয়ে দিলেন যে এ ব্যাপারে তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হলে আমাকে বাড়ি যেতেই হবে। নিরূপায় হয়ে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে গত ষোল তারিখে আমি অর্চু আর নীতাকে সঙ্গে নিয়ে রাজগঞ্জ গিয়েছিলুম। তবে তখন ওরা কেউই জানত না যে রাজগঞ্জ যাবার পেছনে আমার আসল উদ্দেশ্যটা কী। আমি ওদের বলেছিলুম যে বড়মা আমাদের তিনজনকে দেখবেন বলেই আমাকে এমন করে যেতে বলেছিলেন। আর কথাটা যে মিথ্যেও ছিল না সেটা আমি জানতুমই। গিয়ে দেখি সেটাই সত্যি। আমাদের বাড়ির লোকেরা যে তাদের বাড়ি থেকেই অর্চুর বিয়ে দেবেন এ সিদ্ধান্ত তারা আগেই নিয়ে নিয়েছিলেন। শুধু আমাকে জানতে দেননি। বড়মা আমার সাথে অর্চু আর নীতাকে দেখেই তৃপ্ত হয়েছিলেন। অর্চুর নিষ্পাপ মুখটা দেখে ও বাড়ির বড় ছোট সকলেই ওকে এক মূহুর্তে আপন করে নিয়েছিল। সে রাতেই তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন যে অর্চু তো তাদের বড়বৌমারই দিদি। তাই তাদের মেয়েই। তাদের এই মেয়েটির বিয়ের সবরকম আয়োজন করতে তারা খুশী মনে প্রস্তুত আছেন। পরের দিনও তারা আমাদের আসতে দিতে চাইছিলেন না। কিন্তু সেদিনই তোমাদের আলিপুরদুয়ার কোর্টে অর্চুর কেসের হিয়ারিং ছিল বলে আমরা আর থাকতে পারিনি। এভাবে নিজে নিজেই গোটা ব্যাপারটার একটা পরিকল্পনা করেছিলুম। অপেক্ষা করছিলুম শুধু পরির সম্মতির। রচুর নিজের দিদি বিধবা অর্চুকে পরি বিয়ে করতে চাইবে কিনা সেটা নিয়ে তখনও আমার মনে একটু সংশয় ছিলই। কারন আগে নিজের সম্মতি জানালেও পরি তো তখনও জানত না যে আমরা অর্চুর সাথেই ওর বিয়ে দিতে যাচ্ছি। কিন্তু পরি তখন একটা বিশেষ কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে ওর সাথে কথা বলবার তেমন সুযোগই পাচ্ছিলুম না। অবশ্য ও আগে থেকেই ওর এমন ব্যস্ততার কথা আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলুম পরির ব্যস্ততা কেটে গেলেই ওর সাথে বিয়ের দিনক্ষণ আর আয়োজনের ব্যাপার নিয়ে কথা বলব। তারপর সিদ্ধান্তটা কালচিনির মাসি মেসোকে জানাব। কিন্তু তার দু’দিন বাদেই ঊণিশ তারিখ সকালে পরি দুম করে এখানে এসে হাজির হল। কিন্তু তখনও যে ওর সাথে এ ব্যাপারে কোন কথা কেন বলতে পারিনি, সে’কথা তো তোমাদের আগেই বলেছি। কুড়ি তারিখেই ও তোমাদের কাছে গিয়ে পৌঁছোতেই মনে হয়েছিল যে আমার চিন্তা ভাবনা আর এগিয়ে না নেওয়াই ভাল”।

এতগুলো কথা বলে সীমন্তিনী থামতে অর্চনা সীমন্তিনীর হাত ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “আমাকে নিয়ে তুমি এভাবে এতকিছু ভেবে এত সব করে গেছ দিদিভাই? আর কাউকে তার আঁচটুকুও পেতে দাও নি? আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে তুমি যে এত চিন্তা ভাবনা করে এতকিছু করে আসছিলে, তার কিছুই আমাকে জানতে দাও নি। আমি তো এ’সব কথা আজই প্রথম শুনছি। আমি তো এতদিন ভাবতুম যে তুমি আমাকে যেভাবে মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়ে এনেছিলে তার জন্য তোমার কাছে আমার সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। এখন তো দেখছি, এক জনম তো দুরের কথা, সাত জনমেও তো এ ঋণ শোধ হবার নয় গো” বলতে বলতে সীমন্তিনীর কোলের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ল।

সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় আর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ছিঃ অমন কথা কেন বলছিস বোন? তুই আমার বোন না? বোনের জন্য দিদিরা আরও অনেক কিছু করে থাকে। তাই বলে বোনের সাথে দিদির কি কখনও কৃতজ্ঞতার সম্পর্ক হয় রে? এমন কথা আর কখনও বলবি না। এবার কান্না থামা। অনেক রাত হল। পিসিকে আর জাগিয়ে রেখে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না। ওঠ, ওনাদের নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়ে আয়, মশারীটা ভাল করে গুঁজে দিস চারদিকে। আর তোরাও আর গল্প কথায় সময় নষ্ট না করে ঘুমিয়ে পর”।

অর্চনা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনীকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে হৈমবতীদেবী বিছানা থেকে নেমে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীর মাথায় সস্নেহে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “বিধু আর বিভার মুখে শুনেছি ওরা তোমাকে ‘মা অন্নপূর্ণা, মা দুর্গা, মা জগদ্ধাত্রী’ বলে ভাবে। সে শোনা শুধু কানে শোনাই ছিল। উপলব্ধি করতে পারিনি এতদিন। ভাবতুম ওরা তোমাকে ভালোবাসে বলেই হয়ত অমন বলে। আজ বুঝতে পারলুম ওদের ওই সম্মোধনগুলো কতটা সঠিক। তুমি সত্যি সত্যিই মা অন্নপূর্ণা। আর এই মা অন্নপূর্ণার জন্যই আমরা অর্চুর মত এমন একটা লক্ষ্মী প্রতিমাকে কাছে পেলুম। তুমি বয়সে আমার চেয়ে নেহাতই ছোট। তবু অর্চুর ভাঙা চোরা শরীর মন আর আত্মাকে যেভাবে তুমি সারিয়ে তুলেছ, যেভাবে ও আজ মেরুদণ্ড সোজা রেখে চলতে পারছে, যেভাবে ওর আর পরির ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবে এত কিছু তুমি করেছ, তার জন্য তোমায় আজ সত্যি প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে আমার”।

(To be cont'd .......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 247)

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “এমা, ছিঃছিঃ পিসি। এভাবে বলে আমাকে পাপের ভাগী কোর না প্লীজ। আমি আর এমন কী করেছি বলো? আমি তো শুধু আমার আশাপাশের লোকগুলোকে ভাল রাখবার জন্যে নিজের সাধ্যমত একটু চেষ্টাই করি। আর যার যার ভাগ্য, তার তার। সে সব তো বিধাতাই সকলের কপালে লিখে দিয়েছেন। আমাকে তোমরা প্লীজ কোন দেবীর আসনে বসিও না”।

নিরঞ্জনবাবুও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ঠিক বলেছ তুমি মা। যার যার ভাগ্য তার তার। বিধাতাই সকলের কপালে সে’সব লিখে দিয়েছেন। আমাদের মন চাইলেও বাস্তবে তোমাকে দেবীর আসনে বসাতে পারব না। আর সে চেষ্টা করে তোমাকে লজ্জিতও করব না। কিন্তু বিধাতা যে আমাদের কপালেও তোমার সাহচর্যে আসবার কথাটা লিখে দিয়েছিলেন, এ জন্যে তার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ”।

হৈমবতীদেবী আবার সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বললেন, “তুমি মা আমার অনেক চিন্তাই লাঘব করে দিয়েছ। তবু একটা কথা জিজ্ঞেস করছি মা। এ বিয়েটা হবে তো? মানে অন্য কোনদিক থেকে আর কোন বাঁধা বিপত্তি আসবে না তো”?
 

সীমন্তিনীও হৈমবতীদেবীর হাত ধরে মিষ্টি গলায় জবাব দিল, “পিসি, তুমি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো এ ব্যাপারে। মাসি মেসো রাজী, তোমরা সকলে রাজী, পাত্র-পাত্রী রাজি, এমনকি মাসি মেসোর বেয়াই বেয়ানরাও রাজী। তাহলে আর বাঁধা দেবে কে? তবু আমি তোমার গা ছুঁয়ে শপথ করছি, কোন বাঁধা বিপত্তি এলেও আমি একাই তার মোকাবেলা করব। তোমরা শুধু আমার পাশে থেক। অর্চু আর পরির সংসারের সূচনা আমি নিজে হাতে করব”।
 

হৈমবতীদেবী সীমন্তিনীর মাথায় হাত রেখে বলল, “বেঁচে থাকো মা। সুখে থাকো। ও বাবা, তুমি এত লম্বা! একটু নীচু হও না মা”।

সীমন্তিনী একটু হেসে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়াতে হৈমবতীদেবী সীমন্তিনীর কপালে আদরের চুমু খেয়ে বললেন, “এ জনমে তো আর হবার নয়। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি পরের জন্মে যেন তোমার মত একটা মেয়ে পেটে ধরতে পারি আমি”।
 

সীমন্তিনী সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, “নীতা, তুই তোদের ঘরে যা। আর শোবার আগে মনে করে অর্চুকে ওষুধ খেতে বলিস। আমি চট করে এ বিছানাটা পরিপাটি করে দিচ্ছি”।

নীতা বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, “ঠিক আছে দিদি, যাচ্ছি। কিন্তু তোমার ক্যাম্প খাটটা পেতে দিয়ে যাই” বলে আলমাড়ির পেছনে গুটিয়ে রাখা ফোল্ডিং ক্যাম্প খাটটাকে বের করতে যেতেই সুলোচনা বলে উঠলেন, “থাক না নীতা। ওটা বের করতে হবে না। এ খাটটা তো বেশ বড়ই আছে। আমরা দু’জন না’হয় একসাথে এই খাটেই শোব” বলেই সীমন্তিনীর উদ্দেশ্যে বললেন, “অবশ্য মন্তির অসুবিধে হবে কিনা জানিনা”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “তোমার অসুবিধে না হলে, আমারও কোন অসুবিধে হবে না বৌদি” বলে বিছানার চাদরটা উঠিয়ে নিতে নিতেই নিরঞ্জনবাবু আর হৈমবতীদেবীকে তখনও ঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল, “পিসি, পিসো। তোমরা কি আর কিছু বলবে”?

নিরঞ্জনবাবু জবাব দিলেন, “হ্যাঁ, আরেকটা কথা জিজ্ঞেস করবার ছিল মা। আসলে তুমি তো সকালেই অফিসে চলে যাবে। সকালে তোমার সাথে আর কতটুকু সময় কথা বলতে পারব তা তো জানি না। তাই ভাবছিলাম .......”

সীমন্তিনী একটা নতুন চাদর বিছানায় পাততে পাততে বলল, “পিসো, আজ আর কোন কথা নয়। অনেক রাত হয়েছে। আমার মনে হয় এখন আর দেরী না করে তোমাদের শুয়ে পড়া উচিৎ। কালকের কথা কাল দেখা যাবে’খন। তবে একটা কথা আমি এখনই তোমাদের তিনজনকে পরিস্কার বলে দিচ্ছি। তোমরা যদি ভেবে থাকো যে কালই তোমরা এখান থেকে চলে যাবে, সেটি কিন্তু হচ্ছে না। কারন তোমাদের কাছ থেকে আমার এখনও অনেক কিছু জানবার আছে। অনেক কিছু পরামর্শ করবার আছে। সকালে তো আমাকে অফিসে যেতেই হবে। রবিবার বলে আমাদের জীবনে কিছু নেই। তবে আমি দুপুরেই ফিরে আসব। তারপর তোমাদের সাথে বাকি কথা বলব। তোমরা অর্চুর সাথে কথা বলেই সকালটা কাটিয়ে দিও। অবশ্য কাল তো নীতাও বাড়িতেই থাকবে। ওদের দু’জনের সাথে কথা বলেই একটা বেলা কোনরকমে কাটিয়ে দিও তোমরা। আমিও একটা দেড়টার ভেতরেই চলে আসব”।

নিরঞ্জনবাবু ‘আ হা হা’ করে কিছু বলতে যেতেই সীমন্তিনী দু’হাতে নিরঞ্জনবাবু আর হৈমবতীদেবীকে ঠেলে ঘরের দড়জার দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আর কোন কথা নয় পিসো। তোমাদের ছেলের বিয়ে বলে কথা। এক কথাতেই কি বিয়ে সমাধা হয় নাকি? তার জন্যে অনেক তোড়জোড় অনেক আয়োজন করতে হয়। অনেক শলা পরামর্শ করতে হয়। আর সেগুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করে ফেলতে হবে না? তাই কালই আমরা বাকি আলোচনা গুলো সেরে ফেলব। এখন যেটুকু রাত বাকি আছে, একটু শান্তিতে ঘুমিয়ে নাও তো”।
 

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের সময়ে নিরঞ্জনবাবু সীমন্তিনীকে বললেন, “মন্তি মা, কাল রাতে কথা শেষ করবার সময় তুমি যে আমাদের বলেছিলে আজ তোমার এখানে থেকে যেতে, সেটা বোধহয় সম্ভব হচ্ছে না মা। আজ রাতে বোধহয় আমাদের পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব হবে না”।
 

সীমন্তিনী খেতে খেতেই জবাব দিল, “পিসো, আমি জানি তোমাদের খুব বড় ব্যবসা। তোমরা আর দাদারা সকলেই খুব ব্যস্ত থাক সারা দিন। গল্প গুজব করে কাটাবার মত সময় তোমাদের কারো হাতে থাকে না। তবু আমি তোমাদের কোন কথা কিন্তু শুনব না। তোমরা আজ এখানেই থাকছ। আজ রবিবার। নীতাও সারাদিন বাড়ি থাকবে। আমার অবশ্য রবিবার বলে কোন ব্যাপার নেই। নর্থের চার খানা জেলায় আমাকে ছুটোছুটি করতে হয়। সাতদিন চব্বিশ ঘন্টাই আমাদের ডিউটি। তবু আমি দুপুরেই বাড়ি চলে আসবার চেষ্টা করব। তারপর এ বিয়ের ব্যাপারে বাকি সমস্ত শলা পরামর্শগুলো আজ রাতেই সেরে ফেলব আমরা। তবে হ্যাঁ, কথা দিচ্ছি, কাল আর তোমাদের এখানে আঁটকে রাখব না”।

নিরঞ্জনবাবু আবার বললেন, “না মা, তুমি ভুল বুঝছ। আমাদের যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, পরির জন্য আমাদের হাতে সময়ের অভাব কখনও হবে না। আর তোমার এখানে আজ থেকে যেতেও আমাদের খুব একটা সমস্যা হত না। কিন্তু আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়”।
 

সীমন্তিনী এবার মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “অন্য কী সমস্যা পিসো”?
 

এবার হৈমবতীদেবী বললেন, “আজ সকালে বাড়িতে ফোন করে এদিকের সমস্ত খবরাখবর জানাতেই বাড়িতে হুলুস্থুল পড়ে গেছে মা। তুমি আমাদের তিনজনকে এখানে থেকে যেতে বলছ। কিন্তু ওদিকে আমাদের বাকি দুই বৌমা আর ছেলেরাও সকলে আজই এখানে আসতে চাইছে অর্চুকে আর তোমাকে দেখবার জন্য। বাচ্চা কাচ্চাগুলোও নাকি বায়না করছে আসবার জন্য। আজ রবিবার বলেই আমাদের ছেলেরা আসতে পারছে। ওদের সকলেরই তো দোকান বন্ধ থাকে রবিবারে, তাই। আর এ’সব শুনে বাচ্চারাও বায়না ধরেছে আসবে বলে। কিন্তু তোমার এখানে যে এতগুলো লোকের স্থান সংকুলান করা সম্ভব নয় সেটা কাউকে বোঝাতেই পারছি না। শামু, বিমু, অমু, মেজবৌমা, ছোটবৌমা, সাথে আবার পাঁচ পাঁচটে ছেলে মেয়ে। কি করি বল তো মা”?
 

সীমন্তিনীর সাথে সাথে নবনীতা আর অর্চুও হৈমবতীদেবীর কথা শুনে কম অবাক হল না। সীমন্তিনী খাওয়া থামিয়ে ভাবতে ভাবতে বলল, “তারা সকলে যে আসতে চাইছেন, এ তো আমাদের পরম সৌভাগ্য পিসি। তবে তুমি যেটা বললে, সেটাও তো সত্যি কথা। কাল রাতে তো বড়বৌদিরই বোধহয় ঘুমোতে অসুবিধে হচ্ছিল। আমি তো ক্যাম্পখাটে শুতে চেয়েছিলুম। কিন্তু বড়বৌদির কথাতেই তার সাথেই আমাকে শুতে হয়েছিল। বাড়তি তেমন কোনও বিছানাপত্রও বাড়িতে নেই যে মেঝেতে ঢালাও বিছানা করে দেব। আসলে আমার এখানে তো এতদিন অব্দি বেশী কেউ আসেনি। তাই বাড়তি বিছানা রাখবার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। এখানে ভাল কোনও হোটেলও নেই। আমাদের ডিপার্টমেন্টের একটা গেস্ট হাউস অবশ্য আছে। আমাদের থানার পাশেই। সেটা আমি নিজে কখনও দেখিনি। অবশ্য অফিসের নিয়ম অনুযায়ী আমাদের ডিপার্টমেন্টের লোক ছাড়া অন্য কেউ সেখানে থাকতে পারে না। আর তাছাড়া সেখানে থাকা বা শোয়ার বন্দোবস্ত কতটুকু বা কেমন, কিংবা ক’জন থাকতে পারে, সেটাও ঠিক জানা নেই আমার। তবে ঠিক আছে, আমি অফিসে গিয়েই সেটা দেখে সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। তোমাদের নাহয় ফোনেই জানিয়ে দেব। তোমরা এ নিয়ে ভেবো না। কোথাও কিছু বন্দোবস্ত না হলে কিছু বিছানা, মশারী আর বালিশ ভাড়া করে আনব” বলে লক্ষ্মীকে ডেকে বলল, “লক্ষ্মীদি, আরও দশজন অতিথি আসছেন আজ। তাদের সকলকে তুমি সামাল দিতে পারবে তো”?
 

লক্ষ্মী জবাবে বলল, “ও নিয়ে তুমি ভেবো না দিদিমণি। তুমি বেরিয়ে গেলেই আমি বাজারে চলে যাব। আর তাড়াতাড়ি ফিরে এসেই কোমর বেঁধে কাজে লেগে যাব। আমার সোনাদির বিয়ে বলে কথা। এ’টুকু কাজ দেখেই ঘাবড়ে গেলে চলবে”?
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “না মন্তিমা, তুমি অযথাই এত চিন্তা কোর না। ওরা বলেছে যে ওরা দুপুরের খাবার খেয়েই ওখান থেকে রওনা হবে। তিনটে সাড়ে তিনটের মধ্যে এখানে পৌঁছোবে। আর সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ আমরা এখান থেকে রওনা হয়ে গেলে রাত আটটার মধ্যেই আমরা বাড়ি পৌঁছে যাব”।

সীমন্তিনী মুচকি হেসে অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “বুঝেছিস অর্চু? তোর পিসিশাশুড়ি, পিসেশশুর আর ভাশুর জায়েরা আমাদের ঘরের রান্না খাবেনই না। কালও তারা সকলের খাবার সাথে নিয়ে এসেছিলেন। আবার আজও প্রায় সেই একই কাজ করতে চাইছেন। তারা ওখানে লাঞ্চ সেরে রওনা হবেন, আর এখানে শুধু চা খেয়েই আবার সন্ধ্যের আগেই সবাই মিলে ফিরে যাবেন”।

অর্চনা সীমন্তিনীর কথা শুনে লজ্জায় দৌড়ে রান্না ঘরে চলে গেল। কিন্তু হৈমবতীদেবী বললেন, “না গো মা, অমন করে ব্যাপারটাকে দেখো না তুমি। আসলে আজ রবিবার বলেই ওরা আসতে চাইছে। আর তোমার ঘরেও তো এতগুলো লোকের শোবার জায়গা হবে না”।

সীমন্তিনী নিজের খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে পিসি। যেভাবেই হোক, যে করেই হোক, আমি সেটা সামলে নেব। কিন্তু আমাকে এখনই বেরোতে হবে। তোমরা সকলেই আজ নাগরাকাটাতেই থাকছ। বাকি কথা অফিস থেকে ফিরে এসে আলোচনা করব” বলে নবনীতার উদ্দেশ্যে বলল, “নীতা, এনাদের কারো যেন কোনরকম অসুবিধে না হয়, এবেলায় সেটা দেখা কিন্তু তোর দায়িত্ব, বুঝলি তো”?

অফিসে বেরোবার আগে সীমন্তিনী নবনীতা আর অর্চনাকে আলাদা ঘরে নিয়ে জানিয়ে দিল যে সে নিজে দুপুর পর্যন্ত খুব ব্যস্ত থাকবে। তাই তার পক্ষে হয়তো পরিতোষকে ফোন করা সম্ভব নাও হতে পারে। ওরা দু’জন যেন পরিতোষ আর রচনাকে এদিকের সমস্ত ঘটণা জানিয়ে দেয়, কিন্তু কালচিনির বাড়িতে এ বিয়ে পাকা হবার ব্যাপারে যেন এখনই কাউকে কিছু না জানায়। কারন সীমন্তিনীর ইচ্ছে যে পরিতোষের পিসি পিসোরাই যেন সে খবরটা তাদেরকে জানায়। তারপর বিধুবাবু আর বিভাদেবী নিশ্চয়ই অর্চনা, নীতা বা সীমন্তিনীকে ফোন করবেন। তখন তাদের বিশদভাবে সব কিছু বলে দেওয়া যাবে।
 

সীমন্তিনী বাড়ি থেকে বেড়িয়েই সবার আগে রচনাকে ফোন করে আগেরদিন রাত অব্দি পরিতোষের পিসি পিসো আর বৌদির সাথে যা যা আলোচনা হয়েছে, সব সংক্ষেপে জানিয়ে দিল। আরও জানাল যে আজ বিকেলে পরিতোষের দাদারা তিনজন আর অন্য বৌদিরাও তাদের বাচ্চা কাচ্চাদের নিয়ে সীমন্তিনীর এখানে আসছেন। বিয়ের দিনক্ষণ স্থানের ব্যাপারে আজ বিকেল থেকে আলোচনায় বসে সব স্থির করা হবে। রচনা সে’সব শুনে খুশীতে যেন পাগল হয়ে গেল। সে তখনই সীমন্তিনীকে বলল যে সে রাজগঞ্জ আর কালচিনির সবাইকে সু’খবরটা জানিয়ে দেবে। কিন্তু সীমন্তিনী রচনার উচ্ছ্বাসে বাঁধা দিয়ে তাকে জানিয়ে দিল যে রচনা যেন কালচিনির বাড়িতে কাউকে এখনই খবরটা না জানায়। এতে পরির পিসি পিসেমশাইরা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হতে পারেন। কিন্তু রচনা চাইলে রাজগঞ্জের বাড়িতে সুখবরটা জানাতেই পারে। তবে রাজগঞ্জের বাড়ির কেউ যেন আবার কালচিনির বাড়িতে খবরটা না জানায় সেদিকে নজর রাখতে বলল।
 

তারপর পরিতোষের মোবাইলে একটা টেক্সট মেসেজ পাঠাল “অফুলি বিজি টুডে। কনভে এনি আর্জেন্ট মেসেজ টু নীতা। উইল ট্রাই টু কল ইউ অ্যাট লেট নাইট অর টুমরো মর্নিং”।
 

অফিসে ঢুকে নিজের চেম্বারে ঢোকবার আগে সে ওসির চেম্বারে উঁকি দিল। ওসি মিঃ সিকদারের সাথে চোখাচোখি হতেই সিকদার বললেন, “গুড মর্নিং ম্যাম। কিছু বলবেন”?

সীমন্তিনী ওসির ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “গুড মর্নিং সিকদারবাবু। আপনার কাছে ছোট্ট একটা ব্যাপারে কিছু আলাপ করতে চাইছি। আপনি কি ব্যস্ত আছেন”?

সিকদারবাবু বললেন, “আমার ব্যস্ততা তেমন নেই এ মূহুর্তে। বসুন প্লীজ। আর বলুন তো, কী ব্যাপার”?

সীমন্তিনী সিকদারবাবুর চেয়ারের উল্টোদিকের একটা চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “আসল আমি একটা ছোট্ট সমস্যায় পড়েছি সিকদারবাবু। আপনাকে তো কালই বলেছিলুম যে আমার ঘরে কয়েকজন গেস্ট আসছেন। সে জন্যেই আমাকে কাল তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। আপনি নিশ্চয়ই মিঃ পরিতোষ সান্যালের নাম শুনেছেন”?

সিকদারবাবু চোখ বড় বড় করে বললেন, “পরিতোষ সান্যাল? মানে আপনি কি আমাদের সেই বিখ্যাত পুলিশ রবিনহুডের কথা বলছেন ম্যাম”?

সীমন্তিনী সামান্য হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ সিকদারবাবু, তার কথাই বলছি আমি। গতকাল মিঃ সান্যালের পিসি, পিসো আর এক বৌদি আমার কাছে এসেছেন। মিঃ সান্যালের বিয়ের ব্যাপারে আমার সাথে কিছু পরামর্শ করতে। আলোচনার রেজাল্ট পজিটিভ হলেও, কাল রাত বারোটা অব্দি ডিসকাস করবার পরেও কিছু কিছু ব্যাপারে এখনও আলোচনা করা বাকি রয়ে গেছে। ওনারা সকলেই চাইছেন ওই বাকি আলোচনা গুলোও আজই করবেন। তাই আজ আবার মিঃ সান্যালের তিন পিসতুতো দাদা, দু’ বৌদি আর পাঁচজন ভাইপো ভাইঝিরা আসছে আমার কাছে। খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন সমস্যা নেই। ও’সব আমার ওখানেই হয়ে যাবে। কিন্তু আমার কোয়ার্টারে তো এতগুলো লোকের থাকবার জায়গার বন্দোবস্ত করা প্রায় অসম্ভব। আর এখানে তো ভাল কোন হোটেল টোটেলও নেই। আমাদের তো একটা গেস্ট হাউস আছে, তাই না? সেটার কেমন অবস্থা সিকদারবাবু? মানে মিঃ সান্যালের মত সিনিয়র আইপিএস অফিসারের আত্মীয়রা কি সেখানে থাকতে পারবেন রাতে”?

সিকদারবাবু বললেন, “কিন্তু ম্যাম, আমি তো এতদিন শুনেছি যে মিঃ সান্যালের নিজের বলতে কেউই নেই এ পৃথিবীতে। আর কোনও পিছুটান নেই বলেই তো তিনি এমন ডেয়ারিং সব কাণ্ড কীর্তি করে যেতে পারেন অনায়াসে”।

সীমন্তিনী এবারে একটু হেসে জবাব দিল, “আপনার ইনফর্মেশন ভুল নয় সিকদারবাবু, বরং বলা ভাল, ভুল ছিল না। আপনি হয়ত জানেন না, আমি যখন আইপিএস ট্রেনী ছিলাম তখনই মিঃ সান্যালের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, হায়দ্রাবাদে। আর এতদিনে তার সাথে আমার বেশ ভাল বন্ধুত্বও হয়েছে। আর আপনি হয়তো এটাও জানেন না যে মিঃ সান্যাল গত ঊণিশ তারিখে আমাদের নাগরাকাটায় এসেছিলেন। আমাদের থানার এদিকটাতেও তিনি এসেছিলেন”।

এ’কথা শুনেই সিকদারবাবু নিজের চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন, “কী বলছেন ম্যাম? মিঃ সান্যাল আমাদের থানাতে এসেছিলেন! ঈশ, একবার তাকে দেখতে পেলাম না আমি! এটা কি ঠিক হল ম্যাম? অমন একজন দুঁদে আইপিএস অফিসারকে একটু দেখবার সুযোগ দিলেন না আপনি”?
 

সীমন্তিনী হেসে হাত তুলে সিকদারবাবুকে চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে বলল, “আপনি যা ভাবছেন, তেমন কিছু হয়নি সিকদারবাবু। উনি সেদিন আমাদের থানায় ঢোকেন নি। উনি একটা ব্যক্তিগত কাজে তিন চারদিনের ছুটিতে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন। আর আমি নিজেও ওই মূহুর্তে ব্যাপারটা জানতুম না যে তিনি বিকেলে আমাদের থানার সামনে এসেছিলেন। তিনি তো তখন আমাকেও সেটা জানান নি। সেদিন রাতে আমি জানতে পেরেছি যে উনি ওইদিন একটা অটোতে চেপে আমাদের থানা পর্যন্ত এসেছিলেন। তারপর অন্যত্র কোথাও গিয়েছিলেন”।

সিকদারবাবু একটু হতাশভাবে বললেন, “ও, সরি ম্যাম। আমি তো তাহলে মিছেমিছিই আপনার ওপর হতাশ হয়েছি। তা উনি কি এই বিয়ের ব্যাপারেই এখানে এসেছিলেন নাকি”?

সীমন্তিনী আবার হেসে জবাব দিল, “না সিকদারবাবু, আমি তো আগেই আপনাকে বললুম যে উনি ওনার ব্যক্তিগত কোনও কাজে এসেছিলেন। আমার সঙ্গে শুধু দেখা করবার জন্যই এখানে এসেছিলেন। পরদিন খুব সকালেই উনি চলে গিয়েছিলেন কালচিনি। সেখান থেকে আলিপুরদুয়ার, মালবাজার হয়ে কলকাতা ফিরে গেছেন। কিন্তু যেদিন আমার এখান থেকে চলে গেলেন, সেদিনই প্রথমে তিনি কালচিনিতে আমার মেসোর সাথে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলেন যে আমার ওই মেসো তার বাবার ছোটবেলার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। আর মেসোর কাছ থেকেই জানতে পেরেছিলেন যে তার বাবার মায়ের পেটের দিদি মানে তার আপন পিসি এখনও বেঁচে আছেন, আর তারা আলিপুরদুয়ারে আছেন। সেদিনই তিনি আলিপুরদুয়ারে গিয়ে তার পিসিকে খুঁজে পেয়েছেন। এর আগে পর্যন্ত উনি নিজেকে পুরোপুরি অনাথ বলেই জানতেন”।

সিকদারবাবু এবার শ্বাস ছেড়ে বললেন, “ও, এই কথা। খুবই ভাল খবর ইনডিড। কনগ্রেচুলেশন ম্যাম। আপনার মত একজনের অমন স্বামীই হওয়া উচিৎ। কিন্তু উনিও কি হাইটের দিক থেকে .........”

সীমন্তিনী মুচকি হেসে মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আপনি যা ভাবছেন, তা নয় সিকদারবাবু। তিনি হাইটে প্রায় আমার সমান সমান হলেও আমরা দু’জন কিন্তু কেবলই বন্ধু, আর কিছুই নই। তবে বলতে পারেন উনি আমার গুরু হবার সাথে সাথে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, ফিলজফার অ্যান্ড গাইডও। আর তার সাথে আপনার দেখা না হবার দুঃখ হয়ত খুব বেশীদিন থাকবে না। ওনার বিয়েতে আমার তরফ থেকে আপনার নিমন্ত্রন অবশ্যই থাকবে। তখন চাক্ষুষ তাকে নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন। আমার মাসতুতো বোনের সাথে ওর বিয়ে পাকা হল গতকাল। বিয়ের আনুষঙ্গিক কথাবার্তাগুলো ফাইনাল করবার জন্যেই আজ ওর দাদা-বৌদিরা আসছেন। তাই তাদের রাতে থাকবার বন্দোবস্ত করতে হিমশিম খাচ্ছি। সে জন্যেই আপনার কাছে জানতে চাইছি সিকদারবাবু, আমাদের গেস্ট হাউসটার অবস্থা কেমন? তাতে ওই ভদ্রলোক ভদ্রমহিলারা একটা রাত কাটাতে পারবেন কি? আর তার চেয়ে বড় কথা তারা কি সেখানে থাকবার সুযোগ পেতে পারেন”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 248)

সিকদারবাবু একটু হতাশ গলায় জবাব দিলেন, “একেবারেই না ম্যাম। আমাদের গেস্ট হাউসের যে কী অবস্থা তা আপনি নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। বাইরের অফিসারেরা এসে সেখানে যেসব কীর্তিকলাপ করে তাতে সেটা ভদ্রলোকদের থাকবার মত উপযুক্ত থাকে না। এমনিতে চৌকিদার আর সুইপারেরা সাফ সুতরোই রাখে। কিন্তু ভেতরে ঢুকলেই দুর্গন্ধে বমি এসে যায় প্রায়। ম্যাট্রেস, মশারী আর বালিশ ফালিশের যা অবস্থা। একেবারে যাচ্ছে তাই। বালিশে মাথা রাখলেই নাকে দুর্গন্ধ ঢোকে। সেখানে কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব”।

সীমন্তিনী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলল, “ওঃ, বুঝেছি। কিন্তু অল্টারনেটিভ কী করা যায়, এ ব্যাপারে কিছু সাজেশান দিতে পারেন আপনি”?

সিকদারবাবু কয়েক মূহুর্ত ভেবে বললেন, “এত ভাববেন না ম্যাম। অল্টারনেটিভ অ্যারেঞ্জমেন্ট কিছু না কিছু হয়েই যাবে। আপনার কোয়ার্টারে কয়েকটা এক্সট্রা বেডের বন্দোবস্ত করে দিতে খুব মুস্কিল কিছু হবে না। তবে আর একটা অপশন একটু ভেবে দেখি। আপনাকে একটু পরেই সেটা জানাচ্ছি। আমি আগে একটু খবর নিয়ে নিই”।

সীমন্তিনী আর দেরী না করে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সিকদারবাবু। আপনি প্লীজ একটু দেখুন ব্যাপারটা। আমি চেম্বারে আছি। আর হ্যাঁ, কোনও রিকুইজিশন বা অর্ডার আছে আমার জন্যে আজ”?
 

সিকদারবাবু জবাব দিলেন, “না ম্যাম, নতুন কিছু আর নেই”।

সীমন্তিনী সেখান থেকে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকতে না ঢুকতেই পর পর দু’বার তার পার্সোনাল মোবাইলে দুটো মেসেজ ঢোকবার শব্দ পাওয়া গেল। নিজের চেম্বারের চেয়ারে বসে প্রথমে ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের পার্সোনাল মোবাইলটা বের করে ইনবক্স মেসেজদুটো দেখল। প্রথম মেসেজটা কিংশুকের। লিখেছে “প্রণাম নিও দিদিভাই”। মেসেজটা পড়ে সীমন্তিনী একটু অবাকই হল। কিংশুকের এমন মেসেজের অর্থ কালচিনির বাড়িতে আসল খবরটা পৌঁছে গেছে! কে জানাল? রচনা, রতীশ, নীতা, অর্চনা আর পরিতোষ নিজেও যে সীমন্তিনীর কথার অন্যথা করে তাদেরকে এ খবরটা দেয়নি, এ ব্যাপারে তার কোন সন্দেহ নেই। তাহলে কি বড়মা জানালেন? না কি নিরঞ্জনবাবুদের কেউই সেটা জানালেন। দ্বিতীয় মেসেজটা পরিতোষের। লিখেছে “ফীল ফ্রি টু কল মি এনি টাইম। নীতা কল্ড মি। থ্যাঙ্কস টু গড। ধর্ম সঙ্কটে পড়তে হয়নি আমাকে। আই অ্যাম হ্যাপি। কালচিনিতে কখন কিভাবে জানাবে, ইটস আপ টু ইউ। বি কেয়ারফুল টু ফিক্স দা ডেট অ্যান্ড লোকেশান। তোমাকে আর নীতাকে কিন্তু আমার বিয়ের সমস্ত অনুষ্ঠানে আর সমস্ত লৌকিকতায় হাজির থাকতে হবেই। অ্যাট এনি কস্ট। রেস্ট ইগনোরেবল”।

পরিতোষের মেসেজটাতে “আই অ্যাম হ্যাপি” দেখে সীমন্তিনী খুব খুশী হল। পরিতোষ যে অর্চনাকে বিয়ে করতে রাজী আছে, তার মনে যে কোনরকম সংশয় নেই, এতে আর কোনও সন্দেহ রইল না। খুশী মনে নিজের ড্রয়ারগুলো খুলে স্টীল কেবিনেট থেকে কয়েকটা ফাইল বের করে আবার চেয়ারে বসতে না বসতেই ওসি মিঃ সিকদার দরজায় নক করে বললেন, “ম্যাম, আসব”?

সীমন্তিনী অনুমতি দিতেই সিকদারবাবু ঘরে ঢুকে বললেন, “ম্যাম, শুনলাম বসাক গারমেন্টসের মালিক মিসেস জয়া বসাকের সাথে আপনার জানাশুনো আছে”।

সীমন্তিনী একটু কৌতূহলী দৃষ্টিতে সিকদারবাবুর দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ, তা আছে। কিন্তু তার আবার কী হল সিকদারবাবু? বসুন। বসে বলুন তো কি ব্যাপার? বসাক গারমেন্টসে কিছু হয়েছে নাকি”?

সিকদারবাবু উল্টোদিকের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “না না ম্যাম, সেখানে কিছু হয়নি। আসলে বসাক গারমেন্টসের যে ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিটটা আছে তাদের বাড়ির পাশে। সেখানে একটা সর্ট অফ লজ আছে। যেটার মালিকও ওই জয়া বসাকই। তাদের বাইরের দামী ক্লায়েন্টরা বা মহাজনেরা যখন এখানে এসে রাত কাটাতে বাধ্য হয় তখন তাদের অ্যাকোমোডেট করবার জন্যেই খানিকটা লজের মত করে একটা তিন রুমের ঘর বানিয়েছেন। প্রত্যেকটা রুমেই অ্যাটাচ বাথরুমও আছে। আমি তাদের ম্যানেজারের সাথে কথা বলে জানতে পারলুম যে আজ তাদের ওই লজে থাকবার মত কেউ নেই। আর ওই ম্যানেজারবাবুই বললেন যে যদিও বাইরের লোকদের ব্যবহারের জন্য সেটা দেওয়া হয় না, তবে আপনার সাথে জয়া বসাকের যেমন হৃদ্যতা আছে, তাতে আপনি নিজে তাকে একটু অনুরোধ করলেই উনি সেখানে আপনার গেস্টদের নিশ্চয়ই থাকতে দেবেন। আর সেখানে রুম বাথরুম, বিছানাপত্র নাকি খুবই সাফ সুতরো। জল, আলো, পাখা, মশারী সবকিছুই একদম ঠিকঠাক আছে। সেটা শুনেই আমি নিজে আর জয়া বসাকের সাথে কোন যোগাযোগ না করে আগে আপনাকেই কথাটা জানাতে এলাম। আপনি চাইলে তার সাথে একটু কথা বলে দেখতে পারেন”।

সীমন্তিনী সিকদারবাবুর কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল, “আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সিকদারবাবু। আমার কাছে তার নাম্বার আছে। আমি তার সাথে কথা বলে নেব’খন। আর হ্যাঁ, সুখেন্দু এসেছে কি? ও এসে থাকলে ওকে একটু আমার সাথে দেখা করতে বলে দেবেন প্লীজ”।

সিকদারবাবু “ঠিক আছে ম্যাম, আমি সুখেন্দুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে জয়া বসাকের কাছ থেকে সাহায্য না পেলে আমাকে জানাবেন কিন্তু। তখন আমি আপনার কোয়ার্টারে এক্সট্রা খাট বিছানা পাঠাবার ব্যবস্থা করব” বলে বেরিয়ে গেলেন।

সীমন্তিনী দুটো ফাইল মন দিয়ে দেখতে দেখতেই একজন তার চেম্বারের দরজায় নক করে বলল, “ম্যাম, আপনি আমায় ডেকেছিলেন”?

সীমন্তিনী দড়জার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ সুখেন্দু এস প্লীজ। বোসো”।

সুখেন্দুর সাথে সমস্ত দরকারী কথা বলে তাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে সীমন্তিনী আবার কাজে ডুবে গেল। কিছুক্ষণ টেবিলে বসে কাজ করবার পর ফাইলগুলো টেবিলের ওপর গুছিয়ে রেখে সে তার চেম্বারের কোনায় রাখা ডেস্কটপ কম্পিউটারটা চালু করল। কয়েকটা গুরুত্বপূর্ন চিঠির জবাব টাইপ করে ই মেইল করে দিল। এক সময় তার ব্যাগের ভেতরে রাখা ফোনটা বেজে উঠতেই সীমন্তিনী কম্পিউটার টেবিল থেকে সরে এসে ফোনটা ধরল। অন্যপাশ থেকে নিরঞ্জনবাবু জানালেন যে তার ছেলেরা আর অন্যান্যরা সবাই বেলা একটার সময় আলিপুরদুয়ার থেকে রওনা হয়েছে। দুটো গাড়িতে তারা আসছেন শুনে সীমন্তিনী সেই গাড়িগুলোর নাম্বার জেনে নিল। কথা শেষ করে দেখল বেলা তখন একটা কুড়ি। তাই আর সময় নষ্ট না করে সে কম্পিউটার বন্ধ করতে গিয়েই তার নজরে পড়ল পরিতোষ একটা ই-মেইল পাঠিয়েছে। তাড়াতাড়ি ই মেইলটা পড়েই সে কম্পিউটার বন্ধ করে নিজের ফাইলপত্র গুছিয়ে ড্রয়ারে আর কেবিনেটে রেখে সব কিছু চাবি মেরে চেম্বার থেকে বেরিয়ে পড়ল।

সীমন্তিনী বাড়ি এসে পৌঁছলো প্রায় সওয়া দুটো নাগাদ। অফিস থেকে জয়া বসাকের সাথে দেখা করতে যাবার সময়েই পরিতোষ তাকে ফোন করে জানতে চেয়েছিল যে তার পাঠানো ই-মেইলটা সে পড়েছে কি না। সীমন্তিনী মেইলটা পড়েছে বলতেই পরিতোষ বলেছিল ‘নির্দেশগুলো মেনে চলো’। আর বেশী কোন কথা বলেনি। সীমন্তিনী জয়া বসাকের সাথে আলোচনা করে তার গেস্টরুমে সমস্ত ব্যবস্থা পাকা করে সেখান থেকে বাড়ির দিকে রওনা দেবার আগেই নীতাকে ফোন করে জেনে নিয়েছিল যে বাড়িতে সকলের খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে। তখন সে নীতাকে জানিয়ে দিয়েছিল যে সে মিনিট পনেরোর ভেতরেই পৌঁছে যাবে, আর সে বাড়ি গিয়ে লাঞ্চ করবে। আর কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডে ঢুকে গার্ডদের কেবিনে গিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে আর তার ড্রাইভার রামসিংকে কিছু বিশেষ নির্দেশ দিয়ে সে ঘরে এসে কলিং বেল বাজাতেই আজ অর্চনা, নবনীতা বা লক্ষ্মীর পরিবর্তে সুলোচনা দড়জা খুলে দিতে সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা, তুমি কেন দড়জা খুলে দিতে এলে বড়বৌদি? নীতা অর্চু ওরা সব কোথায় গেল”?

সুলোচনা সীমন্তিনীকে ভেতরে টেনে নিয়ে দড়জা বন্ধ করতে করতে জবাব দিলেন, “মা ওই দুই জনকে নিজের দু’বগল দাবা করে রেখেছেন। তাদের এক মূহুর্তের জন্যেও ছাড়তে চাইছেন না। আর তোমার এখনও খাওয়া হয়নি বলে লক্ষ্মীদি তোমার জন্যে খাবার গরম করছে। তাই আমি খুললাম” বলে একটু থেমে সীমন্তিনীর দিকে ভরপূর দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বললেন, “তোমাকে পুলিশের এই পোশাকে, কী যে দারুণ লাগছে না মন্তি, কী বলব”।
 

সীমন্তিনী একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “কি যে বলছ না তুমি বড়বৌদি, ধ্যাত। আচ্ছা, তোমরা সবাই খেয়ে নিয়েছ তো”?

সুলোচনা জবাব দিলেন, “হ্যাঁগো, আমাদের সকলেরই খাওয়া দাওয়া হয়ে গেছে। তুমি যে বাড়ি এসে খাবে সেটা তো আগে কেউ বলেনি। নইলে আমি অন্ততঃ তোমার জন্যে অপেক্ষা করতুম”।

সীমন্তিনী বলল, “এমা না না, তুমি কেন আমার জন্যে .... আচ্ছা সে যাই হোক, আমি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছি। তুমি বরং সকলে যেখানে আছেন সেখানেই গিয়ে গল্প কর। আমি আসছি এক্ষুনি” বলে তার কাছ থেকে বিদেয় নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল।

মিনিট দশেক বাদে হাতমুখ ধুয়ে শালোয়ার কামিজ পড়ে সীমন্তিনী প্রথমে রান্নাঘরে এসে দেখে লক্ষ্মী তিনটে প্লেটে খাবার সাজাচ্ছে। সেটা দেখে অবাক হয়ে সে জিজ্ঞেস করল, “একি গো লক্ষ্মীদি? একটু আগেই না শুনলুম যে সকলের খাওয়া হয়ে গেছে। তাহলে আর তিনটে থালা সাজাচ্ছ কেন তুমি? আমি একাই তো শুধু খাব এখন, না কি”?
 

লক্ষ্মী মুচকি হেসে উত্তর দিল, “একবার গেস্টরুম থেকে ঘুরে এস দিদিমণি, তাহলেই বুঝতে পারবে”।
 

সীমন্তিনী আর কোন কথা না বলে গেস্টরুমে গিয়ে ঢুকতেই সেখানে বাকি সকলের সাথে চন্দ্রকান্তবাবু আর সরলাদেবীকে দেখে অপ্রত্যাশিত আনন্দে চমকে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “বড়মা, কাকু? তোমরা? তোমরা কখন এলে? আমি তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে। কী করে এটা সম্ভব হল” বলতে বলতে চন্দ্রকান্তবাবুকে প্রণাম করল। তারপর সরলাদেবীকে প্রণাম করতেই সরলাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মুখটা চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে বললেন, “সোনা মা আমার, নিজের প্রতি কি একেবারেই যত্ন নিস না নাকি রে? এত শুকিয়ে গেছিস কেন রে মা? ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস না বুঝি, তাই না”?
 

সরলাদেবীর স্নেহের আলিঙ্গনে সীমন্তিনীর দু’চোখ জলে ভরে যাচ্ছিল। তার গলা রুদ্ধ হয়ে গেল। ঘরের বাকি সবাই চুপ করে তাদের দুজনকেই দেখে যাচ্ছিল। বেশ কয়েক মূহুর্তের পর হাসি হাসি মুখে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনী বলল, “আমি ঠিক আছি বড়মা। একদম ঠিক আছি। কিন্তু তোমরা এভাবে কোন খবরাখবর না দিয়েই হঠাৎ করে এসে পড়লে যে? আমাকে তো একটু ফোন করে জানিয়ে দিতে পারতে অন্ততঃ”।

সরলাদেবী সীমন্তিনীর গালে কপালে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “আমরা তোর কেউ নই জানি রে মা। কিন্তু তুই তো আমাদের মেয়ে। মেয়ের বাড়িতে আসতে হলে কোন মায়ের যদি মেয়ের কাছ থেকে আগাম অনুমতি নিতে হয়, তাহলে সে মায়ের বেঁচে থাকার চাইতে ম......”

সীমন্তিনী সাথে সাথে সরলাদেবীর মুখে হাত চেপে ধরে অভিমানী গলায় বলল, “বড়মা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। ও’সব অলক্ষুণে কথা বোল না প্লীজ। তোমরা তো জান না, কাল রাত থেকে তোমার আর কাকুর কথা খুব মনে পড়ছিল আমার। মনে হচ্ছিল আজ যদি তোমরা দু’জনও আমাদের সাথে আলোচনায় থাকতে পারতে তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু কাজে কাজে আর বিভিন্ন চিন্তায় এতটাই ডুবে গিয়েছিলুম যে একটা ফোনও করতে পারিনি। তাই তো রচুকেই সে দায়িত্বটা দিয়েছিলুম। আর তাছাড়া, আগে থেকে কোন খবর না দিয়ে হুট করে তোমাদের আসতে বললেও তো তোমরা আসতে পারতে না। তাই আর .... কিন্তু.... আচ্ছা সে যাই হোক। তোমরা এসেছ কখন বল তো? আর এনাদের সাথে পরিচয় নিশ্চয়ই হয়ে গেছে এতক্ষণে”?
 

এবার চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “আমরা তো এই মাত্র মিনিট পনেরো আগে এসেছি রে মা। আর এসেই তো এনাদের সঙ্গে পরিচিত হলাম। তুই যখন নীতাকে ফোন করেছিলিস তার বোধহয় মিনিট দুয়েক বাদেই আমরা এসে পৌঁছেছি। তুই লাঞ্চ করিসনি শুনে, অর্চু নীতা ওরা বারবার খেতে বলা সত্বেও আমরা তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ভাবছিলাম তুই এলে তিনজনে একসঙ্গে বসে খাব। কতদিন তোর সাথে একসাথে বসে খাইনি। আজ এমন একটা সুযোগ পেয়ে আর সেটা হাতছাড়া করতে পারলুম না রে মা”।
 

সরলাদেবী একইভাবে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়েছিলেন। লক্ষ্মী তাদের খেতে ডাকতে এসেও দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপলক নয়নে সেই দু’জনকে দেখে যাচ্ছিল। এমন সময় হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি মা, যাও, আর দেরী না করে তোমার কাকু আর বড়মাকে সঙ্গে নিয়ে খেয়ে এস। ওরাও হয়ত আর এক বা সওয়া ঘন্টার মধ্যে এসে পড়বে। তার আগে খেয়ে নিয়ে একটু বিশ্রাম নাও মা। তোমার ওপর দিয়ে তো কম ধকল যাচ্ছে না”।
 

সীমন্তিনী সকলের কাছ থেকে দৃষ্টির মাধ্যমে অনুমতি নিয়ে সরলাদেবী আর চন্দ্রকান্তবাবুকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে বসল। নীতা আর সুলোচনাদেবীও তাদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল। অর্চনাকে হৈমবতীদেবী নিজের পাশেই বসিয়ে রাখলেন। খেতে খেতে সরলাদেবী আর চন্দ্রকান্তবাবু সীমন্তিনীকে জানালেন যে সকালে রচনা তাদের বাড়িতে সুখবরটা দেবার সাথে সাথেই রতিকান্তবাবু তার ছোটভাই আর স্ত্রীকে এখানে আসবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর বিয়ের ব্যাপারে তাদের কিছু নির্দেশ আর উপদেশও দিয়ে পাঠিয়েছেন। তাই তারা দেরী না করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শিলিগুড়ি থেকে ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ধরে সোজা নাগরাকাটা চলে এসেছেন।

সীমন্তিনী খুশীতে উচ্ছ্বল হয়ে বলল, “তোমরা আসাতে আমি সত্যি খুব খুশী হয়েছি কাকু। নীতা আর অর্চুকে নিয়ে রাজগঞ্জ থেকে ঘুরে আসবার পর এই ক’টা দিনে এত দ্রুত এতসব ঘটণা ঘটে গেছে যে আমি নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পাচ্ছিলুম না কি করা উচিৎ বা কোনটা অনুচিত। আমি ভেবেছিলুম যে পাকা কথার ব্যাপারটা কালচিনির বাড়িতে হলেই সবথেকে ভাল হত। কারন মাসি মেসোরও তো কিছু আশা থাকতে পারে। কিন্তু কালচিনি বাড়ির যা অবস্থা তাতে সেখানে সকলকে ডেকে নিয়ে আলোচনায় বসতেও অসুবিধে হত। আর এ ছাড়াও ', ঘরের বিধবা মেয়ের আবার বিয়ে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে সেটা পাড়া পড়শীরা আগে থেকে জেনে গেলে নানারকম কথাও সেখানে উঠত। মাসি মেসোরা হয়তো সে’সব সহ্য করতে পারতেন না। আর পিসি পিসোরা গতকাল এমন হঠাৎ করে এখানে এসে পড়লেন যে কাল দুপুর পর্যন্ত আমি এর বিন্দু বিসর্গও জানতে পারিনি। তাই ওই মূহুর্তে কাকে ডাকবো, কাকে খবর দেব এসব ভাবনা দুরে রেখে আগে আমি তাদের অভ্যর্থনার দিকেই জোর দিয়েছিলুম বেশী। আর সত্যি বলতে তো তখন তারাও কেউ আমাকে এটা বুঝতে দেন নি যে তারা পরি আর অর্চুর বিয়ের কথা ভেবেই এখানে আসছেন। তাই কাউকে এ বিষয়ে আর কি করে কী জানাব বল। অর্চুকে তারা তো এক কথায় পছন্দ করে ফেলেছেন। কিন্তু কাল রাত প্রায় বারোটা অব্দি অনেক বিষয়ে কথা হলেও বিয়ের দিন ক্ষণ বা অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে সেভাবে কোন কথাই হয় নি। তাছাড়া মাসি মেসো তো তখনও জানতেন না যে পিসি পিসোরা পরির সাথে অর্চুর বিয়ে দিতে রাজী আছেন। আজ সকালেই পিসি পিসোরা জানালেন যে বিয়ের আয়োজন নিয়ে পাকাপাকি সবকিছু ঠিক করে ফেলবেন বলে পরির অন্যান্য দাদাবৌদিরাও আজই আসছেন। কিন্তু এমন তাড়াহুড়োর মধ্যে তোমাদেরকে ডেকে পাঠাবার মত সময়ও হাতে ছিল না। আবার এতগুলো লোকের রাতে থাকবার ব্যবস্থার জন্যেও কিছুটা ছোটাছুটি করতে হল। তাই বেশ চাপেই ছিলুম আমি। তবু মনের ভেতরে একটা কাঁটা যেন কিছুটা খচখচ করছিল। মাসি মেসোর অনুপস্থিতিতে তাদের বড়মেয়ের বিয়ের সবকিছু ঠিক করে ফেলা আমার পক্ষে হয়ত অনুচিতই হবে। আর রাজগঞ্জের বাড়ির সকলেও বিয়ের আয়োজনটা সেখানেই করা হবে বলে সকলেই খুব খুশী ছিলেন। কিন্তু পিসি পিসোরা তাতে মত দেবেন কিনা সেটা নিয়েও মনে সন্দেহ আছে। আমি সত্যি বুঝে উঠতে পারছিলুম না কারো সাথে পরামর্শ না করেই এ’সব আয়োজনের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা সত্যিই আমার পক্ষে উচিৎ হচ্ছে কি না। ফোন করে ডেকে পাঠালেও মাসি মেসোরা বা রাজগঞ্জের বাড়ির কেউ, হুট করেই তো এখানে আসতে পারবেন না। অন্ততঃ চব্বিশ ঘন্টা আগেও যদি তোমাদের সবাইকে কথাটা জানাতে পারতুম, তাহলেও না হয় একটা কথা ছিল। তবে তোমরা এভাবে এসে পড়াতে আমি অনেকটাই স্বস্তি পেলুম গো বড়মা। যদি কালচিনি থেকে মাসি মেসোরাও এভাবে চলে আসত, তাহলেই ষোলকলা পূর্ণ হত। জানিনা তারা আমার এ কাজে সত্যি কোন মনঃকষ্ট পাবেন কি না”।
 

সীমন্তিনীর পেছনে দাঁড়ানো সুলোচনাদেবী সীমন্তিনীর কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, “সত্যি মন্তি, তোমাকে যত দেখছি, তত অবাক হচ্ছি আমি ভাই। এমন একজন যদি পাশে থাকে তাহলে একটা খোঁড়া লোকও অনায়াসে এভারেস্টে উঠে যেতে পারবে। তবে ভাই, তোমার দুশ্চিন্তা কম করবার জন্যে বলছি, কালচিনির বাড়ির কাউকে নিয়ে তোমাকে এ ব্যাপারে না ভাবলেও চলবে। বিধুমামু, মামী আর ভাই তাদের সকলকেই আজ সকালেই এ’সব কিছু জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তুমি অফিসে চলে যাবার সাথে সাথেই মা নিজে বিধুমামুকে ফোন করেছিলেন। মা বাবা দু’জনেই গতকাল এখানে যা যা আলোচনা হয়েছে সবকিছু তাদের খুলে বলে তাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আর তারাও সকলেই আমাদের সিদ্ধান্তটাকে খুশী মনে মেনে নিয়েছেন। যদিও তাদের পক্ষে হুট করে আজই এখানে চলে আসা সম্ভব ছিল না, তবু বাবা আর মা তাদের আসতে বলেছিলেন। হাজার হলেও তাদের মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে আমরা পাকাপাকিভাবে সবকিছু ঠিকঠাক করতে যাচ্ছি। কিন্তু মামী আর বিধুমামু দু’জনেই কী বলেছেন জানো? তারা এক সুরে বলেছেন, তাদের ‘মা অন্নপূর্ণা’ যেখানে আছেন সেখানে তাদের উপস্থিতি অনুপস্থিতিতে কিছুই এসে যায় না। তাদের ‘মা অন্নপূর্ণা’ যা বলবেন, ঠিক তাই হবে। তাই বুঝতেই পাচ্ছ, তুমি তাদের সকলের পক্ষ থেকে একেবারে সুপ্রীম অথরিটি পেয়ে গেছ। আর নিশ্চয়ই তোমার মনে কোন দ্বিধা রইল না। তবে একটা কথা না বলে পারছি না ভাই। ভাইদাকে ফিরে পাবার অনেক আগে থেকেই তোমার নামে অনেক কিছু শুনেছি আমার স্বামী শ্বশুর আর দেওরদের কাছ থেকে। আর সেসব শুনে আমরা সকলেই তোমার প্রশংসা করতুম। কিন্তু তোমাকে যে কোনদিন এত কাছ থেকে দেখতে পাবো, এ আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি। তোমাকে দেখেছি এখনও চব্বিশটা ঘন্টাও কাটেনি। কিন্তু এটুকু সময়েই আমার মনটাও বলতে শুরু করেছে সেই একই কথা। তুমি সত্যি ‘মা অন্নপূর্ণা’ গো। তোমার তুলনা শুধু তোমার সাথেই করা সম্ভব” বলতে বলতে চেয়ারের পেছন থেকেই সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার চুলে মুখ ডুবিয়ে একটা স্নেহের চুমু খেলেন।

সীমন্তিনী বাম হাতে সুলোচনাদেবীর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “বৌদি প্লীজ, তুমিও অন্যান্যদের মত একই কথা বলে আমাকে লজ্জা দিও না গো” বলেই কথা পাল্টাবার উদ্দেশ্যে নবনীতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আচ্ছা নীতা, গেস্টরুমে তো এখনই আর বসবার জায়গা নেই। আর কিছুক্ষণ বাদেই তো দাদাবৌদিরাও এসে পড়বেন। বাচ্চারা হয়ত বাইরে খেলাধুলো করে বা বসবার ঘরে টিভি দেখে যেতে পারবে। কিন্তু বড়রা সকলে মিলে একসাথে কোথায় বসা যায় ভেবেছিস”?

নবনীতা জবাবে বলল, “দিদি তোমার ঘরটাই তো সবচেয়ে বড়। তাই পিসো আর কাকু বলছিলেন যে তোমার ঘরেই বিছানা আর সোফায় যে ক’জন বসতে পারে বসিয়ে মেঝেয় কার্পেট বা শতরঞ্চি পেতে দিলেই সকলে মিলে বসতে পারবে। কিন্তু দিদি, ঘরে তো তেমন কার্পেট বা শতরঞ্চি নেই”।

সীমন্তিনী একটু ভেবে জবাব দিল, “এক কাজ কর নীতা। আমার বিছানার নিচে যে বক্সটা আছে না? সেখানে কয়েকটা পুরনো ব্লাঙ্কেট রাখা আছে। সেগুলো বের করে দেখ তো কী অবস্থা। ওগুলো পেতে ওপরে বেডশীট বিছিয়ে মেঝেয় বসবার বন্দোবস্ত করা যায় কি না দেখ। তাড়াতাড়ি গিয়ে এখনই দেখ। নইলে আমাকে কাউকে ফোন করে কিছু আনতে বলতে হবে”।


______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 249)

নবনীতা চলে যেতেই চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “মন্তি মা, তোকে একটা কথা আগে থেকেই জানিয়ে রাখছি। বড়দা কিন্তু পরিস্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে অর্চুও আমাদের আরেকটা মেয়েই। তাই তার বিয়েটা আমাদের বাড়ি থেকেই দেওয়া হবে। আর মেয়ে পক্ষের তরফে যা কিছু করা প্রয়োজন তা আমাদের তরফ থেকেই করা হবে”।
 

সীমন্তিনী নিজের খাওয়া শেষ করে বলল, “জেঠু তো এ’কথা আমাকে আগেই বলেছিলেন কাকু। তবে এ’সব নিয়ে কথা তো যথাসময়েই হবে। তার আগে আরেকটা কথা বল তো আমায়। আমি যে এখান থেকে তোমাদের সকলের জন্য পূজোর কাপড় চোপড় পাঠিয়েছিলাম, সেগুলো কি এখনও তোমাদের কাছে গিয়ে পৌঁছোয় নি”?
 

এবারে সরলাদেবী জবাবে বললেন, “তোরা যেদিন চলে এলি সেদিন বিকেলেই কুরিয়ার কোম্পানীর লোকেরা এসে সেগুলো দিয়ে গেছে রে মা। তোকে হয়ত বলতে ভুলে গেছি আমি”।
 

সকলের খাওয়া হয়ে যেতে সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তারপর থেকে দিনগুলো যেভাবে কাটছে, আমারও তো সেটা মনেই ছিল না। এখন হঠাতই সেটা মনে হল বলে জিজ্ঞেস করলুম। তা বড়মা, জিনিসগুলো তোমাদের সকলের পছন্দ হয়েছে তো? জানো বড়মা, নীতা যেখানে কাজ করে ওখান থেকেই সবকিছু কিনেছিলুম। ওটাই এখানকার সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে নামী কাপড়ের দোকান”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বেসিনে হাত মুখ ধুচ্ছিলেন। সরলাদেবী সীমন্তিনীর কথার জবাবে বলল, “হ্যাঁরে মা। সকলেরই সব কিছু খুব পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এত দামী দামী জিনিস কেনবার কী দরকার ছিলরে মা? এত টাকা খরচ করবার কোনও মানে হয়”?

সীমন্তিনী তার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, “ও’সব কথা ছাড় তো বড়মা। রোজ রোজ তো আর এ’সব করি না। চাকরি পাবার পর প্রথমবার হায়দ্রাবাদ থেকে তোমাদের জন্যে পূজোর কাপড় পাঠিয়েছিলুম তিন বছর আগে। তার পরের দু’বছরে তো তোমাদের কাউকে আর কিছু দিই নি। এবারেই কিছু দিলাম। কিন্তু ঈশ, কথাটা তো আমার মনেই ছিল না একদম” বলে নিজের ঘরের দিকে মুখ করে নবনীতাকে ডাকল।

একটু বাদে নবনীতা এসে বলল, “দিদি ব্লাঙ্কেটগুলো ঠিকই আছে। একেবারে পেতে ওপরে বেডশীট পেতে দিয়ে বসবার ব্যবস্থা সেরে এলুম”।

সীমন্তিনী আর সরলাদেবীর হাত মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে ততক্ষণে। সীমন্তিনী নবনীতাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা নীতা, এ’ ক’দিনের এত হুলুস্থুলে কথাটা আমার মাথাতেই ছিল না। বলছি কালচিনির বাড়ির সকলের জন্য আর ডক্টর সোমের জন্য যা যা কেনা হয়েছিল, সেগুলো তো পাঠানো হয়নি রে। ওগুলো কোথায় আছে জানিস”?

নবনীতা বলল, “ওগুলো তো আমাদের ঘরেই আছে দিদি। তুমিই তো বলেছিলে এরপরে কালচিনি যাবার সময় ওগুলো নিয়ে যাবে। তুমি তো তার পর আর কালচিনি যাও নি”।

সীমন্তিনী একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “যাক বাবা, ঠিক আছে। এবারে ও গুলো পাঠাতে হবে। আমার একদম মনেই ছিল না রে। আচ্ছা আর একটা কথা শোন। আমি অফিস থেকে ফেরার পথে জয়া ম্যামের কাছে গিয়েছিলুম। তোদের কারখানার পাশে তাদের নিজস্ব একটা লজ আছে না। সেখানে তিনটে রুমে ছ’টা বিছানা আছে। বেশ ভাল এরেঞ্জমেন্ট আছে সেখানে। ওনারা অবশ্য নিজেদের মহাজন আর ক্লায়েন্ট ছাড়া সেখানে কাউকে থাকতে দেন না। তবে আমার কথা শুনে জয়া ম্যাম আজ তিনটে রুমে আমাদের অতিথিদের থাকতে দিতে রাজী হয়েছেন। আর আমি রামসিংকে সব কিছু দেখিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছি। তাই রাতে সবকিছু চুকে বুকে যাবার পর তুই শুধু তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে পৌঁছে দিয়ে আসিস। রামসিং তোর সাথে থাকবে। ওখানে তাদের থাকবার ব্যবস্থা ঠিকঠাক মত হয়েছে কিনা ভাল করে দেখে তবে আসবি। আর প্রয়োজন হলে আমাকে বা জয়া ম্যামকে ফোন করবি। তার সাথে এ ব্যাপারে সব কথা বলে এসেছি আমি। ঠিক আছে”?

নবনীতা সব শুনে বলল, “ঠিক আছে দিদি। কোন সমস্যা হবে না”।

সীমন্তিনী এবার সরলাদেবী আর সুলোচনাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বড়মা, বড়বৌদি। তোমরা যদি কিছু মনে না করো তাহলে গেস্টরুম থেকে সবাইকে আমার রুমে একটু ডেকে আনো না। আমি ততক্ষণে কয়েকটা দরকারী ফোন সেরে নিই”।

সরলাদেবী, সুলোচনা আর নবনীতাকে নিয়ে গেস্টরুমের দিকে রওনা হতেই সীমন্তিনী নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকল। তারপর নিজেদের ডিপার্টমেন্টের কয়েকজনের সাথে ফোনে সংক্ষেপে কথা বলতে লাগল। খানিক বাদেই সকলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে ঢুকতেই সীমন্তিনী ফোন সুইচ অফ করে বলল, “এসো পিসো, এসো কাকু। তোমরা আমার বিছানায় বোসো। মা আর পিসি তোমরাও খাটেই বোস। দাদারা এলে সোফায় বসতে দেব। আর বৌদিদের নিয়ে আমি অর্চু আর নীতা মেঝেয় বসব’খন”।

হৈমবতীদেবী অর্চনার হাত ধরে বললেন, “মন্তি মা, অর্চুকে আমার পাশে বসতে দাও না মা”।

সীমন্তিনী তার কথার ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলে বলল, “আমার বোনটাকে তো চিরদিনের জন্য তোমার হাতেই তুলে দিলাম পিসি। আচ্ছা বেশ, অর্চু, তুই পিসির সাথেই বোস। আমি একটু লক্ষ্মীদির সাথে কথা বলে আসছি। নীতা আমার সাথে আয় একটু”।

নীতাকে নিয়ে রান্নাঘরে এসে দেখে লক্ষ্মীকে তখনও রান্নাঘর গোছোতে ব্যস্ত থাকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “বুঝতে পারছি লক্ষ্মীদি। তোমার ওপর আজ বড্ড বেশী চাপ পড়ে গেছে গো। কিন্তু কী করব বলো। আর যে কোন উপায় খুঁজে পেলুম না। এদিকে তিনটে তো বেজেই গেছে। একটু পরেই বোধহয় আবার আরেক পার্টি এসে পৌঁছবে। নীতা, আয় তো আমরা হাত লাগিয়ে চটপট রান্নাঘরটা গুছোতে লক্ষ্মীদিকে একটু সাহায্য করি”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা কাজে হাত লাগাতেই লক্ষ্মী বলল, “না না দিদিমণি, আমার কাজ তো প্রায় হয়েই এসেছে। তোমরা গিয়ে তাদের সাথেই কথা বলো গিয়ে”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা হাতে হাত মিলিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই রান্নাঘরের সবকিছু গুছিয়ে নেবার পর সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি, ওদের তো আসবার সময় হয়ে গেল। তবে শোনো। ওনারা এলে তো আমার ঘরেই গিয়ে বসবে। ওনারা আসবার পর প্রথমে সবাইকে কিছু মিষ্টি আর শরবৎ দিও। নীতা এসে তোমাকে সাহায্য করতে পারে। রাতের খাবার তো ওনারাই নিয়ে আসছেন। তাই রাতে রান্নার খুব বেশী ঝামেলা হবে না। আর ওদিকে আমরা তো আলোচনাতেই ব্যস্ত থাকব। আমি হয়তো তখন আর ও’ঘর থেকে বেরোতে পারব না। তাই কয়েকটা কথা এখনই বলে যাচ্ছি। নীতা, তুইও শুনে রাখ। প্রয়োজন মত তুই লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করিস। সন্ধ্যের ঠিক আগে আগে সকলকে চা আর স্ন্যাক্স দিও। কেউ যদি আলাদা করে কিছু খেতে চায় তাহলে সেটাও করতে হবে। নইলে রাত আটটার দিকে আরেকবার করে সকলকে চা দিয়ে তুমি রাতের খাবারগুলো দেখে নিয়ে গরম টরম করে রেখ। আর নীতা, তুই কয়েকটা কথা খুব মন দিয়ে শুনে রাখ। আমি যা যা বলছি, তুই কিন্তু ঠিক ঠিক সেটাই করবি। রাতে খাবার সময় পরির দাদা বৌদি আর ভাইপো ভাইঝিদের আগে খাইয়ে দিবি। ওদের খাওয়া হলেই বেশী দেরী না করে ওদের সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বি। এখানে তোকে কয়েকটা কথা আগে থাকতেই বলে দিচ্ছি, নইলে তুই ভয় পেয়ে যেতে পারিস বা ভাবনায় পড়তে পারিস। তুই কিন্তু যাবার সময় রামসিং এর গাড়িটা পাবি না। তুই দাদাদের কোন একটা গাড়িতে উঠবি। খুব অসুবিধে হবে বলে মনে হয় না। তবে কথাটা তুই মনে রাখিস, যাবার সময় তুই কিন্তু আমাদের গাড়িটা দেখতে পাবি না। রামসিংকে আমি এ’সব বুঝিয়ে দিয়েছি। তবে দাদাদের দুটো গাড়ির পেছনে আমাদের কম্পাউন্ডের বাইরে থেকেই আরও একটা গাড়ি যাবে। সে গাড়িতে কে থাকবে না থাকবে তা নিয়ে তুই কিছু ভাবিস না। আর কাউকে কিছু বলবিও না। তবে তোরা গেস্ট হাউসের সামনে পৌঁছে গেলে পেছনের গাড়িটা অন্যদিকে চলে যাবে। আর তোদের কারখানার কাছাকাছি গিয়ে তুই জয়া ম্যামকে ফোন করে জানিয়ে দিবি যে তুই আমাদের অতিথিদের নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিস। জয়া ম্যাম নিজেই আসতে পারেন, নইলে অন্য কাউকে চাবি দিয়ে তাদের লজে পাঠিয়ে দেবেন। দাদাদের গাড়িগুলো রাখবার জায়গা তারা দেখিয়ে দেবে। সেখানে তাদের পৌঁছে দিয়ে, সব রুমে আলো, পাখা, জল, বাথরুম সব কিছুর আয়োজন ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে সবগুলো বিছানায় মশারী টাঙিয়ে, তাদের আর কিছু প্রয়োজন আছে কিনা জেনে নিয়ে, সে প্রয়োজন মিটিয়ে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসবি। জয়া ম্যামকে আমি সবরকম ভাবে বুঝিয়ে বলে এসেছি। উনি প্রয়োজন মত তোকে সাহায্য করবেন। তখন তুই বেরিয়ে এলে রামসিংএর গাড়িটাকে লজের ঠিক সামনেই দেখতে পাবি। আর সময় নষ্ট না করে গাড়ির মাঝের সীটে তুই উঠে বসবি। দাদাদের গাড়ির ড্রাইভার দু’জনকে পেছনে উঠতে বলবি। তবে দুটো কথা মাথায় রাখিস বোন। ফেরবার পথে রামসিং কিন্তু অন্য রাস্তা দিয়ে আসবে। আর সে গাড়িতে রামসিংএর পাশের সীটে আগে থেকেই আরেকজন বন্দুকধারী কনস্টেবল থাকবে। তাতে ভয় পাস নে। আর সেখান থেকে গাড়ি স্টার্ট দেবার আগেই আমার মোবাইলে একটা ফোন করবি। তারপর রামসিং তোকে বাড়ি নিয়ে আসবে। বুঝেছিস তো”?

সীমন্তিনীর এতসব উপদেশ শুনে নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল, “এত সতর্কতার কি খুব দরকার ছিল দিদি? এইটুকু তো পথ। দশ মিনিটেই তো সেখানে পৌঁছে যাব আমরা”।

সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “সেটা নিয়ে তুই ভাবিস নে। তবে জেনে রাখ, এ’সব পরির নির্দেশেই করতে বাধ্য হচ্ছি আমি। আর তুই তো জানিস পরিকে আমি আমার গুরু বলে মানি। শিষ্যা হয়ে আমি কি গুরুর আদেশ অমান্য করতে পারি বল? তবে পরি চায় তার আত্মীয় স্বজনরা যেন কোন রকম ঝামেলায় না পড়েন। আর বেশী রাতের ব্যাপার বলে আমিও তাতে আপত্তি করিনি। তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস নে। কিন্তু যেভাবে যেভাবে যা যা করতে বললুম সেগুলো মনে রেখে ঠিকঠাক মত করিস। আর সেখান থেকে রওনা হবার আগে কিন্তু আমাকে অবশ্যই একটা ফোন করবি। ভুলবি না কিন্তু”।

নবনীতা সীমন্তিনীর কথায় সায় জানাতেই সীমন্তিনী গেটের দিকে দুটো গাড়ি আসতে দেখে বলল, “এই নীতা, ওনারা বোধহয় এসে গেছেন রে, আয়” বলে ঘর থেকে বেরিয়ে এল।

সিকিউরিটি গার্ডদের যথাযথ নির্দেশ সীমন্তিনী আগেই দিয়ে রেখেছিল। তারা গাড়ি চেক করবার নিয়মরক্ষা করতে করতেই সীমন্তিনী আর নবনীতা সিঁড়ির নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। রামসিং গাড়ি দুটোকে ঈশারা করতেই গাড়ি গুলো সিঁড়ির কাছে এসে থামল। ততক্ষণে লক্ষ্মীও নিচে নেমে এসেছে। রামসিং আর লক্ষ্মী গাড়ি থেকে খাবার দাবারের কন্টেনারগুলো ঘরে নেবার ব্যবস্থা করতে লাগল। আর সীমন্তিনী আর নবনীতা আগতদের সকলকে আদর অভ্যর্থনা করে ঘরের দিকে রওনা হল। যেতে যেতেই একে অপরের সাথে পরিচিত হয়ে নিল। বাচ্চারাও অবাক চোখে সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বারান্দায় উঠেই একজন জিজ্ঞেস করল, “তুমিই কি আমাদের পুলিশ পিসি নাকি গো”?

সীমন্তিনী মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা, আমিই তোমাদের পুলিশ পিসি। আমার নাম সীমন্তিনী। তোমার নাম কি”?

ছেলেটা নিজের নামের সাথে অন্যান্য বাচ্চাদের নামগুলোও বলে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পুলিশ পিসি, তোমাদের এখানে নাকি খুব সুন্দর খেলবার জায়গা আছে? কোথায় গো? আমরা কিন্তু সেখানে খেলব বলে সাথে ফুটবল নিয়ে এসেছি। আমাদের বাড়িতে একটুও খেলার জায়গা নেই। এখানে কিন্তু আমরা খেলব”।

সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ঠিক আছে বাবা, খেলবে’খন। আর খেলার জায়গা তো আমাদের ঘরটার ঠিক পেছনেই। তবে তার আগে ঘরে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও, একটু কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে নাও”।

সকলকে নিয়ে ঘরে ঢোকবার পর সীমন্তিনী সবাইকে সোজা তার রুমেই নিয়ে এল। সকলের সঙ্গে সকলের পরিচয় হয়ে যাবার পর সুলোচনাদেবী তার দুই জাকে নিয়ে অর্চনার সামনে এসে তাদের সাথে অর্চনার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলেই অর্চনাকে দেখে খুব খুশী।
 

মিনিট দশেক বাদে লক্ষ্মী আর নবনীতা সবাইকে কোল্ড ড্রিঙ্কস আর মিস্টি খাইয়ে দেবার পরেই সকলে মিলে আলোচনা শুরু করল।

সকলে মিলে অনেকসময় ধরে বিশদ ভাবে সব কিছু আলোচনা করা হল। বিধুবাবুদের কালচিনির বাড়িতে শুভ গৃহারম্ভের ভূমি পূজোর অনুষ্ঠানটা হচ্ছে ১৮ই অক্টোবর। তখন তারা সাময়িক ভাবে একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যেই তিন চার জনের থাকা খাওয়া আর শোবার ব্যবস্থা করতে বাধ্য হবেন। কারণ কিংশুকের ফাইনাল পরীক্ষা আর বিধুবাবুর দোকান দীর্ঘদিন বন্ধ রাখবার ব্যাপার আছে। তাই সেটা অসম্ভব। আবার বাড়ির কাজ শুরু হবার তিনদিন বাদেই দুর্গাপূজো, আর তার পর লক্ষ্মীপূজো। সকলেই এক কথায় সম্মতি জানাল যে খুব তাড়াতাড়ি কাজ হলেও অন্ততঃ মাস ছয়েকের আগে কিছুতেই বাড়ি তৈরীর কাজ শেষ হবে না। তাই বিধুবাবু আর বিভাদেবী নিজেদের বাড়িতেই বিয়েটা দিতে চাইলে অন্ততঃ ছ’মাসের মধ্যে কিছুতেই বিয়েটা দেওয়া সম্ভব হবে না। আর ছ’মাসের মধ্যে বাড়ি কমপ্লিট হলেও গৃহপ্রবেশের দিনক্ষণ বাছাবাছি করতে হয়ত আরও কিছু দেরী হয়ে যেতে পারে। এতটা দেরী করতে কেউই রাজী হলেন না। তাছাড়া ', ঘরের বিধবা মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বলে কালচিনির মত একটা ছোট্ট শহরের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ', সমাজে ক্ষোভের সৃষ্টিও হতে পারে। সেটা নিয়েও কিছুটা ঝামেলা হবার সম্ভাবনা প্রবল। তাই কালচিনিতে বিধুবাবুদের নতুন বাড়ি নির্মাণ আর কিংশুকের পরীক্ষার কথা এবং কালচিনির লোকদের ক্ষোভের আশঙ্কা মাথায় রেখে ঠিক করা হল যে মেয়ের আশীর্বাদ হবে সীমন্তিনীর নাগরাকাটার এই কোয়ার্টারেই নভেম্বরের ২৩ তারিখে। আর একই দিনে পরিতোষের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে আলিপুরদুয়ারে তার পিসির বাড়িতে। বিয়ের অনুষ্ঠানটা হবে রাজগঞ্জে আর বৌভাত ও ফুলশয্যা হবে পরিতোষের পিসির বাড়িতেই। বিভাদেবী চাইছিলেন যে ওদের দ্বিরাগমণের অনুষ্ঠানটা যেন কালচিনিতে তাদের নিজের বাড়িতেই হয়। কিন্তু তখনও নতুন বাড়ি তৈরীর কাজ শেষ হবে না বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে যেহেতু রাজগঞ্জের বাড়ি থেকেই বিয়েটা দেওয়া হচ্ছে, তাই দ্বিরাগমনের অনুষ্ঠানটাও সেই বাড়িতেই হবে। আলিপুরদুয়ারে বৌভাত আর ফুলশয্যা হবার পর পরিতোষ আর অর্চনা সেখান থেকেই রাজগঞ্জ চলে যাবে দ্বিরাগমণ সারতে। তারপর সেখান থেকেই তারা কলকাতা চলে যাবে।
 

আলোচনার মাঝেই বেশ কয়েকবার ফোনে রতিকান্তবাবু, পরিতোষ, বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সাথেও কথা বলা হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সামনের ২৩ নভেম্বরে, বাংলার ৭ই অঘ্রাণে দু’জনের বিয়ের আশীর্বাদের অনুষ্ঠান হবে। পরিতোষকে আলিপুরদুয়ারে গিয়ে আশীর্বাদ করবেন বিধুবাবু, বিভাদেবী, রতিকান্তবাবু এবং তার স্ত্রী সরলাদেবী। আর সেদিনই আলিপুরদুয়ার থেকে নিরঞ্জনবাবু, হৈমবতীদেবী, শ্যামলেন্দু আর সুলোচনা এসে সীমন্তিনীর কোয়ার্টারেই অর্চনাকে আশীর্বাদ করবেন। বিয়ের দিন স্থির করা হল ২৯শে নভেম্বর। বাংলার ১৩ই অঘ্রাণ। বিয়ের যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে রাজগঞ্জেই। নিরঞ্জনবাবু আর পরিতোষ আপত্তি করা সত্বেও রতিকান্তবাবু আর তার দুই ভাই মেয়ের অভিভাবক আর কন্যাপক্ষ হিসেবে বিয়ে এবং দ্বিরাগমণের সমস্ত খরচপত্রের দায়ভার স্বেচ্ছায় নিজেদের হাতে তুলে নিলেন। গ্রাম বাংলার রীতিতেই বিয়ের অনুষ্ঠান চলবে দুদিন ব্যাপী। বিয়ের দু’দিন বরপক্ষ কন্যাপক্ষ সব মিলিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা ১০৮ জনের অভ্যর্থনা এবং থাকা খাওয়ার ব্যাপার পুরোটার দায়িত্বই পাত্রীর ছোটবোনের বাড়ির লোকেরাই সামলাবেন। পরিতোষের তরফ থেকে নিমন্ত্রিত থাকছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ জনের মত। এরা মূলতঃ কলকাতা, আলিপুরদুয়ার আর মালবাজার থেকে আলাদা আলাদা ভাবে আসবেন। কালচিনি, নাগরাকাটা আর কলকাতা থেকে কন্যাপক্ষের লোক হিসেবেও পঁয়তাল্লিশ জন আসবেন। এদের মধ্যে কলকাতার তিনজন, কালচিনির তিনজন আর নাগরাকাটার তিনজন বিয়ের দু’দিন আগেই রাজগঞ্জের বাড়িতে এসে যাবেন। বাকিরা বিয়ের দিন। রাজগঞ্জের বাড়ির আর রতিকান্তবাবুদের দু’চারজন ঘনিষ্ঠ লোক মিলিয়ে প্রায় ঊণত্রিশ জনের মত বিয়েতে হাজির থাকবেন। ক্যাটারার আট দশজন ছাড়া জনা দশেক সিকিউরিটির লোকও থাকবে। সব মিলিয়ে একশ’ চল্লিশ থেকে একশ’ পঞ্চাশ জন লোকের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

গ্রাম বাংলার নিয়মে বাসি বিয়ের দিন বর-কনেকে নিয়ে বরপক্ষের লোকেরা আলিপুরদুয়ারে পরির পিসির বাড়িতে গিয়ে উঠবে। বধূবরণ, কালরাত্রি, বৌভাত, ফুলশয্যা এ’সব অনুষ্ঠান ও বাড়িতেই হবে। বৌভাতের অনুষ্ঠানে কনেপক্ষের তরফ থেকে কলকাতা, কালচিনি, রাজগঞ্জ এবং নাগরাকাটার কয়েকজন উপস্থিত থাকবেন। তার দু’দিন পর পরিতোষ আর অর্চনা রাজগঞ্জের বাড়িতে আসবে দ্বিরাগমণ সারতে। কালচিনির বাড়ি থেকে অর্চনার মা, ভাই বোনও তখন রাজগঞ্জেই থাকবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। আর পরিতোষের যথেষ্ট আপত্তি সত্বেও বরপক্ষ থেকে বিয়ের যাবতীয় আয়োজন এবং ব্যবস্থাপনার ভার তুলে নিলেন পরির পিসি হৈমবতী দেবী, নিরঞ্জনবাবু, আর তাদের পূত্র ও পূত্রবধূরা।

সমস্ত আলাপ আলোচনা শেষ হয়ে যাবার পর সীমন্তিনী নিজেই উদ্যোগী হয়ে শ্যামলেন্দু, বিমলেন্দু, দেবিকা, রুমা আর বাচ্চাদেরকে আগে খাইয়ে দিল। তারপর নবনীতার সাথে তাদের সকলকে জয়া বসাকের লজে পাঠিয়ে দেবার সময় নবনীতাকে আরেকবার ভাল করে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “তোর মোবাইলটা সব সময় হাতে রাখিস। আর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবি। আর ওখান থেকে গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে অবশ্যই কিন্তু আমাকে ফোন করবি। আর শোন, পরিও হয়তো তোকে ফোন করতে পারে। তবে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলতে চাইলে আমার ফোনে ফোন করতে বলিস। আর বেশী সময় কথা বলবি না ওর সাথে, বুঝলি”?

সীমন্তিনী নিজেও সকলের সাথে বাইরে এসে সকলকে যখন গাড়িতে তুলে দিচ্ছিল তখন শ্যামলেন্দুকে কিছুটা ইতস্ততঃ করতে দেখে সীমন্তিনী নিজেই জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবেন বড়দা”?
 

শ্যামলেন্দু কিছুটা ইতস্ততঃ করেই জবাব দিলেন, “একটা কথা ছিল দিদি। একটু এদিকে আসবেন”? বলে কিছুটা তফাতে যেতে ঈশারা করলেন।

সীমন্তিনী কিছুটা অবাক হলেও শ্যামলেন্দুর কাছে গিয়ে বলল, “বড়দা, আপনি আমার থেকে বয়সে বড়। আমাকে আপনি করে বলবেন না প্লীজ। আমাকে নাম ধরে তুমি করে বলবেন। আচ্ছা হ্যাঁ বলুন কী বলবেন”।

শ্যামলেন্দুর দ্বিধাগ্রস্ত ভাবটা যেন কাটতেই চাইছে না। ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে তিনি বললেন, “মানে, কিভাবে যে বলি কথাটা। আসলে কথাটা আমি পরিতোষকেও বলেছিলাম। কিন্তু ও তোমাকে সে ব্যাপারে কিছু বলেছে কিনা জানিনা”?

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে গলা নিচু করে জিজ্ঞেস করল, “না পরি তো সেভাবে কিছু বলেনি আমাকে। কিন্তু আপনি কি সেদিন পরিকে বলেছিলেন যে এদিকের কয়েকটা উগ্রপন্থীদের হিটলিস্টে আমার নাম আছে”?

শ্যামলেন্দু হতভম্বের মত সীমন্তিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখে আর কোনও কথাই সরছিল না। তার অমন অবস্থা দেখে, আর তাড়াতাড়ি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সীমন্তিনী মৃদু হেসে বলল, “ও নিয়ে ভাববেন না বড়দা। পুলিশদের নাম উগ্রপন্থী বা টেররিস্টদের হিট লিস্টে সব সময়ই থাকে। আর সে ব্যাপারে আমরাও সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। আপনি ও নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। আর চেষ্টা করবেন, আপনার মুখ থেকে যেন আর কেউ এ’সব কথা না শুনতে পায়। বড়বৌদিও যেন না জানেন”।


______________________________
Like Reply
(Update No. 250)

শ্যামলেন্দুবাবু বেশ কিছুটা হকচকিয়ে গেলেও তোতলাতে তোতলাতে বললেন, “আসলে আমি তো রোডওয়েজের ব্যবসা করি। ড্রাইভার আর খালাসীদের মুখে মুখে অনেক রকম খবরই তো ঘোরাফেরা করে। তাদের মুখেই আমি বিভিন্ন সময়ে এ ব্যাপারটার আঁচ পেয়েছি। এতদিন তো তোমার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না। তবে এখন তো তোমাকে আমাদের বড় আপন, বড় কাছের বলে মনে হচ্ছে। তাই ভাবলুম তোমাকে এ ব্যাপারে একটু সাবধান করে দেওয়া উচিৎ। তাই .....”

সীমন্তিনী তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই মিষ্টি হেসে বলল, “আপনাদের মত হিতৈষী পাওয়াও বড় ভাগ্যের ব্যাপার বড়দা। আপনাকে তাই আমার অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। আর আমার সুরক্ষার কথা ভেবে আমাকে বা পরিকে কোনও কিছু জানাবার চেষ্টাও করবেন না দয়া করে। কথাটা অন্যভাবে নেবেন না প্লীজ, কিন্তু সত্যি বলছি বড়দা, তাতে আপনারই বিপদ হতে পারে। জানেন তো যারা পুলিশ বা আর্মির সহায়তা করে তাদের ওপরেও কিন্তু উগ্রপন্থীদের নজর থাকে। ব্যক্তিগত ভাবে আমি চাইনা আপনার বা আপনাদের পরিবারের কোন ক্ষতি হোক। আর জানেনই তো আমাদের কাজটাই এমন। সব সময় প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় নিয়েই আমাদের চলতে হয়। এছাড়া তো আর উপায় নেই। তবে যথাসম্ভব সাবধান থাকবার চেষ্টাই করি। আর সে জন্যেই তো এখন ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমি আপনাদের ছাড়তে সেই লজে যেতে পাচ্ছি না। আচ্ছা, সে’কথা ছেড়ে এবার বরং গাড়িতে গিয়ে উঠুন। অনেক রাত হয়ে গেল। আর বড়দা, আপনাদের গাড়ি গুলো ওখানে রেখেই আপনাদের ড্রাইভারেরা কিন্তু এখানে ফিরে আসবে নীতার সাথে। কাল সকালে ওরা গিয়ে আপনাদের নিয়ে আসবে। ভাববেন না। রাতে সেখানে কোনরকম অসুবিধে হলে আমাকে ফোন করবেন। আর একটা কথা, সকালে এখানে সবাই মিলে জল খাবার খেয়ে নেবার পরই কিন্তু আপনারা রওনা দিতে পারবেন। তার আগে নয়। এ’কথাটা অন্যান্য সবাইকে জানিয়ে দেবেন প্লীজ। কাল সকাল সাতটার মধ্যেই আপনাদের ড্রাইভারেরা সেখানে পৌঁছে যাবে। আপনারা তৈরী হয়ে থাকবেন প্লীজ” বলে গাড়ির কাছে আসতেই শ্যামলেন্দু গাড়িতে উঠে বসতে সীমন্তিনী আবার নবনীতাকে বলল, “রামসিং ওখানে ঠিক সময়ে পৌঁছে যাবে নীতা। তাই ওখানে সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আর দেরী করবি না। তাড়াতাড়ি চলে আসবি। তুই এলেই কিন্তু আমরা খেতে বসব, ঠিক আছে”?

নবনীতা “হ্যাঁ দিদি, ঠিক আছে, আসছি তাহলে আমরা” বলতেই সীমন্তিনী ঈশারা করতেই গাড়ি দুটো গেটের দিকে এগিয়ে গেল। সীমন্তিনী একটু সাইডে এসে গেটের দিকে পরিস্কার নজর ফেলল। শ্যামলেন্দু বাবুদের গাড়ি দুটো বেরিয়ে যাবার পর পরই পুলিশের একটা পেট্রোলিং জীপকে যেতে দেখে মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে মোবাইলে সময় দেখে সে ঘরের দিকে চলল।

তখন ডাইনিং টেবিলে নিরঞ্জনবাবু, হৈমবতীদেবী, সরলাদেবী, আর চন্দ্রকান্তবাবু খাচ্ছিলেন। সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে আগে থেকেই এমন নির্দেশ রেখেছিল। কিন্তু সুলোচনাদেবীকে সেখানে না দেখে লক্ষ্মীকে জিজ্ঞেস করল, “বড়বৌদি বসেননি? তিনি কোথায়”?

লক্ষ্মী কিছু বলবার আগেই হৈমবতীদেবী বললেন, “ও’ঘরে অর্চু একা বসে আছে দেখে বড়বৌমা ওর কাছে গিয়ে বসেছে। বলল তোমাদের সাথে পরে একসাথে বসবে খেতে” বলে অর্চনাদের থাকবার ঘরের দিকে ঈশারা করলেন।

সীমন্তিনী তাদের সাথে টুকটাক দু’একটা কথা বলে অর্চনার ঘরে গিয়ে চুপিচুপি উঁকি মেরে দেখে যে সুলোচনাদেবী অর্চনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। অর্চনার মুখটা উল্টোদিকে ছিল বলে দড়জা থেকে দেখা যাচ্ছিল না। সীমন্তিনী তখন ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সুলোচনাদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বড়বৌদি, তুমিও তো মা-পিসিদের সাথে বসে যেতে .......”

কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই অর্চনা এক ঝটকায় সুলোচনাদেবীর বুক থেকে উঠে সীমন্তিনীর ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে জোরে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে ‘হাউ হাউ’ করে কেঁদে উঠল। সীমন্তিনী তার অবস্থা দেখে হকচকিয়ে উঠে তাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে সোনা? এমন করছিস কেন রে? এভাবে কাঁদছিস কেন”?

অর্চনা কোনও কথা না বলে একভাবে কেঁদেই যেতে লাগল। সীমন্তিনী অর্চনার কাঁধে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে চোখের ঈশারায় সুলোচনাদেবীকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “আমিও তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনা মন্তি। তুমি ওদেরকে নিয়ে বেরিয়ে যাবার পরেই ও একা একা এ ঘরে চলে এসেছিল। আমি তোমাদের সাথে খাবো শুনে মা বললেন অর্চুর কাছে এসে বসতে। আমি এ’ঘরে ঢুকে দেখি ও হাঁটুতে থুতনী চেপে বসে বসে কাঁদছে। আমি বারবার জিজ্ঞেস করা সত্বেও কিছু বলছে না। তারপর আমি জোর করে ওর মুখটা টেনে তুলতেই আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে একনাগাড়ে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। কিন্তু কিচ্ছুটি বলছে না”।
 

সীমন্তিনী সুলোচনাদেবীর কথা শুনে তাকে চোখের ঈশারায় করে চুপ করতে বলে আবার অর্চনার কাঁধে পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আচ্ছা বোন, তুই তো সেদিন আমার কাছে নিজেই স্বীকার করলি যে পরিকে তুই মনে মনে ভালবেসে ফেলেছিস। আজ আমরা তোদের দু’জনের বিয়ের সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেললাম। তোর তো এখন খুশীতে ময়ুরের মত পেখম তুলে নাচ করবার কথা! আর তুই কাঁদছিস? তোর মনে কিসের এত দুঃখ জেগে উঠল বল তো? তুই কি এ বিয়েতে রাজি নোস? আর যদি সেটাই হয়, তবে খুলে বল আমাকে। আমি এখনই এ বিয়ে নাকচ করে দেব। আমি বেঁচে থাকতে তোর ইচ্ছের বিরূদ্ধে কেউ কারো সাথে তোর বিয়ে দিতে পারবে না”।

এবার অর্চনা হঠাৎ করেই নিজেকে সীমন্তিনীর হাতের বাঁধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ঝুপ করে তার পায়ের ওপর মুখে চেপে দু’হাতে সীমন্তিনীর দুটো পা জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কেঁদে উঠল। সীমন্তিনী অর্চনার এমন আচরণ দেখে হতভম্ব হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতেই কয়েকটা মূহুর্ত চলে গেল। ততক্ষণে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসা সকলেই অর্চনার কান্না শুনে ছুটে এসেছে। লক্ষ্মীও এসে পড়েছিল। সীমন্তিনী তখন নিচু হয়ে অর্চনার দুটো হাত ধরে তাকে টেনে তুলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু অর্চনা একটা ছোট জেদী বাচ্চার মত দু’হাতের সর্বশক্তি দিয়ে সীমন্তিনীর পা দুটো আঁকড়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছিল। এদিকে দড়জার কাছে ভিড় করে থাকা সকলেই ‘কি হয়েছে, কি হল’ বলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সীমন্তিনী তাদের সকলকে চোখের ঈশারায় বুঝিয়ে জোর করে অর্চনাকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলল, “এ কি করছিস অর্চু। তোকে না কতদিন বলেছি তোরা কেউ আমার পায়ে হাত দিবি না। সে’কথা তুই ভুলে গেলি কি করে রে? কী হয়েছে, সেটা তো বলবি”।
 

অর্চনা ছোট বাচ্চার মত আবার সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারব না দিদিভাই। কিছুতেই পারব না। সাতটা বছর আমি মা বাবা ভাই বোনকে ছেড়ে নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছি। ভগবান চাইলে আমায় সারাজীবন আবার অমন শাস্তি দিন। যত কষ্টই হোক আমার, আমি মুখ বুজে সয়ে যাব। কিন্তু তোমায় ছেড়ে আমি বাঁচতে পারব না দিদিভাই। আমি মরে যাব”।

অর্চনার মনের কথা শুনতে পেয়ে সকলেই আশ্বস্ত হলেও প্রত্যেকের মুখেই সমবেদনা মিশ্রিত হাসি ফুটে উঠল। সীমন্তিনী বাইরের সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “বড়মা, তোমরা গিয়ে খাওয়াটা শেষ করো। কিছু যে হয়নি সেটা তো বুঝতেই পারছ তোমরা। আমি ওকে সামলাচ্ছি, তোমরা যাও”।

বেশ কিছুক্ষণ অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে, বাইরের সবাই ডাইনিং টেবিলের দিকে ফিরে যেতে, সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়ে ধীরে ধীরে একটা জানালার পাশে গিয়ে পর্দা সরিয়ে খোলা আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, “দ্যাখ অর্চু, ওই আকাশের দিকে একটু তাকিয়ে দ্যাখ। কত তারার ভিড় ওখানে, কত গ্রহ নক্ষত্র উপগ্রহে ভরা। এ সব কিছুই তো ঈশ্বরের সৃষ্টি। আমাদের এই পৃথিবী, পৃথিবীর বুকের সমস্ত কিছু, এসবও সেই ভগবানেরই সৃষ্টি। তোকে, আমাকে, এই বড়বৌদিকে, আর এমন প্রত্যেককটা লোককে সেই একই ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষ প্রত্যেকটা জীব আর প্রতিটা স্থাবর অস্থাবর সব কিছুই নিজের নিজের আলাদা আলাদা পথে চলে। পুরোপুরি এক পথে কিন্তু দুটো মানুষ বা দুটো বস্তু কখনোই চলতে পারে না। ওই যে দেখছিস সপ্তর্ষি মন্ডল। সেখানে প্রশ্নবোধক চিহ্নের আকার দিয়ে সাতটা নক্ষত্র আছে। ওদের সাতজনকে একটা পরিবারে ভগবান সৃষ্টি করেছেন। তাই ওই পরিবারের নিজস্ব নাম দেওয়া হয়েছে সপ্তর্ষি মন্ডল। এখন ধর ওই সাতটা নক্ষত্রের প্রথমটা মেসো, পরেরটা মাসি, তার পরেরটা তুই, তার পরেরটা রচু, তারপর ভাই, পরেরটা ধর তোর রতুদা, আর সব শেষেরটা ধর আমাদের পরি কিংবা তুই আমাকেও ধরতে পারিস। দুর থেকে সকলেই এটাকে সপ্তর্ষি মন্ডল পরিবার বলেই চেনে। কিন্তু এই সাতজনের কেউই কিন্তু একসাথে থাকে না, বা একসঙ্গে পথ চলে না। প্রত্যেকের গতিপথ কিন্তু আলাদা। তার মানে বুঝতে পারছিস, কেউ কারো হাত ধরে পাশাপাশি চলতে পারে না। একেকজনের নির্দিষ্ট পথে একেক জনকে চলতে হয়। এক পরিবারের সদস্য হলেও কিন্তু প্রত্যেকের গতিপথ বা যাত্রাপথ আলাদা। আমাদের পৃথিবীর প্রত্যেকটা পরিবারও কিন্তু একই নিয়মে চলে। স্বামী, স্ত্রী, সন্তান, মা, বাবা, ভাই বোন সাময়িকভাবে জীবনের কিছুটা সময় পাশাপাশি থাকতে পারে। যেমন দুটো নক্ষত্র, গ্রহ বা উপগ্রহ তাদের নিজ নিজ গতিপথে থেকেও একে অপরের খুব কাছাকাছি চলে আসে কোন কোন সময়। কিন্তু কেউই একসাথে চলতে পারে না সারাজীবন। তাই কেউ কাউকে সারাজীবন আঁকড়ে ধরে থাকতেও পারেনা। সবাইকেই কোন না কোন সময় তাদের প্রিয়জনের কাছ থেকে দুরে সরে যেতে হয়। ভগবানের প্রতিটা সৃষ্ট বস্তুই কিন্ত এই একই নিয়মে চলে। আর এ নিয়ম ভাঙবার শক্তি বা সামর্থ্য কারোরই নেই। আমার বা তোরও সে ক্ষমতা নেই। তাই আমরাও সেই একই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি যে দুর থেকে ওই সপ্তর্ষি মন্ডলটাকে যেমন দেখতে লাগে, আমাদেরকেও যেন তেমন এক পরিবারভুক্ত মনে হয়। তুই ভাবছিস পরির সাথে বিয়ে হলে তুই আমার কাছ থেকে দুরে সরে যাবি। কিন্তু তা নয়রে বোন। সেটা কিছুতেই হতে পারে না। আমি যে নিজেকে মনে প্রাণে তোদের পরিবারের একজন বলেই ভাবি রে বোন। রচুকেও আমি এমন একটা কথা বলেছিলাম ওদের বিয়ের আগেই। আজ তোকেও বলছি সোনা। যতদিন আমি বেঁচে থাকব, যতদিন আমার শ্বাস প্রশ্বাস চলতে থাকবে, ততদিন আমি তোদের পাশে এভাবেই থাকব। দুরে থেকেও আমি তোদের সকলকে আগলে রাখব। যেদিন সেটা পারব না সেদিন বুঝে নিবি, সপ্তর্ষি মন্ডলের শেষ নক্ষত্রটা তার গতিপথ থেকে খসে পড়ে গে...”।

অর্চনা “দিদিভাই” বলে চিৎকার করে সীমন্তিনীর মুখে হাত চাপা দিয়ে তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, “এ’সব কি বলছ দিদিভাই? আবার আমাকে কাঁদাতে চাইছ, না”?
 

সীমন্তিনী অর্চনার কথার জবাবে কিছু বলবার আগেই তার হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল। নীতা কলিং দেখে সে সাথে সাথে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ নীতা, বল। ওদিকে সব ঠিকঠাক আছে তো? কখন ফিরছিস তোরা”?

নবনীতা ও’পাশ থেকে জবাব দিল, “এদিকে সব কিছু ঠিক আছে দিদি। ম্যাম আগে থেকেই সবকিছু রেডি করে রেখেছিলেন। আমরা ফিরছি এখন”।

সীমন্তিনী আশ্বস্ত সুরে বলল, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি চলে আয় তুই। তুই এলে আমরা একসাথে খেতে বসব” বলে ফোন কেটে দিল।
 

সুলোচনাদেবী মুগ্ধ দৃষ্টিতে সীমন্তিনীর দিকে দেখতে দেখতে অর্চনাকে নিয়ে বিছানায় বসাতে বসাতে বললেন, “সব ঠিক হয়ে যাবে বোন। কিচ্ছুটি ভাবিস না। বিয়ে যখন স্থির হয়ে যায় তখন নিজের মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজনদের ছেড়ে যাবার কথা মনে এলেই সব মেয়ের বুকের ভেতরটাই এমন যন্ত্রণায়, এমন কান্নায় ভরে ওঠে রে। কিন্তু কী করার আছে বল। এটাই যে আমাদের সমাজের রীতি। সব মেয়েকেই যে বুকে পাথর চেপে রেখে মুখ বুজে এ’সব মেনে নিতেই হয়। আর জানিসই তো, মেয়েদের জীবনে তিনটে ধাপ আছে। কন্যা, জায়া আর জননী। কন্যা তো সকলে জন্মগত ভাবেই হয়ে যায়। তবে প্রকৃত জায়া আর জননী হয়ে ওঠা কিন্তু খুব সহজ ব্যাপার নয়। বাপের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে যারা সে নতুন অজানা বাড়িটাকে নিজের বলে মেনে নিতে পারে, অচেনা শ্বশুরবাড়ির সকলকে যখন শ্রদ্ধা, স্নেহ ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়ে আপন করে নিতে পারে, তারা তখন কন্যা থেকে হয়ে ওঠে জায়া। এতে আন্তরিক প্রচেষ্টা আর সদিচ্ছার সাথে সাথে অনেক ধৈর্য্যেরও খুবই প্রয়োজন হয়। আর জননী হয়ে ওঠা তো আরও কঠিন। স্বামীর যথার্থ প্রেমিকা হয়ে ওঠবার পর ভগবানের আশিস পেলে তবেই একমাত্র একটা মেয়ে জায়া থেকে জননী হয়ে উঠতে পারে রে বোন। তবে আমার মনে হয় তুই যেমন মা-বাবার ঘরে জন্মেছিস তাতে এ’সব ব্যাপারে তুই যথার্থ শিক্ষা অনেক আগেই পেয়েছিস নিশ্চয়ই। সে বিষয়ে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আর তুই আর ভাইদা যে একে অপরকে নিয়ে খুব সুখী হবি এ বিষয়েও আমরা সবাই নিশ্চিত। আর এ বিশ্বাসও আমার মনে আছে যে তুই স্বার্থক কন্যার সাথে সাথে প্রকৃত অর্থেই যথাসময়ে স্বার্থক জায়া আর স্বার্থক জননীও হয়ে উঠবি। আর তোর দিদিভাইয়ের সাথে সাথে আমরাও সকলে সে’সব দু’চোখ ভরে তা দেখব। আর তোদের পাশে থাকব”।

নির্ধারিত দিনে রাজগঞ্জের বাড়িতে নির্বিঘ্নে পরিতোষ আর অর্চনার বিয়ে সম্পন্ন হল। পরিতোষ আর অর্চনার বিয়ের সময় সীমন্তিনী আর নবনীতার দেখা পেয়ে মহিমা আর বীথিকার আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের অন্ত ছিল না। সীমন্তিনী আর পরিতোষের আমন্ত্রণে কলকাতা থেকে মহিমা, বীথিকা, রেস্টুরেন্ট মালিক দীপুদা, ডঃ দিব্যেন্দু, তার স্ত্রী দীপা, মেয়ে আকাঙ্ক্ষা, বিট্টু, শেখর, বিপ্লব, প্রণব, আব্দুল, প্রীতি আর বিট্টুর কলেজের প্রিন্সিপ্যাল হৈমন্তী ম্যাডাম ছাড়াও পরিতোষের পাঁচ ছ’জন কলিগ সে বিয়েতে এসেছিল। কালচিনি হাসপাতালের ডঃ সোম এবং তার পরিবারের চার জন, কালচিনি থানার ওসি মিঃ রায় ও তার পরিবারের তিন জন, কালচিনি হাসপাতালের তিনজন নার্স যারা অর্চনাকে শুশ্রূষা করেছিল, নাগরাকাটার অধিকারী কনস্ট্রাকশনের মালিক তরফের চার জন, নাগরাকাটা থানার সীমন্তিনীর কলিগ এবং তাদের পরিবারের ন’ জন, জয়া ম্যাডামের পরিবারের তিন জন, নীতার সহকর্মী ছ’জন, রামসিং, লক্ষ্মী এরা সকলেই সেই বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিল। এছাড়া কালচিনি ও রাজগঞ্জের বাড়ির সকলে ছাড়াও রতিকান্তবাবুদের খুব ঘণিষ্ঠ আট দশ জন কন্যাপক্ষের নিমন্ত্রিত হিসেবে ছিল। বরপক্ষের তরফ থেকে নিরঞ্জনবাবুদের পুরো পরিবার ছাড়াও তার দুই মেয়ের পরিবারের সকলে, আর মালবাজারের মিঃ বক্সী এবং তার দলবলের ছ’জন উপস্থিত ছিল।

আমন্ত্রিত নিমন্ত্রিত আর দু’পক্ষের সমস্ত আত্মীয় স্বজনেরা নব দম্পতীকে প্রাণভরা শুভেচ্ছা, ভালবাসা আর আশীর্বাদ দিয়ে আশাতীত হর্ষোল্লাসের সাথে বিয়েটা সুসম্পন্ন করেছিল।


*****************
 
(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 251)

এরপর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ঘটণাও ঘটে গেছে। পরিতোষ আর অর্চনা একে অপরকে নিয়ে খুব সুখে শান্তিতে সংসার করছে।
 

সীমন্তিনীর কথায় রতীশকে অর্চনার বিয়ের সময় ছুটি দেবার সময় মহিমা তাকে নিজেদের মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট থেকে পাকাপাকি ভাবে ছেড়ে দিয়েছিল অর্চনা আর পরিতোষের আশীর্বাদের তিন দিন আগে। তবে তার বিনিময়ে সীমন্তিনী আর রতীশকে মহিমার দুটো শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল। প্রথম শর্ত মতে উত্তর কলকাতায় মহিমা রতীশের জন্য বেশ বড়সড় জায়গায় একটা যোগা সেন্টার বানিয়ে দিয়ে সেটা রচনার নামে লিখে দিয়েছিল। রতীশও ব্যাঙ্কে গচ্ছিত টাকা দিয়ে খুব সুন্দরভাবে সেন্টারটা সাজিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করেছে ২০১৩ সালের মে মাস থেকে। তার তিন মাস বাদে ১৫ই আগস্টে মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধন হয়েছে। মহিমার দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে কলকাতায় মহিমার মার্কেট কমপ্লেক্সের উদ্বোধনের দিন সীমন্তিনীকে সেখানে উপস্থিত হতে হয়েছিল। সীমন্তিনীর সাথে পরিতোষ, অর্চনা, রতীশ আর রচনাও সে অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিল। নবনীতাই শুধু যায় নি।
 

অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের মাস পাঁচেক পরে বিধুবাবুদের নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল। বিমল আগরওয়ালার অপারেশন থেকে যা টাকা পাওয়া গিয়েছিল তাতে বাড়ি তৈরী আর সমস্ত খরচ খরচার পরেও পঁচিশ লক্ষ টাকা পরিতোষের হাতে থেকে গিয়েছিল। অর্চনা আর পরিতোষের বিয়ের পরের বছর পরিতোষের সাথে পরামর্শ করে সীমন্তিনী কালচিনির বিধুবাবুর দোকানটাকে বড় করে সেই দোকানের ঠিক পাশেই আরও তিনটে রুমে নবনীতার জন্যে একটা বুটিক বানিয়ে দিয়েছিল দুর্গাপূজোর ঠিক আগে আগে। নবনীতা জয়া ম্যাডামের কারখানায় মাস ছয়েকের ভেতরেই সমস্তকিছু শিখে ফেলেছিল। অর্চনার বিয়ের প্রায় এগারো মাস বাদেই নবনীতা জয়া ম্যাডামের ওখান থেকে পাকাপাকিভাবে ছুটি নিয়ে সীমন্তিনীকে আর নাগরাকাটা ছেড়ে কালচিনিতে এসে নিজের বুটিক খুলে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর আরেক মেয়ে হয়ে সেখানেই থাকতে শুরু করেছে। সে আর কলকাতা ফিরে আসতে রাজী ছিল না। বিধুবাবু আর বিভাদেবীও নবনীতাকে তাদের অন্য দুই মেয়ের মতই আপন করে নিয়েছেন। আর অমন স্নেহশীল এক পরিবারের একজন হয়ে নবনীতাও খুব সুখে আছে। এখন কালচিনিতে তার বুটিকের খুব নামডাক। নিজের ডিজাইন করা সামগ্রী ছাড়াও সে জয়া ম্যাডামের কারখানা থেকে থেকে প্রচুর মাল নিয়ে আসে। নবনীতার মিষ্টি কথায় আর ব্যবহারে তার দোকানের গ্রাহক সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।

কিংশুক হায়ার সেকেন্ডারীতে রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান পেয়েও কোনও বিশেষ কোর্স নিয়ে পড়তে চায়নি। মালবাজারের এক কলেজ থেকে বিএ পাশ করে সে এখন নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি থেকে পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিসেসের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় বসবে বলে প্রস্তুতি নিচ্ছে। সীমন্তিনী এখনও তাকে সবরকম সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে ঠিক আগের মতই। শিলিগুড়িতে সীমন্তিনী তার এক বান্ধবীর বাড়িতে কিংশুককে পেয়িং গেস্ট থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। ছুটি ছাটায় বাড়ি এলে কিংশুক তার নতুনদি আর বাবার ব্যবসায় যথাসম্ভব সাহায্য করে। অর্চনার বিয়ের সময় থেকেই সে নবনীতাকে নতুনদি বলে ডাকে আর নিজের দিদির মতই সম্মান ও শ্রদ্ধা করে। নবনীতাও বিধুবাবু, বিভাদেবী, আর কিংশুককে নিজের বাবা মা আর ছোট ভাই হিসেবে পেয়ে খুব খুশী। সে এখন মনে মনে ভাবে, ভাগ্য বিরূপ না হলে সে আমৃত্যু বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সংসারে তাদের পাশে নিজের মেয়ে হয়েই থাকবে।
 

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে রচনা ফুটফুটে একটি পূত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। তবে তার আগেই তারা আগের ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে পরিতোষদের বাড়ির কাছাকাছি একটা জায়গায় একটা টু বেডরম ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এসেছে। সীমন্তিনীই তার নাম রেখেছে যিষ্ণু। অর্চনা আর রচনার পরিবারের সাথে মহিমা, বীথিকা, ডঃ দিব্যেন্দু আর আব্দুল ও তার পরিবারের যোগাযোগ খুব ঘনিষ্ঠ হয়েছে। এরা সকলেই যেন সকলের নিকট আত্মীয়ও হয়ে উঠেছে। রচনার বাচ্চার জন্মের সময় রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে সরলাদেবী, চন্দ্রাদেবী আর কালচিনি থেকে বিভাদেবী এসে কলকাতায় তাদের দু’মেয়ের বাড়িতে তিন মাস থেকে গেছেন। দু’দিনের জন্যে সীমন্তিনী আর নবনীতাও এসেছিল কলকাতায়।
 

দেশদ্রোহিতা, একাধিক খুন এবং তার সাথে আরও অনেকগুলো মামলায় দোষী সাব্যস্ত হবার ফলে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারে বিমল আগরওয়ালার মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে। বিমল সুপ্রীম কোর্টে অ্যাপীল করেছে। তবে সুপ্রীম কোর্টে মামলার শুনানি এখনও চলছে। সবিতা আগরওয়ালা আর বিকি তাদের কলকাতার স্থাবর অস্থাবর সমস্ত কিছু বিক্রী করে দিয়ে নিজেদের দেশের বাড়ি রাজস্থানে চলে গেছে।

২০১৫ সালের আগস্ট মাস। চার মাস আগেই ২৫শে এপ্রিল নেপালে ঘটে গেছে সেই বিধ্বংসী ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্পে প্রায় ন’হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল। অনেক গ্রাম এবং শহরের প্রচুর পরিমান বাড়িঘর, মন্দির, পুল, রাস্তাঘাট ও স্থাপত্য ধুলিস্যাত হয়ে গিয়েছিল। ভূমিকম্প পরবর্তী আফটার শকেও নেপালের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় শ’ তিনেক লোকের মৃত্যু হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের তীব্র স্পন্দন অনুভূত হয়েছিল ভূটান, তিব্বত এবং আমাদের দেশের বিস্তীর্ণ উত্তর অঞ্চল এবং সিকিম সহ গোটা উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে। এর চার বছর আগে সিকিমেও বড় ধরণের এক ভূমিকম্পে প্রচুর জান মানের ক্ষয় ক্ষতি হয়েছিল। এবারের এই ভূমিকম্পেও সিকিম সহ গোটা পশ্চিমবঙ্গের মাটিও কেঁপে উঠেছিল। উত্তরবঙ্গের এবং নিম্ন আসামের বেশ কয়েকটি জেলায় কম্পণের মাত্রা বেশ তীব্র ছিল। বেশ কিছু বাড়িঘরে ফাটল ধরে গিয়েছিল। দু’ এক জায়গায় বাড়ি ঘর ভেঙেও পড়েছিল। সিকিম এবং দার্জিলিং এর পাহাড়েও প্রচুর ফাটল দেখা দিয়েছিল। ভূমিকম্পের দু’মাস বাদেই বর্ষা এসে পৌঁছতেই ফাটলে জর্জরিত সিকিম, ভূটান, দার্জিলিং এবং নেপাল সীমান্ত সংলগ্ন বিহার, উত্তর প্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ আর উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকায় যত্র তত্র পাহাড় ধ্বসে ধসে পড়ে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। এ সবই এখন ইতিহাস। তবে ওই বড় দুটো ভূমিকম্পের ফলে নেপাল সীমান্তবর্তী ওই সব অঞ্চলে পাহাড়ের গায়ে যেসব ফাটল ধরে গিয়েছিল, সেই সব ফাটলে প্রতি বছর বর্ষার সময়ে বৃষ্টির জল ঢুকে পড়বার ফলে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যাচ্ছে। আর ধ্বসে ধ্বসে পড়েছে। এই ২০১৮ সালেও মাত্রাতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের ফলে বিহার থেকে শুরু করে উত্তর প্রদেশ, উত্তরাঞ্চল, হরিয়ানা এবং হিমাচল প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশাল বিশাল ধ্বস নামবার ফলে প্রচুর বাড়িঘর রাস্তাঘাট ধুলিস্যাত হয়ে গেছে। বহু মানুষ আর গবাদি পশু নিহত হয়েছে।
 

সীমন্তিনী তখন তার নাগরাকাটার কোয়ার্টারে আবার আগের মতই একা। ঘরে সঙ্গী বলতে শুধু লক্ষ্মী। আগস্টের আঠার তারিখ সীমন্তিনী ওয়ারলেস মেসেজ মারফৎ নির্দেশ পেল যে তাকে মালবাজারে ওএসডি হিসেবে বদলী করা হয়েছে। তার জায়গায় বিশাল কুলকার্নী বলে এক আইপিএস অফিসার আসছেন। সাতদিনের মধ্যে নতুন ওএসডি কুলকার্নীকে সমস্ত দায়ভার বুঝিয়ে দিয়ে তাকে মালবাজার থানায় রিপোর্ট করতে হবে পঁচিশ তারিখের মধ্যে। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনীর এ ব্যাপারে কথাও হয়েছে। ঊণিশ তারিখ থেকে একটানা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হয়ে চলেছে উত্তরবঙ্গের চারটি জেলায়।
 

একুশ তারিখ গভীর রাতে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা অর্চনা যখন পরিতোষের বুকে মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন তখনই বিছানার পাশে রাখা পরিতোষের মোবাইলটা বেজে উঠল। ঘুম ভেঙে যেতে পরিতোষ খানিকটা বিরক্তি নিয়েই ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল একটা অচেনা নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। রাত তখন প্রায় একটা। প্রচুর বিরক্ত হয়েই সে কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় ‘হ্যালো’ বলতেই ও’পাশ থেকে উদ্বিঘ্ন গলায় এক পুরুষকন্ঠ বলল, “স্যার, আমি নাগরাকাটা থানার ওসি সিকদার বলছি। একটা খারাপ খবর আছে স্যার”।
 

“হোয়াট”? বলেই এক ঝটকায় অর্চনাকে বুকের ওপর থেকে সরিয়ে দিয়ে পরিতোষ লাফ মেরে বিছানায় উঠে বসে বলল, “কী বলছেন মিঃ সিকদার? কী হয়েছে? আপনাদের ম্যাডাম ঠিক আছেন তো”?
 

ও’পাশ থেকে সিকদারবাবু আমতা আমতা করে কোনরকমে বললেন, “সরি স্যার। কথাটা বলতে আমার জিভ ভারী হয়ে উঠছে। কিন্তু তা সত্বেও অনেক চেষ্টা করে আপনার নাম্বারটা পেলাম বলেই আপনাকেই কথাটা বলতে বাধ্য হচ্ছি স্যার। খুব দুঃখের সাথেই জানাচ্ছি, ম্যাডাম সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আজ রাতে উগ্রপন্থীদের অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন স্যার”।

পরিতোষ খাট থেকে লাফ মেরে নিচে নেমে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “হোয়াট ননসেন্স আর ইউ টকিং মিঃ সিকদার? এ কিছুতেই হতে পারে না। ইটস অ্যাবজার্ড, ইটস সিমপ্লি অ্যাবজার্ড। না না, আপনি নিশ্চয়ই ভুল কোন ইনফর্মেশন পেয়েছেন”।
 

অপরদিক থেকে সিকদারবাবু কান্না ভেজা গলায় বলল, “স্যার, ইনফর্মেশনটা ভুল হলে এ মূহুর্তে সবচেয়ে খুশী বোধহয় আমি হতাম। আমি জানি স্যার, আপনি ভট্টাচার্যি ম্যামের খুব ঘণিষ্ঠ বন্ধু। আমরা তো ম্যামের বাড়ির কারো নাম্বার খুঁজে পাইনি এখনও। জয়া বসাকের মাধ্যমে নবনীতা ম্যাডামের কাছ থেকে আপনার নাম্বারটা কোনভাবে কালেক্ট করতে পেরেই খবরটা আমি আপনাকেই প্রথম জানাচ্ছি স্যার। আর স্যার, বুঝতেই পাচ্ছেন, এদিকে এখন হুলুস্থুল চলছে। আমরাও এখন চরম ব্যস্ততার মধ্যে আছি। আপনার পক্ষে যদি সম্ভব হয় তাহলে ম্যামের বাড়িতে খবরটা পাঠিয়ে দেবেন স্যার। নইলে কাল সকালের আগে আমাদের পক্ষে বোধহয় রাজগঞ্জে কোনও খবর পাঠানো সম্ভব হবে না। আর স্যার, গোটা ঘটণাটার ডিটেইলস আমার কাছে এখনও এসে পৌঁছয় নি। আপাততঃ শুধু এটুকুই বলতে পারি, মিসহ্যাপটা হয়েছে নাগরাকাটা থেকে প্রায় তেত্রিশ কিলোমিটার উত্তরে ভূটানের একটা এলাকায়। আমাদের কাছে খবর এসেছে রাত বারোটা নাগাদ। পাহার ধ্বসে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার দরুন সেখানে কোনও রেসকিউ টিম বা অন্য কোনও সাপোর্টও পাঠাতে পারছিনা স্যার আমরা। অবশেষে হাসিমারা এয়ারবেস থেকে আর্মির হেলিকপ্টারের রিকুইজিশন চেয়ে পাঠিয়েছি। মালবাজার আর জলপাইগুড়ি থেকে র*্যাফ আর এনডিআরএফ-এর কয়েকটা টিম আসছে। কপ্টার হয়ত আর পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই এসে পড়বে এখানে। সাথে সাথেই আমরা সেখানে যাচ্ছি। তারা প্রায় সকলেই ওই স্পটেই আছে। আমাদের টিমের একজন পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ে বোধহয় প্রাণে বেঁচে গিয়েছিল। সে-ই অনেক কষ্টে কাছের একটা চা বাগানে গিয়ে সেখান থেকেই ফোনে ঘটণাটা আমাদের জানিয়েছে” বলে একটুক্ষণ থেমেই সে আবার বলল, “স্যার আমাকে বেরোতে হচ্ছে এক্ষুনি। তাই ছাড়ছি এখন। আপনি কি করতে পারেন দেখুন” বলেই ফোন কেটে দিল।

নিজের বুক থেকে ঝটকা দিয়ে অর্চনাকে সরিয়ে দেবার সময়েই অর্চনা জেগে গিয়েছিল। তারপর পরিতোষের অবস্থা দেখে আর পরিতোষের মুখে ‘ম্যাডাম’ শব্দটা শুনেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। পরিতোষ ফোনে কথা শেষ করে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে আছে দেখে অর্চনা তার কাছে এসে বলল, “কি হয়েছে গো? তুমি এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কোন ম্যাডামের কি হয়েছে গো? বলো না। তুমি চুপ করে আছ কেন”?
 

পরিতোষ অর্চনার কথার জবাবে কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার বুকটা ঘণ ঘণ শ্বাস প্রশ্বাসের ফলে হাপরের মত ওঠানামা করছিল। অর্চনা এবার পরিতোষের দুটো কাঁধ শক্ত করে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “কি হল? কথা বলছ না কেন তুমি? কার কি হয়েছে বলো না”।

পরিতোষ এবার অর্চনাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে অর্চু। মন্তি... মন্তি ......” বলে থেমে গেল।

মন্তির নাম শুনেই অর্চনাও কেঁদে ফেলল। পাগলের মত পরিতোষকে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সে বলল, “কি হয়েছে দিদিভাইয়ের? বলো না কী হয়েছে? দিদিভাই ঠিক আছেন তো”?

পরিতোষ কান্নায় ভেঙে পড়ে আর্ত চিৎকার করে বলল, “মন্তি, মন্তি আর নেই অর্চু। তোমাদের দিদিভাই আমাদের সব্বাইকে ছেড়ে চলে গেছে চিরদিনের মত, ও হো হো” বলে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

অর্চনাও পরিতোষের থেকে দুরে ছিটকে গিয়ে “না আ আ আ.....” বলে চিৎকার করে উঠেই অজ্ঞান হয়ে বিছানার ওপর পড়ে গেল।


*****************

পরের দিন সকালের ফ্লাইটে পরিতোষ অর্চনা, রচনা, রতীশ আর রতীশের দেড় বছরের শিশুপুত্রকে নিয়ে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জ এসে পৌঁছল বেলা সাড়ে ন’টা নাগাদ। কলকাতা থেকে রওনা হবার আগে চেনাজানা সকলকে দুঃসংবাদটা জানিয়ে দিয়েই নিজের মোবাইল দুটোই সুইচ অফ করে দিয়েছিল। সারা রাজগঞ্জ শহরটাই যেন শোকস্তব্ধ। শহরের শুরু থেকেই সমস্ত দোকানপাট বন্ধ। কিন্তু রাস্তায় প্রচুর ভিড় ভাট্টা। বাস, ট্যাক্সি, অটো রিক্সা কিছু চলছে না। শুধু লোক আর লোক। দু’একটা রিক্সায় দু’ একজন যাত্রী অবশ্য চোখে পড়ল। কিন্তু তাদের সকলের মুখেও দুঃখের ছায়া আর চোখের পাতা জলে ভেজা। আর রিক্সাগুলোও লোকের ভিড়ে এগোতে না পেরে রাস্তার পাশে গিয়ে থেমে আছে। বাগডোগড়া থেকে ভাড়া করা ট্যাক্সিটা আগা গোড়া বেশ ভাল গতিতে এলেও রাজগঞ্জ শহরের সীমায় ঢুকতে না ঢুকতেই জনতার ভিড়ে আর যেন এগোতেই পারছিল না। খুব সাবধানে ঠেলাগাড়ির গতিতে কিছুদুর এগিয়ে একসময় ড্রাইভার রাস্তার মাঝেই গাড়ি থামিয়ে দিতে বাধ্য হল। ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে বাইরের ভিড়ের দিকে কাউকে উদ্দেশ্য না করেই জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে দাদা? রাস্তায় এত ভিড় কিসের? কোনও এক্সিডেন্ট ফেক্সিডেন্ট কিছু হয়েছে নাকি”।

ভিড়ের মধ্যে থেকে বেশ কয়েকজন একসাথেই কিছু বলল। কিন্তু ড্রাইভার তাদের কথার একটা শব্দও বুঝে উঠতে না পেরে বলল, “আপনারা যে কোন একজন বলুন না। সবাই মিলে একসাথে যা বললেন, আমি তো তার কিছুই বুঝতে পারছি না”।
 

এবার একজন মধ্যবয়স্ক লোক ভারি গলায় বললেন, “আমাদের শহরের সকলের প্রিয় একজন মেয়ে গত রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের গুলিতে শহীদ হয়েছে ভাই। তাই আমাদের সারা শহরের লোক এখন তার বাড়ির দিকে রওনা হয়েছে, তাকে শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে, তার পরিবারকে সহানুভূতি জানাতে, আর সম্ভব হলে শেষ বারের মত তার দেহটাকে এক নজর দেখতে। এ রাস্তায় আর গাড়ি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে বলে মনে হয় না”।

ড্রাইভার ছেলেটা বোধহয় এতক্ষণে বুঝতে পারল যে তার গাড়িতে বসে থাকা এই চার জন যাত্রী কেন আগাগোড়া এভাবে কেঁদে যাচ্ছে। কলকাতা থেকে এ পর্যন্ত সারাটা পথই রচনা আর অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে এসেছে। মাঝরাত থেকেই চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে তাদের গলা ভেঙে গেছে। এখন আর কান্নার শব্দও বের হচ্ছে না। দু’জনের গলা থেকে শুধু ফ্যাসফেসে শব্দই বেরোচ্ছে। কিন্তু অবিরাম। তাদের দু’চোখ থেকে অবিরত নদীর জলের মত অশ্রু বয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই ওদের দু’জনকে শান্ত করা যায় নি। আর শান্ত করবেই বা কে? কাঁদছে রতীশও। তবে তার কান্নাটা প্রায় নিরব। অনবরত ঝরে পড়া চোখের জলে তার গাল গলা বুক ভেসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কান্নার উথলে ওঠা আবেগ সইতে না পেরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে দু’হাতে মুখ চোখ ঢেকে বলে উঠছে, “ওফ, হা ভগবান”। রচনার দেড় বছরের ছোট ছেলেটাকে পরিতোষই সামলে এনেছে গোটা পথটা। ওই ছোট্ট ছেলেটার মুখ থেকেই যা দু’ একটা শব্দ বের হচ্ছে এই মূহুর্তে। পরিতোষও পুরোটা সময় ছেলেটাকে কোলে নিয়ে স্থানুর মত বসে থাকলেও তার দু’চোখ দিয়ে অবিরত জলের ধারা বয়ে বেরোচ্ছিল। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল এতক্ষণ যেভাবে কেটেছে, কেটেছে। তাকে নিজেকে এখন সামলে নিতেই হবে। নইলে পরিস্থিতির মোকাবেলা করাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
 

মধ্যবয়স্ক লোকটির কথা শুনেই সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে বসে থাকা রতীশ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। রতীশদের বাড়ি তখনও দু’ কিলোমিটার দুরে। গাড়ি আর কিছুতেই এগোতে পারছে না। বেচারা ড্রাইভার হাল ছেড়ে দিয়েছে। পরিতোষ এ পরিস্থিতি থেকে বেরোবার কথা ভাবতে ভাবতেই বাইরের ভিড়ের মধ্যে থেকে এক যুবক প্রায় চেঁচিয়ে উঠে নিজের গলায় যত জোর আছে তা দিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠল, “আপনারা সবাই মাঝখান থেকে একটু সরে যান দয়া করে। এ গাড়িতে সীমন্তিনী দিদির দাদা-বৌদিরা আছেন। দয়া করে এনাদের গাড়িটাকে এগিয়ে যেতে দিন। আপনারা তাদের যাবার জন্য একটু রাস্তা দিন”।

রতীশ মুখ থেকে হাত সরিয়ে জলভরা চোখে চেয়ে দেখল চিৎকার করে ওঠা ছেলেটা রতন। রিক্সাওয়ালা। তার বাবা একসময় রতিকান্তবাবুদের ক্ষেতি জমিতে চাষবাসের কাজ করত। তাকে তারা কানাইকাকা বলে ডাকত। রতন রতীশের জানালার কাছে এসে ওঠানো কাঁচে টোকা দিতেই রতীশ জানালা খুলে দিল। আর ততক্ষণে নির্বাক বিশাল জনতার মধ্যে যেন হুড়োহুড়ি পড়ে গেছে। গাড়ির সামনে থেকে ভিড়টা অনেকটাই হাল্কা হয়ে গেছে। কিন্তু সামনে যতদুর চোখ যায় ততদুর লোকে লোকারণ্য।
 

জানালা খুলতেই রতন রতীশের একটা হাত নিজের দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠে বলল, “তুমি এসেছ বড়দা? এ কী হল বল তো? বড়দি আমাদের সকলকে এভাবে ছেড়ে চলে গেল”?
 

আর প্রায় সাথে সাথেই আশেপাশের প্রায় অনেকেই একসাথে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। ড্রাইভার বেচারা কিছু বুঝতে না পেরে পরিতোষের দিকে ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল, “স্যার, কাল রাতে ভূটান বর্ডারে উগ্রপন্থীদের সাথে বেশ বড় রকমের একটা সংঘর্ষ হয়েছে, আর তাতে অনেকগুলো টেররিস্টের সাথে বেশ কয়েকজন পুলিশের লোকও মারা গেছে। তার মধ্যে সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি নামের এক মহিলা পুলিশ অফিসারও নাকি ছিল। সে খবর তো বাগডোগড়াতেই আজ ভোরে পেয়েছিলাম। এরা কি ওনার কথাই বলছে? আর আপনারা কি তাদের বাড়িই যাচ্ছেন”?
 

পরিতোষ নিজের ঢোঁক গিলে কোনরকমে তার শুকিয়ে আসা গলাটা ভিজিয়ে নিয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ ভাই। সীমন্তিনী আমাদের আত্মীয়। আর তোমার পাশে যে বসে আছে সে সীমন্তিনীর দাদা। আর এরা দু’জন সীমন্তিনীর বোন আর বৌদি। আমরা সকলে কলকাতায় থাকি। সেখান থেকেই এলাম সকালের ফ্লাইটে। কিন্তু বাড়ি তো এখনও দেড় থেকে দু’ কিলোমিটার দুরে। আর এখানে যা অবস্থা দেখছি তাতে পুলিশের সাহায্য ছাড়া রাস্তা বের করা তো প্রায় অসম্ভব। এই ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এমন ভিড়ের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাওয়াও তো নিরাপদ নয়”।

ড্রাইভারটা বলল, “স্যার, রাস্তার অবস্থা দেখে আমি তো এখানেই আপনাদের নামিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন যা সব শুনলাম তাতে করে এখন তেমনটা করলে সকলে আমাকে অমানুষ বলবে। যে করেই হোক, যেভাবেই হোক, আপনাদের বাড়ি অব্দি আমি নিয়ে যাবই। স্যার এখানকার থানার নম্বর আমার কাছে আছে। আমি থানায় ফোন করে তাদের কাছ থেকে সাহায্য চাইছি”।
 

পরিতোষ প্রায় সাথে সাথে বলল, “তুমি এক কাজ কর ভাই। থানার নাম্বারটা আমাকে বল। আমিও একজন পুলিশ অফিসার। তাই তাদের কাছে আমি সাহায্য চাইলে তারা নিশ্চয়ই সাহায্য করতে আসবে”।

ওদিকে রতীশ রতনের হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে গাড়ির দড়জা খুলতে যেতেই রতন উল্টোদিক থেকে দড়জা চেপে ধরে বলল, “না না বড়দা, এই ভিড়ের মধ্যে তুমি গাড়ি থেকে বেড়িও না গো। পাবলিক তোমাদের দেখলে পাগল হয়ে উঠবে এখন। কাউকে সামলানো যাবে না। বড়দি এত বছর ধরে এ শহর ছেড়ে থাকলেও তাকে এ শহরের একটা লোকও যে এখনও ভুলে যায়নি, সেটা তো বুঝতেই পারছ। এতক্ষণ সবাই দুঃখে মনমরা হয়ে ধীরে ধীরে তোমাদের বাড়ির দিকে এগোচ্ছিল। কিন্তু তোমরা গাড়ি থেকে নামলেই হুড়োহুড়ি পড়ে যাবে। আমি দেখছি, কিভাবে তোমাদের গাড়িটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়”।

পরিতোষও রতনের কথায় সায় জানিয়ে রতীশের কাঁধে হাত দিয়ে চেপে দিতে রতীশ চুপ করে বসে আবার কাঁদতে শুরু করল। অর্চনা আর রচনাও এবার গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। তবে ওই কান্নারও একভাগ স্বর, আর বাকি তিন ভাগই শুধু ফুসফুসের হাওয়া। পরিতোষ থানার নাম্বার ডায়াল করে ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই বলল, “শুনুন, আমি সিনিয়র আইপিএস পরিতোষ সান্যাল বলছি। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি আমার আত্মীয়া। আমরা কলকাতা থেকে বাগডোগড়া হয়ে রাজগঞ্জে ঢুকতে গিয়ে রাস্তার ভিড়ে আঁটকে গেছি। গাড়ি এগোতে পারছে না ভিড়ের জন্য। সীমন্তিনীর বোন আর দাদা বৌদিও আমার সঙ্গে আছে। আপনারা যদি রাস্তার ভিড়টা একটু সরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতেন তাহলে খুব উপকৃত হতাম। আসলে সঙ্গে দেড় বছরের ছোট একটা বাচ্চাও আছে বলে আমরা এই ভিড়ের মধ্যে হেঁটে যেতে পারছি না। তাছাড়া রাস্তার ভিড় এতক্ষণে জেনে গেছে যে সীমন্তিনীর দাদা বৌদিরা এ গাড়িতে আছে। তাই সকলেই আমাদের গাড়িটাকে ঘিরে ধরেছে। ব্যাপারটা আশা করি বুঝতে পারছেন”।

ও’পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “স্যার আমাদের থানা থেকে দুটো গাড়ি অনেক আগেই সীমন্তিনী ম্যাডামের বাড়িতে চলে গেছে। আমাদের স্যারও সেখানে আছেন। তবে স্যার, আপনারা এ মূহুর্তে ঠিক কোথায় আছেন বলুন তো। আমরা চেষ্টা করছি কিভাবে আপনাদের নিরাপদে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া যায়”।

পরিতোষ রতীশের কাছ থেকে লোকেশানটা জেনে নিয়ে থানায় জানিয়ে দিল। এদিকে বাইরে ততক্ষণে রতন প্রায় পনের কুড়িজন রিক্সাওয়ালাকে একসাথে জুটিয়ে নিয়ে সকলে মিলে জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে রাস্তা ফাঁকা করে দেবার অনুরোধ জানাতে শুরু করেছে। সামনের কিছুটা জায়গা ফাঁকা হয়ে যেতে ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করে ধীর গতিতে চালাতে লাগল। এভাবে প্রায় পনের মিনিটে কয়েকশ’ মিটারের মত যাবার পরেই উল্টো দিক থেকে সাইরেন বাজাতে বাজাতে একটা পুলিশের গাড়ি এসে হাজির হল।

______________________________
Like Reply
(Update No. 252)

পুলিশের গাড়ির সাহায্যে বাকি রাস্তাটুকু পেরোতে আরও প্রায় পনেরো মিনিট পেরিয়ে গেল। বাড়ির সামনে লোকের ভিড় আরও বেশী। তিল ধারনের জায়গা নেই বলা যায়। আশেপাশের বাড়িগুলোর ব্যালকনিতে আর ছাঁদেও মানুষের ভিড়। রাস্তার এপাশে ওপাশে উঁচু উঁচু গাছগুলোতেও অনেক ছেলে আর কম বয়সী পুরুষেরা উঠে সীমন্তিনীদের বাড়ির দিকে উঁকি ঝুঁকি মারছে। পুলিশের লোকেরা আর রতনের সঙ্গী রিক্সাওয়ালারা গাড়ি থেকে তাদের নামিয়ে ভিড় ঠেলে অনেক কষ্টে তাদের সকলকে বাড়ির গেটের কাছে পৌঁছে দিল। বাড়ির গেটে পুলিশের ব্যারিকেড। বাইরের কোন লোককে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না তারা। পরিতোষ রচনার ছেলেকে কোলে নিয়েই গেটের সামনে আসতে একজন পুলিশ অফিসার ছুটে এসে পরিতোষের হাত ধরে বলল, “খুবই মর্মান্তিক ঘটণা স্যার। কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। যান ভেতরে যান। ভেতরেও অবশ্য হুলুস্থুল চলছে। বাড়ির লোকেরা যে কেউ যখন তখন অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। আমরা তিন চারজন ডাক্তার আর কয়েকজন নার্সকেও আনিয়েছি। তারা সাধ্যমত পরিচর্যা করছেন। অ্যাম্বুলেন্সও আছে”।

অন্যান্য সকলে ততক্ষণে বাচ্চাটাকে পরিতোষের কাছে ছেড়েই বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে। আর বাড়ির ভেতরে সেই সাথে সাথে কান্নার রোলও বেড়ে উঠল। পরিতোষ সেই অফিসারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “একটা কথা বলুন অফিসার। সীমন্তিনীর বডি এখানে কখন আসবে সে ব্যাপারে কোন খবর আছে আপনাদের কাছে”?

অফিসার বলল, “না স্যার, সে খবর এখনও পাই নি। তবে যেটুকু জানতে পেরেছি তাতে মনে হচ্ছে ভীষণ বড় ধরণের একটা অ্যাম্বুশ হয়েছিল। শুনেছি যে সকাল আটটা নাগাদ ভূটান সীমান্তের ওই জায়গা থেকে আর্মির দুটো হেলিকপ্টারের সাহায্যে সবশুদ্ধ ছত্রিশ জনের ডেডবডি, আর গুরুতর আহত অবস্থায় তিন চার জন পুলিশকে তুলে আনা হয়েছে নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজে। তার ভেতর নাকি সীমন্তিনী ম্যাডামের বডিও আছে। ওখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো বোধহয় তাদের আত্মীয় স্বজনদের হাতে তুলে দেওয়া হবে। আমাকে এসপি অফিস থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এদিকে পরিস্থিতি সামাল দিতে আর এ বাড়ির কাউকে শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে যেতে। এর পরে আর কোনও আপডেট পাইনি স্যার আমরা”।

পরিতোষদের ট্যাক্সির ড্রাইভার ছেলেটাও তাদের পাশে দাঁড়িয়েই দু’জনের কথা শুনছিল। পরিতোষ এবার অফিসারকে বলল, “নর্থ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ তো শিলিগুড়িতেই, তাই না অফিসার। এখান থেকে গাড়িতে সেখানে পৌঁছোতে কতটা সময় লাগতে পারে বলুন তো”?

অফিসার জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, শিলিগুড়িতেই। এখান থেকে কারে যেতে পঞ্চাশ পঞ্চান্ন মিনিটের মত লাগে। কিন্তু এ বাড়িতে যা অবস্থা চলছে তাতে তো কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছি না। এখান থেকে তার বডি আনতে কে যাবে না যাবে কিছুই বুঝতে পারছি না”।

পরিতোষ অফিসারকে আশ্বস্ত করে বলল, “আমি সেটা দেখছি অফিসার। আপনি বরং এদিকটাই সামলান আপাততঃ। ভিড় যেভাবে বাড়ছে তাতে কিন্তু সিচুয়েশন কন্ট্রোলের বাইরে চলে যেতে পারে। একটু কেয়ারফুলি হ্যান্ডেল করবেন ব্যাপারটা প্লীজ। কাউকে যেন ফিজিক্যালি হ্যারাস না করা হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিন। আর আরও কিছু ফোর্স বা হোমগার্ড এনে রাস্তায় ডিউটিতে লাগিয়ে দিন। অনেকদুর পর্যন্ত কিন্তু রাস্তা পুরো জ্যাম হয়ে গেছে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিলিগুড়ি রওনা দেবার চেষ্টা করছি”।
 

অফিসারটি বললেন, “ঠিক আছে স্যার, আমি গাড়ির বন্দোবস্ত করছি”।

এমন সময় ড্রাইভার ছেলেটি হাত জোড় করে পরিতোষকে বলল, “স্যার সীমন্তিনী ম্যাডামের কথা আমি আগেও অনেক শুনেছি। বিশেষ করে কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্টে তো ম্যাডামের নাম সকলের মুখে মুখে ঘোরে। তাকে চাক্ষুষ দেখবার সুযোগ কখনও হয়নি। কিন্তু আজ তার জীবনের শেষ দিনে আমি তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি এ কথা ভাবতেও যেন অবাক হচ্ছি। স্যার এটা তো বুঝতেই পারছি আজ সারা দিনে আপনাদের অনেককে অনেক ছোটাছুটি করতে হবে এদিকে সেদিকে। গাড়িরও প্রয়োজন পড়বেই। তাই বলছি স্যার, যদি আমাকে একটু সুযোগ দেন, তাহলে যতক্ষণ অব্দি প্রয়োজন পড়ে আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই। না না, আমি গাড়ি ভাড়া দেবার উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলছি না স্যার। আমি এ জন্যে একটা পয়সাও নেব না। ধরে নিন না আমার মত নগন্য এক ট্যাক্সিচালক এভাবেই এক সত্যিকারের দেশপ্রেমিক পুলিশ অফিসারকে সম্মান জানাচ্ছে। প্লীজ স্যার। আমাকে এটুকু সুযোগ দিন। আমি সারাটা জীবন আজকের দিনটার কথা মনে করে গর্ব বোধ করব”।

কথাগুলো বলতে বলতে ড্রাইভারটার দু’চোখ থেকে জলের ধারা বইতে শুরু করল। পরিতোষের ভেতর থেকে যেন আরও একবার কান্না উথলে আসছিল। কিন্তু কোনরকমে নিজেকে সামলে সে ড্রাইভার ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “কি নাম তোমার”?

ছেলেটা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে জবাবে বলল, “আমার নাম অজিত স্যার। অজিত সূত্রধর। আমি শিলিগুড়ির শালুগাড়াতে থাকি”।

পরিতোষ তার কাঁধ থপথপিয়ে বলল, “শোনো ভাই, বুঝতেই তো পারছ যে এ অবস্থায় তোমার চা বা খাবারের কোনও বন্দোবস্ত করা কিন্তু আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। সেটা যদি তুমি নিজে ম্যানেজ করতে পারো, আর এখানকার থানার অফিসারেরা যদি তোমাকে সে অনুমতি দেয়, তাহলে থাকো। তুমি এনার সাথে কথা বল এ ব্যাপারে। আমি ভেতরে গিয়ে দেখি”।

পরিতোষ ভেতরে যেতেই আরেকবার কান্নার রোল প্রবল হয়ে উঠল। সকলেই পাগলের মত কান্নাকাটি করছে। পরিতোষ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখে বুক ভরে দু তিনটে বড় বড় শ্বাস নিয়ে একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরের ভেতর সরলাদেবী, সীমা দেবী, চন্দ্রাদেবীর সাথে অর্চনা, রচনা আর চন্দু, সতীশের স্ত্রী দেবাংশী আর বাড়ির কাজের মহিলারা ছাড়াও আরও দু’তিনজন মেয়ে মহিলারা সমস্বরে কেঁদে চলেছে। রচনা দড়জার খুব কাছেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছিল। পরিতোষ ঝুঁকে নিচু হয়ে রচনার একটা হাত ধরে টেনে তুলে ঘরের বাইরে এনে বলল, “খোকাকে একটু ধর বোন। এত চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে ও বার বার কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার কোলের ভেতরে। এ সময় বাচ্চাদের মায়ের কোলেই রাখতে হয়। আর নিজেকে সামলাও রচু। তোমার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলাও। দেখ বোন, আমাদের কপালে যা ছিল সেটা তো ঘটেই গেছে। কিছুই তো আর ফিরিয়ে আনতে পারব না আমরা কেউ। কিন্তু নিজেদেরকে তো সামলাতে হবে। তাই বলছি বোন। নিজেকে শক্ত রাখবার চেষ্টা কর। ভুলে যেও না, তুমি এ বাড়ির বড় বৌ। এই মূহুর্তে নিজেকে শক্ত রেখে তোমাকেই সকলকে সামলাতে হবে বোন। আমাকে তো এখনই শিলিগুড়ি যেতে হবে আবার। ওখানে মেডিক্যাল কলেজেই নাকি পোস্ট মর্টেম হচ্ছে। পোস্ট মর্টেম শেষ হবার পরেই বডি দেবে। তাই আমাকে এখনই যেতে হবে নাও। তুমি ছেলেকে কোলে নাও। আর কাকুরা ভাইরা কোথায়? রতু কোথায়”?
 

রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে নিজের কান্নার হেঁচকি সামলাতে সামলাতে একটা ঘরের দিকে ঈশারা করে ফ্যাসফেসে গলায় জবাব দিল, “বাবা কাকুরা বোধহয় ও ঘরে আছেন। উনিও হয়তো সেখানেই আছেন”।

পরিতোষ ছেলের দিকে ঈশারা করে বলল, “ওর এতক্ষণে নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। কিছু খাওয়াও ওকে। আমি ওদিকে দেখছি” বলে রচনার দেখানো ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে রতিকান্তবাবুরা তিন ভাই মাথায় হাত দিয়ে বসে চোখের জল ফেলছেন। অচেনা বেশ কয়েকজন বয়স্ক লোকও সেখানে বসে আছেন। রতীশ আর সূর্যও সে ঘরে আছে। কাঁদতে কাঁদতে তাদের চোখও লাল হয়ে গেছে। কিন্তু চঞ্চল আর সতীশকে সেখানে দেখা গেল না।

শশীকান্তবাবুর সাথে পরিতোষের চোখাচোখি হতেই পরিতোষ তার দিকেই এগিয়ে গেল। শশীকান্তবাবু পরিতোষের হাতটা ধরে হাউ হাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদবার পর কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “পরিতোষ বাবা। যে বাবা মা ছোট্ট মেয়ের একটা অপরাধের শাস্তি দিতে গিয়ে যদি তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়, সেই বাবা মায়ের কোল খালি করে ভগবান বুঝি এভাবেই শাস্তি দেন। এতদিনে এতগুলো বছর পরে ভগবান আজ আমাদের সে শাস্তিই দিলেন। তোমরাও কেউ আমাদের ক্ষমা কোর না বাবা। কেউ ক্ষমা কোর না। আমরা সবাই সকলের ক্ষমার অযোগ্য”।

পরিতোষ তার দুটো হাত ধরে শুধু ঈশারায় তাকে শান্ত থাকতে বলে রতীশকে ডেকে ঘরের বাইরে এনে বলল, “রতু, কালচিনির কারো কোনও খবর পেয়েছ? ওরা খবর পেয়েছে”?

রতীশ ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “খবর তো সকলেই পেয়ে গেছে পরিদা। মা, বাবা, নীতাদি সকলেই শিলিগুড়ির পথে রওনা হয়েছে ন’টা নাগাদ। আর ভাই তো শিলিগুড়িতেই আছে। ও এখন মেডিক্যাল কলেজেই আছে। নীতারাও হয়তো সেখানেই যাবে। আর কোলকাতা থেকে মহিমা বৌদি, বীথিকা আর দীপা বৌদি বেলা এগারোটার ফ্লাইটে উঠছেন। ওনারাও হয়তো সাড়ে বারোটা একটার মধ্যে শিলিগুড়ি পৌঁছে যাবেন। আর ভাই খানিকক্ষণ আগেই ফোন করে জানাল যে নাগরাকাটা থেকে সুরজিত অধিকারী, থানার ওসি ছাড়াও আরও অনেক লোক সেখানে এসে গেছেন। আলিপুরদুয়ার থেকেও নাকি অনেকেই আসছেন শিলিগুড়িতে। এ ছাড়া আর তেমন কিছু জানি না”।

পরিতোষ সব শুনে বলল, “এদিকে বাইরে ওসির মুখে শুনলাম যে সকাল আটটা নাগাদ নাকি অনেক গুলো ডেডবডি দুর্ঘটণাস্থল থেকে মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে পোস্টমর্টেম হবার পর বডিগুলো যার যার আত্মীয় স্বজনদের হাতে দেওয়া হবে। তাই আমাদের তো এখনই বেরোতে হয় ভাই। বাড়ি থেকে কে কে যাবে, এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা হয়েছে”?

রতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে ব্যাপারে তো কেউ কিছু বলে নি। আমারও মাথা কোন কাজ করছে না পরিদা”।

এমন সময় রচনা ছেলেকে কোলে নিয়ে দড়জা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে রতিকান্তবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “বাবা, দিদিভাইকে তো বাড়িতে আনতে হবে। আমার মনে হয় এখনই বাড়ি থেকে দু’তিনজনের বেরিয়ে পড়া উচিৎ। পরিদা তো যাবেনই। আর আমি চাই পরিদার সাথে আপনার বড় ছেলেও যাক। আর আপনারা আর কেউ যেতে চাইলে তৈরী হয়ে নিন। আর দেরী না করাই ভাল” বলে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “পরিদা তুমি প্লীজ একটু আমার সঙ্গে এসো”।

রচনা পরিতোষকে সঙ্গে নিয়ে তারা আগে যে রুমে থাকত সেখানে এসে দেখে সতীশ আর চঞ্চল সেখানে বসে বসে কাঁদছে। রচনা ঘরে ঢুকে চঞ্চলকে বুকে জড়িয়ে ধরে সতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “মেজদাভাই, তুমি চঞ্চুকে নিয়ে একটু ও’ঘরে জেঠুদের কাছে গিয়ে বসো না। আর যারা যারা দিদিভাইকে আনতে যাবেন, তাদের সকলকে প্রস্তুত হতে বলো”।

“ঠিক আছে বৌদিভাই” বলে সতীশ চঞ্চলকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে সীমন্তিনী ছেলেকে কোলে নিয়েই পরিতোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোজাসুজি তার চোখের দিকে চেয়ে বলল, “পরিদা, এখন আমি তোমাকে এমন একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছি, যার জবাব একমাত্র তুমি ছাড়া এই মূহুর্তে এ পৃথিবীতে আর কেউ আমাকে দিতে পারবে না। হয়ত আরও দু’ একজন সে প্রশ্নের জবাবটা জানেন। আমার মামনি, মেজমা। কিন্তু এই মূহুর্তে তাদের এ প্রশ্নটা আমি করতে পারছি না। দিদিভাই আমাদের সকলকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেলেন। তোমরা তো এখন তার দেহটাকেই শুধু নিয়ে আসবে এখানে যাতে আমরা সকলে শেষ বারের মত আমার দিদিভাইয়ের খোলসটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে পারি। দিদিভাইয়ের কাছে এ প্রশ্নটা আমি বহুবার করেছি। দিদিভাই আমাকে কথা দিয়েছিলেন, যে একদিন না একদিন তিনি সে কথাটা আমাকে বলবেন। কিন্তু আজ ভগবান তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়েছেন। দিদিভাইয়ের কাছ থেকে সে জবাব আর আমার পাওয়া হল না। এ মূহুর্তে আমি সেই কথাটাই তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছি পরিদা”।

পরিতোষ রচনার মনের আসল কথাটা বুঝতে পেরে শান্ত কন্ঠেই জবাব দিল, “রচু বোন আমার। তোমার প্রশ্নের জবাব আমি আগেও যেমন দিতে পারিনি, আজও দিতে পারব না। মন্তি যে আমাকে বিশ্বাস করত। তুমি কি চাইছ আজ সে নেই বলেই আমি তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি? সরি রচু, আমার প্রাণ থাকতে আমি সেটা করতে পারব না”।
 

রচনা এবার কাঁদতে কাঁদতে বলল, “তুমি দিদিভাইকে যতটা ভালবাসো আমি কি তার চেয়ে তাকে কিছু কম ভালবাসি? কম শ্রদ্ধা করি পরিদা? আমি তো আগেই বললুম যে দিদিভাই নিজেই সে কথাটা আমাকে বলবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু ভগবান সে সুযোগটুকু দিলেন না আমাকে। কিন্তু আজ এই মূহুর্তে সেটা জানা যে আমার খুব দরকার পরিদা। তুমি কি জানো না, সধবা স্ত্রীরা মারা গেলে তাদের সিঁথি সিঁদুরে রাঙিয়ে, ফুল মালা দিয়ে সাজিয়ে তাদের চিতায় ওঠাতে হয়। তুমি চাও না? তোমার মন্তি সধবার চিহ্ন নিয়ে এ পৃথিবীর বুক থেকে চলে যাক? বলো চাও না তুমি সেটা”?
 

পরিতোষ রচনার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “সেটা করা তো আর সম্ভব নয় রে বোন। আমি জানি, মন্তি যাকে নিজের স্বামী বলে মেনে নিয়েছিল সে এখনও বেঁচে আছে। আমিও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি সে আরও একশ’ বছর বেঁচে থাকুক। কিন্তু মন্তিকে তো তুমি আর সকলের চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়ে তার সিঁথিতে সিঁদুর পড়াবার সুযোগ পাবে না রচু। আর সকলের সামনে সেটা করতে গেলে নানা জনে নানা কথা বলতে শুরু করবে। তাতে তো মন্তিকেই অপমান করা হবে। তবে আমি জানি, মন্তির সিঁথিতে তার স্বামীর নামের সিঁদুর এখনও লেগে আছে। কারো চোখে না পড়লেও আমি সে ব্যাপারে নিশ্চিত। ও সব সময় ওর সিঁথিতে সেই সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখত”।
 

রচনা প্রায় স্বগতোক্তির মত করে বলল, “সব সময় সিঁদুরের ছোঁয়া লাগিয়ে রাখতেন দিদিভাই? কিন্তু দিদিভাইকে তো আমি খুব কাছ থেকে খুব ভাল ভাবে দেখেছি। কখনও সিঁদুর তো দুরের কথা সিঁদুরের সামান্য আভাটুকু পর্যন্ত তার সিঁথিতে কখনও দেখিনি আমি”।

পরিতোষও যেন নিজের মনের সাথেই কথা বলছে, এমনভাবে বিড়বিড় করে বলল, “জলের দাগ কি আর কারো চোখে পড়ে অত সহজে”?

বিড়বিড় করে বলা কথাগুলোও রচনা পরিস্কার ভাবেই শুনতে পেল। তাই সে এবার বিস্মিত ভাবে জিজ্ঞেস করল, “জলের দাগ”?

পরিতোষ জল ভরা চোখে রচনার দিকে তাকিয়ে বলল, “মন্তিকে যে তুমি নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতে সে তো আমি জানিই বোন। আজ তুমি যেটা করতে চাইছ সেটা আমিও মনে প্রাণে সমর্থন করি। আমার মনে হয় মন্তির আত্মাও তাতে খুশী হবে। কিন্তু মন্তির কাছে আমি যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যাকে সে নিজের স্বামী বলে মানে, আমি বেঁচে থাকতে তার নাম কখনও কারো কাছে প্রকাশ করব না। তাই মন্তিকে দেওয়া কথা রক্ষা করে তোমার মনের ইচ্ছে পূরণ করবার জন্য আমার পক্ষে শুধু এটুকুই বলা সম্ভব বোন। মন্তির ব্যাগে সব সময় ছোট্ট একটা শিশিতে জল ভরা থাকত। মন্তি রোজ স্নানের পর সেই জলই তার সিঁথিতে ছোঁয়াতো। আমার সামনেও দু’একবার এমন করেছে হায়দ্রাবাদে থাকতে। ওই জলটাই ছিল ওর সেই স্বামীর পা ধোঁয়া জল। সেটাকেই সিঁদুর ভেবে ও নিজের সিঁথিতে ছোঁয়াতো রোজ। এর বেশী আর কিছু তোমাকে বলতে পারব না”।

রচনা পরিতোষের কথা শুনে চমকে উঠে মনে মনে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “আচ্ছা পরিদা, লক্ষ্মীদির খবর কি গো? সে কোথায় আছে? সে কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে? বলো না পরিদা”।

পরিতোষ এবার বলল, “না রচু, লক্ষ্মীদির খবর কিছু জানি না আমি। আসলে আমি আমার ফোন সুইচ অফ করে রেখেছি। রতুর কাছেই যা খবরাখবর আসছে”।

রচনা সাথে সাথে বলল, “ইশ, এতোসব ডামাডোলের ভেতরে লক্ষ্মীদির কথা মনেই পড়েনি আমার। ও পরিদা এখনই দিদিভাইয়ের কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইনে একটা কল করনা গো। আমি এখনই লক্ষ্মীদির সাথে একটু কথা বলতে চাই। লক্ষ্মীদিও তো সেখানে একা আছে। সে দিদিভাইকে খুব ভালবাসত। নাজানি সে একা একা কী করছে”।

পরিতোষ পকেট থেকে ফোন বের করে সুইচ অন করতেই হুড়হুড় করে অনেকগুলো মেসেজ আর মিস কলের ইনর্মেশন এসে ঢুকল। সে’সবের দিকে নজর না দিয়ে পরিতোষ সীমন্তিনীর কোয়ার্টারের ল্যান্ডলাইন নাম্বার ডায়াল করল। দু’তিনবার রিং হতেই ওদিক থেকে কান্না ভেজা গলায় লক্ষ্মী ‘হ্যালো’ বলতেই পরিতোষ রচনাকে ফোন দিতেই রচনা বলল, “লক্ষ্মীদি, আমি তোমার বৌদিমণি বলছি গো”।

এ’কথা শুনেই লক্ষ্মী হাউ মাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও বৌদিমণি গো। এ আমাদের কি সর্বনাশ হল গো। আমাদের কপালে ভগবান এই লিখে রেখেছিলেন? আচ্ছা বৌদিমণি, দিদিমণিকে নাকি শিলিগুড়ি হাসপাতালে নিয়ে গেছে? তুমি কি ওখানেই আছ? আমার যে খুব ইচ্ছে করছে দিদিমণির মুখটা একটুখানি দেখতে গো। কিন্তু কে আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে বল? আমি একাও তো যেতে পারব না। আমি কি
আমার দিদিমণির মুখটা একবারটি শেষ বারের জন্য দেখতেও পাব না, বৌদিমণি”?
 

লক্ষ্মীর কথা শুনে রচনাও কাঁদতে শুরু করল। ওদিক থেকে লক্ষ্মী এক নাগাড়ে কেঁদে কেঁদে বিলাপ করে যাচ্ছে। রচনা বেশ কিছুক্ষণ পর কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি যদি তোমার দিদিমণিকে শেষ দেখা দেখতে চাও তাহলে চট করে তোমার জামা কাপড় কিছু গুছিয়ে নাও। আমি তোমাকে আনবার ব্যবস্থা করছি। আর লক্ষ্মীদি তোমাকে সাথে করে দিদিভাইয়ের একটা জিনিস নিয়ে আসতে হবে গো। সে জিনিসটার এখন খুব দরকার। আমি তোমাকে বলছি। একটু মন দিয়ে শোন। দিদিভাইয়ের ভ্যানিটি ব্যাগটার ভেতরে একটা ছোট্ট জলের শিশি আছে। সেই শিশিটা নিয়ে এস। আর যদি সেটা খুঁজে না পাও, বা তাতে যদি জল না থেকে থাকে, তাহলে ঠাকুরঘরে যে তোমার দিদিমণির দাদাভাইয়ের একটা ছবি দেয়ালে টাঙানো আছে, সে ছবিটার পেছনে দেখবে একটা ছোট্ট তাকের মত আছে। সেই তাকের ওপর একটা জলের বোতল রাখা আছে। সেই বোতলটাকে তোমার সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। নইলে ওই বোতল থেকে ছোট্ট শিশিটাতে কিছুটা জল ঢেলে নিয়ে আসবে। বুঝেছ তো”?

লক্ষ্মী রাজি হতেই রচনা ফোন কেটে দিয়ে পরিতোষকে বলল, “তুমি একটু এখানেই থাকো পরিদা। আমি আসছি এখুনি” বলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। আবার খানিক বাদেই রতীশের হাত ধরে টানতে টানতে ঘরে এসে রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা সোনা, নাগরাকাটা থেকে লক্ষ্মীদিকে যে আনতে হবে এখানে। সেখান থেকে কেউ কি শিলিগুড়ি বা এখানে আসছে”?

রতীশ বলল, “নাগরাকাটা থানার ওসি আর কয়েকজন শিলিগুড়িতে এসেছে জানি। কিন্তু তারা তো কেউ আর এখন শিলিগুড়ি থেকে সেখানে গিয়ে লক্ষ্মীদিকে আর আনতে পারবে না। শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজ থেকে নাগরাকাটার দুরত্ব তো অনেক। প্রায় আশি কিলোমিটারের মত। যেতে আসতে তো প্রায় চার ঘন্টার মত সময় লেগে যাবে”।
 

রচনা সাথে সাথে হাত পেতে বলল, “আমার ফোনটা যে কোথায় রেখেছি মনে পড়ছে না। তুমি নীতাদির নাম্বার লাগিয়ে ফোনটা আমাকে দিয়ে একটু ও’ঘরে গিয়ে দেখ তো আমার ব্যাগটা সেখানে আছে কি না। ব্যাগের ভেতরেই ফোনটা আছে। পেলে একটু এনে দিও প্লীজ”।


______________________________
Like Reply
(Update No. 253)

রতীশ ফোন বের করতেই রচনা পরিতোষকে বলল, “পরিদা, তুমি একটু খবর নিয়ে দেখ না, নাগরাকাটা থানা থেকে আর কেউ এখন শিলিগুড়ি আসবে কি না”।

রতীশের ফোন থেকে নবনীতার নাম্বার ডায়াল করে ফোন কানে লাগাতেই ও’পাশ থেকে নবনীতা ভারী গলায় বলল, “আমরা শিলিগুড়ির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি রতুদা। মনে হয় আর মিনিট পনের কুঁড়ির ভেতরেই মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে যাব”।

রচনা কথা বলতে গিয়ে “নীতাদি আমি ...” বলতেই আবার কেঁদে ফেলল। ওদিকে নবনীতাও “বৌদি” বলে কেঁদে ফেলতেই আরও একজনের কান্নার শব্দ শোনা গেল। রচনার বুঝতে অসুবিধে হল না এটা তার মায়ের কান্না। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাতে সামলাতে রচনা বলল, “নীতাদি, সারা জীবন ধরেই তো আমাদের কাঁদতে হবে গো এখন। কিন্তু এখন যেটা বলছি সেটা শোন। লক্ষ্মীদি একা একা ওখানে কেঁদে মরছে। তার কাছে তো কেউ নেই। তাকে যদি কেউ একজন শিলিগুড়ি নিয়ে আসত তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু নাগরাকাটা থেকে বেশ কয়েকজন নাকি আগেই শিলিগুড়ি চলে এসেছে। তুমি তো ওখানে কিছুদিন ছিলে। এমন কাউকে কি তোমার মনে পড়ে যে এমন সময় আমাদের একটু সাহায্য করতে লক্ষ্মীদিকে শিলিগুড়ি অব্দি পৌঁছে দিতে পারে”?

নবনীতা জবাবে বলল, “ইশ লক্ষ্মীদির কথা তো আমার মাথাতেই আসেনি। তবে জয়া ম্যাম নিজেই খবরটা শুনে আজ ভোরবেলাতেই আমাকে ফোন করেছিলেন। তিনিও তো দিদিকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। বলেছিলেন যে কোন কিছুর প্রয়োজন হলে যেন তাকে জানাই। আমি তার সাথে একটু কথা বলে দেখি। মনে হয় উনি কোন একটা ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করতে পারবেন। আমি এখনই তাকে ফোন করছি। তারপর তোমাদের জানাচ্ছি”।

ততক্ষণে রতীশ রচনার মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকেছে। সেটা দেখে রচনা বলল, “আচ্ছা নীতাদি। মা বাবার শরীর ঠিক আছে তো”?

নবনীতা বলল, “এমন খবর পেয়ে কি আর কেউ ঠিক থাকতে পারে বৌদি। আর তুমি তো ভাল করেই জানো দিদি তাদের কাছে কী ছিল কতখানি ছিল। তাদের সামাল দিতে দিতেই তো আমি হিমশিম খাচ্ছি। তবে মোটামুটি ঠিকই আছেন”।

রচনা এবার বলল, “নীতাদি আরও কয়েকজনকে ফোন করতে হবে গো। তাই রাখছি এখন। তুমি ওই ব্যাপারে কিছু বন্দোবস্ত করতে পারলে আমার নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দিও” বলে ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা রতীশের হাতে ফেরত দিয়ে নিজের ফোনটা নিয়ে বলল, “আচ্ছা শোনো, অনেক দেরী হয়ে গেছে। পরিদা তোমরা এবার বেরিয়ে পড়ো। মনে হয় লক্ষ্মীদিকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত আনবার একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন থেকে ফোন আমার হাতেই রাখছি। প্রয়োজনে আমাকে ফোন কোর তোমরা”।

পরিতোষ বেরিয়ে যেতে রচনা রতীশের হাত ধরে তাকে পেছনে টেনে ধরে কাতর কন্ঠে বলল, “আমার একটা কথা রাখবে সোনা। দিদিভাইকে নিয়ে আসবার সময় তার মাথাটাকে তোমার কোলে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে রেখে তাকে বাড়ি নিয়ে এসো সোনা। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার যেন একটুও কষ্ট না হয়”।

রতীশ মুখে কিছু না বলে মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল। পরিতোষের সাথে শুধু রতীশ ছাড়া বাড়ি থেকে আর কেউ গেল না। বাবা কাকাদের কথায় সতীশ বাড়িতে থেকে গেল।
 

******************

শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নাগরাকাটা থানার ওসি মিঃ সিকদার পরিতোষকে পুরোটা বিস্তারিত ভাবে বলে বোঝাতে জানাল যে নাগরাকাটা সুপারমার্কেটের পাশ দিয়ে তালঝোরা রোড বরাবর উত্তরদিকে গিয়ে নাগরাকাটা চা বাগানকে বাম পাশে রেখে চাম্পাগুড়ি বাজার ডান দিকে রেখে উত্তরাভিমুখে গেলে ২২ কিমি পর তালঝোরা বলে একটা সুন্দর ভিউ পয়েন্ট আছে। তার পর থেকেই বেশ বড়সড় একটা চা বাগানের শুরু, যেটা ভূটান সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। সেই চা বাগানের পাশ দিয়ে গিয়ে ভূটান সীমান্তের ভেতরে ঢুকে সীমান্ত বরাবর উত্তর পশ্চিম অভিমুখে আরও কিছুদুর যাবার পর ঘণ জঙ্গলে ভরা একটা জায়গায় ২০-২৫ জন উগ্রপন্থীর একটা গোপন আস্তানার খবর পেয়ে সীমন্তিনী একদল পুলিশ নিয়ে সেখানে রেইড করতে গিয়েছিল। সে জায়গাটা নাগরাকাটা থেকে প্রায় ৩৩ কিমি দুরে। ওই পথের শেষ চার কিমি পথ ভূটানের অন্তর্গত ছিল। তাই ভূটান পুলিশের সাথেও যোগাযোগ রাখা হয়েছিল।

উল্টোদিকে গৈরিবাস পুলিশ ক্যাম্প থেকেও তিনটে গাড়িতে ২০ জন সশস্ত্র পুলিশ আসবার কথা ছিল। আবার সীমান্তবর্তী অঞ্চলের ভূটান পুলিশের একটা দলও সেখানে আসবার কথা ছিল। গৈরিবাস থেকে সোজাসুজি সে জায়গাটার দুরত্ব মাত্র ৯-১০ কিমি হলেও সেদিক দিয়ে কোনও সড়ক যোগাযোগ নেই। তাই সেখান থেকে ওই স্পটে আসতে সড়কপথে অনেকটা ঘুরে প্রায় ৪১ কিমি দুরত্ব অতিক্রম করতে হয়। গাড়িতে আসতে প্রায় দেড় ঘন্টার মত সময় লাগে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ক্রমে পাহাড়ে নানা জায়গায় ধ্বস নামবার ফলে দু’দিকেই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবার দরুন ভূটান পুলিশ বা গৈরিবাসের পুলিশ দল কেউই আর সেখানে পৌঁছোতে পারেনি।
 

চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার আর ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে উগ্রপন্থীদের আস্তানা খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসবার পথে ৩ কিমি আসবার পরেই একটা ৯০ ডিগ্রী ব্লাইণ্ড কর্নারে আসতেই তারা দুর্ঘটণার মুখে পড়ে। ওই জায়গাটা থেকে নাগরাকাটার দুরত্ব ছিল ৩০ কিমি। সীমন্তিনীর সঙ্গে ৩টে গাড়িতে ২০ জন সশস্ত্র পুলিশ ছিল। সীমন্তিনীর সাথে একই গাড়িতে অন্য পাঁচজনের মধ্যে নতুন কাজে যোগ দিতে আসা সীমন্তিনীর পরিবর্ত বিশাল কুলকার্নীও ছিল। তারা ছিল মাঝের গাড়িটাতে। ওই জায়গাটায় প্রথম গাড়িটা ওই মোড়টা পেরিয়ে গেছে, সীমন্তিনীর গাড়িটা ঠিক মোড়ের কোনে, আর পেছনের গাড়িটা তখনও মোড়ের অন্যপাশে মোড় থেকে কিছুটা দুরে। ঠিক তখনই তাদের মনে হয়েছিল খুব জোরে পরপর দু’বার মেঘ গর্জে উঠল যেন। সঠিক ভাবে কিছু বুঝে উঠবার আগেই সীমন্তিনীর সামনের গাড়িটা যেন বাঁ পাশে গভীর খাঁদের দিকে ঢলে পড়ল। আর রাস্তা সমেত ডানদিকের পাহাড়ের বিশাল একটা অংশ একই সাথে ধ্বসে পড়েছিল বাঁদিকে। সীমন্তিনীর গাড়ির ড্রাইভার রামসিং ব্রেক কষে গাড়ি থামাতেই সকলে অবাক চোখে দেখল পেছনেও একই রকমের একটা ধ্বস নেমে এসেছে। তবে সেটা আগের ধ্বসটার মত অতটা বিশাল ছিল না। কিন্তু পেছনের গাড়ীটাও সেই ধ্বসের ধাক্কায় রাস্তা থেকে বাঁদিকে অনেকটাই নিচে নেমে গিয়েছিল। তবে সেখানে বাঁদিকে খাঁদটা খুব বেশী গভীর ছিলনা বলেই গাড়িটা বেশীদুর গড়িয়ে যায়নি। কিন্তু একই সাথে সামনে এবং পেছনে ডানদিকে অন্ধকার পাহাড়ের ওপর থেকে একনাগাড়ে গুলী আর গ্রেনেড নিক্ষেপ হতে শুরু করেছিল। প্রথম গাড়িটা তো ধ্বসের নিচে পুরোপুরি ভাবেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। দু’ একজন গাড়ি থেকে ছিটকে পড়লেও ধ্বসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তারাও ধ্বসের নিচেই চাপা পড়ে গিয়েছিল। উগ্রবাদীরা হামলা করেছে বুঝতে পেরেই পেছনের গাড়ির কয়েকজন আর সীমন্তিনীর গাড়িতে যারা ছিল, তারা রিটালিয়েট করতে শুরু করে দিয়েছিল। কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে নিচে থেকে পাহাড়ের ওপরে লুকিয়ে থাকা দুষ্কৃতীদের বাগে আনা সহজ কথা নয়। আর পর্যাপ্ত লোক আর অস্ত্রশস্ত্রও ছিল না তখন সঙ্গে। তিনটে টিমের মধ্যে দুটো টিম তো আসতেই পারেনি। আর সীমন্তিনীর দলেরও আট দশজন ততক্ষণে মাটির তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। তাই খুব বেশী কিছু করবার ক্ষমতাও তাদের ছিল না। ওদিকে একের পর এক গ্রেনেডের বিস্ফোরণে অনবরতঃ ছোট খাটো ধ্বস নেমে আসছিল ওপর থেকে। সীমন্তিনীর পায়ে আর কাঁধে তিনটে গুলি লেগেছিল। এছাড়াও গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের আঘাতে তার শরীরের অনেক জায়গায় ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে’সব দিকে তার তখন বোধহয় হুঁশ ছিল না। সে নির্ভীক যোদ্ধার মত লড়ে যাচ্ছিল। প্রায় আধ ঘন্টার মত সংঘর্ষের পর পাহাড়ের ওপর থেকে আর গোলাগুলির সাড়া শব্দ না পেয়ে অন্ধকারে চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পরিস্থিতিটা বুঝতে চেষ্টা করতেই সীমন্তিনীদের গাড়িটার ঠিক নিচেই একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল। খুব সম্ভবতঃ সেটা বোধহয় ল্যান্ড মাইনের বিস্ফোরণ ছিল। আর সেই বিস্ফোরণের ধাক্কায় সীমন্তিনী বাঁপাশে অন্ধকার খাঁদের মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। আর তার ওপর পড়েছিল তাদের গাড়ি সহ আরও কয়েকটা দেহ। গাড়িটা অবশ্য সীমন্তিনীর শরীরের ওপর দিয়েই গড়িয়ে খাঁদের আরো নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু রাস্তা আর রাস্তার ওপর থেকে পাহাড় এমন ভাবে ভেঙে পড়ল যে সীমন্তিনী সে ধ্বসের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল। সীমন্তিনীর দেহে তিনটে গুলি লাগলেও ময়না তদন্তে বলা হয়েছে শ্বাস রোধ হবার ফলেই তার মৃত্যু হয়েছে। সীমন্তিনীর কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেবার জন্য যে বিশাল কুলকার্নী এসেছিল, সে-ও ওই দুর্ঘটণায় নিহত হয়েছে। তবে সে গুলির আঘাতেই মারা গেছে। আর তার বডিটা পাওয়া গেছে খাঁদের অনেক নিচে মাটির তলায় গাড়ির নিচে চাপা পড়ে থাকা অবস্থায়। সামনের গাড়িতে যে সাতজন ছিল তারা সকলেই মাটির তলায় চাপা পড়ে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে প্রাণ হারিয়েছে। পেছনের গাড়িটার একজন বেশ ভালরকম আহত হলেও সে ঘটণার পর কোনও রকমে সে খাঁদ থেকে উঠে প্রায় এক কিলো মিটার দুরে ওই চা বাগানে গিয়ে পৌঁছোতে পেরেছিল। সে-ই ওই বাগানের ফোন থেকে থানার ল্যান্ডলাইন ফোনে ফোন করে দুর্ঘটণার খবরটা জানিয়েছিল। তার মুখেই পুরো ঘটণাটার বিবরণটা জানা গেছে। পেছনের গাড়ির আরও তিনজনকে গুরুতর আহত এবং প্রায় মৃতপ্রায় অবস্থায় সকালে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। তারা এখন মেডিক্যাল কলেজেই চিকিৎসাধীন আছে। পুলিশ টিমের ওই চারজনই শুধু জীবিতাবস্থায় ফিরে এসেছে। সীমন্তিনীদের গাড়িতে যে ছ’জন ছিল, তাদের কাউকেই জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায় নি।

রাত বারোটা নাগাদ নাগরাকাটা থানা খবর পেলেও দুর্গতদের সাহায্যের জন্য তারা তেমন কিছুই প্রায় করে উঠতে পারে নি। ওই অঞ্চলে মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। তিনটে গাড়িতে তিনটে স্যাটেলাইট ফোন থাকলেও তাতে যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। একটানা ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফলে বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ঘাট ধ্বসে যাবার ফলে সড়ক পথেও কোন রেসকিউ টিম পাঠানো সম্ভব হয়নি। আর্মির দুটো হেলিকপ্টার রাত প্রায় দুটো নাগাদ দুর্ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছলেও ওই অন্ধকার ঘণ জঙ্গলের মধ্যে ধ্বসে যাওয়া পাহাড়ে পাইলটরা কপ্টারগুলো ল্যান্ড করতে পারেনি। ওই চা বাগানে গিয়ে তারা অপেক্ষা করছিল। ভোরের আলো ফুটে উঠবার সাথে সাথেই কপ্টারদুটো ওই জায়গায় গিয়ে কয়েকজনকে সিঁড়ির সাহায্যে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে এসেছিল ওই বাগানে। ঘন্টা তিনেকের পরিশ্রমে কপ্টার নামবার মত টেম্পোরারি একটা উপযোগী জায়গা তৈরী হতেই তারা উদ্ধার কার্য শুরু করেছিল। সকাল আটটার মধ্যেই জীবিত এবং মৃত অবস্থায় যাদের পাওয়া গিয়েছিল তাদের সকলকেই শিলিগুড়ি মেডিক্যাল কলেজে নিয়ে আসা হয়েছিল। গাড়িগুলো এখনও সেখানেই পড়ে আছে। আর এমন সম্ভাবনাও আছে যে ধ্বসের ভেতরে আরও কোনও উগ্রপন্থীর বডি হয়ত পাওয়া যেতে পারে। তবে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু না হওয়া অব্দি সেখানে আর কোনও ভাবে তল্লাশী করা বোধহয় সম্ভব হবে না। তবে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ সে বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করছে।

সকালে আর্মির হেলিকপ্টারের সাহায্যে দুর্ঘটণাস্থল থেকে সব মিলিয়ে মোট চল্লিশ জনের ডেডবডি আর গুরুতর আহত তিনজন পুলিশকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। আর আগে বাগানে পৌঁছে যাওয়া ওই আহত পুলিশটিকেও কপ্টারেই তুলে আনা হয়েছিল। এই চল্লিশ জনের মধ্যে ড্রাইভার তিনজন সহ পুলিশ টিমের মোট ঊণিশ জনের প্রাণ গেছে। বাকি একুশটা বডি উগ্রপন্থীদের বলে সনাক্ত করা হয়েছে। এই একুশ জনের মধ্যে ন’জন মাটির তলায় চাপা পড়ে মারা গেছে। আর বাকি বারো জনের প্রাণ গেছে গুলির আঘাতে। আর এই সব কটা গুলিই সীমন্তিনী ম্যাডামের রিভলভারের।
 

ডেডবডি আনতে আনতে বেলা দুটো বেজে গেল। সারা রাজগঞ্জ শহর তখন লোকে লোকারন্য। ছোট্ট শহরটাতে মানুষের ভিড় তখন আরও বেড়েছে। শহরটার প্রতিটা রাস্তা প্রতিটা গলিতেই শুধু মানুষ আর মানুষ। জায়গায় জায়গায় লোকের হাতে নানা ধরণের ব্যানার, পোস্টার আর সীমন্তিনীর ছবি।
 
“সীমন্তিনী- তুমি আমাদের গর্ব”,
 
“সীমন্তিনী- আমরা তোমায় ভুলব না”,
 
“সীমন্তিনীর মত সাহসিনী বীরাঙ্গনা প্রতিটা ঘরে জন্ম নিক”,
 
“মৃত্যু নয়, তুমি অমর হয়ে আমাদের সকলের মাঝে বেঁচে থাকবে সীমন্তিনী”,
 
“সীমন্তিনী- তুমি এ শহরের গর্ব, এ দেশের গর্ব”,
“অমর শহীদ সীমন্তিনীকে সশ্রদ্ধ প্রণাম”,
 
এমন নানা ধরণের বড় বড় ব্যানার, ছবি আর শ্লোগান দেখতে পাওয়া গেল। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিটি লোকের হাতে সীমন্তিনীর ছবি দেখা গেল।

কয়েকটা গাড়ি মিছিল করে রাজগঞ্জের সীমানায় ঢুকতেই রাস্তার দু’পাশের জনতা সমবেত কণ্ঠে চিৎকার করে সীমন্তিনীর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল। সমস্ত লোক দু’হাত তুলে কাঁদতে কাঁদতে সীমন্তিনীকে তাদের শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ জানাতে শুরু করল।
 

সীমন্তিনীকে নিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্সে রতীশ, কিংশুক আর পরিতোষ ছিল। পুলিশের অনুরোধ সত্বেও হাসপাতালের স্ট্রেচারে সীমন্তিনীকে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়নি। স্ট্রেচার এসেছিল শুধু সীমন্তিনীকে অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত পৌঁছে দিতে। রতীশ, পরিতোষ আর কিংশুকের কোলের ওপর তুলে দেওয়া হয়েছিল সীমন্তিনীর নিথর দেহটাকে। রতীশ পরম যত্নে সীমন্তিনীর মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর রেখে অনিমেষ নয়নে তার মুখের দিকে চেয়ে বসে বসে এসেছে প্রায় গোটা রাস্তাটাই। ছোটবেলা থেকে সীমন্তিনীর হাজারো স্মৃতি সে রোমন্থন করে যাচ্ছিল। আর দু’চোখ থেকে অবিরত জলের ধারা বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছিল সীমন্তিনীর মাথায় আর মুখে। পরিতোষ সীমন্তিনীর দেহের মধ্যভাগটাকে নিজের কোলে নিয়ে বসেছিল। আর কিংশুক তার আদরের দিদিভাইয়ের পা দুটো নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে আকুল নয়নে কেঁদে যাচ্ছিল। আর বার বার সীমন্তিনীর হিম শীতল পায়ের পাতায় মাঝে মাঝে চুমু খাচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের আগে পুলিশের একটা গাড়ি। তাতে রাজগঞ্জ থানার পুলিশেরা আছে। আর তারও আগে আরেকটা পুলিশের গাড়ি সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলেছে। পরিতোষের ভাড়া করা অজিতের ট্যাক্সিটা অ্যাম্বুলেন্সের ঠিক পেছনে ছিল। তাতে বসে ছিল লক্ষ্মী, অধিকারীবাবুরা দুই ভাই আর জয়া বসাক। তার পেছনের একটা গাড়িতে নবনীতা বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে নিয়ে বসেছিল। তার পেছনের দুটো গাড়িতে মহিমা, বীথিকা, ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া, তার স্ত্রী দীপা, মেয়ে আকাঙ্ক্ষা, প্রীতি আর আব্দুল। তারপরের দুটো গাড়িতে শ্যামলেন্দু, বিমলেন্দু, অমলেন্দুরা আর তাদের স্ত্রীরা এসেছেন। তার পেছনে আরও দুটো পুলিশের গাড়ি। তাতে এসপি, ডিএসপি সহ জেলা স্তরের আরও কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারেরা এসেছেন জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার থেকে। এতগুলো গাড়ির মিছিল যত এগোচ্ছিল রাস্তার দু’পাশের জনতার মধ্যে সীমন্তিনীর জয় জয়কারের ধ্বণি যেন ততই বাড়তে শুরু করছিল।
 

বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামতেই বাড়ির প্রায় সকলেই গেটের সামনে ছুটে এল। ওই ভিড়ের মধ্যে ছুটে আসতে গিয়েই সরলাদেবী আর সীমাদেবী আবার জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন। অন্যেরা ধরাধরি করে তাদের ঘরে নিয়ে যাবার পর ডাক্তার নার্সরা তাদের উপচার শুরু করল। সবগুলো গাড়ি থেকে সকলে নেমে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভেতর ছুটতে লাগল। পুলিশের লোকেরা অনেক কষ্টে ভিড় সরিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে এসপি সাহেবকে রতিকান্তবাবুদের সামনে এনে দাঁড় করাল।

এসপি সাহেব রতিকান্তবাবুকে সমবেদনা জানিয়ে বললেন, “আপনাদের সমবেদনা জানাবার ভাষাও এই মূহুর্তে আমার মুখে আসছে না। সীমন্তিনীর মত এমন দক্ষ মেয়ে আইপিএস অফিসার আমি আমার জীবনে আর দ্বিতীয়টি দেখিনি। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিস্থিতিতে একটা ট্র্যাপে পড়ে গিয়ে ওকে এভাবে প্রাণটা হারাতে হল। এমনটা আমরা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি কখনও। তবে, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। এখন আমাদের ওপরে আদেশ আছে যে সীমন্তিনী ভট্টচার্যিকে যথাযথ রাষ্ট্রীয় মর্য্যাদা দিয়ে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করবার। তাই এখানকার কলেজের শিক্ষকদের অনুরোধে সেই কলেজের মাঠেই তাকে রাষ্ট্রীয় শ্রদ্ধাঞ্জলী দেওয়া হবে। তারপর সেখান থেকে তার মরদেহ আপনারা শ্মশানে নিয়ে যেতে পারবেন। আমরাও শেষ পর্যন্ত আপনাদের সাথেই থাকব। তবে যা শুনছি তাতে মনে হয় কলেজের মাঠে ওনাকে বেশ কিছুক্ষণ রাখতে হবে। অনেকগুলো স্থানীয় সরকারী বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে দলে দলে লোক সীমন্তিনীকে শেষ অভিবাদন জানাতে ইতিমধ্যেই কলেজের মাঠে গিয়ে হাজির হয়েছে। সেখানেই তাকে আমাদের ডিপার্টমেন্টের তরফ থেকে গান স্যালিউট দেওয়া হবে। তাই বলছিলাম, আপনাদের বাড়িতে যা কিছু করণীয় সে’সব একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পারলে ভাল হত”।

রতিকান্তবাবু মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের সম্মতি জানালেন। বাড়ির ভেতরে তখন আরেক প্রস্থ কান্নার রোল শুরু হয়েছে। আর তার তীব্রতা যেন এখন আগের থেকেও অনেক বেশী। ছেলেকে ছোটমার কোলে রেখে রচনা লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিল। বাড়ির ভেতর প্রত্যেকটা লোক তখন পাগলের মত করে কাঁদছে। এমন সময় সীমন্তিনীর দেহটাকে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর থেকে বের করতেই হঠাতই বাইরে থেকে তুমুল সমবেত কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। মনে হল আকাশে বাতাসে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ছে। আর প্রায় সাথে সাথেই অনেকগুলো পুলিশ ঠেলাঠেলি করে লোকজনদের সরিয়ে দিতে দিতে সীমন্তিনীর দেহটাকে বাড়ির ভেতর এনে ঢোকাতে লাগল। রতীশ, সতীশ, সূর্য্য, কিংশুক আর পরিতোষ মিলে ধরাধরি করে সীমন্তিনীর দেহটাকে উঠোনের তুলসীতলায় আগে থেকে পাতা একটা বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। সাথে সাথে রচনা, অর্চনা, চন্দু আর নবনীতা সীমন্তিনীর দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে অবাধে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। পাশের ঘরের দড়জার সামনে দাঁড়ানো চন্দ্রাদেবীর পায়ের জোর যেন কমে আসছিল। রচনার ছেলেকে দু’হাতে প্রাণপণে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁপতে কাঁপতে সেখানেই বসে পড়লেন তিনি। বাইরের পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে তখন অনেক লোক বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়েছে। বেশীর ভাগই পরিবারের লোকদের মতই হাউ হাউ করে কাঁদছে, কেউ কেউ হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।
 

কিছুক্ষণ বাদে একদিক থেকে সরলাদেবী পাগলের মত আলুথালু বেশে ছুটে এসে সীমন্তিনীর দেহের ওপর আছড়ে পড়লেন। ওদিকে অন্তঃসত্বা অর্চনা সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা শরীরের ওপরেই অজ্ঞান হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। সাথে সাথেই দু’জন নার্স ছুটে এসে অন্য কয়েকজনের সাহায্যে অর্চনাকে তুলে নিয়ে একটা ঘরের দিকে চলে গেল। বাড়ির এবং বাড়ির আশেপাশের আকাশ বাতাস সমবেত কান্নার স্বরে ভরে উঠল। তখন কে আর কাকে প্রবোধ দেয়, কে আর কাকে সামলায়। এভাবে প্রায় মিনিট কুড়ি পেরিয়ে যাবার পর কিছু পুলিশ ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে সীমন্তিনীর দেহের খুব কাছে দাঁড়ানো ভিড়কে কিছুটা পেছনে সরিয়ে দিল। কয়েকজন মেয়ে পুলিশ এসে সীমন্তিনীর দেহের ওপর পড়ে কাঁদতে থাকা মেয়ে মহিলাদের প্রবোধ দিতে দিতে টেনে ওঠালো।

এক পুলিশ অফিসার বলল, “শুনুন। আপনারা একটু বোঝবার চেষ্টা করুন। এভাবেই এসব চলতে থাকলে তো দাহ করতে করতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। তাই আপনারা এখানে যা কিছু করণীয় আছে তা একটু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলুন। আমরা কিন্তু আর আধঘণ্টা বাদেই ম্যাডামের মরদেহ নিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলী দেবার জায়গায় নিয়ে যাব”।

কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে পেতেই অর্চনা পাগলীর মত ঘরের ভেতর থেকে ছুটে এসে আবার সীমন্তিনীর শরীরের ওপর পড়ে ‘দিদিভাই দিদিভাই’ বলে কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু তখন তার গলা দিয়ে আর এক ফোঁটা স্বরও বেরোচ্ছিল না। রচনা নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে লক্ষ্মীর কাছ থেকে ছোট্ট জলের শিশিটা হাতে নিয়ে অর্চনাকে টেনে তুলে বলল, “যা দিদি, আমাদের দিদিভাইকে শেষবারের মত একটু সাজিয়ে দে” বলেই আবার কেঁদে ফেলল।

______________________________
Like Reply
(Update No. 254)

তুলসীতলার কাছেই আগে থেকেই একটা ডালিতে ফুল, মালা, মিষ্টির প্লেট আর জলের গ্লাস সাজিয়ে রাখা ছিল। অর্চনা কাঁদতে কাঁদতে সেই ডালিটা কাছে টেনে নিয়ে সীমন্তিনীর পাশে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে তার মুখমন্ডল সাজাতে শুরু করল। চারপাশে কান্নার রোল সমান ভাবেই চলছে তখনও। চন্দনের ফোঁটার পর রজনীগন্ধা আর গাদা ফুলের মালা পড়িয়ে দেবার পর অনেকগুলো ধূপকাঠি জ্বালিয়ে দিয়ে প্লেট থেকে একটা মিষ্টির টুকরো নিয়ে সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে সে আরেকবার কেঁদে উঠল। তারপর জলের গ্লাসটা সীমন্তিনীর ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিতেই রচনা হাতের ঈশারায় রতীশকে কাছে ডেকে নিল। রতীশ কাছে আসতে তাকে সীমন্তিনীর দেহের একপাশে বসিয়ে রচনা অন্যপাশে গিয়ে সেই ছোট্ট শিশিটা থেকে কিছুটা জল নিজের ডানহাতের তালুতে ঢেলে রতীশের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “তোমার আঙুলের ডগায় করে এখান থেকে জল নিয়ে দিদিভাইয়ের সিঁথিতে লাগিয়ে দাও সোনা। তিনবার দেবে এভাবে”।

রতীশ একটু অবাক হয়ে রচনার দিকে চাইতে রচনা বলল, “দেরী কোর না সোনা। তোমার মন্তিকে তুমি শেষ আশীর্বাদটুকু করবে না? এটা না করলে যে আমার দিদিভাইয়ের আত্মার শান্তি হবে না”।

রতীশ আর কিছু না বলে তিনবার ডানহাতের আঙুলের ডগায় রচনার হাতের তালু থেকে জল নিয়ে সীমন্তিনীর সিঁথিতে ঘসে দিল। তারপর রতীশ সরে যেতেই রচনা তার হাতের তালুর বাকি জলটুকু সীমন্তিনীর মাথার চুলে মাখিয়ে দিয়ে তার ঠোঁটে মিষ্টি আর জল ছুঁইয়ে মৃতদেহের দু’গালে অনেকগুলো চুমু খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে উঠে সেখান থেকে একদিকে ছুটে গেল। এর পর একে একে পরিতোষ, সতীশ, সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা, কিংশুক, অর্চনা, লক্ষ্মী, নবনীতা সীমন্তিনীর মরদেহকে প্রণাম করল। তারপর বাড়ির বড়রাও কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে তাদের নিজেদের করণীয় সারলেন।
 

রচনা চন্দ্রাদেবীর কোল থেকে নিজের ছেলেকে নিয়ে ছেলেকে লক্ষ্মীর কোলে দিয়ে চন্দ্রাদেবীকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলল, “চলো ছোটমা, দিদিভাইকে আশীর্বাদ করবে না? আর মেজমা কোথায় গো? তাকে তো দেখছি না”?

চন্দ্রাদেবী ক্লান্তভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “মেজদি তো আবার অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল তো”।
 

কাছে নবনীতাকে দেখতে পেয়ে রচনা তাকে বলল, “নীতাদি, ছোটমাকে একটু ধরে দিদিভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও না। আমি মেজমাকে নিয়ে আসছি”।

পাশের একটা ঘরে গিয়ে দেখে সীমাদেবী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। একজন নার্সও তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রচনা খাটের ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমাদেবীর মুখের সামনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “আজকের এমন দিনেও তুমি দিদিভাইয়ের ওপর রাগ করে থাকবে মেজমা। তিনি তো এখন আমাদের সকলের রাগ ভালবাসার ঊর্ধে চলে গেছেন গো। এ সময়েও তিনি তার মায়ের হাতের একটু ছোঁয়া পাবেন না”?

সীমাদেবী মাথাটা একটু তুলে রচনার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও বললেন না। তার ঠোঁট দুটো তিরতির করে কাঁপল খানিকটা।

রচনা তাকে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আজ এই দিনেও তুমি মেয়ের ওপর অভিমান করে থাকবে মেজ মা? তাহলে যে দিদিভাইয়ের আত্মা কষ্ট পাবে গো। এসো, আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি। ওদিকে সকলে দিদিভাইকে নিয়ে যাবার জন্য তাড়া দিচ্ছে যে”।

রচনা ক্রন্দনরতা সীমাদেবীকে ধরে খুব ধীরে ধীরে তুলসীতলায় নিয়ে এল। সীমাদেবী থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে হাঁটু ভেঙে বসে সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা গালে সামান্য হাত ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। রচনা তাড়াতাড়ি সীমাদেবীর হাতটা সীমন্তিনীর মাথায় ছুঁইয়ে আশপাশ থেকে সাহায্য চাইতেই কয়েকজন ধরাধরি করে আবার সীমাদেবীকে ঘরে নিয়ে গেল।

কালচিনি, নাগরাকাটা আর আলিপুরদুয়ার থেকে যারা এসেছিলেন তারাও সীমন্তিনীকে প্রণাম ও আশীর্বাদ করলেন। বিধুবাবু আর বিভাদেবী যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। ভোরবেলা থেকে কাঁদতে কাঁদতে তাদের শরীরের শেষ শক্তিবিন্দুটুকুও বুঝি বেরিয়ে গেছে। কোনমতে অন্যের সাহায্যে টলমল পায়ে এসে তারা সীমন্তিনীর কপালে আর মাথায় চুমু দিয়ে শেষবারের মত তাদের ‘মা অন্নপূর্ণা’কে আদর করলেন। তারপর কিংশুক এগিয়ে আসতেই রচনা ভাইকে টেনে সীমন্তিনীর মুখের সামনে বসিয়ে দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “নে ভাই, আমাদের দিদিভাইকে শেষ বারের মত একটু আদর করে দে”।

কিংশুক আপ্রাণ চেষ্টায় নিজের কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে সীমন্তিনীর মুখটাকে দু’হাতের অঞ্জলীতে ধরে কয়েক মুহূর্ত অপলক নয়নে তার আদরের দিদিভাইয়ের মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে তার পায়ের দিকে সরে যেতে লাগল। একেবারে সীমন্তিনীর পায়ের তলায় এসে কিংশুক নিজের পকেটে হাত দিয়ে কিছু একটা বের করে সীমন্তিনীর হিম শীতল পায়ের তলায় ছোঁয়াতে লাগল। রচনা সেদিকে চেয়েই বুঝতে পারল, এটা সেই ক্যাডবেরি চকলেটের মোড়কটা, যেটা দিদিভাই প্রথম দিন কালচিনির বাড়িতে গিয়ে ভাইকে খেতে দিয়েছিল। এটা বুঝতে পেরেই রচনা কিংশুককে জড়িয়ে ধরে আবার চিৎকার করে কেঁদে উঠল। এবার আর কিংশুক নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। সীমন্তিনীর ঠাণ্ডা পা দুটোর ওপর নিজের মুখ চেপে ধরে হাউ হাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কেউ একজন তাকে উঠিয়ে নেবার চেষ্টা করতেই কিংশুক সীমন্তিনীর পা দুটোকে দু’হাতে শক্ত করে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে লাগল। এক সময় রচনাই ভাইকে টেনে উঠিয়ে তাকে বুকে চেপে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে সরিয়ে আনল।

গাড়ির ড্রাইভার ওই অজিত বলে ছেলেটা আর বেশ কিছু বাইরের লোক, যারা পুলিশের ব্যারিকেড এড়িয়ে ভেতরে এসে ঢুকেছিল তারাও কয়েকজন সীমন্তিনীকে প্রণাম করবার পর বাকিরা সীমন্তিনীর দেহের কাছে যেতে চাইলেও পুলিশ তাদের বাঁধা দিল।
 

সীমন্তিনী ছোটবেলা থেকে যে কলেজে মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল, সেই কলেজের বিশাল মাঠে উঁচু করে বানানো একটা মঞ্চে যখন সীমন্তিনীর মৃতদেহ এনে রাখা হল, তখন বিকেল প্রায় চারটে। স্থানীয় এমএলএ, এমপি, সরকারী উচ্চপদস্থ আধিকারিক, পুলিশ প্রশাসন, বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, মহিলা সমিতি, এনসিসি, এনজিও, বাস লরি ট্যাক্সি অটো এসোসিয়েশন, রিক্সা এসোসিয়েশন, বিভিন্ন কলেজ কলেজের ছাত্র ছাত্রী এবং সুবিশাল জনসমাবেশের উপস্থিতিতে সীমন্তিনীর মৃতদেহের ওপর দেশের জাতীয় পতাকা বিছিয়ে দেওয়া হল। আকাশ বাতাস তখন সীমন্তিনীর জয়ধ্বনিতে মুখরিত। সেই শব্দ ছাপিয়ে এক সময় পুলিশের ব্যান্ড বেজে উঠল। একুশ জন বন্দুকধারী আকাশের দিকে মুখ করে একুশবার গুলি ছুঁড়ে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাল। তারপর বিশাল জনতা সার বেঁধে মঞ্চে উঠে সীমন্তিনীকে পুষ্পার্ঘ্য দিল। সুবিশাল ভিড়কে আয়ত্ত্বে রাখতে মাইকে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে নানারকম নির্দেশ বাণী প্রচার করা হচ্ছিল।

সন্ধ্যে প্রায় ছ’টা নাগাদ পুলিশের সাহায্যে সীমন্তিনীর মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে আসা হল। মুখাগ্নি করবার আগে রতীশ শেষবারের মত সীমন্তিনীর কপালে বিদায় চুম্বন একে দিল।


*****************
______________________________
 
Like Reply
(Update No. 255)

অজিত বয়স্কা তিন মহিলাকে প্রণাম করবার পর উঠোনের এক পাশে তুলসী তলায় এসে একটা জায়গায় হাঁটু গেঁড়ে বসে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করে উঠে বসতেই রতীশ আর রচনা দু’জনেই তার দিকে অবাক চোখে চাইতে সীমাদেবী রচনার ছেলেকে কোলে তুলে বললেন, “ওকে দেখে অবাক হচ্ছ বড়বৌমা? প্রথম দিন ওকে আমাদের বাড়িতে দেখে আমরাও এমনই অবাক হয়েছিলুম। মন্তি চলে যাবার পর থেকে ও যেদিনই রাজগঞ্জে আসে সেদিনই আমাদের বাড়ি এসে তুলসীতলার পাশে ঠিক ওই জায়গাটায় একটা প্রণাম না করে ও রাজগঞ্জ ছেড়ে যায় না” বলে অজিতের উদ্দেশ্যে বললেন, “অজিত, তুমি ওই বারান্দার চেয়ারটাতে বসো বাবা। একটু চা খেয়ে যেও। আর মনে রেখো, বাড়ির কর্তারা কিন্তু সকলেই তোমার ওপর সমস্ত দায়ভাড় ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে আছেন। বড়খোকা তো এই মাত্র এল।”।

অজিতের মুখের হাসিটা যেন হঠাতই মিলিয়ে গেল। শুকনো মুখে সে জবাব দিল, “না মেজমা ভুলব না। বড়বাবু, মেজোবাবুরা তো সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছেন আমাকে আগেই। বাড়িতে ঢোকবার আগেই তো দেখে এলাম, প্যান্ডেলের স্ট্রাকচার হয়ে গেছে। প্যান্ডেলের বাকি যেটুকু কাজ আছে তা তো একবেলাতেই শেষ করে ফেলবে ওরা। তবু যাবার সময় ওদের আরেকটু ভাল করে বুঝিয়ে দিয়ে যাব। আর এদিকের কাজটার জন্যেও কাল সকালেই লোক চলে আসবে। আর বড়দাও তো এসে গেছেন। কাল সকালে আমি দুটো গাড়ি নিয়ে চলে আসব। আসবার সময় পরিতোষ স্যারদের আমার গাড়িতেই নিয়ে আসব। তারপরই কোমড় বেঁধে লেগে পড়ব কাজে”।
 

চন্দু রচনার হাত ধরে তাকে একটা ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “বৌমণি, এসো ঘরে এসো”।

রচনা চন্দ্রিকাকে নিয়ে ঘরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করল, “চন্দু, তোমার মেজদা মেজোবৌমণির তো আজই আসবার কথা। ওনারা কখন আসছেন, কিছু শুনেছ”?
 

চন্দ্রিকা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জবাব দিল, “মেজোবৌমণি নয় বৌমণি। আমার বৌমণি শুধু তুমি। উনি শুধু আমার মেজোবৌদি। তবে মেজদা আর মেজবৌদি আজ রাতে আসবেন”।

অজিতের পাশে একটা চেয়ারে রতীশ বসতেই অজিত তাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বড়দা, দিদি তো আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন গত বছর ২১শে আগস্ট। তার বছর পূর্তি তো ২১ তারিখেই হওয়া উচিৎ। তাহলে তার বাৎসরিকীর এ অনুষ্ঠানটা ১৪ তারিখে করা হচ্ছে কেন”?

এমন সময় বাড়ির রান্নার লোক মমতাদি এসে রতীশ আর অজিতের হাতে খাবারের প্লেট গেল। রতীশ হাত মুখ না ধুয়ে খাবে না বলাতে মমতা অজিতের হাতে একটা প্লেট দিয়ে চলে যেতে রতীশ বলল, “তারিখ হিসেবে ধরলে তো সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল ভাই। কিন্তু বাৎসরিক শ্রাদ্ধটা তিথি মিলিয়ে করতে হয় তো। তিথি মিলিয়ে ঠাকুর মশাইয়ের বিধান হিসেবে ১৪ তারিখেই সেটা করা হচ্ছে”।

সেদিন রাতে গঙ্গারামপুর থেকে সতীশ আর তার স্ত্রী দেবাংশী এসে পৌছালো। সতীশ সেখানেই একটা ব্যাঙ্কে চাকরী করে। বিয়ের পর তার স্ত্রীকে নিয়ে সে সেখানেই থাকে। পরদিন সকালে প্রথমেই এল মহিমা, বীথিকা, পরিতোষ, অর্চনা আর তাদের ছ’মাসের ছেলে প্রত্যুষ। তাদের সঙ্গে আব্দুলের স্ত্রী প্রীতি আর ডক্টর দিব্যেন্দুর স্ত্রী দীপাও এল। দীপার মেয়ে আকাঙ্ক্ষা তখন একটা কোচিং নিতে দিল্লীতে ছিল বলে তার আসা সম্ভব হয়নি। সেজন্যে তার মন খুব খারাপ। দুপুরের আগে আগেই আলিপুরদুয়ার থেকে সুলোচনা, শ্যামলেন্দু, দেবিকা, অমলেন্দু আর কালচিনি থেকে বিধুবাবু, বিভাদেবী আর নবনীতা এসে পৌছালো। সন্ধ্যের আগে শিলিগুড়ি থেকে কিংশুকও এসে হাজির হল। সে তখন পলিটিকাল সায়েন্সে মাস্টার্স করবার সাথে সাথে আইএএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিংশুক মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তার দিদিভাইকে দেওয়া কথা তাকে রাখতেই হবে।
 

অজিতের তত্ত্বাবধানে বাড়ির পাশের বাগানে বেশ বড়সড় একটা প্যান্ড্যাল বানানো হল। আর বাইরে বাড়ির মেইন গেট থেকে তুলসী তলার চার পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে একটা প্যাসেজের মত বানিয়ে পেছনের প্যান্ড্যালের দিকে নিয়ে যাওয়া হল। তুলসী তলার চার পাশে একটা সাত আট ফুট ব্যাসার্ধের বৃত্ত রচনা করে ডেকারেটাররা কাপড়ের ঘেরাও দিয়ে প্যাসেজটা বানিয়েছিল।

বিকেলে দিল্লী থেকে এক সাপ্লায়ার কোম্পানীর বিশেষ একটা গাড়িতে মহিমার অর্ডার দেওয়া একটা বিশেষ জিনিস এসে পৌছালো। গত বছর ২১শে আগস্ট বিকেলে, তুলসী তলার পাশে যে জায়গাটিতে সীমন্তিনীর প্রাণহীন দেহটাকে শুইয়ে শেষ বারের মত তার কপালে চন্দনের ফোঁটা আর গলায় ফুলের মালা দিয়ে, বাড়ির সকলে মিলে তাদের শেষ আশীর্বাদ আর ভালবাসার অর্ঘ্য দিয়েছিল, সেই জায়গাটাকে চারদিক ঘিরে নিয়ে সারা রাত ধরে সেখানে তারা কাজ করে গেল। একমাত্র মহিমাই সারা রাত তাদের কাজের তদারকি করে গেছে। সকালে বাড়ির লোকেরা ঘুম থেকে উঠে দেখল, দু’ফুট চওড়া আর চার ফুট উচ্চতার কিছু একটাকে সুন্দর রূপোলী রাংতা দিয়ে মুড়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির অনেকেই যদিও আগে থেকেই জানতেন যে মহিমা সেখানে তাদের সকলের অনুমতি নিয়ে কী করতে চলেছে, তারা জিনিসটা সম্বন্ধে কেউই তেমন অবহিত ছিলেন না। কিন্তু রচনা আর মহিমার অনুরোধে বাড়ির কেউ কোনও আপত্তি করেননি।

সকালে শ্রাদ্ধের কাজের সবরকম আয়োজন গুছিয়ে নেবার পর পুরোহিত যখন সীমন্তিনীর একটা ছবি চাইলেন, তখন মহিমার ঈশারা পেয়ে রচনা সীমাদেবী আর শশীকান্তবাবুকে হাত ধরে বৃত্তের মাঝখানে রাংতায় মোড়া জিনিসটার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে বলল, “মেজোমা, মেজকাকু, তোমরা দুজনে মিলে এটার ওপর থেকে রাংতার মোড়কটা খুলে দাও। তাহলে আমাদের দিদিভাইয়ের আত্মা পরম শান্তি পাবে” বলে পেছনদিকে দাঁড়িয়ে থাকা অর্চনাকে ঈশারা করতেই অর্চনা, পরিতোষ, রতীশ, মহিমা আর বীথিকা মিলে সকল আত্মীয় স্বজনকে সেই বৃত্তের চারদিকে এনে দাঁড় করালো। সীমাদেবী নিজের জলে ভরা দুটো চোখ মুছে নিয়ে রাংতার আচ্ছাদন খুলতে লাগলেন। শশীকান্তবাবুও হাত লাগালেন। রাংতার আবরণ সরে যেতেই দেখা গেল দু’ ফুট বাই চার ফুট বাই চার ইঞ্চি একটা কৃস্টাল ব্লকের ভেতরে পুলিশের ইউনিফর্মে সীমন্তিনী স্যালিউট দেবার ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিক থেকেই একই ছবি দেখা যাচ্ছিল। ব্লকটার ঠিক তলায় সাদা রঙের চিনেমাটির একটা ডিম্বাকার বেদী। আর সেই বেদীর ওপর লেখাঃ-
সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি
জন্মঃ ১৪ অক্টোবর ১৯৮৪
মৃত্যুঃ ২১ আগস্ট ২০১৫
অর্চনা, নবনীতা, মহিমা আর চন্দ্রিকা মিলে কৃষ্টাল ব্লকটার চারদিকে বড় বড় রজনীগন্ধা আর গাঁদা ফুলের মালা ঝুলিয়ে দিল।
 

বাড়ির কর্তারা কিংবা সদস্যরাও অজিতের এমন একটা প্যাসেজ বানাবার যৌক্তিকতা বুঝতে পারেনি প্রথমে। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই যখন দলে দলে লোক এসে সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে শুরু করল, তখন সবাই মনে মনে অজিতের প্রসংশা না করে পারল না। অমন ব্যবস্থা আগে থেকে না করে রাখলে পরে জনতার ভিড়কে সামাল দিতে খুব বেগ পেতে হত। বাড়ির মেইন গেটের একদিকে যেখান থেকে প্যাসেজটার শুরু হয়েছে সেখানে প্রচুর পরিমানে গোলাপ এবং রজনীগন্ধা ফুলের সম্ভার রাখা হয়েছিল। যারা সীমন্তিনীকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিল তারা সকলেই সেখান থেকে ফুল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছিল। সুশৃঙ্খল ভাবে বাইরে থেকে ওই প্যাসেজ দিয়ে ভেতরে ঢুকেই সকলে সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিটি দেখতে দেখতে সেখানে ফুল অর্পন করে ভেজা চোখে জোড়হাতে প্রণাম করে বৃত্তাকার পথ অনুসরন করেই পেছনের বাগানে তৈরী করা প্যান্ড্যালে চলে যাচ্ছিল। সেখানে আগে থেকেই ক্যাটারাররা নানাবিধ খাবারের আয়োজন পসরা সাজিয়ে রেখেছিল। যার যার পছন্দমত খাবার খেয়ে সেখান থেকেই আরেক প্যাসেজের মধ্যে দিয়ে বাড়ির মেইন গেটের অন্য পাশ দিয়ে সামনের রাস্তায় বেরিয়ে যাচ্ছিল। বাড়ির ভেতরের লোকেদের ভিড়ে কোন রকম ভাবে ব্যতিব্যস্ত হতে হয়নি। রাত সাড়ে এগারোটা অব্দি লোকজনের যাতায়াত অব্যাহত ছিল।
 

সন্ধ্যের সময় বাড়ির সকলেই বেদীটার চারধারে একটা একটা করে প্রদীপ জ্বালিয়ে দিল। রচনা প্রদীপ জ্বালিয়ে মেয়েকে কোলে নিয়ে রতীশ আর ছেলের সাথে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে অস্ফুটকণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল, “তুমি ভাল থেকো দিদিভাই। আর এই পরিবার আর তোমার এই ছেলে মেয়েগুলোকে দেখে রেখো”। চারপাশে বসে থাকা সকলের চোখ থেকেই অশ্রুধারা বেয়ে নামছে। সকলেই জলভরা চোখে মনে মনে সীমন্তিনীর আত্মার শান্তি কামনা করল।

রচনা তার ছেলেকে সীমন্তিনীকে ‘বড়মামনি’ বলে ডাকতে শিখিয়েছে। রচনা তার কোলের মেয়েটার নাম রেখেছে মন্তিশ্রী। অর্চনা আর পরিতোষেরও ইচ্ছে তাদের ছেলে প্রত্যুষের মুখে বুলি ফুটলে তারাও তাকে সীমন্তিনীকে বড়মামনি বলে ডাকতে শেখাবে। ছোট্ট যিষ্ণু সীমন্তিনীর প্রতিচ্ছবিকে প্রণাম করে বলল, “ভাল থেকো বড়মামনি”।
ভাল থাকবেন আপনারাও সবাই।
 
শুভমস্তু


********** ********** ********** ********** **********
সমাপ্ত

______________________________

ss_sexy
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
Absolutely masterpiece creation
Like Reply
Speechless
Like Reply
কাঁদিয়ে দিলে! এমন ও গল্প হয় এতো দিন শুনেছিলাম এত দিনে পড়ার সৌভাগ্য হল
[+] 1 user Likes masud127's post
Like Reply
দাদা, এই গল্পটা তো শেষ হল, এখন ss_sexy দিদির "আমি, আমার স্বামী ও আমাদের যৌন জীবন" গল্পটা কি পোস্ট করবেন? এটার জন্য অপেক্ষায় আছি।
Like Reply
আপনি অসাধারণ লেখক, নতুন গল্পের আশায় রইলাম এবার
Like Reply
Amazing.....never thought that I'll come across such a story on an adult forum.
Thank you for presenting such a wonderful emotionally charged story. My best wishes.
[+] 1 user Likes Pundit77's post
Like Reply
(25-09-2020, 02:44 PM)Pundit77 Wrote: Amazing.....never thought that I'll come across such a story on an adult forum.
Thank you for presenting such a wonderful emotionally charged story. My best wishes.

Simanti golpo tate sex er poriman kmn eta ki porokiya kendrik kisu ???
Like Reply
বহুদিন আগে পড়া , পুরোনো ফোরামের একটা অন্যতম সেরা গল্প ছিল এটা .....
Like Reply
(02-07-2022, 10:14 AM)ddey333 Wrote: বহুদিন আগে পড়া , পুরোনো ফোরামের একটা অন্যতম সেরা গল্প ছিল এটা .....

দাদা সেক্স এর পরিমান কেমন? পরকিয়া কেন্দ্রীক গল্প কি?
Like Reply




Users browsing this thread: 4 Guest(s)