Thread Rating:
  • 14 Vote(s) - 3.21 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
বিপ্লব পোদ্দার- ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার- complete
#41
চায়ের পয়সা দিয়ে সোজা হাঁটা লাগালাম ঘাটের দিকে। প্যান্টটা খুলে শুধু জাঙ্গিয়াটা পরে জলে নামলাম। হাতদুটো জড় করে একটা প্রতিজ্ঞা ‘ঈশ্বর আমায় শক্তি দাও, ওই অসুস্থ মেয়েটার জন্য আমায় সুস্থ রাখো। যেন জীবনে কোনোদিন রমাকে কষ্ট না দি’ ডুব দিয়ে পাড়ে উঠবো ঠিক এমনসময় অন্য আরেকজন, হয়ত এই মৃতব্যাক্তিরই কোন আত্মীয় স্নান করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, হাতে একটা রিষ্ট ওয়াচ। রিষ্ট ওয়াচের কথাটা মনে পড়তেই আমার মনে হোল কেসটা অনেকটাই সল্ভ হয়ে যাবে যদি আমি সেই চেনা রিষ্ট ওয়াচ ও সেটা কার হাতে দেখেছিলাম তা মনে করতে পারি। সেই রিষ্ট ওয়াচ, পিঠে একটা কালো দাগ এগুলো থেকে আমায় খুঁজে বার করতে হবে সেই লোকগুলোকে। জামা, প্যান্ট পড়ছিলাম। দুজন বুড়ো মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছিল। ওদেরই খোশ গল্প কানে আসতে লাগলো। ‘এই যে দুতলা বাড়ি, এতদিন ধরে মানুষ করার কষ্ট সব তো এই শর্মাই করেছে। আর আজ বুড়ো হয়ে যেতেই আমি নন্দ ঘোষ। শালা, ছেলেপুলেকে এতো কষ্ট করে মানুষ করাই উচিত হয়নি’ আমার কানে যেন একটা চকলেট ব্যোম ফাটল। ‘শর্মা’ এই শব্দটা শুনে যেন কতদিনের পুরনো একটা রহস্য আমি সমাধান করে ফেললাম। মনে পড়ে গেলো সেদিনের কথা। শর্মাজীর গাড়ি আমাকে ওভারটেক করে দাঁড়াল। নেমে এসে নিজের পা থেকে চপ্পলটা খুলে আমার দিকে এগিয়ে দিলো এবং মুখে সেই অদ্ভুত ন্যাকামো ‘লিন দাদা, লিন। এই লিন আমার চপ্পলটা লিয়ে আমারই গালে ঠাস ঠাস করে মারুন’। সেদিনই প্রথম ওই সোনার ঘড়িটা আমি ওর হাতে দেখেছিলাম। হয়ত তার কিছুদিন আগেই ও কিনেছিল।
শর্মার সাথে আমার প্রথম পরিচয় আমারই কেবিনে। মাস তিনেক আগে। ‘দাদা, একটা নতুন বিজনেস স্টার্ট করছি। আমাকে একটা লোণ পাইয়ে দেন, হামি আপনারটা দেখবো আপনি হামারটা দেখবেন। হি হি হি (সেই বিচ্ছিরি হাঁসিটা)’ সেটা প্রথম পরিচয় হলেও সাক্ষাত হয়েছিল তারও মাস দুয়েক আগে। যদিও আমি সেটাকে নেহাতই কাকতালীয় একটা ব্যাপার ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
সেটা ছিল মহাঅষ্টমীর রাত। আমি আর রমা সুরুচি সংঘের প্যান্ডেল দেখতে গিয়েছিলাম। ছেলেদের একটা আলাদা লাইন ও মেয়েদের একটা আলাদা লাইন ছিল। যথারীতি দুজনে আলাদা হয়ে পড়ি। প্যান্ডেলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আর কিছুতেই রমাকে খুঁজে পাইনি। পাগলের মত এদিক ওদিক খুঁজে অবশেষে বহুদুরে একটা দোকানের মধ্যে রমাকে দেখতে পাই। রমা দাঁড়িয়ে আছে, আর একটা লোক রমাকে কিসব বলে যাচ্ছে। আমি সামনে যেতেই সেই লোকটা পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায়। রমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘রমা লোকটা কি বলছিল?’ রমার উত্তর ছিল ‘আমাকে নাকি কোথায় দেখেছে, বারবার করে জিজ্ঞেস করছিল’ সেদিন ভেবেছিলাম পাতি মাগিবাজ মাল বোধ হয়। পরে সেই শর্মাজীই আমার কেবিনে আসে। প্রথমে ভেবেছিলাম মালটাকে ভাগিয়ে দেবো। কিন্তু সব তো আর আমার হাতে নেই। অবশেষে লোণের কেসটা আমায় নিতেই হোল। ঠিক এই কারনেই আমি শর্মাজীকে কখনো বাড়িতে নিয়ে আসিনি। আমার ভিজিটিং কার্ডটাতে ল্যান্ড ফোন ও মোবাইল দুটো নাম্বারই দেওয়া থাকে। কিন্তু কেন জানিনা ও অধিকাংশ সময়ই ল্যান্ড নাম্বারটায় ফোন করত।
মনে পড়ে গেলো আরও একটা ঘটনা। সেদিন অফিস থেকে বেরচ্ছি, এমন সময় হথাত শর্মাজীর সাথে দেখা। কথা প্রসঙ্গে ওর ছেলের কথা উঠল। অদ্ভুত একটা কথা বলেছিল। ‘আরে দাদা, পড়াশুনা শিখলে কি হয়! আমি তো এইট ফেল আছি। আপনি জানেন হামার প্রথম বিজনেস কি ছিল; রেলের লুহা চুরি। একবার পুলিশ তাড়া করল, একদম ব্রিজের ওপর থেকে ঝাঁপ মারলাম। পিঠে এমন লেগেছিল যে এখনো দাগ রয়েছে। কিন্তু সেই শর্মা আজ কত তারকি করেছে লাইফে দেখে লিন’ অঙ্কের প্রতিটা হিসেব অদ্ভুতরকম ভাবেই মিলে যেতে শুরু করল। জানি এবার সম্পূর্ণ কেসটাই আমি বুঝে ফেলেছি। মনে পড়ে গেলো বিজয়দার কথা। ‘যেকোনো কেসে পুলিশ হোক বা ডিটেকটিভ, প্রথম লক্ষ্য হওয়া উচিত, শক্তিশালী একটা চার্জশিট। যাতে কিছুতেই আইনের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে অপরাধীরা পালাতে না পারে’ শুধু সন্দেহ আর কিছু সামান্য তথ্যপ্রমান দিয়ে কখনোই শর্মার মত পয়সাওয়ালাদের জেলে পোড়া যায়না। আমার সবকিছু বিজয়দাকে জানানো উচিত। মোবাইলটা বার করে দেখলাম ভোর ৫ টা। নাহ, এতো ভোরে আর ওকে ফোন করতে মন গেলনা।
স্কুটারটা চালিয়ে আবার ফ্ল্যাটের দিকে যেতে শুরু করলাম। রমা যদি ঘুম থেকে না ওঠে এর মধ্যে তাহলে দরজাটা খোলাই থেকে যাবে। সত্যি খুব খারাপ লাগছিল, যতই হোক রমা সুস্থ নয়। মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়েছি হথাত ফোনটা বেজে উঠল। এতো সকালে কে ফোন করবে? ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি, বিজয়দার ফোন। রিসিভ করার সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো একটা উদ্বিগ্ন গলা।
‘দেখুন বিপ্লব বাবু কাল যদি আপনি ওরকম ভয় না পেয়ে সঠিক তথ্য প্রমান জোগাড় করে আনতেন! আজ হয়ত এতো প্রবলেমের মধ্যে পড়তে হতনা’ সত্যি বিজয়দাকে অবিশ্বাস করে বিশাল একটা ভুল কাজ করেছিলাম। আমি চাইলেই ওখান থেকে অনেক কিছু তথ্য জোগাড় করে আনতে পারতাম। কিছুটা সহানুভুতির সুরেই বললাম ‘কেন কি হয়েছে বিজয়দা?’ সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো বিজয়দার উত্তর। ‘কাল এই রাত ২ টো নাগাদ আবার একটা খুন হয়েছে। মৃতদেহ আবার দ্বিতীয় হুগলী সেতুর পাশেই পাওয়া গেছে। কিন্তু সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হোল এবার খুনের স্টাইলটা একদম আলাদা। বিষ প্রয়োগ হয়নি, যদিও এখনো ময়নাতদন্ত হয়নি তবে আমি চেক করে দেখেছি, আগের মৃতদেহগুলোর মত নয়। কেসটা আরও জটিল হয়ে গেলো বিপ্লব বাবু কারন খুন হয়েছে...’ দেখলাম বিজয়দা কিছুটা থমকে গেলেন। আমি আর ধৈর্য রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘কে খুন হয়েছে বিজয়দা?’
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#42
16

বিজয়দার কথা শুনে আমার হ্রিদস্পন্দন প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেলো। এটা কি করে হয়! আমি তো ওর গলা শুনে চিনে ফেলেছিলাম যে ওই শান। এমনকি মেকআপ লোশন দিয়ে প্রলেপ লাগানোর পরও আমি ওর হাতের কালো দাগটা চিনতে পেরেছিলাম। এটা কি করে হয়। আমাকে নির্বাক থাকতে দেখে বিজয়দাই বললেন ‘নিজেকে শান্ত করুন, বিপ্লববাবু, সত্যিই রঞ্জন খুন হয়েছে। আপনার মত আমারও সন্দেহের তালিকায় এক নম্বরে ওই ছিল। ওই যে শান তার বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রমান আমার হাতে ছিল, কিন্তু তা ওকে গ্রেফতার করার জন্য যথেষ্ট ছিলনা’ নিজেকে কোনরকমে শান্ত করলাম। এতদিন ধরে ধীরে ধীরে আমি রহস্যের জালটা গুটিয়ে এনেছিলাম রঞ্জন তথা শানের মৃত্যুতে রহস্যের জালটা আরও বুনিয়াদ হয়ে গেলো। কিছুটা আক্ষেপের স্বরেই বললাম ‘বিজয়দা, সব আমার দোষ। আমার সেদিন ওরকম আবেগপ্রবণ হয়ে ওখান থেকে চলে আসা উচিত হয়নি। আমি ওখানে থাকলে আরও কিছু তথ্য জোগাড় করতে পারতাম’ বিজয়দা কিছুটা গম্ভীর হয়ে বললেন ‘কি বলেছিলাম বিপ্লব বাবু, নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। আপনার থেকে ওদের মস্তিষ্ক অনেক বেশী উর্বর। আপনাকে এই রহস্যটা আবার প্রথম থেকে ভাবতে হবে’। বিজয়দা ফোনটা কেটে দিলো।
একটা অদ্ভুত জিনিষ আমি লক্ষ্য করলাম। রঞ্জনই যে শান এবং আমি তাকে চিনতে পেরেছি এই কথা আমি বিজয়দাকে একবারের জন্যও বলিনি। বিজয়দা বারবার দাবী করে এসেছেন যে উনি জুলি কে চিনতে পেরেছেন। কিন্তু একবারও দাবী করেন নি যে উনি শানকেও চিনতে পেরেছেন। বরঞ্চ শানকে চিনতে পাড়ার জন্যই আমাকে আর রমাকে মধুকর ভিলায় পাঠানো। আরও একটা অদ্ভুত জিনিষ, বিজয়দার কাছ থেকে ‘নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না, পুলিশ আপনার চেয়ে বেশী বুদ্ধিমান’ এই কথাটা আমি অন্তত ১০০ বার শুনেছি। কিন্তু আজ কথাটা একটু হলেও পরিবর্তিত। ‘কি বলেছিলাম বিপ্লব বাবু, নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। আপনার থেকে ওদের মস্তিষ্ক অনেক বেশী উর্বর। আপনাকে এই রহস্যটা আবার প্রথম থেকে ভাবতে হবে’- এর সাথে সাথে ফোনটা কাটার আগে এক অদ্ভুত সন্তোষজনক হাঁসি। কিসের সন্তোষ? আমার মত পুলিশেরও তো সমস্ত ভাবনা চিন্তায় জল মিশে গেছে। তাহলে কেন হতাশার স্থলে এই সন্তোষ। আমি যে রঞ্জনকে চিনতে পেরেছি তা কোনমতেই বিজয়দার জানা সম্ভব নয় যদি না রঞ্জন নিজে বিজয়দাকে...
আবার কেমন সমীকরনগুলো মিলে যেতে শুরু করল। এই চক্রটাকে আজ ১০ বছর ধরে আমি খুঁজে চলেছি। কখনো ব্যাঙ্কের নেটওয়ার্কে, কখনো ফেসবুকে অথবা কখনো ব্যাক্তিগতভাবে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই বুঝেছি, মুখ্য অপারেটর শান। কিন্তু এই প্রমান আমি কখনো পাইনি যে শানই এই চক্রটার মাথায় রয়েছে। আজকে অন্তত আমি নিশ্চিত যে শান এর মাথায় নয়, এর মাথায় অন্য কেউ। যে শানকে সরিয়ে দিয়ে বিশাল একটা মিসিং লিঙ্ক তৈরি করে দিলো। সন্দেহের তালিকায় মোট দুজন। কিন্তু নিশ্চিতভাবে কিছুই বলা সম্ভব নয়। স্কুটারটা নিয়ে যে কতক্ষন দাঁড়িয়ে রয়েছি সেদিকে কোন খেয়াল নেই। হথাত হুঁশ ফিরল, বাড়িতে রমা একা রয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব আমায় ওখানে পৌঁছে যেতে হবে।
প্রচণ্ড বেগে স্কুটারটা চালিয়ে চলেছি আর মাথার মধ্যে দুটো নাম বারবার করে কিলবিল করে উঠছে। বিজয় সামন্ত ওরফে বিজয়দা এবং শর্মাজী। বিজয়দা সবচেয়ে বেশী রহস্যময়। আমার বাড়িতে এলেন, কিন্তু কখন এলেন তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা। মদ্যপান করলেন, প্রচণ্ড মাতলামি করলেন। এই রহস্যটা নিয়ে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট ঠিক কি ভাবছে তা আমার সামনে গড়গড় করে সব বলে দিলেন। এতদিনের অভিজ্ঞ একজন পুলিশ অফিসার কি এতটাও ভুল করতে পারেন! যতই হোক পুলিশের সন্দেহে প্রত্যেকেই থাকে। আর শর্মাজী সেই দুর্গা পুজার দিন থেকে আজ অবধি লোকটা সত্যিই প্রচণ্ড রহস্যময়। রঞ্জনের ক্ষতি করার জন্য আমাকে একটা প্রপসাল দেওয়া। ও কেন রঞ্জনের ক্ষতি করতে চায় তা আমি কখনো ভাবিওনি আর জিজ্ঞেস ও করিনি। তাহলে কি রঞ্জনকে সরিয়ে দেওয়াটা অনেকদিন আগে থেকেই প্ল্যান করা ছিল। সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে শুরু করল। এইসব ভাবতে ভাবতেই আমি ফ্ল্যাটের সামনে এসে পৌছালাম।
ভেতরে ঢুকে আগে টেবিলের কাছে খেয়াল করলাম। না, শান্তনু আসেনি। ওকে যদি পুলিশ জেরা করত তাহলেও অনেক তথ্য বাইরে আসত। কিন্তু ওকি আদৌ আর এই ফ্ল্যাটে ফিরবে! আমার তো মনে হয় শুধু আমার আর রমার ওপর নজরদারির জন্যই ওকে এখানে আনা হয়েছিল। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। না, রমা সত্যিই ঘুম থেকে ওঠেনি। দরজাটাও তাই খোলাই ছিল। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে আবার ফোন। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি বিজয়দা করেছে। রিসিভ করলাম।
‘বিপ্লব বাবু, মৃতদেহ সনাক্ত করতে হবে। আর মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি আপনার বাড়িতে আসছি। আপনি আর মিসেস পোদ্দার আমার সাথে যাবেন’ আমি আর কি উত্তর দিতাম। ‘হুম’ বলে একটা শব্দ করলাম। বিজয়দাও ফোনটা কেটে দিলেন। রমাকে যত দ্রুত সম্ভব উঠিয়ে দিতে হবে। ভেতরের ঘরে গিয়ে ৩-৪ বার রমা রমা বলে ডাকতেই ওর ঘুম ভেঙে গেলো। রমার ঘুম বরাবরই খুব পাতলা। আমি ওর পাশে বসে পিঠে কিছুটা সহানুভুতির ছোঁয়া দিয়ে বললাম ‘রমা, খুব খারাপ একটা খবর আছে’। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, তার ওপর ওর কাঁচা ঘুমটা আমি ভাঙিয়ে দিলাম, তাই ওর চোখদুটো টকটকে লাল হয়ে রয়েছে। বেশ কিছুটা চমকে গিয়ে আমার দুহাত ধরে রমা বলল ‘কি হয়েছে বিপ্লব’ কিছুটা নম্রভাবে বললাম ‘রমা, রঞ্জনদা খুন হয়েছে’ রমা ডুকরে উঠল। ওকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে ক্রমাগত স্বান্তনা দিয়ে চললাম। রমার মুখ দিয়ে খালি একটাই অস্পষ্ট কথা বাইরে বেরচ্ছিল ‘আমার দিদিটার কি হবে?’ এই এতো বছর ধরে দিদি বোনের মধ্যে কি যে সম্পর্ক রয়েছে আমার জানা নেই। মিতা শেষ আমাদের বাড়িতে এসেছিল প্রায় ৩ বছর আগে। আমাকে বিয়ে করা থেকে শুরু করে প্রতিটা ক্ষেত্রেই মিতা নিজের বোনকে খালি খোঁটাই দিয়েছে। অথচ রঞ্জন মারা যাওয়ার পর রমার রঞ্জনের চেয়ে নিজের দিদির ভবিষ্যৎ নিয়েই বেশী দুশ্চিন্তা। ভাবলেও কেমন অবাক লাগে।
রমার পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে আমি বললাম ‘রমা, তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। বিজয়দা আসবেন। ওনার সাথে আমাদের যেতে হবে। ডেড বডি সনাক্ত করতে হবে’ আমার কথা শুনে রমা কিছুটা হলেও নিজেকে শান্ত করে বাথরুমের দিকে যেতে উদ্যত হয়। আমি বিছানায় বসেই ভাবতে শুরু করি। যেদিন প্রথমবার শর্মাজী আমার কাছে এসেছিলেন আমি খুব একটা বিস্মিত হইনি। ব্যাক্তিগত জীবনে উনি ভালো না মন্দ তা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথাই ছিলনা। আমার কাছে লোণের জন্য এইধরনের ধরিবাজ মানুষই আসেন সাধারনত। আর তাদেরকেই টুপি পড়ানো এবং লোণের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া, এই হোল আমার ছোট্টখাট্টো প্রফেশন। বিশাল অঙ্কের একটা লোণ পাইয়ে দেওয়ার দাবী জানান শর্মাজী। এতে কোন অবাক হওয়ার মত ব্যাপার ছিলনা। অবাক করার ব্যাপারটা হয়েছিল তার প্রায় ১ মাস পর। একদিন শর্মাজীর ফোন আসে আমার কাছে। আমার তো তখন মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়, কারন বহু চেষ্টা করেও আমি কিছুতেই শর্মাজীর লোণটা জোগাড় করতে পারিনি।
Like Reply
#43
কিছুটা ভয়েই আমি ফোনটা রিসিভ করলাম ও ওপাশ থেকে কোন কথা ভেসে আসার আগেই উত্তর দিলাম ‘শর্মাজী, সত্যি বলতে আমি এখনো লোণের টাকাটা জোগাড় করতে পারিনি। আমার কিছুদিন সময় লাগবে’ একটা বিকট অট্টহাস্য ও ওপাশ থেকে ভেসে এলো রহস্যময় এক প্রস্তাব। ‘আরে ধুর বোকা, কে আপনাকে লোণের জন্য তাগাদা করছে। আপনার ওপর আমার ফুল বিসবাস আছে। হামি ফোন করেছি দুসরা একটা প্ল্যান লিয়ে। এতো মুনাফা দেবো যে আপনি জিন্দেগী ভর হামায় ইয়াদ রাখবেন’ আমি তো প্রায় থ হয়ে গেছিলাম। কি এমন প্রস্তাব! শর্মাজীর পরের প্রস্তাবটা সত্যিই আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলনা। ‘রঞ্জন, আপনার সম্বন্ধী আছে?’ ওর মুখে রঞ্জনের নাম শুনে আমি সত্যিই কিছুটা চমকে উঠেছিলাম। ‘ওই শালা হারামজাদাটা আমার এক নাম্বারেরর কম্পিটিটর আছে। ও শালা আমার চেয়েও বড় জালী’ রঞ্জনের ওপর রাগ তো আমার বরাবরই ছিল। রঞ্জনের দুনাম্বারি ব্যাবসাটা ঠিক কিসের ওপর তা সত্যিই আমি জানতাম না। শর্মাজীই ছিল একমাত্র উৎস যার থেকে আমি সব জানতে পারি। আমিও শর্মাকে টোপটা দিলাম। কিছুটা শর্মার সাথে গলা মিলিয়ে বললাম ‘আরে বলবেন না, এক নাম্বারের নচ্ছার লোক। আমাকে তো মানুষ বলেই মনে করেনা। ওর কোন সর্বনাশ করতে পারলে আমি নিজেকে ধন্য মনে করব’ সঙ্গে সঙ্গে শর্মার উৎফুল্ল হয়ে ওঠা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ‘আরে হারামিটা বেনামে ব্যাঙ্ক আকাউন্ত খুলেছে। ওর বেশির ভাগ ক্যাশ ওই আকাউন্তেই থাকে। একসাথে গরমেনট, পুলিশ সবাইকে চুনা লাগাচ্ছে। ওর কাছে কোটি কোটি টাকার ব্ল্যাক মানি রয়েছে’ আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের ব্যাঙ্কে যে কিছু ফেক আকাউন্ত আছে টা আমার জানা। কিন্তু সেগুলো সবই ভিভিআইপিদের। রঞ্জনও যে ফেক আকাউন্তে টাকা রাখে তা সত্যিই আমার জানা ছিলনা। আসলে এইসব ফেক আকাউন্তের ব্যাপারে সামান্য কিছু তথ্য আমার কাছে থাকলেও সেভাবে আমি বিশদে জানতাম না। কারন এগুলো সবই অফিসিয়াল লেভেলের ব্যাপার সাপার। আমি তো সামান্য লোণ সেক্সানের কর্মচারী।
শর্মাজীর পরের কথাটায় আমার বিচি মাথায় উঠে গেছিল। ‘কি করতে হবে তা বাদ মে বলছি। লেকিন আগে কমিশনটা জেনে লিন। পুরা ৫০ লাখের কমিশন’ শালা বাপের জন্মে কখনো ৫০ লাখ কামাতে পারবো বলে ভাবিনি। কিন্তু এটাও জানতাম যে কাজটার মধ্যেও ৫০ লাখের রিস্ক আছে। সেই কারনে নিজেকে সংবরন করে উত্তর দিয়েছিলাম ‘টাকাটা বড় কথা নয় শর্মাজী। আগে কাজটা শুনি। আর এটা বোঝেন তো যে রঞ্জন আমার রিলেটিভ’ একটা অট্টহাস্য আর তার সাথে সাথেই শর্মাজীর গলাটা ভেসে আসে। ‘আরে, দাদা, রিস্ক হি লিলেন না তো লাইফে কি লিবেন! শোনেন আপনাকে হামি চোরি ভি করতে বলছিনা আর ডাকা ভি ডালতে বলছিনা। আপনার কাজটা খুব সিম্পিল আছে। আপনি খোঁজ লিন, কোন নামে রঞ্জনের ফেক আকাউন্ত আছে। আর সেটা গরমেনট কে ফাঁস করে দিন। ব্যাস, কাম খতম’ শর্মাজীর কাছে ব্যাপারটা ঠিক যত সরল ছিল আমার কাছে ততটাই কঠিন। কারন ফাঁস করতে আমার কয়েকটা মাস সময় লাগবে। কিন্তু এতে আমার ব্যাঙ্কিং ক্যারিয়ার একদম শেষ হবে। যে কাজটা এতদিন ধরে দুবেলা ভাত জুগিয়ে গেছে তার সাথে বেইমানি করার কথা ভাবতেও পারিনি। প্রথম শোনার পর থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম কখনোই শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপসালটা একসেপ্ট করবোনা। তা রঞ্জনের ওপর আমার যতই রাগ থাকুক না কেন। ‘দাদা, একটু শুধু মেহনত করতে হবে। কারন ওর ফেক আকাউন্তটা কলকাতা নয়, মুম্বাইএর ব্রাঞ্চে রয়েছে। এবার আপনার দায়িত্ব এটা যে আপনি কি করে মুম্বাই এর ব্রাঞ্চ থেকে ওর আকাউন্তটার হদিশ জানবেন’ সেদিন আমি শুধু একটাই কথা বলেছিলাম ‘ভেবে দেখছি’। মন থেকে কোনোদিনই এই কাজটা গ্রহন করতে পারিনি তাই একসেপ্ট ও করিনি। আমি বেচু হই আর চাপরাশি কখনো নিজের প্রফেশনের সাথে বেইমানি করতে পারবোনা।
রমা এখনো বাথরুমে। আমি শুধু ভেবে চলেছিলাম; শর্মাজীর এই দ্বিতীয় প্রপসালটার সাথে রঞ্জনের খুন হওয়ার বেশ ভালোই যোগ রয়েছে। এমনসময় হথাত কলিং বেলটা বেজে উঠল। জানি বিজয়দাই এসেছে। দরজা খুলতে যাচ্ছি এমনসময় হথাত ই মনে পড়ল যে রমা বাড়িতে থাকা অবস্থায় এর আগে কখনোই বিজয়দা আসেনি। বিজয়দা রমাকে মাত্র একবারই দেখেছে; রমাকে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর থেকে উদ্ধার করার সময়। যেকোনো মানুষ সে যত চালাকই হোক না কেন, শরীরের ভাষায় অনেক কিছু প্রকাশ পায়। না কথাটা আমার নয় আমার গুরু প্রদোষ মিত্তিরের। অর্থাৎ এই মুহূর্তে আমার একটাই লক্ষ্য, বিজয়দাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা ও ওনার সাথে কিছুই না বোঝার অভিনয় করে যাওয়া।
আমি দরজাটা খুলে দিলাম। হ্যাঁ, বাইরে বিজয়দাই কিছুটা গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে আসতে বলব তার আগেই উনি নিজের থেকে ভেতরে প্রবেশ করে গেলেন। দরজাটা লক করব এমন সময়েই উনি বলে উঠলেন ‘বিপ্লব বাবু সমস্ত রহস্যটা আরও জটিল হয়ে গেলো’ আমি দরজাটা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিলাম ‘হুম, ঠিকই বলেছেন। সেদিন যদি আমি এতটা ভুল না করতাম!’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘ছাড়ুন, ওই কথা যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সামান্য ক্লু আমি পেয়েছি। এবং তা আপনাকে না জানিয়ে সত্যিই পারলাম না’ আমিও কিছুটা উদ্বেগের ভান করে বললাম ‘কি ক্লু বিজয়দা?’
‘বিপ্লব বাবু, এতদিন ধরে আমরা ভাবছিলাম রবির খুনটা একটু তাড়াহুড়ো করে হয়ে গেছিল। কিন্তু মনীন্দ্র বাবুর খুনটা ছিল একদম প্রিপ্ল্যানড। ওই সিরিয়াল কিলিং এ ঠিক যেরকম হয়, সেরকম’। বিজয়দার কথা শুনে আমিও মাথা নাড়লাম কারন সত্যিই আমারও মত তাই। মনীন্দ্র বাবুকে প্রথমে স্লো পয়সন ও তারপর ছাদ থেকে ফেলে খুন করা হয়েছিল। খুনের পদ্ধতি যথেষ্ট পরিকল্পনামাফিক। এইসব ভাবতে ভাবতেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘আজকের খুনের পর নতুন একটা লিঙ্ক মাথায় এসেছে। তা হোল দ্বিতীয় হুগলী সেতু’ আমি প্রায় চমকে গিয়ে বললাম ‘কি, খুনের সাথে দ্বিতীয় হুগলী সেতুর সম্পর্ক?’ মনে মনে ভাবলাম ‘লোকটা কি সত্যিই ভাঁট বকছে নাকি সত্যিই কোন সম্পর্ক আছে’। আমার কথা শেষ হতে না হতেই বিজয়দা বললেন ‘রবির মৃতদেহ পাওয়া গেছিল দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ঠিক নীচে। আর রঞ্জনের মৃতদেহও পাওয়া গেলো দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে। আরেকটা অদ্ভুত জিনিষ জানেন; মনীন্দ্র বাবুর ময়না তদন্তের রিপোর্টে জানা গেছে যে ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার আগে ওনার সাথে খুনির যথেষ্ট ধ্বস্তাধস্তি হয়েছে’ আমিই ওনাকে চুপ করিয়ে বললাম ‘না, বিজয়দা, আপনার এই যুক্তিটা আমি কিছুতেই মানতে পারছিনা। দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ব্যাপারটা নেহাতই কাকতালীয়। কারন, আমি গতরাতে সত্যিই শানের দেখা পেয়েছিলাম। ওর মুখ দেখতে পাইনি কিন্তু কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছিলাম। চেষ্টা করেছিল গলাটা বিকৃত করে আমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে রঞ্জনই আসলে শান। এবার দেখুন, কোলাঘাট থেকে কলকাতা আসতে গেলে দ্বিতীয় হুগলী সেতু হয়েই আসতে হবে। দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই’ আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উনি বলে উঠলেন ‘কিন্তু দ্বিতীয় হুগলী সেতুই কেন? অন্য কোন জায়গা কেন নয়?’ সত্যিই আমার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর ছিলনা।
নিজেকে কিছুটা সংযত করে বিজয়দা বললেন ‘ভালো করে বুঝুন। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট, খুনের স্টাইল এসব থেকে একদম পরিস্কার যে মনীন্দ্র বাবুকে খুন করেছিলেন মোট দুজন আলাদা আলাদা সময়। প্রথম খুনী একজন নারী, যিনি মদের গ্ল্যাসে বিষ মিশিয়েছিলেন এবং দ্বিতীয় খুনি একজন পুরুষ যিনি মনীন্দ্র বাবুকে ওপর থেকে নীচে ফেলে দিয়েছিলেন’ শুধুই চুপ করে শুনে যাওয়া ছাড়া আমার কাছে দ্বিতীয় কোন উপায় ছিলনা। ‘শুধু তাই নয়, সেই নারী ও পুরুষ দুজনেই জানতেন না যে তারা প্রত্যেকেই খুনের মোটিভ নিয়ে এসেছেন। পরে উভয়েই জানতে পারেন। এবং তার পর থেকেই খুনের স্টাইলটা চেঞ্জ হয়ে যায়’ হুম, সত্যিই বিজয়দার লজিকে দম আছে। এই ব্যাপারটা আমার মাথায় আগে আসেনি। কিন্তু সবার আগে আমায় যা বুঝতে হবে তা হোল রঞ্জন ঠিক কিভাবে খুন হয়েছে? আমি বিজয়দাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আচ্ছা, বিজয়দা, রঞ্জনের খুনটা ঠিক কিভাবে হয়েছে?’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দার উত্তর ‘আরে মশাই এটাই তো সবচেয়ে জটিল ব্যাপার। এবারের খুনের সাথে আগের খুনগুলোর কোন মিল নেই। এর আগের প্রতিটা ম্রিতদেহে একটা কমন ব্যাপার ছিল। মৃত্যুর আগে মুখ দিয়ে গ্যাঁজা উঠেছে। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। অর্থাৎ বিষ প্রয়োগ হয়নি’ আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করেই বসলাম ‘তাহলে খুনটা কিভাবে হয়েছে?’
Like Reply
#44
‘অন্তত ৪ বার শরীরের বিভিন্ন স্থানের ওপর দিয়ে গাড়িটা চলে গেছে। মাথাটা প্রায় থেঁতলে গেছে। বিকৃত একটা শরীর। আশেপাশে কোন পার্সোনাল কার ও লক্ষ্য করিনি। অতএব কেউ একজন রঞ্জনকে গাড়ি চাপিয়ে দ্বিতীয় হুগলী সেতুতে নিয়ে এসেছে এবং ওখানেই গাড়ি থেকে নামিয়ে খুন করেছে’ বিজয়দার মুখ থেকে এই কথাটা শুনে আমার মাথাটা বোঁ বোঁ করে ঘুরতে শুরু করল। ‘বিপ্লব বাবু আমি নিশ্চিত যে এই খুনের পেছনে কাজ করছে এক চরম প্রতিশোধের স্পৃহা। এই দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ওপরই কোন না কোন ঘটনা ঘটেছিল। আর সেই কারনেই তার পাণ্ডাদেরকে এক এক করে এখানে এনে মেরে ফেলা হচ্ছে। খুনটা যেই করুক তাকে আমি ঠিক ধরবই। কারন আইনের চোখকে কেউ...’ বিজয়দা কথাটা শেষ করলেন না, কথাটা বলার সময় ওনার চোখে এক চরম আত্মবিশ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম অথচ সেই আত্মবিশ্বাসই হথাত এক চরম যৌন লালসার আগুনে পরিনত হোল। আমি একদৃষ্টিতে বিজয়দার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, কোন এক দুর্মূল্য বস্তুর লোভে ওনার চোখদুটো চকচক করে চলেছে। শ্বাস প্রশ্বাস, হ্রিদস্পন্দন সবই কেমন অস্বাভাবিকরকম হয়ে গেছে। আমি পেছন ঘুরে দেখি তো আমারও বিচি টোটালি আউট।
বাথরুমের দরজার কাছে শুধু একটা সাদা তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে রমা। যেন সম্মানটুকু ঢেকে দিতেই কোনোমতে দুহাত দিয়ে তোয়ালের মুখটা বুকের কাছে ধরে থাকা। রমার দুচোখ পাগলের মত বিজয়দাকে দেখে যাচ্ছে। যেন কিছু একটা মনে করতে চেষ্টা করছে ও। আমিও মাথাটা ঘুরিয়ে একবার বিজয়দার দিকে তাকালাম। বিজয়দার শরীরী ভাষা এখন আর শুধুই নিষিদ্ধ যৌনাচারকে প্রকাশ করছেনা তার সাথে কিছু একটা ভয়ও রয়েছে। বিজয়দাকে এর আগে আমি কখনো নার্ভাস হতে দেখিনি। আজ কেন জানিনা ওনার চোখে মুখে বিশাল একটা চিন্তার ছাপ, যেন উনি বুঝি ধরা পড়ে গেছেন কারুর হাতে। আমার আর এই দৃশ্য সহ্য হচ্ছিলনা। আমি পেছন ঘুরে রমার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘রমা যাও তৈরি হয়ে নাও। আমাদের এক্ষুনি বেরোতে হবে’ রমা কিছুটা ঘাবড়ে গেলো, আর সাথে সাথে বেডরুমের মধ্যে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। রমা ভেতরে প্রবেশ করার পর কিছুটা অন্যমনস্ক হয়েই বিজয়দা বললেন ‘শি ইস বিউটিফুল’। বিজয়দার ওপর সন্দেহ আমার ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
মুখ দিয়ে বেফাঁস কথা বেরিয়ে গেছে এটা বিজয়দা বেশ ভালোই বুঝতে পারলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরন করে উনি বললেন ‘এখন বাজে সাড়ে ৬ টা। রঞ্জন বাবুর মিসেস আর ১ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা পৌঁছে যাবেন’ ওনার কথা শুনে আমার হুঁশ ফিরল। হ্যাঁ, সত্যিই তো আমিও তো মিতাকে জানাইনি। অথচ মিতাকে আমারই জানানো উচিত ছিল। এর চেয়েও অদ্ভুত যা হোল, সব জেনেও মিতা কেন আমাদের কিছু জানালো না। যতই নাকউঁচু হোক ও, এই মুহূর্তে ওর পাশে দাঁড়ানোর মত তো শুধুই আমি আর রমা। ‘আচ্ছা, বিপ্লব বাবু, মিতা দেবীর সম্বন্ধে আপনার কি মত?’ প্রশ্নটা শুনে আমি কি বলব তাই বুঝতে পারলাম না। ‘না, মানে আমি বলছি, মিতা দেবী কি কোনভাবে এইসবের সঙ্গে যুক্ত’ সত্যি বলতে মিতার ব্যাপারে আমিও কখনো ভেবে দেখিনি। এতটুকুই জানি, মিতা প্রচণ্ড অহংকারী। হয়ত নিজের স্বামী ও আপনজনের চেয়েও টাকাকেই ও বেশী ভালোবাসে। আর এরচেয়েও অদ্ভুত হোল আমার বিয়ের পর থেকে মিতা আমাদের বাড়িতে মাত্র ৫ বার এসেছে। তার মধ্যে ২-৩ বার বাবাই প্রচণ্ড অসুস্থ এই খবর শুনে। ‘এই ব্যাপারে আমি সেরকম কিছুই জানিনা আর ভাবিওনি’ এই বলেই আমি ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু গুরু মস্তিস্কে ভর হওয়া প্রদোষ মিত্তিরকে কি করে আঁটকে রাখি। এই মুহূর্তে সন্দেহের তালিকায় মোট ৩ জন চলে এলো বিজয়দা, শর্মাজী ও নবতম সংযোজন মিতা, রমার দিদি।
রমা, রেডি হয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ওকে দেখা মাত্রই বিজয়দা টপিকটা সম্পূর্ণ চেঞ্জ করে দিলেন। যেন উনি চাননা রমা কিছুতেই এই ব্যাপারে কিছু জানুক। ‘চলুন, আমাদের এবার বেরনো উচিত। আর হ্যাঁ, মিসেস পোদ্দার, আপনি কিন্তু নিজেকে একটু সংবরন করবেন। কারন মৃতদেহের অবস্থা শোচনীয়’ হ্যাঁ, এই কথাটা বিজয়দা সত্যিই বলেছেন। রমার শরীরের যা অবস্থা তাতে সত্যিই ওকে এরকম বীভৎস একটা মৃতদেহ দেখতে না দেওয়াই উচিত। আমি তাই বিজয়দাকে বললাম ‘আচ্ছা, বিজয়দা, মিতা তো আসছেই, আমিও আছি তাহলে কি রমাকে আর নিয়ে যাওয়ার কোন দরকার আছে?’ আমার কথা শুনে বিজয়দা একবার রমার মুখের দিকে তাকালেন এবং সেই অবস্থাতেই বললেন ‘ওকে, মিসেস পোদ্দারকে যেতে হবেনা। কিন্তু আমি ওনার সাথে পার্সোনালি কয়েকটা কথা বলতে চাই। আপনি যদি একটু নীচে গিয়ে দাঁড়ান খুব ভালো হয়’ আমার চরম আপত্তি ছিল, কিন্তু একজন পুলিশ অফিসার একজন সাধারন নাগরিককে জেরা করতে চান, সত্যিই এতে আমার বাধা দেওয়ার কিছুই নেই। আমি মুখটা বিজয়দার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম ‘বিজয়দা, দেখবেন, ওর কিন্তু মানসিক অবস্থা ভালো নয়’
আমায় প্রায় অবাক করেই বিজয়দা কিছুটা জোরে হেঁসে উঠে বললেন ‘আরে ধুস, আপনি মিসেস পোদ্দারকে যতটা অসুস্থ মনে করেন উনি ততটাও নন। আপনি নীচে যান আমি আসছি’ প্রায় পিলে চমকে গিয়ে আমি রমার দিকে তাকালাম। রমার দুই চোখ যেন বারবার করে আমায় বলছে ‘বিপ্লব, এই লোকটার কাছে আমাকে একা ছেড়ে কোথাও যেওনা প্লিস’। আমি বিজয়দার চোখটার দিকেও তাকালাম। যেন এক আদিম হিংস্র পশু ওনার দুই চোখ ঠিকরে বাইরে বেরিয়ে আসছে। আমার আর কিছুই করার ছিলনা। আমি ধীরে ধীরে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলাম।
Like Reply
#45
17
ল্যাদ খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি ফ্ল্যাটের বাইরে, কখন বিজয়দা রমাকে জিজ্ঞাসাবাদ সম্পূর্ণ করে আসবেন তার অপেক্ষায়। ‘বিজয়দা’ এই চরিত্রটি বড় বড় উপন্যাসের জটিল চরিত্রকে হার মানায়। কখনো মানুষটিকে চরম আদর্শবান ও সিস্টেমের প্রতি নিবেদিতপ্রান মনে হয় কখনো আবার সেই লোকটিই চরম রহস্যময়। আমি আর রমা যে হিন্দি সিনেমার আদব কায়দায় মধুকর ভিলা থেকে বেরইনি তা আমি খুব ভালো করেই জানি। এর পেছনে যে বিজয়দার অদৃশ্য হাত ও সহযোগিতা রয়েছে তা আমি ভালোই বুঝি। কিন্তু কেন? কেন এই লোকটি আমায় প্রতি মুহূর্তে এই রহস্যের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে দিচ্ছে। কখনো কখনো বিজয়দাকে প্রচণ্ড সন্দেহ হয়। আসলে মানুষের চরিত্র একটা সাদা কালো নেগেটিভ ফিল্ম। এর সাদা স্পটগুলো সেই মানুষকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে আর নেগেটিভ স্পটগুলো সেই মানুষকেই চরম অবিশ্বাস করতে বাধ্য করে। আমি রয়েছি গোলকধাঁধায়, বিজয়দার অদ্ভুত ও অত্যন্ত আকর্ষক এই চরিত্র বিশ্লেষণে আমি সত্যিই অপারগ। তবে, এটা প্রচণ্ড সত্য যে এই মুহূর্তে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনায় আমার মনে কালো স্পটগুলোই ভেসে উঠছে। সত্যিই কি বিজয়দা এই খুনের সাথে জড়িয়ে? বিজয়দা যে ঘুষের টাকার কথা বলেছিলেন, অথবা হথাত করে বিজয়দা ও রঞ্জনকে একসাথে বিজি দেখতে পাওয়া, অথবা আমার বাড়িতে কিছুক্ষন আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তো আমাকে বারবার বিজয়দাকে সন্দেহ করতে বাধ্য করছে। এইসবই ভাবছি এমন সময় দেখি বেশ হাসিহাসি মুখে বিজয়দা আমার দিকে আসছেন।
‘চলুন যাওয়া যাক’। বিজয়দার কথাটা শুনে তো মনে হচ্ছিল যে আমরা বোধ হয় ম্যাটিনি শো দেখতে যাচ্ছি। যাই হোক আমি গাড়িতে চেপে বসলাম। আমার ফ্ল্যাট থেকে হসপিটাল এমন কিছু দূর নয়। এই মিনিট দশেকের রাস্তা। বিজয়দার চোখে মুখে একটা প্রশস্তির ছাপ। যেন কোন এক অজানা ভয়কে উনি সবে মাত্র জয় করেছেন। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা হাসপাতালে পৌছালাম। একটা ভুঁড়িওয়ালা হাবিলদার এগিয়ে এসে বিজয়দাকে বলল ‘স্যার, ময়নাতদন্ত হয়ে গেছে’ কিছুটা সিরিয়াস হয়ে বিজয়দা ওকে বললেন ‘ডাক্তারের সাথে মৌখিক কিছু পরামর্শ করতে বলেছিলাম তোমায়?’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো ‘হ্যাঁ, স্যার, সবই জিজ্ঞেস করেছি। না, এবার সত্যিই আর সেই আফ্রিকান বিষ প্রয়োগ করা হয়নি। খুন হয়েছে এই রাত দুটো নাগাদ। শরীরের ওপর দিয়ে মোট ৫ বার ও মাথার ওপর দিয়ে মোট ২ বার গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে’ দুটো হাত দিয়ে প্রচণ্ড জোরে একটা শব্দ করে বিজয়দা আমার দিকে তাকালেন। আমি কিছুটা হতবাক হয়েই তাকিয়ে থাকলাম। ‘ব্যাস, আর কি পুরো কেসটাই তো হাতের মুঠোয় চলে এলো। এবার একটাই কাজ পড়ে রয়েছে। কি?’ আমারই মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে একটা শব্দ বেরিয়ে এলো ‘চার্জসিট’। প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলেন বিজয়দা। আবার মুখটা কিছুটা গম্ভীর করে আমার উদ্দেশ্যে বললেন ‘বউয়ের জন্য কিছু রাখা আছে তো? মানে এই ইনসিওরেন্স বা নগদ টাকা ইত্যাদি?’ কথাটা শুনে ওখানে দাঁড়িয়েই আমার পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিলো। তবে কি বিজয়দা...?
আমি বিজয়দার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। বিজয়দার দুটো অনুসন্ধিৎসু চোখ যেন আমার শরীরটা গিলে খেয়ে নেবে। আমার মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অবধি বারবার করে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন। যেন আমার শরীরটা নয় শরীরের মধ্যে থাকা মনটাকে উনি রিড করতে চাইছেন। কিছুটা অধৈর্য হয়েই আমি বলে উঠলাম ‘কি বলতে চাইছেন আপনি?’ আবার একটা অট্টহাস্য। আমার কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন ‘একটু সাইডে আসুন’ ওনার কথা শুনে সেই হাবিলদারটিই হেঁটে কিছুটা দূরে সরে গেলো। আমার সাড়া শরীরে এক অদ্ভুত শিহরন শুরু হয়েছে। তাহলে কি সত্যি বিজয়দাই...। ওনার ঠোঁটদুটো ধীরে ধীরে আমার কানের কাছে এসে গেলো। আমিও শুনতে চাই, উনি আমায় ঠিক কি বলতে চান। ‘আপনার কিছু হয়ে গেলে রমার কি হবে?’ সাথে অত্যন্ত নোংরা একটা হাঁসি। হাঁসিটার ইঙ্গিত হয়ত আমার নয় রমার দিকে। নিজেকে আর সংবরন করতে পারলাম না, কিছুটা চিৎকার বলেই বলে ফেললাম ‘বিজয়দা আপনি?’ সঙ্গে সঙ্গে বিজয়দার মুখের হাঁসিটা কর্পূরের মত উড়ে গিয়ে তার জায়গায় ভেসে এলো এক পর্বত কঠিন কঠোর মানসিকতার মানুষ। কিছুটা গলাটা গম্ভীর করে উনিও বলে উঠলেন ‘আমি কি?’ জানি বিজয়দার মত একজন পুলিশ অফিসারের সাথে লড়ার ক্ষমতা আমার নেই। তাই নিজেকে কিছুটা সংবরন করে নিয়ে কিছুটা কাতরভাবেই বললাম ‘আপনি কি চান বিজয়দা?’ এতো জটিল একটা প্রশ্নের উত্তরে শুধুই একটা অমলীন হাঁসি। এমন এক হাঁসি যার মধ্যে হাজারো রহস্য ও তার সমাধান লুকিয়ে রয়েছে। ‘চার্জশিট’ আবার ওই শব্দটাই উচ্চারন করলেন বিজয়দা। এই মানুষটা কে? এই পৃথিবীতে কি এনার আগমন শুধুই আমাকে মানব জনমের জটিলতা ও বাস্তবের কঠোরতা বোঝানোর জন্য? ‘চলুন মর্গের দিকে যাওয়া যাক’। আর কথা না বাড়িয়ে আমিও চলতে লাগলাম।
চারপাশে ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। কোনটা সেলাই করা। কোনটার বা চোখগুলো বেরিয়ে আছে। কি বীভৎস, জানি রমা আসেনি ভালো হয়েছে। রমা সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু আমি পারবো, বাবাইএর মৃত্যুকে আমি নিজের চোখে দেখেছি। দেখেছি কিভাবে একটা মানবদেহ থেকে ধীরে ধীরে প্রাণবায়ুটা বেরিয়ে যায়। শেষ ২ মিনিট বাবাই যখন ক্রমাগত হেঁচকি তুলে যাচ্ছিল আমার গলা দিয়ে কিছুতেই আওয়াজ বেরচ্ছিল না। চোখের সামনে যমরাজকে দেখেছিলাম। ‘সরি, নিজেকে নিয়ন্ত্রন করুন, স্ত্রীর পাশে থাকুন, আমরা আপনার ছেলেটাকে নিয়ে যাচ্ছি’ যেন যমরাজ এই কথাটাই আমার মুখের ওপর বলেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম বাবাইকে আমি বাঁচাতে পারবো না। ডাক্তার মৃতদেহর মুখের ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিল। কি বীভৎস! হাবিলদারটা ওয়াক করে একটা আওয়াজ করে দরজার দিকে দৌড়ে গেলো। বিজয়দাও দেখলাম মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আমি তাকিয়ে আছি। একটা মৃতদেহ; আমারই আত্মীয় রঞ্জনের। আমি ওই চেপ্টে যাওয়া নৃশংস মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি। কে যেন হয়ত আমার বিবেক আমাকে প্রশ্ন করে চলেছে, ‘কি বিপ্লব, এই মৃতদেহটা কার? উচ্চবিত্তের? মধ্যবিত্তের? নিম্নবিত্তের? শোষকের? শোষিতর? জবাব দাও বিপ্লব। ব্যাখ্যা কর তোমার ওই বস্তাপচা তত্ব দিয়ে’। নিজের মনেই বিড়বিড় করে উঠলাম ‘এই মৃতদেহ একটা জানোয়ারের! টাকা নামক যন্ত্র দিয়ে যে গোটা পৃথিবীকে কুক্ষিগত করতে চেয়েছিল’ বীভৎস ওই নারকীয় পরিবেশে আর কেউ থাকতে পারছিলনা, আমি ছাড়া। খেয়ালই করিনি পেছন ঘুরে বিজয়দা আমার হাতটা ধরে টেনে টেনে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা কেউ আমার মুখের হাঁসিটা দেখেনি। আমি হাসছিলাম, আমি বিদ্রুপ করছিলাম, একটা জানোয়ার মরেছে, একটা বিপ্লব হয়েছে, সমাজ পাল্টাচ্ছে।
Like Reply
#46
বিজয়দা টানতে টানতে আমায় বাইরে নিয়ে গেলেন, প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলেন ‘আপনি কি মানুষ! কিভাবে? কিকরে আপনি পারলেন! এইরকম বীভৎস একটা মৃতদেহের দিকে আপনি কি করে তাকিয়ে রয়েছেন?’ আমার হুঁশ ফিরল। হাবিলদারটা একটা জলের বোতল নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে এলো। ভালো করে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিয়ে শান্ত করলাম নিজেকে। মনে পড়ল, মিতার কথা। সত্যি এই মুহূর্তে মিতার পাশে দাঁড়ানো ও ওকে স্বান্তনা দেওয়াই আমার প্রধান কর্তব্য। বিজয়দাকে প্রশ্ন করলাম ‘বিজয়দা, মিতা মানে রঞ্জনের স্ত্রী কি এসে গেছে?’ বিজয়দা একবার ওই হাবিলদারের দিকে তাকালেন। সেই আমাকে জবাব দিলো ‘হ্যাঁ, উনি এসে গেছেন। ওনাকে বাইরের ঘরটায় বসিয়ে এসেছি’ আমরা প্রত্যেকেই মিতার সাথে দেখা করতে চললাম। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর দেখলাম মিতা সিঁড়ির ওপর বসে। মাথায় দুহাত দিয়ে রয়েছে, দেখেই মনে হচ্ছে, মানসিকভাবে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত। আমিই সবার আগে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই মিতা উঠে দাঁড়াল। আমি কিছু বোঝানোর আগেই বা স্বান্তনা দেওয়ার আগেই মিতা বলে উঠল ‘বিপ্লব আমার কি হবে! আমি তো দেউলিয়া হয়ে গেলাম!’ হাতটা মিতার মাথার দিকে নিয়ে যাচ্ছিলাম ওকে স্বান্তনা দিতে, লঘুমস্তিস্কের কোন এক জটিল প্রক্রিয়ায় হাতটা ওখানেই দাঁড়িয়ে গেলো। বলে কি মেয়েটা। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সকলের সামনেই ও বলল ‘বিপ্লব, রঞ্জনের সমস্ত টাকা কোন এক ফেক আকাউন্তে রয়েছে। আমার হাতে ৩-৪ লাখ টাকা ছাড়া কিছু নেই। আমি তো দেউলিয়া হয়ে গেলাম’ শালা হাসবো না কাঁদবো তাই বুঝলাম না। সত্যিই কি তাহলে উচ্চবিত্তের আবেগও আমাদের থেকে আলাদা হয়। একটা মানুষ যে মিতার স্বামী ছিল সে মারা গেছে। আর আজ তার মৃত্যুর যন্ত্রণাকে হার মানিয়ে ওপরে উঠে আসছে একটা যন্ত্র যার নাম টাকা। টাকা দিয়ে এরা ভালোবাসা কেনে, শরীর কেনে, এগুলো আমি আগেই জানতাম এখন দেখছি টাকা দিয়ে এরা মানুষের আবেগও কিনে নেয়।
‘তুমি কোন চিন্তা করোনা। কোন না কোন একটা ব্যাবস্থা ঠিকই হয়ে যাবে’ এই কথাটা বলা ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলনা। ‘মিতাদেবী আপনি এখন তাহলে বিপ্লববাবুর বাড়িতে উঠুন। যেকোনো সময় আপনাকে জেরা করার জন্য ডাকা হতে পারে’ হাতের রুমালটা দিয়ে চোখের জলটা একবার মুছে মিতা শুধু মাথাটা নাড়াল। ‘চলুন আপনাদের ছেড়ে দিয়ে আসি’ হাবিলাদারের কথায় আমার একটু স্বস্তি ফিরল। আমরা দুজনেই গাড়ির পেছনে বসে আছি। সামনে সেই হাবিলদার ও একজন ড্রাইভার। বিজয়দা ডাক্তারের সাথে কথা বলার জন্য ওখানেই থেকে গেলেন। হথাত দেখি আমার হাতের ওপর মিতার হাতটা এসে স্পর্শ করল। কিছুটা চমকে গিয়েই ওর দিকে তাকালাম। ‘বিপ্লব, আমাকে তুমিই বাঁচাতে পারবে। রঞ্জন আমায় কোনোদিন জানায়নি কোন নামে ওর আকাউন্ত আছে। শুধু এটাই জানি তোমাদের ব্যাঙ্কেই ওর আকাউন্ত আছে। তুমি যেভাবে হোক আমায় বাঁচাও। নয়ত আমি নিঃস্ব হয়ে যাবো’ আমি কোন জবাব দিলাম না। শুধুই সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ‘কি অদ্ভুত এই পৃথিবী, একদিন এই মেয়েটিই চাইত যেন কোনমতেই আমার আর রমার বিয়ে না হয়। আমার সাথে রমার বিয়ে হওয়ার পর শুধুই গঞ্জনা আর হেয় হওয়া, তাও আজ সেই মানুষটিই আমার দুহাত ধরে অনুরোধ করে চলেছে। শুধু মিতাকে নিজের পাওনা গণ্ডা ফিরিয়ে দিতে নয়, রঞ্জনের আসল আকাউন্তটির ব্যাপারে আমারও জানা অত্যন্ত জরুরি। আজ আমায় যেভাবে হোক অফিসে যেতে হবে। আজ প্রায় ৩ দিন হয়ে গেলো আমি অফিস যাইনি।
লিফটে করে আমি ও মিতা দুজনেই ওপরে উঠছি। আমি ভেবে চলেছি কি করে লাখ লাখ আকাউন্তের মধ্যে থেকে একটা বেনামী আকাউন্ত আমি খুঁজে বার করব। বিজয়দার থেকেই জেনেছিলাম যে রঞ্জনের ফেক আকাউন্তটি মুম্বাইতে আছে। পরপর কতগুলো ঘটনা আমার মাথায় সেজেগুজে বসে গেলো। মনীন্দ্রদার খুন হওয়া, শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপসাল এবং তারপর রঞ্জনের খুন হওয়া। ‘স্পেশাল আকাউন্ত’ হ্যাঁ, সবার আগে এই টার্মটাই আমার মাথায় এসেছিল। আমাদের ব্যাঙ্কে কিছু স্পেশাল আকাউন্ত আছে। ব্যাঙ্কের অফিসিয়ালদের পার্সোনাল রেকমেনডেশনে কিছু আকাউন্ত খোলা হয়। এর জন্য ডকুমেন্ট ও যৎসামান্যই লাগে। এই পাসপোর্ট জাতীয় কিছু হলেই যথেষ্ট। মনিদা কেন খুন হলেন? এর পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট কারন রয়েছে। মিতার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘মিতা তুমি বাড়িতে ঢোক, রমা আছে। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি’। মিতা কিছু বলল না, আমিও ঝড়ের বেগে ফ্ল্যাট থেকে বেরোতে শুরু করলাম। আমাদের অফিস অনেক সকালেই খুলে যায় কিন্তু স্টাফরা সবাই ১১ টা নাগাদ আসে। এটাই পারফেক্ট সময়। দ্রুত স্কুটারটা স্টার্ট দিয়ে অফিসের দিকে যেতে শুরু করলাম।
অফিসে যখন পৌছাই তখন প্রায় ৯ টা। সিকিউরিটি গার্ডটা আমাকে দেখে কিছুটা ভুরু কুঁচকে উঠে দাঁড়াল। আমিও হাত পা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলাম ‘হেব্বি চাপ, বাপু। কাজ করতে হবে নয়ত স্যাক হয়ে যাবো’। দ্রুত অফিসে ঢুকে পড়লাম, হ্যাঁ সত্যিই আমি ছাড়া অন্য কোন স্টাফ এই মুহূর্তে নেই। কিন্তু আমার সিস্টেম থেকে তো আকাউন্ত সেকশন অ্যাকসেস করা যায়না। অতএব অন্য কারুর সিস্টেমে হাত মারতে হবে। সবচেয়ে বেস্ট চিনুর সিস্টেম। ওর আলাদা কেবিন রয়েছে, মেন এন্ট্রান্স থেকে চট করে কারুর নজরও পড়বে না। সঙ্গে সঙ্গে ওর সিস্টেমটা খুলে ফেললাম। আকাউন্ত সেক্সানে ক্লিক করতেই দেখি অলরেডি লগ ইন করা রয়েছে। মাথা থেকে একটা বিশাল চাপ নেমে গেলো। বিশাল লম্বা একটা লিস্ট। কারসারটা ধরে একদম নীচের দিকে নামতে শুরু করলাম। একদম তলার দিকে স্পেশাল আকাউন্ত এর একটা কলাম। কিন্তু এখানেও লিস্টটা বেশ বড়সড়। খুঁজে বার করা যথেষ্ট চাপের। কলামের একদম শেষ রো টার নাম ‘রেকমেনডেড বাই’। যদি আমার অনুমান সঠিক হয়ে যায় তাহলে আমি ৫ মিনিটের মধ্যেই রঞ্জনের ফেক আকাউন্তটি খুঁজে বার করে দেবো। ওই রো বরাবর মনিদার নাম খুঁজতে শুরু করলাম। কারসার ক্রমশ নীচের দিকে নামছে কিন্তু মনিদার নাম নেই। আমারও হতাশা বেড়েই চলেছে।
Like Reply
#47
কারসারটা একদম শেষে এসে থেমে গেলো। সবার শেষে পেলাম একটি আকাউন্ত, নাম সুধীররঞ্জন গুপ্তা, রেকমেনডেড বাই মনীন্দ্র বসু। আমার আর বুঝতে কোন অসুবিধেই রইলনা এটাই রঞ্জনের ফেক আকাউন্ত। ঘড়ির দিকে তাকালাম ৯ টা ১০। অর্থাৎ হাতে এখনো বেশ কিছুটা সময় রয়েছে আমার। ক্লিক করলাম, আকাউন্তটির ওপর। সাথে সাথে সম্পূর্ণ আকাউন্ত ডিটেলস আমার হাতে চলে এলো। নিউ জেনারেটেড পেজটায় আমার চোখ পড়তেই হার্ট ফেল হওয়ার উপক্রম হোল। ‘নেট ব্যালেন্স ৮০ লাখ’। আকাউন্ত ডিটেলসটা একবার মিলিয়ে দেখার জন্য ক্লিক করলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছি ঠিক তাই। জালী পাসপোর্ট দিয়ে ফেক আকাউন্ত। এটা রঞ্জনের ই ফেক আকাউন্ত। শালা, মানুষ দুবেলা খাবার পেতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে আর এরা খোলাম কুচির মত কালোটাকা নিয়ে ফুর্তি করছে। হথাত মোবাইলটা বেজে উঠল। সবার আগে সিস্টেমটা বন্ধ করলাম। কারন এটাকে খুলে রাখা উচিত নয়। ফোনটা রিসিভ করতে যাবো দেখি তার আগেই ফোনটা কেটে গেলো। এইসময় কে ফোন করল? কল লিস্ট হাতড়ে বুঝলাম চিন্ময় ফোন করেছে। চিন্ময়? কিন্তু কেন? সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা লাগিয়ে দিলাম। রিং হয়েই গেলো কিন্তু চিনু ফোনটা রিসিভ করলনা। আমার উদ্বেগ হুহু করে বাড়তে শুরু করল। চিনু আমায় কি জানাতে চায়। মধুকর ভিলায় যে আসলে চিনুই আমাদের দুজনকে বার করেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। আমি আবার কল করতে যাচ্ছি এমন সময় দেখি চিনুর ই ফোন চলে এলো।
‘বিপ্লবদা আপনি কোথায়? আমি আপনাকে এক্ষুনি একটা ম্যাসেজ করেছি চেক করুন। ওই ম্যাসেজটার মধ্যে অনেককিছু রয়েছে। বিপ্লবদা আমি কিছুক্ষন পরে ফোন করছি। আমি বিশাল বিপদে’ আমি কিছু বলার আগেই চিনু ফোনটা কেটে দিলো। নতুন এক রহস্য। ফোনটা ভালো করে চেক করলাম, না কোন ম্যাসেজ আসেনি। আসলে অফিসের মধ্যে নেটওয়ার্কের এতো প্রবলেম যে ম্যাসেজ খুব কষ্টে ইনবক্সে ঢোকে। কিন্তু এটা বেশ ভালো মতই বুঝতে পারছিলাম যে এই ম্যাসেজটা অত্যন্ত জরুরি। যদি এক্ষুনি পাঠিয়ে থাকে, অফিসের বাইরে গেলে ম্যাসেজটা রিসিভ করার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। আমি প্রায় রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে অফিসের বাইরে চলে গেলাম। হাতে মোবাইলটা নিয়ে অপেক্ষা করছি, এমনসময় ম্যাসেজ রিং টোন টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ইনবক্স ওপেন করলাম।

‘Ranjan100isshan’ ‘25thmagh’

এ এক অদ্ভুত ম্যাসেজ। এতটুকু বুঝলাম যে বলতে চাইছে রঞ্জন ই হোল শান। সেটা আমি গতরাতে মধুকর ভিলাতেই জেনে গেছিলাম। আর ২৫ শে মাঘ আমার ছেলের মৃত্যুদিন। এই দুটোর মধ্যে কি সম্পর্ক? একমাত্র চিনুই আমায় ভালো করে বুঝিয়ে সব বলতে পারে। সুতরাং আবার চিনুকেই ফোন লাগালাম। ওপাশ থেকে ‘হ্যালো, হ্যালো, হ্যালো বিপ্লবদা শুনতে পাচ্ছেন? হ্যালো হ্যালো’ এই কথাটাই ভেসে আসছে। আমি যত বলছি ‘হ্যাঁ চিনু আমি সব শুনতে পাচ্ছি’ ততই একি কথা ওপাশ থেকে ভেসে আসছে। বেশ কিছুক্ষন এরকম চলার পর চিনু বলে উঠল ‘বিপ্লবদা, আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছিনা। আমি এই মুহূর্তে গাড়িতে। আপনি কোনা এক্সপ্রেসওয়ে ধরে এগিয়ে আসতে শুরু করুন। আমার পেছনে লোক লেগেছে। মনে হয় বাঁচব না। আর হ্যাঁ, বিজয়দাকে...’ হথাত লাইনটা কেটে গেলো। শালা কোনা এক্সপ্রেসওয়ে কি পাড়ার গলি, যে চিনুকে তুড়ি মেরে খুঁজে বার করব। তবুও আমায় যেতেই হত। স্কুটারটায় স্টার্ট মারলাম।
যতটা স্পীডে এই স্কুটারটা চালানো যায় ঠিক ততটাই স্পীডে চালাচ্ছিলাম। একটু সকাল সকাল হওয়ায় সেভাবে ট্রাফিকের প্রবলেম ও হয়নি। বাধ সাধল রবীন্দ্র সদনের কাছে এসে। বিশাল একটা জ্যাম। কিছুই করার নেই, স্টার্টটা বন্ধ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হথাত ই চোখে পড়ল বেশ কিছুটা দূরে একটা পুলিশের জিপ। কলকাতার রাস্তায় পুলিশের জিপ থাকাটা অস্বাভিক কিছু নয়। কিন্তু আমার মনে কিছু জটিল সমীকরন কিলবিল করে চলেছে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওইদিকে। হথাত ই জটিল বহুঘাত সমীকরনের সমাধান হয়ে গেলো। গাড়ির ভেতর থেকে নেমে এলো বিজয়দা। হেঁটে কিছুটা গিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে কিছুটা ধমকের স্বরে কিছু বললেন। আমি চুপ করে তকিয়ে আছি ওই দিকেই। ধাতানি খেয়ে ট্রাফিক পুলিশটাও কিছুটা তাড়াহুড়ো করে গাড়িগুলোকে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দিলো। তাহলে কি বিজয়দাই?
অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রাফিক ক্লিয়ার হয়ে গেলো। আমিও প্রচণ্ড বেগে স্কুটারটা ছোটাতে শুরু করলাম। কিন্তু পুলিশের জিপের সাথে কি আমার মধ্যবিত্ত স্কুটার পারে। কিছুক্ষনের মধ্যেই বিজয়দার জীপটা আমার নজরের বাইরে চলে গেলো। মনে মনে সঙ্কল্প করলাম যেভাবে হোক আমি চিনুকে বাঁচাবো। ক্রমশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। আবার একটা জ্যাম। আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। না পুলিশের জীপটা আর দেখা যাচ্ছেনা। হতাশা ক্রমশ আমাকে গ্রাস করে চলেছে। তাহলে কি আমি সত্যিই চিনুকে বাঁচাতে পারবো না। কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রাফিক ক্লিয়ার হয়ে গেলো ও আমি সোজা চলতে লাগলাম। এরপর রাস্তাটা সোজা হাইওয়েতে উঠেছে, আর সেরকম জ্যামে পড়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কখন যে দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে গেছি খেয়াল করিনি।
কিছুটা দূরে একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে। চিনুর গাড়িটা আমি চিনি, এটা চিনুরই গাড়ি। আরও কিছুটা আগে যেতে বুঝলাম তার ঠিক পেছনে পুলিশের জিপও দাঁড়িয়ে। আমি একদম গাড়িটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। ভেতরে দুটো মৃতদেহ। একটা চিনুর একটা চিনুর ড্রাইভারের। পেছনে জিপের ওপর হেলান দিয়ে বিজয়দা কাউকে ফোন করছেন, সম্ভবত থানা থেকে লোক পাঠানোর জন্য। আমাকে দেখে ফোনটা একটু কান থেকে নামিয়ে বলে উঠলেন ‘একি বিপ্লব বাবু আপনি এখানে?’ এর উত্তর দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিলনা। শুধু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হোল ‘আপনি এখানে কি করে?’ কিন্তু পারলাম না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে বিজয়দা আবার ফোনে কথা বলতে শুরু করলেন। ‘হ্যাঁ, একটা এ্যাম্বুলেন্স আর ৪ জন পাঠাও’ ফোনটা রেখে আমায় বললেন ‘প্রচুর চেষ্টা করলাম কিন্তু বেচারাকে বাঁচাতে পারলাম না’। আমার মুখ দিয়ে একটাও শব্দ বেরোল না। মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাহলে কি বিজয়দাই?
Like Reply
#48
18

চিনুর মৃত্যুর সাথে সাথে রহস্য সমাধানের একটা মুখ বন্ধ হয়ে গেলো। আমি একদৃষ্টিতে চিনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার আর রমার শপিং মলে যাওয়া, একটা ছিঁচকে চোরের রমার ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি করা, আমার পেছন থেকে চিনুর দৌড়, বেশ কিছুক্ষন পর ডান হাতে ক্ষত নিয়ে চিনুর ফিরে আসা, গায়ে একটা উগ্র সেন্ট, চিনুর রমাকে সিডিউস করা, আবার আমাকে কিছু অঙ্গভঙ্গি করে ওখান থেকে চলে যাওয়ার ইঙ্গিত করা, অবশেষে আমায় ফোন ও একটা অদ্ভুত ম্যাসেজ পাঠানো; সবকিছুকেই একটা সরলরেখায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু চিনুর মৃত্যুতে সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। রমার চিঠিটা থেকে বুঝেছি শানের সহযোগী মোট ৫ জন। প্রত্যেকেই পুরুষ। অবিলম্বে খুন হয়ে যাওয়া প্রত্যেকে শানের সহযোগী হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। সেইরকম ভাবেই ভেবে নিয়েছিলাম। মনিদা, রবি, ও রঞ্জন ওরফে শান অবিলম্বে খুন হয়ে গেছে। শানের আরও দুজন সঙ্গী রয়েছে। এই দুজন কারা? এই মুহূর্তে সন্দেহের তালিকায় বেশ কয়েকজন। তারমধ্যে একজন নিশ্চিত, কারন মধুকর ভিলায় আমি তার উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি, সে হোল শর্মাজী। কিন্তু অপর জন কে? চিন্ময়? ফ্ল্যাটের সেই সিকিউরিটি গার্ড, শান্তনু? নাকি অন্যকেউ। মানুষের সবচেয়ে উত্তেজনা প্রবন ইন্দ্রিয় হোল সন্দেহ। সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ই বারবার করে আমায় জানান দিচ্ছে, শানের দ্বিতীয় সহযোগী আর কেউ নয় বিজয়দা। এইসবই ভাবছিলাম, হথাত বিজয়দাই অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করে উঠলেন
‘আচ্ছা, বিপ্লব বাবু, একটা অদ্ভুত জিনিষ খেয়াল করেছেন; শেষ দুখানা খুনে আর সেই আফ্রিকান বিষটি ব্যাবহার করা হচ্ছেনা’ আমি অন্যমনস্ক ছিলাম। বিজয়দার আকস্মিক এই প্রশ্নে আমি কিছুটা চমকে গিয়েই ওনার দিকে তাকালাম। বিজয়দার মুখে অদ্ভুত এক সন্তোষজনক হাঁসি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই উত্তর দিলাম ‘আসলে মনে হয় ওরা পুলিশএর চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য...’ আমাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলেন। প্রায় মিনিট দুয়েক পরে ওনার হাঁসি থামল। হাঁসতে হাঁসতেই কিছুটা অবজ্ঞার ছলে আমায় বললেন ‘বিপ্লববাবু, ভাবছি পুলিশের চাকরিটা এবার ছেড়ে দেবো। যা টাকা জমিয়েছি তা দিয়ে শ্যামবাজারে একটা পান দোকান খুলে বসে যাবো’ আবার সেই বিচ্ছিরি একটা হাঁসি। ‘কেন জানেন? শালা, পুলিশের কোন সম্মান নেই। দিনরাত পলিটিসিয়ানের পোঁদে পোঁদে ঘোরা, মাঝেমাঝে পাবলিকের ক্যালানি তবুও নিজেদের একটা বেশ হিরো হিরো লাগত। কিন্তু আজকাল তো দেখছি ব্যাংকাররাও শারলক হোমস হয়ে যাচ্ছে’ বিজয়দার এই বিদ্রুপ আমার আর সহ্য হচ্ছিলনা। কিছুটা মেজাজ হারিয়েই বলে ফেললাম ‘আপনি কি বলতে চান বলুন তো? আমাকে এইসব বলবেন না। আমায় চিন্ময় কিছুক্ষন আগে ফোন করেছিল। ও বলল ও বিপদে পড়েছে, কোনা এক্সপ্রেসওয়ে বরাবর আসতে। আমাদের ওখানেই দেখা হয়ে যাবে। আর আপনাকে...’ ‘আমায় কি? আমায় না জানাতে বলেছিল তাই তো’ বিজয়দার শেষ কথাটার কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। কারন সত্যিই চিনুর শেষ বাক্যটা আমি পরিস্কারভাবে শুনতে পাইনি। ‘আর হ্যাঁ, বিজয়দাকে...’ এটা শোনার পরই লাইনটা কেটে গেছিল। এই বাক্যটা তো মোট দুভাবে সম্পূর্ণ করা যায়। ‘আর হ্যাঁ বিজয়দাকেও খবরটা দিয়ে দিন অথবা আর হ্যাঁ বিজয়দাকে খবরটা দেবেন না কারন উনি ওদেরই লোক’ এর মধ্যে কোনটা সত্যি আর কোনটা ভ্রম? এর উত্তর আমার কাছে নেই। আমি বিজয়দার মুখের দিকে তাকালাম। ওনাকে যথেষ্ট গম্ভীর লাগছে। আমি কিছু বলার আগেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘বিপ্লব বাবু এবার আপনি যান। আপনার অফিস আছে। পুলিশকে পুলিশের কাজটা করতে দিন’
আমিও একটু অসম্মানিত বোধ করলাম। আর কথা না বাড়িয়ে স্কুটারটা স্টার্ট দিয়ে পেছন দিকে চলতে শুরু করলাম। একটার পর একটা বাস, ফুটব্রিজ পেরিয়ে চলেছি কিন্তু মস্তিস্কে রয়েছে এই কাহিনীর সবচেয়ে রহস্যজনক চরিত্র, বিজয়দা। বিজয়দা যে খুব একটা সহজ সরল মানুষ নন তা আমি প্রথম দিনই বুঝে গেছিলাম। যেদিন থানায় আমাদের সকলকে ডেকে পাঠালেন, আমাকে দেখার পর জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনার নাম?’ আমি প্রায় পিলে চমকে গেছিলাম। বিজয়দার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ আজ থেকে প্রায় ৩ বছর আগে। তারপর আর ওনার সাথে আমার কোন সাক্ষাৎ হয়নি। কিন্তু সেই প্রথম সাক্ষাৎটি এতটাই ঘটনাবহুল ছিল যে যেকোনো সাধারন মানুষই আমৃত্যু তা মনে রাখবেন আর বিজয়দা তো পুলিশ অফিসার। পুলিশের স্মৃতিশক্তি সাধারন মানুষের থেকে একটু বেশীই উর্বর হয়। বিজয়দা আসলে কি সত্যিই খলনায়ক? কেন আমার মন বারবার ওনাকে সন্দেহ করছে। অথচ থানায় ওনার সাথে দেখা করার সময় বা ওনার বেমালুম আমার কথা ভুলে যাওয়া এগুলোর পরেও আমি ওনাকে সন্দেহ করিনি। যেকোনো উপায়ে আমায় এই সন্দেহের বেড়াজাল থেকে বাইরে আসতে হবে। কিন্তু উপায় কি? সিগন্যালে গাড়িটা দাঁড় করাতে হোল। হথাত মাথায় এলো, বিজয়দা, রমার সাথে একান্তে কিছু কথা বলেছেন। রমার কাছে এই কথাগুলো অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে ও রমা নিজের ডায়েরিতে তা লিখে রাখবে। সুতরাং বিজয়দার চরিত্র বিশ্লেষণ একমাত্র রমার ডায়েরী থেকেই সম্ভব। কিন্তু পরপর ৩ দিন অফিস কামাই করেছি আর আজ যেহেতু একবার অফিসে চলে গেছি তাই কামাই করা সম্ভব নয়। সুতরাং বাড়ি ফিরেই ওই ডায়েরী থেকে বিজয়দার রহস্যটা উদ্ঘাতন করতে হবে।
Like Reply
#49
সোজা অফিসের দিকে চলতে শুরু করলাম। আরও একটা রহস্য রয়ে গেছে। চিনুর ম্যাসেজ। ও আমায় কি বোঝাতে চাইল ওটা বলে। ‘Ranjan100isshan’ ‘25thmagh’ রঞ্জনই যে শান তা আমি জানি, কিন্তু আমার ছেলের মৃত্যুবার্ষিকী কেন উল্লেখ করল ও। আর রঞ্জনের নামের পাশের ওই ১০০ কথাটারও বা মানে কি? হয়ত এর উত্তর আমি পেয়ে যেতাম যদি চিনু জীবিত থাকতো। এইসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ব্যাঙ্কের সামনে চলে এসেছি খেয়াল নেই। লিফট দিয়ে ওপরে উঠে ভেতরে উঁকি মারতেই দেখি ম্যানেজার বাবু অলরেডি চলে এসেছেন। পরপর ৩ দিন কামাই করেছি আজ আবার সকাল সকাল এসে বেরিয়ে গেছি; জানি কপালে প্রচুর দুঃখ রয়েছে। গুটি গুটি পায়ে নিজের টেবিলটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি এমনসময় হথাত ম্যানেজার স্যার এর ডাক। ‘বিপ্লব বাবু, একটু আমার কেবিনে এসে দেখা করে যাবেন’ হ্যাঁ, আজ আমার গাঁড় ফাটাবে মালটা। আবার স্যাক করে দেওয়ার হুমকি, ইংরিজিতে অখাদ্য কিছু গালাগাল ইত্যাদি। টেবিলে গিয়ে সিস্টেমটা অন করেই ম্যানেজারের কেবিনের দিকে যেতে শুরু করলাম। ‘মে আই কাম ইন স্যার?’ ভেতর থেকে খ্যারখ্যারে গলায় আওয়াজ এলো ‘হ্যাঁ, আসুন’। ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলাম। কখন শুরু হবে টাইফুন তার অপেক্ষায়।
‘হ্যাঁ, বিপ্লব বাবু যার জন্য ডাকা। আজ অফিসে স্টাফ প্রচুর কম। আপনাকে ২-৩ টে সেকশন সামলাতে হবে একসাথে। কিছুক্ষন পরেই এক ভদ্রলোক আসবেন, নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কিছু বিষয় নিয়ে...’ আমি ওনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে বলে উঠলাম ‘স্যার, আমি তো এই কাজগুলো খুব একটা জানিনা’ ম্যানেজার বাবু প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন ‘জানিনা মানে। ১০ বছরের অপর ব্যাঙ্কে চাকরি করছেন আর বলছেন জানিনা’ আমি চুপ করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওনার বুঝি একটু মায়াই হোল আমার প্রতি। ‘ওকে, আমি কিছু পেপার পাঠাচ্ছি, ওগুলো পড়ে নিন, সব বুঝে যাবেন’ আমি চুপচাপ নিজের টেবিলে গিয়ে বসে গেলাম। কিছুক্ষনের মধ্যেই নেট ব্যাঙ্কিং সংক্রান্ত কাগজপত্র চলে এলো। আমিও কাগজগুলো খুলে ভালো করে চোখ বোলাতে শুরু করলাম। ‘একটা ইউসার নেম ও একটা পাসওয়ার্ড। ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ড এ লেটার এর পাশাপাশি অঙ্কও থাকা বাধ্যতামুলক। যেমন prokashroy এটা সঠিক ইউসারনেম নয় কারন এরমধ্যে শুধুই লেটার রয়েছে কোন ডিজিট বা অঙ্ক নেই, কিন্তু prokashroy345 একটি সঠিক ইউসার নেম। একিভাবে password112 একটি সঠিক পাসওয়ার্ড হলেও password সঠিক পাসওয়ার্ড নয় কারন এরমধ্যে কোন অঙ্ক নেই। হাতদুটো একবার মাথার ওপর তুলে মনে মনে বিড়বিড় করে উঠলাম ‘প্রদোষ মিত্তিরের জয় হোক’। দু একজন স্টাফ আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। আমি সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংবরন করে নিলাম। ওরা তো আর জানেনা আমার মাথায় মাঝে মধ্যেই প্রদোষ মিত্তির ভর করে। মনে হয় আমি যা ভাবছি তা সঠিক। কিন্তু যা ভাবছি তা অত্যন্ত সন্তর্পণে করতে হবে। এর জন্য দরকার এর পরের স্টেপগুলো ভালো করে বোঝা।
‘আপনাকে এমন অনেক কাস্টমারকে হ্যান্ডেল করতে হতে পারে, যিনি টেকনিক্যাল ব্যাপারে একেবারে অজ্ঞ। মানে ধরুন ইন্টারনেট ব্যাবহার করতে জানেন না, ফোনের সিম যে নেট ব্যাঙ্কিং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তাও বোঝেন না। এইরকম মানুষজন মাঝেমধ্যেই বিভিন্নরকম অসুবিধের সম্মুখীন হন। হয় তারা ইউসার নেম নয় পাসওয়ার্ড ভুলে যান। প্রতিটি ইউসারের আকাউন্তকে অ্যাকসেস করার জন্য ব্যাঙ্কেরও একটি প্রসেস আছে। খালি ব্যাঙ্কারকে সেই কাস্টমারের ইউসারনেম ও পাসওয়ার্ড জানতে হবে’ চোখদুটো চকচক করছিল আমার। আজ একটা অপারেশনে নামবো। হথাত দেখি এক ভদ্রলোক আমার সামনে এসে দারিয়েছেন। ‘আপনিই কি বিপ্লববাবু, আমাকে ম্যানেজারবাবু পাঠিয়েছেন’ বুঝলাম ইনিই সেই যার দয়ায় কিছুটা ভাগ্যের জোরে আজ আমি ব্যাংকার অফ দা ইয়ার হতে চলেছি। জীবনে কখনো কোন কাস্টমারের সাথে এতো ভালো ব্যাবহার করিনি। দাঁতগুলো বাইরে বার করে হেঁসে ওনাকে বসতে বললাম। ‘আরে আর বলবেন না। আমি লোহার বিজনেস করি। আমরা কি আর এইসব নেট ফেট বুঝি। ছেলের জন্যই সব করতে হচ্ছে’ কিছুটা অনুসন্ধিৎসু হয়েই ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম ‘আপনার ছেলে কি করে? কোথায় থাকে?’ ‘আরে আর কি বলব ছেলের তো বিশাল ব্যাপার! কিছুতেই ১১-১২ এ সাইন্স পাচ্ছিল না, লাইন করে কলেজে সাইন্স পাইয়ে দিলাম। আজকাল তো আবার ইঞ্জিনিয়ার না হলে পাড়ায় মুখ দেখানো যায়না। বললাম, ব্যাটা ভালো করে পড়। ওই যে কিসব জয়েন্ট ফয়েন্ট হয়না, বললাম সেগুলো দে। শালা তাতেও ডাহা ফেল। ৩-৪ টে লিস্ট বার করল গরমেনট, ওর শালা নাম নেই। তারপর এক বন্ধু বলল প্রাইভেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোতে নাকি ম্যানেজমেন্ট কোটা থাকে। এই দশ বিশ লাখ ডোনেশন দিতে হয়’ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ‘সেরকমই একটা কলেজে গেছিলাম বলে নেট ব্যাঙ্কিং এ টাকা দিতে হবে তাই একটা বানাতে এলাম’ আমার মনের কথাতো আর ওনার পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়, উনি এটাও বুঝলেন না আমি কেন এতো হাসিখুশি রয়েছি। আনন্দে ওনার দুহাত জড়িয়ে ধরলাম। ‘আপনার ছেলে তো দাদা আর ৩-৪ বছরেই ভিআইপি হয়ে যাচ্ছে। আমার একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে। আমি একটা গরীব ছেলেদের জন্য এনজিও চালাই। বলবেন চাকরি পাওয়ার পর যেন কিছু দান করে’ সেই ভদ্রলোকের হাঁসি তো বাঁধ মানেনা। সত্যিই পয়সায় বেচে যাওয়া শিক্ষাব্যাবস্থার মেধা ওনার ছেলে, এরাই তো দেশের ভবিষ্যৎ।
সেই ভদ্রলোককে নেট ব্যাঙ্কিং এর আকাউন্ত ক্রিয়েট করে দিয়ে আমিও চললাম নিজের অপারেশনে। অপারেশন কমপ্লিট করতে প্রায় ঘণ্টা তিনেক লেগে গেলো। মনে মনে একবার বিড়বিড় করে উঠলাম ‘বিপ্লব পোদ্দার ব্যাংকার অফ দ্যা ইয়ার’। শালা এতদিন পরে নিজেকে সত্যি হিরো হিরো লাগছিল। প্রায় ঘণ্টা ৬-৭ একটা সিগারেট ধরাইনি। তাই আমি অফিসের বাইরে চলতে শুরু করলাম। অফিস থেকে বেরিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে সুখটান দিয়ে চলেছি আর মনে পড়ে যাচ্ছে একেকটা ঘটনা। তখন সবেসবে চাকরি পেয়েছি, এক ব্যাক্তি এসে প্রায় পায়ে পড়ে গেলো। ‘দাদা, ছেলেটা জয়েন্টে দারুন র*্যাঙ্ক করেছে। গরমেনট কলেজে চান্স পেয়েছে। মাত্র ৫০ হাজার টাকা লোণ চাই। আমি রিক্সা চালাই দাদা। আপনাদের হাতে তো এতো টাকা, দাদা আমায় এইকটা টাকা যেভাবে হোক দিয়ে দিন। ছেলেটাকে কলেজে ভর্তি করতে না পারলে কাউকে মুখ দেখাতে পারবো না দাদা’। মুখের ওপর বলেছিলাম ‘না দাদা, এখানে আপনাদের মত নিম্নবিত্তকে লোণ দেওয়ার কোন স্কিম নেই’। তার ঠিক ২ বছর পর আমার ছেলেটা মারা গেছিল। শালা এ্যাম্বুলেন্সে যখন ছেলেটা হেঁচকি তুলছিল, বিচি শুকিয়ে গেছিল একদম। মনে হচ্ছিল সেই রিক্সাওয়ালাটা পাশে বসে বলে চলেছিল ‘দেখ রে মাদারচোঁদ, ছেলের কষ্ট কেমন লাগে’। শালা ছেলের মৃত্যুর চেয়েও বোধ হয় বেশী কষ্ট ছেলের ক্যারিয়ার নিজের চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যেতে দেখা। দৌড় দৌড় শুধু ইঁদুর দৌড়। এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে গেলে অন্য কেউ পাছায় লাথি মেরে বেরিয়ে যাবে। শুধু দৌড়াতে হবে। কি পেলাম এই দৌড়ে, ছেলেটাকেই তো বাঁচাতে পারলাম না। বউটা শালা দুরারোগ্য রোগের রুগী হয়ে গেলো। যদি আমার বাপের একটা দু নাম্বারি বিজনেস থাকতো? যদি আমি মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মাতাম? তাহলে কি আমায় সত্যিই এই দিন দেখতে হত? শালা উচ্চবিত্তের ছেলে মেধাবী না হয়েও ম্যানেজমেন্ট কোটায় ইঞ্জিনিয়ার আর নিম্নবিত্তের ছেলে মেধাবী হয়েও রিক্সা চালায়। ১০ শতাংশ মানুষ, রোজ বাকি ৯০ শতাংশের পোঁদ মেরে চলেছে, আর আমরাও ভাগ্য, ঈশ্বর ইত্যাদি অজুহাত দেখিয়ে রোজ ওই ১০ শতাংশের দিকে পোঁদটা সুন্দরভাবে এগিয়ে দিচ্ছি। না, আমি নগন্য। আমি শুধুই থিওরি চোঁদাতে পারি।
Like Reply
#50
এইসব আতলামি করতে করতেই মগজটা হথাত অন্য অভিমুখে ঘুরে গেলো। অফিসের সামনে বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম হয়েছে। সার দিয়ে একের পর এক গাড়ি দাঁড়িয়ে। তারই মধ্যে একটা সাদা রঙের আম্বাসাডার গাড়ি। এই গাড়িটা আমি প্রচণ্ড ভালো করে চিনি। এটা শর্মাজীর। কাঁচটা সামান্যই নীচের দিকে নামানো। তাও বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে গাড়ির মধ্যে সাজুগুজু করা কোন এক সুন্দরী রমনী রয়েছে। কে সে? এইকি জুলি? একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওইদিকে। গাড়ির কাঁচটা ধীরে ধীরে নীচে নামছে। আমিও জানি আজ এই মুহূর্তেই হয়ত আমি এতো বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকা রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে পারবো। গাড়ির কাঁচটা একটু একটু করে নীচে নামছে আর আমারও মনের সেই ইচ্ছেটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। জুলি কে? হথাত গাড়িটা বেশ কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো। আমি কিছু বোঝার আগেই সিগন্যালটা গ্রিন হয়ে গেলো ও গাড়িটা অনেক আগে এগিয়ে গেলো। জানি এই সুযোগ হয়ত আর জীবনে দ্বিতীয়বার পাবনা। রাস্তা বরাবর দৌড়াতে শুরু করলাম, সামনেই একটা নো রিফিউসাল ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে। অন্য কেউ চেপে বসার আগেই আমায় ওটায় চেপে বসতে হবে।
ভাগ্য আমারই পক্ষে ছিল। খুব সহজেই ট্যাক্সিটা পেয়ে গেলাম। ‘দাদা, ওই সামনের গাড়িটাকে ফলো করুন। টাকা নিয়ে ভাববেন না’। শালা টাকার লোভ কেই বা ছাড়তে পারে। আমার ট্যাক্সিটাও প্রচণ্ড বেগে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। শত চেষ্টা করেও আমি গাড়ির ভেতরে যে মহিলা আছে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছিনা। আমাদের গাড়িটা প্রচণ্ড স্পীডে শর্মাজীর গাড়িটাকে ফলো করতে শুরু করল। প্রায় আধ ঘণ্টা আমরা পিছু নিয়ে চলেছি। আবার বাঁধ সাধল সেই ট্রাফিক সিগন্যাল। শালা, এইবার ভাগ্য বিশাল জোরে একটা লাথি মারল। ওদের গাড়িটা সিগন্যাল রেড হওয়ার বেশ কিছু আগেই পার হয়ে গেছিল। মনে হয়না ৫ মিনিটের আগে আমরা এখান থেকে বেরোতে পারবো। সুতরাং জুলি কে সেই রহস্য আমার পক্ষে আর সমাধান করা সম্ভব নয়। রমাকি জুলি? না রমা জুলি নয়? রমার ডায়েরী বা রমার চিঠি এই দুটো থেকেই আমি বুঝেছি, রমা জুলি নয়, কিন্তু জুলি রমার পরিচিত কেউ। কিন্তু কে সে? এরকম নয়ত রমা ছলনা করছে। রমা আমায় ঠকাচ্ছে! নিজেরই মনে একবার বলে উঠলাম ‘না, রমা আমার সাথে এরকম করতে পারেনা’। জানি ওদের আর ধরতে পারবো না, কিন্তু রমাই কি জুলি? এই রহস্যটা সমাধান এখনো সম্ভব। যদি শর্মাজীর গাড়িতে রমা থেকে থাকে তাহলে ল্যান্ড লাইনে ফোন করলে ও কিছুতেই রিসিভ করতে পারবেনা।
যা ভাবা তাই কাজ, সঙ্গে সঙ্গে আমার ল্যান্ড লাইন নাম্বারটায় ফোন লাগিয়ে দিলাম। মনে সন্দেহ রয়েছে, দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে কিন্তু হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘না রমা, বাড়িতেই আছে’। ক্রিং ক্রিং করে রিং হয়ে চলেছে। প্রতিটা রিং এর প্রতিধ্বনি আমার বুকের মধ্যে হচ্ছে। আমার হৃদয় বারবার করে বলে চলেছে ‘রমা তুমি ঘরের যে প্রান্তেই থাকো আগে ফোনটা রিসিভ কর’ অন্তত ২০ বার ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হোল, কিন্তু কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। রমার দিদি মিতা কোথায়? ওরা দুই বোন মিলে আবার কোথাও বেরয়নি তো? এই শোকের পরিবেশে বাইরে ঘুরতে যাওয়াটা সত্যিই অস্বাভাবিক। আমি আবার একবার কল করলাম। কিন্তু বারবার রিং হওয়ার পরও কেউ ফোনটা রিসিভ করলনা। নিজেরই অজান্তে চেঁচিয়ে উঠলাম ‘রমা তুমি কোথায়?’ এদিকে সিগন্যালটা আবার গ্রীন হয়ে গেছে। ড্রাইভার গাড়িটা একটু বাঁদিক করে পার্ক করে আমায় জিজ্ঞেস করল ‘স্যার, এবার কোথায় যাবো’। হতাশায়, ভয়ে আমার দুই চোখ জলে ভোরে উঠেছে। ‘ঈশ্বর যেন আমার সন্দেহ সত্যি না হয়। যেন রমা বাড়িতেই থাকে’ মনে মনে বলে উঠলাম। দেখি ড্রাইভারটি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘কিছু প্রবলেম হয়েছে স্যার?’ ওর কথায় আমার হুঁশ ফিরল। কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলাম ‘ভাই, আমি স্যার নই। তোমারই মত খেটে খাওয়া এক মানুষ। কলকাতার এই রাস্তাগুলো তুমি আমার চেয়ে অনেক ভালো বোঝ। ওই গাড়িটার মধ্যে আমার জীবন রয়েছে। ওই গাড়িটা খুঁজে না পেলে আমি বাঁচব না’ দেখলাম ড্রাইভারটা বেশ কিছুক্ষন আবেগপ্রবণ হয়ে রইল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘চিন্তা করবেন না দাদা, এই রাস্তাটা সোজা বাইপাসের দিকে গেছে। আমি ওইদিকেই যাচ্ছি’ গাড়িটা আবার চলতে শুরু করল। শ্রান্ত শরীরে আমিও হেলান দিয়ে পড়ে থাকলাম।
সত্যিই কি রমার ওই চিঠি বা রমার ডায়েরী এসব শুধুই আমার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য! বারবার করে নিজের মনে প্রশ্ন করতে লাগলাম। আমার হৃদয়ে রমার অংশই সর্বাধিক। ‘না রমা জুলি নয়’ এই কথাটাই তাই বারবার করে ভেসে আসতে লাগলো। আমার তো আর কলার আইডি নেই, তাই ল্যান্ড ফোনে কে ফোন করেছে তা ওর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। শেষ উপায় রমার মোবাইলে ফোন করা। যদি সত্যিই ও শর্মাজীর সাথে থেকে থাকে তাহলে আশেপাশের ট্রাফিকের আওয়াজেই আমি তা বুঝে যাবো। কল লাগালাম রমার মোবাইলে। সুইচড অফ। চোখদুটো হতাশায় বন্ধ করে নিলাম। মনিদা খুন হয়েছিল শুক্রবার। শুক্রবার অফিসে চরম ব্যস্ততা ছিল। ফিরতে একটু দেরী হবে এটা বলার জন্য ওকে ফোন করেছিলাম। একদম একি অবস্থা ছিল। ল্যান্ড ফোনে কেউ ফোন রিসিভ করেনি। রমার মোবাইলটা সুইচ অফ বলছিল। বাড়ি ফিরে দেখলাম বিছানার ওপর রমার ঘামে ভিজে প্যানটিটা পড়ে রয়েছে। সাধারনত সালোয়ার পরে বাইরে না বেরলে রমা প্যানটি ইউস করেনা। সঙ্গে সঙ্গে রমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘রমা, তুমিকি কোথাও গিয়েছিলে?’ কিছুটা চমকে উঠেছিল রমা। ও তারপর উত্তর দেয় ‘কই না তো’। আরও অনেক অনেক ঘটনা রয়েছে এবং তার সাথে যোগ হয়েছে রমার এই ফোন না ধরা। রমাকি সত্যিই আমায় ছলনা করে চলেছে। নিজের মনকে বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। আবার ল্যান্ড ফোনে একবার ফোন করলাম। সেই একি ক্রিং ক্রিং করে শব্দ হোল আর তারপর ফোনটা কেটে গেলো। হতাশা শুধুই হতাশা। চোখদুটো বন্ধ করে পড়ে রইলাম।
এইভাবে কতক্ষন গাড়িটা চলেছে খেয়াল নেই। বাইপাশের ঠাণ্ডা হাওয়া আর সারাদিনের ধকল; সবমিলিয়ে এতো ক্লান্তি এসেছিল কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। ড্রাইভারের প্রচণ্ড জোরে একটা চিৎকারে ঘুমটা ভাঙল। ‘স্যার, ওই যে গাড়িটা’। চোখ খুলে দেখি, বাইপাশের একধারে গাড়িটা পার্ক করা আছে। আমাদের গাড়িটা ঠিক ওর পেছনে পার্ক করা হোল। আমরা দুজনেই দৌড়ে গাড়িটার কাছে গেলাম। আবার দুটো মৃতদেহ, শর্মাজী আর শর্মাজীর ড্রাইভার। আশপাশটা সম্পূর্ণ জনহীন। একজনকেও দেখা যাচ্ছেনা। খালি কয়েকটা গাড়ি প্রচণ্ড স্পীডে বেরিয়ে চলে যাচ্ছে।
Like Reply
#51
19

ড্রাইভারের মুখের দিকে একবার তাকালাম। ভয়ঙ্কররকম ভয় পেয়ে গেছে। আমাকে ফিসফিস করে বলতে শুরু করল ‘স্যার, চলুন এখান থেকে পালিয়ে যাই, নয়ত পুলিশ কেসে ফেঁসে যাবো’। সত্যি ও ঠিকই বলছে, এই অবস্থায় যদি আমাদের কেউ দেখে ফেলে তাহলে স্বয়ং ভগবানও আমাদের বাঁচাতে পারবেনা। দ্রুত গাড়িটা স্টার্ট করে আবার অফিসের দিকে যেতে শুরু করলাম। কাল রাতে রঞ্জন খুন আর আজ সকালে চিন্ময় খুন আর এখন শর্মাজী খুন। কোন উর্বর মস্তিস্কের সিরিয়াল কিলার এতো দ্রুত খুন করার চেষ্টা করেনা কারন এতে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল হয়। তাহলে কেন? কেউকি পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে সেফ স্থানে রাখতে চাইছে। কিন্তু কে? রঞ্জন, চিন্ময়, শর্মাজী মৃত। তাহলে কে? সন্দেহ করার মত একজনই বাকি রয়েছে তিনি বিজয়দা। মধুকর ভিলা থেকে প্রায় ফিল্মি আদবকায়দায় পালিয়ে আসার সময় থেকেই বিজয়দার ওপর আমার প্রবল সন্দেহ। কিন্তু, সত্যি বলতে বিজয়দা ঠিক কিভাবে এই ঘটনার সাথে জড়িত তা এখনো আমার কাছে পরিস্কার নয়।
ভাবলাম আরও একবার রমাকে ফোন করি। বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন করে লাভ নেই কারন আমি সিওর যে বাড়িতে নেই। রমার মোবাইলে আবার একবার ফোনটা লাগালাম। অদ্ভুতভাবে এবার রিং হোল অথচ কিছুক্ষন আগেও সুইচ অফ ছিল। বার ৬-৭ রিং হওয়ার পরই রমা রিসিভ করল। আমার মাথা থেকে যেন একরাশ কালো মেঘ নেমে গেলো।
‘হ্যালো, রমা তুমি কোথায়? তুমি জানো তোমায় কতবার ফোন করেছি আমি। তোমার মোবাইল সুইচ অফ...’ আমার কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই রমা বেশ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল ‘বিপ্লব, তুমি কোথায়? আমায় এক্ষুনি তোমার সাথে দেখা করতে হবে’ ওর কথাটা মোটামুটি বুঝতে পারলেও ভয়েসটা ক্লিয়ার আসছিলনা। আশপাশ থেকে বেশ কিছু বাস ট্রামের শব্দে বিশাল একটা নয়েস তৈরি হচ্ছিল। এতোটুকু বুঝলাম যে রমা খুব ভয়ের মধ্যে রয়েছে। আমি বললাম ‘রমা তুমি কোথায় আছো বল আমি এক্ষুনি আসছি’ মনে হয় রমা আমার কথাটা শুনতে পেলো না। ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলতে বলতে লাইনটা কেটে গেলো। এ এক ভয়ঙ্কর বিপদ। রমা কোথায় আছে তা না জানলে ওকে কোনমতেই উদ্ধার করা সম্ভব নয়। আমি আবার একবার ওকে ফোন করতে যাচ্ছি দেখি আমার মোবাইলেই ফোন চলে এলো। কার ফোন না দেখে সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে নিলাম।
‘হ্যালো রমা তুমি কোথায়? প্লিস বল তুমি কোথায়? আমি সত্যিই খুব চিন্তায় আছি’ আমাকে সম্পূর্ণ স্তম্ভিত করে দিয়ে ওপাশ থেকে এক পুরুষ কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘আরে বিপ্লব বাবু আপনি কোথায় বলুন তো? কতবার বলেছি যে নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না। যা কিছু হবে পুলিশকে জানাবেন। আবার আপনি একা একা...’ আমার আর সহ্য হচ্ছিলনা। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বললাম ‘বিজয়দা, আমার স্ত্রী ছাড়া এই পৃথিবীতে সত্যিই আমার কেউ নেই। ওর কোন ক্ষতি যেন না হয়’ বিজয়দার উত্তরটা ছিল ভয়ঙ্কর রহস্যময়। ‘নিজেকে একটু বেশীই স্মার্ট ভেবে ফেলেছেন আপনি। রমাদেবী কি করে বিপদ কাটিয়ে উঠবেন তা আমি জানিনা। কিন্তু আপনি ভাবুন আপনি নিজের বিপদটা কিকরে কাটাবেন?’ যেন মাথার ওপর বাজ পড়ল। বিজয়দা কি আমায় হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন। নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম ‘আপনি কি বলতে চান?’ সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে ঠাণ্ডা গলায় যা ভেসে এলো তা আমার হৃদয়ে কম্পন ধরাতে বাধ্য। ‘যেদিন মনীন্দ্র বাবু খুন হয়েছিলেন হোটেলের ঠিক বাইরে আপনার স্কুটার পার্ক করা ছিল। হোটেলের পারকিং লিস্টে আপনার স্কুটারের নাম্বার পাওয়া গেছে। পার্ক করেছিলেন ঠিক ৯-১০.০০ এর মধ্যে। মনিবাবুকে ওপর থেকে নীচে ফেলে দেওয়া হয় ঠিক সাড়ে ৯ টার সময়’ আর সত্যিই নিজেকে সংবরন করা সম্ভব ছিলনা। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে বলে উঠলাম ‘বিজয়দা আপনি কি মনে করেন খুনগুলো আমি করছি। আর আপনি বোধ হয় এটা ভুলে গেছেন যে হোটেলে মনিবাবু উঠেছিলেন তার ঠিক উল্টো দিকেই আমার অফিস। অফিস যাওয়ার পথে হোটেলটা বাঁ দিকে পরে তাই মাঝে মধ্যে ওখানে আমি গাড়িটা পার্ক করে দি। সেদিন অর্ধেক রাস্তা যাওয়ার পর আমি ফেরত আসি। শর্মাজীর লোণের কাগজ অফিসেই ফেলে এসেছিলাম। ওটাই আনতে যাই। সাক্ষী হিসেবে আমি...’ আর বলতে পারলাম না, কিকরে বলি সাক্ষী হিসেবে আমি শর্মাজীর নাম বলতে পারি, ও তো মৃত। ফোনে হলেও বিজয়দার অট্টহাস্য চিনতে আমার খুব একটা অসুবিধে হলনা।
‘সাক্ষী হিসেবে কার নাম আপনি পেশ করবেন বিপ্লব বাবু? শর্মাজী? শর্মা তো মরে ভূত হয়ে গেছে’ আমার মাথাটা বনবন করে ঘুরতে শুরু করে দিলো। শর্মাজী যে মারা গেছে তা বিজয়দা কিকরে জানলেন? আমার কোন জবাব দেওয়ার আগেই বিজয়দা বলে উঠলেন ‘চিন্ময়ের খুন হওয়ার সময়ও ঘটনাস্থলে আপনি ছিলেন’ এবার আর আমার পক্ষে নিজেকে সংবরন করা সম্ভব ছিলনা। চেঁচিয়ে বলে উঠলাম ‘রাষ্ট্র ব্যাবস্থা আপনাদের অস্ত্র দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে তার মানে তো এটা নয় যা ইচ্ছে তাই বলবেন। চিন্ময়ের খুন হওয়ার সময় তো আগে ঘটনাস্থলে আপনি পৌঁছেছিলেন’ আমার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বেশ জোরে একটা অট্টহাস্যের সাথে বিজয়দা বলে উঠলেন ‘কই না তো আমি তো ঘটনাস্থলে খুন হওয়ার অনেক পরে গেছিলাম। এক সোর্স এর দেওয়া ইনফরমেশন পেয়ে গেলাম আর দেখি আপনি দাঁড়িয়ে আছেন, আপনার হাতে রক্তের দাগ। কি বিপ্লব বাবু, চার্জশিটটা কেমন হবে বলুন তো? ওহ মিডিয়া থেকে পলিটিসিয়ান প্রত্যেকেই একদম চেটে পুটে খাবে’ নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছিলনা। কিছুটা হতাশার সুরে আমি বললাম ‘বিজয়দা, কোন প্রমান ছাড়া আপনি কিছুতেই আমায় গ্রেফতার করতে পারবেন না’ আবার একটা অট্টহাস্য। ‘আপনার বাবা কি এমএলএ না আপনার মেসোমশাই মন্ত্রী? কে বলল পুলিশ কোন প্রমান ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনা। শুধু একটা শক্তিশালী চার্জশিট বানাতে হয়’ আর সত্যি ধৈর্য রাখা সম্ভব ছিলনা। ‘আপনার যা করার করে নিন, পারলে ফাঁসি কাঠে চড়িয়ে দিন। এখনো দেশে গনতন্ত্র বলে...’ আমায় আবার থামিয়ে দিয়ে বিজয়দা কিছুটা উপহাস করেই বলে উঠলেন ‘একি ভুতের মুখে রামনাম শুনছি তো। বিপ্লব আর গনতন্ত্র। ওরে বাবা, বিপদে পড়লে যেমন মানুষ মন্দিরে যায় বিপ্লবও তাহলে গনতন্ত্রের কথা বলে’ সত্যিই আমার উত্তর দেওয়ার কিছুই ছিলনা। নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বললাম ‘আপনি কি চান বিজয়দা? আপনি কার পক্ষে, সত্যের না মিথ্যার?’ প্রায় এক মিনিট নীরবতা। ‘আমি আপনাকে একটা শিক্ষা দিতে চাই, এমন শিক্ষা যা আপনি সারাজীবন মনে রাখবেন। কাল সকাল ৬ টায় আমি আপনাকে গ্রেফতার করব। ওপরমহল থেকে এই কেসটার চার্জশিট বানিয়ে ফেলার জন্য প্রচুর চাপ দিচ্ছে। আমার কাছে যা মেসিনারি আছে তাতে অনায়াসেই আপনাকে গ্রেফতার করা যায়’ আমার মুখ দিয়ে একটাও কথা বেরোল না। জানি বাঘের মুখে পড়ে গেছি, তবুও ঠাণ্ডা মাথার মানুষকে ছুঁতে বাঘও দুতিন বার ভাবে। তাই নিজেকে একটু সংবরন করে বললাম ‘বিজয়দা, যদি আমি পালিয়ে যাই তাহলে?’
[+] 1 user Likes samss400's post
Like Reply
#52
আবার একটা অট্টহাস্য। ‘আপনি তো ড্রাইভারের পাশে বসে আছেন তাই তো। একবার আড় চোখে ওর প্যান্টের পকেটের দিকে তাকান’ কিছুটা বিস্মিত হয়েই আমি তাকালাম। প্যান্টের পকেটটা উঁচু হয়ে রয়েছে। ‘কি দেখলেন আর কি বুঝলেন?’ আমি ভেবেচিন্তে কিছু জবাব দেওয়ার আগেই বিজয়দা বললেন ‘ও পুলিশের ইনফরমার। ৭ বছর জেল খেটে এখন জামিনে মুক্ত। আমার এক বাক্যে ও আপনার মাথায় টুক করে একটা গুলি মেরে লাশটা বাইপাশে ফেলে চলে আসবে’ ভয়ে আমার হাত পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিলো। চুপ করে বসে থাকলাম। ‘পালাবার কোন চেষ্টা করবেন না। আপনাকে প্রতি মুহূর্তে কেউ না কেউ নজর রাখছে’ আমি জানি আমি চক্রব্যূহের মধ্যে পড়ে গেছি। এখান থেকে পালানো প্রায় অসম্ভব। মোবাইলটা কানে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলাম। আবার একবার আড় চোখে ড্রাইভারের দিকে তাকালাম। ‘বিজয়দাকে আমার প্রনাম জানাবেন’ ড্রাইভারের কথায় আমার বুকের ধুকপুকানিটা ১০০ গুণ বেড়ে গেলো। ‘বিপ্লব বাবু, শারলক হোমস হওয়ার জন্য আমাদেরকে ২ বছরের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আপনাদের মত সাধারন লোক যদি শারলক হোমস হয়ে যায় আমরা খাবো কি!’ আমার কাছে কোন দ্বিতীয় রাস্তা ছিলনা, শুধুমাত্র বিজয়দার কথা শুনে যাওয়া ছাড়া। ‘এই পুলিশের চাকরিটা করার জন্য আমি ২ খানা এসি ঘরের চাকরি ছেড়েছি বিপ্লব বাবু। আপনি তো এখনো জুলিকেই খুঁজে বার করতে পারলেন না। ওহ সরি, সত্যি বলতে চিনতে চাইলেন না। ভালোবাসা, বুঝলেন বিপ্লব বাবু ভালোবাসা এটা মানুষকে অন্ধই বানিয়ে এনেছে চিরকাল’ ফোনটা কেটে দিলেন বিজয়দা। ওনার শেষ কয়েকটা কথা হয়ত আমার কাছে অমৃতবানীর সমান। সত্যি ভালোবাসা, এই শব্দটার জন্য আমি কেরানী হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিলাম।
চোখ দুটো বুজে ভেবে চলেছি, দেখি আবার ফোন। জানি রমাই ফোনটা করেছে। কিছুতেই মন চাইছিলনা ফোনটা রিসিভ করতে। বারবার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘বিপ্লব বাবা, সোনা আমার, আমাদের কথাও একটু ভাব। তুই একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। এভাবে একটা মেয়ের জন্য পাগল হয়ে যাস না বাবা। কত সরকারী চাকরির পরীক্ষা বেরোয়, ওগুলোর জন্য পড়, তুই একটা সরকারী চাকরি পেলে আমাদের অবস্থা ফিরে যাবে, কত কষ্ট করে তোকে আমরা পড়িয়েছি বল তো?’ সেদিন নিজেকে সামলাতে পারিনি কেঁদে মায়ের কোলে মাথা গুঁজে দিয়েছিলাম। ‘মা, আমি রমাকে ছাড়া বাঁচব না মা। ওর বাড়িতে আমাদের বিয়েটা কিছুতেই মেনে নেবেনা। আমাকে একটা চাকরি জোগাড় করতেই হবে মা। নয়ত আমি রমাকে হারিয়ে ফেলব’ মায়ের চোখেও জল ছিল, ‘দেখ যা ভালো বুঝিস, তবে তোর বাবাও মানবে না। তোর জন্য আমরা সবই ছেড়েছি। তোর বাবা, কখনো মানবে না’ না আমার বিয়েটা আমার বাবা মেনে নেয়নি কখনো। প্রথমে এই ব্যাঙ্কের চাকরিটা জোগাড় করা তারপর রমাকে বিয়ে করে একটা ভাড়া বাড়িতে উঠলাম। শ্রেনী বৈষম্যই এই সমাজের সবচেয়ে বড় রোগ। অনেক পরে বুঝেছি, একটা বড়লোকের মেয়েকে বিয়ে করেই জীবনটা নষ্ট করেছি। মায়ের কথা, বাবার কথা, পুরনো বন্ধুদের কথা এগুলো যত মনে পড়ছিল, বুকের মধ্যে একরাশ ঘৃণা জমা হচ্ছিল। ফোনটা বাধ্য হয়েই রিসিভ করলাম।
‘বিপ্লব, আমার কথাটা মন দিয়ে শোন...’ ভালো লাগছিলনা আর রমার ওই ন্যাকা ন্যাকা মিষ্টি মিষ্টি কথাগুলো শুনতে। ওকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলাম। ‘রমা, তুমি কি সত্যিই আমায় ভালোবাসো? পারবে আমি যদি তোমায় এক্ষুনি হাওড়া ব্রিজ থেকে ঝাঁপ দিতে বলি, ঝাঁপ দিতে। রমা তোমাকে না পেলে সত্যিই আমি আত্মহত্যা করতাম। রমা তুমি আমায় ঠকিয়েছ। রমা আমার ওই বস্তাপচা আইডিওলজিই ঠিক। শ্রেনী চরিত্রই শেষ কথা। আমার উচিত হয়নি তোমার মত একটা বড়লোকের আদুরে মেয়েকে ভালোবাসা। তোমার জন্য আমি আমার বাবা মার কাছে ছোট হয়ে গেছি’ আমি নিজেও বুঝতে পারিনি যে আমার কণ্ঠস্বর ক্রমশ এতো তীব্রতর হয়ে যাবে। ট্যাক্সিচালক কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েই গাড়িটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করায়। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে তখন রমার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠার শব্দ ভেসে আসছে। ‘বিশ্বাস কর বিপ্লব, আমি তোমায় ঠকাই নি। আমি তোমায় আজও ভালোবাসি আগের চেয়ে অনেক বেশী ভালোবাসি। আমি প্রতি মুহূর্তে তোমার খেয়াল রাখার চেষ্টা করি’ মাথাটা বনবন করে ঘুরছিল ‘খেয়াল রাখার চেষ্টা কর! এতবড় মিথ্যে কথাটা তুমি বলতে পারলে। কোনোদিন ভেবেছ ওই পুরনো বাড়িটায় আমার বাবা মা একা একা কি করে থাকে? তুমি জানো শেষ দশ বছরে প্রতিদিন আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। একবারও বুঝতে পেরেছ, আমি কষ্ট পাই বলে। তোমার মুখে হাঁসি ফোটানোর জন্য আমি কি করিনি রমা! ক্লাউন সেজেছি ব্যাঙ্কে কেরানীর চাকরি করেছি, নিজের আইডিওলজি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি, তুমি কি করেছ রমা’
রমার বুজে আসা গলাটা থেকে একটাই শব্দ বেরোল ‘আমি জানি বিপ্লব তুমি আমায় বিশাল ভুল বুঝেছ। কিন্তু আমি তোমায় সত্যি প্রচুর ভালোবাসি বিপ্লব’ আর শালা শুনতে ভালো লাগছিলনা। ‘ভালোবাসা’ এর মানে কি? তাই শালা বুঝলাম না। নিশ্চয়ই ভালোবাসা মানে এই নয় একটা বড়লোকের মেয়ের আজীবন চাকরে পরিনত হয়ে যাওয়া। রমার ওপর আমার দুঃখটা শুধু একটাই জায়গায়। আমি ফোনটা কেটে দিলাম। জানি রমাও প্রচণ্ড অভিমানী ঘুরে ফোনটা আর ও করবেনা। নাহ, এরকম মাগীর মত ফিচফিচ করলে হবেনা। চোখদুটো ভালো করে মুছে ডান দিকে তাকালাম। দেখি ড্রাইভারটি অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
‘ভাই তুমি তো দাগী আসামী। হাড়কাটা গলি বা সোনাগাছিতে যাতায়াত আছে নিশ্চয়ই’ আমার এই আকস্মিক কথাটা শুনে ড্রাইভার ভাই তো পুরো পিলে চমকে গেলো। আমি আবার বললাম ‘সেরকম কিছু করেছ কি?’ এবার একটু আমতা আমতা করে ওর জবাব এলো ‘সেরকম মানে? কি বলছেন?’ একটু মুচকি হেঁসে উত্তর দিলাম ‘এই বিডিএসএম মানে দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে রেন্দি চোঁদা বা ওইধরনের কিছু?’ ‘আরে দাদা, কি যে বলেন। আমরা কি আর হাইফাই মাগী চুদি। আমরা তো পেটো বেশ্যাতেই খুশি থাকি’ বুঝলাম মালটার ওইদিকে একটু আধটু যাতায়াত রয়েছে। টোপটা দিয়েই দিলাম। ‘আপার ক্লাস কল গার্ল কে চুদবে? একদম ফুল বিডিএসএম। টাকা নিয়ে ভাববে না’ বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর উত্তর এলো ‘হ্যাঁ, দাদা, আপনি যদি পাইয়ে দেন, কেন হাতছাড়া করব’ আমিও জিজ্ঞেস করলাম ‘একটা ফাঁকা ঘর জোগাড় করতে পারবে। আমার আবার একটা শখ রয়েছে। যতই হাইক্লাস মাগী চুদি না কেন ওই হাড়কাটা গলি বা সোনারগাছির ভেতরেই চুদব। ওখানে মজাই আলাদা’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর এলো ‘আরে দাদা, কোন চিন্তা করবেন না। হাড়কাটা গলিতে আমার খাতা চলে। প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম ‘দেখি তোমার ফোনটা। একটা মাগী আছে নাম জুলি। প্রথমে রং নাম্বার বলবে। তারপর নিজেই অন্য একটা নাম্বার থেকে কল করবে। যে রেট ই বলুক না কেন হ্যাঁ বলে দেবে। আর একটা কথা একটু আপার ক্লাসদের মত কথা বল। নাও ডায়াল করে দিয়েছি কথা বলে নাও। আর হ্যাঁ, একটু খেয়াল কর তো গলাটা কি একটু ধরা ধরা লাগছে? নাও কথা বল’
কানটা খাড়া করে পেতে রাখলাম। অনেকক্ষণ রিং হোল কিন্তু কেউ রিসিভ করল না। ‘দাদা, ফোন তো রিসিভ ই করলনা’ ড্রাইভারের দিকে একটু মুচকি হেঁসে বললাম ‘কয়েক মিনিটের মধ্যে একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসবে। রিসিভ করবে’ কথাটা শেষ হতে না হতেই অন্য একটা নাম্বার থেকে ফোন এসে গেলো। আমিও সজাগ হয়ে থাকলাম। ‘হ্যালো জুলি?’ ‘একদম কাজের কথায় চলে আসছি। তোমার নাম্বার ইন্টারনেটের একটা সাইট থেকে পেয়েছি। বহুদিনের শখ তোমায়। কি? আরে কথাটা তো বলতে দাও’ আমি কানটা খাড়া করে পেতে রেখেছিলাম। দুখানা আবেগ; আনন্দ ও দুঃখ। আনন্দে বুকটা উথাল পাতাল হয়ে যাচ্ছে এই ভেবে যে আন্দাজে আমার মারা ঢিলটা একদম ঠিক জায়গায় লেগেছে। আর যন্ত্রণা; থাক সে আর কাকে বোঝাবো! হৃদয় ভাঙ্গার যন্ত্রণা তো নিম্ন ও মধ্যবিত্তের রোজকার সম্বল। ড্রাইভার আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘কি নাম্বার দিয়েছেন দাদা, বলল তোমার নাম্বার পুলিশকে দিচ্ছি কয়েক মিনিটের মধ্যে পুলিশই তোমায় ফোন করবে’ আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। প্রচণ্ড জোরে অট্টহাস্য করে উঠলাম। মনে মনে বিড়বিড় করলাম ‘হ্যাঁ, পুলিশ, পুলিশই ফোন করবে’ মুহূর্তের মধ্যে অন্য একটা আননোন নাম্বার থেকে কল এলো। ড্রাইভার ফোনটা রিসিভ করল। এই কণ্ঠস্বরটি চিনতে পারা আমার পক্ষে অত্যন্ত দরকার। কানটা একদম সজাগ করে রইলাম। হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই। এই রাশভারী কণ্ঠস্বরটা কি আমি কোনোদিন ভুলতে পারি। ‘ওকে। হ্যাঁ, আমার গাড়ির নাম্বার এক্সক্সক্স। আর আধ ঘণ্টার মধ্যে কলেজ স্ট্রিটে ঢুকে যাচ্ছি। কলেজ স্কয়ারের সামনে অপেক্ষা করব। ওকে নো প্রবলেম’ ফোনটা কেটে ড্রাইভার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বলল ‘দাদা, ২ লাখ বলছে’ আমি শুধুই মুচকি হাসলাম। আরও একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে। তাই করেই ফেললাম ‘আচ্ছা, ভাই, জুলির গলাটা কি একটু ধরা ধরা লাগছিল?’ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে ও উত্তর দিলো ‘হ্যাঁ, একটু ভারী ভারী লাগছিল’
Like Reply
#53
আমাদের গাড়িটা ক্রমশ কলেজ স্ট্রিটের দিকে এগিয়ে চলেছে। বুকের মধ্যে একরাশ যন্ত্রণা যেমন রয়েছে এই ১০ বছর ধরে চেপে থাকা সমস্ত যন্ত্রণার একটা প্রতিশোধ নেওয়ার আনন্দও রয়েছে। ‘ভাই, আমার কিন্তু কয়েকটা শর্ত আছে। প্রথমত তুমি আরও ২-৩ জনকে জোগাড় কর। আর আন্যাল সেক্স ছাড়া অন্য কোনকিছু হবেনা। উফ জাস্ট ভাবতে পারছিনা। আপার ক্লাস কল গার্লকে আমরা সবাই মিলে পোঁদ মারব। ওর হাত পা দড়ি দিয়ে জানলার গরাদের সাথে বেঁধে রাখবো। সারা ঘর জুড়ে পানের পিকের দাগ। উফ জাস্ট ভাবতে পারছিনা’ ড্রাইভারটা কিছুটা নার্ভাস হয়েই উত্তর দিলো ‘দাদা, কোন প্রবলেম হবেনা তো? যদি...’ হয়ত ও ভাবতে পারেনি আমি এভাবে চেঁচিয়ে উথব। ‘মাদারচোঁদ ওই রেন্দিটার জন্য আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। ও মরে গেলেও আমার কোন কষ্ট নেই’ ও আর বেশী কথা বাড়াল না। আমাদের গাড়িটা মহানগরের বুক চিড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করল। চোখ দুটো বুজে নিলাম। এই কলকাতাতেই আমি জন্মেছি, জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছি। কত হেঁটেছি এই রাস্তায়। দুচোখ মেলে দেখতে থাকলাম আমার স্বপ্ন সুন্দরীকে আর ভেসে এলো এক নিম্নবিত্তের চোখে দেখা কলকাতা শহর।
‘রমা, আর দুটো মাস সময় দিতে পারবে! তুমি তো জানোই আমার অঙ্কটা প্রচণ্ড স্ত্রং। খালি ইংলিশ আর জিকেটা একটু ঘষে মেজে নিতে হবে’ ‘না, বিপ্লব তুমি সত্যি আমায় ভালোবাসো না। আমায় ভালবাসলে এভাবে শুধু নিজের কথাটাই ভাবতে পারতে না। তুমি জানো, আজ এক ডাক্তারের সম্বন্ধ এসেছিল। তুমি কি বোঝ কত কষ্টে আমি ওই সম্বন্ধটা আঁটকে দিয়েছি। আমার বাবা মা দাদারাও তো চায় যে আমি তাড়াতাড়ি সেটেল হয়ে যাই’ ‘রমা, আমার বাবা আমায় প্রচুর কষ্ট করে পড়িয়েছে। তুমি তো জানো আমাদের ওই পানের দোকানটায় সেরম কোন আয় নেই। আমি যদি একটা গরমেনট জব পেয়ে যাই, তাহলে পুরো সংসারটাই দাঁড়িয়ে যাবে’ ‘তুমি কি করে এই কথাগুলো বলছ বিপ্লব। একবারও বুঝতে পারছ না আমার ওপর দিয়ে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আর আমি তো তোমায় সারাজীবন প্রাইভেটে জব করে যেতে বলছি না। আগে আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক তারপর তুমি চেষ্টা করতে থাকো’
‘তুমি কি বিপ্লব, এখন আমরা সংসারী। তুমি জানো, একটা ছেলের বিয়ের পর কত দায় দায়িত্ব হয়। তুমি বলছ সরকারী চাকরির চেষ্টা করবে। একবারও তোমার হুঁশ আছে বিপ্লব, ৮০০০ টাকায় সংসারটা কিকরে চলবে?’ ‘দেখো রমা, আজকাল তো মেয়েরাও চাকরি করে। তুমিও যদি প্রাইভেটে একটা চাকরি করতে তাহলে আমিও পড়াশুনা করে একটা গরমেনট জবের জন্য চেষ্টা করতে পারি’ ‘তুমি কি বলছ বিপ্লব! জানো যদি বাবা সত্যি জানতে পারে টাকা রোজগারের জন্য আমি ওই প্রাইভেট এর নোংরা পরিবেশে গেছি, তাহলে সত্যিই হয়ত তোমাকে কখনো জামাই বলে মেনে নেবেনা’ ‘রমা কেন প্রতিটা কথায় তুমি তোমার বাবা, তোমার বাড়ি এগুলো টেনে নিয়ে আসো। তোমার বাবা মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্মেছে আমি নই। জীবনে অনেক কষ্ট করেছি রমা। টিউশন করে কলেজের খরচা তুলেছি। তোমার দাদা তো আমার সাথে পড়ত! ও জীবনে করেছে টা কি? বড়লোকের জানোয়ার ছেলে একটা। খালি ডাইলগবাজী আর দেখনদারী’ ‘বাহ বাহ চমৎকার। এই তো কলেজে শিখেছ। তোমাদের গোটা পৃথিবী সেই ৯০ এর দশকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কেউ তোমাদের আর ধর্তব্যের মধ্যেই রাখেনা। সেই গরীব, বড়লোক বিত্তের কচকচানি। তোমরা কবে বুঝবে বিপ্লব, যুগটা পাল্টাচ্ছে। এখন আর ওই থিওরি মানুষ খাচ্ছেনা। তোমার ক্যারিয়ার তোমার ওই বস্তাপচা তত্বই নষ্ট করেছে আমি নই’
‘বিপ্লব, তুমি কি মানুষ না পশু! কি হবে রঞ্জনদার কথাটা মেনে নিলে। ও তো বলেছে যে ওই কাজটায় ওর প্রায় ১৫ লাখের প্রফিট তার থেকে ১০ লাখ আমাদের ধার হিসেবে দিয়ে দেবে। কে আগে? আমাদের ছেলে না তোমার ওই বস্তাপচা আইডিওলজি?’ ‘রমা, বাবাইকে আমিও ভালোবাসি, নিজের প্রানের চেয়ে বেশী ভালোবাসি। কিন্তু ওকে বাঁচাতে অন্যকে আমি পথে বসাতে পারবো না। কোনমতেই পারবো না। আদর্শ বলে একটা জিনিষ আজও আমার মধ্যে রয়েছে, সে যতই আমি বড়লোকের মেয়ের চাকর হয়ে যাই না কেন!’ ‘চাকর! বাহ ভালো বলেছ তুমি। এই তোমার ভালোবাসা। বিপ্লব তুমি ভালোবাসার মধ্যেও রাজনীতির রং খুঁজে বেড়াও। নিজের ছেলেকে বাঁচানোর চেয়ে একটা গরীব মানুষকে বাঁচানো তোমার কাছে বেশী দামী হয়ে গেলো। কি পাবে, একটু নাম, লোকের প্রশংসা। আমি কিচ্ছু চাইনা আমি শুধু বাবাইকে দেখতে চাই’ ‘দেখো রমা, আমি তো বাবাইএর বদলে অন্যের ভালো করছিনা, আমি শুধু বাবাইএর ভালোর জন্য অন্যের ক্ষতি করতে চাইনা’ ‘তুমি মানুষ নয়, তুমি জানোয়ার। কেন আমায় ভালোবাসার স্বপ্ন দেখিয়েছিলে। বাবা, ঠিকই বলত ছেঁড়া কাঁথার ভালোবাসা জানলা দিয়ে পালিয়ে যায়। তুমি আমায় ভালোবাসো না বিপ্লব। তুমি বাবাইকেও ভালোবাসো না। তুমি শুধু নিজেকে ভালোবাসো। তুমি শুধু অন্যের মুখ থেকে নিজের ব্যাপারে ভালো ভালো কথা শুনতে চাও’ ‘আর এভাবে একটা মানুষকে শেষ করে দিওনা রমা। আমি জীবনে চুরিও করিনি, ডাকাতিও করিনি। তোমায় ভালোবেসে ফেলেছিলাম। তোমরা বড়লোক, তোমাদের বাড়িতে মানবে না এটা জেনেই তো আমরা ভালবেসেছিলাম। রমা, তোমায় বলিনি এতদিন। আমি কিডনি বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আজকের মধ্যেই জানতে পেরে যাবো কবে যেতে হবে’ ‘বাহ, চমৎকার। আবার সেই চে গুএভারা হওয়ার ইচ্ছে। তোমাদের চে কবেই মরে ভূত হয়ে গেছে। তুমি কিডনিটা বিক্রি করলে আমাদের হবে কি! একবারও ভেবেছ বিপ্লব। বিপ্লব বেরিয়ে আসো তোমার ওই বস্তাপচা তত্ব থেকে। এটা বিপননের দুনিয়া। তোমরা পিছিয়ে পড়েছ বিপ্লব’
‘রমা একটাবার মুখ ফুটে কথা বল। রমা রোজ অফিস থেকে এসে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। রোজ ভাবি আজ তুমি ঠিক কথা বলবে। রমা কেন তুমি কথা বলনা। ডাক্তার আমাকে প্রচুর বকে, বারবার করে বলে একবারের জন্যও আমি চেষ্টা করছিনা। রমা বোঝ এইভাবে তুমি একটা মারাত্মক ব্যাধির দিকে চলে যাচ্ছ। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমার কি হবে রমা? আমি কি করে বাঁচব? তুমি ছাড়া তো আমার আর কিছুই নেই, কেউ নেই। সবাই দূরে সরিয়ে দিয়েছে। রমা, একটু জিভটা নাড়াও, চেষ্টা কর তুমি ঠিক পারবে’ ‘বিপ্লব তুমি খুনি। তুমি বাবাইকে মেরে ফেলেছ। তোমায় কক্ষনো ক্ষমা করব না বিপ্লব। তুমি সারা জীবন একটা বস্তাপচা তত্ব আঁকড়ে পড়ে থাকলে। একবারও আমাদের কথা ভাবলে না। আমায় একটু বিষ দাও বিপ্লব’ ‘আমায় তুমি এভাবেই শেষ করে দাও রমা, এভাবেই প্রতি মুহূর্তে নিজের চোখে ছোট ছোট হতে হতে আমি মরতে চাই। আমি আমার বাবা, মাকে দেখিনি। তোমার চোখেও কখনো নায়ক হয়ে উঠতে পারিনি। আমি তোমার থেকে এগুলোই শুনতে চাই রমা। কিন্তু রমা, তুমি বল, যা তোমার মনে আসে তাই বল। আজ ৬ মাস পর তুমি কিছু বললে। রমা আর তুমি নীরব হবেনা কোনোদিন। প্রতি মুহূর্তে আমায় দায়ী করে যাও...’
‘দাদা, কলেজ স্ট্রীট এসে গেছে’ শুনে যেন মনে হোল এক পৃথিবী থেকে অন্য এক পৃথিবীতে এসে নামলাম। গলা দিয়ে কোন কথা বেরোচ্ছে না, ড্রাইভারটা ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নোনতা বিস্বাদ জলে আমার পুরো মুখ ভিজে যাচ্ছে। শুধু বাঁ হাতটা উঁচু করে অঙ্গভঙ্গি করে বোঝালাম ‘একটু জল, আমি একটু স্বাভাবিক হতে চাই’ ও নীচে নেমে দোকান থেকে একটু জল জোগাড় করতে গেলো। আমার শরীর আর পারছেনা। কোনরকমে মাথাটা সামনের ডেকটার ওপর রেখে দিলাম। চোখদুটো বন্ধ করে পরে থাকলাম। ‘একটা মানুষ জীবন্ত জ্বলে যাচ্ছে। দাউদাউ করে জ্বলছে। আমি জানলার রেলিং ধরে দেখছি। ভয়ঙ্কর একটা আর্তনাদ। ‘বিপ্লব তোমার ছেলে বাঁচবে না, বিপ্লব আমার অভিশাপ রইল তোমার ছেলে কষ্ট পেতে পেতে মরবে। এই টাকাটা আমার ৩ মেয়ের বিয়ের জন্য রেখেছিলাম। ওদের বিয়ে ভেঙে গেছে। বিপ্লব, তুমিও সেই নেতাদেরই মত যারা প্রতিদিন আদর্শকে ;., করে চলেছে। বিপ্লব তুমি যদি সাচ্চা হতে এতো কষ্টেও তুমি নিজেকে বিক্রি করতে না। বিপ্লব তোমার ছেলে মরবে এর চেয়েও বেশী কষ্ট পেয়ে মরবে। তুমি বাবাইকে বাঁচাতে পারবে না বিপ্লব। মিলিয়ে নিয়ো আমার কথাটা’
‘মেসোমশাই আমার কথাটা শুনুন’ প্রচণ্ড জোরে চিৎকার করে উঠলাম আমি। দেখি ড্রাইভার ভাই হন্তদন্ত করে হাতে একটা জলের মগ নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। ‘কি হয়েছে দাদা? শরীর খারাপ লাগছে? নিন চোখে মুখে একটু জল দিন’
ওর দিকে একবার তাকালাম। না ওকে আমি বোঝাতে পারলাম না কেন প্রতি রাতে হথাত আমার ঘুম ভেঙে যায়। কেন আজ ১০ বছর ধরে স্বাভাবিক একফোঁটা ঘুম আমার জীবন থেকে চলে গেছে।
Like Reply
#54
20

‘কিরে কি চাই তোর? ভূগোল না ইতিহাস?’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতা আমি দেখিনি, তবে প্রতিদিন আমাদের সমাজ যে ক্যান্সার রুগীর মত একটু একটু করে পচে চলেছে তা আমি জানতাম। আজ যেন স্বচক্ষে তা উপলব্ধি করছি। ‘কিরে সোনা যাবি নাকি! আমি তানিয়া, মিছে কথা বলিনা। পুরো মাখন রে’ বুকের আঁচলটা নীচে টেনে ঝুলে যাওয়া দুটো স্তন ও তার মাঝের খাঁজ আমার সামনে বার করে আনল। ঠোঁটের খয়েরী লিপস্টিকের মধ্যে এই সমাজের কত বঞ্চনা মুখ বুজে রয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। এক এক করে তানিয়াদের পার করে আমি এগিয়ে চলেছি। নির্লজ্জ কতগুলো চোখ আমার দিকে সহাস্যে তাকিয়ে আছে। চোখ তুলে দেখতে পারছি না। ওরা যেন উপহাস করছে আর হাসছে ‘ওই যে ভদ্র সমাজের প্রতিনিধি’। কিছুটা দূরে পাঁচিলের গায়ে বসে এক বৃদ্ধা। পরনে শুধুই একটা নোংরা বেগুনি সায়া আর ছিঁড়ে যাওয়া ব্লাউজ। ও কি চায়? ও কেন এখানে? এক পাও সামনে এগোতে পারলাম না। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম, না এই দুই চোখে সেই বিষ নেই, ভদ্র সমাজের প্রতি নির্লজ্জ চাহুনি নেই। বরং রয়েছে একরাশ ভয়, যন্ত্রণা ও অসহায়তা। বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল। ভালো করে শোনার জন্য সামনে এগিয়ে কানটা পেতে দিলাম। ‘মুখে নেবো, ১০ টাকা, শুধু ১০ টাকা। সকাল থেকে কিছু খাইনি। এভাবে মরে যাবো। শুধু ১০ টাকা, যতবার বলবি ততবার’। আমার দুটি ঠোঁট একটু নড়ার চেষ্টা করছিল, কিছু শব্দ বার করার চেষ্টা করছিল, কিন্তু আমি পারছিলাম না। দুটো জরাজীর্ণ হাত ক্রমশ আমার প্যান্টের জিপের দিকে এগিয়ে আসছে। ‘কি নৃশংস এই সমাজ। কি বর্বর এই তিলোত্তমা’। বিদ্যুতের বেগে ২-৩ পা পিছিয়ে এলাম। সেই রুগ্ন রমনীর দুচোখে শুধুই একরাশ হতাশা, খাবার জোগাড় করতে না পারার যন্ত্রণা। কি বর্বর! শুধু কি আমরাই, যারা স্রোতের বীপরীতে হেঁটেছিলাম তারাই পিছিয়ে পড়েছি? আর এরা? ফেসবুক, ওয়াটস আপ, স্ন্যাপডিল এখানে কোথায়? এরা কি ওএলএক্স এ নিজেদের পুরনো হয়ে যাওয়া শরীরটা বেচে দিয়ে নতুন একটা শরীর কিনতে পারবে। সত্যিই কি আমরা ভুল ছিলাম?
আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব ছিলনা। পকেট থেকে একটা ১০০ টাকার নোট বার করে হাতে ধরিয়ে দিলাম। জানি এই ১০০ টাকাটা হয়ত দুটো দিন ওর মুখে ভাতের জোগান দেবে, কিন্তু তারপর? তারপর ওর ভবিষ্যৎ কি? এই বিপননের দুনিয়ায় ও বাঁচবে কি করে? সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। ট্যাক্সি ড্রাইভারটির নাম রতন। রতনের সাথে শলাপরামর্শ করেই আমার ভেতরে চলে আসা। জুলি যদি আমাকে দেখতে পায় কখনো এই ফাঁদে পা দেবেনা। ও বলেছিল, সোজা গিয়ে বাঁদিকে বাঁকতে। বাঁদিকে বাঁকতেই দেখি তিনটে লোক। আমায় দেখা মাত্র ওরা সামনে এগিয়ে এলো। ‘আপনিই বিপ্লব বাবু, রতন পাঠিয়েছে?’ আমি শুধু মাথাটা নাড়লাম। ‘আসুন, আমরা বরং ভেতরে অপেক্ষা করি, রতন আসার আগে মিস কল দিয়ে দেবে’ ওদের সাথে একটা ঝুপড়ি মত ঘরের ভেতরে ঢুকলাম। চারপাশে পানের পিকের দাগ, ঘর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে কিছু ব্যবহৃত ও পরিত্যক্ত কনডম, মাথার ওপর টিমটিম করে জ্বলছে ১০০ ওয়াটের একটা বাল্ব। কানটা পেতে আছি, হয়ত এই ঘরের মধ্যেই কত সহস্র গরীব মেয়ে পেট চালাতে রোজ শরীর বিক্রি করে, তাই হয়ত এই আর্তনাদ আমার কানে ভেসে আসছে। এটা কার আর্তনাদ? সমাজ সভ্যতা তো অনেক অনেক এগিয়ে গেছে তাহলে কেন এই আর্তনাদ? ওরাও পিছিয়ে আছে ঠিক আমাদেরই মত। ‘বিপ্লব, তুমি মানো বা না মানো তোমার মধ্যে আজও একটা আগুন লুকিয়ে আছে, এবং চিরকাল থাকবে। ফাইট বিপ্লব ফাইট’ মেসমশাই এর কথাগুলো কানের সামনে ভেসে আসছিল। বেচুগিরির জীবনে একটাই তো মানুষ পেয়েছিলাম যার কাছে গেলে মনটা জুড়িয়ে যেত। বটবৃক্ষের মত যিনি আমায় আদর্শের দিশা দেখিয়ে এসেছেন, আমার সেই বটবৃক্ষ আমারই চোখের সামনে আগুনে দাউ দাউ করে একদিন জ্বলে উঠল। কে খুনি? আমি? ‘ফাইট বিপ্লব ফাইট’। বারবার করে মেসমশাই এর এই কথাটাই কানে ভেসে আসছিল।
‘দাদা, রতন মিস কল দিয়েছে’ ওদেরই মধ্যে কোন একজনের কথায় আমার হুঁশ ফিরল। ‘দাদা, আপনি ওই আলমারিটার পেছনে লুকিয়ে যান’। আমিও ওদের কথামতো আলমারির পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার শুধুই অপেক্ষা। আমার মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার করে ঘুরঘুর করছে, আমি পারবো তো? আমি পারবো তো এক টুকরো আগুনে ওই সামাজিক কীটটাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারতে? কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্যাক্সির আওয়াজ। বুঝলাম জুলি এসে গেছে। পলকহীন দুই চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দরজাটা প্রচণ্ড জোরে খুলে গেলো আর হুরমুরিয়ে সামনে এসে পড়ল জুলি। ওর দুটো হাত শক্ত করে পিছমোড়া করে বাঁধা, মুখে একটা লাল গামছা এতটাই শক্ত করে বাঁধা যে ওর গোঙানির সামান্য শব্দটুকু বাইরে আসছেনা। রতনই পেছন থেকে চেঁচিয়ে উঠল ‘নিন, বিপ্লব বাবু আপনার পাখীকে তুলে এনেছি, এবার আপনি পোঁদ মারুন আর যাই করুন, আমাদের কিছু যায় আসেনা’ আলমারিটার পেছন থেকে একপা সামনে এসে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমি কি পারবো? আমি কি পারবো ওদের মত নৃশংস বর্বর হতে? ‘কি দাদা, খুব তো বলছিলেন, পোঁদ মারবেন, হ্যান করবেন ত্যান করবেন। কি হোল ফেটে গেলো নাকি?’ ওরা জানেনা যে আগুন দশ বছর ধরে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছি তা বাইরে এলে শুধু জুলি কেন, এই মহানগরের প্রতিটা আগাছাই জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। জুলির মুখের দিকে তাকিয়ে আছি, ও কিছু বলতে চাইছে। সামনে গিয়ে মুখের বাঁধনটা খুলে দিলাম।
‘বিপ্লব, আমার কথা শোন প্লিস। কত টাকা তোমার চাই? কত টাকা? তোমায় আমি এতো টাকা দেবো যে...’ ওর দিকে উপহাসের হাঁসি ছুঁড়ে দিয়ে আমি উত্তর দিলাম ‘জুলি, বাবাইকে দেখতে কি ছিল বলতো? তুমি ওকে এক মুহূর্ত না দেখে থাকতে পারতে না। সবসময় ওর গাল দুটো টিপে দিতে। জুলি, বাবাইকে ফিরিয়ে দাও। একটা টাকাও লাগবে না’ জুলির দু চোখে মৃত্যুভয় আমি দেখতে পাচ্ছিলাম। একবার আমার দিকে আর একবার ওই ৪ টে জানোয়ারের লালসাময়ী মুখগুলোর দিকে তাকাচ্ছিল জুলি। ‘আমায় জুলি কেন বলছ বিপ্লব? বিপ্লব তুমি আবার একটা বিয়ে কর। আমি কথা দিলাম আমি বাধা দেবো না। আমায় ছেড়ে দাও বিপ্লব’ আমার বুকের যন্ত্রণাগুলো ক্রমশ আগুনে পরিনত হচ্ছিল। ‘জুলি, তোমার মেসমশাইকে মনে আছে? সেই যে রবিউল হক। ওহ, কি আদর্শবান এক মানুষ! জুলি, মেসমশাইকে ফিরিয়ে দাও!’ জুলির দু চোখ বেয়ে জলের প্লাবন বয়ে চলেছে। না এটা অনুতাপের নয় এটা ভয়ের অশ্রু। কাঁপা কাঁপা দুটো ঠোঁটে জুলি বলে ওঠে ‘বিপ্লব, আমি তোমায় সত্যিই ঠকাই নি, তুমি ভুল ভেবেছ আমায়’। আর সহ্য হচ্ছিলনা। শৈশবে নিম্নবিত্তের যন্ত্রণা, কৈশোরে ইঁদুর দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার যন্ত্রণা আর যৌবনে জীবন যুদ্ধে হেরে যাওয়ার যন্ত্রণা। আর কত যন্ত্রণা আমরা সহ্য করব। বিপননের দুনিয়ার প্রতিটা দালালের পোঁদ মারি।
Like Reply
#55
জুলি হয়ত কল্পনাও করতে পারেনি একটা ছাপোষা কেরানীর মধ্যে এতো নিষ্ঠুর একটা জানোয়ার লুকিয়ে থাকতে পারে বলে। বিদ্যুতের বেগে জুলির লাস্যময়ী শরীরটা দুহাতে তুলে ধরে দেওয়ালে পিষে দিলাম। লাল চিকনের সাড়ি আর সাদা সায়াটা কোমরের কাছে গুটিয়ে দিয়ে এক টানে লাল প্যানটিটা টেনে হাঁটুর কাছে নামিয়ে দিলাম। জুলির শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। আমার ছেলেটাও কাঁপছিল, ঠিক এরকমভাবেই। গাঁড় ফেটে গেছিল আমার। বাবাই এর হেঁচকিগুলো আমি প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি। চোখের সামনে একটু একটু করে বাবাইকে মরতে দেখেছিলাম। সেই একি ভয়, জুলির দুচোখে। ‘জুলি, তুমি তো এক্সপেরিমেন্ট কর! নতুন নতুন যৌন আচরন তুমি উদ্ভাবন কর। এই মুহূর্তে তোমার বাজার দর কত জুলি?’ প্যান্টের জিপ আমি এখনো খুলিনি, শুধুই ঠোঁটদুটো জুলির কানের কাছে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললাম। ‘আমায় ছেড়ে দাও বিপ্লব, আমায় ছেড়ে দাও, আমি তোমায় টাকা দেবো, যত চাইবে ততই দেবো’। ‘তোমার বাজার দর কত জুলি?’ এতো জোরে যে আমি চিৎকার করব তা হয়ত জুলি কেন ওই ৪ টে জানোয়ারও বুঝতে পারেনি। জুলির শরীরটা খানিকটা বাবাইএর শেষ নিঃশ্বাস ফেলার সময়ের মত করেই নড়ে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে আমার সম্পূর্ণ যৌনাঙ্গটা জুলির পায়ুছিদ্রে প্রবেশ করিয়ে দিলাম। ‘বিপ্লব, আমি মরে যাবো। বিপ্লব টাকা, কত টাকা চাও তুমি’। যন্ত্রণায় কাতর সেই লোভী পশুটার মুখ থেকে অজান্তে যে শব্দটা বেরিয়ে এলো তা হোল ‘টাকা’। প্রচণ্ড জোরে জোরে নিজের যৌনাঙ্গটা ওর পায়ুছিদ্রে ঢুকিয়ে বার করে নিচ্ছি, জুলির মুখ দিয়ে কয়েকটা কাতর শব্দ বেরিয়ে আসছে, তার মধ্যে একটাই আমার কানে প্রবেশ করছে তা হোল ‘টাকা’। সামান্য কোন যৌন উত্তেজনা আমার শরীরে নেই, শুধু চাই এই পশুটাকে জবাই করতে। কষ্ট দিয়ে দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে। জুলির আর্তনাদ ছাপিয়ে ভেসে আসছে মেসোমশাই এর সেই আর্তনাদ। ‘বিপ্লব, তোমার ছেলে মরবে, এর চেয়েও বেশী কষ্ট পেয়ে মরবে’। যন্ত্রণায় চোখদুটো বুজে নিলাম। চোখের সামনে ভেসে এলো সেই দিনগুলো।
রমা ছিল বাপের বাড়িতে। সম্ভবত আমাদের বিয়ের পর ওটা ওর তৃতীয় বার বাপের বাড়ি যাওয়া। রমার ফোন এলো আমার কাছে। ‘বিপ্লব, রঞ্জনদা আমায় সব বলেছে। মেসোমশাই এর মেয়ের বিয়ে আমরা দেবো। তুমি তো চাকরি কর, বিপ্লব। পারবেনা সারাদিন খেটে টাকাটা জোগাড় করতে! বিপ্লব মেনে নাও। আমার মনে হয়না আমি ১০ লাখ টাকা জোগাড় করতে পারবো বলে’। সেদিন রমার কথার কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। রঞ্জন এসেছিল আমার বাড়িতে। পাশের ঘরে বসে পেপার পড়ছিল। একবার উঁকি মেরে আমার দিকে তাকাল। আমি কি করব, কোথায় যাবো কাকে বলব জানিনা। এসএসকেএম এ এক রুগী ভর্তি। কিডনি খারাপ হয়ে গেছে। বহু গোপনে কন্টাক্ট করেছিলাম। ব্লাড গ্রুপ মিলে গেছিল। ঠিক ছিল আজই বিকেলে গিয়ে নিজের একটা কিডনি বিক্রি করে দেবো। হথাত সকালে জানতে পারলাম সেই ভদ্রলোক মারা গেছে। এবং তার সাথে সাথে আমারও ১০ লাখ টাকার উৎসটাও হারিয়ে গেলো। কি করে টাকা জোগাড় করব? ডাক্তার বলেছে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বাবাইকে নার্সিংহোমে অ্যাডমিট করতে হবে। পুরো ১০ লাখ টাকাটাই অ্যাডভান্স লাগবে। পেপারে সাহায্য চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম একমাস আগে, কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি। ছেলেটাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে রেখেছিলাম তবুও বিছানায় ছটপট করে চলেছে।
‘বিপ্লব ঘরে আছো নাকি?’ গলাটা শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। এই একজনই মানুষ আমি পেয়েছিলাম গোটা পৃথিবীতে যে আমায় প্রতি মুহূর্তে অনুপ্রানিত করেন। আমার বাড়ি মালিক, রবিউল হক। ৭২ সাল থেকে জেলে বন্দী, ছাড়া পান ৭৭ এ। ততদিনে কলকাতা ইউনিভার্সিটির অধ্যাপনার চাকরি গেছে, উচ্চ মধ্যবিত্ত জীবন থেকে নিম্নবিত্তে উত্তরন ঘটেছে, ছেলে মেয়ের ক্যারিয়ার গেছে, সংসারে সুখ উড়ে গেছে, তবুও লোকটা কি নির্বিকার। একটা আদর্শকে পুজি করে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘হ্যাঁ মেসোমশাই ভেতরে আসুন’। রোগা পটকা সদা হাস্যমান লোকটির প্রথম প্রশ্নটিও আমার জানা আছে। ‘পাভেলের শরীর কেমন আছে’। ‘পাভেল’ সেই ম্যাক্সিম গোর্কির ‘পাভেল’। বাবাইকে উনি পাভেল বলে ডাকতেন। ওনার মতে বাবাই একদিন পাভেল হয়ে যাবে, শ্রেনী সংগ্রামের যুদ্ধে নিজেকে সঁপে দেবে। আমার মুখ দিয়ে কোন উত্তর বেরোল না। আমার কাঁধে দুটো হাত রেখে সেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ভঙ্গীতে বলে উঠলেন ‘ফাইট বিপ্লব ফাইট’। চোখদুটো ছলছল করছিল, গলাটা জড়িয়ে এসেছিল। কোনরকমে উত্তর দিলাম ‘কার সাথে লড়ব মেসোমশাই?’ দেখলাম উনিও কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন। বহুকষ্টে বাঁ হাতটা দিয়ে চেয়ারটা টেনে বসলেন। ‘বিপ্লব, আমাদের এই আইডিওলজির চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ জীবন। ছেলেকে বাঁচাতে যদি ডাকাতিও করতে হয় তাই কর’ আমি চমকে উঠলাম। একি বলছেন মেসোমশাই, যে মানুষটা আজীবন আদর্শের জয়গান দিয়ে নিজের জীবনটা নষ্ট করে দিলেন তিনিই এই কথা!
‘জানি তুমি অবাক হয়ে গেলে বিপ্লব! দুখানা মেয়ের জন্ম দিয়েছিল তোমার মাসীমা, তারপর আসে ছেলে। তোমার মাসিমা অল্পঅল্প করে টাকা জমিয়ে রাখতেন। আমি বাধা দিতাম। বলতাম ওরা দুজন আমার সন্তান, ওদের কি আমি বিক্রি করব যে তুমি টাকা জমিয়ে রাখছ। পন দিয়ে মেয়ের বিয়ে আমি দেবনা, আমি বদ্ধমূল ছিলাম বিপ্লব। আমি হেরে গেছি বিপ্লব। ছেলেটা দিনরাত কথা শোনায় ‘বাবা, তোমার জন্যই আমি ট্যাক্সিচালক হয়েছি’ পাড়া প্রতিবেশী কথা শোনায় ‘মেয়েরা কি অবিবাহিতই থেকে যাবে!’ আজ দুটো মেয়েরই বিয়ে ঠিক করে এলাম, বলতে পারো বিক্রি করে এলাম। দুপক্ষকে নগদ আড়াই লাখ করে দিতে হবে। মন মানছিল না। কিন্তু এবারও বিয়েটা ভেঙে গেলে তোমার মাসীমা সত্যিই ওদের বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে। বিপ্লব আর পারছিলাম না সহ্য করতে! নিজের আদর্শকে বেচে দিলাম’ মাথা নীচু করে বসে ছিলাম আমি। ‘কিন্তু বিপ্লব আমি কি ভুল! নিজের সন্তানকে বাঁচানোর জন্যই হয়ত আমি এতোবড় একটা আদর্শচ্যুতি ঘটালাম। বিপ্লব তোমার কাছে তো ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ ‘ইস্পাত’ আর ‘মাদার’ তিনটে বইই আছে। একবার আমায় দিতে পারো। আবার পড়ি নতুন করে’ ‘মেসোমশাই আপনি কোন ভুল করেননি’ মুখ দিয়ে শুধু এই কথাটাই বেরিয়েছিল। আমার পিঠটা নিজের প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়া ডান হাতটা দিয়ে চাপড়ে দিয়ে বললেন ‘তুমিও পারবে বিপ্লব। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো’ আমি শুধু মাথাটা নীচু করে বসে থাকলাম। ‘তোমার এই বিপদের মধ্যেও তোমার কাছে সেই সাহায্যর জন্যে এসেছি’ আমার হুঁশটা ফিরল। ‘আপনি চিন্তা করবেন না মেসোমশাই, আমি ব্যাঙ্কে যাবো আজ’ আমার কথা শুনে উনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ‘আজই ওদেরকে অগ্রীম টাকাটা দিতে হবে, তবেই বিয়ের দিন ফাইনাল হবে। আমার আকাউন্ত এ কত টাকা আছে বিপ্লব? ৫ লাখ হবে তো?’ আমি উত্তর দিলাম ‘হ্যাঁ, মেসোমশাই এই ৫ লাখের সামান্য বেশী হবে’ সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস আর উত্তর ‘বিপ্লব, তুমি আজ ৫ লাখ টাকা তুলে এনো। ওরা আজ বিকেলেই আসবে’ আমি চুপ করে থাকলাম। ‘দেখো, বিপ্লব এই হাতটার দিকে দেখো। পুলিশের মারে কেমন অকেজো হয়ে গেছে। নিজের সইটাও করতে পারিনা। প্রতিবার তুমিই সই নকল করে টাকাটা তুলে দাও। অথচ এটাও কিন্তু অনৈতিক। কার জন্য কর? আমার জন্য। একটা অসহায় মানুষের জন্য। অর্থাৎ এটা নৈতিক’ মেসোমশাই কোনরকমে বেঁকে বেঁকে দরজার দিকে চলে গেলেন।
দেখিনি, কখন রঞ্জন উঠে চলে এসেছে। ‘কি ভাবছ বিপ্লব! আমি তো বললাম ২ ঘণ্টার মধ্যেই তোমায় ১০ লাখ জোগাড় করে দেবো’ এতদিন ছিল শুধুই ছেলের চিকিৎসার টাকা জোগাড়ের চিন্তা, এর সাথে যোগ হোল তীব্র এক পাপবোধ। সোফা থেকে নেমে সোজা রঞ্জনের দুপা জড়িয়ে ধরলাম। ‘রঞ্জনদা, এতো বড় পাপ আমি করতে পারবো না। রঞ্জনদা আপনার অনেক টাকা। আপনি যেভাবে হোক আমায় টাকাটা জোগাড় করে দিন’। ‘দেখো বিপ্লব, আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি তোমায় ১ মাস আগেই টাকাটা দিয়ে দিতাম। আমরা ব্যবসায়ী মানুষ। আমাদের হাতে টাকা থাকেনা, আমরা টাকা বিনিয়োগ করে দি’ নিজেকে কিছুতেই সংবরন করতে পারছিলাম না। ‘এটা কেমন নিয়ম, রঞ্জনদা। তোমাকে ৫ লাখ টাকা দিলে তবেই তুমি আমায় ১০ লাখ টাকা দিতে পারবে’ ‘বিপ্লব আবেগপ্রবন হয়ে যেওনা। ১০ লাখ টাকাটা তো আর আমি একা দিচ্ছিনা। আমার একটা সামান্য শেয়ার রয়েছে এর মধ্যে। ৫ লাখ টাকা হার্ড ক্যাশ জমা দেবো আর বলব আমার ১০ লাখ দরকার অন্য এক খাতে বিনিয়োগ করার জন্য। কেন বুঝতে পারছনা বিপ্লব, টাকাটা তো আমার একার নয়, আরও ২-৩ জন আছে’ শেষ ৩-৪ দিনে আমি অন্তত এক ডজন বার রঞ্জনের পা দুটো চেপে ধরেছি, প্রতিবারই একি উত্তর।
Like Reply
#56
‘আরে দাদা, আধ ঘণ্টা তো হয়ে গেলো। আমাদেরও একটু ছাড়ুন। আপনি মনে হয় ভিয়াগ্রা নিয়ে এসেছেন। আমরা কতক্ষন অপেক্ষা করব’ রতনের কথায় আমার হুঁশ ফিরল। জুলির মুখ দিয়ে তখনও করুন আর্তনাদ ভেসে আসছে। এর সাথে ভেসে আসছে প্রতিশোধের হুমকি। ‘বিপ্লব, তুমি বাঁচবে না। আমাদের ক্ষমতা তোমার জানা নেই’ ‘ডাকো তোমাদের মাথাকে’ আমার চিৎকারে জুলির শরীরটা আরও একবার তীব্র বেগে কেঁপে উঠল। নীচ থেকে জুলির ভ্যানিটি ব্যাগটা তুলে মোবাইলটা বার করলাম। জুলির হাতের বাঁধনটা খুলে দিলাম। মুহূর্তের মধ্যে মোবাইলটা লুফে নিয়ে কল করে দিলো জুলি। ওর পায়ুছিদ্রকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিতে দিতে আমিও আমার মুখটা ওর কানের কাছে নিয়ে গেলাম। ‘হ্যালো, আআআহ ওমা, আমায় বাঁচাও। বিপ্লব আমায় মেরে ফেলবে’ ‘তুমি কোথায় আছো শুধু বল। আমি বাকি সব সামলে নেবো’ জুলির হাত থেকে মোবাইলটা কাড়িয়ে নিয়ে আমি বলে উঠলাম ‘হ্যালো তমাল সেন ওরফে শান ওরফে... জুলির পোঁদে আমার বাঁড়াটা পুরোপুরি ভোরে দিয়েছি। যখন ফেরত পাবে, ও আর তোমাদের বিনোদনের রানী হওয়ার যোগ্য থাকবে না’ ফোনটা কেটে দিয়ে প্রচণ্ড জোরে জোরে থাপিয়ে গেলাম। জুলির মুখ থেকে বারবার করে একি আর্তনাদ ভেসে আসছে। ‘আমি মরে যাবো বিপ্লব। এভাবে কষ্ট দিওনা আমায়’। কিন্তু সেই আর্তনাদকেও ছাপিয়ে ভেসে আসছে আমার ১২ বছরের যন্ত্রণা।
আমি সবে অফিসে পৌঁছেছি। রমার ফোন। ‘বিপ্লব, এখানে চরম অপমানিত হতে হচ্ছে। বাবার থেকে আমি কিছুতেই টাকা আনতে পারবো না। বিপ্লব, তুমি রঞ্জনদার প্রপসালটা মেনে নাও’ একটাও কথার জবাব দিতে পারিনি। কাঁদতে কাঁদতে রমা নিজেই ফোনটা কেটে দিয়েছিল। অফিসের ব্যাগের চেনটা খুলে হাতটা দিলাম। একটা পাসবই আর একটা চেকবই। কয়েকটা কাগজ একটা পেন ব্যাস এক বৃদ্ধ মানুষের সারাজীবনের পুঁজি ধুলোয় মিশে যাবে। চোখের সামনে বারবার করে ‘বাবাইএর যন্ত্রণায় কাতর শরীরটা ভেসে উঠছিল’। দ্রুত মেসমশাইএর সিগনেচার লিখে ক্যাশ সেক্সানে জমা দিলাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার ব্যাগে চলে এলো, কতগুলো ৫০০ টাকার নোটের বান্ডিল। যার ফেস ভ্যালু ৫ লাখ টাকা। মেসমশাই এর ফোন এলো। সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ করে নিলাম। ‘বিপ্লব, তোমার মাসীমা খুব ভয় পেয়ে গেছে। বউমাও বারবার বলছে পাভেলকে এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যাওয়া উচিত, তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো বাড়ি চলে আসো’ আমার গলা দিয়ে একটাও কথা বেরচ্ছিলনা। কোথায় নিয়ে যাবো বাবাইকে? তখন আমার স্কুটারটা ছিলনা। বাসে করেই যাতায়াত করতাম। আমার অফিসটা তখন ছিল রবীন্দ্রসদনে। কসবা যাওয়ার বাস কিছুতেই পাচ্ছিলাম না। একের পর এক বাস দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরিয়ে সাঁতরাগাছি চলে যাচ্ছে। আমার ছেলের হসপিটালটাও ওই পথে। কি করব আমি? ভেবে চলেছিলাম। নিজের ছেলেকে বাঁচাতে অপরকে পথে বসাবো। বারবার চোখের সামনে রমা আর বাবাইএর মুখটা ভেসে আসছিল। মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজ ইউনিয়নে অংশ নেওয়া ডিবেট গুলোর।
‘তোমাদের মুখেই বড় বড় বুলি। নিজেদের ব্যাক্তিগত জীবনে সঙ্কটে পড়লে দেখো কোথায় থাকে এই আদর্শ, ইউটোপিয়া। গোটা পৃথিবী তোমাদের এই কারনেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আজকের সমাজ পুঁজিনির্ভর। জীবনে বাঁচতে গেলে পুঁজি সঞ্চয় করতে হবে’ বিরোধী ইউনিয়নের জিএস ক্যান্ডিডেটের বক্তৃতার পর আমি উঠেছিলাম ডায়াসে। ‘পারবে পুঁজি দিয়ে তোমার ওই কষ্ট করে লড়াই করে পাওয়া মাধ্যমিক, এইচএস এর সার্টিফিকেটগুলো কিনে আনতে। ইউটোপিয়াতে তোমরাই রয়েছ বন্ধু। এই পুজির তত্ব তোমরা গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছ কারন পৃথিবীর ৯০ ভাগ মানুষ কিছু বোঝেনা। ওদের থেকে শিক্ষা, খাদ্য, কর্মসংস্থান প্রতিটা মৌলিক অধিকার তোমরা কেড়ে নিয়েছ। যেদিন ওরা তোমাদের দিকে তেড়ে আসবে, তোমরা লেজ গুটিয়ে পালাবে’ সঙ্গে সঙ্গে কানের তালা ফাটানো করতালি। হৃদয়টা দুলে উঠেছিল, বুঝে গেছিলাম আমরাই জিতছি। স্টুডেন্ট লাইফ আর বাস্তব জীবনের কি তফাৎ। আবেগ দিয়ে গুছিয়ে কিছু বক্তৃতা দিতাম, জানতাম ছাত্রদের একদম হৃদয়ে কথাটা পৌছাচ্ছে। সেই করতালি আজও এক্সাইড বাস স্ট্যান্ডে শুনতে পাচ্ছি। প্রায় জনা পঞ্চাশ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। সবাই যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাততালি দিচ্ছে আর বলছে ‘নাচ, বিপ্লব নাচ। একবার বাঁদিকে একবার ডান দিকে শরীরটা দোলা’ পকেটের মধ্যে হাতটা দিয়ে মোবাইলটা বার করার চেষ্টা করছিলাম। কে যেন আমার হাতটা চেপে ধরে আছে আর চিৎকার করে বলছে ‘না, বিপ্লব না। এতবড় আদর্শচ্যুতি ঘটাস না’ আমি পারলাম না, হেরে গেলাম। মোবাইলটা বার করে রঞ্জনকে ফোন করলাম।
‘রঞ্জনদা আমি ৫ লাখ টাকা তুলেছি। তোমায় এক্ষুনি দিতে চাই। কিন্তু কাইন্ডলি তুমিও ১০ লাখ টাকাটা ক্যাশে নিয়ে আসো’ বাঁদিকের রাস্তাটা আমার পক্ষে আর কোনোদিন গ্রহন করা সম্ভব নয়। ডান দিকে রয়েছে দ্বিতীয় হুগলী সেতু, ওটা পার করলেই সেই নার্সিংহোম।
দরজায় প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাথার ওপরের ১০০ ওয়াটের বাল্বটায় একটা গুলি। মুহূর্তের মধ্যে সারা ঘরটা অন্ধকার হয়ে গেলো। জুলির পায়ু ছিদ্রে তখনও আমার যৌনাঙ্গটা ভরা আছে। আমি জানি যেকোনো মুহূর্তেই আমার মাথায় রিভলবারের নলটা এসে স্পর্শ করবে। তবুও আমি তীব্র জিঘাংসায় জুলির পায়ুছিদ্রকে ক্ষত বিক্ষত করে দিতে শুরু করলাম। আমার দিকে এক পেশীবহুল মানুষ এগিয়ে আসছে। আমি জানি ও কি চায়, ও চায় টাকা।
‘ওকে ছেড়ে দাও, বিপ্লব’ কথাটা শেষ হতে না হতেই রিভালবারের বাঁট দিয়ে আমার মাথায় সজোরে একটা আঘাত। গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছে। কিন্তু আমি হেঁসে চলেছি। আরও ২-৩ জন এসে আমায় গায়ের জোরে টেনে মাটিতে ফেলে দেয়। একটা কালো হ্যাট পড়া লোক, আমার মুখের কাছাকাছি মুখটা এনে ফিসফিস করে বলে ‘আমি জানি বিপ্লব, তোমার কাছে এই মুহূর্তে ৮০ লাখ টাকা রয়েছে। সেই টাকাটা আমায় দিয়ে দাও। আমি কথা দিলাম যে পুলিশ, প্রশাসন কেউ আর তোমায় বিরক্ত করবেনা। আচ্ছা ঠিক আছে এর মধ্যে থেকে ১০ লাখ তোমার। নাও এবার লক্ষী ছেলের মত টাকাটা ফেরত দাও দেখি’ আমার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছিল। তাও হেঁসে উঠে আমি বললাম ‘ভাববেন না আমি আপনাকে চিনতে পারিনি। আপনিই যে শান, আপনিই যে তমাল সেন তা আমি জানতাম। বাবাইকে ফিরিয়ে দিন আমিও আপনাকে ৮০ লাখ টাকা দিয়ে দেবো’ আমার বুকের ওপর প্রচণ্ড জোরে আবার একটা লাথি।
‘রঞ্জন তোমার মৃতদেহর দিকে তাকিয়ে আমি পাগলের মত হেসেছিলাম। আমি জানতাম ওটা তোমার মৃতদেহ নয়। আমি এটাও জেনে গেছিলাম যে মিতাই আসলে জুলি। আর পুলিশ প্রশাসন, গনতন্ত্র এই শব্দগুলোকে আমি মানিনা। তুমি যে লুকিয়ে লুকিয়ে রমার ডায়েরীটা পড়ো তা আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম। এটাও জানতাম যে তুমি নিজেকে বাঁচাতে অধৈর্য হয়ে কিছু একটা করবে। চিন্ময়, শর্মাজী এরা তো তোমার পার্টনার ছিল, ওদের খুন করলে কেন?’
আবার প্রচণ্ড জোরে একটা লাথি। ‘তুমি আমার কিছুই করতে পারবেনা বিপ্লব। তোমায় ২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম, আমার ৮০ লাখ টাকা আমায় ফিরিয়ে দাও’
[+] 1 user Likes samss400's post
Like Reply
#57
21

অসম্ভবরকম যন্ত্রণা হচ্ছিল পেটে, চোখদুটো বুজে ফেলেছিলাম। অন্ধকার ঘরটায় বেশ কিছুক্ষন ধুপধাপ আওয়াজ হোল, বুঝলাম রঞ্জন ও মিতা চলে গেলো। ২৪ ঘণ্টা সময়, ওদের ৮০ লাখ টাকা আর বিনিময়ে আমার আর রমার নিরাপত্তা। মনে পড়ে গেলো বিজয়দার সেই কথাটা ‘নিজেকে শারলক হোমস ভাববেন না’। আমার জীবনের এই চরম রহস্যময় কাহিনীর সবচেয়ে রহস্যময় ও আকর্ষক চরিত্রটি আসলে বিজয়দা নিজেই। লোকটি কখনো প্রচুর কথা বলে কখনো বা খুবই কম কথা বলে, কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই কেবলমাত্র প্রয়োজনীয় কথাটুকুই বলে। মেঝে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমিও দরজা দিয়ে বাইরে বেরলাম। এই মুহূর্তে আমার প্রথম কর্তব্য রমা কোথায় আছে তার খোঁজ নেওয়া। রমাকে ফোনটা লাগিয়েও দিলাম কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এলো সেই পরিচিত গম্ভীর কণ্ঠ। হ্যাঁ জানি এটা বিজয়দাই, এবং সম্ভবত রহস্যের যে সমাধান আমি নিজের মস্তিস্কে করে ফেলেছি তা হুবহু মিলেও যাচ্ছে। ‘শুনুন, বিপ্লব বাবু, আইনের দেবতার চোখে কালো কাপড় বাঁধা রয়েছে। আপনার মিসেস আমার সাথে থানায় রয়েছে। আমি সবই জানি’ ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠল, কিন্তু একটা আশার আলোও রইল। ‘শারলক হোমস, নিজের কাজ শেষ করে আমায় জানাবেন, রমা দেবীকে আমি নিজে আপনার ফ্ল্যাটে পৌঁছে দিয়ে আসবো। আপাতত রমা দেবীর দায়িত্ব আমি নিলাম’। মানসিক অবস্থা ঠিক ছিলনা নয়ত তক্ষুনি ‘ইউরেকা’ বলে লাফ দিয়ে উঠতাম। ঠিক, এইরকম সমাপ্তিই আমি চেয়েছিলাম।
আবার ফোন লাগালাম, না এবার রমাকে নয় রঞ্জনকে। ‘রঞ্জন, তোমার ৮০ লাখ আমি ফেরত দিতে চাই, তুমি দ্বিতীয় হুগলী সেতুর ওপর চলে আসো’। এই সেই দ্বিতীয় হুগলী সেতু, যেখানে একদিন আমাদের এ্যাম্বুলেন্সটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। চোখের সামনে দেখেছিলাম বাবাই এর শরীর থেকে কেমন ধীরে ধীরে প্রান বায়ুটা বেরিয়ে গেছিল। বাবাই আর ফিরে আসেনি। কিন্তু অন্য এক বাবাইকে আমি আর রমা বাবাই রুপেই মানুষ করছি। আমাদের বাড়িতে যে মহিলা কাজ করেন তিনি আর কেউ নন, মেসোমশাই এর গৃহবধূ আর বাবাই ওনার ছেলে মনিরুলের পুত্র। মনিরুল আজ ৩ বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত ওর ছেলের দায়িত্ব আমি নিয়েছি। মনিরুলই মধুকর ভিলার বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষায় ছিল। পরে বুঝেছি সম্পূর্ণ প্ল্যানটা বিজয়দাও জানতেন। আর সেই কারনেই মধুকর ভিলা থেকে আমাদের ফেরত আনতে মনিরুলকেই পাঠিয়েছিলেন। মনিরুলের সাথে আমার আরও একটা চুক্তি হয়েছে, চুক্তি না বলে মনিরুলের প্রতিদান বলাই ভালো। মনিরুলকে আগে থেকেই ইনফরম করে রেখেছিলাম। কিছুক্ষন পড়েই ট্যাক্সি নিয়ে ও চলে এলো। এই মনিরুলের ট্যাক্সিতে এর আগেও অনেকবার চেপেছি। তবে আজ একটু বেশীই আলাদা অনুভুতি হচ্ছে।
সবশেষ। হয়ত এটাই বলা ভালো যে নতুন এক দিগন্তের সূচনা। আজ এই মুহূর্ত থেকে নিজের ওই বাতিল হয়ে যাওয়া আইডিওলজিটা বস্তাপচা মনে হচ্ছেনা। নিজেকে সেই কলেজের ডায়াসের ওপরই দেখতে পাচ্ছি। যেন বক্তৃতা দিচ্ছি আমি, ‘আইডিওলজি কখনো ভুল হয়না বন্ধু, ভুল হই আমরা। নৈতিক অধঃপতন মানুষের হয় তত্বর নয়’। সেই কলকাতা, সেই ফুটপাথের ওপর শুয়ে সর্বহারা, কিন্তু আজ আর ওদের বঞ্চিত বানচোঁদ নয় ধরিত্রী মাতার সন্তান মনে হচ্ছিল। পরিশ্রান্ত শরীরে আমি কোনরকমে পেছনের সিটটায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছি। আমার সামনেই বসে মনিরুল। কাল থেকে প্রিন্ট মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া, পাড়ার চায়ের দোকান প্রতিটা স্থলে একটাই আলোচনার বিষয় বস্তু ‘মনিরুল, এই সিস্টেম এর ওপর বিতৃষ্ণা থেকে যে একের পর এক সিরিয়াল মার্ডার করে গেলো।’ কখন যে ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে গেছি জানিনা, পুলিশের জীপটা তখনও দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। রাস্তার ওপরেই রমা ও বিজয়দা দাঁড়িয়ে। আমাকে দেখা মাত্র রমা দৌড়ে চলে এলো ‘কি হয়েছে তোমার? বিজয়দা বলেছে তুমি নাকি বিশাল বিপদে রয়েছ তাই উনি আমার সাথে রয়েছেন। তুমি ভালো আছো তো?’ এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো শেষ করে দিলো রমা। আমি শুধুই নিস্পলক দৃষ্টিতে ওর দুচোখের দিকে তাকিয়ে আছি। ‘ভালোবাসা’ এই শব্দটা আজও আমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। নতুন করে বেঁচে ওঠার, নতুন এক পৃথিবী গড়ে তলার স্বপ্ন ঠিক ওই কলেজ জীবনের মত করেই আমার দুচোখে ভেসে আসছিল।
‘তাহলে কি এখনই হ্যান্ড ওভার করবেন?’ আমি একবার মনিরুলের দিকে তাকালাম। ওর দুচোখে যন্ত্রণা থাকলেও তাকে ছাপিয়ে এসেছে জীবনে অন্যের জন্য কিছু করার আনন্দ। রমার দিকে তাকিয়ে বললাম ‘রমা, তুমি একটু ভেতরে যাও, আমার একটু বিজয়দা আর মনিরুলের সাথে বিশেষ কাজ রয়েছে’। কিছুক্ষন ওখানেই থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো রমা, কিন্তু আমার নীরবতা দেখে গুটি গুটি পায়ে ভেতরের দিকে যেতে শুরু করল। বেশ কিছুটা দূর চলে যাওয়ার পর আমিই মনিরুলের দিকে কাতরভাবে তাকালাম। কিছুটা জোর করে হাঁসার চেষ্টা করল মনিরুল। ‘আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি বিপ্লবদা’। আবেগের সমস্ত বাঁধ ভেঙে আমি মনিরুলকে জড়িয়ে ধরলাম, ‘বিশ্বাস কর মনিরুল, শুধুই ৩ ঘণ্টার জন্য আমি মেসমশাইকে ঠকিয়েছিলাম। বাবাই মারা যাওয়ার পর আমি ভেঙে পড়িনি। আমি জানতাম ওই ৫ লাখ টাকা বাবাই এর প্রানের মত তোমার বোনেদের বিয়েতেও জরুরি। নার্সিংহোম অথারিটির পায়ে ধরেছিলাম, ওরা টাকা ফেরত দেয়নি। ফিরে এসে মেসমশাইকে বোঝানোর সময় পাইনি, তার আগেই সব শেষ’। ‘সব ভুলে যান, বিপ্লবদা, আব্বুর মৃত্যু আপনাকে এক নতুন জীবন দিয়েছে, সারাজীবন গরীব দুঃখীর জন্য করে যান। আর আমার কথা ভেবে কষ্ট পাবেন না। আমি এমনিতেই ৩ মাসের অতিথি’ মনিরুলের হাতে হাতকড়া পড়িয়ে বিজয়দা নিয়ে চলে গেলো।
Like Reply
#58
রমা প্রচণ্ড ক্লান্ত ছিল। মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত আমার ঘুম এলনা। নতুন এক ভোরের অপেক্ষায় আমিও ছিলাম। কাল সকালে আলোড়ন পড়ে যাবে। চোখ দুটো বুজে নিলাম, আজ আর চোখের সামনে মেসমশাইএর সেই জ্বলন্ত শরীরটা নয়, সদা হাস্যময় মুখটা ভেসে এলো। আমি অপেক্ষায় ছিলাম কখন কাকগুলো ডেকে উঠবে, আমিও চোখে সানগ্লাস পড়ে তারিয়ে তারিয়ে এই সমাজ ব্যাবস্থার নগ্ন রূপটা দেখতে পাবো। অবশেষে গভীর কালো রাতের অবসান ঘটিয়ে এলো ভোরের সূর্যোদয়, নতুন এক দিগন্ত। দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ভোর সাড়ে ৬ টা। কূপমণ্ডূকের মত আর এক ঘরের এক কোনে বসে থাকতে মন গেলনা। ত্রাউজারটা পড়ে বেরিয়ে পড়লাম। পাড়ার চা দোকানটায় আজ যে ঠিক কত বছর পর যাচ্ছি তার কোন ঠিক নেই। দোকানের সামনে বিশাল জটলা। প্রত্যেকেই একেকটা মাতব্বর। ‘আরে আপনি চুপ করুন মশাই, ক্যান্সার আমার এক দুঃসম্পর্কের ভাইএর ও হয়েছিল, কই সেতো হাতে পিস্তল নিয়ে মানুষ খুন করতে বেরিয়ে পড়েনি’ ‘আরে না না মশাই, সবই ওই গ্লোবালাইজেশন, দেখছেন না আমরা কেমন প্রতি মুহূর্তে আমেরিকাকে নকল করে চলেছি। আমাদের সংস্কৃতিটা ঠিক করে বুঝলে ওইসব সিরিয়াল কিলিং ফিলিং হতনা’ বেশ মজা লাগছিল, সামাজিক ব্যাবস্থার মধ্যে যে এতো বড় একটা ক্যান্সার লুকিয়ে আছে তা জানতাম কিন্তু সেটা যে এভাবে প্রকাশ্যে চলে আসবে তা সত্যিই বুঝতে পারিনি। ‘আরে বিপ্লবদা যে শুনেছেন, কোন এক ট্যাক্সি চালক হতাশগ্রস্ত হয়ে গিয়ে একের পর এক খুন করে কাল গভীর রাতে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে’ কিছুটা ন্যাকাচোঁদার মত মুখটা করে আমিও বললাম ‘সে কি?’ সঙ্গে সঙ্গে এক দিকগজের উত্তর এলো ‘আরে আপনিও তো ব্যাঙ্কেই চাকরি করেন। ভাবুন তো, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কেউ আপনাকে লোণ চাইল আর আপনি দিলেন না। ব্যাস, সিরিয়াল মার্ডার করতে হবে’ আমি শুধুই মুচকি মুচকি হাসলাম। এক রসিক মানুষ বলে উঠলেন ‘কাল বাংলা বন্ধ, একদিক থেকে ভালো হয়েছে, একটা ছুটি তো পাওয়া গেলো’
চায়ের পয়সা দিয়ে আমিও হাঁটা লাগালাম। আর কয়েকটা দিন পড়েই ২৫ শে মাঘ আসবে। বাবাই এর মৃত্যুদিন। এই ২৫ শে মাঘ আমার জীবনে বহুবার এসেছে আর প্রতিবারই কিছু না কিছু ঘটেছে। সেটা ছিল এমনই এক ২৫ শে মাঘ, আজ থেকে ঠিক ৩ বছর আগে। আমি অফিসে বসে মন দিয়ে নিজের কাজ করে চলেছি, হথাত বাইরে প্রচণ্ড চেঁচামিচির আওয়াজ। দেখছি একজন লোককে আমাদের ৩ জন সিকিউরিটি গার্ড মিলে প্রচণ্ড জোরে আঁটকে রেখেছে। বাকি স্টাফদের মত আমিও বাইরে বেরলাম। ‘ওই শালা বিপ্লব চিটিংবাজ মাল একটা, ওকে এক্ষুনি অফিস থেকে বার করে দিন’। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ৩ জনকে ঠেলে ফেলে মনিরুল আমার দিকে দৌড়ে এলো। ‘আপনি কি ভাবেন আমি কুছি জানিনা, বিপ্লবদা আমার ক্যান্সার ধরা পড়েছে, কি করব আমি? কোথায় যাবো? বউ বাচ্চার কি হবে?’ কথা শেষ হতে না হতেই আমার গালে সপাটে তিনটে চড়। মাথাটা নীচু করে ছিলাম, ওর চোখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। সিকিউরিটি ওকে ধাক্কা মারতে মারতে অফিসের বাইরে নিয়ে গেলো। অন্য একজন স্টাফ এসে আমায় একটু ব্যঙ্গ করে বলে উঠল ‘কত টাকা ঝাড়লেন বিপ্লবদা?’ লজ্জায় আর এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়াতে পারছিলাম না। দৌড়ে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। এক পা এক পা করে হাঁটছি আর পেছন থেকে ভেসে আসছে কিছু মানুষের বিদ্রুপ ‘ওই শালা বিপ্লব চোর’। কোথায় যাবো? বাড়িতে সেই অসুস্থ বউ, বাবা মা কবেই পর করে দিয়েছে। পকেট হাতড়ে দেখলাম ৫০০ টাকার একটা নোট পড়ে রয়েছে। ঢুকে পড়লাম রাস্তার পাশের সস্তার বারটায়।
একটার পর একটা পেগ শেষ করে চলেছি আর বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছেন মেসমশাই, মেসমশাইএর জ্বলন্ত দেহটা। এতদিন ভাবতাম মনিরুলরা বোধ হয় জানত না মেসমশাই কেন আত্মহত্যা করেছেন? মনিরুলের চড়টার চেয়েও বেশী লজ্জার এই ব্যাপারটা। কতবার ওদের বাড়িতে গেছি, মাসীমা চায়ের কাপ হাতে এগিয়ে এসেছেন, কাকুতি মিনতি করেছেন ‘দুটো মেয়েরই তো বিয়েটা ভেঙে গেলো, দেখনা তুমি যদি কোনরকমে মেয়েদুটোর কোন ব্যাবস্থা করতে পারো’। ওরা কেন আমায় কোন শাস্তি দিলনা। শুধু এই ভেবে ‘বিপ্লব যা করেছে তা নিজের ছেলের প্রান বাঁচানোর জন্য’। পাপবোধ চরম পাপবোধ, সারা শরীরটা পাপের বিষাক্ত দহনে জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল। ‘রমার জন্য আমার সুস্থ স্বাভাবিক থাকা অত্যন্ত জরুরি’ এই একটাই চিন্তা এতদিন আমার মাথায় ছিল। কিন্তু মনিরুলদের পরিবারটা? এতোগুলো মানুষ শুধুই আমার জন্য রাস্তায় বসে পড়ল। বার থেকে অনেকক্ষন বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছিলাম। কিছুটা দূরে রাস্তার মোড়ে একটা কার্ল মার্ক্সের মূর্তি। কলেজ জীবনে মাথাটা বিগড়ে গেছিল, যখন এই লোকটার লেখা একখানা বই আমার হাতে এসে পড়ল। ‘শালা, দুনিয়া বদলে দেওয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। অলীক একটা স্বপ্ন’, যদি এই লোকটা না থাকতো আমিও হয়ত বাকি দশজনের মতই হতাম। যেদিন প্রথম জেনেছিলাম মার্ক্সের বাচ্চা ছেলেটাও বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে অদ্ভুত লেগেছিল কিন্তু উপলব্ধি করতে পারিনি। সেদিন ওখানে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করছিলাম। আমি ও কার্ল দুজনেই এক কিন্তু ওকে সবাই সম্মান করে আর আমায় জোচ্চোর বলে।
সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ল ওই পাথরের মূর্তিটার ওপর। পায়ের সামনেই একটা আধলা ইট পড়ে ছিল। ঠিক মার্ক্সের মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলাম। লাগলো না। খেয়াল করিনি কিছুটা দুরেই একটা পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে ছিল। দৌড়ে দুখানা হাবিলদার আমার দিকে এসে কলার ধরে জিপের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। ‘শালা, মাতাল, কাকে পাথর মারছিস জানিস? ভাগ্যিস লাগেনি নয়ত এক্ষুনি রাজনৈতিক দাঙ্গা শুরু হয়ে যেত। চল শালা থানায়’ ওরা আমায় টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাচ্ছিল, আর আমার অবচেতন মনে বারবার একটাই প্রশ্ন আসছিল ‘ঢিলটা মার্ক্সের মাথায় কেন লাগলো না? তাহলে কি সত্যিই মার্ক্স চায় আমি হার না মানি, আমি লড়ে যাই। মার্ক্স তো বিপ্লবের দেবতা’।
‘স্যার, এই একটা মাতালকে ধরে এনেছি’, হাবিলদারটা প্রায় ধাক্কা মেরে আমায় ভেতরের ঘরটায় ঢুকিয়ে দিলো। সামনে বসে রাশভারী এক অফিসার। ‘ওহ, এই শহরের আনাচে কানাচে রেপিস্ত আছে, খুনী আছে, সমাজবিরোধী আছে আর তোমরা মাতাল ছাড়া আর কাউকেই পাওনা’ গলাটা শুনেই আমার বুকটা কেমন ধুকপুক করে উঠল, পুলিশের মার কখনো খাইনি। ‘কিরে তোরা কি ভদ্রভাবে সব স্বীকার করবি না আমাকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যেতে হবে’ এতক্ষন খেয়াল করিনি, বিজয়দার ঠিক পাশে ৩ খানা ছেলে দাঁড়িয়ে প্রত্যেককেই ভদ্র বাড়ির ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। তাদেরই মধ্যে একজন বলে উঠল ‘স্যার, তার আগেই আপনার ফোনটা বেজে উঠবে’। দেখলাম বিজয়দা, ছেলেটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। সঙ্গে সঙ্গে কর্কশ স্বরে ফোনটাও বেজে উঠল। খ্যারখেরে গলায় বিজয়দা বলে উঠলেন ‘এই এদেরকে ভেতরের ঘরে নিয়ে যাও আর দেখো কোন আওয়াজ যেন না আসে’। সঙ্গে সঙ্গে একজন হাবিলদার ৩ জনকেই টানতে টানতে ভেতরের ঘরে নিয়ে চলে গেলো। আমি ওইভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ‘হ্যালো, ওহ হ্যাঁ স্যার বলুন! নাতো, না না আমি তো এরকম নামের কাউকে গ্রেফতার করিনি। ও বিজনেস ম্যানের ছেলে! কোন ব্যাপার নয়, মিসিং ডায়েরী করতে হবে? স্যার, ওই এরিয়াটা তো আমার নয়, আপনি পাশের থানায় খবর নিন’। ফোনটা রেখে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভীষণ বিশ্রী একটা হাঁসির সাথে বিজয়দা বললেন ‘একেই বলে চোরের ওপর বাটপাড়ি’। আমি কিছুই উত্তর দিলাম না।
‘আচ্ছা, এবার আপনার কেসটা বলুন তো? ওই এদিকে আসো। বল একে ধরে কেন আনলে?’ বিজয়দার উত্তরে আমি কিছুই বললাম না, ওই হাবিলদারটিই গড়গড় করে সব বলতে শুরু করে দিলো। ‘আর বলবেন না, শালা, মার্ক্সের মূর্তিতে ঢিল ছুঁড়েছে। মাতাল শালা’ সঙ্গে সঙ্গে রাশভারী গলায় বিজয়দার প্রশ্ন ধেয়ে এলো ‘কি ব্যাপার আপনি মার্ক্সেরে মূর্তিতে ঢিল মেরেছেন কেন? জানেন এর থেকে শহরের আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে। কি হোল উত্তর দিন’ মদের নেশাটা আমার তখনও কাটেনি। গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম ‘এই শালা মার্ক্স ই আমায় লড়াই করতে সত্যের পথে চলতে শিখিয়েছিল। ওর ছেলের মত আমার ছেলেও বিনা চিকিৎসায় মারা গেলো, অথচ আমি জোচ্চোর আর ও দার্শনিক। তাই ভাবলাম ঢিল মেরে ওর মূর্তিটা ভেঙে ফেলি’ প্রচণ্ড জোরে একটা অট্টহাস্য। বিজয়দাকে ওইভাবে হাঁসতে দেখে হাবিলদারটাও ফিকফিক করে হেঁসে ফেলল। ‘আপনি তো মশাই ভেতরের আগুনটা এই বয়সেও পুষে রেখেছেন। আপনাকে খুব ভালো লাগলো। চলুন, আপনাকে আজ একটা নতুন রাস্তায় ঘুরিয়ে আনি’ ‘ওই দুটো বানচোঁদকে বার কর, ওদের আজ প্রসাদ খাওয়াবো। শালা, গরীবের মেয়েকে রেপ করেছে মাদারচোঁদগুলো’ বিজয়দার পেছন পেছন আমিও চলতে লাগলাম।
Like Reply
#59
গাড়িটা চলতে শুরু করল। সামনে আমি আর বিজয়দা। পেছনে ওই তিনটে কালপ্রিট আর এক হাবিলদার। ‘দেখলেন তো স্যার, সেই কষ্ট করে আপনাকে বাড়ি অবধি ছাড়তে যেতে হোল’ বিজয়দা শুধুই মুচকি হাসলেন। গাড়িটা ক্রমশ ইএম বাইপাশের দিকে যেতে শুরু করল। ‘একি আপনি বাইপাসের দিকে কেন নিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের বাড়ি তো সল্টলেকে’ ওদের উত্তরে বিজয়দা শুধুই হাসলেন। বেশ কিছুটা যাওয়ার পর গাড়িটা ক্যাঁচ করে শব্দ করে দাঁড়িয়ে গেলো। আমার নজর বিজয়দার পকেটের দিকে। একটা সাদা রুমাল, আর তাতে চাপা দিয়ে একটা পিস্তল। পেছন দিকে তাকিয়ে দেখি তিনটে ছেলেরই কপাল দিয়ে ঘাম ঝরছে। ‘স্যার, কত টাকা চান বলুন? কত টাকা চাই আপনার?’ মিষ্টি একটা হাঁসির সাথে বিজয়দা উত্তর দিলেন ‘এক টাকাও লাগবেনা, যা পালা!’ পরপর তিনটে গুলি, রাস্তার ধারে লুটিয়ে পড়ল তিনটে সামাজিক কীট। ভয়ে আমার জিভটা শুকিয়ে গেছিল, কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছিল। আমার কাঁধে একটা আলতো চাপ আর আবার বিজয়দার কণ্ঠ ‘মশাই, মার্ক্স তো দার্শনিক, ওকি দোষ করল বলুন তো, আসল দোষী তো আমরাই। সবকিছু মুখ বুজে মেনে নিচ্ছি’। সেদিন আমার সাথে বিজয়দার আর কোন কথা হয়নি। এটাই ছিল আমাদের প্রথম আলাপ। এরপর যখন থানায় দেখা হোল, বেমালুম আমাকে চিনতে না পারার ভান করলেন। অনেক পরে বুঝেছি এটাই বিজয়দা, যেকোনো কেসকে উনি প্রথমে নিজে স্টাডি করেন ও তারপর পরিস্থিতি বুঝে ব্যাবস্থা নেন।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছি খেয়াল করিনি। জানি রমা এখনো ঘুমাচ্ছে। ও ঘুমাক। ওকে আমি নতুন করে চিনেছি। কিছু যে একটা রহস্য রয়েছে তা আমি প্রথম বুঝেছিলাম মনিদার সাথে দেখা করতে গিয়ে। সেদিন ছিল শুক্রবার। অফিস থেকে বেরিয়ে একটা সিগারেট ধরাচ্ছি দেখি মনিদা ল্যাগেজ নিয়ে আমাদের অফিসের উল্টো দিকের হোটেলটায় উঠছে। মনিদাকে একা পাবো এটা কখনো ভাবতেও পারিনি। অফিসে ফিরে গিয়ে প্ল্যান বানাচ্ছিলাম। শান আসলে কে? জুলি আসলে কে তা আমি কিছুই জানতাম না। একদিন হথাত রমার ডায়েরীটা হাতে পড়ল। আমি ভাবতাম আমি যে মেসমশাই এর ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছি তা রমা জানেনা। কিন্তু সেদিন বুঝলাম রমা অনেক কিছু জানে। ‘বিপ্লব, নিজেকে প্রতি মুহূর্তে ছোট মনে করে। ও ভাবে সবকিছুর জন্য ওই দায়ী। কিন্তু আসলে এর পেছনে শান’ সেদিন বুঝেছিলাম কোন একটা বিশাল বড় চক্র রয়েছে যারা দেহব্যাবসা ও কালোটাকা উভয়ের সাথেই যুক্ত। রমার ডায়েরী থেকেই প্রথম মনিদার নামটা জেনেছিলাম। ‘মনীন্দ্র বাবুর সাথে আমায় দেখা করতে হবে, উনি সব জানেন’ এটা পড়েই বুঝেছিলাম মনিদাই হোল সেই সিঁড়ি যাকে ব্যাবহার করে আমি মাথা অবধি পৌছাতে পারবো। কিন্তু রমা কেন এদের খোঁজ করছে তার কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। আমি ভেবেছিলাম যে রমা হয়ত কোনভাবে মনিরুল বা অন্য কারুর থেকে মেসমশাইএর মৃত্যুর কারন জেনেছে এবং সেই ব্যাপারেই এতো চিন্তা করছে। যদিও এর পেছনে কোন লজিক ছিলনা।
প্রায় সন্ধ্যে ৮ টা নাগাদ একটা কালো কোর্টে সারা শরীর ঢেকে আমি হোটেলে পৌছাই। রুম নাম্বার আগে থেকেই জেনে গিয়েছিলাম। রুমের কিছুটা কাছে পৌঁছানোর পরই দেখি মনিদা কোথাও বেরচ্ছেন। এই প্রবল শীতের মধ্যেও ওর সারা শরীরে দরদর করে ঘাম দিচ্ছে। আমাকে দেখা মাত্র ছাদের দিকে দৌড় লাগালেন। আমিও পেছন পেছন ছুটলাম। ততক্ষনে শরীরে বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই পা পিছলে নীচে পড়ে যান মনিদা। আমি কোনরকমে লুকিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে যাই। সেদিন কিছুই বুঝিনি, পরে থানায় গিয়ে জেনেছি মনিদার মৃত্যু আসলে বিষক্রিয়ায় হয়েছে। কিন্তু কে এই বিষ মেশাল? কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আর কেনই বা আমার আকাউন্তে ১০ লাখ টাকা পাঠানো হোল? তারও কোন উত্তর আমার কাছে ছিলনা। হুগলী ব্রিজের ওপর রঞ্জনকে কষ্ট দিয়ে মারার সময়ই এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাই।
পুরোটাই ছিল রঞ্জনের ষড়যন্ত্র। রঞ্জন রমার ডায়েরীটা অনেক আগেই পড়ে ফেলেছিল। সেটা আমি জানতাম না, হয়ত রমাও জানত না। ও জানত আমি ঠিকই ওদের কাছাকাছি পৌঁছে যাবো। ওর মনে হয়ত এই দুশ্চিন্তাও ছিল যে রমার সমস্ত স্মৃতি মনে পড়ে যেতে পারে। সেইকারনেই মনিদাকে চাপ দিয়ে আমার আকাউন্তে টাকা পাঠানো ও পরে মনিদাকেই খুন করে দেওয়া জুলি অর্থাৎ মিতাকে পাঠিয়ে। ওদের ওই কোডগুলোও আমি উদ্ধার করতে পারিনি, হয়ত ওরা ওগুলোর সাহায্যেই ম্যাসেজ করত। রঞ্জন চেয়েছিল এই কেসটায় আমায় ফাঁসিয়ে দিতে। সেই ভেবেই বিজয়দাকে ১০ লাখ টাকা ঘুষ দেওয়া ও আমায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া। না, এই কথা বিজয়দা আমায় কোনোদিন বলেননি। আমি মনিরুলের থেকে জেনেছি। বিজয়দা ছিলেন ওদের লোক, তাই প্রতি মুহূর্তে কি ঘটতে পারে তা বিজয়দা খুব ভালো করেই জানতেন। আর আমরাও সেইভাবেই প্রতিক্ষেত্রে বেঁচে গেছি। কিন্তু রমা কেন বারবার ওদের সন্ধান করছে তা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না।
সব জানতে বা বুঝতে পারলাম রমার চিঠিটা আমার হাতে আসার পর। ওর চিঠিটার থেকেই আমি প্রথম জানতে পারলাম মিতা টাকাটা জোগাড় করার জন্য ওকে বাপের বাড়ি নয় নিয়ে গেছে মধুকর ভিলায়। যাদের যাদের কণ্ঠস্বর বা মুখ দেখে রমার কিছু মনে পড়েছে রমা তাদের প্রত্যেকেরই নাম ওই চিঠিটায় লিখে রেখেছিল। এর মধ্যে যেমন ফ্ল্যাটের গার্ড শান্তনু আছে তেমনই আছে শর্মাজী, চিন্ময়, রবি এবং রঞ্জন। মিতা রমাকে ১০ লাখ টাকার অজুহাতে এই ৫ টা জানোয়ারের হাতে তুলে দিয়েছিল। সেই ১০ লাখ টাকা আমাদের কোন কাজে লাগেনি, বাবাইকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। কিন্তু এই ১০ লাখ টাকাই রমাকে এক দুরারোগ্য রোগের দিকে ঠেলে দিলো। রমা কোনোদিন আমায় জানাতে পারতো না এই কথাগুলো। হয়ত সেই কারনেই চিঠিটা লিখেছিল, কিন্তু আমায় দিতে পারেনি।
রবি, চিন্ময় ও শরমাজী এই ৩ জনকেই রঞ্জন খুন করেছিল। শেষ দিকে যে টাকার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে রঞ্জন আর শর্মাজীর মধ্যে যথেষ্ট মনমালিন্য হচ্ছে তা আমি জানতাম। সেই কারনেই হয়ত শর্মাজীর দ্বিতীয় প্রপসাল এবং রঞ্জনের শর্মাজীকে খুন করা। চিন্ময় যে পুলিশের হয়ে কাজ করছে ও এর আগের একটা ব্যাঙ্ক জালিয়াতি কেসে ফেঁসে আছে তা হয়ত রঞ্জন আগে জানত না। মধুকর ভিলা থেকে আমরা পালিয়ে যাওয়ার পরই জানতে পেরেছিল। রবি কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়েছিল, হয়ত ওর ভয় ছিল রবি সব বলে দিতে পারে। তাই রবি খুন হোল। ওরা ৩ জন যে খুন হবে আমিও সেটা জানতাম। আমি বাধা দিইনি। কেনই বা দিতাম, রঞ্জন না মারলে তো আমিই মেরে দিতাম। যেদিন মর্গে সেই মৃতদেহটা দেখেছিলাম সেদিনই জানতাম ওটা রঞ্জনের নয় ওটা শান্তনুর। মুখটাকে বিকৃত করে দিয়ে রঞ্জন নিজের মৃতদেহ বলে চালাতে চেষ্টা করেছে ও সবার চোখে ধোয়া দিয়েছে। খুন আমি শুধুই দুজনকে করলাম, রঞ্জন ও মিতা। এটা না করলে হয়ত মরেও শান্তি পেতাম না। রমার ওপর আমার সামান্য কোন রাগ নেই। কিন্তু খারাপ একটাই লাগলো যে শেষ দিন অবধিও ও নিজের দিদি মিতাকে নিজের অর্ধাঙ্গ মনে করে গেলো। অথচ ওর ওই দিদিই বিপদের দিনে ওকে দেহ ব্যাবসায় যুক্ত করেছিল।
হয়ত আমি খুনদুটো করতে পারতাম না। মনিরুল ই আমায় বলেছিল ‘দাদা, আমার বেঁচে থাকা মরে যাওয়া দুটোই সমান। শুধু মরার আগে যারা আমার আর আপনার পরিবারকে শেষ করে দিলো তাদের ওপর প্রতিশোধ চাই’। আমি মনিরুলের ছেলের ও পরিবারের দায়িত্ব নিলাম আর ও খুনের অভিযোগ নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিল। আর বিজয়দা কেন সবকিছু মেনে নিল? সম্ভবত ও ভেবেছিল এরা এতটাই শক্তিশালী যে আইনের রাস্তায় এদের শাস্তি দেওয়া অসম্ভব।

THE END
Like Reply
#60
খুব সুন্দর লেখাটা মনকে ণর দিয়ে যায়।
Like Reply




Users browsing this thread: 3 Guest(s)