Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
(Update No. 119)

পরদিন সকাল সাতটায় চা খেতে খেতে পরিতোষ সীমন্তিনীকে ফোন করল। সীমন্তিনী সাড়া দিতেই সে বলল, “গুড মর্নিং ডার্লিং। ঘুম ভেঙেছে তো? না ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “গুড মর্নিং পরিতোষ। ঘুম অনেকক্ষণ আগেই ভেঙেছে। তা এত সকাল সকাল কি মনে করে? সব ঠিকঠাক আছে তো”?

পরিতোষ বলল, “আমার মত একটা থার্ড ক্লাস লোককে যমেও নিতে চায় না ডার্লিং। সেটা ....”

সীমন্তিনী পরিতোষকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে প্রায় ধমকের সুরে বলল, “আজেবাজে কথা না বলে কেন ফোন করেছ এ সকালে সেটা বল তো”।

পরিতোষ হেসে বলল, “জানি আমার নিজের মনের কথা শোনবার মত এ দুনিয়ায় একটা প্রাণীও নেই। ওকে ওকে ডার্লিং, তাহলে আসল কথাতেই আসছি। শোনো, তোমাকে আসলে কাল রাতেই ফোন করব ভাবছিলাম। কিন্তু ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলেই আর করা হয়নি। তবে একটা গুড নিউজ আছে। টারগেট ওয়ানে অপারেশন সাকসেসফুলি শেষ হয়েছে। আমার সতীনের জন্য হাতে পেয়েছি সাড়ে তিন লাখ। সেটাও আপাততঃ আমার কাছেই সুরক্ষিত রাখতে হবে জানি। তবে খবরটা তোমাকে জানানো উচিৎ বলেই এই সাত সকালে ফোনটা করেছি। ও আর হ্যাঁ, আরেকটা খবর আছে। রবিশঙ্কর আর তার দুষ্কর্মের আরও দুই পার্টনারকে গতকাল পুলিশ এরেস্ট করেছে। আর তাকে যেভাবে আইনের জালে আটকানো হয়েছে, তাতে অন্ততঃ বছর পাঁচেকের ইমপ্রিজন্টমেন্ট হতে পারে। তবে এটা অন্য একটা কেসে”।

সীমন্তিনী বেশ খুশী হয়ে বলল, “এরই মধ্যে দুটো টার্গেটই ফিনিশ হয়ে গেল? স্যালিউট স্যার। কিন্তু আমি যে আরেকটা কাজ তোমাকে দিয়েছিলাম সেটার ব্যাপারে তো কিছু বল এবার”?

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ টার্গেট থ্রি আর ফোরের ওপরেও আমার নজর আছে। তবে টার্গেট থ্রির ব্যাপারে পজিটিভ কোন রিপোর্ট এখনও পাইনি। তবে মনে হয় আমার সতীনের কেসটার ব্যাপারে সে বোধহয় তেমন ভাবে জড়ায় নি। আমার মনে হয় ডুপ্লিকেট চাবির সাহায্যেই তোমার দাদাভাইকে ঠকানো হয়েছিল। আর সে ব্যাপারে টার্গেট থ্রি নিজে হয়ত জড়িত ছিল না। তার মত একজন কোটিপতি সামান্য দু’লাখ টাকার জন্য এমন একটা কাজ করবে সেটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না আমার। তবে মালটা তো বেশ ঘাগু মাল। জোর দিয়ে বলাও যায় না কিছু। তবে ওয়াচ রাখছি তার ওপরেও। আর টার্গেট ফোর-এ তো দক্ষিণ কলকাতার এক যোগা ইনস্টিটিউটে কাজে যোগ দিয়েছে দিন তিনেক হল। আশা করি তুমি সেটা জানোই। আর টার্গেট ফোর-বি সুস্থ এবং ভাল আছে। ব্যস”?

সীমন্তিনী এবার বলল, “ব্যস মানে? তোমার বিয়ের নিমন্ত্রনটা কবে পাচ্ছি সেটার খবর কোথায়”?

পরিতোষ নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ওঃ ওটার কথা বলছ? সরি ডার্লিং। ও ব্যাপারে পজিটিভ কিছু শোনাতে পারছিনা তোমাকে। তবে এটুকু জেনে রাখো। নতুন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল বটে। কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে এবারেও ছিঁড়ল না। কি করব বল”?
 

সীমন্তিনী একটু বেশী উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “নতুন সম্ভাবনা এসেছিল? কিন্তু সেটাও কব্জা করতে পারনি তুমি? আমাকে তো দু’দিন দেখেই তিন দিনের দিন সোজা প্রোপোজ করে বসেছিলে”!

পরিতোষ গম্ভীরভাবে জবাব দিল, “প্রোপোজ তো এবারেও করেছিলাম সুইট হার্ট। কিন্তু কথায় বলে না? কপালে না থাকলে ঘি- ঠকঠকালে হবে কি। আমারও সে অবস্থাই হয়েছে। আমার প্রোপোজাল তো নাকচ করেই দিল। সেই সাথে আরেক আবদার পেতে বসল। সে আমার ভূতপুর্ব প্রেমিকা সরি আমার বন্ধু এবং আইপিএস সীমন্তিনী ভট্টাচার্য্যির সাথে দেখা করতে চায়। এখন তুমি বলো। তুমি আছ পাঁচ ছশ’ মাইল দুরে আর তিনি আছেন এই কলকাতা শহরে। কিকরে তোমাদের দু’জনের সাক্ষাৎ ঘটাই বল তো? ওঃ ভাল কথা। তুমি কি কলকাতা আসবার প্ল্যান করছো”?

সীমন্তিনী এবার অবাক হয়ে বলল, “আমি কলকাতা যাচ্ছি? এ খবর কোথায় শুনলে? আমি তো কিছু জানি না”।

পরিতোষ বলল, “গোপন সূত্রের খবর। তোমাকে নাকি এখানে হেড কোয়ার্টারে তলব করা হচ্ছে। অবশ্য তারিখের ব্যাপারটা সঠিক বলতে পারছি না। তবে তোমার নর্থ-ওয়েস্ট ডুয়ার্সের রিপোর্টের ব্যাপারেই যে তলব করা হচ্ছে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত”।

সীমন্তিনী চিন্তিত সুরে বলল, “সেটা হলেও হতে পারে। কিন্তু এখন অব্দি আমি এ ব্যাপারে কিছু শুনিনি। ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার থেকে আমাকে এমন কোন খবর পাঠায়নি। জানিনা। তবে অমন অর্ডার এলে তো আমাকে যেতেই হবে। আর তুমিও জানতেই পারবে”।
 

পরিতোষ এবার বলল, “আচ্ছা ম্যাডাম, এবার আমার আরেকটা কথার জবাব দাও তো। আমার সতীনের সম্পত্তিগুলো কবে আর কিভাবে কার হাতে দেব”?

সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “ওগুলো আপাততঃ তোমার কাছেই থাক। যদি আমাকে কলকাতা যেতেই হয় তখন এ ব্যাপারে কথা বলব আমরা। কিন্তু তখন ..... না থাক। সেটা পরে দেখা যাবে”।

পরিতোষ বলল, “ওকে সুইট হার্ট। তাহলে আপাততঃ বার্তালাপ এখানেই শেষ করছি। ভাল থেক। হ্যাভ এ গুড ডে” বলে ফোন কেটে দিল।
 

*******************

রতীশ দিন চারেক আগে মহিমার ইনিস্টিটিউটে কাজে যোগ দিয়েছে। মহিমার কথা বার্তা ব্যবহারে সে খুব খুশী। ইনস্টিটিউটের অন্যান্যরাও, অফিসের জমাদার রাজু, পিয়ন অজয়দা থেকে শুরু করে অন্যান্য ট্রেনাররা এমনকি সব চেয়ে কম কথা বলা অফিস এসিস্ট্যান্ট বীথিকা পর্যন্ত সকলেই রতীশের সঙ্গে খুব ভাল ব্যবহার করে। রতীশও সকলের কাছ থেকে সুব্যবহার পেয়ে খুশী। কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে রোজ ভোর সাড়ে চারটেয় তাকে বাড়ি থেকে বের হতে হয়। তবে বাড়ি থেকে বেরোনটা কোন সমস্যা নয়। আসল সমস্যাটা হচ্ছে ইনস্টিটিউটে সময়মত গিয়ে পৌঁছনোটা। অত সকালে বাস ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। অটো দু’একটা চলে। কিন্তু সেগুলোর কোন নির্দ্দিষ্ট টাইম টেবিল নেই। পাওয়া যে যাবেই তাও জোর দিয়ে বলা যায় না। আর পাওয়া গেলেও বরানগর থেকে সরাসরি গড়িয়া পর্যন্ত কোন অটোই যায় না। কয়েকবার পাল্টাপাল্টি করে যেতে হয়। মহিমা বৌদি তার সাপ্তাহিক ছুটির দিন ঠিক করে দিয়েছেন বৃহস্পতি বার। গত চারদিনের মধ্যে একদিন বৃহস্পতি বার ছিল বলে সেদিন রতীশকে ভোরবেলা বাড়ি থেকে বের হতে হয়নি। কিন্তু আর তিনদিনই ইনস্টিটিউটে যাবার পথে তাকে প্রচণ্ড টেনশনে ভুগতে হয়েছিল। একদিন তো জেনারেল সেশন শুরুই হয়ে গিয়েছিল পৌঁছতে পৌঁছতে। যদিও মহিমা সেজন্যে তাকে বেশী কিছু বলেনি। কিন্তু সে নিজেই সে ব্যাপারে মনে মনে খুব অস্বস্তিতে আছে। সকাল ছ’টা থেকে সাড়ে দশটা অব্দি তাকে ডিউটি করতে হয়। সাড়ে দশটায় তার ছুটি। ফিরতি পথে তার কোন সমস্যা হয় না। বাস ট্যাক্সি অটো মেট্রো সব কিছুই পাওয়া যায়।
 

আজও ভোর সাড়ে চারটেয় সে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। নিচের রাস্তায় এসে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা রচনাকে হাতের ঈশারায় বাই জানিয়ে সে বড়রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। একবার কব্জি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা বেজে পাঁচ। এদিক ওদিক সবদিকে তাকিয়ে দেখল কোথাও কোন অটো দেখা যাচ্ছে না। শুধু তার কাছ থেকে হাত ছয়েক দুরে আরেক ভদ্রলোক ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। এমন সময় পাশের একটা গলি থেকে হুট করে একটা খালি অটো বেরিয়ে এল। রতীশ হাত দেখাবার আগেই পাশের লোকটাই অটোটাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করছে “ভাই নরেন্দ্রপুর যাবে”?
 

রতীশ ধীরে ধীরে অটোটার কাছে আসতে আসতে ভাবল যে ও লোকটা যদি আপত্তি না করে তাহলে সে নিজেও এই অটোটাতেই যেতে পারবে। তার ইনস্টিটিউট নরেন্দ্রপুরের রাস্তাতেই পড়ে। রতীশ ভাবল এই অজানা অচেনা লোকটাকে কিছু বলার চাইতে অটো ড্রাইভারটার সাথেই বরং কথা বলে দেখা যাক। এই ভেবে সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে অটো ড্রাইভারটাকেই জিজ্ঞেস করল, “ভাই গড়িয়া যাওয়া যাবে”?

অটো ড্রাইভারটা জবাব দিল, “গড়িয়া মেট্রো হলে উঠে পড়ুন। কিন্তু অন্য কোনদিকে হলে হবে না দাদা। আমি বারুইপুরের রাস্তায় যাব”।
 

রতীশ সাথে সাথে বলল, “না মানে মেট্রো ঠিক নয়। তবে সেখানে পৌঁছে দিলেও হবে”।

ড্রাইভার বলল, “তাহলে আর দেরী না করে উঠে পড়ুন। ভাড়া কিন্তু সত্তর টাকা নেব দাদা। পরে ঝামেলা করবেন না কোন”।

রতীশ কোন কথা না বলে অটোয় ওঠা অন্য লোকটার পাশে গিয়ে বসতেই সেই লোকটা ড্রাইভারকে বলল, “সত্তর টাকা ভাড়া চাইছ মেট্রো পৌঁছাতে? তাহলে নরেন্দ্রপুর মিশন অব্দি কত নেবে”?

ড্রাইভার বলল, “মিশন গেটে নামলে আপনাকে নব্বই টাকা দিতে হবে স্যার। আর মন্দির গেটে নামলে আশি টাকা নেব”।

লোকটা বলল, “এত বেশী ভাড়া চাইছ কেন ভাই। মিটারে গেলে তো এত পয়সা পড়বে না”।

ড্রাইভার ছেলেটা একটু কর্কশ ভাবে বলল, “আপনি কি এই প্রথম এখান থেকে নরেন্দ্রপুর যাচ্ছেন দাদা? আপনি জানেন না? এদিক থেকে কোন অটোই ডাইরেক্ট নরেন্দ্রপুরের দিকে যায় না। দু’ তিন জায়গায় অটো পাল্টে পাল্টে যেতে হয়। আমার স্পেশাল পারমিট আছে বলেই আপনারা এমন সুযোগ পাচ্ছেন। আর এ’সময়ে মিটারে চলবে না দাদা। আর এই ভোরবেলায় ভাড়া সব রাস্তাতেই একটু বেশীই দিতে হবে। সে লোভেই তো ঘুম কামাই করে এত সকাল সকাল রাস্তায় বেরোই। আপনার না পোষালে আপনি নেমে যান। এভাবে সময় নষ্ট করবেন না আমাদের সবার”।

লোকটা এবার তর্ক করা ছেড়ে দিয়ে বলল, “বেশ ঠিক আছে ভাই, চল”।

ড্রাইভার অটো ছেড়ে দিল। পাশের লোকটা গোটা রাস্তাটা একদম চুপচাপ থাকলেও অটোর ড্রাইভার রতীশের সঙ্গে অনেক ব্যাপারে কথা বলল। সে বলল তার নাম নিখিল বারুই। তাকে এখন থেকে রোজ সকাল পাঁচটায় নাকি অটো নিয়ে বারুইপুর যেতে হবে। কোন এক হকার নাকি তাকে রোজকার জন্য বাধা করে নিয়েছে। রোজ সকাল সাড়ে ছ’টায় নিখিল তাকে বারুইপুর থেকে বরানগর নিয়ে আসবে। তার সাথে মাসকাবারি চুক্তি হয়েছে। সে কথা শুনে রতীশ তাকে বলল যে সেও রোজই তাহলে নিখিলের অটোতেই গড়িয়া আসবে। নিখিলও সে কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল যে রতীশ যদি রোজ তার অটোতেই যায় তাহলে সে তার সাথেও মাসকাবারি চুক্তি করে নিতে পারে। তাহলে ভাড়ার দিক থেকে বেশ কিছুটা কম নিতে সে রাজি আছে। তবে রাস্তায় প্যাসেঞ্জার পেলেও সে তুলে নেবে। রতীশ তাকে জানাল যে মাসকাবারি চুক্তি সে এখনই করতে চায়না, কিছুদিন যাবার পর সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু সে যে রোজ নিখিলের অটোর জন্যেই বড় রাস্তার ওই মোড়েই দাঁড়িয়ে থাকবে, সেটা জানিয়ে দিল। নিখিল খুব খুশী হয়ে তাতে সম্মতি দিল। রতীশও মনে মনে খুব খুশী হল। ভাবল রোজ সকালে অটো খোঁজার টেনশন থেকে সে মুক্তি পেল।

প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে গড়িয়া মেট্রো ষ্টেশনের কাছাকাছি আসতেই নিখিল জিজ্ঞেস করল, “দাদা আপনি মেট্রো ষ্টেশন থেকে ঠিক কোন দিকটায় যাবেন বলুন তো”?

রতীশ বলল, “তুমি তো বারুইপুর যাবে। আমাকে সে রাস্তাতেই মেট্রো থেকে মিনিট পাঁচেক যাবার পর একটা জায়গায় নামতে হবে”।
 

নিখিল গড়িয়া ষ্টেশন ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “তাহলে আর এখানে নামতে চাইছেন কেন। আপনি ঠিক জায়গা মতই নামতে পারবেন”।

অটো এগিয়ে চলল। কয়েক মিনিট বাদেই ইনস্টিটিউটের গলির মোড় আসতেই রতীশ অটো থামাতে বলল। অটো থেকে নামতে নামতে কব্জিঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল পাঁচটা পঞ্চান্ন। পকেট থেকে পার্স বের করতেই নিখিল বলল, “দাদা সত্তর নয়, ষাট টাকা দিন। আপনি আমার বাধা প্যাসেঞ্জার হয়ে গেলেন, তাই দশ টাকা কনসেশন আপনি পেতেই পারেন”।

রতীশ মিষ্টি করে হেসে ভাড়া দিতে দিতে বলল, “ইস, আর পাঁচটা মিনিট আগে পৌঁছলে ভাল হত”।

নিখিল টাকা নিতে নিতে বলল, “কাল থেকে আরেকটু ডাবিয়ে আসব। আপনাকে ঠিক পাঁচটা পঞ্চাশের মধ্যেই এখানে নামিয়ে দেব দাদা, ভাববেন না। আপনি ওই মোড়েই আমার জন্য অপেক্ষা করবেন। আমি ঠিক পাঁচটায় আপনাকে তুলে নেব। আচ্ছা চলি দাদা। ভাল থাকবেন”।

******************

সকালের জেনারেল সেশন শেষ হবার পর মহিমার চেম্বারে সকলে মিলে ব্রেকফাস্ট করবার সময় মহিমা বীথিকাকে জিজ্ঞেস করল, “আজ কেবিন সেশনে ক’জনকে ট্রিটমেন্ট দিতে হবে বীথি”?

বীথিকা জবাব দিল, “আজ তো তিনজন আসবে ম্যাম। মিসেস ডালমিয়া ফোন করে জানিয়েছেন আজ উনি আসতে পারবেন না। তার ঘরে নাকি কিছু একটা ফাংশন আছে। মিসেস আগরওয়ালা, মিসেস দাস আর মিসেস দত্ত আসবেন। কিন্তু ম্যাম, মিসেস আগরওয়ালা বুঝি আমাদের সার্ভিসে ইদানীং খুব খুশী নন। উনি কারো সাথে সেশন শেয়ার করতে চাইছেন না। বলছেন দেড় ঘণ্টার সেশনে আরেকজনের সাথে ট্রেনার শেয়ার করাটা তার মনঃপুত হচ্ছে না। তিনি ট্রেনারের সঙ্গে একাই সেশন এটেণ্ড করতে চান”।

মহিমা খেতে খেতেই জবাব দিল, “হুম, কথাটা উনি আমাকেও বলেছেন। কিন্তু কি করব বলো। কবিতাটা যে চলে গেল। এ অবস্থায় বুধবার, শুক্রবার, শনিবার আর রবিবার আমাদের তিনজন ট্রেনার থাকবে। একা করাতে গেলে তিনজন শুধু তিনজনকেই কোচিং দিতে পারবে। তিনজনের বেশী ট্রেণী হলে তো একসাথে দু’জনকে কোচিং না দিয়ে উপায় নেই। আর সোমবার, মঙ্গলবার আর বৃহস্পতি বার তো দু’জন ট্রেনার থাকে আমাদের হাতে। ওই তিনদিন তো একসাথে দু’জনকে কোচিং না দিয়ে উপায়ই নেই। আচ্ছা ঠিক আছে আমি তার হাসব্যাণ্ডের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলব। আচ্ছা মিসেস আগরওয়ালা কবে কবে আসছেন এখন”?

বীথিকা জবাব দিল, “উনি তো রবিবার আর বৃহস্পতি বার আসেন ম্যাম”।

মহিমা খেতে খেতেই কিছুক্ষণ মনে মনে কিছু একটা ভাবল। তারপর জিজ্ঞেস করল, “বুধবারে স্পেশাল ট্রেনী কে কে আসে”?

বীথিকা জবাব দিল, “ম্যাম, সেটা ফাইলে দেখতে হবে। ঠিক মনে পড়ছে না এখন”।

মহিমা নিজের সামনের ল্যাপটপের কী-প্যাডে খুটখাট করে একটা ফাইল বের করে দেখতে দেখতে বলল, “শোন বীথিকা। বুধবারে তো দেখতে পাচ্ছি তিনজনের এন্ট্রি আছে। মিঃ চৌরাশিয়া, মিসেস নটরাজন আর মিসেস বটব্যাল। তুমি ব্রেকফাস্ট করে তোমার কেবিনে গিয়ে দেখ যে এদের ভেতর কাউকে বৃহস্পতি বারে শিফট করা যায় কি না। যদি সম্ভব হয় তাহলে তাকে সেটা জানিয়ে দিয়ে মিসেস আগরওয়ালাকে বুধবার আর রবিবারের সিডিউলে ফেলে দাও। ওই দু’দিন তো বরুন, সুজয় আর রতীশ তিনজন থাকবে। তুমি এরপর থেকে একা মিসেস আগরওয়ালার জন্যে একজনকে এলট করে দিও। প্রয়োজন হলে অন্য দু’জনকে ডাবল ক্লায়েন্ট দিয়ে দিও। আপাততঃ এভাবে চালাও কিছুদিন। তারপর দেখা যাক। আর হ্যাঁ, আজ মিসেস আগরওয়ালার কেবিনে রতীশকে পাঠিও। আর তার আগে রতীশকে তোমার চেম্বারে নিয়ে গিয়ে মিসেস আগরওয়ালার ফাইলটা ওকে দেখিয়ে দিও। আর শুধু তাই নয়। যে সব ক্লায়েন্টের শারীরিক সমস্যা আছে, সময় করে তুমি তাদের সকলের ফাইলই রতীশকে দেখিও। রতীশ ফাইলগুলো ভাল করে স্টাডি করে বরুন আর সুজয়কে বুঝিয়ে দেবে কোন পেশেন্টের ক্ষেত্রে কি কি করা বারণ। বরুন সুজয়, তোমরাও শুনে রাখো। যেসব ব্যাপার তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে না, সে সব ব্যাপারে রতীশের পরামর্শ নেবে। আর রতীশ, তোমাকে কথাটা আমি আগেও বলেছি। আর আজও বলছি, বীথিকার কাছ থেকে ফাইলগুলো নিয়ে স্টাডি করে তুমি ওদেরকে বুঝিয়ে দিও কাকে কোনটা করানো উচিৎ, কোনটা করানো অনুচিত। আশা করি তুমি কিছু মাইণ্ড করবে না”।

রতীশ প্রায় সাথে সাথে বলল, “না না ম্যাম, এতে মনে করার কি আছে? আমি বীথিদির কাছ থেকে ফাইলগুলো নিয়ে পড়ে বরুন-দা আর সুজয়-দাকে সব বুঝিয়ে দেব”।

রতীশের কথা শুনে ঘরের সকলেই অবাক হয়ে তার মুখের দিকে চাইল। রতীশ সেটা দেখে একটু অবাক হল। মনে মনে ভাবল, সে বেফাঁস কিছু বলে ফেলেনি তো?
 

এমন সময় সুজয় ‘হা হা’ করে হেসে উঠল। সাথে সাথে বাকিরাও। রতীশ সকলকে এভাবে হাসতে দেখে কিছু না বুঝেও লজ্জা পেল। একসময় হাসি থামিয়ে সুজয় বলল, “রতীশদা, আপনার যা বয়স এবং যা কোয়ালিফিকেশন, তাতে আমরা কেউই আপনার দাদা দিদি হবার উপযুক্ত নই। আপনি প্লীজ আমাদের নাম ধরে তুমি করে বলবেন। আমরা কেউই এখনও পঁচিশ পেরোই নি। তাই আমরাই আপনাকে রতীশদা বলব”।

রতীশ এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মিষ্টি করে হেসে বলল, “ওঃ, আমি তো ভাবছিলাম আমি বুঝি বেফাঁস কিছু ....”

রতীশকে মাঝপথে বাধা দিয়ে বরুন বলল, “হ্যাঁ রতীশদা, সুজয় একদম ঠিক বলেছে। আপনি আমাদের নাম ধরেই ডাকবেন। তবে আপনি যেহেতু বয়সে বা যোগ্যতায় আমাদের সকলের চেয়েই ওপরে, আমরা আপনাকে রতীশদা বলেই ডাকব। তবে আমার মনে হয় আপনি আজ্ঞে করলে নিজেদের মধ্যে দুরত্বটা একটু বেশী মনে হবে। তারচেয়ে সবাই সবাইকে তুমি তুমি করে বললেই ভাল হবে। তাই না ম্যাম”?

মহিমাও মিষ্টি করে হেসে বলল, “সেটা তোমাদের ওপর ডিপেণ্ড করে। আমি আর কি বলব। তবে রতীশ, তুমি কিন্তু আমাকে একটু আগেও ম্যাম বলে ডাকলে ভাই। আমার কিন্তু তাতে ভাল লাগেনি। আর এমন কথাও কিন্তু ছিল না। হ্যাঁ বীথি, বরুন, সুজয়, তোমরা সবাই জেনে রাখো। রতীশ আর ওর স্ত্রী রচনার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে। ওরা আমার দেবর দেবরানী। তাই আমি রতীশকে বলেছি যে অফিসেও যেন ও আমাকে বৌদি বলেই ডাকে। তোমরা কেউ তাতে কিছু মনে কোর না প্লীজ”।
 

বরুন, সুজয় আর বীথিকা তিনজনেই একসাথে বলে উঠল যে তারা কেউ কিছু মনে করবে না। অমন সম্পর্ক যখন আছে, তখন অফিসের বস হলেও রতীশের ম্যামকে বৌদি বলেই ডাকা উচিৎ।

ব্রেকফাস্টের পর বীথিকা রতীশকে ডেকে তার কেবিনে নিয়ে গেল। রতীশকে উল্টোদিকের একটা চেয়ার দেখিয়ে বলল, “রতীশদা আপনি এখানে বসুন। আমি মিসেস আগরওয়ালার ফাইলটা আগে আপনাকে দিচ্ছি। আজই তো তাকে এটেণ্ড করতে হবে আপনাকে। অন্যদের ফাইলগুলো সময় সুযোগ মত আমার কাছ থেকে চেয়ে নেবেন”।

রতীশ চেয়ারে বসে বলল, “বেশ তা না হয় হল। কিন্তু খানিক আগেই বৌদির চেম্বারে যে বলা হল আপনি আজ্ঞে চলবে না, সেটা মানা হচ্ছে না কেন জানতে পারি”?
 

বীথিকা নিজের চেয়ারে বসে অদ্ভুত চোখে রতীশের মুখের দিকে চেয়ে বলল, “বাব্বা, তুমি তো খুব চালাক! কি সুন্দর ভাববাচ্যে কথাটা বললে? বাট আই লাইকড ইট। এই নাও মিসেস আগরওয়ালার ফাইল”।

রতীশ ফাইলটা হাতে নিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগল। হৃষ্টপুষ্ট এক মহিলার ছবি ফাইলের প্রথম পাতাতেই। দেখে মনে হয় এককালে বেশ সুন্দরীই ছিলেন ভদ্রমহিলা। কিন্তু মুটিয়ে যাবার ফলেই শরীরের লাবণ্য অনেকটাই হারিয়েছেন। বয়স তেতাল্লিশ। নাম মিসেস সবিতা আগরওয়ালা। স্বামীর নাম মিঃ বিমল আগরওয়ালা। রতীশের মনে পড়ল এ ইনস্টিটিউটে ইন্টারভিউএর দিন বিমল আগরওয়ালা তাকে বলেছিলেন যে তার স্ত্রীও এখানে যোগা করতে আসেন। মিসেস আগরওয়ালার শরীরে প্রচুর ফ্যাটস আছে। বডি ওয়েটও বেশ। পঁচানব্বই কেজি। শরীরের ফ্যাটস আর ওজন কম করার অভিপ্রায় নিয়েই তিনি এ ইনস্টিটিউটের ক্লায়েন্ট হয়েছেন। রতীশ মনে মনে ভেবে নিল এমন ধরণের মহিলাকে কোন কোন বিশেষ বিশেষ যোগাসন করান উচিৎ, তবে দু’বেলা প্রাণায়াম আর কপাল ভারতী চর্চা করা অবশ্য প্রয়োজনীয়।

______________________________

Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
(Update No. 120)

বীথিকা নিজের কাজ করতে করতে বার বার চোরা চোখে রতীশের দিকে দেখছিল। কিন্তু রতীশকে মগ্ন হয়ে ফাইলের লেখাগুলো পড়তে দেখে সে মনে মনে কিছুটা অবাকই হল। একবারও মুখ তুলে বীথিকার দিকে তাকাচ্ছেনা সে। বরুন সুজয় ওরা হলে এতক্ষণ কত খুনসুটিই না করত তার সাথে। রতীশের সুন্দর দেহসৌষ্ঠব দেখে বীথিকা মনে মনে ভাবছিল রতীশকে মহিমার ক্লায়েণ্টরা একবার দেখতে পেলেই তাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে। আর একবার যদি রতীশ তাদের পূর্ণ তৃপ্তি দিতে পারে তাহলে ম্যামের সমস্ত ফিমেল ক্লায়েণ্ট একে কাছে পেতে চাইবে বারবার। ম্যাম যে একে দিয়ে প্রচুর পয়সা কামাতে পারবেন এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু ম্যাম তো বললেন রতীশ তার দেবর। কেমন দেবর? রতীশ তো ',। মহিমা ম্যাম বা তার স্বামী তো ', নন। কতটা কাছের সম্পর্ক তাদের? ম্যাম কি সত্যিই তার দেবরকেও দেহব্যবসার কাজে নামাবেন? রতীশের স্ত্রী রচনাকেও কি ম্যাম তার ওই কাজে ব্যবহার করবেন? রচনাও তো দেখতে শুনতে যথেষ্ট সুন্দরী। ম্যামের আসল ব্যবসায় ফিমেল এসকর্ট হবার মত যোগ্যতাও তার যথেষ্টই আছে।
 

এমন সময়ে দু’জন বয়স্কা মহিলা বীথিকার কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই বীথিকা তাদের উদ্দেশ্যে বলল, “ওহ, আপনারা এসে গেছেন? ওয়েল, মিসেস দাস আপনি দু’নম্বর কেবিনে আর মিসেস দত্ত আপনি তিন নম্বর কেবিনে চলে যান প্লীজ”।
 

ভদ্রমহিলা দু’জন চলে যেতেই বীথিকা তার টেবিলের কলিং বেলে চাপ দিল। রতীশ মিসেস আগরওয়ালার ফাইলটা পড়ে এমন গভীরভাবে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছিল যে কলিং বেলের শব্দে সে একেবারে চমকে উঠল। বীথিকার সাথে চোখাচোখি হতেই সে হেসে ফেলল। কয়েক সেকেণ্ড বাদে অজয় কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই বীথিকা তাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অজয়দা, বরুন আর সুজয়কে দু’নম্বর আর তিন নম্বর কেবিনে যেতে বল, সেখানে ক্লায়েন্টরা এসে গেছে”।

অজয় চলে যেতেই রতীশ জিজ্ঞেস করল, “এখানে কেবিনে যারা যোগা ক্লাস করতে আসে তাদের বুঝি ক্লায়েণ্ট বলা হয়”?

বীথিকা একটু হেসে বলল, “ঠিক ধরেছ তুমি রতীশদা। ম্যামের নির্দেশেই এমন বলি আমরা। কেবিনে যারা ট্রিটমেন্ট নেন তারা ক্লায়েণ্ট আর জেনারেল সেশনে যারা ক্লাস এটেণ্ড করে তারা হচ্ছে এখানকার ট্রেইনী। আর কেবিনের সেশনটাকে ঠিক ক্লাস তো বলা যায় না। ক্লায়েণ্টরা কেউই যোগা শিখতে এখানে আসেন না। তারা সকলেই আসেন তাদের নিজস্ব কিছু সমস্যা সারিয়ে তুলতে। তাই কেবিন ক্লাস না বলে আমরা কেবিন সেশনই বলি। ওহ, রতীশদা তোমার আজকের ক্লায়েন্টও এসে গেছেন” বলে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসুন মিসেস আগরওয়ালা”।

রতীশও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একটু আগে সে যে ভদ্রমহিলার ফাইলটা পড়ছিল সেই সবিতা আগরওয়ালা। রতীশ ফাইলের ছবি দেখে ভদ্রমহিলাকে যতটা মোটা বলে ভেবেছিল ভদ্রমহিলাকে দেখে তেমন মোটা বলে মনে হচ্ছে না। অবশ্য ভদ্রমহিলার হাইট খুব ভাল বলেই বুঝি এমনটা মনে হচ্ছে। তিনি যদি আরেকটু খাটো হতেন তাহলে তাকে সত্যিই বেঢপ লাগত দেখতে। এখন তাকে দেখে মনে হল ভদ্রমহিলা সত্যিই বেশ সুন্দরী। দামী শাড়ি ব্লাউজ পড়ে এসেছেন। দেখেই বোঝা যায় যে বেশ পয়সাওয়ালা ঘরের রমণী। অবশ্য মহিলার স্বামী বিমল আগরওয়ালাকে রতীশ তো আগে থেকেই চেনে। পয়সা প্রতিপত্তির অভাব নেই তাদের।

মিসেস আগরওয়ালা বীথিকার কেবিনে ঢুকে রতীশের পাশের চেয়ারটায় বসতেই বীথিকা বলল, “মিসেস আগরওয়ালা আপনি বৃহস্পতি বার না এসে বুধবারে আসতে পারবেন”?

পাশের চেয়ারে ভদ্রমহিলা বসতেই সুন্দর পারফিউমের গন্ধে ঘরটা ভরে গেল। বীথিকার প্রশ্নের জবাবে ভদ্রমহিলা বললেন, “হ্যা তা হয়ত পারব। কিন্তু এর কারনটা জানতে পারি বীথি”?
 

বীথিকা বলল, “আসলে মিসেস আগরওয়ালা, আপনার কমপ্লেনটা নিয়েই ম্যামের সাথে আলোচনা করেছি। বৃহস্পতি বারে আমাদের এখানে শুধু দু’জন ট্রেনার থাকে। তাই আপনাকে একা ট্রিটমেন্ট দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছে না। আপনি যদি বুধবার আসতে পারেন তাহলে আপনাকে আমরা হয়ত সে সুযোগটা দিতে পারব। বুধবার আমাদের তিনজন ট্রেনার ইনস্টিটিউটে থাকে। তাই বলছি আর কি”।

ভদ্রমহিলা তবু জিজ্ঞেস করল, “নতুন আর কোন ট্রেনার এসেছে না কি”?

বীথিকা এবার একটু হেসে রতীশের দিকে ইশারা করে বলল, “হ্যা মিসেস আগরওয়ালা। ইনি আমাদের একজন নতুন ট্রেনার। মিঃ রতীশ ভট্টাচার্যি। বর্তমানে কোলকাতায় এনার মত কোয়ালিফায়েড যোগা ট্রেনার আর কেউ নেই। আমাদের সৌভাগ্য, তিন চার দিন আগেই উনি আমাদের এখানে কাজে যোগ দিয়েছেন। আজ ইনিই আপনাকে কোচিং দেবেন”।

মিসেস আগরওয়ালা রতীশের মুখোমুখি হয়ে তার একটা ভারী মাংসল হাত রতীশের দিকে এগিয়ে দিল। রতীশ সৌজন্যতা বজায় রাখতেই তার হাত নিজের হাতে নিয়ে হ্যাণ্ডশেক করল। সবিতা আগরওয়ালা রতীশের চেহারা ভাল করে দেখতে দেখতে মৃদু হাসলেন। তারপর বীথিকাকে বললেন, “বাহ, এ তো দারুণ খবর একটা। ঠিক আছে বীথি, আমি তাহলে বৃহস্পতিবার না এসে সামনের সপ্তাহ থেকে বুধবারেই আসব”।

বীথিকাও মিষ্টি করে হেসে বলল, “বেশ মিসেস আগরওয়ালা। আমি আপনার সিডিউলটা এখনই চেঞ্জ করে দিচ্ছি। আপনি বুধবার আর রবিবার আসবেন এখন থেকে। আর আজ আপনি এক নম্বর কেবিনে চলে যান। আপনার ড্রেস চেঞ্জ করে নিন। ইনি একটু বাদেই আপনার কেবিনে যাচ্ছেন”।
 

ভদ্রমহিলা আর কথা না বলে “থ্যাঙ্ক ইউ বীথি” বলে রতীশের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল, “আপনি পাঁচ মিনিট বাদেই কেবিনে আসুন” বলে বেরিয়ে গেল।
 

মিসেস আগরওয়ালা বেরিয়ে যেতেই রতীশ বীথিকাকে প্রশ্ন করল, “চেঞ্জ করে নেবেন মানে? উনি কি ট্রেনীদের ওই কস্টিউম পড়বেন না কি”?

বীথিকা হেসে বলল, “না রতীশদা ঠিক তা নয়। ট্রেনীদের কস্টিউম শুধু জেনারেল সেকশনের ট্রেনীদের জন্যই। তবে শাড়ি পড়া অবস্থায় তো কাউকে ঠিকমত যোগাসন করানো যায় না। তাই কেবিনে যারা আসেন তারা নিজেদের পছন্দমত সালোয়ার কামিজ বা চুড়িদার বা অন্য কোন ধরণের কোন পোশাক বা কস্টিউম সঙ্গে নিয়ে আসে। এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউটের কোন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। তারা যে যেটাতে সাচ্ছন্দ বোধ করে তেমন পোশাকই পড়ে”।

রতীশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ওকে বীথি। আমিও তাহলে যাচ্ছি”।

রতীশ পেছন ফিরতেই বীথিকা বলল, “বেস্ট অফ লাক রতীশদা”।

রতীশ বীথিকার কেবিন থেকে বেরোতে বেরোতেও একটু অবাক হয়ে একবার পেছন ফিরে বীথিকাকে দেখল। বীথিকার মুখে এক রহস্যময় হাসি দেখা গেল যেন। কেবিনে যাবার আগে রতীশ টয়লেটে গেল। তারপর এক নম্বর কেবিনে ঢুকেই সে চমকে উঠল। বিশাল বপুর অধিকারিনী মিসেস আগরওয়ালা একটা সুইমিং কস্টিউম পড়ে কেবিনের সরু বিছানায় বসে আছেন। উজ্জ্বল ফর্সা লম্বা আর যথেষ্ট স্বাস্থবতী সবিতা আগরওয়ালাকে সুইমিং কস্টিউমে একেবারে দুর্ধস্য লাগছিল। রতীশ তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে দরজার পর্দাটা নামিয়ে দিয়ে বলল, “মিসেস আগরওয়ালা, আমি এখানে নতুন। কিন্তু সঠিক ভাবে যোগা চিকিৎসা করতে আপনার বর্তমান শারীরিক সমস্যার কথা গুলো আমাকে জেনে নিতে হবে। আপনার ফাইলে আমি দেখেছি যে আপনি শরীরের ফ্যাটস আর ওজন কমাবার জন্যেই এ সেন্টারে এসেছেন। কিন্তু এখানে গত বছর দুয়েক যোগাচর্চা করে উন্নতি বা অবনতি কিছু হয়েছে কিনা সেটা আমার জানা দরকার। তাই এখন আপনার শরীরের কোথায় কী ধরণের সমস্যা আছে তা যদি আপনি আমাকে একটু বুঝিয়ে বলেন তাহলে আমি আপনার সঠিক যোগা চিকিৎসার ব্যাপারটা ভেবে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারব”।

মিসেস আগরওয়ালা রতীশকে দেখেই বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে বলল, “প্রায় দু’বছর ধরে এখানে আসছি। কিন্তু এখন অব্দি বিশেষ কোন পরিবর্তন আমি বুঝতে পারছিনা রতীশ। কিছুটা চেঞ্জ অবশ্যই হয়েছে। তবে যতখানি আশা করেছিলাম, ততখানি হয়নি। আমি যখন এখানে যোগা করতে শুরু করেছিলাম তখন আমার ওয়েট ছিল পঞ্চানব্বই কেজি। আজ দু’বছর বাদে আমার ওয়েট হয়েছে পচ্চাশি কেজি। আর গত ছ’ সাত মাসে মনে হচ্ছে কোন চেঞ্জই হয়নি আমার। এমনিতে আমার অন্য কোন বড় সমস্যা নেই। শুধু মোটা হয়ে গেছি বলেই ভাল লাগছে না। ডাক্তাররা বলেছে আমার শরীরে নাকি খুব ফ্যাটস জমে গেছে। তারাই আমাকে যোগাচর্চা করবার নির্দেশ দিয়েছিল। তাই এখানে জয়েন করেছি। বন্ধু বান্ধবেরা সকলেই বলে বেশী মোটা হয়ে গেছি বলেই নাকি আমাকে আর আগের মত সুন্দরী লাগছে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমারও তাই মনে হয়। বরুন সুজয় কবিতাদের নির্দেশ মত সব কিছু করেও তো দু’বছরে যতোখানি স্লিম হতে চেয়েছিলাম তার অনেকটাই হয়নি। তুমি প্লীজ আমাকে হেল্প কর রতীশ। তোমাকে দেখে আমার মনে হচ্ছে আজ আমি আসল লোক খুঁজে পেয়েছি। এবার আমার সমস্যার সমাধান হবেই”।

রতীশ কোণার চেয়ারে বসে বলল, “মিসেস আগরওয়ালা। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব আপনার সমস্যা দুর করতে। কিন্তু আসল কথা কি জানেন মিসেস আগরওয়ালা। শুধু যোগাচর্চা করলেই যে আপনার সমস্যা সেরে যাবে, সেটা ঠিক নয়। আপনার দৈনন্দিন জীবনের কিছু কিছু ব্যাপারও শরীরের চর্বি কম করার ব্যাপারে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। আপনি যদি যোগাচর্চার সাথে সাথে আমার কয়েকটা নির্দেশ মেনে চলেন তাহলে আপনি নিশ্চিত ফল পাবেন। যোগাচর্চার দিকটা তো আমরাই দেখব। কিন্তু অন্য ব্যাপারগুলো কিন্তু আপনাকেই কন্ট্রোল করতে হবে। আর এ কন্ট্রোলটা করতে হবে খাওয়া দাওয়া, ঘুম, বিছানা, শোবার পদ্ধতি এ’সব ব্যাপারে। এ ব্যাপারগুলো তো আর আমরা দেখতে বা শোধরাতে পারব না। এটা আপনার নিজেকেই দেখতে হবে। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আপনার ইচ্ছাশক্তি
নিজের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে গেলে আপনাকেই সবচেয়ে বেশী সচেষ্ট হতে হবে। আমি আপনাকে কিছু কিছু নির্দেশ দিয়ে যাব। আপনি যদি সেগুলো মেনে চলেন তাহলে সেন্টারে এসে যেটুকু যোগাচর্চা করবেন, আপনি তাতেই ফল পাবেন। তবে কত তাড়াতাড়ি সে ফল পাবেন সেটা কিন্তু আপনার ওপরেই নির্ভর করবে। এবার আসুন, আমি আপনাকে যোগার ব্যাপারগুলো আগে বুঝিয়ে দিই। প্রথমে আপনাকে দশ মিনিট প্রাণায়াম করতে হবে। আমি যেভাবে দেখাচ্ছি, আপনিও সেভাবে চেষ্টা করুন। একেবারেই কঠিন কিছু নয়। এভাবে করুন” বলে মেঝের কার্পেটের ওপর বসে প্রাণায়াম শুরু করল।

মিসেস আগরওয়ালাও রতীশের নির্দেশ মত প্রাণায়াম করতে শুরু করল। দশ মিনিট পর রতীশ কপাল ভারতী শুরু করল। কিন্তু মিসেস আগরওয়ালা কিছুতেই ঠিকঠাক মত সেটা করতে পারছিলেন না। রতীশ তাকে নানা ভাবে বুঝিয়েও পারছিল না। একসময় রতীশ নিজের ঊর্ধাঙ্গের পোশাকটা ওপরে টেনে তুলে নিজের পেট উন্মুক্ত করে বলল, “একটা জিনিস লক্ষ্য করুন মিসেস আগরওয়ালা। আমি যখন নাক দিয়ে ভেতর থেকে হাওয়া বের করব, তখন আমার পেটের মাঝখানের মাংসপেশীগুলো ভেতরের দিকে ঢুকে যাবে। আপনাকেও ঠিক তেমনটাই করবার চেষ্টা করতে হবে। তবে এখনই যে আপনি পুরোপুরি সঠিক ভাবে করতে পারবেন তা হয়ত হবে না। তবে চেষ্টাটা করতে হবে। করতে করতে ধীরে ধীরে ব্যাপারটা রপ্ত হবে। আর হাত দুটো কোমড়ের দু’পাশে রাখবেন, এভাবে” বলে আবার কয়েকবার করে দেখাল।

মিসেস আগরওয়ালাও রতীশের কথামত একবার চেষ্টা করেই বললেন, “তুমি একটু হাত দিয়ে দেখিয়ে দাও না ঠিক কোথায় কিভাবে কী করতে হয়। আমি ঠিক বুঝতে পাচ্ছি না জিনিসটা। আর বরুন সুজয় ওরাও কোনদিন এভাবে করতে বলেনি”।

রতীশ মিসেস আগরওয়ালার হাতদুটো ধরে তার কোমড়ের দু’পাশে বসিয়ে দিয়ে বলল, “হাতদুটো এই দুদিকে এভাবে চেপে ধরবেন” বলে তার হাতের ওপর চাপ দিতেই তুলতুলে মাংসপিণ্ডের ভেতর মিসেস আগরওয়ালার হাত দুটো ডেবে গেল। রতীশ এবার নিজের পেটের মাঝখানটায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “যখন নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়বেন তখন পেটের এই জায়গাটাকে ভেতরের দিকে টেনে নেবার চেষ্টা করবেন। আর একই সাথে কোমরে হাত দিয়ে চাপ দেবেন দু’দিক থেকে, এভাবে” বলে নিজে আরেকবার করে দেখাল।

কিন্তু দশ মিনিটের প্রচেষ্টাতেও মিসেস আগরওয়ালা একবারও সঠিক ভাবে করতে পারল না ব্যাপারটা। তখন রতীশ যোগাসন দেখাতে শুরু করল। ছ’ সাতটা আসন করাতে করাতে মিসেস আগরওয়ালার অনুরোধেই সে বেশ কয়েকবার তার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিতে বা চেপে ধরতে সাহায্য করেছে।

সাড়ে দশটায় সেশন শেষ করলে মিসেস আগরওয়ালা মিষ্টি করে হেসে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে রতীশের দিকে চেয়ে বলল, “দু’বছর ধরে আমি এ সেন্টারে আসছি। এতদিন মনেও হয়নি যে আমি যোগা করছি। আজ এই প্রথমবার মনে হচ্ছে এবার আমি সঠিক ট্রেনার পেয়েছি”।
 

রতীশ একটু হেসে বলল, “শুধু ট্রেনার দিয়ে কাজ হয়না মিসেস আগরওয়ালা। ট্রেনারের শিক্ষাটা ভালো করে কাজে লাগাতে পারলে তবেই ফল পাবেন। আপনি তো এখানে আসবেন সপ্তাহে মোটে দু’দিন। কিন্তু সপ্তাহের বাকি দিন গুলোতেও আপনাকে বাড়ীতে বসেই রোজ দুবেলা চর্চা করে যেতে হবে। ঠিক যেভাবে আমি আপনাকে দেখিয়ে দেব সেভাবে। আর বাইরের জাঙ্ক ফুড আর বিরিয়ানী খাওয়া একেবারে বন্ধ করতে হবে। আর যা যা করতে হবে সে’গুলো আমি আপনাকে বুধবারে একটা কাগজে লিখে দেব হিন্দিতে। সেগুলো মেনে চললে আগামী চারমাসের ভেতরেই আপনি অনেক পরিবর্তন দেখতে পাবেন। এ’কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি”।

মিসেস আগরওয়ালা বেশ খুশী মনে বলল, “আমার মন বলছে, তোমার ট্রেনিংএ আমি খুব তাড়াতাড়িই আবার স্লিম হয়ে উঠতে পারব। কিন্তু রতীশ, এখানে তো সপ্তাহে দু’দিনের বেশী আসতে পারি না। তুমি আলাদাভাবে আমাকে অন্য কোথাও স্পেশাল ট্রেনিং দিতে পারবে না? না মানে। এজন্যে তুমি যত টাকা চাইবে, যা চাইবে, তোমাকে আমি সে’সব দেব। তুমি যেখানে যেতে বলবে আমি সেখানেই যাবো। তুমি অন্ততঃ সপ্তাহে আরও দু’দিন আমাকে এক্সট্রা কোচিং কর প্লীজ”।
 

রতীশ মিষ্টি হেসে জবাব দিল, “সেটা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না মিসেস আগরওয়ালা। আমি এই সেন্টারের বাইরে কোথাও গিয়ে কোনও ট্রেনিং বা কোচিং দিই না। তবে কয়েক মাস পর আমি নিজেও একটা যোগা সেন্টার খুলতে চলেছি। আপনি চাইলে সেখানেও সপ্তাহে দু’দিন কোচিং নিতে পারবেন”।
 

কেবিন কোচিং শেষ করে রতীশ নিজের কস্টিউম বদলে প্রথমে বীথিকার কেবিনে গিয়ে দেখে দু’ চেয়ারে সুজয় আর বরুন বসে বীথিকার সাথে গল্প করছে। রতীশ আর সেখানে না ঢুকে মহিমার চেম্বারের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করে জিজ্ঞেস করল, “বৌদি, ভেতরে আসব”?
 

ভেতর থেকে মহিমা জবাব দিল “হ্যা ভাই এসো”।

রতীশ ভেতরে ঢুকতেই মহিমা মিষ্টি করে হেসে রতীশকে বলল, “বোসো ভাই। তারপর বল তো শুনি। চারদিন তো এখানে কাজ করলে। কেমন লাগছে? কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো”?
 

রতীশ চেয়ারে বসতে বসতে জবাব দিল, “না বৌদি কোন অসুবিধেয় পড়িনি এখনও। তবে বৌদি একটা কথা বলার ছিল। না না আপনি এমন ভাববেন না যে আমি কোন কমপ্লেন করছি আপনার কাছে”।

মহিমা নিজের হাতের কাজ থামিয়ে রতীশের মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল, “আহা, তুমি এমন করে বলছ কেন ভাই। বলনা কী বলতে চাও? ডিড ইয়ু ফেস এনি প্রব্লেম”?

রতীশ একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “না বৌদি আমার কোন অসুবিধের কথা নয়। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার নজরে এল। আর সেটা এ ইনস্টিটিউটের পক্ষেই ক্ষতিকারক হবে বলে মনে হচ্ছে আমার। সে’কথাই বলতে চাইছি। কিন্তু ভাবছি, এতে করে আমি অনধিকার চর্চা করে ফেলব না তো”?

মহিমা একটু সতর্ক হয়ে বলল, “না রতীশ। কোন অনধিকার চর্চা হবে না। আমার বিশ্বাস আমার ইনস্টিটিউটের ভালর জন্যেই তুমি কিছু বলতে চাইছ। খুলে বল তো ব্যাপারটা কি? কেবিন কোচিংএ কোন সমস্যা হয়েছে”?

রতীশ তবু একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আসলে বৌদি, আজ কেবিনে আমি মিসেস আগরওয়ালাকে কোচিং দিলাম। মানে বিমল আগরওয়ালার স্ত্রীকে। তার শারীরিক সমস্যাটার কথাও জানলাম। উনি বলছিলেন যে উনি প্রায় দু’বছর যাবত এখানে আসছেন। কিছুটা উপকারও পেয়েছে। কিন্তু তার সমস্যার খুব বেশী রকম পরিবর্তন হয়নি এখনও। তার সাথে কথা বলে আমার মনে হল তার সমস্যাটা দুর করতে তাকে যে সব আসন আর প্রাণায়াম করানো উচিত ছিল, এখানে সে সব করানোই হয়নি। আর তাছাড়া বৌদি, মিসেস আগরওয়ালার যেটা মূল সমস্যা এমন সমস্যা তো পয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে যাবার পর যে কোন মহিলার ক্ষেত্রেই হতে পারে। আর তার মত আরও হয়ত কিছু পেশেন্ট আমাদের এ সেন্টারে আছে। আমার মনে হচ্ছে, এমন সমস্যা যাদের আছে, তাদের কারুর ক্ষেত্রেই সঠিক এক্সারসাইজ প্রেসক্রিপশন করা হয়নি। তাই তারা আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না। আমার মনে হয় এদিকটা আপনার একটু ভাবা উচিৎ”।
 

রতীশ থামতে মহিমা চট করেই কিছু বলল না। বেশ কিছুক্ষন চুপ করে মনে মনে কিছু একটা ভেবে সে “এক মিনিট’ বলে কলিং বেলে চাপ দিল। অজয় চেম্বারে এসে ঢুকতেই মহিমা তাকে বলল, “বরুন আর সুজয় বোধহয় বীথির কেবিনে আছে। ওদের দু’জনকে আমার এখানে আসতে বল”।

অজয় বেরিয়ে যেতেই মহিমা রতীশকে বলল, “আমার মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে তুমি আমাকে কিছু সাজেস্ট করতে চাইছ। তাই না ভাই”?

রতীশ নিজের দু’হাত কচলে আমতা আমতা করে বলল, “হ্যা বৌদি, আপনি ঠিকই অনুমান করেছেন। কিন্তু আমি সবে এখানে জয়েন করেছি। অন্য সকলেই এখানকার পুরোন স্টাফ। আমার সিনিয়র তারা। তাদেরকে তো আমি কিছু নির্দেশ দিতে পারি না। আর যেহেতু এটা ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িত, তাই ভাবলাম, যদি আপনি এটাকে আমার ধৃষ্টতা বলে মনে না করেন, তাহলে কথাগুলো আপনাকেই বলা ভাল। তাই বলছিলাম আর কি। কিন্তু আপনি তো ওদেরকে ডেকে পাঠা....”

রতীশকে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে মহিমা মিষ্টি করে হেসে বলল, “দেখ ভাই, মিসেস আগরওয়ালা বা তার মত একই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আরও যারা এখানে আসেন, তাদের চিকিৎসার যদি কোন ত্রুটি হয়ে থাকে, তাহলে সে ত্রুটিটা হয়েছে বরুন সুজয় আর কবিতার। কবিতা তো এখন নেইই। কিন্তু বরুন আর সুজয়রা কী ভুল করছে এটা ওদের বোঝা উচিৎ। ব্যাপারটা আমার নলেজে আজই এল। তাই আমি চাই তুমি এ ভুল শোধরাবার জন্য যে উপায় বলবে সেটা আমাদের মেনে নেওয়াই উচিৎ। আর সেটা আমার চেয়ে বেশী দরকার বরুন আর সুজয়ের। কারন প্র্যাকটিকালি ওরাই পেশেন্টদের কোচিং দেয়। তাই আমি চাই ওরাও তোমার পরামর্শগুলো শুনুক আর শিখুক। যাতে ভবিষ্যতে আর এমন ভুল ওরা না করে। সেজন্যেই ওদের ডেকেছি। আর আমি তো তোমাকে এবং ওদের দু’জনকেও বলেছি যে তোমার মতো এক্সপার্ট ওরা কেউই নয়। তুমি যোগার সমস্ত ব্যাপারে ওদের গাইড করবে। আজই যে তুমি এ ব্যাপারে আমার সাথে আলোচনা করতে এসেছ, এতে আমি খুব খুশী হয়েছি। কিন্তু আমি চাই, বরুন সুজয়কেও তুমি নিজেই বলে বুঝিয়ে দাও”।

মহিমার কথা শেষ হতেই কেউ দরজায় নক করল। মহিমা ভেতরে আসবার অনুমতি দিতেই বরুন সুজয়ের সাথে বীথিকাও চেম্বারের ভেতর ঢুকল। মহিমার সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উল্টোদিকে পাঁচখানা চেয়ার সব সময়ই রাখা থাকে। মহিমা সবাইকে বসতে বলে বলল, “বরুন সুজয়, তোমাদের আমি প্রথম দিনই বলেছি যে রতীশের মত এক্সপার্ট যোগা টিচার এ কোলকাতায় বর্তমানে আর কেউ নেই। তাই তোমাদের দু’জনকেই আমি বলেছি যে যোগা ট্রেনিং আর কোচিংএর ব্যাপারে সব সময় ওর পরামর্শ মেনে চলবে। আজ ও মিসেস আগরওয়ালাকে কোচিং দিয়ে বুঝেছে যে এতদিন ধরে আমরা যেভাবে তাকে গাইড করেছি তাতে তার খুব একটা উপকার হয়নি। এ ব্যাপারে রতীশ তোমাদের কিছু বলবে। তোমরা মন দিয়ে কথাগুলো শোন”।

রতীশ বলল, “বরুন সুজয়। সবার প্রথমেই তোমাদের দু’জনের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি ভাই। তোমরা ভেবো না যে আমি তোমাদের কাজের ভুল ধরবার জন্য এ’সব বলছি। যারা আমাদের এখানে শারীরিক সমস্যা দুর করতে আসেন, তারা যদি এখানে এসে সুফল পান তাহলেই বাজারে আমাদের সুনাম হবে। আমি শুধু চাইছি যে আমাদের এই ইনস্টিটিউটের যেন কোন বদনাম না হয়”।

তারপর প্রায় আধঘণ্টা ধরে রতীশ একনাগারে সবাইকে বুঝিয়ে গেল। তার বলা শেষ হলে বরুন আর সুজয় দু’জনেই এককথায় রতীশের পরামর্শ মেনে নিল। মহিমা তাদের সকলকে চেম্বার থেকে বিদেয় করে রতীশের কাছে এসে তার হাতদুটো ধরে মিষ্টি গলায় বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাই। বরুন আর সুজয়কে যেভাবে যুক্তি দিয়ে সবটা বুঝিয়ে বললে, এত সুন্দরভাবে বুঝি আমিও ওদের বোঝাতে পারতাম না। কিন্তু তোমাকে আমি আজ কয়েকটা কথা বলব বলে ভেবেছিলাম, সেটা হল না। আজ তো তোমার অনেক দেরী হয়ে গেল। তোমার দেরী হচ্ছে দেখে রচনা নিশ্চয়ই দুশ্চিন্তা করবে। তাই আজ তুমি বরং বেরিয়ে পড়ো। আর বরুন সুজয়কে কিছু বোঝাবার হলে বা পরামর্শ দেবার হলে ব্রেকফাস্টের সময় সেটা করবে। নইলে রোজ রোজ এভাবে তোমার দেরী হয়ে গেলে আমি নিজেই রচনার কাছে অপরাধী হয়ে যাব ভাই”।


______________________________
ss_sexy
Like Reply
(Update No. 121)

রতীশ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মহিমা নিজের চেয়ারের দিকে যেতে যেতে বলল, “এক মিনিট দাঁড়াও ভাই” বলে নিজের টেবিলের ড্রয়ার খুলে তার ভেতর থেকে একটা টিফিন কৌটো আর একটা কাগজের প্যাকেট বের করে রতীশের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এ দুটো নিয়ে যাও। রচনাকে দিও। ওকে বোলো টিফিন কেরিয়ারের ভেতর যেটা আছে সেটা আমি কাল রাতে নিজে হাতে বানিয়েছি। একটা পাঞ্জাবী খাবার। আমরা এটাকে রাজমা চাওল বলি। অনেকদিন বাদে আমি কিচেনে কিছু রান্না করেছি। শুধু রচনার জন্য। আর এই প্যাকেটে দোকান থেকে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে এনেছি। রচনাকে বোলো রাজমা চাওলটা যেন একটু গরম করে নেয়। তোমরা দু’জনে মিলে খেলে আমার ভাল লাগবে”।

রতীশ কিছু একটা বলতে যেতেই মহিমা তাকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “উহু, কোন কথা নয়। চুপচাপ নিয়ে যাও। আর নিয়ে সোজা রচনার হাতে জিনিসগুলো দেবে বুঝেছ”?

রতীশ আর কথা না বলে মহিমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল।
 

*******************

মহিমা বাড়ি থেকে ইনস্টিটিউটে রওনা হবার আগে নিজের ঘরের তার ব্যক্তিগত লকার থেকে আশি হাজার টাকা নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। আজ নতুন মাসের শুরু। ইনস্টিটিউটের সবাইকে তাদের বেতন দিতে হবে। ইনস্টিটিউটে যাবার পথে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে মহিমা ভাবল রতীশ তার ওখানে কাজে যোগ দিয়েছে গত মাসের মাঝামাঝি। খুব সম্ভবতঃ আঠারো তারিখে। সে হিসেবে ওকে এবার চৌদ্দ দিনের বেতন দেওয়া উচিৎ। কিন্তু মহিমা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রতীশকে সে পুরো একমাসের বেতনই দিয়ে দেবে। পয়সার অভাব একসময় থাকলেও এখন তার হাতে প্রচুর পয়সা আসছে। তার বাইরের ব্যবসাই তাকে প্রচুর পয়সা এনে দিচ্ছে। তাই রতীশকে তার প্রাপ্যের চেয়ে কিছু বেশী দিতেও তার অসুবিধে হবে না। তাছাড়া রতীশ কাজে যোগ দেবার পর তার ইনস্টিটিউটের ট্রেনী সংখ্যাও লক্ষণীয় ভাবে বেড়েছে। অন্যান্য বছর এ সময়ে ইনস্টিটিউটে নতুন কোন ট্রেনী ভর্তিই হত না। কিন্তু রতীশ কাজে যোগ দেবার সপ্তাহ খানেক পর থেকেই রোজ পাঁচ ছ’জন নতুন ট্রেনী অ্যাডমিশন নিচ্ছে। এমন ট্রেণ্ড চলতে থাকলে খুব অল্পদিনের ভেতরেই নতুন অ্যাডমিশন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আর উপায় থাকবে না। কারন তার তিনটে সেকসনে দেড়শ’র বেশী ট্রেনীর স্থান সংকুলান হবে না। গত দশ দিনে মোট আটচল্লিশ জন নতুন ট্রেনী অ্যাডমিশন নিয়েছে। বছরের এমন ডাল সীজনেও যে রোজ নতুন ট্রেনী ভর্তি নিচ্ছে, এটা যে শুধু রতীশের জন্যেই হচ্ছে সে ব্যাপারে তার সাথে বীথিও একমত। ট্রেণীদের সাথে মহিমার সরাসরি বার্তালাপ খুব কমই হয়। তবে বীথিকাই তাকে বলেছে যে সব ট্রেনীই তাদের রতীশ স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আর লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে ইনস্টিটিউটের পুরনো ট্রেনারদের মধ্যেও। বরুন সুজয় এরা তার বাইরের কাজে যতটা এন্থুসিয়েস্টিক যোগা ট্রেনিংএর ব্যাপারে ততটা চনমনে ছিল না কখনও। ইনস্টিটিউটের কাজে তাদের কেমন যেন একটা গা-ছাড়া গা-ছাড়া ভাব চোখে পড়ত। কিন্তু রতীশ আসবার পর তাদের হাবভাবেও লক্ষণীয় পরিবর্তন হয়েছে। এখন বরুন সুজয় ওরা অনেক বেশী স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে উঠেছে। রতীশ কাজে যোগ দেবার সময় ইনস্টিটিউটের ট্রেনী সংখ্যা ছিল একানব্বই। গতকাল অব্দি ট্রেনী সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে একশ’ ঊণচল্লিশ। আর স্টুডেন্টরাও আগের চেয়ে অনেক বেশী চনমনে আর মনযোগী হয়ে উঠেছে। আগে সবগুলো সেকশনেই শোরগোলটাই যেন বেশী হত। কিন্তু এখন সবক’টা সেকশনই খুব শান্ত থাকে। আর সব সেকসনের ট্রেনীরাই শুধু রতীশ স্যারের ক্লাস চায়। কিন্তু মহিমার নির্দেশেই রতীশ আর বরুন সুজয়রা রোজ আলাদা আলাদা সেকসনে ক্লাস নেয়। কেবিন সেশনের ক্ষেত্রেও মহিমা এমন নিয়মই চালু করেছে। যাতে সব কেবিন ক্লায়েণ্ট এবং সব সেকসনের ট্রেনীরা সমানভাবে রতীশের কাছে শিক্ষা নিতে পারে।

নিজের কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে মহিমা অজয়কে বলল, “বীথি এসেছে অজয়? ও এসে থাকলে আমার এখানে আসতে বল তো ওকে”।

নিজের চেয়ারে বসবার আগে আলমারি থেকে ল্যাপটপ আর ড্রয়ারের চাবিগুলো বের করে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। টেবিলের দু’পাশের ড্রয়ারগুলো চাবি দিয়ে খুলে নিজের ব্যাগে ভরে আনা টাকাগুলো টেবিলের ড্রয়ারে রেখে ব্যাগের ভেতর থেকে এক্সটারনাল হার্ড ডিস্কটা ল্যাপটপে কানেক্ট করে ল্যাপটপ চালাতেই বীথিকা বাইরে থেকে নক করে ভেতরে ঢোকবার অনুমতি চাইতেই বলল, “হ্যাঁ বীথি এসো”।

বীথিকা ভেতরে ঢুকে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “গুড মর্নিং ম্যাম”।

মহিমা জবাবে বলল, “হ্যাঁ বীথি, গুড মর্নিং। জেনারেল সেশন চলছে”?

বীথিকা বলল, “হ্যাঁ ম্যাম। তিন সেকশনই পুরোদমে চলছে। কিন্তু ম্যাম, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন। আগে সবগুলো সেকসনে তুমুল হৈ হট্টগোল হত। কিন্তু ইদানীং সব কতোটা শান্ত লাগে”?

মহিমা একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ বীথি সেটা আমিও লক্ষ্য করেছি। আসলে ভালো টিচারের ক্লাসে হৈ হট্টগোল কমই হয়। রতীশ আসবার পর ট্রেনীরাও বুঝে গেছে আসল যোগা টিচার কাকে বলে”।

বীথিকা আবার বলল, “কিন্তু ম্যাম শুধু রতীশদার সেকসনই নয়। বরুন সুজয় ওদের সেকসনেও এখন আগের মত অত শোরগোল হয় না”।

মহিমা আবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “সেটাও রতীশের জন্যই হয়েছে। তুমি খেয়াল করেছ? যেদিন থেকে রতীশ বরুন আর সুজয়কে গাইড করতে শুরু করেছে সেদিন থেকে ওদের ভেতরেও একটা অন্যরকম ভাব দেখা যাচ্ছে। আগের মত সেই উড়ু উড়ু ভাবটা নেই। ওরা দু’জনেও অনেক বেশী সিরিয়াস হয়ে উঠেছে। আর এটা হয়েছে একমাত্র রতীশের কাজ আর মিষ্টি ব্যবহারে। সত্যি ছেলেটাকে আমি যত দেখছি তত মুগ্ধ হচ্ছি। আর তুমি তো ওর বৌকেও দেখেছ। যেমন দেবা তেমন দেবী, তাই না? ও যে কত ভাল একটা মেয়ে সেটা আমি তোমায় বলে বোঝাতে পারব না। আমি একদিন হঠাৎ ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়েছিলাম রতীশকেই কিছু বলব বলে। কিন্তু ওর বৌ রচনাকে দেখে আমি যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। নিজের কথা কিছু না বলেই পেট পুরে ওদের সাথে খেয়ে চলে এসেছিলাম। কী সুন্দর রান্না ওর হাতের বীথি। ওঃ কি একটা ডাল বানিয়েছিল যেন। ওঃ হ্যাঁ মনে পড়েছে, চালতা দিয়ে মটরের ডাল। আঃ কী অপূর্ব তার স্বাদ। সে তুমি না খেলে বুঝবে না। রচনাকে দেখার পর থেকেই আমিও যেন কেমন হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে প্রথম আমি গলায় কাপড় দিয়ে শরীর ঢেকে ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণকে প্রণাম করেছি। উঃ, আমি ভাবতেই পাচ্ছি না। সে’কথাগুলো মনে পড়লে এখনও আমার গা শিড়িশিড় করে ওঠে”।

বীথিকা অবাক হয়ে মহিমাকে দেখে যাচ্ছিল। তার ম্যামের মুখে চোখে এ মূহুর্তে যেমন ভাবের প্রকাশ সে দেখতে পাচ্ছে এমনটা আগে কখনও দেখেনি। প্রায় ছ’বছর ধরে বীথিকা মহিমার সাথে এখানে কাজ করছে। ম্যামের ইনস্টিটিউট আর বাইরের এসকর্ট সার্ভিসের ব্যবসার সে অনেক কিছুই জানে। সে নিজেও ম্যামের এসকর্ট ব্যবসার একজন ফিমেল এসকর্ট। বরুন সুজয় ওরাও ম্যামের সে কাজের সাথে যুক্ত আছে। কিন্তু ম্যামের ব্যবসার ভেতরের কথা বীথিকা যতখানি জানে, ততখানি আর কেউ জানে না। তবে অনৈতিক কাজে লিপ্ত থাকলেও মহিমা যে কারো ওপর কোন জুলুম করে না এটা বীথিকা খুব ভাল ভাবেই জানে। কিন্তু রতীশ এ ইনস্টিটিউটে জয়েন করবার পর ট্রেনীদের আচার আচরণে, বরুন সুজয়দের ভাবসাবে যে পরিবর্তন হয়েছে, বীথিকার মনে হচ্ছে সে পরিবর্তনের কিছুটা ছোঁয়া যেন তার ম্যামের ওপরেও পড়েছে। তার ম্যামও যেন এক মাস আগের ম্যাম নেই। যদিও ম্যাম বলেছে যে রতীশ তার দেবর। কিন্তু বীথিকা জানে ম্যামের স্বামী অরিন্দম সেনের কোন ভাই নেই। তাই এ সম্পর্কটা যে শুধুই একটা পাতানো সম্পর্ক, সেটা বুঝতে তার দেরী হয়নি। তার ম্যামও যে নিজেও নামী দামী ক্লায়েন্টদের মাঝে মাঝে এসকর্ট সার্ভিস দিয়ে থাকে সে’কথাও বীথিকার অজানা নয়। যে কোন পুরুষকে পরিপূর্ণ যৌনসুখ দিতে তার ম্যাম সক্ষম। রতীশের মত এমন হ্যাণ্ডসাম একটা ছেলেকে ম্যাম নিজের এসকর্ট ব্যবসায় তো নামাচ্ছেনই না। এমনকি সে নিজেও যে রতীশকে ভোগ করেছেন বা তেমন কোনও অভিসন্ধিও যে নিজের মনে পুষে রেখেছেন, সেটাও মনে হয় না বীথিকার। কিন্তু সুন্দর হ্যাণ্ডসাম সুপুরুষদের ওপর তার ম্যামেরও যে লোভ আছে, তার ম্যামও যে পছন্দসই অনেক পরপুরুষের সাথেই সেক্স করে থাকেন, এসব কথাও বীথিকার অজানা নয়। কিন্তু রতীশের প্রতি তার মনোভাব যেন একেবারেই আলাদা। রতীশকে সে দেবর বলে ভাবে। ভাই বলে ডাকে সব সময়। এ’সবের পেছনে ম্যামের কি অন্য কোনও উদ্দেশ্য আছে? সহজ সরল রতীশকে সহজেই যৌনতার দিকে আনা যাবেনা ভেবেই কি মহিমা অন্য কোনও প্ল্যান করছেন?

এসব ভাবতে ভাবতে বীথিকা বলল, “ম্যাম, রতীশদার স্ত্রীকে তো আমি দেখেছি। সত্যি খুব সুন্দরী। কিন্তু রতীশদা লোকটা সত্যিই বড় অদ্ভুত। এমন সহজ সরল ছেলেও যে আজকের যুগে আছে, এটা তাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। এ’ কটাদিনে আমি অন্ততঃ এটুকু বুঝেছি যে মেয়ে মহিলার ওপর রতীশদার একেবারেই লোভ নেই। আমার কেবিনে সে তো মাঝে মধ্যেই যায়। আমার আগ্রহেই সে আমাকে তুমি তুমি বলে ডাকে। কিন্তু সে আমার মুখ বাদে শরীরের অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের দিকে একেবারেই তাকায় না। কিন্তু বরুন সুজয় ওরা একটু সুযোগ পেলেই আমার গায়ে হাত দেয়। কিন্তু ম্যাম, আজ তো মাসের এক তারিখ। সবাইকে তো বেতন দিতে হবে। আমি তো সে জন্যেই আজ তাড়াতাড়ি এসেছি। কিন্তু রতীশদাকে নিয়ে আমরা যেমন গল্পে মেতে উঠলাম তাতে তো বেতন দেবার কাজে দেরী হয়ে যাবে। তাই আমার মনে হয়..”

বীথিকাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিয়েই মহিমা বলে উঠল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ইশ দেখেছ। এই ছেলেটা আমাকেও পাগল করে তুলেছে যেন। যাও যাও তুমি বরং ওদের বেতন দেবার ব্যাপারটাই দেখ এখন। আর এ জন্যেই আমি তোমাকে ডেকেছিলাম। কিন্তু কথায় কথায় আসল কথাটা ভুলেই গিয়েছি। শোনো বীথি, রতীশ তো আঠারো তারিখে জয়েন করেছে, তাই নিয়ম হিসেবে ওর চৌদ্দ দিনের বেতন পাবার কথা। কিন্তু তুমি ওর বেতনটা প্রোরাটা হিসেব কোরো না। ওকে আমি এ মাসে পুরো ছাব্বিশ হাজার টাকাই দেব, তুমি সেভাবেই সব কিছু বানিও। আর সকলের সেলারী বানানো হয়ে গেলে ফাইলটা নিয়ে আমার এখানে এসো”।

বীথিকা একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “রতীশদাকে পুরো মাসের বেতন দেবেন? প্রোরাটা হিসেবে বানাতে বারণ করছেন? ঠিক আছে ম্যাম। আপনি যা বলছেন, তাই না হয় করব। কিন্তু ম্যাম, কিছু যদি মনে করেন তাহলে একটা কথা বলব”?
 

মহিমা বলল, “হ্যাঁ, বলো না কি বলবে? তুমি তো আমার ডান হাত। তোমার এমন অনেক কিছু বলার বা জানার অধিকার আছে, যা আর কারো নেই”।

বীথিকা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “ম্যাম, বলছিলাম কি, রতীশদাকে তো এমনিতেই বরুন বা সুজয়ের থেকে বেশী সেলারী দেওয়া হচ্ছে। এটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্যেরা জানলে তো তাদের মনেও প্রশ্ন উঠতে পারে”।

মহিমা হেসে বলল, “এটা তো সরকারি কোন অফিস নয় বীথি। কাকে কত বেতন দেব সেটা আমার নিজের ওপর নির্ভর করে। তবে কারো মনে প্রশ্ন এলে তারা সে প্রশ্ন আমাকে করতেই পারে। তাদের প্রশ্নের জবাব আমি দেব। কিন্তু তুমি তো নিজেই দেখেছ। এ অফ সীজনেও গত দশ দিনে আটচল্লিশ জন নতুন ট্রেণী আমাদের এখানে ভর্তি হয়েছে। তাতে আমাদের মাসিক আয় বাড়ছে বাহাত্তর হাজার। আর এটা হয়েছে কেবল মাত্র রতীশের জন্য। বরুন সুজয় এরা আমার পুরনো স্টাফ হলেও এমনটা তো তারা কেউ করতে পারেনি কোনদিন। আর যার জন্যে আমি মাসে মাসে এ বাড়তি ইনকাম পাচ্ছি তাকে একটু বাড়তি সুবিধে আমি কেন দেব না। তুমি তো জানই বীথি, তোমরা সকলেই আমার ভেতরের বাইরের সব কাজে নানাভাবে সাহায্য করে থাক। আমিও তোমাদের সুবিধে অসুবিধের ওপর সব সময় নজর রাখি। আমার মনে হয় না আমি কখনও কাউকে কোনভাবে এক্সপ্লয়েট করেছি। আর সেটা করতেও আমি ঘৃণা করি। তোমাকেও যেমন সেলারী আর এসকর্ট ফি ছাড়াও নানাভাবে আমি আর্থিক সাহায্য করে থাকি, তেমনি ভাবে বরুন সুজয় অজয় ওদের সবাইকেও আমি প্রয়োজন মত সাহায্য করি। এটা তো তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। তাই রতীশকেই বা ঠকাব কেন। একজন ক্লায়েন্টের কাছে তোমাকে পাঠিয়ে আমার এক্সট্রা ইনকাম হয় বলেই তোমাকে দশ হাজার করে দিই। বরুন সুজয়কে ফিমেল ক্লায়েন্টদের কাছে পাঠিয়ে আমার অতিরিক্ত কিছু আয় হয় বলেই আমি ওদেরকেও পাঁচ হাজার করে দিই। সেখানে রতীশের জন্য যখন আমার আয় প্রতি মাসে বাহাত্তর হাজার বেড়ে যাচ্ছে, তাহলে ওকে একটু বেশী না দিলে ওর প্রতি অবিচার করা হবে না”?

বীথিকা মহিমার কথায় লজ্জা পেয়ে বলল, “সরি ম্যাম, ব্যাপারটা আমি সেভাবে ভেবে দেখিনি। আমার মনে হয়েছিল যে এমনিতেই রতীশদাকে বরুন আর সুজয়ের দেড়গুণ বেতন দেওয়া হচ্ছে। তার ওপর তার কনভেয়ান্স বাবদও চার হাজার দেওয়া হচ্ছে, তাই আমার মনে হচ্ছিল যে রতীশদাকে একটু বেশী দেওয়া হয়ে যাচ্ছে”।

মহিমা হেসে বলল, “তোমার এ’কথার জন্য অন্য যে কেউ তোমার ওপর চটে যেত বীথি। কিন্তু তুমি তো জানই আমি মানুষটা একটু অন্যরকম। তাই তোমার ওপর রাগ না করে আমি তোমাকে একটু বোঝাতে চাইছি। দেখ বীথি এই পৃথিবীতে আত্মীয় পরিজন আপন পর চেনা অচেনা ভাই বন্ধু- সব ধরণের সম্পর্কের ভেতরেই স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। সে স্বার্থ ইকনমিক্সের ভাষায় ক্যাশও হতে পারে, আবার ইন কাইন্ডও হতে পারে। অন্যান্য সম্পর্ক গুলোর কথা নাহয় ছেড়েই দিচ্ছি, আমরা যে সম্পর্কটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মহান আর পবিত্র বলে ভাবি, সেই মা-সন্তানের সম্পর্কের মধ্যেও স্বার্থ থাকে। সন্তান তার জন্মদাত্রীকে মা বলে ডাকবে, বুড়ো বয়সে সে সন্তান তার ভরণ পোষণ সহ অন্য সবকিছুর দিকে নজর রাখবে, এটাই মায়ের স্বার্থ। আর সন্তান মার কাছ থেকে স্নেহ মমতা ভালবাসা পরিচর্যা ভরণ পোষন পাবে এটা তার সন্তানের স্বার্থ। আমি তোমাকে এসকর্ট হিসেবে পাঠিয়ে অর্থ উপার্জন করি সেটা আমার স্বার্থ। তুমি আমার কথায় এসকর্টের কাজ করে আমার কাছ থেকে পয়সা পাও, এটা তোমার স্বার্থ। শারীরিক সম্পর্কের কথা না তুললেও একজন স্ত্রী স্বামীর সংসার সামলায় এটা স্বামীর স্বার্থ। স্ত্রী সংসারের কাজ করার বিনিময়ে স্বামীর কাছ থেকে ভরণ পোষন সুরক্ষা পায়, এটা স্ত্রীর স্বার্থ। পৃথিবীতে এমন কোন সম্পর্ক নেই যার পেছনে বিনিময় বলতে কিছু নেই, কোন না কোন ধরণের স্বার্থ লুকিয়ে নেই। তোমাদের সকলের সাথে আর রতীশ আর ওর স্ত্রীর সাথেও আমার যেমন সম্পর্ক গড়ে উঠেছে, তার সবটার পেছনেই আছে স্বার্থ। রতীশের মাধ্যমে আমার বাড়তি আয় হচ্ছে এটা যেমন আমার স্বার্থ, তেমনি তার বাড়তি কিছু পাওয়াটাও রতীশের স্বার্থ। তাই একদিক দিয়ে বিচার করলে দেখবে এ পৃথিবীর প্রত্যেকটা লোকই স্বার্থপর। যারা দু’ তরফ থেকে বিনিময়ের কথা না ভেবে, অন্যের স্বার্থের কথা না ভেবে, শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবে তাদেরকেই আমরা বলি স্বার্থপর। আমি তেমন স্বার্থপর উপাধি নিতে চাই না। তাই রতীশকেও বাড়তি সুবিধা দিচ্ছি। বরুন সুজয় ওরা আমাদের ইনস্টিটিউটের আয়ে এমন কোন বৃদ্ধি করতে পারেনি বলেই তোমার মনে হচ্ছে আমি রতীশকে বাড়তি সুবিধা দিচ্ছি। কিন্তু কেন দিচ্ছি সেটা এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারলে। সবটাই দেয়া নেয়া। বিনিময়ের ব্যাপার। বিনিময় না হলেই স্বার্থপরতা চলে আসবে। আর তাছাড়া আর একটা ব্যাপারও আছে। আচ্ছা বীথি, ধর তুমি একটা মলের কোন একটা দোকানে গিয়ে একটা ভাল কোয়ালিটির দামী টয়লেট সাবান কিনতে চাইলে। সেটার দাম ধর একশ’ টাকা। সেখানে সস্তার সাবান থাকতেও তুমি কমদামী সাবান না নিয়ে একটা একশ’ টাকার সাবান কিনে নিলে। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলে, আরেকজন গ্রাহক এসে কুড়ি টাকায় একটা টয়লেট সাবান কিনে নিয়ে গেল। তোমরা দুজনেই টয়লেট সাবানই কিনলে। কিন্তু সে নিল কুড়ি টাকার জিনিস, আর তুমি নিলে একশ’ টাকার জিনিস। এমনটা কেন হয় বলো তো”?
 

বীথিকা একটু নড়েচড়ে বসে বলল, “ম্যাম সেটা তো কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে। কুড়ি টাকার সাবানের যে কোয়ালিটি, একশ’ টাকার সাবানের কোয়ালিটি তার থেকে অনেক ভাল”।

মহিমা হেসে বলল, “একদম ঠিক বলেছ তুমি। কোয়ালিটি। বরুন সুজয়দের যা সার্ভিস কোয়ালিটি তাতে পনের হাজার দেওয়া যায়। কিন্তু রতীশের সার্ভিস কোয়ালিটি যে ওদের থেকে কত বেশী, সেটা তো তুমিও এতদিনে বুঝতে পারছ। তাই না? আচ্ছা এ’সব কথায় সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তুমি সকলের সেলারী বানিয়ে রেজিস্টার আর খামগুলো নিয়ে আমার কাছে এসো”।

বীথিকা “ঠিক আছে ম্যাম” বলে চলে গেল। মহিমা তার ল্যাপটপ কাছে টেনে নিয়ে কাজ করতে শুরু করল। প্রায় আধঘণ্টা বাদে বীথিকা সেলারী রেজিস্টার আর কতগুলো খালি এনভেলপ নিয়ে মহিমার ঘরে এল। মহিমা সেলারী রেজিস্টারের এন্ট্রিগুলো ভাল ভাবে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে নিজের ড্রয়ার থেকে টাকা বের করে দিল। বীথিকা সকলের নামে আলাদা আলাদা খাম বানিয়ে প্রত্যেকের বেতনের পয়সা যার যার খামে ঢুকিয়ে দিয়ে মহিমার হাতে দিতেই হলঘরের দিকে একটি শোরগোল শোনা গেল। বীথিকা সাথে সাথে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “ম্যাম, মনে হয় জেনারেল সেশন শেষ হল। আমি কেবিনে যাচ্ছি। এ সময় ট্রেনীরা অনেকেই তাদের ফি জমা দিতে চায়” বলে চলে গেল।
 

বীথিকা নিজের কেবিনের সামনে বেশ ভিড় দেখতে পেল। বরুন সুজয় আর রতীশকে সে মহিমার চেম্বারে যাবার কথা বলে নিজের কেবিনে গিয়ে ঢুকল। জেনারেল সেশন শেষ হবার পরের সময়টুকু বীথিকাকে বেশ ব্যস্ত থাকতে হয়। ট্রেনীরা তাদের মাসিক ফি জমা দিতে আর অন্যান্য অনেক ব্যাপারে কথা বলতে আসে তার সাথে। একজনের সাথে আরও দু’তিনজন করে বীথিকার চেম্বারে ঢুকে পড়ে। তারা বীথিকার সুন্দর শরীরটাকে একটু চোখের দেখা দেখতে আসে। তাতেই যেন তারা ধন্য হয়ে যায়। বীথিকাও এ ব্যাপারে সচেতন। কিন্তু সে জানে ওই চোখের দেখা ছাড়া তারা আর কেউ কিছু করবার সাহস পাবে না। বীথিকাও প্রয়োজনীয় গাম্ভীর্যটুকু বজায় রেখেই সকলের চাহিদা মিটিয়ে থাকে।
 

সাড়ে দশটার পর কেবিন সেশন শেষ হবার পর সকলেই আবার মহিমার চেম্বারে এল। ট্রেনাররা সকলে তার আগে নিজেদের পোশাক পড়ে নিয়েছে। অফিসের জমাদার ছেলেটাকে অন্য কোন দিন এ সময়ে ইনস্টিটিউটে দেখা যায় না। রতীশ তাকে আজ প্রথম দেখল। মহিমা সকলের হাতে তাদের নামলেখা খামগুলো দিতেই সকলে এক এক করে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে চলে গেল। কেউ খাম খুলে দেখল না। রতীশও নিজের খামটা হাতে নিয়ে মহিমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাড়ি অভিমূখে রওনা হল।
 

******************

সবাই চলে যাবার পর মহিমা তার চেম্বারের জিনিসপত্র গুছিয়ে তার ল্যাপটপ আর এক্সটারনাল হার্ড ডিস্ক ব্যাগে ঢুকিয়ে ড্রয়ার আর আলমারি লক করে অজয়কে ইনস্টিটিউট বন্ধ করবার নির্দেশ দিল। তারপর সুজয় আর বরুনকে নিয়ে বীথিকাকে আসতে বলে নিচের তলার তার রেস্টরুমে এসে ঢুকল। রতীশ কাজে যোগ দেবার পর থেকে সে আর ওপর তলার নিজের চেম্বারে বসে তার এসকর্ট ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে কারো সাথেই কথা বলে না। এসকর্ট ব্যবসার সব কিছুই সে এখন তার এই রেস্টরুমে এসেই করে। আর রতীশের কাছেও সে তার এই রেস্টরুমের কথাটা গোপন রেখেছে নিরূপায় হয়েই।
 

রেস্ট রুমে এসে আবার তার ল্যাপটপ অন করে এক্সটারনাল হার্ড ডিস্কটা ল্যাপটপের সাথে জুড়ে দিয়ে গভীর মনযোগ সহকারে কাজে মন দিল। বীথিকা বরুন আর সুজয়কে সাথে নিয়ে রেস্ট রুমে এসে ঢুকতেই বরুন আর সুজয়কে আলাদা করে পাঁচ পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে মহিমা তাদের বুঝিয়ে দিল কোন কোন ক্লায়েন্টের কাছে তাদের যেতে হবে। বরুন আর সুজয় বিদায় নিতে মহিমা বীথিকাকে বলল, “বীথি তোমাকে আজ দুটো ক্লায়েন্ট এটেণ্ড করতে হবে। তুমি যে মিঃ সরকারকে কী যাদু করেছ, তা তুমিই জানো। সে আজ লাঞ্চ টাইমে তোমাকে চেয়েছে। তুমি ঠিক দুটোয় তার অফিসে পৌছে যাবে। আর একটা বুকিং আছে মিঃ হালদারের। হালদারকে তো তুমি আগেও এটেণ্ড করেছ, তাই না”?

বীথিকা জবাব দিল, “হ্যা ম্যাম। গত মাসেও একবার মিঃ হালদারকে সার্ভিস দিয়েছিলাম আমি। তা আগের বার তো সে আমাকে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল সারা রাতের জন্যে। আজও কি তাই”?

মহিমা বলল, “না আজ সে হোল নাইটের জন্য বুক করেনি। সন্ধ্যে ছ’টা থেকে দু’ঘণ্টার জন্যে তোমাকে তাকে সার্ভিস দিতে হবে। কোন সমস্যা নেই তো”?

বীথিকা বলল, “না ম্যাম কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তার সাথে কোথায় মিট করব আমি? তার অফিসেই”?

মহিমা বলল, “তুমি সন্ধ্যে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় তার অফিসের পার্কিংএ তার জন্য অপেক্ষা করবে। সে তোমাকে সেখান থেকেই পিকআপ করবে। তারপর তোমাকে কোন একটা হোটেলে নিয়ে যাবে সে”।

বীথিকা চলে যাবার পর মহিমা সাত আটটা ফোন কল করে অনেককে ডেকে পাঠালো। তারা এক এক করে আসবার পর মহিমা সকলকেই টাকা দিয়ে তাদের গন্তব্য এবং স্থান কাল পাত্রের ব্যাপারে সব কিছু বলে বুঝিয়ে বিদায় করল। অনেকে এসে টাকা ভর্তি খাম মহিমার হাতে দিয়ে চলে গেল। সবশেষে এল নবনীতা। মহিমা নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “বল নবনীতা, এ কাজ কেমন লাগছে তোমার? কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো”?

নবনীতা একটু হেসে বলল, “না ম্যাম, আমার কোন অসুবিধে হচ্ছে না। তা আজ কোন বুকিং আছে আমার”?

মহিমা বলল, “তুমি যদি চাও, তাহলে আজ তোমাকে দুটো ক্লায়েন্টের কাছে পাঠাতে পারি। একজনকে এটেণ্ড করতে হবে দুপুর আড়াইটেয়। একঘণ্টার সেডিউল। আর অন্যজনকে সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টা থেকে রাত সাড়ে সাতটা পর্যন্ত। পারবে”?

নবনীতা বলল, “পারব ম্যাম”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 122)

মহিমা দুটো চিরকুটে ক্লায়েণ্টদের নাম ঠিকানা লিখে চিরকুটদুটো নবনীতার হাতে দিয়ে বলল, “এখানে লেখা আছে তোমাকে কখন কোথায় যেতে হবে। তোমার কাছে এরা দু’জনই নতুন। একটু দেখে বলো এরা কেউ তোমার পরিচিত নয় তো”?

নবনীতা চিরকুটের লেখাগুলো পড়ে বলল, “ঠিক আছে ম্যাম। কোন সমস্যা নেই”।

মহিমা এবার নিজের ড্রয়ার থেকে পনের হাজার টাকা নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “এটা রেখে দাও। চৌদ্দ হাজার তোমার ফি। আর একহাজার কনভেয়ানস বাবদ দিলাম। আর কাগজটা সাবধানে ব্যাগে রেখে দাও। ঠিক সময় মত ক্লায়েন্টদের কাছে পৌছে যাবে”।

নবনীতা টাকা আর চিরকুটটা ব্যাগের ভেতর রেখে বলল, “আর কিছু ম্যাম”?

মহিমা একটু হেসে বলল, “না আজ আর কিছু বলার নেই। অ্যাসাইনমেন্টগুলো কমপ্লিট হলে আমাকে ফোন করে জানিও। এবার এসো। আর হ্যা শোন, কোনরকম অসুবিধে হলে আমাকে খুলে বোল”।

“ওকে ম্যাম” বলে নবনীতা বেরিয়ে গেল। মহিমা আবার নিজের ল্যাপটপে কিছু কাজ করে দেখে সন্তুষ্ট হল। এখনকার সব কাজ সাড়া। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বেলা প্রায় বারোটা। রতীশ আসবার পর থেকে সে আর বারোটার আগে ইনস্টিটিউট থেকে বেরোতেই পারে না। রতীশ যতক্ষণ ইনস্টিটিউটে থাকে ততক্ষণ সে তার এই ব্যবসার ব্যাপারগুলো দেখতে পারে না। রতীশের কাছ থেকে ব্যাপারগুলো গোপন রাখতেই তাকে এমন করতে হচ্ছে। সব জিনিসপত্র গোছগাছ করে কলিং বেল বাজাতেই অজয় এসে হাজির। মহিমা তাকে রেস্ট রুম বন্ধ করবার কথা বলে সেখান থেকে নিজের ভারী ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।


****************

বেলা প্রায় বারোটা নাগাদ রতীশ বাড়ি পৌঁছল। ঘরে ঢুকেই রচনার হাতে বেতনের টাকা ভরা খামটা দিতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “এতে কি আছে সোনা”?
 

রতীশ ভেতরের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “ওতে আমার গত মাসের মাইনে আছে। বাড়িতে থাকতে তো কলেজের বেতন সোজা আমার ব্যাঙ্ক একাউন্টে গিয়ে জমা হত। এখানে তো তা হবে না। প্রতি মাসের এক তারিখে মাইনে এনে এখন থেকে আমার ঘরের লক্ষ্মীর হাতে তুলে দেব। তুমিই তো এখন আমার ঘরের মালকিন”।

রচনা মনে মনে খুশী হলেও মুখে বলল, “আহা, ঢং দেখে আর বাঁচি না। কিন্তু আগে পোশাক খুলে একটু বসে জিরিয়ে নাও তো। আমি তোমার জন্য একটু শরবৎ বানিয়ে আনছি। যা গরম পড়েছে আজ। শরবৎ খেলে একটু ভাল লাগবে”।

রতীশ নিজের শার্ট আর গেঞ্জী খুলতে খুলতে দুষ্টুমি করে বলল, “পোশাক খুলে বসতে বলছ? সব খুলে”?

রচনা লাজুক ভাবে “ধ্যাত অসভ্য কোথাকার। সব কথার বাজে মানে বের করা তোমার একটা অভ্যেসে পরিণত হচ্ছে। দুষ্টু কোথাকার” বলে হাতের খামটাকে বিছানার তলায় রেখে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

মিনিট দশেক বাদে দু’হাতে দু’গ্লাস শরবৎ এনে বেডরুমে এসে হাজির হল। রতীশ ততক্ষণে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা পাজামা পড়ে নিয়েছে। রতীশের হাতে শরবতের গ্লাস দিয়ে রচনা বিছানার কোনায় বসে বলল, “বাড়ি থেকে মামনি ফোন করেছিলেন। বললেন সকলে ভালই আছে। চন্দুটাও আগের চেয়ে নাকি অনেক শান্ত হয়ে গেছে। মন দিয়ে লেখাপড়া করছে। ছোটমা নাকি ওকে বলেছেন ওকে ওর বৌমণির মত রেজাল্ট করতে হবে। চন্দুও নাকি খুব পড়াশোনা করছে”।

রতীশ হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কিন্তু চাইলে এবার গ্রাজুয়েশনটা করে নিতে পার রচু। কলকাতায় তো কত ভাল ভাল কলেজ আছে। বাড়ির কাছাকাছি কোনও একটা কলেজে কিন্তু তোমাকে ভর্তি করে দিতে পারি। তোমার কিছুটা সময় কলেজ আর পড়াশোনায় কেটে যাবে”।

রচনা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “ধুর? কতদিন হল পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আর ছাত্রী সেজে কলেজে যেতে ভাল লাগবে না। ও আচ্ছা শোন না, মামনি বলেছেন আর দু’মাস বাদেই তো পূজো। আমাদের পূজোর দু’দিন আগে যেতে বলেছেন। আর লক্ষ্মীপূজো পার করে ফিরতে বলেছেন। দুর্গাষষ্ঠী নাকি এবার অক্টোবরের কুড়ি তারিখ। আর লক্ষীপূজো পড়েছে ঊনত্রিশ তারিখে। মামনি চাইছেন দেরী হলেও আমরা যেন আঠারো তারিখে গিয়ে পৌঁছই। আর একত্রিশ তারিখের আগে নাকি আমাদের ফিরতে দেবেন না। তুমি কি এতদিন ছুটি নিতে পারবে”?

রতীশ শরবতের গ্লাসে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “আঠার তারিখে পৌঁছতে হলে এখান থেকে রওনা হতে হবে সতের তারিখ। অবশ্য আঠার তারিখ সকালের কোন ট্রেনে রওনা হলেও সন্ধ্যের আগে পৌঁছে যাব। কিন্তু ফিরে আসতে আসতে তো তাহলে নভেম্বরের এক তারিখ হয়ে যাবে। দু’ তারিখের আগে আর কাজে জয়েন করা যাবে না। তাহলে তো প্রায় পনেরো ষোল দিনের ছুটি নিতে হবে। সেটা কি সম্ভব হবে? মাত্র দু’ আড়াই মাস কাজ করেই পনের দিনের ছুটি চাইলে বৌদি কী ভাববেন বল তো? অফিসের নিয়ম হিসেবে চার দিনের বেশী ছুটি কেউ একসঙ্গে নিতে পারে না। আর আমি তো সবে জয়েন করলাম। অত লম্বা ছুটি কি দেবেন আমাকে”?

রচনাও মুখ কালো করে বলল, “হ্যাঁগো, কথাটা তো তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু লক্ষ্মীপূজো পার না করে যে মামনি কিছুতেই ছাড়তে চাইবেন না আমাদের। আমাদেরও কি ভাল লাগবে? কতদিন বাদে আমরা বাড়ির সবাইকে কাছে পাব। পূজোর চারদিন তো হৈ হুল্লোরেই কেটে যাবে। ভাল করে মা-দের সাথে ভাইবোনদের সাথে একটু জমিয়ে গল্পও করা যাবে না”।

রতীশ রচনার কাঁধে হাত রেখে বলল, “দেখা যাক। ছুটি না পেলে তো আর কিছু করার থাকবে না। তবে বৌদিকে আমি শুরুতেই বলে দিয়েছিলাম যে পূজোর সময় আমার চারদিনের সাথেও যেতে আসতেও দুটো দিন আমার লাগবেই। তাই কম করেও আমাকে ছ’টা দিনের ছুটি দিতে হবে। বৌদি মনে হয় আমার সে আবদারটুকু রাখবেন। এর বেশী ছুটির কথা বলতে তো আমারই সঙ্কোচ হবে। মাত্র দু’আড়াই মাস চাকরি করে প্রাইভেট চাকরিতে এত বড় ছুটি চাওয়াটাই বেমানান। দেখা যাক কী হয়। আচ্ছা সে কথা থাক। খামটা খুলে দেখ তো। ওতে কত টাকা আছে”?

রচনা বিছানার নিচ থেকে খামটা বের করে সেটা খুলে ভেতরের নোটগুলো বের করল। রতীশ প্রথমটায় অতটা খেয়াল না করলেও রচনা যখন বলল “পাঁচশ টাকার বাহান্নটা নোট মানে ছাব্বিশ হাজার”, সে’কথা শুনেই রতীশ চমকে উঠে বলল, “কী বলছ তুমি রচু। আমি তো কালচিনি থেকে ফেরার পর আঠারো তারিখ কাজে জয়েন করেছি। তাই আমি চৌদ্দ দিনের মাইনেই শুধু পাব এ মাসে। বৌদি কি তাহলে ভুল করে পুরো এক মাসের মাইনে দিয়ে ফেলেছেন নাকি? তুমি ঠিক গুনেছ তো? ভুল করনি তো”?

রচনাও অবাক হয়ে বলল, “নাগো ভুল হয়নি। এখানে তো পাঁচশ টাকার বাহান্নটা নোটই আছে। তাহলে তো ছাব্বিশ হাজারই হল”।
 

রতীশ চরম অবাক হয়ে রচনার হাত থেকে টাকা গুলো নিয়ে গুণে দেখল, সত্যিই ছাব্বিশ হাজার আছে! সে কিছুক্ষণ হতভম্বের মত রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থেকে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে মহিমাকে ফোন করল। চার পাঁচবার রিং হবার পর মহিমার সাড়া পাওয়া গেল, “হ্যাঁ ভাই, বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছ তো”?

রতীশ জবাব দিল, “বৌদি বাড়ি তো পৌঁছে গিয়েছি। কিন্তু ঘরে এসে খামটা খুলেই তো অবাক হয়ে গিয়েছি। আপনি তো ভুল করে আমাকে একমাসের পুরো মাইনে দিয়ে দিয়েছেন। আমার তো এমাসে শুধু চৌদ্দ দিনের মাইনে পাবার কথা”!
 

মহিমা দু’সেকেণ্ড চুপ করে থাকবার পর বলল, “ওঃ তাই বুঝি? তাহলে বোধহয় ভুল করেই সেটা খামে ভরে দিয়েছি। আচ্ছা ঠিক আছে, শোন ভাই, তুমি ওটা নিয়ে এত ভেব না। সামনের মাসে না হয় আমি সেটা অ্যাডজাস্ট করে দেব। ঠিক আছে? আমি এখন বাড়ি ফেরার পথে। গাড়ি ড্রাইভ করছি। তাই এখন রাখছি ভাই। রচনাকে আমার আদর দিও” বলে ফোন কেটে দিল।

ফোন নামিয়ে রেখে রতীশ রচনাকে বলল, “বৌদি বোধহয় ভুল করেই পুরো মাসের বেতন দিয়েছেন। কাল আমার অফ ডে। তাই ভাবছিলাম পরশু গিয়ে বৌদিকে বাড়তি টাকাটা ফিরিয়ে দেব। কিন্তু বৌদি বললেন, সামনের মাসে নাকি অ্যাডজাস্ট করে দেবেন”।

রচনা টাকাগুলো আবার খামের ভেতর ভরতে ভরতে বলল, “ঠিক আছে। বৌদিকে তো জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উনি যখন বলছেন পরের মাসের মাইনে থেকে অ্যাডজাস্ট করে দেবেন, তাহলে আর সমস্যার কিছু রইল না। আচ্ছা সোনা, এবার তুমি চানটা করে নাও। আমি তোমার খাবার রেডি করছি”।

***************

দুপুরের খাবার খেয়ে রতীশ আর রচনা বিছানায় শুয়ে শুয়ে গল্প করতে করতে রতীশ হঠাৎ রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “চল না সোনা, আজ বিকেলে একটা টিভি কিনে নিয়ে আসি। বৌদি যখন ভুল করে পুরো মাসের মাইনেটাই দিয়ে দিয়েছেন, তাহলে একটা টিভি কিনে আনাই যায়”।

রচনাও রতীশের একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “এখনই এত তাড়াহুড়ো করবার কি হল সোনা? আর একটা মাস যেতে দাও না। একটা টিভি আর সাথে ডিশ কিনতে গেলে তো পুরো টাকাটাই বেরিয়ে যাবে। আর সামনের মাসেও তো তুমি পুরো বেতন পাচ্ছ না। বৌদি তো এবারের বাড়তি টাকাটা কেটেই তোমাকে মাইনে দেবেন, আর একটা মাস পরে কিনলে কী এমন ক্ষতি হবে? অবশ্য বৌদির দেওয়া শগুণের টাকা গুলোও আছে। কিন্তু পূজোর সময় বাড়ি গেলে তখন টাকা পয়সার প্রয়োজন পড়বে না? সকলকেই কিছু দিতে পারি আর না পারি, ভাইবোনদের হাতে কিছু পূজোর উপহার তো তুলে দিতেই হবে। আর কিছুদিন পরেই না হয় টিভি কিনব”।

রচনার কথার জবাবে রতীশ কিছু একটা বলতে যেতেই তার ফোনটা বেজে উঠল। রচনা ফোনটা নিয়ে স্ক্রীনের দিকে দেখে বলল, “দিদিভাইয়ের ফোন। নাও কথা বল”।

রতীশ ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে স্পীকার অন করে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ মন্তি বল, লাঞ্চ করেছিস”?

রচনা রতীশের বুকে মাথা রেখে সীমন্তিনীর জবাব শুনল, “হ্যাঁরে দাদাভাই। লাঞ্চ হয়ে গেছে। হাতে কাজ একটু কম আছে বলেই তোকে ফোন করলাম। তা তোদের খাওয়া দাওয়া হয়েছে তো”?

রতীশ জবাব দিল, “হ্যাঁরে আমাদেরও খাওয়া হয়ে গেছে। এখন বিছানায় শুয়ে একটু রেস্ট নিচ্ছি। তারপর বল কী খবর। তুই ঠিক আছিস তো”?

সীমন্তিনী ও’পাশ থেকে বলল, “হ্যাঁরে দাদাভাই, আমি ঠিক আছি। তা রচু কোথায় রে”?

রতীশ রচনার মাথার ওপর হাত বুলিয়ে বলল, “ও তো এখানেই আছে। নে কথা বল ওর সাথে” বলতেই রচনা ফোনের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই বল”।

সীমন্তিনী ‘মুয়াআআ’ করে একটা চুমু খেয়ে বলল, “কেমন আছিস রচুসোনা”?

রচনাও খুশী গলায় জবাব দিল, “ভাল আছি দিদিভাই। তুমি তো আজ লাঞ্চ টাইমে ফোন করলে না। আমি ভাবছিলুম তুমি বুঝি কাজে খুব ব্যস্ত আছ”।

সীমন্তিনী বলল, “নারে, আজ কাজ একটু হাল্কা বলেই ভাবছিলাম লাঞ্চের পর তোকে ফোন করব। আচ্ছা রচু, একটা কথা বল তো। তোরা তো এক বেডরুমের ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিস। তোদের ঘরে যদি হঠাৎ কেউ এসে পড়ে তাহলে থাকবার জায়গা দিতে পারবি”?
 

রচনা খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্নের উত্তর দিল, “সে একজন বা দু’জন এলে কোন সমস্যা হবে না। আমাদের সামনের ঘরে মানে লিভিং রুমে একটা সোফা কাম বেড আছে। সেটায় দু’জন আরামে ঘুমোতে পারবে। তবে বাথরুম তো একটাই। সবাই মিলে সেটাই ইউজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের এখানে কে আর আসবে বল। আমাদের এ বাড়িতে একমাত্র মহিমা বৌদি ছাড়া আর কেউই কখনো আসেনি। অবশ্য যেদিন আমরা ঘরে এসে ঢুকেছিলাম সেদিন ঘরের মালিক আর তার সাথে আরেকটা ছেলে একবার এ ঘরে এসেছিল। আর রাতে থাকবার মত তো কেউই নেই, কিন্তু তুমি .....” বলতেই কি মনে হতেই সে রতীশের বুক থেকে লাফ দিয়ে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, “দিদিভাই! তুমি আসছ? সত্যি বলছ তুমি কলকাতায় আসছ? ইশ আমি যে খুশীতে পাগল হয়ে যাচ্ছি গো। বলোনা দিদিভাই কবে আসছ? আজই কি রওনা হচ্ছ ওখান থেকে? বলো না দিদিভাই। তুমি চুপ করে আছ কেন”?

সীমন্তিনী শান্তভাবে জবাব দিল, “আমাকে বলতে দিচ্ছিস কোথায় তুই? তুই নিজেই তো বকবক করে যাচ্ছিস। শোন রচু। আজ তো এক তারিখ। আগামী তেরো তারিখ সোমবার কোলকাতার হেড কোয়ার্টারে আমাকে একটা মিটিংএ অ্যাটেণ্ড থাকতে হচ্ছে। আমাদের অফিসিয়াল মিটিং। আমি ভাবছিলাম তখন দুটো দিন তোদের সাথে কাটিয়ে আসব। তোদের অসুবিধে হবে না তো”?

রচনা খুশীর সাথে অবাক হয়ে বলল, “আমাদের অসুবিধে হবে? তুমি আমাদের এখানে এলে আমাদের অসুবিধে হবে, এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে দিদিভাই? তোমার দাদাভাই আর তোমার রচু কি অমন মানুষ? শোনো দিদিভাই দু’দিন কলকাতায় কাটিয়ে যাওয়া নয়, অন্ততঃ চারটে দিন তোমাকে আমাদের সঙ্গে কাটাতে হবে। আর সেটা ওই মিটিং-এর দিন বাদ দিয়ে। আমি কিন্তু কোন কথা শুনব না”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “শোন রচু। মিটিং ছাড়াও কলকাতায় আমার আরও কিছু কাজ আছে। আর সে’সব কাজ যখন করব তখন আমাকে তোদের ছেড়ে বেরোতেই হবে। তবে দু’এক জায়গায় তোকেও হয়ত সাথে নিয়ে যেতে পারি। সেটা প্রয়োজন সাপেক্ষে। তাই মিটিং ছাড়াও দুটো দিন হয়ত আমাকে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে। তাই আমি ন’ তারিখ অফিস করে রাতের ট্রেনে চাপবো। শুক্র, শনি আর মঙ্গলবার এ তিনদিন ছুটি নেব। সোমবার আমার মিটিং। আমি শুক্রবার সকালে কোলকাতা পৌঁছবো। শুক্র, শনি, রবি আর মঙ্গলবার এ চারটে দিন তোদের সাথে কাটাব। তবে এরই মধ্যে আমাকে একটু এদিক সেদিক যেতে হবে, সেটা নিয়ে কোন আপত্তি করিস না বোন আমার। বুধবার পনেরোই আগস্ট আমাকে কোলকাতার হেডকোয়ার্টারে হাজিরা দিতে হবে। আর সেদিন বিকেলের ট্রেনেই আমার ফেরার টিকিট কাটা হচ্ছে। এবার খুশী তো”?

রচনা খুশীতে আটখানা হয়ে বলল, “উঃ দিদিভাই কি বলছ তুমি? আমি তো আর ভাবতে পারছিনা গো। ইশ আজ সবে এক তারিখ। তোমাকে দেখতে পাব দশ তারিখে। এতগুলো দিন কি করে কাটাবো আমি বল তো? আচ্ছা দিদিভাই তুমি কি আর দুটো দিন আগে আসতে পারবে না? প্লীজ দিদিভাই”।

সীমন্তিনী বলল, “নারে সোনা। এর চেয়ে আর বেশী ছুটি নিতে পাচ্ছিনা এখন। তুই মন খারাপ করিসনে। কাল অফিসের মিটিং-এর খবরটা আসবার পর থেকেই আমি ছটফট করছিলাম তোকে খবরটা জানাতে। কিন্তু ক’দিনের ছুটি নিতে পারব এটা বুঝতে পারিনি বলেই তোকে আগে জানাইনি। আজ লাঞ্চের একটু আগে জলপাইগুড়ির অফিসের সাথে কথা বলে প্রোগ্রামটা ফাইনাল করেই তোকে জানাচ্ছি। শনিবার আর মঙ্গলবার এ দুদিন অফিসিয়ালি আমার জার্নি পেরিয়ড। এসপি অফিসের সাথে কথা বলে শুক্রবার আর বুধবারটাকে জার্নি পেরিয়ডে কনভার্ট করে শনিবার আর মঙ্গলবার দু’দিন ছুটি নিতে পারলাম। তাই তো বৃহস্পতিবার অফিস করে আমি রাতেই রওনা হচ্ছি। শুক্রবার সকালে পৌঁছে যাব। শুক্র, শনি, রবি আর মঙ্গলবার চারটে দিন ফ্রি থাকব। ওই চারিদনই আমি তোর সাথে সময় কাটাব। এর বেশী আর সম্ভব হচ্ছে নারে এবারে”।
 

রচনা বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই, ছুটি না পেলে আর কি করা যাবে বল। কিন্তু শুক্রবারে কিন্তু আমাদের ঘরে বসে তোমাকে ব্রেকফাস্ট করতে হবে। ট্রেন থেকে নেমে তুমি সোজা বাড়ি চলে আসবে। অন্য কোথাও কিছু খাবে না কিন্তু”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমাকে অত বোকা ভাবছিস তুই? তোর হাতের রান্না ছাড়া আমি কলকাতা গিয়ে আর কিছু খাব? আচ্ছা শোন রচু, দাদাভাইকে ফোনটা আরেকটু দে না”।

রচনা বলল “হ্যাঁ দিদিভাই, দিচ্ছি। কিন্তু তার আগে আরেকটা কথা বল তো। পরশুদিন ভাই ফোন করেছিল। বলল তুমি নাকি আবার কালচিনি গিয়েছিলে। শুনে খুব ভাল লেগেছে আমার। কিন্তু দিদিভাই, দিদি কেমন আছে গো? ও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছে তো? আমি যতবার ফোন করি তখন সবাই বলে দিদি ভাল আছে। কিন্তু দিদির গলার স্বর শুনেই আমার মনে হয় ও এখনও পুরোপুরি সেরে ওঠেনি। তুমি আমায় সত্যি কথাটা বলনা দিদিভাই”।

সীমন্তিনী বলল, “রচু সোনা, অর্চুর ওপর এতগুলো বছর ধরে ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরা কি কম অত্যাচার করেছে? মেয়েটাকে তো প্রায় মেরেই ফেলেছিল তারা। ভগবানের আশীর্বাদেই তাকে আমরা ফিরে পেয়েছি। কিন্তু এতদিনের অত্যাচারের যন্ত্রণা এত তাড়াতাড়িই কি সারিয়ে ফেলা যায় রে? তবে সেদিন অর্চুকে দেখে আমার বেশ ভাল লেগেছে। ওপরে ওপরে তার শরীরের সৌন্দর্য অনেকটাই ফিরে এসেছে। খুব ভাল লেগেছে দেখতে। ভেতরের দুর্বলতাও নাকি অনেকটাই কমেছে। ওষুধপত্র ঠিকঠাক খাচ্ছে। সামনের দশ তারিখে ডক্টর সোম আবার তার চেকআপ করবেন। তুই একদম ভাবিস না। আমার মনে হয় আর অল্প ক’দিনের ভেতরেই তোর দিদি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে”।

রচনা সবটা শুনে একটু স্বস্তির শ্বাস নিয়ে বলল, “তুমি ছিলে বলেই বড় কোনও দুর্যোগ হল না। তোমার কথায় আমি অনেকটা আশ্বস্ত হলাম দিদিভাই। আচ্ছা এই নাও, তোমার দাদাভাইয়ের সাথে কথা বল” বলে রতীশের হাতে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে সে খুশীতে রতীশকে জড়িয়ে ধরল। রতীশ ফোন নিয়েই বলল, “ইস তুই যদি আর একটা দিন আগে আসতে পারতিস তাহলে তোকে রিসিভ করতে আমি ষ্টেশনে যেতে পারতামরে মন্তি। তুই শুক্রবার সকালে এখানে এসে পৌঁছবি। আমি তো তখন ইনস্টিটিউটেই থাকব। তোকে রিসিভ করতে যাব কিভাবে”?

সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই তুই একদম ভাবিস না। আমি একা যাচ্ছি না। আমার সাথে সিকিউরিটি থাকবে। আমি তোদের বাড়ি গিয়ে না পৌঁছনো অব্দি চার পাঁচ জন সিকিউরিটি আমার সাথে থাকবে। আর তোর বাড়ির ঠিকানা তো আমার জানাই আছে। আমার কোন অসুবিধে হবে না। কিন্তু দাদাভাই একটা কথা শোন। আমি যে একজন পুলিশ অফিসার এটা তোরা কাউকে জানাবি না। আমি প্লেন ড্রেসে তোদের বাড়ি যাব। কারুর সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবার সময় তোরা কিন্তু একবারের জন্যও বলবি না যে তোর বোন একজন পুলিশ অফিসার। আমি সেখানে শুধু তোর বোনের পরিচয় নিয়েই সকলের সাথে পরিচিত হতে চাই। বুঝেছিস”?

রতীশ বলল, “ঠিক আছে রে মন্তি। তাই হবে। তুই কিছু ভাবিস না”।
 

সীমন্তিনী আবার বলল, “আর রচুকেও কথাটা বুঝিয়ে দিস দাদাভাই। আজ ছাড়ছি তাহলে” বলে ফোন কেটে দিল।

রচনা রতীশের বুকে মুখ চেপে ধরে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ইশ আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে। দিদিভাই আসছেন”?

রতীশও রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার মাথার চুলে নিজের নাক ডুবিয়ে দিল। রচনা স্বামীর আদর খেতে খেতে মনে মনে সীমন্তিনীর কথা ভাবতে ভাবতে হঠাতই বলে উঠল, “সোনা একটা কথা রাখবে? চল না আজ একটু গড়িয়াহাট থেকে ঘুরে আসি”।

রতীশ একটু অবাক হয়ে বলল, “গরিয়াহাট? কেন”?

রচনা বলল, “আমাদের বিয়ের পর থেকে আমি দিদিভাইকে কিচ্ছুটি দেবার সুযোগ পাইনি। এবার দিদিভাই প্রথম বাড়ি আসছে। চল না তার জন্যে একটা ভাল শাড়ি কিনে আনি। টিভি না হয় আমরা পরে কিনব”।

রতীশ রচনাকে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় চুমু খেয়ে আদর করে বলল, “বেশ, তুমি যখন চাইছ, তাহলে চল যাওয়া যাক। চারটে তো বাজতেই চলল। তুমি তাহলে তৈরী হয়ে নাও। পাঁচটার আগে আগেই বেরিয়ে যাই তাহলে”।

***************
 
(To be cont'd ......)
______________________________
Like Reply
(Update No. 123)

গরিয়াহাটের প্রসিদ্ধ আদি ঢাকেশ্বরী বস্ত্রালয় থেকে রচনা সীমন্তিনীর জন্য শাড়ি পছন্দ করল। টকটকে লাল রঙ, পারটা ঘণ সবুজ রঙের। রচনার ভারী পছন্দ হয়েছে শাড়িটা। সীমন্তিনীকে বড় চমৎকার লাগবে এ শাড়িতে। সঙ্গে ব্লাউজ পিস আছে। কিন্তু ব্লাউজের মাপ সঙ্গে নেই বলে ব্লাউজ বানানো সম্ভব ছিল না। তবে দোকানের লোকগুলো বলেছে মাস খানেকের মধ্যে ক্যাশমেমো সহ যে কোন দিন এসে তারা ব্লাউজের মাপ দিয়ে যেতে পারবে। দু’দিনের মধ্যেই ব্লাউজ বানিয়ে দেওয়া হবে। রচনা মনে মনে ভাবল, সীমন্তিনী যেদিন কলকাতা আসবে সেদিনই তাকে নিয়ে গরিয়াহাট এসে ব্লাউজ বানাতে দিয়ে যাবে। দু’দিন পর ডেলিভারি নিয়ে সীমন্তিনীকে দিয়ে দেওয়া যাবে।

কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে সামনের ফুটপাথ দিয়ে এগিয়ে চলল তারা। রচনা মনে মনে ভীষণ খুশী। এ শাড়িটা পড়লে তার দিদিভাইয়ের দিকে থেকে কেউ চোখ সরাতেই পারবে না মনে হয়। সরু ঘিঞ্জি ফুটপাথের ওপরেও একের পর এক হকারদের দোকান। বেশীর ভাগই নানা ধরণের কাপড়ের দোকান। আর একটু বাদে বাদেই ফুটপাথের ডানদিক দিয়ে এক একেকটা গলি বেরিয়ে গেছে। ফুটপাথ আর সব গুলো গলিতেই প্রচুর লোকের ভিড়। রতীশ রচনাকে সাথে নিয়ে ফুটপাথ ধরে জেব্রা ক্রসিং-এর দিকে এগিয়ে চলল। রাস্তা পেরিয়ে তাদের অন্যদিকে চলে যেতে হবে। তারপর সেখান থেকে অটো ধরতে হবে।

হঠাতই সেই ভিড়ের মধ্যে কেউ রচনার হাতে ধরে থাকা ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল। রচনা প্রায় সাথে সাথে চিৎকার করে উঠল। দু’একজন লোকও হা হা করে উঠল। রতীশ রচনার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল কী হয়েছে। ডানদিকের একটা গলির অনেকটা ভেতর দিকে “চোর চোর” চিৎকারও শোনা গেল। কিন্তু ওই অবস্থায় রচনাকে একা ছেড়ে রতীশ চোরের পেছনে ধাওয়া করবার কথা ভাবল না। রচনা রতীশের হাত জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। তার হাতের ব্যাগটা যে কে ছিনিয়ে নিয়ে কোন দিকে ছুটে পালিয়ে গেছে তা সে একেবারেই বুঝতে পারেনি। ভিড়ের মধ্যেও তাদেরকে ঘিড়ে একটা ছোট জটলা তৈরী হয়ে গেল। একজন বলল, “একটা কম বয়সী ছেলে ম্যাডামের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে গেল”। আরেকজন বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আমিও দেখেছি। পাশের ওই গলিটার ভেতর দিয়ে পালিয়েছে বদমাশটা”। আরেকজন বলল, “ছিঃ ছিঃ কী দিনকাল পড়েছে। কোথাও এতটুকু নিরাপত্তা নেই মানুষের”।
 

রচনা যেন কারো কথা শুনতে পাচ্ছিল না। তার দিদিভাইয়ের জন্য কেনা এমন পছন্দের শাড়িটা যে এভাবে ছিনতাই হয়ে যেতে পারে, এ সে ভাবতেই পারেনি। তার বুকের ভেতর থেকে উথলে ঠেলে বেরিয়ে আসা কান্নাকে সামলাতে না পেরে সে ফুটপাথের ওপরেই বসে পড়ে কেঁদে ফেলল। রতীশ রচনাকে সামলাবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কিছুতেই যেন তাকে শান্ত করা যাচ্ছিল না। দু’একজন সমব্যথীও নানা প্রবোধ বাক্য বলতে লাগল। রতীশ রচনাকে ধরে তুলে তাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। আশেপাশে মানুষের ভিড় যেন বেড়েই যাচ্ছিল। ঠিক এমন সময় পেছন দিকে থেকে কেউ বলে উঠল, “একটু সরুন দেখি। আমাকে একটু যাবার জায়গা দিন। বদমাশটা ধরা পড়েছে। ও ব্যাটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। ব্যাগটা ম্যাডামের হাতে ফিরিয়ে দিতে দিন আমাকে, একটু সরুন প্লীজ”।

অমনি অনেকে হৈ হৈ করে উঠল। ভিড় ঠেলে লোকটা রচনা আর রতীশের কাছাকাছি এসে বলল, “দেখুন তো ম্যাডাম। এটাই আপনার সে ব্যাগটা কি না”।

রচনা কান্না ভেজা চোখে লোকটার দিকে চাইতেই লোকটা বাদামী রঙের কাগজের ক্যারি ব্যাগটা উঁচিয়ে ধরল। রচনার চিনতে অসুবিধে হল না। সে হাত বাড়িয়ে লোকটার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়েই তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে ভেতরের শাড়িটাকে বের করে দেখে বলল, “হ্যাঁ, এই তো। এটাই তো আমার ব্যাগ”।

রতীশ লোকটার কাছে এসে তার হাত ধরে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ দাদা। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। কিন্তু আপনি এটা পেলেন কি করে”?

লোকটা বলল, “আমি তো ম্যাডামের ঠিক পেছন পেছনই আসছিলাম। বদমাশটা ব্যাগটা কেড়ে ঐ গলির ভেতর ঢুকে যেতে আমিও ছুটে গিয়েছিলাম তার পেছন পেছন। চোর চোর বলে চেঁচাচ্ছিলাম। ওই গলিটার ভেতরের দিকে একটা জায়গায় দু’ তিনজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল। আমার চিৎকার শুনেই তারা বদমাশটাকে ধরে ফেলেছে। উত্তম মধ্যম দিতে দিতে ওকে তারা নিয়ে গেছে। আর ব্যাগটা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আসলে তারা হয়ত ভেবেছিল যে আমার হাত থেকেই বদমাশটা ওটা ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আমি তো জানি এটা আমার নয়, এটা এই ম্যাডামের। তাই আমিও আর দেরী না করে উল্টোপায়ে ছুটে এলাম। মনে মন ভয় হচ্ছিল, এসে আপনাদের দেখতে পাব কি না”।
 

রতীশ লোকটার সাথে হ্যাণ্ডশেক করে বলল, “আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ দাদা” বলতেই পেছন থেকে আরেকজন এসে বলল, “আরে দাদা! আপনি এখানে? কিছু হয়েছে না কি”?

রতীশ ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটার দিকে চেয়েই বলে উঠল, “আরে নিখিল? তুমি এখানে”?

নিখিল বলল, “একটা জিনিস কিনতে এসেছিলাম দাদা। কিন্তু এখানে জটলা দেখেই এগিয়ে এলাম। আর আপনাকে দেখে আরও অবাক হলাম। কিন্তু হয়েছেটা কি? ইনি কাঁদছেন কেন”? বলে রচনার দিকে ইশারা করল।

রতীশ নিখিলের হাত ধরে বলল, “ওনার নতুন কেনা একটা শাড়ি ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল। পেছন থেকে কেউ ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু এখন সেটা ফেরত পাওয়া গেছে। এই ভদ্রলোক সেটা উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন” বলে উদ্ধার কর্তার দিকে চেয়ে আরেকবার বলল, “সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার ভাষা আমার নেই। তবে এখন আসছি দাদা”।
 

নিখিল রতীশের হাত ধরে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন দাদা। আমার সঙ্গে আসুন। চলুন আমি আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছি”।

রতীশও আর কোন কথা না বলে রচনার হাত ধরে ভিড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। একটু এগিয়ে যাবার পর নিখিল একটা গলির ভেতর ইশারা করে বলল, “দাদা এদিক দিয়ে চলুন। এ গলি থেকে বেরিয়েই ওদিকে আমার অটো পেয়ে যাবেন। তা দাদা, আপনার সঙ্গে ইনি বুঝি আমাদের বৌদি”?

রতীশ জবাব দিল, “হ্যাঁ ভাই, উনি আমার স্ত্রী”।

নিখিল এবার একটু হেসে বলল, “কিছু মনে করবেন না বৌদি, আপনার কপালটা কিন্তু সত্যিই ভাল। নইলে এভাবে ছিনতাই হয়ে যাওয়া জিনিস কখনোই ফিরে পেতেন না”।


****************

রাত দশটায় সীমন্তিনী পরিতোষকে ফোন করল। তার কোলকাতা আসবার খবরটা জানাতেই পরিতোষ বলল, “রাতের বেলা ট্রেন জার্নি করে আসছ, একটু এলার্ট থেকো। তা কোন রাস্তায় আসছ তুমি? ডুয়ার্সের রাস্তায় আসবে না নিউ আলিপুরদুয়ার হয়ে আসবে”।

সীমন্তিনী বলল, “না ডুয়ার্সের রাস্তায় যাব না। অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমি এখান থেকে আলিপুরদুয়ার বা এনজেপি পর্যন্ত গাড়িতে চলে যাব বিকেলের দিকে। সেখান থেকে ট্রেণে যাব। তুমি অত টেনশন নিও না তো”।

পরিতোষ বলল, “আচ্ছা বেশ শোন। ডিপার্টমেন্ট থেকে কি সিকিউরিটি দিচ্ছে”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “হু পাঁচজন সিকিউরিটি থাকবে আমার সাথে সিভিল ড্রেসে। আর আমিও প্লেন ড্রেসেই যাচ্ছি। আমাকে দাদাভাইয়ের বাড়ি ড্রপ করে দেওয়া পর্যন্ত সিকিউরিটি থাকবে আমার সাথে। আর যেদিন আমি ফিরে আসব সেদিন সকাল থেকে সিকিউরিটি পাবো। তবে কলকাতায় থাকা কালীন কলকাতা পুলিশ আমাকে কোন সিকিউরিটি দেবে কিনা তা ঠিক জানতে পারিনি এখনও। এসপি সাহেব বলেছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করবেন। দেখা যাক কি হয়”।

পরিতোষ বলল, “কলকাতায় যতদিন থাকবে ততদিনকার ব্যাপার তুমি আমার ওপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পার। কোলকাতা পুলিশের সাথে আলাদা ভাবে যোগাযোগ না করলেও চলবে। আই উইল টেক কেয়ার অফ দ্যাট। তোমার সিকিউরিটি তোমাকে তোমার দাদাভাইয়ের বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় থেকে আমার পার্সোনাল টিম তোমার কেয়ার নেবে। কিন্তু একটা কথা বল তো ডার্লিং”।

সীমন্তিনী বলল, “তার আগে তুমি আমার একটা কথা শোনো পরিতোষ। এগারো তারিখ সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত এর মধ্যে আমি তোমার সাথে ফিজিক্যালি দেখা করতে চাই। আর সেই সাথে তোমার ওই নতুন খুঁজে পাওয়া মহিলার সাথেও দেখা করতে চাই। ইজ ইট পসিবল”?

পরিতোষ এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “তুমি যখন চাইছ তাহলে পসিবল হতেই পারে। কিন্তু ডার্লিং নিজের তরফ থেকে আমি তো তোমাকে গ্যারান্টি দিতেই পারি। কিন্তু অন্য আরেকজনের সাথে কথা না বলে তো তোমাকে পুরোপুরি পাকা কথা দিতে পারছি না। তবে আমি চেষ্টা করব। তোমাদের দু’জনের মধ্যে এপয়েন্টমেন্টটা যাতে করতে পারি। কিন্তু তবু বলছি। আকাশ কুসুম কিছু ভেবে বসো না আগে থেকেই। কারন আমি জানি, তুমি যেমনটা ভাবছ, ব্যাপারটা তেমন একেবারেই হবে না। তবে আমি নিজেও চাই তোমরা দু’জন একবার একে অপরের মুখোমুখি হয়ে কথা বল”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আমিও তার সাথে কথা না বলে কলকাতা থেকে ফিরব না। যে করেই হোক তার সাথে আমাকে মুখোমুখি কথা বলতেই হবে। আচ্ছা সে’কথা এখন থাক। তুমি শুধু এপয়েন্টমেন্টটা কনফার্ম করো আমাকে। আর অন্যান্য খবর কি বল”?
 

পরিতোষ বলল, “নতুন খবর তো আর তেমন কিছু নেই আপাততঃ সুইট হার্ট। দিবাকর আর রবিশঙ্করের পাট তো চুকে গেছে। ওঃ হ্যাঁ, কলকাতা এসে এবার কিন্তু আমার কাছে গচ্ছিত থাকা আমার সতীনের সম্পদ গুলো নিয়ে আমার কাঁধ থেকে বোঝাটা নামিয়ে ফেলো প্লীজ”।
 

সীমন্তিনী বলল, “বরানগর এরিয়ায় কোন একটা ন্যাশনালাইজড ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট করতে হবে। আপাততঃ টাকাটা সেখানেই রাখতে হবে। ওই এরিয়ার কোন ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সাথে তোমার জানা শোনা আছে”?

পরিতোষ বলল, “ও নিয়ে ভেব না। ইটস এ ম্যাটার অফ হার্ডলি হাফ এন আওয়ার। হয়ে যাবে। কিন্তু যার নামে একাউন্ট খোলা হবে তার আইডি, প্যান কার্ড, আধার কার্ড বা ভোটার আইডি কিন্তু থাকতে হবে”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ সে’সব আছে। কিন্তু নর্থ বেঙ্গলের ভোটার আইডি চলবে তো”?

পরিতোষ বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তাতে কোন সমস্যা হবে না। আমি নিজে তোমাকে ব্যাঙ্কে নিয়ে যাব”।

সীমন্তিনী বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ পরিতোষ। কিন্তু তুমি কিছু মনে কোর না। আমি এখনই চাইছিনা যে আমার দাদাভাই বা আমার রচুসোনার সাথে তোমার এখনই পরিচয় হোক। আমি এখনই তাদের সাথে তোমার মুখোমুখি করাতে চাই না। তবে ব্যাপারটা অন্য রকমও হতে পারে। সেটা এখনই বলতে পারছি না। তবে আপাততঃ সেটা চাইছি না আমি”।

পরিতোষ বলল, “ওকে ডার্লিং। অ্যাজ ইউ উইশ। তবে তোমাকে আমি আগে বলেছি কিনা ঠিক মনে করতে পারছি না। তোমার দাদাভাই আর তোমার রচুসোনা আমাকে না চিনলেও, আমি কিন্তু দু’জনকেই ভাল ভাবে চিনি”।

সীমন্তিনী বলল, “সে আমি নিজেও আন্দাজ করতে পারছি। তবু আমি চাইনা তোমাদের মধ্যে ফরম্যাল পরিচয়টা এখনই হোক। হবে তো বটেই। এবারেই যে হবে না সেটাও জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ইফ সিচুয়েশন ডিমান্ডস তবে সেটা হতেই পারে। তবে সবটাই ডিপেণ্ড করছে সারকামস্ট্যান্সের ওপর। দেখা যাক। তুমিও আমাকে প্রেসার দিও না এ ব্যাপারে প্লীজ”।
 

পরিতোষ বলল, “ওঃ হ্যাঁ, যে কথাটা আগে বলতে চেয়েছিলাম, একটা খবর দেবার আছে। তোমার দাদাভাই আর তোমার রচুসোনা আজ গরিয়াহাট মার্কেটে গিয়েছিল। সেখানে একটা শাড়ি কিনে ফুটপাথ দিয়ে যাবার সময়েই তোমার বৌদির হাত থেকে শাড়িটা ছিনতাই হয়ে যায়”।

সীমন্তিনী প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “অ্যা? কী বলছ তুমি? ওরা আজ গরিয়াহাটায় গিয়ে ছিনতাইবাজের পাল্লায় পড়েছিল? আমার সাথে দুপুরে ওদের কথা হয়েছিল। তখন তো ওরা কেউ বেরোবার কথা বলেনি আমাকে? আর আমার মনে হয় দাদাভাই বোধহয় এই প্রথম রচুকে কিছু একটা কিনে দিয়েছিল। আর সেটা ছিনতাই হয়ে গেল? ইশ”।
 

পরিতোষ বলল, “এতোটা আফসোস করার কিছু নেই ডার্লিং। তুমি তো জানই, তারা দু’জনেই আমার কনস্ট্যান্ট ওয়াচে আছেন। দু’মিনিটের ভেতর ছিনতাইবাজ ধরা পড়েছে। তোমার বৌদিও তার ছিনতাই হয়ে যাওয়া জিনিস ফেরৎ পেয়ে খুশী হয়েছেন”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক গড। তোমাকেও অনেক অনেক ধন্যবাদ পরিতোষ। বিয়ের পর রচুসোনা কখনও দাদাভাইয়ের কাছে কিছু কেনার বায়না ধরেনি, এ আমি খুব ভালভাবে জানি। এই প্রথম বুঝি দাদাভাই ওকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেটা হারিয়ে গেলে রচু আর দাদাভাই দু’জনেই খুব কষ্ট পেত। তাই তোমাকে আরও একবার থ্যাঙ্কস জানাচ্ছি”।

পরিতোষের সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করবার আগেই ফোনটা দু’বার বিপ করেছিল। পরিতোষ ফোন কাটতেই সীমন্তিনী দেখল রচনা ফোন করেছিল। মোবাইলটা রেখে সে ল্যাণ্ডলাইন ফোনটা টেনে নিয়ে রচনার মোবাইলে ফোন করল। রচনা ফোন ধরতেই সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে রচু, তুই ফোন করেছিলি? আমি একটু আরেকজনের সাথে কথা বলছিলাম রে। বল কি খবর? রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে তোদের”?
 

রচনা বলল, “না দিদিভাই এখনও খাইনি। কিন্তু সন্ধ্যের পর তোমার সাথে কথা হয়নি বলেই ফোন করলাম। তুমি বাড়িতেই আছ তো? না কি”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁরে, ঘরেই আছি”।

রচনা বলল, “কবে যে দশ তারিখ আসবে, আর কবে যে আমি তোমাকে দেখতে পাব, এটা ভেবেই আমি অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আর দিদিভাই শোনো না, আজ না একটা ঘটণা ঘটে গেছে গো”।

সীমন্তিনী উদ্বিঘ্ন ভাবে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে রে? তুই আর দাদাভাই ঠিক আছিস তো”?

রচনা তাড়াতাড়ি বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ দিদিভাই আমরা সবাই ঠিক আছি। আসলে আমরা আজ গরিয়াহাটে গিয়েছিলাম একটু ঘুরতে। না এমনি এমনি ঘুরতে যাই নি। আসলে তোমার দাদাভাই আজ প্রথম মাইনে পেয়েছেন মহিমা বৌদির কাছ থেকে। সেই খুশীতে তিনি আমাকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। আর জানো দিদিভাই, শাড়ির দোকানটা থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে আসবার সময়েই কেউ একজন ভিড়ের মধ্যে আমার হাত থেকে ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল”।

সীমন্তিনী সব জেনেও না জানার ভাব করে বলল, “ওমা সে কিরে? তারপর”?

রচনা বলল, “আমি তো কেঁদেই ফেলেছিলাম। শাড়িটা খুব পছন্দ করে কিনেছিলাম গো। তোমার দাদাভাই এই প্রথম একটা শাড়ি কিনে দিয়েছিলেন। সেটা হাতছাড়া হয়ে যেতে আমি তো কাঁদতে কাঁদতে ফুটপাথের ওপরেই বসে পড়েছিলাম। তোমার দাদাভাই আমাকে কোনরকমে সামলেছিলেন। তারপর কোত্থেকে একটা লোক শাড়ির ব্যাগটা এনে আমার হাতে দিয়ে বলল যে ছিনতাইবাজটা পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আর লোকটা আমার শাড়ির ব্যাগটা নিয়ে এসেছে। আমি তো বিশ্বাসই করতে পারিনি যে শাড়িটা আবার ফিরে পাব”?

সীমন্তিনীও খুশী হয়ে বলল, “সত্যিরে। আমার রচুসোনা নিশ্চয়ই খুব লাকি। নইলে গরিয়াহাটের মত ভিড় ভার এলাকায় এভাবে ছিনতাই হয়ে যাওয়া জিনিস কেউ খুঁজে পায়? আচ্ছা কেমন শাড়ি কিনেছিস রে? খুব দামী”?

রচনা বলল, “খুব দামী নয় গো দিদিভাই। আসলে তুমি তো জানই কলকাতা আসবার পর থেকে আমরা কত অশান্তির ভেতর দিন কাটাচ্ছি। কয়েকদিন হল মহিমা বৌদির ওখানে কাজ শুরু করবার পর থেকে তোমার দাদাভাই কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠেছেন। আজ উনি প্রথম মাইনে পেয়েছেন। বলছিলেন একটা টিভি কিনবেন। আমিই তাকে বাধা দিয়ে বললাম যে এখন টিভি কিনতে হবে না। টিভি এক দু’মাস পরে কিনব। তখন জোর করে আমাকে শাড়িটা কিনে দিলেন। আমি তো নিতেই চাইছিলাম না। আচ্ছা তুমি বল তো দিদিভাই, এমন সময় এসব ফালতু খরচা করবার কোন মানে হয়? সামনেই পূজো। তখনও তো কিছু খরচাপাতি আছে। আর জিনিসটাও দেখ, প্রায় হাতছাড়া হয়েই গিয়েছিল। ভাগ্যিস ফিরে পেয়েছি”।
 

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কেমন রে শাড়িটা? একটু বল না”।

রচনা বলল, “একটা সাউথ ইণ্ডিয়ান সিল্কের শাড়ি গো। টকটকে লাল। পাড়টা ডীপ গ্রীন কালারের। লাল সিল্কের ওপর লাল সিল্কের সুতো দিয়েই পাতা পাতার ডিজাইনের এমব্রয়ডারি করা। আমার খুব পছন্দ হয়েছে শাড়িটা। তুমি শাড়িটা পড়লে তোমাকে খুব দারুণ দেখাবে। তুমি যখন এখানে আসবে তখন তুমি সেটা প্রথম পড়বে দিদিভাই। এ কটা দিন শাড়িটা আমি তুলে রাখব”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “পাগলী সোনা আমার। তোর বর এই প্রথম তোকে একটা শাড়ি কিনে দিয়েছে। আর তুই নিজে সেটা না পড়ে আগেই আমাকে পড়াতে চাইছিস”?

রচনা ধীর গলায় বলল, “তাতে যদি আমার ভালো লাগে, তুমি তাতে বাঁধা দেবে দিদিভাই”?

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পাগলী মেয়ের পাল্লায় পড়েছি তো? আচ্ছা বাবা দিস। পড়ব আমি। হয়েছে এবার খুশী তো”?

রচনা বলল, “নিজে নীলকণ্ঠ হয়ে আমার জীবনে সব খুশী তো তুমিই এনে দিয়েছ দিদিভাই। তুমি না থাকলে আমি কি আজকের এই দিনটা দেখতে পেতুম বল? এখানে আসবার পর থেকে বাড়ির সকলের জন্য মন কেমন করে। আমাদের বিয়ের পর থেকেই তুমি আমাদের কাছ থেকে দুরে সরে গেছ। আমার জীবনে যত আপনজন আছে তুমি হচ্ছ তাদের সবার ওপরে। তোমাকে যে আমার অনেক কিছু দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পারছি কোথায়? তুমি তো স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে গেছ আমাদের সবাইকে ছেড়ে। দিদিকে দেখতে গিয়ে তোমার সাথে শুধু একটা রাত কাটিয়ে এসেছি। কিন্তু তাতে কি মন ভরেছে আমার? এখন মনে হচ্ছে তোমার দাদাভাইয়ের সাথে আমার বিয়েটা না হলেই বোধ হয় ভাল হত। আমাদের বিয়ের আগেই তো আমি তোমাকে বেশী কাছে পেতাম। বিয়ের পর তোমাদের সংসারে এসে সব কিছু পেয়ে আমি তোমাকেই হারিয়ে বসেছি”।
 

সীমন্তিনী রচনাকে থামিয়ে দিয়ে আদর ভরা সুরে বলল, “রচু সোনা বোন আমার, তুই মন খারাপ করিস নে বোন। দ্যাখ তোর এ দিদিভাইটা যে আর পাঁচটা অন্য মেয়ের মত নয়। বাড়িতে তো আমাকে বংশের কুলাঙ্গার বলে সবাই। আর সেটা যে মিথ্যে, তাও তো নয়। আমি সত্যিই খুব বেয়ারা মেয়ে। কিন্তু আমার জীবনের এখন শুধু একটাই চাওয়া। তুই আর দাদাভাই যেন সব সময় সুখে থাকিস। আমি আর কিছু চাই না রে। তোকে পেয়ে তোর মা বাবা ভাই বোনকেও কাছে পেয়েছি। আর কি চাই বল? আচ্ছা, ও’সব কথা থাক। শোন তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে। সে’সব ফোনে বলব না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোকে আমার বুকে জড়িয়ে ধরে বলব। তোদের বিয়ের আগে কালচিনির বাড়িতে তোর বিছানায় শুয়ে যেভাবে গল্প করতাম, সেভাবে। এবার খুশী তো”?

রচনা খুশী ভরা গলায় বলল, “তাতেও তো দশটা দিন আমাকে স্বস্তিতে থাকতে দেবে না। এ দশটা দিন যে আমার কি করে কাটবে”!

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা রচু। এবার রাখতে হবে রে। খুব ক্ষিদে পেয়েছে। লক্ষীদিও খাবার বেড়ে ডাকছে। তাই এখন ছাড়ছি রে। তবে শোন। দশ তারিখ সকালে আমি যেন তোর হাতের স্পেশাল আলুর দম আর লুচি খেতে পারি”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 124)

রচনা ফোন নামিয়ে রাখতেই রতীশ তাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি মন্তিকে ও’সব মিথ্যে কথা বললে কেন রচু”?

রচনা স্বামীর একটা হাত ধরে বলল, “তুমি রাগ করেছ? না সোনা রাগ কোর না। আসলে ভেবেছিলাম যে আমি সত্যি কথাটা বললে দিদিভাই আমাকে বকবেন। হয়ত বলবেন কি দরকার ছিল তার জন্যে শাড়ি কিনতে যাবার। আর তাছাড়া দিদিভাই এখানে আসবার পর তাকে আমি সত্যি কথাটা বলবই। শাড়িটা দিয়ে তাকে আমি একটা শুধু সারপ্রাইজ দিতে চাই। তুমি প্লীজ আমার ওপর রাগ কোর না সোনা”।

রতীশ রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ও, এই কথা? তবে ঠিক আছে। এবার এস তো আমার আদরের বৌটাকে একটু ভাল করে আদর করি”।

রচনাও রতীশকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল।


*****************

দশ তারিখ ভোর বেলা রতীশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই রচনা খুশী ভরা মনে আলুর দম বানাবার যোগার যন্ত্র করতে লাগল। রতীশ আগের দিন সব্জী আর মুদির দোকান থেকে অনেক কিছু কিনে এনেছে। রচনা ভেবেছে সীমন্তিনীর জন্যে ছোলার ডালের রসা বানাবে। সীমন্তিনী নিজেই বলেছে সেটার কথা। আর সীমন্তিনীর কথাতেই সে আগের রাতে ছোলার ডাল জলে ভিজিয়ে রেখেছিল। রচনা মনে মনে ভাবল, আগে আলুর দমটা বানিয়ে হাতে সময় থাকলে ছোলার ডালগুলো বেঁটে মুঠো করে সেদ্ধ করে রাখতে পারলে রান্নার সময় সময়টা কম লাগবে। সকাল সাতটার মধ্যেই আলুর দম তৈরী হয়ে গেল। তারপর ছোলার ডাল গুলো বাটতে শুরু করতেই সীমন্তিনীর ফোন এল। জানাল যে সে হাওড়ায় পৌঁছে গেছে। সেখান থেকে সোজা বাড়ি আসবে। রচনা খুব খুশী হয়ে ডাল বাটতে শুরু করল।

আটটা বাজতে না বাজতেই রতীশের ফোন এল। জিজ্ঞেস করল “মন্তি ফোন করেছিল রচু? ও কি হাওড়া পৌঁছে গেছে”?

রচনা জবাব দিল, “হ্যাঁ সোনা, দিদিভাই সাতটার দিকেই হাওড়া পৌঁছে গেছেন। প্রায় একঘণ্টা তো হয়েই গেল। নিশ্চয়ই আর খানিকক্ষণের ভেতরেই চলে আসবেন”।
 

ফোনে কথা বলতে বলতে রচনা তাদের ব্যালকনিতে এসে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাল। একটু দুরে পানের দোকানটার সামনে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোন ট্যাক্সি বা অটো দেখা যাচ্ছে না। ফোনে কথা শেষ করতেই মনে হল ব্যালকনির নিচে রাস্তায় একটা গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ পাওয়া গেল। তাদের বিল্ডিঙের সামনেটা ব্যালকনি থেকে চোখে পড়ে না। রচনা মনে মনে ভাবল এ গাড়িটা কার? এ গাড়িতেই আসেননি তো দিদিভাই? ভাবতে ভাবতেই দেখতে পেল একটা ট্যাক্সি বাড়ির দিক থেকে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর তার ঠিক পেছনেই আরেকটা ট্যাক্সি দেখা গেল। দ্বিতীয় ট্যাক্সিটা পানের দোকানটার কাছে গিয়ে থামতেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো লোক গাড়িটার কাছে এগিয়ে গেল। আর খানিক বাদে দু’জন লোক গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা আবার বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। আর প্রায় সাথে সাথে ঘরের কলিং বেলটা বেজে উঠল। রচনা চমকে উঠে ড্রয়িং রুমের ভেতর ঢুকে সামনের দরজার ম্যাজিক আইয়ের ফুটোয় চোখ রেখে সীমন্তিনীকে দেখেই “দিদিভাই” বলে চেঁচিয়ে উঠে দরজা খুলে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল।
 

সীমন্তিনীও “রচু, রচু, সোনা বোন আমার” বলতে বলতে রচনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরল। খুশীতে রচনার দু’চোখ জলে ভরে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পড়ে আবেগ সামলে রচনা বলল, “এস দিদিভাই, ভেতরে এস। তোমার লাগেজ কোথায়”?

সীমন্তিনী দরজার বাইরে থেকে নিজের লাগেজটা ভেতরে আনতেই রচনা দরজা বন্ধ করে দিয়ে ব্যাগটা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “তোমার দাদাভাই এইমাত্র ফোন করেছিলেন। খোঁজ নিচ্ছিলেন তুমি এসে পৌঁছেছ কি না। দাঁড়াও এখন ওনার ব্রেকফাস্ট ব্রেক চলছে। খবরটা এখনই জানিয়ে দিই। নইলে চিন্তায় থাকবেন। তুমি বোসো দিদিভাই” বলে রতীশকে ফোন করল। রতীশ ফোন ধরতেই রচনা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, “হ্যাঁ শোনো, দিদিভাই এইমাত্র ঘরে এসে পৌঁছেছেন। তুমি তোমার ক্লাস শেষ হবার সাথে সাথে বেরিয়ে পড়ো। আর হ্যাঁ শোনো, বলছি কি, আজ আর তোমাকে মাছ আনতে হবে না। দিদিভাইকে বরং কাল মাছ খাওয়াব। তুমি তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এস। এই নাও দিদিভাইয়ের সাথে একটু কথা বল” বলে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল।

সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল “দাদাভাই, আমি এই জাস্ট এসে পৌঁছলাম। তুই কখন আসবি রে”?

রতীশ বলল, “ন’টা থেকে সাড়ে দশটা আমার একটা কোচিং আছে। তারপরই ছুটি”।

সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তোর সেশন শেষ হলে তাড়াতাড়ি চলে আসিস। তোকে আজ আর কোথাও গিয়ে মাছ টাছ আনতে হবে না। কাল দেখা যাবে। তুই তাড়াতাড়ি চলে আয় শুধু”।

“আচ্ছা ঠিক আছে” বলে রতীশ ফোন কেটে দিতেই সীমন্তিনী রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁরে রচু, আলুর দম আর লুচি বানিয়েছিস তো”?

রচনা নিজের আলমারি খুলে একটা ধোয়া নাইটি বের করে সীমন্তিনীকে দিয়ে বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। আলুর দম হয়ে গেছে। লুচির আয়োজনও করে রেখেছি। তুমি হাতমুখ ধুয়ে এস। আমি গরম গরম ভেজে দিচ্ছি”।

রচনা সীমন্তিনীকে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কিচেনে গিয়ে লুচি বানাবার আয়োজন করতে লাগল। হঠাৎ ড্রয়িং রুমের ভেতর থেকে ফোন বেজে ওঠার শব্দ পেয়েই রচনা ছুটে এসে দেখল সীমন্তিনীর ফোনটা বেজে যাচ্ছে। সীমন্তিনী বাথরুমের ভেতর থেকে নিজের ফোনের শব্দ চিনতে পেরে দরজা না খুলেই চেঁচিয়ে বলল, “রচু ফোনটা ধরে একটু বলে দে আমি খানিকক্ষণ বাদে কলব্যাক করব”।

রচনা কলটা রিসিভ করে কানে ফোন লাগাতেই ভারিক্কি পুরুষকণ্ঠে কেউ একজন বলে উঠল, “তুমি যে তোমার দাদাভাইয়ের বাড়ীতে পৌঁছে গেছ সে খবর তো আমি পেয়েই গেছি। কিন্তু ডার্লিং, তুমি নিজে একটা ফোন করে আমাকে একটু আশ্বস্ত করলে আমি আরেকটু খুশী হতাম”।

সীমন্তিনীকে কেউ “ডার্লিং” বলে সম্মোধন করছে শুনেই রচনা এক মূহুর্তের জন্য থতমত খেয়ে গেল। সে কী বলবে না বলবে ভাবতে ভাবতেই পুরুষ কণ্ঠটি আবার বলে উঠল, “কি ব্যাপার সুইট হার্ট, একেবারে সাড়া শব্দটি নেই যে? তুমি ঠিক আছ তো? এনি প্রব্লেম? দাদা-বৌদি ভালভাবে আপ্যায়ন করেছে তো তোমাকে? না কি”?

রচনা একটা ঢোঁক গিলে তাড়াতাড়ি বলল, “দিদিভাই বাথরুমে স্নান করছেন। আপনাকে একটু বাদে ফোন করবেন বলেছেন”।
 

কোনরকমে কথাটুকু বলে ফোনটা অফ করতে যেতেই ও’পাশ থেকে আবার বলল, “স্যরি, আমি বুঝতে পারিনি যে ফোনটা অন্য কেউ ধরেছে। আপনি নিশ্চয়ই মন্তির বৌদিসোনা। কিন্তু ওভাবে না জেনে শুনেই ও’কথাগুলো বলা আমার ঠিক হয়নি। কিছু মনে করবেন না প্লীজ। রাখছি” বলতেই লাইন কেটে গেল।
 

রচনা ফোনটা দেখে বুঝল ‘পরি’ বলে কোন একজন ফোনটা করেছিল। ফোনটা টেবিলে রেখে সে আবার কিচেনে আসতে আসতে ভাবতে লাগল, লোকটা কে? ‘পরি’ বলে কারুর কথা তো সে দিদিভাইয়ের মুখে কখনও শোনেনি। কিন্তু লোকটা তো দিদিভাইকে মন্তি বলে ডাকছে! তাকে ডার্লিং, সুইট হার্ট বলছিল ফোনে। এমন ভাবে তো প্রেমিক বা স্বামীরাই কথা বলে। দিদিভাই কি তাহলে এ লোকটার সাথে প্রেম করছে? এ’কথা মনে হতেই রচনার মনটা খুশীতে ভরে উঠল। মনে মনে বলল, “হে ভগবান, তাই যেন হয়। আমার দিদিভাইয়ের একটা ঘর-বর হলে এর চেয়ে সুখের খবর আর কি হতে পারে”।

সীমন্তিনী স্নান সেরে বেরোতে রচনা কিচেন থেকেই বলল, “দিদিভাই, চুল আঁচড়ে এ ঘরে চলে এস। হয়ে গেছে আমার”।
 

লুচি, আলুর দম, ছোলার ডালের ধোকার রসা, আর পায়েস। আলুর দম দিয়ে লুচির একটা টুকরো মুখে ফেলেই সীমন্তিনী একহাত দিয়ে পাশে বসা রচনার একটা হাত ধরে বলল, “উম্মম কী বানিয়েছিস রে রচু সোনা! তোর মনে আছে? তোদের বিয়ের পরদিন বাড়িতে তুই জোর করে লুচি আলুর দম বানিয়েছিলি। জেঠু বাবা কাকু সবাই খুব খুব প্রশংসা করেছিল তোর। মায়েরা সেদিন মুখ ফুটে কিছু না বললেও তারাও যে খেয়ে খুব খুশী হয়েছিলেন সেটাও মনে আছে আমার। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তার চেয়েও বেশী টেস্টি হয়েছে রে। আঃ দারুণ। এতদিন তোর হাতের রান্না বড্ড মিস করেছি রে”।
 

ব্রেকফাস্ট খেতে খেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “লক্ষীদির হাতের রান্না কেমন গো দিদিভাই? ভাল”?
 

সীমন্তিনী খেতে খেতেই জবাব দিল, “ঠিকই আছে মোটামুটি। চলে যায় কোনরকম। মাঝে মাঝে সত্যিই খুব ভালো রাঁধে। মাঝে মধ্যে আবার অতটা ভাল হয় না। আচ্ছা রচু, আমি যখন স্নান করছিলাম তখন কে ফোন করেছিল রে? ফোনটা তো আর দেখাও হল না”।

রচনা খেতে খেতেই জবাব দিল, “নামটা তো ঠিক বলেননি দিদিভাই। তবে আমি কলটা রিসিভ করে কিছু বলে ওঠবার আগেই, বাড়ি পৌছে তুমি তাঁকে কোন খবর দাওনি বলেই একটু অনুযোগ করছিলেন। তুমি বাথরুমে আছ শুনে, আর তেমন কিছু বলেননি। কলটা কেটে যাবার পর দেখলাম “পরি” নামের কেউ একজন ফোন করেছিলেন”।

রচনার মুখে এ’কথা শুনেই সীমন্তিনী নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “এই সেরেছে রে। নিশ্চয়ই কথা বলবার আগেই ডার্লিং, প্রেয়সী, সুইটহার্ট- এসব বলেছে তাই না”?
 

রচনা একটু মনঃক্ষুণ্ণ ভাবে বলল, “এ ভদ্রলোকের কথা তো কখনও আমাকে বলনি দিদিভাই। কতদিন ধরে তার সাথে জানা শোনা তোমার? আমাকেও তুমি জানতে দাও নি”?
 

সীমন্তিনী খেতে খেতে রচনার হাতটা ধরেই বলল, “হু, যা ভেবেছি, ঠিক তাই। তুই নিশ্চয়ই ভেবেছিস ওর সাথে আমি প্রেম করছি। তাই না”?

রচনা বেশ শান্ত গলায় বলল, “অমন ভাষায় প্রেমিক আর স্বামী ছাড়া আর কেউ কথা বলে বলে তো আমার জানা নেই দিদিভাই। কিন্তু অবাক হচ্ছি এই ভেবে, যে তুমি আমার কাছে থেকেও সে’সব কথা বেমালুম চেপে গেছ এতদিন”?

সীমন্তিনী আর থাকতে না পেরে জোরে ‘হাহা হা’ করে হেসে উঠে বলল, “আমি ঠিক জানতুম। তুই এ’সব কথাই বলবি। আরে পাগলী, তুই তো আমার জান রে। তোর কাছে আমি কিছু লুকোতে পারি? তুই যা ভাবছিস তা নয়রে পাগলী। ওর কথা বার্তাই অমন। যখনই ফোন করবে তখন আগে ওই সব শব্দ গুলো ব্যবহার করবেই। ডার্লিং, সুইট হার্ট, প্রেয়সী, প্রিয়তমা - যা মুখে আসে তাই বলে। কিন্তু খুব ভাল লোক রে। আমার কলিগ আইপিএস অফিসার। আমার চেয়ে বছর চারেকের সিনিয়র। বয়সে অবশ্য অত বড় নয় আমার চেয়ে। মোটে বছর দুয়েকের মত বড়। ও আমার বড় বলেই আমাকে নাম ধরে ডাকে। আর ওর সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেছে বলে আমিও ওকে ছোট নামে ডাকি। পরি বলে। ওর আসল নাম হচ্ছে পরিতোষ। তবে তুই একেবারেই ভাবিস না যে তার সাথে আমার কোনরকম প্রেম ভালবাসার সম্পর্ক আছে”।

রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছ তো? না আমাকে টুপি পড়াচ্ছ দিদিভাই”?

সীমন্তিনী রচনার হাতটা ধরেই বলল, “তুই এ কথা ভাবছিস কি করে যে আমি তোর কাছে মিথ্যে কথা বলব? তুই জানিসনা? যেদিন থেকে তুই সম্পর্কে আমার বৌদি হয়েছিস সেদিন থেকেই তুই যে আমার জীবনের সব কিছু হয়ে উঠেছিস রে। আমি হয়ত নিজের মনকে ধোকা দিতেও মনে মনে কোন মিথ্যে কথা বলতে পারি। কিন্তু তোকে কখনও মিথ্যে বলতে পারব না। খুব বেশী প্রয়োজন হলে তোর কাছে হয়ত আমি কিছু কথা গোপন রেখে যেতে পারি। তবে সেটাও সাময়িক। তোর কাছে কিছু গোপন করে রাখলেও সময়মত তোকে সেটা খুলে বলবই আমি। আর তুই তো জানিসই আমার জীবনের একটা কথাই শুধু আমি তোর কাছে এখনও গোপন রেখেছি। সেটাও তোকে ঠিক সময়ে বলব। আর তখন গোপন রাখার কারনটাও জানতে পারবি তুই। তবে তুই বিশ্বেস কর বোন। এই পরি আমার শুধুই একজন খুব ভাল বন্ধু। আমার জীবনে বর্তমানে ওর চেয়ে বড় বন্ধু আর কেউ নেই। তাই ওর ওই আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও না শোনা করে উড়িয়ে দিই”।

রচনা একটু সহজ হয়ে উঠে বলল, “তার মানে তুমি বলছ আমার কাছেও কিছু গোপন কর তুমি”?

সীমন্তিনীও সহজেই জবাব দিল, “হ্যা করিই তো। আর সে কি আজকের থেকে? তোর সাথে আমার যেদিন পরিচয় হয়েছে সেদিন থেকেই তো এমন গোপন রাখতে শুরু করেছি। পুরনো কথাগুলো সব কি ভুলে গেছিস তুই? তোর সাথে যখন আমার পরিচয় হয়েছিল, তখন তোরা কেউ কি জানতিস যে আমি রতীশ ভট্টাচার্যির ছোট বোন। বা এটাও কি বুঝতে পেরেছিলিস যে তোকে আমার দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেব বলেই তোর সাথে আর ভাই, মাসি মেসোর সাথে ভাব করেছিলাম। নিজের পরিচয় গোপন রেখেই তো তোর সাথে ভাব করেছিলাম আমি। কিন্তু ঠিক সময়ে আমি নিজেই তো সে গোপনতার ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়েছিলাম তোদের কাছে। এখনও অনেকের কাছে অনেক কথা আমি গোপন যাই। আবার সঠিক সময় এলে এসব কথাও সবাইকে খুলে বলি। এ’কথাও তো তোকে আগেই বলেছি আমি। আর পুলিশের কাজে আমাদের নানা সময় নানা জনের কাছে অনেক কিছু গোপন রাখতেই হয় রে। নিজের লোকদের কাছেও। সেটা আমাদের সার্ভিসেরই একটা অঙ্গ বলতে পারিস। এই তো দেখনা, তোদের দিদিভাই যে একজন পুলিশ অফিসার এটা তো কলকাতায় সকলের কাছ থেকে আমি গোপন রাখতে চাইছি। তোদেরকেও সে সত্যিটা গোপন রাখতে বলেছি। প্রয়োজন আছে বলেই। আর সে প্রয়োজনটা কিসের সেটাও পরে কখনও নিশ্চয়ই জানতে পারবি তোরা। তবে এই মূহুর্তে তোর কাছে পরিকে নিয়ে আমি যে কোন কথা গোপন করছি না, এটা তুই বিশ্বাস করতে পারিস”।

রচনা খেতে খেতেই বলল, “তা তোমার এই পরির সাথে তোমার কতদিনের পরিচয় দিদিভাই? এটা বলা যাবে? না এটাও গোপন রাখবে আপাততঃ”?

সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে রচনার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, “খুব দুষ্টুমি করতে শিখেছিস না? খুব পেকেছিস। তবে শোন, পরিতোষকে আমি আগে চিনতুমই না। তোদের বিয়ের পর পুলিশের ট্রেনিং নিতে হায়দ্রাবাদ যখন গিয়েছিলাম, তখনই ওর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। ও আমাদের ট্রেনিং-এ একজন গেস্ট ফ্যাকাল্টি মেম্বার ছিল। মাঝে মাঝে আমাদের ক্লাস নিতে আসত। সেই থেকেই পরিচয়। আর ওই ব্যাচে আমিই একমাত্র বাঙালী মেয়ে ছিলাম বলে স্বাভাবিক কারণেই আমার সাথে ও একটু বেশী কথা বলত। আর অবিবাহিত বলে স্বাভাবিক ভাবেই আমার ওপর কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরিচয় হবার মাস ছয়েক বাদেই ও আমাকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু আমি তো তোকে আগেই বলেছি যে আমি কখনও বিয়ে করব না। ওকেও একই কথা বলেছিলাম। ও একটু দুঃখ পেয়েছিল। কিন্তু আমাকে কোনরকম জোরাজুরি না করে আমার বন্ধু হতে চাইল। লোক হিসেবে ভাল লাগত বলে আমিও তাকে বন্ধু করে নিয়েছি। আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর ওর সাথে আমার আর দেখাই হয়নি। কিন্তু আমাদের মধ্যে নিয়মিত ফোন যোগাযোগ আছে। ও দু’বছর ধরে কলকাতাতেই পোস্টেড আছে। আর যখনই ফোন করবে তখন প্রথমেই ডার্লিং, সুইটহার্ট এসব বলে। অনেক বারন করেও ওকে এটা থেকে বিরত করতে পারিনি আমি। তাই এখন আর ওই কথাগুলো গায়ে মাখি না। আর একই ডিপার্টমেন্টে কাজ করি বলে আমাদের বন্ধুত্বটা দিনে দিনে বাড়ছেই। কিন্তু ও নিজেও যেমন বুঝে গেছে যে আমি সত্যিই কোনদিন কাউকে বিয়ে করব না, তেমনি আমিও ওর আবোল তাবোল কথাগুলো শুনেও মনে মনে বিশ্বাস করি, ও আর কোনদিন আমাকে বিয়ে করবার কথা বলবে না। এখন আমরা দু’জনেই দু’জনার খুব ভাল বন্ধু। ওকে যখন যা অনুরোধ করি, ও আমার সব কথা রাখে। তাই আমিও ওকে পরম বন্ধু বলে ভাবতে শুরু করেছি। ওর নিজের বলতে কেউ নেই। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছে। পুলিশে চাকরী পাবার মাস দু’য়েকের ভেতরেই ওর বাবাও মারা যান। সেই থেকে ওর মাথার ওপর আর কেউ নেই। এখন ওর থার্টি প্লাস চলছে বলে আমি চাইছি ও এখন একটা বিয়ে করুক। এটাও আমার এবারের একটা কাজ। ওর সাথে কাল বা পরশু একটা মেয়ে দেখবার কথা আছে। এবারে বুঝেছিস তো পাগলী? তুই যা ভাবছিস, তা একেবারেই নয়”।

খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে খুশী হলেও মনে মনে একটু হতাশ হল। সে ভেবেছিল তার দিদিভাই বুঝি আগের সবকথা ভুলে গিয়ে নিজের জন্য একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু সীমন্তিনী যে তাকে মিথ্যে কিছু বলছে না, এ ব্যাপারেও তার মনে আর কোন সন্দেহ রইল না।
 

সীমন্তিনী হাত ধুতে ধুতে বলল, “রচু সোনা, আমি একটু পরিকে একটা ফোন করে নিই রে। ও বোধহয় এতক্ষণে অফিসে চলেই গেছে” বলে ড্রয়িং রুমে এসে নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে আবার ডাইনিং রুমে এসে পরিতোষকে ফোন করল। পরিতোষ কল রিসিভ করতেই সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা পরি, এতদিনেও তুমি শোধরালে না। আমি বাথরুমে স্নান করছিলাম বলে রচুকে ফোনটা ধরতে বলেছিলাম। আর তুমি ওই সব বলে মেয়েটাকে ঘাবড়ে দিলে? আমি এখন আমার রচু সোনাকে বোঝাতেই পারছি না যে আমি তোমার ডার্লিং প্রেমিকা সুইটহার্ট কিছুই নয়। আমরা শুধু একে অপরের বন্ধু”।

সীমন্তিনী ফোনের স্পীকার অন করে রচনার গলা জড়িয়ে ধরতেই ও’পাশ থেকে পরিতোষ বলল, “সরি ডার্লিং। আই এম ভেরি সরি। কিন্তু ফোনটা যে তোমার রচুসোনা তুলবে, এটা কি আমার জানা ছিল? আর তাছাড়া আমি নিজেই তো তার কাছে আমার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছি”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা সে করেছ, করেছ। এবার আসল কথাটা বল দেখি। ওই মেয়েটার কাছে আমাকে কবে নিয়ে যাচ্ছ”?

পরিতোষ বলল, “সকালে তার সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি তাকে দেখতে চাও বলাতে সে কোন আপত্তি করেনি। কাল সকাল ন’টায় তোমার সাথে দেখা করতে রাজি আছে। পরশু সে সময় দিতে পারবে না। কিন্তু একটা মুস্কিল আছে সুইট হার্ট”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কিসের মুস্কিল? কালই প্রগ্রামটা ফিক্স করে ফ্যাল তাহলে”।

পরিতোষ বলল, “না না ডার্লিং সমস্যাটা অন্য জায়গায়। উনি নিজে যেখানে আছেন সে ফ্ল্যাটটা তার এক বান্ধবীর ফ্ল্যাট বলে সেখানে দেখা করতে চান না। আবার কোন হোটেল বা রেস্টুরেন্টেও আসতে চাইছেন না। তুমি যেখানে আছ সেখানেও তো তাকে নিয়ে আসা সম্ভব হবে না। আর আমার নিজের বাড়ির কথা না বলাই ভাল। সব কিছু যাচ্ছেতাই অবস্থায় আছে। ওটাকে ঠিকঠাক করে তোলাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে আবার বেলা এগারোটার পর থেকে তার মোবাইল সুইচড অফ থাকে। আজ আর আধঘণ্টার মধ্যে প্ল্যানটা পাকাপাকি না করলে কাল সকালের আগে তাকে আর ফোনে পাওয়া যাবে না। কি করি বল তো”?

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “তাহলে তো সমস্যাই। আচ্ছা পরি, একটা নিউট্রাল ভেনিউ খুঁজে পাচ্ছ না? যেখানে আমিও যেতে পারি আর তারও কোন অসুবিধে না হয়”।

পরিতোষ বলল, “তেমন কিছু তো মাথায় আসছে না ডার্লিং। তবে একটা জায়গা আছে। আমার এক পরিচিতের বাড়ি। ছেলেটা আমাকে দাদা বলে ডাকে। সে বাড়িতে শুধু বৃদ্ধা মা আর তার ছেলে থাকে। কিন্তু সে ছেলেটাও তো এতক্ষণে কাজে বেরিয়ে গেছে। ওর সাথে বোধহয় কন্টাক্টও করতে পারব না”।

সীমন্তিনী বলল, “একটু চেষ্টা করে দেখ না। তুমি তো জানই আমার হাতেও অনেক কাজ আছে। কাল হলেই সবচেয়ে ভাল হয়”।

পরিতোষ বলল, “ওকে দেখছি আমি কি করা যায়। আমি তোমাকে পরে কল করছি আবার” বলে ফোন কেটে দিল।
 

রচনা দু’জনের কথোপকথন শুনে নিজের মনের সব সন্দেহ নিরসন করে সীমন্তিনীকে বলল, “তোমার বন্ধু তো দেখছি খুবই সমস্যায় পড়েছেন। পাত্রী দেখবার জায়গাই খুঁজে পাচ্ছেন না। আচ্ছা দিদিভাই, পরিতোষ বাবুকে বলে দাও না। মেয়েটাকে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসুক। আমাদের এখানে তো কোন সমস্যা হবে না। তোমার দাদাভাই তো ভোর পাঁচটা থেকে এগারোটা সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বাড়িতেই থাকে না”।

সীমন্তিনী বলল, “নারে সেটা হবে না। এ’কথা আমি আগেই পরিকে বলেছিলাম। কিন্তু এতে পরিতোষেরই আপত্তি আছে। দাদাভাই বা তোর ওপর কোন ঝামেলা চাপাতে চায় না সে। দেখা যাক কি হয়”।

______________________________
Like Reply
(Update No. 125)

ঠিক সাড়ে এগারোটায় রতীশ বাড়ি এল। সীমন্তিনীকে দেখে সে খুব খুশী। সীমন্তিনী রতীশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই রচনা লক্ষ্য করল তার দিদিভাইয়ের চোখ দুটো যেন জলে ভরে আসছে।
 

সীমন্তিনীকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওমা এ কি দিদিভাই? তুমি কাঁদছ কেন”?

সীমন্তিনী নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে ম্লান হেসে বলল, “নারে, কিছু না। ছোটোবেলার কথাগুলো মনে পড়ছিল। একটা সময় ছিল যে কলেজের সময়টুকু ছাড়া দাদাভাই সব সময় আমার কাছে কাছে থাকত। আমিও দাদাভাইকে ছেড়ে একটা মূহুর্তও থাকতে পারতুম না। আর আজ দ্যাখ। দিনের পর দিন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পেরিয়ে যায় আমি আমার দাদাভাইকে একটু চোখের দেখাও দেখতে পাই না”।
 

রচনা আদর করে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও তো তোমাকে আমার সারাটা জীবন ধরে চোখের সামনে দেখতে চাই দিদিভাই। কিন্তু তুমি যে আগে থেকেই আমাদের কাছ থেকে দুরে সরে থাকবার প্ল্যান করে রেখেছ, সেটা যদি বিয়ের আগে বুঝতে পারতুম, তাহলে হয়তো এ বিয়েতে আমি রাজীই হতুম না”।
 

রচনার কথা শুনে সীমন্তিনী কিছু একটা বলে ওঠবার আগেই কথা ঘুরিয়ে রচনা নিজেই বলে উঠল, “আচ্ছা দিদিভাই, তোমার কালকের প্রোগ্রাম তো এখনও ঠিক হল না। তবে আজ বিকেলে কিন্তু আমরা তোমাকে নিয়ে গরিয়াহাট যাব একটু। তোমার আপত্তি নেই তো”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আবার গরিয়াহাট যাবি? সেদিন না নতুন শাড়িটা তোর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। আজ আবার সেখানেই যাবি”?

রচনা একটু হেসে বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই। ওই দোকানটাতেই যেতে হবে। ওই শাড়িটার জন্যেই একটা ব্লাউজ বানাতে দিতে হবে। সেদিন পুরোন ব্লাউজ সঙ্গে নিয়ে যাইনি বলে মাপ দিতে পারিনি। আজ ব্লাউজটা বানাতে দিয়ে আসব। তোমার ব্লাউজ এনেছ তো দিদিভাই? একটা নিয়ে নিও সাথে”।

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ওমা, ব্লাউজ বানাবি তুই। তাহলে আমার ব্লাউজ নিতে বলছিস কেন”?
 

রচনা দুষ্টুমির হাঁসি হেসে বলল, “কিছু কিছু কথা আমিও কিছু সময়ের জন্য গোপন রাখতে পারি কি না দেখি। আর ভাবছ কেন দিদিভাই। এখানে দর্জিরা নাকি খুব ভালো ব্লাউজ বানায়। তুমিও একটা বানিয়ে নিয়ে যেও”।

মিনিট দশেক বাদেই পরিতোষ ফোন করে জানাল যে মেয়েটার সাথে অন্য আরেক বাড়িতে দেখা করবার প্রোগ্রাম ঠিক করা হয়েছে। পরিতোষ ঠিক আটটার সময় সীমন্তিনীকে সামনের বড় রাস্তার মোড় থেকে গাড়িতে তুলে নেবে। সীমন্তিনীও রাজি হল। তবে সীমন্তিনী চেয়েছিল রচনাকেও সাথে নিয়ে যাবে। পরিকে সে কথা বলতেই সেও সহর্সে রাজি হল। ঠিক হল কাল সকালে সীমন্তিনীর সাথে রচনাও যাবে পরিতোষের জন্যে মেয়ে দেখতে।

বিকেলে নতুন শাড়িটার ব্লাউজ পিচটা কেটে নিয়ে রচনা রতীশ আর সীমন্তিনীকে নিয়ে গরিয়াহাটে গিয়ে দু’জনের জন্য ব্লাউজ বানাতে দিয়ে এল। ফেরার পথে একটা রেস্টুরেন্টে হাল্কা খাবার খেয়ে ঘরে ফিরল।
 

*****************

পরেরদিন শনিবার রতীশ ভোরে বেরিয়ে যাবার সময় বলে গেল ইনস্টিটিউট থেকে ফেরবার পথে বাজার থেকে মাছ নিয়ে আসবে। রচনা ইলিশ মাছ আনবার কথা বলে দিল রতীশকে। কিন্তু রতীশ বেরিয়ে যেতেই রচনা চিন্তিত ভাবে সীমন্তিনীকে বলল, “ও দিদিভাই, তোমার দাদাভাইকে তো বলে দিলাম মাছ আনতে। কিন্তু আমরা কি সাড়ে এগারোটার মধ্যে ফিরে আসতে পারব”?

সীমন্তিনী তাকে আশ্বস্ত করে বলল, “ভাবিস না রচু। আমাদের যদি ফিরতে দেরীও হয় তাহলেও এমন কিছু হবে না। দাদাভাইকে ফোন করে বলে দেব’খন। কিন্তু দাদাভাইয়ের কাছে কি ঘরের ডুপ্লিকেট চাবি আছে”?

রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, আজ যাবার সময় ডূপ্লিকেট চাবিটা তাকে দিয়ে দিয়েছি আমি”।
 

সীমন্তিনী আর রচনা দু’জনেই বেরোবে বলে সাজগোজ করছিল তখন। সীমন্তিনী বলল, “যেভাবে তুই ঘরটা সাজিয়েছিস তা মোটামুটি ঠিকই আছে রচু। তবে আর দুটো জিনিস থাকলেই আর তেমন কোন অভাব থাকত না। একটা টিভি আর একটা ফ্রিজ। এ দুটো হলেই আপাততঃ আর কিছু না হলেও চলবে। দাদাভাই সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর তুই তো একেবারে একা একা থাকিস। একটা টিভি থাকলে তবু এতটা খারাপ লাগত না”।

রচনা বলল, “থাকলে তো মাঝে মাঝে দেখতামই। আর তাতে সবচেয়ে সুবিধে হত তোমার দাদাভাইয়েরই। তোমার দাদাভাই ঘরে ফিরে আসবার পর থেকে তার তো আর তেমন কোন কাজ থাকে না। সারাদিন শুধু এ’ঘর ও’ঘর করে ঘুরে বেড়ান। বাড়িতে থাকতে তো তিনি নিয়ম করে টিভিতে নিউজ দেখতেন। বিকেলের দিকে ছোটকাকুর দোকানে গিয়ে বসতেন। এখানে সে’সব করতে পারছেন না। খবরের কাগজ পড়ার অভ্যেসও তেমন নেই। আমি তো একটা বেলাই ঘরে একা থাকি। এটা সেটা করতে করতেই সময় কেটে যায়। তোমার দাদাভাই তো এ মাসেই মাইনে পেয়ে টিভি কিনতে চাইছিলেন। আমিই বারণ করেছি। বলেছি আর দু’ এক মাস যাক। তারপর না হয় কেনা যাবে। কিন্তু এখন বেশী দরকার একটা ফ্রিজের। তোমার দাদাভাই তো আর অন্যান্যদের মত রোজ সকালে বাজারে যেতে পারেন না। অফিস থেকে ফেরার পথে দু’ তিনদিন বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শাক সবজি, মাছ মাংস কিনে আনেন। একটা ফ্রিজ থাকলে সেসব ফ্রিজে রেখে দেওয়া যেত। কিন্তু বাড়ি থেকে যা নিয়ে এসেছিলেন তা থেকে দু’লাখ টাকা তো লুঠই হয়ে গেল। এখন হাতে জমা পুঁজি যেটুকু আছে সেটুকু তো হুটহাট করে খরচ করে ফেললে হবে না। এখানে তো মহিমা বৌদি ছাব্বিশ হাজার করে মাইনে দিচ্ছেন তাকে। কয়েকমাস না গেলে ফ্রিজ কেনা সম্ভব হবে না”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা সে’সব কথা এখন থাক। পরে আলাপ করা যাবে। তোর কদ্দুর? হয়েছে? তাহলে চল, আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়ি”।

আটটা বাজবার মিনিট পাঁচেক আগেই তারা বেরিয়ে পড়ল। লিফটে চেপে নিচে নেমে বাইরের রাস্তায় আসতেই সীমন্তিনী লক্ষ্য করল, পরিতোষের ওয়াচাররা তখনও পানের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবল, পরিতোষের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে হবে। এখন যখন দিবাকর আর রবিশঙ্কর পুলিশের হাতে ধরা পড়েই গেছে, তাহলে এখন আর রচু বা দাদাভাইয়ের ওপর নজর রাখবার তেমন কোন দরকার নেই।
 

বড় রাস্তার মোড়ে এসে রচনা সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই আমরা কি অটোতে যাব এখান থেকে”?

সীমন্তিনী বলল, “না রে, আমরা এ মোড়েই দাঁড়াব। পরি তো বলেছে ঠিক আটটায় গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাবে”। কবজি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “সময়ের হেরফের করা পরি খুব অপছন্দ করে। এখনই কোন একটা গাড়ি আমাদের নিতে আসবে দেখিস”।

রচনা জিজ্ঞেস করল, “পরিতোষদা কি নিজেই আসবেন গাড়ি নিয়ে? না অন্য কাউকে পাঠাবেন”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “সেটা তো ও স্পেসিফিক কিছু বলেনি। আর আমিও জিজ্ঞেস করিনি। তবে আটটা তো বাজলই, দেখা যাক”।

তারা খেয়াল করেনি একটা গাড়ি আগে থেকেই মোড়ের একটু আগে দাঁড়িয়েছিল। তার ড্রাইভিং সীটে পরিতোষ বসে দুই রমণীকে গভীরভাবে দেখে যাচ্ছিল। একপাশ থেকে শাড়ি পড়া সীমন্তিনীকে দেখে সে এক পলকে চিনতে পারেনি। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড বাদে রচনার মুখটা দেখতে পেয়েই সে গাড়ি ব্যাক গিয়ারে দিয়ে আস্তে আস্তে তাদের কাছে গাড়ি এনে থামিয়ে পেছনের দরজাটা খুলে দিয়ে বলল, “উঠে এস ডার্লিং”।

সীমন্তিনী পরিতোষকে দেখেই রচনার হাত ধরে পেছনের সীটে উঠে বসতেই পরিতোষ দরজা বন্ধ করে দিয়ে দু’ সীটের মাঝখান দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “গুড মর্নিং, বাব্বা এই ক’টা মাসেই চেহারার এত পরিবর্তন করে ফেলেছ সুইট হার্ট। আমি তো তোমায় চিনতেই পাচ্ছিলাম না”।
 

পরিতোষের কথা শুনে রচনা মনে মনে হেসে ফেলল। সীমন্তিনী পরিতোষের সাথে হ্যাণ্ডশেক করে মৃদু ধমক দিয়ে বলল, “আঃ পরিতোষ। আমার বৌদি সঙ্গে আছে। একটু ভদ্র ভাবে কথা বল প্লীজ। ও কী মনে করবে বল তো? কালও ফোনে তুমি এমন সব শব্দ উচ্চারণ করছিলে। ওকে ঠাণ্ডা করতে আমাকে কত কী না করতে হয়েছে”।

পরিতোষ হেসে বলল, “ও’টুকুতেই তো আমার আনন্দ সুইট হার্ট। নইলে আমার সারা জীবনে প্রাপ্তির ঘর তো একেবারে শূণ্য” বলেই রচনার দিকে মুখ করে হাতজোড় করে বলল, “নমস্কার বৌদি। আমি হচ্ছি ঠোঁট কাটা পরিতোষ। আপনার দিদিভাইয়ের বন্ধু”।

হাল ফ্যাশনের সানগ্লাস চোখে লোকটার দিকে তাকিয়ে রচনা হাতজোড় করে বলল, “নমস্কার দাদা। আমি কিচ্ছু মনে করছি না। কিন্তু আপনার গলার স্বরটা আমার এত চেনা চেনা লাগছে কেন বলুন তো? আমরা কি আগে কখনো মুখোমুখি হয়েছি”?

পরিতোষ চোখের ওপর থেকে সানগ্লাসটা সরিয়ে নিয়ে হঠাৎ বলল, “আরে হ্যা। আপনিই তো সেই মহিলা! ওই গরিয়াহাট- শাড়ি ছিনতাই- মনে পড়ছে”?

রচনা সাথে সাথে প্রায় চেচিয়ে বলে উঠল, “আরে আপনি? আপনিই পরিতোষদা। ছিঃ ছিঃ সেদিন ওই তালেগোলে আপনাকে ভাল করে একটু ধন্যবাদও দিতে পারিনি আমরা। কিন্তু সেদিন আপনি যা করেছেন তাতে আমরা চির কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে”।

সীমন্তিনী জেনে বুঝেও না জানার ভাণ করে বলল, “কি ব্যাপার রে রচু? তুই পরিকে আগে কোথাও দেখেছিস? মানে গরিয়াহাটায় ওই শাড়ি ছিনতাইয়ের দিন”?

রচনা উচ্ছ্বসিত ভাবে বলল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই। তোমায় সেদিন বললুম না? এই পরিতোষদাই তো সেদিন ছেলেটাকে ধরে পুলিশের হাতে দিয়ে শাড়িটা এনে আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ইশ, আমি তো ভাবতেই পারিনি এভাবে তোমার বন্ধুর সাথে আমার কখনো দেখা হতে পারে”।

পরিতোষ তখন বলল, “ঠিক আছে দেরী না করে বরং রওনা হই আমরা। যেতে যেতে কথা বলা যাবে” বলে গাড়ি স্টার্ট করল।
 

সীমন্তিনী পরিতোষের দিকে তাকিয়ে ছদ্ম অভিনয় করে বলল, “তুমি তো ফোনে আমাকে সে’কথা বলনি পরি”।

পরিতোষও সীমন্তিনীর দুষ্টুমি বুঝতে পেরে বলল, “আরে এটা আর একটা বলবার মত কথা হল নাকি? পথে ঘাটে এমন সব ঘটণা তো আকছার হচ্ছে। আর আমি তো সেদিন জানতাম না যে ওই মহিলাই তোমার রচু সোনা। জানলে নিশ্চয়ই বলতাম। তবে এখন আমার আরও বেশী ভাল লাগছে ডার্লিং। আমি না জেনেই সেদিন তোমার বৌদির শাড়িটা উদ্ধার করে এনেছিলাম বলে। যাক ভালই হল। এখন থেকে বৌদি যখনই শাড়িটা পড়তে যাবেন তখনই আমার কথা মনে পড়বে”।

সীমন্তিনী বলল, “ধ্যাত, তুমি যে ওকে বৌদি বলে ডাকছ, একদম ভাল লাগছে না পরি। তুমি ওকে বরং নাম ধরেই ডেকো, আর তুমি করে বোল। ও তো তোমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট”।

পরিতোষ বলল, “উহু আমার বন্ধুর বৌদিকে বৌদি বলে না ডাকলে কি চলে? তবে বৌদি যদি পারমিশন দেয় তাহলে তুমি করে বলতে আমার আপত্তি নেই”।

রচনা বেশ সহজ ভাবে বলল, “আমার একদম আপত্তি নেই। আপনি যদি আমাকে দিদিভাইয়ের মত রচু বলেও ডাকেন তাতেও আমার আপত্তি নেই। আর তুমি করেই বলবেন প্লীজ। ইশ আমি এখনও ভাবতেই পাচ্ছিনা দিদিভাই, পরিতোষদাই সেদিন আমার হারিয়ে যাওয়া শাড়িটা ফিরিয়ে এনেছিলেন। তোমার দাদাভাই শুনলে তো বিশ্বাসই করবেন না”।

সীমন্তিনী প্রসঙ্গ পাল্টে পরিতোষকে বলল, “আচ্ছা পরি তুমি আমাদের নিয়ে কতদুর যাবে তা তো ঠিক জানিনা। কিন্তু আমাকে আর রচুকে কিন্তু সাড়ে এগারোটার মধ্যে ফিরতেই হবে”।

পরিতোষ গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই বলল, “যে কাজে যাচ্ছ, মানে যাকে দেখতে যাচ্ছ, তার কাছে যদি দেরী না হয়, তাহলে কোন অসুবিধে হবে না সুইট হার্ট। কিন্তু সেখানে তোমরা তিন মহিলা মিলে কতক্ষণ সময় নষ্ট করবে, তা তো আর আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার জন্যে যে তোমাদের দেরী হবে না সে গ্যারান্টি আমি দিতে পারি। আমার উদ্দেশ্য তো শুধু তোমাদের তিনজনকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ানো। সেটা করতে পারলেই আমি খুশী”।
 

মিনিট পনেরো পর গাড়িটার গতি কমতে কমতে একসময় বাঁদিকে ফুটপাথ ঘেষে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। সীমন্তিনী লক্ষ্য করল নীল শাড়ি পড়া বেশ সুন্দরী একটা মেয়ে ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা পুরোপুরি থেমে যেতেই পরিতোষ ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “মন্তি ডার্লিং, দরজাটা একটু খুলে দাও প্লীজ। আর ওনাকে গাড়িতে উঠতে দাও” বলেই জানালার দিকে তাকিয়ে একটু জোরে বলল, “এসো নবনীতা, উঠে এস”।

সীমন্তিনী দরজা খুলে দিতেই নবনীতা পেছনের সীটে উঠে বসতেই পরিতোষ গাড়ি ছুটিয়ে দিয়ে বলল, “নবনীতা, তুমি যার সাথে দেখা করতে চাইছিলে তিনি তোমার ঠিক পাশেই বসে আছেন। মিস সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি। আর তার পাশে তার বৌদি রচনা” বলে সীমন্তিনীকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আর মন্তি, তোমাকে যার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলাম ইনিই তিনি। মিস নবনীতা দেব। তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিলাম। এখন তোমরা নিজেরা নিজেরা কথা বল। আমি ড্রাইভিংএ মন দিই”।
 

নবনীতা হাতজোড় করে সীমন্তিনী আর রচনাকে নমস্কার করে বলল, “পরিতোষের মুখে আপনার কথা অনেক শুনেছি দিদি। আপনাকে দেখবার খুব ইচ্ছে করছিল। আজ মনের সে সাধ পূর্ণ হল”।
 

সীমন্তিনী প্রথমে হাতজোড় করে প্রতি নমস্কার করেই নবনীতার একটা হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আমিও তো আপনাকে দেখবার অপেক্ষায় ছিলাম। আশা করি আমাদের উদ্দেশ্য সফল করতে আপনি কোন বাধা দেবেন না”।
 

নবনীতা কিছুটা ভারী গলায় জবাব দিল, “নিজের নিজের চাওয়া মতই তো জীবনে সব কিছু ঘটে না সীমন্তিনীদি। যার ভাগ্যে যা আছে তাই তো হবে। তবে আমার মনে হয় সে ব্যাপারে আলাপ এ গাড়ির মধ্যে না করাই ভাল, তাই না”?

রচনা মন দিয়ে নবনীতাকে দেখে যাচ্ছিল। বেশ সুন্দরী দেখতে মেয়েটা। পরিতোষদার সাথে খুব ভাল মানাবে।

পরিতোষ চুপচাপ গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। সীমন্তিনী নবনীতার হাতটাকে আগের মতই ধরে থেকে বলল, “অত কষ্ট করে আমাকে পুরো নামে ডাকতে হবে না। আর আপনি আজ্ঞে না করে তুমি করে বললেই আমি খুশী হব। আর ছোট্ট করে মন্তিদি বলে ডাকতে পার আমায়”।

রচনা একটু হেসে বলল, “নবনীতাদি বলে ডাকাটাও আমার পক্ষে একটু বিব্রতকর বলে হবে। আমি কিন্তু তোমাকে নীতাদি বলেই ডাকব”।

নবনীতাও এবার মিষ্টি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে বৌদি, তাই বলো”।
 

আরও মিনিট পনের বাদে পরিতোষ একটা জায়গায় এসে গাড়ি সাইড করে থামিয়ে দিয়ে বলল, “ব্যস আমরা এসে গেছি। তবে নবনীতা, মন্তি তোমাদের সবাইকেই বলছি, আমরা যে বাড়িতে যাচ্ছি সে পরিবারের আর্থিক অবস্থা কিন্তু খুবই দৈন্য। তাই পুরোন ভাঙাচোরা বাড়ি বলে কেউ বাড়ির লোকগুলোকে কোন অসম্মানসূচক কথা বল না প্লীজ। এ বাড়িটা যার তাকে আমি আমার ছোট ভাইয়ের মত স্নেহ করি। সে-ও আমাকে দাদার মত সম্মান করে। এখানে সে আর তার বৃদ্ধা মা থাকেন শুধু”।

পরিতোষের কথা শেষ হতে পেছনের সীটের তিন মহিলা গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াতেই উল্টোদিকের পুরোন বাড়িটা থেকে একটা চব্বিশ পঁচিশ বছরের ছেলে দৌড়ে গাড়ির কাছে এসে বলল, “দাদা, আপনারা এসে গেছেন? আসুন আসুন”।

পরিতোষ গাড়ি লক করে ছেলেটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, “একিরে? তুই আজ কলেজে যাসনি বিট্টু”?

বিট্টু বলল, “হ্যাঁ দাদা, গিয়েছিলাম। কিন্তু এগারোটার আগে আমার ক্লাস নেই বলে অ্যাটেনড্যানসে সই করে ম্যামকে বলে দু’ঘন্টার ছুটি নিয়ে এসেছি। আসলে আমিও একটু টেনশনে ছিলাম আপনারা সবাই আসবেন বলে। মা বুড়ো মানুষ। ঠিকমত আপনাদের দেখভাল করতে পারবেন কি না, তাই আর কি”।

পরিতোষ বিট্টুর হাত ধরে অন্য সকলের দিকে তাকিয়ে বলল, “মন্তি, এ হচ্ছে বিট্টু। আমার ছোটভাইয়ের মত। এদের বাড়িতেই আমরা আজ বসব” তারপর বিট্টুর দিকে ঘুরে বলল, “তুই যখন দু’ঘণ্টার ছুটি নিয়ে চলেই এসেছিস, তাহলে একটা কাজ করবি ভাই”?

বিট্টু সাথে সাথে বলল, “হ্যাঁ দাদা, বলুন না কী করতে হবে”?

পরিতোষ বলল, “সামনের ওই রেস্টুরেন্টে আমি ছটা ব্রেকফাস্ট প্যাক আর ছ’বোতল জলের অর্ডার দিয়ে অ্যাডভান্স পেমেন্ট দিয়ে এসেছি। আমরা তো তোদের বাড়িতে বসে আলাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ব। তাই বলছিলাম কি তুই যদি গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আসতে পারতিস, তাহলে আমার একটু সুবিধে হত”।

বিট্টু বলল, “আপনি এমন করে বলছেন কেন দাদা। এ আর এমন কী কাজ। আমি আপনাদের ঘরে বসিয়ে দিয়ে এখনই সাইকেল নিয়ে গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে আসছি”।

সবাই মিলে রাস্তা পেরিয়ে বিট্টুদের বাড়ির দিকে চলল। পরিতোষ বিট্টুকে বলল, “না সাইকেল নিয়ে যাস নে ভাই। ওরা একটা কার্টনে সব প্যাকিং করে দেবে। সেটা সাইকেলে আনতে তোর অসুবিধে হতে পারে। তুই বরং যাবার সময় একটু কষ্ট করে হেঁটেই যা ভাই। ফেরবার পথে না হয়ে একটা অটো ভাড়া করে চলে আসিস”।

বিট্টু সবাইকে নিয়ে বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আচ্ছা দাদা, ঠিক আছে। আমি সে’সব দেখে নেব’খন। তবে মা কিন্তু চায়ের অ্যারেঞ্জমেন্ট করে রেখেছেন নিজেই। তাই চা টুকু কিন্তু আমাদের তরফ থেকেই দেওয়া হবে আপনাদের সবাইকে”।

গেট দিয়ে ঢুকতেই বিট্টুর মাকে দেখা গেল ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সকলকে দেখেই তিনি বারান্দা থেকে নেমে তাদের কাছে আসতে আসতে বললেন, “এস বাবা পরিতোষ, এস। কত ভাগ্য আমাদের, এতসব মা লক্ষীদের তোমার সাথে নিয়ে এসেছ”।

পরিতোষ বিট্টুর মাকে প্রণাম করে বলল, “মাসিমা, এদের একজন হচ্ছে আমার অফিসের কলিগ সীমন্তিনী, আর একজন উনি হচ্ছেন আমার এই কলিগ বন্ধুর বৌদি রচনা। আর ইনি হচ্ছেন আমার আর এক বন্ধু নবনীতা” বলে তিন জনকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখিয়ে দিয়ে বলল, “আসলে মাসিমা, এরা সকলেই প্রথমবার আমার বাড়ি আসতে চাইছিল একটা বিশেষ ব্যাপারে আলোচনা করতে। কিন্তু আমার ঘরের যা অবস্থা, এদেরকে নিয়ে গিয়ে আমার সাথে সাথে এদের সবাইকেও বিব্রত করে ফেলতাম আমি। তাই বাধ্য হয়ে আপনাদের এখানেই আসতে হল”।

পরিতোষের দেখাদেখি সীমন্তিনী, রচনা আর নবনীতা বিট্টুর মাকে প্রণাম করতে তিনি সবাইকে আশীর্বাদ করতে করতে বললেন, “খুব ভাল করেছ বাবা। তুমি যে এদের সবাইকে নিয়ে এসেছ তাতে আমরা খুব খুশী হয়েছি। কিন্তু তুমি তো আমাদের কথা সবই জানো বাবা। একটু খানি চা ছাড়া তোমাদের হাতে এক এক টুকরো বাতাসা দেবার সাধ্যও যে আমাদের ......”

বিট্টু তার মাকে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে বলল, “আঃ, মা ও’সব কথা কেন টানছ। তুমি চা রেডি কর, আমি এনাদের আমার ঘরে বসিয়ে আসছি” বলে সবাইকে নিয়ে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “দাদা, আপনারা সবাই মিলে বরং আমার ঘরেই বসুন। পেছনের ঘরে তো জায়গা বেশী নেই”।

পরিতোষ জিজ্ঞেস করল, “তোর অসুবিধে না হলে আমাদের আর কি? তবে শোন মাসিমাকে বেশী টেনশন নিতে বারণ কর। আর চা যদি বানানো হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে নিয়ে আয়। আর তুইও চা খেয়ে ছুটে ওই রেস্টুরেন্টে চলে যা। আমার নাম করে বললেই ওরা সব দিয়ে দেবে”।

ঘরের ভেতরের বিছানায় তিন রমণীকে বসিয়ে বিট্টু পরিতোষের জন্য একটা চেয়ার পেতে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আর খানিক বাদেই ট্রেতে করে চা আর বিস্কুট এনে সকলকে দিয়ে আবার চলে গেল।

______________________________
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
(Update No. 126)

পরিতোষ চেয়ারে বসে সকলকে চা খেতে বলে নিজেও চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমার মনে হচ্ছে, আর দেরী না করে আমাদের আলোচনাটা শুরু করে দিলেই ভাল হয়। আমার ধারণা দু’ এক কথায় আমাদের এ আসর শেষ হবে না। তবে মূল আলোচনা শুরু করবার আগে একটু গৌরচন্দ্রিকা না করে নিলে আলোচনাটা ফলপ্রসু হবে বলে মনে হয় না আমার। মন্তি আর নবনীতা, তোমরা দু’জনেই আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো, আবার অনেক কিছুই জানো না। আর বৌদি তো বোধহয় আমার ব্যাপারে তেমন কিছুই জানেন না। তুমি আর নবনীতা তো নিজের নিজের বক্তব্যই শুধু রাখবে। আমার মনের স্থিতি তোমরা সঠিকভাবে ধারণা করতে পারবে না। কিন্তু আমার মনে হয় বৌদিই আজ নিরপেক্ষভাবে নিজের মতামত জানাতে পারবেন। তাই আমার আগেকার কিছু কথা বৌদিকে জানিয়ে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করছি আমি। আর এ’সব কথার কিছু কিছু হয়ত তোমাদের দুজনেরও অজানা। তাই আগে সে কথাগুলো বলছি”।

সকলেই চুপচাপ পরিতোষের কথা শুনে যাচ্ছিল। পরিতোষ বলতে লাগল, “শোনো বৌদি, আজ থেকে ন’বছর আগে আমি একটা মেয়েকে ভালবেসেছিলাম। তখনও আমি পুলিশের চাকরিতে ঢুকিনি। প্রায় বেকারই ছিলাম। এবাড়ি ও বাড়ি টিউশানি করে নিজের হাত খরচা যোগার করতাম। বাড়িতে বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না। মাকে ছোটবেলাতেই হারিয়েছিলাম আমি। ২০০৫এ আমি যখন আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করলাম তখন আমার প্রেমিকাকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে আমার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাবাকে বলেছিলাম যে আমরা পরস্পরকে বিয়ে করতে চাই। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি। আমরা ', হলেও আমার প্রেমিকা ছিল কায়স্থ পরিবারের মেয়ে। আর ওদের সংসারের আর্থিক অবস্থাও খুব খারাপ ছিল। আমার ঠাকুর্দা ঠাকুমারা জাত পাতের ব্যাপারে বেশ কট্টর ছিলেন। তাই আমার মনে মনে একটু সংশয় ছিল যে বাবা হয়তো আমার সেই প্রেমিকাকে নিজের পুত্রবধূ হিসেবে স্বীকার করবেন না। কিন্তু কেন জানিনা, সেদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে বাবা এককথায় আমাদের সম্পর্কটা মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু তখন আমাকে ইমিডিয়েট হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং নিতে যেতে হয়েছিল বলে বিয়ের ব্যাপারটা আর এগোয়নি। তবে বাবা সেদিনই বলেছিলেন, আমার ট্রেনিং শেষ হবার সাথে সাথেই আমাদের বিয়ে দেবেন। আমার প্রেমিকাকে তার পূত্রবধূ করে নেবেন ভেবে বাবা সেদিনই তাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু বিধাতা বোধহয় সেটা চান নি। ট্রেনিং-এ যাবার মাস দুয়েক বাদেই বাবা হঠাৎ মারা যান, স্ট্রোকে। বাবার যে হাই ব্লাড প্রেসার ছিল, এটাই আমার অজানা ছিল। ট্রেনিং পেরিয়ডে ছুটি নেওয়া বারণ এ’কথা তো মন্তি তুমিও জানো। কিন্তু স্পেশাল কেস হিসেবে শুধু বাবার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করবার জন্যেই আমাকে সাত দিনের ছুটি দেওয়া হয়েছিল। বাবাকে দাহ করবার সুযোগ আমি পাইনি। আমার বন্ধুরাই তার দাহ সৎকারের কাজটুকু করেছিল। শ্রাদ্ধের দু’দিন আগে এসে আমি তার শ্রাদ্ধ শান্তি করেছিলাম। তখন সে মেয়েটাও আমার অনেক উপকার করেছিল। মেয়েটা একটা বস্তিতে তার মা বাবা আর বখাটে এক দাদার সাথে থাকত। মেয়েটার বাবা একটা চটকলে কাজ করত। সামান্যই মাইনে পেত। তবু সে সামান্য আয়েই হয়ত তাদের সংসারটা কোন ভাবে চলে যেত। কিন্তু তার বাবার মদের নেশাতেই তার আয়ের প্রায় সবটুকুই চলে যেত। ছেলেটাও কোন রুজি রোজগার করত না। তার ফলে মেয়েটার মাকে অসীম লাঞ্ছণা গঞ্জনা সহ্য করে এ বাড়ি ও বাড়ি কাজ করে নিজের সংসার চালাতে হত। প্রায় তিন বছর ধরে আমার আর মেয়েটার সম্পর্ক তৈরী হলেও মেয়েটার বাড়ির লোকজনেরা সে ব্যাপারে কিছুই জানত না। তাই ওই সময়টায় মেয়েটার মা বাবা চেষ্টা করছিল কোনভাবে তাদের মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে। বাবার শ্রাদ্ধের পর মৎস্যমুখীর পরের দিনই আমি মেয়েটার অনুরোধেই তাদের বাড়ি যাই। তার মা বাবা ও দাদাকে আমাদের সম্পর্কের কথা বলি। আর এ’ কথাও বলি যে আমরা একে অপরকে বিয়ে করতে চাই। মেয়ের বাড়ির সকলেই আমার প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল। তখন আমি তাদের বলেছিলাম যে আমার বাবা যেমনটা চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই আমার ট্রেনিং শেষ হবার পর আমাদের বিয়ে হবে। মেয়েটা ততদিন তার মা বাবার কাছেই থাকবে। তবে তার বাড়ির লোকজনেরা যেন তাকে অন্যত্র বিয়ে দেবার চেষ্টা না করেন। সৌভাগ্যক্রমে তারা সকলেই আমার কথা মেনে নেন। পরের দিন আমি আবার হায়দ্রাবাদ ফিরে গিয়েছিলাম। হায়দ্রাবাদ পৌঁছোবার পরের দিনই খবর পেলাম যে মেয়েটাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেদিন আমি তাদের বাড়ি গিয়ে আমাদের বিয়ের কথা বলেছিলাম সেদিন রাতের পর থেকেই তাকে আর কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তখন আর আমার ছুটি নিয়ে কলকাতায় চলে আসা সম্ভব ছিল না। প্রায় পাগল হয়ে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করে, বন্ধু বান্ধবদের মাধ্যমে সব রকম চেষ্টা করেও কোন ফল হল না। শুধু এটুকু জানতে পারলাম যে যেদিন তার মা বাবার সাথে কথা বলে আমি বিয়ে ঠিক করেছিলাম সেদিন রাত থেকেই মেয়েটাকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাড়া পড়শিরা বলছিল যে মেয়েটার অমতে তার মা বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছিল বলেই সে রাতেই মেয়েটা তার কোন প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে। কথাটা আমার মোটেও বিশ্বাস হয়নি। কারন আমি তো তাকে তিন বছর আগে থেকে জানতাম। আমি ছাড়া তার জীবনে অন্য কোন ছেলে যে ছিল না, এটা আমি খুব ভাল ভাবেই জানতাম। তাই তার নিখোঁজ হয়ে যাবার পেছনের কারনটা আমি আর কোনদিনই জানতে পারিনি। আমার আড়াই বছরের ট্রেণিং শেষ হবার পর অন্ধ্রপ্রদেশেই আমার পোস্টিং হয়েছিল, ভাইজ্যাগে। আড়াই বছর বাদে ট্রেনিং শেষে ভাইজ্যাগ যাবার আগে আমি দু’দিনের জন্য কোলকাতা এসেছিলাম বাড়ি থেকে আমার কয়েকটা জরুরী জিনিসপত্র নিয়ে যাবার জন্য। বাড়ির লেটারবক্সে একটা বিবর্ণ চিঠির খাম পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। চিঠিটা কোত্থেকে লেখা হয়েছিল, কতদিন আগে সেটা এসে পৌঁছেছিল বা কতদিন ধরে সেটা আমাদের বাড়ির ওই লেটারবক্সে পড়ে ছিল, কিছুই সেদিন বুঝতে পারিনি। তবে চিঠিটা খুলে দেখেছিলাম আমার প্রেমিকা মেয়েটিই চিঠিটা লিখেছিল। সে তাতে লিখেছিল, আমি যেন তাকে ভুলে যাই, আর অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করে আমি যেন সুখে থাকি। তখন মেয়েটার বাপের বাড়িতেও আমি গিয়েছিলাম। মেয়েটার খোঁজ তারাও কেউ দিতে পারেনি। আর শুনলাম মেয়েটা পালিয়ে যাবার পর তার মা-ও নাকি আত্মহত্যা করেছিল আগেই। নিজের জীবনের একমাত্র ভালবাসাকে হারিয়ে ফেলে আমি আবার ভাইজ্যাগে চলে গিয়েছিলাম। আজ থেকে বছর তিনেক আগে হায়দ্রাবাদ ট্রেনিং সেন্টারেই আমি মন্তিকে প্রথমবার দেখি। মন্তিকে দেখবার পর একসময় আমার মনে হল এ মেয়েটাকে জীবনসঙ্গী করতে পারলে হয়ত আমার আগের প্রেমিকাকে ভুলতে পারব। তবে আগের বারের মত প্রেমে অন্ধ হবার আগেই আমি মন্তিকে সোজাসুজি প্রোপোজ করেছিলাম। আর মন্তিও তার অপারগতার কথা বিস্তারিত ভাবে বুঝিয়ে দিয়ে আমাকে সোজাসুজিই জানিয়ে দিয়েছিল যে সে আজীবন অবিবাহিতা থাকবে বলে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সীমন্তিনী আমাকে প্রত্যাখ্যান করলেও তার সহজ সোজা কথায় আমি খুব খুশী হয়েছিলাম। আমাদের দু’জনের ভেতরে প্রেমিক প্রেমিকার সম্পর্ক গড়ে না উঠলেও মন্তি আমার বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল। সে বন্ধুত্ব আজও অটুট আছে। মন্তির হায়দ্রাবাদে ট্রেনিং শেষ হবার আগেই আমি কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে এলাম। হঠাৎ সপ্তাহ তিনেক আগে আমি কোলকাতার এক রাস্তাতেই আমার প্রেমিকা সেই মেয়েটিকে দেখতে পাই। তার সাথে কথা বলে আমি আবার তাকে আমার জীবনে ফিরে পেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে এবারেও আমার ডাকে সাড়া দিল না”।

এতখানি বলে পরিতোষ থামতেও কেউ কোন কথা বলল না। কয়েক সেকেণ্ড বিরতি দিয়ে পরিতোষ রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বৌদি তোমার দিদিভাই এখনও তার সে সিদ্ধান্তে অটল আছে। আর আমি জানি আজীবন সে তাই-ই থাকবে। কিন্তু সে চাইছে আমি যেন আমার পছন্দের কোন মেয়েকে বিয়ে করে সংসারী হই। সে আমাকে আমার নিজের পছন্দের একটা মেয়ে খুঁজে বের করতে বলেছে। তাকে আমি কয়েকদিন আগে বলেছি এমন একজনকে আমি খুঁজে পেয়েছি ঠিকই। কিন্তু সেও আমাকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে না। আর এ’কথাও বলেছি যে মন্তি কলকাতা এলে আমি তাকে মেয়েটার কাছে নিয়ে আসব”।

বলে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “মন্তি, নবনীতাই সেই মেয়ে যার সাথে আমি তোমাকে দেখা করাব বলে কথা দিয়েছিলাম। নবনীতাও আমাকে বিয়ে করতে প্রস্তুত নয়। তাহলে বৌদি, এবার তুমি নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে বল তো আমার কি করা উচিৎ”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিল। রচনা নিজের গলা পরিস্কার করে বলল, “আচ্ছা পরিতোষদা, আপনার কথা তো সবটাই শুনলুম। খুবই দুঃখজনক। কিন্তু একটা কথা আমার মাথায় ঠিক ঢুকছে না। দিদিভাইয়ের নাম তো আপনি বললেন। কিন্তু আপনার সেই প্রেমিকাটির নাম কিন্তু একটিবারও উচ্চারণ করেননি আপনি। এর কারনটা কি জানতে পারি”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “সেটা ইচ্ছে করেই এতক্ষণ বলিনি বৌদি। তবে আমার মনে হয় সেটা না বললে তুমি বা মন্তি গোটা ব্যাপারটা ঠিক মত বুঝতে পারবে না। আমার সেই প্রেমিকাটি হচ্ছে তোমার পাশে বসে থাকা অপর মহিলাটি। মানে নবনীতা”।

পরিতোষের কথা শুনে সীমন্তিনী আর রচনা এমনভাবে চমকে চিৎকার করে উঠল যেন ঘরের ওপর বিনা মেঘে বজ্রপাত হয়েছে। আর নবনীতা মাথা নিচু করে নিজের চোখের জল মুছে যাচ্ছে। সীমন্তিনী আর রচনা অনেকক্ষণ হতভম্বের মত হাঁ করে বসে থাকবার পর সীমন্তিনীই প্রথম নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “পরি কি ঠিক বলছে নবনীতা? তোমাকেই ও ন’বছর আগে থেকে ভালবাসত”?

নবনীতা নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “হ্যাঁ দিদি। ও যতটুকু জানতো তার সবটুকুই ঠিকঠাক বলেছে। কিচ্ছু বাড়িয়ে বলেনি। কিচ্ছু লুকিয়েও যায়নি। আমাকেই ও ন’বছর আগে ভাল বেসেছিল”।

রচনা এবার আর থাকতে না পেরে নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমিও কি তাকে ভালবাসতে না”?

নবনীতা মাথা নিচু করেই নিজের চোখের জল সামলাতে সামলাতে জবাব দিল, “বাসতাম বৌদি, আমিও ওকে ভালবাসতাম। নিজের প্রাণের চেয়েও বেশী ভালবাসতাম”।

রচনা আবার সাথে সাথেই জিজ্ঞেস করল, “আর এখন? এখন তুমি পরিতোষদাকে ভালবাস না”?

নবনীতা নিজেকে সামলাতে সামলাতে বলল, “এখনও বাসি। হয়ত জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত আমি শুধু ওকেই ভালবেসে যাব”।

রচনা এবার পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “তুমিও নীতাদিকে এখনও ভালবাস পরিতোষদা”?

পরিতোষ ম্লান হেসে বলল, “আমি তো জীবনে শুধু মাত্র ওকেই ভালবেসেছি বৌদি। এখনও একই সমান ভালবাসি। আমি তো ওকে কয়েকদিন আগেও বলেছি যে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। কিন্তু ও সেটা কিছুতেই মানতে চাইছে না”।

রচনা আবার নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে সমস্যাটা কোথায় নীতাদি”?

নবনীতা কোন কথা বলার আগেই দরজার বাইরে থেকে বিট্টু বলে উঠল, “দাদা আপনাদের ব্রেকফাস্টটা এখানে এনে দিয়ে দিই”?

পরিতোষ একবার নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ বিট্টু, নিয়ে আয়”।

নবনীতা তাড়াহুড়ো করে নিজের চোখ মুছে নিতেই বিট্টু ঘরে ঢুকে প্রথমে খালি চায়ের কাপগুলো নিয়ে গেল। তারপর একমাত্র টেবিলটার ওপর লাঞ্চ প্যাক গুলো রাখতে রাখতে বলল, “প্যাকেট শুদ্ধোই দেব? না প্লেটে সাজিয়ে আনব”?

সীমন্তিনী বলল, “না ভাই তোমাকে আর কিচ্ছু করতে হবে না। আমরা প্যাকেট হাতে নিয়েই বসে বসে খাব। তুমি শুধু চারটে জলের বোতল এখানে দিয়ে যাও”।

পরিতোষ বিট্টুকে বলল, “তুই আর মাসিমাও খেয়ে নিস কেমন”?

বিট্টু “ঠিক আছে দাদা” বলে জলের বোতল গুলো প্রত্যেকের কাছে একটা একটা রেখে ঘর থেকে চলে গেল। বিট্টু চলে যাবার পর নবনীতা বলল, “আমার কাছে তোমাদের যে অনেক প্রশ্ন আছে, আর তার জবাব যে আমাকে আজ দিতেই হবে, এটা আমি আগে থেকেই জানতাম মন্তিদি। কিন্তু আমি কিছু বলার আগে মনে হয় ব্রেকফাস্টটা সেরে নেওয়া উচিৎ। তাই কেউ আপাততঃ আর কোন প্রশ্ন না করে খেয়ে নাও”।

সকলেই নবনীতার কথা মেনে নিয়ে নিজের নিজের প্যাকেট হাতে নিয়ে খেতে আরম্ভ করল। একেক জনের মনের ভেতর এক একরকম প্রশ্ন। সীমন্তিনী ভাবছে পরিতোষ তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসাকে আবার চোখের সামনে দেখতে পেয়ে তাকে নিয়েই বাঁচবার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু নবনীতা নিজেই তাতে বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রচনা ভাবছে, আগে যা হবার তাই নয় হয়েছে। কিন্তু এখনও যদি দু’জন দু’জনকে ভালবাসে তাহলে একসাথে ঘর বাঁধতে বাঁধাটা কিসের হতে পারে? পরিতোষ ভাবছে, এ জীবনে যে দুটো মেয়েকে নিয়ে ঘর বাঁধার কথা সে ভেবেছিল, তারা দু’জনেই এ মূহুর্তে তার সামনে বসে আছে। কিন্তু এমনই কপাল তার যে তাদের কাউকে নিজের করে নেবার ক্ষমতা তার নেই। আর নবনীতা ভাবছে, সে নিজে আর কোনভাবেই পরিতোষের সাথে নিজেকে জড়াতে চায় না। তার মনের এবং অতীতের সব কথা জানবার পর মন্তিদি যদি পরিতোষকে বিয়ে করতে রাজি হত তাহলে সে-ও খুব খুশী হত। কিন্তু মন্তিদির জীবনে এমন কী হয়েছে যে সেটার জন্যেই সে চির অবিবাহিতা থাকবার পণ করেছে!
 

খাওয়া শেষ করে পরিতোষ রচনাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “বৌদি, এরা দু’জনেই নিজ নিজ কথার স্বপক্ষে অনেক যুক্তি দেখাবে। তারা আমার দিকটা কেউ দেখতে চাইবে না আমি জানি। তুমি হয়ত তোমার দিদিভাইয়ের এমন ধনুকভাঙ্গা পণের ব্যাপারে জেনেই থাকবে। তোমার দিদিভাইকে আমি যতই ডার্লিং, প্রেয়সী, সুইটহার্ট বলে ডাকি না কেন, আমি খুব ভালভাবে জানি তার প্রতিজ্ঞা থেকে তাকে কিছুতেই টলানো যাবে না। হয়ত তুমিও জানো সে’কথা। আর সে চেষ্টাও আমি করি না। তার প্রতি আমার অনুরাগ বা ভালবাসা জন্মাবার আগেই সে আমাকে সবকিছু পরিস্কার করে বলেছিল। তার অমন প্রতিজ্ঞার কারণটা জানবার পর আমিও তার মতকে সমর্থন করেছি। করেছিই যে তা নয়, বরং বলা ভাল করতে বাধ্য হয়েছি। তাই মন্তিকে বিয়ে করার কথা আমি আর মনেই আনতে চাই না। কারন এখনও সেটা করতে চাইলে মন্তির মনের ওপর জোর খাটাতে হবে। কিন্তু আমি খুব ভালভাবেই জানি, জোর করে অনেক কিছু পাওয়া গেলেও কারুর ভালবাসা পাওয়া যায় না। তাই মন্তি প্রথম যেদিন তার অসামর্থতার কথা বলেছিল সেদিন থেকেই আমি তার কথা মেনে নিয়েছি। কিন্তু সে যাকে মনে মনে ভালবাসে সে ভালবাসার প্রতি আমি নিজেও শ্রদ্ধা জানাই। কাউকে যে এভাবে সারাজীবন ভালবাসা যায় তা মন্তিকে না দেখলে আমি বুঝতেই পারতাম না। তাই আমিও সেভাবে মন্তিকে কখনও ভালবাসিনি। আমি ভালবেসেছিলাম তো শুধু এই নবনীতাকেই। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখ। নবনীতাকে ভালবেসে যে নামে একসময় ওকে ডাকতাম সে নামটাও এখন সে আর আমার মুখ থেকে শুনতে চায় না। আর সীমন্তিনী আমাকে কোন সম্বোধন করতেই বাঁধা দেয় না। আমাকে ভাল না বাসলেও আমার প্রেমিকা না হয়েও সে আমার মুখে প্রেমিকার সম্বোধন পেতে লজ্জা বোধ করে না। এতেই তো স্পষ্ট, নিজের ভালবাসার ওপর এখনও তার কতটা আস্থা আছে। প্রেম বিশ্বাস আর ভালবাসার দিক দিয়ে বিচার করলে মন্তি আমার থেকে অনেক অনেক ওপরে। সেই উঁচু আসন থেকে তাকে আমি টেনে নামিয়ে আনতে চাই না। তাই ওকে নিয়ে ঘর বাঁধবার স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি। কিন্তু যাকে আমি ন’বছর আগে থেকে ভালবেসে আসছি, যে নবনীতা আজও বলছে সে আমাকে এখনও ভালবাসে, তাকে নিয়েও ঘর বাঁধার স্বপ্ন আমি দেখতে পাচ্ছি না। মন্তি বলছে, ‘তুমি একটা ভাল মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে কর’। আর নবনীতাও বলছে ‘তুমি বিয়ে করে সংসারী হও। তাহলে আমিও খুশী হব’। কিন্তু আমি যে আমার জীবনে অন্য কোনও মেয়েকে খুঁজে পাইনি। এবার তুমি নিরপেক্ষ ভাবে বিচার করে বল তো দেখি বৌদি, এ অবস্থায় আমার কী করণীয়”?
 

ততক্ষণে সকলেরই খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। রচনা পরিতোষের কথা শুনে নবনীতাকে বলল, “নীতাদি, এখানে আসবার আগে দিদিভাই বলেছিল যে আমরা পরিতোষদার জন্য একটা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। তুমি যখন গাড়িতে উঠলে তখন আমার মনটা খুশীতে ভরে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমাদের জুটিটাকে খুব ভাল মানাবে। কিন্তু পরিতোষদার মুখে এতক্ষণ যা শুনলাম তাতে আমিও অবাক হবার সাথে সাথে দুঃখও পাচ্ছি। পরিতোষদাকে তুমি এখনও ভালবাস বলছ। তা সত্বেও বিয়েতে রাজি হচ্ছ না কেন সেটা তো কিছুতেই বুঝতে পারছি না”।

নবনীতা এবার বেশ ধীর শান্ত গলায় বলল, “বৌদি, পরিস্কার আকাশে পুর্ণিমার চাঁদকে দেখতে তো সকলেরই ভাল লাগে। আমি মাঝে মাঝে সে দৃশ্য দেখে ভাবি ওই চাঁদটার গলায় যদি একটা গন্ধরাজ ফুলের মালা পড়িয়ে দিতে পারতাম, তাহলে কী অসাধারণ সুন্দরই না লাগত। কিন্তু বাস্তবে কি সেটা হয়? চাঁদের গলায় মালা কেউ কি আর পড়াতে পারে? তাই পরিতোষ চিরটা কাল আমার কাছে সুদুর আকাশের চাঁদ হয়েই থাকবে। দুর থেকে আমি তাকে দেখতে পাব। কিন্তু তার গলায় আমার হাতের মালা কিছুতেই পড়াতে পারব না আমি”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “কিন্তু তুমি এমন ভাবছ কেন নীতা? পরিতোষ তো তোমাকে এখনও চাইছে? সে তো তোমার হাতের মালা নিজের গলায় নিতে প্রস্তুত আছে”।

নবনীতা আগের মতই শান্তভাবে জবাব দিল, “পরিতোষকে আমি আজও ভালবাসি মন্তিদি। পরিতোষ সুখে থাকুক এটাই আমার জীবনের একমাত্র কাম্য। কিন্তু তার পবিত্র ভালবাসাকে কলুষিত করার অধিকার যে আমার নেই। যেদিন পরি আমার মা বাবার সাথে কথা বলে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করে গিয়েছিল সেদিন আমার খুশীর সীমা ছিল না। সে রাতে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে সুখের দিনটার কল্পণা করতে করতে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, তখন নিজেকে একটা অপরিচিত ঘরের ভেতর দেখতে পেয়ে চমকে উঠেছিলাম। আমার পরণের নাইটিটা ফালা ফালা হয়ে আমার শরীরের সাথে এদিক ওদিক দিয়ে ঝুলছিল। শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করছিলাম। খানিক বাদেই বুঝতে পেরেছিলাম কেউ আমার চরম সর্বনাশ করে গেছে”।

এটুকু শুনেই ঘরের বাকি তিনজন চমকে উঠল। রচনা থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “ওমা সেকি? কে তোমার অমন অবস্থা করেছিল নীতাদি”?
 

(To be continued .......)
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 127)

নবনীতা আগের মতই শান্ত স্বরে বলে চলল, “সেটা প্রথমে আমিও ওই মূহুর্তে বুঝতে পারিনি বৌদি। আমি একটা বন্ধ ঘরের ভেতর একটা খাটিয়ার ওপর পড়ে ছিলাম। নিজের চরম সর্বনাশের কথা বুঝতে পেরে আমি অনেক কষ্টে খাটিয়া থেকে উঠে সে ঘরটা থেকে বেরোবার পথ খুঁজতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু দেখেছিলাম ওই ঘরটায় শুধু মাত্র একটাই দরজা ছিল যেটা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। অনেক চেষ্টা করেও সে দরজা খুলতে পারিনি আমি। নিরাশ হয়ে আবার সেই খাটিয়াটাতেই বসে পড়েছিলাম। আবছা অন্ধকারে শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে বাইরে দিনের আলো আছে। কিছুক্ষণ বাদে মনে হল বাইরে থেকে কেউ দরজাটা খুলছে। ছিন্ন ভিন্ন পোশাকটাকে টেনে টুনে নিজের শরীর ঢাকবার বৃথা চেষ্টা করতে করতেই দেখলাম দুটো ছেলে সে ঘরে ঢুকছে। আবছা অন্ধকারে অবাক হয়ে দেখেছিলাম ওই দুটো ছেলেই আমার পরিচিত। তারা আমাদের বস্তিতেই থাকত। একজনের নাম বিরজু, আর আরেক জনের নাম ছিল কালু। বিরজু আমাকে বস্তিতে নানাভাবে উত্যক্ত করত। মাঝে মধ্যেই আমাকে একা পেলেই আমার ওপর চড়াও হবার চেষ্টা করত। কিন্তু আমি নিজেকে সব সময় ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে নিতাম। পরে জানতে পেরেছিলাম ওই রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় আমাকে অজ্ঞান করে আমার বাড়ি থেকে বিরজু আর কালু আমাকে নিয়ে চলে এসেছিল। তারপর অজ্ঞান অবস্থাতেই তারা আমার শরীরটাকে ভোগ করেছিল। বিরজু আর কালু ঘরে ঢুকে আবার আমাকে ভোগ করল। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেও ওই দুই বদমাশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারলাম না। প্রায় তিন মাস আমাকে তারা ওই ঘরেই বন্দী করে রেখে রোজ একাধিকবার আমাকে পিষে মারত। জায়গাটা কোথায় ছিল আমি সেটাও বুঝতে পারিনি। আজও জানি না। শুধু টয়লেট আর বাথরুমে যাবার প্রয়োজন হলেই সে ঘরটা থেকে বেরোতে পারতাম। তারা দু’জন পাহারা দিয়ে আমাকে বাথরুমে বা টয়লেটে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে সেখানেও আমাকে ''. করত। বাথরুম টয়লেটে যাবার সময় আশে পাশে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম ওটা একটা পোড়ো বাড়ির মত ছিল। আশেপাশে কোনও জনমানুষ দেখতে পেতাম না। তিনমাস সেখানে থাকবার পর বিরজু আর কালু আমাকে আসানসোলের দিকে কোন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে যাবার পরেও আমার দুর্ভোগের শেষ হয়নি। দু’জন মিলে যখন খুশী তখনই আমার শরীরটাকে ভোগ করত। কিছুদিন পর আমি প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়লাম। কোন একটা হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তারা আমার গর্ভপাত করিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ওই হাসপাতালের ডাক্তার আর ওয়ার্ড বয়েরাও আমাকে নিয়মিত ভোগ করতে শুরু করল। তখন আমাকে নিয়ে তারা দু’জন গ্রামের শেষ ভাগে একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকত। একসময় তাদের পক্ষে বাড়ির ভাড়া মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়তেই রোজ আলাদা আলাদা পুরুষ বাড়ি এসে আমাকে ভোগ করতে শুরু করল। এভাবে আমাকে রোজ অগুনতি পুরুষের কামনার শিকার হতে বাধ্য করা হত। ঘরের বাইরে আমাকে একেবারেই যেতে দেওয়া হত না। আর একা বাথরুম বা টয়লেটেও যেতে দিত না। ২০০৫ সালে আমাকে ওরা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। অত্যাচারিত হতে হতে আমার ভেতর আর প্রতিরোধের ক্ষমতা একবিন্দুও অবশিষ্ট ছিল না। নিজেকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমার সামনে আর অন্য কোন পথ ছিল না। কাউকে একটা খবর পর্যন্ত দেবার সাধ্য আমার ছিল না। প্রায় বছরদেড়েক বাদে বাইরের যেসব পুরুষ আমায় ভোগ করতে আসত তাদের একজনের কাছ থেকে কাগজ আর কলম চেয়ে নিয়ে পরিতোষকে ওই চিঠিটা আমি লিখেছিলাম। তারপর ওই লোকটার মাধ্যমেই চিঠিটা পোস্ট করতে পাঠিয়েছিলাম। সে চিঠি আদৌ পোস্ট করা হয়েছিল কি না বা আদৌ পরি সে চিঠি পেয়েছিল কি না, সেটাও আমি বুঝতে পারিনি। সেদিন পরিই বলল ২০০৭ সালে ওর ট্রেনিং শেষ হবার পর দু’দিনের জন্য বাড়ি এসে ও আমার সেই চিঠিটা পেয়েছিল। বছরের পর বছর এভাবে লাঞ্ছিতা হতে হতে আমি একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলাম। ধীরে ধীরে আমার প্রতিরোধ কমতে কমতে একেবারে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। আমার প্রতিরোধ কমে আসছে দেখে আমার ওপর নজদাড়িতে একটু ঢিল দেওয়া হয়েছিল। আর তখনই সুযোগ পেতেই একদিন সেখান থেকে পালিয়ে বিনা টিকিটেই কলকাতার কোন একটা ট্রেনে চেপেছিলাম। সেটা বছর দেড়েক আগের কথা। হাতে টিকিট ছিল না। দ্বিতীয় আর কেউ সঙ্গেও ছিল না। সুযোগ বুঝে ট্রেনের টিটিও আমাকে ভোগ করল, ট্রেনের টইলেটের ভেতর নিয়ে গিয়ে। কলকাতা পৌঁছেই আমি আমাদের বস্তিতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাবা আর দাদা আমাকে তাড়িয়ে দিল। ইজ্জত খোয়ানো মেয়েকে তারা নিজের কাছে রাখতে রাজী হলেন না। শুনলাম আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার দিন তিনেক পরই নাকি মা বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। আর শুনেছিলাম গোটা বস্তির লোকেরা এটাই জানে যে আমি কোন ছেলের সাথে স্বেচ্ছায় পালিয়ে গিয়েছিলাম। পরিতোষের কথা মনে হয়েছিল তখন। যদিও পরিতোষের সাথে দেখা করার ইচ্ছে আমার ছিল না, তবু যাবার আর কোন জায়গা ছিল না বলে ওর বাড়িতেই গিয়ে হাজির হলাম। কিন্তু বাড়িটা তখন তালা বন্ধ। পরি ছিল না। পরে শুনেছি, ওই সময় সে অন্ধ্রপ্রদেশে ছিল। আর তার সপ্তাহ খানেক বাদেই ও কলকাতা বদলি হয়ে এসেছিল। অভুক্ত অস্নাত অবস্থায় আর কোন জায়গা না পেয়ে রেল ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়েছিলাম। পরের প্রায় এক বছর ভিক্ষে করে যা পেতাম তাই খেতাম। আর রাতে কোন ষ্টেশনের প্লাটফর্মে শুয়ে পড়তাম। সেখানেও নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারতাম না। রেল পুলিশ, রেলের স্টাফ, ষ্টেশনের কুলিরা ছাড়াও অনেকেই খুশী মত আমাকে প্লাটফর্ম থেকে অন্য কোথাও নিয়ে গিয়ে আমার শরীরটাকে ভোগ করত। প্রথমবার আসানসোলে গর্ভপাত করাবার সময়ই ভবিষ্যতে আমার সন্তান হবার সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল বলে আর প্রেগন্যান্ট হইনি কখনও। আসানসোল থেকে পালিয়ে বাঁচতে পারলেও নিজেকে আর দশটা লোকের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি আমি। প্রায় রোজ রাতেই কেউ না কেউ আমাকে ভোগ করত। একটা সময় আমিও এটাকেই আমার ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলাম। মাস ছয়েক আগে আমার কলেজের এক সহপাঠিনী আমাকে রাস্তায় ভিক্ষে করতে দেখে তার সাথে নিয়ে যায়। সে একা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকে। আমার ওই বিধ্বস্ত চেহারাতেও ও যে কি করে আমাকে চিনতে পেরেছিল জানিনা। আমি তো নিজেই নিজেকে চিনতে পারতাম না। কিন্তু ও আমাকে প্রায় জোর করেই ওর ফ্ল্যাটে নিয়ে যায়। আমি খানিকটা স্বস্তি পেয়ে কোন একটা কাজ টাজ যোগাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারলাম না” এতখানি বলে নবনীতা একটু থামল।

ঘরের সবাই নিশ্চুপ নিথর। বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে নবনীতা আবার বলল, “এখানে আমার সে বান্ধবীর নাম ঠিকানা আমি ইচ্ছে করেই গোপন রেখে যাব। আমার চরম বিপদের দিনে যে আমায় আশ্রয় দিয়েছে তার কোন ক্ষতি হোক, এ আমি চাই না। আমার বান্ধবীর বস্তির বাড়িতে তার বাবা দীর্ঘদিন ধরে শয্যাশায়ী। একটা পঙ্গু ভাইয়ের ভরন পোষনও তাকেই করতে হয়। আমারই মত সেও খুব বেশী লেখাপড়া করেনি। তাই ভাল কোন কাজও জোটাতে পারেনি। ও একটা প্রাইভেট যোগা ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করে। কিছু মনে করো না তোমরা। সে ট্রেনিং সেন্টারের নাম ঠিকানাও আমি গোপন করতে বাধ্য হচ্ছি। সেখানে আমার বান্ধবী পনেরো হাজারের মত মাইনে পায়। কিন্তু অতটুকু পয়সায় নিজের পরিবারের ভরণ পোষন কুলিয়ে উঠত না বলে ও এসকর্ট ব্যবসায় নেমেছে বেশ কয়েক বছর আগে থেকে। এখন আর ওর পয়সার অভাব তেমন একটা নেই। তাই বস্তির বাড়ি ছেড়ে ও আলাদা এক জায়গায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে। ওর কাজের ব্যাপারে ও আমাকে সব কিছু বললেও কখনও আমাকে ওর মত এসকর্ট হবার পরামর্শ দেয় নি। আমি ওর ফ্লাটে থেকে ওর পয়সায় খেয়ে অন্য কাজের চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চার মাস কেটে যাবার পরেও কোন কাজ জোটাতে সক্ষম হলাম না। ওর আশ্রয়ে আমি অনেক নিরাপদে থাকলেও ওর ঘাড়ের ওপর চেপে থাকতে আমার সঙ্কোচ হচ্ছিল। তারপর একদিন আমি নিজেই ওকে বললাম যে আমিও ওর মত এসকর্ট ব্যবসায় নামতে চাই। ততদিনে আমার শরীর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি হয়েছিল। মনে মনে ভেবেছিলাম যে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই তো কত পুরুষ আমার দেহটাকে লুটে পুটে খেয়েছে। এখন না হয় নিজে বেঁচে থাকার তাগিদেই নিজের দেহটাকে পুরুষদের হাতে তুলে দেব। নতুন করে আর কোন ক্ষতি তো হবার ছিল না। আমার বান্ধবী তখন আমাকে ওর ম্যাডামের কাছে নিয়ে যায়। ওর ম্যাডাম আমার একটা ইন্টারভিউ নেন তারপর আমাকেও তার ব্যবসার এসকর্ট বানিয়ে নিলেন। এখন আমিও আমার বান্ধবীর মতই একজন এসকর্ট। সোজা বাংলায় যাকে একটা বেশ্যা বলা হয়। অবশ্য বেশ্যাবৃত্তি তো আমাকে অনেক বছর আগে থাকতেই করতে হত। কিন্তু তখন হাতে কোন পয়সা পেতাম না। এখন আমার শরীরের দাম আমিই পাই। আমার বান্ধবীর সাথে একসাথে থাকি, ওর ফ্ল্যাটের ভাড়া শেয়ার করি, আর দুপুরের পর থেকে নানা পুরুষের মনোরঞ্জন করে পয়সা উপার্জন করি। এই হচ্ছে মোটামুটি ভাবে আমার বর্তমান জীবনের কথা। পরির সাথে আমার আর কখনো দেখা হোক এটা আমি মন থেকেই চাইতাম না। কিন্তু কয়েকদিন আগে পরির মুখোমুখি পড়ে যাই। তারপর পরি আমাকে আবার তার কাছে ডেকেছিল। কিন্তু আমার নোংড়া অপবিত্র শরীরটা নিয়ে ওর ঘরে গিয়ে ওঠা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। পরির প্রতি আমার ভালবাসা এখনও অপবিত্র আছে বলে মনে করি আমি। সেই পবিত্র ভালবাসাকে আমি কিছুতেই কলঙ্কিত করে ফেলতে পারব না। যাকে একটা সময় মন প্রাণ দিয়ে ভালবেসেছি, সেই নিষ্পাপ লোকটার জীবন কি আমি কলঙ্কময় করে তুলতে পারি? আর ওকে দেবার মত আমার কাছে আর আছেই বা কি? আমি তো আমার শরীর, আত্মা, মান মর্য্যাদা সব কিছু হারিয়ে বসে আছি। মা হবার যোগ্যতাটুকুও আমার মধ্যে অবশিষ্ট নেই। এ অবস্থায় হাজার প্রলোভনেও আমি পরির জীবনটা নষ্ট করতে পারব না। তোমাদের সকলের কাছে আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। এমন অনুরোধ তোমরা কেউ কোর না আমাকে”।

নবনীতা অদ্ভুত দৃঢ়তার সাথে এতগুলো কথা বললেও কথা শেষ করে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। সীমন্তিনী পাশ থেকে নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরল। সকলের মুখ থেকেই যেন শব্দ হারিয়ে গিয়েছিল। বেশ কিছুক্ষণ পর পরিতোষ চেয়ার থেকে উঠে নবনীতার কাছে এসে বলল, “সত্যি কথাটা না জেনে আমি তোমার ওপর অনেক অভিমান করেছিলাম নীতা। অনেক অভিযোগ জমা হয়েছিল আমার মনের মধ্যে তোমার বিরূদ্ধে। তোমার ওপর দিয়ে যে এত ঝড় বয়ে গেছে, সে তো আমি ভাবতেও পারিনি। কিন্তু আজ সব কথা শোনার পর তোমার ওপর আর আমার কোন অভিযোগ রইল না। এখন শুধু ভাগ্যের দোহাই দেওয়া ছাড়া আর কোন পথ রইল না আমার কাছে। বাবা তোমাকে তার পূত্রবধূ হিসেবে মেনে নিলেও আমার ভাগ্যই তোমাকে আমার কাছে আমার জীবনে আসতে দেয়নি। তোমার চিন্তাধারাকে আমি সম্মান জানাচ্ছি। তবু শেষবারের মত আমি তোমায় বলতে চাই, এত সব কিছু হওয়া সত্বেও আমি তোমাকে নিজের করে নিতে রাজি আছি। আরেকবার তোমাকে অনুরোধ করছি আমার এ প্রার্থনাটুকু স্বীকার করে নাও। সব পরিস্থিতির মোকাবেলা আমি করতে প্রস্তুত আছি”।

অশ্রু ভেজা চোখে পরিতোষের দিকে চেয়ে কান্না ভেজা গলায় নবনীতা বলল, “আমায় ক্ষমা কর পরি। আমি কিছুতেই আমার পবিত্র ভালবাসাকে অসম্মান করতে পারব না। যদি তুমি মন থেকে আমাকে সত্যি ভালবেসে থাক তাহলে আমার অনুরোধ মেনে তুমি একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তার সাথে সুখে সংসার কর। তোমাকে সুখী দেখতে পেলেই আমার জীবনের সব চাওয়া আমার পূর্ণ হয়ে যাবে। আমি আর কিচ্ছুটি চাই না। আমি হাতজোড় করে তোমার কাছে এ ভিক্ষাটুকু চাইছি পরি। তোমার ভালবাসার বনি জীবনে এই প্রথমবার তোমার কাছে একটা জিনিস চাইছে। তুমি তাকে ফিরিয়ে দিও না প্লীজ”।

পরিতোষ হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল। সীমন্তিনী কান্নায় ভেঙে পড়া নবনীতাকে নিজের বুকে চেপে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল। রচনা নির্বাক নিশ্চুপ হয়ে বাকি তিনজনের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছিল।
 

অনেকক্ষণের প্রচেষ্টায় নবনীতা খানিকটা শান্ত হলে সীমন্তিনী ভারী গলায় পরিতোষকে বলল, “সর্বস্য হারিয়ে বসা একটা মেয়ের মনের দুঃখ সবাই বুঝতে পারবে না পরি। কিন্তু নীতার সব কথা শোনার পর ওর অমন সিদ্ধান্তের জন্য আমি ওকে একেবারেই দোষারোপ করতে পারছি না। নিজের ভালবাসাকে পবিত্র করে রাখতে অনেক মেয়েই এমন ধরণের সিদ্ধান্ত নেয়। আমি নিজেও তো অনেকটা তাই করেছি। তাই আমি যদি আমার সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে ভাবি, তাহলে ওর সিদ্ধান্তের মর্যাদাও আমাকে দিতেই হবে। যে আশা নিয়ে আমি আজ এখানে এসেছিলাম, সে আশা পূর্ণ হচ্ছে না বলে মনটা খারাপ হলেও নীতাকে আমি আর কোন রিকোয়েস্ট করতে পারব না। আমার এখন ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছে যে তোমার জীবনের দুটো পছন্দের মেয়েই তোমার ভালবাসার পূর্ণ পরিণতি দিতে পারল না। কিন্তু পরি, এভাবে তো চিরটা কাল চলতে পারে না। আমি আমার ভবিষ্যৎ স্থির করে নিয়েছি। নীতাও তাই। তোমার মা বাবা বেঁচে থাকলে তোমার ভবিষ্যৎ নিয়ে হয়ত তারাই ভাবতেন। কিন্তু তারা নেই বলেই তুমি তো নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করতে পারো না। যথেষ্ট দেরী হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। তাই তোমার বন্ধু হিসেবে আমি এটাই চাই যে যত শীঘ্র সম্ভব একটা ভাল মেয়েকে বিয়ে করে তোমাকে এখন সংসারী হতেই হবে। আর এ চাওয়া শুধু আমার নয়। আমি জানি, নীতাও ঠিক এটাই চাইছে”।
 

পরিতোষ হতাশ ভাবে বলল, “আমার জীবনে তোমরা দু’জন ছাড়া আর তো কেউ নেই মন্তি। এতদিন আসল ব্যাপারটা না জেনে নবনীতার ওপর আমার অনেক অভিমান হয়েছিল। কিন্তু আজ আর ওর ওপর আমার কোন অভিমান নেই। আমার দুর্ভাগ্য। আমার জীবনের দুই নারীই নিজের নিজের সিদ্ধান্তেই অটল থাকবে, সেটা আমি খুব ভালভাবে বুঝতে পারছি। কিন্তু তোমাদের অনুরোধও বা কি করে স্বীকার করে নিই বল? বিয়েটা তো আর একটা ছেলেখেলা নয়”।

সীমন্তিনীর হাতের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে নবনীতা বলল, “জানি পরি, বিয়েটা কোন ছেলেখেলা নয়। কিন্তু এটাও তো সত্যি যে অনেক ছেলে মেয়েই এখনও তাদের অভিভাবকদের পছন্দ করা অজানা অচেনা পাত্র পাত্রীকে বিয়ে করে খুব সুখেই সংসার করতে পারে। আমার এটুকু জীবনে দুঃখ কষ্ট তো আমি কম কিছু পাইনি। সে’সব ভুলে গিয়ে নিজেকে সকলের কাছে বিলিয়ে দিয়েও আমি এখন অনেক স্বস্তিতে আছি। কিন্তু তোমাকে বিয়ে করে সংসারী হতে না দেখলে আমি যে সারাটা জীবন একেবারেই শান্তি পাব না। আমার কেবলই মনে হবে তোমার জীবনটাকে আমি ছন্নছাড়া করে দিয়েছি। প্লীজ পরি, আমার এই একটা অনুরোধ তুমি রাখো। আমি আর কক্ষনও তোমার আমার ভালবাসার দোহাই দিয়ে তোমার কাছে কিচ্ছুটি চাইব না”।
 

নবনীতার কথা শেষ হলে সীমন্তিনীও বলল, “হ্যাঁ পরি, আমিও সেটাই চাই। আমি জানি তোমার মাথার ওপর কোন অভিভাবক নেই। কিন্তু আমি খুব খুশী মনে সে দায়িত্ব পালন করতে রাজি আছি। তোমার জন্যে আমি নিজে একটা উপযুক্ত পাত্রী খুঁজে বের করব। তোমার যদি তাকে পছন্দ হয় তাহলে তাকেই তুমি বিয়ে কোর। কিন্তু আমাদের এই দুই অভাগীর মত তুমিও বিয়ে করব না বলে পণ করে বোস না প্লীজ। বন্ধু হিসেবে আমি কি তোমার কাছে এতটুকু দাবী করতে পারি না”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “আমি তো আগে থেকেই জানতাম, তোমরা কেউ আমার প্রার্থনা শুনবে না। আর এটাও জানতাম যে, আজকের এই দেখা সাক্ষাতের পর ঠিক কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তাই আলোচনাটা মনে হয় শেষ করা উচিৎ। এবার নিরপেক্ষ হিসেবে বৌদি যা বলবে আমি সেটাই মেনে নেব। বৌদি, তুমি বল। কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়”।

রচনা একটু ইতস্ততঃ করে বলল, “আমি যে কী বলব সেটা তো বুঝতেই পাচ্ছি না পরিতোষদা। এখানে এসেছিলাম এক উদ্দেশ্য নিয়ে। কিন্তু ঘটণা এমন একটা দিকে ঘুরে গেল যার কল্পনাই করিনি। আমি তো আপনাদের তিনজনের অবস্থাই বুঝতে পারছি। কিন্তু আপনারা যে যেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে কারুর সিদ্ধান্তকেই আমি ভুল বলতে পাচ্ছি না। কিন্তু এটাও তো ঠিক নয় যে দিদিভাই বা নীতাদিকে নিজের করে নিতে পারছেন না বলে আপনি সারাজীবন বিয়ে না করে এভাবে জীবন কাটিয়ে যাবেন। তাছাড়া একটা মেয়ে হয়ে আমি নীতাদির মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি। দিদিভাইয়ের শপথের কথা তো আমি আমাদের বিয়ের আগে থেকেই জানি। আমি এদের কাউকেই নিজের শপথ ভুলে যাবার কথা বলতে পারি না। নিজের নিজের ভালবাসাকে পবিত্র রাখতে এনারা দু’জন যা করছেন, তাকে আমি মোটেও অসমর্থন করতে পাচ্ছি না। তাই আমার মনে হয় দিদিভাই যে সমাধানটা দিচ্ছেন, সেটাই আপনার মেনে নেওয়া উচিৎ। দেখুন পরিতোষদা, এ বয়সে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনিও হয়ত নিশ্চিন্তেই থাকবেন। কিন্তু ভবিষ্যতের কথাও তো একটু ভেবে দেখতে হবে। আপনি যদি একটা জয়েন্ট ফ্যামিলীর সদস্য হতেন তবু না হয় কথা ছিল। বিপদে আপদে পরিবারের অন্যান্য সদস্যেরা আপনার দিকে সাহায্যের হাত এগিয়ে দিত। কিন্তু আপনার মাথার ওপর তো কেউ নেই। আজ আপনি শারিরীক ভাবে সুস্থ আছেন বলে একজন জীবনসঙ্গীর কথা হয়ত তেমন ভাবে ভাবছেন না। কিন্তু একসময় এমনও তো হতে পারে যে আপনি একটা অবলম্বনের অভাব বোধ করবেন। তখন হয়ত হাজার চাইলেও দিদিভাই বা নীতাদি আপনার সে অবলম্বন হতে পারবে না। তখন এমন একজনের প্রয়োজন পড়বে যে আপনার একান্ত আপন। আর সেটা হতে পারে কেবল স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভেতরেই। তাই আমার মনে হয় অন্য কোনও সুপাত্রীকে আপনার বিয়ে করাই উচিৎ। আর আপনি নিজে সেটা না পারলেও আমার দিদিভাই আপনার জন্য নিশ্চয়ই একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করতে পারবেন”।

সীমন্তিনী আর নবনীতা দু’জনেই রচনার কথার সমর্থন করতে পরিতোষ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “উহ, আর ভাবতে পারছিনা আমি। ঠিক আছে। তোমরা সবাই যখন এমনটাই চাইছ, তবে তাই হোক। মন্তি যাকে খুঁজে আনবে আমি তাকেই বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিলাম”।

নবনীতা সাথে সাথে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ পরি। মন্তিদি আমি তো অসামাজিক কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছি। আর নিজে তো অনেক আগে থেকেই নোংরা হয়ে গেছি। তবু বলছি, এ কাজে আমার তরফ থেকে কোন সাহায্যের প্রয়োজন হলে আমাকে বোল। আমি সাধ্যমত চেষ্টা করব”।

সীমন্তিনী বলল, “তোমার সাহায্যের প্রয়োজন তো হবেই। সে জন্যে আমরা দু’জন কাছাকাছি থাকতে পারলে ভাল হত। তুমি কি কলকাতা ছেড়ে আমার সাথে যেতে পারবে”?

নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ দিদি? কলকাতা ছেড়ে কোথায় যাব আমি”?

সীমন্তিনী খুব সহজ ভাবেই বলল, “কেন কলকাতা ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে তোমার অসুবিধে আছে”?

নবনীতা একটু থতমত খেয়ে বলল, “না তা নয়। কিন্তু কোথায় যাব আমি? আর অন্য কোথাও গিয়ে করবই বা কি”?

সীমন্তিনী শান্তভাবে বলল, “তুমি আমার সঙ্গে যাবে। আমার সাথে থাকবে। আর কী করবে বলছ? প্রথমে আপাততঃ তোমার জন্য একটা সম্মানজনক কাজ খুঁজে দেব আমি। আর তারপর আমরা পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজে বের করব। আমার ছোটবোনের মত তুমি তোমার দিদির সাথে থাকবে। তোমার বর্তমান জীবন তোমাকে আর কাটাতে হবে না”।

নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে হতবাক হয়ে গেল। কয়েক মূহুর্ত অবাক চোখে সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার দু’চোখ জলে ভরে গেল। কিছু বলার চেষ্টায় মুখ খুলতেই তার ঠোঁট দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। মুখ থেকে আর কথা ফুটল না। রচনাও সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রথমটায় চমকে উঠেছিল। কিন্তু পর মূহুর্তেই ভাবল এমন সিদ্ধান্ত তার দিদিভাইই বুঝি শুধু নিতে পারেন। সে নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “হ্যাঁ নীতাদি। তুমি আপত্তি কোর না। আমার দিদিভাইয়ের কাছে গেলে তোমার কোন অমর্যাদা হবে না”।

সীমন্তিনী পরিতোষকে বলল, “পরি আমাদের হাতের সময় প্রায় শেষ হয়ে আসছে। তোমার ব্যাপারে আমি দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছি। আর সে দায়িত্ব পালন করবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। কিন্তু আপাততঃ আজ তোমাকে আমার জন্যে তিনটে কাজ করতে হবে”।

পরিতোষ বলল, “বল কী করতে হবে”?

সীমন্তিনী নবনীতার আরেকটা হাত ধরে বলল, “নীতা, তোমার কাছে নিশ্চয়ই মোবাইল আছে। সেটা আমাকে দাও তো আগে”।

নবনীতা কোন কথা না বলে নিজের মোবাইলটা সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে দিল। সীমন্তিনী নবনীতার ফোনের সিমকার্ডটা খুলতে খুলতে বলল, “পরি, নীতাকে এখন আমরা আমাদের সাথেই নিয়ে যাব। তবে সেখানে ওকে রাতে রাখব না। তোমার প্রথম কাজ হবে নবনীতার একটা থাকার জায়গা ঠিক করে দেওয়া। ও আর ওর বান্ধবীর ফ্ল্যাটে ফিরে যাচ্ছে না। আর তার ওই ম্যাডাম বা তার বান্ধবীর সাথে আর কোন যোগাযোগ করবার চেষ্টাও করবে না। তাই তোমার প্রথম কাজ হচ্ছে আজ রাত থেকে পনের তারিখ অব্দি নীতাকে একটা নিরাপদ জায়গায় রাখা। আর তোমার দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে পনের তারিখ আমি যে ট্রেনে যাচ্ছি সেই ট্রেনে নীতার জন্য একটা টিকিট কাটা। পনের তারিখ নীতা আমার সঙ্গেই কলকাতা ছাড়বে। আর তোমার তিন নম্বর কাজ হচ্ছে নীতার জন্যে একটা নতুন মোবাইল যোগার করে দেওয়া। নীতার বর্তমান মোবাইলটা ও আর ইউজ করতে পারবে না। বুঝতে পেরেছ”?

পরিতোষ একটু হেসে বলল, “বেশ হয়ে যাবে। আর কিছু”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ আরেকটা কাজ অবশ্য আছে। তবে সেটা যে আজই করতে হবে, এমন নয়। তোমার কাছে আমার যে ফাণ্ডটা আছে তা থেকে একটা মাঝারী সাইজের ভাল কোম্পানীর ফ্রিজ আর একটা ভাল কোম্পানীর এলইডি টিভিসেট আর তার সাথে ডিস কিনে আমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে পাঠিয়ে দেবে প্লীজ”।

রচনা সীমন্তিনীর কথা শুনে হা হা করে কিছু বলতে যেতেই সীমন্তিনী হাত তুলে তাকে বাধা দিয়ে বলল, “তোকে এর মধ্যে কিছু বলতে হবে না রচু” বলে পরিতোষের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “করতে পারবে তো”?

পরিতোষ হেসে বলল, “অবশ্যই পারব। তবে তোমার দাদাভাইয়ের ফ্ল্যাটে যে টিভি ফ্রিজ নেই এ’কথা তুমি আমাকে আগেও বলতে পারতে”।


______________________________
Like Reply
(Update No. 128)

সীমন্তিনীও মিষ্টি হেসে বলল, “আমায় ভুল বুঝোনা পরিতোষ। ওদের ঘরে যে টিভি ফ্রিজ নেই সেটা আমি নিজেও জানতুম না। খবরটা আমার আগেই নেওয়া উচিৎ ছিল। এবার এসেই সেটা জানতে পেরেছি। তাই তোমাকে আগে বলতে পারিনি”।
 

পরিতোষ বলল, “ওকে, নো প্রোব্লেম। সেটা এবার আমি দেখছি। তাহলে আর তো কিছু আলোচনা করবার নেই তাই না? চলো, তাহলে বেরিয়ে পড়ি। এখন না বেরোলে সাড়ে এগারোটার আগে তোমাদের পৌছে দিতে পারব না”।
 

বিট্টু আর বিট্টুর মা-র সাথে দেখা করে সবাই বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে যেতে যেতে নবনীতা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদি, তুমি সত্যি যে আমাকে তোমার সাথে নিয়ে যেতে চাইছ, এতে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আমি তো ওখানে একা থাকি। তুমি থাকলে তো তবু আমি একটা সঙ্গী পাব। আর দেখো, তোমারও ভাল লাগবে। তুমিও একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে। তবু বলছি তোমার যদি কখনও এমন মনে হয় যে তুমি আমার ওখানে ভাল থাকছ না, তাহলে আমি তোমাকে কথা দিলাম, তোমাকে আবার কলকাতায় পৌছে দেব আমি। তবে আমরা ওখানে গিয়ে দু’জনে মিলে ভাল করে পরামর্শ করে দেখব এ ব্যাপারে। আপাততঃ তুমি শুধু আমার সাথে যাচ্ছ, আমরা দু’জন মিলে পরিতোষের জন্য একটা ভাল মেয়ে খুঁজব, এটাই ফাইনাল হয়ে রইল”।

নবনীতা মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলল, “কিন্তু দিদি, আমার বান্ধবীকে আর ম্যাডামকে বলে যাওয়া উচিৎ ছিল না? ব্যাপারটা কেমন হচ্ছে না? তাছাড়া আমার কাপড়চোপড় গুলোও তো নিতে হবে। ওগুলো ছেড়ে গেলে তো আমারই অসুবিধে হবে”।

সীমন্তিনী বলল, “তোমার জামা কাপড়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু আপাততঃ আমরা কলকাতা থেকে চলে না যাওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার বান্ধবীর সাথে আর যোগাযোগ করতে পারছ না। তোমার ম্যাডামের সাথে তো একেবারেই নয়। ওখানে চলে যাবার পর ভেবে দেখব তোমার বান্ধবীকে জানানো উচিৎ হবে কি না। আপাততঃ তুমি ধরে নাও তোমাকে আমরা কিডন্যাপ করছি। আর তুমি সেভাবেই থাক”।

রচনাদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছি এসে পরিতোষ বলল, “আমি তোমাদের বাড়ির সামনে ড্রপ করে দিয়েই চলে যাচ্ছি মন্তি”।

সীমন্তিনী সে কথার জবাবে কিছু না বললেও রচনা বলে উঠল, “এ মা, এ কী বলছেন আপনি পরিতোষদা? আপনি আমাদের ঘরে না ঢুকে কিছুতেই যেতে পারবেন না”।

এবার পরিতোষ কিছু বলার আগেই সীমন্তিনী বলল, “নারে রচু, এখন পরিতোষকে আটকে রাখা একেবারে ঠিক হবে না। ওকে অনেকগুলো কাজ করতে দিয়েছি আমি। সে কাজগুলো যত তাড়াতাড়ি ও সেরে ফেলতে পারবে ততই ভাল”।

এবার পরিতোষ বলল, “হ্যা বৌদি। আজ তোমার সাথে পরিচয় যখন হয়েই গেল তখন তোমার বাড়িতেও আমি অবশ্যই যাব। কিন্তু তোমার দিদিভাইয়ের দেওয়া কাজগুলো সমাধা করাই এখন জরুরী বেশী”।

বাড়ির সামনে তিনকন্যাকে নামিয়ে দিয়েই পরিতোষ গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল। রচনা সীমন্তিনী আর নবনীতাকে নিয়ে নিজেদের ফ্ল্যাটে এসে ঢুকল। রতীশ তখনও বাড়ি এসে পৌঁছয় নি। রচনা সীমন্তিনীকে নবনীতার কাছে রেখে নিজে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। খানিক বাদে রতীশও বাড়ি এসে হাজির। রতীশের সাথে সীমন্তিনী নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিতেই নবনীতা রতীশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। তারপর তিনজনে নানা ধরণের গল্প করতে করতেই পরিতোষের ফোন এল সীমন্তিনীর নাম্বারে। সে জানাল, নবনীতার ট্রেণের টিকিট কাটা আর মোবাইল কেনা হয়ে গেছে। আর তার টেম্পোরারি শেল্টারও ঠিক হয়ে গেছে। তবে সেখানে সন্ধ্যের পর পরিতোষ নিজে নবনীতাকে পৌঁছে দেবে। আরও জানাল রতীশের ফ্ল্যাটের জন্য টিভি আর ফ্রিজ কিছুক্ষণ বাদেই কেনা হয়ে যাবে। আজ রাতেই হয়ত হোম ডেলিভারি দিয়ে দেবে।

সীমন্তিনী সব কথা শুনে রতীশ আর নবনীতার কাছ থেকে সরে গিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বলল, “পরিতোষ শোনো না। নবনীতার জন্য কিছু পোশাক তো এখনই কেনা উচিৎ। তাই বলছিলাম কি তোমার কাছে দাদাভাইয়ের যে ফাণ্ডটা আছে, সেখান থেকেই আমাকে আপাততঃ কুড়ি পঁচিশ হাজার দিতে পারবে? তাহলে আজই মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনে আনতাম”।

পরিতোষ একটু সময় নিয়ে বলল, “ওকে তাহলে এক কাজ কর ডার্লিং। আমি বিকেল পাঁচটা নাগাদ তোমার কাছে ফাণ্ড পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি। কিন্তু তোমরা কোন মার্কেটে যেতে চাইছ বলো তো”?

সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই বুঝি বিকেলে গরিয়াহাট যাবেন। ভাবছি আমরাও তখন তার সাথেই যাব”।

পরিতোষ আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তাহলে শোন ডার্লিং। টিভি আর ফ্রিজটা আমি কাল সকালের দিকে ডেলিভারি দিতে বলি। আমি বিকেল পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার ভেতর সকালে যে জায়গায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম সেখানে পৌঁছে যাব। তোমরা সাড়ে পাঁচটার ভেতরেই ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এস। আমি তোমাদের গড়িয়াহাটে পৌঁছে দেব। আবার তোমাদের মার্কেটিং শেষ হলে তোমাদের পৌঁছেও দিতে পারব”।

সীমন্তিনী বলল, “তোমার ওপর তো বড্ড চাপ পড়ে যাবে পরিতোষ। আমার হাতে অত ফাণ্ড থাকলে তোমাকে আর কষ্ট দিতাম না। এমনিতেই তোমার ওপর অনেক বোঝা চাপিয়ে দিয়েছি”।

পরিতোষ সীমন্তিনীকে আশ্বস্ত করে বুঝিয়ে ফোন কেটে দিল। ডাল, ভাজা আর ইলিশ ভাঁপা দিয়ে রচনার হাতের সুস্বাদু রান্না খেয়ে সকলেই খুব পরিতৃপ্ত হল। রচনার অমায়িক ব্যবহারে নবনীতা অভিভূত হয়ে পড়ল। খেতে খেতেই গড়িয়াহাট যাবার প্ল্যান করা হল।
 

***************

বিকেল সাড়ে পাঁচটার কিছু আগেই রতীশ, রচনা, সীমন্তিনী আর নবনীতা বড় রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়াতেই পরিতোষ গাড়ি নিয়ে এসে হাজির। গাড়িতে উঠেই সীমন্তিনী পরিতোষের সাথে রতীশের পরিচয় করিয়ে দিল। তারপর বলল, “দাদাভাই, রচু, তোদের জন্যে একটা সুখবর আছে”।

রতীশ আর রচনা দু’জনেই উন্মুখ হয়ে তার দিকে চাইতেই সীমন্তিনী বলল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ আর তার দুই সাকরেদ পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। আর তার চেয়েও বড় সুখবর হচ্ছে টাকাটা ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করা গেছে। তাও সুদ এবং জরিমানা সমেত”।

রতীশ আর রচনা দু’জনেই খুশীতে প্রায় চিৎকার করে উঠল। সীমন্তিনী বলল, “এর পেছনে পরিতোষের একটা বড় ভূমিকা আছে। তবে টাকাটা পুলিশ হাতে হাতে দেবে না। তোদের ব্যাঙ্ক একাউন্টেই টাকাটা এসে জমা হবে। শুনেছি জরিমানা আর সুদ সমেত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নাকি পুলিশ উদ্ধার করেছে। কিন্তু দাদাভাই তোর তো এখানে ব্যাঙ্ক একাউন্ট নেই। তাই আমি ভাবছি কাল রচুর নামে এখানে কোন একটা ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলে দেব, তাহলে টাকাটা এ একাউন্টে এসে জমা হবে। তবে দাদাভাই পরিতোষের কাছ থেকে আমি তিয়াত্তর হাজার টাকা ধার নিয়ে তোদের ফ্ল্যাটের জন্য ফ্রিজ আর টিভি আনছি। আগামীকালই এসে যাবে ওগুলো। আর নীতার জন্যে কিছু জামা কাপড় কিনছি। পুলিশ যে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা উদ্ধার করেছে, তার থেকেই পরিতোষকে ওই তিয়াত্তর হাজার ঘুরিয়ে দেব। বাকি চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকাই আমি এখন রচুর একাউন্টে জমা করে দিয়ে যাব। এবার তুই নিশ্চিন্তে তোর মনের মত করে নিজের একটা যোগা সেন্টার খুলতে পারবি”।

রতীশ বলল, “কিন্তু আমার তো কালও ইনস্টিটিউটে যেতে হবে। তাহলে ব্যাঙ্কে যাব কি করে”?

সীমন্তিনী বলল, “সেজন্যেই তো বলছি একাউন্টটা রচুর নামে খুলে দেব। টাকাটা ওখানে এসে জমা হোক। তারপর যখন তোদের প্রয়োজন হবে তখন রচুই ব্যাঙ্ক থেকে টাকাটা তুলতে পারবে। আর এটিএম কার্ডটা পেয়ে গেলে তো আর টাকা ওঠাতেও ব্যাঙ্কে যেতে হবে না। এটিএম থেকেই টাকা তুলতে পারবি। তাই তুই সঙ্গে না থাকলেও আমি রচুকে নিয়ে ব্যাঙ্কে গিয়ে কাজটা সেরে ফেলতে পারব বলে মনে হয়”।

*********************

সেদিন বিকেলে গরিয়াহাট থেকে নবনীতার জন্য কিছু পোশাক আর রচনা আর সীমন্তিনীর ব্লাউজ গুলো ডেলিভারি নেওয়া হল। পরিতোষ নবনীতাকে তার নতুন মোবাইল দিল। তারপর রাত আটটা নাগাদ পরিতোষ রতীশ ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে নবনীতাকে নিয়ে চলে গেল। রচনা আর রতীশের অনেক অনুরোধ সত্বেও পরিতোষ তাদের ফ্ল্যাটে ঢুকল না। তবে কথা দিয়ে গেল খুব শিগগীরই সে রতীশের ফ্ল্যাটে আসবে।

ঘরে ঢুকে সকলে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নেবার পর রচনা সকলের জন্যে চা করে আনল। ড্রয়িং রুমে বসে চা খাবার পর রচনা সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই তুমি আগে ব্লাউজ গুলো দেখ তো? ঠিকঠাক বানিয়েছে কি না” বলে রতীশকে উদ্দেশ্য করে বলল, “তুমি একটু সময় এ’ঘরেই থেক সোনা। আমি দিদিভাইকে নিয়ে একটু বেডরুমে যাচ্ছি”।

বেডরুমে এসে ব্লাউজ গুলো দেখতে দেখতে রচনা আলমারি থেকে নতুন কেনা শাড়িটা বের করে সীমন্তিনীকে বলল, “দিদিভাই এ শাড়িটার সাথে ওই ম্যাচিং ব্লাউজটা একটু পড় না তুমি”।

সীমন্তিনী শাড়িটা দেখে বলল, “ওমা, এটা তো তোর কেনা সেই শাড়িটা তাই না? কিন্তু এটা আমাকে পড়তে বলছিস কেন তুই? তুই পড়”।

রচনা সীমন্তিনীর দুটো হাত ধরে বলল, “রাগ কোরনা দিদিভাই। তোমার কাছে একটা কথা আমি গোপন করে গিয়েছিলাম। এ শাড়িটা আসলে তোমার জন্যেই কিনেছিলুম আমি। তোমাকে দেব বলে। তোমার দাদাভাইয়ের কাছ থেকে তুমি তো কখনও কিছু নাও নি। আমারও খুব সখ ছিল তোমাকে কিছু একটা দেবার। কিন্তু সে সুযোগ তো কখনও পাইনি। তাই আমি আর তোমার দাদাভাই যেদিন শুনলাম তুমি আসছ, সেদিনই মার্কেটে গিয়ে তোমার জন্যে এটা কিনেছিলাম। তুমি শুনে রাগ করবে বলেই আগে তোমাকে বলিনি। তাই এটার ব্লাউজটাও তোমার মাপেই বানিয়ে এনেছি। প্লীজ দিদিভাই, রাগ কোর না তুমি। তোমার রচু সোনার এ অনুরোধটুকু তুমি রাখো প্লীজ। তোমার দাদাভাইয়ের দেওয়া প্রথম উপহারটুকু তোমার হাতে তুলে দেবার সুযোগ আমাকে দাও”।

সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবার পর নতুন শাড়ি আর ব্লাউজটা তুলে নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল। রচনা খুশী হয়ে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশের সাথে বসল। মিনিট দশেক বাদে সীমন্তিনী নতুন শাড়ি ব্লাউজ পড়ে সামনের ঘরের দরজার সামনে এসে রচনার নাম ধরে ডাকতেই রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই এস”।

সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে রচনা একেবারে অভিভূত হয়ে পড়ল। সীমন্তিনীকে বিনা প্রসাধনেও ওই শাড়ি ব্লাউজে অসাধারণ সুন্দরী লাগছিল। রচনা সীমন্তিনীকে ধরে ঠাকুরঘরে নিয়ে গেল। সীমন্তিনী ঠাকুরকে প্রণাম করে আবার রচনার হাত ধরে ড্রয়িং রুমে এসে রতীশকে প্রণাম করল। রতীশও মুগ্ধ দৃষ্টিতে সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বলল, “বাহ, কি সুন্দর লাগছে তোকে দেখতে মন্তি। রচু ঠিকই বলেছিল। এ শাড়িটাতেই তোকে খুব সুন্দর মানিয়েছে”।

সীমন্তিনীর চোখ দুটোতে জল টলমল করছিল। রচনা সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের উচ্ছ্বাস চাপতে চাপতে খুশী মাখা গলায় বলল, “সত্যি দিদিভাই, তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে”।

সীমন্তিনী নিজের উদ্গত কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আজকের এ দিনটা আমি কখনও ভুলব না রে রচু। তোর আর দাদাভাইয়ের এ উপহার আমি খুব যত্ন করে রাখব”।
 

পরের কয়েকটা দিন রচনার যেন স্বপ্নের মত কাটল। পরের দিন সীমন্তিনী রচনাকে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাবার আগেই ঘরে টিভি আর ফ্রিজ এসে গেল। পরিতোষই এসে তাদের ব্যাঙ্কে নিয়ে গেল। ব্যাঙ্কে কাগজ জমা দেবার পর পরিতোষের অনুরোধে ব্যাঙ্কের ম্যানেজার নিজে উদ্যোগ নিয়ে আধঘন্টার ভেতরে রচনার নামে একাউন্ট খুলে দিল। পাসবুক আর চেকবুক নিয়ে তারা বাড়ি ফিরে এল। পরের দিন পরিতোষ তার জিমের লকার থেকে টাকা এনে রচনার সেই একাউন্টে চার লাখ সাতাত্তর হাজার টাকা জমা করে দিয়েছিল। সীমন্তিনীকে এতদিন বাদে কাছে পেয়ে রচনার আর খুশীর সীমা ছিল না। নবনীতা চারটে রাত আব্দুলের বাড়িতে পরিতোষের প্রীতিদির হেফাজতে ছিল। পনেরই আগস্ট পরিতোষের গাড়ি চড়েই রচনা আর রতীশ সীমন্তিনী আর নবনীতাকে ট্রেনে তুলে দিল।

*****************

দুপুর প্রায় এগারোটা নাগাদ সীমন্তিনী নবনীতাকে নিয়ে নিজের কোয়ার্টের এসে পৌঁছল। পাহাড়ের ওপর চারধারে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বাড়িটা দেখে নবনীতার খুব ভাল লাগল। কিন্তু কোনকিছুই যেন সে মন দিয়ে উপভোগ করতে পারছিল না। যে মহিলা তার কাছে পুরোপরি অচেনা ছিল, প্রথম দেখাতেই সে মহিলা তাকে নিজের সাথে রাখবে বলে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, এটা ভাবতেও যেন তার কেমন লাগছিল। তবে প্রথমদিন কয়েকটা ঘন্টা রচনা আর সীমন্তিনীর সাথে কাটিয়ে আর ট্রেনে দীর্ঘ সময় সীমন্তিনীর সাথে নানারকম কথাবার্তা বলে বুঝেছে সীমন্তিনী সত্যিই খুব ভাল মনের মানুষ। এখানে এসে পৌঁছতে পৌঁছতে তার মনের দ্বন্দ অনেকটা কমে গেলেও, সে যেন পুরোপুরি সহজ হতে পারছিল না।
 

সীমন্তিনী ঘরে ঢুকেই প্রথমে লক্ষ্মীদির সাথে নবনীতার পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, “নীতা আজ থেকে এখানেই আমাদের সাথে থাকবে। তুমি ওকে ছোড়দি বলে ডেকো লক্ষ্মীদি”।

লক্ষ্মীকে সীমন্তিনী আগেই ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল যে তার সাথে আরও একজন আসছে, তাই লক্ষ্মীও তিনজনের খাবার বানিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। সীমন্তিনী তারপর রচনাকে আর পরিতোষকে ফোন করে জানিয়ে দিল তারা ভালোভাবে বাড়ি পৌঁছে গেছে। আর পরে ভাল করে কথা বলবে।

তারপর নবনীতাকে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে বলল, “নীতা, তুমি একেবারেই কোনরকম অস্বস্তি বোধ কোর না। এটা কে নিজের বাড়ি বলেই ভেব। আর আমাকে তোমার দিদি বলেই ভাববে কেমন? আর এখন তো দুপুর হতেই চলল। তুমি কি চা-টা কিছু খাবে? না স্নান সেরে একেবারে দুপুরের খাবার খাবে”?
 

নবনীতা বলল, “না দিদি, এখন আর চা-টা কিছু খাব না। আগে বরং স্নানটা করে নিলেই ভাল হবে”।

সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে তাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে বলল, “এখন থেকে এটাই তোমার ঘর। এ ঘরেও এটাচড বাথরুম আছে। খাট বিছানা আলমারি টেবিল চেয়ারও আছে। কিন্তু ড্রেসিং টেবিল নেই। তবে আলমারির ভেতরের পাল্লায় আয়না লাগানো আছে। আপাততঃ সেটাতেই কাজ চালাও। অসুবিধে হলে পরে একটা ড্রেসিং টেবিল যোগার করে দেব”।

নবনীতা বলল, “না না দিদি, আলমারির পাল্লার ভেতর যদি আয়না থেকে থাকে, তাহলে আর আলাদা ড্রেসিং টেবিলের কোনও দরকার পড়বে না। কিন্তু দিদি, আমি তোমার কথায় এভাবে চলে এসে তোমাকেই অসুবিধেয় ফেলে দিলাম কি না বুঝতে পাচ্ছি না”।

সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে খাটে বসে বলল, “নীতা, ও’সব একেবারেই ভাববে না। দেখ অনেক বছর থেকে আমি আমার বাড়ি ঘর আত্মীয় পরিজনদের ছেড়ে দুরে দুরে থাকছি। মাধ্যমিক পাশ করবার পর থেকেই। ধর সে প্রায় বারো বছর। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বাড়ি ভর্তি লোকজন। জেঠু, বড়মা, বাবা, মা, কাকু ছোটমা ছাড়াও আমরা ছ’ ভাই বোন। আমার দাদাভাই, যাকে তুমি কলকাতায় দেখে এসেছ, তিনিই আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে সবথেকে বড়। তারপর আমি। দাদাভাই আর আমি মাত্র ছ’মাসের ছোট বড়। একই ক্লাসে পড়তাম আমরা। মাধ্যমিক পাশ করবার পর আমাদের দাদাভাই দেরাদুনে পড়তে গিয়েছিলেন। আর আমি চলে গিয়েছিলাম আমাদের জেলা শহর জলপাইগুড়িতে। তারপর থেকে আমি আর কখনও তেমন পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে থাকিনি। ছোট ভাই বোন গুলোর কথা মাঝে মাঝেই মনে পড়ে। কষ্ট হয় খুবই। সারাদিন তো অফিসের কাজে কর্মেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঘরে ফিরে আসবার পরেই ভীষণ একা লাগে নিজেকে। দাদাভাই আর রচুর সাথে আমি রোজ নিয়ম করে দু’ তিনবার ফোনে কথা বলি। বাড়ির লোকদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না আমার। তাই ঘরে যতক্ষণ থাকি নিজেকে ভীষন একা একা লাগে মাঝে মাঝে। এখন থেকে তুমি আমার সাথে থাকলে আমাকে তো অত লনলি ফীল করতে হবে না। তাই তুমি আমার সাথে থাকলে আমারই তো লাভ। আমি তোমার সদ্য পরিচিত বলে তুমি একেবারে অস্বস্তি বোধ করবে না। তুমি এটাকে একেবারে নিজের বাড়ি নিজের ঘর বলেই ভেব। আমরা দু’বোন মিলে হাসিতে খুশীতে সময় কাটাব” একটু থেমে বলল, “আচ্ছা বলার শোনার তো আরও অনেক কথা আছে। কিন্তু আপাততঃ আর কোনও কথা নয়। তুমি স্নান করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমিও স্নান সেরে নিচ্ছি। আজ তো আর আমি অফিসে যাচ্ছি না। খাবার পর থেকে একসাথে বসে অনেক গল্প করব আমরা”।
 

আগের রাতে ট্রেনে কারুরই ভাল ঘুম হয়নি। স্নানের পর দুপুরের খাবার খেতে খেতে সীমন্তিনী বলল, “নীতা কাল রাতে তো কেউই ভাল ভাবে ঘুমোতে পারিনি। তুমি কি খেয়েদেয়ে একটু ঘুমিয়ে নেবে”?

নবনীতা বলল, “এমনিতে দিনের বেলা ঘুমোনোর অভ্যাস আমার নেই দিদি। কিন্তু কাল রাতে সত্যি একেবারে ঘুম হয়নি। ভাবছি একটু ঘুমিয়ে নিই”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ একটু ঘুমিয়েই নাও। আমিও একটু ঘুমিয়ে নিই। ঘুম থেকে ওঠার পর আমরা গল্প করব”।

****************
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 129)

সীমন্তিনীর ঘুম ভাঙল বেলা প্রায় সাড়ে চারটেয়। বাথরুম থেকে মুখ ধুয়ে বেরোতেই লক্ষ্মী তার ঘরে ঢুকে বলল, “চা খাবে তো দিদিমণি”?

সীমন্তিনী সে কথার সরাসরি জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করল, “নীতা উঠেছে”?

লক্ষ্মী জবাব দিল, “না দিদিমণি, ছোড়দি এখনও ওঠেনি। অবশ্য আমি তার ঘরে ঢুকিনি”।

সীমন্তিনী নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে নবনীতার রুমের দিকে যেতে যেতে বলল, “তুমি চা বানিয়ে নীতার ঘরেই নিয়ে এস। ওখানেই চা খাব”।

লক্ষ্মী কিচেনের দিকে চলে যেতে সীমন্তিনী নবনীতার ঘরে ঢুকে দেখে নবনীতা বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে। সে ধীরে ধীরে নবনীতার শিয়রের পাশে বসে তার ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। কী মিষ্টি লাগছে দেখতে নীতাকে। সীমন্তিনী ভাবতে লাগল, এমন সুন্দর ফুটফুটে দেখতে মেয়েটাকে এই টুকু জীবনে কত দুঃখ যন্ত্রণাই না সইতে হয়েছে। বিনা দোষে ওর গোটা জীবনটাই ছাড়খার হয়ে গেছে। ভাবতে ভাবতে আনমনে সে নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল।

নবনীতার ঘুম ভেঙে যেতেই চোখের সামনে সীমন্তিনীকে দেখে সে হুড়মুড় করে উঠে বসে বলল, “ওমা দিদি তুমি? কতক্ষণ এসেছ তুমি”?

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “এখনই এলাম গো। তা তুমি চা খাবে তো? যাও, চটপট মুখটা ধুয়ে এস। লক্ষ্মীদি এখনই চা নিয়ে আসবে”।
 

নবনীতা বাথরুমে ঢুকে পড়ল। খানিক বাদে লক্ষ্মী ট্রেতে করে তিনকাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল। চায়ের ট্রেটা বিছানায় নামিয়ে রাখতে রাখতে লক্ষ্মী জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি, দাদাবাবু আর বৌদিমণির খবর তো কিছুই বললে না আমাকে। তারা ভাল আছেন তো”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁগো লক্ষ্মীদি, তারা দু’জনেই ভাল আছে। রচু তো রোজই তোমার কথা ওঠাতো। ওই একটা রাত শুধু এ বাড়ীতে ছিল রচু। কিন্তু তোমার কথা বলতে পঞ্চমুখ। কী যাদু করেছ তুমি তোমার বৌদিমণিকে”?
 

লক্ষ্মী একটা মোড়া টেনে বসতে বসতে বলল, “আমি আর কোথায় কি করেছি গো দিদিমণি। বৌদিমণি আসলেই খুব ভাল মেয়ে। আর কী সুন্দর দেখতে! আমার বাপ-মা যে তাদের এই পেঁচিমুখো মেয়েটার নাম লক্ষ্মী কেন রেখেছিল কে জানে। আমার বৌদিমণিই হল আসল মা লক্ষ্মী। যেমন দেখতে, তেমন সুন্দর কথা, আর তেমনি সুন্দর তার ব্যবহার। আহা হা। দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায় যেন। তার মুখটা দেখলেই আমার মনে হত সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মীই যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন”।

নবনীতা বাথরুম থেকে বেরিয়ে লক্ষ্মীর শেষ কথা গুলো শুনতে শুনতে জিজ্ঞেস করল, “কার কথা বলছ লক্ষ্মীদি”?

লক্ষ্মী খুশী খুশী মুখে বলল, “দিদিমণির বৌদিদির কথা বলছি গো ছোড়দি। আমি শুধু একদিন তাকে দেখেছি। কিন্তু তার কথা সব সময় আমার মনে পড়ে। বৌদিমণির কথা মনে হলেই মনটা ভাল হয়ে যায় যেন” বলতে বলতে লক্ষ্মী সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিল। নবনীতা সীমন্তিনীর পাশে বসে বলল, “হ্যাঁ গো লক্ষ্মীদি। তুমি একদম ঠিক বলেছে। আমিও তো তাকে বলতে গেলে একটা দিনই দেখেছি। কিন্তু আমারও মনে হয়েছে, হাজারটা মেয়ের মধ্যে একজনই বৌদির মত মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে। তা হ্যাঁগো দিদি, রতীশদা-দের বিয়ের কতদিন হল গো”?

সীমন্তিনী চা খেতে খেতেই জবাব দিল, “প্রায় সাড়ে তিন বছর হল”।

নবনীতা এবার জিজ্ঞেস করল, “তোমার দাদা বৌদি, দু’জনেই খুব চমৎকার মানুষ। দু’জনকে মানিয়েছেও বেশ। তা দিদি, ওরা বাচ্চা নিচ্ছে না কেন”?

সীমন্তিনী বলল, “নেবেনা কেন, নিশ্চয়ই নেবে। সময় তো আর শেষ হয়ে যাচ্ছে না। ওদের বয়স কম আছে। একটু দেরী হলে ক্ষতি কিসের? আসলে দাদাভাই আর রচু তো এতদিন বাড়িতেই থাকত। দাদাভাই তখন একটা কলেজে টিচারি করত। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তার স্বপ্ন ছিল একটা যোগা সেন্টার খুলবার। সে উদ্দেশ্য নিয়েই চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাত্র আড়াই মাস আগে কলকাতা গেছে। রচুকেও সাথে পাঠাতে বাধ্য হয়েছে বাড়ির সবাই। আর ওখানে গিয়েই এক ঠগের পাল্লায় পড়ে দু’লাখ টাকা খুইয়ে বসেছে। তাই এখন অন্য একটা যোগা সেন্টারে কাজ করছে। তবে কিছুদিনের মধ্যেই ভাল একটা জায়গায় একটা কমপ্লেক্স ভাড়া নিতে পারলেই হয়ত সেন্টার খুলে বসবে। আর সেন্টার না খোলা পর্যন্ত রচু মা হচ্ছে না। ওরা এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে”।

নবনীতা বলল, “ও, তাহলে তো ঠিকই আছে। তবে বৌদি কিন্তু সত্যিই যেমন রূপে তেমন গুনে। লক্ষ্মীদি একেবারে ঠিক বলেছে”।

সীমন্তিনী বলল, “যেদিন রচুকে আমি প্রথম দেখেছিলাম, সেদিনই দাদাভাইয়ের জন্য ওকে পছন্দ করে ফেলেছিলাম। বাড়ি থেকে জেঠু কাকুদের ওদের ওখানে পাঠালাম। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। তারপর আমি ওর সাথে, ওর বাড়ির সকলের সাথে ভাব করি। তারপর আমার দাদাভাইয়ের সাথে ওর বিয়ে দিতে পেরেছিলাম। রচু সত্যিই খুব ভাল। এখন তো দাদাভাই আর রচুই আমার সব। আমি ওদের জন্য আমার প্রাণটা পর্যন্ত দিয়ে দিতে পারি। ওহ, লক্ষ্মীদি, তোমাকে তো বলতেই ভুলে গেছি। তোমার বৌদিমণি তো তোমার জন্য একটা শাড়ি পাঠিয়েছে গো। রাতে বের করে দেব তোমায়। আমাকেও খুব সুন্দর একটা শাড়ি দিয়েছে এবার। পরে দেখাব, তোমাকে”।

নবনীতা আবার কিছু একটা বলতে যেতেই সীমন্তিনী বলে উঠল, “দাঁড়াও নীতা। আগে একটা জরুরী ফোন সেরে নিই। এ’ ক’টা দিন কলকাতা থেকে একবারও খবর নিতে পারিনি” বলে হাতের মোবাইল থেকে ডক্টর সোমকে ফোন করল। ও’পাশ থেকে সাড়া পেতেই বলল, “গুড ইভিনিং ডক্টর সোম। আমি সীমন্তিনী বলছি”।

ডক্টর সোম জবাব দিলেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ ম্যাডাম। ভেরি গুড ইভিনিং। সেদিন শুনলাম আপনি নাকি কলকাতা গিয়েছেন। কেমন আছেন বলুন”।

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ডক্টর, আমি ভালই আছি। আজই ফিরেছি কলকাতা থেকে। ভাবলাম আপনার কাছ থেকে আগে অর্চনার খবরটা নিই। সে চেকআপের দিন এসেছিল তো? এখন তার কণ্ডিশন কেমন দেখলেন”?

ডক্টর সোম বললেন, “হ্যাঁ ম্যাডাম এসেছিল। আর খুব ভাল রিপোর্ট। শারিরীক সমস্যাগুলো প্রায় কেটেই গেছে। তবে মনের ওপর চাপটা একটু আছেই। আর ও’টুকু তো এত তাড়াতাড়ি সারবেও না ম্যাডাম। বোঝেনই তো কতগুলো বছর মেয়েটাকে শারিরীক আর মানসিক ভাবে নির্যাতিতা হতে হয়েছে। সব কথা ভুলতে একটু সময় তো লাগবেই। তবে আমার প্রেসক্রিপশান মেনে ঠিকঠাক ওষুধগুলো খেয়েছে বলে শারিরীক ভাবে সে এখন প্রায় পুরোপুরিই সুস্থ হয়ে উঠেছে। এখন মা, বাবা, ভাইদের সাথে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে মনের বোঝাগুলোও হাল্কা হতে শুরু করবে। আর আমার মনে হয় আপনি যখন তার সাথে আছেন, তাহলে আর কোন সমস্যা হবে না। তবে এবারেও আমি দুটো মেডিসিন প্রেসক্রাইব করেছি। সে ওষুধ দুটো দু’মাস কন্টিনিউ করতে হবে। আশা করি আর কোনও প্রব্লেম হবে না”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “ডক্টর, আমি আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে একটু পরামর্শ করতে চাইছিলুম। আপনি কি খুব ব্যস্ত আছেন”?

ডক্টর সোম জবাব দিলেন, “না খুব একটা ব্যস্ত নই আমি এখন। বলুন কি বলতে চান”?

সীমন্তিনী বলল, “ডক্টর আসলে আমি ভাবছিলুম যে অর্চনাকে কিছু দিনের জন্য আমার এখানে নিয়ে আসব। কিন্তু ও আপনার ট্রিটমেন্টে আছে। আপনার অনুমতি ছাড়া ওকে নিয়ে আসাটা বোধহয় ঠিক হবে না। তাই আপনার মতামতটা জানতে চাইছিলুম”।

ডক্টর সোম বেশ উৎফুল্ল ভাবে বলে উঠলেন, “ম্যাডাম, আমি তো ভেবেছিলাম যে এর পরের বার আপনার সাথে দেখা হলে আমিই আপনাকে এমন একটা পরামর্শ দেব। আসলে অর্চনা শারীরিক ভাবে ইতিমধ্যেই প্রায় নাইনটি পার্সেন্ট রিকভারড হয়ে গেছে। এখন ওর মানসিক স্থিতিটা নর্মাল হলেই ও পুরোপুরি ভাবে সেরে উঠবে। আর এমন সময়ে ওর প্রাণের খুব কাছের একজনের সাথে ও যদি কিছুটা দিন হেসে খেলে কাটাতে পারে তাহলে ও আরও তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে”।

সীমন্তিনী মনে মনে খুব খুশী হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তাহলে, আপনার এতে আপত্তি নেই তো? আমি আমার এখানে ওকে নিয়ে আসতে পারি? কিন্তু ওর চেকআপের বা অন্য রকম কোন অসুবিধে হবেনা তো”?
 

ডক্টর সোম সহজ গলাতেই জবাব দিলেন, “ওর পরের চেকআপ করব প্রায় দু’মাস বাদে। ওই দুটো মাস মেডিসিন গুলোকে সময় মত খেলেই হবে। কোনও আনটুয়ার্ডস কিছু হবে না বলেই আশা করছি আমি। আর ইন কেস কোনও রকম কমপ্লিসিটি যদি সত্যিই দেখা দেয়, তাহলে এনি টাইম এনি ডে, আপনি আমায় কন্টাক্ট করবেন। তাতে তো কোনও প্রব্লেম নেই ম্যাডাম”।
 

সীমন্তিনী খুব খুশী হয়ে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা ডক্টর, আজ তাহলে আপনাকে আর বিরক্ত করছি না। প্রয়োজন হলে যে কোন ব্যাপারে আমাকে ফোন করবেন। রাখছি তাহলে এখন? গুড নাইট”।

সীমন্তিনী ফোন কেটে দিতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “অর্চনা কে গো দিদি? তোমার বোন”?

লক্ষ্মী খালি কাপগুলো ট্রেতে উঠিয়ে নিতে নিতে বলল, “বোন বলছ কি গো ছোড়দি। সে তো আমাদের বৌদিমণির দিদি গো। এক মায়ের পেটের দু’বোন তারা। ভারী বিপদে পড়েছিল মেয়েটা। দিদিমণি তো কত দৌড়ঝাঁপ করে মেয়েটার চিকিৎসা করিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলল”।
 

নবনীতা অবাক হয়ে বলল, “বৌদির দিদি? তার এমন কী হয়েছিল গো দিদি”?

সীমন্তিনী বলল, “আমার কাছে যখন এসেই পড়েছ, ধীরে ধীরে সবটাই জানতে পারবে নীতা। তবে দাঁড়াও একটু। আমি আরেকটা ফোন করে নিই আগে” বলে কিংশুককে ফোন করল। কিংশুক ফোন ধরেই বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই বল। তোমরা ঠিকমত এসে পৌঁছেছ তো? রাস্তায় কোন অসুবিধে কিছু হয়নি তো”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ ভাই, আমরা ঠিকমতই এসে পৌঁছেছি। কোনও অসুবিধে হয়নি। তা তোমরা সবাই কেমন আছ বল তো? কলকাতায় ক’টা দিন এমন ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাকে একেবারেই ফোন করার সময় করে উঠতে পারিনি। মাসি, মেসো, দিদি সবাই ভাল আছে তো”?

কিংশুক বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সবাই ভাল আছে। দিদির চেকআপও হয়ে গেছে। ডক্টর বলেছেন অন্য কোনও কমপ্লিকেশন দেখা না দিলে দু’মাসের ভেতর আর কোন চেকআপের দরকার নেই। তবে দুটো ওষুধ আরও দু’মাস ধরে খেতে বলে দিয়েছেন। এই নাও, মা তোমার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছেন”।

বিভাদেবীর গলা শোনা গেল প্রায় সাথে সাথে, “মন্তি মা। তোরা ঠিক মত বাড়ি পৌঁছেছিস তো মা? আমি যে বড্ড চিন্তায় ছিলুম রে”?

ভালোবাসা মাখা কথা গুলো শুনে সীমন্তিনীর চোখের কোলে হঠাতই জল চলে এল যেন। নিজেকে সামলে সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “হ্যাঁ মাসি। আমরা ভালভাবেই বাড়ি পৌছে গেছি গো। ভাল আছি। তোমরা সবাই ভাল আছ তো”?

বিভাদেবী জবাব দিলেন, “হ্যাঁরে মা, আমরাও সবাই ভাল আছি। তোর মেসোর দোকানেও বিক্রীবাট্টা ভালই হচ্ছে। তিনিও এখন আগের চেয়ে অনেক ভাল আছেন। এমন একটা দিন যায়না, যেদিন তিনি তোর কথা না বলে থাকেন। সত্যি রে মা। নিজের পেটের মেয়েও বুঝি আমাদের জন্য এতসব করত না”।

সীমন্তিনী বলল, “মাসি আবার তুমি সে’সব কথা বলছ? এখনও আমাকে নিজের মেয়েদের সমান ভাবতে পারছনা তুমি, তাই না”?
 

বিভাদেবী বললেন, “রাগ করিস নে মা। আগের জন্মে আমিই বোধহয় তোর মেয়ে ছিলুম রে। তাই মা যেভাবে তার সন্তানদের সুখ দুঃখের কথা ভাবে সব সময়। তুইও ঠিক তেমনি করেই আমাদের সকলের কথা ভাবিস। আচ্ছা শোন মা। রচু কাল রাতেই ফোন করে জানিয়েছিল তোরা আজ পৌঁছবি। তোর ফোন পেয়ে এখন মনটা শান্ত হল। তা বাড়ি কবে আসছিস”?

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, আমি তো সবে আজই এলাম। কাল অফিসে জয়েন করব। তারপর অফিসের কাজকর্ম একটু বুঝে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। কিন্তু মাসি আমার একটা আবদার আছে তোমার কাছে”।

বিভাদেবী বললেন, “ওমা। মেয়ের কথা শোন। বল না কি বলবি”?

সীমন্তিনী বলল, “আমি দিন সাতেকের মধ্যেই একবার চেষ্টা করব যাবার। কিন্তু মাসি, এবার আমি অর্চুদিকে কয়েকটা দিনের জন্য আমার কাছে নিয়ে আসতে চাই। তোমরা আপত্তি করবে না তো”?

বিভাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “ওমা আপত্তি কিসের? অর্চু তোর ওখানে যাবে, এতে কে আপত্তি করবে। আর অর্চুও এখন আগের থেকে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। আর শোন, তুই আবার ওকে অর্চুদি বলছিস যে বড়”?

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে মাসি, তার খবর আমি জানি। একটু আগেই ডক্টর সোমের সাথে কথা বলেছি আমি। তার কাছ থেকে ওর কথা সব শুনেছি। তা সে কোথায় গো? একটু কথা বলতে পারি তার সাথে”?

বিভাদেবী বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ রে মা। অর্চুও তো তোর সাথে কথা বলতে চাইছে। এই নে”।

একটু বাদেই ফোনে অর্চনার গলা শোনা গেল, “হ্যাঁ দিদিভাই বল। রচু তোমাকে যে শাড়িটা দিয়েছে সেটা পড়লে তোমাকে নাকি মা দুর্গার মত লাগে দেখতে। শাড়িটা সত্যি এত সুন্দর”?
 

সীমন্তিনী অর্চনার গলার এমন স্বাভাবিক সুর শুনে মনে মনে খুব খুশী হয়ে বলল, “ওই পাগলীটার কথা আর বোলো না অর্চু। সে শাড়ি কিনতে গিয়ে তো ছিনতাইবাজের খপ্পরে পড়ে শাড়িটা খুইয়েই বসেছিল। ভাগ্যিস তখন একজন পুলিশ সাদা পোশাকে ওর পেছন পেছন যাচ্ছিল”।

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, রচু আমাকে বলেছে সে’সব কথা। আর সে পুলিশ অফিসার নাকি তোমারই খুব ভাল বন্ধু? রচু তো সে’কথা বলতে বলতে আনন্দে লাফাচ্ছিল”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা অর্চু শোনো। মাসিকে আমি বলেছি। আমি দিন সাতেকের মধ্যে একবার কালচিনি যাব। আর ফেরার সময় আমি তোমাকে সাথে করে আমার এখানে নিয়ে আসতে চাই কয়েক দিনের জন্য। তোমার আপত্তি নেই তো ভাই”?

অর্চনা বলল, “তুমি আমাকে তোমার ওখানে নিয়ে যাবে, আর আমি তাতে আপত্তি করব। এমন কথা তুমি ভাবতে পারলে দিদিভাই? আমার এ জীবনটা যে তোমারই দান গো। তোমার কোন নির্দেশ না মেনে আমি থাকতে পারি? তুমি যা বলবে তাই হবে। আর মনে হয় না মা-বাবাও এতে কোনও রকম আপত্তি করবেন”।

সীমন্তিনী বলল, “বেশ তাহলে ওই কথাই রইল। আর শোনো, ডক্টরের সাথে আমি একটু আগেই কথা বলেছি। উনিও বললেন আর ভয়ের কিছু নেই। তবে যে অসুধ দুটো খেতে বলেছে সেটা নিয়ম করে খেয়ে যাবে। আর কক্ষনও একা একা থাকবে না। সব সময় মাসি, মেসো বা ভাইয়ের সাথে থাকবে। পুরোনো কথাগুলো একেবারেই ভাববে না। আর হ্যাঁ, থানা থেকে মিঃ রায় কি আর কিছু বলেছেন”?

অর্চনা বলল, “না দিদিভাই। থানা থেকে কেউ আর কিছু বলেনি। তবে তুমি কলকাতা যাবার আগেই তো এখানকার ওসি বলেছেন যে কেসটা কোর্টে উঠে গেছে। আমাদের হয়ত সামনের মাসে গিয়ে কোর্টে হাজিরা দিতে হবে”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “বেশ, সময় মত মিঃ রায়ই সেটা জানিয়ে দেবেন। কিন্তু জানো অর্চু, আমি কলকাতা যাবার আগে ভেবেছিলাম তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব। রচুর ওখানে কয়েকটা দিন কাটিয়ে এলে তোমারও ভাল লাগত। কিন্তু ডক্টর সোমের ওখানে তোমার চেকআপটা করা বেশী দরকারি ছিল বলেই সেটা আর করিনি। সেজন্যে তুমি আমার ওপর রাগ কোর না ভাই। তা আমার এখানে আসছ তো? না ভয় পাচ্ছ”?
 

অর্চনা বলল, “তোমার কথায় আমি মরতেও দ্বিধা করব না দিদিভাই”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “ছিঃ, অমন কথা মুখেও এনো না অর্চু। আচ্ছা শোনো। আমি এখন রাখছি। মেসো এখন নিশ্চয়ই দোকানে আছেন। তাকে আমার প্রণাম জানিও। সামনের সপ্তাহে আসছি আমি। তুমি আমার সঙ্গে চলে আসবার জন্য তৈরী থেকো, কেমন”?

অর্চনা বলল, “ঠিক আছে দিদিভাই। তুমিও ভাল থেক” বলে একটু থেমেই আবার বলল, “ওঃ দিদিভাই, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছি গো। রচু বলছিল তুমি নাকি কলকাতা থেকে কাকে তোমার সঙ্গে নিয়ে এসেছ। সে কি তোমার সাথে এসেছে”?

সীমন্তিনী নবনীতার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ অর্চু। ওর নাম নবনীতা। আমার আরেকটা বোন বলে ধরে নিতে পার। তুমি এলে তার সাথে তোমার পরিচয় হবে। ঠিক আছে? ছাড়ছি তাহলে, কেমন? সবাই ভাল থেকো তোমরা” বলে ফোন কেটে দিয়ে একটা বড় করে শ্বাস নিল।

সীমন্তিনীর ফোনে কথা বলা শুনতে শুনতে নবনীতা চুপ করে ছিল। এবার সে বলল, “অর্চনাদি কি সত্যি আমাদের বৌদির দিদিই”?
 

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “হ্যাঁ নীতা। রচু ওরা দু’বোন এক ভাই। রচুর মাকে আমি মাসি বলে ডাকি। কিন্তু মায়ের মতই শ্রদ্ধা করি। ওদের তিনজনের সাথেই কথা বললাম। কয়েকদিন কলকাতায় এত ব্যস্ততার মধ্যে ওদের খবর নিতে পারিনি। রচুর দিদি অর্চনার খুব বড় একটা দুর্ঘটণা ঘটেছিল। এখনও চিকিৎসা চলছে। তবে আজ যা শুনলাম তাতে মনে হয় প্রায় সেরে উঠেছে”।

নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছিল বৌদির দিদির? বল না আমাকে”।

সীমন্তিনী অর্চনার ব্যাপারে সংক্ষেপে সব কিছু শুনিয়ে বলল, “মেয়েটা যে কী সুন্দর দেখতে তা তোমায় কি বলব নীতা। রচুর থেকেও সুন্দরী। কিন্তু ঘটকের মিথ্যে কথায় বিশ্বাস করে মেসো ওর বিয়েটা দিয়েই খুব বড় ভুল করে ফেলেছিলেন। তুমি ভাবতে পার নবনীতা? পাঁচ বছর স্বামীর সাথে ঘর করেও সে এখনও কূমারী। সুতরাং বুঝতেই পাচ্ছ স্বামী সোহাগ বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই সে পায় নি। ওর বর নাকি বিয়ের পরদিন থেকেই রোজ রাতে মদ খেয়ে বাড়ি এসে ওকে শুধু মারধোর করত। স্বামী মারা যাবার পরেও প্রায় দুটো বছর সে শ্বশুর বাড়িতেই ছিল। তার শ্বশুর শাশুড়ি সৎ ছেলেরা তার ওপর অকথ্য অত্যাচার করত। ওর স্বামীর প্রভিডেন্ট ফান্ড আর পেনশনের টাকা গুলো হাতে পাবার পরেই ওর শ্বশুর বাড়ির লোকেরাই ওকে মেরে ধরে আধমরা করে রাতের অন্ধকারে ওকে রেল লাইনের ওপর ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। লোকাল থানার পুলিশকে আমি আগে থেকেই আমার সন্দেহের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম বলে ওর ওপর তারা আগে থেকেই নজর রেখে যাচ্ছিল। তারা সময়মত খবর পেয়েই তাকে রেল লাইন থেকে তুলে এনে হাসপাতালে ভর্তি করে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু তখনও ওর অবস্থা খুব শোচনীয় ছিল। মাস দেড়েক চিকিৎসা চলবার পর এখন নাকি বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠেছে। ভাবছি আগামী সপ্তাহে গিয়ে ক’দিনের জন্য ওকে এখানে নিয়ে আসব। ওর মনের ওপর থেকে পুরনো বোঝা গুলো এখনও পুরোপুরি সরে যায়নি। কয়েকটা দিন আমাদের সাথে কাটালে হয়ত আরও একটু স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। আর আমি অফিসে চলে গেলেও তুমি ওকে কম্পানি দিতে পারবে। তোমারও ভাল লাগবে”।

নবনীতা সব শুনে বলল, “সত্যি দিদি। বিনা দোষে কত মেয়েকে যে কত দুর্ভোগই না সইতে হয়। ওই সাতটা বছর বৌদির দিদি তো অমানুষিক কষ্ট পেয়েছে। আর তার সাথে বৌদির মা বাবাও তাদের মেয়েকে চোখের দেখা দেখতে না পেয়ে কতই না কষ্টে ছিলেন”।

সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে বলল, “ভগবান যার ভাগ্যে যা লিখে দিয়েছেন তাকে তো সেটা ভোগ করতে হবেই হবে। নইলে তোমারই বা কি দোষ ছিল বল তো? কোন অপরাধে তোমাকে এতগুলো বছর অমন নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে”।

নবনীতা ছোট্ট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার কথা আর তুলো না দিদি। থাক। ও’সব কথা যত ভাবব, ততই তো কষ্ট হবে”।

সীমন্তিনী নবনীতার বিছানা থেকে উঠতে উঠতে বলল, “আচ্ছা ছাড়ো এসব কথা। চল, আজ আর বাইরে কোথাও যাব না। এমনই ঘরের পেছনের বাগানে একটু হাঁটাহাঁটি করে আসি”।

পেছনের বাগানে আসতেই সীমন্তিনীর হাতের মোবাইল বেজে উঠল। পরিতোষের ফোন। বাগানে ঘুরতে ঘুরতে দু’জনেই পরিতোষের সাথে কথা বলল। সন্ধ্যের অন্ধকার ঘণিয়ে আসতেই তারা ঘরে ফিরে গেল।


****************
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 130)

রবিবার বলে মহিমার কাজ আজ অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশী। আজ পনেরজন ক্লায়েন্টের কাছে এসকর্ট পাঠাতে হবে। ইনস্টিটিউটের কাজ শেষ হবার পর সে ইনস্টিটিউট বন্ধ করে নিজের প্রাইভেট রেস্ট রুমে এসে ঢুকল। আগে সে ইনস্টিটিউটে নিজের চেম্বারে বসেই তার এসকর্ট ব্যবসার যোগাযোগ আর কথা বার্তা চালিয়ে যেত। কিন্তু রতীশ তার ইনস্টিটিউটে যোগ দেবার পর সে আর নিজের চেম্বারে বসে সে’সব করে না। রতীশ যাতে কোনভাবেই তার এসকর্ট ব্যবসার কথা জানতে না পারে, তাই সে এমন সতর্কতা অবলম্বন করেছে। সাড়ে দশটার পর ইনস্টিটিউট বন্ধ করে বরুন সুজয় আর বীথিকাকে নিয়ে সে তার রেস্ট রুমে এসে ঢোকে। তারপর বরুন সুজয় আর বীথিকে তাদের নিজের নিজের কাজের দায়িত্ব দিয়ে বিদেয় করে সে অন্য সব ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ করে। তাদের জন্য এসকর্টের বন্দোবস্ত করে।
 

বিমল আগরওয়ালা আজ আবার আসবে বলেছে। রতীশ কাজে যোগ দেবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই মহিমা নিজে কোন ক্লায়েন্টের মনোরঞ্জন করা প্রায় ছেড়েই দিয়েছে। কিন্তু এমন বাছা বাছা কয়েকজন ক্লায়েন্ট আছে, যাদেরকে সে আর ফিরিয়ে দিতে পারে না। নিজের শরীর বা মন না চাইলেও নিজের এই অনৈতিক ব্যবসাটা নির্ঝঞ্ঝাটে চালিয়ে নিয়ে যেতে, হাতে গোনা কয়েকজন পুরুষ ক্লায়েন্টকে সুখ দিতেই হয়। তবে রতীশ কাজে যোগ দেবার পর গত একমাসে সে শুধুমাত্র নিজের স্বামী অরিন্দম ছাড়া কেবল বিমল আগরওয়ালার কাছেই নিজের শরীরটাকে সমর্পন করেছে। তার নিজের ইচ্ছে থাকুক বা না থাকুক, আট দশ দিন বাদে বাদেই বিমল তার কাছে আসে। ঘন্টাখানেক ধরে মহিমার লোভনীয় শরীরটা নিয়ে নিজের বাসনার ক্ষুধা মেটায়। আজ আবার বিমল আসছে। বিমল নিশ্চয়ই একই উদ্দেশ্যে আসছে। কিন্তু মহিমার মনটা আজ কেন যেন সায় দিচ্ছে না। বিমলকে আজ নিজের শরীরটা ভোগ করতে দিতে তার একদম ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বিমল তার একটা সময় খুব উপকার করেছে। বিমলের সাহায্য না পেলে সে ওই সময়ে তার ছেলেমেয়ে দুটিকে ব্যাঙ্গালোর আর আহমেদাবাদে পাঠাতে পারত না। তাই তারপর থেকে বিমল প্রায় প্রতি মাসেই দু’বার বা তিনবার তার শরীরটাকে ভোগ করে। প্রথম প্রথম পয়সার তাগিদেই সে বিমলের সাথে এ’সব করত। কিন্তু এখন আর তার পয়সার অভাব নেই। তাই সে নিজে কাস্টমার নেওয়া পুরোপুরি ভাবেই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু উকিল আর পুলিশ অফিসারদের আবদার তাকে রাখতেই হয়। এসকর্ট ব্যবসা চালাতে গেলে এদের সাথে ভাল রিলেশান রাখাটা নিতান্তই দরকারি। ব্যতিক্রম শুধু এই বিমল। বিমল তার ব্যবসার ব্যাপারে তেমন কোন সাহায্য করে না। কিন্তু একটা সময় সে মহিমাকে বড়সড় রকমের এমন আর্থিক সাহায্য করেছিল যে মহিমা নেহাত কৃতজ্ঞতা বোধেই বিমলের চাহিদা মিটিয়ে যাচ্ছে এখনও। কিন্তু আজ কেন জানিনা বিমলের কাছে নিজের শরীরটাকে মেলে ধরতে তার একেবারেই ইচ্ছে করছে না।
 

বিমলকে সাড়ে বারোটায় আসতে বলেছে সে। তার আগে নিজের অন্য কাজগুলো মহিমা গুটিয়ে নিয়েছে। সময়ের আগেই বিমল এসে পৌঁছল। ইচ্ছে না থাকলেও বিমলের আবদার সে ফেলতে পারল না। আধঘণ্টা ধরে মহিমাকে ভোগ করে তৃপ্ত হয়ে বিমল তাকে রেহাই দিল। কিন্তু কাজের শেষে বিমল মহিমাকে বলল, “ডার্লিং, তোমার সাথে আমার আরেকটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে। আর আমি আজই সেটা বলতে চাই”।

মহিমা নিজের নগ্ন দেহটাকে ভালভাবে পোশাকাচ্ছন্ন করে বলল, “বল কি বলবে”?

বিমল আগরওয়ালা বলল, “ডার্লিং, রতীশবাবু কেমন কাজ করছে? ঠিক ঠাক আছে তো”?

মহিমা একটু ভুরু কুঁচকে বলল, “রতীশ? তুমি রতীশের ব্যাপারে এমন কি ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলতে চাও বিমল”?

বিমল হেসে বলল, “আরে না না, রতীশ বাবুর ব্যাপারে আমি তেমন কিছু বলব না। আমি বলতে চাই তার স্ত্রীর কথা। জবরদস্ত মাল একটা। তুমি রতীশবাবুর বৌকে দেখেছ কখনও”?

মহিমা বিমলের মুখে রচনার কথা শুনে মনে মনে ভীষন অবাক হলেও মুখে সে ভাব প্রকাশ না করে বলল, “রতীশের বৌকে তো আমি ঠিক দেখিনি বিমল। কিন্তু তুমি হঠাৎ তার বৌয়ের ব্যাপারে এত ইন্টারেস্টেড হয়ে উঠেছ কেন? খুব সেক্সী নাকি সে”?

বিমল নিজের শার্টের বুক পকেট থেকে একটা ছবি বের করে মহিমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “এই ছবিটা দেখ। তাহলেই বুঝতে পারবে কেমন মাল”।

মহিমা হাত বাড়িয়ে ছবিটা নিয়ে তার দিকে তাকিয়েই ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল। এ যে সত্যি রচনার ছবি! কিন্তু নিজের মনের ভাব খুব পারদর্শিতার সাথে গোপন রেখে সে জিজ্ঞেস করল, “কার ছবি এটা? রতীশের বৌয়ের”?

বিমল আগরওয়ালা মুখ বেঁকিয়ে হেসে জবাব দিল, “হ্যাঁ ডার্লিং। এটা রতীশবাবুর বৌয়েরই ছবি। নাম রচনা। কি সাংঘাতিক মাল দেখেছ? এমন মাল তোমার কোম্পানীতে আর একটাও আছে”?

মহিমা ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড অবাক হলেও সন্তর্পণে মুখের ভাব বজায় রাখতে রাখতে বলল, “হু, সত্যিই দারুণ সুন্দরী। আমি তো একে দেখিনি কখনও। কিন্তু ছবিটা দেখে তো দারুণ লাগছে। কিন্তু তুমি তার ছবি পেলে কোত্থেকে বিমল”?

বিমল শয়তানী হাসি হাসতে হাসতে বলল, “অনেক কষ্ট করে যোগার করেছি ডার্লিং। তোমার কাছে তো কতবার বলেছি যে এমন একটা ঊণিশ কুড়ি বছরের মাল আমাকে একদিন দাও, যে বিবাহিতা আর নিজের স্বামী ছাড়া অন্য কারুর সাথে সেক্স করেনি। তুমি তো সেটা দিতে পারলে না। আমার আরেক বন্ধু এ মেয়েটার খোঁজ এনেছিল মাস দুয়েক আগে। কিন্তু একটা মুস্কিল হয়ে গেছে বলেই তোমার কাছে আসতে হল আমাকে”।

মহিমা এবার চেষ্টা করেও যেন নিজের গলার স্বর আয়ত্বে রাখতে পারল না। প্রায় শুকনো গলায় সে বলল, “এ ছবি দিয়ে আমি কী করব”?

বিমল আগরওয়ালা বলল, “শোনো ডার্লিং। তোমার সেন্টারের অন্যদের মত রতীশও যে তোমার আসল ব্যবসায় নেমে পড়বে সে’কথা তো আমি জানিই। আর তোমার লেডি কাস্টমারদের কাছে তার ডিমাণ্ডও খুব হবে। আমি জানি তাকে দিয়ে তুমি অনেক পয়সা কামাবে। আর রতীশের বৌকেও তুমি যে একটু চেষ্টা করলেই তোমার ব্যবসার এসকর্ট বানিয়ে নিতে পারবে, এটাও আমি জানি। কিন্তু আমি চাই রতীশবাবুর বৌকে অন্য কেউ নেবার আগে আমি যেন প্রথম খেতে পারি। আর এ কাজটা আমার জন্যে তুমিই করতে পার”।

বিমলের কথা শুনে মহিমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রচনার ওপর এমন একটা বিপদ ঘণিয়ে আসছে ভেবে সে মনে মনে অস্থির হয়ে উঠলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “দ্যাখ বিমল, রতীশ সবে মাস খানেক হল আমার এখানে কাজে যোগ দিয়েছে। ওকে আমি এখনও আমার আসল ব্যবসায় নামাতে পারিনি। একটু সময় লাগবে। কারন ও যতটা ভদ্র ঠিক ততটাই মুখচোড়া। তাই ওকে লাইনে আনতে আমাকে ধীরে সুস্থে এগোতে হবে। এমন লাজুক স্বভাবের একটা ছেলেকে এ লাইনে নামাতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন। আর রতীশের বৌকে তো আমি চিনিই না। তাকে লাইনে আনতে চাইলেও হুট করে তো আনতে পারব না। অনেক সময় লাগবে। কিন্তু তুমি তো বললে দু’মাস আগে তুমি এ ছবি যোগার করেছ। এতদিন তো এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলনি তুমি”?

বিমল আগরওয়ালা বলল, “তোমার কাছে যে এ ব্যাপারে আমাকে আসতে হবে, সেটা তো আমি আগে জানতাম না ডার্লিং। কাজটা আরেকজন করবে বলে কথা দিয়েছিল। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপারে সে নিজেই থানা পুলিশের জালে জড়িয়ে পড়েছে বলেই সে আর এদিকের কাজটা করতে পারেনি। আর আমি তো নিজেই জানি, মালটা তোমার হাতের আওতার ভেতরেই আছে। তুমিও একদিন না একদিন মালটাকে ঠিক লাইনে এনে তুলবেই। হয়ত তোমার মাধ্যমেই আমিও কখনও মালটাকে ভোগ করতে পারব। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে আমার আগে তুমি অন্য কারো হাতে মালটাকে তুলে দিতে পার। তাই আমি তো আর তাকে ফ্রেশ খেতে পারব না। তাই আর কোথাও না গিয়ে আমি তোমার কাছেই এলাম সরাসরি। তুমি মালটাকে তোমার বড়শীতে গেথে তোল। আর সবার আগে তাকে আমাকে ভোগ করতে দিও। তুমি তার যা রেট ধরবে আমি তোমাকে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী পয়সা দেব। কিন্তু এই মালটাকে আমার চাইই চাই”।

মহিমা বিমলের কথা শুনে রচনার সমূহ বিপদের কথা ভেবে ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হয়ে উঠল। রচনার ওপর বিমলের নজর যখন একবার পড়েছে, তাহলে আজ হোক বা কাল হোক বিমল রচনাকে ভোগ করবেই। ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়েও কোনও ফল হবে না। কিন্তু রতীশ আর রচনাকে সে পরিচয় হবার দিনটি থেকেই অন্যভাবে ভালবেসে ফেলেছে। তাই রতীশকে যেমন সে নিজের এসকর্ট ব্যবসায় নামাতে চায়নি, তেমনই রচনাকেও সে তার ব্যবসার মূলধন করবার কথা কখনও ভাবে নি। দেখতে অত সেক্সী মনে না হলেও রচনা সত্যিই খুবই সুন্দরী। এসকর্টের ব্যবসায় নামলে তার ক্লায়েন্টের অভাব হবে না। কিন্তু রচনার অমায়িক ব্যবহার আর কথাবার্তায় তার মনে সে চিন্তা কখনই আসেনি। রচনাকে দেখলেই খুব পবিত্র পবিত্র মনে হয়। ওর সুন্দর মিষ্টি মুখটা মনে পড়লেই মহিমার মনটা যেন শান্ত হয়ে ওঠে। রচনা আর রতীশের সুন্দর ব্যবহার দেখে আর তাদের মিষ্টি কথা শুনে মহিমাও মনে মনে তাদের দু’জনকে নিজের বড় আপন বলে ভাবতে শুরু করেছে। কিন্তু বিমল আগরওয়ালার হাতে রচনা নষ্ট হয়ে যাক, ওদের সুন্দর সংসারে অশান্তি নেমে আসুক, এমনটা মহিমা ভাবতেও চায় না। কিন্তু রচনাকে বিমলের হাত থেকে সে বাঁচাবেই বা কি করে? বিমল তার কাছে যে প্রস্তাব নিয়ে এসেছে সে প্রস্তাব সে মেনে না নিয়ে বিমলকে ফিরিয়ে দিলে বিমল তো অন্যভাবে রচনাকে ভোগ করবার প্ল্যান করবে। হয়ত অন্য কাউকে সে এ কাজের এ দায়িত্ব দেবে। আর তখন রচনার ওপর কোনদিক থেকে কখন বিপদ নেমে আসবে, তা সে নিজেও বুঝতে পারবে না। তার চেয়ে বিমলের কাজটা হাতে নিয়ে নিলে তবু কিছুদিনের জন্য বিমলকে চুপ করিয়ে রাখা যাবে। আর রচনাকে বাঁচাবার চেষ্টা করা যাবে। ভেবেচিন্তে যে করেই হোক একটা পথ বের করতেই হবে। আর কোনভাবেই যদি রচনাকে বাঁচাবার কোন পথ খুঁজে না পায়, তাহলে রতীশকে বলবে সে যেন রচনাকে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে যায়। রতীশ বা রচনার কোনও রকম বিপদ হোক এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারবে না। রতীশ চলে গেলে তার ইনস্টিটিউটের ক্ষতি হবে। তা সত্বেও সে প্রয়োজন হলে রতীশকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে রচনাকে বাঁচাবে।
 

মহিমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিমল আগরওয়ালা বলল, “কি হল ডার্লিং? কি ভাবছ? এ মালটাকে জালে ফেলতে পারলে তোমার ব্যবসাও চড়চড়িয়ে বাড়বে দেখো। হেভি ডিমাণ্ড হবে মার্কেটে। কিন্তু সবার আগে আমিই মালটাকে পেতে চাই বলে তোমাকে এভাবে বলছি। ওকে প্রথমদিন করবার সুযোগ পেলে আমি তোমাকে এক লাখ দেব ডার্লিং”।

মহিমা একটু আমতা আমতা করে বলল, “কী যে বলি তোমাকে সেটাই ভাবছি বিমল। তবে এটা যদি সত্যিই রতীশের বৌয়ের ছবিই হয়ে থাকে তাহলে তুমি যা বলছ সেটা মিথ্যে হবে না। মার্কেটে এর ডিমাণ্ড বেশ ভালই হবে। কিন্তু আমি তো এখনও রতীশকেই নিজের আসল কাজে লাগাতে পারিনি। ওর মত ভদ্র ছেলেকে লাইনে নামাতে বেশ সময় লাগবে। আর তুমি তো জানই কাউকে আমি জোর করে এ লাইনে আনিনা। তবে রতীশকে যদি লাইনে আনতে পারি তাহলে তার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই আমি ওর বৌকেও জালে ফেলতে পারব। কিন্তু এ’সব করতে তো বেশ সময় লাগবে। চট করেই তো আমি কিছু করতে পারব না। রতীশকে খুব ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে আস্তে আস্তে পটাতে হবে। হয়ত মাস ছয়েকও লেগে যেতে পারে। বা তার বেশীও লাগতে পারে। কিন্তু তুমি কি আর ততদিন এ ছবিটাকে বুকে নিয়ে ঘুরেই শান্ত থাকতে পারবে”?

বিমল আগরওয়ালা বলল, “তুমি যদি আমাকে পাকা কথা দাও যে কাজটা তুমি করবে, তাহলে সে আশাতেই আমি বসে থাকতে পারব। লাগুক না ছ’মাস। তুমি চেষ্টা কর। আর তুমি নিজে তো আমার হাতে আছই। তোমার কাছ থেকে মাঝে মাঝে এসকর্ট নিয়ে আর মাঝে মধ্যে তোমাকে করেই যেভাবে দিন কাটাচ্ছি, সে ভাবেই না হয় আরও ছ’টা মাস কাটিয়ে দেব। কিন্তু ওই মালটা অন্য কারো ভোগে লাগবার আগে আমিই যেন ওকে আমার ভোগে লাগাতে পারি, তুমি শুধু এই কথাটা আমায় দাও ডার্লিং। তাহলেই হবে”।

মহিমা মনে মনে একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল, “বেশ, তাহলে আমি তোমার কথা মত ওকে লাইনে আনার চেষ্টা করব। কিন্তু তোমার কাছে মেয়েটার আর কোনও ছবি আছে বিমল”?

বিমল জবাব দিল, “না ডার্লিং, আর কোন ছবি আমার কাছে নেই। শুধু এটাই আছে। কিন্তু তুমি কি ওর কোনও ছবি তোমার কাছে রাখতে চাইছ”?

মহিমা বলল, “যদি অন্য কাউকে কাজে লাগাতে হয়, তাহলে তো একটা ছবির প্রয়োজন পড়বেই। নইলে কাজে ভুল হয়ে যেতে পারে”।

বিমল বলল, “তাহলে তুমি এ ছবিটাই তোমার কাছে রেখে দাও। আমার কাছে তো আর ছবি নেই”।

মহিমা এবার রচনার ছবিটাকে আবার দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “এ ছবিটা কোত্থেকে পেয়েছ তুমি? তুমি নিজে তুলেছ”?

বিমল বলল, “না ডার্লিং। আমি তো মালটাকে নিজের চোখে দেখিইনি এখন পর্যন্ত। এই ছবিটা দেখেই ফিদা হয়ে গেছি। আগে যে কাজটা করবে বলে বলেছিল, সেই-ই এটা আমাকে দিয়েছিল। একবার ভেবেছিলাম রতীশবাবুর সাথে একদিন তার বাড়িতে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে আসব। কিন্তু সেটা আর হয়ে ওঠেনি। তোমার এখানে কাজে যোগ দেবার পর রতীশবাবুর সাথেও তো আমার দেখা হয় নি। কিন্তু আবার ভাবছি এতে আসল কাজটা বিগড়ে না যায়”।

মহিমা বলল, “ঠিক আছে বিমল। আমি তাহলে এ ছবিটাই রেখে দিচ্ছি আমার কাছে। কিন্তু আগেই বলে রাখছি, কাজটা সমাধা করতে কিন্তু বেশ সময় লাগবে। তুমি কিন্তু আমাকে বেশী প্রেসার দিও না কাজটা তাড়াতাড়ি করবার জন্য”।

বিমল বলল, “ঠিক আছে ডার্লিং। আমি তোমাকে সময় নিয়ে আর কোন কথা বলব না। আমি জানি, তুমি ওকে ঠিক লাইনে আনতে পারবে। কিন্তু আমিই যেন ওর প্রথম ক্লায়েন্ট হই। এ’দিক দিয়ে তুমি আমাকে ঠকিও না প্লীজ”।

মহিমা বলল, “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি বিমল। যতই সময় লাগুক কাজটা করতে, তুমিই হবে ওর প্রথম ক্লায়েন্ট। ওকে”?

বিমল “ওকে ডার্লিং” বলে মহিমাকে জড়িয়ে ধরে তার গালে আর ঠোঁটে দুটো চুমু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। আর মহিমা দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। রচনার নিষ্পাপ সুন্দর মুখটা তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আর সেই সাথে রাজ্যের দুশ্চিন্তা।


******************

আজ দিন সাতেক হল নবনীতা সীমন্তিনীর এখানে এসেছে। এই ক’টা দিনেই তার মনে হচ্ছে সীমন্তিনী যেন তার কত কাছের, কত আপনজন। গত কয়েকটা দিন সীমন্তিনী যতক্ষণ নিজের কোয়ার্টারে ছিল ততক্ষণ প্রায় সব সময়ই তারা দু’জন একসাথে সময় কাটিয়েছে। সীমন্তিনীর মিষ্টি কথাবার্তায় আর অমায়িক ব্যবহারে নবনীতার মনে হচ্ছে সীমন্তিনী যেন ঠিক তার নিজেরই দিদি। সীমন্তিনী কাজে বেরিয়ে গেলে নবনীতা নিজের আর সীমন্তিনীর ঘর দুটো সাফ সুতরো করে ভালো করে সব কিছু গোছগাছ করে রাখে। তারপর লক্ষীদির সাথে হাতে হাত মিলিয়ে কিছু করবার চেষ্টা করে। বিকেলের দিকে লক্ষীদির সাথে বেড়িয়ে আশেপাশে একটু ঘুরে আসে। এ পাহাড়ি ছোট্ট শহরটা সত্যিই খুব সুন্দর। কলকাতার মত হুলুস্থুল হৈ হট্টগোল এখানে নেই। শুধু বাজার এলাকাটাই যা একটু কোলাহলমুখর। দু’চার জনের সাথে কথা বার্তা বলেও তার মনে হয়েছে, এখানকার লোকগুলো বেশ সহজ সরল। শহুরে নোংরামো নেই তাদের ভেতরে। আর প্রাকৃতিক পরিবেশ তো ভীষণ রকমের সুন্দর। কোয়ার্টারের জানলায় দাঁড়িয়ে দুরের সবুজ পাহাড় গুলোর দিকে তাকিয়েই ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়া যায়। ওদিকে চেয়ে থাকলেই মনটা এক অদ্ভুত শান্তিতে ভরে ওঠে যেন। তখন তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটণাগুলো কতগুলো দুঃস্বপ্নের মতই মনে হয় তার।
 

সীমন্তিনীর এখানে আসবার পর থেকে গত কয়েকদিনের ভেতর তিন চার দিন সীমন্তিনীর অফিস থেকে ফিরতে বেশ দেরী হয়েছিল। তবে সীমন্তিনী আগেই ফোন করে সেকথা জানিয়ে দিত। আজ সীমন্তিনী এখনও না ফেরায় নবনীতার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। আজ যে সীমন্তিনীর ঘরে ফিরতে দেরী হবে এ’কথা সে আগে জানায়নি। অবশ্য সীমন্তিনী তাকে আগেই বুঝিয়েছে, পুলিশের চাকরিতে ডিউটি আওয়ার্স বলে কোনও কথা নেই। যখন তখন যে কোনও কাজে তাদেরকে বাড়ি বা অফিস ছেড়ে ডিউটিতে চলে যেতে হয়। দিন তিনেক আগে সীমন্তিনী একবার দেরী করে কোয়ার্টারে আসবার পরেও অন্যান্য দিনের মত নবনীতার সাথে গল্প করতে বসেনি। তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিল। সেদিন চা খেয়েই নবনীতাকে বলেছিল, “নীতা আমার একটা কথা শোনো বোন”।

নবনীতা জিজ্ঞাসু চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলেছিল, “হ্যাঁ দিদি, বলো”।

সীমন্তিনী বলেছিল, “দ্যাখো নীতা, আমাদের পুলিশের যেমন ডিউটি আওয়ার্স বলে কিছু নেই তেমনি আমরা সব সময় সকলের কাছে অনেক সত্যি কথা বলতে পারিনা। আমাদের ডিউটির খাতিরেই আমাদের পরিজন বা বন্ধুবান্ধবদের কাছে আমাদের অনেক কিছুই লুকিয়ে রাখতে হয়। নইলে মাঝে মাঝে আমাদের নিজেদেরই বিপদে পড়তে হয়। আমি নিজের প্রাণের চাইতেও যাদেরকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসি, সেই দাদাভাই আর রচুর কাছেও আমার কর্মসংক্রান্ত ব্যাপারগুলো অনেক সময়েই লুকিয়ে রাখতে হয়। তাই অনেক সময় হয়তো তোমার কাছেও আমাকে অনেক কিছু লুকিয়ে যেতে হবে। কিন্তু শুধু আমার একটা কথায় আমার সাথে চলে আসবার পর তুমি যদি কখনও বুঝতে পারো যে আমি তোমার কাছে কোন কথা লুকিয়ে গেছি, তাহলে তুমি মনে কষ্ট পেতে পারো। কিন্তু আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, তুমি সেভাবে কষ্ট পেও না ভাই। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমাদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কোনও ব্যাপারেই আমি তোমাকে কখনও মিথ্যে কথা বলব না। কিন্তু আমার অফিসিয়াল কিছু কিছু ব্যাপার তোমাকে আমি জানাতে পারব না। তুমি এটাকে কিন্তু তোমার প্রতি আমার অবহেলা বলে বিবেচনা কোর না বোন”।
 

নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে বলেছিল, “দিদি, তোমার কথা আমি বুঝেছি। আমারও ধারণা যে পুলিশের চাকরি যে সে চাকরি নয়। এ কাজে অনেক ঝুঁকি আছে। জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত। আর মেয়েদের পক্ষে তো ঝুঁকি আরও বেশী। তাই তোমাদের অফিসিয়াল ব্যাপারে যে কিছু কিছু গোপনীয়তা রাখতেই হবে সে কি আর আমি বুঝি না”?

সীমন্তিনী নবনীতাকে কাছে টেনে এনে তার কপালে আদর করে একটা চুমু খেয়ে বলেছিল, “লক্ষ্মী বোন আমার। আমি জানি তুমি খুব ভাল মনের একটা মিষ্টি মেয়ে। তাই তো তোমাকে এভাবে আমি নিজের কাছে নিয়ে এসেছি। তা হ্যারে বোন, আজ পরিতোষের সাথে কথা হয়েছে তোমার”?

নবনীতা জবাবে বলেছিল, “হ্যাঁ দিদি। দুপুরের দিকে আমার মোবাইলে ফোন করেছিল একবার। আমার এখানে কেমন লাগছে, জায়গাটা কেমন, তোমাকে আর লক্ষ্মীদিকে কেমন লাগছে, এসবই জিজ্ঞেস করছিল”।
 

সীমন্তিনী একটু মুচকি হেসে ঠাট্টা করে বলেছিল, “তুমি নিশ্চয়ই বলেছ যে আমি তোমার ব্যাপারে কিছু ভাবছি না। তোমাকে দিয়ে শুধু আমার ঘরের কাজকর্ম করিয়ে যাচ্ছি, তাই না”?
 

নবনীতা অভিমানী গলায় বলেছিল, “তোমার সম্বন্ধে আমি তেমন কথা বলতে পারি বলে ভাবো তুমি দিদি? আমি যে এখানে খুব ভাল আছি, খুব স্বস্তিতে আছি একথাই বলেছি”।
 

সীমন্তিনী হেসে বলেছিল, “আরে আমি তো ঠাট্টা করছিলাম রে পাগলী। তবে শোনো নীতা, একটা কাজের কথা বলি তোমাকে এখন। এরপর কিছুটা সময় কিন্তু তুমি আমার রুমে থাকবে না। একটা জরুরী ব্যাপারে আমাকে কয়েকজনের সাথে ফোনে কথা বলতে হবে। তখন আমি চাই না তুমি বা লক্ষ্মীদি কেউ আমার কাছাকাছি থাকো। তবে তার আগে তোমাকে একটা কথা বলি। কথাটা ভাল করে মন দিয়ে শোনো। তারপর আমি ওদিকে ফোনে ব্যস্ত থাকতে থাকতে আমার কথাটা নিয়ে ভালো করে ভাবনা চিন্তা কোর। তারপর আমাকে তোমার মতামত জানিও, কেমন”?
 

নবনীতা কিছু না বলে মাথা কাত করে সম্মতি দিতে সীমন্তিনী বলেছিল, “এখানে বাজারে একটা গারমেন্টস শপ আছে। তাদের নিজস্ব টেইলারিং আর ডিজাইনিং-এর ইউনিট আছে। সেখানে পনের কুড়ি জন মেয়ে মহিলা কাজ করে। তারা এমন কিছু কিছু গারমেন্টস তৈরী করে যা বাজারে আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। শুধু তাদের নিজস্ব ওই গারমেণ্টসের দোকানেই পাওয়া যায়। তাই দোকানটার এ শহরে আলাদা একটা নামডাক আছে। তার মালিক এক বিধবা মহিলা। এখন তাদের দোকান আর ফ্যাক্টরী মিলে প্রায় তেইশ চব্বিশ জন এমপ্লয়ী। সে ভদ্রমহিলার সাথে আমার ভাল পরিচয় আছে। কোনও একটা সময়ে একটা উটকো ঝামেলার হাত থেকে তাকে আমি বাঁচিয়ে ছিলাম। তখন থেকেই তিনি আমাকে খুব স্নেহ করেন। তুমি যদি চাও তাহলে তুমি তার ওখানে কোনও একটা কাজে ঢুকে পড়তে পার। আমি তাকে এখনও কিছু বলিনি। তবে আমি অনুরোধ করলে মনে হয় সে তোমাকে নিশ্চয়ই কাজে রাখবে। কিন্তু আমি চাই তুমি আগে আমার কথাটা ভেবে দেখ। তুমি তাদের ডিজাইনিং টেলরিং ইউনিটে কাজ করতে চাও, না তাদের শোরুমে সেলস গার্ল হতে চাও, সেটা ভেবে দেখ। তোমার যদি মনে হয় তুমি সেটা করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করবে তাহলে আমার ফোনে কথা বলা শেষ হলে আমরা এ বিষয়ে কথা বলব। চাইলে তুমি এ সময়ের মধ্যে পরিতোষের সাথেও কথা বলে নিতে পারো। তবে আমার একটা অনুরোধ মাথায় রেখো ভাই। সেখানে তোমার পূর্বজীবনের কোনও কথা কারো সাথে শেয়ার করবে না। সেখানে তোমার পরিচয় হবে শুধু আমার মাসতুতো বোন হিসেবে। আর তোমার বাবার আর্থিক অবস্থা ভাল নয় বলেই তুমি আমার কাছে এসেছ এমন কথাই সবাইকে বলবে”।
 

প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে সীমন্তিনী তার ঘর থেকে বেড়িয়ে নবনীতার ঘরে এসেছিল। ততক্ষণে নবনীতা পরিতোষের সাথেও ফোনে কথা সেরে নিয়েছিল। পরিতোষ তাকে এক কথায় বলেছিল যে সীমন্তিনীকে সে চোখ বুজে ভরসা করতে পারে। তবে ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর ইউনিটে কাজে ঢুকলেই বোধহয় বেটার হবে। কারন ভেতরের কাজকর্মগুলো শিখে নিতে পারলে ভবিষ্যতে নবনীতা নিজেই হয়তো কোথাও এমন একটা কাজ শুরু করতে পারবে। শো-রুমের সেলস গার্ল হলে তো উন্নতির তেমন সুযোগ থাকবে না।

সীমন্তিনীকে সে পরিতোষের কথাগুলোই বলেছিল। তখন সীমন্তিনী বলেছিল দু’এক দিনের ভেতরেই সে ওই দোকানের মালিকের সাথে কথা বলবে।
 

আজও সীমন্তিনীর ফিরতে দেরী হচ্ছে। সন্ধ্যা ঘণিয়ে এসেছে। নবনীতা সামনের বারান্দায় পায়চারী করতে করতে বার বার সামনের পথের দিকে তাকাচ্ছিল। সীমন্তিনী ঘরে ফিরে এলেই তার মনটা কেমন যেন চনমনে হয়ে ওঠে। তাই রোজ দিনের শেষে এ সময়টাতে সে অধীর হয়ে সীমন্তিনীর জন্য অপেক্ষা করে। বড় ভাল লাগে কারুর জন্যে এভাবে প্রতীক্ষা করতে। গত সাত বছরে তার জীবনের ওপর যত ঝড় ঝাপটা বয়ে গেছে, তাতে করে এক সপ্তাহ আগেও, কলকাতায় থাকতে সে ঘূণাক্ষরেও ভাবেনি যে এক সপ্তাহ পর সে বিশেষ একজনের জন্যে এভাবে প্রতীক্ষায় থাকবে।

(To be cont'd ......)
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
(Update No. 131)

লক্ষ্মী ভেতর থেকে বাইরের বারান্দায় এসে বলল, “ছোড়দি, ভেতরে এস। সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালব এখন। এ সময় ঘরের বাইরে থাকতে নেই”।
 

নবনীতা কোনও কথা না বলে ঘরের ভেতর চলে এল। কয়েক মিনিট বাদে লক্ষ্মী ঠাকুরঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে শাঁখে ফুঁ দেবার সাথে সাথেই কলিংবেল বেজে উঠল। নবনীতা হাত জোড় করে ঠাকুরকে প্রণাম করেই দরজার দিকে ছুটে গেল। সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতেই নবনীতা জিজ্ঞেস করল, “আজ তো ফিরতে দেরী হবে বলে বলনি দিদি? তাহলে এত দেরী হল যে”?
 

সীমন্তিনী নিজের ঘরের দিকে এগোতে এগোতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সরি গো ঠাকুমা আমার। খুব ভুল হয়ে গেছে। আর এমন ভুল হবে না কক্ষনো” বলে নবনীতার হাত ধরে নিজের ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “আসলে অফিস থেকে ঠিক সময়েই বেড়িয়েছি গো। কিন্তু ফেরবার পথে একটু মার্কেটে গিয়েছিলাম একটা কাজ সারতে। তাই একটু দেরী হয়ে গেল”।

নবনীতা হেসে বলল, “আচ্ছা বেশ। তুমি ঘরে গিয়ে চেঞ্জ করে হাত মুখ ধুয়ে নাও। আমি চা বানিয়ে আনছি”।

সীমন্তিনী নবনীতার হাত ছেড়ে দিলেও জিজ্ঞেস করল, “ওমা, তুমি চা বানাতে যাবে কেন? লক্ষ্মীদির কি হয়েছে”?

নবনীতা বলল, “কিচ্ছু হয়নি লক্ষ্মীদির। কিন্তু সে তো সব ঘরে ঘরে সন্ধ্যা প্রদীপ দেখাচ্ছে। তাই এখন চা টা আমিই করে আনছি। আর অমন করছ কেন? সারাটা দিন তো ঘরে শুয়ে বসেই থাকি। তেমন কোন কাজই তো আমাকে করতে হয় না। এখন না হয় তোমার জন্যে এক কাপ চা-ই বানালুম। একবার খেয়েই দেখ না আমার হাতের চা। একেবারে অখাদ্য কিছু হবে না”।

সীমন্তিনী এবার নবনীতার হাত ছেড়ে দিয়ে তার একটা গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। আমিও পোশাক পাল্টে তৈরী হয়ে নিই। তারপর চা খেতে খেতে তোমার সাথে একটা দরকারী কথা বলব। ঠিক আছে”?

মিনিট পনেরো বাদে ঘরের তিনজনে একসাথে চা খেতে খেতে সীমন্তিনী নবনীতাকে জিজ্ঞেস করল “নীতা আজ কি পরিতোষ তোমাকে ফোন করেছিল”?

নবনীতা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদি, লাঞ্চ আওয়ারে ফোন করেছিল একবার। জিজ্ঞেস করছিল, তুমি আমার জন্যে কোনও কাজের খোঁজ করেছ কি না। আমি তাকে বলেছি, এখানে এসে আমি খুব ভাল আছি। জীবনে এত ভাল বোধহয় আমি আগে আর কখনও ছিলুম না। কিন্তু সবে তো মাত্র দিন সাতেকই হল এখানে এসেছি। আর এখানে আসবার পর অফিসে জয়েন করে তুমিও খুব ব্যস্ত আছো। তাই হয়তো আমার কাজের ব্যাপারে কোনও খবরাখবর করতে পার নি। একটু ফুরসৎ না পেলে আর কী করে কি করবে”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “আজ আমার পরিতোষের সাথে কোনও কথা হয়নি। কিন্তু কাল রাতে ঘুমোবার আগে ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়েছে। তোমার জন্যে যে কাজের কথা আমি ভেবেছি। সেটা নিয়েই ওর সাথে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। আমার মুখে সবকিছু শুনে পরিতোষও বলল তোমার জন্যে কাজটা ভালই হবে। তাই আজ অফিস থেকে ফেরার পথেই সেখানে গিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম একবারে তোমাকে সাথেই নিয়ে যাব। কিন্তু সেটা করতে গেলে আজ আর যাওয়া হত না। কারণ আমি ভাবছি আগামীকাল আমি কালচিনি যাব। অর্চনাকে কয়েকটা দিনের জন্য এখানে নিয়ে আসি। তাহলে ওর মনটা আরও খানিকটা ভাল হবে। তাই কাল আর মার্কেটে যেতে পারব না বলে আজই কাজটা সেরে এলুম। আচ্ছা শোনো, তোমার কি টেইলারিং বা ডিজাইনিং-এর কাজ কিছু জানা আছে”?

নবনীতা একটু দ্বিধান্বিত স্বরে জবাব দিল, “না গো দিদি, আমার ওসব কিছুই জানা নেই। পরিতোষের বাবার মৃত্যুর পর ও যখন আবার হায়দ্রাবাদ চলে গেল তখন ভেবেছিলুম ডিজাইনিংএর একটা কোর্স করব। কিন্তু তখনই তো আমার জীবনটা ওলোট পালট হয়ে গিয়েছিল”।
 

সীমন্তিনী নবনীতার কথা শুনে একটু চুপ থেকে কিছু একটা ভেবে বলল, “সেসব পুরনো কথা মনে এনে আর কষ্ট পেওনা নীতা। শোনো, তোমাকে তো সেদিন বলেছিলাম, এখানে মার্কেটে বসাক গারমেন্টস বলে একটা দোকান, মানে বেশ বড়সড় একটা শো-রুম আছে। তার মালকিন আমার পরিচিত এক বিধবা ভদ্রমহিলা। জয়া বসাক। শো-রুমের পাশাপাশি তাদের নিজস্ব ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর একটা বেশ বড়সড় ইউনিট আছে। সেখানে পনের ষোল জন মেয়ে কাজ করে নিত্য নতুন ডিজাইনের পোশাক আশাক তৈরী করে। এ তল্লাটে অমন সুন্দর কালেকশন আর কোথাও নেই। আর তাদের ফ্যাক্টরীর প্রোডাকশন গুলো কেবল মাত্র তাদের নিজস্ব শো-রুমেই বিক্রী হয়। তাই দোকানটায় বিক্রী বাট্টাও বেশ। আশেপাশের এলাকা থেকেও লোকেরা এখানে অন্য ধরণের নতুন নতুন ডিজাইনের পোশাক পাবে বলে আশা করে আসে। কিছুদিন আগে একটা উটকো ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে ওই ভদ্রমহিলাকে আমি কিছুটা সাহায্য করেছিলাম। তখন ওই মহিলা আমাকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অনেক পুলিশ অফিসারের মত আমার তো ঘুষ নেবার অভ্যেস বা প্রয়োজন কোনটাই নেই। তাই তখন তাকে বলেছিলাম, যে আমার যদি কখনও তার সাহায্যের দরকার পড়ে তখন আমি তাকে বলব। আজ আমি সেখানেই গিয়েছিলুম। গিয়ে তোমার কথা বললুম। আর তাকে অনুরোধ করলুম, তোমাকে তাদের ওখানে কোন একটা কাজে নিয়ে নিতে। তখন উনি বললেন, যে তারা তাদের মূল শো-রুমের জন্য একজন ভাল স্বভাবের সেলস গার্লের খোঁজ করছেন। তাছাড়া তাদের ফ্যাক্টরীতেও ডিজাইনিং বা টেলারিং জানা মেয়ে বা মহিলার দরকার। আমার সিফারিসে তিনি তোমাকে কাজে নিতে রাজি আছেন। তাই আমি মনে মনে ভাবছিলুম তোমাকে ওই ফ্যাক্টরীতেই টেলারিং বা ডিজাইনিংএর কাজে লাগিয়ে দেব। কারণ তাতে ভবিষ্যতে একটা ভালো কিছু করতে পারবে। কিন্তু সে কাজ করতে গেলে তো প্রাথমিক ভাবে আগে থেকে কিছুটা জানা দরকার। এখন তুমি যখন বলছ যে এ ব্যাপারে তোমার কোনও অভিজ্ঞতা নেই, তাহলে তো সেখানে কাজ করতে গেলে তোমাকে সেলস গার্লের কাজেই আপাততঃ ঢুকতে হবে। তুমি কি তাতে রাজি আছো”?

নবনীতা নিজের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, “আগের কোনও অভিজ্ঞতা না থাকলেও সেলস গার্লের কাজ মনে হয় করতে পারব দিদি। কিন্তু তুমি যেমন বললে, পরিতোষও সেদিন একই কথা বলেছিল। ডিজাইনিং বা টেলারিং ইউনিটে চান্স পেলেই মনে হয় বেশী ভাল হত। কিন্তু ও সব কাজ তো আগে থেকে জানা না থাকলে করা সম্ভব নয়”।

সীমন্তিনীও নিজের চা শেষ করে দেয়াল ঘড়ির দিকে একবার দেখে বলল, “সেলস গার্লের কাজেও তোমাকে তারা নিয়ে নেবেন বলেছেন। কিন্তু আমি চাই না তুমি সারাজীবন ওই সেলস গার্লের কাজই করে যাও। আমি চাই তুমি এমন কিছু একটা কর, যাতে করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারো। ভবিষ্যতে স্বাধীন ভাবে কিছু একটা করতে পারো। তাই আমি চাই তুমি আপাততঃ সেখানে সেলস গার্লের কাজে যোগ দিলেও রোজ কয়েক ঘন্টা করে তাদের কারখানায় যাবে। অন্যান্য কর্মীদের সাথে ভাব করে তাদের কাজের নমুনা দেখে শুনে সবকিছু শেখার চেষ্টা করবে। এভাবে যদি তুমি ডিজাইনিং বা টেলারিংএর কাজ শিখে নিতে পারো তাহলে একদিন তুমি নিজেই সেসব করতে পারবে। আর আমি মনে মনে সেটাই চাই। আমি ওই ভদ্রমহিলাকে সেভাবে অনুরোধ করলে তিনি আমার অনুরোধ নিশ্চয়ই রাখবেন। তোমাকে তাদের কারখানায় যাবার অনুমতি দেবেন। বাকিটা ডিপেন্ড করবে তোমার নিজের ওপর”।

একটু থেমে আরেকবার দেয়াল ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “তুমি ব্যাপারটা ভালভাবে ভেবে দেখ। চাইলে পরিতোষের সাথেও পরামর্শ কর। তারপর যেটা সিদ্ধান্ত নাও আমাকে বোলো। আমি সেভাবেই বন্দোবস্ত করব। তবে এখন আমি কিছুক্ষণ এঘরে একা থাকতে চাই। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে আমার বলা কথাগুলো ভেবে দেখ, কেমন”?
 

নবনীতা খালি চায়ের কাপগুলো নেবার জন্যে হাত বাড়াতেই লক্ষ্মী নিজেই কাপগুলো তুলে নিতে নিতে বলল, “ও দিদিমণি, তুমি তো বললে কাল কালচিনি যাবে বৌদিমণির বাপের বাড়ি। আমার না বৌদিমণির মা বাবাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে গো। আমায় সঙ্গে নেবে”?

সীমন্তিনী একমূহুর্ত তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তাদের সবাইকেই তুমি দেখতে পাবে লক্ষ্মীদি। ভেব না। কিন্তু কাল তোমাকে নিয়ে যাব কি করে গো? নীতাকে এ বাড়িতে একা ফেলে আমরা দু’জনে মিলে চলে যাব, এটা তো ঠিক হবে না। আর আমি অফিসের কাজে আগে যাব আলিপুরদুয়ার, ফেরার পথে কালচিনি হয়ে ফিরব। তাছাড়া ফিরতে ফিরতে তো আমাদের সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তুমি ঘরে থাকলে তো অর্চুর জন্যে কিছু খাবার টাবার বানিয়ে রাখতে পারবে। নইলে আমার ঘরে এসে অর্চুকে তো খালি মুখে বসে থাকতে হবে কিছুক্ষণ। আর তেমন হলে তোমার বৌদিমণি কিন্তু .......”

সীমন্তিনীকে তার কথা শেষ করতে না দিয়েই লক্ষ্মী বলে উঠল, “হ্যাঁ গো দিদিমণি। তুমি তো ঠিকই বলছ। আমি তো কোনকিছু না ভেবেই যাবার বায়না ধরে বসলুম। আমি যদি আগে ভাগে খাবার তৈরী না করি তাহলে বৌদিমণির দিদিকে তো কিছুটা সময় না খেয়েই বসে থাকতে হবে। না না, সেটা করা একেবারেই ঠিক হবে না। বৌদিমণি তাহলে আমার ওপর রেগে যাবেন। না না দিদিমণি, তুমিই যাও। আর তুমি যখন বলছ যে তাদের আমি দেখতে পাবোই, তাহলে আর অত তাড়াহুড়ো করবার কি আছে”?
 

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “ঠিক আছে লক্ষ্মীদি। তবে আমি তোমাকে বলছি, খুব অল্প দিনের ভেতরেই তুমি তোমার বৌদিমণির মা, বাবা, ভাই সবাইকেই দেখতে পাবে। আমি সে বন্দোবস্তই করবার চেষ্টা করব। এবার খুশী তো”?
 

লক্ষ্মীও সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে একটু হেসে কিচেনের দিকে চলে যেতে সীমন্তিনী নবনীতার একটা হাত ধরে বলল, “নীতা, সোনা বোন আমার। সেদিনও তোমাকে তোমার ঘরে পাঠিয়ে আমি কিছুক্ষণ আমার ঘরে একা ছিলুম। আর আজ এখনও আমি কিছুক্ষণ একা থাকতে চাই বলেছি বলে রাগ বা অভিমান কোর না প্লীজ। তবে ব্যাপারটা তোমাকে একটু পরিস্কার করে বোঝানো দরকার। আসলে নীতা, এ’কথাগুলো তোমাকে সেদিনও বলেছি। তবু আজ আবার বলছি, পুলিশের কাজটা তো সাধারণ অন্য যে কোনও কাজের থেকে আলাদা। এ কাজে অনেক সময়েই আমাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তাই সব রকম সতর্কতা আমাদের অবলম্বন করতে হয়। তাই কাজের খাতিরেই আমাদের নিজেদের লোকের কাছেও নানারকম মিথ্যে কথা বলতে হয়। নানা কথা লুকিয়ে যেতে হয়। আর এ এলাকাটা গত কয়েকবছর ধরে এতই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে আমাদের সামান্য একটু অবহেলাও নিজেদের ওপর চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। তাই সব সময় আমাদের সতর্ক থাকতে হয়। তাই আজ তোমাকে একটা কথা বুঝিয়ে বলছি। আমি যখন এর পরেও কখনো একা থাকতে চাইব তখন বুঝে নিও যে আমি ইম্পর্ট্যান্ট কোনও অফিসিয়াল ব্যাপারে কারুর সাথে কোন ডিসকাশন করছি। আর সেসব ডিসকাশন আমি তোমাকে বা লক্ষ্মীদিকে শোনাতে চাই না। কারন পুলিশের অনেক গোপন কর্মসুচী থাকে যা আমাদের ডিপার্টমেন্টের সব এমপ্লয়ীরাও জানতে পারে না। সেসব পুলিশের টপ লেভেলের কিছু অফিসার আর গোয়েন্দাদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাই সে সব ব্যাপারে আলোচনা ও খবরের আদান প্রদান আমাদের খুবই গোপনীয় ভাবে করতে হয়। আর সে জন্যেই আমি তোমার আর লক্ষীদির বর্তমানে সেসব ব্যাপার নিয়ে ফোনে আলাপ করব না। আর শুধু তোমরাই নও, যে দুটো ব্যক্তি আমার জীবনে সবচাইতে মূল্যবান, যারা আমার সবচাইতে কাছের মানুষ, সব চাইতে প্রিয়জন, সেই দাদাভাই আর রচুর কাছেও আমাকে সেসব কথা গোপন রেখে চলতে হয়। তাই বলছি ভাই, তুমি তো এখানে নতুন এসেছ। আমি তোমাকে আমার কাছ থেকে সরে তোমার ঘরে যেতে বলেছি বলে তোমার মনে দুঃখ হতে পারে। তুমি ভাবতে পারো যে যার মুখের একটি কথায় তুমি সব কিছু ছেড়ে তার সাথে চলে এসেছ, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার তুমি মনে মনে আশা করনি। কিন্তু সেটা একেবারেই ঠিক নয় বোন। তাই তোমাকে আমি সেদিনও এভাবে বুঝিয়েছিলুম। আজও আবার একই কথা বলছি। আশা করি তুমি আমার কথা বুঝতে পারবে। তোমাকে আমি আজ আরও পরিস্কার করে বলছি, আমার দাদাভাই আর রচুসোনা আমার জীবনের সবকিছু। ওদের জন্য আমি সব কিছু করতে পারি। আমার প্রাণটাও বিসর্জন দিয়ে দিতে পারি। আর বর্তমানে আমার দাদাভাই আর রচুর পরেই আমার প্রিয়জনের তালিকায় আমার মাসি মেসো, মানে রচুর মা বাবা, ভাই বোন ছিল। আজ সে তালিকায় তোমার নামটাও ঢুকে গেছে। তোমাকে আমি আমার নিজের ছোটবোনের মতই আগলে আগলে রাখব। শুধু তুমি আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কোরো বোন। অ্যাট লিস্ট যখন আমি একা থাকতে চাইব, তখন যেন আমাকে ভুল বুঝোনা বোন। বুঝেছ তো”? বলে নবনীতার গালে আলতো করে হাত রাখল।

নবনীতাও সীমন্তিনীর আরেকটা হাত নিজের হাতে নিয়ে একটু ম্লান হেসে বলল, “বুঝেছি দিদি। আমি এ ব্যাপারে তোমাকে ভুল বুঝব না। তবে সত্যি কথা বলছি দিদি, সেদিন তুমি ওভাবে বলতে আমার মনে একটু ধাক্কা লেগেছিল সত্যি। কিন্তু এখন তোমার কথাগুলো শুনে আমার মন একেবারে ভাল হয়ে গেছে। পরিতোষও তার পরের দিন আমাকে এসব বুঝিয়েছে”।

সীমন্তিনী নবনীতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “লক্ষ্মী বোন আমার। আমার কথাগুলো যে তুমি বুঝেছ সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তবে শোনো, আমার হাতে আর সময় নেই। এখনই আমাকে জলপাইগুড়ি আর কলকাতা অফিসের সাথে কথা বলতে হবে। তুমি তোমার ঘরে গিয়ে তোমার কাজের ব্যাপারে যে কথাগুলো বললুম সেগুলো নিয়ে ভাল করে ভাবো। ফোনে কথা বলা শেষ হলেই আমি তোমাকে আমার ঘরে ডেকে নেব, কেমন”?

নবনীতা সীমন্তিনীকে ছেড়ে মিষ্টি হেসে বলল, “ঠিক আছে দিদি” বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
 

*******************

প্রায় মিনিট চল্লিশেক পর সীমন্তিনী নবনীতার ঘরে ঢুকে দেখে নবনীতা হাতে মোবাইল নিয়ে খুটখাট করছে। তার পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এবার আমি আমার ছোটবোনটার সাথে গল্প করব। তা তুমি মোবাইল নিয়ে কী করছ নীতা? জরুরী কিছু”?

নবনীতা মোবাইল বিছানায় রেখে বলল, “নাগো দিদি, কিছুই করছিলাম না। গেমস খেলে একটু সময় কাটাচ্ছিলুম। কি করব বল? লক্ষ্মীদিও রান্না ঘরে ঢুকতে দিল না। একা একা কি চুপচাপ বসে থাকা যায়”?

সীমন্তিনী নবনীতার হাতে একটা চুমু খেয়ে বলল, “একা একা চুপচাপ একেবারেই বসে থাকবে না। মোবাইলে গেমস খেলো, প্রয়োজন হলে আমার ঘর থেকে ল্যাপটপটা নিয়ে এসেও সময় কাটাতে পারো। কাগজ ম্যাগাজিন পড়তে পারো। আমার ঘরের আলমারির ভেতর কিছু বই আছে। ইচ্ছে হলে সেসবও পড়তে পারো। তবু একা একা থেকে নিজের জীবনের আগের ঘটণাগুলো নিয়ে একেবারেই ভাববে না। যা কিছু হয়েছে, সেসব ভুলে গিয়ে তোমাকে এখন থেকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হবে”।

নবনীতা একটু দ্বিধান্বিত স্বরে বলল, “ল্যাপটপ তো আমি চালাতেই পারি না দিদি”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তাতে কোন সমস্যা হবে না। আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব। খুবই সহজ ব্যাপার। তবে আরেকটা কথা শোনো বোন। কাল আমাকে অফিসের কাজেই আলিপুরদুয়ার যেতে হচ্ছে। ফেরার পথে কালচিনি হয়ে আসব। অর্চনাকে নিয়ে আসব। ওকে নিয়ে আসাটা খুবই দরকারী। কিছুদিন ওকে যদি আমাদের এখানে রাখতে পারি তাহলে আশা করি ও আরও খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠবে”।

নবনীতা বলল, “দিদি সেদিনও তুমি এ কথাগুলো বলছিলে। কিন্তু অর্চনাদির এমন কী হয়েছে গো”?

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ওর জীবনে খুব বড় একটা বিপর্যয় ঘটে গেছে গো। মেয়েটা যেমন গুণী তেমনি সুন্দরী। গরীব পরিবারের হলেও বাবা-মার সুশিক্ষা পেয়েছে। কিন্তু কপালের লেখা কে খন্ডাতে পারে বল? আচ্ছা তুমি একটু লক্ষ্মীদিকে বলে এস আমাদের জন্যে যেন দু’কাপ চা বানিয়ে আনে। তারপর তোমাকে সব কথা বলছি”।
 

নবনীতা রান্নাঘরে গিয়ে লক্ষ্মীকে চা বানাবার কথা বলে ফিরে আসতেই সীমন্তিনী তার হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে বলল, “অর্চনা হচ্ছে আমাদের রচু সোনার বড় বোন। আমার রচু সোনা কে, বুঝেছ তো”?

নবনীতা হেসে বলল, “বারে বুঝব না কেন? তোমার রচুসোনা তো তোমার সেই বৌদি, রচনা বৌদি, তাই না? আচ্ছা দিদি, তুমি তাকে বৌদি বলে ডাক না কেন গো? তোমার চেয়ে বয়সে ছোট বলে”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “সেকথা বলতে গেলে তোমাকে তো মহাভারতের উপাখ্যান বলতে হবে বোন। সে’সব না হয় অন্য কোন সময় শুনো। আজ তোমাকে অর্চনার কথা বলি” বলে অর্চনার বিয়ে থেকে শুরু করে বর্তমানে তার বাপের বাড়িতে এসে উপস্থিত হবার পুরো ঘটণাটাই সবিস্তারে খুলে বলল। এর মাঝে লক্ষ্মীর বানিয়ে আনা চা খেয়ে শেষ করেছে তারা।

সব ঘটণা শুনে নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কি আশ্চর্যের ব্যাপার। ২০০৫ থেকে ২০১২। এ সাতটা বছর আমার জীবনেও যেমন বিভীষিকাময় ছিল, অর্চনাদির ক্ষেত্রেও তাই। আমি তো তবু বাঁচবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছি নিজের মান সম্মান ইজ্জত সব কিছু বিসর্জন দিয়ে। শেষ অব্দি কিছুটা হলেও হয়ত সফল হয়েছিলাম। কিন্তু অর্চনাদি বেচারী তো কোন সুযোগই পায়নি। তার জীবনটা তো শেষই হয়ে গিয়েছিল। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার দু’জনেরই সেই ঘোর বিভীষিকার সমাপ্তি হল তোমার সাথে দেখা হবার পর। তুমি কি পরশ পাথর দিদি”?

সীমন্তিনী শান্ত স্বরে বলল, “নারে বোন। আমি কোনও পরশ পাথর নই। আমিও একটা অভাগী মেয়ে। আমার নিজস্ব পরিবারের কেউ আমাকে ভাল মেয়ে বলে ভাবে না। আমার মা বাবার কাছে আমি ছোটবেলা থেকেই অলক্ষ্মী। আমি সব আত্মীয় পরিজন ছেড়ে দিয়ে সেই ছোট্টবেলা থেকেই শুধু আমার দাদাভাইকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলুম। আমার মা বাবা কেউ আমার সাথে কথা বলেন না বহু বছর হয়ে গেল। বাড়ি থেকে শুধু বড়মা মানে আমার জেঠিমা, দাদাভাইয়ের মা আর আমার ছোটকাকুই শুধু মাঝে মধ্যে আমার খবরাখবর নিয়ে থাকেন। তবে বাড়ির তরফ থেকে আমি ফাইনেন্সিয়াল সাপোর্টটা আগাগোড়া পেয়েছিলাম বলেই আজ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছি। সেজন্যে তাদের প্রতি আমি চিরকৃতজ্ঞ। দাদাভাইই ছিল আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন। আর সেই দাদাভাইয়ের মাধ্যমেই রচু, রচুর বাবা মা ভাই বোনকে কাছে পেয়েছি। ওরা সকলেই বড় অমায়িক। আমাকেও তাদের আরেকটি মেয়ের মত ভালবাসেন। পরিতোষের মত একটা বন্ধু পাওয়াও আমার জীবনের একটা উপরি পাওনা। ভগবানকে এ জন্য অশেষ ধন্যবাদ। আর আজ সেই পরিতোষের মাধ্যমেই তোমাকেও আমার ছোটবোনের মত কাছে পেয়েছি। তোমাদের সবাইকে নিয়েই আমি বেঁচে থাকতে চাই। তবে যার যেটা কপালে লেখা থাকে সেটা থেকে কেউই রেহাই পায় না। তোমার কপালে, অর্চুর কপালে যে দুর্ভোগ ছিল সেটাই তোমরা ভোগ করেছ। কেউ কারো জন্য কিছু করতে পারে না রে। যদি পারতো তাহলে আমি আরও তিন চার বছর আগে অর্চুকে ওই নরক থেকে উদ্ধার করে আনতে পারতুম। আর পরিতোষ কলকাতা ট্র্যান্সফার হয়ে এসেছে ২০১০এ। তোমার সাথেও পরিতোষের দেখাও আরও অন্ততঃ কয়েক মাস আগে হতে পারত। কিন্তু সেসব হয়নি। কারন তোমাদের কপালে লেখা দুর্ভোগের আরও খানিকটা বাকি ছিল বলে। আমি কেউ না, আমি কিচ্ছু না। শুধুই উপলক্ষ্য মাত্র। মানুষের জীবনে সুখ যেমন চিরস্থায়ী নয় তেমনি দুঃখেরও একটা না একটা সময় সমাপ্তি আসে। নিয়তির নিয়মেই তোমাদের দুঃসময়টা কেটে গেছে। এখন আমি শুধু চাই আমার আশে পাশের মানুষগুলো সবাই ভাল থাকুক। ভগবানের কাছে আর কিছু আমার চাইবার নেই এখন”। বলতে বলতে সীমন্তিনীর গলা ধরে এল।

______________________________
 
Like Reply
(Update No. 132)

নবনীতা সীমন্তিনীর কথা শুনে তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেঁদো না দিদি। তুমি পরশ পাথর কিনা আমি তা জানিনা। কিন্তু তোমার দেখা না পেলে আজ এই মূহুর্তটা আমার জীবনে যে কখনোই আসত না সেটা আমি খুব ভালভাবেই জানি” বলে নিজেও ঝরঝর করে কেঁদে দিল।

লক্ষ্মী খালি চায়ের কাপ নিতে এসে দু’জনকে ওভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে বলল, “ওমা! তোমরা এভাবে কাঁদছ কেন গো দিদিমণি”?

সীমন্তিনী নবনীতার চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “নাগো লক্ষ্মীদি, কিছু হয়নি। তোমার রান্না হয়ে গেছে”?

লক্ষ্মী খাটের নিচে মেঝেয় হাঁটু গেঁড়ে বসে বলল, “বয়স তো একেবারে কম হয়নি আমার দিদিমণি। গরীব মুখ্যুসুখ্যু মানুষ হলেও মানুষের মনের কথা কিছু কিছু বুঝতে তো পারি। জানো ছোড়দি, প্রায় তিন বছর আমি এই দিদিমণির কাছে আছি। কতদিন তাকে একা একা কাঁদতে দেখেছি আমি। তার কষ্ট দেখে আমিও মনে মনে কাঁদতুম। কিন্তু তাকে কোনরকম সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে পেতুম না আমি। আজ প্রথম দেখছি উনি আরেকজনের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে পারছেন। তুমি আমার দিদিমণিটাকে একটু দেখে রেখ গো। মুখ ফুটে নিজের মনের কথা খুলে বলবার মত কেউ তার পাশে নেই” বলে সেও নবনীতার কোলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলল।

পরের কয়েকটা মূহুর্ত শুধু তিনজনের ফোঁপানি ছাড়া ঘরে আর কোনও শব্দ শোনা গেল না। বেশ কিছুক্ষণ পর নবনীতা লক্ষ্মীর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “হ্যাঁ লক্ষ্মীদি। আমি আজ থেকে দিদির মনের সব দুঃখের কথা শুনে তাকে সান্ত্বনা দেব। আর শুধু মুখের সান্ত্বনাটুকু ছাড়া আপাততঃ তো আর কিছু নেই আমার। ভবিষ্যতে ভগবান যদি সামর্থ্য দেন তো দিদির কষ্ট দুর করবার চেষ্টা করব আমি”।
 

সীমন্তিনী এবার নিজেকে সামলে নিয়ে নবনীতা আর লক্ষ্মীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল, “আচ্ছা তোমরা দুটিতে মিলে কি শুরু করলে বল তো? যার কপালে যা আছে তাই তো হবে। আচ্ছা লক্ষ্মীদি, তোমার রান্না কি সাড়া হয়েছে”?

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর চোখের জল মুছতে মুছতে জবাব দিল। “হ্যাঁ দিদিমণি। রান্না হয়ে গেছে”।

সীমন্তিনী আবার কিছু একটা বলতে যেতেই নবনীতার ফোনটা বেজে উঠল। নবনীতা ফোন হাতে নিয়ে দেখল রচনার ফোন। কল রিসিভ করে কানে লাগাতেই রচনা বলল, “হ্যাঁগো নীতাদি, দিদিভাইয়ের খবর কি গো? তখন থেকে একনাগাড়ে ফোন করে যাচ্ছি। একবারও তার সাড়া পাচ্ছি নে। দিদিভাই কি ঘরে ফেরেননি এত রাতেও”?

নবনীতা নিজের গলা পরিস্কার করে বলল, “না বৌদি, তা নয়। তোমার দিদিভাই আমার সাথেই আছেন। এই নাও তার সাথে কথা বলো” বলে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিল।

সীমন্তিনী ফোন কানে লাগিয়েই বলল, “সরি রে রচু সোনা। কিছু মনে করিস না বোন। আমার ফোন দুটোই আমার ঘরে রেখে নীতার ঘরে বসে ওর সাথে কথা বলছিলুম। তাই তোর কল রিসিভ করতে পারিনি রে। রাগ করিস নে বোন”।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকবার পর রচনা ভারী গলায় জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে দিদিভাই? তোমার গলার স্বরটা এত ভারী লাগছে কেন গো? কাঁদছিলে না কি? তুমি ঠিক আছ তো”?

সীমন্তিনী তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক গলায় উত্তর দেবার চেষ্টা করল, “নারে পাগলী, কিচ্ছু হয়নি আমার। নীতার সাথে গল্প করতে করতে অর্চুর কথা এসে পড়তেই গলাটা একটু ধরে গেছে। তুই ও নিয়ে কিচ্ছু ভাবিস না সোনা”।
 

রচনা ও’পাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, “সত্যি বলছ তো”?
 

সীমন্তিনী এবার মুখে হাসি আনবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “হ্যারে সত্যি বলছি আমি। কিচ্ছু হয়নি আমার। তোর নামে দিব্যি করে বলছি, হল তো এবার”?

রচনা বলল, “উহু আমার নামে দিব্যি করলেও আমি মানব না দিদিভাই। যদি সত্যি তোমার আর কিছু হয়ে না থাকে তাহলে তোমার দাদাভাইয়ের নামে দিব্যি করে বলো দেখি”।
 

সীমন্তিনী হেসে জবাব দিল, “বেশ ঠিক আছে। আমি আমার দাদাভাইয়ের নামে শপথ করে বলছি, আর কিচ্ছু হয়নি। এবার হল তো”?
 

রচনা বলল, “হু এবার বিশ্বাস করছি। আচ্ছা দিদিভাই, ভাইয়ের সাথে আমার একটু আগে কথা হল। ভাই বলল তুমি নাকি কাল দিদিকে তোমার ওখানে নিয়ে যাচ্ছ? সত্যি”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে। ভাই তোকে সত্যি কথাই বলেছে। আমি তোকে আজ রাতেই কথাটা জানাতুম। আমি ভাইকে আজ দুপুরেই ফোন করে বলেছি সে কথা। যাতে করে অর্চু ওর জিনিসপত্র গোছগাছ করে রাখে। কাল আমি আলিপুরদুয়ার থেকে ফেরার পথে কালচিনি থেকে ওকে সঙ্গে নিয়ে আসবো। আসলে ডাক্তার সোম বললেন যে অর্চুর আর কোনরকম শারীরিক সমস্যা নেই। এখন আত্মীয় পরিজন প্রিয়জনদের সাথে থাকলেই ধীরে ধীরে তার মনের অবসাদটা কাটিয়ে উঠতে পারবে। আর এখন আমার এখানে নীতাও আছে। তাই আমি অফিসে চলে গেলেও অর্চুকে আর একা থাকতে হবে না। আর মেসো মাসির শরীরও ভাল আছে। সেজন্যেই কটা দিনের জন্য ওকে নিয়ে আসব বলে মেসো মাসির অনুমতিও চেয়ে নিয়েছি। আমি জানি তুইও এতে খুশী হবি। কারন, আত্মীয় পরিজন নাই বা হলাম আমি তো অর্চুর এক প্রিয়জন, তাই না”? বলে থামল।
 

রচনাও এক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “ভাল হচ্ছে না কিন্তু দিদিভাই। আমি না তোমার ছোটবোন। তুমি আমাদের আত্মীয় পরিজন নও, এভাবে কথা বলে আমাকে কষ্ট দিতে পারলে তুমি”?

সীমন্তিনী হো হো করে হেসে উঠে বলল, “ক্ষেপেছিস তো? তোকে একটু ক্ষ্যাপাবার জন্যেই কথাটা বললাম শুধু। নইলে ভুলে যেতে পারিস তো যে কালচিনিতেও আমার মা বাবা ভাই বোন বলে কেউ আছে”।
 

রচনা অনুযোগের সুরে বলল, “ক্ষ্যাপাতেই যদি হয় তবে অন্য কোনভাবে ক্ষেপিও। এসব কথা কিন্তু একেবারেই ভাল লাগে না আমার”।
 

সীমন্তিনী এবার বলল, “রচু সোনা আমার, রাগ করিস নে ভাই। একটু ঠাট্টা করলাম তোর সাথে। আমার বোন হলেও তুই তো আমার বান্ধবীও আবার বৌদিও। বান্ধবী আর বৌদির সাথে এটুকু মজা তো করাই যায়”।
 

রচনাও এবার হাল্কা ভাবে বলল, “কিন্তু তোমার বান্ধবী বা বৌদি হবার আগে কিন্তু আমি তোমার বোন হয়েছিলাম। সে’কথাটা ভুলে যেও না। আর এ বোনটা তোমার অমন ঠাট্টা শুনতে রাজি নয়”।
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা বাবা ঘাট হয়েছে। আর রাগ করিস নে লক্ষ্মীটি। আর শোন না লক্ষ্মীদি কী বায়না ধরেছে জানিস? লক্ষ্মীদি আমার সাথে কালচিনি গিয়ে মাসি মেসো আর ভাই বোনকে দেখার বায়না ধরেছে”।
 

রচনা বলল, “ওমা তাই? তাহলে নিয়েই যাও না। আর শুধু লক্ষ্মীদি কেন তুমি তো নীতাদিকেও সঙ্গে নিতে পার”।

সীমন্তিনী বলল, “এই আরেক পাগলীর পাল্লায় পড়েছি আমি। আরে বাবা, আমাকে একটা অফিসিয়াল কাজে আলিপুরদুয়ার যেতে হচ্ছে বলেই ফেরার পথে অর্চুকে সাথে নিয়ে আসব বলে ভেবেছি। সঙ্গে আমার অফিসিয়াল সিকিউরিটিও থাকবে। নীতা, লক্ষ্মীদিকে সাথে নিয়ে গেলে সারাটা দিন ওরা আলিপুরদুয়ারে কি করে সময় কাটাবে? সেটা সম্ভব নয় বলেই আমি লক্ষ্মীদিকে বোঝালাম যে লক্ষ্মীদিও যদি আমার সাথে যায় তাহলে অর্চুকে আমার ঘরে আনবার পর তো ওকে কিছু খেতে দিতে পারব না। লক্ষ্মীদি স্নান সেরে রান্নাঘরে ঢুকে কিছু একটা বানাবে। ততক্ষণে তো অনেক দেরী হয়ে যাবে”।

এতক্ষণ ফোনের স্পীকার অন করেই সীমন্তিনী কথা বলছিল। তাই লক্ষ্মী আর নবনীতা দু’জনেই দু’তরফের কথাবার্তা শুনতে পারছিল। এবার সীমন্তিনীর কথা শেষ হতেই লক্ষ্মী একটু গলা তুলে বলল, “ও বৌদিমণি, দিদিমণি বলেছে যে আর কিছু দিনের মধ্যেই তোমার মা বাবা আর ভাইকে একদিন আমাদের এখানে নিয়ে আসবেন। তাই তো আমি কাল যাবার বায়না ছেড়ে দিলুম”।
 

রচনা এবার খানিকটা বিস্মিত গলায় বলল, “তাই নাকি দিদিভাই? সত্যি মা বাবা আর ভাই তোমার ওখানে যাবে? কই ভাই তো এ ব্যাপারে আমাকে কিছু বলেনি”?
 

সীমন্তিনী বলল, “এখনও পাকাপাকি ভাবে কবে আনব সেটা ভাবিনি। তবে যখনই আনি তোকে সেটা আগেই জানাবো। এবার তোদের কথা বল তো? তোরা ভালো আছিস তো? রাতের খাবার খেয়েছিস”?

রচনা বলল, “এখানে সব ঠিক আছে দিদিভাই। রাতের রান্না হয়ে গেছে। তোমার সাথে কথা হচ্ছিল না বলেই একটু চিন্তায় ছিলাম। এবারে খেতে বসব। আচ্ছা দিদিভাই, এবার রাখি। তোমাদের সাথে আবার কাল কথা হবে। গুডনাইট”।

সীমন্তিনী “গুডনাইট সোনা’ বলে ফোন নামিয়ে রাখল। মোবাইলেই সময় দেখে নবনীতাকে বলল, “এখনই খাবে না আরেকটু গল্প করবে নীতা”?
 

নবনীতা জবাব দিল, “একটু আগেই চা খেলাম। একটু পরেই না হয় খাই। আচ্ছা দিদি, বৌদি তোমাকে খুব ভালবাসে তাই না”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁগো নীতা। রচু আমাকে খুব ভালবাসে। আসলে ও মেয়েটাই এমন ওর আশেপাশের সকলকে ভালবাসায় ভরিয়ে দিতে ওর সমকক্ষ কাউকে দেখিনি আমি। আমাকে তো ও বিয়ের অনেক আগে থেকেই পেয়েছে। তখন থেকেই আমি ওর দিদি হয়েছিলুম। কিন্তু বিয়ের পর ও আমাদের বাড়ির বড় ছোট প্রত্যেকটা লোককে এমনভাবে কাছে টেনে নিয়েছিল যে দশ দিন যেতে না যেতেই বাড়ির সকলেই এক মুহূর্ত ওকে চোখের আড়াল করতে চাইত না। আর ও নিজেও কী অদ্ভুতভাবে যে সকলের প্রয়োজন মিটিয়ে যেত সেটা আমি নিজের কানে শুনেও বিশ্বাস করতে পারতুম না। কিন্তু কয়েক মাস আগে দাদাভাইয়ের সাথে কলকাতায় চলে যেতে হয়েছে বলে ওর মনটাও খুব একটা ভাল নেই। সারা দিনে তিনবার অন্ততঃ আমার সাথে কথা বলা চাইই ওর। লক্ষ্মীদিকে হাজার রকমের নির্দেশ দেয়। তাছাড়া বাড়ির সকলের সাথেও ভাল যোগাযোগ রাখে। নিজের বাপের বাড়ির সাথেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। আসলে ও মেয়েটাই এমন যে ওর সাথে পরিচিত হলে কেউ ওকে না ভালবেসে থাকতে পারবে না”।

নবনীতা সায় দিয়ে বলল, “আমি তো তার সাথে কয়েকটা ঘন্টাই কাটিয়েছি শুধু। আমারও তাকে খুব মিষ্টি আর ভাল মনের মানুষ বলে মনে হয়েছে। আমার থেকেও নিশ্চয়ই বয়সে ছোট হবে। তা সত্বেও কেন জানিনা ওকে শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছে করে”।

সীমন্তিনী বলল, “রচু সত্যিই তেমনি একটা মেয়ে। বয়সে ও বোধহয় তোমার চেয়ে প্রায় বছর চারেক ছোট হবে। তাই তুমিও তাকে অনায়াসে তুই বা তুমি করে বলতে পারো। শুনেছি ওর দিদি অর্চনাও নাকি একই রকম স্বভাবের। ছোটবেলায় নাকি অর্চনা রচুর চাইতেও সুন্দরী ছিল। রচুদের বাড়িতে ওদের দু’বোনের একটা পুরনো ছবি আমি দেখেছিলাম। অবশ্য বিয়ের পর গত কয়েকটা বছরে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারে ওর সমস্ত লালিমা সমস্ত সৌন্দর্যই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি যখন ওকে প্রথম কালচিনি হাসপাতালের বেডে দেখেছিলাম সেদিন আমি তো দুরের কথা, প্রথম দেখায় ওর ছোটভাইও ওকে চিনতে পারছিল না। অবশ্য এখন হয়ত ওর স্বাস্থ্যের কিছুটা উন্নতি নিশ্চয়ই হয়েছে। ওর ডাক্তার তো বলল যে ও এখন শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ। মানসিক অবসাদটা কাটতে নিশ্চয়ই আরও কিছু সময় লাগবে। তাই তো ওকে কিছুদিন আমার এখানে এনে রাখতে চাই। এখানে এলে আমরা তিনজন মিলে ওকে সব সময় হাসিখুশীতে ভরিয়ে রাখব বুঝেছ লক্ষ্মীদি”।

লক্ষ্মী বলল, “সেকথা আর তোমায় বলতে হবে দিদিমণি, আমার বৌদিমণির দিদিকে আমি সব রকম ভাবে যত্নে রাখব, দেখে নিও”।

সীমন্তিনী নবনীতার হাত ধরে বলল, “নীতা, আমাকে তো সারাটা দিন অফিসের কাজেই বাইরে থাকতে হয়। তাই এতদিন চাইলেও অর্চুকে এখানে আনতে পারিনি। তোমার কাছে আমার একটা অনুরোধ, তুমি তো দিনের পুরোটা সময় ওর সাথে থাকবে। তাই ওর মন ভাল করে তুলতে তুমিই সবচেয়ে বেশী সুযোগ পাবে। বয়সে ও তোমার চেয়ে মাত্র বছর দুয়েকের ছোট হবে। তাই খুব সহজেই তোমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে। আমি কিন্তু মনে মনে সেটাই চাই। তুমি আমাকে নিরাশ কোরনা প্লীজ। আর তোমার যে কাজের কথা ভাবছি সেখানে তুমি সামনের মাসের এক তারিখ থেকে কাজে যোগ দিতে পারবে। তাই মাঝের ক’টা দিন তোমরা দু’জন যেন দুই বান্ধবীর মত হেসে খেলে ওকে আগের চেয়ে অনেক উৎফুল্ল আর প্রাণবন্ত করে তুলতে পারো”।

নবনীতাও সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে বলল, “অবশ্যই করব দিদি। তোমার প্রিয়জন কাউকে আমি কি আর অবহেলা করতে পারি, বল? আমি সব রকম ভাবে তোমার পরামর্শ মেনে চলতে চেষ্টা করব”।


**************
 
Like Reply
(Update No. 133)

বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ সীমন্তিনীর পুলিশের কনভয় বিধুবাবুর বাড়ির সামনে এসে থামতেই বাড়ির ভেতর থেকে বিভাদেবী প্রায় ছুটে বেড়িয়ে এলেন। কিংশুক আর বিধুবাবু তখন দোকানেই ছিল, পুলিশের গাড়ি থামতেই তারাও দোকান থেকে বেড়িয়ে এল। আশে পাশের দু’চারটে বাড়ি থেকেও অনেকে বেড়িয়ে এসেছিল।

বিভাদেবী সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “এসেছিস মা? আয় আয়। সেই কখন থেকে তোর পথ চেয়ে বসে আছি। এত দেরী করলি আসতে”?
 

ততক্ষণে বিধুবাবুও কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। সীমন্তিনীর এসকর্টেরা তাকে বাঁধা দিতে গেলে সীমন্তিনী হাতের ঈশারায় তাদের বারন করে আগে বিধুবাবু ও পরে বিভাদেবীকে প্রণাম করতে করতে বলল, “দেরী কোথায় মাসি? সবে তো তিনটে বেজেছে। আর আলিপুরদুয়ারের কাজটা তো তাড়াতাড়িই সেরে চলে এলুম”।
 

সোজা হয়ে দাঁড়াতেই কিংশুক সীমন্তিনীর পায়ের দিকে ঝুঁকতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ভাই কেমন আছো? পড়াশুনো ঠিক চলছে তো? ফাইনাল এক্সামের প্রিপারেশন ঠিক আছে তো”? বলে কিংশুকের কপালে স্নেহের চুম্বন একে দিল।

কিংশুক জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। সব দিক দিয়েই আমি পুরো তৈরী আছি”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “এই না হলে আমার ভাই”? বলে কিংশুকের মাথার চুলগুলো একটু নেড়ে দিয়ে বলল, “চল মাসি ভেতরে চল। তা অর্চু কোথায়? ও সবকিছু গোছগাছ করে নিয়েছে তো”?

বলতে বলতে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকেই গেটের পাশে আড়ালে অর্চনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সীমন্তিনী থমকে দাঁড়িয়ে গেল। সত্যি অর্চনার শরীর স্বাস্থ্যের অনেক উন্নতি হয়েছে। অপরূপা লাগছে তাকে দেখতে। চেহারার অনেক উন্নতি হলেও ওর মুখশ্রীতে মলিনতার আভাসও বড় সুস্পষ্ট। এক মূহুর্ত থমকে থেকেই প্রায় ছুটে গিয়ে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই তো আমার অর্চু সোনা। ইশ কী ভালো লাগছে গো তোমাকে দেখতে। ডাক্তার সোম অবশ্য কালই আমাকে বলেছেন। তবু আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না”।

অর্চনাও দু’হাতে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে “দিদিভাই” বলে কেঁদে ফেলল। বেশ কয়েক মূহুর্ত সেভাবেই কেটে যাবার পর প্রথম কথা বললেন বিধুবাবু। তিনি অর্চনার কাঁধে হাত রেখে বললেন, “দিদিভাইকে নিয়ে আগে ঘরে গিয়ে বোস অর্চু। মেয়েটার নাজানি কত কষ্ট হয়েছে আজ। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে দেখ”।

অর্চনা সীমন্তিনীর শরীর থেকে হাতের বাঁধন আলগা করলেও তার একটা হাত ধরে রেখেই আরেকহাতে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে কান্না ভরা গলায় বলল, “এতদিন বাদে বুঝি এই বোনটার কথা মনে পড়ল তোমার”।

সীমন্তিনী অর্চনার হাত ধরে ঘরের বারান্দার দিকে যেতে যেতে বলল, “কে বলেছে এতদিন বাদে আজই আমার তোমার কথা মনে পড়ল? তোমাকে যেদিন থেকে দেখেছি, সেদিন থেকে একটা দিনও আমার এমন যায়নি যেদিন তোমার কথা আমার মনে না এসেছে। ডাক্তার সোমের সাথে তো আমি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতুম। রচুর সাথে রোজ কথা বলার সময় তোমার কথাও হয়। মাসি মেসো আর ভাইয়ের সাথে যখন কথা বলি তখন তো তোমার সাথেও কথা বলি আমি। তবু তোমার মনে হচ্ছে এতদিন আমি তোমাকে ভুলে ছিলুম”?
 

বারান্দায় উঠে কিংশুকের পেতে দেওয়া চেয়ারে সীমন্তিনীকে আদর করে বসিয়ে দিয়ে অর্চনা বলল, “তুমি যে আমার সব খবরাখবর রেখেছ তা কি আর আমি জানিনা দিদিভাই। কিন্তু সেই যে রচুর সাথে তোমাকে হাসপাতালে দেখেছিলুম তারপর থেকে তো আর কখনো আমার সাথে দেখা করনি। আজ পাক্কা এক মাস এগার দিন বাদে তোমার দেখা পেলুম। মনে হচ্ছে যেন কতদিন বাদে তোমাকে দেখছি”।

বিধুবাবু বিভাদেবীকে বললেন, “শুনছো, তুমি মন্তিমাকে একটু চা জল খাবার দাও। ও তো খুব বেশীক্ষণ বসবে না জানি” বলে কিংশুককে বললেন, “খোকা, আমরা দু’জনেই তো দোকান খুলে রেখেই চলে এসেছি রে। তুই একটু দোকানে গিয়ে বোস, আমি একটু মন্তিমার সাথে দুটো কথা বলে নিই চট করে। আমি গিয়েই তোকে আবার পাঠিয়ে দেব। তখন তুই দিদিভাইয়ের সাথে কথা বলিস”।

বিধুবাবুর কথায় কিংশুক উঠোন পেরিয়ে গেট দিয়ে বাইরে চলে গেল। বিভাদেবীও রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন। সীমন্তিনী তখন অর্চনাকে বলল, “অর্চু সোনা, তুমি তোমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে নিয়েছ তো”?

অর্চনা জবাব দিল, “হ্যাঁ দিদিভাই, একটা ব্যাগে আমার কাপড় চোপড় ভরে নিয়েছি। শুধু পড়নের পোশাকটাই চেঞ্জ করতে হবে”।

সীমন্তিনী তখন বলল, “বেশ তবে তুমি চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নাও। আমি মেসোর সাথে একটু কথা বলে নিই কেমন? আর হ্যাঁ, মনে করে তোমার ওষুধ আর ডাক্তারের প্রেস্ক্রিপশন সঙ্গে নিতে কিন্তু ভুলো না”।

“আচ্ছা দিদিভাই” বলে অর্চনা ঘরের ভেতর ঢুকে যেতেই সীমন্তিনী বিধুবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “মেসো তুমি বল কী বলবে? তার আগে বল তোমার শরীর ঠিক আছে তো? আর দোকান কেমন চলছে? কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো”?
 

বিধুবাবু সীমন্তিনীর কাছাকাছি একটা মোড়া পেতে বসে বললেন, “শরীর এখন ভালই আছে মা। বেশ ভালই আছি। আগের থেকে অনেক জোর পাচ্ছি শরীরে। আর প্রথম প্রথম একটু অসুবিধে হলেও এখন দোকান চালাতে আর অত কষ্ট হচ্ছে না। বিক্রী বাট্টাও ভগবানের আশীর্বাদে বেশ ভালই হচ্ছে। তবে বাজারের চাইতে দাম এক দু’টাকা বেশী নিতে হচ্ছে বলে অনেক গ্রাহকই অনুযোগ করছে। তাই আমি ভাবছি এখন থেকে আলিপুরদুয়ারের মহাজনদের কাছ থেকে মালপত্র আনব। তাতে পর্তা আরও ভাল পড়বে। যার ফলে বাজারে যে রেটে মাল বিক্রী হয় আমিও সেই একই দামে বিক্রী করতে পারব। তাতে পুরোনো গ্রাহকরা যেমন খুশী হবে, তেমনি আরও নতুন নতুন গ্রাহক পাব। তাতে লাভও বাড়বে। তুমি কি বলো মা”?
 

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “কথাটা তো ঠিকই বলেছ মেসো। কিন্তু এখন লোকাল মহাজনদের কাছ থেকে যেমন সপ্তাহে সপ্তাহে মাল আনছ, তাতে সময়ও কম লাগছে আর পরিশ্রমও কম হচ্ছে। আলিপুরদুয়ার থেকে সপ্তাহে সপ্তাহে মাল আনতে হলে তো তোমার খরচাও বেশী পড়বে আর যাতায়াতের ধকলও তোমাকে সইতে হবে”।

বিধুবাবু একটু ভেবে বললেন, “সপ্তাহে সপ্তাহে না এনে আমি পনের দিন পর পর যদি দু’সপ্তাহের যোগান একসাথে নিয়ে আসতে পারি তাহলে বাড়তি খরচার ব্যাপারটা পুষিয়ে যাবে। আর যাতায়াতের খরচাও মানিয়ে নেওয়া যাবে। তবে শারিরীক পরিশ্রমটুকু তো করতেই হবে। ওটুকু না করলে তো চলবে না। তবে শরীরে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশী জোর পাচ্ছি বলেই সাহস করছি”।
 

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “তুমি যদি ভাবো যে তুমি সামলে নিতে পারবে সবকিছু তাহলে করতে পারো। কিন্তু আরেকটা কথাও ভেবে দেখো মেসো। ভাই এখনও এখানেই আছে বলে ও সকাল বিকেলে কিছুটা সময় দোকানে বসতে পারছে। কিছুটা হলেও তার কাছ থেকে একটা সাহায্য পাচ্ছ। কিন্তু মাস তিনেক বাদেই তো ভাই বারো ক্লাসের ফাইনাল দেবে। তারপর ওকে তো বাইরে চলে যেতে হবে। তখন তো তুমি একা হয়ে যাবে। তখন একা সব কিছু সামাল দিতে পারবে তো”?

বিধুবাবু বললেন, “মাগো, তুমি যখন আমায় যজমানি ছেড়ে দোকান করবার পরামর্শ দিয়েছিলে তখন আমার মনে খুব সংশয় ছিল। বাপ ঠাকুর্দারা কেউ তো ওসব করেন নি। ভয় হচ্ছিল, সামাল দিতে পারব কি না। কিন্তু এই মাস খানেকের ভেতর যা অভিজ্ঞতা অর্জন করলুম তাতে মনের জোর অনেকটাই বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব সামলে নিতে পারব। আর তুমি যখন খোকার পড়াশোনার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছ তখন বারো ক্লাস পেরোলে যে ওকে বাইরে যেতেই হবে, এ কথা তো ঠিকই। কিন্তু তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে হবে। ভগবান সহায় হলে হয়ত একটা কর্মচারীও রাখতে পারি। সেটা করতে পারলে আর সমস্যা হবে না হয়ত। কিন্তু তুমি অনুমতি না দিলে আমি কিছুই করব না মা”।

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “ঠিক আছে মেসো, তোমার মনে জোর যখন আছে, তাহলে করতে পারো। তবে এর পরেও যদি কোনও সমস্যার সম্মুখীন হও, আমাকে জানাবে কিন্তু। আচ্ছা মেসো তোমাকে যে বলেছিলাম ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলতে, সেটা করেছ”?
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যাঁ মা, তুমি যেমন বলেছিলে, আমার আর খোকার নামে একটা জয়েন্ট একাউন্ট খুলেছি সমবায় ব্যাঙ্কে। আর তোমার কথা মতই দু’দিন পর পর দোকানে যা আমদানী হচ্ছে তা ওই একাউন্টে জমা করে দিচ্ছি। এ ভাঙা ঘরে বেশী নগদ টাকা রাখিনা একদম। যখন মাল খরিদ করব তখন ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে নেব”।

সীমন্তিনী বলল, “মেসো যেভাবে ভাল হয় বুঝে শুনে কোর। কিন্তু রান্নাঘরটার যা অবস্থা দেখছি তাতে করে এবারের বর্ষা কোনরকমে কেটে গেলেও সামনের বছর বর্ষা আসবার আগেই কিন্তু মেরামত করতে হবে। আর আমি ভাবছি এবার আর বাঁশের খুঁটি দড়মার বেড়া না দিয়ে পাকাপোক্ত ভাবে বানিয়ে দেব। তুমি সময় সুযোগ মত একজন ভাল রাজমিস্ত্রীর কাছ থেকে আনুমানিক একটা হিসেব বানিয়ে নিও তো। সেটা নিয়ে পরে আমি সময় মত আলোচনা করব”।

বিধুবাবু মাথা নিচু করে একটু সময় চুপ করে থেকে বললেন, “কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ মা। রান্নাঘরটা সামনের বর্ষার ধকল হয়ত সইতে পারবে না। কিন্তু তুমি আর কত করবে মা আমাদের জন্য। সংসারের খরচের জন্যে টাকা দিচ্ছ, খোকার কলেজের ............”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, “মেসো এই এক কথাগুলো আর কতবার বলবে গো তোমরা। যদি সত্যি আমাকে তোমাদের একটা মেয়ে বলে ভাবো তবে এই কথাগুলো কেন বারবার টেনে আনছো তোমরা বল তো? মেয়ের যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে মা বাবা ভাই বোনদের জন্য সে কি কিছু করতে পারে না”? একটু থেমে বিধুবাবু কিছু একটা বলবার আগেই আবার বলল, “আর কোনও কথা নয়। যদি আমি তোমাদের আরেকটা মেয়েই হয়ে থাকি, তবে এমন কথা আর কোনদিন যেন আমাকে শুনতে না হয়। যা বললাম সে কথাগুলো মনে রেখো। আর সেভাবে কাজ কোর। আর এর পরেও যদি তোমরা কেউ এ ধরণের কথা আবার বলো, তবে সেদিন থেকেই আমি কিন্তু আর তোমাদের সাথে কোন রকম যোগাযোগ রাখব না, এই পরিস্কার বলে দিলুম”।
 

বিধুবাবু হাঁ হাঁ করে উঠে বললেন, “এই দ্যাখ মা। তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? আচ্ছা ঠিক আছে। আর কখনো এমন কথা বলব না। কিন্তু মা, মুখের কথা না হয় মুখ বুজে বন্ধ করে ফেলা যায়, কিন্তু মনের তো টুটি চেপে ধরা যায় না। তার মুখ কে কবে বন্ধ করতে পেরেছে বলো? যেদিন বিবেক বলে কিছু থাকবে না সেদিনই হয়ত মনেও এসব কথা আর আসবে না”।

বিধুবাবুর কথাটা শুনে সীমন্তিনী হঠাৎ করেই চুপ হয়ে গেল। সত্যিই তো, মুখে কুলুপ এঁটে মুখের সবকথা তো বন্ধ করে দেওয়া যায় ঠিকই। কিন্তু মন যে কথা বলে তাকে আটকাবার কি উপায় আছে? সেই ছোট্ট বেলা থেকে তার নিজের মন যা বলে আসছিল, সে কথাগুলো তো মুখ ফুটে সে বেরোতে দেয়নি। কিন্তু মন কি তাই বলে সেসব কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে? সে যে তার হৃদয়ে লেখা নাম। সে নাম কি কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারে?
 

সীমন্তিনীর মুখের গাম্ভীর্য্য দেখে বিধুবাবু সীমন্তিনীর একটা হাত নিজের দু’হাতের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি আমার কথায় কষ্ট পেলে মা? আমার বড্ড ভুল হয়ে গেছে মাগো। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আর কক্ষনো এমনভাবে তোমাকে দুঃখ দেব না”।

সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতদুটো ধরে ধরা গলায় বলল, “মেসো, তুমি শান্ত হও। আমি তোমার কথায় কিছুই মনে করিনি গো। তুমি তো ঠিকই বলেছ। হৃদয়ের কথা যে হৃদয়ে চিরতরেই থেকে যায়। নিজেরই দোষে সেই কোন ছোটবেলা থেকে নিজের জন্মদাতা মা বাবার সাথে আমার বার্তালাপ বন্ধ হয়ে গেছে। বাবার স্নেহ ভালবাসা মায়ের মমতাও সেদিন থেকেই হারিয়ে বসেছি। রচুর মাধ্যমে তোমাদের পেয়ে মনে হয়েছিল নতুন করে আমি আবার মায়ের মমতা আর বাবার ভালবাসার স্বাদ পাচ্ছি। তাই তোমাদের কাছে বার বার ছুটে আসি। আমার শুধু তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ, সারা জীবন তোমাদের স্নেহ ভালবাসা থেকে আমাকে বঞ্চিত কোর নাগো। আমি আর কিচ্ছুটি চাই না জীবনে” বলতে বলতে তার চোখ ঝাপসা হয়ে এল।
 

ততক্ষণে বিভাদেবী প্লেটে করে বেশ কিছু খাবার দাবার নিয়ে এসেছেন। সীমন্তিনীকে ওভাবে কাঁদতে দেখেই বিধুবাবুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি কি গো? দিলে তো মেয়েটাকে কাঁদিয়ে। ওঠো দেখি এবার। তুমি দোকানে গিয়ে খোকাকে পাঠিয়ে দাও বাড়িতে। ও এসে আমায় একটু সাহায্য করুক”।

বিধুবাবু তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ যাচ্ছি” বলেই সীমন্তিনীর মাথায় হাত রেখে বললেন, “এই খাবারটুকু খেয়ে নাও মা। আর তুমি যা বললে আমি সেভাবেই সব কিছু করব। তবে মা, যাবার আগে একটা কথা বলে যাই। যেদিন পুজো করে দোকান উদ্বোধন করলুম সেদিন খুব আশা ছিল তুমি এসে লক্ষ্মী গনেশের প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করবে। তুমি তো ব্যস্ত ছিলে বলে আসতে পারনি সেদিন। আর তারপর আজই তুমি প্রথম এলে। তাই বলছি মা, চলে যাবার আগে একবারটি দোকানের ভেতরে ঢুকে যেও। কাল থেকে আমি তাহলে ভাবতে পারব যে আমার অন্নপূর্ণা মা আমার দোকানে এই জায়গায় দাঁড়িয়েছিল। এই জায়গায় বসেছিল। আমার এ কথাটা রাখবে মা”?
 

সীমন্তিনী মুখে হাসি এনে বলল, “আচ্ছা মেসো যাবো’খন। কিন্তু সকাল থেকেই এ ইউনিফর্ম পড়ে আছি। এত জায়গায় ঘোরাফেরা করেছি। এ অবস্থায় তোমার ঠাকুরের আসন ধরাটা তো উচিৎ হবে না”।

বিধুবাবু আবার বললেন, “ঠিক আছে মা, ঠাকুরের আসন না হয় নাই বা ছুঁলে। কিন্তু তুমি তো আমার মা দুর্গা গো। তুমি ভেতরে ঢুকলে আমার দোকানের কিচ্ছু অশুচি হবে না। এসো কিন্তু মা। আচ্ছা, আমি গিয়ে খোকাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি” বলে চলে গেলেন।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর সামনে খাবার থালা রেখে জলের গ্লাসটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “একটু মুখটা ধুয়ে নে তো মা”।

সীমন্তিনী বলল, “আমি কলপারে গিয়ে ধুয়ে আসছি মাসি। সত্যি মুখটা ঘামে চটচট করছে গো”।

বিভাদেবী বলল, “কলপারে যেতে হবে না। এই গ্লাসের জলটা দিয়েই বারান্দার ওপাশে গিয়ে ধুয়ে নে মা। খাবার জল আমি পরে এনে দিচ্ছি। আয় এদিকে আয় তো”।

সীমন্তিনী আর কথা না বাড়িয়ে বারান্দার কোনার দিকে গিয়ে দাঁড়াতেই বিভাদেবী বললেন, “সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়া। আমি তোর মুখ ধুইয়ে দিচ্ছি”।

সীমন্তিনী এক মূহুর্ত বিভাদেবীর মুখের দিকে তাকিয়ে কোন কথা না বলে সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। বিভাদেবী হাতের আঁজলায় গ্লাস থেকে জল নিয়ে সীমন্তিনীর চোখে মুখে ছিটিয়ে দিলেন। যেন এক মা তার শিশুকন্যার মুখ ধুইয়ে দিচ্ছেন। দু’বার জল ছিটিয়ে দেবার পর তার হাত দিয়েই সীমন্তিনীর কপাল গাল চিবুক একটু ঘষে দিয়ে আবার দু’বার জলের ঝাপটা দিয়ে বললেন, “গ্লাস থেকে একটু জল মুখে নিয়ে কুলকুচি করে ফেলে দে তো মা”।

সীমন্তিনীর বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তার নিজের মা কোনদিন এভাবে তার মুখ ধুইয়ে দিয়েছেন কিনা তা তার মনে পড়েনা। হ্যাঁ, তার বড়মার কাছ থেকে সে অনেক স্নেহ মমতা পেয়েছে। কিন্তু গত তিন সাড়ে বছরের ভেতর সে তার বড়মাকেও চোখে দেখেনি। ভেতর থেকে একটা কান্না যেন উথলে উঠতে চাইছিল। অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে সে গ্লাস থেকে জল মুখে নিয়ে দু’বার কুলকুচি করতেই বিভাদেবী নিজের কোমড়ে জড়ানো শাড়ির আঁচলটা খুলে নিয়ে সীমন্তিনীর মুখ মুছিয়ে দিলেন। তারপর সীমন্তিনীর হাত ধরেই তাকে আবার চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে খাবারের প্লেটটা হাতে দিয়ে বললেন, “ইশ মুখটা সত্যি কেমন শুকনো শুকনো লাগছে রে। নে তো মা এ খাবারটুকু খেয়ে নে। সবটা খাবি কিন্তু। আমি তোর জন্যে খাবার জল নিয়ে আসছি”।

এমন সময় সীমন্তিনীর পেছন থেকে অর্চনার গলা শোনা গেল, “মা রচুর কথা ভুলে গেলে? কাল সে তোমায় কী বলেছিল”? অর্চনা যে কখন পোশাক বদলে সীমন্তিনীর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে তা সীমন্তিনী বুঝতেই পারেনি।

বিভাদেবী দাঁতে জিভ কেটে বললেন, “ইশ, সত্যিই তো রে। আমি তো একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। ভাগ্যিস তুই মনে করিয়ে দিলি। আচ্ছা অর্চু, তুই তাহলে এ গ্লাসটা নিয়ে যা। ধুয়ে কলসী থেকে ঠাণ্ডা জল গড়িয়ে নিয়ে আয় তোর দিদিভাইয়ের জন্য”।
 

সীমন্তিনী ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “কি ব্যাপার গো মাসি? কী বলেছে রচু”?

বিভাদেবী খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে সীমন্তিনীর চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন, “আজ তুই বাড়ি আসবি জানতে পেরেই তোর রচুসোনা আমাকে নিজের হাতে তোকে খাইয়ে দিতে বলেছে মা। কিন্তু আমি কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলুম। নে হাঁ কর তো দেখি”।

সীমন্তিনী আর কথা না বলে হাঁ করতেই বিভাদেবী তার মুখে গ্রাস তুলে দিলেন। সীমন্তিনীর চোখ আবার জলে ভরে এল। ঠিক অমন সময় কিংশুক বাড়ির ভেতর এল। আর অর্চনাও জলের গ্লাস নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে এল। বিভাদেবী সীমন্তিনীর মুখে খাবার তুলে দিতে দিতে বললেন, “খোকা, রান্নাঘরে একটা বড় থালায় কিছু মিষ্টি আর খাবার রেখে এসেছি। থালাটা নিয়ে বাইরে গিয়ে মন্তিমার সাথে যারা এসেছে তাদেরকে খাইয়ে আয়। আর সাথে জলের জগটাও নিয়ে যাস কেমন”?

“আচ্ছা মা” বলে কিংশুক চলে যেতেই অর্চনা সীমন্তিনীর অন্যপাশে এসে দাঁড়িয়ে দেখল সীমন্তিনীর চোখ দুটো জলে ভেজা। অর্চনা তখন সুতীর শালোয়ার কামিজ পড়ে ছিল। ওড়না দিয়ে সীমন্তিনীর চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “এ কি দিদিভাই, তুমি কি কাঁদছ নাকি? না মা ঠিকমত তোমার ভেজা চোখ দুটো মুছে দেননি”।

সীমন্তিনী খাবার চিবোতে চিবোতেই কোন কথা না বলে একটু মুচকি হাসল। সীমন্তিনীর খাওয়া শেষ হলে কিংশুক বাড়ির ভেতর ফিরে আসতেই সীমন্তিনী তাকে ডাকল। কিংশুক কাছে আসতেই তাকে জিজ্ঞেস করল, “ভাই নভেম্বরে পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই কিন্তু এরপর যা করবে তা নিয়ে উঠে পড়ে লাগতে হবে। কোন লাইনে পড়তে চাও তার এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হবে। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। কিন্তু আগে থেকেই মনস্থির করতে হবে যে কোন লাইনে যেতে চাও। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার যা-ই হতে চাও তার জন্য তোমাকে অল ইন্ডিয়া লেভেলের কম্পিটিটিভ এক্সাম গুলো দিতে হবে। তাই টুয়েল্ভথের পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই স্টাডি মেটেরিয়াল কালেক্ট করতে হবে। অবশ্য সে সব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সে সব আমিই জোগার করে দেব তোমাকে। কিন্তু কোন লাইনে যেতে চাও সেটার ডিসিশন নিয়ে আমাকে কিন্তু পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথে জানিয়ে দিও। আর পরীক্ষা শেষ হবার আগেই যদি জানিয়ে দিতে পারো তাহলে তো আরও ভাল হয়। তবে একটা কথা মনে রেখো। কোন লাইনে পড়লে খরচ বেশী হবে, কোন লাইনে পড়লে খরচ কম হবে সেসব নিয়ে একদম ভাববে না। তুমি যা পড়তে চাইবে তাই পড়তে পারবে। শুধু তোমার সিদ্ধান্তটা আমাকে জানিও। বাকি সব কিছু আমি সামলে নেব। কিন্তু বারো ক্লাসের পরীক্ষাই বলো আর কম্পিটিটিভ পরীক্ষাই বলো, সবটাতেই কিন্তু টপার হবার চেষ্টা করতে হবে তোমাকে”।

কিংশুক সীমন্তিনীর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “সে চেষ্টাই করব দিদিভাই। তুমি শুধু আমাকে প্রাণ ভরে আশীর্বাদ কোর, তাহলেই হবে”।

সীমন্তিনী কিংশুকের মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল, “ভাইদের ওপর দিদিদের আশীর্বাদ চিরদিনই থাকে ভাই। আর তুমি তো আমার এত মিষ্টি ছোট ভাই। তোমাকে আশীর্বাদ না করে থাকতে পারি? আমার আশীর্বাদ, ভালবাসা, স্নেহ, মমতা সব কিছু তোমার জন্যে আলাদা করে তোলা আছে। সেটা থেকে আর কেউ কোনও ভাগ পাবে না”।
 

কিংশুক হেসে বলল, “আমিও তোমার চাওয়া পূরণ করে দেখাবো দিদিভাই। আমাকেও তো প্রমাণ করতে হবে যে আমি তোমার যোগ্য ভাই”।


 ------------------------------------
Like Reply
(Update No. 134)

সীমন্তিনীও হেসে কিংশুকের মাথার চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলল, “এই না হলে আমার ভাই”? বলে বিভাদেবীর দিকে চেয়ে বলল, “ও মাসি, তাহলে আজ উঠছি গো। অর্চুও তৈরী হয়ে গেছে। ভাই, তুমি বড়দির ব্যাগটা নিয়ে বেরোও। দোকানে গিয়ে অপেক্ষা করো। আমি আসছি। মাসি তুমি একটু আমার সাথে ভেতরে এসো তো” বলে বিভাদেবীর হাত ধরে তাদের ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল।

নিজের প্যান্টের পকেটের ভেতর থেকে পার্স বের করে তার ভেতর থেকে পাঁচ হাজার টাকা তুলে বিভাদেবীর হাতে দিতে দিতে বলল, “মাসি এ টাকাটা রেখে দাও। এটা মেসোকে দিও না। তোমার কাছে আলাদা ভাবে রেখে দিও”।

বিভাদেবী বললেন, “ওমা, আবার এসব দিচ্ছিস কেন মা? তুই তো এ পরিবারের এ তিনটি প্রাণীর সব চাহিদাই সময়ে সময়ে পূরণ করছিস। তাহলে আবার আলাদা করে এত টাকা দিচ্ছিস কেন”?

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, আমাকে তো নানা কাজে নানাভাবে ব্যস্ত থাকতে হয়। এমন যদি কখনও হয় যে তোমাদের কিছু টাকার প্রয়োজন, কিন্তু আমি তখন আসতে পেলুম না। তখন এখান থেকে খরচা কোরো। আর শোনো, মেসোকে বলেছি, পাকা পোক্ত ভাবে রান্নাঘর বানাতে কত টাকা খরচ হতে পারে এ ব্যাপারে কোনও ভাল মিস্ত্রীর সাথে যেন কথা বলে দেখেন। তুমিও কথাটা একটু মনে করিয়ে দিও। এবারের বর্ষা পেড়িয়ে গেলে রান্নাঘরটাকে নতুন করে বানিয়ে দেব। নইলে তোমাদের সকলেরই খুব অসুবিধে হবে। আমি তো সময় সুযোগ পেলে আসবই। আসতে না পারলেও ফোনে যোগাযোগ তো রাখবই। তুমি শুধু মেসোকে কথাটা মনে করিয়ে দিও। আর তোমার বড়মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি বলে দুশ্চিন্তা কোর না। ওকে কবে তোমার কাছে ফেরত পাঠাব তা এখনই ঠিক বলতে পাচ্ছি না। তবে তুমি একেবারে ভেব না। এতদিন আমি শুধু একা ছিলুম। তাই ইচ্ছে থাকলেও অর্চুকে নিতে পারিনি। কারন আমি যে কবে কতক্ষণ ঘরে থাকতে পারব তার তো কোনও ঠিক ঠিকানা নেই। এখন ঘরে লক্ষ্মীদি আর নীতা আছে। ওর কোন অসুবিধে হবে না। সারাক্ষণ কেউ না কেউ ওর সাথে থাকবে। ওর কোনও অমর্য্যাদা তো আমার ওখানে হবেই না। ও খুব ভালও থাকবে”।

বিভাদেবী বললেন, “অর্চু তার আদরের দিদিভাইয়ের কাছে যাচ্ছে, এ নিয়ে আমার মনে চিন্তা হবার কি আছে মা? আমি ওকে পেটে ধরলেও তুইই তো ওকে পূনর্জীবন দিয়েছিস। কিন্তু হ্যারে মা, রচুও বলেছে তুই নাকি কলকাতা থেকে ফেরার সময় কোন একটা মেয়েকে সাথে নিয়ে এসেছিস? আর তাকে নাকি তোর কাছেই রাখবি? মেয়েটা কে রে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ মাসি। ওর নাম নীতা। পুরো নাম নবনীতা দত্ত। কায়স্থ। মেয়েটার সব কথা তোমাকে শোনাতে গেলে আজ আর আমার ফিরে যাওয়া হবে না। তবে খুব সংক্ষেপে একটুখানি বলি। মেয়েটা খুব গরীব ঘরের। কলকাতার এক বস্তিতে থাকত। এগার ক্লাস অব্দি পড়াশোনা করেছে। আমার এক বন্ধুকে ভালবাসত। কিন্তু আজ থেকে সাত বছর আগে যেদিন ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছিল সেদিনই ওদের বস্তির দুটো বদমাশ ওকে রাতের অন্ধকারে অজ্ঞান করে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। বদমাশগুলো ওর সর্বস্য লুটে নিয়েও ওকে ছাড়েনি। অনেক দুরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ওকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে টাকা কামিয়ে নিত। অনেক চেষ্টার পর অনেক কষ্ট করে এক দেড় বছর আগে ও সেখান থেকে কোনমতে পালিয়ে কলকাতা এসেছিল। দু’তিন মাস আগে আমার সে বন্ধুর সাথে ওর দেখা হয়েছিল। আমার বন্ধু ওর সবকথা শোনার পরেও ওকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু ও নিজেই সে আহ্বান প্রত্যাক্ষান করেছে। বলেছে যে ও মরে গেলেও ওর নোংড়া অপবিত্র শরীরটা নিজের ভালবাসার লোকের হাতে তুলে দিতে ও কিছুতেই পারবে না। আমি কলকাতা গিয়ে যেদিন ওকে প্রথম দেখি, সেদিন রচুও আমার সাথে ছিল। ওর জীবনের কথাগুলো শুনতে শুনতে আমার বারবার অর্চুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। অর্চুও ওর জীবনের সাতটা বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করেছে। এ মেয়েটাও তাই। বয়সে অর্চুর থেকে বছর দুয়েকের বড় হলেও অর্চু যেমন শুধু মাধ্যমিক পাশ করেছে, ও-ও তেমনি এগার ক্লাস অব্দি পড়েছে। দেখতে শুনতেও খুব ভাল। কথাবার্তা ব্যবহার সবই খুব চমৎকার। ওকে যেদিন বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল তার ক’দিন বাদেই ওর মা মারা গিয়েছিল। মেয়ের শোকেই তার প্রাণ গিয়েছিল। কলকাতা পালিয়ে আসবার পর ও নিজের বাবা দাদার কাছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা অমন কূলটা মেয়েকে আর সংসারে ঠাঁই দেয়নি। তখন নিরুপায় হয়ে পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াত। ভিক্ষে করে খেত আর রেল ষ্টেশনে শুয়ে রাত কাটাত। সে অবস্থায়ও ওকে কতভাবে নিপীড়িতা হতে হয়েছে সেসব কথা শুনলে তুমি কেঁদে ফেলবে মাসি। মেয়েটার সব কথা শোনবার পর ওকে আমি সঙ্গে না এনে পারিনি। আপাততঃ আমি ওকে কোন একটা কাজে ঢুকিয়ে দেব। তারপর দেখা যাক ভবিষ্যতে কী হয়। তবে ও আমার কাছে আছে বলে অর্চুর কোন ক্ষতি হবে, ওর অযত্ন হবে, এ’কথা তুমি মনেও এনো না” বলে একটু থেমে বলল, “মাসি, দেরী হয়ে যাচ্ছে গো। আমাকে যে এখন বেরোতেই হবে। আবার মেসোর দোকানেও তো একটু ঢুকতে হবে”।

নবনীতার গল্প শুনতে শুনতে বিভাদেবীর দু’চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। তিনি নিজের চোখ মুছে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, “তুই সত্যিই মা অন্নপূর্ণা রে। নাজানি আরও কতজনের জীবনে তুই এভাবে আশীর্বাদ বিলিয়ে যাবি। অর্চুকে নিয়ে আমার কোন ভাবনা নেই। ও এখন আগের থেকে অনেক ভাল আছে। আর তোর কাছে গিয়ে ও আরও ভাল থাকবে সে আমি জানি। কিন্তু মা ওই মেয়েটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে আসবি? আমার ওকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে মা”।

সীমন্তিনী বিভাদেবীর হাত ধরে বলল, “কথা তো দিতে পারছি না মাসি। আমার কাজের ব্যস্ততা দিন দিন বেড়েই চলছে। তবে সময় সুযোগ হলে নিশ্চয়ই নিয়ে আসব। কিন্তু এবার আর দেরী করা যাবে না মাসি। চল বেরোই”।
 

বিধুবাবুর দোকানে ঢুকে একটু সময় কাটিয়েই সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অর্চনাকে নিয়ে নিজের গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিল।

অর্চুকে নিয়ে সীমন্তিনী কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে জানতে পেরে নবনীতা আর লক্ষ্মী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। লক্ষ্মী বিকেল বেলাতেই আলুর দম আর পায়েস বানিয়ে রেখেছে। নবনীতা ময়দা মেখে তৈরী করে রেখে দিয়েছে। ওরা ফিরে এলেই গরম গরম লুচি ভেজে দেবে লক্ষ্মী।

সন্ধ্যে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সীমন্তিনীর গাড়ি কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডে ঢুকতেই নবনীতা আর লক্ষ্মী ছুটে ঘর থেকে বেড়িয়ে এল। ওরা গাড়ি থেকে নামতে না নামতেই লক্ষ্মী আর নবনীতা গিয়ে দু’জন দু’পাশ থেকে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরতে অর্চনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। সীমন্তিনী হেসে উঠে বলল, “অর্চু, এ হচ্ছে আমার লক্ষীদি, আর ও হচ্ছে নীতা। তোমার মতই আমার আরেকটা বোন”।

অর্চনা সীমন্তিনীর কথা শুনে নিচু হয়ে দু’জনকে প্রণাম করবার চেষ্টা করতেই লক্ষ্মী তাকে আবার জড়িয়ে ধরে বলল, “ও কি করছ ও কি করছ সোনাদি, তুমি আমাকে প্রণাম করে পাপের ভাগী কোরনা গো। আমি কি আর তোমার প্রণাম নেবার যোগ্য। তুমি যে সাক্ষাৎ ভগবতী গো”।

নবনীতাও অর্চনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “হ্যাঁ বোন। আমিও তো কায়স্থ ঘরের মেয়ে। কায়স্থ হয়ে ', মেয়ের প্রণাম নিলে আমারই যে পাপ হবে গো। তাই প্রণাম টনাম আর করতে হবে না। চল, ভেতরে চল”।

অর্চনা নবনীতার দিকে চেয়ে জবাব দিল, “আমরা সে-সব রীতি মানিনে গো নীতাদি। আমরা ভাই বোনেরা মা-বাবার কাছে এমন শিক্ষাই পেয়েছি যে শ্রদ্ধেয় বয়োজ্যেষ্ঠ সকলকেই প্রণাম করা যায়” বলে সে আবার নবনীতার পায়ের দিকে ঝুঁকতেই নবনীতা তাকে আবার বুকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “ইশ কী মিষ্টি গলার স্বর গো তোমার। আচ্ছা ঠিক আছে বোন, তোমার প্রণাম আমি এমনিতেই স্বীকার করে নিলুম। আর পায়ে হাত দিতে হবে না। এবার ঘরে চলো। কতক্ষণ ধরে তোমাদের আসার অপেক্ষায় ছিলুম আমরা। তোমাকে দেখে আমার চোখ সার্থক হল ভাই, এসো” বলে অর্চনাকে জড়িয়ে ধরেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “দিদিমণি, সোনাদির ব্যাগ ট্যাগ কোথায় গো? কিছু সঙ্গে আনেনি নাকি”?

সীমন্তিনী গাড়ির ভেতর ঈশারা করে ব্যাগটা দেখিয়ে দিতেই লক্ষ্মী ব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বলল, “চলো চলো, ভেতরে চলো। আর তাড়াতাড়ি করে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি বৌদিমণির কথা মত তোমাদের জন্য পায়েস আর আলুর দম বানিয়ে রেখেছি। গরম গরম লুচি ভেজে দেব। সবাই মিলে আগে খেয়ে নাও, তারপর যা করবার কোর”।

ঘরে ঢুকে লিভিং রুমের এক কোনায় লক্ষ্মী অর্চনার ব্যাগটা রাখতেই সীমন্তিনী বলল, “লক্ষ্মীদি, অর্চুর লাগেজটা গেস্ট রুমে ঢুকিয়ে দাও একেবারে, আর ..........” তার কথা শেষ হবার আগেই তার হাতে ধরা মোবাইল বেজে উঠল। রচনার ফোন। অর্চনার দিকে তাকিয়ে “রচু ফোন করেছে” বলেই কল রিসিভ করে বলল, “হ্যাঁ রচুসোনা, বল”।

রচনা ওপাশ থেকে বলল, “তোমরা পৌঁছে গেছ দিদিভাই”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “হ্যারে, এইমাত্র ঘরে এসে ঢুকলুম। এখনও লিভিং রুমেই দাঁড়িয়ে আছি। অর্চুকে গেস্ট রুমে পাঠাচ্ছিলুম। হাত মুখ ধুয়ে এলে আমার রুমে বসে তোর অর্ডারের লুচি, আলুর দম আর পায়েস দিয়ে জলখাবার খাব। আচ্ছা নে, তোর দিদির সাথে আগে কথা বলে নে”।
 

রচনা সাথে সাথে বলল, “দিদিভাই শোনো না। দিদিকে কি তুমি একা গেস্ট রুমে থাকতে দেবে নাকি”?

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ সেটাই ভাবছিলুম। কিন্তু তুই এ’কথা বলছিস কেন বল তো”?

রচনা বলল, “আমার অপরাধ নিও না দিদিভাই। তোমাকে কিছু বলে বোঝানো তো আমার ধৃষ্টতা হবে। তবু বলছি, দেখো, দিদি একা হলেই তো ওর মনে বারবার ওর স্বামী শ্বশুর বাড়ির কথাগুলো মনে পড়বে। তাই বলছিলাম কি ওকে একা বেডরুমে রাত কাটাতে না দিয়ে তোমার বা তোমার পাশের রুমে নীতাদির সাথেই থাকতে দাও না। তাহলে ও আর একা একা বসে সে’সব কথা ভাববার ফুরসৎ পাবে না। আমি কি ভুল বলছি দিদিভাই”?

সীমন্তিনী এক পলক অর্চনার দিকে চেয়ে ফোনে বলল, “একদম ভুল বলিস নি তুই। এই জন্যেই তোকে এত ভালবাসিরে সোনা আমার। কথাটা তো আমার মাথাতেও আসা উচিৎ ছিল। ঠিক আছে, আমি সে ভাবেই বন্দোবস্ত করছি। নে এবার দিদির সাথে একটু কথা বল। কিন্তু সংক্ষেপে সারিস। নইলে লুচি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে কিন্তু” বলে ফোনটা অর্চনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও অর্চু, রচুর সাথে কথা বলো”।

অর্চনা ফোন কানে লাগিয়ে বলল, “হ্যাঁ রচু বল”।

রচনা ওপাশ থেকে বলল, “দিদি তুই ঠিক আছিস তো? আসতে খুব কষ্ট হয়নি তো”?

অর্চনা হেসে বলল, “ওমা কষ্টের কি আছে? দিদিভাইয়ের গাড়িতে তার পাশে বসে তো বেশ আরামেই এসেছি। আর ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই পৌঁছে গেছি এখানে। আর শরীরও ঠিক আছে আমার। তুই ভাবিস না বোন”।
 

রচনা আবার বলল, “লক্ষ্মীদি নীতাদির সাথে আলাপ হয়েছে? কেমন লাগল তাদের”?

অর্চনা বলল, “হ্যারে, ঘরে ঢোকবার আগেই তাদের সাথে আলাপ হয়েছে। তুই আগে যেমন বলেছিলিস ঠিক তেমনই মনে হল। আর শুনলাম তুই নাকি লক্ষ্মীদিকে আমার পছন্দের লুচি, আলুর দম আর পায়েস বানাতে বলেছিস। লক্ষ্মীদিও তাই করেছে। তা হ্যারে, তুই আর রতুদা ভাল আছিস তো সবাই”?
 

রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদি, আমরা সবাই ভাল আছি। আচ্ছা শোন এখন আর বেশী আটকাবো না তোকে। তোরা ফ্রেশ হয়ে আগে চা জল খাবার খেয়ে নে। আমি পরে আবার ফোন করব, কেমন”?
 

অর্চনা বলল, “ঠিক আছে। রাখছি তাহলে” বলে ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে বাড়িয়ে দিল। সীমন্তিনী ফোন নিতে নিতেই বলল, “লক্ষ্মীদি, গেস্ট রুমে নয়। আপাততঃ আমার রুমেই অর্চুর লাগেজটা নিয়ে নাও। চা জল খাবার খেয়ে পরে পাকাপাকি ব্যবস্থা করা যাবে”।

লক্ষ্মী সীমন্তিনীর ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “সে নাহয় রাখছি। কিন্তু তোমরা এভাবে এখন ফোনের পর ফোন করতে থাকলে তো দেরী হয়ে যাবে। আমি কিন্তু রান্নাঘরে চললুম লুচি ভাঁজতে। তোমরা দুটিতে দয়া করে তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে নাও”।
 

সবাই মিলে লুচি খাবার পর চা খেতে খেতে সীমন্তিনী কালচিনিতেও ফোন করে নিজেদের পৌছ সংবাদ দিল। নবনীতার অনুরোধেই অর্চনাকে তার ঘরেই থাকতে দেওয়া হল।
 

****************
______________________________
ss_sexy
Like Reply
(Update No. 135)

বিগত কয়েকটা দিন ধরে মহিমা বড় দুশ্চিন্তায় আছে। বিমল আগরওয়ালার শ্যেনদৃষ্টি রচনার ওপর পড়েছে সেটা জানবার পর থেকেই সে আর নিজের মনকে শান্ত রাখতে পারছে না। বিমলের সাথে তার পরিচয় হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ছ’বছর আগে। ২০০৬ সালে তার যোগা ইনস্টিটিউট চালু হবার কয়েক মাস পরেই। তখন তার মেয়ে রিতিকা হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল। মহিমা আর অরবিন্দ দু’জনেই চাইছিল ছেলে মেয়েদুটোকে ভাল উচ্চশিক্ষা দিতে। রিতিকার ইচ্ছে ছিল বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নিয়ে পড়ার। তাই অনেক খোঁজাখুঁজি খবরাখবর করবার পর আমেদাবাদের একটা ভাল প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে সেখানে রিতিকার অ্যাডমিশনের বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু রেজিস্ট্রেশন, কোর্স ফি, এক্সাম ফি, হোস্টেল একোমোডেশন আরও নানা খরচ খরচাপাতি মিলিয়ে প্রায় কুড়ি লাখ টাকার প্রয়োজন হয়েছিল। তখন তার স্বামী অরিন্দমের ব্যবসাটাও তেমন দাঁড়ায় নি। আর যোগা ইনস্টিটিউটটা তার মাস পাঁচ ছয় আগেই শুরু করা হয়েছিল। তাই স্বামী স্ত্রী কারো হাতেই তেমন পুঁজি ছিল না। কিন্তু দুজনেই চাইছিল তাদের মেয়েটা ওই ইনস্টিটিউটেই পড়ুক। তখন অরিন্দমের কাছে ব্যাপারটা গোপন রেখেই টাকার বিনিময়ে সে নিজের যুবতী শরীরটাকে বিভিন্ন কামপিপাসু পুরুষের হাতে তুলে দিতে শুরু করেছিল। বিমলও ছিল তাদের মধ্যে একজন। কিন্তু তখন সে এক এক দিনে তিরিশ চল্লিশ হাজার টাকাই উপার্জন করতে পারত। কিন্তু রিতিকার অ্যাডমিশনের জন্য পনেরো দিনের ভেতর কুড়ি লাখ টাকা আমেদাবাদের ইনস্টিটিউটে জমা দেবার নোটিস পেয়েই সে বিমলের কাছে হাত পেতেছিল। কামুক বিমল পাক্কা ব্যবসাদার হলেও মহিমাকে সেদিন ফিরিয়ে দেয়নি। সে বলেছিল পুরো টাকাটাই সে মহিমাকে দেবে, আর সে টাকার ওপর মহিমাকে কোনও সুদও দিতে হবে না। কিন্তু মহিমাকে তার একটা শর্ত মানতে হবে। বিমল সারাজীবন ধরে মহিমার সুন্দর শরীরটাকে মুফতে প্রতি মাসে দু’দিন করে ভোগ করতে চেয়েছিল। মহিমা তাতে আপত্তি করবার মত কিছু দেখেনি। বাইশ বছর বয়সে অরিন্দমকে বিয়ে করবার পর থেকে সে স্বামী ছাড়া অন্য কোনও পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক না করলেও, বিয়ের আগে পর্যন্ত নিজের হাতখরচা মেটাতে সে অনেক ছোট বয়স থেকেই দিল্লীর বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন পুরুষের সাথে যৌন সম্ভোগ করত। আর মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতে তো সে ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজনের সাথে সম্ভোগে লিপ্তা হয়েছে। তাই একথোকে কুড়ি লক্ষ টাকা জোটাবার অন্য কোন পথ না পাওয়ায় সে বিমলের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিল। সেই থেকেই প্রতি মাসে বিমল তাকে দু’দিন করে ভোগ করে আসছে। আর মেয়েকে আমেদাবাদ পাঠাবার দু’বছর বাদে ছেলেকে ব্যাঙ্গালোরে পড়তে পাঠাবার সময় আরও একুশ লাখ টাকার প্রয়োজন পড়েছিল। তখন বিমল পুরনো শর্তেই তাকে আরও পনের লাখ টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিল। অবশ্য তারপর থেকে বিমল তাকে মাসে দু’দিনের বদলে তিনদিন করে ভোগ করতে শুরু করেছে। তখনই সে এসকর্ট ব্যবসায় অন্য ছেলেমেয়ে কাজে লাগাতে শুরু করেছিল। তাতে প্রচুর আয় হতে লাগল। বছর খানেকের ভেতরেই বিমলের পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা সে ফিরিয়ে দিয়েছিল। তারপরের আরও দুটো বছর সে এসকর্ট ব্যবসায় নিজেকেও কাজে লাগিয়েছে। কিন্তু তারপর সে নিজে গ্রাহকদের কাছে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতে তার আর কোনও অসুবিধে হয়নি, কারন অন্যান্য মেয়ে মহিলা আর পুরুষকে এসকর্টের কাজে লাগিয়েই তার প্রচুর আয় হত। তবে সে যে নিজেকে আর পরপুরুষদের হাতে একেবারেই সমর্পন করত না, তা নয়। এই সাতচল্লিশ বছর বয়সেও সে এখনও যথেষ্ট রূপবতী আর যৌন আবেদনময়ী। এখনও যে কোন বয়সী পুরুষ মানুষকে আকৃষ্ট করতে সে সক্ষম। এখনও বিমলের মত আরও অনেকেই তার শরীরটাকে পেতে চায়। কিন্তু সে নিজেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। যে সব গ্রাহকরা তাকে চায় তাদের নিজের শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে বা অন্য কোন ছুতো দেখিয়ে অন্য কোনও এসকর্ট তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তবে নিজের এসকর্ট ব্যাবসায় যাতে তাকে প্রশাসনিক কোন ঝামেলায় পড়তে না হয়, সেজন্য তাকে বিভিন্ন মন্ত্রী, পুলিশ অফিসার, আইনজীবি ও সরকারি অফিসারদের বিনে পয়সায় মনোরঞ্জন করে যেতেই হচ্ছে। নইলে তাকে এ ব্যবসা বন্ধ করতে হবে। আর বিমলের শর্তপূরনও করে যেতে হচ্ছে তাকে।

বিমলের সাথে সম্ভোগে মহিমা নিজে যে খুব তৃপ্তি পায়, তা নয়। কিন্তু বিমলের উপকারের কথা মাথায় রেখেই সে এখনও বিমলের শর্তানুযায়ী তাকে নিজের যৌবন সঁপে দিচ্ছে। বিমলের স্ত্রী সবিতাও তার যোগা ইনস্টিটিউটের ক্লায়েন্ট। সে নিজেও মহিমার কাছ থেকে এসকর্ট চেয়ে নেয় মাঝে মাঝে। তবে তার পছন্দ তার ছেলের বয়সী আঠার ঊণিশ বছরের কচি কচি ছেলে। মহিমার এসকর্টের কাজে কুড়ি বছরের নিচে কেউ নেই। অমন কচি কাঁচাদের নিয়ে মহিমা ব্যবসা করে না। সবিতা তাই বেশীরভাগ সময় অন্য কোন মাধ্যমে কচি কাঁচা ছেলে যোগার করে নিজের যৌন বাসনা মেটায়। তবু সবিতা মাঝে মাঝে কুড়ি একুশ বছরের মেল এসকর্ট হায়ার করে থাকে মহিমার কাছ থেকে। কিন্তু সবিতার প্রতি মহিমার তেমন কোনও দায়বদ্ধতা না থাকলেও বিমলের কাছে সে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সারা জীবন বা বলা ভাল যতদিন তার দেহে যৌবনের লালিমা থাকবে ততদিন পর্যন্ত সময়ে সময়ে তাকে বিমলের অঙ্কশায়িনী হতেই হবে। সবিতার মুখেই সে শুনেছে যে অনেকটা মুটিয়ে যাবার ফলে তার স্বামী বিমল নাকি তার সাথে সম্ভোগ করে আর তৃপ্তি পায় না। তাই হয়ত বিমল এখনও মহিমার কাছে আসে। তবে মুটিয়ে গেলেও সবিতার চেহারার লালিমা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি তা মহিমা জানে। সে এটাও জানে যে বিমল শুধু তার কাছেই আসে না, মহিমা ছাড়াও অন্য অনেক মেয়ে মহিলার সাথেও তার যৌন সম্পর্ক আছে। অবশ্য যাদের হাতে পয়সা আছে তাদের মেয়ে যোগার করতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। কিন্তু ওর কূনজর যে রচনার ওপরেও পরেছে তাতেই মহিমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে।

প্রথম দর্শনে রতীশের সুগঠিত সুঠাম শরীরটা দেখে মহিমার ভেতরেও এক মূহুর্তের জন্য যৌন ক্ষুধা জেগে উঠেছিল। মনে হয়েছিল এ ছেলেটার সাথে শরীরের খেলা খেলে খুব তৃপ্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু রতীশের সরল সুন্দর মুখশ্রী, ভদ্রতা আর সুমিষ্ট ব্যবহারে তার মনের সে ভাবনা উধাও হয়ে গিয়েছিল। কামের পরিবর্তে তার মনে নিখাদ স্নেহ আর মমতা জেগে উঠেছিল। আর রতীশ কাজে যোগ দেবার পর তার যোগা ইনস্টিটিউটের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এ ক’টা দিনেই। আর রতীশকে যে সে নিজের ভাই বলে ডাকে সেটাও একেবারেই মেকি নয়। সে সত্যি মনে মনে তাকে নিজের ছোটভাই বা নিজের দেবরের মতই ভালবাসতে শুরু করেছে। এ ভালবাসায় কাম নেই। আছে অন্য এক নেশা। এর কাছে তার শরীরের নেশাও হার মেনেছে। কোনও ছেলের প্রতি সে যে এমনভাবে আকৃষ্ট হতে পারে, এ’কথা মহিমা ভাবতেও পারত না। আর রচনাকে প্রথম দিন দেখার পর থেকে তার ভেতর কী যে হয়েছে তা সে নিজেও ভেবে পায় না। মেয়েটার মধ্যে কী যেন আছে। মূহুর্তের মধ্যে তাকে কেমন আপন করে নিয়েছিল রচনা। মহিমার জীবনে এমন মেয়ে সে আর আগে কখনো দেখেনি। রতীশ কাজে যোগ দেবার পর থেকে রোজ মেয়েটার সাথে একটু কথা না বললে মহিমার ভাল লাগে না। বড্ড আপন, বড্ড কাছের মানুষ বলে মনে হয় মেয়েটাকে। সুন্দরী তো সে বটেই। কিন্তু রচনার চেয়েও অনেক বেশী সুন্দরী মেয়ে সে অনেক দেখেছে জীবনে। তার এসকর্টের কাজেও রচনার চাইতে সুন্দরী দু’ তিনজন মেয়ে আছে। কিন্তু তাদের কাউকে দেখেই এভাবে ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনি মহিমার। মহিমা তখন থেকেই মনে মনে ভেবে নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন, রচনা ও রতীশের সাথে তার নিষ্কাম ভালবাসার সম্পর্কটা সে আমৃত্যু বজায় রাখবে। ওদের পাশে সে সব সময় তাদের পরম বন্ধুর মত থাকবে। কিন্তু বিমলের বদ অভিসন্ধি জানবার পর থেকেই মহিমা বেশ দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

তার মন চাইছে রতীশ আর রচনার পাশে বড়দিদির মত স্নেহ ভালবাসার বৃত্ত রচনা করে তাদের সমস্ত বিপদ আপদ থেকে দুরে রাখতে। বিমলের মুখেই সে শুনেছে যে রতীশ একটা যোগা ইনস্টিটিউট করবে বলেই কলকাতায় এসেছিল। সেটা তার বহুদিনের স্বপ্ন। কোন এক ঠগের পাল্লায় পড়ে টাকাটা খুইয়ে বসতে রতীশের পক্ষে আর তার ইচ্ছে পূরণ করবার সাধ্য ছিল না বলেই রতীশ তার ওখানে কাজে যোগ দিয়েছে। রচনার সাথে পরিচিত হবার পর, তাকে ভালবেসে ফেলার পর মহিমা ভেবেছিল, কিছুদিন রতীশকে দিয়ে বরুন সুজয় ওদেরকে কিছুটা ট্রেইনড করে তুলতে পারলেই সে নিজেই রতীশকে সাহায্য করবে একটা যোগা সেন্টার খুলবার জন্যে। অর্থের অভাব এখন আর মহিমার নেই। আর্থিক ভাবে তো বটেই, সে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়েও রতীশকে সবরকম ভাবে সাহায্য করতে পারবে। মাস ছয়েক বাদে সে এ ব্যাপারটা নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বিমলের প্রস্তাব শুনেই তার ভেতরের সবকিছু যেন ওলোট পালট হয়ে যাচ্ছে।
 

বিমলকে আটকানো প্রায় অসম্ভব। সে প্রচুর পয়সার মালিক। পয়সা খরচ করেই সে যে কোন মেয়ে বা মহিলাকে তাদের ইচ্ছের বিরূদ্ধেও ভোগ করতে পারে। আর মন্ত্রী আমলা থেকে শুরু করে থানা পুলিশ দারোগা সব কিছুই বিমলের হাতের মুঠোয়। একবার যখন রচনার ওপর তার নজর পড়েছে, যে কোন ভাবেই হোক, সে রচনাকে ভোগ না করে নিবৃত্ত হবে না, এ’কথা মহিমা খুব ভাল করেই জানে। বিমল মহিমাকে যে কাজটা করতে বলেছে সেটা মহিমা পারবে না বলে ফিরিয়ে দিলে বিমল অন্য কাউকে এ কাজ দেবে। পয়সার বিনিময়ে এ শহরে অনেকেই এমন কাজ করতে ওস্তাদ। তারা যে কোন ভাবেই হোক একদিন না একদিন রচনাকে বিমলের হাতে তুলে দেবেই দেবে। আর তার খবরও হয়ত মহিমা জানতে পারবে না। তাই অনেক ভেবে চিন্তেই বিমলের কাজটা হাতে নিয়ে সে তার কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে। যাতে রচনার ওপর অন্যকোন দিক থেকে বিপদ নেমে না আসে। কিন্তু মহিমা তো এটা হতে দিতে চায় না। তার মন বলছে যেকোন ভাবে রচনাকে বিপদমুক্ত করতে। বিমল তাকে আপাততঃ ছ’মাস সময় দিয়েছে। যার মানে এই ছ’টা মাস বিমল এ কাজে মহিমার সাফল্যের জন্য অপেক্ষা করবে। তবে ছ’মাস পেরিয়ে যাবার পরেও হয়ত বিমলকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আরও কিছু সময় চেয়ে নেওয়া যাবে। কিন্তু রচনার ওপর বিপদের খাঁড়া তো ঝুলতেই থাকবে। কী করে বাঁচাবে সে রচনা আর রতীশকে?
 

একবার যখন বিমলের নজর রচনার ওপর পড়েছে, তাহলে রতীশের বাসা বদলে ওদের অন্যত্র সরিয়ে নিলেও বিপদ কাটবে না। সারা কলকাতার যেখানেই ওরা যাক না কেন বিমল ওদের ঠিক খুঁজে বের করবে। তাই মোটামুটি ধরে নেওয়া যায় যে রতীশ আর রচনা কলকাতায় একেবারেই সেফ নয়। তবে কি মহিমা রতীশ আর রচনাকে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে বলবে? কিন্তু রতীশের স্বপ্নের যোগা সেন্টার তো সে খুলতে পারবে না তাহলে। আর মহিমাও তাদের কাছ থেকে দুরে চলে যেতে বাধ্য হবে। তাতে তার নিজের যোগা সেন্টারেরও ক্ষতি হবে। অবশ্য সেটা মূখ্য ভাবনা নয় মহিমার। নিজের যে কোন রকম ক্ষতি সে স্বীকার করে নেবে রচনা আর রতীশের মুখ চেয়ে। নিজেদের জায়গায় যোগা সেন্টার ভাল চলবেনা বলেই ছেলেটা কলেজের চাকরি ছেড়ে এখানে এসেছে। এখান থেকে ফিরে গিয়ে সে কি সেখানেই গিয়ে সেন্টার খুলতে পারবে? আর তা করতে না পারলে সে আর কী করবে? কলেজের চাকরিটা কি আর ফিরে পাবে? নাহ, সেটাও তো দুরাশা। তাহলে তো ওদের জীবনে নানা কষ্ট নেমে আসবে। দু’দিন পর ওদের বাচ্চা কাচ্চা হবে। সংসারের খরচ আরও বাড়বে। কিকরে সামলাবে রতীশ? না, না, রতীশকে ফিরে যেতে বলা ঠিক হবে না।
 

কিন্তু তাহলে অন্য আর কী উপায় থাকতে পারে রচনাকে বাঁচাবার! গত একটা সপ্তাহ থেকে মহিমা সারাক্ষণ এ ব্যাপারেই ভেবে যাচ্ছে। বিমলের মন থেকে রচনার নাম মুছে দেওয়া সম্ভব নয়। বিমলের যা সোর্স আর যত অর্থ প্রতিপত্তি আছে, তাতে তাকে কোনভাবেই বিরত করা সম্ভব নয়। মহিমার নিজেরও কিছু সোর্স, অর্থ প্রতিপত্তি আছে। নিজের এসকর্ট ব্যবসা সুচারু ভাবে চালাতে অনেকের মত তাকেও কিছু কিছু গুন্ডা বদমাশ পুষতে হয়। কিছু কিছু থানা পুলিশ আমলা মন্ত্রীও তাকে অনেক সময় অনেক ঝামেলা থেকে মুক্ত করে। তারা মহিমার আদেশে বা অনুরোধে অন্য সব কিছু করলেও বিমলের মত লোকের পেছনে কিছুতেই লাগতে চাইবে না। আর তাতে করে মহিমার নিজেরও বড় বিপদ হতে পারে। বিমল একবার যদি ঘূণাক্ষরেও টের পায় যে এ সবের পেছনে মহিমার হাত আছে, তাহলে সে দিনটাই হবে মহিমার জীবনের শেষ দিন। মহিমাকে এ পৃথিবীর বুক থেকে সরিয়ে দিতে দু’মিনিটও লাগবে না বিমলের। অনেক ভাবনা চিন্তা করেও মহিমা কোন কুল কিনারা পাচ্ছে না।
 

এদিকে ব্যাপারটা নিয়ে যে রতীশ বা রচনার সাথে সে পরামর্শ করবে তাও সম্ভব নয়। ওরা দু’জনেই খুব সহজ সরল। ওরা ঘাবড়ে যাবে। ভয় পেয়ে যাবে। হয়ত উপায়ান্তর না পেয়ে তারা তাদের বাড়িতেই ফিরে যাবে। মহিমা সেটাও চায় না। তাহলে আর কী করতে পারে সে! গত সাতদিন ধরেও নানাদিক দিয়ে বিচার করেও কোন সমাধান সূত্র পেল না মহিমা। অবশেষ সিদ্ধান্ত নিল ভেতরের কথাগুলো পুরো খুলে না বলেই রতীশের সাথে একটু আলোচনা করে দেখা যাক না কিছু সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যায় কি না। এ কলকাতা শহরে তাদের হিতাকাঙ্ক্ষী বলে কি আর কেউ নেই? যে তাদের বিপদে আপদে তাদের কিছুটা সাহায্য করতে পারে!


**************
(To be cont'd .....)
 
Like Reply
(Update No. 136)

আজ রবিবার। অফিস ছুটির দিন। তাই আজ বেশ কিছু এসকর্ট পাঠাতে হবে অনেকের কাছে। রতীশ কেবিন কোচিং শেষ করে বেলা পৌনে এগারটা নাগাদ মহিমাকে বলে চলে গেছে। মহিমা মনে মনে ভেবেছিল আজ সে রতীশের ফ্ল্যাটে গিয়ে তার সাথে আর রচনার সাথে কথা বলবে। কিন্তু প্রায় ডজন খানেক ক্লায়েন্টের কাছে এসকর্ট পাঠাবার বন্দোবস্ত করতে করতে বেলা প্রায় একটা বেজে গেল। যখন তার এ বেলার কাজ শেষ হল তখন ভেবে দেখল বরানগর পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা দুটো পেড়িয়ে যাবে। আর এই দুপুরে রচনা তাকে না খাইয়ে কিছুতেই তাদের ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে দেবে না। তাই সে মনে মনে ভাবল, বাড়ি গিয়ে স্নান খাওয়া দাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে বিকেল তিনটে নাগাদ সে বরানগর যাবে।

দুপুরের পর রতীশ আর রচনা যখন তাদের বেডরুমে শুয়ে শুয়ে গল্প করছিল তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। কলিং বেলের শব্দে দু’জনেই যথেষ্ট অবাক হয়েছিল। রচনা প্রায় লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসে নিজের ত্রস্ত ব্যস্ত শাড়িটাকে ঠিকঠাক করতে করতে বলল, “সোনা, আমার কপালের সিঁদুরটা ঘেঁটে গেছে। আমি বাথরুমে ঢুকছি। তুমি গিয়ে দেখো এ অসময়ে আবার কে এল”।
 

রতীশ বিছানা থেকে নেমে আয়নায় নিজের মুখে বা গালে কোন সিঁদুরের দাগ নেই দেখেই লিভিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। রচনা বাথরুমে ঢুকে গিয়ে নিজের মুখ ধুতে লাগল।

রতীশ দরজার ম্যাজিক আইতে চোখ লাগিয়ে মহিমাকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি দড়জা খুলে অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, “একি বৌদি? আপনি এ সময়ে”?

মহিমা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, “একটা কাজে এদিকে আসতে হয়েছিল ভাই। কাজটা খুব অল্প সময়েই শেষ হয়ে গেল। তাই ভাবলাম, অনেকদিন ধরে রচনাকে দেখিনি। একবার দেখা করে যাই। তা রচনা কোথায়? ঘুমোচ্ছে নাকি”?
 

রতীশ জবাব দিল, “না না বৌদি। ঘুমোয়নি। ও বাথরুমে আছে। আপনি বসুন প্লীজ। ও এক্ষুনি এসে পড়বে। আর আপনাকে দেখেও খুব খুশী হবে” বলতে বলতে দেয়ালে লাগানো সুইচ বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেল। সিলিং ফ্যান চালিয়ে দিয়ে মহিমার উল্টোদিকের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি সেন্টার থেকে বেরিয়েই এদিকে এসেছিলেন নাকি বৌদি? তাহলে তো লাঞ্চ করা হয়নি আপনার”!

মহিমা নিজের হাতব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নিজের গাল আর গলা মুছতে মুছতে জবাব দিল, “না না ভাই, তা নয়। আমি বাড়িতে লাঞ্চ করে তারপরেই বেড়িয়েছিলাম”।

রচনা বাথরুম থেকে বেরিয়েই লিভিং রুম থেকে মহিমার গলার আওয়াজ পেয়ে যতটা খুশী হল তার চেয়ে বেশী অবাক হল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা লাগিয়েই ছুটে লিভিং রুমে এসে মহিমার কাছে এসে উৎফুল্ল গলায় বলল, “ওমা বৌদি, তুমি”?

মহিমা রচনাকে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে আদর করে বলল, “হ্যাঁগো। তোমাকে বেশ কটা দিন ধরে দেখিনি। তাই মনটা খুব চাইছিল তোমাকে দেখতে। আজ এদিকে অন্য একটা কাজে আসতে হল। তাই কাজটা শেষ করেই তোমাকে দেখতে এলাম ভাই। বল, কেমন আছ”?

রচনা মহিমার একটা হাত নিজের দু’হাতে নিয়ে বলল, “ভাল আছি বৌদি। কিন্তু একটু দাঁড়াও। আমি আগে তোমার জন্যে একটু শরবৎ বানিয়ে আনি। গরমে ঘেমে নেয়ে এসেছ। তুমি ততক্ষণ হাত মুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর কথা হবে”।

মহিমার মৃদু আপত্তি সত্বেও রচনা তাকে জোর করে বাথরুমের দিকে টেনে নিয়ে গেল। বাথরুমের দরজা খুলে দিয়ে বলল, “সাবান, হ্যান্ডওয়াস, ফেসওয়াস, টাওয়েল সব রাখা আছে। ভাল করে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। একদম হেজিটেট করবে না। আমি শরবৎ তৈরী করছি”।
 

মহিমা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে রচনাকে কিচেনে দেখে সেখানে চলে এল। রচনা তাকে দেখে শরবতের সাথে বরফ মেশাতে মেশাতে মিষ্টি হেসে বলল, “আজ প্রচণ্ড গরম পড়েছে, তাই না বৌদি। আমাদের ঘরে তো এসি নেই। তোমার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে না গো”?
 

মহিমা রচনার পেছনে দাঁড়িয়ে তার দুটো কাঁধ ধরে গালে গাল ঘসতে ঘসতে বলল, “কিচ্ছু কষ্ট হচ্ছে না আমার। অত ভেবো না তো তুমি। তোমাকে দেখেই তো আমার শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছে গো। আর এটা কিসের শরবৎ বানাচ্ছ তুমি বলো তো”?

রচনা হাতের কাজ করতে করতেই জবাব দিল, “লস্যি বানাচ্ছি বৌদি। গরমের মধ্যে খেতে খুব ভাল লাগবে দেখো। কিন্তু বৌদি, এদিকে যদি তোমার আসবারই দরকার ছিল, তাহলে লাঞ্চের আগে এলেনা কেন? আমাদের সাথে লাঞ্চ করলে আমাদের খুব ভাল লাগত। এর আগে যেদিন এসেছিলে সেদিনও বিনা নোটিশে এসেছিলে। তোমাকে সাধারণ খাবার খাইয়েছিলাম। আজ যদি তোমার দেবরকে আগে থাকতে বলে দিতে তাহলে তোমার জন্যে একটু ভালো আয়োজন করতে পারতাম”।

মহিমা আগের মতই রচনার গালে গাল লাগিয়ে জবাব দিল, “তোমার হাতের রান্নার স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে রচনা। আর তুমি বলছ সাধারণ খাবার? কিন্তু আজ যে এদিকে আসব সেটা সত্যিই আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল না। হঠাৎ একটা জরুরী কাজ পড়ে যাওয়াতেই আসতে হল। আর এদিকে এসে তোমার সাথে দেখা না করে চলে যাব, তাতে মনটা সায় দিচ্ছিল না। তাই তো শুধু তোমাকে একটু চোখের দেখা দেখতেই চলে এলাম। কিন্তু তোমরা দু’জনেই হয়ত খেয়ে দেয়ে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলে। অসময়ে এভাবে এসে তোমাদের ডিসটার্ব করে ফেললাম”।

রচনা হাঁ হাঁ করে উঠে বলল, “এমা, না না বৌদি। একদমই তা নয়। আমরা কেউই দিনের বেলায় ঘুমোই না। আমরা তো এমনি এটা সেটা নিয়ে কথা বলে সময় কাটাচ্ছিলাম। তুমি আসাতে তো ভালই হল। এখন তিনজনে মিলেই গল্প করতে পারব। আচ্ছা বৌদি। এ ঘরে ফ্যান নেই, গরম বেশী লাগে। আর দু মিনিটেই আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে। তুমি বরং ততক্ষণ তোমার দেবরের সাথে কথা বলতে থাক। লিভিং রুমটায় গরম এ রুমের চাইতে অনেক কম”।

মহিমা একটু হেসে বলল, “আমার দেবরের সাথে দেখা তো আমার রোজই হয়। আজও হয়েছে। আমি তো তোমার সাথে দেখা করতে এখানে এসেছি। আর তুমি আমাকে তোমার কাছ থেকে দুরে চলে যেতে বলছ”?

রচনা নিজের কাজ থামিয়ে মহিমার দিকে ঘার বেঁকিয়ে উত্তর দিল, “এমা, দেখেছ? আমি কি সেটা মিন করে বলেছি নাকি? ছিঃ ছিঃ। আমাকে তুমি এই ভাবলে বৌদি? এ ঘরের গরমে তোমার কষ্ট হবে বলেই ও’কথা বলছিলাম”।

মহিমা একহাতে রচনার একটা গাল টিপে দিয়ে বলল, “আরে বাবা তোমার সাথে একটু ঠাট্টা করছিলাম শুধু। কিছু মনে করো না ভাই। তা একটা প্রাইভেট কথা জিজ্ঞেস করতে পারি তোমাকে? সিরিয়াসলি। কিছু মনে করবে না তো”?
 

রচনা আবার কাজ করতে করতে বলল, “না কিচ্ছু মনে করব না। বল, কী জানতে চাও”?

মহিমা বলল, “তোমাদের বিয়ের তো তিন বছর পেরিয়ে গেছে। আমি তো বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যেই মা হয়ে গিয়েছিলাম। আমার এই দেবরানীটা কবে মা হচ্ছে শুনি”? বলে রচনার চিবুকটা ধরে নাড়িয়ে দিল।

রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে লাজুক গলায় জবাব দিল, “কি বলব বৌদি তোমাকে। আসলে আমরা তো এ বছরই বাচ্চা নেবার কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু জানোই তো, এখন আমাদের সময়টা খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। যেটা ভেবে আমরা কলকাতা এসেছিলাম, তোমার দেবর যদি তেমন ভাবে একটা যোগা সেন্টার খুলতে পারতেন, তাহলে হয়ত আর কোন সমস্যা হত না। তবু তোমার ওখানে ও কাজের সুযোগ পাওয়াতে কিছুটা হলেও সামলে উঠেছেন। ওদিকে যে টাকাটা লুট হয়ে গিয়েছিল পুলিশ সেটা উদ্ধার করেছে শুনেছি। এখন আবার সে নিজের সেন্টার খুলবার চেষ্টা করতে পারবে। কিন্তু আমাদের এই চরম বিপদের দিনে তুমি ওকে কাজ দিয়ে যে উপকার করেছ, সে’কথা ভেবেই ও এখনই তোমার সেন্টারে কাজ করা ছেড়ে দিতে চাইছে না। আর আমি নিজেও সেটা চাই না। তাই আমরা ভেবেছি যে আর কয়েকটা মাস তোমার ওখানে কাজ করার পর তুমি যদি ওকে ছাড়তে রাজী হও, তখন সে কোথাও একটা কমপ্লেক্স ভাড়া নিয়ে নিজের যোগা সেন্টার খুলবে। আর ভগবান চাইলে তখনই হয়ত আমরা আবার বাচ্চা নেবার কথা ভাবতে পারব” বলে একটু থেমে প্রায় সাথে সাথেই আবার বলল, “তোমার ওখানে কাজ ছেড়ে দেবে বলাতে তুমি রাগ করলে বৌদি”?
 

মহিমা রচনার কাঁধে তার থুতনী চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “নাগো বোন, রাগ করিনি। রতীশ যে কোন না কোন সময় আমার ইনস্টিটিউট ছেড়ে যাবেই এটা তো আগে থেকেই জানা আমার। তাই ওকে কাজ দেবার সময়েই আমি সেকথা পরিস্কার বলে দিয়েছিলাম যে ওর যখন খুশী ও আমার কাজ ছেড়ে চলে যাবার সুযোগ পাবে। কিন্তু এ ক’টা দিনে রতীশকে আর তোমাকে এমন ভালবেসে ফেলেছি যে তোমার কথায় মনে একটা ধাক্কা লাগল আমার। তোমরা আমাকে ছেড়ে যাবে, এ’কথা শুনেই বুকের ভেতরটা কেমন জানি করে উঠল গো”।

রচনার হাতের কাজ ততক্ষণে শেষ হয়ে এসেছে। সে তিনটে গ্লাসে লস্যি ঢেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে মহিমার মুখোমুখি হয়ে বলল, “তোমার মত হিতাকাঙ্ক্ষী এ কলকাতায় তো আমাদের আর কেউ নেই গো বৌদি। তাই তোমাকে ছেড়ে যাবার কথা তো আমরা ভাবতেই পারি না। তোমাকে সারা জীবন একজন পরম বন্ধু হিসেবে আমাদের পাশে দেখতে চাই। ও শুধু তোমার ওখানে কাজটাই ছেড়ে দেবে। নিজের সেন্টার খুললে তো আর তোমার ওখানে কাজ করা ওর পক্ষে সম্ভব হবে না। কিন্তু তোমার সাথে আমাদের যে এমন একটা সুসম্পর্ক তৈরী হয়েছে, সেটা আমরা কিছুতেই নষ্ট হতে দিতে চাই না”।
 

মহিমা ম্লান হেসে বলল, “জানি রে বোন। আমার ওখানে কাজ না ছাড়লে তো নিজের সেন্টার খোলা সম্ভব হবে না রতীশের পক্ষে। আর রতীশের স্বপ্নপূরনে আমিও কোন বাঁধা দেব না। বাঁধা দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না বরং আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, সমস্ত ভাবে ওকে সাহায্যই করব। ওর যা প্রয়োজন হয় আমি তাই ওকে দেব। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে এমনকি টাকা পয়সা দিয়েও আমি ওকে সাহায্য করতে রাজী আছি। কিন্তু রচনা বোন আমার, তোমরা আমাকে ভুলে যেও না। আমার সাথে তোমরা যোগাযোগটা কিন্তু রাখবে। আর আমাকেও তোমাদের ফ্ল্যাটে আসতে বারণ কোর না, প্লীজ”।

রচনা এবার দু’হাতে মহিমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “অমন কথা স্বপ্নেও ভেব না বৌদি। তোমার মত বন্ধু তো আমাদের আর কেউ নেই। তোমার দেবর চিরদিন তোমার দেবর তোমার ভাই হয়েই থাকবে। আর আমিও চিরদিন তোমার ছোট বোন হয়েই থাকব। তোমার আর আমাদের সম্পর্ক এমনই থাকবে। আমিও তোমাকে এ কথা দিলুম আজ”।

মহিমা রচনাকে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ বোন। আমার বুকের একটা বোঝা তুমি আজ হাল্কা করে দিলে”।

রচনা মৃদু হেসে বলল, “হয়েছে আর মন খারাপ কোর না। এবার ও ঘরে চলো। লস্যির ঠান্ডাটা কেটে যাচ্ছে। ওঘরে গিয়ে সবাই একসাথে বসে গল্প করব, এসো”।

রচনার হাতের সুস্বাদু লস্যি খেতে খেতে তিনজনে মিলে টুকটাক কথাবার্তা বলে চলছিল। একসম মহিমা জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ভাই, তোমাদের বাড়ি তো শুনেছি রাজগঞ্জে। আর রচুর বাপের বাড়ি কালচিনিতে। কলকাতায় তোমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই”?

রতীশ জবাব দিল, “না বৌদি, কলকাতায় আমাদের আত্মীয় স্বজন কেউ তো নেইই, এমনকি চেনা পরিচিত বলতেও তেমন কেউ নেই। ওই রবিশঙ্কর বলে লোকটার সাথেই কেবল আগে থেকে জানাশোনা ছিল আমাদের পরিবারের। তার কথায় ভরসা করেই এখানে এসেছিলাম। কিন্তু এখানে আসবার পরের দিনই সে আর তার সাথে আরেকজন মিলে আমার দু’লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দিয়েছিল। অনেক খুঁজেও তার আর দেখা পাইনি। বেলেঘাটায় তার বাড়িতে গিয়েও তাকে ধরতে পারিনি। তখনই ভগবানের আশীর্বাদের মত আপনি এলেন আমাদের জীবনে। এখন এ কলকাতায় কেবল আপনিই আছেন আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী হিতৈষী। অবশ্য এ জন্যে বিমল আগরওয়ালার প্রতিও আমি কৃতজ্ঞ”।

মহিমা রতীশের কথা শুনে মনে মনে কিছু একটা ভেবে আবার জিজ্ঞেস করল, “বিমলের কাছে আমিও কৃতজ্ঞ ভাই। বিমল তোমাকে আমার কাছে না গিয়ে গেলে আমি কি এমন একটা হীরের টুকরোর খোঁজ পেতাম কখনো? তা ভাই বিমলের সাথে কি তোমাদের আগে থেকে কোনও পরিচয় ছিল”?

রতীশ বলল, “না বৌদি, একেবারেই না। তবে রবিশঙ্কর অন্য এক ভদ্রলোককে বিমল আগরওয়ালা সাজিয়েই আমার সাথে একটা কমপ্লেক্স লিজ দেবার ব্যাপারে আলোচনা করেছিল। যেদিন আমি ওদের হাতে টাকাটা দিয়ে দিয়েছিলাম, তার পরের দিনই আমি জানতে পারলাম যে আসল বিমল আগরওয়ালা অন্য লোক। আর তার সাথে আমার সেদিনই আলাপ”।

মহিমা অবাক হয়ে বলল, “ওঃ মাই গড! এত বড় জোচ্চুরি করেছে ওরা! কিন্তু ওরা যে কমপ্লেক্সটা তোমাকে লিজ দিতে চেয়েছিল সেটা তাহলে কার ছিল”?
 

রতীশ বলল, “সেটা আসলে এই বিমল আগরওয়ালারই। আমিও তার কিছুদিন আগে আরেকবার এসে আশেপাশের লোকজনদের কাছে শুনেছিলাম যে ওই কমপ্লেক্সটার মালিক বিমল আগরওয়ালা। তাই রবি শঙ্কর ওই ভুয়ো লোকটাকে বিমল আগরওয়ালা বলে পরিচয় করিয়ে দিতে আমার মনে কোনও সন্দেহ হয়নি। আমি তাকেই কমপ্লেক্সের মালিক ভেবে তার সাথে ডিলটা করেছিলাম। ছেলের কলেজের অ্যাডমিশনের জন্য টাকাটা তার সেদিনই দরকার ছিল বলে সরল বিশ্বাসে তার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। আর সেই রবিশঙ্করও ভরসা দিয়েছিল যে কোনরকম উল্টোপাল্টা কিছু হবে না। পরের দিন সকালেই লিজ এগ্রিমেন্ট সাইন হয়ে যাবে। কিন্তু পরের দিন আর তাদের কাউকে দেখা গেল না। দেখা পেলাম আসল বিমল আগরওয়ালার। তার কাছে গিয়েই আমি রবিশঙ্কর আর তার সাথের লোকটার ব্যাপারে কথা বলতে বলতে পুরো ঘটণাটা খুলে বলেছিলাম, সব কথা শুনে তিনি শুধু সমবেদনাই জানিয়েছিলেন আমাকে। আর তার নাম ভাড়িয়ে কেউ আমাকে ঠকিয়েছে বলে তিনি খুব অনুশোচনাও করছিলেন। তিনি আমাকে থানায় গিয়ে ডাইরী করবার উপদেশ দিয়ে তার কার্ড দিয়ে বলেছিলেন যে প্রয়োজন হলে যেন আমি তার সাথে দেখা করি। সেদিন সন্ধ্যের পর রবিশঙ্কর আর তার সাথের ওই লোকটার ব্যাপারে খবরাখবর করতেই আমি তার অফিসে গিয়েছিলাম। আর তখনই তিনি আমাকে আপনার ওখানে কাজের খবর দিয়েছিলেন”।

মহিমা রতীশের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনছিল। রতীশ থামতেই সে বলল, “তুমি কমপ্লেক্সের ভেতরটা দেখতে চাও নি কখনও”?

রতীশ জানাল, “হ্যাঁ বৌদি, তার মাস দুয়েক আগে সে লোকটা আমাকে কমপ্লেক্সের ভেতরে নিয়ে সব কিছু দেখিয়েছিল। আমিও দেখে শুনে খুশী হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে খুব বড়সড় না হলেও একটা নতুন সেন্টার খুলবার পক্ষে কমপ্লেক্সটা মোটামুটি মানানসই হবে। তাই তো দরদাম করে দু’লাখ টাকায় এক বছরের জন্য সেটা লিজ নিতে রাজী হয়েছিলাম। আর যেদিন আমি তাদের টাকাটা দিলাম, সেদিনও তাদের সাথে আমি কমপ্লেক্সের ভেতরে ঢুকে বসে কথাবার্তা বলেছিলাম। কিন্তু তার পরের দিনই জানতে পারলাম যে সে কমপ্লেক্সটা অন্য আরেক জনের। আরেক বিমল আগরওয়ালার”।

মহিমা অবাক হয়ে বলল, “এটা কি করে সম্ভব? কমপ্লেক্সটা যদি তার না হবে তাহলে ওই কমপ্লেক্সের চাবি তার কাছে গেল কি করে”?

রতীশ বলল, “সে প্রশ্নের জবাব নিতেই আমি সেদিন রাতে বিমলজীর অফিসে গিয়েছিলাম বৌদি। সে আমাকে আদর আপ্যায়ন করে কফি খাইয়ে আমাকে জানিয়েছিলেন যে ওই কমপ্লেক্সের তালার দুটো চাবি আছে। একটা চাবি তার অফিসের একটা লকারে রাখা থাকে। আর ওই লকারের চাবি শুধু তার কাছেই থাকে। তাই অন্য কেউ সে লকার খুলতেই পারে না। আর অন্য চাবিটা তার ব্যাঙ্কের লকারে। তাই অন্য কারুর হাতে এ চাবি যাবার কোন সম্ভাবনাই নেই। তাই কেউ যদি তার কমপ্লেক্স খুলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে থাকে, তাহলে সে কোন না কোনভাবে ওই তালার ডুপ্লিকেট চাবি বানিয়ে নিয়েছিল। আর এ’কথাও বলেছিলেন যে তিনি রবিশঙ্কর প্রসাদ নামে কাউকে চেনেন না। কিন্তু ব্যাপারটা আজও আমার মাথায় ঢুকছে না বৌদি”।
 

মহিমা বেশ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে স্বগতোক্তির মত করে বলল, “যে চাবি বিমল ছাড়া আর কারুর হাতে যাবার সম্ভাবনা নেই, সে তালার চাবি ওই ঠকবাজ গুলো পেল কি করে? আশ্চর্য তো”।

এবার রচনা বলল, “বৌদি, এ কথাটাই আমি সেদিন থেকে তোমার ভাইকে আর পুলিশকে বলে আসছি। কিন্তু পুলিশ সেভাবে এ কথাটার ওপর কোনও গুরুত্বও দেয় নি। কিন্তু আমার মনটা সেদিন থেকেই বলছিল যে ওই ঘটণার পেছনে বিমল আগরওয়ালার কোন না কোন হাত নিশ্চয়ই ছিল। তাই তো আমি ওকে বলেছি যে ওই লোকটার সাথে যেন আর যোগাযোগ না রাখে”।
 

মহিমাও মনে মনে ভেবে এতক্ষণে নিশ্চিত যে রচনার কথা মিথ্যে হতে পারে না। হঠাতই তার মনে হল আচ্ছা বিমল কি কোথাও রচনাকে চাক্ষুস দেখেছে? কথাটা মনে হতেই সে রচনার দিকে চেয়ে বলল, “আচ্ছা রচনা, তুমি কি বিমল আগরওয়ালাকে কখনও দেখেছ কোথাও”?
 

রচনা জবাব দিল, “না বৌদি, আমি তাকে কক্ষনো দেখিনি কোথাও। আমি শুধু তোমার ভাইয়ের মুখে তার নামটাই শুনেছি। তবে তার ভিজিটিং কার্ড একটা সে দিয়েছিল তোমার ভাইকে। তাতে তার ছবিও ছিল। সে ছবি আমি দেখেছি। কিন্তু তাকে চাক্ষুস কখনো দেখিনি আমি”।

মহিমা সাথে সাথেই আবার জিজ্ঞেস করল, “বিমল কি তোমাকে কোথাও দেখেছে বলে মনে হয়”?
 

রচনা এবার একটু ভেবে একবার রতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার তো তেমন মনে হয় না। মানে আমি তো আর ওই কমপ্লেক্সে বা বিমল আগরওয়ালার অফিসে কখনও যাই নি। তাছাড়া কলকাতা আসবার পর আমি খুব বেশী এদিক সেদিকেও ঘোরাফেরা করিনি। তবে বৌদি, দু’চার দিন যেখানে যেখানে গেছিও সেসব জায়গায় বিমল আগরওয়ালা ছিল কিনা, বা সে আমাকে দুর থেকে দেখেছে কি না, তা তো আর জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে সেভাবে দেখে থাকলেও আমার সাথে তার মুখোমুখি দেখা কখনোও হয়নি। কারন তেমন হলে তোমার ভাই আমাকে নিশ্চয়ই বলতেন যে ওই লোকটাই বিমল আগরওয়ালা”।
 

সাথে সাথে রতীশও রচনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “হ্যাঁ বৌদি, রচু যা বলছে তা ঠিকই। কারন ও তো একা কোনদিন রাস্তায় বেরোয় না। যে ক’দিন বেড়িয়েছে সে আমার সাথেই বেড়িয়েছে। সে কদিন বিমল আগরওয়ালাকে আমরা ধারে কাছে কোথাও দেখিনি। তবে একদিন ও আমার বোনের সাথে বেরিয়েছিল। সেদিন আমি সঙ্গে ছিলাম না। তবে সেদিনও বিমল তাকে দেখেছে বলে মনে হয় না। কারন ওরা আমাদের ফ্ল্যাটের সামনের মোড় থেকেই দিদির এক বন্ধুর গাড়িতে উঠেছিল। আর ফেরার পথেও ফ্ল্যাটের সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমেছে। তাই সেদিনও বিমলের সাথে ওর দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না”।
 

মহিমা রচনা আর রতীশের কথা শুনে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ব্যাপারটা কিছুতেই পরিস্কার হচ্ছে না। আচ্ছা সে’কথা থাক এখন। আচ্ছা ভাই, একদিন তো তুমি আমায় বলেছিলে যে তোমরা ছ’ ভাই বোন। এছাড়াও বাড়িতে মা বাবা, কাকা কাকিমারা আছেন। এদের মধ্যে কে তোমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে বলো তো? মা”?


______________________________
Like Reply
(Update No. 137)

রতীশ প্রায় সাথে সাথেই জবাব দিল, “মা তো সন্তানকে ভাল বাসবেনই বৌদি। কিন্তু আমার মনে হয় আমার বোন মানে আমার থেকে মাত্র ছ’মাসের ছোট আমার খুড়তুতো বোন, যে ক’দিন আগেই আমাদের এখানে এসেছিল, সে-ই আমাকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে”।

রচনাও সাথে সাথেই বলল, “হ্যাঁ বৌদি, দিদিভাইই তোমার ভাইকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসেন। আর আমাকেও তিনি একেবারে নিজের ছোট বোনের মত ভালবাসেন। সেই দিদিভাইই তো আমাদের বিয়েটা দিয়েছিলেন বলতে গেলে” বলে একটু হেসে বলল, “জানো বৌদি, প্রথমে ওদের বাড়ি থেকে যখন বিয়ের সম্মন্ধ গিয়েছিল তখন তো আমি না করে দিয়েছিলাম। তারপর ওই দিদিভাইয়ের কথাতেই আমি রাজি হয়েছিলাম”।

মহিমা একটু হেসে বলল, “ওমা, তাই নাকি? তা তোমার সে দিদিভাইয়ের কি বিয়ে হয়ে গেছে? সে কোথায় থাকে”?
 

এবার রচনা একটু সতর্ক হয়ে রতীশ কিছু জবাব দেবার আগেই বলেছিল, “না বৌদি, দিদিভাই এখনও অবিবাহিতা আছেন। আসলে উনি সার্ভিসে আছেন। সরকারি অফিসে চাকরী করেন। আর নর্থ বেঙ্গলের ডুয়ার্সে একটা ছোট জায়গায় আছেন। এই তো কিছুদিন আগেই উনি অফিসের একটা কাজেই কলকাতা এসেছিলেন। তখন আমাদের এখানে চারদিন ছিলেন” বলতে বলতে রতীশের দিকে চেয়ে মহিমার চোখের আড়ালে ঈশারা করে চুপ থাকতে বলল।

রতীশ রচনার ইঙ্গিত বুঝতে পারল। তার মনে পড়ল মন্তি যে পুলিশ অফিসার এ’কথা কাউকে বলতে বারণ করে গেছে। মহিমা রচনার কথা শুনে বলল, “হু, তাহলে তোমার সেই দিদিভাইই তোমাকে আর রতীশকে সবচেয়ে বেশী ভালবাসে। তা সে এসে এখানে চারদিন থেকে গেল, তোমরা কেউ তো আমাকে সে’কথা বলনি। আমিও একটিবার এসে তাকে দেখে যেতে পারতাম”।

রচনাও প্রায় সাথে সাথে জবাব দিল, “সে ইচ্ছে তো আমারও ছিল বৌদি। আমি সে’কথা দিদিভাইকে বলেও ছিলাম। আমি বলেছিলাম যে তুমি আমাদের খুব ভালবাসো। তোমার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেব। তোমার ওখানে একবার তাকে নিয়ে যাব বলেও ভেবেছিলাম। কিন্তু বাব্বা, সে আর সম্ভব হল কই। দিদিভাই তো রোজই সকাল আটটা সাড়ে আটটা নাগাদ বেরিয়ে যেতেন। কোথায় কোথায় ঘুরে অফিসের কাজকর্ম করে সন্ধ্যেবেলায় টায়ার্ড হয়ে ঘরে ফিরতেন। তাই আর সেটা হয়ে ওঠেনি গো”।

মহিমা এবার রতীশের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “ইশ, আমার খুব আফসোস হচ্ছে ভাই। আমাকে যদি তুমি একটু বলতে যে তোমার বোন এখানে এসেছে, তবে আমি নিজেই এসে তার সাথে দেখা করতাম। তা তোমার সে বোনের নাম কি ভাই”?

এবারেও রতীশের জবাব দেবার আগেই রচনা বলে উঠল, “দিদিভাইয়ের নাম মন্তি গো বৌদি। খুব ভাল মেয়ে। প্রায় তোমার সমান হাইট। যেমন দেখতে তেমনি গুনে। এরপর তিনি যদি আর কখনও আসেন, তবে তোমার সাথে তার নিশ্চয়ই দেখা করাব”।
 

মহিমা একটু হেসে বলল, “সেটা না করলে আমি তোমাকে তখন খুব বকবো, এ কিন্তু আগে থেকেই বলে রাখছি” বলে রতীশের দিকে চেয়ে বলল, “তা ভাই, তোমার সে বোনের কন্টাক্ট নাম্বারটা আমায় দেবে? আমার খুব ইচ্ছে করছে তার সাথে একটু কথা বলতে”।

রতীশ একবার রচনার দিকে তাকিয়ে খুব সতর্ক ভাবে বলল, “বৌদি, আপনি প্লীজ কিছু মনে করবেন না। মন্তির নাম্বার আপনাকে দিলেও কোন লাভ হবে না। আপনি তার সাথে কথা বলতে পারবেন না। আসলে মন্তি সরকারি অফিসের এমন একটা পদে কাজ করে যে চেনা অচেনা সকলেই তাকে যখন তখন ফোন করে নানারকম আর্জি করে তাকে বিরক্ত করে। তাই ও আননোন নাম্বারের কল রিসিভই করে না। আপনার নাম্বারও তো তার ফোনে সেভ করা নেই। তাই আপনি ফোন করলেও সে ধরবে না। তখন আপনি মনে দুঃখ পাবেন। তারচেয়ে ......”

রতীশের কথা শেষ হবার আগেই রচনা মহিমার পাশে বসে তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “সে নিয়ে তুমি ভেবনা বৌদি। দিদিভাইয়ের সাথে তোমার কথাও হবে আর তুমি তাকে দেখতেও পাবে। তবে তোমার ভাই, ঠিক কথাই বলেছেন। দিদিভাই নিজেও আমাদের বারণ করেছেন কাউকে তার নাম্বার দিতে। তবে আমি আজই দিদিভাইকে বলব যে তুমি তার সাথে কথা বলতে চাইছ। আর দিদিভাই তো জানেনই যে এ কলকাতায় তুমিই বর্তমানে আমাদের একমাত্র হিতৈষী। তোমার সাথে তিনি কথা বলবেন না এমন তো হতেই পারে না। তুমি তার সাথে কথা বলতে চাইছ শুনলে তিনি নিজেই তোমাকে ফোন করবেন দেখো। হয়ত আজ রাতেই তোমাকে ফোন করে বসবেন। আচ্ছা দাঁড়াও। আমি এখনই দিদিভাইকে ফোন করছি” বলে বেডরুমে নিজের ফোন আনতে চলে গেল।
 

রতীশ একটু হেসে মহিমাকে বলল, “রচনা ভুলেই গেছে যে মন্তি এখন ওর ফোনও ধরবে না। ও অফিসে এত ব্যস্ত থাকে যে আমাদের ফোনও ধরে না। ও ফোনটাকে সাইলেন্ট করে রেখে দেয়। তাই ওর কথা মতই আমরা ওর লাঞ্চ টাইমে ফোন করি আর বিকেল সাড়ে পাঁচটার পর। অবশ্য পাঁচটা তো বাজতেই চলল। আপনি আর কিছুক্ষণ বসলে আমাদের ফোনেই হয়ত তার সাথে কথা বলতে পারবেন”।
 

মহিমাও তার হাতের ঘড়ির দিকে দেখে বলল, “আরে সত্যিই তো পাঁচটা তো হতেই চলল। রতীশ, আজ আর আমি বসতে পারব না ভাই। আসলে রোজ বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা অব্দি আমি যোগাচর্চা করি। তাই আমাকে এখন উঠতেই হবে ভাই। তুমি তোমার বোনকে বোলো সে যেন একবার আমায় ফোন করে। তবে যোগাচর্চার ওই সময়টা তো আমিও সব ফোন বন্ধ করে রাখি। তাই তাকে বলে দিও যে সন্ধ্যে সাতটার পর যেন সে আমাকে ফোন করে”।
 

রতীশ বলল, “ঠিক আছে বৌদি, আমি মন্তিকে সেভাবেই .....” তার কথার মাঝেই রচনা ফোন হাতে নিয়ে লিভিং রুমে এসে বলল, “নাগো বৌদি, দিদিভাই ফোন ধরছেন না। আসলে তার ফোনটা এ সময় সাইলেন্ট থাকে বলেই বুঝি বুঝতে পারছেন না”।

মহিমা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মহিমার হাত ধরে বলল, “ঠিক আছে রচনা। এখন নয় নাই বা কথা হল। তোমরা তাকে পরেই নাহয় জানিয়ে দিও। আর এখন আমাকেও বেরোতে হবে। তাই তোমরা তাকে বলে দিও সে যেন সন্ধ্যে সাতটার পর আমাকে ফোন করে। আসলে তার সাথে কথা বলতে আমার খুবই ইচ্ছে করছে”।

রচনাও মহিমার একটা হাত ধরে বলল, “সে তো বলবই। কিন্তু তুমি কি এখনই চলে যাবে বৌদি”?

মহিমা মিষ্টি করে হেসে বলল, “হ্যাঁগো, সোনা বোন আমার। আমাকে এখন যেতেই হবে। নইলে বাড়ি পৌঁছতে দেরী হয়ে যাবে”।

রচনা তবু বলল, “আরেকটু বসো না বৌদি। আমাদের সাথে এক কাপ কফি খেয়ে যাও, প্লীজ”।
 

মহিমা এবার রচনাকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “নারে বোন। আজ আর বসা সম্ভব হবে না। সাড়ে পাঁচটা থেকে সন্ধ্যে সাতটা অব্দি আমি নিজে যোগা চর্চা করি। বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে আজ তো দেরীই হয়ে যাবে। তাই আজ যাচ্ছি আমি। আরেকদিন তোমাদের এখানে এসে আরও অনেক গল্প করব, কেমন”?
 

রচনা রতীশের দিকে একনজর তাকিয়ে বলে উঠল, “কিন্তু ......”

মহিমা রচনার কাছ থেকে সরে গিয়ে রতীশের কাছে গিয়ে তার হাত ধরে বলল, “আর কিছু বোলো না রচনা। রতীশ আমি যাচ্ছি ভাই”।

রচনা উপুড় হয়ে মহিমার পায়ের দিকে ঝুঁকে বলল, “আবার বলছ যাচ্ছি? সেদিন বলেছি না যাচ্ছি বলবে না”।

মহিমা রতীশের হাত ছেড়ে দিয়ে রচনাকে ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, “হয়েছে, আর প্রণাম করতে হবে না। আচ্ছা, এবার আসছি তাহলে? হল তো”?
 

রচনাও এবার মিষ্টি হেসে বলল, “ঠিক আছে, এস বৌদি। আরেকদিন কিন্তু আগে থেকে জানিয়ে দুপুরের আগে এসে আমাদের সাথে খাবে। আর সেদিন খুব খুব গল্প করব আমরা”।
 

মহিমাও আদর করে রচনার গালটা একটু টিপে দিয়ে হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আচ্ছা রতীশ, আমি আসি ভাই” বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। রতীশ আর রচনা তার সাথে বেরিয়ে তাকে লিফট অব্দি পৌঁছে দিল।
 

****************

সীমন্তিনী বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে তার গাড়ির ড্রাইভার রাম সিংকে বাজারের দিকে যেতে বলল। গাড়ি বাজার অভিমুখে চলতেই তার পকেটের মোবাইল বেজে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে রচনার নাম দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। কল রিসিভ করে বলল, “রচু সোনা, আমি তো তোকে এখনই ফোন করতে যাচ্ছিলুম রে। বল সোনা কেমন আছিস”?

রচনা বলল, “ভাল আছি দিদিভাই। তুমি কি বাড়ি যাচ্ছ এখন? গাড়ির ইঞ্জনের শব্দ পাচ্ছি মনে হচ্ছে”।

সীমন্তিনী বলল, “নারে ঠিক বাড়ি যাচ্ছি না। তোকে সেদিন বলেছিলুম না যে নীতার জন্যে একটা কাজের ব্যবস্থা করবার চেষ্টা করছি। সে ব্যাপারেই একটু মার্কেটে যাচ্ছি রে। একটু আগেই তো আমি অফিস থেকে বেরোলাম”।

রচনা বলল, “ও তা বেশ। নীতাদি একটা কাজ পেয়ে গেলে বেশ ভাল হবে। তবে দিদিভাই তুমি কি বাজারে পৌঁছে গেছ নাকি? না মানে একটা কথা বলতুম তোমাকে। এখন সময় হবে”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যাঁ বল না। বাজারে পৌঁছতে আরও মিনিট পনের লাগবে আমাদের”।

রচনা বলল, “জানো দিদিভাই, আজ বৌদি আবার আমাদের বাড়ি এসেছিলেন”।

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কোন বৌদি রে? ওই দাদাভাই যার ওখানে কাজ করে, সেই মহিমা মালহোত্রা না কি, সে”?

রচনা বলল, “হ্যাঁগো দিদিভাই, তিনিই। তার সাথে কথায় কথায় তোমার কথা উঠতেই তোমার ভাই বলে ফেলেছেন যে তুমি কদিন আগেই কলকাতা এসেছিলে। আমাদের ফ্ল্যাটেই চারদিন ছিলে। সে’কথা শুনে ভদ্রমহিলা আমাদের ওপর খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। তোমাকে তার কাছে নিয়ে যাইনি কেন, তার সাথে তোমার আলাপ করালাম না কেন, এসব নিয়ে খুব দুঃখ করছিলেন। আর তোমার সাথে কথা বলবেন বলে তিনি তোমার ফোন নাম্বারও চেয়েছিলেন আমাদের কাছে। কিন্তু তোমার কথা মতই আমরা তাকে তোমার কন্টাক্ট নাম্বার দিই নি। এটা সেটা বলে বুঝিয়ে দিয়েছি যে কোনও আননোন নাম্বার থেকে কল গেলেও তুমি সে কল রিসিভ কর না। কিন্তু তার আগ্রহ দেখে আমরা শেষ পর্যন্ত তাকে বলেছি যে আমরা তোমাকে তার কথা বললে তুমি নিজেই তাকে ফোন করবে। ও দিদিভাই, আমরা কি ভুল কিছু করেছি? তুমি কি রাগ করলে”?

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তোরা কি তাকে বলে দিয়েছিস যে আমি পুলিশে কাজ করি”?

রচনা তাড়াতাড়ি বলল, “না না দিদিভাই, আমরা তাকে এ’কথা বলিনি। আমরা শুধু তাকে বলেছি যে তুমি এখনও বিয়ে থা করনি। আর সরকারি অফিসের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা পদে তুমি কাজ কর। আর তোমার পুরো নামটাও তাকে আমরা বলিনি। শুধু মন্তি বলা হয়েছে”।
 

সীমন্তিনী একটু ভেবে বলল, “সে কি আমার বিয়ের ব্যাপারে কোন ছেলের সম্মন্ধ আনতে চাইছে নাকি”?

রচনা এবার হেসে বলল, “তা তো তিনি আমাদের বলেন নি দিদিভাই। তবে তেমন আশা থাকলেও যে সে আশায় গুড়ে বালি, তা তো আমি জানিই। তবে উনি বলছিলেন যে তোমার সাথে কথা বলতে তার ভীষন ইচ্ছে করছে”।

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “আমি যে তাকে ফোন করব এ ব্যাপারে তোরা তাকে ঠিক কী বলেছিস বল তো”?
 

রচনা বলল, “তেমন বিশেষ কিছু বলিনি দিদিভাই। বলেছি যে কলকাতায় তিনিই যে আমাদের সবথেকে কাছের সবচেয়ে প্রিয়জন সে’কথা তুমিও জানো। আর আমাদের যারা ভালবাসেন তাদের তুমিও ভালবাস। তুমি তোমার দাদাভাইকে সবচেয়ে বেশী ভালবাস শুনেই তিনি তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলেন। তোমার ফোন নাম্বার চেয়েছিলেন। কিন্তু তোমার আগের কথাগুলো আমাদের মনে ছিল বলেই তাকে আমরা তোমার পুরো নামটা বলিনি। তুমি যে পুলিশে কাজ কর এ কথাও বলিনি। আননোন নাম্বারের ফোনকল তুমি রিসিভ করবে না বলেই তাকে তোমার ফোন নাম্বার দিলেও কাজের কাজ কিছু হবে না, এভাবে বুঝিয়েই আমরা তোমার ফোন নাম্বারও দিই নি। তবে আমি তাকে বলেছি যে আমি তোমাকে অনুরোধ করব তার সাথে কথা বলতে। আর আমার অনুরোধে তুমি নিশ্চয়ই তাকে ফোন করবে। শুধু এ কথাগুলোই বলেছি”।

সীমন্তিনী এবার বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, তার কন্টাক্ট নাম্বারটা আমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দে। আমি বাড়ি গিয়ে তাকে ফোন করব’খন। আর শোন তাদের বাড়ির ল্যান্ডলাইন নাম্বারটাও পাঠাস”।

রচনা খুশী হয়ে বলল, “হ্যাঁ তা পাঠাচ্ছি। কিন্তু দিদিভাই, বৌদির মোবাইল আর ল্যান্ডলাইন সব ফোনই সন্ধ্যে সাতটা পর্যন্ত বন্ধ থাকে। সাড়ে পাঁচটা থেকে সাতটা পর্যন্ত উনি যোগাভ্যাস করেন। তাই তুমি সাতটার পর তাকে ফোন কোরো”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। আমি সাতটার পরেই তাকে ফোন করব। তা তোরা দুটিতে কেমন আছিস বল তো? দাদাভাই ভাল আছে তো”?
 

রচনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, আমরা দুজনেই ভাল আছি। আচ্ছা দিদিভাই, দিদি কেমন আছে গো? নীতাদি আর লক্ষ্মীদি তার সাথে ভাল ব্যবহার করছে তো”?

সীমন্তিনী বেশ খুশী খুশী গলায় বলল, “ওই দু’ পাগলীর কথা আর বলিস নে রচু। অর্চুকে ওরা মাথায় করে রাখবে না বুকে করে রাখবে, এ যেন তারা বুঝতেই পারছে না। সব সময় অর্চনার সাথে নানারকম গল্প করতে থাকে। লক্ষ্মীদি তো অর্চুকে কি খাওয়াবে না খাওয়াবে তা নিয়েই দিশেহারা হয়ে গেছে প্রায়। আর জানিস? লক্ষ্মীদি কি নামে ডাকে অর্চুকে? সোনাদি। একটা মূহুর্তও অর্চুকে ওরা একা থাকতে দেয় না। আর অর্চুকে দেখেও খুব ভাল লাগছে রে রচু। আমার এখানে যদি একটা মাস ওকে রাখতে পারি তাহলে মনে হয় ওকে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে তুলতে পারব। আর লক্ষ্মীদি নীতাও আমাকে এ ব্যাপারে খুব ভাল সাপোর্ট দিচ্ছে। কিন্তু একটা কথাই ভাবছি। নীতাকে খুব সম্ভবতঃ সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই ওখানে কাজে যোগ দিতে হবে। এখন যেমন নীতা সারাক্ষণ রচুর সাথে থাকতে পারছে, তখন তো আর তেমনটা পারবে না। আর ও হয়ত রাত আটটা নটার আগে কাজ থেকে ছুটিও পাবে না”।

রচনা বলল, “সে নিয়ে আমার মনে কোন চিন্তা নেই। তুমি নিজেই সব সামলে নেবে এ বিশ্বাস আমার আছে। আমার দিদিভাই কি আমার দিদির অবহেলা হতে দেবেন”?
 

সীমন্তিনী সামনের রাস্তার দিকে দেখতে দেখতে বলল, “হয়েছে, দিদিভাইকে আর গ্যাস দিয়ে ফোলাতে হবে না তোমাকে। এই শোন, আমি আমার গন্তব্যে এসে পৌঁছে গেছি রে। ছাড়ছি এখন। পরে রাতে কথা হবে আবার” বলে ড্রাইভারকে বলল, “রামসিং, বসাক গারমেন্টসের সামনে গাড়ি সাইড করে রেখো”।

**********************
______________________________
Like Reply
(Update No. 138)

জয়া বসাক সীমন্তিনীকে সাদর আমন্ত্রণ করে তাকে নিয়ে নিজের কেবিনে বসিয়ে নবনীতার ব্যাপারে আলোচনা করলেন। সীমন্তিনীর অনুরোধে তিনি নবনীতাকে তার শোরুমের সেলস গার্ল হিসেবে কাজে নিতে রাজি হলেন। আর সীমন্তিনীর কথাতেই রোজ দুপুরের আগে দু’ঘন্টা নীতাকে তাদের কারখানায় গিয়ে কাজকর্ম দেখতে দেবার ব্যাপারেও সম্মত হলেন। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল প্রথম দিন সীমন্তিনী নবনীতাকে বসাক গারমেন্টসে নিয়ে গিয়ে জয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে। নবনীতা সামনের মাসের এক তারিখ থেকেই বসাক গারমেন্টসে কাজে যোগ দেবে। আর নবনীতাকে দুপুর দুটো থেকে রাত আটটা অব্দি শোরুমে থাকতে হবে। সেখানে সেলস গার্ল হিসেবেই তাকে মাসে মাসে আট হাজার করে বেতন দেওয়া হবে। আর সে রোজ দুপুর বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত কারখানায় যেতে পারলেও ওই সময়ের জন্য তাকে কোনও পারিশ্রমিক দেওয়া হবে না। আর জয়া বসাকের আরেকটা শর্তও নবনীতাকে মেনে নিতে হবে। জয়ার কারখানায় ডিজাইনিং টেলারিং-এর কাজকর্ম শিখে নেবার পর নবনীতা যদি নিজস্ব কোনও কারখানা বা দোকান খুলতে চায় সেটা সে ওই শহরে করতে পারবে না। সেটা তাকে অন্যত্র করতে হবে।
 

সীমন্তিনী বেশ খুশী মনেই বসাক গারমেন্টসের শোরুম থেকে বেরিয়ে এল। যাক নবনীতার কিছু একটা ব্যবস্থা তো আপাততঃ করা গেল। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। বাজার থেকে টাটকা কিছু ফল কিনে গাড়িতে উঠে বসতেই রাম সিং কোয়ার্টারের পথে গাড়ি হাকিয়ে দিল। ফিরতে ফিরতে মহিমার কথা মনে পড়ল সীমন্তিনীর। মহিলা তার সাথে কথা বলতে এত আগ্রহী হয়ে ওঠবার কারন কি? দাদাভাই তার ওখানে কাজ করছে বলে কি তিনি কোন সমস্যায় পড়েছেন? দাদাভাইয়ের কাজে কি তিনি সন্তুষ্ট নন? না অন্য কিছু? অনেক ভেবেও কোন পরিষ্কার ধারণা করে উঠতে পারল না সীমন্তিনী। মনে মনে ভাবল আজ রাতে ভদ্রমহিলাকে ফোন করেই ব্যাপারটা জানতে হবে। আর পরিতোষকেও একটা ফোন করতে হবে।
 

*******************

পরিতোষের কথা মনে হবার সাথে সাথে সীমন্তিনী পকেট থেকে ফোন বের করে পরিতোষকে কল করল। নীতার কাজের ব্যাপারে জয়া বসাকের সাথে যেসব কথা হল তা ডিটেইলসে জানিয়ে দিল। পরিতোষও সায় দিল যে এ কাজটাই নবনীতার পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত হবে। পরিতোষের সাথে কথা বলা শেষ হতেই গাড়ি কোয়ার্টারের কম্পাউন্ডের মেইন গেটের কাছে এসে পৌঁছল।
 

সীমন্তিনী ঘরের কলিং বেল বাজাতেই অর্চনা আর নবনীতা দু’জনে ছুটে এসে দরজা খুলে দিতেই সীমন্তিনী দু’হাতে তাদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কেমন আছে আমার বোন দুটো শুনি? সারাদিন কপোত কপোতীর মত গুটুর গুটুর করেছ বোধহয় তাইনা”?

অর্চনা সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরেই ঘরের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “হ্যাঁ গো দিদিভাই, আজ প্রায় সারাটা দিনই আমরা দু’জন গল্প করে কাটিয়েছি। কিন্তু তোমার আজকের দিনটা কেমন কেটেছে বল”?

নবনীতা সীমন্তিনীর হাত থেকে ফলের ব্যাগটা নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই লক্ষ্মীদি ব্যাগটা তার হাত থেকে নিয়ে বলল, “দাও ছোড়দি, এটা আমাকে দাও। তুমি বরং দিদিমণির কাছেই বসো গিয়ে”।

সীমন্তিনী অর্চনাকে বলল, “আজ আমার দিনটাও মোটামুটি ভালই কেটেছে গো। ফেরবার পথে বাজারে গিয়ে নীতার কাজের ব্যাপারটাও পাকাপাকি করে এলুম। আর তোমার জন্যে একটু ফলও নিয়ে এলাম। তা হ্যাগো অর্চুসোনা, আমি যেসব ফলটল এনে দিচ্ছি সেগুলো খাচ্ছ তো তুমি”?

অর্চনা বলল, “খাচ্ছি তো দিদিভাই। আমি কি তোমার কথার অন্যথা করতে পারি বলে ভাবো তুমি”?

নবনীতা কাছে এসে বলল, “এমনিতে কি আর খায় দিদি? সে একা কিছুতেই ওসব খাবে না। আমাকে আর লক্ষ্মীদিকেও তার সাথে বসে খেতে হয়। নইলে সে তো .....”

অর্চনা অনুযোগের সুরে নবনীতাকে বলল, “কেন বানিয়ে বানিয়ে বলছ নীতাদি? আমি কি খাই নে”?

লক্ষ্মী কিচেন থেকে ডাইনিং রুমে যেতে যেতে অর্চনার কথার জবাবে বলল, “হ্যাঁ খাও তো বটেই। কিন্তু দিদিমণিকে এটাও বল যে আমাদের দু’জনের হাতে না দিয়ে তুমি নিজের মুখে কিচ্ছুটি তোল না” বলে ডাইনিং রুমে কিছু একটা রেখেই সীমন্তিনীর কাছে এসে বলল, “জানো দিদিমণি, তোমার অর্চু সোনার স্বভাবও একেবারে তোমার রচু সোনার মতই। বৌদিমণি শুধু একটা দিনের জন্যে এখানে এসে আমাকে কতবার জোর করে এটা ওটা খাইয়েছেন। সোনাদিও এখানে আসবার পর থেকেই ঠিক তেমন করে যাচ্ছে। আর বলে কি জানো? আমরা না খেলে সে নাকি একটা টুকরোও মুখে দেবে না”।
 

সীমন্তিনী নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাদের সব কথা আমি একটু বাদে শুনছি। আগে আমাকে ফ্রেশ হয়ে নিতে দাও। তারপর সবাই মিলে ডাইনিং রুমে বসে জল খাবার খেতে খেতে সবাই মিলে গল্প করব। নীতার সুখবরটাও বলব”।

অর্চনা নবনীতার একটা হাত জড়িয়ে ধরে খুশীতে ঝলমল করে উঠে বলল, “তাই নাকি দিদিভাই? কি সুখবর গো বলো না”।

সীমন্তিনী আদর করে অর্চনার গালে হাত বুলিয়ে বলল, “বললুম না, যে ওর কাজের ব্যাপারটা পাকা করে এলুম। সেটাই খুলে বলব। কিন্তু আমাকে একটু ফ্রেশ হয়ে আসতে দাও। এই ইউনিফর্ম পড়েই সারাটা দিন থাকতে হয়। ঘরে এসে ফ্রেশ না হলে ভাল লাগে বলো”?

বাথরুমে স্নান করতে করতে সীমন্তিনী ভাবল অর্চনা আর নবনীতার মাঝে বেশ ভাব হয়ে গেছে মনে হয়। এমনটাই সে মনে মনে চেয়েছিল। ওরা যেন দু’জনে দুই বান্ধবী হয়ে উঠতে পারে। তাহলে অর্চনাকে মানসিক দিক দিয়ে পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা যাবে। প্রায় আধঘণ্টা বাদে ডাইনিং রুমে বসে জলখাবার খেতে খেতে সীমন্তিনী প্রথমে নবনীতার কাজের ব্যাপারে সবাইকে খুলে বলল। সবাই খুশী হলেও নবনীতার মুখটা একটু ভার হয়ে গেল। সেটা দেখেই সীমন্তিনী তাকে সান্ত্বনা দিতে বলল, “তোমার মুখ ভার হল কেন নীতা? আট হাজার টাকা বেতন দেবে শুনে মনটা ছোট হয়ে গেল নাকি? আরে তুমি ওটা নিয়ে একদম ভেব না। তোমাকে তো এখানে আর কোনও খরচ করতে হচ্ছে না। তুমি তো আমার সাথেই থাকছ। তাই মাসে মাসে যে টাকাটা পাবে সেটা তুমি পুরোটাই ভবিষ্যতের কাজের জন্য জমা করে রাখবে। এ মাসেই তোমার নামে ব্যাঙ্কে একটা একাউন্ট খুলে দেব। আর তোমার বেতনের পুরো টাকাটাই প্রতি মাসে সেখানে জমা করে দেবে। তবে আমি নিজেও চাই না যে ওই সেলস গার্লের চাকরি তুমি বেশীদিন করো। আমি চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তুমি ডিজাইনিং আর টেলারিং-এর কাজগুলো শিখে ফ্যালো। তারপর তুমি স্বাধীনভাবে নিজেই একটা ছোটখাট কাজ শুরু করে দিতে পারবে”।

নবনীতা চিন্তিত ভাবেই বলল, “নাগো দিদি আমি মাইনে নিয়ে কিছু ভাবছি না। আমি নিজে কোনও কাজ শুরু করতে গেলে তো এখানে কিছু করতে পারব না। তার মানে তোমাকে ছেড়ে আমাকে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে”?

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “এখনই সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে নীতা। আর তুমি কি ভাবছ যে আমি চিরদিন এখানেই থাকব? আমাদের ট্রান্সফারেবল সার্ভিস। যে কোনদিন অন্য যে কোনখানে আমার ট্র্যান্সফার হয়ে যেতে পারে। তখন কি আমি তোমাকে এখানে একা ফেলে যাবো বলে ভাবছো? আমি তখন তোমাকেও আমার সাথে নিয়ে যাব। আমি যেখানে থাকব, তুমিও সেখানেই থাকবে। আর নিজে কাজগুলো শিখে ফেলতে পারলে তুমি যে কোনও জায়গায় গিয়ে নিজের মত করে কাজ করতে পারবে। আর আমি তো তোমার সাথেই থাকব। ভাবছ কেন”?

এবার নবনীতার মুখের কালো মেঘ যেন কেটে গেল। সে স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করতে করতে বলল, “ওঃ আমি তো এদিকটা ভেবেই দেখিনি। সত্যি তো, তোমাকে বা আমাকে তো চিরটা কাল এখানে থাকতে হবে না। কিন্তু দিদি, আমাকে কিন্তু কোন অবস্থাতেই তোমার কাছ থেকে দুরে পাঠিয়ে দিও না। এখান থেকে তোমার অন্যত্র ট্র্যান্সফার হলে আমি যদি সেখানে গিয়ে কিছু করতে না-ও পারি, আমি তোমার ছোট বোনটি হয়েই ঘর সংসার সামলাবার কাজ করব”।

নবনীতাকে মৃদু ধমক দিয়ে সীমন্তিনী বলল, “দুর পাগলী। এভাবে ভাবছ কেন? আমি পরিতোষকে কথা দিয়ে এসেছি না, তোমার সমস্ত দায়িত্ব আমার। তা আমার দায়িত্ব নিয়ে আমাকেই ভাবতে দাও না। তুমি শুধু সামনে আসা পরিস্থিতির কথা ভাবো। জয়াদি যে যে শর্তের কথা বলেছেন, সেসব মেনে তুমি কাজটা করতে রাজি আছ তো”?

নবনীতা বলল, “সে তো রাজি আছিই দিদি। কিন্তু অর্চনাকে তো ঘরে একা ছেড়ে যেতে হবে”।

সীমন্তিনী আবার হেসে বলল, “ওমা একা কোথায়? লক্ষ্মীদি আছে না? আর তোমাকে তো সকাল থেকে সারাটা দিন সেখানে থাকতে হচ্ছে না। হ্যাঁ রাত আটটার আগে ওখান থেকে ছুটি পাচ্ছ না সেকথা ঠিকই। কিন্তু তোমাকে তো ঘর থেকে সাড়ে এগারটায় বেরোলেই চলবে। বারোটা থেকে দুটো পর্যন্ত কারখানায় থাকবে, তারপর দুটো থেকে রাত আটটা অব্দি শোরুমে থাকবে। আর তোমার যাতায়াতের ব্যাপার নিয়েও চিন্তার কিছু নেই। একটা ভাল রিক্সাওয়ালাকে ঠিক করে দেব। সে তোমায় সাড়ে এগারোটায় এখান থেকে নিয়েও যাবে আর রাত আটটায় তোমাকে বাড়িতে এনে ফিরিয়েও দিয়ে যাবে। তাই অর্চুকে সাড়ে এগারোটা থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত, এই একটা বেলাই শুধু লক্ষ্মীদির সাথে থাকতে হবে। আমার বাইরে কোথাও ডিউটিতে যেতে না হলে আমি তো সাড়ে পাঁচটা ছ’টার মধ্যেই বাড়ি ফিরে আসব। কী অর্চু, তোমার কি খুব অসুবিধে হবে”?

অর্চনা বলল, “না দিদিভাই, লক্ষ্মীদির সাথে থাকতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না। তাছাড়া আমার জন্য তোমাদের কাউকে যদি কাজের ক্ষতি করতে হয় তাহলে আমারও সেটা ভাল লাগবে না। তুমি কিচ্ছু ভেব না নীতাদি। এমন একটা কাজ যখন পেয়েছ সেটা না করা মোটেও ঠিক হবে না”।

নবনীতা অর্চনার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে চেপে ধরে শুধু মাথা নাড়ল। সীমন্তিনী এবার বলল, “আচ্ছা অর্চু সোনা, আজ তোমার কার কার সাথে কথা হয়েছে শুনি। বাড়ি থেকে কেউ ফোন করেনি”?

অর্চনা বলল, “হ্যাঁ দিদিভাই, ভাই বিকেলে ফোন করেছিল। তখন মা বাবার সাথেও কথা হয়েছে। রচুও ফোন করেছিল এগারোটা নাগাদ। আমার সাথে আর নীতাদির সাথে কথা বলেছে”।

সীমন্তিনী তাকে জিজ্ঞেস করল, “দু’দিন ধরে মা বাবা ভাইকে দেখতে পাচ্ছ না বলে কি মন খারাপ করছে তোমার? আমার এখানে ভাল লাগছে তো”?
 

অর্চনা একটু ভাবুক হয়ে জবাব দিল, “যেদিন থেকে তুমি আমার জীবনে এসেছ, সেদিন থেকেই তো আমার জীবনটা পাল্টে গেছে দিদিভাই। সেদিন থেকেই তো আমার জীবনে নতুন সূর্য্যের আলো পাচ্ছি আমি। আমার জীবনের সব আঁধার তো সেদিন থেকেই কেটে গেছে। দু’দিন ধরে মা বাবা ভাইকে দেখতে না পেলেও তাদের সাথে রোজ কথা তো বলতে পারছি। আগের সাতটা বছর যে আমার কপালে সেটুকুও জোটেনি দিদিভাই। আর তোমার কাছে এসে তো আমার মনে হচ্ছে আমি সত্যিই বোধহয় স্বর্গে আছি। সারাটা দিন তুমি বাইরে থাকলেও নীতাদি লক্ষ্মীদির সাথে থাকতে আমার খুবই ভাল লাগে। আর দিনের শেষে যখন তোমাকে দেখি তখন মনে হয় আর কিছুই যেন আমার চাওয়ার নেই। আমার দিদিভাইকে আমি পেয়ে গেছি”।

সীমন্তিনী একটু ঝুঁকে অর্চনার মাথাটাকে নিজের কাঁধের সাথে চেপে ধরে বলল, “ও’সব পুরনো কথাগুলো ভুলে যাবার চেষ্টা করো না বোন। মনে করো ওগুলো দুঃস্বপ্ন ছিল। ভগবানের আশীর্বাদে সে দুঃস্বপ্ন তুমি কাটিয়ে উঠেছো। এখন অতীতের ওই সাতটা বছরের কথা একদম ভুলে যাও। আর এখন শুধু তোমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবো। আমি চাই আমার আশেপাশের মানুষগুলোর ভবিষ্যৎ জীবন খুব সুন্দর হয়ে উঠুক সবদিক দিয়ে। আর আমার বর্তমান তো এখন শুধু তোমরা। আমার দাদাভাই, রচু, তুমি, ভাই, মাসি মেসো, নীতা, লক্ষ্মী, পরিতোষ। আমিও তো আমার জীবনের আগের সবাইকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছি তোমাদের সবাইকে আঁকড়ে ধরে। পুরনোদের মধ্যে তো একমাত্র দাদাভাইই শুধু আমার জীবনে রয়ে গেছে। জ্ঞান বোধ হবার আগে থেকেই দাদাভাই আর আমি দু’বন্ধুর মত বড় হয়েছি। তাই আমার অতীতের অন্য সকলের মত দাদাভাইকে আমি ভুলে যেতে পারিনি। আর সত্যি কথা বলতে ভুলতে চাইও না। ওই দাদাভাই আমার জীবনে ছিল বলেই না আমি রচুকে, তোমাকে, ভাইকে, মেসো মাসিকে কাছে পেয়েছি। তাই দাদাভাইয়ের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। যতদিন পর্যন্ত আমার হৃদয়ে স্পন্দন থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমি শুধু তোমাদের সকলের কাছের লোক হয়ে থাকতে চাই। আর আরেকটা কথা ......” বলেই সে থেমে গেল।
 

তারপর আবার বলল, “নাহ, এসব ফালতু কথা নিয়ে সময় নষ্ট করে কোনও লাভ নেই। বিকেলে রচু ফোন করে আমাকে একজনকে ফোন করবার কথা বলছিল সাতটার পর। সাতটা তো প্রায় হতেই চলল। চলো, তোমরা সবাই আমার ঘরে চল”।

***************

সীমন্তিনীর ঘরের দিকে যেতে যেতে অর্চনা জিজ্ঞেস করল, “রচু কাকে ফোন করতে বলেছে গো দিদিভাই”?

সীমন্তিনীও ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই জবাব দিল, “ওই দাদাভাই যে ইনস্টিটিউটে কাজ করে তার মালিক। সে নাকি আজ রচুদের ফ্ল্যাটে এসেছিল। রচু আর দাদাভাইয়ের মুখে শুনেছে যে ক’দিন আগে আমি কলকাতা গিয়ে চারদিন ছিলাম। কিন্তু তার সাথে আমার দেখা হয়নি বলে সে নাকি রচু আর দাদাভাইয়ের ওপর খুব অভিমান করেছে। তাই রচু আমাকে বলেছে আজ রাত সাতটার পর আমি যেন তাকে ফোন করি”।

সীমন্তিনীর ঘরে তিনজন বিছানার ওপর বসতে প্রথম কথা বলল নবনীতা, “আচ্ছা দিদি, রতীশ-দা কলকাতার কোন যোগা ইনস্টিটিউটে কাজ করেন গো”?

সীমন্তিনী তার একটা মোবাইল হাতে নিয়ে সেটা অন করে দেখল রচনার মেসেজটা আনরেড দেখাচ্ছে। মেসেজ খুলতে খুলতে সে জবাব দিল, “দক্ষিণ কলকাতার একটা জায়গায়। ইনস্টিটিউটটার নাম যতদুর মনে পড়ছে, মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট। এক পাঞ্জাবী মহিলা তার মালিক”।

সীমন্তিনীর মুখে এ কথা শুনেই নবনীতা প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “কি বলছো তুমি দিদি? মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট? গড়িয়া থেকে বারুইপুরের রাস্তায় যেতে পড়ে তো? সেটা তো মহিমা মালহোত্রা সেনের ইনস্টিটিউট”!
 

সীমন্তিনী রচনার মেসেজ খুলে মহিমার কন্টাক্ট নাম্বার দুটো দেখতে দেখতে নবনীতার গলার স্বরে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ, মহিমা মালহোত্রা সেন। তা তুমি তাকে চেনো নাকি”?
 

নবনীতা কি বলবে না বলবে বুঝতে না পেরে হতভম্বের মত একবার সীমন্তিনী আরেকবার অর্চনার মুখের দিকে চাইতে লাগল। অর্চনাও এবার জিজ্ঞেস করল, “তুমি ওই মহিলাকে সত্যি চেনো নীতাদি”?
 

সীমন্তিনী কোন কথা না বলে হাতে মোবাইলটা ধরে রেখেই তীক্ষ্ণ চোখে নবনীতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নবনীতার মুখে দুশ্চিন্তা আর ভয়ের মিশ্রিত একটা ছায়া যেন তার চোখে পড়ল। সে বুঝতে পারল নবনীতা নিশ্চয়ই ওই মালহোত্রা সেন যোগা ইনস্টিটিউট আর মহিমার সাথে পরিচিত। নইলে সে ওই যোগা ইনস্টিটিউটের নাম শুনেই ওভাবে চমকে উঠতো না। সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার পাঠানো ফোন নাম্বার দুটোর দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবলো, না ফোনটা এখনই না করে আগে নবনীতার চমকে ওঠার কারনটা জেনে নেওয়া বেশী প্রয়োজন।

অর্চনা আবার নবনীতাকে বলল, “ও নীতাদি, বলোনা তুমি কি রতু-দার মালিককে চেনো নাকি”?
 

নবনীতা অর্চনার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল, “দাঁড়াও অর্চনা। আমাকে একটু ভাবতে দাও”। নবনীতা নিজের গলার স্বর স্বাভাবিক রাখবার চেষ্টা করলেও সীমন্তিনী বুঝল, নবনীতা ভেতর ভেতরে যথেষ্ট উত্তেজিত এবং উৎকণ্ঠিত। তবু সে ওই মূহুর্তেই সরাসরি নবনীতাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে মনে মনে ভাবল পরিতোষের সাথে নীতার যখন পুনরায় দেখা হয় তখন নীতা ওর এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে থাকত। অন্য কোনও কাজ যোগার করতে না পেরে ওর বান্ধবীর মাধ্যমেই এক ম্যাডামের এসকর্ট ব্যবসায় নিজের নাম লিখিয়েছিল। ও বলেছিল ওর ওই ম্যাডামের একটা যোগা সেন্টারও ছিল। সে ম্যাডাম কি তবে এই মহিমাই? কিন্তু রচু আর রতীশ তো মহিমার প্রসংশায় প্রায় পঞ্চমুখ। মহিমা নাকি রতীশকে নিজের ভাইয়ের মত স্নেহ করে, রচুকেও নাকি খুব ভালবাসে। আর রতীশ তো তাকে বলেছে যে সে ইনস্টিটিউটে কোনও নোংড়া কাজ হয় বলে তার মনে হয়নি। আর মহিমাও তো রতীশকে বলেছিল যে রতীশের যদি কখনও কোনও ধারণা বা সন্দেহ হয় যে মহিমার ইনস্টিটিউটে কোনরকম অনৈতিক কাজকর্ম হয়, তাহলে রতীশ সে দিনই সেখানে কাজ ছেড়ে দিতে পারে। এমন চ্যালেঞ্জিং কথা যখন মহিমা বলেছিল তখন ধরেই নেওয়া যায় যে সে ইনস্টিটিউটে এমন কোন কাজকর্ম হয় না। তাহলে সে ইনস্টিটিউটের নাম শুনে নবনীতার এমনভাবে চমকে ওঠার কারন কি? কিন্তু ওই মহিমা মালহোত্রাই যদি নবনীতার সেই ম্যাডাম হয়ে থাকে, তাহলে তো ধরেই নেওয়া যায় যে তার সহজ সরল দাদাভাই নিজের অজান্তেই আরেক চরম এক বিপদের মুখোমুখি হয়ে পড়েছে।

মহিমাকে ফোন করবার আগে নবনীতার কাছ থেকে ব্যাপারটা পরিস্কার করে জানতে হবে। কিন্তু নবনীতা কি অর্চনার সামনে সব কথা খুলে বলতে পারবে? সে যে একটা সময় পরিস্থিতির শিকার হয়েই দেহ ব্যবসায় নামতে বাধ্য হয়েছিল, আর এর উদ্দেশ্য যে শুধু তার খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই ছিল তা কি অর্চনা সাদা মনে মেনে নিতে পারবে? অর্চনার মনে কি নীতার প্রতি বিদ্বেষ বা ঘৃণাভাব জন্মাবে না? সে কি এত সহজ ভাবে নীতার সাথে মিশতে পারবে? আর সেটা করতে না পারলে তো অর্চনা নিজেও স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে না এখানে। তাহলে নবনীতার সাথে মহিমার ব্যাপারে জিজ্ঞসাবাদ করার আগে তো অর্চনাকে এ ঘর থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু অর্চনার মনেও তো এতে একটা সন্দেহ তৈরী হতে পারে। সে ভাবতে পারে সীমন্তিনী আর নবনীতা তার কাছে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে। তাই সে আর তাদের কাছে আগের মত সহজ খোলামেলা ব্যবহার করতে পারবে না। এটাও তো সীমন্তিনীর একেবারেই কাম্য নয়। কিন্তু নবনীতার এভাবে আঁতকে ওঠার কারনটাও যে তাকে জানতেই হবে। সীমন্তিনী শান্ত হয়ে ভাবতে চেষ্টা করল এমন পরিস্থিতিতে তার ঠিক কী করা উচিৎ।
 

এমন সময় নবনীতা প্রায় হঠাতই বলে উঠল, “দিদি সেদিন আমি তুমি আর বৌদি যখন পরির সাথে দেখা করতে ...............”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে নবনীতার হাত চেপে ধরে তার চোখের দিকে চেয়ে ঈশারা করতেই নবনীতা থেমে গেল। তারপর চোখে চোখেই সীমন্তিনীকে অভয় দেবার ইঙ্গিত করে একটু ম্লান হেসে বলল, “ভেবো না দিদি। অর্চনাকে আমি আজ আমার জীবনের সব কথাই খুলে বলেছি। তাই ওর এখন আর নতুন করে চমকাবার কিছু নেই। আর আমরা যখন ওর ছোটবোন আর তার স্বামীকে নিয়ে কথা বলছি, সেসব ওর কাছে লুকিয়ে গেলে ওর মনের ওপর একটা বাড়তি চাপ পড়বে। সেটা তো ভাল হবে না। তাই বৌদি আর রতীশদার ওপর নেমে আসা কোন আপদ বিপদ বা ঝামেলার সম্ভাবনার কথা তার সামনেই আলোচনা করলেই অর্চু স্বাভাবিক ভাবে আমাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিতে পারবে। আমরা তিনজনে মিলে একসাথে বিচার বিবেচনা করেই দাদা-বৌদিকে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত করতে পারব। আমার মনে হয় অর্চনাও তাতে স্বস্তি পাবে। তাইনা অর্চু”?
 

অর্চনা একটু চিন্তান্বিত ভাবে বলল, “হ্যাঁ, তা তো তুমি ঠিকই বলছ নীতাদি। কিন্তু তুমি রচু আর রতু-দার ওপর আপদ বিপদ নেমে আসবে বলছ কেন? কি হয়েছে গো? আমাকে খুলে বলো না দয়া করে”? বলতে বলতে ওর গলা শুকিয়ে এল যেন।

______________________________
ss_sexy
Like Reply




Users browsing this thread: