Thread Rating:
  • 28 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
সীমন্তিনী BY SS_SEXY
#21
বিধুবাবু বললেন, “না মা আপত্তি কেন হবে। খণাই বলে গেছেন, মঙ্গলের ঊষা বুধে পা, যথা খুশী তথা যা। বুধবার সকালে রওনা হওয়া খুবই শুভ হবে”। 

বিভাদেবী বললেন, “তাহলে তো তাদের ওখানে একটা খবর দেওয়া উচিৎ যে আমরা বুধবার তাদের বাড়ি যাচ্ছি”।

সীমন্তিনী বলল, “তাতে অসুবিধের কি আছে। তারা তো তাদের বাড়ির ফোন নাম্বার দিয়েই গেছেন। রচুর মোবাইলটা এনে এখনই ফোন করে বলে দাও না”।

বিভাদেবী উঠে অন্য ঘরে চলে গেলেন। একটু বাদে হাতে একটা কাগজ আর রচনার মোবাইলটা এনে সীমন্তিনীর হাতে দিয়ে বলল, “নে মা, ফোনটা তুইই কর”।

সীমন্তিনী কাগজটা হাতে নিয়ে দেখল। তার ছোটকাকা চন্দ্রকান্তবাবুর হাতের লেখা সে স্পষ্ট চিনতে পারল। চন্দ্রকান্তবাবু বাড়ির ল্যাণ্ডলাইন ফোন নাম্বারের সাথে সাথে তার পিসিওর নাম্বারটাও লিখে দিয়ে গেছেন। কিন্তু এত সকালে তার পিসিও হয়ত খোলেই নি। তাই বাড়ির ল্যাণ্ডলাইন আর ছোটকাকুর পিসিওর নাম্বার দুটো রচনার নতুন মোবাইলে সেভ করতে করতে বলল, “মেসো আমি লাইনটা ধরিয়ে দিচ্ছি। কথাটা তুমি নিজে মুখে বল। আমি এখন তাদের সাথে কথা বলতে চাইছি না”।
 

সীমন্তিনী ভাবল ফোনটা যদি সতীশ রিসিভ করে ফেলে, তাহলে একটু গড়বড় হয়ে যেতে পারে। তাই বুদ্ধি করে নিজেই বাড়ির নাম্বারটা ডায়াল করল। ও’পাশে কয়েকবার রিং হবার পরেই ছোটমার গলা শুনতে পেয়ে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “হ্যালো, এটা কি রতিকান্ত ভট্টাচার্যির বাড়ি”?
 

ও’পাশ থেকে ছোটমা চন্দ্রাদেবী বললেন, “হ্যা। তা আপনি কে বলছেন”?

সীমন্তিনী বলল, “আপনি আমায় ঠিক চিনবেন না। আমি কালচিনি থেকে বলছি। নিন কথা বলুন” বলে ফোনের স্পীকারটা অন করে ফোনটা বিধুবাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বিভাদেবীর কানে কানে ফিসফিস করে
 
বলল, “ছেলের ছোটকাকিমা ফোন ধরেছেন”।
 

বিধুবাবু ফোন হাতে নিয়ে চুপ করে আছেন দেখে সীমন্তিনী তাকে ঈশারায় কথা বলতে বলল। বিধুবাবু বললেন, “হ্যা আমি কালচিনি থেকে বিধূভূষণ চক্রবর্তী কথা বলছি। একটু রতিকান্তবাবু বা চন্দ্রকান্তবাবুর সাথে কথা বলতে পারি কি”?
 

ও’পাশ থেকে চন্দ্রাদেবী খুশীর সুরে বলে উঠলেন, “ওহ, আপনি রচনার বাবা তো? নমস্কার আমি রতীশের ছোটকাকিমা চন্দ্রা বলছি। আপনারা সবাই ভাল আছেন তো দাদা”?
 

বিধুবাবু বললেন “নমস্কার দিদি। হ্যা আমরা ভালই আছি। ওনারা কেউ কি বাড়ি আছেন এখন”?
 

চন্দ্রাদেবী বললেন, “ইশ দাদা, ওনারা তিন ভাই এইমাত্র বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। আমি কি বড়দিকে মানে রতীশের মাকে ফোনটা দেব? বা আপনি চাইলে আমার সাথেও কথা বলতে পারেন”।
 

সীমন্তিনী ঈশারায় বিধুবাবুকে বলল ছেলের মায়ের সাথে কথা বলতে। বিধুবাবু বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে দিদি। ওনারা যখন বেরিয়েই গেছেন, তাহলে একটু রতীশের মাকেই ডেকে দিন না দয়া করে”।

চন্দ্রাদেবী জবাব দিলেন, “হ্যা হ্যা বড়দি আমার পাশেই আছেন। নিন কথা বলুন”।

সরলাদেবীর গলা শোনা গেল, “নমস্কার দাদা। আপনারা সবাই ভাল আছেন তো? রচনা কেমন আছে”?
 

বিধুবাবু বললেন, “হ্যা দিদি, আমরা সবাই ভগবানের কৃপায় ভালই আছি। তা দিদি বলছিলাম কি। আমরা মনস্থ করেছি আগামী বুধবার আপনাদের ওখানে যাব। আপনাদের কোন অসুবিধে হবে না তো”?
 

সরলাদেবী খুশী গলায় বলে উঠলেন, “সত্যি বলছেন দাদা? আপনারা বুধবার আসছেন? না না, অসুবিধে হবে কেন। আমরা সাগ্রহে আপনাদের জন্যে অপেক্ষা করব”।
 

বিধুবাবু বললেন, “তাহলে কথাটা রতিকান্তবাবু আর তাদের ভাইদের জানিয়ে দেবেন দয়া করে দিদি। আমরা সকাল সকালই এখান থেকে রওনা দেব”।
 

সরলাদেবী বললেন, “হ্যা দাদা। আপনি ফোন করাতে আমি যে কত খুশী হয়েছি, সেটা আপনাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি সবাইকেই এ সুখবরটা জানিয়ে দেব। তা দাদা, এটা কার ফোন থেকে আপনি কথা বলছেন? কোন পিসিও থেকে বলছেন কি”?
 

বিধুবাবু জবাব দিলেন, “না দিদি। এটা আমার মেয়ের ফোন থেকে করছি। কালই এটা পেয়েছে ও”।

সরলাদেবী বললেন “নতুন কিনেছে বুঝি? তা রচনা কোথায়? ওর সাথে একটু কথা বলা যাবে না দাদা”?
 

সীমন্তিনী বিভাদেবীর কানে কানে বলল, “তোমরা কথা বলতে থাক। আমি রচনাকে ডেকে আনছি” বলেই ছুটে রচনার ঘরের দিকে চলে গেল।

রচনা ঘরে জামা কাপড় গোছাচ্ছিল। সীমন্তিনী ওর হাত ধরে টানতে টানতে মা বাবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “চল চল, তোর হবু শাশুড়ি মা তোর সাথে কথা বলতে চাইছেন। আয় শিগগীর”।

রচনা চমকে উঠে বলল, “না না দিদিভাই। আমি তাকে কী বলব এখন”?
 

সীমন্তিনী তাকে নিয়ে এগোতে এগোতে বলল, “তোকে কিছু বলতে হবে না। শুধু প্রণাম জানাবি। আর উনি তোকে যা জিজ্ঞেস করবেন শুধু তার জবাব দিস”।

বিধুবাবুর ঘরে ঢুকে দেখল বিভাদেবী ফোনে বলছেন, “হ্যা দিদি, সে’কথা আর বলতে? কিন্তু আমাদের অবস্থা তো সব দেখেই গেছেন আপনারা। আমার মেয়েটাকে যদি আপনাদের পায়ে একটু জায়গা দেন তাহলে মা হয়ে আমিও খুব সুখী হব। এই নিন দিদি। রচু এসে গেছে। ওর সাথে কথা বলুন” বলেই ফোনটা রচনার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “কথা বল। রতীশের মা”।

রচনা হতভম্বের মত ফোনটা হাতে নিয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “হ্যা হ্যালো। আমি র-রচনা। আমার প্রণাম নেবেন”।
 

সরলাদেবী খুশীতে উছলে উঠে বলল, “বেঁচে থাক মা। রাজরানী হও তুমি। তোমার গলাটা শুনে মনটা খুশীতে ভরে গেল মা গো। তা তুমি ভাল আছ তো মা”?

রচনা হাঁপাতে হাঁপাতে কোনরকমে জবাব দিল, “হ্যা হ্যা, ভাল আছি। আপনারা সবাই ভাল আছেন তো”?

সরলাদেবী বললেন, “কি করে ভাল থাকি বল তো মা? তোমাকে দেখার পর থেকেই যে তোমাকে নিজের মেয়ে করে নিতে ইচ্ছে করছে আমার। তুমি আমার কোলে না আসা পর্যন্ত কি আর ভাল লাগে আমার”?
 

রচনা লজ্জা পেয়ে বিভাদেবীর হাতে ফোনটা গুঁজে দিয়েই ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সীমন্তিনী ওর পেছন পেছন যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে গেল। বিভাদেবী তখন ফোনে বলছেন, “দিদি রচু লজ্জা পেয়ে চলে গেছে। আপনি কিছু মনে করবেন না দয়া করে”।

সরলাদেবী বললেন, “না না দিদি, সেটা আমিও বুঝেছি। ওর মিষ্টি গলাটা শুনতে পেয়েছি। তাতেই আমি খুশী। ওকে আমি দুর থেকেই আশীর্বাদ করছি। আমরা কিন্তু খুব আশায় রইলাম দিদি। আশা করি আমাদের আশা হত করবেন না আপনারা। বুধবার আপনাদের দেখা পাবো শুনে খুব ভাল লাগল”।

বিভাদেবী বললেন, “হ্যা দিদি, ভগবান সব কিছু ঠিক ঠাক রাখলে, সেদিন অবশ্যই আপনাদের সাথে দেখা হবে। আচ্ছা এখন রাখছি তাহলে দিদি। নমস্কার”।
 

সরলাদেবীও ওদিক থেকে নমস্কার জানিয়ে দিতে বিভাদেবী ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিতেই সীমন্তিনী চট করে ফোন ডিসকানেক্ট করে দিয়ে বলল, “কথা শেষ হয়ে গেলে সব সময় এই লাল বোতামটা টিপে দিয়ে লাইনটা কেটে দেবে মাসি। নইলে কিন্তু পয়সা কেটে যেতে পারে”।

বিভাদেবী বললেন, “দিনে দিনে কত কিছুই না দেখছি। একটা চিঠি পাঠালে সেটা হয়ত কতদিন পরে গিয়ে তাদের কাছে পৌঁছত। এখন এক মিনিটেই সব কাজ হয়ে গেল”!

সীমন্তিনী বলল, “ব্যাস, তাহলে কথা তো হয়েই গেল। তোমরা বুধবার সকালে এখান থেকে রওনা হচ্ছ। আমিও মঙ্গলবার বিকেলে এখানে এসে পড়ব। এবার তাহলে আমি রওনা হতে পারি তো মাসি”?
 

বিভাদেবী উঠতে উঠতে বলল, “ওমা যাচ্ছি বললেই হল নাকি? দাঁড়া, দুটো লুচি বানিয়ে দিচ্ছি তোকে। সেটা খেয়ে তবে যাবি”।

সীমন্তিনী রচনার ঘরে এসে দেখে রচনা বিছানায় চুপ করে বসে আছে। সীমন্তিনী প্রথমে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে নিজের মোবাইলটা বের করে সেটাকে সুইচ অফ করে ব্যাগে ভরে রেখে দিল। কারন সে জানে তার বড়মা হয়ত এখনই আবার তাকে ফোন করে সুখবরটা দিতে চাইবে। আর সীমন্তিনী সেটা এ মূহুর্তে চাইছে না। তারপর রচনার পাশে বসে তার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে দুষ্টুমি করে বলল, “কিরে মেয়ে? হবু শাশুড়ির সাথে কথা বলে দেখি একেবারে ঠাণ্ডা মেরে গেলি তুই”?
 

রচনা বলল, “তুমি না খুব দুষ্টু। ইশ, আমার বুকের ভেতরটা এখনও ধড়ফড় করছে। কি বলতে কি বলে ফেলেছি কে জানে”।
 

সীমন্তিনী হেসে রচনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “তেমন কিছু তো বলিস নি। কিন্তু আরেকটু সময় কথা বললে ভদ্রমহিলা খুব খুশী হতেন। আচ্ছা সে না হয় পরে পূরণ হয়ে যাবে। তোর ফোন নাম্বার জেনে গেছেন উনি। দেখিস পরেও নিশ্চয়ই ফোন করবেন। তখন এত লজ্জা না পেয়ে ভালভাবে কথা বলিস”।

রচনা বলল, “আমি যে তাকে কী বলে সম্মোধন করব সেটাই তো বুঝতে পাচ্ছিলুম না দিদিভাই। তাই আরও বেশী ঘাবড়ে গিয়েছিলাম”।
 

সীমন্তিনী বলল, “এরপর যখন ফোন করবেন তখন কী বলে সম্মোধন করবি, সেটা আগে থেকেই ভেবে রাখ”।
 

রচনা বলল, “ইশ দিদিভাই, আমার যে খুব লজ্জা লাগছে গো। কী বলে ডাকব আমি তাকে বল তো? বিয়ের পর হলে তো অনায়াসেই মা বলে ডাকতে পারব। কিন্তু বিয়ের আগে তাকে কি বলব গো? মাসিমা না কাকিমা”?
 

সীমন্তিনী বলল, “তুই যখন বিয়েতে রাজি আছিস, তাহলে তো মোটামুটিভাবে বলাই যায় যে তোর বিয়ে রতীশের সাথেই হবে। শুধু আরেকটু সময়ের প্রয়োজন। মাসি মেসো ওখান থেকে ফিরে আসুন, আর আমি একবার রাজগঞ্জ থেকে ঘুরে এলেই ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে যাবে”।
 

রচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি তাদের বাড়ি যাবে দিদিভাই”?

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “যেতে তো হবেই রে। আমার এমন মিষ্টি বোনটাকে তাদের হাতে তুলে দেবার আগে আমাকে ভাল করে বাজিয়ে দেখতে হবে না? যদিও আমার মনে হয় নেতিবাচক কিছুই আমার কানে আসবে না। আমি তো আগে থেকেই ও পরিবারের প্রায় সকলকেই চিনি। তবু গত সাত আট বছরে তো তাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি আমার। একটু ভাল করে সকলের বর্তমান অবস্থার খবরাখবর তো আমাকে নিতেই হবে। নইলে মেসোকে তোর বিয়ের পাকা কথা বলার কথা বলব কিকরে? মাসি মেসোরা তো সেখানে যাবার আগেই আমি তাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। আর তখন যদি দেখি সবকিছু ঠিকঠাক আছে, তাহলে তোকেই সবার আগে জানাব। আর তখন থেকেই তুই তোর শাশুড়িকে মা বলে ডাকতে পারবি। জানিস তো? ছেলের বৌ যদি শাশুড়িকে নিজের মায়ের জায়গায় বসাতে পারে, আর শাশুড়িও যদি ছেলের বৌকে নিজের মেয়ে করে নিতে পারে, তাহলে সে সংসারে সুখ শান্তি চিরদিন বজায় থাকে। আমি চাই তুই সারাটা জীবন যেন অমন সুখে থাকতে পারিস। তবে রতীশের মা-র সাথে আমি অনেকবার কথা বলেছি। উনি সত্যিই খুব ভাল মনের মানুষ”।

রচনা বলল, “আমার মনের ভেতরটা সেদিন থেকেই যে কেমন করছে না দিদিভাই। আমার খুব ভয় করছে গো। বার বার শুধু দিদির কথা মনে পড়ছে। আমার কপালটাও যদি দিদির মতই হয়”!

সীমন্তিনী রচনার মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “একদম দুশ্চিন্তা করবি না তুই। তোর দিদির বিয়ের সময় তোদের সাথে আমার পরিচয় থাকলে এমনটা হয়ত হত না রে। ভবিতব্যকে তো না মেনে উপায় নেই। তোর দিদির এমন ভবিতব্যই বিধাতা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মুখের কথার ওপর তুই ভরসা রাখতে পারিস। আমি খুব ভাল ভাবে খবর নিয়ে নিজে সন্তুষ্ট না হলে তোর বিয়ে হতেই দেব না আমি। সে পাত্র ওই রতীশই হোক বা অন্য কেউ। আমি তোকে কথা দিচ্ছি বোন”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে রচনার চোখে জল এসে গেল। সীমন্তিনীর একটা হাত দু’হাতে ধরে নিজের গালের চেপে ধরে বলল, “তুমি আমার জন্যে যা কিছু করছ, তার জন্য আমাকে বোধ হয় সারা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকতে হবে গো দিদিভাই। জানিনা বিয়ের পরেও তোমার সাথে আমার কোন যোগাযোগ থাকবে কি না”।

সীমন্তিনী রচনাকে আদর করে বলল, “পাগলী মেয়ে তুই একটা। আমি না তোর দিদি? দিদি হয়ে তোর ভাল মন্দ দেখবার দায়িত্ব কি আমার নয়, যে এভাবে বলছিস? আর দেখিস, বিয়ের পরেও তুই যেখানেই থাকিস না কেন, আমার সাথে তোর যোগাযোগ থাকবেই। আমি সারা জীবন তোর পাশে থাকব। যেখানে যত দুরেই থাকি না কেন, আমি তোর দিদি হয়েই থাকব রে, দেখে নিস”।
 
****************
ss_sexy
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#22
(Update No. 47)

জলপাইগুড়ি ফিরে এসে ষ্টেশনে নেমেই সীমন্তিনী নিজের ফোনটা সুইচ অন করতেই দেখা গেল বাড়ির নাম্বার থেকে আর রচনার নাম্বার থেকে মিসকল। ষ্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠে সীমন্তিনী প্রথমে বাড়ির নাম্বারে কল করল। সরলাদেবী ফোন ধরতেই সীমন্তিনী জানাল সব খবরই তার জানা আছে। রচুর বাবা মা বুধবার তাদের বাড়ি যাচ্ছেন। আর দাদাভাইকে দেখে আর পরিবারের সবাইকে দেখে ভাল লাগলে তারা এ সম্পর্ক করতে রাজি হয়ে যাবেন। সীমন্তিনী তার বড়মাকে বলে দিল যে ছেলের বিয়ে উপলক্ষ্যে কোন রকম যৌতুক দান সামগ্রীর কথাই যেন ওঠানো না হয়। রচনার মত একটা লক্ষী মেয়ে ঘরে এলে তাদের পরিবার এমনিতেই সুখে স্বাচ্ছন্দে ভরে উঠবে। আর বিয়েটা যে বছর খানেক বাদে হবে এটাও যেন বাড়ির সকলে মেনে নেয়। সরলাদেবী সীমন্তিনীকে আশ্বস্ত করলেন, সে যা চাইছে তা-ই হবে।
 

সীমন্তিনী তার বড়মাকে বলল, “বড়মা তুমি সতুকে মঙ্গলবার সকালে জলপাইগুড়ি পাঠিয়ে দিও। আমি সেদিন দুপুরের দিকেই আবার কালচিনি চলে যাব। আর ভাইয়ের হাতে হাজার পাঁচেক টাকা পাঠিয়ে দিও। রচুর বাবা মা কালচিনি ফিরে যাবার পর আমি জলপাইগুড়ি চলে আসব। ভাইকে এ দুটো দিন একাই থাকতে হবে এ ঘরে। আর ওকে বলে দিও আমি কালচিনি থেকে জলপাইগুড়ি ফেরার পর ওর সাথে একটু আলোচনা করব। তারপর ও আবার বাড়ি যেতে পারবে”।

সরলাদেবী অবাক হয়ে বললেন, “ওমা তুই এ কথা বলছিস? আর আমি তো ভেবেছি সতুকে সেদিন বাসস্ট্যাণ্ডে পাঠাব রচনার মা বাবাকে আমন্ত্রণ জানাতে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আমন্ত্রণ জানাবার জন্যে তুমি অন্য কাউকে পাঠিও বড়মা। তোমাকে তো আগেই বলেছি যে এ গোটা ব্যাপারটা থেকে আমি আর সতু আড়ালে থাকব। তবে খুব বেশীদিন আর এমন আড়ালে থাকবার দরকার পড়বে না। আর কয়েকদিনের মধ্যেই সব কিছু সকলের কাছে পরিস্কার করে দেব। তখন আর লুকোচুরির প্রয়োজন পরবে না”।

সরলাদেবী বললেন, “তা অবশ্য ঠিকই বলেছিস। কিন্তু আমার মনে মনে এখন একটু ভয়ও হচ্ছে রে মা। দেখিস, যা কিছু করার সেসব একটু ভেবে চিন্তে খুব সাবধানে করিস মা। ওরা যদি তোর আসল পরিচয়
 
আর আসল উদ্দেশ্যটা জানবার পর তোকে ভুল বুঝে সম্পর্কটাই ভেঙে দেয়, তাহলে কি হবে রে”?

সীমন্তিনী বলল, “তুমি সেসব নিয়ে ভেব না বড়মা। তোমাকে তো আমি আগেই কথা দিয়েছি, রচনাকে তুমি তোমার বড়ছেলের বৌ করে ঘরে তুলতে পারবে। তুমি দেখে নিও ওনারাও কেউ আমায় ভুল বুঝবেন না, আর রচুও তোমার ছেলের বৌ হয়ে আমাদের পরিবারে আসছেই”।

এরপর সীমন্তিনী রচনার নাম্বারে ফোন করে জানিয়ে দিল যে সে ঠিকমত জলপাইগুড়ি পৌঁছে গেছে।
 
**************

বুধবারে বিধুবাবু আর বিভাদেবী রতীশদের বাড়ি এসে বাড়ির ছোট বড় সকলের সাথে কথা বলে আর সমস্ত বাড়ি ঘর দেখে যার পর নাই খুশী হলেন। সীমন্তিনী জোর করে বিধুবাবুর হাতে পাঁচ হাজার টাকা গুঁজে দিয়ে বলেছিল জলপাইগুড়ি থেকে কিছু মিষ্টি টিষ্টি কিনে নিয়ে রাজগঞ্জ যেতে। বিকেল বেলায় তারা জায়গাটা ঘুরে ফিরে দেখে দু’চার জনের মুখে ভট্টাচার্যি বাড়ির প্রভূত প্রশংসা শুনে অসম্ভব প্রীত হলেন। মনে মনে ভাবলেন রাজরানী না হলেও তাদের ছোটমেয়ে রচনা এ পরিবারে খুবই সুখে থাকবে। অপূর্ব দেখতে রতীশের পাশে তাদের মেয়েকে যে খুবই ভাল লাগবে দেখতে এ ব্যাপারে তাদের মনে কোন সন্দেহই রইল না। রাতে রতিকান্তবাবুরা দোকান থেকে ফিরে এসে সবাই মিলে আলোচনায় বসলেন। বিধুবাবু যথেষ্ট সঙ্কোচের সাথে নিজেদের দৈন্য দশার কথার উল্লেখ করে সীমন্তিনীর কথা মতই সব কিছু বললেন। রতীশের বাড়ির লোকেরা নির্দ্বিধায় তাদের সব কথা মেনে নিলেন। ছোটকাকা চন্দ্রকান্ত বললেন যে বিয়ের সমস্ত খরচ খরচা তারা নিজেরাই বহন করবেন। বিধুবাবু যেন শুধু নিজেরা বিয়ের আয়োজনটুকু করেন। টাকা পয়সার যোগান ছেলের বাড়ি থেকেই দেওয়া হবে।
 

বিধুবাবুরা পরদিন কালচিনি ফেরত গিয়ে সীমন্তিনীকে সব কথা খুলে বললেন। সীমন্তিনী ছেলের বাড়ি সম্পর্কে যা যা বলেছিল তার সব কিছুই একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে বলে সীমন্তিনীকে তারা ধন্যবাদও দিলেন। সীমন্তিনীও সব কথা শুনে খুব খুশী হয়ে জলপাইগুড়ি ফিরে এল। সতীশ সে সময় জালপাইগুড়িতে ছিল। ফোনে ফোনে সব খবর পেলেও সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল দিদির জন্য। সীমন্তিনী ঘরে ঢুকেই নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে মিষ্টির প্যাকেট বের করে সতীশের মুখে দিতে দিতে বলল, “নে ভাই। জানি তুই আমার ওপর খুব রেগে আছিস। তবু রচনা তোর বৌদি হয়ে আমাদের ঘরে আসছে, এ খুশীতে আগে একটু মিষ্টি মুখ করে নে সোনা ভাই আমার। তারপর দিদিকে যত খুশী গালমন্দ করিস”।
 

সতীশ দুটো মিষ্টি খাবার পর জল খেয়ে বলল, “এই বড়দি, আগে বলনা বৌদি, মানে রচনা এ বিয়েতে রাজি আছে তো”?
 

সীমন্তিনী সতীশের মাথার চুলগুলো নেড়ে চেড়ে বলল, “একদম ভাবিসনে ভাই। সব ঠিক আছে। তবে রচু তো কিছুটা শান্ত প্রকৃতির। আবেগ উচ্ছ্বাসটা সব সময় প্রকাশ করে না। আর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে নম্র ভদ্র মেয়েরা একটু লজ্জা পেয়েই থাকে। কিন্তু আমার সাথে যতটুকু কথা হয়েছে তাতেই আমি খুশী। আর মাসি মেসোও দাদাভাইকে দেখে আমাদের বাড়ির আর সবাইকে দেখে খুব খুশী হয়েছেন। আর বিয়ে তো প্রায় ঠিকই হয়ে গেল। শুধু দিনক্ষণটা স্থির করা বাকি রইল। আর সেটা তো এখন করবও না। এতে দু’পক্ষেরই সুবিধে। বিয়ে পাকা হবার পর এক বছর বাদে বিয়েটা হচ্ছে। এই এক বছরের মধ্যে কত কিছুই তো হতে পারে। এতে আমাদের আর ওদের বাড়িতে অনভিপ্রেত কিছু হলেই সকলের মনে একটা দ্বিধাভাব জেগে উঠতে পারে। তাই এখন দিন স্থির করার কথা ওঠাবই না আমরা। আপাততঃ আমার হাতে শুধু দুটো কাজ রইল। প্রথম কাজটা হচ্ছে আমি যে তোর আর আমার পরিচয়টা তাদের কাছে লুকিয়ে রেখেছি সেটা তাদের কাছে ঠিকভাবে প্রকাশ করে দেওয়া। আর দুই হচ্ছে, রচনার সাথে আমাদের বাড়ির সকলেই যেন ফোন করে মাঝে মাঝে কথা বলেন। রচনা যেন বুঝতে পারে বিয়ের পর তাকে যাদের সাথে থাকতে হবে তারা সবাই খুব ভাল লোক। তাহলে আমাদের বাড়ির লোকদের ওপর ওর ভরসা বাড়বে। তুই কিন্তু এবার বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দিবি বাড়ির সবাইকে”।

সতীশ শুনে বলল, “সে তো ঠিক আছেরে বড়দি। কিন্তু আমি কি দাদার বিয়ের আগে আর বৌদিকে দেখতে পাব না? বৌদির বাবা মা আমাদের বাড়ি এলেন, তখনও তুই আমাকে বাড়িতে থাকতে দিলি না। আমি তো তাদের কারোর সাথে দেখা করবার বা কথা বলবার সুযোগই পাচ্ছি না। এতে আমার মনে কষ্ট হয়না বল”?
 

সীমন্তিনী দুষ্টুমি করে বলল, “বুঝেছি। আমি যে দু’ তিনবার ওদের বাড়ি গিয়েছি, থেকেছি, তাতে তোর হিংসে হচ্ছে, না ভাই? কিন্তু আর ভাবিস না। এবার তোকেও নিয়ে যাব। কবে যাবি বল। আজ না কাল”?

সতীশ একটু মনমরা হয়ে বলল, “বুঝেছি, তুই এখনও আমাকে নিয়ে যাবি না”।
 

সীমন্তিনী নিজের মোবাইলটা সতীশের হাতে দিয়ে বলল, “নে। বড়মাকে ফোন কর। উনি যেন রচনাদের বাড়িতে খবর দিয়ে দেন যে রতীশের ভাই আর বোন তাদের বাড়ি যাচ্ছে। আর তুই কবে যেতে চাস সেটাও বড়মাকে বলে দে। তবে পরের সপ্তাহে শুক্রবার পর্যন্ত আমার রেগুলার ক্লাস আছে। যদি আমার সাথে যেতে চাস তাহলে শনিবার যেতে হবে। আর তুই যদি একা যেতে রাজি থাকিস, তাহলে তোর খুশী মত যে কোনদিন যেতে পারিস। তোর কলেজ তো বন্ধই আছে এখন”।
 

সতীশ অবাক হয়ে বলল, “পাগল হয়েছিস তুই? আমি একা গেলে সব গুবলেট হয়ে যাবে। কি বলতে কি বলে ফেলব। শেষে তোর ওপর তারা সবাই রেগে মেগে সম্পর্কটাই না নাকচ করে দেন। না না, তোকে যেতে হবে আমার সাথে”।

সীমন্তিনী হেসে বলল, “বেশ যাব। নে বড়মাকে ফোনটা কর। আর বলে দে আমাদের নাম উল্লেখ না করে তিনি যেন সেভাবেই রচুদের বাড়িতে খবরটা দিয়ে দেন”।
 

সতীশ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে বলল, “তুই সত্যি বলছিস তো বড়দি? আমার ওপর রাগ করে এ কথা বলছিস না তো”?
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “নারে পাগল ছেলে। আমাকে তো যেতেই হবে। তাদের কাছে যে সত্যি কথাটা এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছি সেটা তো এখন খোলসা করতেই হবে রে। নইলে পরে ব্যাপারটা অন্য মাত্রায় পৌঁছে যাবে। আর সত্যি বলতে কি জানিস? আমারও রচুকে বার বার দেখতে ইচ্ছে করছে। নে তুই ফোনটা কর”।
 

সীমন্তিনীর কথা শেষ হবার আগেই সতীশের হাতে ধরা ফোনটা বেজে উঠল। সতীশ ফোনের দিকে দেখে বলল “এই বড়দি, বৌদি ফোন করেছে রে। ধর”।
 

সীমন্তিনী বলল, “কলটা তুই রিসিভ কর। বলিস আমি বাথরুমে আছি। আর দেখ কি বলে। স্পীকারটা অন করে দিস”।
 

সতীশ কলটা রিসিভ করেই স্পীকার অন করে দিতেই শোনা গেল রচনা বলছে, “তুমি কী গো দিদিভাই। এতরাত হয়ে গেল। এখনও তোমার পৌছ সংবাদটা দিলে না? জানো, বাবা মা আর ভাই তখন থেকে চিন্তা করছে। তুমি কি এখনও বাড়ি গিয়ে পৌঁছও নি নাকি”?

সতীশ নিজের গলাটা পরিস্কার করে বলল, “না মানে শুনুন। দিদি একটু বাথরুমে আছে। তাই আমি ফোনটা ধরেছি। আমি সতু”।

রচনা বলল, “সরি দাদা, আমি তো বুঝতে পারিনি। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লীজ। আসলে দিদিভাই এতক্ষণেও কোন ফোন না করাতে আমরা সবাই একটু চিন্তায় ছিলাম। তাই মা বলল আমাকেই ফোন করে খবরটা নিতে। কিন্তু ফোনটা যে আপনি ধরেছেন, এটা তো আমি বুঝতে পারিনি। অপরাধ নেবেন না দাদা”।
 

সতীশ সীমন্তিনীর দিকে চাইতেই সীমন্তিনী ঈশারায় তাকে বলল কথা চালিয়ে যেতে। সতীশ তাই বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি সেটা নিয়ে অযথা ভাববেন না। তা ফোনটা বেজে উঠতে দেখলাম রচনা নামে কেউ একজন ফোন করেছে। আপনিই কি রচনা? আর দিদি কি কালচিনিতে কাল আপনাদের বাড়িতেই ছিল”?

রচনা বলল, “হ্যা দাদা। আপনি তো দিদিভাইয়ের ভাই, তাই না? আমার প্রণাম নেবেন দাদা। আর প্লীজ আমাকে মাফ করে দেবেন”।
 

সতীশ বলল, “আরে বার বার মাফ চাইবার মত এমন কিছু অপরাধ তো আপনি করেন নি। দিদি যে এখানে পৌঁছে আপনাকে ফোন করে খবর দেয় নি, সেটা তো তারই ভুল। তবে আপনি ভাববেন না। দিদি কিছুক্ষণ আগেই ঘরে এসে পৌঁছেছে। আর সে সুস্থই আছে। সে তো এখন বাথরুমে। সে চান সেরে বেরোলেই আমি তাকে বলব যে আপনি ফোন করেছিলেন। একদম ভাববেন না”।

রচনা বলল, “ধন্যবাদ দাদা। আচ্ছা রাখছি এখন” বলে ফোন কেটে দিল। সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “কিরে ভাই? বৌদির সাথে কথা বলে কেমন লাগল”?
 

সতীশ মন্ত্রমুগ্ধের মত বলল, “কি সুন্দর গলার ভয়েস রে বড়দি? মনে হচ্ছে কানে যেন মধু ঝরে পড়ছিল। এতদিন জানতুম তোর গলার মত এত মিষ্টি গলা আর বুঝি কারুর নেই। বৌদির গলা তো তোর গলার চেয়েও মিষ্টি লাগল রে”!
 

সীমন্তিনী বলল, “তাহলে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলি কেন? আরও খানিকক্ষণ কথা বলে যেতে পারলি না”?

সতীশ বলল, “মনে মনে লোভ তো ঠিকই হচ্ছিল রে বড়দি। কিন্তু বৌদি হয়ে আমাকে যেভাবে আপনি আজ্ঞে করে কথা বলছিল তাতে আর বেশীক্ষণ কথা বললাম না। শেষে দেখা যাবে বিয়ের পরেও আমাকে আপনি আপনি করে কথা বলবে। আমি তো মুখ ফস্কে বৌদিই বলে ফেলছিলুম প্রায়। নে এবার তুই একটু তার সাথে কথা বল। তাহলে ওর ভাল লাগবে”।
 

সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে একহাতে সতীশের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “দে। আর তুইও শোন আবার তোর বৌদির মিষ্টি গলা” বলে রচনার নাম্বার ডায়াল করল। রচনা ফোন ধরেই বলল, “ও দিদিভাই। আমি যে বড় অন্যায় করে ফেলেছি গো। তোমার ভাইকে তো তুমি ভেবে রেগেমেগে কত কিছু বলে ফেলেছি আমি। উনি নিশ্চয়ই আমার ওপর খুব রেগে গেছেন, তাই না গো”?

সীমন্তিনী বলল, “কই? না তো! ওকে দেখে তো আমার তেমন মনে হয়নি। ও তো শুধু আমাকে এটুকুই বলল যে তুই ফোন করেছিলি আমাকে। আর আমি বাথরুমে ছিলুম বলে ও কলটা রিসিভ করেছিল। আর তো কিছু বলে নি! তা তুই এমন কী বলেছিস যে ও রাগ করবে”?
 

রচনা বলল, “তুমি চলে যাবার পর এখনও ফোন করনি বলে মা বাবা ভাই সবাই চিন্তা করছিলেন। বার বার বলছিলেন তুমি ঠিকমত গিয়ে পৌঁছলে কিনা। তাই ও’পাশে তুমিই আছ ধরে নিয়ে অভিমান করে আর অনেক অনুযোগ করে অনেক কিছু বলছিলাম। আমি তো ভেবেছিলুম যে ফোনটা তুমিই ধরেছ। ফোনটা যে সতুদা ধরেছে আমি তো সেটা না শুনেই ও’সব কথা বলে ফেলেছিলুম”।
 

সীমন্তিনী বলল, “তুই কি ওকে আপনি আপনি করে বলেছিলিস নাকি”?

রচনা বলল, “হ্যা দিদিভাই, তাই তো বলেছি! প্রথমবার তার সাথে আজ কথা বললাম। সত্যি করে বলতে
 
গেলে তো আমাদের মধ্যে পরিচয়ই ছিল না আগে। তাই আপনি করেই বলেছি। কেন গো তাতে কী হয়েছে”?

সীমন্তিনী বলল, “না তেমন কিছু হয় নি। আমার ভাইটা একটু অভিমান করেছে। বলল যে আমি ওর বড় দিদি। আমাকে তুই নিজের দিদির মত তুমি তুমি বলছিলিস। আর ওকে তুই আপনি করে বলেছিস, তাতে ও খুব দুঃখ পেয়েছে”।
 

রচনা বলল, “এ মা, সে এমন কথা বলেছে বুঝি? ইশ আমাকে নিশ্চয়ই সে খুব খারাপ ভেবেছে, তাই না গো দিদিভাই”?

সীমন্তিনী বলল, “না না, খুব বেশী খারাপ বলে ভাবেনি রে। তবে ওই যে বললুম একটু অভিমান করেছে। ওই আর কি। তবে তুই ভাবিস নে। আমি ওকে বুঝিয়ে দেব। কিন্তু এরপর যদি আবার কখনও তার সাথে কথা হয় সেদিন আর আপনি আজ্ঞে করে বলিসনে ভাই। ও তো আমার ছোট ভাই। বয়সে অবশ্য তোর থেকে বড়ই হবে। তাই দাদা বললেও অন্ততঃ তুমি করে বলিস”।
 

রচনা বলল, “ইশ আমার খুব খারাপ লাগছে গো দিদিভাই। না জেনে না বুঝেই সতুদার মনে দুঃখ দিয়ে ফেলেছি। তুমি তো আমার লক্ষী দিদিভাই। তাকে একটু বুঝিয়ে বলোনা গো”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা রে বাবা আচ্ছা। দেব বুঝিয়ে। আর তোকে কান্নাকাটি করতে হবে না। এবার তোদের খবর বল তো শুনি। তোরা কে কেমন আছিস? আর রাজগঞ্জ থেকে কেউ আজ ফোন করেছিল”?
 

রচনা বলল, “হ্যা গো দিদিভাই। ওনার মা ফোন করেছিলেন। মা বাবার সাথে কথা বলার পর আমার সাথেও অনেকক্ষণ কথা বলেছেন আজ”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “ওমা! তাই! তা আজই এত কী কথা বললেন তিনি”?
 

রচনা বলল, “আর বোলো না গো দিদিভাই। আমি কেমন ড্রেস পড়তে ভালবাসি, কি খেতে ভালবাসি, সাজতে ভালবাসি কি না? সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিলেন তিনি”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলেননি তিনি”?

রচনা জবাব দিল, “বলেছে গো দিদিভাই। আরও অনেক কথা বলেছেন তিনি। তবে সে সব কি আর ফোনে এত ডিটেইলসে বলা যায় নাকি”?

______________________________
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#23
(Update No. 48)

সীমন্তিনী আবার জিজ্ঞেস করল, “তোর ভাল লেগেছে? ভাল করে কথা বলেছিস তো তার সাথে? না সেদিনের মত ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা ছিল তোর”?
 

রচনা বলল, “তোমাকে তো মিথ্যে বলতে পারব না দিদিভাই। একটু অস্বস্তি তো হচ্ছিলই। তবে সেদিনের মত অতটা নার্ভাস হইনি আজ”।
 

সীমন্তিনীর পরের প্রশ্ন, “তাহলে হবু শাশুড়ি মার সাথে আমার বোনটা আজ ভাল করেই কথা বলেছে। তা এত কথার মধ্যে তার কোন কথাটা তোর সবচাইতে ভাল লেগেছে বল তো শুনি”।
 

রচনা একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, “তার কোন কথাই তো খারাপ লাগেনি দিদিভাই। তবে সেদিন তুমি আমাকে একটা কথা বলেছিলে, সেটার সাথে তার একটা কথা একেবারে মিলে গিয়েছে। উনি আমাকে বলেছেন যে ‘তুমি আমাকে কী বলে ডাকবে জানিনা রচনা, আমিও তোমাকে কি বলে ডাকব সেটা এখনও ভেবে ঠিক করতে পারিনি আমি। কিন্তু তোমাকে আমি আমার ছেলের বৌ না ভেবে আমার মেয়ে বলে ভাবব, আমার নিজের কোন মেয়ে নেই। ভগবান আমাকে দুটো ছেলেই দিয়েছেন, তাই তুমি আমার মেয়ে হয়েই থাকবে চিরদিন’। ওই কথাটাই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে গো দিদিভাই”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাঃ, আমিও তো মনে মনে তাই চাইছিলুম রে রচু। তোর শাশুড়ি মা তোকে যেন তার নিজের মেয়ের মত করে ভালবাসেন। তা তুই কি বলেছিস তাকে? তুইও তাকে নিজের মায়ের মতই ভাববি সেটা বলিস নি”?
 

রচনা বলল, “না দিদিভাই। সেটা বলতে পারিনি গো। আসলে কি জান দিদিভাই, ভক্তি শ্রদ্ধা ভালবাসা এসব জিনিস তো বলে কয়ে বা ঢাক ঢোল পিটিয়ে হয় না। নিজের মনের ভেতর থেকে একটা তাগিদ জেগে না উঠলে বুঝি কাউকেই ভালবাসা যায় না, শ্রদ্ধা করা যায় না। তুমি প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিলে সেদিন মনের ভেতর থেকে কে যেন বলেছিল, এ তোর পরম আপনজন। তাই তো সহজেই তোমাকে আমার দিদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছিলাম। আর ওনাকে বিয়ের পর প্রথা মেনেই মা বলেই তো ডাকব। তবে প্রাণের ভেতর থেকে তাগিদটা না পেলে তাকে সত্যি সত্যি মায়ের জায়গায় বসাতে পারব কি না কে জানে। যদিও মনে মনে সে তাগিদ পাব বলেই আশা করছি আমি”।
 

সীমন্তিনী রচনার কথা শুনে সতীশের মুখের দিকে অবাক হয়ে চাইল। দেখে সতীশের চোখে মুখেও বিস্ময়ের ছাপ। ফোনে বলল, “আমি জানিরে রচু। তুই তোর প্রাণের ভেতর থেকেই সে তাগিদটা অনুভব করবি। তোর শাশুড়ি সত্যিই খুব খুব ভাল রে। আমি জানি। তবে তুই তো আজ আমাকে অবাক করে দিলি রে! এমন সুন্দর করে কথাটা বললি যে আমি একেবারে অভিভূত হয়ে গেলুম রে। ভাল থাকিস বোন। খুব খুব ভাল থাকিস তুই, আর তোরা সবাই”।
 

ফোন কেটে দিয়ে সীমন্তিনী সতীশের মুখের দিকে চাইতেই সতীশ অবাক গলায় বলে উঠল, “এ কি মেয়ে রে বড়দি? ভালবাসা ভক্তি শ্রদ্ধা নিয়ে এখনকার যুগের একটা মেয়ে এমন কথা বলতে পারে! সেটা নিজে কানে না শুনলে কখনই বিশ্বাস করতুম না আমি”।

সীমন্তিনীও রচনার মুখে এমন কথা শুনবে বলে আশাই করে নি। কত গভীর মর্মাথের একটা কথা রচু কি সহজেই না বলে বুঝিয়ে দিল! মাত্র সতের বছরের একটা মেয়ের ভেতর এ উপলব্ধি কী করে এল? সে সতীশের কথার জবাবে বলল, “এখন বুঝতে পাচ্ছিস ভাই? কেন আমি রচুকে আমাদের ঘরের বৌ করে তুলবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছি? এমন ভাবনা ক’টা মেয়ের মনে আসতে পারে বল। আমি জানি রচু আমাদের সংসারটাকে সবদিক দিয়ে একেবারে পরিপূর্ণ করে তুলবে। বাড়ির প্রত্যেকে ওকে ভালবাসতে বাধ্য হবে দেখিস। ও আমাদের সকলের চোখের মণি হয়ে উঠবে”।
 

সতীশ বলল, “হ্যারে বড়দি। এতদিন শুধু তোর আর মার মুখে ওর প্রশংসাই শুনেছি। আজ নিজের কানে ওর মুখের যে কথা শুনতে পেলুম, তাতে আমিও তোর কথার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত না হয়ে থাকতে পারছি না রে। আমার তো আর তর সইছে না। মনে হচ্ছে এখনই ছুটে চলে যাই কালচিনি”।

সীমন্তিনী বলল, “তুই বড়মাকে ফোন করে বলে দে। রচুদের বাড়িতে ফোন করে বলে দিক যে ছেলের ভাই আর বোন তাদের বাড়ি যাচ্ছে শনিবার। আর এটা বলতে ভুলিস না, আমাদের নাম যেন না বলেন। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে আনছি ভাই”।

ফ্রেশ হয়ে চা বানিয়ে সতীশের রুমে এসে দেখে সে তখনও ফোনে কথা বলে যাচ্ছে। সীমন্তিনীকে ঢুকতে দেখে সতীশ বলল, “এই যে বড়দি এসে গেছে মা। নাও দিদির সাথে কথা বল” বলে সীমন্তিনীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে তার হাতে ফোন ধরিয়ে দিল।
 

সীমন্তিনী ফোন হাতে নিয়ে বলল, “কিগো বড়মা? হবু বৌমার সাথে খুব কথা বললে আজ শুনলুম। তা কেমন লাগল তোমার বৌমাকে? তোমার মনের মত হয়েছে তো”?
 

সরলাদেবী বললেন, “আমি এখন বৌমার কথা ভাবছি না রে মা। আমি তো এখন তোর কথাই ভাবছি। তুই মাঠে না নামলে রচুকে কি আমরা পেতাম? তুই আমার জন্যে, তোর দাদাভাইয়ের জন্যে যা করলি তাতে তো আমরা সারা জীবনের জন্য তোর কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে থাকব রে মা। আমাকে ক্ষমা করিস মা। কিন্তু এবার নিজের জীবনটা নিয়েও একটু ভাবিস। এটা তোর কাছে আমার মিনতি রে মা। বল, তুই আমার এ মিনতিটা রাখবি তো”?
 

সীমন্তিনী সরলাদেবীর কথা শুনে অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বড়মা, তুমি তো জান মিথ্যে কথা বলা আর মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আমি আর যাকে যা-ই বলি না কেন। তোমাকে কখনও মিথ্যে কথা বলতে পারব না। তাই ও’কথা থাক না বড়মা। তোমার এ মেয়েটাকে তার তপস্যা নিয়ে থাকতে দাও না তুমি”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে সরলাদেবীও কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন “জানিরে মা। কারুর কথায় তুই কিছু করবি নে। তুই তো শুধু তোর মনের কথা শুনিস। তবে তোর এই মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখিস। আর ঠিক আছে শোন, সতুকে নিয়ে তুই যখন পরের শনিবার কালচিনি যাচ্ছিস তাহলে ওকে কাল বাড়ি পাঠিয়ে দিস। শুক্রবার ওর সাথে আমি কিছু জিনিস পাঠিয়ে দেব। ওগুলো কালচিনিতে নিয়ে যাস তোরা সাথে করে। আর রচুকে বলিস, যেন আমায় ফোন করে”।

সীমন্তিনী বলল, “ঠিক আছে বড়মা। তবে শোন, আমি যে সতুকে নিয়ে কালচিনি যাব, সে কথাটা এত আগেই তাদের জানিও না। শুক্রবারে সতু বাড়ি থেকে রওনা দেবার পর তাদের ফোন করে কথাটা বোল।
তবে মনে রেখো বড়মা, তখনও কিন্তু তোমরা আমার আর সতুর নামটা তাদের জানাবে না। শুধু বলবে যে বাড়ি থেকে ছেলের ভাই আর বোন কালচিনি যাচ্ছে। আর তোমাকে আরেকটা কথা বলছি বড়মা। ছেলের হবু বৌয়ের সাথে তুমি একাই শুধু কথা বললে হবে না। তোমার দুই জা, তোমার স্বামী আর দেওররাও যেন মাঝে মাঝে রচুর সাথে কথা বলে। আমি চাই ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতে রচু তোমাদের সকলের সাথে খোলামেলা হয়ে উঠুক, তোমাদের সবাইকে নিজের কাছের লোক বলে ভাবতে শুরু করুক। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে এসে সব মেয়েই একটু দ্বিধান্বিত একটু শঙ্কান্বিত থাকে। স্বামীর বাড়ির লোকেরা কে কেমন, তার কথা বার্তাকে কে তারা কিভাবে নেবে, এসব নিয়ে সব নতুন বৌরাই বেশ টেনশনে থাকে। আমি চাইনে রচু যখন আমাদের বাড়ির বৌ হয়ে আসবে, তখন ওর মনে কোন টেনশন থাকুক। সকলের সাথে ফোনে কথা বললে সকলের ব্যাপারেই ওর মনে একটা ধারণা জন্মে যাবে। আর আমি তো জানি, আমি সকলের চক্ষুশূল হলেও আমাদের বাড়ির লোকেরা সবাই সবাইকে ভালবাসতে পারে। ওদের বিয়েটা তো বছরখানেক বাদেই হবে। তাই আমি চাই এ বছর খানেকের মধ্যে জেঠু থেকে শুরু করে চন্দু পর্যন্ত সকলকেই যেন ও ফোনের মাধ্যমে চিনে উঠতে পারে। তাহলে বৌ হয়ে আমাদের বাড়িতে পা রাখবার সময় ওর মনে আর কোন দ্বিধা কোন সঙ্কোচ থাকবে না। ও জানবে যে বাপের বাড়ি ছেড়ে ও এমন একটা বাড়িতে আসছে যে সেখানে সবাই ওর পরিচিত। কেউই তার অচেনা নয়। আর এটা সম্ভব হবে ফোনে ফোনে সকলের সাথে কথা বলতে বলতেই। তাই বাড়ির কেউ যদি নিজে ইচ্ছে প্রকাশ না-ও করে তুমি রচুর সাথে তাদের কথা বলাবে”।
 

সরলাদেবী বললেন, “তুই যে কত ভাল একটা মেয়ে সেটা তো আর আমার জানতে বাকি নেই রে মা। কিন্তু আজ তোকে যেন একটু অন্যভাবে চিনলাম আমি। ভালো থাকিস মা। সুখে থাকিস। রাখছি”।
 

সীমন্তিনী জানে, তার বড়মা এবার নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে খানিকক্ষণ কাঁদবেন। তার কথা ভেবে চোখের জল বাড়ির আর কেউ যে ফেলে না, সেটা সে ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছে। বড়মা আর কাকু চন্দ্রকান্তই শুধু এখনও সীমন্তিনীকে ভালবেসে যাচ্ছেন। কিন্তু এ’কথা ভেবে তার চোখেও কখনও জল আসে না। সে জানে এতে বাড়ির লোকদের কোন দোষ নেই। সব দোষ শুধু তার একারই। প্রাণের চেয়ে প্রিয় তার দাদাভাইয়েরও এতে কোন দোষ নেই।
 
**************

বিধুবাবু সকাল সকালই বাজারে চলে গেছেন। রাজগঞ্জ থেকে তার হবু বেয়ান জানিয়েছেন যে রতীশের এক বোন আর এক ভাই আজ তাদের বাড়ি আসছে। তারা দু’জনেই নাকি বাইরে পড়াশোনা করছে। দাদার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে শুনে তারা নাকি তাদের হবু বৌদিকে দেখবার জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে। তাই তারা আজ কালচিনি আসছে।
 

বিধুবাবু এবং তার স্ত্রী বিভাদেবী রতীশের সাথে রচনার সম্মন্ধ পাকা করে ফেলে খুব খুশী হয়েছেন। পাত্রের বাড়ির প্রত্যেকটা লোকই বড় অমায়িক। তারা বুঝতে পেরেছেন যে তাদের ছোট মেয়ে রতীশদের বাড়িতে খুব স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারবে। কোন কিছুর অভাব নেই সে বাড়িতে। বড় মেয়ের মত দুর্ভোগ তাদের ছোট মেয়ের কপালে হবে না, এটা ভেবেই তারা খুশী। তারা স্বামী স্ত্রী রোজ রাতে রতীশদের বাড়ির লোকজনদের ভাল আন্তরিক ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করেন।

রাজগঞ্জ যাবার আগে সীমন্তিনী বিধুবাবুর হাতে জোর করেই পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিল। আসা যাওয়ার বাস, ট্রেন, রিক্সাভাড়া আর মিষ্টি কিনতে শ’ পাঁচেক টাকাও খরচ হয় নি। বাকি টাকাটা তার হাতেই রয়ে গেছে। তাই বিভাদেবীর কথাতেই তিনি সকাল সকাল বাজারে ছুটেছেন। আজ ভাল দেখে মাছ নিয়ে যাবেন রতীশের ভাই আর বোনকে খাওয়াবার জন্যে। বাজারের পথে যেতে যেতে তার সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল। মেয়েটা তাদের জন্য রচুর জন্য কত কী করছে। তিন তিনবার তাদের বাড়িতে এসে নানারকম ভাবে তাদের সাহায্য করেছে। রচুকে একটা দামী মোবাইল দিয়েছে। ছেলের বাড়ির সমস্ত খবরাখবর জানিয়েছে। তার বুদ্ধিমত চলেই বিনা পণে মেয়েকে অমন একটা সুন্দর পরিবারে বিয়ে দিতে পারছেন তারা। নইলে তো তার সাহসই হত না এগিয়ে যাবার। কিন্তু মেয়েটাকে শুধু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছু খাওয়াবার সামর্থ্যই হয়নি তাদের। আজ যদি সেও আসত তাহলে কি ভালই না হত। ইশ মেয়েটাকে ফোন করে একবার আসতে অনুরোধ করা যেত। বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আগের রাতেও তো মেয়েটা তাদের সাথে কথা বলেছে। বিভাদেবীই তো তাকে জানিয়ে দিয়েছেন যে রতীশের ভাই আর বোন আসছে। ইশ তখনও যদি কথাটা মাথায় আসত! কিন্তু রাতে রচনা বলছিল যে সীমন্তিনীকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন নাকি বেজে যাচ্ছে, কিন্তু সীমন্তিনীর সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এখন বাজার থেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে ওকে ফোন করেও তো আর কোন লাভ হবে না।
 

বিভাদেবীও সকালের চা খেয়েই দুপুরের রান্নার আয়োজন করতে শুরু দিয়েছেন। রাতে ছোলার ডাল ভিজিয়ে রেখেছিলেন। ডাল, কুমড়ো ভাজা, চালকুমড়োর ঘন্ট, আর সরসে বাটা দিয়ে ইলিশ ভাপার সাথে ছোলার ডালের রসা বানাবেন বলে ভেবেছেন। ছোলার ডালের রসাটা করতেই সবচেয়ে বেশী সময়ের প্রয়োজন। ডাল বেটে চপের মত আকৃতিতে ডেলা বানাতে হয়। তারপর সেটাকে গরম জলে রেখে শক্ত করে তুলতে হয়। তারপর ডেলা গুলোকে ছুড়ি দিয়ে চাকা চাকা করে কেটে নিয়ে একটু ঘিয়ে ভেজে নিতে হয়। তারপর সেগুলো নিয়ে রসা বানাতে হয়। অনেকটাই সময় লেগে যায়। তবে রসাটা রচুই বানাবে বলে অত চিন্তা হচ্ছে না। শুধু ডালটা তিনি নিজে শিলনোড়ায় বেটে দেবেন। মেয়েকে আগে থেকেই রান্নাবান্না শিখিয়ে দিয়েছেন। বেশ ভালই রাঁধে রচু। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা তার মেয়ের হাতের রান্না খেয়ে নিশ্চয়ই খুশী হবে। ডাল বাটতে বাটতে সীমন্তিনীর কথা মনে পড়ল তার। মেয়েটা তিন দিন এসেছে তাদের বাড়ি। কিন্তু ডাল ভাত ছাড়া আর কিছুই খাওয়াতে পারেননি তিনি। আজ তার স্বামীর হাতে কিছু পয়সা আছে ভাল করে বাজার করবার মত। আর সেটাও তো সীমন্তিনীর দৌলতেই। আজ যদি মন্তিও আসত তাহলে কী ভালই না হত। এমন ভাল মন্দ রান্না করার সুযোগ তো অনেক বছরের মধ্যে আসেনি। মেয়েটাকে খাওয়াতে পারলে তার মনটাও বেশ শান্তি পেত। রোজই তো মেয়েটা ফোন করে। কালও করেছিল। সকলের সাথে কথা বলেছে। তবে বলছিল এ সপ্তাহটা নাকি ক্লাস আর পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত আছে। কিন্তু মেয়েটাকে তো আসবার কথা বলা হয়নি। আর শেষ যখন কথা হয়েছে তখন তো রতীশের ভাই বোনের আসার খবরটা জানাতে গিয়ে অন্য কিছু বলাই হয়ে ওঠেনি। পরে বাড়ির কেউই কথাটা মনে করেনি। মনে মনে তিনি নিজেই নিজেকে গালমন্দ করে রাতে রচুকে বলেছিলেন সীমন্তিনীকে ফোন করতে। কিন্তু রচু আর কথা বলতে পারেনি। সীমন্তিনী নাকি ফোন ধরেই নি। বিভাদেবী ভেবে অবাক হয়েছিলেন, এমনটা তো এতদিনে কখনও হয় নি। যখনই সীমন্তিনীকে ফোন করা হয়েছে তখনই তার সাথে কথা হয়েছে।
 

রচনার কলেজ নেই এখন। দিন কয়েক আগে এগারো ক্লাসের পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছে। বরাবরের মত রচনা এবারেও প্রথম হয়েছে। কলেজে গিয়ে রেজাল্ট পেয়ে সবার আগে সে সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। তার দিদিভাই ফোনে কথাটা শুনেই আনন্দে চিৎকার করে উঠেছিল। রচনা তার দিদিভাইকে বলেছে একদিন কালচিনি আসতে। এ’কথাও বলেছিল যে আজ রাজগঞ্জ থেকে রতীশের এক ভাই আর এক বোন আজ তাদের বাড়ি আসছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে ও বাড়ির প্রায় সকলের সাথেই কথা হয়েছে তার। শুধু রতীশের নিজের ভাই আর বড়কাকা শশীকান্তবাবুর মেয়ের সাথেই তার কথা হয়নি। তারা দু’জনেই বাইরে পড়াশোনা করছে। আজ নাকি তারাই আসবে রচনাদের বাড়ি। এখন আর রচনা আগের মত অতটা ঘাবড়াচ্ছে না। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল, এ সময় তার দিদিভাই যদি তার পাশে থাকত তাহলে খুব ভাল হত। বাবা আর তার দিদিভাই যে রাজগঞ্জের ওই ছেলের সাথেই তার বিয়ে দেবে, এতে আর রচনার মনে কোন সন্দেহই নেই। আর প্রথমে দিদিভাইয়ের মুখে আর পরে মা বাবার মুখে ছেলের ও ছেলের বাড়ির সুখ্যাতি শুনে রচনাও মনে মনে খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছে। তার নিজের শ্বশুর বাড়ি দিদির শ্বশুর বাড়ির মত হবে না, এটা সে বুঝতে পেরেছে। আর দিদিভাই যা বলেছে তাতে তো মনে হয় ছেলেও দেখতে শুনতে ভালই হবে। তার মা বিভাদেবীও তো ছেলের অনেক প্রশংসা করেছেন। শুধু ছেলের ব্যাপারেই নয়, তার বাবা মা তো ছেলের বাড়ির সকলেরই প্রশংসা করেছেন। তবু রচনার মনের ভেতর আর একটা আশা ছিল, যে ব্যাপারে তার মা বাবা বা তার দিদিভাই প্রায় কিছুই বলেনি। সে ভেবেছিল কেউ না কেউ পাত্রের একটা ছবি নিশ্চয়ই তাকে দেখাবে। কিন্তু কেউই সেটা করেননি বলে মনে মনে একটু হতাশ হয়েছে সে। আর একটা চিন্তা তার মনে রয়ে গেছে। মা বলেছেন ছেলের বড় কাকার মেয়ে নাকি প্রায় ছেলের বয়সীই। মাত্র ছ’মাসের ছোট। বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে সে হবে রচনার বড় ননদ। ননদদের সাথে বৌদিদের নাকি প্রায় অহি নকুলের মত সম্পর্ক হয়ে থাকে। তাই বাবা মা রাজগঞ্জ থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই রচনা মনে মনে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছে, তার বড় ননদের সাথে যেন তার মনের মিল হয়। তার মনটা খুব চাইছে যে তার বড় ননদ যেন দিদিভাইয়ের মতই তাকে ভালবাসে। দিদিভাইয়ের মত একটা বড় ননদ তার কপালে জুটলে তার আর চিন্তার কিছু থাকবে না। তার সব স্বপ্নই তাহলে পূর্ণ হবে।

কুইজ কনটেস্টে যাবার দিন থেকে এই ক’টা দিনের মধ্যে তার জীবনে এমন সব ঘটণা ঘটে গেছে, যে সে একের পর এক চমৎকৃত হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় চমক হচ্ছে সীমন্তিনীর সাথে তার দেখা হওয়া। না, তার বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার ব্যাপারটাও কম চমকপ্রদ মোটেও নয় তার কাছে। কিন্তু তার পেছনেও তো সীমন্তিনীর হাত অনেকটাই আছে। তার দিদিভাই না থাকলে এমন একজন শিক্ষিত, সুন্দর দেখতে পাত্র, আর সেই সাথে এমন সুন্দর একটা শ্বশুর বাড়ির স্বপ্নও বুঝি সে দেখতে পেত না। অবশ্য রতীশকে সে এখনও দেখেনি। তার কোন ছবিও এখনও দেখেনি। তার খুব আশা ছিল যে মা বাবা নিশ্চয়ই ছেলের একটা ছবি চেয়ে আনবেন। কিন্তু তারা তা আনেননি। তবে তার দিদিভাইয়ের মুখে যতটা শুনেছে, তা থেকেই নিজের মনে রতীশের একটা অবয়ব তৈরী করে নিয়েছে সে। মাঝে মাঝে সে অবয়বটা তার চোখে সামনে ভেসে উঠে তাকেই যেন লজ্জিত করে ফেলে।

তার দিদিভাই নাকি ক্লাস আর টিউশন নিয়ে এ সপ্তাহটা খুব ব্যস্ত আছে। সামনেই নাকি একটা পরীক্ষা আছে। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও রচনা তাকে আসতে বলতে পারেনি। কিন্তু রাতে মা বিভাদেবীর কথায় সে আবার সীমন্তিনীকে ফোন করেছিল। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও সীমন্তিনীর সাথে আর কথা হয়নি। ফোনটা বেজে বেজেই থেমে যাচ্ছিল বারবার।
 

সকালে বাবা বাজারের ব্যাগ হাতে করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর রচনা ফোন করল সীমন্তিনীকে। এবারেও একই দশা। ফোনটা বেজে বেজে একসময় লাইন কেটে গেল। মনে মনে বেশ চিন্তা হচ্ছিল তার। এতদিনের মধ্যে একদিনও এমন হয়নি যে সীমন্তিনীকে ফোন করে সে তার সাথে কথা বলতে পারেনি। কাল রাত থেকে বারবার এমন হচ্ছে কেন, সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। সীমন্তিনী তার ফোন রিসিভ করবে না, এমনটা তো হতেই পারে না। তাহলে কি নেটওয়ার্কের কোন সমস্যা হচ্ছে কে জানে?

এমন সময় রান্নাঘর থেকে মা ডাকতেই সে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। বিভাদেবী মেয়েকে রান্নার কাজে একটু সাহায্য করতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে। মন্তিকে কি সকালে ফোন করেছিলিস”?

রচনা ছোলার ডালের ডেলা বানাতে বানাতে জবাব দিল, “একটু আগেই একবার করেছিলাম মা। কিন্তু এবারেও রাতের মতই দিদিভাইয়ের সাড়া পেলাম না। কেন যে এমনটা হচ্ছে কিছু বুঝতেই পাচ্ছি না”।

বিভাদেবী বললেন, “আমাদের কপালটাই বুঝি খারাপ রে মা। মেয়েটা এতবার আমাদের বাড়িতে এসেছে। কোনদিন একটুখানি ভালমন্দ রেঁধে ওকে খাওয়াতে পারিনি। আজ ওরই দয়াতেই তোর বাবার হাতে দুটো পয়সা ছিল বলে রতীশের ভাইবোনের আসার উপলক্ষ্যে দুটো পদ রান্না করতে পারছি। মনটা খুব চাইছিল, ওর মুখেও আজ একটু খাবার তুলে দিতে। কিন্তু দেখ, ফোনটাই কাজ করছে না। ভাগ্যের দোষ ছাড়া আর কি বলব একে? আচ্ছা খোকা কি করছে রে? বেরিয়ে গেছে নাকি”?
 

রচনা জবাব দিল, “না মা, ভাই পড়ছে গো। আর বাইরে গেলে কি ও তোমাকে না বলে বেরোয় কখনও? আচ্ছা মা, একটা কথা বলবে? তুমি দিদিভাইকে মনে মনে খুব ভালবেসে ফেলেছ, তাই না মা”?
 

বিভাদেবী বললেন, “সে তো ওকে দেখার পর থেকেই ভালবেসে ফেলেছি রে। সত্যি অমন মেয়ে ক’টা হয়
 
বল তো? তবে ও আমাদের জন্য যা কিছু করছে তার জন্যে ওকে আরও বেশী ভালবেসে ফেলেছি। কিন্তু সেসব বলতে গেলে নিজেকেই স্বার্থপর বলে মনে হবে। কিন্তু এমন মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়েকে ভাল না বেসে থাকা যায়, বল? আর কী সুন্দর দেখতে! মনে হয় সাক্ষাৎ মা দুর্গা। ওর মার কথা ভেবে আমার সত্যিই হিংসে হয় রে। একেবারে রত্নগর্ভা মেয়ে। কিন্তু মন্তির কপালটা দেখ। সেদিন আমার কোলে মাথা পেতে শুয়ে কি বলেছিল, তোর মনে আছে? ওর মা নাকি কখনও ওভাবে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন নি! এমন একটা মেয়ে পেয়েও কোন মা তাকে আদর না করে থাকতে পারে”?
 

রচনা বলল, “দেখ মা, দিদিভাইকে দেখে আমারও মনে হয় সে আমার খুব আপন। তুমি ঠিকই বলেছ। আমাদের জন্যে দিদিভাই যা কিছু করেছেন সে’সবের জন্যই যদি আমরা তাকে ভালবেসে থাকি, তাহলে সকলেই আমাদের স্বার্থপর বলে ভাববে। কিন্তু ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে যেদিন তাকে প্রথম দেখেছিলাম, তখনই আমার তাকে খুব ভাল লেগেছিল। আর তার দু’দিন বাদেই কাবেরীর সাথে যখন আমাদের বাড়ি এসে হাজির হয়েছিলেন তখন তো খুশীতে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আমার অনেক অনেক কাছের একজন অনেকদিন বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছেন। কিন্তু মা, দিদিভাইয়ের জীবনের কতটুকু কথা আর আমরা জানি বল? সে নিজে আমাকে অনেকবার বলেছে যে সে খুব খারাপ মেয়ে। সেদিন তোমার কোলে শোবার সময়েও তো বলছিল যে তার মা নাকি তাকে সবচেয়ে বড় অলক্ষ্মী বলে ভাবেন। তার মা যে কেন কোনদিন তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেননি, কেন তাকে অলক্ষ্মী বলে ভাবেন, সে’সব কথা তো আমাদের খুলে বলেনি। নিশ্চয়ই কোন কারন থেকে থাকবে এসবের পেছনে। কিন্তু সেসব নিয়ে ভেবে আমরা তো কোন কুল কিনারা বের করতে পারব না। তবে দিদিভাইয়ের মত মেয়ে লাখেও একটা খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ আছে। ভগবান যদি আমায় সুযোগ দেন, দিদিভাইয়ের সুখের জন্য আমি সব কিছু করার চেষ্টা করব”।

বিভাদেবী বললেন, “আমি তো সারা জীবনেও ওকে ভুলতে পারব না। কিন্তু ওর উজ্জ্বল মুখটার পেছনে একটা ব্যথাও যেন কোথাও জমা হয়ে রয়েছে, আমার এমনটাই মনে হয়। নইলে এমন অপরূপা বিদুষী একটা মেয়ের ছাব্বিশ বছর বয়স হতে চলল, অথচ তার বাবা মায়েরা তার বিয়ে দেন নি! এটা ভেবে কেন যেন ভাল লাগছে না রে”।
 

রচনা বলল, “আজকাল তো অনেক মেয়েই লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় মা। আর দিদিভাই লেখাপড়াতেও খুব ভাল। এখন এমএ পড়ছেন। এরপর তিনি আইপিএসে বসে পুলিশ অফিসার হবার স্বপ্ন দেখছেন। এতে দোষের কিছু আছে বলে আমার মনে হয় না মা। তবে বিয়ে সাদির ব্যাপারে মনে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। আমি অনেকবার ভাবলেও তার বিয়ের ব্যাপারে কোন কথা জিজ্ঞেস করতে পারিনি”।
 

এমন সময় বিধুবাবু বাড়িতে ঢুকে খুব খুশী হয়ে হাক ছাড়লেন, “রচু মা, কোথায় গেলি রে? দেখ আজ কি ভাল ইলিশ মাছ পেয়েছি রে! একেবারে পদ্মার ইলিশ। শিলিগুড়ি থেকে এনেছে এখানে” বলতে বলতে রান্নাঘরের বারান্দায় উঠে এলেন। বিভাদেবী আর রচনাও ঘর থেকে বেরিয়ে মাছ দেখে খুব খুশী।
 

বিভাদেবী মাছটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের ভেতর ঢুকতেই বিধুবাবু রচনাকে বললেন, “ও তুইও বুঝি কাজে ব্যস্ত আছিস? তা হ্যারে মা। মন্তিমাকে কি আর ফোন করেছিলিস”?

রচনা জবাব দিল, “করেছিলাম বাবা। কিন্তু এবারেও কথা হয় নি”।

বিধুবাবু কলপাড়ের দিকে যেতে যেতে নিজে নিজেই বললেন, “কী আশ্চর্য ব্যাপার! এমনটা তো কখনও হয়নি”।

রচনা রান্নাঘরে ঢুকে আবার নিজের কাজে হাত দিল। খানিকক্ষণ বাদে কিংশুক রান্নাঘরে ঢুকতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “কিরে ভাই? পড়া শেষ হয়েছে তোর? এখন কি বেরোবি”?
 

কিংশুক বলল, “নারে ছোড়দি, আজ এ বেলা আর বেরোব না। তোর শ্বশুর বাড়ি থেকে লোকজন আসবে। আমাকে না দেখলে তারা খারাপ পাবেন না? আমি এখন দিদিভাইয়ের দেওয়া ভিডিও গেম খেলব। মা তুমি কিন্তু বারণ কোর না”।
 

বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে খেলগে যা”।

______________________________
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#24
(Update No. 49)

বিভাদেবী আর রচনা মিলে রান্না প্রায় শেষ করে ফেলেছে। এমন সময় বিধুবাবু বাইরের ঘরের বারান্দা থেকে প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, “ওরে রচু। এই দেখ কে এসেছে”?
 

রচনা আর বিভাদেবী হাতের কাজ ফেলে রেখেই রান্নাঘরের বারান্দায় এসে উঠোনের দিকে চেয়েই খুশীতে চেঁচিয়ে উঠল। সীমন্তিনী আর সতীশ দু’জনেই হাতে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। রচনা বারান্দা থেকে লাফ দিয়ে নেমে “দিদিভাই” বলে ছুটে এসে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরল। সীমন্তিনীও রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরল।
 

বিভাদেবী বারান্দা থেকেই বলে উঠলেন, “রচু তোর হাতের মশলা মন্তির কাপড়ে লেগে যাবে দেখিস”।

সীমন্তিনী রচনাকে একটু আদর করে ছেড়ে দিয়ে বলল, “দাঁড়া আগে মাসি মেসোকে প্রণাম করতে দে” বলে সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “আয় ভাই। এই দেখ আমার আরেকটা ভাই” বলে কিংশুকের গাল টিপে দিল। বারান্দায় প্যাকেটগুলো রেখে সীমন্তিনী আর সতীশ বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করে বলল, “মাসি মেসো, ও আমার ভাই সতু। তোমাদের বলেছিলাম না আমরা দু’জন জলপাইগুড়িতে একসাথে থেকে পড়াশোনা করছি”।
 

বিভাদেবী আর বিধুবাবু দু’জনকে আশীর্বাদ করে বসতে বললেন। সতীশকে নিয়ে নিজেদের বারান্দায় উঠে
 
বিধুবাবু একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, “তোমরা আসাতে আজ আমরা খুব খুশী হয়েছি বাবা, বোসো এখানে”।

সীমন্তিনী রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কি রান্না করছিস নাকি”?

রচনা হেসে বলল, “মাকে একটু সাহায্য করছিলাম শুধু”।

সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে বলল, “একটু আয় এদিকে” বলে সতীশের কাছাকাছি নিয়ে বলল, “ভাই দেখ। এটাই আমার রচু সোনা। আমার বোন, আমার বান্ধবী সব”।
 

রচনা অভিমানী গলায় বলল, “ইশ দিদিভাই। একটু দাঁড়াও না। হাতটা ধুয়ে আসতে দাও। সেদিন দাদাকে উল্টোপাল্টা কত কিছু বলে দুঃখ দিয়েছি। আজ একটু প্রণাম করে আগে তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে দাও আমাকে” বলে সতীশের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হেসে বলল, “একটু বস দাদা। আমি হাতটা ধুয়ে আসছি”।
 

সতীশও হেসে বলল, “হাত ধুয়ে আসবে, সে ঠিক আছে। কিন্তু প্রণাম টনাম করতে হবে না তোমাকে। আর যেটুকু অভিমান আমার সেদিন হয়েছিল, সেটুকুও এখন আর নেই। তাই ক্ষমাও চাইতে হবে না তোমাকে”।
 

সীমন্তিনী সতীশকে বলল, “ভাই তুই একটু মেসো আর ভাইয়ের সাথে কথা বল। আমি মাসির সাথে একটু কথা বলে আসছি” বলে কলতলার দিকে চলে গেল। হাত পা ধুয়ে রান্নাঘরের দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল মা আর মেয়েতে মিলে দুটো উনোনে রান্না করছে।

রচনা তাকে দেখে বলল, “এসো দিদিভাই। আর একটু সময় দাও আমাকে। আমার রান্নাটা শেষ হয়ে এসেছে। এখনই হয়ে যাবে। আর মা-র রান্নাও শেষ হয়ে গেছে” বলে বিভাদেবীকে বলল, “মা তুমি নাহয় দিদিভাইকে নিয়ে ঘরে যাও। আমি রসাটা নামিয়েই আসছি”।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর চিবুকে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বললেন, “তুই আজ এসে খুব ভাল করেছিস মা। তোর কথা খুব মনে পড়ছিল আজ। চল ও ঘরে চল” বলে নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,
 
“তোরা তো এলি। কিন্তু রতীশের ভাই আর বোন কখন আসবে কে জানে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “ভেব না মাসি। ওরাও এসে পরবে। আমরা তো ভোরের ট্রেন ধরে এসেছি। আচ্ছা মাসি আমি একটু আমার ছোট ভাইটার সাথে একটু কথা বলে নিই। নইলে ওর অভিমান হবে আবার” বলে কিংশুকের কাছে গিয়ে বলল, “ভাই, তোমার খবর কি? পড়াশোনা ঠিকঠাক চলছে তো”?
 

কিংশুক খুশী হয়ে বলল, “হ্যা দিদিভাই। পড়াশোনা ঠিকমতই করছি। মাত্র আধঘন্টা আগে আমি পড়া
 
ছেড়ে উঠেছি। তাই তোমার দেওয়া ভিডিও গেম খেলছিলাম বসে বসে। এই দ্যাখ” বলে ভডিও গেমটা দেখাল।

সীমন্তিনী কিংশুককে আদর করে বলল, “খুব ভাল। কিন্তু আমার কথাটা মনে আছে তো ভাই”?

কিংশুক হেসে বলল, “মনে আছে দিদিভাই। আর মনে প্রাণে সেটা মেনেও চলছি। তোমাকে দেওয়া কথা আমি ভুলে যেতে পারি? এবারেও দেখো, আমিই ফার্স্ট হব”।
 

সীমন্তিনী কিংশুকের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “এই না হলে আমার ভাই? কিন্তু শুধু এ বারের কথা বললে হবে না ভাই। তোমাকে কিন্তু সব সময় সব পরীক্ষায় প্রথম হতে হবে। নইলে আমি কিন্তু খুব দুঃখ পাব। তুমি আমার মনে দুঃখ দিতে পারবে”?
 

কিংশুক মাথা নিচু করে বলল, “দিদিভাই, তোমাদের চেয়ে বয়সে আমি অনেক ছোট। অনেক কিছুই হয়ত ভালভাবে বুঝতে পারি না। কিন্তু গত কয়েকটা দিনে তুমি আমাদের জন্যে যা যা করেছ, এমনটা কেউ কখনও আমাদের জন্যে করে নি। এটুকু অন্ততঃ বুঝেছি আমি। তাই তুমি আমার কাছে ভগবানের মত হয়ে গেছ। আর নিজেকে দেওয়া কথাও হয়ত কেউ অমান্য করতে পারে। কিন্তু ভগবানকে দেওয়া কথা কি কেউ ফেলতে পারে? তোমাকে আমি আজ কথা দিচ্ছি দিদিভাই। তুমি যা চাইছ সেটা করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব। এরপর কী হবে সেটা ভবিষ্যতে দেখতে পাবে তুমি”।
 

সীমন্তিনী কিংশুকের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে অনেকক্ষণ তার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। তারপর তার দু’গালে হাত রেখে তার মুখটাকে উঁচু করে ধরে তার কপালে একটা স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, “না ভাই। আমাকে ভগবানের সাথে তুলনা কোর না। আমি ভগবানও নই, আর খুব ভাল মানুষও নই। আমি, আমি খুব খারাপ একটা মেয়ে। কিন্তু তোমাকে ভাল হতে হবে ভাই। মনে রেখ, তোমাকে বড় হয়ে নিজের সাথে সাথে তোমার মা বাবার ভবিষ্যতটাও সুন্দর করে তুলতে হবে। আজ তারা তোমার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রেখেছেন। ভবিষ্যতে তুমি বড় হয়ে তাদের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেবে। আর সে দায়িত্ব ভালভাবে পালন করতে হলে তোমাকে ভবিষ্যতে নিজের পায়ের তলার মাটিটাকে অনেক অনেক শক্ত করে তুলতে হবে। তাই এখন থেকেই তোমাকে সে লক্ষ্যস্থির রেখে এগোতে হবে ভাই। তাই মন দিয়ে লেখাপড়া করাটা খুবই দরকার। তাই না”?
 

কিংশুক সীমন্তিনীর হাত দুটো নিজের হাতে মুঠো করে ধরে বলল, “তোমার কথা আমার মনে থাকবে দিদিভাই। আর সে চেষ্টাই করব”।
 

সীমন্তিনী মিষ্টি করে হেসে বলল, “লক্ষ্মী ভাই আমার। এবার খেলা ছেড়ে আমার সাথে একটু ও ঘরে চল তো। আর এ প্যাকেটগুলো নিতে আমাকে একটু সাহায্য কর”।
 

দু’জনে মিলে প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বিধুবাবুর ঘরে এসে ঢুকল। রচনা তখন সতীশ আর বিধুবাবুর হাতে চায়ের কাপ উঠিয়ে দিচ্ছিল। সীমন্তিনী ঘরে ঢুকতেই রচনা তার হাতেও চায়ের কাপ তুলে দিয়ে বলল, “ভাইকে আদর করা হল তোমার দিদিভাই? নাও চা নাও”।
 

বিভাদেবী বিধুবাবুও সতীশের পাশে বসেছিলেন। বিভাদেবী একটু উদবিঘ্ন গলায় স্বামীকে বললেন, “কি গো, বেলা তো এগারটা বেজে গেল। ওদের তো দেখা নেই এখনও। আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম, ষ্টেশনে গিয়ে অপেক্ষা করতে। ওরা প্রথমবার আসছে। বাড়ি খুঁজে পেতে হয়ত অসুবিধে হচ্ছে”।
 

বিধুবাবু বললেন, “সত্যি গো। তাদের তো এতক্ষণে পৌঁছে যাওয়া উচিৎ ছিল। হ্যারে মা রচু। আজ কি রাজগঞ্জ থেকে কেউ ফোন করেছিল? ওরা রওনা হয়েছে কি না কিছু বলেছে”?
 

রচনা একটা টুলে বসতে বসতে বলল, “না বাবা, আজ তো কেউ ফোন করেনি”।

বিভাদেবী আবার বললেন “আমার সত্যি চিন্তা হচ্ছে গো এখন”।

সীমন্তিনী সতীশের দিকে ঈশারা করতে সে বলল, “মাসিমা। আপনারা অযথা চিন্তা করবেন না। আসলে আমরা আপনাদের কাছে একটা সত্য গোপন করে যাচ্ছি। সেজন্যে আগে থেকেই আপনাদের সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমরা। যদি আপনারা অভয় দেন, তাহলে আমি এবার সত্যি কথাটা খুলে বলি”।

সীমন্তিনী আর সতীশ বাদে ঘরের সকলেই এ কথা শুনে অবাক হল। বিধুবাবু কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বললেন, “আমি তো তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না বাবা। কোন সত্য গোপন করবার কথা বলছ তুমি, বল তো”।

সতীশ কিছু বলার আগেই রচনা বলে উঠল, “আমি বলছি বাবা শোন। রাজগঞ্জ থেকে যাদের আসবার কথা ছিল আজ, তারা অনেক আগেই আমাদের বাড়ি পৌঁছে গেছেন”।
 

বিভাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে”?
 

রচনা সতীশ আর সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে বলল, “এখনও বুঝতে পাচ্ছ না মা? আমাদের এ গরীবখানায় এই মূহুর্তে যে দু’জন বসে আছেন আমাদের সামনে, এনারাই তারা। শ্রীমান সতীশ ভট্টাচার্যি আর শ্রীমতী সীমন্তিনী ভট্টাচার্যি”।

সতীশ চা খেতে খেতে বিষম খেল। আর সীমন্তিনীও চোখ বিস্ফারিত করে রচনার দিকে চাইল। বিধুবাবু, বিভাদেবী আর কিংশুকও রচনার কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক।
 

কিংশুক ছুটে রচনার কাছে গিয়ে তার হাতে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করল। “তুই ঠিক বলছিস ছোড়দি? আমার এ দিদিভাইই আমার নতুন জামাইবাবুর বোন? মানে তুই বিয়ের পর দিদিভাইদের সংসারের একজন হয়ে উঠবি”?

রচনা সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে আগের মতই মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে জবাব দিল, “ভাই, সেটা তোর দিদিভাইকেই জিজ্ঞেস কর না”।
 

কিংশুক ছুটে সীমন্তিনীর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, বল না গো। ছোড়দি কি ঠিক বলছে”?

সীমন্তিনী নিজের হাতের কাপটা নামিয়ে রেখে কিংশুকের হাত ধরে বলল, “হ্যা ভাই, তোমার ছোড়দি একেবারে ঠিক কথা বলেছে”।

তারপর সীমন্তিনী বিধুবাবুর কাছে গিয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “হ্যা মেসো। আমিই তোমার হবু জামাইয়ের ছোট বোন সীমন্তিনী। আর তোমাদের জামাইই আমার আদরের দাদাভাই। আর এতদিন যে সতুকে তোমরা শুধু আমার ভাই বলে জানতে, ও আসলে তোমার জামাইয়ের ছোট ভাই সতীশ। তোমাদের কাছে নিজের আসল পরিচয়টা গোপন রেখেছিলাম বলে আমাকে ক্ষমা কর তোমরা সবাই। কিন্তু দয়া করে এমনটা ভেবনা, যে এর পেছনে আমার মনে কোন দুরভিসন্ধি ছিল বা আমি কোন মিথ্যে কথা বলে তোমাদের ঠকাতে চাইছিলাম”।
 

বিভাদেবী এবার নিজের মুখ খুলে বললেন, “তার মানে রচু ঠিক বলছে? তোমরাই রতীশের ভাই বোন”?

বিধুবাবুও নিজের নিস্তব্ধতা ভেঙে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “কিন্তু এভাবে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে মিথ্যে কথা বলে আমাদের ঠকালে কেন মা তুমি”?
 

এবার সতীশ বিধুবাবুর হাত ধরে মিনতি ভরা গলায় বলল, “না মেসোমশাই, এমন কথা বলবেন না প্লীজ। আপনাদের কোনভাবে ঠকানোর ইচ্ছে আমাদের ছিল না। আর সেটা দিদি বা আমি করিও নি কখনও। বিয়ে শাদি তো আর ছেলেখেলা নয়। আর এটা শুধুমাত্র একটা ছেলে আরেকটা মেয়ের জীবনের ব্যাপার নয়। দুটো গোটা পরিবার নতুন আত্মীয়তার সূত্রে বাঁধা পড়ে যায় এতে। আর আত্মীয়তা কথাটা আত্মার সঙ্গে জুড়ে থাকে। আর মিথ্যের ওপর আত্মীয়তার ভিত গড়লে সে আত্মীয়তা কখনও মজবুত হতে পারে না। আপনি আমার অপরাধে নেবেন না মেসোমশাই। কিন্তু কথাটা না বলেও পারছি না। আপনার বড় মেয়ের কথা তো আমরা শুনেছি। আপনি নিজেই তো সেটা বুঝতে পেরেছেন যে মিথ্যের ওপর সরল মনে বিশ্বাস করে বড় মেয়ের বিয়ে আপনারা ঠিকই দিয়েছেন। কিন্তু তাতে কি ভাল কিছু হয়েছে? হয়নি। না আপনার মেয়ে সেখানে ভাল আছে, না সে পরিবারের সাথে আপনাদের কোন আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর আমার বড়দা আমাদের বাড়ির এ জেনারেশনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। আপনার ছোটমেয়ে আমাদের বাড়ির বড়বৌ হতে চলেছে। আর একটা একান্নবর্তী পরিবারে বড়বৌয়ের হাতে অনেক দায়িত্ব থাকে। আমাদের বাড়ির গুরুজনদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম, কিন্তু আমাদের ছ’ ভাইবোনকে নিজের ভাইবোনদের মত ভালবাসতে হবে তাকে। তাই আপনার ছোটমেয়ের মতই এমন মিষ্টি স্বভাবের একটা মেয়ে আমরা সবাই খুঁজছিলাম। কিন্তু জানেন তো, এমনিতে হয়ত অনেক ভাল ছেলে মেয়ের সাথেই দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু ঘরের বৌ বা ঘরের জামাই করবার সময় পছন্দসই মেয়ে বা ছেলে দুটোই খুঁজে পাওয়া খুব দুষ্কর। আর আমাদের পরিবারের মধ্যে আমার দিদি আমার দাদাকে যতটা ভালবাসে, ততটা ভাল আর কেউ বাসে না। আর দাদাও দিদির সম্মতি ছাড়া কোন কাজ করে না। আপনার ছোট মেয়েকে সেদিন ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে প্রথমবার দেখেই আমি, দাদা আর দিদি আপনার মেয়েকে পছন্দ করেছিলাম। আর আমাদের বাড়ি থেকে দিদির ওপরেই ভার দেওয়া হয়েছিল দাদার জন্যে একটা উপযুক্ত মেয়ে খুঁজে বের করবার। আপনাদের মেয়েকে ভাল লাগলেও আমাদের মনে কিছুটা সংশয় ছিল। অপরাধ নেবেন না মেসো মশাই। আজকাল দেশের পরিস্থিতি যা হয়েছে, তাতে এ যুগের ছেলে হয়েও আমার স্বীকার করতে বাঁধা নেই যে একটা ভাল মেয়েকে উঠতি বয়সের ছেলেরা নানারকম প্রলোভন দেখিয়ে তাদের নিজেদের ভালবাসার জালে জড়িয়ে ফেলে। আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই মেয়ের অভিভাবকেরা এ ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে যান। তারা মেয়ের মনের ভেতরের কথা না জেনেই অন্য কোন ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে দেন। কখনও কখনও এমনও হয়ে থাকে যে তারা তাদের মেয়ের ভালবাসাকে মেনে না নিয়ে জোর করেই তারা অন্য ছেলের সাথে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেন। কিন্তু এমন বিয়ের পরিণাম কখনও ভাল হয় না। পরিবারে পরিবারে অশান্তি তো হয়েই থাকে। এমনকি পরিবারের সদস্যদের অনেকের প্রাণ পর্যন্ত চলে যায়। আপনাদের মেয়েকে দেখে আমাদের ভাল লাগলেও আমরা সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আপনাদের কাছে আসতে চাইনি। আমরা চেয়েছিলাম কোন ভাবে আপনার মেয়ের মনের ভেতরের কথাটা জানতে। তাই আমাদের সবার সাথে পরামর্শ করে দিদি এখানে এসেছিল। দিদির ভেতর একটা অদ্ভুত শক্তি আছে। সে খুব সহজেই সকলের সাথে মিলে মিশে যেতে পারে। তাই দিদিকে আমরাই এখানে পাঠিয়েছিলুম, শুধু এটা জানতে যে আপনার মেয়ে কোন ছেলেকে ভালবাসে কি না। আর সে আমাদের ঘরের বড়বৌ হবার উপযুক্ত কিনা। আমাদের কারুর মনেই আর অন্য কোন অভিসন্ধি ছিল না”।
 

সবাই চুপচাপ সতীশের কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। সতীশ থামতেই সীমন্তিনী বলল, “হ্যা মেসো। ভাই যা বলছে তা সম্পূর্ণ ঠিক। তবে আমি জানি তোমাদের কাছে মিথ্যে পরিচয় দিয়ে মিথ্যে কথা বলেছি বলে তোমার মনে দুঃখ হয়েছে। আর এমনটা তো হবারই কথা। কিন্তু আমি মনে করি ভাল কিছু করবার জন্যে একটু আধটু মিথ্যে কথা বললে সেটা বড় কোন অপরাধ করা হয় না। আমি রচুর কথা ছেড়ে দিচ্ছি আপাততঃ। তুমি আর মাসি তো আমাকে মেয়ে বলে মেনেছ। কিংশুক প্রথম দিন থেকেই আমাকে তার দিদিভাই বানিয়ে নিয়েছে। তোমরা তো কেউ আমার সাথে মিথ্যাচার করনি। আমার নিজের বাবা মা আমাকে কতটা ভালবাসেন তা আমি এতদিন বুঝতেই পারিনি। কিন্তু তুমি আর মাসি আমাকে যতটা ভালবেসেছ এতটা ভালবাসা আমি আমার মা বাবার কাছ থেকে কখনও পাইনি। তাই মনে মনে আমিও নিজেকে তোমাদের আরেকটা মেয়ে বলে ভেবেছি। তাই তোমার দিব্যি করে বলছি, আমি যে ও বাড়িরই মেয়ে, এটা গোপন রাখতেই শুধু কিছু মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের পরিবারের ব্যাপারে, আমার দাদাভাইয়ের ব্যাপারে একটা বর্ণও তোমাদের আমি মিথ্যে বলিনি। তোমরা নিজেরাও তো সেখানে গিয়ে দেখেছ। তোমাদের কি মনে হয়েছে আমি মিথ্যে কিছু বলেছি? এখনও যদি তোমাদের মনে কোন সংশয় থেকে থাকে, তাহলে তোমরা আরো খোঁজ খবর নিয়ে দেখ। একটা বছর সময় তো হাতে আছেই। আমার মনে হয় কোন ছেলের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেবার পক্ষে একবছর সময়টা যথেষ্ট। কিন্তু দোহাই তোমার। তোমরা এ সম্পর্কটাকে নাকচ করে দিও না মেসো। আমাকে তোমরা যে শাস্তি দিতে চাও দাও। আমি তোমাদের সব শাস্তি মাথা পেতে নেব। তোমরা চাইলে মিথ্যে কথা বলার অপরাধে আমাকে মেরে ফেলতে পার। আমি কিচ্ছুটি বলব না। কিন্তু রচুকে আমার দাদাভাইয়ের হাতে তুলে দিতে আপত্তি কোর না” বলতে বলতে বিধুবাবুর পায়ে লুটিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
 

ঘরে সবাই চুপ করে থাকলেও কিংশুক ছুটে এসে পেছন থেকে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলতে লাগল, “ও দিদিভাই। তুমি কেঁদো না গো”।

কিংশুকের কথায় যেন সকলের সন্বিত ফিরল। রচনাও আরেকপাশ থেকে সীমন্তিনীকে ধরে ওঠাতে চেষ্টা করে বলল, “ওঠো দিদিভাই। তুমি এভাবে কাঁদছ কেন? ওঠো প্লীজ”।

সীমন্তিনী তবু বিধুবাবুর পা জড়িয়ে ধরে পাগলের মত একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে, “আমাকে শাস্তি দাও তুমি মেসো। কিন্তু এ বিয়েটা ভেঙে দিও না। দয়া কর আমাকে”।
 

সীমন্তিনীর অবস্থা দেখে সতীশের চোখেও জল এসে গেল। সে আর থাকতে না পেরে উঠে ঘরের বাইরে চলে যেতে উদ্যত হতেই বিভাদেবী তার হাত ধরে ধরা গলায় বললেন, “কোথায় যাচ্ছ বাবা তুমি? বস তুমি এখানে। আমি দেখছি” বলে তাকে আবার বিছানায় বসিয়ে দিয়ে রচনা আর কিংশুককে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে সীমন্তিনীকে পেছন থেকে জাপটে ধরে বললেন, “ওঠ মা। আর কাঁদতে হবে না। তুই না তোর মেসোর মা অন্নপূর্ণা। তোর মত একটা মেয়ে আমার ঘরে চোখের জল ফেললে আমার যে অমঙ্গল হবে রে”।

সীমন্তিনী তাও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, “না না মাসি, মেসো আমাকে ক্ষমা না-ই করুন। আমি আর কখনও আমার এ মুখ নিয়ে তোমাদের কাছে আসব না, আমি কথা দিচ্ছি। কিন্তু মেসো যতক্ষণ না বলবেন যে তিনি এ বিয়েটা ভেঙে দেবেন না, ততক্ষণ আমি আমি এভাবেই তার পায়ে পড়ে থাকব”।

বিভাদেবী তার স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, “ওগো তুমি কিছু বলছ না কেন? মেয়েটা এভাবে কেঁদে কেঁদে তোমার পায়ের ওপরেই মরে যাক, এটাই কি চাইছ তুমি”?
 

বিধুবাবু এবার সীমন্তিনীর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “ওঠো মা। মা অন্নপূর্ণা হয়ে তুমি এভাবে আমার পায়ের ওপর চোখের জল ফেলে আমাকে আর পাপী করে তুলো না মা। ওঠো। আর তুমি তো সত্যিই কোন অন্যায় করনি। তুমি যে তোমার দাদাভাইকে কতখানি ভালবাস, সেটা বুঝতে পারছি। আর আমাদের রচুকেও যে তুমি এমনি করে ভালবাসবে, তাও আমি বুঝেছি। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মা। রচুর বিয়ে তোমার দাদাভাইয়ের সাথেই দেব আমরা। এবার ওঠো লক্ষ্মী মা আমার”।
 

সীমন্তিনী সে কথা শুনে একেবারে শান্ত হয়ে গেল। বিভাদেবী জোর করে তাকে টেনে তুলতেই তার দেহটা বিভাদেবীর বুকের ওপর এলিয়ে পড়ল। সীমন্তিনীর বোজা চোখ দুটোর ভেতর থেকে জলের ধারা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তার শরীরে একেবারে সাড় নেই। বিভাদেবী আঁতকে উঠে বললেন, “ওরে ও রচু, মেয়েটা বুঝি অজ্ঞান হয়ে গেছে রে। একটু জল নিয়ে আয় মা শিগিগীর”।
 

ঘরের মধ্যে মূহুর্তে শোরগোল পড়ে গেল। বিভাদেবী, বিধুবাবু আর কিংশুক সকলেই সীমন্তিনীর নাম ধরে ডাকতে শুরু করল। সতীশও কি করবে কি করবে না কিছু বুঝতে পারল না। চরম উৎকণ্ঠা বুকে চেপে সকলের পেছনে দাঁড়িয়ে সে দিদির মুখের দিকে চেয়ে রইল।
 

কয়েক সেকেণ্ড বাদেই রচনা একটা জলের মগ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে সীমন্তিনীর পাশে বসে তার মাথাটাকে নিজের কোলের ওপর টেনে নিয়ে তার চোখে মুখে জলের ঝাঁপটা দিতে লাগল। একটু বাদেই সীমন্তিনী চোখ মেলে চাইতেই বিভাদেবী বলে উঠলেন, “এই তো, এই তো মা আমার চোখে মেলে চেয়েছে। রচু মা, আমি ওকে ধরছি। তুই এক কাপ দুধ নিয়ে আয় তো মা চট করে। একটু দুধ খেলেই ও ঠিক হয়ে যাবে। আর শোন দুধটা বোধ হয় ঠাণ্ডা হয়ে গেছে এতক্ষণে। একটু হাল্কা গরম করে আনিস”।

রচনা আবার ছুটে রান্নাঘরে চলে গেল। কিংশুক সীমন্তিনীর মুখের ওপর ঝুঁকে বলল, “ও দিদিভাই। তুমি ঠিক আছ তো? বল না দিদিভাই। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে তোমার”?

সীমন্তিনী আলতো করে কিংশুকের একটা হাত ধরে একটু হাসবার চেষ্টা করে বলল, “না ভাই, কিচ্ছু হয়নি আমার। কোন কষ্ট হচ্ছে না আমার। এই তো দেখ না। আমি একদম ঠিক হয়ে গেছি এখন”।
 

বিধুবাবু আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “ইশ। কী ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে মা তুমি? এমন করে কাঁদবার কি হয়েছে বল তো? তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমাকে গালমন্দ করব? তাই কি কখনও হতে পারে মা? তুমি যে আমাদের মা অন্নপূর্ণা গো”।
 

সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে বিধুবাবুর পায়ে হাত দিয়ে বলল, “সত্যি বলছ মেসো? আমাকে তুমি ক্ষমা করে
 
দিয়েছ তো? আমার দাদাভাইয়ের সাথে রচুর বিয়ে দেবে তো”?
 

বিধুবাবু নিচু হয়ে সীমন্তিনীর হাত ধরে বললেন, “তোমার দাদাভাইয়ের সাথে আমি মেয়ের বিয়ে দেব না, এ’কথা কি একবারও বলেছি আমি? আর তোমাকে ক্ষমাই বা করার প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? তুমি তো যা কিছু করেছ তা কেবল তোমার দাদাভাইয়ের জন্যে করেছ। আর এতে তোমার ইচ্ছেপূর্তির সাথে সাথে আমরাও তো উপকৃত হয়েছি মা। আমার ছোট মেয়েটা যে এত কপাল করে এসেছিল সে তো আমি ভাবতেও পারিনি। চিরদিনের মত তোমার মত একটা দিদি পেয়ে গেল। এ কি ওর কম সৌভাগ্য? ওঠ মা, উঠে বস”।
 

সীমন্তিনী উঠে বিভাদেবীকেও একটা প্রণাম করে বলল, “তুমিও আমাকে ক্ষমা করে দিও মাসি”।


______________________________
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#25
(Update No. 50)

বিভাদেবী কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর মুখটাকে নিজের বুকে চেপে ধরলেন। এবার সতীশও সামনে এসে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে প্রণাম করতে বিধুবাবু হা হা করে উঠে বললেন, “আচ্ছা তোমরা দু’ভাইবোন মিলে কী শুরু করেছ বল তো? এতবার করে প্রণাম করছ কেন”?

সীমন্তিনী বিছানায় বসে কিংশুককে কাছে টেনে নিয়ে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, “ভাই, আজ থেকে আমি তোমার সত্যি সত্যি দিদি হয়ে গেলাম। মনে রেখ”।

সতীশও বিধুবাবুর কথার জবাবে বলল, “এর আগে যখন প্রণাম করেছিলাম তখন আপনারা ছিলেন আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ গুরুজন। এখন থেকে আপনারা যে আমাদের আত্মীয় আমাদের আপন লোক হয়ে উঠলেন। এবারের প্রণামটা সে জন্যেই করলাম”।
 

এমন সময় রচনা দুধের গ্লাস নিয়ে ঘরে ঢুকে সীমন্তিনীর কাছে এসে ভারী গলায় বলল, “নাও দিদিভাই। এ দুধটুকু খেয়ে নাও”।
 

সীমন্তিনী রচনার মুখের দিকে চেয়েই বুঝতে পারল ও ভেতরে ভেতরে কাঁদছে। নিজের ভেজা চোখ মুছতে মুছতে বলল, “খাব, তবে এতটা নয়। তুই আর ভাই আগে একটু একটু খেয়ে কমিয়ে দে। তারপর নিজে হাতে বাকিটুকু আমায় খাইয়ে দে”।

রচনা কয়েক মূহুর্ত স্থির চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে রইল। তারপর কোন কথা না বলে দুধের গ্লাসটায় একটা চুমুক দিয়ে কিংশুকের মুখের সামনে গ্লাসটা তুলে ধরল। কিংশুকও বিনাবাক্যে একটুখানি দুধ খেয়ে নেবার পর সীমন্তিনীর ঠোঁটে গ্লাস ছুঁইয়ে রচনা বলল, “নাও”।
 

সীমন্তিনী আর কোন কথা না বলে দুধটুকু খেয়ে নিতেই রচনা দু’হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। সীমন্তিনীও রচনাকে নিজের বুকে চেপে ধরে বলল, “জানি রে। আমি তোকেও খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমাকে মাফ করে দে বোন। আর কক্ষনও তোর কাছে কোন মিথ্যে কথা বলব না”।

রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “তুমি সত্যিই খুব খুব খারাপ দিদিভাই। কাল রাত থেকে আমাকে এভাবে কষ্ট দিতে তোমার একটুও বাঁধল না”?

সীমন্তিনী বলল, “আজ তোদেরকে সত্যি কথাটা বলব বলেই তো অমনটা করেছিলুম রে। ছোটবেলা থেকে আমি কখনও মিথ্যে কথা বলিনি। জীবনে এই প্রথম আমি তোর কাছে, মাসি মেসোর কাছে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। ভেবেছিলাম আমার দাদাভাইয়ের সুখের জন্য এটুকু মিথ্যে কথা বললে কোন দোষ হবে না। কিন্তু আর আমি এমনটা চালিয়ে যেতে পারছিলাম না রে। তোদের সকলের বিশ্বাস নিয়ে আর খেলা করতে পারছিলাম না। তাই তো আজ সব খুলে বললাম। আমাকে ক্ষমা করে দে বোন। লক্ষ্মী বোন আমার”।

বিভাদেবী দুই মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “তোমরা দু’বোন সারাজীবন এমনি করেই দু’জন দু’জনকে ভালবেসো মা”।
 

সীমন্তিনী রচনাকে আরো জোরে নিজের বুকে চেপে ধরে বিভাদেবীর কথার জবাবে বলল, “আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মাসি। তোমার মেয়েকে আমার জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত এভাবেই আগলে রাখব আমি”।
 

বেশ কিছুক্ষণ বাদে রচনা নিজেকে সামলে নিয়ে সীমন্তিনীকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “দিদিভাই তোমার যে সে ক্ষমতা আছে, তা তো আমি বুঝেই গেছি। কিন্তু জান তো? ভালবাসা গ্রহন করার যোগ্যতা না থাকলে তাকে কেউ সেভাবে ভালবাসা দিতেও পারে না। আমাকে তুমি তোমার ভালবাসা পাবার যোগ্য করে তুলো। আমাকে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিও তুমি”।

এবার সতীশ ঘরের আবহাওয়াটাকে খানিকটা হাল্কা করবার উদ্দেশ্যে কিংশুককে বলল, “ভাই তুমি একটু আমার কাছে এস তো। আমাকে একটু সাহায্য কর”।
 

কিংশুক সতীশের কথা মত প্যাকেটগুলো নিয়ে তার হাতে দিতেই সতীশ বিধুবাবুকে বলল, “মেসোমশাই, বৌদি ভাল রেজাল্ট করেছে শুনে আসবার সময় মা আপনাদের সকলের জন্য কিছু কিছু উপহার পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা আপনার” বলে একটা প্যাকেট বিধুবাবুর হাতে দিয়ে তাকে প্রণাম করল।

তারপর বিভাদেবীর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে তাকেও নমস্কার করল। এরপর কিংশুকের হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল, “ভাই, এটা তোমার জন্য”।

কিংশুক প্যাকেটটা হাতে নিয়েই ঢিপ করে সতীশকে প্রণাম করতেই সতীশ হা হা করে উঠে বলল, “আরে আরে এ কি করছ ভাই? থাক থাক। আমাকে প্রণাম করতে হবে না”।
 

কিংশুক প্রণাম সেরে উঠে বলল, “না দাদা, কেউ কোন উপহার দিলে, তাকে তো প্রণাম করতেই হয়। ছোটবেলা থেকেই মা বাবা এটা শিখিয়েছেন আমাদের”।
 

সতীশ সীমন্তিনীকে বলল, “এই বড়দি, এবার তুই আমাকে বাঁচা। বৌদির প্যাকেটটা তার হাতে তুইই তুলে দে। নইলে সেও আমাকে প্রণাম করে ফেলবে”।
 

সতীশের কথা শুনে ঘরের সকলেই হো হো করে হেসে উঠল। হাঁসি থামিয়ে সীমন্তিনী বলল, “দেওর হয়ে কেউ বৌদির প্রণাম পেয়েছে বলে কখনও শুনিনি রে ভাই। আজ তুই সেটা পেলে মন্দ হবে না। একটা বিশ্ব
 
রেকর্ড হয়ে যাবে। তাই তুইই দে ওটা তোর বৌদির হাতে”।
 

সবাই আরেক চোট হাসল। সতীশ খানিকটা দুরে গিয়ে লম্বা করে হাত বাড়িয়ে রচনার দিকে প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ও বৌদি, প্লীজ ভাইয়ের মত তুমি কিন্তু ও’সব কোর না। নাও এটা”।
 

রচনা সতীশের মুখে বৌদি ডাক শুনে লজ্জায় দু’হাতে নিজের মুখ ঢাকল। সীমন্তিনী এগিয়ে এসে সতীশের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে রচনাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “এই মেয়ে, আর লজ্জা পেতে হবে না। বৌদিকে বৌদি বলবে না তো কি বলবে? নে, এটা তোর শাশুড়ি মায়ের প্রথম উপহার। তাই সতুকে বা আমাকে প্রণাম না করে এটা নিয়ে মনে মনে তাকেই একটা প্রণাম করিস তাহলেই হবে। অবশ্য তিনটের দিকে তোর শাশুড়ি নিজেই তোকে ফোন করবেন। তখন ফোনেও প্রণাম জানাতে পারবি”।
 

রচনা প্যাকেটটা হাতে নিয়ে সীমন্তিনীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “কে কখন ফোন করবে, কে কখন ফোন ধরবে, তোমরা সব আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছ, না”?

সীমন্তিনী হেসে রচনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোকে এত সহজে ছেড়ে দেব ভেবেছিস”?
 
*************

দুপুরের খাওয়া দাওয়া সারতে সারতে বেলা আড়াইটে বেজে গেল। রচনা মা-র সাথে হাতে হাত মিলিয়ে সব কাজ সারছিল। বিভাদেবী রচনাকে বললেন, “তোর বাবা তো এখন একটু ঘুমোবেন। তুই যা, সতু আর মন্তিকে তোর ঘরে নিয়ে তাদের সাথে একটু কথা বলগে যা। বাকিটুকু আমি সেরে নেব’খন। আর খোকাকে বল ও-ও যেন একটু ঘুমিয়ে নেয়”।
 

রচনা হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে তার বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকল। বিধুবাবু সীমন্তিনী আর সতীশের সাথে গল্প করছিলেন। রচনা তার বাবাকে বলল, “বাবা তুমি তো ঘুমোবে এখন তাই না? তাহলে আমি দাদা আর দিদিভাইকে নিয়ে আমার ঘরে যাই” বলে সীমন্তিনীর হাত ধরে বলল, “চল দিদিভাই, আমরা ও ঘরে যাই। দাদা তুমিও এস”।
 

সীমন্তিনী রচনার সাথে তার ঘরে এসে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে রচু? মেসো বললেন। ছোলার ডালের রসাটা নাকি তুই নিজে বানিয়েছিস? সত্যি নাকি রে”?
 

রচনা বিছানায় সতীশ আর সীমন্তিনীকে বসতে বলে বলল, “ওটাই শুধু করেছি। বাকি সবকিছু মা নিজেই করেছেন। ভাল হয়নি বুঝি, তাই না দিদিভাই”?
 

সীমন্তিনী অবাক হয়ে বলল, “ভাল হয়নি মানে? দারুণ হয়েছে জিনিসটা। পেটে যদি জায়গা থাকত তাহলে আরো খানিকটা চেয়ে নিতুম। তুই এত সুন্দর রান্না করতে পারিস? আমার কথা বিশ্বেস না হলে সতুকে জিজ্ঞেস কর। দেখ ও কি বলে”?
 

রচনা আগ্রহ সহকারে সতীশকে জিজ্ঞেস করল, “দাদা, সত্যি করে বল তো? তোমার কেমন লেগেছে”?
 

সতীশ কোন কথা না বলে নিজের মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, “মানছি দিদির সাথে তোমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে অনেক আগেই। তাই তাকে আদর করে দিদিভাই বলে ডাক তুমি। কিন্তু এতদিন আমি আসিনি বলেই আমাকে এভাবে দাদা বলে ডাকবে তুমি বৌদি? আমি না তোমার দেওর”?
 

রচনা বলল, “বারে, হলেই বা দেওর। কিন্তু তুমি আমার চেয়ে বয়সে তো বড়। তোমাকে আমি কখনোই নাম ধরে ডাকতে পারব না। দাদা বলেই ডাকব”।
 

সতীশ বলল, “তাহলে তোমার সাথে আজ থেকেই কথা বন্ধ করে দেব বলে দিচ্ছি। রাস্তা ঘাটে যেমন লোকেরা ‘ও দাদা ও দাদা’ বলে ডাকে তুমিও আমাকে সেভাবে ডাকবে বুঝি? ও’সব হবে না। তার চেয়ে তুমি নাম ধরে ডাকলেই আমার বেশী ভাল লাগবে। আর সেটা করতে না পারলে ডাকারও দরকার নেই আর কথা বলারও দরকার নেই”।

রচনা কাতর চোখে সীমন্তিনীর দিকে চেয়ে বলল, “ও দিদিভাই, তুমি একটু বোঝাও না তোমার ভাইটাকে। নাহলে তুমি বলে দাও আমি ওনাকে কী বলে ডাকব”?
 

সীমন্তিনী বলল, “আমাদের ছোট ভাইবোনেরা সবাই ওকে মেজদা বলে ডাকে। তা ওর যখন দাদা ডাক শুনতে আপত্তি আছে, তাহলে তুই বরং ওকে শুধু মেজো বলে ডাকিস”।
 

রচনা বলল, “ধ্যাত। একদম বাজে লাগবে শুনতে। আর তাছাড়া তোমার বড়মা তো তোমার মাকে মেজো বলে ডাকেন। তার চেয়ে আমি বরং এ দাদাকে মেজদাভাই বলে ডাকব। চলবে তো”?
 

সতীশ লাফিয়ে উঠে বলল, “দারুণ বলেছ বৌদি। মেজদাভাই ডাকটা শুনতেও খুব ভাল লাগবে। আমাদের সকলের বড়দি তোমার দিদিভাই, আর আমি সকলের মেজদা হলেও তোমার মেজদাভাই। তবে ওই রসাটা কিন্তু সত্যি দারুন বানিয়েছ বৌদি। এমন সুস্বাদু জিনিস আগে কখনও খেয়েছি কিনা মনে করতে পারছি না। মা শুনে খুব খুশী হবেন”।
 

রচনা মাথা নিচু করে বলল, “যদি আমার মন রাখতে এ’কথা বলে থাক, তাহলে তো আর কিছু বলার থাকে না মেজদাভাই”।

সীমন্তিনী বলল, “না রে রচু, আমরা কেউ বাড়িয়ে বলছি না। সত্যি খব সুন্দর রেঁধেছিস তুই। তবে একটা কথা আমি এখনও বুঝতে পারছিনা রে। তুই কি করে ....”

সীমন্তিনীর কথার মাঝখানেই রচনার মোবাইল বেজে উঠল। সীমন্তিনী জানে, এটা বড়মার ফোন। রচনা ফোনের স্ক্রিন দেখেই সীমন্তিনীর দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নাও দিদিভাই, তোমার বড়মার ফোন”।

সীমন্তিনী বলল, “বড়মা তো তোর ফোনে করেছেন। তার মানে তিনি তোর সাথে কথা বলতে চাইছেন। তুই না ধরে আমাকে দিচ্ছিস কেন? তাড়াতাড়ি রিসিভ কর নইলে টাইম আউট হয়ে যাবে”।
 

রচনা ফোনটা রিসিভ করে বলল, “প্রণাম নিও মামনি”। সীমন্তিনী হাত বাড়িয়ে ফোনের লাউডস্পীকার অন করে দিল।

সরলাদেবী জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে মা, ওদিকের খবর কিরে? সব ঠিকঠাক আছে তো? আমি তো সকাল থেকে বড় দুশ্চিন্তায় আছি রে”।

রচনা শান্ত গলায় জবাব দিল, “না মামনি, দুশ্চিন্তা করবার মত কিছু হয়নি। দিদিভাই আর মেজদাভাই সব কিছু সুন্দর ভাবে সামলে নিয়েছেন। এখন খাওয়া দাওয়া সেরে আমার ঘরে বসে তাদের সাথেই তো কথা বলছি। তা, তুমি ভাল আছ তো মামনি”?

সরলাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “এই সোনা, তোর এই দিদিভাই, মেজদাভাই এরা সব কারা রে মা? তোদের কোন আত্মীয় বুঝি”?

রচনা একটু লাজুকভাবে জবাব দিল, “হ্যা মামনি, আত্মীয়ই তো। পরম আত্মীয়। আমি তো তোমার এ’ দু’ ছেলেমেয়েকে ও’ নামেই ডাকি”।

সরলাদেবী রচনার কথা শুনে আশ্বস্ত হয়ে বললেন, “যাক রে মা। আমার চিন্তাটা দুর হল। ইশ সকাল থেকে কী যে টেনশন হচ্ছিল ভেতরে ভেতরে, কী বলব তোকে। আচ্ছা জিনিসগুলো তোদের পছন্দ হয়েছে মা? আমি ইচ্ছে করেই শাড়ি না পাঠিয়ে তোর জন্য দুটো চুড়িদার কিনে পাঠিয়েছি। বিয়ের পর থেকে তো শাড়িই পড়বি। এর আগের সময়টুকু চুড়িদার শালোয়ার কামিজ পড়ে নে চুটিয়ে। অবশ্য তুই চাইলে বিয়ের পরেও বাড়িতে ওসব ড্রেস পড়তে পারবি। আমরা তোকে বারণ করব না। তা তোর পছন্দ হয়েছে তো”?
 

রচনা বলল, “হ্যা হ্যা মামনি। খুব পছন্দ হয়েছে আমার। তোমার পছন্দ খুবই ভাল”।

সরলাদেবী খুশী হয়ে বললেন, “ঠিক আছে রে মা। আমার মন থেকে দুশ্চিন্তাটা কাটল। তাই তোকে আর বিরক্ত করব না। তুই ওদের সাথে কথা বল। কিন্তু তোর মা বাবা আর ভাই, ওদের জিনিসগুলো যদি মাপে ছোটবড় বা অপছন্দ হয়ে থাকে তাহলে সতুর সাথেই পাঠিয়ে দিস। এখান থেকে পাল্টে নিয়ে পরে আবার পাঠিয়ে দেব। তোর ভাইয়েরটা নিয়েই চিন্তায় আছি। যাহোক, তুই নিজে একটু দেখিস মা। আর প্রয়োজন হলে পাঠিয়ে দিস। কেমন”?

রচনা বলল, “ঠিক আছে মামনি। তোমরা ভাল থেক। প্রণাম নিও আমার। আর বাড়ির অন্য সবাইকেও আমার প্রণাম জানিও”।

সরলাদেবী বললেন, “তুইও ভাল থাকিস মা”।
 

ফোনে কথা বলা বন্ধ হতেই সতীশ সীমন্তিনীকে বলল, “বাব্বা, দেখেছিস বড়দি? আমরা এখানে আছি জেনেও মা আমাদের কারো সাথে কথাই বললেন না”!

সীমন্তিনী মুচকি হেসে বলল, “তাহলে দেখলি তো? আমার কথাটা কিভাবে ফলে গেল? আমি তোকে বলেছিলুম না? যে রচু আমাদের ঘরের বৌ হয়ে যাবার পর সবাই শুধু তাকে নিয়েই মাতামাতি করবে। তোর আমার আর আমাদের অন্য সব ভাইবোনেদের কদর এবার কমে যাবে”।

রচনাও সীমন্তিনীর রসিকতা বুঝে জবাব দিল, “ভেবনা দিদিভাই। তোমাদের বাড়িতে নতুন যে যাচ্ছে সে তোমাদের সব আদর কদর পুরো করে দেবে। কারুর ভাগে কিচ্ছুটি কম পরবে না দেখে নিও”।

সীমন্তিনী রচনাকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বলল, “সে আশা আমাদের মনে আছে বলেই তো তোকে আমাদের ঘরে নিয়ে যাবার জন্য এত কাঠখড় পোড়াচ্ছি রে। তা হ্যারে রচু, তোর শাশুড়িকে মামনি বলে কে ডাকতে বলেছে তোকে”?
 

রচনা একটু লজ্জা পেয়ে বলল, “কেউ বলেনি গো। আমি নিজেই ও নামে ডেকেছি। আর মামনিও সেটা পছন্দ করেছেন”।
 

সতীশ জিজ্ঞেস করল, “কবে থেকে মাকে তুমি মামনি বলে ডাকছ বৌদিভাই”?
 

রচনা রতীশের মুখে ‘বৌদিভাই’ ডাক শুনে একটু যেন কেঁপে উঠল। কিন্তু পর মূহুর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “যেদিন বাবা মা তোমাদের ওখান থেকে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন, তার পরের দিন থেকে”।

সীমন্তিনী এবার প্রসঙ্গ বদলে বলল, “আচ্ছা রচু, একটা কথা বল তো আমাকে। আমিই যে দাদাভাইয়ের বোন আর আমার ভাই বলে যাকে চিনতিস, সে-ই সতুই যে তোর বড় ঠাকুরপো, এটা তুই কবে বুঝতে পেরেছিস রে”?

রচনা ঠোঁট টিপে হেসে বলল, “আজই সেটা বুঝেছি দিদিভাই। তোমরা যখন বাড়ি এসেছ ঠিক তখনই
 
কথাটা প্রথম আমার মনে এসেছিল”।
 

সতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি করে বুঝে ফেললে তুমি”?
 

এমন সময় বিভাদেবী ট্রেতে করে তিন কাপ চা নিয়ে ঘরে এসে ঢুকে বললেন, “নাও মা। তোমরা একটু চা খাও”।

সতীশ উঠে বিভাদেবীর হাত থেকে ট্রেটা নিতে নিতে বলল, “আপনিও বসুন মাসিমা আমাদের সাথে”।

সকলের হাতে চায়ের কাপ তুলে দিয়ে সতীশ রচনাকে বলল, “হ্যা বৌদিভাই, এবার বল তো? কি করে চোর ধরলে তুমি”?
 

রচনা হেসে বলল, “দিদিভাই প্রথম যেদিন আমাদের বাড়ি এসেছিল, সেদিনই আমার মনে প্রথম একটু সন্দেহ হয়েছিল। ডিস্ট্রিক্ট অডিটোরিয়ামে দেখা হবার ঠিক দু’দিন বাদেই তাকে আমাদের বাড়ি আসতে দেখেই সে সন্দেহটা হয়েছিল আমার। সেদিন রাতে যখন দিদিভাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে আমি কোন ছেলের সাথে প্রেম করি কি না, তখন ধারণাটা আরও একটু পোক্ত হয়েছিল। কিন্তু তারপর যেভাবে দিদিভাই আমাদের সাথে সব কিছু নিয়ে কথা বলেছে, তাতে আমার মনে হয়েছিল যে সন্দেহটা বুঝি সত্যিই অমূলক। কিন্তু মা বাবা রাজগঞ্জ থেকে ফিরে যখন বললেন যে তারা ও বাড়িতে সবাইকেই দেখতে পেয়েছেন। শুধু বড়কাকুর বড় মেয়ে আর ছেলের ছোট ভাইকে দেখেন নি। তখন আমার মনে সন্দেহটা আবার দানা বেঁধেছিল। মা বাবার মুখেই শুনেছি যে তোমাদের বাড়ির সকলেই নাকি এ সম্মন্ধ নিয়ে খুব উৎসাহী। ছোট বড় সবার ভেতর এত উৎসাহ, আর ছেলের নিজের ছোটভাই আর সমবয়সী প্রায় বন্ধুর মত ছোটবোন সেখানে থাকবে না, এটা সহজ ভাবে মেনে নিতে পারিনি আমি। এর আগে মামনি, বাবা আর ছোটকাকুরা যেদিন এখানে এসেছিলেন, তখন বাড়ির সকলের ব্যাপারে সব কিছু খুলে বললেও তোমাদের দু’জনের ব্যাপারে প্রায় কিছুই বলেননি তারা। শুধু আরেক ছেলে আর মেয়ে আছে, এটুকুই শুধু বলেছিলেন। আর বাবা মার সাথে তাদের দেখা না হবার ব্যাপারে বলেছিলেন যে তারা বাইরে লেখাপড়া করছে বলেই তারা সেদিন বাড়ি ছিল না। এসব শুনেই খটকাটা আরও বেশী হয়েছিল। তারপর গত কয়েকদিনের মধ্যে তোমাদের বাড়ির সকলেই আমার সাথে ফোনে কথা বলেছেন। তোমাদের সবচেয়ে ছোট বোন চন্দ্রিকা পর্যন্ত আমার সাথে কথা বলেছে। কিন্তু শুধু ছেলের ভাই আর বোনই আমার সাথে ফোনে কথা বলেনি। ভাই বোন হিসেবে তোমাদের দাদার বিয়ের খবর পেয়ে খুশী হওয়া সত্বেও তোমরা কেউ আমাকে ফোন করনি দেখে আমার ধারণটা আরো খানিকটা দানা বেঁধেছিল। আর কাল মামনি যখন আমাদের কাছে বললেন যে আজ ছেলের সে ভাই আর বোন আমাদের বাড়ি আসছেন, তখন খবরটা দিদিভাইকে জানিয়ে দেবার পর থেকেই দিদিভাই আর আমার ফোন কল রিসিভ করছিল না। রাতে পাঁচ ছ’বার আর আজ সকালেও একবার কল করেছি আমি। প্রত্যেক বারই ফোনটা বেজে বেজে কল এন্ড হয়ে যাচ্ছিল। প্রথম প্রথম ভাবছিলাম যে হয়ত নেটওয়ার্কের সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু রাতে ঘুমোবার সময় ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে কেন জানিনা মনে হল, দিদিভাই আর তুমিই ছেলের সে ভাই বোন। তবু একেবারে নিশ্চিত হতে পারছিলুম না। কয়েক দিন আগে মামনি ফোনে আমার পছন্দ অপছন্দের কথা জানতে চেয়েছিলেন। আর কাল মামনি বললেন যে আমি পরীক্ষায় ভাল করেছি বলে তিনি আমার জন্যে তোমাদের হাতে কিছু উপহার পাঠাবেন। কিন্তু মামনি তখনও তোমাদের দু’জনের নাম আমাদের কাউকে বলেন নি। সকালে তোমরা যখন প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে ঢুকলে, তখনই আমি বুঝে গেছিলুম যে তোমরা আসলে কারা। এবার বুঝেছ তো কিভাবে দুই দুইয়ে চার করতে পেরেছিলুম আমি”?

______________________________
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#26
ভালোবাসা আরোও একবার। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দাদা।
Astroner
[+] 1 user Likes astroner's post
Like Reply
#27
Darun dada. Update plz.

""পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ আমরা সবাই অভিনেতা"" !! Sad

[+] 2 users Like Kolir kesto's post
Like Reply
#28
(25-02-2020, 03:24 PM)astroner Wrote: ভালোবাসা আরোও একবার। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দাদা।

(25-02-2020, 08:02 PM)Kolir kesto Wrote: Darun dada. Update plz.

সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের। আমি তো রিপোস্ট করছি মাত্র। xossipy-তে contribute করা আমাদের সবারই দায়িত্ব। সত্যিকারের ধন্যবাদ এর প্রাপ্যতা ss_sexy-র।
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#29
(Update No. 51)

সতীশ চোখ বড় বড় করে রচনার কথা শুনতে শুনতে অবাক হয়ে যাচ্ছিল। তার কথা শেষ হতেই সে লাফ মেরে নিচে নেমে রচনার পায়ের দিকে ঝুঁকতে ঝুঁকতে বলল, “তুমি তো দেখছি একটা ঝানু গোয়েন্দা গো বৌদিভাই। একটু তোমার পায়ের ধুলো নিতে দাও”।
 

রচনা ছুটে বিছানার উল্টোদিকে গিয়ে প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “ও মাগো, ও দিদিভাই তোমার ভাইকে থামাও। মেজদাভাই প্লীজ”।

সীমন্তিনী সতীশকে হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল। “ভাই, থাক। মেয়েটাকে আর বিরক্ত করিস না”।
 

বিভাদেবীও এসব দেখে হাসতে শুরু করেছিলেন। তিনিও সতীশকে বললেন, “হ্যা বাবা, তুমি ওকে আর লজ্জা দিও না। সম্পর্কে ওর দেওর হলেও তুমি তো ওর চেয়ে বয়সে বড়। তাই ও তোমার প্রণাম নিতে কখনই রাজি হবে না। তুমিও ওকে বৌদির চেয়ে নিজের বোনের মত ভালবাসলেই আমরা সবাই খুশী হব”।

সতীশ আবার বিছানায় বসে বলল, “মাসিমা, সে’কথা আর আপনাকে বলে দিতে হবে? ওকে তো নিজের বোন বলে ভাবতেই আমার বেশী ভাল লাগবে। তাই তো বৌদি শব্দটার সাথে বোন কথাটাও জুড়ে দিতে ইচ্ছে করছিল আমার। কিন্তু বৌদিবোন বা বোনবৌদি ডাকটা শুনতে তো ভাল লাগে না, তাই তো আমি ওকে বৌদিভাই বলে ডাকতে শুরু করেছি। এ ডাকটা তো শুনতে ভাল লাগবে, তাই না মাসিমা”?
 

বিভাদেবী বললেন, “খুব ভাল বাবা। আমি তো মনে মনে সেটাই কামনা করি। আমার রচু তোমাদের বাড়ির বৌ না হয়ে মেয়ে হয়ে থাকুক। তোমরা সব ভাইবোনেরা সবাই ওকে নিজের দিদি নিজের বোনের মত ভালবেসো, আর তোমার মা বাবা কাকা কাকিমারাও সবাই যেন ওকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন” বলতে বলতে তার গলা ধরে এল।

সীমন্তিনী রচনাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “মাসি আমি তো তোমায় আগেই বলেছি। রচুকে তো আমি অনেক আগে থেকেই আমার বোন বানিয়ে নিয়েছি। আর তুমি দেখে নিও। আমাদের আলাদা করে কোন চেষ্টাই করতে হবে না। তোমার এ মেয়েটা যা মিষ্টি, আমাদের বাড়ির সকলে ওকে মাথায় তুলে রাখবে। তোমার মেয়ের কখনও কোন অযত্ন হবে না ও বাড়িতে। সে’কথা আমি তোমায় দিচ্ছি। আমি ওকে সারা জীবন আমার বুক দিয়ে আগলে রাখব। যদি কখনো তোমাদের মনে হয় তোমার মেয়ে ও বাড়িতে কষ্টে আছে, তাহলে সবার আগে তুমি আমাকে শূলে চড়িও”।

বিভাদেবী নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে বললেন, “আজ থেকে নয় রে মা। তোর কথা শুনে প্রথম থেকেই তোর ওপর আমার ভরসা করতে ইচ্ছে করেছে। আর তোদের বাড়িতে গিয়ে মনে হয়েছে, রচু সেখানে সত্যিই খুব ভাল থাকবে। কিন্তু জানিস তো? আমি যে ওর মা। সন্তানকে নিয়ে মায়ের মনে যে কত দুশ্চিন্তা হয়, তা তো তোরা হয়ত কল্পনাও করতে পারবি না। তোর মা কাকিমারাই সেটা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো দেখছিসই। সাধ ষোল আনা থাকলেও সাধ্য যে একেবারেই নেই রে। এ জন্যেই বড় মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি গিয়ে রোজ হেনস্থার শিকার হচ্ছে। ওর কথা মনে হলেই বুকটা ভেঙে যায় আমার। তাই রচুকে নিয়েও মনে বড় আশঙ্কা ছিল আমার। কিন্তু তোদের সকলের সাথে পরিচিত হবার পর আমার মন অনেকটাই শান্ত হয়েছে। তাই বলছি মা, এই যে এ মূহুর্তে তুই যেভাবে রচুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আছিস, এভাবেই সারাজীবন ওকে তোর বুকে করে রাখিস মা”। বলতে বলতে বিভাদেবীর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়তে লাগল।
 

সীমন্তিনী রচনাকে ছেড়ে বিছানা থেকে নেমে বিভাদেবীর মাথাটাকে নিজের বুকে চেপে ধরে তার চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “তুমি রচুকে নিয়ে একেবারে দুশ্চিন্তা কোর না মাসি। আমাদের বাড়িতে রচুর কোনরকম অমর্যাদা হবে না। তুমি নিজেকে সামলাও। আমি বলছি, রচুর জীবনে নেমে আসা সব দুর্যোগের মোকাবিলা আমি করব। আমি প্রায় সাত আট বছর ধরে বাড়ি ছেড়ে আছি। আর নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে ভেবেছি, তাতে সে বাড়িতে বোধহয় পাকাপাকিভাবে আর কখনও থাকতেও পারব না। কিন্তু তা সত্বেও আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, ওর প্রতিটা প্রয়োজনে আমি দুরে থেকেও সব সময় ওর পাশে পাশে থাকব। এটা তোমার কাছে তোমার এ মেয়েটার আরেকটা প্রতিশ্রুতি বলে ভেব তুমি”।
 

বিভাদেবীও সীমন্তিনীকে আদর করে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললেন, “তোর কথায় ভরসা করেই তো এতদুর এগিয়েছিরে আমরা মা। তোর কথা শুনে আমার মন ভরে গেছে”।

সীমন্তিনী এবার কথা ঘুরিয়ে বলল, “আচ্ছা মাসি, তোমরা কেমন গো? আমাদের বাড়ি থেকে দাদাভাইয়ের একটা ছবি চেয়ে আনতে পারনি? তোমার মেয়েটা তো অন্ধের মত আমার তোমার কথার ওপর ভরসা করেই বিয়ে করতে চলছে। আমার দাদাভাই তো ওকে দেখেছে। ওরও তো মনে মনে একটু ইচ্ছে করতেই পারে, যার সাথে ওর বিয়ে হবে তার চেহারাটা একটু দেখতে। একটা ছবি চেয়ে এনেও তো ওকে দেখাতে পারতে তোমরা”।
 

বিভাদেবী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কথাটা যে আমার মনে হয়নি তা নয় রে মা। কিন্তু মুখ ফুটে কারো কাছে সে’কথাটা বলতে পারিনি। তবে এখন আমি জানি, তুই যা মেয়ে, তুই নিজেই সে ব্যবস্থা করবি। তাই আমাকে আর সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না”।
 

সীমন্তিনী হেসে বলল, “তুমিও কম চালাক নও মাসি। দিলে তো আমার কাঁধে বন্দুকটা তুলে? আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু ছবির ব্যবস্থা করে দিলে তোমরা আবার কিছু মনে করবে না তো”?
 

বিভাদেবী হেসে জবাব দিলেন, “নারে মা। এখন আর সঙ্কোচের কোন কথা নেই। তুই নিজে যদি রচুকে তোদের বাড়িতেও নিয়ে যেতে চাস, আমি তাতেও বাঁধা দেব না। তুই চাইলে তোর দাদাভাইকেও এখানে নিয়ে আসতে পারিস”।

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “বাব্বা মাসি! তুমি তো দেখছি অনেক ছাড় দিয়ে দিচ্ছ আমাকে। কিন্তু কথায় বলে না শেয়ালকে ভাঙা বেড়া দেখাতে নেই। তোমার মেয়েকে আমি যদি বাড়ি নিয়ে যাই, তাহলে ও আর সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। এটা ভেবেছ”?

বিভাদেবী আগের মতই হেসে বললেন, “যা না নিয়ে। আমি বারণ করব না”।

সীমন্তিনী বিভাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমার মত মা পাওয়া সত্যি খুব ভাগ্যের ব্যাপার গো মাসি”।
 

বিভাদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তোরা কথা বল। আমি দেখি তোর মেসোর ঘুম ভাঙল কি না। তাকে আবার চা করে দিতে হবে” বলে ট্রেতে খালি চায়ের কাপগুলো তুলে চলে গেলেন।

সীমন্তিনী খাটে বসে রচনাকে জিজ্ঞেস করল, “তা হ্যারে রচু, মোবাইলের সব কিছু ঠিকমত বুঝতে পেরেছিস তো? অপারেট করতে কোন অসুবিধে কিছু হচ্ছে না তো”?
 

রচনা জবাব দিল, “আমি তো শুধু কল করা আর কল রিসিভ করা ছাড়া আর কিছু করিনা দিদিভাই। আর তেমন প্রয়োজনও পড়েনি”।
 

সীমন্তিনী বলল, “ওমা সেকি রে? আজকাল ছেলে মেয়েরা মোবাইল হাতে পেলেই তো এটা ওটা টেপাটিপি করে কোথায় কি আছে সব দেখতে চায়। আর তুই কিছুই দেখিস নি? তোকে তো আগের বার সবকিছু বলে গিয়েছিলাম আমি। কিছুই দেখিস নি? আচ্ছা দে তো দেখি তোর ফোনটা। আমাদের আবার যাবার সময় হয়ে এল”।

রচনা তার ফোনটা সীমন্তিনীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “যাবার সময় নিয়ে ভেবে ব্যাকুল হয়ে লাভ নেই। যত কষ্টই হোক, আজ তোমরা এখানেই থাকছ সবাই”।

সীমন্তিনী সতীশের দিকে চেয়ে বলল, “কিরে ভাই? কী বলছে তোর বৌদিভাই”?
 

সতীশ হেসে বলল, “আমার কিন্তু আপত্তি নেই রে। কাল তো রবিবার। তোর তো ক্লাস টিউশন কিছু নেই। তাই থেকে গেলে কোন ক্ষতি হবে না। বরং লাভই হবে। আরো কিছু সময় আমার মিষ্টি বৌদিভাইয়ের কাছাকাছি থাকতে পারব আমরা। চল না যাবার প্রোগ্রাম ক্যানসেল করে বিকেলে সবাই মিলে একটু এদিক ওদিক বেরিয়ে জায়গাটা একটু ঘুরে ফিরে দেখে আসি”।

সীমন্তিনী মোবাইলে খুটখাট করতে করতে বলল, “তুই কিন্তু ভাই দিনে দিনে বেশী হ্যাংলা হয়ে উঠছিস রে। লক্ষণটা কিন্তু ভাল নয়। তবে আজ তোকে কনসিডার করছি” বলে একহাতে রচনাকে কাছে ডেকে বলল, “এই দেখ রচু। ফটোস বলে এখানে যে ফোল্ডারটা আছে সেটা মাঝের এই বোতামটায় চাপ দিয়ে সিলেক্ট কর”।
 

রচনা মোবাইলটা হাতে নিয়ে সেটা করতেই পুরোটা স্ক্রিন জুড়ে খুব ছোট ছোট অনেকগুলো ছবি দেখে বলল, “এতে তো দেখি খুব ছোট ছোট কতগুলো ছবি। এগুলো কিসের ছবি গো দিদিভাই? ঠিক মত বোঝা যাচ্ছে না”।

সীমন্তিনী রচনার মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে মোবাইলের দিকে চেয়ে বলল, “হ্যারে, প্রথমে অমন ছোট ছোটই দেখা যায়। এবার এই মাঝের বোতামটার এদিক ওদিক চাপ দিলেই দেখবি একেকটা ব্লক আলাদা আলাদা ভাবে সিলেক্ট হচ্ছে। দেখেছিস? এবার ধর এ ছোট্ট ছবিটাকে তুই বড় করে দেখতে চাইছিস। তখন এ ব্লকটাকে বক্সের ভেতরে রেখে সিলেক্ট বোতামটা চাপ দিলেই দেখবি ছবিটা বড় করে দেখা যাবে। এই দেখ”।
 

রচনা অবাক হয়ে বলল, “ওমা, এ যে তোমার ছবি গো দিদিভাই। ইশ কী সুন্দর লাগছে গো তোমাকে দেখতে”?

সীমন্তিনী সতীশের কাছে এসে বলল, “ভাই একটু গিয়ে দেখ না, কিংশুক ঘুম থেকে উঠেছে কি না। আর মাসি মেসোকে জিজ্ঞেস করে দেখ তারা আমাদের রচু আর ভাইকে নিয়ে একটু বেরোতে দেবেন কি না”।

সতীশ বেরিয়ে যেতেই রচনা জিজ্ঞেস করল, “ও দিদিভাই, এখানে কি আরও ছবি আছে? না এই একটাই”?
 

সীমন্তিনী রচনাকে নিজের শরীরের সাথে চেপে ধরে বলল, “মুখ ফুটে বলছিস না কেন তুই কার ছবি দেখতে চাইছিস? এই দেখ এবার এই এরো কী-টায় চাপ দিলেই আরেকটা ছবি বেরোবে। দে চাপ দে। হ্যা এই তো। দেখ”।

মোবাইলের পর্দায় তখন রতীশের একটা ছবি বেড়িয়েছে। রচনা তাকিয়ে দেখে যে খুব সুন্দর একটা ছেলের ছবি। হাঁসি হাঁসি মুখে ছেলেটা যেন তার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে। সীমন্তিনী আড় চোখে রচনার মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখের ভাবভঙ্গী লক্ষ্য করতে লাগল। রচনা কিছুক্ষন ছবিটা ভাল করে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “এটা কার ছবি গো দিদিভাই? তোমার কোন বন্ধু”?
 

সীমন্তিনী মজা করে বলল, “হ্যা সেটা বলতে পারিস। আমার সবচাইতে প্রিয় বন্ধুও, আর আমার দাদাও। এটা তোর হবু বর, আমার দাদাভাই রে বোকা মেয়ে”।
 

রচনার চোখ দুটো এক সেকেণ্ডের জন্যে চকচক করে উঠল। পরক্ষণেই লজ্জা পেয়ে সীমন্তিনীর কোলে মুখ লুকিয়ে ফেলে বলল, “ইশ দিদিভাই, তুমি কী গো”?
 

সীমন্তিনী রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রচনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, “কিরে? কেমন লাগছে আমার দাদাভাইকে? পছন্দ হয়েছে তো”?
 

রচনার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় ধড়ফড় করছে। সীমন্তিনীর কোলে আরো জোরে নিজের মুখটা চেপে ধরে সে হাঁপাতে লাগল। সীমন্তিনী আর কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বোলাতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর সীমন্তিনী ঝুঁকে রচনার মাথায় চুমু খেয়ে বলল, “ওঠ পাগলী। লজ্জা পাচ্ছিস কেন? আগে থেকেই এ ছবিগুলো তোর মোবাইলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম তুই দেখবি বলে। কিন্তু তুই এ’সব দেখিস নি শুনেই আমাকে এটা করতে হল। ওঠ ওঠ। আরো আছে দেখ। আমাদের বাড়ির সকলের ছবিই আছে। দেখ”।
 

রচনা তবুও লজ্জায় মাথা ওঠাতে পারছে না। সীমন্তিনী এবার জোর করে রচনাকে ঠেলে তুলে হাঁসি হাঁসি মুখে তার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “বল না বোন। তোর পছন্দ হয়নি আমার দাদাভাইকে? আরো কয়েকটা আছে। তবে আগে তুই বল তোর কেমন লেগেছে। তারপর তোকে বাকি ছবিগুলো দেখাচ্ছি। বল না লক্ষ্মী বোন আমার। আমি না তোর বান্ধবী! তাহলে আমার কাছে আর লজ্জা করছিস কেন? সেজন্যেই তো সতুকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছি। তোর মুখ থেকে কথাটা না শুনলে আমি যে শান্তি পাব না রে”।

রচনা এবার সীমন্তিনীকে হঠাৎ করে আঁকড়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। সীমন্তিনী কিছু না বলে রচনার পিঠে আর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। অনেকক্ষণ পর রচনা কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আমার কপালে কি এত সুখ সইবে দিদিভাই? আমি তো স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি যে এমন কেউ আমার জীবনে আসতে পারে”।
 

সীমন্তিনী রচনাকে আদর করে বলল, “স্বপ্ন নয় রে পাগলী। এটাই সত্যি। তুই এর স্ত্রী হয়েই আমাদের সংসারে যাচ্ছিস। আচ্ছা, তুই না হয় পরে দাদাভাইয়ের বাকি ছবিগুলো দেখিস। আমি তোকে অন্যদের ছবি দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি” বলে রচনাকে কোলের ওপর রেখেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরপর রতীশের অনেকগুলো ছবি বাদ দিয়ে নিজের জেঠুর ছবি বের করে বলল, “এটা দেখ, দেখ তো চিনতে পারিস কি না”।
 

রচনা তবুও সীমন্তিনীর কোল থেকে মুখ ওঠাচ্ছে না দেখে সীমন্তিনী জোর করে তাকে উল্টে দিয়ে দেখে রচনার চোখে জল। সীমন্তিনী অবাক হয়ে রচনার চোখের জল মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করল, “কি হল রে তোর? দাদাভাইকে দেখে পছন্দ হয়নি তোর”?
 

রচনা নিজেকে সামলাতে সামলাতে ভারী গলায় বলল, “না দিদিভাই, তা নয়। আসলে দিদির কথা মনে পড়ছে আমার। তাই ...”
 

সীমন্তিনী আদর করে রচনাকে শান্ত করে বলল, “দেখ, ইনি আমার জেঠু মানে তোর শ্বশুর মশাই শ্রীযুক্ত রতিকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার বড়মা, তোর শাশুড়ি শ্রীমতী সরলা ভট্টাচার্যি। এটা সতু বুঝতেই পারছিস। আর ইনি হচ্ছেন আমার বাবা, মানে তোর বড় খুড়শ্বশুর শ্রীযুক্ত শশীকান্ত ভট্টাচার্যি। ইনি আমার মা আর তোর বড় খুড়শাশুড়ি শ্রীমতি সীমা ভট্টাচার্যি। এটা আমার ছোট ভাই, তোর মেজ দেওর সূর্য্য। আমাদের বাড়ির ভেতর সবচেয়ে গম্ভীর। ইনি আমার ছোটকাকু শ্রীযুক্ত চন্দ্রকান্ত ভট্টাচার্যি। আর ইনি হচ্ছেন আমার ছোটকাকিমা শ্রীমতী চন্দ্রা ভট্টাচার্যি তোর ছোট খুড়শাশুড়ি। এটা তোর ছোট দেওর চঞ্চল, আমাদের ছোট কাকুর ছেলে। আর এটা আমাদের পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য, আমার ছোটকাকুর মেয়ে, আর তোর ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা”।

রচনা খুব আগ্রহ সহকারে ছবিগুলো দেখে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী সব শেষে বলল, “এই ফোল্ডারটার মধ্যেই দাদাভাইয়ের আরো ন’টা ছবি আছে। তুই যখন একা একা থাকবি, তখন প্রাণ ভরে দেখিস। আর এই পোড়ামুখী মেয়েটাকে যদি বান্ধবী ভেবে কিছু বলতে চাস, তাহলে বলিস”।

রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বলল, “তোমাকে একবারটি আমায় প্রণাম করতে দেবে দিদিভাই? তুমি তো শুধু আমার ননদ আর আমার বান্ধবীই নয়। তুমি যে আমার বড় দিদিও। ছোট বোন ভেবে আমাকে একবার তোমাকে প্রণাম করতে দাও না প্লীজ”।
 

সীমন্তিনী রচনাকে আবার বুকে চেপে ধরে বলল, “আমি কারুর প্রণাম নেবার যোগ্যই নই রে বোন। আমি বড় বাজে একটা মেয়ে। আর সেটা আজ থেকে নয়। সেই ছোট বেলা থেকেই আমি প্রচণ্ড রকম জেদী, গোঁয়ার আর অবাধ্য। তাই আমার নিজের মা বাবাও আমায় ভালবাসেন না। ও বাড়ির বড়দের মধ্যে কেবল শুধু বড়মা আর ছোটকাকুই আমার সাথে কথা বলেন। আর কেউ আমার সাথে কথাও বলেন না। তবে আমি খুব জেদী বলেই বোধহয় সবাই আমাকে ভাল না বাসলেও বেশ সমীহ করে চলেন। ভাল না বাসলেও বাড়ির সকলেই এটা জানেন যে সেই ছোটবেলায় একটা অন্যায় করা ছাড়া আমি আর কখনও কোন অন্যায় করিনি। আর আমার জেদী স্বভাবের সাথেও তারা খুব ভালভাবে পরিচিত। তাই হয়ত আমার কথার বিপক্ষে গিয়ে তারা কখনও কিছু করেন না। আমার যখন যা কিছুর প্রয়োজন হয়েছে তারা সবাই সে প্রয়োজন মিটিয়েছেন। এজন্য তাদের সকলের প্রতিই আমি কৃতজ্ঞ। তাই বুঝতেই পারছিস, পরিবারের লোকদের সমর্থন সহযোগিতা পেলেও তাদের ভালবাসা আমি খুব বেশী পাই নি। তাই তুই আমাকে শুধু একটু ভালবাসিস বোন। আর তুই তো আমার বুকের মধ্যে বসে গেছিস রে। তাই তুই কখনো আমাকে প্রণাম করবি না। তুই শুধু আমাকে আদর করবি। আমাকে ভালবাসবি”।

রচনাও সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মন খারাপ কোর না দিদিভাই। ঠাকুর তোমার সব অভাব একদিন ঠিক মিটিয়ে দেবে দেখো”।
 
***************
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#30
(Update No. 52 date. 26.7.2018)

রতীশ আর রচনার বিয়ের মাস তিনেক আগে সীমন্তিনীর এমএ ফাইনাল পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছিল। পলিটিকাল সায়েন্সে খুব ভাল নম্বর পেয়ে সে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভার্সিটির মধ্যে দ্বিতীয় স্থান দখন করেছিল। সাফল্যের প্রথম খবরটা দিয়েছিল সে রচনাকে। তারপর তার দাদাভাইয়ের মাধ্যমে বাড়ির সকলকে খবর দিয়েছিল। রচনা তার দিদিভাইয়ের সাফল্যের খবর পেয়ে মা, বাবা আর ভাইকে সাথে নিয়ে শিলিগুড়ি গিয়ে সেবকেশ্বরী কালিবাড়িতে তার দিদিভাইয়ের নামে পূজো দিয়েছিল। তারপর সেখান থেকে জলপাইগুড়ি গিয়ে সীমন্তিনীর ভাড়া নেওয়া বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। সীমন্তিনীর ভাড়া করা ঘরটা সেদিন উৎসবমুখর হয়ে উঠেছিল। সতীশও সে উৎসবে সামিল হয়েছিল। সে দিনটার মত অমন আনন্দমুখর দিন সীমন্তিনীর জীবনে আগে আর কখনও আসেনি। তার মাস খানেক আগেই রচনার হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষার রেজাল্ট বেড়িয়েছিল। রচনা এবারেও জেলায় প্রথম হয়েছে। তাই দু’জনের এই সাফল্যে সকলেই প্রাণ ভরে আনন্দে হুল্লোরে মেতে উঠেছিল সেদিন।

সীমন্তিনীর বাড়ি থেকেও তার বড়মা, ছোটকাকু আর দাদাভাই সেদিন জলপাইগুড়ি আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সীমন্তিনীর বাড়িতে সকলের শোবার জায়গার সংকুলান হয়ে উঠবে না বলেই তাদের আর আসা হয়নি। তাই সীমন্তিনী বাড়িতে খবর দিয়েছিল যে রচনা ওরা জলপাইগুড়ি থেকে ঘুরে যাবার পর সে-ও বাড়ি আসবে। গতকাল রচনারা সকলে বাড়ি ফিরে গেছে। এতদিনে রচনা রতীশদের বাড়ির সকলের সাথেই খুব সহজ হয়ে উঠেছে। তাই সীমন্তিনী আর দেরী না করে রতীশ আর রচনার বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লাগল।
 

আজ সকালের গাড়িতে সতীশের সাথে রওনা হয়ে সীমন্তিনী রাজগঞ্জ বাস স্ট্যাণ্ডের মাটিতে পা দিয়েছে সুদীর্ঘ আট বছর বাদে। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে বেরিয়েই সতীশ একটা অটো ধরতে চেয়েছিল। সীমন্তিনী তাকে বাঁধা দিয়ে বলল, “ভাই একটু দাঁড়া না। কত বছর বাদে রাজগঞ্জের হাওয়ায় শ্বাস নিচ্ছি। একটু দাঁড়িয়ে যাই এখানে”।

সতীশও জানে আজ আট বছর বাদে তার দিদি নিজের জন্মস্থানের মাটিতে পা দিয়েছে। একটু ইমোশনাল তো হতেই পারে সে। সীমন্তিনী বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে এ’পাশে ও’পাশে তাকিয়ে দেখতে দেখতে বলল, “কিরে ভাই? রাজগঞ্জে এই ক’টা বছরের ভেতর এত দোকান পাট এত নতুন নতুন বাড়ি হয়েছে? আমি তো চিনতেই পাচ্ছি না রে। আমার চোখে তো আট বছর আগের ছবিগুলোই ভাসছে এখনও”।
 

সতীশ বলল, “এখানে আর কী দেখছিস? বাজারে গেলে তুই আরো অবাক হয়ে যাবি দিদি। অনেকগুলো
 
বড় বড় বিল্ডিং হয়েছে। অনেক নতুন নতুন দোকান হয়েছে। আর বাড়ি যাবার রাস্তায় দেখিস, ফাঁকা
 
জায়গা প্রায় নেই বললেই চলে। কত বাড়ি ঘর হয়েছে এ আট বছরের মধ্যে”।
 

সতীশের কথা শেষ হতেই পাশ থেকে কেউ বলে উঠল, “আরে বড়দি যে? উঃ কত বছর বাদে তোমায় দেখলাম গো”?

সীমন্তিনী মাথা ঘুরিয়ে দেখে একটা রিক্সাওয়ালা। কিন্তু তাকে ঠিক চিনতে পারল না সে। কৌতুহলী চোখে সতীশের দিকে চাইতেই সতীশ বলল, “চিনতে পারিস নি, তাই না দিদি? আরে এটা রতন। আমাদের ক্ষেতে যে চাষ করত কানাই কাকা, তার ছেলে রে”?
 

সীমন্তিনীর মনে পড়ল কানাই কাকার কথা। তাদের ক্ষেতে চাষবাসের কাজ করত। বছর পাঁচেক আগে সে মারা গেছে, এ খবরও পেয়েছিল সে। সে রিক্সাওয়ালার দিকে চেয়ে বলল, “তুই রতন? বাব্বা কত বড় হয়ে গেছিস রে? কি করে চিনব বল? আট বছরে তুই যে এমন হাট্টাকাট্টা হয়ে উঠতে পারিস, সেটা তো আমি ভাবিই নি রে? ভাল আছিস ভাই”?
 

রতন রিক্সা থেকে নেমে এসে সীমন্তিনীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল, “হ্যা গো বড়দি। তোমাদের আশীর্বাদে ভালই আছি। তা তোমরা বুঝি এইমাত্র বাইরে থেকে এলে? ইশ এতদিন বাদে তোমাকে দেখে আমার কি যে ভাল লাগছে না বড়দি। তা বাড়ি যাবে তো? এসো পৌঁছে দিচ্ছি তোমাদের”।
 

সীমন্তিনী খুশী হয়ে বলল, “তুই নিয়ে যাবি আমাদের? কিন্তু আমরা তো সোজা বাড়ি যাব না রে। আগে যে আমি আমাদের কলেজে যাব রে ভাই”।

সতীশ একটু অবাক হয়ে বলল, “কলেজে যাবি এখন”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে ভাই। এখন তো কলেজ খুলে গেছে। চল না, সুকোমল স্যারের সাথে একটু দেখা করে যাই। উনি বড্ড স্নেহ করতেন আমাকে। কিন্তু ভাই একটা কাজ কর না। আমি এখানেই দাঁড়াচ্ছি। তুই গিয়ে একটু মিষ্টি কিনে আন না ভাই। স্যারের কাছে খালি হাতে গিয়ে দাঁড়াতে ভাল লাগবে না। আর শোন বাড়ির জন্যেও কিছু নিস। একটু বেশী করে নিস। সকলে যেন খেতে পারে। আর স্যারের জন্য আলাদা আলাদা দুটো প্যাকেটা আনিস” বলে নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বের করে সতীশের হাতে দিল।
 

সতীশ নিজের আর সীমন্তিনীর ব্যাগদুটো রতনের হাতে দিয়ে বলল, “রতন এটা রাখ। আর তুই দিদির সাথেই থাকিস। আমি আসছি একটু”।

রতন বলল, “ঠিক আছে মেজদা, তুমি ভেব না। আমি আছি বড়দির সাথে”।
 

সীমন্তিনী রতনের সাথে কথায় কথায় রাজগঞ্জের অনেক কথা জেনে নিল। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন রিক্সা ওয়ালা আর অটো ড্রাইভার তাকে চিনতে পেরে এসে নমস্কার করে গেল। মিনিট দশেক বাদে সতীশ একটা ক্যারিব্যাগে তিনটে প্যাকেট নিয়ে আসবার পর তারা রিক্সায় উঠে বসল। বাসস্ট্যান্ড থেকে কলেজে পৌঁছতে প্রায় মিনিট দশেক সময় লাগল। কলেজের সামনে রিক্সা থেকে নেমে সীমন্তিনী সতীশকে বলল, “ভাই স্যারের প্যাকেট দুটো হাতে নিয়ে নে। আর রতন, এ প্যাকেটটা এখানেই রেখে যাচ্ছি। খেয়াল রাখিস। আর শোন। একটু দেরী হলে রাগ করিস না ভাই”।
 

রতন বলল, “তুমি নিশ্চিন্তে ঘুরে এস বড়দি। যখন খুশী এস। আর তোমাদের জিনিস পত্র নিয়েও কিছু ভেব না। আমি সব আগলে রাখব”।
 

কলেজ খোলা। কিন্তু ক্লাস চলছে বলে আপাততঃ কোন শোরগোল নেই। সীমন্তিনী আর সতীশ চেনা পথ দিয়ে হেঁটে প্রিন্সিপ্যালের রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করে বলল, “মে উই কাম ইন স্যার”?

প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অনুমতি পেয়ে তারা দু’জন ভেতরে ঢুকতেই শিক্ষক মহাশয় চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “একি রে মন্তি, সতু, তোরা? আয় আয় বাবা। আমি তো নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিনে রে। কত বছর বাদে তোকে দেখতে পেলাম রে মন্তি। সেদিন কাগজে তোর রেজাল্টের খবরটা পড়লাম। খুব খুশী হয়েছি রে। তোর জন্যে গর্বে তো আমারই বুক ফুলে উঠেছে। আয় আয় মা”।

সীমন্তিনী আর সতীশ দু’জনেই সুকোমল স্যারের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে উনি দু’জনকে আশীর্বাদ করলেন। সীমন্তিনী মিষ্টির প্যাকেটদুটো স্যারের হাতে দিয়ে বললেন, “স্যার, এটা নিন। একটা প্যাকেট বাড়ি নিয়ে যাবেন। আর এটা কলেজে সবাই মিলে খাবেন”।
 

প্রিন্সিপ্যাল স্যার প্যাকেটদুটো হাতে নিয়ে বললেন, “এ তুই কী করেছিস মা? এত সব .... আচ্ছা আচ্ছা তোরা বস। আমি রতুকে ডেকে পাঠাচ্ছি। ও কি জানে যে তোরা এখানে এসেছিস”?
 

সীমন্তিনী একটা চেয়ারে বসতে বসতে বলল, “না স্যার, দাদাভাই জানে না যে আমরা এখানে এসেছি। আসলে আমি তো এখনও বাড়িই যাই নি। বাসস্ট্যাণ্ড থেকে সোজা আগে আপনার কাছে এসেছি”।

সুকোমল স্যার বললেন, “সে কি বলছিস মা? তুই বাড়ি না গিয়ে আগে এখানে এলি? আমার সাথে দেখা করতে? বড় খুশী হলাম রে মা। আচ্ছা দাঁড়া, আগে কাজটা সেরে নিই” বলে টেবিলের ওপর থাকা কলিং বেলে চাপ দিলেন।
 

একজন বিয়ারার এসে দাঁড়াতেই স্যার তাকে বললেন, “রতীশ স্যারকে খবর দাও। এখনই যেন আমার কেবিনে চলে আসে”। বিয়ারারটা চলে যেতেই স্যার আবার বললেন, “কত ছাত্র ছাত্রীকেই তো পড়ালাম রে মা সারাটা জীবন ধরে। আমার পুরোন ছাত্ররা কতজন কত উঁচু উঁচু পদে কাজ করছে। কত বড়বড় সরকারি অফিসার হয়েছে। তারা কেউ তো রাস্তায় দেখা হলেও আমাকে চিনতেই পারেনা বোধহয়। তুই যে আমার কথা মনে রেখেছিস, এটা জেনেই বড় খুশী হয়েছি রে। তা এবার কি করবি ভাবছিস”?

সীমন্তিনী জবাব দিল, “এবার আইপিএস দেব ভাবছি স্যার। আশীর্বাদ করুন। যেন ভাল ফল করতে পারি”।
 

সুকোমল স্যার খুশী হয়ে বললেন, “বাঃ বাঃ খুব ভাল। খুব ভাল। আমার আশীর্বাদ তো সব সময় তোর ওপর থাকবেই। তবে মা একটা কথা মনে রাখিস। আইপিএস হওয়া যতটা সহজ আইপিএসের দায়িত্বটা পালন করা কিন্তু ততটা সহজ নয়। তবে আমি জানি, তুই আর দশটা মেয়ের চেয়ে আলাদা। তুই পারবি, নিশ্চয়ই পারবি মা”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “স্যার আপনার বাড়ির সবাই ভাল আছে তো”?
 

সুকোমল স্যার বললেন, “হ্যারে মা ভগবানের কৃপায় সবাই ভাল আছি। ছেলেটা ব্যাঙ্গালোরে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। মেয়েটা এবার হায়ার সেকেণ্ডারী দেবে। ও আবার সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চায়। দেখা যাক রেজাল্ট কি করে। আর আজকাল ভাল ইনস্টিটিউশনে চান্স পাওয়াও তো দিনে দিনে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে। আরে হ্যা, ভাল কথা মনে পড়েছে। রতুকে জিজ্ঞেস করলে তো সব সময় এড়িয়ে যায়। তুই বল তো মা। কানাঘুষো রতুর বিয়ের কথা শুনছি। সত্যি নাকি”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা স্যার। বিয়েটা তো ঠিকই হয়ে গেছে। শুধু ডেটটা এখনও ফাইনাল হয় নি। মনে হচ্ছে আগামী মাস দু’য়েকের ভেতরেই দিন স্থির করা হবে। দাদাভাই আর বাড়ির পক্ষ থেকে আমি আপনাকে আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে রাখছি স্যার। বাড়ির সবাইকে নিয়ে আসবেন কিন্তু বৌভাতের দিন”।
 

সুকোমল স্যার খুশী হয়ে বললেন, “সত্যি খুব ভাল খবর। অবশ্যই যাব মা। আরে এস রতু, ভেতরে এস”।

স্যারের কথা শুনেই সীমন্তিনী আর সতীশ ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে চাইল। রতীশ ঘরে ঢুকেই সীমন্তিনী আর সতীশকে দেখে চমকে উঠে বলল, “এ কিরে? তোরা এখানে? কখন এলি”?

সীমন্তিনী চেয়ার ছেড়ে উঠে রতীশের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে রতীশের মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। এক বছর বাদে সে তার প্রিয়তম পরুষটিকে চোখের সামনে দেখে সব বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলল। রতীশও অবাক হয়ে অপলক চোখে সীমন্তিনীর মুখের দিকে চেয়ে রইল। সীমন্তিনীর ভেতর থেকে একটা কান্না উথলে উঠতে চাইছিল যেন। নিজেকে সামলে নিয়ে একটু পিছিয়ে আসতে সতীশও দাদাকে প্রণাম করল।

সীমন্তিনী নিজের চোখের কোল মুছতে মুছতে সুকোমল স্যারকে বলল, “সরি স্যার। কিছু মনে করবেন না। আসলে প্রায় আট বছর আগে এ কলেজ থেকে মাধ্যমিক পাশ করে বেরোবার পর থেকে এতদিনের মধ্যে আর রাজগঞ্জের কাউকে চোখে দেখিনি আমি। আট বছর বাদে এ কলেজে এসে আমার কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। আচ্ছা স্যার, আমরা এখন উঠছি। রিক্সা দাঁড় করিয়ে রেখেছি। পরে আবার দেখা করব” বলে আবার তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে সতীশকে বলল, “চল ভাই”।
 

সুকোমল স্যার বললেন, “ঠিক আছে মা। আয়। তবে শোন, আইপিএস কোর্সের কিছু স্টাডি মেটেরিয়াল আমার কাছে আছে। ছেলেটাকে আইপিএস বানাবার ইচ্ছে ছিল আমার। তাই কিছু মেটেরিয়ালস কালেক্ট করেছিলাম। কিন্তু ও তো শেষ পর্যন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং লাইনেই গিয়ে ঢুকল। তাই তোর প্রয়োজন হলে এক সময় বাড়ি এসে ওগুলো নিয়ে যাস”।

সীমন্তিনী “আচ্ছা স্যার” বলে সতীশকে নিয়ে বেরিয়ে এল।

বাড়ির সামনে রিক্সা থেকে নেমে সতীশ ব্যাগদুটো নিয়ে বলল, “দিদি, মিষ্টির প্যাকেটটা তুই নিস” বলে বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল। রিক্সাওয়ালা রতন কিছুতেই তার বড়দির কাছ থেকে ভাড়া নেবে না। সীমন্তিনী অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওর হাতে জোর করে একশ’টা টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে রতন, শোন ভাই। আমি তোকে ভাড়া দিচ্ছি না। কিন্তু এ টাকাটা তুই নে ভাই। বাড়ি যাবার সময় কাকিমার জন্য কিছু মিষ্টি নিয়ে তার হাতে দিয়ে বলিস যে আমি পাঠিয়েছি। লক্ষ্মী ভাই, আমার কথাটা রাখ”।
 

রতন টাকাটা হাতে নিয়ে আবার সীমন্তিনীকে প্রণাম করে রিক্সা নিয়ে ফিরে গেল। সীমন্তিনী বাড়ির গেটের দিকে ঘুরতেই সরলাদেবী ছুটে এসে তাকে বুকে চেপে ধরলেন। সীমন্তিনী নিজেও তার বড়মাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে কাঁদতে দেখতে পেল গেটের ভেতরে শাড়ি পড়া কেউ একজন লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছে। তার বুঝতে বাকি রইল না কে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সরলাদেবীর হাতের বাঁধন কিছুটা শিথিল করতেই সীমন্তিনী ঝুঁকে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।
 

সরলাদেবী সীমন্তিনীর চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বলল, “ইশ, কি চেহারা বানিয়েছিস রে মা? জানি তো। একা থাকলে তুই বুঝি ঘরে রান্নাবান্না না করে বাইরের খাবার খেয়েই থাকিস। আর কিছু না হোক নিজের শরীরটার ওপর তো একটু যত্নবান হতে হয়। চল চল ভেতরে চল। আমি কখন থেকে তোর পথ চেয়ে বসে আছি রে মা। আয় আয়” বলে তার হাত ধরে টানতে লাগলেন।
 

গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে কাউকে দেখতে পেল না সীমন্তিনী। বুঝতে অসুবিধে হলনা, যিনি লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখছিলেন তিনি ভেতরে চলে গেছেন। সীমন্তিনী হাতের প্যাকেটটা সরলাদেবীর হাতে দিতে দিতে বলল, “বড়মা একটু ধর না এটা”।
 

সরলাদেবী প্যাকেটটা হাতে নিতেই সীমন্তিনী মাটিতে ঢুকে সেই জায়গাটায় হাত ছুঁইয়ে নিজের মাথায়
 
ছোঁয়াল। সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এ কিরে? তুই এখানে প্রণাম করছিস কেন মা”?

সীমন্তিনী ভারী গলায় জবাব দিল, “আট বছর বাদে আমার জন্ম ভিটেয় ফিরে এলাম। তাই একটু আমার জন্মভিটেকে প্রণাম করলাম বড়মা। চল ঘরে যাই”।

সরলাদেবী সীমন্তিনীর হাত ধরে বললেন, “তোর বড়মার চোখেও ধুলো দিতে চাইছিস তুই? ভাবিস নে মা। এবার দেখিস, সব ঠিক হয়ে যাবে। আয়”।

ঘরের বারান্দায় উঠতেই আরেক ঘর থেকে চন্দ্রাদেবী ছুটে এলেন। সীমন্তিনী তাকেও প্রণাম করে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ ছোটমা”?
 

চন্দ্রাদেবীও সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বললেন, “ভাল আছিরে মা। কিন্তু তুই এত শুকিয়ে গেছিস কেন রে? ঠিক মত খাওয়া দাওয়া করিস না বুঝি, তাই না”?

সীমন্তিনী হেসে বলল, “ডায়েটিং করছি গো। বেশী খেলে যে মুটিয়ে যাব। তা বাড়ির আর সবাই কোথায়”?
 

সরলাদেবী বললেন, “এ সময়ে আর কে থাকে বাড়িতে? ছেলেমেয়েরা তো সবাই এখন কলেজে। তোর মা রান্নাঘরে আছে। আর কর্তারা তো সবাই যে যার দোকানে। চল ঘরে চল মা” বলে চন্দ্রাদেবীকে বললেন, “ছোটো, তুই রান্নাঘরের বাকি কাজটুকু সেরে ফেল বোন। আমি একটু বাদে আসছি”।
 

ছোটমা চলে যেতে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “কোন ঘরে যাব বড়মা? আমার ঘর যে আরেকজনকে ছেড়ে দিয়েছি আমি”।
 

সরলাদেবী বললেন, “মন খারাপ করিস নে মা। তুই যে ছোটবেলা থেকেই নীলকন্ঠ হয়ে উঠেছিস রে। তাই তুই চাইলে তোর দাদাভাইয়ের ঘরেও যেতে পারিস। আর সেটা না চাইলে তুই আমার ঘরে থাকবি”।

সীমন্তিনী বলল, “শেষবারের মত আজকের রাতটা আমাকে দাদাভাইয়ের ঘরে থাকতে দেবে বড়মা? তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পার। আর নতুন করে কোন জটিলতার সৃষ্টি আমি করব না। এখন আমার জীবনে শুধু দুটোই লক্ষ্য। আইপিএস হওয়া। আর দাদাভাই আর রচুর পাশে থাকা। আর আমার মনে হয় রচুর সাথে দাদাভাইয়ের বিয়ের আগে তাকে কয়েকটা কথা আমার ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া উচিৎ। তাই আজকের রাতটা আমি তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি বড়মা। কাল থেকে আমি তোমার সাথে শোব রাতে”।
 

সরলাদেবী সীমন্তিনীকে নিয়ে রতীশের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “ঠিক আছে, তুই যা চাইছিস, তা-ই হবে”।

সীমন্তিনী রতীশের ঘরের ভেতরে ঢুকে সরলাদেবীকে বলল, “আর শোনো বড়মা, আগামী পরশু দিন জেঠুকে কালচিনি যেতে হবে। খবরটা তাকে এখনই জানিয়ে দিও। তারও তো প্রস্তুতি নেবার দরকার আছে। অবশ্য দুপুরে যখন খেতে আসবে তখন কথাটা আমিও তাকে বলব। তবু তুমি আগে থেকে তাকে কথাটা জানিয়ে রাখো। আর ঘরে পাঁজি আছে তো? নইলে জেঠুকে বলে দাও দুপুরে বাড়ি আসবার সময় একখানা পাঁজি যেন নিয়ে আসেন। বিকেলেই সেটা আমার দরকারে লাগবে। আর আজ রাতে বাড়ির সব বড়দের সাথে আমার আলোচনা আছে। তাই বাবা, কাকু, জেঠু সবাইকে বলে দিও তারা যেন আটটা সাড়ে আটটার ভেতর বাড়ি ফিরে আসেন। দাদাভাই সেখানে না থাকলেও চলবে। তবে সতুকেও থাকতে হবে। কথাটা ওকেও জানিয়ে দিও”।

সরলাদেবী বললেন, “বেশ আমি সবাইকে এখনই জানিয়ে দিচ্ছি। তুই স্নান টান করে ফ্রেশ হয়ে নে মা”।


_________________________________________________________________________________________________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#31
(Update No. 53 date. 26.7.2018)

দুপুরে খেয়ে দেয়ে সীমন্তিনী বড়মার ঘরে পাঁজি নিয়ে বসল। তারপর রচনার ফোনে ফোন করে বিধুবাবু আর বিভাদেবীর সাথে কথা বলল। সরলাদেবীকে জিজ্ঞেস করে তাদের বিয়ের দিন জেনে নিল। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ির বড় ঘরে বড়রা সবাই এসে জড়ো হয়েছেন। ছেলেমেয়েরা সবাই যার যার ঘরে পড়াশোনা শুরু করেছে। রতীশ নিজের ঘরে শুয়ে তার আগামী জীবনের কথা ভেবে যাচ্ছে। সতুকে সঙ্গে নিয়ে সীমন্তিনী বড় ঘরে এসে বলল, “জেঠু, তোমরা কি দাদাভাই আর রচুর বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভেবেছ? কবে নাগাদ দিতে চাও তোমরা বিয়েটা”?
 

রতিকান্তবাবু বললেন, “নারে মা। সেভাবে তো কিছু এখনও ভাবিনি আমরা। বিয়েটা তো হবেই, এটা জেনেই আমরা খুশী রয়েছি। আসলে আমরা তো তোর আর রচুর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হবার অপেক্ষা করছিলাম। তোর পরীক্ষার ফল বেরোবার পর তোর বড়মা বলছিল যে তুই এসে যা করার করবি। তাই তো আমরা সবাই তোর অপেক্ষাতেই ছিলাম। এখন তুই যা বলবি, আমরা সেভাবেই সব কিছু করব। তুই বল, কবে কী করতে হবে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “বেশ, তবে শোনো। মার্চ মাসে একটা ভাল দিন আছে। ন’ তারিখ। বাংলায় ২৫শে ফাল্গুন। মঙ্গলবার। গোধূলি লগ্ন। ভাই পাঁজিটা বাবার হাতে দে। তোমরা দেখে নাও। যদি কারুর কোন আপত্তি থাকে সেটা আমাকে বল। বাকি কথা পরে বলছি”।

রতিকান্তবাবু দু’ভাইকে সাথে নিয়ে পাঁজি খুলে বসলেন। তিথি, নক্ষত্র, রাশি, লগ্ন, সবদিক দিয়ে বিচার বিবেচনা করে দেখলেন দিনটা ভালই। সব দেখে শুনে রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে, দিনটা সত্যি ভাল। তবে দিন স্থির করার আগে রচুর বাবা মার বিয়ের দিন, মাস আর রচুর জন্মের দিন মাসটাও জেনে নিতে হবে রে মা”।
 

সীমন্তিনী বলল, “সে’সব কিছু আমি জেনে নিয়েছি জেঠু। আর সবদিক বিচার করেই আমার মনে হয়েছে এ দিনটা সবদিক থেকেই খুব ভাল। রচুর মা বাবাও এ দিনটার পক্ষেই মত দিয়েছেন। এবার তোমরাও
 
যদি এ দিনটার পক্ষে মত দাও, তাহলে এই ডেটটাকেই ফাইনাল হিসেবে ধরে পরের কথায় আসি আমি”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা। দিনটা ভাল। আর কালচিনির তরফ থেকে যখন কোন বাঁধা নেই তাহলে ওই তারিখটাই ফাইনাল হল। তা বিয়েটা হচ্ছে কোথায় রে মা? বিধুবাবুর যা আর্থিক দুরবস্থা, তাতে করে কালচিনিতে বিয়ের আয়োজন করা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “সে’ কথায় একটু পরে আসছি কাকু। তার আগে শোনো, ওই তারিখেই যদি বিয়েটা হয়, তাহলে হাতে দেড় মাসের মত সময় থাকছে। আর দিনগুলো দেখতে দেখতেই কেটে যাবে। তাই সময় থাকতে থাকতে সব কিছু গোছগাছ করে নিতে হবে। জেঠুর সাথে তোমরা যে যে যেতে চাও, তারা আগামী পরশুই কালচিনি যাবে। সেখানে বিয়ের দিন স্থির করার সাথে সাথে একবারে রচুকে তোমরা ভাবী পুত্রবধূ হিসেবে আশীর্বাদ করে আসবে। সকাল সকাল রওনা না হলে তোমরা একদিনে কাজ সেরে ফিরতে পারবেনা হয়ত। তাই আমার মনে হয় একটা গাড়ি ভাড়া করে গেলেই সবচেয়ে ভাল হবে। আর সঙ্গে আপাততঃ লাখ খানেক টাকা আলাদা করে নিয়ে যেও। রচুর বাবার হাতে টাকাটা দিয়ে বোল, তারা যেন বিয়ের আয়োজন শুরু করে দেন। আমি তাদের সাথে যোগাযোগ রেখেই যাব। তাদের ওখানে কি কি করতে হবে না হবে তা আমি মেসোকে বলে দেব। আর হ্যা, টাকাটা যে তোমরা দিচ্ছ এ’ কথাটা তাদের কাছে প্রকাশ কোর না। তাতে মেসো হয়ত অপমানিত বোধ করতে পারেন। তোমরা বলবে যে টাকাটা আমি পাঠিয়েছি তোমাদের হাত দিয়ে। তারা আমাকে তাদের আরেকটা মেয়ে বলেই ভাবেন। তাই তারা ভাববেন যে তাদের এক মেয়ের বিয়ের জন্য আরেক মেয়ে আর্থিক ব্যয়ভার বহন করছে। এতে খানিকটা মনঃকষ্ট হলেও তারা অপমানিত বোধ করবেন না”।

একটু থেমে সীমন্তিনী সকলের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল, “এ ব্যাপারে তোমাদের কিছু বলার আছে”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “দেখ মা, বিধুবাবুর আর্থিক অবস্থা তো আমরা সকলেই জানি। তাই নিজেদের তরফের খরচ খরচা ছাড়াও মেয়ের বাড়ির সব খরচও যে আমাদেরই বহন করতে হবে এ’কথা তো আগে থেকেই আমাদের জানা। কিন্তু এক লাখেই তারা সবটা কুলিয়ে উঠতে পারবেন বলে মনে হয় তোর? আর তাছাড়া যতদুর শুনেছি, তাদের হাতে লোকবল বলতেও প্রায় কিছুই নেই। ছেলেটা তো ছোট। বিধুবাবু একা হাতে সব কিছু সামলাতে পারবেন বলে তোর মনে হয়”?
 

সীমন্তিনী বলল, “আগে টাকার ব্যাপারটা বলি কাকু। এক লাখেই হয়ত কুলোবে না, সেটা সত্যি। তবে আপাততঃ সেটাই তাদের হাতে দিয়ে এস। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আর সেখানে বিয়ের আয়োজন কী হবে, কে করবে, এসব নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবে না। তবু তোমাদের জানিয়ে রাখছি। তোমরা রচুকে আশীর্বাদ করে ফিরে এলেই আমি কালচিনি চলে যাব। সেখানকার সব কাজের ভার আমি নিজে হাতে তুলে নেব। আশাকরি সব কিছু সামলে নিতে পারব। আমি কালচিনি যাবার পরের দিনই মাসি আর মেসো এসে দাদাভাইকে আশীর্বাদ করে যাবেন। এখন যে তোমাদের একলাখ টাকার কথা বললুম, এটা আসলে সে জন্যেই। তারা কি খালি হাতে পাত্রকে আশীর্বাদ করতে আসবেন নাকি? এদিকের সব আয়োজনে আমি না থাকলেও কোন অসুবিধে হবে না। তোমরা সবাই আছ, সতুও থাকছে। অবশ্য তেমন প্রয়োজন হলে সতুকে দু’একদিনের জন্যে আমি ডেকে নিতেও পারি। তাতেও তোমাদের এদিকের কাজে খুব একটা ব্যাঘাত হবে না। তবে রচুকে আশীর্বাদ করার পর থেকেই আমি মেয়েপক্ষের লোক হয়ে যাব। ও’দিকের সমস্ত আয়োজনের ভার আমার হাতেই থাকবে”।

সরলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তার মানে? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সময় তুই বাড়ি থাকবি না”?

সীমন্তিনী সোজা জবাব দিল, “না-ই বা রইলাম বাড়িতে বড়মা। তাতে কারুর তো কোন অসুবিধে হবার নয়। আমি তো আট বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া। তাতে কার কোন কাজটা আঁটকে আছে বল? কিন্তু সেই কন্যাদায়গ্রস্ত লোকটার পাশে না দাঁড়ালে যে রচু আর দাদাভাইয়ের বিয়েটাই আঁটকে যাবে। হ্যা তোমরা হয়ত বলতে পার, যে রচুকে এখানে তুলে এনে তোমরা দাদাভাইয়ের সাথে বিয়ে দেবে। সেটা অসম্ভবও কিছু নয়। কিন্তু বড়মা সেক্ষেত্রেও তো সমস্ত ব্যয়ভার আমাদেরই বহন করতে হবে তাই না? আর কালচিনিতে আয়োজন করতে হলে হয়ত আর কিছুটা বেশী খরচ পড়তে পারে। কিন্তু তুমি তো মা বড়মা। মাসির, মানে রচুর মায়ের কথাটা একটু ভেবে দেখ তো। শুধু গরীব বলেই তিনি নিজের বাড়ি থেকে কনে বিদেয় করতে পারবেন না? এটা কি তুমিই মেনে নিতে পারবে? আর যে মেয়েটা সারা জীবনের জন্যে নিজের মা বাবা ভাই বোনদের ছেড়ে তোমার সংসারে আসতে চলেছে, সে মেয়েটার মনেও কতটা দুঃখ হতে পারে একটু ভাবো তো”।

একটু থেমে একবার সীমাদেবীর মুখের দিকে দেখে সীমন্তিনী আবার বলল, “সবাই তো আর তোমার এ মেয়েটার মত অলক্ষ্মী নয় বড়মা। নিজের বড় মেয়েটাকে কূপাত্রে দান করে মাসি মেসো দু’জনেই যেন অকালেই কেমন বুড়িয়ে গেছে, তা তো তোমরা স্বচক্ষে দেখেছ বড়মা। মেয়েটার দুর্ভোগের কথা না হয় ছেড়েই দিচ্ছি। কিন্তু তাদের বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি গিয়েও তারা তাদের মেয়েটাকে বিয়ের পর একটা দিনও দেখতে পারেন নি। তার বেয়াই বেয়ানরা দুর দুর করে তাড়িয়ে দিয়েছে বার বার। এটা যে ওই বাড়ির লোকগুলোর পক্ষে কতটা দুঃখের ব্যাপার সেটা আশা করি তুমিও বুঝতে পারছ। ছোট মেয়ের বিয়ে দিতে তাদের বাড়ি ছাড়া হয়ে এখানে বা জলপাইগুড়ি আসতে হোক এটা আমি চাই না। তবে তোমরা যদি মনে কর যে এ বাড়তি খরচাটুকু তোমরা করতে পারবে না, তাহলে তার সমাধানও আমার কাছে আছে। কোনও একটা মন্দিরে নিয়ে গিয়ে তোমরা ছেলের বিয়ে দিতে পারো। খরচ খুব কম হবে। তবে সেক্ষেত্রেও কালচিনির কোন মন্দিরেই সেটা সমাধা করতে হবে। মাসি নিজের ওই ভাঙা বাড়িটা থেকেই তার ছোটমেয়েকে বিদেয় করতে পারবেন”।

সরলাদেবী নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে সীমন্তিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “তুই এমন করে বলছিস কেন রে মা? আমি কি তাই বলেছি নাকি? তোর দাদাভাইয়ের বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব তো আমি তোর কাঁধেই দিয়েছি রে মা। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি যদি কিছু ভুল বলে থাকি আমায় ক্ষমা করিস মা তুই”।

সীমন্তিনী সরলাদেবীকে শান্ত করতে করতে বলল, “না বড়মা, তুমি কিছুই ভুল বল নি। কিন্তু আমি তো তোমাকে কথা দিয়েছিলাম যে দাদাভাইকে সংসারী করে তোমার ঘরে পূত্রবধূ এনে দেবই আমি। আমি তো সেটাই করতে চাইছি। রচুকে যে ভাবেই হোক তোমার ছেলের বৌ করে এ বাড়িতে এনে দেবই আমি। তাই সম্ভাব্য সব রকম পথের কথাই তোমাদের বলছি। তোমরা কোন পথে যেতে চাও সেটা তোমরা বিচার করে দেখ। তুমি বসো এখানে। আর কেঁদো না। ছেলের বিয়ে নিয়ে আলোচনায় বসেছ, এটা কত সুখের কথা। এমন মূহুর্তে ছেলের মা হয়ে চোখের জল ফেলতে আছে”?

রতিকান্তবাবু এবার বললেন, “ঠিক আছে রে মা। ভগবানের আশীর্বাদে এ’টুকু বাড়তি খরচ বহন করবার মত সামর্থ্য তো আমাদের আছেই। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। কিন্তু এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। তুই যে রচুকে আশীর্বাদ করবার দিনই ওর বাবার হাতে এক লাখ টাকা দিয়ে আসতে বলছিস, সে ব্যাপারে বলি। তুই তো বলছিস যে আমরা রচুকে আশীর্বাদ করে আসবার পরের দিনই তুই তাদের ওখানে যাবি। ওই একটা দিনেই তো আর টাকার অত প্রয়োজন হবে না। তাই বলছিলাম কি, রাস্তা ঘাটে এতগুলো ক্যাশ টাকা নিয়ে যাতায়াত করাটা তো খুব নিরাপদ নয়। আমি না হয় কালই তোর ব্যাঙ্ক একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করে দেব। তুই কালচিনি গিয়ে সেখানে এটিএম থেকে যখন যেমন প্রয়োজন হবে তুলে নিবি। এটা করলে তোর কোন আপত্তি আছে”?
 

সীমন্তিনী একটু ভেবে নিয়ে বলল, “কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ জেঠু। ঠিক আছে তাহলে তা-ই কোর। তাহলে আশীর্বাদ আর বিয়ের দিন পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। বিয়ের পরের ব্যাপারগুলো, মানে বৌভাত, পার্টি বা ওদের মধুচন্দ্রিমা এ’সব ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই। তোমরা যা ভাল বুঝবে তাই করবে। প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। না জানালেও কোন ব্যাপার নেই। তবে আর দুটো ব্যাপারে আমার কিছু বলার আছে। বিয়ের দিন বরযাত্রী সংখ্যা যেন পঞ্চাশ ছাড়িয়ে না যায়, সেদিকে খেয়াল রেখ। কারন বরযাত্রীদের সকলের জন্যেই তো সেখানে রাতে থাকবার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেটা হোটেল বা লজ ভাড়া নিয়েই করতে হবে। তাই এর বেশী বরযাত্রী হলে সামলান মুস্কিল হবে হয়ত। তবে এটাও আমি সেখানে না গেলে বুঝতে পারব না। তবে আপাতাতঃ এমনটাই ধরে রাখ তোমরা। ওখানে গিয়ে সবকিছু দেখে শুনে পরে আমি তোমাদের জানাব। আর অন্য কথাটা হচ্ছে, আমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সুকোমল স্যারকে নিয়ে। তাকে আমি আজই আগাম নিমন্ত্রন জানিয়ে এসেছি। সতু জানে। অবশ্য তাকে আমি বৌভাতের দিনের জন্যেই বলেছি। কিন্তু দাদাভাইয়ের তরফ থেকে তাকে বিয়ের দিন বরযাত্রী যাবার জন্যেও তোমরা অনুরোধ কোর। উনি নিজে যেতে না পারলে না যাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় আমাদের পক্ষ থেকে আমন্ত্রনটা তাকে জানানো উচিৎ”।

রতিকান্তবাবু বললেন, “হ্যা হ্যা, সুকোমল স্যারকে অবশ্যই বলব আমরা। ভদ্রলোক সব সময় আমাদের কাছে তোর ব্যাপারে খবরাখবর নেন। তোকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসেন। তাকে নিশ্চয়ই বলব। আর বরযাত্রীর ব্যাপারেও তুই যা বললি, তা-ই হবে। বাড়ির বড়ছেলের বিয়ে। সম্ভব হলে তো আরও অনেককেই নিয়ে যেতাম। তবে বৌভাতের দিন চেনা পরিচিত সকলকে ডেকেই না হয় সে সাধ মেটাব। ও’খানে তোর যদি আরও টাকার প্রয়োজন পড়ে তাহলে সময় থাকতেই আমাকে জানিয়ে দিস। আমরা সব ব্যবস্থা করে দেব”।

এবার শশিকান্ত বাবু প্রথমবার মুখ খুললেন। বললেন, “আচ্ছা বৌদি, বিয়ের দিন পড়ছে তাহলে পঁচিশে
 
ফাল্গুন। ছেলে-বৌ বাড়ি আসছে ২৬ তারিখে। তারপর এদিকে ওইসব কালরাত্রি, বৌভাত, পার্টি আর ওদের হানিমুনের ব্যাপারটা বাকি রইল। সে’সব ব্যাপারেও না হয় আলোচনাটা সেরে ফেলা যাক একবারেই”।
 

সরলাদেবী কিছু বলবার আগে রতিকান্তবাবু বললেন, “কথাটা ঠিকই বলেছিস শশী। ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ে আমরা সকলেই এত ব্যস্ত থাকি যে তিন ভাই মিলে একত্রে বসে ওঠা প্রায় হয়ই না। আজ মন্তির ডাকেই আমরা যখন একত্রিত হয়ে বসেছি, আর হাতেও যখন সময় আছে, তাহলে সে’সব নিয়েও আলোচনা করা যাক”।
 

সীমন্তিনী সে সভা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, “বেশ তোমরা আর যা যা আলোচনা করতে চাও কর। কিন্তু বড়মা এখন আমার সাথে যাবেন। তার সাথে আমার আলাদা করে কিছু কথা আছে। আমার হাতে সময় কম। আমিও পরশুই চলে যাব। কাল আবার আমাকে দু’বেলা একটু বাইরে বেরোতে হবে। কয়েকজনের সাথে দেখা করবার আছে। তাই বড়মার সাথে ব্যক্তিগত কথাটুকু আমি আজই সেরে নিতে চাই”।

সরলাদেবীও উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “হ্যা হ্যা চল মা। ওনারা আলোচনা করুন। আমি পরে সে’সব জেনে নেব। চল” বলে সীমন্তিনীর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বাইরে যেতে যেতে সীমন্তিনী একবার তার মায়ের মুখের দিকে চাইল। সীমাদেবী একদৃষ্টে তার মেয়ের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।

বড় ঘর থেকে বেরিয়ে রতীশের ঘরের দিকে যেতে যেতে নিজের হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখল রাত প্রায় দশটা। বাড়ির খাওয়া দাওয়া হয় রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে। তাই সে ভাবল, বড়মার সাথে আলোচনা করবার মত যথেষ্ট সময় এখন হাতে নেই। তাই সে থেমে সরলাদেবীকে বলল, “না গো বড়মা। তোমার সাথে এখন আর কথা বলা যাবে না। দশটা বাজতে চলল। আর আধঘন্টা বাদেই তো সবাইকে খেতে দিতে হবে। শোন না, তুমি না হয় আবার বড় ঘরেই ফিরে গিয়ে তাদের সাথে আলোচনায় বস গিয়ে। আমি ততক্ষণে আমার ভাইবোন গুলোর সাথে একটু কথা বলে নিই। রাতে সকলের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে তুমি আমার সাথে একটু বসতে পারবে না”?

সরলাদেবী বললেন, “তা পারব না কেন? অবশ্যই পারব”।

সীমন্তিনী বলল, “তাহলে তা-ই কর। তুমি ওঘরেই যাও” বলে কাকুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। সে ঘরে চন্দ্রিকা আর চঞ্চলের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে সীমন্তিনী নিজের মায়ের ঘরের ভেতর গিয়ে ঢুকল। সামনের রুমেই শশীকান্তবাবু আর সীমাদেবীর বিয়ের সময়কার একটা ছবি আছে, সেটা সে আগে থেকেই জানে। পাশের রুমেই সূর্য্যর পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। সীমন্তিনী ফটোটার কাছে গিয়ে ফটোটাকে হাতে নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরে চোখ বুঝল। তারপর কপালে ছুঁইয়ে ফটোটাকে আবার ঠিক জায়গায় রেখে
 
দিয়ে নিজের চোখ মুছে নিল। তারপর সূর্য্যর ঘরে ঢুকে দরজার কাছ থেকেই ডাকল, “ভাই”।
 

সূর্য্য চমকে উঠে ঘাড় ঘুরিয়ে দিদিকে দেখেই লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, “দিদি তুমি”?
 

সীমন্তিনী দু’হাত বাড়িয়ে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “হ্যারে ভাই আমি। কেমন আছিস ভাই তুই? ভাল আছিস তো? টিউশন থেকে কখন ফিরেছিস আমি তো বুঝতেই পারিনি। ইশ কী ভাল লাগছে রে তোকে দেখতে ভাই”।
 

সূর্য্য অনেকক্ষন দিদির হাতের আদর খেয়ে নিচু হয়ে দিদিকে প্রণাম করে বলল, “কত বছর বাদে আজ তোমাকে দেখতে পাচ্ছি দিদি। মেজদা তো তবু মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। তাকে তো তবু দেখতে পাই। তুমি কেন বাড়ি আস না গো দিদি? আমার মনটা যে মাঝেমধ্যে তোমাকে খুব দেখতে চায় গো। একবার মেজদার সাথে যাবার জন্য কত কান্নাকাটি করেছিলাম। মা যেতে দেন নি। তুমি ভাল আছ তো দিদি”?

সীমন্তিনী ভাইয়ের কপালে আদর করে চুমু খেয়ে বলল, “হ্যারে ভাই, আমি ভাল আছি। তুই মন দিয়ে লেখাপড়া করছিস তো? এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দিবি। ভাল রেজাল্ট করতে হবে কিন্তু। বড়মা বলছিলেন তুই নাকি সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাস, আর ফিরিস রাত ন’টা নাগাদ। খুব কষ্ট হয় না রে ভাই”?

সূর্য্য ম্লান হেসে জবাব দিল, “তা তো একটু হয়ই দিদি। তবে বড়মা আমার জন্য সব সময় বেশী করে টিফিন গিয়ে দেন। দুপুরে কিছুটা খাই। আর বিকেলে একটা টিউশানি শেষ হলে বাকিটুকু খাই। তাই ক্ষিদেয় কোন কষ্ট পেতে হয় না। কিন্তু সকালে একটা আর বিকেলে দুটো টিউশান ক্লাস করে ফিরতে ফিরতে রোজই ন’টা বেজে যায়। তুমি কখন বাড়ি এসেছ দিদি”?
 

সীমন্তিনী সূর্য্যর হাতটা হাতে ধরে রেখেই জবাব দিল, “আমি তো সাড়ে দশটা নাগাদ এখানে এসেছি। তবে বাড়ি আসবার আগে তোদের কলেজে গিয়েছিলাম। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের সাথে দেখা করে তারপর বাড়ি এসেছি”।

সূর্য্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি আমাদের কলেজে গিয়েছিলে দিদি? তবু আমার সাথে একটু দেখা করনি তখন”?

সীমন্তিনী ভাইকে আদর করে বলল, “রাগ করিস না ভাই। তখন তোদের ক্লাস চলছিল তো। তাই ও সময়ে তোকে ক্লাস থেকে ডেকে পাঠালে তোর পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটত না? তবে তখন যদি আমি জানতুম যে তুই রাত ন’টার আগে বাড়ি ফিরবি না, তাহলে তোর ওই ক্লাসটা শেষ হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করতুম রে। কিন্তু আমি তো সেটা জানতুম না। বিকেলে চন্দু চঞ্চু ওরা যখন কলেজ থেকে ফিরল তখন তোকে না দেখে ওদের জিজ্ঞেস করেই জানলুম যে তুই রাত ন’টায় ফিরবি। আর এখন বাবা কাকু জেঠুদের সাথে কথা বলেই তো তোর ঘরে ছুটে এলাম তোকে দেখব বলে”।

সূর্য্য একটু অবাক হয়ে বলল, “বাবা তোমার সাথে বলেছে? সত্যি বলছ তুমি দিদি”?
 

সীমন্তিনী মিথ্যে বলল, “বা রে, কেন বলবেন না? বাবা, মা কাকু, কাকিমা সবার সাথেই তো আমি কথা বললুম এতক্ষণ”।
 

সূর্য্য একটু আমতা আমতা করে বলল, “ও, কিন্তু তাহলে তোমার কথা তুলে কিছু বলতে গেলেই বাবা মা আমাকে ধমক দেন কেন, সেটা তো বুঝতে পারছি না”।
 

সীমন্তিনী ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ও কিছু নয় রে ভাই। আসলে আমি অনেক দিন আগে কী যেন একটা সাংঘাতিক অন্যায় কাজ করে ফেলেছিলুম। আমার ঠিক মনেও নেই। কিন্তু মা বাবা বুঝি সে কথাটা ভুলতে পারেননি এখনও। তাই তোকে অমন করে বলেন। ও নিয়ে তুই ভাবিস না ভাই। তুই ভাল করে মন দিয়ে পড়াশোনা করবি। আর মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করবি। কখনো মা বাবাকে কোন কষ্ট দিস না যেন। আচ্ছা শোন ভাই, আজ রাতে আমি তুই আর চন্দু চঞ্চু একসাথে বসে খাব, হ্যা”?
 

সূর্য্য বলল, “কতদিন তোমার সাথে একসাথে বসে খাইনি দিদি। আজ নিশ্চয়ই খাব। কিন্তু মা যদি আবার বকেন”?
 

সীমন্তিনী বলল, “না বকবেন না। কিচ্ছু বলবেন না। চল আমরা খাবার ঘরে যাই। চন্দু আর চঞ্চুকেও সাথে নিয়ে যাব চল। তুই ওদের ডেকে নিয়ে আয়, আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি, কেমন”?
 

সীমন্তিনী বড় ঘরের সামনে এসে দেখল, আলোচনা তখনও চলছে। দরজার বাইরে থেকেই সে বড়মাকে ডেকে বলল, “বড়মা, একটু আসতে পারবে তুমি”?
 

সরলাদেবী ঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, “কি হয়েছে রে মা? কিছু বলবি”?

সীমন্তিনী সরলাদেবীর হাত ধরে বলল, “সূর্য্যর খুব ক্ষিদে পেয়েছে গো। আর চন্দু চঞ্চু ওরাও বায়না ধরেছে আমার সাথে খাবে বলে। ওদের পড়াও শেষ হয়ে গেছে। তুমি আমাকে একটু দেখিয়ে দেবে, কি কি রান্না হয়েছে, আর কোথায় কিভাবে রাখা হয়েছে। তাহলে আমি ওদের খেতে দিয়ে ওদের সাথে নিজেও বসে পড়তাম”।
 

সরলাদেবী বলল, “মমতা তো রান্নাঘরেই আছে। তুই বাচ্চাদের নিয়ে খাবার ঘরে আয়। আমি বেড়ে দিচ্ছি”।
 

ছোট তিন ভাই বোনের সাথে নানা রকম খুনসুটি করতে করতে সীমন্তিনী তাদের সাথেই খাবার খেল। তবে রতীশকেও তাদের সঙ্গে নিয়ে বসেছিল।


______________________________
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#32
(Update No. 54 date. 26.7.2018)

খাওয়া শেষ হলে সীমন্তিনী সরলাদেবীকে বলল, “বড়মা আমি দাদাভাইয়ের ঘরে থাকবো। তোমার খাওয়া হলে তুমি সেখানে এস”।

ততক্ষণে বড় ঘরের আলোচনা শেষ হয়ে গেছে। খাবার ঘর থেকে বেরোতেই চন্দ্রাদেবী সীমন্তিনীর কাছে
 
এসে চঞ্চলকে জিজ্ঞেস করলেন। “কিরে তোরা খেয়েছিস”?

চন্দ্রিকা উৎফুল্ল গলায় জবাব দিল, “হ্যা মা। আমরা খেয়ে নিয়েছি। জানো মা? বড়দি আজ আমাকে সেজদাকে আর ছোড়দাকে সব্বাইকে নিজে হাতে করে খাইয়ে দিয়েছে। খুব মজা হয়েছে। এখন বড়দি আমাকে গল্প শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়িয়ে দেবে বলেছে”।

চন্দ্রাদেবী চন্দ্রিকার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন, “বাহ, এ তো দারুণ খবর। তা পেট ভরে খেয়েছ তো তোমরা সবাই? তাহলে যাও। বড়দির আদর খেতে খেতে আর তার মুখে গল্প শুনতে শুনতে লক্ষী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পড় গিয়ে” বলে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে মা। এই পুচকো গুলো তোকে খুব জ্বালাচ্ছে, তাই না রে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “একটুও জ্বালায়নি ছোটমা। ওরা সবাই লক্ষী ছেলেমেয়ের মত খেয়ে নিয়েছে। তুমি ভেব না। তুমি যাও ওদিকের খাবার ঘরের ঝামেলা সামলাও গিয়ে। আমি ওদের ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি”।

সূর্য্য আগেই নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। সীমন্তিনী চঞ্চল আর চন্দ্রিকাকে নিয়ে ছোটমার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দু’জনকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে তাদের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে রূপকথার গল্প শোনাতে লাগল। অনেকক্ষণ গল্প শুনবার পর একটা সময় তারা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লে সীমন্তিনী দু’জনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে তাদের গায়ের ওপর ভাল করে চাদর বিছিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতেই চন্দ্রকান্তবাবু ঘরে এসে ঢুকলেন। সীমন্তিনীকে দেখে বললেন, “কিরে মা? বিচ্ছু দুটো ঘুমোল? তুই পারলি ওদের ঘুম পাড়াতে? তোর ছোটমা তো রোজ এ কাজ করতে একেবারে গলদঘর্ম হয়ে ওঠে। আর এ দুটোও সত্যি খুব জ্বালায়
 
রে তোর ছোটমাকে”।
 

সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর কাছে এসে হেসে বলল, “কই আমার সাথে তো ওরা তেমন কিছু করেনি। খেতেও কোন ঝামেলা করেনি, আর ঘুমোতেও না। তবে দু’দুটো গল্প শুনে তবে ঘুমিয়েছে” বলে একটু হাসল।

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই কি এখনই শুতে যাবি মা? নইলে একটু বোস না। এতদিন পর তুই বাড়ি এসেছিস। আমি তো সকাল হতে না হতেই আবার বেরিয়ে যাব। বোস না একটু। দুটো কথা বলি তোর সাথে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “বসতে নয় কাকু, কিছু সময় থাকতে পারি। তবে একটা শর্তে”।

চন্দ্রকান্তবাবু নিজের বিছানায় বসতে বসতে বললেন, “তোর সাথে দুটো কথা বলব, তাতেও শর্তের কথা বলছিস মা? বেশ শুনি, কী শর্ত তোর? সেই ছোট্টবেলার মতো আমার কোলে মাথা পেতে শুবি নাকি”?
 

সীমন্তিনী বিছানায় চন্দ্রকান্তবাবুর পাশে বসে বলল, “হ্যা কাকু, সেটাই চাইছি। একটু সরে বোস তুমি। ইশ কত বছর বাদে তোমার কোলে একটু শোবার সুযোগ পেয়েছি! এ সুযোগ ছাড়া যায়”? বলতে বলতে চন্দ্রকান্তবাবুর কোলে মাথা পেতে শুয়ে পড়ল।
 

চন্দ্রকান্তবাবু সীমন্তিনীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “শুনেছিস মা? বৌভাত আর পার্টি, দুটোই হবে এগার তারিখে। বৌভাতটা ঘরোয়া ভাবে দিনের বেলাতেই সারা হবে। আর পার্টিটা হবে সন্ধ্যের পর থেকে। ভাল হবে না”?
 

সীমন্তিনী চোখ বুজে কাকুর আদর খেতে খেতে বলল, “হু ভালই হবে”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তবে ওদের মধুচন্দ্রিমা নিয়ে কোন মীমাংসা হলনা রে। আসলে সবাই বলল যে রতীশ কবে ছুটি পাবে সেটা না জানতে পারলে তো সে ব্যাপারটা ফাইনাল করা যাবে না। আর এটা তো ওদের দু’জনের পছন্দ অপছন্দের ওপর নির্ভর করে। সতু অবশ্য বলছিল যে ওদের সুইজারল্যাণ্ড পাঠাতে চায়। কিন্তু সেখানে যেতে হলে তো পাসপোর্ট ভিসা, এ’সবের প্রয়োজন হবে। ওদের তো কারুরই পাসপোর্ট নেই। মাসখানেকের মধ্যে পাসপোর্ট পাওয়া গেলেও ভিসার বন্দোবস্ত করে ফেলা যাবে বলে ভরসা কম। তুই কি বলিস”?
 

সীমন্তিনী চোখ বুজেই বলল, “এ ব্যাপারে আর আমি কী বলব বল? তবে আমার মনে হয় রচু আর দাদাভাই মিলে ডিসিশনটা নিলেই সবচেয়ে ভাল হবে। কিন্তু কাকু আমি একটা অন্য কথা বলতে চাই তোমাকে। ছোটবেলা থেকে তুমি আমার অনেক ন্যায় অন্যায় আব্দার রেখেছ। আজ আরেকটা আব্দার করব তোমার কাছে, তুমি রাখবে না সেটা”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “নিশ্চয়ই রাখব মা। বল কী চাস তুই”?
 

সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর অন্য হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, “আমি তো আর এ বাড়িতে থাকছি না। আমার ভবিষ্যৎ জীবনটা নিয়ে অন্যভাবে প্ল্যান করেছি। আমাদের পরিবারটা ভাল। রাজগঞ্জের সকলেই আমাদের পরিবারকে সম্মানের চোখে দেখে। এ বাড়ির সকলেই খুব ভাল। একমাত্র খারাপ শুধু আমিই। আর নতুন করে যে এ পরিবারে আসতে চলেছে, সে-ও সত্যি খুব ভাল। রচু সত্যি খুব ভাল মেয়ে। আমি তো প্রায় বছর খানেক ধরে ওর সাথে, ওর পরিবারের সাথে যোগাযোগ রেখে আসছি। তাই তোমাদের সকলের চেয়েও আমি ওকে বেশী ভাল করে জেনেছি, চিনেছি। তাই বলছি, রচুকে আমি আমার বৌদি কম বান্ধবী আর ছোট বোন বলে ভেবেই বেশী সুখ পাই। ওর মত একটা মেয়ে যে এ পরিবারে আসছে, এটা আমাদের সকলের পরম সৌভাগ্য কাকু। তাই আমি চাই, এ বাড়ির কেউ যেন গরীব ঘরের মেয়ে বলে ওকে কোন কষ্ট না দেয়। তুমি তো জানই কাকু, দাদাভাইকে আমি কতটা ভালবাসি। রচুকে দেখবার পর থেকে, ওর সাথে মেশবার পর থেকে রচুকেও আমি একই সমান ভালবেসে ফেলেছি। এখন থেকে ওরা দু’জনই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের লোক। আর আমি জানি, রচনার যা মিষ্টি স্বভাব, তাতে ও দু’দিনেই তোমাদের সকলের মন জয় করে নেবে। এ বাড়ির অনেকেই আমাকে ঘৃণা করে, আমার ছায়াও মাড়াতে চায় না তারা। কিন্তু তারাও রচনাকে নিজের মেয়ের মতই ভালবাসতে বাধ্য হবে, এ’কথা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। আমার মনের কথা শোনবার লোক এ বাড়িতে খুব বেশী নেই। শুধু তুমি আর বড়মা ছাড়া। তাই তোমাদের দু’জনের কাছেই আমি মিনতি করছি কাকু, রচুকে তোমরা কখনও কোন কষ্ট দিও না। ওকে তোমরা ভালবেসে কাছে টেনে নিও। ওকে তোমরা চার আনা ভালবাসলে ও তার চার গুণ ভালবাসা তোমাদের ফিরিয়ে দেবে দেখো”।

চন্দ্রকান্তবাবু সীমন্তিনীর মাথায় আদর করে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “তুই কিচ্ছু ভাবিস না মা। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, এ বাড়িতে কেউ কখনও রচুর অমর্যাদা করবে না। আমিও তো মেয়েটাকে দেখেছি। কি মিষ্টিই না দেখতে মেয়েটা। আর যতটুকু সময় ওকে দেখেছি, তাতে ওকে খুব নম্র আর খুব ভদ্র বলেই মনে হয়েছে আমাদের সবার। তবে এটাও ঠিক, তুই যেভাবে ওর সাথে মেলামেশা করেছিস আমরা তো সেভাবে মেলামেশা করার সুযোগ পাইনি। তুই নিশ্চয়ই আমাদের চেয়েও ওকে বেশী ভাল চিনতে পেরেছিস। আর রতুও যে তোর কাছে কী, কতখানি সেটাও আমরা বুঝিরে মা। রতুর অমঙ্গল তুই কখনও বরদাস্ত করতে পারবি না জানি। এটাও জানি কেউ রতুর কোন অমঙ্গল করতে চাইলে তুই তার সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়াবি। রতুকে আমরা যেমন ভালবাসি, রচুকেও ঠিক ততটাই ভালবাসব দেখিস। আর অমন মিষ্টি একটা মেয়েকে কেউ ভাল না বেসে থাকতে পারব আমরা”?
 

এমন সময় চন্দ্রাদেবী ঘরে ঢুকে বললেন, “এক বছর ধরে শুধু মেয়েটার কথাই শুনে যাচ্ছি। চোখের দেখা তো দুর। একটা ছবিও কেউ এনে দেখাল না আমাকে”।
 

সীমন্তিনী চোখ মেলে ছোটমার দিকে চেয়ে বলল, “ওমা সেকি ছোটমা? তুমি এখনও রচুর কোন ছবি দেখ নি? দাঁড়াও, এখনই দেখাচ্ছি তোমাকে” বলে চন্দ্রকান্তবাবুর কোল থেকে মাথা তুলে উঠে রতীশের ঘরের দিকে চলল। রতীশ বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। নিজের ব্যাগ থেকে মোবাইলটা নিতে নিতে বলল, “দাদাভাই, আর একটু অপেক্ষা কর লক্ষীটি। আমি ছোটমার সাথে একটু কথা বলে আসছি”।

ছোটমার ঘরের দিকে যেতে যেতে রান্নাঘরের বারান্দায় সরলাদেবীকে দেখে সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “তুমি খেয়েছ বড়মা”?

সরলাদেবী বললেন, “হ্যারে খেয়েছি। তুই কোথায় যাচ্ছিস”?

সীমন্তিনী বলল, “তুমিও এস। একটু ছোটমার ঘরে যাচ্ছি”।
 

সরলাদেবীকে সাথে নিয়ে সীমন্তিনী চন্দ্রকান্তবাবুর ঘরে ঢুকে বলল, “কই ছোটমা এস”।

বিছানায় একপাশে বড়মা আর একপাশে ছোটমাকে নিয়ে বসে সীমন্তিনী মোবাইলে রচনার ছবি বের করে
 
বলল, “এই দেখো ছোটমা। এই হচ্ছে রচু। তোমাদের বাড়ির হবু বড়বৌ”।
 

রচনার পাঁচ ছ’টা ছবি দেখার পর চন্দ্রাদেবী বললেন, “ইশ কি সুন্দর দেখতে রে! ও বড়দি, এ যে সাক্ষাৎ মা লক্ষী গো”!
 

সীমন্তিনী বলল, “না ছোটমা, শুধু মা লক্ষ্মী নয় গো। এ মেয়ে একেবারে যাকে বলে রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী, ঠিক তাই। লেখাপড়ায় দারুন ভাল। মাধ্যমিকে উচ্চ মাধ্যমিকে জেলার ভেতরে ফার্স্ট হয়েছে। ক্লাসে ছোটবেলা থেকে বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছে”।
 

চন্দ্রাদেবীর পেছন থেকে চন্দ্রকান্তবাবু ছবি গুলো দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যারে মন্তি, মেয়েটা তো দেখতে সত্যিই চমৎকার রে। আর চলাফেরা কথা বলা দেখে শুনে বেশ নম্র আর ভদ্র বলেই মনে হয়েছে। কিন্তু ঘরকন্নার কাজে বা রান্না বান্নায় কেমন রে”?

সীমন্তিনী বলল, “ঘর গোছানোতে যে খুব ওস্তাদ সে তো প্রথম দিন থেকেই দেখছি। আর মাসি বলেছেন রচু সব রকম ঘরোয়া রান্নাবান্না জানে। অবশ্য তুমি যদি ইটালিয়ান খাবার চাইনীজ খাবার বা কন্টিনেন্টাল ফুডের কথা বল, তাহলে সে’সব কিছু ও জানে না। আর অমন গ্রামাঞ্চলের অমন গরীব ঘরের মেয়ে এসব জানবেই বা কেমন করে? কিন্তু কাকু। তোমাকে কী বলব? যেদিন সতুকে নিয়ে ওখানে গিয়েছিলাম সেদিন রচু ছোলার ডালের রসা বানিয়ে খাইয়েছিল আমাদের। কী দারুণ যে বানিয়েছিল না! কী বলব তোমাকে! সে স্বাদ মনে হয় এখনও আমার মুখে লেগে আছে। সতুকে জিজ্ঞেস করে দেখ”।

চন্দ্রাদেবী বলল, “তাহলেই হল। আমাদের বাড়িতে তো আর ওকে কন্টিনেন্টাল ফুড রান্না করবার প্রয়োজন হবে না। আমরা ডাল ভাত মাছ যা খাই সেটুকু করতে পারলেই হল। তাই না গো বড়দি”?
 

সরলাদেবী বললেন, “একদম ঠিক বলেছিস। এর বেশী আমাদের আর কি চাই”।
 

সীমন্তিনী বলল, “এ ছবিটা দেখ ছোটমা। এটা রচুর ছোট ভাই কিংশুক। আমাদের চঞ্চুর থেকে বছর খানেকের মত বড়। কিন্তু পড়াশোনায় তুখোর। ও-ও রচুর মত ক্লাসের ফার্স্ট বয়। আর এটুকু বয়সেই কি বুদ্ধি তার! বয়সের তুলনায় অনেক বেশী বোঝদার। আর মাঝে মাঝে এমন এমন সব কথা বলে না! আমি শুনে অবাক হয়ে যাই। ও-ও আমাকে খুব ভালবাসে”।

চন্দ্রাদেবী বললেন, “বাঃ ছেলেটাও তো বেশ দেখতে”।
 

সীমন্তিনী মোবাইল বন্ধ করে বলল, “চলো বড়মা, এবার আমরা যাই। তোমার সাথে কিছু দরকারি কথা সেরে নিই এবার” বলে চন্দ্রকান্তবাবুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “কাকু, তুমি আমার মোবাইলটা নিয়ে গিয়ে তোমার মেজদা আর মেজোবৌদিকে রচুর ছবিগুলো দেখাও গিয়ে। তারাও তো রচুর ছবি দেখেননি এখনও”।
 

সরলাদেবীকে নিয়ে রতীশের ঘরে এসে সীমন্তিনী দেখে রতীশ আগের মতই বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে আছে। ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিতে সামান্য শব্দ হল। সে শব্দে রতীশ চোখ মেলে চেয়ে বলল, “এসেছিস মন্তি? হয়েছে সকলের সাথে কথা বলা”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে দাদাভাই। মোটামুটিভাবে হয়েছে কথা। এখন শুধু তোর আর বড়মার সাথে কথা বলা বাকি। উঠে বোস। বড়মাকে বসতে দে”।
 

রতীশ উঠে খাটের একপাশে হেলান দিয়ে বসতে সীমন্তিনী সরলাদেবীকে ধরে বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি মনে মনে নিশ্চয়ই ভাবছ বড়মা যে তোমার সাথে কথা বলব বলে তোমাকে এ’ ঘরে টেনে আনলুম কেন। শোনো বড়মা। ছোটবেলা থেকে আমাকে নিয়ে তো এ বাড়িতে কম অশান্তি হয়নি। কিন্তু যা কিছু হয়েছে তাতে বাড়ির সবাই আমাকে ও দাদাভাইকে সমানভাবে দোষী বানিয়েছে। না তোমরা সবাই যা করেছ তা নিয়ে আমি কোন সমালোচনা করছি না। তোমরা যা করেছ, অভিভাবক বা গুরুজন হিসেবে তা একেবারেই অনুচিত কিছু ছিল না। তবে তোমরা যে কথাটা এতদিন জানতে পারনি, আজ আমি সে’ কথাটাই তোমাকে বলব বলে এখানে ডেকে এনেছি তোমাকে। ছোটবেলা থেকে আমার আর দাদাভাইয়ের মধ্যে যা কিছু হয়েছে, তাতে দাদাভাইয়ের কোন দোষই ছিল না। সব কিছুতেই অগ্রণী ভূমিকা ছিল শুধু আমার। দাদাভাই আমাকে কষ্ট দিতে চায়নি বলেই আমার সব কথা চুপচাপ মেনে নিত। কিন্তু তোমরা জানতে যে দাদাভাইও আমার মতই দোষী ছিল। তাই আমাকে ও দাদাভাইকে তোমরা একই ভাবে শাসন করতে চেয়েছিলে। সে’সব দিনের কথাগুলো একটু মনে করে দেখো বড়মা। মা বাবা তোমরা আমাকে অনেক বুঝিয়েও যখন আমাকে সোজা পথে আনতে ব্যর্থ হয়েছিলে, তখন মা আর বাবা আমাকে মারধোর করতে শুরু করেছিলেন। তাদেরও কোন দোষ ছিল না। অবাধ্য মেয়েকে বাবা মায়েদের তেমনি করেই শাসন করা উচিৎ। আমাকেও তারা তেমনি করেই শাসন করেছেন। নিজের দোষ মুখ বুজে স্বীকার করে নিয়ে তাদের সব অত্যাচার আমি হাসিমুখে সহ্য করে গেছি। হ্যা, মাঝে মাঝে প্রতিবাদও করেছি। চরম অবাধ্য হয়ে তোমাদের সকলের মুখের ওপর অনেক কথা বলেছি। কিন্তু সেটা করেছি শুধু তখনই যখন তোমরা আমার দাদাভাইয়ের নিন্দা করতে, তাকে গালিগালাজ করতে কিংবা তাকে মারতে আসতে। দাদাভাইয়ের তো সত্যি তেমন কোন দোষ ছিল না। ও তো কেবল ওর এই ছোটবোনের চাওয়াগুলো পূরন করেছিল। দোষ যা করার সে তো আমি করেছিলাম। আর আমার দোষের শাস্তি দাদাভাই কেন পাবে? তাই তোমরা সবাই যখন দাদার দোষ আছে ভেবে তাকে শাস্তি দিতে চাইতে, তখন নির্দোষ দাদাভাইকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতেই আমি তোমাদের বিরোধিতা করতুম। তোমরা যা করেছ সেটাও অভিভাবক হিসেবে যেমন ঠিক ছিল, তেমনি আমি মনে করি একজন নির্দোষকে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাতে আমি যা কিছু করেছি, সেটাও সম্পূর্ণ ঠিক ছিল। আমাদের দু’জনের সম্পর্ক নিয়ে তোমরা যেভাবে আমাদের বুঝিয়েছ, সে’সব বুঝতে পারলেও আমি নিজেকে কিছুতেই দাদাভাইয়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিতে পারছিলাম না। কিন্তু তোমাদের প্রত্যেকটা কথাই যে অমোঘ সত্য ছিল, সেটাও বুঝেছিলাম আরেকটু বড় হয়ে। কিন্তু ততদিনে আমি এমন একটা জায়গায় গিয়ে পৌছেছিলাম যে ফিরে আসা আর সম্ভব ছিল না। দাদাভাইকে ছেড়ে থাকবার কথা আমি ভাবতেও পারতুম না। কিন্তু একটা সময় বোধ বুদ্ধি আরেকটু বাড়তেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে তোমাদের কথা না মেনে আমি কত বড় ভুল করেছিলাম। তাই তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে আমার যত কষ্টই হোক না কেন, দাদাভাইয়ের জীবনটাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আমাকে বন্ধ করতেই হবে। সেই সাথে আমাদের এ বাড়ির সম্মানটাও অক্ষুন্ন রাখতে হবে। শুধু মাত্র নিজের জেদ আর নিজের সুখের জন্য তোমার, জেঠুর, মা বাবার, কাকু ছোটমার সম্মান নিয়ে ছেলেখেলা করার অধিকার আমার নেই। তাই যে পথে ধরে এগিয়েছিলাম সে পথে ফিরে আসতে না পারলেও পথের অন্য একটা বাঁকে এসে গন্তব্যটাকে বদলে ফেলেছিলাম। দাদাভাইয়ের কাছ থেকে দুরে সরে যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম তখনই। দাদাভাইকে বাড়ি থেকে হাজার মাইল দুরে পাঠিয়ে দিয়ে আমি নিজেও বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে দাদাভাইয়ের সাথে আমার যেন আর কখনও মুখোমুখি দেখা না হয়। সফলও হয়েছি। ছোটবেলা থেকে যাকে প্রাণের চেয়ে বেশী ভালবাসতুম, সেই দাদাভাইকে না দেখে আটটা বছর দিব্যি কাটিয়ে দিতে পেরেছি। দাদাভাইও পেরেছে। কিন্তু দাদাভাইয়ের সাথে আমার নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হত। আজ ন’ বছর বাদে তাকে দেখে আমার মন আর আগের মত চঞ্চল হয়ে উঠছে না। তাই বুঝতে পারছি সেই ছোটবেলার মানসিকতাকে আমি বদলে দিতে পেরেছি”।

একটু থেমে লম্বা করে একটা শ্বাস নিয়ে সীমন্তিনী আবার বলল, “বাড়ির আর সবার চেয়ে তুমি আমাকে বেশী চেনো বড়মা। ছোটবেলা থেকেই আমি যে সত্যি কথা বলতে ভয় পাই না, তা তুমি জানো। অপরাধ করে স্বীকার করবার মত সৎ সাহসটুকু আমার যে আছে, তাও তুমি জানো। আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলুম, তোমার বড়ছেলেকে সংসারী করে তুলব। আজ সেই সুন্দর মূহুর্তটা আমাদের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। রচু এ বাড়িতে তোমার ছেলের বৌ হয়ে আসছে। রচুকে প্রথম দিন দেখবার পর থেকে ওকে এতদিনে আমি এতটাই ভালবেসে ফেলেছি যে ওর মনে দুঃখ দেবার কথা আমি ভাবতেও পারব না। আর শুধু রচুকেই নয়, ওর মা, বাবা আর ভাইটাকেও আমি খুব ভাল বেসে ফেলেছি। ওনারাও আমাকে ওনাদের ঘরের মেয়ের মতই ভালবাসেন। তাই আমি চাই না রচু এ বাড়িতে এসে কোনভাবে কষ্ট পাক। তাই তোমার কাছে প্রার্থনা করছি বড়মা, তুমি এ ব্যাপারে একটু নজর রেখ। আমার আর দাদাভাইয়ের ভেতরে ছোটবেলা থেকে যা কিছু হয়েছে, সে সব তোমরা মন থেকে একেবারে মুছে ফেলে দিও। রচনা যেন ঘুণাক্ষরেও সেসব ঘটণার বিন্দু বিসর্গও জানতে বা বুঝতে না পারে। তাহলে ওর জীবনটা একটা নরক হয়ে উঠবে। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, ওদের দু’জনের সম্পর্কের মধ্যে আমার ছায়া পর্যন্ত পড়বে না। কিন্তু আমি যে কতটা জেদী সে প্রমাণ তোমরা বহুবার পেয়েছ। তাই একটা কথা মনে রেখ। কোনদিন যদি জানতে পারি দাদাভাই আর আমার সম্পর্ক নিয়ে এ বাড়ির কেউ কোন কথা রচুকে বলেছে, তবে সেটাই হবে আমার জীবনের শেষ দিন। কারন রচুর সামনে এসে দাঁড়াবার মত মুখ আর থাকবে না আমার। আমি তোমায় গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করছি বড়মা, সেদিন আমি আত্মহত্যা করব”।

রতীশ আর সরলাদেবী দু’জনেই সীমন্তিনীর কথা শুনে চমকে উঠল। সরলাদেবী সীমন্তিনীর মুখে হাত চেপে বললেন, “না মা, অমন কথা মুখেও আনিস না তুই। আমি আমি তোকে কথা দিচ্ছি মা, রচু এসব কথা কোনদিন জানতে পারবে না। আমি মেজো আর ছোটোকে সব বুঝিয়ে বলব। তুই কিচ্ছু ভাবিস না”।
 

সীমন্তিনী নিজের মুখের ওপর থেকে বড়মার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে আমার এ’ কথাটাই বলে বোঝাবার ছিল বড়মা। আর তোমার কাছে একটা জিনিস চাইবার আছে আমার। আমি জানি আমার জন্যে তোমরা কিছু গয়নাগাটি বানিয়ে রেখেছ। সে’গুলো তুমি আজ আমাকে দেবে বড়মা”?

সরলাদেবী একটু অবাক হয়ে বললেন, “সেগুলো এখন নিয়ে তুই কি করবি মা? ও’গুলো তো তোর বিয়েতে দেব বলে গড়িয়ে রেখেছি আমরা”।
 

সীমন্তিনী শান্ত কন্ঠেই বলল, “জানি গো বড়মা। আর সে’জন্যেই তো সে’গুলো চাইছি আমি আজ। ওই গয়নাগুলো পড়ে যেখানে আমি বসবো বলে ভেবেছিলুম ছোটবেলা থেকে, আজ সেই পিড়িতে আমি আমার রচুসোনাকে বসাতে যাচ্ছি। আমার অর্ধেকটা সত্ত্বাই এখন রচুর ভেতরে ঢুকে গেছে এতদিনে। তাই আমি চাই রচু ওই গয়নাগুলো পড়েই বিয়ের পিড়িতে বসুক। তাতে আমি খুব খুশী হব। তোমরা দু’জনেও আজ থেকে অমনটাই ভেবো। রচুকে যখন তোমরা দেখবে তখন ভেবো, ওর ভেতরে তোমাদের এই অলক্ষ্মী মেয়েটাও আছে। তুমি আর দাদাভাই আমাকে যতটা ভালবেসেছো, রচুকেও ঠিক তেমনি করে ভালবেসো”।

সীমন্তিনীর কথা শুনে সরলাদেবী আর রতীশ দু’জনেই বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইল। সীমন্তিনী প্রথমে রতীশের দিকে দেখে তার বড়মাকে জিজ্ঞেস করল, “আমাকে ও’গুলো দেবে বড়মা”?

সরলাদেবী জল ভরা চোখে আরও কিছুক্ষণ সীমন্তিনীর দিকে তাকিয়ে থেকে নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “তোরা বোস একটু। আমি আসছি” বলে বেরিয়ে গেলেন”।


______________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#33
(Update No. 55 date. 26.7.2018)

সরলাদেবী বেরিয়ে যাবার পর রতীশ জিজ্ঞেস করল, “আমরা যা করছি, সেটা ঠিক করছি তো মন্তি”?

সীমন্তিনী নিজের মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, “দাদাভাই, একদিন দু’দিন নয় রে। আমি গত দশ বছর ধরে ভেবে ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আর তুই আমার ওপর ভরসা রাখ। আমি বলছি সবটাই ঠিক হবে”।

রতীশ আরও কিছু বলতে যেতে সীমন্তিনী তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “আর একটু অপেক্ষা কর দাদাভাই। এখন আর কিছু বলিস না প্লীজ। বড়মার সাথে কাজটা সেরে নিয়ে তাকে বিদেয় দিয়ে তোর সাথে কথা বলছি”।
 

মিনিট দুয়েক বাদেই সরলাদেবী একটা গয়নার বাক্স হাতে নিয়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। কোনও কথা না বলে তিনি বাক্সটা সীমন্তিনীর হাতে তুলে দিলেন। সীমন্তিনী বাক্সটা বিছানায় রেখে সরলাদেবীর পায়ের ওপর ঝুঁকে পড়ে তাকে প্রণাম করে বলল, “অনেক ভাগ্য করে তোমার মত একটা মা পেয়েছি গো বড়মা। অনেক ভুল করেছি জীবনে। অনেকবার তোমার ক্ষমাও চেয়েছি। তুমিও বারবার আমাকে ক্ষমা করেছ। তবু আজ শেষ বারের মত বলছি, হাজার অপরাধে অপরাধী তোমার এ নষ্টা মেয়েটাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তবে বড়মা, তোমার সাথে আমার যে কাজ ছিল, সেটা সারা হল। তুমি এখন চলে যাবার পর দাদাভাইয়ের সাথেও আমি কিছু কথা বলব। হয়ত অনেকটা সময় লাগবে। তাই তোমার কাছে আমি আজকের রাতটা ভিক্ষা চেয়েছি। এটাই আমার জীবনে দাদাভাইয়ের ঘরে শোবার শেষ রাত। তুমি যদি চাও, তুমিও থাকতে পারো, তবে আমার কাজে কোনও বাঁধা দিও না দয়া করে। আর যদি আমার ওপর বিশ্বাসের ছিটেফোঁটাও থাকে, তাহলে দাদাভাইয়ের কাছে আমাকে রেখে তুমি তোমার ঘরে চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে আগেই বলেছি, নতুন করে আর কোনরকম জটিলতার সৃষ্টি হবে না”।

সরলাদেবী নিজের চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন, “ঠিক আছে মা। তুই তোর দাদাভাইয়ের সাথে থাক। কিন্তু আমার একটা কথা শোন। নিজের বুকে পাথর চাপা দিয়ে তুই আমার আর বাড়ির সকলের কথা ভেবে আমার কথা রাখলি। আজ যদি আরেকটা কথা তোর কাছ থেকে চাই, সেটা তুই আমাকে দিবি না মা”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “আমি যে মিথ্যে কথা বলি না, তা তো তুমি জানো বড়মা। তাই তোমাকে মিথ্যে আশ্বাসও তো কিছু দিতে পারব না। আমি জানি, তুমি আমার কাছে আর কি চাইতে পারো। কিন্তু তোমায় সে’কথা দিতে আমি পারব না গো বড়মা। আমাকে ক্ষমা করো তুমি”।

সরলাদেবী মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আবার ফুঁপিয়ে উঠল। সীমন্তিনী বড়মার কাছে এসে তার চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “কেঁদো না বড়মা। তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে কথাটা আমি অনভাবে বলতাম। কিন্তু তোমাকে বলছি, এ জীবনে সবার সব আশা কি পূর্ণ হয়? আমারও একটা আশা অপূর্ণ থেকে যাবে। তোমারও এ আশাটা অপূর্ণই থেকে যাবে। আর তোমরাই না বল যে- অতি বড় ঘরনী না পায় ঘর, অতি বড় সুন্দরী না পায় বর। আমি না তোমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে? তাহলে আমার ক্ষেত্রে আর ব্যতিক্রম কিছু হবে কেন”?

সরলাদেবী কাঁদতে কাঁদতেই বলে উঠলেন, “তাই বলে তুই ইচ্ছে করে সারাটা জীবন......”

সীমন্তিনী বড়মার মুখ চেপে ধরে তার কথা থামিয়ে দিয়ে বলল, “না আর কোন কথা নয়। তোমাকে আমার যা বলার ছিল তা বলে দিয়েছি। তবু তোমার শেষ প্রশ্নের জবাবে বলছি। আমার ভবিষ্যৎ নিয়েও আমি ভেবে রেখেছি। আর জীবনটাকে সেভাবেই সে পথেই চালিয়ে নেব। তুমি শুধু আমাকে আশীর্বাদ করো। এবার তুমি এস বড়মা। অনেক রাত হল। গিয়ে একটু ঘুমোও। আমি দাদাভাইয়ের সাথে কথাটুকু শেষ করি”।
 

সরলাদেবী আর কোন কথা না বলে নিজের চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সীমন্তিনী দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে হেঁটে এসে বিছানা ঘেঁসে দাঁড়াল। রতীশ অপলক চোখে সীমন্তিনীর দিকে অনেকক্ষন চেয়ে থেকে খুব আস্তে করে বলল, “বোস”।
 

সীমন্তিনী বিছানায় বসে গয়নার বাক্সটা খুলে একে একে সবগুলো গয়না পড়তে লাগল। কানে ঝুমকো, নাকের ফুল, মাথায় টিকলি, গলায় তিন রকমের তিনটে হার, বাজুতে বাজুবন্ধ, হাতে মানতাসা, বালা, আর চুড়ি, কোমড়ে কটিবন্ধ, পায়ে পায়েল, পায়ের ও হাতের আঙুলে আংটি। এ’সব পড়ে বিছানার নিচে দাঁড়িয়ে ধীর শান্ত গলায় বলল, “একটু নেমে দাঁড়া তো দাদাভাই”।

রতীশ বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী হাঁটু গেঁড়ে বসে রতীশের পায়ের পাতার ওপর মাথা নামিয়ে
 
দিয়ে প্রণাম করল। কিন্তু প্রণাম যেন তার আর শেষ হচ্ছে না। মিনিট খানেক বাদে সীমন্তিনী রতীশের দুটো পায়ের পাতায় চুমু খেতে শুরু করল। রতীশের অস্বস্তি হলেও সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কয়েকবার করে পায়ের পাতা দুটোয় চুমু খাবার পর সীমন্তিনী আবার রতীশের পায়ের পাতায় নিজের কপাল ছোঁয়াতে শুরু করল। মিনিট খানেক দাঁড়িয়ে থাকবার পর রতীশের মনে হল তার পায়ের পাতা দুটো যেন ভিজে উঠছে। সীমন্তিনী তার পায়ে মাথা রেখে কাঁদছে বুঝতে পেরেও রতীশ তাকে বাঁধা দিতে পারছে না।

আরও কিছুক্ষন বাদে সীমন্তিনী কান্না ভেজা গলায় বলে উঠল, “বিছানায় বসে পর দাদাভাই”।
 

রতীশ বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসতেই সীমন্তিনী রতীশের একটা পা উঁচু করে তুলে তার পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে নিজের সিঁথির জায়গাটা ঘসতে শুরু করল। তার দাদাভাইয়ের পায়ের আঙুলে লেগে থাকা তার নিজের চোখের জলই তার সিঁথি ভিজিয়ে দিল।

রতীশ আর চুপ করে থাকতে না পেরে বলে উঠল, “কি করছিস মন্তি? ওঠ এবার”।

সীমন্তিনী রতীশের পা ছেড়ে দিয়েও মাথা নিচু করে কিছু সময় হাঁটু গেঁড়ে বসেই রইল। তারপর রতীশের দুটো পায়ের পাতায় আরো একবার করে হাত বুলিয়ে উঠে রতীশের পাশে বসে বলল, “আমায় আশীর্বাদ কর দাদাভাই। আমি যেন সারা জীবন আমার শপথ মেনে চলতে পারি”।
 

রতীশ তার একটা হাত সীমন্তিনীর মাথায় রেখে বলল, “তোর কথার, তোর চাওয়ার বিরূদ্ধে কোনদিন কি আমি কিছু করেছি রে? আজও করব না। জানিনা, আমার পায়ে মাথা রেখে তুই কী শপথ নিয়েছিস। তবু
 
বলছি, তোর শপথ যেন অটুট থাকে”।

সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত চোখ বুজে রইল। তারপর চোখ মেলে জিজ্ঞেস করল, “তোদের বিয়ের ব্যাপারে কি ফাইনাল ডিসিশন নেওয়া হল, শুনেছিস”?
 

রতীশ বলল, “মা একবার বলতে এসেছিলেন। কিন্তু আমি তাকে বলেছি যে সে’সব কথা আমি তোর মুখ থেকে শুনতে চাই”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আগামী পরশু দিন জেঠুরা গিয়ে রচুকে আশীর্বাদ করে আসবেন। তার দু’দিন বাদে মাসি মেসোরা এসে তোকে আশীর্বাদ করে যাবেন। আর বিয়েটা হচ্ছে মার্চের ন’ তারিখে। দশ তারিখে রচুকে বৌ করে এ বাড়িতে এনে দেবার পর আমার ডিউটি শেষ”।

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “তুই নাকি পরশু দিনই চলে যাচ্ছিস”?
 

সীমন্তিনী বলল, “হ্যারে দাদাভাই। পরশুদিন জেঠুরা সকাল সকাল এখান থেকে রওনা হয়ে যাবেন। আমি বিকেলে এখান থেকে যাব। রাতটা জলপাইগুড়িতে থেকেই পরদিন ভোরের ট্রেন ধরে কালচিনি যাব। নইলে মাসি মেসোরা এখানে এসে তোকে আশীর্বাদ করবেন কিভাবে? রচু আর কিংশুক অত বড় বাড়িটাতে একা থাকবে, এটা তো হতে দেওয়া যায় না। আর তাছাড়া ওখানে আমাকে বিয়ের আয়োজন গুলোও তো করতে হবে। ওদের বাড়িতে বড় কোনও পুরুষ মানুষ যদি আর কেউ থাকত যে মেসোকে সব কাজে সাহায্য করত, তাহলে হয়ত আমার যাবার প্রয়োজন হত না। কিন্তু মেসোর একার পক্ষে এ বয়সে দৌড়ঝাঁপ করে সবদিক সামাল দেওয়া সম্ভব নয় রে। তাই আমাকে যে যেতেই হবে”।

রতীশ বলল, “তার মানে তুই এখন থেকে কন্যা পক্ষের লোক হয়ে গেলি”?
 

সীমন্তিনী একটু হেসে বলল, “সে কি আর আজ থেকে হলাম ভাবছিস তুই? প্রথম প্রোজেক্ট ওয়ার্ক করবার অছিলায় যেদিন রচুদের বাড়ি গিয়েছিলাম সেদিন থেকেই তো ও বাড়ির মেয়ে হয়ে গেছিরে দাদাভাই। নিজের মা বাবাকে ছোটবেলায় হারিয়ে ফেলে এতদিন বাদে আমি আবার কাউকে বাবা মা বলে ভাবতে শুরু করেছি। তোর বিয়ে উপলক্ষে এটা আমার সবচেয়ে বড় পাওনা। তাই ছোট বোনের বিয়েতে বড়বোন বাড়িতে না থাকলে চলে? তবে ভাবিস না দাদাভাই, কন্যাপক্ষের লোক হবার পেছনে আরো একটা উদ্দেশ্য আছে। সেটা হচ্ছে সুষ্ঠভাবে আমার দাদাভাইয়ের বিয়েটা সম্পন্ন করা”।

রতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তার মানে আমাদের বিয়ের আগে তুই আর এ বাড়িতে আসছিস না”?
 

সীমন্তিনী আগের মতই হাসিমুখে বলল, “বিয়ের আগেই শুধু নয় রে দাদাভাই। বিয়ের পর তুই যখন রচুকে নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবি, আমি সেদিনও বাড়ি ফিরব না। তবে এগার তারিখ অবশ্যই আসব। সেদিন আমি পাত্রপক্ষের লোক হয়ে রচুর হাতের বৌভাত খেতে আসব। আচ্ছা শোন দাদাভাই। কাকু বলছিলেন তারা না কি তোদের হানিমুনে যাবার ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন নি। তুই কাল কলেজে গিয়ে সুকোমল স্যারকে তোর বিয়ের দিন ঠিক হয়ে যাবার কথাটা বলিস। আর বিয়ের জন্য তোকে মার্চের সাত তারিখ থেকে অন্ততঃ এক সপ্তাহের ছুটি তো নিতেই হবে। আর হানিমুনটা যদি সাথে সাথেই সেরে দিতে চাস, তাহলে কোথায় যাবি, কিভাবে যাবি, এসব ভেবে মোটামুটি একটা আন্দাজ করে তোকে ছুটি নিতে হবে। আর যদি বিয়ের সাথে সাথেই না গিয়ে কয়েকদিন পরে হানিমুনে যাবার ইচ্ছে হয়, তাহলে আপাততঃ সাত দিনের ছুটি নিলেই হবে। কি করবি সেটা একটু ভেবে দ্যাখ। কাল রাতে আমাকে বলে দিস। অবশ্য সে সিদ্ধান্তটা আমাকে না জানিয়ে সরাসরি রচুর সাথে কথা বলে নিলেই ভাল করতিস। কিন্তু তুই তো আজ অব্দি রচুর সাথে একদিনও ফোনে কথা বলিস নি। তাই বলছি, আমাকেই জানিয়ে দিস ডিসিশনটা। আমি রচুকে সেভাবে জানিয়ে দেব। কিন্তু দাদাভাই, সবার আগে আমাকে একটা কথা বল তো। বছর খানেক আগে থেকেই রচুর আর তোর বিয়ের ব্যাপারে দু’ বাড়ির সবাই খুশী মনে সম্মতি দিয়েছিল। তখন থেকেই সবাই জানত যে রচু হায়ার সেকেণ্ডারি পাশ করলেই বিয়েটা হবে। এতদিনের মধ্যে এ বাড়ির ও বাড়ির সকলের মধ্যেই নিয়মিত ফোনে যোগাযোগ হয়েছে। রচুর ফোন নাম্বার তোর কাছেও আছে। আর তোকে আমি যতটা সম্ভব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সব কিছু জানিয়েছি। কিন্তু তুই এতদিনের মধ্যে একটিবারও ও বাড়ির কারুর সাথে কথা বলিস নি। তাই মুখে না বললেও ওদের মনে কিন্তু কথাটা বাজছেই। তোর কি একবারও ইচ্ছে হয়নি রচুর সাথে একটু কথা বলতে”?

রতীশ জবাব দিল, “কথাটা আমিও ভেবেছি রে মন্তি। কিন্তু করব করব ভেবেও শেষ পর্যন্ত বলবার মত কোন কথা খুঁজে পাইনি আমি। খুব লজ্জা করছিল। তাই আর করিনি”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “সত্যি করে বল তো দাদাভাই? এ বিয়েতে তুই রাজি আছিস তো? তোর মনে কোন দ্বিধা কোন সংশয় নেই তো”?
 

রতীশ ম্লান হেসে বলল, “তোর কাছে আমি কখনো কিছু লুকিয়েছি রে? আমাদের ছাব্বিশ বছরের জীবনে তোর কাছে কখনও মিথ্যে কথা বলেছি আমি? তাহলে আজ এমন কথা জিজ্ঞেস করছিস কেন? তুই আমি তো বটেই, এ বাড়ির প্রত্যেকটা লোক জানে যে তোর কথা ছাড়া আমি কখনও কিছু করি না। তোর কথা মানেই আমার কথা। তোর সম্মতি মানেই আমার সম্মতি, এটা তো সকলেই জানে”।

সীমন্তিনী বলল, “তাহলে আমার কথাটার সোজা উত্তর দিচ্ছিস না কেন দাদাভাই? তুই মন থেকে রচুকে নিজের স্ত্রী বলে ভাবতে পারছিস তো? প্লীজ দাদাভাই, আর কথা ঘোরাস না। এটাই কিন্তু শেষ মূহুর্ত। তোর মনে যদি তিলমাত্র দ্বিধা থাকে, তাহলে এখনই আমাকে বল। আশীর্বাদের পালা শুরু হবার আগে এটা জানা আমার পক্ষে খুব প্রয়োজন”।
 

রতীশ সীমন্তিনীর চোখে সরাসরি তাকিয়ে জবাব দিল, “হ্যারে মন্তি। আমি মানসিকভাবে এ বিয়ে করতে পুরোপুরি প্রস্তুত আছি ঠিকই। কিন্তু মনে একটুও যে দ্বিধা নেই, সেটাও জোর দিয়ে বলতে পাচ্ছি না”?

সীমন্তিনী খুব আগ্রহের সাথে বলল, “বল দাদাভাই, তোর মনের দ্বিধাটা কী নিয়ে সেটা আমাকে খুলে বল”।

রতীশ বলল, “বিয়ের পর তোর রচুকে আমি যথাযথ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারব কি না, এটা নিয়েই মনে একটু সংশয় আছে। আসলে সেই ছোট্ট বেলা থেকে একটা মেয়েকেই তো সেভাবে সে চোখে দেখে এসেছি আমি। এখন থেকে নতুন একজনকে সে চোখে দেখতে হবে। সেটা আমি পারব তো”?
 

সীমন্তিনী বলল, “দাদাভাই, রচুর মত এমন ভাল মনের মেয়ে আমি আর দুটি দেখিনি রে। আমি তোকে বলছি, ওর যা মিষ্টি স্বভাব, তাতে তুই মন থেকে ওকে ভাল না বেসে থাকতে পারবি না। তোর মনের এ দ্বিধাটা খুব অল্পদিনের মধ্যেই সরে যাবে দেখিস। ওকে আমি এই একটা বছরে এমন ভালবেসে ফেলেছি যে ওকে ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারছি না যেন। আজ বড়মার অনুমতি নিয়ে তোর ঘরে থাকতে এসেছি কেন জানিস? ছোটবেলা থেকে আমাকে তুই যতটা ভালবেসেছিস, সে ভালবাসার দাবী নিয়ে জীবনে শেষ বার, তোর কাছে কয়েকটা অনুরোধ করব। রাখবি তো দাদাভাই”?
 

রতীশ জবাব দিল, “তোকে অদেয় আমার কিছু নেই, তা কি আজ নতুন করে জানতে চাইছিস”?
 

সীমন্তিনী বলল, “নারে দাদাভাই। কোন কিছু জানতে চাইনে তোর কাছে। শুধু তোর কাছে ভালবাসার শেষ উপহারটা চাইছি আমি। রচুকে কখনও কোন কষ্ট দিস না দাদাভাই। রচুর বাহ্যিক চাহিদা খুব বেশী কিছু নেই। ও শুধু সবাইকে ভালবেসে সকলের কাছ থেকে ভালবাসা ছাড়া আর কিছু চায় না। তুই এতোগুলো বছর ধরে যেভাবে আমাকে ভালবেসে এসেছিস, রচুকেও সেভাবেই ভালবাসবি। ও সেটুকু পেলেই খুব খুশী হবে। আর একটা কথা জেনে রাখিস দাদাভাই। রচু কোন কষ্ট পেলে সেটা ওর বুকে যতটা বাজবে, তার চেয়ে হাজার গুন বেশী ব্যথা পাবো আমি। আমাকে তুই কখনো কোন কষ্ট দিস নি। ভবিষ্যতেও দিস না। ওকে তুই যথাযথ স্ত্রীর মর্যাদা দিতে না পারলে আমি কিন্তু কষ্ট পাবো। তাই বলছি, তোদের ঘণিষ্ঠ মূহুর্তে তুই ভাবিস, তোর কাছে রচু নয়, তোর এই বোনটা আছে। তুই আমাকে আদর করছিস ভেবেই রচুকে আদর করিস। রচুকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাববি রচু নয়, আমিই তোর দুটো হাতের মধ্যে আছি। আর রচু যা কিছু করতে চাইবে, তাতে কোন রকম বাঁধা দিবি না। সব সময় ওর কথা মেনে চলবি। রচু কখনও তোর কাছে কোন অন্যায় আবদার করবে না, সেটা আমি জানি। তাই ওর আব্দার মেটাতে তোকে সত্যি কখনও খুব বেশী বেগ পেতে হবে না। তুই আমাকে ছুঁয়ে কথা দে, আমার এ দাবিটুকু তুই মেনে চলবি” বলে একটু কাছে এসে রতীশের একটা হাত টেনে নিয়ে নিজের গালে চেপে ধরল।

রতীশ সীমন্তিনীর গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, “বেশ তোকে কথা দিচ্ছি, তোর সবটা অনুরোধ মেনে চলবার চেষ্টা করব। কিন্তু মন্তি, ছোটবেলায় তোর কাছে আমি অনেক আবদার করেছি, আর তুইও আমার সব আবদার পূরণ করেছিস। আজ আমিও যদি শেষবারের মত তোর কাছে কিছু চাই, তুই সেটা আমাকে দিবি না”?

সীমন্তিনী রতীশের হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে বলল, “তোর জন্য তো আমি আমার প্রাণটাও উৎসর্গ করে দিতে পারি রে দাদাভাই। কিন্তু তুইও তো সেটাই বলতে চাইছিস, যেটা বড়মা খানিক আগে আমার কাছে চাইছিলেন। বড়মাকে কি জবাব দিয়েছি সেটা তো তুই শুনেছিসই। তোর কথার জবাবেও আমি সেই একই কথা বলছি। তবে কিছু কথা বড়মাকে খুলে বলতে পারিনি। কিন্তু তোকে সেটা বলতে বাঁধা নেই। জানিনা আমার সীমন্তিনী নামটা কে রেখেছিল। কিন্তু আজ থেকে আমি সত্যি সত্যি সীমন্তিনী হলাম রে। তোর পায়ের ধুলোর সাথে আমার চোখের জল মিশিয়ে আমি আমার সিঁথিতে ছুঁইয়ে নিয়েছি। তাই আমি আজ থেকে সত্যিকার অর্থে সীমন্তিনী হয়ে উঠলাম। কেউ জানবে না, কেউ দেখবে না, কিন্তু আমি জানবো আমার সিঁথিতে আমার চোখের জলের এমন সিঁদুর আজ আমি লাগিয়ে নিয়েছি, যা চিরস্থায়ী ভাবে অদৃশ্য হয়ে থাকলেও আমি নিজে সেটা সারা জীবন মনে মনে দেখতে পাব। আজ থেকে আমি বিবাহিতা সীমন্তিনী হয়ে উঠলুম। আমার জীবনের সব আশা আজ পূর্ণ হল। এখন শুধু একটা উদ্দেশ্য নিয়েই আমি বেঁচে থাকব। সারা জীবন তোর আর রচুর পাশে থাকব। আর কিছু বলবি না আমাকে। এখন জীবনের শেষবারের মত আমার কপালে একটু আদর করে বুঝিয়ে দে তুই আমার ইচ্ছেপূরন করলি”।
 

রতীশ কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর মুখটা দু’হাতে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে তার কপালে ঠোঁট চেপে ধরল। সীমন্তিনী চোখ বুজে তার প্রেমাস্পদের শেষ চুম্বনের স্বাদ নিতে নিতে বুঝতে পারল তার বন্ধ দুটো চোখের থেকে জলের ধারা নেমে আসছে।
 

নিজেকে রতীশের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে নিজের চোখ মুছতে মুছতে মুখে জোর করে হাঁসি টেনে এনে বলল, “দাদাভাই আরেকটা কথা শোন। রচু যে পড়াশোনায় কত ভাল, তা তো শুনেছিসই। আর ওর বয়সও খুব বেশী কিছু নয়। সবে আঠারো পেড়লো। তাই আমার মনে হয় ও বিয়ের পর গ্রাজুয়েশনটা করে নিতে পারলে খুব ভাল হয়। এখনই তো বলতে পারছিনা বিয়ের পর পরস্থিতি কেমন হবে। তবে রচুর সাথে কথা বলে দেখিস। সমস্যা একটাই। রচু এরই মধ্যে আমাদের এ বাড়ির সবাইকে ভালবেসে ফেলেছে। আর রচু জলপাইগুড়ি গিয়ে কলেজে ভর্তি হতে চাইবে কি না সেটা নিয়েও সমস্যা আছে। তবে আমি যদি আরও বছর তিন চার জলপাইগুড়িতে থাকতুম তাহলে যে কোন ভাবেই হোক আমি সেখানে ওকে নিয়ে যেতুম। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আগামী দু’ তিন মাসের মধ্যেই আমাকে জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে। তাই বিয়ের পর ওর সাথে কথা বলে দেখিস, যদি কোনভাবে ব্যাপারটাকে সম্ভবপর করে তোলা যায়। ও নাহয় এখানকার কোন কলেজেই পড়ুক। আর হ্যা আরেকটা কথা। রচুর বয়স কম, তোরও সবে ছাব্বিশ কমপ্লিট হল। তাই মা বাবা হবার জন্য তাড়াহুড়ো করবার দরকার নেই। দুটো বছর বাদে সেসব নিয়ে ভাবিস। কুড়ি বছরের আগে কোন মেয়ের পক্ষে মা হওয়া উচিৎ নয়”।

রতীশ চুপচাপ সীমন্তিনীর কথা শুনে যাচ্ছিল। সীমন্তিনী একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলল, “দাদাভাই, আমার জন্য এখন একটা কাজ করবি তুই”?

রতীশ প্রশ্নসূচক দৃষ্টি তুলে তার মুখের দিকে চাইতেই সীমন্তিনী টেবিলের ওপর থেকে একটা জলের
 
বোতল তুলে নিয়ে বলল, “একটু বাথরুমে আয় না দাদাভাই”।

রতীশ কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর পেছন পেছন এটাচড বাথরুমে ঢুকে গেল। সীমন্তিনী বোতলের জলটুকু বাথরুমের মেঝেয় ফেলে দিয়ে খালি বোতলটা হাতে নিয়ে বলল, “জলের ট্যাপটা খুলে তোর পায়ে জল ফেলবি। তোর পা বেয়ে নেমে আসা জল আমি এ বোতলে ভরে নেব দাদাভাই। বুঝেছিস”?

রতীশ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এভাবে বোতলে জল ভরবি বলছিস কেন তুই”?

সীমন্তিনী রতীশের একটা হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বলল, “প্লীজ দাদাভাই, কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিস না। যেটা বলছি, শুধু সেটাই করে দে না। আর কিছু তোর কাছ চাইছি না তো। প্লীজ দাদাভাই”।

রতীশ আর কোন কথা না বলে সীমন্তিনীর কথা মত ট্যাপ খুলে নিজের পায়ের পাতার ওপর জল ফেলতে লাগল। আর সীমন্তিনীও রতীশের পায়ের বুড়ো আঙুলের ডগা দিয়ে গড়িয়ে নামা জলের ধারাকে বোতলের মধ্যে ভরে বোতলটাকে ভর্তি করে নিল। তারপর ট্যাপ বন্ধ করে রতীশকে নিয়ে বাথরুমের ভেতর থেকে ঘরে এসে বোতলের মুখটা আটকাতে আটকাতে বলল, “দাদাভাই, কাল সকালে এ’ঘরে বসেই তোর সাথে আমি চা খাব। তখন তুই রচুর সাথে ফোনে প্রথমবার কথা বলবি। আমি নিজে কানে শুনতে চাই সেটা। এবার শুয়ে পর। অনেক রাত হয়েছে। আমিও খুব টায়ার্ড হয়ে গেছি”।

রতীশকে শুইয়ে দিয়ে তার গায়ের ওপর ভালো করে ব্লাঙ্কেট বিছিয়ে দিয়ে বেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিয়ে ঘরের বড় আলোটা নিভিয়ে দিল। তারপর রতীশের ব্লাঙ্কেটের তলায় ঢুকে বেড ল্যাম্পটা নিভিয়ে দিয়ে রতীশের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। সে জানে, দাদাভাইয়ের বুকে মাথা রেখে শোয়ার সুযোগ ছোটবেলা থেকে আট ন’বছর আগে পর্যন্ত বহু বার পেলেও আজ এ’ রাতটার পর সে জীবনে আর কখনও এমন সুযোগ পাবে না।
 

*************

(To be cont'd .......)
______________________________
ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#34
(Update No. 56 date. 27.7.2018)

বিয়েটা খুব ভালভাবেই সম্পন্ন হল। সীমন্তিনীর ব্যবস্থাপনায় কোন ত্রুটি ছিল না। রচনার আর রতীশের বিয়ের গাটছড়া সীমন্তিনী নিজের হাতে বেঁধে দিয়েছিল। ১০ই মার্চ সকাল সাড়ে এগারটা নাগাদ বর কনেকে নিয়ে বরযাত্রীরা সবাই রাজগঞ্জ অভিমুখে রওনা হল। রতিকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু বার বার সীমন্তিনীকে তাদের সাথে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সীমন্তিনী তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে শান্ত করেছিল। সকলকে বুঝিয়েছিল যে তার দু’একটা দিন কালচিনিতে থেকে বিয়ে বাবদ এর ওর কাছে যা কিছু বাকি বকেয়া আছে তা মিটিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু তার মূল উদ্দেশ্য ছিল অবসাদে ভেঙে পড়া রচনার মা বাবাকে সঙ্গ দেওয়া। দুর্গাপূজোর প্রতিমা নিরঞ্জনের পর খালি পূজো প্যাণ্ডেলের মত নিস্তব্ধ বাড়িতে বিধুবাবু ও বিভাদেবীকে একা ছেড়ে যেতে তার মন সায় দেয়নি।
 

কিংশুককে রচনার সাথে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাড়িতে শুধু রচনার মা আর বাবা। বড় মেয়ে অর্চনার শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বিয়ের নিমন্ত্রন করে, অনেক অনুরোধ আব্দার করেও মেয়ের সাথে দেখা করতে পারেননি বিধুবাবু। অর্চনাকে ছোটবোনের বিয়েতে আসতেও দেয়নি তারা। মায়ের আঁচলে দু’মুঠো চাল ছিটিয়ে দিয়ে রচনা মা বাবার সমস্ত ভরণ পোষণের ঋণ শোধ করবার সাথে সাথে বিভাদেবী মেয়েকে বিদেয় দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সীমন্তিনী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিয়েছিল। পরের দিনই রচনার বৌভাত। সকলের অনুরোধ রাখতে বিভাদেবী আর বিধুবাবু বৌভাতে যেতে রাজি হয়েছিলেন। তাই সময় নষ্ট না করে সীমন্তিনী ডেকারেটর, ক্যাটারার, আর হোটেলের বকেয়া পেমেন্ট গুলো মিটিয়ে দিয়ে জীবনে প্রথমবার উনোনে রান্না করে রচনার মা বাবাকে খাওয়াল।
 

পরের দিন বৌভাত খেয়ে বিধুবাবু আর বিভাদেবীকে কালচিনি ফিরে আসতে হবে বলে একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করে সীমন্তিনী তাদেরকে সঙ্গে করে নিজেদের বাড়ি এসে পৌঁছলো সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। বিভাদেবী মেয়েকে হাসিখুশী দেখে খুব খুশী হলেন। বিকেলে ফিরে আসবার সময় বিভাদেবী নিজের মেয়েকে আশীর্বাদ করে যতটা আদর করেছিলেন, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশী আদর করেছিলেন সীমন্তিনীকে। সীমন্তিনী রচনার মোবাইলটা তার কাছ থেকে নিয়ে বিধুবাবুর হাতে দিয়ে বলেছিল, “মেসো এটা নিয়ে যাও তোমরা। মেয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলে যে কোন সময় কথা বলতে পারবে”।

বিধুবাবু সীমন্তিনীকে আদর করে বললেন, “আমাদের জন্যে, আমার মেয়েটার জন্যে তুমি যা করলে, তাতে
 
তোমার কাছে আমি সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকব মা গো। প্রতিদান দেবার সামর্থ্য তো নেই আমার। আর হবে বলেও মনে হয় না। তবু কথা দিচ্ছি, তোমার সব কথা রাখবার যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করব। তুমি শুধু আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো মা। আমার লক্ষ্মীকে আমি আমার মা দুর্গার হাতে সঁপে গেলাম”।
 

১১ই মার্চ খুব ধুমধামের সাথে বৌভাত আর রাতের পার্টি সম্পন্ন হল। সকলেই বৌ দেখে খুব খুশী। সকলের মুখে এক কথা, একেবারে রতীশের উপযুক্ত বৌ। বৌভাতের দিন রাতেই রতীশ আর রচনার ফুলশয্যার বিছানা সীমন্তিনী নিজের হাতে সাজিয়ে দিল। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে রতীশের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়িয়ে বিছানার ওপর বসে থাকা রতীশের দিকে ঈশারা করে রচনাকে বলল, “রচু, ওই যে ঘরে যে ছেলেটা বসে আছে, ওই ছেলেটা দু’দিন আগে পর্যন্ত আমার জীবনের সর্বস্য ছিল। তোদের বিয়ের দিন গাঁটছড়া বেঁধে আমার জীবনের এই অমূল্য সম্পদটাকে আমি তোর হাতে তুলে দিয়েছি। আমার আদরের দাদাভাইকে সারা জীবন পরম যত্নে রাখবি সোনা বোন আমার। যা, ভেতরে যা। ঈশ্বর তোদের মঙ্গল করুন। আমি দুর থেকে এই হরপার্বতীর পাশে থাকব সারা জীবন” বলে রচনার কপালে ভালবাসা ভরা চুমু দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
 

বাড়ি নিঝুম হয়ে যাবার পরেও সীমন্তিনী ঘুমোতে এল না দেখে সরলাদেবী খুঁজতে খুঁজতে উঠোনে এসে দেখলেন, আবছা অন্ধকারে একটা চেয়ারে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। কাছে এসে দেখলেন ঘুমিয়ে আছে। তার দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা শুকিয়ে আছে। নিজের সর্বস্য বিলিয়ে দিয়ে কেমন ভিখিরির মত পড়ে রয়েছে মেয়েটা। নিজের হাতে এমন হাসিমুখে নিজের কলজেটা উপড়ে আরেকজনের হাতে তুলে দিতে তিনি আর আগে কখনো দেখেননি। সরলাদেবী একবার সীমন্তিনীকে ডেকে নিজের ঘরে নিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু পরক্ষণেই নিজের মত বদলে আবার নিজের ঘরে ঢুকে গেলেন। এক মিনিট বাদেই একটা মোটা চাদর এনে সীমন্তিনীকে ভাল করে ঢেকে দিয়ে তার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে ঠাকুর, আমার এ মেয়েটাকে তুমি দেখো ঠাকুর। ওর যে নিজের বলতে আর কেউ রইল না। কিচ্ছু রইল না। সব থেকেও মেয়েটা আজ থেকে সর্বহারা হয়ে গেল। তুমি ওকে বিপদে আপদে সব সময় রক্ষা করো ঠাকুর”।

বৌভাতের পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টা নাগাদ রচনা ঘুম থেকে উঠে পড়েছিল। রতীশের ঘরের এটাচ বাথরুমে গিয়ে স্নান সেরে ঘর থেকে বেড়িয়েই দেখে উঠোনের প্যাণ্ডেলে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সীমন্তিনী আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। রচনা পায়ে পায়ে তার কাছে গিয়ে মৃদু স্বরে তার নাম ধরে ডাকতেই সীমন্তিনী চোখ মেলে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এ কিরে রচু? এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছিস কেন রে? রাতে তো অনেক দেরী করে শুতে হয়েছে। এত তাড়াতাড়ি ওঠবার কি দরকার ছিল”?
 

রচনা তীক্ষ্ণ চোখে সীমন্তিনীর মুখটা দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল, “দিদিভাই, তোমাদের ঠাকুর ঘরটা কোথায় গো”?
 

সীমন্তিনী হাত দিয়ে একদিকে ঈশারা করে বলল, “ওই তো, চল আমি খুলে দিচ্ছি” বলে রচনার হাত ধরতে গিয়েই হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “ওহ, তুই তো স্নানও সেরে ফেলেছিস রে! না তোকে এখন ছোঁয়া ঠিক হবে না। আগে ঠাকুর প্রণাম সেরে আয়। আয় আমার সাথে”।

ঠাকুর প্রণাম সেরে উঠে ঘুরে দাঁড়িয়েই রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করল, “এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার দিদিভাই! সারা রাত উঠোনে ওই চেয়ারটায় বসে বসে তুমি কেঁদেছ? কেন গো, বল না দিদিভাই। কী হয়েছে তোমার”?
 

সীমন্তিনী নিজের চোখ মুছতে মুছতে বিব্রত হয়ে জবাব দিল, “কোথায় না তো? আমার এমন সুখের দিনে আমি কাঁদতে পারি রে বোকা মেয়ে। তুই এক কাজ কর তো বোন। তোদের ঘরের বাথরুম থেকে আমাকে একটু পেস্ট এনে দে না ভাই। হাত মুখটা ধুয়ে নিই” বলে রচনাকে ঠেলতে ঠেলতে রতীশের ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে রচনাকে ভেতরে ঠেলে দিল।

রচনা ভেতরে ঢুকে যেতেই সে আবার নিজের চোখের কোল দুটো হাতের চেটোয় খানিকটা ঘসে নিল। খানিকক্ষণ বাদেই রচনা পেস্ট নিয়ে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার ব্রাশ কোথায় দিদিভাই”?
 

সীমন্তিনী মুখে হাঁসি টেনে বলল, “বড়মার বাথরুমে রেখেছি রে ওটা। বড়মার ঘরের দরজা তো এখনও খোলেনি। তাই আপাততঃ আঙুলে মেজে নিচ্ছি”।

রচনা বলল, “দাঁড়াও। আমার কাছে নতুন ব্রাশ আছে। এনে দিচ্ছি তোমাকে” বলে আবার ঘরের ভেতর ঢুকে গেল। একটু বাদেই একটা নতুন ব্রাশ এনে নিজেই তাতে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বলতে লাগল, “আমার ফুলশয্যার রাতের শেষে আমার দিদিভাইয়ের চোখে জল দেখব, এমনটা আমি কখনও কল্পনাও করিনি”।
 

সীমন্তিনী রচনার হাত ধরে আবার উঠোনে এসে বলল, “তুই এমন আবোল তাবোল ভাবতে শুরু করেছিস কেন বল তো রচু? কিচ্ছু হয়নি রে আমার। রাতে হঠাৎ একটা পোকা চোখে এসে পড়েছিল। চোখটা বেশ জ্বালা করছিল। কিন্তু এত টায়ার্ড ছিলুম যে কখন ঘুম এসে গেছে, টেরই পাই নি। আর তুই যখন বলছিস চোখের জলের দাগ লেগে আছে, তাহলে হয়ত সত্যি সত্যি চোখ দিয়ে জল বেরিয়েছিল। কিন্তু আমি সত্যি কিছু টের পাইনি। আচ্ছা, তুই একটু দাঁড়া। আমি মুখটা ধুয়ে আসি। তারপর চা বানাচ্ছি” বলে বাথরুমের দিকে চলে গেল।

সীমন্তিনীর বলা কথাগুলো রচনার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু তার দিদিভাই তাকে মিথ্যে কথা বলবে? না না, এটা হতে পারে না। কিছুক্ষন সীমন্তিনীর চলে যাবার পথের দিকে চেয়ে থেকে সে আবার রতীশের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। রতীশ বিছানায় নেই। হয়ত বাথরুমে ঢুকেছে। সে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখল বাড়ির রাঁধুনি মমতাদি রান্না ঘরের দরজার তালা খুলছে।
 

রচনাকে দেখে সে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। “ওমা! বৌমণি! তুমি এত সকাল সকাল উঠে পড়েছ”?

রচনা তার কাছে গিয়ে বলল, “বাড়ির লোকেরা কে কখন ওঠে, তা তো আমি জানিনা মমতাদি। মনে মনে ভেবেছিলুম আজ সকালে আমি চা করে সবাইকে দেব”।

মমতা বলল, “ওমা, এ কী কথা বলছ তুমি বৌমণি? ক্ষেপেছ তুমি? এ বাড়ি এসে প্রথম দিনেই বড়মার হাতে আমাকে হেনস্থা করতে চাইছ না কি? না না, তুমি ঘরে গিয়ে বোস, আমি চা বানিয়ে আনছি। বড় দাদাবাবুর হাত মুখ ধোওয়া হয়ে গেছে”?
 

রচনা জবাব দিল, “উঠেছেন, তবে উনি বুঝি বাথরুম সেরে বেরোননি এখনও”।

মমতা হেসে বলল, “বাথরুম? না না, বড়দাদাবাবু এখন ব্যায়াম করছে নিশ্চয়ই” এমন সময় সীমন্তিনীকে রান্নাঘরে ঢুকতে দেখে মমতা বলল, “ও বড়দি, দেখ তোমার বোন কী বলছে? উনি বাড়ির সকলের জন্য চা বানাতে চাইছেন এখন”।

সীমন্তিনী রচনার কাছে এসে বলল, “এখন তোকে চা করতে হবে না রচু। বাড়ির সকলে আজ কে কখন উঠবে বলা মুস্কিল। কাল তো সকলেই রাত করে শুয়েছে। তাই তুই সবাইকে চা বানিয়ে দিতে চাইলে তোকে হয়ত অনেকক্ষণ চা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে। আজ বাবা, কাকু জেঠুরাও তো দোকানে যেতে দেরী করবেন। তাই আজ নয়, ওটা পরে কখনো করিস। মমতাদি তুমি আমাদের চা বানিয়ে দাও। রচু আমার সাথে আয়। আমরা বাইরে গিয়েই কথা বলি”।

রচনা মমতাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা মমতাদি, আজ সকালের খাবার কী বানানো হবে গো”?

মমতা জবাব দিল, “সে বড়মা যা বলবেন, তা-ই হবে”।

রচনা বলল, “আচ্ছা মমতাদি ঘরে কি ছোট ছোট আলু আছে”?

মমতা জবাব দিল, “গুড়ো আলু? হ্যা সে তো আছেই। কিন্তু গুড়ো আলু দিয়ে তুমি কি করবে গো”?

রচনা বলল, “আলুর দম বানাব। মামনিকে আমি সামলে নেব। তুমি চা করতে করতে পরিমান মত কিছু আলু সেদ্ধ করতে বসিয়ে দিতে পারবে? না হলে আমাকে দেখিয়ে দাও। আমি বসিয়ে দিচ্ছি”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা তুই আজই রান্না করবার জন্যে এত উতলা হচ্ছিস কেন বল তো? এখন তো এ বাড়িতেই থাকছিস তুই। যথেষ্ট সুযোগ পাবি রান্না করবার”।
 

রচনা বলল, “কাল রাতে তোমার দাদাভাই বলছিলেন, আজই নাকি আমাদের কালচিনি যেতে হবে দ্বিরাগমন সারতে। দুপুরের পর পরই যাবেন বলেছেন। আর সেখান থেকে দু’দিন বাদে ফিরে এসে তোমাকে এ বাড়িতে পাব না জানি। মামনি তো বললেন যে তুমি নাকি কালই এখান থেকে চলে যাবে। তাই কিছু একটা বানিয়ে তোমাকে খাওয়াবার সুযোগ দেবে না একটু”?
 

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, মমতাদি তুমি আলু সেদ্ধ বসিয়ে দাও। তুমি লুচিটা বানিও। আর আলুর দমটা এ পাগলীটাকে বানাতে দিও। নইলে ওর মুখ গোমড়া হয়ে যাবে। আমি বড়মাকে বলে দেব’খন। আর চা বানিয়ে দাও আমাদের”।

রচনা সীমন্তিনীর হাত ধরে বাইরে এল। দু’জনে দু’টো চেয়ারে বসে রচনা হঠাৎ সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা দিদিভাই, তুমি রাতে কোন ঘরে না গিয়ে বাইরে এই চেয়ারটার ওপর বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে কেন গো”?
 

সীমন্তিনী মনে মনে একটু চমকে উঠে বলল, “আরে আমি কি এখানে ঘুমোব বলে বসেছিলুম না কি? আমি তো শুধু একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে বসেছিলাম। বড়মার ঘরে আমার বিছানা তো রেডিই ছিল। কিন্তু হয়ত টায়ার্ড ছিলুম বলেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি। তুই ওটা নিয়ে এত ভাবিসনে তো? ওই তো দাদাভাই এসে গেছে” বলেই একটু গলা তুলে বলল, “মমতাদি, তিনকাপ চা এনো। দাদাভাইও খাবে আমাদের সাথে”।
 

রতীশ একটা চেয়ারে বসে সীমন্তিনীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যারে মন্তি, আমরা যদি এখান থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে যাই, তাহলে কালচিনি পৌঁছতে কতক্ষন লাগবে বলে মনে হয় রে”?
 

সীমন্তিনী জবাব দিল, “গাড়ি নিয়ে গেলে তো তিন ঘন্টাও লাগবে না। তোরা এখান থেকে তিনটে নাগাদ রওনা হয়ে আলিপুরদুয়ার হয়ে না গিয়ে মাদারিহাট হয়ে গেলে রাস্তা আরও শর্ট হবে। আমি তো কাল ওই রাস্তা দিয়েই এসেছি। আলিপুরদুয়ার হয়ে ঘুরে গেলে সময় বেশী লাগে”।

মমতা সকলের হাতে চা দিয়ে যাবার পর রতীশ আবার জিজ্ঞেস করল, “তুই কি আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করবি? না তার আগেই চলে যাবি”?

সীমন্তিনী চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “না রে দাদাভাই। আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব হবে না রে। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। আইপিএস পরীক্ষার এপ্লিকেশনটা জমা দিতে হবে। মঙ্গলবার জমা দেবার শেষ দিন। আজ শুক্রবার। মাঝের শনিবার আর রবিবার অফিস বন্ধ থাকবে। তাই বুঝতে পারছিস, আমার যাওয়াটা কতটা জরুরী। সোমবারেই এপ্লিকেশনটা জমা করবার চেষ্টা করব। শুনেছি দু’মাস বাদেই নাকি রিটেন টেস্ট। তাই পড়াশোনাও তো শুরু করতে হবে”।
 

রচনা এ’কথা শুনে একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তার মানে তুমি আর এ দু’মাসের মধ্যে বাড়ি আসছ না দিদিভাই”?

সীমন্তিনী ম্লান হেসে বলল, “আমি তো প্রায় ন’ বছর থেকেই বাড়ি ছাড়া হয়ে গেছি রে। তবে তুই ভাবছিস কেন? আমি তো রোজ তোর সাথে ফোনে কথা বলব। ও হ্যা, ভাল কথা দাদাভাই। আমি তো রচুর আগের মোবাইলটা মেসোকে দিয়ে দিয়েছি। নইলে তারা তো ওর সাথে কথা বলতে পারবেন না। তাই আজ না হলেও, কালচিনি থেকে ফিরে এসেই ওকে একটা নতুন মোবাইল কিনে দিস। আর সে নাম্বারটা আমায় জানিয়ে দিস। আর মনে রাখিস। এখন রচুর সমস্ত দায়িত্ব কিন্তু তোর। ওকে কখনও কষ্ট দিবি না। মনে রাখিস, রচু কষ্ট পেলে সে ব্যথা কিন্তু ও একা পাবে না। আমিও একই সমান কষ্ট পাব। আর রচু, তুইও একটা কথা মনে রাখিস। এখন থেকে তুই আর দাদাভাইই আমার সব কিছু। তাই সব পরিস্থিতিতে তোরা একে অপরের খেয়াল রাখবি। দাদাভাইকে যত্নে রাখবি। আমার দাদাভাইটা খুব সরল রে। একেবারে প্রায় একটা শিশুর মত। ও খুব সহজেই সকলের কথা মেনে নেয়। নিজের ভালমন্দ বুঝতে চেষ্টা করে না। কিন্তু তুই বেশ বুদ্ধিমতী। তুই ওকে সব সময় উচিৎ পরমর্শ দিবি। আর দাদাভাই, তুইও রচুকে না জানিয়ে কখনও কিছু করবিনা কিন্তু”।

রচনার হাতের আলুর দম খেয়ে সকলেই খুব প্রশংসা করল। বিকেল তিনটের দিকে কিংশুককে সাথে নিয়ে রতীশ আর রচনা কালচিনি রওনা হয়ে গেল। পরদিন সরলাদেবীর অনেক অনুরোধ সত্বেও সীমন্তিনী বাড়ি ছেড়ে জলপাইগুড়ি চলে গেল।

***************

সীমন্তিনীর ভবিষ্যত বানীকে সত্য প্রতিপন্ন করে রচনা ভট্টাচার্যি বাড়ির সকলের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে। বাড়ির বড় ছোট সকলেই যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ রচনাকে ডাকাডাকি করতে শুরু করে। ঘুম থেকে উঠবার পর সকলকে প্রথম চা করে খাওয়ানো দিয়ে রচনার দিন শুরু হয়। তারপর সুর্য্য, চন্দ্রিকা আর চঞ্চলকে কলেজে পাঠাবার জন্যে তাদের তৈরী করে দেয়।
 

এরই মধ্যে শ্বশুর রতিকান্ত বাবু বলে ওঠেন “বড়বৌমা, আমাকে বাজারের ব্যাগটা এনে দাও। আর বাজার থেকে কি কি আনতে হবে সে’সব লিস্ট করে দাও”।
 

বড় খুড়শ্বশুর ডেকে হয়ত বলেন, “বৌমা, আমাকে সকালের খাবারটা খেতে দাও দেখি। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে আজ”।
 

ঠিক তখনই হয়ত সূর্য্য তার ঘরের ভেতরে চেঁচিয়ে উঠবে, “ও বৌমণি, আমার ফিজিক্স কপিটা একটু খুঁজে দাও না গো, পাচ্ছি না”।
 

আরেকঘর থেকে চিরুনি হাতে চন্দ্রিকা ছুটে এসে বড়বৌদির কাছে এসে বলে ওঠে, “আমার চুলটা একটু
 
আঁচড়ে দাও না বৌমণি। দেরী হয়ে যাচ্ছে গো আমার”।
 

একই সময়ে ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু হয়ত বলে ওঠেন, “বড়বৌমা আজ আমি কি পড়ে বেরোব একটু দেখিয়ে দিয়ে যাও না”।
 

আর তার ছেলে চঞ্চল কলেজের জুতো হাতে নিয়ে এসে বলবে, “ও বৌমণি, আমার জুতোর ফিতেটা লাগিয়ে দাও না গো। কিছুতেই পারছি না”।

আর তার সর্বভোলা পতিদেবটি তো আছেনই। রোজ কলেজে যাবার আগে সে তার প্রয়োজনীয় কোন কিছুই যেন খুঁজে পায় না। রচনা প্রায় একটা চড়কির মত ছুটোছুটি করে সকলের সব চাহিদা পুরন করে। সূর্য্য, চঞ্চল, চন্দ্রিকা আর রতীশের জন্য দুপুরের খাবার প্যাক করে দিতে হয় এসব ব্যস্ততার মধ্যেই। সকাল সাড়ে ন’টার আগে সে নিজের চায়ের কাপ হাতে তুলে নেবার সময়টুকু পর্যন্ত পায় না।
 

সরলাদেবী আর সীমাদেবী একা একাই নিজেদের মনে গজগজ করতে থাকেন, “বাড়ির সকলেই যেন ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে গেছে। আরে বাবা এতদিন কি এ সংসার চলেনি? বিয়ের পর থেকে মেয়েটাকে একটা দিনের জন্যেও কেউ সকালের চা টুকু খাবার সময় দেয় না। যতক্ষণ বাড়ি থাকবে ততক্ষন সকলেই যেন বড়বৌমা বৌমণি ছাড়া আর কিচ্ছুটি বোঝে না। বড়বৌমা আমাদের নেহাত নিপাট ভালমানুষ। তাই কারুর কথার কোন প্রতিবাদ করে না। অন্য কোন মেয়ে হলে দেখতে কি করত। ছোটদের কথা না হয় ছেড়েই দিলুম। তোমরা বুড়ো ধাড়িরাও একটুও সুস্থ হয়ে বসতে দাও মেয়েটাকে? বলি তোমাদের সংসারে এসে মেয়েটা এমন কী অপরাধ করে বসেছে যে নিত্য তাকে এমনভাবে নাকানি চোবানি খেতে হবে”?

রতিকান্তবাবু স্ত্রীর এ’সব কথা শুনে বেশীর ভাগই কোন জবাব দেন না। কিন্তু একদিন আশেপাশে রচনা না থাকাতে বলে ফেলেছিলেন, “কত ভাগ্য করলে এমন একটা মা লক্ষ্মী কারো সংসারে আসে, তা কি তোমরা বোঝ না? তাই তো যে কোন ছলছুতোয় আমরা শুধু তাকে একটু দেখতে চাই গো। তোমরা তো জানো না গিন্নী। বড়বৌমা যেদিন থেকে আমাদের সংসারে পা রেখেছে সেদিন থেকে আমাদের সবগুলো দোকানেই বিক্রীবাট্টা আগের থেকে অনেক বেড়ে গেছে গো। শশী আর চন্দ্রকে জিজ্ঞেস করে দেখ। ওরাও একই কথা বলবে। আগের থেকে রোজ দেড়গুণ দু’গুণ বেশী টাকা আমদানি হচ্ছে আমাদের সকলের দোকানে। দুটো কর্মচারীর সাথে নিজেরা হাত মিলিয়েও আমরা ভিড় সামলাতে পারিনা জানো? এটা যে কী করে সম্ভব হল তা বোঝ? সব হয়েছে একমাত্র আমাদের মালক্ষ্মী বৌমার জন্যে। আমাদের সংসারে যে মা লক্ষ্মী এসেছেন গো। বয়সে ছোট, সম্পর্কে আমাদের পূত্রবধূ। তাই হাত বাড়িয়ে তার পায়ের ধুলো মাথায় নিতে তো পারিনা। কিন্তু সকাল সন্ধ্যে দু’বেলা যখন দোকানে মা লক্ষ্মীর আসনে প্রণাম করি তখন মনের ভেতর বড়বৌমার ছবিটাই ভেসে ওঠে গো। তাই তো বাড়ি ফিরেই সে জীবন্ত মা লক্ষ্মীকে দেখার জন্যে প্রাণটা ছটফট করে ওঠে”।

______________________________
ss_sexy
 
[+] 3 users Like riank55's post
Like Reply
#35
Update No. 57 (date 27.7.2018)

সে’কথা শুনে সরলাদেবীর নিজের বুকটাও খুশীতে ভরে উঠেছিল সেদিন। মনে মনে তিনি আরেকবার
 
সীমন্তিনীকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। সীমন্তিনী না থাকলে এ সোনার লক্ষ্মী প্রতিমা কি তাদের সংসারে আসতো?

সবাই দোকানে আর কলেজে চলে যাবার পর রচনার ফুরসত হয় সকালের চা খাবার। তার তিন শাশুড়িমাও সকালের চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। রচনার সাথে একসাথে বসে চা খান তারা সবাই। তারপরই শুরু হয় রান্নাবান্নার কাজ। রান্নার রাঁধুনি থাকলেও, রচনা রোজ একটা না একটা কিছু রাঁধবেই। রান্নার হাতটাও বড় সুন্দর তাদের বড়বৌমার। যাই রাঁধুক সবই কেমন অপূর্ব সুস্বাদু হয়ে থাকে। সকলেই চেটে পুটে খায়। তিন শাশুড়িমার সাথে চা খেয়েই তাদেরকে আর রান্না ঘরে থাকতে দেয় না রচনা। তারা যে যার ঘরের কাজকর্ম করতে বাধ্য হয়। দুপুরে তিন শ্বশুরমশাইকে খেতে দিতে হয় রচনাকেই। বৌমার হাত ছাড়া আর কারুর হাত থেকে ভাতের থালা নিতে তারা প্রস্তুত নন কেউই।

রচনার মনে কিন্তু কোন ক্ষোভ নেই। সবার সব ফরমাস পুরো করে সেও খুব খুশী হয়। এমন সুন্দর স্বামী আর শ্বশুর বাড়ি পেয়ে সে রোজ ঠাকুর প্রণাম করবার সময় মনে মনে সে তার দিদিভাইকেও প্রণাম করে। দিদিভাই ছিলেন বলেই না এমন একটা শ্বশুর বাড়ি সে পেয়েছে। কিন্তু তাদের দ্বিরাগমনের পর আর একটা দিনের জন্যেও তার দিদিভাইয়ের সাথে তার দেখা হয়নি। দ্বিরাগমনে যাবার দিন সে তার দিদিভাইকে শেষবার দেখেছিল। বাপের বাড়ি থেকে ফিরে এসে সে আর তাকে দেখতে পায়নি। রচনার সাথে নিয়ম করে দু’বেলা ফোনে কথা বললেও সীমন্তিনী আর কখনো বাড়ি আসেনি। তাদের বিয়ের মাস চারেক বাদেই সীমন্তিনী আইপিএস পরীক্ষায় পাশ করে জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল কোলকাতায়। সেখানে এক মাসের মত থেকেই সে হায়দ্রাবাদ চলে গিয়েছে আড়াই বছরের আইপিএসের ট্রেনিং নিতে।
 

শ্বশুর বাড়ির প্রত্যেকে রচনাকে যতটা ভালবেসেছে রচনাও ঠিক তেমনি করে সবাইকে ভক্তি শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। সকলের সব প্রয়োজনের দিকে তার তীক্ষ্ণ নজর। বিয়ের মাস খানেকের মধ্যেই সে বুঝে গিয়েছিল কার কোন সময় কোন জিনিসটার প্রয়োজন হয়। তারা বলবার আগেই রচনা তাদের হাতের কাছে সে জিনিস পৌঁছে দেয়। তাই বাড়ির ছোট বড় প্রত্যেকজন সদস্যই কোন না কোন ভাবে রচনার ওপর কিছুটা হলেও নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। রচনা একটা দিন কোন কারনে বাড়ির বাইরে থাকলেই সকলে যেন চোখে অন্ধকার দেখে। সকাল থেকে শুরু করে রাত এগারটা অব্দি একটু সুস্থির হয়ে বসবার সুযোগ পায় না সে। কিন্তু তার যেন তাতে কোন ক্লান্তি নেই। সর্বদাই তার মুখে মিষ্টি একটা হাঁসি যেন লেগেই আছে। তার মনে শুধু একটাই দুঃখ ছিল। তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় দিদিভাইয়ের মুখটা সে দেখতে পাচ্ছে না। দিদিভাই বিয়ের আগেই তাকে বলেছিল, রচনা যেন বিয়ের পর গ্রাজুয়েশানটা করে নেয়। কিন্তু সেটা করতে গেলে তাকে জলপাইগুড়িতে গিয়ে থাকতে হবে। রতীশ তাকে বাঁধা দেয় নি। সে বলেছিল যে সেও জলপাইগুড়ি থেকেই রোজ আসা যাওয়া করে কলেজের চাকরী করতে পারবে। কিন্তু বাড়ির সকলেই সে’কথা শুনে মুখ ভার করেছিল। রচনাও বাড়ির সকলের মনে কষ্ট দিয়ে নিজের পড়াশোনা করতে চায়নি। তাই সে আর কলেজে ভর্তি হয় নি। নিজেকে পুরোপুরি গৃহবধূ বানিয়ে তুলেই সে পরম আনন্দে দিন কাটাচ্ছিল।
 

প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তিতে থাকলেও অল্প কিছু সময়েই বাড়ির অন্যান্য সকলের মত রতীশও রচনার ন্যাওটা হয়ে উঠেছিল। রচনার মিষ্টি কথায় আর ব্যবহারে রতীশও তাকে ভালবাসতে শুরু করেছিল। সে বুঝতে পেরেছিল সীমন্তিনী বিয়ের আগে তাকে যে’সব কথা বলেছিল, কথাগুলো একেবারে খাঁটি ছিল। আর নিজের মন থেকে রচনাকে মেনে নিতে পেরে সে আরেকবার সীমন্তিনীকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়েছিল। ফুলশয্যার রাতে বন্ধ ঘরে রচনার শরীরটাকে নিজের দু’হাতের মধ্যে নিয়ে রতীশ ভাববার চেষ্টা করেছিল সে যেন তার মন্তিকেই বুকে জড়িয়ে আছে। তাই আট বছরের পুরনো অভ্যেসেই সে শুধু জড়িয়ে ধরা, একটু আদর করা, আদর করে দু’ একটা চুমু খাওয়া এ সবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছিল। কারন মন্তির সাথে সেই ছোট্টবেলা থেকে সে এসবই করতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু ফুলশয্যার রাতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে যাবার পর বুদ্ধিমতী রচনা তার অনভিজ্ঞ স্বামীর সীমাবদ্ধতা বুঝে গিয়েছিল। তাই একটা সময় সে নিজেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। আর সে রাতেই রতীশ বুঝতে পেরেছিল, বান্ধবী বা প্রেমিকার থেকে একজন স্ত্রী তার পুরুষকে কতটা বেশী করে আপন করে নিতে পারে। তাদের প্রথম মিলনের পরেই রতীশ বুঝতে পেরেছিল যে মন্তি ছোটবেলা থেকে তার প্রেমিকা হয়ে থাকলেও, সে সব সময় রতীশকে একটা সীমার ভেতরেই বেঁধে রেখেছিল। সেই ফুলশয্যার রাতেই রতীশ বুঝতে পেরেছিল যে তার আর মন্তির মধ্যে যে আদর ভালবাসার সম্পর্ক ছিল সেটা একান্তভাবেই আত্মিক ছিল। মনের গভীরে শিকড় গেঁড়ে বসলেও শারীরিক ভাবে তারা কখনোই প্রকৃত স্বামী-স্ত্রীর মত আচরণ করেনি। কিন্তু মন্তি যে তাকেই নিজের স্বামী বলে মানে এ ব্যাপারটাও সে অনেক আগে থেকেই জানত। কিন্তু বুদ্ধিমতী মন্তি খুব সতর্ক ভাবেই নিজেকে এবং রতীশকে ওই সীমারেখার বাইরে চলে যেতে দেয়নি। সেই রাতে রতীশ নিজেই বুঝতে পেরেছিল যে রচনা যেভাবে তার হাতে নিজের সর্বস্ব তুলে দিয়েছিল, সেভাবে মন্তিও যদি নিজেকে উজার করে দিত, তাহলে তাদের জীবনে কতবড় বিপর্যয় নেমে আসত। তাই প্রথম রাতের ওই মিলনের শেষেই সে মন্তিকে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে মন্তির নির্দেশের কথা মাথায় রেখে রচনাকে আপন করে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আর তার সে সিদ্ধান্ত বজায় রাখতে রচনাও কখনও কোনওরকম কার্পণ্য করেনি। তাই রচনাকে সে সর্বতোভাবেই একাত্ম করে নিয়েছিল। রচনার ইচ্ছেতেই মধুচন্দ্রিমা সারতে বিয়ের পরের মাসেই রচনা আর রতীশ ব্যাঙ্গালোর উটি আর চেন্নাই ঘুরে এসেছে।

সীমন্তিনী আইপিএস হয়ে ২০০৯ এর আগস্ট মাসে হায়দ্রাবাদ চলে গেছে আড়াই বছরের ট্রেনিং নিতে। ২০০৯ সালের দর্গাপূজোর দিন চারেক আগে চন্দ্রকান্তবাবুর দোকানে কুরিয়ারের লোক এসে একটা বিশাল বড় কার্টন ডেলিভারি দিয়ে গেল। চন্দ্রকান্তবাবু অমন বিশাল আকারের কার্টন দেখে একটু মনে মনে অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু প্রেরকের ঠিকানায় সীমন্তিনীর নাম দেখে তিনি ডেলিভারি নিয়েছিলেন। এতবড় কার্টনে সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদ থেকে কী পাঠাতে পারে সেটা ভাবতে ভাবতেই তার মনে হল সীমন্তিনী নিশ্চয়ই সকলের জন্য পূজোর উপহার পাঠিয়েছে। প্রচণ্ড কৌতুহল হওয়া সত্বেও সে নিজেকে সম্বরন করে ভাবলেন রাতে বাড়ি ফিরেই না হয় সকলের সামনে সেটা খোলা যাবে।

সন্ধ্যের সময় চন্দ্রকান্তবাবুর পিসিওর নাম্বারে সীমন্তিনীর ফোন এল। চন্দ্রকান্তবাবু ফোন ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই সীমন্তিনী বলল, “কাকু আমি মন্তি বলছি”।

চন্দ্রকান্তবাবু মন্তির কথা শুনে খুব উৎফুল্ল ভাবে জিজ্ঞেস করলেন, “মন্তি মা তুই? তুই ভাল আছিস তো মা”?

সীমন্তিনী বলল, “হ্যা গো আমি ভাল আছি। কাকু শোন, তোমার দোকানের ঠিকানায় একটা প্যাকেট পাঠিয়েছি আমি এখান থেকে। তুমি ওটা পেলে .....”

চন্দ্রকান্তবাবু তার কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন, “তুই এটাকে প্যাকেট বলছিস? এটা তো বিশাল সাইজের একটা কার্টন রে মা”!

সীমন্তিনী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “তারমানে, তুমি সেটা পেয়ে গেছ? আমি তো ভেবেছিলুম তুমি সেটা আরও দু’একদিন বাদে পাবে হয়ত। আচ্ছা, শোনো না কাকু। আমার মনে একটা সাধ ছিল যে চাকরি পেয়ে বাড়ির সকলকে কিছু না কিছু দেব। কিন্তু সিলেকশন হবার সাথে সাথেই আমাকে কলকাতা চলে আসতে হয়েছিল। আর তার পরের মাসেই হায়দ্রাবাদ চলে আসতে হল আমাকে। এখন তো এ আড়াই বছরের ট্রেনিং শেষ না হওয়া অব্দি এখান থেকে অন্য কোথাও যেতেই পারব না। এদিকে সামনে পূজো। দাদাভাইয়ের বিয়ের পর এটাই প্রথম পূজো। তাই এখান থেকেই বাড়ির সকলের জন্য কিছু কাপড় জামা পাঠালুম। তোমরা সবাই এ’সব নেবে তো? না এ অলক্ষ্মী মেয়েটার দেওয়া উপহারও তোমরা নেবে না”?

চন্দ্রকান্তবাবু হা হা করে বলে উঠলেন, “এসব তুই কী বলছিস মা? এমন আজেবাজে কথা একদম ভাববি না তুই। আমি তোকে কথা দিচ্ছি মা, আমি মেজদা আর মেজবৌদিকে সামলে নেব। তুই কিচ্ছু ভাবিস না। সবাই তোর উপহার নেবে। কেউ আপত্তি করবে না”।

সীমন্তিনী বলল, “কাকু, ছোটবেলা থেকে তোমার কাছেই শুধু আব্দার করে এসেছি। আজও আরেকটা অনুরোধ আছে গো তোমার কাছে। তুমি সেটা কিন্তু অবশ্যই রাখবে”।

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই এমন করে কেন বলছিস রে মা? বল না কী চাই তোর”?
 

সীমন্তিনী বলল, “তেমন কিছু চাইনে কাকু। শুধু সামান্য একটা অনুরোধ। এ প্যাকেটটা তুমি দোকানে বা বাড়িতে গিয়ে খুলে ফেল না। বাড়ি নিয়ে গিয়ে এটা রচুর হাতে দিয়ে বোল, রচু নিজে হাতে যেন এটা খোলে। তারপর যেন যার যার হাতে জিনিসগুলো তুলে দেয়”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “ঠিক আছে রে মা। এ আর এমন কী কথা? বড়বৌমাই এটা খুলবে। তা তুই কি বড়বৌমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেছিস”?
 

সীমন্তিনী বলল, “না কাকু। রচুর সাথে কথা তো রোজই বলি। কিন্তু এ ব্যাপারে আমি ওকে কিছু বলিনি। কিন্তু আমি জানি, আমি মনে মনে যা ভাবছি রচু ঠিক তা-ই করবে। তোমাকেও ওকে আলাদা করে কিছু বলতে হবে না। শুধু গিয়ে বোল, ও যেন নিজে হাতে প্যাকেটটা খোলে। আর যখন ও প্যাকেটটা খুলবে তখন তোমরা বাড়ির সবাই বড়ঘরে থেকো। সতুও তো বাড়ি ফিরে এসেছে। ওকেও থাকতে বোল। তাহলেই হবে”।

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “ঠিক আছেরে মা। তাই করব। তুই ভাবিসনা”।
 

অন্যান্য দিন চন্দ্রকান্ত বাবুদের তিন ভাইই রাত ন’টার পর দোকান বন্ধ করেন। কিন্তু আজ রাত আটটা বাজতেই চন্দ্রকান্তবাবু দোকান বন্ধ করবার সময় রতীশকে বললেন, “রতু, তুই দোকানে তালা লাগিয়ে দে। তবে এ প্যাকেটটা বাইরে বের করে রাখিস। এটা বাড়ি নিয়ে যেতে হবে। আমি একটু দাদাদের সাথে কথা বলে আসছি”।

বড়দা আর মেজদার সাথে কথা বলে চন্দ্রকান্তবাবু ফিরে এসে একটা রিক্সা ডেকে কার্টনটাকে নিয়ে রতীশের সাথে রিক্সায় চেপে বসলেন। বাড়ি এসে রতীশের সাহায্যে কার্টনটাকে নিয়ে বড় ঘরে রেখে রচনাকে ডেকে বললেন, “বড়বৌমা, মন্তি হায়দ্রাবাদ থেকে এ প্যাকেটটা পাঠিয়েছে। কিন্তু ফোনে আমাকে বলেছে যে প্যাকেটটা যেন বাড়ির আর কেউ না খোলে। এটা খোলবার দায়িত্ব সে তোমাকে দিয়েছে। বড়দা মেজদা এলে আজ এ ঘরেই সবাইকে চা খেতে দিও। তারপর প্যাকেটটা খুলো”।
 

রচনা একটু অবাক হল ছোটকাকুর কথা শুনে। একটু আগেও তো দিদিভাই তার সাথে ফোনে কথা বলেছেন! কিন্তু এ ব্যাপারে তো কিছু বলেননি তিনি! আন্দাজ করাই যাচ্ছে যে তিনি হায়দ্রাবাদ থেকে বাড়ির লোকদের জন্যে কিছু পূজোর উপহার পাঠিয়েছেন। কিন্তু প্যাকেটটা তাকেই খুলতে বলেছেন ভেবে একটু অবাকই হল। প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে দেখল ছোটকাকুর নামেই প্যাকেটটা এসেছে। হঠাতই তার মনে হল, সে তার দিদিভাইয়ের মনের ইচ্ছেটা বুঝতে পেরেছে। নিজের মনের ভাব মনেই লুকিয়ে রেখে সে বলল, “ঠিক আছে ছোটকাকু। আমি আগে তোমাদের সবার জন্যে চা টা বানিয়ে আনি। তারপর এটা খুলছি। কিন্তু বাবা আর বড়কাকু বাড়ি এলেই তো এটা খুলব? নাকি”?
 

চন্দ্রকান্তবাবু নিজেদের ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, “আমি দাদাদের বলে এসেছি। তারাও এক্ষুনি এসে পড়বেন মা”।
 

মিনিট দশেকের ভেতরেই বাড়ির সবাই এসে বড় ঘরে হাজির হল। বাড়ির তিন কর্তা হাত মুখ ধুয়ে সে ঘরে এসে হাজির হয়েছেন। বাড়ির তিন গিন্নী আর ভাইবোনেরাও চন্দ্রকান্তবাবুর নির্দেশ ওই ঘরে এসে বসেছে। রচনা মমতার সাথে সবার জন্য চা জল খাবার নিয়ে ঘরে এসে সকলের হাতে দিয়ে মেঝেয় পেতে রাখা মাদুরের ওপর বসে কার্টনটা খুলতে শুরু করল। কার্টনটার ভেতরে বড় ছোট নানা ধরণের অনেক গুলো প্যাকেট দেখা গেল। সবার ওপরের প্যাকেটটার গায়ে একটা স্টিকার লাগানো আছে। আর তাতে মার্কার পেন দিয়ে লেখা “জেঠু”। সে প্যাকেটটা বের করে শ্বশুর মশাইয়ের হাতে দিয়ে নিচু হয়ে তার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল।

রতিকান্তবাবু বললেন, “একি বড়বৌমা, তুমি প্রণাম করছ কেন”?
 

রচনা একটু হেসে বলল, “বাবা, দিদিভাই তো এজন্যেই আমাকে প্যাকেটটা খুলতে বলেছেন। তিনি জানেন যে আমি এ উপহারগুলো তোমাদের হাতে তুলে দিয়ে তার হয়ে আমি তোমাদের প্রণাম করব। তাই আমার এ প্রণামটা স্বীকার করে তোমরা সবাই আশীর্বাদটা আমার দিদিভাইকে কোর। দিদিভাই মনে মনে এটাই চেয়েছেন”।
 

ঘরের প্রায় সকলেই রচনার কথা শুনে অবাক হল। বাড়ির বড়মেয়েটা আট দশ বছর ধরে বাড়ির বাইরে বাইরে কাটাচ্ছে। বাড়ির কেউ কেউ মেয়েটা ভাল আছে কি না, সুস্থ আছে কি না, এ কথা ভাবলেও তার ইচ্ছে অনিচ্ছার কথা কেউ ভেবে দেখেনি কোনদিন। আর তাদের বাড়ির সবচেয়ে নতুন সদস্য তাদের বড়বৌমা তাদের বড়খুকির মনের ইচ্ছেটা কত সহজেই না বুঝে ফেলল। রতিকান্তবাবু বড়বৌমার মাথায় হাত দিয়ে চোখ বুজে সীমন্তিনীকে আশীর্বাদ করলেন। সেই সঙ্গে তার বড়বৌমাকেও।

রচনা এরপর এক এক করে সকলের নাম লেখা প্যাকেটগুলো যার যার হাতে তুলে দিল। বয়োজ্যেষ্ঠ সবাইকে প্রণাম করল, আর ছোটদের কপালে চুমু খেয়ে আদর করল। মেজকাকু আর মেজমাও তাদের প্যাকেটগুলো নিয়ে রচনার প্রণাম স্বীকার করে দু’হাত কপালে ঠেকিয়ে ঈশ্বরের কাছে মনে মনে বুঝি কোন প্রার্থনা করলেন।
 

মমতাদির নামেও একটা প্যাকেট ছিল। আর বাগানের মালী আর ক্ষেতের কাজের দু’জনের জন্যেও দুটো প্যাকেট ছিল। সীমন্তিনীর দেওয়া উপহার সকলের হাতে তুলে দেবার পর রচনার নাম লেখা প্যাকেটটা বের হল। তারপর আরেকটা বড় প্যাকেট বের হল। তার গায়ে লেখা আছে কালচিনি। রচনা সেটা বুকে চেপে ধরে কেঁদে ফেলল। নিজের বুকের ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নার বেগকে কোন ভাবেই আর সামলাতে পারল না সে। সরলাদেবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে দিতে বললেন, “কাঁদিস নে মা। কাঁদিস নে। জানি তো, তোর দিদিভাইকে না দেখে তুই মনে মনে খুব কষ্টে আছিস। আমরাও কি ওকে দুরে রেখে সুখে আছি রে মা? কিন্তু আমরা কে আর কি করতে পারি বল? ও যে নিজে স্বেচ্ছায় আমাদের সকলের কাছ থেকে দুরে চলে গেছে রে। তুই কাঁদিস নে মা”।

সতীশ পরিস্থিতি সামাল দিতে বলল, “আচ্ছা মা, দিদির এ উপহার পেয়ে আমারও তো তাকে প্রণাম করা উচিৎ। তোমরা তো বৌদিভাইকে আশীর্বাদ দিয়েই দিদিকে আশীর্বাদ করলে। তাহলে আমিও বৌদিভাইকে প্রণাম করলেই তো দিদি সে প্রণামটা পেয়ে যাবে তাই না”?
 

রচনা সতীশের এ কথা শুনেই সরলাদেবীর পেছনে লুকোতে লুকোতে বলল, “মামনি, তোমার এই ছোট ছেলেটাকে ভাল করে বুঝিয়ে দাও, আমি তার থেকে বয়সে ছোট। আর বয়সে ছোট না হলেও আমি তার প্রণাম নিতুম না। সূর্য্য, চঞ্চু, চন্দু ওদের সবাইকে আমি নিজের ভাই বোনের মত স্নেহ করি। তাই ওরাও যেন কেউ আমাকে প্রণাম না করে”।

এমন সময় সূর্য্য বলে উঠল, “কিন্তু বৌমণি, দিদির এ উপহারটা পেয়ে তাকে যে একবার খুব প্রণাম করতে ইচ্ছে করছে আমার”।
 

রচনা সূর্য্যর হাত ধরে বলল, “ভাই, তুমি ঠাকুরঘরে গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম কর। তাহলেই দিদিভাইকে প্রণাম করা হবে, যাও”।
 

চঞ্চল আর চন্দ্রিকাও সাথে সাথে লাফিয়ে উঠল, “আমরাও করব তাহলে”।

চন্দ্রাদেবী বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা সবাই গিয়ে ঠাকুরকে প্রণাম করে বল ঠাকুর যেন তোমাদের বড়দিকে ভাল রাখেন। যাও”।
 

সরলাদেবী তার স্বামীকে বললেন, “হ্যাগো, একটা প্যাকেট তো বেয়াই বেয়ানদের জন্যেও পাঠিয়েছে মন্তি। পুজো তো সামনের সপ্তাহেই। তবে এটা কালচিনি পাঠাবার ব্যবস্থা কি করবে”?
 

রতিকান্তবাবু বললেন, “সতুকে কাল পাঠিয়ে দেব’খন। তাহলেই তো হল। কাল সকালে গিয়ে ও না’হয় কালই ফিরে আসবে। আর থাকতে চাইলে রাতটা না হয় থেকেই আসবে”।


______________________________
ss_sexy
 
[+] 3 users Like riank55's post
Like Reply
#36
(Update No. 58 date. 27.7.2018)

চন্দ্রকান্তবাবু নিজের পকেট থেকে মোবাইল বের করে সীমন্তিনীর নাম্বার ডায়াল করলেন। দু’বার রিং হতেই সীমন্তিনী কল রিসিভ করে বলল, “হ্যা কাকু, তুমি তো এখনও বড় ঘরেই আছ, তাই না”?

চন্দ্রকান্তবাবু মজা করে জবাব দিলেন, “কই না তো। আমি তো এখন আমাদের ঘরে বসে আছি রে”।

সীমন্তিনী সাথে সাথে বলল, “তোমার ঘরের পূবের জানালাটা কি খোলা আছে কাকু? তাহলে সে জানালা দিয়ে একটু তাকিয়ে দেখ তো, চাঁপা গাছ থেকে কি ফুল ঝরে পড়ছে? রচু বলছিল সব ফুলগুলো নাকি গাছ থেকে ঝরে ঝরে যাচ্ছে”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু হেসে ফেলে বললেন, “মোক্ষম চাল চেলেছিস মা। আইপিএস হয়ে তোর বুদ্ধি দেখি বেশ খুলে গেছে রে। আমি এ মূহুর্তে কোথায় আছি, তা তুই ঠিক বুঝে গেছিস”।

সীমন্তিনী জিজ্ঞেস করল, “আমার উপহার আর প্রণামটা স্বীকার করেছ তোমরা”?
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “সে তো করেছিই রে মা। কিন্তু বিকেলে তুই আমাকে মিথ্যে কথা বললি কেন? বৌমাকে তো আগে থেকেই সব কিছু জানিয়ে দিয়ে তাকে বলে দিয়েছিলিস যে তোর উপহার গুলো সে আমাদের হাতে তুলে দিয়ে যেন তোর হয়ে আমাদের সবাইকে প্রণাম করে। আর আমাকে বললি, তুই ওকে এ ব্যাপারে কিছু বলিস নি”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আমি যে অলক্ষ্মী, মুখপুড়ি, হতচ্ছাড়ি, এ তো ছোটবেলা থেকেই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি কাকু। কিন্তু আমি যে মিথ্যেবাদী এ ক’থাটা আজ তুমি আমায় প্রথমবার বললে”।
 

চন্দ্রকান্তবাবু এবার হকচকিয়ে উঠে বললেন, “মন্তি। মন্তি মা আমার। আমায় ভুল বুঝিসনে তুই। আমি তো সেটা সিরিয়াসলি বলিনি রে। আমি তো তোর সাথে একটু ঠাট্টা করছিলুম রে। কিন্তু সত্যি তুই বৌমাকে কিছু বলিস নি”?
 

সীমন্তিনী বলল, “না কাকু, রচুকে আমি কিচ্ছু বলিনি। কিন্তু আমি জানতুম, ও সেটাই করবে। তাই তোমাকে বলেছিলুম যে প্যাকেটটা যেন রচু নিজে হাতে খোলে। আচ্ছা কাকু, তোমার মেজদা মেজবৌদি ও’গুলো ফিরিয়ে দেননি তো? আর রচুর প্রণামটাও নিয়েছেন”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যাঁরে মা, নিয়েছে। সবাই খুব খুশী মনে তোর উপহারগুলো স্বীকার করে নিয়েছে রে। সবাই খুব খুব খুশী হয়েছে”।
 

সীমন্তিনী কয়েক মূহুর্ত চুপ করে থেকে বলল, “কাকু, শোন না। কালচিনির মাসি মেসো আর ভাইয়ের জন্যেও একটা প্যাকেট পাঠিয়েছি। ওটা কাউকে দিয়ে পুজোর আগেই পাঠিয়ে দিতে পারবে না”?

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “তুই ভাবিসনে মা। বড়দা তো এখনই বললেন, যে কালই সতুকে পাঠিয়ে দেবেন। সতুই গিয়ে দিয়ে আসবে’খন”।

সীমন্তিনী বলল, “ফোনটা একটু রচুকে দেবে কাকু”?
 

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “হ্যারে মা দিচ্ছি। ওকে একটু সান্ত্বনা দিয়ে দে। তোর উপহারের প্যাকেটটা বুকে চেপে ধরে মেয়েটা একেবারে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। একটু বুঝিয়ে দে ওকে” বলে ফোনটা রচনার দিকে বাড়িয়ে দিল।
 

রচনা ফোনটা হাতে নিয়েও কোন কথা বলতে পারছিল না যেন। তার গলা দিয়ে যেন আবার কান্না ঠেলে উঠছিল। কোনরকমে “হ্যালো” বলতেই সীমন্তিনী বলল, “রচু সোনা। সোনা বোন আমার। তুই কেঁদে আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনরে পাগলী? তুই জানিসনা? তুই কাঁদছিস শুনলে আমার কী অবস্থা হবে? শোন লক্ষ্মীটি। আমি ভাল আছিরে। তোর ভালবাসা যে সর্বক্ষণ আমাকে ঘিরে রেখেছে রে। কাঁদিস নে বোন। তুই আমার মনের ইচ্ছেটা বুঝতে পারবি, এ বিশ্বাস আমার ছিল। তবু তোকে ধন্যবাদ জানিয়ে কষ্ট দেব না। আমার অনেক অনেক আদর আর ভালবাসা নিস বোন, ভাল থাকিস” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

রচনা আর কিছু না বলে আবার হু হু করে কেঁদে উঠল। সরলাদেবী এবার আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আবার রচনাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। রচনা শাশুড়ি মায়ের বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ও মামনি, দিদিভাইও যে কাঁদছেন গো। তুমি তো আমাকে বুকে নিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছ। ওই মেয়েটাকে কে সান্ত্বনা দেবে এখন গো। তার পাশে যে কেউ নেই এখন। সে যে একা”।
 

এ প্রশ্নের জবাব কারুর কাছেই ছিল না। সরলাদেবী শুধু নিজের বৌমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন।


**************

কিন্তু মানুষের জীবনের কোন সুখই তো আর নিরবচ্ছিন্ন নয়। রচনা আর রতীশের বিয়ের প্রায় ন’মাস বাদেই দুঃসংবাদ এল, রচনার দিদি অর্চনার স্বামী গাড়ি চাপা পড়ে মারা গেছেন। সে দুঃসংবাদ পেয়ে রতীশ রচনাকে সাথে নিয়ে কালচিনি গিয়েছিল। সেখানে দুঃখে ভেঙে পড়া শ্বশুর শাশুড়িকে প্রবোধ দিতে দিতে তারা জানতে পারল যে অর্চনার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা এমন সময়েও বিধুবাবুকে মেয়ের সাথে দেখা করতে দেয় নি। আগের মতই দুর দুর করে তাদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। খুব ইচ্ছে থাকলেও রচনা তখনও তার দিদিকে দেখতে পায় নি।

বিয়ের বছর দুয়েক বাদেই এক রাতে রতীশের মুখের একটা কথা শুনে রচনার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। রতীশ নিজের ভবিষ্যতটাকে আরও সুন্দর করবার জন্য কলেজের চাকরি ছেড়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে চায়। রতীশ কলেজ থেকে ফিরে রোজ জলখাবার খেয়ে ছোটকাকুর পিসিওতে গিয়ে বসে। রবিশঙ্কর প্রসাদ বলে একটা লোক কলকাতা থেকে এসে ছোটকাকুর দোকানে নানা জিনিস সাপ্লাই দেয়। বেশীর ভাগই ফটোস্ট্যাটের সামগ্রী। প্রতি মাসেই সে নিয়ম করে দু’বার রাজগঞ্জে আসে। আর রাজগঞ্জে তার সবচেয়ে বড় খদ্দের হচ্ছেন রতীশের ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু। তাই সে যখন রাজগঞ্জ আসে তখন যে’কদিন থাকে সে ক’দিন রোজই চন্দ্রকান্ত বাবুর দোকানে অনেকটা সময় কাটায়। অবসর সময়ে সে চন্দ্রকান্ত বাবুর পিসিওতে এসে সকলের সাথে গল্প গুজব করে সময় কাটায়। রতীশের সাথেও তার ভাল পরিচয় এবং বন্ধুত্ব হয়েছে। সেই রবিশঙ্কর প্রসাদই প্রথম রতীশকে পরামর্শ দিয়েছিল, কলকাতা গিয়ে একটা যোগা কলেজ খুলতে। সে বলতো রতীশ যোগাতে খুবই এক্সপার্ট। আর রতীশের মত যোগার এত বড় বড় ডিগ্রীধারী আর কোন প্রশিক্ষকই নেই কলকাতায়। তাই রতীশ যদি কিছু চেষ্টা চরিত্র করে কলকাতায় একটা যোগা কলেজ খুলতে পারে, তবে তার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন চিন্তাই করতে হবে না।

রতীশ ভেবে দেখেছে, কলেজের চাকরি করে সে যা বেতন পাচ্ছে তাতে খুব ভালভাবে সংসার চালানো সম্ভব নয়। তবে বাড়িতে আছে বলেই তাদের খাবার খরচ আলাদা করে দিতে হয়না। কিন্তু সারা জীবন এভাবে চললে, তার তো আর উন্নতি বেশী কিছু হবে না। বিয়ের পর দুটো বছর তো কেটেই গেছে। আর কিছুদিন পর তো তাদের সন্তান হবে। তখন সাংসারিক খরচ তো আরও বাড়বে। এখন কলেজের কুড়ি হাজার বেতনের বেশীর ভাগটাই তার ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা হচ্ছে। তার কাছ থেকে সংসার খরচও তার বাবা কাকারা নিতে চায়নি। শুধু রচনার কথায় ছোট ছোট ভাই বোন গুলোকেই মাঝে মধ্যে দু’একটা পোশাক কিনে দিতে হয়েছে তাকে। রচনা নিজের জন্যেও কখনো কোন বায়না করেনি। বিয়ের সময়কার উপহার সামগ্রী গুলোর বেশীর ভাগই অধরা রয়ে গেছে। আজ অব্দি সামান্য একটা নেল পালিশও সে নিজের স্ত্রীকে কিনে দিতে পারেনি, বা বলা ভাল দেবার প্রয়োজন হয়নি।
 

কিন্তু চিরটা কাল তো এভাবে চলতে পারে না। বিয়ে করে স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে সে বাবার পয়সাতেই নিজের সংসারের খরচ মিটিয়ে যাবে, এটা তো হতেই পারে না। তাই তার ভবিষ্যতে উন্নতির পথ বেছে নিতেই হবে তাকে। এই ভেবে একদিন রাতে সে রচনাকে বলল, “রচু, তোমার কাছ থেকে একটা ব্যাপারে আমার পরামর্শ চাই”।

রচনা স্বামীকে আদর করতে করতে সহজ ভাবেই উত্তর দিয়েছিল, “হ্যা বল না, কী পরামর্শ চাও তুমি”?
 

রতীশ নিজের মনের ভাবনার কথা গুলো খুলে বলে বলেছিল, “তাই আমি ভাবছি, কলেজের চাকরী ছেড়ে দিয়ে কলকাতা গিয়ে একটা যোগা ট্রেনিং ইনস্টিটিউট খুলব। প্রথম প্রথম কিছুদিন হয়ত একটু স্ট্রাগল করতে হবে ঠিকই। কিন্তু একবার ইন্সটিটিউটটা দাঁড়িয়ে গেলে আর ভাবনার কিছু থাকবে না। তুমি কি বলছ”?
 

রচনা রতীশের কথাগুলো খুব মন দিয়ে শুনেছিল। তারপর শান্ত গলায় বলেছিল, “বেশ তোমার যুক্তি সবটাই না হয় মেনে নিলুম আমি। কিন্তু তুমি আমাকে এখানে বাড়িতে ফেলে একা কলকাতা চলে যাবে? আমি যে তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না সোনা। আর ওখানে তুমি একা নিজের হাত পুড়িয়ে রান্না করে খাবে নাকি”?
 

রতীশ বলেছিল, “আমিও কি তোমাকে ছেড়ে সেখানে একা গিয়ে বেশীদিন থাকতে পারব সোনা? তোমাকেও যে আমার সাথে যেতে হবে”।

রচনা স্থির চোখে অনেকক্ষণ স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিল, “দেখ সোনা, এ বাড়ির লোক গুলোকে ছেড়ে কোথাও পাকাপাকিভাবে চলে যেতে আমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে থাকবার কথাও আমি কল্পনাও করতে পারি না। একদিকে তোমার মনের সাধ পূর্ণ করতে আমাকে তোমার পাশে থাকতে হবে। আবার অন্যদিকে বাড়ির সকলের মনে দুঃখ দিয়ে তাদের সবাইকে ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের। এ দুটোর মধ্যে কোন একটাকে বেছে নেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। তাই আমার মনে হয় বাড়ির সকলের সাথে বসে তুমি এ ব্যাপারে পরামর্শ করে যা সিদ্ধান্ত নেবার নিও। আর আমার মনে হয় দিদিভাইয়ের সাথেও কথা বলাটা প্রয়োজন। কার ওপর ভরসা করে তুমি কলকাতা যাবার সিদ্ধান্ত নিচ্ছ সেটাও সবাইকে খুলে বলো। আর এটা নিয়েও সকলের সাথে আলোচনা করো। তবে তাদের সাথে এসব নিয়ে আলোচনা করবার সময় আমি তোমার সাথে থাকতে চাইনা। কারন সিদ্ধান্ত যাই নেওয়া হোক না কেন, আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারব না। আমি শুধু একটা কথাই জানি। বিয়ের আগেই দিদিভাই আমাকে বহুবার বলেছেন যে আমি যেন কোন অবস্থাতেই তোমাকে একা ছেড়ে না দিই। শুধু দিদিভাইকে দেওয়া কথা রাখবার জন্যেই নয়, আমি নিজেও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। তাই তোমরা যা সিদ্ধান্ত নেবে আমাকে সেটাই মানতে হবে। তবে আমি পরিস্কার করে তোমায় একটা কথা বলতে পারি। যদি সবাই তোমাকে কলকাতা যাবার অনুমতি দেন, তাহলে এ বাড়ি ছেড়ে যেতে আমার যতই কষ্ট হোক না কেন, আমিও তোমার সাথে যাব। সে কলকাতাই হোক বা পৃথিবীর যে কোনও জায়গাই হোক”।
 

পরের কয়েকটা দিন বাড়ির সকলকেই খুব চুপচাপ দেখা গেল। রচনা নিজে যেমন দোটানায় পড়েছিল তেমনি বাড়ির আর সকলেও। কেউই মন খুলে রতীশের কথায় সায় দিতে বা তার কথার বিরোধিতা করতে পারছিলেন না। অবশেষে অপারগ হয়ে সবাই সীমন্তিনীর ওপর এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার ভার দিলেন। তখনও সীমন্তিনী হায়দ্রাবাদে ট্রেনিংএ। তার সাথে একমাত্র রাতের বেলা ছাড়া আর কখনও কথা বলা সম্ভব হত না। সীমন্তিনী সব শুনে রতীশকে বলেছিল, “দাদাভাই, কলকাতা গিয়ে তুই একা একা তোর যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে পারবি? না সেখানে তোকে সাহায্য করবার মত আর কেউ আছে”?

রতীশ জবাবে বলেছিল, “না ওখানে আর তেমন কে থাকবে। তবে ছোটকাকুর দোকানে ফটোস্ট্যাটের জিনিসপত্র সাপ্লাই দেয় যে রবিশঙ্কর প্রসাদ। সে ফ্যামিলী নিয়ে কলকাতাতেই থাকে। সে বলেছে আমাকে কোচিং সেন্টার খুলবার জন্য একটা ভাল জায়গা সে খুঁজে দিতে পারবে। আর আমাদের থাকবার জন্যে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যবস্থাও সে করে দেবে। সাহায্য বলতে এটুকুই। বাকিটা তো নিজেকেই দেখে শুনে নিতে হবে”।

সীমন্তিনী বলেছিল, “হ্যা লোকটাকে মনে হয় আমিও দেখেছি। কিন্তু লোকটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। তুই শোন দাদাভাই। রবিশঙ্কর প্রসাদ কলকাতায় কোথায় থাকে, সে ঠিকানাটা আমাকে এসএমএস করে পাঠিয়ে দিস তো। লোকটার ব্যাপারে একট খোঁজ খবর নিয়ে দেখি। তারপর তোকে জানাব”।

রবিশঙ্কর প্রসাদ তখন রাজগঞ্জেই ছিল। তাই তার কাছ থেকে তার বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নাম্বার নিতে রতীশের দেরী হল না। সেটা সে সীমন্তিনীকে জানিয়ে দিয়েছিল। তার তিনদিন বাদেই সীমন্তিনী ফোন করে জানিয়েছিল যে লোকটার ঠিকানা ঠিকই আছে। ভুয়ো ঠিকানা সে দেয়নি। সীমন্তিনী বলেছিল, “দাদাভাই লোকটার ঠিকানা তো ঠিকই আছে। কিন্তু হায়দ্রাবাদে বসে লোকটা সম্বন্ধে আমি আর বেশী কিছু খোঁজ খবর করতে পারছি না। আমি কাকুর সাথে কথা বলব। তুইও একটু ভাল করে ভেবে দ্যাখ লোকটা সত্যি সত্যি বিশ্বাসযোগ্য কি না। আর তোর যদি মনে হয় সব ঠিকঠাক আছে, তাহলে তুই একবার একা তার সাথে কলকাতা গিয়ে দেখে আয় কোথায় জায়গা খুঁজে পাওয়া যায়। তোদের থাকার জায়গাও দেখে আয়। বাকিটা তারপর দেখা যাবে”।
 

তার পরের মাসেই রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়েছিল। রবিশঙ্করের ছোট ঘরে থাকবার জায়গা নেই বলে সে একটা হোটেলে উঠেছিল। রবিশঙ্করের সাথে উত্তর কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নেবার ব্যাপারে কথা হল। আর যোগা কোচিং সেন্টার খুলবার জন্যেও একটা কমপ্লেক্স দেখল। কমপ্লেক্সটা তার থাকবার ওই ফ্ল্যাট থেকে খুব বেশী দুরে নয়। কমপ্লেক্সটা দেখে রতীশের বেশ ভাল লেগেছিল। তবে কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালার সাথে কোন কথাবার্তা বলা সম্ভব হয়নি। সে দিন পনেরোর জন্য দিল্লী গিয়েছিল।
 

বাড়ি ফিরে এসে সবাইকে সব কথা খুলে বলে রতীশ সকলের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করল যে সে কলকাতা গিয়ে ওই কমপ্লেক্সেই নিজের যোগা কোচিং সেন্টার খুলতে চায়। তাদের ঘরের লক্ষ্মী রচনা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে ভেবে সকলেরই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু রতীশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কেউ আর অমত করেন নি।

তখন থেকেই বাড়ির সকলের সাথে সাথে রচনাও যেন মুষড়ে পড়েছিল। এ বাড়ি ছেড়ে, বাড়ির এই লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে ভেবে সেও মনে মনে খুব কষ্ট পাচ্ছিল। মাঝে মাঝে নিজের অজান্তেই তার চোখ দিয়ে জল পড়তে শুরু করত। কোন কাজ করতে করতে হঠাতই তার মনটা উদাস হয়ে উঠত। বড়রা সকলেই নিজের মনকে প্রবোধ দিতে পারলেও তার ছোট্ট ননদ চন্দ্রিকা কিছুতেই বাড়ির লোকদের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছিল না। যখন তখন রচনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠত, “ও বৌমণি তুমি বড়দাকে বলে দাও সে একা চলে যাক কলকাতা। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না। তোমাকে না দেখে আমি যে একটা দিনও থাকতে পারব না। পড়শোনাতেও মন বসবে না আমার। আমি পরীক্ষায় ফেল করব। কে আমায় খাইয়ে দেবে? কলেজে যাবার সময় কে আমায় তৈরী করে দেবে। আমি কারো কোন কথা শুনতে চাই না। আমি তোমাকে কিছুতেই যেতে দেব না ব্যস”।

রচনা হাজার বুঝিয়েও তাকে শান্ত করতে না পেরে তাকে জড়িয়ে ধরে সে নিজেও কেঁদে ফেলত। তখন তার তিন শাশুড়ি মায়ের কেউ একজন জোর করে চন্দ্রিকাকে রচনার হাত থেকে ছাড়িয়ে দূরে সরিয়ে নিয়ে যেতেন। সীমন্তিনী প্রায় রোজই তার সাথে ফোনে কথা বলত। সেও নানাভাবে রচনাকে বোঝাত।

সীমন্তিনী একদিন তার ট্রেনিংএর শেষে চন্দ্রকান্তবাবুকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছিল, “ছোটকাকু, দাদাভাই তো কলকাতা যাচ্ছে। কিন্তু ওখানে গিয়ে নতুন করে একটা যোগা সেন্টার খুলতে গেলে কতটা পয়সাকড়ি লাগতে পারে, সে’সব তোমরা ভেবে দেখেছ? দাদাভাইয়ের হাতে কি অত পয়সা আছে? তাহলে সে কী করে কি শুরু করবে? কলেজের চাকরিতে রিজাইন দেবার আগে এ সব ব্যাপার নিয়ে তোমরা সবাই আলোচনা করে দেখ। আমি তো সবে চাকরিতে ঢুকলাম। আমার হাতে যদি কিছু থাকত আমি তো সেটা দাদাভাইকে দিতে দু’বার ভাবতুম না। আর দাদাভাই কলেজ থেকে যা বেতন পেত তা থেকে আর কতটুকু সেভিংস করতে পেরেছে। তোমরা দাদাভাইকে নিয়ে বসে একটু শলা পরামর্শ করে কতটা কি লাগে, আর তা কোত্থেকে কিভাবে পাবে, সেসব নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা কোর। আর বাড়ির সবাই কে কি বলছে এ ব্যাপারে”।

চন্দ্রকান্তবাবু বললেন, “বাড়ির কথা আর বলিসনে মা। সবাই চুপচাপ হয়ে গেছে। কারুর মুখে হাঁসি নেই। শুধু চন্দুটাই যা একটু চেঁচামেচি করছে। আর তারও মুখে একটাই কথা। তার বৌমণি তাকে ছেড়ে চলে যেতে পারবে না। আসলে রচু এ বাড়ির বৌ হয়ে আসবার পর থেকে ও তো আর তার বৌমণি ছাড়া কিছুটি বোঝে না। আমরা বড়রা তো রতুর ভবিষ্যতের কথা ভেবে নিজেদের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারি। দশ এগার বছরের একটা মেয়ে কি আর সেসব বুঝতে পারবে? কিন্তু সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে তো আমাদের বৌমাই। সে না পারছে এ বাড়ির লোকগুলোকে ছেড়ে চলে যেতে, না পারছে রতীশকে একা চলে যাবার কথা বলতে। বাড়ির সব কটা মানুষকে ও যে কতটা ভালবাসে সে’কথা আমাদের চেয়ে বেশী আর কে জানবে বল? রোজ দুপুরে মেয়েটা তার তিন শাশুড়ির সাথে বসে তাদের সেবা যত্ন করে। কাল তোর ছোটমা বলছিল, কাল বিকেলে তোর মায়ের চুল আঁচড়ে দিতে দিতে ও নাকি হঠাৎ হু হু করে কেঁদে ফেলেছিল। আমরা সবাই তো নিজেদের মনের অনেক প্রশ্ন অনেক কথাই একে ওকে বলে থাকি। কিন্তু ও মেয়েটা যে কাউকে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না রে। কার দাবী ও সমর্থন করবে, আর কার বিপক্ষে যাবে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “জানি গো কাকু। ও মেয়েটাই সবচেয়ে বেশী কষ্ট পাচ্ছে মনে মনে। কিন্তু দেখ কাকু, দাদাভাই যেটা ভাবছে, সেটাকেও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওদের বিয়ের প্রায় তিন বছর হতে চলল। ঠাকুরের আশীর্বাদে এখন তো ওদের সংসারে যে কোন সময় নতুন অতিথি আসতে পারে। এ কলেজের চাকরি করে বাড়িতে থাকতে কোন বাঁধা না থাকলেও, দাদাভাই চিরদিন বাবা কাকাদের আয়ে নিজের পরিবারের ভরণ পোষন করে যাবে, এটা সে মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। তাই সে চাইছে নিজের আয় বাড়াতে। আর রাজগঞ্জে কোন যোগা সেন্টার খুলে তো লাভ হবে না। তাই ও চাইছে কোলকাতা গিয়ে কিছু একটা করতে। আমার মনে হয় তাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করা আমাদের সকলেরই উচিৎ”।


**************

২০১২ সালের মার্চ মাসে সীমন্তিনীকে জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত ডুয়ার্সের একটি মহকুমা শহরে পোস্টিং দেওয়া হল এক বিশেষ উদ্দেশ্যে। নাগরাকাটায় তাকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি করে পাঠানো হল। রাজগঞ্জ থেকে সে জায়গাটা যতটা দুরে, কালচিনি থেকে সে জায়গাটা প্রায় অতটাই দুর। রাজগঞ্জের দুরত্ব সেখান থেকে প্রায় ৭৬ কিমি। আর কালচিনিও সেখান থেকে প্রায় ৭৮ কিমি। তবে ট্রেনে আসতে প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগে কালচিনি থেকে। এ লাইনে ট্রেন খুব বেশী চলাচল করে না। তবে ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টার জলপাইগুড়ি থেকে তার জায়গায় যেতে হলে যে সড়কপথে তাকে যাতায়াত করতে হবে সে রাস্তায় কালচিনি পড়ে না। তার ওখান থেকে ট্রেনে আলিপুরদুয়ার যাবার পথে কালচিনি পড়ে। অফিস থেকে তাকে থাকবার কোয়ার্টার দেওয়া হয়েছে। একটা টিলার ওপর একতলা বাংলো প্যাটার্নের একটা কোয়ার্টার। কোয়ার্টারটাতে সব মিলে মোট ছ’খানা ঘর। দুটো বেডরুম আর গেস্ট রুমের সাথে এটাচড বাথরুম আছে। লিভিং রুম, কিচেন আর একটা স্টোর রুম। পেছনে একটা ছোট্ট ফুলের বাগান, আর একটা ছোট ফাঁকা জায়গা। তার পেছনদিকে ছোটখাটো একটা পার্ক আর পার্কের পেছনে একটা পাহাড়ি ঝর্ণা। কোয়ার্টারের সামনের দিকে এক পাশে সার্ভেন্টস কোয়ার্টার। আর ওয়াচম্যান এবং সিকিরিটির লোকদের থাকবার দুটো আলাদা ঘর। তিনদিকে সবুজ পাহাড় আর একদিকে চা বাগান ঘেরা জায়গাটা সত্যি খুব মনোরম। সীমন্তিনী ভেবেছিল সেখানে কাজে যোগ দেবার আগে সে একবার কালচিনি গিয়ে রচনার মা বাবাকে প্রণাম করে যাবে। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে সে পথে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় নি। তাকে বলা হয়েছিল ডিস্ট্রিক্ট হেড কোয়ার্টারে আসা যাওয়া করতে হলে তাকে সবচেয়ে কম দুরত্বের রাস্তায় আসা যাওয়া করতে হবে। গত কয়েক বছরে আসাম এবং উত্তরবঙ্গের অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠণের উগ্রপন্থীরা বিস্তীর্ণ ডুয়ার্স এলাকা এবং ভূটানের কিছু অঞ্চল জুড়ে তাদের গোপন ঘাঁটি বানিয়ে এসব অঞ্চলে ঘোরা ফেরা করছে। তাই সীমন্তিনীর সাথে সব সময়ই কয়েকজন সিকিউরিটি থাকবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও সীমন্তিনী তার উচ্চপদস্থ অফিসারদের কথা অমান্য করে কালচিনি যেতে পারেনি।
 

হায়দ্রাবাদ ট্রেনিংএ যাবার পর সীমন্তিনী আর কখনও কালচিনি যেতে পারেনি। রচনার ছোটভাই কিংশুক এবার হায়ার সেকেণ্ডারি দেবে। সীমন্তিনী মনে মনে ভেবে রেখেছে কিংশুকের লেখাপড়ার খরচ সে নিজে বহন করবে। এখন তার সামর্থ্য আছে। কিংশুক দু’বছর আগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে চতুর্থ স্থান পেয়েছিল। তার মত অমন ব্রিলিয়ান্ট একটা ছেলে পয়সার অভাবে লেখা পড়া ছেড়ে দেবে, এটা সীমন্তিনী কিছুতেই হতে দেবে না।
 

অফিসে জয়েন করার দিন সন্ধ্যে বেলায় কোয়ার্টারে ফিরে এসে কালচিনির নাম্বারে ফোন করল। কয়েকবার রিং হতেই কিংশুকের গলা শুনতে পেল, “হ্যা দিদিভাই বল। তুমি কোথায় আছ? জলপাইগুড়িতে”?

সীমন্তিনী বলল, “আজ সকালে নাগরাকাটা এসে পৌঁছেছি রে ভাই। ভেবেছিলুম ওদিক দিয়ে এলে তোমাদের সাথে দেখা করে আসব। কিন্তু সেটা আর হয়নি। আমাকে অন্য রাস্তায় আসতে হয়েছে। আচ্ছা ভাই, বাড়ির সবাই কেমন আছে রে? সবাই ভাল আছে তো”?
 

কিংশুক বলল, “হ্যা দিদিভাই, সবাই ভাল আছে। তবে কেউই আর আগের মত হাসিখুশি নেই। তুমি তো সব খবরই জান দিদিভাই। বড়জামাইবাবুর দুর্ঘটণার পর থেকে মা বাবা দু’জনেই যেন কেমন হয়ে গেছেন। বড়দির শ্বশুর বাড়ি গিয়ে বাবা অনেকবার চেষ্টা করেছেন তার সাথে একটু দেখা করতে। কিন্তু দেখা করা তো দুর, বাবাকে তারা বসতে পর্যন্ত দেয়নি। জামাইবাবু মারা গেছেন তিন বছর হল। এতটা সময়ের মধ্যে আমার বড়দির কোন খবর পাইনি। এই নিয়ে কিছুদিন পরপরই মা কান্নাকাটি করেন। বাবার শরীরটা আগের থেকে অনেক ভেঙে গেছে। এসব আর কত বলব তোমাকে দিদিভাই। তোমার তো আর কিছু অজানা নেই”।

সীমন্তিনী বলল, “ভাই, মা বাবা আছেন বাড়িতে”?
 

কিংশুক বলল, “দিদিভাই, বাবা তো একটু বাজারে গেছে, আমি মাকে দিচ্ছি”।

খানিক বাদে বিভাদেবীর গলা শোনা গেল, “হ্যারে মন্তিমা বল। ভাল আছিস তো”?

সীমন্তিনী জবাবে বলল, “হ্যা মাসি, আমি তো ঠিক আছি। কিন্তু ভাই এ সব কী বলছে? তুমি নাকি রোজ কান্নাকাটি করছ বাড়িতে”?
 

বিভাদেবী বললেন, “তোকে আমি কী করে বোঝাব রে মা। আমি যে মা। পেটে ধরা মেয়েটাকে কত বছর থেকে চোখের দেখাটুকুও দেখতে পাচ্ছি না। জামাই চলে যাবার পর তোর মেসো কতবার মেয়েটাকে শুধু একটু চোখের দেখা দেখতে গিয়েছিলেন। কিন্তু ওদের বাড়ির লোকেরা মেয়েটাকে দেখতে তো দেয়ই নি, তোর মেসোকে বসতে পর্যন্ত দেয় নি। মেয়েটা কেমন আছে সে খবর টুকুও আমরা জানতে পাচ্ছি না। তুই তো মা আমার ছোট মেয়েটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিস। নইলে ওর কপালেও যে কী হত কে জানে। প্রায় সাত বছর হয়ে গেল। অর্চুকে একটুখানি চোখের দেখাও দেখিনি। একজন মায়ের পক্ষে এটা যে কতটা কষ্টের, সেটা তো আমি তোকে বোঝাতে পারব না রে মা। আমাদের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়েই তো আমাদের বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে”।

সীমন্তিনী বলল, “মাসি, তুমি এসব ভেবে ভেবে নিজের শরীর খারাপ কোর না গো। ভাইয়ের কথাটা একটু ভাবো। তোমাকে মেসোকে সর্বক্ষণ মন ভারী করে বসে থাকতে দেখলে ওর কি ভাল লাগবে বল? এবার ও বারো ক্লাসের পরীক্ষা দেবে। ভাল রেজাল্ট করতে হবে ওকে। তোমাদের ও’ভাবে দেখলে ও যে মন দিয়ে পড়াশোনাটাও করতে পারবে না গো, সেটা বোঝ না তোমরা”?

বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে বললেন, “সবই তো বুঝিরে মা। কিন্তু আমরা যে এতই অপদার্থ বাবা-মা যে ছেলেমেয়ে গুলোর ভবিষ্যৎ গড়ে দেবার মত সাধ্যও আমাদের নেই। কলেজের প্রিন্সিপ্যাল স্যার রচুর মত খোকাকেও স্কলারশিপ জুটিয়ে দিয়েছেন বলেই বার ক্লাসটা পড়তে পারছে। এরপর কি হবে কে জানে। হয়ত কারো একটা দোকান টোকানে কাজে ঢুকিয়ে দিতে....”।

সীমন্তিনী বিভাদেবীকে বাঁধা দিয়ে বলে উঠল, “মাসি, এমন আজে বাজে কথা বোলনা তো। রচুর বিয়ের পর আমাকে দুরে চলে যেতে হয়েছিল বলে ওকে আমি গ্র্যাজুয়েট করতে পারিনি। আর সেও আমাদের বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে রাজি হয়নি। তাই ইচ্ছে থাকা সত্বেও আমি ওকে পড়াতে পারিনি। তখন আমার নিজের কোন আয়ও ছিল না। কিন্তু তোমাদের আশীর্বাদে আজ আমার সে ক্ষমতা আছে। তাই ভাই যা পড়তে চাইবে আমি তাকে সেটা পড়ার সুযোগ দেব। ওর পড়াশোনার সমস্ত দায়িত্ব আমার। আমি তো ওর দিদি। ভাইয়ের জীবনটা ভাল করে গড়ে তোলার এটুকু দায়িত্ব তো আমিও নিতে পারি। তুমি ও’সব নিয়ে ভেব না। ভাইকে আমি সব বুঝিয়ে বলব। আর ওকে সেভাবেই তৈরী করব। আর শোন মাসি। ভাই বলছিল মেসোর শরীরটা নাকি ভাল যাচ্ছে না। আমি কয়েকদিন বাদে একবার কালচিনি যাবার চেষ্টা করব। তখন মেসোর সাথেও কথা বলব”।

বিভাদেবী সীমন্তিনীর কথা শুনে প্রায় কেঁদে ফেলেন আর কি। অনেক কষ্টে বললেন, “তুই আমাদের জন্যে আর কত করবি মা? আমাদের ওপর তোর ঋণের বোঝা যে দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে রে। আমি তো তোকে পেটে ধরিনি রে মা। তুই কোন জন্মের ঋণ শোধ করতে চাইছিস, জানি না”।

সীমন্তিনী বলল, “আবার আজেবাজে কথা বলছ তুমি মাসি? শোন, তোমার ছোটমেয়ে আর জামাই তো এবার কলকাতা চলে যাবে শুনছি। মেয়ে দুরে চলে যাচ্ছে বলে তোমরা মন খারাপ কোর না। ওদের ওপর আমি সব সময় নজর রাখব। তোমাকে আমি ওদের বিয়ের আগে যে কথা দিয়েছি, সেটা আমি ভুলিনি। তাই তুমি আর মেসো এ’কথাটা সব সময় মাথায় রেখ। আমি সারা জীবন তোমার ছোটমেয়ে আর জামাইয়ের পাশে থাকব। আর শোন মাসি। আমি পরের সপ্তাহে মেসোর নামে কিছু টাকা পাঠাব। তোমরা সেটা ফিরিয়ে দিও না যেন। তোমার এ মেয়েটা তার নিজের আয় থেকে জীবনে প্রথমবার তার মা বাবাকে কিছু দিতে যাচ্ছে। তোমরা সেটা অস্বীকার করে আমাকে দুঃখ দিও না দয়া করে। আচ্ছা, আজ ছাড়ছি মাসি। পরে আবার কথা বলব। তবে একটা কথা মনে রেখ, তোমাদের যে কোন সমস্যা হোক, সবার আগে আমাকে সেটা জানাবে। নইলে কিন্তু আমি খুব দুঃখ পাব। রাখছি”।
 


******************
 ________________________________________________________________________
ss_sexy
[+] 3 users Like riank55's post
Like Reply
#37
(Update No. 59 date. 28.7.2018)

পরের সপ্তাহে সীমন্তিনীকে অফিসের কাজেই আলিপুরদুয়ার যাবার প্রয়োজন হল। তাই সে সকাল সকাল বেরিয়ে সকাল দশটার আগেই সেখানে পৌঁছে গেল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে নিজের কাজ সেরেই নিজের সাথে যাওয়া টিমের সবাইকে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে বলে নিজেও হোটেলে খেয়ে নিল। তারপর বেলা দুটো নাগাদ রওনা হবার আগে পেছনের গাড়িতে বসে থাকা সিকিউরিটি টিমের কমাণ্ডিং অফিসারকে বলে বুঝিয়ে দিল যে তারা কালচিনিতে ঘন্টা খানেকের মত হল্ট করে তারপর নিজের অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। কালচিনিতে সে তার মাসির বাড়িতে একটু দেখা করে যাবে।
 

দুপুর তিনটে নাগাদ পুলিশের গাড়ি দুটো বিধুবাবুর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াতেই পাড়াপড়শি অনেকেই কৌতুহলী চোখে দু’গাড়ি ভর্তি পুলিশ দেখে একটু অবাক হল। পেছনের গাড়ির সিকিউরটিরা গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিকে একটু একটু তফাতে দাঁড়িয়ে এ কে ৪৭, স্টেনগান আর মেশিনগান নিয়ে পজিশন নেবার পর পেছনের গাড়ির কমান্ডিং অফিসার সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে ঈশারা করতেই সে গাড়ি থেকে বেরোল।
 

বাড়ির সামনে গাড়ি থামবার শব্দ পেয়ে ভেতর থেকে বিভাদেবীও কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলেন। গেটের ভেতর থেকেই উঁকি দিয়ে দেখেই তিনি ছুটে নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমন্ত স্বামীকে ডেকে তুলে বললেন, “ওগো, শুনছ তুমি? শিগগীর ওঠো। দেখ আমাদের বাড়ির গেটের সামনে দুটো পুলিশের গাড়ি এসে থেমেছে। অনেক পুলিশ আমাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নেমেছে”।
 

বিধুবাবু দুপুরের খাবার খেয়ে রোজকার মতই একটু ঘুমিয়ে ছিলেন। স্ত্রীর কথা শুনেই বিছানা থেকে নামতে নামতে বললেন, “আমাদের বাড়ির সামনে পুলিশ? কী বলছ তুমি”।

এমন সময়েই টিনের গেটে কেউ জোরে কড়া নেড়ে বলল, “বাড়িতে কে আছেন? একটু দরজাটা খুলুন”।
 

বিধুবাবু ধুতি গেঞ্জী পড়া অবস্থাতেই ত্রস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে গেট খুলে দিলেন। আর গেটের
 
বাইরে পুলিশের পোশাক পড়া সীমন্তিনীকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই তিনি চিৎকার করে উঠলেন, “গিন্নী শিগগীর এস। দেখ কে এসেছে”?
 

সীমন্তিনী নিচু হয়ে বিধুবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ মেসো? এ মা, তুমি এত রোগা হয়ে গেছ কেন গো”?
 

ততক্ষণে বিভাদেবীও স্বামীর পেছন থেকে চিৎকার করে উঠে বললেন, “ও মা মন্তি তুই”?

সীমন্তিনী এগিয়ে এসে নিচু হয়ে তাকে প্রণাম করবার আগেই বিভাদেবী তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। সীমন্তিনীও তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “রাস্তার সব লোক তোমার কান্না শুনে এখানে এসে ভিড় করবে মাসি। আমাকে কি ঘরে ঢুকতে দেবে না? না কি এখান থেকেই বিদেয় করবে”।

বিভাদেবী কাঁদতে কাঁদতেই সীমন্তিনীকে আঁকড়ে ধরে ভেতরের দিকে নিতে নিতে বললেন, “তুই যে আজ আসবি এ’কথাটা আগে জানাস নি কেন রে মা”?
 

সীমন্তিনী উঠোনে এসে বিভাদেবীকে প্রণাম করে জবাব দিল, “অফিসের কাজে একটু আলিপুরদুয়ার যেতে হয়েছিল মাসি। এমনিতে তো আমার আর এদিকে আসবার সুযোগ হয় না। তাই সেখানে কাজ শেষ করে ফেরার পথে ভাবলুম তোমাদের সাথে একটু দেখা করে যাই” বলতে বলতে নিজের পকেট থেকে পার্স বের করে দু’খানা পাঁচশ টাকার নোট বিধুবাবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “মেসো আগে এটা ধর তো। ভাই তো বাড়ি নেই জানি। তাই একটু কষ্ট করে একটা পাঞ্জাবী পড়ে কাছের ওই মিষ্টির দোকনটা থেকে একটু মিষ্টি কিনে আনবে? আমার সাথে আরও আটজন আছে। তাদের সকলের আর তোমাদের জন্যেও এনো”।

বিধুবাবু টাকার দিকে চেয়ে বললেন, “তা ঠিক আছে। আমি এখনই গিয়ে আনছি। কিন্তু তোমাকে টাকা দিতে হবে না মা”।
 

সীমন্তিনী টাকাটা জোর করে বিধুবাবুর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “হ্যা ঠিক আছে। তোমার পয়সা দিয়েই এনো। তবে এটা রেখে দাও। ভাই আর তোমরা পরে আমার তরফ থেকে কিছু কিনে খেও। আসলে আমার নিজেরই আনা উচিৎ ছিল। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে এসেছি বলে ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তাড়াতাড়ি নিয়ে এস। আমি কিন্তু খুব বেশীক্ষণ বসতে পারব না”।
 

বিধুবাবু আর কিছু না বলে চলে যেতেই বাইরে থেকে একজন সিকিউরিটি গেটের ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখতে দেখতে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল।
 

বিভাদেবী সীমন্তিনীর হাত ধরে ঘরের বারান্দায় উঠে বললেন, “তুই একটু দাঁড়া মা। আমি একটু ঠাকুরঘর থেকে আসছি” বলেই চলে গেলেন। সীমন্তিনী বাড়ির চারদিক দেখতে দেখতেই বিভাদেবী এসে ঠাকুরের পুজোর ফুল সীমন্তিনীর মাথায় আর বুকে ছুঁইয়ে ফুলটা তার হাতে দিয়ে বললেন, “এটা তোর পকেটে করে নিয়ে যা মা। বাড়িতে গিয়ে একটা ভাল জায়গায় রেখে দিস”।
 

সীমন্তিনী ফুলটা নিয়ে একবার কপালে ঠেকিয়ে প্যান্টের পকেটে রাখতে রাখতে দেখল বিভাদেবী অপলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। সীমন্তিনীকে দেখতে দেখতে বিভাদেবী খুশী ভরা গলায় বলে উঠলেন, “তোকে কি সুন্দর লাগছে রে মা পুলিশের পোশাকে! মনে হচ্ছে শুধু তাকিয়েই থাকি তোর দিকে। ইশ খোকাটা কলেজে। নইলে তোকে দেখতে পেত”।

সীমন্তিনী বিভাদেবীর হাত ধরে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, “নজর লাগিয়ে দিও না মাসি। একটু তোমার হাতের চা খাব বলেই এসেছি শুধু আজ। বেশী সময় হাতে নেই। তাই চল, চা বানাতে বানাতে আমার সাথে কথা বলো”।
 

বিভাদেবী রান্না ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “তুই এ পোশাকে পিড়িতে বসতে পারবিনে তো মা। দাঁড়া, আমি ও ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে দিচ্ছি তোকে”।
 

সীমন্তিনী বলল, “আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। তুমি উনোন ধরাতে থাক। আমি ও’ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে আসছি” বলে বিধুবাবুর ঘরে ঢুকে সেখান থেকে একটা মোড়া হাতে নিয়ে রান্নাঘরে এসে বসে বলল, “মাসি, তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি গো অসময়ে এসে। একটু বেশী করে চা বানিও। আমার সাথে যে আটজন এসেছে ওদেরকেও তোমার হাতের চা একটু খাইয়ে দিও, নইলে ওরা সবাই ভাববে আমার মাসি ওদের কিছু খেতে না দিয়েই বিদেয় করে দিল”।

বিভাদেবী চায়ের জল উনোনে চাঁপাতে চাঁপাতে বললেন, “ওদেরকে ডেকে ভেতরে বসালি না কেন মা? ওরা সকলে কী ভাববে বল তো”?
 

সীমন্তিনী বিভাদেবীর পাশে এসে বসে বলল, “ওরা ভেতরে আসবে না মাসি। ওরা বাইরেই থাকবে। সেটাই ওদের ডিউটি। তুমি ভেব না” বলে একটু থেমেই পেছন থেকে বিভাদেবীকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ইশ কতদিন বাদে তোমার গায়ের এ মিষ্টি ঘ্রাণ নাকে এল গো মাসি”।
 

বিভাদেবী নিজের কাজ করতে করতেই জবাব দিলেন, “তোর পাগলামী আর গেল না। তোর মাসি কি আর তোদের মত গায়ে কোন সুগন্ধী ক্রিম পাউডার এসব লাগায়, যে তার শরীর থেকে মিষ্টি ঘ্রাণ বেরোবে”?

সীমন্তিনী বিভাদেবীর কাঁধের পেছনে নিজের গালটা চেপে ধরে বলল, “সেটা তোমরা মায়েরা বুঝবে না গো। সেটা মায়েদের ছেলেমেয়েরা বোঝে। তা মাসি, রচু আর দাদাভাই কলকাতা চলে যাচ্ছে শুনে তোমরা মন খারাপ কর নি তো”?
 

বিভাদেবী বললেন, “জামাইয়ের সাথে থাকতেই তো যাচ্ছে রে মা। তাই কষ্ট পাচ্ছিনা ঠিকই। কিন্তু তোদের বাড়ির সবাই যে রচুকে কতটা ভালবাসে সে’কথাও তো জানি। রচু আর রতীশ চলে গেলে তোদের বাড়ির সকলেরই মন খারাপ হয়ে যাবে ভেবেই আমাদেরও মনটা একটু কেমন কেমন করছে রে মা। আচ্ছা মা, এমন কী হয়েছে যে রতীশ বাড়ি ছেড়ে কলকাতা চলে যেতে চাইছে”?
 

সীমন্তিনী বলল, “না না মাসি। বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে ভাবছ কেন? আমাদের বাড়ির সকলের ভেতর আগে যত ভাব ভালবাসা ছিল সেটা দাদাভাইয়ের বিয়ের পর আরও বেশী মজবুত হয়েছে গো। রচু এখন ও বাড়ির ছোট থেকে বড় সকলের চোখের মণি। আর রচুকে ঘিরেই সকলের ভেতর মনের টান আরও বেড়ে গেছে সকলের। আর তুমি যে বললে বাড়ির সকলের খুব খারাপ লাগবে, সেটা ঠিকই বলেছ তুমি। বাড়ির সকলেই ওদের চলে যাবার সিদ্ধান্তে খুব মুষড়ে পড়েছে। কিন্তু দাদাভাই যে সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সেটাকেও সমর্থন না জানিয়ে পারছে না কেউই। আসলে তুমি তো এতদিনে বুঝেই গেছ যে তোমার ছোট জামাই কত সরল মনের মানুষ। বিয়ের পর থেকে এতদিন বাবা কাকার সংসারে একসঙ্গে থাকতে থাকতে ওর মনের ওপর একটা বোঝা চেপে বসেছে। নিজের আর নিজের বৌয়ের সমস্ত খরচ খরচা বাবা কাকাদের ওপর দিয়ে চালিয়ে নিতে ও আর চাইছে না। তাছাড়া একটা যোগ শিক্ষাকেন্দ্র খুলবার স্বপ্ন ওর ছোটবেলা থেকেই ছিল। তাই দেরাদুনে পড়বার সময় ও যোগা-র অনেকগুলো বড় বড় ডিগ্রীও নিয়েছিল। এখন ও সেটা করতে চাইছে। আর রাজগঞ্জে বা জলপাইগুড়িতে এসব করে খুব একটা সুবিধের হবে না বলেই ও কলকাতা যেতে চাইছে। তাই রচনাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে জেনেও বাড়ির সবাই দাদাভাইয়ের কথাটা মেনে নিয়েছেন। আমিও তাই মত দিয়েছি। দাদাভাইয়ের সব ইচ্ছে পূর্ণ হোক, আমি তো এটাই চাই”।
 

এমন সময় বিধুবাবু মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, “বাড়ির সামনে তো হাটের লোক জড়ো হয়ে গেছে গো গিন্নী। আমাকে রাস্তায় কতজনে ঘিরে ধরে জানতে চাইল আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছে কেন। সবাইকে জবাব দিতে দিতে আমার তো জেরবার অবস্থা। দু’একজন যারা মন্তিকে চেনে, তারা ভেতরে আসতে চাইছিল। কিন্তু পুলিশের লোকেরা তাদের ভেতরে ঢুকতে দেয় নি”।

সীমন্তিনী উঠে দাঁড়িয়ে নিজের টুপিটা খুলে মোড়ার ওপর রেখে বলল, “মেসো, প্লেটগুলো আমাকে দাও। আমি সাজিয়ে দিচ্ছি। মাসি তুমি চা বানাতে থাক। আমি এদিকটা দেখছি”।

সীমন্তিনী প্লেট নিতে গিয়ে দেখে মোটে গোটা চারেক প্লেট আছে। তাই সে মনে মনে ভেবে বলল, “মেসো, এতদুর থেকে প্লেট সাজিয়ে নিয়ে যাবার দরকার নেই। আমি একটা প্লেটে আমাদের চারজনের জন্যে কিছুটা তুলে রাখছি। তারপর প্যাকেট সহ গিয়ে ওদেরকে হাতে হাতে দিয়ে দেব’খন” বলে একটা প্লেটে গোটা আটেক মিষ্টি তুলে রেখে মিষ্টির প্যাকেটটা আর একটা জগে জল ভরে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। গেটের বাইরে এসে একজন সিকিউরিটির হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বলল, “শোন ভাই। আমার মাসি তোমাদের জন্যে মিষ্টি পাঠিয়েছেন। তোমরা একটু হাতে হাতে নিয়ে খেয়ে নাও। আর এই জলের মগটা থেকে জল খেয়ে নিও কেমন”?

বাইরে সত্যি অনেক লোকের ভিড়। কেউ একজন ভিড়ের মধ্যে থেকেই বলে উঠল, “ওমা! এ যে রচুর বড় ননদ গো”।

আরেকজন পাশ থেকে বলল, “হ্যা হ্যা, ঠিক বলেছেন। ইনিই তো নিজে হাতে রচুর বিয়ের সমস্ত দায়িত্ব নিয়ে বিয়েটা দিয়েছিলেন। বাঃ বাঃ, আমাদের পরিচিত একটা মেয়ে পুলিশের এত বড় অফিসার, সেটা ভাবতেও ভাল লাগছে”।

পাশ থেকে আরেক মহিলা কন্ঠ বলে উঠল, “রচুকে তো এ মেয়েটা আগের থেকেই নিজের বোনের মত ভালবাসত। রচুর মা বাবা আর ভাইকেও বড় আপন করে নিয়েছে মেয়েটা। এমন মেয়েকে যে মা পেটে ধরেছেন তিনি সত্যিই রত্নগর্ভা”।
 

সীমন্তিনী কয়েকজনের দিকে হাতজোড় করে বলল, “আপনাদের কাউকে এরা ভেতরে ঢুকতে দেয়নি বলে আমাকে আপনারা মাফ করবেন। আসলে ওরা ওদের ডিউটিই করছে। আমি চাইলেও এসময় আপনাদের কাউকে ভেতরে ডেকে নিতে পারব না। তবে আমরা চলে যাবার পর আপনারা ভেতরে ঢুকে মাসি মেসোর সাথে কথা বলবেন। আর একটু মিষ্টি মুখ করে যাবেন দয়া করে”।

সীমন্তিনী ভেতরে আসতে আসতে ভাবতে লাগল, বাইরে চা দেবার ব্যবস্থা কি করে করা যায়। বাড়িতে তো বোধহয় কাপও নেই। রান্নাঘরে ঢুকে দেখে একটা থালায় সাত আটটা প্লাস্টিকের গ্লাস বসিয়ে চা ঢালছেন বিভাদেবী। চা ঢালা হয়ে গেলে সীমন্তিনী থালাটা হাতে নিতে নিতে বলল, “আমি এটা দিয়ে আসছি ওদের”।

চা দিয়ে এসে সীমন্তিনী বিভাদেবী আর বিধুবাবুর সাথে চা মিষ্টি খেতে খেতে বলল, “মেসো, তোমাদের অনুমতি না নিয়েই আমি একটা কাজ করে ফেলেছি গো। রাগ কোর না প্লীজ। শোনো না বাইরে তো বেশ কয়েকজন আছে যারা আমাকে আগে থেকে চেনে। আমি তাদের বলেছি, আমরা চলে যাবার পর তারা যেন এসে তোমাদের সাথে কথা বলেন, আর একটু মিষ্টি মুখ করে যান। কিন্তু ঘরে তো আর মিষ্টি নেই। তাই তোমাকে আরেকটু কষ্ট করতে হবে। আমি ফেরার পথে তোমাকে দোকানে নামিয়ে দিয়ে যাব। তুমি তোমার এ মেয়েটার জন্য আরেকটু কষ্ট কোর”।

বিধুবাবু বললেন, “কষ্টের কথা কেন বলছ মা। এ যে কত বড় সুখের দিন তুমি আমায় আজ উপহার দিলে, এ কথা আমার সারাটা জীবন মনে থাকবে। কিন্তু মা তুমি একটু আগে থেকে আমাদের জানিয়ে এলেনা কেন বল তো? তোমার জন্যে দুটো ডালভাত তো রেঁধে দিতে পারত তোমার মাসি। আমাদেরও মনটা একটু খুশী হত”।
 

সীমন্তিনী বলল, “মেসো, এমন করে বলছ কেন বল তো? আমি তো তোমাদেরই একটা মেয়ে। আমাদের সকলের খাবার বন্দোবস্ত আগে থাকতেই করা হয়েছিল। তাই মিটিং শেষে আলিপুরদুয়ারেই আমাদের খেতে হয়েছে। আচ্ছা সে’কথা ছাড়। ভাই কলেজ থেকে ফেরে কখন গো? আমাকে তো চারটের সময় রওনা হতেই হবে”।
 

বিধুবাবু বললেন, “ও তো চারটের দিকেই ফেরে সচরাচর। তবে আজ দেরী করবে কি না এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারছি না”।
 

সীমন্তিনী চা খাওয়া শেষ করে বিভাদেবীকে বলল, “ও মাসি, তোমার চা খাওয়া হয়ে গেছে? তাহলে একটু ও ঘরে চল না গো। তোমার কোলে একটুখানি মাথা রেখে শোব আমি”।
 

বিভাদেবী সাথে সাথে উঠে সীমন্তিনীর হাত ধরে বললেন, “চল” বলে স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি দরজাটা ভেজিয়ে এস। আমি আমার পাগলী মেয়েটাকে একটু আদর করে দিই” বলে সীমন্তিনীর হাত ধরে নিজেদের ঘরে এসে ঢুকলেন। বিছানায় বসেই সীমন্তিনীকে টেনে নিজের কোলের ওপর শুইয়ে দিয়ে তার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “তুই আজ আমাদের এখানে এসেছিস, এ’কথা শুনে রচু বিশ্বাসই করবে না দেখিস”।

সীমন্তিনী দু’হাতে বিভাদেবীর কোমড় জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, “এখন আর কোন কথা বোল না
 
মাসি। আমাকে প্রাণ ভরে একটু তোমার সোহাগ নিতে দাও”।
 

একটুবাদে বিধুবাবুর পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ মেলে সীমন্তিনী বলল, “মেসো বসো। আর শোনো, ভাইকে বোলো, ও যেন ওর পড়াশোনা নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা না করে। ও যা পড়তে চায়, যে লাইনে যেতে চায়, সব করতে পারবে। ওর এই দিদিভাই ওর সব ইচ্ছে পূরণ করবে। আরেকটা কথা শোনো। এখন তুমি আর বাড়ি বাড়ি ঘুরে যজমানদের জন্যে পুজো আচ্চা করবে না। তোমার শরীরটা আগের চেয়ে অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। তুমি থিতু হয়ে বসে কোন কাজ করতে পার কি না ভেবে দেখো। বাড়ির সামনে ছোটখাট কিছু একটা দোকান টোকান দিয়ে বসতে পার। টাকা পয়সা যা লাগবে আমি দেব। কিন্তু এ সপ্তাহেই তুমি ভাই আর মাসিকে নিয়ে আলিপুরদুয়ার গিয়ে একজন ভাল ডাক্তার দেখাবে। ডাক্তার যদি কোন টেস্ট ফেস্ট করতে বলে সে’সবও করাবে। আর যা যা ওষুধ দেয়, তা সব ওখান থেকেই নিয়ে আসবে। আর আমাকে সবটা জানাবে”।

বিধুবাবু বললেন, “তুমি এ’সব কী বলছ মা? ডাক্তারের কাছে গেলেই তো কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করতে হবে”।

সীমন্তিনী একটু রাগী গলায় বলল, “বলেছি তো সেসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার কথা যদি না শোনো, তাহলে এটাই তোমাদের কাছে আমার শেষ আসা। আর কখনও তোমাদের কাছে আমি আসব না বলে দিচ্ছি”।
 

বিধুবাবু বললেন, “এই দেখ দেখি। কেমন রেগে যাচ্ছে। আচ্ছা আচ্ছা রে মা, তুমি যা বলছ তা-ই করব। তুমি আমাদের ভুলে যেও না মা”।

সীমন্তিনী বলল, “এতদিনে আমি আর্থিক ভাবে সক্ষম হয়ে উঠেছি মেসো। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে আমার নিজের বাবা মায়ের জন্য আমাকে ভাবতে হয় না। রচু, দাদাভাই আর তোমরাই তো আমার জীবনের সব। তোমাদের জন্যেও যদি আমি কিছু করতে না পারি, তাহলে আমার বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায় বল তো? আমি যে তোমাদের আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চাই। তোমরা আমাকে নিজের মেয়ের মত কাছে টেনে নিয়ে এটুকু করবার সুযোগ আমাকে দেবে না”?
 

বিধুবাবু একটু এগিয়ে এসে স্ত্রীর কোলে শুয়ে থাকা সীমন্তিনীর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, “আগের জন্মে আমি বুঝি তোমার পেটেই জন্মেছিলাম। নইলে এ জীবনে তো এমন কোন পূণ্য আমি করতে পারিনি যে তোমার মত একটা মেয়েকে এভাবে কাছে পাব। ভাল থেক মা। ঈশ্বর যেন সব সময় তোমাকে সব বিপদ আপদ থেকে দুরে রাখেন”।

সীমন্তিনী নিজের হাতঘড়ির দিকে নজর দিয়ে বিভাদেবীর কোল থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, “মাসি, আর বসতে পারব না গো। আমার দেরী হয়ে যাবে। সন্ধ্যের আগেই আমাকে অফিসে গিয়ে ঢুকতে হবে।
 
ভাইয়ের সাথে দেখা হল না। তুমি ওকে বোল, আমি পরে ওর সাথে ফোনে কথা বলব”।

বিভাদেবী বললেন, “আচ্ছা মা সে না হয় বলব। কিন্তু তোকে দেখলে খোকা খুব খুশী হত রে। তবে একটু দাঁড়া। তোর মাথার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি আঁচরে দিচ্ছি” বলে কোনার টেবিল থেকে চিরুণি হাতে নিয়ে সীমন্তিনীর চুলের খোঁপা খুলে দিলেন। একঢাল কাল চুল সীমন্তিনীর কোমড় অব্দি ঝুলে পড়ল। মিনিট পাঁচেক পর বিভাদেবী আবার সীমন্তিনীর চুল খোঁপা করে দিতে সীমন্তিনী উঠে দাঁড়াল। নিজের পকেটের ভেতর থেকে পার্স বের করে ভেতর থেকে চার হাজার টাকা বিধুবাবুর দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল, “মেসো, এ টাকাটা রাখো। সামনের পূর্ণিমায় আমার নামে তোমাদের ঠাকুরকে ভোগ দিও একটা। আর সামনের সপ্তাহে আলিপুরদুয়ার গিয়ে একজন ভাল ডাক্তার দেখিয়ে এস। মাসি তুমি খেয়াল রেখ, মেসো যেন ভুলে না যান। আর এবার চল। আমি যাবার পথে তোমাকে নামিয়ে দিয়ে যাব বাজারে। সেখান থেকে আরও কিছু মিষ্টি এনে পাড়ার লোকদের খাইয়ে বোল, তারা যেন আমায় আশীর্বাদ দেন”।


_______________________________________
 ss_sexy
[+] 2 users Like riank55's post
Like Reply
#38
(Update No. 60 date. 28.7.2018)

সীমন্তিনী নিজের গাড়িতে বিধুবাবুকে নিয়ে উঠে বসল। ড্রাইভারের পাশে বিধুবাবুকে বসিয়ে দিয়ে সীমন্তিনী জীপের পেছনের সীটে গিয়ে বসল। সিকিউরিটির লোকেরাও পেছনের গাড়িতে বসতেই কমাণ্ডিং অফিসার হুইসেল বাজাল। বিভাদেবী সীমন্তিনীর চিবুকে হাত বুলিয়ে বললেন, “ওখানে পৌঁছে খবর দিস মা”।
 

দুটো গাড়ি বাজারের দিকে এগিয়ে চলল। কিন্তু কিছুটা যেতেই সীমন্তিনী ড্রাইভারকে বলল গাড়ি থামাতে। গাড়িটা রাস্তার পাশে দাঁড়াতেই পেছনের গাড়ি থেকে কমাণ্ডিং অফিসার নেমে ছুটে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, “কী হল ম্যাডাম? এনি প্রব্লেম”?

সীমন্তিনী বলল, “না কোন প্রব্লেম নেই। কিন্তু আপনি একটু ওই ছেলেটাকে ডেকে আনুন তো প্লীজ। ওই যে কলেজ ইউনিফর্ম পড়া ছেলেটা ওই গলি দিয়ে যাচ্ছে। প্লীজ একটু তাড়াতাড়ি করুন”।
 

কমাণ্ডিং অফিসার সেদিকে ছুটে গেল। খানিক বাদেই দেখা গেল কিংশুককে সাথে নিয়ে সে সীমন্তিনীর গাড়ির কাছে এসে হাজির হল। বিধুবাবু ছেলেকে দেখেই বলে উঠলেন, “খোকা এসেছিস”?

কিংশুক পুলিশের গাড়িতে বাবাকে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “বাবা তুমি? পুলিশের গাড়িতে? কী হয়েছে”?

বিধুবাবু কিছু বলবার আগেই পেছনের সীট থেকে সীমন্তিনী নেমে চুপি চুপি কিংশুকের পেছনে গিয়ে বলল, “শুধু বাবা নয়, তোমাকেও ধরে নিয়ে যাব”।

কিংশুক মাথা ঘুরিয়ে পুলিশের পোশাকে সীমন্তিনীকে দেখেই আনন্দে চিৎকার করে উঠল, “দিদিভাই তুমি”?

সীমন্তিনী কিংশুককে জড়িয়ে ধরে তার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার সাথে দেখা করবার জন্যে এতক্ষন বাড়িতে বসেছিলুম ভাই। কিন্তু সন্ধ্যের আগেই আমাকে গিয়ে পৌঁছতে হবে বলে আর দেরী করতে পারছিলুম না। ভাগ্যিস এখানে দেখা হল। নইলে তোমাকে না দেখেই ফিরে যেতে হত”।

কিংশুক হঠাৎ করে ঝুঁকে সীমন্তিনীকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াতেই সীমন্তিনী বলল, “একি ভাই? তোমাকে না আমি বলেছি যে কখনও আমাকে প্রণাম করবে না। সে’কথা ভুলে গেছ তুমি”?

কিংশুক বলল, “ভুলিনি দিদিভাই। কিন্তু এ পোশাকে তোমাকে প্রথমবার দেখে একটা প্রণাম না করে থাকতে পারলুম না গো। তোমাকে যে কী সুন্দর দেখাচ্ছে গো”।

সীমন্তিনী বলল, “আচ্ছা ভাই, এভাবে রাস্তায় আর বেশী দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তুমি বাড়ি যাও। বাবাকে আমি বাজারে নামিয়ে দিয়ে যাব। মাকে কিছু কথা বলে এসেছি। সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও। আর যা যা করতে বলেছি সে সব কোর। পরে তোমার সাথে কথা বলব কেমন”?
 

কিংশুক বলল, “ইশ আর একটু আগে এলে তোমার সাথে অন্ততঃ একটু কথা বলতে পারতুম। কিন্তু আমি কি আর জানতুম যে তুমি কোন খবর না দিয়ে এভাবে চলে আসবে? জানলে আমি আগেই চলে আসতুম কলেজ থেকে”।
 

সীমন্তিনী আরেকবার কিংশুকের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল, “পরে কখনও সুযোগ পেলে আবার আসব
 
ভাই। সেদিন আগে থেকে জানিয়েই আসব। আজ চলি ভাই। আর দেরী করা ঠিক হবে না। তুমি মন খারাপ কোর না। বাড়িতে যা যা বলে এসেছি সে’সব মার কাছ থেকে শুনে নিও, কেমন? লক্ষ্মী ভাই আমার। আজ আসছি কেমন”?
 

******************

একদিন রাতে রতিকান্তবাবু নিজের দু’ভাই আর রতীশকে নিয়ে চন্দ্রকান্তবাবুর দোকানে আলোচনায় বসলেন। কলকাতা গিয়ে নতুন একটা যোগ শিক্ষাকেন্দ্র খুলে সঙ্গে সঙ্গেই সেটার আয় থেকে রতীশ নিজের সংসার চালাতে পারবে না। অন্ততঃ ছ’টা মাস তো নিজের জমানো পুঁজি থেকেই নিজেদের সব খরচ খরচা মেটাতে হবে। তারপর ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে হবে মাসে মাসে। ফ্ল্যাটে কিছু আসবাব পত্র আর গ্যাসের ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন যোগা সেন্টার খুলতে গেলে একটা বড়সড় ক্যাম্পাসের দরকার। আর সেটা কারো কাছ থেকে লিজে নিতে হবে। একটা ছোটখাট অফিস সাজিয়ে বসতে হবে। সেখানেও কিছু চেয়ার টেবিল আলমারি ইত্যাদির প্রয়োজন হবে। অফিস ঝাড়পোঁছ করবার জন্য একজন কর্মচারী রাখতে হবে। হয়ত অফিসের জন্য একজন এসিস্ট্যান্টও রাখতে হবে। তাদের বেতন ছাড়াও বিদ্যুতের বিল, জলের বিল এসব দিতে হবে। কিছু বৈদ্যুতিক সামগ্রী কিনতে হবে। রবিশঙ্কর জানিয়েছে যে কমপ্লেক্সটা রতীশের পছন্দ হয়েছে সেটা লিজ নিতে হলে বছরে দু’লাখ টাকা অগ্রিম জমা দিয়ে এক বছরের লিজ নিতে হবে। সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে দেখা গেল মোট লাখ চারেক টাকার প্রয়োজন শুরুতেই। রতীশ জানাল তার হাতে যা আছে তাতে আগামী আট দশ মাসের সংসার খরচ চালিয়ে নিতে পারবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে শশীকান্তবাবু আর চন্দ্রকান্তবাবু এক এক লাখ করে দেবেন, বাকি দু’লাখ দেবেন রতিকান্তবাবু নিজে। রতীশকে বলা হল সে রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে থাকবার ফ্ল্যাট আর কমপ্লেক্স লিজ নেবার ব্যাপারটা যেন সেরে আসে।

সকলের পরামর্শ মত মে ২০১২র মে মাসে রতীশ রবিশঙ্করের সাথে কলকাতা গিয়ে বরানগরে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিল। মাসিক আট হাজার টাকা ভাড়া। আর বিদ্যুতের বিল আলাদা। পরের মাস থেকে ভাড়া দিতে হবে। বাড়ি ভাড়ার এগ্রিমেন্টও সাইন করা হল। যে কমপ্লেক্সে রতীশ যোগা সেন্টার খুলবে বলে ভেবেছিল সেখান থেকে তার ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটটা খুব একটা দুর নয়। পায়ে হেঁটে গেলেও দশ বারো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। কমপ্লেক্সের মালিক বিমল আগরওয়ালাকে দেখে রতীশের মনে হল রোগা লম্বা লোকটাকে দেখে মারোয়ারী বলে মনেই হয় না। বরং তার চেহারা ছবি আর কথা বার্তার স্টাইল দেখে তাকে বিহারী বলেই সকলে ভুল ভাববে। বিমল আগরওয়ালা বছরে দু’লাখ চল্লিশ হাজারে কমপ্লেক্সটা লিজ দিতে চাইল এক বছরের জন্য। রতীশ আর রবিশঙ্করের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত দু’লাখ টাকায় রাজি হল। কিন্তু রতীশ পরের মাস থেকে কমপ্লেক্সের পজেশন নেবে বলে সে আগেই এগ্রিমেন্ট বানাতে চাইল না। বলল যে পরের মাসে রতীশ পাকাপাকিভাবে কলকাতা চলে এলেই সে একদিনের মধ্যে লিজ এগ্রিমেন্ট রেডি করে তাকে কমপ্লেক্সের পজেশন দিয়ে দেবে।

অবশেষ একদিন বাড়ির সবাইকে কাঁদিয়ে নিজেও কাঁদতে কাঁদতে রচনা রতীশের সাথে কলকাতার পথে পাড়ি দিয়েছিল জুন মাসের ঊনত্রিশ তারিখে। রতীশ ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে তাকে বলে দিয়েছিল যে তারা পরের দিন সকাল এগারটার আগে ফ্ল্যাটে গিয়ে ঢুকবে। রবিশঙ্করও তাদের সাথে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে একই কামরায় উঠেছিল। নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশন থেকেই তাদের তিনজনের রিজার্ভেশন করা হয়েছিল।
 

পরদিন সকাল প্রায় আটটায় তারা হাওড়া ষ্টেশনে পৌঁছল। রচনা সারা রাতে ট্রেণে একটা মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোতে পারেনি। নিজের বার্থে শুয়ে শুয়ে সে নিঃশব্দে কেঁদেছে সারাটা রাত ধরে। বাড়ির সকলের কথা ঘুরে ফিরে তার মনে আসছিল বারবার। সন্ধ্যে থেকে রাত এগারটা পর্যন্ত আধঘন্টা বাদে বাদেই বাড়ির ফোনে ফোন করে সকলের খবরাখবর নিয়েছে। সে জানে, সে বাড়ি ছেড়ে চলে আসাতে সবচেয়ে বেশী দুঃখ পেয়েছে চন্দ্রিকা। একটা মূহুর্তও সে রচনাকে ছেড়ে থাকতে চাইত না। আগের দিন তার বৌমণি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে বলে চন্দু কলেজে যায়নি। সারাদিন রচনার পেছন পেছন ঘুরঘুর করেছে আর বারবার রচনাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছে, “তুমি যেও না বৌমণি। তুমি কি জান না আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারিনা”?
 

আগের তিন চার মাস ধরে তাকে সবরকম ভাবে বুঝিয়েও কেউ শান্ত করতে পারেনি। রচনাও একসময় হাল ছেড়ে দিয়েছিল। ভেবেছিল সময়ের সাথে সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে। হাওড়া ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে আসবার সময় রতীশ লক্ষ্য করল রচনার মুখ চোখ বেশ ফুলে উঠেছে। চোখদুটো বেশ লাল হয়ে আছে। রচনা যে সারা রাত জেগেই কাটিয়েছে এটা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি।
 

রবিশঙ্কর আর রতীশ কুলির ট্রলিতে সবগুলো লাগেজ তুলে দিয়ে তাদের পেছন পেছন ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এল। এমন সময়ে রচনার মোবাইলটা বেজে উঠল। সীমন্তিনীর ফোন। কিন্তু রচনার ওই মূহুর্তে আর কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না বলে সে ফোনটা রতীশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “দিদিভাইয়ের ফোন। তুমি কথা বল। আমার ভাল লাগছে না এখন কারো সাথে কথা বলতে। জিজ্ঞেস করলে বলে দিও আমি ঠিক আছি”।

রতীশ ফোনটা রিসিভ করে বলল, “হ্যা মন্তি বল ......হ্যারে পৌঁছে গেছি। এই তো ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে এলুম ....... হ্যা, সেও আমাদের সাথেই আছে...... ওর কথা আর কি বলব তোকে, সারা রাতে বোধহয় এক মূহুর্তের জন্যেও ঘুমোয় নি... কেঁদে কেঁদে মুখ চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে .... মা তো অনেক কিছুই সঙ্গে দিয়েছিলেন, কিন্তু প্রায় কিছুই খায়নি ও..... এখান থেকে ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হবে...... হ্যা হ্যা ঠিক আছে, আমি দুপুর দুটো নাগাদ তোকে ফোন করব... হ্যা ঠিক আছে” বলে কথা শেষ করে ফোনটা রচনার হাতে ফিরিয়ে দিল।

সব গুলো লাগেজ একটা ট্যাক্সিতে চাপান সম্ভব হল না। ঘর সংসারের প্রয়োজনীয় অনেক কিছুই নিয়ে আসতে হয়েছে তাদের সাথে করে। দু’খানা ট্যাক্সি ভাড়া নিতে হল। একটায় রবিশঙ্কর বসল, অন্যটায় রচনাকে নিয়ে রতীশ উঠে বসল। সাড়ে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেল তারা। রবিশঙ্কর আর রতীশ মালপত্র গুলো ট্যাক্সি থেকে নামাতে নামাতেই ফ্ল্যাটের মালিক এসে গেল। রচনা দেখল প্রায় রতীশেরই বয়সী একটা ছেলে। রতীশ রচনার সাথে তার পরিচয় করিয়ে দিতে রচনা হাতজোড় করে তাকে নমস্কার করল। তার সাথে একটা কম বয়সী ছেলেও এসেছিল। চারজনে মিলে ধরাধরি করে লাগেজগুলো টেনে লিফটে নিয়ে ঢোকাল। ফ্ল্যাটের মালিক তার সঙ্গের ছেলেটিকে নিয়ে লিফটে ঢুকতে ঢুকতে রতীশকে বলল, “আপনারা একটু অপেক্ষা করুন। লিফটে তো বেশী জায়গা নেই আর। আমি আগে এগুলো নিয়ে যাই। তারপর আপনারা লিফটে উঠে আসুন”।
 

ফ্ল্যাটটা সেই চারতলা বিল্ডিঙের তিন তলায়। রবিশঙ্কর ফ্ল্যাটে না ঢুকে নিচে থেকেই বিদেয় নিয়ে বলল, “আমি তাহলে এখন আর ওপরে যাচ্ছি না রতীশবাবু। ম্যাডামকে দেখে বেশ টায়ার্ড মনে হচ্ছে। আপনারা বরং আজকের দিনটা রেস্ট নিন। সম্ভব হলে একটু গোছগাছ করে নিন। আমি কাল সকালে আপনার সাথে যোগাযোগ করব। তখন বিমলজীর সাথে দেখা করে কমপ্লেক্সের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করব”।

রতীশও তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদেয় করে রচনাকে নিয়ে লিফটে চেপে তিনতলায় উঠে এল। ফ্ল্যাটের মালিক দীপকবাবু তখন ছেলেটাকে দিয়ে জিনিসপত্র গুলো ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছে। রতীশ আর রচনা ফ্ল্যাটে ঢুকতেই সে বলল, “রতীশবাবু, আপনার কথামত আমি এক ফার্নিচারের দোকানে কথা বলে সব কিছু ঠিকঠাক করে এসেছি। ওদের ফোন করে বলে দিলেই ওরা সে’সব পাঠিয়ে দেবে। সঙ্গে ওদের লোক এসে সব কিছু ফিটিং করে দিয়ে যাবে। কিন্তু আমার মনে হয় বৌদিকে সাথে করে সেখানে নিয়ে গিয়ে আপনাদের একটু জিনিসগুলো দেখে নেওয়া উচিৎ। আমার পছন্দের সাথে আপনাদের পছন্দ তো না-ও মিলতে পারে”।

রতীশ দীপকবাবুর হাত ধরে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, “আপনাকে অনেক কষ্ট দিচ্ছি আমরা দীপকবাবু। সে জন্যে নিজেরই লজ্জা লাগছে খুব। কিন্তু রাতে শোবার বন্দোবস্ত তো কিছু একটা করতেই হবে। তাই ভাবছি খাওয়া দাওয়া করেই সেখানে যাব। আপনি দোকানের নাম্বারটা আমায় দিয়ে যান। আর রান্নার গ্যাসের বন্দোবস্ত কিছু করতে পেরেছেন কি? নইলে তো ঘরে রান্না বান্না করা যাবে না”।
 

দীপকবাবু বলল, “দু’ তিন দিনের মধ্যেই আপনাদের নিজস্ব গ্যাস কানেকশন পেয়ে যাবেন। তবে বিকেলে আমি একটা সিলিণ্ডার পাঠিয়ে দেব। একটা এক্সট্রা আছে আমার কাছে। আপাততঃ সেটা ব্যবহার করুন। আপনাদের নতুন কানেকশন এসে গেলে আমি না হয় এটা নিয়ে যাব। আর এ জন্যে আপনাকে আলাদা করে কোন পয়সাও দিতে হবে না”।

দীপকবাবুর কাছ থেকে ফার্নিচারের দোকানের নাম্বারটা চেয়ে নিয়ে রতীশ বলল, “অনেক ধন্যবাদ আপনাকে দীপকবাবু। কিন্তু সে এক্সট্রা সিলিণ্ডারটা যদি এখন পাওয়া যেত, তাহলে আমরা এখনই গিয়ে গ্যাস স্টোভটা কিনে আনতুম। যদিও দুপুরের খাবার আজ বাইরেই খেতে হবে। কিন্তু বিকেলের রান্নাটা ঘরে করতে পারলে ভাল হত”।

দীপকবাবু বলল, “আমি যদি কাছাকাছি কোথাও থাকতুম তাহলে আপনাদের এসময়ে একটু সাহায্য করতে পারতুম। কিন্তু জানেনই তো এখান থেকে আমার ওখানে যেতে প্রায় আধঘন্টা লেগে যাবে। তবে আপনি এক কাজ করুন। এ ছেলেটাকে একশোটা টাকা দিয়ে দিন। ও একটা অটো ভাড়া করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই সিলিন্ডারটা এনে দিয়ে যাবে। আপনারা ততক্ষণ স্নানটান সেরে বাইরে গিয়ে খেয়ে আসুন”।

দীপকবাবু বেরিয়ে যাবার পর রতীশ রচনাকে কাছে টেনে বলল, “তোমাকে সত্যি খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে সোনা। একটু চা খাবে? তাহলে সামনের দোকানটা থেকে নিয়ে আসছি”।

রচনা স্বামীর বুকে মাথা হেলিয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলল, “বাড়ির সকলের জন্য খুব মন কেমন করছে গো। চন্দুটা আজ কী করছে কে জানে। কলেজে গেছে কি না। বাবা কাকুরা সকালের খাবার খেয়ে গেছেন কি না”।

রতীশ রচনার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “কিচ্ছু ভেব না সোনা। জানি, তোমাকে আমার সাথে নিয়ে এসেছি বলে বাড়ির সকলেরই মন খারাপ হয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো। কিন্তু আমি তোমাকে বাড়িতে ফেলে এখানে একা এসে কি থাকতে পারতুম বল? ছোটবেলা থেকে আমার সব কিছু মন্তি দেখাশোনা করত। তারপর অনেক বছর আমি ছন্নছাড়ার মত জীবন কাটিয়েছি। তুমি এসে আবার আমার জীবনের হাল ধরেছ। তোমাকে ছেড়ে যে আমি এখন একটা দিনও কাটাতে পারব না। তাই তো তোমাকে নিয়ে এসেছি। প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন আমাদেরও খারাপ লাগবে। বাড়ির সকলেরও খারাপ লাগবে। তারপর দেখো, ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। তবে শোন না লক্ষ্মীটি। সারাটা রাত তুমি যে এক মূহুর্তও ঘুমোওনি, তা তো আমি জানিই। বলছি কি, এখন একটু চা খেলে তোমার ভাল লাগবে। তাই ফ্লাস্কটা বের করে দাও। আমি দু’কাপ চা নিয়ে আসছি। তারপর চা খেয়ে, স্নান সেরে চল বাইরে গিয়ে খেয়ে আসি। তারপর একটু ঘুমিয়ে নিও। বিকেলে বেরিয়ে একটা খাট আর রান্নার স্টোভ কিনে আনব। আর রাতে যতটুকু পারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নেবার চেষ্টা করব”।

রচনা আর কোন কথা না বলে একটা ব্যাগ খুলে তার ভেতর থেকে ফ্লাস্ক বের করে রতীশের হাতে দিল। রতীশ বেরিয়ে যাবার পর রচনা ঘুরে ঘুরে ফ্ল্যাটটা দেখতে লাগল। সামনের করিডোর থেকে ভেতরে ঢুকেই মাঝারি সাইজের একটা বসবার ঘর। তার বাঁ পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দেখল ছোট খাট একটা ব্যালকনি যেখান থেকে সামনের রাস্তার বেশ কিছুটা জায়গা দেখা যায়। রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখতে পেল একটা ঘরের আড়াল থেকে রতীশ বেরিয়ে এসে রাস্তা দিয়ে সামনের মোড়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উল্টোদিকে চেয়ে দেখল কয়েকটা ঘরের ব্যালকনির পরে রাস্তাটা সোজা অনেক দুর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ব্যালকনি থেকে আবার বসবার ঘরে এসে ডানদিকের একটা দরজা দিয়ে ঢুকল। দেখল সেটা রান্না ঘর। কুকিং স্ল্যাব বসান আছে। একপাশে দেয়ালের সঙ্গে সেট করা কয়েকটা কেবিনেট আছে। একটা জানালা আছে, যেটা সামনের করিডোরের দিকে খোলে। কুকিং টেবিলের সাথেই একটা সিঙ্ক বসান আছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার বসবার ঘরে এসে ভেতরের দরজা দিয়ে ঢুকে দেখল ভেতরে একটা মাঝারি সাইজের করিডোরের মত। করিডোরের ডান পাশে পরপর তিনখানা দরজা। প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকে একটা রুম দেখে মনে হল, এটা নিশ্চয়ই ডাইনিং রুম হবে। এ রুমটার ভেতর দিকে আরেকটা দরজা দেখা গেল। রচনা দরজাটা খুলে দেখল ওদিকে রান্নাঘরটা। ডানদিকের দু’নম্বর আর তিন নম্বর দরজাগুলো খুলে দেখল ছোট ছোট দুটো রুম। রচনা মনে মনে ভাবল এর একটাকে ঠাকুর ঘর করে অন্য ঘরটাকে স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করবে। বসবার ঘর থেকে ভেতরের করিডোরে এসে বাঁ দিকের দরজাটা খুলে দেখল বেডরুম। সে রুমটা চওড়ায় মাঝামাঝি হলেও বেশ লম্বা। বেডরুমের একদিকে একটা ছোট দরজা খুলে দেখল সেটা বাথরুম। ভেতরে শাওয়ার ছাড়াও অন্যান্য ফিটিংস আছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একটা ভেন্টিলেটর আছে। বাথরুমটার দু’দিকে দুটো দরজা। একটা বেডরুম থেকে ঢোকার আর অন্যটা ভেতরের করিডোর থেকে ঢোকার জন্য। তার মানে বাথরুম ব্যবহার করতে গেলে দু’দিকের দুটো দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতে হবে। বেডরুমের লাগোয়া দরজার ওপর একটা গিজারও বসান আছে দেখা গেল। ঘর দেখে মোটামুটি পছন্দই হল রচনার। সাফ সুতরোও আছে। বাড়ির মালিক নিজেই হয়ত লোক লাগিয়ে সব পরিস্কার করিয়ে রেখেছেন। ঘরগুলো সব নতুন করে রং করা হয়েছে। কিছুটা রঙের গন্ধও যেন নাকে ঢুকছে।
 

নিজের ব্যাগ থেকে একটা টাওয়েল বের করে বাথরুমে গিয়ে মুখে চোখ ভাল করে ধুয়ে বেডরুমের ভেতর আসতেই ডিংডং শব্দে কলিং বেল বেজে উঠল। মুখ মুছতে মুছতেই রচনা সামনের দরজা খুলে দিতেই রতীশ ফ্লাস্ক হাতে ঘরে ঢুকল। এক হাতে কয়েকটা প্লাস্টিকের চায়ের কাপ। দু’জনে মিলে চা খেতে খেতেই রতীশের মোবাইল বেজে উঠল। বাড়ি থেকে রতীশের মা ফোন করেছেন। তারা ফ্ল্যাটে এসে ঢুকেছে শুনে সরলাদেবী আশ্বস্ত হলেন। রচনাও একটু কথা বলল। শুনল, চন্দ্রিকা আজও সকালে ঘুম থেকে উঠেই কান্নাকাটি করেছে। সবাই মিলে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে কলেজে পাঠিয়েছে। বাড়ির আর সবাই ভাল আছে।

চা খেয়ে রতীশ রচনাকে স্নান সেরে নিতে বলল। রচনা দুটো লাগেজ টেনে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে গেল। তারপর একটা ব্যাগ থেকে শাড়ি সায়া ব্লাউজ বের করে টাওয়েল নিয়ে স্নান করতে ঢুকে গেল। রচনা স্নান করতে করতেই শুনতে পেল তার মোবাইল বাজছে।
 

স্নান সেরে বের হতেই রতীশ বলল, “বাবা আর মেজকাকু ফোন করেছিলেন। আমাদের খবর নিলেন”।
 

রচনা নিজের ভেজা চুল মুছতে মুছতে বলল, “স্নান করে বেশ ক্ষিদে লাগছে গো। তুমিও আগে স্নান করে নাও। তারপর খেয়ে দেয়ে দেখা যাবে কি করা যায়”।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনের মোড়টা পেড়িয়েই একটা ছোটখাট খাবার হোটেল দেখা গেল। সেখানেই খাওয়া দাওয়া সেরে ফ্ল্যাটে ফিরে আসতে না আসতেই আবার কেউ এসে কলিং বেল বাজাল। রতীশ দরজা খুলে দেখল ফ্ল্যাটের মালিকের সাথে যে ছেলেটা আগে এসেছিল সে একটা গ্যাস সিলিণ্ডার নিয়ে এসেছে। ছেলেটা সেটা দিয়ে চলে যেতেই আবার ফোন বেজে উঠল। এবারে ছোটকাকুর সাথে কথা বলা শেষ করে রতীশ বলল, “বসবার মতও তো কিছু ঘরে নেই সোনা। একটু গড়িয়ে নিলে ভাল হত না। তুমি তো কাল সারাটা রাত একেবারে ঘুমোও নি। এক কাজ কর, আমি বেডিংটা খুলে ম্যাট্রেসটা ফ্লোরে পেতে দিচ্ছি। তুমি একটু শুয়ে নাও। তারপর তিনটে নাগাদ বেরিয়ে যাব। আগে ফার্নিচারের দোকানে গিয়ে একটা খাট, একটা সেন্টার টেবিল, সোফা সেট আর দু’ তিনটে চেয়ার আপাততঃ কিনে নিই। তারপর বাজার থেকে রান্নার জিনিসগুলো কিনে বাড়ি ফিরব। তারপর বাদ বাকি যা কিছু দরকার তা ধীরে সুস্থে পরে কেনা যাবে”।
 

মেঝেতে ম্যাট্রেস পেতে রচনা শুয়ে পড়ল। রতীশও মোবাইলে এলার্ম সেট করে রচনার পাশে শুয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। বেলা দুটোর সময় মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠতে তাদের ঘুম ভাঙল। রতীশ প্রথমে সীমন্তিনীকে ফোন করল। রচনাও তার সাথে কথা বলল। তারপর পোশাক আশাক বদলে তারা তিনটে নাগাদ ফ্ল্যাট থেকে বেরোল। একটা অটো ভাড়া করে ফার্নিচারের দোকানে গেল। খাট, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, সোফাসেট, সেন্টার টেবিল, ফোর সিটার ডাইনিং টেবিল আর চারখানা চেয়ার পছন্দ করল তারা। সব মিলে দাম হল মোট আটশট্টি হাজার টাকা। পঁচিশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিয়ে সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ মালগুলো ফ্ল্যাটে ডেলিভারি দিতে বলে দিয়ে তারা বাজারে গিয়ে রান্না ঘরের জন্য কিছু শাক সব্জী মশলা আর মুদি দোকানের জিনিস আর একটা গ্যাস স্টোভ কিনে নিয়ে একটা অটো ভাড়া করে সন্ধ্যে ছ’টার আগেই ফ্ল্যাটে ফিরে এল।

ঠিক ছ’টায় ফার্নিচার গুলো সব এসে গেল। লোকগুলো সবকিছু জায়গা মত বসিয়ে দিয়ে ঠিকমত ফিটিং করে দিয়ে রাত ন’টা নাগাদ বাকি টাকা নিয়ে চলে গেল। রচনা ততক্ষণে রান্নাঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েছে। রচনার রাতের রান্না শেষ হতে হতে রতীশ বেডরুমের বিছানা আর বসবার ঘরটা মোটামুটি গুছিয়ে ফেলল। রাতে সীমন্তিনী, ছোটকাকু চন্দ্রকান্তবাবু আর রতীশের মা সরলাদেবীর সাথে আবার ফোনে কথা বলল। রচনা শাশুড়ি মাকে আর জিজ্ঞেস না করে থাকতে পারল না, “মামনি, চন্দু কেমন আছে গো”?

সরলাদেবী জবাব দিলেন, “ওর কথা তোকে আজ আর কিছু বলছি না রে মা। মন্তি বারবার করে বারণ করে দিয়েছে। তাই তুই ও’সব নিয়ে ভাবিস না। আমি খাইয়ে দাইয়ে শুইয়ে দিয়েছি ওকে। ও এখন ওদের ঘরে ঘুমোচ্ছে। তুই মন খারাপ করিসনে মা। কাল সারা রাত তুই ট্রেনে একটুও ঘুমোস নি শুনেছি। আজও তো বেশ পরিশ্রম গেছে তোর। তাই এবার সব ভাবনা ছেড়ে একটু ভাল করে ঘুমোবার চেষ্টা কর সোনা মা আমার। আমরা বাড়ির সকলেই ভাল আছি। তুই আমাদের নিয়ে ভাবিস না”।

ভেতর থেকে উথলে ওঠা কান্নাকে চেপে রাখতে রাখতে রচনা বলল, “জানি মামনি, ওখানে তোমরা সবাই সবাইকে প্রবোধ দেবে সান্ত্বনা দেবে। আমি থাকা না থাকাতে তোমাদের আর বেশী কষ্ট কী হবে”?
 

সরলাদেবী একটু অভিমানী সুরে বললেন, “আমি যত নিজেকে সামলে রাখবার চেষ্টা করছি, তুই ততই আমাকে কাঁদাবার চেষ্টা করছিস না? আমি ছাড়ছি এবার। কাল কথা বলব আবার” বলেই ফোন কেটে দিলেন। রচনাও সাথে উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগল।
 


**************
 ___________________________________
ss_sexy
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#39
(Update No. 61 date. 28.7.2018)

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন রচনা আর রতীশ চা খাচ্ছিল, তখনই রবিশঙ্করের ফোন এল। রবিশঙ্কর রতীশকে বলল যে সে বিমল আগরওয়ালাকে সঙ্গে নিয়ে কমপ্লেক্সে পৌঁছে যাবে সকাল ন’টার ভেতর। রতীশ যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেখানে চলে আসে। রচনা সে’কথা শুনেই বলল, “ইশ, আমি ভেবেছিলুম সকালে ঘুম থেকে উঠেই স্নান করে ঠাকুর ঘরে ঠাকুরের আসনটা পেতে দেব। তুমি ঠাকুরকে প্রণাম করে বেরোতে পারতে। কিন্তু আজই দেরী করে ঘুম ভাঙল। তুমি কখন বেরোবে গো”?
 

রতীশ বলল, “আধঘন্টার মধ্যেই বেরোতে হবে আমাকে। কিন্তু তোমাকে তাড়াহুড়ো করে কিছু করতে হবে না। কালও তো তুমি বারোটার আগে ঘুমোওনি। তাড়াতাড়ি না উঠে ভালই হয়েছে। তুমি বরং এক কাজ কর সোনা। আমাকে কিছু একটা খাবার বানিয়ে দাও। সে’টুকু খেয়েই বেরিয়ে যাব। আজ যদি কমপ্লেক্সে ঢুকতে পারি তাহলে সেন্টারের জন্য যে জিনিসগুলো কিনতে হবে সে’সব বিকেলেই কিনে এনে সেখানে রেখে দেব”।

রচনা খালি কাপ প্লেটগুলো উঠিয়ে নিতে নিতে বলল, “না সোনা, আজই সেখানে কোন জিনিস ঢুকিও না। আজ যদি তারা কমপ্লেক্সের চাবিটা তোমার হাতে দিয়ে দেয়, তাহলে শুধু চাবিটাই নিয়ে এস। ভেতরে যদি সাফ সাফাই কিছু করতে হয় সেটা বিকেলে গিয়ে দু’জনে মিলে করে নেব। কাল সকালে সেখানেও আমি ঠাকুর বসিয়ে দেব। তারপর তোমার যা কিছু করার প্রয়োজন সে’সব কোর”।
 

রুটি সব্জী খেয়ে রতীশ ফ্ল্যাট থেকে বেরোল বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ। একটা হাতব্যাগে দু’লাখ টাকা ভরে নিতে দেখে রচনা বলল, “সোনা শোন। এগ্রিমেন্ট সাইন না হওয়া অব্দি কিন্তু তুমি তাদের কোন টাকা পয়সা দিও না। দিদিভাইও কিন্তু বারবার করে এ’কথা বলে দিয়েছেন”।

রতীশ সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। পায়ে হেঁটে গেলে পনের মিনিটেই পৌঁছে যাবে। রচনা ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রতীশকে সামনের মোড়ের দিকে যেতে দেখে দু’হাত জোড় করে মনে মনে ঠাকুরকে প্রণাম করল।
 

রতীশ কমপ্লেক্সের সামনে এসে যখন দাঁড়াল তখনও ন’টা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই রবিশঙ্করের সাথে বিমল আগরওয়ালা এসে পৌঁছল। বিমলজী চাবি দিয়ে বিল্ডিঙের দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল। রতীশ ভেতরের সব কিছু ঘুরে ঘুরে দেখল। পরিস্কারই আছে সবগুলো রুম। কমপ্লেক্সটা একটা পার্টিশান দিয়ে দু’ভাগে ভাগ করা। প্রথম ভাগটা খুব বড় নয়। কিন্তু ভেতরের অংশটা বেশ বড়। ছত্রিশ ফুট বাই চল্লিশ ফুট বেশ বড় একটা হলঘরের একদিকে দুটো ছোট ছোট রুমের সাথে একটা মাঝারি সাইজের বাথরুম। সামনের অংশটাতেও একটা ছোট বাথরুম আছে। এ’সব রতীশ আগেই দেখে গিয়েছিল। সামনের ছোট অংশটা সে তার অফিসঘর হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। আর ভেতরের অংশে মূল ট্রেনিং দেওয়া যাবে। তবে আগে ভেতরটা এত পরিস্কার ছিল না। এখন সবকিছুই বলতে গেলে ঝকঝকে তকতকে। বিমলজী সব কিছু দেখিয়ে রতীশকে বলল, “আমি দু’দিন আগে লোক লাগিয়ে সব পরিস্কার করে রেখেছি রতীশবাবু। ইলেকট্রিক লাইন গুলো, আর বাথরুমের জলের পাইপ গুলো সব চেক করে ঠিকঠাক করে রেখেছি। আর কোন সমস্যাই নেই”।
 

রতীশ খুশী হয়ে বলল, “হ্যা, সে তো দেখতেই পাচ্ছি বিমলজী। কিন্তু বলছিলাম কি আজ তো এক তারিখ। আমাকে এটার পজেশান আজই দেবেন তো? আর এগ্রিমেন্টটা বানানো হয়েছে”?
 

বিমলজী রতীশ আর রবিশঙ্করকে দুটো চেয়ারে বসতে দিয়ে নিজেও একটা চেয়ারে বসে বলল, “পজেশান আপনি কাল পাবেন রতীশবাবু। আসলে উকিলবাবু এগ্রিমেন্টটা ফাইনাল করতে পারে নি। ভুলটা আমারই হয়েছে। আপনার নাম ঠিকানা আমি যে কাগজটায় লিখে রেখেছিলাম, সে কাগজটা কোথায় যে হারিয়ে ফেলেছি তা আর খুঁজেই পেলাম না। আর এগ্রিমেন্টে তো সে’সব লিখতে হবে। তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি আবার আমাকে ওই জিনিসগুলো লিখে দিন। আমি আজ বিকেলের মধ্যেই দু’কপি এগ্রিমেন্ট বানিয়ে রেডি করে রাখব। কাল সকালেই এগ্রিমেন্টে সই করে আপনি চাবি নিয়ে নেবেন”।

নিরূপায় হয়ে রতীশ নিজের ব্যাগের ভেতর থেকে কাগজ কলম বের করে আবার নিজের নাম ধাম লিখে কাগজটা বিমলজীর হাতে দিয়ে বলল, “এই নিন। কিন্তু আজ তো তাহলে আর আমি কোন কাজ শুরু করতে পাচ্ছি না। ভেবেছিলুম আজই এখানে অফিসটা সাজিয়ে ফেলব”।
 

রবিশঙ্কর বলল, “একটা দিনের জন্যে আর এমন কী প্রব্লেম হবে রতীশবাবু। সব কথা তো আগেই হয়ে গেছে। কাল থেকেই আপনি কাজ শুরু করতে পারবেন। আপনি বরং বিমলজীর পেমেন্টটা করে দিন আজ”।
 

রতীশ বলল, “হ্যা সে তো করতেই হবে। কিন্তু বলছিলাম কি, এগ্রিমেন্টটা তো আজ আর সাইন করা হচ্ছে না। ওটা করেই না হয় পেমেন্টটা দিতুম”।
 

বিমলজী বলল, “আপনি ঠিক কথাই বলছেন রতীশবাবু। কিন্তু আমার ছেলেটার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি করতে আমাকে আজই সেখানে চার লাখ টাকা জমা দিতে হবে। কিন্তু আমার হাতে আজ অতগুলো টাকা নেই। তাই ভাবছিলাম, আপনার কাছে থেকে দু’লাখ টাকা পেলে আমাকে আর অন্য কোথাও খোঁজ করতে হবে না। আর আমার একটু অসাবধানতার জন্যেই আপনার কাগজটা হারিয়ে ফেলেছি বলেই মুস্কিলটা হল। তবে কাল তো আপনি এ বিল্ডিঙের পজেশান পেয়েই যাচ্ছেন। কিন্তু কলেজে টাকাটা যে আমাকে আজই পেমেন্ট করতে হবে। আজই শেষ দিন”।
 

রবিশঙ্কর মিষ্টি করে হেসে বলল, “সে নিয়ে ভাবছেন কেন রতীশবাবু। আমি তো সব কিছুর সাক্ষী থাকছি। আর আপনাদের এগ্রিমেন্টে সাক্ষী হিসেবে আমিও তো সই করব। তাই ও নিয়ে ভাববেন না। চাচাজীর আজ টাকাটা দরকার। দিয়ে দিন। কাল সকাল ন’টায় আপনার সব কাজ হয়ে যাবে। আমি তো আছিই”।
 

রতীশ মনে মনে একটু দোনামনা করলেও আর কিছু না বলে ব্যাগ থেকে দু’লাখ টাকা বের করে বিমলজীর হাতে দিল। বিমলজী টাকাটা নিজের পকেটে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “খুব উপকার করলেন আমার রতীশবাবু। নইলে আমার ছেলের অ্যাডমিশনের টাকাটা যোগার করতে আমাকে অনেক দৌড়ঝাঁপ করতে হত। থ্যাঙ্কিউ। কাল সকাল এ’রকম সময়েই চলে আসবেন। আমরাও আসব”।

রতীশ একটু অবাক হয়ে বলল, “কিন্তু বিমলজী, টাকাটা নিয়ে আমাকে একটা রসিদ দেবেন না”?

রবিশঙ্কর জবাব দিল, “হ্যা সে তো অবশ্যই পাবেন। চাচাজীর রসিদ বই ছাপানোই আছে। কাল সকালে এগ্রিমেন্টের কপি আর বিল্ডিঙের চাবির সাথে সাথে সেটাও পেয়ে যাবেন। তাহলে এখন এখান থেকে বেরোন যাক চলুন। চাচাজী আপনি এখনই উকিলবাবুকে কাগজটা দিয়ে এগ্রিমেন্টটা ফাইনাল করতে বলে দিন। আজ বিকেলেই যেন দু’কপি এগ্রিমেন্ট সে বানিয়ে দেয়। তবে এগ্রিমেন্টে একটা কথা একটু বদলে দেবেন চাচাজী। রতীশবাবু দু’তারিখে বিল্ডিঙের পজেশান পাচ্ছে। তাই লিজ পেরিয়ড শুরু হবে দু’তারিখ থেকেই। আর শেষও হবে দু’তারিখে”।

বিমলজী চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, “হ্যা হ্যা, সেটাই তো হবে। একটা দিন লিজ কম পাবেন কেন রতীশবাবু। ও আমি উকিলবাবুকে বলে দেব। উনি সব ঠিক করে দেবেন”।

রতীশ কিছুটা দোনামনা করলেও আর কিছু বলে উঠতে পারল মা। ভাবল, রবিশঙ্কর তো সব কিছুর সাক্ষী থাকছেই। কী আর হবে।

হাতে আর কোন কাজ না থাকাতে রতীশ বাড়ির পথ ধরল। ভাবল, রচনা একা একা ঘর সংসারের সমস্ত কাজ সামলে ঘরের জিনিসপত্র গুলো গোছগাছ করতে ব্যস্ত। অন্য কোথাও না গিয়ে এখন ঘরে গিয়ে বাকি ঘরগুলো একটু ঠিকঠাক করে দিলে রচনার পরিশ্রম খানিকটা কম হবে।
 

দশটার আগেই রতীশকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখে রচনা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কি গো? এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? কাজ হলনা আজ”?
 

রতীশ নিজের গায়ের জামা খুলতে খুলতে বলল, “হ্যা গো এগ্রিমেন্টটা রেডি হয়নি এখনও। বিমলজীকে আমি আগে একটা কাগজে আমার নাম ঠিকানা সব কিছু লিখে দিয়েছিলুম। সে কাগজটা সে কোথাও হারিয়ে ফেলেছে বলে উকিল না কি এগ্রিমেন্টটা বানাতে পারেন নি। আজ আবার সে’সব লিখে দিলুম। আজ বিকেলের মধ্যেই না কি এগ্রিমেন্টটা রেডি হয়ে যাবে। কাল সকালেই আমাকে ঘরের চাবি দিয়ে দেবে বলেছে। রবিশঙ্করও এসেছিল। আর ভেতরের সবকিছুই পরিস্কারই আছে। তাই নতুন করে আর কিছু করতে হবে না। কাল সকালে কমপ্লেক্সের চাবিটা পেলেই আমি এসে তোমাকে নিয়ে যাব। তুমিও জায়গাটা দেখে নিও। বেশী দুর নয় এখান থেকে। হেঁটে গেলেও পনের কুড়ি মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাওয়া যায়। আর অটোতে গেলে তো পাঁচ মিনিটেই পৌঁছে যাব। তাই আজ আর কিছু হচ্ছে না বলে চলে এলুম। ভাবলুম ঘরে তো গোছগাছ তুমি একা একাই সবটা করছ। হাতে যখন সময় আছে আমিও কিছু একটা করে তোমাকে সাহায্য করি”।

রচনা বলল, “তাহলে তুমি এক কাজ কর। জামা কাপড় ছেড়ে হাত মুখ ধুয়ে একটা ধোয়া পাজামা পড়ে নাও। তারপর ডাইনিং রুমের পরের ছোট ঘরটাতে ঠাকুরের আসনটা বসিয়ে দাও। রান্নাঘর, খাবার ঘর, শোবার ঘর আর বসার ঘর তো মোটামুটি গোছান হয়েই গেছে। ঠাকুর ঘরটা ঠিক করতে পারলেই এখন আপাততঃ হয়ে যাবে। এ কার্টনটায় ঠাকুর ঘরের সব কিছু আছে। এটা খালি করে জিনিসগুলো সাজিয়ে দিলেই হয়ে যাবে। আর শোনো, কয়েকটা পর্দা বানাতে দিতে হবে গো। পেছনের স্টোর রুমে পর্দা না লাগালেও অন্য ঘর গুলোর দরজায় তো পর্দা লাগাতেই হবে। আর বসার ঘর, শোবার ঘর, আর ডাইনিং রুমের জানালা গুলোতেও পর্দা লাগাতে হবে”।

রতীশ বলল, “ঠিক আছে, তাই করছি। জানালা দরজার মাপ গুলো কাগজে টুকে নিয়ে বিকেলে গিয়ে না হয় পর্দার কাপড় পছন্দ করে পর্দা বানাতে দিয়ে আসব। তুমিও যাবে কিন্তু আমার সাথে। তোমার পছন্দসই কাপড় কিনব”।
 

সীমন্তিনী আর বাড়ির সকলকে জানিয়ে দেওয়া হল যে কমপ্লেক্সের এগ্রিমেন্টটা আজ সাইন হয় নি। কাল এগ্রিমেন্টে সই করবার সাথে সাথে বিল্ডিঙের চাবিও রতীশ পেয়ে যাবে।


**************

পরদিন সকাল ন’টার একটু আগেই রতীশ কমপ্লেক্সের সামনে এসে দাঁড়াল। কিন্তু বিমল আগরওয়ালা বা রবিশঙ্কর কাউকেই দেখতে পেল না। মনে মনে ভাবল, হয়ত কোন জরুরী কাজে ব্যস্ত আছে, তাই আসতে দেরী হচ্ছে। কাছাকাছি একটা গাছের ছায়ায় গিয়ে দাঁড়াল সে। দশটা বেজে যাবার পরেও কাউকে আসতে না দেখে রতীশের চিন্তা হতে লাগল। বিমলজী বা রবিশঙ্কর কারুরই দেখা নেই। তাদের আসতে দেরী হচ্ছে বলে কেউ কোন ফোনও করেনি তাকে। আরো আধঘন্টা পেড়িয়ে যাবার পর রতীশ আর থাকতে না পেরে নিজের মোবাইল থেকে রবিশঙ্করের নাম্বার ডায়াল করল। কিন্তু শোনা গেল তার ফোন সুইচড অফ। আরও কয়েকবার চেষ্টা করেও কোন ফল হল না। প্রত্যেক বারেই একই জবাব, ফোন সুইচড অফ।
 

গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়েও রতীশ এবার ঘামতে শুরু করল। তার মনটা যেন কূ গেয়ে উঠল। টাকাগুলো হাতে পেয়েই ওরা গা ঢাকা দিল না তো? হে ভগবান, এমনটা হলে সে কী করবে? কোথায় যাবে? বাবা কাকাদের কাছ থেকে আনা টাকাগুলো সে এভাবে খোয়াল? সীমন্তিনী আর রচনা দু’জনেই তাকে বারবার করে বলে দিয়েছিল যে এগ্রিমেন্ট সাইন না হওয়া অব্দি রতীশ যেন কোন টাকা পয়সা তাদের হাতে না দেয়। কিন্তু মালিকের ছেলের কলেজে অ্যাডমিশনের শেষ দিন ছিল বলেই কাল বিমলজী তার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা চেয়ে নিয়েছিল। রতীশ যে সীমন্তিনী আর রচনার কথা ভুলে গিয়েছিল, তা নয়। সে কাল টাকাটা না দিলে বিমলজীকে হয়ত অন্যান্য জায়গায় ছুটোছুটি করতে হত। তার ছেলের অ্যাডমিশনটাও হয়ত হত না। কিন্তু বন্ধুর মত রবিশঙ্করের মিষ্টি কথায় রতীশ আর এমন সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখে নি। কিন্তু এখন এ মূহুর্তে সে বুঝতে পারছে, কত বড় ভুলটা সে আগের দিন করেছে। সময়ের সাথে সাথে তার মনের ধারণা আরও যেন পুষ্ট হতে লাগল।

প্রায় বারোটা নাগাদ সুন্দর পোশাক পড়া বছর পঞ্চাশের একজন মারোয়ারী ভদ্রলোককে দেখা গেল সেই কমপ্লেক্সের দরজার তালা খুলতে। তার সঙ্গে আরও একজন লোক। রতীশ অবাক চোখে দেখতে দেখতে প্রায় ছুটে লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি বিমল আগরওয়ালার লোক”?

ভদ্রলোক রতীশের দিকে অচেনা দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলল, “বিমল আগরওয়ালার লোক মানে? না না আপনি ভুল করছেন। আমি বিমল আগরওয়ালার লোক নই। আসলে আমি নিজেই বিমল আগরওয়ালা। এই বিল্ডিঙের মালিক। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন তো”?
 

তার কথা শুনে রতীশের পায়ের তলার মাটি যেন কেঁপে উঠল। কোনরকমে তোতলাতে তোতলাতে বলল, “আ-আপনিই বি-বিমল আগরওয়ালা? কিন্তু তাহলে কাল যে এসেছিল সে .....”
 

রতীশ আর নিজের কথা শেষ করতে পারল না। তার পা দুটো উত্তেজনা আর উৎকণ্ঠায় কাঁপতে শুরু করল। মাথাটাও কেমন যেন একটু ঘুরে উঠল। ভদ্রলোক রতীশের অবস্থা দেখে খপ করে তার হাতটা ধরে বললেন, “আরে আরে কী হল আপনার। আপনি আসুন তো। ভেতরে গিয়ে একটু বসুন। তারপর আপনার যা বলার আছে বলবেন। আসুন” বলে রতীশের হাত ধরে তাকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে গেল। রতীশকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিতে দিতে তার সঙ্গের লোকটাকে এক গ্লাস জল আনতে বলল। লোকটা সামনের একটা টেবিলের ওপর থেকে একটা খালি জলের জগ নিয়ে লাগোয়া বাথরুমে ঢুকে গেল।
 

রতীশের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। চেয়ারের হাতল দুটো শক্ত করে ধরে সে চোখ বুজে রইল। খানিকক্ষণ বাদে লোকটা জগে জল ভরে এনে টেবিলের ওপর উপুড় করে রাখা একটা কাচের গ্লাস ধুয়ে তাতে জল ভরে রতীশের কাছে এসে বলল, “এ জলটুকু খেয়ে নিন তো দেখি। একটু ভাল বোধ করবেন। নিন”।

রতীশ অবসাদে আচ্ছন্ন অবস্থায় তার হাত থেকে জলের গ্লাসটা নিয়ে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাসের জলটুকু খেয়ে ফেলল। কিন্তু তার হাত পা তখনও ঠরঠর করে কাঁপছিল। কাঁপা কাঁপা হাতেই নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে আগে ঠোঁট মুছে নিয়ে তারপর কপালে ঘাড়ে গলায় লেগে থাকা ঘাম মুছতে মুছতে শূণ্য দৃষ্টিতে ভদ্রলোকটার দিকে চাইল। ভদ্রলোক সিলিং ফ্যানটা চালিয়ে দিয়ে রতীশের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “এখন কেমন লাগছে বলুন তো? শরীর খারাপ লাগছে খুব”?
 

রতীশ দুর্বল গলায় কোন রকমে জবাব দিল, “না ঠিক আছে”।
 

ভদ্রলোক আরেকটা চেয়ার টেনে রতীশের কাছাকাছি এনে বসে বলল, “এবার বলুন তো? আপনি আমাকে খুঁজছেন কেন? আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পাচ্ছি না”।
 

রতীশ এবার ভাল করে চেয়ে দেখে ঘরের ভেতরে এক কোনায় একটা টেবিলের ওপর তিন চারটে কাঁচের গ্লাস আর একটা জলের জগ রাখা। কাল এ ঘরে শুধু চারখানা চেয়ার ছাড়া আর কিছু ছিল না। টেবিলের অভাবে নিজের ব্যাগের ওপরেই কাগজ রেখে নিজের নাম ঠিকানা লিখে ওই বিমল আগরওয়ালাকে সে দিয়েছিল। আর এখন এ লোকটা বলছে যে ইনিই বিমল আগরওয়ালা! গতকালের বা তারও আগে দেখা ওই লোকটা তাহলে কে ছিল?
 

রতীশ ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপনি সত্যি বলছেন? আপনিই বিমল আগরওয়ালা? এ বিল্ডিঙের মালিক বিমল আগরওয়ালা”?
 

ভদ্রলোক জবাব দিল, “হ্যা হ্যা, আমিই তো বিমল আগরওয়ালা। আপনি কি আমাকেই খুঁজছেন? আপনার বাড়ি কোথায়? আপনি কে? আমি তো আপনাকে আগে কখনও দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না”।
 

রতীশ ততক্ষণে বুঝে গেছে যে তার চরম সর্বনাশ হয়ে গেছে। দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে সে বলল, “আপনি ক্ষমা করবেন আমাকে। আসলে অন্য আরেকজন লোক নিজেকে এ বিল্ডিঙের মালিক বিমল আগরওয়ালা বলে পরিচয় দিয়ে আমাকে এ বিল্ডিংটা এক বছরের জন্যে লিজে দেবে বলে রাজি হয়েছিল। মাস দুয়েক আগে তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল আমার এক পরিচিত লোকের মাধ্যমে। গতকাল লোকটা আমার সাথে এখানে বসে কিছুক্ষণ কথাও বলে গেছে। আমার সে বন্ধুও ছিল। কাল আমার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। আজ লিজ এগ্রিমেন্ট সই করে আমাকে পজেশান দেবে বলে কথা ছিল। আমি সকাল ন’টা থেকে এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছি। তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। অনেকক্ষণ ধরে ফোন করে যাচ্ছি। ফোন সুইচড অফ পাচ্ছি বারবার। আর এখন আপনি বলছেন, বিমল আগরওয়ালা আপনি”।

ভদ্রলোক সব শুনে মাথায় হাত দিয়ে বলল, “হে ভগবান। কী জমানা এসে গেছে? মানুষ মানুষকে এভাবে ঠকায়”?
 

রতীশ তার কথার অর্থ না বুঝে জিজ্ঞেস করল, “কি বলছেন আপনি”?
 

ভদ্রলোক তার দামী শার্টের বুক পকেট থেকে একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে রতীশের হাতে দিয়ে বলল, “এই দেখুন, এই আমার ভিজিটিং কার্ড। এতে আমার ছবি নাম, বাড়ির আর অফিসের ঠিকানা সবকিছু লেখা আছে। দেখুন”।
 

রতীশ কার্ডখানা হাতে নিয়ে দেখল। তাতে লেখা- বিমল আগরওয়ালা। প্রোপাইটর আগরওয়ালা রিয়েল্টরস। সেখানে ভদ্রলোকের বাড়ি এবং অফিসের ঠিকানার সাথে তার একটা ছবিও ছাপান আছে। তার অফিসের আর রেসিডেন্সের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারও লেখা আছে। কার্ডটা দেখার পর রতীশের মুখে আর কথা যোগাচ্ছিল না।

ভদ্রলোক বলল, “এবার নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে আমি আপনাকে মিথ্যে কথা বলছি না। আমি একজন
 
বিল্ডার। এ বিল্ডিংটা আমার নিজস্ব। কয়েক মাস ধরে ফাঁকা পড়েছিল। এখন একটা ব্যাঙ্ক এটাকে পাঁচ বছরের জন্য লিজ নিয়ে এখানে তাদের একটা ব্রাঞ্চ খুলবে। আজ বিকেলেই ব্যাঙ্কের অফিসাররা এখানে আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। আমি দু’দিন আগে লোক লাগিয়ে কমপ্লেক্সটা পরিস্কার করিয়ে রেখেছি। তবু আজ ব্যাঙ্কের লোকেরা আসছে বলে আমি একটু দেখতে এসেছি সব কিছু ঠিকঠাক আছে কি না” একটু থেমেই ভদ্রলোক আবার বললেন। “কিন্তু আপনি বলছেন যে কাল আপনি এ কমপ্লেক্সে ঢুকেছিলেন। এখানে বসে তাদের সাথে কথা বলেছেন”?
 

রতীশ জবাব দিল, “হ্যা, আমি সত্যি বলছি। আর কালই শুধু নয়। মাস দুয়েক আগেও একবার এখানে এসেছিলুম। তখন কমপ্লেক্সের ভেতরটা দেখে আমার মনে হয়েছিল যে এটা একটা যোগা সেন্টার বানাবার উপযুক্ত। তারপর থেকে আমার সে বন্ধুর মাধ্যমেই তার সাথে যোগাযোগ হয়েছে আমার। কাল আমার বন্ধুর সাথে এসে সে নিজে চাবি দিয়ে এ ঘরের তালা খুলেছিল। এখানে বসেই আমরা প্রায় আধঘন্টা ধরে কথা বলেছি। অবশ্য এ ঘরে তখন এই টেবিল, জলের জগ গ্লাস এসব কিছু দেখিনি। শুধু চারখানা চেয়ারই ছিল। তবে এ চেয়ারগুলো নয়। কাল যে চেয়ারগুলোতে আমরা বসেছিলাম তার সবকটাই হাতল ছাড়া ছিল”।
 

ভদ্রলোক চুড়ান্ত অবাক হয়ে বলল, “এটা কী করে সম্ভব হয় বলুন তো? এ দরজার চাবি তো একমাত্র আমার কাছেই থাকে। হ্যা গত পরশু দিন আমি তিন চারটে লেবার লাগিয়ে রুম গুলো পরিস্কার করিয়ে ছিলাম। আমার অফিসের একটা ছেলেকে চাবি দিয়ে পাঠিয়েছিলাম তখন। কিন্তু কাল তো আমি কাউকে চাবি দিই নি। তাহলে এ’ঘরটা কে কীভাবে খুলে দিল আপনাকে? সেটা শুনে তো আমিই অবাক হয়ে যাচ্ছি”।
 

রতীশ অসহায় ভাবে বলে উঠল, “হে ভগবান, এ তুমি আমায় কোন বিপদের মুখে ফেললে”?

ভদ্রলোক রতীশের কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “কেউ যে মিথ্যে কথা বলে, মিথ্যে পরিচয় দিয়ে আপনার কাছ থেকে দু’লাখ টাকা লুঠ করে নিয়ে গেছে, সেটা তো আশাকরি এতক্ষণে আপনি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু আপনি আমাকে বলুন তো, আপনার বাড়ি কোথায়? আর কী নাম আপনার”?
 

রতীশ বিদ্ধস্ত গলায় জবাব দিল, “আমার নাম রতীশ ভট্টাচার্যি। আমি রাজগঞ্জ থেকে এসেছি। আমি একজন যোগা টিচার। কলকাতায় একটা যোগা সেন্টার খুলব বলেই কলকাতা এসেছি। আজ এ বিল্ডিঙের পজেশানটা পেলে কাল থেকে সেন্টারটা খুলবার চেষ্টা করতাম। কিন্তু সব আশা সব স্বপ্নই আমার হারিয়ে গেল। বাবা কাকাদের কাছে থেকে আনা টাকা গুলোও খুইয়ে বসলাম। এখন আমি কি করব বলুন তো”?
 

বিমল বলল, “দেখুন রতীশবাবু, যা হবার তা তো হয়েই গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় লোকাল থানায় গিয়ে আপনার একটা ডাইরী করা উচিৎ। আপনার কথা শুনে তো বোঝাই যাচ্ছে যে আপনার সেই বন্ধু আর ওই ভুয়ো লোকটা প্ল্যান করেই এ’সব করেছে। যদিও দেরী হয়ে গেছে। এখন আর তাদেরকে ধরতে পেলেও আপনার টাকা যে আপনি ফেরত পাবেন, সে সম্ভাবনা খুবই কম। কিন্তু যেহেতু ক্রাইমটা হয়েছে, তাই পুলিশের কাছে রিপোর্ট করাটা দরকার। থানায় গিয়ে সবটা খুলে বলুন। তাদের নাম, ঠিকানা, ফোন নাম্বার যা কিছু আপনি জানতেন সে’সব কিছু পুলিশের কাছে বলুন। তাদের দেখতে কেমন, তাদের চেহারার বিবরণ সব পুলিশকে বলুন। কপাল ভাল থাকলে কিছু হলেও হতে পারে। আর থানায় গিয়ে আপনি আমার কথাও নিশ্চয়ই বলবেন। আমার নাম ভাড়িয়েই তো ব্যাপারটা ঘটানো হয়েছে। তাই পুলিশ তৎপর হলে হয়ত আমাকেও জেরা করবে। আর আমার সাথে দেখা হল বলেই না জোচ্চুরির ব্যাপারটা এখন আপনি বুঝতে পেলেন। তাই আমার নামটাও অবশ্যই বলবেন। আমার কার্ড আপনার কাছে রইলই। সেটা পুলিশকে দেখাতে পারেন। আর আপনিও যদি আমার কাছ থেকে আর কিছু জানতে চান। তাহলে আমাকে ফোন করতে পারেন বা আমার অফিসে এসেও দেখা করতে পারেন। তবে অফিসে আমাকে সন্ধ্যের পরেই শুধু পাবেন। সারাদিন তো আমি এদিকে ওদিকে ছোটাছুটি করতেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু আপনি কি এখন একা যেতে পারবেন? না মানে, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ধাক্কাটা খানিকটা সামলে নিয়েছেন”।
 

রতীশ বলল, “না না, আমি ঠিক আছি বিমলজী। আমি যেতে পারব। আচ্ছা আসছি আমি তাহলে” বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল।
 

কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথের একটা দোকান থেকে এক গ্লাস জল চেয়ে খেল। দোকানের লোকটা রতীশকে দেখে বলল, “দাদা আপনাকে কালও এখানে আসতে দেখেছি। আপনার সঙ্গে আরও দু’জনকে দেখেছিলাম। লোকগুলো কিন্তু ভাল নয় দাদা। ও’সব লোকের সাথে মেলামেশা করলে কিন্তু বিপদ হতে পারে। একটু সাবধান থাকবেন”।
 

রতীশ কিছুক্ষণ লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা ঝাঁকিয়ে “ধন্যবাদ ভাই” বলে সরে পড়ল।

রতীশ যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, তার এখন কী করণীয়। বড় রাস্তায় এসে ফুটপাথে একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে সে আবার মোবাইল থেকে রবিশঙ্করের নাম্বারে ফোন করল। এবারেও সুইচড অফ ফোন। তার কাছে এতক্ষনে ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেছে যে রবিশঙ্করই ওই ভুয়ো লোকটার সাথে মিলে আগে থেকেই তার টাকা লুটে নেবার প্ল্যান করেছিল। তাই এখন হাজার বার ফোন করেও তাকে আর পাওয়া যাবে না। মোবাইলটা পকেটে রাখবার পর তার হাতটা নিজের অজান্তেই যেন তার শার্টের বুক পকেটে উঠে এল। হঠাৎ তার মনে হল, একটা কাগজে রবিশঙ্করের বাড়ির ঠিকানা লেখা ছিল। সে কাগজটা তো পকেটেই থাকবার কথা। পকেটের ভেতরের জিনিসগুলো বের করে সে দেখতে দেখতে একটা ছোট কাগজে রবিশঙ্করের বাড়ির ঠিকানাটা দেখতে পেল।
 

(To be cont'd .......)
______________________________
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply
#40
(Update No. 62 dt. 29.7.2018)

রবিশঙ্করের বাড়ি সে আগে কখনও যায় নি। কাগজে লেখা ঠিকানায় যেতে হলে কোন রুটে কোন দিকে যেতে হবে তা তার জানা ছিল না। ফুটপাথের একটা ফলের দোকানে গিয়ে দোকানের লোকটাকে কাগজে লেখা ঠিকানাটা বলে সে রাস্তার হদিশ জেনে নিল। তারপর দোকানিটার কথা মত একটা বাসে উঠে পড়ল। বেলা দেড়টা নাগাদ সে বাসের কন্ডাক্টরের কথায় একটা জায়গায় নেমে পড়ল। বাস থেকে নেমে আরেকটা দোকানে ঠিকানাটা জিজ্ঞেস করতেই দোকানের লোকটা একদিকে হাতের ঈশারা করে বলল, “আপনি এখান থেকে ওই গলিটা দিয়ে এগিয়ে যান। কিছু দুর গেলে রাস্তার ডানপাশে একটা লন্ড্রী দেখতে পাবেন। সেখানে রাস্তার ঠিক উল্টোদিকে একটা মোটর পার্টসের দোকান আর একটা ওষুধের দোকান দেখতে পাবেন। সেখানে বাড়ির নম্বরটা বললেই তারা দেখিয়ে দেবে আপনাকে”।

রতীশ লোকটার নির্দেশ মত আট ন’ মিনিট হাঁটবার পর রাস্তার বাঁদিকে মোটর পার্টসের আর ওষুধের দোকান দুটো দেখতে পেল। কিন্তু উল্টোদিকে অন্যান্য অনেক গুলো ছোট খাটো দোকান থাকলেও কোন লন্ড্রী সে দেখতে পেল না। অবশ্য দু’তিনটে বন্ধ দোকান ঘর দেখা গেল। রতীশ পায়ে পায়ে ওষুধের দোকানটায় গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই দোকানের লোকটা রতীশের মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উল্টোদিকের একটা বাড়ির দিকে ঈশারা করে বলল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ ওই বাড়িটাতেই থাকত। কিন্তু তারা বোধ হয় এখন আর নেই এখানে”।
 

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “নেই মানে? তারা কি বাইরে কোথাও চলে গেছে”?
 

দোকানের লোকটা জবাব দিল, “কোথায় গেছে সে’সব কথা জানিনে দাদা। কিন্তু কাল দুপুর দুটো নাগাদ তাকে বৌ বাচ্চা নিয়ে সঙ্গে বেশ কিছু মালপত্র নিয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে দেখেছি। এর বেশী কিছু আমি আর বলতে পারছি না”।
 

রতীশ বোবা চোখে বাড়িটার দিকে দেখতে লাগল। ছোট্ট একতলা বাড়িটার দরজা জানালা একটাও খোলা নেই। সামনে একটা তালাও ঝুলছে। রতীশ মনে মনে ভাবল, রবিশঙ্কর তার কাছ থেকে টাকা গুলো লুটে নিয়েই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে গেছে। সুতরাং তার দেখা পাবার সম্ভাবনা আর নেই। রতীশের মনে হচ্ছিল তার শরীরে বুঝি আর শক্তি নেই। পা দুটো যেন আর এগোতে চাইছে না। ক্লান্ত অবসন্ন মনে শরীরের বোঝা টানতে টানতে সে আবার বাস স্টপের দিকে এগিয়ে গেল। সে এখন কোথায় যাবে তা বুঝে উঠতে পারছিল না। কিন্তু ফ্ল্যাটে তো তাকে ফিরতেই হবে। রচনা না জানি মনে মনে কত কিছু ভেবে বসে আছে। সবার আগে সে অফিস ঘরে ঠাকুরের আসন বসাবে। তার আগে কোন জিনিস কিনে সেখানে নিয়ে যেতে মানা করেছিল। সে নিশ্চয়ই সব কিছু যোগার যন্ত্র করে তৈরী হয়ে আছে, বিকেলে তার সাথে তাদের কমপ্লেক্সে আসবে বলে। এখন বাড়ি ফিরে গিয়ে সে রচনাকে কী বলবে? রবিশঙ্করের মিষ্টি কথায় ভুলে কাল সে বোকার মত দু’লাখ টাকা খুইয়ে বসেছে। এ’কথা রচনাকে সে কোন মুখে বলবে। নিজের মুর্খামীর কথা ভেবে তার নিজেরই লজ্জা লাগছে সে কথা ভাবতে।

রুটের বাস আসতেই সে বাসে উঠে পড়ল। বাড়ির সামনের স্টপেজে এসে নেমেও তার পা দুটো যেন আর বাড়ির দিকে এগোতে চাইছিল না। বাস স্টপের একটা শেডের ভেতরে গিয়ে দাঁড়াল সে। এমন সময় তার পকেটের ভেতরের মোবাইলটা বেজে উঠল। সে জানে বাড়ি থেকে কেউ কিংবা রচনা ফোন করে থাকবে হয়ত। কিন্তু ইচ্ছে করেই কলটা আর রিসিভ করল না সে। বসে বসে ভাবতে লাগল, সে ঘরে ফিরে রচনার মুখোমুখি দাঁড়াবে কী করে। একটু বাদেই ফোনটা আবার বেজে উঠল। এবার আর থাকতে না পেরে সে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রচনার ফোন। ইশ স্বামী এখনও ঘরে ফিরে আসেনি বলে বেচারী মেয়েটা হয়ত কত দুশ্চিন্তা করছে। কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগাতেই রচনার গলা শুনতে পেল, “কী গো, কী হয়েছে তোমার? খেতে আসবে না নাকি? আমি কখন থেকে তোমার অপেক্ষায় বসে আছি। কাজ শেষ হয়নি এখনও না কি”?
 

রতীশ ঘড়ঘড়ে গলায় কোনরকমে বলল, “এই তো রাস্তাতেই আছি, ফিরছি। কিন্তু আমাকে এখন খেয়েই আবার বেরিয়ে আসতে হবে। কাজটা শেষ হয়নি এখনও। ঠিক আছে আসছি”।
 

রতীশ যখন ফ্ল্যাটে ফিরে এল তখন বেলা প্রায় সাড়ে তিনটে। ঘরে ঢুকেই সে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে রচনার দিকে না তাকিয়েই বলল, “চটপট খাবার বেড়ে ফেল সোনা। আমাকে এখনই বেরোতে হবে আবার”।

রচনা রতীশের কথা বলার ভঙ্গী দেখে একটু অবাক হল। রতীশের মুখটাও খুব শুকনো দেখাচ্ছে। রান্নাঘরে গিয়ে থালায় খাবার সাজাতে সাজাতে ভাবল, এই চড়া রোদের মধ্যে এতোটা পথ বুঝি হেঁটেই এসেছে তার স্বামী। তাই হয়ত এমন লাগছে। কিন্তু বিয়ের তিন বছরের মধ্যে এমনটা কখনও হয়নি যে রতীশ ঘরে এসে তার মুখের দিকে না তাকিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেছে। মনে মনে ভাবল কাজটা শেষ হয়নি বলেই বোধ হয় একটু টেনশনে আছে।

কিন্তু খাবার টেবিলে রতীশকে মাথা নিচু করে গোগ্রাসে খেতে দেখে সে আবার অবাক না হয়ে পারল না। রতীশ বরাবর ধীরে সুস্থে খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আজ সে এমন তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছে যেন একটু দেরী হলেই তার গাড়ি ছুটে যাবে। মনে মনে অবাক হলেও রচনা কিছু বলল না। কিন্তু সামান্য একটু খেয়েই রতীশ উঠে পড়ল। বেসিনে হাত ধুয়েই সে আবার বেরোতে বেরোতে বলল, “আমি আসছি সোনা। কাজ শেষ হলেই ফিরে আসব”।
 

রচনা তখনও তার এঁটো হাত ধুয়ে উঠতে পারেনি। সে ছুটে সামনের ঘরে এসে রতীশের পেছন থেকেই বলে উঠল, “শোনো, বাকি সব জিনিস আমি গুছিয়ে নিয়েছি। তুমি আসবার সময় সম্ভব হলে একটা ফুলের মালা কিনে নিয়ে এস। আর আমাকে কখন নিয়ে যাবে”?

রতীশ লিফটের দিকে এগোতে এগোতে বলল, “আমি ফিরে এসে তোমাকে নিয়ে যাব” বলেই লিফটের ভেতর ঢুকে পড়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। রচনার চোখের সামনে সে আর থাকতে পারছিল না।
 

বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনির্দিষ্ট ভাবে ফুটপাথ ধরে একদিকে হেঁটে চলল। মনের ভেতর তার হাজারটা প্রশ্ন। কিন্তু কোন প্রশ্নেরই কোন জবাব সে খুঁজে পাচ্ছিল না। উদ্দেশ্য বিহীন ভাবে এ’পথ ও’পথ ধরে হাঁটতে লাগল। পকেটের ফোনটা এর ভেতর অনেক বার বেজে উঠেছে। কিন্তু সে একটা কলও রিসিভ করে নি। সে জানত রচনা আর সীমন্তিনী বাদেও বাড়ি থেকে অনেকেই কমপ্লেক্সের লিজ নেবার কাজটা সম্পন্ন হয়েছে কিনা, সেটা জানতেই তাকে ফোন করছে। কিন্তু কাউকে তো কিচ্ছুটি বলবার নেই তার। নিজের বোকামির কথাটা বুক ফুলিয়ে সে কী করে বলবে সবাইকে?

এ রাস্তা সে রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে সে ভাবল, থানায় গিয়ে একটা ডাইরী করা বোধহয় তার উচিৎ। যদিও টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, তবু ব্যাপারটা থানায় জানিয়ে রাখা উচিৎ। তবে তার আগে মন্তির সাথে কি একটু কথা বলে নেবে? কিন্তু সব শুনে মন্তি তো তাকে ছিঃ ছিঃ করবে। মন্তি হয়ত তাকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। রবিশঙ্কর যে লোকটাকে বিমল আগরওয়ালা বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সে আসলে কে? ওই কমপ্লেক্সের চাবি সে পেল কোথায়? রবিশঙ্কর আর ওই লোকটার সাথে আসল বিমল আগরওয়ালার সম্পর্ক কী? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হবে, বার বার করে বলে দেওয়া সত্বেও রতীশ এগ্রিমেন্ট সই করবার আগেই তাকে টাকাগুলো দিয়ে দিল কেন?
 

এসব প্রশ্নের একটারও উত্তর তার জানা নেই। তার মনে হল, দুপুরে আসল বিমল আগরওয়ালার সাথে দেখা হবার পর সে এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিল যে অনেক কথাই সে জানতে চায়নি। তাকে এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা উচিৎ ছিল। পুলিশের কাছে গেলে পুলিশও তো তাকে এ’সব প্রশ্ন করবে। তার মনে হল বিমল আগরওয়ালার কাছ থেকে এসব তথ্য তার জেনে নেওয়া উচিৎ।
 

কথাটা মনে হতেই সে পকেটের ভেতর থেকে বিমল আগরওয়ালার ভিজিটিং কার্ডটা বের করল। সে বলেছিল সন্ধ্যের পরই তাকে অফিসে পাওয়া যাবে। এখন তো সন্ধ্যে হতেই চলল। তার অফিসের ঠিকানায় পৌঁছতে পৌঁছতে তো আরও চল্লিশ পঞ্চাশ মিনিট কেটে যাবে। তাই এখন রওনা হলেই ভাল হবে। এই ভেবে সে একটা সিটিবাসে উঠে পড়ল।
 

নির্দিষ্ট স্টপেজে বাস থেকে নেমে সে একটা দোকানের একজনকে জিজ্ঞেস করে একদিকে এগিয়ে চলল। মিনিট পাঁচেক বাদেই রাস্তার ডানদিকে একটা সাত তলা বিল্ডিঙের তিনতলায় আগরওয়ালা রিয়েল্টর্স লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখতে পেল। গ্রাউণ্ড ফ্লোরের দোকানটায় জিজ্ঞেস করে সে লিফটে চড়ে তিনতলায় উঠে এল। করিডোর ধরে একটু এগিয়ে যেতেই অফিসটা চোখে পড়ল। ভেতরে ঢুকে রিসেপশনে বসা একজন সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেয়ে তার কাছে গিয়ে বিমল আগরওয়ালার নাম বলতেই সে একদিকে একটা রুমের দিকে ঈশারা করে দেখিয়ে দিল। রতীশ সে ঘরটার দরজার সামনে যেতেই ভেতর থেকে বিমল আগরওয়ালার গলার স্বর ভেসে এল, “আরে রতীশবাবু যে! আসুন আসুন”।
 

রতীশ ঘরে ঢুকে দেখল মাঝারি সাইজের একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ও’পাশে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে বিমল একটা ফাইল খুলে দেখছে। রতীশ ভেতরে ঢুকতেই বিমল তাকে চেয়ারে বসতে বলে বলল, “হ্যা বলুন দেখি। থানায় গিয়েছিলেন? ডাইরীটা করেছেন”?
 

রতীশ চেয়ারে বসে পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের চোখ মুখ মুছতে মুছতে জবাব দিল, “না বিমলজী। তখন থেকেই মনের ভেতরটা এতটাই অস্থির হয়ে আছে যে কোন কিছুই ঠিক মত ভেবে উঠতে পারছি না। আর আমার নিজের মনেই কয়েকটা প্রশ্ন ঘোরাফেরা করছে। কিন্তু সে’সব প্রশ্নের জবাব যারা দিতে পারে তারা দু’জনেই তো আমার সর্বস্ব লুট করে গা ঢাকা দিয়েছে। তাই ভাবলুম দু’ একটা কথা আপনার কাছ থেকেও জেনে নিতে পারলে একটু সুবিধে হবে। তাই আপনার কাছে এসেছি। আপনি কি খুব ব্যস্ত আছেন”?

বিমল তার হাতের ফাইলটা বন্ধ করতে করতে বলল, “কাজ তো সারা জীবন ধরেই থাকবে রতীশবাবু। কিন্তু এ’সময়ে আমি মোটামুটি ফ্রিই থাকি। আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন। তবে এক মিনিট দাঁড়ান। কি খাবেন বলুন তো? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে সারাদিন কিছুই খাননি। অবশ্য এ অবস্থায় খাবার মত মনের অবস্থাও যে আপনার নেই, সেটাও তো আন্দাজ করতেই পারছি। তবু চা কফি বা আর কিছু খেতে চাইলে বলুন। তারপর আপনার কথা শুনছি”।

রতীশ হাত তুলে বলল, “না না বিমলজী, কিছু লাগবে না। আমি শুধু....”

তাকে মাঝপথে বাঁধা দিয়ে বিমল বলল, “বেশ ঠিক আছে। তাহলে একটু কফিই খান শুধু” বলেই তার চেম্বার সংলগ্ন কাঁচে ঘেরা একটা কেবিনের দিকে চেয়ে ঈশারা করতেই এক সুন্দরী যুবতী বেরিয়ে আসতেই তাকে কফি আনবার আদেশ দিয়ে রতীশের দিকে চেয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বলল, “হ্যা এবার বলুন, কী জানতে চাইছেন আমার কাছে”।

রতীশ জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বিমলজী, আপনি কি রবিশঙ্কর প্রসাদ বলে কাউকে চেনেন? আসলে তার মাধ্যমেই ওই কমপ্লেক্সটা ভাড়া নেবার কথা হয়েছিল”।

বিমল মনে মনে ভাবতে ভাবতে জবাব দিল, “রবিশঙ্কর প্রসাদ? বিহারী লোক হবে নিশ্চয়ই। কিন্তু এ নামে কাউকে তো আমি জানি না। লোকটা থাকে কোথায়? কী কাজ করে”?

রতীশ বলল, “লোকটা আসলে একজন রিপ্রেজেন্টেটিভ। ফটোস্ট্যাট আর পিসিওর জিনিসপত্র সাপ্লাই করে। রাজগঞ্জে আমার কাকুর দোকানে সে অনেক বছর ধরে এসব জিনিস যোগান দিত”।

বিমল বলল, “দেখুন রতীশবাবু, আমার কাজ হচ্ছে বাড়ি ঘর বানানো। পুরোন বাড়ি ঘর বা জায়গা জমি কিনে সেখানে বড় বড় রেসিডেন্সিয়াল আর কমার্সিয়াল কমপ্লেক্স বানিয়ে বিক্রী করি। তাই ফটোস্ট্যাটের লাইনের কারুর সাথে আমার খুব বেশী জানা শোনা নেই। আমার নিজের অফিসে ফটোস্ট্যাট মেশিন দুটো আছে ঠিকই। কিন্তু এ কমপ্লেক্সেরই দু’তলায় একজন সাপ্লায়ার আছে। তাদের কাছ থেকেই নেওয়া। আর কখনো সখনো সার্ভিসিংএর প্রয়োজন হলে ওরাই এসে করে দিয়ে যায়। কিন্তু রবিশঙ্কর বলে কাউকে তো আমি চিনি না”।

এমন সময়ে রতীশের পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠল। রতীশ ফোন বের করে দেখে সীমন্তিনীর ফোন।
 

ইচ্ছে করেই কলটা রিজেক্ট করে দিয়ে সে আবার জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বিমলজী, আপনি তো বলেছেন যে ওই কমপ্লেক্সের চাবি আপনার কাছেই থাকে। তাহলে কাল এবং দু’মাস আগেও ওই লোকটা কী করে কমপ্লেক্সটার দরজায় লাগানো তালা খুলে আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারল”?

বিমল বলল, “আরে সে’কথাটা আমিও তো অনেকবার ভেবেছি। অফিসে এসে পরশু যে ছেলেটাকে আমি চাবি দিয়ে সেখানে সাফ সাফাই করতে বলেছিলাম, তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। সে অন্য কাউকে চাবিটা দিয়েছিল কি না। কিন্তু সে বলল সে কাউকে চাবি দেয়নি। আর সে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সব কাজ দেখাশুনো করেছে। কাজ শেষে সে নিজে হাতে দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি নিয়ে এসেছে। অফিসে এসে আমাকেও সন্ধ্যের সময় সে চাবিটা দিয়ে গেছে, আর আমিও রোজকার মত সেটা লকারে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু আপনার মুখে এসব কথা শুনে তো আমি ভেবেই পাচ্ছি না, এটা কী করে সম্ভব হয়? চাবিটা তো সব সময় আমার এ লকারটার ভেতরে রেখে থাকি আমি। আর এ লকার কেবল আমি ছাড়া আমার অফিসের আর কেউ খোলে না। আর এটার চাবিও সব সময় আমার সাথেই থাকে” বলে একদিকে রাখা একটা আলমারির দিকে ঈশারা করল।

এমন সময়ে মহিলা কফি নিয়ে এল। রতীশকে একটা কাপ দিয়ে বিমল অন্য কাপটা নিজের হাতে নেবার পর রতীশ জিজ্ঞেস করল, “সেটার কোন ডুপ্লিকেট চাবি......”

আবার পকেটের ভেতর মোবাইল বেজে উঠতেই রতীশ কথা থামিয়ে ফোন বের করে দেখে সীমন্তিনীর কল। রিজেক্ট করে জিজ্ঞেস করল, “ওই কমপ্লেক্সের তালার কোন ডুপ্লিকেট চাবি কি অন্য কারো কাছে আছে”?

বিমল জবাব দিল, “হ্যা রতীশবাবু। ডুপ্লিকেট চাবিও একটা আছে। কিন্তু সেটা তো সবার নাগালের বাইরে আমার ব্যাঙ্কের লকারে রাখা আছে”।

রতীশ এবার হতাশ গলায় বলল, “ওহ, তাহলে তো সেটা নিয়ে আর কোন কথাই ওঠানো উচিৎ নয়। কিন্তু ওই লোকটা কী করে তাহলে কমপ্লেক্সটা খুলল, সেটা তো কিছুতেই স্পষ্ট হচ্ছে না। ইশ, কী যে করি এখন আমি। আমার সব স্বপ্ন সব আশা এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে, এ তো আমি ভাবতেই পাচ্ছি না। রাজগঞ্জে কলেজের চাকরিতেও রিজাইন করে এসেছি। ফিরে গেলেও সে চাকরি আর আমি ফিরে পাব না। এখানে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। কোন কাজকর্ম ছাড়া কী করে থাকব এখানে? নতুন করে কোন একটা কমপ্লেক্স ভাড়া নেবার মত পয়সাও হাতে নেই। ফ্ল্যাটের ভাড়াও বা যোগাব কোত্থেকে”?
 

বিমল বলল, “রতীশবাবু, আপনার আজই থানায় গিয়ে ডাইরীটা করা খুব দরকারি ছিল। যত সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, আপনার টাকা ফিরে পাবার সম্ভাবনা কিন্তু ততই কমে যাচ্ছে। আপনি আর দেরী না করে কাল সকালেই লোকাল থানায় গিয়ে ব্যাপারটা জানান। আপনার যা কিছু জানা আছে, সেসব কথা পুলিশকে খুলে বলুন”।

রতীশ আনমনে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বলল, “সে না হয় করব বিমলজী। কিন্তু তারপর? তারপর আমি কী করব? পুলিশ কি আমার ডাইরি নেবার সাথে সাথেই আমার টাকাটাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পারবে? আমি খাব কী? সংসার চালাব কী দিয়ে? ফ্ল্যাটের ভাড়া কী করে যোগাবো”?
 

রতীশের পকেটের মোবাইলটা আবার বেজে উঠতে বিমল বলল, “বার বার কলটা কেটে দিয়ে ঠিক করছেন না রতীশবাবু। আপনি বরং কলটা রিসিভ করে বলে দিন যে আলোচনায় ব্যস্ত আছেন। আপনি পরে তাকে কল ব্যাক করবেন”।

রতীশ সীমন্তিনীর কলটা রিসিভ করে ফোনটা কানে লাগাতেই সীমন্তিনী ওদিকে থেকে কী বলে যাচ্ছিল, সেসব না শুনেই সে বলল, “মন্তি আমি কমপ্লেক্সের মালিকের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত আছি। তোকে একটু বাদে আমি ফোন করছি” বলেই ফোন কেটে দিল।
 

বিমল আগরওয়ালা কিছু সময় চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবল। তারপর বলল, “রতীশবাবু। আমার একটা কথা শুনুন। দক্ষিণ কোলকাতায় আমার এক বন্ধুর একটা যোগা সেন্টার আছে। তার ওখানে তিন চারজন টিচার থাকলেও তারা কেউই তেমন এক্সপার্ট নয়। তাই সে একজন ভাল যোগা টিচার খুঁজছে। আপনি যদি সেখানে যোগা টিচারের কাজ করতে রাজি থাকেন, তাহলে আমি তার সাথে কথা বলে দেখতে পারি। ভাল টিচার পেলে সে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার পর্যন্ত স্যালারি দিতে রাজি আছে। আপনি করতে চান সে কাজ”?

রতীশ জবাব দিল, “কিছু না কিছু তো আমাকে করতেই হবে বিমলজী। কিন্তু এখন এই মূহুর্তে আমার মনটা এতটাই অস্থির হয়ে আছে যে ভাল মত কিছু ভাবতেও পাচ্ছি না। তবে আমাকে না জেনে না চিনে আপনি যে আমার এতটা উপকার করতে চাইছেন সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ। কিন্তু আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাববার সুযোগ দিন”।
 

বিমল বলল, “হ্যা হ্যা, আমি আপনার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছি রতীশবাবু। এমন অবস্থায় আর মাথার ঠিক থাকে বলুন। তবে ভিজিটিং কার্ডে আমার মোবাইল নাম্বার দেয়া আছে। আপনি আপনার সুবিধে মত যে কোন সময় আমাকে ফোন করতে পারেন”।

রতীশ বলল, “যাকে দশ বছর ধরে আমরা সবাই জানতুম চিনতুম সে লোকটাই এমন অবলীলায় আমার সর্বস্ব লুট করে পালিয়ে গেল। আর আমাকে না জেনে না চিনেই আমার জন্য এতটা ভাবছেন বিমলজী”।

বিমল জবাব দিল, “দেখুন রতীশবাবু, মানুষ যেমন মানুষের শত্রু, তেমনি মানুষই মানুষের বন্ধুও হয়ে থাকে। আমরাও তো সারাদিন লোক চড়িয়ে খাই। তাই মানুষ চিনতেও পারি। আপনাকে দেখে আমার মনে হয়েছে, আপনি খুবই ভদ্র পরিবারের একজন সজ্জন মানুষ। আর তাছাড়া আপনার এই ঘটণাটার সাথে আমার নামটাও জড়িয়ে পড়েছে। তাই মনে হচ্ছে আপনার এমন বিপদের সময় আমি যদি একটু আপনার পাশে থাকতে পারি, তাহলে ক্ষতি কি? আর আপনাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারলে আমার তো কোন লোকশান হবে না। আমার বন্ধু আপনার মতই একজনকে খুঁজছে। তাই আমি শুধু তার কাছে আপনাকে নিয়ে যাব। আর তো কিছু আমাকে করতে হবে না। তারপর কি হবে সেটা আমার বন্ধু বুঝবে আর আপনি বুঝবেন। তবে আপনি যদি চান, তাহলে আমি আমার এই কনস্ট্রাকশন ফার্মেও আপনাকে কোনও একটা কাজ দিতে পারি। কিন্তু আমাদের সমস্ত কাজই হচ্ছে লেবার মিস্ত্রীদের নিয়ে। আপনার মত ভদ্রলোকের পক্ষে এ’সব কাজ করা হয়ত সম্ভব হবে না। তাই আমার বন্ধুর যোগা সেন্টারের কথাটা বললাম আপনাকে। আপনি তো ওই লাইনেরই লোক”।

রতীশ কফি শেষ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ঠিক আছে বিমলজী। আজ তাহলে আমি উঠছি। আর অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আমি দু’একটা দিন ভেবে দেখি। যদি কোথাও কাজে ঢুকতেই হয় তাহলে আপনাকে ফোন করে জানাব। চলি নমস্কার” বলে বিমলের অফিস থেকে বেরিয়ে এল।
 

*************
 
[+] 1 user Likes riank55's post
Like Reply




Users browsing this thread: 4 Guest(s)