Thread Rating:
  • 41 Vote(s) - 3.29 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight) Written By pinuram
#1
মধ্যরাত্রে সূর্যোদয় (Dawn at Midnight)

Written By pinuram


এই লেখাটি অনেক বড় হওয়ার সুবাদে এবং ব্লগের লিমিট ক্ষেত্র বিশেষে সমস্যা করতে পারে, তদুপরি লোড হতে পাঠকদের একটু সময় লাগছে ও পড়ার সুবিধার্থে আমরা চ্যাপ্টারগুলো বেশ কয়েকটি খন্ডে (নাম অনুযায়ী) বিভক্ত করে দিলামঃ



সূচিপত্র

প্রথম অধ্যায়ঃ পরিণত পরী মিতা
----------------------------------------

বন্দিনী রাজকন্যে, তিস্তা একটি নদীর নাম (#01, #02)
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01, #02), ভগ্ন হৃদয়ের সান্তনা
ম্লান আশার আলো (#01, #02)
শ্বেত পাথরের মূর্তি (#01, #02)
সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01, #02)
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#01, #02, #03)
ভাঙ্গা ধানের শীষ (#04), ছিন্ন নাড়ির টান

****************************

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ তপ্ত বালুচর
--------------------------------------
পরীর আত্মসমর্পণ (#01, #02, #03)
সপ্তপদীর বহ্নিশিখা (#01, #02)

****************************

কেমন লাগলো দু-একটা শব্দ হলেও প্লিজ লিখে জানান। আপনাদের মহামূল্যবান মন্তব্যই আমার গল্প শেয়ার করার মূল উদ্দেশ্য।
[+] 2 users Like Nefertiti's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
[বন্দিনী রাজকন্যে, তিস্তা একটি নদীর নাম (#01, #02)]

Disclaimer: এই কাহিনীর কিছু চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক, কিছু চরিত্র এবং ঘটনা বাস্তব। পুরানো হলুদ কিছু পাতা নিয়ে আবার করে সামনে আসা, এক নতুন ভাবে পরিবেশন করা এই গল্প।

ভুমিকাঃ

এটি একটি নারীর জীবনের গল্প, এই নারী তার ভালবাসার পাত্রকে হারিয়ে কান্না আর বেদনাকে বুকে বেঁধে জীবনের পথে চলার চেষ্টা করেছে। এই সমাজের কঠিন নিয়মাবলির বন্ধনে এই নারী তার ভালোবাসা হারিয়েছে। এই সমাজ দুটি অজানা অচেনা মানুষকে একসাথে জীবন অতবাহিত করার প্রশ্রয় দেয় কিন্তু যারা একে ওপরকে প্রান দিয়ে ভালবাসে তাদের ভালবাসার মুল্য দেয় না। সমাজ বড় কঠিন, বড় নিষ্ঠুর। এই নারীর জীবনে অনেকে আসে, অনেকে তাকে স্বপ্ন দেখায়, অনেকে তাকে ভালোবাসা দেখায়, কিন্তু সত্যি কি সে তার ভালোবাসা খুঁজে পায়?

আসুন, লেখকের সাথে আর সেই নারীর জবানবন্দীতে শুনি সেই শ্বেত পাথরের মূর্তির কাহিনী। আশা করি আপনাদের চোখের জল ফুরিয়ে যাবে পড়তে গেলে! তাও যদি পড়তে চান, আসুন তার সাথে, একবারের জন্য।

এই গল্পের ঘটনা ক্রম September 2001 থেকে শুরু আর April 2011 এ শেষ।

যারা প্রথম বার এই গল্প পরছেন, তাদের জানিয়ে রাখি যে এই গল্প পড়ার আগে ভালবাসার রাজপ্রাসাদ(বাংলাতে)/[Forbidden Love(In English)] পড়ে নেবেন।








প্রথম অধ্যায়ঃ পরিণত পরী মিতা

বন্দিনী রাজকন্যে


তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই মিতা, এই পুজোতে কি কিনছো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই, “কিছু না রে। দেখি ছোটমা আমাকে যা কিনে দেবে তাই পরব আর কি।”

“তুমি না একদম কি যে বলি।”

গালে আলতো চাঁটি মেরে হেসে উত্তর দিল তিস্তা।

নাক কুঁচকে হেসে জিজ্ঞেস করি, “তোর কি খবর? তুই কি কিনবি এই পুজোতে?”

কাছে এসে কানেকানে বলে, “দাড়াও, আমার নতুন বয়ফ্রেন্ড যদি আমাকে কিছু পড়তে দেয় তবে না আমি কিছু পরে থাকতে পারব।”

আমি ওর দিকে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করি, “বাঃবা... দুষ্টু মেয়ে ত তুই, তা এই নতুন ছাগল টি কে?”

ও আমার দিকে চোখ টিপে উত্তর দিল, “কেন, তোমার দরকার নাকি? আমি চেখে দেখি তারপরে তোমাকে না হয় দিয়ে দেব।”

আমি ওর গালে আলতো চটি মেরে বলি, “জাঃ আমি কারুর এঁটো খাই না।”

তিস্তা আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন, তুমি নতুন কাউকে পাকড়াও করেছ নাকি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে হেসে উত্তর দিলাম, “না রে বাবা, আমার সেই ক্ষমতা নেই কাউকে পাকড়াও করার। ছোটমা বাবু জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না তাহলে।”

দিনটা ছিল, শুক্রবার, আমি দাঁড়িয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে, এই প্রেসিডেন্সি থেকে বেড়িয়ে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলাম। কোলে ধরেছিলাম পাটের ব্যাগ। দেরি দেখে বারবার হাতের ঘড়ির দিকে চোখ যাচ্ছিল। বাসের দেরি, ওদিকে বাবুর কঠিন আদেশ যে সন্ধ্যের আগে যেন বাড়ি ঢোকা হয়।

ছোটমা আমার নিজের মা নয়, আমার দূর সম্পর্কের দিদি হন, আমার মায়ের বয়সি। আমি দিদিকে ছোটমা ডাকতাম কেননা আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার বাবা মারা যান আর ছোটমা আমাকে তাঁর ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে বড় করেছিলেন। রাতের পর রাত যখন আমার চোখে ঘুম আসতো না, ছোটমা আমাকে কোলে করে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পারাত আর আমি ছোটমায়ের গান শুনে তাঁর কোলে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমি দাদাবাবু কে বাবু বলে ডাকতাম। বাবার স্নেহ বা আদর কি, সেটা আমি কোনদিন জানতে পারিনি, তাই আমি বাবুর ভালবাসায় পিতৃ স্নেহ খুঁজে এই খরা হৃদয়কে সিঞ্চন করতাম। আমার ছোটো দাদা, সুব্রতদার বিয়ের পরে ছোটমা আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসে আর সেই জন্যেই আমি সেদিন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলাম।

আমি প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হই, সেপ্টেম্বর 2001 এ, বি এস সি রেসাল্টের পরেই। ছোটমা আর বাবু অনেক কে ধরে আমার এডমিসান করিয়ে দিয়েছিলেন কলেজে। আমার মেজর ছিল নিউক্লিয়ার ফিসিক্স।

গত পঁচিশ বছরের মধ্যে সেই দুর্গ পুজো আমার সব থেকে বেদনাময় কেটেছিল। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে গেছিল সেইবার। সামনে পুজো, কোলকাতা সাজ সাজ রব, আকাশে বাতাসে কেমন যেন পুজো পুজো গন্ধ। লোকেরা সব নতুন জামা কাপর পরে কেনা কাঁটা করতে বেড়িয়েছে। বর্ষার শেষ আকাশ ঘন নীল, তাঁর মাঝে মাঝে তুলোর মতন পোজা পোজা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। বুক ভরে শ্বাস নিলে যেন ধুপ ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায় সেই আকাশে আর বাতাসে। কান পেতে শুনলে যেন আগমনির সুর ভেসে আসে। কিন্তু আমার কানে সেই সুর বাজে না।

আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি বাসের জন্য আর তিস্তা ওর সেলফোনে কারুর সাথে কথা বলতে থাকে। আমার সেলফোন ছিলনা। বাবু কিনে দেয়নি আমাকে। বেশ খানিক পরে বাস এসে গেলে আমি বাসে চেপে বাড়ির উদেস্যে রওনা দেই।

বাড়ির চাবি বাবুর কাছেও থাকে আর আমার কাছে একটা থাকে। ছোটমা দেরি করে বাড়ি ফেরে তাই ছোটমায়ের কাছে বাড়ির চাবি থাকেনা। আমি চাবি খুলে বাড়ি ঢুকে দেখি বাবু বাড়িতেই ছিলেন, নিজের ঘরে বসে পেপার পড়ছিলেন। আমার বাবু, গত মাসে এয়ারপরট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, দমদম এয়ারপোর্ট এ সিনিয়ার ম্যানেজার পদ থেকে অবসর পেয়েছেন। বাবু এমনিতে খুব কড়া ধরনের মানুষ তাই বাড়িতেও সেই রকম থাকতেন, সব কিছু যেন নিয়ম মাফিক চাই বাবুর।

আমি ঘরে ঢুকতেই বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “সোনা মা, কলেজ কেমন গেল?”

আমি নিচু স্বরে উত্তর দেই, “ভালো গেছে বাবু। হাওড়া থেকে যত বাস আসে সব কটাতেই কত ভিড় তাই বাস পাইনি আর একটু দেরি হয়ে গেছে।”

বাবু আমাকে বলল, “ঠিক আছে, সোনা মা এক কাপ চা হবে কি?”

আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে করে দিচ্ছি।”

কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে রোজকার প্রশ্ন বাবুর যে আমার কলেজ কেমন গেল। বাবুর মেজাজ ভালো থাকলে আমাকে সোনা মা বলে ডাকে আর না হলে পরী।

আমি যথারীতি জামাকাপড় বদলে রান্না ঘরে ঢুকে যাই চা বানানোর জন্য। তাক থেকে সসপেন নিয়ে উনুনে চাপিয়ে জল ঢেলে দিলাম। চোখের সামনে সসপেনে জল ফুটতে শুরু করে আর আমি আমার খেয়ালে ডুবে যাই। জলের বাস্প আমার চোখে মুখে লেগে আমার চোখে জল নিয়ে আসে। একটি ছোটো ভুলের মাশুল গুনছি আমরা দুজনে। বলেছিল আমাকে যে জীবন ঠিক ৬৪ খানা দাবার ছকের মতন, ৩২ টা কালো আর ৩২ টা সাদা। আমার হৃদয় আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে চলে যাবার পর, আমি এক প্রাণহীন শ্বেত পাথরের মূর্তি হয়ে গেছিলাম। কি তার পাপ? সে আমাকে ভালবেসেছিল সেটাই তার পাপ? নিজের বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হয়। কেন সে কি ভালবেসে ভুল করেছিল? আমাকে খুব ভালবাসত যে, আমার প্রাণহীন দেহে প্রান দিয়েছিল, ম্লান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিল। আমাকে নিয়ে গেছিল সুদুর পাহাড় চুরায়, সেই ছোটবেলার ছেলে খেলার মতন আমাকে নিয়ে খেলত। শীতের রাতে যখন আমার শীত লাগত, আমি ওর বাহু পাসে বদ্ধ হয়ে নিজেকে ভুলে যেতাম, ওর বাহুপাস যেন আমার কাছে সব থেকে নির্বিঘ্ন স্থান ছিল, যেখানে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু সে ত আর নেই আমার কাছে, চলে যেতে হয়েছে তাকে। আমি ওর চেয়ে দু বছরের বড় তাই আমাদের ভালোবাসা পাপ, না ও আমার ছোটমায়ের ছেলে বলে আমাদের ভালোবাসা পাপ। কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে, কাকে বুঝাই আমি ভালোবাসা পাপ নয়।

বুক চিরে, পায়ে ধরে ছোটমা কে বুঝাতে চেষ্টা করেছিল যে ভালোবাসা পাপ নয়, কিন্তু সেই কথা ছোটমায়ের কানে যায় নি। বুঝাতে চেষ্টা করেছিল যে বয়সের ব্যাবধান কিছুনা আর আমাদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই যে আমাদের সম্পর্ক কোন পাপের পরিনত হতে পারে। কিন্তু ছোটমা সমাজের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলনা। ছোটমা আর বাবু ওর চলে যাওয়ার পর থেকে আমার ওপরে খুব কড়া নজর রাখত। তিনতলার সেই ঘরে চিরকালের জন্য তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাকে ছাদে যেতে দেওয়া হতনা। বাড়ির দেওয়াল থেকে, মেঝে থেকে, পর্দা থেকে জানালা থেকে, ওর চিনহ মুছে ফেলা হয়। ওর জামাকাপড় এক নয় গরিব মানুষকে না হয় বাসন অয়ালাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নতুন কেউ বাড়ি এলে বাড়ি দেখে জানার অবকাশ ছিল না যে ছোটমায়ের একটা ছেলে আছে। বাড়ি থেকে এমন ভাবে ওর চিনহ মুছে ফেলা হয়েছিল। নতুন লোকে সবাই জানত যে আমি ছোটমায়ের একমাত্র মেয়ে।

ওর দেওয়া সেই ঘিয়ে রঙের শাল খানি ছোটমা নিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে। ওর চিহ্ণ স্বরুপ ওর ভালোবাসা আমার বুকে আঁকা আর থেকে যায় ওর সেই ধুসর রঙের ডায়রি, আমার বাইবেল, আমার কোরান আমার গীতা। কথায় বলে, প্রদীপের তলায় অন্ধকার তাই আমি সেই ডায়রি টাকে মলাট দিয়ে তার ওপরে “অপ্টিক্স নোটবুক” লিখে আমার পড়ার বইয়ের তাকে রেখে দিয়েছিলাম। সবার চোখ যেত কিন্তু নজরে আসতো না কারুর। অপ্টিক্স ওর সবথেকে প্রিয় সাব্জেক্ট ছিল।

ও চলে যাওয়ার পরে ওর ব্যাপারে বাড়িতে কেউ কথা পর্যন্ত বলত না। রাতে আমাকে দরজা খুলে শুতে হত। ছোটমা হয়ত ভয় পেত যে আমি দুঃখে হয়ত আত্মহত্যা করে ফেলি যদি। কিন্তু আমি ছিলাম গ্রামের এক সাদাসিধে মেয়ে, আত্মহত্যা করার মতন সাহস আমার বুকে ছিল না। আমি একটা পাথরের মূর্তির মতন জীবন বেছে নেই। নিজের মনে কাঁদতে পারতাম না, সবসময়ে যেন এক জোড়া চোখ আমাকে লক্ষ্য করে থাকত। শুধু মাত্র বাথরুমে গেলে আমি আমার মতন সময় পেতাম, একটু কেঁদে হালকা হয়ে নিতাম। কত বার চেষ্টা করেছিলাম আয়নায় মাথা পিটিয়ে আয়না ভাঙ্গার, কিন্তু হায় অদৃষ্ট, আয়নাও আমার সাথে ছিল না। আমি প্রানপন চাইতাম যে আয়না ভেঙ্গে যাক আর কাঁচের টুকরো মাথায় ঢুকে আমার যেন মাথা ফেটে যায়, কিন্তু না পোরা কপাল আমার, আয়না আমাকে দেখে হাসত।

বাবু আমাকে ডাক দেয়, “সোনা মা, চা কি হয়ে গেছে? আমাকে আবার বাজার যেতে হবে।”

আমি, “না বাবু এই এক মিনিটে হয়ে যাবে।”

আমার চোখের এক ফোঁটা জল হয়ত সেদিন ওই চায়ের জলে মিশে গেছিল। হাতের উলটো পিঠে চোখ মুখ মুছে চায়ের কাপ হাতে করে বাবুর ঘরে যাই। আমি চায়ের কাপ বাবুর সামনে রাখি, বাবু পেপার পড়তে মগ্ন।

আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “কাল তোমার ছোটমা তোমাকে নিয়ে শ্যামবাজার যাবে পুজোর বাজার করতে। এবার পুজোয় কি কিনবে তুমি?”

আমি কিছু না উত্তর দিয়ে বাবুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। বাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে আমার চোখের পাতা ভিজে। মুখ দেখে বাবু বুঝে গেলেন আমার বুকের মাঝের বেদনা। দাঁতে দাঁত পিষে উঠে চলে গেলেন।

গম্ভির স্বরে আমাকে বললেন, “তোমার ছোটমা আসার পরেই আমি বাজার যাবো, সেটাই ভালো।”

বাবু উঠে বসার ঘরে চলে গেলেন আর টিভি চালিয়ে বসে পড়লেন। যাবার আগে আমার দিকে পেপার দিয়ে বলে গেলেন যে, “তোমার কিছু যদি কাজ করার না থাকে তাহলে পেপার পড়ো, তাতে তোমার ইংরাজি ভালো হবে।”

ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। নিচে নেমে দরজা খুলে দেখি ছোটমা এসে গেছেন। ছোটমা আমাকে দেখি হেসে আমার চিবুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে, তোর কলেজ কেমন গেল?”

আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে জানালাম যে কলেজ ঠিক ঠাক গেছে।

সিঁড়ি দিয়ে চড়ার সময়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবু কি করছে রে?”

আমি উত্তর দিলাম, “বাবু বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে।”

ছোটমা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “বুড়ো টার আর কোন কাজ নেই। আমি বাজারে যেতে বলেছিলাম, ঘরে কোন সবজি পাতি নেই, ফ্রিজ খালি। আর এখনো বসে টিভি দেখছে?”

উত্তর দেওয়ার কিছু ছিল না। আমি ওপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরি। মনের মধ্যে আবার সেই পুরানো বিরহের কান্না বেজে ওঠে, দু চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে সেই দুঃখে। বালিসে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠি আমি। আঙুল কামড়ে ধরি যাতে আমার কান্নার আওয়াজ বাড়ির কেউ শুনতে না পায়।

ছোটমা কিছু পরে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে এই সময়ে শুয়ে আছিস কেন? সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে থাকতে নেই উঠে পর।”

বুকের মাঝে চিৎকার করে উঠি আমি, “আমাকে কি একটুকু সময়ের জন্য একলা ছাড়া যায় না, ছোটমা।” না আমার সেই চিৎকার গলা থেকে বের হয় না, বুকের কান্না বুকের কোনে লুকিয়ে যায়। কোনোরকমে উঠে পরে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আসি আমি।

রাতের বেলা খাওয়ার সময়ে ছোটমা জিজ্ঞেস করে আমি কি কিনতে চাই। আমার মন একদম ভালো ছিল না। কিসের জন্য আনন্দ, কিসের জন্য নতুন জামা কিনব আমি? কে আছে আমার কাছে যে আমার রুপ, আমার সৌন্দর্য দেখবে? না, সে ত আমার জীবন থেকে বিতাড়িত।

বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী, কি হল এত চুপচাপ কেন?”

আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই যে, কিছু হয়নি আমার। কিন্তু সত্যি কি কিছুই হয়নি? সত্যি কি আমার হৃদয় উতফুল্ল ছিল সেই উত্তর দেওয়ার জন্য? কেউ কি বুঝতে পেরেছিল আমার বুকের ব্যাথা? কেউ কি শুনতে পেরেছিল আমার পাঁজর ভেঙ্গে শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে?

রাতের খাবার পরে বাথরুমে গিয়ে আবার খানিক কেঁদে নিলাম আমি। কান্না যেন আর থামেনা আমার চোখের জল যেন ফুরিয়ে ও ফুরাতে চায় না। গালের সেই গোলাপি লালিমা আর নেই, চোখের কোনে কালি। আয়নায় দেখতে চেষ্টা করলাম, মুখ খানি কেমন যেন ফ্যকাসে দেখায়। জন্ডিস হয়নি ত? না আমার জন্ডিস হয় নি, আমার জীবনের সব রঙ যে উবে গেছে। গালের লালিমা, চোখের কাজল, ঠোঁটের মিষ্টতা, সবকিছু শেষ।

রাতে শোবার আগে প্রতিদিনের মতন ছোটমায়ের সাবধান বানী, “দরজা বন্ধ করবি না।”

আমি আমার বিশাল বিছানায় একা শুয়ে থাকলাম। চোখে বন্ধ করে পরে থাকলেই কি আর ঘুম আসে, না, অনেক ক্ষণ এই পোড়া চোখে ঘুম আসে না। চলে যাবার আগেরদিন আমার বুকের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই আগুন আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নরম বালিস বুকে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে কেঁদে ফেলি আমি। রাতের অন্ধকার আমার কান্না দেখে যেন হেসে ওঠে হি হি করে।

জানালার পাশের গাছের ডাল গুলি যেন নড়ে উঠে আমাকে ভুতের মতন কাছে ডাকে। চলে যাবার পর থেকে প্রতি রাতে আমার খোলে চোখের সামনে ভেসে উঠত ওর মুখ। আমি জেগে কাটিয়ে দিতাম রাত, ওর স্বপ্ন দেখে। ঘুম আসতো না তাও, একসময়ে আকাশের তারা গুনতাম, দশ হাজার এক, দশ হাজার দুই...

পরদিন আমি আর ছোটমা পুজোর বাজার করতে শ্যামবাজার গেছিলাম। ছোটমা আমার কেনা কাটার ব্যাপার আমার ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভঙ্গুর হৃদয়ের ওপরে পর্দা দিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে ছোটমায়ের পাসে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করি। দুটি সুন্দর সালোয়ার কেনা হল, একটা হলুদ আর লাল রঙের আর একটা তুঁতে রঙের। ছোটমা নিজের জন্য একটা দামী ঢাকাই জামদানি শাড়ি কিনলেন। ছোটমা আমাকেও শাড়ি কেনার জন্য বললেন কিন্তু আমার কোন শাড়ি পছন্দ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ছোটমা আমার জন্য একটা চায়না সিল্কের কাথা স্টিচ শাড়ি কিনে দিলেন। শ্যামবাজারে জামা কাপড় কেনার পরে ছোটমা আমাকে নিয়ে বউবাজার গেলেন।

আদর করে আমাকে বললেন, “আমার পরীর বিয়ের জন্য কিছু গয়না কিনতে ত হবে।”

আমি মৃদু হেসে দিলাম।

আমার ঠোঁটে ম্লান হাসি দেখে ছোটমা আমাকে বললেন, “আমার লক্ষ্মী মেয়ে। এই হাসি যেন সর্বদা ঠোঁটে লেগে থাকে। তুই বড় হয়েছিস, সব কিছু বুঝতে শিখেছিস।”

আমি ছোটমাকে বললাম, “ছোটমা, আজ বাড়ি চল। আজ আর গয়না কিনতে হবে না।”

ছোটমা, “ঠিক আছে, আজ না হয় বাড়ি ফিরে গেলাম। এই নিয়ে কিন্তু দ্বিতীয় বার খালি হাতে ফিরছি। পরের বার কিন্তু গয়না কিনেই ফিরব।”

হ্যাঁ, এই নিয়ে দ্বিতীয় বার আমারা বউবাজার থেকে খালি হাতে ফিরছিলাম। আগে একবার আমার গয়না কেনার কথা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল ও, সেদিন গয়না কেনার বদলে এস্প্লানেড গিয়ে আমার জিন্স আর টি শার্ট কেনা হয়েছিল। সেদিন ছিল খুশির দিন, মনের ভেতরে ছিল এক অধবুত আনন্দ।

কিছুদিন পরে আমি বাবুর কাছে সেলফোনের আব্দার করি। বাবু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেলফোন কেন চাই?”

আমি, “কলেজের সবার কাছে সেলফোন আছে, শুধু আমার কাছে নেই তাই।”

আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বাবু উত্তর দিলেন, “তোমাকে সেলফোন দিলে সারা দিন ত বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মারবে।”

আমি আদর করে বাবুর কাছে আব্দার করি, “বাবু, প্লিস প্লিস, আমি কথা দিচ্ছি আমি বেশিক্ষণ সেলফোনে গল্প করব না।”

বাবু হেসে উত্তর দিলেন, “ঠিক আছে। তোমার ছোটমা এলে আমি আর তুমি বাজারে যাবো খানে। দোকানে গিয়ে যেটাতে হাত রাখবে সেটা আমি কিনে দেব।” তারপরে আমাকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “মাসে কিন্তু চারশ টাকার রিচারজ হবে তার বেশি নয়।”

আমি আনন্দে নেচে উঠে বাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলি, “আমার সোনা বাবু। এক কাপ চা খাবে নাকি?”

আমার দিকে স্নেহ ভরা হাসি দিয়ে বললেন, “ঘুস দেওয়া হচ্ছে নাকি? তা সোনা মায়ের হাতের চা খেতে পারি, মন্দ নয়।”

বিকেলে ছোটমা স্কুল থেকে ফিরে আসার পরে বাবু ছোটমাকে জানালেন সেলফোনের কথা।

ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন চাই সেলফোন?”

বাবু, “উলুপি, পরী আর ছোটো বাচ্চা নয়, কলেজে এমএসসি পড়ছে। ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল পরীর।”

ছোটমা বাবুকে বললেন, “হ্যাঁ, তুমি কি বুঝবে মায়ের ব্যাথা। যার মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিতা আর অবিবাহিতা সেই মায়ের রাতের ঘুম হয় না চিন্তায়।”

আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রোজ দিন আমাকে কল লগ দেখাবি।”

ওই কথা শুনে আমি রেগে যাই আর চিৎকার করে উঠি, “আমি কি একটুকু স্বাধীনতা পর্যন্ত পাবো না?”

বাবু আমার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে বললেন, “পরী, তোমাকে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, মনে করে দেখ, সেই স্বাধীনতা পেয়ে তুমি কি করেছিলে।”

আমি ব্যাথিত হয়ে উঠে রেগে চিৎকার করে উঠি, “চাই না আমার সেলফোন।”

ছোটমা আর বাবুর মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিলাম সেদিন।

মহালয়ার কিছু দিন আগে, আমি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম, ঠিক সেই সময়ে বাবু কিছু কোর্টের কাগজ নিয়ে ঘরে ঢোকেন। আমি জিজ্ঞেস করাতে আমাকে জানালেন যে ওই কাগজ গুলি আমার লিগাল গারডিয়ানশিপের।

বাবু, “তোমার মা লিগাল গারডিয়ানশিপের কাগজে সই করে দিয়েছে।”

আমি বাবুর দিকে একবার চেয়ে দেখে, কাগজে সই করে দিয়েছিলাম। সেইদিন থেকে আমি কানুন মাফিক এক সম্রাট সম্রাজ্ঞীর বাঁধা রাজকন্যে হয়ে গেছিলাম।

বন্দিনী আমি এক রাজকুমারী। আমার দিনের আলো ম্লান আর রাতের অন্ধকার বেদনায় ভরা। সোনার খাচায় বন্দি আমি রাজার তোতা পাখি। নস্বর পৃথিবীর সব সুখ আমার পায়ের নিচে, ভালো জামা কাপড়, ভালো খাবার। ঠিক সেই সোনার খাচার তোতাপাখির মতন। সকাল সন্ধ্যে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী আমাকে শিশিরের জলে স্নান করায়, আঙ্গুর আর বাদাম খেতে দেয়, কিন্তু আমার পায়ে সেই সোনার বেড়ি।

বন্দিনী আমি এক রাজকন্যে!

তিস্তা একটি নদীর নাম (#01)

আমার কলেজের প্রথম দিন। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বাবু আমাকে ছাড়তে গেট পর্যন্ত এসেছিলেন, তারপরে আমি বলেছিলাম যে আমি আর ছোটো মেয়ে নই, বাকি টুকু আমি একা যেতে পারব। করিডোরে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে এমএসসি ফিসিক্সের ক্লাসে ঢুকি। পরনে ছিল সাদা লম্বা স্কার্ট আর ঢিলে সাদা শার্ট। গলায় সবসময়ে একটা স্টোল জড়িয়ে রাখতাম। কাঁধের ওপরে আমার চুল ছোটো একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা, ঠিক যেমন কলেজের দিনে সাজতাম সেই রকম আর খোঁপার মধ্যে গোঁজা আমার পেন।

ক্লাসে ঢুকতেই লক্ষ্য করলাম যে কয়েক জোড়া চোখ আমাকে নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিল। ছেলে গুলর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ক্লাসে ঢুকে পরি আমি। ক্লাসে ঢুকতেই করিডোর থেকে কেউ আওয়াজ দেয়, “গুরু যা কাটপিস একদম মাস্টারপিস মাল।” কান দিলাম না ওদের কথায়। ক্লাসে বেশির ভাগ ছেলে আর কয়েক জন মেয়ে। সেকেন্ড বেঞ্চে একটা উজ্জ্বল শ্যম বর্ণের মেয়ে বসে ছিল আর অন্যদের সাথে বেশ চুটিয়ে গল্প করছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কাছে ডাকে। আমি চুপ করে গিয়ে ওর পাসে বসে পরি।

আমাকে মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, “তুমি যেমন ভাবে ক্লাসে ঢুকলে তাতে সন্দেহ নেই যে তুমি কোলকাতার মেয়ে নও। তোমার বাড়ি কোথায়?”

আমি উত্তর দিলাম, “দমদমে।”

মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “জাঃ বাবা, তুমি দমদমে থাকো?”

আমি হেসে উত্তর দেই, “হ্যাঁ বাবা, আমি দমদমে থাকি।”

মেয়েটা, “আমি তিস্তা সরকার, লেকটাউনে থাকি আর তোমার নাম?”

আমি, “শুচিস্মিতা মন্ডল।”

তিস্তা, “ঠিক ধরেছিলাম, তোমার হাসিটার মতন তোমার নাম।”

তিস্তার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেছিলাম আমি, একি রে, একটা মেয়ে আমার হাসি দেখে পাগল। “ধ্যাত, মাথা খারাপ নাকি।”

তিস্তা চোখ টিপে বলে, “ফার্স্ট পিরিওড বাঙ্ক করবে? চল কফি হাউস যাই।”

আমি মাথা নাড়াই, “না না, ফার্স্ট পিরিওড বাঙ্ক করব না, কফি হাউস পরে যাওয়া যাবে।”

আমাদের পেছনের বেঞ্চে বসা একটা মেয়ের দিকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম ডেলিসা খাতুন, পার্ক সার্কাসে থাকে।”

সত্যি বলছি, আমি একটা '. মেয়েকে এমএসসি ফিসিক্সে দেখব বলে আশা করিনি। খুব সুন্দরী আর ফর্সা ডেলিসা, গায়ের রঙ যেন আপেলের মতন লাল। গাড় নীল রঙের সালোয়ার পড়ে ছিল আর মাথায় জড়ানো কালো সুন্দর হিজাব।

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “মাথার কাপড় কি সবসময়ে পরে থাকতে হয়?”

হাত নাড়িয়ে উত্তর দেয় ডেলিসা, “না রে, আব্বাজান বার বার বলে তাই পড়া। আম্মি ত হিজাব পরতেই দেয় না, বলে যে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি ওই সব হিজাব পরে কি হবে যখন এমএসসি পড়তে যাচ্ছি।”

ঠিক সেই সময়ে পেছন থেকে কেউ আমাদের উদ্দেশ্যে জোর গলায় টিটকিরি দেয়, “গুরু আজ ত কাঠের বেঞ্চে আগুন লেগে যাবে।”

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করি যে কে বলল কথা টা। তিস্তা ছেলেটার দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “গা... মুখ বন্ধ রাখ।” আমাকে বলল, “ওর দিকে তাকিও না।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “ছেলেটা কে?”

তিস্তা, “দেবব্রত, আমার আগের কলেজের বন্ধু। বড় ফাজিল কিন্তু পড়াশুনায় খুব ভাল বিশেষ করে কোয়ান্টামে খুব ভাল।”

আমি দেবব্রতর দিকে তাকালাম, বেশ লম্বা চওড়া ছেলে, চোখে চশমা, গায়ের রঙ একটু তামাটে। গোঁফ দাড়ি কামানো, পেছনের দিকে আঁচড়ান চুল, ছোটো চোখ। দু হাত পেছনের বেঞ্চে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে দেখেই কেমন যেন মনে হল, বুকের ছাতি বেশ চওড়া। সাদা নীল ডোরা কাঁটা জামার ভেতর থেকে যেন বুকের ছাতি বেড়িয়ে এসেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে হাত নারালাম। আমাকে দেখে দেবব্রত দুই আঙুল দিয়ে পিস্তলের ইশারা করে গুলি মেরে দিল। আমি হেসে ফেললাম ওর হাবভাব দেখে।

তিস্তা আমাদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করছিল, আমার দিকে হেসে বলে, “প্রথম দিনেই ঘায়েল ওর গুলিতে?”

আমি একটু হেসে উত্তর দেই, “নারে, আমার ঘায়েল হবার জো নেই।” নিজেকে বললাম, ঘায়েল ত আমি আগে থেকেই, পাঁজর ভেঙ্গে যে রক্তাত হয়ে গেছে বুক। মৃতদেহ কে মেরে কি আর রক্ত বার করা যায়?

কিছু দিন পরে, এক দুপুরে লাঞ্চ ব্রেকের সময়ে আমি, তিস্তা আর ডেলিসা মেডিকেলের গল্প করতে করতে দিকে হাঁটছিলাম। দেবব্রত দৌড়ে এসে আমার কাঁধে আলতো করে চাঁটি মারে। আমি ওর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করি, “কিরে কি হয়েছে?”

দেবব্রত তিস্তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “এই আমি তোদের সাথে আসতে পারি?”

তিস্তা ওর দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমি করে বলে, “মেট্রো তে ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখালে আমাদের সাথে হাঁটতে দেব।”

দেবব্রত ওর মাথায় আলতো চাঁটি মেরে বলে, “কেন রে তোর তথাগতর কি হল?”

আমি ডেলিশা কে জিজ্ঞেস করি, “এই তথাগত আবার কে?”

ডেলিশা কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দেয়, “আমি কি করে জানব ওর কথা?”

দেবব্রত আমাকে উত্তর দিল, “তিস্তার অনেক বয়ফ্রেন্ড আর তথাগত তার মধ্যে একজন। কি রে ঠিক কিনা?”

তিস্তা বিরক্ত হয়ে দেবব্রত কে রাস্তার মাঝে মারতে শুরু করে দেয়, “কুকুর, গান... সবাইকে সব কথা বলে দিতে হবে নাকি?”

দেবব্রত হাসতে হাসতে বলে, “আচ্ছা আচ্ছা, বুঝলাম ওটা তার মানে পাস্ট। তা এখন কাকে নাকে দরি দিয়ে ঘুরাচ্ছিস?”

আমি জিজ্ঞেস করি, “হ্যাঁ রে, তিস্তার কটা বয়ফ্রেন্ড?”

দেবব্রত, “মিতা, আমি যদি এখন গুনতে শুরু করি তাহলে সকাল হয়ে যাবে ওর বয়ফ্রেন্ডের নাম গুনতে গুনতে।”

তিস্তা ওর দিকে বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “শালা কুত্তা, তুই চুপ কর এবারে না হলে তোকে মেরে ফেলব আমি।”

দেবব্রত, “একটা চুমু দে তাহলে আমি চুপ করে যাব।”

আমি জিজ্ঞেস করি, “তিস্তা, তোর তাহলে অনেক বয়ফ্রেন্ড?”

তিস্তা, “মিতা, তুমি প্লিস শুরু হয়ে যেও না।”

হ্যাঁ, কলেজে এক নতুন নাম পেলাম, “মিতা”, ও চলে যাওয়ার পরে আমার জীবন থেকে “পরী” মুছে গেছে। শুধু মাত্র ছোটমা আর বাবু আমাকে ওই নামে ডাকে। এক নতুন বন্দিনী, “মিতা”।

বাবু সেলফোন কিনে দিল না, মন টা সেদিন খুব ভারাক্রান্ত ছিল আমার। ক্লাসে চুপ করে বসে ছিলাম আমি। তিস্তা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে তোমার?”

আমি ওর দিকে মাথা নাড়িয়ে উত্তর দিলাম, “কই কিছু না ত?”

আমার চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল, “একদম মিথ্যে কথা বলবে না। তোমার মনের ভেতরে কিছু একটা চলছে।”

আমি ওর দিকে ম্লান হাসি দিয়ে বলি, “আমি ঠিক আছি। তুই কফি হাউস যাবি?”

আমার হাত ধরে টেনে ক্লাস থেকে বের করে নিয়ে এসে আবার জিজ্ঞেস করে, “সত্যি করে বলত কি হয়েছে তোমার?”

আমি কি করে ওকে সত্যি কথা বলি? আমার দুঃখ শুধু মাত্র আমার থাক, এই রক্তাক্ত বুকের পাঁজর নিলাম করে লাভ কি।

আমি, “কিছু না রে, এই এমনি একটু মন খারাপ। অনেক দিন দেশের বাড়ি যাইনি, মাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে তাই।”

তিস্তা জানত না যে ছোটমা আর বাবু আমার আসল বাবা মা নয়, তাই অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, “কেন, তোমার বাবু মা দমদমে থাকে না?”

আমি, “না রে, আমার দেশের বাড়ি বসিরহাট গ্রামে, কোলকাতা থেকে অনেক দুরে।”

আমাকে সাথে নিয়ে তিস্তা কফি হাউস ঢোকে। কফি হাউসে ঢুকেই আমার পা কেঁপে ওঠে। দুতলার ওই চেয়ারে বসতে আমার মন কেমন করে ওঠে। মাথার ওপরে বিশাল পাখা গুলো যেন ককিয়ে ককিয়ে কেঁদে আমাকে ডাক দেয় আমি একা কেন। শেষবার যখন ওর সাথে এসেছিলাম ওই দু তোলার জানালার ধারের চেয়ারে দুজনে বসেছিলাম। সেই চেয়ারে সেদিন অন্য কেউ বসে। আমাকে দেখে সেই চেয়ার যেন ডুকরে কেঁদে জিজ্ঞেস করে, “তোমার সাথি কই।”

আমি মুক, উত্তর নেই আমার কাছে!

একতলায় একটা টেবিলে বসে তিস্তা চিকেন পকোড়া আর ঠাণ্ডা কফির অর্ডার দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার ব্যাপারে কিছুই জানি না। ওই সুন্দর চোখের পেছনে যেন অন্য এক মিতা লুকিয়ে আছে। আজ আমি জানতে চাই এই শুচিস্মিতা আসলে কে?”

আমি ওকে বলি, “না রে, কেউ নেই। বাবু আমাকে সেলফোন কিনে দেয়নি তাই মন একটু খারাপ।”

তিস্তা, “না এটা আমি মানতে পারলাম না।”

আমি শেষ পর্যন্ত আমার জীবনের কিছু কথা তিস্তাকে জানাই। হ্যাঁ, আমার ভালবাসার কথা, আমার ব্যাথার কথা আমি চেপে যাই। কেন সেই ব্যাথা আবার বুকে টেনে আনা, কেন সেই ব্যাথার গল্প শুনে কেউ আমার কাঁধে হাত রাখবে? আমার সেই সুন্দর স্বপ্নের দিন গুলো শুধু মাত্র আমার হৃদয়ের কোনে গোপনে থাকুক। কফি হাউসে বসে আমরা বাকি দিন কাটিয়ে দিলাম।

গল্প শুনে আমার দিকে ব্যাথিত নয়নে বলল, “তোমার ছোটমা আর বাবুর মতন মানুষ হয় না।”

আমি ওর দিকে ম্লান হেসে উত্তর দেই, “হ্যাঁ আমার বাবু আর ছোটমায়ের মতন মানুষ হয় না।”

শুধু মাত্র আমার হৃদয় জানে, যে আমি এক বন্দিনী রাজকুমারী।

বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা, দিনটা ছিল শুক্রবার। কোন এক কারনে কলেজ ছুটি ছিল সেদিন। আমরা মানে, তিস্তা, আমি আর ডেলিসা রাস্তায় গল্প করতে করতে হেদুয়ার দিকে হাঁটছিলাম। ডেলিসা আমাদের বলল যে ও আমাদের ট্রিট দিতে চায়। আমি ওকে কারন জিজ্ঞেস করাতে লাজুক হেসে উত্তর দিল ডেলিসা, “কাল আমার আর দানিসের এনগেজমেন্ট হয়েছে তাই।”

তিস্তা ওর দিকে হেসে বলে, “শেষ পর্যন্ত আরও একটা মুরগি কাটা পড়ল। ত আমরা কোথায় যাচ্ছি তাহলে?”

আমি, “পিটারক্যাটে গিয়ে ছেলো কাবাব, এর কমে ত কথাই হবে না।”

আমার মুখে পিটারক্যাটের নাম শুনে ওরা দুজনে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনেই আমাকে জিজ্ঞেস ক্করে, “কি ব্যাপার, তুমি পিটারক্যাটের নাম কি করে জানো? তুমি ত ডুবে ডুবে জল খাওয়ার মেয়ে দেখছি। হুম, ওখানে নিশ্চয় একা যাওনি, কে গেছিল সাথে, হ্যাঁ?”

আমি ওদের ক্ষান্ত করে উত্তর দিলাম, “না রে বাবা, আমি আমার এক বান্ধবী আর তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে গেছিলাম ওখানে।”

তিস্তা আমাকে বলে, “ঠিক আছে বাবা, নিঃশ্বাস করে নিলাম।” তারপরে ডেলিসার দিকে তাকিয়ে ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হ্যাঁরে, দানিস কেমন রে, মানে তোকে কি রকম সুখ দেয়?”

ফর্সা ডেলিসার গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায় তিস্তার কথা শুনে, তিস্তাকে আদর করে চাঁটি মেরে বলে, “ধ্যাত, আমি অন্তত তোর মতন নয় যে বারো ঘাটের জল খেয়ে বেরাই।”

ডেলিসা আমাদের জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কি পিটার ক্যাট যাচ্ছি আমরা?”

তিস্তা জোরে বলে উঠল, “না না, অনেক দিন পরে কিছু ভালো বন্ধু পেয়েছি, আজ আর পিটারক্যাট নয়, আজ আমার বাড়িতে। বাড়িতে বৌদি ছাড়া আর কেউ নেই, চল না আমার বাড়িতে গিয়ে একটু মজা করা যাক।”
[+] 2 users Like Nefertiti's post
Like Reply
#3
তিস্তা একটি নদীর নাম (#02)

আমরা তিনজনে ট্যাক্সি চেপে তিস্তার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমি মাঝখানে বসে আর আমার দুপাশে তিস্তা আর ডেলিসা। তিস্তা সবসময়ে জিন্স আর টপ পড়তে ভালবাসত, মাঝে মাঝে স্কার্ট পড়ত বইকি কিন্তু কোনদিন সালোয়ার পড়তে দেখিনি ওকে। ওর স্কার্ট গুলো বেশ ছোটো হত, হাঁটু পর্যন্ত আর মসৃণ পা দেখে ছেলেদের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। ডেলিসা একদম অন্য স্বভাবের মেয়ে, সবসময়ে সালোয়ার পরে কলেজে আসতো। সেই প্রথম দিনের পরে আর কোনদিন ও হিজাব পরেনি। কিন্তু ওর সালোয়ার গুলি ভারী সুন্দর দেখতে হত।

সেই চিতকুলের ভ্রমণের পরে আমি আর কোনদিন জিন্স পড়িনি। একদিন ছোটমায়ের নজর লুকিয়ে আমি আমার জিন্স আর সেই তুঁতে রঙের লেহেঙ্গা একটা প্ল্যাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে মুড়ে মেডিকেল কলেজের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম। কেন আর ওই সব কাপড় পড়া, কার জন্য পড়া।

আমার দুপাশে ওরা দুজনে বসে গল্প করে আর কুকুর বিড়ালের মতন মারামারি শুরু করে। ওদের বেশির ভাগ থাপ্পর আমার বুকে হাতেই লাগছিল। আমি ওদেরকে জোর গলায় বলি, “তোরা যদি মারামারি না থামাস তাহলে কিন্তু তোদের মাথা ঠুকে দেব এবারে।”

ডেলিসা আমার দিকে তাকিয়ে মজা করে বলে, “বাঃ বা, মিতা ম্যাডাম আবার রাগ করতে ও জানে। আচ্ছা মিতা তোমার বয়স কত?”

আমি জানাই যে আমার বয়স ছাব্বিশ। আমার বয়স শুনে ওরা আরও অবাক হয়ে গেল, আমি ওদের চেয়ে প্রায় বছর চারেকের বড় ছিলাম। তিস্তা মজা করে বলে, “ধ্যাত, মিথ্যে কথা। তোমার সামনে ত আমরা তাহলে কচি বাচ্চা।”

ডেলিসা, “তোমার ঠিক সময়ে বিয়ে হলে তিস্তার মতন মেয়ে হয়ে যেত...”

তিস্তা আমার দিকে মজা করে হাত জোর করে বলে ওঠে, “মিতা মাতা, প্রনাম নেবেন।”

আমি হেসে ফেলি ওর কার্যকলাপ দেখে।

তিস্তার বাড়ি তিনতলা। একতলায় ভাড়া থাকে। দুতলায় ওর দাদা বৌদি আর তিনতলায় বাবা মায়ের তিস্তা থাকে। আমরা বাড়ি পৌঁছতেই ওর বৌদি আমাদের জন্য দরজা খুলে দেন। তিস্তা বৌদিকে জড়িয়ে ধরে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল, “আমার বৌদি, বনানিদি।”

তারপরে আমাদের দিকে তাকিয়ে আমাদের পরিচয় দেয়।

তিনতলায় ওর ঘরে নিয়ে যায় তিস্তা। ঘরে ঢুকে দেখি দেয়ালে একটা বিশাল সোয়ার্জেনেগারের পোস্টার টাঙ্গানো। মাংস পেশি ফুলিয়ে একটা পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে সেই লোক।

ডেলিসা পোস্টার দেখে তিস্তা কে মজা করে বলে, “কিরে সোয়ার্জেনেগার কি রাতে তোর স্বপ্নে আসে?”

তিস্তা ডেলিসার কথা শুনে বলে, “উম্মম্মম্ম... মাল কি বলব, যেদিন ও পোস্টার থেকে বেড়িয়ে আসবে সেদিন আমি ওর হাতে নিজেকে সমর্পণ করে দেব।”

আমার দিকে তাকিয়ে তিস্তা বলে, “দাঁড়িয়ে কেন? পোস্টার দেখে পায়ের ফাঁকে কিছু হয়ে গেল নাকি তোমার?”

বলেই আমার পেছনে আদর করে চাঁটি মারে।

আমি কাঁধের ব্যাগ বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে ওর বিছানায় চেপে বসে পরি। আমি ওর দিকে দুষ্টুমি ভরা হাসি দিলে জিজ্ঞেস করি, “পোস্টারের সাথে প্রেম করে কি লাভ দেবে।”

ডেলিসা হেসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “হুম ... মিতার যেরকম দেখতে মেয়ে ঠিক সেই রকম নয়, ও অনেক ডুবে ডুবে জল খায়।”

আমি ওদের দিকে চেঁচিয়ে উঠি, “এই তোদের কি সেই সব কথা ছাড়া আর কোন কথা মুখে আসে না?”

তিস্তা আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে। আমি পেটের ওপরে শুয়ে ছিলাম, তিস্তা আমার পিঠের ওপরে শুয়ে পরে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। দেহের দুপাশ থেকে হাত নিচে করে বুকের কাছে এনে চাপ দেয়। তিস্তা চেপে ধরে মজা করে বলে, “সোনা মেয়ে, একদিনে ত মাল এত ফোলেনি তোমার, সত্যি কথা বলত।”

বুকের ওপরে তিস্তার নরম আঙ্গুলের পরশ আমার বুকের মাঝে সেই পুরানো আগুন ধুক করে জ্বলে ওঠে। শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে যেন এক বিদ্যুৎ খেলে চলে যায়। আমি ঘুরে যাই আর ওকে আমার পিঠ থেকে বিছানায় ফেলে দেই। ওর চাপের ফলে আমার শরীর অল্প গরম হয়ে গেছিল আর সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছিল।

তিস্তা ডেলিসার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলে, “দেক ওর বুক, দানিস টিপে টিপে কত বড় করে দিয়েছে।”

ডেলিসা তিস্তার ওপরে ঝাঁপিয়ে পরে ওর শার্ট খুলে ফেলে দেয়। তিস্তার নরম উন্নত বুক জোরা কালো অন্তর্বাসে ঢাকা আমাদের চোখের সামনে উন্মুক্ত হয়ে যায়।

তিস্তা চেঁচিয়ে ওঠে ডেলিসার দিকে, “হুম... গরম হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে।”

বুক নাচিয়ে দেয় আমাদের চোখের সামনে, দুটি পীনোন্নত বুক জোরা কালো অন্তর্বাসের ভেতরে যে একে ওপরকে ঠেলে ধরে রাখে, এই যেন ফেটে বেড়িয়ে পড়বে এর একটু হলে।

ডেলিসা ওর ফোলা ফোলা বুকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কি রে, কয় জোরা হাতের চাপ খেয়েছিস তুই?”

তিস্তা ছাদের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয়, “উম্মম... চার জোরা হাত বে।”

আমি অবাক হয়ে বলি, “বাপ রে চার জোরা? তুই পারিস বটে।”

তিস্তার কথা শুনেই আমার মনের মধ্যে সেই পুরানো দিনের প্রেমের কথা মনে পরে যায় আর সারা শরীর কেঁপে ওঠে।

তিস্তা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “হুম, তোমার ভেতরে কেমন যেন হচ্ছে তাই না।”

আমি চেঁচিয়ে উঠি, “না না না...”

প্রানপন চেষ্টা করি আমার মনের সেই উষ্ণ প্রানবন্ত দিন গুলির কথা ঢেকে রাখতে।

তিস্তা শুরু হয়ে যায় ওর গল্প বলতে, “একটা ছিল আমি যখন ক্লাস টেনে পড়তাম। খুব বাচ্চা বাচ্চা প্রেম ছিল সেই সময়ে, তাই কয়েকটা চুমু আর জড়াজড়ি ছাড়া কিছুই হয় নি। যা শালা, আমি ত ওর নাম টাও ভুলে গেছিরে। যাক, তার পরে হল, বিক্রমজিত, যখন আমি ক্লাস টুয়েল্ভে পড়ি। মাল, প্রথম ছোঁয়া ওর কাছ থেকে পেয়েছিলাম। সারা শরীরে একদিন চুমু খেয়েছিল, উম্মম, ভুলতে পারব না সেই ফিলিংস।”

ডেলিসাও কম যায়না, তিস্তার জিন্সের ওপর দিয়ে জানুসন্ধি চেপে ধরে বলে, “আর এটার ছিপি কে খুলেছে রে?”

ডেলিসা চাপ দেয় আর তিস্তা শীৎকার করে ওঠে আনন্দে, “না রে, এখন ত তুই আমার ওখানে ঝাঁট জ্বালিয়ে দিলি। বিক্রমজিত মাল বেল্টের নিচে নামেই নি।”

ওদের কথা শুনে আমার ত মাথা ঘুরতে শুরু করে দিয়েছিল, এই সহুরে মেয়েদের কার্যকলাপ বড় উদ্ভট মনে হয়েছিল। ডেলিসা আমার চকচক চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মিতা এত চুপ করে কেন ভাই, কিছু তুমি ও বল।”

আমি লজ্জায় লাল হয়ে বললাম, “ধ্যাত, তোরা দুজনে না একদম যাতা। তিস্তা তোর গল্প শুনি তাই বল।”

তিস্তা আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, “আমি ত আমারটা বলব, কিন্তু তোমার গল্প শুনি না।”

আমি, “না রে আমার কোন গল্প নেই।”

ডেলিসা আমার দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে উত্তর দেয়, “সতী মেয়েরে মিতা। একজনের কাছেই শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরা দেবে।”

আমি মনে মনে হেসে ফেলি ওর কথা শুনে, “হ্যাঁ একজনের কাছেই আমি আমার সব কিছু বিসর্জন দিয়েছি আর তাঁর জন্য আমার মনে কোন ক্ষোভ বা দুঃখ নেই।”

তিস্তা ডেলিসা কে জিজ্ঞেস করে, “তুই দানিসের কথা বল, খাটে কেমন ও?”

ডেলিসা, “কেন রে, তুই টেস্ট করতে চাস নাকি?”

তিস্তা, “দেখি না শুনে, তোরটা কেমন আর আমার টা কেমন।”

ডেলিসা ঠোঁট কুঁচকে মৃদু চিৎকার করে ওঠে, “উফফফ... আর সেই দিনের কথা মনে করাস না ভাই, জল চলে আসে।”

আমি ওর কথা শুনে উৎসুক হয়ে উঠি, পরে অবশ্য ভেবেছিলাম যে সেদিন কি হয়েছিল আমার মনের কোনে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “বল বল কি করেছিল সেদিন তোর সাথে।”

ডেলিসা মৃদু শীৎকার করে ওঠে ওর সেই রতিক্রিয়ার কথা মনে করে, “কি বলব তোদের, ছাল নামানো, শক্ত যেন লোহার মুগুর আর আগুনের মতন গরম। যখন ঢুকিয়েছিল আমার ভেতরে মনে হয়েছিল যেন মাথা ফুড়ে বেড়িয়ে আসবে, আমি ব্যাথায় ককিয়ে উঠেছিলাম, কিন্তু মাল সেই যে সুখ, উম্মম... ”

তিস্তা শয়তানি হাসি দিয়ে বলে, “তোদের এটাই বড় সুখের।”

ডেলিসা বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”

আরও একটা শয়তানি হাসি মাখিয়ে উত্তর দেয় তিস্তা, “কলেজে আমার ছিপি খোলে আহিল।”

আমি অবাক, “হ্যাঁ কি বলিস, তাহলে শুধু বুদ্ধিসিম আর ক্রিস্টিয়ান্স বেঁচে আছে তোর হাত থেকে নাকি ওদের খাওয়াও হয়ে গেছে?”

তিস্তা, “আরে না না, আহিল সাথে ত চুরান্ত খেলা চলেছিল। ওর সাথে কি আর প্রেম করেছিলাম নাকি?”

তিস্তা আমাদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোরা জিন্স পরিস না?”

আমরা দুজনেই মাথা নাড়াই, “না জিন্স পড়িনি।”

তিস্তা, “উফ, তাহলে তোদের বুঝাই কিকরে সেই শিরশিরানি।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “জিন্সে আবার কিসের শিরশিরানি?”

তিস্তার ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি, “তোরা নিচে সবসময়ে প্যান্টি পরিস তাই না।”

ডেলিসা কিছুই বুঝতে পারছেনা আমিও তথৈবচ।

তিস্তা চোখ বন্ধ করে নিজের জানু মাঝে আঙ্গুল চেপে ধরে বলে, “জিন্সের স্টিচ যখন ওখানে ঘষা খায়, কি যে শিরশিরানি হয় সেখানে সেটা কি আর আমি বলে বুঝাতে পারব তোদের? ভেতরে পান্টি না পরে শুধু জিন্স পড়লে ওখানে দারুন লাগে। হাঁটতে চলতে উঠতে বসতে পায়ের ফাঁকে ঘষা খায় আর আমি মাল একদম ভিজে যাই। সারা পেটের মধ্যে কেমন যেন করে ওঠে।”

বলতে বলতে হটাত তিস্তা আমার জামার কলার ধরে আমাকে চিত করে শুয়িয়ে দিল বিছানার ওপরে। আমার লাল নরম ঠোঁটের ওপরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরে, আমার নরম বুকের ওপরে নিজের বুক চেপে ধরে তিস্তা। আমাদের দুজনের চাপের ফলে নরম সুগোল বক্ষ পিষে যায়, আমার বুক যেন অন্তর্বাসের ভেতর থেকে ফেটে বেড়িয়ে আসে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা, ওর মাথার পেছনে হাত দিয়ে ওর মুখ খানি আরও নিজের ঠোঁটের ওপরে চেপে ধরি। জীবনের সেই প্রথম বার একটা মেয়ের চুম্বনে আমার শরীর গরম হয়ে ওঠে। আমার বুকের নুড়ি পাথরের মতন শক্ত হয়ে যায়, তিস্তার নুড়ি আমার বুকের ওপরে যেন দাগ কেতে দেয় তপ্ত পেরেকের মতন। আমি সম্পূর্ণ পাগল হয়ে উঠেছিলাম কামনার আগুনে। তিস্তা আমার মুখের ভেতরে জিব ঢুকিয়ে দেইয়ে আমার জিব নিয়ে খেলা করতে শুরু করে দেয়। আমি ওর ঠোঁটের সিক্ত মধু খেতে শুরু করে দেই। তিস্তা আমার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আমার মুখের ভেতরের হাওয়া শুষে নেয়। আমি ওর মাথা আরও জোরে চেপে ধরি ঠোঁটের ওপরে। কিছু পরে তিস্তা আমার ঠোঁট ছেড়ে দেয়, দুজনেই উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেদিনের খেলায়। দুজনেই আগুনে ঝলসে হাপাতে থাকলাম। তিস্তার কামনা ভরা চোখ দুটি যেন আমাকে ঝলসে দিয়েছিল। আমি ডেলিসার দিকে তাকিয়ে দেখি, দুষ্টুমি ভরা হাসি মেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল সে।

ডেলিসা আমাদের কার্যকলাপ দেখে হেসে বলে, “তোরা তোদের প্রেমলিলা চালিয়ে যা আমাকে আবার পার্কসার্কাস ফিরতে হবে।”

আমি উঠে বসে জামা আর স্কার্ট ঠিক করে নেই। তিস্তা আমার হাত ধরে অনুনয় করে বলে ফেলে, “সরি মিতা, আমি জাস্ট বয়ে গেছিলাম একটু।”

আমি ওর দিকে চোখ টিপে হেসে বলে ফেলি, “নারে সরি কেন, আমার বেশ ভালো লেগেছে রে।”

তিস্তা আমাদের আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে বলে। কিন্তু বাড়িতে বাবু আমার পথ চেয়ে বসে থাকবে তাই আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হয় সেদিন। বাড়ি ফেরার আগে তিস্তা নিজের বুকের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে হেসে বলে, “এই মুরগি একটা নতুন মোরগ ধরেছে।” বাসস্টান্ড পর্যন্ত তিস্তা আমাদের এগিয়ে দিয়েছিল সেদিন।

পুজোর ছুটির কিছু দিন আগের ঘটনা। তিস্তা আর আমি কলেজের গেতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিস্তা আমাকে সেদিন কারুর সাথে দেখা করাবে বলেছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করাতে উত্তর দেয় যে আগের দিন যার কথা বলেছিল তাঁর সাথে আমার দেখা করাতে চায়।

আমি, “তুই কবে তোর নতুন মোরগের কথা আমাকে বলেছিস?”

তিস্তা, “যা বাবা, মিতা। এই ত সেদিন তোমাকে বলেছিলাম না। অইজে যেদিন আমি আর তুমি বাসের অপেক্ষা করছিলাম।”

আমি মাথা নারলাম, হ্যাঁ মনে পড়েছে।

কিছু পরে একটা এই পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের ছেলে আমাদের দিকে আগিয়ে এসে তিস্তাকে দেখে হাসল। তিস্তা ওর দিকে দৌড়ে গিয়ে হাত জড়িয়ে ধরে। ও আমার দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। আমি হাত জোর করে অভিবাদন জানালাম। ছেলেটা আমার হাতজোর দেখে হেসে বলে, “আমি কাকুর মতন এখন বুড়ো হয়ে যাইনি যে হাতজোড় করে প্রনাম জানাতে হবে।”

তিস্তার চেয়ে ছেলেটা বেশ লম্বা। ছেলেটা দেখতে বেশ সুদর্শন, চওড়া কাঁধ পেটান চেহারা। নীল স্ট্রাইপ শার্ট আর ধুসর রঙের পান্টে বেশ দেখাচ্ছিল ছেলেটাকে। পাশাপাশি তিস্তা আর ছেলেটাকে দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল ওদের জুটি। ওদের দেখে আমার সেই পুরানো দিনের কথা মনে পরে যায়, আমি আর ও একসাথে এই রাস্তা দিয়ে হাত ধরে বেশ কয়বার হেঁটে গেছি।

তিস্তা আমাকে বলে, “এ, তির্থাঙ্কর সেনগুপ্ত। যাদবপুর উনিভারসিটি থেকে নিউক্লিয়ার ফিসিক্সে পিএইচডি করছে।”

আমি তিস্তার হাত ধরে একপাসে টেনে জিজ্ঞেস করি, “কিন্তু দেবব্রত সেদিন অন্য কোন ছেলের নাম বলেছিল যে?”

আমার কথা শুনে তিস্তা একটু বিরক্তি ভরা চাহনি দেয় আমার দিকে, “চুপ চুপ, একদম ওই কথা মুখে আনবে না।”

আমি তিস্তার কথায় সব কিছু বুঝে নিলাম।

তিস্তা তিরথাঙ্করকে জিজ্ঞেস করে, “তীর্থ, গাড়ি এনেছ?”

আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, “ওরে বাবা, গাড়ি ও আছে ওর কাছে?”

আমার কানেকানে বলে, “বাপ মায়ের একমাত্র ছেলে আর ওর বাবা খুব বড়োলোক।”

তিরথাঙ্কর আমাকে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে নিল। তিস্তার দিকে কম আর আমার দিকে যেন বেশি করে চেয়ে দেখছিল তির্থাঙ্কর। ওর চোখের চাহনি আমার ঠিক ভালো লাগেনি, কেমন যেন লম্পট ছেলদের মতন হাঁ করে তাকিয়েছিল।

আমি তিস্তা কে বললাম, “এই আমি না বাড়ি যাচ্ছি। তোদের বেশি ডিস্টার্ব করব না।”

তির্থাঙ্কর আমাকে বলে, “আরে বাবা, বাড়ি যাবে খানে। অনেক দিন পরে তিস্তা এক সুন্দরী বান্ধবীর সাথে দেখা করাল। তুমি সাথে থাকলে বেশ ভালোই হবে।”

তিস্তা ওর হাতে চিমটি কেটে বলে, “তুমি কি মিতার সাথে ফ্লার্ট করছ? একদম নজর দেবে না ওর দিকে।”

আমি তিস্তাকে জানালাম, “বাবু আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে রে। আমি না গেলে বাবু চা পাবেনা। তোদের সাথে না হয় অন্য কোনদিন ঘুরতে যাবো।”

অতি ভদ্রতার সাথে ওদের আমন্ত্রন উপেক্ষা করেছিলাম। তির্থাঙ্করের চোখের সেই লিপ্সা মাখা চাহনি আমার একটুও ভালো লাগেনি। মেয়েদের মাথার মধ্যে এক ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করে, চোখের চাহনি দেখে বলে দিতে পারে কে কেমন ভাব নিয়ে ওদের দিকে তাকায়। আমি ওদের কে ওখানে ছেড়ে বাসস্টান্ডের দিকে হাটা দিয়েছিলাম। বাসে এল, আমি চরতে যাবো তার আগে দেখলাম যে তির্থাঙ্কর আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়াল। ওর হাত নাড়ানো দেখে আমার কেমন বিরক্তি লেগেছিল।

আমি বাসে চরতে যাবো আর ঠিক সেই সময়ে কেউ পেছন থেকে আমার খোঁপায় গোঁজা পেন টেনে নেয় আর আমার চুল খুলে যায়। সেই লোকটার আচরনে আমি খুব রেগে যাই আর পেছন ফিরে তাকে বেশ ভালো ভাবে কথা শুনানর জন্য প্রস্তুত ছিলাম। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি দেবব্রত আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওর হাসি মুখ দেখে আমার রাগ জল হয়ে যায়।

দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তিস্তার সাথে দাঁড়িয়ে কি করছিলে?”

আমি ওকে উলটো প্রশ্ন করি, “কেন তোমার নজর তিস্তার ওপরে ছিল নাকি?”

দেবব্রত আমার কাছে এসে কানে কানে বলে, “আরে জাননা, কলেজের দিন থেকে ওর ওপরে আমার নজর ছিল, কিন্তু ও তখন একটা '. ছেলের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছিল তাই আর আমি ওর দিকে ঘেসিনি।”

আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “কিন্তু সেদিন যে তুমি বললে অন্য কেউ ছিল? কি যেন নাম।”

দেবব্রত, “ও আচ্ছা, তথাগত। আহিল ত ওকে শুধু বিছানায় নেবার জন্য প্রেমের ভান করেছিল, তথাগত ওকে সত্যি ভালবাসত।”

আমি, “এখন তথাগত কোথায়?”

দেবব্রত, “আরে মেয়েটা ডাম্প করে ওকে, বেশি বড়লোকের ছেলে ছিলনা তথাগত, তিস্তার মনের দাম মেটাতে পারেনি, তাই তিস্তা ডিচ করে। গ্রাজুয়েসান শেষ করে স্কলারসিপ নিয়ে বাইরে চলে যায়, কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। শালি কুত্তি চিজ, যতক্ষণ না জ্বালা মিটবে ততদিন ওর শান্তি হবে না”

এই বলে হিহি করে হেসে ফেলে।

এই ছিল আমার বান্ধবী তিস্তা, ঠিক যেন পাহাড়ি এক নদী, উচ্ছল উদ্দাম সবসময়ে যেন নেচে বেড়াচ্ছে, কারুর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তিস্তা, আমার বান্ধবী, তিস্তা একটি নদী।
Like Reply
#4
Pinuram sir এর লেখা অসাধারণ. যেমন ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ তেমনি এটা. অনেকদিন ধরে এই গল্পটা বাংলায় খুজছিলাম আপনি দিলেন. আশা করি পুরোটা আছে আপনার কাছে. অনেক ধন্যবাদ.
Like Reply
#5
দাদা ধন্যবাদ গল্পটা দেবার জন্য।
এই গল্পটা বাংলা অনেক খুজেছি পাইনি।
দাদা নিয়মিত আপডেট দেবার অনুরোধ রইল।
Like Reply
#6
(02-11-2019, 01:42 AM)Baban Wrote: Pinuram sir এর লেখা অসাধারণ. যেমন ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ তেমনি এটা. অনেকদিন ধরে এই গল্পটা বাংলায় খুজছিলাম আপনি দিলেন. আশা করি পুরোটা আছে আপনার কাছে. অনেক ধন্যবাদ.

জ্বি, পুরোটাই আছে।
Like Reply
#7
ভালোর কোনো শেষ নেই,,,,,,,,,স্বাগত
Like Reply
#8
(02-11-2019, 07:19 AM)Nefertiti Wrote: জ্বি, পুরোটাই আছে।

Jene Khub anondito holam... Pinuram dar english e lekha ta ache kintu bangla ta xossip e pinuram dar thread e porleo amar kache nei, othocho golpo ta eto sundor je bar bar porte ichche kore.... Asha korbo apni niyomito (parle olpo olpo kore roj) update deben... Osonkho Dhonnobad... Valo thakben...
291
Keep Reading... Namaskar
Like Reply
#9
dada , update plese,
Like Reply
#10
[অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01, #02), ভগ্ন হৃদয়ের সান্তনা]

অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#01)

ততদিনে শশাঙ্কদা টেলিফোনের জন্য আবেদন করে দিয়েছিলেন আর গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন চলে আসে। তারপর থেকে মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিন কথা হত।

না সেই জুলাই মাসের পরে আমাকে কোনদিন ফোন করেনি ও। হয়ত করেছিল জানিনা আর ফোন হয়ত বা করেছিল কিন্তু ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিলেন আর আমাকে হয়ত দেওয়া হয়নি। আমি একদিন বাবুর ফোনের ডায়রিতে ব্যানারজি কাকুর ফোন নাম্বার খুঁজতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পাইনি। আমি চেষ্টা করেছিলাম অরুন্ধতির সাথে দেখা করতে, কিন্তু পারিনি, সেই চেষ্টাও বৃথা গেল আমার। আমি জানিনা কেন ও আমার সাথে দেখা করেনি। ও চলে যাওয়ার পরে ছোটমা ওর আর অরুন্ধতির সম্পর্কের কথা হাজার বার আমাকে জিজ্ঞেস করে। আমি ছোটমাকে সত্যি কথা জানাই যে আমি ওকে ভালবাসতাম আর ও আমাকে ভালবাসত। জানিনা, হয়ত আমার মাথায় হাত দিয়ে করা প্রতিজ্ঞার ফলে ও অনেক ব্যাথিত হয়েছিল আর তাই হয়ত মনে প্রানে চাইত যে আমার কোন ক্ষতি না হোক। হয়ত বা ওই অরুন্ধুতিকে আমার সাথে দেখা করতে বারন করেছিল বা হয়ত অরুন্ধুতি আমাকে ফোন করেছিল কিন্তু আমি সেই ফোনের উত্তর দিতে পারিনি।

মহালয়ার দুদিন পরের ঘটনা। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি বাথরুমে দাঁত ব্রাস করছিলাম, ঠিক সেই সময়ে ফোন বেজে ওঠে। বাবু অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়েন, আর সেদিন বাবু সকাল সকাল বাজারে সেরে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। ফোন যখন বেজে ওঠে তখন বাবু ফোনের কাছেই ছিলেন আর ছোটমা রান্না ঘরে ছিলেন। বাথরুম থেকে আমি ওদের কথা শুনতে পাই।

বাবু, “পরীকে কি এই সব কথা জানাতে হবে?”

ছোটমা, “না এখুনি ওকে এই সব কথা জানিয়ে দরকার নেই। বাড়ি গিয়ে অবস্থা বুঝে দেখি তারপরে। আমি চাই না আমার মেয়ের এই পুজোর ছুটি এখুনি মাটি হয়ে যাক। দেখি পুজোর ছুটিতে কোথাও বেড়াতে বেড়িয়ে যাবো।”

আমি দাঁত ব্রাস করতে করতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে ওদের কাছে এলাম। আমি জিজ্ঞেস করি, “কি হয়েছে?”

ছোটমা মাথা নাড়িয়ে কথা চেপে বললেন, “না কিছু হয়নি।”

বাবু আমার পাসে এসে দাঁড়িয়ে ছোটমাকে বললেন, “উলুপি, আমার মনে হয় পরীকে জানিয়ে দেওয়া উচিত।”

ছোটমা আমাকে টেনে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে গাউন খুলতে নির্দেশ দিলেন, আমি ছোটমায়ের আচরনে অবাক হয়ে যাই। ছোটমা নিজেই আমার গাউনের ওপরের কয়েকটা বোতাম খুলে বুকের ওপরে হাত দিয়ে নেড়ে চেরে কি যেন দেখলেন। আমি খুব অপ্রস্তুত হয়ে পরি ছোটমায়ের আচরনে। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার বুকের বোঁটা থেকে কোন কিছু তরল বের হয় কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম যে না বের হয় না।

ছোটমা আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে নে, আমরা গ্রামের বাড়িতে যাবো।”

ছোটমায়ের আচরনে আমি ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছিলাম, আবার তাড়াতাড়ি জামাকাপড় পরে বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মন খুব উদবিগ্ন হয়ে উঠেছিল। প্রথমেই আমার মায়ের কথা চিন্তা হয়েছিল, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি যে বাড়িতে কার কি হয়েছে।

ছোটমা উত্তর দিলেন, “তোর মা ভালো আছেরে সোনা মা। পুজোর ছুটি ত আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে আমি ভাবলাম কয়েক দিন আগেই তোকে বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি।”

ছোটমা বাবুকে ট্যাক্সি ডাকতে বলে দিলেন। ট্যাক্সি চেপে আমি আর ছোটমা গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ট্যাক্সিতে চেপে ছোটমা আমার কলেজের কথা আমার বন্ধু বান্ধবীদের কথা জিজ্ঞেস করেন। আমি মাথা নেড়ে উত্তর দেই, কিন্তু মনের কোন এক গহিন কোনে সংশয় থেকে যায়। আমার মা ঠিক আছেন তাহলে বাড়ির অন্য কারুর কি কিছু হয়েছে। ছোটমা আমাকে কিছুতেই জানাতে দেয় না সেই কথা।

কথা ঘুরিয়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “নতুন বান্ধবী হল তোর?”

আমি বুঝে গেছিলাম যে আমার মনের উদ্ভিগ্নতা কম করার জন্য ছোটমা কথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে কথার রেশ টানছেন, সেই জন্য ত আমার দিদি আমার মা।

আমি হেসে উত্তর দিলাম, “ছোটমা, কলেজে কি আর আধ খানা বান্ধবী হয়, সবাই ওখানে বন্ধু বান্ধবী।”

ছোটমা মাথা নাড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে বলেন, “সোনা মা, কলজের জীবন স্কুলের জীবনের থেকে অনেক আলাদা। কলেজে সবাই মতলবি হয়, সবাই যেন বন্ধুতার বদলে কিছু চায়। এটা তোর গ্রাম নয় রে সোনা মা, এটা কোলকাতা, এখানে মানুষ মানুষকে তখনি চেনে যখন ওপর জনের কাছ থেকে কিছু পাবার আশা থাকে।”

আমি ছোটমাকে জানাই আমার দুটি ভালো বান্ধবীর ব্যাপারে, তিস্তা সরকার আর ডেলিসা খাতুন। ছোটমা বললেন, “পুজোর পরে ওদের বাড়িতে ডাক একদিন।”

আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে।"

আমি একটু ইতস্তত করে ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “ছোটমা, আমার কিছু বলার আছে।”

ছোটমা, “কি?”

আমি, “ছোটমা, আমার একটা সেলফোন চাই। আমার কলেজের বন্ধু বান্ধবীদের কাছে সেলফোন আছে ওদের সামনে কেমন যেন মনে হয় আমার। প্লিস ছোটমা।”

ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ঠিক আছে, পরের জন্মদিনে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”

আমি, “না ছোটমা, অনেক দেরি আমার জন্মদিন আসার।”

গত আগস্টে আমার জন্মদিন ছিল, পরের জন্মদিন মানে প্রায় এক বছর অপেক্ষা করা, আমার যেন তর সইছিল না। আমি মাথা নেড়ে আব্দার করে বলি, “না না ছোটমা আমার এখুনি চাই।”

ছোটমা, “ঠিক আছে, এই ক্রিস্টমাসে তোকে সেলফোন কিনে দেব।”

আমি খুশিতে নেচে উঠে ছোটমায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই, “আমার আদরের ছোটমা।”

ছোটমা স্কুলের টিচার, ছেলে মেয়েদের মানসিকতা নিয়ে প্রতি নিয়ত থাকতে হয়। ছোটমা জানতেন কি করে আমার মন ভুলান যায়, তাই আমার ছোটমাকে এত ভালো লাগত। কিন্তু কোন এক সময়ে মনে হত, কি করে ছোটমা ওর প্রতি অত নিষ্ঠুর আচরন করেছিলেন, কি করে নিজের ছেলেকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

দুপুর নাগাদ আমরা গ্রামের বাড়ি পৌঁছে গেছিলাম। ট্যাক্সি থেকে নেমেই দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে পড়েছিলাম। বাড়ির সবাই যেন আমাদের পথ চেয়ে বসেছিল। লক্ষ্য করলাম যে মা খাওয়ার ঘরে বসেছিল, মেঘনা বৌদি আর মৈথিলী পাশেই দাঁড়িয়েছিল। দুপুর বেলা দেখে বাড়িতে শশাঙ্কদা আর সুব্রতদা ছিলেন না, বড়দা হয়ত মাঠে গেছেন আর পার্বতী বৌদি হয়ত বড়দা কে খাবার দিতে গেছেন। আমাকে দেখে মা আর মেঘনা বৌদি একটু হাসলেন।

আমি মাকে জিজ্ঞেস করি, “কার কি হয়েছে?”

মা আমাকে উত্তর দিলেন, “পরী, তুই অনেক দূর থেকে এসেছিস, খেয়ে দেয়ে নে তারপরে কথা হবে। কারুর কিছু হয়নি এখানে সবাই ঠিক আছে।”

শেষের কথাগুলি বলার সময়ে মায়ের গলা কেন জানিনা কেঁপে উঠেছিল। চেহারার বেদনার ছায়া দেখেও আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা যে ঝড় আসছে।

ছোটমা বাড়িতে ঢুকে মাকে নিয়ে অন্য ঘরে ঢুকে পরে। আমি মেঘনা বৌদিকে প্রশ্ন করাতে বৌদি সেই একি উত্তর দিলেন। আমি শেষ পর্যন্ত মৈথিলীকে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু মৈথিলী আমার প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

ঠিক সেই সময়ে দুষ্টু আমাকে দেখে দৌড়ে এসে কোলে চাপে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খাই। দুষ্টুর প্রথম প্রস্ন আমাকে জর্জরিত করে তোলে, “পিসি, তুমি একা কেন? অভি কাকু কোথায়?”

অনেক দিন পরে ওর মুখে সেই নাম শুনে মন হুহু করে কেঁদে ওঠে। মনে হল যেন পায়ের তলার মাটি নড়ে উঠেছে। দুষ্টুকে প্রাণপণে বুকের কাছে জড়িয়ে ওর নরম গালে ঠোঁট চেপে ধরি।

আমি অর দিকে ম্লান হেসে ঝাপসা চাহনি নিয়ে বলি, “পরের বার আসবে। অনেক দুরে গেছে চাকরি করতে নতুন চাকরি তাই এবারে পুজোর ছুটি পায়নি।”

আমি ওকে প্রবোধ দিলাম বটে, কিন্তু মনের মাঝে নিজেকে কি বলে প্রবোধ দেব সেই চিন্তা করি।

দুষ্টুর মুখে তারপরের বাক্য আমার পায়ের তলার মাটি নাড়িয়ে দিয়েছিল, “বড় জেঠিমা বুকে ব্যাথা নিয়ে হস্পিটালে ভর্তি।”

আমি দুষ্টুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি। আমার বুকের মাঝে আগে থেকেই এক প্রবল ঝড় বইছিল তার ওপরে ওই খবর শুনে আমার বুক ফেটে যায়। আমি ওকে কোলে নিয়েই দৌড়ে যাই ঘরে, যে ঘরে ছোটমা আর মা বসেছিলেন। পার্বতী বৌদি, সর্বদা আমার ভালো চেয়েছিলেন, সে কথা আমাকে ও বলেছিল।

আমি ছোটমা আর মায়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠি, “দুষ্টু কি বলছে, মা? তোমরা দুজনে আমার কাছ থেকে কি লুকিয়ে রেখেছ?”

আমি ভুলে গেছিলাম যে আমার কোলে দুষ্টু, আমি ছোটমাকে জিজ্ঞেস করি, “কেন ছোটমা আমার বুক ধরে চেক করছিল?”

মা আমার কোল থেকে দুষ্টুকে নিয়ে অন্য ঘরে যেতে বলে। আমি লক্ষ্য করলাম যে ছোটমা আড়ালে নিজের চোখ মুছে নিলেন। আমি ছোটমায়ের কাছে এগিয়ে এসে পায়ের কাছে বস পরি।

ছোটমা আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে, “তোর বড় বৌদি ঠিক আছে। একটু বুকের ব্যাথা হয়েছে তাই ওকে নিয়ে হস্পিটালে গেছে, বিকেলের মধ্যে ফিরে আসবে তোর বড় বৌদি।”

আমি বিশ্বাস করিনা, “কিন্তু সকালে আমার বুক টিপে কি দেখছিলে তুমি?”

ছোটমা, “কিছু না এমনি একটু চেক করছিলাম।”

আমি ছোটমায়ের কথা বিশ্বাস করতে পারিনা যে বড় বউদির শুধু মাত্র একটু বুক ব্যাথা হয়েছে, “না, তোমরা সবাই আমাকে মিথ্যে কথা বলছ।”

মা ছোটমায়ের দিকে ইশারা করে যাতে আমাকে কিছু না জানানো হয়, আমি সেই ইশারা লক্ষ্য করি আর বড় ব্যাথা জাগে বুকের ভেতরে সেই দেখে। আমি কাতর চোখে ছোটমাকে প্রশ্ন করি, “প্লিস ছোটমা, বল না কি হয়েছে।”

ছোটমা বুক ভরা এক নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, “পার্বতীর ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়েছে।”

আমার ছোটো পাখীর মতন বুকে আর কত ঝড় আসবে সেটা বুঝে পাইনা। আমি ছোটমায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে কোলে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে ফেলি। আমি চিৎকার করে উঠি, “না এ হতে পারে না।”

ছোটমা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, “জ্যাতস হি ধুব মৃত্যু, ধ্রুভম জন্ম ম্রিতশ্যচ, তস্মাদ অপরিহার*্যথে, নঃ ত্বম সচিতুম অরহসি।”

আমি সেই সংস্কৃত শ্লোক শুনে রেগে যাই, চিৎকার করে বলি, “ছোটমা তোমার সংস্কৃত শ্লোক কি আমার পার্বতী বৌদিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে? আমি রক্ত মাংসের ছোটো একটি মেয়ে। আমাকে শুধু এই টুকু বল, কেন আমার জীবনের সব রঙ মুছে যায় বারে বারে।”

ছোটমা আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে বলেন, “সোনা মা, তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস, জীবনের অনেক কিছু তোর এখন বোঝা উচিত।”

আমি মাথা দুলিয়ে জোরে বলি, “না না না, আমি এখুনি বউদির কাছে যেতে চাই।” ছোটমা আমাকে অনেক বুঝিয়ে শান্ত করেন সেদিন।

বিকেল হয়ে সন্ধ্যে গড়িয়ে আসে, দাদারা কেউ ফেরে না দেখে আমি আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। বুকের মাঝে চরম সত্যি কথা শোনার জন্য মন বেঁধে তৈরি হয়ে নেই। এক সেকেন্ড যেন আমার কাছে এক বছরের মতন মনে হয়। এমন সময়ে ফোন বেজে ওঠে, আমি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরি, ওপর পাসে সুব্রত।

আমাকে জিজ্ঞেস করে সুব্রত, “তুই এখানে কখন এলি?”

আমি জোর গলায় বলি, “আগে আমাকে বল যে বৌদি কেমন আছে?”

সুব্রত, “মাকে ফোন দে।”

আমি চেঁচিয়ে উঠি, “না আমি মাকে ফোন দেব না, আমি কি এই বাড়ির কেউ নই যে আমাকে বউদির কথা বলা যাবেনা?”

বুক ভরে শ্বাস নিয়ে উত্তর দেয়, আমি চোখ চেপে বন্ধ করে থাকি চরম খবর শোনার জন্য। সুব্রত বলে, “বৌদি এখন ঘুমাচ্ছে, তাঁর কেমথেরাপি শুরু হয়ে গেছে। এবারে মাকে একটু ফোন দে।”
Like Reply
#11
অন্নপূর্ণা বিসর্জন (#02)

আমি মায়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দেই। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে, সুব্রতর সাথে কি কথা হয়েছে সেটা শোনার জন্য সবাই উদগ্রীব। আমি জানালাম যে বড় বউদির কেমো শুরু হয়ে গেছে আর বৌদি ঘুমোচ্ছে। সেই সময়ে আমি বুঝতে পারি যে কেন সকাল বেলায় ছোটমা আমার বুক টিপে পরীক্ষা করছিলেন। আমি ছোটমার দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেলি, এত ভালবাসে আমাকে?

ছোটমা আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, “কাল তোকে হস্পিটাল নিয়ে যাবো।”

রাতে দাদারা হস্পিটাক থেকে ফিরে আসার পরে সবাই ঘরে বসে কথা বার্তা বলেন। আমার সেই ঘরে ঢোকা মানা ছিল। আমার সেই দিনের কথা মনে পরে যায়, আমি আর ও যেদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসি। সেইদিন প্রথম বার বড় বৌদি নিজের হেঁসেল ছেড়ে বাড়ির উঠান পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে দিতে এসেছিলেন। আমি জানিনা, বড় বউদির সাথে ওর কি কথা হয়েছিল। কিন্তু সেদিন বড় বউদির হাসি হাসি চোখ আমার ঝাপসা দৃষ্টির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে।

আমি ছাদে উঠে এক কোনায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি। সেদিন ঠিক যে জায়গায় ও দাঁড়িয়েছিল আর আমাকে চুমু খেয়েছিল। ওর সাথে দেখা করার জন্য মন আকুলি বিকুলি হয়ে ওঠে, কিন্তু একি সাথে ছোটমায়ের ভালোবাসা আর স্নেহ মমতা আমাকে পেছনে টেনে ধরে রাখে। ছোটমাকে ছেড়ে কি করে আমি চলে যেতাম, আমার জীবন যে ছোটমায়ের কাছে ঋণী। আমি কি করে ছোটমায়ের মান সন্মান এই সমাজের সামনে নিচু করে দিতাম শুধু মাত্র নিজের জন্য? আমি বাংলার গ্রামের সামান্য একটি মেয়ে, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পদক্ষেপের আগে আমি শত বার মরে যেতাম যে।

আমার মাথায় চিন্তার বেড়ি যেন ঝনঝন করে ওঠে। বড় বউদির ক্যান্সার, আমার ভালোবাসার হারিয়ে যাওয়া আর ছোটমায়ের অকপট স্নেহ মমতা। আমার মাথা ঝিনঝিন করতে শুরু করে, চোখের সামনে অন্ধকার দেখি আর ধুপ করে ছাদের মেঝেতে লুটিয়ে পরে যাই।

চোখ খুলে দেখি যে আমি বিছানায় শুয়ে, মাথার কাছে মা বসে চারপাশে ছোটমা আর বাড়ির লোকে। মায়ের দুচখে জল, ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় প্রশ্ন করে মা, “উলুপি আমার বাড়িতে এই সব কি ঘটে চলেছে?”

একমাত্র ছোটমা জানে আমার মনের ব্যাথার আসল কারন। ছোটমা বুঝতে পারে যে বড় বউদির ক্যান্সারের খবর আমার জ্ঞান হারানোর কারন নয়, আমার জ্ঞান হারানোর আসল সত্য অন্য কিছু।

মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আর আমি চুপ করে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। ছোটমায়ের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে আমার মুখ দেখে, হয়ত ছোটমায়ের মন কাঁদে তাঁর একমাত্র ছেলের জন্য। কিন্তু নিজের মনের ভাব ছোটমা কোনদিন প্রকাশ করেননি। ছোটমা আমার পাসে এসে বসে বলেন যে পরের দিন আমাকে হসপিটাল নিয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন কোন এক অজুহাত দেখিয়ে আমাকে হসপিটাল যেতে দেওয়া হয় না।

দিনটা ছিল চতুর্থী, আকাশে বাতাসে যেন আগমনীর সুর ভেসে বেড়ায়, কিন্তু আমার মন ভারাক্রান্ত। ভালোবাসার বিচ্ছেদ আর বড় বউদির ক্যন্সার। আগমনীর সুরের সাথে বুকের ভেতরে বেদনার করুন বাঁশি বেজে ওঠে। আমি ঘুরতে ঘুরতে বাড়ির পেছনের দিকে যাই। সেই পুকুর পাড়, সেই আম কাঠালের বাগান, সব জায়গায় যেন ওর ছোঁয়া খুঁজে বেরাই আমি। এমনকি বাড়ির আনাচে কানাচে তেও যেন ওর ছোঁয়া লেগে আছে বলে মনে হয় আমার। আমি সেই পুকুর পাড়ের এককোণে ওর পোঁতা আম গাছের নিচে গিয়ে বসে পরি। আম গাছের গুঁড়ি ছুঁয়ে ওর হাতের পরশ অনুভব কররা প্রানপন চেষ্টা করি। এই আম গাছের তলায় এক দিন ও আমাকে চুমু খেয়েছিল, পাগল করে তুলেছিল এক শীতের রাতে। সেই চুম্বন আমার গালে, আমার কপালে আজও লেগে আছে। আমি নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকাই, নীল আকাশের নিচে, সাদা মেঘের ভেলা ঘুরে বেড়ায়। বাতাসের সেই পুজোর গন্ধ আমার নাকে প্রবেশ করেনা, নাকে লেগে থাকে ওর গায়ের গন্ধ।

এমন সময়ে দুষ্টু বাড়ির দিক থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জানায়, “বড় জেঠিমা বাড়ি ফিরে এসেছে।”

আমি আনন্দে লাফিয়ে উঠি, বউদির ফেরার খবর শুনে বুকের ভেতরের বেদনা যেন কিছু টা কমে যায়। আমি দৌড়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেস করে দেখি যে সবাই খাবার ঘরে গোল করে বসে। মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা উত্তর দেন যে বৌদি নিজের ঘরে শুয়ে আছেন।

আমি বউদির ঘরে ঢুকে, সেই দৃশ্য দেখে কেঁদে ফেলি। চোখের জল মুছে তাকিয়ে দেখি, বৌদি বিছানায় শুয়ে, গলা পর্যন্ত চাদরে ঢাকা। খুব রোগা হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে একটু হাসেন, মনে হয় যেন বউদির সেই হাসিতে কান্না ঝরছে। আমি বৌদিকে বলতে চেষ্টা করি, “বৌদি তোমাকে হাসতে হবে না, শুধু মাত্র তুমি আমার কাছে ফিরে এস।”

সেই ক্ষণের পরে আমি এক মুহূর্তের জন্যেও বড় বউদির পাশ ছেড়ে যাইনি। রাতেও আমি বউদির পাশে শুয়ে থাকতাম, যদি আমাকে ছেড়ে চলে যায় সেই ভয়ে। বউদির বাম স্তন বাদ দিয়ে দেওয়া হয়, কোমরে কেমো র থলি। কয়েকদিনের মধ্যে বৌদি কিছুটা শক্তি ফিরে পান। অন্তত বিছানায় উঠে বসতে পারতেন বা বাথরুম পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারতেন।

সেই দিন, নবমি। বউদির শরীর একটু ভালো ছিল। আমি বৌদিকে স্নান করিয়ে দেয়ার পরে মাথার চুল আঁচরে দেই। কেমোর জন্য মাথার অনেক চুল ঝরে গিয়েছিল।

বৌদি মিনমিন করে আমাকে বললেন, “পরী আমাকে একটু দুর্গা মন্দির নিয়ে যাবি?”

আমি উত্তর দিলাম, “নিশ্চয় বৌদি।”

বৌদি, “আজ বিকেলে?”

আমি, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি যাবো, তুমি যাবে, মা ছোটমা, সবাই তোমাকে নিয়ে যাবে।”

বিকেল গড়িয়ে আসে, আমি খুব খুশি ছিলাম, বৌদি অন্তত হাঁটতে পারছিলেন। আমি বৌদিকে শাড়ি পড়িয়ে দিয়েছিলাম, লাল পাড় ঘিয়ে রঙের দামী তাঁতের শাড়ি। বৌদিকে দেখতে ঠিক মা দুর্গার মতন লাগছিল সেদিন। বৌদি আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন। কিছু পরে কষ্টে বললেন যে আলমারিতে একটা আকাশী নীল রঙের শাড়ি আছে, সেটা যেন আমি পরি। আমার বড়দা নাকি বউদির জন্য কিনেছিলেন সেই শাড়ি কিন্তু বৌদি আমাকে পড়তে বলে। আমি সেই শাড়ি পরে বউদির কাছে আসি। বাড়ির সবাই আমাকে সেই শাড়িতে দেখে বেশ খুশি হয়েছিল। মা আমার কপালে চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করেন।

বড় বৌদি বিছানার ওপরে বসেছিলেন, সামনে একটা কাঠের বাক্স রাখা। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখে বড় বৌদি তাঁর সামনে বসতে বললেন। আমার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, চোখের চাহনি ঝাপসা হয়ে আসে বউদির।

আমি জিজ্ঞেস করি, “তুই কাঁদছ কেন বৌদি, তুমি ত এখন ঠিক হয়ে যাবে।”

কাকে কে প্রবোধ দেয়, হে ভগবান আমি জানতাম যে সেই প্রবোধ বাক্যের কোন মুল্য নেই। ঘড়ির কাঁটা অতি দ্রুত গতিতে ঘুরছে, হাতে সময় খুব কম। দম ফুরিয়ে এসেছে জীবনের কাটার, যেকোনো সময়ে থমকে যাবে হৃদপিণ্ড।

বৌদি আমাকে বলেন, “আমি দেখছি আমার সুন্দরী ননদকে।”

আমার হাতে সেই কাঠের বাক্স তুলে দিয়ে খুলতে বললেন। আমি খুলে দেখি যে সেটা বউদির গয়নার বাক্স। আমি হতভম্ব হয়ে বউদির দিকে তাকিয়ে থাকি। বৌদি কিছু না বলে সেই বাক্স থেকে একটা সোনার হাড় বের করে আমার গলায় পড়িয়ে দেয়। তারপরে এঁকে এঁকে বাকি গয়না গুলি আমাকে পড়িয়ে আমাকে সোনায় সাজিয়ে তোলে। গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পরে আমার। শেষে আমার হাতে একটা মোটা বালা পড়িয়ে আমার মুখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। আমাকে বলে সুমন্তদাকে ডাকতে। আমি সুমন্তদাকে ডেকে আনি।

বৌদি সুমন্তদাকে দেখে বলে, “দেখ তোমার বোনকে কত সুন্দরী দেখাচ্ছে। ঠিক যেন স্বগের পরী আমার সামনে বসে।”

বউদির হাবভাব দেখে আমার বুক কেঁপে ওঠে এক অজানা আশঙ্কায়। আমার গালে যখন হাত দিয়েছিলেন আমি সেই হাত গালের ওপরে চেপে ধরে থাকি। হটাত করে বৌদি কেঁপে ওঠেন, মনে হয় যেন শত সহস্র ঢেউ এসে বউদির শরীরে ধাক্কা দেয়। আমি দুহাতে বৌদিকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে মাকে ডাকি। সুমন্তদা বৌদিকে বিছানায় শুতে অনুরধ করেন।

বৌদি অতি কষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, “না বিছানায় নয়, আমাকে ওর কোলে শুতে দাও।”

আবার কেঁপে ওঠে বউদির বুক, ব্যান্ডেজ থেকে রক্ত বের হতে শুরু হয়। বউদির ঠোঁট শুকিয়ে আসে। অতি কষ্টে ডান হাত তুলে আমার মাথায় রাখে।

আমি আমার শেষ শক্তি টুকু সঞ্চয় করে চেঁচিয়ে উঠি, “মা শিগগির এসো।”

সবাই দৌড়ে আসে।

বৌদি আমার মাথায় হাত চেপে ধরে বলেন, “তুই আমার পাসে আছিস, এই বারে আমি শান্তিতে শুতে পারব।”

আমি প্রাণপণে বৌদিকে বুকের সাথে চেপে ধরে জোরে বলি, “না না, তুমি আমাকে একা ফেলে যেতে পার না।”

বউদির বুকের রক্ত আমার শাড়ি, আমার বুক ভাসিয়ে দিয়েছিল। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে, আমি চেপে ধরে বউদির উষ্ণতা অনুভব করার প্রানপন চেষ্টা করি। কিছু পরে বউদির হাত আমার মাথা থেকে এলিয়ে পরে যায়, কোলের ওপরে মাথা একপাসে বেঁকে যায়। গাছের ভাঙ্গা ডাল কোলে করে বসে থাকি আমি।

বড়দা আমার পাসে এসে আমার মাথা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে। আমি কান্নার জন্য ঠিক ভাবে শ্বাস পর্যন্ত নিতে পারছিলাম না। আমার কোলে অন্তিম নিদ্রায় শায়িত আমার প্রানের বৌদি, মৃত্যু কে বাধা দেওয়ার মতন ক্ষমতা আমার ছিলনা।

সুমন্তদা কেঁদে ওঠেন, “আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”

নবমির দিনে, আকাশে বাতাসে যখন আগমনীর সুর বাজে, আমি তখন আমার বউদির প্রাণহীন দেহ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমার সাধের, আমার পুজ্য মা দুর্গা কে একদিন আগেই বিসর্জন দিতে হয়।

আমি জানি, প্রতি বছর নতুন করে দুর্গা পুজো আসবে, কিন্তু আমার দেবী অন্নপূর্ণা, আমার পার্বতী বৌদি আমার কাছে কোনদিন আর ফিরে আসবে না।
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply
#12
ভগ্ন হৃদয়ের সান্তনা

শ্রাদ্ধের কাজ তের দিনে হবে, তাই আমাকে দুই সপ্তাহের জন্যে গ্রামের বাড়িতেই থাকতে হয় তখন। ছোটমা তার পরদিন স্কুল চলে যান, স্কুল যাওয়ার আগে আমাকে জানিয়ে যান যে প্রতিদিন বাড়ি ফেরার আগে আমার সাথে দেখা করে যাবেন।

কল্যাণী আমাদের বাড়িতে রোজ আসতো। একদিন বিকেলে আমি আর কল্যাণী পুকুরের দিকে হাঁটছিলাম। কল্যাণী আমাকে ওর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে, “পরী, অভিমন্যু কেন এলনা? তুই ওকে বউদির কথা জানাস নি? ওর ত এই সময়ে আসা উচিত।”

আমি ভেবে পাইনা, কি উত্তর দেব। ওকে সত্যি কথা বলব কি না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “তোর বাড়ি থেকে একটা এসটিডি করতে দিবি?”

আমি সুপ্রতিমদার বাড়ির নাম্বার জানতাম, আমার কথা শুনে কল্যাণী একটু অবাক হয়ে গেল। আমাকে জিজ্ঞেস করে, “এসটিডি, কেন মানে, অভিমন্যু কোথায় গেছে?”

আমার বুক কেঁপে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে। আমরা আম গাছের দিকে হেঁটে যাই। আমি সেই আম গাছ ধরে ওর পরশ অনুভব করার চেষ্টা করি। কল্যাণী আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তুই ওকে খুব মিস করছিস তাই না?”

আমি মৃদু হেসে বুকের বেদনা টাকে লুকিয়ে ফেলি। কল্যাণী আমার চুবুক নাড়িয়ে বলে, “ঠিক আছে চল ওকে, ফোন করি।”

আমি ওকে বলি, “আমি যে ওর ফোন নাম্বার জানিনা।”

হতবাক হয়ে যায় কল্যাণী, “মানে? ও চলে গেছে তোকে ওর ফোন নাম্বার দিয়ে যায়নি? চলে যাওয়ার পরে ও কি তোকে ফোন করেনি?”

আমি আমতা আমতা করে উত্তর দেই, “না মানে, হয়ত করেছিল সেই সময়ে হয়ত আমি কলেজে ছিলাম, ছোটমা বা বাবু হয়ত ফোন ধরেছিল।”

কল্যাণী আমার কথা বিশ্বাস করতে পারেনা। আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে, কল্যাণী আমার চিবুক ছুঁয়ে ওর দিকে তাকাতে বলে।

আমার ঝাপসা চোখ দেখে জিজ্ঞেস করে, “কি ব্যাপার বলত? তোর চোখ অন্য কিছু বলছে, শুধু মাত্র অভি চলে গেছে সেটা কারন নয়। এর গুড় কারন অন্য কিছু যেটা তুই আমাকে বলছিস না।”

ওর হাতের ছোঁয়ায় আমার মন গলে যায়, আমি ডুকরে কেঁদে ফেলি, “ও আমার কাছে ফিরে আসবে, তাই না?”

আমি আম গাছের নিচে বসে পরি, কল্যাণী আমার পাসে বসে পরে আমার মুখ খানি আঁজলা করে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে কান্নার কারন। আমি ধরা গলায় ওকে জানাই, “ছোটমা আমাদের সম্পর্কের কথা জেনে যায় আর ওকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, সব কিছু আমার ভুলের জন্য রে, আমি পাপী।”

কল্যাণী, “কি করে, কবে এই সব হয়েছে? তুই এক বারের জন্যেও আমাকে জানালি না কেন?”

আমি, “আমি বাড়ি থেকে কি করে ফোন করতাম, সব সময়ে ছোটমা না হয় বাবু আমার ওপরে নজর রেখেছিল যে।”

কল্যাণী, “তুই কলেজ থেকে ও ত ফোন করতে পারতিস।”

আমি, “আমি ভাবলাম কেন তোকে এই সব কথা জানিয়ে বিরক্ত করা।”

আমার সখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, “আরে তুই আমার বান্ধবী না।”

আমাকে মাটি থেকে টেনে তুলে বলে, “তুই কি বাড়ি ছেড়ে দিল্লী যেতে চাস?”

আমি ওর কথা শুনে হকচকিয়ে যাই। আমি চোখের জল মুছে ওকে বলি, “না আমি বাড়ি ছেড়ে যেতে পারিনা, আমি ছোটমা বাবু কে ছেড়ে যেতে পারিনা। ছোটমা আমার জীবন, আমার মায়ের মতন। আমার জন্য অনেক করেছে, সেই ঋণ এই জীবনে শোধ হবে না। আমি কিছুতেই পারবনা ওদের মাথা এই সমাজের সামনে ঝুকিয়ে দিতে।”

বুক ভরা শ্বাস নিয়ে বলি, “ও যদি আমাকে সত্যি ভালবাসে তাহলে আমার কাছে ফিরে আসবে। আমি জানি ও আসবে। এই সমাজ শুধু মাত্র টাকার খেলা জানে, ও আমার জন্যে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আমাকে নিয়ে যেতে আসবে। কিন্তু তাই বলে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারিনা।”

কল্যাণী আমাকে জড়িয়ে ধরে আসস্থ করে, “হ্যাঁ ও নিশ্চয়ই আসবে তোর কাছে। সত্যি তোদের ভালোবাসা দেখে আমার খুব ভালো লাগে, তোর প্রান ভরা বিশ্বাস আর ওর জীবন যুদ্ধ।”

বাড়ি পর্যন্ত আমার সাথে হেঁটে যায়। বাড়ি ফেররা পথে আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমি সুপ্রতিমদা কে ফোন করতে আই কি না, আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই যে সুপ্রতিমদা কে ফোন করলে হয়ত ওর খবর জানা যেতে পারে।

বাড়িতে পা রাখতেই দেখি যে ছোটমা মায়ের সাথে উঠানে বসে কিছু কথা বলছে। কল্যাণী আর আমাকে দেখে ছোটমা একটু হাসে। ভয়ে আমার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়, ছোটমা জানেন যে কল্যাণী আমাদের সাথে বেড়াতে গিয়েছিল। হয়ত ছোটমা কল্যাণীকে ওর কথা জিজ্ঞেস করবে। আমি আর কল্যাণী একে ওপরের মুখ চাওয়া চায়ি করি। কল্যাণী আমার দিকে ইশারা করে বলে যে ছোটমা কিছু জিজ্ঞেস করলে ও সামাল দিয়ে দেবে।

কিন্তু সেই সব কিছুই হয় না, ছোটমা কল্যাণী কে কুশল মঙ্গল জিজ্ঞেস করেন। তারপরে কল্যাণীকে বলেন, “তুই ত এর ছোটো বেলার বান্ধবী, ও যদি তোর কাছে কিছু দিন থাকে তাহলে হয়ত ওর মনের অবস্থা ভালো হয়ে যাবে।”

আমি আর কল্যাণী যেন হাপ ছেড়ে বেঁচে যাই। ছোটমা আরও বলেন, “এই বাড়িতে থাকলে হয়ত ওর মন খারাপ বেশি করবে। তুই এক কাজ কর, ওকে তুই কিছুদিনের জন্য তোর বাড়িতে নিয়ে যা।”

আমার সেই সময়ে মনে হয়েছিল যে দৌড়ে গিয়ে ছোটমাকে জড়িয়ে ধরি। ছোটমা মায়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “পরী যদি কল্যাণীর সাথে থাকে তাহলে কি তোমার কিছু আপত্তি আছে?”

মা ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে হেসে উত্তর দেন, “ও ত তোর মেয়ে, তুই যা ভাল বুঝিস তাই কর।”

বাকি কটা দিন আমি কল্যাণীর বাড়িতে থেকে যাই। সেই রাতে আমি সুপ্রতিমদার বাড়িতে ফোন করেছিলাম, কিন্তু আমার অদৃষ্ট, কেউ ফোন তোলেনি। প্রায় প্রত্যেক দিন আমি দিল্লীতে ফোন করার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু প্রতিবার সেই এক উত্তর, কেউ বাড়িতে নেই। আমার হৃদয় একটু একটু করে ভেঙ্গে যায় কিন্তু নিজেকে সান্তনা দেই।

বাড়ি ফিরে যাওয়ার দিন, দুষ্টু আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, “পরের বার একা আসবে না, সাথে অভি কাকু যেন থাকে। অনেক দিন কাকুর গল্প শুনিনি।”

আমি হেসে ওর চুলে বিলি কেটে বলি, “হ্যাঁ আমি ওকে জানিয়ে দেব যে তুই ওর গল্প শোনার জন্য জেগে বসে আছিস।”

আমিও যে ওর সাথে দেখা করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। নতুন শক্তি সঞ্চার করে ফিরে যাই আমার সোনার খাচায়। বুকে আশা বেঁধে নেই, আসবে আমার সেই চোর যে আমাকে চুরি করে নিয়ে যাবে পাহাড়ের কোলে। শুধু মাত্র সময়ের অপেক্ষায় থাকি আমি, আশা বেঁধে বুকে।
Like Reply
#13
 [ম্লান আশার আলো (#01, #02)]



ম্লান আশার আলো (#01)

দিনের পর দিন চলে যায়। দমদমে ফিরে আসার পরে আমাকে কিছু টা স্বাধীনতা দেওয়া হয়। রাতের বেলা দরজা বন্ধ করে শুতে গেলে ছোটমা আর বকেন না। একদিন রাতে খাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে সেই ডায়রি খুলে বসি। অনেক দিন পরে ডায়রি হাতে নিয়ে আমার মনটা খুব ভালো লাগে। শুরুর কয়েক পাতা শুধু আবল তাবল কবিতায় ভর্তি যার কোন মাথা মুন্ডু নেই। অনেক দিন পরে ওর কথা ভেবে আমার হাসি পায় আর মনের ভেতরের সেই কালো মেঘ যেন উড়ে চলে যায়। রোজ রাতে ওর ডায়রি খুলে বসতাম আর ওর হাতের লেখা পড়ে মনে হত যেন ও মার পাসে বসে আমার সাথে কথা বলছে। বুকের মাখে এক নতুন আশার আলো উঁকি দিয়ে ওঠে। ছোটমা আর বাবু আমার হাসি মুখ দেখে খুশি। ওরা ভাবে যে আমি পুরানো কথা ভুলে গেছি, কিন্তু আসল কথা যে আমার বুকে, ও যে ডায়রির মাধ্যমে রোজ রাতে আমার সাথে কথা বলে।

ক্রিসমাসের ঠিক দিন পনেরো আগের ঘটনা, সুব্রত আর মৈথিলীর প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিল সেইদিন। আর সেইদিন ওর সাথে বড় হওয়ার পড়ে আমার প্রথম দেখা। আমার পক্ষে খুব স্মরণীয় দিন ছিল সেদিন। সকাল থেকেই আমি বেশ খুশি ছিলাম, কোলকাতার শীত যেমন মিষ্টি তেমন মিষ্টি মনে হয়েছিল সেদিনের সকাল। আমার প্রথম চুম্বনের দিন, কপালে চুমু খেয়েছিল কিন্তু খুব মিষ্টি সেই পরশ। সকালে ঘুম জড়ানো চোখে বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি সেই চুম্বনের পরশ কপালে অনুভব করেছিলাম। বুকের মাঝে যেন এক অনাবিল আনন্দের ঢেউ খেলে বেড়ায়। আমার হৃদয় জানে, যেখানেই থাকুক ও সেই এক অনুভব করছে নিজের ঠোঁটের ওপরে।

ছোটমা আর বাবু এই সবে সুব্রত আর মৈথিলীকে ফোন করে। ছোটমা আমাকে ও মৈথিলীর সাথে কথা বলতে বলে, কিন্তু সেইদিনের ঘটনার পরে ওর নাম শুনলেও যেন আমার গা পিত্তি জ্বলে যেত। তাই আমি ছোটমাকে বলি যে বলে দিতে আমি বাথরুমে আছি আর পরে ওদের ফোন করে নেব। মৈথিলীর সেই ভয়ঙ্কর অভিশাপের কথা মনে পরে যায়, মনে হয় যেন ওর জন্যেই আজ আমার দুজনা একসাথে নেই। রাগে বুক কেঁপে ওঠে আমার।

তারপরে ছোটমা স্কুলে বেড়িয়ে যান। আমি কলেজের জন্য তৈরি হচ্ছিলাম নিজের ঘরে। বাবু ফোনের কাছেই কিছু করছিলেন, ঠিক সেইসময়ে ফোন বেজে ওঠে। আমার মন বলছিল যে ফোন যেন ওর হয়।

বাবু, “হ্যালো, কে বলছে?”

আমি চুপ করে দরজায় দাঁড়িয়ে। যেই ওপারে ছিল, তাঁর গলার আওয়াজ শুনে বাবুর চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। বাবু আমার দরজার দিকে পেছন করে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাই আমাকে দেখতে পান না। আমি বাবুর মুখ দেখতে পাই।

বাবু, “আমরা সবাই ভালো আছি। কেন ফোন করেছিস তুই?”

বাবুর কথা শুনে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। বুকের মাঝে যেন রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। ওপারে যে ও কথা বলছে সেটা বুঝতে একটুও দেরি হয় না আমার। আমি ঝাঁপ দিয়ে ওই ফোনের রিসিভারের মধ্যে ঢুকে যেতে চাই যেন, মন চায় যে ওই ফোনের তার আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাক। আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, যদি একটু ওর গলার আওয়াজ শোনা যায়।

বাবু, “না ও বাড়িতে নেই, ও গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে।”

বাবুর মুখে মিথ্যে কথা শুনে আমার গা রিরি করে জ্বলে ওঠে। ও জানে না যে আমার গ্রামের বাড়িতে টেলিফোন এসে গেছে, না হলে নিশ্চয় বাড়িতে ফোন করে খবর নিত। আমি চোখ বন্ধ করে নেই, আমার চোখের পাতা ভিজে ওঠে, কান গরম হয়ে যায়, বুক কাঁপতে থাকে।

বাবু, “হ্যাঁ, ও এমএসসি পড়ছে। আমরা ওর বিয়ের ঠিক করে ফেলেছি, এমএসসি শেষ হলেই ওর বিয়ে হয়ে যাবে।”

আমি জানতে পারিনা যে ওই কথা শুনে ওর মনের কি অবস্থা হতে পারে। কিন্তু এই টুকু বিশ্বাস ছিল যে বাবুর কথা ও বিশ্বাস করবে না। আমি দরজার পর্দা ধরে পাথরের মূর্তির মতন দাঁড়িয়ে থাকি। ঝাপসা চোখের সামনে সারা পৃথিবী দুলতে শুরু করে দেয়। বুকের মাঝে শুধু এক চিন্তা ঘুরে বেড়ায়, এত কাছে এসেও আমি ওকে আবার হারিয়ে দিলাম, শুধু মাত্র বাবুর একটি ছোটো মিথ্যে কথার জন্য। না, বিশ্বাস যে বড় জিনিস, আমার ওপর সেই বিশ্বাস যেন ওর থাকে।

বাবু, “এখানে ফোন করে আর ওকে জ্বালাতন করিস না। ও সব কিছু ভুলে সুখী আছে এখন।”

আমি চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পরি। রাগে দুঃখে বালিশ ছিঁড়ে ফেলি কুটি কুটি করে। বিছানায় মাথা পিটিয়ে মরে যেতে ইচ্ছে করে। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। ফোন করেছিল আমাকে, কিন্তু অদৃষ্ট আমার, শেষ পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলতে পারেনা। আমি বালিশ কামড়ে নিজের বুক ফাটার আওয়াজ ঢেকে ফেলি।

বাবু আমার দরজায় টোকা মেরে বলেন, “সোনা মা, কলেজের দেরি হয়ে যাবে যে।”

আমি বুক ফাটিয়ে আর্তনাদ করে ছিলাম, “না আমি ভালো নেই, আমাকে তোমরা মেরে ফেললে না কেন। চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে। কি করে এত বড় মিথ্যে কথা তুমি বলতে পারলে বাবু?”

না গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয়নি সেদিন। বুকের কান্না বুকের মাঝে ঢাকা পরে যায়। দাঁতে দাঁত পিষে নিচু স্বরে উত্তর দেই, “আমার শরীর ভালো লাগছে না বাবু, আজকে আর কলেজ যাবো না।”

বাবু, “ঠিক আছে, বিশ্রাম করো। বিকেলে তোমার ছোটমা এলে তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে খানে।”

আমার ভাগ্য এই টুকু ভালো যে বাবু জানতেন না যে আমি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে বাবুর আর ওর সব কথা শুনে ফেলেছিলাম। যদি জানতে পারতেন তাহলে হয়ত বাড়িতে আরও একটা কুরুক্ষেত্র বেঁধে যেত।

সেইদিনের ঘটনার পরে আমি খুব মর্মাহত হয়ে পরি। আমার বেদনা আমার ব্যাথা আমার চেহারায় ছড়িয়ে পরে আর সেই ছায়া ডেলিসা আর তিস্তা বুঝতে পারে। বারে বারে ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার ভারাক্রান্ত মনের কথা কিন্তু আমি কাউকে আসল কারন জানাইনি। সেই দিনের ঘটনার পরে আমি নিজেকে একটা শামুকের খোলের মধ্যে গুটিয়ে ফেলি। মাথার মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা ঘুরে ফিরে দানা বাঁধে যে এত কাছে আসা সত্তেও আমি ওকে আবার হারিয়ে ফেললাম। বাবুর একটা বাক্য আমার সব আশার আলো মুছে দিয়ে চলে গেল।

সেইদিনের কিছু দিন পরে আমি কলেজ স্ট্রিটের বাসস্টান্ডে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কোলকাতায় শীত কাল চলে এসেছিল। ক্রিসমাসের আমজে যেন আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। সালোয়ার আর কারডিগান ছিল গায়ে। শীত বিশেষ ছিল না কিন্তু মনের দুখের জন্যে আমার যেন বেশি করে শীত লেগেছিল। ঠিক সেই সময়ে আমার কাঁধে কেউ হাত রাখে, আমি চমকে যাই।

আমাদের কলেজের সঙ্খ চক্রবর্তী, “অনেক ক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি তোমাকে, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে কিন্তু কোন বাসে উঠছ না।”

সঙ্খ আমার সাথে এমএসসি পরে, খুব কম কথা বলে। বিশেষ লম্বা নয় ছেলেটা, খুবই সাধারন দেখতে কিন্তু ভারী বুদ্ধিমান এবং পড়াশুনায় খুব ভালো। আমার ধারে কাছে কোনদিন ঘেঁসেনি কেননা সবসময়ে আমার চারদিকে তিস্তা, ডেলিসার বাঁ দেবব্রত থাকত। এমনিতে ক্লাসে আমার নামের পেছনেও সবাই বলত বইয়ের পোকা, আর আমি শুধু তিস্তা বাঁ দেলিসা ছাড়া কারুর সাথে বিশেষ কথাও বলতাম না।

আমি ওর দিকে হালকা হেসে জিজ্ঞেস করি, “এমনি দাঁড়িয়ে, বাস গুলো সব খুব ভিড় ছিল তাই আর চরিনি।”

সঙ্খ, “শিয়ালদা পর্যন্ত হাঁটবে আমার সাথে? ওখান থেকে তুমি বাড়ি ফেরার অনেক বাস পেয়ে যাবে।”

আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, ঠিক আছে।

আমি আর সঙ্খ হাটা শুরু করেছি কি দেবব্রত আমদের দেখে শীষ দেয়। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরে যাই যে শয়তানটা অনেক কিছু ভেবে বসে আছে। দেবব্রত আমাদের দিকে দৌড়ে এসে বলে, “সঙ্খ, তুই? হ্যাঁ রে তুই আমার গার্ল ফ্রেন্ড কে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলি?”
Like Reply
#14
ম্লান আশার আলো (#02)

দেবব্রত আমাকে অনেক খেপাত, সবসময়ে যেন প্রানপন চাইত আমার ম্লান ঠোঁটে হাসি ফোটানোর। আমি ওর কথা শুনে ব্যাগ ছুঁড়ে মারি ওর দিকে। সঙ্খ ওর কথা শুনে লজ্জায় পরে যায়। দেবব্রত সঙ্খর পিঠে থাবড়ে বলে, “যা ভাই বাড়ি যা, এখান থেকে আমি ওকে নিয়ে যাবো।”

আমি ওর দিকে জোর গলায় বলে উঠি, “শয়তান ছেলে এই রকম ভাবে বলছিস যেন আমি তোর কেনা বাঁদি?”

দেবব্রত আবার আমাকে খেপিয়ে বলে, “এখনো নয় তবে...”

সঙ্খ আমাদের মারামারি দেখে বেশি ক্ষণ দাঁড়ায় না, চুপ চাপ ওখান থেকে চলে যায়।

সঙ্খ চলে যাওয়ার পরেই দেবব্রত গম্ভির হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা বলো তো কি হয়েছে তোমার? কয়েক দিন থেকে নজর করছি তুমি যেন কেমন হয়ে গেছ, কারুর সাথে ঠিক করে কথা বলছ না বা হাসছ না।”

আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই, “কিছু না রে, আমার বড় বৌদি মারা গেছেন তাই মন খারাপ।”

আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আরে বাবা, এতে আর দুঃখ করে কি হবে।”

ওর হাতের বন্ধুতের স্পর্শ আমার ভারাক্রান্ত মনের মাঝে একটু শান্তির বারি প্রদান করে। আমাকে জিজ্ঞেস করে দেবব্রত, “শীতের ছুটিতে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছও নাকি?”

আমি মাথা নাড়াই, “নারে যাচ্ছি না, তুই কোথাও যাচ্ছিস কি?”

দেবব্রত, “হ্যাঁ।”

আমি, “কোথায়?”

দেবব্রত, “দিল্লী, আমার বড়দি থাকে ওখানে।”

দিল্লীর নামে শুনেই আমার মন নেচে ওঠে, আমার ভালোবাসা দিল্লীতে থাকে, কিছু করে যদি একটা খবর পাঠানো যায়।

দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি হল?”

আমি প্রায় ভিক্ষে চাওয়ার মতন কাতর প্রার্থনা করি ওর সামনে, “আমার একটা কাজ করে দিবি?”

দেবব্রত, “হ্যাঁ নিশ্চয়, কি করতে হবে বলো?”

আমি শুধু জানতাম যে সুপ্রতিমদা সিআরপার্কে থাকে কিন্তু বাড়ির ঠিকানা জানতাম না। আমার শুধু মনে আছে যে বাড়ির কাছে একটা বড় কালি মন্দির ছিল আর একটা বড় বাজার ছিল। জায়গার নাম জানতাম না ঠিক মতন।

আমি ওকে বলি, “আমি তোকে একটা চিঠি দেব আর একটা ফোন নাম্বার দেব। তুই প্লিস দিল্লী গিয়ে সেই ফোন নাম্বারে ফোন করে আমার চিঠি পৌঁছে দিবি?”

আমার কথা শুনে ওর চোখ যেন দুষ্টুমিতে জ্বলজ্বল করে ওঠে, “হুম্মম্ম... পুরান ভালোবাসা, হ্যাঁ?”

আমি বুকের ভাষা লুকিয়ে ওকে বলি, “না না, সেই রকম কিছু নয়। চিঠিটা আমার এক বান্ধবীর বর কে দিতে হবে।”

আমার কথা কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, “তুমি চাও আমি তোমার বান্ধবীর বরের সাথে দেখা করে তাঁর হাতে চিঠি দেই?”

আমি, “হ্যাঁ প্লিস আমার এই কথাটা রাখ।”

দেবব্রত, “আচ্ছা দিয়ে দেব। আমি কিন্তু জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চলে যাবো। চিঠিটা তার আগেই দিয়ে দিও।”

আমি খুব খুশি হয়ে গেছিলাম, আমার চিঠি অন্তত কিছু একটা খবর নিয়ে আসবে এই ভেবে। কেউ ত ছিল যে কিনা আমার মনের খবর আমার ভালোবাসার কাছে পৌঁছে দিতে পারে। কিন্তু সেইসাথে মনের মধ্যে একটা সংশয় জাগে, দেবব্রত ঠিক মানুষের হাতে চিঠি পৌঁছে দেবে ত? আমি যে সুপ্রতিমদার বাড়ির ঠিকানা জানতাম না, শুধু মাত্র একটা ফোন নাম্বার সম্বল করে আমি চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিছুদিন পরে আমি সুপ্রতিমদার নামে একটা চিঠি লিখে দেবব্রতর হাতে দেই। সেই চিঠিতে আমি সুপ্রতিমদাকে লিখেছিলাম যে আমার ভালোবাসা যেন আমার ওপরে বিশ্বাস রাখে আর আমি ওর জন্য অপেক্ষা করে থাকব।

সেইবারে আমি আরও এক কারনে খুব খুশিতে ছিলাম, ছোটমা কথা দিয়েছিলেন যে আমাকে সেলফোন কোনে দেবেন। কিন্তু বাড়িতে কেউ সেই নিয়ে কোনদিন কথা বলেনা তাই সেলফোন পাওয়া নিয়েও আমার মনের মধ্যে সংশয় থেকে যায়। আদৌ কি বাবু আমাকে সেলফোন উপহার দেবে?

ক্রিসমাসের দিন সকালবেলা। ছোটমা বাবুর অভ্যাস, সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার, আমি উঠে দেখি যে ছোটমা বাবু বসার ঘরে বসে চা খাচ্ছিলেন। আমি বাথরুমে থেকে বেড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখি বিছানার ওপরে একটা উপহারের বাক্স। সেই বাক্স খুলে দেখি তাঁর মধ্যে সেলফোন, নোকিয়া 3330, আমার স্বাধিনতার প্রথম পদক্ষেপ ভেবে বুকে চেপে ধরি সেই বাক্স। দৌড়ে বসার ঘরে গিয়ে ছোটমাকে জড়িয়ে ধরি।

ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “এবারে খুশি ত?”

আমি তখন খুব খুশি, “হ্যাঁ, খুউউউউউব...”

ছোটমার সাবধান বানী ঠিক তারপরে, “কিন্তু আমাকে একটা কথা দিতে হবে। তুমি এমন কোন পদক্ষেপ নেবেনা যার জন্য অপমানিত হয়ে সবার সামনে আমাদের মাথা নিচু হয়ে যায়।”

মনের ভেতরে যত খুশি যত আনন্দ ছিল, সব যেন এক ফুঁ তে উবে গেল। আমি সেলফোন ধরে নিজের ঘরে ঢুকে পরি। ছোটমা আমার পেছন পেছন আসেন। ছোটমা আবার জিজ্ঞেস করেন, “পরী আমি কিন্তু উত্তর পেলাম না।”

আমার বুকে যেন শক্তিশেল ফুটে, আমি ধিরে মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দেই যে আমি কোন পদক্ষেপ নেবনা যার জন্য ছোটমায়ের মাথা অপমানে সবার সামনে নিচু হয়ে যায়। আমি সেদিন মিথ্যে কথা বলেছিলাম, আমি যদি কোন রকমে ওর একটা খবর পেতাম তাহলে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করতাম। ছোটমা আমার উত্তরে খুশি হয়ে চলে গেলেন।

চলে যাবার পরেই আমার মনে হয়েছিল ওকে ফোন করার কিন্তু আমি যে ওর ফোন নাম্বার জানতাম না। মন কেঁদে উঠেছিল, কিন্তু আমি নিরুপায়। রাতের বেলা খাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রথম ফোন ওর খবর নেওয়ার জন্য করি। আমি সুপ্রতিমদার বাড়িতে ফোন করেছিলাম, মনে একটু সংশয় ছিল যে অত রাতে হয়ত বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পরে যাবে কিন্তু ব্যাথিত মন মানতে চায় নি।

সুপ্রতিমদার মা ফোন ধরেছিলেন, “হ্যালো, কে বলচ্ছে?”

আমি, “আমি সুপ্রতিমদার বান্ধবী, কোলকাতা থেকে বলছি।”

আমার গলা শুনে মাসিমা চিনতে পেরেছিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে, তোমরা আমার বাড়িতে এসেছিলে। কেমন আছো?”

যাক শেষ পর্যন্ত একটা আশার আলো দেখা গেল, খড়া বুকের মাঝে যেন শান্তির জল পরে। আমি মাসিমা কে জিজ্ঞেস করি যে সুপ্রতিমদার সাথে কথা বলা যাবে কি?

মাসিমা জানালেন, “সুপ্রতিম তো দিল্লী থাকেনা। বিয়ের পরে কর্ম সুত্রে ব্যাঙ্গালর চলে গেছে।”

সুপ্রতিমদার চলে যাওয়ার খবর শুনে একটু ধাক্কা লাগে বটে কিন্তু আশা হারিয়ে ফেলিনা। আমি মাসিমাকে সুপ্রতিমদার ফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করি।

তারপরে আমি জিজ্ঞেস করি, “অভিমন্যুর কোন খবর আছে আপনার কাছে?” অনেক দিন পরে ওর নাম নিজের ঠোঁটে শুনে আমার মন কেমন করে ওঠে, ঠোঁট চেপে কেঁদে ফেলেছিলাম আমি।

মাসিমা।, “হ্যাঁ, সপ্তাহ দুয়েক আগে বাড়িতে এসেছিল।”

সেই কথা শুনে মনে হল যেন আমার জীবনে এক নতুন সূর্যোদয় ঘটতে চলেছে, আমি জিজ্ঞেস করি, “ওর ফোন নাম্বার দেবেন?”

মাসিমা, “ঠিক বলতে পারব না, এখন ও দিল্লীতে আছে কি না।”

আমার সেদিন মনে হয়েছিল যেন আমি প্রানপন দৌড়ে রেসের শেষ সীমানায় পৌছাতে চেষ্টা করছি কিন্তু শেষ প্রান্তে এসে দেখি যে সেই লাল ফিতে কেউ যেন টেনে নিয়ে চলে গেছে। বুকের মাঝে কান্নার রোল বেজে ওঠে, নিজেকে সামলে নিয়ে প্রশ্ন করি, “কোথায় গেছে কিছু জানেন?”

মাসিমা, “না মা, তবে সুপ্রতিম জানতে পারে হয়ত, ওকে ফোন করতে পার।”

বাবুর একটা বাক্য আমাদের জীবন আবার ধ্বংস করে দিল। আমি ফোন রেখে সুপ্রতিমদাকে ফোন করি। সুপ্রতিমদা আমার ফোন পেয়ে খুব অবাক। আমার বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ দোলা দেয়, যদি কিছু খবর পাই ওর, আর না পেলে আমি কি করব জানিনা। কিন্তু যে খবর সুপ্রতিমদা আমাকে দেয় সেই শুনে আমার সব আশা সব স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়।

সুপ্রতিমদা, “অভি লাস্ট সপ্তাহে কল করেছিল আমকে। ও বলল তোমার নাকি বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে?”

আমি চাপা কেঁদে উঠে বলি, “না, মিথ্যে কথা।”

সুপ্রতিমদা, “অভি খুব মর্মাহত হয়ে পড়েছিল সেই খবর শুনে। শুধু মাত্র তোমার সাথে কথা বলার জন্য ফোন করেছিল। ও জানাতে চেয়েছিল যে নিজের মাথা উঁচু করে সমাজের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তোমাকে নিয়ে যাবে। জানো ত এই সমাজ শুধু টাকা চেনে, তাই টাকা রোজগার করতে এখন ব্যাস্ত কিন্তু বিপথে যায়নি তোমার অভি। শুধু তোমার ভালোবাসা বুকে বেঁধে এখন বেঁচে আছে, কিন্তু...”

আমি, “কিন্তু কি? ও এখন কোথায়? আমি ওর সাথে কথা বলতে চাই, ওর নাম্বার দেবে আমাকে?”

সুপ্রতিমদা, “অভি আমাকে জানিয়েছিল যে ও ইস্রায়েল যাচ্ছে, ওর কম্পানি ওকে কয়েক বছরের জন্য ওখানে পাঠাবে। ও আমাকে বলে, যেহেতু তোমার বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে তাই ও আর কোনদিন কোলকাতা ফিরবে না। মাত্র চারদিন আগে ইসরায়েল চলে গেছে অভিমন্যু। তুমি যদি আর কিছুদিন আগে ফোন করতে তাহলে হয়ত কিছু হত। এখন কি করতে চাও তুমি?”

আমি একদম ভেঙ্গে পরি, চোখের সামনে যেন কালো ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায়। সুপ্রতিমদা, “তোমরা যে হেরে গেলে।”

আমি চিৎকার করে উঠি, “না আমি হেরে যেতে পারিনা। আমি হারিনি, আমাকে ছল কপট করে হারিয়ে দেওয়া হয়েছে, আমার অভি হারতে পারেনা।”

আমি ফোন রেখে বিছানায় শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ ধরে। কান্না চাপার জন্য বুকের ওপরে বালিশ চেপে ধরেছিলাম। অনেক পরে বিছানা ছেড়ে উঠে আমি তাক থেকে ওর সেই ডায়রি নামাই। ঝাপসা চোখে সেই ডায়রির পাতা গুলো এক এক করে পড়তে থাকি। সেই ডায়রির সব লেখা আমার কেমন যেন মেকি মনে হয়, সব প্রেমের কথা, ভালোবাসার কথা যেন মিথ্যে। একবারের জন্য মনে হয় সেই ডায়রির পাতা গুলো ছিঁড়ে ফেলে জ্বালিয়ে দেই। সেই “অপ্টিক্স নোটবুক” যেন একটা মিথ্যে প্ররোচনার বাসা। এই ডায়রি গত কয়েক মাসে আমার প্রানের উৎস ছিল, কিন্তু সেদিনের খবর শুনে মনে হয়েছিল যে সেই ডায়রি মিথ্যে। কিন্তু আম্মি সেই ডায়রি ছিঁড়ে ফেলতে পারিনি আবার সযত্নে তাকে তুলে রেখে দিয়েছিলাম।

প্রথম এই সমাজের বন্ধন আমাদের ভালোবাসার পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু একটা আশা ছিল যে আমার অভি আমার বুকে আবার ফিরে আসবে। বাবুর একটা ছোট্ট মিথ্যে আবার যেন আমার বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিয়ে চলে যায়। আমার সব আশা, সব স্বপ্নের আলো যেন চোখের সামনে থেকে নিভে আসে ধিরে ধিরে। যদি একবারের জন্যেও আমার প্রতি ওর বিশ্বাস থাকে তাহলে নিশ্চয় বিশ্বাস করবে যে বাবুর কথা মিথ্যে আর আমি সেই বিয়েতে মত দেই নি। কিন্তু সেই কথা আমি ওকে জানাতাম কি করে।

কিচুদিন পরে আমি দেবব্রতর কাছে সেই চিঠি ফেরত চাই। তার কিছুদিন পরে আমি গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমি কল্যাণীর হাতে সেই ডায়রি তুলে দিয়ে বলেছিলাম। ডায়রি খুলে আমাকে কল্যাণী জিজ্ঞেস করে যে এতে কি আছে। আমি জানিয়েছিলাম যে ওই ডায়রি আমার কাছে প্রানের উৎস, কিন্তু এখন আর নয়।

কল্যাণী অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এটা ত অভিমন্যুর ডায়রি, এটা আমি নিয়ে কি করব?”

আমার গলা ধরে আসে, কিন্তু আমি কল্যাণীকে সব ঘটনা খুলে জানাই। সবকিছু শুনে আমাকে বলে, “তুই এটা তোর কাছেই রাখ।”

আমি, “আমাকে ছেড়ে যখন চলেই গেছে তাহলে আর ডায়রি রেখে কি করব।”

কল্যাণী ডায়রি হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এটা তোর সম্পত্তি, তুই এটা জ্বালিয়ে দিচ্ছিস না কেন তাহলে?”

আমি বুক ভরা শ্বাস নিয়ে ওকে জানিয়েছিলাম, “এই ডায়রির পাতায় ওর ছোটবেলা আছে, এই ডায়রির পাতায় ওর লেখা আছে সেই 1992 থেকে। এই ডায়রি শুধু মাত্র আমাদের ভালোবাসা নয়, এই ডায়রিতে আছে ওর ছোটবেলা, ওর দুঃখ, ওর কষ্ট, ওর সুখ, ওর শান্তি, ওর খুশি ওর বন্ধু ওর বান্ধবী। আমি নিজে থেকে ওকে হত্যা করতে পারব না, কল্যাণী।”

কল্যাণী, “তুই এখন কি করবি তাহলে?”

আমি মাথা দুলিয়ে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি জানি না রে আমার ভবিষ্যতে কি হবে, তবে যাই আসুক আমি তাই মেনে নেব।”

কল্যাণী, “মানে?”

আমি বুক ভরে শ্বাস নিয়ে কল্যাণীর মানের উত্তর দেই, “আমার মাও মনে হয় আমাদের সম্পর্ক মেনে নেবে না। আমার থেকে দু বছরের ছোটো আর আমাদের মাঝে যদিও একটা ক্ষীণ সম্পর্কের বন্ধন আছে। এইমত অবস্থায় আমার কাছে কে বেশি গুরুত্তপূর্ণ আমার ভালোবাসা না আমার মা আর ছোটমা? আমি এক গ্রামের সাধারন ঘরের মেয়ে, আমাদের জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, জীবনে অনেক কষ্ট সহ্য করে চলতে হয় আমাদের। যদি ও আমাকে এই রকম ভাবে ছেড়ে চলে না যেত তাহলে আমি ওর জন্য সারা জীবন বসে থাকতাম, সারা পৃথিবীর সাথে যুদ্ধ করে যেতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে ছেড়ে চলে গেল, আমি আর কি নিয়ে থাকব?”

কল্যাণী আমার কথা শুনে মাথা নাড়িয়ে বলে, “তোরা দুজনেই জানতিস তোদের ভবিষ্যৎ, তোরা প্রন করেছিলিশ যে দুজনে মিলে একসাথে সেই ভবিষ্যতের সাথে যুদ্ধ করবি। সেই প্রতিজ্ঞার কথা কি হল? এটাও ত হতে পারে যে, ও কিছু করার জন্য বাইরে গেছে, এটাও ত হতে পারে যে তোর জন্য একদিন ও আবার ফিরে আসবে। এত তাড়াতাড়ি সব আশার জলাঞ্জলি দিস না।”

আমি, “আমি খুব ক্লান্ত রে কল্যাণী। সুপ্রতিমদার কাছে যদি কোন কিছু বলে যেত তাহলে না হয় অন্য কথা ছিল, কিন্তু অজে কিছুই বলে যায়নি। ও যে শেষ পর্যন্ত ভাঙ্গা মন নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।”

কল্যাণী, “তোর বাবুর মুখে ওই কথা শোনার পরে যে তোর বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে, কি করা উচিত ছিল ওর?”

আমি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম যে আমাদের ভালোবাসার ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঢাকা। আমার চোখের সামনে সব আশা, সব স্বপ্নের আলো ধিরে ধিরে ম্লান হয়ে যায়।
Like Reply
#15
[শ্বেত পাথরের মূর্তি (#01, #02)]


শ্বেত পাথরের মূর্তি (#01)

কেউ চলে গেলে কি কারুর জীবন থেমে যায়? পুবালি ছেড়ে চলে যাবার পরে কি অরুন্ধুতির জীবন থমকে গিয়েছিল, না অরুনা আবার ফিরে পেয়েছিল তার জীবন। আমিও মন কে প্রবোধ দেই যে আমার দূর্ভাগ্যের জন্য আজ আমাদের এই দশা। ভাগ্য আমাদের একসাথে এনেছিল এক সময়ে, কিন্তু সেই ভাগ্যের পরিহাসে আমরা দুইজন আজ পৃথক পৃথক পথে চলে গেছিলাম। এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। দিন যায়, আমি আমার মন শক্ত করতে চেষ্টা করি। কিন্তু বারে বারে পাপী মন মানে না, বারে বারে তার কথা মনে পরে যায়। দিনে দিনে আমি শুকিয়ে গেছিলাম। ছোটমা বাবু দুজনেই আমার শরীর খারাপ দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন।

এক রবিবার সকালবেলায় বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “কি হয়েছে তোমার? ঠিক ভাবে খাওয়া দাওয়া করছ না তুমি। ওজন কমে গেছে, দিনে দিনে শুকিয়ে যাচ্ছও? এই ভাবে কত দিন চলবে, পরী?” ছোটমা গলায় চিন্তার সুর। সেদিন বিকেলে ছোটমা আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান, কিন্তু সেই অসুধে আমার শরীর ঠিক হয় না। আমার ওষুধ যে অন্য কারুর কাছে, সেটা আমি বলে বুঝাতে পারিনা।

শীতের ছুটির পরে কলেজ শুরু হয়ে যায়। আমি নিজেকে পড়াশুনায় আর কলজের কাজে ব্যাস্ত রাখতে চেষ্টা করি। আমার সেই চঞ্চল, উচ্ছল হাসি মুখ হারিয়ে যায়। ছোটমায়ের মন যেন কেঁদে ওঠে আমার ম্লান চেহারা দেখে।

একদিন ছোটমা আমাকে বলেন, “পরী তোকে এইরকম ভাবে ভেঙ্গে পড়লে ত হবে না। তুই বড় হয়েছিস, তোকে তোর অতীত ভুলে নতুন জীবনে পা রাখতে হবে। তোর সামনে এক বিশাল সুন্দর জীবন পরে আছে।”

আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলি, “তুমি কি করে আমাকে বল সেই সব দিনের কথা ভুলে যেতে?”

ছোটমা আমার হাত ধরে বলেন, “আমি ওর মা, পরী। আমি যদি থাকতে পারি তাহলে তুই কেন পারবি না।”

আমি ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আমি নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দেব, ছোটমা। আমি প্রানপন চেষ্টা করব নিজেকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ছোটমা, তোমার ছেলে তুমি হারিয়েছ, তার বেলায় তুমি কি করবে?”

ছোটমা, “ও হয়ত একদিন বুঝতে পারবে, যে আমি যা করেছি ওর ভালর জন্য করেছি।”

আমি ধরা গলায় বলি, “ছোটমা, আমি একটু একা থাকতে চাই।”

ছোটমা ঘর থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরে আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম ছোটমায়ের প্রান তাঁর ছেলের জন্য প্রতিরাতে কাঁদে, কিন্তু সেই কান্নার আওয়াজ কোনদিন বুক থেকে মুখে আনেননি ছোটমা, শুধু মাত্র সমাজ আর আত্মীয় সজ্জনের কাছে মুখ দেখানর ভয়ে। ছোটমা কি জানে যে তার একমাত্র পুত্র দেশ ছেড়ে চলে গেছে? হয়ত জানে না।

ছোটমা আর বাবু বুঝতে পারেন যে আমি নিজেকে বদলে ফেলেছি আর নিজেকে পড়াশুনায় ডুবিয়ে দিয়েছি। আমার স্বাধিনতার বেড়ি একটু বেড়ে যায় তারপর থেকে।

শীতকাল চলে যায়। চিতকুলের ভ্রমণের পর প্রায় এক বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের ঘটনা। একদিন আমরা সব বন্ধু বান্ধবী মিলে মেডিকেলের দিকে হেটে যাচ্ছিলাম।

দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা সেই চিঠি টা তুমি নিয়ে নিলে কেন?”

আমি, “সুপ্রতিমদা, যার জন্য সেই চিঠি লিখেছিলাম সে আর দিল্লীতে থাকেনা, সে ব্যাঙ্গালর থাকে।”

দেবব্রত, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি কি? সেদিন সেই চিঠি পৌঁছানর ব্যাপারে তোমাকে খুব মরিয়া লাগছিল?”

আমি বুকের বেদনা লুকিয়ে হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “না আমাকে কোন প্রশ্ন করতে পারিস না তুই। আমার বান্ধবীর কাছে লেখা সেই চিঠি আর এই সব মেয়েলি ব্যাপার।”

কি বুঝল দেবব্রত জানিনা। কিন্তু তিস্তা আর দেলিসা আমাদের দেখে ফিকফিক করে হেসে ফেলে।

তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কি গো, কিছু যেন গন্ধ পাচ্ছি মনে হচ্ছে?”

দেবব্রত ওর মাথার ওপরে চাঁটি মেরে বলে, “নিজের মতন সবাইকে ভাবিস কেন বলত?”

দেলিসা, “হুম খুব বেশি ভাব মনে হচ্ছে, এখন থেকেই এত আগলে রাখা।”

দেবব্রত, “শোন, আমি তির্থাঙ্কর নই আর মিতা, তিস্তা নয়। সুতরাং তোরা মুখে কুলুপ এটে থাকলে ভালো হবে।”

আমি বুঝতে পারলাম যে কথার প্রসঙ্গ আমাকে নিয়ে আর সেই প্রসঙ্গ ধিরে ধিরে বিরূপ ধারন করছে। আমি সবাইকে বলি, “আমরা সবাই বন্ধু বান্ধবী, সেই সম্পর্ক যেন আমাদের মধ্যে থাকে আর সেটাই বিবেচ্য। আর যেন এই নিয়ে কোন কথা না হয় আমাদের মধ্যে।”

দেবব্রত সবাইকে বলে, “ভালো ত, এই তোরা সিনেমা দেখতে যাবি?”

রজত, পুশপাঞ্জলি, সঙ্খ সবাই এক মত। আমার সেদিন সিনেমা দেখতে যাওয়ার মন ছিল না। আমি চুপ করে ছিলাম। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হল?”

আমি বলি, “না আজকে নয়, অন্য কোনদিন যেতে পারি।”

দেবব্রত, “রবিবার?”

আমি জানালাম যে ছোটমাকে না জানিয়ে আমি কথা দিতে পারছিনা। দেবব্রত, “ঠিক আছে, রবিবার, গ্লোব।”

রজত পুশপাঞ্জলি একসাথে চেঁচিয়ে ওঠে, “এক জনের জন্য কেন সিনেমা দেখা বন্ধ করা হবে?”

তিস্তা আমার মনের কথা বুঝে ফেলে ওদের বলে, “না না, আজ নয়, রবিবার হলে, তির্থাঙ্কর আমাদের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে পারবে।”

দেলিসা ওদের বলে, “ভালো ভালো, তাহলে দানিস কে আমি ডেকে নেব।”

শনিবার রাতে আমি ছোটমাকে রবিবারের সিনেমা দেখার কথা জিজ্ঞেস করি। ছোটমাকে আমাকে সিনেমা দেখতে অনুমতি দিলেন সাথে সাথে সাবধান বানী দিলেন, যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মায়ের মন, সর্বদা যেন চিন্তিত কিন্তু তাও যেন আমি সোনার খাচায় বন্দিনী এক রাজকন্যে। সেই প্রথম বার বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাওয়া। বুকের মাঝে স্বাধীনতার মলয় কিন্তু সেই বাতাসে যেন পরাধীনতার কটু গন্ধ ভেসে আসে মাঝে মাঝে।

রবিবার সকালে তিস্তা আমাকে ফোন করে জানায় যে ও আমাকে নিতে আসবে। আমি ওর কথা শুনে একটু থমকে যাই কেননা ওর সাথে নিশ্চয় তির্থাঙ্কর থাকবে। প্রথম দিনে তির্থাঙ্কর যেরকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়েছিল তাতে আমার মনে ওর প্রতি একটু ঘৃণা ভাব জাগে। মন শক্ত করে নিলাম আমি, দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়। আমি বাসস্টান্ডে ওদের জন্য অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বেশ কিছু পরে মারুতি চেপে তির্থাঙ্কর আর তিস্তা এসে পৌঁছায়।

আমাকে দেখে তিস্তা আনন্দে দৌড়ে এসে বলে, “তোমাকে সব কিছুতেই মানিয়ে যায়।”

আমি সেদিন একটা খুব সাধারন গোলাপি রঙের চুরিদার পড়েছিলাম। তিস্তা একটা চাপা গাড় নীল রঙের টপ আর হাল্কা নীল রঙের জিন্স পড়েছিল। তিরথাঙ্করের দিকে তাকিয়ে একটু মাথা নারিয়েছিলাম ভদ্রতার খাতিরে। আমাকে দেখে তির্থাঙ্কর ইশারা করে পেছনের সিটে বসতে বলে। আমি আর তিস্তা পেছনের সিটে বসে পরি।

তিস্তা তির্থাঙ্করের মাথায় চাঁটি মেরে বলে, “একদম পেছনের দিকে দেখবে না, বুঝলে, সোজা গাড়ি চালাও।”

তির্থাঙ্কর, “পেছনের সিটে যদি এত সুন্দরী দুই মহিলা বসে থাকে তাহলে কি করে মন দিয়ে গাড়ি চালাই বল?”

আমি জানতাম যে ওর কথার ছোবল আমার দিকে, তাও আমি চুপ করে থাকি। আমি চুপ করে বসে থাকি আর তিস্তা গল্প শুরু করে, একবার বকতে শুরু করলে তিস্তা যেন আর থামতে চায় না।

আমাকে চুপচাপ দেখে তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি হয়েছে বলতো? তুমি এত চুপচাপ কেন?”

আমি মৃদু হেসে বলি, “আমার স্বভাব এইরকম তাই।”

মাথা নাড়ায় তিস্তা, “না না, একদম নয়। সেই পুরানো মিতা যেন নেই, কোথায় যেন হারিয়ে গেছে সেই মিতা।”

আমি হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “আরে বাবা, জগত পরিবর্তনশীল। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বুঝলি না রে।” সবাই আমরা হেসে ফেলি।

গ্লোবে পৌঁছে দেখি দানিস আর দেলিসা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দানিস কে সেই প্রথম বার দেখলাম। অনেক লম্বা চওড়া ছেলে, প্রায় ছ ফুটের মতন লম্বা, ফর্সা আর দারুন দেখতে। হালকা নীল রঙের জিন্স আর গোলাপি চেক শার্টএ দারুন মানিয়ে ছিল ওকে।

দেলিসা আমকে দেখে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আর বদলাবে না। সেই সাদা মাটা কাপড় কিন্তু কত আভিজাত্য আছে তোমার মধ্যে।”

দানিস কে দেখে আমি হাত জোর করে অভিবাদন জানাই। দানিস সেই দেখে হেসে ফেলে। দানিস যেন অন্য মাটির মানুষ, ওর চোখের চাহনি যেন সব ছেলেদের থেকে অনেক আলাদা। আমাকে দেখে হেসে বলে, “প্রনাম করতে নেই আপা।”

আমি বুঝতে পারিনা ও কি বলে আমাকে ডাকল। দেলিসা আমাকে জানিয়ে দিল যে দিদিকে আপা বলে ডাকে। দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, আমার বড় আপা দুবাই থাকে। অনেকদিন তাঁর সাথে দেখা হয়নি। তোমাকে দেখতে ঠিক আমার বড় আপার মতন, তাই তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।”

ওর কথা শুনে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। দেলিসা আমার ঝাপসা চোখ দেখে বলে, “আরে চল, সিনেমা দেখি।”

আমি দেলিসা কে বলি, “হ্যাঁ রে, তোর দানিস ত ভারী হ্যান্ডসাম ছেলে। তোদের দুজনকে যেন ভগবান একসাথে বানিয়েছে।”

ওদের দেখে আমার নিজের ভালোবাসার কথা মনে পরে যায়। মনে পরে যায় আমাদের “সিন্ডলারস লিস্ট” সিনেমা দেখতে যাওয়ার ঘটনা। কিছু পরেই পুশপাঞ্জলি আর সঙ্খ এসে পৌঁছে যায়। কিন্তু আমাদের দলের মাথা, দেবব্রতর দেখা নেই। আমি সিনেমার পোস্টার দেখলাম, গ্লোবে সেদিন স্টালনের “ক্লিফহ্যাঙ্গার” চলছিল।

তিস্তা সঙ্খর সাথে পুস্পাঞ্জলিকে দেখে উত্যক্ত করার জন্য বলে, “কিরে তুই আর পুশপাঞ্জলি একসাথে, কি ব্যাপার?”

সঙ্খ এমনিতে চুপচাপ থাকার ছেলে, তাই লাজুক হেসে বলে, “নারে, পুশপাঞ্জলি আমার বাড়ির পাসে থাকে তাই আমরা একসাথে এসেছি।”

আমি পুস্পাঞ্জলিকে রজতের কথা জিজ্ঞেস করাতে একটু বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়, “আমি কি করে জানব ওর কথা।”

দেলিসা আমার কানে কানে এসে বলে, “কিছু জিজ্ঞেস করো না, তেতে আছে মেয়ে। কাল দুজনার মাঝে এক চোট হয়ে গেছে।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, ওরা কি পস্পরের সাথে...” আমি ওদের ভেতরের খবর জানতাম না যে রজত আর পুশপাঞ্জলির মাঝে প্রেমের খেলা চলছে।

বেশ কিছু পরে লক্ষ করি যে দেবব্রত আর রজত সিগারেট ধরিয়ে আমাদের দিকে হেঁটে আসছে। আমাদের সাথে দানিস আর তিরথাঙ্করকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠে, “আজ দেখি সব জামাইদের মেলা, আমরা তাহলে আর খরচ কেন করব, জামাই রা করুক।” ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেলে, দানিস সবার টিকিট কাটে।

সিনেমা হলে ঢুকে সবাই সিনেমা দেখতে বসে পরে। আমার একদিকে তিস্তা আর তার পাসে তির্থাঙ্কর। আমার অন্য পাসে পুশপাঞ্জলি তাঁর পাশে দেবব্রত, পুশপাঞ্জলি রাগে রজতকে পাশে বসতে দেয়না। সিনেমা শুরু হওয়ার কিছু পরে আমার মনে হল যেন কেউ আমার পিঠে হাত রেখেছে, ঠিক ঘাড়ের খোঁপার নিচে, আঙুল দিয়ে আঁচর কেটে দিচ্ছে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি তির্থাঙ্করের হাত, রাগে আমার মাথা জ্বলে ওঠে। চোখে জল চলে আসে, মনে হল যেন ওই আঙুল আমাকে ;., করছে। কামুক প্রব্রিতির মানুষ, পাসে ওর প্রেমিকা বসে তাও আমার ওপরে ওর নজর। আমি সামনের দিকে ঝুঁকে যাই। পুশপাঞ্জলি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে কেন আমি সামনে ঝুঁকে আমি ওকে কিছু বলি না। কিছু পরে পেছনে ফিরে দেখি সেখানে আর তির্থাঙ্করের হাত নেই, তাই আমি আবার সিটে হেলান দিয়ে বসি। কিছু পরে আবার সেই একি ঘটনা, তির্থাঙ্করের হাত আমার পিঠে এসে পরে। আমি রাগে অপমানে কেঁপে উঠি, কিন্তু আবার কিছু না বলে সামনে ঝুঁকে যাই। এবারে দেবব্রত আমাকে লক্ষ্য করে। দেবব্রত পেছনে দেখে যে আমার সিটের ওপরে তির্থাঙ্করের হাত। চুপচাপ পুশপাঞ্জলির পেছন দিয়ে হাত বাড়িয়ে আমার সিটের পেছনে হাত রাখে। আমি বুঝতে পারি যে একটা মারামারি লাগবে এবারে কেননা দেবব্রত খুব গরম মাথার ছেলে।

ঠিক সেই, কিছু পরে আবার তিরথাঙ্কর হাত দিতে চেষ্টা করে আমার পিঠে আর এবারে ওর হাত ধরে ফেলে দেবব্রত। সিনেমা হলের মাঝে দেবব্রত তিরথাঙ্করের দিকে গম্ভির গলায় বলে, “ওঠ সিট ছেড়ে, বাইরে আয় তোর সাথে কথা আছে।”

তিস্তার অগোচরে ওর পিঠের পেছনে যে এত কান্ড ঘটে যায় সেটা তিস্তার খেয়াল নেই। আমার দিকে, দেবব্রতর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে তিস্তা। তিস্তা জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে?”

তিরথাঙ্কর অকাঠ মিথ্যে কথা বলে তিস্তা কে, “আরে বাবা, কিছু হয়নি, আমি তোমার পিঠে হাত রাখতে গিয়েছিলাম আর হয়ত মিতার পিঠে হাত লেগে গেছে।”

আমি ওর মিথ্যে কথা শুনে রেগে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পরি, “আমি আর সিনেমা দেখব না, আমি বাড়ি যাচ্ছি।”

দেবব্রত গর্জে ওঠে তিরথাঙ্করের দিকে, “এই শুয়রের বাচ্চা, বেড়িয়ে আয় তারপরে তোকে মজা দেখাচ্ছি।”

দানিস দেবব্রতর পাশেই বসে ছিল। দেলিসা আর দানিস আমাকে ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে আমি জানাই যে আমার শরীর খারাপ লাগছে তাই আমি বাড়ি যেতে চাই। দেবব্রত রেগে ফেটে পড়েছিল। তিরথাঙ্করের হাত ধরে সিট থেকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে, “সেই শুয়োরের বাচ্চা, তুই বের হবি হল থেকে না এখানে তোকে মেরে ফেলব।”

তিস্তা হাঁ করে আমাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।

আমি তিস্তাকে বলি, “আমি বাড়ি যাচ্ছি রে, শরীর ভালো লাগছে না।”

আমি হল ছেড়ে বেড়িয়ে আসি। দেবব্রত আর রজত আমার পেছন পেছন হল থেকে বেড়িয়ে আসে। দেবব্রত আমাকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু আমি শুধু জানাই যে আমার শরীর ভালো লাগছে না। রাগে অপমানে আমার গাঁ হাত পা কাঁপছিল। চোখে জল এসে গেছিল, আমি ওদের নজর লুকিয়ে চোখের কোল মুছে ফেলি কিন্তু দেবব্রত সেটা লক্ষ্য করে ফেলে। কিছু পরে দেলিসা আর দানিস বেড়িয়ে আসে হল থেকে। দানিস আমাকে সেই এক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে। দেবব্রত দানিস কে তিরথাঙ্করের আচরনের কথা জানায়, সেই শুনে দানিস রেগে যায়। কিছু পরে তিস্তা পুস্পাঞ্জলিকে সাথে নিয়ে হল থেকে বেড়িয়ে আসে। তিস্তা কে দেখে আমি রাগে ফেটে পরি।

দেবব্রত তিস্তা কে দেখে জোর গলায় বলে ওঠে, “তুই কুত্তা, তোর কুকুরটাকে বেঁধে রাখ না হলে কোন দিন আমার হাতে মারা পড়বে।”

তিস্তা দেবব্রতর কথা শুনে রেগে গিয়ে বলে, “একদম মুখ সামলে কথা বলবি তুই।”

আমি থাকতে না পেরে তিস্তা কে বলি, “ওই জায়গায় তুই থাকলে তোর কেমন লাগত সেটা একবার ভেবে দেখিস।”

তিস্তা বলে, “না না, ও ইচ্ছে করে করেনি, হয়ত হটাত করে হাত লেগে গেছে।”

রাগে আমার ঠোঁট শুকিয়ে গিয়েছিল, আমি ঠোঁট মুছে ওর দিকে রেগে বলি, “তুই ভালো করে জানিস তুই কাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিস।”

তিস্তা আমার হাত ধরে অনুনয় করে, “প্লিস রাগ কোর না। যদি ও কিছু করে থাকে তাহলে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তোমার কাছে, আমি ওর সাথে কথা বলে নেব এই ব্যাপারে, কিন্তু একটি বার ভেতরে চলো।”

আমার আর সিনেমা দেখার মন ছিল না, আমি ওকে জানাই, “না, আমি বাড়ি ফিরে যেতে চাই। আমার ছোটমা আমাকে বলেছিলেন যে, এই জগতে প্রকৃত বন্ধু পাওয়া দুস্কর, তোদের সাথে মেশার আগে আমাকে ভেবে দেখা উচিত ছিল রে।”

আমরা দুজনে বুঝতে পারি যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরেছে। আমি ওর দিকে ব্যাথা ভরা চাহনি নিয়ে তাকাই।

দেলিসা আমাকে বলে, “ছাড় ওর কথা।”

তিস্তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, “তোর স্বভাবের জন্য একদিন তুই পস্তাবি। তোর স্বভাবের জন্য তোর আশেপাশের বন্ধু বান্ধব তোকে ছেড়ে চলে যাবে একদিন।”

দেলিসার কথা শুনে তিস্তা কেঁদে ফেলে।

দানিস আমার কাছে এসে বলে, “আপা, ওকে ছেড়ে দাও। চল আমার বাড়ি চল, আমার বড়দি, তিন বছর হল বাড়ি আসেনি আম্মি তোমাকে দেখে খুব খুশি হবে।”

দেলিসাও আমাকে অনুরধ করে ওর শ্বশুর বাড়ি যেতে।
Like Reply
#16
শ্বেত পাথরের মূর্তি (#02)

আমি বললাম যে আমাকে বাবুর অনুমতি নিতে হবে। আমি ফোন করে বাবুকে জানিয়ে দিলাম যে আমার ফিরতে দেরি হবে। বাবু অনুমতি দিয়ে দিলেন কিন্তু প্রত্যকে স্নেহভরা পিতার মতন মেয়েকে সাবধান করে দিলেন যে আমি যেন সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরে আসি। মাঝে মাঝে ছোটমা আর বাবুকে বুঝতে আমার বড় কষ্ট হত।

হল থেকে বেড়িয়ে এলাম আমরা। তিস্তা হলের সামনে চোখে জল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

দেবব্রত দানিস কে ওর বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করে, দানিস জানায় যে ওর বাড়ি খিদিরপুরে। দেলিসা দেবব্রত কে মজা করে বলে, “তুই আসছিস নাকি আমাদের সাথে? তোকে ত আমরা নেমন্তন্ন করিনি।”

দেবব্রত হেসে উত্তর দেয়, “না রে আমার আজকে আর ভালো লাগছে না, অন্য কোনদিন যাবো।”

আমি দেলিসা আর দানিস ট্যাক্সি চেপে খিদিরপুরের দিকে রওনা দিলাম। যাত্রাপথে আমি দানিসকে জিজ্ঞেস করি যে আমাকে বাড়ি ছেড়ে কে আসবে। দানিস উত্তর দেয় যে ওর দাদার গাড়ি নিয়ে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। বিকেল হয়ে এসেছিল। খিদিরপুরে গাড়ি ঢুকে পরে। একটা ছোটো গলির শেষে ওর বাড়ি। বাড়ির দরজা ছোটো, কিন্তু বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি বাড়িটা বেশ বড় আর সুন্দর সাজান।

এক মধ্য বয়সি ভদ্রমহিলা এসে দেলিসাকে দেখে খুশি হয়ে জড়িয়ে ধরে। দানিসের মা, নিজের হবু বউমাকে দেখে খুশি। আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ, তারপরে দেলিসাকে জিজ্ঞেস করে আমার কথা।

দেলিসা জানায়, “ও শুচিস্মিতা আমার বান্ধবী, আমার সাথে কলেজে পরে।”

আমি ঝুঁকে পা ছুঁয়ে প্রনাম করি, দানিসের মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, “তোমাকে দেখে আমার সায়মার কথা মনে পরে গেল, সায়মা, দানিসের দিদি, দুবাইয়ে থাকে। অনেক দিন মেয়েকে দেখিনি, শুধু ফোনে কথা হয়, মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে।”

দানিসের মা আমাকে হালিম খেতে দিয়েছিলেন। সেই প্রথম বার আমি ওই রকম কোন মাংস খাই, মাংসের সাথে দাল দিয়ে তৈরি, একটু মিষ্টি একটু ঝাল, খুব ভালো খেতে। এর মাঝে বাবু ফোন করে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরে মনে হল যেন দেরি হয়ে যাবে। আমি দানিস কে অনুরধ করি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে। বাড়ি ফেরার আগে দানিসের মা আমাকে একটা রুপোর কয়েন দিয়েছিলেন, সেই কয়েনে আল্লহার নাম লেখা ছিল।

পুরো দিনের ঘটনার জন্য আমার মন খুব বিচলিত ছিল, আমার মনের দন্দ আমার মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাতে খাওয়ার সময়ে ছোটমা আমার মুখ দেখে বুঝতে পেরে যান যে আমার সাথে কিছু অঘটন ঘটে গেছে। ছোটমা বার বার জিজ্ঞেস করেন কিন্তু আমি চুপ করে থাকি। খাওয়ার পরে আমার ঘরে ঢুকে ছোটমা আমাকে বলেন, “তোর সাথে কে কি করেছে?”

আমি ছোটমায়ের কথা শুনে অবাক হয়ে যাই, মায়ের চোখ ফাকি দেওয়া যায় না। আমি কেঁদে ফেলি, ছোটমাকে সব ঘটনা জানিয়ে দেই। ছোটমা আমাকে সাবধান করে বলেন, “দেখ মা, তোকে বার বার বলেছিলাম যে এখানে বন্ধু পাওয়া অনেক মুশকিল, এর পর থেকে সাবধানে চলা ফেরা করিস।”

আমি ছোটমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলাম। ছোটমা আমাকে সান্তনা দিয়ে বলেন, “চিন্তা করিস না, এর পর থেকে মানুষের সাথে একটু বুঝে শুনে মেলামেশা করিস যেন।”

দিন যায়, আমার চারপাশের ছোটো ঢেউ আর যেন আমাকে ছুঁতে পারেনা। আমি এক অন্য শুচিস্মিতা হয়ে গেছিলাম। তিস্তার সাথে আমার ব্যাবধান বেড়ে চলে। সাথে সাথে দেলিসা, পুষ্পাঞ্জলি সবাই তিস্তার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয়।

সামনে হোলি। ঠিক এক বছর আগে আমি কত স্বপ্ন দেখেছিলাম যে পরের হোলি তে ওর সাথে রঙ খেলবো, কিন্তু বিধি বাম। আমি চেয়েছিলাম আমাদের প্রথম হোলি খেলা স্মরণীয় হয়ে থাক, কিন্তু সেদিন আমার জীবনে আসে না। প্রত্যেক দিনের মতন সেদিন আমি সকাল বেলা স্নান সেরে পুজো দিয়ে ছিলাম। ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন যে আমার কোন বন্ধু বান্ধবী আসবে কি না। আমি জানাই যে আমার সেই রকম কোন বন্ধু বান্ধবী নেই যে কিনা আমার সাথে রঙ খেলবে। আমি বাবুর পায়ে ছোটমায়ের পায়ে রঙ মাখিয়ে দেই। ছোটমা আদর করে আমাকে আশীর্বাদ করেন। সারাদিন কাজের ছলে কেটে যায়, আমার জীবনের রঙ যেন সাদা আর কালো, আর যেন কোন রঙ আমার জীবনে ছিল না।

পরের দিন কলেজে গেলাম। সবার গায়ে রঙের দাগ। কলেজের বান্ধবীরা আমাকে জিজ্ঞেস করে যে আমার হোলি খেলিনি? আমি জানায় যে আমার রঙ্গে এলারজি আছে তাই আর হোলি খেলিনি। কলেজ শেষে আমি করিডোর ধরে হেঁটে যাচ্ছিলাম।

ঠিক সেই সময়ে দেবব্রত এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “সেই প্রথম দিন থেকে তোমাকে লক্ষ করছি, তুমি বাকিদের থেকে অনেক আলাদা। অনেক দিন ভেবেছি তোমাকে তাঁর কারন জিজ্ঞেস করি, কিন্তু প্রতি বার তুমি উত্তর এড়িয়ে চলে যাও।”

আমি ম্লান হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, “কিছু নারে বাবা, রঙ্গে আমার এলারজি তাই আমি হোলি খেলিনা।”

দেবব্রত, “আমি হোলির রঙের কথা জিজ্ঞেস করিনি। সেদিন তুমি চিঠি নিয়ে নিলে তারপরে তুমি কেমন যেন হয়ে গেলে।”

আমি ওকে বলি, “আমি চেষ্টা করছি দেবব্রত, সেই শামুকের খোল ছেড়ে বেড়িয়ে আসার জন্য। কিছু দিন আগে আমার বড় বৌদি মারা গেছেন তাই এই বারে আমার হোলি খেলা হয়নি।”

দেবব্রত শয়তানি হেসে বলে, “আমি তোমাকে সেই শামুকের খোল থেকে যদি বের করে নিয়ে আসি?”

হটাত করে আমার মুখের ওপরে আবির মাখিয়ে দেয় দেবব্রত। আমি রেগে যাই ওর আচরনে। না, আমার গায়ে রঙ মাখানোর এক মাত্র অধিকার ওর, ও ছাড়া আমার জীবনে কেউ রঙ আনতে পারেনা।

আমি জোর গলায় ওকে বকে দিয়েছিলাম, “কি করছিস? আমাকে ছেড়ে দে।”

আমার গালে হাত বুলিয়ে দেয়, সারা গালে মাথায় লাল রঙ। চোখ ফেটে জল চলে আসে আমার। দেবব্রত মজা করে বলে, “মিতা, আজ হোলি, সবাই সবাইকে রঙ লাগায়।”

আমি রেগে গিয়ে বলেছিলাম, “প্লিস এই রকম আচরন আর কখন আমার সাথে করবি না।”

আমার কাঁপা গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়িয়ে পরে দেবব্রত।

আমার দুচখের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার ভেতরে ওই চোখের পেছনে কিছু লুকিয়ে আছে, আমি একদিন সেই মিতার ভেতর থেকে শুচিস্মিতাকে ঠিক বের করে আনব।”

আমি মাথা দোলাই, আমার ভেতরের শুচিস্মিতাকে কেউ বের করে আনতে পারেনা। এই মিতা সেই মিতাই থেকে যাবে যতদিন না ও এসে হাথ ধরে পরীকে টেনে বের করে আনবে। আমি ওকে জিগেছ করেছিলাম, “আমি কি কিছু জিজ্ঞেস করেতে পারি?”

দেবব্রত, “আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য তৈরি আছি মিতা।”

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বল আমাকে, তুমি কলেজে থাকতে তিস্তাকে প্রোপস কেন করলে না?”

আমার প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে যায় দেবব্রত। আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে উলটে জিজ্ঞেস করে, “আমি তোমার মুখে এই প্রশ্ন আশা করিনি, আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্য কিছু জিজ্ঞেস করবে।”

আমি মাথা নাড়াই, আমি জানতাম দেবব্রত আমার মুখ থেকে কি আশা করেছিল। আমি বুঝতে পেরে গিয়েছিলাম যে দেবব্রত আমার প্রতি একটু ঝুঁকে পড়েছে। আমি ওকে আবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, “এতই যদি ভালবাসতিস ওকে তাহলে প্রোপস করতে বাঁধা কোথায় ছিল?”

দেবব্রত মাথা দুলিয়ে উত্তর দেয়, “না সেই সব কথা, অতীত। তিস্তা কোনদিন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেনি। তিস্তা শুধু দেখেছে আমার বন্ধুত্ত।”

আমি জিজ্ঞেস করি, “তাঁর মানে এখন তোর মনের ভেতরে ওর প্রতি একটু ভালোবাসা বেঁচে আছে তাই ত।”

দেবব্রত, “ছাড়ো ওই সব কথা। সেইসব দিন ত আর আমি ফিরে পাবো না। আমি খোলা চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে চলি।”

আমার কাজল কালো দুচখের দিকে অকেন ক্ষণ ধরে তাকিয়ে থাকে দেবব্রত। শেষ পর্যন্ত আমার কাছে ওর আচরনের জন্য ক্ষমা চেয়ে মুখ ধুয়ে নিতে বলে। আমি মুখ ধুয়ে নিয়েছিলাম, আমার দেহে ওর রঙ ছাড়া আর কারো রঙ দেবার অধিকার নেই।

বসন্ত শেষে গ্রীষ্ম কাল এসে দাঁড়ায় আমার দোরগোরায়। আমি একা একা ফাঁকা রাস্তা দিয়ে রোজ হেঁটে যাই, সাথে কেউ নাই। তপ্ত বালুচর পায়ের তলায়, মাথার ওপরে একটু ছায়া নেই। ঠিক এক বছর আগে আমি কোলকাতার বাড়িতে এসেছিলাম, ওর বন্ধনের মাঝে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলাম। ছোটমায়ের সাথে সেই যে আসা, সেই দিন আমি ভাবিনি যে কয়েক মাস পরেই আমাদের জীবন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, ভেঙ্গে পড়ে যাবে আমাদের ভালোবাসার রাজপ্রাসাদ।

কলেজ শেষ, আমি একা একা কলেজ স্ট্রিটের বইয়ের গলি দিয়ে হাটি বাড়ি ফেরার জন্য। চারপাসে অসংখ্য বইয়ের দোকান। একা একা হাঁটতে হাঁটতে সেই কথা মনে পরে যায়, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে যে এখানে কত গুলো বইয়ের দোকান আছে। আমাকে উত্যক্ত করার জন্য উত্তর দিয়েছিল, “আট হাজার, ছয়শ বাইস খানা বইয়ের দোকান।”

আমি ওর কথা বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম এমন বোকা মেয়ে। সেই কথা ভেবে নিজের মনেই হেসে ফেলি আমি।

আনমনে রাস্তা পাড় করতে যাই ঠিক সেই সময়ে কী আমার হাত ধরে টেনে ধরে। আর ঠিক সামনে দিয়ে একটা বাস চলে যায়। আমি থমকে দাঁড়িয়ে পরি।

দেবব্রত আমাকে জোর গলায় বকে দেয়, “হাঁটার সময়ে মন কোথায়, এখুনি বাসের নিচে পড়তে তুমি।”

আমার সামনে দিয়ে বাস চলে যাওয়ার পরে আমার বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়, হয়ত এখুনি বাসের তলায় পরে মারা যেতাম কিন্তু আমার ভাগ্য যে অত ভালো নয়। আমি ওর দিকে তাকিয়ে ম্লান হেসে উত্তর দেই, “আমি অত ভাগ্য করে আসিনি রে।”

আমার বাজু ধরে টেনে ফুটপাথে উঠিয়ে আমাকে বলে, “আজ আমি তোমাকে ছারব না, তোমার সব কথা শুনতে চাই আমি।”

আমি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “কি জানতে চাস তুই? তোর কাছে আমার বলার কিছুই নেই। কেন আমাকে একা ছেড়ে দিতে পারিস না।”

আমার বাজু ছেড়ে দিয়ে আমাকে বলে, “আমি কি তোমার কেউ নই, এমন কি একটা ভালো বন্ধুও না?”

আমি ওকে বলেছিলাম, “দেখ দেবব্রত, তুই আমার ভালো বন্ধু, কিন্তু তাও আমি বলছি যে তোকে আমার বলার কিছু নেই।”

আমার দিকে ব্যাথিত নয়নে তাকিয়ে থাকে। আমি আমার বুকের বেদনা লুকানোর জন্য ওর দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। ফাঁকা বুকে বেজে ওঠে কান্নার সুর, সেই বেদনা বুকে ছাড়িয়ে চোখে চলে আসে, আমি নজর লুকিয়ে চোখের জল মুছে ফেলি। গভীর শ্বাস টেনে সেই ফাঁকা বুক ভরে নিতে আপ্রান চেষ্টা করি আমি। আমি দিনে দিনে বুঝতে পারি যে দেবব্রত আমার প্রতি আকৃষ্ট হয় যায়। প্রতিপদে আমার ম্লান ঠোঁটে হাসি ফোটানোর আপ্রান চেষ্টা করে কিন্তু আমার ভাঙ্গা বুকে কারুর জন্য কোন জায়গা নেই। আমি নিজেকে সেই সব হাতছানির থেকে দুরে সরিয়ে রাখি, চারদিকে উঁচু দেওয়াল তুলে নিজেকে ভালোবাসার হাতছানি থেকে দুরে করে নিয়েছিলাম। বুকের মাঝে পুরানো ভালোবাসা ছাড়া কোন নতুন কাউকে আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবতে পারিনা আমি।

মে মাসের একদিন, গরমের ছুটির কয়েক দিন আগের ঘটনা। আমি এক রাতে, অনেক সাহস সঞ্চয় করে সুপ্রতিমদাকে ফোন করেছিলাম। বুকের মাঝে এক আশা বেঁধে, যদি ও সুপ্রতিমদাকে ফোন করে কিছু জানিয়ে থাকে, সেই ভেবে। রিতিকা আমার ফোনের উত্তর দিয়েছিল।

রিতিকা আমাকে জিজ্ঞেস করে, “তোমার কি খবর? আমি খবর পেলাম যে তোমার নাকি বিয়ে?”

ওর কথা শুনে প্রায় চেঁচিয়ে উঠি আমি, “না, মিথ্যে কথা, বাবু তোমাদের দুরে রাখার জন্য সেই খবর ছড়িয়েছে।”

আমি বুকের মাঝে শক্তি সঞ্চয় করে দাঁতে দাঁত পিষে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ও কি ফোন করেছিল? কিছু খবর দিয়েছে?”

রিতিকা, “হ্যাঁ কিছু দিন আগেই ফোন করেছিল। এখন ও ইস্রায়েলে।”

আমার বুকের মাঝে যেন হাজার ঘোড়ার দৌরের শব্ধ ছনা যায়, আমার গলা ধরে আসে আমি জিজ্ঞেস করি, “আর কি বলেছে ও?”

আমি ঠোঁট চেপে ধরি, চোখে বুজে থাকি ওর খবর পাওয়ার আশায়।

রিতিকা জানায়, “ও জানিয়েছে যে তোমাকে কিছু করে হোক খবর পাঠাবে। একবার তোমার ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল, কিন্তু তোমার সাথে কথা বলতে পারেনি, এবারে ও অন্য কিছু করে তোমার সাথে সম্পর্ক করবে। পরের বার যদি আমাকে ফোন করে তাহলে আমি তোমার ফোন নাম্বার দিয়ে দেব আমি।”

রিতিকার কথা শুনে আমার চোখে জল চলে এসেছিল। আমার বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত জিতে গেল, আমার ওপরে বিশ্বাস হারায়নি তাহলে, বাবুর কথা তাহলে ও বিশ্বাস করেনি।

রিতিকা আমাকে বলে, “পরী কাঁদে না। তোমার বাবুর কথা ও এক বিন্দু বিশ্বাস করেনি। কিন্তু যাওয়ার সময়ে খুব ভারাক্রান্ত মনে দেশ ছেড়ে গেছে। পরী একবার ওর দিক ভেবে দেখ, তোমার বাবু এত বড় দুঃসংবাদ জানালে ও আর কি করতে পারে বলো? ইস্রায়েল থেকে একবার মাত্র ফোন করেছিল অভি, জানিনা আবার কবে ফোন করবে।”

আমি ফোনে চুমু খেয়ে ওকে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ রিতিকা।”

ওর কথা আরও জানতে ইচ্ছে করছিল তাই জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা একটা কথা বলতে পার আমাকে, ও এখন কি করে?”

রিতিকা, “ও এখন একটা আইটি কম্পানিতে চাকরি করছে। সেই কম্পানি থেকে ওকে কাজের সুত্রে বাইরে পাঠিয়েছে। খুব খাটতে পারে তোমার অভিমন্যু, অনেক বড় হবে দিনে দিনে।”

রিতিকার কাছে ওর সংবাদ পেয়ে ফাঁকা বুকের মাঝে যেন শীতল হাওয়া বয়ে যায়। মন যেন পেখম তোলা ময়ুরের মতন নেচে ওঠে। আমি চোখ খুলে দেখি যে ও আমার সামনে দু হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আমি দৌড়ে ওর কোলে গিয়ে মাথা রেখে শুয়ে পরি।

আমি সুন্দর স্বর্গোদ্যানে একা একা ঘাসের বাগানের মাঝে ঘুরে বেড়াই। আমার চারপাশে সুন্দর ফুলের বাগান। আকাশে বাতাসে গোলাপের গন্ধ, পায়ের তলার ঘাস শিশিরে ভেজা। গাছের ডালে ছোটো ছোটো পাখীর অতি মুধুর সঙ্গিত মৃদু মলয় কে মুখরিত করে তোলে। সেই বাগানের মাঝে একটা সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমার পরনে দুধ সাদা মখমলের পোশাক, মাথায় ফুলের মুকুট, হাথে ফুলের চুড়ি। আমার মাথার লম্বা ঘন কালো চুল বাতাসে ওড়ে। আমার পিঠের পেছনে ঝিল্লি সুতোর বোনা বিশাল রঙ্গিন পাখা। আমি উড়তে চেষ্টা করি, প্রানপন শক্তি দিয়ে পাখা মেলে ধরি। কিন্তু কোন অদৃশ্য শক্তি আমাকে মাটির সাথে টেনে ধরে থাকে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি যে আমার পায়ে ঘাসের দড়ির বেড়ি বাঁধা। সেই দুধ সাদা ঘোড়া আমার দিকে ধিরে ধিরে এগিয়ে আসে। আমি সেই সাদা ঘোড়ার কাছে কাতর মিনতি করে বলি আমাকে ঘাসের বেড়ি থেকে মুক্ত করতে। আমি চেঁচিয়ে উঠে বলি, “সাদা ঘোড়া, আমাকে ছাড়িয়ে দাও, আমি তোমার সাথে উড়ে যেতে চাই।”

চিৎকারে নিজের ঘুম ভেঙ্গে যায়, বুকের মাঝে উত্তাল ঢেউ বয়ে চলে। আমি যে একটা স্বপ্নের ঘোরে ছিলাম এতক্ষণ। আমি আবার চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের শেষ দেখতে চেষ্টা করি, কিন্তু সেই স্বপ্ন হারিয়ে যায় খোলা চোখের আড়ালে।

ছোটমা আমার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে আমার দরজা ধক্কা দেয়, “সোনা মা কি হয়েছে?”

আমি হাঁপাচ্ছিলাম, আমি উড়তে পারছিলাম না কিছুতেই। ছোটমায়ের গলার আওয়াজ শুনে যেন বুকে শান্তি ফিরে আসে। আমি দরজা খুলে ছোটমায়ের দিকে তাকিয়ে বলি, “কিছু না ছোটমা আমি একটা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

ছোটমা আঁচল দিয়ে আমার মুখ, কপাল মুছিয়ে দেন। ঘুম জড়ানো চোখের মাঝেও ছোটমায়ের স্নেহ ভালোবাসা যেন কমে না। আমাকে বলেন, “তোকে কত বার বলেছি দরজা খুলে শুতে।”

সকালের আলো জানালার কাছে এসে যায়।

আমি আবার বিছানায় শুয়ে সকালের সেই স্বপ্নের কথা ভাবতে চেষ্টা করি। স্বপ্নের মানে বুঝতে পেরে আমার সারা গায়ে ভয়ে কাটা দিয়ে ওঠে। আমি শ্বেত পাথরের মূর্তির মতন ঠায় বসে থাকি বিছানার ওপরে, পায়ের কাছে সকালের রোদ খেলা করে। আমি পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় যেন ঘাসের দড়ির বেড়ি আমার পায়ে বাঁধা। পরী উড়ে যেতে চায় প্রাণপণে কিন্তু সেই বেড়ির বাঁধনের ফলে সুন্দরী পরী উড়তে পারেনা। স্বপ্নের শেষ দেখতে পারিনি আমি, জানিনা সেই সাদা ঘোড়া তাঁর ভালোবাসার পরীকে বাঁধন মুক্ত করতে পেরেছিল কিনা। আমি কোনদিন হয়ত জানতে পারবোনা, যে সেই স্বরগদ্যানের পরী শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়েছিল কি না।

বুকের মাঝের ছোটো হৃদয়, গড়িয়ে যায় ঘাসের মাঠের ওপরে, গড়িয়ে চলে নদীর তীরে, গড়িয়ে চলে পাহাড়ের প্রান্তে, ঢালাও প্রান্তে, কখন উঁচু গাছের উপরে উঠে পরে, কখন নদীর অতল তোলে তলিয়ে যায়। গড়িয়ে চলে আমার ছোটো ব্যাথিত হৃদয়, থেমে থাকলে যে হৃদয়ে ভাঙ্গন ধরে যাবে সেই ভয়ে।
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply
#17
Next Coming Soon.....


 [সাদা ঘোড়ার রুপকথা (#01, #02)]
[+] 1 user Likes Nefertiti's post
Like Reply
#18
Ektai onurodh golpo ta majpothe Likha chere diben na. Onek ASHA nie golpo ta abar Porte suru korchi
[+] 1 user Likes Bappa91283's post
Like Reply
#19
Onek onek thanks apnake golpo ta notun kore amader upohar diyar jonno
[+] 1 user Likes Bappa91283's post
Like Reply
#20
Ki bolbo jani na. But mugdho emon ekta golpo pore. Xossipy te emon glopo ase bhabte pari nai. Thanks a lot Pinuram dada. Apni sotti khub boro writter. Update er opekhai thakbo.
Ralph..
Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)