Thread Rating:
  • 27 Vote(s) - 3.3 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
#1
সীমন্তিনী
ss_sexy




ঘোষণাঃ- আমাদের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ প্রয়াসে লেখা “দ্বারোদ্ঘাটক বন্ধু” এবং “নিয়তির স্রোতস্বিনী”-র মতই এ কাহিনীটাও সম্পূর্ণরূপেই আমাদের কল্পণাপ্রসূত। জীবিত বা মৃত কোন ব্যাক্তির জীবনের সাথে এ কাহিনীর স্থান, কাল, পাত্র অথবা কাহিনীর কোনও অংশের যদি কোনও সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়, তবে আমরা আগে থেকেই জানিয়ে দিচ্ছি, তা হবে নেহাতই কাকতালীয়।

______________________________
ss_sexy

(Re-posting by Riank55)
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
(Update No. 1)


১২ই আগস্ট ২০১৬।
 

সকাল প্রায় আটটা। বাগডোগড়া এয়ারপোর্ট চত্বর থেকে এক পরিবারের কয়েকজন সদস্য বেরিয়ে এল। স্বামী, স্ত্রী, তাদের সাথে বছর বেয়াল্লিশের এক মহিলা। আড়াই বছর বয়সী ফুটফুটে একটা ছেলে বয়স্কা মহিলাটির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় বত্রিশ বছরের স্বামী ভদ্রলোক একটা ট্রলিতে করে চারখানা লাগেজ বয়ে নিয়ে বাইরে এসেছে। আর বছর পঁচিশেক বয়সের মহিলাটির কোলে একটা ছোট্ট নবজাত শিশু। এয়ারপোর্টের মেইন গেট থেকে বেরিয়ে আসতেই একপাশে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের ভিড় চোখে পড়ল। বিমান যাত্রীদের বেরোতে দেখেই তারা চিৎকার করে সকলের মনযোগ আকর্ষণ করবার জন্যে বলছে, “আসুন স্যার, আসুন ম্যাডাম। গ্যাংটক, থিম্পু, দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্সিয়াং, নেপাল বর্ডার, ধুলাবাড়ি, কুচবিহার, কিশানগঞ্জ, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার,এসি নন-এসি সব আছে। আসুন আসুন”।

যুবকটি ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ভিড় থেকে সকলকে সাথে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের মুখ আর গলার ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “সামনের দিকে তো প্রচণ্ড রোদ রচু। তোমরা বরং এখানেই এ ছায়ায় একটু দাঁড়াও। আমি আগে গিয়ে একটা ট্যাক্সি ঠিক করে আসছি। তারপর এসে তোমাদের নিয়ে যাব। লক্ষ্মীদি তুমি খোকার হাত ধরে থাকো”।

এই বলে কয়েক পা এগোতে না এগোতেই উল্টোদিক থেকে ছাব্বিশ সাতাশ বছরের এক যুবক একেবারে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়াতে ভদ্রলোক চমকে উঠল। সে কিছু বুঝে ওঠবার আগেই যুবকটি তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “আসুন বড়দা, এ রোদে আর কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। আমার গাড়ি ওই দিকটায় আছে। একটু খানি হাঁটতে হবে” বলে বাচ্চা কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রমহিলা আর তার পাশের বয়স্কা মহিলার দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের দু’জনকেও পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “আসুন বড়বৌদি, এসো লক্ষ্মীদি”।
 

ভদ্রমহিলা তার স্বামীর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “একী গো? ও আমাদের চেনে? কে ও”?

ভদ্রলোক এবার ছেলেটির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “দ্যাখো ভাই, আমরা কিন্তু কেউই তোমাকে চিনতে পারছি না। তুমি সত্যি আমাদের চেনো”?

ছেলেটি নিষ্পাপ হেসে জবাব দিল, “এ কী বলছেন বড়দা? আমি আপনাদের চিনব না? তাহলে তো মরে গিয়ে আমি নরকেও ঠাঁই পাব না। আপনি তো রাজগঞ্জের ভট্টাচার্যি বাড়ির বড়ছেলে রতীশবাবু। আর ইনি তো বড়বৌদি। উনি হচ্ছেন লক্ষ্মীদি, আর এই ছোট্ট সোনাটা তো আপনাদের ছেলে। তবে ওর নামটা ....... চন্দুবোনের মুখে অবশ্য শুনেছিলাম। কিন্তু এ মূহুর্তে ঠিক মনে করতে পারছি না। আর বৌদির কোলে যে আছে ওকে তো আমি আজই প্রথম দেখছি। ও নিশ্চয়ই আমার নতুন ভাইঝিই হবে। বাড়ির তিন মা তো ওকে দেখবার জন্যে উতলা হয়ে আছেন। চলুন চলুন, তাড়াতাড়ি বাড়ি যাওয়া যাক” বলতে বলতে রতীশের হাত থেকে ট্রলিটা নিয়ে একদিকে এগোতে লাগল।


_______________________________________________________________________________________________________________
[+] 3 users Like riank55's post
Like Reply
#3
(Update No. 2)

রতীশ খানিকটা হতভম্ব হয়েই সকলকে নিয়ে ছেলেটাকে অনুসরণ করতে শুরু করল। তার স্ত্রী রচনা একটু পা চালিয়ে হেঁটে তার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, “ছেলেটা কে গো? ওর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে আমাদের আর আমাদের বাড়ির লোকজনদেরও ও চেনে। তিন মায়ের কথা বলল। চন্দুর কথা বলল। চিনতে পেরেছ তুমি? না কোনও চিটিং বাজের পাল্লায় পড়তে চলেছি আমরা”?

রতীশ চাপা গলায় বলল, “দাঁড়াও, অতো ভেবো না। দেখছি কী ব্যাপার। তবে লক্ষ্মীদিকে বলে দাও খোকার হাতটা যেন শক্ত করে ধরে থাকে। আর তোমরা সব সময় আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকো”।

এমন সময়ে ছেলেটা আগে আগে যেতে যেতেই জিজ্ঞেস করল, “তা বড়দা, পরশু দিনই তো কাজ। পরিতোষ স্যাররা আসছেন না”?

রতীশ আরেকবার অবাক চোখে তার স্ত্রীর দিকে দেখে ছেলেটার কথার জবাবে বলল, “ওনারা আজ সন্ধ্যায় উত্তরবঙ্গ ধরবেন। কাল সকালে এসে পৌঁছবেন শিলিগুড়ি”।

ছেলেটা রতীশের কথা শুনে মনে হল বেশ আশ্বস্ত হল। বলল, “ভালই হবে। কাল তাহলে রাজগঞ্জ যাবার সময় আমিই তাদের নিয়ে যেতে পারব। তা বড়দা, শুনেছিলাম পরিতোষ স্যারেরা ছাড়াও আরও নাকি দু’ তিনজন আসবেন”।

রতীশ তার কথার জবাবে বলল, “সেটা আজ দুপুর বা বিকেল নাগাদই সঠিক জানা যাবে। কিন্তু ভাই, কিছু মনে করো না। তোমাকে কিন্তু আমরা এখনও ঠিক চিনতে পারছি না। আর তোমার গাড়ির ভাড়া কত দিতে হবে সেটাও তো তুমি এখনও বললে না”।

ছেলেটা তখন ট্রলিটা এক জায়গায় থামিয়ে দিয়ে ব্যাগগুলো হাতে নিতে নিতে বলল, “ভাড়া তো বড়দা আপনার কাছ থেকে নেব না আমি। মেজমাই ভাড়া দেবেন বলেছেন। আপনারা ভাববেন না। আমি কোন চিটিং বাজ নই। আপনারা যে কেউ আমায় চিনতে পারছেন না, তাতে আপনাদের কোনও দোষ নেই বড়দা। তবে বছর খানেক আগেও আমি আপনাদের চারজনকে মানে আপনাকে, বড়বৌদিকে, পরিতোষ স্যার আর তার স্ত্রীকে, এখান থেকেই রাজগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিন আপনারা সবাই যে পরিস্থিতিতে ছিলেন তাতে করে আমার কথা মনে না থাকাই স্বাভাবিক” বলে দু’হাতে চারটে লাগেজ তুলে নিয়ে একটা গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আসুন বড়দা। ওই যে আমার গাড়ি”।

গাড়ির ডিকিতে লাগেজগুলো খুব ভালভাবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে ছেলেটা বলল, “আপনারা মনে কোনও রকম দুশ্চিন্তা রাখবেন না বড়দা। আমার নাম অজিত। অজিত সূত্রধর। আমি শিলিগুড়ির মাটিগাড়াতে থাকি। আগে অন্যের ট্যাক্সিতে ড্রাইভারি করতাম। আজ দিদির আশীর্বাদে আজ আমি পাঁচ পাঁচখানা ট্যাক্সির মালিক। এক বছর আগে যেদিন আপনারা আমার গাড়িতে চেপে রাজগঞ্জ গিয়েছিলেন, সেদিনের পর থেকেই আমার


_________________________________________________________________________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#4
(Update No. 3)

জীবনটা আমূল বদলে গেছে। তারপর থেকে যখনই আমি রাজগঞ্জ যাই, সব সময় আপনাদের বাড়ি গিয়ে আপনাদের তুলসীতলায় একটা প্রণাম করে আসি। অবশ্য প্রথমদিন কেউ আমাকে বাড়িতে ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না। আমার কপালগুণে কিকরে যেন চন্দুবোন আমায় চিনেছিল সেদিন। তারপর তার কথাতেই মায়েরা আমায় বাড়ি ঢুকতে দিয়েছিলেন। আর এখন তো আপনাদের বাড়ির সকলেই আমাকে এমন ভালবাসেন যে পরশুদিনের সমস্ত কাজের দায়িত্বই তারা আমার কাঁধে তুলে দিয়েছেন। কাল পরিতোষ স্যারদের এনজেপি থেকে নিয়ে গিয়েই একেবারে কোমর বেঁধে লেগে পড়বো”।

কথা বলতে বলতে ডিকি বন্ধ করে পেছনের একটা দড়জা খুলে দিয়ে ছেলেটা রতীশের স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আসুন বড়বৌদি। উঠুন। লক্ষ্মীদি তুমিও উঠে পড় বাবুসোনাকে নিয়ে। আর বড়দা, আপনি সামনের সীটে বসুন”।
 

রতীশের ঈশারায় রচনা মেয়েকে কোলে করে গাড়িতে উঠে একদিকের জানালার দিকে চেপে বসতে লক্ষ্মী ছেলেটাকে আগে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজেও উঠে বসতে, ছেলেটা গাড়ির দড়জা বন্ধ করে দিয়ে, সামনের দিকের দড়জাটা খুলে বলল, “উঠুন বড়দা”।
 

রতীশ তবুও শেষ বারের মত কিছু একটা বলতে যেতেই পেছনের সীটে বসা ছোট ছেলেটা তার মায়ের হাতে ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বলে উঠল, “ওমা, মা, ওই দেখ। বড়মামনির ছবি” বলে তার ছোট্ট ছোট্ট হাত দুটোকে একসঙ্গে করে নিজের কপালে ছোঁয়াল।

ছেলের কথা শুনে মহিলাটি চমকে উঠে ছেলের চোখের দৃষ্টি অনুসরন করে গাড়িটার ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকাতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। আর সাথে সাথে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “ওগো শুনছ? দ্যাখ, গাড়ির সামনে কার ছবি”?

রতীশ “কী দেখতে বলছ” বলে মাথা নিচু করে গাড়ির জানালা দিয়ে ড্যাশবোর্ডের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। বেশ কয়েক সেকেন্ড অপলক নয়নে সেদিকে দেখবার পর ছলছল চোখে মাথা বের করে একবার ড্রাইভার অজিতের দিকে দেখে আর একটিও কথা না বলে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল। যুবকটির স্ত্রীও একহাতে তার মেয়েকে বুকে চেপে ধরে রেখে অন্যহাতে শাড়ির খুঁট দিয়ে তখন নিজের চোখের জল মুছছিল। পাশে বসে থাকা ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে সেই বয়স্কা মহিলাটিও দু’হাত জোড় করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে নিজের চোখের জল মুছতে লাগল।
 

রতীশ গাড়িতে বসতেই অজিত নিজের ড্রাইভিং সীটে বসে ড্যাশবোর্ডের ওপরে লাগানো লক্ষ্মী গণেশের ছোট ছোট মুর্তিদুটো আর তার মাঝে বসানো ওই ছবিটাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে গাড়ি স্টার্ট দিল। কার পার্কিংএর অনেক গাড়ির ভিড়ের ভেতর থেকে সাবধানে নিজের গাড়িকে রাস্তার দিকে এগিয়ে নিতে নিতে সে বলল, “জানেন বড়দা। এক বছর আগের ওই দিন রাতে সব কিছু চুকে বুকে যাবার পর আমি রাত প্রায় বারোটা নাগাদ রাজগঞ্জ থেকে শিলিগুড়ির দিকে রওনা হয়েছিলাম। সাড়ে বারোটা নাগাদ শিলিগুড়ি শহরে ঢোকবার মুখেই


______________________________________________________
SS_SEXY
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#5
Star 
(Update No. 4)

একটা ধাবা খোলা আছে দেখতে পেয়ে সেখানে গাড়ি থামিয়েছিলাম। আপনাদের সকলের মত সেদিন আমারও সারাদিনে পেটে কিছু পড়েনি। ধাবায় তড়কা রুটি খেয়ে বেরিয়ে এসে যখন আবার গাড়িতে উঠতে যাব, ঠিক তখনই একটা বাচ্চা ছেলে এসে আমাকে দিদির এ ছবিটা দিয়েছিল। অত রাতে ওই ছবিটা দেখে আমার মধ্যে কী যেন একটা হয়ে গিয়েছিল। আমি ..................”
 

অজিত গাড়ি চালাতে চালাতে একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছিল। কিন্তু সে বোধহয় বুঝতেই পারছিল না যে তার গাড়ির যাত্রীদের কারো কানেই তার একটা কথাও ঢুকছিল না। অজিতের কথাগুলো শুনতে শুনতেই পেছনে বসা স্বামী-স্ত্রী, আর তাদের সঙ্গের বয়স্কা মহিলাটিও যেন অতীতের স্মৃতিতে ডুবে গেল। তাদের সকলের চোখই তখন জলে ঝাপসা। চোখে কিছু দেখতে না পেলেও তাদের সকলের মনের আয়নায় তখন অতীতের বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটণা ছবির মত ভেসে উঠছে। আর তারা মনের চোখেই সে’সব দেখে যাচ্ছিল বিভোর হয়ে।

প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের মাথাতেই বাড়ির সামনে গাড়ি থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে তিন চারজন বয়স্কা মহিলা আর একটা পনের ষোল বছরের কিশোরী মেয়ে আনন্দোল্লাস করতে করতে বেরিয়ে এল। যাত্রীরা গাড়ি থেকে নামতেই সবচেয়ে বয়স্কা মহিলাটি যুবকের স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, “দেখি দেখি আমার ছোট্ট দিদিমণিটাকে আগে দেখি”।

রতীশের স্ত্রী আগের মহিলাটির কোলে নিজের মেয়েটাকে তুলে দিতেই কিশোরী মেয়েটি তাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলে উঠল, “বৌমণি-ই-ই-ই”।

রতীশের স্ত্রী মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার গালে কপালে চুমু খেতে খেতে বলল, “চন্দু সোনা! কেমন আছ বোন। ইশ, কত্ত বড় হয়ে গেছ গো তুমি”।
 

চন্দু, যার ভাল নাম চন্দ্রিকা, সে তার বৌমণির কথার জবাবে তাকে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “আমাকে কি তোমরা চিরদিন সেই ছোট্টটিই বানিয়ে রাখতে চাও বৌমণি? আর তিন চার মাস বাদেই আমি মাধ্যমিক দিতে চলেছি, সেটা কি ভুলে গেছ তোমরা”?

রতীশের স্ত্রী দু’হাতে চন্দ্রিকার দুটো গাল চেপে ধরে তার নাকে নিজের নাক ঘসতে ঘসতে বলল, “কিচ্ছু ভুলিনিগো সোনা আমার, কিচ্ছু ভুলিনি। কিন্তু একটু ছাড়ো বোন, আগে মা-দের প্রণামটা সেরে নিই”।
 

আরেকজন এসে রতীশের ছেলেটাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে লাগল। রতীশ আর তার স্ত্রী একে একে তিন বয়স্কা মহিলার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তার স্ত্রী আগের মহিলাটির কোলে নিজের মেয়েটাকে হাসতে দেখে বলল, “দেখেছ মামনি? এতক্ষণ কিন্তু ঘুমোচ্ছিল। তোমার গলা শুনেই কেমন জেগে উঠেছে দেখ দুষ্টুটা”।


___________________________________________________________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#6
(Update No.5)

এর মধ্যেই প্রথম বয়স্কা মহিলাটি আরেকজন বয়স্কা মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “ওমা! ও মেজো, ও ছোটো! এ আমি কাকে দেখছি রে? দ্যাখ দ্যাখ, এ যে হুবুহু আমাদের মন্তির মুখটা রে! মন্তির মুখটাও তো ছোট্টবেলায় ঠিক এমনটিই ছিল”।

তৃতীয় বয়স্কা মহিলাটি স্থির দৃষ্টিতে বাচ্চার মুখটাকে দেখতে দেখতে জবাব দিল, “বড়খুকীর যখন এমন বয়স ছিল তখন তো আর আমি তাকে দেখিনি বড়দি। তবে ওর ছোট বেলাকার ছবির সাথে আমাদের এই ছোট্ট দিদিসোনাটার সত্যিই এতোটা মিল যে মনে হচ্ছে আমাদের বড়খুকীই যেন আবার আমাদের পরিবারে ফিরে এসেছে” বলতে বলতে বাচ্চাটাকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরলেন।
 

পেছনের ডিকি থেকে যাত্রীদের লাগেজগুলো বের করে অজিত বাড়ির ভেতরের দিকে এগোতেই দ্বিতীয় বয়স্কা মহিলাটি তাকে দেখে বলে উঠলেন, “ও মা? অজিত? তুমিই এদের নিয়ে এলে বুঝি”?

অজিত লাগেজগুলো বারান্দায় রেখে একে একে বয়স্কা মহিলাদের সবাইকে প্রণাম করতে করতে বলল, “বড়দা-বড়বৌদিরা যে আজ আসছেন, এ’ কথাটা তো আপনারা কেউ আমাকে জানানই নি মেজোমা? ভাগ্যিস আমি এয়ারপোর্টেই ছিলাম। আর তাদের ওপর আমার চোখে পড়ে গিয়েছিল। নইলে পরে আমাকে কত আফসোস করতে হত বলুন তো। দিদির সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা বাড়ি এলেন, আর তাকে বাড়িতে এনে পৌঁছে দেবার সুযোগটা আমি হারালে, আমার কতটা কষ্ট হত বলুন তো”?
 

প্রথম বয়স্কা মহিলাটি যাকে ‘মেজো’ বলে ডেকেছিলেন তিনি তখন মেয়েকে কোলে নিয়ে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছোট্ট মেয়েটার মুখটাকে অনেকক্ষণ ধরে দেখবার পর বললেন, “হ্যাঁ গো বড়দি, তুমি তো ঠিক বলেছ! এ যে অবিকল আমাদের বড় খুকীর সেই মুখটাই গো। আমাদের বড়খুকী তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটাকে ছেড়ে বেশীদিন থাকতে পারেনি গো। আবার তার কাছেই চলে এসেছে” বলে শিশু কন্যাটিকে বুকে চেপে ধরে আদর করতে করতে কেঁদে ফেললেন।
 

তার পাশে দাঁড়ানো অপর দুই মহিলা এবং অন্য সকলেও বাচ্চার মুখ দেখে সমস্বরে একই কথা বললেন।

মহিলারা যাকে ‘বড়খুকী’ বলে অভিহিত করলেন সে-ই ‘বড়খুকী’ই এ কাহিনীর মূল কেন্দ্রবিন্দুতে আছে। মূলতঃ তাকে নিয়েই আমাদের এ কল্প-কাহিনী। তবে এই ২০১৬ সালে সে কাহিনী লিখতে শুরু করলেও এ কাহিনীর সূত্রপাত হয়েছিল আরও অন্ততঃ বছর পঁচিশেক আগে। পাঠক পাঠিকাদের অবগত করানোর জন্যে এ কাহিনী শুরু করবার আগে এ পরিবারের কিছুটা পরিচয় করিয়ে দেওয়া আবশ্যক বলে মনে করছি।


**************
Like Reply
#7
(Update No. 6)


উত্তরবঙ্গের প্রমুখ শহর শিলিগুড়ি থেকে প্রায় বাইশ কিলো মিটার দক্ষিন পূর্বে রতিকান্ত বাবুদের সুবিশাল পৈত্রিক বাড়ি। সম্ভ্রান্ত এবং সম্পন্ন পরিবার বলতে যা বোঝায়, এ ভট্টাচার্যি পরিবার ঠিক তাই। ২০১৫ সালের পর থেকে এ শহরের প্রতিটা মানুষ এই পরিবারের এবং পরিবারের সদস্যদের পরম শ্রদ্ধার চোখে দেখলেও, অনেক আগে থেকেই এ তল্লাটের প্রায় সকলেই ভট্টাচার্যি পরিবারকে এক ডাকে চেনে এবং সম্মান করে।

রতিকান্ত ভট্টাচার্যি সেই ছোট শহরের সবচেয়ে বড়সড় মুদি এবং প্রসাধনী সামগ্রীর দোকানটির মালিক। তাদের একান্নবর্তী পরিবারে তিনিই বয়োজ্যেষ্ঠ। তারা তিন ভাই। মেজভাই শশীকান্তবাবু আর ছোটভাই চন্দ্রকান্তবাবু।
বড়ভাই রতিকান্তবাবু আর তার স্ত্রী সরলাদেবীর দুটি ছেলে। বড়টির নাম রতীশ আর ছোটটির সতীশ। মেজভাই শশীকান্তবাবু আর তার স্ত্রী সীমাদেবীর এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়েটি বড়। সীমন্তিনী। আর ছেলের নাম সূর্য।
চন্দ্রাদেবী এ বাড়ির ছোটবউ, মানে ছোটভাই চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্যির স্ত্রী। তাদের ঘরেও একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটি বড়। তার নাম চঞ্চল। আর তাদের মেয়ে চন্দ্রিকা হচ্ছে এ পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্যা। সব মিলিয়ে এ ভট্টাচার্যি বাড়িতে পরিবারের বারোজন সদস্য সদস্যা ছাড়াও আছে দুটো কাজের আয়া আর একজন চাকর আর দুটো মালী।
মেজভাই শশীকান্তের অলঙ্কার ও মনোহারী দোকানটিও এ জায়গার সবচেয়ে বড়। আর ছোটভাই চন্দ্রকান্ত তার পুরোনো ওষুধের দোকানের ব্যবসার পাশাপাশি বছর দশেক যাবত একটা পিসিও ফটোস্ট্যাটের দোকান এবং মাঝারী সাইজের একটি কম্পিউটার এবং কম্পিউটার সামগ্রীর দোকানও চালু করেছেন। রতিকান্তবাবু আর শশীকান্তবাবুর দোকানে দু’জন করে কর্মচারী। আর চন্দ্রকান্তবাবুর তিনটে দোকানে তিনজন। প্রত্যেকের দোকানের সব কর্মচারীরাই মালিকের পরিবারেই দুপুরে ও রাতে খাওয়া দাওয়া করে থাকে। তাই সব মিলিয়ে প্রায় চব্বিশ পঁচিশ জনের রান্না বাড়ির একটিমাত্র হেঁসেলেই হয়ে থাকে। রান্নার লোক থাকলেও বাড়ির তিন বৌ বলতে গেলে সারাক্ষণই ঘরকন্যার কাজে ব্যস্ত থাকেন। তাদের তিন বৌয়ের ভেতরেই ভাব ভালবাসা প্রচুর। দেখে মনে হয় যেন তারা তিন জা নয়, এক মায়ের পেট থেকে জন্মানো তিন বোন। আর ছেলেমেয়ে গুলোকে দেখে তো বোঝাই দায় যে কে কোন ঘরের। তবে কাহিনীর মূল চরিত্রদের মধ্যে একজন এ কাহিনীর শুরু থেকেই এ পরিবারের সদস্যা নয়। এ পরিবারে তার আগমন হবে কাহিনীর মাঝেই।

২০০৬ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি একটা দিন। বেলা তখন সাড়ে এগারটা। স্কুলের প্রিন্সিপালের রুম থেকে খুশী মনে বেরিয়ে এল রতীশ। প্রথমটায় সে আসতেই চাইছিল না। প্রিন্সিপ্যাল সুকোমল স্যার বাড়িতে ফোন করে তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। শুধুমাত্র মন্তির কথাতেই সে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল স্কুলে। বছর পাঁচেক আগে সে আর মন্তি এ স্কুল থেকেই একসাথে মাধ্যমিক পাশ করেছিল। তারপর তার ভাই সতীশও এখান থেকেই মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য ছোট ভাই বোনেরাও এখন এ স্কুলেই পড়ছে। কি ব্যাপারে স্যার ডেকেছিলেন তার বিন্দুমাত্র আন্দাজও রতীশের ছিল না। কিন্তু মন্তির বারংবার অনুরোধে সে আসতে বাধ্য হয়েছিল। একটা সময় ছিল, যখন সে মন্তিকে ছাড়া কিছু বুঝত না। রতীশের খুড়তুতো ভাই বোনেরাও সবাই সে স্কুলেই পড়ছিল তখন। তাদের ব্যাপারেই যদি অভিভাবকদের সাথে কিছু বার্তালাপের প্রয়োজন হয়ে থাকে, তাহলে তাকে না ডেকে তার বাবা বা কাকাদের কাউকেই ডাকা উচিৎ ছিল। কিন্তু স্যার তাকেই যে কেন ডেকেছিলেন!


__________________________________________________

ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#8
(Update No. 7)

গত পাঁচ বছরে সে একবারও মন্তিকে চোখে দেখতে পায়নি। কিন্তু এই পাঁচ বছরের প্রতিটা দিন রোজ অনেক বার মন্তির সাথে তার ফোনে কথা হয়ে থাকে। তার ভাবতেও অবাক লাগে। যে মন্তিকে সে এক মূহুর্তের জন্যেও চোখের আড়াল করতে চাইত না, তাকে পাঁচ বছরের মধ্যে একবারও সে না দেখে কী করে বেঁচে আছে! ছোট বেলা থেকেই তারা দু’জন যেন এক সূতোয় বাধা ছিল। পাঁচ বছর আগে মাধ্যমিক পাশ করবার পর সে আর মন্তি দু’জনেই একসাথে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল। কিন্তু দু’জনের গন্তব্য ছিল আলাদা। নিজেদের শহরেই কলেজ থাকা স্বত্বেও বাড়ির প্রায় সকলের মতের বিরূদ্ধে গিয়ে মন্তি তাদের শহর ছেড়ে জেলাশহরের এক কলেজে গিয়ে এগার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। আর মন্তির কথাতেই রতীশ দেরাদুনের একটি নামকরা আবাসিক স্কুলে এগার ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। তাই তাদের গন্তব্য ছিল আলাদা আলাদা। রতীশ ছোটবেলা থেকেই যোগচর্চা করত। তার সাথে সাথে মন্তিও করত। কিন্তু মন্তিই তাকে বুঝিয়েছিল যে দেরাদুনে রতীশকে সাধারণ পড়াশোনার পাশাপাশি যোগার উচ্চতর ডিগ্রীও হাসিল করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই মন্তির কথাই রতীশের কাছে বেদবাক্য।

পাঁচ বছর দেরাদুনে কাটিয়ে সবে মাস দুয়েক হল সে ফিরে এসেছে বাড়ি। সঙ্গে এনেছে ইকনমিক্সে স্নাতক হবার ডিগ্রী সেই সাথে যোগা মাস্টার ডিগ্রী। আর মন্তি খুব ভাল মার্ক্স নিয়ে পলিটিকাল সায়েন্সে স্নাতক হয়ে এমএ তে ভর্তি হয়েছে। অবশ্য সে আর জেলাশহরে আগের মত একা নেই। রতীশের নিজের ছোট ভাই সতীশও গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করে জেলাশহরে পড়তে যাবার সময় থেকে তার বড়দির সাথেই আছে। রতীশ আর সতীশের খুড়তুতো বোন মন্তি। বাড়ির সকলে মন্তি বলে ডাকলেও তার নাম রাখা হয়েছিল সীমন্তিনী। সতীশের চেয়ে প্রায় আড়াই বছরের বড় হলেও মন্তি রতীশের মাত্র ছ’মাসের ছোট। ছোটবেলা থেকেই রতীশ ছিল মন্তির সর্বক্ষনের সঙ্গী। হামাগুড়ি দেবার সময় থেকেই বা বলা ভাল মায়েদের কোলে থাকতেই রতীশ আর মন্তি একসাথে থাকতে শুরু করেছিল। একসাথে খেত, একসাথে ঘুমোত। রতীশের মা সরলাদেবী যখন ছেলেকে নিজের বুকের দুধ খাওয়াতেন, তখন মন্তি ছুটে এসে তার অন্য স্তনটা মুখে নিয়ে তার দুধ খেত। আবার উল্টোটাও দেখা যেত। মন্তির নিজের মা, রতীশ আর সতীশের মেজমা, সীমাদেবীও একসাথে তার স্তনভাণ্ড দুটো নিজের মেয়ে আর বড়-জার ছেলেকে ভাগ করে দিতে বাধ্য হতেন। নইলে তার নিজের মেয়েও তার বুকের দুধ খেতে চাইত না। আর একটু বড় হতে রতীশ আর মন্তি একই সাথে স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। একই ক্লাসে। তখন থেকে স্কুলে যাওয়া আসা, পড়াশোনা, খাওয়া দাওয়া, খেলাধুলো, ঘোরাফেরা সব সময়েই মন্তি যেন রতীশের শরীরের ছায়া হয়ে থাকত। রাতে শোবার সময় তাদের দুটো শরীর এক হয়ে যেত। আর রতীশও তার জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটিতেই ধীরে ধীরে মন্তির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল।

পাঁচ বছর অদর্শনের পরেও রতীশ মন্তির কথার অবহেলনা করতে পারেনি। মন্তি যে কেন তাকে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের দেখা করতে বলেছিল, সে কারনটাও তার জানা ছিল না। রতীশকে অবাক করে দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল স্যার তাকে সাময়িক ভাবে স্কুলের যোগা প্রশিক্ষক এবং স্পোর্টস টিচার হিসেবে কাজে বহাল করলেন। তবে তিনি এ’কথাও বললেন যে রতীশকে স্কুলের স্পোর্টস টিচারের পাশাপাশি তাকে একজন ইকোনমিক্স

 

(Update No. 8)


টিচার হিসেবে পাকাপাকি ভাবে রাখতে তার যা কিছু করণীয়, তিনি তার সবটাই করবেন। রতীশ যেন শুধু মন দিয়ে কাজ করে যায়।

খুশী মনে বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে রতীশ মন্তির কথাই ভেবে যাচ্ছিল। কতদিন হয়ে গেল সে মন্তিকে দেখতে পায়নি। মাধ্যমিক পাশ করবার আগে সে একটা মূহুর্তও মন্তিকে ছেড়ে থাকতে পারত না। মন্তিও প্রায় ছায়ার মত তার সাথে থাকত। ছোটবেলা থেকেই সে মন্তির সাথে সাথে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। যেদিন মন্তি তাকে দেরাদুন যাবার কথা বলেছিল, সেদিন রতীশ সারা দিন সারা রাত ধরে কেঁদেছিল। সে কিছুতেই বুঝতে পাচ্ছিল না, মন্তি যদি জেলা শহরে গিয়ে পড়তে পারে, তাহলে তাকেও সেখানে নিয়ে যাচ্ছে না কেন? কেন তাকে বাড়ি ছেড়ে মন্তিকে ছেড়ে এতদুরে চলে যেতে বলেছিল? তারা দু’জনেই তো খুব ভালভাবে জানত, তারা কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। প্রথম প্রথম দেরাদুনে হোস্টেলে রাতে শুয়ে সে ঘুমের ঘোরেই বিছানায় হাতরে হাতরে মন্তিকে খুঁজত। ছোটবেলা থেকে মন্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে শোয়াতেই সে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। মন্তিও ছোটবেলা থেকেই তার দাদাভাইকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোত। তাদের শরীরে যৌবনের আগমণ ঘটার পরেও তারা এতে কোন সঙ্কোচ বা দ্বিধাবোধ করত না। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর হঠাতই মন্তির শরীরটা বদলে যেতে শুরু করেছিল। তার বুক, নিতম্ব আর ঊরু দুটো দিনে দিনে ভারী হয়ে উঠছিল। ছোট বয়স থেকেই মন্তি অসাধারণ সুন্দরী ছিল। কিন্তু দেহে যৌবনের ছোঁয়া লাগতেই সে যেন একেবারে স্বর্গের অপ্সরাদের মতই উদ্ভিন্ন যৌবনা হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। এলাকার ছোট বড় সকলের মুখেই মন্তির রূপের চর্চা ঘুরে বেড়াত। তখন মেজগিন্নী সীমাদেবী সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবনের কথা ভেবেই সীমন্তিনী আর রতীশকে আলাদা আলাদা ঘরে শোয়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাগে রণচণ্ডী হয়ে ওঠা সীমন্তিনীকে কেউ বোঝাতে পারেনি। তখনই রতীশের মা সরলাদেবী তার আর মন্তির জন্য একটা আলাদা রুমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। বড়সড় সে রুমটাতেই তারা দু’জনে বসে পড়াশোনা করত, আর রাতেও সে রুমেই তারা ঘুমোত। গরমের রাতগুলোতে মন্তি তার বুকের সমস্ত আবরণ সরিয়ে দিয়ে রতীশের মুখটাকে নিজের খোলা বুকে চেপে ধরে সারা রাত ঘুমিয়ে থাকত। কোনও সঙ্কোচ বোধ করত না সে। মন্তির বুকে মুখ রেখে ঘুমোতে রতীশেরও খুব ভাল লাগত। মাঝে মধ্যে তারা দু’জনেই রাতে বিছানায় শুয়ে ঘুমোবার আগে পর্যন্ত একে অপরের শরীরটাকে নানা ভাবে আদর করত। রতীশ যা করতে চাইত, যেভাবে মন্তির শরীরটা নিয়ে খেলতে চাইত, মন্তি তাতে কখনও কোন বাঁধা দেয় নি। তার দাদাভাইয়ের সমস্ত চাহিদা সে খুশী মনে মেটাত। আর সেটা করে রতীশের চোখে মুখে খুশী দেখে সে নিজেও খুব শান্তি পেত। তবে রতীশের চাইতে সীমন্তিনী বোধ বুদ্ধিতে অনেক পরিণত ছিল। তাই সে নিজেকে একটা গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ রেখেছিল বরাবর। আর তার দাদাভাইকেও একই সীমানার গণ্ডিতে রাখতে তার কোন কষ্টই হয় নি। কারন মন্তির কথাই ছিল রতীশের কাছে শেষ কথা।

______________________________
 
 
(Update No. 9)

সকালে ঘুম থেকে উঠে রতীশ আর মন্তি দু’জনে প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে যোগচর্চা করত। তারপর চা খেতে খেতেই দু’জনে পড়তে বসত। ন’টায় উঠে স্নান খাওয়া দাওয়া সেরে স্কুলে যেত। স্কুলেও সারাটা সময় তারা দু’জন একসাথেই থাকত। বিকেলে একই সাথে দু’জনে বাড়ি ফিরে আসত। হাল্কা কিছু একটা খেয়ে নিয়েই তারা আবার পাড়ার মাঠে খেলতে চলে যেত। কিন্তু সন্ধ্যের আগেই তারা আবার বাড়ি ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে অন্যান্য ভাইবোন, মা কাকিমাদের সাথে একটু সময় কাটিয়েই তারা নিজেদের রুমে ঢুকে পড়ত। রাত দশটা সাড়ে দশটা পর্যন্ত একনাগাড়ে চলত পড়াশোনা। তারপর রাতের খাবার খেয়ে আবার তারা তাদের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় উঠে একে অপরকে আদর করতে শুরু করত। আর এ আদরের মাত্রা দিনে দিনে কম হবার বদলে বেড়েই যাচ্ছিল যেন। আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছিল মন্তির রূপ সৌন্দর্য্য। কিন্তু সীমন্তিনী গণ্ডির ব্যাপারে সর্বদাই সজাগ ছিল।

মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার মাস ছয়েক আগে থেকেই মন্তি যেন মাঝে মাঝেই গভীর চিন্তায় ডুবে যেত। কিন্তু রতীশ জানতে চাইলে সে কথা ঘুরিয়ে অন্য কথা পেড়ে বসত। রতীশ মন্তির ওপর কোন রকম জোরাজুরি করত না। তার আশেপাশে মন্তির উপস্থিতি টের পেলেই তার আর কিচ্ছুটির অভাব থাকত না যেন। মাধ্যমিক দেবার পরে একদিন রাতে বিছানায় গিয়ে রতীশকে প্রাণ ভরে আদর করবার পর মন্তি রতীশের বুকের ওপর শুয়ে বলেছিল রতীশকে দেরাদুনে গিয়ে এগার ক্লাসে ভর্তি হতে হবে। আর মন্তি নিজে তাদের জেলা শহরে চলে যাবে। কথাটা শুনেই রতীশ কাঁদতে শুরু করেছিল। তারপর থেকে রোজ রাতেই মন্তির বুকে মুখ চেপে ধরে নিজের চোখের জলে মন্তির বুক ভাসিয়ে দিত রতীশ। মন্তিকে বোঝাতে চেষ্টা করত যে সে তাকে ছেড়ে একা কিছুতেই থাকতে পারবে না। মন্তিও তাকে বলত, তার দাদাভাইকে ছেড়ে থাকতে তারও খুব কষ্ট হবে। কিন্তু দু’জনের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তাদের আলাদা আলাদা জায়গায় থাকতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হবে।

ছোটবেলা থেকেই রতীশের ব্যাপারে সবকিছুর সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার যেন মন্তিই পুরোপুরি নিজের হাতে
তুলে নিয়েছিল। আর রতীশও মন্তির সব কথা নির্দ্বিধায় মেনে চলত। কারন ছোটবেলা থেকেই সে বুঝতে পেরেছিল যে মন্তিই তাকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে। রতীশের জন্যে মন্তি নিজের যে কোন ক্ষতি স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকত। প্রয়োজনে হয়ত রতীশের জন্যে নিজের প্রাণটাও বিলিয়ে দিতে পারত সে। রতীশ লক্ষ্য করেছিল, তাদের বাড়ির গুরুজনেরাও মন্তির কথার বিরূদ্ধে যেতেন না। তারা সকলেই যে মন্তিকে একটু এড়িয়ে এড়িয়েই চলতেন, সেটা বুঝতে পারলেও রতীশ এর পেছনের কারনটাকে ওই বয়সে বুঝতে পারেনি। মন্তি খুব ছোটবেলা থেকেই অসম্ভব রকমের জেদী আর রাগী। তবে তার জেদ আর রাগটা ছিল তার দাদাভাইয়ের চারপাশে একটা অদৃশ্য বৃত্তের মত। রতীশকে কেউ গালমন্দ করলে, রতীশের ওপর কেউ রাগ করলে, তার ওপর কেউ কোনও বিধি নিষেধ আরোপ করলেই মন্তির রাগ ফেটে বেরতো। আর তার ক্রোধের মুখোমুখি হবার সাহস বাড়ির বড় ছোট কেউ দেখাতে পারত না। একমাত্র রতীশের মা সরলাদেবী আর ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবুই তাদের দু’জনের সাথে কথা বলতেন। আর মন্তির নিজের মা সীমাদেবী, যাকে রতীশ মেজমা বলে ডাকে, তিনি যেন কেমন বোবা চোখে তাদের দিকে চেয়ে থাকতেন মাঝে মাঝে।

______________________________
 
 
 
(Update No. 10)


দেরাদুন আসবার পর পর প্রথমদিকে দু’তিন মাস রতীশ রাতে ঠিকমত ঘুমোতেই পারত না। রোজ রাতে শুয়ে শুয়ে কাঁদত। ছোটবেলা থেকে যে শরীরটাকে বুকে জড়িয়ে শুতে সে অভ্যস্ত ছিল, সে শরীরটা তার হাতের নাগালের মধ্যে ছিল না। বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু মন্তি আর রতীশকে দুটো মোবাইল দিয়ে দিয়েছিলেন। সে মোবাইলের মাধ্যমে দিনে অসংখ্য বার রতীশ আর মন্তির কথা হত। মন্তি সব সময় রতীশকে নির্দেশ দিয়ে বুঝিয়ে দিত, রতীশ কি করবে না করবে। মন্তির কথাতেই সে কলেজের পড়াশোনার পাশাপাশি যোগা কলেজেও ভর্তি হয়েছিল। পয়সা কড়ির ভাবনাও রতীশকে ভাবতে হত না। মন্তির নির্দেশেই সে দেরাদুনে একটা ব্যাঙ্ক একাউন্ট খুলেছিল। আর সে একাউন্টে নিয়মিত বাড়ি থেকে পয়সা পাঠিয়ে দেওয়া হত। বাড়ি থেকে একমাত্র তার মা আর ছোটকাকুই মাঝে মধ্যে ফোন করে তার খবরাখবর নিতেন। আর তার কখন কি প্রয়োজন তার খবরাখবর একমাত্র মন্তিই রাখত।

বয়সে মন্তির থেকে মাস ছয়েকের বড় হলেও রতীশের স্বভাব একটা ছোট বাচ্চার মতই ছিল। সরল আর সিধেসাধা। নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা তো দুরের কথা, কোনকিছু নিয়েই সে তেমন ভাবে ভাবত না। তার সমস্ত ভাবনা চিন্তা সে তার মন্তির ওপর ছেড়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু মন্তি সে তুলনায় অনেক বেশী বাস্তববুদ্ধি সম্পন্না ছিল। আর প্রখর বিচার বুদ্ধির সাথে সাথে ভগবান তাকে অফুরন্ত রূপের ডালি দিয়ে সাজিয়ে দিয়েছিলেন। মন্তি ফোনে ফোনেই রতীশকে একটু একটু করে সব কিছু বুঝিয়েছিল। বুঝিয়েছিল যে তাদের ভাইবোনের স্বাভাবিক সম্পর্কটার সীমা তারা অনেক বছর আগেই পেরিয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে তারা প্রেমিক প্রেমিকা হয়ে উঠেছিল। তাদের ভালবাসার শিকর মন্তির হৃদয়ে এমন গভীরভাবে গেঁড়ে বসেছিল যে মন্তির পক্ষে অন্য কোনও পুরুষকে তার জীবনে স্থান দেওয়ার কোন উপায় ছিল না। সে মনে মনে তার মন প্রাণ দেহ সবকিছুই তার দাদাভাইকে সঁপে দিয়েছে অনেক বছর আগে। তাই তাকে বিয়ে করে স্ত্রীর মর্য্যাদা দেবার অধিকার এ পৃথিবীতে একমাত্র রতীশেরই আছে। কিন্তু জেঠতুতো খুড়তুতো ভাই বোনের বিয়ে বাড়ির লোকেরা তো দুর, সমাজের কেউই স্বীকার করে নিতে পারবে না। রতীশ যদি তার নিজের জেঠতুতো ভাই না হত, তাহলে সে হয়ত সকলের কথার বিরূদ্ধে গিয়েই রতীশের সাথে পালিয়ে গিয়ে কোন মন্দিরে বা কোর্টে বিয়ে করে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে সংসার পেতে বসবার কথা ভাবতে পারত। কিন্তু মাধ্যমিক দেবার অনেক আগে থেকেই মন্তি বুঝতে পেরেছিল যে তার ভালবাসার দাদাভাইকে বিয়ে করা, তার দাদাভাইকে চিরদিন নিজের করে ধরে রাখা, কোনমতেই সম্ভব নয়। আর রতীশ বাড়ির বড় ছেলে। তার ওপর পরিবারের সকলেরই অনেক আশা ভরসা আছে। বংশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে রতীশকে ভবিষ্যতে অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হতে হবেই। তাই তার মন থেকে মন্তির প্রভাবটাকে দুর করতে হলে তাদের মাঝে শারীরিক ব্যবধানটা দুর করা একান্তই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। তাই মন্তি পনেরো বছর বয়সেই তাকে নিজের কাছ থেকে অনেক দুরে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছিল।

______________________________
 
 
 
(Update No. 11)

মন মানতে না চাইলেও মন্তির কথার যথার্থতা রতীশ ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিল। পাঁচ বছরে মন্তির সুন্দর লোভনীয় শরীরটার মোহ তার মন থেকে একেবারেই সরে গিয়েছিল। এখন আর সে রাতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে না। কিন্তু ফোন যোগাযোগটা আগের মতই অক্ষুন্ন আছে তাদের। আজও রতীশের ভাল মন্দ সব কিছুর সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার একমাত্র তার ছোটবোন মন্তিরই। তাই মন্তির কথাতেই সে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছিল।

বাড়ির কাছাকাছি এসে সে মন্তিকে ফোন করে জানিয়ে দিল প্রিসিপ্যাল স্যারের সাথে তার কি কি কথা হয়েছে।



****************
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#9
(Update No. 12)

বিধুভূষন চক্রবর্তী নিতান্ত দরিদ্র এক ব্রাহ্মণ। উত্তরবঙ্গের ডুয়ার্স এলাকায় ছোট একটা পাহাড়ী জনপদের বাসিন্দা তিনি। জায়গাটা ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি। পুরুষানুক্রমে যজমানি করেই তিনি তার পরিবারের ভরন পোষন করেন। পরিবার বলতে দু’টি মেয়ে আর একটি ছেলে সমেত তারা স্বামী-স্ত্রী। বিধুবাবুর স্ত্রী বিভাদেবী একসময়ে ওই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী গৃহবধূ ছিলেন। এখন দারিদ্র আর বয়সের ভারে তার শরীর অনেকটাই ভেঙে পড়লেও এখনও তিনি যথেষ্ট সুন্দরী। বিভাদেবীর মমতাভরা হাতের ছোঁয়ায় অভাবী সংসারটা কোন রকমে গড়িয়ে গড়িয়ে চলত। বিধুবাবু নিজেও তরুণ অবস্থায় খুবই সুন্দর ছিলেন। এখন বয়সের ভারে, দারিদ্র আর সংসারের নানাবিধ দুশ্চিন্তায় তারও শরীর স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙে গেছে। বড় মেয়ে অর্চনা, ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক তিনজনই দেখতে শুনতে খুবই চমৎকার। আশেপাশের পাঁচ সাতটা গ্রামের মধ্যে অর্চনা আর রচনার মত সুন্দরী মেয়ে আর একটাও নেই। কিংশুক ভাইবোনদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তিন ভাই বোনই সুন্দর দেহশ্রীর সাথে সাথে খুবই নম্র আর মিষ্টি স্বভাবের। দীন দরিদ্র হলেও বিধুবাবু আর বিভাদেবী তাদের সবক’টি ছেলেমেয়েকেই সুন্দর সংস্কারী করে তুলেছেন।

ছোট মেয়ে রচনা আর ছেলে কিংশুক পড়াশোনায় খুব চৌকশ। তারা দু’জনেই স্কুলের প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম স্থান পেত। বড়মেয়ে অর্চনা অন্য ভাই বোনের মত পড়াশোনায় পারদর্শিনী না হলেও ঘরকন্যার কাজে বলতে গেলে অতুলনীয়া। তার সুনম্র আচার ব্যবহার আর সুমিষ্ট কথায় গ্রামের সকলেই তাকে খুব স্নেহ করত, ভালবাসত। আর তার রূপের প্রশংসা তো আশেপাশের সকলের মুখেই প্রায় প্রচলিত ছিল। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ করতেই তার বাবা বিধুবাবু আর্থিক টানাপোড়েনের জন্যই তাকে আর পড়াতে পারেননি। তবে স্কুলের পাট চুকিয়ে তাকে খুব বেশীদিন ঘরে বসে থাকতেও হয়নি। ২০০৫ সালে ঘটকের মাধ্যমেই পাশেরই এক পাহাড়ী গ্রামের এক দোজবর স্কুল শিক্ষকের সাথে বিধুবাবু তার বড় মেয়ে অর্চনার বিয়ে দিয়েছিলেন।

অর্চনার বয়স তখন মাত্র ষোল বছর। প্রাথমিক ভাবে বিধুবাবু এ বিয়েতে রাজি হতে চাইছিলেন না মূলতঃ দুটি কারনে। এক, পাত্রের বয়স তার মেয়ের বয়সের দ্বিগুণের চেয়েও বেশী। আর দুই, চল্লিশোর্ধ পাত্রটি বিপত্নীক আর তার বারো এবং দশ বছর বয়সী দুটো পূত্র সন্তানও বর্তমান ছিল। তার আগের পক্ষের স্ত্রী নাকি অসুখে ভুগে বছর দুয়েক আগে মারা গিয়েছিল। কিন্তু ভাল সরকারী স্কুলের শিক্ষক, আর বাড়ি ঘর দোরের ভাল অবস্থা দেখে বিধুবাবু ভেবেছিলেন, যে মেয়েটা হয়ত সেখানে ভালই থাকবে। বাবার ঘরে ছোটবেলা থেকে সে যে দৈন্য দশার মধ্যে বড় হয়েছে, তেমন অবস্থায় তাকে পড়তে হবে না। মেয়ের হবু শ্বশুর শাশুড়ির আচার ব্যবহারও ভালই লেগেছিল তার। চেনাজানা ঘটক লোকটা তাকে সব দিক দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বিয়েতে মত দিতে বলেছিল। একদিকে দোজবর পাত্রের সাথে তার অমন মিষ্টি মেয়েটার বিয়ে দিতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু অন্যদিকে সংসারের অভাব অনটন দিনে দিনে এমন একটা পর্যায়ে চলে এসেছিল যে কোন কোনদিন ঘরে দু’বেলা রান্নাও হত না। তার ওপর আরেক মেয়ে ও ছেলের লেখাপড়ার খরচা। বিধুবাবু যেন কিছুতেই কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। প্রায় নিরুপায় হয়েই যেচে আসা সম্মন্ধটিকে হাত ছাড়া না করে তিনি বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন।

দিদির বিয়ের সময় রচনার বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। সবে সে ক্লাস এইটে উঠেছিল। কিন্তু ওইটুকু বয়সেই অভাবের সংসারে বড় হতে হতে সে মানসিক ভাবে অনেক পরিপক্কা হয়ে উঠেছিল। বিয়ের আনন্দ অনুষ্ঠানের মধ্যেও দিদির দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে সে অনেক বার আড়ালে আবডালে গিয়ে চোখের জল ফেলেছিল। মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেছিল যে তার দিদি যেন সুখে থাকে।

দ্বিরাগমন সেরে যাবার পর তার দিদি বা জামাইবাবু কেউই আর তাদের বাড়ি আসেনি কখনও। কিন্তু বিয়ের মাসদুয়েক বাদেই লোক মারফত দিদির লিখে পাঠানো একটা চিঠি পেয়ে রচনা জানতে পেরেছিল যে দিদি তার শ্বশুর বাড়িতে একেবারেই ভাল নেই। তার জামাইবাবু রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে দিদির ওপর অকথ্য অত্যাচার করে। মারধর করে। আর দিনের বেলায় তার শ্বশুর শাশুড়ি তো বটেই এমন কি তার সৎ ছেলে দুটোও দিদিকে নাকি যখন তখন গালমন্দ করে। তার অপরাধ ছিল, বাপের বাড়ি থেকে যথেষ্ট পরিমানে দান সামগ্রী নিয়ে আসতে না পারা। বিয়ের একমাসের মধ্যেই দু’তিন দিন তার দিদিকে অভুক্ত থাকতে হয়েছে। সারাদিন শ্বশুর শাশুড়ির গঞ্জনা আর মানসিক অত্যাচার আর রাতের বেলায় স্বামীর হাতে লাঞ্ছনা আর গঞ্জনাই তার নিত্যদিনের প্রাপ্তি।

তখন থেকেই তার নিজের মনের ভেতর একটা ভয় ঢুকে গিয়েছিল। তার পরিণতিও কি তার দিদির মতই হবে? মাধ্যমিক পাশ করলেই বাবা কি তারও এভাবে বিয়ে দিয়ে দেবেন? এমনই আধবুড়ো বিপত্নীক কোন দোজবরের সাথে? ভাবতে ভাবতে সে নিজেই কেঁপে উঠত। সে মনে মনে ভাবত, এমন বিয়ে হওয়ার চেয়ে সারাজীবন কূমারী হয়ে থাকাও বোধহয় ভাল। কিন্তু সে জানে, মা বাবার কথার বিরূদ্ধে যাবার ক্ষমতা, তার দিদির মত, তারও নেই। তাই রোজ সকাল সন্ধ্যা দু’বেলা ঠাকুরঘরে গিয়ে মনে মনে মিনতি করত, তার কপালে যেন এমনটা না হয়।

রচনা প্রথম বিভাগে জেলার মধ্যে প্রথম স্থান নিয়ে মাধ্যমিক পাশ করবার পর বিধুবাবু মনে মনে ভেবেছিলেন ইচ্ছে থাকা সত্বেও তিনি আর রচনাকে পড়াতে পারবেন না। কিন্তু রচনাদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল বিধুবাবুর এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন। নিঃসন্তান প্রিন্সিপ্যাল রচনাকে ছোটবেলা থেকেই নিজের মেয়ের মত ভাল বাসতেন। তিনি রচনাকে তাদের স্কুলেই এগার ক্লাসে ভর্তি করে বিধুবাবুকে বলেছিলেন যে রচনার জন্য সে স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দেবেন। তাই বিধুবাবুর ওপর কোন আর্থিক চাপ পড়বে না। আর নিতান্তই যদি স্কলারশিপের ব্যবস্থা না করতে পারেন, তাহলেও বিধুবাবুকে কিছু ভাবতে হবে না। তিনি নিজে রচনার পড়াশোনার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবেন।

****************
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাস। ইন্টারস্কুল কুইজ কনটেস্টে স্কুল থেকে বাছাই করা ছ’জন ছাত্রকে নিয়ে রতীশকে তাদের জেলা শহরে যেতে হল। মন্তি আর সতীশ তো আগে থেকেই সেখানে থেকে পড়াশোনা করছিল। মন্তি এম এ ফাইনাল ইয়ারে আর সতীশের বিএসসি ফাইনাল পরীক্ষা সবে শেষ হয়েছে। মন্তি রতীশকে তার ভাড়া করা বাড়িতে গিয়ে থাকতে বলেছে। কিন্তু একটা সরকারি গেস্ট হাউসে তাদের স্কুলের সকলের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে রতীশ ছাত্রদের সাথেই সে গেস্ট হাউসেই থাকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রোগ্রামের প্রথম দিনেই একটি মেয়েকে দেখে রতীশ চমকে উঠেছিল। প্রথম রাউণ্ডের ফলাফল প্রকাশ হতেই দেখা গেল যে কালচিনি ব্লকের একটা স্কুলের নাম ফলাফলের লিস্টে প্রথম স্থানে। আর সে টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। সেদিন রাতেই রতীশ মন্তিকে ফোন করে বলল, সে যেন পরের দিন সকালে সতীশকে সঙ্গে নিয়ে অডিটোরিয়ামে আসে। সৌভাগ্যক্রমে পরের দিন মন্তি আর সতীশ দু’জনেরই কলেজ ছুটি ছিল। সকাল ন’টার আগেই তারা দু’জন রতীশদের গেস্ট হাউসে চলে এল। রতীশের স্কুলের ছাত্ররা সীমন্তিনী আর সতীশকে দেখে খুব খুশী হল। সবাই একসাথে দল বেধে ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে এসে হাজির হল সকাল দশটার আগেই। সবাইকে জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় এসে বলল, “তোদের দু’জনকে একজনকে দেখাব বলে ডেকে এনেছি আমি। তোরাও তাকে দেখে তোদের মতামত জানাবি”।

সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কাকে দেখাবি দাদা”?

রতীশ বলল, “একটা মেয়ে। কালচিনি ব্লকের কোন একটা স্কুলের ছাত্রী। আর ওই টিমের গ্রুপ লিডারের নাম রচনা চক্রবর্তী। এর বেশী কিছু আর জানিনা”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “মেয়েটাকে দেখে তোর ভাল লেগেছে দাদাভাই”?

রতীশের মুখ দিয়ে এবার আর যেন কথা সরতে চাইছিল না। দেরাদুনে থাকতেই মন্তি তাকে বুঝিয়েছিল যে রতীশকে অন্য কোন মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে। আর স্কুলে চাকরি পাবার পর থেকেই সীমন্তিনী যেন উঠে পড়ে লেগেছিল, তার দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে। রোজ ফোনে জিজ্ঞেস করত রতীশ কাউকে পছন্দ করেছে কি না। রতীশ বারবার মন্তির কথা শুনেও শোনে নি। আসলে মন্তিকে ভালবেসে সে নিজের মনের মণিকোঠার যে জায়গাটায় বসিয়েছিল, সেখান থেকে তার ছবিটাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য কোনও মেয়েকে জায়গা দেবার কথা সে ভাবতেও পারত না। কিন্তু এই মেয়েটিকে প্রথমবার দেখেই তার মনটা যেন খুশীতে ভরে উঠেছিল। কিন্তু নিজে যেন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। তাই তার ছোটবেলা থেকে সে যার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল, সেই মন্তিকে ডেকে এনেছে। কিন্তু যে মুখে অজস্রবার সে মন্তিকে ভালবাসার কথা বলেছে, সে মুখে অন্য কোন মেয়ের নাম উচ্চারণ করতে তার সঙ্কোচ হচ্ছিল। কিন্তু এ মূহুর্তে শুধু মন্তিই নয়, সতীশের মনেও যে একই প্রশ্ন উঠেছে তা সে জানত।

মাথা নিচু করে বলল, “দেখ মন্তি, তুইই বারবার করে আমাকে বলছিলিস কোন মেয়েকে পছন্দ করতে। কিন্তু আমার চোখে এমন মেয়ে আগে আর কখনও পড়ে নি। এ মেয়েটাকে দেখে প্রাথমিক ভাবে আমার ভাল লেগেছে বলেই তোদের ডেকে এনেছি। আমি তো শুধু কাল মেয়েটাকে দেখেছি। আমি ওর নাম, ঠিকানা, পরিচয় কিছুই জানিনা। কাল ফার্স্ট রাউণ্ডের সময় জানলাম যে ও কালচিনি ব্লকের কোন একটা স্কুলের ছাত্রী। এর বেশী আর কিছুই আমি জানিনা। তোদেরকে ডেকেছি তোদের মতামত নেবার জন্য। আর তোরা দু’জনেও যেমন জানিস, তেমনি আমাদের বাড়ির সকলেও জানে যে তোর কথা ছাড়া আমি কোন কাজ করি না। তাই তোরা দু’জনে মেয়েটাকে দেখে তারপর তোদের যা বলার বলিস”।

দ্বিতীয় দিনের প্রতিযোগিতা শুরু হবার সাথে সাথে রতীশ মন্তি আর সতীশকে নিজের সাথে নিয়ে বসল। রচনাদের টিমের ছাত্ররা যখন ডায়াসে এসে বসল, তখন রতীশ সতীশ আর মন্তির কানের কাছে মুখ নিয়ে
 
বলল, “একদম বাঁদিকের কোনায় বসে থাকা মেয়েটার কথা বলছিলাম আমি”।

মেয়েটাকে দেখে মন্তির খুব ভাল লাগল। সতীশেরও তাই মত। দ্বিতীয় রাউণ্ডেও মেয়েটা একাই প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের পালা শেষ হতেই সীমন্তিনী রতীশকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দাদাভাই, তোকে কি সারাক্ষন এখানে বসে থাকতে হবে”?

রতীশ বলল, “তেমন কোন বাধ্য বাধকতা নেই। হলঘর থেকে আমি বেরোতেই পারি। কিন্তু আমাদের স্কুলের টিমের পারফর্মেনস শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাকে ক্যাম্পাসের ভেতরেই থাকতে হবে। তারপর ছাত্রদের সাথে নিয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারব”।

মন্তি বলল, “তাহলে চল দাদাভাই। আমরা ক্যান্টিনে গিয়ে বসে একটু কথা বলি”।

তিনজনে ক্যান্টিনে এসে একটা টেবিলের তিনদিকে বসতেই সতীশ সবার আগে বলল, “বড়দি, আমার কিন্তু খুব পছন্দ হয়েছে রে মেয়েটাকে। দাদার সাথে খুব ভাল মানাবে”।

মন্তি রতীশের মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সতীশকে বলল, “সেটা তো ঠিকই বলেছিস রে সতু। মেয়েটা তো দেখতে শুনতে খুবই ভাল। কিন্তু জানিস তো? আজকাল কোন সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পেছনে ভাল মন্দ ছেলেদের লাইন পড়ে যায়। প্রায় সব মেয়েই কোন না কোন ছেলের সাথে ভালবাসায় জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এ মেয়েটার মুখে চোখে আমি অন্য একটা ছোঁয়া দেখতে পেয়েছি রে সতু। মেয়েটা খুবই লক্ষীমন্ত হবে। তবে কারুর সাথে প্রেমটেম করে কিনা সেটা বলা মুস্কিল। তবে দাদাভাইয়ের যখন পছন্দ হয়েছে, তবে মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ খবর নিতেই হচ্ছে। শোন সতু, কালচিনি স্কুলের টিমটার সাথে টিচার কে এসেছেন, একটু খবর নিয়ে দেখ তো। মেয়েটার নাম ঠিকানা বা বাবার নাম এসব কিছু জানা যায় কিনা। আর আমি মেয়েটার একটা ছবি তুলে নেবার চেষ্টা করছি। আর কোনভাবে মেয়েটার সাথে ভাব করতে পারি কিনা দেখি। তাহলে হয়ত ভেতরের খবরগুলো জানা যাবে। আর দাদাভাই, তুইও যদি পারিস, কিছু খবরাখবর নে। তবে একটা কথা, মেয়েটার সাথে তোরা কেউ সরাসরি কথা বলার চেষ্টা করিস না। বাকিটা আমি দেখছি”।

ক্যান্টিন থেকে বেড়িয়েই সীমন্তিনী একা একদিকে চলে গেল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল ডেলিগেটসদের ঘরের সামনে। ঘরের ভেতর বিভিন্ন স্কুলের ছেলেমেয়ের জটলা। কালচিনি স্কুলের টিম তাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডের কুইজ শেষ করে ঘরের এক কোনায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তারা সকলেই তাদের পারফর্মেন্সে উচ্ছ্বসিত। সীমন্তিনী অনেক কষ্টে ভিড় কাটিয়ে সেই দলের কাছে গিয়ে অন্য একটা মেয়ের কাছে গিয়ে বলল, “ভাই শোনো, কিছু মনে কোর না। তোমাদের সেকেণ্ড রাউণ্ডেও তোমরা খুব ভাল পারফর্ম করেছ। তাই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এলাম। কিছু মনে করছ না তো”?

মেয়েটা জবাব দিল, “না না দিদি, মনে করব কেন? বলুন কী বলতে চান”?

______________________________
 
 
(Update No. 13)

সীমন্তিনী বলল, “শোন ভাই। আমার নাম সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে এমএ পড়ছি। ফাইনাল ইয়ার। তোমরা তো কালচিনি ব্লক থেকে এসেছ, তাই না”?

মেয়েটা বলল, “হ্যা দিদি। আমরা কালচিনি থেকেই এসেছি। কিন্তু আপনাকে দেখে তো কালচিনির মেয়ে বলে মনে হচ্ছে না”।

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “না ভাই আমি কালচিনির নই। আমার বাড়ি এখান থেকে একটু দুরে। বাসে যেতে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট মিনিটের মত লাগে। কিন্তু তোমরা কালচিনির শুনেই তোমাদের সাথে একটু কথা বলতে এসেছি। আসলে কি হয়েছে জানো। আমাদের ইউনিভার্সিটিতে ডুয়ার্সের কোন একটা ব্লক নিয়ে একটা রিপোর্টিং জমা দিতে হবে আমাকে। ওই প্রোজেক্ট ওয়ার্ক আর কি। আমাদের এক স্যার আমাকে পরামর্শ দিয়েছেন যে কালচিনি ব্লকের ওপর একটা প্রতিবেদন লিখতে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আমাকে সেখানে গিয়ে সব কিছু দেখে শুনে রিপোর্টটা বানাতে হবে। কিন্তু অজানা অচেনা জায়গায় যেতে ঠিক সাহস পাচ্ছি না। আর ওখানে চেনা পরিচিত কেউ নেই আমার। তাই ভাবলাম তোমাদের কাছ থেকে একটু খবরাখবর নিই। আচ্ছা তোমাদের ওখানে কি থাকবার মত কোন হোটেল টোটেল আছে”?

মেয়েটা বলল, “না দিদি। আমাদের জায়গাটা ব্লক হেড কোয়ার্টার হলেও খুবই অনুন্নত। কয়েকটা খাবার হোটেল অবশ্য আছে। কিন্তু থাকতে হলে কারুর বাড়ি ছাড়া একমাত্র সরকারি ডাক বাংলোই পাবেন। তবে আপনি যদি একা যান, তাহলে ওই সব ডাক বাংলোয় থাকাটা খুব ঝামেলার হয়ে উঠতে পারে। লোকাল এমএলএ আর তাদের দলবলের লোকেরা প্রায় সারাক্ষণই সেখানে আড্ডা মারতে থাকে। ড্রিঙ্ক করার পক্ষে সেসব জায়গা খুব উপযুক্ত। তাই একা কোন মেয়ের সেখানে না যাওয়াটাই উচিৎ”।

সীমন্তিনী যেন মেয়েটার কথা শুনে খুব হতাশ হল। এমন ভাব করে বলল, “ইশ, তাহলে তো ভারী মুস্কিল হল আমার। আচ্ছা আমি যদি সকালে গিয়ে কিছুটা কাজ করে আবার ফিরে আসতে চাই, তাহলে ফেরার গাড়ি পাব তো? আর কোন রাস্তায় কোনদিক দিয়ে যেতে হবে, তাও তো জানিনা”।

মেয়েটা বলল, “এখান থেকে কালচিনি যাবার দু তিনিটে রাস্তা আছে দিদি। তবে বেশীর ভাগ লোকই ভায়া আলিপুরদুয়ার আসা যাওয়া করে। অবশ্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ঘূপগুড়ি, মাদারীহাট, বীরপারা হয়ে গেলে প্রায় পৌনে তিন ঘন্টায় কালচিনি পৌঁছে যাওয়া যায়। আর ডাইরেক্ট ট্রেনে যেতে হলে তো সময় আরও অনেক বেশী লাগে। এখান থেকে সেবক চালসা নাগরাকাটা বানারহাট হয়ে বাস কালচিনিতে পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে সাত ঘন্টা আট ঘন্টার মত সময় লেগে যায়। আর এখান থেকে বাসে আলিপুরদুয়ার যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। আর আলিপুরদুয়ার থেকে বাসে কালচিনিতে যেতে আরও এক ঘন্টার মত লাগে। তাই বাসে এখান থেকে আলিপুরদুয়ার হয়ে কালচিনি যেতে মোট চার ঘন্টার মত লাগে। আমরাও বাসে সে পথেই এসেছি। কিন্তু দিদি, আপনি যেমনটা চাইছেন তা বোধ হয় সম্ভব হবে না। এখান থেকে আমাদের জায়গায় যেতে প্রায় চার ঘন্টা সময় লেগে যায়। আসা যাওয়াতেই তো আপনার আট ঘন্টা সময় চলে যাবে। আপনি সকালে এখান থেকে গিয়ে যদি দু’ তিন ঘন্টা থেকে সেখান থেকে ফিরে আসতে চান, তাহলে তো আপনার এখানে আসতে গভীর রাত হয়ে যাবে। আর রাতের বেলায় একা একজন মেয়ের পক্ষে এ’সব রাস্তায় চলাফেরা করা একেবারেই উচিৎ হবে না”।

সীমন্তিনী আরও মুষড়ে পড়ে বলল, “ওরে বাবা, না না, একা একা অজানা অচেনা রাস্তায় রাতের বেলায় জার্নি করার সাহসই হবে না আমার। ইশ, কি যে করি এখন আমি”।

এমন সময় রতীশের চোখে পড়া মেয়েটি এগিয়ে এসে সীমন্তিনী যার সাথে কথা বলছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে রে কাবেরী? কোন প্রব্লেম”?

কাবেরী তার দিকে চেয়ে বলল, “নারে রচনা তেমন কিছু নয়। আসলে এ দিদি একটু সমস্যায় পড়ে গেছে”।

রচনা ততক্ষণে দু’জনের কাছে এসে গেছে। সে হাতজোড় করে সীমন্তিনীকে নমস্কার করে জিজ্ঞেস করল, “নমস্কার দিদি, আমি রচনা। রচনা চক্রবর্তী। আমি কি শুনতে পারি কি সমস্যা হয়েছে আপনার”?

রচনার অপূর্ব মিষ্টি গলার স্বর শুনে সীমন্তিনী চমকে উঠল। কিন্তু নিজেকে সংযত করে জবাব দিল, “ওঃ হ্যা, নমস্কার ভাই। আমি সীমন্তিনী। এখানে ইউনিভার্সিটিতে পড়ছি। আসলে একটা প্রোজেক্ট ওয়ার্ক করতে আমার কালচিনি যাবার দরকার হয়ে পড়েছে। কালচিনি সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনা। তাই ওর কাছে একটু তোমাদের জায়গাটার ব্যাপারে খবর নিচ্ছিলাম, যে ওখানে গিয়ে কোথাও থাকবার জায়গা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু ওর মুখে যা শুনছি তাতে তো যাবার সাহসই পাচ্ছিনা। তোমার বান্ধবী বলল, ওখানে নাকি সরকারী ডাক বাংলো ছাড়া আর কোন জায়গা নেই থাকবার। সে বাংলোতেও নাকি আমার পক্ষে রাত কাটানো ঠিক হবে না। আর এখান থেকে আপ ডাউন করেও আমার কাজটা করা সম্ভব নয়। তাই একটু চিন্তায় পড়ে গেছি ভাই। কিন্তু তোমাদের বিরক্ত করেও কোন লাভ হল না আমার। সরি ভাই। তোমরা কিছু মনে কোর না। আমি অযথাই তোমাদের সময় নষ্ট করলাম”।

রচনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ, দিদি, আপনি এমন করে বলছেন কেন? আমি বা আমার বান্ধবী কেউই কিছু মনে করিনি আমরা। কিন্তু দিদি, কাবেরী কিন্তু আপনাকে সত্যি কথাই বলেছে। মেয়েদের পক্ষে আমাদের ওখানের ডাক বাংলোয় থাকাটা কিন্তু একেবারেই সমীচীন নয়। আপনার যদি সেখানে যেতেই হয় তাহলে চেনা পরিচিত কারো বাড়িতে থেকেই আপনাকে নিজের কাজ সারতে হবে”।

সীমন্তিনী রচনার একটা হাত নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে বলল, “কাবেরীও তো সে’কথাই বলল আমাকে। কিন্তু আমি তো সেখানে কাউকে চিনিনে। তবে তোমরা দু’বান্ধবী সত্যিই খুব ভাল গো। আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা আমার ওপর রাগ করবে। চেনা নেই জানা নেই, এভাবে এতক্ষণ ধরে তোমাদের সাথে কথা বলাতে তোমরা বিরক্ত তো হতেই পার। আমার উদ্দেশ্যটা হয়ত সফল হল না। তবু তোমাদের এমন মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তোমাদের দু’জনকেই অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। আমি কাল স্যারকে বলে দেব আমার পক্ষে ওই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। আমাকে যেন তিনি অন্য কোন প্রোজেক্ট দেন। আসি ভাই। আর তোমাদের বিরক্ত করব না। আমার শুভেচ্ছা রইল তোমাদের টিমের জন্য। তোমরা এ কনটেস্টে চ্যাম্পিয়ন হলে আমি খুব খুশী হব। আসি ভাই” বলে মিষ্টি করে একটু হেসে তাদের ছেড়ে একদিকে এগিয়ে গেল।

সেদিন রাতে সীমন্তিনী সতীশের পাশে বসে দু’জনে চা খেতে খেতে গল্প করছিল। সতীশ নিজের মোবাইলে তোলা রচনার ছবি দেখিয়ে সীমন্তিনীকে বলল, “বড়দি, মেয়েটার নাম রচনা চক্রবর্তী। কালচিনির একটা গ্রামে বাড়ি। তার বাবার নাম বিধুভূষণ চক্রবর্তী। তার পেশা যজমানী। যথেষ্ট সৎ এবং ভদ্রলোক। কিন্তু খুব গরীব। তার দু’মেয়ে আর একটি ছেলে। ছেলেটা ছোট। ক্লাস এইটে পড়ে। আর তাদের বড় মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে এখন তাদের বাবা মা আর দু’ভাই বোন। তবে কোন ছেলের সাথে কোন এফেয়ার আছে কিনা, সে খবরটা জানতে পারিনি রে”।

সীমন্তিনী শুনে বলল, “বাব্বা, তুই তো অনেক খবর যোগাড় করেছিস রে ভাই! আমি তো শুধু এটুকুই জেনেছি যে ও মেয়েটাই রচনা চক্রবর্তী। কিন্তু মেয়েটার গলার স্বরটা যে কী মিষ্টি না, তা তোকে বলে বোঝাতে পারব না রে ভাই। একটুখানি কথাও বলেছি তার সাথে। তাতে মনে হল বেশ ভদ্র”।

সতীশ বলল, “ওঃ আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছিরে বড়দি। মেয়েটা আর তার ছোট ভাই দু’জনেই লেখাপড়ায় খুব ভাল। দু’জনেই ক্লাসে ফার্স্ট হয় বছর বছর। আর মাধ্যমিকে সে এ ডিস্ট্রিক্টে ফার্স্ট পজিশন পেয়েছিল”।

সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “মেয়েটা বেশ সুন্দর, তাই নারে সতু?
জেঠু আর বড়মার নিশ্চয়ই পছন্দ হবে তাই নারে”?

সতীশ বলল, “তাদের অপছন্দ হলেই বা কি? তোর যদি পছন্দ হয়ে থাকে, তাহলে তোর কথার ওপর আর কেউ কিছু বলবে ভেবেছিস? অবশ্য এটাও ঠিক, এ মেয়েকে শুধু মা বাবা কেন, যে দেখবে সেই পছন্দ করবে। আমার তো খুবই ভাল লেগেছে। হাইটটা আর ইঞ্চি দুয়েক বেশী হলে ফাটাফাটি হত। কিন্তু ওকে তো খাটোও বলা যায় না। পাঁচ চার সাড়ে চার হবে ডেফিনিটলি”।

সীমন্তিনী বলল, “আমি সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছি দাদাভাইয়ের পছন্দ হয়েছে বলে। তবে হ্যা, তুই যেটা বললি, সেটাও ঠিক। আর ইঞ্চি দুয়েক হাইট বেশী হলে খুব ভাল হত। দাদাভাই আর আমি তো সমান। পাঁচ এগার। ওর যদি পাঁচ সাত আটের মত হত তাহলে আরো ভাল হত। কিন্তু একটা ব্যাপারেই সামান্য একটু খামতি থাকলেও মেয়েটা কিন্তু আর সব দিক দিয়েই একেবারে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। দেখতে চমৎকার মিষ্টি চেহারা। গায়ের রঙও খুব চমৎকার। হাঁসিটা তো অপূর্ব। একেবারে মন কেড়ে নেয়া হাঁসি। ওর হাঁসি দেখেই সবাই ওকে ভালবাসবে। তার ওপর কথাবার্তা, আচার ব্যবহারও ভাল। লেখাপড়ায় ভাল। আর মুখে একটা লক্ষী লক্ষী ভাব আছে। ভদ্র পরিবারের মেয়ে। আর কী চাই বল। শুধু হাইটটা নিয়ে কম্প্রোমাইজ করলেই মেয়েটা সবদিক দিয়েই দাদাভাইয়ের উপযুক্ত। হ্যা, ওর বাবার আর্থিক অবস্থাটা ভাল নয়। তাতে কি হল? দাদাভাই তো আর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ঘরজামাই হয়ে শ্বশুরের পয়সায় খাবে না। তাই আমি কিন্তু মনে মনে মেয়েটাকে আমাদের বৌদি বানিয়ে নিতে রাজি হয়ে গেছিরে ভাই”।

সতীশও খুব খুশী হয়ে বলল, “তাহলে বাড়িতে ফোন করে মাকে খবরটা দিই, না কি বলিস”?

সীমন্তিনী বলল, “নারে সতু। এখনই নয়। এখন দাদাভাইকে বা বাড়ির কাউকে কিছু বলিস না। দ্যাখ এমন সুন্দরী আর গুণী মেয়ের পেছনে অনেক ছেলেই লাগতে পারে। কারো সাথে মেয়েটার প্রেম ভালবাসার কোন সম্পর্ক আছে কিনা, সেটা একটু খোঁজ খবর করে দেখতে হবে সবার আগে। আমি একটা প্ল্যান করেছি মনে মনে। তাতে যদি দেখি যে তেমন কিছু নেই, তাহলে ওই মেয়েটাই আমাদের বাড়ির বড়বৌ হবে দেখিস”।

সতীশ নিজের উচ্ছ্বাসকে সংযত করে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু সেটা তুই কিভাবে করবি বল তো বড়দি? কাউকে কি এ ব্যাপারে সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায়”?

সীমন্তিনী বলল, “না সেটা হয়ত যায় না রে ভাই। আর লজ্জা সঙ্কোচ ছেড়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও তার সত্যি জবাব কখনোই পাওয়া যাবে না। তাই এটা জানতে একটা অন্য ফন্দি বের করতে হবে। আর সেটা আমি মনে মনে ভাবছি। কিন্তু আমি না বলা পর্যন্ত তুই রচনার ব্যাপারে কাউকে কিছু বলবি না, বুঝেছিস”?

সতীশ বলল, “তোর কথা অমান্য করার সাহস আমাদের পরিবারে কার আছে রে বড়দি? তুই যা বলছিস তাই হবে। কিন্তু কী ফন্দি আঁটছিস তুই, একটু বলবি আমাকে”?

সীমন্তিনী বলল, “আপাততঃ এটুকু বলতে পারি যে আমি কালচিনি যাচ্ছি। তারপরে কী করব সেটা এখনও ভাবিনি। শোন ভাই। তোর তো কাল বাড়ি যাবার কথা ছিল। তুই বড়মাকে ফোন করে জানিয়ে দে তুই কাল নয়, কয়েকদিন বাদে বাড়ি যাচ্ছিস। কুইজ কনটেস্ট তো কালই শেষ হচ্ছে। ওরা সকলে হয়ত কালই চলে যাবে। আমি পরশুদিন কালচিনি যাব। অবশ্য পরের দিনই ফিরে আসবার চেষ্টা করব। আমি ফিরে এলেই তুই বুঝতে পারবি আমাদের এরপর কী করতে হবে। তারপর বাড়ি গিয়ে কাকে কি বলবি তা তুই নিজেই বুঝতে পারবি। তাই তুই বড়মাকে ফোন করে আপাততঃ বলে দে যে তুই কাল বাড়ি যাচ্ছিস না। তিন চারদিন বাদে যাচ্ছিস। আর আমিও দাদাভাইকে সেভাবেই বলে দেব। দাদাভাইও তো কাল বিকেলেই চলে যাবে বলেছে”।

সতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই কালচিনি যাবি? একা”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যারে ভাই। দাদাভাইয়ের জন্য এটুকু করতে পারব না আমি? আর তুই ভাবিস না।
 
জানিস তো? আমি ক্যারাটেতে ব্ল্যাকবেল্ট পেয়েছি। যে কোন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা করতে পারব আমি। কালচিনি না গেলে আমি আসল খবরটা পাব না। তাই যেতে আমাকে হবেই। তুই আর দুটো দিন থাক এখানে। প্রয়োজনে আমাকে ফোন করিস। কিন্তু রচনার ব্যাপারে বাড়িতে বা দাদাভাইকে আপাততঃ কিচ্ছুটি বলিস না। আর আমি যে কালচিনি যাচ্ছি, এ’কথাটাও কাউকে বলবি না”।

**************

দু’দিন বাদে সীমন্তিনীকে দেখা গেল কালচিনি বাস স্ট্যাণ্ডে। বেলা তখন প্রায় বারোটা। সকাল আটটায় সে জলপাইগুড়ি থেকে রওনা হয়েছিল। বাস থেকে নেমেই সবার আগে সে কোন হোটেলে গিয়ে খেয়ে নিতে চাইল। বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল তার। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে সে একটা ছোটখাট খাবার হোটেল খুঁজে পেল। খেয়ে দেয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আসবার আগেই হোটেলের কাউন্টারে বসে থাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করে রচনাদের বাড়ির হদিশ জেনে নিল। তারপর এদিক সেদিক ঘুরতে ঘুরতে বিকেলের দিকে একটা রাস্তায় সে কাবেরীকে দেখতে পেল। কাবেরী একটা ছোট ছেলের হাত ধরে ফুটপাথ ধরে একদিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী একটু পা চালিয়ে কাবেরীর অনেকটা কাছাকাছি গিয়ে পেছন থেকে কাবেরীর নাম ধরে ডাকল।

কাবেরী পেছন ফিরে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে দিদি? আপনি এখানে”?

সীমন্তিনী হাঁপাতে হাঁপাতে ম্লান হেসে বলল, “আর বোলনা গো। কপালে দুর্ভোগ থাকলে যা হয় আর কি”।

কাবেরী আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি তো সেদিন বললেন যে আপনি কালচিনি আসছেন না! আপনার স্যারকে বলে আপনার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করে নেবেন। তাহলে আজ আবার এখানে কেন এসেছেন আপনি? আর কোথায় উঠেছেন”?

সীমন্তিনী আবার একটু কষ্ট মিশ্রিত হাঁসি হেসে বলল, “উঠব আর কোথায় ভাই? তোমাকে বললাম না? কপালের দুর্ভোগ। স্যার কিছুতেই আমার প্রোজেক্টটা চেঞ্জ করতে রাজি হলেন না। আর সাতদিনের মধ্যে আমাকে রিপোর্ট জমা দিতে বললেন। তাই নিরূপায় হয়ে আমাকে আসতেই হল। অবশ্য ঘন্টা তিনেক হয়ে গেছে এখানে এসেছি। কিছু ম্যাটেরিয়ালসও নোট করেছি। বাস স্ট্যাণ্ডে শুনলাম বিকেল পাঁচটায় নাকি আলিপুরদুয়ার যাবার শেষ বাস। সেটাতেই যাব ভেবেছি। তোমার সাথে যে এভাবে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়ে যাবে, ভাবতেই পারিনি। এখানে তো আমি আর কাউকে চিনি না। তোমাকে দেখে তাই খুব ভাল লাগল গো। মনে হল অচেনা জায়গায় এসে নিজের কাউকে যেন খুঁজে পেলাম”।

কাবেরী বলল, “সে না হয় বুঝলুম দিদি। কিন্তু পাঁচটার বাসে গিয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে জলপাইগুড়ি গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে তো বেশ রাত হয়ে যাবে আপনার”!

সীমন্তিনী বলল, “কি আর করা যাবে বল? আর তো কোন উপায় নেই। ফিরে তো যেতেই হবে। কিন্তু ওঃ। কনগ্রেচুলেশন। কুইজ কনটেস্টে তোমরা ফার্স্ট হয়েছ। দারুণ ব্যাপার” বলে কাবেরীর হাত ধরল।

কাবেরী হেসে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দিদি। তবে রচনা আমাদের টিমে না থাকলে কিছুই হত না”।

সীমন্তিনী নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “ইশ তোমার সাথে দেখা হল। কিন্তু রচনার সাথে বোধহয় আর দেখা করা সম্ভব হবে না গো। ওর সাথে দেখা হলে খুব খুশী হতুম”।

কাবেরী সীমন্তিনীর হাত ধরে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “আপনি যাবেন দিদি? রচনার বাড়ি এখান থেকে খুব বেশী দুরে নয়। অটোতে গেলে দশ মিনিটেই পৌঁছে যাব আমরা। আপনার বাস ধরতে তো এখনও প্রায় ঘন্টাখানেক দেরী আছে। চলুন না দিদি। রচনাও আপনাকে দেখে খুব খুশী হবে”।

সীমন্তিনী বলল, “ওর সাথে দেখা হলে তো আমারও খুব ভাল লাগবে কাবেরী। কিন্তু এভাবে হুট করে কারো বাড়িতে যাওয়াটা কি ভাল দেখাবে বল”?

কাবেরী ততক্ষণে হাতের ঈশারায় একটা পথ চলতি অটো থামিয়ে দিয়েছে। অটোটা থামতেই সীমন্তিনীর হাত ধরে টানতে টানতে অটোতে উঠতে উঠতে কাবেরী বলল, “আপনাকে আমি ঠিক সময় মত বাস স্ট্যাণ্ডে পৌঁছে দেব দিদি। এখন সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি আসুন”।

রাস্তায় একটা মিষ্টির দোকানের সামনে অটো থামিয়ে সীমন্তিনী চটপট দু’বাক্স মিষ্টি কিনে নিল। অটোতে ফিরে এসে পাশের ছেলেটির দিকে ঈশারা করে বলল, “ও বুঝি তোমার ছোট ভাই”?

কাবেরী জবাব দিল, “হ্যা দিদি, ও আমার ভাই শিবতোষ”।

সীমন্তিনী একটা মিষ্টির বাক্স কাবেরীর হাতে দিয়ে বলল, “এটা রাখ। তোমাদের ভাই বোনের জন্য। এ দিদির তরফ থেকে একটু মিষ্টি খেও তোমরা”।

কাবেরী প্যাকেটটা হাতে নিয়ে একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “এ সবের কি দরকার ছিল দিদি”?

সীমন্তিনী মিষ্টি হেসে বলল, “বারে দিদি হয়ে ছোট ভাই বোনকে কিছু দেওয়া কি অপরাধ”?

কাবেরী তটস্থ হয়ে বলল, “না না দিদি, এমন কথা বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না প্লীজ”।

সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “তাহলে আর কথা বোল না। বাড়ি গিয়ে দু’ভাই বোনে মিলে খেতে খেতে এ দিদিটার কথা একটু মনে কোর”।

একটা পুরোন জীর্ন প্রায় বাড়ির সামনে এসে অটোটাকে থামতে বলে কাবেরী সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি আমরা এসে গেছি”।

অটো থেকে নামতে নামতে সীমন্তিনী বলল, “অটোর ভাড়া আমি চুকিয়ে দিচ্ছি কাবেরী। তুমি ডেকে দেখ তো রচনা বাড়ি আছে কিনা”?

কাবেরী বাইরে থেকেই চিৎকার করে রচনাকে ডাকল। অটোর ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী পেছন ফিরতেই রচনা বাড়ির গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দিদি, আপনি? কবে এসেছেন? কখন এসেছেন? কাবেরীর দেখা কোথায় পেলেন? ইশ আপনাকে দেখে যে কী ভাল লাগছে! আমি তো ভাবতেই পারিনি, এখানে এভাবে আমাদের বাড়ি চলে আসবেন”!

সীমন্তিনীও রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ দুপুরেই এসেছি আমার প্রোজেক্টের কাজে। কিছুটা কাজ করতেও পেরেছি। হঠাৎ করেই রাস্তায় কাবেরীর সাথে দেখা হয়ে গেল। আর ওই আমাকে জোর করে তোমাদের বাড়ি নিয়ে এল। আসলে তোমাদের সাথে তো আর দেখা হয়নি আমার সেদিনের পর। তাই ফেরার বাস ধরবার আগে তোমাকে কনগ্রেচুলেশন জানাতেই শুধু এসেছি গো” বলে হাতে ধরা প্যাকেটটা রচনার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “নাও তোমার জন্যে একটু মিষ্টি এনেছিলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ আর বসতে পারব না গো ভাই। আমার যে আলিপুরদুয়ারের লাস্ট বাসটা ধরতেই হবে”।

রচনা সীমন্তিনীর হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “ইশ যাব বললেই আমি আপনাকে ছেড়ে দেব ভেবেছেন? আগে ঘরে এসে বসবেন তো। অতিথি বাড়ির দোরগোড়া থেকে ফিরে গেলে গৃহস্থের অকল্যান হয় যে। আসুন আসুন, আয় কাবেরী” বলে সকলকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকতেই সীমন্তিনী দেখতে পেল বারো তের বছরের একটা ছেলে একটা ঘরের দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কৌতুহলী চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকাচ্ছে।

রচনা বাড়ির উঠোনে এসেই ‘মা মা’ বলে ডাকতেই আরেকটা ঘরের ভেতর থেকে একটা মলিন লাল পেড়ে শাড়ি পড়া এক মহিলা বেরিয়ে এলেন। মহিলার দিকে চোখ পড়তেই সীমন্তিনীর সারাটা শরীরে যেন এক শিহরণ বয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখটা অসাধারণ সুন্দর। বয়স বোধহয় চল্লিশের কাছাকাছি হবে। মনে হচ্ছে তার সামনে বুঝি স্বয়ং মা দুর্গা দরিদ্র বেশে এসে হাজির হয়েছেন। সীমন্তিনীর ইচ্ছে করছিল তখনই ছুটে গিয়ে সেই অপরূপা মাতৃ রূপিনী মহিলার পায়ে লুটিয়ে পড়তে। সীমন্তিনী সেই অপরূপাকে দেখে একটা স্থানুর মত দাঁড়িয়ে রইল।

To be continued .........
___________________________________________________________________
ss_sexy
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#10
(Update No. 14)

রচনার কথায় সে যেন তার হুঁশ ফিরে পেল। রচনা সেই অপরূপার দিকে ঈশারা করে বলল, “দিদি, ইনি আমার মা” বলে তার মাকে বলল, “মা আমি তোমাকে বলেছিলাম না জলপাইগুড়িতে একজনের সাথে আমাদের কথা হয়েছিল। ইনিই সে। সীমন্তিনী দিদি”।

বিভাদেবীও মুগ্ধ হয়ে সীমন্তিনীকে দেখে যাচ্ছিলেন। রচনার কথায় সার পেয়ে তিনি এগিয়ে আসতেই সীমন্তিনী নিচু হয়ে বিভাদেবীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মায়ের এমন রূপ আমি আর আগে কখনও দেখিনি মাসিমা”।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর মাথায় আর চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন, “বেঁচে থেক মা। সুখে থেক। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুণ”।

রচনা তার মাকে বলল, “দেখেছ মা, দিদি বাড়িতে না ঢুকেই গেটের বাইরে থেকেই চলে যেতে চাইছিলেন। এবার তুমি বল, দিদিকে কি এভাবে আমরা ছেড়ে দিতে পারি”?

বিভাদেবী মাথা নিচু করে রচনার কথার জবাবে বললেন, “কি করবি রে মা। আমাদের যে সাধ আছে সাধ্য নেই। আমাদের এমন হার হাভাতে সংসারে এমন লক্ষী প্রতিমা কি আর বেশীক্ষণ থাকতে পারে রে? তাকে যে চলে যেতেই হবে। কী দিয়ে এ প্রতিমার পূজো করব আমরা”!

বিভাদেবীর মুখের কথাগুলো যেন সরাসরি সীমন্তিনীর হৃদয়ে এসে আঘাত হানল। সে বিভাদেবীর একটা হাত নিজের দু’হাতে মুঠো করে বলল, “মাসিমা, এমন করে বলে আমাকে কষ্ট দেবেন না দয়া করে। আসলে আমি একটা কাজে এসেছিলাম এখানে। আমাকে আবার জলপাইগুড়ি ফেরত যেতে হবে আজই। আর এখান থেকে পাঁচটার পর আর কোনও বাস নেই। তাই আমাকে যে সে বাসটাই ধরতে হবে মাসিমা”।

বিভাদেবী বললেন, “তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি মা আমি। কিন্তু তুমি তো ফিরে যাচ্ছ জলপাইগুড়ি। আলিপুরদুয়ার হলেও না হয় মানতুম যে সাতটার আগেই তুমি পৌঁছে যাবে। আলিপুরদুয়ার থেকেও তো তোমাকে বাসে কিংবা ট্রেণে যেতে হবে আরও অনেকটা পথ। কত রাত হবে কে জানে। আর তুমি একা যাচ্ছ বলেই মনটা ভাল লাগছে না। তাই বলছিলাম কি, আজ রাতটা এখানে থেকে যদি তুমি কাল সকালে যেতে তাহলে ভাল হত না মা”?

কথাগুলো বলতে বলতে বিভাদেবী সীমন্তিনীর একটা গালে এমন ভাবে হাত বোলালেন যেন অভিমানী মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। সীমন্তিনী মনে করতে পারল না তার নিজের মা এভাবে তার গালে শেষ কবে হাত বুলিয়েছেন। কেমন একটা অদ্ভুত ভাল লাগার আমেজ যেন তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। তার চোখ দুটো যেন আপনা আপনি বুজে আসছিল। বিভাদেবীর কথার জবাবে সে বলল, “মাসিমা, আমি যে নিরূপায়। ফিরতে যে আমাকে হবেই। নইলে ভাই খুব চিন্তা করবে”।

______________________________
 
 
(Update No. 15)

বিভাদেবী এবার কাবেরীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে কাবেরী, আমি তো অতশত বুঝিনা রে। আচ্ছা পাঁচটার বাসে গিয়ে ও কখন জলপাইগুড়ি গিয়ে পৌঁছবে, সেটা কি আন্দাজ করতে পারছিস”?

কাবেরী জবাব দিল, “কাকিমা আমিও তো খুব সঠিক বলতে পারছিনা। তবে রাত ন’টার আগে তো কোনভাবেই পৌঁছতে পারবে না, এটা বলতেই পারি। আর শুনেছি শেষ বাসটায় নাকি সময় আরও বেশী লাগে। কে জানে, হয়ত জলপাইগুড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে রাত দশটাও হতে পারে”?

বিভাদেবী সে’ কথা শুনে প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, “ওমা, তাই নাকি রে? রাত দশটাও হতে পারে বলছিস! না না, এ কিছুতেই হতে পারে না। জেনে বুঝে তোমাকে আমি কিছুতেই আজ আর যেতে দিচ্ছি না আমি সীমন্তিনী” বলতে বলতে বিভাদেবী সীমন্তিনীর একটা হাত আঁকড়ে ধরলেন।

নিজের মনে মনে ভাবা ফন্দি মতই ঘটণাক্রম চলছে দেখে সীমন্তিনী মনে মনে খুশী হল। কিন্তু মুখে সে খুশীর ভাব ফুটিয়ে না তুলে সে বলল, “মাসিমা, আপনি মিছেমিছি এমন ভাবছেন। আমি তো কালচিনি সম্বন্ধে, এ’দিকের রাস্তাঘাট সম্বন্ধে কিছু জানতুম না। তাই সেদিন কাবেরী আর রচনার সাথে কথা বলে জেনে নিয়েছিলাম যে জলপাইগুড়ি থেকে সকালে এসে আবার ফিরে যেতে যেতে রাত হবেই। আর এখানেও থাকবার মত কোন জায়গা পাব না। কিন্তু না এসেও উপায় ছিল না আমার। তাই বাধ্য হয়েই আসতে হয়েছে। আর ভাইকেও সেভাবেই বলে এসেছি। ভাই আমাকে নিতে বাস স্ট্যাণ্ডে চলে আসবে”।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর হাত ধরে একটা ঘরের বারান্দায় উঠতে উঠতে বলল, “খোকা, তোর পড়ার টেবিল থেকে চেয়ারটা নিয়ে আয় তো। দেখ, কেমন সুন্দর আরেকটা দিদি এসেছে তোদের ঘরে। এই রচু, তখন থেকে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রয়েছিস যে বড়। কাবেরী ওদেরকে বসতে দে, আমি আসছি” বলে রচনার হাত থেকে মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে একটু দুরের একটা ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

রচনা ঘরের ভেতর থেকে দুটো মোড়া আর একটা মাদুর এনে বারান্দায় বিছিয়ে দিল। ঘরের ভেতরের ছেলেটা একটা চেয়ার এনে বারান্দায় রাখতেই রচনা বলল, “দিদি ও আমার ভাই, কিংশুক”।

কিংশুকও খুব সুন্দর দেখতে। চোখ দুটো দেখেই বোঝা যায় বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। সীমন্তিনী নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে চারটে চকলেটের প্যাকেট বের করে একটা প্যাকেট কিংশুকের হাতে দিয়ে বলল, “নাও ভাই”।

কিংশুক একটু ইতস্তত করে সীমন্তিনীর হাত থেকে চকলেটের প্যাকেটটা নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল। সীমন্তিনী বাকি প্যাকেটগুলো রচনা, কাবেরী আর কাবেরীর ভাই শিবতোষের হাতে দিতে দিতে বলল, “আমি যদি জানতুম যে কালচিনি এসে এমন দুটো ছোট ভাইকে দেখতে পাব, তাহলে ওদের জন্য কিছু উপহার অবশ্যই আনতুম। কিন্তু আপাততঃ সঙ্গে যে এর বেশী কিছু আর দেবার নেই”।

______________________________
 
 
(Update No. 16)

রচনা বলল, “তাতে কি হয়েছে দিদি। আপনি যে আমার আর কাবেরীর কথা মনে রেখেছেন এটাই তো আমাদের কাছে অনেক। তার ওপর নিজে আমাদের বাড়ি এসে আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন, এটা ভেবেই তো আমার অহঙ্কার হচ্ছে। আচ্ছা দিদি, আপনার প্রোজেক্ট ওয়ার্কের কাজ কি শেষ হয়ে গেছে? না আপনাকে আবার আসতে হবে এখানে”?

সীমন্তিনী বলল, “ঘন্টা তিনেকের মধ্যে কিছু ডাটা নোট করে নিয়েছি। এখন এ’সব থেকে রিপোর্টটাকে কতটা সাজাতে পারি দেখা যাক। যদি কোনরকমে ছ’সাত পাতার একটা রিপোর্ট বানিয়ে ফেলতে পারি, তাহলে হয়ত আর আসবার প্রয়োজন হবে না। নইলে হয়ত আরেক দিন আসতে হবে” কথা বলতে বলতে সীমন্তিনী আড়চোখে লক্ষ্য করছিল যে কিংশুক প্যাকেটটা হাতে নিয়ে শুধু দেখেই যাচ্ছিল। অন্যদের মত প্যাকেটের মোড়ক খুলে খেতে শুরু করেনি।

কাবেরী সীমন্তিনীর কথা শুনে বলল, “দিদি, পরে যদি আবার কোনদিন আসেন সেদিন কিন্তু আমাদের বাড়ি আপনাকে যেতেই হবে। কিন্তু ইশ, রচুদের মত আমাদের বাড়িতেও তো ফোন নেই। আজ তো স্কুল ছুটি ছিল বলে ভাইকে নিয়ে কাকুর বাড়ি গিয়েছিলাম। ফেরার পথে হঠাৎ করেই আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু পরে যেদিন আসবেন সেদিন হয়ত আমরা স্কুলেই থাকব”।

সীমন্তিনী একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে দেখে বলে উঠল, “ওমা, এ যে সাড়ে চারটে বেজে গেল! আমাকে তো এবার উঠতে হবে গো রচনা। মাসিমা কোথায় গেলেন, একটু ডাক না ভাই। তাকে আর একবার প্রণাম করে যাই”।

রচনা কিছু বলবার আগেই বিভাদেবী দু’হাতে দুটো প্লেট নিয়ে তাদের দিকে আসতে আসতে বললেন, “আজ আর আমি তোমায় যেতে দিচ্ছি না মা। আজ রাতটা এ গরীব মাসিমার বাড়িতে দুটো ডাল ভাত খেয়ে কাটিয়ে দাও। কাল সকালে আর তোমায় আটকাব না” বলতে বলতে সীমন্তিনীর কাছে এসে তার দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “এ মিষ্টিটুকু আপাততঃ মুখে দাও, নাও। নে কাবেরী” বলে অন্য প্লেটটা কাবেরীর হাতে দিয়ে বললেন, “রচু মা, রান্নাঘরে আরেকটা প্লেট সাজিয়ে রেখেছি। সেটা এনে শিবকে দে তো মা”।

তারপর সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “সীমন্তিনী মা, তুমি চা খাও তো”?

সীমন্তিনী প্লেটটা হাতে নিয়ে দেখল, একটু আগে সে মিষ্টির দোকান থেকে যে মিষ্টিগুলো এনেছিল, সে গুলোই তার প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগন্তুক অতিথিকে খেতে দেবার মত ঘরে বোধ হয় আর কিছু ছিল না। বাড়ি ঘরের অবস্থা দেখে এতক্ষনে সে খুব ভাল ভাবেই বুঝে গেছে যে এদের আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভাল নয়। সীমন্তিনী বিভাদেবীর কথার জবাবে বলল, “মাসিমা, যেতে যখন দেবেনই না, তখন আর তাড়াহুড়ো করবার তো আর দরকার নেই। তাই এসব না হয় একটু পরেই খাব। কিন্তু কাবেরী তুমি খেয়ে নাও ভাই। তোমার বাড়ি যেতে দেরী হলে তোমার বাড়ির লোকেরা তো আবার চিন্তা করবেন। আর

______________________________
 
 
(Update No. 17)

মাসিমা, আপনিও একটু বসুন না এখানে। আচ্ছা মাসিমা, মেসোমশাইকে দেখছি না তো। তিনি কি বাইরে কোথাও গেছেন”?

বিভাদেবী জবাবে বললেন, “হ্যা মা, উনি একটু বাজারে গেছেন। আর একটু বাদেই হয়ত এসে পড়বেন”।

সীমন্তিনী এবার তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিংশুকের একটা হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার ভাই? চকলেটটা তোমার পছন্দ হয়নি? খাচ্ছ না যে”?

কিংশুক একটু থতমত খেয়ে বলল, “না না দিদি। খুব পছন্দ হয়েছে আমার। আমি তো এমনি এমনি তোমায় দেখছিলাম একটু”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “আমায় দেখছিলে? কেন ভাই? আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে যে আমি ভিন গ্রহের বাসিন্দা? বা চিড়িয়াখানার কোন আজব জন্তু”?

কিংশুক সরল নিষ্পাপ কন্ঠে বলল, “তুমি না খুব সুন্দর। একেবারে সরস্বতী প্রতিমার মত দেখতে তুমি”।

সীমন্তিনী আদর করে কিংশুকের গাল টিপে দিয়ে বলল, “আর আমার এ ভাইটাও তো কার্তিকের মত সুন্দর। খুব মিষ্টি তুমি। কিন্তু চকলেটটা তুমি যেভাবে ধরে রেখেছ এভাবে বেশীক্ষণ হাতে ধরে রাখলে এটা তো নরম হয়ে যাবে ভাই। তুমি যদি এটা পরে খেতে চাও তাহলে ঘরের ভেতরে কোথাও রেখে এস”।

রচনা তখন আবার ফিরে এসে বসেছে। সীমন্তিনী নিজের প্লেট থেকে একটা মিষ্টি তুলে রচনার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও তো রচনা। আমার সাথে একটু শেয়ার কর। মাসিমা তো আমাকে প্লেট ভর্তি করে দিয়েছেন। এতটা আমি কিছুতেই খেতে পারব না”।

রচনা বলল, “না না দিদি, ওটুকু আপনাকে খেতেই হবে”।

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “হ্যা খাব তো বটেই। কিন্তু তোমাকে আর তোমার ভাইকে আমার প্লেট থেকে অন্ততঃ একটা একটা মিষ্টি নিতেই হবে। নইলে আমিও খাবনা কিন্তু”।

রচনা সীমন্তিনীর হাত থেকে মিষ্টিটা নিতে নিতে বলল, “ঠিক আছে দিদি। এই একটা নিয়ে আমি আর ভাই শেয়ার করে খাচ্ছি। বাকিগুলো আপনাকেই খেতে হবে”।

সীমন্তিনী আর কিছু না বলে মিষ্টি খেতে লাগল।

______________________________
 
 
(Update No. 18)

কিংশুক এবার রচনার কাছে গিয়ে বলল, “এই ছোড়দি, আমার চকলেটের মোড়কটা সুন্দর করে খুলে দিবি? একটুও যেন ছিঁড়ে না যায়”।

রচনা জিজ্ঞেস করল, “মোড়কটা ছিঁড়ে ফেলে দে না”।

কিংশুক বলল, “না না, ওটা একটা অন্য কাজে লাগবে আমার। তাই তো তোকে দিচ্ছি, মোড়কটা না ছিঁড়ে আস্তে করে খুলে দে না”।

সীমন্তিনী নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে মোবাইলটা বের করে বলল, “মাসিমা আমি একটু আমার ভাইকে ফোন করে জানিয়ে দিই যে আমি আজ এখানে থেকে যাচ্ছি” বলে বারান্দা থেকে নেমে উঠোনের একদিকে গিয়ে সতীশকে ফোন করে বলল, “হ্যা সতু”।

সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার রে বড়দি। সারাটা দিন কেটে গেল একটা ফোনও করিস নি। আমার তো খুব চিন্তা হচ্ছিল রে। তুই এখন কোথায় আছিস, বল তো? কখন ফিরবি”?

সীমন্তিনী বলল, “শোন ভাই, আমি তো পাঁচটার বাসে এখান থেকে রওনা হব ভেবেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারছিনা রে। তুই কিছু চিন্তা করিস না ভাই। আমি ঠিক আছি। এখন কালচিনিতেই আছি। আর ভাবিস না, ভাল জায়গাতেই আছি। কাল ফিরব আমি”।

সতীশ জিজ্ঞেস করল, “ওদের বাড়িটা খুজে পেয়েছিস? দেখা হয়েছে ওদের বাড়ির কারুর সাথে”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে ভাই, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছিলাম, তার অনেকটাই পূর্ণ হয়ে গেছে। বাকিটুকু নিজে চেষ্টা করলেই হয়ে যাবে বোধ হয়। আর শোন, তোকে সেদিন বললাম না? ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে কাবেরী আর রচনা বলে কালচিনির দুটো মেয়ের সাথে আমার কথা হয়েছিল। ওই কাবেরীর সাথে হঠাৎ রাস্তায় দেখা হয়েছে আমার। কাবেরীই আমাকে নিয়ে এসেছে রচনাদের বাড়িতে। এখন ওদের বাড়িতেই আছি রে। আর মাসিমা, মানে রচনার মা-ই আমাকে আর যেতে দিচ্ছেন না। উনি খুব ভাল মানুষ রে। বলছেন রাতটা এখানে থেকে কাল চলে যেতে। তাই তুই কিচ্ছু ভাবিসনা। আমি একদম ঠিক আছি। আর শোন, বাড়িতে কাউকে কিছু বলিস না এখন। শুধু দাদাভাইকে ফোন করে বলে দিস যে আমার ফোন সুইচড অফ থাকবে আজ রাতে। কাল জলপাইগুড়ি গিয়ে আমি সকলের সাথে কথা বলব। ব্যাটারীর চার্জ থাকবে না মনে হচ্ছে। তাই সুইচ অফ করে রাখব। তুইও ভাবিস না, কেমন”।

সীমন্তিনীর ফোনে কথা বলার সময়ই বাড়ির গেট দিয়ে একজন ধুতি পাঞ্জাবী পড়া বয়স্ক লোক বাড়িতে ঢুকেছিলেন। তার হাতে একটা বাজারের ব্যাগ ধরা ছিল। সীমন্তিনী অনুমান করেছিল ইনিই বুঝি রচনার বাবা। ফোনের কথা শেষ করে বারান্দার দিকে এগোতেই রচনা বলল, “দিদি, এই যে আমাদের বাবা এসে গেছেন”।

______________________________


 
 
(Update No. 19)

সীমন্তিনী এগিয়ে গিয়ে বিধুবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। বিধুবাবু তার মাথায় আলতো করে হাত ছুইয়ে দিয়ে বললেন, “বেঁচে থেক মা, ভাল থেক। তুমি বস, আমি একটু ওর মায়ের সাথে একটা কথা সেরে নিই। তারপর হাত মুখ ধুয়ে তোমার সাথে কথা বলছি” বলে বিভাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে পাশের আরেকটা ঘরে ঢুকে গেলেন।

কাবেরী বলল, “এই রচু, এবার তো আমায় উঠতে হবে রে। আর শোন, সীমন্তিনীদি যদি কাল একটু বেলা করে বেরোন, তাহলে আমাদের বাড়ি নিয়ে যাস একটু তাকে”।

সীমন্তিনী বলল, “ওমা? তুমি কাল যাবার কথা বলছ কাবেরী? আমি তো এখনই যাব ভাবছিলাম”।

কাবেরী খুব খুশী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছেন দিদি? আপনি যাবেন”?

সীমন্তিনী একটু দুষ্টুমি করে হেসে বলল, “তুমি নিয়ে যেতে না চাইলে আর যাব কি করে বল ভাই। কিন্তু তোমরা যদি আমার দুটো শর্ত মেনে নাও, তাহলে এখনই যাব তোমাদের বাড়ি”।

কাবেরী একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা এতে আবার শর্তের কথা আনছেন কেন দিদি”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সেটা শর্তটা শুনলেই বুঝতে পারবে তোমরা। শোনো, তোমাদের এই মিষ্টি মিষ্টি ভাই বোন গুলোর মুখে আপনি আপনি শুনতে আমার আর ভাল লাগছে না। আর দ্বিতীয় শর্তটা হচ্ছে তোমার সাথে শুধু আমি একা নই রচনা আর কিংশুকও যাবে”।

কথাটা শুনেই কিংশুক লাফ মেরে সীমন্তিনীর কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “ঠিক বলেছ দিদি তুমি। তোমার মত এমন মিষ্টি একটা দিদিকে আপনি করে বলতে আমারও একদম ভাল লাগছেনা গো। কিন্তু তোমাকে কী বলে ডাকব বল তো? আমার তো বড়দি আর ছোড়দি আছে। তোমাকে কি দিদি বলব”?

সীমন্তিনী আদর করে কিংশুকের হাত ধরে বলল, “তোমার বড়দিও আছে বুঝি? তা বেশ, তোমার যখন
বড়দি ছোড়দি সবই আছে, তখন আমাকে না হয় বুড়িদিদি বলে ডেক তুমি”।

সবাই হো হো করে উঠল সীমন্তিনীর কথা শুনে। কিংশুক লজ্জা পেয়ে বলল, “ধ্যাত, তাই বলে কি ডাকা যায়? তুমি কি বুড়ি নাকি যে তোমাকে অমন নামে ডাকব? আমি তোমাকে দিদিভাই বলে ডাকব”।

কাবেরী বারান্দা থেকে নেমে বলল, “বেশ দিদি, তোমার শর্ত মেনে নিলাম আমরা। তাহলে রচু, আর দেরী না করে চল বেরিয়ে পড়ি আমরা। একটু বাদেই সন্ধ্যে হয়ে যাবে”।

______________________________
 
 
(Update No. 20)

রচনাও বারান্দা থেকে নামতে নামতে বলল, “দাঁড়া, মাকে বলে আসছি’ বলে যে ঘরে বিভাদেবী আর বিধুবাবু ঢুকেছিলেন, সে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। খানিক বাদেই রচনার সাথে বিভাদেবীও বাইরে এসে সীমন্তিনীকে বললেন, “তোমরা কাবেরীদের বাড়ি যাবে? বেশ তো, যাও একটু ঘুরে এস। তবে মা খুব বেশী রাত করো না। কেমন”?

কাবেরীদের বাড়িতে চা খেয়ে সীমন্তিনী রচনা আর কিংশুককে নিয়ে রাস্তায় এসে রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের এখানে আসল বাজারটা কোন দিকে গো রচনা”?

রচনা একদিকে ঈশারা করে বলল, “এই তো এদিকে, কাছেই”।

সীমন্তিনী কিংশুকের হাত ধরে যেতে যেতে বলল, “চল না, একটু বাজার দিয়ে ঘুরে যাই। অসুবিধে হবে কিছু”?

রচনা বলল, “না অসুবিধের কিছু নেই দিদি। কিন্তু মা তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে বলেছেন বলেই ভাবছি। তবে চল, ওদিকের রাস্তা দিয়েই চলে যাব বাড়ি”।

সীমন্তিনী এবার কিংশুককে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা কিংশুক, তোমাকে যদি তোমার এ দিদিভাই আজ কিছু একটা উপহার দিতে চায়, তাহলে তুমি কি নেবে”?

কিংশুক কিছু জবাব দেবার আগেই রচনা বলল, “না না দিদি, এসব কি বলছ তুমি? মা বাবা কিন্তু তাহলে আমাকেই বকবেন”।

সীমন্তিনী বলল, “কেউ তোমাকে বকবেন না। আচ্ছা রচনা, তুমি আমাকে একটা কথা বল তো ভাই। তোমার বড়দিকে তো দেখতে পাইনি। সে কোথায় গো”?

রচনা জবাব দিল, “দিদির তো বিয়ে হয়ে গেছে বছর তিনেক আগেই। সে তো তার শ্বশুর বাড়িতে। তাই তাকে দেখতে পাচ্ছ না”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “ও তোমার চেয়ে বুঝি সে বয়সে বেশ বড় তাই না”?

রচনা সীমন্তিনীর প্রায় গা ঘেঁসে যেতে যেতে জবাব দিল, “ঠিক তা নয় গো দিদি। দিদি তো আমার চেয়ে মাত্র দু’বছরের বড়। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করবার কয়েক মাস পরেই এই বছর তিনেক আগে দিদির বিয়ে হয়েছে”।

______________________________
 
 
(Update No. 21)

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “ওমা, সে কি কথা? ষোল সতের বছর বয়সেই তার বিয়ে দেওয়া হয়েছে”?

রচনা বলল, “হ্যাগো দিদি, বলতে বা শুনতে যতই খারাপ লাগুক না কেন, সেটাই সত্যি। আসলে তুমি হয়ত আমাদের বাড়ির অবস্থা দেখে বুঝতেই পেরেছ যে আমরা খুব গরীব। কিন্তু জান দিদি, আমার দিদি আমার চাইতে অনেক সুন্দরী ছিল। পাড়ার সবাই বলত দিদি নাকি রাজরানীর মত রূপ নিয়ে জন্মেছিল। দিদি মাধ্যমিক পাশ করতেই এক ঘটক দিদির জন্যে এক পাত্রের খোঁজ এনেছিল। তাদের কোন দাবী দাওয়া নেই, বাড়ি ঘরের ভাল অবস্থা, পাত্র সরকারী স্কুলে চাকরি করে, এসব শুনে বাবা মা দিদির বিয়ে দিয়ে দিল। দিদির শ্বশুর বাড়িও এখান থেকে কাছেই। সামান্য দুরে একটা গ্রামেই। কিন্তু বিয়ের পর দ্বিরাগমন সেরে যাবার পর থেকে সে দিদিকে আর চোখের দেখা দেখিনি আমরা কেউ। বাবা বেশ কয়েকবার দিদির শ্বশুর বাড়ি গেলেও তারা কেউ দিদির সাথে তাকে দেখা করতে দেয় নি। বলেছে, যে বাবা মেয়েকে বিয়ের সময় এক রত্তি সোনাও দিতে পারেনা, তার কোন যোগ্যতাই নেই তার মেয়ের মুখ দেখবার। অপমান করে, যথেচ্ছ গালিগালাজ করে বাবাকে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল”।

সীমন্তিনী রচনার মুখে হাত চাপা দিয়ে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “চুপ চুপ রচনা। আর কিছু বলনা এখন। ভাই এসব শুনে মন খারাপ করে ফেলতে পারে”।

রচনা নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে বলল, “আচ্ছা দিদি”।

বাজারে গিয়ে ঢুকতে ঢুকতেই সন্ধ্যে হয়ে গেল। কিংশুকের পছন্দ মত একটা ব্যাটারি চালিত ভিডিও গেম আর বাড়ির জন্যে আরও কিছু মিষ্টি কিনে তারা আবার বাড়ির পথ ধরল। বাড়ি ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। আশেপাশের সব বাড়িতে আলো জ্বললেও রচনাদের বাড়িটা অন্ধকার। বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে দেখে একটা ঘরের বারান্দায় একটা হ্যারিকেন লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখা।

কিংশুক বাড়িতে ঢুকেই ছুটে মায়ের কাছে গিয়ে বলল, “মা মা, দেখ, দিদিভাই আমাকে এটা কিনে দিয়েছে, ভিডিও গেম”।

সীমন্তিনী কিংশুকের কাছে এসে বলল, “ভাই তোমার দিদিভাইয়ের একটা কথা রাখবে তুমি”?

কিংশুক খুশী হয়ে বলল, “হ্যা দিদিভাই, বলনা কি করতে হবে”।

সীমন্তিনী তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “শোনো ভাই, এটাকে শুধু ভিডিও গেম ভেব না। এটা কিন্তু তোমার প্রতি তোমার দিদিভাইয়ের ভালবাসাও, বুঝেছ? তাই দিদিভাইয়ের ভালবেসে দেওয়া এ উপহারের সাথে দিদিভাই তোমাকে দুটো কথাও বলবে। সেটা কিন্তু তোমাকে রাখতে হবে ভাই”।



____________________________________________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#11
(Update No. 22)

কিংশুক এবার আস্তে করে বলল, “হ্যা দিদিভাই বল। আমি তোমার সব উপদেশ মানব”।

সীমন্তিনী বলল, “এই খেলনাটা নিয়ে যখন তখন খেলতে খেলতে পড়াশোনার কথা ভুলে গেলে কিন্তু ভাল হবে না ভাই। পড়াশোনাটা কিন্তু ঠিকঠাক করতে হবে তোমাকে। নইলে আমি কিন্তু খুব রাগ করব, খুব দুঃখ পাব। তুমি কি তোমার এ দিদিভাইকে দুঃখ দিতে চাও”?

কিংশুকের মুখে চোখে একটু হতাশার চিহ্ন এলেও সে মুখে বলল, “এত দামী উপহার আর কেউ কখনও দেয়নি আমাকে দিদিভাই। তাই তোমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি আমি পড়াশোনায় কোন গাফিলতি করব না। রোজকার পড়াশোনা ভালভাবে সেরেই তবেই আমি এটা নিয়ে খেলতে বসব”।

সীমন্তিনী কিংশুকের মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলল, “লক্ষী ভাই আমার। এবার হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে গিয়ে পড়তে বসবে কেমন? আমি মা বাবা আর ছোড়দির সাথে কিছুক্ষন কথা বলে তোমার কাছে যাব। তখন তুমি আমার সামনে এটা নিয়ে প্রথমবার খেলবে। ঠিক আছে”?

কিংশুক মাথা নেড়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বললেন, “তুমি এক কাজ কর মা। সকাল থেকে তো এসবই পড়ে আছ তুমি। রচুর কোন কিছুই তো তোমার মাপের হবে না। আমি আমার
একটা শাড়ি দিচ্ছি। তুমি শাড়ি পড় তো”?

সীমন্তিনী বলল, “মাসিমা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমার সাথে এক্সট্রা পোশাক আছে। ফেরার পথে যদি কোথাও রাতে আঁটকে যাই, একথা ভেবেই আমি রাতে পড়বার জন্যে একটা নাইটি সঙ্গে করে এনেছি। আমি সেটাই পড়ে নেব, ভাববেন না”।

বিভাদেবী রচনাকে বললেন, “রচু, তুই তাহলে দিদিকে তোর ঘরে নিয়ে যা। আর তোরা দু’জনেই হাত মুখ ধুয়ে নে। দিদিকে সব কিছু দেখিয়ে টেখিয়ে দিস। অন্ধকারে ওকে একা কোথাও যেতে দিস নে”।

রচনা সীমন্তিনীকে নিয়ে একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। লন্ঠনের মৃদু আলোতে দেখল সে ঘরের ভেতর একটা পার্টিশান করে দুটো আলাদা আলাদা রুম করা হয়েছে। দেখেই বোঝা যায় প্রথম ভাগটা কিংশুকের। সেখানে একটা খাট ছাড়াও পড়ার টেবিল চেয়ার আছে। রচনার সাথে ভেতরের অংশে ঢুকে দেখে সেখানেও একই রকমের হলেও খাটটা একটু চওড়া। দু’জন অনায়াসে শোয়া যাবে। সেখানেও রচনার পড়ার টেবিল ছাড়াও একটা আলমারী আর আলনা দেখা গেল।

পোশাক চেঞ্জ করতে করতে সীমন্তিনী রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি থাকাতে তোমার নিশ্চয়ই পড়াশোনার ক্ষতি হবে। তোমার স্কুল কি এখন খোলা রচনা”?

______________________________
 
 
(Update No. 23)

রচনাও নিজের পোশাক পাল্টাতে পাল্টাতে বলল, “না দিদি, এখন তো আমাদের স্কুল বন্ধ। ইলেভেন ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। মাস দুয়েক বাদে বারো ক্লাসের পড়াশোনা আরম্ভ হবে। তাই এখন আর আপাততঃ পড়াশোনার ঝামেলা নেই তো”।

অন্ধকারে একহাতে লন্ঠন নিয়ে অন্যহাতে সীমন্তিনীর হাত ধরে রচনা বাড়ির রান্নাঘরের পেছন দিকে তাদের কলতলায় নিয়ে গেল। কলতলার পাশেই দড়মার ঘেরা দেওয়া ছোট একটা স্নানের জায়গা। তার ঠিক পাশেই একই রকমের দড়মায় বেড়া দিয়ে ঘিরে মেয়েদের ইউরিনাল বানানো হয়েছে। আর অনেকটা পেছন দিকে টালির চালা আর টিনের বেড়া দেওয়া একটা পায়খানা। এ ছাড়া বাড়িতে আর মোট তিনখানা ঘর আছে। সবগুলোরই ওপরে টালি আর চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া। সে তিনটের একটা হচ্ছে রান্নাঘর। একটা কিংশুক আর রচনার থাকবার ঘর। আর অন্যটা রচনার বাবা মায়ের থাকবার ঘর। সবগুলো ঘরের মেঝেই মাটির। কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর ভাবে মাটি দিয়ে লেপা।

হাত মুখ ধুয়ে ঘরে এসে দেখে কিংশুক লন্ঠনের আলোয় পড়তে শুরু করেছে। রচনার সাথেই সীমন্তিনী রান্নাঘরের বারান্দায় এসে জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা, আমি কি এ ঘরে ঢুকতে পারি”?

বিভাদেবী তখন মাটির উনুনে কাঠের খড়ি জ্বালিয়ে রান্না শুরু করেছিলেন। সীমন্তিনীর গলা শুনেই চমকে উঠে বললেন, “ওমা। মেয়ের কথা শোন। এস এস মা। কিন্তু এসব দেখে তো তোমার ভাল লাগবে না মা। এমন রান্নাঘরের কল্পনাও হয়ত তোমরা করতে পারবে না। ওরে ও রচু, যা ও’ঘর থেকে একটা মোড়া এনে দিদিকে বসতে দে”।

সীমন্তিনী ঘরের কাঠের খুটির সাথে দু তিনটে পিড়ি দেখে রচনার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “কোত্থাও যেতে হবে না। এ পিড়িগুলোতেই তো বসা যাবে” বলে নিজেই একটা পিড়ি পেতে বিভাদেবীর পাশে বসে পড়ল। রচনাও তার পাশে বসল।

সীমন্তিনী দেখল রান্নাঘরটার ভেতরেও পার্টিশান করা আছে। মাটির উনোনের ওপরে একটা লোহার কড়াই চাপিয়ে কিছু একটা রান্না হচ্ছে। তা দেখে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কি ডাল রান্না করছেন মাসিমা? গন্ধ শুনে তো মনে হচ্ছে মুগের ডাল বানাচ্ছেন, তাই না”?

বিভাদেবী বললেন, “হ্যা মা ঠিক ধরেছ তুমি। ডাল ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়াবার মত সামর্থ্য যে
তোমার এ গরীব মাসিমার নেই মা। তোমার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হবে খেতে”।

এমন সময় বিধুবাবু হাতে মোড়া নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বললেন, “তোমরা সবাই এখানে? একা একা ও ঘরে বসে থাকতে ভাল লাগছে না আমার। তাই এখানে চলে এলাম। সীমন্তিনী মায়ের সাথে তো আমার কথাই হল না”।

______________________________
 
 
 
(Update No. 24)

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা মেসোমশাই, বসুন না এখানেই”।

বিধুবাবু মোড়ায় বসে বললেন, “তা মা, তুমি কি জলপাইগুড়িতেই থাকো”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যা মেসোমশাই, আমি আর আমার ভাই দু’জনেই জলপাইগুড়িতে থাকি। আমি এমএ পড়ছি। আর আমার ভাই বিএসসি ফাইনাল দিল এবার”।

বিধুবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, “বাঃ বাঃ, বেশ ভাল। আর তোমাদের বাবা মা”?

সীমন্তিনী বলল, “তারা জলপাইগুড়ির কাছে আমাদের বাড়িতে আছেন। কিন্তু আমাদের ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস আর কলেজ থেকে বাড়ি বেশ দুরে বলে আমি আর আমার ভাই একসাথে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে জলপাইগুড়িতে আছি”।

বিভাদেবী তার স্বামীকে বললেন, “বাব্বা, তুমি দেখছি মেয়েটাকে জেরা করতে শুরু করলে গো। রচু আর কাবেরীর সাথে ওর জলপাইগুড়িতে দেখা হয়েছিল। আজ একটা কাজে এসেছিল এখানে। কাবেরীর সাথে রাস্তায় দেখা হল বলে কাবেরীই সাথে করে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসেছে ওকে। ওর জলপাইগুড়ি ফিরে যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে বলে আমিই ওকে জোর করে রেখে দিয়েছি এখানে। একা একা এমন সোমত্ত একটা মেয়ে রাতের বেলায় এতটা পথ যাবে, এটা ভেবেই আমি.....”

বিধুবাবু একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, “আরে তুমি আমাকে এমন করে বলছ কেন? ওর সাথে তো আমার কথাই হয়নি। তাই একটু কথা বলতে এলাম। আর কথা বলতে গেলে তার পরিচয়টা তো জেনে নেওয়া দরকার। আর তুমি এটাকে জেরা বলে ভাবছ কেন? আমি কি একবারও বলেছি যে ও কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে এখানে এসেছে। ওকে দেখেই তো বোঝা যায় ও খব ভদ্র ঘরের খুবই ভাল একটা মেয়ে। এমন মা লক্ষীর মত দেখতে মেয়েটার সাথে দুটো কথাও বলতে দেবেনা আমায়”?

রচনা কিছু একটা বলতে যেতেই সীমন্তিনী তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “মেয়েকে নিয়ে বাবা মার ভেতরে এমন ঝগড়া দেখে আমার তো বেশ লাগছে। মাসিমা আপনি একটু মেসোমশাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ান না। আমার মনের অনেকদিনের একটা সাধ পূর্ণ করে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। একটুখানি সময়ের জন্য আসুন না, প্লীজ”।

বিভাদেবী উনোনের কাছ থেকে উঠে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী তার হাত ধরে বিধুবাবুর দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আপনিও উঠুন না মেসোমশাই”।

বিধুবাবু উঠে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী তার পাশে বিভাদেবীকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে দু’পা পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দু’জনের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল। তার মনে পড়ে গেল নিজের বাবা মায়ের

______________________________
 
 
 
(Update No. 25)

কথা। ছোটবেলা থেকেই বাবা মার ভালবাসা সে হারিয়ে বসেছে। অবশ্য সীমন্তিনী নিজেই জানে, এতে তার মা বাবার কোন দোষ নেই। সব দোষ তার নিজের। অবোধাবস্থা থেকে নিজের দাদাভাইকে ভালবেসে সে আর সবার ভালবাসা হারিয়ে বসেছে। তার চোখের কোল দুটো ভিজে উঠল। নিজেকে সামলাতে না পেরে সে হাঁটু গেঁড়ে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করল।

অনেকক্ষণ কেটে যাবার পরেও সীমন্তিনীকে উঠতে না দেখে বিভাদেবী, বিধুবাবু আর রচনা একে অপরের মুখের দিকে দেখতে লাগল। হঠাৎ বিধুবাবুর মনে হল তার পায়ের পাতাটা ভেজা ভেজা। তিনি চমকে উঠে বললেন, “রচু ওকে ওঠা শিগগীর। ও বোধহয় কাঁদছে রে”।

বিভাদেবী আর রচনা দু’জনে ধরাধরি করে সীমন্তিনীকে প্রায় টেনে ওঠাল। বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “একি মা? তুমি কাঁদছ কেন? শান্ত হও মা। ছিঃ ছিঃ। ও রচু, ওকে এক গ্লাস জল এনে দে তো মা”।

রচনা তাড়াতাড়ি করে ছুটে গিয়ে জলের কুজো থেকে জল এনে সীমন্তিনীর মুখের সামনে গ্লাসটা ধরে বলল, “ও দিদি, একটু জল খাও না, হাঁ কর”।

সীমন্তিনী দু’ঢোক জল খেয়ে গ্লাসটা সরিয়ে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে রচনা। সরি। তোমাদের সবাইকে অপ্রস্তুত করে ফেলেছি তাই না? কিন্তু মাসিমা আপনি আর মেসোমশাই আমার মাথায় হাত দিয়ে একটু আশীর্বাদ করবেন না”?

বিধুবাবু আর বিভাদেবী একই সাথে সীমন্তিনীর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। বিভাদেবী রচনাকে বললেন, “যা রচু, উনোন থেকে ধোয়া বেরচ্ছে। ওর কষ্ট হবে। তুই ওকে নিয়ে আমাদের ঘরে গিয়ে বসগে। খোকা পড়ছে, ওর পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাস না”।

নিজের চোখ মুছতে মুছতে রচনার সাথে সীমন্তিনী এসে বিভাদেবীর ঘরে বসতেই পেছন পেছন বিধুবাবুও সে ঘরে ঢুকে বললেন, “কিরে রচু? ও ঠিক আছে তো? উঃ মেয়েটার কাণ্ড কারখানা দেখে তো আমি ঘাবড়ে গেছি রে”।

রচনাও উদবিঘ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, তুমি ঠিক আছ তো? বল না, তোমার কি শরীর খারাপ
লাগছে”?

সীমন্তিনী মাথা নিচু করে রচনাকে আশ্বস্ত করে বলল, “না রচনা। আমি ঠিক আছি। কিচ্ছু হয়নি আমার, ভেব না। মেসোমশাই আপনি বসুন না”।


______________________________
 ss_sexy
 
Like Reply
#12
(Update No. 26)

বিধুবাবু খাটের এক কোনায় বসে বললেন, “যাক বাবা। আমাকে তো তুমি খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে মা। প্রণাম করতে গিয়ে কেঁদে পা ভাসিয়ে দিলে আমাদের? আমার জীবনেও আমি এমন ঘটণার কথা শুনিনি”।

সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আমি আপনাদের ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি মেসোমশাই। আসলে জ্ঞান হবার পর থেকে নিজের বাবা-মাকে কখনও এভাবে প্রণাম করার সুযোগ পাইনি। তাই বোধহয় একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম আমি। সেজন্যে আমাকে ক্ষমা করবেন মেসোমশাই”।

বিধুবাবু বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে মা। তুমি ও নিয়ে ভেব না। রচু, তোরা এ ঘরে বসেই কথা বল। আমি একটু ওদিকে দেখছি” বলে আবার বাইরে চলে গেলেন।

সীমন্তিনী প্রসঙ্গ পাল্টে রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রচনা, তুমি তো এবারেই বারো ক্লাসে উঠছ। তা বারো ক্লাসের পর কি করবে ভাবছ”?

রচনা বলল, “জানিনা গো দিদি। আমার কপালে যে কী আছে কে জানে। বাবা তো মাধ্যমিকের পরেই আমায় পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বলেছিলেন। শুধু আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল স্যার আমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন বলে বারো ক্লাস অব্দি পড়ার সুযোগটা পেয়েছি। এরপর হয়ত আবার একটা আধবুড়ো দোজবর পাত্র খুঁজে এনে বাবা দিদির মত করেই আমারও একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন”।

সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে চমকে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি রচনা? মাসিমা মেসোমশাই তোমাকে আধবুড়ো দোজবরের সাথে বিয়ে দেবেন”?

রচনা মাথা নিচু করে বলল, “তাদের আর কি দোষ দেব দিদি? অভাবের সংসারে যখন দু’দুটো মেয়েকে বিয়ে দেবার বোঝা কাঁধে চেপে বসে, তখন সব কন্যাদায়গ্রস্ত মা বাবাই বুঝি এমন করতে বাধ্য হয়। নইলে আমার দিদির কি এমন পরিণতি হত”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা, তখন তুমি রাস্তাতেও তোমার দিদির ব্যাপারে কিছু বলতে চাইছিলে। আমি তো একজন বাইরের মেয়ে। তাই জিজ্ঞেস করাটা হয়ত ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু তোমার দিদির ব্যাপারে আমার জানতেও খুব ইচ্ছে করছে”।

রচনা বলল, “দিদির কথা মনে পড়লেই মনটা খুব খারাপ হয়ে যায় গো দিদি। ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস
করেই বাবা দিদির বিয়েতে মত দিয়েছিলেন। ঘটক বলেছিল, পাত্র পক্ষের কোন দাবীদাওয়া নেই। তাদের আর্থিক অবস্থা খুব ভাল। ভাল বাড়িঘর। অনেক জমিজমা সম্পত্তি আছে তাদের। বাবার মনে হয়েছিল তার মেয়ের জন্য যেচে আসা এ সম্মন্ধটাকে হাতছাড়া করা একেবারেই উচিৎ হবেনা। তাই সে পাত্রের সাথেই দিদির বিয়ে দিয়েছিলেন। দিদি যখন দ্বিরাগমনে এসেছিল তখনও আমি অতটা বুঝিনি। কিন্তু বিয়ের মাস দুয়েক বাদে অনেক কষ্টে শ্বশুর বাড়ির লোকদের চোখে ফাঁকি দিয়ে দিদি আমাদের গ্রামের একটা লোকের

______________________________
 
 
(Update No. 27)

হাতে আমার নামে একটা চিঠি পাঠিয়েছিল। তাতে লিখেছিল যে আমার জামাইবাবুর আগের পক্ষের যে দুটো ছেলে আছে, তাদের একজনের বয়স বারো, আর অন্যজনের দশ। আর জামাইবাবু রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে দিদিকে মারধর করে। সারাদিন শ্বশুর শাশুড়ি তার ওপর নাকি অকথ্য অত্যাচার করে। এমনকি তার সৎ ছেলে দুটোও নাকি কারনে অকারনে দিদির ওপর হাত ওঠায়। দিদির অপরাধ শুধু এটুকুই যে সে বাপের বাড়ি থেকে কোন দান সামগ্রী কোন যৌতুক নিয়ে যেতে পারেনি। আর এ অপরাধেই দিদিকে মুখ বুজে শ্বশুর বাড়ির সমস্ত অত্যাচার সয়ে যেতে হচ্ছে”।

রচনার কথা শুনে সীমন্তিনী আঁতকে উঠে বলল, “ইশ, কি বলছ তুমি রচনা”?

রচনা নিজের চোখের কোলে এসে জমা হওয়া জলগুলো হাতের চেটোয় মুছতে মুছতে বলল, “হায়ার সেকেণ্ডারির পর তো কলেজে যেতে হবে। তখন আর আমাকে স্কলারশিপ পাবার ব্যবস্থা কে করে দেবে। আর ইচ্ছে থাকলেও বাবা আর আমাকে পড়াতে পারবেন না, জানি। তখন তো আমাকেও তারা বিয়ে দিতে চেষ্টা করবেন। যৌতুক দান সামগ্রী দেবার সামর্থ্য তার এখনও নেই। তাই আমার কপালেও হয়ত দিদির মত পরিণতিই লেখা আছে” বলতে বলতে রচনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

সীমন্তিনীর বুকের ভেতরটা রচনার কান্না দেখে যেন মোচড় দিয়ে উঠল। দু’হাতে রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। অনেকক্ষণ বাদে রচনার কান্না থামতে সীমন্তিনী বলল, “তুমি দেখতে এত সুন্দর! এমন মিষ্টি। তোমার নিশ্চয়ই ভাল বিয়ে হবে দেখ রচনা। ভেঙে পোরো না। ভগবান তোমার প্রতি এতটা নিষ্ঠুর কখনই হবেন না”।

রচনা ম্লান হেসে বলল, “এটা যে শুধুই সান্ত্বনার কথা দিদি, সেটুকু বোঝবার ক্ষমতা আমার আছে গো। আমার দিদি তো আমার চেয়েও ঢের বেশী সুন্দরী ছিল। তার কপালে কেন তাহলে এমনটা হল, বলতে পার”?

সীমন্তিনী রচনাকে আরো জোরে নিজের বুকে চেপে ধরল। তার চোখ দুটোও জলে ভরে গেল। নিজের গলা দিয়েও যেন আর কথা বেরোচ্ছিল না তার। আর রচনা। প্রচণ্ড জলস্রোতে ভেসে যাওয়া একটা পিঁপড়ে যেভাবে খড়কুটো আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, সেও যেন তেমনি ভাবে সীমন্তিনীকে আঁকড়ে ধরেছে। অনেকক্ষণ বাদে সীমন্তিনী নিজের চোখ মুছে নিয়ে রচনার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “তুমি তো দেখতে খুব সন্দরী। কোন একটা ছেলেকে নিজে পছন্দ করে নিতে পার নি”?

রচনা আবার আগের মতই ম্লান হেসে বলল, “এমনটাও যে ভাবিনি, তা নয় দিদি। কিন্তু তাতেও কি কোন নিশ্চয়তা আছে, বল? কতজনকে তো দেখলাম, বছরের পর বছর ধরে প্রেম করেও বিয়ের সময় দেনা পাওনা নিয়ে মিটমাট না হতে বিয়ে ভেঙে চলে যায়। এমনও তো দেখেছি, ভালবেসে বিয়ে করা সত্বেও এক দু’বছর যেতে না যেতেই স্বামী-স্ত্রীর ভেতরে ভালবাসার ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট থাকে না। সংসারে রোজ অশান্তি, রোজ ঝামেলা। তাই এমনটা করে নিজের মনের ওপর ব্যথার বোঝা আরও বাড়িয়ে তুলে লাভ কি

______________________________
 
 
(Update No. 28)

বল? আর তাছাড়া সে ছেলেটাকে যদি বাবা মা পছন্দ না করেন, তাহলে সংসারে তো নিত্য অশান্তি শুরু হবে। প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে বাবা মার মনে দুঃখ দিতেও আমি পারব না। তাই ভাগ্যের স্রোতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোন পথ নেই দিদি”।

সীমন্তিনী আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল এবার। অনেকক্ষণ পর এবার রচনাই সীমন্তিনীকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলল, “ওঠো দিদি। কার জন্যে কে আর কি করতে পারে বল? যার যার ভাগ্য নিয়েই তো আমরা সবাই জন্মেছি। তাই ভাগ্যে যা আছে সেটাই মেনে নিতে হবে। এ কথাগুলো মনের ভেতর চেপে রেখে একা একাই কষ্ট পেয়েছি এতদিন। কাউকে বলতে পারিনি কোনদিন। আজ কেন জানিনা, তোমার কাছে সবকিছু খুলে বলে ফেলে তোমাকেও কষ্ট দিয়ে ফেললুম। আমাকে সেজন্যে ক্ষমা কোর দিদি”।

সীমন্তিনী আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মুখ তুলে বলল, “দেখ রচনা। আমাদের মধ্যে তো তেমন চেনাজানা হয়নি এখনও। বলতে গেলে আজই আমরা দু’জন দু’জনের সাথে প্রথম আলাপ করছি। কিন্তু তোমাকে এখন একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি খারাপ ভাববে না তো”?

রচনা শান্ত ভাবে বলল, “বল দিদি, আমি কিচ্ছু মনে করব না”।

সীমন্তিনী বলল, “আমি তোমাকে আমার ফোন নাম্বারটা দিয়ে যাব। তুমি কোন পিসিও থেকে আমাকে মাঝে মধ্যে ফোন করতে পারবে”?

রচনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “জানিনা দিদি। আমার হাতে তো একটা পয়সাও থাকে না। তোমাকে ফোন করতে পারব কিনা, সেটাও বলতে পারছি না”।

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা তোমাদের বাড়ির আশেপাশে কারো বাড়িতে ফোন নেই? ধর আমি যদি তাদেরকে ফোন করে তোমাকে ডেকে দিতে বলি, তারা তোমায় ডেকে দেবে না”?

রচনা একটু ভেবে বলল, “আমাদের পাশের বাড়িতে ফোন অবশ্য আছে। কিন্তু তুমি ফোন করলে তারা আমাকে ডেকে দেবেন কি না সেটা ঠিক বলতে পারছিনে”।

সীমন্তিনী বলল, “তোমার কোন বন্ধু বান্ধবের কারুর নিজের মোবাইল নেই”?

রচনা বলল, “হ্যা তা তো আছে বেশ কয়েকজনের। কিন্তু তারা তো কেউ আমাদের বাড়ির কাছাকাছি থাকে না দিদি”।

______________________________
ss_sexy
Like Reply
#13
(Update No. 29)

সীমন্তিনী একটু উৎসাহিত হয়ে বলল, “বেশ, তাহলে আমার কথাটা মন দিয়ে শোন। তুমি যদি তাদের ফোন থেকেও আমার সাথে কথা বলতে না চাও, তাহলে তাদেরকে বলে আমার নাম্বারে শুধু একটা মিসকল দিও। আর একটু অপেক্ষা কোর। আমি সাথে সাথেই সে নাম্বারে ফোন করব। তাহলে তোমার সাথে কথা বলতে পারব। আর তাদের ফোনেও কোন বিল উঠবে না। বুঝেছ”?

রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যা তা না হয় হল। কিন্তু তুমি আমাকে ফোন করতে বলছ কেন দিদি”?

সীমন্তিনী বলল, “দেখ রচনা, আমি মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে। টাকা পয়সা নিয়ে খুব একটা অভাব এখনও বুঝিনি। কিন্তু আমার নিজের যদি কোন সোর্স অফ ইনকাম থাকত, তাহলে আমি আজ এ মূহুর্তে থেকে তোমার পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিতুম। কিন্তু তেমন কোন সোর্স তো আমার নেই। কিন্তু তোমার জীবনটা অকালে শুকিয়ে যাবে, এটাও আমি মানতে পারছি না। তাই তোমাকে বলছি, যদি মাসিমা মেসোমশাই এমন কোন পাত্রকে পছন্দ করে ফেলেন, যাকে তুমি মন থেকে মেনে নিতে পারবে না, তাহলে কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে যে কোন সময় আমাকে একটা অমন মিসকল দিও। আমি তোমার মুখে গোটা ব্যাপারটা শুনে একটা প্রতিকারের চেষ্টা করব। আর এ ছাড়াও, তোমার যদি আমার সাথে কখনও কথা বলতে ইচ্ছে করে, তাহলেও সেটা করতে পার”।

রচনা এবার আরও অবাক হয়ে বলল, “আমার জন্যে তুমি এতকিছু করতে চাইছ কেন দিদি? তোমার কি লাভ হবে এসব করে”?

সীমন্তিনী রচনাকে আবার নিজের বুকে টেনে নিয়ে বলল, “জানিনে গো। তোমার এ প্রশ্নের উত্তর আমিও জানিনে। হয়ত তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি বলেই। আর লাভ লোকশানের কথা না-ই বা তুললে রচনা। সবকিছু নিয়ে কি লাভক্ষতির হিসেব কষা যায় গো বোন”?

সীমন্তিনীর কথা শেষ হতেই বিধুবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। তার দু’হাতে দুটো চায়ের কাপ। তাদের দু’জনকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, “যাক, দু’বোনের দেখছি গলায় গলায় ভাব হয়ে গেছে। বাঃ, বেশ লাগছে তোমাদের দেখতে। নাও তো মা। তোমার মাসিমা তোমার জন্যে চা পাঠালেন। বিকেলে নাকি চা খাওনি। নাও, এটা খেয়ে নাও। আর রচু, তুই রান্নাঘরে যা। তোর মা একটু ডেকেছে তোকে”।

রচনা দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি, একটু বোস তুমি। আমি আসছি” বলে বাইরে চলে গেল।

বিধুবাবু চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, “তুমি আমার কথায় কিছু মনে করনি তো মা”?

সীমন্তিনী বলল, “না না মেসোমাশাই, মনে করার কি আছে? আপনি তো আমাকে অন্যায় কোন প্রশ্ন করেননি”।


___________________________________________________
ss_sexy
Like Reply
#14
(Update No. 30)

বিধুবাবু একটু ইতস্ততঃ করে বললেন, “দ্যাখ মা। আমার বয়স হয়ে গেছে। রোজগারপাতি কোনদিনই সংসারের প্রয়োজন মেটাবার মত করে করতে পারিনি। তাই সংসারের চিন্তায় প্রায় সারাক্ষণই মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাই মনে মনে না চাইলেও কখনও কখনও মুখ ফস্কে অনেক কিছুই বেরিয়ে যায়। তাই বলছি, তোমাকে তখন যে প্রশ্ন গুলো করেছি তাতে যদি তুমি মনে দুঃখ পেয়ে থাক, তাহলে আমায় ক্ষমা করে দিও মা”।

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “ছিঃ ছিঃ মেসোমশাই। আপনার দু’মেয়ের চেয়ে বয়সে খানিকটা বড় হলেও আমি তো আপনার মেয়েরই মত। তাই আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে পাপের ভাগী করে তুলবেন না প্লীজ। আমিও তো আপনাদের দু’জনকে আমার মা বাবার জায়গায় বসিয়ে প্রণাম করলাম”।

বিধুবাবু বললেন, “তুমি সত্যি বড় লক্ষী মাগো। তোমাকে দেখেই বুঝেছি তোমার ভেতরে অনেক শক্তি আছে। ধন্য তোমার বাবা মা, যাদের ঘরে তুমি জন্ম নিয়েছ”।

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে বলল, “মেসোমশাই আমি তো বলতে গেলে আপনাদের কাছে পুরোপুরি অজানা। আগন্তুক এক অতিথি। তাই কথাটা বলতে একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। আপনি যদি এটাকে আমার অনধিকার চর্চা বলে না ভাবেন, তাহলে একটা কথা বলতাম”।

বিধুবাবু বললেন, “হ্যা হ্যা মা, বল না কি বলবে”?

সীমন্তিনী একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আসলে মেসোমশাই, রচনার সাথে এতক্ষন ধরে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করেই ওর দিদির প্রসঙ্গ আসতে ও কেঁদে ফেলল। ওর দিদি নাকি শ্বশুর বাড়িতে একদম ভাল নেই”।

বিধুবাবু ওপরের দিকে মুখ তুলে ঘরের কড়িকাঠের দিকে চেয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি তোমায় কী বলি মা? জীবনে এত বড় ভুল আমি আর কখনও করিনি। তিনটে হীরের টুকরো ছেলে মেয়ের বাবা হয়েও কোনদিন তাদের কোন চাহিদা পূরন করবার ক্ষমতা আমার ছিল না। আজও আমি সেটা করতে পারিনা। চেনাজানা ঘটকের মুখে ভাল উপায়ী পাত্রের সম্মন্ধ পেয়ে আমি তার কথাতেই বিশ্বাস করে খুব কম বয়সেই মেয়েটার বিয়ে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম গরীব বাবার ঘরে জন্মে কোন সুখ না পেলেও শ্বশুর বাড়ি গিয়ে অন্ততঃ একটু সুখে থাকবে। নিজের তরফ থেকে আর কোন খবরাখবর নেবার চেষ্টাই করিনি। আমার সে ভুলের মাশুল এখন মেয়েটাকে সারা জীবন ধরে দিয়ে যেতে হবে। এত বড় একটা আঘাত পেয়েও আমি যে এখনও বেঁচে আছি, সেটা ভেবেই অবাক হচ্ছি আমি। জানিনা, ঈশ্বর আমার এ
পাপের কি শাস্তি বিধান করে রেখেছেন। খোকা আর রচু না থাকলে, আমরা বুড়োবুড়ি দু’জনেই হয়ত প্রাণ
বিসর্জন দিয়ে সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতুম”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুর কথা শুনে চমকে উঠে তার একটা হাত ধরে বলল, “ছিঃ মেসোমশাই। এসব কথা মনেও আনবেন না। যার কপালে যেটা হবার সেকি আর কেউ পাল্টে দিতে পারে? মেয়েটার কপালে


______________________________________________
ss_sexy
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#15
(Update No. 31)

ভগবান এমন দুঃখ লিখেছিলেন বলেই ওর এমনটা হয়েছে। হয়তো ও ওর আগের কোন জন্মের কোন পাপের শাস্তি পাচ্ছে। কিন্তু আপনাদের মত জীবনে অভিজ্ঞ অনেকেই বলে যে, যা হয় তা ভালর জন্যই হয়। ভগবান যা করেন তা নাকি ভাল জন্যে করেন। দেখবেন, চিরদিন এমন অবস্থা থাকবে না। আপনার বড় মেয়ের জীবনেও একদিন না একদিন সুদিন আসবেই”।

বিধুবাবু বললেন, “তোমার মুখে ফুল চন্দন পড়ুক মা। ঈশরের কাছ দু’বেলা তো শুধু সেই প্রার্থনাই করছি আমি। আমার অর্চুর কপালে একটু সুখ আসুক”।

সীমন্তিনী এবার বিভুবাবুর একটা হাত নিজের হাতে ধরে বলল, “মেসোমশাই, রচনার বিয়েটা এমনভাবে দেবেন না দয়া করে। ও লেখাপড়ায় এত ভাল। ওকে যতটা সম্ভব পড়তে দিন। আজকাল তো মেয়েরাও লেখাপড়া শিখে অনেকে অনেক কিছু করছে। ওকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে দিন”।

বিধুবাবু আহত গলায় জবাব দিলেন, “কোন বাবা মা কি চায় তার সন্তানেরা সুখ না পাক? আমরাও তা চাইনা মা। কিন্তু ওদের কাউকেই তো উচ্চশিক্ষা দেবার ক্ষমতা আমার নেই। রচুর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল ওকে দু’বছরের স্কলারশিপ দেওয়াতেই ওকে এখনও পড়াতে পারছি। কিন্তু বারো ক্লাস পেরিয়ে গেলে বোধ হয় আর স্কলারশিপও পাওয়া যাবে না। তখন ওকে কী করে পড়াব বল? পূজো আচ্চা করে যা দু’পয়সা হাতে আসে তাতে তো সংসারের খাওয়া পড়ার খরচই জুটিয়ে উঠতে পারিনা মা। রচুকে আরও পড়াবার কথা তো ছেড়েই দাও, খোকার ভবিষ্যতে কী হবে সেটা নিয়েও তো খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে আমার। গেলবার পূজোর সময় কাউকে একটা নতুন গামছাও কিনে দিতে পারিনি আমি। ছেলেমেয়ে দুটো পুরোন জামাকাপড় পড়েই প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে ঘুরে পূজো দেখেছে। রচু তো অনেক বুদ্ধিমতী। আমাদের অবস্থাটা ও বেশ ভাল ভাবেই বোঝে। মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলে না। কিন্তু অবুঝ খোকা একটা নতুন শার্ট নেবার জন্য কত কান্নাকাটিই না করল। বুকে পাথর চাপা দিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ওর কান্না শুনে গিয়েছিলাম শুধু। একজন অপারগ বাবার পক্ষে এটা যে কত বড় দুঃখ, সে তুমি বুঝতে পারবে না মা। তাই আমাকে ক্ষমা কোর তুমি। রচনার লেখাপড়ার ব্যাপারে তোমাকে কোনও প্রতিশ্রুতি আমি দিতে পাচ্ছি না”।

বিধুবাবুর কথা শুনতে শুনতে সীমন্তিনীর চোখ দুটো আবার জলে ভরে এল। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “মেসোমশাই, রচনাকে এ’টুকু সময়ে আমি আমার ছোটবোনের মত ভালবেসে ফেলেছি। তাই আপনার কাছে অনুরোধ করছি, রচনার জন্য কোন বিয়ের সম্মন্ধ এলে, কাউকে কোন প্রতিশ্রুতি দেবার আগে, আপনি আমাকে জানাবেন। আমি চাই না ওর দিদির মত ওর কপালেও কোন দুঃখ দুর্ভোগ নেমে আসুক। আর আমি নিজেও চেষ্টা করব ওর জন্য একটা ভাল পাত্র খুঁজে বের করতে। এ’টুকু কথা তো আপনি আমাকে দিতেই পারেন মেসোমশাই”।

বিধুবাবু নিজের চোখের কোনা মুছে সীমন্তিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “জানিনা মা, তোমার সাথে রচুর দেখা হবার পেছনে ভগবানের উদ্দেশ্য কী। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি, রচুর বিয়ের কোন প্রস্তাব এলে

______________________________
 
 
(Update No. 32)

সবার আগে আমি তোমাকে জানাব। কিন্তু মা, তুমি তো আর রোজ এখানে আসতে পারবে না। আর আমাদের ঘরে ফোন মোবাইল কিছুই নেই। কি করে তোমার কাছে খবর পাঠাব বল”?

সীমন্তিনী বলল, “আমি সে’সব রচনাকে বুঝিয়ে দেব মেসোমশাই। আর রচনার কাছে আমার ঠিকানাও লিখে দিয়ে যাব। যদি কোনভাবেই আমার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব না হয়, তাহলে একটা চিঠি লিখে অন্ততঃ আমাকে জানাবেন”।

বিধুবাবু বললেন, “ঠিক আছে মা। আমার আরেকটা মেয়ের এ অনুরোধটুকু আমি রাখবার চেষ্টা করব”।

সীমন্তিনী খাট থেকে নেমে বিধুবাবুকে প্রণাম করে বলল, “আপনি যখন আমাকে আপনার আরেকটা মেয়ে বলে স্বীকার করলেন, তাহলে আমিও কিন্তু আজ থেকে এ বাড়িরই আরেকটা মেয়ে হয়ে গেলাম মেসোমশাই”।

বিধুবাবু সীমন্তিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন, “অবশ্যই মা। তুমিও আজ থেকে আমার আরেকটা মেয়ে হলে”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে বলল, “ও মাসি, এদিকে এস তো”।

বিভাদেবী চমকে উঠে বললেন, “ওমা! কি হল তোমার”?

সীমন্তিনী বিভাদেবীকে আর একটা প্রণাম করে বলল, “মেসো আমাকে তার আরেকটা মেয়ে বানিয়ে নিয়েছেন। তাই আমি তো তোমারও মেয়ে হয়ে গেলাম। তাই তোমাকে প্রণাম করে জানতে চাইছি আমি তোমারও মেয়ে হলাম তো আজ থেকে”?

বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “পাগলী মেয়ে তুমি একটা। আমি তো তোমাকে আগেই মেয়ে বলে ভেবে নিয়েছি গো। তাই তো আমার এ মেয়েটাকে রাত করে যেতে দিইনি আমি”।

সীমন্তিনী খুশীতে একটা ছোট বাচ্চার মত লাফাতে লাফাতে বলল, “তাহলে আমাকে আর তুমি তুমি করে বলছ কেন? রচুকে যেমন তুই তুই করে বল, আমাকেও তেমনি করে বল। আমিও কিন্তু আর তোমাকে বা মেসোকে আপনি আপনি করে বলব না”।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর গালে হাত বুলিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাই বলব”।

______________________________
 
 
(Update No. 33)

সীমন্তিনী এবার রচনার দিকে ঘুরে তার একটা হাত ধরে বলল, “এই যে রূপসী রচনা। এখন থেকে আমি তোমারও সত্যি সত্যি দিদি হলুম। আমি কিন্তু এখন থেকে তুই তোকারি করে কথা বলব তোর সাথে। আর কোন রকম বেচাল দেখলেই কিন্তু তোকে শাসন করব। মনে রাখিস”।

রচনা সীমন্তিনীর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “তোমার মত একটা দিদি পেয়ে আমিও খুব খুশী হলাম, তাই ভাইয়ের মত আমিও তোমাকে দিদিভাই বলে ডাকব এখন থেকে”।

সীমন্তিনী বলল, “শোন রচু, শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না। আমি যেমন মেয়ে হয়ে মাসি মেসোকে প্রণাম করলাম, তেমনি তোকেও কিছু একটা করে আমাদের দিদিবোনের সম্পর্কটাকে পাকা করে তুলতে হবে”।

রচনা হেসে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক আছে, আমিও তোমাকে প্রণাম করছি” বলে নিচু হতেই সীমন্তিনী তাকে ধরে ফেলে বলল, “নারে, প্রণাম নয়, তোর কাছ থেকে আমি অন্য কিছু চাইব। তবে এখন নয়। রাতে ঘুমোবার আগে বলব। আর শোন আমি কিন্তু তোর সাথেই শোব রাতে”।

রচনা হেসে বলল, “তাছাড়া আর শোবার জায়গা কোথায় যে শোবে”?

রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে রচনার ঘরে এসে নিজের ব্যাগ থেকে রাইটিং প্যাড আর কলম বের করে তাতে নিজের নাম, ফোন নাম্বার আর জলপাইগুড়ির ঠিকানা লিখে কাগজটা রচনাকে দিয়ে সীমন্তিনী বলল, “এটা রাখ। ভাল করে রাখবি। হারিয়ে যেন না যায়। এতে আমার ফোন নাম্বার আর ঠিকানা লিখে দিলাম। যে কোন সময় যে কোন প্রয়োজনে আমাকে ফোন করবি বা চিঠি লিখে জানাবি”।

চালাকি করে নিজের পদবী ছেড়ে শুধু নামটুকুই লিখে দিয়েছিল সীমন্তিনী সে কাগজটাতে। বিছানায় সীমন্তিনীকে পাশে নিয়ে শুয়ে রচনা জিজ্ঞেস করল, “তোমার বোনের কাছ থেকে কী চাইবে বলছিলে, বলবে না দিদিভাই”?

সীমন্তিনী রচনার একটা গালের ওপর নিজের একটা হাত আলতো করে রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি খুব মিথ্যে কথা বলিস”?

রচনা অবাক হয়ে উল্টে জিজ্ঞেস করল, “ওমা? আমি আবার কখন কি মিথ্যে কথা বললাম তোমার কাছে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে’কথা বলছি না রে। জানতে চাইছি, তুই মিথ্যে কথা বলিস কি না”।

রচনা সরল গলায় বলল, “আমি কোনদিন কাউকে মিথ্যে কথা বলি না দিদিভাই। তবে হ্যা, প্রয়োজনে কারো কারো কাছে কিছু কথা লুকিয়ে যাই”।

______________________________
 
 
 
(Update No. 34)

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আমাকে তোর ভাল লেগেছে কিনা জানিনা। কিন্তু তোকে সেদিন প্রথম দেখেই আমি ভালবেসে ফেলেছিলাম রে। তাই তো আজ এখানে আসবার পর থেকে মনটা তোকে দেখবার জন্য ছটফট করছিল। ভাগ্যিস কাবেরীর সাথে রাস্তায় দেখা হয়ে গিয়েছিল। তাই তো তোর কাছে আসতে পেলাম। তোকে আরও বেশী ভাল লেগে গেল। আজকের দিনটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে রে”।

রচনা সীমন্তিনীর হাতটা নিজের গালের ওপর চেপে ধরে বলল, “আমারও তোমাকে খুব ভাল লেগেছে দিদিভাই। নইলে আমার মনের এতসব কথা তোমাকে খুলে বলতাম আমি”?

সীমন্তিনী রচনার কপালে আদর করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমার কাছেও কোন কথা লুকিয়ে যাবি”?

রচনা বলল, “তোমার সাথে যে সব প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছি, তাতে কিছুই লুকোইনি তোমার কাছে”?

সীমন্তিনী আবেগ ভরা গলায় বলল, “তাহলে আমাকে কথা দে, ভবিষ্যতেও আমাকে কোনদিন মিথ্যে কথা বলবি না। আমার কাছে কিচ্ছু লুকোবি না”।

রচনা সীমন্তিনীর মুখের দিকে শান্ত চোখে কয়েকমূহুর্ত চেয়ে থেকে বলল, “ঠিক আছে, কথা দিলাম। তুমি যদি আমার কোন গোপন কথা অন্য কারো সাথে শেয়ার না কর, তাহলে আমিও তোমার কাছে কক্ষনও কিছু লুকোব না দিদিভাই”।

সীমন্তিনী বলল, “তুই কিন্তু আমাকে ছুঁয়ে কথা দিলি। মনে রাখিস কোনদিন যদি আমাকে মিথ্যে বলিস আমি কিন্তু সেদিনই মরে যাব”।

রচনা শোয়া থেকে প্রায় লাফ দিয়ে উঠে সীমন্তিনীর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলল, “দিদিভাই। এমন কথা কিন্তু আর কক্ষনও বলবে না বলে দিচ্ছি”।

সীমন্তিনী শোয়া অবস্থাতেই রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আচ্ছা বাবা আচ্ছা, আর বলব না। তবে কথাটা মনে রাখিস”।

রচনা প্রায় নিজের মনেই বলে উঠল, “আজ প্রথমবার আমার জীবনে এমন একজনকে পেলাম, যার সাথে আমি মন খুলে এত কথা বলতে পারছি। জানিনা কপালে কি আছে। কিন্তু তোমার ওপর সব কিছু ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে আমার দিদিভাই”।

______________________________
 
 
 
(Update No. 35)

সীমন্তিনী বলল, “আর দুটো বছর অপেক্ষা কর। আমাকে আইপিএস হতে দে। তারপর দেখিস তোর সব কিছুর ভার আমি নিয়ে নেব”।

রচনা উৎফুল্ল হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আইপিএস হতে চাও দিদিভাই? কেন গো”?

সীমন্তিনী বলল, “সেটাই যে আমার জীবনের প্রথম টার্গেট বানিয়েছি রে। আচ্ছা এবার সত্যি করে একটা কথা বল তো রচু। তুই কোন ছেলেকে ভালবাসিস? লুকোবিনা কথা দিয়েছিস কিন্তু”।

রচনা হেসে বলল, “আমি জানতুম, দিদিভাই। এ প্রশ্নটা তুমি আমাকে করবেই”।

সীমন্তিনীও হেসে বলল, “তোর মত এত সুন্দরী, এতো লেখাপড়ায় ভাল একটা মেয়েকে অনেক ছেলেই যে প্রেম নিবেদন করবে সেটা তো জানা কথাই। কিন্তু আমি জানতে চাইছি তুই কাউকে মন দিয়েছিস কি না। যদি তেমন কেউ থাকে তো বল। আমি যেভাবেই হোক তার সাথেই তোর বিয়ে দেবার চেষ্টা করব”।

রচনা বলল, “নাগো দিদিভাই। এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। আমার জীবনে সত্যি তেমন কেউ নেই। তবে তোমার কথাও ঠিক। প্রেম নিবেদন অনেকেই করেছে। কিন্তু আমি হাতজোড় করে তাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। তখন বললাম না তোমাকে? নিজে কাউকে পছন্দ করে মা বাবার মনে কষ্ট দিতে চাই না আমি। আর প্রেমের ব্যর্থতা নিয়ে নিজেই নিজের দুঃখ বাড়াতে চাই না”।

সীমন্তিনী বলল, “তাহলে তোর জন্যে তো আমাকেই ছেলে খুঁজতে হবে দেখছি। তা আমি যদি কাউকে তোর জন্য পছন্দ করি তাকে বিয়ে করবি তো? না আমার মুখ নষ্ট করবি”?

রচনা বলল, “তোমার পছন্দের ছেলেকে আমি না দেখেই বিয়েতে রাজি হয়ে যাব, দিদিভাই”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “এতখানি ভরসা করতে পারছিস আমার ওপর”?

রচনা বলল, “কারনটা জানতে চাইলে বলতে পারব না ঠিকই। কিন্তু জানিনা, এ’টুকু সময়েই কেন যেন তোমার ওপর চোখ মুদে ভরসা করতে পারছি”।

সীমন্তিনী রচনার হাতে আদর করে হাত বুলিয়ে বলল, “তাহলে এবার আমি আমার জিনিসটা চাইব তোর কাছে, দিবি তো”?

রচনা বলল, “আমার সাধ্যের বাইরের কিছু না হলে অবশ্যই দেব তোমাকে দিদিভাই। বল কী চাও”।

______________________________
 
 
(Update No. 36)

সীমন্তিনী রচনার একটা হাতের তালুর ওপর নিজের গাল পেতে ধরে বলল, “আমি শুধু তোর দিদি নয়, তোর বান্ধবীও হতে চাই। বল, আমার বান্ধবী হতে রাজি আছিস”?

রচনা হেসে সীমন্তিনীর মাথা জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যা গো দিদিভাই, আজ থেকে তুমি আমার দিদি হবার সাথে সাথে আমার বান্ধবীও হলে। কিন্তু তাই বলে তোমাকে তুই তোকারি করে কথা বলতে বোল না আবার। সেটা কিন্তু পারব না আমি”।

সীমন্তিনী রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ রচু সোনা আমার”।

*************
পরদিন সকালে কালচিনি থেকে রওনা হয়ে সীমন্তিনী জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছল প্রায় বারোটা নাগাদ। সতীশ অধীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করেছিল। সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতেই সতীশ তাকে একের পর এক অনেকগুলো প্রশ্ন করল। সীমন্তিনী সতীশের হাত ধরে তার বিছানায় বসতে বসতে বলল, “দাঁড়া দাঁড়া সতু। এত কথা তোকে বলার আছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা দিয়ে শুরু করি। দাঁড়া একগ্লাস জল খেয়ে নিই আগে। আচ্ছা রান্নাও তো করতে হবে রে, তাই না”?

সতীশ বলল, “তোর ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে যাবে বলে আমি ডাল শব্জী করে রেখেছি। খাবার আগে ডিমের ওমলেট বানিয়ে নেব। হবে না”?

সীমন্তিনী খুশী গলায় বলল, “হবে না মানে? খুব ভাল করেছিস। তোকে সমস্ত ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে বলতে পারব তাহলে” বলে ঢকঢক করে একগ্লাস জল খেয়ে বলল, “শোন ভাই, কালচিনির কথা তোকে পরে বলছি। তার আগে শোন, তুই তোর ব্যাগ গুছিয়ে নে। আজ সন্ধ্যের সময়ই তুই বাড়ি চলে যাবি। তোর মোবাইলে তো রচুর ছবি আছেই”।

সতীশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “রচু? সে আবার কে”?

সীমন্তিনী বলল, “আরে রচনার কথা বলছি রে। ওর সাথে আমার ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। বাড়ির সকলে ওকে রচু বলে ডাকে বলে আমিও সেভাবেই ডাকতে শুরু করেছি”।

সতীশ খুশীতে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “তাহলে মেয়েটার সাথে আমাদের দাদাভাইয়ের বিয়েটা হচ্ছে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “এখনও যদিও সে ব্যাপারে কোন কথাই হয় নি। তবে আমি তোকে বলছি, রচু দাদাভাইয়ের বৌ হয়ে আমাদের বাড়ি আসবেই আসবে। যে করেই হোক, আমি সেটা করবই। আচ্ছা তোকে বাড়ি গিয়ে কাকে কি বলতে হবে সেটা আগে ভাল করে শোন। আচ্ছা দাঁড়া, আগে তোর ফোনটা দে তো। আমার ফোনের ব্যাটারী ফুরিয়ে গেছে। বড়মার সাথে আগে একটু কথা বলে নিই” বলে নিজের মোবাইলটা চার্জে বসিয়ে দিল।

______________________________
 
 
(Update No. 37)

সতীশ নিজের মোবাইলটা দিদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ইশ, বড়দি, তাড়াতাড়ি বল না ওদিকে কি কি হল? তুই তো এ’কথা সে’কথা বলেই সময় কাটাচ্ছিস শুধু। আমার ভেতরটা যে ছটফট করছে রে”।

সীমন্তিনী সতীশের মোবাইল থেকে বাড়ির ফোনে কল করে বলল, “আর একটা মিনিট দাঁড়া ভাই। আমিও তো তোকে কথাগুলো না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না”।

ও’পাশ থেকে কেউ ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই সীমন্তিনী তার মায়ের গলা চিনতে পারল। কিন্তু তার মা যে তার সাথে কথা বলবেন না সেটা তার জানাই আছে। তাই সে বলল, “আমি মন্তি বলছি”।

ও’পাশ থেকে আর সাড়া নেই। কিন্তু তার মা যে বড়মাকে ডাকছেন সেটা বোঝা গেল। খানিক বাদেই সরলাদেবীর গলা শোনা গেল, “হ্যা, মন্তি বল। তোরা ভাল আছিস তো”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যা বড়মা, আমি আর ভাই দু’জনেই ভাল আছি। একটা সুখবর তোমাকে দেবার আছে”।

সরলাদেবী খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস মা? যাক তোর সুমতি হয়েছে তাহলে। আমি আজই মন্দিরে গিয়ে তোর নামে মদন মোহনকে পূজো দেব”।

সীমন্তিনী বলল, “পূজো তুমি দিও বড়মা। কিন্তু আমার নামে নয়। তোমার বড়খোকার নামে দিও”।

সরলাদেবী বললেন, “মানে? কী বলছিস তুই”?

সীমন্তিনী বলল, “তোমার বড়ছেলের জন্য আমি একটা মেয়ে পছন্দ করেছি গো বড়মা। আর সে মেয়েকে দেখে তোমরাও সবাই পছন্দ করবে। তবে ফোনে এত কথা বলা সম্ভব নয়। সতু সন্ধ্যের দিকে বাড়ি যাচ্ছে। ও গিয়ে তোমাদের সব কিছু খুলে বলবে। মেয়ের ছবি, তার বাড়ির ঠিকানা, আর মেয়ের বাড়ির সব কথা সতুর মুখ থেকেই শুনতে পারবে তোমরা। ও মেয়ের পেছনে নিশ্চয়ই অনেক ছেলে অনেক ছেলের মা বাবারা লেগে আছে। তুমি কাল বা পরশুর মধ্যেই জেঠুকে মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। পাঁজি দেখে দিনক্ষণ মূহুর্ত দেখে সময় নষ্ট করা চলবে না। সম্ভব হলে কালই পাঠিয়ে দিও। নইলে পরশু অবশ্যই পাঠাবে। তারপর জেঠু ফিরে এলে আমায় খবর দিও। বুঝেছ”?

সরলাদেবী উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলেন, “সত্যি বলছিস তুই মা? কিন্তু বড়খোকা কি এতে রাজি আছে”?

সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “তোমাকে বড়খোকা ছোটখোকা কোন খোকার কথাই ভাবতে হবে না বড়মা। আমি তোমায় কথা দিয়েছিলুম, তোমার বড়ছেলের সংসার বসিয়ে দেব। আজ সে সুযোগ পেয়েছি। আমি

______________________________
 
 
(Update No. 38)

নিজে মেয়েটাকে দেখেছি। অমন একটা মেয়ে যে ঘরে যাবে সে ঘরের কপাল খুলে যাবে গো বড়মা। তাই যে করেই হোক, এ মেয়েটাকেই আমি তোমার বড়ছেলের বৌ করে তোমার কাছে আনব। তুমি শুধু দেখ, আমি যেমনটা বলছি, বাড়ির সকলে যেন সেটা করে। বাকিটা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও”।

সরলাদেবী খুশীতে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা শোননা মা। একটু কিছু তো বল মেয়েটার সম্বন্ধে। নইলে মনটা যে খুব ছটফট করবে রে আমার। অন্ততঃ এটুকু তো বল মেয়েটা ব্রাহ্মণ কি না, দেখতে কেমন”?

সীমন্তিনী বেশ জোরে বলল, “ব্রাহ্মণ কিনা মানে? তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে যে আমি যাকে পছন্দ করব সে মুচি মেথর যাই হোক তাকেই তুমি তোমার বড়ছেলের বৌ হিসেবে মেনে নেবে। তার জাতপাত নিয়ে তুমি কোন রকম প্রশ্ন ওঠাবে না। তাহলে এখন আবার এমন কথা বলছ কেন? কিন্তু শোন বড়মা। তুমি তো জানই তোমার এ নষ্টা মেয়েটা কতটা জেদী। আমি যখন মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তখন ওই মেয়েটার সাথেই আমার দাদাভাইয়ের বিয়ে হবে। তোমরা গুরুজনেরা মানলেও হবে, না মানলেও হবে”।

সরলাদেবী থতমত খেয়ে বললেন, “তুই রাগ করছিস কেন রে মা? তুই যা বলছিস তাই হবে। কিন্তু মনে হাজারটা প্রশ্ন উঠছে বলেই তোকে ওভাবে বলে ফেলেছি। কিছু মনে করিস না মা আমার”।

সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, কথাটা মনে রেখ। এ মেয়ের সাথেই দাদাভাইয়ের বিয়ে হবে। সতুকে বাড়ি পাঠাচ্ছি। ওর মুখে সব শুনতে পাবে। তবে আপাততঃ এটুকু জেনে রাখ, মেয়েটার নাম রচনা চক্রবর্তী। কিন্তু খুবই গরীব ঘরের মেয়ে। বলতে গেলে তাদের দিন আনতে পান্তা ফুরোয়। কিন্তু সে জন্যে যেন সম্মন্ধ ভেঙে না যায় মনে রেখ। বিয়ের সমস্ত খরচ খরচা আমাদের হবে। বাকি সব সতু গিয়ে বলবে তোমাদের। এখন আমি রাখছি। সতু রওনা হবার আগে আগে ওকে সবকিছু খুলে বলতে হবে তো” বলে ফোন কেটে দিল।

একটা বড় শ্বাস নিয়ে সতীশের হাত ধরে সীমন্তিনী বিছানায় বসতে বসতে বলল, “ভাই শোন, আমার বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে রে। চল খেতে খেতে তোকে ধীরে ধীরে সব কিছু বলি”।

কালচিনি যাবার পর থেকে যা যা হয়েছে, কার কার সাথে কি কি কথা হয়েছে সব কিছু খুলে বলল সতীশকে সীমন্তিনী। তারপর খাওয়া শেষ করে উঠে বলল, “ভাই তুই তোর ব্যাগটা চটপট গুছিয়ে নে। আমি বাসনগুলো ধুয়ে তোকে বলছি বাড়িতে গিয়ে কি কি করবি”।

মিনিট দশেক বাদেই সব কাজ সেরে সীমন্তিনী সতীশকে বলল, “শোন ভাই। বড়মাকে তো ফোনে বলেই দিয়েছি আমি। তুই গিয়ে তাদের সবকিছু খুলে বলিস। জেঠু সঙ্গে বাবা বা কাকুকে নিয়ে কাল সম্ভব না হলেও পরশু যেন অবশ্যই কালচিনি যান। তবে একটা কথা তাদেরকে বুঝিয়ে দিস। আগে রচুদের বাড়িতে কোন খবরাখবর না দিয়ে হুট করে গিয়ে পৌঁছলে ওরা সকলের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে উদবিঘ্ন হয়ে

______________________________
(Update No. 39)

পড়তে পারে। তাই জেঠুকে বলিস, তারা যেন ওখানে গিয়ে কোন হোটেলে আগে খেয়ে নেন। ওদের অবস্থা এতোটাই খারাপ যে অতিথি সৎকার করবার জন্য তাদের ঘরে এক প্যাকেট বিস্কুটও হয়ত থাকবে না। তাই জেঠুরা যেন কোন ভাবে তাদের বিব্রত না করেন। আর তাদের বাড়ি যাবার আগে যেন কিছু ফল মিষ্টি নিয়ে যান। তবে একটা কথা তাদের সবাইকে ভাল মত বুঝিয়ে দিবি। ওখানে গিয়ে যেন তারা আমার ব্যাপারে কোন কথা না বলেন। আমরা যে ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে রচনাকে দেখেই প্ল্যান করে এসব করছি, সেটা রচুদের বাড়ির লোকেরা এখনই জেনে ফেলুক এটা আমি চাই নে। রচুর মা বাবাকে তো আমাদের বাড়ির কথা বলতেই হবে। সবটাই তারা বলুক। কিন্তু আমার আর তোর নাম যেন তারা কেউ মুখে না আনেন। আমি মেসোকে আর রচুকে বলে এসেছি যে রচুর জন্যে কোন পাত্রপক্ষ তাদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা যেন আমাকে ফোন করে জানায়। আমি সেটাও একটু পরীক্ষা করে দেখতে চাই। জেঠুরা যেন গিয়ে বলেন কোন এক পরিচিত লোকের মুখে তারা রচনার কথা শুনেই সেখানে গেছেন। বুঝেছিস”?

সতীশ খুব উৎসাহের সাথে বলল, “এই বড়দি, আমিও যাব বাবা কাকুদের সাথে। তুই বারণ করিস না প্লীজ”।

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “তুই তো ওকে দেখেছিসই সতু। তাহলে এখন আবার যেতে চাইছিস কেন? ডুয়ার্সের শোভা দেখতে”?

সতীশ সীমন্তিনীর হাত ধরে আব্দারের সুরে বলল, “লক্ষী দিদি আমার। তুই মানা করিস নে প্লীজ। বৌদিকে তো আমি তোর মত অত কাছে থেকে দেখিনি”।

সীমন্তিনী একটু কৌতুক করে বলল, “বারে ছেলে, এখনই সে তোর বৌদি হয়ে গেল”!

সতীশ হেসে বলল, “তুই যখন ওর পেছনে লেগেছিস, তাহলে আমাদের বৌদি না হয়ে ওর আর কোন উপায় আছে”?

সীমন্তিনী হেসে সতীশের মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, “তুইও একটা পাগল। কিন্তু ভাই, তুই গেলে যে আমার প্ল্যানটা ফেল হয়ে যাবে রে। তোর নাম শুনলেই তারা বুঝে ফেলবেন যে তুই আমার ভাই। কাল ওদের বাড়ি থেকে তোকে যখন ফোন করেছিলাম, তখন আমি তো তোকে নাম ধরে সতু বলে ডেকেছিলাম। ওরা সকলেই সেটা শুনে থাকবেন। তাই জেঠু বা কাকুরা যখন তোকে তাদের সামনে তোর নাম ধরে ডাকবেন তখন তো তারা বুঝে ফেলবেন। তাই তোর এখন যাওয়াটা একেবারেই ঠিক হবে না। তবে আমি তোকে কথা দিচ্ছি ভাই। আমি নিজে তোকে সাথে নিয়ে ওদের বাড়ি যাব। আর খুব শিগগীরই যাব”।

সতীশ সীমন্তিনীর হাত খামচে ধরে বলল, “সত্যি বড়দি? তুই কথা দিচ্ছিস”?

______________________________
 
 
 
(Update No. 40)

সীমন্তিনী স্নেহের হাঁসি হেসে বলল, “হ্যা রে পাগলা। তোর দিদি তোকে কথা দিচ্ছে। আর শোন, জেঠুরা কালচিনি থেকে ফিরে এলে সেখানে কি কথা হল তা সব কিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ জেনে নিয়ে তুই আমাকে ফোন করবি। তখন তোকে বলে দেব কখন কি করতে হবে। আর ছোটকাকুকে বলিস, জেঠুরা যখন কালচিনি রওনা হবে তখন তাদের সাথে যেন একটা নতুন ভাল মোবাইল সেট দিয়ে দেন আমার জন্য। আর সেই সাথে একটা প্রিপেইড সিমও যেন পাঠান। আমি তাদের কাছ থেকে নিয়ে নেব”।

সতীশ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুই আবার নতুন মোবাইল নিতে চাইছিস কেন? এটা কি খারাপ হয়ে গেছে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমার জন্যে নয় সেটা। সেটা তোর হবু বৌদির জন্য, বুঝেছিস? ওর সাথে আমাদের যোগাযোগ রাখতে হবে না? তবে এ’কথাটা বাড়িতে কাউকে বলিস না। বাড়িতে যেন সবাই জানে যে এটা আমার জন্যেই নিচ্ছি আমি। একটা ভাল দামী সেট দিতে বলিস। আর এয়ারটেলের সিম দিতে বলিস। অবশ্য আমিও আজ রাতে বা কাল ছোটকাকুকে সব বুঝিয়ে বলব। আর শোন, এক রাতের ভেতরেই জেঠুরা পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নিয়ে কাল সকালেই হয়ত রওনা হতে পারবেন না। পরশু যাওয়াই ভাল হবে। আর বলিস তারা যদি কালচিনি যাবার পথে আমার সাথে দেখা করতে এখানে আসতে চান, তাহলে কালচিনি গিয়ে পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে। তাই আমিই গিয়ে তাদের সাথে দেখা করব। আমাকে শুধু জানিয়ে দিস তাদের সাথে কোথায় গিয়ে দেখা করব আমি। আর শোন, শিলিগুড়ি থেকে কালচিনি যাবার অনেক পথ ও মাধ্যম আছে। জেঠুদের যেভাবে যেতে ইচ্ছে করে সেভাবেই তারা যেতে পারেন। জেঠুরা যদি জলপাইগুড়ি হয়ে যেতে চান, তাহলে আমি জলপাইগুড়ি ষ্টেশনেই তাদের সাথে দেখা করব। আমার নতুন ফোনটাও তখন কাকুর কাছ থেকে নিয়ে নেব। আর যদি তারা বাসে যেতে চান তাহলে আমি বাসস্ট্যাণ্ডে গিয়ে তাদের সাথে দেখা করব। কিন্তু আটটায় এখান থেকে আলিপুরদুয়ার যাবার বাসে চাপলে তারা আলিপুরদুয়ারে গিয়ে পৌছবেন বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ। তারপর সেখান থেকে কালচিনির বাস ধরে গেলে তারা প্রায় বারোটায় গিয়ে পৌছবেন কালচিনি। আর কালচিনিতে নেমে তারা খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে দুটো আড়াইটে নাগাদ একটা অটো ভাড়া করে যেন ওদের বাড়ি যান। আমি তোকে কাগজে নক্সা করে লিখে বুঝিয়ে দেব সব। সেটা তুই জেঠুকে বুঝিয়ে দিস। তবু কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন করলেই হল। তবে একটা কথা তাদের সবাইকে খুব ভাল করে বুঝিয়ে দিবি, কালচিনিতে তাদের বাড়িতে গিয়ে তারা কেউ যেন তোর আর আমার নাম মুখে না আনেন, আর ওই বাড়িতে তারা যতক্ষন থাকবেন ততক্ষণ যেন তোর বা আমার মোবাইলে কোন ফোন না করেন”।

সতীশ বলল, “দাঁড়া দাঁড়া বড়দি। তুই এত সব ইনস্ট্রাকশন দিচ্ছিস যে আমি বোধহয় সব গুলিয়েই ফেলব। দাঁড়া, আমি কাগজে নোট করে নিচ্ছি” বলে রাইটিং প্যাড আর কলম নিয়ে বসে লিখতে লিখতে বলতে লাগল, “মেয়ের নাম রচনা চক্রবর্তী। বাবার নাম শ্রী বিধূভূষন চক্রবর্তী। তারপর বাড়ির ঠিকানা। হ্যা হল। তারপর ট্রেন রুট। এনজেপি বা জলপাইগুড়ি রোড ষ্টেশন থেকে নিউ আলিপুরদুয়ারে পৌঁছবে,

______________________________
 
 
(Update No. 41)

তারপর সময় নষ্ট না করে অটো নিয়ে আলিপুরদুয়ার জংশন- সেখান থেকে কালচিনি, ঠিক আছে তো বড়দি”?

সীমন্তিনী বলল। “হ্যা ঠিক আছে। আর বাস রুটটাও নোট কর”।

সতীশ আবার লিখতে লখতে বলল, “বাসে গেলে জলপাইগুড়ি থেকে সকাল আলিপুরদুয়ার তিন ঘন্টা। তারপর আলিপুরদুয়ার থেকে বাস ধরে কালচিনি পৌঁছতে আরও একঘন্টা লাগবে। তারপর হোটেলে খাওয়া দাওয়া সেরে দুটো আড়াইটে নাগাদ অটো ভাড়া নিতে হবে। তারপর ওদের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। ওঃ হ্যা, আরো আছে তো। তোর জন্যে মোবাইল সেট আর এয়ারটেলের সিম। তারপর তোর সাথে দেখা করার লোকেশান। আর ওদের বাড়ি গিয়ে তোর বা আমার নাম মুখে আনা যাবে না। আর ফিরবেন ক’টায় তারা”?

সীমন্তিনী বলল, “ওখান থেকে আলিপুরদুয়ারের লাস্ট বাস ছাড়ে বিকেল পাঁচটায়। তবে শেষ গাড়ি বলে আলিপুরদুয়ারে পৌঁছোতে দেরী হতে পারে। তারপর বাস বা ট্রেন কখন কি পাওয়া যায় সেটা আমার ঠিক জানা নেই। সেটা তারা খবর নিয়ে দেখবেন। তবে জলপাইগুড়ি আসতে রাত হয়ে গেলে সে রাতে আমাদের এখানে থেকে তারা পরদিন বাড়ি যেতে পারবেন। এছাড়া কোনও গাড়ি ভাড়া করেও যেতে পারেন। শুধু আমাকে জানিয়ে দিতে বলিস। তাহলে আমি প্রিপায়ার্ড থাকব। তাদের জন্য রান্নাও করতে পারব”।

সতীশ সব কিছু নোট করে বলল, “হ্যা হয়েছে। আর কিছু লিখতে হবে বড়দি”?

সীমন্তিনী বলল, “কাগজটা আমাকে দে, ওটাতে আমি কালচিনি ষ্টেশন থেকে রচুদের বাড়ি যাবার পথের নক্সা একে দিচ্ছি। তাহলে আর জেঠুদের কোন অসুবিধেই হবে না। তবে ভাই, যারা যাবেন তাদের কিন্তু ভাল করে বুঝিয়ে দিবি যে ওখানে গিয়ে তারা যেন ভুলেও তোর আর আমার নাম মুখে উচ্চারণ না করেন।
আর কে কে যাবেন সেটা তারাই ঠিক করুক। তবে আমার মনে হয় জেঠু, বাবা আর ছোটকাকুর সাথে বড়মাও যদি যান, তাহলে খুব ভাল হয়। আমি দাদাভাই আর ছোটকাকুর সাথে কাল কথা বলব। তবে তুই আজ রাতেই বাড়ির সকলকে একসাথে নিয়ে বসে কথাটা বলবি। দাদাভাই যদি কোন কারনবশতঃ সবার সাথে একসাথে বসতে না চায় তাহলে তাকে আলাদা ভাবেও বলতে পারিস। কিন্তু আমি কি উদ্দেশ্য নিয়ে কালচিনি গিয়েছিলাম এটা যেন সকলেই এখন রচুদের বাড়ির সকলের কাছে গোপন রাখেন, এ কথাটাও সবাইকেই ভাল করে বুঝিয়ে দিবি। অবশ্য ছোটকাকু গেলে আমার আর চিন্তা থাকবে না। অন্য কেউ মুখ ফস্কে কিছু বলে ফেললেও ছোটকাকু সেটা সামাল দিতে পারবেন”।

সীমন্তিনীর সব কথা হৃদয়ঙ্গম করে সতীশ সন্ধ্যে ছ’টার গাড়িতে বাড়ি চলে গেল।



*****************************************************************
ss_sexy
Like Reply
#16
(Update No. 42)

রাত আটটার সময় রতীশ ফোন করতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “দাদাভাই, সবটা শুনেছিস”?

রতীশ বলল, “আমি এখনও সব কিছু সেভাবে শুনিনি রে মন্তি। তবে তুই মাকে দুপুরবেলা ফোন করতেই বাড়িতে সোরগোল চলছে তখন থেকেই। মাকে তুই যা বলেছিস সেটুকু শুনেছি আমি। বাবা কাকুরা সবাই সতু আসবার প্রায় সাথে সাথেই বাড়ি চলে এসেছেন। বাবার ঘরে এখন বাড়ির সবাই মিলে বসেছে। সতু তাদের সব কিছু বলছে। কিন্তু মন্তি, আমি এখনও বুঝতে পাচ্ছি না রে আমরা ঠিক করছি কি না”।

সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই, অনেক ভাগ্য করলে তবেই রচনার মত একটা বৌ পাওয়া যায় রে। আমি ওর সাথে পনের ষোল ঘন্টা কাটিয়ে এসেছি। আমি ওকে খুব ভাল করে স্টাডি করেছি। দেখিস আমাদের ঘরে সত্যি সত্যি মা লক্ষী আসছে রে দাদাভাই। আমি জানি, ওকে বিয়ে করে তুই খুব খুব সুখী হবি দাদাভাই”।

রতীশ কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আমি ওই মেয়েটার ব্যাপারে কিছু বলছিনা রে মন্তি। আমরা যা করতে চাইছি, তা ঠিক হচ্ছে কিনা সেটাই বুঝতে পাচ্ছি না”।

সীমন্তিনী বলল, “আমরা যা করছি তা একদম ঠিক করছি। রচনা সত্যি খুব ভাল মেয়ে রে দাদাভাই। যেমন কথাবার্তা তেমন সুন্দর দেখতে, আর তেমনই সুন্দর ওর আচার ব্যবহার। আর কী সরল মনের মেয়ে। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমার সাথে এমন ফ্রি হয়ে গেছে যে কী বলব তোকে। রচনা আর ওর ছোটভাই কিংশুক তো আমাকে দিদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছে। আর ওর মা বাবাও খুবই ভদ্র আর অমায়িক মানুষ। কিন্তু ওরা নিতান্তই গরীব। ওদের ঘরের অবস্থা দেখেই বুঝেছি যে কখন কখনও বুঝি তাদের ঘরে দু’বেলা রান্নাও হয়না। কিন্তু তাদের তিনটি ছেলেমেয়েই খুব ভদ্র আর সুশীল। ছেলেমেয়েদের তারা খুব সংস্কারি করে তুলেছেন। রচনা আর ওর ছোটভাই দু’জনেই পড়াশোনায় খুব ভাল। বরাবর ক্লাসে প্রথম হয় ওরা। রচনা এবার ইলেভেন পাশ করছে। আর কিংশুক ক্লাস এইটে পড়ছে। আর ওদের মা-ও কি সুন্দর দেখতেরে দাদাভাই! ওর মা একটা লালপেড়ে পুরোন শাড়ি পড়ে ছিল। আমার তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে সাক্ষাৎ মা দুর্গা যেন গরীব গৃহবধূর বেশে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। আর ওর বাবাও একেবারে মাটির মানুষ। পয়সার অভাবেই এক ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে তাদের বড় মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু মেয়েটা শ্বশুর বাড়িতে খুব কষ্টে আছে বলে ওর বাবা খুব মনঃকষ্টে আছেন। আমার সাথে তারা সকলেই এমনভাবে কথা বলেছেন যে আমি যেন তাদের কত আপন। আমি যেন তাদের নিজের ঘরেরই আরেকটা মেয়ে। তাই বলছি দাদাভাই, তুই একদম ভাবিস না। রচনার মত একটা মেয়েকে জীবনসঙ্গী করতে পারলে তুই যে সত্যি খুশী হবি, সে বিষয়ে আমার মনে একেবারেই সন্দেহ নেই”।

রতীশ বলল, “আমাকে তুই এত কথা বলছিস কেন রে মন্তি? বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে মার মুখে ব্যাপারটা শুনেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম যে মেয়েটাকে তোর পছন্দ হয়েছে। আর এটাও জানি, ওই মেয়ের সাথেই তুই আমার বিয়ে দিবি। কিন্তু দ্বিধাটা অন্য জায়গায় রে। তুই তো জানিসই সেই ছোটবেলা থেকে আমি কেবল একটা মেয়েকেই ধ্যানে জ্ঞানে জেগে ঘুমিয়ে আমার পাশে দেখতে চেয়েছিলাম। পাঁচ ছ বছর ধরে আমরা একে অপরকে ছেড়ে আছি। কিন্তু এখনও তুইই যে আমার সব। আমার মনের আয়নায় আমি এখনও তোকে সব সময় দেখতে পাই। অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে আমি তার ক্ষতি করে ফেলব না তো? বিয়েটা তো কোন ছেলে খেলা নয়। বিয়ে করে আমি ওকে যদি পুরোপুরি ভাবে স্ত্রীর মর্য্যাদা দিতে না পারি? তুইই তো বললি, ওর দিদির বিয়ে হবার পর মেয়েটা সুখী হয়নি। আর মেয়ে সুখী হয়নি বলেই ওর বাবা মার মনেও দুঃখ আছে। ছোটমেয়ের বিয়ের পরেও তারা যদি আবার নতুন করে দুঃখ পান? তোকে যে আমি ভুলতে পারবনা। আমি কি সত্যিই মন থেকে ওকে স্ত্রী বলে মেনে নিতে পারব? এটা নিয়েই শুধু ভাবছি রে”।

সীমন্তিনী রতীশের কথা শুনে বলল, “দাদাভাই, আমরা দু’জনেই একটা ভুল করে ফেলেছিলাম রে ওই ছোট বয়সে। সেদিন তো বুঝিনি। কিন্তু ক্লাস এইটে ওঠবার পর থেকেই আমাকে বড়মা সব বুঝিয়েছিলেন। আমিও তার প্রতিটা কথা বুঝেছিলাম। কিন্তু ততদিনে আমি এমন একটা অবস্থায় গিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম যে আমরা দু’জন কেউ কাউকে বিয়ে করতে পারবনা বুঝেও তোকে জোর করে দুরে পাঠিয়ে দিয়ে তোর আর আমার শারীরিক সম্পর্কটায় ইতি টানতে পারলেও, তোকে আমার মন থেকে সরাতে পারিনি। আর আমি জানি, জীবনের বাকি দিনগুলোতেও হয়ত আমি সেটা করতে পারব না। তাই জীবনের লক্ষ্যটাকে একটু বদলে নিয়েছি। বড়মাকে দেওয়া কথা রাখবার পাশাপাশি তোকেও আমি সুখী দেখতে চাই সারাটা জীবন ধরে। দুরে থেকেও আমি সব সময় তোর আর তোর স্ত্রীর পাশে থাকব। তাই এমন একটা মেয়ে খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন ছিল যাকে তোর ভাল লাগবে। ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে রচনাকে দেখে মনে হয়েছিল, একেই বুঝি আমরা খুঁজছিলাম। আর কালচিনি গিয়ে বুঝতে পেরেছি ওর মত একটা মেয়েই তোকে সুখী রাখতে পারবে। তাই মন থেকে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ ঝেড়ে ফেলে দে। তোকে বেশী কিছু করতে হবে না। সেই ছোটবেলা থেকে যে কাজটা করে এসেছিস, সেটাই করে যা। তোর মন্তি তোকে যা করতে বলেছে, এতদিন তুই তো শুধু সেটাই করে এসেছিস না? আজও নাহয় তাই করে যা। আমার কথাটা রাখ। ভবিষ্যতের সমস্ত দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দে। আমি সারাজীবন দুরে থেকে তোকে আগলে রাখব। তোর কাছে এটুকু চাইতে পারিনা আমি দাদাভাই”?

রতীশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ওই একটা কাজ করতেই তো আমি অভ্যস্ত রে। আমাকে সুখী করতে তুই নিজের পায়ে কুড়োল তো ছোট থাকতেই মেরে বসেছিস। এবার তো নিজের বুকে ছোড়া বেঁধাতে চাইছিস তুই। হয়ত আমিই তোকে এমনটা করতে বাধ্য করেছি। কিন্তু তোর নিজের কি হবে”?

রতীশের কথা শুনে সীমন্তিনীর বুকটা টনটন করে উঠল। তবু নিজেকে সংযত করে সে বলল, “আমার জীবন তো তুই অনেক আগেই পূর্ণ করে দিয়েছিস দাদাভাই। আমার যা কিছু কাম্য ছিল, যা কিছু পাবার ছিল, সে সব কিছু আমি পেয়ে গেছিরে। আর আমার নতুন করে কিচ্ছুটি পাবার নেই। কিন্তু একটা কথা শুধু তোকে বলছি। রচনার সঙ্গে বিয়ে তো তোর হবেই। তবে সেটা কিন্তু এখনই হবে না। বছর খানেক সময় লাগবে। আর তারপর যে রচনাকে তুই বিয়ে করবি, সে রচনার মধ্যে আমাকেও পাবি। রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তুই ভাববি তোর দু’হাতের মাঝে আবদ্ধ শরীরটা রচনার হলেও, সে শরীরটার ভেতর থাকব আমি। তুই চোখ বুজে সেটা বুঝতে চাইলেই বুঝতে পারবি। তুই শুধু আমাকে একটা কথা দে দাদাভাই। আমাকে যেমন ছোটবেলা থেকে তুই কোন কষ্ট দিসনি, রচনাকেও ঠিক সেভাবেই কোন কষ্ট দিবি না। আমার সব কথা যেমন তুই মেনে চলিস, তেমনি ওর সব কথাও তুই মেনে চলবি। এ কথাটুকু দিবি না আমাকে”?

রতীশ বলল, “তোর মুখের প্রত্যেকটা কথাই তো আমার কাছে একেকটা নিয়ম রে মন্তি। আজ অব্দি তোর কোন কথা আমি অমান্য করেছি? আজও করব না। তবে ভবিষ্যত নিয়ে তোর মনে যতটা জোর আছে, আমার যে ততটা নেই, এ তো তুই ভালভাবেই জানিস। তবে তোর কথা যে মেনে চলব, সেটা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে রে”।

সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই, কিচ্ছু ভাবিস না। যা হবে সব ভাল হবে। আচ্ছা শোন দাদাভাই। আমি এখন আর কথা বলছি না। রাতের রান্নাটা সেরে নিই। পরে তোর সাথে কথা বলব আবার, কেমন”?

ফোন কেটে দিয়ে নিজের চোখ বেয়ে নেমে আসা জলের ধারাকে মুছে নিয়ে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সীমন্তিনী। তার মনে পড়ে গেল অনেক বছর আগের একটা কথা। তখন তার দেহে যৌবনের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। দাদাভাইয়ের সাথে সে ছোটবেলা থেকেই একসাথে ঘুমোত। একদিন তার মা তাকে বলেছিলেন যে সীমন্তিনীর ওভাবে দাদাভাইকে জড়িয়ে ধরে শোয়াটা ঠিক নয়। সেদিনই মন্তি রেগে উঠে বলেছিল যে সে তার দাদাভাইয়ের বৌ। আর সব স্বামী স্ত্রীই একসাথে ঘুমোয়। সেও তাই তার দাদাভাইয়ের সাথেই ঘুমোবে রোজ। কেউ সেটা আটকাতে পারবে না। এ নিয়ে প্রচুর বাকবিতণ্ডা হলেও মার কোন কথাই সে শোনেনি। মার সাথে সাথে তার বড়মা-ও তাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু সীমন্তিনী কারুর কথায় কর্ণপাত না করে রেগে গিয়ে ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে শুরু করেছিল। আর এমন ঘটণা শুধু একদিনের বা একবারের নয়। বহুবার এর পুনরাবৃত্তিও ঘটেছিল। কিন্তু জেদী, রাগী, উগ্র মন্তি কোনদিন কারুর কথা শোনেনি। তার বাবা আর মা তাকে প্রচুর মারধরও করেছিলেন ওই সময়ে। একদিন রাতে দাদাভাইয়ের বিছানায় শুতে যাবার সময় তার বাবা তাকে বেত দিয়ে এমন মার মেরেছিলেন যে তার দুটো পায়ের হাঁটুর কাছে অনেকটা করে ছড়ে গিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছিল। সে ক্ষতের চিহ্ন এখনও তার শরীরে বিদ্যমান রয়ে গেছে। এমন ক্ষতচিহ্ন তার শরীরে আরও আছে। ডানদিকের পাঁজরের নিচে কোমড়ের একটু ওপরে আর পিঠেও তার বাবার প্রহারের চিহ্ন এখনও আছে। কিন্তু এত কিছু সত্বেও তার জেদের কাছে তার বাবাকে হার মানতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তার দাদাভাই ছিল একেবারেই শান্ত স্বভাবের। তাকে যখন বাড়ির লোকেরা মারতেন, তখন তার দাদাভাই শুধু দুরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সকলের কাছে মিনতি করত তারা যেন আর ব্যথা না দেয় মন্তিকে। কিন্তু তার কথা রেগে যাওয়া বাড়ির গুরুজনদের কানে গিয়ে হয়ত পৌঁছতই না। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে তারা যখন মন্তিকে ছেড়ে দিতেন তখন দাদাভাই তার ক্ষত গুলোর ওপর মলম লাগিয়ে দিত। বড়মা নিজেই দুর থেকে মলমটা ছুঁড়ে দিতেন তাদের বিছানার ওপর। তার দাদাভাই যখন আদর করে তার ক্ষতগুলোর ওপর মলম লাগিয়ে দিত তখন তার মনে হত তার আর কোন কষ্ট নেই। বছর দুয়েক পর সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছিল। তারপর এক সময় বড়মা প্রায় বাধ্য হয়েই দাদাভাই আর তার জন্য আলাদা একটা শোবার ঘরের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে কেউ আর তাকে মারধোর করতনা। কিন্তু তার বাবা আর মা মেয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তখন থেকেই। ছোটমা তখন বাড়ির নতুন বৌ। তিনি সীমন্তিনীর ওপর হাত না তুললেও অনেক ভাবে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতেন। ছোটকাকু আর জেঠুও তাই করতেন। কিন্তু সীমন্তিনীর মনের ওপর কেউ কোন প্রভাব ফেলতে পারেন নি। খাবার টেবিলে সকলের সাথে তাদের দু’জনকে খেতে দেওয়াও হত না। বড়মা দু’জনের খাবার তাদের ঘরে দিয়ে যেতেন। তখন থেকে একমাত্র বড়মা সরলাদেবী আর ছোটকাকু চন্দ্রকান্ত ছাড়া বাড়ির আর কেউ সীমন্তিনীর সাথে কথা বলতেন না।

আর একটু বড় হবার পর সীমন্তিনী নিজেই বুঝতে পেরেছিল, যে মনে মনে সে তার দাদাভাইকে তার স্বামী বলে মানলেও তার দাদাভাইকে সে কখনও বিয়ে করতে পারবে না। বাড়ির গুরুজনেরা বা সমাজের অন্য কেউই তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক মেনে নিতে পারবে না। আর প্রশ্নটা পারা না পারার নয়। এ যে একেবারেই অসম্ভব সেটা তখন সে নিজেই বুঝতে হয়েছে। বড়মা রোজই শান্তভাবে তাদের দু’জনকে বোঝাতেন। কিন্তু রতীশের মুখে শুধু একটা কথাই ছিল। মন্তি যা চাইবে তা-ই হবে। ক্লাস টেনে পড়বার সময় মন্তি যখন চিন্তাধারায় পরিপক্ক হয়ে উঠেছিল, তখন বড়মাকে সে কথা দিয়েছিল যে তার বড়ছেলের কোন সর্বনাশ সে করবে না। সে ধীরে ধীরে তার দাদাভাইয়ের জীবন থেকে সরে আসবে। কিন্তু তার একটা কথাও বাড়ির সবাইকে মেনে নিতে হবে। আর সে দায়িত্ব নিতে হবে বড়মাকেই। বড়মা রাজি হওয়াতে সীমন্তিনী তাকে বলেছিল, দাদাভাইয়ের সাথে সে অন্য কোন মেয়ের বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করে তুলবে। কিন্তু বাড়ির কেউ যেন কখনও সীমন্তিনীকে বিয়ে করতে না বলে। সে’কথা শুনে তার বাবা শশীকান্ত রেগে গিয়ে তার বড়মাকে বলেছিলেন যে মেয়েকে আইবুড়ো করে ঘরে বসিয়ে রেখে সে সারাজীবন তাকে খাওয়াতে পড়াতে পারবেন না। সীমন্তিনীও জবাবে বলেছিল, সে নিজেও সেটা চায় না। তার নিজের জীবনের চিন্তা সে নিজেই করবে। বাড়ির কাউকে তার ব্যাপারে কোন মাথা ঘামাতে হবে না। বাড়ির লোকেরা যদি তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য না করেন তাতেও তার কোন ক্ষোভ থাকবে না। তবে দাদাভাইকে বাড়ির কেউ কোন কিছু বলতে পারবে না, তার দাদাভাইয়ের ব্যাপারে কোন কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হলে সেটা শুধু সে নিজেই নেবে। আর তার কথা বাড়ির সকলকে মেনে নিতে হবে। তার দাদাভাইকে কেউ শারীরিক বা মানসিক কষ্ট দিলে সীমন্তিনী কাউকে ছেড়ে কথা বলবে না।

বাড়ির সকলে নিরূপায় হয়েই সীমন্তিনীর কথা মেনে নিয়েছিলেন। বরং বলা ভাল, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাধ্যমিক পাশ করবার পর মন্তি অনেক ভেবে চিন্তেই দাদাভাইকে দেরাদুন কলেজে পাঠিয়ে দিয়েছিল। নিজেও বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছিল জলপাইগুড়ি। তারপর থেকে এতটা বছর এ ভাবেই চলছে। নিজের বাবা মা তার সাথে কথা বলেন না। তার পড়াশোনার ব্যাপারেও তারা কোন মাথা ঘামান না। তার সমস্ত প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছেন তার বড়মা আর ছোটকাকু। ধীরে ধীরে দাদাভাইয়ের মন থেকে তার শারীরিক মোহটা যে সে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে সে তা জানে। এখন রচনার মত একটা সুন্দর মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করলে ধীরে ধীরে রতীশ পুরোপুরিভাবেই তার মায়া কাটিয়ে উঠতে পারবে বলেই তার বিশ্বাস। আর রচনাকে যখন তার দাদাভাইয়ের ভাল লেগেছে, তখন রচনাই সেটা করতে পারবে। তাই যে কোন মূল্যে রচনার সাথে রতীশের বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। তবে রচনার বয়স কম। সবে সতের চলছে। আর পড়াশোনার যেটুকু সুযোগ সে পেয়েছে সেটুকু পড়ে নিক। হায়ার সেকেণ্ডারী পাশ করবার পর ওদের বিয়ে নিয়ে ভাবা যাবে। ততদিনে রচনাও প্রাপ্ত বয়স্কা হয়ে উঠবে। তবে রচনাকে যেভাবেই হোক হাতে রাখতেই হবে। হাতছাড়া করা একেবারেই চলবে না।

হাতজোড় করে মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করল “হে ঠাকুর আমার মনোবাঞ্ছা পূরন কোর তুমি”।

****************

রতীশদের বাড়ি থেকে রতিকান্তবাবু স্ত্রী সরলাদেবী আর ছোটভাই চন্দ্রকান্তকে নিয়ে কালচিনি গিয়েছিলেন। সীমন্তিনীর কথা মতই দুপুর পার করে তারা বিধুবাবুর বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। পরিচয় পর্ব সেরে রতিকান্তবাবু তাদের উদ্দেশ্য খুলে বলে বিধুবাবুর কাছে নিজের বড়ছেলের সাথে রচনার বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন। একেবারেই ঘরোয়া পোশাকে রচনাকে দেখে সকলেরই খুব পছন্দ হয়েছিল। বিধুবাবু আর বিভাদেবীও ছেলে পক্ষের কথাবার্তা শুনে খুব খুশী হয়েছিলেন। কিন্তু বাদ সাধল মেয়ে নিজেই। মৃদু গলায় সে বিনীতভাবে সবাইকে বলেছিল যে মা বাবার পছন্দ মতই সে বিয়ে করবে। কিন্তু তাকে ক’টা দিন ভাববার সময় দিতে হবে। আর হায়ার সেকেণ্ডারী পাশ না করা পর্যন্ত সে বিয়ে করতেও রাজি নয়। এ’কথা বলে ছেলের মা, বাবা আর কাকুকে সে শ্রদ্ধা ভরে প্রণাম করেছিল।

কালচিনি থেকে ফেরার পথে তারা কেউ আর সীমন্তিনীর সাথে দেখা করেন নি। জলপাইগুড়ি এসে হাতের সামনেই রাজগঞ্জের গাড়ি পেয়ে তারা সোজা বাড়ি চলে এসেছিলেন। বাড়ি পৌঁছেই সরলাদেবী সীমন্তিনীকে ফোন করলেন। সীমন্তিনীও সারা দিন নিজের কাজে ব্যস্ত থাকলেও বিকেল থেকেই কিছু একটা খবরের আশায় ছটফট করতে শুরু করেছিল। বড়মার ফোন আসতেই সে ফোন ধরে বলল, “তোমরা কোথায় আছ গো বড়মা? এখনও কি জলপাইগুড়ি এসে পৌঁছোও নি তোমরা”?

সরলাদেবী বললেন, “আর বলিসনে রে মা। জলপাইগুড়ি এসেই এদিকের একটা বাস পেয়ে যেতে তোর কাকু জেঠু আমাকে সে বাসেই তুলে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। এই তো মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই বাড়ি এসে ঢুকেছি। আর পোশাক আশাক খুলে হাত মুখ ধুয়েই তোকে ফোন করলুম আমি”।

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা। তোমরা বাড়ি পৌঁছে গেছ? আর আমি অপেক্ষা করছি তোমাদের জলপাইগুড়ি আসার। তোমরা এলে রান্না বসাব বলে ভাবছি। তা ঠিক আছে। কালচিনিতে রচনার মা বাবার সাথে তোমাদের আলাপ কি হল? আর রচনাকে কেমন লাগল”?

সরলাদেবী খুব খুশী খুশী গলায় বললেন, “মেয়েটাকে তো আমাদের সকলেরই দারুণ পছন্দ হয়েছে রে। সতু আর তুই ঠিক বলেছিস। মেয়ে তো নয় যেন সাক্ষাৎ মা লক্ষী। কিন্তু হলে কি হবে রে। মেয়ের মা বাবা রাজি হলেও মেয়ে নিজেই তো সবকিছুর ওপর জল ঢেলে দিল”।

সীমন্তিনী চমকে উঠে বলল, “মানে? ও আবার কি করেছে? হঠাৎ করে কোন খবরাখবর না দিয়ে তোমরা সরাসরি গিয়ে তার বিয়ের কথা তুলেছ বলে তোমাদের কোন অপমান টপমান করেছে নাকি”?

সরলাদেবী বললেন, “আরে না না তেমন কিছু নয়। মেয়েটা তো যথেষ্ট ভদ্র আর শান্ত। কিন্তু খুব বিনয়ী হয়েই ও মা বাবার সামনেই আমাদের যে কথা বলল, তা শুনেই মনে একটু খটকা লেগেছে রে”।

সীমন্তিনী অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আরে ও বলেছেটা কি সেটা তো বল”।

সরলাদেবী বললেন, “মেয়েটা বলেছে যে ও ওর মা বাবার পছন্দ মতই বিয়ে করবে। কিন্তু তাকে ভেবে দেখবার জন্য ক’টা দিন সময় দিতে হবে। আর বারো ক্লাসের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে বিয়ে করবে না”।

______________________________
 ss_sexy
Like Reply
#17
 
(Update No. 43)

সীমন্তিনী হাঁপ ছেড়ে বলল, “ও এই কথা। তা এ তো ভাল কথাই বলেছে। একদম ঠিক কথা বলেছে”।

সরলাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “কি বলছিস তুই? ঠিক কথা বলেছে? আমার তো মনে হয় ও মেয়ে মনে মনে কাউকে ভালবেসে রেখেছে। তাকেই বিয়ে করবে। তাই সোজাসুজি না বলে এভাবে আমাদের বিদেয় করেছে”।

সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “বড়মা, এখন দিন কাল পাল্টেছে। তোমাদের জমানায় যা হত এখনকার ছেলেমেয়েরা কি আর তেমন করে? আর তুমি কি জান? আঠারো বছরের আগে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা এখন আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ। রচনার বয়স এখন মাত্র সতের বছর। ও এগার ক্লাসে পড়ছে। বারো ক্লাস পার হতে হতে ওর আঠারো বছর হয়ে যাবে। বিয়েটা তো তখনই সম্ভব হবে”।

সরলাদেবী বললেন, “তাই নাকি? এখন দেশে এমন আইন হয়েছে”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাগো বড়মা। আর আমিও তো মনে মনে তাই চাইছি। মেয়েটা লেখাপড়ায় এত ভাল। মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে প্রথম স্থানে ছিল। বিয়ের পর আমাদের সংসারে এসে ও আর পড়তে পারবে কিনা তা তো এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে আমি তো চাইব ও অন্ততঃ গ্রেজুয়েশনটা কমপ্লিট করুক। তাই বিয়েটা বছর খানেক বাদে হলে তো হায়ার সেকেণ্ডারিটা ও কমপ্লিট করে নিতে পারবে বিয়ের আগে। আঠারো বছর পার না হলে আমরাও ওকে ঘরের বৌ করে ঘরে আনব না। আর তাই তো বলছি, ও একদম ঠিক কথাই বলেছে”।

সরলাদেবী বললেন, “ও, কিন্তু সতু তো আমাদের এ কথাগুলো বলেনি। আর সেটাই যদি হত তাহলে এত তাড়াহুড়ো করে আমাদের যাবার প্রয়োজনটাই বা কি ছিল”?

সীমন্তিনী বলল, “বড়মা তুমি এটাও বুঝতে পাচ্ছ না? আরে আঠারো বছরের আগে বিয়ে দেওয়াটা আইনতঃ অপরাধ, সেটা তো ঠিক। কিন্তু বিয়ের কথাবার্তা বলতে তো দোষ নেই। বিয়ে পাকাপাকি করতেও বাঁধা নেই। আর অমন সুন্দরী মেয়ের পেছনে যে কত ছেলে কত ছেলের মা বাবারা লাইন দিয়ে আছে কে জানে। কথাটা পাকা হয়ে গেলেই তো আমাদের উদ্দেশ্যটা সিদ্ধি হত। সে জন্যেই তাড়াহুড়ো করে তোমাদের ওখানে যেতে বলেছিলুম আমি”।

সরলাদেবী বললেন, “ওমা, তা এ কথাগুলো সতু কেন খুলে বলেনি আমাদের? কিন্তু তা সত্বেও মেয়েটার
আরেকটা কথাও যে মনে খচখচ করছে রে। মেয়েটা যদি সত্যি সত্যি মা বাবার পছন্দ করা পাত্রকেই বিয়ে করবে তাহলে সে আর ভাববার জন্য সময় চাইল কেন”?

সীমন্তিনী বলল, “ও নিয়ে কিচ্ছু ভেব না তুমি বড়মা। মেয়েটা কেন তোমাদের কাছে ক’টা দিন সময় চেয়েছে, সেটা বোধ হয় আমি জানি। তাই বলছি তুমি যেটা ভাবছ সেটা সত্যি নয়”।

সরলাদেবী এবার খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস তুই মন্তি”?

সীমন্তিনী বলল, “তুমি তো তোমার এ মেয়েটাকে চেন বড়মা। সত্যি কথা অন্যায় হলেও বুক ফুলিয়ে সে সেটা স্বীকার করতে পারে। আর তোমার কাছে সে কখনও মিথ্যে বলেনি, এ’কথাও তো তুমি জান। আজও যে মিথ্যে বলছি না এটা তুমি বিশ্বাস করতে পার। আর যেখানে আমার দাদাভাইয়ের স্বার্থ জড়িয়ে আছে, সেখানে আমি মিছে কথা বলতে পারি বলে তুমি বিশ্বাস কর”?

সরলাদেবী বললেন, “জানিরে মা জানি। তোকে কি আমি চিনি না? তোর দাদাভাইয়ের সুখের জন্য গত পাঁচ ছ’টা বছর ধরে তুই তো অনেক কিছুই করে যাচ্ছিস। অন্য কারো কাছে প্রকাশ করতে না পারলেও আমি নিজে তো জানি সেই ছোট্ট বেলা থেকে তোর দাদাভাইই তোর প্রাণ। কিন্তু রচনার সময় চেয়ে নেবার পেছনে কারনটা কী হতে পারে বল তো মা”?

সীমন্তিনী বলল, “শোন বড়মা। রচনার খুব হিতৈষী একজন দিদি আছে। আর সে দিদিকে ও কথা দিয়েছে যে কোন জায়গা থেকে তার বিয়ের কোন সম্মন্ধ এলে, সে বিয়েতে মত দেবার আগে ওর সেই দিদির সাথে পরামর্শ করবে। আর ওর সেই দিদিটা কালচিনিতে থাকে না। আর ওদের বাড়িতে ফোনও নেই, যে চট করেই সে দিদির সাথে ফোনে কথা বলবে। বাইরের কোন পিসিও থেকে ফোন করবার মত পয়সাও হাতে না থাকতে পারে। হয়ত চিঠিতেই লিখে জানাবে। তাই ক’টা দিন সময় তো ওকে নিতেই হবে”।

সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই এত সব কথা জানলি কি করে? কে বলেছে তোকে এসব কথা? আর এ জন্যই যে সে সময় চেয়েছে তা-ই বা বলছিস কি করে”?

সীমন্তিনী দুষ্টুমি করে বলল, “বারে জানব না কেন বড়মা? তোমার এই অলক্ষ্মী মেয়েটাই যে ওর সেই দিদি গো। আর সে জন্যেই তো ও বাড়িতে গিয়ে আমার আর সতুর নাম তোমাদের মুখে আনতে বারণ করেছিলাম আমি। তুমি দেখো। ওরা ঠিক দু’একদিনের মধ্যেই আমাকে ফোন করতে পারে। আর ফোন করতে না পারলে চার পাঁচ দিনের মধ্যেই আমি ওর চিঠি পাব”।

সরলাদেবী প্রায় শ্বাসরুদ্ধ গলায় বললেন, “কী বলছিস তুই মন্তি? সত্যি? তুই একবার মেয়েটার সাথে দেখা করেই ওকে এমনভাবে আপন করে নিয়েছিস? ও তোর ওপর এতোটা ভরসা করতে শুরু করেছে”?

সীমন্তিনী বলল, “তুমি কিগো বড়মা? তখন থেকে শুধু মেয়েটা মেয়েটা করে বলে যাচ্ছ? নাম ধরে বলতে তোমার কষ্ট হলে বড়বৌমাও তো বলতে পার? তুমি এখন থেকে সেটা অভ্যেস করতে পার। আর পারলে আগামী বছরের পাঁজি খুঁজে পেলে ফাল্গুন মাসের প্রথম পনের দিন বাদে একটা বিয়ের দিন ঠিক করে রাখ। তখন রচনার আঠারো বছরও হয়ে যাবে, আর ওর বারো ক্লাসের পরীক্ষাও শেষ হয়ে যাবে। আর তুমিও কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারবে তোমাদের কাছে রচনা সময় চেয়ে নেবার পেছনে যে কারনের কথা আমি বললাম, সেটা ঠিক না ভুল”।

সরলাদেবী খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন, “সত্যি বলছিস মা তুই? আমার তো খুশীতে নাচতে ইচ্ছে করছে রে। আমি কাল সকালেই রতুকে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে পূজো দেব”।

সীমন্তিনী বলল, “দিও বড়মা। রচুকে আমি যতটুকু চিনেছি তাতে আমি তোমাকে কথা দিলাম ও-ই তোমার বড়ছেলের বৌ হয়ে তোমার ঘরে যাবে। তুমি দেখে নিও। এটা তোমার কাছে তোমার এই অবাধ্য মেয়ের প্রতিজ্ঞা”।

সরলাদেবী বললেন, “তোর মুখে ফুল চন্দন পড়ুক মা”।

তার গলা শুনেই সীমন্তিনী বুঝতে পেল বড়মা খুশীতে কেঁদে ফেলেছেন। সেও জবাবে বলল, “ফুল চন্দন চাইনে গো বড়মা। আমি শুধু তোমার স্নেহ পেলেই খুশী হব। আচ্ছা বড়মা, এখন রাখছি। তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম বলে রাতের রান্না করিনি। এবার সেটা না করলে আমাকে আজ রাতে না খেয়েই ঘুমোতে হবে”।

সরলাদেবী বললেন, “আচ্ছা আচ্ছা মা। রাখছি আমি। তুই না খেয়ে ঘুমোসনা লক্ষীটি। তোর বড়মার দিব্যি রইল। আর ভাল থাকিস মা। কাল কথা বলব আবার” বলে ফোন রেখে দিলেন।

************

পরের দিন ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে সীমন্তিনী ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে সুইচ অন করল। ক্লাসে থাকলে মোবাইল অফ করে রাখতে হয়। ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে গেটের দিকে যেতে যেতেই হঠাৎ তার মোবাইলটা দু’বার রিং হয়েই থেমে গেল। কেউ বুঝি মিসকল দিল। ফোনটা বের করে দেখে সত্যি সত্যি একটা আননোন নাম্বার থেকে মিসকল এসেছে একটা। এ মিসকল তাকে কে দিল? রচনাই কি তার কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে এ মিসকল দিয়েছে? না অন্য কেউ? ভাবতে ভাবতেই সে নাম্বারে কল করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও’পাশ থেকে একটা মেয়ের গলা শোনা গেল, “তুমি দিদিভাই তো”?

সীমন্তিনী বলল, “দিদিভাই মানে? কে বলছেন”?

ওপাশ থেকে জবাব এল, “দিদিভাই আমি রচু বলছি গো”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে জবাব দিল, “রচু তুই? সত্যি বলছিস তো? আমি তো ভাবতেই পাচ্ছি না”?

রচনাও খুব খুশী গলায় জবাব দিল, “হ্যা গো দিদিভাই। আধঘন্টা থেকে তোমাকে ফোন করবার চেষ্টা করছিলাম। বার বার শুধু শুনছিলাম যে ফোন সুইচ অফ সুইচ অফ। এই মাত্র শুধু একটা কল ঢুকেছিল”।

সীমন্তিনী বলল, “সরি রে রচু সোনা। তোকে কথাটা বোধহয় বলিনি আমি। একটু আগে ক্লাসের ভেতর ছিলাম। আর ক্লাসে ঢোকার আগে ফোন সুইচ অফ করতে হয়, এটাই নিয়ম। তাই ক্লাস থেকে বেরিয়ে ফোনটা অন করেছিলাম। তখনই তোর মিসকলটা পেলাম। তা কার ফোন থেকে করেছিস? এটা কি কোন পিসিওর ফোন নাকি রে”?

রচনা বলল, “নাগো দিদিভাই, এটা আমার এক বান্ধবীর ফোন। তোমাকে একটা কথা জানাবার আছে বলেই ওর ফোন থেকে তোমাকে মিসকল দিয়েছিলাম। তা তুমি কি ব্যস্ত আছ এখন”?

সীমন্তিনী বলল, “যাক আমার কথাটা তাহলে মনে রেখেছিস। খুব খুশী হলাম। আর এখন ক্লাস শেষ হয়ে গেছে বলে ফ্রীই আছি। বল কি বলবি। তবে আগে বল মাসি মেসো আর ভাই কেমন আছে”।

রচনা বলল, “হ্যা দিদিভাই, সকলেই ভাল আছে। কিন্তু কাল একটা ঘটণা ঘটে গেছে। তোমাকে সেটাই জানাব বলে ফোন করেছি”।

সীমন্তিনী বলল, “হুমমম মনে হচ্ছে কোন পাত্রপক্ষের ব্যাপার। তাই কি”?

রচনা লাজুক গলায় বলল, “হ্যা গো দিদিভাই। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ কোন এক রাজাগঞ্জ না রানিগঞ্জ, এমনই কোন একটা জায়গা থেকে কাল এক ছেলের মা বাবা আর কাকা আমাদের বাড়ি এসে হাজির। ভাগ্যিস তারা খাওয়া দাওয়া সেরে এসেছিলেন। নইলে আমরা তো খুব লজ্জায় পড়ে যেতাম। আচ্ছা তুমিই বল তো দিদিভাই, এভাবে খবর না দিয়ে কেউ মেয়ে দেখতে আসে”?

সীমন্তিনী মনে মনে বেশ মজা পেলেও মুখে বলল, “ওমা সেকি? এভাবে আগে থেকে যোগাযোগ না করে কেউ মেয়ে দেখতে আসে নাকি? লোকগুলো তো ভারী অভদ্র। মুখে ঝামা ঘসে দিতে পারলি না? তাহলে হয়ত একটু ভদ্রতা শিখত তারা”।

রচনা বলল, “নাগো দিদিভাই, ঠিক তা নয়। লোকগুলো একেবারেই অভদ্র ছিল না। তারা নাকি তাদের কোন এক পরিচিতের মুখে আমার কথা শুনে আমাকে দেখতে এসেছিলেন। আর আগে খবর না দিয়ে ওভাবে হঠাৎ চলে এসেছেন বলে তারা আগে থেকেই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। আর তারা সকলেই খুব ভদ্র আর বিনয়ী ছিলেন। আর জান দিদিভাই, তারা হাতে করে অনেকগুলো প্যাকেটে করে মিষ্টি আর ফলমূল এনেছিলেন। আর কথাবার্তা শুনেও তাদের বেশ ভদ্র বলেই মনে হয়েছে। আর ছেলের মা ভদ্রমহিলা তো খুবই ভাল। আমাকে কাছে ডেকে নিয়ে এমনভাবে আমাকে আদর করছিলেন যে তোমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল আমার। তুমিও সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে আমাকে ওভাবে আদর করেছিলে”?

সীমন্তিনী একটা ক্লাসঘরের পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে বলল, “হুমমম বুঝতে পাচ্ছি। হবু শ্বশুর শাশুড়ি আর খুড়শ্বশুরকে আমার বোনটা পছন্দই করেছে। তা ছেলেও এসেছিল? সে কেমন দেখতে রে, কি করে”?

রচনা বলল, “ছেলে নিজে আসেনি গো দিদিভাই। তবে শুনলাম সে নাকি তাদের স্থানীয় একটা স্কুলেই শিক্ষকতা করেন। হাজার কুড়ির মত বেতন পায়। তবে তাদের জয়েন্ট ফ্যামিলীতে অনেক সদস্য। ছেলের বাবা কাকারা তিন ভাই। তাদের সকলের স্ত্রী আর দু’জন করে ছেলে মেয়ে আছে। বাড়িতে নাকি কাজের লোক আছে চারজন। তারা ঘরের বাইরের বাগানের কাজ টাজ সামাল দেয়। কিছু আবাদী জমিজমাও নাকি আছে তাদের। একজন রান্নার লোকও আছেন। তাদের তিন ভাইয়ের সবারই আলাদা আলাদা দোকান। ছেলের বাবার মুদি আর কসমেটিক্সের দোকান। বড়কাকার স্টেশনারী দোকান আর ছোটকাকার ওষুধের দোকান, পিসিও ফটোস্টেটের দোকান, কম্পিউটারের দোকান আরও কত কি যেন বলছিলেন”।

সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে মুখ টিপে টিপে হাসছিল। রচনা একটু থামতে সে জিজ্ঞেস করল, “পাত্রের নাম কি? আর তার ভাইবোন ক’জন? তারা কে কি করছে”?

রচনা আবার একটু লাজুক গলায় বলল, “তারা কেউ তাদের বাড়ির অন্য ছেলেমেয়েদের নাম বলেছেন বলে মনে পড়ছে না দিদিভাই। তবে পাত্রের নামটা বলেছেন। তার নাম নাকি রতীশ ভট্টাচার্যি। যে দু’জন ভদ্রলোক এসেছিলেন তাদের মধ্যে বড়জনের ছেলে সে। আর ছেলের মা-ও তো এসেই ছিলেন। ছেলের নিজের ভাই আর তার খুড়তুতো ভাইবোনেরা সকলেই পড়াশোনা করছে। তবে তাদের কারুর নামটাম শুনিনি”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তোর পছন্দ হয়েছে? আর মেসো মাসি কি বলছেন”?

রচনা বলল, “তোমার কথা আমাদের সকলেরই মনে ছিল। পাত্রের কথা আর পাত্রের বাড়ি ঘরের কথা শুনে তো বাবা মা দু’জনেই বেশ খুশী হয়েছেন। কিন্তু তারাও তোমার কথা ভেবেই তাদের প্রস্তাবে সরাসরি হ্যাঁ না কিছু বলেননি। শেষে আমিই তাদেরকে বলে দিয়েছি যে আমরা কয়েকদিন ভেবে তারপর তাদেরকে জানাব। আর আরেকটা কথা বলেছি আমি। বলেছি যে আমার বারো ক্লাসের পড়া শেষ না হলে আমি বিয়ে করব না। আচ্ছা দিদিভাই, আমি ভুল কিছু বলিনি তো”?

সীমন্তিনী বলল, “না, একদম ঠিক বলেছিস। কিন্তু এই পাত্রটির ব্যাপারে তোর নিজের কি মত? তোর ভাল লেগেছে”?

রচনা বলল, “বারে সেটা আমি কি করে বলব দিদিভাই? আমি কি ছেলেকে দেখেছি নাকি”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কেন? তারা ছেলের কোন ছবিও তো নিয়ে যেতে পারতেন তোদের দেখাতে”?

রচনা বলল, “বাবা সে’কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তারা বলেছিলেন যে কোন ছবি টবি আনেন নি”।

সীমন্তিনী একটু দুষ্টুমি করে বলল, “ও মা! এ আবার কেমন কথা? ছেলে নিজে আসেনি, তার অভিভাবকেরা ছেলের একটা ছবিও নিয়ে যায়নি। আর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে চলে এলেন তারা? অবশ্য তুই নিজেও তো আমাকে বলেছিলিস যে ছেলেকে না দেখেও তুই বিয়েতে রাজি হয়ে যাবি”?

রচনা বলল, “সেটা কি সব ছেলের ব্যাপারে বলেছি নাকি আমি? সেটা আমি শুধু তোমাকেই বলেছিলাম। তোমার পছন্দ করা পাত্রকে আমি না দেখেই বিয়ে করতে রাজি হব বলে বলেছিলাম। তাই বলে এ ক্ষেত্রেও কি তেমনটা করব নাকি আমি? সম্মন্ধটা তুমি আনলে আমি নিশ্চিন্তে রাজি হয়ে যেতুম”।

সীমন্তিনী মনে মনে হেসে বলল, “হুম, বেশ ভাল খবর। তা তোর কথা শুনে পাত্র পক্ষের লোকেরা কি বললেন? তারা তোর শর্ত মেনে বছরখানেক অপেক্ষা করতে রাজি আছেন”?

রচনা বলল, “না সে কথা তারা বলেননি। তবে সকলেই যে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন সেটা বুঝেছি। তারা শুধু তাদের বাড়ির নাম ঠিকানা আর ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে চলে গেছেন”।

সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে রচু। শোন। এ শনিবারে আমার ক্লাস নেই। আমি কালচিনি যাচ্ছি। তারপর মাসি মেসো আর তোর সাথে কথা বলব”।

রচনা খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “তুমি আসবে দিদিভাই? সত্যি বলছ”?

সীমন্তিনী বলল, “আসব না মানে? তুই কি ভেবেছিস সেদিন আমি তোকে আর মাসি মেসোকে যা বলে এসেছিলাম, তা শুধু আমার মুখের কথা? তোর জন্য পাত্র বেছে বের করবার দায়িত্ব আমি কাঁধে নিয়েছি। সে দায়িত্ব আমি এড়িয়ে যাব এখন? এ পাত্রের ব্যাপারে আমাকে খোঁজ খবর নিতে হবে না? নাকি তুই আমাকে বারণ করতে চাইছিস”?

রচনা মুখ ভার করে বলল, “বারণ করব বলছ কেন দিদিভাই? তুমি বলেছিলে বলেই তো আমি তোমাকে মিসকল দিয়েছিলাম। তোমাকে সেদিন থেকেই আমার বড় কাছের বড় আপন বলে মনে হচ্ছে। তাই আমিও তোমাকে আমার মনের সব গোপন কথা খুলে বলেছিলাম। তুমিই বলেছিলে যে আমার কোন সম্মন্ধ এলে তাদের কোন রকম কথা দেবার আগে যেন তোমাকে জানাই। আমার কথা রাখবার জন্যেই তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলাম”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমিও তো আমার কথা রাখব বলেই কালচিনি যেতে চাইছি। ছেলেটার বাড়ির ঠিকানাটা না পেলে আমি খোঁজটা নেব কি করে বল তো? আর যাচ্ছি বলার পরেও সব কিছু জেনেও তুই
 
যদি আবার প্রশ্ন করিস, তাহলে আর কি বলব বল”?

রচনা আদুরে ভঙ্গীতে বলল, “উমমম দিদিভাই, তুমি আমার লেগপুল করছ না? যাও, আমি আর তোমাকে কিচ্ছু বলব না”।

সীমন্তিনী বলল, “শোন রচু সোনা, অনেকক্ষণ কথা বলা হয়েছে। যার ফোনে কথা বলছিস, সে নিশ্চয়ই এবার বিরক্ত হচ্ছে। তাই আজ কথা শেষ করছি। আমি শনিবার আলিপুরদুয়ার থেকে সকাল দশটার ট্রেন ধরব। মাসিকে বলিস আমার জন্যে যেন সেদিনের মত মুগ ডাল আর মিষ্টি কুমড়োর ফুলের বড়া বানিয়ে রাখেন। আর তাদের দু’জনকে আমার প্রণাম জানাস। ভাইকে আমার হয়ে একটু আদর করে দিস। রাখছি”।

***************
Like Reply
#18
(Update No. 44)

পরদিন সকালেই চা খেতে খেতে সীমন্তিনী সতীশের নাম্বারে ফোন করতেই সতীশ ফোন ধরে বলল, “হ্যা বড়দি, বল”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা সতু, তোর মাথায় আর বুদ্ধি শুদ্ধি কবে হবে রে”?

সতীশ অবাক হয়ে বলল, “বারে, আমি আবার এমন কি করেছি”?

সীমন্তিনী রাগত স্বরে বলল, “যা করেছিস সেটা নিয়ে কিছু বলছি না। যা করিস নি সেটার কথাই বলছি রে হাঁদারাম”।

সতীশ বলল, “তুই যা যা বলেছিস, সে সব কথাই তো আমি সকলকে বলেছি। আর কি করা বাকি রেখেছি আমি”?

সীমন্তিনী বলল, “তোকে নিয়ে আর পারছিনা রে বাবা। মেয়ের বাড়িতে দাদাভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাড়ির গুরুজনেরা গিয়েছিলেন এটা তো ঠিকই আছে। কিন্তু তুই একবার ভেবে দেখ তো কোনও মা বাবা কি ছেলেকে না দেখেই মেয়ের বিয়ে দিতে রাজি হবে? রচুর বাড়ির লোকেরাই বা সেটা কি করে করবে? দাদাভাইকে পাঠাবার কথা তো ছিল না। সেটা ঠিকই আছে। কিন্তু বড়মা বা কাকু জেঠুদের হাতে দাদাভাইয়ের একটা ছবি পাঠিয়ে দেওয়া উচিৎ ছিল না তোর? পাত্রকে না দেখে পাত্রের কোন ছবিও না দেখে কোন মেয়ের বাবা তার বিয়ে দিতে রাজি হবেন? বল তো”?

সতীশ বলল, “হ্যারে বড়দি সেটা তো ঠিকই বলেছিস। কিন্তু শোন বড়দি, কথাটা একবার আমার মনে এসেছিল ঠিকই। কিন্তু তুই এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলিসনি বলেই আর সে ব্যাপারে কোন কথা আমি
ওঠাঁইনি”।

সীমন্তিনী বলল, “আর রচুর সাথে আমার কি কি কথা হয়েছিল সে সবও তো পুরোপুরি বলিসনি বাড়ি গিয়ে। রচুর বিয়ের কোন সম্মন্ধ এলেই তারা চট করেই রাজি হবে না। আগে আমার সাথে কথা বলবেন তারপর তারা পাত্রপক্ষকে তাদের মতামত জানাবেন। এ’ কথাগুলো তুই জেঠুদের বলিস নি। রচুদের বাড়ি থেকে যে এমন জবাবই দেবে সেটা কি তোকে আমি বলিনি? জেঠুরা অমন জবাব পেয়েই মুখ ভার করে চলে এসেছেন। আরে এমনটাই তো হবার কথা ছিল”।

সতীশ আমতা আমতা করে বলল, “সত্যি রে বড়দি। তোর সাথে বৌদি আর বৌদির বাবার যে এ’সব কথা হয়েছিল, সে কথাগুলো বলতে ভুলে গিয়েছিলাম রে। আমাকে মাফ করে দিস সেজন্যে। কিন্তু বড়দি, এ জন্যেই কি বিয়েটা হচ্ছে না”?

সীমন্তিনী এবার একটু নরম সুরে বলল, “বিয়েটা হচ্ছে না, এ’কথা তোকে কে বলল? আচ্ছা শোন, ফোনটা বড়মাকে দে তো। আর তুইও বড়মার সাথে দাঁড়িয়ে স্পীকার অন করে আমার কথাগুলো শুনিস”।

একটু বাদে সরলাদেবী ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা বড়মা, তোমরা কি গো। ছেলের জন্যে মেয়ে দেখতে যাচ্ছ, মেয়ের মা বাবার মতামত জানতে চেয়েছ, আর নিজের ছেলের একটা ছবিও তোমরা সাথে নিয়ে যাওনি? আচ্ছা বড়মা, আজ কোন ছেলের মা বাবা যদি আমার সাথে তাদের ছেলের বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে আসে, তাহলে ছেলেকে না দেখে, ছেলের কোন ছবি না দেখেই তোমরা কি বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে”?

সরলাদেবী বললেন, “ওমা তাই আবার হয় নাকি? ছেলে দেখতে কেমন এটাই তো লোকে সবকিছুর আগে বিচার করে। ছেলেকে না দেখেই কি মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায় নাকি”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তাহলে তুমি নিজেই বল বড়মা। রচু বা রচুর বাবা তোমাদের যে জবাব দিয়েছেন, এ ছাড়া আর কি বলতে পারতেন তারা তোমাদের”?

সরলাদেবী বললেন, “হ্যারে, কথাটা তো ঠিকই বলেছিস। রতুর দু’একটা ছবি আমাদের সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল। সত্যিরে, কথাটা তো আমাদের কারুর মাথায়ই আসেনি। কিন্তু তুই এ’কথা কিকরে জানলি রে মা? আমি তো তোকে বলিনি”।

সীমন্তিনী মজা করে বলল, “আর কে বলবে? তোমার বড়ছেলের হবু বৌ নিজেই আমাকে এ’কথা বলেছে গো”।

সরলাদেবী প্রায় চিৎকার করে উঠে বললেন, “কী বলছিস তুই মন্তি? রচনা তোকে ফোন করেছিল? সত্যি
বলছিস”?

সীমন্তিনী বলল, “তোমাকে তো পরশু রাতেই বলেছিলুম বড়মা যে আমার ধারণা সত্যি হলে, আর রচুদের বাড়ির লোকেরা ভদ্র হলে কয়েকদিনের মধ্যেই আমার সাথে যোগাযোগ করবে। তোমরা যে রচনাকে দেখতে গিয়েছিলে, সে কথা অবশ্যই জানাবেন। দেখলে তো আমার কথাটা কত তাড়াতাড়ি ফলে গেল। কাল বিকেলেই রচু আমাকে ফোন করে সব কথা বলেছে গো”।

সরলাদেবী খুশী হয়ে বললেন, “তুই সত্যি বলছিস মন্তি? রচনা নিজে তোকে ফোন করেছিল”?

সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “হ্যাগো বড়মা, সত্যি বলছি। তবে ওরা কেউ তো আর এটা জানে না যে পাত্র আমার দাদাভাই। আর তোমরাও কেউ এখনই তাদের কাছে আমার আর সতুর নাম বোল না কিন্তু। তবে আরেকটা খবর দিতে পারি তোমাকে”।

সরলাদেবী উচ্ছ্বল গলায় বলে উঠলেন, “বল বল মা। আর কিছু বলেছে তোকে রচনা”?

সীমন্তিনী বলল, “সব কিছুই বলেছে। কিন্তু সেসব কথা তোমরা সকলেই জান। তবে একটা এমন কথা বলেছে যে তোমরা কেউই হয়ত বুঝতে পার নি। কী বলেছে জানো? বলেছে ওর হবু শাশুড়িকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি যখন ওর গালে হাত দিয়ে আদর করেছিলে তখন ওর খুব ভাল লেগেছিল”।

সরলাদেবী প্রায় চেঁচিয়ে বললেন, “ওমা তাই? ও সত্যি এমন কথা বলেছে? সত্যি এমন কথা বলেছে ও”?

সীমন্তিনী একটু অভিমানী গলায় বলল, “তুমি যদি আমার মুখের কথাও বিশ্বাস না কর, তাহলে আমি আর কী করতে পারি বল বড়মা। বারবার শুধু জিজ্ঞেস করছ সত্যি বলছিস। সত্যি বলছিস। আমি কবে তোমাকে মিথ্যে কথা বলেছি, সেটা একটু মনে করিয়ে দাও তো আমাকে”।

সরলাদেবী বললেন, “রাগ করিসনে মা। তোর কথা শুনে আনন্দে আমি বুঝি পাগল হয়ে গেছিরে। খুশীতেই আমি অমন উল্টোপাল্টা বলে ফেলছি রে। কিন্তু বলনা আর কি কি বলেছে রচনা”?

সীমন্তিনী বলল, “অনেক কথাই তো বলতে চেয়েছিল। ফোন ছাড়ছিলই না। কিন্তু ওর নিজের তো ফোন নেই। এক বন্ধুর মোবাইল থেকে আমাকে মিসকল দিয়েছিল। তারপর আমি ওকে কলব্যাক করে ওর সাথে কথা বলেছি। কিন্তু অনেকক্ষণ কথা বলার পর আমিই ওকে বোঝালাম যে যার ফোন থেকে ও আমার সাথে কথা বলছিল সে বিরক্ত হয়ে যাবে। তাই আমিই ওকে সেকথা বলে বুঝিয়ে, তখন লাইন কেটে দিয়েছিলুম”।

সরলাদেবী বললেন, “তাহলে এরপর আমরা আর কি করব বল তো”?

সীমন্তিনী বলল, “আপাততঃ তোমাদের আর কিছু করতে হচ্ছে না। তবে আমি আবার কালচিনি যাচ্ছি এ
 
শনিবারে”।

সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই আবার যাচ্ছিস”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “যেতে তো হবেই বড়মা। তোমার হবু বেয়াই বেয়ান আর ছেলের বৌকে যে আমি কথা দিয়েছি, রচনার জন্যে কোন ছেলের সম্মন্ধ এলে সে ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ খবর করে আমি তাদেরকে জানাব। আর আমার জবাব না পাওয়া অব্দি তারা ছেলেপক্ষের কারো সাথে যোগাযোগ করবেন না। তোমরা তো তোমাদের বাড়ির ঠিকানা ফোন নম্বর সব কিছু লিখে দিয়ে এসেছ তাদের হাতে। এখন সেই ঠিকানাটা এনে ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেবার দায়িত্ব যে আমার। তাই সেটা জানবার জন্যেই যে আমাকে যেতে হচ্ছে। এবার বুঝেছ তো আমি কতটা আটঘাট বেঁধে এগোচ্ছি”।

সরলাদেবী হাসতে হাসতে বললেন, “তার মানে তুই সে বাড়ি থেকে তোর বাড়ির ঠিকানা জেনে নিয়ে তোর দাদাভাইয়ের ব্যাপারে খোঁজ খবর করে তাদের জানাবি? হাঃ হাঃ হাঃ। তোর মাথায় এতসব বুদ্ধি কী করে আসে রে মা”?

সীমন্তিনী বলল, “তোমাকে দেওয়া কথা রাখতেই আমাকে এসব করতে হচ্ছে বড়মা। তবে তোমরাও আমাকে না জানিয়ে ওদিক থেকে কালচিনির কারো সাথে যোগাযোগ কোর না যেন। তাহলে কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে”।

সরলাদেবী বললেন, “ঠিক আছে রে মা। আমি সেদিকে খেয়াল রাখব। কিন্তু তোর কথা ভেবেই তো আমার ভয় হচ্ছে রে। তোর সাথে ও বাড়ির সকলের সাথেই যে খুব হৃদ্যতা হয়ে গেছে, সেটা তো বুঝতেই পারছি। তাই তো ভয় হচ্ছে, যেদিন তারা বুঝতে পারবেন যে তাদের সাথে এমন হৃদ্যতা করবার পেছনে তোর মনে একটা মতলব ছিল, তখন তাদের সামলাতে পারবি তো”?

সীমন্তিনী বলল, “আমাকে নিয়ে ভেবো না বড়মা। আমি তাদের কাছে খারাপ হলেও আমার তাতে কিছু এসে যাবে না। কিন্তু রচনার সাথে দাদাভাইয়ের বিয়ে দিতে আমাকে যদি আরও ছলনার আশ্রয় নিতে হয় আমি তাতেও পিছপা হব না। তোমরা শুধু আমার কথা মত চলে আমাকে সাপোর্ট দিও। তাহলেই আমি খুশী হব। তবে আমি মনে মনে যেসব কথা ভাবছি, সেভাবে সব কিছু করতে পারলে তুমি দেখে নিও বড়মা, রচনার বাড়ির সকলেই আমাকে তোমার মত করেই ভালবাসবে। কিন্তু বড়মা, তোমরা সকলে তো দেখেই এসেছ রচনাদের বাড়ির অবস্থা। ওদের তো প্রায় দিনান্তে পান্তা ফুরোবার মত অবস্থা। তাই আগে থেকেই তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি। বিয়েতে কোন দান সামগ্রী যৌতুক তো তোমরা পাবেই না। উল্টে তোমরা যদি সামাজিক ভাবে ছেলের বিয়ে দিয়ে ঘরে বৌ তুলতে যাও, তাহলে কিন্তু বিয়ের সমস্ত খরচ খরচা তোমাদেরই বহন করতে হবে। তাতে তোমাদের কিন্তু বেশ পয়সা খরচ করতে হবে। তুমি জেঠু কাকুদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করে আমাকে জানিও। নইলে আমাকে অন্য ভাবে প্ল্যান করে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করিয়ে রচনাকে তোমার হাতে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এ’কথাটা মাথায় রেখ, রচনাকে যদি আমরা আমাদের ঘরের বৌ করে তুলতে না পারি, তাহলে দাদাভাইকে আর অন্য কোন মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে পারব কিনা, সে বিষয়ে কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ থাকবে। তুমি সকলের সাথে বসে পরামর্শ করে তোমাদের সিদ্ধান্ত আমাকে জানিও দু’একদিনের মধ্যে”।

সরলাদেবী বললেন, “হ্যারে সেটা তো তুই ঠিকই বলেছিস। সেদিন বাড়ি ফেরবার সময় তোর বাবা আর কাকুর সাথে এ ব্যাপারে কথাও বলেছি। কিন্তু তখন তো জানতুম যে সম্মন্ধটা বুঝি ভেস্তেই যাচ্ছে। এখন তো তুই আবার আমাদের মনে আশা জাগিয়েছিস। ঠিক আছে দু’এক দিনের ভেতরেই তোর বাবা আর কাকুদের সাথে বসে আলোচনা করে এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেব”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা বড়মা। তোমাদের ইচ্ছেটা না জানলে আমি পরের ব্যাপারগুলো সাজাতে পারব না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এ ব্যাপারে তোমরা কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছ সেটা আমাকে জানিও। আজ তাহলে রাখছি বড়মা। আমার কলেজে যেতে হবে আজ”।

সরলাদেবী বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে রে মা। তুই ভাল ভাবে থাকিস। ওহ, সতু তোকে কিছু একটা বলবে নে”।

সতীশ বলল, “বড়দি আমার ওপর রাগ করেছিস তুই”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “নারে ভাই। দিদিরা কি ভাইয়ের ওপর রাগ করে বেশীক্ষণ থাকতে পারে? কিন্তু ভাই কোথায় কি ভুল করছে, সেটাও তো বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। তাই তুইও আমার ওপর রাগ করিস নে”।

সতীশ বলল, “আচ্ছা বড়দি, তুই যে শনিবারে আবার কালচিনি যাচ্ছিস বললি। আমিও কি আসব? তুই না বলেছিলিস আমাকে সাথে নিয়ে কালচিনি যাবি”।

সীমন্তিনী বলল, “আমি যাকে যা কথা দিই, সেটা সব সময় রাখি। তোকেও সাথে করে কালচিনি অবশ্যই নিয়ে যাব। কিন্তু সেটা এবারে নয় ভাই। যেদিন আমাদের আসল পরিচয়টা ওদের জানাব সেদিন তোকে নিয়ে যাব। তুই মন খারাপ করিস না। এবার আসলে আমাকে আরও কিছু ট্রিক্স করতে হবে সেখানে গিয়ে। তাই তোকে নিচ্ছি না এবার। আচ্ছা ছাড়ছি এখন রে ভাই”।

*****************
Like Reply
#19
(Update No. 45)

শনিবার বেলা প্রায় এগারটা নাগাদ সীমন্তিনী কালচিনি ষ্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে অটো স্ট্যাণ্ডের দিকে এগোতেই একপাশ থেকে রচনা তাকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনী প্রথমে দারুণভাবে চমকে উঠলেও ডানহাতের কনুইটা উচিয়ে ধরে পেছনে আঘাত হানবার আগেই তার পেছন থেকে কাউকে ‘দিদিভাই’ বলে ডাকতে শুনেই সে হাত নামিয়ে মুখ ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই চোখের একেবারে সামনে রচনার মুখটা দেখতে পেয়ে বলল, “রচু তুই? আমাকে তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলিস তুই। ইশ, এখনও আমার বুকটা কাঁপছে। তুই ষ্টেশনে এসেছিস কেন? আমি তো একাই বাড়ি যেতে পারতুম”।
 

রচনা এবার সামনে ঘুরে এসে সীমন্তিনীর হাত ধরে হেসে বলল, “তুমি এত কষ্ট করে এতদুর আসছ, আর আমরা বাড়ি থেকে ষ্টেশন পর্যন্ত এটুকু রাস্তা আসতে পারব না? আর দেখ, আমি একা নই। ভাইও এসেছে আমার সাথে”।
 

সীমন্তিনী এতক্ষণে কিংশুককে দেখতে পেল রচনার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে। তারপর তার হাত ধরে টেনে কাছে এনে বলল, “কেমন আছ ভাই”?
 

কিংশুক খুশী গলায় বলল, “ভাল আছি দিদিভাই, আর তোমাকে দেখে তো এখন আরও ভাল লাগছে”।

সীমন্তিনী কিংশুকের গালটা আদর করে টিপে দিয়ে বলল, “চল রচু। এখানে বেশীক্ষণ এই ভিড়ের মধ্যে থাকা ঠিক হবে না। তা হ্যারে, মাসি মেসো সবাই ভাল আছেন তো”?

বিভাদেবী আর বিধুভূষন বাবু বেশ আগ্রহ সহকারে বাইরের বারান্দায় বসে প্রতীক্ষা করছিলেন সীমন্তিনীর জন্য। বিধুবাবু আজ তাড়াতাড়িই সকালের বাজার করে এনেছেন। বাজারে আজ খুব ভাল ইলিশ মাছ উঠেছিল। খুব লোভ হওয়া সত্বেও হাতে বেশী পয়সা ছিল না বলে, তা আর আনতে পারেন নি। আর বিভাদেবীও সীমন্তিনীর ফরমাশ মত মুগের ডাল রেঁধেছেন। সাথে একটা নিরামিষ তরকারী করেছেন। আর মিষ্টি কুমড়োর ফুলের বড়া বানাবার জন্যে সব কিছু তৈরী করে রেখেছেন। খাবার আগে আগে গরম গরম ভেজে দেবেন বলে।

গেটের বাইরে একটা অটো এসে থামতেই বিধুবাবু বললেন, “ওই তো এসে গেছে ওরা” বলে বারান্দা থেকে নামলেন। বিভাদেবীও স্বামীর পেছন পেছন রওনা হতেই কিংশুক ছুটে এসে বলল, “মা, দিদিভাই এসে গেছেন। এস এস”।
 

কিংশুক মায়ের হাত ধরে গেটের দিকে যেতে যেতে বলল, “মা দিদিভাইকে আজ যে কী সুন্দর লাগছেনা দেখতে, কি বলব তোমাকে”।

সীমন্তিনী অটো ভাড়া দিয়ে বাড়ির গেটের দিকে ফিরতেই রচনা তার হাত ধরে বলল, “এসো দিদিভাই”।

দু’পা এগোতেই বিভাদেবী সামনে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসেছিস মা? আয়। হ্যারে রাস্তায় কোন অসুবিধে হয়নি তো”?

সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুকে প্রণাম করে বলল, “না মাসি, কোন সমস্যা হয়নি। আমার জন্যে মিষ্টি কুমড়ো ফুলের বড়া করেছ তো তুমি”?

বিভাদেবী হেসে বললেন, “হ্যারে হ্যা, করেছি। তুই আগে চানটা সেরে ফ্যাল। তারপরই খেতে দেব। কথাবার্তা যা আছে সে খাবার পর হবে। এই রচু, তোর দিদিভাইকে চানঘরের সবকিছু দেখিয়ে টেখিয়ে দিস। আর বালতি গুলোতে দু’বালতি জল তুলে দিস”।

বিধুবাবু বললেন, “জান মন্তি মা, তুমি যে সত্যি সত্যি আমাদের ডাকে চলে আসবে, সেটা মনে মনে আশা করলেও ঠিক ভরসা করে উঠতে পারছিলুম না। মুখে তো কতজনেই কতকিছু বলে। কিন্তু সে’সব কথা আর ক’জন মনে রাখে বল। তবে তুমি, আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছ যে তুমি আর দশজনের মত নও। যাও মা। ঘরে গিয়ে বসে একটু বিশ্রাম নিয়ে চান করে এস। খেয়েদেয়ে আমরা কথা বলব। আমার আবার বিকেলের দিকে এক যজমানের বাড়ি যেতে হবে শনিপূজো করতে। রচু, খোকা, তোরা আর দিদিভাইকে এখন বিরক্ত করিসনে যেন। কতটা পথ আসতে হয়েছে ওকে। ওর নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়ে গেছে। আগে ওকে চানটান করে খেয়ে নিতে দে। যাও মা, ঘরে যাও”।
 

রচনার সাথে তার ঘরে ঢুকেই সীমন্তিনী দু’হাতে রচনার মুখটা অঞ্জলি করে ধরে বলল, “একটু দাঁড়া। আগে আমার মিষ্টি বোনটাকে দু’চোখ ভরে দেখে নিই একটু” বলে রচনার সুন্দর মুখটাকে দেখতে দেখতে বলল, “একি রে রচু? বিয়ের সম্মন্ধ আসতে না আসতেই দেখি তোর রূপ খুলতে শুরু করেছে রে! কী দারুণ লাগছে তোকে দেখতে রে? ইশ মেয়ে জীবনে আজ প্রথমবার আফশোস হচ্ছে রে। আমি ছেলে হলে নিজেই তোকে বিয়ে করে নিয়ে যেতুম রে”।
 

রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ধ্যাত দিদিভাই। আমার চেয়ে তুমি ঢের ঢের বেশী সুন্দরী। মা, বাবা, ভাই সবাই সে কথা বলেন”।
 

সীমন্তিনী রচনার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করে একটা চুমু খেয়ে বলল, “তারা সবাই তোকে সব সময় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন বলেই তোর রূপ বিচার করেন না। কিন্তু আমার চোখে তুই আমার চেয়ে অনেক বেশী মিষ্টি, অনেক বেশী সুন্দরী”।
 

রচনা নিজেকে সীমন্তিনীর হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল, “হ্যা ঠিক আছে। এখন ও’সব কথা ছাড় দেখি। ড্রেস চেঞ্জ করে নাও। তুমি চানে যেতে দেরী করলে কিন্তু আমিই মা বাবার কাছে বকুনি খাব এখন”।
 

বিভাদেবীর হাতের সাধারণ রান্নাও যে কতটা অসাধারণ হতে পারে, সে কথা সীমন্তিনী আরেকবার বুঝল। পরম তৃপ্তি সহকারে সে পেট ভরে খেল। তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি আর আগে কখনও খায়নি। বিধুবাবু আর বিভাদেবীর খাওয়া শেষ হবার পর কিংশুক সীমন্তিনীর কাছে এসে বলল, “ও দিদিভাই। এখন তো তুমি মা বাবার সাথে গল্প করতে বসবে জানি। আমি ততক্ষণে একটু মাঠে খেলে আসি”?
 

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কী খেলতে যাবে ভাই? ক্রিকেট”?

কিংশুক বলল, “আজ ফুটবল খেলব গো দিদিভাই। ক্রিকেট ভাল লাগলেও বেশী খেলি না। অনেক সময় লাগে এক একটা ম্যাচ শেষ হতে। পড়াশোনার ক্ষতি হয়। আমি বেশীর ভাগ ব্যাডমিন্টন আর ফুটবলই খেলি সে জন্যে। বাবা বেরিয়ে যাবার আগেই বাড়ি চলে আসব। তুমি রাগ করবে না তো”?
 

সীমন্তিনী আদরের সুরে বলল, “ঠিক আছে ভাই। খেলে এসো তুমি। কিন্তু আমি তো বিকেলের শেষ গাড়িতে চলে যাব। তার আগে আসবে তো তুমি”?
 

কিংশুক হেসে বলল, “ও’সব কথা বলে আজ পার পাবেনা গো দিদিভাই। আজ তোমার যাওয়া হচ্ছে না। আজ রাতে তুমি আমাদের এখানেই থাকবে। মা-ই তোমাকে যেতে দেবেন না আজ, আমি জানি। তবে আমিও সন্ধ্যের আগেই চলে আসব। তারপর তোমার সাথে গল্প করব। আসছি আমি”।
 

কিংশুক বেরিয়ে যাবার প্রায় সাথে সাথেই বিধুবাবু বারান্দা থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি একটু শুয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবে মন্তিমা”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “না না মেসো। আমি দিনের বেলায় কখনও শুই না। তুমি এস না ভেতরে”।
 

বিধুবাবুর সাথে সাথে বিভাদেবীও ঘরে এসে ঢুকলেন। রচনা কিংশুকের পড়ার টেবিলের কাছ থেকে চেয়ারটা টেনে এনে বলল, “বাবা, তুমি এখানে বস। আমি মা আর দিদিভাই বিছানায় উঠে বসছি”।
 

সীমন্তিনী বলল, “রচু সেদিন ফোন করে বলল, কোন পাত্রপক্ষ নাকি ওকে দেখতে এসেছিল”?
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যাগো মা। আর আমিই ওকে বলেছিলাম তোমাকে ফোন করতে। ক’দিন আগেই তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম, যে রচুর কোন সম্মন্ধ এলে সবার আগে তোমাকে জানাব। তাই মনে হয়েছিল তোমাকে কথাটা জানান উচিৎ। কিন্তু সে’কথা শুনে তুমি যে সত্যি সত্যি চলে এসেছ, সে জন্যে তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মা”।

সীমন্তিনী বলল, “মেসো, আমাকে ধন্যবাদ দিচ্ছ কেন তুমি? মেয়েকে কি কোন বাবা ধন্যবাদ দেন নাকি? ও’সব ছেড়ে আসল কথাটা বল দেখি। কে এসেছিল? তারা কোথাকার লোক? রচু তো জায়গার নামটাও ঠিক মত বলতে পারেনি আমাকে। বলল রাজাগাঞ্জ না রানিগঞ্জ। রানিগঞ্জ বলে তো একটা জায়গা আছে, দুর্গাপুরের কাছাকাছি। তা তারা কি সেখানকারই বাসিন্দা”?
 

বিধুবাবু বললেন, “না মা তা নয়। রচু বুঝি তোমাকে ঠিকমত বলতে পারেনি। যারা এসেছিলেন তারা
 
রাজগঞ্জের লোক। জলপাইগুড়ির খুব কাছেই নাকি জায়গাটা”।
 

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “রাজগঞ্জ? সে তো আমাদেরই জায়গা গো মেসো। আমাদের আসল বাড়ি তো রাজগঞ্জেই। তা রাজগঞ্জের অনেক লোককেই তো আমি চিনি। ছেলের নাম কি বলেছে গো ওনারা”?
 

বিধুবাবু বললেন, “পাত্রের নাম তো বলল রতীশ ভট্টাচার্যি”।

সীমন্তিনী প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কি বললে? রতীশ ভট্টাচার্যি? তার বাবার নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি”?
 

বিধুবাবুও সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “হ্যা মা। তাই। তুমি চেন নাকি তাদের”?
 

সীমন্তিনী আগের মতই উচ্ছ্বল গলায় বলল, “মেসো, চিনব না মানে? খুব ভাল করে চিনি গো। রতীশ আর আমি তো একসাথে স্কুলে পড়তাম। আমার সহপাঠী ছিল। খুবই ভাল ছেলে। কিন্তু মেসো, ছেলেটা তো আমার বয়সীই। রচনার তো কেবল সতের চলছে। প্রায় বছর সাতেকের মত তফাৎ হবে দু’জনের”।
 

এবার বিভাদেবী বললেন, “স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সাত আট বছরের ব্যবধান থাকাই ভাল। এর বেশী হলেও খারাপ, আর ব্যবধান এর কম থাকাও ভাল নয়। তা মা, তুমি ওদের ব্যাপারে কতটা কি জান, সেটা বল তো”?
 

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, ছেলের ব্যাপারে তো আমি একেবারে নিশ্চিত যে ও খুবই ভাল ও সৎ ছেলে। স্কুল জীবনে পড়াশোনায় খুব বেশী যে ভাল ছিল, তা নয়। তবে কখনও পরীক্ষায় ফেল টেলও করেনি। কিন্তু খেলাধুলো আর যোগা ব্যায়ামে খুব এক্সপার্ট ছিল। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমি জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলাম। আর রতীশ দেরাদুনে একটা কলেজে পড়তে গিয়েছিল। বছর চারেক আগে দেরাদুন থেকে ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে গ্রাজুয়েট হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে। মাস খানেক আগেই ওর সাথে রাস্তায় দেখা হয়েছিল একদিন আমার। তখন ওর মুখেই শুনলাম যে ও নাকি বিএ পাশ করবার সাথে সাথে কয়েকটা বড় বড় যোগা ডিগ্রীও নিয়ে এসেছে। হরিদ্বারের একটা ইনিস্টিটিউট থেকে ওকে যোগাশাস্ত্রী না কি একটা যেন উপাধিও দেওয়া হয়েছে। আর আমাদের ওখানের হায়ার সেকেণ্ডারী স্কুলেই সে বছর দুয়েক ধরে টিচারী করছে। আমরাও ওই স্কুল থেকেই মাধ্যমিক পাশ করে বেরিয়ে এসেছিলুম। খুবই ভাল ছেলে মেসো। যেমন দেখতে, তেমনি চমৎকার গায়ের রং আর উচ্চতা। স্বাস্থ্যও খুল ভাল। লম্বায় আমার সমান সমান। ওকে নিজেদের জামাই করবার জন্যে আশেপাশের অনেক মেয়ের বাবামা-ই তো মুখিয়ে আছে। কিন্তু ওর বাড়ি থেকে না কি কেউ কোন সাড়া দেয়নি”।

বিধুবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি তো তাহলে ওকে খুব ভাল ভাবেই চেনো মা। তা ওদের বাড়িঘর বা বাড়ির লোকজনেরা কেমন, সে বিষয়ে কিছু জানো তুমি”?

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “স্কুলে পড়ার সময় রতীশের সাথে মাঝে মধ্যেই ওদের বাড়ি যেতুম আমরা
 
মেসো। কিন্তু মাধ্যমিক পাশ করে আমিও জলপাইগুড়ি চলে এসেছিলুম আর রতীশও দেরাদুন চলে গিয়েছিল বলে তারপর আর সেভাবে যাওয়া আসা হয়নি। তবে পূজো পার্বনে রতীশদের বাড়ির অনেকের সাথেই তো দেখা হয়। রতীশের মা তো আমাকে খুব ভালবাসেন। খুব ভাল ভদ্রমহিলা। ওহ উনি তো এসেছিলেন এখানে শুনেছি, তাই না”?
 

বিভাদেবী বললেন, “হ্যা মা। ছেলের বাবা, মা আর ছোটকাকু এসেছিলেন আমাদের বাড়ি। ভদ্রমহিলাকে দেখে আমাদেরও বেশ ভাল লেগেছে। কিন্তু শুধু পাত্রপক্ষ আর ঘটকের মুখের কথায় বিশ্বেস করে আমাদের বড়মেয়েটার ওভাবে বিয়ে দিয়ে যে আমরা যে ভুল করেছি, তার আর পুনরাবৃত্তি করতে চাইনে আমরা। আর তুমিও সেদিন আমাদের যেভাবে ভরসা দিয়েছ, তাতে আমরা চাই রচুর বিয়েটা আমরা একটু ভাল ভাবে খোঁজ খবর নিয়েই দেব”।

বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মা। আমাদের সামর্থ্য বলতে তো প্রায় কিছুই নেই। আর যার কপালে বিধাতা যা লিখে দিয়েছেন, তাকে তো সেটাই ভোগ করতে হবে। রচুর কপালেও যদি অর্চুর মতো দুঃখই লেখা থাকে তাহলে তা আর কে খণ্ডাবে বল। কিন্তু একবার যে ভুলটা আমরা করেছি সেটা আর দ্বিতীয়বার করতে চাইনে। তারপর ওর কপালে যা আছে, তাই তো হবে”।

সীমন্তিনী একহাতে রচনাকে জড়িয়ে ধরে তাকে আদর করে বলল, “মেসো। তোমাদের বড়মেয়ের বিয়ের আগে তোমাদের সাথে যদি আমার পরিচয় হত, তবে ব্যাপারটা হয়ত অন্যরকম হত। কিন্তু যা হবার ছিল সেটাই হয়েছে। কিন্তু রচুর ব্যাপারে যে আমি ভাল করে ছেলেপক্ষের খবরাখবর নেব এ’কথা তো সেদিনই তোমাদের বলেছিলাম আমি। আর সে জন্যেই আজ এসেছি আমি। তবে এ পাত্রের নাম শুনেই বলছি আমাকে আলাদা করে খুব বেশী খবর যোগাড় করতে হবে না। ওকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই চিনি। শোনো মেসো। ছেলের বাবারা তিনভাই। সবাই জয়েন্ট ফ্যামিলীতে থাকে। তাদের বড়ভাইয়ের নাম রতিকান্ত ভট্টাচার্যি, মেজ ভাই শশীকান্ত বাবু, আর ছোট ভাই চন্দ্রকান্ত বাবু। বাড়ির তিন বৌয়ের মধ্যেও প্রচণ্ড ভাব ভালবাসা। রতিকান্তবাবুর দু’ ছেলে। বড়টিই হচ্ছে রতীশ। শশীকান্ত বাবুর এক মেয়ে এক ছেলে, আর চন্দ্রকান্তবাবুরও তাই এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলেমেয়েগুলোও সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। ওদের পাড়ার অনেক লোকও বুঝতে পারে না ও বাড়ির ছেলে মেয়েরা কে কোন ঘরের। আমিও তো প্রথম প্রথম বুঝতে পারতুম না কে রতীশের নিজের ভাই বোন আর কে খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সবাইকে দেখেই মনে হত যেন এক মায়ের পেটের ভাইবোন সবাই। সবাই সবাইকে খুব ভালবাসে। অমন ভাল পরিবার আমাদের ও তল্লাটে বুঝি আর একটাও নেই। রাজগঞ্জের সকলেই একডাকে তাদের পরিবারকে চেনে। আর সে জন্যেই সব ব্রাহ্মণ পরিবারই সে পরিবারের সাথে আত্মীয়তা করতে চায়”।
 

বিভাদেবী খুব খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি বলছিস মা তুই”?
 

সীমন্তিনী বলল, “সত্যি বলছি মানে? তুমি কি ভাবছ আমি মিথ্যে কথা বলছি? আসলে রতীশের কথা শুনেই আমি এতটাই খুশী হয়েছি যে তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না মাসি। ওদের পরিবার সম্বন্ধে আমি এত কথা বলতে পারি যে রাত কাবার হয়ে যাবে। তোমরাই শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে উঠবে। আর এতকিছু বলছি বলেই হয়ত তোমাদের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে”।

বিভাদেবী হাত বাড়িয়ে সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বললেন, “নারে মা, ও’কথা বলিসনে। জানিসনা? কথায় বলে, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘে দেখেই ভয় পায়। আমাদের অবস্থাও ঠিক তাইরে”।
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যা মন্তিমা। আমাদের অবস্থা ঠিক তাই। তুমি তোমার মাসির কথায় কিছু মনে করো না। আচ্ছা মা, তোমার কথায় তো বুঝতেই পারছি তুমি তাদের পরিবারকে খুব ভাল ভাবে চেনো। ওই পরিবারের লোকদের মধ্যে ভাব ভালবাসা খুব ভাল। তাই পরিবার নিয়ে আর মনে কোন চিন্তা রইল না। কিন্তু মা তাদের আর্থিক অবস্থা বা আচার ব্যবহার নিয়ে কিছু জানা আছে কি তোমার”?
 

সীমন্তিনী বলল, “মেসো ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই খুব অমায়িক গো। তোমরা তো তিনজনকে দেখেছ। তোমাদের কেমন লেগেছে তাদের”?
 

বিধুবাবু বললেন, “ওই তিনজনকে তো আমাদেরও খুব ভদ্র বলে মনে হয়েছে। আর বলতে বাঁধা নেই। বেশ অমায়িকও মনে হয়েছে। নইলে মেয়ে দেখতে এসে কেউ অতগুলো ফলমূল আর মিষ্টি নিয়ে আসে? হয়ত আমাদের হত দরিদ্র অবস্থার কথা শুনেই তারা ও’সব নিয়ে এসেছিলেন। আর এমন সময়ে এসেছিলেন যে তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যাপার নিয়েও আমাদের কোন দুশ্চিন্তায় পড়তে হয়নি। তারা দুপুরের খাবার খেয়েই এখানে এসেছিলেন। অমায়িক না হলে কি আর এমনটা কেউ করে”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা মেসো, তুমি ঠিক বলেছ। শুধু রতীশের বড় কাকা, মানে শশীকান্ত বাবুই একটু বেশী গম্ভীর প্রকৃতির। আর শশীকান্তবাবুর ছেলে, মানে রতীশের মেজকাকার ছেলে। সেও অন্যান্য ভাইবোনদের তুলনায় একটু কম কথা বলে। কিন্তু তাই বলে তাদেরও কেউ খারাপ বলতে পারবে না। ওই এলাকার সকলের সাথেই তাদের সকলেরই খুব ভাল সম্পর্ক। আর আর্থিক দিক দিয়ে বলছি। রাজগঞ্জ হাটে বেশ বড়সড় একটা নিজস্ব কমপ্লেক্সে তাদের তিন ভাইয়ের পাঁচটি বড় বড় দোকান। রতিকান্ত বাবুর বিশাল মুদি দোকান। শশীকান্ত বাবুর খুব বড় স্টেশনারী দোকান। আর ছোটভাই চন্দ্রকান্ত বাবুর একটা বড় ওষুধের দোকান, একটা পিসিও ফটোস্ট্যাটের দোকান আর একটা কম্পিউটারের দোকান আছে। সব ক’টা দোকানের ব্যবসাই খুব ভাল। তাই বুঝতেই পারছ তাদের আর্থিক অবস্থা খুবই ভাল। আর ব্যবসা করলেও তারা লোক ঠকিয়ে টাকা উপার্জন করেন না বলে, যে কোন দোকানের চেয়ে তাদের তিন ভাইয়ের দোকান গুলোর ওপর লোকজনের একটা অন্য রকম আস্থা আছে। তাই তাদের দোকানের কাস্টমার দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। আর এলাকার সকলেই তাদের ওপর খুব বিশ্বাস করে। প্রত্যেকের দোকানেই দু’তিনজন করে কর্মচারী আছে। কয়েকটা কর্মচারী তো তাদের বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া করে। এছাড়া বাড়িতে রান্নার লোক, কাজের ঝি, চাকর আর বাগানের মালীও আছে। জমিজমাও আছে বেশ কিছু। চাষ বাস করবার লোকও রেখেছে তারা। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা মেসো। ওই বাড়ির ছোট বড় কারুর ভেতরেই অহঙ্কার বলতে কিছু নেই। গরীব হোক পয়সাওয়ালা হোক সকলের সাথেই তারা সকলে একই রকম আন্তরিক ব্যবহার করে থাকে”।

বিধুবাবু বললেন, “তাই নাকি মা? আমার মেয়ে গুলোর জন্যে মনে মনে আমি যে এমনই পরিবার খুঁজে বিয়ে দিতে চাইছিলাম। অর্চুর জীবনটা আমি নিজে নষ্ট করে ফেলেছি। রচুকে যদি এমন একটা পরিবারের বৌ করে পাঠাতে পারি, তাহলে আমার চেয়ে খুশী আর কে হবে বল মা”।

বিভাদেবী বললেন, “হ্যাগো, ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু আমাদের রচু কি এত ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে? ওরা যদি যৌতুক চেয়ে বসে তাহলে আমরা কী করব? আমরা যে ওকে পড়বার জন্যে দুটো ভাল শাড়িও দিতে পারব না”।

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এখনই ওসব নিয়ে ভাবছ কেন বল তো? আগে তোমরা সবাই ভাল করে ভেবে দেখ, ওই ছেলের সাথে রচুর বিয়ে দিতে তোমরা রাজি আছ কিনা। তারপর তো সেসব প্রশ্ন আসছে। তোমরা রাজি থাকলে, আমিও গিয়ে তাদের সাথে কথা বলব। তাদের সকলকেই তো আমি চিনি। আর আমাকেও তারা খুব স্নেহ করেন। রতীশ তো আমার সহপাঠী বন্ধু। আলাপ আলোচনা করে দেখা যাবে। আর এটা মনে রেখ, রচুকেও তো আমি আমার নিজের বোনের মত ভালবাসি। আমিও আমার সাধ্যমত সব কিছু করব। সব সময় তোমাদের পাশে থাকব আমি। তাই ও’সব নিয়ে এখনই দুশ্চিন্তা কোর না”।
 

বিধুবাবু বললেন, “মন্তি মা। তোমাকে একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে আমার। কিন্তু এ মূহুর্তে কথাটা বললে সেটা শুনে তুমি হয়ত আমাকে চরম স্বার্থপর বলে ভাবতে পার। কিন্তু তবু বলছি মা। সেদিন তোমাকে প্রথমবার দেখেই আমার মনে হয়েছিল আমার জীর্ন কূটিরে বুঝি সত্যি সত্যি এতদিনে মা লক্ষীর আগমন হয়েছে”।

সীমন্তিনী বলল, “ছিঃ ছিঃ মেসো। তুমি কেন এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দিচ্ছ বল তো? আমার মা বাবা আমাকে বলেন আমি নাকি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অলক্ষী মেয়ে। ছোটবেলা থেকে এ’কথা শুনতে শুনতেই বড় হয়েছি আমি। আচ্ছা, ওসব কথা ছাড়ো। শোন, আমাকে তো পাঁচটার বাসটা ধরতে হবেই। ছেলের বাড়ির ঠিকানাটা নেবার জন্যই শুধু এসেছিলুম। তা যে ছেলের কথা শুনলুম তাতে তো দেখছি আমাকে আর আলাদা করে কোন খবর যোগাড় করার চেষ্টাই করতে হবে না। আমার তো আগে থাকতেই এ ছেলের বাড়ির সকলের খবরাখবর জানা। তাই আর এখানে থাকবার প্রয়োজন নেই। তোমরা এক কাজ কর মাসি। দু’একটা দিন ভাল করে এ সম্মন্ধের ব্যাপারটা ভেবে দেখ। দাবি-দাওয়া যৌতুকের কথা ভেবে আগে থেকেই মুষড়ে পড়ো না। সেটা আপাততঃ না হয় আমার ওপর ছেড়ে দাও। তোমরা নিজেদের মনস্থির কর। আর যদি দেখ তোমরা মনস্থির করতে পেরেছ, তাহলে আমাকে একটু ফোন করে বলে দিও। আর ছেলের বাড়িতেও খবরটা জানিয়ে দিয়ে তোমরা গিয়ে ছেলের বাড়ি ঘর দেখে তার বাড়ির লোকজনদের সাথে কথা বার্তা বলে এস। বিয়েটা তো আর এখুনি হচ্ছে না। রচু বারো ক্লাসের ফাইনাল পরীক্ষাটা না দেওয়া অব্দি তো বিয়েটা হচ্ছে না। আর সে’কথা তো তাদের আগেই বলা হয়েছে। মনে হয় তারা সেটা মেনেও নেবেন। আর সেটা হলে হাতে তো বছর খানেক সময় পাচ্ছি আমরা। দাবি দাওয়া যৌতুক টৌতুক নিয়ে ভাববার বেশ কিছুটা সময় আমরা পাব। আর বললামই তো সে ব্যাপারটা আমি দেখব”।

______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#20
 
(Update No. 46)

বিধুবাবু সীমন্তিনীর কথা শুনে এতটাই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন যে তার চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে তিনি সীমন্তিনীর একটা হাত নিজের দু’হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে ধরা গলায় বললেন, “তোমার কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছি না মাগো। কে তুমি? কেন এমন অযাচিত ভাবে তুমি আমাদের বাড়ি এসেছ? তুমি কি ছদ্মবেশী মা অন্নপূর্ণা হয়ে আমাদের মনের আকাঙ্ক্ষা পূরন করতেই এসেছ মা? এতো পূণ্যও আমি কখনও করেছি যে আমার ঘরে মা অন্নপূর্ণা স্বয়ং এসে ......” নিজের কথা শেষ করবার আগেই বিধুবাবুর ধরা গলা পুরোপুরি রূদ্ধ হয়ে গেল।
 

সীমন্তিনী খাট থেকে নামবার চেষ্টা করতেই রচনাও তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে ‘দিদিভাই’ বলে তার কোলে মুখ চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। আর বিভাদেবীও সীমন্তিনীর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলেন। সীমন্তিনী যেন মহা ফাঁপরে পড়ল। সে কাকে ছেড়ে কাকে সামলাবে! মা, বাপ বেটি তিনজনে মিলেই তো একসঙ্গে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে!
 

অনেকক্ষণের চেষ্টায় তাদের সবাইকে শান্ত করে রচনাকে নিজের বুকে চেপে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে তাকে শান্ত করতে করতে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। আমাকে ছাড় একটু বোন। মাকে আর বাবাকে সামলা এখন” বলে নিজে খাট থেকে নেমে বিধুবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “মেসো, তোমরা এভাবে কান্নাকাটি করলে আমি কিন্তু এখনই চলে যাব, বলছি। মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কথা হচ্ছে, একটা ভাল ছেলের সম্মন্ধ এসেছে। এমন খুশীর কথা শুনে কেউ এভাবে কাঁদে বল তো”?

রচনাও ততক্ষনে নিজের মাকে সান্ত্বনা দিতে শুরু করেছে। কয়েক মিনিট বাদে বিধুবাবু নিজেকে সামলে নিয়ে সীমন্তিনীর হাত দুটো ধরে বললেন, “মাগো। মন্তি মা আমার। আমার একটা কথা রাখবে মা”?
 

সীমন্তিনী বলল, “এমন করে বলছ কেন মেসো। বলোনা কি করতে হবে আমাকে”।

বিধুবাবু বললেন, “আজ রাতটা তুমি থেকে যাও মা। আজ যেও না লক্ষী মা আমার”।
 

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে মেসো। তুমি যা বলছ তাই করব। এবার শান্ত হয়ে বস তো প্লীজ”।

বিভাদেবী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “হ্যারে মা। তুই যা বললি তা না হয় মানলুম। তা আমরা ফোন করে তাদের কি বলব, সেসব একটু ভাল করে বুঝিয়ে দে তোর মেসোকে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “মাসি। ছেলেদের বাড়ির লোকেরা এসে মেয়েকে দেখে গেছেন। মেয়েকে তারা পছন্দ করেছেন। এবার তো তোমরা যাবে ছেলেকে দেখতে। ছেলেকে না দেখেই কি আমরা বিয়েতে রাজি হব নাকি? তুমি আর মেসো তো যাবেই, সঙ্গে তোমাদের আরো দু’ একজন নিকটাত্মীয়কেও নিতে পার। তোমরা তাদের আগে থেকে জানিয়ে দেবে কবে তোমরা সেখানে যাচ্ছ। তারপর সেখানে গিয়ে ছেলেটাকে দেখবে, তার সাথে কথা বলবে, তার বাড়ি ঘর দেখবে। বাড়ির লোকদের সাথে কথা বলে তাদের আচার ব্যবহার আন্তরিকতা এসব বুঝবার চেষ্টা করবে। আর হাতে কিছু সময় থাকলে বাইরের দু’ চারজন লোকের কাছেও তাদের বাড়ির ব্যাপারে বা ছেলের ব্যাপারে খবরাখবর নেবে। দেখবে আমি তোমাদের যা যা বললাম সে’সব সত্যি কি না। তারপর সব কিছু দেখে শুনে তোমরা খুশী হলে তাদের সেভাবে বোল। তবে ভবিষ্যতে যাতে কোন রকম ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেজন্যে প্রথমেই তাদের সকলকে পরিস্কার করে বলে দেবে যে তোমরা যৌতুক একেবারেই দিতে পারবে না। তবে তোমাদের সাধ্যমত কিছু দান সামগ্রী মেয়েকে তোমরা অবশ্যই দেবে। আর বিয়েটা কিন্তু বছর খানেক পরেই হবে। রচনার বারো ক্লাসের পরীক্ষা শেষ হবার আগে বিয়ে কিছুতেই হবে না। তোমাদের কথা শুনে তারা রাজি না হলে তোমরা তোমাদের অপারগতার কথা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে আসবে। আর যদি আমাদের শর্তে রাজি হয়ে যায়, তাহলে বলবে যে এদের বিয়ের ব্যাপারে তোমরাও রাজি আছ। তবে এখনই কোন আশীর্বাদ টাশীর্বাদ করবে না তোমরা। তারা যদি বলেনও যে আপনারা আজই ছেলেকে আশীর্বাদ করে যান, তাহলে তোমরা বলবে যে এখন আশীর্বাদ করবে না। এক বছর আগেই আশীর্বাদ সেরে ফেলবার তো কোন দরকার নেই। এক বছরের মধ্যে কত কীই তো হতে পারে। এখন থেকেই কোন বাধ্য বাধকতার ভেতরে যাবার তো দরকার নেই। তবে তারা যদি চান, তাহলে মাসে দু’মাসে তারা কেউ তোমাদের এখানে এসে রচুর সাথে, তোমাদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে যোগাযোগটা অক্ষুন্ন রাখতে পারে। আর তাদের ছেলে আর আমাদের রচুও মানসিক ভাবে প্রস্তুত হতে সময় পাবে। ব্যস। আর কিছু করবার দরকার নেই এখন”।

বিধুবাবু বললেন, “তুমি কি সুন্দর করে আমাদের সবটা বুঝিতে দিলে মা। কিন্তু মা, আমাদের নিকটাত্মীয় বলতে এখানে তেমন কেউ তো নেই। আজ তো মনে হচ্ছে তুমিই আমাদের সবচেয়ে বড় আত্মীয়। তুমিই চল না মা আমাদের সাথে”।

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “মেসো, আমাকে নিয়ে একদম ভেব না। আর তাছাড়া আমি তো বললামই যে ও বাড়ির সকলেই আমাকে চেনেন। আর আমিও ও বাড়ির প্রায় সকলের ব্যাপারেই সবকিছু জানি। আমি তো সে বাড়িতে যাবই। হয়ত খুব শিগগীরই যাব। কিন্তু তোমাদের সাথে যাব না। আমি আলাদাভাবে গিয়ে তাদের পরিবারের সকলের মতামত জানব। তাদের পরিবারের ভেতরের কিছু কথা জানতে চেষ্টা করব। যেটা তারা তোমাদের সামনে হয়ত স্পষ্ট করে বলতে চাইবেন না। তাই আমার মনে হয় আমার এখনই সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আর তাছাড়া আরো একটা ব্যাপার আছে। তুমি আর মাসি যখন যাবে তখন এ বাড়িতে তো রচু আর ভাই ছাড়া আর কেউ থাকবে না। তোমাদের হয়ত রাতে সেখানে থাকতেও হতে পারে। রচু আর ভাইকে রাতে একা এ বাড়িতে রাখা কি ঠিক হবে? তাই আমি ভাবছি, যেদিন তোমরা রাজগঞ্জ যাবে সেদিন আমি এসে এখানে থাকব। সেটা ভাল হবে না? আর তুমি দেখো, তোমরা যাবার আগেই আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করব। তাই তোমাদের সেখানে কোন কষ্ট হবে না। আমি সব খবর রাখবার চেষ্টা করব। আর যদি তেমন কিছু হয় যে তোমরা জবাব দিতে পারছ না, তবে তাদের কাছ থেকে একটু সময় চেয়ে নিয়ে সেখান থেকেই রচুর ফোনে একটা ফোন কোর, আমি তোমাদের বুঝিয়ে দেব সব কিছু”।

বিধুবাবু অবাক হয়ে বললেন, “রচুর ফোনে ফোন করব মানে? ওর কি ফোন আছে নাকি”?
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে’ কথাটা তো বলতেই ভুলে গেছি আমি মেসো। এই রচু ওদিকে আমার ব্যাগটা আছে। দে তো একটু আমার হাতে”।
 

রচু ব্যাগটা সীমন্তিনীর হাতে দিতেই ব্যাগের ভেতর থেকে মোবাইল সেটের প্যাকেটটা বের করে রচনার হাতে দিয়ে বলল, “এই নে তোর মোবাইল। আজ থেকে আর ফোন করবার জন্যে তোকে অন্য কোথাও যেতে হবে না। যে কোন সময় যে কোন জায়গা থেকেই প্রয়োজন হলে সকলের সাথে কথা বলতে পারবি। তোকে সব কিছু শিখিয়ে দেব আজ রাতেই। এটা প্রিপেইড ফোন। মাঝে মাঝে স্টার ওয়ান টু থ্রি হ্যাস লিখে ডায়াল করলেই কত টাকা ব্যালেন্স আছে সেটা দেখাবে। যখন ব্যালেন্স শেষ হয়ে আসবে তখন আমাকে জানিয়ে দিবি। আমি ওখান থেকেই রিচার্জ করে দেব। নে”।
 

রচনা চুড়ান্ত অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, “কী বলছ তুমি দিদিভাই? আমার জন্যে তুমি নতুন একটা মোবাইল কিনে এনেছ”?
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “কিনে এনেছি না চুরি করে এনেছি, তাতে তোর কি রে মেয়ে? তবে এটা পুরোনো নয়। একেবারে নতুন। আর এটা ঠিক তোর জন্যে নয়। এটা কার জন্যে কিনেছি সেটা তোকে এখন বলব না। তবে এখন থেকে তুই যতদিন এ বাড়িতে থাকবি ততদিন তুই এটা ব্যবহার করবি। তারপর তুই রাখতে না চাইলে এটা আমাকে ফিরিয়ে দিস। ততদিন তুই আর মাসি মেসো কারো সাথে কথা বলতে চাইলে এটা থেকেই করবি। আমারও তো তোর সাথে মাসি মেসোর সাথে অনেক কথা বলার দরকার হবে। সব সময় কি পড়াশোনা ফেলে ছুটে আসতে পারব আমি তোর কাছে? নে রাখ এটা তোর কাছে”।
 

রচনা হতভম্ব হয়ে সীমন্তিনীর হাত থেকে মোবাইলটা নেবার পর সীমন্তিনী বলল, “তোর ফোনের নম্বর ৯৮........। মেসো তোমরা এ নম্বরটাই দিয়ে আসবে ছেলের বাড়িতে। তারা প্রয়োজন হলে তোমাদের সাথে ফোনে কথা বলতে পারবেন। তবে বিয়েতে রাজি হলেই শুধু দিও। বিয়েতে রাজি না হলে দেবার দরকার নেই”।
 

বিভাদেবী ধরা গলায় বলে উঠলেন, “তুই আমাদের জন্যে এত কিছু করছিস। এর প্রতিদানে তোকে আমরা কী দেব রে মা”?
 

সীমন্তিনী বিভাদেবীর কোলে মাথা পেতে শুয়ে বলল, “আপাততঃ শুধু আমাকে তোমার একটা মেয়ে ভেবে একটু আদর করে দাও। তাতেই হবে গো মাসি। কত বছর হয়ে গেছে আমি নিজের মায়ের কোলে মাথা
 
পেতে শুতে পারিনি। একটু আদর করবে না আমাকে”?
 

বিধুবাবু তার স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “এ মেয়েটা আমাদের সবাইকে সারা জীবনের জন্য বেঁধে রাখতে চাইছে গো গিন্নী। তোমার এই অপদার্থ গরীব স্বামী তোমাকে একটা দিনের জন্যেও সুখী করতে পারেনি। আজ তোমার কপাল খুলেছে। সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা মা তোমার কোলে মাথা পেতে শুয়েছে। দাও দাও, মেয়েটার মাথায় একটু আদর করে হাত বুলিয়ে দাও গো”।
 

বিভাদেবী ঝুঁকে সীমন্তিনীর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে তার মাথায় আদর করে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ গো। এ যে সত্যি আমাদের মা অন্নপূর্ণা গো। না চাইতেই আমাদের সব ইচ্ছে পূর্ণ করে চলছে ও”।

সীমন্তিনী বিভাদেবীর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে রইল। রচনাও কিছুটা এগিয়ে এসে সীমন্তিনীর একটা হাতের ওপর নিজের গাল চেপে ধরল। বিধুবাবু উঠে বললেন, “আমি উঠছি গো। বেরোতে হবে আমাকে। নইলে ওদের বাড়ি পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে। মন্তি মা, তুমি একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও। ফিরে এসে আবার তোমার সাথে কথা বলব”।

বিভাদেবী খানিকক্ষণ বাদে সীমন্তিনীকে ছেড়ে দিয়ে রচনাকে বলল, “এই রচু, দিদিভাইকে একটা প্রণাম করলি না যে তুই? দিনে দিনে মা বাবা যা কিছু শিখিয়েছে সব ভুলতে বসেছিস নাকি”?

সীমন্তিনী প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “না না মাসি। এ কী বলছ তুমি? আমি ওর প্রণাম নিয়ে নিজের পাপ বাড়াতে চাইনে গো। ও তো আমার ছোটবোন গো। না না রচু, থাম ভাই”।
 

রচনা ততক্ষন খাট থেকে নেমে গিয়ে মেঝেয় দাঁড়িয়ে সীমন্তিনীর হাত ধরে টানতে টানতে বলল, “তোমাকে আজ একটা প্রণাম না করলে যে আমার পাপ হবে দিদিভাই। কারুর কাছ থেকে উপহার পেলে তাকে তো প্রণাম না করলে পাপ হয়। এস, নেমে এস প্লীজ”।
 

সীমন্তিনী বলল, “না না তোরা ব্রাহ্মণ। আমি তোর প্রণাম নিতে পারিনা। আচ্ছা শোন বোন। তুই মুখে বলেছিস এতেই হয়েছে। আমি তোর প্রণাম স্বীকার করে নিলুম। আর কিছু করতে হবে না। বোস এখানে”।
 

রচনা তবু জোর করেই সীমন্তিনীকে নামাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “দেখ দিদিভাই, প্রণামটা হচ্ছে একটা শ্রদ্ধার জিনিস। আমরা ও’সব ব্রাহ্মণ অব্রাহ্মণ মানি না। বয়সে বড় হলে, আর কাউকে প্রণাম করে শ্রদ্ধা জানাতে ইচ্ছে করলে সেটা করতে কোন দোষ নেই”।

সীমন্তিনী রচনাকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “বেশ ঠিক আছে। তুই একটু আমাকে আদর করে দে তাতেই হবে। তোকে আমি কিছুতেই আমার পায়ে হাত দেব না। তুই যে আমার বুকের মধ্যে বাসা বেঁধে
 
বসে গেছিস রে পাগলী। আয়”।
 
***************

রাতে শোবার আগে রচনাকে সীমন্তিনী মোবাইলের ফিচার গুলো বুঝিয়ে দিয়ে বলল, “অপ্রয়োজনে, শুধু নেহাত কথা বলার জন্য কাউকে নিজে থেকে ফোন করবি না। আর কারো সাথে কথা বলার সময় কথাটা যত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলা যায় সে চেষ্টা করবি। নইলে একদিকে যেমন পয়সা বেশী খরচ হয়ে যাবে তা-ই শুধু নয়। অন্য কেউ তোর সাথে জরুরী কোন কথা বলতে চাইলেও সেটা করতে পারবে না। তোর ফোন এনগেজড পাবে। আর টকটাইম ব্যালেন্স কত রইল সেটা এভাবে নাম্বারটা লিখে ডায়াল করলেই সেটা দেখতে পাবি। ব্যালেন্স পাঁচ দশ টাকায় নেমে এলেই আমাকে জানিয়ে দিবি। আমি আবার রিচার্জ করে দেব। তাই এখন তোর আর মাসি মেসোর কারো সাথে কথা বলতে অসুবিধে হবে না। তবে মনে রাখিস আজেবাজে কথা বলে সময় আর পয়সা কোনটাই নষ্ট করবি না”।

রচনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “তুমি আমাদের জন্যে এতসব করে আমায় লজ্জায় ফেলে দিচ্ছ দিদিভাই”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোকে লজ্জা দেবার জন্যে আমি কিছু করছিনা রে পাগলী। আসলে আমিও যে তোর সাথে কথা না বলে থাকতে পারবনা রে। তাই তো তোকে মোবাইলটা দিলাম। এখন আমি যেমন রোজ তোর সাথে কথা বলতে পারব, তুই আর মাসি মেসোরাও ইচ্ছে হলেই আমার সাথে বা অন্যদের সাথে কথা বলতে পারবি। বন্ধুদের মোবাইল থেকে কি সব সময় কথা বলা ভাল দেখাবে? ওদেরও তো অসুবিধে হতে পারে। আর শোন, তোর যতদিন বিয়ে না হয় ততদিন ফোন সব সময় তোর কাছে রাখবি। তোর যখন বিয়ে হয়ে যাবে, তখন এটা এ বাড়িতেই রেখে যাবি। তাতে তুইও এ নাম্বারে ফোন করে মা বাবা ভাইদের সাথে কথা বলতে পারবি। আর যেখানেই বিয়ে হোক না কেন, তোর বর তোকে একটা মোবাইল কিনে দেবেই। তা হ্যারে, একটা কথা বলবি? সত্যি সত্যি জবাব দিবি কিন্তু। রাজগঞ্জের রতীশ বা তার পরিবারের কথা যা শুনলি আমার মুখে, তাতে তুই এ বিয়েতে রাজি আছিস তো”?
 

রচনা আরো লজ্জা পেয়ে বলল, “আমার লজ্জা করছে দিদিভাই”।

সীমন্তিনী রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “দুর বোকা মেয়ে, এখানে কি আর কেউ আছে নাকি? আর আমি না তোর বান্ধবী হয়ে গেছি। বান্ধবীর কাছে আর দিদির কাছে সব সিক্রেট খুলে বলা যায়, জানিস না? বল না বোন। নইলে আমিও তো নিশ্চিন্তে ব্যাপারটা নিয়ে এগোতে পারব না”।
 

রচনা সীমন্তিনীর কোলে নিজের মুখ লুকিয়ে প্রায় অস্ফুট গলায় বলল, “আমার অমত নেই”।

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছিস? রতীশকে না দেখেই তুই বিয়েতে রাজি হয়ে গেলি”?
 

রচনা একই ভাবে সীমন্তিনীর কোলে মুখ চেপে ধরে বলল, “তুমি তো তাকে ভাল ভাবেই দেখেছ। আর
 
তুমি তাকে ভাল ছেলে বলছ। আর আমার দেখার কি দরকার”?
 

সীমন্তিনী রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “আমার মুখের কথা শুনেই তুই রাজি হয়ে গেলি”?

রচনা বলল, “তোমার মুখের কথার চেয়ে বড় আর কিছু নেই আমার কাছে দিদিভাই। এখন তুমি আর বাবা মা যা চাইবেন, তা-ই হবে”।
 

সীমন্তিনী রচনাকে আরো জোরে বুকে চেপে ধরে বলল, “আমার ওপর যে ভরসা করছিস, সেটা আমিও নষ্ট হতে দেব না রে বোন। এখন থেকে সব সময় আমি তোর পাশে আছি। এ’কথা মনে রাখিস। যখনই তোর কোন সমস্যা হবে, তুই সব কিছু খুলে আমাকে বলিস। আমি তোর সব সমস্যার সমাধান করে দেব, দেখিস”।

পরদিন সকালে চা খেতে খেতে সীমন্তিনী আবার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বিধুবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “মেসো, রাজগঞ্জের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু ভাবলে”?

বিধুবাবু কিছু বলার আগে বিভাদেবীই বলে উঠলেন, “পাত্রের বাড়ির লোকেরা যেদিন আমাদের এখানে এসেছিলেন সেদিনই তো তাদের কথা বার্তা আর ব্যবহার দেখে আমাদের ভাল লেগেছিল মা। কিন্তু তোর সাথে আগে কথা না বলে আমরা কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইনি। এখন তোর মুখে থেকে ছেলেটার ব্যাপারে আর তাদের বাড়ি ঘরের লোকজন আর সংসারের অবস্থার কথা শুনে তো বেশ ভালই লাগছে”।

বিধুবাবুও বললেন, “হ্যা মন্তিমা। কাল রাতেও আমি আর তোমার মাসি এ ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করেছি। আমার মনে হয়, তুমি যেমনটা বলেছিলে, তাদের একটা খবর পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ যে আমরা তাদের ওখানে যাচ্ছি”।
 

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “তাহলে তো খুব ভাল কথা। কিন্তু মেসো, আমার কয়েকটা কথা কিন্তু তোমাদের রাখতে হবে”।

বিধুবাবু বললেন, “হ্যা হ্যা মা। বল না। তুমিও তো আমাদের একটা মেয়ে। আর রচুকে তো তুমিও যথেষ্ট ভালবাস। বলনা কি বলবে”?

সীমন্তিনী বলল, “রচনা হায়ার সেকেণ্ডারী পাশ না করা অব্দি কিন্তু বিয়ে হবে না, আর ছেলেপক্ষকে যৌতুকের ব্যাপারে কী বলবে, সে’কথা তো কালই বলেছি। সেভাবেই কথা বোল তোমরা। এখন আরেকটা কথা বলছি। তোমাদের সাথে যে আমার পরিচয় আছে সেটা আপাততঃ তাদের জানতে দিও না। আমি তো প্রায় আট ন’বছর বাড়ি ছাড়া। এ সময়ের মধ্যে ওদের সংসারে বা ওদের সামাজিক মর্যাদায় কোন পরিবর্তন হয়েছে কিনা, সে খবরটা আমাকে নিতে হবে। তোমরা যদি আগে থেকেই তাদের জানিয়ে দাও যে আমি তোমাদের পরিচিত অথবা ঘনিষ্ঠ তাহলে সে কাজটা করা আমার পক্ষে একটু কষ্টকর হয়ে উঠবে। তাই রাজগঞ্জ গিয়ে তোমরা আমার নাম একেবারেই মুখে আনবে না কিন্তু। তারা কেউ যেন কোনভাবে আমার কথা জানতে না পারে সেদিকে তোমরা খুব সচেতন থাকবে। ব্যাপারটা যদি শেষ পর্যন্ত স্থির হয়েই যায়, তাহলে আমি নিজেই সবাইকে যথাসময়ে সব কিছু খুলে বলে দেব”।

বিধুবাবু বললেন, “ঠিক আছে মা। তোমার কথা আমরা মনে রাখব। তুমি আমাদের জন্যে যা করছ, তাতে তোমার কথা না রেখে কি পারি আমরা”?
 

সীমন্তিনী বলল, “কেউ কারো জন্যে কিছুই করতে পারে না মেসো। যার কপালে যা আছে তা-ই হয়ে থাকে। তাহলে তোমরা কবে যাবে বল তো? সেদিন তো আবার আমাকে আসতে হবে এখানে”।

বিভাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা মা, এখান থেকে রাজগঞ্জ গিয়ে পৌঁছতে কতক্ষন সময় লাগবে রে? আমরা কি সেদিনই ফিরে আসতে পারব না”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “এখান থেকে ট্রেন বা বাস ধরে আলিপুরদুয়ার চলে গেলে সেখান থেকে ট্রেনে দু’ ঘন্টাতেই পৌঁছে যাবে জলপাইগুড়ি রোডে। ষ্টেশন থেকে অটো বা রিক্সা ধরে জলপাইগুড়ি বাস স্ট্যান্ডে চলে গেলে সেখান থেকে পনের কুড়ি মিনিট বাদে বাদেই রাজগঞ্জের এক একেকটা বাস ছাড়ে। তাই তোমরা যদি সকাল সাতটায় এখান থেকে রওনা হয়ে যাও তাহলে দুপুর বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ রাজগঞ্জ পৌঁছে যাবে। তোমরা অবশ্য আলিপুরদুয়ার থেকে ট্রেনে শিলিগুড়িও যেতে পার। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে তোমাদের উল্টোদিকের বাস ধরে রাজগঞ্জ পৌঁছাতে হবে। তাতে সময় একটু বেশী লাগবে। তাই জলপাইগুড়ি হয়ে গেলেই ভাল। আর রাজগঞ্জে নেমে যে কোন রিক্সায় চেপে তাদের তিন ভাইয়ের যে কোন একজনের নাম করলেই দশ মিনিটের মধ্যে তাদের বাড়ি পৌঁছে যাবে তোমরা। কিন্তু তোমরা যদি সেদিনই ফিরে আসতে চাও, তাহলে বেশী সময় সেখানে থাকতে পারবে না। একটা দেড়টার মধ্যেই তোমাদের ফিরতি বাস ধরতে হবে। তাহলে হয়ত সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় এখানে এসে পৌছবে। কিন্তু আমি চাই, তোমরা একটা রাত সেখানে থেকেই এস। দেখ মাসি, বারবার তো আর যাওয়া আসা সম্ভব হবে না। তাই বিকেলের দিকে একটু তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাজার টাজার দেখে নিও। আর দু’চার জনের কাছ থেকে তাদের ব্যাপারে ভাল মন্দ খবরও নিতে পারবে। সেখানকার সব লোকই তাদের সবাইকে চেনে। তাই অনায়াসেই তোমরা খবর নিতে পারবে। আর বাড়ির জন্যে তো ভাবতে হবে না তোমাকে। আমি তো তোমরা যাবার আগের দিন বিকেলেই চলে আসব। আর তোমরা ফিরে না আসা পর্যন্ত রচু আর ভাইকে দেখে শুনে রাখব। আর রাতটা তাদের বাড়িতে কাটালে পরিবারের ভেতরের ব্যাপার স্যাপারগুলোও তুমি অনেক কিছু আন্দাজ করতে পারবে। পরিবারের ছোট বড় সকলের সাথেই একটু একটু আলাপ করতে পারবে। আর তারাও নিশ্চয়ই তোমাদের অবহেলা করবেন না”।

বিভাদেবী শুনে বললেন, “নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করে তুই আবার আসবি মা”?

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “এ কী বলছ তুমি মাসি? আমার বোনের বিয়ের ব্যাপারে দুটো দিন পড়াশোনা না করলে এমন কী ক্ষতি হবে আমার? শোনো, সামনের সপ্তাহে আমাদের কলেজের বার্ষিক খেলাধুলো হবে। তাই কোন ক্লাস হবে না। আমি মঙ্গলবার সন্ধ্যেয় এখানে এসে পড়ব। তোমরা বুধবার রাজগঞ্জ যেও। তারপর তোমরা বৃহস্পতি বার চলে এলে আমি শুক্রবার ফিরে যাব। তোমাদের বুধবার যেতে কি আপত্তি আছে”?
 
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)