Thread Rating:
  • 43 Vote(s) - 3.26 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram
#41
সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#02)

বুকের মাঝে সযত্নে লুকিয়ে রাখা বাঁধ ভেঙ্গে যায়, বুক কাঁপিয়ে কান্না বেড়িয়ে আসে চোখের কোল থেকে। মায়ের চোখের আড়াল করে কোন সন্তান তাঁর দুঃখ লুকিয়ে রাখতে পারে না। আমি ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আমার বুকের বেদনা ধরে রাখতে পারিনা আমি। আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম মায়ের মতামত জানার জন্য। মা আমার মাথায় হাত স্পর্শ করেন আমি মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি। আমার বুকের কান্না মায়ের কাছে আমার ব্যাথার কাহিনী ব্যক্ত করে দেয়। মা চুপ করে থাকেন, আমি কাঁদতে থাকি। মা আমাকে সেইরাতে নিজের কাছে শুতে বলেন। আমি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি। 

মা আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলেন, “জগতের অনেক কিছু আছে যে গুলো মেনে নেওয়া অসম্ভব। আমি সর্বদা তোর হাসি মুখ দেখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই খুশি যে এইরকম ভাবে আমার সামনে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতে পারিনি। আমাদের সমাজে অনেক নিয়ম কানুন আছে, তাঁর মধ্যে অনেক কিছু আছে যে গুলো সমাজ মেনে নিতে পারেনা।”

আমি কেঁদে জিজ্ঞেস করি, “আমি কি করব মা?”

মা, “সময়ের ওপরে ছেড়ে দে, পরী। সময় বড় বলবান।”

আমি ডুকরে কেঁদে উঠেছিলাম, “কেন মা কেন? আমার জীবনে আজ পর্যন্ত যা এসেছে তাই আমি মুখ বুজে মেনে নিয়েছি, আমি তোমাকে বা দিদিদের কোনদিন প্রশ্ন করিনি যে কেন তোমরা আমাকে ঠিক ভাবে দেখনি।”

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পরে মা উত্তর দেন, “পরী, আমাকে কিছু সময় দে ভাবার জন্য। এখুনি আমার মাথায় কিছু কাজ করছে না, আমার কিছু সময় চাই।”

আমি প্রায় বুক ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিলাম, “না মা, আমি এখুনি জানতে চাই যে আমি এখন কি করব?”

মা আমাকে শান্ত করে পাশে শুয়ে পড়েন। বিছানার একপাসে আমি, অন্য পাশে মা। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনি। মায়ের কাছেও আমাদের সম্পর্কের কথা আর লুকিয়ে থাকে না। আমি ভেবে কুলকিনারা পাইনা যে মায়ের উত্তর কি হবে, মা কি মেনে নেবেন আমাদের সম্পর্ক না মা ছোটমায়ের মতন এবারে আমাকে বহিস্কার করে দেবেন। সারা রাত মা ঘুমাতে পারেন না, সারা রাত দুজনে ঘুমানোর ভান করে নিজের নিজের চিন্তায় ডুবে ছিলাম।

সকাল বেলার রোদ পুব আকাশে উঁকি মারে। মা আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, “তুই সারা রাত ঘুমোস নি।”

আমি শান্ত গলায় বলি, “কি করে ঘুম আসে, মা।”

মা বিছানায় উঠে আমার দিকে ফিরে বললেন, “আমার মনে হয়, তোর ছোটমা আর বাবু এই ঘটনায় খুব মর্মাহত হয়েছেন। তারা দুজনেই অনেক রেগে আছেন এখন।”

দুরে আম গাছের বাগানের পেছন থেকে নবীন ঊষার আলো উঁকি দিচ্ছে। মা বললেন, “আগে তোর এমএসসি শেষ হোক, অভিমন্যু তোর সাথে যোগাযোগ করুক। আমাকেও কিছু সময় দে আর তোর ছোটমা আর বাবুকেও কিছু সময় দে। সময় যে বড় বলবান, সব ঘায়ের মলম সময়। সময়ের সাথে সাথে সবার রক্ত, সবার রাগ কমে আসবে। তুই ও বুঝতে পারবি তোরা কি করেছিস, তোর ছোটমাও বুঝতে পারবে ধিরে ধিরে। তোর ছোটমা, তাঁর একমাত্র ছেলেকে এই পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছে, তাঁর বুকের বেদনা একটু বুঝতে চেষ্টা করে দেখ, তুই যাতে বড় হতে পারিস সেই জন্য তোর ছোটমা এই সব করেছে। সঠিক সময়ে সব কিছু সঠিক হবে।”

আমি শান্ত গলায় উত্তর দেই, “ছোটমা আর বাবু আমাকে খুব ভালবাসে আর সেই কথা আমি মনে প্রানে জানি। কিন্তু আমার মন রাখার জন্য ছোটমা কোনদিন নিজের আত্মসন্মান বলিদান দেবেন না।”

বুকের মাঝে ধরে রাখা এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা আমাকে বলেন, “পরী, সময়ের চেয়ে বলবান কোন ওষুধ আজ পর্যন্ত জগতে নেই। সময় সব ব্যাথা বেদনার মলম, সেটা মনের হোক বা শরীরের হোক। আমাকে কথা দে, যে তোর এমএসসি শেষ হওয়া পর্যন্ত তুই এই নিয়ে কারুর সাথে কোন কথা বলবি না। আমরা আমাদের ভবিতব্য বদলাতে পারিনা পরী, কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে পারি। তোর এমএসসি শেষ হোক আগে, অভি দেশে ফিরে আসুক। অভিকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস, তারপরে আমি দেখি কি করতে পারি।”

আমি মাকে দুহাতে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরেছিলাম, শেষ পর্যন্ত আমার মা আমাদের ভালবসার প্রতি বিরূপ না হয়ে মেনে নেন, সেটাই আমার সব থেকে বড় সম্বল ছিল। মা আর আমি দুজনেই কেঁদে ফেলেছিলাম। মা আমাকে বললেন, “আমার সেদিন বুঝে নেওয়া উচিত ছিলরে, ওইদিন পুজোর ঘরে আমার কাছে আমার খেলার পুতুল চেয়েছিল।”

আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হেসে বলেন, “এবারে খুশি? এবারে হাস, আর কথা দে পরশুনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই কথা আর মুখে আনবি না।”

আমি সেদিনের পর থেকে অনেক খুশি, আমার মা আমাদের সম্পর্ক মেনে নেন। মনের মধ্যে নতুন শক্তির সঞ্চার হয়, আমি যেন সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। চোখের দুষ্টুমি ফিরে আসে, গালের লালিমা ফিরে আসে, একবার মনে হয় যেন সেই পুরানো পরী ফিরে এসেছে আমার মধ্যে। বুকের মাঝের সেই অনন্ত কালো শূন্যতা যেন ভরে যায় মায়ের কথায়।

একদিন আমি বাড়ির পেছনের বাগানের ভেতর দিয়ে হেঁটে জাছচিলাম মাথের দিকে। গ্রীষ্ম কালের পড়ন্ত রোদ পশ্চিম আকাশে, আমের বাগানে মাএর গন্ধে মম মম করছে, কাঁঠাল গুলো গাছের গুঁড়ির সাথে ঝুলে আছে, লিচু গাছে লাল লাল লিচু ভর্তি। ফলের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা তার সাথে আমার মনের আমেজ মাতোয়ারা। আমি পুকুর পাড়ের সেই ওর পোঁতা আমের গাছের দিকে হেঁটে গিয়েছিলাম। সেই আম গাছের গুঁড়ি ছুঁতেই এক দমকা হাওয়া এসে আমার মুখে লাগে, আমার যেন মনে হয় ও আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার গালে হাত রেখে। আমি আম গাছের দিকে তাকিয়ে থাকি, কাঁচা পাকা আমে ভর্তি সেই আমের গাছ। 

আমি গাছ খানা জড়িয়ে ধরে ওর কানে কানে বলেছিলাম, “তোর মনের মানুষ তোর জন্য আসছে একটু সবুর কর।”

আমার হৃদয় সপ্তম আসমানে ছিল, মা আমার ভালোবাসার প্রতি বিরূপ হননি। কিন্তু মায়ের সাবধান বানী আমার কানে বাজে, এমএসসি শেষ করার আগে যেন আমি আমার মনের ভাব কাউকে খুলে না জানাই। আমি সেই মিলন বেলার অধির প্রতীক্ষা করেছিলাম। মৈথিলী বুঝতে পারে আমার গালের লালিমা ফিরে এসেছে।

একদিন বিকেলে আমি ছাদে দাঁড়িয়ে আম খাচ্ছিলাম, এমন সময়ে মৈথিলী এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। আমার দিকে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করে, “খুব খুশি মনে হচ্ছে?”

আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করি, “কেন, আনন্দে থাকা কি পাপ, আমি আমার বাড়িতে অনেক দিন পড়ে এসেছি তাই আমি খুশি।”

মৈথিলী, “হুম, মনে হচ্ছে অভিমন্যুর খবর এসেছে, তাই না।”

আমি ওকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম সেদিন, “হ্যাঁ, এসেছে।”

মৈথিলী, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি কি?”

অনেক দিন ধরেই আমি অপেক্ষা করছিলাম সেই প্রশ্নের, আমি মাথা নাড়াই, “জিজ্ঞেস করো।”

মাথা নিচু করে, পায়ের নখে ছাদের মেঝে খুঁটতে খুঁটতে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “ওকে একবার জিজ্ঞেস করত ও কি চায় আমাদের কাছ থেকে?”

আমি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “কেন, তুমি ভালো করে জানো ও কি চায় আবার সেই প্রশ্ন কেন? যাই হোক, এখন ও দেশের বাইরে, যখন আমাকে ফোন করবে আমি জিজ্ঞেস করে নেব।”

মাথা নাড়ায় মৈথিলী, “ঠিক আছে।”

আমি ওকে আশস্ত করে বলি, “পরের বার ফোন করলে আমি বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়ে দেব, তুমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলে নিও।”

আমার বুকের মাঝে এক নতুন সাহস জেগে ওঠে, আমি যেন সেইসময়ে অপরাজিতা ছিলাম।

এক রাতে আমি বিছানায় শুতে যাবো, এমন সময়ে দুষ্টু এসে বায়না ধরে পিসি একটা গল্প বলো। বেশির ভাগ দিন আমি ওকে ডায়রিতে লেখা ওর কবিতা গুলি দুষ্টুকে পড়ে শুনাতাম, অনেক কবিতার কোন মাথা মুন্ডু থাকত না, পড়তে পড়তে দুজনেই হেসে ফেলতাম। দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করত, যে এই সব গালগল্প কে লিখেছে। আমি ওকে বলতাম যে ওর অভি কাকু যখন ছোটো ছিল তখন এই সব গালগল্প লিখত।

দিন কেটে যায়, গরমের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে আসে। এর মাঝে ছোটমা ফোন করে জানায় যে ছুটির শেষে আমাকে নিতে আসবে। ছোটমায়ের কথা শুনে একটু মন খারাপ হয়ে যায়, আবার মাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “মা এবারে আমার সাথে ওই বাড়ি চলো।”

মা আমাকে উত্তর দিয়েছিলেন, “তোর কাছে তোর ছোটমা আছে কিন্তু সুমন্তর এই জগতে আর কেউ নেই, আমি চলে গেলে ওকে কে দেখবে রে, তাই আমি কোথাও যেতে পারিনা।”

দমদমের বাড়িতে ফিরে যাবার ঠিক একদিন আগের রাতে, দুষ্টু আমার কাছে এসে গল্প শোনার বায়না ধরে। আমাকে আদর আর অভিমান করে জিজ্ঞেস করে, “পরের পুজোতে অভি কাকুকে বাড়িতে আসতে বলবে।”

আমি ওর দিকে মিষ্টি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “ঠিক আছে বলে দেব, কিন্তু একটা সর্তে।”

আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে দুষ্টু। আমি ওকে বলি, “তুই আমাকে তোর অভির কাকুর শুনান গল্পটা যদি বলিস তাহলে।”

আমার গালে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে শয়তান ছেলে আমাকে বলে, “ও ওই গল্পটা, সে গল্পত আমি ভুলে গেছি।”

আমি ওর দিকে মৃদু অভিমান করে তাকিয়ে বলি, “তাহলে তোর অভি কাকুকে সঙ্গে নিয়ে আসছি না।”

এই বলে আমি ওকে কাতুকুতু দিতে শুরু করি। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে দুষ্টু, শেষ পর্যন্ত আমাকে সেই গল্প বলে। আমার বাম হাত বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে আমার পাশে শুয়ে গল্প শুরু করে।

“অনেক অনেক দিন আগের কথা, এক দূর দেশে এক পরীর দেশের রানী থাকতেন। তাঁর কুঠিরের চারপাশ অনেক উঁচু উঁচু গাছে ঘেরা আর একপাসে অনন্ত ঘাসের মাঠ। পরীরানীর কুঠিরের পেছনে একটা ছোট্ট জলাশয় ছিল, সেই জলাশয়ে পদ্ম শালুক আরও অনেক জলের ফুল ফুটে থাকতো। কুঠিরের সামনের ফুলের বাগানে অনেক রঙ বেরঙের ফুল ফুটে থাকে, সেই ফুলের মধু খেতে রোজ নানান রঙের পাখিরা উড়ে আসত আর তাঁর সাথে নিয়ে আসত মৌমাছি আর ভ্রমর। একদিন সেই জলাশয়ে পরী রানী লক্ষ্য করেন যে একটা ছোট্ট পদ্মের কুঁড়ি ফুটে আছে। বেশ কিছু দিন যায়, সেই পদ্মের কুঁড়ি আর ফুলে পরিনত হয় না। অনেক ভেবে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি নিজের কুঠিরে নিয়ে আসেন আর একটা কাঁচের গামলায় জল দিয়ে রেখে দেন। রোজ সকালে পরী রানী সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ির ওপরে শিশিরের জল, মিষ্টি মধু আর দুধ ঢেলে দিতেন যাতে সেই কুঁড়ি একদিন ফুলে পরিনত হয়ে উঠতে পারে।”

“এইভাবে দিন কেটে যায়। একদিন সকাল বেলা পরী রানী ঘুম থেকে উঠে দেখেন যে কাঁচের গামলায় সেই পদ্ম ফুলের কুঁড়ি আর নেই, সেই জায়গায় একটা ছোট্ট মিষ্টি পরী শুয়ে সকালের মিষ্টি রোদের সাথে খেলা করছে। ত্বকের রঙ দুধে আলতা, মাথায় ঘন কালো চুল। পিঠের ওপরে ছোটো ছোটো দুটি রঙ বেরঙের পাখনা। ছোট্ট দশ আঙুল দিয়ে সেই ছোট্ট পরী কাঁচের গামলা আঁচরে দেয়, বার বার সেই কাঁচের গামলা ছেড়ে বেড়িয়ে আসার চেষ্টা করে। ছোট্ট দুটি নীল চোখে আসে পাশের নতুন পৃথিবী দেখে জুলু জুলু করে। পরী রানী আনন্দে কেঁদে ফেলে। তাঁর সযত্নে রাখা পদ্মের কুঁড়ি একটা ছোট্ট পরী হয়ে গেছে। পরী রানী সেই ছোট্ট পরীকে কাঁচের গামলা থেকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরী রানী রোজ দিন সেই ছোট্ট পরীকে মধু আর শিশিরের জল খেতে দিতেন, তার সাথে দিতেন নানান মিষ্টি ফল।”

“দিনে দিনে সেই ছোট্ট পরী বড় হয়ে এক সুন্দরী পরী হয়ে যায়। সেই সুন্দরী পরীর ডানা অনেক বড় আর প্রচুর রঙ্গে মাখা। ঝলমলে ডানা যেন সাত রঙের রামধনু নিয়ে আসে সেই কুঠিরে। কিন্তু পরীর ডানা বড় হলেও ওর উড়ে যাওয়ার মতন শক্তি ছিলনা। পরী রানী পরীকে উড়তে শেখায় না কোনদিন। পরী রানী চাইতেন না, যে পরী তাকে ছেড়ে চলে যাক। সেই সুন্দরী পরী কুঠিরের সামনের মাঠে খেলা করত সূর্যের আলোয় স্নান করত। সামনের ফুলের বাগানে ফুলের দেখাশুনা করত। রোজ সকালে ঘাসের ডগা থেকে শিশিরের জল নিয়ে খেত আর বাগানের মিষ্টি ফল খেত। মৌমাছিরা ওই পরীর জন্য দূর দুরান্ত থেকে মধু যোগাড় করে নিয়ে আসত। দিনে দিনে সেই সুন্দরী পরীর মাথার ঘন কালো চুল কাঁধ ছাড়িয়ে মাটিতে নেমে আসে। বাগানের ফুল গেঁথে পরী নিজের গলার মালা আর হাতের বাজু বানিয়ে নিজেকে সাজিয়ে রাখত।”

“একরাতে পরী রানী কোন এক কাজে কুঠির ছেড়ে বাইরে চাঁদের আলোয় ঘুরতে গিয়েছিলেন। সুন্দরী পরী, কুঠিরে একা, রাতে ঘুম আসেনা দুই কাজল কালো চোখে। জানালার ধারে বসে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল পরী। ঘন নীল আকাশের বুকে শত সহস্র তারা উঁকি মেরে ওকে যেন ডাক দেয়। এমন সময়ে কোন আওয়াজ শুনে সুন্দরী পরীর ধ্যান ভেঙ্গে যায়। আসেপাসে তাকিয়ে দেখে কিন্তু কোথাও কাউকে দেখতে পায়না। চুপিচুপি দরজা খুলে বাইরে তাকায় পরী, দরজার সামনে একটা অতি সুন্দর শ্বেত শুভ্র ঘোড়া দাঁড়িয়ে। ঘোড়া দেখে অবাক হয়ে যায় সুন্দরী পরী, ভেবে পায়না কি করা উচিত। সুন্দরী পরী সেই ঘোড়ার কাছে এসে ওর ঘাড়ে হাত রেখে আদর করে দেয়। ঘোড়া ওকে দেখে চিঁহি করে ডাক ছাড়ে, ডাক শুনে ভয় পেয়ে যায় পরী, পেছনে সরে আসে। কিন্তু সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া সুন্দরী পরীর গালে নিজের ঘাড় ঘষে আসস্থ করে যে ওর কোন ভয় নেই। সুন্দরী পরী ঘোড়াটাকে কুঠিরের ভেতরে নিয়ে আসে। ঘোড়ার দিকে দীর্ঘকাল ধরে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে সুন্দরী পরী। একসময়ে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।” 

“সকাল বেলার প্রথম সূর্যের আলো সুন্দরী পরীর পায়ের কাছে এসে লুটপুটি খায়, পায়ে নতুন ঊষার আলোর উষ্ণতা পেয়ে জেগে ওঠে সুন্দরী পরী। কাজল কালো চোখ মেলে দেখে একটা সুদর্শন যুবক বসে আছে ওর কাছে আর সেই শ্বেতশুভ্র ঘোড়া কুঠিরের ভেতরে নেই। সেই সুদর্শন যুবক কে দেখে ভয় পেয়ে যায় পরী, ভয়ে চিৎকার করতে চেষ্টা করে, ঠিক সেই সময়ে সেই যুবক পরীর ঠোঁট চেপে ধরে চিৎকার করতে বারন করে। ভয়ে জড়সড় হয়ে কুঠিরের এক কোনে বসে থাকে পরী, ভেবে পায়না, কি করে সেই ঘোড়া উধাও হয়ে গেল আর তার জায়গায় এই সুদর্শন যুবক কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করল।”

“সেই সুদর্শন যুবক পরীকে জানায় যে ও একটা তস্কর, পরী রানীর কুঠিরে পরী রানীর জাদুর পুতুল চুরি করার জন্য এসেছিল। কিন্তু জানালা দিয়ে সুন্দরী পরীকে দেখে সেই জাদু পুতুলের কথা ভুলে যায়। রুপ বদলে এক শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে কুঠিরের ভেতরে প্রবেশ করার জন্য। সুন্দরী পরী ওই সুদর্শন যুবকের কথা মন দিয়ে শোনে। সুদর্শন যুবক সুন্দরী পরীকে জিজ্ঞেস করে যে পরী উড়তে চায় কিনা। উড়ে ওই উঁচু গাছের জঙ্গল পেরিয়ে দূর দেশে পারি দিতে চায় কিনা, শুনতে চায় কি ভাবে নদী নিজের খেয়ালে গান করে আর নেচে নেচে পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলে? সুন্দরী পরী সেই সুদর্শন যুবকের গুরু গম্ভির গলার স্বর শুনে মোহিত হয়ে যায়। পরী মৃদু মাথা নাড়িয়ে নিজের ইচ্ছে প্রকট করে, উড়ে বেড়াতে চায়।”

“সেই সুদর্শন তস্কর পরীকে একটা মখমলের কাপরে জড়িয়ে নিয়ে কুঠিরের মেঝে খুঁড়তে শুরু করে। খুঁড়ে চলে তস্কর, সেই বিশাল ঘাসের ময়দানের নিচ দিয়ে, সেই ঘন জঙ্গলের নিচ দিয়ে। এক সময়ে জঙ্গল অতিক্রম করে অন্য পাশে বের হয় যায় দুইজনে। সামনে উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড় দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সুন্দরী পরী।”

“সুদর্শন তস্কর সুন্দরী পরীকে কে জিজ্ঞেস করে ও উড়তে চায় কি না? সুন্দরী পরী মাথা নাড়ায়, কিন্তু জানায় যে ও উড়তে জানেনা। সুদর্শন তস্কর পরীকে কোলে নিয়ে হাওয়ায় ছুঁড়ে দেয়, পরী প্রাণপণে ডানা মেলে ধরে, বারেবারে পাখনার ঝাপটা মেরে উড়তে চেষ্টা করে, কিন্তু উড়তে সক্ষম হয় না। পরী পরে যায় আর সুদর্শন তস্কর ওকে মাটিতে পড়ার আগেই কোলে ধরে ফেলে। কিছু পরে সুদর্শন তস্কর আবার পরীকে কোলে করে নিয়ে আকাশে ছুঁড়ে দেয়, এইবারে পরী নিজের পাখা মেলে উড়ে যায়। উড়তে উড়তে অনেক উপরে উঠে যায় সুন্দরী পরী, নিচে তাকিয়ে দেখে সেই সুদর্শন তস্কর রুপ বদলে শ্বেতশুভ্র ঘোড়ার রুপ ধারন করে ঘাসের মাঠের ওপরে দিয়ে পাহাড়ের দিকে দৌড়াতে থাকে। পরী উড়তে উড়তে সেই বরফ ঢাকা পাহারে চলে যায় আর সেই শ্বেতশুভ্র তস্কর পরীর ছায়া অনুসরন করে পাহাড়ে দিকে চলে যায়।”

গল্প শেষ করে দুষ্টু আমাকে জিজ্ঞেস করে, “গল্প এখানে শেষ, তুমি জানো এরপরের ওদের কি হয়?”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কেন, গল্প কি এখানে শেষ?”

মাথা নাড়ায় দুষ্টু, “হ্যাঁ, অভি কাকু এই পর্যন্ত গল্প শুনিয়েছে।”

আমি গল্পের কথা ভাবি, এই গল্প আমার হৃদয় তস্করের, সেই তস্কর পরী রানীর কাছ থেকে সুন্দরী পরীকে চুরি করে সুদূর পাহাড়ে চলে যায়। সেই তস্কর পরীকে উড়তে শেখায়। হ্যাঁ, পরী তারপরে উড়তে শেখে, কিন্তু উড়তে উড়তে একসময়ে নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে যে সেই তস্কর আর নেই। একবার ভাবে সেই তস্কর হয়ত ওর জন্য খাবার আনতে গেছে, অপেক্ষা করে পরী, কিন্তু সেই তস্কর ফেরে না। 

আজও অপেক্ষা করে আছে সেই সুন্দরী পরী তার প্রানের সুদর্শন তস্করের জন্য।

আমি দুষ্টুর টোপা গাল টিপে বলেছিলাম, “এখন ঘুমিয়ে পর, আমি অভি কাকুকে বলে দেব, পরের বার এসে ও যেন তোকে বাকি গল্প টুকু বলে দেয়।”
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#42
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#01)

গরমের ছুটির পরে ছোটমা আমাকে দমদমের বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আসেন। বিদায় বেলায় মায়ের চোখে জল ছিল। প্রতিবারের মতন বাবু গাড়ি পাঠিয়েছিলেন আমাকে আর ছোটমাকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ি ফেরার সময়ে ছোটমা আমাকে ছুটি কেমন কেটেছে সেই সব কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, যে আমি যখন বাড়ি ছিলাম না তখন ছোটমায়ের কেমন লেগেছে।

ছোটমা আমার গালে হাথ বুলিয়ে উত্তর দেন, “তুই না থাকাতে ঘর অনেক খালি খালি লাগছিল রে।” আমি ছোটমাকে জড়িয়ে ধরি, ছোটমা আমার পিঠে হাথ দিয়ে আদর করে জিজ্ঞেস করেন, “কি হল রে?”

আমি উত্তর দিলাম, “তোমার কথা খুব মনে পড়ত, তাই।”

ছোটমা, “সামনে কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষা এবারে কিন্তু ঠিক ভাবে পড়াশুনা করতে হবে।”

কলেজ শুরু হয়ে যায়, দিনের পর দিন কেটে যায়। ওর কোন খবর আসে না, যতদিন যায় আমি তত বেশি বিচলিত হয়ে উঠি। অশান্ত হৃদয়কে নিজেই শান্তনা দিতাম, আসবে হয়ত একদিন ওর খবর। সেই চিন্তা থেকে দুরে পালাবার জন্য ডুবে গেছিলাম বইয়ের মধ্যে। 

জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহের কথা। আমার প্রথম বর্ষের পরীক্ষার ফলাফল এসে গেছে, আমি ভালো অঙ্কে উত্তীর্ণ হয়েছি। বাবু ছোটমা দুজনেই বেশ খুশি আমার ভালো ফলাফল দেখে। সেদিন সকাল থেকে বৃষ্টি পড়ছিল। ঠিক এক বছর আগে, এইরকম একদিনে সে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল। বাবু আর ছোটমায়ের আচরন বদলে যায় সেদিনে। আমি বুঝতে পারি যে তাদের একমাত্র সন্তানের কথা মনে পড়ছে। আমার মন খুব ভারাক্রান্ত ছিল সেদিন। আমি সেদিন বুঝতে পারি যে আমি তাদের ঔরস জাত সন্তান নই, একটি পোষ্যপুত্রী মাত্র। সেদিন কলজে থেকে ফেরার পরে বাবু আমার মোবাইল দেখতে চান, আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি তার কারন। কিন্তু পরে বুঝলাম যে বাবু আমার কল লগ দেখার জন্য আমার ফোন চেয়েছিলেন, দেখতে চেয়েছিলেন যে ও আমাকে ফোন করেছে কি না। 

আমি বাবুর হাথে ফোন ধরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লাম। বৃষ্টি অবিরাম ধারায় ঝরে, আকাশ বাতাস বারেবারে বজ্র বিদ্যুতের কম্পনে কেঁপে উঠে। কিছু পরে ছোটমা কলেজ থেকে ফিরে আসেন। আমি রান্না ঘরে রান্না করছিলাম। ছোটমা রান্না ঘরে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, আমি কেমন আছি। আমি মাথা নেড়ে জানাই যে আমি ঠিক আছি। আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছোটমা পেয়াজ কাটতে শুরু করেন। পেয়াজের ঝাজে না বুকের কান্না আমি জানিনা, কিন্তু ছোটমায়ের চোখে জল চলে আসে। আমি বুঝতে পারি একসময়ে যে ছোটমা তাঁর ছেলের কথা মনে করে কাদছেন, আমি ও সেই রাতে অনেক কেঁদেছিলাম। 

আমাকে নিচু গলায় ছোটমা বলেন, “পরী, জীবনে অনেক কিছু ঘটে যায় যার মানে আমরা বুঝতে পারিনা।”

আমি ছোটমায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি ছোটো বাচ্চা নই যে ছোটমায়ের মনের দুঃখ বুঝতে আমার কষ্ট হবে। 

সেই রাতে ছোটমা আর বাবু খুব চুপচাপ ছিলেন। রাতে খাওয়ার সময়ে শুধু মাত্র আমার কলেজের কথা ছাড়া আর কোন কথা হয়না। তাদের চিন্তিত মুখ আমাকে বড় অশান্ত করে তোলে। সেই রাতে আমি ওর “অপ্টিক্স নোটবুকে” অনেক ব্যাথা আর বেদনার কথা লিখে ফেলি। 

আমি সেই রাজকন্যে যার হাতের ছোঁয়ায় যে কোন বহুমুল্য বস্তু সোনার বদলে ছাইয়ে পরিনত হয়ে যায়। আমার জন্মের পরেই আমার বাবা দেহ রক্ষা করেন। আমার উচ্চ বিদ্যালাভের কারনে, ছোটমা আমাদের বাড়ি আসেন আর সেই সুত্রে অভিমন্যু আমার কাছে আসে। আমাকে ভালোবাসার ফল স্বরুপ বিতাড়িত হতে হয় এই বাড়ি থেকে, বিশাল পৃথিবীতে একা একা ঘুরে বেড়ায়। ছোটমা আর বাবু তাদের রক্ত মাংসের একমাত্র ছেলেকে হারায় আমার জন্য। আমার কি করা উচিত? আমি কোথায় যাবো? যে আট মাস আমার পাশে পাশে ছিল, আমার জীবনের সব থেকে আনন্দের সময় সেইদিন গুলি। সেই স্মৃতি সযত্নে রাখা হৃদয়ের এক কোনে। সেই সময়ে আমি ভেবেছিলাম যে ও পাশে থাকলে আমি পৃথিবী জয় করে নিতে পারি। কিন্তু এখন আমার পাশে নেই। এক শুচিস্মিতা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে আসে, পরী হয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করে। সময়ের সাথে আর বিধির লিখনে সেই পরী পরিবর্তিত হয়ে যায় এক নতুন মিতা। আর কি বাকি আছে আমার জীবনে, ভবিষ্যতে বিধি আর কি লিখে গেছেন আমার কপালে?

সেই দিন থেকে ছোটমা আর বাবুর সাথে আমার সম্পর্কে একটু চিড় ধরে। ধিরে ধিরে তাদের আচরনে বিরূপতা প্রকাশ পায়। দিন কেটে যায়, মাস চলে যায় কিন্তু ও আমার সাথে কোন যোগাযোগ করেনা। ধিরে ধিরে ওর স্মৃতি আমার মন থেকে মুছে যায়। সেই “অপটিক্স নোটবুক” খুব কম বের হত বইয়ের তাক থেকে। জীবনের পাঁকে নিজেকে ডুবিয়ে দিলাম, আশার আলো ধিরে ধিরে ম্লান হয়ে আসে চোখের সামনে। পড়াশুনার মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে মনের বেদনা ভুলে যেতে চেষ্টা করি। আমি চাইনি আমার জীবনের সাথে আর কারো জীবন প্রবাহ এসে মিশে যাক। প্রতি পদে পদে নিজেকে পাপী মনে হত। 

সেইদিন আমার জন্মদিন, রোজকার মতন সেদিন সকালে উঠে পরি। মা ফোন করে আমাকে জন্মদিনের আশীর্বাদ জানায়। আমি মায়ের গলার আওয়াজ শুনে কেঁদে ফেলি প্রায়। সেদিন নিজেকে খুব একা মনে হয়েছিল এই বিশাল পৃথিবীতে।

মা জিজ্ঞেস করেন, “তুই ভালো আছিস?”

আমি, “হ্যাঁ আছি এই একরকম, মা তোমার কথা খুব মনে পরে মা।”

ছোটমা আমার কাছে এসে দাঁড়ান, আমি মাকে বলি, “মা আমি তোমাকে পরে ফোন করব, আমাকে এখন কলেজ যেতে হবে।”

স্নান সেরে নিজের ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার ওপরে একটা সুন্দর বাক্স রাখা। আমি বাক্স খুলে দেখি তাঁর মধ্যে একটা সুন্দর আকাশী নীল রঙের চুরিদার। ছোটমা পেছন পেছন ঘরে ঢোকেন, আমি ছোটমায়ের পা ছুঁয়ে প্রনাম করলাম।

ছোটমা আমার মাথায় হাথ রেখে জিজ্ঞেস করেন, “চুরিদার পছন্দ হয়েছে তোর?”

আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম, হ্যাঁ।

ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমি আমার বান্ধবীদের নিয়ে কোথাও যেতে চাই কিনা।

আমি, “ঠিক জানিনা।”

ছোটমা, “তাহলে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসিস, তোর বাবু তোকে নিয়ে দোকান যাবে, তোর জন্য ডেক কিনে দেবে।”

আমি ছোটমাকে বললাম, “মিউসিক সিস্টেম কিসের জন্য দরকার? আমার চাইনা।”

গালে হাত দিয়ে আদর করে বলেন, “তুই মন খারাপ করে আছিস?”

সত্যি সেদিন আমার মন খুব খারাপ ছিল, আমি অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের জল আড়াল করতে চেষ্টা করি। আমি ছোটমাকে বললাম, “মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।” 

ছোটমা আমার চোখের জল দেখেনি কিন্তু মনের ব্যাথা বুঝতে পেরেছিলেন। ছোটমা আমার হাতে এক হাজার টাকা দিয়ে বললেন, “মন খারাপ করিস না, আজ তোর জন্মদিন, বান্ধবীদের সাথে নিয়ে বাইরে যা দেখবি ভালো লাগবে। তবে সন্ধের আগে বাড়ি ফিরে আসিস যেন।”

কলেজে পৌঁছে মন কেমন করে ওঠে, কিছুটা ভালো কিছুটা ফাঁকা। সেদিন প্রথম আমি তিস্তাকে লক্ষ্য করে দেখি যে তিস্তা একটা লাল হলুদ রঙ মেশানো সুন্দর একটি চুরিদার পরে কলেজে এসেছে। আমি ওকে দেখে একটু হাসি। আমার হাসি দেখে প্রত্তুতরে আমাকে হাসি দেয়। আমার পাশে এসে বসে পরে তিস্তা। অনেক দিন পরে আমার কাঁধে হাথ রাখে।

তিস্তা আমাকে জন্মদিনের অভিবাদন জানায়, আমি ওর দিকে পালটা হেসে জিজ্ঞেস করি, “তুই জানলি কি করে?”

তিস্তা আমাকে বলে, “তুমি একদিন আমাকে বলেছিলে তাই মনে আছে।” 

আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, “তুই আজ চুরিদার পরে, কি ব্যাপার?”

তিস্তা নিচু স্বরে উত্তর দেয়, “ভাবলাম নিজেকে বদলানোর দরকার, তাই।”

ঠিক সেইসময়ে দেবব্রত ক্লাসে ঢুকে সোজা আমার পাশে এসে আমাকে জন্মদিনের অভিবাদন জানায়। আমাকে দেখে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলে, “যা দেখতে লাগছে না তোমাকে মনে হয় তুমি আজ ক্লাসে আগুন ধরিয়ে দেবে।”

ওর কথা শুনে সারা ক্লাস হেসে ফেলে, আমি লজ্জায় লাল হয়ে উঠি। দেলিসা আর পুষ্পাঞ্জলি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওদের কোথায় নিয়ে যাবো, জন্মদিনের পার্টি দিতে? 

দেবব্রত তিস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তিস্তার কানে কানে কিছু একটা বলে, আমি তিস্তার পাশেই বসেছিলাম, আমি ওদের কথা শুনতে পাই। দেবব্রত তিস্তাকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে তোকে আজ অনেক আলাদা দেখাচ্ছে, কি ব্যাপার তোর?”

তিস্তা ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “এই কয়েক বছরে মনে হল নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম, তাই একটু নিজেকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করছি।”

তিস্তার সেই কথা শুনে আমার মনে হল, যে তিস্তাকে দেখেছি সেই তিস্তা আমার পাশে বসে নেই। আমার পাশে বসে এক নতুন তিস্তা, হয়ত সেই তিস্তা হারিয়ে গেছে অথবা কোথাও লুকিয়ে রয়েছে। দেবব্রত মজা করে ওর চুল টেনে নিজের সিটে বসে পরে।

কলেজ শেষে সবাই আমাকে ঘিরে ধরে, ওদের জন্মদিনের ট্রিট চাই। রজত, পুষ্পাঞ্জলি জেদ ধরে যে পিটারক্যাট নিয়ে যেতে হবে। আমার হাথে মাত্র হাজার টাকা, আমি জানতাম না, পিটারক্যাটে খাওয়ালে কত টাকা লাগবে। আমি ওদের বলি, আমার কাছে যে অত টাকা নেই। তিস্তা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে বলে, “তুমি এত চিন্তা করো না মিতা, তিস্তা আছে তোমার সাথে।”

দেবব্রত আমাদের বলে, “এবারে কিন্তু কোন জামাই আদর নয়, দানিস বা তির্থাঙ্কর নয়। শুধু আমরা বন্ধু বান্ধবীরা যাবো।”

তিস্তা ম্লান হেসে দেবব্রতকে বলে, “তির্থাঙ্কর অতীত।”

ম্লান হেসে দেলিসার দিকে তাকিয়ে বলে, “দানিস কে সাথে নিতে আমার আপত্তি নেই।”

দেবব্রত তিস্তার সাথে মজা করে বলে, “উম্ম, তুই সত্যি কথা বলছিস? আমি কতদিন ধরে এই দিনের জন্য অপেক্ষা করেছিলাম, যেই তোকে একলা পাবো ওমনি প্রোপস করে দেব, সেক্সি।” 

তিস্তা একটু রেগে গিয়ে দেবব্রত কে মারতে শুরু করে দেয়, ওদের দেখে আমার মনে হল যেন এক নতুন দুষ্টু মিষ্টি তিস্তা আমার সামনে। কলেজ থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় এসে দেখি বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। আমরা সব মিলে সাত বন্ধু বান্ধবী, সবাই একসাথে যাবার জন্য জেদ ধরে। কিন্তু একটা ট্যাক্সিতে সবাই যেতে পারবেনা।

দেবব্রত আমাদের বলে, “একটা উপায় আছে, যদি মেয়েরা আমাদের কোলে বসে তাহলে আমরা সবাই এক গাড়িতে এস্প্লানেড যেতে পারি।”

আমি ওদের কথা শুনে বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়াই।

বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য ছাতা খুলতে চেষ্টা করি, কিন্তু ছাতা আটকে যায়। দেবব্রত আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর ছাতা আমার মাথার ওপরে মেলে ধরে। আমি ওর দিকে কৃতজ্ঞতা সুলভ চোখে তাকালাম। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে আমার জামার হাথা ভিজে যায়, গলায় জড়ানো ওড়না দিয়ে নিজেকে ঢাকতে চেষ্টা করলাম। ঠিক সেইসময়ে দেবব্রত আমার বাম কাঁধে হাথ রাখে। ওর উষ্ণ হাতের পরশে যেন বিদুত্য বয়ে যায় শরীরে, আমার শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কিন্তু সেই স্পর্শে কোন কামনা বাসনার লেশ ছিলনা, ছিল শুধু বন্ধু সুলভ আলতো ছোঁয়া। আমি আসেপাসে তাকিয়ে দেখি দেলিসা আর তিস্তা আমার দিকে তাকিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আমার ডানদিকের খালি বাজু ওর বুকের ওপরে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। আমাদের চারপাশে বৃষ্টি ভেজা ঠাণ্ডা হাওয়া বয়ে চলে। আমি ওর হাথের তালুর উষ্ণতা নিজের কাঁধের ওপরে শুষে নিতে চাই। মনের মধ্যে এক ঝড় ওঠে, ক্ষণিকের জন্যে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে, আমি মাটির দিকে তাকিয়ে থাকি নিজেকে সামলানোর জন্য। 

সঙ্খ দুটি ট্যাক্সি ডেকে আনে। একটা ট্যাক্সিতে আমি, দেলিসা তিস্তা আর দেবব্রত চেপে গেলাম, দেবব্রত সামনে বসে। আমি আর দেবব্রত বেশ চুপচাপ। আমার কাঁধে ওর হাতের ছোঁয়ায় আমার মনে প্রানে যেন এক নতুন জীবনের আলো দেখায়। আমার চঞ্চল মন আনমনা হয়ে ওঠে, আমি ট্যাক্সির জানালার বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে থাকি। 

আমাকে অস্বাভাবিক রকম চুপ থাকতে দেখে তিস্তা জিজ্ঞেস করে, “মিতা, কি হল, জন্মদিনের দিন এত চুপ করে কেন?”

আমি মনের চাঞ্চল্য লুকিয়ে উত্তর দিলাম, “মাকে খুব মনে পড়ছে তাই মন একটু খারাপ।” 

সত্যি কি ও ফিরে আসবে আমার কাছে? কি ভাবে আমার সাথে যোগাযোগ করবে? কেন এখন কোন খবর পাইনা? আমি দিনেদিনে অশান্ত হয়ে উঠি। দিগন্তে একটা ছোটো জাহাজের মাস্তুল দেখা দেয়, যতদিন যায় সেই জাহাজের মাস্তুল দিগন্তের কোলে হারিয়ে যেতে থাকে। আমি শত চেষ্টা করেও সেই জাহাজটাকে ধরতে পারিনা।

দেবব্রত অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল, আমি বুঝতে পারি যে আমার পাশে দাঁড়িয়ে, আমার শরীরের উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে ওর মন হারিয়ে গেছে। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে দেবব্রতর মাথার পেছনে চাঁটি মেরে জিজ্ঞেস করি, “এই তুই এত চুপচাপ কেন রে?”

ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে, “নাগো কিছু না এমনি চুপ।”

তারপরে হেসে মজা করে বলে, “আমার সাথে তিন তিন খানা সুন্দরী, আজ আবার সবাই চুরিদার পরে এসেছে। আমাকে দেখে ত সব ছেলেরা জ্বলে পুরে খাক হয়ে যাবে।”

তিস্তা ওকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “অন্তত দেলিসাকে ত ছেড়ে দে।”

রেস্টুরেন্টে দেবব্রত আমার আর তিস্তার মাঝে বসে। আমি লক্ষ্য করি যে তিস্তা দেবব্রতর প্রতি অন্য দিনের থেকে একটু বেশি সহানুভুতি দেখায়। আগ বাড়িয়ে দেবব্রতকে সব জায়গায় আগলে আগলে রাখে। মনে মনে হেসে ফেলি আমি তিস্তার কার্যকলাপ দেখে। দেবব্রত যে আমার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে সেটা ভেবে মন আনমনা হয়ে যায়। 

আমি ওদের সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি অর্ডার করা হবে?”

তিস্তা, “ছেলো কাবাব, দেবু তোর কি মত?”

দেবব্রত তিস্তার মুখে ওর ছোটোনাম শুনে একটু থমকে যায়, আমি মনে মনে হেসে ফেলি, পাখি ধরা পরে গেছে খাচায়। দেবব্রত ওর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, সেই চাহনি দেখে প্রথম বার তিস্তা লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলে।

তিস্তা লাজুক হেসে দেবব্রতকে বলে নিচু গলায় বলে, “এই ওইরকম ভাবে আমার দিকে তাকাস না, প্লিস।”

বেশ মজা হয় সেদিন। অনেকক্ষণ ধরে গল্প গুজব করে আমরা ছেলোকাবাব শেষ করে রেস্টুরেন্টের বাইরে বেড়িয়ে আসি। বৃষ্টি থামেনি তখন। ছাতা খুলে আমি আর তিস্তা বড় রাস্তার দিকে হাটা লাগাই, আমরা দুজনে একদিকে যাবো। আমাদের সাথে সাথে দেবব্রত হাঁটতে থাকে।
Like Reply
#43
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#02)

তিস্তা দেবব্রতকে জিজ্ঞেস করে, “তুই এমএসসি’র পরে কি করবি?”

দেবব্রত মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিল, “এখন কিছু ঠিক করে ভেবে উঠিনি কিন্তু লেকচারার হওয়ার শখ আছে বা দেখি কিছু নিয়ে রিচারচ করব হয়ত।”

তিস্তাকে পালটা জিজ্ঞেস করে, “তুই কি করবি?”

তিস্তা হেসে বলে, “আমি পড়াশুনা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি রে, আমি এমএসসি পড়া শেষে বিয়ে করে ঘর সংসার করব।”

আমার দিকে ফিরে তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “মিতা তুমি কি করবে এর পরে?”

আমি ওর প্রশ্নের উত্তরে বলি, “আমি টিচার হতে চাই, কিন্তু ভবিতব্যের কথা কে বলতে পারে। দেখা যাক ভবিষ্যতে কি হয়, সবসময়ে আমরা যা চাই তাই ত আমরা পাইনা।”

আমার কথা শুনে দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। সেই চাহনির সামনে নিজেকে কেমন ব্যাথিত মনে হয় আমার, যা চায় আমার কাছে সেটা আমি ওকে কি করে দেই। আমাকে জিজ্ঞেস করে দেবব্রত, “তোমার কি হয়েছে একটু বলতে পারো? আজকাল কেমন করে যেন কথা বলো তুমি, কেমন উদাস হয়ে থাক?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, “কই কিছু না ত।”

আমরা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তিস্তা দেবব্রতর কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমি লক্ষ্য করে দেখি যে তিস্তার হাথ, দেবব্রত হাথের কাছে, মাঝে মাঝে আঙুল দিয়ে ছুঁতে চেষ্টা করে দেবব্রতকে। আমি বুঝতে পারি তিস্তার মনে বাসনা, পুনরায় দেবব্রত প্রেমের ভাষা একবার শুনতে ওর মন আখাঙ্কিত। আমার বুকের মাঝে কেমন একটা ফাঁকা সুর বেজে ওঠে। বেশ কিছু পরে ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম আমরা। আমি ট্যাক্সিতে চেপে যাই, ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে দেখি। তিস্তা হাঁ করে দেবব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, আর দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। একটু পরে আমার দিকে এগিয়ে আসে দেবব্রত। আমার হাথে একটা ছোটো উপহারের বাক্স দিয়ে বলে এটা, “আমার মতন ক্ষুদ্র একটা বন্ধুর তরফ থেকে তোমার জন্মদিনের উপহার।”

আমি হেসে ওকে বলি, “তুই যদি আমার মৌন বন্ধু, তাহলে সারা পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।”

তিস্তা ওর দিকে চেয়ে মজা করে বলে, “আমার উপহার কোথায়?”

দেবব্রত মাথা চুলকে বলে, “আরে বাবা, তোকে উপহার দেবার মতন শক্তি কি আমার আছে?”

তিস্তা আমার পেছন পেছন ট্যাক্সিতে চেপে যায়। ট্যাক্সি ছাড়ার আগে দেবব্রতর দিকে ছোটো একটি বাক্য ছুঁড়ে দেয়, “তোর উপহারের জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকব।”

ট্যাক্সি বৃষ্টি ভেজা কোলকাতার রাস্তা ধরে এগিয়ে চলে। আমার মনের মধ্যে এক অন্য চিন্তা ভাবনা ভর করে, ওদিকে তিস্তার মনে অন্য ভাবনা। আমি ভাবতে থাকি, আমার চারপাশে শেষ পর্যন্ত এই হতে শুরু করেছে? সারা রাস্তা তিস্তা বেশ চুপ করে থাকে। তিস্তা নিজের ভালোবাসার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত আর আমি আমার ভালোবাসার অতীত নিয়ে স্বপ্ন দেখি। লেকটাওন এসে যায়, তিস্তার নামার সময় এসে যায়। তিস্তা ট্যাক্সি থেকে নামার আগে আমাকে জড়িয়ে ধরে। ট্যাক্সি থেকে নেমে আমার ট্রিটের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে যায়।

ওদিকে সূর্য ডুবে গেছে অনেখন আগেই, বৃষ্টি আর ধরে না। আমি বাড়ি ফিরে আসি। বাবু ছোটমা আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকেন। অন্যদিন ছোটমা দেরিতে বাড়ি ফেরেন, কিন্তু সেদিন সময়ের আগেই ছোটমাকে বাড়িতে দেখে আমি একটু অবাক হয়ে যাই। আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন ছোটমা আর মিষ্টি হাসেন।

আমি জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে তোমাদের?”

ছোটমা আমাকে বলেন, “আমি কথা দিয়েছিলাম তোর জন্য মিয়ুসিক সিস্টেম কিনে দেব, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় বদলে নে, দোকান যেতে হবে।”

আমি ওদের বলি, “ছোটমা, আমি আগেই বলেছি যে আমার মিয়ুসিক সিস্টেম চাই না।”

ছোটমা আমার কাছে এসে স্নেহ ভরা সুরে জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে তোর?”

আমার সেই স্বর শুনে কান্না পেয়ে যায়, কেন তুমি এক পরের মেয়ের জন্য এত কর ছোটমা? আমার জীবন তোমার কাছে চিরকালের জন্য ঋণী। এত ঋণ হয়ত আমি মাথা কেটে তোমার পায়ের তলায় রেখে দিলেও শোধ করতে পারবোনা। কিছু বলতে পারিনি আমি, কাপড় বদলে ছোটমা বাবুর সাথে বাজারে গিয়েছিলাম ডেক কেনার জন্য। আমি গান শুনতে গান গাইতে ভালবাসতাম ঠিকই, কিন্তু আমার জীবনের গান ওর সাথে চলে গেছে। আমি মিয়ুসিক সিস্টেমটা আমার পড়ার টেবিলের ওপরে রেখে দিয়েছিলাম, মাঝে মধ্যে খুব খারাপ লাগলে গান শুনতাম তবে গান শুনতে আর ভালো লাগত না।

সেইরাতে আমি দেবব্রতর দেওয়া উপহারের ছোটো বাক্স খুলে দেখি, কি দিয়েছে। ছোটো বাক্সের মধ্যে একটা গোল কাঁচের বল, তাঁর মধ্যে জল ভরা আর তাঁর মধ্যে ছোটো দুটি পুতুল হাত ধরে রয়েছে এক ওপরের। একটা ছেলের পুতুল একটা মেয়ের পুতুল। উপহার দেখে আমি ওর মনের অভিপ্রায় বুঝতে পেরে হেসে ফেলি। দেবব্রত, তুই যা চাইছিস তাই আমি তোকে দিতে পারব নারে। আমি যে আমার ভালোবাসা হারিয়ে ফেলেছি, আর যা আমি হারিয়ে ফেলেছি সেই মন তোকে আমি দেই কি করে। আমি ওর দেওয়া সেই উপহার আবার বাক্স বন্দি করে বইয়ের তাকের এককোনায় তুলে রেখে দেই, দ্বিতীয় কোনদিন সেই উপহার সেই জায়গা থেকে বের করে দেখিনি আমি।

পুজোর ছুটির সময়ে ছোটমা আর বাবু আমাকে বাড়িতে থাকতে অনুরোধ করেন। আমি ওদের কথা মেনে নিয়েছিলাম, আমি কোনদিন কোলকাতার দুর্গাপুজো দেখিনি। পুজোর আগে ছোটমা আর বাবু আমাকে নিয়ে বউবাজার গিয়েছিলেন আমার জন্য গয়না কেনার জন্য। আমি সেবারে আর তাদের অনুরোধ প্রত্যাখান করতে পারিনা। 

অষ্টমীর দিন সকালে দেবব্রত আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে যে আমি ওদের সাথে ঠাকুর দেখতে বের হতে চাই নাকি। আমি ওদের জিজ্ঞেস করি, যে কেকে যাচ্ছে সেই জেনে আমি যেতে পারি। দেবব্রত আমাকে জানায় যে সব বন্ধুরা মিলে ঠাকুর দেখতে যাবে, আমি সেই কথা শুনে আনন্দে ওদের হ্যাঁ বলে দিয়েছিলাম। 

আমি, “একটা গাড়ি না আলাদা আলাদা গাড়ি।”

দেবব্রত, “কেন আমার সাথে যেতে তোমার কোন অসুবিধে আছে নাকি?”

আমি হেসে জবাব দেই, “না মানে, সবাই একটা গাড়িতে গেলে বেশ মজা হবে তাই জিজ্ঞেস করলাম।”

দেবব্রত, “ঠিক আছে আমি একটা বড় গাড়ির ব্যাবস্থা করব যাতে আমরা সব বন্ধু বান্ধবী মিলে ঠাকুর দেখতে যেতে পারি।”

আমি, “তিস্তা আমাদের সাথে যাচ্ছে কি?”

দেবব্রত, “হ্যাঁ বাবা, এই সব প্লান ওই করেছে।”

ছোটমা আমাকে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দিলেন, কিন্তু সাথে সাথে একটু সাবধানে চলাফেরা করতে বলে দিলেন। ও যখন নেই আমার পাশে তখন অত সেজে গুঁজে কি হবে সেই ভেবে আমি সেদিন সাধারন একটা সবুজ পাড়ের ঘিয়ে রঙের শাড়ি পড়েছিলাম। ছোটমা আমার সাজ দেখে একটু অভিমান করে বলেন, “পরী, এটা কি রকমের সাজ? আজ অষ্টমী পুজো আর তুই এই রকম সাদামাটা সেজে বের হবি? আমি যে একটা সাউথ সিল্ক কিনে দিয়েছি সেটা কেন পড়লি না।”

আমি ম্লান হেসে উত্তর দেই, “এটাই ভালো, ছোটমা।”

আমাকে ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলেন, “এই রকম সাদা মাটা সেজে যেতে হবে না, জীবন একটু রংচঙে কর মা।”

আমি সেই সাউথ সিল্ক পরে নিলাম। সবুজ রঙের ঝলমলে খুব সুন্দর শাড়ি, সোনালি রঙের পাড়, আমার ফর্সা গায়ের রঙের সাথে বেশ মানিয়েছিল। ছোটমা নিজের গয়নার বাক্স খুলে একটা মোটা গলার হার আমার গলায় পড়িয়ে দেয়। আমি ছোটমাকে বলি, “এটার কি দরকার?”

ছোটমা, “কিছুনা, আমি শুধু দেখছি আমার মেয়েটাকে কত সুন্দর দেখতে। যা নিজের বন্ধু বান্ধবীদের সাথে ঘুরে আয়, আর হ্যাঁ মোবাইল অন রাখিস, কল করলে যেন জানতে পারি যে তুই কোথায় আছিস।”

আমি মাথা দুলিয়ে ছোটমাকে আশস্ত করে বলি, “অহ ছোটমা, আমি আর ছোটো মেয়ে নেই।”

সেই সবুজ রঙের সাউথ সিল্কের শাড়িতে নিজেকে দেখতে মন্দ লাগছিল না, তাঁর সাথে মিলিয়ে ছোটো হাথার সবুজ ব্লাউস ছিল গায়ে। মাথার চুল বেনুনি করে বেঁধেছিলাম, পিঠের ওপরে সাপের মতন দুলছিল। হাথে কয়েক গাছা সোনার চুড়ি, কানে সোনার দুল, নিজেকে আয়নায় দেখে নিজের লজ্জা লেগে যায়। নিজেই নিজেকে বলে ফেলি, পরী তুই কোলকাতার পুজোতে আগুন ধরিয়ে দিবি। ঠিক সেই সময়ে কেউ যেন আমার কাঁধে হাত রাখে, ভারি নরম ভালোবাসার স্পর্শ। আমি আয়নায় চেয়ে দেখি, কেউ নেই পেছনে কিন্তু আমার মন জানে যে সত্যি আমার কাঁধে কারুর হাত স্পর্শ করেছিল। 

কানেকানে ফিসফিস করে ওর গলার আওয়াজ শুনি আমি, “হৃদয় নন্দিনী তোমাকে আজ দারুন দেখতে লাগছে।”

কানের ভেতরে ওর গলার আওয়াজ পেয়ে আমার মন কেমন করে ওঠে, বুক কেঁপে ওঠে। নাকের পাটা ফুলে ওঠে, চোখ লাল হয়ে যায়, কান্না ভেঙ্গে আসে বুকের মাঝে। আমি নিজের বুক চেপে ধরে নিজেকে শান্ত করে নিয়েছিলাম। আমি জানি তুমি আমার আসেপাসেই আছো কিন্তু একবারের জন্য দেখা দাও। আমি কাঁধে ঠিক যেখানে ওর হাতের পরশ পেয়েছিলাম, সেখানে ছুঁয়ে নিজের ঠোঁটে মেখে নিয়েছিলাম। 

ঠিক সেই সময়ে আমার মোবাইল বেজে ওঠে। তিস্তা ওদিক থেকে চেঁচিয়ে ওঠে, “কি গো তুমি, এতক্ষণ ধরে আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছি আর তোমার দেখা নেই কেন? তাড়াতাড়ি সেজে এস, আমরা সবাই আমাদের রানীর জন্য অপেক্ষা করে আছি।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি, চোখের কোনের জল মুছে হেসে বলি, “দাঁড়া একটু, আমি এখুনি আসছি।”

ঘর থেকে বের হতেই দেখি ছোটমা সামনে দাঁড়িয়ে, আমাকে দেখে কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে আদর করে বলেন, “সাবধানে যাস আর মন ভরে বন্ধুদের সাথে মজা করিস।”

আমি আমার বাদামি রঙের ক্লাচ হাথে নিয়ে বেড়িয়ে পরি।

বাসস্টান্ডে এসে দেখি তিস্তা আর দেবব্রত আমার জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। তিস্তা একটা খুব সুন্দর হাল্কা গোলাপি রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে, সঙ্গে ছোটো হাথার ব্লাউস। উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ ত্বকের সাথে বেশ মানিয়েছে শাড়ির রঙ। কানে ক্রিস্টালের দুল ঝকমক করছে। গলায় পাতলা সোনার চেন। সেইদিন প্রথম আমি তিস্তাকে শাড়ি পড়তে দেখেছিলাম। আমাকে দেখে আমার দিকে দৌড়ে আসে তিস্তা, জড়িয়ে ধরে কানেকানে বলে, “আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে তোমার সাথে চুটিয়ে প্রেম করতাম।”

আমি ওকে জড়িয়ে বলি, “তুই কম যাচ্ছিস না কিন্তু, তোকে দেখে কোলকাতা জ্বলে যাবে রে।”

আমি দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে দেখি ও একটা কালো পাঞ্জাবী পড়েছে, পাঞ্জাবির ওপরে সোনালি সুতোর কাজ, বেশ সুদর্শন দেখাচ্ছে দেবব্রতকে। আমি ওদের একসাথে দেখে নিজেকে বলি, ভগবান যেন ওদের মিলিয়ে দেওয়ার জন্য এঁকে ওপরের জন্য বানিয়েছে। 

দেবব্রত আমার কাছে এসে বলে, “আজ আমার কপালে দুঃখ আছে, সাথে এত সুন্দরী দুই মেয়ে।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি, দেবব্রত, দুটি নয়, একটি তোর আর তুই আমার কাছে যা চাস তা তোকে দিতে পারছিনা। একবারের জন্য চোখ মেলে তাকা দেবব্রত, তিস্তার চোখে তোর জন্য ভালোবাসা উপচে পড়ছে, তুই যে তিস্তা কে চিনতিস সেই তিস্তা আর নেই রে, সে অনেক বদলে গেছে, শুধু তোর জন্য নিজেকে অনেক বদলে নিয়েছে রে।

না আমি কিছুই ওকে বলিনি, বরং ওর মাথায় চাঁটি মেরে বলি, “আমার দিকে একদম দেখবি না, তোর চোখ গেলে দেব।” আমি আসেপাসে তাকিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করি, “বাকিরা কোথায়?”

তিস্তা আমাকে চোখ টিপে বলে, “আমাদের সাথে আর কেউ নেই। শুধু আমরা তিনজনে ঘুরতে যাবো।”

আমি প্রায় চেঁচিয়ে বলি ওকে, “কি?”

দেবব্রত আমাকে বলে, “কেন, আমার সাথে যেতে তোমার আপত্তি আছে নাকি?”

মনে মনে একটু বিরক্ত বোধ করি। আমার চোখের সামনে ওদের মতলব পরিষ্কার ফুটে ওঠে। চোখের সামনে তিস্তার হাসি হাসি মুখ দেখে বুঝতে বাকি থাকে না যে এই মতলব আসলে তিস্তার, তিস্তা চেয়েছিল দেবব্রতকে নিয়ে পুজোতে ঘুরতে যেতে কিন্তু সাহস করেনি হয়ত, দেবব্রতকে হয়ত বলেছিল নিজের অভিপ্রায় আর দেবব্রত যেহেতু আমার প্রতি একটু ঝুঁকে সেইজন্য দেবব্রত তিস্তাকে বলে আমাকে সাথে নিয়ে যেতে। আমি ওদের কার্যকলাপ বুঝতে পেরে মনে মনে হেসে ফেলি। অনেকদিন পরে মনে হল যেন একটু খোলা বাতাস আমার জমাট বাঁধা বুকের ওপর দিয়ে বয়ে চলে গেল, না নিজের জন্য নয়, তিস্তার হাসি মুখ দেখে সেই জমাট বাঁধা বুক আনন্দে ভরে ওঠে।
Like Reply
#44
খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি গল্প টা শেষ করেছেন পিনুদা কিন্তু বাংলায় শেষ করেননি।কেন যে এমনটা করলেন তা হউত উনি ভালো জানেন।যদিও বলে দিয়েছিলেন কেন করেছেন।কিন্তু এর পরে কোন লেখকই নিজ উদ্যোগে গল্প টা শেষ করার চেষ্টা করেননি যদিও অনেকে অনেক গল্প অনুবাদ করেছে। জানি না কেন এমনটা হয়েছে।যদি কোন দিন সম্ভব হয় ইংরেজীতে গল্প টা শেষ করব।বাংলাতে হয়ত পড়া হবে না।
Like Reply
#45
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#03)

রাত প্রায় এগারোটা, আমরা তিনজনে মহম্মদ আলি পার্কে দাঁড়িয়ে। অষ্টমীর পুজো অনেক ভিড় চারপাশে। প্যান্ডেলের সামনে ঠাকুর দেখার জন্য বিশাল লাইন। আমি সেই লাইন দেখে থমকে গিয়ে দেবব্রতর দিকে তাকাই, আমি ওকে জানাই যে আমি এত ভিড়ের মধ্যে প্যান্ডেলের ভেতরে যাবো না। তিস্তা আমার কথা শুনে আমার দিকে করুন চোখে তাকায়, অনুরোধ করে ঠাকুর দেখতে ভেতরে যেতে। দেবব্রত আমার কথা শুনে বেঁকে বসে, আমি ভেতরে না গেলে ও ভেতরে যাবেনা। আমি পরে যাই ফাপরে, একদিকে তিস্তার করুন চোখের আবেদন, অন্যদিকে দেবব্রতর জেদ। তিস্তা আবার আমাকে অনুরোধ করে। আমি একটা আছিলায় বলি যে আমাকে একটা ফোন করতে হবে তাই আমি বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব।

আমার সেদিন সুপ্রতিমদাকে ফোন করার ইচ্ছে করছিল, যদি ওর খবর কিছু জানা যায়। এত আনন্দের দিনেও যেন আমি ওকে ভুলে থাকতে পারিনা। বিগত ষোলো মাসে ওর কোন খবরা খবর না পেয়ে আমার মন খুব বিচলিত ছিল, কি করছে, একবারের জন্য কিছু ত জানাক, আমি দাঁড়িয়ে আছি ওর সংবাদের অপেক্ষায় আর ওদিকে ও বেশ নিশ্চিন্ত মনে, একবারের জন্যেও কি আমার কথা মনে পরে না।

তিস্তা দেবব্রতর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওদের দিকে ম্লান হেসে ইশারা করি ভেতরে যাওয়ার জন্যে। তিস্তা দেবব্রত হাথ ধরে প্যান্ডেলের দিকে হাটা শুরু করে। প্রানপন শক্তি দিয়ে দেবব্রতর হাতখানি নিজের মুঠিতে ধরে থাকে, মনে হয় যেন ছেড়ে দিলে দেবব্রত ওর কাছ থেকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে যাবে। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলি।

চারপাশে অসম্ভব রকমের ভিড়। প্যান্ডেলের ভেতরে ঢুকতে যাবে দেবব্রত, ঠিক সেই সময়ে থমকে দাঁড়িয়ে পরে আমার দিকে হাথ বাড়ায়। আমি ক্লাচ থেকে মোবাইল বের করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করতে যাই। কিন্তু দেবব্রতর অনুরোধ মাখানো চাহনি দেখে থাকতে পারিনা। দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি, মিতা।”

তিস্তার জল ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে, আমি হাথে মোবাইল নিয়ে ফোন করতে ভুলে যাই। চোখে ভালোবাসা হারানোর জল, কিন্তু ঠোঁটে মাখা হাসি। সেই হসি দেখে আমি মাথা দুলিয়ে বলি, দেবব্রত একবার চোখ খুলে দেখ তোর পাশে, তোর ভালোবাসা তোর দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলি, “তুই আর বদলাবি না তাই না?”

আমার হাথ ধরে বলে, “সত্যি কি আমার বদলান উচিত?”

সেই কলাহলের মধ্যে নিচু গলায় তিস্তা ওকে বলে, “দেবু, শুধু মাত্র আমার জন্যে একবার বদলে দেখ।”

সেই কথা দেবব্রতর কানে যায় না, পুজোর কোলাহলে সেই করুন আবেদন ঢাকা পরে যায়, কিন্তু আমি সেই করুন আবেদন শুনে ফেলি।

এক রাতে আমি সুপ্রতিমদাকে ফোন করি, রিতিকা ফোন ধরে উত্তর দেয়। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যে ওর কোন সংবাদ আছে কি না। রিতিকা জানায় যে ও নাকি অনেক দিন ওদের কোন ফোন করেনি। সেই কথা শুনে আমার মনে ভয় ঢুকে পরে। মাথা ঠাণ্ডা রেখে আমি ওকে বলি, যদি আবার কোনদিন রিতিকাকে ফোন করে তাহলে যেন জানিয়ে দেয় যে আমি এখনো ওর পথ চেয়ে বসে আছি, আমি ওর কাছ থেকে কোন সংবাদ এখনো পাইনি। আমার কথা শুনে রিতিকা রিতিমতন অবাক হয়ে যায়। আমাকে শান্তনা দিয়ে বলে, যে কোন না কোন পথ বের করে নেবে আমার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য। আমি নিজের ভাঙ্গা হৃদয়কে প্রবোধ দেই যে ও নিশ্চয় আমার সাথে সম্পর্ক করবে। নদীর জল গড়িয়ে যায়, সময় কারুর জন্য থেমে থাকেনা, দেখা যাক কত দূর কি হয়। 

ছোটমা আর বাবু আমার সাথে আবার সেই মেয়ে সুলভ আচরন করেন। ওদের মুখে হাসি ফিরে আসে, মাঝে ওদের ব্যাবহার একটু পালটে গিয়েছিল, কি কারনে আমি জানতাম না। কিন্তু সেই পুরানো স্নেহের ছোঁয়া যেন আর থাকেনা। বাবুর মুখে “সোনামা” ডাক হারিয়ে যায়। কয়েক মাস পরে আবার বাবু ছোটমায়ের মন খুব বিচলিত হয়ে ওঠে। আমি আবার ওদের মনের ভাব বুঝে উঠতে পারিনা।

একদিন আমি বুকের মাঝে সব শক্তি সঞ্চয় করে ভেবেছিলাম কারন জিজ্ঞেস করি। ছোটমা কলেজ থেকে ফিরে এসেছিলেন, আমি নিজের ঘরে ছিলাম। বাবু বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। ছোটমা আমার ঘরে ঢুকে আমার পড়াশুনা, কলেজের কথা জিজ্ঞেস করেন। 

আমি সেই সময়ে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা, তুমি মাঝে মাঝে এত অন্যমনস্ক আর বিচলিত হয়ে যাও কেন? সেই সবের কারন কি আমি?”

ছোটমা আমার বিছানার ওপরে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “না না, তোর জন্য কেন বিরক্ত হব। আমরা তো আমাদের কপালের লিখনের জন্য মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে উঠি।”

আমি ছোটমায়ের মনের কথা বুঝতে পারি। ছোটমা আমাকে বলেন, “তুই বড় হয়েছিস, পরের বছর সাতাসে পা দিবি তুই। আমি ভাবছিলাম তোর বিয়ের জন্য ছেলে খোঁজার।”

ছোটমায়ের কথায় আমি বড় আহত হয়ে ছিলাম, আমি বেদনা ঢাকতে দাঁতের মাঝে পেন পিষে ধরে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা আমি কি তোমাদের এতই গলগ্রহ যে আমাকে তাড়িয়ে দিতে হবে?”

ছোটমা, “পরী, জীবনে বয়স একটা খুব বড় জিনিস। যত বড় হবি তত বুঝতে পারবি যে কেউ পাশে না থাকলে কেমন একা একা লাগে। আমি বা তোর মা তর পাশে ত আর চিরদিন থাকতে পারব না।”

আমি, “জানো ছোটমা, আমার এক এক সময়ে মনে হয় যে আমি আর এমএসসি পড়বো না, মনে হয় যেন বাড়ি ফিরে যাই।”

ছোটমা ধরা গলায় বলে, “একদম ওই সব কথা মুখে আনবি না, পরী। আমরা তোকে নিজের মেয়ের মতন ভালোবাসি। তুই কখন আমাদের গলগ্রহ নস। মেয়ে বড় হলে সব বাবা মায়ের চিন্তা হয়।”

আমি, “তাহলে আমার বিয়ের কথা বলছ কেন?”

ছোটমা, “না মানে রাগ করিস না, আমি বলছিলাম যে আমাদের চোখ বোজার আগে তোকে সুখী দেখতে চাই। আমাদের বয়স হচ্ছে, তোর মায়ের বয়স হচ্ছে। তোর মাও চিন্তিত তোর বিয়ে নিয়ে।”

আমি থমকে যাই ছোটমায়ের কথা শুনে, আমার মা আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলেছে? আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “আমার মা কি তোমার সাথে আমার বিয়ে নিয়ে কোন কথা বলেছে?”

ছোটমা আমতা আমতা করে বলেন, “না মানে সোজাসুজি বলেন নি, কিন্তু মায়ের মন সেটা আমি ত বুঝতে পারি।”

আমি মনে মনে বলি, আচ্ছা তাহলে আমার বিয়ের ব্যাপারে তুমি বেশি উৎসুক। আমি আমার মাকে জানি, আমার মা আমার বিয়ে নিয়ে নিশ্চয় চিন্তা করবে না। আমার মা জানেন আমি কাকে চাই। আমি বেশ বুঝতে পারছি ছোটমা, তুমি আমাকে যত তাড়াতাড়ি বিদায় দিতে পারলে বাঁচও। ছোটমা আমার চিন্তিত মুখ দেখে জিজ্ঞেস করেন যে আমি কি ভাবছি এত। আমি ছোটমাকে বলি, “কিছু না ছোটমা, তুমি এখন আমার সামনে বিয়ের কথা উঠিও না, আমার পড়াশুনায় ব্যাঘাত ঘটে।”

ছোটমা, “ঠিক আছে, আমরা এই নিয়ে পরে কথা বলব। তোর সামনে একটা বছর পরে আছে, আমাদের হাথে অনেক সময় আছে এই সব নিয়ে কথা বলার জন্য।”

তারপরে ছোটমা চলে যান, কিন্তু আমি সেদিন আর পড়াতে মন বসাতে পারিনা। 

শীতের ছুটি এগিয়ে আসে, আমার এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা আর পাঁচ মাস পরে। আমি সেই শীতের ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাই। সেইবারে ছোটমা অথবা বাবু, কেউ আমার সঙ্গে যায় না, আমি একা একা গাড়ি করে বাড়ি গিয়েছিলাম। আমি একা গাড়ি থেকে নামতে মা আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কি ব্যাপার এবারে একা কেন?”

আমি মাকে জানাই যে ছোটমা বাবু নিজেদের কাজে ব্যস্ত তাই সেবারে আমাকে ছাড়তে আসতে পারেন নি, কিন্তু ফিরে যাবার সময়ে ছোটমা আসবেন। আমার মা আমার মনের কথা বুঝে ফেলেন।

সেইরাতে আমি সেই “অপটিক্স নটবুকে” কিছু লিখছিলাম, মা আমার ঘরে আসেন। মাকে দেখে আমি ডায়রি বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমি ওর কোন খবর পেয়েছিলাম কি না। আমি মাকে জানিয়েছিলাম যে আমাকে এখন কোন সংবাদ দেয় নি আর না সুপ্রতিমদাকে কোন ফোন করেছে।

মা, “কি করছে ছেলেটা? কেন তোর সাথে এখন কোন যোগাযোগ করছে না?”

আমি ব্যাথায় চেঁচিয়ে উঠি, “আমি কি করে জানব, আমার পোড়া কপাল আর কি। কেন যে মরতে আমার জীবনে এসে সব কিছু ছিন্ন ভিন্ন করে চলে গেল আমি আজো বুঝতে পারি না।”

মনের মধ্যে ভয় রাগ আর বেদনার সংমিশ্রণে এক অধভুত দানা বাঁধে। ভয়, কিছু উল্টো পালটা হয়নি ত ওর? রাগ, শেষ পর্যন্ত কি আমাকে ভুলে গেল? বেদনা, কেন আমার সাথে একবার যোগাযোগ করছে না। আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “তুমি কবে ছোটমায়ের সাথে এই সব ব্যাপারে কথা বলবে?”

আমার মা আমার পাশে বসে মাথায় হাথ বুলিয়ে আদর করে বলেন, “এত ব্যাতিব্যাস্ত হলে চলবে না, মা।”

আমি, “আমি চঞ্চল হয়ে উঠেছি? আঠের মাস হতে চলল, এখন আমি ওর কোন সংবাদ পাইনা, কোন রকম ভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা টুকুও নেই ওর মধ্যে।”

মা আমাকে একটা প্রশ করেন, “নিজের হৃদয় কে প্রশ্ন করে দেখ পরী, তোর মন কি বলে। কি বলছে, কেন তোর সাথে যোগাযোগ করছে না অভি? যদি তুই সঠিক উত্তর পেয়ে যাস, তাহলে ওর জন্য অপেক্ষা করিস, না হলে তোর অদৃষ্টে যা লেখা আছে সেটা মেনে নিস।”

মা চলে যাবার পরে আমি দরজা বন্ধ করে ভাবতে বসি, কেন এখন আমার সাথে যোগাযোগ করেনি। অনেক ভেবেও কোন কূলকিনারা পেলাম না খুঁজে। সুপ্রতিমদাকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু উত্তর এলো, “ফোন নাম্বার চেক করে নেবেন।”

সেই উত্তর শুনে আমার মন ভেঙ্গে গেল, মনে হল বুকের মাঝে হাজার হাজার কাঁচের জানালা একসাথে ঝনঝন করে ভেঙ্গে গেল। আমার শেষ সম্বল টুকু যে আমার বিধাতা আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিল। সেদিন আমি আর কাঁদতে পারলাম না। চোখে জল ছিলনা, সারা রাত ঘুমাতে পারিনা আমি। নিজের ওপরে খুব রাগ হয়েছিল সেদিন, প্রেম করেছিলাম তাই বলে কি আমার হৃদয় মন বলে কিছু নেই, একা একা ছেড়ে আমাকে চলে গেল, বারে বারে জানায় যে যোগাযোগ করবে, কিন্তু কিছতেই করেনা। অনেকদিন অপেক্ষা করেছি আমি। ধিরে ধিরে বুকের মাঝে ফাঁকা হয়ে আসে, কোন ব্যাথা বেদনা কিছুই থাকেনা সেই হৃদয়ে। 

সামনে পরে থাকা “অপটিক্স নোটবুক” এর দিকে তাকিয়ে থাকি। একবার মনে হয় কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলি ওই ডায়রি, কেন, রেখে কি হবে, বারে বারে আমাকে শুধু মেরে ফেলবে ওই ডায়রি। ও যখন আমার কথা একবারের জন্যেও ভাবল না, তখন আমি কেন ওর ছোটবেলা, ওর ভালোবাসা ওর বন্ধুত নিয়ে ভাবি? আমি ওই ডায়রি হাথে নিয়ে ছিঁড়তে যাই, মেলে ধরি ডায়রি, আর চোখের সামনে খুলে যায় ওর লেখা একটা ছোটো হিন্দি কবিতা, একসময়ে আমার জন্য লিখেছিল। আমি সেই কবিতা দেখে কেঁদে ফেলি, ডায়রি আর ছেঁড়া হয় না।

সারা শীতের ছুটিতে নিজেকে পড়াশুনার মাঝে ডুবিয়ে ফেলেছিলাম আমি। আশাহত হয়নি তখন মন, আমার সাথে আমার মায়ের আশীর্বাদ ছিল আর সেই শক্তি প্রানে ধরে আমি যেন পৃথিবী জয় করে নিতাম।

একরাতে সুমন্তদা আমার ঘরে এসে আমকে কিছু কাগজে সই করতে বলেন। আমি জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারি যে কাগজ গুলি বাড়ির কাগজ। বাড়ি ভাগ হয়ে গেছে। সুব্রতর বিয়ের পরেই রান্না ঘর আলাদা হয়ে গিয়েছিল, সেদিন মনে হল যেন উঠানে এবারে দেয়াল উঠবে।

ছুটির শেষ রাতে আমি আমার ঘরে বিছানায় শুয়ে ফিসিক্সের একটা অঙ্ক করছিলাম। আমার মা ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে উত্তর পেলি?”

আমি অঙ্কে ডুবে ছিলাম, মা আমার পাশে এসে বসে আমার মাথায় হাথ বুলিয়ে দেন। 

আমি খাতা থেকে মুখ না উঠিয়ে মাকে উত্ত্র দেই, “না।”

মা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ওরে পাগলি মেয়ে আমি, তোর অঙ্কের কথা জিজ্ঞেস করছি না, আমি তোকে যে প্রশ্ন করেছিলাম তাঁর উত্তর কি তুই পেয়েছিস?”

আমি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম, “তুমি সাথে থাকলে আমার কোন চিন্তা নেই মা, আমি সারা জীবন ওর জন্য অপেক্ষা করতে রাজি।”

মা আমার দিকে ম্লান হেসে বললেন, “তুই ভালো করে পড়াশুনা কর। দেখ কবে ও তোর সাথে যোগাযোগ করে, ওকে বলিস আমার সাথে দেখা করতে। আমি তোর ছোটমায়ের সাথে কথা বলার আগে ওর সাথে একবার কথা বলতে চাই।”

আমি মাকে জড়িয়ে ধরি, আমার মন সেদিন বলেছিল যে আমার কাছে ফিরে আসবে একদিন।
Like Reply
#46
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#04)

ছুটির পরে ছোটমা আমাকে নিতে আসেন। প্রতিবারের মতন সেবারেও সবার বুকে যেন বিচ্ছন্নের সুর বাজে। আমি ওদের সকলকে জানাই যে ফাইনাল পরীক্ষার পরে আমি অনেকদিনের জন্য বাড়িতে থাকব।

দুষ্টু আমার কানেকানে বলে, “পিসি, তুমি কিন্তু এবারেও আমার কথা রাখলে না।”

ওর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতন ক্ষমতা ছিলনা আমার। আমি চুপ করে ছোটমায়ের সাথে গাড়িতে উঠে পরি।

বেশ কিছুদিন আমি সুপ্রতিমদাকে ফোনে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবারে সেই এক উত্তর, “নাম্বার ডায়েল করার আগে এক বার চেক করে নিন।”

একরাতে খাওয়ার পরে আমি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম। সেইসময়ে ছোটমা বাবুর কথোপকথন আমার কানে ভেসে আসে। সেই সংলাপের মানে আমি সেদিন বুঝিনি, অনেকদিন পরে সেই সংলাপের মানে বুঝেছিলাম।

বাবু, “কি করা যায় বলত? পরী নিশ্চয় লুকিয়ে লুকিয়ে কারুর সাথে যোগাযোগ রেখেছে।”

ছোটমা, “একদম বাজে ব্যাপার তাহলে। কিন্তু ও কি করে যোগাযোগ করতে পারে?”

বাবু, “আমার মনে হয় ও করেনি। আমি একদিন ওর ফোনের লগ দেখেছিলাম, তাতে ত কোন অন্তর্জাতিক কল ছিলনা।” 

ছোটমা, “আমি এইসবের মানে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।”

বাবু, “আমিও কিছুই বুঝতে পারছিনা এ সব কি?”

ছোটমা, “এই নিয়ে কোন কথা না বলাই ভালো। কিন্তু আজকাল কোথায় ও? এক বছর আগে একবার ফোন করেছিল তারপরে আর করেনি।”

বাবু, “হ্যাঁ তা করেছিল, কিন্তু তারপরে ত ল্যান্ডলাইনে আর করেনি বা ওর ফোনেও করেনি মনে হয়।”

ছোটমা, “পরীকে একবার জিজ্ঞেস করলে হত না?”

বাবু, “না, তুমি কি পাগল হয়ে গেলে যে পরীকে এইসব কথা জিজ্ঞেস করতে যাবে?”

ছোটমা, “জানো মাঝে মাঝে ওর কথা খুব মনে পরে। আমার একমাত্র ছেলে, সেইসাথে কি করে পরীকে একা ছেড়ে দেই, আমি যে মাসিমাকে কথা দিয়েছি যে ওকে আমি আমার মেয়ের মতন করে রাখব।”

ছোটমা আর বাবু কথায় আমি সেদিন এই টুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে ও আমাকে কোন ভাবে যোগাযোগ করেনি। কিন্তু সেইসাথে আমার মনে প্রশ্ন জাগে, কি করছে তাহলে, কেমন আছে, সত্যি কি ভুলে গেছে যে ওর প্রেমিকা ওর জন্য অপেক্ষা করছে? প্রতিসন্ধ্যের সাথে আমার হৃদয়ের আশার আলো দিগন্তের রেখায় ম্লান হয়ে যায়।

কলেজ শুরু হয়, ফাইনাল পরীক্ষার আর কয়েক মাস বাকি। সেদিন লাঞ্চের পরে ফ্রি পিরিওড ছিল। আমি ক্লাসে বসে আমার প্রাক্টিকাল খাতা লিখছিলাম, অনেক বাকি। তাড়াহুড়ো তে সেদিন আমি খাবার আনতে ভুলে গিয়েছিলাম। ক্লাসে খুব ছাত্রছাত্রী বসে ছিল। দেলিসা, দেবব্রত বা তিস্তা কেউ ক্লাসে ছিল না। সময়ের ঠিক খেয়াল ছিল না।

এমন সময়ে কেউ আমার কাঁধে হাত দেয়। আমার মনোযোগের ধারায় ব্যাঘাত ঘটে আমি একটু বিরক্ত বোধ করে ছেলেটার দিকে তাকাই। দেবব্রত আমার দিকে একটু রেগে তাকিয়ে একটা স্যান্ডউইচ আমার সামনে ধরে বলে, “লেডি বিদ্যাসাগর, লাঞ্চ না খেয়ে ক্লাসে ফার্স্ট আসতে চাও।”

আমি ওকে বলি, “তোকে কে বলল যে আমার খিদে পেয়েছে?”

দেবব্রত, “তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। যাই হোক তুই খেয়ে নাও না হলে কিন্তু আমি তোমার মাথা ফাটিয়ে দেব।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “এইসব কেন করছিস তুই আমার সাথে?”

দেবব্রত আমার কোন কথায় কান দিলনা, আমার মুখের মধ্যে জোর করে স্যান্ডউইচটা ঢুকিয়ে দিল। আমি ওর আচরনে অবাক হয়ে যাই। গলার মধ্যে হটাত করে শুকনো স্যান্ডউইচ ঢুকতে গলা কেমন শুকিয়ে আসে।

আমি ওকে জোর গলায় বলি, “কুত্তা, আমার লাগছে, ছাড় আমাকে।”

ঠোঁটের কাছে স্যান্ডউইচ ধরে থাকে আর আলতো করে আমার গালের ওপরে আঙুল ছুঁইয়ে দেয়। আমার রাগ দেখে যেন মজা পেয়ে গেছে দেবব্রত। ঠিক সেই সময়ে আমি লক্ষ্য করে দেখি যে দরজার কাছে তিস্তা দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে। ওর সেই কালো চোখ দুটিতে কেমন বেদনা মাখা। আমার গালে দেবব্রত্র হাথ দেখে কেমন ওর চোখে জল চলে আসে। আমি দেবব্রতর হাথ আমার গাল থেকে একরকম জোর করে সরিয়ে দিলাম।

ওকে বললাম, “চলে যা এখান থেকে।”

তিস্তা চুপচাপ আমার পাশে এসে বসে পরে। আমি ওর মুখের দিকে তাকাতে পারিনা, মনের মধ্যে মনে হয় যেন আমি ওর ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছি। মাথা নিচু করে আমার পাশে বসে পরে। ক্লাস পুরো নিস্তব্ধ আমার চেচানি শুনে, আমি তিস্তার বুকের ঝড় শুনতে পাই। 

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করি, “কি রে, তুই বাড়ি যাবি না?”

দেবব্রত, “কেন?”

আমি, “আর ত কোন পিরিওড নেই, তাহলে এখানে কার জন্য অপেক্ষা করে আছিস?”

ব্যাগ উঠিয়ে নিয়ে আমার বেঞ্চের কাছে এসে দাঁড়ায়। একবার আমার দিকে একবার তিস্তার দিকে তাকায়। তিস্তা তখন মাথা নিচু করে বসে। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে যে তিস্তার কি হয়েছে।

আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উলটে ওকে জিজ্ঞেস করি, “তুই কার জন্য অপেক্ষা করছিস?”

ফিসফিস করে উত্তর দেয় দেবব্রত, “তোমার জন্য, মিতা।”

আমি আড় চোখে লক্ষ্য করি যে দেবব্রত ওই কথা শুনে তিস্তার শরীর টানটান হয়ে যায়, বেঞ্চের নিচে হাতের মুঠি করে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করে। দেবব্রত তিস্তার ব্যাপার বুঝতে পারেনা, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

আমি ওকে বলি, “আমার বাড়ি যেতে দেরি আছে, আমি প্রাক্টিকাল শেষ করে তবে বাড়ি যাব।”

দেবব্রত, “ঠিক আছে, ক্লাস তোমার একার নয়। আমি এখানে বসে থাকব তাহলে।”

আমি দাঁতে দাঁত পিষে ওকে বলি, “তোর কিছু করার না থাকলে, এখুনি ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যা।”

আমার রাগ দেখে থমকে যায় দেবব্রত। ভাষা হীন চোখে তাকিয়ে আস্তে আস্তে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যায়। দেবব্রত ক্লাস থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আমি তিস্তার পিঠে হাথ রাখি। তিস্তা আমার হাথের ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে ওঠে, ঠিক যেন একটা ছোটো আমের পল্লব বৈশাখী ঝরে আক্রান্ত। আমি ওর মুখখানি আঁজলা করে নিয়ে নিজের দিকে ধরি। ও চোখ বন্ধ করে থাকে। আমি ওর গালের ওপরে চোখের জল মুছিয়ে দেই।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কেন তুই আমাকে খুলে বলিস নি তোর মনের কথা?”

তিস্তা কেঁদে ফেলে, “আমি তোমাকে কি বলতাম? তুমি জানো, দেবব্রত আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। ও এখন ভাবে যে আমি সেই আগের তিস্তা। আমি সেই তিস্তা নই, মিতা, আমি ওর জন্য অনেক বদলে নিয়েছি নিজেকে।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে বলি, “পাগলি মেয়ে, এতদিনে তাহলে তোর মনের কথা ওকে বলিস নি কেন?”

তিস্তা, “কি করে বলতাম? ওযে শুধু তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তোমার মনের কথা আমি কি করে জানব?”

আমি, “হ্যাঁ ভগবান, ঠিক আছে, কাঁদিস না, কলেজ শেষ হওয়ার আগে আমি তোদের দুজনকে মিলিয়ে দিয়ে তবে যাবো।”

তিস্তা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মানে, তোমার মনে কি...”

আমি ম্লান হেসে এক বাক্যে আমার মনের কথা জানিয়ে দেই ওকে, “আমার ভালোবাসা আমার কাছে নেই। অনেকদিন আগেই আমার হৃদয় কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। যা আমার কাছে নেই তাত আমি কাউকে দিতে পারিনা।”

একটু থেমে ওকে বলি, “এর চেয়ে বেশি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাস না, আমি উত্তর দিতে পারব না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ যে আমার ভালোবাসা আর আমার সাথে নেই।” খুব জোরে জড়িয়ে ধরে আমার কাঁধে মাথা রাখে তিস্তা। আমি ওর পিঠের ওপরে হাথ বুলিয়ে দিয়ে বলি, “আমি আপ্রান চেষ্টা করব তোদের দুজনকে একসাথে আনার জন্য।”

ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষার সিডিউল বেড়িয়ে গেছে। পড়ার জন্য ছুটি পরে যাবে আর কিছুদিনের মধ্যেই। লাস্ট পিরিওড শেষ, আমি ব্যাগের মধ্যে আমার বই খাতা ঢুকাচ্ছিলাম। তিস্তা ক্লাসের মধ্যে বসে ছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি যে ও বাড়ি যাবে কি না। মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয় যে কিছু পরে যাবে। আমার বাড়ি ফেরার একটু তাড়া ছিল তাই ওকে ছেড়ে দিয়েই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আসি। করিডরে এসে দেখি দেবব্রত আমার দিকে হেঁটে আসছে। আমি ওকে দেখে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসি আর এগিয়ে যাই। এগিয়ে যেতেই দেবব্রত আমার হাথ ধরে টান দেয়। আমি ওর ওপরে পরে যাই। রাগে অপমানে আমার মাথায় রক্ত চলে আসে। আমার বুক ওর ছাতির ওপরে চেপে যায়। আমার হাথ কিছুতেই ছাড়ে না দেবব্রত। আমি ওর এই আচরনে প্রচন্ড রেগে যাই।

দেবব্রত আমার মুখের কাছে ঠোঁট নামিয়ে এনে বলে, “কলেজের দিন শেষ হওয়ার আগে তোমাকে কিছু বলতে চাই।”

আমি ওর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে থাকি। আমি জানতাম যে একদিন আমাকে এই কথার সম্মুখিন হতে হবে, হয়ত আগে থেকে যদি বাঁধা দিতাম তাহলে হয়ত হত না, কিন্তু জানিনা কেন দিতে পারিনি। আমার মুখের ওপরে ওর উষ্ণ শ্বাস বয়ে চলে। একটু ঝুঁকে আমার কাজল কালো চোখের দিকে এক ভাবে তাকিয়ে থাকে। বুকের ওপরে আমি ওর বুকের ধুকপুকানি অনুভব করি। সারা শরীরে হটাত করে একটা বিজলি চমকে যায়। আমার রাগ যেন জল হয়ে আসে ওর ভালোবাসার ছোঁয়া পেয়ে। 

গলার স্বর নামিয়ে আমার কানেকানে বলে, “মিতা, আমি একটা বাইক কিনেছি। আমার খুব ইচ্ছে তুমি প্রথম আমার বাইকে চড়ো।”

আমি ওর কথা শুনে গলতে শুরু করে দেই। কিন্তু কোনোরকমে দাঁত পিষে মন শক্ত করে নেই আমি। আমি কি শেষ পর্যন্ত বয়ে চলে যাচ্ছি ওর ভালোবাসার কাছ থেকে? না, আমি তা হতে দিতে পারিনা। আমি শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে ওর বুকের ওপরে হাথ রেখে ওকে ঠেলে দিয়ে ওর দিকে রেগে তাকাই।

আমি ওকে রেগে বলি, “এই রকম করিস না দেবব্রত।”

দেবব্রত করুন সুরে বলে, “কেন, মিতা, আমি কি খারাপ ছেলে?”

আমি, “নারে তুই খারাপ ছেলে নয়। যা কিছু খারাপ সে আমার মধ্যে। তুই যা চাস তা আমি তোকে দিতে পারিনা। তোর জন্য অন্য কেউ অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে।”

দেবব্রত, “কে?”

আমি ওর হাথ ধরে টানতে টানতে ক্লাসের মধ্যে ঢুকে পরি। তিস্তা আমাদের ক্লাসে ঢুকতে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবব্রত কে বলি, “ও তোর জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে।”

আমাকে জিজ্ঞেস করে দেবব্রত, “তুমি?”

আমি ওর দিকে জোর গলায় বলি, “আমি কি আমি? তুই কি ওর চোখে নিজের ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছিস না? ওই তোর সেই ভালোবাসা যাকে তুই অনেকদিন ধরে খুজছিস।”

আমি তিস্তার কাছে দেবব্রতকে টানতে টানতে নিয়ে এসে ওর হাতে তিস্তার হাথ রেখে দেই। তিস্তা আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। আমার বুকের কাছেও এক অব্যাক্ত কান্না ঠেলে বের হওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু আমি সেই কান্নাকে চেপে দেই। দেবব্রত্র বুকের মাঝে একটা আলোড়ন শুনতে পাই তিস্তার হাথ ধরে।

দেবব্রত তিস্তাকে বলে, “আমার প্রেম বুঝতে তোর পাঁচ বছর লাগলো?”

তিস্তা দেবব্রতর কোমর জড়িয়ে ধরে ফেলে। দেবব্রত ওর মাথা নিজের পেটের ওপরে চেপে ধরে থাকে। আমার দিকে কৃতজ্ঞতার চোখে তাকিয়ে থাকে দেবব্রত। 

আমি তিস্তার গাল ছুঁয়ে বলি, “আমি আমার কথা রেখেছি, এবারে তোর হাথে সব, ছারিস না যেন একে।”

আমি ওদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি। তিস্তা দেবব্রতকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতে চায়। আমি ওকে ইশারায় জানাই যে আমি ভালো আছি, ঠিক আছি। ওদের প্রেম শুরু ওদের এবারে এক নতুন জীবন। ওদের প্রেম দেখে আমার চোখে জল চলে আসে। 

আমি ধিরে ধিরে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকি। চোখ বন্ধ করে নেই আমি। ডান দিকে তাকিয়ে দেখি যে একটা ধবধবে সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসছে। বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখি যে উর্বর মাটি ফুঁড়ে একটা ছোটো ধানের শীষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে। আমি ধানের শীষের দিকে ফিরে একপা এগিয়ে সেই ধানের শীষ পায়ের তলায় মথে দেই আর তারপরে একপা পেছনে সরে এসে আমার ভালোবাসার সাদা ঘোড়ার জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকি।

এমএসসি ফাইনাল পরীক্ষা শেষ। আমি জানতাম যে আমার ফলাফল ভাল হবে, সেইজন্য আমার বিশেষ কোন চিন্তা ছিল না। আমি অন্য আরেক কারনে বেশ খুশি ছিলাম। আমি মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম যে আমি এই সোনার খাঁচা ছেড়ে উড়ে যাব। মনের মধ্যে যেন এক স্বচ্ছ মলয় বয়ে চলে। 

সেদিন সকালে বাড়িতে কেউ ছিলনা, আমি মাকে ফোন করি, “মা, আমার পরীক্ষা শেষ, আমি তোমার কোলে ফিরে আসছি মা।”

মায়ের কোলে মেয়ে আবার ফিরে আসবে শুনে মায়ের গলা ধরে আসে, “হ্যাঁ রে পরী আমি তোর অপেক্ষা করে আছি রে। কতদিন তোকে দেখিনি, ফিরে আয় আমার কোলে।” 

আমি, “হ্যাঁ মা, এবারে আমি তোমার কোলে আবার ফিরে আসব। আমি ওখানে থেকেই চাকরি খুজব মা।”

মা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “অভিমন্যুর কোন খবর পেলি কি?”

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেই, “না মা এখন আমার সাথে কোনোরকমের যোগাযোগ করেনি। কিন্তু আমার মন বলছে যে ও আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি ওর জন্য অপেক্ষা করব মা, আমি জানি ও আসবে।”

মা, “ঠিক আছে, তুই কবে আসছিস?”

আমি, “এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসব।”

মা, “একটা ভালো খবর আছে রে।”

আমি, “কি?”

মা, “কল্যাণীর বাচ্চা হবে।”

আমি খুব খুশি হয়েছিলাম ওই খবর শুনে। মায়ের সাথে কথা বলার পরে আমি কল্যাণীকে ফোন করি, “কিরে তুই নাকি মা হতে চলেছিস?”

কল্যাণীর গলা খুব ক্ষীণ, কিন্তু বেশ খুশি ছিল, “হ্যাঁ রে। এই দুমাস হল। আমি লাস্ট মেন্স মিস করেছিলাম, একটু চিন্তিত ছিলাম, কিন্তু ডাক্তার দেখানর পরে সব ঠিক হয়ে যায়।”

আমি খুব খুশি ওর খবর শুনে। আমি প্রায় চেঁচিয়ে বলি, “আমি ফিরে আসছি রে, আমি এবারে তোর পাশে থাকব আর তোকে দেখব, তোর কোন চিন্তা নেই।”

কল্যাণী, “আমি তোর জন্য অপেক্ষা করে আছিরে।”

আমি তারপরে তিস্তাকে ফোন করি, “কিরে মেয়ে কেমন আছিস।”

তিস্তা আমার গলা শুনে অবাক হয়ে যায়, “কি ব্যাপার বলো তো, বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে?”

আমি, “হ্যাঁ তা একটু খুশি। আমি এবারে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাবো।”

তিস্তা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে যায়, “তুমি ফিরে যাবে, মানে? তুমি আর কোনদিন কোলকাতা আসবে না?”

আমি ওকে শান্তনা দিয়ে বলি, “আরে বাবা, আমি ফিরে যাচ্ছি তাঁর মানে এই নয় যে আমি এই জগত ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তোর সাথে আমার যোগাযোগ থাকবে ত, চিন্তা করছিস কেন?”

তিস্তা, “তোমার সাথে আমার এখুনি দেখা করতে ইচ্ছে করছে।”

আমি, “আমি কথা দিচ্ছি, গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগে আমি তোদের সাথে দেখা করে যাব।”

ওর গলা ধরে এসেছিল, “সত্যি কথা দিচ্ছ ত?”

আমি, “হ্যাঁ রে বাবা, কথা দিচ্ছি।”

আমি ছোটমাকে জানাই যে আমি গ্রামের বাড়ি ঘুরতে যেতে চাই। ছোটমা মানা করেননি আমার আবদারে। আমি আমার আসল অভিপ্রায় ছোটমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখি। আমি জানাই না যে আমি একবার বাড়ি ফিরে গেলে আর আসব না। আমি জানতাম যে আমি যদি ছোটমার কাছে থাকি, তাহলে ছোটমা আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবে। আমি আমার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষা করতে পারব না। প্রায় সাতশ তিরিশ দিন অতিবাহিত হয়ে গেছে আমি ওর গলার আওয়াজ শুনেছি। রোজ রাতে আমি একবার করে ওর “অপটিক্স নোটবুক” বার করতাম আর তার মধ্যে আমার মনের যাতনা, মনের আনন্দ লিখে রাখতাম। প্রত্যেক পাতায় আমি আমার লাল ঠোঁটের ছোঁয়া লাগিয়ে দিতাম, অনেক পাতায় আমার চোখের জলের দাগ পরে যায়।
Like Reply
#47
ছিন্ন নাড়ির টান

ছোটমা মায়ের জন্য শাড়ি আর বাকি সবার জন্য বিভিন্ন উপহার কেনাকাটায় ব্যাস্ত হয়ে পরে। ছোটমা খুব খুশি, অবশেষে ছোটমা তাঁর কথা রেখেছেন। আমার মুখে হাসি দেখে ছোটমা বাবু দুজনেই অনেক আনন্দিত। আমার সেই হাসি মুখের পেছনের আসল উদ্দেশ্য আমি গোপন করে যাই। আমার জন্মদিন পরের মাসে, আর মাত্র দের মাস বাকি। 

প্রতকে রাতে নিজেকে প্রশ্ন করতাম আমি, তুমি কবে ফিরবে? আমি আর থাকতে পারছিনা তোমাকে ছেড়ে। তোমার স্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় প্রতি রাতে। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা, সারা রাত বিছানায় জেগে বসে থাকি, তুমি আসবে আর আমাকে ঘুম পারাবে। সেই প্রথম রাতের কথা আমার খুব মনে পরে, কি ঝগড়া না করেছিলাম দুজনে। সেই সকাল, উম, কি সুন্দর তারপরের দিনের সকাল। তুমি কোথায় আমার সাদা ঘোড়া, এবারে আমি তোমার পিঠে চেপে ঘুরব, আর আমি উড়তে চেষ্টা করব না। একবার উড়তে চেষ্টা করে আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। এবারে তুমি আমাকে তোমার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে সেই ঢালাও প্রান্তরে ঘুরতে নিয়ে যাবে, সেই উঁচু উঁচু বিপিন দেবদারুর বনে, সেই পাইন কেদার গাছের তলায়। তোমার আলিঙ্গনে নিজেকে সঁপে দিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমাতে চাই।

একদিন দেবব্রত আমাকে ফোন করে বলে যে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমি ওদের আমার বাড়িতে ডেকে নেই। সেদিন আবহাওয়া কেমন যেন একটু গুমোট ছিল। বাইরে যেন বাতাস ছিলনা। কয়েক ঘন্টা পরে তিস্তা আর দেবব্রত আমার বাড়ি পৌঁছে যায়। তিস্তা একটা সাধারন সুতির সালোয়ার পরে, আমি ওকে দেখে অবাক।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কিরে কি হয়েছে তোর?”

লাজুক হেসে দেবব্রতর দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “ও আমার জিন্স পরা পছন্দ করে না তাই সালোয়ার।”

আমি হেসে ফেলি তিস্তার লাজুক চেহারা দেখে, “বাপরে, প্রেম যেন উথলে পড়ছে।”

দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, একটু পরে বলে, “এই দুই বছরে আমরা এত কাছাকাছি থেকেও আজ মনে হচ্ছে যেন আমি তোমাকে চিনি না। সত্যি বলোত তুমি কে? তুমি আমার চেয়ে বড় তাই একবার ...”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কি বলতে চাস?”

দেবব্রত, “না থাক। তোমাকে দেখে আমি আমার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।”

দেবব্রতর গলা কথা বলার সময়ে ধরে এসেছিল। তিস্তা ওর পিঠে হাথ বুলইয়ে দেয়। তিস্তা আমার দিকে দেখে বলে, “সত্যি মিতা, তুমি আমাদের জন্য যা করলে। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো জানিনা। তোমাকে দেখে অন্য জগতের মেয়ে বলে মনে হয়। তোমাকে একটা খুব ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করতে পারি কি?”

আমি জানতাম কি সেই ব্যাক্তিগত প্রশ্ন, আতি আমি আগে থেকেই তিস্তাকে বারন করে দিলাম, “আমি জানি তুই আমাকে কি জিজ্ঞেস করবি। জিজ্ঞেস করিস না, আমি তাঁর উত্তর দিতে পারব না।”

দুজনে আমার উত্তর শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে, “ঠিক আছে, জিজ্ঞেস করব না। শুধু উপরয়ালার কাছে প্রার্থনা করব যার জন্য তুমি এতদিন অপেক্ষা করে আছো, সে যেন তোমার কাছে ফিরে আসে।”

আমি জানি রে সে কথা, শুধু আমার সময় আমার সাথে নয়। 

জুন মাসের মাঝামাঝি, গ্রীষ্ম কাল। আমি সকাল বেলার জলখাবার করতে রান্না ঘরে ব্যাস্ত ছিলাম। ছোটমা কলেজ ফেরত সেদিন আমাদের বাড়ি যাওয়ার কথা বলেছিলেন। আমি খুব খুশি ছিলাম যে মায়ের সাথে ছোটমার দেখা হবে। ফোন বেজে ওঠে। 

ছোটমা ফোন ধরে আঁতকে ওঠে, “কি, কখন। না...”

আমি ছোটমা আঁতকে ওঠা শুনে দৌড়ে রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আসি। কার ফোন, কার কি হয়েছে, এইসব ভেবে মনের ভেতরে ভিতির সঞ্চার হয়। ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, ছোটমার চোখে জল দেখে। 

আমি ছোটমার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠি, “কার কি হয়েছে, ছোটমা?”

ছোটমা কোন উত্তর দেন না। কোনোরকমে কান্না চেপে ফোনে বলেন, “না, আমরা এখুনি আসছি। ওখানে থাক তোরা, আমি মেয়েকে নিয়ে শ্মশানে যেতে চাইনা রে।”

আমি ছোটমায়ের কথা শুনে তাঁর দিকে দৌড়ে যাই। ছোটমায়ের জল ভরা চোখ আর ঠোঁটের কাপুনি দেখে থেমে থাকতে পারিনা। ছোটমা ফোন ছেড়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাবুকে তাড়াতাড়ি একটা গাড়ির ব্যাবস্থা করতে বলেন। আমি বুঝে উঠতে পারিনা কার কি হয়েছে। বাবু ছোটমায়ের কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে কারন জিজ্ঞেস করেন।

ছোটমা আমার মাথা বুকে চেপে ধরে বাবুকে বলেন, “মাসিমা... তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি ডাকো তুমি।”

ছোটমায়ের মুখে “মাসিমা” শুনে আমি পাথর হয়ে যাই। আমি চোখ বুজে ফেলি, সারা পৃথিবী আমার চোখের সামনে দুলতে শুরু করে দেয়। আমি ছোটমায়ের কোলে মুখ গুঁজে পরে যাই, তারপরে আর কিছু মনে নেই আমার।

চোখ খুলে দেখি আমি আমার বিছানায় শুয়ে। মাথার কাছে তিস্তা আর দেলিসা। আমি ওদের দেখে পাথর হয়ে যাই। তিস্তা কোনরকমে আমাকে কাপড় পড়িয়ে দেয়। দানিস গাড়ি নিয়ে আসে। আমাকে ধরে ধরে গাড়িতে উঠায়। দুজনে আমার দুপাশে বসে থাকে। মায়ের সেই দুঃসংবাদ আমাকে পাথর করে দেয়।

গাড়ি থেকে নেমে দেখি, আমার মা, অন্তিম শয্যায় শুয়ে আছে উঠানে, তুলসিতলার পাশে। মাথার কাছে বড়দা বসে। সাদা শালুর কাপরে ঢাকা আমার মা। কষ্টে আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুকে যেন কেউ পাথর বসিয়ে দিয়েছে, সেই বিশাল পাথরের নিচে আমার কান্না, আমার কষ্ট আমার বেদনা সব কিছু চাপা পরে যায়। আমি সেই পাথর সরাতে পারিনা, কাঁদতে পারিনা।

আমার ছোটো বৌদি, মৈথিলী সেই এগারো দিন আমার কাছে ছিল, এক মুহূর্তের জন্যেও আমার পাশ ছাড়েনি সে। আমাকে খাওয়ান, আমাকে দেখা সব কিছু ভার সে একা নিয়ে নেয় নিজের হাথে। আমার ভগ্ন হৃদয় জোড়া লাগাতে চেষ্টা করে কিন্তু আমার হৃদয় ততদিনে ভেঙ্গে শত টুকরো হয়ে যায়, কুড়িয়ে কুড়িয়ে সব টুকরো একত্র করে উঠতে পারেনা মৈথিলী। সে এগার দিন আমি নিজেকে আমার ঘরে বন্দিনী করে রাখি।

এগার দিনের কাজে আমার সব আত্মীয় সজ্জন আসেন। ইন্দ্রানিদি, চন্দ্রানিদি আমাকে এসে বলেন যে আমি সব থেকে ভালো হাথে আছি, আমার ছোটমা আর বাবু সর্বদা আমার জন্য আমার পাশে থাকবে। কিন্তু আমি কেউ জানত না যে আমি শুধু মাত্র এক বন্দিনী রাজকুমারীর জীবন জাপন করি সেই সোনার খাঁচায়। আমি জানতাম আমাকে ফিরে যেতে হবে সেই সোনার খাঁচায়, চিরদিনের মতন। আমার নাড়ি ছিঁড়ে গেছে।

দমদমের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগের দিন বিকেল বেলা আমি একা একা বাড়ির পেছনের বাগানে যাই। সেই আম গাছের কাছে গিয়ে দাড়াই। একটা আমের প্পল্লব তুলে নিয়ে রুমালে বেঁধে নেই। সেই গাছের তলা থেকে এক মুঠ মাট নিয়ে আম পল্লবের সাথে রুমালে বাঁধি। 

আমি ওর পোঁতা আম গাছ জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলি, “অভিমন্যু, তোমার পরী আজ মারা গেল।”

কিছু দিন আগে পর্যন্ত যে আশার আলো দেখেছিলাম, সেই ক্ষীণ আশার আলো আমার মায়ের সাথে নিভে যায়। এই বাড়ির সাথে, আমার গর্ভধারিণীর সাথে সাথে নাড়ীর টান ছিন্ন হয়ে যায়। আমি ছোটমা আর বাবু পোষা তোতাপাখি, তাঁরা যা বলবেন এবার থেকে আমাকে তাই করতে হবে, তাঁরা যা করবেন সেটাই ঠিক। অনন্ত সাগর তীরে নিজের অজানা ভাগ্যের হাথে নিজেকে সঁপে দিয়ে আমি একাকী দাঁড়িয়ে থাকি।





====== প্রথম অধ্যায়ের সমাপ্তি ======
[+] 3 users Like Nefertiti's post
Like Reply
#48
প্রথম পর্ব শেষ করলাম।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তপ্ত বালুচর

সময় করে পোষ্ট করবো।
Like Reply
#49
English এ পূরুটা পড়তে চাইলে নিচের লিংক এ যান।  বাংলায় সময় লাগবে।



https://xossipy.com/showthread.php?tid=23700
Like Reply
#50
(21-03-2020, 11:03 AM)Nefertiti Wrote: প্রথম পর্ব শেষ করলাম।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তপ্ত বালুচর

সময় করে পোষ্ট করবো।

অনেক অনেক ধন্যবাদ পোস্ট করার জন্য, ভুলে জাননি দেখে ভালো লাগল
Like Reply
#51
কেউ অনুবাদ করতে চাইলে আমাকে মেসেজ করুন। আর না হলে আমি পুরুটা অনুবাদ করতে পারবো না। আমি দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ করব। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব করবো কিনা ভাবতে হবে। কেউ help করেন।
Like Reply
#52
আপডেট দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা। আশা করি পরবর্তী আপডেট গুলো দ্রুত এবং নিয়মিত আসবে।
Like Reply
#53
দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তপ্ত বালুচর

পরীর আত্মসমর্পণ (#01)





উড়তে মানা আকাশের তোর, বসতে মানা ডালে,

বাসা বাঁধিতও মানা, কি আছে কপালে,

বলি ঝরে হারাতে ত মানা নাই।

ওরে মন পাখি, কেন ডাকাডাকি, তুই থাক না গোপনে,

উড়তে আছে মানারে বন্ধু এই খোলা আসমানে, 

তুই থাক না গোপনে। 




রাজকন্যে ফিরে আসে তাঁর সোনার খাঁচায়, তাঁর যে আর মাথা গোঁজার জায়গা নেই। ভগ্ন হৃদয়, আশার সব আলো নিভে গেছে। দিগন্তের বুকে সেই ছোটো জাহাজের মাস্তুল ধিরে ধিরে বাঁকা দিগন্তের তলায় তলিয়ে গেল। সেই সাদা ঘোড়া আর ফিরে এল না, পরীর কাঁধ ছুঁয়ে আদর করল না, পরী ওর ডাকের জন্য অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু শূন্য সে বুক। চারপাশে শুধু অন্ধকারে ঢাকা। 

আগস্টে আমি আঠাশ বছরে পা দিলাম। আমি নিজেকে শামুকের খোলে মধ্যে গুটিয়ে নেই, আমার ঘর থেকে খুব বের হতাম। কলেজ শেষ, রান্না ঘর আর আমার ঘর আমার সব কিছু ছিল। বাইরের জগতের সাথে একরকম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ছোটমা বাবু আমার চেহারা দেখে খুব চিন্তিত হয়ে পড়েন। মা চলে যাওয়ার পরে আমি যেন কোন কিছুতে আর খুশি খুঁজে পাইনা। সেই সাদা ঘোড়া আর কোনদিন আমার কাছে ফিরে আসবে না, সেটা আমি ভালো ভাবে বুঝতে পেরে গেছিলাম। মায়ের চিতার আগুনে আমার সব আশা, সব আখাঙ্খা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আমার মা ছোটমাকে জানাতে পারলেন না তাঁর মনের অভিপ্রায়। সাদা ঘোড়া চিরতরে হারিয়ে গেল। মায়ের সাথে সাথে সেই “অপ্টিক্স নোটবুক” বইয়ের তাকে ঢুকে পরে, সেই ডায়রির লেখার কোন মানে নেই আর।

ছোটমা একদিন আমার ঘরে এসে আমাকে বললেন, “সোনা মা, আমি তোর মায়ের মতন।”

আমি করুন চোখে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি, হ্যাঁ সত্যি তুমি আমার মায়ের মতন কিন্তু আমার মা নও। আমি ছোটমাকে ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করি, “আর কি চাও আমার কাছ থেকে, ছোটমা?”

ছোটমা, “ওই রকম ভাবে আমার সাথে কথা বলছিস কেন? এক মা তাঁর মেয়ের কাছে কি আর চাইবে, তাঁর ভালোই চাইবে।”

আমি তোমার মেয়ে হতে চাইনি ছোটমা, আমি তোমার বাড়ির বউমা হতে চেয়েছিলাম। পূরণ করতে পারবে আমার মনের আশা? আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি আমার জন্য ছেলে খুঁজছও?”

ছোটমা মাথা দুলিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে, পরী, আমি আর তোর বাবু, তোর জন্য ছেলে খুঁজছি।”

আমি ছোটমায়ের কথা শুনে একটু রেগে যাই, বলি, “আমি কলেজ টিচার হতে চেয়েছিলাম, তাঁর কি হবে? তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে যে।”

ছোটমা আমার পাশে বসে আমার গালে হাত রেখে আদর করে বলেন, “সোনা মা, আমি তোর জন্য সেই রকম ছেলেই খুঁজব যে তোকে চাকরি করতে দেবে, তোকে পড়াশুনা করতে দেবে। বিশ্বাস কর।”

আমি ফুঁপিয়ে উঠি, “যত তাড়াতাড়ি পারো তুমি আমাকে বাড়ি থেকে তারাতে চাও, তাই না?”

ছোটমা মৃদু বকুনি দিলেন আমাকে, “কি সব উল্টপাল্টা বলছিস তুই, আমি কেন তোকে তাড়াতে চাইব।”

আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে, চোখের সামনে সব আলো নিভে গেছে। হারানোর মতন আমার কাছে আর কিছু নেই। মনের মধ্যে সব সাহস সঞ্চয় করে ছোটমাকে বলি, “আমার যাওয়ার কোথাও আর জায়গা নেই তাই কি তুমি আমার জীবন নিয়ে খেলা করছ? আমি এখন বিয়ে করব না, আমি গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাবো, সেখানেই থাকব।”

ছোটমা গম্ভির সুরে বলেন, “তুই ফিরে যেতে পারিস না, আমি তোকে যেতে দেব না। কে তোকে দেখবে? তোর দাদারা? না, ওদের নিজেদের সংসার আছে, ওরাও তোকে বিয়ে দিতে চেষ্টা করবে। তুই ভালো করে ইন্দ্রানি আর শশাঙ্কর অভিপ্রায় জানিস।”

আমি ছোটমায়ের দিকে আশাহত হয়ে তাকিয়ে থাকি, সত্যি আমার আর কেউ নেই দেখার। আমি ছোটমাকে জানাই যে আমার কিছু সময় চাই ভেবে দেখার জন্য। ছোটমা আমাকে জানান যে কোলকাতার পেপারে আমার বিয়ের জন্য ইস্তেহার দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই কথা শুনে আমার মনে হল যেন কেউ গরম তেল আমার মাথার ওপরে ঢেলে দিয়েছে।

আমি জোর গলায় ছোটমাকে বলি, “আমাকে জিজ্ঞেস করার কথা একবারের জন্যেও তোমার মনে হল না?”

খুব ধীর শীতল গলায় উত্তর দিলেন ছোটমা, “আমরা যা কিছু করছি সেটা তোর ভালোর জন্যেই করছি। তোর কিসে ভালো কিসে মন্দ আমরা ভালো করে জানি।”

ছোটমা চলে যাওয়ার পরে আমি চুপ করে বিছানায় বসে থাকি। বাইরের আকাশের মতন মন ভারাক্রান্ত। বর্ষাকাল শেষ, কিন্তু আকাশ একটু মেঘলা। ওর কাছ থেকে কোন যোগাযোগ নেই, আমি আশাহত।

প্রতিদিন বিকেলে দেখতাম আমার বিয়ের জন্য অনেক ফোন আসে। বাবু সেই ফোন ধরে সব কিছু লিখে নিতেন। আমি কিছু বলতাম ওদের। মাঝে মাঝে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করত যে কি ধরনের ছেলে আমার পছন্দ, তাঁর উত্তর আমি দিতাম না।

একদিন আমি ছোটমাকে বলি, “ছোটমা, আমি তোমার সব ঋণ শোধ করে দেব। আমি তোমার রক্ত মাংসের মেয়ে নই, তা সত্তেও তুমি আমার জন্য অনেক কিছু করেছ। কিন্তু...”

ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কিন্তু, কি পরী?”

আমি বুক ভরে এক শ্বাস নেই, কিছুক্ষণ বাবু আর ছোটমার দিকে তাকিয়ে তারপরে বলি, “একবার, শুধু একবারের জন্য আমাকে উপরের ঘরে যেতে দেবে।”

কথা বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে এসেছিল। 

ছোটমা বাবু আমার মুখে ওই কথা শুনে অবাক হয়ে যান। পরস্পরের মুখ চাওয়াচায়ি করেন। বাবু গম্ভির গলায় আমাকে বলেন, “না তুমি ওই ঘরে যেতে পারবে না। ওর ঘর তালা বন্ধ।”

আমি ওদের দিকে রেগে তাকিয়ে বলি, “ঠিক আছে, তোমরা এতই যখন আমার বিয়ে নিয়ে ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পরেছ, তাহলে এত খুঁজছ কেন? যাকে খুশি ধরে নিয়ে আস, আমি তাঁর সাথে বিয়ে করে নেব।”

আমি ওদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেই। বুকের মাঝে আগুন জ্বলে ওঠে, বেদনার তীব্র আগুনে আমার পাঁজর, আমার রক্ত ফুটতে থাকে। চুপ করে বিছানায় বসে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমার সাথে প্রতারনা করল, আমার ভালোবাসা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে চলে গেল, একবারের জন্য ফিরে তাকাল না, এত বার বলেও একবারের জন্য যোগাযোগ করার চেষ্টা করল না। সারা রাত আমি ঘুমাতে পারিনা, জেগে বসে থাকি আমার অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতকে দেখার জন্য। বুক ফাঁকা, বুক চেপে কান্না দিয়ে ভরিয়ে দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু বুকের আগুন হাথের ছোঁয়ায় আরও ধিকধিক করে জ্বলে ওঠে।

মাঝ রাতে দরজায় আওয়াজ শুনে আমি উঠে দরজা খুলি। দরজায় ছোটমাকে দেখে আমি একটু থমকে যাই। ছোটমা আমার হাথে ওর ঘরের চাবি দিয়ে করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।

ছোটমায়ের দুচোখে জল, আমি হাথ থেকে চাবি নিয়ে ছোটমায়ের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকি। ওই চাবি যেন আমার কাছে সব কিছু।

ছোটমা চোখের জল মুছে আমাকে নিচু গলায় বলেন, “সোনা মা, যা। কিন্তু সকালে আমি যেন সঠিক উত্তর পাই।”

আমি ধিরে ধিরে সিঁড়ি চড়ে ওর ঘরের সামনে এসে দাড়াই। বুকের মাঝে এক উত্তাল ঢেউ এসে আছড়ে পরে। শ্বাস বন্ধ করে নেই, তালা খোলার আগে। নিচের ঠোঁট চেপে ধরে থাকি, মনে হয় যেই আমি তালা খুলে ভেতরে ঢুকব, সেই খনে আমাকে এসে জড়িয়ে ধরবে। আমি শেষ পর্যন্ত তালা খুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ি। গত দু’বছর এই ঘর বন্ধ ছিল, কারুর পায়ের চিহ্ণ নেই গরের ধুল মলিন মেঝের ওপরে। বন্ধ থাকার জন্য ঘরের হাওয়া গুমোট বেঁধে থাকে। সেই গুমোট গন্ধে আমার বুক কেঁপে ওঠে, ঠিক যেন একটা ছোটো দিপের শিখা ঝড়ো হাওয়ায় দুলে ওঠে। টেবিলের নিচে এক কোনায় একটা ইদুর মরে পরে আছে। ওর পড়ার টেবিল, চেয়ার ধুলোতে ঢাকা। বিছানার চাদর গত দু’বছরে বদলানো হয়নি। টিকটিকির মল আর ইঁদুরের মল ছড়িয়ে আছে বিছানার চাদরের ওপরে। খাটের দুপাশে মাকড়সার জালে ভর্তি।

আমি জানালা খুলে দিয়ে নতুন বাতাসকে আহবান জানাই সেই বদ্ধ ঘরের ভেতরে। চেয়ারের ধুলো ঝেরে জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসে পরি। চোখের কোনে জল চলে আসে, বুক কেঁপে ওঠে ওর কথা মনে করে। না কিছুতেই কাঁদব না, কার জন্য কাঁদব আমি, যে কিনা আমাকে ভুলে গেছে? ঠিক চলে যাওয়ার আগের দিনে আমি ঠিক সেইখানে বসে ছিলাম, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার ছবি আঁকছিল। আমি সেইদিকে তাকিয়ে থাকি, হয়ত বাঁ এখনো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু আমার চোখে শুধু অন্ধকার দেখে, না ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে নেই, সব আমার মনের ভ্রম। আমি টেবিলের ড্রয়ার খুলে দেখি একটা ছোটো কাঠের বাক্সে কত গুলো কাঁচের গুলি রাখা। আমি আবার সেই বাক্স যথাস্থানে রেখে দিলাম।

শেষ বারের মতন ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিলাম। জানালা বন্ধ করে দিলাম। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি, চোখের পাতা ভিজে আসে। শেষ পর্যন্ত তালা বন্ধ করে দিলাম দরজায়, সেই তালার পেছনে আমার সব আশা সব ভালোবাসা বন্ধ করে দিয়ে নিচে নেমে চলে এলাম। ছোটমা বসার ঘরে বসে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

আমি ছোটমায়ের হাথে চাবি ধরিয়ে দিয়ে বলি, “আমার আর কোন পথ নেই, যেখানে ভাগ্যবিধাতা আমাকে নিয়ে যাবে, আমি চুপ করে সেখানে যাবো।”

সেইরাতে শেষ বারের জন্য আমি ওর “অপ্টিক্স নোটবুক” তাক থেকে বের করি। ডায়রি আর ওর দেওয়া সেই বুদ্ধের মূর্তি একটা কাগজে মুড়ে একটা বাক্স বন্দি করে দেই। সেই বাক্স আমি মোম দিয়ে এটে দেই।

একদিন আমি ছোটমাকে বলি যে আমি কল্যাণীর সাথে দেখা করতে যাবো। ছোটমা মানা করেন নি। আমি কল্যাণীর বাড়ি যাই, ওর হাথে সেই বাক্স তুলে দিয়ে বলি, “আমার জীবন শেষ।”

কল্যাণী বাক্স হাথে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে তাঁর মানে। 

আমি বলি, “এই বাক্সে কিছু অকেজো জিনিস আছে। আর আমার কাজে লাগবে না ওর ডায়রি। আমার এত শক্তি নেই যে আমি ওর ডায়রি জ্বালিয়ে দেই, তাই তোর কাছে নিয়ে এলাম আমি। তুই আমার হয়ে এই টুকূ কাজ করে দে, পারলে এই জিনিস গুলো ধ্বংস করে দিস। ছোটমা বাবু আমার জন্য ছেলে খুঁজছে, কিছুদিনের মধ্যে আমার বিয়ে হয়ে যাবে।”

কল্যাণী আমার কথা শুনে আঁতকে ওঠে, “কি বলছিস তুই? ও যদি ফিরে আসে?”

আমি ম্লান হেসে ওকে বলি, “দু বছর, দু বছর আমি ওর জন্য অপেক্ষা করে করে হাঁপিয়ে গেছি। একবারের জন্যেও আমার সাথে যোগাযোগ পর্যন্ত করল না। ভুলে গেছে আমাকে, ভুলে গেছে ও কাউকে ভালবাসত। ভালোবাসা ওর জন্য নয়, ও এক কাপুরুষ, হৃদয় হীন মানুষ। নিজের বাবা মায়ের কথাও ভুলে গেছে।”

আমার চোখে সেদিন জল ছিলনা, কিন্তু আমার কথা শুনে কল্যাণীর চোখে জল চলে আসে। আমার ফাঁকা বুক, সেই চোখের জল ভরিয়ে দেইতে পারেনা। বেদনায় আর রাগে আমার হাত পা কেঁপে ওঠে। আমি ওর কান্না দেখে ওকে বলি, “কেন এক অভাগিনী মেয়ের জন্য চোখের জল ফেলছিস তুই? কেঁদে লাভ নেই রে।”

আমি ওর গালে হাত দিয়ে বলি, “তুই সুখী থাক, খুব ভালো মা হবি তুই।”

কল্যাণী আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ওঠে, “পরী...”

সেই নাম শুনে আমার কান্না গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসে। আমি ধরা গলায় ওকে বলি, “কল্যাণী, পরী অনেক দিন আগেই মরে গেছেরে। তোর সামনে এক অন্য মেয়ে দাঁড়িয়ে, মিতা, জানিনা এই মিতার ভবিষ্যতে ভাগ্যবিধাতা কি লিখে গেছে।”

কল্যাণী আমার কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখে। ওর হাতের স্নেহের স্পর্শে আমার মন গলে যায়, আমি ওকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠি। কল্যাণী আমার পিঠে হাত বুলিয়ে আমাকে সান্তনা দেয়। আমি ওকে বলি, “কল্যাণী রে, যেদিন ছোটমা ওকে বের করে দেয় সেইদিন পরী মরে গেছে। যেদিন আমার মা মারা যান সেদিন পরী মারা যায় আবার। আমার বুকে বেশি প্রাণ বেঁচে নেইরে কল্যাণী, বারেবারে আমি মরতে পারিনা রে। আমি আমার ভাগ্যের কবলে নিজেকে সমর্পণ করে দিয়েছি রে।”

সেইদিন আমি আর গ্রামের বাড়িতে গেলাম না, আমি সারাদিন কল্যাণীর সাথেই ছিলাম। বিকেলে আবার বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। বাড়ি ফেরার আগে কল্যাণীকে আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে আসি আমার বিয়েতে আসার জন্য। কল্যাণী ওর গর্ভের ওপরে হাত বুলিয়ে আমার দিকে হেসে বলে, “লাথি মারছে রে। জানিনা তোর বিয়ে কবে, জানিনা যেতে পারবো কিনা, তবে কথা দিচ্ছি যে দীপঙ্কর যাবে।”
Like Reply
#54
পরীর আত্মসমর্পণ (#02)

আমি ফিরে আসি আমার খাঁচায়, হাসতে ভুলে, কাঁদতে ভুলে এক পাথরের মূর্তির মতন দিন গুনতে আরম্ভ করি আসন্ন অন্ধকার দিগন্তের জন্য। কয়েকদিন পরে ছোটমা আমাকে জানায় যে তাদের সাথে আমাকে একটা বিয়ে বাড়ি যেতে হবে। আমি অনুধাবন করেছিলাম যে, বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন উপলক্ষ মাত্র, আসল উদ্দেশ্য মেয়েকে দেখানোর। ছোটমা আমাকে সুন্দর করে সাজতে বলেন আর বলে সেই তুঁতে রঙের শাড়ি পড়তে। আমি কোন বাঁধা দেই না ওদের। মন ভাসিয়ে দেই মরা গাঙ্গে।

অনেকদিন পরে সেদিন আমার যেন সাজতে ইচ্ছে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বলি, কেঁদে লাভ নেই পরী, দুঃখ করেও লাভ নেই, দুহাথে বরন কর নতুন জীবন। ওকে উত্যক্ত করার জন্য যেন আমি সেদিন বেশি করে সাজি। তুঁতে রঙের শাড়ি, রুপলি সুতোর ভারী কাজ করা আঁচল, তাঁর সাথে মিলিয়ে ছোটো হাথার ব্লাউস গায়ে। কপালে গাড় নীল আর আকাশী রঙের টিপ, চোখের কোনে কাজল। মাথার চুল সাপের মতন বেনুনি করে বাঁধা, পিঠের ওপরে ঝুলে থাকে। কানে সোনার ঝুমকো, গলার ছোটমায়ের দেওয়া সেই মোটা সোনার হার। বাম কব্জিতে টাইটানের সোনার ঘড়ি আর অন্য হাথে কয়েক গাছি তুঁতে আর সাদা রঙের চুড়ি। নিজেকে দেখে নিজের বেশ ভালো লাগে।

আয়নায় দেখে নিজেকে বলি, “শুচিস্মিতা, তোকে আজ দারুন দেখতে লাগছে।”

সেদিন আমার কাঁধ কেউ ছোঁয় না, কেউ আমার কানেকানে এসে বলেনা যে আমাকে সুন্দর দেখাচ্ছে। আমি তার অপেক্ষাও করিনা।

ছোটমা আমাকে দেখে খুব খুশি হয়ে বলেন, “সোনা মাকে আজ দারুন দেখতে লাগছে।”

আমি ওদের দিকে হেসে বলি, “চলো। আমি ভালো করে জানি আমাকে কেন বিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছ। আমার আঠাশ বছর বয়স হয়ে গেছে, আমার মাথায় কিছু ত বুদ্ধি আছে, ছোটমা।”

ছোটমা আমার দিকে হেসে বলেন, “পরী আমরা যা করছি তোর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে করছি।”

পরী অনেক দিন আগেই মারা গেছে, ছোটমা, যেদিন তুমি ওকে ঘর থেকে বের করে দিলে, তাঁর সাথে সাথে সেই পরী চলে গেছে এই দেহ ছেড়ে। না আমি সেই কথা মুখে আনিনি, শুধু একটু হেসে ছোটমায়ের সাথে বিয়েবাড়ির দিকে রওনা হয়ে যাই।

বিয়েবাড়িতে কাউকেই আমি চিনতাম না, বাবুর এক আত্মীয়র বিয়ে ছিল। আমার চারপাশে লোকের ভিড়, আমি একা। পুরুষের নজর আমার দিকে, সবাই যেন আমার একটু হাসির জন্য উন্মুখ। আমি মনেমনে ওদের ভাবব্যাক্তি দেখে হেসে ফেলি। খুব একা মনে হয় এই পৃথিবীতে। আমি একটা চেয়ার নিয়ে বিয়ে বাড়ির বারান্দায় বসে আকাশের তারা গুনতে শুরু করে দেই। সামনে দুর্গা পুজো, আকাশে বাতাসে আবার আগমনীর সুর ভেসে আসে। আকাশে পোজা পোজা সাদা তুলোর মতন মেঘের ভেলা চড়ে বেড়ায়। তারা গুনতে গুনতে আমি হারিয়ে যাই ওই খোলা গাড় নীল আকাশে।

একজনের গলা খাঁকাড়ি দেয়ার আওয়াজে আমার চিন্তার তার ভেঙ্গে যায়। আমি ঘুরে তাকিয়ে দেখি এক সুদর্শন যুবক আমার দিকে তাকিয়ে। বেশ লম্বা ছেলেটা, বয়স আমার কাছাকাছি হবে। শক্ত চোয়াল, সুঠাম দেহ। গাড় বাদামি সুটে বেশ সুন্দর দেখায় ছেলেটাকে। আমাকে দেখে হাত জোর করে অভিবাদন জানায়। আমি দাঁড়িয়ে উঠে প্রতি প্রনাম জানাই হাত জোর করে। একটু বিরক্ত বোধ করেছিলাম ওর অযাচিত ব্যাবহারে।

বেশ গভীর গলায় হাসি মুখে আমাকে বলে, “আমি নিলাদ্রি কর্মকার।”

আমি একটু দনামনা করার পরে উত্তর দেই, “শুচিস্মিতা।”

মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেয়, “হ্যাঁ, আপনার নাম জানি, আপনার মা বলেছেন।”

“আমার মা?”

আমি প্রশ্ন করাতে ভদ্রলোক আমার ছোটমায়ের দিকে আঙুল দিয়ে দেখায়। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা একজন বয়স্ক ভদ্রলোকের সাথে একটু দুরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। 

নিলাদ্রি, “আমার দাদা ঝামাডোবা কোলিয়ারির ম্যানেজার, আমরা ধানবাদে থাকি। আপনি ধানবাদের নাম শুনেছেন?”

আমি, “হ্যাঁ ধানবাদের নাম শুনেছি।”

নিলাদ্রি সেই ভদ্রলোকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “আমার বাবা, কমলেশ কর্মকার, ধানবাদের খুব বড় কয়লার কন্ট্রাক্টার। আমার দাদার নাম হিমাদ্রি কর্মকার, এইএসএম ধানবাদ থেকে মাইনিং নিয়ে পাস করেছে। এইএসএম জানেন?”

আমি, “হ্যাঁ নাম শুনেছি।”

নিলাদ্রি বলে, “আমি শুনেছি আপনি ফিসিক্সে এমএসসি করেছেন? আমার দাদা পড়াশুনায় খুব ভালো। দাদা মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার, উনিশশো-পঁচানব্বইয়ে পাশ করেছেন।”

আমি ওর দাদার বয়স মনে মনে যোগ করে দেখলাম এই বত্রিশের মতন হবে। কিন্তু আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, ছেলেটা বারবার ওর দাদার ব্যাপারে কেন বলছে, নিজের ব্যাপারে কেন কিছু বলছে না। আমাকে চেয়ারে বসতে বলে একটা সিগারেট জ্বালায়।

একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলে, “আমার বাবা দাদার জন্য পাত্রী খুঁজছেন।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি। আমার হাসি দেখে নিলাদ্রি বুঝতে পারে যে আমি এতক্ষণ ওর কথা ভাবছিলাম। নিলাদ্রি আমার চেহারার লাজুক হাসি দেখে বলে, “না না আমি নই, আমার বয়স আপনার মতন হবে এই আঠাস।”

আমি লজ্জায় অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে ফেলি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে নিলাদ্রি। আমাকে মজা করে বলে, “আপনাকে কি নামে ডাকা যায় বলুনত? শুচিস্মিতা বৌদি অনেক বড় নাম, দাঁত খুলে হাতে চলে আসবে।”

আমি ওর কথা শুনে হেসে ফেলি, “এমি এখনো আপনার বৌদি হইনি, কিন্তু।”

নিলাদ্রি ছোটমা আর ওর বাবার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “যে ভাবে আপনার মা আর আমার বাবা কথা বলছেন, মনে হয় দাদা থাকলে আপনাদের এই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিত।”

অনেকদিন পরে মনের মধ্যে হালকা হাসির ছোঁয়া পাই আমি, ওর কথাবার্তা খুব মিশুকে, আমার খুব ভালো লাগছিল ওর সাথে কথা বলতে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “আপনার দাদা কোথায়?”

নিলাদ্রি হেসে কপাল চাপড়ে বলে, “কাজ আর অফিস। সত্যি দাদাকে আসা উচিত ছিল, আপনাকে একবার দেখলে দাদা কাজ ভুলে যাবে।”

আমার মুখ লাল হয়ে যায় লজ্জায়। নিচের ঠোঁট কামড়ে বড় বড় চোখ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। মুখ নিচু করে আমার কানের কাছে এসে বলে, “দাদা সত্যি আপনাকে দেখলে থাকতে পারবে না।”

ওর কথাবার্তা মাঝে মাঝে অতি বিরক্তিকর বলে মনে হচ্ছিল। 

আমি পেছন ফিরে ছোটমাকে খুঁজতে চেষ্টা করি। ঘুরে দেখি ছোটমা আর নিলাদ্রির বাবা আমাদের পেছনে দাঁড়িয়ে। ছোটমা আমাকে ইঙ্গিত করেন ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে। আমি ঝুঁকে ভদ্রলোকের পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। ভদ্রলোক আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “অনেকদিন ধরে ছেলের জন্য একটা লক্ষ্মী ঠাকুর খুজছিলাম, তোমাকে দেখে মনে হল শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেছি আমার লক্ষ্মী।”

আমি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে চোখের কোনে ছলকে আসা ব্যাথা লুকিয়ে নেই। শেষ পর্যন্ত আমার ভবিতব্য আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে, আমার বিবাহ আসন্ন। এক নতুন দিগন্ত, এক নতুন জীবন আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

নিলাদ্রির বাবা ছোটমাকে বললেন, “হিমাদ্রির এখানে আসা উচিত ছিল, তাহলে একেবারে শুচিস্মিতাকে দেখে যাওয়া যত। আমাদের আবার আসতে হবে, মা লক্ষ্মীকে দেখতে।”

ছোটমা, “এবারে কিন্তু বৌদিকে নিয়ে আসবেন।”

এমন সময়ে বাবু এসে নিলাদ্রি আর নিলাদ্রির বাবাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলেন।

ছোটমা আমার চিবুক ছুঁয়ে বললেন, “খুব আময়িক ভদ্রলোক। হিমাদ্রি মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার।”

আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি, ছোটমা শেষ পর্যন্ত আমাকে তাড়াবার একটা উপায় তুমি খুঁজে পেয়ে গেলে।

বিয়েবাড়ি থেকে ফিরে আসার আগে নিলাদ্রি আমার কাছে এসে বলে, “পরের রবিবার আপনাদের বাড়িতে আসছি। আমি একদম পাক্কা যে আপনি আমার বৌদি হবেন।”

আমি ওর দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ফেলি। সেই হাসিতে খুশির আমেজ ছিলনা, আমার চারপাশে সব যেন মেকি। আমার হাসি মেকি, আমার খুশি মেকি। 

বাড়ি ফেরার পরে বাবু জানালেন যে পরের রবিবার আমাকে দেখতে আসবে, বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে যাবে। আমি মৃদু মাথা দুলিয়ে বাবুকে বলি, “সত্যি কি আমাকে দেখার কোন দরকার আছে?”

বাবু, “হ্যাঁ নিশ্চয় আছে।”

আমি তোমাদের গলগ্রহ, আমি বাবুকে বললাম, “তোমাদের পছন্দ হলেই হল, আমার জেনে দরকার কি যে আমি কার সাথে বিয়ে করছি? শুধু আমাকে বলে দিও এইদিনে আমাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে আমি বসে যাব, কাঠের পুতুলের মতন।”

ছোটমা আমাকে করুন সুরে বললেন, “পরী, দয়া করে রবিবার যেন এইরকম ভাবে ব্যবহার করিস না মা।”

আমি চোয়াল শক্ত করে ছোটমাকে বলি, “আমাকে একটু একা থাকতে দিতে পারো?”

আমি ওদের মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেই।

অবশেষে সেই রবিবার আসে। প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন আমি সকালে উঠে স্নান সেরে নিয়েছিলাম। পরনে ছিল একটা অতি সাধারন নীল রঙের চুড়িদার কামিজ। সকাল পড়ায় দশটা বাজে, আমি রান্না ঘরে দুপুরের খাওয়া রান্না করছিলাম। অতিথিরা, যারা আমাকে দেখতে আসবে তারা দুপুরের খাওয়া খেয়ে যাবে। তাই সেদিন অনেক প্রকারের ব্যাঞ্জন রান্না হয়েছিল, গলদা চিংড়ি, ফ্রাইড রাইস, ইলিশ মাছ আরও অনেক। ছোটমা আমাকে রান্না করতে সাহায্য করছিলেন। রান্না করতে করতে আমার মনে ওর চিন্তা এসে ভর করে। কত সাধারন ছিল ওর খাওয়া দাওয়া, একটু ডাল ভাত আলুসেদ্ধ হলে হয়ে যায়।

কলিং বেল বেজে ওঠে। বাবু নিচে দরজা খুলতে যান। ছোটমা রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে অতিথিদের আদর আপ্পায়ন করতে চলে যান, ছোটমা যাওয়ার আগে আমাকে শাড়ি পড়তে বলে যান।

আমি ছোটমাকে বলি, “আমি কি খেলার পুতুলের নাকি যে সেজে গুঁজে বসে থাকতে হবে? আমাকে যদি পছন্দ করতে হয় তাহলে এই পোশাকেই পছন্দ করবে।”

ছোটমা গম্ভীর সুরে আমাকে বকে দিলেন, “পরী ঘরে গিয়ে শাড়ি পরে নে।”

আমি রাগে দাঁতে দাঁত পিষে নিজের ঘরে ঢুকে পরি। ঢুকতে যাব, সেইসময়ে খাওয়ার ঘরে এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলাকে দেখি।

সেই ভদ্রমহিলা আমাকে দেখে বললেন, “না মা, তোমাকে কাপড় পাল্টাতে হবে না। তুমি যা পরে আছো তাতেই আমরা খুশি।”

ছোটমা আমাকে ইঙ্গিতে বলেন সেই ভদ্রমহিলার পা ছুঁয়ে প্রনাম করতে, আমি তাঁর পা ছুঁয়ে প্রনাম করি। ভদ্রমহিলা আমার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “ঠিক যে রকমের লক্ষ্মী চেয়েছিলাম সেরকম পেয়ে গেছি।”

ভদ্রমহিলা আমাকে বসার ঘরে আসতে বলে চলে গেলেন।

আমি ছোটমাকে বললাম যে আমার একটু সময় চাই। ছোটমা আমার দিকে একটু বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বললেন, “বেশি দেরি করিস না”

আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম চোখে মুখে জল দিতে। মনের আঙ্গিনায় এক অজানা ভিতি ভর করে এসেছে।

ছোটমা আমার কানেকানে বলেন, “পরী দয়া করে সব কিছু ভেস্তে দিস না, মা।”

আমি মাথা নাড়িয়ে ইশারায় জানিয়ে দেই যে আমি কিছুই করব না, তাদের চিন্তা করতে বারন করে দিলাম। বাথরুমের আয়নায় নিজের প্রতিফলনের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার প্রতিফলন আমাকে বলে, “শুচিস্মিতা অবশেষে তোমার ভবিতব্য তোমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রানখুলে হাসি মুখে বরন করে নাও তোমার আসন্ন ভবিষ্যৎ।”

আমি সেই প্রতিফলনকে বলি, “আমি প্রাণহীন এক শ্বেত পাথরের মূর্তি, আমি আমার ঋণ শোধ করতে যাচ্ছি!”
Like Reply
#55
পরীর আত্মসমর্পণ (#03)

আমি বসার ঘরে ঢুকে আড় চোখে হিমাদ্রির দিকে তাকাই। সেদিন নিলাদ্রি আসেনি। হিমাদ্রি আর তাঁর বাবা মা এসেছিলেন। আমি হিমাদ্রির দিকে দেখে ভদ্রতার জন্য হাত জোর করে প্রনাম করি। হিমাদ্রি দাঁড়িয়ে প্রত্যুত্তরে আমাকে দেখে মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। সেই ক্ষণিকের মধ্যে আমি ওকে দেখে বুঝে নেই যে আমার চেয়ে বেশি লম্বা নয় হিমাদ্রি, ওর পাশে দাঁড়ালে হয়ত আমাকে বেশি লম্বা লাগবে ওর থেকে। বিগত কয়েক মাসে আমি অনেক রোগা হয়ে গেছিলাম। 

হিমাদ্রির গায়ের রঙ একটু বেশি শ্যামবর্ণের, হয়ত কাজের জন্য গায়ের রঙ পুড়ে গেছে। মাথার সামনের দিকে চুল নেই, একটু টাক। নাকের নিচে পুরু গোঁফ, কালো ঠোঁট, থ্যাবড়া নাক। একটু ভুরি আছে, তাও আবার সুটের ভেতর থেকে অল্প বেড়িয়ে গেছে। 

আমি ওর উলটো দিকের সোফার ওপরে বসে যাই। হিমাদ্রির বাবা আমাকে আমার পড়াশুনার ব্যাপারে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন, চুপচাপ নিচু স্বরে তাঁর উত্তর দিলাম। এ যেন এক পরীক্ষার মতন মনে হল আমার। 

হিমাদ্রির বাবা ছোটমাকে বললেন, “আমরা এক গৃহবধূ চাইছি।”

আমি একবার হিমাদ্রির দিকে তারপরে ছোটমায়ের দিকে তাকালাম। আমার হারানোর কিছু ছিলনা, আমার পিঠ দেয়ালে ঠেকনাও। হৃদয়ের অন্তিম সাহসের কনা সঞ্চয় করে বললাম, “আমি কলেজের টিচার হতে চাই।” 

হিমাদ্রি এতক্ষণ চুপচাপ ছিল, আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে বুঝতে চেষ্টা করছিল। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভদ্রতার খাতিরে একটু হাসি। বাবু বাকিদের বলেন যে আমাদের দুজনকে একটু একা কথা বলতে দিতে, বাকিদের নিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন।

আমার বুক খুব জোরে জোরে ধুকপুক করতে শুরু করে দেয়। মনে হল যেন বুকের পাঁজর ভেঙ্গে হৃদপিণ্ডটা এই মাটিতে পরে গড়াগড়ি খাবে। আমার সামনে এক সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যাক্তি বসে, আমি তাঁর সামনে একটা পাথরের পুতুলের মতন বসে থাকি। সবাই বেড়িয়ে যাওয়ার পরে, অনেকক্ষণ আমাদের দুজনের মুখে কোন কথা ছিলান। নিস্তব্ধ ঘরের মধ্যে আমি আমার বুকের ধুকপুক শব্ধ যেন শুনতে পাই। 

হিমাদ্রি কিছু পরে গলা খাকরে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুমি এই বছর প্রেসিডেন্সি থেকে পাস করেছ?”

আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।

হিমাদ্রি, “বেশ নাম করা কলেজ।”

আমি আবার মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই, হ্যাঁ।

কোলের ওপরে আমার হাত জড় করে রাখা, আমি ছোটো টেবিলের দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই টেবিলের কাঁচের প্রতিফলনে আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর দৃষ্টি আমার চেহারার ওপরে নিবদ্ধ। 

হিমাদ্রি, “শুচিস্মিতা অনেক বিশাল নাম। তোমাকে ছোটো করে কি বলে ডাকা যায় বলতো?”

সেই প্রশ্ন শুনে মনে হল, আবার এক নতুন পরিচয়। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে মন করল না আমার। আমি চুপ করে থাকি।

হিমাদ্রির পরের কথা আমাকে হাসিয়ে দিল, “আচ্ছা, চুপচাপ থাকা ছাড়া আর কি কি করা হয় তোমার?”

আমি নিচের ঠোঁট কামড়ে লজ্জা ঢেকে নেই। হাসি হাসি মুখ করে ওর দিকে চোখ তুলে তাকাই। সেই প্রথম বার আমাদের চার চোখ এক হয়। আমার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে হিমাদ্রি।

হিমাদ্রি বলে, “বাবার কথা অত মাথায় রেখ না। আমি কথা দিচ্ছি যে তুমি চাকরি করতে পারবে, আমি তাতে বাঁধা দেব না। আমি ধানবাদে অনেক কলেজ জানি, যেখানে তুমি খুব সহজে ফিসিক্স টিচারের চাকরি পেয়ে যাবে।”

ওর কথা শুনে আমার বুকে জল আসে, আমার বুক হালকা হয়ে যায়। আমি মাথা ঝুকিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাই।

হিমাদ্রি আমাকে বলে, “এত চুপচাপ কেন, তোমার সম্বন্ধে কিছু বলো? নিলাদ্রি নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে কিছু বলেছে, তাও তোমার যদি কিছু প্রশ্ন থাকে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো।”

আমি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেই, “আমার কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। তোমার যদি কিছু জিজ্ঞেস করার থাকে তাহলে তুমি জিজ্ঞেস করতে পারো, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে।”

বুক ভরে এক শ্বাস নেই আমি, মাথার ভেতরে কোন প্রশ্ন জাগেনা, বুকের ভেতরে কোন অনুভুতি জাগেনা। চারপাশের ছন্দ আমাকে দুলিয়ে দিতে চেষ্টা করে কিন্তু আমি অনড়, নিশ্চল। হিমাদ্রি আমার শান্ত চেহারার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ঘরের মধ্যে আবার এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছেয়ে যায়।

সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমি শেষে ওকে বলি, “দুপুরে নিশ্চয় খেয়ে যাবে?”

সামনের দিকে ঝুঁকে আমার মুখের কাছে মুখ এনে হিমাদ্রি আমাকে বলে, “তুমি রান্নাও জানো?”

আমি আলতো মাথা নাড়াই, হ্যাঁ।

হিমাদ্রি হেসে বলে, “তাহলে ত খেয়ে যেতেই হচ্ছে।”

দুপুরে খাওয়ার সময়ে সবাই খেতে বসে আমার রান্নার খুব তারিফ করল। আমি সর্বক্ষণ ঠোঁটে এক মেকি হাসি মাখিয়ে ওদের পরিবেশন করে গেলাম।

ওরা চলে যাওয়ার পরে আমি নিজের ঘরে ঢুকে চুপচাপ বিছানার ওপরে বসে পরি। জানালার বাইরের একভাবে তাকিয়ে থাকি। চোখের সামনে এক তপ্ত বিস্তীর্ণ ফাঁকা মরুভুমি দেখতে পাই। সেই মরুভুমির ওপর দিয়ে এবারে আমাকে হেঁটে যেতে হবে। আমি জানিনা, সেই মরুভুমির মাঝে আমি কোন মরুদ্যান খুঁজে পাবো কি না, আমি শুধু এই টুকু জানি যে সেদিন থেকে আমার বুক এক শূন্য মরুভুমিতে পরিনত হয়ে গেছিল।

ছোটমা আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “হিমাদ্রি কে দেখে কেমন লাগল?”

আমি ছোটমায়ের প্রশ্ন শুনে খুব বিচলিত হয়ে উঠি। ছোটমা আমার মনের কথা জানেন, তাও আমাকে কেন এই প্রশ্ন করা। তিনি ভালো করে জানেন আমার কাকে ভালো লাগে। আমি ছোটমায়ের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে উত্তর দেই, “তোমরা আগে থেকেই আমার জীবনের সবকিছু ঠিক করে ফেলেছ, তারপরে আমার আর কি বলার আছে।”

ছোটমা আমার পাশে বসে আমাকে বললেন, “পরী, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নামি ব্যাক্তি, ওরা খুব বড়লোক। হিমাদ্রি ইঞ্জিনিয়ার, ভালো ছেলে। তোর জন্য অনেক সম্বন্ধ এসেছিল, আইএএস, আইপিএস, কিন্তু সেসব বাইরের। আমি তোকে বেশি দুরে পাঠাতে চাইনা রে মা। ধানবাদ কোলকাতা থেকে বেশি দুরে নয়, ট্রেনে শুধু মাত্র ছয় ঘন্টা লাগে, তুই আমার সাথে দেখা করতে যেকোনো সময় আসতে পারিস, আমি যেকোনো সময়ে তোর কাছে যেতে পারব।”

আমি মাথা দুলিয়ে বলি, ঠিক আছে।

ছোটমা আমার মাথায় গালে হাত বুলিয়ে মুখে হাসি ফুটাতে বলেন, আমি অনেক কষ্টে ছোটমার চোখের দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসি। কথায় কথায় জানতে পারি যে, হিমাদ্রির বাড়ি ধানবাদের হিরাপুর নামে এক জায়গায়। বাবা মায়ের সাথে একত্র পরিবার। ছোটো ভাই নিলাদ্রি, তাঁর বাবার কন্ট্রাক্টারির কাজে সাহায্য করে, হিমাদ্রির বাবা ধানবাদের নাম করা কয়লার কন্ট্রাক্টর। হিমাদ্রির মায়ের নাম রজনী কর্মকার, একজন গৃহবধূ।

সেই বছরের মাঝামাঝি আমার বিবাহের দিন ঠিক করা হয়। ছোটমা মৈথিলী আর মেঘনা বৌদিকে ফোন করে সব জানিয়ে দেন।

একদিন রাতে আমি কল্যাণীকে ফোন করে আমার বিয়ের কথা জানাই। কল্যাণী আমার মুখে সেই সংবাদ শুনে মর্মাহত হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।

তারপরে কল্যাণী আহত সুরে বলে, “আমি তোর বেদনাপ্লুত চেহারার সামনে যেতে পারবোনা রে পরী। আমার হয়ে দীপঙ্কর যাবে তোর বিয়েতে।”

আমি কপালে করাঘাত করে ধরা গলায় ওকে বললাম, “মেয়ে হয়ে জন্মেছিরে, ভাগ্যের পরিহাসের সামনে কি করে রুখে দাঁড়াব বল? এই সমাজ আমাদের বলিদান চায় পদেপদে, আমাদের জন্ম শুধু বলিদান দেওয়ার জন্য, রে কল্যাণী।”

কল্যাণী আর কোন কথা না বলে ফোন রেখে দেয়। সেইরাতে আমি আর ঘুমাতে পারি না। নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকার চিড়ে আমার কানে বেজে ওঠে আমার বলিদানের সানাইয়ের করুন সুর। সেই কান্নার সুরেও আমার চোখে জল আসেনা, জল শুকিয়ে গেছে।

পরের দিন সকাল বেলা উঠে মৈথিলীকে দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। অত ভোরে মৈথিলী আমাদের বাড়ি পৌঁছে যায়। বসার ঘরে বসে ছোটমায়ের সাথে কথা বলছিল মৈথিলী। আমাকে দেখতে পেয়ে, বসার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে আমাকে আমার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় ঠেলে।

ভুরু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “একি করছ পরী?”

আমি প্রথমে ওর প্রশ্ন ঠিক বুঝে উঠতে পারিনা। আমি ওর মনের ভাবাবেগ তখন ঠিক ভাবে বুঝে উঠতে না পেরে ওকে প্রশ্ন করি, “কেন কি হয়েছে?”

আমার হাত ধরে বিছানার ওপরে বসিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি বিয়ে করছ? কি ব্যাপার, তোমার ভালোবাসার কি হবে?”

আমি ফাঁকা বুক নিয়ে বিছানার ওপরে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলি, “আমি আর কি করতে পারি, চুরনি?”

মৈথিলী আমার ব্যাথিত মুখখানি নিজের দিকে তুলে ধরে। ওর সমবেদনার স্পর্শে আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে। আমার মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে বলে, “কোথায় আছে ও, বলো। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব, তুমি চলে যাও। এখানে যা হবে সব আমি সামলে নেব, আমি তোমাকে এই ভাবে পুড়তে দেখতে পারব না।”

আমি ওর বুকে মাথা গুঁজে কেঁদে ফেলি, “আমার আর যাওয়ার কোন জায়গা নেই চুরনি। আমার ভালোবাসা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে, আমার সাথে একবারও যোগাযোগ করেনি।”

আমার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে আমাকে শান্ত করে বলে, “পরী একদম বলবে না যে তোমার যাওয়ার কোন জায়গা নেই। আমি সারা জীবন তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকব। যা কিছু হোক। কিন্তু তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যে আমিও বড় নিরুপায়। বাড়ির সবাই এই ভাবে যে তোমার ছোটমা তোমার জন্য যা করছে তাই তোমার জন্য ঠিক।”

সেই প্রথম বার আমি ওর চোখে আমার দুখের জন্য জল দেখি। আমার ব্যাথায় ব্যাথিত হয়ে কাঁদে ওর হৃদয়। আমি ওর কোমর জড়িয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলি, “আমার মা নেই, ও আর আমার সাথে যোগাযোগ করলনা। আমি জানি না, ও কোথায় আছে, কেমন আছে। আমার আর কোন জায়গা নেই যাওয়ার চুরনি। আমি আমার ভালোবাসা হেরে গেছে চুরনি। ওর ভালোবাসার পরী এই সমাজের নিয়মাবলীর সামনে আত্মসমর্পণ করে দিয়েছে।”
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply
#56
অসাধারণ সৃষ্টি
Like Reply
#57
(21-03-2020, 12:11 PM)Nefertiti Wrote: কেউ অনুবাদ করতে চাইলে আমাকে মেসেজ করুন। আর না হলে আমি পুরুটা অনুবাদ করতে পারবো না। আমি দ্বিতীয় পর্ব পর্যন্ত অনুবাদ করব। তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব করবো কিনা ভাবতে হবে। কেউ help করেন।
আপনার কথায় হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।পিনুরাম নিজেই তো বাংলাতে গল্পটা ২য় চ্যাপ্টার অর্থাৎ "সপ্তপদীর বহ্নিশিখা"   পর্যন্ত অনুবাদ করেছেন। আর আপনি কি অনুবাদ করবেন?অনুবাদ করলে ৩,৪র্থ চ্যাপ্টার করার কথা বলুন।
Like Reply
#58
(23-03-2020, 10:55 PM)Isiift Wrote: আপনার কথায় হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছি না।পিনুরাম নিজেই তো বাংলাতে গল্পটা ২য় চ্যাপ্টার অর্থাৎ "সপ্তপদীর বহ্নিশিখা"   পর্যন্ত অনুবাদ করেছেন। আর আপনি কি অনুবাদ করবেন?অনুবাদ করলে ৩,৪র্থ চ্যাপ্টার করার কথা বলুন।

অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু অনুবাদ টুকু তো নেই। আপনি যদি আগে এই গল্পটা পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন এইটা আলাদা পার্ট করে আলাদা অনু করে, অনুবাদ করা হয়েছে। পিনুরামদা এমনটা করেন নি।
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply
#59
দাদা দেখুন না আপনি যদি পুরো অনুবাদটা শেষ করে দিতে পারেন। এখন অনুবাদের দায়িত্বটা যদি কোন আনাড়ি লেখকের হাতে যায় তাহলে হয়তো পুরো গল্পটার মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
Like Reply
#60
আমার কাছেই আছে অনুবাদটুকু।আপনার আলাদা করে করতে হবে না।
Like Reply




Users browsing this thread: 3 Guest(s)