পর্ব ২
অমরেশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মিনিট পাঁচেক এর মধ্যে লেকের কাছে পৌঁছে গেল বিমলেশ। লেকের বাইরে রাস্তায় গাড়ি পার্ক করে সে হাটা দিল লেকের ভিতরে। সেখানকার শান্ত স্নিগ্ধ ও নিরিবিলি পরিবেশে বিমলেশ লেকের ঠিক জলাশয়ের পাড়ে একটি খালি বেঞ্চ দেখে বসে পড়ল। মনে মনে সে ভাবল যে তার প্রিয় বন্ধু অমরেশ তাকে ঠিক উপদেশই দিয়েছিল। সত্যিই লেকের শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশ ও জলাশয়ের ওপর দিয়ে বয়ে চলা মৃদুমন্দ বাতাস মানুষের জীবনের দুঃখ কষ্ট কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলিয়ে দিতে সক্ষম। বিমলেশ ও বেশ কিছুক্ষন চোখ বুজে সেই পরিবেশের স্নিগ্ধতা আস্বাদন করার পর তার জীবনে ঘটে যাওয়া সেই অভিশপ্ত দিনটির কথা মনে করল।
দিনটি ছিল এক বুধবার। আজ থেকে মাস চারেক আগে। সেদিন বিমলেশের ক্লাবের স্থানীয় লিগের ম্যাচ ছিল একটি লিগ তালিকার নীচের দিকে থাকা একটি দলের বিরুদ্ধে। বিমলেশ ছিল তার ক্লাব দলের অধিনায়ক। সেই ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে বিপক্ষের ১৮ গজ পেনাল্টি বক্সের জাস্ট বাইরে একটি ৫০-৫০ বল নিজের দখলে আনার জন্য বিমলেশ শূন্যে নিজের শরীরটিকে ভাসিয়ে দেয় ও বিপক্ষ দলের লেফট ফুলব্যাক, ময়দানে মারকুটে খেলোয়াড় হিসেবে কুখ্যাত সুজেশ প্রসাদ বিমলেশকে একটি জঘন্য ট্যাকেল করে নিজের বুট হাওয়ায় তুলে with his studs showing. এই ট্যাকেলের জন্য রেফারি তৎক্ষণাৎ সুজেশকে লালকার্ড দেখায়। কিন্তু বিমলেশ মাটিতে পরে যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে ও তাকে মাঠ থেকেই সোজা হসপিটালে এডমিট করতে হয়। হসপিটালে বিমলেশের বিভিন্ন ডাক্তারি পরিক্ষা নিরিক্ষা চালানোর পর জানানো হয় আঘাতটি অত্যন্ত গুরুতর ও আঘাতের ফলে মুল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বিমলেশের পুরুষাঙ্গটি। ক্ষতির পরিমান জানতে হাসপাতাল থেকে একজন কোন এন্ড্রোলজিস্টের পরামর্শ নেওয়ার কথা জানানো হয় বিমলেশের পরিবারকে। সেই মত সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার অভিন্নহৃদয় বন্ধু অমরেশের পরিচিত একজন এন্ড্রোলজিস্টের চিকিৎসাধীন ছিল বিমলেশ। আজ বিকেলে তার কাছেই গিয়েছিল বিমলেশ। কিন্তু তিনি এত দিন ধরে বিমলেশের বিভিন্ন মেডিক্যাল টেস্ট করানোর পর আজ ফাইনালি জানিয়ে দিয়েছেন যে বিমলেশের পক্ষে আর কোনদিন সন্তানের পিতা হওয়া সম্ভব নয়। এই হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ শোনার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে না পেরে সে তার পরম মিত্রের কাছে ছুটে যায় নিজের দুঃখকষ্ট শেয়ার করতে কারণ অমরেশই এমন একজন যার সাথে বিমলেশ তার নিজের মনের ভিতর জমে থাকা সমস্ত কষ্ট নির্দ্বিধায় শেয়ার করে এসেছে।
পরক্ষনেই বিমলেশ মনে মনে ভাবল “আমি এতটা স্বার্থপর কি করে হলাম, আমি শুধু আমার কষ্টের কথা জানাতে অমরেশের কাছে ছুটে গেছি কিন্তু ভুলেই গেছি যে ও নিজে কি ভয়ানক ট্রমা ফেস করেছে বছর দেড়েক আগেই।’ অমরেশের জীবনে একটি চরম ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যায় আজ থেকে বছর দেড়েক আগে। অমরেশ গত বছর জুলাই মাসে নিজের স্ত্রী অনুপমা ও তার শ্বশুর শাশুড়িকে নিয়ে সিকিমের পাহাড়ে ভ্রমণ করতে যায় আর সেখানেই গাড়িতে করে একটি দুর্গম ও পিচ্ছিল রাস্তা ধরে যাত্রা করার সময় তাদের গাড়ির চাকা স্কিট করায় চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে ও তাদের গাড়িটি পাহাড়ের গভীর খাঁদে পড়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় একমাত্র অমরেশ কোনক্রমে বেঁচে যায় কিন্তু তার শ্বশুর শাশুড়ি ও তার স্ত্রী অনুপমার মৃত্যু ঘটে।
বিমলেশের মনে পড়ে যে সে নিজে কতবার অমরেশকে পই পই করে বুঝিয়েছিল যে এরকম জুলাই মাসের ভরা বর্ষায় ওরকম দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় না যেতে। কিন্তু অমরেশ তার কোন সাবধানবানীকেই পাত্তা দেয়নি। বিমলেশ এই ব্যাপারে কিছু বললেই অমরেশ “তুই বেকার বেকার ভয় পাচ্ছিস’ বলে তার কথা হেসে উড়িয়ে দিত।
বিমলেশ ভাবল যে তার দুঃখ তো অমরেশের দুঃখের তুলনাই কিছুই না। তার পরিবার তো এখনও তার সাথে আছে, তার পাশে আছে। না যা ঘটার তা ঘটে গেছে, যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে, সে এখানে বসে থাকলে তো সমস্যার কোন সমাধান হবেনা, তার থেকে ভালো বাড়ি ফিরে যাওয়া। এই ভেবে বিমলেশ আগের তুলনায় কিছুটা হালকা মনে গাড়ির উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। বিমলেশ গাড়ি নিয়ে তার সাদার্ন এভিনিউ স্থিত প্রাসাদোপম অট্টালিকাতে প্রবেশ করল ও বাড়ির দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতেই তার আড়াই বছর বয়সের পুত্র ‘রিক’ বাবা বাবা বলে ছুটে এসে এক লাফে তার কোলে উঠে পড়ল। বিমলেশও পরম স্নেহে নিজের পুত্রের গালে ও মাথায় চুমু খেয়ে তাকে আদর করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে বিমলেশের মা সর্বজয়া দেবী ও বাবা কেদারেশ্বর মিত্র সেখানে এসে পড়েছেন। এমনকি পরিবারের সর্বময় কর্তা বিমলেশের জ্যাঠামশাই বিশ্বেশ্বর মিত্র ও এই বৃদ্ধ বয়সে সেখানে এসে পড়েছেন। অকৃতদার বিশ্বেশ্বর মিত্র এককালের রাজ্যের ক্রিকেট নিয়ামক সংস্থার একজন শীর্ষকর্তা ছিলেন। এখন বয়সের ভারে তিনি সকল পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন কিন্তু এখনও তিনি সমাজে একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যাক্তি।
সর্বজয়া দেবীই প্রথম বিমলেশকে প্রশ্ন করলেন “কি রে ডাক্তারবাবুর সাথে তো আজ তোর দেখা করার কথা ছিল, তা উনি কি বললেন ?”
বিমলেশ রিক কে তার কোল থেকে নামিয়ে তাকে বলল “রিক এখন তুমি তোমার ঘরে গিয়ে খেলা করো” বলে রিকের দেখাশোনা করার দ্বায়ীত্বে যে ভৃত্য আছে তাকে চোখের ইশারায় রিককে সেখান থেকে নিয়ে যেতে বলে বিমলেশের তার বাবার হাতে মেডিকেল রিপোর্টের ফাইলটি দিয়ে দিল ও ডাক্তার তাকে কি বলেছে সেই কথাও সেখানে উপস্থিত সবাইকে জানালো। বিমলেশ সেই কথা সকলকে জানানোর পর মুহূর্তের মধ্যে গোটা মিত্রবাড়ির আকাশ বাতাস যেন এক ঘোর বিষণ্ণতার কালো ছায়ায় নিমজ্জিত হল। বিমলেশের মা সর্বজয়া দেবী তো বাক্রুদ্ধ হয়ে পড়লেন, কেদারেশ্বর বাবুও একটি চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়লেন। এমনকি বিশ্বেশ্বর বাবুর মতন ওরকম এক কালের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মানুষের চোখের কোন থেকে চোখের জল গড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু বাড়িতে এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও বাড়ির একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ সদস্যা রয়ে গেল এই সমস্ত ঘটনায় অনুপস্থিত। সে ছিল বিমলেশের জীবনের সব থেকে কাছের মানুষ তার অর্ধাঙ্গিনী মাধুরিলতা মিত্র।
বিমলেশ ধীর পায়ে বাড়ির দ্বিতলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল ও ঘরে পৌঁছে দেখল তার স্ত্রী মাধুরিলতা তার মোবাইল ফোনে কারোর সাথে খোশগল্পে মশগুল। বিমলেশকে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গিয়ে মাধুরিলতা শুধু “পরে কল করছি” বলে ফোনটা কেটে দিল।
এবার সে বিমলেশকে দেখে মুখে হাসি এনে তাকে বলল “ও তুমি এসে গেছো, তুমি যাও বাথরুমে গিয়ে মুখ হাত পা ধুয়ে বাইরের জামাকাপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে নাও আমি তোমার চা জলখাবারের বন্দোবস্ত করছি।”
বিমলেশ মনে মনে ভাবলো “ও তো জানতো যে ডাক্তারের কাছে আজ আমার মোস্ট ইম্পরট্যান্ট বিষয় নিয়ে দেখা করার কথা, কিন্তু ও আমাকে তো এই ব্যাপারে কিছুই জানতে চাইল না।“ আবার পরক্ষনেই তার মাথায় আসলো যে “না আমিই বেশি ভাবছি, ও আমার কথা ভেবেই যাতে আমার কোন ভাবে কোন রকম স্ট্রেস না হয় তাই নিজের কষ্ট মনে চেপে রেখে আমার সাথে হাসিমুখে ব্যাবহার করছে। সত্যিই আমি মাধুরীর মত স্ত্রী পেয়ে ধন্য।”
বিমলেশ তাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল তার আগেই মাধুরিলতা বিমলেশের হাতে তার তোয়ালে ও বাড়িতে পড়ার জামাকাপড় ধরিয়ে দিয়ে বলল “তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি তোমার চা জলখাবার পাঠাতে বলে আসছি।“
এই কথা বলেই মাধুরিলতা বিছানা থেকে তার মোবাইল ফোনটা নিয়ে তাদের ঘর থেকে বেড়িয়ে গেল। আর ঘর থেকে বেড়িয়ে দু পা যেতেই মাথুরিলতার ফোনটা ‘টিং টিং’ করে বেজে উঠে জানান দিল যে তার ফোনে একটি হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এসেছে। মাধুরিলতা সেদিকে চোখ ফেরাতেই প্রেরকের নাম ও মেসেজটা তার দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠল।
প্রেরকের নাম ‘Amu
’ ও মেসেজটির বক্তব্য হল “উদগান্ডুটা আজও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছে।“
(ক্রমশ)