Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 174)

প্রায় ঘন্টা খানেক সবাই মিলে নানা ধরণের আলোচনা করবার পর কনভেনার বললেন, “মিঃ সান্যাল, ফার্ম হাউসের সিক্রেট চেম্বার খুলবার চাবিকাঠি হাতে এনে আপনি এমন একটা অসাধ্য সাধন করেছেন যেটা আমাদের দেশের সরকার বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেও গত দশ বছরেও কিচ্ছুটি করতে পারেনি। লোকটা অসম্ভব রকমের চালাক বলেই আমাদের আগের অপারেশনগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এমন একটা চেম্বার যে আছেই সেখানে এটা আমরা অনেক আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু কিছুতেই খুঁজে বের করতে পারিনি। এবার আপনার সাহায্যে আমরা মনে হয় সে অসাধ্য সাধনটা করতে পারব। আর অপারেশনটা সাকসেসফুলি কমপ্লিট করতে পারলে আপনি যে একটা বিশাল প্রমোশন পাবেন সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান। আমি আমাদের দেশের প্রায় সমস্ত বড় বড় শহরের এফিসিয়েন্ট পুলিশ অফিসারদের সাথে কাজ করেছি। আপনার ব্যাপারেও অনেক তথ্য আমাদের কাছে আছে। আপনি একটা বিশেষ মহলে পুলিশ রবিনহুড নামে খুব বিখ্যাত। কেন? সেটাও কিছু কিছু আমরা জানি। না না, আমরা আপনার কাজের কোনও সমালোচনা করতে এখানে আসিনি। বা আপনার কোর্ট মার্শাল করতেও বসিনি। আর তাছাড়া আপনার বিরূদ্ধে কোন প্রমাণ তো কোথাও অবশিষ্ট রাখেনই না আপনি। কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি আপনার মত স্মার্ট একজন পারসোনালকে মামুলী পুলিশ ডিপার্টমেন্টে ফেলে রাখাটা আমাদের দেশের পক্ষে খুবই লজ্জার কথা। আপনার মত এফিসিয়েন্ট অফিসারের স্থান অ্যাট লিস্ট ইন্টেলিজেন্সে তো হতেই পারে। তবে সেটা তো আমাদের কারুর হাতে নেই। তাই সে’কথা বরং থাক। আমি এ সভাকক্ষে যতজন হাজির আছেন, তাদের সকলের পক্ষ থেকে আপনার কাজের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ধারণা আগরওয়ালার বাড়িতেও এমনই কোনও সিক্রেট সেফ বা চেম্বার থাকতে পারে। যদিও আমরা এ ব্যাপারে হানড্রেড পার্সেন্ট সিওর নই। তবে ওই ফার্ম হাউসের চেম্বার থেকেই আমরা এতকিছুই পাব বলে আশা রাখছি যাতে ওই ক্রিমিনালটাকে লম্বা সময়ের জন্য জেলে পুড়তে পারব আমরা। আর তার সাথে অনেক নামী দামী আমলা নেতাও জালে ফাঁসবে। প্রচুর পরিমানে ব্ল্যাকমানিও যে পাব তাতেও কোন সন্দেহ নেই। তাই আমরা আর সময় নষ্ট না করে আগামী একসপ্তাহের ভেতরেই দক্ষিণেশ্বরের ওই ফার্ম হাউসের অপারেশনটা শেষ করে ফেলতে চাই। এ ব্যাপারে আপনার কি বক্তব্য”।

পরিতোষ একটুক্ষণ মনে মনে ভেবে বলল, “স্যার, আগরওয়ালার বাড়িতেও যে এমনই কোন সিক্রেট চেম্বার বা সেফ থাকতে পারে এমন একটা সম্ভাবনার কথা আমার মাথাতেও এসেছে। ওর বাড়ির ভেতরেও আমি অলরেডি আমার লোক ঢুকিয়ে দিয়েছি। কিন্তু কোনও পজিটিভ রিপোর্ট পাইনি এখনও। আমার লোক এখনও সেটার পেছনে লেগে আছে। কিন্তু ফার্ম হাউসের অপারেশনটা আমরা যদি আগেই করে ফেলি তাহলে ওই বাড়িতে আমার লোকের এন্ট্রি তো বন্ধ হয়ে যাবে স্যার। তখন তো আর কোন ইনভেস্টিগেশন করবার রাস্তাই থাকবে না আমার হাতে”।

অনেকেই পরিতোষের কথার সমর্থন করল। কনভেনার তখন বললেন, “আই আন্ডারস্ট্যান্ড মিঃ সান্যাল। তাহলে আমি আর মাক্সিমাম এক সপ্তাহ সময় আপনাকে দিতে পারি সেটা খুঁজে বের করবার জন্য। বাট নট মোর দ্যান দ্যাট। এর মধ্যে যদি আপনি সেটার হদিশ বের করে ফেলতে পারেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা হবেই। আর একান্তই যদি সেটা না পারেন তাহলে আই এম সরি, ফার্ম হাউসের অপারেশনটা কিন্তু আর পেছনো যাবে না। আজ ন’ তারিখ। ফার্ম হাউসের অপারেশনটা সতের তারিখে ফাইনাল করা হচ্ছে। এরমধ্যে যা পারেন করুন। বাড়িতে চেম্বারের হদিশ পেলে ওয়েল এন্ড গুড না পেলেও ফার্ম হাউসে যা পাওয়া যাবে সেটাই ওকে লম্বা সময়ের জন্য জেলে ঢোকাবে, এ ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই। ফার্ম হাউসের অপারেশনটা হবে ঠিক রাত আটটায়। কিন্তু আমরা তখন আপনাকে সাথে নিতে চাই না মিঃ সান্যাল। এটা আপনারই সেফটির কথা ভেবে বলছি আমি। আপনাকে আমি পুরোপুরি পিকচারের বাইরেই রাখতে চাই। এ’কথা অবশ্য আমি আগেই আপনাকে জানিয়েছি। অপারেশনটা লিড করবে দত্ত। তাই সিক্রেট চেম্বারে অ্যাকসেস পাবার আর ভেতরের সেফটা খোলার মোডাস অপারান্ডিটা আপনি ওকে নিখুঁত ভাবে বুঝিয়ে দেবেন প্লীজ। আর সেটা আজই। কারন দত্তর সাথে এটাই আপনার প্রথম ও শেষ দেখা। দত্ত, তুমি প্লীজ মিঃ সান্যালের কাছ থেকে ডিটেইলস গুলো খুব ভাল ভাবে বুঝে নাও। মনে রেখো আমাদের আগের পাঁচটা অপারেশন যে ব্যর্থ হয়েছে তা কিন্তু শুধু এই ব্যাপারটার জন্যই। ইউ মেক ইয়োরসেলফ ফুললি ক্লিয়ার এবাউট দা সিস্টেম অ্যান্ড প্রোসিডিওর। আমরা ওই নব গুলোর হদিশ আগেও পেয়েছিলাম। কিন্তু কাজের কাজটা হয়নি। এবারে আমরা সিক্রেট চেম্বারের দরজার হদিশ পেয়ে গেছি, তার লকের চাবি পেয়েছি। এমনকি সেফের চাবিটা পর্যন্ত মিঃ সান্যাল আমার হাতে দিয়েছেন। আমি চাই না এত সমস্ত লিড পাবার পরেও আমাদের অপারেশন এবারেও ব্যর্থ হোক। তবে সব থেকে ক্রিটিকাল পয়েন্টটা হচ্ছে ওই স্পেশাল সিকোয়েন্সটা ফলো করা। সেটা এতদিন আমাদের ধারণার বাইরেই ছিল। তবে এমন ধরণের কোন টেকনিকই যে সেখানে করা আছে সেটা আমরা সন্দেহ করতে পারলেও সেটা বুঝতে বা খুঁজে বের করতে পারিনি। এবারে মিঃ সান্যালের মাধ্যমে সে জিনিসটা আমরা জানতে পেরেছি। সেই সিকোয়েন্স মেইন্টেন করাটাই কিন্তু আসল কাজ। বাকি যা কিছু তা খুব সহজেই হয়ে যাবে। এখন তো সাতদিন আরও এক্সট্রা সময় পাচ্ছ। আজ তুমি মিঃ সান্যালের কাছ থেকে পুরো সিস্টেমটা খুব ভাল করে বুঝে নাও। আর কিপ ইট ইন ইয়োর মেমোরি। তুমি চাইলে সিস্টেমটা এক্সটারনাল কোনও ডিভাইসেও নোট করে রাখতে পার। তবে সেক্ষেত্রে তোমাকে কিছু এক্সট্রা প্রিকশান নিতেই হবে, এন্ড ইউ নো দ্যাট। তবে ইভরিথিং ইস আপটু ইউ অনলি। তোমার যেভাবে সুবিধে হবে তুমি সেটাই করতে পার। তবে এবারে যেন আর কোনও মিস্টেক আমরা না করে ফেলি। এবার ফুল রেসপনসিবিলিটি কিন্তু তোমারই। আর মিঃ সান্যাল আপনাকে বলছি, সতের তারিখেই কিন্তু অপারেশনটা হচ্ছে। ইটস ফাইনাল। সেভেনটিন্থ সেপ্টেম্বের শার্প এট এইট পিএম। ওই সময়টায় মানে সেদিন সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা থেকে রাত সাড়ে ন’টা অব্দি, আমি সাজেস্ট করব, আপনাকে ওই ফার্ম হাউসের লোকেশান থেকে অন্ততঃ দশ কিলোমিটার দুরে থাকতে। অবশ্য আমি জানি এ’কথা আপনাকে না বললেও আপনি আপনার সমস্ত অপারেশনে যেমন করেন এবারেও নিজেকে সমস্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রাখবেন। আমি আর এক মিনিটও এক্সটেন্ড করব না। কারন আগরওয়ালা তার অফিসের চেম্বার থেকে চাবিগুলো যে হাওয়া হয়ে গেছে সেটা যে কোনও সময় সে বুঝে যেতে পারে। তাহলেই আমাদের সব পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে। অন্যান্য বারের মত এবারেও আমরা বিফল হব। আমি সেটা কোনভাবেই বরদাস্ত করতে পারব না”।

পরিতোষ এবার একটু মুচকি হেসে বলল, “সেটা কি করে হবে স্যার? চাবিগুলো তো তার অফিসের সিক্রেট লকারে যথাস্থানেই আছে। আগরওয়ালা তো সেটা জানে। আজ দুপুরেও তো সে ওই চাবিগুলো নিয়ে তার ফার্ম হাউসে গিয়েছিল। আর তার স্ট্রং রুমে ঢুকে ওই সেফটাও খুলেছিল। আমার কাছে সে খবরও আছে। আর আগামী সতেরো তারিখেও সে আবার ওই সেফ খুলবে। এ খবরও একেবারে পাকা। কোন ভুল নেই তাতে। চাবিগুলো এই মূহুর্তেও আগরওয়ালার অফিসের লকারেই আছে”।

কনভেনার এবার হতাশ আর সাথে সাথে অবাক হয়েই প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, “ও মাই গড। আই এম ফিনিশড। তাহলে আর অপারেশন কী করে সাকসেসফুল হবে? কিন্তু তাহলে আপনি আমাকে কোন চাবিগুলো দিয়েছেন। আর কেনই বা দিয়েছেন? ওগুলো কি আমি ভাজা করে খাব”?

পরিতোষ শান্ত গলায় বলল, “ঘাবড়াবেন না স্যার। এত কাঁচা খেলা আমি খেলিনা। আসলে আপনার হাতে যে চাবিগুলো আছে সেগুলোই অরিজিনাল চাবি। আর এখন আগরওয়ালার অফিসের লকারে যে চাবিগুলো আছে সেগুলো এ চাবিগুলোরই ডুপ্লিকেট। লকার থেকে আমি যেদিন চাবিগুলো আমার হাতে পেয়েছিলাম তার পরের দিনই ডুপ্লিকেট চাবিগুলো আবার ওই লকারে রেখে দিয়েছি। সাত দিন তো দুর, আগরওয়ালা সাত জনমেও বুঝতে পারবে না যে তার ফার্ম হাউসের সিক্রেট চেম্বারের অরিজিনাল চাবি গুলো এখন আমাদের হাতে।“

ঘরের ভেতর প্রায় সকলেই যেন দমবন্ধ করে বসে ছিল এতক্ষণ। পরিতোষের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই যেন সকলে শ্বাস নিতে শুরু করল। কনভেনার নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে পরিতোষকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মাই গড! আই কান্ট বিলিভ ইট! ইউ আর রিয়েলি এ জিনিয়াস মিঃ সান্যাল। আপনার মত এমন এফিসিয়েন্ট কাউকে আমি আমার তিরিশ বছরের সার্ভিস লাইফে দেখিনি। আই এম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ। ইস আপনার মত একজনকে যদি আমার সমস্ত অপারেশনে সাথে পেতাম, তাহলে আমি বোধহয় দেশের টপমোস্ট সিক্রেট এজেন্ট হয়ে যেতাম। আই এম রিয়েলি রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ” বলে পরিতোষের পিঠ চাপড়াতে লাগলেন।

এমন সময় একজন একটু বিচলিত ভাবে বলে উঠলেন, “স্যার, বাইরে রাস্তায় কিছু গন্ডগোল হচ্ছে। একটা ব্লাস্ট হয়েছে। তবে সিচুয়েশন আন্ডার কন্ট্রোল”।

কনভেনার পরিতোষকে ছেড়ে নিজের চেয়ারের দিকে যেতে যেতে বললেন, “হতে দাও গিরি, হতে দাও। আই ডোন্ট কেয়ার এনিমোর। ওরা তো বিল্ডিংটাকে আগে থেকেই চেনে। মাঝে মধ্যে চারপাশে ঘোরাফেরা করে খবরাখবর নেয় এ তো আমরা জানিই। আজও যে এমন হতে পারে তা তো আমরা এক্সপেক্ট করেই ছিলাম। যা হচ্ছে হতে দাও। ও’সব টেক কেয়ার করবার লোক বাইরেই আছে। শুধু খবর নাও মিঃ সান্যাল বিনা ঝামেলায় তার বাইক নিয়ে চলে যেতে পারবেন কি না। আর হ্যাঁ, মিঃ সান্যাল যে রাস্তায় ফিরে যাবে, সে রাস্তায় আমাদের পেট্রোলিং বাড়িয়ে দাও। আমি চাই না এখন তার ওপর কোন ধরণের হামলা হোক”।
 

পরের আধঘন্টা অনির্বান দত্ত পরিতোষের সাথে একান্তে বসে ফার্ম হাউসের ব্যাপারটা নিখুঁত ভাবে বুঝে নিল। অন্যান্য সকলে আসন্ন অপারেশনের সাফল্য কামনায় ড্রিঙ্ক নিয়ে বসল। পরিতোষের জন্য স্পেশাল কফির বন্দোবস্ত করা হল। পরিতোষ যে মদ খায় না এ তথ্য এখানকার সকলেই জানে দেখা গেল।
 

আধঘণ্টা বাদে অনির্বানের কাছ থেকে ছুটি পেয়ে তারা কনভেনারের কাছে আসতেই কনভেনার নিজের চেয়ার থেকে উঠে পরিতোষের সাথে হ্যান্ডসেক করে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ সান্যাল। আপনার সাথে আমার আর বোধহয় দেখা হবে না। তবে অপারেশনটা সাকসেসফুলি শেষ করবার পর সম্ভব হলে একদিন আপনার সাথে অবশ্যই দেখা করব। তখন আপনাকে আমি আমার প্রাইভেট কন্টাক্ট নাম্বারটা দেব। মাঝে মাঝে কথা বলবেন আমার সাথে প্লীজ। আই উইল বি হ্যাপি। আর এ সাতদিনের মধ্যে যদি বাড়ির ব্যাপারে কোনও ক্লু বা ডকুমেন্টস খুঁজে পান তাহলে আপনাকে দেওয়া ওই নতুন মোবাইলটা থেকে দত্তকে ওভার ফোন কন্টাক্ট করবেন। পারসোনালি মিট করবার চেষ্টা করবেন না প্লীজ। আমাদের তরফ থেকে প্রয়োজনীয় কোনও নির্দেশ থাকলে সেটা আপনাকে আমরা সঠিক সময়ে জানিয়ে দেব। আর ভাল থাকবেন। আপনার মত এমন একজনকে আরও অনেক অনেক দিন দেশের সেবা করতে হবে”।

পরিতোষও তার হাতে ঝাঁকি দিয়ে বলল, “সো কাইন্ড অফ ইউ স্যার। তা এবার কি আমি যেতে পারি”?

কনভেনারও আবার হাত ঝাঁকি দিয়ে বললেন, “ওঃ, শিওর। ইউ আর ফ্রি নাউ। যান, আপনার বোন আপনার খাবার রেডি করে বসে আছে আপনার প্রতীক্ষায়। আর শুনুন, বাইরে গিয়ে এদিক ওদিক দেখাদেখি করবার দরকার নেই। আপনাকে যারা এসকর্ট করে এখানে এনেছিল তারা ছাড়াও এখন আরও কয়েকজন রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় আপনার সিকিউরিটির জন্য মোতায়েন করা আছে। তবে ঘাবড়াবার কিছু নেই। ইটস অনলি এ সিকিউরিটি মেজার। আর আমি জানি ইউ ও’ন্ট মাইন্ড ইট। থ্যাংক্স এগেইন অ্যান্ড গুড নাইট”।
 

পরিতোষও তাকে “গুড নাইট স্যার” আর বাকি সকলকে “গুড নাইট এভরিবডি” বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। অনির্বান দত্তও পরিতোষের সাথে বেরোল। লিফটে চড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসবার পর অনির্বান বলল, “স্যার, এবার আপনার ব্লুটুথটা আবার কানে লাগিয়ে নিন, আর আমার কন্টাক্ট নাম্বারটা নিয়ে নিন”।

পরিতোষ প্রথমে অনির্বানের নাম্বারটা তার প্রাইভেট মোবাইলে সেভ করে নিয়ে পকেট থেকে ব্লুটুথটা বের করে নিজের কানে লাগিয়ে নিতেই অনির্বান মেইন দরজাটা খুলে বলল, “গুড নাইট স্যার”।

পরিতোষও গুড নাইট বলে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এল। বাইরে রাস্তায় এসে এদিক ওদিক না তাকিয়ে নিজের বাইকের দিকে এগিয়ে গেল। বাইকে বসে হেলমেট পড়ে বাইকে স্টার্ট দেবার পরেই মনে হল আশে পাশেই কোথাও আরও কয়েকটা গাড়ি বাইক চলতে শুরু করেছে। সেও নিজের বাইক হাঁকিয়ে দিল ফেরার রাস্তায়। হেডলাইটের আলোয় দেখল দু’তিনটে ছোট আর মাঝারি গাড়ী রাস্তার একপাশে উল্টে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা গেল হাল্কা বা মাঝারি ধরণের বম্ব ব্লাস্ট হয়েছে।
 

আব্দুলের গ্যারেজের ভাঙা ঘরেই পোশাক পাল্টে নিজের ইউনিফর্ম পড়ে সে আব্দুলের সাথেই তাদের ঘরে গিয়ে যখন পৌছলো রাত তখন প্রায় সাড়ে ন’টা। প্রীতি পরিতোষকে কাছে পেয়ে ছোট্ট কিশোরীর মত খুশী আর চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। রাতের ডিনার সেরে প্রীতিকে প্রণাম করে আর ছোট্ট আপ্রীতকে অনেক অনেক আদর করে পরিতোষ আব্দুলের সাথে বেরিয়ে এল। নিজের গাড়িতে ড্রাইভিং সীটে বসে আব্দুলকেও পাশের সীটে বসিয়ে পরিতোষ বলল, “আব্দুল, সময় কাছে এসে গেছে। তোর সেকেন্ড অপারেশনটা সামনের সতের তারিখেই করতে হবে। আর সেটা করতে হবে সন্ধ্যে সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার ভেতর। তোর টিম রেডি আছে তো”?

আব্দুল বলল, “স্যার আমি আর আমার দুটো টিমের প্রত্যেকেই রেডি আছে। আমি তো শুধু আপনার ফাইনাল নোটিসের অপেক্ষাতেই ছিলাম”।
 

পরিতোষ একটু ভেবে নিয়ে বলল, “তোর প্রথম ভাগের কাজটা কিন্তু তার দু’তিনদিন আগেই করতে হবে। তার মানে হচ্ছে সেটা তোকে করতে হবে তেরো থেকে ষোলো তারিখের ভেতর। সুতরাং হাতে আর মোটে তিনটে দিন আছে। তুই বারো তারিখ সকালে আমার গাড়ী সারাই করবার অজুহাত নিয়ে আমার বাড়ি চলে আসবি। তখন তোকে জিনিসগুলো দিয়ে দেব। পরদিন থেকেই তোর এ টিমের কাজ শুরু করে দিবি। ফান্ডটা আদায় করবি সতের তারিখে। বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে সেটা করতে পারলে ভাল হয়। আর ফান্ডটা হাতে আসবার আধঘন্টার মধ্যেই তোর সেকেন্ড অ্যাকশনটা করবি। রাত আটটার ভেতরই যেন ডাঃ বড়ুয়ার হাতে চলে যায় কেসটা। আর সেখানেই স্পেশাল ব্রাঞ্চের পুলিশেরা এসে তাদের কাজটা করবে”।

আব্দুল খুব মন দিয়ে পরিতোষের কথাগুলো শুনে বলল, “কিন্তু স্যার, ওই হারামজাদার কাছ থেকে কি এক কোটিই আদায় করব না কম বেশী কিছু”?

পরিতোষ মনে মনে ভাবল, আজ রাতেই মন্তির সাথে কথা বলতে হবে। কালচিনীর বাড়ি তৈরী করতে কত টাকার এস্টিমেট বানানো হয়েছে সেটা এখনও সে জানতে পারেনি। তাই আব্দুলের কথার জবাবে সে বলল, “সেটা আমি বারো তারিখ সকালে যখন তুই আমার বাড়ি যাবি তখনই বলে দেব। আর ক্যাশটা সতের তারিখে তোর হেপাজতেই রাখবি। আঠেরো তারিখে আমি তোকে ফোন করে জানিয়ে দেব সেটা কখন কোথায় নিয়ে যেতে হবে”।
 

কথা শেষ হতেই পরিতোষের মোবাইল বেজে উঠল পকেটের ভেতর। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল “মুন ডার্লিং কলিং”। মানে সীমন্তিনীর ফোন। কিন্তু কলটা রিসিভ না করে সে রিজেক্ট করে দিয়ে ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বলল, “হ্যাঁ, বল, আর কিছু বলবি”?

আব্দুল একটু মাথা নিচু করে ভেবে বলল, “স্যার বলছিলাম যে সতেরো তারিখে ক্যাশটা না হয় আমার হিফাজতেই রাখব। আর পরদিন সেটা আপনার ডেরাতেও পৌঁছে দিতে পারব। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু স্যার, এমাউন্টের ব্যাপারটা যদি বারো তারিখের আগেই আমাকে জানিয়ে দিতে পারতেন তাহলে আমার পক্ষে একটু সুবিধে হত। মানে অপারেশনটার ফাইনাল শেপ দিতে একটু সুবিধে হত”।

পরিতোষ একটু চিন্তিত ভাবে বলল, “বুঝতে পেরেছি বুঝতে পেরেছি রে। কিন্তু আসলে হয়েছে কি জানিস, আমি তো ভেবেছিলাম ফার্স্ট স্টেজের কাজটা করতে অন্ততঃ মাস খানেক সময় লেগে যাবে। তাই ধীরে সুস্থে সব কিছুর ফাইনাল শেপ বানাতে পারব। কিন্তু কাজটা যে শেখরের টিম এত তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে পারবে সেটা একেবারেই ভাবিনি। আর ওদের কাজটা শেষ হয়ে গেছে বলেই সিক্রেট সার্ভিসের অফিসারেরা আর দেরী করতে চাইছেন না। তারা তো কাল পরশুর মধ্যেই তাদের অপারেশনটা করতে চাইছিলেন। আমার অনুরোধে তবু সাতদিন দেরীতে করতে রাজী হয়েছে। তাই আমার সবগুলো অপারেশন তাদের অপারেশন শুরু করবার আগেই শেষ করতে হবে। নইলে আমার উদ্দেশ্যটা পূর্ণ হবে না। তাই তাড়াহুড়ো করতে হচ্ছে আমাকেও। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করছি তোকে যত তাড়াতাড়ি সেটা জানিয়ে দিতে পারি। আচ্ছা এবার তুই ঘরে যা। আমিও রওনা দিই আর দেরী না করে। আজ রাতেই আমাকে আরও কয়েকটা ইম্পর্ট্যান্ট কাজ সারতে হবে”।


______________________________
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
(Update No. 175)

আব্দুলের গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে পরিতোষ অন্য রাস্তা দিয়ে ঘুরপথে চলল। কিছুটা দুর এসে পকেট থেকে মোবাইল বের করে সীমন্তিনীকে ফোন করল। রাত তখন প্রায় এগারোটা। সীমন্তিনী কল রিসিভ করতেই বলল, “সরি ডার্লিং। একটু আগে তোমার কলটা রিজেক্ট করতে বাধ্য হয়েছিলাম। একটু ব্যস্ত ছিলাম, তাই। ডোন্ট মাইন্ড। বলো কি জন্যে ফোন করেছিলে? এনিথিং সিরিয়াস”?
 

ও’পাশ থেকে অভিমানী গলায় সীমন্তিনী জবাব দিল, “বারে সিরিয়াস ব্যাপার ছাড়া আমি বুঝি তোমাকে ফোন করতে পারি না”?

পরিতোষ হেসে বলল, “আরে না না, তা কেন। তুমি তো আমার প্রেয়সী। চব্বিশ ঘন্টা আমার দ্বার আমার ফোন তোমার জন্যে খোলা। সে তো তুমি জানো ডার্লিং। আসলে খুব চাপে পড়ে গেছি গো। অনেকগুলো কাজ একসাথে এভাবে সামনে এসে পড়েছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা করি ভেবেই পাচ্ছি না। কিন্তু সবগুলোই সাত দিনের ভেতর কমপ্লিট করতে হবে। তাই অন্যদিকে মন সংযোগ করাটা আর হয়ে উঠছে না। আচ্ছা তোমার কথা শোনবার আগে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দাও তো ডার্লিং। কালচিনির বাড়ি তৈরীর এস্টিমেটটা কি হয়ে গেছে। কত পড়ছে খরচ তাতে”?
 

সীমন্তিনী একটু আমতা আমতা করে বলল, “না মানে, আমি যে ইঞ্জিনিয়ারকে সাইট দেখে এস্টিমেট বানাতে বলেছি উনি কালচিনির বাড়ির সাইটটা দেখবার পরের দিনই কলকাতা চলে গেছেন ব্যবসার কাজে। তেরো চৌদ্দ তারিখ নাগাদ হয়তো ফিরবেন। তারপর তার সাথে আমার মিটিং হবার কথা”।

পরিতোষ বলল, “ও নো। আচ্ছা উনি কি আনুমানিক আন্দাজেও কিছু বলেন নি”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “হ্যাঁ যেদিন সাইট দেখে এলেন সেদিন ফোনে তার সাথে আমার কথা হয়েছিল। তখন একটা আনুমানিক আন্দাজ করেই বলেছিলেন যে ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ লাখের মত লাগতে পারে। কিন্তু এতোটা কি তোমার পক্ষে ম্যানেজ করা সম্ভব পরি? সরি, আমি জানি পরি, আমি হয়তো তোমার ওপর বড্ড বেশী চাপ দিয়ে ফেলছি। কিন্তু আর যে কোন অল্টারনেটিভ আমার কাছেও খোলা নেই”।

পরিতোষ এবার প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “ও’সব ছেদো কথা ছাড় তো ডার্লিং। আচ্ছা এবার তুমি বল তো কি জন্যে ফোন করেছিলে আমায়”।
 

সীমন্তিনী একটু চুপ করে থেকে বলল, “দুটো কথা জানবার ছিল তোমার কাছ থেকে”।

পরিতোষ একটা বাঁক নিতে নিতে বলল, “তাড়াতাড়ি প্রথম কথাটা বলে ফ্যালো”।

সীমন্তিনী প্রায় সাথে সাথে জবাব দিল, “তুমি কি যোগা ইনস্টিটিউটের মালিক মহিমা মালহোত্রা সেনের কাছে যাবে বলে ঠিক করেছ”?

পরিতোষ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই জবাব দিল, “আগে ভেবেছিলাম, হয়ত প্রয়োজন পড়বে। কিন্তু যেসব টিমকে আমি কাজে লাগিয়েছি, তারা এমনভাবে কাজটা করেছে যে আপাততঃ আর ওই মহিমা মালহোত্রা সেনের সাথে দেখা না করলেও চলবে আমার। তবে মহিলাকে চাক্ষুষ দেখবার ইচ্ছে একটু আছেই মনে। এবার দ্বিতীয় কথাটা বলে ফ্যালো প্লীজ”।

সীমন্তিনী এবার কৌতুক ভরা গলায় বলল, “সেটা তোমাকে আগেই জানিয়েছিলাম। অবশ্য তুমি আমাকে এ ব্যাপারে ব্লাইন্ড সাপোর্ট আগেই দিয়েছ। তাই সে ব্যাপারে পরবর্তী আপডেটটা তোমায় জানাচ্ছি। একটু বাদেই তোমার কাছে একটা ছবি পাঠাচ্ছি। পছন্দ হয় কি না জানিও। আর সেটা তাড়াতাড়ি জানাবে প্লীজ”।

পরিতোষ প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “প্লীজ প্লীজ প্লীজ ডার্লিং। নট নাউ, নট নাউ”।

সীমন্তিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কী বলছ তুমি পরি? আমি আর নীতা দু’জনেই মেয়েটাকে পছন্দ করেছি। এখন তুমি তোমার কথা পাল্টে ফেলতে চাইছ”?

পরিতোষ এবারেও প্রায় সাথে সাথে বলে উঠল, “না না মন্তি, তুমি আমায় ভুল বুঝছ। আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছিনা একেবারেই। কিন্তু প্লীজ একটু বোঝার চেষ্টা করো ডার্লিং। সতেরো তারিখ অব্দি আমি নতুন অন্য কোন বিষয়েই মাথা ঘামাতে চাইছি না। আমি খুব বাজে ভাবে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি অনেকগুলো কাজ নিয়ে। কথাটা তো তোমাকে আগেও বললাম। তোমাকে দেওয়া কথা কি আমি ফিরিয়ে নিতে পারি কখনও? এই তুমি চিনলে এতদিনে”?

সীমন্তিনী এবার কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থাকবার পর বেশ সিরিয়াস গলায় জিজ্ঞেস করল, “পরি, কি হয়েছে বলো তো? তোমাকে এত টেনসড আমি কোনদিন দেখিনি। কি হয়েছে বলো না প্লীজ”।

পরিতোষ বলল, “ওকে ওকে, বলছি। কিন্তু তোমার টেনশন নেবার মত কিছু নেই। রিল্যাক্স। আসলে বিমল আগরওয়ালার ব্যাপারে যে ব্লু প্রিন্টটা বানিয়েছিলাম সে হিসেবে আশা করেছিলাম যে কাজটা শেষ হতে হতে ত্রিশ থেকে চল্লিশ দিন লেগে যাবে। মোট তিনটে ফেজ ছিল সেই প্ল্যানে। প্রথম ফেজেই সময় লাগবার কথা ছিল কুড়ি থেকে পঁচিশ দিন। কিন্তু প্রথম ফেজের এই কাজটা এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। আমার বাকি দুটো ফেজের কাজের সময়সীমা রেখেছিলাম বারো থেকে পনেরো দিন। কিন্তু আমার নিজস্ব তিনটে ফেজ ছাড়াও প্ল্যানে একটা ফোর্থ স্টেজ ছিল। তাতে কয়েকটা সেন্ট্রাল গভঃমেন্ট এজেন্সী ইনভল্ভড আছে। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে আমার ফার্স্ট স্টেজ কমপ্লিট হবার সাথে সাথে তাদের প্রয়োজনীয় এমন সব জিনিস আমার হাতে এসে পড়েছে যা ইডি, এসিবি, ক্রাইম ব্রাঞ্চ, আইটি ডিপার্টমেন্টের লোকেরা গত দশ বছর আগরওয়ালার পেছনে লেগে থেকেও নিজেদের আয়ত্বে আনতে পারেনি। তাই গত দশ বছরে পাঁচ বার হানা দিয়েও তারা বিমল আগরওয়ালার টিকিটি পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। এবার আমার হাতে তার মৃত্যুবান এসে গেছে। আর অমন মূল্যবান একটা জিনিস আমি নিজের কাস্টডিতে রাখবার সাহস সত্যি জুটিয়ে উঠতে পারিনি। আমি বাধ্য হয়েছিলাম এসিবির সাথে কন্টাক্ট করতে। ডকুমেন্টস গুলো তাদের হাতে দেবার সাথে সাথে কলকাতা থেকে দিল্লী পর্যন্ত হুলুস্থুল শুরু পড়ে গেছে। এখন এসএস আর সিবিআইও তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। ভেতরে ভেতরে নিশ্চয়ই আরো কিছু ব্যাপার আছে, নইলে সিবিআই, ইন্টেলিজেন্স বা সিক্রেট সার্ভিস এতে নিশ্চয়ই জড়াত না। তবে ও নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। তবে এই মাত্র ঘন্টা খানেক আগে আমি তাদের সাথেই এক জায়গায় সিক্রেট মিটিং করে এলাম। বিভিন্ন এজেন্সীর একত্রিশ জন সেখানে উপস্থিত ছিল। আগরওয়ালার মৃত্যুবানটা হাতে পেয়েই তারা সব প্ল্যান করে ফেলেছেন। তারা চাইছিলেন কাল পরশুর ভেতরেই বিমলের বাড়ি, অফিস আর ফার্ম হাউসে একসাথে রেড করতে। আমি যেহেতু তাদের সবচেয়ে বড় সাহায্যটা করেছি, আর তারা একটা ছোট্ট জিনিস এখনো তাদের হাতে পায়নি তাই হয়তো আমাকেও সে মিটিংএ ডেকেছিলেন। ওহ মাই গড! ইট ওয়াজ এ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। আনবিলিভেবল। কিন্তু সে কথা যাক, মোদ্দা কথা হল তারা ভাবছেন যে বিমলের বাড়িতেও অমন কোনও সিক্রেট চেম্বার বা সেফ থাকতে পারে যেখানে আরো কিছু বেআইনী ডকুমেন্টস থাকতে পারে। কিন্তু আমি জানি চতুর বিমল নিজের বাড়িতে তেমন কিছু করে নি। কিন্তু তারা যদি কাল পরশুর ভেতরেই অ্যাকশনে নেমে পড়ে তাহলে আমার বাকি দুটো ফেজের কাজ আর করা যাবে না। আর বলাই বাহুল্য, তখন আমাদের প্ল্যান মাঠে মারা পড়বে। তাই আমি তাদের সাথে একটু ফাউল প্লে করতে বাধ্য হয়েছি। তাদের কাছ থেকে সাতদিন সময় চেয়ে নিয়েছি। বলেছি যে সাতদিনের মধ্যে আমি তাদের কাছে বিমলের বাড়ির ব্যাপারে ফাইনাল রিপোর্ট দেব। তারা তাতে রাজী হয়েছেন। তাই সতেরো তারিখে বিমল আগরওয়ালা সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হচ্ছে। তারা সবাই জানে যে এই সাতদিন আমি বিমলের ঘরের ভেতরের খবর যোগাড় করব। কিন্তু আসলে এই সাত দিনের মধ্যে আমার পরের প্ল্যান গুলো সেরে ফেলাই আমার মূল উদ্দেশ্য। এখন সতেরো তারিখের আগেই আমার বাকি দুটো ফেজের কাজ গুটিয়ে ফেলতে হবে। আর সতেরো তারিখ সন্ধ্যের মধ্যেই আমার অপারেশন শেষ করতে বাধ্য হচ্ছি। তাই খুব তাড়াতাড়ি আমাকে এখন অনেকগুলো কাজ সারতে হচ্ছে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, আমি কতটা প্রেসারে আছি। এখন আমি রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করছি। আরও দু’ তিনটে জায়গায় আজই যেতে হবে। জানিনা, আজ সারা রাত হয়ত ঘুমোতেই পারব না। তাই বলছি ওই ছবি টবির ব্যাপারে আমাকে এই সাতটা দিন প্লীজ ইনভল্ভ কোর না। আর তাছাড়া আমাকে ছবি টবি পাঠাবার দরকারই বা কি আছে বলো তো? আমি তো আগেই তোমাকে বলেছি যে তুমি আর বনি যা সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটাই মেনে নেব। কেন তাহলে আর আমাকে আবার এইসব উটকো ঝামেলায় ফেলতে চাইছ বলো তো”?

সীমন্তিনী এবার পরিতোষের ব্যস্ততার ধরণ আর গম্ভীরতা বুঝতে পেরে বলে উঠল, “সরি পরি। আমাকে মাফ করো। আমি বুঝতে পারিনি যে তুমি এতোটা ব্যস্ত আছ। সেইসাথে আরেকবার সরি বলছি, আমার জন্যেই তুমি এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়েছ বলে। আই এম এক্সট্রিমলি সরি। আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে নাহয় তোমার সাথে পরে কথা বলব। কিন্তু পরি, তুমি প্লীজ সাবধানে থেক। আর রোজ তোমার ফুরসৎ মত একবার করে ফোন করো প্লীজ। নইলে আমরা সবাই খুব দুশ্চিন্তায় ভুগবো। আমি তোমার এত ব্যস্ততার মধ্যে তোমাকে ফোন করে আর বিব্রত করতে চাই না। সতেরো তারিখ পেরিয়ে যাবার পরেই আমি তোমাকে ফোন করব। ভালো থেকো পরি। আচ্ছা তুমি ডিনার করেছ তো”?

পরিতোষ সংক্ষেপে জবাব দিল, “হ্যাঁ করেছি। প্রীতিদির বাড়িতে খেয়েছি”।

সীমন্তিনী একটা নতুন নাম শুনে জিজ্ঞেস করল, “কোন প্রীতিদি”?

পরিতোষ তখন বলল, “সেটা পরে বলব ডার্লিং। আজ সময় নেই। গুড নাইট”।

পরিতোষ গুড নাইট বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফোন পকেটে পুরে রাখল। অনেকক্ষণ পর এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে আবার কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “তোমার সাথে কিছু জরুরী কথা আছে। এখন আমি তোমার বাড়ির খুব কাছেই আছি। তুমি ফ্রি আছ”?

ও’পাশের কথা শুনেই সে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ি লক করে একদিকে হেঁটে চলল। প্রায় তিরিশ পঁয়ত্রিশ মিটার হেঁটে যাবার পর সে একটা বাড়িতে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর সে সেখান থেকে বেরিয়ে গাড়িতে বসেই আবার শেখরকে ফোন করে বলল, “শোন, আগামী পরশু মানে এগারো তারিখ আমার সাথে তোরা দু’জন ডিনার করবি। আমি কোথায় ডিনার করি তা তো জানিসই। রাত ঠিক ন’টায় চলে আসবি সেখানে। কাউন্টারে আমার নাম করে বলবি। ওরা তোকে দোতলায় একটা রুমে নিয়ে যাবে। সেখানে আমার জন্য ওয়েট করিস। আমি সময়মত সেখানে চলে যাব। আর ডকুমেন্ট গুলো ভালো করে একটা গিফট প্যাকে নিয়ে আসবি। অবশ্য তার আগে পুরোপুরি ভাবে ভেরিফাই করে নিবি সিডি গুলো। কারন ওগুলো ভেরিফাই করবার মত সময় আর আমার হাতে থাকবে না। আর প্রত্যেকটা সিডির ওপর মার্কার পেন দিয়ে এক একটা কোড লিখে দিবি। আর একটা সাদা কাগজে কোন কোডের কি মিনিং সেটা লিখে সে কাগজটাকেও গিফট প্যাকের ভেতরে ঢুকিয়ে দিবি। খেয়াল রাখিস আব্দুলের যেন বুঝতে অসুবিধে না হয়। আর পরশু রাত ঠিক ন’টা। মনে রাখবি, ঠিক আছে”?
 

কথা শেষ করে ঘড়িতে সময় দেখল, রাত বারোটা পঁচিশ। চুপ করে আরও মিনিট দুয়েক ভেবে সে গাড়ি স্টার্ট করে ইউ টার্ন নিল। কিন্তু না, তার বাড়ির উদ্দেশ্যে নয়। তার গাড়িটাকে যখন তার বাড়ির সামনে দেখা গেল রাত তখন প্রায় তিনটে। ঘরে ঢুকে ড্রেস বদলে ঢকঢক করে দু’গ্লাস জল খেয়ে অগোছালো বিছানার ওপরেই শুয়ে পড়ল সে।


*******************
 
(To be cont'd ......)
______________________________
ss_sexy
Like Reply
(Update No. 176)

এলার্মের শব্দে পরিতোষের ঘুম ভাঙতেই সে প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল। তড়িঘড়ি বাথরুমের কাজ সেরে কিচেনে গিয়ে চট করে এক কাপ চা বানিয়ে তার অগোছালো ড্রয়িং রুমের সোফায় বসেই নিজের প্রাইভেট মোবাইল থেকে বিট্টুকে ফোন করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর তারপর সাড়া পেতেই বলল, “গুড মর্নিং বিট্টু, পরিতোষ হিয়ার”।

বিট্টু খুব উৎফুল্লিত স্বরে জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা গুড মর্নিং। কিন্তু কি ব্যাপার, অনেক দিন ধরে আমাদের বাড়ি আসছেন না তো”?

পরিতোষ বলল, “যাব রে যাব। আসলে এত কাজের চাপ পড়েছে না, কি বলব তোকে? আচ্ছা মাসিমার শরীর কেমন আছে রে”?

বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা মোটামুটি ভালই আছেন। কালও আপনার কথা বলছিলেন যে আপনি অনেকদিন আসছেন না”।

পরিতোষ বলল, “এ সপ্তাহটা খুব বিজি আছি রে। মাসিমাকে বলিস পরের সপ্তাহে কোন একদিন অবশ্যই যাব। আচ্ছা ভাই, আমার ছোট্ট একটা কাজ করে দিবি প্লীজ”।

বিট্টু বলল, “এমন করে কেন বলছেন দাদা? বলুননা কি করতে হবে? তবে আমার তো কলেজ আছে, সে তো আপনি জানেনই”।

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আরে সে তো জানিই। তোকে কলেজ কামাই করতে হবে না। ইন ফ্যাক্ট তোকে কোথাও যেতেও হবে না। শুধু দুটো ফোনেই কাজটা সারতে পারবি। আসলে আমি নিজে ফোনটা করতে চাইছি না। বুঝিসই তো আমাকে কত ভাবে কত কী করতে হয়”।
 

বিট্টু সাথে সাথে বলল, “বুঝেছি দাদা। আপনি এবার কাজের কথাটা বলুন দেখি”।

পরিতোষ বলল, “তোকে আমি এখনই ডঃ দিব্যেন্দু বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বার এসএমএস করে পাঠাচ্ছি। উনি একজন সার্জন। তুই এখনই তাকে ফোন করবি। আর তাকে বলবি এক পেশেন্টের অপারেশনের ব্যাপারে তুই তার সাথে একটু কনসাল্ট করতে চাস। কথায় কথায় জানতে চাইবি যে তার অফ ডে কবে, আর অফ ডেতে উনি বাড়িতেই থাকেন না অন্য কোথাও, সেটা জানতে হবে। আর কবে কোন সময় তার বাড়িতে তাকে পাওয়া যায়। আসলে আমি আজ বা আগামীকালের মধ্যেই তার সাথে তার বাড়িতে দেখা করতে চাই। তাই এ দু’দিনের মধ্যে ঠিক কোনসময় ওনাকে বাড়িতে পাব সেটাই আমি জানতে চাইছি। কিন্তু আমি নিজে এটা তার কাছ থেকে জানতে চাইছি না, একটু অসুবিধে আছে বলেই তোকে বলছি। এটুকু খবর নিতে পারবি না একটু বুদ্ধি করে”?

বিট্টু এক মূহুর্ত চুপ করে থেকেই বলল, “খবর তো যোগাড় করতে পারব। কিন্তু দাদা, অনেক ডাক্তারই তো ফোন কল ধরতেই চায় না। আর আমার নাম্বার তো তার কাছে আননোন। আননোন নাম্বারের কল যদি উনি রিজেক্ট না করে দেন তাহলে খবর আমি নিতে পারবই”।

পরিতোষ এবার অনুনয়ের সুরে বলল, “তুই এখনই একবার কল করে দেখ না ভাই। একবারে কল রিসিভ না করলে দু’ তিনবার ট্রাই কর। তারপরেও যদি রেসপন্স না পাস তাহলে আমাকে জানাস। আমি অন্য ব্যবস্থা করব তখন। তবে ব্যাপারটা খুব আর্জেন্ট। তাই এখনই কাজটা করিস”।

বিট্টু বলল, “ঠিক আছে দাদা, আপনি এসএমএসটা পাঠিয়ে দিন, আমি দেখছি”।

পরিতোষ আর কথা না বলে ফোন কেটে দিয়ে সাথে সাথেই ডঃ বড়ুয়ার কন্টাক্ট নাম্বারটা অভিকে এসএমএস করে দিল। তারপর তাড়াহুড়ো করে ঘরোয়া পাজামা পাঞ্জাবী পড়েই পার্সোনাল মোবাইলটা পকেটে নিয়ে সে ঘরে তালা মেরে সামনের গুমটি চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। সেখানে ডালপুরি দিয়ে সকালের ব্রেকফাস্ট করতে করতে বিট্টুর ফোন এল। বিট্টু বলল, “দাদা, কথা হয়েছে। প্রতি সোমবার নাকি তার অফ ডে। তাই আজ ওনার হাসপাতাল ডিউটি নেই। কায়দা করে জেনে নিয়েছি আজ সারাদিন উনি বাড়িতেই থাকবেন। অবশ্য সন্ধ্যের দিকে বৌ আর মেয়েকে নিয়ে একটু শপিংএ যাবার সম্ভাবনাও আছে, এমনটাই বললেন”।
 

পরিতোষ মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ বিট্টু। তুই সত্যি দারুণ উপকার করলি রে ভাই। আচ্ছা, নেক্সট উইক তোদের বাড়ি আসছি। এখন রাখছি কেমন? বাই”।
 

ফোন কেটে আরেককাপ চা খেতে খেতে ভাবল রচনাকে ফোনটা করা যাক। কিন্তু পরের মূহুর্তেই মনে হল না সেটা হয়ত ঠিক হবে না। রচনা তাকে চিনলেও এভাবে এ উদ্দেশ্য নিয়ে ফোন করলে তার অস্বস্তি হতে পারে। একবার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সাতটা পঞ্চান্ন। তার মানে মন্তি এখনও কোয়ার্টারেই থাকবে হয়ত। এ’কথা মনে হতেই আর এক সেকেন্ড সময় নষ্ট না করে সে সীমন্তিনীকে ফোন করল। তিনবার রিং হতেই ও’পাশ থেকে সীমন্তিনীর সাড়া পেয়ে পরিতোষ বলল, “গুড মর্ণিং ম্যাডাম। বাড়ির বাইরে চায়ের দোকানে বসে তোমাকে ফোন করছি। বেশী লম্বা ডিসকাশনের সময় নেই। আমি যদি বৌদিকে মানে তোমার রচু সোনাকে আজ বিকেলে আমার সঙ্গে কোথাও নিয়ে যাই, তাহলে তোমার আপত্তি আছে”?
 

সীমন্তিনী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “হোয়াট? তুমি রচুকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যাবে... মানেটা কী”?

পরিতোষ গলায় অধৈর্যের সুর এনে বলল, “প্লীজ কোনও কাউন্টার কোয়েশ্চেন করো না। আই অ্যাম রানিং শর্ট অফ টাইম। শুধু যা জানতে চাইছি, সেটার জবাব দাও প্লীজ”।

সীমন্তিনী তবু কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকবার পর বলল, “ওকে ওকে, অবশ্যই নিয়ে যেতে পার। কিন্তু এ ব্যাপারে একটুও হিন্টস দেবে না”?

পরিতোষ সে’ কথার জবাব না দিয়ে বলল, “ওকে, দেন প্লীজ ডু মি এ ফেভার। তুমি বৌদিকে ফোন করে জানিয়ে দাও যে আমি দুপুরের পর যে কোনও সময় তার ওখানে যাব। আর তাকে একটু তৈরী হয়ে থাকতে বোলো। তাকে বোলো যে আমার এক ডাক্তার বন্ধু আর তার বৌ এবং মেয়ে আমার বৌদিটাকে মানে তোমার রচু সোনাকে দেখতে চেয়েছে বলেই আমি তাকে সেখানে নিয়ে যাচ্ছি। নাথিং সিরিয়াস,ওকে? ও হ্যাঁ, তোমার দাদাভাইকেও জানিয়ে রেখো ব্যাপারটা। ফিরে আসতে একটু রাত হতে পারে। ওনার চিন্তা হতে পারে। তাই জানিয়ে রাখা ভাল। আর বৌদি আমার সাথে যেতে রাজী আছেন কিনা বা যাবেন কি না, এটা আমাকে কনফার্ম করো অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল, বাট পজিটিভলি বিফোর নুন। আর বাকি কথা পরে হবে, ওকে”?

কথা শেষ করেই চায়ের বিল মিটিয়ে বাড়ি অভিমুখে চলল।
 

******************

পরিতোষ ফোন কেটে দেবার আধঘণ্টা বাদে যখন সীমন্তিনীরা তিনজনে মিলে ব্রেকফাস্ট করছিল তখনই রচনার ফোন এল, “গুড মর্নিং দিদিভাই”।

সীমন্তিনী অর্চনা আর নবনীতার দিকে এক নজর দেখে হেসে বলল, “গুড মর্নিং, রচু সোনা” বলে ফোনটা অর্চনা আর নবনীতার দিকে এগিয়ে ধরতে তারা দু’জনেও “গুড মর্নিং রচু” আর “গুড মর্নিং বৌদি” বলতে সীমন্তিনী ফোনটা স্পীকার মোডে দিয়ে টেবিলে রেখে বলল, “সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছি বলে ফোনটা স্পীকারে রাখলুম রে। অর্চু আর নীতাও তাহলে তোর কথা শুনতে পারবে। তাই আজেবাজে বেফাঁস কিছু বলে ফেলিস না যেন। দাদাভাই নিশ্চয়ই চলে গেছেন। তুই সকালের খাবার খেয়েছিস”?

রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, খেয়েছি। এখন চা খেতে খেতে কথা বলছি। আর তোমার দাদাভাই তো রোজকার মতই সকাল পাঁচটায় বেরিয়ে গেছেন”।
 

সীমন্তিনী বলল, “তা খবর টবর কি? সব ঠিক ঠাক চলছে তো”?

রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সব ঠিকই আছে। কিন্তু বাড়ির জন্যেই মনটা ক’দিন ধরে খুব টানছে গো। কতদিন দেখিনি কাউকে।”

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “কোন বাড়ির কথা বলছিস? কালচিনির”?

রচনা বলল, “কালচিনির জন্যে ভাবিনে গো দিদিভাই। কালচিনির সব দায়িত্ব তো তুমিই নিয়েছ। তাই ও বাড়ি নিয়ে আমি একদম ভাবি না। রাজগঞ্জের জন্যেই মনটা খারাপ লাগছে। বিশেষ করে মেজদাভাই, সূর্য্য চঞ্চু আর চন্দুর জন্য। অবশ্য সূর্য্য তো এখন ভূবনেশ্বরে। কিন্তু বড্ড ইচ্ছে করছে গো চন্দুটাকে একটি বার দেখতে” বলতে বলতে রচনার গলাটা ভারী হয়ে এল।
 

সীমন্তিনী রচনাকে আশ্বস্ত করতে বলে উঠল, “মন খারাপ করিসনে সোনা বোন আমার। এই তো আর মাত্র ক’টা দিনের ব্যাপার। সামনের মাসেই তো পূজো। তখন তো তোরা বাড়ি যাবিই”।

রচনা একটু খেদের সাথে বলল, “হ্যাঁ, যাব তো ঠিকই, কিন্তু তোমার দাদাভাই কি বলছেন জানো? উনি বলছেন সপ্তমীর দিন গিয়ে দশমীর পরের দিনই নাকি আমাদের চলে আসতে হবে। উনি নাকি তার ম্যাডামের কাছ থেকে এর বেশী ছুটি চাইতে পারবেন না। এখন তুমিই বল তো দিদিভাই, যেতে আসতেই তো দুটো দিন বরবাদ হয়ে যাবে। তার মানে ওখানে শুধু তিনটে দিন থাকতে পারব। এতে কি মন ভরে বলো তো? এতদিন বাদে গিয়ে ......”

সীমন্তিনী আবার সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তুই মন খারাপ করিস নে। আমি এ ব্যাপারে দাদাভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখব। কিন্তু তোর যখন এত খারাপ লাগে তখন বিকেলের দিকে দাদাভাইকে নিয়ে একটু ঘুরতে টুরতে তো যেতে পারিস। কলকাতায় কত জায়গা আছে ঘোরবার। একটু এদিক ওদিক গেলে মনটা তো ভাল হবে”।

রচনা বলল, “মাঝে মাঝে তো যাই দিদিভাই। এটা ওটা সংসারের জিনিস কিনতে তো বেরোই আমরা”।

সীমন্তিনী বলল, “আরে মার্কেটিং করাকে কি আর ঘোরা বলে, বোকা মেয়ে কোথাকার। বেলুর মঠ, দক্ষিণেশ্বরের ভবতারিণী মন্দির এ’সব তো তোদের ওখান থেকে বেশী দুরে নয়। ও’সব জায়গায় গেলে কত ভাল লাগে। দাদাভাই তো এখন দুপুরের পর থেকে পুরো ফ্রিই থাকে। কোনকোনও দিন তো দিনের বেলার প্রেমটা স্থগিত রেখে দুটিতে মিলে ও’সব জায়গায় যেতে পারিস। দেখবি গিয়ে ....”
 

রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ইস দিদিভাই, তুমি কী গো? এসব কথা বলতে আছে? ছিঃ ছিঃ। দিদি, নীতাদি সবাই তো শুনছে। এ মা”।

সীমন্তিনী একবার অর্চু ও নীতার মুখের দিকে চেয়ে দেখল তারা দু’জনেই ঠোঁট টিপে আসছে। চোখের ঈশারায় তাদের চুপ করে থাকতে বলে ফোনের কাছে মুখ এনে বলল, “ঈশ, মেয়ের লজ্জা দেখ। যেন আমার শাশুড়ি মা। আরে তুই যে আমার বৌদি, বোন, বান্ধবী সবকিছু এ’কথা অর্চু আর নীতা দু’জনেই জানে। বৌদি বান্ধবীর সাথে এ’সব কথা বলব না তো কার সাথে বলব? আচ্ছা আচ্ছা, তোকে আর লজ্জা দেব না। কিন্তু আমি যেমন বলছি, তেমন একবার গিয়েই দেখ না। আমি নিশ্চিত জানি দক্ষিনেশ্বর গেলে তোর খুব ভাল লাগবে। একবার গেলে পরে বারবার যেতে চাইবি, দেখিস। এছাড়া আশে পাশে কত পার্ক টার্কও আছে। সেখানে ছোট ছোট বাচ্চারা ছাড়াও স্বামী-স্ত্রীরা, প্রেমিক প্রেমিকারা কত মজা করে গিয়ে। এই বয়সে ও’সব জায়গায় গিয়েই সবাই এনজয় করে। দাদাভাইকে নিয়ে মাঝে মাঝে যেতেই তো পারিস”।

রচনা এবার নকল রাগের ভাণ করে বলল, “ছাড়ো তো তোমার ফালতু কথা। ও’সব করবার কোন দরকার নেই আমার। আমি শুধু আমার কাছের মানুষগুলোর মুখ দেখতে পেলেই খুশী। আর কিচ্ছু চাইনে আমি”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “তুই একটা কী যে না, উঃ, তোকে আর মানুষ করতে পারলুম না আমি। আচ্ছা শোন, আজ বিকেলে বরং কোথাও ঘুরে আয়। যা মনটা ভাল লাগবে”।

রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা! আজ বিকেলে আবার কোথায় যাব”?

সীমন্তিনী বলল, “এক কাজ কর। আমি পরিতোষকে বলে দিচ্ছি। ও নাহয় তোকে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে। কিরে? যাবি তো? না কি পরিতোষের সাথে ঘুরতে যেতে তোর মনে কোন দ্বিধা আছে”?

রচনা প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “পরিতোষদা! পরিতোষদা আমায় নিয়ে ঘুরতে যেতে চায়? আর উনি যে ব্যস্ত সমস্ত মানুষ, তার কি অমন সময় হবে”?
 

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “ও তোকে নিয়ে যাবে কিনা বা ওর সে সময় হবে কিনা বা ও চায় কিনা, সেটা ছেড়ে তুই এটা বল, তার সাথে যাবি তো? না ভয় পাচ্ছিস”?

রচনা একটু সময় কিছু একটা ভেবে বলল, “পরিতোষদার সাথে বেরোতে আমার কোন সঙ্কোচ নেই দিদিভাই। কিন্তু সত্যি করে বলো তো? তোমার কি অন্য কিছু প্ল্যান আছে? তুমি কি পরিতোষদাকে ওই ব্যাপারে কিছু বলেছ নাকি”?
 

সীমন্তিনী খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “দুর পাগলী, অন্য প্ল্যান আবার কি থাকবে। আর শোন, এখন ওসব আলতু ফালতু কথা বলবি নে একদম, বুঝেছিস তো? পরিকে আমি কিছুই বলিনি এখনও। তুই সারাটা দিন ঘরে একা একা বসে থাকিস। আবোল তাবোল ভাবিস, তাই বলছি। তুই যদি রাজি থাকিস, তাহলে আমি এখনই পরিতোষকে বলে দেব”।
 

রচনা একটু কিন্তু কিন্তু করে বলল, “না গো দিদিভাই। সেটা ঠিক হবে না বোধহয়। আমি তো আজ অব্দি তোমার দাদাভাই ছাড়া অন্য কোন লোকের সাথে কোথাও বেরোইনি। তাই কেমন কেমন যেন লাগছে। আর তাছাড়া আমি একা থাকি তো সকাল থেকে দুপুর পর্যন্তই। দুপুরের পর তো তোমার দাদাভাই বাড়ি এসেই পড়েন। তারপর তো আমার আর একা একা লাগে না”।

সীমন্তিনী এবার মনে মনে একটু ভেবে নিয়ে বলল, “আসলে হয়েছে কি জানিস, কথাটা আমি তোকে বলিনি ঠিকই। কিন্তু পরিতোষ আমাকে বেশ কয়েকবার বলেছে যে ওর বিশেষ পরিচিত এক ডাক্তারের পরিবারের সাথে ওর বিশেষ ঘণিষ্ঠতা আছে। ওই ডাক্তার আর তার স্ত্রীর সাথে বোধ হয় কথায় কথায় ও তোর কথা বলে ফেলেছিল কোনদিন। হয়তো তোর কিছু প্রশংসাও করেছিল। তারপর থেকেই তারা বারবার করে তোকে দেখতে চাইছেন। আর তুইও যখন আজ বলছিস যে ঘরে মন টিকছে না, তাই ভাবলুম পরির সাথে ওই ডাক্তারদের ওখানেই না হয় একটু ঘুরে আয়। তাতে তোরও যেমন সময়টা ভাল কাটবে, তেমনি পরিতোষও খুশী হবে। তুই বোধহয় জানিস না, তোকে দেখার পর থেকে পরি তোকে মুখে বৌদি বলে ডাকলেও আসলে ও তোকে নিজের বোন বলে ভাবতে শুরু করেছে। আমার সাথে যখনই ওর কথা হয় তখন তোর ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবেই নেবে। তাই বলছিলাম”।

রচনা এবারেও দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, “পরিতোষদা তো সত্যি খুব ভাল মানুষ দিদিভাই। প্রথম দিন দেখার পর থেকেই তাকে আমিও মনে মনে শ্রদ্ধা করি। তার জীবনটা সুখের হোক, এ প্রার্থণা আমি রোজই ঠাকুরের কাছে করি। কিন্তু দিদিভাই তোমার দাদাভাইকে ছাড়া আমি একা কখনই তার সাথে কোথাও গিয়ে অপরিচিত কোন ফ্যামিলির সাথে পরিচিত হতে চাই নে গো। তুমি প্লীজ, আমাকে ভুল বুঝো না। পরিতোষদা আমাদের বাড়ি এলে আমি খুশীই হব। প্রয়োজনে তুমি বললে আমি তার সাথেও কোথাও দেখা করতে পারি। কিন্তু অন্য কারুর সাথে নতুন করে পরিচিত হবার জন্যে আমি একা তার সাথে যেতে চাইনে গো”।

সীমন্তিনী রচনার চিন্তাধারা বুঝতে পেরে মনে মনে খুব খুশী হয়ে বলল, “এই না হলে তুই আমার বোন? সত্যি আমি তোকে হান্ড্রেড পার্সেন্ট মার্ক্স না দিয়ে পারছি না। আমি তো তোকে একটু বাজিয়ে দেখছিলাম রে পাগলী। আমার বোনটা কলকাতা শহরের হাওয়া খেয়ে কতখানি পাল্টাল সেটাই দেখছিলাম”।

রচনা এবার আরও অভিমানী গলায় বলল, “আমাকে বাজিয়ে দেখতে গেলে কোনদিন তোমায় কোন ছল চাতুরীর সাহায্য নেবার দরকার নেই দিদিভাই। তুমি স্পষ্ট করে জানতে চেও। আমি এতদিন যেমন করেছি ঠিক তেমনি করে স্পষ্ট ভাষায় তোমার কথার সত্যি জবাব দেব”।

এবার সীমন্তিনী কিছু বলবার আগেই অর্চনা আর থাকতে না পেরে বলল, “একদম ঠিক বলেছিস রচু। কাছে থাকলে আমি এখন তোকে খুব করে আদর করতুম রে। দিদিভাই তো বুঝবেন না যে তিনি আমাদের কাছে কী। দিদিভাই যে একটা বট গাছ। আর আমরা সবাই যে পরগাছার মত তাকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি, এটা তিনি হয়ত কোনদিনই মানতে বা বুঝতে চাইবেন না। কিন্তু তুই, আমি আমাদের মা-বাবা ভাই .........”

সীমন্তিনী অর্চনার মুখে হাত চেপে ধরে ফোনে বলল, “হয়েছে হয়েছে আর ইমোশনাল ড্রামা করতে হবে না আমার বোন দুটোকে। এই শোন রচু, আমি সত্যি বলছি, অফিসে গিয়ে আমি দাদাভাইকে বলে দেব। তুই আর দাদাভাই দু’জনেই পরিতোষের সাথে বেড়াতে যাবি আজ বিকেলে। আমি পরিতোষকেও সে’কথা বলে দেব। তোরা সেইমত তৈরী থাকিস। রাখছি, বাই” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

ততক্ষণে সবারই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। সীমন্তিনী নিজের ঘরে ঢুকে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগল। কিন্তু খানিক বাদেই অর্চনা আর নবনীতা তার ঘরে এল। অর্চনা সীমন্তিনীর পাশে দাঁড়িয়ে তার একটা হাত হাতে নিয়ে বলল, “ও দিদিভাই, একটু খুলে বলো না ব্যাপারটা কি। পরিতোষদার সাথে তুমি রচু আর রতুদাকে এভাবে কোথায় পাঠাতে চাইছ গো”?

সীমন্তিনী নিজের লম্বা চুলগুলোকে ভালমত খোঁপা করে বেঁধে অর্চনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এ আরেক পাগলীকে নিয়ে পড়েছি আমি। আরে বাবা, রচুর বা তোদের কারো কোন অসুবিধে হোক এমন কিছু কি আমি, নীতা, লক্ষ্মীদি বা পরি কেউ করতে পারি? কিন্তু তোর যখন মনে কিছু আশঙ্কা হচ্ছেই তাহলে বলি শোন। পরিতোষ সত্যি ওদের আজ এক জায়গায় নিয়ে যাবে। তবে তার উদ্দেশ্যটা কী, সেটা আমাকেও খুলে বলেনি। তবে ওর ওপর আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে যে দাদাভাই আর রচুকে ও সব সময় নিরাপদেই রাখবে। তবে আমার মনে হয় ওই বিমল আগরওয়ালার ব্যাপারে পরি যা কিছু প্ল্যান করছে, এটা তারই একটা অঙ্গ। তবে, তোরা কেউ একদম দুশ্চিন্তা করিস না। পরে একসময় আমরা ঠিকই জানতে পারব পরি এটা কেন করছে। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাক, রচু বা দাদাভাইয়ের কোন কিছু হবে না। এবার বুঝেছিস তো? আমি যদি রচুকে বলতাম যে পরি ওদের এক জায়গায় কোন একটা উদ্দেশ্যে নিয়ে যেতে চাইছে, তাহলে ওদের মনে একটা সন্দেহ দেখা দেবে না? আমরা তো বিমল আগরওয়ালাকে নিয়ে যা কিছু প্ল্যান করছি, তা তো ওদের কাছে গোপন রেখেছি। তাই এ ব্যাপারটাও আমাকে এভাবে সারতে হল। পরিতোষ যদি সরাসরি দাদাভাই বা রচুকে বলত ওর সাথে যেতে তাহলেও ওদের মনে কোন না কোন সংশয় হতই। তাই পরি আমাকে দায়িত্বটা দিয়েছে রচু আর দাদাভাইকে রাজি করাবার। আমার এটাই মনে হচ্ছে। তুই এ ব্যাপারে একেবারে দুশ্চিন্তা করিসনে বোন”।

বলে নবনীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “নীতা, তুই এ পাগলিটাকে সামলা। আমি বেরোচ্ছি” বলে দাঁড়িয়ে অর্চুর চিবুকটা নাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আর মন খারাপ করে থাকিস না বোন। আমি বেরোচ্ছি। তুই কিন্তু একদম টেনশন নিস না প্লীজ, আমি আসছি হ্যাঁ”?

অর্চনা জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলে মাথা নাড়ল।

______________________________
Like Reply
(Update No. 177)

গাড়িতে চেপে অফিসে যেতে যেতেই সীমন্তিনী পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে রচু পরিতোষের সাথে যাবে ঠিকই তবে ও একা যাবে না, ও রতীশকেও সঙ্গে নেবে। পরিতোষ সে’কথা শুনে শুধু বলল “নো প্রব্লেম”।
 

আবার বারোটা নাগাদ রতীশকে ফোন করে পরিতোষের সাথে বিকেলে বেরোবার কথা বুঝিয়ে দিল। রতীশ সীমন্তিনীর কথা এককথায় মেনে নিলেও জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে মন্তি, তুই কি চাইছিস যে অর্চুদির ব্যাপারে আমরা পরিতোষদার সাথে কোনরকম আলোচনা করি”?

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “দাদাভাই আজই বা এখনই সেসব কিছু দরকার নেই রে। আসলে পরিতোষ আগামী সাতদিন সাংঘাতিক রকম ব্যস্ত থাকবে। তাই ভেবেছি, সাত দিন পরেই ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা শুরু করব। তবে কাল রাতে একবার আমি সে চেষ্টা করেছিলুম। তখন আমি আসলেই জানতুম না যে ও এতটা ব্যস্ত আছে। প্রসঙ্গটা তুলতেই ও ওর ব্যস্ততার কথা বলল। আর অবশ্য সাথে এ’কথাও বলেছে যে আমার আর নীতার পছন্দই ও চোখ বুজে মেনে নেবে। তাই ও ব্যাপারটা নিয়ে আমি আরও আশাবাদী হয়ে উঠেছি সত্যি, কিন্তু ওর ব্যস্ততার ধরণটা বুঝতে পেরে আমি নিজেও বুঝতে পারছি যে, ও যে ব্যাপারটা নিয়ে এখন ব্যস্ত আছে সেটা শেষ না হওয়া অব্দি ওর মাথায় এখন আর অন্য কোন কথাই ঢুকবে না। তাই তুই আজ ও ব্যাপারে ওকে কোনরকম হিন্টস দিস না প্লীজ। ব্যাপারটা আমার ওপর ছেড়ে দে। আমি সময়মত কাকে কখন কী করতে হবে সেইমত তাদের সেগুলো করতে বলব। তবে দাদাভাই, ইন দা মিন টাইম, তুই কিন্তু একটা কাজ একটু এগিয়ে রাখতে পারিস”।

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “কী কাজ রে? বল না”?

সীমন্তিনী এক সেকেন্ড ভেবে বলল, “দ্যাখ দাদাভাই, পূজোর পরে পরেই আমি কালচিনির বাড়িতে নতুন ঘর বানাবার কাজ শুরু করতে চাইছি। তখন প্রায় গোটা বাড়িটাই ভাঙা পড়বে। তখন হয়তো একটা টেম্পোরারি শেড বানিয়ে মাসি মেসোদের থাকতে হবে। আবার ওদিকে অর্চুর বিয়েটাও ভাবছি অঘ্রান মাসেই কোন একটা সময়ে দেব। কিন্তু ততদিনে তো বাড়ির কাজটা শেষ হবে না। আর তাছাড়া অর্চুর বিয়েটা বোধহয় এমনিতেও কালচিনি থেকে দেওয়া সহজ হবে না। ', ঘরের বিধবা মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ছোট জায়গায় এমন ব্যাপারে স্বভাবতঃই একটু বেশী কানাঘুষো বা হৈ চৈ হয়ে থাকে। মাসি মেসোরা হয়ত সেটা বরদাস্ত করে উঠতে পারবেন না। তাই বিয়েটা কালচিনি ছাড়া অন্য কোথাও আয়োজন করতে পারলেই ভাল হয়। কিন্তু দ্যাখ, আমি তো থাকি অফিসিয়াল কোয়ার্টারে। তাই আমার এখান থেকে বিয়েটা তো আর দেবার বন্দোবস্ত করা যাবে না। হয়তো আলিপুরদুয়ার বা জলপাইগুড়ির কোন একটা বিবাহ ভবন ভাড়া করে আয়োজন করা যেতে পারে। কিন্তু মন থেকে আমি সেটা ঠিক মেনে নিতে পারছি না রে। কারন অমন বিয়েতে বিয়ের সত্যিকারের মজাটাই উপভোগ করা যায় না। একটা ঘরোয়া পরিবেশ না হলে বিয়ে সাদির ব্যাপারটা আসলেই জমে না। এখন এ ছাড়া আর অলটারনেটিভ বলতে আমাদের হাতে একটাই মাত্র উপায় থাকে। আর সেটা হল আমাদের রাজগঞ্জের বাড়ি থেকে যদি বিয়েটা দেওয়া যায়। তাহলে মাসি মেসোরাও অতটা অস্বস্তি ফীল করবেন না, আর তোরাও সকলে বিয়েতে ভরপুর স্ফুর্তি করতে পারতিস। তাই বলছি, তুই বড়মা বা জেঠুর সাথে এ ব্যাপারটা নিয়ে একটু কথা বলিস না দাদাভাই। যদি তাদের ওখানে তাদের নিজেদের কারো কোন অসুবিধে না হয়, তাহলে বিয়ের আয়োজনটা ওখানে করলেই সবথেকে ভাল হয়রে। অবশ্য কারো পরীক্ষা টরীক্ষার সাথে ক্ল্যাস করলে অবশ্য অন্যভাবে ভাবতেই হবে। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে ভাই বোন কারো পরীক্ষা থাকতেই পারে, সে ব্যাপারটাও কনসিডারেশনে নিস”।

রতীশ সীমন্তিনীকে এ ব্যাপারে আশ্বস্ত করে বলল যে সে তার মা বাবার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলবে। তখন সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা দাদাভাই শোন আরেকটা কথা আছে। তুই নাকি রচুকে বলেছিস যে পূজোর সময় রাজগঞ্জে গিয়ে মাত্র দু’তিনদিন থাকবি? এ’কথা কেন বলেছিস রে”?
 

রতীশ জবাব দিল, “হ্যাঁরে অমন কথা বলেছি ঠিকই। আর রচু যে এ’কথা শুনে খুশী হয়নি তাও বুঝেছি। কিন্তু কি করব আমি বল তো? বৌদি তো আমাকে এখন একটা দিনের জন্যেও ছুটি দিতে চাইছেন না। কিন্তু যখন আমি তার ওখানে কাজে ঢুকেছিলাম তখন কিন্তু বৌদি অন্য কথা বলেছিলেন। তখন উনি বলেছিলেন যে আমার বাড়ি দুরে বলে উনি আমাকে নিয়মের বাইরেও কিছু এক্সট্রা ছুটি দেবেন। অবশ্য তেমনটা যে তিনি করেন নি তাও নয় একেবারে। অর্চুদি যখন হাসপাতালে, সে খবর শুনেই আমি চাকরিতে জয়েন করবার আগেই তিনি আমাকে বেশ ক’দিনের ছুটি দিয়েছিলেন কালচিনি যাবার জন্য। আর শুধু ছুটি দেওয়াই নয়, উনি তো আমার আর রচুর যাতায়াতের টিকিটও করে দিয়েছিলেন। তাই তার ওপর শুরু থেকেই কৃতজ্ঞ ছিলুম আমি। কিন্তু এখন যে কেন তিনি এমন করছেন, সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না রে। আর তোকে তো আগেও বলেছি, ইদানীং বৌদিকে খুব টেন্সড দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে সব সময় কোন একটা দুশ্চিন্তা তাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু এমন অবস্থায় তার কাছে আমি লম্বা ছুটি কিকরে চাই বল তো”?
 

সীমন্তিনী রতীশের কথা শুনে বলল, “ও এই ব্যাপার? ঠিক আছে, ও নিয়ে তুই ভাবিস নে। আমি তোর মহিমা বৌদির সাথে সময়মত এ ব্যাপারে আলাপ করব। আচ্ছা ঠিক আছে দাদাভাই, এখন ছাড়ছি তাহলে আমি। আর হ্যাঁ, পরিতোষ এলে ওকে ফিরিয়ে দিসনে যেন। রচুকে বুঝিয়ে বলিস। ও-ও যেন যেতে অরাজী না হয় কেমন”?

রতীশ সম্মতি জানাতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিল।


*****************

বিকেল তখন ঠিক পাঁচটা। পরিতোষ সিভিল ড্রেসে রতীশদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে বলল, “হ্যাঁ শোন, আমি একটু বাদেই এ দু’জনকে নিয়ে বেরোবো। দমদমের দিকে যাচ্ছি। তোদের একটা টিম এখানে এদের ঘরের ওপর নজর রাখবি। আর একটা মোবাইল টিম আমার গাড়িটাকে ফলো করবি। যদিও কোন ঘটণা ঘটবে বলে মনে হয় না, তবুও সঙ্গে আর্মস রাখবি। আর সব সময় আমার গাড়ির ওপর কড়া নজর রাখবি। দমদমে এক জায়গায় গিয়ে গাড়িটা একটা গলির ভেতর রেখে আমরা একটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে যাব। সেখান থেকে বেরোতে বেশ দেরী হবে। রাত দশটা এগারটাও হতে পারে, আবার তার আগেও যে কোন সময় বেরিয়ে আসতে পারি। কিন্ত আমরা যতক্ষণ ওই অ্যাপার্টমেন্টে থাকব, ততক্ষণ আমাদের গাড়িটার ওপর কড়া নজর রাখবি। আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু আমার নিজের গাড়িটা নিই নি। এ বিল্ডিংএর ঠিক সামনেই রাস্তার ধারে তাকিয়ে দেখ। একটা ব্লু কালারের ওয়াগন আর পার্ক করা আছে। আমরা ওই গাড়িতেই যাচ্ছি। আর ফিরে এখানে না আসা পর্যন্ত তোরা কন্টিনিউয়াস শার্প ওয়াচ রাখবি এ গাড়ির ওপর” বলে ফোন কেটে দিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।

রতীশদের ঘরের কলিং বেল বাজাতেই রচনা আর রতীশ দু’জনেই সহর্ষে পরিতোষকে স্বাগত জানাল। তাদের দু’জনকেই পোশাকে দেখে পরিতোষ বলল, “বাঃ, আপনারা তৈরীই আছেন দেখছি। তাহলে চলুন দাদা, আমরা আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ি”।

রতীশ পরিতোষের একটা হাত ধরে বলল, “দাদা, এর আগে যেদিন আপনার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেদিন আমরা সকলেই এমন একটা বিজি সিডিউলের মধ্যে ছিলুম যে আপনার সাথে ভাল করে কথাও বলতে পারিনি। আজ হয়ত বেশ কিছুটা সময় আপনার সাথে কাটবে আমাদের। কিন্তু দাদা, দুটো কথা আমরা ঘর থেকে বেরোবার আগেই আপনাকে বলতে চাই”।

পরিতোষ মনে মনে একটু অবাক হলেও মুখের স্বাভাবিক ভাব বজায় রেখেই বলল, “বেশ তো, বলুন না”।

রতীশ পরিতোষের হাত ধরে তাকে সামনের ঘরের সোফার দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “আসুন, বসে কথা বলা যাক”।

রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। পরিতোষকে এক সোফায় বসিয়ে রতীশ উল্টোদিকের সোফায় বসে বলল, “দাদা, আপনি মন্তির বন্ধু হলেও ওর থেকে বয়সে এবং সার্ভিসে সিনিয়র। আমি আর মন্তি প্রায় সমবয়সী। তাই বুঝতেই পারছেন আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আর রচুর কথা নাই বা বললাম। অবশ্য রচুকে আপনি আগে থেকেই তুমি করে বলছেন। কিন্তু দাদা, আমিও কিন্তু আপনার কাছ থেকে তুমি সম্মোধনটাই শুনতে চাই”।
 

পরিতোষ মিষ্টি করে হেসে জবাব দিল, “ওকে, ব্রাদার, ডান। আর দ্বিতীয় কথাটা কি শুনি”।

রতীশ কিছু বলবার আগেই রচনা দুটো প্লেটে কিছু মিষ্টি আর খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “দ্বিতীয় কথাটা হচ্ছে, আজ আপনি প্রথম আমাদের ঘরে পা রেখেছেন। তাই আপনাকে একটু মিষ্টিমুখ করতেই হবে। না বললে শুনছি না কিন্তু”।

পরিতোষ হা হা করে বলে উঠল, “বৌদি প্লীজ, এসব করতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। আচ্ছা ঠিক আছে, আমি শুধু একটা মিষ্টি উঠিয়ে নিচ্ছি”।

রচনা বলল, “উহু, ওসব হবে না। আর খুব বেশী কিছু তো আমি দিই নি দাদা। মিষ্টির সাথে দুটো স্ন্যাক্স আর নিজের হাতে বানানো একটু পায়েসই তো শুধু দিয়েছি। বোন হয়ে কি এটুকুও করবার অধিকার নেই আমার শুনি”?

রচনার এমন সুমিষ্ট কথা শুনে পরিতোষ আর কোন কথা না বলে রচনার হাতে ধরা ট্রে থেকে একটা প্লেট উঠিয়ে নিয়ে গপগপ করে খেতে লাগল। তা দেখে রচনা হেসে বলল, “এমা, অত তাড়াতাড়ি খেতে হবে না। শেষে বিষম টিষম খাবেন তো। আপনি ধীরে সুস্থে খান, দাদা। আমি চা আনছি”।

পরিতোষ হাত তুলে বাধা দেবার আগেই রচনা ভেতরে ঢুকে গেল। চা না খেয়ে পরিতোষ আর এখান থেকে বেরোতে পারবে না বুঝে গেল। কিন্তু রচনার হাতের পায়েস খেয়ে তার মনে হল এমন সুস্বাদু খাবার সে বুঝি তার জীবনে আজই প্রথম খেলো। কিন্তু খাবারের প্রশংসা করে সময় নষ্ট একেবারেই করতে চাইল না সে ওই মূহুর্তে। তাই চা খাবার পর আর একটা মিনিটও দেরী না করে রচনা আর রতীশকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে এল।

পেছনের সীটে রচনা আর রতীশকে বসিয়ে পরিতোষ গাড়ি ছেড়েই বলল, “রতুদা আর বৌদি, তোমরা দু’জনেই হয়ত খুব অবাক হয়েছ এভাবে তোমাদের কোথাও নিয়ে যাচ্ছি দেখে। কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করতে পারো, এর পেছনে আমার কোনও বদ মতলব নেই। তবে হ্যাঁ, মতলব একটা অবশ্যই আছে। সেটা আমি এখনই তোমাদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত মনে করছি। নইলে তোমরা মনে মনে কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে থাকবে। তবে তারও আগে আমি আরেকটা কথা বলে নিতে চাই, নইলে কথাটা হয়ত পরে আমার মাথা থেকে বেড়িয়েই যাবে। ভাগ্যিস আমার আপত্তিতে কান না দিয়ে তুমি জোর করেই আমাকে তোমার হাতের বানানো পায়েসটুকু খাইয়ে ছিলে বৌদি। ঈশ, না খেলে সত্যি বড্ড মিস করতাম। এটা ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সুস্বাদু খাবার। এত সুস্বাদু পায়েস এই প্রথম আমার কপালে জুটল আজ”।

রচনা প্রায় সাথে সাথে বলল, “এ মা, কী বলছেন দাদা আপনি? তবে, এ’কথাটা তখন বলেন নি কেন? আরো ছিল তো! আরেকটু দিতে পারতুম তো আপনাকে। ঈশ, দেখেছেন, আপনি ঘরে ঢোকবার সাথে সাথে এমন তাড়া দিলেন যে আমি আর সাহস করে দ্বিতীয়বার আপনাকে সাধতে সাহস পাইনি। তখন ভেবেছিলুম, তাতে করে আপনি হয়ত সময় নষ্ট হচ্ছে বলে বিরক্ত হবেন। ঈশ, ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার কথা বলুন তো”?

পরিতোষ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে মাথা ঘুরিয়ে রচনা আর রতীশদের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “সত্যি বৌদি, এখন আমার খুব আফসোস হচ্ছে। তবে এ পায়েস খাবার লোভেই হয়ত তোমাদের ওখানে আবার আমি ছুটে যাব কোনদিন। আর সেদিন আগে থেকে নোটিস দিয়েই যাব। একটু বেশী করে খাইও প্লীজ”। বলে হাঃ হাঃ করে হেসে দিল।
 

রচনা একটু অভিমানী সুরে বলল, “সে যেদিন আবার আমার ভাগ্য হবে, সেদিন হয়তো সেটা হবে। কিন্তু আজ যখন আমাদের ফিরিয়ে এনে আবার বাড়িতে নামিয়ে দেবেন, তখন কিন্তু আপনাকে আমাদের ঘরে ঢুকতেই হবে। আরেকটু পায়েস আপনাকে খেয়ে যেতেই হবে”।
 

পরিতোষ আবার হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বৌদি। সেটা দেখা যাবে’খন। তবে কখন যে ফিরব, সেটা তো আমি নিজেও জানিনা। দেরী হলে প্লীজ তোমরা কেউ আমার ওপর রেগে যেও না। আসলে তোমাদের নিয়ে আমি আজ যেখানে যাচ্ছি, তারা আমাকে খুবই স্নেহ করেন। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দীপা বড়ুয়া আমাকে যতটা স্নেহ করেন, তার চেয়ে অনেক বেশী ভালবাসে তাদের মেয়ে আকাঙ্ক্ষা। অসম্ভব মিষ্টি মেয়েটা। কিন্তু মজার ব্যাপার কি জানো রতুদা, ওদের সাথে এর আগে আমার শুধু একদিনই দেখা হয়েছিল, তাও আজ থেকে প্রায় আড়াই বছর আগে। ভাইজ্যাগে। এ আড়াই বছরের মধ্যে তারা বহুবার আমাকে তাদের ওখানে যেতে বলেছেন। কিন্তু আমি কাজে এতই ব্যস্ত থাকি যে ইচ্ছে করলেও গিয়ে উঠতে পারিনি। আর ডক্টর বড়ুয়াও খুব ব্যস্ত ডাক্তার। এতদিন বাদে এই সেদিন আবার ডক্টর বড়ুয়ার সাথে আমার দেখা হয়েছে কাজের সূত্রেই। আর উনি এমন করে বললেন যে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হতে লাগল। আর মন্তিও দুপুরে ফোন করে বলল যে বাড়ির লোকজনদের কথা ভেবে ভেবে বৌদির মনটাও নাকি খুব খারাপ। তাই তোমাদের দু’জনকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসতে। তখনই হঠাৎ মনে হল, তাহলে একসাথে দুটো কাজই আজ সেরে ফেলা যাক। ডক্টর বড়ুয়াদের সাথে দেখা করবার সাথে সাথে একসাথে তোমাদের নিয়ে একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। মন্তির অনুরোধটাও রক্ষা করা হবে। তবে বৌদি আর রতুদা, অচেনা একজনের বাড়িতে তোমাদের নিয়ে যাচ্ছি বলে তোমরা কোনও রকম মন খারাপ কোর না প্লীজ। আসলে জানো কি? আমার তো আর পৃথিবীতে নিজের বলতে কেউ নেই। তোমাদের মত, মন্তি বা নীতার মত আরও কয়েক জনকে নিজের আত্মীয় বানিয়ে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিই। আর এদের সকলের কাছে যেটুকু স্নেহ ভালবাসা আমি পাই তাতেই নিজেকে সুখী বলে ভাবতে চেষ্টা করি। এই আর কি”।

রতীশ এতক্ষণ পরে প্রথম কথা বলল, “না না দাদা, আপনি আমাদের জন্য অযথা চিন্তা করবেন না। মন্তি তো আমাকে আগেই ফোন করে বলে দিয়েছিল। তাই আমরাও মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম”।

রচনা বলল, “দাদা, একটা কথা বলব”?
 

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ বৌদি, বলো না”।

রচনা একটু হেসে বলল, “বলছিলাম কি এই যে আপনি ওকে নাম ধরে আর আমাকে বৌদি বলে সম্বোধন করছেন না? এ ব্যাপারটা ঠিক জমছে না। আমি আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট। আমাকে যখনই আপনি বৌদি বলে ডাকছেন, আমার মনে হচ্ছে আমি যেন বুড়িয়ে গেছি। আপনি তো দিদিভাইয়ের বন্ধু। সম্পর্কে আমি তার বৌদি হলেও দিদিভাই শুরু থেকেই আমাকে নাম ধরেই ডাকেন। আসলে আমি তার মুখে অমন ডাক শুনতেই ভালবাসি। আপনিও যদি আমাকে অমন ভাবে নাম ধরে ডাকেন তাহলে আমার আরও বেশী ভাল লাগবে। বৌদি ডাকটা আপনার মুখে থেকে শুনতে আমার একদম ভাল লাগছে না। প্লীজ দাদা, আমি আপনার বৌদি হতে চাইনে। আপনি আমায় আপনার ছোট বোন বলে ভাবুন না” বলেই রতীশের উদ্দেশ্যে বলল, “কিগো তুমি বল না দাদাকে, উনি যেন আমাকে বৌদি বলে না ডাকেন”।

রতীশ সাথে সাথেই বলল, “হ্যাঁ দাদা, রচু কিন্তু ঠিক কথাই বলেছে। আর আমাকেও আপনি রতুদা বা রতীশদা না বলে শুধু আমার ডাক নাম ধরে রতু বলে ডাকুন, আমার সেটাই বেশী ভাল লাগবে। আসলে সত্যিই আপনি যখন ওকে বৌদি বলে ডাকছেন, তখন ডাকটা আমার কানেও শ্রুতিকটু লাগছে। আর রচু হয়তো মনে মনে নিজেকে আপনার ছোট বোনের মতই ভাবছে”।
 

রচনা সাথে সাথে রতীশের হাত চেপে ধরে ঈশারায় চুপ করতে বলল। তবে পরিতোষও এবার একটু হেসে বলল, “বেশ তো, তোমরা দু’জনেই যদি এটাই চাও, তাহলে তা-ই নাহয় বলব। কিন্তু আমারও তাহলে একটা আবদার আছে। মন্তি যখন তোমায় রচু সোনা বলে ডাকে তখন সত্যি বলছি ডাকটা আমার কাছে খুব মিষ্টি মনে হয়। আমিও কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে ওভাবেই ‘রচু সোনা’ বলে ডেকে ফেলতে পারি। তখন কিন্তু রাগ করতে পারবে না। অবশ্য আমার গলা তো আর মন্তির গলার কত অমন মিষ্টি নয়। আমার হেড়ে গলায় ‘রচু সোনা’ ডাকটা তোমাদের কানে বেখাপ্পা বা বিসদৃশ্য মনে হতেই পারে। কিন্তু ছুটটা কিন্তু আমাকে দিতেই হবে। নইলে আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকতে পারব না”।

রচনা খুশী হয়ে বলল, “এতে আর আমাদের অনুমতি চাইবার কি আছে দাদা। আপনার যদি সেভাবে ডাকতে ভাল লাগে, তাহলে ডাকবেন। তবে এতে লাভ তো আমারই হচ্ছে। আমরা দু’বোন এক ভাই। ভাইটা সকলের ছোট। তাই আমাদের দাদা বলে কেউ ছিল না এতদিন। আজ থেকে একটা দাদা পেয়ে গেলাম আমি”।

রতীশও খুশী মনে রচনার কথায় সায় দিতেই, রচনা আবার পরিতোষকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কিন্তু পরিদা? একটা কথা ভেবে কিন্তু ......” বলেই নিজের ভুল ধরতে পেরে বলল, “ঈশ, ছিঃ ছিঃ, আপনাকে আমি নাম ধরে ডেকে ......”

তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়েই পরিতোষ হেসে বলল, “বেশ করেছ। তোমার মুখে ‘পরিদা’ ডাক শুনে আমারও অন্য রকম লাগছে। আসলে জানো রচু, ওই একটু আগেই বললাম না যে আমার নিজের বলতে কেউ না থাকলেও অনেকেই আমাকে স্নেহ করেন, ভালবাসেন। কিন্তু তারা কেউ আমাকে পরিদা বলে ডাকে না। কেউ ‘দাদা’ বলে, কেউ ‘আঙ্কল’ বলে, কেউ ‘মামা’ বলে। কেউ কেউ ‘ভাই’ বলেও ডাকে। আর বেশীর ভাগই ‘স্যার’ বলে। আমার মনের সবচেয়ে কাছের দুটো মানুষ আমাকে পরি বলে ডাকে। কিন্তু পরিদা বলে ডাকবার কেউ নেই। তুমি যদি আমাকে সেভাবেই ডাকো তাহলে বেশী খুশী হব। আচ্ছা কি বলছিলে সেটা বলে ফ্যালো। আমরা কিন্তু আর একটু বাদেই আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাব”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 178)

রচনা বলল, “দাদা, কথায় কথায় আমাদের দু’জনকেই অনেক সহজ করে তুলেছেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সত্যি বলছি দাদা, পুরোপুরি অচেনা অজানা কারো বাড়িতে যেতে কেমন যেন লাগছে আমার। আসলে তারা যেমন আমাদের অচেনা, ঠিক তেমনি আমরা দু’জনও তো তাদের অচেনা। সেখানে দু’পক্ষের কেউই হয়ত পুরোপুরি সহজ হয়ে উঠতে পারব না”।

পরিতোষ আগের মতই শান্তভাবে জবাব দিল, “আমি জানি রচু, এখন আমি তোমাদের যত কিছুই বোঝাই বা বলি না কেন তোমাদের মনের সঙ্কোচ কিন্তু এতে পুরোপুরি কাটবে না। তবে একটা কথা বলছি, ও বাড়িতে দশ মিনিট কাটাবার পরেও যদি তোমাদের মনে হয় তোমাদের মনের অস্বস্তি কাটছে না, বা এমন যদি মনে হয় যে ওনারাও তোমাদের সাথে পুরোপুরি ফ্রি হচ্ছেন না, তাহলে তোমরা আমাকে শুধু একটু ঈশারা করে দিও। আমি তোমাদের নিয়ে ঠিক তখনই বেড়িয়ে আসব। ঠিক আছে তো? এবার তোমরা দু’জনেই একটু চুপটি করে বোসো, আমি একটা ফোন কল সেরে নিই”।

পরিতোষ নিজের মোবাইল থেকে ডক্টর বড়ুয়াকে ফোন করতেই ও’পাশ থেকে সাড়া পেয়ে বলল, “গুড ইভিনিং ডক্টর। পরিতোষ বলছি”।

ও’পাশ থেকে ডক্টর দিব্যেন্দুর আনন্দিত স্বর ভেসে এল, “ভেরি গুড ইভিনিং স্যার। বড্ড চমকে দিয়েছেন সত্যি। তা বলুন কেমন আছেন? আপনার সাথে আর ও ব্যাপারে কোনও কথাই তো হল না”।

পরিতোষ বড় রাস্তা থেকে একটা গলিতে গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “সে জন্যেই তো এখন ফোন করছি স্যার। বলছিলাম কি, বৌদি আর মামনি কি বাড়িতে আছে না তারা বাইরে কোথাও বেড়িয়েছে”?
 

ডক্টর বড়ুয়া জবাব দিলেন, “না না ওরা বাড়িতেই আছে। আসলে আজ তো আমার অফ ডে। তাই ওদের নিয়ে একটু মার্কেটিংএ যাবার প্ল্যান করছি। তা আপনার সাথে কোথায় আমাকে দেখা করতে হবে বলুন তো? আমি ওদেরকে সাথে নিয়েই যেতে পারি আজ। ওরাও খুব খুশী হবে”।

পরিতোষ বলল, “স্যার, আমি আমার এক ভাই আর বোনকে নিয়ে দমদমের এদিকেই একটা কাজে এসেছিলাম। হঠাৎ মনে হল যে ব্যস্ততার মধ্যে তো মামনির সাথে দেখা করতেই পারছি না। তাই ভাবছিলাম, আজ এখনই আপনার বাড়ি যেতাম। কিন্তু আপনারা যখন বলছেন যে আপনারা বেরোবার প্ল্যান করছেন, তাহলে বরং থাক। অন্য কোনদিন চেষ্টা করব”।

ডক্টর বড়ুয়া প্রায় সাথে সাথেই বললেন, “না না স্যার, প্লীজ ফিরে যাবেন না। এই প্রথমবার আপনি আমার ঘরে আসতে চেয়েও ঘুরে যাবেন তা কখনোই হতে পারে না। আমরা আমাদের প্রোগ্রাম ক্যানসেল করছি আজ। আপনি প্লীজ আসুন। আমাদের মার্কেটিং এমন কিছু জরুরী নয় যে আজ না গেলেই নয়। আচ্ছা এই নিন, দীপা আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে। নিন ওর সাথে কথা বলুন”।

পরক্ষনেই ডক্টর দিব্যেন্দুর বৌ দীপার গলা শোনা গেল, “স্যার, আপনি যদি আজ আমাদের বাড়ির এত কাছাকাছি এসেও ফিরে যান, তাহলে কিন্তু বড় দুঃখ পাব আমরা। এমন করবেন না প্লীজ। আমাদের মার্কেটিং আজ না করলেও আমাদের কোন অসুবিধে হবে না। আপনি একদম দ্বিধা করবেন না। প্লীজ এত কাছে এসেও দেখা না করে যাবেন না, প্লীজ স্যার”।

পরিতোষ ততক্ষণে গাড়িটা রাস্তার পাশে একজায়গায় সাইড করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। দীপার কথা শুনে একবার রচু আর রতুর দিকে দেখে এবার একটু আমতা আমতা করে বলল, “আসলে বৌদি, আমার এক ভাই আর তার স্ত্রীও আমার সাথে আছে। ওরা তো আপনাদের পরিচিত নয়। তাই আমার সাথে আপনাদের বাড়ি ঢুকতে ওদের একটু সঙ্কোচ হচ্ছে। আর ওদিকে আপনাদেরও যখন বাইরে যাবার প্রোগ্রাম আছে, তাই ভাবছি ....”

পরিতোষের কথা শেষ না হতেই দীপা বলল, “প্লীজ স্যার, এভাবে বলবেন না। গত আড়াইটে বছরে আমি ওকে কতবার বলেছি একবার আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবার জন্য। একটিবার আপনাকে চোখের দেখা দেখবার জন্য ওর কাছ কত মিনতি করেছি। কিন্তু ও নিজের কাজ ছাড়া আর কিছু করবারই ফুরসৎ পায় না। আর আপনিও ভাইজ্যাগ থেকে এখানে এসেও তো একই রকম ব্যস্ত থাকেন, সেটাও জানি। তাই বলছি, আজ যখন কাছাকাছি এসেই পড়েছেন, তাহলে প্লীজ এভাবে ফিরে যাবেন না স্যার। প্লীজ স্যার। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আপনার ভাই আর তার স্ত্রীর আপ্যায়নে আমি কোনও খামতি রাখব না”।

পরিতোষ তখন বলল, “আচ্ছা বৌদি, ঠিক আছে। আপনি মন খারাপ করবেন না। আমরা আসছি” বলে ফোন কেটে দিয়েই গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, “নেমে এসো রতু। আমরা এসে গেছি”।

রচনা গাড়ি থেকে নেমে নিজের পড়নের শাড়িটা টেনে টুনে ঠিক ঠাক করতে করতে বলল, “তাহলে বোঝা যাচ্ছে পরিদা, আপনি যে আজ এ বাড়িতে আসবেন, আর আমাদের দু’জনকেও যে সঙ্গে নিয়ে আসবেন, এ ব্যাপারে আপনার ডাক্তার বন্ধু বা তার পরিবার একেবারেই কিছু জানত না। আর এটাও আমি বেশ ভালই বুঝতে পাচ্ছি যে এখানে আসবার পেছনে আপনার কিছু একটা গভীর উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু এদের সাথে আমাদের তো কোনও পরিচয়ই নেই। আর এটাও মনে হচ্ছে না যে আপনি আমাদের ঘুঁটি বানিয়ে দাবার চাল চালবেন। তবে আমাদের কেন নিয়ে এলেন বলুন তো”?

পরিতোষ মনে মনে রচনার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারল না। রচনাকে সঙ্গে আনবার পেছনে তার যে উদ্দেশ্য আছে সেটা ডক্টর বড়ুয়া আর রচনাই কেন শুধু, অন্য কোন তৃতীয় ব্যক্তিই সেটা এখন অব্দি জানে না। এমনকি সীমন্তিনী পর্যন্ত। কিন্তু সে’কথা এখনই এদের খুলে বলা যাবে না। আবার খুলে না বললেও রচনা হয়ত এ প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করতে পারে। তাই কিছু একটা বলে তার মুখটাকে আপাততঃ বন্ধ করে দিতেই হবে। রাস্তার এপাশে ও’পাশে সামনে পেছনে ভাল করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে গাড়ির দরজা লক করে বলল, “রচু সোনা, তুমি সত্যিই খুব বুদ্ধিমতী। কিন্তু বোন, আমায় যখন দাদা বলে মেনেই নিয়েছ, তাহলে এই দাদার ওপর একটু ভরসা করতে পারছ না? তুমি আমার মন্তির রচু সোনা। তোমাকে বা রতুকে কি আমি কোনও বিপাকে ফেলতে পারি বোন? তবে তোমার প্রশ্নের জবাবে বলি, উদ্দেশ্য একটা আমার আছে ঠিকই। কিন্তু সেটা যে কী, তা এখন তো নয়ই, আরোও কিছুদিনের মধ্যেও তোমাকে জানাতে পারব না বোন। তবে, একদিন তোমাদের কাছে সেটা প্রকাশ পাবেই। সেদিনই তোমরা সেটা জানতে পারবে। তার আগে নয়। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পার, যে আমি তোমার বা রতুর বা যে বাড়িতে যাচ্ছি সে বাড়ির কারোর বিয়ের সম্বন্ধ করতে যাচ্ছি না”।
 

রচনা লজ্জা পেয়ে বলল, “ঈশ, পরিদা, আপনি যে কী না, ধ্যাৎ। আচ্ছা চলুন চলুন। দেখি আপনার বন্ধু বন্ধুপত্নী কে কেমন”?
 

রতীশও পরিতোষের কথা শুনে হেসে ফেলেছিল। পরিতোষ পেছনের দিকে তাকিয়ে আশ্বস্ত হয়ে দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে একদিকে এগিয়ে চলল। একটা আটতলা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে ঢুকে লিফটে চড়ে পাঁচ তলায় এসে লিফট থেকে বেরিয়ে একটা দড়জার কলিং বেল বাজাবার সাথে সাথেই বছর বারো তেরোর এক কিশোরী দরজা খুলেই “আঙ্কল” বলে পরিতোষকে জড়িয়ে ধরল।
 

মেয়েটার পেছন পেছন এক সুন্দরী মহিলা আর একজন পুরুষকে দেখেই রচনা আর রতীশ বুঝতে পারল এনারাই সেই ডাক্তার দম্পতী। ডক্টর বড়ুয়া আর স্ত্রী। তারা দু’জনেই রচনা আর রতীশের হাত ধরে সাদর আমন্ত্রণ জানিয়ে ঘরের ভেতর টেনে নিলেন।
 

পরিতোষ মেয়েটার মুখটাকে দু’হাতে ধরে তার কপালে আদরের চুমু দিয়ে বলল, “কেমন আছ, মামনি”?

আকাঙ্ক্ষা পরিতোষকে বেশ কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে থাকবার পর তাকে ছেড়ে একপা পিছু হটে অভিমানী গলায় বলল, “এই কথা তুমি দিয়েছিলে আমাকে তাই না”?

পরিতোষ চট করে মেঝেতে হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “সরি মামনি। আমি জানি তোমাকে দেওয়া কথার খেলাপ করে ফেলেছি আমি। তবে সেটা যে কারনেই হোক, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হল আমি তোমাকে দেওয়া কথাটা রাখতে পারিনি। সেজন্যে আমি দুঃখিত। তুমি চাইলে আমাকে শাস্তি দিতেই পার”।

আকাঙ্ক্ষা এবার আরো এক পা পেছনে গিয়ে বলে উঠল, “ও মা, দেখ না আঙ্কল কী বলছে? আমি কী বলেছি আমি তাকে পানিশমেন্ট দেব”? বলে নিজেই পরিতোষের হাত ধরে টেনে তুলতে তুলতে বলল, “প্লীজ আঙ্কল, এমন করে আমাকে দুঃখ দিও না”।
 

পরিতোষও সাথে সাথে উঠেই আকাঙ্ক্ষার হাত ধরে বলল, “ছিঃ ছিঃ আমি কি আমার মামনিটাকে কষ্ট দিতে পারি? তাহলে তো আমার অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কিন্তু মামনি, আমার অপরাধের শাস্তি মুকুব হল কিনা সেটা তো আগে জানতে হবে”?

আকাঙ্ক্ষা পরিতোষের হাত ধরে ঘরের ভেতর নিতে নিতে বলল, “মুকুব হচ্ছে না মশাই। তবে পোস্টপন্ড রইল আপাততঃ। এবার এসে বোসো তুমি। তোমার সাথে আমি খুব ঝগড়া করব”।

পরিতোষ হেসে বলল, “ওকে ডার্লিং। ঝগড়া কোর। কিন্তু দ্যাখ মামনি, আমাকে তো তুমি চেনই। কিন্তু আমার সাথে যে আরেক আঙ্কল আর আন্টি এসেছে, তাদের সাথে কথা বলবে না তুমি”?

আকাঙ্ক্ষা জিভে কামড় দিয়ে বলল, “ঈশ, আই মেড আ ব্লান্ডার। সরি আঙ্কল। সরি আন্টি। আপনারা প্লীজ কিছু মনে করবেন না” বলেই রচনার হাত ধরে আন্তরিক সুরে বলল, “আমি আকাংসা। আকাংসা বড়ুয়া”।

রচনা আকাঙ্ক্ষার চিবুক ধরে আদর করে বলল, “ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি”।

পরিতোষ ঘরের প্রায় মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে বলল, “ডক্টর বড়ুয়া, বৌদি, এরা আমার এক ভাই রতীশ আর তার স্ত্রী রচনা। রতীশ একজন যোগা এক্সপার্ট। খুব শিগগীরই কলকাতায় একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে। আর রচনা ওর যোগ্য সহধর্মিনী এবং গৃহবধূ। আর রতু, ইনি ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়া, সার্জন হিসেবে কলকাতায় বেশ সুনাম আছে এনার। আর ইনি তার স্ত্রী দীপা বৌদি, আর আকাঙ্ক্ষা মামনির পরিচয় তো পেয়েই গেছ তোমরা। এনাদের একমাত্র সন্তান”।

ডক্টর বড়ুয়া আর তার স্ত্রী দু’জনেই হাতজোড় করে রতীশ আর রচনাকে নমস্কার জানালেন। রতীশ আর রচনা তাদের প্রতি নমস্কার করতেই আকাঙ্ক্ষা সকলের হাত ধরে সোফায় বসাতে বসাতে বলল, “হয়েছে হয়েছে, পরিচয় পর্ব নিয়ে আর বেশী সময় কাটানো চলবে না। তোমরা সবাই প্লীজ বসো এবার”।

দীপা এসে রচনার পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “সত্যি স্যার, আজ আপনারা আসাতে আমরা সকলেই যে কী পরিমান খুশী হয়েছি, সেটা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। আড়াই বছর ধরে এ দিনটার অপেক্ষায় ছিলাম। তবে আজ আপনার সাথে সাথে বোনাস হিসেবে এদেরকে পেয়ে সত্যি ভাল লাগাটা দ্বিগুন হয়ে গেছে”।

ডক্টর বড়ুয়া এবার জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা স্যার, রতীশবাবু কি আপনার নিজের ভাই”?

পরিতোষ ম্লান হেসে জবাব দিল, “সে অর্থে আমার নিজের বলতে তো কেউই নেই স্যার। তবে আপনাদের মত এদের মত সকলের সাথে বিভিন্ন রকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হবার চেষ্টা করি আমি। তবে ওই যে সেদিন আপনাকে বলছিলাম না, আমার খুব কাছের এক প্রিয়জনের কথা। এই রচনার ব্যাপারেই সেদিন কথাগুলো বলেছিলাম। এই রতীশের বোন মন্তির সাথে গত তিন চার বছরে আমার এমন একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে যে সে এখন আমার জীবনের খুব কাছের এক প্রিয়বন্ধু। আর সেই সম্পর্কের সূত্র ধরেই এদেরকেও আমি আমার আত্মীয় বলে ভাবি”।

ডক্টর দিব্যেন্দু চোখ বড় বড় করে রচনাকে দেখতে দেখতে প্রায় অবিশ্বাসের সুরে বললেন, “কী বলছেন আপনি স্যার? ইনিই ...”

পরিতোষ সাথে সাথে চোখের ঈশারায় ডক্টরকে চুপ করবার নির্দেশ দিয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, এই রচনা আর রতীশই আমার বন্ধু মন্তির প্রাণ বলতে পারেন”।

ডক্টর বড়ুয়া আবার কিছু একটা বলবার জন্য মুখ খুলতেই দীপা রচনাকে বলল, “আমিও কিন্তু তোমাকে তাহলে বোন বলেই ডাকব ভাই। আর রতীশও আজ থেকে আমার একটা ভাই। তোমরা আপত্তি করবে না কিন্তু একেবারেই। তা রচনা, তোমার শ্বশুর বাড়ি কি কলকাতাতেই”?

রচনা জবাব দেবার আগেই আকাঙ্ক্ষা বলল, “মা তোমার ভাই হলে তো আমি ওনাকে আঙ্কল বলব না। মামু বলব। ইশ, এতদিনে এখানে মামু বলে ডাকবার মত কাউকে পেলাম। আমার নিজের মামু দু”টাকে তো আমি কাছেই পাই না”।

রতীশ হেসে তার পাশে বসা আকাঙ্ক্ষার মাথায় হাত দিয়ে বলল, “আপত্তি করব কেন মামনি। আজ থেকে আমি তোমার মামুই হলাম। আর ইনি তোমার মামী হলেন”।

আকাঙ্ক্ষা খুশী হয়ে রতীশের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমি কিন্তু তাহলে তোমাদের দু’জনকে মামা মামী বলেই ডাকব। আঙ্কল আন্টি বলব না”।
 

এবার রচনাও আকাঙ্ক্ষার একটা হাত ধরে মিষ্টি হেসে বলল, “আচ্ছা তাই ডেকো সোনা। আমারও ওই ইংরেজী স্টাইলের আঙ্কল আন্টি ডাক শুনতে ভাল লাগে না। কে যে কাকা, কে যে জেঠু, কে পিসি, কে মাসি তা বোঝাই যায় না। বাংলা সম্বোধনটাই ভাল” বলে দীপার দিকে চেয়ে বলল, “আমরাও কিন্তু তাহলে আপনাকে দিদি বলে ডাকব। তবে দিদি, আপনি যেটা বলছিলেন, আমার শ্বশুর বাড়ি বাপের কোনটাই কলকাতায় নয়। আসলে আপনার ভাই একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলবে বলেই আমাদের কলকাতায় আসা। এমনিতে আমার শ্বশুর বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে, জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক্টে। আর আমার বাপের বাড়ি হচ্ছে কালচিনিতে। সেটাও আগে জলপাইগুড়িতে জেলার ভেতরে থাকলেও এখন সেটা আলিপুরদুয়ার জেলায়”।

আকাঙ্ক্ষা রচনার কথা শুনেই তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ও মা, বড়মামুও কি ওই কালচিনিতেই থাকে নাকি গো”?

দীপা বলল, “হ্যাঁ সোনা, তোমার বড়মামুও কালচিনিতেই থাকেন”।

এবার রচনা একটু অবাক হয়ে বলল, “ওমা সেকি দিদি? তোমার বাপের বাড়িও কালচিনিতেই নাকি? কিন্তু কৈ তোমাকে কখনও সেখানে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না”!

দীপা জবাব দিল, “না ঠিক তা নয় রচনা। আমার বাপের বাড়ি আসলে মালবাজারে। তবে আমার এক দাদা মানে আমার আপন বড়দা কালচিনি হাসপাতালে আছেন এখন, উনিও ডাক্তার। এখন তিনি কালচিনি হাসপাতালের ইনচার্জ”।
 

রচনা আর রতীশ দু’জনেই এবার অবাক চোখে দীপার দিকে তাকাল। রতীশ বলল, “তাই নাকি দিদি? কিন্তু কালচিনি হাসপাতালে এখন যে ইনচার্জ তার নাম তো ডঃ শিবরঞ্জন সোম”!

দীপা উৎফুল্ল হয়ে বলল, “হ্যাঁ, সেই তো আমার বড়দা। তোমরা তাকে চেনো নাকি”?
 

রচনা আনন্দে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ দিদি? ডঃ সোম তোমার দাদা? উনি যে আমাদের কত বড় উপকার করেছেন তার জন্য সারা জীবন আমরা সবাই তার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব। আমার দিদি তো প্রায় মরেই যাচ্ছিল। ডঃ সোমই তো তাকে বাচিয়েছেন। আমরাও দিদির অমন খবর পেয়ে কালচিনি গিয়েছিলুম এখান থেকে। এই তো মাত্র মাস দুয়েক আগের কথা। তাই না গো”? বলে রতীশের দিকে চাইল।

রতীশ রচনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদি, রচু একদম ঠিক বলছে। ডঃ সোমের সাথে আমাদের কথাও হয়েছে। সত্যিই খুব ভাল মানুষ। এখনও তো অর্চুদি তার ট্রিটমেন্টেই আছেন”।

দীপা জিজ্ঞেস করল, “অর্চুদি কে”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 179)

রচনা জবাব দিল, “আমার দিদি। সাত বছর ধরে ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ওর ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছে। শেষ অব্দি মেরে ধরে অজ্ঞান করে রেল লাইনে ফেলে দিয়ে এসেছিল রাতের অন্ধকারে। অবধারিত মৃতুর হাত থেকে সে কোনরকমে রক্ষা পেয়েছিল। আর তাকে সুস্থ করে তুলেছেন তো তোমার সেই দাদাই, মানে ওই ডক্টর সোম”।
 

দীপা হঠাৎ বলে উঠল, “এই দাঁড়াও দাঁড়াও। এমন একটা ঘটণা আমি বড়দার মুখে শুনেছিলুম বটে। আচ্ছা তোমার দিদির পুরো নাম কি অর্চনা আচার্যি নাকি”?
 

রচনাও প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল, “হ্যাঁ তো! ওর শ্বশুর বাড়ির উপাধি আচার্যিই। আর ওর নাম অর্চনাই। আমরা বাড়ির লোকেরা ছোট করে অর্চু বলে ডাকি। আমি যেমন রচনা আর রচু, তেমনি”।

দীপা বলল, “দেখেছ, কার সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ হয়ে যায়। বড়দার মুখে ওই মেয়েটার কথা শুনে আমরাও খুব দুঃখ পেয়েছিলুম। আচ্ছা, শোনো রচু। আমরা বরং ভেতরের ঘরে গিয়ে বসি। জমিয়ে গল্প করব। ওরা বরং এখানে বসে কথা বলুক। এসো ভাই” বলে রতীশ রচনা আর আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে ভেতরের ঘরে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই পরিতোষ আকাঙ্ক্ষাকে বলল, “মামনি, একটু এদিকে এস”।

আকাঙ্ক্ষা তার কাছে যেতেই পরিতোষ পকেট থেকে একটা সুন্দর কলমের প্যাকেট আর একটা বড় চকলেটের প্যাকেট বের করে আকাঙ্ক্ষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আর কিছুদিনে মধ্যেই তো তোমার এক্সাম, তাই না? এবারের এক্সামে এই পেনটা দিয়ে লেখবে, কেমন? আর এই চকলেটটাও তোমার জন্য, নাও”।
 

আকাঙ্ক্ষা খুব খুশী হয়ে পরিতোষের গালে একটা চুমু খেয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ আঙ্কল”।

পরিতোষ দুষ্টুমি করে বলল, “উহু, এটা তো চলবে না মামনি। ওরা তোমার বাঙালী মামা মামী হয়ে গেল আর আমি ইংরেজীর সাহেব আঙ্কলই থাকব, এটা কি ঠিক হল”?
 

আকাঙ্ক্ষা হি হি করে হেসে বলল, “আচ্ছা, আজ থেকে তুমি তাহলে আমার কাকু, ঠিক আছে তো”?
 

ভেতরের ঘরে যেতে যেতে রতীশ রচনার কানে কানে বলল, “মন্তির অফিসিয়াল আইডেন্টিটিটা বলে ফেল না যেন মুখ ফস্কে”।

রচনা ঈশারায় সম্মতি জানিয়ে দীপার পেছন পেছন ভেতরের ঘরে গিয়ে ঢুকল। ডক্টর বড়ুয়া পরিতোষের উদ্দেশ্যে বললেন, “স্যার, আপনি কি সেদিনের ওই ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলবেন? তাহলে আমরা বরং ওদিকের ঘরে গিয়ে বসি। কারণ আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অন্য সকলের কাছেই সিক্রেট আছে এখনও”।

পরিতোষ সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমিও আপনাকে সে কথাই বলতে যাচ্ছিলাম। চলুন তাহলে”।

দীপা ওরা যে ঘরে ঢুকেছে সে ঘরের দড়জার কাছে দাঁড়িয়ে ডক্টর বড়ুয়া গলা তুলে বললেন, “দীপা আমরা ও’দিকের ঘরে যাচ্ছি”।

ভেতরে তখন একটা বিছানার ওপর দীপা, রচনা আর আকাঙ্ক্ষা জমিয়ে বসেছে, আর রতীশ একটা চেয়ারে বসা। অন্য ঘরে এসে বসতেই ডক্টর বড়ুয়া পরিতোষকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা স্যার, সেদিন আপনি যার বিপদের কথা বলছিলেন সে কি এই মেয়েটাই”?

পরিতোষ ঠাণ্ডা গলায় বলল, “হ্যাঁ স্যার, দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি কথা। তবে প্লীজ স্যার। এ ব্যাপারে ওরা যেন কোনরকম হিন্টস না পায়, এ ব্যাপারে একটু সাবধান থাকবেন। ওরা এ’সব ব্যাপারে কিছুই জানে না। আমরা যারা জানি, তারা ওদের কাছে গোটা ব্যাপারটাই এখনও লুকিয়ে রেখেছি। কারণ ওরা জানতে পারলেই দুশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করবে। তাই আমি চাই না ....”

পরিতোষের মাঝপথেই ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “বুঝেছি স্যার, বুঝেছি। এ ব্যাপারে আপনাকে আর দ্বিতীয়বার কিছু বলতে হবে না। আর দীপাকেও এ ব্যাপারে আমি এখনও কিছু বলিনি। আর ভবিষ্যতেও বলব না। আসলে যে কাজটা করতে যাচ্ছি, সেটা তো একজন ডাক্তারের পক্ষে সত্যি নিন্দনীয় কাজ। তাই দীপাকে আমি কখনোই এ ব্যাপারে কিছু জানাব না। কিন্তু ওরা কালচিনির যে ঘটণাটা নিয়ে আলাপ করছিল, সেটাও সত্যি খুব স্যাড। ঘটণাটা আমরা মোটামুটি জানতাম। আসলে ওই অর্চনা আচার্যির কেসটা এতটাই সিরিয়াস ছিল যে অমন ছোট একটা হাসপাতালে বড়দা যে তাকে সুস্থ করে তুলেছেন, সেটা আমি নিজেও বিশ্বাস করতে পারিনি। তবে মেয়েটা যতদিন হাসপাতালে ছিল বড়দা আমার সাথে রোজই কেসটা নিয়ে আলোচনা করতেন। আমার কাছ থেকে রেগুলার সাজেশান নিতেন। কিন্তু ওই সময়ে কালচিনি থানার ওসি ছাড়াও আরও এক লেডি আইপিএস অফিসারের কথা আমি শুনেছিলাম। সেই অফিসার নাকি মেয়েটার এক আত্মীয়। সে তাহলে কে ছিল”?

পরিতোষ বুঝতে পারল যে ডঃ দিব্যেন্দু সীমন্তিনীর কথা বলছেন। কিন্তু তার পুলিশী মন সাথে সাথেই তাকে সতর্ক করে দিল। তাই একটু হেসে জবাব দিল, “আসলে স্যার, কালচিনির ওই ঘটণাটার ব্যাপারে আমি আগে কিছুই শুনিনি। আজই প্রথম বৌদি আর রচুর মুখে কথাটা শুনছি। তাই ওই লেডি আইপিএস অফিসারের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। হতে পারে, সেও হয়তো আশেপাশের কোন জায়গায় পোস্টেড ছিল, বা কোনভাবে ওই কেসের সাথে জড়িত ছিল। আমি শুধু এটুকুই জানি, রচনার দিদি একটা মারাত্মক বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছে। তার নাকি প্রাণ সংশয় হয়ে পড়েছিল একেবারে। বাঁচবার আশা নাকি প্রায় ছিলই না। আর কালচিনির মত ছোট একটা পাহাড়ি হেলথ সেন্টারের এক ডাক্তার নিজের অসাধারণ বিদ্যা বুদ্ধি আর চিকিৎসায় তাকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন”।
 

ডক্টর দিব্যেন্দু বললেন, “আচ্ছা, বেশ ও নিয়ে আলোচনা করে তো এখন আর কোন লাভ নেই। যা হবার ছিল, সেটা হয়েই গেছে। আমরা বরং বর্তমানের ঘটণা নিয়েই কথা বলি। তা স্যার, আপনি বলছেন এই রচনাই অমন বিপদে পড়েছে”?
 

পরিতোষ জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার। রচনাকে তো নিজের চোখেই দেখলেন আপনি। এমন ফুটফুটে মিষ্টি একটা মেয়ের ওপর কেউ অমন কূনজর দিলে, আর বিশেষ করে সে যদি আমার খুব কাছের কেউ হয় তাহলে কি নিজেকে সংযত রাখা যায় বলুন? আসলে রতীশ রচনা ওরা এখানে আসবার আগে থেকেই ওদের ওপর ওই বিমল আগরওয়ালার নজর পড়েছিল। যার ওপর ভরসা করে রতীশ এখানে ইনস্টিটিউট খোলবার স্বপ্ন নিয়ে এসেছিল সে লোকটাই তার টাকা পয়সা লুঠ করে পালিয়েছিল। যার ফলে রতীশ এখন অন্য একজনের ইন্সটিটিউটে ট্রেনার হিসেবে কাজ করছে। আর সেই লোকটাই এই বিমল আগরওয়ালার সাথে চুক্তি করেছিল যে রচনাকে তার হাতে তুলে দেবে। কিন্তু সেই লোকটা অন্য একটা কেসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ায় বিমল আগরওয়ালার স্বপ্ন সফল হয়নি। ওই লোকটার কাছ থেকেই বিমল রচনার ছবি পেয়েছিল। আর ওরা বরানগরে যেখানে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে, সেখানকার ঠিকানাও যোগাড় করে ফেলেছে। তাই সে এখন আরেকজন আনসোশ্যাল দালালের সাথে যোগাযোগ করেছে রচনাকে ভোগ করবার উদ্দেশ্যে। এদিকে কাকতালীয় ভাবেই রতীশের বোন মন্তি কথাটা জানতে পেরেছে। মন্তি এখানে থাকেনা। সেও ডুয়ার্সের একটা জায়গায় সরকারি চাকুরিতে পোস্টেড। তাই আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে যে আমি যেন ওর দাদাভাই আর তার স্ত্রীকে সবরকম বিপদ থেকে দুরে রাখতে পারি”।

এতটা বলে একটু থেমে আবার বলল, “স্যার, আর একটা কথা আমি সকলের কাছে গোপন রেখেছি। কিন্তু আপনাকে না বললে আপনি ঠিক বুঝতে পারবেন না আমি রচনাকে নিয়ে কেন এতটা সিরিয়াস। আসলে ডক্টর, এই মন্তিকে আমি এক সময় ভাল বেসেছিলাম। ওকে বিয়েও করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মন্তি খুব ছোটবেলা থেকেই একজনকে ভালবাসত। তাকেই মনে মনে নিজের স্বামী হিসেবে মানতে শুরু করেছিল। এ’কথাটা প্লীজ আপনি কিন্তু অন্য কারো সাথে এমনকি বৌদির সাথেও শেয়ার করবেন না স্যার। মন্তি যদিও ছোটবেলা থেকেই জানত যে ওর প্রেমিককে ও কখনোই নিজের স্বামী হিসেবে পাবে না, কারন ছেলেটা ওর খুব নিকটাত্মীয়। তবু তাকেই সে মনে মনে নিজের স্বামী বলে মানে। নিজের ছোট্ট বেলার ভালবাসাকে এভাবে বুকে আঁকড়ে ধরে থাকতে আমি আর কাউকে দেখিনি। তাই ওর ভালবাসাকে সম্মান জানিয়ে আমি বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু তারপর থেকে আজ অব্দি আমরা একে অপরের পরম বন্ধু, পরম হিতৈষী হয়ে আছি। তাই মন্তির কোন অনুরোধই আমি কখনও ফেলতে পারি না। রতীশ মন্তির দাদা। আর রতীশের সাথে বিয়ে হবার অনেক আগে থেকেই মন্তি রচনাকে নিজের বোন বলে ভাবে। তাই রচনা একদিকে যেমন মন্তির বৌদি, অন্যদিকে সে মন্তির বান্ধবী এবং বোনও। তাই বুঝতেই পারছেন আন্তরিক ভাবে ওরা একে অপরের কত কাছাকাছি। আর সেজন্যেই রচনার এমন কথা শুনে বন্ধু হিসেবে আমার ওপরেই রচনার সুরক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে ও। আর বিমল আগরওয়ালা লোকটার এতোটাই প্রভাব প্রতিপত্তি যে ব্ল্যাকমানির কুমীর হওয়া সত্বেও, গত দশ বছর ধরে অনেকবার ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট, এনফোর্সমেন্ট, অ্যান্টিকরাপশন বুরো, থানা পুলিশ তার পেছনে লেগেও তার কেশাগ্রও ছুঁতে পারে নি। উল্টে তারাই বিপদে পড়েছে নানাভাবে। আর লোকটা নিজের পয়সা প্রতিপত্তির জোরেই এমনভাবে স্টেট গভঃমেন্ট আর সেন্ট্রাল গভঃমেন্টের মেশিনারিগুলোকে কব্জা করে ফেলেছে, যে সে সবরকম ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। এক দালালের খপ্পর থেকে রচনাকে রক্ষা করতে পারলেও বিমল আবার কোন না কোন ভাবে রচনার ক্ষতি করতে চাইবেই। লোকটার ঘরে মোটামুটি সুন্দরী স্ত্রী আছে, উঠতি বয়সের একটা যুবক ছেলেও আছে। তা সত্বেও সে রোজ কোন না কোন মেয়ের শরীর ভোগ না করে থাকতে পারে না। তার অফিসের কর্মাচারী মেয়েরা ছাড়াও আরও অনেক মেয়ে মহিলা এই বিমলের লোভের শিকার হয়েছে। আর প্রতিনিয়ত হয়ে যাচ্ছে। তারা কেউ মুখ ফুটে কিচ্ছুটি বলতে পারে না। দু’একজন দুঃসাহসী হয়ে পুলিশের সাহায্যও চেয়েছিল। কিন্তু নিজে পুলিশ হয়ে নিজেরই বলতে লজ্জা করছে স্যার, পুলিশের লোকেরাই ওই মেয়েগুলোকে ভোগ করে তাদের ওপর অবিচার করেছে। আবার উল্টোদিকে বিমলের কাছ থেকেও পয়সা খেয়েছে, তাকে বিপদমুক্ত করেছে বলে। তাই এ লোকটাকে শায়েস্তা করার আর অন্য কোন উপায় নেই। আইনি ভাবে সব কিছু করেও একে আটকানো যাবে না। দু’ঘন্টাতেই আইনের পথ ধরেই লকআপ থেকে বেড়িয়ে আসবে সে। আর বেড়িয়ে এসে আমাকেই সে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে। তাই নিরূপায় হয়ে আমাকে এমন একটা পথ বেছে নিতে হচ্ছে। আড়াই বছর আগে আপনাদের কেসে যেভাবে এনকাউন্টার করে বদমাশগুলোকে গুলি করে মেরেছিলাম, তেমনটা করতে পারলে আর আপনার কাছে আমায় আসতে হত না। আসলে লোকটা পয়সার জোরেই নিজেকে এমন একটা জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করেছে, যে তাকে শুট করলে রাজনৈতিক মহলে সাংঘাতিক রকমের হূলুস্থুল পড়ে যাবে। সেটা সামাল দেওয়া হয়ত খুব কঠিণ ব্যাপার হবে। তাই বাধ্য হয়ে আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। আমি লোকটাকে মেরে ফেলতে চাইছি না। আমি শুধু এটুকু করব যে ও বেঁচে থাকলেও আর অন্য কোন মেয়ের সর্বনাশ করতে পারবে না। তাহলেই আমি রচনাকেও পুরোপুরি বিপদমুক্ত করতে পারব”।

এমন সময় ঘরের বাইরে থেকে দীপার গলা শোনা গেল, “এই তোমাদের চা কি ওখানে পাঠিয়ে দেব না তোমরা এখানে একসাথে বসে খাবে আমাদের সাথে”।
 

ডক্টর দিব্যেন্দু জবাব দিল, “এখানেই পাঠিয়ে দাও গো। আমরা একটু আলোচনায় ব্যস্ত আছি” বলে পরিতোষের উদ্দেশ্যে বলল, “স্যার, আমি জানি, আপনি সমাজের অনেক নির্দোষকে বাঁচাবার জন্য এমন অনেক কিছুই আইন বহির্ভূত কাজ করে থাকেন। সেজন্যে আমি মনে মনে আপনাকে খুবই শ্রদ্ধা করি। আর এবারেও যে তেমনই কিছু একটা করবার উদ্দেশ্যে আমার সাহায্য চেয়েছেন, সেটাও বুঝতে পেরেছিলাম আমি। কিন্তু নিজের মনকে কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছিলাম না। আজ রচনাকে দেখে আর আপনাদের ভেতর এমন একটা সম্পর্ক আছে দেখে, আমি নিজেও জীবনে প্রথমবার কোন একটা অনৈতিক কাজ করতে হয়ত রাজী হয়েই যাব। কিন্তু স্যার, আপনাকে একটা কথা কিন্তু দিতে হবে”।

পরিতোষ প্রায় সাথে সাথেই বলল, “হ্যাঁ বলুন ডক্টর কী চান আপনি। তবে আমি আপনাকে আগেই বলে রাখছি, আপনার কাজের যথাযথ পারিশ্রমিক কিন্তু আমি দেব”।
 

ডক্টর বড়ুয়া পরিতোষের কথা শুনে নির্বাক হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই রচনা আর দীপা দুটো ট্রেতে করে অনেক কিছু খাবার দাবার আর কফি নিয়ে ঢুকল। দীপা একটা ছোট টেবিলের ওপর জিনিসগুলো নামাতে নামাতে তার স্বামীকে বলল, “এই কফিটা কিন্তু তোমার এই নতুন শালার বৌ বানিয়েছে। খেয়ে দেখ কেমন বানিয়েছে” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “স্যার, আপনারা কিন্তু আজ এখানে ডিনার করে তবে যাবেন”।
 

পরিতোষ হা হা করে উঠে বলল, “না না বৌদি, এ কী বলছেন আপনি? ওদের দু’জনকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবে তো আমাকে বাড়ি যেতে হবে। খুব দেরী হয়ে যাবে তো”।

দীপার পাশে রচনা মুচকি মুচকি হাসছে। দীপা পরিতোষের কথার জবাবে বলল, “হোক দেরী। তবু আমি আজ আপনাদের সকলকে না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়ব না। আমার নিজের কোন ছোট বোন নেই। আজ রচু আর রতুর সাথে সুন্দর একটা সম্পর্কের শুরু হল। মনে হচ্ছে আমি একটা মিষ্টি বোন পেলাম। তাই আজ আমি কারো কোন কথা শুনছি না” বলতে বলতে রচনার হাত ধরে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল।

কফির কাপ হাতে তুলে পরিতোষ ডক্টর বড়ুয়াকে কিছু একটা বলতে যেতেই তিনি বললেন, “এ ব্যাপারে আমার কাছে অ্যাপীল করে কোন ফল পাবেন না স্যার। তাই ও’সব নিয়ে ভাবা বাদ দিন। আমরা বরং আমাদের আলোচনাই করি”।
 

পরিতোষ একটু অসহায়ভাবে বলল, “কিন্তু স্যার, একটা বড় মুস্কিল আছে। কথাটা বলতে চাইছিলাম না। কিন্তু এখন না বলে আর উপায় নেই। আসলে স্যার, রচনা আর রতুর ওপর আমি চব্বিশ ঘন্টা নজর রেখে যাচ্ছি কিছু স্পেশ্যাল সিকিউইরিটির মাধ্যমে। আমরা যে আপনার এখানে এসেছি, এখানেও একটা টিম আমাদের ওপর আর আমরা যে গাড়িতে এসেছি তার ওপর একটানা নজর রাখছে। ওই শয়তান বিমল আগরওয়ালার ক্ষমতার কথা ভেবেই এ সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হয়েছে। লোকটা চাইলে যে কোনও সময় রচনাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু রচনা বা রতীশ কেউ এ’কথা জানে না। তারা এর বিন্দু বিসর্গ টের পেলেই মনে মনে ঘাবড়ে যাবে, তাই তাদের কাছে ব্যাপারটা পুরোপুরি অজানা। কিন্তু আমরা যতক্ষণ বাইরে থাকব ততক্ষণ তো ওই টিমের লোকগুলোকেও ডিউটি করে যেতে হবে”।

ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “তারা যদি চব্বিশ ঘন্টাই ডিউটিতে থাকে তাহলে আপনারা এখান থেকে চলে গেলেই তো তারা ছুটি পাচ্ছে না স্যার। আপনি রতীশ আর রচনাকে তাদের ঘরে রেখে চলে যাবার পরেও তো তাদের ডিউটি চালু থাকবেই। তবে হ্যাঁ, তারা হয়ত সময় মত তাদের ডিনারটা সারতে পারবে না। তবে আপনি যদি বলেন আমি তাদের জন্যেও খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি। কিন্তু দীপা আপনাকে যে’কথা বলে গেল সে কথার বিরোধিতা করবার সাধ্য বা ইচ্ছে কোনটাই আমার নেই। গত আড়াইটে বছরে দীপা অনেকবার আমাকে বলেছে আপনাকে একদিন আমাদের এখানে নিয়ে আসতে। আমারও খুব সাধ ছিল। আজ আমি যে বেঁচে আছি, আমাদের পরিবারটা যে বেঁচে আছে, সেটা তো স্যার আপনার দয়াতেই। সেদিন ভাইজ্যাগের ওই লেকের ধারে ভগবানের মত আপনি যদি আমাদের পাশে এসে না দাড়াতেন, তাহলে যে কী হত সেটা ভাবতেও তো ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। আমার ছোট্ট মেয়েটাও ওই আড়াই বছর আগের ওই দিনটার পর থেকেই আপনাকে ভগবান ভাবতে শুরু করেছে। ও তো আমাকে খুব বেশী সময় কাছে পায় না স্যার। শুধু এই সোমবারের দিনটাই। এমন একটা সোমবারও যায়নি যেদিন ও আপনাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসবার কথা বলেনি। সেদিনটার পর থেকে আপনার সাথে দেখা করবার বা আপনাকে আমাদের এখানে আনবার কথাও বহুবার ভেবেছি। কিন্তু সেটা পারিনি স্যার। কারন আপনি নিজেই সে পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আজ যখন ঘটণাচক্রে আমাদের ঘরে এসেই পড়েছেন, তখন যদি আমাদের বাড়িতে দুটো খাবার খেয়ে যান, তাহলে আমরা সত্যি খুব খুশী হব”।

পরিতোষ হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গীতে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “এমন করে বলবেন না ডক্টর প্লীজ। দেখুন স্যার, সেদিন আমি কিন্তু যতটুকু করেছি তা নেহাতই আমার বিবেকের তাগিদে। আমার বিবেক যেটাকে ঠিক বিবেচনা করে, বেআইনী হলেও আমি তা করতে দ্বিধা বোধ করি না। সেদিনও আমি যা করেছি তা আইন বিরুদ্ধ। তবে এমন আইন বিরুদ্ধ কাজ করতে আমাকে আগুপিছু অনেক কিছু আগে থেকে ভেবে নিতে হয়। যাতে আমি নিজে কোন বিপাকে না পড়ি। যেমনটা এই রচনার কেসে করছি। তবে সেদিন আপনাদের ওই ঘটণার সময় আমার পক্ষে আগে থেকে কোনও প্ল্যানিং করা সম্ভব হয়নি। আর তার আগে আপনাদের কাউকেই আমি চিনতাম না। তাই ওই মূহুর্তে স্পটে দাঁড়িয়ে কিছু ভাবার অবকাশও ছিল না। এক মূহুর্ত দেরী হলেও আপনাদের চরম বিপদ হয়ে যেত। আর সে আশঙ্কার কথা ভেবেই সেদিন সরাসরি এনকাউন্টার করে দিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নইলে আপনাদের বাঁচাতে পারতাম না”।

ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “জানি স্যার। তবে সেদিন জানতুম না, কিন্তু আজ জানি কেন লোকে আপনাকে পুলিশ রবিনহুড বলে ডাকে। কিন্তু স্যার, একটা কথা আমি কিন্তু এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না স্যার। তবে আপনি আমায় আপনার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখতে কেন বারণ করেছিলেন? আপনি কি অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত কারো সাথে কোন রকম ঘণিষ্ঠতা রাখতে চান না? না কি এর পেছনে অন্য কোনও কারন আছে”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 180)

পরিতোষ কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “আপনি যেমনটা ভাবছেন, তেমনটা নয় ডক্টর। আপনার কথা বৌদির কথা আর বিশেষ করে আকাঙ্ক্ষা মামনির কথা আমি কোনদিন ভুলিনি। আপনাদের সাথে দেখা করার ইচ্ছেও যে কখনও হত না এমনও নয়। কিন্তু আপনাদের সাথে যোগাযোগ না রাখবার পেছনে দুটো বড় কারন ছিল। প্রথম কারনটা হচ্ছে, আপনারা সেদিন যেমন একটা গ্যাঙের খপ্পরে পড়েছিলেন, ওই সব গ্যাংগুলোর ছড়ানো ছিটানো অনেক শাখা প্রশাখা থেকে থাকে। গ্যাঙের কেউ কারো হাতে মার খেলে, বা কারও হাতে যদি গ্যাঙের কোন লোক মারা যায়, তাহলে তাকে বা তাদেরকে খুঁজে বের করে মেরে না ফেলা পর্যন্ত তারা শান্ত হয় না। আমি ভেবেছিলাম, ওই গ্যাংটাও তেমনি হবে। তাই ওই ঘটণার পর তাদের গ্যাঙের বাকি সদস্যরা আমাকে বা আপনাকে খুঁজে বের করবার চেষ্টা করবেই। আমার নিজের ব্যাপারে আমি তো সবসময়ই এলার্ট থাকি। আমার ওপর চট করে কেউ হামলা করতে চাইবে না। কিন্তু আপনাদের হদিশ পেয়ে গেলে আপনারা আবার বিপদের মুখোমুখি হতেন। আমার সাথে আপনাদের যোগাযোগ থাকলে বা আমাদের মধ্যে পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত থাকলে ওরা খুব সহজেই আবার আপনাদের হদিশ পেয়ে যেত। তাতে করে আবার বিপদের সম্ভাবনা দেখা দিত। এসব ভেবেই আপনাকে অমন অনুরোধ করেছিলাম। আসলে আমি এমনই একটা কাজের সাথে যুক্ত আর নৈতিক কিংবা অনৈতিক এমন সব কাজ করি যে আমাকে যে কোনও কাজের প্রতিকূল পরিণতির কথাই বেশী করে ভাবতে হয়। ওই একটা কথা আছে না? হোপ ফর দা বেস্ট বাট প্রিপেয়ার ফর দা ওয়ার্স্ট। আর খারাপ সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতেই আমাকে এভাবে প্রিয়জনদের অনেক আদর আহ্বান উপেক্ষা করতে হয়। আজ আপনাকে একটা কথা বলছি স্যার। যে গ্যাঙের লোকেরা সেদিন আপনাদের ওপর হামলা করেছিল, সে গ্যাঙের সবকটা ক্রিমিন্যালকে জেলে ঢোকাতে প্রায় একটা বছর সময় লেগেছে। ওদের সব ক’টাকে জেলে না পোড়া অব্দি আপনাদের পুরোপুরি সুরক্ষিত করতে পারতাম না আমি। এখন আর চট করেই আপনাদের ওপর ওদিক থেকে আর কোনও বিপদ নেমে আসবার সম্ভাবনা নেই। অন্ততঃ ছ’টা বছর এখন নিশ্চিন্ত। আপনাকে যে আমার সাথে যোগাযোগ রাখতে বারণ করেছিলাম তার মূল কারন কিন্তু এটাই ছিল। আর দ্বিতীয় কারনটা নেহাতই আমার কর্মব্যস্ততা। আর কিছুই নয়। তবে এবারে আমার পার্সোনাল মোবাইল নাম্বারটা আপনি নোট করে রাখুন। এখন মাঝে মধ্যে ইচ্ছে হলে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবেন”।

পরিতোষ একটু থেমেই আবার বলল, “এক মিনিট ডক্টর, আমি একটা ফোন করে নিই একটু” বলে পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নাম্বার ডায়াল করে বলল, “হ্যাঁ শোন, ওদিকে কোন গন্ডগোল নেই তো”?

অপর প্রান্তের কথা শুনে বলল। “ঠিক আছে। তবে শোন, আমাদের এখান থেকে বেরোতে দেরী হবে। রাত দশটা সাড়ে দশটা হয়ে যেতে পারে। বা তার বেশীও হতে পারে। তোদের যদি ডিনার করতে হয় তাহলে এদিকেই সেরে নিস। তবে একজন একজন করে। একজন ডিনার করতে গেলে বাকিরা সজাগ থাকবি, বুঝেছিস তো”?

আবার কয়েক সেকেন্ড ওদিকের কথা শুনে বলল, “ওকে, সেভাবেই করিস তাহলে। রাখছি”।

ফোন বন্ধ করে পকেটে রাখতেই ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “ওদের খাবারের বন্দোবস্ত তো আমরাই করতে পারতাম স্যার”।

পরিতোষ একটু হেসে জবাব দিল, “আপনি ক্ষেপেছেন স্যার? ওদের খাবার বন্দোবস্ত এখানে করলে খুব গড়বড় হয়ে যাবে। বৌদি, রচনা রতীশ এরা সবাই জেনে যাবে যে ওদের ওপর নজর রাখবার জন্যে আমি লোক লাগিয়ে রেখেছি। আচ্ছা, ও’কথা ছাড়ুন। ওদের আমি প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। ওরা নিজেরা নিজেদের মত করে ডিনার সেরে নেবে। কিন্তু আপনি এবার আমাকে বলুন, আপনার কাছে আমি যেমন সাহায্য চাইছি, সেটা আপনার পক্ষে করা সম্ভব হবে তো? মানে সোজা কথায়, আপনার ডাক্তারি এথিক্সের বাইরে গিয়ে কাজটা করতে আপনার মন সায় দিচ্ছে তো? আসলে আমি যেমন আমার বিবেকের কাছে পরিষ্কার তেমনি এটাও চাইনা যে বিবেকের বিরূদ্ধে গিয়ে কেউ আমার কথায় কোন কাজ করুক। কারো কাছ থেকে জোর করে কোন ফেভার নিই না আমি”।

ডক্টর দিব্যেন্দু জবাব দিলেন, “সত্যি বলছি স্যার, আপনারা আজ আমাদের ঘরে আসবার সময় পর্যন্তও আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলুম না। আপনি ও ব্যাপারে জানতে চাইলে আমি যে কী জবাব দেব তা যেন বুঝতেই পাচ্ছিলাম না। কিন্তু রচনাকে দেখে, আর আপনার মুখে ওর বিপদের যে সম্ভাবনার কথা শুনলুম তার গম্ভীরতা বুঝতে পেরে আমি মোটামুটি মনস্থির করে ফেলতে পেরেছি। হোক এথিক্সের বাইরে। কিন্তু একটা নিষ্পাপ মেয়েকে বিপদমুক্ত করতে, এটা আমি করব, নিশ্চয়ই করব। আর আশা করি আমার বিবেকও আমাকে পিছু টানবে না। কিন্তু স্যার। বুঝতেই তো পারছেন, দীপার সাথে এ ঘটণাটা আমি তো কিছুতেই শেয়ার করতে পারব না। তাই স্যার, আপনাকেও আমি অনুরোধ করছি, দীপা বা আকাঙ্ক্ষা ওরা কেউ যেন ব্যাপারটা ঘূণাক্ষরেও জানতে বা বুঝতে না পারে”।

পরিতোষ উঠে দাঁড়িয়ে ডক্টর বড়ুয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। থ্যাঙ্ক ইউ এ লট”। তারপর আবার চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “তবে ডক্টর আরো একটা ব্যাপার কিন্তু আপনাকে জানাবার আছে আমার। আপনি তো জানেনই এ কাজটা তিনটে ফেজে করবার প্ল্যান করেছি। আপনার কাজটা লাস্ট স্টেজে। শুরুতে আমি ভেবেছিলাম যে প্রথম দুটো ফেজের কাজ হতে হতে তিরিশ পঁয়ত্রিশ দিন লেগে যাবে। তাই ভেবেছিলাম আপনার কাজটা শুরু বা শেষ হতে এখনও দেরী আছে। কিন্তু আমার প্রথম স্টেজের কাজটা অবিশ্বাস্য রকম কম সময়ে শেষ হয়ে যাওয়াতে পরের সিডিউল গুলো বাধ্য হয়েই এগিয়ে আনতে হয়েছে। তাই আপনার কাজের সিডিউলটা ফিক্স করা হয়েছে সামনের সতের তারিখে। আপনার কাজটা কিন্তু সেদিন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকেই শুরু করতে হবে। দিনটা কাকতালীয় ভাবে বিশ্বকর্মা পূজোর দিন। আপনার হয়ত তাতে একটু অসুবিধে হতে পারে। তবে ডক্টর কাজটা কিন্তু আর রিসিডিউল করা যাচ্ছে না, তাই ওই দিনই অপারেশনটা করতে হবে। আর সময়ও হাতে বেশী নেই একেবারেই। মাঝে মাত্র আর ছ’টা দিন। এই ছ’দিনের ভেতরেই কিন্তু আপনাকে সবরকম প্রিপারেশন নিতে হবে”।
 

ডক্টর বড়ুয়া এক মূহুর্ত চিন্তা করে বলল, “আমি নিজে তো যে কোনদিনই সেটা করে ফেলতে পারব স্যার। কিন্তু এ কাজে অ্যাসিস্ট করবার জন্য একজন নার্স আর একজন এনেস্থেসিস্ট আমার সঙ্গে থাকা খুবই দরকার। এনেস্থেসিস্ট সঙ্গে নিতে হলে ব্যাপারটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে। তাই এমন একজন সিনিয়র আর এফিসিয়েন্ট নার্স, যে কিনা এনেস্থেসিস্টের কাজও জানে, এমন কাউকে পেলেই খুব ভাল হয়। শুধু সেটা নিয়েই একটু ভাবতে হবে, আর তাতে দু’ একটা দিন লাগতেই পারে”।

পরিতোষ তখন বলল, “আচ্ছা ডক্টর অপারেশনটা করতে কতটা সময় লাগতে পারে আর অপারেশনের কতক্ষণ পর তার সেন্স ফিরে আসবে? বা তাকে কতক্ষণ হাসপাতালে থাকতে হবে”?

ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “আসল কাজটা করতে ম্যাক্সিমাম আধঘণ্টা লাগবে। তবে তাকে কতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে, এটা তো আগে থেকেই বলা সম্ভব নয় স্যার। এটা ডিপেন্ড করবে, কতটা ইনজুরি হয় তার ওপর। খুব বেশী ইনজুরি না হলে হয়তো পরের দিনই রিলিজ করে দেওয়া যাবে”।

পরিতোষ বলল, “হাসপাতালে সে এক মাস পড়ে থাকলেও কোন সমস্যা নেই ডক্টর। আর হাসপাতালের নিয়ম মোতাবেক আপনি সব ফরমালিটিই যথাযথ ভাবে করবেন। যাতে হাসপাতালের নিয়ম পূরণে কোন রকম ফাঁক না থাকে। আপনার ওপর কেউ যেন কোনরকম সন্দেহ করতে না পারে। আর হাসপাতালের বিলও যথাযথ পেমেন্ট হয়ে যাবে। কিন্তু যে ব্যাপারটা নিয়ে আমি ভাবছি, সেটা হল, তাকে যতদিন হাসপাতালে থাকতে হবে ততদিন তার নার্সিংএর জন্য বিশেষ দুই বা তিন জন নার্সের বন্দোবস্ত করতে হবে। কারন তার শরীরের কোথায় অপারেশন করা হয়েছে, আর কী ধরণের অপারেশন করা হয়েছে, সেটা অন্যান্য নার্স বা ডক্টররা জেনে ফেলুক, এটা আমি চাই না। তাই সিলেক্টেড তিন বা চার জন নার্সকে শিফটিং করে তার নার্সিংএ রাখতে চাই। এতে করে আপনার ঝুঁকিটাও অনেক কমে যাবে। আর আমার পারপাসও ফুলফিল হবে। আপনি যদি তেমন কয়েকজন নার্সের বন্দোবস্ত করতে পারেন, তাহলে খুবই ভাল হয়। তবে তার জন্যে তাদের যদি এক্সট্রা পারিশ্রমিক দিতে হয় তার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। আর আপনার পক্ষে সেটা করা সম্ভব না হলে এখনই আমাকে সেটা পরিষ্কার ভাবে বলে দিন। আমি সেটা অন্যভাবে ডিল করব”।
 

ডক্টর বড়ুয়া একটু ভেবে বলল, “আপনার সাজেশানটা সত্যি খুব ভাল। কিন্তু স্যার, আমি যদি সেটা করতে যাই, তাহলে হাসপাতালের অন্য কেউ হয়ত ভাবতে পারে যে এর পেছনে আমার কোনও রকম দুরভিসন্ধি বা স্বার্থ আছে”।
 

পরিতোষ বলল, “বেশ, তাহলে ও ব্যাপারটা আমি অন্যভাবে সামলে নেব। সেটা নিয়ে তাহলে আপনাকে আর টেনশন করতে হবে না। তবে হাসপাতালে পুলিশ না আসা পর্যন্ত ব্যাপারটা কিন্তু আপনাকেই ট্যাকেল করতে হবে। মানে পুলিশ না আসা অব্দি তার নার্সিংএ শুধু বিশেষ একজন নার্সকে রাখবার চেষ্টা করবেন। সেটা সম্ভব হবে তো আপনার পক্ষে”?
 

ডক্টর বড়ুয়া বললেন, “হ্যাঁ সেটুকু আমি অবশ্যই করতে পারব স্যার। পেশেন্টের সিরিয়াসনেসের কথা ভেবে আমরা বিশেষ কোন নার্সকে পেশেন্টের সেবায় রাখতেই পারি, অন্ততঃ কিছু সময়ের জন্য”।

পরিতোষ বলল, “ব্যস তাহলেই হবে। বাকিটা আমি সামলে নেব। তবে ডক্টর সিডিউলটা মনে রাখবেন প্লীজ। সতের তারিখ, সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আপনার হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সটা গিয়ে পৌঁছবে। তারপরই ব্যাপারটা আপনি টেক আপ করবেন প্লীজ। তবে আমার মনে হয়, আপনি আরও আধঘণ্টা আগে থেকেই হাসপাতালে থাকলে ভাল হয়। কারন অ্যাক্সিডেন্ট কেস বলে কথা। আর সেদিন বিশ্বকর্মা পূজো বলে রাস্তায় ট্র্যাফিক কম থাকলে অ্যাম্বুলেন্স হয়ত সময়ের কিছু আগেই গিয়ে পৌঁছতে পারে। তাই আগে থেকে আমাদের প্রিপেয়ার্ড থাকা উচিৎ, তাই না ডক্টর”?

ডক্টর দিব্যেন্দু বললেন, “হু, ঠিক বলেছেন স্যার। আমি সন্ধ্যা সাতটা থেকেই হাসপাতালে থাকব। আর পেশেন্টকে কিভাবে কী করব, অপারেশনের জন্য একজন বিশ্বস্ত নার্স রাখা, সবটাই আমি সামলে নেব। আপনি চিন্তা করবেন না”।

পরিতোষ একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে বলল, “আপনার কথায় আশ্বস্ত হলাম ডক্টর। তবু আরেকবার আপনাকে বলছি, আমাদের দু’তরফেই সিক্রেসীটা যেন বজায় থাকে। সেদিকে যেন আমাদের কোন তরফ থেকেই কোনও গাফিলতি না হয়”।
 

ডক্টর দিব্যেন্দুও সায় দিয়ে বললেন, “অবশ্যই স্যার। সেটা আপনার ও আমার দু’জনের পক্ষেই জরুরী” বলে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, “তাহলে চলুন, এবার আমরা গিয়ে বরং ওদের সকলের সাথে গল্প করি”।

রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ যখন আকাঙ্ক্ষা, দীপা আর ডক্টর বড়ুয়া, রচনাদের সবাইকে গুড নাইট বলে বিদায় দিল তখন তাদের দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না যে আজই রচনা আর রতীশের সাথে তাদের প্রথম পরিচয় হয়েছে।
 

**************

__________________________________
ss_sexy
Like Reply
কেসের জাল গুটিয়ে আসছে শীঘ্রই মনে হচ্ছে
[+] 1 user Likes Mr Fantastic's post
Like Reply
(Update No. 181)

বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সীমন্তিনী অফিস থেকে বেড়িয়ে নিজের কোয়ার্টারে না এসে বাজারের দিকে চলল। সে কথাটা আগেই মনে মনে ভেবে রেখেছিল যে বিয়ের ব্যাপারে অর্চনার মতামত নেবার আগে নবনীতার সাথে কথা বলাটা খুব প্রয়োজন। পরির তরফ থেকে কোনও বাধা যে আসবে না, এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত। নবনীতা পরিতোষকে বিয়ে করতে রাজী না হলেও একটা সময় সে তো পরিকে ভাল বেসেছিল। তাই পরিতোষের ওপর সামান্য কিছু দুর্বলতা তার এখনও থাকতেই পারে। যদিও সে নিজে মুখেই বলেছে যে সীমন্তিনীর সাথে হাতে হাত মিলিয়েই সে পরিতোষের জন্য একটা ভাল পাত্রীর সন্ধান করবে। কিন্তু নিজের ভালবাসার লোককে অন্যের হাতে তুলে দিতে অনেকেরই বুক কেঁপে ওঠে। তার মনে পড়ে গেল রাজগঞ্জের বাড়িতে কাটানো সেই রাতটার কথা। রতীশ আর রচনার বিয়ের আগে শেষবার যখন সে রাজগঞ্জ গিয়েছিল। নিজের ভালবাসার লোকটাকে চিরদিনের জন্য রচনার হাতে তুলে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে রতীশ আর তার ভেতরে সে রাতে রতীশের ঘরে তার যখন কথা হচ্ছিল, তখন মুখে তার সামান্য স্মিত হাসি থাকলেও তার বুকের ভেতরটায় ওই সময়গুলোতে যে কষ্ট হয়েছিল, সে কষ্ট সহ্য করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। বুকের ভেতরটা সে রাতে তার ক্ষত বিক্ষত হয়ে গিয়েছিল। যার কথা একমাত্র তার অন্তরাত্মা ছাড়া আর কেউ জানতে পারেনি। সে নিজে যেমন ছোট্ট বয়স থেকেই জানত যে তার ভালোবাসা কোনদিন পরিণতি পাবে না, নবনীতা তো তেমন জানত না। সে নিজে যেমন জানত যে তার প্রেমিককে সে সারা জীবনেও নিজের স্বামী রূপে কাছে পাবে না, নবনীতার ক্ষেত্রে তো তেমন ছিল না। একটা সময় পরিতোষের বাবা নবনীতাকে তার হবু পুত্রবধূরূপে আশীর্বাদ করেছিলেন। নবনীতার পরিবারও তো পরিতোষ আর তার বিয়েতে রাজী হয়েছিল। হ্যাঁ, দুর্ভাগ্য বশতঃ নবনীতার সে স্বপ্নটা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু এতদিন বাদেও তো পরিতোষ তাকে নিজের করে নিতে রাজী আছে। এ’কথা তো নবনীতাও খুব ভাল করে জানে। আজও যদি নবনীতা নিজের মত বদলে ফেলতে পারে, তাহলে পরিতোষ তাকে নিশ্চয়ই বিয়ে করতে রাজী হবে। কিন্তু সে যদি নিজের চিন্তাধারা বদলাতে না পারে, সে যখন বুঝতে পারবে যে তার ভালবাসার পাত্রটি অন্য আরেকটা মেয়েকে চিরতরে তার জীবনসঙ্গী করে নিতে চলেছে, তখন হয়ত চেপে রাখা আবেগ আর সামলে রাখতে পারবে না সে। তাই ওর সাথে পরিষ্কার করে আরেকবার আলোচনা করে নেওয়াটা ভীষণ দরকার। যদি দেখা যায় পরিকে বিয়ে করতে নবনীতা একটু হলেও নিমরাজীও হয়েছে, তখন অর্চু আর পরির বিয়ের ব্যাপার নিয়ে আর এগোনো যাবে না। তেমন হলে নবনীতার সাথেই পরির বিয়েতে সায় দেবে সে। আর নবনীতা যদি এখনও আগের মতই পরিতোষের সঙ্গে সংসার করতে অরাজী হয়, তাহলে পরির সাথে অর্চনার বিয়ের কথা ভাবাই যেতে পারে। কিন্তু অর্চনার অনুপস্থিতিতেই নবনীতার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। কিন্তু সে যতক্ষণ নবনীতাকে কাছে পায়, ততক্ষণ অর্চনাও তাদের ধারে কাছেই থাকে। তাই বাড়িতে নবনীতার সাথে এ বিষয়ে আলাপ করা একেবারেই সম্ভব হবে না। তাই এখন তাকে বসাক গারমেন্টসে গিয়েই নবনীতার সাথে কথা বলতে হবে।
 

বসাক গারমেন্টসের সামনে গাড়ি থেকে নেমে সে শোরুমের ভেতরে ঢুকেই দেখতে পেল একটা কাউন্টারে নবনীতা কয়েকজন খদ্দের সামলাতে ব্যস্ত। বেশ কয়েকজন খদ্দের দাঁড়িয়ে আছে। নবনীতার সাথে তার চোখাচোখিও হল না। তাকে ব্যস্ত দেখে সীমন্তিনী পাশের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। জয়া বসাকের চেম্বারের খোলা দড়জার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “ভেতরে আসতে পারি ম্যাডাম”?
 

জয়া বসাক মুখ তুলে দড়জার দিকে তাকিয়ে সীমন্তিনীকে দেখেই প্রায় চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন, “আরে ম্যাডাম আপনি? হোয়াট এ প্লেজান্ট সারপ্রাইজ! আসুন আসুন প্লীজ”।

সীমন্তিনী ঢুকে একটা চেয়ারে বসবার আগেই ইন্টারকমের সুইচ টিপে জয়া বসাক দু’কাপ কফির অর্ডার দিলেন। তারপর সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে খুশী ভরা মুখে জিজ্ঞেস করলেন, “সরি ম্যাডাম, একটু বিজি ছিলাম বলে সিসিটিভিতে ঠিক চোখ ছিল না। তাই আপনার আসার ব্যাপারটা চোখে ধরা পড়েনি। তা কিছু কিনতে এসেছিলেন নাকি”?
 

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “বিনা নোটিসে এসে আপনাকে ডিসটার্ব করে ফেললুম না তো”?

জয়া বসাক সাথে সাথে বললেন, “আরে কী বলছেন আপনি ম্যাম। কোনও ডিস্টার্ব হয়নি আমার। আমি তো আপনাকে আগেই বলে দিয়েছি, আপনি যে কোন সময় আমার কাছে আসতে পারেন”।

সীমন্তিনী বলল, “ম্যাডাম, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এলুম। আপনারা কি হোম ডেলিভারি করেন”?

জয়া বসাক বললেন, “এমন ছোট শহরে কোলকাতার মত হোম ডেলিভারি সিস্টেম এখনও শুরু হয়নি ম্যাম। তবে অল্প ডিস্ট্যান্সের মধ্যে কোনও ভাল্যিয়ুড কাস্টমারের পক্ষ থেকে তেমন অর্ডার পেলে আমরা হোম ডেলিভারী দিয়ে থাকি। তবে অবশ্যই অর্ডারটা ভাল এমাউন্টের হলেই সেটা করে থাকি। তা আপনার কোয়ার্টারে পাঠাবার জন্য হোম ডেলিভারির দরকার কি ম্যাম? নবনীতাই তো ফেরার পথে নিয়ে যেতে পারবে। বাই দি বাই, নবনীতা কি আপনাকে এখানে আসতে দেখেছে”?

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “না ম্যাম, নীতার কাউন্টারে বেশ কয়েকজন কাস্টমার দেখেছি। ও তাদের এন্টারটেইন করতেই ব্যস্ত ছিল। আমিও ওর কাউন্টারের সামনে যাই নি। সোজা আপনার চেম্বারে চলে এসেছি”।

জয়া বসাক, “নিজের সামনের ল্যাপটপের দিকে দেখে বলল, “হ্যাঁ, ওর কাউন্টারে কয়েকজন কাস্টমার আছে। আচ্ছা বলুন তো হোম ডেলিভারির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছেন কেন”?

সীমন্তিনী বলল, “আসলে ম্যাম, আপনি হয়তো জানেন না, আমার আসল বাড়ি হচ্ছে রাজগঞ্জে। সেখানে আমাদের বেশ বড় পরিবার। জয়েন্ট ফ্যামিলী। পূজোর তো খুব বেশীদিন দেরী নেই আর। কিন্তু আমি কাজে এমনই ব্যস্ত যে এবার পূজোয় বাড়ি যেতে পাচ্ছি না। কিন্তু বাড়ির সকলের জন্যে পূজোর জামা কাপড় কিছু না পাঠাতে পারলেও তো মনটা ভাল লাগবে না। তাই ভাবছিলুম এখানে থেকেই যদি সেখানে ও’সব পাঠিয়ে দিতে পারতুম, তাহলে খুব ভাল হত। কিন্তু আপনারা যখন শুধু লোকাল কাস্টমারদের ......”
 

জয়া বসাক সীমন্তিনীর কথার মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বুঝেছি বুঝেছি ম্যাম। আর বলতে হবে না। হয়ে যাবে। আপনার জন্য আমি ও’টুকু নিশ্চয়ই করতে পারব। আপনি শুধু পোষাকগুলো পছন্দ করে দিন। পূজোর আগেই সেগুলো আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব আমার”।
 

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ম্যাম। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ”।

জয়া বসাকও মিষ্টি করে হেসে বললেন, “মেনশন নট ম্যাম। আপনি আমার যত বড় একটা উপকার করেছেন, তার বিনিময়ে আপনার জন্য এটুকু করা কোন ব্যাপারই না”।

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আমি আপনার এমন কী উপকার করেছি ম্যাম? উল্টে নীতাকে আপনার এখানে কাজ দিয়ে আপনিই তো আমার উপকার করেছেন”।

সীমন্তিনীর কথা শেষ হতেই একটা বেয়ারা টাইপের ছেলে এসে দু’কাপ কফি টেবিলে নামিয়ে রেখে জয়া বসাককে বলল, “আর কিছু লাগবে ম্যাম”?
 

জয়া বসাক সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “ম্যাম, অল্প কিছু লাইট রিফ্রেশমেন্ট নিতে আপত্তি নেই তো”?

সীমন্তিনী জলের গ্লাস হাতে নিয়ে বলল, “না না ম্যাম, প্লীজ, আর কিছু নয় এখন। ইটস ওকে”।

জয়া বসাকের ঈশারায় ছেলেটা চলে যেতেই তিনি বললেন, “নিন ম্যাম, কফি নিন। আর নবনীতার কথা বলছিলেন না? সেটাই তো বলছিলুম আমি। নবনীতাকে আমার কাছে কাজে দিয়েই তো অতবড় উপকারটা আমার করেছেন। এই তো নিজের চোখেই দেখে এলেন, ওর কাউন্টারেই সবচেয়ে বেশী ভিড়। জানিনা, ও নিজে আপনাকে কিছু বলেছে কি না। তবে খুব অল্প দিনেই ও সেলস গার্লের কাজে খুব এক্সপার্ট হয়ে উঠেছে। জানেন ম্যাম, গত কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছি, বেশীর ভাগ খদ্দেরই নবনীতার কাউন্টারে যেতে চাইছে। ওর মিষ্টি মুখ আর সুমিষ্ট কথায় খদ্দেররা ওর কাউন্টারের প্রতিই বেশী আকৃষ্ট হয়। আর নীতাও সাংঘাতিক দক্ষতার সাথে সবাইকে হাসিমুখে সার্ভিস দিয়ে সন্তুষ্ট করে। আজ আপনি যদি আর ঘন্টাখানেক আগে আসতেন, তবে দেখতে পেতেন যে ওর কাউন্টারে খদ্দেররা লাইন করে দাঁড়িয়েছিল। দু’একটা কাউন্টার তখন পুরো খালি হওয়া সত্বেও খদ্দেররা সে’সব কাউন্টারে যায় নি। নতুন নতুন খদ্দের অনেক আসছে আমাদের শো রুমে। তাই বুঝতেই পাচ্ছেন, সেলও বেশী হচ্ছে আমাদের। সত্যি, বড্ড মিষ্টি মেয়েটা। আর খুব চমৎকার স্বভাব আর তেমনি মিষ্টি ওর ব্যবহার। আমিও তো ওকে ভালবাসতে শুরু করেছি। এই ক’টা দিনেই ও একেবারে এক্সপার্ট সেলসগার্ল হয়ে উঠেছে। কলিগদের সাথেও খুব ভাল ব্যবহার করে। সবাই ওকে ভালবাসে। এমন একটা মেয়ে আমায় দেবার বিনিময়ে একটা ধন্যবাদ তো আপনার প্রাপ্যই ম্যাম”।

সীমন্তিনীও খুব খুশী হয়ে বলল, “আপনার কাছ থেকে এমন কথা শুনে আমি সত্যি খুব খুশী হলাম ম্যাম। মেয়েটা সত্যিই খুব দুঃখী। ও যদি নিজের পায়ে একটু দাঁড়াতে পারে, তাহলেই আমার উদ্দেশ্য স্বার্থক হবে”।

জয়া বসাক বললেন, “আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন ম্যাম। নবনীতা আপনাকে একদম হতাশ করবে না। আমি শুনেছি, কারখানার কাজও ও খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলছে। ডিজাইনিংটা তো অনেকটাই রপ্ত করে নিয়েছে এ ক’দিনে। এখন শুধু কাটিং টেলারিংএর কাজটা শিখে ফেলতে পারলেই ও নিজের কোন ব্যবসা শুরু করতে পারবে” বলে একটু হেসে বললেন, “অবশ্য সেদিনের কথা ভেবে, মনে মনে একটু ভয়ই হচ্ছে আমার। আমার দোকানের কাস্টমার না কমে যায়”।

সীমন্তিনীও হেসে বললেন, “ও নিয়ে আপনি ভাববেন না ম্যাম। কৃতজ্ঞতা বোধ ওর ভালই আছে। আপনার কাছে কাজ শিখে ও নিশ্চয়ই আপনার ক্ষতি করতে চাইবে না। আর তাছাড়া, ওকে নিয়ে আমার একটু অন্য রকম ভাবনা চিন্তা আছে। আপনার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ পেলে ও একদিন ওর নিজের ব্যবসা অবশ্যই চালু করবে। তবে সেটা এ শহরে হবে না, হবে অন্য কোথাও। তাই আপনার গ্রাহক কমে যাবার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। বরং এমনও হতে পারে যে ও আপনাদের এখান থেকেও অনেক মাল টেনে নেবে ও”।
 

জয়া বসাক এবার বললেন, “আপনার বোনের ওপর আমার আশীর্বাদ আর শুভেচ্ছা সব সময় থাকবে ম্যাম। তবে এবারে আপনি রাজগঞ্জে যে ডেলিভারীটা দিতে চাইছেন, আমরা বরং সে ব্যাপারেই কথা বলি। বলুন তো ঠিক কি কি পোশাক আপনি পাঠাতে চাইছেন”?

সীমন্তিনী কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমার বাবা, জেঠু আর কাকুর জন্যে খুব ভাল কোয়ালিটির পাঞ্জাবী আর ধুতি চাই। সঙ্গে গেঞ্জী আর আন্ডারওয়ারও। আর জেঠীমা, মা আর কাকিমার জন্যে ভাল শাড়ী। ব্লাউজ চাই নে, কারন কার শরীরের মাপ কতটা চেঞ্জ হয়েছে সেটা আমার সঠিক জানা নেই। তাই শাড়ি গুলো এমন হওয়া চাই যাতে ব্লাউজ পিচ অবশ্যই থাকে। তারা ওখানে বানিয়ে নিতে পারবেন। সঙ্গে ম্যাচিং পেটিকোট দেবেন। আর দু’ভাইয়ের জন্য খুব ভাল কোয়ালিটির শার্ট আর জীনস দেবেন। এদের দু’জনেরই ফুল লেংথ পোশাক দেবেন। আর এক ভাই তের বছর বয়সী। তার জন্যেও মাপ মত খুব ভাল শার্ট আর জীনসের প্যান্ট দেবেন। একটা ছোট বোন আছে, এগারো বছর বয়স। তার জন্যে মাপ মত একটা সুন্দর লহংগা চুড়িদার দেবেন। এ ছাড়া বাড়ির কাজের দু’জন মহিলা আছে আর দু’জন পুরুষ আছে, তাদের জন্যেও শাড়ি আর ধুতি শার্ট নিতে হবে”।

জয়া বসাক সব শুনে বললেন, “হয়ে যাবে ম্যাম। আমি একজনকে বলে দিচ্ছি। আপনি তার সাথে গিয়ে পোশাকগুলো পছন্দ করে ফেলুন। দামের জন্য ভাববেন না, আপনার জন্যে আমি স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবই”।

সীমন্তিনী বলল, “ম্যাম বলছিলুম কি, অন্য কাউকে আমার সাথে না দিয়ে নীতাকেই কি এ কাজটা দিতে পারেন না? মানে বলছিলাম কি, তাহলে আমরা দু’জনে মিলেই পোশাকগুলো চয়েস করতে পারতুম, আর তাতে সময়টাও কম লাগত”।

জয়া বসাক হেসে বললেন, “আচ্ছা আমি দেখছি” বলে ল্যাপটপে সিসিটিভি ক্যামেরা গুলোর অনস্ক্রীন ফুটেজের দিকে দেখতে দেখতে ইন্টারকম তুলে কাউকে বললেন, “স্বপন, একটা কাজ করো তো। শুভার কাউন্টারে দেখছি এখন কাস্টমার নেই। ওকে নবনীতার কাউন্টারে দিয়ে নবনীতাকে আমার চেম্বারে পাঠিয়ে দাও, এখুনি” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বললেন, “নবনীতা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে ম্যাম। আপনি ওর সাথে গিয়ে কাজগুলো সেরে আসুন। বাকিটা আমি দেখে নেব”।

সীমন্তিনী মহিলাকে ধন্যবাদ জানাল। এমন সময় সীমন্তিনীর মোবাইল বেজে উঠল, সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখল অর্চনার ফোন। জয়া বসাকের অনুমতি নিয়ে কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ সোনা, বল”।

অর্চনা ওপার থেকে বলল, “দিদিভাই, তুমি কোথায়? এখনও বাড়ি আসছ না যে? অফিস থেকে বেরোওনি এখনও”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “সরি, রে সোনা, আমি তোকে বলতে ভুলে গেছি রে। আসলে আমি একটু বাজারের দিকে এসেছি। একটু কাজ আছে এখানে। একটু সময় লাগবে। তুই ভাবিস নে কিছু। তুই আর লক্ষীদি জল খাবার খেয়ে নে। আমার ফিরতে একটু দেরী হবে। আমি নীতার সাথেই ফিরছি আটটা নাগাদ”।

মিনিট পাঁচেক বাদেই নবনীতা জয়া বসাকের চেম্বারে ঢুকে সীমন্তিনীকে দেখে যার পর নাই অবাক হল। কিন্তু সে কিছু বলে ওঠার আগেই জয়া বসাক তাকে বললেন, “নবনীতা তোমার দিদিকে নিয়ে ওপরের তলায় চলে যাও। উনি যা যা পছন্দ করেন সেগুলো বাছাই করা হয়ে গেলে ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে আমার এখানে এসো”।
 

নবনীতা মাথা ঝাঁকিয়ে “আচ্ছা ম্যাম” বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “এসো দিদি”।

নবনীতার সাথে ওপরে আসতে আসতে সীমন্তিনী তাকে রাজগঞ্জ আর কালচিনির সকলের জন্য পূজোর পোশাক পছন্দ করবার কথা বলল। সকলের পোশাক পছন্দ করতে করতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল যে রাজগঞ্জের পোশাকগুলো যেন আলাদা প্যাকেট করা হয়। সেগুলো এখান থেকে রাজগঞ্জে হোম ডেলিভারী দেওয়া হবে। আর কালচিনির পোশাকগুলো আলাদা প্যাক করবার নির্দেশ দিল। সে প্যাকেটটা নিজেরা সঙ্গে নিয়ে যাবে বলল।
 

নবনীতা সেভাবেই পোশাকগুলোকে আলাদা আলাদা লটে সাজিয়ে একটা বেয়ারাকে বুঝিয়ে দিয়ে সীমন্তিনীকে নিয়ে আবার দোতলায় জয়া বসাকের চেম্বারে এসে হাজির হল। জয়া বসাক তখন নবনীতাকে বললেন, “তোমাকে আর এখন কাউন্টারে বসতে হবে না নীতা। আমি ম্যানেজারকে যা বলার বলে দিয়েছি। তুমি তার সাথে দেখা করে তোমার ব্যাগ নিয়ে আবার এখানে এসো। ম্যাম তোমার জন্যে এখানেই অপেক্ষা করবেন ততক্ষণ, কেমন”?

নবনীতা কোন কথা না বলে সম্মতি জানিয়ে চলে যেতে জয়া বসাক সীমন্তিনীকে বললেন, “ম্যাম, কিছুই তো খেলেন না আপনি। তবে আরেকবার একটু কফির কথা বলি”?

সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, এখন আর ও’সব কিছু নেব না। আমি বরং এখানে বসে না থেকে একটু বিলিং কাউন্টারে গিয়ে পেমেন্টটা করে আসি”।

জয়া বসাক আপত্তি করে বললেন, “আপনি বসুন তো এখানে। কোত্থাও যেতে হবে না আপনাকে। বিল রেডি হয়ে গেলে নবনীতাই নিয়ে আসবে সেটা”।

সীমন্তিনী বলল, “না ম্যাম, আসলে আমি তো কার্ডে পেমেন্ট করব। তাই কাউন্টারে তো যেতেই হবে”।

জয়া বসাক হেসে বললেন, “সে সব এখানে বসেই হয়ে যাবে, ভাববেন না। আপনি বরং ততক্ষণ আপনার রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানাটা আমায় লিখে দিন”।
 

সীমন্তিনী জয়া বসাকের এগিয়ে দেওয়া প্যাডে রাজগঞ্জের বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে দিতেই নবনীতার সাথে দুটো প্যাকেট হাতে আরেকজন বেয়ারা চেম্বারে এসে ঢুকল। বেয়ারা চেম্বারের এক কোনায় একটা টেবিলে প্যাকেটগুলো রাখতেই নবনীতা বলল, “দিদি, এ’দুটো কালচিনির প্যাকেট। বাকি গুলো আলাদা প্যাক করা হচ্ছে রাজগঞ্জে পাঠাবার জন্য। আর সব মিলিয়ে বিল হল ছেষট্টি হাজার সাতশ’ তেত্রিশ টাকা। তোমার কার্ডটা দাও”।

সীমন্তিনী নিজের পার্সের ভেতর থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করতে করতে জয়া বসাক ম্যানেজারের সাথে কথা বলে ফাইভ পার্সেন্ট স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেওয়া হয়েছে কি না, জেনে নিলেন। নবনীতা সীমন্তিনীর কার্ড পজ মেশিনে পাঞ্চ করে মেশিনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী তাতে নিজের পিন নাম্বার দিয়ে পেমেন্ট শেষ করে বলল, “ম্যাম, অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আজ তাহলে উঠি আমরা”।

জয়া বসাক বেয়ারাটাকে বলল, “ম্যাডামের প্যাকেটটা তার গাড়িতে তুলে দে। আর নবনীতা, তোমারও তো কাজ শেষ হয়েছে, তুমি বরং ম্যামের সাথেই বেড়িয়ে পড়ো”।


*******************

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে সীমন্তিনী নবনীতাকে বলল, “কাজে কাজেই তো পুরো সময়টা কেটে গেলরে নীতা। তোর সাথে কিছু প্রাইভেট কথা আলোচনা করব ভেবেছিলুম। সেটা তো আর গাড়িতে বসে করা ঠিক হবে না”।

নবনীতা বলল, “আমরা তো বাড়িতেই যাচ্ছি দিদি। বাড়িতে গিয়েই তো কথা বলতে পারব”।

সীমন্তিনী বলল, “তুই আমার কথাটা ঠিক মত শুনিস নি। আমি বললুম প্রাইভেট কথা। বাড়িতে গিয়ে সেটা অর্চুর সামনে বলা যাবে না”।

নবনীতা নিজের ভুল বুঝতে পেরে বলল, “ওহ, সরি দিদি। কিন্তু কথাটা কি অর্চুর ব্যাপারেই? আবার কি হল ওর”?

সীমন্তিনী বলল, “কিছু হয়নি। কিন্তু আলোচনাটা ওকে নিয়েই। তাই ওর সামনে আমি সেটা করতে চাই নে। শুধু তোর সাথেই আলোচনাটা করা দরকার। এক কাজ করি, চল সামনের ওই রেস্টুরেন্টে বসে চা খেতে খেতেই না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক। আর ওই দ্যাখ, খগেন তার রিক্সা নিয়ে তোর অপেক্ষায় আছে। ওকে বলে দে আজ তুই ওর রিক্সাতে যাবি না। আমার সাথে যাবি”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 182)

বেয়ারাটা ততক্ষণে প্যাকেট দুটো নিয়ে গাড়ির সামনে চলে এসেছে। ড্রাইভার রামসিংকে প্যাকেটগুলো ভাল মত রাখবার নির্দেশ দিয়ে সীমন্তিনী নবনীতাকে নিয়ে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। এগরোল আর চায়ের অর্ডার দিয়ে সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা নীতা, পরির ব্যাপারে তুই সত্যি সত্যি কী ভাবছিস বল তো”?
 

নবনীতা অবাক হয়ে বলল, “তুমি তো বললে অর্চুর ব্যাপারে আলাপ করবে, তাহলে আবার পরির কথা তুলছ কেন দিদি”?

সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “বলছি, তার কারন আছে। এবার আমি যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে। আসলে পরি তো তোর জীবনের সমস্ত ঘটণার কথা জেনেও তোকে বিয়ে করতে রাজী আছে। কিন্তু আমার সামনেই তুই তার সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলিস। আজ আমি আবার তোর কাছে জানতে চাইছি, তুই কি সত্যি ওকে ছেড়ে সারাটা জীবন থাকতে পারবি বোন? পরি যদি আজ অন্য কাউকে বিয়ে করে, তাহলে তুই সেটা সত্যি মন থেকে মেনে নিতে পারবি তো”?
 

নবনীতা মাথা নিচু করে জবাব দিল, “পারতে যে আমাকে হবেই দিদি। যাকে আমি একদিন পরম যত্নে আমার মনের সিংহাসনে বসিয়েছিলাম, তার জীবনে কলঙ্কের ছোঁয়া লাগাতে আমি পারব নাগো দিদি। পরি যদি সত্যিই কাউকে বিয়ে করে সংসারী হয়, তবে প্রথম প্রথম মনে একটু কষ্ট হয়তো পাবো। কিন্তু দিদি, আমি সে ব্যথা সয়ে নিতে পারব। তবু আমি চাই, পরি আমার অপেক্ষায় থেকে নিজের জীবনটা নষ্ট না করে অন্য কোনও মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হোক”।

সীমন্তিনী একটুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রায় ফিসফিস করে বলল, “সত্যি বলছিস? পারবি? কাজটা কিন্তু মোটেও সহজ নয় রে। নিজের পাঁজরের টুকরোকে অন্যের হাতে তুলে দিতে যে কী কষ্ট হয়, সেটা আমি জানি রে নীতা। তুই পারবি সে কষ্ট সইতে”?

নবনীতা এবার আগের চেয়েও দৃঢ় স্বরে বলল, “পারব দিদি। যতই কষ্ট হোক না কেন, পরির ভবিষ্যতের কথা ভেবে, ওর সুখের কথা ভেবে, আমি সে কষ্ট ঠিক সয়ে নিতে পারব”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “শোন নীতা, তুই যদি এ ব্যাপারে আরেকটু ভাল করে ভেবে দেখতে চাস, তাহলে আমি তোকে এক মাস সময় দিতে রাজী আছি। এরমধ্যে তুই আমাকে তোর শেষ সিদ্ধান্ত জানাস”।

নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “এক মাস সময় কেন দিচ্ছ দিদি? তুমি কি পরির জন্য সত্যি কোনও মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছ না কি”?
 

সীমন্তিনী শান্ত স্বরেই জবাব দিল, “অনেকটা তাই। একটা মেয়েকে আমার খুব ভাল লেগেছে। অবশ্য তাকে এ ব্যাপারে এখনও কিছু বলিনি আমি। কিন্তু পরিতোষকে তো আমরা বলেছি যে আমরা দু’জনে মিলেই ওর জন্য পাত্রী খুঁজব। তাই তোকেও মেয়েটাকে দেখাব। কিন্তু তার আগে তোর মনের ইচ্ছেটা আমার জানা দরকার। তুই যদি ভাবিস যে পরির জীবনে তুই আবার ফিরে আসতে পারবি, হয়ত তাতে আরও কিছু সময়ের দরকার হতে পারে, কিন্তু আমিও তখন খুব খুশী মনে তোদের বিয়েটা মেনে নেব। আমার খুশীর সীমা থাকবে না। তখন অন্য কোন মেয়ে, সে তোর চাইতে হাজার গুণ গুণী আর সুন্দরী হলেও তাকে আমি পরির জন্য নির্বাচন করব না। কারন আমি জানি, পরি এখনও তোকে ভালোবাসে। তাই তোর কাছে পরিষ্কার করে জানতে চাইছি”।

নবনীতা এবার একটু হতাশ ভাব নিয়ে আবার বলল, “আমার কথা ছেড়েই দাও দিদি। কিন্তু তুমি কি সত্যি কাউকে পছন্দ করে ফেলেছ”?

সীমন্তিনী নবনীতার স্বরে এবার একটু অবাক হলেও প্রায় আগের মত শান্ত কন্ঠেই বলল, “বললুমই তো, প্রায় তাই। মেয়েটাকে আমার খুব খুব পছন্দ হয়েছে। তবে তুই তাকে পছন্দ না করলে, বা তুই যদি পরিকে বিয়ে করতে রাজী থাকিস, তাহলে আমি তাদের সাথে কোনরকম যোগাযোগ করব না”।

নবনীতা এবার আরও হতাশ হয়ে বলল, “না দিদি, আমি কিছুতেই পরিকে বিয়ে করতে পারব না। কিন্তু দিদি, আমিও যে একটা মেয়েকে মনে মনে পছন্দ করেছি গো পরির জন্যে। সেও ভীষণ সুন্দরী ও গুণী। পরির সাথে ওকে খুব ভাল মানাবে। আর ওকে বিয়ে করে পরি যে সুখী হবে, এ ব্যাপারেও আমি প্রায় নিশ্চিত। আর আমি জানি, তুমিও তাকে অপছন্দ করবে না। কিন্তু তোমাকে কথাটা বলব বলব করেও বলা বয়ে ওঠেনি”।

খাবার এসে যাওয়াতে দু’জনেই একটু চুপ করল। ওয়েটারটা চলে যেতে সীমন্তিনী বলল, “ওমা, তুইও কাউকে পছন্দ করে রেখেছিস পরির জন্যে? কে মেয়েটা? আর তুই তাকে দেখলিই বা কোথায়? তুই তো শুধু বাড়ি আর বসাক গারমেন্টস ছাড়া কোথাও যাসই নি! কোথায় দেখলি তাকে? তোদের বসাক গারমেন্টসেই কাজ করে বুঝি? না তোদের কারখানার কেউ? নাকি তোদের কোনও কাস্টমার? আমি কি তাকে চিনি? বল না, চুপ করে আছিস কেন”?
 

নবনীতা মুখ নিচু করে মনঃক্ষুণ্ণ ভাবে বলল, “কি আর বলব দিদি? তুমি তো আরেকজনকে পছন্দ করে ফেলেছ”।

সীমন্তিনী বলল, “আরে বাবা, আমি পছন্দ করেছি, তাতে কি হল? আমার পছন্দের সাথে সাথে তোর পছন্দটাও তো একই সমান জরুরী। পরিকে আমরা কী কথা দিয়েছিলুম তা কি তুই ভুলে গিয়েছিস? আমি আর তুই দু’জনে মিলেই না ওর জন্যে পাত্রী পছন্দ করব? আচ্ছা তুই বল তো, তুই যাকে পছন্দ করেছিস, সেই মেয়েটা কে? আমি কি তাকে দেখেছি কোথাও”?

নবনীতা এবার মুখ তুলে বলল, “দেখবে না কেন? আমাদের অর্চুকে দেখতে আর তোমার বাকি আছে”?

এগরোলের একটা গ্রাস কেবল সীমন্তিনী মুখে পুরেছিল। নবনীতার কথা শুনে মুখের মধ্যে গ্রাসটা রেখেই সে হাঁ করে নীতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অবাক চোখে। নবনীতা সীমন্তিনীকে অবাক হতে দেখে ভাবল তার দিদি হয়ত তার কথায় মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে। এভাবে হুট করেই অর্চনার নামটা বলে ফেলা হয়ত তার উচিৎ হয়নি। একটু রয়ে সয়ে কথাটা বলা তার উচিৎ ছিল। কিন্তু প্রসঙ্গটা কথায় কথায় এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছিল যে সে আর অর্চুর নামটা না বলে থাকতে পারেনি। নইলে অর্চুর সাথে পরির বিয়ে দেবার কথাটা তো বেশ কিছুদিন আগেই তার মাথায় এসেছে। অর্চুর রূপ, মিষ্টি স্বভাব, সুন্দর মনের পরিচয় পেয়ে সে ভেবেছিল সীমন্তিনীর মনোভাবটা বুঝে ধীরে সুস্থে কথাটা তার কাছে পাড়বে। কিন্তু সীমন্তিনী এরই মধ্যে অন্য আরেকটা মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে শুনেই সে নিজেই বিচলিত হয়ে অর্চনার নামটা এভাবে বলে ফেলল। এ’সব কথা ভেবে সে মাথা নুইয়ে খুব আস্তে করে বলল, “সরি দিদি, আমি জানি, আমি হয়ত ......”

কিন্তু তার কথার শুরুতেই সীমন্তিনী কিছু বলবার জন্য ভেতরে শ্বাস টানতেই খেল প্রচণ্ড বিষম। তাকে বিষম খেতে দেখে নবনীতা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে সীমন্তিনীর পিঠে আস্তে আস্তে চাপড় দিতে দিতে বলল, “দিদি, জল খাও একটু। এই নাও” বলে সীমন্তিনীর মুখের কাছে জলের গ্লাস তুলে ধরল।
 

কিন্তু সীমন্তিনীর কাশির ধাক্কা যেন কমছিলই না। কাশতে কাশতে তার মুখ চোখ লাল হয়ে উঠল। নাকের জল চোখের জল মাখামাখি হতে শুরু করল। সীমন্তিনী নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করবার চেষ্টা করেও কাশির দমকে সেটাও ঠিক করে করে উঠতে পারছিল না। নবনীতা নিজের ব্যাগ থেকে একটা রুমাল বের করে সীমন্তিনীর হাতে ধরিয়ে দিল। রেস্টুরেন্টের কয়েকজন কর্মচারী আর আশে পাশের টেবিলে বসে থাকা কয়েকজন গ্রাহকও তাদের টেবিলের চারপাশে এসে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল “ম্যাডাম, জলটা খান একটু”, কেউ কেউ নবনীতাকে বলল, “দিদি আপনি ম্যাডামের পিঠে আর কাঁধের পেছনে একটু জোরে জোড়ে চাপড়ে দিন”। কিন্তু কাশির দমক এমন উপর্যুপরি ভাবে আসছিল যে সীমন্তিনীর মুখে জলের গ্লাসটা চেপে ধরতেও নবনীতার ভয় হচ্ছিল। প্রায় মিনিট খানেক ধরে কাশবার পর কাশির দমকটা একটু কমতেই নবনীতা আবার জলের গ্লাসটা সীমন্তিনীর মুখের কাছে নিয়ে বলল, “নাও দিদি, একটু কষ্ট করে এক ঢোঁক জল খাও তো দেখি” বলে সীমন্তিনীর নাক থেকে বেড়িয়ে আসা জল তার রুমাল দিয়ে মুছতে শুরু করল। সীমন্তিনী অনেক কষ্টে একটুখানি জল খেতে পারল। তাতে সামান্য স্বস্তি পেতে আরও দু’ঢোক জল খেল।

সীমন্তিনীর কাশির দমক থামবার পর তার চোখ মুখের ভয়ঙ্কর চেহারা দেখে রেস্টুরেন্টের এক কর্মী বলল, “ম্যাডাম, আপনি এদিকে আসুন। বেসিনে গিয়ে মুখটা একটু ধুয়ে নিন। বড় সাংঘাতিক রকমের একটা বিষম খেয়েছেন আপনি। আসুন এদিকে আসুন”।

নবনীতা সীমন্তিনীকে ধরে চেয়ার থেকে ওঠাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “হ্যাঁ দিদি, চলো”।

সীমন্তিনী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ঠিক আছে। তুই বোস। আমি একাই যেতে পারব” বলে নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে বেসিনের দিকে এগিয়ে গেল।
 

নবনীতা সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই সীমন্তিনীর ওপর নজর রাখছিল। এভাবে সীমন্তিনীর বিষম খাওয়া দেখে সে মনে মনে নিজেকেই দোষী ভাবতে শুরু করল। সীমন্তিনী মুখে চোখে জল দিয়ে ফিরে আসবার সময়েই তার পকেটের মোবাইল আবার বেজে উঠল। তাদের সীটের কাছে এসে পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে অর্চনার ফোন। সীমন্তিনীর শ্বাস প্রশ্বাস তখনও স্বাভাবিক হয়নি। মোবাইলটা সে নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে শুধু বলল, “অর্চুর সাথে কথা বল”।

নবনীতা কলটা রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ অর্চু, বলো”।

ওদিক থেকে অর্চনা উদ্বিঘ্ন গলায় বলল, “ও নীতাদি? দিদিভাই কোথায় গো? আর তোমরা এখনও আসছ না কেন? কোথায় আছ তোমরা”?

নবনীতা নিজের অস্থিরতাকে যথাসম্ভব সামলাবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “আমরা এখনও বাজারেই আছি গো অর্চু। আমি এখন দিদির সাথেই আছি। আসলে দিদির কাজটা এখনও সারা হয়নি বলেই আমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছে”।

অর্চনা আবার জিজ্ঞেস করল, “ও, তার মানে দিদিভাই কাজে ব্যস্ত বলেই বুঝি তোমাকে কথা বলতে বললেন আমার সাথে? কিন্তু তোমাদের দেরী দেখে আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল, তাই ফোনটা না করে থাকতে পারলুম না”।

নবনীতা বলল, “হ্যাঁ অর্চু, তুমি ঠিকই ধরেছ। দিদি কাজে ব্যস্ত বলেই ফোনটা আমি ধরলুম। তবে তুমি দুশ্চিন্তা করো না। আমরা ঠিক আছি। দিদির কাজ বোধহয় আর অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই শেষ হয়ে যাবে, আর তারপর আমরা সোজা বাড়িই যাচ্ছি। তোমরা একদম ভেবো না। আচ্ছা বৌদি কি তোমার ফোনে ফোন করেছিল নাকি গো”?

অর্চনা বলল, “কে রচু? নাহ, সেও আজ এখন অব্দি ফোন করেনি। রোজ তো আটটা সাড়ে আটটার দিকে নিয়ম করে ফোন করে ও। আজ যে কেন ফোন করল না বুঝতে পারছি না। আমি একবার একটু আগে ওর নাম্বারে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে বেজে থেমে গেল। কেন যে ধরল না সেটাও বুঝতে পারছি না। দিদিভাই হয়ত কিছু জানতে পারে। তাই দিদিভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলুম আমি”।

নবনীতা বলল, “তুমি অহেতুক চিন্তা করো না অর্চু। বৌদি হয়ত কোন কাজে ব্যস্ত আছে বলেই তোমার ফোনটা ধরতে পারেনি। হয়ত ফোনটা তার হাতের কাছে নেই। কিংবা সে হয়ত ফোনের রিংটোনটা শুনতে পায়নি। তবে সে যে ঠিক আছে সেটা ধরেই নিতে পার। বৌদির তেমন কিছু হলে দিদি আর এখানে এই মূহুর্তে এভাবে কাজে ব্যস্ত থাকতো? তার সব কাজের থেকেও বৌদি অনেক বেশী ইমপর্ট্যান্ট। তা তো তুমি জানোই। সুতরাং বৌদির জন্যেও কোন দুশ্চিন্তা করো না। সে নিশ্চয়ই ঠিক আছে। আর আমরাও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসছি। কেমন”?

অর্চনা শান্ত গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোমরা তাড়াতাড়ি ফিরে এসো প্লীজ” বলতে নবনীতা ফোন কেটে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আমরা ঘরে ফিরছি না, ওদিকে বৌদিকে ফোন করেও নাকি পায়নি, তাই অর্চু চিন্তা করছে। আচ্ছা, এখন তুমি ঠিক আছ তো দিদি”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ রে এখন ঠিক আছি। চল এবার তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে বাড়ি ফিরি। কিন্তু সত্যি বলছি রে নীতা এমন বিষম আমি সারা জীবনেও খাইনি রে। একেবারে দম বন্ধ হয়ে আসছিল, বাবা! শ্বাস নিতেই পারছিলুম না”।

নবনীতাও খাওয়া শুরু করে বলল, “সব আমার দোষ, আমি ওভাবে অর্চুর নামটা না তুললে তো তুমি এভাবে বিষম খেতে না। তবে, তাড়াহুড়ো করোনা দিদি। এখন একটু ধীরে সুস্থে খাও। কিন্তু আমরা বরং চায়ের অর্ডারটা ক্যানসেল করে দিই কি বলো? অর্চুটা একা আছে। খুব চিন্তা করছে”।

সীমন্তিনীও খেতে খেতে বলল, “না, চাটা খেয়েই যাই। ততক্ষণে আমাদের কথাটা নিয়েও আলোচনাটা শেষ করতে পারব। আচ্ছা তুই যে পরির জন্য অর্চুর কথা বললি, তার কারনটা কি বল তো? না, আমি মানছি অর্চু খুবই ভাল মেয়ে। যেমন রূপে তেমনি গুনে। কিন্তু অমন একটা বিধবা মেয়েকে পরি বিয়ে করতে রাজি হবে বলে মনে হয় তোর”?

নবনীতা সাথে সাথে বলল, “কিসের বিধবা? ওকে দেখে কেউ বলতে পারবে যে ও বিধবা? তাছাড়া তুমিই তো বলেছ ও শারীরিক ভাবে এখনও পুরোপুরি কূমারী। পরিতোষের পাশে ওকে মানাবেও খুব সুন্দর। আর ওর মত মেয়ে যে ঘরে যাবে সে’ ঘর তো একটা স্বর্গ হয়ে উঠবে গো দিদি। রূপে গুনে ও যে সত্যিই মা লক্ষ্মী। ওই তোমার কোন আচার্যি না ফাচার্যি পরিবার, ওই বদমাশ পরিবারের কথা আর তুলো না তুমি”।

সীমন্তিনী তবু নবনীতাকে আরও একটু বাজিয়ে দেখবার উদ্দেশ্যে বলল, “কিন্তু অর্চু যে মোটে মাধ্যমিক পাশ রে। তাছাড়া, মাসি মেসোরা তো বিয়েতে যৌতুক টৌতুকও কিছু দিতে পারবেন না। তাদের আর্থিক অবস্থা যে কি, তা তো তুই জানিসই। অমন গরীব পরিবারের বিধবা মেয়েকে বিয়ে করতে পরি কি সত্যি রাজি হবে বলে ভাবিস”?

নবনীতা একটু অবাক হয়েই বলল, “তুমি কী বলছ দিদি? আমি মানছি অর্চু অল্প শিক্ষিতা, মাধ্যমিক পাশ। কিন্তু আমিই বা কোন স্কলার গো? আমিও তো মাধ্যমিক পাশই। হ্যাঁ হায়ার সেকেন্ডারিতে ভর্তি হয়েছিলাম তা ঠিক। কিন্তু বারো ক্লাস তো পেরোতেই পারিনি আমি। পরি তো তখনই আমাকে ভালবেসেছিল। আর এখনও সে আমাকে বিয়ে করতে রাজী আছে। তাহলে অর্চু মাধ্যমিক পাশ বলে অসুবিধে হবে কেন। আর তুমি মাসি মেসোদের আর্থিক অবস্থার কথা বলছ, যৌতুকের কথা বলছ? এটাও কি ভাববার মত কোন বিষয় হল? পরির জন্য আমরা কোন মেয়ের বাড়ির কাছে যৌতুকের দাবী করব? আর পরি নিজেও কি যৌতুক নিয়ে কোনও মেয়েকে বিয়ে করবে বলে ভাবছ তুমি? আমার বাবাও কোন লাখপতি কোটিপতি ছিলেন না। পরি কিন্তু বিয়ে ঠিক করবার সময় যৌতুকের কথা বলেনি আমার বাবা দাদাকে। পরির বাবাও যখন আমাকে তার হবু পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন তখনও কিন্তু কোনরকম যৌতুকের কথা তিনিও তোলেন নি। হ্যাঁ, মানছি, এর মাঝে সাতটা বছর কেটে গেছে। কিন্তু পরির স্বভাব তো পাল্টায়নি দিদি। আর ওর আর্থিক অবস্থারও এমন কোন অবনতি হয়নি যে ওকে মেয়েপক্ষের কাছ থেকে যৌতুক চাইতে হবে। নাহ, একেবারেই না। আর তুমিও তো পরিকে কিছু কম চেনো না দিদি। কী করে তুমি এমন কথা বলছ? আর সবচেয়ে বড় কথা পরিতোষ তো আমাদের হাতেই সবকিছু ছেড়ে দিয়েছে। ও তো পরিষ্কার ভাবে বলেছে যে আমরা দু’জনে মিলে যাকে পছন্দ করব, তাকেই ও নির্দ্বিধায় নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে। আর তোমার কি মনে হয় না যে অর্চু পরিতোষের ভবিষ্যৎ জীবনটাকে সুখী করে তুলতে পারবে? আমার তো মনে হয় অর্চু সবদিক থেকে পরিতোষের উপযুক্ত। আর শুধু তাই নয়, আমার মনে হয় ও-ই পরিতোষের সবচেয়ে উপযুক্ত জীবনসঙ্গী হয়ে উঠবে। তোমার কি এমনটা মনে হয় না দিদি? তোমার মনে হয়না যে অর্চু পরিকে সুখী করে তুলতে পারবে”?

সীমন্তিনী আস্তে করে বলল, “হ্যাঁ তা হয়ত পারবে। কিন্তু আমিও যে মেয়েটাকে মনে মনে পছন্দ করেছি, সে মেয়েটাও কিন্তু কম কিছু নয়রে নীতা”?
 

নবনীতা শুকনো মুখে বলল, “ও, তা তোমার সেই মেয়েটি কে, একটু বলো তার ব্যাপারে। যদি আমার মনে হয় সে অর্চুর চাইতেও পাত্রী হিসেবে বেশী লোভনীয়, তাহলে হয়তো আমিও তাকে মেনে নেব”।
 

সীমন্তিনী এবার একটু কৌতুক ভরা গলায় বলল, “নারে নীতা, বেশী হবে না বোধহয়।তবে সমান সমান”।

নবনীতা সীমন্তিনীর কথার মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “সমান সমান মানে বুঝলুম না”।

ততক্ষণে চা এসে গেছে। সীমন্তিনী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বলল, “সমান সমান মানে সমান সমান। এটা না বোঝার কি হল? ওই মেয়েটা আর আমাদের অর্চু সোনা, সবদিক দিয়েই একেবারে সমান সমান। কেউ কারো থেকে একচুল বেশী নয়, কেউ একচুল কমও নয়। তাই দু’জনেই পরির স্ত্রী হবার যোগ্যতাতেও একেবারে সমান সমান”।
 

নবনীতা এবারেও কিছু বুঝতে না পেরে বলল, “কি বলছ তুমি দিদি, আমি তোমার কথার মাথামুন্ডু সত্যি কিছু বুঝতে পারছি না। দুটো লোক সবদিক দিয়ে পুরোপুরি ভাবে কিকরে একেবারে একরকম, একেবারে সমান সমান হতে পারে”?

সীমন্তিনী বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আরেক চুমুক চা খেয়ে বলল, “এতকিছু বলার পরেও যদি তুই বুঝতে না পারিস, তাহলে আমি আর কি বলব বল তো। আরে পাগলী আমি যে মেয়েটাকে পছন্দ করেছি তার নামও যে অর্চুই রে” বলে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

এবার বিষম খাবার পালা নবনীতার। তবে নিজেকে কোনরকমে সামলে নিয়ে সে বিস্ফারিত চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “তুমি সত্যি বলছ দিদি? তুমিও অর্চুকেই পছন্দ করেছ? না না, আমার মনে হয় তুমি আমার মন রাখবার জন্যেই শুধু এখন এ’কথা বলছ তাই না দিদি”?

সীমন্তিনীও একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মিষ্টি হেসে বলল, “হ্যাঁরে পাগলী। অর্চুর মত মেয়ে আমরা আর কাউকে খুঁজে পাব নাকি? তোকে সত্যি বলছি, কলকাতায় সেদিন যখন পরি তোর আর আমার ওপর নিজের পাত্রী পছন্দের দায়িত্ব দিয়েছিল, সেই মূহুর্ত থেকেই তো অর্চুর কথা আমার মনে এসেছিল। কিন্তু অর্চুকে নিয়ে আমি আরও একজনের সম্পর্কের কথাও ভাবছিলুম। কিন্তু সেটা হয়নি। আর পরির ব্যাপারে তোর পছন্দটাও হওয়া দরকার ছিল, তাই ওই মূহুর্তে আমি তোদের কাউকে কিছু বলিনি। আর সে জন্যেই তুই এখানে আসবার পর আমি অর্চুকে এখানে নিয়ে এসেছি। যাতে তুই ওকে ভাল মত বুঝতে চিনতে পারিস। তুই কি ভাবছিস, অর্চু এখানে এসে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে, শুধু এই ভেবেই আমি ওকে এখানে নিয়ে এসেছি? না রে। হ্যাঁ সবাইকে সে’কথা বললেও মনে মনে আমার উদ্দেশ্য ছিল এটাই যে অর্চুকে যেন তোর পছন্দ হয়। আর তোর হাবেভাবে আমিও বুঝে গিয়েছিলুম যে অর্চুকে তোর অপছন্দ হবে না। কিন্তু তুইও যে মনে মনে ওকেই পছন্দ করেছিস সেটা তো আমাকে আগে বলিস নি। তাই এখন আমিও খুব খুশী”।
 

নবনীতার চোখ মুখে খুশীতে জ্বলজ্বল করছে। সে সীমন্তিনীর কথা জবাবে বলল, “বেশ কয়েকদিন আগে থেকেই আমি তোমাকে কথাটা বলব বলব বলে ভাবছিলুম গো দিদি। কিন্তু যতক্ষণ আমি আর তুমি একসঙ্গে থাকি ততক্ষণ তো অর্চুও আমাদের সাথে বা কাছাকাছি থাকে। তাই তো বলে উঠতে পারিনি। কিন্তু দিদি, আমার না খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু এই রেস্টুরেন্টে সেটা করলে অন্য রকম ব্যাপার হতে পারে। তাড়াতাড়ি চল দিদি, বাড়ি গিয়ে তোমাকে আজ অনেকগুলো চুমু খাব আমি”।

সীমন্তিনী হাসি হাসি মুখে বলল, “সে ঠিক আছে। কিন্তু সাবধান, অর্চুর চোখের আড়ালে সেটা করবি কিন্তু। আর ঘরে আলাপটা করতে পারছিলুম না বলেই তো আজ তোর সাথে আলোচনা করব বলেই আমি এসেছি। মার্কেটিং তো দু’দিন বাদে করলেও চলতো। আর শোন, এখনই অর্চুর কাছে এ ব্যাপারটা খোলসা করতে চাইনে আমি। তুইও প্লীজ অমনটা করিস নে। তার আগে আমাদের পরির সাথে কথা বলে ওর মতামতটা জানা দরকার। অর্চু যদি এখনই ব্যাপারটা জেনে ফেলে, আর পরি যদি পরে নিজের অসম্মতি জানায়, তাহলে অর্চু কতটা দুঃখ পাবে, সেটা বুঝতে পারছিস”?

নবনীতা একটু ভেবে বলল, “হ্যাঁ দিদি, সেটা একদম ঠিক বলেছ তুমি। কিন্তু দিদি, পরি তো গোটা ব্যাপারটাই আমাদের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। তাহলে আবার ওর অসম্মতির কথা উঠছে কেন”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 183)

সীমন্তিনী নবনীতাকে বোঝাবার প্রয়াস করতে করতে বলল, “আরে পাগলী, সে তো দিয়েছে। তবু এখন যখন আমরা অর্চুকে ওর জন্যে পছন্দ করেই ফেলেছি, তখন ওর সাথে একবার কথা বলা খুবই দরকারী। অবশ্য কাল রাতেই পরিতোষকে আমি বলেছিলুম যে আমি ওর মোবাইলে একটা মেয়ের ছবি পাঠাচ্ছি, সে মেয়েটাকে ওর পছন্দ হয় কিনা তা যেন আমাকে জানায়। কিন্তু পরিতোষ ওই বিমল আগরওয়ালার কেসটা নিয়ে বড্ড বাজে ভাবে ব্যস্ত আছে বলে জানাল। ও আশা করছে, আর দিন সাতেকের ভেতরেই বিমলের বিরূদ্ধে অপারেশনটা শেষ হয়ে যাবে। তাই সে এই সাতদিনে আর অন্য কোনও ব্যাপারে মাথা ঘামাতে চাইছে না। আমিও ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর ওকে কিছু বলিনি। অর্চুর ছবিও এখনও পাঠাঁইনি ওর কাছে। অবশ্য তখনও ও একই কথা বলেছে যে তুই আর আমি পছন্দ করলেই হবে। তবু ফাইনালি বিয়ের ব্যাপারে মাসি মেসোদের সাথে কথা বলবার আগে, অর্চুর ছবি পরিতোষকে দেখানোটা খুবই জরুরী। আর তার পছন্দ হওয়াটাই সমান জরুরী। তাই সেটার জন্যে এ’ ক’টা দিন আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে”।
 

নবনীতা নিজের খুশী চেপে রাখতে পারছিল না যেন। সে আবার বলে উঠল, “তুমিও যে অর্চুকে পছন্দ করেছ এটা জেনে আমার ভেতরে ভেতরে যে কী খুশীর জোয়ার বইছে দিদি, আমি তোমায় সেটা বলে বোঝাতে পারব না গো। ঈশ, আমার এখন কি ইচ্ছে করছে জানো দিদি? আমার ইচ্ছে করছে এখনই উঠে ধেই ধেই করে নাচি”।

সীমন্তিনীও হেসে বলল, “নাচতে ইচ্ছে করছে তো বাড়ির সামনে গিয়ে নাচিস। তবে ঘরে ঢোকবার আগে। অর্চু যেন তোর নাচ না দেখে ফেলে, সেদিকে খেয়াল রাখিস। কারন আমাদের উদ্দেশ্যটা সফল হোক বা না হোক, অর্চুকে কোনও কষ্ট পেতে দেব না আমি। আমি তোর কাছ থেকেও ঠিক সেটাই চাই নীতা”।

নবনীতা এবার খানিকটা শান্ত হয়ে বলল, “আমার মন বলছে দিদি, তেমন কিছুই হবে না। দ্যাখো, সেদিন আমরা যখন অর্চুকে আবার বিয়ে করবার কথা বলছিলুম, সেদিন অর্চুও তো বলেছে তুমি যা বলবে ও তাই মেনে নেবে। আর পরিও একই কথা বলেছে। তাই এ ব্যাপারে আর কোনও জটিলতার তো কিছুই নেই। তুমি কেন এত নিগেটিভ ভাবছ”?

সীমন্তিনী শান্ত গলায় আবার বলল, “সে সব ঠিক আছে নীতা। তবু আমি চাইছি বিয়ের পিড়িতে বসবার আগে ওরা দু’জন দু’জনকে একবার দেখে নিক। কিন্তু সেটা করতে হলে হয় অর্চুকে নিয়ে আমাকে কলকাতা যেতে হবে, নয়তো পরিকে এখানে অথবা কালচিনিতে আসতে হবে। কিন্তু আমি আর পরি দু’জনেই এখন অনেক ক’টা ব্যাপারে খুব ব্যস্ত। আমি যেমন একদিকে অর্চুকে নিয়ে ভাবছি, আবার ও’দিকে কালচিনির বাড়ি বানাবার কথা ভাবছি। আবার মহিমা বৌদির ব্যাপারেও একটা প্ল্যান করছি। তুই হয়ত জানিস না, তোর মহিমা ম্যাডাম আর তার ওই এসকর্টের ব্যবসা করতে চাইছেন না। তাই উনি এ ব্যাপারে আমার সাহায্য চাইছেন। তবে হ্যাঁ, একটা কথা মনে পড়ে গেলরে হঠাৎ। শোন নীতা, আমি যে পুলিশ অফিসার, এ’কথাটা তুই যেন তোর মহিমা ম্যাডামকে বলে ফেলিস না। তাকে এসকর্ট ব্যবসা থেকে বাইরে বের করে আনার পর সেটা তার কাছে প্রকাশ করব। তুই প্লীজ, কথাটা সব সময় মনে রাখিস। আর হ্যাঁ, ওদিকে দাদাভাই, রচু আর পরিকে নিয়েও আমাকে অনেক কিছু ভাবতে হচ্ছে। আবার ভাইয়ের হায়ার স্টাডিজের ব্যাপারেও চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছে। তাই আমার পক্ষে এ মূহুর্তে কলকাতা যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আর পরিও এখন কিছুদিন এমন ব্যস্ততার মধ্যে আছে যে ওকে এখানে বা কালচিনিতে আসতেও বলা যাচ্ছে না। তাই আপাততঃ আমি ভাবছি যে অর্চু আর পরি দু’জনকেই দু’জনের ছবি দেখিয়ে তাদের মতামত চাইব। তবে অর্চুকে আগেই পরির ছবিটা দেখাব না, আগে পরিকে অর্চুর ছবি দেখাতে হবে। বুঝলি”?

নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ভাবল। তারপর কিছুটা কাতর গলায় বলল, “ও দিদি, আমাদের ভাবনা যেন সত্যি হয় গো। পরির সাথে অর্চুর বিয়েটা যেন আমরা দিতে পারি গো। আমার মন বলছে দিদি, এ বিয়েটা হলে পরি আর অর্চু দু’জনেই খুব সুখী হবে। যে ভাবেই হোক এটা আমাদের করতেই হবে” বলেই আবার একটু থেমে বলল, “আচ্ছা দিদি, তোমার কি মনে হয়, বৌদির মা বাবা কিংবা রতীশদা বা বৌদি এরা কেউ কি এ বিয়ের ব্যাপারে অমত প্রকাশ করতে পারে”?

সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “তুই কি ভাবিস, কাল আমি কালচিনি গিয়েছিলাম এমনি এমনি? কাল কালচিনি যাবার পেছনে মূল উদ্দেশ্য আমার এটাই ছিল রে। মাসি মেসো ভাই, সব্বাই রাজী হয়েছেন রে। আর দাদাভাই আর রচুও রাজী”।
 

নবনীতা আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “সত্যি দিদি”?

সীমন্তিনী চাপা কন্ঠে নবনীতাকে শান্ত থাকতে বলে বলল, “হ্যাঁরে সত্যি বলছি। আমাদের এখন শুধু দুই দেবাদেবির মনের ইচ্ছেটাই শুধু জানতে হবে। সেটা তুই আর আমি মিলে অবশ্যই করব। মন তো বলছে, ওরা কেউই অরাজী হবে না। তবু ওদের মুখ থেকে সেটা শোনা খুব দরকার। তবে তুই একটু সাবধান থাকিস। পরির সাথে কথা বলবার আগে অর্চুকে কিন্তু এ ব্যাপারে কোন আঁচ দিস নে। কালচিনির বাড়ির সবাইকে, দাদাভাই আর রচুকেও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছি। ওরাও কেউ আমার কাছ থেকে গ্রীন সিগন্যাল না পাওয়া অব্দি অর্চুকে কিছু জানাবে না। তুইও প্লীজ এ’কথাটা মাথায় রাখিস বোন”।

নবনীতা বলল, “ঠিক আছে দিদি। আমি তোমাকে কথা দিলাম। পরির সম্মতি না পাওয়া পর্যন্ত আমিও অর্চুকে কিছু বুঝতে দেব না এ ব্যাপারে। এবার চল, আমরা উঠি। অর্চুটা ওদিকে বৌদির সাথে কথা বলতে না পেরে চিন্তায় আছি। আমাদেরও কথায় কথায় অনেক দেরী হয়ে গেল। তাই এখন আর একদম দেরী করা ঠিক হবে না, চলো”।

বাড়ি ফেরার পথেই সীমন্তিনী অর্চনাকে ফোন করে বলল, “অর্চু সোনা, আজ তোকে অনেকক্ষণ একা থাকতে হলরে। কিছু মনে করিস নে বোন। আসলে একটা জরুরী কাজ শেষ করতে খুব দেরী হয়ে গেল রে। আর নীতাটাকেও আমি আমার সাথেই আটকে রেখে দিয়েছিলুম। তোর খুব খারাপ লেগেছে নারে”?

অর্চনা ও’পাশ থেকে জবাব দিল, “না না দিদিভাই, তোমরা তো আর আমাকে একা ছেড়ে কোথাও মজা করতে যাও নি। কাজ থাকলে সে তো করতেই হবে। শুধু তোমাদের ফিরতে দেরী হচ্ছিল বলেই একটু চিন্তা হচ্ছিল। আর ওদিকে দেখোনা, রচুকে সন্ধ্যের পর থেকে তিন তিনবার ফোন করলুম। একবারও ও ফোনটা ধরছে না। বাড়িতে ফোন করতে ভাইও বলল যে ও বাড়ির কেউও জানে না। সেজন্যেই আমার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে গো? ও দিদিভাই, তুমি কি জানো, রচু ওরা এখন কোথায়”?

সীমন্তিনী অর্চনাকে আশ্বস্ত করতে বলল, “ঈশ দেখেছিস? কাজের চাপে আমি এ খবরটাও তোকে দিতে ভুলে গেছিরে। আরে রচু আর দাদাভাই আজ এক জায়গায় বেড়াতে গেছে রে। তাই হয়তো তোর ফোন ধরেনি। হয়তো ফোনটা ব্যাগের মধ্যে আছে। বা সাইলেন্ট করা আছে। তুই ভাবিসনে। দুপুরেই আমি এ খবরটা পেয়েছিলুম। ভেবেছিলুম বাড়ি ফিরে তোকে বলব। কিন্তু বাজারে এসে একটা জরুরী কাজ সারতে সারতে তোকে কথাটা জানাতেও ভুলে গেছি রে বোন। প্লীজ, কিছু মনে করিস নে”।

অর্চনা খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বুঝি? কিন্তু ও তো ঘর থেকে বেরোবার আগে আমাকে বা ভাইকে কথাটা জানিয়ে দিতে পারতো। আমি এদিকে চিন্তায় মরছি। কিন্তু ও দিদিভাই, ওরা যে বিপদের মধ্যে আছে, এরমধ্যে আবার বাইরে বেড়াতে যাবার দরকারটা কি ছিল বলো তো”?
 

সীমন্তিনী মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আঃ অর্চু, কি হচ্ছে? লক্ষ্মীদি তো শুনে ফেলতে পারে তোর কথা। তখন আমার মাথা খেয়ে ফেলবে”।

অর্চনা চাপা গলায় বলল, “না না দিদিভাই, লক্ষ্মীদি এখন রান্নায় ব্যস্ত আছে। আমি তো আমাদের ঘর থেকে কথা বলছি তোমার সাথে। শুনতে পাবে না। কিন্তু দিদিভাই, ওরা যখন তোমাকে বাইরে বেড়াতে যাবার কথা বললো, তখন তুমি বাধা দাওনি কেন বলো তো? ওরা না জানুক, তুমি তো জানো ওরা কতটা খারাপ সময়ের মধ্যে আছে”।

সীমন্তিনী হাল্কা করে হেসে বলল, “আরে পাগলী, ভয়ের কিচ্ছু নেই রে। ওদের সাথে পরিও আছে। তাই আমি বারণ করিনি। এবার বুঝেছিস”?

অর্চনা এবার পুরোপুরি আশ্বস্ত হয়ে বলল, “ও তাই বলো। যাক, এখন নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু আমি কিন্তু আজ রচুকে খুব বকবো দিদিভাই। বাইরে কোথাও গেলেই কি ফোন করা বা ফোন ধরা মানা”?
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সে তুই তোর ছোট বোনকে বকতেই পারিস। এর ভেতর আমার আর কি বলার থাকতে পারে বল। তা সন্ধ্যেয় চা জল খাবার খেয়েছিস তো? না আমরা বাড়ি নেই বলে তুইও না খেয়ে আছিস”?
 

অর্চনাও হেসে বলল, “তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম তো। তাই একটু দেরী হয়ে গেছে। তারপর যখন শুনলাম তুমি বাজারের দিকে গেছ, তখন আমি আর লক্ষ্মীদি খেয়ে নিয়েছি”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর রাত আটটার সময় যে ওষুধ ছিল তোর? সেটা খেয়েছিস তো”?

অর্চনা আবারও হেসে বলল, “না খেয়ে উপায় আছে? ঘড়ির কাটায় আটটা বাজতে না বাজতেই লক্ষ্মীদি ওষুধ নিয়ে এসে হাজির”।

সীমন্তিনী এবার আদুরে সুরে বলল, “খুব ভাল করেছিস। সোনা বোন আমার। আর শোন, আমরা প্রায় এসেই গেছি। আর চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব। তাই ছাড়ছি এখন, হ্যাঁ? বাই”।

ও’পাশ থেকে অর্চনাও ‘বাই’ বলতে সীমন্তিনী ফোন পকেটে পুরতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “পরি সত্যি রতীশদা আর বৌদিকে নিয়ে বাইরে কোথাও গেছে দিদি? কী দরকার ছিল এতটা ঝুঁকি নেবার বলো তো”?

সীমন্তিনী চাপা গলায় বলল, “আস্তে, ড্রাইভার শুনে ফেলতে পারে। আর তুই এত ভাবছিস কেন? রচু আর দাদাভাইয়ের দায়িত্ব তো পরিই নিয়েছে। পরি যদি তাদের কোথাও নিয়ে যায় এতে তোর আমার চিন্তার কি আছে? ঝুঁকি আছে কি না, বা কিজন্যে পরি এমন করছে, সেটা তো ও নিশ্চয়ই আমাদের চেয়ে ভাল বুঝবে। আর বুঝে শুনেই করবে। তুই আর আমি এতদুর থেকে সবকিছু তো আর জানতে বুঝতে পারব না। তাই পরির ওপরেই তো আমরা ভরসা করে বসে আছি। তবে পরি আমাকে ব্যাপারটা আজ সকালেই জানিয়েছিল। কিন্তু কোথায় কেন নিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কিছু বলেনি। তবে আমার বিশ্বাস পরি কিছু একটা প্ল্যান করেই এ’সব করছে। তবে ও নিয়ে মিছে ভাবিসনে। পরে ঠিকই জানতে পারব আমরা”।

একটু থেমে সীমন্তিনী আবার বলল, “আর শোন নীতা, অর্চুকে পরির ছবি দেখাবার আগে বা আমরা যে তাদের দু’জনের বিয়ে দিতে চাই, এ কথাটা জানাবার আগে তুই কিন্তু একটা কাজ করতে পারিস”।

নবনীতা উৎসুক ভাবে বলল, “কী কাজ দিদি”?

সীমন্তিনী বলল, “অর্চুর সাথে পরির ব্যাপারে মাঝে মাঝেই গল্প করবি। পরির স্বভাব চরিত্র, ব্যবহার, ওর একাকীত্ব, পরের উপকার করবার নেশা, ওর গুণাগুণ, ওর বাড়ির পরিবেশ আর আরও যা কিছু মনে পড়ে তোর, সে সব কিছু নিয়ে খুব খুব গল্প করবি। যাতে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যায়। তবে কিছু বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলবি না, বুঝেছিস"?

নবনীতা খুশী হয়ে বলল, “ঠিক বলেছ দিদি। আগে থেকে পরির সম্বন্ধে ওর মনে একটা পজিটিভ ধারণা জন্মালে যখন আমরা ওকে পরির ছবি দেখাব, আর যখন ও জানতে পারবে যে ওর বাবা-মাও পরিকে পছন্দ করেছেন, তখন ও আর একেবারেই অমত করবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো দিদি। এ দায়িত্ব আমি খুব ভালভাবে পালন করব”।
 

বলতে না বলতেই গাড়ি কোয়ার্টারের গেটে এসে পৌঁছলো। কিন্তু গাড়ির শব্দ পেয়েই অর্চনা ঘরের দড়জা খুলে বাইরে এসেছিল বলে নবনীতা আর নাচতে নাচতে সীমন্তিনীকে চুমু খেতে পারল না।
 

*******************

রাতের ডিনার সেরে সীমন্তিনীর ঘরে যখন মন্তি, নবনীতা আর অর্চনা এসে বসল, তখনই রচনার ফোন এল সীমন্তিনীর ফোনে। সীমন্তিনী ফোনটা অর্চনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এই নে অর্চু। তোর বোন ফোন করেছে। তুই তো তখন থেকে উতলা হয়ে আছিস। তুই আগে কথা বলে নে, তারপর আমরা কথা বলব”।

অর্চনা ফোন হাতে নিয়ে কল রিসিভ করেই ফোনটাকে স্পীকার মোডে দিয়ে বলল, “হ্যাঁরে রচু, তুই কী রে? সন্ধ্যের পর থেকে আমি তিন তিনবার তোকে ফোনে করেছি, ভাই তোকে ফোন করেছে। তুই কারুর ফোন ধরছিস না। কি ব্যাপার রে তোদের”?

রচনা অপরাধীর মত গলা করে জবাব দিল, “সত্যিরে দিদি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে রে আমার। রাগ করিসনে লক্ষ্মীটি। আসলে হয়েছে কি জানিস, আজ পরিতোষদার সাথে আমি আর উনি দমদমের দিকে পরিতোষদার পরিচিত একজনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলুম। আর ফোনটাকে আমার পার্সের ভেতরে রেখে দিয়েছিলুম। ও বাড়িতে গিয়ে দীপাদির বেডরুমে বসে গল্প করছিলুম, আর পার্সটা রেখে দিয়েছিলুম ওদের ড্রয়িং রুমের সোফায়। আমরা ওনাদের বেডরুমে ঢুকে যাবার পর পরিদা আর ডাক্তার বাবুও আরেক ঘরে গিয়ে গল্প করছিলেন। তাই ফোনের শব্দ আমরা কেউই টের পাইনি। সবাই মিলে খুব মজা করে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ যখন বেড়োলাম ওখান থেকে তখনই ফোনটা বের করে দেখি তোর আর ভাইয়ের অনেকগুলো মিস কল। আর সেটা দেখেই সাথে সাথে আগে ভাইকে ফোন করলুম। তারপর দিদিভাইয়ের নাম্বারে ফোন করলুম তোদের সকলের সাথে কথা বলব বলে। রোজ নিয়ম করে দিদিভাইকে রাত আটটার দিকে আমি ফোন করি। আজ ও বাড়িতে গিয়ে সব যেন একেবারে ভুলে গিয়েছিলুম। হ্যাঁরে দিদি, দিদিভাই নিশ্চয়ই খুব রেগে আছেন না রে? নইলে নিজে ফোনটা না ধরে তোকে দিয়ে দিতেন”?

অর্চনা এবার মোলায়েম স্বরে বলল, “দিদিভাই তো জানতেনই যে তোরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেড়িয়েছিস। তবে দিদিভাইয়েরও আজ বাড়ি ফিরতে অনেক দেরী হয়েছে। রাত প্রায় সাড়ে ন’টার দিকে এসেছেন। নীতাদিও তার সাথে একই সাথে এসেছেন। দুপুর থেকে বাড়িতে শুধু আমি আর লক্ষ্মীদি ছিলুম। তোকে ফোন করে না পেয়ে আমিই দিদিভাইকে ফোন করেছিলুম। কিন্তু তিনি মার্কেটের দিকে কোথাও কাজে ব্যস্ত ছিলেন বলেই তখন নীতাদিই ফোনটা ধরেছিলেন। পরে অবশ্য দিদিভাইয়ের কাজ শেষ হতেই উনি আমাকে ফোন করেছিলেন। তখনই শুনলুম তোরা কোথায় বেড়াতে গিয়েছিস। এখন দিদিভাই আর আমরা সবাই একসাথেই বসে আছি। তুই ফোন করেছিস দেখেই, আমি তোর সাথে কথা বলবার জন্যে খুব উতলা ছিলাম বলে উনি আমাকেই আগে কথা বলতে বললেন। এই নে, তার সাথে কথা বল”।

সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়েই বলল, “কিরে পাগলী, খুব তো যাব না যাব না বলছিলিস। আমিই তো তোকে জোর করে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠালুম। আর ওখানে গিয়ে এতই মজে গেলি যে রাত সাড়ে এগারটায় ওখান থেকে বেড়োলি তোরা? দিদিভাইকে ফোন করতেও ভুলে গেলি একেবারে? আমি তো ওই ডাক্তার আর তার পরিবারের কাউকে চিনি না। এমন কি ছিলরে ওখানে”?

রচনা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “ও দিদিভাই, তোমাকে কি বলব গো। ডক্টর দিব্যেন্দু বড়ুয়ার স্ত্রী যে কী ভাল মহিলা না? কী বলব তোমাকে। আর জানো দিদিভাই, ওই দীপাদির আপন দাদাই আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ওই ডাক্তার সোম গো। ও বাড়িতে যাবার পরে পরেই তার অমন পরিচয় পেয়েই তো আমি গলে গিয়েছিলুম। আর কী ভাল যে সে মহিলা কি বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার দাদাভাইকে তো সে প্রথমেই নিজের ভাই বানিয়ে নিলেন। আর তাদের মেয়েটা আকাঙ্ক্ষা, কী মিষ্টি সে মেয়েটা গো দিদিভাই। ওকে দেখেই তো আমার চন্দুর কথা মনে পড়ে গেছে। ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু মামী মামী বলে আমাকে একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। সারাটা সময় আমার গায়ে গায়ে লেগেছিল ও। বারবার আদর করছিল আমাকে। আমার তো ওর দিকে তাকালেই চন্দুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। চন্দুটাকে কতদিন ধরে দেখি না। আজ আকাঙ্ক্ষাকে দেখবার পর চন্দুটার জন্যে ভীষণ মন খারাপ ......” বলতে বলতেই থেমে গেল।
 

সীমন্তিনী বেশ কয়েকবার ‘হ্যালো হ্যালো’ করেও আর সাড়া পাচ্ছিল না। একটু বাদে রতীশের গলা ভেসে এল, “ও কেঁদে ফেলেছে রে মন্তি। তবে শোন, এখন আমরা রাস্তায় আছি। পরিতোষদার গাড়িতেই আমরা বাড়ির দিকে ফিরছি। তবে কলকাতা আসবার পর এত সুন্দর সন্ধ্যে এই প্রথম কাটল আমাদের দু’জনের। সত্যি বলছি মন্তি, আজকের সন্ধ্যেটার জন্য তোকে আর পরিতোষদাকে অসংখ্য ধন্যবাদ রে। তবে শোন, এখন রচুকে সামলাতে হচ্ছে। তাছাড়া আজ তো অনেক রাতও হয়ে গেল। তাই কাল বাকি কথা শুনিস। আমিও পরে তোর সাথে কথা বলব। গুডনাইট” বলে ফোন কেটে দিল।

*****************
______________________________
Like Reply
(Update No. 184)

সীমন্তিনীও ফোন বন্ধ করে রচনার কান্নার ব্যাপারে ভাবতে লাগল। তার নিজের মনটাও ভারী হয়ে উঠল। রচনাকে যেমন রাজগঞ্জের বাড়ির প্রত্যেকে ভালবাসে, তেমনি রচনাও তো বিয়ের পর থেকেই ও বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। আর চন্দু তো রচনার সবচেয়ে আদরের ছিল ও বাড়িতে। কলকাতা যাবার সময় তো সারাটা পথেই ও চন্দুর কথা ভেবে ভেবে কেঁদেছে। এদিকে চন্দুটারও খুব করুণ অবস্থা হয়েছিল তখন। অনেক কষ্টে বাড়ির লোকেরা ওকে বোঝাতে পারলেও অমন হাসিখুশী মেয়েটা সেই থেকে নাকি খুব চুপচাপ হয়ে গেছে, সীমন্তিনীর নিজেরও খুব ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে চন্দুকে একটু কাছে পেতে। তিন বছর হয়ে গেল, ও বাড়ির কাউকে সে দেখতে পায়নি। চন্দুটা নাজানি কত বড় হয়ে গেছে এতদিনে। ভাবতে ভাবতে সীমন্তিনীর চোখ দিয়েও জল গড়াতে লাগল।

সীমন্তিনীকে কাঁদতে দেখে নবনীতা আর অর্চনা ঘাবড়ে গেল। তারা সীমন্তিনীকে সামলাবার প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সীমন্তিনী একটু ধাতস্থ হয়ে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “ঠিক আছে, ছাড় আমাকে, আমাকে আরেকটা ফোন এখনই করতে হবে” বলে চন্দ্রকান্তবাবুর নাম্বার ডায়াল করল। বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও’পাশ থেকে চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “কীরে, মন্তি? এতো রাতে ফোন করেছিস কেন? কি হয়েছে রে মা? তুই ঠিক আছিস তো”?
 

সীমন্তিনী ভারী গলায় বলল, “না কাকু, কিচ্ছু হয়নি। আমি ঠিক আছি। আসলে বাড়ির সকলের কথা খুব মনে পড়ছে গো আজ। তাই ফোনটা করলুম। আচ্ছা কাকু, চন্দু কেমন আছে গো? ঠিকমত পড়াশোনা করছে তো? আগের মত হাসিখুশী থাকছে তো”?
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে চন্দু তো ভালই আছে। পড়াশোনাতেও আগের চেয়ে অনেক ভাল রেজাল্ট করছে। ওর কলেজের মাষ্টার মশাইরা তো বলছেন যে চন্দুই বোধহয় এবার ওদের ক্লাসে প্রথম হবে। তা তুই কি ওর সাথে কথা বলতে চাইছিস? কিন্তু ও তো ঘুমিয়ে পড়েছে রে মা”।
 

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “না না কাকু, ওকে ডাকতে হবে না। আসলে রচু একটু আগে ফোন করে বলল যে চন্দুকে অনেকদিন ধরে দেখতে পাচ্ছে না বলে ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। তাই আমি ফোনটা করলুম চন্দুর খবর নেবার জন্যে। এর আগে তুমি বলেছিলে যে চন্দু আগের মত হাসি খুশী নেই, খেলাধূলোও করে না, হৈ হুল্লোড় করা তো একেবারেই ছেড়ে দিয়েছে। এখনও কি অমনই আছে কাকু”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “আমরা তো আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি রে মা। কিন্তু চন্দু কিছুতেই আর আগের মত উচ্ছল প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে নারে। তবে বড়বৌমার কথাতেই ও খাওয়া দাওয়া পড়াশোনা সবকিছুই ঠিকঠাক মত করছে। শরীর স্বাস্থ্যও ঠিক আছে। শুধু আগের সেই উচ্ছলতাটাই হারিয়ে ফেলেছে। ওর একমাত্র ধ্যান জ্ঞান এখন বড়বৌমার মত ভাল রেজাল্ট করা। আর জানিস মন্তি? রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে ও বড়বৌমার ছবিতে প্রণাম করে। এসব দেখে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস, বড়বৌমা বোধহয় ওকে কোনও যাদুতে বন্দী করে রেখেছে”।

সীমন্তিনী খুব ধীর গলায় বলল, “রচু তো আমাদের সবাইকেই যাদুতে বন্দী করে রেখেছে কাকু। আচ্ছা যাক সে কথা। শোনো, আজ এখান থেকে তোমাদের সকলের জন্য কিছু কাপড় চোপড় পাঠিয়ে দিয়েছি আমি। কার জন্যে কোনটা, তা সব লিখে দিয়েছি। তবে প্রায় তিন বছর যাবৎ তোমাদের কাউকে আমি দেখিনি। মাপ আন্দাজ করে কিনেছি। কারো পোশাক যদি মাপে ছোটবড় হয়ে যায়, তাহলে সাথে সাথে কুরিয়ার করে পাঠিয়ে দিও দেরী না করে। আর সে জন্যেই হাতে সময় থাকতেই ওগুলো পাঠালাম। যাতে বদলাতে হলেও পূজোর আগেই সেটা করে ফেলা যায়। আর হ্যাঁ কাকু, এবার তো আমার হয়ে প্রণাম করবার কেউ নেই বাড়িতে। তাই তোমরা সবাই আমার প্রণাম নিও” বলে কেঁদে ফেলল।

চন্দ্রকান্তবাবু ওদিক থেকে সীমন্তিনীকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “মন্তি মা, এমন অভিমান করে এভাবে আর কতদিন থাকবি মা? একবারটি আয় না মা দু’দিনের জন্য। তোকেও তো আমাদের দেখতে ইচ্ছে হয় রে। কিন্তু তুই তো তোর মাথার দিব্যি দিয়ে আমাদের তোর কাছে যাবার পথ বন্ধ করে দিয়েছিস চিরতরে। আর তুইও যে ভেতরে ভেতরে কেঁদে মরছিস, সেটাও তো আমি খুব ভালই জানিরে মা। একবার আয় না লক্ষ্মী মা আমার ......”

চন্দ্রকান্তবাবুর কথা শেষ না হতেই সীমন্তিনী ফোন কেটে দিয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল। অর্চনা আর নবনীতা সীমন্তিনীর হতভম্ব অবস্থা দেখে কী করবে না করবে ভেবে পেল না। তারা দু’জনে দু’দিক থেকে সীমন্তিনীর গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শুধু সান্ত্বনা দিতে লাগলো।

প্রায় মিনিট দশেক বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবার পর সীমন্তিনী নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে নবনীতা আর অর্চনাকে তাদের ঘরে ঘুমোতে পাঠিয়ে দিল। আর নিজেও মোবাইলে ভোর পাঁচটার এলার্ম সেট করে একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে শুয়ে পড়ল।


*****************

এলার্মের শব্দেই সীমন্তিনী উঠে পড়ল। লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে দাঁত ব্রাশ করে মুখ ধুয়ে বেড়িয়ে ঘরের মেঝেতে একটা শতরঞ্চী পেতে প্রাণায়াম আর যোগাচর্চা করল। প্রায় সাতটা নাগাদ নিজের ঘর থেকে বেরোতেই অর্চনাকে ট্রেতে করে চায়ের কাপ হাতে তার ঘরের দিকে আসতে দেখে বলল, “গুড মর্নিং, অর্চু সোনা। এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস তোরা”?

অর্চনাও মিষ্টি করে হেসে বলল, “গুড মর্নিং দিদিভাই। কোথায় বসবে? ডাইনিং টেবিলে না তোমার ঘরে”?

সীমন্তিনী ডাইনিং টেবিলের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “ডাইনিং টেবিলেই বসি চল। তা নীতা লক্ষ্মীদি ওরা সব কোথায়”?

অর্চনাও সীমন্তিনীর পাশে পাশে যেতে যেতে বলল, “ওরা রান্নাঘরে আছে। আসছে এখনই। তুমি বোসো”।

সীমন্তিনী একটা চেয়ারে বসতেই লক্ষ্মী আর নবনীতাও রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। সীমন্তিনীর নির্দেশেই রোজ সকালে তারা চারজনে একসাথে বসে সকালের চা খায়। চা খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “অর্চু, কাল তো ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ দেরী হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা কাজ আর করতে পারিনি। কিন্তু আমাকে তো একটু পরেই বেড়িয়ে যেতে হবে। তাই তোকে একটা কাজের ভার দিচ্ছি। নীতা অবশ্য জানে, কাল আমরা কিছু কাপড় চোপড় মার্কেটিং করে এনেছি। কালচিনির সকলের জন্যে। আমি বেড়িয়ে যাবার পর তুই আর নীতা প্যাকেটটা খুলে সেসব বের করে দেখবি। সবগুলো তোর পছন্দ হয় কিনা সেটা নীতাকে বলবি। অপছন্দ হলে সেগুলো পাল্টে আনতে হবে। আর নীতা, একটা ছোট্ট ভুল হয়ে গেছে রে। আমার ইচ্ছে ছিল কালচিনির ডাক্তার সোমের জন্যেও কিছু একটা নেব। আমাদের জন্যে লোকটা যা করেছে তার বিনিময়ে একটা ছোট উপহার তো তাকে দেওয়াই উচিৎ। কিন্তু কাল কথাটা আমার মাথাতেই আসেনি। ওদিকে ডাক্তার সোমের বোনের সাথে রচু আর দাদাভাইয়ের পরিচয় হল কাল। ডাক্তার সোমের বোন দীপা নাকি দাদাভাই আর রচুকে নিজের ভাই বোন বানিয়ে নিয়েছেন। তাই কিছু একটা না দিয়ে শান্তি পাচ্ছি না। তাই আমার হয়ে তোকে দুটো কাজ করতে হবে। আমি বেড়িয়ে যাবার পরে পরেই তুই রচুর সাথে কথা বলে জেনে নিবি, ডাক্তার সোমের ফ্যামিলীতে তার স্ত্রী ছাড়া আর কে কে আছে? মানে ছেলে মেয়ে ক’জন আর তাদের বয়স কেমন, এসব জেনে নিবি। তারপর তোদের শোরুমে গিয়ে ডাক্তার সোমের জন্যে ভালো একসেট পাঞ্জাবী আর পাজামা, তার স্ত্রীর জন্যে সুন্দর দেখে একটা শাড়ি, আর বাচ্চাদের জন্যে কিছু পোশাক, তোর পছন্দ মত বেছে রাখিস। আমি আজ দুপুরের দিকেই অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়ব। তারপর তোদের শোরুম থেকে ওগুলো নিয়ে আসব। আর হ্যাঁ, কাল যেগুলো এনেছি ওগুলোর মধ্যে অর্চুর অপছন্দ হওয়া জিনিসগুলোও নিয়ে যাস। ওগুলোও একসাথে পাল্টে আনব। তোর অসুবিধে হবে না তো”?
 

নবনীতা বলল, “অসুবিধের কি আছে দিদি? কিন্তু দিদি, তুমি কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোরা দুটো আমার দুটো বোন। বোন হয়ে দিদিকে সব রকম কথা বলার অধিকার তোদের আছে। এতে এত কিন্তু কিন্তু করছিস কেন? তবে তুই কী বলবি তা বোধহয় আমি আন্দাজ করতে পারছি। তুই পরি কিংবা রচু বা দাদাভাইয়ের ব্যাপারেই কিছু বলবি, তাই না”?
 

নবনীতা একটু লাজুক মুখে জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি। তবে এত লোকের জন্যে এতকিছু কিনতে তোমার কত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। সেদিন আমাদের এ বাড়ির সকলের জন্য সবকিছু আনলে। কাল রাজগঞ্জের বাড়ির সকলের জন্য, কালচিনির সকলের জন্য কত খরচ হল। আবার এখন ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির জন্যে আবার কত খরচ হবে কে জানে। আমি তো সবে কাজে ঢুকলাম। আমার পক্ষে তো কাউকেই কিছু দেওয়া সম্ভব না এখন। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছে ছিল, যদি রতুদা, বৌদি আর পরির জন্যেও কিছু একটা কিনে পাঠাতে পারতুম”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুই কি ভেবেছিস নীতা? দাদাভাই, রচু ওদের কথা ভুলে গিয়ে আমি অন্য সকলের কথা ভাবছি? আরে পাগলী, আমি আগেই রচুর একাউন্টে পঁচিশ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিরে। তবে সে কথাটা এখনও ওদের বলিনি। পূজোর আগে আগে ওদের বলব যে ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলে ওরা যেন নিজেদের পছন্দ মত কিছু পোশাক কিনে নেয়। ওদের জন্য ইচ্ছে করেই এখানে থেকে আর কিছু নিলাম না। ওখানে অনেক দোকানপাট আছে। ওরা অনেক দেখেশুনে পছন্দসই জিনিস কিনে নিতে পারবে। আর পরি আর তোর মহিমা ম্যাডামেকেও কিছু একটা দিতে বলব”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে অর্চনা আর নবনীতা দু’জনেই অবাক চোখে তার দিকে চাইল। সীমন্তিনী চা খাওয়া শেষ করে নিজের রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “লক্ষ্মীদি, তুমি সকালের খাবারটা বানিয়ে ফেলো। আমি চান সেরে আসছি”।
 

****************

অফিসে যাবার পথে রচনার সাথে সংক্ষেপে কথা হল। অফিসে এসে নানারকম কাজে ঘন্টা তিনেক ডুবে থাকবার পর সীমন্তিনী একটু ব্রেক নিয়ে মহিমাকে ফোন করল। দু’বার রিং হতেই মহিমা সাড়া দিল। সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, তুমি কি খুব ব্যস্ত আছ নাকি এখন”?

মহিমা সীমন্তিনীর ফোন পেয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় জবাব দিল, “না না মন্তি, আমি ফ্রি আছি। ইনস্টিটিউট বন্ধ করে বেরোবার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে খুব ভাল লাগল”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “বৌদি, তোমার ব্যাপারে একটা নতুন প্ল্যান আমার মাথায় এসেছে। তবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে অনেক সময় লাগবে। আমি তো এখন অফিসে আছি। তাই ভাবছি আজ রাতে তোমার সাথে ও ব্যাপারে কথা বলব। তুমি শুধু একটা কথা আমায় বল বৌদি। তুমি কি সত্যিই তোমার ওই ব্যবসাটা ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তই নিয়েছ? আর তোমার হাতে যে টাকা গুলো জমেছে, তা কি সত্যি তোমার মেয়েদের ওপর খরচ করতে রাজী আছ”?

মহিমা প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল, “হ্যাঁ মন্তি। এর আগের দিন তোমার সাথে কথা বলার পর আমি ব্যাপারগুলো নিয়ে অনেক ভেবেছি। তারপর মনে হয়েছে, তোমার সাজেশান অনুযায়ী অমন কিছু করতে পারলেই হয়ত আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে পারব। জীবনে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য অনেক পাপ করে ফেলেছি আমি। এখন আমি সত্যিই মানসিক ভাবে খুব ক্লান্ত মন্তি। অনেক ভেবে দেখেছি, আমার এখন শুধু মাত্র তিনটে ইচ্ছে পূরণ হলেই আমি শান্তিতে বাঁচতে বা মরতে পারব। এরমধ্যে প্রথম ইচ্ছেটা হল, আমি এই ব্যবসাটা পুরোপুরি ভাবে বন্ধ করে দিতে চাই। দ্বিতীয় ইচ্ছে হল, আমার মেয়েগুলোকে সৎপথে বাঁচবার সুযোগ করে দিতে চাই, যাতে ওদের ভবিষ্যতে আর এভাবে নিজেদের শরীর বিক্রী করে বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করতে না হয়। আর তৃতীয় ইচ্ছেটা হচ্ছে, ওই রাহু বিমলের হাত থেকে যেন আমি মুক্তি পাই। এছাড়া আমার আর জীবনে কিছুটি চাইবার নেই গো”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আমি তোমাকে আগেও বলেছি বৌদি যে তুমি এমনটা চাইলে আমি তোমার পাশে থাকব। আজও আবার একই কথা বলছি। কিন্তু বৌদি, এখন আমার হাতে সময় খুব বেশী নেই। তোমার সাথে আমি রাতে কথা বলব। কিন্তু ইন দা মিন টাইম, তুমি একটা কাজ করে রাখবে প্লীজ”?

মহিমা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো না কী করতে হবে আমার”?

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ থেকে বলল, “তুমি তো বলেছিলে যে নামে বেনামে বিভিন্ন ব্যাঙ্ক একাউন্টে তোমার অনেক টাকা জমে আছে। সব একাউন্ট মিলিয়ে তোমার কাছে এখন কত টাকা আছে, আর এরমধ্যে থেকে কত টাকা তুমি তোমার মেয়েদের পেছনে খরচ করতে পার, সেটার একটা রাফ হিসেব করে রাখবে প্লীজ। তারপর রাতে আমরা এ ব্যাপারে ডিটেইলস আলোচনা করব, কেমন”?

মহিমা জবাব দিল, “ঠিক আছে মন্তি, আমার সব ক’টা ব্যাঙ্ক একাউন্টের হিসেব করে আমি তৈরী থাকব। আর তুমি এখন ব্যস্ত আছ। তাই আর তোমার সময় নষ্ট করছি না। রাত ন’টার পর যে কোনও সময় ফোন করো। আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকব”।
 

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বৌদি, তাই হবে। রাখছি এখন, বাই” বলে ফোন কেটে মিঃ অধিকারীর নাম্বারে ফোন করে জানতে পারল যে অধিকারীবাবু রাতের ট্রেনে কলকাতা থেকে রওনা হচ্ছেন। সীমন্তিনী তাকে অনুরোধ করল উনি যেন আগামীকাল কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপারে একটা রাফ এস্টিমেট বানিয়ে সীমন্তিনীর সাথে দেখা করেন।
 

***************

অফিসে আজ খুব বেশী কাজের চাপ না থাকায় সীমন্তিনী তার থানার বড়বাবুর হাতে দায়িত্ব দিয়ে দুপুর একটা নাগাদই বাড়িতে চলে এল। অর্চনার সাথে লাঞ্চ করতে করতে জেনে নিল যে আগের দিনে কেনা সব পোশাকই অর্চনার খুব পছন্দ হয়েছে। লাঞ্চের পর একটু বিশ্রাম নিয়েই সীমন্তিনী অর্চনাকে নিয়েই বসাক গারমেন্টসে চলে এল। পথে অর্চনার মুখেই শুনে নিল ডাক্তার সোম কালচিনিতে একাই থাকেন তার কোয়ার্টারে। তার স্ত্রী আর দশ বছরের ছেলে থাকে মালবাজারে তাদের পৈতৃক বাড়িতে। তার ঊণিশ বছরের মেয়ে ব্যাঙ্গালোরে বিডিএস পড়ছে। এ’সব কথা রচনার কাছ থেকেই জানা গেছে। নবনীতার কাউন্টারে ভিড় আজ আরও বেশী। তাই তার কাউন্টারে না গিয়ে সীমন্তিনী অন্য এক কাউন্টারে গিয়ে ডাক্তার সোমের ফ্যামিলির সকলের জন্যে পোশাক কিনে বাড়ি ফিরে এল।
 

সন্ধ্যে হতে তখনও অনেক বাকি। হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হতেই লক্ষ্মী চা নিয়ে এল। সীমন্তিনী তার হাত থেকে চা নিয়ে বলল, “অর্চুর চা কোথায়? ও খাবে না”?

লক্ষ্মী জবাব দিল, “সোনাদি বাথরুম থেকে এখনও বেরোন নি তো”।

সীমন্তিনী বলল, “তোমাদের দু’জনের চা-ও আমার ঘরেই নিয়ে এস। একসাথে বসে গল্প করতে করতে খাব সবাই। অর্চুকেও এখানে আসতে বলো”।

খানিক বাদে তিনজনে একসাথে চা খাবার সময় সীমন্তিনী অর্চনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে অর্চু? রচুর সাথে আজ তোর কথা হয়েছে নিশ্চয়ই। আমি তো শুধু অফিসে যাবার সময় ওর সাথে অল্প একটু সময় কথা বলেছি। কাল ওরা কোথায় গিয়েছিল, কেমন মজা হয়েছে, এসব বলেছে তোকে”?

অর্চনা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, অনেকক্ষণ কথা হয়েছে গো আমাদের। ও বলল, আগে নাকি ও যেতেই চাইছিল না। তুমিই নাকি ওকে বলে কয়ে রাজি করিয়েছিলে। কিন্তু পরিতোষবাবুর সঙ্গে দমদমে তার ওই বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে ওদের নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই ডাক্তারবাবু ... কি যেন নামটা বলল ... ও হ্যাঁ, দিব্যেন্দু বড়ুয়া, উনি নাকি কোলকাতার নামকরা একজন সার্জন। তার স্ত্রী দীপা যিনি আমাদের কালচিনি হাসপাতালের ডাক্তার সোমের বোন, আর তাদের বারো তের বছরের মেয়ে আকংক্ষাকে নাকি খুব ভাল লেগেছে। ওই বাচ্চা মেয়েটা রতুদাকে মামা আর রচুকে মামী বলে ডেকেছে। ওদের আবার যেতে বলেছে বারবার। কলকাতা যাবার পর এত খুশী নাকি ওরা কখনও হয়নি। আর তোমার বন্ধুর কথাও খুব করে বলছিল। অমন ব্যস্ত সমস্ত এক বড় পুলিশ অফিসার নিজে সঙ্গে করে ওদের নিয়ে গেছেন, আবার বাড়ি অব্দি পৌঁছেও দিয়েছেন এ’সব কথা বলতে বলতে তো রচু খুশীতে হাঁপিয়ে উঠছিল দিদিভাই। খুব প্রশংসা করছিল পরিতোষবাবুর” বলে হেসে ফেলে বলল, “ও যে কী পাগলামী শুরু করে দিয়েছিল না দিদিভাই সে কি বলব তোমাকে। ও ওই ডাক্তার বাবুর কথা বলবে, না তার স্ত্রীর মেয়ের কথা বলবে না তোমার পরিতোষবাবুর কথা বলবে তা যেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না। ওর খুশী দেখে আমারও খুব ভাল লেগেছে গো। কিন্তু বেচারী তো জানেও না যে ওর ওপর ........”

সীমন্তিনী চট করে অর্চনার হাত ধরে চোখের ঈশারায় তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলল, “বুঝেছি বুঝেছি। রচু আর দাদাভাই কাল সন্ধ্যেটা খুব ভাল উপভোগ করেছে। আসলে জানিস অর্চু, রচুর মনটা খুব খারাপ ছিল। ওর নাকি ক’দিন ধরে রাজগঞ্জের সকলের জন্য, বিশেষ করে আমাদের সবচেয়ে ছোট বোন চন্দুর জন্য ওর মনটা খুব বিষণ্ণ ছিল। রচুকে তো ও বাড়ির সকলেই বিয়ের পরদিন থেকেই খুব ভালবাসে। কিন্তু চন্দু প্রথম দিন থেকেই রচুর এত নেওটা হয়ে গিয়েছিল যে যতক্ষণ বাড়িতে থাকত ততক্ষণ রচুর সাথেই সর্বক্ষণ ঘুরঘুর করত। রচু কলকাতা চলে যাবার পর নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল ও। কেউ ওকে আয়ত্বে আনতে পারেনি। তারপর রচুই ফোনে ফোনে কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পথে এনেছিল। আর কাল তো শুনলিই, কাকু কি বললেন। চন্দু রোজ ঘুম থেকে উঠে আর শুতে যাবার আগে রচুর ছবিতে প্রণাম করে। মন দিয়ে পড়াশোনা করছে যাতে রচুর মত রেজাল্ট করতে পারে। তাহলে বুঝতেই পারছিস, রচুকে ও কতখানি ভালবাসে”।

এ’কথা শুনে লক্ষ্মীদি বলল, “বৌদিমণি আসলেই তো অমন গো দিদিমণি। অমন মেয়েকে কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারে। সে যে রূপে সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী আর গূণে মা সরস্বতী গো। আর ঠিক তেমনই আমার এই সোনাদিদিও” বলে অর্চনার দিকে ঈশারা করে বলল, “সত্যি এমন দুটো মেয়ের জন্ম যিনি দিয়েছেন তিনি যে সত্যিই খুব ভাগ্যবতী গো দিদিমণি। আমার তো খুব ইচ্ছে করে সেই জন্মদাত্রীটিকে একটিবার দেখতে। কবে যে আমার সে ইচ্ছে পূরণ হবে কে জানে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোমার সে ইচ্ছে পূর্ণ হতে আরে খুব বেশী দেরী নেই গো লক্ষ্মীদি। আমি তো তোমাকে আগেই কথা দিয়েছিলুম যে তোমার বৌদিমণির মা বাবাকে তুমি দেখতে পাবে। আর বেশী অপেক্ষা করতে হবে না তোমায়। খুব শিগগীরই তুমি আমার মাসি মেসো ভাই সব্বাইক দেখতে পাবে গো। এই ঘরে বসেই দেখতে পাবে তাদের”।

লক্ষ্মী আর অর্চনা দু’জনেই প্রায় একসাথে বলে উঠল, “সত্যি বলছ”?

সীমন্তিনী অর্চনাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, “হ্যাঁরে। সামনের মাসের বারো তারিখে তারা সবাই এখানে আসছেন। মাসি, মেসো ভাই সবাই আমাকে সে কথা দিয়েছে। আর এই যে কাল তাদের জন্য পূজোর কাপড় চোপড় কিনলুম সেগুলো তখনই তাদের হাতে দেব। তার আট ন’দিন বাদেই তো পূজো”।
 

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর পায়ে উপুড় হয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক প্রণাম গো দিদিমণি। তোমার জন্যেই আমার এমন সৌভাগ্য হল। ঈশ, বৌদিমণির সাথে ফোনে কথা বলতে বলতেই তাকে একটিবার চোখের দেখা দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল আমার। আর সে ইচ্ছে যেদিন পূর্ণ হল সেদিন থেকেই তার মা বাবাকে দেখার সখ হয়েছিল। এখন তোমার দয়ায় সে সখও আমার পূর্ণ হবে। আমি তোমাকে কি বলব গো দিদিমণি। তুমি যে কল্পতরুর মত আমার সব সাধ পূর্ণ করছ গো। আমি তো মুখ্যু সুখ্যু গরীব মানুষ। তোমাকে এর কোন প্রতিদান দেবার সাধ্যিও তো আমার নেই। তবে, আমি আমার জীবনটাই তোমার পায়ে সঁপে দিলাম। সারা জীবন আমি তোমাকে ছেড়ে যাবনা গো দিদিমণি”।

সীমন্তিনী লক্ষ্মীর কাঁধ ধরে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আঃ লক্ষ্মীদি, এভাবে আমার পায়ে পড়ে আমাকে কেন পাপের ভাগী করছ গো। তুমি তো বয়সে আমার থেকে বড়। ওঠো ওঠো। তোমার কাছ থেকে কোনও প্রতিদানও আমি চাইনে। তুমি ভাল থেক আর আমাদের সবাইকে ভাল রেখ, তাহলেই হবে”।

অর্চনা সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে আদুরে গলায় বলল, “ও দিদিভাই, আমার একটা আবদার রাখবে গো”?

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এমন করে বলছিস কেন রে? তোদের জন্যে আমি তো সবকিছু করতে রাজী আছি। বলনা কী বলবি”?

অর্চনা সীমন্তিনীর কোলের দিকে ঈশারা করে বলল, “আমাকে একটু তোমার কোলে মাথা রেখে শুতে দেবে”?
 

সীমন্তিনী আদর করে অর্চনার মাথা টেনে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে তার মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “ঈশ, ধাড়ি মেয়ের বায়না দেখ লক্ষ্মীদি। যেন দুধের শিশু একটা”।

অর্চনা সীমন্তিনীর কোলে মাথা রেখে চোখ বুজে বলল, “আহ, কী শান্তি গো দিদিভাই। মনে হচ্ছে আমার পুরো শরীর মন একেবারে হাল্কা হয়ে গেল”।

সীমন্তিনী পরম মমতায় অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিকক্ষণ চুপ থেকে অর্চনা বলল, “কার কাছে তুমি কী, তা আমি জানিনে দিদিভাই, কিন্তু আমার কাছে তুমি সত্যিই এক পরশমণি গো। তিনমাস আগেও তো আমি ভাবতে পারিনি এমন একটি কোলে মাথা রেখে আমি কখনও শুতে পারব। জানিনা, আমি রচু ভাই বা মা-বাবা কে কোন পূণ্য করেছিল। কিন্তু আমাদের জীবনে তোমাকে পাওয়া সত্যি কোন বিরাট পূণ্যের ফল। জানো দিদিভাই, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যখন ভাই আর রচুর মুখে তোমার কথা শুনেছিলুম, সেদিনই মনে হয়েছিল রচুই বুঝি আমাদের পূণ্যের ফল। আমরা রচুকে পেয়েছিলুম বলেই না তোমাকে পেয়েছি। নইলে অমন ভাবে তোমার সাথে তার পরিচয় হত”?

(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 185)

সীমন্তিনী আগের মতই অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “নারে অর্চু। আসলে রচুই বুঝি আমার কাছে আমার পূর্বজন্মের কোন পূণ্যফল। জানিস অর্চু সেই কোন ছোট্টবেলা থেকে আমি পাগলের মত আমার দাদাভাইকে ভালবাসতুম। দাদাভাইয়ের গায়ে সামান্য আঁচড়টুকু লাগলেও সকলের সাথে ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিতুম। দাদাভাইকে বাড়ির কেউ বকাবকি করলে আমি দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দিতুম। কেউ আমাকে বাগে আনতে পারত না। এতোটাই জেদী ছিলুম আমি। আমার জেদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল বাড়ির সবাই। জলপাইগুড়িতে রচুকে যেদিন প্রথম দেখেছিলুম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল, আমার দাদাভাইয়ের জন্য এই মেয়েটাই একমাত্র উপযুক্ত। আমার ধারণা মিথ্যে হয়নি রে। রচু সত্যি সত্যি নিজেকে দাদাভাইয়ের উপযুক্ত বলে প্রমাণ করছে। দাদাভাইয়ের সাথে সাথে ও বাড়ির প্রত্যেকটা লোককে এমন করে আপন করে নিয়েছে যে সবাই রচুকে নিজেদের নয়নের মণি বলে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। দাদাভাই যখন ঠিক করল কলকাতা যাবে, তখন বাড়িতে কেউই তার কথা মানতে চাইছিল না। রচুও রাজী ছিল না বাড়ির সকলকে ছেড়ে দাদাভাইয়ের সাথে যেতে। আবার দাদাভাইকে ছেড়ে বাড়িতে থাকবার কথাও মুখ ফুটে বলতে পারছিল না। তখনও ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আমিই রাজী করেছি। এর জন্যেও হয়ত বাড়ির লোকেরা আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছেন। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত যে কতটা ঠিক তা এক সপ্তাহের মধ্যেই বাড়ির লোকেরা বুঝতে পেরেছিল। দাদাভাইয়ের দু’লাখ টাকা লুট হয়ে যাবার পর ওই সময়ে রচু যদি ওর সাথে না থাকত, তাহলে দাদাভাই কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারত না। তাই রচুকে আমি আমার জীবনের কোহিনুর হীরে বলে মনে করি রে। দাদাভাইয়ের স্ত্রী হয়ে ও আমার যে উপকার করেছে তার বিনিময়ে আমি ওর জন্যে, ভাইয়ের জন্যে, তোদের সকলের জন্যে যতকিছুই করিনা কেন, তা খুবই সামান্য”।

অর্চনা সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে তার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “তুমি সত্যি খুব ভাল গো দিদিভাই। তবে দিদিভাই, কাল যখন রচুকে ফোনে পাচ্ছিলুম না, তখন আমার সত্যি খুব দুশ্চিন্তা হয়েছিল গো। তুমি যখন বললে যে রচু ওরা পরিতোষবাবুর সাথে কোথাও বেরিয়েছে, তখনই মনটা শান্ত হয়েছিল। আর রাতে রচুর কথা শুনেই বুঝলুম ও কাল কতটা খুশী হয়েছিল। আসলে অজানা অচেনা একটা বাড়িতে গিয়ে যে পূর্ব পরিচিত একজনের সাথে তাদের সম্পর্ক আছে, এটা জানতে পেরেই রতুদা আর রচুর খুব ভাল লেগেছে। আর তাদের অমায়িক ব্যবহারে ওদের মন ভরে গেছে। সত্যি দিদিভাই, রচুর মনটা খারাপ বলে এত দুরে থেকেও তুমি কিকরে ওর মনের সব কষ্ট দুর করে দিলে। ভাবতেও অবাক লাগে। মনে হয় যেন ম্যাজিক। অবশ্য তোমার বন্ধু ওই পরিতোষবাবুও এজন্যে একই সমান ধন্যবাদের অংশীদার। রচু তো বলল যে উনি তোমার চেয়েও বড় পুলিশ অফিসার। আর কোলকাতার মত বড় শহরে তিনি কাজ করেন। তাই নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় যে তার ব্যস্ততাও তোমার চেয়ে অনেক বেশী। তা সত্বেও তিনি এতোটা সময় ধরে ওদের সাথে থাকলেন! এ তো শুধু তোমারই খাতিরে”।

সীমন্তিনী কিছু বলে ওঠার আগে লক্ষ্মী ঘরের কাজ করতে হবে উঠে চলে গেল। লক্ষ্মী চলে যেতে সীমন্তিনী বলল, “সত্যি রে অর্চু। ঠিক বলেছিস তুই। পরি সত্যিই আমাদের ধন্যবাদ পাবার মত কাজ একের পর এক করেই যাচ্ছে। তোকে তো আগেই বলেছি, পরি রচু আর দাদাভাইকে সুরক্ষিত রাখতে কত কী করে যাচ্ছে”।

অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি আর পরিতোষবাবু দু’জনেই তো পুলিশেই কাজ কর। কিন্তু তুমি তো চাকরি পাবার পর এখানেই আছ। পরিতোষবাবুও কি এদিকে ছিলেন কখনও? নইলে তোমাদের পরিচয় আর এমন বন্ধুত্ব হল কি করে”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়ের তিন চার দিন পরেই আমি আইপিএস পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপ করেছিলুম। দু’মাস বাদেই পরীক্ষা দিলুম, পাস করলুম। তার মাস দুয়েক পর ট্রেনিংএ যেতে হল হায়দ্রাবাদে। পরি তারও বছর চারেক আগে আইপিএস হয়েছিল। আমাদের ট্রেনিংএর সময় ও গেস্ট ফ্যাকাল্টি হিসেবে আমাদের ক্লাস নিত” এই বলে একটু থেমে অর্চুকে জিজ্ঞেস করল, “এরপর কী হয়ে থাকতে পারে ভাব তো”?

অর্চনা দুষ্টু দুষ্টু ভাব করে হেসে বলল, “এমন সুন্দরী আমার দিদিভাইটাকে দেখে তিনি নিশ্চয়ই তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন। আর সেই থেকেই তোমাদের বন্ধুত্ব, তাই না”?
 

সীমন্তিনীও হেসে বলল, “কিছুটা তা হলেও পুরোপুরি ঠিক নয়। আমার প্রেমে পড়েছিল, সেটা পুরো না হলেও কিছুটা ঠিক। কিন্তু সেই থেকেই যে আমাদের বন্ধুত্ব হয়েছে তা ঠিক নয়। এর পেছনে আরও কিছু কথা আছে”।

অর্চনা বলল, “বলোনা দিদিভাই। এর ভেতরে আর কী কথা আছে, সেটা বলতে যদি তোমার বাধা না থাকে, তাহলে বলো না। কোন ছোট্ট বেলায় মা-র কোলে মাথা রেখে আমরা দু’বোন একসাথে এমন গল্প শুনতুম। আজ কেন জানিনা, অমন করে গল্প শুনতে ইচ্ছে করছে”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তোর কাছে সে’সব কথা বলতে বাধা নেই আমার। কিন্তু এ গল্প শেষ হতে কিন্তু অনেক সময় লাগবে। শুনবি”?

অর্চনা হাসিমুখে মাথা ঝাঁকাতে সীমন্তিনী আবার বলল, “ঠিক আছে, যতটা ছোট করে বলা যায়, সে চেষ্টা করছি। তবে মাঝে মাঝে প্রশ্ন করে এটা ওটা জানতে চাইলে কিন্তু গল্প আর শেষ হবে না আজ। আচ্ছা শোন, তুই যেমন বললি, পরি আমাকে তেমন করে প্রেম নিবেদন কখনও করেনি। ও সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু আমি তো ছোটবেলা থেকেই বিবাহিতা। তাই ......”

অর্চনা চমকে উঠে বলল, “কী বললে তুমি দিদিভাই? তুমি বিবাহিতা? তাও ছোটবেলা থেকে? মানে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “এ ব্যাপারটা প্লীজ তুই জানতে চাস নে বোন। ও’কথা শুধু আমি ছাড়া আর কেউ জানে না রে অর্চু। এমনকি রচু বা দাদাভাইও সেটা জানে না। শুধু এই কারনেই আমি মাধ্যমিক পাশ করবার পরেই ও বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেড়িয়ে এসেছি। আমার নিজের মা-বাবাও আর আমার খোঁজ খবর নেন না। অবশ্য তাদের সত্যিই কারো দোষ নেই। আমার জেদ আর আমার একগুয়েমিই এর জন্য দায়ী। তবে রচুকে আমি কথা দিয়েছি যে এ ব্যাপারে যদি কখনও আমাকে কিছু বলতেই হয়, তাহলে শুধু ওকেই বলব। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে আর কখনও কিছু জিজ্ঞেস করিসনে আমায়, প্লীজ” বলে একটু থেমে আবার বলল, “এবার যে কথটা বলতে শুরু করেছি সেটা শোন। ট্রেনিং সেন্টারে আমাকে দেখে পরির নিশ্চয়ই ভাল লেগেছিল। কিন্তু প্রেম করবার কথা না বলে ও সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। তখন আমি পরিকে জানিয়েছিলুম যে আমি বিবাহিতা। কিন্তু আমার কপালে সিঁথিতে সিঁদুরের ছোঁয়া না দেখে বা আমার হাতে কোন শাঁখা পলা না দেখে ও আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। কিন্তু ভালভাবে ব্যাপারটা বোঝার পর ও আমাকে অনুরোধ করেছিল যে আমি যাতে ওর অন্ততঃ বন্ধু হয়ে থাকি। আমি সে কথাটা মেনে নিয়েছিলুম। কিন্তু তখনও আমি জানতুম না যে পরি আসলেই কতটা দুঃখী। সেটা জানলুম এবার কলকাতা গিয়ে। তখন আমিই শুধু নই, রচুও ব্যাপারটা জেনেছে। তোকে কি বলব অর্চু। ওর অতীতটা যে এমন দুঃখজনক সেটা আমি আগে একেবারেই বুঝতে পারিনি। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব হবার প্রায় দেড় দু’বছর পর আমার ট্রেনিং শেষ হয়। আর তার পরপরই আমার এখানে পোস্টিং হয়। আর পরিতোষও তার আগেই কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে আসে। আমাদের মাঝে নিয়মিত ফোনে কথা হত। কিন্তু দেখা সাক্ষাৎ হত না। আমি ওকে বারবার বিয়ে করবার কথা বলতুম। অবশেষে একদিন ও বলল যে ও একটা মেয়েকে পছন্দ করেছে। কিন্তু আমি গিয়ে মেয়েটার সাথে কথা না বললে ও বিয়ে করবে না। তাই আগেরবার কলকাতা গিয়ে পরির পছন্দ করা মেয়েটাকে দেখতে রচুকে সঙ্গে নিয়েই আমি পরির সাথে দেখা করি। সেদিনই নীতার সাথে আমাদের দেখা হয়”।
 

এ’কথা শুনেই অর্চনা প্রায় চিৎকার করে উঠল, “নীতাদি? তার মানে কি নীতাদিকেই পরিতোষবাবু .....”

সীমন্তিনী অর্চনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “সে’সব কথাই বলছি তোকে” বলে নবনীতা আর পরিতোষের ব্যাপারে সব কথা খুলে বলল। বলতে বলতে রাত প্রায় আটটা বেজে গেল। সীমন্তিনীর মুখে নবনীতার কথাগুলো শুনতে শুনতে অর্চনা বার বার কেঁদে ফেলছিল। মোটামুটিভাবে নবনীতার কথা শেষ করে সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কত মানুষের জীবনে যে এমন কত্তো বিষাদের উপাখ্যান জড়িয়ে আছে, সে’সব তো বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায়না রে। নবনীতাকে পরিতোষ আবার ফিরে না পেলে, বা আমি পরিকে বিয়ের ব্যাপারে চাপাচাপি না করলে পরি হয়তো নীতার সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিতেও চাইত না। আর আমিও ওদের ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানতে পারতুম না। রচুও আমার সাথে ছিল বলে সবটাই সেদিন জানতে পেরেছে। এই এত বড় পৃথিবীতে পরির আপন বলতে নিজের বলতে আর কেউ নেই। তাই তো সেদিন নীতা আর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলুম যে আমরা যে করেই হোক ওর বিয়ে দেব। আর দ্যাখ, আমার সাথে ওর বন্ধুত্বের মর্য্যাদা দিয়েই ও দাদাভাই আর রচুর ওপর সদা সর্বদা নজর রেখে যাচ্ছে। আমিও দাদাভাই আর রচুর নিরাপত্তার কথা ভেবে স্বার্থপরের মত ওর কাছে একের পর এক বায়না করে যাচ্ছি, আর দিনে দিনে ওর কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছি রে। জানিনে বেঁচে থাকতে ওর ঋণ আমি শোধ করতে পারব কি না”।

এবার থেমে অর্চনার চোখের জল মুছতে মুছতে সীমন্তিনী বলল, “কাঁদিস নে বোন। যার যার কপালের লেখা তাকে সেটা ভোগ করতেই হয়। আমার কপালে যা আছে আমিও সেটাই ভোগ করছি। তোর কপালে যে দুর্ভোগ ছিল তা তুই ভোগ করেছিস। আর নীতারও তাই। ও-ও ওর কপালের দুর্ভোগ ভোগ করেছে। জানিনে বিধাতা আমাদের কার কপালে কী ভবিতব্য লিখে রেখেছেন। কিন্তু আমি মনপ্রাণ দিয়ে শুধু এটুকুর চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমার আশেপাশে জড়িয়ে থাকা এই লোকগুলোর মুখে আমি হাসি ফুটিয়ে রাখতে পারি। নিজের মা-বাবাকে, নিজের বাড়ির সকলকে যে দুঃখ আমি দিয়েছি, এভাবেই যদি তার প্রায়শ্চিত্ত করে উঠতে পারি। যাক, ওঠ এবার। নীতার ফেরার সময় হয়ে এল। আর তোরও ওষুধ খাবার সময় হয়ে গেছে”।

অর্চনা সীমন্তিনীর কোল থেকে উঠে নিজের চোখ ভাল করে মুছতে মুছতে বলল, “পরিতোষবাবু আর নীতাদির কথা শুনে মনটা সত্যি খুব ভারী হয়ে গেল গো দিদিভাই। লোকটা যে দু’দুটো মেয়েকে পছন্দ করেছিল, সেই দু’জনকেই সে হারিয়ে বসেছে। আহা রে। আমি মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করব দিদিভাই, যেন তোমার আর নীতাদির চেষ্টা সফল হয়। পরিতোষবাবুর জন্যে সত্যিই তোমরা একটা ভাল মেয়ে যেন খুঁজে পাও। লোকটার নিঃসঙ্গ জীবনে একজন সত্যিকারের সঙ্গিনী যেন তোমরা জুটিয়ে দিতে পার”। বলে উঠে নিজের ঘরে চলে গেল।

ওষুধ খেয়ে খানিকক্ষণ পরে আবার সীমন্তিনীর কাছে এসে বসে বলল, “তা দিদিভাই, তুমি বা নীতাদি কোনও মেয়ের খোঁজ করেছ পরিতোষবাবুর জন্যে”?

সীমন্তিনী কাতর চোখে অর্চনার দিকে চেয়ে বলল, “কই আর তেমন করে উঠতে পারছি বল। রচু আর দাদাভাইয়ের চিন্তাতেই তো মরছি আমি, আবার একদিকে ভাইয়ের পড়াশোনার কথা, আরেকদিকে অফিসের কাজের চাপ, আরেকদিকে কালচিনির বাড়ি তৈরীর ব্যাপার, আবার দাদাভাইয়ের ইনস্টিটিউটের মালিক মহিমা বৌদির ব্যাপার, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই তো আমি হিমশিম খাচ্ছি। কিকরে আর পাত্রী খুঁজি আমি বল। আর নীতাই বা কি করবে। ও তো এখানে একেবারে নতুন। ও আর কাকে চেনে কাকে জানে যে পাত্রী খুঁজবে। তবু ক’দিন আগে একটা মেয়ের খোঁজ পেয়েছি। কিন্তু কাজের ব্যস্ততাতেই তাদের সাথে এখনও কোন যোগাযোগ সেভাবে করে উঠতে পারিনি। কিন্তু একটা ভাল মেয়ে খুঁজে তো বের করতেই হবে পরির জন্যে। হ্যাঁরে তোদের কালচিনিতে তোর জানাশোনা কোনও ভাল পরিবারের ভদ্র সভ্য কোন ', মেয়ে আছে তোর জানাশোনার মধ্যে”?
 

অর্চনা মুখ কালো করে জবাব দিল, “গত সাতটা বছর ধরে কালচিনির কোনও খবরই তো আমি জানতে পেতুম না দিদিভাই। আর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পর আমি তো কোথাও বেরোতুমই না। বাড়িতেই শুধু থাকতুম। এই প্রথম আমি বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে তোমার কাছে এসেছি। তাই কোনও মেয়ের খোঁজ তো আমার কাছেও নেই। তবে তুমি বাবার সাথে কথা বলো না। বাবার জানাশোনার মধ্যে কোন মেয়ের খোঁজ থাকতেও পারে”।
 

সীমন্তিনী চিন্তার ভাব করে বলল, “হু, কথাটা মন্দ বলিস নি। মেসো তো এতদিন বাড়ি বাড়ি যজমানি করেই কাটিয়েছেন। কোন বাড়িতে কোন মেয়ে আছে, তা তিনি নিশ্চয়ই জানেন। মেসোর সাথেই কথা বলে দেখি কাজের কাজ কিছু হয় কি না .....”

সীমন্তিনীর কথা শেষ হবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। সীমন্তিনী সাথে সাথে উঠে বলল, “ওই নীতা এল বুঝি। চল চল”।

তারা দু’জন মূল দড়জার কাছে যাবার আগেই লক্ষ্মী দড়জা খুলে দিয়েছিল। নীতা ভেতরে ঢুকে অর্চনার সাথে সীমন্তিনীকে দেখেই বলে উঠল, “একি দিদি? তুমি এত তাড়াতাড়ি অফিস থেকে চলে এসেছ”?

সীমন্তিনী নীতার একটা হাত ধরে বলল, “নারে, তোদের ওখান থেকে এসে আর আমি অফিসে যাইনি আজ। আসলে আজ তেমন কাজ ছিল না। তাই ঘরে বসে বসে অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালাম এতোক্ষণ”।

নীতা সকলের সাথে ঘরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়ে বলল, “বিকেল থেকে এতো রাত অব্দি অর্চুর সাথে গল্প করে কাটালে? তাহলে আমার সাথে আর কোনও গল্প করবে না”?

সীমন্তিনী বলল, “করবো রে পাগলী করবো, ভাবিস নে। যা পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে আমার ঘরে আয়”।

নীতা নিজের ঘরের দিকে এক পা এগিয়েও থেমে গিয়ে আবার বলল, “তোমরা যখন গিয়েছিলে, তখন আমার কাউন্টারে ভিড় ছিল সত্যি। কিন্তু তাই বলে আমার সাথে একটা কথাও বললে না তোমরা? আর জয়া ম্যামও তোমাদের দেখেছিলেন। তার সঙ্গে দেখা না করেই চলে এসেছ বলে তিনি আমাকেও জিজ্ঞেস করছিলেন, এমন কেন করলে তোমরা”?
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “রোজ রোজ তোর জয়া ম্যামের চেম্বারে গিয়ে এটা সেটা খেয়ে আসব, সেটা কি ভাল দেখায়, বল? আজ ইচ্ছে করেই আমি তার চেম্বারে যাই নি। তবে উনি যে তার চেম্বারে বসেই সিসি টিভি ক্যামেরায় আমাকে দেখেছেন, সেটা তো জানিই। আর আজও উনি ম্যানেজারবাবুকে স্পেশাল ডিসকাউন্ট দেবার কথা বলে দিয়েছেন, সেটাও জানি। তুই তাকে বলিস যে, আমি একটু ব্যস্ত ছিলুম বলেই তার সাথে আজ দেখা করিনি। তাহলেই হবে। পরে না হয় আবার কোন একদিন তার কাছে যাব। এবার যা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। আর শোন, আমার ঘরেই আসিস। আমি ততক্ষণ রচুর সাথে একটু কথা বলে নিই। তারপর রাত ন’টার পর আরেকটা জরুরী ফোন করতে হবে” বলে নিজের ঘরে চলে গেল।
 

*******************

রাত ন’টা বাজবার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে পরিতোষ পেছনের রাস্তা দিয়ে বিট্টুদের বাড়িতে ঢুকল। শেখর আর বিপ্লব দু’জনে আরও পাঁচ মিনিট আগেই বিট্টুদের বাড়িতে এসেছে। পরিতোষ পেছনের ঘরে এসে ঢুকতেই শেখর আর বিপ্লব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। পরিতোষ চেয়ারে বসে ওদের দু’জনকে চেয়ারে বসতে বলে বিট্টুকে ডাকল। বিট্টু আসতেই পরিতোষ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা সবাই ভাল আছিস তো ভাই? মাসিমা কেমন আছেন”?

বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা, মা আমি দু’জনেই ভাল আছি। মা-র সাথে দেখা করলেন না”?

পরিতোষ বলল, “মাসিমার সাথে তো অবশ্যই দেখা করব। তবে আগে এদের সাথে দরকারী কাজগুলো সেরে নিই” বলে নিজের পকেট থেকে পার্স বের করতে করতে বলল, “ঘরে ফ্লাস্ক আছে রে? পাঁচ ছ’ কাপ চা আনবার মত”?
 

বিট্টু জবাব দিল, “হ্যাঁ দাদা আছে। কিন্তু চা তো মা-ই বানাবেন বলেছেন”।

পরিতোষ পার্স থেকে একশ’ টাকার একটা নোট বের করে বিট্টুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মাসিমার হাতের চা আমি পরে খাব। এদের সাথে মিটিং শেষ করে নিই তারপর। এখন এরা এসেছে, এরপর আবার আরেকজন আসবে। তুই এক কাজ করনা ভাই, একটু কষ্ট করে সামনের দোকানটা থেকে ফ্লাস্কে করে ছ’কাপ চা আর খাবার কিছু একটা নিয়ে আয়। পকোরা বা চপ টপ যা পাস কিছু একটা নিয়ে আসিস চার পাঁচ জনের মত। আর মাসিমাকে বলে যাস, আমি কাজ শেষ করে তার ঘরে গিয়ে তার হাতের চা খাব”।

বিট্টু টাকাটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে “ঠিক আছে দাদা” বলে বেড়িয়ে গেল। পরিতোষ তখন শেখর আর বিপ্লবের দিকে মুখ করে বলল, “হ্যাঁ এবার বল। সবগুলো জিনিস নিয়ে এসেছিস তো”?
 

শেখর নিজের কোলের ওপর রাখা ব্যাগটার দিকে ঈশারা করে বলল, “হ্যাঁ স্যার, সব রেডি। এ ব্যাগেই আছে। বের করব”?

পরিতোষ বলল, “হু, বের কর”।

____________________________
Like Reply
(Update No. 186)

শেখর ব্যাগটা খুলে তার ভেতর থেকে একটা গিফট প্যাক বের করে সেটা খুলে ফেলল। গিফট প্যাকের ভেতর থেকে কতকগুলো সিডি বের করে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “সব মিলে স্যার তেরোটা এপিসোড রেকর্ড করা হয়েছে। আর প্রত্যেকটা এপিসোডই আলাদা আলাদা করে সিডি বানিয়েছি। আর এক থেকে তেরো অব্দি সিরিয়ালি নাম্বার দিয়ে দিয়েছি”।

একটা সিডির প্যাকেট হাতে নিয়ে আবার বলল, “এই দেখুন স্যার, এটার সাথে একটা ছোট স্টিকার লাগানো আছে। আর তাতে লেখা আছে (11) OFFICE-RESTROOM-FATHER+1F. এখানে অফিস আর রেস্টরুমের মানে তো বুঝতেই পাচ্ছেন। ওটা লিখে লোকেশানটা বোঝাতে চেয়েছি আমরা। ফাদার মানে হচ্ছে বিমল আগরওয়ালা। আর ওয়ান এফ মানে হচ্ছে বিমলের সাথে একজন মেয়ে বা মহিলা। অফিসের রেস্ট রুমের তিনটে সিডি আছে। তবে সব কটাই যে ওয়ান এফ এন্ডিং তা নয়। একটা টু এফ এন্ডিং সিডিও আছে। মানে ওটাতে বিমলের সাথে দু’জন মহিলা বা মেয়ে আছে। আর শুরুতে যে ইলেভেন লেখা আছে সেটা সিডির সিরিয়াল নাম্বার। এক থেকে তেরো নাম্বারের সিডি এখানে আছে। অন্যান্য সবগুলো সিডির প্যাকেটের ওপরেই এমন ধরণের স্টিকার লাগিয়ে তাতে এমন ধরণেরই কিছু কোড লিখে দিয়েছি, যাতে করে আপনার বুঝতে কোনও অসুবিধে না হয়” বলে আরেকটা সিডির প্যাকেট হাতে তুলে দেখিয়ে বলল, “আর এটা দেখুন স্যার। এটাতে লেখা আছে (1) HOUSE-MOTHER+SON+4TB. এর মানে হচ্ছে এটা সিডি নাম্বার ওয়ান আর বিমলের বাড়ির লোকেশানের সিডি, আর এটাতে যাদের দেখা যাবে তারা হল মাদার মানে বিমলের স্ত্রী, সন মানে বিমলের ছেলে বিকি, আর ফোর টিবি মানে হচ্ছে চারজন টিনেজার বয়। আসলে এরা বিকিরই বন্ধুবান্ধব”।

তারপর আরও একটা সিডি বেছে নিয়ে বলল, “এটা দেখুন স্যার, এতে কিন্তু কোডটা আবার আলাদা। এতে লেখা আছে (5) HOTEL-MOTHER + SON + 1F. এর মানে হচ্ছে এটা পাঁচ নাম্বার সিডি, আর এটার লোকেশান হচ্ছে বিমলের স্ত্রী সবিতা আগরওয়ালার ভাড়া নেওয়া হোটেল রুম। এতে যারা আছে তারা হল সবিতা, তার ছেলে বিকি আর অন্য আরেকজন মহিলা। আর আরও এক লোকেশানের সিডি আছে” বলে সিডিগুলো নাড়াচাড়া করে আরেকটা সিডি হাতে নিয়ে বলল, “এই যে স্যার, এটা। এটাতে কোড লেখা আছে (12) FARM HOUSE-FATHER+1F. যার মানে হচ্ছে বারো নাম্বার সিডিতে দক্ষিণেশ্বরের ওই ফার্ম হাউসে বিমলের সাথে একজন মহিলা আছে। এই চারটে লোকেশানের মোট তেরোটা সিডি এখানে আছে। বাড়ির চারটে, ফার্ম হাউসের দুটো, অফিসের রেস্টরুমের তিনটে আর হোটেলের চারটে। এখানে তো তেরোটা আছেই, আর অনুপমার সাথে বিমলের একটা সিডি তো আগেই রেকর্ড করা ছিল ওই রবিশঙ্করের কেসটার সময়। সেটা তো বলেছিলেন যে আপনার কাছে আছে। সেটা কি এনেছেন স্যার”?

পরিতোষ নিজের কোটের পকেট থেকে একটা সিডি বের করে শেখরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এই নে। এটাতেও একটা স্টিকার লাগিয়ে কোড লিখে দিতে পারলে ভাল হয়”।

বিপ্লব হাত বাড়িয়ে সিডিটা নিতে নিতে বলল, “দিচ্ছি স্যার, এখনই লাগিয়ে দিচ্ছি”। বলে শেখরের ব্যাগটার ভেতর থেকে স্টিকার আর মার্কার পেন বের করে স্টিকারটাকে সিডির প্যাকেটের ওপর লাগিয়ে দিয়ে তার ওপর লিখে দিল (14) BOROBAZAR-FATHER+1F.
 

পরিতোষের কানে গেট খোলার আওয়াজ আসতেই সে বলল, “বিট্টু আসবে এখন এ ঘরে। তাই এগুলো চট করে ব্যাগে ঢুকিয়ে ফ্যাল। পরে কথা বলব এ নিয়ে”।

শেখর তাড়াহুড়ো করে সবগুলো সিডি ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলতে না ফেলতেই বাইরে থেকে বিট্টুর গলা শোনা গেল, “দাদা, চা এনেছি। আসব”?
 

পরিতোষ টেবিলের দিকে একবার দেখে জবাব দিল, “হ্যাঁ আয়”।

বিট্টু ঘরে ঢুকে টেবিলের ওপর চায়ের ফ্লাস্ক আর পকোড়ার প্যাকেটটা রাখতে রাখতে বলল, “আমি ঘর থেকে কাপ নিয়ে আসছি দাদা” বলেই বেড়িয়ে গেল। আর খানিক বাদেই চারটে খালি কাপ এনে তিনটে কাপে চা ঢেলে বলল, “ফ্লাস্কে আরও তিন কাপের মত চা রইল দাদা। পরে খেতে পারবেন। আর এটা রাখুন” বলে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট পরিতোষের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “পঞ্চাশ টাকাতেই হয়ে গেছে”।

পরিতোষ কোন কথা না বলে বিট্টুর হাত থেকে টাকাটা নিতেই বিট্টু সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে পরিতোষের অনুমতি নিয়ে চলে গেল। পরিতোষ শেখর আর বিপ্লবকে বলল, “নে পকোড়াও নে। আর শোন। আমাদের হাতে তাহলে চারটে লোকেশানের সিডি আছে, তাই তো? অবশ্য অনুপমার ওটা নিয়ে পাঁচটা লোকেশান হল। তোরা লোকেশান হিসেবে সিডিগুলোকে ভাগ করে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখ”।

চা খেতে খেতেই শেখর আর বিপ্লব মিলে চৌদ্দটা সিডিকে পাঁচটা ভাগে ভাগ করল। তারপর আরেকবার সবগুলোকে ভাল ভেবে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, “হ্যাঁ স্যার, হয়ে গেছে”।
 

পরিতোষ এক ভাগের চারটে সিডি হাতে নিয়ে দেখল একটা সিডির প্যাকেটের ওপরে কোড লেখা আছে (1) HOUSE-MOTHER+SON+4TB, দ্বিতীয় সিডিটার গায়ে কোড লেখা আছে (2) HOUSE-MOTHER+ SON +1F, তৃতীয় সিডির কভারে কোড লেখা (3) HOUSE-MOTHER+2TB, আর চতুর্থ সিডিটার কভারে লেখা আছে (4) HOUSE-MOTHER+SON. পরিতোষ কোডগুলোর যথাযথ মানে বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হয়ে সিডিগুলোকে টেবিলের একদিকে রেখে আরেকটা ভাগ তুলে নিল। সে ভাগেও চারটে সিডির প্যাকেটের ওপর লেখা কোড গুলো দেখল, (5) HOTEL-MOTHER+SON+1F, (6) HOTEL-MOTHER+1MM, (7) HOTEL-MOTHER+2TB আর (8) HOTEL-MOTHER +1TB
 

দ্বিতীয় ভাগের সিডিগুলো টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “একটাতে ওয়ান এমএম লিখেছিস। এটার মানে কি একজন পুরুষ”?

বিপ্লব জবাব দিল “হ্যাঁ স্যার অনেকটা তাই। তবে টিবি মানেও যে টিনেজার বয় বললাম, ওরাও তো পুরুষই, তাই এমএমটাকে শুধু পুরুষ বলে ধরবেন না। বরং ম্যাচিওরড মেল বলে ধরুন। আর সেজন্যেই ডাবল এম লিখে দিয়েছি”।

পরিতোষ ছোট করে ‘হু’ বলে আরেক ভাগের সিডি হাতে তুলে নিল। আর সেগুলোর প্যাকেটের ওপর লেখা কোডগুলো দেখল। একটায় (9) OFFICE-RESTROOM-FATHER+1F, আরেকটায় (10) OFFICE-RESTROOM-FATHER+2F, আর শেষেরটাতেও (11) OFFICE-RESTROOM-FATHER+1F
অর্থগুলো তার কাছে বোধগম্য বলেই মনে হল। শেষের ভাগে মাত্র দুটো সিডি। সে দুটোতে একই কোড লেখা FARM HOUSE-FATHER +1F তবে সিরিয়াল নাম্বারগুলো আলাদা। (12) আর (13)।

সিডিগুলোর কোড ভাল করে বুঝে নেবার পর পরিতোষ বলল, “সিডিগুলো ফল্টলেস আছে তো? চেক করে দেখেছিস তো ভাল করে”?

বিপ্লব বলল, “হ্যাঁ স্যার, এ ব্যাপারে একদম নিশ্চিন্ত থাকুন। কোনটাতে কোন ফল্ট নেই”।

পরিতোষ আবার জিজ্ঞেস করল, “আর পেন ড্রাইভে দিস নি”?

বিপ্লব তাড়াতাড়ি ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পেন ড্রাইভ বের করে টেবিলের ওপর রাখতে রাখতে বলল, “এই যে স্যার। এর ভেতরেই ওই তেরোটা ফাইল একই রকম কোড দিয়ে দেওয়া আছে”।
 

পরিতোষ এবার একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে দেখে জিজ্ঞেস করল, “আর তোদের অপারেশন কমপ্লিট করতে কত খরচ হয়েছে। কাকে কত দিয়েছিস, আর কাকে কাকে আরও কত টাকা দিতে হবে তার হিসেবটা কোথায়”?

শেখর ব্যাগের ভেতরের একটা পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে সেটা পরিতোষের হাতে দিল। পরিতোষ কাগজটা খুলে বেশ কিছুক্ষণ ধরে চোখ বুলিয়ে বলল, “তোদের টোটাল খরচ হচ্ছে তাহলে সাড়ে পাঁচ লাখ। আর হেল্পার চার জনকে সব মিলে মোট চল্লিশ হাজার তোরা অলরেডি পেমেন্ট করে দিয়েছিস, তাই তো”?
 

শেখর জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, ওদের আগাম ওটুকু না দিলে কাজগুলো সাড়া যাচ্ছিল না। তবে বাকি যা যাকে দেবার আছে সে’সব মাসখানেক পরেই তারা পেয়ে যাবে বলে কথা দিয়েছি”।

পরিতোষ শান্ত স্বরে বলল, “একমাস লাগবে নারে। সতেরো তারিখেই আমাদের ফাইনাল অপারেশন শেষ হয়ে যাবে। তবে সেদিনই তোদেরকে টাকাটা দিতে পারব না। হয়তো দু’একদিন দেরী হতে পারে। তবে সেটা আমি ঠিক সময়মত তোদের জানিয়ে দেব। আর একটা ছোট্ট কাজ তোকে করতে হবেরে বিপ্লব”।

বিপ্লব উৎসুক ভাবে বলল, “হ্যাঁ, বলুন স্যার”।

পরিতোষ নিজের পকেট থেকে একটা মোবাইল সিম বের করে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই সিমটার লোকেশান ট্র্যাক করা যাতে সম্ভব না হয়, সে ব্যবস্থা কর। আর এতে যেন কোন ইনকামিং কল না ঢোকে। দু’দিন সময় পাবি। এর মধ্যে কাজটা করে সিমটা আমাকে ফেরত দিবি। খেয়াল রাখিস দু’দিনের বেশী আর একদিনও সময় কিন্তু পাবি না”।

বিপ্লব নিজের পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল, “স্যার সিমটা কি অ্যাক্টিভ আছে, না এখনও অ্যাক্টিভেটেড হয়নি”?

পরিতোষ জবাব দিল, “আজ সকালেই এটা অ্যাক্টিভেট করা হয়েছে”।

বিপ্লব বলল, “তাহলে আর এটা নিয়ে যাবার দরকার পড়বে না। এক মিনিট সময় দিন আমাকে” বলে নিজের হাতের মোবাইলের ব্যাকপ্লেট খুলে ফোন থেকে আগের সিমটা বের করে পরিতোষের কাছ থেকে নেওয়া সিমটা মোবাইলে ঢুকিয়ে মোবাইলটা সুইচ অন করে কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে সেখান থেকেই একটা নাম্বারে কল করল। আবার নিজেই কলটা কেটে দিয়ে নিজের পকেট থেকে আরেকটা মোবাইল বের করে সেটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে, আগের মোবাইল থেকে পরিতোষের সিমটা খুলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “সিমটা রেখে দিন স্যার। এটা আমার নেবার দরকার নেই আর। আর দু’দিন নয়। আজ রাতেই আমি প্রয়োজনীয় কাজটা সেরে ফেলব। আজ রাত বারোটার পর থেকে এ সিমের লোকেশান সারা পৃথিবীতে কেউ ট্র্যাক করতে পারবে না। আর কোন ইনকামিং কলও এ নাম্বারে ঢুকবে না। আমি আপনাকে কাজটা করেই জানিয়ে দেব”।

পরিতোষ সিমটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “ওকে, তোরা তাহলে এবার যা। আমাকে আরও কিছুক্ষণ থাকতে হবে এখানে”।

শেখর আর বিপ্লব বেরিয়ে যাবার সাথে সাথে পরিতোষ আব্দুলকে ফোন করে বলল, “কোথায় আছিস”?

আব্দুল জবাব দিল, “স্যার আমি তো বিট্টুদের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ গজ দুরেই আছি”।

পরিতোষ সাথে সাথে বলল, “তাহলে পেছনের রাস্তা দিয়ে চলে আয় আর দেরী না করে”।
 

মিনিট পাঁচেক বাদেই আব্দুল এসে পরিতোষের সামনে হাজির হল। পরিতোষ তাকে বলল, “ফ্লাস্কে চা আছে, আর এই প্যাকেটে কিছু পকোড়া আছে। এগুলো তুই খা, আর দুটো কাপে চা ঢাল। এক কাপ আমাকে দে”।
 

মিনিট দুয়েক বাদেই চা খেতে খেতে পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “বল, তোর ওদিকের সব কিছু তৈরী তো? না আরও কিছু বাকি আছে”?
 

আব্দুলও চা আর পকোড়া খেতে খেতে জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, আমি সবরকম ভাবে প্রস্তুত আছি। ছ’টা গাড়ি, চোদ্দ জন মেম্বার, একটা অ্যাম্বুলেন্স, সব রেডি আছে স্যার। এখন আপনি আমাকে ম্যাটেরিয়ালস গুলো দিলেই আমি কাজে নেমে পড়তে পারি”।

পরিতোষ টেবিলের ওপরে রাখা জিনিসগুলোর দিকে ঈশারা করে বলল, “তোর সব ম্যাটেরিয়ালস এখানে হাজির আছে। এগুলো আগে দেখে নে। আর সিডি গুলোর ওপরে যে কোড গুলো লেখা আছে সে’গুলো ভাল করে বুঝে নে” বলে কোড গুলোর মানে আর পেনড্রাইভে ফাইলগুলো কিভাবে স্টোর করা আছে, এ সমস্ত ব্যাপারে সব কিছু বিশদভাবে বলে বুঝিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বুঝেছিস সবটা? না আর কোন কনফিউশান আছে”?

আব্দুল সিডিগুলো ভাল করে দেখতে দেখতে বলল, “না স্যার, আর কোনও কনফিউশান নেই। সবটাই বুঝেছি”।
 

পরিতোষ এবার নিজের পকেট থেকে সিমকার্ডটা বের করে আব্দুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “কাল একটা নতুন মোবাইল কিনবি। এমন মোবাইল কিনবি, যেটাতে ইউএসবি ডিভাইস লাগানো যায়। সে মোবাইলে এ সিমটা লাগাবি। এটা তে ইনকামিং বন্ধ থাকবে। শুধু আউটগোয়িং কলই হবে। আর এটাকে আজ রাত বারোটার পর থেকে কেউ ট্র্যাক করতে পারবে না। এটা থেকেই কাল সকালে আমাকে তুই একটা কল করবি। আর এ নম্বরটা তোর টিমের সবাইকে জানিয়ে দিবি। তোর সব টিমের সাথে কথা বলবার জন্য তুই কাল থেকে এ মোবাইলটাই ব্যবহার করবি। যদি কেউ তোকে কন্টাক্ট করতে চায় তাহলে তোর আগের নম্বরগুলোর মধ্যে কোনটাতে কল করতে বলবি। কিন্তু তুই যখন তাদেরকে ফোন করবি, তখন শুধু এই সিমটা থেকেই করবি। আর কাল থেকেই তুই তোর কাজ শুরু করে দিবি। মানে বিমলকে প্রথম ডেলিভারিটা কালই করবি। আর মনে রাখিস যেভাবে প্ল্যান করেছিলাম, তা থেকে যেন একচুলও এদিক সেদিক না হয়। কোনও দিকে কিন্তু একটুও বেচাল হলে চলবে না। এই মোবাইলেই পেন ড্রাইভটাকে ব্যবহার করবি শুধু। আর যে কোডের জিনিস মোবাইল থেকে পাঠাবি, ঠিক সে কোডের সিডিই যেন ডেলিভারি হয় এদিকেও কড়া নজর রাখবি। আর বিমলকে যখন কল করবি, তখনও এই নতুন ফোন থেকেই করবি। ঠিক আছে”?

আব্দুল খুব মন দিয়ে পরিতোষের কথাগুলো শুনে বলল, “হ্যাঁ স্যার, বুঝেছি। কোনও ভুল হবে না। কিন্তু স্যার, আমি একটা কথা ভাবছিলাম। ফাইনাল অপারেশনের স্পটটা অতদুরে না করে একটু কাছাকাছি করা যেত না”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “তুই কেন এ’কথা বলছিস সেটা আমি জানি। কিন্তু সেটা হবে না রে আব্দুল। আমি অনেক ভেবেচিন্তেই এমন ভাবে প্ল্যান করেছি। যাতে তুই আমি, আর আমরা সবাই সবরকম ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকি। কেউ যদি কিছু আন্দাজ করেও ফেলে, তারা আমার আর তোর লোকেশান জানতে বা বুঝতে পারলেই তাদের মাথা থেকে সে’ ভাবনা সরিয়ে দিতে বাধ্য হবে। তবে খেয়াল রাখিস, ফাইনাল অপারেশনটা করতে হচ্ছে কিন্তু সতেরো তারিখেই। তবে, নিজের চোখে অপারেশনটা দেখবার লোভ কিন্তু একেবারেই করিস না। সেদিন সকাল থেকে তুই কিন্তু কোন অবস্থাতেই তোর বাড়ি আর গ্যারেজ ছাড়া আর কোথাও যাবি না। তোর গ্যারেজের কাজে যদি বাইরে কোথাও যেতেই হয় একান্তই, তাহলে সেখানে নিজে না গিয়ে তোর গ্যারেজের অন্য কাউকে পাঠাবি। আবার বলছি, তুই সেদিন সকাল থেকে নিজের বাড়ি আর গ্যারেজেই শুধু থাকবি। সেখানে থেকেই নতুন ফোনের মাধ্যমে সকলের সাথে যোগাযোগ রেখে যাবি। আর অ্যাম্বুলেন্সটাকে সাতটা থেকে সওয়া সাতটার ভেতরে স্পটে পাঠিয়ে দিবি। আর অপারেশন স্পট থেকে খুব বেশী দুরে রাখবি না। যাতে ফাইনাল কাজটা হয়ে গেলেই একদম সময় নষ্ট না করে সেখান থেকে ওকে তুলে নিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়। সাড়ে সাতটা থেকে সাতটা চল্লিশের ভেতর ফাইনাল অপারেশনটা ওভার হয়ে গেলে, ঠিক আটটা থেকে সওয়া আটটার মধ্যেই কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সটাকে হাসপাতালে পৌঁছে যেতে হবে। এতে যেন কোন ভুল না হয়”।

আব্দুল সব শুনে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আপনার প্ল্যানের সবকিছুই আমার মনে আছে। আর সেভাবে তৈরীও হচ্ছি। সবাইকে সেভাবেই রেডি করে রেখেছি। কাজে কোনও রকম কোনও গণ্ডগোল হবেনা স্যার। কিন্তু স্যার, আরেকটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা তো বাদই রয়ে গেল। টাকার অঙ্কটা”?

পরিতোষ মনে মনে এক মিনিট ভেবে বলল, “ওটা এক কোটিতে ফাইনাল করিস। আর তোকে সেদিনও বলেছি টাকাটা হাতে আসবার পর সেটাকে তুই তোর কাছেই নিয়ে রাখবি। সতেরো তারিখে আমরা কেউ কারো সাথে দেখা করব না। ফোনেই শুধু কথা হবে। তুই আমাকে তোর ওই নতুন মোবাইল থেকেই শুধু কল করবি। তোদের সকলের পাওনা গণ্ডা চুকিয়ে বুকিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত আমার সাথে বা তোর টিমের মেম্বারদের সাথে কথা বলবার সময় কিন্তু ওই নতুন নাম্বার ছাড়া অন্য কোন নাম্বার থেকে ফোন একদম করবি না। কাল সকাল থেকে শুরু করে পেমেন্ট না পাওয়া অব্দি ওই ফোনটাকেই শুধু ব্যবহার করবি। আমি প্রয়োজন পড়লে তোর পার্সোনাল মোবাইলে মিস কল দেব। আমার মিস কল পেলে তুই সাথে সাথে নতুন নাম্বার থেকে আমাকে ফোন করবি। সতেরো তারিখ রাতে ডাক্তারের কাজটা শেষ হয়ে যাবার পর তোর সাথে আমার কথা হবে। তখন তোকে জানিয়ে দেব টাকাটা কখন কোথায় নিয়ে যেতে হবে। তখন এই সিমটাও আমি তোর কাছ থেকে নিয়ে নেব, বুঝেছিস”?

আব্দুল বলল, “হ্যাঁ বুঝেছি স্যার। কিন্তু স্যার প্ল্যানে তো আমার সে রাতে হাসপাতালে থাকার কথা ছিল”!

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ সে রকমই ছিল বটে। কিন্তু হাসপাতালের প্ল্যানে কিছু চেঞ্জ করা হয়েছে। তাই তোর আর ওখানে যাবার দরকার নেই। ওটা অন্যভাবে হয়ে যাবে। তুই তোর বাড়িতেই থাকবি। তবে ফাইনাল স্পটে যাবার আগেই যেন তোর টিমের কেউ টাকাটা আদায় করে তোর কাছে নিয়ে আসে, এভাবে ঠিক কর”।
 

আব্দুল মনে মনে একটু ভেবে বলল, “ঠিক আছে স্যার। হয়ে যাবে। তবে আমাকে আরও একজন বাড়তি লোক নিতে হবে”।

পরিতোষ বলল, “ঠিক আছে, নিয়ে নে। বাড়তি একজনকে পেমেন্ট দিতেও কোন অসুবিধে হবে না” বলে মাথা নিচু করে প্রায় মিনিট দুয়েক ভেবে জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলার আছে তোর”?

আব্দুলও এ দু’মিনিট চুপচাপ বসে বসে গোটা ব্যাপারটা মনে মনে আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল। এবার পরিতোষের প্রশ্ন শুনে মুখ তুলে বলল, “না স্যার, আর কিছু বলবার নেই। সব কিছু একদম ক্লিয়ার”।

পরিতোষ একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বলল, “তাহলে এ ম্যাটেরিয়ালস গুলো নিয়ে চলে যা। আর দেরী করার দরকার নেই। তবে মনে রাখিস, কাল সকালে ওই নতুন মোবাইল কিনে প্রথম কলটা করবি আমাকে। তারপর তোর কাজ শুরু করবি। আর সতেরো তারিখ”।

আব্দুল নিজের পকেটের ভেতর থেকে একটা ব্যাগ বের করে পেনড্রাইব আর সিডিগুলো ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাই হবে। তাহলে আমি বেরিয়ে পড়ি স্যার”?

পরিতোষও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ আয়, গুড নাইট”।

আব্দুলের সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে পেছনের গেট দিয়ে বাইরে বের করে দিয়ে পরিতোষ বিট্টুর মার ঘরের দিকে চলল। বিট্টুর মার সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তার হাতে চা খেয়ে বাড়ির সামনের গেট দিয়ে বেরিয়ে গেল।
 

*****************
______________________________
Like Reply
(Update No. 187)

নবনীতা বাড়ি ফিরল রাত আটটা কুড়িতে। নিজের ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে পোশাক বদলে সীমন্তিনীর ঘরে এসে বসতেই লক্ষ্মী সকলের জন্য চা দিয়ে গেল। টুকটাক কথা বলতে বলতে চা খাওয়া শেষ করে প্রায় ন’টা নাগাদ সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা নীতা অর্চু, একটা কথা শোন। আমি এখন মহিমা মালহোত্রা সেনকে ফোন করব। ফোনের স্পীকার অন করে দেব। তোরা সব শুনতে পাবি। কিন্তু তোরা মুখে কোন শব্দ করবি না প্লীজ। কারন আমি চাইনা মহিমা ম্যাডাম জেনে ফেলুক যে আমার সাথে বসে আরো কেউ আমাদের কথা শুনছে, বুঝেছিস তো”?

নবনীতা আর অর্চনা দু’জনেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে সীমন্তিনী অর্চনাকে ল্যান্ডলাইন ফোনটা বিছানায় আনতে বলে উঠে গিয়ে ওয়ারড্রোব খুলে ইউনিফর্মের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে আবার বিছানায় এসে বসল। ফোন এসে গেলে একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত ঠিক ন’টা। মহিমার নাম্বার ডায়াল করবার প্রায় সাথে সাথেই মহিমার সাড়া পেল, “আমি তোমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম মন্তি, বল কী বলবে”?

মহিমা সীমন্তিনীকে ‘মন্তি’ বলে ডাকছে আর ‘তুমি’ করে বলছে শুনে নবনীতা আর অর্চনা দু’জনেই কিছুটা অবাক হল। সীমন্তিনী তখন ফোনে বলল, “হ্যাঁ বৌদি, তোমাকে দুপুরে যে কাজটা করতে বলেছিলুম, সেটা করেছ”?

সীমন্তিনীর মুখে ‘বৌদি’ সম্বোধন শুনে নবনীতা আর অর্চনা আরেক দফা অবাক হল। কিন্তু মহিমা ওদিক থেকে সাথে সাথে জবাব দিল, “হ্যাঁ, আমার সবগুলো ব্যাঙ্ক একাউন্টে আজকের তারিখে মোট পনের কোটি বাইশ লক্ষ চুরাশী হাজার আটশ’ তেইশ টাকা আছে”।
 

সীমন্তিনী টাকার অঙ্কটা শুনে চমকে উঠল। একই অবস্থা নবনীতা আর অর্চনারও। সীমন্তিনী নিজেকে সংযত করে বলল, “এ তো অনেক টাকা গো বৌদি? আচ্ছা এক মিনিট বৌদি, একটু লাইনে থেকো” বলে প্যান্টের পকেট থেকে আনা কাগজটার ভাঁজ খুলে বিছানায় ভাল করে পেতে বলল, “আচ্ছা বৌদি, তোমার মন এ ব্যাপারে তৈরী তো”?

মহিমা জবাব দিল, “হ্যাঁ মন্তি। আমি অনেক ভেবেছি এ ব্যাপারে। আমার মনে আর কোনও দ্বিধা নেই। তুমি এখন আমাকে এমন একটা পরামর্শ দাও, যাতে করে এই টাকার পাহাড়ের বোঝা আমি কমাতে পারি। এ বোঝা বইতে বইতে দিনে দিনে আমার মেরুদন্ড ঝুঁকে যাচ্ছে। আমি তো তোমাকে দুপুরেই বললাম, এখন আমার শুধু ওই তিনটে ইচ্ছে। ওই তিনটে ইচ্ছে পূরণ হলে আমার মরতেও দ্বিধা থাকবে না”।

সীমন্তিনী বলল, “ছিঃ অমন কথা বলোনা বৌদি। তুমি না থাকলে আমার দাদাভাই আর রচুসোনার পাশে কে থাকবে? তোমাকে আরও আরও অনেক দিন বেঁচে থাকতে হবে ওদের জন্য, আরও অনেকের জন্য। শোনো বৌদি, তোমার মনে যে এমন একটা সৎবুদ্ধি জেগে উঠেছে, সেটা দেখে আমার সত্যিই খুব ভাল লাগছে। এখন আমি তোমাকে কিছু পরামর্শ দেব। সে পরামর্শ মত কাজ করলে তোমার দুটো ইচ্ছেই কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ণ হবে। আর আমার পরামর্শ মানো বা নাই মানো, তোমার তৃতীয় ইচ্ছেটা এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ণ হয়ে যাবে”।

মহিমা এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি মন্তি? আমার তৃতীয় ইচ্ছে তো বিমলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া! সেটার কথাই বলছ তুমি? আমি সত্যি ওই রাহুটার হাত থেকে মুক্তি পাব”?

মহিমা শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, “হ্যাঁ বৌদি, আমি সত্যি বলছি। তোমাকে অবশ্য এ ব্যাপারে আমি কিছু বলতে পারব না এখনই। যেদিন তোমার সাথে আমার মুখোমুখি দেখা হবে, সেদিন হয়ত তোমাকে সবটা খুলে বলতে পারব। তাই, এ ব্যাপারে তুমি এখন আর আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি তোমার প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না। তবে আমার মন বলছে, অমনটাই হবে। এবারে তোমার অন্য দুটো ইচ্ছের ব্যাপারেই আমরা কথা বলব এখন”।
 

মহিমা ওদিক থেকে উচ্ছ্বসিত গলায় বলে বলে উঠল, “তোমার কথাটা শুনে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, তা তোমায় বলে বোঝাতে পারব না মন্তি। ওই তোমাদের বাংলায় কি যেন একটা কথা আছে না? ফুলচন্দন না এমনই কিছু...দুর ছাই মনে পড়ছে না এখন.... ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক। সত্যি সত্যি তোমার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক বোন। তবে ঠিক আছে, তুমি যখন এ ব্যাপারে আর প্রশ্ন করতে বারণ করছ, তাহলে আর কিছু জিজ্ঞেস করছি না। বেশ এবারে বলো, টাকাগুলো নিয়ে আমি কি করি”।

সীমন্তিনী এবার একটু শ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, তুমি একটা কথা বলো তো। এই যে তোমার কাছে এখন যত টাকা আছে, মানে তুমি যা বললে ওই পনের কোটি সামথিং। ওই টাকাটা কি পুরোটাই কাজে লাগিয়ে দিতে চাও? না, তোমার নিজের জন্যেও এর থেকে কিছু রেখে দিতে চাও”?

মহিমা জবাব দিল, “সত্যি বলছি মন্তি, আমার তো খুব ইচ্ছে ছিল আট দশ লাখ টাকা দিয়ে রতীশকে একটা যোগা ইনস্টিটিউট খুলে দেব। কিন্তু তুমিই তো তাতে আপত্তি করছ। তবে আমার নিজের জন্যে আর আমি একটা পয়সাও বাঁচিয়ে রাখতে চাই না। আমি আমার সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে আমার মেয়েগুলোকে ভবিষ্যতে সৎপথে চলবার উপায় করে দিতে চাই”।
 

সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তাহলে মন দিয়ে শোনো বৌদি। তোমার কাছে তো এখন আটচল্লিশ জন মেয়ে আছে। এদের প্রত্যেককে যদি তুমি পাঁচ লাখ করে টাকা দিয়ে দাও, তাহলে ওই পাঁচ লাখ টাকায় তো তারা সবাই কোন না কোন ব্যবসা খুলতে পারবে, তাই না”?

মহিমা জবাব দিল, “হ্যাঁ পাঁচ লাখ টাকায় একটা ব্যবসা তো শুরু করাই যায়। কিন্তু আটচল্লিশ জনকে পাঁচ লাখ করে দিলেও তো মোটে দু’ কোটি চল্লিশ লাখ টাকাই যাবে আমার। আচ্ছা ধরলাম তাতে না হয় বড়জোর তিন কোটি টাকাই গেল। বাকি বারো কোটিই তো পড়ে থাকবে আমার কাছে। আর শুধু ক্যাপিটাল হলেই কি ব্যবসা করা যায় মন্তি? ব্যবসা খুলবার জন্য একটা দোকান, কমপ্লেক্স বা জায়গার প্রয়োজন তো পড়বেই। আর আজকাল এ শহরে একটা ছোটখাটো দোকান ঘর ভাড়া নিতে গেলেও হাজার হাজার টাকা সেলামী দিতে হয়। আমার মেয়েগুলো এ’সব কিভাবে যোগাবে”?
 

সীমন্তিনী মহিমার কথা শুনে বলল, “হ্যাঁ, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি বৌদি। কিন্তু আমাকে আগে সবটা বলতে দাও। সবটা শান্তভাবে শোনো, তারপর তোমার যা বলার থাকবে বলো। শোনো, তাদের সকলকে ব্যবসার মূলধন হিসেবে পাঁচ পাঁচ লাখ টাকা দিলে সেখানে খরচ হচ্ছে দু’ কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। এবার তাদের দোকান বা জায়গার কথা বলি”।

সীমন্তিনী নিজের সামনে বিছানায় পেতে রাখা কাগজে চোখ বোলাতে বোলাতে বলল, “তুমি যদি এমন একটা বড়সড় জায়গা কিনে নিতে পারো যেখানে পঞ্চাশটা দোকান ঘর বানিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো ওদের সেলামী দেবার কোন ব্যাপার থাকে না। আমার মনে হয় ছ’হাজার স্কয়ার ফিটের একটা জায়গায় যদি তিনতলা একটা বিল্ডিং বানিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে তাতে পঞ্চাশ থেকে ষাটটা দোকান ঘর হয়ে যাবে অনায়াসেই। আনুমানিক হিসেবে একটা তিনশ’ স্কয়ার ফিটের একটা রুমের খরচ যদি পাঁচ লাখ করে ধরি, তাহলে ষাট রুমের পুরো বিল্ডিংটা তৈরী করতে তিন কোটি টাকার মত লাগবে। আর এটা জমির দাম সহ হিসেব করেই বলছি। এরপর ধরো, অমন একটা শপিং মল বানাতে গেলে লিফট, সিঁড়ি, এলিভেটর, আর কিছু ইন্টেরিয়র ডেকারেশন আর কিছুটা বিউটিফিকেশনেরও প্রয়োজন আছে। এ’সবের জন্য হয়ত আরও দেড় বা দু’কোটি টাকার মত লাগবে। তাহলে বিল্ডিং তৈরী করতে তোমাকে পাঁচ কোটি খরচ করতে হবে। আর ওদিকে মূলধনের যোগান দিতে খরচ হচ্ছে দু’কোটি চল্লিশ লক্ষ, আচ্ছা ধরা যাক তিন কোটিই। তাহলে মোট খরচ হচ্ছে আট কোটি টাকা। আর এবার দ্যাখো, একটা বিল্ডিং তো আর একদিনেই তৈরী করা যাবে না। পঞ্চাশ ষাটটা রুমের একটা তিনতলা বিল্ডিং বানাতে এক বছরও লেগে যেতে পারে। কিন্তু তোমার বর্তমান ব্যবসা যদি এখনই বন্ধ করে দিতে চাও, তাহলে মেয়েগুলো এই একটা বছর তাদের সংসার কি দিয়ে চালাবে? আর যদি তুমি ভাবো যে এক বছর ওরা আগের মতই কাজ করতে থাকুক। অন্যদিকে বিল্ডিংএর কাজ চলতে থাকুক। বিল্ডিং যখন কমপ্লিট হয়ে যাবে তখনই তুমি তাদের হাতে ব্যবসার মূলধন দিয়ে ব্যবসা শুরু করতে দেবে, সেক্ষেত্রে তো তোমার ব্যাঙ্ক একাউন্টে আরও কত কোটি টাকা জমে যাবে। তাই আমার মনে হয় এমন সিদ্ধান্ত নেবার সাথে সাথেই তুমি এ ব্যবসাটা বন্ধ করে দাও। কিন্তু মেয়েগুলো যাতে আবার বিপথে চলে না যায়, আর তারা যাতে তাদের সংসার চালানো নিয়ে কোন সমস্যায় না পড়ে, সেজন্য প্রত্যেকটা মেয়েকেই ব্যবসা শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত প্রত্যেক মাসে মাসে ওদের কিছু টাকা দিলেই হবে। তাতে তাদের সংসার প্রতিপালনে আর কোন সমস্যা হবে না। তখন তাদের মনে যদি সত্যিই সৎপথে বাঁচবার ইচ্ছে থাকে তাহলে এক বছর বাদে যখন বিল্ডিংটা কমপ্লিট হয়ে যাবে, তখন তারা কোন একটা ব্যবসা শুরু করতে পারবে। আচ্ছা বৌদি, তোমার মেয়েরা মাসে মাসে কত রোজগার করে গো, একটু বলো না”।

মহিমা জবাব দিল, “সেটা তো দু’পক্ষের প্রয়োজন আর শারীরিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে মন্তি। একদিকে কাস্টমারের ডিমান্ড অন্যদিকে নিজেদের চাহিদা এবং শারীরিক ক্ষমতা। এমনিতে নরম্যালি এক একটা মেয়ে মাসে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বা ষাট হাজার রোজগার করে। তবে কারো কারো পরিবারে আর্থিক চাহিদাটা একটু বেশী থাকে। তখন তারা বেশী কাস্টমার নিয়ে মাসে সত্তর বা আশি হাজার টাকা রোজগার করে। আর এমন একজন আছে, যার সংসারে তাকে নিয়ে মাত্র তিনটে প্রাণী, কিন্তু বাবা আর ভাইয়ের চিকিৎসাতেই প্রতি মাসে মেয়েটার প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকার প্রয়োজন। তোমাকে তো বীথিকার কথা আগেও বলেছিলাম মন্তি। তোমার হয়তো মনে নেই। ও এখন প্রায় রোজই যত বেশী সম্ভব কাস্টমার নিতে শুরু করেছে। তবু সারা মাসে তিন লাখ সাড়ে তিন লাখের বেশী কামাতে পারেনা। বাকি টাকাটা, মানে প্রতি মাসে দু’ আড়াই লাখ টাকা আমি ওকে আলাদাভাবে দিই। মেয়েটার জন্যে ভীষণ কষ্ট হয় গো। ও-ই আমার সবচেয়ে পুরনো আর বিশ্বস্ত”।
 

সীমন্তিনী বলল, “না না বৌদি, আমার ঠিকই মনে আছে। ওর বাবা বিছানায়, আর একটা পঙ্গু ভাই গাড়ি দুর্ঘটণায় আহত হয়ে হাসপাতালে আছে কোমায়। সপ্তাহে সপ্তাহে সত্তর লক্ষ টাকা হাসপাতালে জমা দিতে হয়, এ’সব তুমি বলেছিলে। আমারও মনে আছে। আচ্ছা ওর ব্যাপারে না হয় আলাদা করে কিছু হিসেবে ধরা যাবে। তবে অন্য সবগুলো মেয়েকেই যদি মাসে ষাট থেকে সত্তর হাজার করে তুমি দাও তাহলে তো আর তাদের সংসার চালাবার জন্য আর কোন চিন্তা করতে হবে না। আর তোমার ওই বীথিকাকে বেশী দেবার ব্যাপারটা ধরেই গড়পড়তা হিসেবে ধর একেকটা মেয়েকে মাসে এক লক্ষ টাকা করে দিতে হবে। তাহলে আটচল্লিশটা মেয়েকে দিতে মাসে আটচল্লিশ লক্ষ টাকা মানে এক বছরে পাঁচ কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ টাকা লাগবে। তাহলে দ্যাখো সব কিছু মিলিয়ে তোমাকে খরচ করতে হচ্ছে তেরো কোটি ছিয়াত্তর লক্ষ টাকা। তোমার হাতে আছে পনের কোটি বাইস লক্ষ। তার মানে তোমার হাতে এরপরেও এক কোটি ছেচল্লিশ লক্ষ টাকা থেকে যাবে। আর কনস্ট্রাকশনের কাজের হিসেবে একটু কম বেশী হতেই পারে। তাছাড়া আমি যে হিসেব করছি সেটাই তো অ্যাকুরেট হিসেব হবে না। ভাল করে প্ল্যান আর এস্টিমেট বানালে টাকার এমাউন্টে এদিক ওদিক হবেই। আর তাছাড়াও সঠিক এস্টিমেট বানিয়ে কাজ শুরু করলেও, দিনে দিনে কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালের দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে হাতে একটু বাড়তি ফান্ড রাখতেই হবে। তাই আপাততঃ এই হিসেবে ওই এক কোটি ছেচল্লিশ লক্ষ যে বাড়তি হচ্ছে, সেটা সত্যি সত্যি অতটা না-ও হতে পারে। আর সে যাই হোক, আমি মনে করি ওটুকু হাতে রাখাই ভাল। কমপ্লেক্সটা পুরোপুরি ভাবে চালু হয়ে গেলে তখন তোমার হাতে বাড়তি কতটুকু থেকে যায়, তা ডিসপোজ করার কথা ভাবা যাবে”।
 

এতগুলো কথা বলার পর সীমন্তিনী একটু দম নিয়ে বলল, “কী মনে হচ্ছে বৌদি? রাজি আছ তুমি”?

মহিমা একটু সময় বাদে ও’পাশ থেকে জবাব দিল, “তোমার এতসব হিসেবের কথা শুনে আমি তো ঘাবড়ে যাচ্ছি মন্তি! তুমি আমার জন্য এতখানি ভেবেছ দেখে আমি সত্যিই খুব অবাক হচ্ছি। ঈশ, তুমি আমার জীবনে আরও আগে কেন আসোনি গো? তাহলে আমাকে আর গলা পর্যন্ত এমন নর্দমায় ডুবে যেতে হত না” বলতে বলতে মহিমা কেঁদে ফেলল। অনেকক্ষণ সে আর কোন কথাই বলতে পারল না।
 

এদিকে নবনীতা আর অর্চনারও একের পর এক বিস্ময়ের ধাক্কায় এমন অবস্থা হয়েছে যে তারা নিজেদের মুখে হাত চেপে ধরে চোখ বড়বড় করে সীমন্তিনীর দিকে দেখতে দেখতে নিজেদের শ্বাস প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। প্রায় মিনিট খানেক পর সীমন্তিনী আবার বলল, “বৌদি, তুমি ঠিক আছ তো? কেঁদো না গো। তোমার মত মেয়ে, যে অন্য অনেকগুলো মানুষের কথা ভেবে তাদের ভাল পথে আনতে চায়, তাদের ভাল চায়, তাকে এভাবে কাঁদতে দেখতে ভাল লাগেনা গো। নিজেকে শান্ত করো। আর ভাল করে আমার কথাগুলো ভেবে দ্যাখো। তারপর তোমার মতামত জানিও আমাকে”।
 

মহিমা এবার প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “আর কী ভাবব গো বোন? আমি বুঝতে পেরেছি, আমার ভাগ্য বিধাতা আর কেউ নয় গো। তোমার রচুসোনাই এখন আমার ভাগ্যদেবী। আজ আমি বুঝতে পারছি, রচনাকে প্রথমদিন দেখবার পর থেকেই আমার ভেতরটা এমন উথাল পাথাল করছিল কেন। রচনার দেখা পেয়েছিলাম বলেই না তোমার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। আর তুমিই আজ পরিত্রাতা হয়ে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছ। আনন্দে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসছে মন্তি। আমি আর কথা বলতে পারছিনা গো। আমি তোমার সাথে কাল কথা বলব। তবে শুধু এটুকু জেনে নাও, তোমার পরামর্শ আমি মানতে রাজি আছি। আমি তোমার সাথে পরে ......” বলে থেমে গেল।

সীমন্তিনী “বৌদি, বৌদি, হ্যালো বৌদি, শুনছ”? বলেও ও’পাশ থেকে সাড়া না পেয়ে ফোন নামিয়ে রেখে মাথা নিচু করে বসে রইল।

অনেকক্ষণ ঘরের সবাই নিশ্চুপ থাকবার পর নবনীতা ফোনের সেটটা অর্চনার হাতে দিয়ে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও দিদি, তুমি মন খারাপ করছ কেন গো? তুমি তো ম্যাডামকে খুব ভাল একটা সাজেশনই দিয়েছ”।

সীমন্তিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “সে তুই ঠিকই বলেছিস নীতা। আসলে মহিমা বৌদির সাথে আমি প্রথম যেদিন কথা বলেছিলুম, সেদিনই আমার মনে হয়েছিল বৌদি কোনও বোর্ন ক্রিমিন্যাল নয়। তারপর তার সাথে আরও কয়েকবার কথা বলার পর জানতে পারলুম সে এই পাপ ব্যবসা করতে করতে এখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বৌদিই আমাকে বলেছিল যে তার হাতে এতদিনে অনেক টাকা জমে গেছে। সে টাকা গুলো সে তার ছেলে মেয়ে স্বামী কাউকে দিতে তো পারবেনই না, এমনকি সে টাকার কথাও কারো কাছে খুলে বলতেও পারবে না”।
 

অর্চনাও জায়গা মতো ফোনটা রেখে এসে সীমন্তিনীর আরেকপাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে নিল। সীমন্তিনী বলতে লাগল, “তখন সেইই আমাকে অনুরোধ করেছিল যে আমি তাকে কোন ভাল পরামর্শ দিতে পারি কি না। সে এ ব্যবসা বন্ধ করে দেবার কথা ভেবেও মেয়েগুলোর দুরবস্থার কথা ভেবেই সেটা করতে পারেনি। সে ভেবেছিল যে সে তার ব্যবসা বন্ধ করে দিলে মেয়েগুলো হয়তো অন্য এসকর্ট প্রোভাইডারদের কাছে চলে যাবে, আর নিজেদের জীবন বিপন্ন করে তুলবে। আর সত্যি কথা বলতে, মহিমা বৌদি এতদিন যাবত যে অসামাজিক কাজ করে চলেছে তাতে তাকে অ্যারেস্ট করে তাকে আদালতে তোলাই একজন পুলিশ অফিসারের কাজ। কিন্তু আমি পরির শিষ্যা। পরি অনেক অপরাধী আর দুস্কৃতীকে সৎপথে টেনে এনে অপরাধের জগৎ থেকে সরিয়ে এনেছে। আজ ওই সমস্ত লোকগুলো খুব সুখে আছে। আর পরিতোষের জন্য তারা নিজেদের প্রাণ দিতে পারে। আমারও খুব ইচ্ছে ছিল এমন করে কাউকে অপরাধের জগৎ থেকে সরিয়ে এনে সমাজের মূল স্রোতে প্রতিষ্ঠিত করতে। যদিও আইনের চোখে বিচার করলে এ’সব কাজ করলে আমরাও দোষী বলে বিবেচিত হব। কিন্তু অনেক মহাপুরুষেরা যেমন বলে গেছেন যে ‘অপরাধকে ঘৃণা কর, অপরাধীকে নয়’, পরিতোষও আমাকে সে শিক্ষাই দিয়েছে। এমন অনেক অপরাধী আছে যারা পুলিশের হাতে ধরা পরে, আদালতের নির্দেশে বছরের পর বছর জেল খেটে বেরিয়ে এসে, আবার আগের মতই অপরাধে ডুবে গেছে। সেটা তো কারুরই কাম্য নয়। আমাদের আইন ব্যবস্থাও সেটা চায় না। আদালতের অপরাধীদের সাজা দেবার পেছনেও এমনই একটা উদ্দেশ্য থাকে। তাই আগে যেমন আমরা বলতুম জেলখানা, এখন সে পরিভাষাটা বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন বলা হয় সংশোধনাগার। তার মানে আইন আদালত সক্কলেই চায় জেলে ঢোকা সমস্ত অপরাধীই যেন শুধরে বের হয়ে আসে। জেল থেকে বেরোবার পর তারা যেন আর ওই অন্ধকারের জগতে চলে না যায়। কিন্তু আমাদের দেশের সিস্টেমই এই। অবশ্য অপরাধের সাজা দেওয়ার প্রথা সব সভ্য সমাজেই থাকা দরকার। তবুও মনে হয় কোন কোন অপরাধীকে জেল হাজত ফাঁসি না দিয়ে তাদের যদি ভালভাবে বাঁচবার একটু সুযোগ দেওয়া যায়, তাহলে মনে হয় অনেক অপরাধীই অপরাধের জগৎ থেকে বেরিয়ে আসত। তবে এটা ঠিক, শুধু আমরা তেমন ভাবলেই চলবে না। ওই অপরাধীর মনেও এমন সদিচ্ছা থাকা খুবই দরকার। তাই আমিও ভাবছিলুম যে তেমন কোন অপরাধীর দেখা পেলে তাকে আমি কোনভাবে সৎপথে ফিরিয়ে আনতুম। কিন্তু তেমন সুযোগ পাচ্ছিলুম না। মহিমা বৌদির মনের ভেতর অনেক দেরীতে হলেও এমনই একটা ইচ্ছে যে জেগে উঠেছে, সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলুম। তারপর পরির সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলেছি। পরিও আমায় উৎসাহ দিয়েছে। তাই মহিমা বৌদিকে এ’সব কথা বললুম। আর পরিতোষও আমাকে কথা দিয়েছে যে আমি যদি সত্যি সেটা করতে পারি তাহলে সেও খুব খুশী হবে। আর সে জন্যেই ও আমাকে কথা দিয়েছে যে যতদিন পর্যন্ত আমি মহিমা বৌদিকে ভাল পথে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করে যাব, ততদিন সে তাকে কোনও আইনী ঝামেলায় ফেলবে না। তবে মহিমা বৌদি যদি আগের মতই ওই অসৎ ব্যবসা নিয়ে মেতে থাকে তাহলে সে পুলিশের হাত থেকে আর বেশীদিন বাঁচবে না। তবে মহিমা বৌদির কথা শুনে আমার মনে হয়েছে যে সে আন্তরিক ভাবেই এ’সব থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু তার ব্যবসার সাথে যেসব মেয়েরা যুক্ত আছে, তাদের কোন রকম বিপদে ফেলতে সে চায় না। তাই অনেক ভেবে এমন একটা পথ আমি বেছে নিলুম, যাতে মহিমা বৌদিও নিজের পাপের ব্যবসায় উপার্জিত টাকাগুলোর সদ্ব্যবহার করতে পারবে, আর সাথে সাথে তার দলের মেয়েরাও সৎপথে থেকে উপার্জন করতে পারবে”।
 

নবনীতা সীমন্তিনীর কাঁধে নিজের গাল চেপে ধরে বলল, “দিদি, আমি তো ম্যাডামের সাথে খুব বেশীদিন মেলামেশা করিনি। তবে যেটুকু তাকে চিনেছি তাতে তাকে আমার খুব ভাল মনের একটা মানুষ বলেই মনে হয়েছে। আর বীথির মুখে তো তার অনেক প্রশংসাই শুনেছি। তাই আমার মনে হয় উনি তোমাকে কিছু বানিয়ে বা মিথ্যে বলেনি। উনি হয়ত সত্যিই এখন এমনটাই করতে চাইছেন। তুমি একটু চেষ্টা করো দিদি। আমাকে যেমন তুমি একটা নর্দমা থেকে তুলে এনেছ, তেমনিভাবে ম্যাডাম আর ম্যাডামের সাথে সাথে বীথি আর বীথির মত আরও অনেক গুলো মেয়েকে তুমি বাঁচাও”।
 

সীমন্তিনী নবনীতার গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল, “নাক যখন গলিয়েছি, আর মহিমা বৌদি যখন কিছুটা হলেও সাড়া দিয়েছে, তাহলে চেষ্টা তো করবই। শেষ অব্দি চেষ্টা করব। এখন তোর ম্যাডাম আর ওই মেয়েগুলো সেটা মন থেকে চাইলে, আর এতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকলে, নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু একটু সময় তো লাগবেই। দেখি মহিমা বৌদি এবার কি বলেন”।
 

অর্চনা এবার বলল, “তোমার কথা শুনে উনি যেভাবে কেঁদে ফেললেন, তাতে তো মনে হয় তার এতদিনের ক্রিয়া কর্মের জন্য তিনি মনে প্রাণে অনুতপ্ত। আর মনে হচ্ছে, তোমার পরামর্শও উনি নিশ্চয়ই মানবেন”।


******************
______________________________
Like Reply
(Update No. 188)

সকালে সীমন্তিনী অফিসে যাবার পথেই মিঃ অধিকারীকে ফোন করে তার সাথে দেখা করবার কথা বলল। মিঃ অধিকারী জানালেন উনি লাঞ্চ টাইমে এস্টিমেটের কপি নিয়ে সীমন্তিনীর সাথে দেখা করবেন। দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি ক্যান্টিনে গিয়ে রচনার সাথে কথা বলতে বলতে সীমন্তিনী নিজের লাঞ্চ শেষ করে চেম্বারে ফিরে আসতেই মিঃ অধিকারী এসে হাজির।
 

মিঃ অধিকারী সীমন্তিনীর অনুমতি নিয়ে তার চেম্বারে ঢুকতে সীমন্তিনী তাকে চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞেস করল, “বলুন মিঃ অধিকারী। আপনার কলকাতার কাজ মিটল”?

মিঃ অধিকারী বললেন, “না ম্যাম, মিটে গেল বলা যায় না। ব্যাপারটা এমন একটা পরিস্থিতিতে আছে যে সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থায় পড়ে গেছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ওগড়াতে”।
 

সীমন্তিনী তার কথা শুনে বেশ অবাকই হল। তবু মনে মনে কিছু একটা ভেবে একটু হাসিমুখ করে বলল, “যে খাবার চট করে গিলে ফেলা যায় না, তাকে আগে চিবিয়ে চিবিয়ে নরম করে নিন। তারপর দেখবেন খুব সহজেই গিলে ফেলতে পারবেন। সাপের সাথে মানুষের এটাও বড় একটা তফাৎ। ওরা চিবোতে পারে না। আচ্ছা সে’কথা যাক। একটু হাল্কা রসিকতা করলাম বলে কিছু মনে করবেন না প্লীজ। তা এবার আমাদের ওই কালচিনির বাড়ির ব্যাপারে বলুন দেখি। সাইট ইনস্পেকশন করবার পর একটা সপ্তাহ তো আপনি কলকাতাতেই কাটিয়ে এলেন। তা ওই ব্যাপারে এস্টিমেট টেস্টিমেট কিছু করতে পেরেছেন, না কি”?

মিঃ অধিকারী বললেন, “হ্যাঁ ম্যাম, এই দেখুন। একটা রাফ নক্সা করে এনেছি আমি। আর এস্টিমেটও একটা মোটামুটি বানিয়ে এনেছি। অবশ্য মিউনিসিপালিটিতে সাবমিট করবার আগে এস্টিমেটটাকে প্রপার ফরম্যাটে বানাতে হবে। সেটা আমি ঠিক সময় মতই করে দেব। আচ্ছা এই দেখুন” বলে একটা বড় ব্লু প্রিন্ট টেবিলে বিছিয়ে নক্সাটার বিশেষ বিশেষ জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখাতে দেখাতে বললেন, “এই দেখুন ম্যাম, এটা হচ্ছে নর্থ সাইড। তাই আমি প্ল্যানটা এমন ভাবে করেছি যে মূল ঘরটা হবে সাউথ ফেসিং। এটা বাস্তুশাস্ত্র হিসেবে বসত বাড়ির ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভাল। আর এখন দোকানটা যেখানে আছে, ঠিক তার সাথে লাগোয়া করেই এই খানটাতে ১,৬৩০ স্কয়ার ফুটের মেইন ফাউন্ডেশনটা হবে। এতে ভেতরে করিডোর রেখে ড্রয়িং রুম, ডাইনিং স্পেস, কিচেন, তিনটে বেডরুম, আর কিচেনের সঙ্গে দক্ষিণ দিকে লাগোয়া একটা স্টোর রুম, একটা ভোগ ঘর আর ঠাকুর ঘর হচ্ছে। ঠাকুর ঘর আর ড্রয়িং রুমের মধ্যিখানটায় চব্বিশ বাই পাঁচ ফুটের একটা বারান্দা থাকছে যেটা দুটো বেডরুমের সাথে সংলগ্ন থাকবে। একটা বেডরুম ভেতরের দিকে হচ্ছে। এই যে এটা। এটার জানালা থাকবে পশ্চিমে। এটার সাথে কোন বারান্দা থাকবে না, তবে এক পাশে তিনফুটের একটা ছোট্ট প্যাসেজের পরেই ড্রয়িং রুম। আর সামনে ডাইনিং রুম। অবশ্য তিনটে বেডরুম, ড্রয়িং রুম আর কিচেন থেকে ডাইরেক্ট এন্ট্রি পাওয়া যাবে ডাইনিং হলে। কিচেনের পুব দিকে একটা খোলা স্পেস থাকবে যেটাকে আপনার মাসিমার পছন্দ অনুযায়ী কলতলা হিসেবে রাখা হয়েছে। মাসিমা টয়লেটটাকে মূল ঘর, ঠাকুর ঘর বা রান্নাঘরের সাথে জুড়ে দিতে চাননি। তার পছন্দের কথা মাথায় রেখেই দুটো বাথরুম, দুটো টয়লেট ছাড়াও একটা লেডিজ টয়লেটের প্রভিশন রাখা হচ্ছে বাড়ির উত্তর পশ্চিম কোনের দিকে। আর আপনার মাসিমা যেমনটি চাইছিলেন, এই ইউনিটটাকে অন্যান্য কোন রুমের সাথে লাগানো হচ্ছে না। একদিকে কিচেন আর অন্যদিকে ডাইনিং হল আর ভেতরের বেডরুমটা থেকে মূল ফাউন্ডেশন থেকে তিন ফুট প্যাসেজ ছেড়ে দিয়ে এই ইউনিটটা সেপারেট ভাবে বানানো হচ্ছে। তাই ভেতরের বেডরুম আর ডাইনিং হলটাও ওয়েল ভেন্টিলেটেড হবে। আমি আপাততঃ সেই হিসেবেই এস্টিমেটটা করেছি। আমি অবশ্য একটু আলাদা টাইপে এ ইউনিটিটা বানাতে চাইছিলাম, কিন্তু আপনার মাসিমা মেশোমশায়ের পছন্দ হিসেবেই এমনটা করেছি। তারা অবশ্য ঠাকুর ঘরটাও আলাদা ভাবে একটা সেপারেট ইউনিটে বানাতে চাইছিলেন। কিন্তু তাতে করে দক্ষিণ দিকের এই যে খোলা উঠোনটা থাকছে সেটা আর এমন রাখা যেত না। অবশ্য আমি যখন এভাবে বারান্দার সঙ্গেই ঠাকুরঘরটা বানাবার কথা বলছিলাম তখন ওনারা সেটা মেনে নিয়েছেন। তাই এভাবেই প্ল্যানটা বানালাম। আর এর ফলে যখন দোতলার কনস্ট্রাকশন হবে তখন ওপরের ফ্লোরে বেশ কিছুটা বাড়তি জায়গা পাওয়া যাবে। আর কোনার এই কলঘরটার ওপর দিয়ে একটা শেড বানিয়ে ওদিকের দোকান ঘর অব্দি টেনে নিয়ে যাব। তাতে দোকান ঘরের পেছনের দড়জা দিয়ে কলপাড়ের পাশ দিয়ে সোজা বাড়িতে ঢোকা যাবে। মোটামুটি এমনটাই তারা পছন্দ করেছেন”।

সীমন্তিনী সব দেখে বলল, “বেশ, তাদের পছন্দ অনুযায়ীই বানানো ভাল। কিন্তু মিঃ অধিকারী, আমি কিন্তু বলেছিলুম দোতলার প্রভিসন রাখতে। সে ব্যাপারটা মাথায় রেখেছেন তো”?

মিঃ অধিকারী এবার একটা ফাইল বের করে বললেন, “হ্যাঁ ম্যাম, সে’কথা আমার মনে আছে। অবশ্য আপনার মেশোমশাই সেদিন বলছিলেন যে অতকিছু করবার দরকার নেই। তবে আপনার কথা মাথায় রেখেই আমি সেভাবেই এস্টিমেটটা বানিয়েছি। পরে যে কোন সময় দোতলায় কনস্ট্রাকশন করা যাবে। তবে ম্যাম, একটা কথা এখানে একটু ক্লিয়ার করে দিচ্ছি আগে। ভবিষ্যতে দোতলায় কনস্ট্রাকশন যখন করবেন, তখন যদি ভাবেন দোতলাতেও বাথরুম টয়লেট বা কলঘরের প্রভিশন রাখবেন তাহলে সেটা কিন্তু দোতলার প্ল্যান বানাবার সময়ই করতে হবে। কারন দোতলায় ও’সব করতে হলে তো সাধারণতঃ রুমের সাথে এটাচ করেই বানাতে হয়। কিন্তু তারা যখন ওই জিনিসগুলোকে মূল ঘরের সাথে এটাচ করে বানাতে চান না, তাহলে কিন্তু দোতলা তৈরীর সময় এই নর্থ সাইড থেকে কিছুটা এক্সটেনশন করে একটা করিডোরের মত বের করে এদিকে একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আমি তো এখন শুধু গ্রাউন্ড ফ্লোর, ঠাকুর ঘর, আর নিচের বাথরুম, টয়লেট আর কলঘরের এস্টিমেটই শুধু করেছি। আর এ সব কিছু মিলিয়ে মোট এস্টিমেট হচ্ছে প্রায় বত্রিশ লক্ষ টাকা। তবে প্রাইস ফ্লাকচুয়েশনের ব্যাপারটা সব সময়েই হিসেবে ধরতে হয়। সেটা কনসিডারেশনে রেখেই ফিফটিন পার্সেন্ট বাড়িয়ে ধরেই এস্টিমেটটা বানিয়েছি। আর সেই ফ্লাকচুয়েশন ধরে সব মিলে টোটাল দাঁড়াচ্ছে ছত্রিশ লক্ষ পচাত্তর হাজার টাকা”।

সীমন্তিনী মনে মনে একটু ভেবে বলল, “আর লেবার কস্ট? তাতে কত লাগতে পারে”?

মিঃ অধিকারী বললেন, “ম্যাম, আমরা যখন এস্টিমেট বানাই তখন ম্যান পাওয়ার লেবার কস্ট সবকিছু ইনক্লুড করেই বানাই। তাই এই ছত্রিশ লক্ষ পচাত্তর হাজারের ভেতরেই লেবার কস্ট ঢুকে আছে। তবে একটা কথা এখানে আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে চাই আপনাকে ম্যাম। কনস্ট্রাকশন যদি ছ’মাসের মধ্যে না হয়, তাহলে কিন্তু কনস্ট্রাকশন কমপ্লিট হতে হতে আরও কিছু বাড়তি খরচ হতে পারে। বুঝতেই পাচ্ছেন ম্যাম, ইট কাঠ রড সিমেন্ট সব জিনিসের দামই তো দিনে দিনে বাড়ছে”।
 

সীমন্তিনী আরেকটু ভেবে বলল, “আচ্ছা আরেকটা কথা বলুন তো মিঃ অধিকারী, আমি যদি আপনাকেই পুরো দায়িত্ব দিয়ে দিই বাড়িটা বানাবার, মানে প্রিপারেটরি স্টেজ থেকে কমপ্লিশন অব্দি এমনকি কালারিং আর ইলেকট্রিফিকেশন, সব মিলিয়ে যা যা করবার দরকার সে সবই আপনাকে করতে হবে, তাহলে কি এই বাজেটের ভেতরেই হয়ে যাবে? না এর চেয়েও কিছু বেশী খরচ পড়তে পারে”?

মিঃ অধিকারী একটু হেসে বললেন, “ম্যাম, আমি যে এস্টিমেট বানিয়ে দিয়েছি, ছ’মাসের ভেতর কাজটা কমপ্লিট করতে পারলে, সে আপনি যে কাউকে দিয়েই কনস্ট্রাকশন করান না কেন, এই বাজেটের ভেতরেই হয়ে যাবে। আর আপনি যদি কাজটা আমাকেই করতে বলেন, তাহলে জুতো সেলাই থেকে চন্ডী পাঠ, সব কিছু সহ বিল্ডিং কমপ্লিট করতে এই বাজেটেড এমাউন্টও লাগবে না। কিছু কমেই হয়ে যাবে। কারন আমরা ম্যাটেরিয়ালস গুলো হোলসেল রেটে কিনতে পারি। কিন্তু কত কম হবে সেটা ম্যাম এখনই কিন্তু বলা সম্ভব হবে না। তবে ম্যাম, কালারিং আর ইলেক্ট্রিফিকেশন কিন্ত এ এস্টিমেটের ভেতর থেকে হবে না। ও’দুটোর বাজেট আর এস্টিমেট কিন্তু আলাদাই হবে মানে এ এস্টিমেটের বাইরে। আর তাতে ধরুন আরও এক থেকে দেড় লাখ টাকা খরচ পড়বে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “মিঃ অধিকারী, আমার মেসো বুড়ো মানুষ, আর ভাইটাও লেখাপড়া নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমি চাই না যে বাড়ি তৈরির ব্যাপারে দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে ওর লেখাপড়ায় ক্ষতি হোক। তাই ও বাড়িতে কাজের দেখাশোনা, জিনিসপত্র কেনা কোনকিছুই তাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়ে উঠবে না। আর আমিও তো দুরে থাকি। তাছাড়া আমাকেও আমার কাজ নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত থাকতে হয়। তাই কাজটা কিন্তু পুরোপুরি আপনার হাতেই ছেড়ে দেব আমি। আর সেই সাথে আরেকটা অনুরোধ করব, যে সবকিছুর দিকে আপনি পার্সোনালি একটু স্পেশাল কেয়ার নেবেন। কোথাও কোন কাজে যেন ফাঁকি বা গাফিলতি না হয়। আর দিন দশেক বাদেই আমি কাজটা শুরু করে দিতে চাই। তাই আপনি প্রিপারেটরি কাজ গুলো, যেমন ব্লু প্রিন্ট, এস্টিমেট, কোন কোন অফিস থেকে পারমিশন বা ক্লিয়ারেন্স নিতে হয়, এসব কাজ এখন থেকেই শুরু করে দিন”।

মিঃ অধিকারী খুব খুশী হয়ে বললেন, “ম্যাম, অনেকের অনেক কাজেই আমরা কিছু কিছু কারচুপি করে থাকি, সেটা অস্বীকার করব না। কিন্তু ম্যাম, আপনাকে তো আমরা অন্য সকলের মত এক ক্যাটাগরিতে ধরি না। তাই আপনার মত লোকের কাজে আমরা এক চুলও কারচুপি করব না, এটুকু বিশ্বাস আপনি আমাকে করতে পারেন। আপনার বিশ্বাসভঙ্গ হবার মত কোন কাজ করব না, এ’ কথা দিচ্ছি”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তাহলে আর দেরী না করে আপনি প্রিপারেটরি লেভেলে যা যা করতে হয়, এ’সব করে ফেলুন। আমি মেসোকে একটা ভাল দেখে গৃহারম্ভের দিন দেখতে বলি, ওকে”?

মিঃ অধিকারী খুব খুশী হয়ে বললেন, “ওকে ম্যাম। আমি ডীলটা অ্যাকসেপ্ট করলাম। আমি কাল বা পরশু থেকেই কাজ শুরু করে দেব। তাহলে এখন আসি ম্যাম”?

সীমন্তিনী তাকে বাধা দিয়ে বলল, “একটু বসুন না। আমার তরফ থেকে এক কাপ চা অন্ততঃ খেয়ে যান। না হাতে একেবারেই সময় নেই আপনার”?

মিঃ অধিকারী একটু হেসে বললেন, “ম্যাম, এভাবে বলে আমাকে লজ্জা দেবেন না প্লীজ। আচ্ছা বলুন, চায়ের অর্ডার দিন"।

সীমন্তিনী কলিং বেল টিপে আর্দালীকে চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, “আচ্ছা, মিঃ অধিকারী, কলকাতায় আপনার জানাশোনা ভাল বিল্ডার বা কন্ট্রাক্টর কেউ আছে? মানে যার ওপর ভরসা করতে পারি। আসলে আমি এমন একজনকে খুঁজছি, যার ওপর নিশ্চিন্তে একটা বড়সড় কনস্ট্রাকশনের দায়িত্ব আমি দিয়ে দিতে পারি”।

মিঃ অধিকারী জিজ্ঞেস করলেন, “সে তো আছেই ম্যাম। আমাদের বিশেষ ঘণিষ্ঠ বেশ কয়েকজন বিল্ডার আছে। কিন্তু এ’কথা জানতে চাইছেন কেন ম্যাম”?

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “এমন কিছু নয়। আসলে আমার এক বিশেষ বান্ধবী, সে কলকাতাতেই থাকে। সে একটা শপিং মল বা ওই ধরণের একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাতে চাইছে। আর ওকে এ ব্যাপারে আমি সামান্য বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছি। তাই জিজ্ঞেস করছিলুম”।

মিঃ অধিকারী জিজ্ঞেস করলেন, “ওনার হাতে কি অমন কোনও বড় প্লট আছে ম্যাম”?

সীমন্তিনী সামান্য হেসে বলল, “না মিঃ অধিকারী, তেমন কোনও প্লট সে এখনও কেনেনি। প্লট আর কমপ্লেক্স সবকিছুই নতুন করে করতে হবে”।

মিঃ অধিকারী বেশ কিছু সময় মাথা নিচু করে কিছু ভেবে বললেন, “ম্যাম, এই যে আমি কলকাতা থেকে ঘুরে এলাম, আমি এমনই একটা লোকেশানের খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিলাম। কিন্তু কলকাতায় আমরা ছোটখাটো বা মাঝারি ধরণের বেশ কয়েকটা প্রোজেক্ট করলেও এত বড় প্রোজেক্ট কখনও বানাইনি। অত ক্যাপিটালও আমাদের নেই। যদি আমরা ওখানকার লোকাল লোকদের কাছ থেকে কিছু অ্যাডভান্স নিতে পারতাম, তাহলে কাজটা নিশ্চিন্তে হাতে নিতে পারতাম। কিন্তু সেটা করতে হলে কিছুটা সময়ের দরকার। অন্ততঃ তিন চার মাস। কিন্তু জমিটার মালিক ততখানি সময় দিতে রাজী নন। তাকে জমিটা তাড়াতাড়িই বেচে দিতে হচ্ছে। তাই কাজটা নিতে সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু এত সুন্দর লোকেশান, আর পটেনশিয়ালিটিও এত ভাল, যে ডিলটাকে হাতছাড়া করতেও ইচ্ছে করছে না”।

সীমন্তিনী বলল, “আপত্তি না থাকলে একটু খুলে বলুন না”।

মিঃ অধিকারী বললেন, “না না ম্যাম, আপত্তি কেন থাকবে। শুনুন, দক্ষিণ কলকাতায় বাইপাস থেকে প্রায় একশ’ মিটার দুরত্বে সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার ফুটের একটা অসম্ভব ভাল প্লট আছে। সে প্লটের যে বর্তমান মালিক, সে আমার বিশেষ পরিচিত। সে সেটার দাম চাইছে প্রায় দেড় কোটি টাকা। ওদিকে জমির যা বাজার চলছে সে তুলনায় খুবই সস্তা। প্রায় জলের দামই বলা যায়। তারা খুব আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে বলেই এত সস্তা দাম চাইছে যাতে তাড়াতাড়ি জমিটা বিক্রী করে দিতে পারেন। দেড় কোটি টাকা দিয়ে জমিটা হয়ত আমরা কিনে ফেলতে পারি। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা এমন যে জমিটা কিনলে আমাদের ক্যাপিটাল আটকা পড়ে যাবে, কারণ ওই জমিতে হাজার তিনেক স্কয়ার ফুট জুড়ে কনস্ট্রাকশন করতে হলে যত টাকার প্রয়োজন তা বর্তমানে আমাদের হাতে তো নেইই, এমনকি আগামি ছ’মাসের মধ্যেও হবে বলে আশা করছি না আমরা। ওদিকে ওখানে লোকাল লোকদের কাছ থেকে ইনভেস্টমেন্ট নিতে চাইলেও সময়ের দরকার। সে সময়টাও আমরা পাচ্ছি না। তাই জমিটা কিনে ফেললে আমাদের দেড় কোটি টাকাই সেখানে আটকে যাবে। তাতে আমাদের বিজনেসের খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। কিন্তু লোকেশান আর দামের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, এমন সুযোগ হাত ছাড়া করে দেওয়া মানে সোজা কথায় বোকামি। তাই তো কোন ফাইনাল ডিসিশন নিতে পারছি না। অন্য যে কোনও প্রমোটার বা বিল্ডার সেটার খোঁজ পেলেই এক মূহুর্ত দেরী না করে কিনে ফেলবে। আর সেজন্যেই তো বলছিলুম না পারছি গিলতে না পারছি ওগড়াতে”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “তাহলে ফাইনালি কি ডিসিশন নিলেন আপনারা”?

মিঃ অধিকারী বললেন, “সেটাই তো নিতে পারছি না ম্যাম। গত সাতদিন অনেক চেষ্টা করেও কোন পথ খুঁজে পেলাম না। তবু দিন দশেক সময় চেয়ে নিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু এখানেও সকলের সাথে কথা বলেও কোনও সুরাহা হচ্ছে না”।

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “আচ্ছা মিঃ অধিকারী, আমি এখন যেটা বলতে চাইছি সেটাকে অন্য ভাবে নেবেন না প্লীজ। ওই প্লটে একটা শপিং মল তৈরী করলে কতটা ফ্রুটফুল হবে”?

মিঃ অধিকারী সাথে সাথে বললেন, “ওখানে একটা শপিং কমপ্লেক্স বানালেই সবচেয়ে ভাল চলবে ম্যাম। অমন সুন্দর মার্কেট কমপ্লেক্সের লোকেশান আশেপাশের দশ মাইলের ভেতরে নেই। আপনারা যদি চান, মানে আপনার সেই বান্ধবী যদি রাজী থাকেন, তাহলে আমি যোগাযোগ করতে পারি কিন্তু। আমাদের পক্ষে তো নেওয়া আর সম্ভবই হচ্ছে না। আপনারা নিতে চাইলে নিতেই পারেন। আমার পক্ষ থেকে যতটুকু সাহায্য করা সম্ভব সেটা আমি করব”।
 

সীমন্তিনী একটু উৎসুক ভাবে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছেন মিঃ অধিকারী? সেটা সম্ভব হবে? মানে আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না তো তাতে”?
 

মিঃ অধিকারী বললেন, “আমাদের আর ক্ষতি কি হবে ম্যাম? জমির মালিক যদি আমাদের ছ’টা মাস সময় দিতেন, তাহলে আমরাই সেটা নেবার বন্দোবস্ত করে ফেলতুম। কিন্তু সেটা তো আর হচ্ছে না। তাই আপনারা চাইলে আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি”।

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “জমিটাতে কোনরকম কোনও ডিসপুট নেই তো? মিউটেশান নিয়ে কোন ঝামেলা টামেলা নেই তো”?

মিঃ অধিকারী বললেন, “সবদিক দিয়ে ক্লিয়ার প্রপার্টি ম্যাম। শুধু বছর দুয়েকের খাজনা বাকি আছে। তা সেটা এমন কিছু আহামরি টাকার ব্যাপার নয়”।
 

সীমন্তিনী এবার বলল, “ওকে মিঃ অধিকারী। আমি আমার বান্ধবীর সাথে আজ রাতে একটু আলাপ করে নিই। আগামীকাল আপনাকে ফোন করে জানাব”।
 

*****************

অধিকারীবাবু বেরিয়ে যাবার পর সীমন্তিনী অধিকারীবাবুর কথা গুলো ভাবতে ভাবতে নিজের মোবাইল থেকে কিংশুককে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “ভাই, তোমরা কি ট্রেনে উঠে পড়েছ”?

কিংশুক জবাব দিল, “না গো দিদিভাই। আমরা সবাই তো তিনটের ট্রেন ধরব বলে খাওয়া দাওয়া করে ঠিক সময়েই ষ্টেশনে এসে পড়েছিলাম। এখনও আমরা স্টেশনেই বসে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। এইমাত্র শুনলুম যে মাদারিহাটের আশেপাশে কোথাও নাকি একটা মালগাড়ির কয়েকটা কামরা লাইনচ্যুত হয়ে গেছে। তাই ট্রেন চলাচল আপাততঃ বন্ধ। কখন লাইন ক্লিয়ার হবে, কখন ট্রেন চলবে, এ ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারছে না। আমরাও যে কি করব না করব, বুঝতে পারছি না। তোমাকে ফোন করবার কথাই ভাবছিলুম আমি। কি করব এখন দিদিভাই আমরা”?
 

কিংশুকের কথা শুনে সীমন্তিনীর মনটা খারাপ হয়ে গেল। বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুকের আজ তার এখানে আসবার কথা ছিল। যদিও কথাটা অর্চনা, নীতা বা লক্ষ্মীকে সে জানায়নি, সে ভেবেছিল হঠাৎ করে সকলে চমকে উঠবে সবাইকে দেখে। কিন্তু ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে শুনে সে বেশ মুষরেই পড়ল। মাসি মেসোরা এলে সবচেয়ে বেশী খুশী হত বোধহয় লক্ষ্মীদিই। মনে মনে এসব ভাবতে ভাবতেই সীমন্তিনী কিংশুককে বলল, “ভাই, তেমনই যদি হয়ে থাকে, তাহলে তো করার আর কিছুই নেই। কিন্তু শোনো ভাই। এখন তো চারটে বেজেই গেছে। যদি আর আধ ঘন্টার মধ্যে ট্রেন না পাও তাহলে বরং বাড়িই ফিরে যেও তোমরা। জানি, খারাপ লাগবে। খারাপ তো আমারও লাগছে। কত আশা করে ছিলুম যে আজ প্রথমবার তোমরা সবাই আমার এখানে আসবে। কিন্তু সাড়ে চারটের পর ট্রেন পাওয়া গেলেও এখানে এসে পৌঁছোতে পৌঁছোতে রাত হয়ে যাবে। ওভাবে আসবার দরকার নেই। রাস্তায় যদি ট্রেন আরো লেট করে, তাহলে তোমরা অসুবিধেয় পড়তে পার। তাই আজ বরং তোমরা বাড়িই ফিরে যাও। পরে কোনদিন বরং সময় সুযোগ মত তোমরা আসতে পারবে। আমি অর্চুকে বুঝিয়ে বলে দেব সবকিছু”।

কিংশুক “আচ্ছা, ঠিক আছে দিদিভাই” বলতে সীমন্তিনী ফোন কেটে দিল।

(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 189)

সেদিন সন্ধ্যের দিকে শহরের এক জায়গায় কিছু গণ্ডগোল হবার দরুন সীমিন্তিনীর বাড়ি ফিরতে বেশ দেরী হল। রাত প্রায় দশটা নাগাদ সে বাড়ি ফিরে আসবার পর নবনীতা, অর্চনা আর লক্ষ্মীকে জানাল যে আজ কালচিনি থেকে সকলের আসবার কথা থাকলেও ট্রেন চলাচল বন্ধ বলে কেউ আসতে পারল না। সে’কথা শুনে সকলেরই মন খারাপ হয়ে গেল।
 

রাতের খাবার খেয়ে সবাই যে যার ঘরে শুতে যাবার পর সীমন্তিনী নিজের ঘরের দড়জা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে মহিমাকে ফোন করল। মহিমা ফোন ধরেই বলল, “কাল ওভাবে কথা বলতে বলতেই লাইন কেটে দিয়েছি বলে তুমি বুঝি আমার ওপর রেগে গেছ, তাই না মন্তি”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “না না বৌদি, একদম তা নয়। আমি বুঝতে পেরেছিলুম যে তুমি কতটা ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলে কাল। আচ্ছা সে’কথা ছাড়ো। এবার বলো তো দেখি, তুমি ব্যাপারটা নিয়ে ভাল করে ভেবেছ? কী মনে হচ্ছে তোমার? অমন কিছু করতে রাজী আছ তুমি”?

মহিমা জবাব দিল, “অনেকবার ভেবেছি মন্তি। গত চব্বিশ ঘন্টায় শুধু তোমার বলা কথাগুলোই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আজ অন্য কোনও কাজে মনই লাগাতে পারছি না আমি। তোমার পরামর্শটা আমার খুব ভাল লেগেছে। কিন্তু অমন একটা মার্কেট কমপ্লেক্স বানাতে যে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হবে গো। আমি একা তো সামাল দিতে পারবোনা মন্তি”।
 

সীমন্তিনী বলল, “বৌদি, কথায় বলে ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। তুমি চাইলে সেটা করতেই পারবে। তবে আমি হয়ত এতদুরে থেকেও তোমাকে এ ব্যাপারে আরও খানিকটা সাহায্য করতে পারব। তবে সে’কথায় পরে আসছি। তার আগে তুমি আমাকে একটা কথা বলো। তুমি তোমার মেয়েদের সাথে এ ব্যাপারে কিছু আলাপ করেছো? ওরা সকলে কি তোমার অমন পরামর্শ মেনে নিতে রাজী আছে”?

মহিমা জবাব দিল, “আজ প্রায় কুড়ি জনের সাথে আমার কথা হয়েছে এ ব্যাপারে। এদের মধ্যে অনেকেই প্রথমে একটু মুষড়ে পড়েছিল, যখন আমি এ ব্যবসা বন্ধ করে দেবার কথা বলেছি। তারপর ওদের যখন বোঝালাম যে ব্যবসা বন্ধ করে দিলেও নতুন ব্যবসা শুরু করবার আগে পর্যন্ত ওদের সংসার চালানোর জন্যে প্রতি মাসে আমি তাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা করে দেব, তখন সবাই রাজী হয়েছে। নিজেদের শরীর আর অন্যের কাছে বিলিয়ে দিতে হবে না, আর এক বছরের মধ্যেই তারা নিজেরা ভদ্র সমাজে একটা ব্যবসা করে নিজেদেরকে সৎপথে রেখেই সংসার চালাতে পারবে, আর সেই ব্যবসার মূলধনও আমিই তাদের দেব, আর সেটা তারা আমার তরফ থেকে উপহার স্বরূপ পাবে, এ’সমস্ত কথা শুনে তো আনন্দে প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল। বারবার আমাকে তারা ধন্যবাদ দিচ্ছিল”।

সীমন্তিনী মনে মনে খুশী হয়ে বলল, “আর যাদের সাথে তুমি এখনও কথা বলতে পারোনি, তারাও কি রাজী হবে বলে মনে হয় তোমার”?

মহিমা বলল, “আমি তো তাদের সকলকে খুব ভালমত চিনি মন্তি। ওরাও সব্বাই রাজী হবে বলেই আমার ধারণা। তবে আমার সবচেয়ে বেশী চিন্তা ছিল বীথিকাকে নিয়ে। কারণ ওর আর্থিক সমস্যাটাই অন্য সকলের চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু ওকে সবটা বুঝিয়ে বলার পরেও ও ঠিক রাজী হতে পারছিল না। আসলে ও ভাবছিল যে ব্যবসা শুরু করবার পরে মাসে মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা উপার্জন করা তো প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এখনও ওর সমস্ত টাকার চাহিদা তো আমিই মেটাই। ও রোজ রোজ কাস্টমার নিয়েও তো সে চাহিদা পূরণ করতে পারে না। কিন্তু আমি ওকে যখন কথা দিলাম যে যতদিন প্রয়োজন ওর বাবা আর ভাইয়ের পুরো চিকিৎসার খরচ আমি বহন করব, তখন ও রাজি হয়েছে। অবশ্য ওকে আমি এতদিন ধরে যেভাবে সাহায্য করে এসেছি, আর ভবিষ্যতেও যে এমনটাই করব বলে কথা দিলাম, সে জন্যে কেঁদে কেটে একসা। তবে মন্তি, আমি একটা কথা ভাবছি জানো? আমার মনে হয় বীথিকার জন্য আমাকে কিছু ফান্ড হাতে রাখতেই হবে”।

সীমন্তিনী বলল, “তুমি মেয়েটাকে সত্যি খুব ভালবাস, বুঝতে পেরেছি বৌদি। তা ওর জন্যে আর কি করতে চাও তুমি শুনি”।
 

মহিমা সীমন্তিনীর কথায় একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “আমি সত্যি ওকে খুব ভালবাসি মন্তি। তোমাকে তো আগেও বলেছি, ওই মেয়েটাই আমার সবচেয়ে কাছের আর সবচেয়ে বিশ্বস্ত। পরিবারের চাপে পড়ে নিজের জীবনটাই ও বরবাদ করে ফেলেছে। ওর পরিবারে এমন সমস্যা না হলে ও নিশ্চয়ই বিয়ে থা করে এতদিন সুখে স্বামীর ঘর করতে পারত। বীথি আমার যোগা সেন্টারের কাজে আর আমার ওই ব্যবসার কাজে প্রচুর সাহায্য করে। তাই আমি চাই না যে ও কোন বিপদে পড়ুক। আমি তো একসময় পুরো ব্যবসাটাই ওর হাতে ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ও ঠিক সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি যে আজ যদি আমি ওকে ছেড়ে দিই, তাহলে ওর বাবা আর ভাই তো মরবেই, ওর সামনেও আর শরীর বেচা ছাড়া অন্য কোনও পথ খোলা থাকবে না। ওকে ওর ভাইয়ের জন্য এখনও মাসে মাসে তিন লাখ টাকা হাসপাতালেই পেমেন্ট করতে হয়। আর ওর বাবার চিকিৎসার পেছনেও মাসে চল্লিশ পঞ্চাশ হাজার টাকার দরকার পড়ে। রোজ রোজ এক বা একাধিক কাস্টমারকে এন্টারটেইন করতে করতে ওর স্বাস্থ্যও খারাপ হতে শুরু করেছে। তাই ওকে বাড়তি সাহায্য আমাকে করতেই হবে। আর সেজন্যেই আমি ভাবছি যে ওর জন্যে আমাকে বেশ কিছু টাকা আলাদা করে রাখতেই হবে”।

সীমন্তিনী মহিমার মনের ইচ্ছেটা শুনে অভিভূত হয়ে বলল, “মার্কেট কমপ্লেক্সটা তৈরী হয়ে যাবার পরেও তো তোমার হাতে বেশ কিছু টাকা থেকেই যাবে বৌদি। সে টাকা থেকেই না হয় ওকে সাহায্য করো তুমি। তাতে সমস্যা কোথায়”?
 

মহিমা এবার একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “কিন্তু মন্তি, কাজটা শেষ হতে হতে যদি দেখা যায় যে আমার হাতে সত্যিই বেশী কিছু আর রইল না। তখন কী হবে ভাবতে পারছ? আমার কথায় মেয়েটা সৎপথে ফিরে এসে আবার নতুন করে বিপাকে পড়বে তখন। আমি তখন কিকরে ওকে সাহায্য করব”?
 

সীমন্তিনী মহিমাকে অভয় দিয়ে বলল। “বৌদি সেটা নিয়ে তুমি এখনই এত ভেঙে পড়ছ কেন? আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যেমন ভাবছ ওর জন্য না হয় আগে থেকেই তুমি দু’কোটি টাকা আলাদা করে রেখে দাও। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, ঠিক আছে”?

মহিমা এবার একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ সেটা করলে অন্ততঃ আরও বছর দুয়েক তো আমি বীথিকাকে প্রোটেকশান দিতেই পারব। তবে তুমি যেন কী বলছিলে? দুরে থেকেও তুমি আর কিভাবে আমাকে সাহায্য করতে পারো বোন”?

সীমন্তিনী তখন মিঃ অধিকারীর মুখে শোনা সাইটটার কথা খুলে বলল মহিমাকে। আর এ’কথাও বলল যে মহিমা চাইলে মিঃ অধিকারীর সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে পারে। সব শুনে মহিমাকে খুব উৎসাহিত বলে মনে হল। সে বলল, “মন্তি, তোমার কাছে তার কন্টাক্ট নাম্বার থাকলে এখনই আমাকে সেটা এসএমএস করে পাঠিয়ে দাও। আমি কাল সকালেই তার সাথে কথা বলব”।

সীমন্তিনীও খুশী হয়ে বলল, “ঠিক আছে বৌদি, তোমার সাথে কথা শেষ হলেই আমি তোমাকে তার নাম্বার এসএমএস করে দিচ্ছি। কিন্তু বৌদি, তুমি তোমার ওই ব্যবসা কবে বন্ধ করছ তাহলে”?

মহিমা আগের মতই খুশীর গলায় বলল, “আমি আমার সমস্ত ক্লায়েন্ট আর গ্রুপের সমস্ত ছেলেমেয়েকে জানিয়ে দিয়েছি যে আর এক সপ্তাহ পরে, মানে এ মাসের ঊণিশ তারিখ থেকে আমি পুরোপুরি ভাবে এ কাজ ছেড়ে দিচ্ছি। তারপর থেকে আমি শুধু আমার যোগা সেন্টার নিয়েই থাকব”।
 

মহিমার সাথে কথা শেষ হবার পর সীমন্তিনী মিঃ অধিকারীর ফোন নাম্বারটা মহিমাকে এসএমএস করে দিল। বিছানায় শুয়ে তার নিজেকে খুব হাল্কা মনে হচ্ছিল। তার এমন বিরাট একটা প্রয়াস সফল হতে চলেছে। একজন দু’জন নয়, একসাথে প্রায় পঞ্চাশ জন মহিলাকে সে অপরাধের রাস্তা থেকে সরিয়ে আনতে পারছে ভেবে ভেতরে ভেতরে তার প্রচণ্ড উত্তেজনা হচ্ছিল। কিন্তু সাথে সাথেই তার মাথায় আরেকটা চিন্তা এল। সে নিজে যে একজন পুলিশ অফিসার এ’কথা মহিমা এখনও জানেন না। কিন্তু সে তো মিঃ অধিকারীর নাম্বার মহিমাকে এসএমএস করে দিল। এখন মহিমা যদি এখনই মিঃ আধিকারীর সাথে ওই ব্যাপারে কথা বলে, তাহলে কথায় কথায় সে সীমন্তিনীর আসল পরিচয়টা জেনে যাবে। ইশ, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। এখনই মিঃ অধিকারীকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেওয়া উচিৎ। কিন্তু এত রাতে তাকে ফোন করাটা কি সমীচিন হবে? আবার মহিমা বৌদিকেও যতটা এক্সাইটেড মনে হল, তাতে তিনি হয়ত এখনই মিঃ অধিকারীর সাথে কথা বলবে। তাহলেই তো নিজেকে আর মহিমার কাছে গোপন রাখা সম্ভব হবে না।

তাই মন থেকে সব দ্বিধা সংশয় ঝেড়ে ফেলে সীমন্তিনী মিঃ অধিকারীর নাম্বার ডায়াল করল। দু’তিনবার রিং হবার পর সাড়া পাওয়া গেল। আর মহিমা প্রায় সাথে সাথেই অনুতপ্ত সুরে বলল, “সরি মিঃ অধিকারী, এমন অসময়ে ফোন করেছি বলে প্লীজ কিছু মনে করবেন না। আসলে ভীষণ জরুরী একটা কথা এখনই আপনাকে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। তাই ভদ্রতাবোধের সীমা পার করে এখনই ফোনটা করতে বাধ্য হলাম”।

ও’পাশ থেকে মিঃ অধিকারী বেশ বিস্মিত গলায় জবাব দিলেন, “ম্যাম, আপনি এমন করে বলছেন কেন? আপনি ফোন করেছেন বলে আমি একদম বিরক্ত হইনি। আর রাত বারোটার আগে কোনদিনই ঘুমোই না। তাই অযথা বিব্রত না হয়ে কোন জরুরী কথা আমাকে জানাতে চান, সেটা নিশ্চিন্তে বলে ফেলুন”।

সীমন্তিনী এবার একটু হাঁফ ছেড়ে অনেকটা স্বস্তির সাথে বলল, “আসলে মিঃ অধিকারী, আমার কলকাতার ওই বান্ধবীর সাথে একটু আগেই আমার কথা হল। আর আপনার বলা জমিটার কথা জানাতেই সে ভীষন এক্সাইটেড হয়ে পড়েছে। সে আপনার সাথে সরাসরি এ ব্যাপারে কথা বলতে চায়। তাই আপনার অনুমতি না নিয়েই আমি তাকে আপনার কন্টাক্ট নাম্বারটা জানিয়ে দিয়েছি। আপনি প্লীজ আমার ওপর মনঃক্ষুণ্ণ হবেন না এ ব্যাপারে”।

মিঃ অধিকারীও এবার হাল্কা গলায় বললেন, “এ আর এমন কি ব্যাপার ম্যাম? এতে আমি কিচ্ছু মনে করছি না। আপনি সেটা ভেবে মিছেই বিব্রত হবেন না”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ অধিকারী। কিন্তু আমি যে কারনে বিব্রত হয়েছি সে ব্যাপারটা একটু আলাদা। আর মূলতঃ সে’কথাটা বলবার জন্যেই আপনাকে ফোনটা করলুম এই অসময়ে”।

মিঃ অধিকারী বললেন, “আপনি নির্দ্বিধায় আপনার কথা বলতে পারেন। আপনার যতটা সময়ের দরকার সেটা দিতে আমার পক্ষ থেকে কোনও অসুবিধে নেই। আপনি বলুন”।

সীমন্তিনী একটু আমতা আমতা করে বলল, “মিঃ অধিকারী, কথাটা যে কিভাবে শুরু করব তা ঠিক মাথায় আসছে না। আসলে আমরা যে প্রফেশানে আছি তাতে অনেক সময় অনেকের কাছে আমাদের নিজেদের আইডেন্টিটি লুকিয়ে রাখতে হয়। আপনাকে আমি আগে বলেছিলাম যে কলকাতার ওই মহিলা আমার এক বান্ধবী। সেটা পুরোপুরি মিথ্যে কথা না হলেও পুরোটা সত্যিও নয়। তার সাথে আমার পরিচয় বা বন্ধুত্ব সবটাই হয়েছে ফোনে ফোনে। আমরা কেউ কাউকে এখনও চাক্ষুষ দেখিনি। এমনকি আমি যে পেশাগত ভাবে একজন পুলিশ অফিসার আমার বান্ধবী কিন্তু এটাও জানে না। সে জানে যে আমি এক সরকারী অফিসে কাজ করি। কিন্তু আপনি তো আমার আসল পরিচয়টা জানেন। আর সে যখন আপনাকে ফোন করবে তখন কথায় কথায় হয়ত সে আমার পরিচয় জেনে যাবে। কিন্তু আমি ঠিক এখনই তার কাছে আমার আসল পরিচয়টা খুলে জানাতে চাইছি না। কিন্তু আপনার কন্টাক্ট নাম্বার আমি তাকে অলরেডি জানিয়ে দিয়েছি। সে যে কোন সময় আপনাকে ফোন করতে পারে। তাই আপনাকে একটা অনুরোধ করবার জন্যেই এখন ফোন করেছি”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে মিঃ অধিকারী বললেন, “বুঝতে পেরেছি ম্যাম। আমার মনে হয়, আপনি যে একজন পুলিশ অফিসার এ’কথাটা যেন আমি তার কাছে প্রকাশ না করি, এটাই আপনি চাইছেন তো”?

সীমন্তিনী সাথে সাথে জবাব দিল, “হ্যাঁ হ্যাঁ মিঃ অধিকারী। আমি ঠিক এ’ অনুরোধটাই আপনাকে করতে যাচ্ছিলুম”।

মিঃ অধিকারী সামান্য হেসে বললেন, “ঠিক আছে ম্যাম, আপনার অনুরোধের কথা আমি মাথায় রাখব। কিন্তু ম্যাম, আপনার এ অনুরোধ শুনে আমার মনে সামান্য একটু দুশ্চিন্তাও হচ্ছে। দেখুন ম্যাম, ব্যবসা জিনিসটা পুরোটাই তো পুরোপুরি সততা বজায় রেখে করা যায় না। কিছু মিথ্যে কথা সময়ে সময়ে আমাদের বলতেই হয়। আর সেটা যে শুধু আমাদের কনস্ট্রাক্সন লাইনেই করতে হয়, তা নয়। সব ধরণের ব্যবসাতেই সবাইকেই এটা করতে হয়। সামান্য মুদী দোকান বা পানের দোকানের মালিকেরাও তাদের গ্রাহকের কাছে প্রায় সব সময়ই মিথ্যে কথা বলে থাকেন। একজন পুলিশ অফিসারের পরিচয় গোপন করে তাকে সরকারী অফিসের চাকুরে বলতে আমার কোনও আপত্তি নেই। আর সেটা তো পুরোপুরি মিথ্যে বলাও হবে না। আপনারাও তো সরকারী চাকুরেই। কিন্তু ম্যাম, কথায় বলে একটা মিথ্যেকে সত্যি প্রমাণ করতে গেলে আরও দশটা মিথ্যে কথা বলতে হয়। তবে এ ব্যাপারে দশটা মিথ্যে বলতেও আমার আপত্তি নেই। কিন্তু এ নিয়ে পরে আর আমি অন্য কোনরকম ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ব না তো”?

সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “একেবারেই না মিঃ অধিকারী। আপনাকে কোনও ঝামেলায় ফেলে আমি নিজের কোন স্বার্থ পূরণ করতে চলেছি, এ’কথা একদম ভাববেন না। আর ভবিষ্যতে যদি আমি কখনও বুঝতে পারি যে আপনার ওপর এ ব্যাপারে কোন ঝামেলা আসতে পারে তাহলে আমিই আপনাকে সে ব্যাপারে আগে থেকে সাবধান করে দেব। আর আপনাকে যথোচিত প্রোটেকশানও দেব। ও নিয়ে আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকুন। তবে আপনার মনে এ প্রশ্ন উঠতেই পারে আমি কেন আমার সেই বান্ধবীর কাছে নিজের পরিচয় লুকোতে চাইছি। এ প্রশ্নের জবাবটাও পরে একসময় জানতে পারবেন। তবে ওই যে আগেই বললুম, আমাদের প্রফেশানে এ’সব হামেশাই করতে হয়। আপাততঃ সেটাই ধরে নিন। তবে আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এ ব্যাপারে আপনাকে কোনদিন কোনরকম ঝামেলায় পড়তে হবে না। আর আমি কাউকে মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিই না, এটা জেনে রাখুন”।

মিঃ অধিকারী এবার নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, “ওকে ম্যাম, আর আমার কোন চিন্তা রইল না। আমি আপনার কথা মনে রাখব। আর কিছু”?

সীমন্তিনীও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আর কিছু নয়। আপাততঃ এ’কথাটুকুই বলবার ছিল আপনাকে। বাকি কথা পরে হবে। গুড নাইট”।

ফোন নামিয়ে রাখলেও সীমন্তিনীর ইচ্ছে করছিল, তখনই সে পরিতোষকে ফোন করে কথাগুলো খুলে বলে। কিন্তু পরিতোষের ব্যস্ততার কথা মাথায় আসতেই, সে চিন্তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল। বেচারা পরিতোষ, তার দাদাভাই আর তার রচুসোনাকে বিপদমুক্ত করতে কত কীই না করে যাচ্ছে। হয়তো সেদিনের মত আজ রাতেও সে অনেকক্ষণ বাইরে থাকবে। এসব ভেবেই আর ফোন না করে ঘুমোবার চেষ্টা করল।
 

******************

সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ বিমল আগরওয়ালা তার অফিসের চেম্বারে এসে বসেই তার সেক্রেটারী নিশিতাকে ডেকে পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আজ আমার কোথায় কি অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলো তো নিশি”?

নিশিতা নিজের হাতের ডাইরী খুলে দেখতে দেখতে বলল, “স্যার, আজ সকাল সাড়ে এগারোটায় দমদমের মেগা প্রজেক্টে যাবার কথা আছে। বিকেল তিনটেয় বেলেঘাটার প্রোজেক্ট। আর সন্ধ্যে ছটায় মিঃ আজিম কুরেশিকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া আছে। অফিসেই মিটিং” বলে একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল, “স্যার, আপনার শরীর ঠিক আছে তো? আপনার মুখ চোখ কেমন যেন লাগছে”।

বিমল নিজের মনের ভাব গোপন করে বলল, “না না তেমন কিছু না। তুমি আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে দাও আগে। তারপর গাড়ি তৈরী করতে বলো। আমরা দমদম যাচ্ছি। তুমিও যাচ্ছ আমার সাথে। তবে তার আগে তুমি ........”

তার কথা শেষ হবার আগেই তারই অফিসের আরেক কর্মচারী চেম্বারের দরজায় এসে বলল, “স্যার, আসতে পারি”?

বিমল অনুমতি দিতেই লোকটা ভেতরে ঢুকে একটা প্যাকেট বিমলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “স্যার এইমাত্র কুরিয়ার সার্ভিস থেকে এটা ডেলিভারী দিয়ে গেল। কনী ম্যাডাম টেবিলে ছিল না বলে আমিই সই করে এটা নিয়েছি”।
 

নিশিতাই হাত বাড়িয়ে প্যাকেটটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে দেখতে দেখতে বলল, “ভেতরে শক্ত মত কিছু একটা আছে স্যার। কোনও কাগজ পত্র নেই মনে হচ্ছে। খুলবো”?
 

বিমল লোকটাকে বিদেয় করে বিরক্তি ভরা সুরে নিশিতাকে বলল, “তুমি আমার সেক্রেটারী নিশি। এটা তো তোমারই ডিউটি। বেশী কথা না বলে খুলে দেখো” বলে নিজের ল্যাপটপটাকে অন করে বলল, “কিন্তু আগে আমাকে এক কাপ কফি দাও। মাথাটা ধরে আছে। আসলে অফিসে আসবার পথেই মোবাইলে ...” বলে কথা শেষ না করেই চুপ করে গেল।
 

নিশিতা লাগোয়া রেস্টরুমে ঢুকে গেল তার বসের জন্য কফি বানাতে। তবে কফি বানাবার আগে তাদের অফিসের এক ড্রাইভারকে গাড়ি রেডি রাখবার কথা বলে দিল। বিমল নিজেই কুরিয়ার সারভিস থেকে আসা প্যাকেটটা হাতে তুলে নিল। সেন্ডারের ঠিকানায় লেখা আছে ‘এস এম খান’। এ নামে কাউকে সে মনে করতে পারল না। কিন্তু কি ভেবে প্যাকেটটা না খুলে নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কিছু একটা দেখতে লাগল। মুখে তার চিন্তার ছাপ খুব স্পষ্ট। আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে ছাপ মুছে ফেলতে পারছিল না সে। নিশিতা দু’হাতে দু’কাপ কফি এনে একটা কফির কাপ বিমলের টেবিলে রাখতেই তার চোখ গেল বিমলের হাতে ধরা মোবাইলটার দিকে। কিন্তু বিমল প্রায় সাথে সাথেই মোবাইলটা বন্ধ করে পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বলল, “ডেলিভারীটা খুলে দেখ তো কি এসেছে”।

নিশিতা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বলল, “এস এম খান বলে আমাদের কোনও ক্লায়েন্ট আছে বলে তো মনে পড়ছে না। কে স্যার ইনি”?

______________________________
Like Reply
(Update No. 190)

বিমল একটু খিঁচিয়ে উঠেই জবাব দিল, “আহা, কেন অযথা সময় নষ্ট করছ তুমি। আমিও জানিনা কে এই এস এম খান। প্যাকেটটা খুলে দেখো। তাহলেই হয়ত বুঝতে পারব আমরা”।
 

নিশিতা বুঝতে পারল, আজ তার বসের মুড অফ। নইলে অন্যদিন অফিসে এসে নিজের চেম্বারে বসে কফি খায় না সে। লাগোয়া রেস্টরুমে ঢুকে নিশিতাকে তার কোলে বসিয়ে নিশিতার সারাটা শরীর নিয়ে খেলতে খেলতে কফি খায় সে। আর কথা না বলে নিশিতা প্যাকেটটা খুলে দেখে ভেতরে একটা সিডি ছাড়া আর কিছু নেই। সিডিটা বের করে বিমলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “স্যার এতে শুধু একটা সিডি আছে। কোন চিঠি ফিটি নেই, আর কিচ্ছু নেই”।
 

বিমল একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “ঠিক আছে, সিডিটা চালিয়ে দাও দেখছি। আর তুমি গাড়ি রেডি করতে বলেছ”?

নিশিতা সিডিটা ল্যাপটপের ডিভিডি ড্রাইভে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, “হ্যাঁ স্যার, গাড়ি তৈরী রাখতে বলে দিয়েছি”।

সিডিটা চলতে শুরু করতেই ল্যাপটপের পর্দায় নিশিতার ছবি ফুটে উঠল। একটা ভিডিও চলছে, তাতে নিশিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফি বানাচ্ছে। নিশিতা সেটা দেখেই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কি স্যার? আপনি আমাদের রেস্টরুমের ঘটণাগুলোর সিডি বানিয়েছেন নাকি? এটা কিন্তু মোটেও ঠিক করেননি স্যার। আমি তো আপনাকে বার বার অনুরোধ করেছি ওসবের সিডি না বানাতে। আপনি তবু ......”

বিমল ল্যাপটপের দিকে তাকিয়েই নিশিতাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে চাপা কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, “শাট আপ। মুখ সামলে রাখো নিশি। আর শিগগীর চেম্বারের দড়জাটা লক করে দাও। যাও কুইক”।

নিশিতা এবার কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই ছুটে গিয়ে চেম্বারের দড়জা ভেতর থেকে লক করে দিল। তারপর প্রায় ছুটে এসে বিমলের চেয়ারের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, এটা কিন্তু সত্যিই একদম ঠিক করেন নি। আমার স্বামীর হাতে এমন সিডি পড়লে আমার কী অবস্থা হবে ভাবুন তো একবার”।

বিমল আবার তাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে ল্যাপটপে অনেকখানি প্লে ফরোয়ার্ড করে সিডিটাকে আবার প্লে করল। এবার দেখা গেল নিশিতার শরীরের ওপরের অংশ একেবারে খোলা। সে বিমলের কোলে বসে আছে। আর বিমল নিশিতার দু’বগলের তলা দিয়ে হাত গলিয়ে দিয়ে তার বুকের মাংসপিন্ড দুটোকে খুব আয়েশ করে চটকাচ্ছে। বিমল আর নিশিতা দু’জনেই হাঁ করে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে। বিমল আবার প্লে ফরোয়ার্ড করে অনেকখানি এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার প্লে করল। এবার দেখা গেল রেস্টরুমের ছোট্ট বিছানায় নিশিতা সম্পূর্ণভাবে উলঙ্গ হয়ে শুয়ে আছে, আর তার ওপর পুরো উলঙ্গ শরীরে একজন বয়স্ক লোক চেপে শুয়ে নিজের কোমড় ওঠানামা করে যাচ্ছে। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তীব্র সম্ভোগ চলছে। খানিক বাদেই সে লোকটার মুখও স্পষ্ট দেখা গেল। এ যে বিমল নিজেই। বিমল সাথে সাথে ল্যাপটপটা বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নিশিতা আবার কিছু একটা বলবার জন্য নিজের মুখ খুলতেই বিমল সপাটে তার গালে একটা জোরদার থাপ্পর কষিয়ে দিয়ে হিংস্র মুখে বলে উঠল, “শালী হারামজাদি, তোর এতবড় সাহস? তোকে চুদি বলে তো তুই যত চাস তাই তোকে দিই আমি। নইলে তোর মত একটা বেশ্যা মাগীকে তো দু’হাজার দিলেই সারা রাত ভর চোদা যায়। দশ হাজার করে নিয়েও তোর পেট ভরছে না? শালী, এভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেল করবি বলে ভেবেছিস তুই? তোকে কেটে টুকরো টুকরো করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেব আমি। তুই কি ভেবেছিস? আমি কিছু বুঝতে পারব না”? বলে নিশিতার অপর গালে আরেকটা থাপ্পর কষাল।

নিশিতার দু’গালে বিমলের আঙুলের দাগ পড়ে গেছে। তার দু’চোখ ফেটে জলের ধারা বইতে শুরু করেছে। নিজের গালে হাত বোলাতে বোলাতে কোনরকমে সে বলল, “এ কী বলছেন স্যার? আপনি ভাবছেন আমি এ’সব করেছি? না স্যার, একদম না। আমি সত্যি বলছি স্যার, এ’সব ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। আমি তো ভেবেছি আপনিই হয়তো এগুলো রেকর্ড করেছেন”।

বিমল এবার খানিকটা থমকে গিয়ে বলল, “তুই করিসনি এ’সব? সত্যি বলছিস? কিন্তু আমার তো মনে হয় একথোকে বেশী টাকা নেবার জন্যেই তুই এভাবে আমাকে ব্ল্যাকমেল করবার চেষ্টা করছিস”।
 

নিশিতা আবার নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বলে উঠল, “না স্যার, আপনি বিশ্বাস করুন। আমি এ’সবের কিচ্ছু জানি না। আর আমি কেন আপনাকে ব্ল্যাকমেল করতে যাব বলুন তো? আমি আপনার কর্মচারী। আপনি আমায় মাসে মাসে বেতন দিচ্ছেন। আর আপনার সাথে এ’সব করি বলে আপনি আমাকে অনেক বাড়তি টাকাও দেন। সে’সব পেয়েই আমি খুশী। তাহলে কেন আমি এ’সব করতে যাব? আমি তো আপনার এখানে এভাবে কাজ করেই সুখে আছি”।

বিমল এবার নিজেকে কিছুটা সংযত করবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “তুমি সত্যি বলছ? এ’সবে তোমার কোন হাত নেই”?

নিশিতা অসহায়ের মত বলল, “না স্যার একেবারেই না। আমি এ’সবের বিন্দু বিসর্গও কিছু জানিনা। সত্যি বলছি আমি। আর আপনি ভাবুন তো, নিজের এমন ভিডিও করে আমি কি অন্য কাউকে দেখাতে পারব? এ তো নিজের পায়ে নিজে কুড়ুল মারা হবে। আর তাছাড়া এই এস এম খান কে? এ নামে তো কাউকে আমি চিনিও না। এমন একটা সিডি তার কাছে গেলই বা কি করে”?

বিমল অনেকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে নিশিতাকে দেখতে দেখতে বলল, “এ চেম্বারে আমি ছাড়া একমাত্র তুমিই যখন তখন ঢুকতে পারো। এ ভিডিওটা তো এই রেস্টরুমেই রেকর্ড করা হয়েছে। আর তুমি বলছ, তুমি কিছু জান না”?

নিশিতা কাকুতি ভরা গলায় বলল, “আপনি বিশ্বাস করুন স্যার। আমি সত্যিই এ’সবের কিচ্ছু জানিনা। আপনি ভাবছেন এই ভিডিও রেকর্ডিং আমি করেছি? কিন্তু স্যার, আমিই শুধু ওই রুমে ভিডিও রেকর্ডিং করতে পারি, এটাই বা কেন ভাবছেন আপনি? আমি ছাড়াও আরও কত মেয়েকে নিয়েও তো আপনি এ রুমে সময় কাটান মাঝে মাঝে। তারাও তো কেউ এ কাজ করতে পারে। তাছাড়া আমি তো আপনার এখানে আট বছর ধরে কাজ করছি স্যার। আমি কি জানিনা, আপনার সঙ্গে শত্রুতা করলে তার পরিণতি কী হয়? সব জেনে বুঝেও এমন কিছু করে আপনাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করে আমি নিজের জীবনটাকেই বিপন্ন করে তুলব, এ আপনি সত্যিই মন থেকে বিশ্বাস করেন স্যার? আর এমন একটা ভিডিও যদি কোনভাবে আমার স্বামীর কাছে চলে যায়, তাহলে আমাদের সংসার কি আর টিকবে? আমার স্বামী হয়তো আমাকে খুনই করে ফেলবে। আমি নিজেই কি অতটাই বোকা? তবু বলছি, যদি সেটাই আপনি বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে আমাকে আপনি যা শাস্তি চান দিতে পারেন। কিন্তু তবু আমি বলব, এই ভিডিওর ব্যাপারে আমি কিচ্ছু জানিনা”।

বিমল নিশিতার কথা শুনে আর নিশিতার ভীত সন্ত্রস্ত ভাব দেখে বুঝতে পারল এ ব্যাপারে সত্যিই হয়ত তার কোন হাত নেই। আর বিমল নিজেও জানে তার চোখের সামনে থেকে নিশিতা তাকে কিছুতেই ছুড়ি মারতে পারবে না। আর পেছন থেকে মারবার চেষ্টা করলেও তা পারবে না। নিজের চেয়ারে বসে ভাবতে লাগল, তাহলে এমন একটা কাজ করল কে? আর কি করেই বা করল? তার অফিসের চেম্বারে না ঢুকে কেউ ওই রেস্টরুমে ঢুকতে পারবে না। আর তার চেম্বারের চাবি শুধু মাত্র নিশিতার কাছেই থাকে। আর সে আর নিশিতা যখন একসাথে কোথাও বের হয় তখন এ চেম্বার লক করে যাওয়া হয়। তাহলে বাইরের কে কিভাবে ওই রেস্টরুমে ভিডিও ক্যামেরা সেট করতে পারে? হ্যাঁ, নিশিতা ছাড়াও তার অফিসের আরও বেশ কয়েকজন মেয়ে বা মহিলাকে নিয়ে সে এ রেস্টরুমে ঢুকে তাদের শরীরের মধু খেয়েছে, এ’কথা ঠিক। কিন্তু তারা যতক্ষণ এ রুমে থাকে ততক্ষণ বিমল নিজেও এ ঘরেই থাকে। তাই তাদের কারো পক্ষেই বিমলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এ ঘরে ক্যামেরা লাগানো সম্ভব নয় একেবারেই। তাহলে কাজটা কে কখন কিভাবে করল? আর এই এস এম খান লোকটাই বা কে? অফিসে আসবার পথে একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে তার মোবাইলে একটা কল এসেছিল। তার আগে একটা এমএমএস এসেছিল তার মোবাইলে। তখনও সে ভিডিও এমএমএসটা দেখেনি। লোকটা ফোনে বলছিল ‘একটা সুন্দর ছোট্ট ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়েছি তোর এই নাম্বারে। খুবই ছোট্ট ক্লিপ। অরিজিনাল ভিডিওটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটের। এই ছোট্ট ক্লিপটা আগে দেখে নে, কিছু পরে ফুল ওই পয়তাল্লিশ মিনিটের অরিজিনাল ভিডিওটা দেখবার সুযোগ পাবি’। আর কিছু না বলেই লোকটা ফোন কেটে দিয়েছিল। বিমল তখন ভিডিও এমএমএসটা দেখেছিল। ছোট্ট ক্লিপটাতে তার বা নিশিতার মুখ কোথাও দেখা যায়নি। তাই সে ভেবেছিল ওটা বুঝি সাধারণ কোন পর্নমুভি থেকে বানানো হয়েছিল। কেউ মজা করে পাঠিয়েছে বলেই সে ভেবেছিল। তার মত প্রতিপত্তিশালী একজনকে নিয়ে কেউ মজা করছে, আর ফোনে সেই লোকটা তাকে তুই তোকারি করেছে, এটা ভেবেই তার মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এখন সে খুব ভাল করেই বুঝতে পারছে যে এটা সাধারণ মজা করবার জন্য কেউ পাঠায়নি। যে-ই এটা করে থাকুক, এর পেছনে নিশ্চয়ই কোন বড় দুরভিসন্ধি আছে তার। এখন এই সিডিটা দেখে মনে হচ্ছে, এই সিডি থেকেই এডিট করে ওই ছোট্ট ক্লিপটা বানানো হয়েছে। কিন্তু এস এম খান নামের এ লোকটাই বা কে? অনেক ভেবেও এমন নামের কাউকে সে মনে করতে পারল না। কিন্তু তার রেস্টরুমে সত্যিই কি কোন ভিডিও ক্যামেরা লুকিয়ে ফিট করা হয়েছে? কথাটা মনে হতেই সে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে রেস্টরুমে গিয়ে ঢুকল। তার পেছন পেছন নিশিতাও রেস্টরুমে এসে ঢুকল। বিমল রেস্টরুমের চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। নাহ। কোথাও কোন ক্যামেরা লাগানো আছে বলে মনে হচ্ছে না। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও সন্দেহজনক কিছুই তার চোখে পড়ল না। অসহায়ের মত নিশিতার মুখের দিকে চেয়ে সে বলল, “বুঝতে পারছি না নিশি। এ’ঘরে এটা কি করে রেকর্ড করা হয়েছে। কোথাও তো কোন ক্যামেরা নেই”।

নিশিতা এবার ভীত স্বরে বলল, “কি হবে স্যার? ভিডিওটা আমার স্বামীর হাতে গেলে বা আমার স্বামী যদি কোনও ভাবে জানতে পারে যে আমার সাথে আপনার এমন একটা সম্পর্ক আছে, তাহলে তো এক কথায় আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে”।

বিমল হাত তুলে নিশিতাকে থামতে বলে বলল, “কে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এ’সব করছে, সেটা আগে জানা উচিৎ। তবে তুমি ভেবো না নিশি। আমার মনে হয় না কেউ তোমাকে বিপদে ফেলবে বলে এসব করছে। যে এসব করছে সে আমাকে টার্গেট করেই এ’ খেলায় নেমেছে। কিন্তু ও জানে না ও ভীমরুলের চাকে ঘা দিয়ে ফেলেছে। বিমল আগরওয়ালাকে ও আন্ডার এস্টিমেট করে ফেলেছে। আর তার ফল ও নিশ্চিত ভাবেই পাবে” বলে নিশিতার হাত ধরে চেম্বারে ফিরে আসতে আসতে বলল, “তোমার গায়ে ওভাবে হাত তোলা আমার উচিৎ হয়নি। আর ওভাবে গালিগালাজ করাও ঠিক হয়নি। কিন্তু প্রাথমিক ভাবে ওই কথা মনে হতেই তোমার ওপরই আমার সন্দেহ হয়েছিল। তাই ওভাবে রিয়েক্ট করে ফেলেছি। প্লীজ, ডোন্ট মাইন্ড। আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এই এস এম খান লোকটা কে, তাকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে নিশি। আর আমি যখন আজ অফিসে আসছিলাম তখন একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে এই ভিডিওটার একটা ছোট্ট ক্লিপ আমার মোবাইলে কেউ পাঠিয়েছিল। একজন সাইবার এক্সপার্টকে কন্টাক্ট করো। যাতে ওই প্রাইভেট নাম্বারের ফোনটার লোকেশান খুঁজে বের করা যায়”।

নিশিতা বলল, “হ্যাঁ স্যার, সে চেষ্টা করছি। কিন্তু আপনার তো দমদম যাবার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে স্যার। গাড়ি তো রেডি আছে”।

বিমল নিজের চেয়ারের কাছে এসে তার কোটটা গায়ে পড়তে পড়তে বলল, “ওকে আমি যাচ্ছি, তুমি বরং চেম্বারেই থাকো। আর ওই এস এম খান আর ওই প্রাইভেট নাম্বারের ফোনটা লোকেট করবার চেষ্টা করো। আমি আমার ওই মোবাইলটাও রেখে যাচ্ছি। আর ঘাবড়িও না। অফিসের কাউকে আর কিছু জানিও না। তুমি শুধু ওই কাজ দুটো করো। তারপর বাকিটা আমি সামলে নেব। ডোন্ট ওরি। আর নিজের মনটাকে শান্ত রেখো। আর আমার অমন ব্যবহারের জন্য প্লীজ ক্ষমা করে দিও” বলে নিশিতার গালে আর ঠোঁটে চুমু খেয়ে ওর উঁচু বুকদুটোকে সামান্য টিপে দিয়ে “আমি আসছি” বলে নিজের ল্যাপটপের ব্যাগটা আর অন্য মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল।

বিমল বেরিয়ে যাবার পর নিশিতা বিমলের দলের খুব ঘণিষ্ঠ কয়েকজনকে ফোন করে এস এম খানকে খোঁজার কথা বলল। আর দু’জন সাইবার এক্সপার্টকে ডেকে পাঠাল তাদের অফিসে।


*******************

বেলেঘাটার একটা প্রজেক্টের কাজ দেখে বিকেল প্রায় পাঁচটা নাগাদ সেখান থেকে বিমল তার অফিসের দিকে রওনা হল। মনটা বিক্ষিপ্ত বলে কাজে তেমন মন দিতে পারছেনা আজ সে। তবু পুর্ব নির্ধারিত কাজগুলো তাকে করতেই হচ্ছে। বেলেঘাটা প্রজেক্টের কাজ শেষ করে নিজের গাড়িতে ফিরে এসে পেছনের সীটে বসতেই ড্রাইভার একটা হলুদ রঙের খাম তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এটা নিন, স্যার”।

বিমল খামটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “কী এটা? আর কে দিল তোমাকে”?

ড্রাইভার একটু অবাক হয়ে বলল, “সে কি স্যার? এটা আপনিই তো পাঠিয়েছেন আমার কাছে”?

এবার বিমল অবাক হয়ে বলল, “আমি পাঠিয়েছি মানে? কে দিয়ে গেল তোমাকে এটা”?

ড্রাইভারও একই সমান বিস্ময়ের সাথে বলল, “স্যার কিছুক্ষণ আগে এই কনস্ট্রাকশন সাইট থেকেই একজন লেবার টাইপের লোক এসে এটা আমার হাতে দিয়ে বলল যে আপনি তাকে ওটা আমার হাতে দিতে বলেছেন। আর ভাল করে রাখতে বলেছেন। খুব দরকারী জিনিস নাকি আছে ওতে। তাই তো আমি হাত পেতে সেটা নিয়েছি। আর দরকারী জিনিস আছে ভেবে আমিও আর গাড়ি থেকে নামিনি। ড্রাইভিং সীটেই বসে আছি তখন থেকে”।
 

বিমল হাত বাড়িয়ে খামটা হাতে নিতেই তার মন বলে উঠল, এর ভেতরেও আবার কোন সিডি এসেছে নিশ্চয়ই। খামটার সাইজ দেখে, আর ওপর থেকে টিপেটুপে তেমনটাই মনে হচ্ছে। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে রাখতে ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বলে সে খামটা খুলল। তার ভাবনাকে সত্যি করেই খামের ভেতর থেকে একটা সিডি বেরিয়ে এল। বিমল মনে মনে একটু শঙ্কিত হল, না জানি এবার আবার কিসের ভিডিও পাঠিয়েছে।
 

গাড়ি তখন চেনা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলছে। বিমল আর মনের অস্থিরতা চেপে রাখতে না পেরে তার ব্যাগের ভেতর থেকে ল্যাপটপটা বের করে সিডিটা প্লে করল। এবার তার চক্ষু ছানাবড়া হবার যোগার। চোখ বিস্ফারিত করে দেখতে পেল ওই সিডিতেও একটা ভিডিও আছে। আর সেই ভিডিওতে বিমল আর একজন বছর ত্রিশের সুন্দরী মহিলা। বিমল অনেক ভেবেও মনে করতে পারল না মহিলার নামটা কি ছিল। তবে এই মহিলাকে অল্প কয়েকদিন আগেই বিমল তার বাগান বাড়িতে মানে দক্ষিণেশ্বরের ফার্ম হাউসে নিয়ে গিয়েছিল। সারাটা রাত ধরে ওই মহিলা তাকে খুব সুখ দিয়েছিল। তাকে দেবার কথা ছিল কুড়ি হাজার টাকা। কিন্তু তার সার্ভিসে বিমল খুশী হয়ে তাকে আরও দশ হাজার টাকা বখশিস দিয়েছিল। বিমলের ইচ্ছে ছিল এ সপ্তাহের শেষের দিকেই সে আরেকবার ওই মহিলাকে ভোগ করবে। কিন্তু এবার তার আর বিষ্ময়ের সীমা রইল না। সকালের সিডিটা দেখে তার প্রথমেই মনে হয়েছিল রেস্টরুমের ওই ঘটণাটা হয়ত নিশিতাই রেকর্ড করেছিল তাকে ব্ল্যাকমেল করবার জন্য। কিন্তু ওই ফার্ম হাউসে ভিডিও রেকর্ডিং করা নিশিতার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব নয়। দক্ষিনেশ্বরে যে তাদের একটা ফার্ম হাউস আছে, এ’কথা জানলেও, নিশিতা কোনদিন সে ফার্ম হাউসে যায়নি। বিমল তাকে কখনও সেখানে নিয়ে যায়নি, বা বলা ভাল, নিয়ে যেতে পারেনি। কারন নিশিতার পক্ষে তার স্বামীকে বাড়িতে রেখে সারা রাত বিমলের সাথে অফিসে, ফার্ম হাউসে বা বাইরে কোথাও কাটানো সম্ভব হয় না। আর ওর স্বামীও এমন একটা কাজ করে যাতে তাকে কখনোই শহরের বাইরে যাবার দরকার পড়ে না। আর একটা রাতও সে তার বৌকে ছেড়ে থাকতে পারে না। তাই অনেকবার বিমল চাইলেও নিশিতা তার ফার্ম হাউসে যায়নি। আর বিমলের অনুপস্থিতিতে ওই ফার্ম হাউসে অন্য কারো পক্ষে ঢোকাই সম্ভব নয়। সেখানকার সিকিউরিটির লোকজনদের তেমন নির্দেশই দেওয়া আছে। তাই নিশিতা কিছুতেই সেখানে যেতে পারে না। এ কাজের পেছনে অন্য কারো হাত আছে। কিন্তু কে? সেটা তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। বড় কোনও বিপদ ঘটার আগে ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করে ফেলা খুবই দরকার।
 

কি মনে হতেই খামটাকে উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতেই এক কোনায় ছোট্ট করে বি এস মন্ডল লেখা দেখতে পেল। সকালের সিডিটায় লেখা ছিল এস এম খান। আর এবারে বি এস মন্ডল। এখন সে কাকে ছেড়ে কাকে ধরবার চেষ্টা করবে। তবে কেন যেন তার মনে হচ্ছে ওই দুটো নামই ভূয়ো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিশিতাকে ফোন করতে যাবার আগেই মোবাইলটা দু’বার বিপবিপ করে উঠল। এটা তার মোবাইলের এমএমএস টোন। মোবাইল অন করতেই দেখে এমএমএস এসেছে। একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে। সেটা খুলতেই একটা ভিডিও ডাউনলোড হতে শুরু করল। প্রায় তিন মিনিট সময় লাগল ভিডিওটা ডাউনলোড হতে। তারপর ভিডিওটা চালাতেই দেখল, এটা একটু আগে পাওয়া সিডিটারই একটা ছোট্ট ক্লিপ। আবার তার ভুরু কুঁচকে উঠল। তার মন বলছে এই দুটো সিডি একজনই পাঠিয়েছে।

মোবাইল থেকে বুঝবার জো নেই। কিন্তু সিডির খামে আর কুরিয়ারের প্যাকেটে যে দুটো নাম আছে সে দুটো নাম আলাদা আলাদা হলেও সেগুলো যে একজন লোকই পাঠিয়েছে, এ ব্যাপারে এখন সে প্রায় নিশ্চিত। সে মনে মনে ভাবল, যে করেই হোক, সেই লোকটাকে খুঁজে বের করতেই হবে। যে কোনও প্রকারে।
 

এমন সময়েই বাঁ হাতে ধরে থাকা ফোনটা বেজে উঠতেই তাকিয়ে দেখে প্রাইভেট নাম্বারের কল। মনটাকে শক্ত করে সে কলটা রিসিভ করল। আর সাথে সাথে ও’পাশ থেকে এক পুরুষকন্ঠ বলে উঠল, “সরিরে শুয়োরের বাচ্চা, একটুখানি ভুল হয়ে গেছে। এমএমএসটাই আগে পাঠাবার কথা ছিল। কিন্তু আজকাল নেটওয়ার্কের যে কী হয়েছে কি বলব তোকে। এমএমএসটা পাঠিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলাম। কিন্তু প্রায় আধঘণ্টা বাদে মেসেজ এল এমএমএস ডেলিভারি ফেইলড। এখন তুইই বল, এতে কি আমার কোন দোষ আছে? নেটওয়ার্কের দোষেই উল্টোপাল্টা ডেলিভারি হয়ে গেল। যেটা আগে যাবার সেটা পৌছলো পরে, আর যেটা তোর হাতে পরে পৌঁছোবার, সেটাই আগে তোর হাতে গিয়ে পড়ল। কী আর করি বল? তবু তুই একটা বেজন্মা শুয়োরের বাচ্চা হলেও তোকে সরি বলছি। এ ভুলের জন্য ক্ষমা করে দিস। অবশ্য তোর মত হারামীর কাছে ক্ষমা চাইতে আমার নিজেরই লজ্জা করছে। কিন্তু কি আর করা যাবে। আর তাছাড়া তুই যে তোর ওই মোবাইলটা তোর অফিসেই ফেলে এসেছিস তা তো আমার জানা ছিল না। তোর এ নম্বরটা খুঁজে পেতে একটু সময় লাগল। তাই তো দেরী হয়ে গেল এমএমএসটা পাঠাতে। আচ্ছা সে যাই হোক, শোন একটা কথা সকালে তোকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটা বলে দিচ্ছি। সকালের সিডিটার ফুল ভার্সনটা আগামি সতের তারিখ সকাল ঠিক এগারোটায় নেটে আপলোড করা হবে। আর এখন যে সিডিটা পেলি, এটার ফুল ভার্সন সফট কপি নেটে আপলোড করা হবে সতেরো তারিখ বিকেল পাঁচটায়। আর শুধু নেটে আপলোড করাই নয়, এগুলো তোর চেনা পরিচিত অনেক রথী মহারথীদের ইমেইলেও পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তবে ই মেইলে ভিডিওগুলোর ফুল ভার্সনটা কাউকেই দেব না। তাতে আমার ব্যবসার ক্ষতি হবে। শুধু ট্রেলার পাঠাব। এই তোর মোবাইলে যেমন করে দুটো ক্লিপ পাঠালাম, সেভাবেই। কারন ট্রেলার দেখেই তো তারা পুরো ছবি দেখতে চাইবে, তাই না”? বলার সাথে সাথে ফোনটা কেটে গেল।
 

বিমল একটা কথাও বলবার সুযোগ পেল না। ফোন কেটে যাবার সাথে সাথেই সে ওই প্রাইভেট নাম্বারেই কলব্যাক করল। একবার, দু’বার, তিনবার। কোনও ফল হল না। প্রতিবারেই শোনাল “ডায়ালড নাম্বার ডাজ নট এক্সিস্ট”। অমন অভদ্র ভাষায় লোকটা আবার তাকে তুই তোকারি, গালিগালাজ দিয়ে ফোন করাতে, রাগে বিমলের সারাটা শরীর কাঁপতে লাগল। তার ফর্সা চোখ মুখ রাগের চোটে লাল হয়ে উঠল। সে সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে হুকুম দিল, “এই এখন অফিসে নয়। সোজা দক্ষিনেশ্বর চল”।

পরবর্তী ট্র্যাফিক সিগন্যালে গিয়েই গাড়ি আগের নির্ধারিত দিশা ছেড়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। কিন্তু বিমলের মন বলছে বড়সড় একটা ঝড় প্রচন্ড বেগে তার দিকে ধেয়ে আসছে।

______________________________
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 191)

দক্ষিনেশ্বর পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় ছ’টাই বেজে গেল বিমলের। সিডির ব্যাপার নিয়ে সে এতোটাই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে, সন্ধ্যে ছ’টায় যে হায়দ্রাবাদের নামী বিল্ডার আজিম কুরেশির সাথে তার অফিসে একটা মিটিঙে তাকে থাকতে হবে, এ’কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল। ওই বদমাশটা যদি সত্যি সত্যি তার এই ভিডিও গুলো নেটে কিংবা তার পরিচিত মহলের লোকদের কাছে পাঠিয়ে দেয়, তবে তো মহা সর্বনাশ। তার সমস্ত পরিচিত মহলে তার এমন বদনাম হবে যে তার আর মুখ দেখাবার জো থাকবে না। ফার্ম হাউসের গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকবার সময়ই কথাটা তার মনে এল। গাড়ি বিল্ডিঙের মূল দড়জার সামনে থামতেই দড়জার সামনে প্রহরারত গার্ড ছুটে এসে গাড়ির দড়জা খুলে বিমলকে স্যালুট ঠুকল। বিমল গাড়ি থেকে নামতেই গার্ডটা ছুটে গিয়ে মূল দড়জার তালা খুলতে শুরু করল।

বিমল দড়জার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে নিশিতাকে ফোন করল। ওদিকে নিশিতা ফোন ধরতেই বিমল জিজ্ঞেস করল, “মিঃ আজিম কুরেশি কি ফোন করেছিল”?

নিশিতা জবাব দিল, “হ্যাঁ স্যার, একটু আগেই উনি ফোন করে জানতে চাইছিলেন যে আজ সন্ধ্যের মিটিংটা হচ্ছে কি না। আমি তাকে বলেছি যে মিটিংটা ঠিক সময়েই হবে। তখন উনি বললেন যে উনি ঠিক সময়েই এসে পৌঁছবেন। কিন্তু স্যার, আপনি এখন কোথায় আছেন? এখনও ফিরলেন না যে”?
 

বিমল নিশিতার কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলল, “না নিশি, মিটিংটা আজ হচ্ছে না। তাকে ফোন করে জানিয়ে দাও যে বিশেষ কাজে আমি অনেক দুরে একটা জায়গায় আটকে গেছি। তাই সময়মত অফিসে পৌঁছতে পারছি না। তুমি তাকে কাল বা পরশুর একটা সময় দিও। আর শোনো, ওই এসএমএস আর মোবাইল লোকেশান ট্র্যাকিং করার ব্যাপার গুলোর কোনও হদিশ করতে পারলে”?

নিশিতা বলল, “স্যার, আপনি অফিস থেকে বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই আমি পরিক্ষীত, সুরজ আর গাবলুদের ফোন করে এস এম খানের খোঁজ করতে বলেছি। আর মুরলিধরন আর শিবেন্দুকে ডেকে আপনার ফোনে কল করা ওই প্রাইভেট ...........”

নিশিতাকে ধমকে থামিয়ে দিয়ে বিমল বলল, “তুমি কী করেছ, সেটা আমি জানতে চাই নি নিশি। আমি জানতে চেয়েছি কোনও হদিশ পাওয়া গেল কি না? তুমি শুধু সেই কথাটা বলো এখন। তুমি কি করেছ না করেছ সেটা আমি পরে দেখব”।

নিশিতা একটু ভয় পেয়ে শান্ত গলায় বলল, “না স্যার, এখনও পর্যন্ত প্রাইভেট নাম্বারের লোকেশান বা এস এম খানের খোঁজ, কোনটাই পাওয়া যায়নি”।

বিমল আর কোন কথা না বলে চরম বিরক্ত হয়ে ফোন কেটে দিল। তারপর ফার্ম হাউসের মূল দড়জা দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। সোজা একতলার তার নিজস্ব মাস্টার বেডরুমে গিয়ে ঢুকল। প্রথমেই সে রিমোট টিপে এসিটা চালিয়ে দিল। গার্ড তার মালিককে এভাবে আসতে দেখে যার পর নাই অবাক হল। যদিও বেশীরভাগ সময়েই মালিকের সাথে কোন না কোন কম বয়সী বা মধ্য বয়সী মহিলা থেকে থাকে, তবে এমন নয় যে তার মালিক এভাবে একা কখনও এ ফার্ম হাউসে আসে নি। অবশ্য দিনের বেলায় যখন আসে তখন বেশীর ভাগ সময়ে সে একাই আসে। কিন্তু তার হাতে কোনও ব্রিফকেস বা কোনও বড় ধরণের ব্যাগ নিশ্চয়ই থাকে। তাই আজ তাকে খালি হাতে দেখে সে চরম বিস্মিত হল।

বিমল তার মাস্টার বেডরুমে এসে এসি চালিয়ে দেবার পর দড়জাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর ঘরের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে শুরু করল প্রতিটা দেওয়ালে। ওপর নিচে সর্বত্র তার সতর্ক দৃষ্টি ঘুরে বেড়াতে লাগল। বিশাল কিং সাইজ খাটটার চারপাশ, খাটের নিচে, ড্রেসিং টেবিল আর আলমারির চার পাশে খুঁটে খুঁটে দেখেও তার চোখে সন্দিগ্ধজনক কিছু ধরা পড়ল না। সব শেষে সিলিং আর সিলিং ফ্যান গুলোর দিকেও ভাল করে দেখল। নাহ, কোথাও কিচ্ছু নেই। হঠাতই তার চোখ গিয়ে পড়ল ঘরের দেওয়ালে লাগানো এসিটার ওপর। কিভেবে সে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার বের করে এসির সামনের কভারটা খুলে ফেলল। নাহ, এখানেও কোন ক্যামেরা বা ওই জাতীয় কোনকিছু নেই। আবার এসির কভারটাকে আগের মত করে লাগিয়ে দিয়ে স্ক্রু ড্রাইভারটা হাতে নিয়েই সে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে পড়ল। অনেকক্ষণ ধরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও বাথরুমেও সন্দেহজনক কোনকিছু তার নজরে পড়ল না। হতাশ হয়ে বেডরুমে ফিরে এসে স্ক্রু ড্রাইভারটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে সে খাটে পাতা বিছানার ওপর বসে ভাবতে লাগল। এ ঘরের বিছানায় ক’দিন আগেই ওই মহিলাকে নিয়ে সে শুয়েছিল। আর তার দিন চারেক বাদে একটা কম বয়সী মেয়েকে নিয়েও সে সারা রাত এ’ঘরে কাটিয়েছে। তখন ঘটণাগুলো কিভাবে রেকর্ডিং হয়ে থাকতে পারে। এ’কথা বলাই বাহুল্য যে সেদিন কোন না কোন ক্যামেরা এ ঘরে নিশ্চয়ই লাগানো ছিল। নইলে ওই সিডিটা কী করে তৈরী করতে পারে কেউ। এক সময় বিমল নিজেই ভেবেছিল যে এ ঘরের চারকোণায় চারটে গোপন ভিডিও ক্যামেরা সে বসাবে, যাতে মেয়ে মহিলাদের সাথে কাটানো অন্তরঙ্গ মূহুর্তের সব কিছু ওই ক্যামেরায় ধরা পরে। অলস অবসর সময়ে ওই সব রেকর্ডের ভিডিও গুলো দেখে সে কিছুটা ভাল সময় কাটাতে পারবে। কিন্তু আজ করি কাল করি বলে সে কাজটা আদৌ করা হয়নি। কিন্তু তার অজান্তে যে-ই সে কাজটা করে থাকুক না কেন তাকে অন্ততঃ দু’দিন এখানে এ’রুমে অবশ্যই আসতে হয়েছে। কারন একবার তাকে এখানে এসে ক্যামেরা গুলো লাগাতে হয়েছে। আর আরেকবার এসে ক্যামেরাগুলো খুলে নিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। কিন্তু এটা কিকরে সম্ভব সেটা তার মাথাতেই আসছিল না। গার্ডদের কাছে চাবি থাকে বটে, কিন্তু এ’ঘরে তার পারমিশন ছাড়া এখানকার গার্ডরাও ঢুকতে সাহস পাবে না। এ’ব্যাপারে তার শুরু থেকেই কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে। আর তাকে না জানিয়ে গার্ডদের চোখে ধূলো দিয়ে কেউ যে এ’ঘরে ঢুকতে পারে, সেটাও প্রায় অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

এসির হাওয়ার প্রভাবে ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। রিমোট হাতে নিয়ে এসির টেম্পারেচার কন্ট্রোল করতে করতে হঠাতই তার মনে পড়ল, কিছুদিন আগে এ ঘরের এসিটা কাজ করছিল না বলে লাখুকে সে এ’ঘরে পাঠিয়েছিল। সে এসে এসিটা সারাই করেছিল। তাহলে ওই লাখুই কি এ’ঘরে ক্যামেরা লাগিয়েছিল? কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল, না না, লাখু তার অনেকদিনের পরিচিত এবং বিশ্বস্ত। সে এমন কাজ করবে বলে মনে হয় না। বিমল তার দ্বিধাবিভক্ত মন নিয়েই এসি বন্ধ করে তার বেডরুম ভাল করে লক করে বেরিয়ে এল।

মূল দড়জার সামনে এসে বিমল হাত তুলে গার্ডদের দিকে ঈশারা করতেই তারা দু’জনই সাথে সাথে বিমলের সামনে এসে দাঁড়াল। বিমল তাদের চোখের দিকে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “এই তোরা ভালভাবে ডিউটি করছিস তো? তোদের ফাঁকি দিয়ে কেউ ফার্ম হাউসে ঢোকেনি তো”?

একজন গার্ড সাথে সাথে বলল, “হ্যাঁ স্যার, আমরা তো দিনরাত খুব সতর্ক ভাবেই পাহাড়া দিচ্ছি। ফার্ম হাউসের কাছে আসা তো দুরের কথা, মেনগেটের ভেতরেও আমরা কাউকে ঢুকতে দিইনা আপনার পারমিশন ছাড়া”।
 

আরেকজন গার্ড প্রশ্ন করল, “কেন স্যার? কিছু হয়েছে কি? আপনার কি মনে হয় আপনার পারমিশন ছাড়া আমরা কাউকে কখনও ভেতরে ঢুকতে দিয়েছি”?
 

বিমল এক সেকেন্ড ভেবে সত্যি কথাটা চেপে গিয়ে বলল, “না তা নয়। আমি এমনি জানতে চাইছি। তোরা ঠিক মত ডিউটি করছিস কি না তা জানতে তো চাইতেই পারি আমি”।
 

একজন গার্ড সাথে সাথে বলল, “হ্যা স্যার, সে তো আপনি করতেই পারেন। কিন্তু এর আগে তো কখনও এভাবে জিজ্ঞেস করেন নি, তাই কেমন যেন লাগছে”।

বিমল নিজেকে একটু সহজ দেখাবার চেষ্টা করে বলল, “না না তেমন কোন ব্যাপার নেই। আচ্ছা, কথায় কথায় একটা কথা মনে পড়ে গেল। লাখু যেন কবে এসিটা সারাই করতে এসেছিল? ওর মজুরীটা এখনও দেওয়া হয়নি। তোরা রেজিস্টার দেখে আমাকে সঠিক তারিখটা বল তো”।
 

একজন গার্ড সাথে সাথে মেন গেটের দিকে দৌড়ে গেল। মেন গেটের ঠিক ভেতরেই ছোট্ট একটা ঘর থেকে একটা খাতা হাতে নিয়ে আবার ছুটে এল বিমলের কাছে। তারপর খাতার পাতাগুলো ওল্টাতে ওল্টাতে এক জায়গায় থেমে গিয়ে বলল, “এই তো স্যার। এই মাসের চার তারিখে লাখু এসেছিল এসি সারাই করতে। কিন্তু সেদিন আপনিই তো পারমিশন দিয়েছিলেন স্যার। তবে সেদিন ও বলেছিল যে ওর কাছে একটা পার্টস ছিল না বলে টেম্পোরারি কাজ চালিয়ে দেবার মত ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। আর আমার সামনেই তো ও আপনাকে ফোন করে সে’কথা বলেছিল। আর গত পরশুদিন সে এসে ওই পার্টসটা এনে এসিটাকে সারাই করে গেছে। সে’কথাও তো আপনি জানেন স্যার। তা স্যার, এসিটা কি ঠিক হয়নি? কাজ করছে না এখন”?

বিমলের মনে পড়ল লাখু তাকে সত্যিই অমন কথা বলেছিল। আর চার তারিখের পরেই সে ভিডিওর ওই মহিলাকে নিয়ে এখানে এসেছিল। তারপর আরও আরেকদিন মিলু নামের একটা কচি মেয়েকেও একদিন এখানে এনেছিল। ওই দু’দিনই এসিটা কম কাজ করছিল। তারপর লাখু এসে মেশিনটার কী একটা পার্টস বদলে দিয়ে গেছে। এ’কথাও তার জানা আছে। আর আজ তো বোঝাই গেল যে এসিটা ঠিক কাজ করছে। তার মানে লাখু এসির কাজের ব্যাপারেই দু’দিন এখানে এসেছিল। আর সে কাজই করে গেছে। আর এটাই প্রথম নয়, এর আগেও লাখু এমনভাবে এসি মেশিন বা ফ্রিজ বা গিজার এ’সব ঠিক করতে এসেছে এবং করেও গেছে। কখনও তো এমন কোন ঘটণা ঘটেনি। লাখু তার খুবই বিশ্বস্ত। তাই এ ফার্ম হাউসে যাবতীয় ইলেকট্রিসিটি বা ইলেকট্রনিক গুডসের মেরামতির জন্য সে লাখু ছাড়া আর কাউকে ডাকে না। তাই লাখুকে সন্দেহ করা একেবারেই অমূলক।
 

গার্ডদের কথায় সন্তুষ্ট হয়ে বিমল নিজেই খাতাটা হাতে নিয়ে দেখল। চার তারিখে আর দশ তারিখে লাখু এসেছিল। লাখুর সইও আছে খাতায়। পাঁচ তারিখ আর ন’তারিখ খাতায় মালিক সাহেবের আসবার কথাও লেখা আছে। তবে এতে কারো সই নেই। বিমলের নির্দেশেই গার্ডরা বিমলের নাম না লিখে মালিক সাহেব বলে খাতায় এন্ট্রি করে। আবার কে কখন বেরিয়ে গেছে সে’সবও খাতায় লেখা আছে। মালিক সাহেবের আসবার এন্ট্রি লেখা আছে পাঁচ তারিখ রাত সাড়ে ন’টার সময়, আর বেরিয়ে যাবার এন্ট্রিতে সময় লেখা আছে ছ’তারিখ সকাল আটটা দশ। আর আরেকবার মালিক সাহেবের আসবার সময় লেখা আছে ন’ তারিখ রাত ন’টা পঞ্চাশ। আর পরদিন তার বেরোবার সময় লেখা আছে দশ তারিখ সকাল সাতটা চল্লিশ। হ্যাঁ কোনও ভুল নেই এন্ট্রিতে। আর লাখুর নামে লেখা আছে লাখু চার তারিখ দুপুর একটা দশে এসে বেরিয়ে গেছে একটা পঁচিশে। তার মানে সে মোটে পনেরো মিনিট ফার্ম হাউসের ভেতরে ছিল। এত কম সময়ে এসি মেশিন খুলে সেটা টেম্পরারি কাজ করবার মতন করে, আবার লুকিয়ে ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে পনের মিনিটের ভেতর বেরিয়ে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। আবার দশ তারিখে বিকেল সাড়ে তিনটেয় এসে বেরিয়ে গেছে বারো মিনিট বাদেই। এই বারো মিনিটেও এসি মেশিনের পার্টস বদলে ভিডিও ক্যামেরা গুলো খুলে ফেলা হয়ত সম্ভব নয়। তাই লাখুকেও সন্দেহ করা যাচ্ছে না। অবশ্য খাতায় যদি ঠিকঠাক লেখা থাকে। কিন্তু তার নিজের নামের এন্ট্রিগুলোতে সময় তো ঠিকঠাকই লেখা আছে। তাহলে ধরে নেওয়া যায় যে লাখুর এন্ট্রি গুলোতেও ঠিক সময়ই লেখা আছে। তাই লাখুকে সন্দেহের বাইরেই রাখতে হচ্ছে। এ ছাড়া খাতায় আরও একটা এন্ট্রি দেখতে পেল সে। গতকালও সে বিকেল চারটেয় এখানে এসেছিল, আর ঘন্টা খানেক পরেই কাজ সেরে বেরিয়ে গিয়েছিল। সে’সবও ঠিক মতই খাতায় লেখা আছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে যে খাতায় এন্ট্রির ব্যাপারে গার্ডদের কোনও ভুল হয়নি। তাহলে তার বেডরুমের ওই দিন রাতে রেকর্ডিংটা কে কিভাবে করল। নাহ, কিচ্ছুই মাথায় আসছে না তার। হতাশ হয়ে রেজিস্টারটা একটা গার্ডের হাতে ফেরত দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা এটা রাখ। আর একটু সাবধান থাকিস। কেউ যেন আমার পারমিশন ছাড়া এখানে ঢুকতে না পারে” বলে নিজের গাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। ফার্ম হাউসের গেট দিয়ে যখন তার গাড়ি বেরোল তখন সাতটা পেরিয়ে গেছে।


*******************

রাত প্রায় সাড়ে আটটা নাগাদ বিমলের গাড়ি নিজের অফিসের সামনে এসে বিমলকে নামিয়ে দিল। বিমল গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে গাড়ির আশেপাশেই থাকতে বলে বিল্ডিংএর ভেতরে ঢুকে গেল। লিফটে চড়ে ওপরে উঠে নিজের অফিসে গিয়ে দেখে বেশীর ভাগ স্টাফই চলে গেছে। সামনের অংশে শুধু দু’জন বসে নিজেদের কাজ শেষ করবার চেষ্টা করছে। নিজের চেম্বারে ঢুকে পাশের কাঁচে ঘেরা কেবিনের দিকে তাকিয়ে দেখল নিশিতা ফোনে কারো সাথে কথা বলছে। ফোনটা টেবিলে রেখে নিজের গায়ের কোটটা খুলে তার রিভলভিং চেয়ারের ব্যাকরেস্টের সাথে ঝুলিয়ে চেয়ারে বসতে না বসতেই নিশিতা তার কাছে প্রায় ছুটে এল। চিন্তাগ্রস্ত মুখে সে বিমলের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “স্যার, বেলেঘাটা থেকে কোথায় গিয়েছিলেন আপনি? ওই লোকটার কোনও খোঁজ পেলেন”?

বিমল হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আগে আমাকে এক গ্লাস জল দাও তো নিশি। তারপর বেশ কড়া করে এক কাপ কফি বানাও প্লীজ”।

নিশিতা আর কোনও কথা না বলে রেস্টরুমের ভেতর ঢুকে গেল। রেস্টরুমের একপাশেই একটা পার্টিশানের ওপারে ছোট্ট একটা ক্লোজেট। সেখানে ফ্রিজের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা মিনারেল ওয়াটারের বোতল থেকে একটা গ্লাসে জল ভরে বিমলের টেবিলে রেখেই সে আবার ভেতরের ক্লোসেটে ঢুকে গেল। নিশিতা মিনিট পাঁচেক বাদে এক কাপ কফি নিয়ে ক্লোজেট থেকে বেরিয়ে চেম্বারে ঢুকে দেখে বিমল চেয়ারটাকে পেছনদিকে হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে আধা শোয়া হয়ে আছে।
 

“স্যার কফি” বলে কাপটা টেবিলে নামিয়ে রাখতেই বিমল চেয়ার সোজা করে বসে কফির কাপ হাতে তুলে নিল। নিশিতা বিমলের চেয়ারের পেছনে গিয়ে বিমলের কপাল মাথা আর কাঁধ টিপতে টিপতে হাল্কা গলায় বলল, “মিঃ আজিম কুরেশিকে আগামীকাল বিকেল পাঁচটার অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছি স্যার”।

বিমল কোন কথা না বলে চুপচাপ কফির কাপে চুমুক দিয়ে যাচ্ছিল। নিশিতা বুঝতে পারল, বিমল খুব গভীরভাবে কিছু একটা নিয়ে ভাবছে। মনে হচ্ছে ওই সিডির ব্যাপারটা নিয়েই। কিন্তু বেলেঘাটা থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যের অ্যাপয়েন্টমেন্টটা ক্যানসেল করে তার স্যার কোথায় গিয়েছিল, এটা জানতে তার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছিল। কিন্তু সে জানে, এখনই কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলে তার স্যার রেগে যাবেন। তার স্যারকে এতোটা উদ্বিঘ্ন সে কখনও দেখেনি। এর আগে ইনকাম ট্যাক্স, আর সিবিআইয়ের রেডের সময়েও স্যারকে সে কখনও বিচলিত হতে দেখেনি। একটু ভেবে নিশিতা “এক মিনিট স্যার” বলে চেম্বার থেকে বেরিয়ে সামনের অংশে গেল। দু’জন সেখানে কাজে ব্যস্ত আছে দেখে সে বলল, “সুধীর, বিকাশ, তোমাদের কাজ শেষ হলে চলে যেও। স্যার একটু বিজি আছেন। তোমরা তার চেম্বারে নক কোর না”। অফিস স্টাফেরা সবাই এ’মন নির্দেশ মাঝে মধ্যেই পেয়ে থাকে। তারা জানে রাত আটটার পর তাদের স্যার কিভাবে বিজি থাকেন। তাই তারা কোনও উচ্চবাচ্য না করে মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানাল।

নিশিতা চেম্বারে ফিরে এসে চেম্বারের দড়জাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিল। তারপর বিমলের পাশে এসে একটু দাঁড়িয়ে আবার বিমলের পেছনে গিয়ে তার কাঁধে গলায় আর ঘাড়ে ম্যাসেজ করতে শুরু করল। খানিক বাদে বিমলের কফি খাওয়া শেষ হতেই নিশিতা বিমলের হাত ধরে চেয়ার থেকে টেনে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “আজ আপনার প্রচুর স্ট্রেস গেছে স্যার, বুঝতে পাচ্ছি। চলুন, একটু রিল্যাক্স করে নেবেন” বলে বিমলের হাত ধরে রেস্টরুমের ভেতরে গিয়ে ঢুকল।
 

বিমল যেন শক্তিহীন একটা পুতুল। নিশিতা বিমলকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজের পড়নের টপটা খুলে ফেলল। তারপর নিজের ব্রাটাও খুলে ফেলল। অন্যান্য দিন ব্রা খোলার কাজটা বিমলই করে। নিশিতা শুধু নিজের ডিউটি পালন করতেই তার বসের কাছে নিজের শরীরটা তুলে ধরে। কিন্তু আজ ব্যাপারটা একটু অন্যরকম হচ্ছে। বিমলকে এত বিদ্ধস্ত সে আগে কখনও দেখেনি। আজ তার এই অসহায়তা দেখে সত্যিই নিশিতার কষ্ট হচ্ছে। তার কোমল মনটা তার বসকে কিছুটা স্বস্তি দিতে চাইছিল। তাই এই প্রথম বসের নির্দেশের অপেক্ষা না করেই, অনেকটা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবেই সে বিমলের সামনে নগ্ন হল। ঈশ্বর সত্যিই নিশিতার দেহটাকে বেশ যত্ন নিয়েই বানিয়েছেন। তার ভরপুর শরীরে কোথাও এতটুকু খামতি নেই। বিমল একদৃষ্টে নিশিতার উলঙ্গ ঊর্ধাংগের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার চোখে বরাবরের মত লোভ লালসার ছায়া নেই আজ। তাকে খুবই নিষ্প্রভ বলে মনে হচ্ছে আজ। নিশিতা নিজেই এগিয়ে এসে তার উঁচু বুকটাকে বিমলের মুখের কাছে উঁচিয়ে ধরল। তবু যেন তার স্যারের কোন হেলদোল নেই আজ। নিশিতা এবার নিজেই নিজের একটা ভারী স্তন কিছুটা উঁচিয়ে ধরে বিমলের ঠোঁটে চেপে ধরে অন্য হাতে তার স্যারের মাথার পেছনদিকটা ধরে নিজের বুকের দিকে টেনে আনল। এমন অবস্থাতেও বিমল কয়েক সেকেন্ডচুপ করে থাকবার পর নিজের ঠোঁট দুটো ফাঁক করল। নিশিতা সাথে সাথে উদ্যোগী হয়ে তার স্যারের মুখের ভেতর নিজের স্তনটা ঢুকিয়ে দিয়ে তার মাথার চুলে হাত বোলাতে লাগল। বিমল বুঝি এবার নিজের অজান্তেই নিশিতার স্তনটাকে বেশী করে নিজের মুখের ভেতর টেনে নিয়ে চুষতে শুরু করল। নিশিতা যখন বুঝতে পারল যে তার স্যার এবার স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে তার মধুভান্ডটাকে চুষতে শুরু করেছে তখন সে বাঁহাতে বিমলের মাথাটাকে নিজের বুকের ওপর চেপে রেখে ডান হাতটা এগিয়ে দিল বিমলের কোমড়ের দিকে। প্যান্টের ওপর দিয়েই সে বিমলের পুরুষাঙ্গের ওপর চাপ দিয়ে বুঝল যে জিনিসটা এখনও ঘুমিয়ে আছে। সে একটু কসরত করে এক হাতের প্রচেষ্টায় বিমলের প্যান্টের জিপারটা খুলে ফেলল। তারপর নিজের হাতটাকে প্যান্টের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে আন্দাজে হাতরে হাতরে জাঙ্গিয়ার ফাঁক দিয়ে বিমলের পুরুষাঙ্গটাকে টেনে বার করল। বিমলের জিনিসটা তখনও বেশ ঠাণ্ডা আর নরম। এমনটা নিশিতা কখনও দেখেনি। আজই প্রথম তার স্যারের এ জিনিসটাকে সে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখতে পেয়ে মনে মনে ভাবল তার স্যার আজ ভীষণই টেনশনে আছেন। টেনশনে নিশিতা নিজেও সারাটা দিন ভুগেছে। সকালে ওই সিডিটা দেখবার পর থেকেই সে নিজেও বড় দুশ্চিন্তায় ভুগছে। অমন একটা সিডি কে কোন উদ্দেশ্যে বানিয়েছে কে জানে। তবে এর পেছনে যে কোন মহৎ উদ্দেশ্য থাকতে পারে না, এটা বুঝতে কারুরই অসুবিধে হবার কথা নয়। কিন্তু ওই এস এম খান নামের লোকটা কাকে বিপদে ফেলতে চাইছে? তাকে না তার স্যারকে? আর কী ধরণের বিপদই বা সামনে আসছে, তারও কোন অনুমান সে সারা দিন ভর ভেবেও বের করতে পারেনি। ওই এস এম খান কি তাকে বা তার স্যারকে কোনভাবে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে? আর এভাবে ব্ল্যাকমেল করে সে কী পেতে চাইছে? তার স্যারের প্রভাব প্রতিপত্তি সম্বন্ধে নিশিতা খুব ভাল ভাবেই ওয়াকিবহাল। কেউ তার স্যারের চুল পরিমাণ বিরোধিতা করলেও তার স্যার তাকে এমনভাবে চরম শাস্তি দিয়ে থাকেন, যে তার বিরূদ্ধে কেউ কোন প্রমাণই দেখাতে পারে না। এ রাজ্যের সমস্ত আমলা মন্ত্রী থানা পুলিশ তার স্যারের কথায় ওঠবস করে। দিল্লীর অনেক মন্ত্রী আমলাও তার স্যারের হাতের মুঠোয় পোরা। তাই তার স্যারকে কেউ বিপদে ফেলতে পারে না। কিন্তু আজ যেন তার স্যার সত্যিই খুব বিচলিত। তাকে এত টেনশনে নিশিতা কোনদিন দেখেনি। এ’সব ভাবতে ভাবতে সে ডানহাতে বিমলের শিথিল হয়ে থাকা পুরুষাঙ্গটাকে আদর করতে লাগল। বিমল ততক্ষণে কিছুটা সহজ ভাবেই নিশিতার বুকের সুধা পান করতে শুরু করেছে। নিশিতাও তার ডানহাতের গতি বাড়িয়ে দিল। আর মিনিট খানেকের ভেতরেই বিমলের ছোট খোকা যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। সেটা এবার ধীরে ধীরে উত্তপ্ত আর উত্থিত হয়ে নিজের পূর্ণাংগ রূপ ধারণ করল।
 

ঠিক এমন সময়েই বিমলের টেবিলের ওপর রাখা ইন্টারকমটা বাজে শব্দ করে উঠল। বিমল আর নিশিতা দু’জনেই প্রায় একই সাথে চমকে উঠল। বিমল নিশিতার বুক থেকে ঝট করে মুখ সরিয়ে নিয়ে রাগী মুখে নিজের টেবিলে গিয়ে ইন্টারকমের রিসিভার না তুলেই সেটাকে স্পীকার মোডে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “এই, তোমরা তো জানো যে আমি এখন খুব ব্যস্ত। কেন তাহলে আমাকে ডিসটার্ব করছ”?

নিশিতা খোলা বুকেই তার স্যারের পেছন পেছন এল। ও’পাশ থেকে কেউ একজন বলল, “স্যার, আমি চৌহান বলছি, আপনার ড্রাইভার। আসলে স্যার, আপনি আপনার ল্যাপটপের ব্যাগটা গাড়িতেই ফেলে এসেছিলেন। সেটাই নিয়ে এসেছি স্যার”।

______________________________
 
Like Reply
(Update No. 192)

এ’কথা শুনেই নিশিতা একলাফে রেস্টরুমের ভেতর গিয়ে নিজের টপটা পড়ে নিল। ব্রা টা বিছানার নিচে লুকিয়ে ফেলল। পড়ার সময় নেই এখন। তারপর আবার বিমলের কাছে এসে বলল, “আমি নিয়ে আসছি স্যার। আপনি বসুন” বলে দড়জার দিকে এগোতে গিয়েই বিমলের চেন খোলা প্যান্টের দিকে তার নজর পড়ল। তার লিঙ্গটা যে প্যান্টের বাইরে বেরিয়ে রয়েছে সেদিকে যেন বিমলের কোন হুশই নেই। নিশিতাই চট করে বিমলের পুরুষাঙ্গটাকে তারা প্যান্টের ভেতর ঠেলে ঠুলে ঢুকিয়ে দিয়ে প্যান্টের জিপারটা টেনে তুলে দিল।
 

চেম্বারের দড়জা খুলে নিশিতা বাইরে বেরিয়ে ড্রাইভারের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আবার চেম্বারে ঢুকে দড়জাটা আগের মতই ভেতর থেকে লক করে দিল। বিমল তখন আবার রেস্টরুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ওটার ভেতর থেকে প্রোজেক্ট ফাইলগুলো বের করে সেফে রেখে দাও নিশি”।

নিশিতা ব্যাগটা খুলে ভেতর থেকে দুটো ফাইল টেনে বের করতেই দেখে ল্যাপটপের সাথে সেঁটে আছে কয়েকটা সিডি। একটু কৌতূহলী হয়ে সে সেগুলো বের করে দেখে সেখানে তিনটে সিডি আছে। একটা সিডি তো সকালে এসেছিল, সেটা সে জানেই। বাকি দুটো সিডি কিসের? আবার পর মূহুর্তেই ভাবল। হতে পারে এগুলো নতুন কোনও প্রোজেক্টের সিডি। তাই সে বলল, “স্যার এই সিডি তিনটে কি এ ব্যাগেই থাকবে? না সেফে রাখবো”?

বিমল চমকে উঠে জিজ্ঞেস করল, “তিনটে সিডি মানে? ওখানে তো দুটো সিডি ছিল”!

নিশিতা এবার অবাক হয়ে বলল, “না স্যার, এখানে তো তিনটে সিডি আছে। এই দেখুন” বলে সিডিগুলো তুলে দেখাল। আর সঙ্গে সঙ্গে বিমল ছুটে তার টেবিলের কাছে এসে নিশিতার হাত থেকে সিডিগুলো নিয়ে উল্টে পাল্টে দেখতে লাগল। এস এম খান, আর বি এস মন্ডলের পাঠানো সিডিগুলোর সাথে আরও একটা সিডি আছে যেটার প্যাকেট এখনও খোলা হয়নি। তার বুকটা অজানা আরেকটা আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। সে প্যাকেটটাকে চোখ বিস্ফারিত করে দেখতে দেখতে এক কোনায় ছোট্ট করে এম ভি আনোয়ার লেখা দেখতে পেল। চরম উত্তেজনায় সে নিজের চেয়ারে বসে পড়ে সাথে সাথে ল্যাপটপটা ব্যাগের বাইরে টেনে বার করে নিশিতাকে বলল, “ল্যাপটপটা অন কর তাড়াতাড়ি”।

তার কথা শেষ হবার আগেই তার মোবাইল ফোনটা আবার বেজে উঠল। বিমলের বুকটা আরও বেশী করে কেঁপে উঠল। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল প্রাইভেট নাম্বার কলিং। একবার ফ্যালফেলে মুখে নিশিতার দিকে দেখে কাঁপা কাঁপা হাতে সে মোবাইল তুলে কলটা রিসিভ করে নিজের কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যা.. হ্যা.. হ্যালো”।

নিশিতা ততক্ষণে ল্যাপটপটা সুইচ অন করে ফেলেছে। বিমলের ফোনে তখন ও’পাশ থেকে সেই একই গলায় কেউ বলল, “কি রে শুয়োরের বাচ্চা, তোর আগের দুই হারেমের ভিডিও দেখে কেমন লাগল? নিশ্চয়ই খুব ভাল লেগেছে। তাই না? সত্যি রে হারামির বাচ্চা, তোর পয়সার যেমন জোর ঠিক তেমনি জোর তোর লন্ডটার। মাগীগুলোকে কি সাংঘাতিক ভাবেই না তুই চুদিস। তোর ক্ষমতা আছে, সেটা মানতেই হবে। কিন্তু তোর বিয়ে করা বউটাও তো একটা খাপ্পাই মাল রে! সেটাকে তুই চুদিস না কেন? তার শরীরটাও তো এখনও গরম আছে। আর তুই নিজেও তো জানিস সেটা। তুই তো এ’কথাও জানিস যে তোর যেমন দুটো হারেম আছে, তেমনি তোর বিয়ে করা বউটারও অমন একটা হারেম আছে। ওই তোর বাড়ির কাছেই ওই হোটেলটাতে। আর তুই জানবিই না বা কেন। তুই নিজেই তো সে হারেমের বন্দোবস্ত করে দিয়েছিস। বেচারী....। তবে আমি কিন্তু তোর বউকে কোনও দোষ দিচ্ছি না। কতই আর বয়স হয়েছে তার বল? সবে পঁয়তাল্লিশ। এই বয়সেই কি একটা মেয়ের শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যায় নাকি? তার শরীরে যৌবন এখনও ভরপুর আছে। বড়রা তো বটেই, কচি কচি ছেলেগুলো পর্যন্ত তোর বেশ্যা বৌটাকে চোদার জন্য পাগল। তুই নিজে যদি তোর অমন সেক্সী বৌটাকে না চুদিস তাহলে সে আর কি করবে বল। শরীরের জ্বালা মেটাতে তাকে তো এখানে সেখানে মুখ মারতেই হবে। তবে ওকে না চুদলেও তুই যে তার জন্য হারেমের ব্যবস্থা করে দিয়েছিস, সেটা না করলে সে তার শরীরের জ্বালা এত সহজে মেটাতে পারত না। এদিক দিয়ে তুই কিন্তু সত্যি স্বামীর কর্তব্য পালন করেছিস। কিন্তু তোর বৌটার একটা ব্যাপার কিন্তু আমার সত্যি ভাল লাগেনি রে। নিজের বয়সী বা বয়স্ক পুরুষ গুলোকে তোর বৌটা খুব বেশী পাত্তা দেয় না। একবার আমিও তাকে চুদতে চাইছিলাম, জানিস। কিন্তু শালী আমাকে পাত্তাই দিল না। আমার চোখের সামনে তোর ছেলের বয়সী একটা কচি ছোড়াকে নিয়ে তার হারেমে ঢুকে গেল। কচি কাঁচা ছেলেগুলোর ওপর তোর বৌটার বড্ড বেশী টান। ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস তো। শহরে কি পাকা চোদারুর কমতি আছে? আর বলিস একদিন যেন আমাকেও একটু চান্স দেয়। তোর বিয়ে করা মাগীটাকে একবার চোদার খুব সখ আছে আমার। তবে কোনরকমে একবার যদি তাকে চুদতে পারি, তাহলে সত্যি বলছি তোর বৌটা আর অন্য কারো চোদা খেতেই চাইবে না। সবসময় আমার পেছনেই ঘুরঘুর করবে চোদা খাবার জন্য। আর এমনও হতে পারে যে তোর ঘর ছেড়ে তোকে ছেড়ে সে পাকাপাকি ভাবে আমার হারেমেই এসে থাকতে শুরু করবে। ওকে জিজ্ঞেস করিস তো, কচি কচি ছেলেগুলোর মাথা খেয়ে, না না মাথা খেয়ে নয়, লন্ড খেয়ে। হ্যাঁ কচি কচি ছেলেগুলোর লন্ড খেয়ে ছেলেগুলোর ভবিষ্যৎ অন্ধকার করতে চাইছে কেন? তুই হারামী আবার এটা বলিস না যে তোর বৌয়ের এমন স্বভাবের কথা তুই জানিস না। অবশ্য তোর বৌ কার সাথে কবে কোথায় মাড়ায়, তা নিয়ে তোর কোনও মাথাব্যথা নেই। তুই তো এটাও জানিস না যে তোর বেশ্যা বৌটা এখন ঠিক এই মূহুর্তে তার ওই হারেমে তিন তিনটে কচি ছেলের সাথে প্রাণভরে চোদাচুদি করছে। শালী সন্ধ্যে ছ’টা থেকে দু’ঘন্টা ধরে ওই ঘরেই আছে সে। ওই তিনটে ছোড়া মিলে তোর বৌটার নাজানি আজ কী দশা করে ছাড়বে। আচ্ছা তুই কি ভাবছিস, আমি তোকে মিথ্যে কথা বলছি? তোর ল্যাপটপের ব্যাগের ভেতর আমার পাঠানো তিন নম্বর সিডিটা পেয়ে যাবি। সেটা চালিয়ে দ্যাখ। তাহলেই তোর বিশ্বাস হবে। আর শোন, এটার ছোট ক্লিপটা আর তোকে পাঠালাম না। আসলে সময় হল নারে। তাই কিছু মনে করিস নে। একেবারে অরিজিনালটাই দেখে নে। ওহ, আরেকটা কথা বলতে ভুলেই গেছি রে। এই ভিডিওটা সতেরো তারিখ রাত ঠিক ন’টায় ইন্টারনেটে আপলোড করব। তোর আর তোর বৌয়ের এমন অসাধারণ চোদাচুদির ছবি নেটে দিয়ে আমার অনেক টাকা ইনকাম হবে। তবে তোকে না জানিয়ে এসব করা তো ঠিক নয়। তাই তোকে আগে ভাগেই সব জানিয়ে দিচ্ছি। যাতে পরে তুই আমাকে কোন দোষ দিতে না পারিস। অবশ্য শুধু এই তিনটেই নয়। আমার কাছে এমন আরও অনেক ভিডিও আছে তোদের সকলের। সকলের মানে তোর ছেলেরও এমন সব ভিডিও আমার কাছে আছে। সে’সব অবশ্য আজ আর পাঠাচ্ছি না। আজ এটাই শেষ। তবে কবে কোনটা নেটে আপলোড করব সেটা তোকে ঠিক সময়ে জানিয়ে দেব। আর তুই যে তোর অফিসেই আছিস এখন সেটাও তো জানি। তোর অফিসের শেষ দুটো ছেলে তো এইমাত্র বেরিয়ে গেল। তুই তোর সেক্রেটারীকে নিয়ে এত রাতেও তোর চেম্বারে আছিস। কী করছিলি এতক্ষণ? তোর সেক্রেটারী মাগিটাকে চুদছিলি নাকি? অবশ্য তোর সেক্রেটারীটাও একটা জব্বর মাল। এক কাজ কর আমার কথা না ভেবে তুই বরং নিশিতাকেই এক কাট চুদে নে এখন। মনটা একটু ভাল হবে। আজ সারাদিন তোর যা টেনশনে কাটল। অবশ্য এটাও মনে হচ্ছে যে তোর লন্ড টেনশনে আজ বোধহয় খাড়াই হবে না। সেটা হলে তো চুদতেও পারবি না। তবে আমার একটা কথা ভাল করে মাথায় রাখিস। তোর বৌটাকে আগামি তিন চার দিনের ভেতর একটু চুদে নিস। অনেকদিন ধরে তো তুই তাকে চুদিস না। আমার কথা মত দু’ একদিনের মধ্যেই চুদে দেখ। সত্যি আরাম পাবি। কারন তোর মাগী বৌটা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী এক্সপার্ট হয়েছে চোদাচুদিতে। একবার করেই দ্যাখ, আমার কথা সত্যি কি না। তবে এখন না চুদলে কিন্তু সারা জীবন পস্তাবি। এমনও হতে পারে যে আর কয়েকদিন পর তুই চাইলেও তাকে চুদতে পারবি না। কারন তুই হয়ত জানিস না, কিন্তু আমি জানি। আর কয়েকদিন পর থেকেই তোর লন্ড আর কোনদিন খাড়াই হবে না। আর লন্ড খাড়া না হলে মাগী চুদবি কেমন করে? হে হে হে” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

অনেকক্ষণ আগেই নিশিতা সিডিটা প্লে করেছিল। ফোনের কথা শুনতে শুনতে বিমল ল্যাপটপের উল্টো দিকে ঘুরে গিয়েছিল। তাই সে দেখতে না পেলেও, নিশিতা দেখছিল একটা বিছানার ওপর তার বসের স্ত্রী সবিতা ম্যাডাম আর একটা কম বয়সী ছেলের উদ্দাম যৌন সম্ভোগের চলন্ত দৃশ্য। ওদের দু’জনের কারো গায়ে এক চিলতে সূতো পর্যন্ত নেই। সেটা দেখে তার হঠাতই মনে হল, যে-ই এ সিডিগুলো পাঠাক না কেন, নিশিতাকে বিপদে ফেলা তার উদ্দেশ্য নয়। তার টার্গেট বিমল আগরওয়ালাই। এ’কথা মনে আসতেই সে যেন কিছুটা স্বস্তি বোধ করল। কিন্তু সবিতা ম্যাম কার সাথে এমন করছে! ছেলেটাকে সে চিনতে পারল না। সে মনে মনে ভাবল, একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। তার বসের যেমন মাঝে মাঝেই আলাদা আলাদা মেয়ের সাথে এ’সব করতে ইচ্ছে করে, তেমনই তার স্ত্রীও আর ঘরে উপোষ করে থাকে না। সেও নিজের চাহিদা মেটাচ্ছে এভাবে। যেমন দেবা তেমন দেবী।

ফোনটা কেটে যেতেই বিমল পেছন ফিরে ল্যাপটপের দিকে চাইতেই সেই চলমান দৃশ্য দেখতে পেল। অমনি একলাফে ল্যাপটপের কাছে এসে ল্যাপটপটাকে বন্ধ করে দিয়ে “না নিশিতা, প্লীজ” বলে নিজের চেয়ারে বসে হাঁপাতে লাগল। তার মুখটা রক্তশূণ্য হয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছিল তার শরীরে শক্তির আর ছিঁটে ফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। ঘণঘণ বড়বড় শ্বাস নিতে নিতে সে ল্যাপটপের দিকে চোখ বিস্ফারিত করে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁপাতে লাগল।

নিশিতা হতভম্বের মত কিছুক্ষণ তার স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল। কারন ফোনের কথোপকথন সে নিজে কিছুই শুনতে পায়নি। বিমলকে ফোনটা কানে চেপে ধরে সে শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। একটা কথাও সে বলেনি। কিন্তু বিমলকে ওভাবে চিৎকার করতে দেখে, আর ল্যাপটপটাকে বন্ধ করতে দেখে সে বুঝে গেছে যে আরেকটা সাংঘাতিক ফোন কল অ্যাটেন্ড করেছে তার বস। বিমলকে দেখেই সে বুঝতে পারছিল সে এবার প্রচণ্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছে। নিশিতা এবার কোন কথা না বলে উঠে রেস্টরুমের ভেতর গিয়ে ঢুকল। আবার খানিক বাদেই এক গ্লাস জল নিয়ে ফিরে এল। জলের গ্লাসটা বিমলের মুখের সামনে ধরে বলল, “স্যার, আপনি আগে একটু জল খেয়ে নিন”।

বিমল যেন নিশিতার কথা শুনতেই পেল না। সে একই ভাবে স্থানুর মত বসে আছে ল্যাপটপটার দিকে তাকিয়ে। নিশিতা এবার বিমলের পিঠে এক হাত রেখে ডাকল, “স্যার”।

বিমলের শরীরটা এবার কিছুটা কেঁপে উঠল। ঘোলা চোখে মাথা ঘুরিয়ে নিশিতার দিকে চাইতেই নিশিতা আবার বলল, “এ জলটুকু খেয়ে নিন স্যার, প্লীজ”।

বিমল গ্লাসটা হাতে ধরতেই গ্লাসের জল কিছুটা ছলকে টেবিলের ওপর পড়ল। বিমলের হাত ঠকঠক করে কাঁপছে দেখে নিশিতা নিজেই আবার গ্লাসটাকে ধরে বিমলের মুখে ঠেকাল। বিমল চোঁ চোঁ করে প্রায় সবটুকু জলই খেয়ে ফেলল। খালি গ্লাসটাকে টেবিলের ওপর রেখে নিশিতা নিজের গায়ের শক্তি প্রয়োগ করে বিমলকে চেয়ার থেকে ওঠাতে ওঠাতে বলল, “স্যার, চলুন একটু রেস্ট নিয়ে নিন। তাহলে একটু ভাল লাগবে আপনার” বলে বিমলকে নিয়ে আবার রেস্টরুমে গিয়ে ঢুকল। বিমল পায়েও যেন জোর পাচ্ছিল না। তার সারাটা শরীরের ভারই যেন নিশিতার গায়ের ওপর পড়েছিল। নিশিতা অনেক কষ্টে বিমলের ভারী শরীরটাকে রেস্টরুমের বিছানায় শুইয়ে দিয়ে লাগোয়া ক্লোজেট থেকে একটা ন্যাকড়া নিয়ে চেম্বারের টেবিলে উপছে পড়া জল মুছে নিল। তারপর বাইরের দিকের দড়জাটা খুলে বাইরে উঁকি মেরে দেখল আর কেউ নেই অফিসে। যারা একটু আগেও কাজ করছিল, তারা নিশ্চয়ই কাজ শেষ করে চলে গেছে।

একটা স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে সে আবার দড়জাটা বন্ধ করে চেম্বারের ভেতর দিয়ে রেস্টরুমে এসে ঢুকল। বিমল তখন চোখ বুজে শুয়ে আছে। কিন্তু তার বুকটা হাপরের মত ওঠানামা করে প্রমাণ করছিল যে তার শ্বাস প্রশ্বাস এখনও স্বাভাবিক হয়নি। হাতের ন্যাকড়াটা আবার ভেতরে রেখে এসে নিশিতা বিমলের কাছে এসে তার বুকে আলতো করে হাত রেখে বলল, “স্যার, আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে”?

বিমল চোখ মেলে কয়েক মূহুর্ত নিশিতার দিকে চেয়ে থেকে দুর্বল কন্ঠে বলল, “একটু আমার মোবাইলটা এনে দাও তো”।
 

নিশিতা আবার চেম্বারে গিয়ে বিমলের মোবাইলটা এনে তার হাতে দিতে সে বলল, “এখন সিডিতে তুমি এইমাত্র যা দেখলে, সে ব্যাপারে কিন্তু কারো কাছে মুখ খুলবেনা তুমি নিশি”।

নিশিতা বিমলের কথার জবাবে বলল, “ছিঃ স্যার, আমাকে আপনি এই ভাবলেন? আপনি আমার স্যার। আমি তো আপনার কেনা গোলাম। ম্যামের ও’সব কথা কি আমি কাউকে বলতে পারি? এ’সব কথা বাইরে চাউর হলে আপনার মান সম্মান যে কোথায় তলিয়ে যাবে, আমি কি আর তা বুঝতে পারিনা স্যার? আপনার অফিসের এমপ্লয়ি হয়ে নিজের বসের আর তার পরিবারের বদনাম ছড়াব, একি কখনও সম্ভব স্যার? এ’সব কথা আমি আর আপনি ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার”।

বিমল আর কথা না বলে তার স্ত্রী সবিতাকে ফোন করল। কিন্তু অনেকক্ষন রিং হয়ে গেলেও কেউ সাড়া দিল না। একসময় থেমে গেল। রীতিমত বিরক্ত হয়ে সে আবার ফোন করল। এবারেও অনেকক্ষণ বেজে গেল ফোনটা। কিন্তু টাইম আউট হবার আগেই ও’পাশ থেকে সবিতার গলা ভেসে এল, “কী হল, এ’সময় .. আহ.. জারা রুক বেটা..... ওহ....ফোন করছ কেন? ... আরে আস্তে বেটা.... কী হয়েছে”?

বিমল রেগে জিজ্ঞেস করল, “জরুরী বলেই আমি তোমাকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছি এখন। আর তুমি আমাকে থামতে বলছ? আর আমাকেই বেটা বলছ? মদ খেয়ে কি পুরো আউট হয়ে গেছ নাকি? তোমার হাসব্যান্ড তোমাকে ফোন করছে এটাও কি বুঝতে পারছ না”?

ও’পাশ থেকে সবিতা শ্রান্ত কন্ঠে জবাব দিল, “আরে বাবা.... ওরে বাবারে.... বুঝব না কেন। বেটা.... আহ আহ.... বেটা কি আর তোমাকে....ওক ওক.... তোমাকে বলেছি নাকি? হাক.... আঃ....একজন আমার মুখে.... ওহ হায় রাম.... আমার মুখে তার লন্ড.... হায়.... রে... ওঃ.... লন্ড ঢোকাচ্ছিল, তাকে... আহ .. আআআআহ ..... তাকে থামতে বলেছি। ...আরি আঃ, এক মিনিট রুক না বেটা..... আহ... আর একজন খুব জোরে .....আহ হাহা আহ .....জোরে ঠাপাতে শুরু করেছিল, তাকে....উঃ উই মা ..... তাকে আস্তে করার কথা.....হাহাহায়.... বলেছি। ও’সব তোমাকে...ওহ....ওহ.... তোমাকে বলিনি। কিন্তু তুমি এখন... আহ উহ ..... কেন ফোন করেছ আমায়?....উহহু হাহ.... আর সময় পেলে না? পরে.... হাক আহ.... পরে কথা বোল”।
 

বিমলের বুঝতে বাকি রইল না তার স্ত্রী এখন কত ব্যস্ত। তবু সে নিজের স্বর সংযত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এক্ষুনি বাড়ি চলে এস। আর এক মূহুর্ত দেরী কোর না ওখানে”।

সবিতা হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল, “কী আবোল... উ মাহ ....আবোল তাবোল বকছ তুমি? অনেক দিন পর... হা হা ওক.... আজ এমন সুখ পাচ্ছি।... হাক হাক আআহ.. আমি ছ’টা থেকে তিনজনের..... হায় রাম.... হাহ.... তিনজনের সাথে আছি। তিন ঘন্টার... অহ ওওহ......তিন ঘন্টার আগে আমি ছাড়া .... হোক হোক.... ছাড়া পাচ্ছি না আজ।.... উউউউহ ধীরে বেটা আহ আআআহ ....রাত ন’টায় আমাদের কাজ .... আআহা আহ .... কাজ শেষ হবে, তারপর .... ওহ ওওহ ... তারপর বাড়ি আসছি.... আহ উই মা ....” বলেই থেমে গেল।

কিন্তু ফোনের লাইনটা তখনও বিচ্ছিন্ন হয়নি। বিমল শুনতে পেল কেউ একজন বলছে “ধুর রাখ তো তোমার ফোন আন্টি। কাজের সময় এমন ডিসটার্ব কারো ভাল লাগে? নাও চোষো আমার ধোনটা। নইলে কিন্তু প্রতীকের লন্ডের সাথে সাথে আমার বাঙালী বাড়াটাও তোমার পোঁদে ঢুকিয়ে দেব। তখন কিন্তু....”।

আর শোনার ইচ্ছে হলনা বিমলের। সবিতা যে কত ভীষণভাবে ব্যস্ত আছে সেটা বুঝতে পেরেই সে ফোনটা কেটে দিল। নিশিতা এবার বেশ নরম স্বরে বলল, “স্যার একটা পেগ বানিয়ে দিই। মনে হচ্ছে এই মূহুর্তে আপনার একটা কড়া পেগ খাওয়া দরকার। আনব স্যার”।

বিমল চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, “হ্যাঁ নিশি, ঠিক বলেছ তুমি। যাও তো, বেশ কড়া করে একটা পেগ বানিয়ে আন। ব্র্যান্ডি এনো, ডাবল পেগ। একটা কড়া পেগ না খেলে আমার নার্ভ আর স্বাভাবিক হবে না মনে হচ্ছে”।

নিশিতা বিমলের কথা শুনেই পাশের ছোট ক্লোজেটটায় ঢুকে গেল। আর বিমল আজ সারাদিনে ওই অজানা লোকটা তিনবার তাকে ফোন করে কি কি কথা বলেছে সে’সব ভাবতে লাগল। লোকটা যেই হোক না কেন তাকে যে খুব সহজে খুঁজে পাওয়া যাবে না এটা সে বুঝে গেছে। কিন্তু কিছু না কিছ তো তাকে করতেই হবে। হাত গুটিয়ে বসে থাকা তো যাবে না। সবিতা এখনই হোটেল থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে না। লোকটা যে ফোনে মিথ্যে বলেনি তার প্রমান তো সে পেয়েই গেল। সবিতা নিজে মুখেই তো বলল, সে তিনজনকে সাথে নিয়ে সন্ধ্যা ছ’টার দিকে তার হোটেলের রুমে ঢুকেছে। আর ওই তিনজনের মধ্যে তাদের ছেলের বয়সীও কেউ নিশ্চয় ছিল যে সবিতাকে আন্টি বলে ডাকছিল। আর সবিতাও তো কাউকে বেটা বেটা বলছিল। ওই হোটেলের রুমেও যে ভিডিও রেকর্ডিং করা হয়েছে তা তো চাক্ষুসই দেখল সে। আর শুধু সেই নয়। নিশিতাও দেখেছে। তার বসের স্ত্রী যে কতখানি বদ চরিত্রের সেটা আর নিশিতার জানতে বাকি রইল না। অবশ্য এখন আর সবিতাকে হোটেল থেকে বের করে আনলেই বা কি হবে। যা হবার তা তো হয়েই গেছে। লোকটা নাজানি কতদিনের রেকর্ডিং করেছে ও ঘরে। তবে তার অফিসের রেস্টরুম আর ফার্ম হাউসের মতই ওখানকার ক্যামেরা গুলোও যে আগেই সরিয়ে ফেলা হয়েছে, এ ব্যাপারেও আর সন্দেহ নেই। ওখানে তল্লাসি করে এখন আর কিছুই পাওয়া যাবে না আর। তাই এখন আর ওই রুমেও কোন ক্যামেরা নেই। করুক, সবিতা তার কাজটা পুরো করেই আসুক। কিন্তু তার মনে আরেকটা সন্দেহ উঁকি মারল। সবিতার হোটেলের ওপর এখনও কেউ নজর রেখে যাচ্ছে। নইলে ওই লোকটা কি করে এই মূহুর্তের সঠিক জানকারি তাকে দিতে পারল।

নিশিতা দু’হাতে দুটো মদের গ্লাস এনে একটা গ্লাস বিমলের হাতে দিয়ে নিজের গ্লাসের সাথে মৃদু ঠোকা দিয়ে প্রায় অস্ফুট স্বরে ‘চিয়ার্স স্যার’ বলল। বিমল গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক ঢোকেই প্রায় অর্ধেকটা গ্লাস খালি করে ফেলল। নিশিতা সামান্য সাবধানবানী শোনাল, “আহ, কি করছেন স্যার। ধীরে ধীরে খান”।

বিমল এবার ধীরে ধীরে সিপ করতে শুরু করল। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তার গ্লাস খালি হয়ে গেল। নিশিতা পরিস্থিতির গম্ভীরতা বুঝে খুব আস্তে আস্তে সিপ করছে। সে জানে আজ দু’জন একসাথে বেহেড হয়ে গেলে বিপদ আরও বাড়বে। বিমল নিজের খালি গ্লাসটা নিশিতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে আগের চেয়ে একটু সতেজ ভাবে বলল, “আরেকটা এ’রকম বড় আর কড়া পেগ বানিয়ে আনো”।

নিশিতা কিছু বলতে চেয়েও বলল না। গ্লাস নিয়ে গিয়ে আবার আগের মতই একটা পেগ বানিয়ে এনে বিমলের হাতে দিল। এবার আর বিমল তাড়াহুড়ো করল না। ধীরে সুস্থে খেতে খেতে বলল, “একটা খুব বড় বিপদের সম্মুখীন হয়েছি আমি নিশি। লোকটা খুব ভাল করে আটঘাট বেঁধে আমার পেছনে লেগেছে। কিন্তু আমিও এত সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নই। ওকে খুঁজে বের করে ওকে চরম শাস্তি দেব আমি। ওর জীবনের শেষ দিন খুব শিগগীরই আসবে”।

নিশিতার এবার মনে হল তার স্যার বোধহয় নার্ভ ফিরে পাচ্ছেন। তাই সে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু স্যার, এই এস এম খান লোকটা কে? তাকে কি চিনতে পেরেছেন”?
 

বিমল এবার রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “ওর চৌদ্দ পুরুষের সব ক’টাকে খুঁজে বের করব আমি। আমার পেছনে লাগা? ওর পুরো খানদানকেই আমি পরপারে পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা আমি যাবার পর তুমি কাকে কাকে কোন দায়িত্ব দিয়েছিলে, সেটা বল তো শুনি”।


(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply




Users browsing this thread: 6 Guest(s)