Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 228)

রান্নাঘরের পেছনেই কলের পাড়ে কিংশুকের গলা পেয়ে বিভাদেবী নিজের চিন্তার জাল ছিঁড়ে ফেলে চায়ের জল চাপালেন উনোনে। রান্নাঘর থেকেই গলা তুলে বিভাদেবী ছেলেকে বললেন, “খোকা, চট করে তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করে আয় তো উনি এখন চা খাবেন কিনা”।

পরিতোষকে কলের পাড় আর বাথরুম দেখিয়ে দিয়ে কিংশুক বাইরে চলে গেল। আর খানিক বাদে ফিরে এসে রান্নাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, “মা, বাবার জন্যেও বানিও চা। উনি আসছেন”।

পরিতোষ হাতমুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে একটা পাজামা আর পাঞ্জাবী পড়ে ঘর থেকে বেরোতে যাবে এমন সময়েই সীমন্তিনীর ফোন এল। পরিতোষ বিধুবাবুর বাড়ি পৌঁছে গেছে শুনে সীমন্তিনীও আশ্বস্ত হল। কিংশুকের ডাকে পরিতোষ ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল বিভাদেবী তার জন্যে চা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন।

পরিতোষ বিভাদেবীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে জিজ্ঞেস করল, “কাকুও তো চা খাবেন বলছিলেন। উনি আসবেন না”?

বিভাদেবী হাতের অন্য কাপটা কিংশুককে দিতে দিতে বলল, “দোকানে বোধহয় খদ্দের আছে। তাই বোধহয় উনি আসতে পারছেন না। খোকা দিয়ে আসবে তার চা-টা। তুমি খাও বাবা”।
 

পরিতোষ চায়ের কাঁপে চুমুক দিতেই বিভাদেবী বললেন, “মন্তিমার মুখে শুনেছি, তুমি নাকি ওর খুব ভাল বন্ধু। কিন্তু এই তো তুমি প্রথম এসেছ ওর ওখানে। কিন্তু দুটো দিনও সেখানে না থেকেই চলে যাচ্ছ বাবা”?

পরিতোষ একটু হেসে জবাব দিল, “কাকিমা, একটা খুব জরুরী কাজ ছিল বলেই আমাকে এভাবে হঠাৎ করে দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে চলে আসতে হয়েছে। মন্তির ওখানে যে কাজে এসেছিলাম সেটা তো হয়ে গেছে। আর আমার বাকি আরেকটা কাজ আছে মালবাজারে। কিন্তু এদিকে এসেছি শুনেই রচনা এমন করে বলল যে এখানে না এসে পারলাম না। তাই ভাবলাম আজ একটা বেলা এখানে আপনাদের সাথে কাটিয়ে আজ বিকেলের দিকেই আমি মালবাজার চলে যাব। আর মালবাজারের কাজটা সেরে কাল বিকেলের দিকে আমি শিলিগুড়ি হয়ে বাগডোগরা চলে যাব। তারপর কলকাতা”।
 

বিভাদেবী পরিতোষের কথা শুনে বললেন, “ওমা সে কী কথা? তুমি আজই চলে যাবে? না না, ওটি হবে না বাবা। তোমাকে আজকের রাতটা আমাদের এখানেই থেকে যেতে হবে। কাল সকালে যেখানে যেতে চাও, চলে যেও। অবশ্য আমাদের বাড়ির যা জরাজীর্ন অবস্থা, তাতে তোমার বেশ অসুবিধেই হবে, জানি। তবু বলছি একটু কষ্ট স্বীকার করেই থেকে যাও বাবা। নইলে রচু আর মন্তি দু’জনেই কিন্তু মন খারাপ করবে”।

পরিতোষ হেসে জবাব দিল, “ওই মেয়েদুটোকে কষ্ট দিতে আমিও চাইনা কাকিমা। আপনি হয়তো জানেন না কাকিমা, আপনার ছোটমেয়ে কিন্তু আমাকে দাদা বলে ডাকে। আমিও ওকে আমার বোন বলেই ভাবি। আসলে আমার তো এ পৃথিবীতে আপন বলতে আর কেউ নেই। তাই রচনার মত একটা বোন পেয়ে আমিও খুব খুব খুশী। আর সে সম্পর্কের সূত্র ধরেই তো মুখ ফসকে আপনাকে মা বলে ফেলেছিলাম। যে মা আমাকে জন্ম দিয়েছেন, তিনি তো আমার বোধবুদ্ধি হবার আগেই স্বর্গে চলে গেছেন। শুধু ছবিতেই তাকে দেখেছি আমি। কিন্তু আজ আপনাকে দেখে মনে হল আমি যেন সত্যি এক মায়ের সান্নিধ্যে এসেছি। জীবনে প্রথমবার আজ মনে হচ্ছে .......” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। মুখ নামিয়ে চুপ করে নিজের চোখ ঠেলে বেরিয়ে আসা অশ্রু সংবরণ করবার চেষ্টা করতে লাগল।

বিভাদেবী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “মন খারাপ কোর না বাবা। ভগবান যার কপালে যা লিখেছেন, তা থেকে কারো কি আর মুক্তি আছে? তুমি রচুকে নিজের বোন বলে ভাবো। তাই আমিও তো তোমার মায়ের মতই। তোমার যখন ইচ্ছে তুমি আমার কাছে চলে আসতে পার”।

এমন সময় কিংশুক মোবাইলে কথা বলতে বলতে ছুটে এসে পরিতোষের হাতে ফোনটা দিয়ে বলল, “পরিদা, ছোড়দি আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে”।

পরিতোষ ফোনটা নিয়ে কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ রচু সোনা, বলো”।

রচনার আদুরে বায়নায় পরিতোষ কালচিনিতে থেকে যেতে মত দিতে বাধ্য হল।

বিধুবাবু দুপুর প্রায় একটা নাগাদ দোকান বন্ধ করে বাড়ির ভেতর এলেন। আর আগে এসে পরিতোষের সাথে কথা বলতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়া হয়ে যাবার পর পরিতোষ সকলের জন্যে নিয়ে আসা পোশাকগুলো সকলের হাতে দিয়ে বলল, “মাকে তো আমি জ্ঞান হবার আগেই হারিয়েছি। আর বাবাকে যখন কিছু দেবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলাম, ঠিক তখনই উনিও আমাকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেলেন। আজ আপনাদের হাতে এ সামান্য উপহারটুকু দিতে পেরে আমার মনে যে কেমন অনুভূতি হচ্ছে, সেটা আপনাদের কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। এর আগে আর আমার এদিকে আসা হয়নি কখনও। ভবিষ্যতেও আর কখনও আসা হবে কিনা, সেটাও জানি না। সামনের মাসেই তো পূজো। তখন আপনারা সবাই এগুলো পড়ে আমাকে আশীর্বাদ করবেন”।

দুপুরে বিধুবাবু দু’ঘন্টার মত দোকান বন্ধ রেখে ঘরে একটু বিশ্রাম নেন। প্রায় ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নেন। তারপর বিকেল তিনটে নাগাদ আবার দোকানে চলে যান। কিন্তু আজ আর তিনি ঘুমোবার কথা মনেও আনলেন না। তিনি ভাবলেন, এই ছেলেটির সাথেই তো মন্তি অর্চুর বিয়ে দিতে চাইছে। প্রথম দেখাতেই ছেলেটাকে তার ভাল লেগেছে। তবু যে কোনও কারনেই হোক ছেলেটা যখন তাদের বাড়ি এসেই পড়েছে, তখন তার সাথে একটু কথা বলে তাকে বোঝবার কিছুটা চেষ্টা তো করাই উচিৎ। তবে তার মন্তি-মার ওপর তিনি চোখ বুজে ভরসা করতে পারেন। তার মন্তি-মা যখনই বলেছে যে ছেলেটা খুব ভাল, তখন থেকেই এই ছেলেটার ব্যাপারে তার মনে আর কোন সংশয় নেই। তবু অন্ততঃ সৌজন্য রক্ষার খাতিরেও তার সাথে কিছু কথা বলা নিতান্তই আবশ্যক। তাই তিনি পরিতোষের উপহার গ্রহণ করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তা বাবা পরিতোষ, একটু আগেই তুমি বললে যে তোমার বাবা-মা দু’জনেই তোমাকে অনাথ করে দিয়ে চলে গেছেন। নিজেকে কখনও অনাথ বলে ভেবনা বাবা। আমি দরিদ্র ',। জীবনে অনেকবার অসহায় অবস্থায় পড়েছি। জীবনের কটু অভিজ্ঞতাও কম সঞ্চয় করিনি। সেই অভিজ্ঞতার জোরেই বলছি বাবা, একটা কথা সব সময় মাথায় রেখ। যাদের আপনজন বলতে পৃথিবীতে কেউ থাকে না, তাদের জন্য ঈশ্বর থাকেন। কথাটা হয়ত তুমিও শুনে থাকবে। কিন্তু আমরা সবাই এটা আমাদের জীবনে উপলব্ধি করেছি। এক ফোঁটাও মিথ্যে নয় কথাটা। তুমি জানো কিনা জানিনা, আমাদের বড়মেয়ে অর্চু, সাত সাতটা বছর ওর নিজের মা, বাবা, ভাই, বোন বেঁচে থাকা সত্বেও একেবারে অনাথের মতই জীবন কাটিয়েছে। সে আমারই দোষে। কিন্তু আমরা ওর কাছে যেতে না পারলেও ভগবান ঠিকই ওর ওপর নজর রাখছিলেন। তাই তো ও যখন মৃত্যুর মুখে পড়েছিল, তখনই ঠিক সময়ে ভগবান নিজের দূত পাঠিয়ে ওকে রক্ষা করেছেন” বলে একটু থেমে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, “তা যাক সে সব কথা। ও’সব দুঃস্বপ্নের স্মৃতিচারণা করাও বড্ড বেদনাদায়ক। তা বাবা, তোমার মা বাবার কী হয়েছিল? কোনও দুরারোগ্য ব্যাধিতেই কি তারা চলে গেছেন”?

পরিতোষ শূণ্যে দৃষ্টি রেখে বলল, “কাকু, আমি যখন মাকে হারিয়েছি তখন আমি মোটে একটা দু’বছরের শিশু। মা-র কোন কথাই আমার মনে নেই। তবে বড় হবার পর বাবার মুখেই শুনেছি যে আমার জন্মের পর থেকেই নাকি উনি প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। কী হয়েছিল, তা আমি আজও জানিনা। বাবা ছিলেন পুলিশের সাধারণ একজন কনস্টেবল। উপার্জনও সীমিত ছিল। তবু তার সাধ্যমত চিকিৎসা তিনি করিয়েছিলেন। কিন্তু মাকে আর সারিয়ে তুলতে পারেননি। মা-র ব্যাপারে আমি শুধু এটুকুই জানি। বাবা একাই আমার ছোটবেলা থেকে আমাকে পেলে পুষে বড় করে তুলেছিলেন। কোনদিন কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করতেন না তিনি। তাই চাকুরী জীবনেও তার প্রাপ্য মর্য্যাদা তিনি পাননি। জানেনই তো সৎ ভাবে বেঁচে থাকতে সবাইকে হাজারো ঝুঁট ঝামেলা পোয়াতে হয়। তার উপার্জনের বেশীর ভাগ অংশটাই তিনি আমার ভরণ পোষণ আর লেখাপড়ার দিকে ব্যয় করতেন। কিন্তু তিনিও যে হাই ব্লাড প্রেসারের রুগী ছিলেন এ’কথা আমি তার মৃত্যুর আগে পর্যন্তও জানতে পারিনি। আমি আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করবার পর যখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে চলে গিয়েছিলাম, তার প্রায় দু’মাস বাদেই বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম। শুনলাম তার স্ট্রোক হয়েছিল। কিন্তু ট্রেনিং পেরিয়ডে ছুটি পাইনি। তাই বাবার দাহ সৎকারও আমি নিজে হাতে করতে পারিনি। আমার বন্ধুরাই সে দায়িত্ব পালন করেছিল। তবে অনেক কাকুতি মিনতি করে দিন সাতেকের ছুটি পেয়ে শ্রাদ্ধের তিনদিন আগে বাড়ি এসেছিলাম। তখন বাবার শ্রাদ্ধটা করতে পেরেছিলাম”।

এতোটা বলে পরিতোষ থামতেই বিভাদেবী বলে উঠলেন, “আহারে, বেচারা মরে গিয়েও নিজের সন্তানের হাতের আগুনটুকুও তার কপালে জুটল না”!

বিধুবাবুও পরিতোষের কথা শুনে খুব আফসোস করলেন। কিন্তু বিভাদেবীর কথা শুনে বললেন, “বিধাতা যার কপালে যা লিখে দিয়েছেন, সেটা আর কে কবে খন্ডাতে পেরেছে বলো। তা বাবা, তোমার বাবার কি খুব বয়স হয়েছিল”?

পরিতোষ নিজের ঝাপসা হয়ে আসা চোখদুটো মুছে নিয়ে বলল, “না কাকু, বাবা মারা গেছেন ২০০৫ এর জুন মাসে। তখন তার বয়স ছিল মোটে আটচল্লিশ। অনেক দিন সার্ভিস বাকি ছিল তার”।

বিধুবাবু ভারাক্রান্ত মনে বলল, “তার মানে, এখন যদি উনি বেঁচে থাকতেন তাহলে তার বয়স হত পঞ্চান্ন। এ তো আমারই বয়সী! আমারও তো এখন পঞ্চান্নই চলছে। ইশ, এ জন্যেই বলে জন্ম মৃত্যু বিয়ে তিন বিধাতা নিয়ে। নইলে ওটা কি চলে যাবার বয়স ছিল? তা বাবা, তোমার আর কোনও আত্মীয় স্বজন নেই কোথাও”?

পরিতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমি তো জীবনে কাউকে দেখিনি কাকু। তবে বাবার মুখেই শুনেছিলাম তার নাকি এক দিদি ছিল। বাবার চেয়ে উনি নাকি প্রায় ছ’ সাত বছরের বড় ছিলেন। বাবা যখন ক্লাস সিক্সে পড়তেন তখনই নাকি তার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল আসাম আর ভূটান বর্ডারের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে। তখন আমার বাবা ঠাকুর্দারাও ওখানেই কোথাও থাকতেন। কিন্তু অ', একটা ছেলেকে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন বলে দাদু, ঠাকুমা তাদের সেই মেয়ের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করে ভিটে মাটি বিক্রি করে দিয়ে সেখান থেকে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। সে আমার জন্মের বহু আগের ঘটণা। আমার বাবাও তখন নাকি মাত্র দশ এগার বছরের। পিসির কোন ছবিও কোথাও দেখিনি। তার নাম ধাম ঠিকানা কিছুই জানিনা আমি। আর তিনি এখনও বেঁচে আছেন কিনা তাও জানিনা”।

বিধুবাবু এবার জিজ্ঞেস করলেন, “সে কি বাবা। নিজের পিসির সম্মন্ধে তুমি কিচ্ছুটি জানো না”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “সে সুযোগই তো কখনও পাইনি কাকু। সে’সব তো আমার জন্মের অনেক আগেকার কথা। আর বাবা বলেছিলেন যে পিসি নিজের পছন্দের এক কায়স্থ নিচু জাতের ছেলের সাথে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন বলে আমার ঠাকুর্দা নাকি তখন থেকেই তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করেছিলেন। আর নিজেদের গ্রামেই তার মেয়ের শ্বশুর বাড়ি বলে ঠাকুর্দা তার মেয়ের বিয়ের দু’তিন মাস বাদেই ওই গ্রাম ছেড়ে ঠাকুমা আর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চিরতরে কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। সেটা খুব সম্ভবতঃ ঊণিশশ’ সাতষট্টি আটষট্টি সালের কথা হবে। বাবা বিয়ে করেছিলেন কলকাতা যাবার প্রায় তের বছর পর ১৯৮১ সালে। আমার জন্ম হয়েছে ১৯৮২ সালে। তখনও ঠাকুর্দা ঠাকুমা বেঁচে ছিলেন। ৮৪ সালে মা মারা গেলেন। তার দু’তিন বছরের মধ্যেই ঠাকুমা আর দাদু মারা গিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকে শুধু বাবাকেই কাছে পেয়েছি আমি। তার মুখেই পিসির সাথে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হবার কথা আমি শুনেছি। বাবাও যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পিসির কোনও খোঁজ খবর করেননি। ঠাকুর্দা নাকি মৃত্যু শয্যায় শুয়ে বাবাকে এ ব্যাপারে শপথ নিতে বাধ্য করেছিলেন। তাই আমার পক্ষেও এর চেয়ে বেশী কিছু জানা সম্ভব হয়নি” বলে একটু দম নিয়ে আবার বলল, “কিন্তু বাড়িতে অলস সময়ে যখন একা বসে থাকি তখন মাঝে মাঝে সেই পিসির কথা মনে আসে আমার। মনে হয়, তার সাথে যদি যোগাযোগ থাকত তবুও বোধহয় রক্তের সম্পর্ক থাকা আমার আপন একজনের পরিচয় আমি দিতে পারতাম। কিন্তু পিসির নামও তো আমি জানিনা। আসাম-ভূটান বর্ডারের কাছাকাছি যে গ্রামে ঠাকুর্দারা থাকতেন, যে গ্রামে পিসির বিয়ে হয়েছিল সে গ্রামের নামটাও আমি জানিনা। আর এত বছর বাদে পিসি এখনও জীবিত আছেন কিনা, বা এখনও ওই গ্রামেই আছেন কিনা, এ’সব তো কিছুই জানিনা আমি। কী করে আর তাকে খুঁজব আমি বলুন”।

পরিতোষের কথা শুনতে শুনতে বিধুবাবু যেন মনে মনে তার স্মৃতির তলানিতে কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছিলেন একনাগাড়ে। পরিতোষ থামতেই তিনি বললেন, “তোমার কথা শুনে মনটা খুব ভারী হয়ে গেল বাবা। এত একাও কি কেউ হতে পারে এ পৃথিবীতে? তবে জানো বাবা, তোমার ঠাকুর্দার পরিবারের যেমন কথা তুমি শোনালে, ঠিক তেমনই একটা পরিবারকে আমি চিনতুম আমার ছোটবেলায়। কাকতালীয়ও হতে পারে। কিন্তু আমার মনের ভেতর থেকে কেউ যেন আমাকে উৎসাহ যোগাচ্ছে কথাটা তোমাকে বলবার জন্য। তখন আমরা কুমারগ্রাম বলে একটা ছোট্ট জায়গায় থাকতুম। সে জায়গাটাও আসাম আর ভূটান বর্ডারের খুব কাছাকাছিই ছিল। ১৯৭০ সালে আমাদের বাড়িটা আগুনে পুড়ে একেবারে ভস্মীভূত হয়ে যাবার পর আমরা সেখান থেকে চলে এসে এখানে বাড়ি করে থাকতে শুরু করেছিলাম। তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। কিন্তু কুমারগ্রামে ছোটবেলায় আমার এক অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল। কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। ওরা থাকত কুমারগ্রামের দক্ষিণ দিকের একেবারে শেষ প্রান্তে। আমার ওই ', বন্ধুর দিদিও বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে একটা কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিল। আর মেয়েটা তাদের পাড়ারই ছেলেকে বিয়ে করেছিল বলে তারা বাড়ি ঘর বিক্রী করে দিয়ে কুমারগ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সেটাও ১৯৬৮ সালের কথা। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি। তখন অবশ্য আমরা জানতুম না যে তারা কোথায় গেছেন। আমরা এখানে চলে আসবার প্রায় বছর তিনেক পর বাবা কি একটা কাজে যেন কুমারগ্রাম গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে উনি আমার নামের একটা চিঠি এনে আমার হাতে দিয়েছিলেন। সে চিঠিটা আমার ওই বন্ধুর লেখা ছিল। ম্যাট্রিক পাশ করবার খবর জানিয়েছিল আমাকে। আমাদের কুমারগ্রাম বাড়ির ঠিকানায় চিঠিটা এসেছিল। আমাদের পাশের বাড়ির মালিক সেটা নাকি রেখে দিয়েছিলেন তার কাছে। তারপর বাবার হাতে দিয়েছিলেন সেটা। সে চিঠিটা কলকাতা থেকে এসেছিল, কিন্তু তাতে আমার বন্ধুর ঠিকানা লেখা ছিল না। তবে এ’টুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে দুর্গারা কুমারগ্রাম ছেড়ে যাবার পর কলকাতাতেই কোথাও আছে”।

বিধুবাবুর মুখে নিজের বাবার নাম শুনে পরিতোষ চমকে উঠে বলল, “কাকু, কী নাম বললেন আপনি? দুর্গা”?

এবার বিধুবাবু চমকে উঠলেন, “হ্যাঁ বাবা, দুর্গা। আমার ওই ছেলেবেলার বন্ধুর নাম। পুরো নাম ছিল দুর্গাদাস সান্যাল। আমরা বন্ধুরা সবাই ছোট্ট করে ওকে ‘দুর্গা’ বলে ডাকতুম”।

পরিতোষ এবার প্রায় রুদ্ধ গলায় বলল, “আমার বাবার নামও তো দুর্গাদাস সান্যালই”।

এবার বিধুবাবু অবাক হয়ে বিছানা থেকে প্রায় লাফ মেরে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “কী বলছ তুমি বাবা? আচ্ছা, তোমার ঠাকুর্দার নাম কি কালীচরন সান্যাল ছিল”?

পরিতোষও নিজের উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, “হ্যাঁ কাকু, ঠিক বলছেন আপনি। আমার ঠাকুর্দার নাম কালীচরণ সান্যালই ছিল। তাহলে আপনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন”?

বিধুবাবু এবার নিজের মনের জড়তা কাটিয়ে উঠে পরিতোষকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “হ্যাঁ বাবা। আমি আর তোমার বাবা ছোটবেলায় অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলুম। কিন্তু কালচক্রের ফেরে আমরা একে অপরের কাছ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলুম। আমার সেই বন্ধু যে আজ আর এ পৃথিবীতে নেই, এ’কথা আজ এত বছর বাদে তার ছেলের মুখেই আমাকে শুনতে হল.... হা ভগবান” বলতে বলতে তার চোখ থেকে জলের ধারা নেমে এল।
 

বিধুবাবুর শরীরটা উত্তেজনায় কাঁপছে বুঝতে পেরে পরিতোষ তাকে দু’হাতে জাপটে ধরে বলল, “কাকু, আপনি শান্ত হোন। আপনি বিছানায় বসে কথা বলুন। আপনার শরীরটা কাঁপছে কিন্তু” বলে বিভাদেবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “কাকিমা, কাকুকে একটু জল খেতে দিন” বলে বিধুবাবুকে আগলে ধরে আস্তে করে বিছানায় বসিয়ে দিল। বিধুবাবু হাঁপাতে হাঁপাতে পরিতোষের গালে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলতে লাগলেন, “পরিতোষ, তুমি সত্যি আমার সেই হারিয়ে যাওয়া বন্ধু দুর্গার ছেলে”?

কিংশুক এতক্ষণ চুপচাপ বিছানার এক কোনায় বসে তার বাবা আর পরিদার কথা শুনে যাচ্ছিল। এতক্ষণ সে একটা কথাও বলেনি। এবার পরিতোষের দিকে চেয়ে একটু হেসে বলল, “পরিদা, তুমি কিন্তু তাহলে আমার ডাবল দাদা হয়ে গেলে এখন থেকে। আগে ছোড়দির দাদা ছিলে, আর এখন আমাদের বাবার বন্ধুর ছেলে হয়ে গেলে”।

পরিতোষ কিংশুকের দিকে চেয়ে কিছু না বলে শুধু একটু হাসল। এমন সময় বিভাদেবী জলের গ্লাস এনে বিধুবাবুর মুখের সামনে ধরে বললেন, “নাও তো, এ জলটুকু খেয়ে নাও। আর দু’মিনিট শান্ত হয়ে চুপটি করে বোস। তারপর কথা বোল”।

বিধুবাবু গ্লাসের প্রায় অর্ধেকটা জল খেয়ে গ্লাসটা ফিরিয়ে দিতেই বিভাদেবী একটু হেসে পরিতোষের দিকে চেয়ে বললেন, “আমি তোমার কাকুর মুখে তার ছোটবেলার বন্ধু দুর্গাবাবুর নাম শুনেছি বেশ কয়েকবার। কিন্তু তাকে কখনও চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। আমাদের বিয়ের অনেক আগেই তারা নিজেদের পৈতৃক গ্রাম ছেড়ে এখানে চলে এসেছিলেন। এখানে আসবার প্রায় চৌদ্দ পনের বছর বাদে আমাদের বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বাবা তুমি তোমার সেই পিসির নামটাও জানো না”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “না কাকিমা, বাবা কোনদিন তার নাম মুখে আনেন নি। যে দু’একবার তার কথা বলেছেন তখন ‘তোর পিসি, তোর পিসি’ বলেই উল্লেখ করেছেন। আমার মনে আছে একদিন আমি তার কাছে পিসির নামটা জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বাবা বলেছিলেন যে ঠাকুর্দাকে তিনি কথা দিয়েছেন কখনও নিজের দিদির নাম মুখে আনবেন না। তাই আমার পক্ষেও জানা সম্ভব হয়নি। আর কলকাতায় বাবার যারা বন্ধুবান্ধব আছেন, তারাও কেউ জানেননা যে আমার একজন পিসি ছিল”।

বিধুবাবু জল খেয়ে খানিকক্ষণ চোখ বুজে তার ছোট্টবেলার বন্ধুর মুখটা মনে করছিলেন। এবার পরিতোষের কথা শুনে তিনি চোখ খুলে বললেন, “ছিল নয় বাবা, আছেন। তোমার পিসি আমাদের হিমুদি, এখনও বেঁচে আছেন। বয়স বাষট্টির মত হলেও এখনও ঈশ্বরের আশীর্বাদে তিনি বেশ সুস্থ সবল আছেন। মাস খানেক আগেই তার স্বামী নিরুদার সাথে আমার দেখা হয়েছে আলিপুরদুয়ারে। হ্যাঁ তারাও অনেক বছর আগেই কুমারগ্রাম ছেড়ে আলিপুরদুয়ারে চলে গিয়েছিলেন। বিরাট ব্যবসা তাদের সেখানে। পাইকারী মনিহারী আর গালামালের ব্যবসা। আমার দোকানের সব জিনিস তো আমি নিরুদার দোকান থেকেই আনি এখন। অবশ্য এখন আর আমাকে সেখানে গিয়ে মাল কিনতে হয় না। চেনাজানা লোকের হাতে একটা খামে টাকা আর মালপত্রের তালিকা পাঠিয়ে দিলেই তারা সবকিছু এখানে পাঠিয়ে দেন। দোকান শুরু করবার পর মাসখানেক আগে প্রথম যখন আলিপুরদুয়ার গিয়েছিলুম মাল কিনতে তখনই নিরুদাকে সেখানে দেখতে পাই। নিরুদা তো আগে থেকেই জানেন যে আমি হিমুদির ভাইয়ের বন্ধু। তাই শালাবাবু বলে খুব খাতিরদারি করে জোর করে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন। বিশাল বাড়ি তাদের। পাঁচতলা বাড়ি। সেদিন আমি প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে হিমুদিকে দেখলুম। হিমুদিও এত বছর বাদে আমাকে দেখে খুব খুশী হয়েছিলেন। দুর্গার কথাও জিজ্ঞেস করেছিলেন। কিন্তু তখন আমিই তো কিছু জানতুম না। তাকে আর কী বলব”।


______________________________
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
(Update No. 229)

বিধুবাবুর কথা শুনে পরিতোষের চোখ দুটোয় খুশীর ঝিলিক ফুটে উঠল। সে চোখ বড়বড় করে উত্তেজিত ভাবে বলল, “আমার পিসি এখনও বেঁচে আছেন আর সুস্থ আছেন? সত্যি বলছেন কাকু”?

বিধুবাবুও খুশী ভরা গলায় জবাব দিলেন, “হ্যাঁ বাবা, তোমার পিসি, এখনও সুস্থ আছেন। তার শরীর স্বাস্থ্য এখনও ঠিক আছে”।

পরিতোষ হঠাৎ করে বিধুবাবুর দুটো হাত ধরে কাতর গলায় বলে উঠল, “কাকু, আপনি আমাকে তাদের নাম ঠিকানাটুকু দিতে পারবেন? অন্ততঃ একটি বার তাকে চাক্ষুষ দেখতে চাই আমি। উনি যদি আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে ঘৃণাও করেন, তবু আমি তাতে কিছু মনে করব না। আমার মনে অন্ততঃ এ শান্তিটুকু থাকবে যে এ পৃথিবীতে আমার আপন বলতে এখনও একজন আছেন” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল। তার দু’চোখ ছাপিয়ে জলের ধারা নেমে এল।
 

বিভাদেবীও পরিতোষের আকুলতা দেখে অভিভূত হয়ে পড়েছেন। বিধুবাবু পরিতোষের হাত ধরে বললেন, “কিচ্ছু ভেবনা বাবা। তুমি যখন চাইছ, তখন তুমি আজ রাতটা এই গরীব কাকুর বাড়িতে থেকে যাও। আগামীকাল সকালে আমি নিজে তোমাকে তোমার পিসির কাছে নিয়ে যাব”।

পরিতোষ ব্যগ্রভাবে বলল, “কাকু, এতদিন জানতাম যে আমার আপন বলতে এ পৃথিবীতে আর কেউ বেঁচে নেই। তাই নিজেকে একেবারে অনাথ বলে ধরে নিয়েই নিশ্চিন্ত ছিলাম। এখন আমার পিসি আছেন শুনতে পেয়ে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। তবে আমি আপনাকে এখনই সেখানে যেতে বাধ্য করতে চাই না। আপনি আমার পিসি আর পিসেমশাইয়ের নাম আর ঠিকানাটা আমাকে একটু বলে দিন। আমি আজই আলিপুরদুয়ার গিয়ে তার সাথে দেখা করতে চাই। আমার মনে হয় এখান থেকে সেখানে যেতে খুব বেশী সময় লাগবে না। যদি আমি ফিরে আসবার জন্য কোনও বাস, ট্রেন কিংবা ট্যাক্সি পেয়ে যাই, তাহলে রাতেই এখানে ফিরে আসব”।

বিধুবাবু পরিতোষের কথা শুনে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “বুঝতে পারছি বাবা। তুমি আর তর সইতে পারছ না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। রক্তের টান বুঝি একেই বলে। কিন্তু আজ তো আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না বাবা। তবে তুমি যদি আজই যেতে চাও, তাহলে তোমায় নাহয় তাদের নাম ঠিকানা লিখে দিচ্ছি” বলে কিংশুকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “খোকা আমাকে একটা কাগজ কলম দে তো”।

পরিতোষ সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলল, “কাকু আপনি বলুন। আমি আমার মোবাইলে লিখে নিচ্ছি”।

বিধুবাবু বললেন, “আচ্ছা, লিখে নাও তাহলে। তোমার পিসির নাম হচ্ছে শ্রীমতী হৈমবতী মন্ডল। আর তোমার পিসেমশাইয়ের নাম হচ্ছে শ্রীযুক্ত নিরঞ্জন মন্ডল। আলিপুরদুয়ার জংশন থেকে দক্ষিণ দিকে প্রায় মাইল খানেক যাবার পরেই একটা বড় তেপথী দেখতে পাবে। সেখানে পৌঁছে যে কাউকে নিরুবাবুর দোকানের কথা শুধোলেই তারা তোমাকে তোমার পিসেমশাইয়ের দোকান দেখিয়ে দেবে। দোকানের ঠিক পেছনেই তাদের পাঁচতলা উঁচু বাড়ি। দোকানটার নাম মণ্ডল হোলসেলার্স। আশা করি তোমার খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হবে না। তবে বাবা, এর মধ্যে একটা কথা আছে। তারা কিন্তু অচেনা অজানা লোকদের চট করেই বিশ্বাস করেন না। অবশ্য তার যথাযথ কারনও আছে” বলে একটু থেমে কিছু একটা ভেবে বললেন, “আচ্ছা দাঁড়াও। আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি চট করে। তুমি বরং সেটা সঙ্গে নিয়ে যাও। যদি তারা তোমার মুখের কথায় আশ্বস্ত না হন তাহলে দোকানের গদিতে যে বসে থাকবে তার হাতেই এ চিঠিটা দিও। আর বোলো আমিই তোমায় সেখানে পাঠিয়েছি। আমার মনে হয় আমার চিঠিটা পেলে তারা নিশ্চয়ই তোমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যাবেন। আর তোমার মনের ইচ্ছেও পূর্ণ হবে” বলে আবার কিংশুককে উদ্দেশ্য করে বললেন, “কইরে খোকা, যা একটা কাগজ কলম এনে দে আমাকে। তাড়াতাড়ি চিঠিটা লিখে দিলে ও যদি এখনই বেরিয়ে পরে তাহলে আড়াইটের ট্রেনটা হয়ত ধরতে পারবে”।

কিংশুক কাগজ কলম আনতেই বিধুবাবু নিরঞ্জন মণ্ডলের নামে একটা চিঠি লিখে দিলেন। এ চিঠি নিয়ে কে তার কাছে যাচ্ছে, তা-ও বিশদে বর্ণনা করে লিখলেন। তার তোষকের তলা থেকে একটা খাম বের করে চিঠিটা তাতে পুড়ে দিতে দিতে পরিতোষকে বললেন, “আমি জানি, হিমুদি তোমাকে খুব আদর যত্ন করবেন। তাই আমার মনে হয়না তুমি আজ ফিরতে পারবে। কিন্তু বাবা, আজ হোক বা কাল হোক, তুমি কিন্তু সেখান থেকেই সরাসরি কলকাতা চলে যেও না। আসলে আজ সকালে যখন রচু তোমার এখানে আসবার খবরটা দিয়েছিল, তার পর আমি আর বাজারে যেতে পারিনি। তাই তোমার কাকিমাও তোমার জন্য খুব একটা আয়োজন করতে পারেন নি। তোমার পিসির ওখান থেকে বেরিয়ে তুমি কিন্তু অবশ্যই আবার এখানে আসবে। তোমাকে একটু ভালমন্দ খাওয়াতে না পারলে যে আমি খুব দুঃখ পাব বাবা। আর পরলোকে দুর্গাও আমাকে নিন্দেমন্দ করবে। তাই আমার এ অনুরোধটুকু তুমি রেখ বাবা”।
 

বিধুবাবু চিঠি লিখতে লিখতেই পরিতোষ নিজের পোশাক পরিবর্তন করে বেরোবার জন্য তৈরী হয়ে গিয়েছিল। বিধুবাবুর হাত থেকে চিঠিটা নিতে নিতে বলল, “আমি কথা দিচ্ছি, অবশ্যই আসব কাকু। আজ আমার কত সৌভাগ্যের দিন। বাবার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর খোঁজ পেলাম। আর ঘন্টা খানেক বাদেই হয়ত এমন আরেকজনের দেখা পেতে চলেছি যে কিনা আমার বাবার রক্তের সম্পর্কের আপন দিদি। আর এখানে না এলে, এ’সব কি আমার কপালে জুটত বলুন। তাই আলিপুরদুয়ার থেকে আমি অবশ্যই এখানে আসব” বলে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করল।


*****************

বিধুবাবু কিংশুককে পরিতোষের সাথে ষ্টেশন অব্দি পাঠাতে চাইলেন। কিন্তু পরিতোষই তাতে বারণ করে একাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। বিকেল তিনটে বাজবার পাঁচ মিনিট আগেই ট্রেন আলিপুরদুয়ার জংশনে পৌঁছে গেল। ষ্টেশন চত্ত্বর থেকে বেরিয়েই সামনের একটা হোটেলে জিজ্ঞেস করে অটো স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গেল। অটোতে যেতে যেতেই সে সীমন্তিনীকে ফোন করবে ভেবেও করল না। তার মনে পড়ল এ সময়ে সীমন্তিনী আর নবনীতা দুজনেই তাদের কাজে ব্যস্ত থাকবে। তাই সে শুধু সীমন্তিনীর ফোনে একটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল যে ব্যক্তিগত জরুরী একটা কাজে সে আলিপুরদুয়ার এসেছে। আজ কালচিনি ফেরা সম্ভব হবে কিনা সে জানে না।

দশ মিনিট বাদেই তেপথীর মোড়ে সে অটো থেকে নামল। তারপর রাস্তার ধারে একটা পানের দোকানে জিজ্ঞেস করতেই দোকানী তাকে রাস্তা চিনিয়ে দিল। মণ্ডল হোলসেলার্সের বিশাল দোকানটার সামনে এসে দেখল পেছনেই পাঁচতলা উঁচু একটা সুন্দর বিল্ডিং। দুরু দুরু বুকে সে দোকানটার ভেতর গিয়ে ঢুকল। প্রথমেই একটা কাউন্টার দেখতে পেল, যেখানে পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সী একজন লোক বসে খদ্দেরদের সাথে লেনদেনের হিসাব করছিল। পরিতোষ তার কাছে গিয়ে বলল, “আচ্ছা, বলছি নিরঞ্জনবাবু কি এখানে আছেন? আমি কালচিনি থেকে আসছি। বিধুভূষণ চক্রবর্তী আমায় পাঠিয়েছেন”।

লোকটা তার ব্যস্ততার মাঝেও মুখ তুলে তার দিকে চেয়ে বলল, “ও কালচিনির বিধুমামু আপনাকে পাঠিয়েছেন? কিন্তু তার মাল তো আমরা গতকালই পাঠিয়ে দিয়েছি। তিনি কি পাননি”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “না আমাকে উনি সে জন্যে পাঠান নি। একটা অন্য কাজে পাঠিয়েছেন। আসলে উনি নিরঞ্জন বাবুর নামে একটা চিঠি লিখে দিয়েছেন। আর চিঠিটা নিরঞ্জন বাবুর হাতেই দিতে বলেছেন”।

লোকটা এবার আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও আচ্ছা” বলে দোকানের ভেতর দিকে মুখ করে কাউকে ডাকল, “এই বলাইদা, একটু এদিকে এসো তো”।

বলাই নামের মাঝ বয়সী একটা লোক কাউন্টারের পেছনে এসে দাঁড়াতেই কাউন্টারের লোকটা তাকে বলল, “এ বাবুকে ভেতরের গদিতে বাবার কাছে নিয়ে যাও তো”।

‘বাবা’ শব্দটা শুনেই পরিতোষ একটু চমকে গেল, এ লোকটা তাহলে তার পিসতুতো ভাই!? কিন্তু সে কিছু বলে ওঠবার আগেই বলাই তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনি ওদিক দিয়ে ঘুরে আসুন বাবু” বলে দোকানের একপাশ দিয়ে একটা সরু করিডোরের মত জায়গা দেখিয়ে দিল।

বলাইয়ের পেছন পেছন কয়েক সেকেণ্ড যাবার পর একটা ঘরের দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে বলাই জিজ্ঞেস করল, “আপনার নামটা বলুন বাবু। বাবুকে সেটা বলতে হবে”।

পরিতোষ বলল, “আমার নাম বললে উনি আমাকে চিনবেন না। আপনি গিয়ে বলুন যে কালচিনির বিধূ ভূষণ চক্রবর্তী তার লেখা একটা চিঠি আমার হাতে পাঠিয়েছেন। আমি সেটা দিতেই এখানে এসেছি”।

লোকটা একবার পরিতোষের আপাদমস্তক ভাল করে দেখে ভেতরে ঢুকে গেল। আর মিনিট খানেক বাদেই আবার দড়জা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আসুন আপনি”।

পরিতোষ নিজের ব্যাগটা কাঁধের সাথে ভাল করে চেপে ধরে ঘরের ভেতর ঢুকল। ভেতরে বেশ বড়সড় একটা সাদা কাপড়ে মোড়া গদিতে ধুতী গেঞ্জী পড়া বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারার এক বৃদ্ধ আধা শোয়া হয়ে বসে আছেন। বয়স নির্ঘাত সত্তরের ওপরেই হবে বলে মনে হল পরিতোষের। গদিতে তার উল্টোদিকে দু’জন মাঝ বয়সী লোক ব্যবসায়িক কথাবার্তায় ব্যস্ত। পরিতোষকে ভেতরে ঢুকতে দেখে বয়স্ক ভদ্রলোক তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললেন, “বিধুর চিঠি নিয়ে তুমিই এসেছ? তা সে কেমন আছে? সুস্থ আছে তো”?

পরিতোষ নিজের বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করতে করতে বলল, “হ্যাঁ, উনি ভাল আছেন। বিশেষ একটা ব্যাপারেই তিনি আমাকে এ চিঠিটা দিয়ে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক চিনি না। আপনিই নিরঞ্জন মণ্ডল তো? আসলে কাকু বলে দিয়েছেন যে এ চিঠিটা আমি যেন নিরঞ্জন বাবু ছাড়া আর কারো হাতে না দিই”।

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিই নিরঞ্জন মণ্ডল। তোমাকে ‘তুমি’ করে বললাম বলে কিছু মনে কোর না। আসলে তুমি তো আমার ছেলেদের বয়সীই”।

পরিতোষ হেসে বলল, “না না, এতে মনে করবার কি আছে? এই নিন” বলে দুরুদুরু বুকে চিঠিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিল। নিরঞ্জনবাবু চিঠিটা হাতে নিয়ে ওপরে তার নাম ঠিকানা লেখাটা দেখে খামটা খুলতে খুলতেও থেমে গিয়ে পরিতোষের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বলাইকে বলল, “এই হারামজাদা, এ বাবু যে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছেন দেখতে পাচ্ছিস না? একটা চেয়ার দে তাকে বসবার। এমন স্যুট বুট পড়া লোক কি গদিতে পা ভাঁজ করে বসতে পারে কখনও? তোদের আক্কেল পছন্দ আর কবে হবে বল দেখি”।

পরিতোষ ‘না না লাগবে না’ বললেও বলাই তড়িঘড়ি তার জন্যে চেয়ার পেতে দিল। পরিতোষের বুকটা এক অজানা আশঙ্কায় যেন কাঁপতে শুরু করল। চেয়ারে বসে বসে ভাবতে লাগল, এ চিঠি পড়ে তার এই পিসেমশাই নাজানি কিভাবে রিয়েক্ট করেন। দেখে তো মনে হচ্ছে, বেশ মেজাজী মানুষ। কিন্তু নিরঞ্জনবাবু চিঠিটা খুলে কয়েক সেকেণ্ড বাদেই আধ শোয়া অবস্থা থেকে উঠে সোজা হয়ে বসে অবাক দৃষ্টিতে অনেক ক্ষণ পরিতোষের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর আবার চিঠির বাকি অংশ পড়তে লাগলেন। এক সময় তার চিঠি পড়া শেষ হলে তিনি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলেন। তারপর মুখ তুলে তার সামনে বসা ওই লোক দুটোকে ভারী গলায় বললেন, “যাদব, সুকুমার, তোমাদের সঙ্গে আজ আর কথা বলতে পারছি না আমি। একটা ভীষণ জরুরী কাজ এসে পড়েছে আমার হাতে। তোমরা বরং কাল বা পরশু যখন খুশী এসো”।

লোকদুটো চলে যেতে নিরঞ্জন বাবু এবার বলাইকে বললেন, “তুইও গিয়ে ছোটবাবুকে বল আমি তাকে ডাকছি একটা বিশেষ কাজে। এক্ষুনি যেন এখানে চলে আসে” বলতে বলতে উঠে দাঁড়ালেন। পেছনে হ্যাঙ্গারে টানানো একটা পাঞ্জাবী পড়তে পড়তে অবিশ্বাস্য নরম গলায় পরিতোষকে বলেলন, “পরিতোষ, বাড়ির ভেতরে যাবার আগে, তোমার পা থেকে জুতোটা খুলে একটু এখানে এই গদীর ওপরে উঠে আসবে বাবা”?

একটু আগে যে ভদ্রলোককে পরিতোষের খুব মেজাজী বলে মনে হচ্ছিল হঠাতই তার গলায় এমন স্নেহমাখা সুর শুনে পরিতোষ মনে মনে অবাক হল। তার কথার অর্থ বুঝতে না পারলেও নিজের পা থেকে জুতো দুটো খুলে ফেলল। তারপর গদির ওপর উঠে দাঁড়াতেই নিরঞ্জনবাবু তার হাত ধরে তার গদির একটা কোনার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন। দেয়ালে টাঙানো একটা ছবির দিকে ঈশারা করে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এনাকে তুমি চেনো নিশ্চয়ই”?

পরিতোষ অবাক হয়ে দেখল দেয়ালে তার ঠাকুর্দার ছবি টাঙানো। সুন্দর ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবিটা। সুন্দর টাটকা জুই ফুলের মালা ঝুলছে ছবিটায়। পরিতোষ প্রায় ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “এ তো আমার ঠাকুর্দা কালীচরন সান্যালের ছবি”!

নিরঞ্জনবাবু হাতজোড় করে ছবিটাকে প্রণাম করে বললেন, “হ্যাঁ, ঠিক চিনেছ বাবা তুমি। ইনি তোমার ঠাকুর্দাই। আর আমার শ্বশুরমশাই। তোমার পিসি খুব ছোট থাকতেই আমি তাকে ভালবেসে ফেলেছিলুম। বেশ কয়েকবছর বাদে সে আমার ভালবাসা স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু আমি নিচু জাতের কায়স্থের ছেলে বলেই তোমার ঠাকুর্দা আমাকে নিজের জামাই হিসেবে স্বীকার করতে রাজি হননি। কিন্তু আমরা দু’জন তো দু’জনকে পরস্পরের জীবন মরণের সঙ্গী করে ফেলেছি ততদিনে। তাই নিরূপায় হয়ে তোমার পিসি ম্যাট্রিক পাশ করবার পরেই আমি তাকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাই। তখন আমরা কুমারগ্রামে থাকতাম। এই আলিপুরদুয়ারে এসেই ছিন্নমস্তা কালী মন্দিরে আমরা বিয়ে করেছিলুম। তিনদিন বাদে কুমারগ্রাম ফিরে গিয়ে আমাদের বাড়িতে উঠেছিলুম। আর সেদিনই তোমার পিসিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলুম। কিন্তু তিনি আমাদের তার বাড়িতে ঢুকতেও দেননি। বলেছিলেন যে তার মেয়ে তিনদিন আগেই মারা গেছে। তার আর কোনও মেয়েও নেই আর মেয়ে জামাইও নেই। হিমু, মানে তোমার পিসি, সেদিন খুব কেঁদেছিল। তাকে সান্ত্বনা দেবার ভাষাও আমি খুঁজে পাচ্ছিলুম না। তোমার পিসিকে নিয়ে যখন আবার নিজেদের বাড়ির দিকে ফিরছিলুম তখন পথে তোমার বাবা দুর্গার সাথে দেখা হয়েছিল। ও তখন খুব ছোট। দশ এগার বছরের বাচ্চা একটা ছেলে। দিদিকে ভীষণ ভালবাসতো। তিনদিন বাদে দিদিকে দেখে সে আমাদের কাছে ছুটে এসেছিল। কিন্তু কাছে এসে তার দিদিকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েই সে থমকে গিয়েছিল। হয়ত বাবার নিষেধাজ্ঞা মনে পড়ে গিয়েছিল তার। সেদিনকার ওই মূহুর্তের দৃশ্যটা আজও আমার চোখের সামনে ভাসছে পরিতোষ। দুর্গা তার দিদির খুব কাছে এসেও দু’পা পিছিয়ে গিয়ে মাটি ছুঁয়ে তার দিদিকে প্রণাম করে এক ছুটে বাড়ির দিকে চলে গিয়েছিল। একটা কথাও মুখ ফুটে বলেনি। তখন তোমার পিসি স্থান কাল ভুলে রাস্তার মাঝেই হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করেছিল। অনেক কষ্টে তাকে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম। আমাদের বিয়ের দু’মাস বাদেই নিজেদের ভিটে জমি বিক্রী করে শ্বশুরমশাই তোমার ঠাকুমা আর বাবাকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর থেকে তোমার পিসিকে শুধু কাঁদতেই দেখেছি। ও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। প্রায় পাগলের মত আচরণ করতে শুরু করেছিল। তারপর প্রায় ছ’মাস ডাক্তারের চিকিৎসা আর আমাদের বাড়ির লোকজনদের পরিচর্যায় ও কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। তারপর নিজের ভবিতব্যকেই মেনে নিয়েছিল। তবে আমি বা তোমার পিসি কেউই কিন্তু তোমার ঠাকুর্দা, ঠাকুমা বা বাবাকে কোনও রকম দোষারোপ করিনি কোনদিন। বরং তাদের মনে দুঃখ দেবার জন্য আমরা আজও নিজেদের অপরাধী বলেই ভাবি। এখনও রোজ সকালে গদিতে এসে আমি শ্বশুর মশাইয়ের এ ছবিটায় নিজের হাতে মালা পড়াই। হাতজোড় করে তার কাছে প্রার্থনা করি, আমাদের দু’জনকে ক্ষমা করে দিতে”।

পরিতোষও হাতজোড় করে তার ঠাকুর্দার ছবিকে প্রণাম করে নিরঞ্জনবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই নিরঞ্জনবাবু হা হা করে উঠে বললেন, “এ কী করলে বাবা? তোমরা ',। আমি কায়স্থ। আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করাটা তোমার উচিৎ হয়নি বাবা”।

পরিতোষ শান্ত গলায় জবাব দিল, “আমি ও’সব জাতপাতে আর ধর্মের গোড়ামিতে বিশ্বাস করিনা পিসেমশাই। আমি বিশ্বাস করি শুধু মানুষে। আপনি আমার গুরুজন। আমার নমস্য। তাই আপনাকে আমি প্রণাম করতেই পারি”।

নিরঞ্জনবাবু আবার তার শ্বশুরের ছবিকে প্রণাম করে বললেন, “এতোদিনে আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হল বাবা। এতদিনে আপনার জামাই হবার স্বীকৃতি পেলাম আমি” বলে পরিতোষের দিকে তাকিয়ে বলল, “জানো পরিতোষ, প্রায় দেড় দু’মাস আগে বিধু যখন আমাদের এখানে প্রথম খরিদ্দারী করতে এসেছিল, তখন আমি তাকে তোমার পিসির কাছে নিয়ে গিয়েছিলুম। তোমার পিসি তখন ভেবেছিল যে বিধু নয় তার নিজের ছোটভাই দুর্গাই বুঝি তার কাছে ফিরে এসেছে। বিধুর হাতদুটো ধরে সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। তার কাছে আমরা তোমার বাবা, ঠাকুমা আর ঠাকুর্দার ব্যাপারে জানতে চাইছিলুম। কিন্তু সে-ও তখন বলেছিল যে সে কিছু জানে না। আজ এতদিন পর মনে হচ্ছে বাবা আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। হয়ত এ আমার আর তোমার পিসির রোজকার প্রার্থনারই ফল। বাবা নিশ্চয়ই আমাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন এতদিনে। নইলে এতগুলো বছর পর তুমি এভাবে আমাদের কাছে এসে পৌঁছাতে না কিছুতেই” বলতে বলতে তার গলার স্বর রুদ্ধ হয়ে গেল।
 

পরিতোষকে দু’হাতে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে নিরঞ্জনবাবু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। পরিতোষের ভেতর থেকেও প্রচণ্ড একটা কান্নার আবেগ ধেয়ে আসতে চাইছিল যেন। বৃদ্ধ নিরঞ্জনবাবুকে সে-ও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নিজের কান্না প্রশমিত করবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। আর ঠিক অমন সময়েই তাদের পেছন থেকে কেউ একজন ‘বাবা’ বলে ডেকে উঠতেই তারা একে অপরের হাতের বাঁধন থেকে মুক্ত হল। নিরঞ্জনবাবু নিজের ধুতির খুট দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলেন। আর পরিতোষ পেছনে তাকিয়ে দেখে খানিক আগে দোকানের সামনের কাউন্টারে যে ভদ্রলোক বসে ছিলেন তিনি এই গদিঘরে এসে পৌঁছেছেন। নিজের বাবাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে লোকটা উদ্বিঘ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন তুমি? ইনি কে”?
 

নিরঞ্জনবাবু চোখে জল থাকা অবস্থাতেও মুখে হাসি এনে তার ছেলের কথার জবাবে বললেন, “অমু, এ তোর ভাই রে। তোর মামাতো ভাই। তোর নিজের মামার ছেলে, পরিতোষ। কলকাতায় থাকে রে। পুলিশের মস্ত বড় অফিসার একজন” বলে পরিতোষকে বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই দোকানে ঢোকবার সময়ই ওকে দেখেছ। ও অমলেন্দু, তোমার পিসির ছোট ছেলে”।

পরিতোষ গদি থেকে নেমে অমলেন্দুর পায়ে হাত দিতে যেতেই অমলেন্দু তার দুটো হাত ধরে বলল, “আরে এ কী করছেন আপনি? না না প্রণাম করতে হবে না”।

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “জীবনে আজ প্রথম আমি এক দাদাকে দেখবার সুযোগ পেলাম। ছোট ভাই হয়ে দাদাকে কি একটা প্রণাম করতে পারিনা আমি”?
 

অমলেন্দু পরিতোষের হাত ধরে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাদের জন্মের আগেই দাদু, দিদিমা আর মামা মা-বাবার সাথে তাদের সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা ভাইবোনেরা ছোটবেলা থেকে শুধু ছবিতেই তাদের দেখেছি। বড় হয়ে ওঠার পর যখন বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই আমরা তিনভাই দু’বোন নানাভাবে নানাদিকে দাদু, দিদিমা আর মামাকে খুঁজেছি। কিন্তু কোথাও তাদের হদিশ পাই নি। মাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে রোজ কাঁদতে দেখেছি আমরা। ভগবান আজ আমাদের দিকে তার সদয় দৃষ্টি দিয়েছেন। তা ভাই, আমাদের দাদু, দিদিমা আর মামা এরা সবাই কে কেমন আছেন? কোথায় আছেন তারা সবাই”?

______________________________
Like Reply
(Update No. 230)

পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “দাদা, তারা কেউই আর এ পৃথিবীতে বেঁচে নেই। সবার আগে আমার মা, মানে আপনাদের মামী, আর তারপর ঠাকুমা, ঠাকুর্দা আমার ছোটবেলাতেই আমাদের ছেড়ে একে একে স্বর্গে চলে গেছেন। আর বাবা গেলেন সাত বছর আগে, ২০০৫এ। তখন থেকেই আমি পুরোপুরি অনাথ হয়ে গেছি”।

অমলেন্দু আর নিরঞ্জনবাবু দু’জনেই হায় হায় করে উঠলেন এ কথা শুনে। নিরঞ্জনবাবু তার শ্বশুরের ছবির নিচেই হাঁটু মুড়ে বসে গদিতে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করে কাঁদতে লাগলেন। আর অমলেন্দুও নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “এতদিন কোন খোঁজ না পেলেও, দাদু যে এতদিনে এ সংসারের মায়া ছেড়ে চলেই গেছেন, এটা আমরা ধরেই নিয়েছিলুম ভাই। তবে মনের কোনায় একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে দিদিমা হয়ত এখনও বেঁচে আছেন। আর মামা মামী তো এত তাড়াতাড়ি চলে যাবার কথাই নয়। কিন্তু এমনই ভাগ্য আমাদের, কাউকেই আর আমরা দেখতে পেলুম না”!
 

পরিতোষ কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। নিরঞ্জনবাবু এবার নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করতে করতে বললেন, “হে ভগবান। এ দিনটা দেখার ছিল বলেই কি এখনও আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছ”?

অমলেন্দুকে ডাকতে দোকানের ওদিক থেকে আরও একজন আসতেই অমলেন্দু তাকে বলল, “এই শোন, তোরা নিজেরাই ওদিকে সামাল দে এখন। আমি আর বাবা এখন খুব জরুরী একটা কাজে ব্যস্ত আছি। তোরা কেউ আমাদের ডিসটার্ব করিস না। আমরা না ডাকলে তোরা কেউ এখানে আসিস না। আর শোন, কাউন্টার থেকে এক্ষুনি আমার মোবাইলটা এনে দিয়ে যা”।
 

পরিতোষ কি করবে না করবে ভেবে পাচ্ছিল না যেন। নিরঞ্জনবাবু দেয়ালে হেলান দিয়ে গদীতে বসেই পরিতোষের হাত ধরে তার কাছে টেনে নিল। পরিতোষও কোন কথা না বলে নিরঞ্জনবাবুর পাশে বসে পড়ল। আর অমলেন্দু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে থাকল। খানিক বাদে দোকানের একজন কর্মচারী এসে অমলেন্দুর হাতে তার মোবাইলটা দিয়ে যেতেই অমলেন্দু একজনকে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই অমলেন্দু বলল, “বড়দা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি চলে আয়। আমি আর বাবা নিচে গদিতে আছি। সেখানেই আসিস” তারপর আরেকটু সময় চুপ করে ও’দিকের কথা শুনে বলল, “নারে বড়দা, একদম দেরী করিস না। আমি মেজদাকেও ফোন করে তাকে আসতে বলছি। তুই যত তাড়াতাড়ি পারিস চলে আয় প্লীজ। নইলে একটা বড় সমস্যা দেখা দিতে পারে”।
 

তারপর ফোন কেটে আরও একজনকে ফোন করে একই কথা বলল। তার কথাতেই পরিতোষ বুঝতে পারল যে অমলেন্দু তার মেজদা আর বড়দার সাথেই কথা বলল। কিন্তু ‘সমস্যা দেখা দিতে পারে’ কথাটা শুনেই সে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। সে ভাবতে লাগল, সে এভাবে এদের কাছে এসে পড়াতেই কি কোনও সমস্যার উৎপত্তি হল? কিন্তু সে তো কোনও সমস্যা সৃষ্টি করবার জন্যে এখানে আসেনি। সে তো শুধু তার পিসিকে একটু চোখের দেখা দেখতেই এসেছে।
 

অমলেন্দুর ফোনে কথা বলা শেষ হতেই পরিতোষ দ্বিধাজড়িত কন্ঠে বলল, “দাদা, আমি এভাবে হুট করে এসে পড়ায় আপনারা যদি কোনও ভাবে বিব্রত হয়ে থাকেন, বা আমি যদি এসে আপনাদের কোনও সমস্যার সৃষ্টি করে ফেলি, তাহলে আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি আপনাদের কাউকেই কোনও সমস্যায় ফেলবার উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসিনি। আমি শুধু আমার পিসিকে একটিবার চোখে দেখব বলেই কিন্তু এসেছি। অন্য কোনও উদ্দেশ্যই আমার নেই”।

নিরঞ্জনবাবু পরিতোষের হাতটা বেশ শক্ত করে ধরে বললেন, “এ তুমি কি বলছ বাবা পরিতোষ। আজ তোমাকে পেয়ে আমরা যে কী পরিমাণ খুশী হয়েছি, সেটা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না আমরা। কিন্তু বাবা, অমু যেমনটা ভাবছে তেমন সমস্যা একটা আছে অবশ্যই। তবে সেটা সমস্যা না বলে আপাততঃ সেটাকে আমাদের একটা দুশ্চিন্তা বলেই ধরে নিতে পার। তবে সে দুশ্চিন্তার কারন তুমি নও বাবা”।

এবার অমলেন্দুও পরিতোষের পাশে বসেই তার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, আমি প্রথমেই তোমাকে একটা কথা বলে দিচ্ছি। নিজের দাদাকে কেউ আপনি আজ্ঞে করে কথা বললে সেটা খুব খারাপ শোনায়। তাই তুমি আমাকে ‘তুই’ বা ‘তুমি’ করে বোলো। আমাদের তিন ভাই আর দু’বোনের মধ্যে আমিই সবচেয়ে ছোট। তাই আমাকে দাদা বা ছোড়দা বলে ডাকবার মত কেউ এতদিন ছিল না। এবার আমিও একটা ভাই পেয়ে গেলুম। তুমি আমাকে কিন্তু ছোড়দা বলে ডাকবে ভাই” বলে একটু থেমে বলল, “আর ফোনে আমি বড়দা আর মেজদাকে খুব তাড়াতাড়ি এখানে আসতে বলেছি, সেটা তো তুমি বুঝতেই পেরেছ। দাদারা দু’জনেও ব্যবসাই করেন। বড়দা রোডওয়েজের ব্যবসা করেন আর মেজদার মেডিক্যাল স্টোর। তারা মনে হয় পনের কুড়ি মিনিটের ভেতরেই এখানে এসে পৌঁছে যাবেন। আমি চাইছি ততক্ষণ আমরা এখানেই থাকব। দাদারা এলেই আমরা বাড়ির ভেতরে যাব। কিন্তু যে সমস্যার কথা বলেছি, সে সমস্যা কিন্তু তুমি একেবারেই নও ভাই। সে সমস্যাটা আমাদের মাকে নিয়ে, মানে তোমার পিসিকে নিয়ে। আচ্ছা ভাই, আমাদের মাকে তো তুমি এই প্রথম দেখবে। মা বাবার মুখে যতটুকু শুনেছি, তাতে মনে হয় তুমি তোমার পিসির কোনও ছবিও হয়ত কোনদিন দেখনি। কিন্তু তোমার পিসির সম্বন্ধে তোমার মনে কিছু একটা ধারণা তো আছেই। হতে পারে তার সম্বন্ধে তুমি মনে মনে কিছু একটা ভেবেছ। তাকে দেখতে কেমন হবে বা তার শরীর স্বাস্থ্য কেমন হবে, এইসব”।

পরিতোষ মাথা নিচু করে বলল, “ছোড়দা, ছোটবেলা থেকে আমি শুধু এ’টুকুই জানতাম যে আসাম আর ভূটান সীমান্তের কাছাকাছি কোনও একটা গ্রামে আমার এক পিসি আছেন, যিনি আমার বাবার চাইতে বয়সে বড়। তিনি তার পছন্দের একজন কায়স্থ ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই ঠাকুর্দা ঠাকুমা তাকে চিরতরে পরিত্যাগ করে কলকাতা চলে গিয়েছিলেন। শুনেছি বাবাও তখন খুব ছোট ছিলেন। কলেজে ক্লাস সিক্সে পড়তেন। তাই পিসির বিয়ে মেনে নেওয়া বা না নেওয়ার ব্যাপারে বাবার মতামতের নিশ্চয়ই তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু ঠাকুর্দা মারা যাবার সময় বাবাকে দিয়ে শপথ করিয়ে নিয়েছিলেন যে বাবা যেন কোনদিন তার দিদির নাম মুখে না আনেন। তাই বাবার মুখে শুধু ওইটুকুই শুনেছি। এর বেশী কিছু আমি আজ সকাল অব্দিও জানতুম না। তবে বাবা যে তার দিদিকে খুব ভালবাসতেন সেটা তার কথা থেকেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম। ঘটণাচক্রে আজ সকালে আমি কালচিনি গিয়েছিলাম কাকুর বাড়িতে। তখন আমি এটাও জানতাম না যে তিনিই আমার বাবার বন্ধু। কিন্তু গতকাল নাগরাকাটায় আমার এক বন্ধুর বাড়িতে তার নামটা শোনবার পর থেকেই আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল বিধু নামটা আমি বোধহয় বাবার মুখেই কখনও কখনও শুনেছি। আর তাছাড়া বিধুকাকুর ছোট মেয়ে তার স্বামীর সাথে কলকাতাতেই থাকে। আর তাদের সাথে আমার ভাল পরিচয়ও আছে। ওই মেয়েটাকে আমি আমার বোনের মত স্নেহ করি। সে-ও বারবার করে বলেছিল, কলকাতা ফেরবার আগে আমি যেন কালচিনি গিয়ে তার মা বাবার সাথে অবশ্যই দেখা করে যাই। তাই আমি আজ সকালেই কালচিনি গিয়েছিলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে কাকু কাকিমার সাথে গল্প করবার সময় হঠাতই কথায় কথায় জানতে পারলাম যে উনি আর বাবা তাদের ছোটবেলায় অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ছিলেন। আর তখনই তার কাছেই জানতে পারলাম যে আমার পিসি এখানে আছেন, ভাল আছেন। গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে পুরোপুরি অনাথ ভেবে কাটাবার পর যে মূহুর্তে জানতে পারলাম যে আমি অতটা অভাগা নই, আমার রক্তের সম্পর্কের একজন পিসি আছেন, তখন আর একটা মুহুর্তও আমি নষ্ট করিনি। কাকু বলছিলেন উনি কাল সকালে নিজেই আমাকে নিয়ে এখানে আসবেন। কিন্তু আমার মনটা ছটফট করছিল এখানে আসবার জন্যে। আমার আর তর সইছিল না দেখে উনি তড়িঘড়ি ওই চিঠিটা লিখে দিয়েছিলেন পিসেমশাইয়ের নামে। আমিও দেরী না করে আড়াইটের ট্রেন ধরে এখানে চলে এসেছি”।

পরিতোষের সব কথা শুনে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “দেখেছিস অমু! একেই বলে প্রদীপের তলায় অন্ধকার। নইলে মাস খানেক আগেই তো বিধুর সাথে আবার আমাদের দেখা হয়েছিল। তখন কি আর জানতুম যে গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমরা হন্যে হয়ে যাদের খুঁজছি তাদের হদিশ আছে বিধুর ছোটমেয়ের কাছে! বিধুর ছোটমেয়ে তোর মামাতো ভাইকে দাদা বলে ডাকে? বিধুও জানতনা যে তার ছোট মেয়ে তার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর ছেলেকে আগেই খুঁজে পেয়েছে”।
 

অমলেন্দুও তার বাবার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু বাবা, মাকে এখন সামলাবে কি করে বলো তো? দাদু, দিদিমা, মামা কেউ বেঁচে নেই শুনে আমরাই তো আমাদের কান্না সামলাতে পারছি না। তার কী অবস্থা হতে পারে”?

নিরঞ্জনবাবুও চিন্তিত মুখে বললেন, “আমিও তো সেটাই ভাবছি রে অমু। গত সপ্তাহেই তো ডাক্তার চেকআপ করে বলল যে প্রেসারটা নাকি একটু বেড়েছে। আজ নিজের ভাইপোকে দেখে সে যতটা খুশী হবে, ঠিক ততটাই দুঃখ পাবে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে। এ ধাক্কাটা সে সইতে পারবে কিনা বুঝতে পারছি না। তুই এক কাজ কর তো। ডাক্তার বিশ্বাসকে ফোন করে দেখ তো সে এখন আসতে পারবে কি না”।

অমলেন্দু বলল, “হ্যাঁ বাবা, দেখছি” বলে ভেতরের দিকে কোথাও চলে গেল।
 

পরিতোষ পিসির প্রেসারের খবর শুনে চিন্তিত স্বরে নিরঞ্জনবাবুকে বলল, “পিসেমশাই, পিসির প্রেসার বেড়েছে? না না, এ অবস্থায় তাকে তার বাবা মা ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ জানানো একেবারেই ঠিক হবে না। আমার বাবাও তো স্ট্রোকেই মারা গেছেন। তবে সেটা কিভাবে হয়েছিল জানিনা। তাকে শেষ দেখাটুকু দেখবার সৌভাগ্যও হয়নি আমার। আমি তখন সবে আইপিএস পাশ করে হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ ছিলাম। না না, পিসেমশাই, পিসিকে এখন কিছু জানাবার দরকার নেই। আর আমি যে এখানে এসেছিলাম, এ কথাও তাকে জানাবার দরকার নেই এখন
আপনারা দয়া করে আমাকে শুধু একটু সুযোগ করে দিন। আমি যেন দুর থেকে পিসিকে একটুখানি দেখতে পারি। তাহলেই আমার মনের ইচ্ছে পূর্ণ হবে। আমি তাকে একটু সময় দেখেই, দুর থেকে তাকে প্রণাম করেই এখান থেকে চলে যাব”।

নিরঞ্জনবাবু ম্লান হেসে বললেন, “তাই কি হয় বাবা? এতদিন বাদে যে আমরা তোমাকে পেয়েছি, এটাই কি কম সৌভাগ্যের কথা আমাদের কাছে? কিন্তু স্বার্থপরের মত আমরাই সে সৌভাগ্য উপভোগ করব, আর যার সাথে তোমার রক্তের সম্পর্ক সেই মহিলাই এ সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত থেকে যাবেন, এটা তো আমরা কেউই মেনে নিতে পারব না বাবা। তুমি একটু ধৈর্য ধরে বোসো। একটা না একটা উপায় ঠিকই বের হয়ে আসবে। তোমার অন্য দুই দাদা আসুক, ডাক্তার আসুক, তারপর সবাই মিলে ভাবলে একটা রাস্তা ঠিক পেয়ে যাব আমরা। কিন্তু বাবা, তুমি অন্য কিছু ভেবো না। ততক্ষণ তোমাকে কিন্তু এখানেই আমাদের সাথে থাকতে হবে। তা তুমি তো সেই দুপুর বেলায় কালচিনি থেকে বেরিয়েছ। সন্ধ্যে হতে চলল, তোমার নিশ্চয়ই ক্ষিদে পেয়েছে। দাঁড়াও তোমার জন্যে আমি কিছু খাবার ব্যবস্থা করি আগে”।

পরিতোষ অনেক বারণ করা সত্বেও নিরঞ্জনবাবু শুনলেন না। নিজের গদীর ওপরে একটা কাঠের ক্যাশ বাক্সের পাশ থেকে নিজের মোবাইলটা নিয়ে ফোন করে কাউকে বললেন, “বড়বৌমা, একজনের জন্য কিছু জলখাবার পাঠিয়ে দিও তো গদীতে” বলে চুপ করে ও’পাশের কথা শুনে আবার বললেন, “সে’সব তুমি পরে জানতে পারবে মা। আপাততঃ ধরে নাও, বিশেষ এক অতিথি এসেছে আমার এখানে। সেটা ভেবেই ভাল করে গুছিয়ে দিও সব কিছু। কেমন? আর তোমার মা কেমন আছেন”? বলে আরও কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে “ঠিক আছে” বলে ফোন বন্ধ করে নামিয়ে রাখলেন।
 

এমন সময় অমলেন্দু পেছনের দড়জা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “বাবা ডাক্তার বিশ্বাস আসছেন। বললেন দশ পনেরো মিনিটের ভেতর এসে পড়বেন”।

তার কথা শেষ না হতেই হন্তদন্ত হয়ে আরও দু’জন দোকানের দিক থেকে গদির ঘরে এসে ঢুকলেন। তার মধ্যে বড়জন অমলেন্দুর কথা ধরেই জিজ্ঞেস করলেন, “ডাক্তার আসছে মানে? কার কী হয়েছে বাবা”?
 

আরেকজন অমলেন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে অমু, মা ঠিক আছেন তো”?

অমলেন্দু কিছু বলবার আগেই নিরঞ্জনবাবু হাত তুলে তার দুই বড়ছেলেকে শান্ত হবার ঈশারা করে বললেন, “তোরা শান্ত হ শামু বিমু। তেমন কিছু হয়নি। তবে তোদেরকে এভাবে ডেকে এনেছি, তার একটা বিশেষ কারন আছে। একে দ্যাখ। আন্দাজ কর তো দেখি এ ছেলেটা কে হতে পারে”? বলে পরিতোষের দিকে ঈশারা করল।
 

অমলেন্দু তার বাবাকে বললেন, “বাবা আমি বাইরে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। ডাক্তারবাবু চলে আসতে পারেন। আগে তো তাকে এখানে এনেই গোটা পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবে, তাই না”?

নিরঞ্জনবাবু অনুমতি দিতে অমলেন্দু বাইরে চলে গেলেন। নতুন আসা অন্য দু’জন পরিতোষকে দেখে কিছু আন্দাজ করতে না পেরে বললেন, “বাবা আমরা তো কিছুই আন্দাজ করতে পারছি না। কে উনি”?

নিরঞ্জনবাবু পরিতোষকে একহাতে জড়িয়ে ধরে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে আনন্দিত স্বরে বললেন, “এ হচ্ছে পরিতোষ। তোদের আরেকটা ভাই। তোদের মামার ছেলে রে। আর পরিতোষ এরা তোমার পিসির দুই বড় ছেলে। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু”।

দুই ছেলেই বিস্ময়ে আর আনন্দে প্রায় একসাথেই বলে উঠলেন, “সত্যি বলছ বাবা? এ আমাদের ভাই? আমাদের একমাত্র মামার ছেলে”?

পরিতোষ গদি থেকে নেমে দুই বড়ভাইকে প্রণাম করবার জন্য ঝুঁকতেই তারা দু’জনেই পরিতোষের হাত ধরে বলল, “থাক থাক ভাই। আমাদের প্রণাম করতে হবে না। ওহ, আজ কত বড় খুশীর দিন আমাদের সকলের। এতগুলো বছর ধরে যাদের আমরা খুঁজে বেড়াচ্ছি, তাদের একজনকে আজ পেয়েছি আমরা। তাহলে তো মামা, মামী, দিদা দাদু সবাইকেই এবার আমরা দেখতে পারব বাবা”।

অপেক্ষাকৃত কম বয়স যার তিনি পরিতোষের একটা হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতেই তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু বাবা, ও এসেছে কখন? আর ওকে এখনও বাড়িতে নিয়ে যাওনি কেন? এখানেই বসিয়ে রেখেছ”?

নিরঞ্জনবাবু একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “বসিয়ে রেখেছি কি আর সাধে রে। ও হচ্ছে সদ্য গাছে ফোটা একটা গোলাপ ফুল। গোলাপ ফুলের রূপ আর সুগন্ধের সাথে সাথে বোঁটার দিকে যে কাঁটাও থাকে রে। সে কাঁটার খোঁচা লাগবে বুঝতে পেরেই তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছি। তাই তো তোদের ডেকে আনলুম। ডাক্তার বিশ্বাসও আসছে। উনি এলে সবাই মিলে বসে পরামর্শ করব, যাতে কাঁটার খোঁচা খেতে না হয়”।

শ্যামলেন্দু তার বাবার কথার অর্থ কিছু বুঝতে না পেরে জজ্ঞেস করলেন, “তুমি কী বলছ বাবা? আমরা তো কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না”।

এমন সময়েই পেছন দিকের দড়জার ওপার থেকে নারীকন্ঠে কেউ বলে উঠল, “কাকাবাবু, খাবার এনেছি। ভেতরে আসব”?
 

নিরঞ্জনবাবু ঠোঁটে আঙুল দিয়ে দুই ছেলে চুপ থাকতে বলে বললেন, “হ্যাঁ তাপসী, ভেতরে নিয়ে আয়”।

বছর তিরিশের এক বিবাহিতা মহিলা খাবারের থালা আর জলের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকল। ঘরটার এক কোনায় যে একটা ছোট টেবিল চেয়ার আছে সেটা পরিতোষের এতক্ষণে নজরে পড়ল। মহিলা ওই টেবিলের ওপর খাবারের থালা আর গ্লাস রেখে শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুকে গদির ঘরে দেখে মনে মনে একটু অবাকই হল। এ সময়ে এই দু’জনের তো এখানে থাকবার কথা নয়। ফিরে যাবার আগে পরিতোষের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে সে বেরিয়ে গেল।
 

নিরঞ্জনবাবু তখন বললেন, “ছেলেটা অনেকক্ষণ হল এসেছে। দুপুরে খাবার খেয়েই কালচিনি থেকে ট্রেনে উঠেছিল। বাড়ির ভেতর নিতে পারছিলুম না। তাই বড়বৌমাকে বলে ওর জন্য কিছু খাবার আনিয়ে নিলাম” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “বাবা পরিতোষ, তুমি তো আশা করি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ। আমার মনটা খুব চাইছে তোমার মুখে প্রথম গ্রাসটা তোমার পিসি নিজেই তুলে দিক। কিন্তু পরিস্থিতি বিচার করেই সেটা আর করতে পারছি না। তুমি আমাদের অসহায়তাটুকু বুঝে আমাদের ক্ষমা করে দিও বাবা। ওই ওদিকে ছোট একটা বাথরুম আছে। সেখানে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এ খাবারটুকু খেয়ে নাও বাবা। নইলে এগুলো ঠান্ডা হয়ে যাবে”।

পরিতোষ একটু লাজুক মুখে বলল, “আমার কিন্তু একেবারেই ক্ষিদে পায়নি পিশেমশাই। আর পিসির কথা ভেবে তো আরও চিন্তা হচ্ছে আমার। এতসব তো খেতেই পারব না আমি”।

নিরঞ্জনবাবু স্নেহমাখা সুরে বললেন, “ঠিক আছে বাবা, যেটুকু পার, খেয়ে নাও। ডাক্তার এলে তার সাথে পরামর্শ করেই তোমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাব আমরা। অবশ্য তোমার পিসি যখন শুনবেন যে আমাদের বাড়ি এসেও তুমি প্রথম খাবার খেয়েছ এ গদিতে বসে, তখন আমাদের সকলের ওপরেই তিনি কিছু চোটপাট করবেনই”।

পরিতোষ উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে এসে টেবিলে খেতে বসবার আগেই দেখল তার দুই দাদা বিধুবাবুর লেখা চিঠিটা পড়ছেন। চিঠি পড়া শেষ হলে মেজছেলে বিমলেন্দু বললেন, “তাহলে শেষ মেষ বিধুমামুই আমাদের এত বড় উপকারটা করলেন”।

বড়ছেলে শ্যামলেন্দু বললেন, “হ্যাঁ বাবা, বিধুমামুই যখন ওকে এখানে পাঠিয়েছেন, তাহলে তো ওকে সন্দেহ করবার মত কিছু নেই। বিধুমামুর মত লোক কিছুতেই কাউকে ঠকাতে পারেন না। তাই পরিতোষই যে আমাদের ভাই, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। কিন্তু ওকে বাড়ির ভেতর নিয়ে যাওনি কেন তোমরা, সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছি না”।
 

নিরঞ্জনবাবু শান্ত গলায় বললেন, “ভগবানের অসীম কৃপা যে পরিতোষ আমাদের কাছে এসে পড়েছে। এ দিনটার জন্যেই তো আমরা চুয়াল্লিশটা বছর ভগবানের কাছে প্রতিনিয়ত প্রার্থনা করে যাচ্ছিলুম। কিন্ত এ সুখের সাথে সাথে অনেকগুলো দুঃসংবাদও যে আমাদের কাছে চলে আসবে, সেটা তো আমরা কেউই আশাই করিনি। তোদের দাদু, দিদিমা, মামা এমনকি তোদের মামীও, এরা কেউই আর বেঁচে নেই রে। এনারা সকলেই এ পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গে চলে গেছেন”।

শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু দু’জনেই চমকে উঠে চাপা চিৎকার করে উঠল, “কী বলছ বাবা? এরা সকলেই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন”!

নিরঞ্জনবাবু আগের মতই শান্ত স্বরে বললেন, “হ্যাঁরে, পরিতোষের মুখেই খানিকক্ষণ আগে এ দুঃসংবাদটা শুনলুম আমরা। আসলে সময়ের ব্যবধানটাও তো কম নয়। চুয়াল্লিশটা বছর পেরিয়ে গেছে আমাদের বিয়ের পর। এতোটা দীর্ঘ সময়ে পৃথিবীর কত কিছু বদলে গেছে। আমরাও সবাই কে কোথায় ছিলুম, কে কোথায় ভেসে এসেছি, কে কোথায় স্রোতের টানে বয়ে গেছে। কিন্তু একসাথেই যে চার চারজনের মৃত্যু সংবাদ আমরা পাবো, এ তো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। এবার বুঝতে পারছিস? ওকে এতক্ষণ ধরে এখানেই বসিয়ে রেখেছি কেন”?

বিমলেন্দু ভীত কন্ঠে বললেন, “মা তো এ দুঃসংবাদ গুলো শুনে সইতেই পারবেন না। কী হবে বাবা”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 231)

নিরঞ্জনবাবু শান্ত কন্ঠেই বললেন, “কোনও অঘটণ যাতে না ঘটে সে জন্যেই তো ডাক্তারের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে আগে আলোচনা করতে হচ্ছে। তারপর ডাক্তার যা পরামর্শ দেয় সে হিসেবেই আমাদের এগোতে হবে। আর সে’জন্যেই বাড়িতে আমরা এখনও পরিতোষের আসার খবরটা জানাই নি। আর এ ছেলেটাকে দ্যাখ, পিসির প্রেসার বেড়েছে শুনেই বলছে যে ও আর ওর পিসির মুখোমুখি হয়ে তাকে বিপদে ফেলতে চায় না। বলছে, দুর থেকে একবার ওর পিসিকে দেখেই এখানে থেকে নাকি চলে যাবে”।

শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “সে কি ভাই? এতগুলো বছর ধরে তোমাদের সবাইকে আমরা খুঁজে চলেছি। আজ তোমাকে পেয়েও আমরা আমাদের মায়ের কাছে তার ভাইপোকে নিয়ে যাব না? পরে যেদিন আমাদের মা এ’কথা জানতে পারবেন সেদিন কি আমরা তার সামনে আর মুখ উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলো? তুমি কিচ্ছু ভেব না। বাবা আর অমু তোমাকে এখানে রেখে সঠিক কাজটাই করেছে। ডাক্তারবাবু এলে তাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললে তিনি নিশ্চয়ই মাকে সুস্থ রাখবার উপায় বের করে আমাদের উচিৎ পরামর্শ দেবেন”।
 

বিমলেন্দু বললেন, “আর তাছাড়া, আমাদের ভাগ্যেই হয়ত ছিল যে দাদু, দিদিমা, মামা, মামী, কাউকেই আমরা চাক্ষুষ দেখতে পারব না। কিন্তু তুমিও তো আমাদের পর নও ভাই। আমাদের মায়ের সাথে তো তোমার রক্তের সম্পর্ক। আর সেটা খুব দুরের কোন সম্পর্কও নয়, খুবই কাছের। তোমার বাবার শরীরে যে রক্ত বইতো, সেই একই রক্ত তো আমাদের মায়ের শরীরেও বইছে। অবশ্য দাদু দিদিমা যে মা বাবার ওপর প্রচণ্ড অভিমান করেই আমাদের পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন, সে কথা তো আমরা সবাই জানি। তাদের মনে আমাদের মা-বাবার প্রতি তিক্ততা আর ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। তোমার মনেও যদি তেমন তিক্ততা বা ঘৃণা থেকে থাকে, তাহলে ....”

ছেলের কথার মাঝপথেই নিরঞ্জনবাবু তাকে বাধে দিয়ে বলে উঠলেন, “ছিঃ বিমু, এ’সব কি বলছিস তুই? ও একটা ', সন্তান হয়েও না একটু আগেই তোদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গিয়েছিল! সেটা এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি? আরে ও বেচারা তো ছোটবেলাতেই নিজের মা, ঠাকুর্দা আর ঠাকুমাকে হারিয়ে বসেছে। ওর বাবাও ওকে ছেড়ে চলে গেছে প্রায় সাত বছর আগে। এই সাতটা বছর ধরে ছেলেটা নিজেকে অনাথ ভেবে আসছে। ও তো ওর পিসির নামটাও শোনেনি সারা জীবনে। ওর পিসির নাম যে হৈমবতী আর সে যে কুমারগ্রামের এক মণ্ডল পরিবারের নিরঞ্জন মণ্ডলকে বিয়ে করেছিল, সেটা তো ও কেবলমাত্র আজ দুপুরেই জানতে পেরেছে তোদের বিধুমামুর কাছ থেকে। আর আমাদের নাম পরিচয় ঠিকানা জানবার পর একটা মূহুর্তও ও আর নষ্ট করেনি। সোজা এখানে চলে এসেছে। আর তুই বলছিস, ওর মনে আমাদের প্রতি তিক্ততা বা ঘৃণা জমে আছে”?

পরিতোষ ততক্ষণে তার সাধ্যমত কিছুটা খাবার খেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু বিমলেন্দুর কথাগুলো শুনেই তার হাত থেমে গিয়েছিল। বাথরুমে ঢুকে বেসিনে হাত ধুয়ে ঘরে ফিরে আসতেই বিমলেন্দু তার কাছে ছুটে এসে তার হাত ধরে অনুতপ্ত সুরে বললেন, “ভাই, আমি সবকিছু না জেনে না বুঝেই তোমার সম্পর্কে অনেক উল্টোপাল্টা বলে ফেলেছি। আমাকে সে’জন্যে ক্ষমা করো ভাই। আর শোনো, এতদিন নিজের সম্বন্ধে যা ভেবেছ তা ভেবেছ। কিন্তু আজকের পর থেকে নিজেকে কখনও আর অনাথ বলে ভাববে না। মনে রেখ, আজকের পর থেকে এ পৃথিবীতে তুমি আর একা নও। তোমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন। তোমার ওপর তিন তিনটে দাদা আছে। দু’ দু’টো দিদি আছে তোমার। কে বলেছে এ পৃথিবীতে তোমার আর কেউ নেই”?
 

পরিতোষ তার কথার কোন জবাব দেবার আগেই বিমলেন্দুর পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। বিমলেন্দু মোবাইল বের করে তার দিকে তাকিয়েই নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ বলো .... আরে না না সে’সব কিছু নয়। ব্যাবসা সংক্রান্ত ব্যাপারেই বাবা আমাকে আর বড়দাকে ডেকে পাঠিয়েছেন একটা ব্যাপারে একটু পরামর্শ করবার জন্য ..... সত্যি বলছি রে বাবা .... কিচ্ছু হয়নি ..... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা ঠিক আছেন। আমরা সবাই মিলে একটা ব্যাপারে আলোচনা করতে বসেছি .... কি বললে?.... ও ও তাই বলো, আরে একজন অনেক দুর থেকে বাবার কাছে এসেছেন। তার দুপুরে খাওয়া হয়নি শুনেই বাবা তার জন্য বাড়ি থেকে খাবার পাঠাতে বলেছিলেন। এই তো উনি এইমাত্র খেয়ে উঠলেন, এখানেই আছেন এখনও ... আরে নারে বাবা, কিচ্ছু হয়নি .... হ্যাঁ? কী বললে? ডাক্তারের গাড়ি? আমাদের দোকানের সামনে? কিজানি, ডাক্তার বিশ্বাস তো এখানে আসেননি। হতে পারে আশে পাশে অন্য কোথাও এসেছেন কোনও কাজে। আচ্ছা এখন ফোনটা রাখো তো। এবার আমরা আলোচনায় বসব। বাকি কথা পরে শুনো, রাখছি”।
 

বিমলেন্দু ফোন বন্ধ করতে না করতেই অমলেন্দুর সাথে একজন বয়স্ক ডাক্তার ঘরে এসে ঢুকলেন। সবাই মিলে ডাক্তারকে গোটা ব্যাপারটা ভাল করে বিস্তারিত ভাবে বলবার পর তার পরামর্শ চাইল। ডাক্তার বিশ্বাস কয়েক মূহুর্ত খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা ভেবে বললেন, “ঠিক আছে মণ্ডলবাবু। আমি এখন আপনার ছোট ছেলেকে নিয়ে ওপরে যাচ্ছি। আগে আপনার মিসেসকে একটু চেকআপ করে দেখি। সবকিছু ভাল করে পরীক্ষা করবার পর প্রয়োজনীয় যা যা করবার করে নিচ্ছি। তারপর আমি খবর পাঠালে আপনারা মিঃ সান্যালকে নিয়ে ওপরে আসবেন। আর এরমধ্যে কোনও কারনে যদি আপনাদের কাউকে ওপরে যেতেই হয়, তাহলে এমন ভাব দেখাবেন যে আমি রেগুলার চেকআপ করতেই এখানে এসেছি। বাড়ির আর কেউ যেন এখনই মিঃ সান্যালের ব্যাপারে কিছু জানতে বা বুঝতে না পারেন”।

ডাক্তার বিশ্বাস উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ তার একটা হাত ধরে উদ্বিঘ্ন ভাবে বলল, “ডক্টর শুনুন, আমি কলকাতায় থাকি। পেশাগত ভাবে আমি একজন একজন পুলিস অফিসার। কলকাতার সমস্ত বড় বড় হাসপাতাল, নার্সিংহোম আর ডাক্তারদের সাথে আমার খুব ভাল পরিচয় আছে। ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে আপনি পরামর্শ দিলে আর এনারা সকলে চাইলে পিসিকে আমি কলকাতা নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু ডক্টর সবার আগে আমি আপনার ওপরেই ভরসা করছি। আপনিও যদি তেমনটা সাজেস্ট করেন, তাহলে সেটা আমি করতেই পারি। তবে ডক্টর যাকে আমি সারাজীবনে এর আগে কখনও দেখতে পাইনি, তাকে দেখব বলেই তার জীবনটাকে বিপন্ন করে তুলতে আমি কিন্তু একেবারেই চাইছি না। আমি চাই না, পিসি কোন বিপদের মুখোমুখি হোন। পিসি এতদিন মনে মনে যে ধারণা নিয়ে বেঁচে আছেন, সেভাবেই থাকুন। তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ তাকে নাহয় আমরা না-ই বা জানালাম। তাতে তো নতুন করে আর কোন ক্ষতি হবে না। আপনি যদি তেমন বোঝেন তাহলে নিচে এখানে একটা খবর পাঠিয়ে দেবেন প্লীজ। আমি পিসির সাথে দেখা না করেই এখান থেকে চলে যাব। তাহলে অন্ততঃ এ সান্ত্বনাটুকু তো আমি নিয়ে যেতে পারব, যে এখানে আমার পিসি আছেন, পিসেমশাই আছেন, দাদারা আছেন। আমি পৃথিবীতে এখনও পুরোপুরি অনাথ হয়ে যাইনি। ভগবান চাইলে নিশ্চয়ই আমি একদিন না একদিন আমার পিসিকে একটা প্রণাম করতে ঠিক পারব। প্লীজ ডক্টর, আপনি আমার এ অনুরোধটুকু রাখবেন প্লীজ” বলতে বলতে পরিতোষের গলা ধরে এল। তার চোখ থেকে জলের ধারা গড়িয়ে পড়ল।

ডক্টর বিশ্বাস পরিতোষের একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে খুব ধীর স্থির ভাবে বললেন, “এত উতলা হবেন না মিঃ সান্যাল। আমি এনাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান। আপনার পিসি আমার অনেকদিনের পুরোন পেশেন্ট। তাই তার ফিজিকাল কন্ডিশন সম্বন্ধে আমি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। আমি প্রতি সপ্তাহেই তাকে রুটিন মাফিক চেক করতে আসি। এতদিন উনি মোটামুটি ঠিকই ছিলেন। শুধু গত সপ্তাহেই তার প্রেসারটা সামান্য বেড়ে ছিল। আর আমি তার যথাযথ ওষুধও দিয়েছি। আশা করি তার প্রেসার হয়ত এ’ ক’দিনে স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। তবু আজকের এমন পরিস্থিতিতে ওনারা আগে থাকতেই আমার সাথে কন্টাক্ট করে খুব ভাল করেছেন। আমি আশা করছি, সব দিক সামলে নিতে পারব। আর অমুর মুখে ফোনে ডিটেইলটা শুনে আমি সব রকম ভাবে প্রস্তুত হয়েই এসেছি” বলে একটু থামলেন। তারপর আবার পরিতোষের মুখের দিকে চেয়ে খুব নরম গলায় বললেন, “তবে, আপনার কথায় আমি সত্যি খুব অবাক হলাম মিঃ সান্যাল। আমার পঁয়ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারে আমি নানান অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে আমি কোনদিন পড়িনি। আমার সামনেও আজ একটা নতুন চ্যালেঞ্জ। তবে আমার নিজের ওপর যতটুকু ভরসা আছে, তার ওপর ভিত্তি করেই বলছি, আমি এ চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে পারব। আপনি নিজেকে শান্ত রাখবার চেষ্টা করুন। কেমন”?
 

ডক্টর বিশ্বাস নিজের ব্যাগটা নিয়ে অমলেন্দুর সাথে পেছনের দড়জার দিকে এগিয়ে গিয়েও হঠাৎ পেছন ফিরে বিমলেন্দুকে বললেন, “ওহ, বিমলেন্দু, একটা কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। আমার গাড়ির চাবিটা তোমার হাতে রাখ। পেছনের ডিকিতে একটা অক্সিজেন সিলিণ্ডার আছে। সঙ্গে একটা প্যাকেটে এক্সেসরি গুলোও রাখা আছে। ভগবান না করুন, আমি যদি সিলিণ্ডার চেয়ে পাঠাঁই তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই সিলিণ্ডার আর প্যাকেটটা ওপরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করবে, কেমন”? বলে বিমলেন্দুর হাতে চাবি দিয়ে আবারও পরিতোষের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “রিল্যাক্স মিঃ সান্যাল। প্রে টু গড ফর দা বেস্ট”।
 

পরিতোষ নিজের চোখ মুছতে মুছতেই মাথা ঝাঁকাল। আর ঠিক তখনই তার পকেটের একটা মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে সীমন্তিনীর ফোন। ফোনটা সাথে সাথে কেটে দিল। এই মূহুর্তে কারো সাথে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না তার। বিমলেন্দু আর শ্যামলেন্দু দু’জনেই পরিতোষের দুটো হাত ধরে আবার গদিতে বসতে বসতে বললেন, “এত চিন্তা কোর না ভাই। ডাক্তার বিশ্বাস মা-র সমস্ত নারী নক্ষত্র জানেন। উনি ঠিক সামলে নেবেন সবটা দেখো”।

পরিতোষ এই মূহুর্তে নিজের মনের পরিস্থিতি কাউকে খুলে বলতে পারবে না। দুই দাদার কথা শুনে মুখে জোর করেই একটুখানি হাসি ফুটিয়ে তুলবার চেষ্টা করতেই পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবারেও সীমন্তিনীর ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিতেই নিরঞ্জনবাবু তার কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললেন, “বাবা পরিতোষ, এতোটা অস্থির হয়ো না বাবা। একটু স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করো। টেনশনে তো আমরা সকলেই আছি। তবে আমার মন বলছে, তুমি নিশ্চয়ই খানিক বাদেই তোমার পিসিকে দেখতে পারবে। এতগুলো বছর বাদে আজকের এই দিনটা আমাদের সকলের জীবনে ভগবান যখন এনেই দিয়েছেন, তাহলে আমার বিশ্বাস, আজ খারাপ কিছু হবে না। তবে আমার মনে হয় তুমি একটু বাইরে থেকে ঘুরে এস। আর কে তোমাকে বারবার ফোন করছে, তার সাথে একটু কথা বলে নাও। তাহলে একটু হলেও তোমার টেনশনটা কমবে”।

নিরঞ্জনবাবুর কথা শেষ হতে না হতেই পরিতোষের পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে এবার কিংশুকের ফোন। আবার কল রিজেক্ট করে দিল সে। নিরঞ্জনবাবু তখন তার বড়ছেলেকে বললেন, “শামু, তুই ওকে নিয়ে একটু বাইরে যা। আর পরিতোষ, ওঠো বাবা তুমি। যারা ফোন করছে তোমায় বারবার, বাইরে গিয়ে একটু হাওয়ায় দাঁড়িয়ে তাদের সাথে কথা বলে এসো। যাও বাবা”।

পরিতোষ নিজের অনিচ্ছা সত্বেও নিরঞ্জনবাবুর কথা মেনে নিজের ব্যাগটা গদির ওপর রেখেই শ্যামলেন্দুর সাথে বাইরের দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে এসেই শ্যামলেন্দু জিজ্ঞেস করলেন, “আমি হয়ত চিনব না ভাই। তবু জিজ্ঞেস করছি, কে বারবার তোমাকে ফোন করছে”?

পরিতোষ মোবাইলটা হাতে রেখেই একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, “কাল নাগরাকাটায় আমি যে বন্ধুর ওখানে ছিলাম সে, আর কালচিনি থেকে কাকুর ছেলে। আমি কালচিনি থেকে চলে আসবার পর তাদের কাউকে কোনও খবর দিই নি। তাই হয়ত তারা সবাই আমাকে নিয়ে চিন্তায় আছেন”।

শ্যামলেন্দু সে’কথা শুনে বললেন, “তুমি ভাই, তোমার বন্ধুকে ফোন করে বলে দাও, যে তুমি আমাদের এখানে পৌঁছে গেছ। আর ঠিক আছ। তাহলে তারা নিশ্চিন্ত হবেন। আর বিধুমামুর ছেলের নাম্বার আমার কাছে আছে। আমি তাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি” বলে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে পরিতোষের কাছ থেকে কয়েক ফুট দুরে চলে গেলেন।

পরিতোষ একটু ম্লান হেসে নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করবার আগেই আবার সেটা বেজে উঠল। এবার রচনার ফোন দেখে কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ও’পাশ থেকে রচনা উদ্বিঘ্ন কন্ঠে বলে উঠল, “পরিদা, কোথায় আছ গো তুমি? কেউ তোমাকে ফোনে পাচ্ছে না কেন? তুমি কেন আলিপুরদুয়ার গিয়েছ, মা-বাবার মুখে সে’সব কথাই আমি শুনেছি। কিন্তু ও’খানে গিয়ে তুমি কাউকে কিচ্ছু জানাওনি এখনও পর্যন্ত। সবাই যে দুশ্চিন্তা করছেন। তুমি ঠিক আছ তো পরিদা? ওখানে গিয়ে কোনও ঝামেলায় পড়নি তো”?
 

পরিতোষ নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে জবাবে বলল, “রচু, সোনা বোন আমার। আমি একদম ঠিক আছি। আসলে এখানে এসে প্রথমবার নিজের অনেক আত্মীয় স্বজন দেখতে পেয়ে কাউকে ফোন করবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। মানে যখন থেকে বোধবুদ্ধি হয়েছে তখন থেকে তো বাবা ছাড়া আর কাউকে চোখেই দেখিনি। এখন পিসি, পিসেমশাই আর তিন তিনটে দাদা পেয়ে নিজেই যেন কেমন হকচকিয়ে গিয়েছি আমি। তাই কাউকে ফোন করবার কথা মনেও আসেনি। আর সবার সাথে কথাবার্তায় এমনভাবে ব্যস্ত আছি যে মন্তি আর কিংশুকের ফোন কলও রিজেক্ট করে দিতে বাধ্য হয়েছি। সরি”।
 

রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “তোমার গলাটা কেমন যেন লাগছে পরিদা। তুমি ঠিক আছ তো? তোমার শরীর ঠিক আছে তো? তোমার পিসি পিসেমশাই কি তোমার সাথে ভাল ব্যবহার করেন নি? তেমন হলে তুমি এখনও কেন আলিপুরদুয়ারে বসে আছ? কালচিনি বা নাগরাকাটায় ফিরে যাচ্ছ না কেন”?
 

পরিতোষ নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করতে করতে জবাব দিল, “না রে বোন, একেবারেই তা নয়। পিসেমশাই আর দাদারা সকলেই আমাকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছেন। সব কথা তো এখনই তোমাকে ফোনে খুলে বলা সম্ভব নয় বোন। তবে পিসিকে এখনও দেখতে পাই নি। আসলে পিসির তো বয়স হয়েছে। ইদানীং তার নাকি প্রেসার বেড়েছে। তাই আমাকে দেখবার সাথে সাথেই পিসি যখন জানতে পারবেন যে তার বাবা, মা, ভাই, ভাইয়ের বৌ এরা কেউ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই তখন তো তিনি বিরাট একটা দুঃখ পাবেন। সেই ধাক্কাটা তিনি সামলে নিতে পারবেন কি না, এটা ভেবেই পিসেমশাই আর দাদাদের সাথে যুক্তি পরামর্শ করছি। আর পিসিকে যে ডাক্তার নিয়মিত দেখেন, তাকেও ডেকে আনা হয়েছে। এখন ওই ডাক্তারবাবু পিসিকে পরীক্ষা করে দেখছেন। খানিকবাদে উনি যেমন সিদ্ধান্ত দেবেন, আমরা তেমনই করব। তাই এই মূহুর্তে আমি মন্তি আর কিংশুকের কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছি”।

রচনা পরিতোষের কথা শুনে বলল, “ও-ও, বুঝেছি। তুমি নিজেও এ মূহুর্তে বেশ টেনশনে আছ। তা তোমার পিসির বয়স কত হয়েছে গো পরিদা”?
 

পরিতোষ জবাবে বলল, “কালচিনিতেই কাকু বলেছিলেন, পিসির বর্তমান বয়স প্রায় বাষট্টি। কিন্তু পিসির যে প্রেসার বেড়েছে, এ খবরটা বোধহয় কাকুও জানতেন না। আর এই মূহুর্তে কারো সাথে ফোনে কথা বলতেও আমার ইচ্ছে করছে না। তাই মন্তি আর কিংশুকের কলগুলো আমি রিজেক্ট করে দিয়েছি। তারপর পিসেমশাই বারবার করে ফোন কলের জবাব দিতে বলাতেই এই মূহুর্তে আমি বাড়ির বাইরে আসবার সাথে সাথেই তোমার কল পেলাম। তাই তোমাকে একটা অনুরোধ করছি বোন। তুমি প্লীজ মন্তি আর ....”

তার কথার মাঝেই রচনা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি কিচ্ছু ভেবো না পরিদা। তোমার পিসির কিচ্ছু হবে না। আমি বলছি, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখো তুমি জীবনে প্রথমবার তোমার পিসির আদর পাবে। আর আমি এখনই কালচিনি আর নাগরাকাটায় ফোন করে বলে দিচ্ছি। তারাও কেউ তোমাকে ফোন করে এখন আর ডিস্টার্ব করবেন না। তুমিও নিজের মনটাকে শান্ত করো। তবে পিসির সাথে দেখা হবার পর তোমার ফুরসৎ মত তুমি কিন্তু আমায় একটি বার ফোন করবে। কথা দাও আমাকে, প্লীজ”।

পরিতোষ আবেগে বুজে আসা গলায় কোন রকমে বলল, “ঠিক আছে সোনা বোন। কথা দিলাম”।

রচনা আবার বলল, “আর হ্যাঁ, শোনো পরিদা। আমি দিদিভাই আর ভাইকে তোমার খবর জানিয়েই এখনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসব। তোমার আর তোমার পিসির জন্য ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব। তোমার ফোন না পাওয়া অব্দি আমি কিন্তু প্রার্থনা করতেই থাকব। তাই পিসির সাথে দেখা হবার পর একটা ফোন কিন্তু অবশ্যই করবে। বুঝেছ”?

পরিতোষ আবার রূদ্ধ গলায় বলল, “হ্যাঁ বোন। করব”।

রচনা এবার বলল, “এবার মনটাকে শান্ত করো। আর ভেতরে গিয়ে দেখো, নিশ্চয়ই এতক্ষণে ডাক্তার তোমার জন্যে সুখবর পাঠিয়েছেন। আমিও ঠাকুরঘরে চলে এসেছি। তুমি ভেতরে ঢোকো” বলে ফোন কেটে দিল।

পরিতোষ ফোন নামাতেই শ্যামলেন্দু কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কে ফোন করেছিল? তোমার কোনও বন্ধু”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “ভেতরে থাকতে প্রথম ফোনটা করেছিল আমার এক কলীগ বন্ধু, নাগরাকাটা থানার ওএসডি। আর পরের বার ফোন করেছিল কালচিনির বিধুকাকুর ছেলে। কিন্তু এবারে যার সাথে কথা হল সে বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনা। ওরা কলকাতাতেই থাকে। কয়েক মাস আগে থেকেই আমি ওদেরকে চিনি। আমাকে দাদার মত শ্রদ্ধা করে মেয়েটা। খুব ভালবাসে আমাকে”।

শ্যামলেন্দু ভুরু কুঁচকে বললেন, “নাগরাকাটা থানার ওএসডি তো এক মহিলা। সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। বড্ড জাদরেল এবং সৎ পুলিশ অফিসার হিসেবে তার খুব সুনাম আছে এ তল্লাটে। তিনিই কি তোমাকে ফোন করেছিলেন”?
 

পরিতোষ একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ দাদা, ওকে সংক্ষেপে আমরা মন্তি বলে ডাকি। এখন আমি যার সাথে কথা বললাম, মানে বিধুকাকুর ছোটমেয়ে রচনা, এই রচনা হল সীমন্তিনীর বৌদি। সীমন্তিনীর সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরেই রচনা আর বিধুকাকুর সাথে আমার পরিচয় হয়েছে” বলে একটু থেমে শ্যামলেন্দু আবার কিছু বলবার আগেই পরিতোষ বলল, “বড়দা, আমার মনে হয়, এবার আমাদের ভেতরে যাওয়া উচিৎ। ডাক্তারবাবু নিশ্চয়ই এতক্ষণে কোনও খবর পাঠিয়ে দিয়েছেন”।
 

শ্যামলেন্দুও পরিতোষের কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। চলো। আমিও কিংশুককে ফোনে তোমার এখানে এসে পৌঁছনোর কথা জানিয়ে দিয়েছি। ওরাও তোমার জন্যে চিন্তায় ছিল। তবে তোমাকে আরেকটা কথা আমার বলবার আছে ভাই। অবশ্য সেটা পরে বললেও চলবে। যদি আমি ভুলে যাই তাহলে একটু মনে করিয়ে দিও ভাই। চল এবার ভেতরে যাই”।

শ্যামলেন্দুর সঙ্গে ভেতরে গদীর ঘরে ঢুকতেই দেখল সেখানে নিরঞ্জনবাবু, অমলেন্দু, বিমলেন্দু ছাড়াও আরও দু’জন বিবাহিতা ভদ্রমহিলা হাতে বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর সকলেরই মুখ চোখ খুশীতে উদ্ভাসিত। পরিতোষ আর শ্যামলেন্দু গদি ঘরে ঢুকতেই নিরঞ্জনবাবু গদি থেকে নেমে পরিতোষের হাত ধরে বললেন, “এসো পরিতোষ এসো বাবা” বলে বিবাহিতা মহিলা দু’জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেজ বৌমা, ছোট বৌমা, এই হল তোমাদের দেবর, পরিতোষ। আর পরিতোষ এরা তোমার দুই বৌদি। এ রুমা, তোমার মেজদা বিমলেন্দুর স্ত্রী, আর ও হচ্ছে তোমার ছোটবৌদি, অমুর স্ত্রী দেবিকা”।

পরিতোষের মনে হল তার মেজ বৌদি তার চেয়ে বয়সে চার পাঁচ বছরের বড় হলেও ছোটবৌদি দেবিকা বোধহয় তার সমবয়সীই হবে। দুই বৌদির দিকে এগিয়ে গিয়ে তাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে যেতেই দু’জনেই ছিটকে পেছনে সরে গেলেন। মেজবৌদি মিষ্টি হেসে বললেন, “তোমার প্রণাম নিলে তো তোমাকে আশীর্বাদও করতে হবে ভাই। কিন্তু দেখছ তো আমাদের দু’জনেরই হাত জোড়া। তাই আশীর্বাদ তো করতে পারব না এখন। এখন আমাদের যা করণীয় সেটাই বরং করতে দাও”।


(To be cont'd ......)
______________________________
ss_sexy
Like Reply
(Update No. 232)

মেজবৌ রুমার হাতে একটা বরণডালা। আর ছোটবৌ দেবিকার হাতে মিষ্টির প্লেট আর জল। মেজবৌ রুমা এগিয়ে এসে পরিতোষের কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা লাগিয়ে দিয়ে বরণডালাটা পরিতোষের কপালে আর বুকে ছোঁয়াল। তারপর ছোটবৌ দেবিকা পরিতোষের মুখে চামচে করে মিষ্টির টুকরো তুলে দিয়ে বলল, “আমার কোন দেবর ছিল না বলে এতদিন দুঃখ করছিলাম। ভগবান আজ আমার সে দুঃখ দুর করলেন” বলে নিরঞ্জনবাবুর দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু বাবা, বরণটা কিন্তু সম্পূর্ণ হল না। বড়দির বারণ আছে বলেই উলু দেওয়া হল না। ওপরে নিয়ে যাবার পর বড়দি নিজে শাঁখে ফুঁ দেবেন বলে সেটাও বাকি রইল”।

নিরঞ্জনবাবু হেসে বললেন, “ডাক্তার যখন অনুমতি দিয়েছে, তখন আচারের বাকি অংশটুকুও বড়বৌমা ঠিক পূর্ণ করবে। তোমরা বরং এবার ওকে নিয়ে ওপরে যাও। আমরাও আসছি তোমাদের পেছনে পেছনে”।

মেজবৌ রুমা বলল, “বাবা, বড়দি কিন্তু সবার আগে আপনাকে মা-র ঘরে যেতে বলেছেন”।
 

ছোটছেলে অমলেন্দু বলল, “হ্যাঁ বাবা, ডাক্তারবাবুও তাই বলেছেন। তুমি সবার আগে যাও। তুমি গিয়ে মা-র পাশে থাকো। বৌদিরা তার পর পরিতোষকে নিয়ে গিয়ে ঢুকবে। আর বড়দা মেজদা, তোরাও এদের সাথেই ওপরে চলে যা। আমি বলাইদাকে দুটো কথা বলেই আসছি” বলে দোকানের দিকে চলে গেল।

পরিতোষ এবার নিজের মনের সংশয় আর চেপে রাখতে না পেরে নিরঞ্জনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু পিসেমশাই, পিসিমা .......”

নিরঞ্জনবাবু মিষ্টি হেসে পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ডাক্তার বলেছে, ভয়ের কিছু নেই। তোমার পিসির প্রেসার এখন পুরোপুরি নর্ম্যাল আছে। আর তাছাড়া ডাক্তারও তো এখন তার কাছেই আছে। কিছু হলে সে সামলে নিতে পারবে। তুমি আর দেরী না করে ওপরে যাও বাবা। অনেকক্ষণ তোমাকে এমন অন্যায়ভাবে আমরা এখানেই আটকে রেখেছি। এবার যাও, গিয়ে তোমার পিসিকে দ্যাখো” বলে বৌদের উদ্দেশ্যে বলল, “তোমরা ওকে নিয়ে লিফটের সামনে এস। তবে তোমাদের আগে আমি ওপরে উঠে যাচ্ছি”।

নিরঞ্জনবাবু বেরিয়ে যেতেই দেবিকা আর রুমা পরিতোষকে নিয়ে লিফটের দড়জার কাছে এসে দাঁড়াল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুও সিঁড়ি বেয়েই ওপরে চলে গেলে দেবিকা পরিতোষকে বলল, “জানো ঠাকুরপো, আমাদের এ বাড়ির সকলের মনেই এতদিন দুঃখ ছিল। বাবার তরফের অনেক আত্মীয় পরিজনদের সাথেই আমাদের যোগাযোগ আছে। কিন্তু মা-র তরফ থেকে আমাদের আত্মীয় বলতে এতদিন কাউকে পাইনি। শুনেছি দাদু-দিদারা কেউই মা-বাবার বিয়েটা মেনে নিতে পারেন নি বলে মা-বাবার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখেন নি। মা-বাবার বিয়ের পর পরই নাকি তারা নিজেদের ভিটেবাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। মা-বাবা আর তাদের ছেলে মেয়েরাও অনবরতঃ তোমাদের হদিশ পাবার চেষ্টা করে গেছেন। আজ এতদিন এত বছর বাদে তোমাকে পেয়ে আমাদের যে কত ভাল লাগছে, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না”।
 

পিসির শারীরিক অবস্থার চিন্তা পরিতোষের মন থেকে যেন কিছুতেই সরছিল না। তাই ছোটবৌদির কথার কোন জবাব না দিয়ে সে বলল, “কিন্তু ছোটবৌদি, পিসির তো শুনেছি হাই প্রেসার। দাদু-ঠাকুমা, বাবা মা-র কথা গুলো শুনে .........”

ও’পাশ থেকে মেজবৌদি রুমা বলল, “ও’সব ব্যাপার নিয়ে আর চিন্তা নেই ঠাকুরপো। ডাক্তারবাবু সব কিছু সামলে নিয়েছেন। মা ইতিমধ্যেই সবকিছু জেনে গেছেন। দাদু-দিদা আর মামাবাবুর মৃত্যু সংবাদ শুনে একটু সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু দু’মিনিট বাদেই ডাক্তারবাবু মা-কে স্বাভাবিক করে তুলেছেন। এখন তিনি ভাল আছেন। আর তার ভাইপো-কে চোখের দেখা দেখবার জন্য উতলা হয়ে আছেন। চলো, আর দেরী করা ঠিক হবে না। কি বলিস ছোটো”?

দেবিকাও তার কথায় সায় দিতে পরিতোষকে নিয়ে দুই জা লিফটের ভেতরে গিয়ে ঢুকল। চারতলায় লিফটের দড়জা খুলতেই সামনে অনেক লোকের ভিড় দেখা গেল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দুর পাশে বেশ কয়েকটা ছেলে মেয়ে, একজন বছর চল্লিশের ভদ্রমহিলা আর তার পেছনে আরও দু’জন মহিলাকে দেখা গেল। এই দু’জনের মধ্যে একজনকে সে গদির ঘরে তার জন্য খাবার নিয়ে যেতে দেখেছিল। সামনের ভদ্রমহিলাকে দেখে পরিতোষ মনে মনে ভাবল, ইনিই বোধহয় শ্যামলেন্দুর স্ত্রী, এ বাড়ির বড় পুত্রবধূ। রুমা আর দেবিকা প্রথমে লিফটের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর রুমা সেই ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ঠাকুরপো, ইনি আমাদের বড়দি। তোমার বড় বৌদি। আর এরা সকলেই এ বাড়ির ছেলে মেয়ে, তোমার ভাইপো ভাইঝি। ওদের সাথে পরে আলাপ করতে পারবে” বলেই তার বড়-জাকে বলল, “নাও বড়দি, এবার শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে আমাদের ঠাকুরপোকে ঘরে বরণ করে নাও”।

পরিতোষ নিচু হয়ে শ্যামলেন্দুর স্ত্রীকে প্রণাম করতে যেতেই ভদ্রমহিলা তার হাত ধরে বললেন, “না না, ভাই, এ কী করছ? প্রণাম করতে হবে না ভাই। তুমি সোজা হয়ে দাঁড়াও” বলে মেজো-জা রুমার হাতে ধরা বরণডালার চন্দনের বাটি থেকে আঙুলের ডগায় একটু চন্দন নিয়ে পরিতোষের কপালে ফোঁটা এঁকে দিয়ে তার হাতে ধরা শাঁখে ফুঁ দিলেন। সাথে সাথে পেছনে দাঁড়ানো মহিলারা একযোগে উলুধ্বনি দিয়ে উঠল।
 

উলুদ্ধ্বনি আর শাঁখের ফুঁয়ের জোয়ার শুরু হতেই পরিতোষের চোখের আড়ালের কোনও এক জায়গা থেকে এক বৃদ্ধার গলা শোনা গেল, “আঃ, কেন আমাকে আটকাচ্ছ বল তো? আমি বলছি তো আমি ঠিক আছি। তোমরা বুঝতে পাচ্ছ না। কিন্তু আমি জানি, যে এসেছে সে শুধু আমার ভাইপো নয়। ওর চেহারাটা হয়ত আলাদা হবে। কিন্তু আজ এ মূহুর্তে ওর ভেতর আমার বাবার আত্মা অধিষ্ঠিত আছে। আমার বাবাই এত বছর বাদে আমায় ক্ষমা করবেন বলে এসেছেন। তাই, আমাকে যেতে দাও ওর কাছে, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে আর বাধা দিওনা দয়া করে। আমাকে ওর কাছে যেতে দাও”।
 

নিজেকে সামলে রাখবার অনেক চেষ্টা করেও পরিতোষ সফল হল না। নিজের চোখের জল লুকোতে চোখ বুজে মাথা নুইয়ে নিল। পরপর তিনবার উলুধ্বনি শেষ হবার পর সামনের সবাই পেছনে সরে যেতেই বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের একটা হাত ধরে বললেন, “এসো ঠাকুরপো”।
 

পরিতোষ এক পা এগোতেই একদিক থেকে নারীকন্ঠ ভেসে এল, “কৈ কোথায় সে? আমার দুর্গার ছেলে কোথায়”?

নতুন শোনা কন্ঠ যেদিক থেকে ভেসে এল সেদিকে চাইতেই দেখে এক বৃদ্ধা করিডোর দিয়ে এলোমেলো পায়ে লিফটের দিকে এগিয়ে আসছেন। তার একটি হাত নিরঞ্জনবাবু নিজে ধরে আছেন। আর অন্য হাতটি ধরে আছেন নিরঞ্জনবাবুর ছোট ছেলে অমলেন্দু। বৃদ্ধার ঠিক পেছনেই ডাক্তার বিশ্বাসকেও দেখা গেল।

পরিতোষের বুঝতে এক মূহুর্তও সময় লাগল না। এক অজানা শক্তি যেন তাকে সেই বৃদ্ধার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। পরিতোষ ছুটে বৃদ্ধার কাছে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তার শ্বাস প্রশ্বাস অসম্ভব রকমের দ্রুত হয়ে উঠল। বৃদ্ধা হৈমবতীদেবী নিজের একহাতে ধরে থাকা চশমাটা নিজের চোখে পড়তে পড়তে বললেন, “তুমি? তুমি বাবা? তুমিই আমার দুর্গার ছেলে”?

পরিতোষ বৃদ্ধার পায়ের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে তাকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াবার আগেই হৈমবতীদেবী পরিতোষের মুখটাকে দু’হাতে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “আয় বাবা, আমার বুকে আয়। চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমার বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। তোকে বুকে চেপে ধরে আগে আমার বুকের সেই আগুনটাকে নিভিয়ে নিই”।

পরিতোষের মুখ দিয়ে কোন কথা সরছে না। কিন্তু দু’চোখ থেকে জলের ধারা বইতে শুরু করেছে। সে উঠে হৈমবতীদেবীর সামনে দাঁড়াতেই তিনি তাকে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে নিজের বুকে চেপে ধরলেন। পরিতোষের হাত দুটোও যেন তার অজান্তেই হৈমবতীদেবীকে সাপটে ধরল। পরিতোষের শরীরের ভেতরে কেমন এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। নিজের মাকে তো জন্মের পরেই হারিয়েছে। ঠাকুমার কথা অল্প অল্প মনে পড়ে। কিন্তু সেই ঠাকুমাকেও এভাবে জড়িয়ে ধরবার সুযোগ সে সত্যি কোনদিন পেয়েছে কিনা তা মনে করতে পারছিল না। তাই জ্ঞানতঃ নিজের রক্তের সম্পর্ক থাকা কোনও মহিলাকে এভাবে জড়িয়ে ধরবার অভিজ্ঞতা তার জীবনে এইই প্রথম। তার মনে হচ্ছিল তার সারাটা শরীর জুড়ে যেন একটা শান্ত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তার অনুভূতি যে ঠিক কেমন তা সে যেন বুঝতেই পারছিল না। কিন্তু তার মনটা যেন সারা জীবন ধরে এমন অনুভূতি পাবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠল। তার মনে হল এ স্নিগ্ধতার তুলনা যেন কোন কিছুর সাথেই করা যায় না।
 

হৈমবতীদেবী পাগলের মত পরিতোষের গালে কপালে চুমু খাচ্ছিলেন। পরিতোষের সারা গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছিলেন। আর মুখে বলছিলেন, “এতদিনে? এত বছর বাদে আমার ওপর তোমার অভিমান কমলো বাবা? কিন্তু আমি এতই অভাগী যে তুমি বেঁচে থাকতে আমাদের ক্ষমা করতে পারলে না। আর ক’টা দিনই বা আছে আমার পরমায়ু! তারপর তো পরলোকে তোমাদের সকলের সাথেই আবার আমার দেখা হত। আর ক’টা বছর আগে যদি ক্ষমা করতে, তাহলে আমার আদরের ভাইটা বড় হয়ে কেমন দেখতে হয়েছিল সেটা অন্ততঃ দেখতে পারতুম বাবা”।

পরিতোষের হাতের বাঁধনে হৈমবতীদেবীর শরীরটা শুরু থেকেই থরথর করে কাঁপছিল। তাই পরিতোষ চেয়েও নিজেকে তার পিসির হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল, সে হাত সরিয়ে নিলেই তার পিসির দেহটা ঢলে পড়বে। সে পিসিকে আঁকড়ে ধরেই ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, “হ্যাঁ, পিসি। আমি তোমার দুর্গার ছেলে পরিতোষ”।

পরিতোষ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই তার পিঠের ওপর এতক্ষণ ঘুরতে থাকা হাত দুটো নিচের দিকে ঝুলে পড়ল। পিসির শরীরটাও যেন নিথর হয়ে গেল। তার শরীরটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। পরিতোষ শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ডাক্তার বিশ্বাসের দিকে চেয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “পিসি অজ্ঞান হয়ে গেছেন ডক্টর”।

ডক্টর বিশ্বাস তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ, বুঝেছি। তবে ঘাবড়াবেন না। ওনাকে ঘরে নিয়ে আসুন। এখনই একটা ইঞ্জেকশন পুশ করতে হবে” বলে পেছন ফিরে একটা ঘরের ভেতর ঢুকে গেলেন। পরিতোষ আর দেরী না করে হৈমবতীদেবীর শরীরটাকে পাঁজাকোলা করে ডাক্তারের পেছন পেছন সেই ঘরে গিয়ে ঢুকল। তার পেছন পেছন বাড়ির প্রায় সকলেই ঘরের ভেতর এসে ঢুকল।

ডক্টর বিশ্বাস নিজের ব্যাগ থেকে সিরিঞ্জ বের করে তাতে ওষুধ ভরতে ভরতে বললেন, “ওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিন। আর অন্যরা ঘরের সবগুলো জানালা খুলে দিন। দড়জার দিকে কেউ ভিড় করবেন না প্লীজ”।

পরিতোষ সযত্নে পিসির শরীরটাকে বিছানায় শুইয়ে দিল। শ্যামলেন্দু আর বিমলেন্দু ঘরের জানালা গুলো খুলে দিলেন। ডাক্তার স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে হৈমবতীদেবীর বুকের স্পন্দন বুঝে নিয়ে তার হাতে ইঞ্জেকশন পুশ করে তার পালস দেখতে দেখতে বললেন, “একটা গ্লাসে হাল্কা গরম জল, আর এক গ্লাস দুধ নিয়ে আসুন, তাড়াতাড়ি” বলতে বলতে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা ট্যাবলেট বের করলেন।

নিরঞ্জনবাবু হৈমবতীদেবীর বিছানার মাথার দিক থেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি বুঝছ ডাক্তার? কোন বিপদ হবে না তো”?

ডক্টর বিশ্বাস বললেন, “ভয় পাবেন না। কিচ্ছু হবে না। সাময়িক উত্তেজনাটা সইতে পারেননি বলেই এভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়েছেন। আশা করছি পাঁচ মিনিটের ভেতরেই সেন্স ফিরে আসবে”।
 

পরিতোষ তার পিসির শিয়রের কাছেই বসেছিল। মাথা ঘুড়িয়ে নিরঞ্জনবাবুর একটা হাত দু’হাতে নিজের হাতে ধরে বলল, “কি দরকার ছিল পিসেমশাই? আমি তো বলেই ছিলাম, আমি দুর থেকে পিসিকে একটা প্রণাম করেই চলে যাব। এভাবে তাকে বিপদে ফেলা কি ......”

তার কথার মাঝেই ডক্টর বিশ্বাস পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে মোলায়েম স্বরে বললেন, “মিস্টার সান্যাল, অত চিন্তা করবেন না। আমি বলছি তো, কোনও বিপদ হবে না। উনি আর একটু বাদেই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আমি দায়িত্ব নিয়ে এ’কথা দিচ্ছি আপনাকে। শি ইস পারফেক্টলি অলরাইট। এবার সেন্স ফিরে এলেই এই ট্যাবলেটটা খাইয়ে দিলেই এভরিথিং উইল বি ওকে। রিল্যাক্স প্লীজ”।
 

এমন সময় ছোটবৌ দু’হাতে দুটো গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বড়বৌ সুলোচনা একটা ছোট টেবিল খাটের পাশে রাখতে রাখতে পরিতোষের উদ্দেশ্যে বললেন, “তুমি শান্ত হও ঠাকুরপো। ডাক্তারবাবু মা-র নাড়ী নক্ষত্র সব কিছু চেনেন। উনি যখন অভয় দিচ্ছেন তাহলে আমাদের ভাববার কিছু নেই। তুমি বরং ততক্ষণ আমার সাথে এসো একটু”।

ছোটবৌ দেবিকা টেবিলের ওপর একটা জলের আরেকটা দুধের গ্লাস রাখতে পরিতোষ সুলোচনাকে বলল, “না বড়বৌদি, প্লীজ। পিসি সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত আমি এখান থেকে সরব না”।

ঠিক এমন সময়েই হৈমবতীদেবীর শরীরটা যেন একটু নড়ে উঠল। আর প্রায় সাথে সাথেই খুব দুর্বল গলায় তিনি বলে উঠলেন, “পরিতোষ, আমার দুর্গার ছেলে কোথায়? আমার ভাই দুর্গার ছেলে কি আবার আমাকে ছেড়ে চলে গেল”?

পরিতোষ সাথে সাথে হৈমবতীদেবীর হাতখানা ধরে বলল, “এই তো পিসি, এই তো আমি। তোমার পাশেই আছি, কোত্থাও যাইনি তো”।
 

ঘরের সকলের মুখেই স্বস্তির ভাব ফুটে উঠল। হৈমবতীদেবী পরিতোষের একটা হাত চেপে ধরে বলল, “তুই তোর হাতটা একটু আমার মাথায় রাখ না বাবা। তাহলে আমি বুঝব, বাবা আমাকে, তোর পিসেমশাইকে আর আমাদের ছেলেমেয়েদের সবাইকে মেনে নিয়েছেন”।

পরিতোষের দু’চোখ বেয়ে দরদর করে অশ্রুধারা নেমে এল। হৈমবতীদেবী নিজেই পরিতোষের হাতটা নিজের মাথার ওপর চেপে ধরলেন। পরিতোষও নিজের হাতটা হৈমবতীদেবীর মাথায় চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “আমি যে তোমাদের কারো নাম ঠিকানা কিচ্ছুটি জানতাম না পিসি। ছোটবেলায় বাবার মুখেই শুধু দু’একবার শুনেছি যে তার এক দিদি ছিল। আমি তো আর কিচ্ছুটি জানতাম না”।

এবার ডক্টর বিশ্বাস হৈমবতীদেবীকে বললেন, “আচ্ছা ভাইপোর সঙ্গে কথা তো রাতভর বলতে পারবেন বৌদি। আমি তো আর রাতভর এখানে বসে থাকতে পারব না। বেশী দেরী হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে যে বৌয়ের ঠ্যাঙ্গানি খেতে হবে। তাই এ ওষুধটা খেয়ে নিন তো দেখি”।

হৈমবতীদেবীকে ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে ডক্টর পরিতোষকে বলল, “মিঃ সান্যাল, এবার আপনি দুধটুকু আস্তে আস্তে আপনার পিসিকে খাইয়ে দিন। তাহলেই দশ মিনিট বাদে দেখবেন উনি বাড়িময় ছুটোছুটি শুরু করে দেবেন” বলে আরেকবার হৈমবতীদেবীর পালস দেখে সন্তুষ্ট মুখে উঠে পড়লেন।
 

যাবার আগে বড়বৌকে কিছু নির্দেশ দিয়ে পরিতোষের সাথে হ্যান্ডশেক করে ডক্টর বিশ্বাস বেরিয়ে গেলেন।


******************

ডাক্তারের কথাকে সত্যি প্রমাণিত করে হৈমবতীদেবী সত্যিই মিনিট দশেক বাদেই বিছানা থেকে উঠে পড়লেন। তিনি সুস্থ হয়ে উঠতেই সারা বাড়িতে যেন উৎসবের ঢেউ বইতে শুরু করল। তিনি নিজেই পরিতোষের হাত ধরে গোটা বাড়িটা ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে দেখাতে শুরু করলেন। পরিতোষও খুশী মনেই পিসির হাত ধরে ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল। তার মনে হচ্ছিল, পিসি নন, হৈমবতীদেবী যেন তার নিজের মা। মায়েরা যেমন ছোট ছেলেকে হাত ধরে হাঁটা শেখান, হৈমবতীদেবীও যেন ঠিক তেমনটাই করছিলেন।
 

পরিতোষেরও যেন খুব ভাল লাগছিল। এমন ভাল লাগা তার জীবনে এর আগে আর কখনও সে পায়নি। কিন্তু কোন একদিকে শাঁখ আর কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠতেই তার মনে হল এ কি! এরই মধ্যে সন্ধ্যে হয়ে গেল! তার তো কালচিনি ফিরে যাবার কথা ছিল। আর সাথে সাথেই মনে পড়ল রচনার কথা। রচনাকে সে কথা দিয়েছিল যে পিসির সাথে দেখা হবার পর সে প্রথম খবরটা তাকেই জানাবে। অবশ্য খবর এখনও কাউকেই দেওয়া হয়নি। কিন্তু রচনা তো তখনই ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিল। আর বলেছিল, যতক্ষণ না পরিতোষের ফোন পায়, ততক্ষণ অব্দি সে প্রার্থনা করেই যাবে। ইশ, একেবারেই মনে ছিলনা কথাটা। পকেট থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে সুইচ অন করল। গদিঘর থেকে বৌদিদের সাথে লিফটে চেপে ওপরে আসবার সময়েই সে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিল।
 

কিন্তু ফোন করতে যাবার আগেই হৈমবতীদেবী তার হাত ধরে আরেকদিকে টানতে টানতে বললেন, “চল বাবা, আজ আমরা মায়ে পোয়ে একসাথে ঠাকুর প্রণাম করি গিয়ে”।

পরিতোষ মায়ের বাধ্য ছেলের মতই মোবাইল পকেটে রেখে পিসির হাত ধরে ঠাকুরঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। দু’জনে ঠাকুর প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই বড়বৌ সারা বাড়িতে ধূপ আর প্রদীপ দেখিয়ে ঠাকুরঘরে এসে বললেন, “ও-ও তোমরা এখানে? আর আমি সারা বাড়িময় তোমাদের খুঁজে এলুম”।
 

হৈমবতীদেবী প্রদীপ আর ধূপের ওম পরিতোষের আর নিজের মাথায় মেখে নিতেই সুলোচনা বললেন, “মা, তুমি ঠাকুরপোকে নিয়ে এখন আর নিজের ঘরে না গিয়ে বরং বসবার ঘরে গিয়ে বসো। ছোটো আর মেজো চা জল খাবার বানিয়ে ওখানেই নিয়ে আসবে। সবাই একসাথে বসে ঠাকুরপোর গল্প শুনতে শুনতে খাব”।

পরিতোষ একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “কিন্তু পিসি, আমাকে যে এখন বেরোতে হবে। আমি কাকুকে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে তোমাকে দেখে আমি আজই কালতচিনি ফিরে যাব”।

হৈমবতীদেবী পরিতোষের হাতটা নিজের হাতে ধরে রেখেই বললেন, “তুই তো বিধুর সাথে দেখা করতেই যাচ্ছিস, তাইনা বাবা? ভাবিস নে। আমি বিধুকে এখনই ফোন করে দিচ্ছি। ও কাল সকালেই এখানে এসে পড়বে দেখিস”।
 

পরিতোষ একটু চিন্তিতভাবে বলল, “কিন্তু পিসি, আজ রাতে কালচিনিতে কাটিয়ে কাল সকালেই আমাকে সেখান থেকে মালবাজার যেতে হবে একটা বিশেষ কাজে। মালবাজারের কাজ শেষ করেই আমি সেখান থেকে বাগডোগরা গিয়ে ফ্লাইটে কলকাতা চলে যাব। কালই আমার ছুটির শেষ দিন”।
 

পরিতোষের কথা শুনে বড়বৌ ঠাকুরের আসনের সামনে টুকিটাকি কাজ করতে করতেই পরিতোষের দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। হৈমবতীদেবী পরিতোষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বললেন, “চুয়াল্লিশটা বছর ধরে রোজ রাধামাধবের কাছে প্রার্থনা করতুম, আমি যেন আমার মা বাবা আর ভাইকে ফিরে পাই। এতগুলো বছরের ভেতর পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে গেছে। আমার মা, বাবা, ভাই, ভাইবৌ এক এক করে সকলকেই ভগবান তার কাছে টেনে নিয়েছেন। তবু তিনি আমার প্রার্থনায় সারা দেন নি। আজ যখন রাধামাধবের অসীম কৃপায় তোকে কাছে পেয়েছি, তখন একটা দিনও আমার কাছে থাকবি না বাবা? আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত কি এখনও সম্পূর্ণ হল না”?

______________________________
Like Reply
(Update No. 233)

পরিতোষ পিসির কথার জবাবে কি বলবে ভেবে পেল না। হৈমবতীদেবীর কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলবার মত কিছুই যেন সে খুঁজে পেল না। পিসির দুটো হাত ধরে সে কাতরকন্ঠে বলল, “অমন করে বোল না পিসি। মাকে তো আমি শুধু ছবিতেই দেখেছি। মায়ের আদর কাকে বলে সেটাও কোনদিন বুঝতে পারিনি। বাবার মুখে ছোটবেলায় শুধু শুনেই ছিলাম যে আমার এক পিসি ছিল, উত্তরবঙ্গে কোথাও। কিন্তু তিনি বেঁচে আছেন না আমার মায়ের মতই স্বর্গে চলে গেছেন, জানতে পারিনি। বাবা চলে যাবার পর গত সাতটা বছর ধরে আমি ভাবতাম আমি একটা অনাথ ছেলে। এতবড় পৃথিবীতে আমার নিজের বলতে একটা লোকও নেই। আজ ভগবানের আশীর্বাদে এই মূহুর্তে আমি যে কত খুশী, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। পিসি মাসি এরা তো মায়েরই সমকক্ষ। তোমার হাত ধরে এতক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হচ্ছিল আমি বুঝি আমার মায়ের হাত ধরেই হাঁটছি। এমন সুখ যে আমার কাছে এতদিন অধরাই ছিল পিসি। আজ দুপুরেই প্রথমে কালচিনিতে কাকু আর বিকেলে গদিতে পিসেমশাইয়ের মুখেই তোমার কথা শুনলাম। যা এতদিন আমার কাছে পুরোপুরি অজানা ছিল। শুনলাম বাবা তোমাকে খুব ভালবাসতেন। বাবা কোনদিন আমার সাথে তোমার ব্যাপারে বেশী কিছু কথা বলতেন না। হয়ত তিনি তার বাবার আদেশ মেনেই সেটা করেছিলেন। আর ঠাকুমা আর দাদু কেন তোমার ওপর অভিমান করেছিলেন সে’কথা আমার চাইতে তোমরাই বেশী ভাল জানো। আমি তো সে’সবের কিচ্ছু জানিনা। হয়তো ওই বয়সে বাবাও সেটা পুরোপুরি বুঝতে পারেন নি। কিংবা নিজের মনের ইচ্ছে মুখে প্রকাশ করে মা-বাবার সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করবার সাহসও হয়তো পাননি তিনি। এই মূহুর্তে আমি শুধু এটুকুই জানি তুমি আমার পিসিমা। আমার মায়ের সমতূল্যা। যাকে আমি আজ জীবনে প্রথমবার দেখতে পেলাম তার ওপর কি আমি অভিমান করে থাকতে পারি, বলো? আর বিগত কয়েকটা ঘন্টায় দাদু ঠাকুমাদের সাথে তোমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হবার ব্যাপারে যা কিছু শুনেছি তাতে শুধু দুঃখই পেয়েছি। আমি ব্যক্তিগত ভাবে ভালোবাসাকে খুব শ্রদ্ধা করি পিসি। যারা নিঃস্বার্থ হয়ে নিখাদ ভাল বাসতে পারে তাদের সব্বাইকে আমি অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করি। তাই তুমি যে আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেও নিজের ভালবাসাকে যেভাবে সম্মান জানিয়েছ তাতে তোমার ওপর আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেছে। দাদু ছিলেন সে যুগের মানুষ। তার মানসিকতা নিশ্চয়ই অন্যরকমই ছিল। তাই হয়ত তিনি সেদিন সেটা মেনে নিতে পারেননি। আজ যদি তারা বেঁচে থাকতেন, তাহলে যুগের ধারার সাথে তাল রেখে তারাও হয়ত অনেক আগেই তোমাকে আবার কাছে টেনে নিতেন। আজ যে ঘটণাচক্রে আমি এখানে এসে পড়েছি, তোমার হাতের আদর আমার কপালে জুটল, এর পেছনে নিশ্চয়ই দাদু ঠাকুমার আত্মার প্রেরণা আছে। নইলে একটু ভেবে দেখো তো, চব্বিশ ঘন্টা আগেও আমি জানতাম না যে আমার আপন পিসি এখানে আছে। কাল বিকেলে নাগরাকাটায় আমার কলীগ বন্ধুর বাড়িতে বিধুকাকুর বড় মেয়ের মুখে তার বাবার নামটা শোনামাত্রই যেন আমার ভেতরে কী একটা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু দেখো, বিধুকাকুর ছোট মেয়ে রচনাকে আমি অনেক আগে থেকেই চিনি। ওদের সাথে আমার খুব ভাল সম্পর্ক। আমি ওকে নিজের ছোটবোনের মত স্নেহ করি। কিন্তু ওর মুখে কখনও আমি ওর বাবার নাম, মানে বিধুকাকুর নামটা শুনিনি। বিধুকাকুর কাছে কোন এক অদৃশ্য শক্তিই যেন আমাকে আজ টেনে এনেছিল। নইলে তোমার বেঁচে থাকবার কথা শোনা, এখানে এসে তোমাদের সকলের সাথে দেখা করা, কিছুই তো হত না। আমি তো জানতেও পারতাম না যে আমার পিসি আছে, পিসেমশাই আছে, তিন তিনটে দাদা, বৌদি, দু’দুটো দিদি আর এতসব ছোট ছোট ভাই ভাইপো ভাইঝি আছে। আর তুমি বলছ আমি এখনও ভাবছি যে তোমার প্রায়শ্চিত্ত এখনও সম্পূর্ণ হয়নি”?
 

হৈমবতীদেবী পরিতোষকে আবার দু’হাতে জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেতে খেতে বলল, “তুই ঠিক বলছিস বাবা। আমারও মন বলছে এর পেছনে বাবার আত্মার নির্দেশ নিশ্চয়ই আছে। নইলে চুয়াল্লিশটা বছর ধরে আমি যে তপস্যা করে যাচ্ছিলুম, তা এক পলকেই এভাবে পূর্ণ কিছুতেই হত না। তবে বিধু আমাকে ওর কাছে চিরঋণী করে ফেলল। ওর এ উপকারের প্রতিদান আমি সারা জীবনেও শোধ করতে পারব না। দাঁড়া, বড়বৌমা, তোমার মোবাইলটা এনে বিধুর সাথে যোগাযোগ করো তো। আমি এখনই ওর সাথে কথা বলব”।

বড়বৌ সুলোচনা এতক্ষণ পিসি ভাইপোর পাশে দাঁড়িয়েই এমন সুন্দর দৃশ্য দু’চোখ ভরে দেখছিলেন। এবার শ্বাশুড়ি মা-র কথা শুনে তিনি বললেন, “মা চলো, বসবার ঘরে গিয়েই আমি বিধুমামুর সাথে তোমার কথা বলিয়ে দিচ্ছি”।
 

ঠিক এমন সময় একটু দুরের একটা দড়জা দিয়ে উঁকি মেরে মেজবৌ রুমা বললেন, “বড়দি, মা, ঠাকুরপোকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে এস তোমরা। ওখানে চা জলখাবারের আয়োজন করে ফেলেছে ছোটো”।
 

বসবার ঘরে সুলোচনা হৈমবতীদেবী আর পরিতোষকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে ঘরের ভেতর আগে থেকে বসে থাকা ছোট ছোট বাচ্চাদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এই তোরা সবাই ছোটকাকুর ঘরে গিয়ে বোস তো। তোদের খাবার সেখানেই দেওয়া হবে। এখানে বড়রা জরুরী ব্যাপারে কথা বলবে”।

বাচ্চারা সকলেই যেন একটু হতাশ হল। তাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় সে মুখ কাচুমাচু করে বলল, “ওমা, আমাদের এই নতুন কাকুটার সাথে তো আমরা কথাই বলতে পারলাম না এখন অব্দি। এখনও আমাদের সবাইকে চলে যেতে বলছ? আর খাবার খেয়ে সাথে সাথে পড়তে না বসলে আবার গালমন্দ করবে। আমরা তাহলে কাকুর সাথে কখন কথা বলব”?
 

সুলোচনাদেবী নিজের ছেলের কথার কিছু একটা কড়া জবাব দেবার আগেই পরিতোষ বাচ্চাদের কাছে গিয়ে দু’তিন জনকে দু’হাতের বেষ্টনীতে নিয়ে বলল, “একদম মন খারাপ কোর না তোমরা কেউ। আজ কেউ তোমাদের কোনরকম গালমন্দ করবে না। তোমরা খাবার খেয়ে যে যার পড়া নিয়ে বোসো। আমি ঘন্টাখানেক তোমাদের মা আর ঠাকুমার সাথে কথা বলেই তোমাদের কাছে চলে আসব। তোমরা এর ভেতরেই নিজের নিজের কলেজের হোমটাস্ক গুলো শেষ করে ফেলো কিন্তু। নইলে আমি চলে আসলে তো সে’সব অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তাই না”?

পাঁচজন বাচ্চাই পরিতোষকে জাপটে ধরে বলল, “ঠিক আছে কাকু। আমরা খুব তাড়াতাড়ি আমাদের হোমটাস্ক কমপ্লিট করে ফেলছি। তুমি কিন্তু এক ঘন্টা বাদে ঠিক চলে আসবে ওখানে” বলে সকলে মিলে পরিতোষের গালে চুমু খেয়ে হৈ হৈ করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
 

এমন অভিজ্ঞতাও পরিতোষের জীবনে এই প্রথম। পাঁচ পাঁচটা শিশু কিশোর একসাথে তাকে চুমো খেতে পারে, এ ভাবনা জীবনেও কখনো তার মনে আসেনি। বাচ্চাদের চলে যাওয়া দড়জার দিকে হতভম্বের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার দু’চোখ জলে ভরে গেল।
 

ছোটবৌ দেবিকা টেবিলের ওপর চায়ের সরঞ্জাম আনতেই বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে স্নেহমাখা গলায় বললেন, “ছিঃ ঠাকুরপো, আজ আমাদের সকলের জীবনে কত বড় একটা খুশীর দিন। এমন দিনে চোখের জল ফেলতে নেই ভাই। এসো, ওঠো। চলো, সবাই মিলে চা খাই”।

ওদিকে হৈমবতীদেবী তখন ফোনে বলছেন, “আমি আলিপুরদুয়ার থেকে তোমার বাবার হিমুদি বলছি বাবা। একটু তোমার বাবাকে ফোনটা দেবে? ...... ও সে এখন দোকানে ..... আচ্ছা আচ্ছা বাবা, আমি লাইনে থাকছি। তা তোমরা বাড়ির সকলে ভাল আছ তো বাবা? তোমার মা ভাল আছেন তো? ... হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা, তোমার পরিদাও ভাল আছেন। এই তো আমরা সবাই মিলে একসাথে বসে চা খাচ্ছি এখন .... হ্যাঁ, কে বিধু? খুব ব্যস্ত আছিস নাকি রে ভাই? ....... আচ্ছা বেশ, তবে শোন। তুই আমার যা উপকার করলি আজ তার বিনিময় তো আমি সারা জীবনেও দিতে পারবনারে ভাই। কিন্তু শোন, কাল সকালেই তুই তোর বৌ আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তোদের সাথে খুব জরুরী কথা আছে আমার ....... না না, ও’সব কথা আমি শুনছি নে। যত কাজই থাকুক, তোদের আসতেই হবে। দোকান বন্ধ রেখে চলে আসবি ...... অ্যা? কি বলছিস? তোর ছেলের কলেজ খোলা? থাকুক কলেজ খোলা। কাল একটা দিন না’হয় ও কলেজ কামাইই করল, তাতে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না। আমি কোন অজুহাতই শুনছি না। কাল সকালে তুই বিভা, অর্চু, কিংশুক সবাইকে নিয়ে এখানে চলে আসবি .... কি? অর্চু নাগরাকাটায়? সেখানে কে আছে? ..... ও-ও তোর ছোট মেয়ে রচুর বড় ননদ?....... আচ্ছা ঠিক আছে, ও বাড়িতে নেই যখন তখন তো আর করবার কিছু নেই। তবে তোরা তিনজন কিন্তু অবশ্যই চলে আসবি। রাতে যদি থাকতে না চাস তাহলে সন্ধ্যের ট্রেন ধরে না হয় ফিরেই যাস তোরা, তখন আটকাব না। কিন্তু কাল সকালে কিন্তু অবশ্যই আসবি ভাই। আর কোন কথা নয়। বাকি কথা কাল সাক্ষাতে আলোচনা করা যাবে। রাখলুম” বলে ফোন নামিয়ে রাখলেন।

ছোটবৌ দেবিকা আর মেজবৌ রুমা হৈমবতীদেবী, পরিতোষ আর সুলোচনাদেবীর হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে নিজেরাও নিজেদেরটা নিয়ে আলাদা আলাদা সোফায় বসল। নিরঞ্জনবাবু আর তার তিন ছেলেই হৈমবতীদেবী সুস্থ হয়ে ওঠবার কিছু পরেই যার যার কর্মস্থলে চলে গেছেন। তবে সকলেই যাবার সময় পরিতোষকে বলে গেছেন যে তারা আজ রাতে একটু তাড়াতাড়িই ফেরবার চেষ্টা করবেন।

পরিতোষ বুঝে গেছে যে পিসির আদেশে আগামীকাল সকালেই বিধুবাবু আর বিভাদেবী এখানে আসছেন। হয়তো কিংশুকও আসবে। এমতাবস্থায় আগামীকাল যে তার মালবাজার যাবার কথা ছিল তা বোধহয় ভেস্তেই যাবে। হাতের ছুটিও শেষ। কে জানত যে নাগরাকাটায় সীমন্তিনীর কাছে এসেই সে তার নিজের পিসি আর তার পরিবারকে খুঁজে পাবে। মনে হচ্ছে ছুটি বাড়াতেই হবে। কারন মালবাজার যাওয়াটা খুবই প্রয়োজনীয়। সেখানে না গিয়ে কলকাতা ফেরা যাবে না।

তার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে মেজবৌ রুমা পরিতোষকে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ঠাকুরপো? এত কি ভাবছ? এখানে এসে আমাদের দেখে বুঝি খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেছ? নিশ্চয়ই ভাবছ, এ কোন চিড়িয়াখানায় এসে পড়লুম রে বাবা”?

পরিতোষ হেসে বলল, “না মেজবৌদি তা নয় গো। আজ কালচিনি ফিরে গিয়ে কাল সকালে মালবাজার যাবার কথা ছিল আমার। সে’কথাই ভাবছিলাম। আর তুমি চিড়িয়াখানার কথা বলছ? গত সাতটা বছর ধরে বিশাল এক চিড়িয়াখানাতেই তো জীবন কাটাচ্ছি মেজবৌদি। ওই বিশাল খাঁচার মধ্যে একমাত্র আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণীর ছায়া পর্যন্ত পড়ে না। তোমাদের এ চিড়িয়াখানায় এসে আশেপাশে এতজনকে পেয়ে মনে হচ্ছে আমি স্বপ্ন দেখছি। আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এমন স্বপ্ন আমি চব্বিশ ঘন্টা আগেও দেখবার কল্পনাও করতে পারিনি। আমার সম্পর্কের এত লোকের সাহচর্য যে আমার কপালে আছে, এ’কথা তো সারা জীবনেও ভাবতে পারিনি আমি। আমার মত একজন অনাথকে আমার নিজের সম্পর্কের কচি কচি পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝি এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরবে এ তো ...........”

রুদ্ধ কান্নায় নিজের কথা শেষ করতে পারল না। পাশে বসে থাকা হৈমবতীদেবী পরিতোষের কাঁধে হাত রেখে তাকে শান্ত করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। ছোটবৌ দেবিকা জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি সত্যিই মা-বাবার ব্যাপারে, আমাদের সকলের ব্যাপারে কিছুই জানতে না এতদিন”?
 

পরিতোষ একটা বড় করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “না ছোটবৌদি, তোমাদের সকলের কথা তো দুর, আমি পিসেমশাই বা পিসির নামটা পর্যন্ত আজ বিকেলের আগে শুনিনি। জন্মের পর খুব ছোট থাকতেই, আমার বয়স যখন মাত্র দু’বছর, তখন মাকে হারিয়েছি। তারপর ছোটবেলাতেই ঠাকুমা আর ঠাকুর্দা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর একমাত্র বাবাকেই দেখেছি। বাবা পুলিশে ছোটখাট একটা চাকরী করতেন। খুব সৎ মানুষ ছিলেন। বাবার স্বপ্ন ছিল তার ছেলেকে আইপিএস অফিসার বানাবার। ২০০৫ সালে আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করে আমি যখন হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে চলে গেলাম তার মাস দু’য়েক বাদেই বাবার হার্ট অ্যাটাক হল। বাবাকে হারালাম। আমাদের বাড়িতে দু’ তিনটে ছবি আছে। তাতে ঠাকুমা, ঠাকুর্দা, বাবা আর মা থাকলেও পিসির কোন ছবি ছিল না। বাবার ছোটবেলাকার একটা ছবি আছে। তাতে কিশোর বয়সের বাবার সাথে তার এক বন্ধুর ছবি আছে। গতকাল জানতে পারলাম বাবার সেই বন্ধুটিই হচ্ছেন কালচিনির বিধুকাকু। পিসির কোন ছবি আমি কোথাও দেখিনি। তবে ছোটবেলায় কথায় কথায় বাবা মাঝে মধ্যে বলতেন যে গ্রামে থাকতে তার এক বড়দিদি ছিল, যাকে উনি খুব ভালবাসতেন। সেই পিসি নাকি ভূটান আর আসাম সীমান্তের কাছাকাছি কোন একটা গ্রামে থাকেন। সেখানেই নাকি নিজে পছন্দ করে অ', এক ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই দাদু ঠাকুমারা তাদের মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছিলেন। পিসির সম্বন্ধে শুধু এটুকুই আমি শুনেছি। তবে কোনভাবে পিসির প্রসঙ্গ উঠলেই বাবা যেন কেমন হয়ে যেতেন। আমি পিসির ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলেই আমাকে বলতেন, আর কিচ্ছু জিজ্ঞেস করবি না। আমার কাছ থেকে সরে গিয়ে আড়ালে গিয়ে কাঁদতেন। সেটা দেখেই আমার ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে বাবা পিসিকে সত্যি খুব ভালবাসতেন। বাবা কাঁদতেন বলে আমিও আর পিসির কথা ওঠাতাম না কখনো। এভাবেই কেটেছে। তারপর তো বাবাও আমাকে একা ফেলে চলে গেলেন। বাবার চেনা পরিচিত কারো মুখে পিসির কথা শুনতাম না। তাই পিসির সম্বন্ধে এতদিন আমি কিচ্ছুটি জানতাম না”।
 

হৈমবতীদেবী নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “হ্যাঁরে, ঠিক বলেছিস তুই, বাবা। ভাই আমাকে সত্যিই খুব ভালবাসত। ছোটবেলায় তার সমস্ত আবদার ছিল আমার কাছেই। আমাদের বিয়ের তিনদিন পর যখন মা-বাবার সাথে দেখা করে তাদের আশীর্বাদ নিতে গিয়েছিলুম, সেদিন বাবা আমাদের মুখের ওপর দড়জা বন্ধ করে বলেছিলেন যে তার মেয়ে তিনদিন আগে অপঘাতে মারা গেছে। এ পৃথিবীতে মেয়ে বলতে তাদের আর কেউ নেই। আমিও যেন ভাবি যে আমার মা বাবা ভাই সবাই মরে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে যখন সে বাড়ি থেকে তোর পিসোর সাথে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছিলুম, তখন রাস্তায় এক জায়গায় তোর বাবার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমাকে দেখে আগের মতই ছুটে কাছে এসে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও থমকে গিয়েছিল। আমার মত ওরও দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা বইছিল। ওঃ সেদিনের সেই দৃশ্যটা সারা জীবন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়েও একলাফে দু’পা পেছনে সরে গিয়েছিল। তারপর কোন কথা না বলে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে হাত ছুঁইয়ে একটা প্রণাম করেই ছুটে একদিকে চলে গিয়েছিল। সেটাই আমার ভাইয়ের তার দিদিকে জীবনের প্রথম আর শেষ প্রণাম করা”।

বলতে বলতে হৈমবতীদেবী আবার কেঁদে ফেললেন। বড়বৌ সুলোচনা ছুটে গিয়ে শাশুড়িমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এ কী করছ মা? এভাবে কাঁদলে তো তুমি আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে। শান্ত হও। ভগবান এতদিনে আমাদের দিকে মুখে তুলে তাকিয়েছেন। তুমি তোমার ভাইপোকে খুঁজে পেয়েছ। আজ আর কান্না নয় মা”।
 

ছোটবৌ দেবিকা এবার শাশুড়িকে বলল, “মা সব কিছু দেখে শুনে আমার মনে হচ্ছে তোমার এ ভাইপো আমার সমবয়সীই হবে। আমাদের ভেতর বৌদি ঠাকুরপোর সম্পর্ক তো থাকবেই, কিন্তু” বলেই হঠাৎ পরিতোষের দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ঠাকুরপো, তুমি বিয়ে করেছ”?

পরিতোষ এমন হঠাৎ প্রসঙ্গে একটু চমকে উঠল। আমতা আমতা করে লাজুক স্বরে বলল, “না ছোটবৌদি, সেটা আর হয়ে ওঠেনি”।

বড়বৌ সুলোচনা বললেন, “আহ, ছোটো, কী হচ্ছে এ’সব? আজই তো ওর সাথে আমাদের পরিচয় হল। এতদিন তো বেচারার অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। এবার আমরাই দেখে শুনে ওর বিয়ে দেব”।

ছোটবৌ দেবিকা একটা কিশোরীর মত আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল, “উঃ, কি মজা হবে। আমার খুব শখ ছিল এক দেবরের বিয়েতে খুব আনন্দ স্ফুর্তি করব। কিন্তু এ পরিবারের ছোটবৌ হবার ফলে সে শখ আর পূর্ণ হয়নি। এতদিনে একটা ঠাকুরপো পেলাম। এবার আমি আমার মনের সে সাধটা মেটাতে পারব”।

এবার মেজবৌ রুমা তার বড়জাকে বলল, “আচ্ছা বড়দি, তোমার কি মনে হয় অভিভাবক নেই বলেই এমন কন্দর্পকান্তি একটা ছেলের বিয়ে হবে না? নিজেরা পছন্দ করেই তো হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বিয়ে করছে। তবে দেবরের জন্য ঘটকালি করবার আগে ভাল করে খবর নিয়ে নিও। তার ভালবাসার কোন পাত্রী টাত্রী আছে কি না। নইলে কিন্তু নিজেই ফ্যাসাদে পড়তে পার”।
 

ছোটবৌ দেবিকা বলল, “একদম ঠিক বলেছ মেজদি। এমন হ্যান্ডসাম ছেলের প্রেমিকা থাকবে না, তাও আবার কলকাতার মত একটা শহরে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। তার খবর তো নিতেই হবে। কিন্তু তোমাদের কথায় আমি মাকে যে কথাটা বলতে যাচ্ছিলুম সেটা তো বলাই হল না, আচ্ছা মা..” বলে হৈমবতীদেবীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বলছিলাম, ঠাকুরপো আমার থেকে বড় ছোট যাই হোক না কেন, আমার তো দাদা বা ভাই বলতে কেউ নেই। আমি যদি চিরাচরিত দেবর বৌদির সম্পর্ক মেনেও ওকে ভাই বলে ডাকি, তাতে তুমি অনুমতি দেবে”?

হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “ওমা পাগলী মেয়ের কথা শোনো। দেবর বৌদির ভেতরে বয়সের ফারাক খুব বেশী না হলে তারা তো ভাই বোনের মত সম্পর্ক রাখতেই পারে। আগেকার দিনে তো দেবরেরা ছেলের বয়সীও হত। তখন বৌদি দেবরের মধ্যে মা-ছেলের মত সম্পর্ক হত। অনেকে তো বৌদিকে মা বলেও ডাকতো। তা হ্যাঁরে পরিতোষ, তোর বয়স কত হল, বল তো”? বলেই স্বগতোক্তির মত করে বললেন, “কপাল আমার, নিজের ভাইপোকে জিজ্ঞেস করছি, তার বয়স কত হল”?

পরিতোষ পিসির হাত ধরে বলল, “আমরা সবাই তো ভাগ্যবিধাতার হাতের খেলার পুতুল পিসি। তুমি যেমন আমার বয়স জানো না তেমনি আমি তো এটাও জানতুম না যে আমার পিসি আছে, দাদারা আছে, বৌদিরা আছে। তাই সেটা তোমার আমার দু’জনেরই দুর্ভাগ্য। তবে যে’কথা হচ্ছিল সেটাই বলি। আমার বয়স এখন তিরিশ। বিএসসি পাশ করবার পর আইপিএস পাশ করেছি। বাবার মৃত্যুর সময় আমি হায়দ্রাবাদে ছিলুম। তারপর কিছুদিন ভাইজ্যাগে ছিলুম। এখন কলকাতাতেই আছি দু’বছরের মত হল”।

এবার ছোটবৌ দেবিকা সাথে সাথে বলল, “দেখেছ মা! আমি বলেছিলুম না যে ও আমার সমবয়সীই হবে। আমি কিন্তু তাহলে এখন থেকেই ওকে ‘ভাইদা’ বলে ডাকব”।

মেজবৌদি রুমা দেবিকার কথা শুনে বলল, “বাহ, দারুণ একটা সম্বোধন খুঁজে বের করেছিস তো ছোটো। ‘ভাইদা’ আহ, সত্যি খুব মিষ্টি লাগছে ডাকটা শুনতে। তাই না বড়দি”? বলে বড়বৌ সুলোচনার দিকে তাকাল।

সুলোচনাও মিষ্টি হেসে বললেন, “হ্যাঁরে মেজো। ডাকটা খুব মিষ্টি লাগবে শুনতে। আমরা তিনজনেই ওকে এখন থেকে ‘ভাইদা’ বলেই ডাকব। মা তুমি কি বলো”?

হৈমবতীদেবী হেসে একহাতে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোমরা ওকে যদি ওই নামে ডেকে খুশী হও, তাতে আমি কেন বারণ করব। কিন্তু বড়বৌমা, ছোটবৌমা ওর সমবয়সী হলেও ও তো তোমার আর মেজবৌমার থেকে বয়সে অনেক ছোট হবে, তবু ওকে ভাই না বলে ভাইদা বলে ডাকবে তোমরা”?

বড়বৌ বললেন, “শুধু বয়সটাই কি সবকিছুর মাপকাঠি হয় মা? আমি তো বিশ্বাস করি আত্মীয়দের মধ্যে অন্তরঙ্গতাকেই সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বলে গণ্য করতে হয় আর সবচেয়ে ওপরে রাখতে হয়। ষোল বছর আগে এ বাড়ির বৌ হয়ে এসেছিলুম। তখন থেকেই তো দেখে আসছি, দাদু দিদিমা আর মামাকে এ বাড়ির সকলে মিলে কত খোঁজা খুঁজি করছে। আমাদের ভাগ্যে ছিল না তাদের কাউকে চাক্ষুষ দেখবার। তাই আজ যখন জানতে পারলুম যে যাদের আমরা এতবছর ধরে খুঁজে চলেছি, তারা সবাই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন, তাতে তো আমরা দুঃখ পেয়েছিই। কিন্তু তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আজ আমাদের সাথে আমাদের সামনে বসে আছে, সে কি আর কোন অংশে কম আনন্দের ব্যাপার মা? ও যে আমাদের কাছে কোহিনূর হীরের চাইতেও দামী গো”।


______________________________
Like Reply
(Update No. 234)

হৈমবতীদেবী খুশী মুখে বললেন, “ঠিক বলেছ বড়বৌমা। পরিতোষ তো আমাদের কাছে সত্যিই হীরের চেয়েও দামী। তাহলে, তোমাদের মন যখন চাইছে, তোমরা ওকে ওই নামেই ডেকো। তবে একটা কথা আমি বা তোমাদের শ্বশুর মশাই নিজেদের মধ্য বলাবলি করলেও, কোনদিন তোমাদের কাছে প্রকাশ করিনি। আজ বলছি। আমি আর তোমার শ্বশুর মশাই মাঝেমধ্যেই নিজেদের মধ্যে আলোচনা করি যে অনেক পূণ্যের ফলে তোমাদের মত তিনটে পুত্রবধূ আমরা পেয়েছি। আজ সেটা আবার প্রমাণিত করলে তোমরা সবাই। তবে সম্ভাষণ আর সম্মোধনটাই তো বড় কথা নয় বৌমারা। এ ছেলেটাকে তোমরা স্নেহ মমতা দিতে কার্পণ্য কোর না। বেচারা জ্ঞান হবার পর থেকে এক বাবা ছাড়া আর কাউকে সেভাবে কাছে পায়নি। আর গত সাতটা বছর ধরে তো পুরোপুরি অনাথই ভেবেছে নিজেকে। জানি ওকে আমরা ধরে বেঁধে এখানে আটকে রাখতে পারব না। ওকে তো কলকাতাতেই ফিরে যেতে হবে। সেখানেই তো ওর কাজ। আর আমাদের দিন তো প্রায় ফুরিয়ে এল। তাই বলছি, শুধু মুখে ভাইদা বলেই নিজেদের কর্তব্য করছ বলে ভেবো না তোমরা। ভাইয়ের মত ওকে আজীবন ভালবেসো তোমরা। ওর পাশে যে কেউ নেই। ও যেন আজকের পর থেকে নিজেকে আর কখনও অনাথ বলে না ভাবতে পারে”।

বড়বৌ সুলোচনা মেজবৌ আর ছোটবৌকে হাত ধরে হৈমবতী দেবীর কাছে এনে বললেন, “মা, আমরা সবাই তো তোমার কাছেই সবকিছু শিখেছি। এতদিনে তো আশাকরি এ বাড়ির সবাই বুঝতে পেরেছেন যে আমরা তিন জা নই, আমরা তিন বোন হয়ে গেছি। এই তিন বোনের হয়ে আমি আজ তোমার কাছে শপথ করে বলছি মা। আমরা যতদিন বেঁচে থাকব, ভাইদাকে নিজের ভাইয়ের মতই স্নেহ ভালবাসা দিয়ে যাব। জানি ও হয়ত কোনদিনই আমাদের সাথে একসাথে থাকতে পারবে না। তবে তুমি নিশ্চিন্ত থেক মা, আজকের পর থেকে ওর সমস্ত ভাল মন্দে সবরকম দুঃখে সুখে আমরা সবসময় ওর পাশে থাকবার চেষ্টা করব”।

মেজবৌ আর ছোটবৌও তাদের শাশুড়ির হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ মা, বড়দি যা বললেন, আজ থেকে আমরা ঠিক তাই করব। ও আমাদের কাছ থেকে দুরে থাকলেও আমরা সব সময় ওর সমস্ত খবরাখবর রাখব। আমরা ওর এই তিন বৌদি, তিন দিদি হয়ে সব সময় ওর পাশে থাকব”।

ছোটবৌ দেবিকা বলল, “আর এখন আমাদের সামনে প্রথম দায়িত্ব হল ভাইদার জন্য সুন্দর একটা বৌ যোগাড় করা”।

এতক্ষণ শাশুড়ি আর তিনবৌয়ের কথাবার্তা শুনতে শুনতে পরিতোষের মনটা খুশীতে ভেতরে ভেতরে কাঁদছিল যেন। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে বসেছিল সে। রচনাকে ফোন করাটা আর হয়েই ওঠেনি। এবারে তার যেন হঠাতই আবার সে’কথা মনে হল। তাই সে গলা পরিস্কার করে বলল, “পিসি, আমি একটু বাইরে থেকে আসি? আসলে একজনকে এখনই আমার ফোন করা উচিৎ”।

হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাবি বাবা? বাইরে কেন যেতে চাইছিস আবার? এখানে অসুবিধে হলে না হয় পাশের ঘরে গিয়ে ফোনটা কর”।

ছোটবৌ দেবিকা পরিতোষের কাছে এসে তার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা এই মূহুর্তেই ফোনটা কাকে করা হবে, সেটা জানতে পারি? নিশ্চয়ই তোমার প্রেমিকা, তাই না ভাইদা”?

পরিতোষ হেসে বলল, “না ছোটবৌদি, এক্কেবারেই তা নয়। তবে তাকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে পিসির সাথে দেখা হবার পরেই তাকে ফোন করব। এতক্ষণেও সেটা আর হয়ে ওঠেনি। ও বেচারী হয়ত এখনও তার ঠাকুরের কাছে আমার জন্য প্রার্থনা করেই চলেছে”।

বলে সোফা থেকে দাঁড়িয়ে বাইরে যাবার উদ্দ্যোগ করতেই হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “তোর জন্যে সে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে, মানে”?

পরিতোষ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “আসলে পিসি, আমি তো নিচে তোমাদের গদিতে অনেকক্ষণ আগেই এসে পৌঁছেছিলাম। কিন্তু সকলে মিলেই দুশ্চিন্তায় ছিলাম যে আমার সঙ্গে দেখা হবার পর মা-বাবা, ঠাকুমা আর দাদুর মৃত্যু সংবাদ শুনে তুমি হয়ত সহ্য করতে পারবে না। একটা বিপদ টিপদ ঘটে যেতে পারে। তাই তো ডাক্তার ডেকে এনে সবকিছু পরামর্শ করেছেন সকলে মিলে। তখনই ওর সাথে ফোনে আমার কথা হয়। তোমার যাতে কোন বিপদ না হয়, আর আমিও যেন জীবনে প্রথমবার তোমাকে দেখতে পারি, এই জন্য ও ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা শুরু করেছিল। আর তখনই আমাকে বলেছিল যে, তোমার সাথে দেখা হবার পরই তোমার সুস্থতার খবরটা যেন আমি ওকে জানাই। আর আমি ফোন না করা পর্যন্ত ও প্রার্থনা করতেই থাকবে। এতক্ষণেও ফোনটা করতে পারিনি। এখন ফোনটা না করলে ওর ওপর খুব অন্যায় করা হবে গো”।

হৈমবতীদেবী সহ ঘরের বাকি তিন মহিলাও অবাক বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে পরিতোষের দিকে তাকালেন। হৈমবতীদেবী নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে বললেন, “একি বলছিস তুই বাবা? এমন মেয়েও এ দুনিয়ায় আছে? আমাকে চেনে না, জানে না, এমন কেউ আমার সুস্থতার জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছে”?

বড়বৌ সুলোচনা পরিতোষের একটা হাত ধরে বিস্ময় ভরা গলায় বললেন, “হ্যাঁ ভাইদা, এ তো সত্যিই খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার। তোমার পিসিকে তো তখনও তুমি নিজেই দেখ নি। আর সেও নিশ্চয়ই দেখে নি মাকে। শুধু তোমার পিসি বলেই মা-র জন্যে সে প্রার্থনা করছে? এ-ও কি সম্ভব”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “সে তোমরা সবাই যতই অবাক হও না কেন বড়বৌদি, আমি একেবারেই বানিয়ে বা বাড়িয়ে কিছু বলছি না। আসলে মেয়েটা অমনই। ও সকলের থেকে আলাদা”।

মেজবৌ রুমা বললেন, “মেয়ে? তাহলে সে নির্ঘাত তোমার প্রেমিকা না হয়ে যায় না। এই ভাইদা, সত্যি করে বলো তো, মেয়েটা কে? তোমাদের সম্পর্ক কতদিন ধরে চলছে”?
 

ছোটবৌ দেবিকা একেবারে পরিতোষের গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ ভাইদা, প্লীজ বলো না। আমারও খুব জানতে ইচ্ছে করছে গো”।

বড়বৌদি আর পিসির দিকে তাকিয়ে পরিতোষ বুঝতে পারল তাদের মনেও একই প্রশ্ন। তাই সে মনে মনে এক মূহুর্ত ভেবে বলল, “আচ্ছা বেশ, দাঁড়াও। আমি তোমাদের সামনে থেকেই তাকে ফোন করছি। আর ফোনের স্পীকারও অন করে দিচ্ছি। আমাদের দু’জনের সব কথাই তোমরা সবাই শুনতে পারবে। তাহলেই তোমাদের সকল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবে তোমরা, ঠিক আছে”?
 

বলে রচনার নাম্বার ডায়াল করে ফোন স্পীকারে দিল। ছোটবৌ দেবিকা পরিতোষের কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “সাবধান, ভাইদা। আগে থেকেই তাকে সতর্ক করে দিও কিন্তু। স্পীকার অন করে রেখে সবার সামনে চুমু টুমু খেয়ে বোসো না যেন তোমরা আবার”।

পরিতোষ তার দিকে চেয়ে মুচকি হাসতেই ও’পাশ থেকে রতীশের গলা শোনা গেল, “হ্যাঁ পরিদা, বলো। ওদিকের খবর কি? আমরা তো এতক্ষণেও তোমার ফোন না পেয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছি গো”।

পরিতোষ বলল, “এদিকের খবর খুব ভাল রতু। তা রচু কোথায়? ফোনটা একটু ওকে দাও না ভাই”।

ওদিক থেকে রতীশ জবাব দিল, “রচু তো সেই তখন থেকেই ঠাকুরের সামনে বসে প্রার্থনা করে যাচ্ছে তোমাদের জন্য। দাঁড়াও, একটু ধরো। আমি ওকে ফোন দিচ্ছি”।

পরিতোষের আশেপাশে তিন জা ঘিরে দাঁড়িয়েছে। ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে এক পুরুষ কন্ঠ শুনতে পাবে, এ ধারণা তারা কেউই করতে পারেনি। একে অপরের মুখ দেখাদেখি করছিল। ওদিকে ফোনের ও’পাশ থেকে আগের সেই পুরুষ কন্ঠের কথা শোনা গেল। সে কাউকে বলছে “এই রচু, এই দেখো পরিদা ফোন করেছেন। তোমার সাথে কথা বলতে চাইছেন। নাও ফোনটা ধরো। উনি লাইনে আছেন”।

কিছু সময় বাদে সুমিষ্ট অথচ উদ্বেগ ভরা মেয়েলী গলায় রচনা বলল, “পরিদা, কী হয়েছে গো? সব ঠিক আছে তো? তোমার পিসেমশাই আর পিসতুতো দাদারা সকলে তোমার সাথে ভাল ব্যবহার করেছেন তো? আর তোমার পিসি? উনি সুস্থ আছেন তো? তোমাকে আদর করে তার কাছে টেনে নিয়েছেন তো? নাকি কোনও আপদ বিপদ কিছু হয়েছে? ডাক্তার কী বলছেন”?
 

পরিতোষ আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিল যে প্রথমেই এমন একগুচ্ছ প্রশ্নের ঝড় তুলে দেবে রচনা। এবার রচনা থামতে সে বলল, “রচু সোনা বোন আমার। একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করলে কোনটা ছেড়ে কোনটার উত্তর দেব বলো তো? তবে প্রথমে এক কথায় তোমার সব প্রশ্নের একটাই উত্তর দিচ্ছি, এদিকে সব কিছু ঠিকঠাক আছে। আর সব কিছু মানে সব কিছু। তুমি আমার হয়ে, পিসির হয়ে আর এ বাড়ির সকলের উদ্দেশ্যে ঠাকুরের কাছে যা যা প্রার্থনা করেছ এতক্ষণ ধরে, তোমার ঠাকুর তোমার সব প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন। পিসেমশাই আর দাদাদের কথা তো আগেই বলেছি। তিন তিনটে মিষ্টি বৌদি আর পাঁচটা মিষ্টি মিষ্টি ছোট ছোট ভাইপো ভাইঝি আর নিজের রক্তের সম্পর্কের পিসিকে পেয়ে আমি তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছি বোন। তাই তো তোমাকে ফোন করবার কথাটাও এতক্ষণ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। আমাকে ক্ষমা কোরো বোন। তোমাকে ফোনটা আরও অন্ততঃ আধঘণ্টা আগেই আমার করা উচিৎ ছিল। কিন্তু নতুন নতুন এতগুলো আপনজনকে কাছে পেয়ে আমি যেন নিজেকেই হারিয়ে বসে ছিলাম এতক্ষণ .......”

পরিতোষের কথা শেষ হবার আগেই ও’দিক থেকে রচনা বলল, “পরিদা, এক মিনিট। একটু লাইনে
 
থাকো। আমি ঠাকুরকে একবার প্রণাম করে নিই। তারপর কথা বলছি”।
 

পরিতোষ কিছু না বলে ঘরের সকলের মুখের দিকে দেখতে লাগল। সবাই যে রীতিমত বিস্মিত, এ’কথা বলাই বাহুল্য। সকলের চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা সকলেই যেন অপ্রত্যাশিত একটা ধাক্কা খেয়েছেন। কেবলমাত্র হৈমবতীদেবীর মুখের ভাবটাই একটু অন্যরকম। তিনি ভুরু কুঁচকে কিছু একটা ভাবছেন মনে হল।

খানিক বাদে ও’পাশ থেকে রচনা বলল, “হ্যাঁ পরিদা ফিরে এসেছি। আসলে তুমি যখন বললে যে ঠাকুর আমার প্রার্থনা শুনেছেন, সে’কথা শোনবার পর ঠাকুরকে একটা প্রণাম না করলে চলে বলো? নইলে তো স্বার্থপর হয়ে যাব। শুধু বিপদের সময় ঠাকুরকে ডাকব, আর বিপদ কাটলেই ঠাকুরকে ভুলে যাব, এমনটা করলে ঠাকুর কি আর আমার প্রার্থনা আর কখনও রাখবেন? তাই ঠাকুরকে প্রণামের সাথে সাথে ধন্যবাদও জানিয়ে এলুম। হ্যাঁ এবার বলো তো, কী কী হল”?

পরিতোষ মোলায়েম স্বরে বলল, “আমি পিসির সামনে আসবার আগেই ডাক্তারবাবু নিজেই আমার মা-বাবা দাদু আর ঠাকুমার ব্যাপারে পিসিকে সবটা খুলে বলেছিলেন। তারপর আমি যখন সামনে এলাম তখন পিসি আমাকে দেখবার পর একটু সময়ের জন্য অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তারবাবু আগে থেকেই তৈরী ছিলেন। তার চিকিৎসায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই পিসি আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এখন তো পিসি আর তিন বৌদির সাথে গল্প করতে করতে আমি উঠে বাইরে গিয়ে তোমাকে ফোন করতে চাইছিলাম। কিন্তু এনারা কেউ আমাকে বাইরে যেতে দিতে চাইছিলেন না। তাই তাদের সাথে বসেই তোমাকে ফোন করছি”।

রচনা এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “আচ্ছা বাবা যাক, দুশ্চিন্তাটা কাটল। তা কালচিনিতে আর দিদিভাইকে এ’সব খবর জানিয়েছ? ওখানেও যে সবাই চিন্তায় আছে”।

পরিতোষ একটু আমতা আমতা করে বলল, “না রচু, সেটা আর করে উঠতে পারিনি। তবে পিসি নিজেই একটু আগে কালচিনির বাড়িতে ফোন করেছিলেন। তোমার বাবার সাথে কথা বলেছেন। কালচিনির বাড়ির সকলকেই আগামীকাল সকালে এখানে চলে আসতে বলেছেন। তাই কালচিনিতে সবাই ব্যাপারটা জেনে গেছেন। কিন্তু মন্তিকে এখনও জানানো হয়নি। একটু পরে আমি ওকে বা নীতাকে ফোন করব। কিন্তু এখানে বৌদিদের আর পিসির সাথে এত কথা বলতে ইচ্ছে করছে যে আদৌ ওদের সাথে শোবার আগে আর ফোনে কথা বলতে পারব কিনা বলা মুস্কিল। এতক্ষণ তো ফোন সুইচ অফ করেই রেখেছিলাম। জানিনা ওরা কেউ ফোন করেছিল কি না। ওদের হয়ত আমার ওপর রাগই হচ্ছে”।

ও’পাশ থেকে রচনা বলল, “পরিদা, ও’সব নিয়ে ভেবনা তুমি। তোমার জীবনের এই খুশীর মূহুর্তটাকে মনে প্রাণে উপভোগ কর তুমি। দিদিভাই আর নীতাদিকে আমি এখনই সবটা জানিয়ে দিচ্ছি। ওরা তোমার ওপর রেগে থাকতে পারেন এ’কথা ঠিক। তবে আমি জানি, তোমার জীবনের এতবড় একটা খুশীর খবর শুনে তাদের সমস্ত রাগ গলে জল হয়ে যাবে। আমি এখনই দিদিভাইকে ফোন করছি। আচ্ছা আমি বরং এখন রাখছি পরিদা। তবে আমার তরফ থেকে তোমার পিসি, পিসেমশাই, দাদা বৌদিদের আর সব ভাইপো ভাইঝিদের প্রণাম আর ভালবাসা জানিও”।

পরিতোষ কিছু বলবার আগেই কেউ একজন তার হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নিল যেন। পরিতোষ দেখল, হৈমবতীদেবী। হৈমবতীদেবী তখন ফোনে বলছেন, “তোমার প্রণাম আমি সাদরে গ্রহণ করলুম মা। ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। তোমার হাতের শাঁখা সিঁদুর অক্ষয় হোক। তুমি যেন তোমার স্বামী সংসার নিয়ে চিরসুখে থাকো”।
 

ও’পাশ থেকে রচনা একটু থতমত খেয়ে বলল, “ক-কে ক-কে বলছেন? আ-আপনি কি পরিদার পিসি”?
 

হৈমবতীদেবী শান্ত স্নিগ্ধ স্বরে জবাব দিলেন, “শুধু তোর পরিদার পিসি কেন বলছিস রে মা? আমি যে তোরও পিসি। তোর বাবা বিধুও যে আমার একটা ভাই রে। আমার ছেলেরা, ছেলের বৌয়েরা সবাই তোর বাবাকে বিধুমামু বলে ডাকে। আমি ছোটবেলায় তোর বাবাকে ভাইফোঁটা দিতুম। তাহলে আমি তোর পিসি হলুম না”?

রচনা এবার একটু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ, আজ সন্ধ্যের সময়ই বাবার মুখে সে’কথা শুনলুম যে তিনি তোমায় হিমুদি বলে ডাকেন। আর তোমার ছোট ভাই বাবার প্রিয় বন্ধু ছিলেন। পরিদার সাথে কয়েক মাস আগেই আমাদের পরিচয় হয়েছে। উনি আমার দিদিভাই মানে আমার বরের বোনের বন্ধু। আমাদের খুব স্নেহ করেন। কিন্তু তার বাবার নামটা জানবার বা শোনবার মত পরিস্থিতিতে আগে কখনও পড়ি নি। আর দুর্গাকাকুকে কখনও চোখে না দেখলেও তার নামটা ছোটবেলায় মাঝে মধ্যে বাবার মুখে শুনেছি। কিন্তু বাবার মুখে তোমার কথা আগে কোনদিন শুনেছি বলে মনে পড়ছে না”।

হৈমবতীদেবী জবাবে বললেন, “কিকরে শুনবি রে মা। আমি অভাগী যে ছোট বয়সেই সব্বাইকে হারিয়ে ফেলেছিলুম। তোর বাবাকে প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে এই তো সেদিন মাত্র মাস খানেক বা মাস দেড়েক আগে আবার দেখতে পেলুম। সেদিন আমার মনে হয়েছিল আমি এক হারিয়ে যাওয়া নিধি ফিরে পেয়েছি। তোর বাবাকে এর আগে শেষ দেখেছিলুম যখন ওর বয়স দশ এগারো বছর। আমি তখন সবে ষোল সতের বছরের এক কিশোরী। ওই বয়সেই মা-বাবার অমতে অ', এক ছেলেকে বিয়ে করেছিলুম বলেই বাবা সেদিন আমাকে মৃতা বলে ঘোষণা করেছিলেন। আমাকে ত্যজ্য করে আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবেন না বলেই বাবা ভিটে বাড়ি বিক্রী করে মা আর ভাইকে নিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন থেকেই বাপের বাড়ির সাথে আমার সম্পর্ক চিরতরে ঘুচে গিয়েছিল। তোর বাবা, বিধু ছিল আমার ছোট ভাই দুর্গার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। আমাকে হিমুদি বলে ডাকত। আমার পুরো নাম তো হৈমবতী। তবে আমাদের বিয়ের প্রায় বছর দুয়েক বাদে একদিন বিধুদের বাড়িতে আগুন লেগে গিয়েছিল। বাড়ি ঘর সবকিছু একেবারে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। তারপর শুনেছিলুম ওরা সেই জমি বিক্রী করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে গিয়েছিল। তারপর ও বাড়ির কাউকে আর কোনদিন দেখিনি। আর কথাতেই তো আছে যে চোখের আড়াল হলেই ধীরে ধীরে মানুষ মনের আড়ালেও চলে যায়। তোর বাবা নিজেও বুঝি আমার মা বাবা ভাইদের মতই আমাকে ভুলে গিয়েছিল। আর আমার ভাই দুর্গাই তোর এই পরিদার বাবা। এবার বুঝলি আমি তোর পিসি হলুম কিভাবে”?

হৈমবতীদেবী থামতে রচনা বলল, “হ্যাঁ পিসি, পরিদাই যে আমাদের দুর্গাকাকুর ছেলে সে’কথা আমরা আজই জানতে পারলুম। বাবা তো আজ তার বন্ধুর ছেলেকে পেয়ে খুশীতে লাফালাফি শুরু করে দিয়েছেন। আর বারবার শুধু দিদিভাইয়ের কথা বলছেন। দিদিভাইয়ের সাথে পরিচয় নাহলে পরিদার সাথে তো আমাদের পরিচয়ই হত না। আর দিদিভাই তো আমার মা বাবা দিদি ভাই, এমনকি আমার জন্যেও কত কী করেছেন গত কয়েকটা বছরে”।

হৈমবতীদেবী একটু হেসে বললেন, “তোদের কাউকেই তো আমার দেখা হয়নি। তবে তোরা যে দু’বোন একভাই, এ’কথা বিধুর মুখে শুনেছি। তোর আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু কিছু কথাও শুনেছি। বিধুর মুখে শুনেছি ও একটা মেয়েকে মন্তিমা বলে ডাকে। সে নাকি ওর মা অন্নপূর্ণা। তা সেই মেয়েটিই কি তোর এই দিদিভাই নাকিরে মা”?

রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁগো পিসি, আমার ওই দিদিভাইই তো আমার মা বাবার মা অন্নপূর্ণা আর মা দুর্গা। সে আমার বরের ছ’মাসের ছোট খুড়তুতো বোন। সম্পর্কে আমার ননদ হলেও বয়সে সে তো আমার থেকে অনেক বড়। আর আমার বিয়ের এক দেড় বছর আগে থেকেই দিদিভাইয়ের সাথে আমার আর আমাদের পরিবারের সকলের পরিচয় হয়েছিল। তখন থেকেই তার মিষ্টি স্বভাবে মুগ্ধ হয়ে তাকে আমি দিদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছি। আমাদের বিয়েটাও তার জন্যেই হয়েছিল। তারপর আমাদের ভাইয়ের পড়াশোনা, বাবার চিকিৎসা, তার নতুন ব্যবসা, বড়দিকে ফিরে পাওয়া, এমনকি কালচিনির বাড়িতে নতুন ঘর বানাবার যে কাজ চলছে, এ সব কিছুই দিদিভাই করেছেন। আমরা দু’জন যে গত চার পাঁচ মাস ধরে কলকাতায় আছি, আমাদের সব খবরাখবর দিদিভাই রাখেন। রোজ দিনে দু’ থেকে তিনবার আমাদের মধ্যে ফোনে কথা হয়”।

হৈমবতীদেবী খুব মন দিয়ে রচনার কথাগুলো শুনে বললেন, “হ্যাঁরে মা, বিধুর মুখে মেয়েটার খুব প্রশংসা শুনেছি আমিও। এখন তোর কথা শুনেও তাকে একটিবার চোখে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে রে। কিন্তু এর সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরেই কি পরিতোষ বিধুর কাছে এসেছে”?

রচনা সাথে সাথে জবাব দিল, “হ্যাঁ গো পিসি। আগেই বললুম না? পরিতোষদা তো আমার দিদিভাইয়ের বন্ধু। আমার দিদিভাইয়ের সাথে দেখা করতেই তো পরিদা নাগরাকাটা গিয়েছিল। সেখানে নীতাদি আর আমার বড়দিও আছে এখন। তাদের সাথে কথা বলার পরই তো পরিদা কালচিনি গিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। আজই সকালে পরিদা আমাদের কালচিনির বাড়িতে গিয়েছিলেন। আর মা বাবার সাথে কথায় কথায় পুরনো সম্পর্কের কথা বেরিয়ে পড়তেই সেই সূতোর টানেই তো তিনি তোমার কাছে গিয়ে পৌছলেন। তাই তো বাবা আরেকবার নতুন করে দিদিভাইয়ের প্রশংসায় মেতে উঠেছেন”।

হৈমবতীদেবী এবার বললেন, “ঠিক বলেছিস মা। আমি তো খানিকক্ষণ আগেও ভাবছিলুম যে বিধু আমাকে সারা জীবনের জন্য ঋণী বানিয়ে দিল। কিন্তু এখন তোর কথা শুনে বুঝতে পারছি, শুধু বিধু নয়। আরেক জনের কাছেও আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। সে তোর ওই দিদিভাই। তার সাথে দেখা করবার ইচ্ছেটা আমার আরও প্রবল হয়ে উঠল। তবে, তোর সাথে আমি আজ রাতে আরও একটু কথা বলতে চাই। তুই তাতে বিরক্ত হবি না তো মা”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 235)

রচনা বিস্মিত গলায় জবাব দিল, “এ কী বলছ পিসি তুমি? তুমি ফোন করলে আমি বিরক্ত হব কেন? তুমি তো জানোনা পিসি, আমার শ্বশুরবাড়িতে বাড়ি ভর্তি লোকজন। তাদের সবাইকে ছেড়ে স্বামীর সাথে এখানে চলে আসতে হয়েছে। এখানে আসবার পর বাড়ির সকলকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিনা বলে মনটা খুব ছটফট করে। তাই তো যখন তখন এর ওর সাথে ফোনে কথা বলি। আর তুমি তো আমার নতুন পিসি। এতদিন পিসি বলে ডাকবার মত কেউ আমাদের জীবনে ছিল না। আজ থেকে তোমায় পেলাম। তুমি ফোন করলে আমি তো খুশীই হব। কিন্তু পিসি ইশ, আমি তো তোমার অনুমতি না নিয়েই প্রথম থেকেই তোমাকে ‘তুমি তুমি’ করে বলছি। এতে তুমি রাগ করোনি তো”?

হৈমবতীদেবী হেসে বললেন, “শোনো পাগলী মেয়ের কথা। যে মেয়েটা আমাকে জীবনে চোখেই দেখেনি, যে আমার সুস্থতা কামনা করে এক দেড় ঘন্টা ধরে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করতে পারে, সে আমাকে তুমি করে বলছে বলে আমি রাগ করব? তোকে আমি বলে বোঝাতে পারবনা রে মা যে আজ আমি কত খুশী। আজ শুধু আমার ভাইপো নয় তার সাথে সাথে তোর মত এমন একটা মিষ্টি মেয়েও তো পেলুম। আবার আমার একটা ভাই যাকে ‘মা অন্নপূর্ণা’ বলে ডাকে তার কথাও জানতে পারলুম। তবে এই মূহুর্তে এত খুশীর মধ্যেও মনে একটা দুঃখও হচ্ছে। ভগবান আমাকে দুটো ডানা কেন দিলেন না। তাহলে এই মূহুর্তে আমি উড়ে গিয়ে তোর সাথে আর তোর সেই দিদিভাইয়ের সাথে দেখা করতুম। তবে তুই হয়ত নিশ্চয়ই ভাবছিস যে বুড়ীটা তো খুব বকবক করতে পারে। তুই তো আবার কাকে কাকে যেন ফোন করে তোর পরিদার কথা বলবি বললি। তাই এখন রাখছিরে মা। রাতে আমার ফোন থেকে তোকে ফোন করব, তখন আরও কথা হবে। অবশ্য তুই যদি বিরক্ত না হোস। তবে এখন আর তোকে জ্বালাচ্ছি না। তোর বরের নাম তো শুনলুম রতু। রতু আর রচু। বাঃ বেশ মানিয়েছে। তোদের দু’জনের জন্য আমার অনেক অনেক ভালবাসা আর শুভেচ্ছা রইল। ভাল থাকিস মা”।
 

রচনা এবার বলল, “আচ্ছা পিসি, পরিদার সাথে আরেকটু কথা বলব আমি। ফোনটা একটু ওনাকে দাও না”।

“হ্যাঁ মা দিচ্ছি” বলে হৈমবতীদেবী পরিতোষের হাতে ফোন দিলেন।
 

প্রায় আধঘণ্টা ধরে রচনার প্রশ্নের জবাবে পরিতোষকে সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলতে হল। তারপর কথা শেষ করে ফোন পকেটে রাখতে না রাখতেই হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁরে পরিতোষ, মন্তি কি তোর শুধুই বন্ধু? না ওর সাথে তোর অন্য কোনও সম্পর্ক আছে? আর নীতা নামের মেয়েটা কে রে? সে-ও কি তোর বন্ধু? না আর কিছু”?

পরিতোষ পিসিকে সোফায় বসিয়ে দিয়ে নিজে তার পায়ের কাছে বসে তার কোলে মাথা চেপে ধরে বলল, “মন্তি আর নীতার সম্বন্ধে সব কিছু তোমাদের বলতে গেলে আজকের পুরো রাতেও সে’সব কথা শেষ হবে না পিসি। ওদের দু’জনকে নিয়ে আলাদা আলাদা ভাবে দুটো ফিল্ম বানিয়ে ফেলা যায়। আজ এতদিন বাদে তোমাকে যখন পেয়েছি, তখন ধীরে ধীরে সব কিছুই তোমাদের বলব পিসি। তবে এখন তোমার প্রশ্নের জবাবে শুধু এটুকুই বলছি, ওরা দু’জন দু’রকম ভাবে দু’জন পুরুষকে ভালবাসে। কিন্তু ওরা ওদের ভালবাসার পাত্রের সাথে কোনদিন ঘর করবে না বা বলতে পারো করা সম্ভবই নয়। ওদের ভালবাসার কথা, ওদের জীবনের সব কথা আমি জানি। ওরা দু’জনেই কোনদিনই তাদের ভালবাসার পুরুষকে বিয়ে করতে পারবে না জেনেও নিজেদের ভালবাসার পাত্রদেরই নিজেদের স্বামী বলে ভাবে। আজীবন সমাজের চোখে ওরা অবিবাহিতাই থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অবশ্য ওদের জীবনের সেইসব কথা শুনলে অনেকেই হয়ত ছিঃ ছিঃ করবে। কিন্তু পিসি আমি কিন্তু ওদের ভালবাসাকে শ্রদ্ধাই করি। আর আমি তো তোমাকে আগেও বলেছি পিসি, যারা নিঃস্বার্থ ভাবে ভালবাসতে পারে তাদের আমি খুব শ্রদ্ধা করি। ওই মেয়েদুটোও তাই। তবে তোমার মত নিজের মা-বাবাকে ছেড়ে প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে যাবার সাধ্য বা সুযোগ কোনটাই ওদের ছিল না। আর এই শ্রদ্ধার বশেই ওদেরকে আমি বন্ধু বলে ভাবি। আপাততঃ এর বেশী কিছু আমি বলছি না। ওরা দু’জনেই আমার খুব ভাল বন্ধু। তবে আজ যে আমি তোমাকে পেলাম, সেটা ওই মন্তির জন্যেই সম্ভব হল। মন্তির কাছে না এলে তোমার হদিশই পেতাম না আমি। তাই একা তুমি শুধু নও, আমিও মন্তির কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব পিসি। ও আমার যা উপকার করল আজ, সে উপকারের বিনিময়ে কোন কিছুই যথেষ্ট নয়। ওকে ধন্যবাদ দিয়েও আমি ছোট করতে পারব না। শুধু ভগবানের কাছে ওর জন্য প্রার্থনাই করে যাব, ভগবান যেন ওকে শান্তিতে রাখেন” বলে একটু থেমে হৈমবতীদেবীর কোল থেকে মাথা তুলে আবার বলল, “কিন্তু পিসি, আমাকে একটু সময়ের জন্য বাইরে যেতে দাও না গো। মন্তিকে, নীতাকে আর বিধুকাকুকে তো রচুই ফোন করে সবকিছু জানিয়ে দেবে। কিন্তু মালবাজারে আর কলকাতায় দুটো জরুরী ফোন করতে হবে আমার অফিসিয়াল ব্যাপারে। আমার তো কালই মালবাজার যাবার কথা ছিল। আর কলকাতা অফিসেও পরশুই আমার কাজে যোগ দেবার কথা ছিল। কিন্তু তুমি তো আমাকে আটকে দিলে। তাই ওদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানিয়ে দেওয়াটা খুব দরকার। আর বুঝতেই তো পারছ, এ’সব পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ব্যাপার। সকলের সামনে এ’সব অফিসিয়াল ব্যাপার নিয়ে কথা বলা যায় না। তোমরা কেউ ব্যাপারটাকে অন্যভাবে নিও না প্লীজ। আমি দুরে কোথাও যাব না। দোকানের পাশে দাঁড়িয়েই তাদের সাথে কথা বলব। প্লীজ পিসি”।

হৈমবতীদেবী পরিতোষের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আচ্ছা বেশ, যা। তবে দোকান থেকে বেশী দুরে কোথাও যাসনে বাবা। তোকে যে সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে পেতে ইচ্ছে করছে আজ। যা। ফোন সেরে আয়। তবে তাড়াতাড়ি ঘুরে আসিস বাবা”।

পরিতোষ হৈমবতীর একটা হাত নিজের দু’হাতে ধরে বলল, “ঠিক আছে পিসি। আমি পনের মিনিটের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি” বলে অন্যান্য সোফায় বসে থাকা তিন বৌদির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে চোখের ঈশারায় সম্মতি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
 

******************

দুপুরের পর থেকেই সীমন্তিনীর মনটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। সকালে অফিসে আসবার পথে পরিতোষের কালচিনি পৌঁছে যাবার কথা শুনে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিল। আজ লাঞ্চ করতে তার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ লাঞ্চ খেতে খেতে সে রচনাকে ফোন করেছিল। তখনই জানতে পারল যে পরিতোষ বিধুবাবুর ছোট বেলার বন্ধুর ছেলে। বিধুবাবুর কাছে তার নিজের পিসি বেঁচে আছেন, আর আলিপুরদুয়ারে আছেন, এ’কথা শুনেই নাকি পরিতোষ দুপুর আড়াইটের ট্রেনে কালচিনি থেকে আলিপুরদুয়ার চলে গেছে। আর ঠিক তখন থেকেই সীমন্তিনীর মনের উদ্বেগ বেড়ে চলছিল। তার কয়েক মিনিট বাদেই পরিতোষের পাঠানো এসএমএসটাও পেয়েছিল। কিন্তু ভেতরের উদ্বেগটা তাতেও কাটেনি। নিজের উদ্বেগ সামলাতে না পেরে বিকেলের দিকে নিজের কেবিনে বসেই সে পরিতোষকে ফোন করেছিল। কিন্তু মনে হল পরিতোষ কলটা রিজেক্ট করে দিয়েছিল। দ্বিতীয়বার ফোন করেও একই ফল হয়েছিল। তখন সে ভেবেছিল যে কোন কারণেই হোক পরিতোষ এই মূহুর্তে তার সাথে কথা বলতে চাইছে না। তারপর একে একে কালচিনিতে, রচনার কাছে আর নবনীতার কাছে বারে বারে ফোন করেও কোনও খবর না পেয়ে তার উদ্বেগ ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করেছিল। অবশেষে বেলা চারটে নাগাদ রচনা ফোন করে তাকে জানাল যে পরিতোষ তার পিসির বাড়িতে পৌঁছে গেছে ঠিকই। কিন্তু তার পিসির শারীরিক অসুস্থতার জন্যেই তখনও সে পিসির কাছে যায়নি। তবে পিসির বাড়ির লোকজনেরা পরিতোষকে পেয়ে খুব খুশী হলেও সকলেই আশঙ্কায় আছেন যে পরিতোষের মা বাবা দাদু ঠাকুমার মৃত্যু সংবাদ শুনে হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী তার পিসির হয়তো কোন বিপদ আপদ হতে পারে। তাই তারা আগে থেকেই তাদের পারিবারিক ডাক্তারকে ডেকে এনেছেন। আর ওই ডাক্তার ভদ্রলোক নাকি সব কিছু সামলে নেবেন বলে তাদের সকলকে আশ্বস্ত করে ওপরের তলায় পরিতোষের পিসির কাছে চলে গেছেন। আর সেই সময়েই নাকি রচনা পরিতোষকে ফোন করেছিল। তখন পরিতোষই নাকি এ’সব কথা তাকে বলেছে। রচনার কাছ থেকে এ খবর শোনবার পর এক দিক থেকে তার মনের উদ্বেগ কিছুটা কমেছিল। পরিতোষকে যে তার পিসেমশাই আর পিসতুতো দাদারা ভাল ভাবে গ্রহণ করেছে এটা জেনে। কিন্তু পরিতোষের পিসির শারীরিক অবস্থার কথা শুনে আরেকটা নতুন উদ্বেগ তাকে ঘিরে ধরেছিল। তখন থেকেই মনে মনে সে ঠাকুরকে ডাকছিল বারবার। এত বছর বাদে জীবনে প্রথমবার নিজের পিসির কাছে গিয়েও তার সাথে দেখা না করেই পরিতোষকে যেন ফিরে আসতে না হয়। ভগবানের কাছে এ প্রার্থনাই করছিল সে। কিন্তু যত সময় কাটছিল, মনের উদ্বেগও সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল। সন্ধ্যের দিকে থাকতে না পেরে সে আবার পরিতোষকে ফোন করল। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। রচনাকে ফোন করতে ফোন ধরল রতীশ। রতীশ জানাল যে রচনা বিকেলে পরিতোষ আর তার সাথে কথা বলবার পরেই ঠাকুর ঘরে গিয়ে পরিতোষের মনস্কামনা পূর্ণ করবার জন্যে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। এ’কথা শুনে এত উদ্বেগের মাঝেও রচনার প্রতি তার মন কৃতজ্ঞ হয়ে উঠল। কিন্তু তার মনের দুশ্চিন্তা যেন আর কিছুতেই কমছিল না।
 

অফিসের কাজ সেরে বেরোতেও একটু দেরী হয়ে গিয়েছিল তার। বাড়ি ফেরবার পথে রতীশকে আরেকবার ফোন করে জানতে পারল যে এখনও কোন খবর পায়নি ওরা। রচনা তখনও ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেই যাচ্ছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই সীমন্তিনীর হাতের মোবাইল বেজে উঠল। কিংশুকের ফোন দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ ভাই, বলো কি খবর”?

কিংশুক সাথে সাথে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “দিদিভাই, এইমাত্র আলিপুরদুয়ার থেকে পরিদার পিসিমা বাবাকে ফোন করেছিলেন। আর তিনি আমাদের সকলকেই কাল সকালে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন”।

সীমন্তিনী মনে মনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তিনি তোমাদের সবাইকে আলিপুরদুয়ারে ডেকে পাঠিয়েছেন”?

কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই। আমার কাল কলেজ আছে, বড়দি তোমার ওখানে, এ’সব শুনে বললেন যে বড়দি যখন বাড়িতে নেই তাহলে তাকে বাদ দিয়েই আমি একদিনের জন্য কলেজ কামাই করেও যেন মা বাবার সাথে তাদের ওখানে যাই। কিন্তু অবশ্যই যেতে হবে সেখানে”।
 

সীমন্তিনী মনে মনে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে বলল, “কিন্তু তোমাদের সবাইকে এভাবে কেন ডাকলেন উনি? আর পরিতোষের সাথে তার পিসির দেখা হয়েছে কি না, এ’সব ব্যাপারে কিছু বললেন উনি”?

কিংশুক জবাবে বলল, “না দিদিভাই, আর অন্য কোন কথাই তিনি বলেননি। শুধু বাবাকে আমাদের সবাইকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার যাবার নির্দেশ দিয়েই ফোন কেটে দিলেন”।
 

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষকে তার পিসির সাথে দেখা করতে দিয়েছে কিনা তারা, এ ব্যাপারে কিছু জানতে পেরেছ তোমরা”?

কিংশুক একটু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে দিদিভাই, পরিদার পিসি তো এ’সব ব্যাপারে কোন কথাই বললেন না। আমরাও যে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করব, সে সুযোগটুকুও তিনি দিলেন না। শুধু নিজের আদেশটুকু শুনিয়েই ফোন কেটে দিলেন। কী করব দিদিভাই”?

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, ফোনটা কে করেছিল? পরির পিসি নিজেই না বাড়ির অন্য কেউ ফোনটা করেছিলেন”?

কিংশুক বলল, “ফোনটা তো প্রথমে আমিই ধরেছিলাম দিদিভাই। পরিদার পিসি নিজেই একটা ল্যান্ড লাইন নাম্বার থেকে ফোনটা করেছিলেন। আর উনি নিজেই বললেন যে উনি পরিদার পিসি আর বাবার হিমুদি। আর বাবাকেও নাম ধরে বিধু বলে সম্বোধন করছিলেন। আর তার গলা শুনে হল তিনি পুরোপুরি সুস্থ”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “তাহলে তো ঠিকই আছে। মেসো তো তাদের সবাইকেই আগে থেকেই চিনতেন। তা ভাই, উনি কখন ফোন করেছিলেন মানে ঠিক ক’টার সময়”?

কিংশুক বলল, “এই তো দিদিভাই, মাত্র মিনিট পাঁচেক আগেই। উনি বাবার সাথে কথা শেষ করতেই আমি তোমাকে ফোন করলুম”।

সীমন্তিনী মনে মনে খানিকটা স্বস্তি পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “তা মেসো কি বলছেন? কাল যাবেন তোমাদের নিয়ে”?
 

কিংশুক বলল, “বাবা তো যেতে রাজী আছেন। কিন্তু আমার কলেজ কামাই করতে হবে ভেবেই আমি নিজে যাব কিনা সেটা স্থির করতে পারছি না। আর আমি না গেলে তো মা-ও যাবেন না”।

কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডের ভেতর গাড়ি ঢুকতে দেখে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি তো এখন বাড়ি ফিরছি। আমি কিছু বাদে তোমাকে ফোন করব। একটু ভেবে নিই ব্যাপারটা। তা মাসি মেসো সবাই ঠিক আছেন তো”?

কিংশুক বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, আমরা সবাই ভাল আছি। কিন্তু পরিদা শেষ পর্যন্ত তার পিসির সাথে দেখা করতে পারলেন কি না সেটা বুঝতে না পেরেই সবাই একটু চিন্তায় আছি”।

সীমন্তিনীর গাড়ি তখন ঘরের সিঁড়ির কাছে এসে থেমে গেছে। নিজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “আচ্ছা ভাই, আমি ঘন্টা খানেক বাদে তোমাকে ফোন করছি। আর দুশ্চিন্তা করো না। ভগবান যা করবেন, ভালই করবেন। ছাড়ছি এখন, কেমন”?

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে সীমন্তিনী ভাবল এখনই সে এ ব্যাপারে অর্চনাকে কিছু বলবে না। কিন্তু শুকনো মুখে অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে দিতেই সীমন্তিনী বুঝে গেল যে অর্চনার কাছে আর সব কিছু গোপন রাখা যাবে না। ও নিশ্চয়ই এতক্ষণে খবর পেয়ে গেছে।

সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “কিরে অর্চু সোনা? তোর মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন রে? কী হয়েছে? দুপুরে খাসনি নাকি”?

অর্চনা সীমন্তিনীর কথার জবাবে কিছু বলবার আগেই রান্নাঘর থেকে লক্ষ্মী বলল, “তোমার সোনা বোন সেই বিকেল থেকে এভাবে মুখ শুকনো করে বসে আছে দিদিমণি। একশ’ বার জিজ্ঞেস করেও তার মুখ থেকে কোন কথা বের করতে পারলুম না আমি। এবার তুমি এসে গেছ। তুমি সামলাও ওনাকে”।

সীমন্তিনী অর্চনার দু’কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘোরাতেই দেখল অর্চনার চোখে জল ছলছল করছে। সীমন্তিনী নিজের মনের ভাব গোপন রেখে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওমা, তুই কাঁদছিস কেন অর্চু? কী হয়েছে রে বোন”?

অর্চনা নিজের ভেতর থেকে উথলে আসা কান্নাকে আর চেপে রাখতে না পেরে সীমন্তিনীর বুকে মুখ চেপে ধরে জোরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনী নিজের কাঁধের ব্যাগটা একদিকে ফেলে দিয়ে অর্চনাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “আঃ, বলবি তো কী হয়েছে। আর তোর যখন এত মন খারাপ তাহলে আমাকে ফোন করিস নি কেন? বল না অর্চু, লক্ষ্মী বোন আমার। বল না কী হয়েছে? কেন কাঁদছিস? কেউ কিছু বলেছে তোকে? কিন্তু আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি কোনও ব্যাপারে। বল না কী হয়েছে”?

অর্চনা কোন কথা না বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদেই যাচ্ছিল। কোনভাবেই তাকে শান্ত করতে না পেরে লক্ষ্মীকে নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে ঘরে রাখতে বলে সে অর্চনাকে ধরে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। বিছানার ওপর অর্চনাকে বসিয়ে তার পাশে বসে অর্চনার চিবুক ধরে তার মুখটা তুলে বলল, “লক্ষ্মী সোনা বোন আমার। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হয়েছে রে? বল না আমায় সবটা খুলে সোনা”।
 

অর্চনা এবার ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, “তোমার বন্ধু কোথায় দিদিভাই? তার কথা কিছু শুনেছ”?

অর্চনার মুখে এ’কথা শুনে সীমন্তিনী প্রথমে অবাক হল। তারপর অর্চনার কাঁদার কারনটা বুঝতে পেরেই মনে মনে পুলকিত হল। অর্চনা যে মনে মনে পরিতোষকে ভালবাসতে শুরু করেছে, এ’কথা বুঝতে পেরে এই উদ্বেগের মাঝেও সে বেশ খুশী হল। তবু মুখে সে ভাব ফুটিয়ে না তুলে কিছু বলতে যেতেই লক্ষ্মী ঘরে ঢুকে বলল, “ওমা দিদিমণি! সোনাদি এভাবে কাঁদছে কেন গো”!

সীমন্তিনী লক্ষ্মীকে বলল, “কিছু হয়নি লক্ষ্মীদি। ও একা একা বসে বোধহয় কিছু ভাবছিল। তোমাকে বলতে পারছিল না। নীতাও নেই বাড়িতে। তাই বোধ হয়। আচ্ছা তুমি আমাদের জন্য চা নিয়ে এস। আমি ওকে শান্ত করছি”।

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর ব্যাগটা রেখে চলে যেতেই সীমন্তিনী অর্চনার চিবুক ধরে বলল, “আমি বুঝতে পেরেছি তুই কী ভাবছিলিস এতক্ষণ একা একা। আচ্ছা, এবার চুপটি করে একটু বোস তো এখানে সোনা। আমি হাতমুখটা ধুয়ে আসছি, কেমন”?

অর্চনা নিজের মাথা হেলিয়ে সম্মতি দিতেই সীমন্তিনী বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। বাথরুম থেকে ফিরে এসে অর্চনার কাছে বসে ওর একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে খুব শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, “বাড়িতে ফোন করেছিলি? ভাই কি তোকে পরিতোষের ব্যাপারে কিছু বলেছে”?

অর্চনা লাজুক ভাবে মাথা নিচু করে বলল, “সন্ধ্যের আগে করেছিলাম। কিন্তু বাড়িতেও কেউ কোন খবর পায়নি”।
 

সীমন্তিনী আবার বলল, “ভাবিস নে। কিচ্ছু হবে না। আমার মন বলছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বোধহয় আমরা ভাল খবর পাব”।
 

অর্চনা নিজের জলে ভরা দুটো চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “যে লোকটা গত সাতটা বছর ধরে নিজেকে একেবারে অনাথ বলে ভেবে এসেছেন, তিনি যখন আজ জানতে পারলেন যে তার রক্তের সম্পর্কের আপন পিসি বেঁচে আছেন, আর তাকে দেখতে গিয়েও যদি তিনি বিফল হয়, তবে কত বড় একটা দুঃখই না পাবেন তিনি”।

সীমন্তিনী মনে মনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “হু ঠিক বলেছিস। কিন্তু একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস অর্চু? এখানেও সেই সাত! তোর জীবনে সাতটা বছর অন্ধকারময় ছিল, নীতারও তাই। পরিও সাত বছর অনাথ থাকবার পর আজ তার বাবার রক্তের সম্পর্কের নিজের দিদিকে খুঁজে পেয়েছে। আজ আর অন্যরকম কিছু হতেই পারে না। ওদিকে রচু সন্ধ্যের আগে থেকেই পরি আর তার পিসির জন্যে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যাচ্ছে। পরিতোষের সাথে তার ঠিক আগেই রচুর কথা হয়েছে। আর পরি ওকে কথা দিয়েছে যে পিসির সাথে দেখা হবার পর পরি সবার আগে রচুকেই ফোন করবে, কারন পরির ফোন না পাওয়া অব্দি ও প্রার্থনা শেষ করবে না। আর আমার মন বলছে, রচুর প্রার্থনা ঠাকুর ঠিক শুনবেন। আমিও তো সেই দুপুর থেকেই চিন্তায় আছি। তোকে ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা জানাইনি। নীতা বাড়িতে থাকলে তোদের অবশ্যই জানাতুম। জানি লক্ষ্মীদির সাথে তুই এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবি না। বাড়িতে একা একা বসেই আবোল তাবোল ভাববি। আর দ্যাখ ঠিক সেটাই হল। আমারই ভুল হয়েছে। আমার উচিৎ ছিল রচু আর ভাইকে আগে থেকে সাবধান করে দেওয়া, যাতে তোকে আগে কিছু জানতে না দেয়। কিন্তু আমিও আজ অফিসে এত ব্যস্ত ছিলুম যে এতটা তলিয়ে ভাববার সময়ই পাইনি। কিন্তু সোনা, এইমাত্র ভাই ফোন করেছিল আমাকে। বলল যে পরির পিসি নাকি কাল সকালে মাসি মেসো আর ভাইকে তাদের বাড়ি যেতে বলেছেন। তোর কথাও বলেছিলেন। কিন্তু তুই আমার এখানে আছিস শুনে আর কিছু বলেন নি”।

______________________________
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
Excellent story, never read such a realistic storyline in any adult site
[+] 1 user Likes Mr Fantastic's post
Like Reply
(Update No. 236)

অর্চনা অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী বলছ দিদিভাই? ভাই তোমাকে ফোন করে এ কথা বলল? তার মানে পরিতোষবাবুর পিসি সুস্থ আছেন? তার সাথে তাহলে তো এতক্ষণে নিশ্চয়ই তার দেখা হয়েছে, তাই না দিদিভাই? কিন্তু ভাই তোমাকে পরিতোষবাবুর ব্যাপারে কিছু বলেনি? তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন ......” বলেই হঠাৎ লজ্জা পেয়ে থেমে গেল।
 

ঠিক তখনই লক্ষ্মী দু’হাতে দু’কাপ চা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকে বলল, “দিদিমণি, তুমি তো শুধু চা আনতে বললে। জল খাবার কিছু খাবে না নাকি”?

সীমন্তিনী লক্ষ্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “আজ অফিস থেকে বেরোবার ঠিক আগেই একটা মিটিং হয়েছে। সেখানে এটা সেটা খেয়েছি গো। তাই এখন আর কিছু খাব না। কিন্তু তোমরা তোমাদের জন্যে কিছু একটা বানিয়ে নাও”।

লক্ষ্মী অর্চনার হাতে চায়ের কাপ দিতে দিতে বলল, “যাক বাবা, এতক্ষণে আমার সোনাদির মুখ গোমড়া ভাবটা দুর হয়েছে। তা সোনাদি, বলো তো তোমার জন্যে কী বানাব? চাউমিন খাবে? না অন্য কিছু”?

অর্চনা লক্ষ্মীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বলল, “অল্প করে চাউমিনই বানাওগে লক্ষ্মীদি। অন্য কিছু আর খেতে ইচ্ছে করছে না আজ”।

লক্ষ্মী চলে যেতে সীমন্তিনী নিজের কাঁপে একটা চুমুক দিয়ে খুব শান্তভাবে জিজ্ঞেস করল, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব অর্চু সোনা? সত্যি জবাব দিবি”?

অর্চনা অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এ কি বলছ দিদিভাই? আমি তোমাকে মিথ্যে বলব, এ কথা তুমি ভাবতে পারলে কী করে গো”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “একদমই ভাবি না। তবু জিজ্ঞেস করলাম। আসলে এমন প্রশ্নও তো তোকে আগে করিনি কখনও”।

অর্চনা এক চুমুক চা খেয়ে সীমন্তিনীর হাতের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “এমন কী জিজ্ঞেস করবে তুমি দিদিভাই”?

সীমন্তিনী কিছুক্ষণ অর্চনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকবার পর জিজ্ঞেস করল, “পরিকে দেখে তোর কেমন লাগল রে? ভাল লেগেছে”?

অর্চনা লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল। কিন্তু কিছু বলল না। সীমন্তিনী আবার বলল, “লজ্জা পাস নে বোন। দ্যাখ, আমার আর নীতার কথায় তুই এ বিয়ের ব্যাপারে রাজী হওয়া সত্বেও আমি এখন অব্দি পরির সাথে কিন্তু কোন আলোচনা করিনি। পরি এখনও জানেনা যে তোর সাথেই আমরা ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি। আমি অপেক্ষা করছিলুম তুই মন থেকে পরিকে কবে মেনে নিতে পারবি। পরি যে এখানে এভাবে হঠাৎ এসে পড়বে সেটাও আমি জানতুম না। কিন্তু ও আসবার পরে ভেবেছিলুম যে ওর সাথে এবার তোদের বিয়ের ব্যাপারে কথাটা বলব। কিন্তু ও যেমন হুট করে এল, তেমনই হুট করে চলেও গেল। ওর সাথে আলোচনায় বসবার সুযোগটাই হল না। আর তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার ছিল। তুই বারবার বলিস তুই, তোরা সবাই আমার ওপর কৃতজ্ঞ। তাই আমার মনেও একটা ধারণা হয়েছিল যে আমার ওপর সেই কৃতজ্ঞতাবোধ বশতই তুই হয়তো আমার কথার বিরোধিতা করতে না পেরেই এ বিয়েতে মত দিয়ে থাকবি। তাই আমি একটু অপেক্ষা করছিলাম। আমি ভেবেছিলুম তুই একবার আগে পরিকে নিজের চোখে দেখে নে। তারপর আমি তোর মনের ইচ্ছেটা জেনে নিয়ে তবে এ ব্যাপারে এগোব। কিন্তু তোর আর পরির দেখা করাবার সুযোগটাই পাচ্ছিলুম না। পরি তো থাকে কলকাতায়। আর আমরা সবাই ওর কাছ থেকে পাঁচশ কিলোমিটার দুরে। তোদের দেখা করাতে হলে তোকে নিয়ে কলকাতায় যেতে হত। নইলে পরিকে এখানে আনতে হত। কিন্তু কোনটারই সুযোগ খুঁজে পাচ্ছিলুম না। কিন্তু পরি হঠাৎ করে এখানে চলে আসতে আমি মনে মনে খুব খুশী হয়েছিলুম। ভেবেছিলুম ও দুটো দিন থাকলে তুই ওর সাথে কথা বলে ওকে একটু ভাল করে বুঝতে পারবি। ওকে ভাল করে দেখার বা জানার সুযোগ পাবি তুই। তারপর তোর যদি ওকে ভাল লাগে তবেই ওর কাছে কথাটা পাড়বো। কিন্তু ও যে শুধু রাতটুকু কাটিয়েই আজ সকালেই এখান থেকে চলে যাবে, সেটা তো আমি ভাবতেই পারিনি। তাই মনে মনে যেমনটা ভেবেছিলুম তার কিছুই হল না। তা সে যাই হোক, পরি যে তোকে ওই দৃষ্টিতে দেখেনি, তা আমি জানি। কিন্তু তুই তো একটা দিন ওকে দেখলি। কাল তোদের ভেতর কিছু কথাবার্তাও হয়েছে। তাই জিজ্ঞেস করছি, কেমন লাগল ওকে? ভাল লেগেছে”?

অর্চনা কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে খুব শান্ত গলায় জবাব দিল, “তোমার প্রশ্নের জবাবে কী বলব তা জানিনে গো দিদিভাই। ঠাকুর কী চাইছেন, তা সত্যিই আমি জানিনে। তবে তোমার ওই বন্ধুকে কি কোন মেয়ের অপছন্দ হতে পারে? সে তো যে কোন মেয়ের কাছে স্বপ্নের রাজপূত্র হতে পারে। আর সত্যি বলছি দিদিভাই, আমি কিন্তু আজ এ’সব নিয়ে একদম ভাবিনি। যখন শুনলুম উনি বাবার ছোটবেলার অভিন্ন হৃদয় বন্ধুর ছেলে, আর এতদিন নিজেকে অনাথ বলে ভাববার পর আজ সে নিজের রক্তের সম্পর্কের একজনকে খুঁজে পেয়েছে, তখন থেকেই মনে নানা ধরণের চিন্তা হচ্ছে। ওনার বাবার ছোটবেলায় তার ঠাকুর্দা ঠাকুমা আর বাবা যার সাথে নিজেদের রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করেছিলেন, নিজের পছন্দের নিচু জাতের একটা ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন বলেই যে মেয়েটাকে তার মা বাবা ভাই চিরতরে পরিত্যাগ করেছিলেন, সেই মহিলা কি সত্যিই ওনাকে নিজের ভাইপো বলে কাছে টেনে নেবেন? আর যদি উনি সেটা না করেন, যদি তারা তাকে অপমান করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেন, তাহলে পরিতোষবাবু কত বড় একটা আঘাতই না পাবেন। যতটা আশা নিয়ে উনি সেখানে গেছেন, বিফল হলে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশী আঘাত পাবেন উনি। সে আঘাতটা তিনি সইতে পারবেন দিদিভাই? তার পাশে যে আর কেউ নেই। তার কাঁধে স্নেহের হাত রাখবার মত কেউ তো নেই। দুপুরের পর থেকে তো শুধু এই চিন্তাই হচ্ছে আমার। কেউ আমাকে ফোন করেনি দিদিভাই। আমিই বিকেলে ভাইকে ফোন করে এ’সব জেনেছি। ভাইই বলল যে উনি আমাদের বাবার ছোটবেলার বন্ধুর ছেলে। আমি চোখে না দেখলেও বাবার মুখে তার বন্ধু দুর্গাদাস কাকুর কথা কিছু কিছু শুনেছি। কিন্তু তোমার এই বন্ধুই যে আমাদের ওই দুর্গাকাকুর ছেলে এ তো আর আমি জানতুম না। তোমার বন্ধুও হয়ত এতদিন এ ব্যাপারটা জানতেন না। রচু, রতুদা আর তোমার সাথে তার পরিচয় থাকলেও তোমাদের কারো মুখেই বোধহয় বাবার নামটা তিনি শোনেন নি এতদিন। গতকাল আমরা যখন কথা বলছিলুম তখন কথায় বাবার নামটা উঠেছিল। তখন তার চোখ মুখ দেখে মনে হয়েছিল তিনি বুঝি তার স্মৃতিতে কিছু একটা খুঁজছিলেন। তখন উনি সেটা আমার কাছে সেভাবে প্রকাশ না করলেও আমার কাছ থেকে বাবার সম্বন্ধে জেনে নিয়ে আনমনেই ‘কালচিনি.. বিধুভূষন.. বিধু .. পঞ্চান্ন ছাপ্পান্ন বছর’ এ শব্দগুলো আউড়ে যাচ্ছিলেন। তখন আমিও তেমন কিছু বুঝতে পারিনি। কিন্তু দিদিভাই, এখন আমার মনে হচ্ছে বাবার নাম শোনবার পরেই তিনি কালচিনি যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন মনে মনে। অবশ্য আমার ফোনেই রচুও তাকে কালচিনি গিয়ে মা-বাবার সাথে দেখা করবার অনুরোধ করেছিল। দুপুরে বাবার সাথে গল্প করবার সময়েই বাবা বুঝতে পারেন যে পরিতোষবাবুই তার ছোটবেলার প্রিয়বন্ধু দুর্গাদাস সান্যালের ছেলে। তোমার বন্ধুও উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে আমাদের বাবাই তার বাবার ছোটবেলার বন্ধু। তখনই কথায় কথায় বাবার কাছ থেকেই উনি জানতে পেরেছেন যে আলিপুরদুয়ারে তার পিসি আছেন। আর সেটা শুনেই নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেন নি। বাবা তাকে বলেছিলেন যে কাল সকালে তিনি নিজে তাকে নিয়ে তার পিসির বাড়িতে যাবেন। কিন্তু তার তর সয়নি। বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তার কাছ থেকে তাদের ঠিকানা জেনে নিয়ে একাই চলে গেছেন তার পিসিকে খুঁজতে। তাহলে তার মানসিক অবস্থাটা তখন ওই মূহুর্তে ঠিক কেমন ছিল, তা তো আন্দাজ করতেই পারছ দিদিভাই। বানভাসি একটা পিঁপড়ে যেমন সামান্য একটা খড়কুটোকেও আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়, পরিতোষবাবুর অবস্থাটা তো প্রায় তাইই ছিল ওই সময়ে। যে নিজেকে একেবারে অনাথ ভেবে ভেবে অভ্যস্ত সে যদি জানতে পারে তার রক্তের সম্পর্কের এক পিসি এখনও বেঁচে আছেন, তাহলে মনে মনে সে কতটা উতলা হয়ে উঠতে পারে সেই পিসিকে দেখবার জন্য সেটা অন্য যে কারো চাইতে আমি খুব ভালভাবে জানি দিদিভাই। আমিও তো সাত সাতটা বছর মা বাবা ভাই বোনকে ছেড়ে দুরে থাকতে বাধ্য হয়েছিলুম। প্রায় একটা অনাথের মতই। তাই জানি, হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনকে চোখে দেখবার আশা কতটা প্রবল হতে পারে। কিন্তু সেই পিসিই যদি তার পরিচয় জানবার পর তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে দেন, তাহলে তিনি সইতে পারবেন দিদিভাই”?

সীমন্তিনী অর্চনার হাতের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে খুব মোলায়েম গলায় বলল, “আমি যে জিনিসটার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম, সেটা পেয়ে গেলুম তাহলে। মনে মনে তোর তাহলে পরিকে ভাল লেগেছে। কিরে? ঠিক বলছি তো”?

অর্চনা কিছু না বলে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করল। সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত লজ্জায় নুয়ে পড়া অর্চনার দিকে তাকিয়ে থাকবার পর তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “এতে এত লজ্জা পাচ্ছিস কেন বোন। আমি তো চাই সারাটা জীবন তুই যেন সুখে কাটাতে পারিস। আমরা তো তোকে আগেও বলেছি, আমি আর নীতা দু’জনেই পরিকে খুব ভালভাবে জানি। ও যে কতটা ভাল সেটা যারা ওকে জানে চেনে, তারা সকলেই জানে। আর তুই নিজেও এটুকু জীবনে এত কষ্ট পেয়েছিস, যেটা তোর কোন ভাবেই প্রাপ্য ছিল না। তাই যেদিন আমি প্রথম তোকে কালচিনি হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় বেডে শুয়ে থাকতে দেখেছিলুম, তখনই মনে মনে ভেবেছিলুম তোর জীবনটাকে সুন্দর করে তোলবার জন্য আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব”।
 

বলে একটু থেমে দম নিয়ে আবার বলল, “তোদের বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আমরা সকলে মিলে কিভাবে প্ল্যান বা চিন্তা ভাবনা করেছিলুম, তুই তো তার কিছুই জানিস না। আসলে আমরা সবাই আগে থেকেই অমন ভাবেই প্ল্যান করেছিলুম যে আগেই তোকে পরির ব্যাপারে কিছু জানাব না। আর সবচেয়ে প্রথমে তোকে আর মাসি মেসোকে রাজী করাতে হবে এ বিয়ের ব্যাপারে। আমি যখন কলকাতায় গিয়ে নীতার সাথে পরিচিত হলাম, নীতার সব কথা শুনলুম, তখনই আমার মনে হয়েছিল তুই, মাসি মেসো আর রচু রাজী হলে পরির সাথেই তোর বিয়ে দেব। ওর মত ছেলে লাখেও একটা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওর সাথে তোর বিয়ে হলে তুই যে সুখী হবিই, এ ব্যাপারে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহও নেই। আর সেদিন রচুর কথায় পরি নিজেও আমার আর নীতার ওপরেই তার জন্যে মেয়ে পছন্দ করবার দায়িত্ব দিয়েছিল। তারপর তোকে এখানে নিয়ে আসবার পর নীতাও পরির জন্য তোকেই পছন্দ করল। তারপরে যেটা করেছিলুম সেটা তুই জানিস। তুইও যে এক কথাতেই আবার বিয়ে করতে রাজী হবি না, এটা আমি জানতুমই। তোকে কিভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তোর মত নিয়েছিলুম আমরা সে তুই জানিসই। তবে তারপরের কথাগুলো তোকে জানাইনি আমরা। আমি প্রথমে রচু আর দাদাভাইয়ের সাথে, আর পরে কালচিনি গিয়ে মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথে আলোচনা করেছি তোদের বিয়ের ব্যাপারে। রচু তো আমার কথা শুনেই নাচতে শুরু করে দিয়েছিল। দাদাভাইও এক কথায় রাজী হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাসি আর মেসো প্রথমে একটু দোনামনা করছিলেন। বলছিলেন ', ঘরের বিধবা মেয়ের দ্বিতীয়বার বিয়ে দিলে সমাজের চোখে তারা ছোট হয়ে যাবেন। কিন্তু ভাই কিন্তু আমায় প্রথম থেকেই সাপোর্ট করেছিল। মাসি মেসোকে রাজী করাতে আমার খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। তারপর তোর নামের উল্লেখ না করে পরির কাছে জানতে চাইলাম যে স্বামীর সাথে পাঁচ বছর সংসার করা একটা মাধ্যমিক পাশ বিধবা ', মেয়েকে আমি আর নীতা তার জন্যে পছন্দ করেছি। সে বিয়ে করতে রাজী আছে কি না। পরিতোষ শুধু তার আগের কথার পুনরাবৃত্তি করেই জানিয়ে দিয়েছিল যে আমার আর নীতার পছন্দই শেষ কথা। আমাদের পছন্দ হলে সে নিশ্চিন্তে সে মেয়েকে বিয়ে করবে। তাই তার পর থেকেই আমরা সকলেই নিশ্চিন্ত আছি যে পরির সাথেই তোর বিয়েটা হচ্ছে। এদিকে আবার কালচিনিতে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হল। আবার ভাইয়ের ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। এ’সব বিচার করে পাঁজি দেখে বিয়ের দিনও মোটামুটিভাবে একটা স্থির করা হয়ে গেছে। কিন্তু ভেবে দেখলুম যে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি বানানো হলেও ডিসেম্বরের চৌদ্দ তারিখের আগে বাড়িতে গৃহপ্রবেশ করা যাবে না। কিন্তু বিয়ের জন্য আমরা যে দিনটা ভেবেছি সেটা নভেম্বর মাসে পড়ছে। তাই কালচিনি বাড়িতে ওই সময়ে বিয়ের আয়োজন করা সম্ভব নয়। তাই সেদিন যখন রাজগঞ্জ গিয়েছিলুম, তখন জেঠু, বাবা কাকুদের সাথে আলোচনা করেছিলুম আমি। ও বাড়ির সকলেই রাজগঞ্জের বাড়িতে তোর বিয়ের আয়োজন করতে খুব আগ্রহী। আর তারাও সবাই তোর এ বিয়েতে খুব খুশী হয়েছেন। জেঠু নিজেই তোর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিতে রাজী আছেন। রচু এ’সব ঘটণা জানে। তবে ওকে আর তোদের কালচিনির বাড়ির সবাইকেও আমি বলে রেখেছিলুম যে আগেই যেন তোর কাছে এ’সব কথা তারা কেউ প্রকাশ না করেন। কিন্তু বিয়ের দিনক্ষণ আর আয়োজনের ব্যাপারে এখনও মাসি মেসোর সাথে সেভাবে কথা বলার সুযোগ পাইনি আমি। তবে ওই যে বললুম, একটা জিনিসের অপেক্ষা করছিলুম আমি মনে মনে। সেটা হচ্ছে পরিকে দেখে তুই মন থেকে ওকে মেনে নিতে পারিস কি না। আজ যখন ঘটণাচক্রে পরি এভাবে হঠাৎ করে এখানে এল, আর এই মূহুর্তে যখন তোর মনের ইচ্ছেটা আমি বুঝতে পারলুম, তখন আর কোন বাধা রইল না। কিন্তু আজ কেন জানিনা আমার মনে হচ্ছে একটা বাধা আসতে পারে। আমার মনে হচ্ছে ......”

সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “কিসের বাধা দিদিভাই”?

সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার হাতের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আমার মন বলছে পরির পিসিই বোধহয় এখন ওর বিয়ে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করবেন। তাই বলছি বোন, পরিকে তোর ভাল লেগেছে সে তো খুবই ভাল কথা। আমাদের আত্মীয় স্বজন সকলেই এ বিয়েতে রাজী। এমনকি তুই আর পরিও। তাই আজ সকাল অব্দি আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলুম। কিন্তু আজ সারাটা দিনে অপ্রত্যাশিত ভাবে যা কিছু ঘটে চলছে, সে সব ব্যাপার আমাকে একটু ভাবিয়েই তুলছে। তাই তোকে এখন একটা কথা বলছি। সম্ভব হলে কথাটা রাখিস বোন”।

অর্চনা অভিমানী কন্ঠে সীমন্তিনীর একটা হাত হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আবার তুমি ও’সব কথাই শুরু করলে দিদিভাই? তোমার কথা যে আমার কাছে ঈশ্বরের আদেশের চেয়েও ওপরে”।

সীমন্তিনী ম্লান হেসে অর্চনার চিবুক ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কথাটা বলতে আমারও একদম ভাল লাগছে নারে সোনা। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারন তুই আর রচু, তোদের দু’বোনের যত গুণই থাকুক না কেন, তোরা দু’জনেই খুব ভাবপ্রবণ। সময়ে সময়েই তোরা দু’জনেই মনের আবেগে ভেসে যাস। মনের লাগাম টেনে ধরতে জানিস না তোরা। বাস্তব অনেক সময়ই বড্ড নির্মম, বড় কঠিন হয়ে থাকে। তাই কখনো কখনো মনের বিরূদ্ধে গিয়েও তাকে স্বীকার করে নিতেই হয়। অনেক নির্মমতার বিরূদ্ধে সব সময় বিরোধিতা করা যায় না। বিবেক, মন না চাইলেও মাথা নিচু করে মুখ বুজে সেই কঠিন বাস্তবকে স্বীকার করে নিতে হয়। রচু তবু গত কয়েকটা মাসে অনেকটা পরিণত হয়েছে এ ব্যাপারে। কিন্তু তুই কিন্ত রচুর থেকে বয়সে বড় হলেও সে জিনিসটা এখনও রপ্ত করতে শিখিস নি। তাই আমাকেই মুখ ফুটে এ’কথা বলতে হচ্ছে আজ। তুই আমাকে কিন্তু ভুল বুঝিস না বোন। তবে এখনই পরিকে নিয়ে মনে মনে কোন স্বপ্ন সাজাতে শুরু করিস না সোনা। স্বপ্ন ভেঙে গেলে খুব কষ্ট হয় রে। আর তুই তো জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছিস। নতুন করে দেখা এই স্বপ্নটা ভেঙে গেলে আরেকটা বড় আঘাত পাবি মনে। অবশ্য আলিপুরদুয়ারে ঠিক কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্বন্ধে এখনও তো কিছুই জানিনা। তবে ভাল বা মন্দ যাই হোক না কেন, সব কিছুর জন্যেই আমাদের তৈরী থাকতে হবে। তাই বলছি বোন, পরিকে নিয়ে মনে মনে কোনও স্বপ্ন সাজাবার আগে আলিপুরদুয়ারের ব্যাপারটা পরিস্কার হতে দে। আমার মনে হয় কয়েকটা দিনের ভেতরেই ব্যাপারটা আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে যাবে। তবে এই একটু আগে পরিকে নিয়ে তুই যে’সব কথা ভাবছিলিস, আমার মনে হয় সেখানে এমন কিছু হবে না যাতে পরি কষ্ট পায়। পরির পিসেমশাই আর তিন পিসতুতো দাদা পরিকে খুব আদর আপ্যায়ন করেছে, এ’ খবর আমি আগেই পেয়েছি। তবে ওর পিসির সাথে ওর দেখা হয়েছে কিনা সেটা এখনও বুঝতে পারিনি। ওর পিসির হাই ব্লাড প্রেসার বলে সবাই একটু চিন্তায় ছিল। সে হয়ত তার মা, বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ সহ্য করতে পারবে না। তাই আগে থেকেই ডাক্তার ডেকে আনা হয়েছিল। এ খবর পেয়েছি বিকেল প্রায় সাড়ে চারটেয়। কিন্তু তারপর থেকে কয়েকবার পরিকে ফোন করেও পাইনি। ও কেন জানিনা ওর দুটো ফোনই সুইচড অফ করে রেখেছে। তাই বিকেলের পর থেকে আমার উদ্বেগ আরও বাড়ছিল। কিন্তু অফিস থেকে ফেরবার সময়েই ভাইয়ের একটা ফোন পেলাম। সে জানালো সন্ধ্যের কিছু পড়েই নাকি পরির পিসি ভাইয়ের ফোনে ফোন করে মেসোর সাথে কথা বলেছেন। আর তিনি মেসোকে আগামীকাল সকালেই মাসি আর ভাইকে সাথে নিয়ে আপিলুরদুয়ারে তাদের বাড়িতে যেতে হুকুম করেছেন। ভাইকে জিজ্ঞেস করেছিলুম যে পরির পিসির সাথে পরির দেখা হয়েছে কি না, বা পরির সম্বন্ধে কোন কথা বলেছেন কিনা। ভাই জানাল যে তিনি অন্য কোন ব্যাপারেই আর কিছু বলেননি মেসোকে। বারবার শুধু মেসোদের সবাইকে তাদের বাড়ি যাবার কথাই বলেছেন। আর শুনলুম মেসোও সেখানে যাবে বলেই ভেবেছেন। ভাইয়ের ফোন পাবার পর একটা ব্যাপারে তো নিশ্চিত হলাম যে পরির পিসি সুস্থই আছেন। আর ডাক্তার যখন ও বাড়িতে বিকেল বেলায় এসেছিলেন, তাতে মনে হয় এতক্ষণে পরি নিশ্চয়ই তার পিসিকে দেখেছে। রচুর সাথে যখন সন্ধ্যার আগে আমার কথা হল, তখন রচু বলেছিল যে আমাকে ফোন করবার একটু আগেই পরির সাথে ওর কথা হয়েছিল। আর তখনই পরি পিসির সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির ভেতর যাচ্ছিল। তাই এটা ধরেই নেওয়া যায় যে এতক্ষণে তাদের পিসি ভাইপোর মিলন নিশ্চয়ই হয়ে গেছে। আর ভদ্রমহিলা যে সুস্থ আছেন সেটা ভাইয়ের ফোনে পেয়েই জানলুম। তবে পরি নিজে কেন যে একটাও ফোন করছে না সেটা ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। অনেক সম্ভাবনাই মনে আসছে। তবে সেগুলো নিছকই আমার অনুমান। তবে তারপর থেকে রচুর সাথেও আমার কথা হয়নি। দাদাভাইয়ের সাথে একবার কথা হয়েছে তারপর। তার মুখেই শুনলুম আমার সাথে কথা বলবার পরেই রচু নাকি ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছে। পরির পিসির যেন কোন বিপদ না হয়, পিসি যেন পরিকে আপন ভেবে কাছে টেনে নেন। আমার মনে হয় রচু ঠাকুরের কাছে এ’সব প্রার্থনাই করছে। আর দাদাভাই এটাও বলল যে পিসির সাথে দেখা হবার পর পরি প্রথম ফোন করবে রচুকেই। ও রচুকে সে কথা দিয়েছে। আর আমি নিশ্চিত পরির ফোন পেয়েই রচু আমাকে ফোন করবেই করবে। তাই, তুই যেমনটা ভাবছিলিস তেমন ভয়ের কিছু নেই। আমি নিশ্চিত, পরির পিসি পরিকে দেখবার পরে তাকে নিশ্চয়ই কাছে টেনে নিয়েছেন, আর তিনি এখনও সুস্থই আছেন। ও নিয়ে তুই আর ভাবিস নে বোন। আমি তো শুধু এখন রচুর ফোনের অপেক্ষায় আছি। ওর ফোন পেলেই এখন সবকিছু জানতে পারব”।

অর্চনা কিছুটা শান্ত হলেও তখনও খানিকটা উদ্বেগ মাখা স্বরে বলল, “তুমি সত্যি বলছ দিদিভাই। ভাই আর রচুর কাছ থেকে তুমি এ’সব জানতে পেরেছ? কিন্তু তোমাদের বন্ধু তোমাকে বা নীতাদিকে একটাও ফোন করে কিছু জানাতে পারলেন না কেন? এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে গো”?
 

সীমন্তিনী এবার অনেকটা সহজ ভাবে বলল, “আরে বাবা, এটা নিয়ে তুই এত মাথা ঘামাচ্ছিস কেনরে বোকা মেয়ে। আরে ওখানে গিয়ে বাড়িতে ঢোকবার আগেই ও প্রথমে ওর পিসেমশাইকে পেয়েছে। তারপর তিন তিনটে দাদাকে পেয়েছে। আর এনারা সকলেই পরিতোষকে ভীষণভাবে কাছে টেনে নিয়েছে। তারপর বাড়ির ভেতর ঢুকে নিশ্চয়ই তিন তিনটে বৌদিও পেয়েছে। কারন ওর দাদারা সকলেই ওর থেকে বয়সে অনেক বড়। তারা সকলেই নিশ্চয়ই বিয়ে থা করেছেন। তাদের সকলেরই হয়ত একটা বা দু’ তিনটে বাচ্চা কাচ্চাও আছে। পরি হয়ত পাঁচ ছ’টা ভাইপো ভাইঝিও পেয়েছে বাড়িতে ঢোকবার পর। পরি যতই শক্ত নার্ভের হোক না কেন যতই প্র্যাক্টিকাল হোক না কেন, আজ সকাল অব্দি যে জানত যে তার এ পৃথিবীতে নিজের রক্তের সম্পর্কের কেউ নেই, সে যদি হঠাৎ করে এত আত্মীয় স্বজনের মাঝে গিয়ে পড়ে, তাহলে কতক্ষণ নিজের নার্ভ শক্ত রাখতে পারবে বল তো। পরির চোখে আমরা কখনও সুখ বা দুঃখ কোনরকম আবেগের অশ্রু দেখিনি। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমি যেমনটা ভাবছি, আলিপুরদুয়ারের সকলে যদি সেভাবেই পরিকে আদর আপ্যায়ন করে থাকে, তাহলে ও আজ কিছুতেই না কেঁদে থাকতে পারবে না। তবে যদি শুনি ও সত্যিই কেঁদেছে বা এখনও কাঁদছে, তাতে আমি কিন্তু দুঃখ পাব না। বরং আমার আনন্দই হবে। ওর বুকের ভেতর এতগুলো বছরের যে নিঃসঙ্গতার কান্না জমে ছিল তার সবটা আজ চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসবে। ওর বুকের ভেতরের পাষানের বোঝাটা আজ হাল্কা হয়ে যাবে। কিছু সময়ের জন্য ও হয়ত নিজেকেও ভুলে যাবে। আমার মনে হয় সেটাই হয়েছে। ওকে ফোনে পাচ্ছিলুম না বলে আমারও বেশ রাগ হচ্ছিল। কিন্তু রচু আর ভাইয়ের সাথে কথা বলবার পর আমি নিজেকে এভাবেই বুঝিয়েছি। আর মনে হয়, সেটাই সত্যি। তাই তুই নিজের মন থেকে ওই দুর্ভাবনাটাকে এবার বিদায় দে বোন। পরি আর ওর পিসি দু’জনেই নিশ্চয়ই ভাল আছেন। আর দেখিস ওই ভিড়ভাট্টা ডামাডোলের ভেতর ও হয়ত ফোন করে উঠতে পাচ্ছে না। তবে রাতে শোবার আগে হলেও ও নিশ্চয়ই আমাদের ফোন করবে। তুই একদম ভাবিস নে”।


(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 237)

অর্চনা সীমন্তিনীর কথায় এবার বেশ কিছুটা শান্ত হল। একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সে বলল, “তুমি তো বললে যে সন্ধ্যের আগেই পরিতোষবাবু তার পিসির সাথে দেখা করবার জন্য বাড়ির ভেতরে যাচ্ছিলেন। এখন তো রাত প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। এতক্ষণেও তিনি রচুকে আর ফোন করেন নি”?

বলতে বলতেই কলিং বেলের শব্দ হল। আর খানিক বাদেই নবনীতা প্রায় ছুটে এসে সীমন্তিনীর ঘরে ঢুকে বলল, “ও দিদি, পরির ব্যাপারটা কী গো? সেই কোন সকালে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর থেকে আমি ওর কোনও খবর পাচ্ছি না। দুপুরের পর থেকে কয়েকবার ওকে ফোন করেছি। ওর ফোন সুইচড অফ শোনাচ্ছে। তোমার সাথে কি ওর কোনও কথা ............”
 

ওর কথা শেষ হবার আগেই সীমন্তিনীর মোবাইলটা বেজে উঠল। অর্চনা ফোনের দিকে তাকিয়েই প্রায় চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিভাই, রচুর ফোন”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা তুলে কল রিসিভ করতেই ও’পাশ থেকে রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনতে পেল, “ও দিদিভাই। কী ভাল খবর পেলুম গো। পরিদা তার নিজের পিসির সাথে দেখা করেছেন। আর পিসিও পরিদাকে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছেন গো”।

রচনার উচ্ছ্বসিত গলা শুনে সীমন্তিনী সাথে সাথে ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে দিয়েছিল। তাই এবারকার কথা অর্চনা আর নবনীতাও শুনতে পাচ্ছিল। কথাটা শুনেই অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল খুশীতে। কিন্তু নবনীতা রচনার কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

সীমন্তিনী বলল, “তোকে ফোন করেছিল পরি”?

রচনা আগের মতই উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই। এইমাত্র পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তোমার দাদাভাইই ফোনটা ধরেছিলেন। কারন আমি তো তখন ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিলুম”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে জিজ্ঞেস করল, “তাই নাকি? আচ্ছা কি কি হয়েছে সেখানে খুলে বল তো? ওর পিসি সুস্থ আছেন তো”?
 

রচনা একই রকম উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। পিসি একদম সুস্থ আছেন। তিনি তো এক মূহুর্তের জন্যেও পরিদাকে নিজের কাছছাড়া করতে চাইছেন না। তিনি নিজে পরিদার হাত ধরে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছেন। পিসি তো আমার সাথেও ফোনে কথা বললেন। আর তোমার সাথে আমাদের পরিচয়ের সূত্র ধরেই যে পরিদা বাবার কাছে আর তার কাছে গিয়ে পৌঁছেছেন এ’কথা শোনবার পর তিনি আমাকে, তোমার দাদাভাইকে আর তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এখন তো পরিদা ও বাড়িতে পিসি, তিন তিনটে বৌদি, পাচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝিদের সাথে এমন ব্যস্ত আছেন যে কাউকে একটা ফোনও করতে পারছেন না। আমি যে তার ফোন না পাওয়া অব্দি ঠাকুরের প্রার্থনাতেই বসে থাকব, এ’কথা জানলেও তিনি পিসির সাথে দেখা হবার একঘন্টার মধ্যেও আমাকে ফোন করবার সুযোগ পাননি। পিসি নাকি কিছুতেই তাকে নিজের কাছ থেকে দুরে যেতে দিতে চাইছিলেন না। বাধ্য হয়ে তার পাশে বসেই পরিদা আমাকে ফোন করেছিলেন। তখন সব কিছু জানতে পারলুম। পিসিও পরিদার সাথে আমি যখন কথা বলছিলুম তখনই বুঝে গিয়েছিলেন যে আমি বিধুভূষন চক্রবর্তীর মেয়ে। তাই তিনিও তখন আমার সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেন। আমিও যেন খুশীতে পাগল হয়ে গিয়েছিলুম। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে পরিদার কাছ থেকে সবকিছু জেনে নিয়েই তোমাকে ফোন করছি। পরিদা বলেছেন, সে রাতে তোমাদের সাথে কথা বলবেন। কিন্তু দিদিভাই, পরিদা বললেন, পিসি বাবাকে আদেশ দিয়েছেন কাল বাড়ির সবাইকে নিয়ে তাদের ওখানে যেতে”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে, সে খবর আমিও পেয়েছি। কিন্তু পরির সাথে তোর আর কি কি কথা হয়েছে সে’সব আগে খুলে বল তো”।

রচনা অনেকটা সময় ধরে সবকিছু গুছিয়ে বলবার পর জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, পিসি যে আগামীকাল সকালেই মা বাবা আর ভাইকে ডেকে পাঠালেন, এর পেছনে কী কারন থাকতে পারে বলো তো”?
 

সীমন্তিনী এবার অপেক্ষাকৃত শান্ত গলায় বলল, “ব্যাপারটা নিয়ে আমিও ভেবেছি রে রচু। আর এটা নিয়েই আমি অর্চুর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলুম। আমার মন বলছে এর পেছনে দুটো কারন থাকতে পারে। আর তার একটা যে সত্যি সে বিষয়ে কোন সন্দেহই নেই আমার। তবে দ্বিতীয় কারনটা যেটা আমি ভাবছি, সেটা সত্যি না-ও হতে পারে। তবে সেটাও যদি সত্যিই হয় তবে আমাদের পক্ষে সেটা ভাল না-ও হতে পারে”।

নবনীতা আর অর্চনা সীমন্তিনীর কথার মানে বুঝতে না পেরে চুপ করে রইল। কিন্তু রচনা বলল, “কী আশ্চর্য দিদিভাই! আমার মনেও কিন্তু দুটো সম্ভাবনার কথাই মাথায় এসেছে। জানিনা তুমিও ঠিক সেটাই ভাবছ কি না। তবে আমার মনে হয় তুমি প্রথম যে সম্ভাবনাটার কথা বলছ সেটা নিজের ভাইপোকে ফিরে পেয়ে বাবাকে পিসি তার কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানাতে চান। তুমিও কি এমনটাই ভেবেছ দিদিভাই”?

সীমন্তিনী রচনার কথায় সম্মতি জানিয়ে বলল, “আমিও ঠিক এটাই ভেবেছি রে রচু। তবে তুই দ্বিতীয় সম্ভাবনা হিসেবে কী ভাবছিস সেটা বল তো। দেখি এটাও আমার ধারণার সাথে মিলে যায় কিনা”?

রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেল। অর্চনাও যে এই মূহুর্তে সীমন্তিনীর পাশে বসে তাদের সব কথা শুনছে সেটা সে আগেই বুঝতে পেরেছে। তাই একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “দিদিভাই, আমার মনে হয় সেটা এ মূহুর্তে না বলাই ভাল। অন্য কোন সময় বলব’খন”।

সীমন্তিনী একহাতে অর্চনাকে তার আরও কাছে টেনে নিয়ে বলল, “তুই ভাবিস না সোনা। আমি আছি তো তোর আর অর্চুর পাশে। আর তোকে বললুম না আগেই? এ ব্যাপারেই আমি এতক্ষণ অর্চুর সাথে কথা বলছিলুম। আর শোন, এতদিন আমরা সবাই অর্চুর কাছে যে’সব কথা গোপন রেখেছিলুম তার সব কিছু আজ ওকে খুলে বলতে বাধ্য হয়েছি। আর কেন বাধ্য হয়েছি জানিস? তোর দিদি যে একদিনের দেখাতেই পরির প্রেমে পড়ে গেছে রে। ও যে আজ সারাটা দিন তোর আমার চেয়েও অনেক বেশী উদ্বেগে কাটিয়েছে। সেটা জানবার পরেই ওকে আমি এতদিন গোপন রাখা সব কিছু খুলে বলেছি”।

রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “অ্যা! কী বলছ তুমি দিদিভাই? দিদি পরিদাকে ভাল বেসে ফেলেছে? সত্যি বলছ তুমি”?

নবনীতাও এ’কথা শুনে অবাক। কিন্তু এতক্ষণে অবাক হবার মত আরও অনেক কিছুই সে শুনেছে। তার মনেও হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে আছে। কিন্তু রচনার সাথে ফোন বার্তালাপ শেষ না হওয়া অব্দি সে তো আর সীমন্তিনীর কাছে কোন প্রশ্ন তুলে ধরতে পারছে না। তাই চুপ করেই রইল। কিন্তু লজ্জায় নুয়ে পড়া অর্চনার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কিগো অর্চু? সত্যি”?

অর্চনা কোন কিছু না বলে লজ্জায় যেন আরও নুয়ে পড়ল। ওদিকে রচনা তখন ফোনে বলছে, “দিদিভাই আমি বুঝতে পাচ্ছিনা তোমার কথা শুনে আমার খুশী হওয়া উচিৎ? না চিন্তিত হওয়া উচিৎ। আমরা সকলেই তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে ব্যাপারটাকে প্রায় ফাইনাল করে এনেছিলুম। এখন পরিদার পিসিই যদি পরিদার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরিদার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন? তাহলে কী হবে গো”?

সীমন্তিনী শান্ত গলায় বলল, “সে সম্ভাবনা মাথায় রেখেই অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম এতক্ষণ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অর্চুর উদ্বেগ দেখেই যখন আমি ওর মনের ব্যাপারটা আঁচ করেছি, তখনই মনে হল, আগে থেকেই ওকে সাবধান করে দেওয়া উচিৎ। তাই এতদিন আমরা সকলে মিলে ওকে আর পরিকে নিয়ে যা যা ভেবেছি, আর সেজন্যে যাকিছু করেছি তার সবকিছুই খুলে বললুম ওকে। এখন পরির পিসি যদি আমাদের আশঙ্কাটাকেই সত্যি প্রমাণ করে অন্য কোন মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান, তাহলে আমরা তো আর সেটা আটকাতে পারব না। আর আগে পরি আমাদের যে প্রতিশ্রুতিই দিয়ে থাকুক না কেন, জীবনে প্রথমবার খুঁজে পাওয়া ওর একমাত্র রক্তের সম্পর্কের পিসির অনুরোধ বা আদেশ সে ফেলতে পারবে না। হয়ত তার প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারার জন্য আমাদের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করবে। আর পরি আমাদের যত কাছের বন্ধুই হোক না কেন, আমাদের তো পরির ওপর বিরূপ চাপ সৃষ্টি করার কোনও অধিকার নেই। মন না চাইলেও কঠিন সেই বাস্তবকে আমাদের মেনে নিতেই হবে। তাই তো এ’সবই এতক্ষণ অর্চুকে আমি বোঝাচ্ছিলুম। ওকে বলছিলুম, আগে থেকেই মনে কোন রঙ্গিন স্বপ্ন যেন ও দেখতে শুরু না করে”।

রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে বলল, “তুমি ঠিকই করেছ দিদিভাই। দিদি জীবনে কম কষ্ট তো পায় নি। আবার জীবনে প্রথম একজনকে মনে মনে ভালবেসে তাকে নিজের করে না পেলে ও যে আরও একটা বড় আঘাত পাবে। আবার কষ্ট পাবে”।

সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “ঠিক সেটা ভেবেই আজ আমি ওকে সব কিছু খুলে বললুম। আসলে যখনই জানতে পেরেছি যে পরি তার পিসির খোঁজ পেয়েছে, তখন থেকেই আমার মনে এ চিন্তাটা এসেছে। এতদিন গোটা ব্যাপারটাই আমার আর নীতার হাতে ছিল। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছিলুম। কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা হঠাৎ করেই বদলে গেল। পরি ওর রক্তের সম্পর্কের পিসিকে খুঁজে পেয়েছে জেনে তুই আমি, মাসি মেসোরা, সবাই তো খুশী হয়েছি। কিন্তু তার সাথে সাথে আমার মনের কোনে একটা ঘণ কালো মেঘের ছায়াও যেন ফুটে উঠছে। পরির পিসির মতের বিরূদ্ধে গিয়ে আমরা তো জোর করে ওদের বিয়ে দিতে পারব না। তবে আমার মনে হয় এখনই হতাশ হবার মত কিছু হয়নি। ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু অর্চু যদি এরই মধ্যে নিজেকে মানসিক ভাবে পুরোপুরি পরির কাছে সমর্পন করে দেয় তাহলেই বিপদ হয়ে যাবে। এ’সব কথাই ওকে বোঝাচ্ছিলুম আমি। তুইও এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করিস নে বোন। আমাদের এখন পরির পিসির মনের ইচ্ছেটা বোঝবার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। যদি সম্ভব হত আমি আজই তার সাথে দেখা করে এ ব্যাপারে আলোচনা করতুম। কিন্তু সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাছাড়া অজানা অচেনা এক মহিলার কাছে অনাহুত ভাবে গিয়ে তার ভাইপোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলাটাও তো উচিৎ না। তাই একটু সময় নিয়ে ভেবে দেখতে হবে গোটা ব্যাপারটা। ততদিন অর্চুকেও নিজের মনটাকে শাসনে রাখতে হবে। সেটা করতে পারলেই ওর পক্ষে মঙ্গল। এ ছাড়া আমাদের সামনে এই মূহুর্তে আর করণীয় কিছু নেই। তুইও আর আজে বাজে কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করিস নে। দেখা যাক কী হয়। পরি হয়ত রাতে ফোন করবে আমাকে বা নীতাকে। ওর সাথে কথা বলেও কিছুটা আঁচ পেতে পারি। যখন যা হয় তুই জানতে পারবি। আর তুইও যদি কোনখান থেকে কিছু জানতে পারিস, তাহলে আমাদের জানাস, কেমন”।

রচনা সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই। রাখছি তাহলে”।

রচনার সাথে ফোনে কথা শেষ করেই সীমন্তিনী নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “কিরে একের পর এক এতসব অপ্রত্যাশিত খবর শুনে হকচকিয়ে গিয়েছিস নিশ্চয়ই। জানি তোর মনের মধ্যে এখন অনেক প্রশ্ন কিলবিল করছে। এক কাজ কর, হাত মুখ ধুয়ে অর্চুকে নিয়ে তোদের ঘরে বসে ওর কাছ থেকে সব কিছু জেনে নে। আমি এই মূহুর্তে তোকে সে’সব শোনাতে পারছি না। আমার এখনই কালচিনিতে ফোন করতে হবে। সেটা পরে শুনে নিস”।

নবনীতা কোন কথা না বলে “এসো অর্চু” বলে অর্চনার হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর সীমন্তিনী সাথে সাথে কিংশুকের নাম্বার ডায়াল করল। ও’পাশ থেকে কিংশুকের সাড়া পেতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “ভাই, মেসো দোকান বন্ধ করে বাড়ি এসেছেন”?

কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, বাবা একটু আগেই বাড়িতে এলেন। বাবার সাথে কথা বলবে তুমি? এক মিনিট ধরো তাহলে, আমি ও’ঘরে যাচ্ছি”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “হ্যাঁ ভাই আমি আছি লাইনে। আচ্ছা ভাই, এর মধ্যে পরির বা আলিপুরদুয়ারের আর কেউ ফোন করেছিল”?

কিংশুক বলল, “না দিদিভাই, ওই তোমাকে যে আগের বার বললুম, পরিদার পিসি বাবার সাথে কথা বললেন, তারপর আর কেউ ফোন করেনি। আচ্ছা দিদিভাই, এই নাও বাবাকে দিচ্ছি”।

একটু পরেই ফোনে বিধুবাবুর গলা শোনা গেল, “কে মন্তি মা? হ্যাঁ মা বলো”?

সীমন্তিনী বলল, “মেসো শুনলুম কাল নাকি তোমরা সবাই আলিপুরদুয়ার যাচ্ছ পরির পিসির বাড়িতে”?

বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁগো মা। আসলে হিমুদি এমনভাবে বললেন যে না গেলে ভাল দেখাবে না। আর আমাদের সকলের মনেও একটু কৌতূহল আছেই। পরিকে ও বাড়ির লোকেরা ঠিক কেমন ভাবে নিয়েছে সেটা তো এখনও বুঝতেই পারিনি আমরা। খোকাকে দিয়ে পরির নাম্বারে দু’বার ফোনও করিয়েছি সন্ধ্যের পর থেকে। কিন্তু ও ফোন ধরছে না। ও নিজেও ফোন করে আমাদের কিছু জানাল না। তাই ভাবলুম হিমুদি যখন এত করে বললেন, তাহলে একটা দিন না হয় দোকান বন্ধ রেখে গিয়ে ঘুরেই আসি। তবে বিকেল বা সন্ধ্যের দিকেই সেখান থেকে ফিরে আসব”।

সীমন্তিনী স্বাভাবিক গলায় বলল, “ঠিক আছে মেসো, আমারও মনে হচ্ছিল তোমাদের যাওয়া উচিৎ। তবে মেসো আমরা যে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, এ’ কথাটা ওখানে তোমরা কেউ এখনই প্রকাশ করে দিও না। তাতে একটু অসুবিধে হতে পারে”।

বিধুবাবু বললেন, “তোমার কথার তাৎপর্য আমি বুঝতে পেরেছি মা। আমি নিজেও সে ব্যাপারে একটু চিন্তিত আছি। কিন্তু মা, পরি তো গতকাল পুরোটা দিনই তোমাদের ওখানেই কাটিয়েছে। পরির সাথে তোমরা কি এখনও ও ব্যাপারে কোন কিছু আলোচনা করোনি”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “ইচ্ছে থাকলেও সেটা করবার সুযোগ পাইনি গো মেসো। পরি যে এভাবে হুট করে আমার এখানে আসবে সেটাই তো আমি জানতুম না। আমি যখন অফিসে যাব বলে ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলুম তখনই ও এসে হাজির। তবু ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে একটু দেরীতেই আমি অফিসে গিয়েছিলুম। আবার অফিস থেকে ফিরে অধিকারীবাবুর সাথে আমি আর পরি মিলে একটা মিটিঙে বসেছিলুম। ভেবেছিলুম ও আরও দু’ একটা দিন নিশ্চয়ই এখানে থাকবে। কিন্তু রাতেই ও জানিয়ে দিল যে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ও তোমাদের সাথে দেখা করতে যাবে। আর ঠিক সেভাবেই আজ সকালেই তো ও বেরিয়ে গেল। তাই ওর সাথে ওই ব্যাপার নিয়ে কোন কথাই বলতে পারিনি। ওর সাথে তো একা বসে গল্প করবার জন্য সুযোগই পেলুম না। আর সকলের সামনে কি আর এ’সব কথা বলা যায়, বলো”?

বিধুবাবু সীমিন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, সে তুমি ঠিকই বলেছ মা। হাতে একটু সময় নিয়ে দু’পক্ষ একসাথে বসবার সুযোগ না পেলে তো আর সে’সব আলোচনা করা সম্ভব হয় না। কিন্তু জানো মন্তি মা। আজ দুপুরের পর থেকে মনটা বড় অস্থির হয়ে আছে। ছোটবেলার বন্ধুর ছেলেকে খুঁজে পেয়ে মনটা খুশীতে ভরে উঠেছিল। পরি নিজের পিসির কাছে যাচ্ছে, এটা ভেবেও খুব আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু হিমুদির যে প্রেসার বেড়েছে, এ’কথা আমার জানা ছিল না। বিকেলে রচু আর নিরুদার বড় ছেলে শ্যামলেন্দু ফোন করে জানাল যে নিরুদা আর তার ছেলেরা পরিকে খুব আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেও হিমুদির প্রেসার বেড়েছে বলে তারা ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া পরিকে হিমুদির সাথে দেখা করতে দিতে চাইছেন না। হাই ব্লাড প্রেসারের রোগী হিমুদি এই বয়সে তার মা বাবা আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে সহ্য করতে পারবেন কিনা তা নিয়ে মনটা খুব শঙ্কিত হচ্ছিল। সন্ধ্যে সাড়ে ছটা নাগাদ হিমুদি নিজেই ফোনে আমার সাথে কথা বললেন। উনি পরিকে দেখেছেন কিনা, ওনার শরীর ঠিক আছে কিনা, এ’সব জিজ্ঞেস করেও কোন উত্তর পেলাম না। হিমুদি শুধু বাড়ির সবাইকে নিয়ে কাল সকালেই তার বাড়িতে যাবার আদেশ শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। ওখানে পরির সাথে কে কেমন ব্যবহার করছে, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলুম না। খানিকক্ষণ আগে রচু ফোন করে সব কিছু জানাল। রচুর কাছ থেকে সবকিছু শুনে আগের দুশ্চিন্তাগুলো মন থেকে কেটে গেলেও নতুন করে আরেক দুশ্চিন্তা মনে এসে ঢুকল। হ্যাঁগো মা, আমরা সবাই মিলে যা ভাবছিলুম সেটা শেষ পর্যন্ত বাস্তবে রূপ নেবে তো? তোমার কি মনে হয় মা”?
 


সীমন্তিনী শান্ত কন্ঠে বলল, “মেসো, এই মূহুর্তে আমাদের সকলের মনেই সেই একই প্রশ্ন। এতদিন তো পরি সবকিছুই আমার আর নীতার ওপর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু আজ ও ওর আপন অভিভাবক খুঁজে পেয়েছে। তাই পরিস্থিতি তো অনেকটাই পাল্টে গেল। এখন পরির পিসি পিসেমশাইরাই তো ওর বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। আর নীতিগত ভাবে তেমনটাই তো হওয়া উচিৎ মেসো। তবে তারা যদি তেমন দায়িত্ব নিতে না চান তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু রচুর মুখে যা শুনলুম তাতে তো মনে হল ও বাড়ির সকলেই পরিকে আপন করে নিয়েছে। তাই ওর বিয়ের ব্যাপারটা তাদের ওপরেই বোধহয় বর্তাবে। আর সেজন্যেই তোমাকে ও’ কথা বললুম। আমরা এতদিন ধরে পরি আর অর্চুর বিয়ের ব্যাপারে যা কিছু ভেবেছি সে’সব কথা তুমি কালই তাদের জানিও না। কারন, একদিকে আমাদের অর্চু অল্পশিক্ষিতা। অন্যদিকে ও বিবাহিতা এবং বিধবা। পাঁচ পাঁচটা বছর এক মোদো মাতাল স্বামীর সাথে সংসার করেছে। সে মেয়ে যতই রূপবতী আর গুণবতী হোক না কেন, কোনও ছেলের অভিভাবকেরাই এমন মেয়ের সাথে এক কথায় ছেলের বিয়ে দিতে রাজী হবেন না। তবে যে মহিলা আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে নিজের মা বাবার মতের বিরূদ্ধে গিয়ে নিচুজাতের একটা ছেলের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে তার সাথে সংসার করতে পারেন, তার ভেতর ধর্মের বা সংস্কারের গোড়ামি কিছুটা হলেও কম হবার কথা। আর অন্য দিক দিয়ে এটাও ভাবা যায় যে পরিকে তো ওনারা আজই পেলেন। তাই এখনই যে ওনারা পরির বিয়ের জন্য উদ্যোগী হয়ে উঠবেন তা মনে হয় হবে না। তাই আমাদের একটু অপেক্ষা করতেই হবে মেসো। আজই তো আর পরির পিসির কাছে অর্চুর সম্মন্ধ নিয়ে যাওয়া যায় না। আর তাছাড়া সবচেয়ে বড় ব্যাপার অর্চুকে তারা পরির জন্য পছন্দ করবেন কি না। আর কথায় কথায় হঠাৎ একটা প্রশ্ন আমার মনে এল। আচ্ছা মেসো, অর্চুর ব্যাপারে পরির পিসো পিসিরা কি কিছু জানেন”?

বিধুবাবু জবাবে বললেন, “অর্চুর ব্যাপারে তারা অনেক কিছুই জানেন রে মা। তোমাকে বোধহয় সে’কথা আগে বলিনি আমি। আসলে এমন একটা দিন যে আমাদের জীবনে আসতে পারে সেটা তো ভাবিনি আগে। তাই সেদিন ছোটবেলার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর দিদিকে দেখার কথাটা তোমাকে বলিনি। তবে যেদিন আমি প্রথম দোকানের জন্য থোকে মাল কিনব বলে আলিপুরদুয়ার গিয়েছিলুম সেদিনই তো নিরুদার সাথে আমার দেখা হয়েছিল। আর নিরুদা অ', আর একটু কড়া ধাচের মানুষ হলেও মানুষ হিসেবে খুবই ভাল। উনি তো আমাকে দেখার সাথে সাথেই আমাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। প্রায় চুয়াল্লিশ বছর বাদে হিমুদিকে দেখতে পেয়ে আমারও খুব ভাল লেগেছিল। হিমুদিও সেদিন সাংঘাতিক খুশী হয়েছিলেন আমাকে পেয়ে। আমাকে নিয়ে যে তিনি কি করবেন না করবেন তা যেন বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। আমার সেই মূহুর্তে মনে হয়েছিল আমিই বুঝি হিমুদির মায়ের পেটের ছোট ভাই। কিছুক্ষণ মা বাবা ভাইদের কথা উঠিয়ে কান্নাকাটি করে অনেক আদর যত্ন করেছিলেন আমাকে। আমাদের সব খবরাখবর নিচ্ছিলেন। তখন আমাদের সকলের কথাই তাকে বলেছি। তোমার কথাও সেদিন তাকে বলেছিলুম। অর্চুর বিয়ের পর সাতটা বছর শ্বশুর বাড়িতে কত কষ্টে ছিল, আর শেষে ওকে আমরা ফিরে পেলাম কিভাবে, এসব প্রায় সবই বলেছি হিমুদিকে”।
Like Reply
(Update No. 238)

সীমন্তিনী তার কথা শুনে বলল, “ও আচ্ছা। তবে মেসো, এখন আমি রাখছি। তোমরা আর কোনও খবরাখবর জানতে পারলে আমাকে জানিও। তবে আমার কথাটা মাথায় রেখো কিন্তু। কাল আলিপুরদুয়ার গিয়ে ও বাড়িতে পরি আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে একটা কথাও কিন্তু তোমরা বোল না। আবার একেবারে হতাশ হয়েও পোরো না। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। হাওয়া কোন দিকে বয় সেটা আগে দেখে নেওয়া দরকার। তারপর সিদ্ধান্ত নেব আমরা। ঠিক আছে”?
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা ঠিক আছে, তাই হবে। আমি খোকাকে আর ওর মাকেও সেটা বুঝিয়ে দেব”।

সীমন্তিনী তারপর কথা শেষ করে গভীরভাবে কিছু একটা ভাবতে লাগল।
 

****************

এর পরের সাত আট দিনের মধ্যে অনেক কিছু হল। পরিতোষ সেদিন রাতে সীমন্তিনীকে ফোন করে পিসির সাথে দেখা হবার সব ঘটণা সীমন্তিনীকে জানিয়েছিল। আর হৈমবতীদেবীও সেদিন রাতে রচনার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলেন। তাদের গোটা আলোচনাটাই সেদিন সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ঘিরে ছিল। নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে অনেক কিছু জানতে পারলেও, সীমন্তিনী কেন পরিতোষের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সেটা হৈমবতীদেবী জানতে পারলেন না।
 

কলকাতায় মহিমার প্রজেক্টের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মহিমা প্রায় রোজই সীমন্তিনীর সাথে রাতে ফোন করে কাজের অগ্রগতীর খবর জানায়।
 

পরিতোষকে আরও তিনদিন আলিপুরদুয়ারে পিসির বাড়িতে থাকতে হয়েছিল। পরিতোষের সাথে তার পিসির যেদিন দেখা হল তার পরের দিনই হৈমবতীদেবীর অনুরোধে কালচিনি থেকে বিধুবাবুরা সকলেই আলিপুরদুয়ারে তাদের বাড়ি এসেছিলেন। নিজের ভাইপোকে ফিরে পাবার জন্য বিধুবাবুকে হৈমবতীদেবী প্রাণভরা আশীর্বাদ আর ধন্যবাদ জানিয়েছেন। পরিতোষের মাধ্যমে বাবার আর ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর সেদিন রাত থেকেই হৈমবতীদেবী অশৌচ পালন করতে শুরু করেছিলেন। বিধুবাবুর সাথে শলা পরামর্শ করে তিনদিন পর তিনি আনুষ্ঠানিক ভাবে বাবার শ্রাদ্ধকৃত্য সম্পন্ন করেছিলেন। তাই শ্রাদ্ধের দিন পর্যন্ত পিসির অনুরোধে পরিতোষকে বাধ্য হয়েই আলিপুরদুয়ারে থাকতে হয়েছিল।
 
চতুর্থ দিন সকালে সে পিসির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কালচিনিতে একবেলা কাটিয়ে বিকেলের ট্রেনে মালবাজার চলে গিয়েছিল। সেখানে এক রাত তার পূর্ব পরিচিত দেবাশীষ বক্সীর সাথে কাটিয়ে পরদিনই সে কলকাতা ফিরে এসেছিল। আর কলকাতায় ফিরে এসেই সেদিন রাতেই পরিতোষ ডক্টর বড়ুয়ার বাড়ি গিয়ে নাগরাকাটা থেকে কিনে আনা উপহার সামগ্রী গুলো তাদের সবাইকে দিয়েছিল। উপহার পেয়ে সবাই খুশী তো হয়েই ছিল, কিন্তু তার চেয়েও বেশী খুশী হয়েছিল দীপা বড়ুয়া, যখন শুনলেন যে পরিতোষ কালচিনি গিয়ে তার বড়দার সাথে দেখা করে এসেছে আর পরিতোষ এতদিনে নিজের রক্তের সম্পর্কের পিসি আর তার বিশাল পরিবারকে খুঁজে পেয়েছে।
 

বিমল আগরওয়ালার অপারেশনে আর রতীশ ও রচনার ওপর নজর রাখবার জন্যে যতজনকে কাজে লাগানো হয়েছিল। তাদের সমস্ত পাওনাগন্ডা চুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন আর রতীশ ও রচনার ওপর কেউ নজর রাখছে না। তবে পরিতোষ স্বয়ং রোজ সকালে রচনাকে আর বিকেলে রতীশকে ফোন করে তাদের সমস্ত সুবিধে অসুবিধের খবর নেয়। এ ছাড়াও তার টিমের প্রণবকেও বলে রেখেছে সে যেন রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর নজর রাখে। প্রণবের বাড়ি রতীশদের ফ্ল্যাট থেকে খুবই কাছে। বাড়ি থেকে যেতে আসতে তাকে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই যাতায়াত করতে হয়। তাছাড়া রতীশদের ফ্ল্যাটের কাছেই যে পানের দোকানটা আছে তার মালিকের সাথেও প্রণবের খুব ঘণিষ্ঠতা আছে। প্রণব সেই দোকানীকেও রতীশদের ফ্ল্যাটের ওপর সর্বদা নজর রাখতে বলেছে। ওদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এলাকায় কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে বা সন্দেহজনক কিছু দেখলেই প্রণব সেটা জানতে পারবে।
 

কিন্তু পরিতোষ আর অর্চুর বিয়ে নিয়ে দুর্ভাবনায় থাকা কলকাতা, নাগরাকাটা আর কালচিনির তিনটে পরিবারের লোকদের দুর্ভাবনা এখনও কাটেনি। পরিতোষের সাথে সীমন্তিনী আর নীতার প্রায় রোজই কথা হয়। পরিতোষ নানা বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলে, আগের মতই বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে। তবে সীমন্তিনীর সাথে কথা বলবার সময় সে প্রায় রোজই সীমন্তিনীকে সব সময় সতর্ক আর সাবধান থাকতে বলে। রোজ পরিতোষ তাকে এমনভাবে সতর্ক করছে কেন তা জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পায়নি সীমন্তিনী। কিন্তু পরিতোষ তাকে বিশেষভাবে বারবার করে ফোনে তাকে বলেছে যে, ব্যক্তিগত কাজেই হোক বা অফিসের কাজেই হোক, সীমন্তিনী নাগরাকাটা থেকে বাইরে কোথাও গেলে যেন পরিতোষকে অবশ্যই সে’কথা জানিয়ে দেয় আগে থেকেই। আর রাতের বেলায় ডিউটি ছাড়া অন্য কোন কাজেই যেন সে কোয়ার্টার ছেড়ে না বেরোয়। আর রাতের বেলা কোথাও ডিউটিতে গেলেও যেন অতিরিক্ত সিকিউরিটি নিয়ে যায়। তবে পরিতোষ সীমন্তিনীর প্রশ্নের পরিস্কার জবাব না দিলেও সীমন্তিনীর ধারণা পরিতোষ হয়ত কোনভাবে জানতে পেরেছে যে সীমন্তিনীর ওপর কোনও আচমকা হামলা হতে পারে। এ ব্যাপারে অবশ্য সীমন্তিনী নিজেও অবহিত আছে মোটামুটি। কয়েকটা উগ্রপন্থী সংগঠনের সদস্যরা যে তার ওপর ক্ষেপে আছে তা সীমন্তিনী নিজেও জানে। জুলাই মাসে দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানের সময়েই সে নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছিল। দার্জিলিং বর্ডারে অনুসন্ধানে যাবার পর থেকেই সে উগ্রপন্থীদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছে। আর পরিতোষের বন্ধু দেবাশীস বক্সীও তখনই সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন। সীমন্তিনী নিজেও সেটা উপলব্ধি করেছে। আর নিজেও সর্বদা চোখ কান খোলা রেখে চলে। তাই সে ভেবেছে যে পরিতোষ যখন মালবাজার গিয়েছিল তখন নিশ্চয়ই দেবাশীস বক্সী পরিতোষকে সে’সব কথা বলেছেন। আর তার পর থেকেই পরিতোষও তাকে রোজ সতর্ক করে যাচ্ছে। আর এই কারনেই অনেক ইচ্ছে থাকা সত্বেও, কোনও অফিসিয়াল কাজ না পরার দরুন সীমন্তিনীর আর আলিপুরদুয়ারে যাওয়া হয়নি। ব্যক্তিগত কাজের অজুহাতে গেলে তার সঙ্গে সিকিউরিটি থাকবে না। তাই সে মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে আবার আলিপুরদুয়ারে কোন একটা অফিসিয়াল মিটিং বা অন্য কোনও ধরণের অফিসিয়াল ডিউটি পড়লে সে পরিতোষের পিসি আর পিসেমশাইয়ের সাথে দেখা করবে। অবশ্য প্রথম দেখাতেই সে পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গটা ওঠাতে পারবে না। তবে আন্তরিক ভাবে পরিচিত হতে পারলে, তাদের মন জয় করতে পারলে, নিশ্চয়ই তাদের ফোন নাম্বার চেয়ে আনা যাবে। আর পরে ফোনেও আসল কথাটা নিয়ে সময় বুঝে আলোচনা করা যাবে।
 

ওদিকে পরিতোষের জীবনটা কালচিনি আর আলিপুরদুয়ার যাবার পর থেকেই অনেকটাই পালটে গেছে। পিসির বাড়িতে তাকে চারটে দিন থাকতে হয়েছিল। সেখানে পিসি, পিসেমশাই, তিন দাদা, তিন বৌদি, আর পাঁচ পাঁচটা ভাইপো ভাইঝির সাথে কাটানো দিনগুলো যেন তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ দিন। সেখানে তিন দিনের দিন হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর আদেশে তাদের দুই মেয়েও তাদের স্বামী আর ছেলেমেয়েদের নিয়ে আলিপুরদুয়ারে এসেছিল। পিসি-পিসোর বড়মেয়ে নিহারিকা আর ছোটমেয়ে সুতনুকা। তারা দু’জনেই বয়সে পরির চেয়ে ন’ এবং সাত বছরের বড়। নিহারিকার একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। ছেলেটির বয়স চৌদ্দ আর মেয়েটির সাত। সুতনুকারও একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। তার ছেলের বয়স বারো আর মেয়ের নয়। এতসব আত্মীয় স্বজনকে কাছে পেয়ে পরিতোষ সত্যিই আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিল। তার পিসির সংসারে সেই কটা দিনের স্মৃতি যেন পরিতোষের মনের ভেতরের সমস্ত দুঃখ সমস্ত গ্লানি দুর করে দিয়েছে। এখনকার পরিতোষ আর সাতদিনের আগের পরিতোষ যেন সম্পূর্ণ আলাদা দুটো লোক। কালচিনি আর আলিপুরদুয়ারে গিয়ে তার যেন এক নবজন্ম লাভ হয়েছে। কলকাতা ফিরে আসবার পর তার পিসতুতো তিন দাদা আর দু’ দিদি প্রায় রোজই ফোন করে তাকে। তার পিসি রোজ রাত ন’টার দিকে ফোন করেন। পরিতোষের জীবনের সব কথা শুনতে শুনতে তিনি যেন পরিতোষের বন্ধু হয়ে উঠেছেন। আর তার তিন বৌদি। তারাও রোজ পরিতোষকে ফোন করেন। ইয়ার্কি ফাজলামো করেন। তবে বড়বৌদি সুলোচনার আন্তরিকতা বা স্নেহে একফোঁটা খামতি না থাকলেও, তিনি নিজে পরিতোষের সাথে অতটা খোলামেলা কথা বলেন না। পরিতোষের আর তার সম্পর্কটা যেন সত্যিকার দিদি আর ভাইয়ের সম্পর্ক। পরিতোষের স্নান খাওয়া দাওয়া হয়েছে কিনা। তার শরীর আর মন ভাল আছে কি না, কাজের ব্যস্ততা কেমন, মূলতঃ এ’সব বিষয়েই তিনি পরিতোষের সাথে কথা বলেন। কিন্তু মেজবৌদি রুমা আর ছোটবৌদি দেবিকার মুখের আগল যেন দিনে দিনে আলগা হচ্ছে। তাদের ভাইদার সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের মত আচরণ করতে শুরু করেছেন তারা। পরিতোষের অবশ্য এটাও মন্দ লাগে না। দিনের শেষে, অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ওই দু’জনের সাথে ঠাট্টা ইয়ার্কি আর খুনুসুটি করতে করতে সে যেন তার শরীরের ভেতরের জীবনীশক্তি ফিরে পায় আবার। নতুন করে তার মনে প্রাণে যেন উদ্যমের জোয়ার ফিরে আসে। আর ওই দু’জনের সাথে যত প্রসঙ্গেই কথা হোক না কেন, ঘুরে ফিরে বারবার পরিতোষের বিয়ের প্রসঙ্গই আসে। এই দুই বৌদি, আর পিসির সাথে বন্ধুত্বসুলভ কথাবার্তায় পরিতোষ তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া ভালবাসার কথাও খুলে বলতে বাধ্য হয়েছে এই ক’দিনেই। হৈমবতীদেবী, রুমা আর দেবিকা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সীমন্তিনী আর নবনীতার সাথে পরিতোষের সম্পর্কের প্রায় সমস্ত খুঁটিনাটিই এ’ ক’দিনে জেনে ফেলেছেন। জীবনে প্রথমবার এতজন আত্মীয় পরিজনের সাথে কথা বলতে বলতে পরিতোষ নিজেও যেন বদলে গেছে। নিজের জীবনের সমস্ত ব্যক্তিগত কথাও সে অনায়াসে প্রকাশ করে ফেলেছে তাদের সাথে। তবে সীমন্তিনীকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি সে ভুলে যায়নি। তাই কবে কোনদিন সে নবনীতা আর সীমন্তিনীকে কিভাবে ভালবেসে ছিল, আর তার ওই ভালবাসার পরিণতি কিভাবে হয়েছিল, এ’সব কথা জানতে পারলেও তার পিসি এবং বৌদিরা সীমন্তিনীর ভালবাসার পাত্রটি আসলে কে, এ প্রশ্নের জবাব হাজার চেষ্টা করেও পরিতোষের কাছ থেকে জানতে পারেন নি।

সীমন্তিনী, নবনীতা, রচনা মাঝে মাঝে পরিতোষকে ফোন করে তার ফোন ব্যস্ত দেখে। পরে অবশ্য পরিতোষই নিজেই তাদের ফোন করে জানায় যে সে আলিপুরদুয়ারের কারো সাথে ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। পরিতোষ যে তার নিজের আত্মীয় পরিজনদের কাছে পেয়ে আগের চেয়ে অনেক ভাল আছে, আনন্দে আছে, এ’কথা বুঝতে পেরে তারা সবাই খুশী হলেও অর্চুর সাথে পরিতোষের বিয়েটা আদৌ আর সম্ভব হবে কিনা তা নিয়ে তাদের তিনজনেরই দুশ্চিন্তা বাড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু কেউই মুখ ফুটে পরিতোষকে এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করতে পারছিল না। তিন জনের মনের মধ্যেই কেমন একটা দ্বিধাবোধ যেন জেগে উঠেছিল। কিন্তু তারা সকলেই সীমন্তিনীর নির্দেশ মেনে পরিস্থিতির গড়ান বোঝবার চেষ্টা করছে।
 

আর অর্চনা তো পরিতোষের আলিপুরদুয়ার যাবার পরের দিন থেকেই নিজে সীমন্তিনী, রচনা বা নবনীতার কাছে পরিতোষের সম্পর্কে কোন কথাই বলে না। তার দিদিভাইয়ের কথাকেই বেদবাক্য ধরে নিয়ে সে মনে মনে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে যাচ্ছে। তবু যেন পুরোপুরি সফল হতে পারছে না সে। যখন সে বাড়িতে একা থাকে তখন বারবারই ঘুরে ফিরে পরিতোষের মুখটা তার মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। তার মনটা তখন বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। পরক্ষণেই সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো সে মনে করবার চেষ্টা করে। তখন বেশীরভাগ সময়েই সে রচনাকে ফোন করে নানা কথায় নিজের মন থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সরিয়ে ফেলবার চেষ্টা করে। তাতে সাময়িক ভাবে কিছুটা সফল হলেও, পরিতোষের ছবিটাকে নিজের মন থেকে যেন সে কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছে না পুরোপুরি ভাবে। তার দিদিভাই আর নীতাদি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন তারা সব সময় তাকে তাদের কাছে কাছে রেখে নানা রকম কথাবার্তায় ভুলিয়ে রাখেন। তার দিদিভাই তাকে এমন কথাও বলেছেন যে পরিতোষ যদি তার পিসির পছন্দমতই কাউকে বিয়ে করে তাহলে অর্চুর জন্যে তিনি ভাল আরেকটা ছেলে খুঁজে বের করবেনই। অর্চুকে তিনি সব সময় স্বচ্ছন্দ আর হাসিখুশী থাকতে নির্দেশ দেন। অর্চনাও তার দিদিভাইয়ের কথা সর্বতোভাবে পালন করবার চেষ্টা করে। সে নিজেই বুঝতে পেরেছে তার দিদিভাই তাকে সঠিক উপদেশই দিয়েছেন।

ক’দিন পর দুপুরবেলায় অফিস ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করতে করতে সীমন্তিনী প্রথমে অর্চনা আর তারপর রচনার সাথে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল। খাওয়া শেষে টিফিন ক্যারিয়ার গুছিয়ে নিয়ে নিজের চেম্বারে ফিরে আসতেই তার পার্সোনাল মোবাইলটা আবার বেজে উঠল। এ’সময় তার এ মোবাইলে কে ফোন করতে পারে ভাবতে ভাবতে সে ফোনটা বের করে দেখে একটা আননোন ল্যান্ডলাইন নাম্বার থেকে কলটা এসেছে। নাম্বারটা কয়েকবার দেখেও তার পরিচিত বলে মনে হল না। শুধু এটুকুই বোঝা গেল যে এটা আলিপুরদুয়ারের নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করবে কি করবে না, ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে গেল। নিজের চেয়ারে বসে ফোনটা হাতে নিয়েই সে ভাবতে লাগল, সে কি কলব্যাক করবে ওই নাম্বারটায়? আবার ভাবল, না থাক, দরকার নেই। পরিচিত কেউ নতুন কোন নাম্বার থেকে ফোন করে থাকলে পরে অবশ্যই জানা যাবে। তখন না হয় অফিসের কাজের ছুতো দেখিয়ে সরি বলে দেবে। এই ভেবে ফোনটা আবার ব্যাগে রাখতে যেতেই সেটা আবার বেজে উঠল। বের করে দেখে আবার সেই একই নাম্বার থেকে ফোন। কিন্তু এবারে আর বেশী ইতঃস্তত না করে সে কলটা রিসিভ করে ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যালো। কে বলছেন”?

ও’পাশ থেকে এক বয়স্কা মহিলাকন্ঠে জবাব এল, “আমি হৈমবতী মন্ডল বলছি আলিপুরদুয়ার থেকে। তুমি না না, আপনি হয়ত আমাকে চিনবেন না। আমি ......”

কে ফোন করেছে বুঝতে পেরেই সীমন্তিনী চমকে উঠে বলল, “আপনি করে বলতে হবে না। আপনি নিশ্চয়ই পরির পিসি, তাই তো”?

ও’পাশ থেকে হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ মা, তুমি ঠিকই চিনেছ। আমি পরির পিসিই বলছি। তবে মা, আমি আগেই তোমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি এমন অসময়ে তোমাকে ফোন করছি বলে। পরি আমাকে আগেই বলেছিল যে আমি দিনের বেলায় তোমার সাথে কথা বলতে চাইলে যেন ঠিক দুপুর আড়াইটে থেকে তিনটের মধ্যে ফোন করি। তোমার নাম্বারটা একটু আগে আমি ওর কাছ থেকেই নিয়েছি। তোমাকে আড়াইটে থেকেই আমি ফোন করে যাচ্ছিলুম। কিন্তু বারবার তোমার ফোন ব্যস্ত পাচ্ছিলুম। তাই .......”

সীমন্তিনী হৈমবতীর কথার মাঝেই তাকে থামিয়ে দিয়ে মিষ্টি গলায় বলল, “না না পিসি, এতে এভাবে ক্ষমা চাইবার কী আছে? আসলে আমি এই সময়ে লাঞ্চ করতে করতেই আমার কাছের মানুষগুলোর সাথে একটু কথা বলি। বাকি সময়ে অফিসের কাজে এতটাই ব্যস্ত থাকি যে কারো ফোন ধরতেও পারিনা। তবে আপনি যখন ফোন করেছিলেন তখন বোধহয় আমি অর্চু কিংবা রচুর সাথে কথা বলছিলুম। আমি রোজ নিয়ম করে ওই সময় ওদের সাথে কথা বলি তো। তাই আমার ফোন ব্যস্ত পেয়েছেন আপনি। তবে আপনি ভাববেন না। আপনার কথা শোনবার পর থেকেই আমারও মনটা চাইছিল আপনার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত আছি যে এখান থেকে বেরোবার ফুরসতই পাচ্ছি না। আপনার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল। বলুন কি বলবেন”?

এমন সময় সীমন্তিনীর অফিসিয়াল মোবাইলটা বেজে উঠল। সেটা হাতে নিয়ে দেখে পরিতোষের ফোন। কলটা সে রিজেক্ট করে দিল।
 

হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি যে কতটা ব্যস্ত থাকো তা আমি পরির মুখে শুনেছি গো মা। আর আমার ছেলেদের মুখেও তোমার অনেক কথা শুনেছি। সবাই বলে আমি নাকি একটু বেশী কথা বলি। তাই বেশী কথা না বলে যেজন্য তোমাকে ফোন করেছি সেটাই সরাসরি বলছি। শোনো মা, তুমি আর নবনীতাই নাকি পরির সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আর তোমরা দু’জনই নাকি ওর সবচেয়ে বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। সেটা জেনেই বলছি মা, তোমাদের দু’জনের সাথেই আমি দেখা করতে চাই। আর সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয় আমাদের পক্ষে ততই মঙ্গল। কিন্তু আমি জানি তুমি নাগরাকাটায় অফিসের কোয়ার্টারে থাকো। আর নবনীতা আর অর্চুও এখন তোমার সাথে তোমার কোয়ার্টারেই আছে। আমি আসলে তোমাদের তিনজনকেই দেখতে চাইছি। হয়ত তুমি ইতিমধ্যে শুনে থাকবে যে অর্চুর বাবা বিধু, আমার ভাই মানে পরির বাবার ছোটবেলার বন্ধু। আমি বিধুকে ছোটবেলা থেকেই আমার আরেকটা ভাইয়ের মতই ভালবাসতুম। তাই ওর বড়মেয়ে অর্চুকে দেখবার বাসনাও আমার মনে আছে। কিন্তু পরির মুখেই শুনলুম তুমি নাকি নিজের ইচ্ছেমত যেখানে সেখানে যে কোন সময় যেতে পারো না। তাই হয়ত, আমি চাইলেও তুমি এখানে আসতে পারবে না চট করে। সেজন্যই আমি ভাবছিলুম আমি নিজেই তোমার ওখানে যাবো। কিন্তু আমার তো বয়স হয়েছে মা। আর বাড়ি থেকে আমাকে একা কোথাও যেতেও দেবে না কেউ। আর এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে তোমার কোয়ার্টারে এখনই তোমরা তিনজন আছ। হয়ত দু’একজন কাজের লোকও আছে। এরমধ্যে আমার সাথে যদি আরও দু’একজনকে নিয়ে যেতে হয়, তবে তো তোমার কোয়ার্টারে স্থান সঙ্কুলানের সমস্যা হতে পারে। তাই জিজ্ঞেস করছি মা, নাগরাকাটায় তোমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি কোথাও কোন থাকবার হোটেল আছে কি মা”?

সীমন্তিনী হৈমবতীর কথা শুনতে শুনতে মনে মনে অনেক কিছু ভেবে যাচ্ছিল। এবার তিনি থামতেই সে বলল, “পরি আমার সবচাইতে ভাল বন্ধু। আর আপনি তার নিজের পিসি। আপনি আমাকে দেখতে এসে যদি হোটেলে রাত কাটান, তাহলে পরির কাছে আমি কি আর মুখ দেখাতে পারবো পিসি? তবু আপনার কথার জবাবে বলছি, নাগরাকাটা আপনাদের আলিপুরদুয়ারের মত বড় জায়গা নয়। প্রায় গ্রামই বলা যায়। এখানে খাবার হোটেল মোটামুটি থাকলেও থাকবার মত ভাল হোটেল আমার কোয়ার্টারের কাছাকাছি তো দুর, গোটা নাগরাকাটাতেও নেই। নামমাত্র দু’একটা হোটেল অবশ্যই আছে। তবে ও’গুলোতে আপনাদের মত ভদ্রলোকেদের পক্ষে থাকা একেবারেই সম্ভব নয়”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে হৈমবতীদেবী খানিকটা হতাশ সুরে বললেন, “ওমা, তাই নাকি? তবে তো ভারী মুস্কিল হল। তুমি তো সারাটা দিনই অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকো। দিনের বেলায় আর কতটুকুই বা সময় তুমি আমাকে দিতে পারবে! আমার যে তোমাকে অনেক কথা বলার আছে মা”।

একজন কনস্টেবল সীমন্তিনীর কেবিনে ঢুকতেই সীমন্তিনী তাকে হাতের ঈশারা করতে সে সাথে সাথে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী ফোনে বলল, “আচ্ছা পিসি, আপনারা কবে আসতে চাইছেন? আর কতজন আসবেন? পুরুষ মানুষ ক’জন থাকবে আপনার সাথে”?
 

হৈমবতীদেবী জবাবে বললেন, “আমরা তিনজন যাব মা। আমরা স্বামী-স্ত্রী, আর আমাদের বড়বৌমা। আর আজই যাব ভাবছিলুম”।
 

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “পিসি, আমার কোয়ার্টারে আপনাদের তিনজনের থাকবার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের খুব বেশী অসুবিধে হবে না। দু’জন পুরুষ মানুষ হলে অবশ্য অসুবিধে হত। তবে আপনাদের হয়ত সামান্য কিছুটা অসুবিধে হতেই পারে। আসলে আপনার বৌমার জন্য আলাদা কোন বিছানা হয়ত হবে না। তাকে হয়ত আমাদের কারো সাথে এক বিছানায় থাকবার প্রয়োজন হতে পারে। এতে তার কোন অসুবিধে হবে না তো”?

হৈমবতীদেবী সাথে সাথে বললেন, “না না মা, আমাদের কোনও অসুবিধে হবে না। তাহলে আমরা আর ঘন্টাখানেক বাদেই রওনা হচ্ছি এখান থেকে”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 239)

সীমন্তিনী কিছু বলতে যাবার আগেই আবার তার অফিসিয়াল মোবাইলে পরিতোষের কল এল। সীমন্তিনী এবারেও কলটা রিজেক্ট করতে করতে হৈমবতীদেবীকে বললেন, “আচ্ছা বেশ পিসি। তা, আপনারা কি ট্রেনে আসছেন? তাহলে ট্রেনটা আলিপুরদুয়ার থেকে ছাড়বার পরেই আমাকে একটা ফোন করে জানিয়ে দেবেন। আমি সময় মত ষ্টেশনে একটা গাড়ি পাঠিয়ে দেব”।
 

হৈমবতীদেবী এবার বললেন, “তোমায় কষ্ট করতে হবে না মা। আমরা আমাদের নিজস্ব গাড়িতে যাচ্ছি। আর তোমার কোয়ার্টারের ঠিকানাও আমাদের ড্রাইভারের জানা আছে। তোমার ওখানে পৌঁছোতে আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। তবে শুনেছি তোমার কোয়ার্টারের সামনে নাকি পুলিশ পাহারা থাকে। তুমি মা তাদের একটু বলে রেখো, যেন আমাদের হেনস্থা না করে”।

সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “সে ব্যবস্থা আমি করছি পিসি। কেউ আপনাদের কোনভাবে বিরক্ত করবে না। তবে পিসি, আরেকটা ব্যাপার আছে, যেটা আমি চাইলেও আটকাতে পারব না। আমার কোয়ার্টারে কম্পাউণ্ডের ভেতর বাইরের কোনও গাড়ি ঢুকতে চাইলে সেগুলোকে কিন্তু গেটে প্রহরারত পুলিশেরা চেক করে। আর এটা আমাদের ওপর তলার অফিসারদের হুকুম। আমি নিজেও কিন্তু তাতে বাধা দিতে পারব না। আপনারা কিন্তু ওতে কিছু মনে করবেন না প্লীজ। তবে যদি গাড়ির নাম্বারটা আপনারা আগে থেকে জানিয়ে দিতে পারেন, তাহলে ভাল হয়”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “হ্যাঁ মা, তোমার পাহারাদাররা যে গাড়ি সার্চ করবে এটা আমাদের ড্রাইভারের মুখেই শুনেছি। তবে আমরা তোমার কোয়ার্টারে পৌঁছোবার আগেই এক সময় আমাদের গাড়ির নাম্বারটা জানিয়ে দেব তোমাকে। আর শোনো মা, তুমি তো এখন থানাতেই আছ। আমাদের আপ্যায়নের জন্য কিন্তু কোন দৌড় ঝাঁপ শুরু করে দিও না। আর রাতের খাবারের আয়োজনও কিছু কোরো না। আমাদের তিন বৌমা মিলে তোমাদের সকলের জন্য রাতের খাবার বানাচ্ছে। আমরা সে’সব সাথে করেই নিয়ে যাব। তুমি কিন্তু এতে আপত্তিও কোরো না, আর বিব্রতও হয়ো না। আমার বাপ-মা মরা ভাইপোটাকে তোমরা যে এতদিন ধরে নিজের বন্ধু বলে ভাবছ, এতটা ভালবেসেছ, তার প্রতিদানে কি আর কিছু দেওয়া যায় মা? তবু আমাদের মনের এ ইচ্ছেটুকু পূরণ করতে বাধা দিও না তুমি, লক্ষ্মী মা আমার”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে পিসি। আপনারা আসুন। আমি আর আমরা সবাই আপনাদের জন্য অপেক্ষায় রইলুম”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “আচ্ছা মা, তুমি সত্যিই খুব লক্ষ্মী মেয়ে। আশীর্বাদ করি মা, তুমি জীবনে খুব বড় হও, দীর্ঘজীবি হও। খুব সুখে থাক। রাখছি মা”।

সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে পিসি। আপনিও আমার প্রণাম নেবেন”।

ফোনটা ব্যাগে রেখেই টেবিলের ওপর রাখা কলিং বেলে চাপ দিতেই আগের কনস্টেবলটা তার কেবিনে এসে ঢুকল। তার সাথে কথা বলতে বলতেই তার অফিসিয়াল ফোনে আবার পরিতোষের কল এল। এবারে কনস্টেবলটাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সে কলটা রিসিভ করে বলল, “সরি স্যার। আপনার আগের দুটো কল বাধ্য হয়েই আমাকে রিজেক্ট করতে হয়েছিল। আসলে আমি তখন আমার প্রাইভেট ফোনে আপনার পিসির সাথে কথায় ব্যস্ত ছিলুম। তাই কলগুলো অ্যাকসেপ্ট করা সম্ভব হয়নি আমার পক্ষে”।
 

ও’পাশ থেকে পরিতোষ অবাক হয়ে বলল, “ও মাই গড, পিসি এরই মধ্যে তোমার সাথে কথা বলে ফেলেছেন? আমি তো একটু আগেই তাকে তোমার কন্টাক্ট নাম্বারটা দিলাম। এরই মধ্যে .......”

সীমন্তিনী এবার আরও সংযত ভাবে বলল, “ঠিক আছে স্যার, আমি এখন একটা ডিসকাশনে ব্যস্ত আছি। মিনিট দশেক বাদেই আপনাকে কল ব্যাক করছি, প্লীজ স্যার”।

পরিতোষ বুঝে গেল যে সীমন্তিনীর আশেপাশে এখন নিশ্চয়ই আরও কেউ আছে। তাই সে বলল, “ওকে ওকে, ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি। তুমি সময় মত ফোন কোরো” বলে ফোন কেটে দিল।

সীমন্তিনীও তারপর কনস্টেবলটার সাথে আলোচনা করে তাকে বিদেয় দেবার সময় বলল, “তুমি এখনই সিকদারবাবুকে আমার কেবিনে আসতে বলে দিও”।

কনস্টেবলটা স্যালুট ঠুকে “ইয়েস ম্যাম” বলে বেরিয়ে যেতেই সীমন্তিনী নিজের ড্রয়ার থেকে একটা ডাইরী বের করে তাতে চোখ বোলাতে লাগল। মিনিট খানেক বাদেই থানার ওসি সিকদারবাবু তার কেবিনের দরজায় নক করে জিজ্ঞেস করল, “ম্যাম, আমায় ডেকেছিলেন”?

সীমন্তিনী তাকে ভেতরে ডেকে প্রথমে আজকের বাকি কাজগুলোর ব্যাপারে আলোচনা করল। তারপর অন্যান্য সম্ভাব্য কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনার পর তাকে বুঝিয়ে দিল যে তার কয়েকজন গেস্ট আসছে বলে সে বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে যাবে। সিকদারবাবুকে বিকেলের পর থেকে ওএসডি ইনচার্যের দায়িত্ব পালন করতে হবে। সিকদারবাবু রাজী হতেই তাকে বিদেয় দিয়ে সীমন্তিনী ঘড়িতে সময় দেখল, প্রায় চারটে বাজতে চলেছে।
 

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে পরিতোষকে ফোন করবার আগে নিজের কোয়ার্টারের নাম্বার ডায়াল করল। ও’পাশ থেকে লক্ষ্মীদির সাড়া পেতেই বলল, “লক্ষ্মীদি, তোমাদের খাওয়া হয়ে গেছে”?

লক্ষ্মী ‘হ্যাঁ’ বলতেই সে আবার বলল, “তাহলে শোনো লক্ষ্মীদি, তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। একটু কষ্ট হবে হয়ত। তোমার আজ দিনের বেলার ঘুমটা হয়তো নষ্ট হবে। কিন্তু উপায় নেই”।

লক্ষ্মী বলল, “আচ্ছা কী হয়েছে সেটা তো বলো দিদিমণি”।

সীমন্তিনী একবার কিছু একটা বলতে গিয়েও সেটা না বলে বলল, “আচ্ছা অর্চু কি করছে গো? ও কি ঘুমিয়েছে নাকি? একবার গিয়ে দেখে এস তো। জেগে থাকলে ওকে ডেকে আনো, আমি ওকে সবকিছু বুঝিয়ে বলছি। আমি লাইনে আছি”।

“আচ্ছা দিদিমণি” বলবার প্রায় মিনিট খানেক বাদে অর্চনার উদ্বেগ ভরা গলা শোনা গেল, “দিদিভাই! কী হয়েছে গো? এই তো দুপুরেই তোমার সাথে কথা হল। আবার এখনই তুমি ফোন করলে? তুমি ঠিক আছ তো দিদিভাই”?

সীমন্তিনী শান্ত স্বরে বলল, “আমি ঠিক আছি সোনা। তবে তোকে আগে যখন ফোন করলুম তার পরেই এমন একটা খবর পেলুম যে তোকে সেটা এখনই জানাতে চাইছিলুম। কিন্তু আমার সন্দেহ ছিল তুই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিস। তাই ল্যান্ডলাইনে ফোনটা করেছি। আচ্ছা শোন অর্চু। আমাদের ঘরে তিনজন অতিথি আসছেন আজ। হয়তো বিকেল বা সন্ধ্যে নাগাদ তারা এসে পড়বেন। তাই বলছি বোন, আমাদের গেস্টরুমটাকে একটু গুছিয়ে রাখিস ভাল করে”।

অর্চনা একটু অবাক হয়ে বলল, “এই অবেলায় আবার কোন অতিথি আসছে দিদিভাই? তারা কি রাতে থাকবেন নাকি এখানে”?

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “আরে ওনারা বাইরে থেকে আসছেন। আন্দাজ করছি যে ও’রকম সময়েই হয়ত এসে পড়বেন। আমিও তার আগেই বাড়ি যাবার চেষ্টা করছি। তবে তারা রাতে থাকবেন আমাদের এখানে। তাই তো তোকে বলছি লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে চটপট গেস্টরুমটা গুছিয়ে ফ্যাল। আর শোন, তারা স্বামী স্ত্রী তাদের ছেলের বৌকে সাথে নিয়ে আসছেন। গেস্টরুমে স্বামী-স্ত্রী দু’জনের থাকবার ব্যবস্থা করবি। আর তাদের ছেলের বৌ নাহয় আমার ঘরেই আমার বিছানায় থাকবেন। বুঝেছিস”?

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ বুঝেছি দিদিভাই। কিন্তু তাদের খাবার দাবারের আয়োজনও তো করতে হবে। লক্ষ্মীদি তো খাবার সময়েই বলছিল যে আনাজ তরকারী বাড়ন্ত। লক্ষ্মীদিকে বাজারে পাঠাতে হবে তো তাহলে”।

সীমন্তিনী বলল, “তার দরকার নেই। আমি তো চলে আসছি বাড়িতে। তেমন দরকার হলে সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আর যারা আসছেন তারা আমাদের সকলের জন্য রাতের খাবার নিয়ে আসছেন। তুই আপাততঃ গেস্টরুমটাই গুছিয়ে রাখ শুধু। আর ঘরে মিষ্টি, দই, শরবৎ এ’সব কিছু আছে কিনা, আর রাতের খাবারের আগে তাদের জন্য হাল্কা কিছু বানাবার জন্য যা প্রয়োজন, তা ঘরে আছে কিনা এটা লক্ষ্মীদিকে জিজ্ঞেস কর তো”?

অর্চনা লক্ষ্মীর কাছ থেকে জেনে নিয়ে বলল, “দিদিভাই ফ্রিজে মিষ্টি আছে। কোল্ড ড্রিঙ্কসের দুটো বোতল আছে। কিন্তু দই ফুরিয়ে গেছে। আর লুচি পায়েস বানাতে হলে দুধ কম পড়বে”।

সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে, লক্ষ্মীদিকে বাজারে পাঠাতে হবে না। সে’সব আমি যোগাড় করছি। তোরা আপাততঃ ঘরগুলো গুছিয়ে রাখ। আমি আসছি আর একটু পরেই” বলে ফোন কেটে দিল।

কিন্তু সাথে সাথেই আবার পরিতোষের নাম্বার ডায়াল করল। পরিতোষ প্রায় সাথে সাথেই সাড়া দিয়ে বলল, “হ্যাঁ মন্তি, তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম আমি। আচ্ছা পিসি তোমায় কি বললেন, আগে সেটা বলো তো প্লীজ”।

পরিতোষের চিরাচরিত সম্মোধনগুলো শুনতে না পেয়ে সীমন্তিনী বুঝল পরিতোষ বেশ টেনশনে আছে। সে জবাব দিল, “তোমার পিসি, পিসেমশাই আর বড়বৌদি আজ আমার এখানে আসছেন। আমার কোয়ার্টারে তাদের থাকবার জায়গা দিতে পারব কিনা, আশেপাশে থাকবার মত কোন ভাল হোটেল আছে কিনা, এ’সব জানতে চাইছিলেন। আর বলছিলেন যে আমাদের তিনকন্যাকে দেখতেই তারা আসছেন। আর আমাদের সাথে নাকি তাদের অনেক কথা বলবার আছে। তুমি তো দেখছি আমার ব্যাপারে সব রকম ফিডব্যাকই দিয়ে রেখেছ পিসিকে। তাই তিনি বুঝে গিয়েছেন যে আমাকে ডেকে পাঠালেও আমি কবে তাদের ওখানে গিয়ে দেখা করতে পারব তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এটা বুঝতে পেরে, আর আমার সাথে সাথে নীতা আর অর্চুকেও দেখবেন বলে তারা আজ আসবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তুমি নিশ্চয়ই এ’সব খবর জানো”।

পরিতোষ বলল, “জানি না বললে ভুল বলা হবে। আবার জানি বললেও সেটা সঠিক বলা হবে না। তারা, মানে আমার পিসি আর তিন বৌদি, তোমাকে আর নীতাকে প্রথম দিনটি থেকেই দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু আমার মুখে তোমার ব্যস্ততার কথা শুনে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তারাই নাগরাকাটা গিয়ে তোমার সাথে দেখা করবেন। কিন্তু সেটা যে আজকেই ঘটতে চলেছে, এটা আমার জানা ছিল না। তবে পিসির সাথে আমার বেলা দুটো নাগাদ কথা হয়েছে। তখনই আমি তোমার প্রাইভেট নাম্বারটা তাকে দিয়েছিলাম। আমি তোমাকে সে’ কথাটা জানাবার জন্যেই তখন ফোন করেছিলাম। হাজার হোক তোমার অনুমতির অপেক্ষা না করেই তো পিসিকে তোমার নাম্বারটা দিয়ে ফেলেছি। তাই তোমার কাছ থেকে পোস্ট ফ্যাক্টো অ্যাপ্রুভাল নেওয়াটা জরুরী ছিল। কিন্তু পিসি যে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে ফোন করবেন, বা তারা যে আজই তোমার ওখানে যাবেন, এটা আমি সত্যি ভাবতে পারিনি। আর পিসি নিজেও সে’কথাটা আমাকে বলেননি। আচ্ছা মন্তি, পিসির সাথে আর কী কী কথা হয়েছে তোমার? অনেকক্ষণ তো তোমার ফোন বিজি ছিল তখন”।

সীমন্তিনী জবাব দিল, “নতুন পরিচয় হলে এদিক সেদিকের কথা তো কিছু হয়েই থাকে। প্রায় সাত আট মিনিট কথা হয়েছে আমাদের। তবে সার কথা যেটুকু তা তো তোমাকে আগেই বললুম”।

পরিতোষ এবার একটু চিন্তিত সুরে বলল, “পিসিরা সবাই তোমার সাথে দেখা করবার জন্যে কেন যে এত তাড়াহুড়ো করছেন, সেটা আমার মাথায় আসছে না। মনে মনে একটু ভয়ও হচ্ছে”।

সীমন্তিনীর মনেও যে একই আশঙ্কা দানা বাঁধছিল, সেটা প্রকাশ না করেই সে বলল, “এতে চিন্তার কী আছে পরি? সত্যি কথা বলতে, তুমি যেদিন আলিপুরদুয়ারে গিয়েছিলে সেদিন থেকেই তোমার পিসিকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। তাই তারা নিজেরা এসে আমার সাথে দেখা করছেন বলে আমি তো বেশ খুশীই হয়েছি। নিজেকে খুব অনার্ড মনে হচ্ছে”।

পরিতোষ আগের মতই চিন্তান্বিত স্বরে বলল, “না না মন্তি, আমার মনে হচ্ছে এর ভেতরে নিশ্চয়ই অন্য কোনও ব্যাপার আছে, যা পিসি তোমাকে ফোনে বলেন নি”।

সীমন্তিনী এবার বেশ সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার কী মনে হচ্ছে তাহলে”?

পরিতোষ বলল, “মন্তি, আমার মনে হয় আমার বিয়ের ব্যাপারে পিসি পিসেমশাই তোমার সাথে কোনও শলা পরামর্শ করবার জন্যই যাচ্ছেন”।

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার এমন মনে হবার কারন কি”?

পরিতোষ বলল, “তোমাকে আগে বলেছি কিনা মনে পড়ছে না। আসলে ওই ক’টা দিন নিজের রক্তের সম্পর্কের একজনকে খুঁজে পেয়ে আমি যেন নিজেকে সাময়িকভাবে হারিয়েই ফেলেছিলাম। কিন্তু সেই প্রথম দিনটি থেকেই ও বাড়ির লোকেরা, বিশেষ করে আমার তিন বৌদি বারবার আমার বিয়ে দেবার কথা ওঠাচ্ছিলেন। তাই আমার মনে এমন একটা চিন্তা আসছে”।

সীমন্তিনী এবার একটু হাল্কা গলায় বলল, “বারে! এ তো সুখের খবর। আমরাও তো সেটাই চাইছি যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি একটা বিয়ে করে ফেলো”।

পরিতোষ অসহায়ের মত স্বরে বলল, “কিন্তু তুমি বুঝতে পাচ্ছ না মন্তি আমি কত বড় একটা ধর্ম সঙ্কটের মুখে পড়েছি”।

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ধর্ম সঙ্কট? সে আবার কী? পিসি পিসেমশাই দু’জনেই তো এখন তোমার অভিভাবক। তারা তোমার বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। আর তোমার জন্য পাত্রীও তারা পছন্দ করতেই পারেন। হ্যাঁ, তাদের পছন্দের পাত্রীকে তোমার অপছন্দ হলে অবশ্য আলাদা কথা। তবে তুমি তোমার অপছন্দের কথা তাদের বলবার সুযোগ মনে হয় পাবেই। তারা নিশ্চয়ই তোমার মতের বিরূদ্ধে কোন মেয়ের সাথে তোমার বিয়ে দেবেন না”।

পরিতোষ এবার তার স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবে অধৈর্যের সুরে বলল, “তুমি কেন বুঝতে চাইছ না মন্তি। পিসি পিসেমশাই আমার অভিভাবক, আমার জন্যে পাত্রী পছন্দ করবার অধিকার তাদের অবশ্যই আছে, এ ব্যাপারে তোমার সাথে আমিও একমত। কিন্তু আমি যে আগে থেকেই তোমাকে আর নীতাকে সে দায়িত্ব দিয়ে রেখেছি। আর তুমিই তো বলেছ যে তোমরা আমার জন্যে এক পাত্রী পছন্দ করে রেখেছ। এখন পিসি পিসেমশাই যদি অন্য কোনও মেয়েকে পছন্দ করে বসেন, তাহলে আমি কি করব বলো তো? এটা ধর্ম সঙ্কট নয়, তো কি”?

সীমন্তিনী নিজের টেবিলের ড্রয়ারগুলো লক করতে করতে শান্ত কন্ঠে বলল, “পরি, এত উতলা হচ্ছ কেন তুমি। তোমাকে কিন্তু এতো উদ্বেলিত হতে আমি আর আগে কখনো দেখিনি। আচ্ছা শোনো, আমার হাতে এখন সময় আর খুব বেশী নেই। আমাকে এক্ষুনি বেরোতে হচ্ছে। আমার মনে হয় তোমার পিসিরা বিকেল ছ’টার মধ্যেই হয়ত চলে আসবেন। তারা আসবার আগেই আমার কোয়ার্টারে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ। নইলে সিকিউরিটির হাতে তাদের হেনস্থা হতে পারে। তাই আমি ফোনটা এখন রাখছি প্লীজ। তবে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে আমি তোমাকে আবার ফোন করছি” বলে স্টীল কেবিনেটগুলো লক করে চাবি গুলো নিজের ব্যাগে রেখে ব্যাগ আর মোবাইল হাতে নিয়ে নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে প্রথমে পাশের আরেকটা কেবিনের দড়জা দিয়ে উঁকি মেরে ভেতরে বসে থাকা সিকদারবাবুর সাথে চোখের ঈশারায় বুঝিয়ে দিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে পড়ল।
 

ড্রাইভার রামসিং ভাবতেও পারেনি যে তার ম্যাডাম আজ এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে আসবেন। থানার উল্টোদিকের একটা চায়ের দোকানে বসে সে আড্ডা দিচ্ছিল। সীমন্তিনীকে দেখেই সে ছুটে এসে একটা স্যালিউট ঠুকে গাড়ির দড়জা খুলে দিল। সীমন্তিনী তাকে বুঝিয়ে দিল যে এখন সে কোয়ার্টারেই যাবে। কিন্তু তাকে কোয়ার্টারে নামিয়ে দিয়ে রামসিংকে আবার বাজারে গিয়ে কয়েকটা কোল্ড ড্রিঙ্কস আর ভালো দই আর কয়েকটা দুধের প্যাকেট কিনে আনতে হবে।

রামসিং গাড়িতে স্টার্ট দিতেই সীমন্তিনীর ব্যাগের ভেতরের মোবাইলটা বেজে উঠল। বের করে দেখে একটা আননোন মোবাইল থেকে কল এসেছে। মনে মনে ভাবল এটা বোধহয় পরিতোষের পিসি বা তাদের কারো ফোনই হবে। কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ও’পাশ থেকে ভারিক্কি গলায় এক বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, “আমি পরির পিসেমশাই, নিরঞ্জন মন্ডল বলছি মা”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে জবাব দিল, “ওহ, পিসেমশাই, আমার প্রণাম নেবেন”।

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বেঁচে থাকো মা। হ্যাঁ, বলছিলাম আমরা চারটের সময় আলিপুরদুয়ার থেকে রওনা হয়েছি। মনে হয় সন্ধ্যে ছ’টা সওয়া ছ’টা নাগাদ তোমার ওখানে পৌঁছে যাব”।

সীমন্তিনী মিষ্টি স্বরে বলল, “ঠিক আছে পিসেমশাই। আমি তখন কোয়ার্টারেই থাকব। কিন্তু পিসেমশাই আপনাদের গাড়ির নাম্বারটা একটু বলুন না। তাহলে আমি আগে থেকেই আমার গেটের গার্ডদের সেটা জানিয়ে দিতে পারতুম”।
 

নিরঞ্জনবাবু গাড়ির নাম্বারটা বলতেই সীমন্তিনী অন্য মোবাইলে নাম্বারটা নোট করে নিল। নিরঞ্জনবাবুর সাথে কথা শেষ করে সীমন্তিনী আবার পরিতোষকে ফোন করল। এবারেও সঙ্গে সঙ্গে পরিতোষের সাড়া পেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা পরি, আমার কয়েকটা কথার জবাব দাও তো। আমার সম্বন্ধে তোমার পিসিকে বা বৌদিদের কতটুকু কী বলেছ”?

পরিতোষ জবাব দিল, “প্রায় সবকিছুই বলেছি মন্তি। শুরু থেকে শেষ অব্দি সবটুকুই বলেছি। আর নীতার ব্যাপারেও সবকিছুই বলেছি”।

সীমন্তিনী বিস্মিত গলায় বেশ জোরেই বলে ফেলল, “কী বলছ তুমি?” পর মূহুর্তেই নিজেকে সংযত করে বলল, “আমার দাদাভাইয়ের সাথে যে আমার .......”

পরিতোষ তার কথার মাঝেই বলে উঠল, “না না, সে ব্যাপারে কিচ্ছুটি বলিনি আমি। যদিও বৌদিরা অনেক চেষ্টা করেছিলেন তোমার প্রেমিকের নামটা জানতে। কিন্তু তাদের আমি সত্যি কথাই বলেছি যে আমি শুরু থেকেই এ ব্যাপারে তোমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি বলেই তার নামটা প্রকাশ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এ’কথা শুনবার পর তারাও আর বেশী জোড়াজুড়ি করেন নি”।


______________________________
Like Reply
(Update No. 240)

সীমন্তিনী মনে মনে আশ্বস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নীতার ব্যাপারেও সবকিছুই খুলে বলেছ? ওর ওই সাতটা বছরের কথাও বলেছ”?

পরিতোষ একটু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ মন্তি, সে’সব কথাও বলতে বাধ্য হয়েছি। আসলে মেজ বৌদি আর ছোট বৌদি এমনভাবে জেরা করছিলেন যে না বলে পারিনি। তবে তাদের সকলকেই আমি বারবার করে অনুরোধ করেছি যে এ’সব কথা যেন তারা অন্য কাউকে না জানান। আর এমন কথাও বলেছি যে তোমাদের সম্পর্কে বলা কথাগুলো যদি তারা অন্য কারো সাথে শেয়ার করেন, তবে আমি বুঝব যে তারা আমার মঙ্গল চান না। তাই আমার মনে হয়না তোমার বা নীতার ব্যাপারে তারা আর কাউকে কিছু বলবেন”।

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আর তুমি যে আমার আর নীতার ওপর তোমার জন্য পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্ব দিয়েছিলে, এ’কথাও কি তারা জানেন”?

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ সেটা তো প্রথম দিনই বলেছি। আমি জানি মন্তি, তুমি বা নীতা এ’সব কথা শুনে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হতেই পার। কিন্তু আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না, ওই তিন চারটে দিন আমি যেন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। আসলে ছোটবেলা থেকে বাবা ছাড়া আর কাউকে তো কাছে পাইনি। আর বাবা চলে যাবার পর তো একেবারে অনাথই হয়ে গিয়েছিলাম। তাই জীবনের এতগুলো বছর পার করে দেবার পর যে মূহুর্তে নিজের এতগুলো আত্মীয় প্রিয়জনকে কাছে পেয়েছিলাম আমি যেন আনন্দে সত্যিই আত্মহারা হয়ে পড়েছিলাম। কারো কোন প্রশ্নের জবাবে মিথ্যে বলতে পারছিলাম না। অবশ্য সে ঘোর যে আমার এখন পুরোপুরি কেটে গেছে সেটাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না। তবে অমন আত্মহারা পরিস্থিতিতেও তোমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আমি ভুলিনি। এখনও বৌদিরা আর পিসি যখন ফোন করেন আমার মনে হয় ফোনে নয় আমি যেন তাদের মুখোমুখি বসে কথা বলছি। পিসি যেন আমার হাতের ওপর তার রেখে আমাকে ঠিক তার পাশটিতে বসিয়ে রেখেছেন। এতগুলো আপনজনের স্নেহ ভালবাসা পাবার সৌভাগ্য যে আমার কখনো হতে পারে, এ তো কোনদিন স্বপ্নেও ভাবিনি আমি মন্তি”।
 

সীমন্তিনী মোলায়েম স্বরে বলল, “জানো পরি, ক’দিন আগে রাস্তার পাশে একটা দোকানে একটা গান বাজতে শুনেছিলাম। ‘চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়’। আজ গানের কথাগুলো তোমার জীবনে সত্যি হল। আচ্ছা পরি, এখন তুমি কোথায় আছ বল তো? আর আজ তোমার আর কি কি কাজ আছে”?

পরিতোষ নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “এখন আমি অফিসেই আছি। তবে তেমন কোন কাজ আপাততঃ হাতে নেই আমার। অফিস থেকে বেরিয়েও তেমন কোন কাজ নেই আজ। আসলে কাজে মন বসাতেও পারছি না। কিন্তু বাড়িতে গিয়েও আজ মন শান্ত রাখতে পারব না। তোমার ওখানে পিসিদের সাথে তোমাদের কার কী কথা হচ্ছে না হচ্ছে এ’সব ভাবতে ভাবতেই আজ অস্থির হয়ে থাকব। তোমাকে দুটো অনুরোধ করব, রাখবে মন্তি”?

সীমন্তিনী মনে মনে ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “এভাবে কথা বলছ কেন পরি? কেন এত অস্থির হচ্ছ তুমি? তুমি আমার সাথে কথা বলছ পরি। তোমার মুন ডার্লিংএর সাথে কথা বলছ তুমি। অনুরোধ উপরোধের এত কথা তুলছ কেন। বলো কী বলবে”?

পরিতোষ অসহায়ের মত বলল, “সরি মন্তি, আমার মাথা এখন সত্যি কাজ করছে না। তবু বলছি, পিসি পিসেমশাইয়ের তোমার ওখানে যাবার আসল উদ্দেশ্যটা জানতে পারলে, আজ রাতে সম্ভব না হলেও কাল সকালে অবশ্যই জানাবে আমাকে প্লীজ। তোমাদের কাছ থেকে সেটা না জানা পর্যন্ত আমার উদ্বেগ কিন্তু কিছুতেই কমবে না। আজ সারাটা রাত বোধহয় আমি ঘুমোতেও পারব না। তাই ব্যাপারটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি জানতে চাই। আর দ্বিতীয় অনুরোধটা, পিসি পিসেমশাইরা আমাদের আগের জেনারেশনের লোক। তাদের ভাবনা চিন্তা বা মানসিকতা আমাদের থেকে কিছুটা হলেও পুরোনপন্থী হবেই। আমার ওপর ভালবাসায় অন্ধ হয়ে তারা যদি তোমাদের কারো কাছে কোনও অন্যায় আবদার করে বসেন কিংবা গর্হিত কিছু করে বসেন অথবা যদি কোনও আনএক্সেপ্টেবল কথা বলে বসেন, তাহলে কষ্ট হলেও তোমরা একটু মানিয়ে নিও প্লীজ। তাদের কাউকে কোন কটূকথা বোলো না। কোনরকম অসম্মান কোরোনা। প্লীজ মন্তি, তুমি আমার এ অনুরোধটা রাখবে তো”?

সীমন্তিনী সাথে সাথে জবাব দিল, “তোমার প্রথম অনুরোধের ব্যাপারে বলি, তাদের সাথে আমাদের কি কি কথা হয়, তাদের আসবার আসল উদ্দেশ্য কি, এ’সব তোমাকে অবশ্যই জানাব পরি। যদি আজ রাতেই সেটা আমরা জানতে পারি তাহলে সম্ভব হলে আজ রাতেই জানাব। নইলে কাল সকালে তোমাকে অবশ্যই জানাব। আর এমন যদি হয় যে আমি তাদের ছেড়ে উঠতেই পাচ্ছি না তবে নীতাকে বলব তোমাকে সেটা জানিয়ে দিতে। আর তোমার দ্বিতীয় অনুরোধের ব্যাপারে শুধু একটা কথাই বলব। আমার ওপর তোমার ভরসা যদি কমে গিয়ে না থাকে, তাহলে কোনরকম দুশ্চিন্তাই তুমি কোরো না। আমি বা নীতা কেউই এমন কিছু করব না যাতে আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে বলে তোমাকে তাদের কাছে লজ্জিত হতে হয়। বুঝেছ তো? এবার একটু শান্ত হয়ে আমার ক’টা কথা তুমি মন দিয়ে শোনো পরি। তোমার পিসি আর পিসেমশাই যদি সত্যিই তোমার জন্যে কোনও মেয়ে পছন্দ করে থাকেন, আর সেই পাত্রীটিকে যদি তোমারও পছন্দ হয় তাহলে আমার মনে হয় তাকেই তোমার বিয়ে করা উচিৎ। নইলে এতগুলো বছর পর তোমার যে আত্মীয়দের তুমি খুঁজে পেয়েছ, তাদের হয়ত তুমি আবার হারিয়ে ফেলবে। তাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক ছিন্ন হোক বা না হোক তোমার প্রতি তাদের আন্তরিকতায় কিন্তু কিছুটা হলেও ঘাটতি হবেই। আর এ ক্ষেত্রে আরও দুটো কথা মনে রেখো তুমি। এক, তোমার পিসি আর পিসেমশাইয়ের কিন্তু বয়স হয়েছে, আর তোমার পিসি হাই ব্লাড প্রেসারের পেশেন্ট। আর দুই, একটা বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়েই কিন্তু তোমার পিসি তোমার দাদু ঠাকুমা আর বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে প্রাণে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যে তোমার আর তাদের সম্পর্ক যেন চিরকাল অটুট থাকে। আর তোমাদের পিসি-ভাইপোর অমন স্নেহ ভালবাসা আর শ্রদ্ধার সম্পর্কের কাছে তুমি আমাদের হাতে যে দায়িত্ব দিয়েছিলে, সেটা নিছকই ঠুনকো। আর সেদিন আমরাও যে এ দায়িত্ব নিয়েছিলাম তার পেছনে এটাই সবচেয়ে বড় কারন ছিল যে তুমি তখন একা ছিলে। তোমার পাশে দাঁড়াবার মত, তোমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবার মত একটা লোকও ছিল না। কিন্তু আজ পরিস্থিতিটা বদলে গেছে। ঠাকুরের আশীর্বাদে আজ তোমার পাশে দাঁড়াবার মত, তোমার দায়িত্ব নেবার মত অনেকগুলো লোক তোমার চারপাশ ঘিরে আছেন। তারা সকলেই কিন্তু তোমার গুরুজন আর তারা সকলেই কিন্তু তোমাকে আন্তরিক ভাবেই গ্রহণ করেছেন এবং ভালবাসেন। তাই আমাদের দেওয়া তোমার ওই প্রতিশ্রুতিটুকু তোমার অতগুলো আত্মীয় পরিজনদের ভালবাসার তুলনায় একেবারেই নগণ্য, একেবারেই মূল্যহীন। তাই তুমি ওই ধর্ম সঙ্কট টঙ্কটের কথা একেবারেই মাথায় এনো না। আর ঠিক তেমনটাই যদি হয়, তাহলে দেখবে আমি আর নীতাও কিন্তু মহানন্দে তোমার বিয়েতে উপস্থিত থাকব। আর আমাদের সাথে তোমার সম্পর্ক আজ যেমন আছে চিরটা কালই ঠিক তেমনটাই থাকবে। আমি নিশ্চিত নীতাও ঠিক একই কথা বলবে। আর আমার দাদাভাই আর রচুও। তাই তুমি অহেতুক ভেবে ভেবে নিজেকে দুর্বল করে ফেল না। আর, আরেকটা সাজেশান দিতে চাই। যদিও সেটা সম্ভব হবে কিনা তা তুমিই বলতে পারবে। আমার মনে হয় আজ রাতটা নিজের বাড়িতে একা একা না কাটিয়ে যদি তুমি তোমার কোন বন্ধু বা প্রিয়জনের সাথে থাকতে পারো, তাহলে খুব ভাল হত। তুমি যদি আমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে আজ রাতটা কাটাতে চাও তাহলে আমি এখনই ওদের ফোন করে সেটা জানিয়ে দিতে পারি। নইলে তোমার পছন্দের অন্য কারো কাছেও যেতে পার। তবে তুমি তো জানোই, দাদাভাইদের ওয়ান বেডরুমের ফ্ল্যাট। সেখানে গেলে কিন্তু তোমাকে লিভিং রুমের সোফাতেই শুতে হবে। আমি দাদাভাইকে ফোন করে বলে দিই তাহলে”?

পরিতোষ প্রায় সাথে সাথেই বলল, “না না মন্তি, প্লীজ ওটা কোরো না। আমি আজ রচুর মুখোমুখি হতে চাই না একেবারেই। তবে তোমার সাজেশানটা ভেবে দেখব। দেখি কী করা যায়। তুমি কিন্তু আমার কথাটা মনে রেখ। তুমি কারনটা জানবার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে কিন্তু সেটা জানিয়ে দেবে প্লীজ”।

গাড়ি তখন কোয়ার্টারের গেটের কাছে এসে থেমেছে দেখে সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে পরি। আমি তোমাকে সে’ভাবেই জানিয়ে দেব। আর শোনো, আমি কোয়ার্টারে পৌঁছে গিয়েছি। তাই এখন কথা বন্ধ করছি। তুমি আমার সাজেশান মত আজ রাতটা অন্য কোথাও কাটিয়ে দিও প্লীজ”।

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ, ঠিক আছে মন্তি। আমি সেটা দেখছি। আর তুমি সাবধানে থেক। পিসিরা আসছেন বলে কোন আয়োজন করবার প্রয়োজন হলে নিজেই হুটহাট করে বেরিয়ে পড়ো না যেন। বাইরে কোথাও যেতে হলে লক্ষ্মীদি বা অন্য কাউকে পাঠিও”।

সীমন্তিনীর গাড়ি ততক্ষণে গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সীমন্তিনী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে গাড়ির দড়জা খুলে নামতে নামতে বলল, “হ্যাঁ, ঠিক আছে। ছাড়ছি তাহলে এখন। আমার কথাটা মনে রেখ” বলে ফোন কেটে দিল।

গাড়ি থেকে নেমেই রামসিং এর হাতে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে তাকে বাজার থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস, দুধ আর দই আনতে পাঠিয়ে দিয়ে গেটের দিকেই সিকিউরিটি গার্ডদের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। গার্ডদের টিম লিডার সীমন্তিনীকে তাদের দিকে আসতে দেখে রুমের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে একটা স্যালিউট ঠুকে বলল, “গুড ইভিনিং ম্যাডাম, কিছু বলবেন”?

সীমন্তিনী নিজের হাতের মোবাইলটা দেখতে দেখতে বলল, “একটা গাড়ির নাম্বার নোট করে রাখো। এই যে এই নাম্বারটা” বলে মোবাইলটা গার্ডের দিকে এগিয়ে দিল। লোকটা সাথে সাথে পকেট থেকে কাগজ কলম বের করে নাম্বারটা নোট করে নেবার পর সীমন্তিনী বলল, “ছ’টা সাড়ে ছ’টা নাগাদ এ গাড়িটা আসবে। তাতে আমার তিনজন আত্মীয় আসছেন। দু’জন মহিলা আর একজন বয়স্ক পুরুষ। সঙ্গে তো ড্রাইভার অবশ্যই থাকবে। তাদের ভেতরে ঢুকতে দেবে। গাড়ি সহ ঢুকতে দেবে। ওনারা আজ রাতে আমাদের কোয়ার্টারেই থাকবেন। আর গাড়িটাও এ’ কম্পাউন্ডের ভেতরেই থাকবে রাতে। ড্রাইভারকে একটা উপযুক্ত জায়গা দেখিয়ে দিও গাড়িটা রাখবার। আর গাড়িতে কিছু প্যাকেট বা কন্টেনার বা ওই জাতীয় কিছু থাকবে যাতে কিছু খাবার জিনিস নিয়ে আসবেন তারা। আর তাদের জামা কাপড়ের ব্যাগও দু’ একটা নিশ্চয়ই থাকবে। গাড়ি সার্চ করবার সময় একটু সাবধান থেকো। ওই জিনিসগুলোর যেন কোন ক্ষতি না হয়। অবশ্য আমি নিজেও টের পেলে তখন বেরিয়ে আসব। তবে আমি যদি আসতে না-ও পারি, তুমি নিজে ব্যাপারটা দেখবে। তাদের যেন কোনভাবে হেনস্থা না করা হয়। ঠিক আছে”?

গার্ডটা আরেকটা স্যালিউট ঠুকে বলল, “ঠিক আছে ম্যাডাম। আমি নিজে ব্যাপারটা দেখব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন”।

সীমন্তিনী আর দেরী না করে ত্রস্ত পায়ে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। কলিং বেল বাজাতেই অর্চনা এসে দড়জা খুলে তাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, “একি দিদিভাই? তুমি এত তাড়াতাড়ি এসে পড়লে”!

সীমন্তিনী হেসে অর্চনার চিবুক ধরে নাড়িয়ে দিয়ে আদর করে বলল, “মনটা তোকে দেখবার জন্য বড্ড ছটফট করছিলরে সোনা। তাই চলে এলুম। আচ্ছা আগে বল তো, গেস্টরুমটা গোছানো হয়ে গেছে তো”?

অর্চনা একটু হেসে দড়জা বন্ধ করতে করতে বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। সব গোছানো হয়ে গেছে। তা কারা আসছেন গো”?

সীমন্তিনী তার কথার সোজা জবাব না দিয়ে বলল, “বলছি দাঁড়া। কিন্তু লক্ষ্মীদি কোথায় রে”?

অর্চনা সীমন্তিনীর কাঁধ থেকে তার ব্যাগটা নিজের হাতে নিতে নিতে বলল, “লক্ষ্মীদি তো রান্না ঘরেই আছে দিদিভাই”।

সীমন্তিনী রান্না ঘরের দড়জার সামনে গিয়ে ভেতরে উঁকি মেরে লক্ষ্মীকে দেখে বলল, “লক্ষ্মীদি, তোমার কোল্ড ড্রিঙ্কস, দুধ আর দই আনবার জন্যে তো রামসিংকে পাঠিয়েছি বাজারে। আর কিছু লাগবে? লাগলে এক্ষুনি বলে দাও, ফোন করে রামসিংকে বলে দিই”।

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর কাছে এসে বলল, “না দিদিভাই আজ ওই হলেই চলে যাবে। যারা আসছেন তারা যখন রাতের খাবার নিয়েই আসছেন তাহলে আজ আর সব্জি টব্জি না আনলেও চলবে। কাল সকালে তো আমি নিজেই বাজারে যাব। তা হ্যাঁ গো দিদিমণি, কারা আসছেন গো? তোমার বাড়ি থেকে কেউ আসছেন বুঝি”?

সীমন্তিনী বসবার ঘরের দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে বলল, “নাগো লক্ষ্মীদি, তোমার এই মুখপুড়ি দিদিমণিকে তার বাড়ি থেকে কেউ দেখতে আসবে, এত ভাগ্য তার কপালে ভগবান লেখেন নি। তবে যারা আসছেন, তাদের কাউকেই আমি আগে কখনও দেখিনি। তারা তোমার বড়দার আত্মীয় স্বজন সবাই”।

লক্ষ্মী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বড়দার আত্মীয় স্বজন? এতদিন তো তিনকুলে তার কেউ নেই বলেই শুনেছিলুম। অবশ্য সাত আটদিন আগেই তো শুনলুম আলিপুরদুয়ারে নাকি তিনি তার এক পিসিকে খুঁজে পেয়েছেন। তারাই কি আসছেন নাকি”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ গো লক্ষ্মীদি। পরির পিসি, পিসেমশাই আর তার তার বড় পিসতুতো দাদার বৌ এনারা তিনজন আসছেন। তাই তাদের খাতিরদারিতে যেন কোন খামতি না থাকে দেখো। নইলে কিন্তু আমাদের সাথে সাথে তোমার বড়দার মান সম্মানও যাবে। আর শোনো, আমি তো আগে ভেবেছিলুম তারা পাঁচটা সাড়ে পাঁচটার ভেতরেই এখানে পৌঁছে যাবেন। তাই একটু তাড়াতাড়িই অফিস থেকে বেরিয়ে পড়েছিলুম। কিন্তু বাড়ি আসবার পথেই শুনলুম তাদের পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধ্যে ছ’টা সাড়ে ছ’টা হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের তাড়াহুড়ো করবার কিছু নেই। তুমি ধীরে সুস্থে তাদের তিনজনের জলখাবার বানাও। আর তাদের রাতের খাবারের ব্যাপারে আমাদের কোন আয়োজনই করতে হবে না। পরির পিসির সখ হয়েছে আমাদের সবাইকে নিজের বাড়ির রান্না খাবার খাওয়াবেন। তাই পরির তিন বৌদি মিলেই নাকি আমাদের সকলের জন্য রাতের খাবার বানিয়ে তাদের সঙ্গেই পাঠিয়ে দিয়েছেন। ওনারা নিজেদের গাড়িতেই আসছেন। তবে তোমাকে কিন্তু কষ্ট করে খাবারগুলো তাদের গাড়ি থেকে ঘরে নিয়ে আসতে হবে। আর কাল তারা চলে যাবার আগে বাসনগুলো ধুয়ে মুছে আবার তাদের গাড়িতে তুলে দিতে হবে”।

লক্ষ্মী বলল, “সে নিয়ে তুমি ভেবো না দিদিমণি। আমি সব সামলে নেব’খন। কিন্তু দিদিমণি তারা তো তিনজন আসছেন। সঙ্গে তো বোধহয় তাদের গাড়ির ড্রাইভারও থাকবেন। বড়দার পিসি পিসেমশাইয়ের শোবার জায়গা তো গেস্ট রুমে করেছি। কিন্তু তার বৌদি আর তাদের গাড়ির ড্রাইভারটাকে কোথায় শুতে দেবে”?

সীমন্তিনী বলল, “বৌদিকে আমার বিছানায় শুতে দেব। আমি ক্যাম্প খাটটা পেতে শুয়ে পড়ব’খন। তবে ভাল কথাই মনে করিয়ে দিয়েছ তুমি আমাকে লক্ষ্মীদি। ড্রাইভারের শোবার জায়গা নিয়ে আমি একেবারেই ভাবিনি গো। আচ্ছা শোনো, রামসিং যখন বাজার থেকে ফিরে জিনিসগুলো ঘরে নিয়ে আসবে তখন তার সাথে কথা বলতে হবে এ ব্যাপারে। আমি ভুলে গেলে আমাকে একটু মনে করিয়ে দিও। অর্চু তুইও কথাটা মাথায় রাখিস। আমাকে মনে করিয়ে দিস। আর লক্ষ্মীদি এখন আর আমাদের জন্যে জলখাবার বানিও না। ওনারা এলে বরং একসাথেই খাব আমরা সবাই। তুমি এখন আমাদের দু’জনকে শুধু দু’কাপ চা বানিয়ে দিও। না কি বলিস অর্চু”?

অর্চনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সেটাই ভাল হবে। কিন্তু দিদিভাই ওনারা ......”

অর্চনাকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়েই সীমন্তিনী তার হাত ধরে নিজের ঘরের দিকে টানতে টানতে বলল, “চল, ঘরে গিয়ে কথা বলি আমরা” বলেই আবার লক্ষ্মীর উদ্দেশ্যে বলল, “রামসিং এলে ওকে কিন্তু একটু অপেক্ষা করতে বোলো কিন্তু লক্ষ্মীদি”।

নিজের ঘরে এসে সীমন্তিনী আগে বাথরুমে ঢুকল। অর্চনা সীমন্তিনীর ব্যাগটা কোনের টেবিলের ওপর জায়গা মত রেখে দিয়ে সীমন্তিনীর বিছানার এক কোনায় বসে অনাগত অতিথিদের কথা ভাবতে লাগল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনী ঘরের পোশাকে বাথরুম থেকে বের হতেই লক্ষ্মী তাদের জন্যে চা নিয়ে এল। চা খেতে খেতে সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “ওহ, একটা কথা তো ভুলেই গিয়েছি রে। দাঁড়া, বলে চায়ের কাপটা বিছানায় রেখেই সীমন্তিনী উঠে নিজের অফিসের ব্যাগের ভেতর হাত ঢুকিয়ে তার ভেতর থেকে দুটো ওষুধের পাতা বের করে অর্চনাকে দিয়ে বলল, “তোর ওষুধটা রাখ। রাতে তো খেতে হবে। ওনারা এলে তাদের সাথে সাথে কথায় কথায় আমি হয়ত ভুলেই যাব” বলে অর্চনার পাশে বসে নিজের চায়ের কাপ হাতে তুলে একটা চুমুক দিতেই অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “তোমার বন্ধুর পিসি পিসেমশাইরা তোমার এখানে আসছেন কেন আজ দিদিভাই”?

সীমন্তিনী মনে মনে ভাবতে ভাবতে বলল, “শোন, হাতে যখন সময় আছে, তাহলে তোকে ব্যাপারটা খুলেই বলি”।

এই বলে গোটা ব্যাপারটাই তাকে খুলে বলল। তার বলা শেষ হতে না হতেই কলিং বেলের আওয়াজ হল। আর প্রায় সাথে সাথেই লক্ষ্মীর গলা শোনা গেল, “দিদিমণি, রামসিং এসেছে গো”।

দু’জনেরই ততক্ষণে চা খাওয়া শেষ হয়েছে। লক্ষ্মীর গলা শুনেই সীমন্তিনী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তারপর রামসিংকে তার কথা বলতেই রামসিং বলল, “ম্যাডাম, আপনি একদম ভাববেন না। আমার রুমের পাশের রুমটা তো খালিই আছে। দেবেন তো ছুটিতে আছে। ওর রুমেই ড্রাইভারের থাকবার বন্দোবস্ত করে দেব আমি। আর সেখানে সব বন্দোবস্ত আমিই করে দেব। আপনি ব্যস্ত হবেন না”।

রামসিং বাজার ফেরত পয়সা সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে চলে যেতেই সীমন্তিনী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা চল্লিশ। সে অর্চনাকে বলল, “অর্চু সময় তো প্রায় হয়ে এল রে। তুই এক কাজ কর না বোন। একটু নীতাকে ফোন করে দ্যাখ তো ধরে কি না। ধরলে ওকে সংক্ষেপে কথাটা জানিয়ে দে। তবে ওকে বুঝিয়ে দিস দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ওনারা তো পুরো রাতই এখানে থাকছেন। তাই ওকে তাড়াহুড়ো করে আগে চলে আসতে হবে না। আমি চট করে রচুর সাথে একটু কথা বলে নিই। ওনারা চলে এলে আর কাউকে ফোন করতে পারব না হয়ত” বলে রান্নাঘরের দড়জার সামনে গিয়ে লক্ষ্মীকে বলল, “লক্ষ্মীদি একটু গেটের দিকে নজর রেখ তো। গেটের কাছে কোনও গাড়ি আসতে দেখলে আমাকে বোলো” বলে নিজের ঘরে চলে এল।


______________________________
[+] 3 users Like riank55's post
Like Reply
দেখা যাক এরপর সবার ভাগ্যে কি লেখা আছে
Like Reply
(29-03-2020, 01:29 PM)Mr Fantastic Wrote: দেখা যাক এরপর সবার ভাগ্যে কি লেখা আছে

নিয়মিত কমেন্ট আর সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ দাদা।
Like Reply
(Update No. 241)

রচনার সাথে কথা বলতে বলতে আলিপুরদুয়ার থেকে পরিতোষের পিসি পিসেমশাই আর বৌদির আসবার কথা জানিয়ে দিল। রচনাও অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিল। কিন্তু সীমন্তিনী তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যতটা সম্ভব সংক্ষেপে কথা শেষ করে অর্চনার খোঁজ করতে করতে পাশের ঘরের দিকে যেতেই অর্চনা সে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “দিদিভাই, নীতাদি বোধহয় খুব ব্যস্ত আছেন। দু’বার ফোন করলুম। ধরলেন না। আমি একটা টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে দিয়েছি শেষে”।

সীমন্তিনী বলল, “ভাল করেছিস। তবে এখন ম্যাক্সিটা ছেড়ে একটা চুড়িদার পড়ে নে চট করে। ওদের গাড়ি এলেই কিন্তু আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নইলে জিনিসগুলো আনতে একা লক্ষ্মীদি হিমশিম খাবে। তুই ড্রেসটা চেঞ্জ করে আয় আমি রান্নাঘরের জানালা থেকে গেটের দিকে নজর রাখছি” বলে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।

সাড়ে ছ’টার একটু পরেই একটা হাল্কা বেগুনী রঙের বেশ বড়সড় একটা গাড়ি তাদের গেটের সামনে এসে দাঁড়াতে সীমন্তিনী গাড়িটার নাম্বার দেখবার চেষ্টা করল। কিন্তু সেটা ঠিক নজরে পড়ছিল না। কিন্তু গেটের একজন গার্ডকে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখল। কয়েক সেকেন্ড পরেই সুন্দর শাড়ী পড়া এক ভদ্র মহিলাকে গাড়ির পেছনের জানালার সামনে বসে থাকতে দেখেই সীমন্তিনী রান্নাঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, “লক্ষ্মীদি, চলে এস। ওনারা এসে পড়েছেন। অর্চু কোথায় গেলি রে? হয়নি এখনও তোর? ওরা এসে পড়েছেন তো”।

অর্চনা প্রায় সাথে সাথেই ঘর থেকে বেরিয়ে এল। মূল দড়জা খুলে অর্চনাকে সাথে নিয়ে সীমন্তিনী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসতেই দেখল দু’জন গার্ড গাড়ির পেছনের ডিকি খুলে পরীক্ষা করছেন। সীমন্তিনী দ্রুত পায়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই গার্ডেরা গেট খুলে দিল। গাড়িটা গেটের ভেতরে ঢুকতেই অর্চনা আর সীমন্তিনীর কাছাকাছি এসে পড়ল। ড্রাইভার তাদের দেখে গাড়ির গতি কমাতেই সীমন্তিনী ঘরের দিকে হাতের ঈশারা করে ড্রাইভারকে বলল, “ওই সিঁড়ির সামনে নিয়ে রাখুন”।

একদিক থেকে রামসিংও ছুটে এল। সিঁড়ির সামনে গাড়ি থামতেই গাড়ির পেছন পেছন সীমন্তিনী আর অর্চনাও সেখানে পৌঁছে গেল। সীমন্তিনী পেছনের এক দড়জা নিজে হাতে খুলে দিয়ে আন্তরিকভাবে বলল, “আসুন আসুন। আমরা সবাই আপনাদের অপেক্ষা করছিলুম”।

অন্য দিকের দড়জাটা ততক্ষণে রামসিং খুলে দিয়েছে। গাড়ির ভেতর থেকে তারা তিনজন নেমে আসতেই সীমন্তিনী আর অর্চনা নিচু হয়ে সকলের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারা তিনজনেই প্রণাম নিতে না চাইলেও সীমন্তিনী আর অর্চনা তাদের প্রণাম করল। হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা দেবী দু’জনকে জড়িয়ে ধরলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বিনা নোটিসে এভাবে হুট করে এসে তোমাদের নিশ্চয়ই খুব বিপাকে ফেলে দিয়েছি আমরা। এরজন্যে আগে ভাগেই তোমাদের সকলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “এমন করে বলবেন না পিসেমশাই। যেদিন থেকে আপনাদের কথা শুনেছি সেদিন থেকেই আপনাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল আমার খুব। কিন্তু কাজের এতটাই প্রেসার যে কিছুতেই সময় বের করে উঠতে পারছিলুম না। আপনারা যে নিজেরাই এসেছেন এতে আমি ব্যক্তিগত ভাবে কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। চলুন, ভেতরে চলুন, আসুন বৌদি, পিসি আসুন” বলে রামসিংকে উদ্দেশ্য করে বলল, “ডিকির জিনিসগুলো ঘরে নিতে লক্ষ্মীদিকে একটু সাহায্য কোরো রামসিং। আর এনাদের ড্রাইভারকে গাড়ি রাখবার জায়গা আর তার থাকবার জায়গা দেখিয়ে দিও”।

হৈমবতীদেবী অর্চনার একটা হাত ধরে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যে সীমন্তিনী সেটা তো এতক্ষণে বুঝেই গেছি মা? কিন্তু এই মা-টি কে গো? এ কি নবনীতা? না আমার আরেক ভাইঝি অর্চু”?

সীমন্তিনী হৈমবতীদেবীর হাত ধরে ঘরের সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ও অর্চু পিসি। নীতা এখনও বাড়ি ফেরেনি। আপনারা পরির মুখে হয়ত শুনেই থাকবেন যে নীতা এখানে একটা গারমেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। ওর ছুটি হয় রাত আটটায়। আর এখন তো পূজোর সীজন বলে ওদের শোরুমে ব্যস্ততা বেশী। তাই আপনাদের আসবার খবর পেয়েও বোধহয় আটটার আগে ছুটি পাবে না”।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে সুলোচনাদেবী অর্চনার হাতটা ধরে বললেন, “তোমার বাবা বিধুমামুকে আমরা দেখেছি প্রায় মাস দুয়েক আগে। এরপর ভাইদা যেদিন আমাদের ওখানে এসেছিল, তার পরদিন মা-ই বিধুমামু মামী আর ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। তোমাদের দু’বোনকেই দেখা বাকি ছিল। আজ তোমাকে দেখবার সৌভাগ্য হল। সত্যি তুমি ভারী মিষ্টি মেয়ে। তোমাকে দেখেই খুব আদর করতে ইচ্ছে করছে। তবে তুমি কিন্তু সম্পর্কে আমার ননদই। তবে ননদিনী রায়বাঘিনী হয়ো না যেন”।
 

অর্চনা লাজুক হেসে বলল, “এ মা, অমন করে বলবেন না বড়বৌদি”।

সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় উঠে সুলোচনাদেবী হেসে বললেন, “আরে বিধুমামুর মত লোকের মেয়ে যে আমাদের ননদিনী রায়বাঘিনী কোনদিনই হবে না, সে আমরা সবাই জানি গো। আমি তো শুধু তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম ভাই। তবে আজ তোমাকে দেখে তোমাকে আমার ননদিনীর বদলে ছোট বোন বলে ভাবতে ইচ্ছে করছে। আমাকেও তুমি তোমার দিদি বলে ভাবতে পার”।


******************

সকলে মিলে বসবার ঘরে বসবার পর অর্চনা সকলের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। লক্ষ্মী আর রামসিং দু’জনে মিলে নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ি থেকে অনেকগুলো কন্টেনার এনে রান্নাঘরে রেখেছে। অর্চনা কন্টেনারগুলো ঠিক জায়গা মত সাজিয়ে রাখতে লাগল। শেষবারে নিরঞ্জনবাবুদের লাগেজ গুলো লক্ষ্মী আর রামসিং গেস্টরুমে নিয়ে রাখল। সীমন্তিনী রামসিংকে আরও একবার নিরঞ্জনবাবুদের গাড়ির ড্রাইভারের কথা মনে করিয়ে দিল।

সীমন্তিনী সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে একটু জলখাবার খেয়ে নেবার অনুরোধ করতেই তারা সকলেই পোশাক বদলে নিতে চাইলেন। সে’কথা শুনে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে আসুন আমি আপনাদের থাকবার এবং শোবার জায়গাগুলো দেখিয়ে দিচ্ছি। সকলকে নিয়ে গেস্টরুমে এসে বলল, “পিসি, আপনি আর পিসেমশাই এ’ঘরে থাকবেন। ও’পাশে বাথরুম আছে। তবে জানালাগুলো এখন আর না খোলাই ভাল। এখানে এখন বাইরে প্রচুর মশার আনাগোনা শুরু হবে। জানালা খুললেই মশা ঢুকে পড়বে। ঘরে মশা তাড়াবার লিকুইড লাগানো আছে। আর রাতে মশারিও টাঙিয়ে দেব। আর বড়বৌদি, আপনি আমার সঙ্গে আমার ঘরে চলুন। আপনার লাগেজ কোনটা”?

সুলোচনা নিজের লাগেজটা নিয়ে বললেন, “তোমাকে নিতে হবে না ভাই, আমি নিচ্ছি”। সীমন্তিনী নিরঞ্জন বাবু আর হৈমবতীদেবীকে ফ্রেশ হতে বলে সুলোচনাকে নিয়ে নিজের ঘরে এল। সুলোচনাকে সব কিছু দেখিয়ে দিয়ে সে আবার রান্নাঘরে এল।

সীমন্তিনীকে দেখেই অর্চনা বলে উঠল, “ও দিদিভাই, ওনাদের কাণ্ড দেখেছ। এতো খাবার এনেছেন যে দু’বেলাতেও শেষ হবে না”।
 

সীমন্তিনীও দেখল সত্যিই প্রচুর খাবার এসেছে। সে বলল, “ঠিক আছে, নিয়েই যখন এসেছেন তবে আর তো কিছু করার নেই। তবে অর্চু, তুই সোনা লক্ষ্মীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে আগে তাদের জলখাবারটা দেবার বন্দোবস্ত করে ফ্যাল চট করে। আমি সবাইকে বসবার ঘরে নিয়ে আসছি”।

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, তুমি তাদেরকেই সঙ্গ দাও। এদিকের সবকিছু আমি আর লক্ষ্মীদি দেখছি। তুমি কিচ্ছু ভেবো না”।

সীমন্তিনী লিভিং রুমে এসে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে চেয়ারগুলো সাজাতে সাজাতেই নিরঞ্জনবাবু আর হৈমবতীদেবী পোশাক পাল্টে সেখানে এসে হাজির হলেন। নিরঞ্জনবাবু বললেন, “তোমার কোয়ার্টারের লোকেশানটা সত্যিই খুব চমৎকার মন্তি মা। একটু বাদেই তো পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। একটু বাইরে গিয়ে চারপাশটা ঘুরে দেখে আসা যাবে”?
 

নিরঞ্জনবাবুর মুখে ‘মন্তি মা’ সম্বোধন শুনে সীমন্তিনী এক মূহুর্তের জন্য চমকে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই জবাব দিল, “এখন সেটা না করাই ভাল পিসেমশাই। একটু আগেই বললুম না চারপাশে এখন প্রচুর মশার উৎপাত হবে। তাই এখন বাইরে না যাওয়াই ভাল। তবে আসুন আমি সবগুলো ঘর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। সব ঘরেই কাঁচের জানালা আছে। বাইরের দৃশ্য দেখতে পাবেন। আপাততঃ ওটুকুতেই মন ভরিয়ে নিন। বাকিটুকু কাল সকালে বাইরে গিয়ে দেখবেন”।
 

হৈমবতীদেবী সীমন্তিনীর কথায় সায় দিয়ে বললেন, “হ্যাঁ সেই ভাল। মিছেমিছি মশার কামড় খেয়ে রোগ বাধাবার দরকার নেই”।

তখনই সুলোচনাও সীমন্তিনীর ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনজনকে নিয়ে এ’ঘরে সে’ঘরে গিয়ে সীমন্তিনী সবাইকে দেখাতে লাগল। আঁধার প্রায় ঘণিয়ে এসেছিল। বেশী দুরের জিনিস আর চোখে পড়ছিল না তেমন। এক সময় অর্চনা এসে শান্ত কন্ঠে বলল, “দিদিভাই, তোমাকে লক্ষ্মীদি একটু রান্নাঘরে যেতে বলছেন। তুমি যাও, বাকি ঘরগুলো নাহয় আমিই তাদের ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছি। আর সন্ধ্যা প্রদীপটাও জ্বালিয়ে দিচ্ছি”।

সীমন্তিনী চলে যেতে বাকি ঘরগুলো তাদের দেখিয়ে অর্চনা ছোট ঠাকুরঘরের কাছে এসে বলল, “এটা হচ্ছে দিদিভাইয়ের ঠাকুরঘর। ভেতরে যাবেন? অবশ্য আমাকে এখন ঢুকতেই হবে। সন্ধ্যা প্রদীপটা জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি”।

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “না থাক। ভেতরে আর ঢুকছি না”।

কিন্তু হৈমবতীদেবী নিরঞ্জনবাবুকে বললেন, “বেশ তুমি তাহলে বসবার ঘরে গিয়েই বোসো। আমি একটু ঠাকুরঘরটা দেখেই যাই”।

সুলোচনাও বললেন, “আমিও ঠাকুরঘরটা দেখব একটু”।

অর্চনা সামান্য হেসে বলল, “বেশ তো, আসুন তাহলে। তবে পিসি, এ ঘরে কিন্তু কোনও চেয়ার বা উচ্চাসন বলতে কিছু নেই। আর আসন শুধু একটাই। তাই বসতে হলে কিন্তু মেঝেতেই বসতে হবে। তাতে হয়তো আপনার অসুবিধে হতে পারে”।
 

হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার সাথে ভেতরে ঢুকেই প্রথমে ছোট্ট একটা সিংহাসনে ঠাকুর শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, মা সারদা, আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবিকে প্রণাম করলেন। অর্চনাও ভক্তিভরে ঠাকুরকে প্রণাম করে মেঝেতে বসেই সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালাবার আয়োজন করতে করতে বলল, “পিসি, আমার তো সন্ধ্যারতি দিতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ ঘরে তো বসতে দেবার মত কিছু নেই। আপনারা বরং বসবার ঘরে গিয়েই বসুন। আমি ঠাকুরের আরতিটুকু সেরেই আসছি”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি তোমার কাজ করো মা। আমরা একটু সময় থাকি এখানে। তারপর যাবো’খন”।

অর্চনা আর কিছু না বলে ধুনুচি আর পঞ্চপ্রদীপ সাঁজাল। তারপর প্রথমে প্রদীপ আর তারপর ধুনুচি জ্বালিয়ে ঠাকুরের আরতি করতে শুরু করল। তারপর তিনবার শাঁখে ফুঁ দিয়ে পঞ্চপ্রদীপ আর ধুনুচি নিয়ে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে এল। এক এক করে সব ক’টা ঘরে প্রদীপ দেখিয়ে রান্নাঘরের সামনে আসতেই সীমন্তিনী আর লক্ষ্মী প্রদীপের ওম নিয়ে নিজেদের মাথায় হাত ছোঁয়াল। বসবার ঘর দিয়ে ফিরে আসবার সময় অর্চনা নিরঞ্জনবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই তিনিও প্রদীপের ওম নিয়ে ঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণাম করলেন। ঠাকুর ঘরে ফিরে এসে দেখে হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাদেবী তখনও ঠাকুর ঘরেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের কাছে যেতেই তারা দু’জনেও প্রদীপের ওম নেবার পর অর্চনা ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে হাঁটু গেঁড়ে বসে প্রদীপের ওম নিয়ে নতজানু হয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করল। সব কাজ শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “আচ্ছা অর্চু মা, তুমি যদি কিছু মনে না করো, তবে এখন তোমাকে দুটো প্রশ্ন করতে পারি”?

অর্চনা হৈমবতীদেবীর দিকে হাসিমুখে চেয়ে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, বলুন কী জানতে চাইছেন”?

হৈমবতীদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “এই এ ঘরে, মানে এই ঠাকুরঘরে বসবার জন্যে কোন চেয়ার বা টুল রাখা হয়নি, কেন গো”?
 

অর্চনা মুচকি হেসে বলল, “আসলে পিসি, আমি আর রচু যেমন আমাদের মা-বাবার মেয়ে, তেমনই দিদিভাইও আমাদের মা-বাবার আরেক মেয়ে। আমরাও সকলেই দিদিভাইকে আমাদের বড়দিদি বলেই মানি। আর আমাদের মা বাবা ছোটবেলাতেই আমাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন যে বৈষ্ণব ধর্মমতে কোনরকম উচ্চাসনে বসে কৃষ্ণকথা শুনতে নেই, উচ্চাসনে বসে ভগবান দর্শন করতে নেই। দিদিভাইও বাবার কাছে এ’ শিক্ষাই পেয়েছেন। তাই এ’ঘরে কোনরকম উচ্চাসন রাখা হয় না। আর তাছাড়া তেমন প্রয়োজনও বোধ হয় পড়েনি”।

হৈমবতীদেবী অর্চনার মুখটা দু’হাতে অঞ্জলী করে ধরে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললেন, “বেঁচে থাকো মা। ঈশ্বর যেন তোমাকে চিরকাল সুখে রাখেন। সত্যি, বিধু তোমাদের খুব ভাল শিক্ষা দিয়েছে”।
 

সুলোচনাদেবী তার শাশুড়িকে বললেন, “মা, আমাদের বাড়িতেও তো ঠাকুরঘরে কোনও উচ্চাসন নেই। কিন্তু তা না থাকবার পেছনে কারন যে এটা, এ’কথা তো আমরাও কেউ জানতুম না। এটাই কি আসল কারন মা”?

হৈমবতীদেবী মিষ্টি করে হেসে তার জবাবে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা। অর্চু যেটা বলল সেটাই আসল কারন। আমার বাবা-মাও আমাকে ছোটবেলায় এ’কথা শিখিয়েছিলেন। আজকালকার ছেলে মেয়েরা তো এ’সব পাঠ প্রায় চুকিয়েই ফেলেছে” বলে আবার অর্চনাকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “আর আমি আরেকটা কথা যেটা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছিলুম সেটা হল, তুমি সব জায়গায় সন্ধ্যা প্রদীপ দেখালে কিন্তু এ ছবিটায় তো দেখালে না! এটা কার ছবি গো”?

অর্চনা একটু হেসে বলল, “জীবিত ব্যক্তির ছবিতে তো মালা পড়াতে, ধূপ বা প্রদীপ দেখাতে হয় না। ইনি আমাদের দিদিভাইয়ের দাদা, তার জেঠুর ছেলে। আর আমার ছোটবোন রচনার স্বামী রতু দা। দিদিভাইয়ের থেকে মাত্র ছ’মাসের বড়। প্রায় সমবয়সী আর দুই বন্ধুর মত একসাথে বড় হয়ে উঠলেও দিদিভাই তাকে ভীষণ ভালবাসেন, আর শ্রদ্ধাও করেন তেমনই। তাই ঠাকুর প্রণাম করতে এসে রোজই তার দাদাভাইকেও প্রণাম করেন। এখানে ছবিটা রাখলে কোনদিন প্রণাম করতে তার ভুল হবেনা বলে দিদিভাইই এই ছবিটা এখানে রেখেছেন”।

হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা অর্চনার কথা শুনে একপলক নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিলেন। সুলোচনা রতীশের ছবিটার কাছে এসে বললেন, “বাঃ, খুব সুন্দর দেখতে কিন্তু! তাই না মা”?

হৈমবতীদেবীও ছবিটার কাছে এসে দেখতে দেখতে বললেন, “হ্যাঁ বড়বৌমা, ঠিক বলেছ তুমি। সত্যি খুব সুন্দর। বিধুর ছোটমেয়েকে তো এখনও দেখিনি আমরা। তবে ওর স্ত্রী,ছেলে আর বড়মেয়েকে দেখে মনে হয় রচনাও বেশ সুন্দরী রূপসীই হবে। দু’জনকে জুটিতে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর দেখাবে। কিন্তু এ ছবিটা তো বেশ পুরনো। মনে হচ্ছে কলেজ পড়ুয়া একটা ছেলে যেন। এটা কতদিন আগে তোলা ছবি, সেটা তুমি জানো অর্চু”?

অর্চনা মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ পিসি, ওদের দুটিকে খুব সুন্দর মানিয়েছে। কালচিনিতে আমাদের প্রতিবেশীরা বলেন ওদের দেখলে নাকি হর-পার্বতীর জুটি বলে মনে হয়। তবে রতুদার এ ছবিটা সত্যিই অনেক পুরনো। তাদের বিয়ের আগের ছবি। তবে কতদিন আগে তোলা, সেটা আমার ঠিক জানা নেই গো”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “তোমার ছোটবোন রচুও নাকি আমাদের পরিকে খুব ভালবাসে। তাকে নাকি নিজের দাদার মত শ্রদ্ধা করে। আর পরিকে যেদিন আমরা পেলুম সেদিন থেকেই জানি ও-ও মেয়েটাকে নিজের বোনের মতই ভালবাসে”।

এবার সুলোচনা বললেন, “জানো অর্চু, ভাইদার মুখে রচনার কথা শুনে আমরা ......”

অর্চনা সুলোচনার কথার অর্থ বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আপনাদের ভাইদা কে গো বৌদি”?

সুলোচনা হেসে বললেন, “ওহ, সত্যিই তো। সেটা না বললে বুঝবে কেমন করে। তবে বৌদি নয়, আগেই বলেছি না তুমি আমাকে দিদি বা বড়দি বলে ডাকবে। তবে শোনো, আমরা তিন জা পরি ঠাকুরপোকে ভাইদা বলে ডাকি। এবার বুঝেছ তো? তা যে’কথা বলছিলুম আর কি। মা-র সাথে দেখা হবার পর ভাইদা যখন সবার প্রথমে রচনাকে ফোন করতে চেয়েছিল, তখন আমরা সবাই ভেবেছিলুম রচনা বুঝি ভাইদার প্রেমিকা। কিন্তু ফোনের স্পীকার অন করে ভাইদা যখন রচনা আর ওর বরের সাথে কথা বলল, তখনই আমাদের ভুল ভেঙেছে”।
 

হৈমবতীদেবী আবার বললেন, “যে মূহুর্তে আমি প্রথম পরিকে দেখেছিলুম সেদিন, ওই মেয়েটা নাকি তখন প্রায় ঘন্টাদেড়েক ধরে ঠাকুরের কাছে আমার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করেছে। ওর প্রার্থনার জোরেই সেদিন হয়ত আমার বড়সড় কোনও বিপদ হয়নি। জানিনা ওকে দেখবার সৌভাগ্য আমার কবে হবে”।

অর্চনা আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “অবশ্যই দেখা হবে পিসি। ওরা হয়ত পূজোর সময় আসবে। আর আমাদের গৃহারম্ভের সময়েও হয়ত আসবেই। তখন আশা করি আপনার সাথেও ওদের দেখা হবে। আর আপনারা যদি আপনাদের ভাইপোর বিয়ের আয়োজন করতে পারেন, তাহলে তো রচু আর রতুদাও সে বিয়েতে আসবেই। তখন তো দেখতেই পারবেন”।

হৈমবতীদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমরা যে পরির বিয়ের আয়োজন করব এ’ কথা তোমাকে কে বলল মা”?

অর্চনা সহজভাবেই জবাব দিল, “না, সেভাবে কেউ বলেনি। কিন্তু এতদিন তো আপনাদের ভাইপোর পাশে নিজের লোক, আপন বা অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই আগেরবার যখন দিদিভাই কলকাতা গিয়েছিলেন, তখন রচু, দিদিভাই আর নীতাদিই অনেক কষ্টে আপনার ভাইপোকে বিয়ের জন্যে রাজী করিয়েছিলেন। দিদিভাই আর নীতাদির পছন্দ করা মেয়েকেই তিনি বিয়ে করবেন বলে তাদের দু’জনের ওপরেই তার জন্য পাত্রী পছন্দ করবার ভারও তিনি দিয়েছিলেন। কিন্তু ক’দিন আগে তিনি যখন আপনাদের খুঁজে পেলেন তখন থেকেই দিদিভাই আর নীতাদি বলছিলেন যে এবারে আর তাদের ওপর পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্বটা রইল না। আপনারা ওনার আত্মীয়, ওনার স্বজন এবং অভিভাবক। তাই আপনারাই এখন দেখে শুনে তার বিয়ে দেবেন। আমিও সে’সব শুনেই এ’ কথা বলছি”।

(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 242)

হৈমবতীদেবী অর্চনার কথা শুনে বললেন, “হ্যাঁ, সে’কথা অবশ্য পরি নিজেও আমাদের বলেছে। তা তোমার দিদিভাই আর নীতা কি এরমধ্যে কোনও মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছে নাকি? এ ব্যাপারে তুমি কিছু জানো কি মা”?

অর্চনা খুব সতর্কভাবে সে প্রশ্নের জবাবে বলল, “তারা দু’জনে খোঁজাখুঁজি যে করছিলেন, সেটা জানি। তবে পিসি, তারা তেমনভাবে কাউকে পছন্দ করেছেন কিনা বা এ বিষয়ে আপনার ভাইপোকে কিছু জানিয়েছেন কি না, সেটা সঠিক বলতে পারব না আমি”।
 

হৈমবতীদেবী আবার কিছু বলে ওঠবার আগেই বসবার ঘর থেকে সীমন্তিনী তাদের ডেকে বলল, “বৌদি, পিসি, আপনারা চলে আসুন। খাবার এসে গেছে। অর্চু ওনাদের নিয়ে আয় বোন”।

অর্চনাও তাদের বলল, “হ্যাঁ পিসি, চলুন। এবার বরং ও’ঘরে যাওয়া যাক”।

দু’জনকে সাথে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে অর্চনা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই, তুমিও ওনাদের সাথে বসে পড়ো। আমি আর লক্ষ্মীদি পরিবেশন করছি”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “আমি আর লক্ষ্মীদি মিলে সকলের প্লেট সাজিয়ে ফেলেছি। তাই তোকে আর সে সব করতে হবে না এখন। আয় তুইও আমার পাশের চেয়ারে বসে পড়। পরিবেশন লক্ষ্মীদি একাই সেরে ফেলতে পারবে। আয় বোস এখানে” বলে নিজের পাশের খালি চেয়ারের দিকে ঈশারা করল।
 

একটা বড় ট্রেতে চারটে খাবারের প্লেট এনে অতিথিদের দিতে দিতে লক্ষ্মী বলল, “হ্যাঁ সোনাদি, তুমিও এনাদের সকলের সাথেই বসে পড়ো। আমি এদিকে সামলে নিতে পারব”।

এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আচ্ছা মন্তি মা, অর্চু মা, তোমরা আমার একটা কথা শোনো আগে। এভাবে অনাহুতভাবে এসে যখন পড়েইছি তখন তোমাদের সকলের সাথেই অনেক কথাই হবে আমাদের। আর সে উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা এসেছি আজ। তবে সবার আগে তোমাদের দু’জনকেই আমি একটা কথা বলে নিতে চাই” বলে একটু থেমে সীমন্তিনী আর অর্চনার দিকে দেখতে দেখতে আবার বললেন, “আমি বা আমরা সবাই তোমাদের চেয়ে বয়সে যতই বড় হই না কেন, তোমরা যদি ‘আপনি’ না বলে আমাদের সাথে ‘তুমি তুমি’ করে কথা বলো, তাহলেই কিন্তু আমরা সবাই বেশী খুশী হব”।

সাথে সাথে হৈমবতীদেবী বললেন, “তুমি আমার মুখের কথাটা ছিনিয়ে নিলে। আমি তো এখনই এ কথাটা বলতে যাচ্ছিলুম। হ্যাঁ মা, মানছি তোমাদের সাথে এই আমাদের প্রথম দেখা প্রথম কথা। তবে পরিচয় নতুন হলেও তুমি আর নীতা যে আমাদের পরির সবচেয়ে ভাল বন্ধু। আর অর্চুর ব্যাপারে আর কি বলব। ও তো আমার নিজেরই ভাইঝি। ওর বাবা তো সেই ছোট্টবেলা থেকেই আমার ভাই। বিধুকে তো আমি ছোটবেলায় ফোঁটাও দিতুম। আমি কপাল দোষে সবাইকে হারিয়ে ফেলেছিলুম বলেই না আমাদের এতদিন দেখা হয়নি। তাই বলে বাবার দিদিকে কেউ আপনি করে বললে কেমন লাগে শুনতে বলো? জানো অর্চু, তোমার বোন রচুর সাথে সেদিন যখন আমি ফোনে প্রথম কথা বললুম, সেদিন প্রথম থেকেই ও আমাকে ‘তুমি তুমি’ করে বলছিল। ওর মুখে অমন আপন করা সম্বোধন শুনে আমার কী যে ভাল লেগেছিল ওই মূহুর্তে সেটা তোমাদের বলে বোঝাতে পারব না। আসলে মেয়েটা তো তখন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা আমার আর পরির মঙ্গল কামনা করে ও ওর ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছিল। আর তখনই ওর সাথে আমি কথা বলেছিলুম। পরে অবশ্য ঘোরটা কেটে যেতেই ‘তুমি’ করে বলার জন্যে ক্ষমা চাইছিল। কিন্তু আমি ওকে অনুমতি দিয়েছি ও যেন আমাকে ও’ভাবেই সম্বোধন করে। আর আমাদের বড়বৌমা তো পরির সাথে বা বিধুর সাথে তোমাদের সম্পর্কসূত্র ধরে তোমাদের বৌদিই হবে। আর বৌদিকে ‘তুমি’ করে ডাকাই যায়। তাই তোমরা আমাদের সকলের সাথে সেভাবে কথা বললেই আমরা বেশী স্বাচ্ছন্দ অনুভব করব। আর আমি কিন্তু শুধু আমাদের এই তিনজনের কথা বলছি না মা তোমাদের। আমাদের পরিবারের সকলকেই তোমরা ও’ভাবেই ডেকো। আসলে ‘আপনি’র চেয়ে ‘তুমি’ বা ‘তুই’ সম্মোধনই বেশী কাছের বলে মনে হয়। তবে নীতাকেও এ’সময় সাথে পেলে আরও ভাল লাগত”।

সীমন্তিনী দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “সাতটা তো প্রায় বাজতেই চলল। নীতা হয়ত আর ঘণ্টা খানেকের ভেতরেই চলে আসবে পিসি। কিন্তু ওর জন্যে অপেক্ষা করলে তো এখন এ খাবারগুলো ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। তাই এখন খেয়ে নিন। রাতে খাবার সময় ওকে আপনার ঠিক পাশেই পাবেন” বলে মিষ্টি করে হাসল।

হৈমবতীদেবী খাবারের দিকে হাত বাড়াতে বাড়াতে বললেন, “হ্যাঁ ঠিকই বলেছ তুমি মা। তবে মা, এবারেও কিন্তু তুমি আমাকে ‘আপনি’ করেই বললে”।

সীমন্তিনী নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবার একটু হেসে বলল, “সরি পিসি। আর হবে না। এবার খাওয়া শুরু করো। পিসো, বৌদি তোমরাও হাত লাগাও”।
 

খেতে খেতে সকলে মিলে পরিতোষ, বিধুবাবু, কালচিনি, কুমারগ্রাম আর আলিপুরদুয়ারের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলল। খাওয়া শেষে সবাই মিলে গেস্টরুমে এসে আগের প্রসঙ্গের সূত্র ধরেই কথাবার্তা বলতে লাগল। ঠিক সওয়া আটটার সময় কলিং বেল বেজে উঠতেই সীমন্তিনী বলল, “ওই নীতা এসে গেছে বোধহয়”।

অর্চনা তাড়াতাড়ি গিয়ে দড়জা খুলে দিতেই নবনীতা ভেতরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে অর্চু? ওনারা সবাই কি চলে গেছেন নাকি”?

অর্চনা দড়জা বন্ধ করতে করতে বলল, “না নীতাদি। ওনারা তো রাতে থাকবেন বলেই এসেছেন। তোমার আর দিদিভাইয়ের সাথে নাকি তাদের অনেক কথা আছে। এখন সবাই গেস্টরুমে আছেন। তুমি কি হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে? না আগে তাদের সাথে পরিচয়টা সেরে নেবে”।

নবনীতা বলল, “চল আগে পরিচয়পর্বটাই শেষ করে নিই। আয়” বলে অর্চনার হাত ধরে গেস্টরুমে গিয়ে ঢুকতেই সীমন্তিনী ঘরের সকলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “এই তো নীতা এসে গেছে। আয় নীতা, দেখ কারা এসেছেন। ইনি পরির পিসেমশাই, ইনি পিসি আর ইনি বড়বৌদি, মানে পরির বড় পিসতুতো দাদার স্ত্রী”।
 

নবনীতা এগিয়ে গিয়ে সকলকে প্রণাম করতে সীমন্তিনী বলল, “আর পিসি, তুমি এতক্ষণ ধরে যাকে দেখবার জন্যে উতলা হয়েছিলে, এই সেই নীতা, মানে নবনীতা। আমার মত ও-ও পরির বন্ধু। আর এখন আমার একটা বোনও হয়ে গেছে”।

নিরঞ্জনবাবু, হৈমবতীদেবী আর সুলোচনা তিনজনেই নবনীতাকে আশীর্বাদ করলেন। হৈমবতীদেবী নীতার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন, “পরির মুখে তোমার সব কথা শুনেছি মা। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল তোমাদের সবাইকে। তাই এভাবে আজ বিনা নোটিশে এসে হাজির হলুম”।

নবনীতাও আন্তরিক সুরে জবাব দিল, “বেশ করেছেন পিসি। আমাদেরও আপনাদের সবাইকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু দিদি বা আমি কেউই কাজ থেকে ছুটি নিতে পারছিলাম না”।

হৈমবতীদেবী মিষ্টি হেসে বললেন, “উহু, ‘আপনি’ নয়। আমাদের সবাইকে ‘তুমি তুমি’ করে বলবে। আমি তো তোমার মায়ের মতই। মাকে কেউ আপনি করে বলে”?
 

নবনীতা অবাক চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, “মা? আজ নিজেকে খুব ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছে পিসি। নিজের জন্মদাত্রী মাকে সাত বছর আগেই হারিয়েছি। তার চলে যাবার খবরটুকুও আমি সময়মত পাইনি। জানলাম সাত বছর বাদে। তারপর এখানে আসবার পর মাসির সাথে মানে অর্চুর মা-র সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তাকে নিজের মা বলে মনে হচ্ছে। তাকে দেখবার সৌভাগ্য আমার এখনও হয়নি। আজ তোমাকেও পেলাম। আজ সত্যি খুব খুশীর দিন আমার”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে নবনীতাকে সতর্ক করে দিয়ে বলল, “নীতা, এখন আর পুরনো কথাগুলো টেনে আনিস না বোন। আর শোন, যা ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়। আর তোর জন্যে জলখাবার রাখা আছে। লক্ষ্মীদির কাছ থেকে সেটা নিয়ে খেয়ে তারপর এখানে আসিস আবার”।
 

মিনিট পনের বাদেই নবনীতা আবার গেস্টরুমে আসতেই হৈমবতীদেবী তাকে নিজের পাশে বসিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবারে আর সময় নষ্ট না করে আমাদের আসল আলোচনাটা শুরু করো”।

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আমি তোমার মত অমন গুছিয়ে কথা বলতে কবে শিখেছি বলো? তুমি আর বড়বৌমা মিলেই বরং শুরু করো। আমি মাঝে মধ্যে প্রয়োজনমত কথা বলব’খন”।
 

হৈমবতীদেবী এবার সীমন্তিনী আর নবনীতার দিকে দেখে বললেন, “শোনো মা। আজ থেকে চুয়াল্লিশ পঁয়তাল্লিশ বছর আগে নিজের মা বাবা আর ভাইয়ের কাছ থেকে আমি কিভাবে হারিয়ে গিয়েছিলুম সে’সব কথাই হয়ত তোমরা এতদিনে জেনে গেছ। তাই সে প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সময় নষ্ট করছি না। তবে এত বছর কেটে যাবার পর, যখন কাউকে ফিরে পাবার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলুম, তখনই হঠাৎ করেই পরি নিজেই আমাদের ওখানে গিয়ে পৌঁছেছিল। নিজের মা বাবা আর ভাইকে তো ফিরে পেলুম না। তবে তোমাদের জন্যেই তাদের একমাত্র উত্তরাধিকারী আমার একমাত্র ভাইপোকে আমি ফিরে পেয়েছি। এ’ পাওয়াটাই বোধহয় আমার জীবনের সেরা প্রাপ্তি। কিন্তু এর পেছনে সম্পূর্ণ অবদানই কিন্তু তোমাদের দু’জনের আর বিধুর। তোমরা যদি পরির বন্ধু না হতে তাহলে পরি কখনোই হয়ত এখানে আসত না। বিধুর নামটাও শুনতে পেত কিনা কে জানে। অর্চুর মুখে বিধুর নাম শুনেই ও কালচিনি গিয়েছিল। বিধু তার ছোট বেলার প্রাণের বন্ধুর ছেলেকে চিনতে পারে। পরিও তার বাবার ছোটবেলার বন্ধুকে খুঁজে পেল। তার মাসখানেক আগেই বিধুর সাথে আমার নতুন করে দেখা হয়েছিল। বিধুর মুখেই পরি ওর পিসির সম্বন্ধে প্রথম কোন কিছু জানতে পারে। তারপর প্রাণের টানে? না রক্তের সম্পর্কের টানে, সেটা জানিনে। কিন্তু ও আমার কাছে গিয়ে পৌঁছল। কিন্তু আমার ব্লাড প্রেসারটা বেড়েছিল বলে সবাই দুশ্চিন্তায় ছিলুম যে, নিজের ভাইপোকে ফিরে পাবার আনন্দ আর একই সাথে মা বাবা ভাই আর ভাই বৌয়ের মৃত্যুসংবাদ, এ’সব কিছু আমি সইতে পারব কিনা। কলকাতায় বসে বিধুর ছোট মেয়ে আমার জন্য দেড়টি ঘন্টা ঠাকুরের কাছে প্রার্থনায় বসেছিল। এ যে নিজে কানে না শুনলে বিশ্বাসই হত না আমার। তাই গোটা ব্যাপারটার সাথেই তোমাদের তিনজনের সাথে সাথে অর্চু আর রচুর কাছেও আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব”।

বলতে বলতে তার গলা ধরে এসেছিল বলে তিনি একটু থামতে নবনীতা তার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “পিসি, থাক না ও’সব কথা। সে’সব কথা মনে করে চোখের জল ফেলে আর কি লাভ হবে বলো? আমরা এখন ভগবানের কাছে শুধু এটাই প্রার্থনা করি যে পরি তোমাদের নিয়ে সুখে থাকুক। ও যেন আর কখনও নিজেকে একটা অনাথ ছেলে ভেবে দুঃখ না পায়। আর তোমরাও সবাই পরিকে নিয়ে আনন্দে থাকো, সুখে থাকো”।

হৈমবতীদেবীর অন্যপাশে বসে থাকা সুলোচনা তার শাশুড়ির আরেকটা হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ মা, নীতা যা বলল, আমার মনের কথাও কিন্তু ঠিক তাই। তুমি শান্ত হও। এমন করে উতলা হয়ে পড়লে যে তোমার শরীর খারাপ করবে আবার। তখন যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এখানে এসেছি, সেটাই বানচাল হয়ে যাবে”।

হৈমবতীদেবী নিজেকে সামলাতে সামলাতে বললেন, “না না বড়বৌমা, ভেবনা, আমি ঠিক আছি। কিন্তু এই মেয়েগুলোর কাছে আমি যতটা ঋণী হয়ে পড়েছি, সে ঋণ শোধ আর কিকরে করব মা”?
 

সীমন্তিনী শান্ত স্বরে বলল, “পিসি, এমন করে বলছ কেন। এখানে ঋণ বা ঋণশোধের কথা আসছে কোত্থেকে? মেসো মানে তোমার কালচিনির ভাই কি বলেন জানো? উনি বলেন বিধাতা প্রত্যেকটা মানুষের কপালেই সুখ আর দুঃখ দুটোই লিখে দিয়েছেন। তবে কোনটাই সময়ের আগে কিছুতেই হয় না। সময় যখন আসবে তখন যা অসম্ভব বলে মনে হয় সেটাও চোখের পলকেই ঘটে যায়। আবার ঈশ্বরের নির্দেশিত সময়ের আগে সহজ একটা কাজও হাজার চেষ্টাতেও সমাধা করা যায় না। তোমার ভাইপোকে তোমার কাছে পাবার সময় ভগবান নিশ্চয়ই আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন। আর সেই নির্ধারিত সময়েই তুমি তাকে পেয়েছ। আর বাকি সবকিছু সবাই তো একেকটা অছিলা বা উপলক্ষ মাত্র”।
 

নিরঞ্জনবাবু এবার বললেন, “ঠিক বলেছ মা। একেবারে যথার্থ বলেছ। সেদিন বিধুর হাতে লেখা চিঠিটা পেয়ে আমি আর নিজেকে সামলে রাখতে পারিনি। গত চুয়াল্লিশটা বছর ধরে যে দিনটার প্রতীক্ষা করতে করতে আমরা সবাই নিরাশ হয়ে পড়েছিলুম, তখনই পরিকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলুম। আজ বুঝতে পারছি, বিধুর কথা আর তোমার কথাটাই সার কথা। সময়ের আগে কোনকিছুই হবার নয়। তবে মা, তুমি আর নীতা যে পরির খুব ভাল বন্ধু, ওর সবচেয়ে বড় হিতৈষী তোমরা, এ’সব কথা পরির মুখেই আমরা শুনেছি। এ’ ক’টা দিনে পরির সাথে তোমাদের সকলের ব্যাপারেই আমাদের অনেক কথা হয়েছে। তোমাদের সাথে ওর যোগাযোগ কিভাবে হয়েছিল, তারপর থেকে কিভাবে তোমরা একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছ, তার সবকিছুই পরি আমাদের কাছে খুলে বলেছে। তাতেই আমরা শুনেছি যে তোমরা দু’জন পরির বিয়ে দেবার জন্য মেয়ের খোঁজ করতে শুরু করেছিলে। পরি আমাদের এটাও বলেছে যে কোন একটা মেয়ে নাকি তোমরা খুঁজেও পেয়েছ। আমরা আজ কিন্তু মূলতঃ সে ব্যাপারেই তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি মা। আসলে তোমরা তো জানোই, পরির ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখনই ওর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার বলে ভাবছি আমরা। তাছাড়া বেচারা কলকাতায় একা একটা বাড়িতে থাকে। ডিউটির তো কোনও বাঁধাধরা রুটিন নেই। কখন বাড়ি ফেরে, কখন রাঁধে, কখন খায়, কে জানে। শরীরে ক্লান্তি থাকলে হয়ত কিছু না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। তাই আমরা ভাবছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর একটা বিয়ে দেব আমরা। কিন্তু পরি যখন বলল যে তোমরা ওর জন্যে একটা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছ তখন ভাবলুম তোমাদের সাথে আগে কথা বলা দরকার। তোমাদের পছন্দের যে কোন মেয়েকেই যে পরি বিয়ে করবে বলেছে, এ’কথাও সে আমাদের বলেছে। আমরাও তাতে আপত্তি করব না। আমার ছেলেরা আর সব বৌমারাও তাতে রাজী। তবে পরির মুখে ও’ কথা শোনবার পর থেকেই তোমাদের পিসি তোমাদের মাধ্যমেই সেই মেয়ের বাড়ির লোকদের সাথে যোগাযোগ করে মেয়েটিকে দেখতে চায়। আর মেয়েটি যদি তার পছন্দ হয়ে যায়, তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা আমরা দিয়ে দিতে চাই”।

সীমন্তিনী মাথা নিচু করে নিরঞ্জনবাবুর কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্চুর ব্যাপারে ভাবছিল। এবার নিরঞ্জনবাবু থামতেই সে মাথা উঠিয়ে বলল, “পিসো। আপনারা যে... ওহ সরি। তোমরা যে এ উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে এসেছ এ’কথা শুনে খুব খুশী হলুম। তবে পিসো, পরিকে আমরা সেভাবে আগে বললেও আমরা কিন্তু এ বিয়ের ব্যাপারে চুড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত এখনও নিই নি। কারন সেটা করতে হলে পরির সাথে মুখোমুখি বসে বিশদভাবে একটা আলোচনা করবার দরকার আছে বলে আমরা ভেবেছিলুম। নাগরাকাটা আসবার দিন পনের আগে থেকে পরি এতোটাই কাজে ব্যস্ত ছিল যে আমাদের সাথে ফোনেও কথা বলতে পারত না। একসাথে বসবার সুযোগটাই হয়ে উঠছিল না। সেদিন কোন খবরাখবর না দিয়েই দুম করে ও এখানে এসে হাজির হল। আমার তখন অফিসে যাবার তাড়া। আমি যখন ঘর থেকে বেরোচ্ছিলুম তখনই ও এসে হাজির। তাই সকালে আর ওর সাথে তেমন কথা বলতেই পারিনি। আর সন্ধ্যের পর অফিস থেকে ফিরে আরেকজনের সাথে আমি আর পরি একটা অন্য ব্যাপারে মিটিং করি। তারপর সবাই মিলে কথা বলতে বলতেই সময় গড়িয়ে গেল। আর ঠিক তখনই ও জানাল যে রাত ভোর হলেই ও কালচিনি যাবে। সেখান থেকে মালবাজার আর তারপর কলকাতা চলে যাবে। তাই ওর সাথে আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনায় বসবার সুযোগই পেলুম না। ও সকালে শুধু চাটুকু খেয়েই বেরিয়ে গেল। দুপুরে ওর মেসেজ পেয়ে জানলুম ও তোমাদের ওখানে গেছে। আর তারপর ওর সাথে আর কন্টাক্ট করতে পারছিলুম না। ও যে তোমাদের মত আপনজনদের খুঁজে পেয়েছে এটা শুনে আমরা সকলেই সেদিন খুব খুশী হয়েছিলুম। কিন্তু আমরা কেউই ওকে ফোনে পাচ্ছিলুম না। পরে শুনেছি ও ইচ্ছে করেই ফোন সুইচ অফ করে রেখেছিল। রাত প্রায় সাড়ে সাতটা নাগাদ রচু ফোন করে মোটামুটি ব্যাপারটা আমাদের জানিয়েছিল। আর পরি রাত প্রায় বারোটায় আমাকে ফোন করেছিল। তখন আমার আর নীতার কাছে ও সবটা খুলে বলেছিল। সবকিছু জানবার পর আমরাও প্রচণ্ড খুশী হয়েছিলুম। তবে মনে মনে তখনই ভেবেছিলুম যে এখন তোমরাই তো পরির অভিভাবক। আর তোমাদের মত এত ভাল একটা পরিবার পরিকে যখন এমনভাবে আপন করে নিয়েছ তখন ওর বিয়ে নিয়েও এবার তোমরাই ভাববে। তাই আমরাও ভেবেছিলুম যে আর ওই মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে না এগোনোই ভাল হবে। তবে তোমরা যখন সেটা জানতেই এসেছ, তাহলে তোমাদের সে’কথা নিশ্চয়ই বলব। তবে এ সময়ে তো আমরা একটু চা খাই। তোমাদের এখন চা খেতে আপত্তি নেই তো”?
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “এ’সময় আমারও একটু চা খেতে সত্যিই ইচ্ছে করছে”।

সীমন্তিনী উঠে অর্চনার হাত ধরে বলল, “নীতা, তুই এনাদের সাথে কথা বলতে থাক। আমি একটু বাথরুম সেরে আসছি” বলে অর্চনাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
 

বসবার ঘরে এসে সীমন্তিনী অর্চনাকে ফিসফিস করে বলল, “তুই লক্ষ্মীদিকে সকলের জন্য চা বানাতে বলে আমার ঘরে আয়”।

অর্চনা রান্না ঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে চা বানাবার কথা বলে সীমন্তিনীর ঘরে এল। মিনিট খানেক বাদেই বাথরুম থেকে বেরিয়ে সীমন্তিনী অর্চনার কাছে এসে শান্ত স্বরে বলল, “অর্চু সোনা। বুঝতেই তো পারছিস ঘটণা কোন দিকে ঘুরছে। মনকে শক্ত রাখিস বোন। তোকে আড়ালে রেখে তাদের সাথে আমি তোকে নিয়ে কথা বলতে চাই নে। কিন্তু এ আলোচনার যে সার্থক সমাপ্তি হবে, এ নিয়ে কিন্তু যথেষ্ট সন্দেহ আছে আমার মনে। তাই এ’কথা বলছি বোন। কারন তোকে ও’ঘর থেকে সরিয়ে দিলে তাদের মনে কিছু সন্দেহের উদ্রেক হতেই পারে। আর তুইও একটু চিন্তায় থাকবি। তাই বলছি, তুই ওই ঘরে আমার পাশেই থাকিস। আর যদি তোর মনে হয় যে তোর আর সে’ঘরে থাকতে ইচ্ছে করছে না, বা উচিৎ নয়, তবে আস্তে করে আমায় একটা চিমটি কাটিস সকলের চোখের আড়ালে। আমি তখন কায়দা করে তোকে ও’ঘর থেকে বের করে দেব। তবে আমার মনে হয় তোর কথা যখন উঠবে তখন তোর ও’ঘরে না থাকাটাই ভাল। তাহলে আমি গোটা ব্যাপারটা আরও ভাল করে সামলাতে পারব। আর সত্যি যদি তোর কথা নিয়ে তাদের সাথে আলোচনা আমাদের করতেই হয় তবে তোর জীবনের ওই সাতটা বছরের সমস্ত কথাও কিন্তু তাদের কাছে খুলে বলব। তুই যদি সেটা সহ্য করতে পারিস তবে থাকিস। আর না পারলে আমাকে ঈশারা করে দিস। আমি তোকে কোনও অজুহাত দেখিয়ে ও’ঘর থেকে বের করে দেব। তবে যতক্ষণ ও ঘরে থাকবি, সাবধান থাকবি। ওনারা যেন আগে থেকেই কিছুতেই বুঝতে না পারেন যে আমরা পরির জন্য তোকেই পছন্দ করেছিলুম। ঘটণা কোনদিকে গড়ায় সে’ভাবেই আমাদের চলতে হবে কিন্তু। বুঝেছিস তো”?

অর্চনা মাথা হেলিয়ে “ঠিক আছে দিদিভাই” বলতে সীমন্তিনী বলল, “কথাটা মনে রাখিস। আর তুই এখন তাদের ওখানে চলে যা। ওখানে গিয়ে তাদের বল যে আমি একজনের সাথে ফোনে কথা বলছি। একটু পরে আসছি”।
 

অর্চনা চলে যেতে সীমন্তিনী কয়েক মিনিট চুপ করে মনে মনে কিছু একটা ভেবে নিয়ে ফোন হাতে নিয়ে একের পর এক দু’তিনটে ফোন করে ফোনটা হাতে নিয়েই গেস্টরুমের দিকে রওনা হল।


______________________________
Like Reply
(Update No. 243)

গেস্টরুমে এসে দেখে লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিচ্ছে। সে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “পিসি, পিসো, আমায় ক্ষমা কোর। তোমাদের বসিয়ে রেখে এতক্ষণ ও’ঘরে ছিলুম বলে। আসলে বাথরুম থেকে বেরোবার সময়েই এসপি অফিস থেকে একটা ফোন এসেছিল। তাদের সাথে কথা বলতে বলতেই একটু দেরী হয়ে গেল”।

হৈমবতীদেবী বললেন, “ঠিক আছে মা। তাতে কিছু হয়নি। আমরা তো আর এক্ষুনি চলে যাচ্ছি না। আর আমাদের আলোচনা করতে অনেকটা সময় লাগবে বলেই তো এখানে রাতে থাকব বলে এসেছি। আর তুমি যে কতটা ব্যস্ত থাকো, সে’ কথা তো পরির মুখেই শুনেছি”।

সীমন্তিনী নিজের চায়ের কাঁপে একটা চুমুক দিয়ে বলল, “আসলে আমার ল্যান্ডলাইন ফোনটা তো আমার ঘরে। আর সেটার রিংটোন এ’ ঘর থেকে প্রায় শোনাই যায় না। আগে দু’বার নাকি তারা ওই নাম্বারে ফোন করেছিল। আমরা সবাই এখানে কথায় ব্যস্ত ছিলুম বলেই টেরই পাইনি। আচ্ছা, সে’ কথা বরং থাক। আমরা বরং যে ব্যাপারে কথা বলছিলুম সেটা নিয়েই কথা বলি”।
 

সীমন্তিনী আবার চায়ের কাপ ঠোঁটে ছোঁয়াতেই হৈমবতীদেবী বললেন, “মন্তি মা, তার আগে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছি মা। তুমি কিছু মনে করবে না তো”?

সীমন্তিনী একটু থমকে গিয়ে বলল, “হ্যাঁ পিসি, বল না কী বলবে”?

হৈমবতীদেবী বললেন, “পরির মুখেই শুনেছি ও নীতাকে একটা সময় খুব ভালবাসত। আমার ভাই দুর্গা বেঁচে থাকতে ওদের দু’জনের বিয়েতে মতও দিয়েছিল। কিন্তু ঈশ্বরই কেমন নিষ্ঠুর একটা খেলা খেললেন ওদের নিয়ে। দুর্গাও চিরতরে এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। আর নীতাও পরির জীবন থেকে হারিয়ে গেল। নীতার সাথে এতক্ষণ আমরা ওই সব নিয়েই আলোচনা করছিলুম। পরি নিজেই বলেছে যে এতসব ঘটণার পরেও নীতাকে বিয়ে করতে ও রাজি আছে। কিন্তু নীতা নিজেই আর এতে রাজি হচ্ছে না। আর আমি এটাও জানি যে নীতা ওর জীবন থেকে হারিয়ে যাবার অনেকদিন পর পরির জীবনে তুমি এসেছিলে। কিন্তু তোমাদের দু’জনের মধ্যে ভালবাসাবাসির কোনও সম্পর্ক গড়ে ওঠবার আগেই তুমি পরিকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে। বুঝিয়ে দিয়েছিলে তাকে, তুমি কেন বিয়ে করবে না। তবে পরির সাথে এখনও তোমাদের দু’জনেরই বন্ধুত্ব অটুট আছে। আর এ’ ক’দিনে আমরা খুব ভালভাবে বুঝে গিয়েছি যে তোমরা দু’জনই পরির সবচেয়ে কাছের এবং সবচেয়ে বড় হিতৈষী। আমি নিজেও একজনকে ভালবেসেই বিয়ে করেছি। তাই নিখাদ ভালবাসা হলে সকলের ভালবাসাকেই আমি ও তোমাদের পিসো শ্রদ্ধা করি। আজ পরির অভিভাবক হিসেবে আমরা যখন ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি, তখন মনে হল তোমাদের দু’জনের সাথেই সবার আগে আমাদের কথা বলা উচিৎ। তোমাদের দেখে আমারও মনে হচ্ছে পরি যদি তোমাদের কাউকে নিজের জীবনসঙ্গী করে নিতে পারে, তাহলে ও সত্যিই খুব সুখী হবে। আমরাও সকলেই কিন্তু তোমাদের দু’জনের সব কথা জেনেও তোমাদের যে কাউকে ওর স্ত্রী হিসেবে দেখতে পেলে খুব খুশী হব। তাই বলছি মা, তোমরা দু’জনেই ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দ্যাখ না”।

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত সময় না নিয়েই বলল, “পিসি, আমি তোমাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়েই বলছি, আমার পক্ষে পরির ওই প্রস্তাবটা মেনে নেওয়া আগেও যেমন সম্ভব ছিল না, এখনও একই রকম অসম্ভব। আর আমি যতদিন বেঁচে থাকব, অমনটা কিছুতেই সম্ভব হবে না। তোমরা হয়ত নীতার সব কথাই পরির মুখে শুনে থাকবে, কিন্তু আমার মনে হয় না আমার রাজী না হবার পেছনে যে কারনটা আছে সেটা পরি তোমাদের বলতে পারে। যদিও পরিই এ পৃথিবীতে একমাত্র লোক যে আমার জীবনের ওই অধ্যায়টুকু জানে। তবে ও আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল সে তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে সেটা প্রকাশ করবে না কোনদিন। ভালবাসাবাসির সম্পর্ক আমাদের মধ্যে না হলেও পরি যে আমাকে দেওয়া কথার খেলাপ কোনদিন করবে না, ওর ওপর সে বিশ্বাস আমার আছে। ওর সাথে আমার যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বছর তিনেক আগে শুরু হয়েছে, সে সম্পর্কের ওপর পুরো আস্থা আছে আমার। তাই আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে তোমাদের কাছেও ও সেটা প্রকাশ করেনি। আর তোমাদের সবাইকেও আমি অনুরোধ করছি পিসি, তোমরাও কেউ ও ব্যাপারে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি সে ব্যাপারে তোমাদের একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারব না। তবে মোদ্দা কথা এটাই যে আমি সারাটা জীবনই এমনভাবেই একা কাটিয়ে দেব। আমার বাড়ির লোকেরাও কেউই মন থেকে আমার এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি বলে আমি নিজেই নিজেকে সকলের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছি। তাতে আমি সুখী আছি না কষ্টে আছি, সেটা ভাববার চেষ্টাও করিনা কখনো। তবে ভাল মন্দ যাই হোক না কেন, আমার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি এভাবেই থাকব”।

হৈমবতীদেবী মন দিয়ে সীমন্তিনীর কথাগুলো শুনে, নিজের সোফা থেকে সীমন্তিনীর পাশে এসে তার মাথায় হাত রেখে স্নেহের পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “বুঝতে পারছি মা। ভালবাসা বড় সাংঘাতিক জিনিস। ভালবেসে যেমন অনেকে অনেক কিছু পায়, তেমনই অনেকে অনেক কিছু হারিয়েও বসে। আমি নিজেও তো কতকিছু হারিয়েছি। তুমিও হয়ত অপরিণত বয়সেই না জেনে না বুঝে কোন একটা ভুল করে ফেলেছিলে। আর সেই ভুলটাকেই তোমার মনের ভালবাসার আসনে বসিয়ে সারা জীবন ভর সে ভুলের খেসারত দিতেও তুমি পিছ-পা হবে না। পরি ঠিকই বলেছিল। ও আমায় বলেছিল যে যারা ভালবাসাকে সম্মান দিতে জানে, তারা তোমার ভালবাসার কাছে মাথা না নুইয়ে থাকতে পারবে না। তোমাকে আমাদের পরির বৌ হিসেবে কাছে পেলে আমরা সত্যিই খুব সুখী, খুব গর্বিত হতুম মা। তবু তোমার কথা শুনে কষ্ট হলেও নিজের মনের ভাবনাটাকে সরিয়ে ফেলে তোমার ভালবাসাকে আমি প্রণাম করছি মা। আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছি, আমি সারাটা জীবনে যদি ছিটেফোঁটা পূণ্যও অর্জন করে থাকি, ঈশ্বর সে পূণ্যের ফল যেন তোমার ভাগ্যের খাতায় যোগ করে দেন। বেঁচে থেক মা। ভাল থেক”।

নিরঞ্জনবাবু এবার বললেন, “ঠিক বলেছ হিমু। ভাল তো আমরাও বেসেছিলাম। আমাকে ভালবেসে তুমিও তো কম কষ্ট পাওনি। তবু অত কষ্ট সয়েও আমরা তো একে অপরকে আঁকড়ে ধরে থাকতে পেরেছি। কিন্তু এমন ভালবাসার কথা তো শুধু গল্প উপন্যাসেই পড়েছি আমি এতদিন। বাস্তব জীবনে এমনভাবে যে কেউ কাউকে সত্যি ভালো বাসতে পারে তা আজ মন্তি-মার মুখোমুখি বসেই জীবনে প্রথমবার উপলব্ধি করলুম। ভালবাসার মাপদণ্ড থাকলে অন্য যে কারো ভালবাসা ওর ভালবাসার কাছে তুচ্ছ এবং হাল্কা প্রমাণিত হত। আমি বয়সে ওর থেকে অনেক বড়। তাই ও তো আমার প্রণাম স্বীকার করবে না, জানি। তবে মনে মনে আমিও ওর ভালবাসাকে প্রণাম জানাই। ঈশ্বর ওকে সুখে রাখুন, ভাল রাখুন”।

ঘরের প্রত্যেকেই কয়েকটা মূহুর্ত একেবারে চুপচাপ রইল। হৈমবতীদেবী আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসতে সুলোচনাদেবী বললেন, “সীমন্তিনী, বড় আশা নিয়ে এসেছিলুম তোমার কাছে ভাই। আর গাড়ি থেকে নেমে তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিল এমন একটা ছোট-জা পেলে আমরা ও বাড়ির তিন বৌয়েরই আনন্দের সীমা থাকবে না। কিন্তু তুমি আমাদের আবেদন উপেক্ষা করলেও আমরা কেউই কিন্তু তোমার ওপর রাগ করতে পারছি না। মা-বাবার মত একই সুরে সুর মিলিয়ে আমিও তোমাকে প্রানভরা আশীর্বাদ করছি। তবে ভাই, যার সাথেই ভাইদার বিয়ে হোক না কেন, চিরদিন তুমি ওর বন্ধু হয়ে ওর পাশে থেকো। আমি জানি, রাজগঞ্জে তোমার বাপের বাড়ির সকলের কাছ থেকে অনেকদিন আগেই তুমি নিজেকে দুরে সরিয়ে নিয়েছ। কিন্তু বিধুমামু আর মামীর মুখে শুনলুম, তারাই নাকি এখন তোমার আপনজন। বিধুমামু, মামী, কিংশুক, অর্চনা, রচনা, রচনার বর আর এই নীতা আর লক্ষ্মীদি, এদের সকলকে নিয়েই তুমি বেঁচে আছ। তবে ভাই, আজ থেকে তোমার ওই লিস্টে সুলোচনা নামটাও ঢুকিয়ে দিও। আর চিরদিন মনে রেখো, সুলোচনা নামে তোমার এক দিদি রইল আলিপুরদুয়ারে। তার কথাটাও মাথায় রেখ ভাই”।

সীমন্তিনী ম্লান হেসে বলল, “আমার সৌভাগ্য। এতদিন দিদি বলে ডাকবার মত কেউ ছিল না আমার। আজ একটা দিদি পেলাম। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আর জোর করে কিছু বলা যায় বড়বৌদি। তবে হ্যাঁ, এটুকু অন্ততঃ আমি জোর দিয়ে বলতে পারি যে আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পরি আমার পরম বন্ধুই থাকবে। তবে আমার মনে হয় এখন আমাকে নিয়ে আর কোনও জল্পনা কল্পনা না করে পরির বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা বলা ভাল। আমি তো এখনও নীতাকে বলি পরির সাথে বিয়েতে ও রাজি হোক। পরি তো এখনও ওকে বিয়ে করতে রাজী আছে। কিন্তু আমি আর রচু মিলে ওকে নানাভাবে বুঝিয়েও রাজী করাতে পারিনি। এখন তোমরা চাইলে ওর সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলে দেখতে পার। তোমরা যদি ওকে রাজী করাতে পারো, তাহলে শুধু পরি নয় আমরা সকলেই খুব খুশী হব”।
 

নিরঞ্জনবাবু বললেন, “হ্যাঁ, মন্তি-মা ঠিক কথাই বলেছে। আচ্ছা মা নীতা, আমরা পরির অভিভাবক হিসেবে তোমার কাছে সে আবেদন করলেও কি তুমি সেটা রাখবে না”?

নবনীতা একবার সীমন্তিনী আর অর্চনার দিকে দেখে মাথা নিচু করে বলল, “দিদির মত করে ভালবাসতে আমি শিখিনি কোনদিন। সারা জীবন ভর চেষ্টা করলেও আমি তেমন করতে পারব না। কিন্তু সত্যি বলছি পিসো, পরিকে আমি একটা সময় মনেপ্রাণেই ভালবাসতাম। ওকে নিয়ে আমি সংসার বাঁধবার স্বপ্নও দেখেছিলাম। পরির বাবাও আমাদের দু’জনের ভালবাসার কথা শুনেই মৌখিকভাবে আমাকে তার পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। পরি হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ যাবার আগেই উনি আমাকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন, পরির ট্রেনিং শেষ হবার পরেই আমাকে তার পুত্রবধূ বানিয়ে তার সংসারে নিয়ে তুলবেন। কিন্তু ভগবান ওই সুযোগটুকু আর আমাদের কাউকে দিলেন না। পরির বাবার শ্রাদ্ধ আর মৎস্যমুখী শেষ করে পরি আমার কথায় নিজেই উদ্যোগী হয়ে আমার মা-বাবার কাছে গিয়ে আমাকে বিয়ে করবার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমার মা-বাবাও তাতে সম্মতি দিয়েছিলেন। তখন সবাই মিলে স্থির করেছিল যে পরির বাবার ইচ্ছানুযায়ী পরির ট্রেনিং শেষ হবার পরই আমাদের বিয়ে হবে। সে’ দিনটাই আমার জীবনের সবচেয়ে খুশী আর আনন্দের দিন ছিল। কিন্তু ওই খুশীটুকু যে এতটাই ক্ষণস্থায়ী ছিল সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। পরির সাথে সংসার বাঁধবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে সে’দিন রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা বুঝতেও পারিনি। ঘুমের মাঝেই .......”

নবনীতার পাশে বসা সুলোচনা নবনীতার একটা হাত ধরে অপর হাতে তার মুখ চেপে ধরে বলল, “থাক নীতা। ওই কথাগুলো আর তুলো না প্লীজ। সেই রাতের পর থেকে পরের সাতটা বছরে তোমার ওপর দিয়ে যা কিছু ঝড় ঝাঁপটা বয়ে গেছে, তার সব কিছুই ভাইদা আমাদের খুলে বলেছেন। ওই কথাগুলোর আর পুনরাবৃত্তি কোর না ভাই। আমাদের কারোরই ভাল লাগবে না। তবে আমরা সকলে সে’সব কথা জেনেও তোমাদের দু’জনের বিয়ে দিতে রাজী আছি। তুমি শুধু রাজী হয়ে যাও ভাই। ভাইদা তো রাজীই আছে। তাহলে নিজের ভালবাসার লোকটার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা তুমি কেন ধরছ না ভাই”?
 

নবনীতার চোখ দিয়ে তখন জল গড়াতে শুরু করেছে। সুলোচনা নবনীতাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে তার চোখের জল মোছাতে মোছাতে বললেন, “কেঁদো না ভাই। বিনাদোষে তুমি সাতটা বছর ধরে তো অনেক কেঁদেছ। এবার ভগবান যখন তোমাকে সুযোগ দিচ্ছেন, সে সুযোগটা তুমি হাতছাড়া কোর না বোন, প্লীজ”।

নবনীতার কথা শুনতে শুনতে অর্চনার চোখ দুটোও জলে ভরে এসেছিল। সীমন্তিনীর একটা কাঁধ চেপে ধরে সে নিজের মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া কান্নার শব্দ আটকালো। নবনীতা অনেকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সুলোচনার একটা হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “তা হয় না গো বড়বৌদি। তা আর আমার পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। যাকে একটা সময় মনে মনে দেবতার আসনে বসিয়ে পূজো করেছি, তার হাতে নিজের এই নোংড়া শরীরটা আমি কিছুতেই তুলে দিতে পারব না। আমি তো পুরোপুরি পাঁকে তলিয়ে গিয়েছিলাম। মন্তিদির সাথে যেদিন আমার দেখা হল, সেদিনই বুঝি আমার পূনর্জন্ম হয়েছিল। দিদি সেই প্রথম দিনেই আমাকে নিয়ে এসেছিল। দিদি আর রচনাবৌদির জন্যেই আজও আমি বেঁচে আছি। আর দিদির এখানে এসে তো খুব সুখেই আছি। এখন আমার স্বপ্ন বলতে শুধু দুটোই বাসনা। চিরটা কাল আমি যেন দিদির পাশে থাকতে পারি। আর পরিকে যেন আমি সুখী সংসারী হতে দেখতে পারি। আর কিচ্ছুটি আমি চাই নে। তোমরা পরির জন্য অন্য কোনও মেয়ে দেখ। পরি যদি তাকে বিয়ে করে তাহলে আমরাও খুব খুশী হব”।

এ’কথা শুনে ঘরের সকলেই আরও কিছুক্ষণ নীরব নির্বাক হয়ে রইল। তারপর সুলোচনাই প্রথম কথা বললেন, “এতগুলো বছর ধরে নিজেকে অনাথ ভেবে আসা আমাদের ভাইদা যে ভালবাসার দিক দিয়ে এতোটা ভাগ্যবান, সেটা বুঝতে পেরে আমার এখন ভাইদাকে প্রচণ্ড হিংসে হচ্ছে মা। এমন দু’দুটো লক্ষ্মী প্রতিমার মত মেয়ে আমাদের ভাইদাকে এ’ভাবে ভালোবাসে যে তার সুখের জন্যেই এরা নিজেদের সুখ বিসর্জন দিতে রাজী”।

এবার নিরঞ্জনবাবু বললেন, “বড়বৌমা, সে তো তুমি একেবারে ঠিক কথাই বলেছ। মা বাপ মরা আমাদের পরিকে এমন দু’দুটো পরী যে আগলে রেখেছে, এ’ভাবে তার মঙ্গল কামনা করছে এ’সব কথা পরির মুখ থেকে শোনবার পরেও আমার যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। আজ প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম। কিন্তু মা, এখন তাহলে আমরা কি করব বলো তো? এদের মত আরেকটা পরী আমরা পরির জন্য কোত্থেকে খুঁজে বের করব এখন”?
 

হৈমবতীদেবী বললেন, “আমাদের প্রথম প্রয়াসটা যে ব্যর্থ হল, তা তো পরিস্কার বোঝাই গেল। এবার দ্বিতীয় প্রয়াসটাই না হয় করে দেখা যাক”।

সুলোচনা বললেন, “হ্যাঁ মা, সেই ভাল”।

হৈমবতীদেবী এবার সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “এ’কথাটা অবশ্য তোমাদের পিসো আগেই উত্থাপন করেছিলেন। কিন্তু তখন আমি তাতে বাধা দিয়ে তোমাদের দু’জনের ব্যাপারটা আগে খতিয়ে দেখলুম। কিন্তু তাতে কাজ তো হল না। এবারে সেই প্রসঙ্গে আসছি। আচ্ছা মন্তি, পরির মুখেই শুনেছি যে ওর নিজের জন্য পাত্রী পছন্দ করবার দায়িত্ব ও তোমাদের দু’জনকে দিয়েছে। আর তোমরাও নাকি ওর জন্যে একটা ভাল মেয়ে খুঁজেও পেয়েছ”।

এ’টুকু শুনেই সীমন্তিনী বলে উঠল, “এক মিনিট পিসি” বলে অর্চনার দিকে তাকিয়ে বলল, “অর্চু সোনা, আমরা সবাই তো এখানে বসে আছি। লক্ষ্মীদি একা বোধহয় হিমশিম খাচ্ছে রে। তুই একটু রান্নাঘরে গিয়ে দেখ না বোন”।
 

অর্চনা সীমন্তিনীর ঈঙ্গিত বুঝতে পেরে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ দিদিভাই, দেখছি আমি” বলে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী তখন বলল, “পিসি, তোমাদের তো ও’কথা আগেই বললুম। ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কোনও চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিইনি এখনও। একটা মেয়েকে আমাদের খুবই পছন্দ হয়েছিল। আমাদের মনে হয়েছিল মেয়েটা সত্যিই পরির উপযুক্ত। কিন্তু এমন কয়েকটা ব্যাপার আছে যা সাবেকি আর সম্ভ্রান্ত ঘরের লোকেরা মেনে নিতে পারবে না। হয়ত তোমাদের পক্ষেও সেগুলো মেনে নেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু সত্যি বলছি পিসি, আমরা তো আর আগে ভাবিনি যে পরির অভিভাবক হিসেবে কেউ এগিয়ে আসবেন, পরিকে কাছে টেনে নেবেন, ওর বিয়ের দায়িত্ব নেবেন। আমাদের চিন্তাধারা আমাদের মানসিকতার সাথে তোমাদের ভাবনা চিন্তার তফাৎ হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। তবে আমার আর নীতার চিন্তাভাবনা আর পরির চিন্তাভাবনা এবং মানসিকতার মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। আমি পরিকে প্রেমিক হিসেবে ভালবাসতে না পারলেও ও আমার জীবনের আদর্শ। আমার কর্মজীবনে ও আমার গুরু। আমি সব সময় ওকে অনুসরন করে চলতে চাই। ওর মত কাজ করতে চাই, ওর মত দক্ষ হতে চাই। তাই আমরা ভেবেছিলুম আমরা যাকে পছন্দ করব পরিও তাকে নিশ্চয়ই পছন্দ করবে। আর এ ব্যাপারে পরি আমাদের হাতেই সবটা ছেড়ে দিয়েছিল। তবে মেয়েটা নিজে এবং তার পরিবারের লোকেরাও প্রাথমিকভাবে আমাদের আবেদনে সাড়া দেয়নি। তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে আমরা রাজী করাতে সক্ষম হয়েছিলুম। কিন্তু মেয়েটার ব্যাপারে সকলের চোখে আপত্তিকর যে ব্যাপারগুলো আছে, সে’সব নিয়ে সবার আগে আমি পরির সাথে কথা বলেছিলুম। পরি সেদিন আমায় বলেছিল যে আমার আর নীতার যদি পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তার নিজের আর কিছুই ভাববার নেই। তখন আমি ওই মেয়ে এবং তার মা-বাবার কাছে পরির ব্যাপারে সবকিছু জানাই। পরি কি কাজ করে, কোথায় থাকে, কেমন ছেলে, ওর পরিবারে পরি নিজে ছাড়া দ্বিতীয় কোন প্রাণী বলতে কেউ নেই, ওর আত্মীয় পরিজন বলতেও কেউ নেই, বিয়ের পর স্বামী ছাড়া মেয়েটা আর কাউকে কাছে পাবে না, এ সবই যথাযথ খুলে বলেছি তাদের। পরি যে বছর সাতেক আগে একসময় নীতাকে ভালবাসত, তারপর আমাকেও যে সে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল, আর আমরা দু’জনের কেউই যে পরিকে বিয়ে করতে পারছি না অথবা চাইনি, এ’ সমস্ত কথাই আমি তাদের খুলে বলেছি। মেয়ের বাড়ির লোকেরা সে’সব কথা শোনবার পরেও এ বিয়েতে মত দেয়। পরে আলাদাভাবে মেয়ের মনের ইচ্ছেটাও আমি জানতে পেরেছিলুম। মেয়ের বাড়ির লোকদের সাথে সম্ভাব্য বিয়ের দিন তারিখ নিয়েও কিছু আলোচনা হয়েছিল আমার। কিন্তু কোনকিছুই সে’ভাবে ফাইনাল করিনি। আসলে আমার মনে হয়েছিল, পরি মুখে যা-ই বলুক না কেন, আমাদের হাতে সবকিছুর অধিকার তুলে দিলেও বিয়ের ব্যাপারে পাকাপাকি সিদ্ধান্ত নেবার আগে ও একবার মেয়েটাকে নিজের চোখে দেখে নিক। আমরা সেটার জন্যেই অপেক্ষা করছিলুম। সেদিন পরি যখন হঠাৎ করেই এখানে চলে এসেছিল তখন ভেবেছিলুম ও যদি দু’ তিনটে দিন এখানে থেকে যায়, তাহলে মেয়েটার সাথে ওর মুখোমুখি দেখা করিয়ে দেবার এবং কথা বলার সুযোগ করে দেব। কিন্তু ও তো মোটে একটা রাত কাটিয়ে পরদিন সকালেই চলে গেল। আর সেটা করবার সুযোগ আমি পাই নি। আর সেদিনই তো তোমাদের কথা শুনতে পেলুম। তখনই আমাদের ভাবনা চিন্তা সেখানেই স্থগিত রেখেছি”।

একটানা এতগুলো কথা বলে থামতে নিরঞ্জনবাবু বললেন, “আচ্ছা মা, তোমার সব কথা তো খুব মন দিয়েই শুনলুম আমরা। পরির মুখেও এ ব্যাপারে আমরা অনেকটাই শুনেছি আগে। তোমাদের দু’জনের কথায় কোনও অসঙ্গতি নেই। তাই বুঝতে পারছি যে পরি আমাদের যা বলেছে তার সবটাই ঠিক। আর তোমাদের আর আমাদের মধ্যে এক জেনারেশনের গ্যাপ আছে সেটাও সত্যি। তবে মা, আমি ও তোমার এই পিসি দু’জনেই কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চেষ্টা করি। আমার তিন ছেলের সাথেই আমি অনেকটা বন্ধুসুলভ আচরণই করে থাকি। অবশ্য বাড়িতে তো আমি খুব কম সময়ই কাটাই। রাতে ঘুমের সময়টুকু ছাড়া আমি দিনে মাত্র চার সাড়ে চার ঘন্টাই বাড়িতে থাকি। তাই আমাদের তিন বৌমাদের সাথে অতটা ফ্রি হয়ত হইনি। তবে আমরা কেউই বৌমাদের কাউকে ঘরের বৌ বলে ভাবি না। আর ওরা তিন জনই তাদের নিজেদের গুনেই আমাদের মেয়ে হয়ে উঠেছে ধীরে ধীরে। আর তাদের সকলের চিন্তাধারার সাথে আমাদের ভাবনা চিন্তার খুব একটা সংঘাত ঘটেনি কখনও। অবশ্য এর সবটাই যে আমাদের জন্যই হয়েছে তা বলা ভুল হবে। আমাদের পছন্দ অপছন্দ বুঝে বৌমারাও একই সমান প্রচেষ্টা করেছে। তাই ওরা সকলেই তোমার পিসির ছেলের বৌ থেকে তার মেয়ে হয়ে উঠেছে। সেটা হয়ত তোমরা এ মূহুর্তেই ঠিক বুঝতে পারবে না। তবে দু’চারদিন আমাদের বাড়ি গেলে তোমরা সেটা অনায়াসেই বুঝতে পারবে। তাই তোমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে আমাদের মনে হয় খুব বেশী কষ্ট হবে না”।
 

একটু থেমেই তিনি আবার বললেন, “তা মা, পরির ব্যাপারে তো মেয়ের বাড়ির লোকদের কাছে সব খুলে বলেছ এ তো বুঝলুম, কিন্তু মা, মেয়ের ব্যাপারে তো তুমি এখনও আমাদের কিছুই বললে না”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ পিসো, পরির মুখে তোমাদের বাড়ির অনেক কথাই আমরা শুনেছি। এমন একটা পরিবারের সকলেই ওকে আপন করে নিয়েছে শুনে আমরা সবাই খুব খুশী হয়েছি। তবে সত্যি বলছি পিসো, সে মেয়েটার ব্যাপারে তোমাদের সবকিছু খুলে বলতে আমার এখনও একটু দ্বিধাই হচ্ছে। আমার মন কেন জানিনা বলছে, এ সম্পর্ক হবার নয়। তবে তোমরা যখন জানতেই চাইছ তাহলে বলছি। মেয়েটা খুবই সুন্দরী। হাঁটা চলা, কথা বার্তা, আচার ব্যবহার অসম্ভব সুন্দর। পারিবারিক আর্থিক সঙ্গতি না থাকবার দরুন কলেজ কলেজের শিক্ষায় হয়ত বেশী এগোতে পারেনি, তবে নিজের মা-বাবার কাছে সাংসারিক সুশিক্ষা পেয়ে বড় হয়েছে। রান্নাবান্না সহ ঘরোয়া সমস্ত কাজেই খুব চৌকস। পরির সাথে বয়সের ফারাক প্রায় সাত বছরের মত হবে। হাইটের দিক দিয়েও দু’জনকে বেশ ভাল মানাবে। তবে ওর বাবার আর্থিক অবস্থা এখন আগের মত অতটা খারাপ না হলেও এখনও খুব একটা সচ্ছল বলা যায় না। দেনা পাওনা যৌতুক দেবার সামর্থ তাদের নেই। তবে আমার মনে হয় সেটা খুব আপত্তিজনক কিছু নয়। কারন আমি জানি, পরি নিজেও যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবে না। কিন্তু মেয়েটা লেখাপড়ায় মোটে মাধ্যমিক পাশ, এটা একটা বড় নিগেটিভ পয়েন্ট। পরির মত একজন আইপিএস অফিসারের স্ত্রী নিদেন পক্ষেও গ্র্যাজুয়েট হওয়া উচিৎ। তবে তার চেয়েও আপত্তিকর ব্যাপার যেটা, সেটা হল .....” বলে একটু থেমে নবনীতার মুখের দিকে একবার দেখে বলল, “মেয়েটা বিধবা”।


______________________________
 
Like Reply
(Update No. 244)

সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই ভেবেছিল ‘বিধবা’ শব্দটা শুনেই নিরঞ্জনবাবুরা সকলে আঁতকে উঠবেন। কিন্তু কাউকে চমকাতে না দেখে তারা নিজেরাই বরং অবাক হল। সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত ধরে সকলের মুখ দেখে নিজের মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি পিসি। তোমরা সবাই হয়ত এটাই ভাবছ যে পরির এত ঘণিষ্ঠ বন্ধু হয়েও এমন একটা বিধবা মেয়ের সাথে আমরা ওর বিয়ে দেবার কথা ভাবছি কি করে। আর সেজন্যেই আমি কথাটা বলতে সঙ্কোচ করছিলুম। আমার আগেই ধারনা হয়েছিল যে মেয়ের বাবার আর্থিক অসচ্ছলতা, মেয়েটার অল্পশিক্ষিত হওয়া এ’সব মেনে নিতে পারলেও এ আশঙ্কা ছিলই যে তোমরা ওর বিধবা হওয়াটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। হয়ত আমি আর নীতা দু’জনেই তাকে পছন্দ করেছি বলেই পরি এ বিয়েতে কোনও আপত্তি করেনি। কিন্তু কোনও ছেলের অভিভাবকই যে এটা মেনে নিতে রাজী হবে না, এটা আমরা আগেই বুঝেছিলুম। পরির মাথার ওপরে এতদিন অভিভাবক বলতে কেউ ছিল না। তাই ওর এমন কাজে বাধা দেবার কেউ নেই ভেবেই হয়ত আমাদের কথায় বিয়েতে রাজী হয়েছিল ও। কিন্তু এখন পরিস্থিতিটা পালটে গেছে। এত বছর বাদে তোমাদের কাছে পেয়ে, তোমাদের মতামত উপেক্ষা করে সে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকেই বিয়ে করুক, এটা আমরাও চাই না”।

সুলোচনা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “শোনো মন্তি, আমরা এ’সব কথা আগেই শুনেছি ভাই। তাই তোমার মুখ থেকেও যে একই কথা শুনব সেটা জানতুমই আমরা। তাই তোমরা মনে মনে যেমন আশা করেছিলে আমরা কেউই তেমন চমকে উঠিনি। তুমি তো আমাদের ভাইদাকে এ’সব কথা আগেই বলেছ। আর ভাইদার কাছ থেকে আমরাও যে সব কিছু শুনেছি তা তো আগেই বলেছি আমরা। কিন্তু ভাইদাকে বোধহয় তোমরা মেয়েটার পরিচয় জানাও নি। কারন আমাদের প্রশ্নের জবাবে সে ওই কথাই বলেছিল। তবে ভাই, এবার তোমাদেরকেও একটা কথা বলি। আমরা যেদিন ভাইদাকে প্রথম দেখেছি, আর যখন অনেকভাবে তাকে প্রশ্ন করে বুঝতে পারলুম যে সে দুটো মেয়েকে ভালবাসলেও নিজের জীবনসঙ্গী বানাবার মত কোন মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক নেই, ওই মূহুর্ত থেকেই আমরা তিন জা-ই চাইছিলাম যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা ভাইদার বিয়ে দেব। তোমাদের দাদারা আর মা-বাবাও আমাদের পূর্ণ সমর্থন করলেন। আর তখনই মা একটা মেয়ের কথা বলেছিলেন। আর চাইছিলেন যে ওই মেয়ের সাথেই ভাইদার বিয়ে দেবেন। কিন্তু আমরা সকলেই ওই মেয়েটার ব্যাপারে আগে থেকে জানলেও তাকে আমরা কেউ কখনও চোখে দেখিনি। কিন্তু চোখে না দেখলেও আমাদের বাড়ির সকলেই ওই মেয়েটাকেই ভাইদার জন্য পছন্দ করে ফেলেছিল। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কী জানো? ওই মেয়েটাও বিধবা”।

সুলোচনার কথা শুনেই নবনীতা আর সীমন্তিনী একসাথে চাপা চিৎকার করে উঠে বলল, “ওমা! সেকি”?

সুলোচনা এবার একটু হেসে আবার বললেন, “হ্যাঁ ভাই, ঠিক তাই। তবে আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। আমরা শুধু মেয়েটার নাম আর তার মা-বাবার পরিচয়টুকুই জানতুম। কিন্তু যেদিন মা মেয়েটার কথা বললেন, তার পরের দিনই ভাইদার মুখে শুনলুম যে তোমরাও তার জন্যে আগেই একটা মেয়েকে পছন্দ করেছিলে। আর তোমাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে তোমরা ভাইদাকে যা যা বলেছিলে, সে তার সবকিছুই আমাদের খুলে বলল। লক্ষ্য করলাম কাকতালীয় ভাবে ‘বিধবা’ শব্দটা দুটো মেয়ের সাথেই জড়িয়ে আছে। আর সেদিনই কালচিনি থেকে বিধুমামু মামী আর ভাইকে নিয়ে আমাদের ওখানে এলেন। সেদিন রাতেই বিধুমামুরা চলে যাবার পর পরই বাবা আমাদের ফ্যামিলি ডক্টর, ডক্টর বিশ্বাসের সাথে কথা বলে তার কাছ থেকে আরেক ডক্টরের ফোন নাম্বার যোগার করলেন। আর তার মিনিট পনেরো বাদেই আমরা জানতে পারলুম যে আমরা যে মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করেছিলুম সে মেয়েটাও আশ্চর্যজনক ভাবে বিধবা এবং কূমারী। কিন্তু মেয়েটার মা বাবার কাছে সম্মন্ধের প্রস্তাব নিয়ে যেতে আমাদের মধ্যে কেউই রাজী হচ্ছিল না, মানে ঠিক সাহসে কুলোচ্ছিল না আমাদের। এদিকে তোমরাও ভাইদার জন্য যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিলে তাকেও দেখা উচিৎ। আর ভাইদাও একদিন কথায় কথায় মুখ ফস্কে বলে ফেলেছিল যে আমাদের পছন্দের মেয়েটাকে তোমরা দু’জন পছন্দ না করলে সে ওই মেয়েকে বিয়ে করবে না। যেহেতু সে আগে থেকেই তোমাদের হাতে এ দায়িত্বটা তুলে দিয়েছিল, তাই তোমাদের মতামতটাও তার পক্ষে জরুরী। এদিকে দেখতে দেখতে সাত আটদিন কেটে গেল। আমরা আর সময় নষ্ট করতে চাইছিলুম না। তাই আজই আমরা আগাম কিছু না জানিয়েই তোমাদের এখানে চলে এসেছি”।

সুলোচনার কথা শুনে নবনীতা অবাক হয়ে সীমন্তিনীর দিকে চাইল। দেখল সীমন্তিনী মাথা নিচু করে গভীরভাবে কিছু একটা ভেবে চলেছে। নবনীতা এবার হৈমবতীদেবী আর নিরঞ্জনবাবুর দিকে চাইল। তাদের দু’জনের মুখেও চিন্তার ছাপ দেখতে পেল। মনে হল তারা দু’জনেই দম বন্ধ করে বসে আছেন। বেশ কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ। তারপর সীমন্তিনী খুব শান্ত গলায় বলল, “বড়বৌদি, একটা ছোট্ট প্রশ্ন করছি। সত্যি জবাব দেবে? তোমরা কি তোমাদের পছন্দের ওই মেয়েটাকে আজই প্রথম দেখেছ? বা বলা ভাল, দেখলে”?
 

সুলোচনা কোন জবাব না দিয়ে মুচকি হাসলেন। কিন্তু হৈমবতীদেবী এবার কৌতুকভরা গলায় বললেন, “অনেক হয়েছে তোমাদের লুকোচুরি খেলা। এবার এ’সব বন্ধ করো দেখি। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না, দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার” বলেই প্রায় চিৎকার করে উঠে দড়জার দিকে মুখ করে বললেন, “ওরে ও অর্চু। তুই গেলি কোথায় রে মুখপুড়ি”?
 

সীমন্তিনীও হেসে ফেলল। কিন্তু নবনীতা তখনও পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি। হৈমবতীদেবীকে এভাবে চেঁচিয়ে উঠতে দেখে সে আরও অবাক হল। শুধু নবনীতা বাদে ঘরে বসে থাকা সকলের চোখে মুখেই খুশীর ছোঁয়া। হৈমবতীদেবীর ওভাবে ডাক শুনেই অর্চনা পড়ি মরি করে ছুটে এসে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “কি হল পিসির? ও দিদিভাই পিসি ঠিক আছেন তো? তার কিছু .....” এটুকু বলতে বলতেই হৈমবতীদেবীর দিকে তাকিয়েই সে থেমে গেল।

নবনীতা এ’সব অপ্রত্যাশিত ঘটণা ঘটতে দেখে যেন আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে সীমন্তিনীর কাছে গিয়ে তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, “ও দিদি, কী হচ্ছে গো এ’সব? আমি তো এ’সবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পাচ্ছিনে গো”!

সীমন্তিনী হেসে বলল, “এখনও বুঝতে পারিস নি? এত বোকা নাকি তুই? আরে পিসিরাও যে পরির জন্যে আমাদের অর্চুকেই পছন্দ করেছেন রে বোকা”।

নবনীতা একলাফে সুলোচনার কাছে এসে তার দুটো হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, “ও বৌদি, দিদি কী বলছে? আমি যে বিশ্বাসই করতে পারছি না গো। তুমি বল না বৌদি, দিদি যা বলল সেটাই কি সত্যি”?

সুলোচনা হেসে নবনীতার হাত ধরে বললেন, “হ্যাঁ নীতা, মন্তি ঠিকই বলেছে”।

অর্চনাও গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে লজ্জায় সীমন্তিনীর পেছনে চলে আসতে সীমন্তিনী তাকে বলল, “আমার পেছনে যাচ্ছিস কেন সোনা? যা, এগিয়ে গিয়ে পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম কর”।

অর্চনা লজ্জায় যেন মাটির সাথে মিশে যেতে চাইল। কিন্তু হৈমবতীদেবী তার উদ্দেশ্যে বললেন, “অর্চু সোনা মা। আয় আমার কাছে আয় মা”।

অর্চনার মন চাইলেও তার পা দুটো যেন মেঝের সাথে আঁটকে গেছে। পা দুটোকে অসম্ভব ভারী বলে মনে হচ্ছিল তার। কিছুতেই যেন এগোতে পারছিল না। আর তার মনের মধ্যে হঠাতই যেন একটা ঝড় বইতে লাগল। এতদিন ধরে রচনা, নবনীতা আর সীমন্তিনীর মুখে পরিতোষের কথা শুনতে শুনতে, পরিতোষ কিভাবে রচনাকে বিপদমুক্ত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল, কিভাবে রচনা আর রতীশের ওপর সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছিল, এ’সব শুনতে শুনতে তার মনটাও যেন পরিতোষের ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ক’দিন আগে লোকটা যখন এখানে এসেছিল তখন তার সাথে যতটুকু কথা সে বলেছে তাতে তারও মনে হয়েছিল যে পরিতোষ সত্যিই খুব সুন্দর মনের একটা লোক। পরদিন সকালে পরিতোষ তাদের কালচিনির বাড়িতে পৌঁছোবার পর যা যা হয়েছে তাতে একদিকে সে মনে মনে যেমন খুশী হয়েছিল, অন্যদিক দিয়ে সে এটাও বুঝতে পেরেছিল যে তার দিদিভাই এতদিন ধরে যে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন সে প্রচেষ্টার সকারাত্মক পরিণতি বোধহয় আর হবে না। তবু সে পরিণতির কথা চিন্তা না করেও তার মন চাইছিল পরিতোষকে যেন তার পিসি আপন করে কাছে টেনে নেন। এ ভাবনা যে তার মনে কেন এসেছিল সেটা সে আগে বুঝতেও পারেনি। কিন্তু তার দিদিভাই অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসবার পর তার সম্মুখে সে যখন কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, তখন তার দিদিভাইই ধরে ফেলেছিলেন যে সে মনে মনে পরিতোষকে ভাল বেসে ফেলেছে। তখন সে নিজেও তার দিদিভাইয়ের কথা মনে মনে স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সে’সময়েই তার দিদিভাই তাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন মনে মনে আগেই কোন রঙিন স্বপ্ন যেন সে না দেখে। তার দিদিভাই যে তাকে যথার্থ উপদেশই দিয়েছেন এ ব্যাপারে তার মনে একবিন্দু সন্দেহও নেই। কিন্তু তার মনের আয়না থেকে পরিতোষের ছবিটাকে সে যেন কিছুতেই মুছে ফেলতে পারছিল না। পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা আসবার পরেও তার মনের শঙ্কা কিন্তু ধীরে ধীরে বেড়েই যাচ্ছিল। যে মূহুর্তে গেস্টরুমের আলোচনার সময় পরিতোষের পিসি পিসেমশাইরা তার দিদিভাই আর নবনীতাকে রাজী করাবার চেষ্টা করছিলেন, তখনও তার মনটা যেন দ্বিধাবিভক্ত ছিল। কিন্তু তার দিদিভাই আর নীতাদি যখন পরিস্কার ভাবেই সবাইকে জানিয়ে দিলেন যে তারা কোন অবস্থাতেই পরিতোষকে বিয়ে করবেন না, তখন অর্চনা ভেবেছিল, এবার বুঝি নিরঞ্জনবাবুরা তাদের পছন্দের মেয়েটার ব্যাপারে নীতাদি আর দিদিভাইয়ের সাথে আলোচনা করবেন। কিন্তু সেটা না করে যখন তারা এটা জানতে চাইলেন যে দিদিভাই আর নীতাদি মিলে কোন মেয়েটাকে পছন্দ করেছেন, তখন এবার তার কথা অবধারিত ভাবে উঠে আসবে ভেবেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছিল। তার মনে হচ্ছিল সে তখনই ও’ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়। আর তার দিদিভাইও নিশ্চয়ই এটাই অনুমান করেছিলেন। তাই তিনি লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার অজুহাত দেখিয়ে তাকে সে ঘর ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু রান্নাঘরে এসেও সে লক্ষ্মীদিকে সাহায্য করবার মত তেমন কিছুই করেনি। তার বুকের ভেতরটা একই ভাবে ধকধক করে যাচ্ছিল। তার মনের ভেতরটা যেন একনাগাড়ে উথাল পাথাল হচ্ছিল। তার উদ্বেগ এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তার মনে হচ্ছিল তার হৃৎপিণ্ডটা বুঝি তার গলা দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষের পিসি জোরে তার নাম ধরে ডেকে উঠতেই তার চিন্তাভগ্ন হয়েছিল। সে ভেবেছিল হৈমবতী দেবীর শরীরটা বোধহয় ভাল নেই। এটা ভেবেই সে ছুটে এসেছিল এ’ঘরে। কিন্তু এ’ঘরে ঢুকেই নবনীতা, সীমন্তিনী আর সুলোচনার কথা শুনেই সে বুঝে গিয়েছিল, যে গত সাত আটদিন ধরে সে মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখতে শুরু করেছিল, সেটা বোধহয় এবার বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। আর তখনই যেন দুনিয়ার লজ্জা এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল। নিজের লজ্জা লুকোতে সে আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তার দিদিভাইয়ের পেছনে গিয়ে নিজের মুখ লুকোতে চাইছিল। পিসির আহ্বানেও সে যেন আর নড়তে পারছিল না।

নবনীতা অর্চনার অবস্থা বুঝে নিজে এগিয়ে এসে অর্চনার একটা হাত ধরে তাকে টানতে টানতে বলল, “এসো অর্চু, পিসি, পিসো আর বৌদিকে প্রণাম করো”।

কিন্তু অর্চনা হঠাৎ করেই ও’পাশ দিয়ে ঘুরে সীমন্তিনীর পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসে তার কোলে মুখ গুঁজে দিয়ে ‘হু হু’ করে কেঁদে ফেলল। ঘরের আর বাকি সকলেই এটা দেখে অবাক হলেও সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নবনীতাকে বলল, “একটু দাঁড়া নীতা। ওকে দুটো মিনিট সময় দে। তুই তো বাড়ি ছিলিস না। বেচারী বিকেল থেকেই বড্ড টেনশনে ছিল রে। আমি বাড়ি এসে ওর মুখ চোখ দেখেই সেটা বুঝতে পেরেছিলুম। আর ওকেও তো কোনও দোষ দেওয়া যায় না। পিসিদের এখানে আসবার কথা শুনেই ও বুঝে গিয়েছিল যে পিসিরা এখানে কোন উদ্দেশ্যে আসছেন। আর আমরাও তো ভেবেছিলুম যে ওকে আর পরিকে নিয়ে আমরা এতদিন ধরে যা কিছু ভাবছিলুম তা বোধহয় আর বাস্তবরূপ নেবে না। ও নিজেও হয়তো তেমনটাই ভেবেছিল। আমিও একই আশঙ্কা করে সন্ধ্যের আগে পর্যন্ত ওকে নানা ভাবে বুঝিয়েছি যে পিসিরা যদি সত্যি অন্য কোনও মেয়ের সাথে পরির বিয়ে দিতে চান তাহলে ওকে নিজেকে সামলাতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। আর আমি ওকে সব সময় আগলে আগলে রাখব। কিন্তু গত সাতদিন ধরে ওর মনের মধ্যে যে ভাবনা তোলপাড় করছিল, সেটা ও মুখ ফুটে আমাদের কাউকে বলেনি। আমার মনে কিছুটা সন্দেহ হলেও কথাটা আমি তোকে বা ওকে বলিনি। কিন্তু মনে মনে আমিও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলুম। সন্ধ্যের সময়েই কথায় কথায় আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে আমার সন্দেহটাই সত্যি। ও মনে মনে পরিকে ভাল বেসে ফেলেছে। তাই ওকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলুম যে এখন থেকেই যেন মনে মনে কোন স্বপ্ন ও সাজিয়ে না বসে। এইটুকু জীবনে বিনাদোষে কম কষ্ট তো ও পায়নি। আমি চাইনি পরিকে ভালবেসে তাকে নিজের করে নিতে না পেয়ে ও আরেকটা কষ্ট পাক। এই মূহুর্তে হঠাৎ করেই ও বুঝে গেল যে ও মনে মনে যে স্বপ্নটা দেখেছিল, সেটাই সত্যি হতে চলেছে। তাই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। ওর ভেতরের সমস্ত উদ্বেগ সমস্ত আশঙ্কা এখন চোখের জল হয়ে বেরিয়ে আসছে। ওকে একটু সামলে নিতে দে”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে সুলোচনা উঠে এসে অর্চনার গা ঘেঁসে বসে বললেন, “পাগলী মেয়ে, তোমাকে না আমি আগেই বলেছি যে আমাকে তুমি বৌদি নয় দিদি বলে ডাকবে। সেটা কি এমনি এমনি বলেছি”?

অর্চনার দমকে দমকে কান্না দেখে মনে হল সুলোচনার কথা বুঝি তার কানেই যায়নি। এবার হৈমবতীদেবী এসে অর্চনার আরেকপাশে বসে দু’হাতে তাকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললেন, “কাঁদিস নে মা। একদম কাঁদিস নে। তুই তো জানিস না, দু’মাস আগে আমি যখন চুয়াল্লিশ বছর পর তোর বাবাকে দেখতে পেলুম, আর তার মুখে তোদের সকলের কথা শুনলুম, সেদিনই ভেবেছিলুম আমার যদি আরেকটা ছেলে থাকত, তাহলে তোকেই আমি তার বৌ করে আমার ঘরে নিয়ে আসতুম। ভগবান বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি দয়া করে পরিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু কুলীন ',ের মেয়ে হলেও চুয়াল্লিশ বছর আগেই তো আমি ', সমাজচ্যুত হয়ে গিয়েছিলুম। আর তোর বাবাও যে তোর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে রাজী হবেন এ ব্যাপারে আমার যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। আমি তো জানি, বিধবা বিবাহ এ যুগেও খুব সহজ ভাবে কেউ মেনে নিতে পারে না। আর তুই হলি একটা গোঁড়া ', ঘরের বিধবা মেয়ে। তাই গত সাত আটদিনে আমরা সকলে অনেক ভেবেও বিধুর কাছে আমার পরির জন্য তোর সম্মন্ধের কথা ওঠাবার সাহস জোটাতে পারছিলুম না। একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছিল, আর পরির বিয়ে নিয়ে আমাদের চিন্তা বাড়ছিল। শেষে মন্তি আর নীতার শরণাপন্নই হতে হল আমাদের। পরির মুখে এদের দু’জনের সাথে ওর সম্পর্কের সবকিছুই আমরা শুনেছি। পরি শুধু আমাদের একটা কথারই জবাব দেয় নি। অবশ্য সে’ কথাটার জবাব আমি এতক্ষণে পেয়ে গেছি। এখানে আসবার আমাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল মন্তি বা নীতা যে কোন একজনকে বিয়েতে রাজী করানো। সেটা যদি কোনভাবেই সম্ভবপর করে না তুলতে পারি তাহলে ওরা পরির জন্য আগে যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছিল, সে মেয়ের সাথেই পরির বিয়ে দেবার চেষ্টা করব। প্রথম উদ্দেশ্যটা সফল না হতে, ওদের কাছে ওই মেয়েটার ব্যাপারে যখনই জানতে চাইলুম তখনই মন্তি তোকে রান্নাঘরে পাঠিয়ে দিতেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে ওই মেয়েটা আর কেউ নয়, সেটা তুইই। অবশ্য এমন একটা ধারণা আমরা আগেও করেছিলুম, যখন শুনেছিলুম এই মন্তি মা-ই বিধুর মা অন্নপূর্ণা। তারপর তোর নাম উল্লেখ না করে মন্তি যা কিছু বলল তাতে আমাদের আর কারো বুঝতে বাকি রইল না। আমরা তো তোকে দেখার আগেই, শুধু তুই বিধুর মেয়ে বলেই, সকলেই তোকে পছন্দ করে ফেলেছিলুম। শুধু তোর বাবার কাছে প্রস্তাবটা দিতে পারছিলুম না। এখন বুঝতে পারছি, মন্তি সে কাজটা সেরে ফেলেছে। এবার তো আর ভাবনার কিছু রইল না। আমাদের অবশ্য তেমন কোনও লাভ হল না। আমি আগেও যেমন তোর পিসি ছিলুম তোদের বিয়ের পরেও তাই থাকব। তবে তফাৎ শুধু এটুকুই যে আগে এক তরফ থেকে পিসি ছিলুম, এখন দু’তরফেই পিসি হব। আয় না মা, এ খুশীতেই তোকে একটু আদর করি আমি”।
 

এবার আর অর্চনা নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। “পিসি” বলে হৈমবতীদেবীকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল। হৈমবতীদেবী অর্চনার গালে কপালে আর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বারবার তাকে কপালে আর গালে চুমু খেতে লাগলেন। এ দৃশ্য দেখে সীমন্তিনী নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। তার দু’চোখ বেয়েও জলের ধারা বইতে শুরু করল। নবনীতা তা দেখে সীমন্তিনীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “কাঁদছ কেন দিদি? আজ আমাদের কত বড় একটা খুশীর দিন বলো তো? আমাদের পরির সংসার গুছিয়ে দিতে পারছি আমরা। তোমার অর্চুসোনার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। আজকের দিনে এ’ভাবে চোখের জল ফেলতে আছে”?

নবনীতার নিজের চোখ থেকেও যে জলের ধারা নামতে শুরু করেছিল তা যেন সে বুঝতেই পারেনি সে। সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে নবনীতার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস। তুইও যে কাঁদছিস, সেটা বুঝতে পারছিস না পাগলী”?

নবনীতা চোখে জল নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “জানি তো দিদি। আমরা দু’জনেই কাঁদছি। এমন খুশীর খবর জানতে পারলে চোখ থেকে এমনিই জল বেরিয়ে আসে গো। তোমার চোখের জলও যে কান্নার অশ্রু নয়, সেটাও আমি জানি। কিন্তু এখন তো এভাবে বসে বসে কাঁদলে চলবে না। এ সুখবরটা যে সবাইকে জানাতে হবে গো”।

সুলোচনা অর্চনাকে ধরে হৈমবতীদেবীর থেকে আলাদা করতে করতে বললেন, “আয় বোন। আমিও একটু তোকে আদর করি” বলে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরলেন।

নবনীতা ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে বলল, “ও লক্ষ্মীদি, মিষ্টি কোথায় গো? শিগগীর বের করো। একটা প্লেটে সাত আটটা মিষ্টি বেড়ে দাও তাড়াতাড়ি”।

লক্ষ্মী নবনীতাকে ছটফট করতে দেখে অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে ছোড়দি? তুমি এমন করছ কেন”?
 

নবনীতা খুশীতে লক্ষ্মীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কী হয়েছে মানে? তোমার সোনাদির বিয়ে ঠিক হল গো। আর কার সাথে জানো? তোমার বড়দার সাথে গো”?

লক্ষ্মী বিস্ময়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি ছোড়দি? বড়দার সাথে আমার সোনাদির বিয়ে? সত্যি বলছ তুমি? আমার যে বিশ্বাসই হচ্ছে না গো”।

নবনীতা আগের মতই আনন্দোচ্ছল ভাবে বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি, সেজন্যেই তো বলছি তাড়াতাড়ি মিষ্টি নিয়ে ও’ঘরে এস। মিষ্টিমুখ করতে হবে তো। শাঁখ বাজাতে হবে। উলু দিতে হবে। ওঃ আমি তো উলু দিতে পারি না। তুমি উলু দিতে পার তো লক্ষ্মীদি”?
 

লক্ষ্মী একটা বড় প্লেটে মিষ্টি সাজাতে সাজাতে আনন্দের সাথে বলল, “হ্যাঁ ছোড়দি। পারি। তুমি তাহলে ঠাকুরঘর থেকে শাঁখটা নিয়ে ও’ঘরে যাও। আমি মিষ্টি আর জল নিয়ে যাচ্ছি”।

এদিকে ও’ঘরে সুলোচনা অর্চনাকে আদর করে চুমু খেয়ে বললেন, “যা বোন, মা বাবাকে প্রণাম করে তাদের আশীর্বাদ নে”।

অর্চনা ততক্ষণে অনেকটাই সামলে উঠেছে। সুলোচনার কথা শুনে সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী এগিয়ে এসে অর্চনাকে নিয়ে নিরঞ্জনবাবুর সামনে দাঁড় করাতে অর্চনা নিচু হয়ে হাঁটু মুড়ে নিরঞ্জনবাবুকে প্রণাম করল। তারপর হৈমবতীদেবী আর সুলোচনাকেও প্রণাম করল। তারা তিনজনেই অর্চনাকে আশীর্বাদ করবার পর সুলোচনা নিজের গলা থেকে মোটা ভারী একটা সোনার হার খুলে অর্চনার গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে বললেন, “এটাকে তোর বিয়ের আশীর্বাদী বলে ভাবিস না অর্চু। এটা আজ আমি তোর দিদি হিসেবে তোকে উপহার দিচ্ছি। আজ থেকেই তুই আমার ছোট বোন হয়ে গেলি কিন্তু। তাই তোকে এখন থেকে আর ‘তুমি তুমি’
 
করে নয়, ‘তুই’ বলে সম্বোধন করব”।


______________________________
Like Reply




Users browsing this thread: 4 Guest(s)