29-10-2024, 12:40 AM
অফিসের টেবিলে এক কোণায় "গল্পগুচ্ছ" পড়ে থাকতে দেখে বেশ অবাকই হলো রাকিব। অফিসের টেবিলে আর যাই পড়ে থাক, বই থাকার মতন স্থান যে এটা না তা একটা পাগলেও বোঝে। কিন্তু কোনোভাবে বইটা এসেছে, আর তার টেবিলেই এসেছে। একবার ভাবলো পিয়নকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, কিন্তু এই সকালবেলায়ই লোকটাকে আর ডাকাডাকি করতে ইচ্ছে করলো না। বইয়ের পাশেই আজকের খবরের কাগজটা পড়ে আছে। সেটা তুলে নিয়ে শিরোনামে চোখ বোলাতে লাগলো রাকিব। রবিবারের সকালে এরচে' বেশি আর কিছু করারও ফুসরত নেই, হাজারটা কাজ জমা পড়ে আছে। টেবিলের পাশে ফাইলের স্তূপ দেখেই মনটা বিষিয়ে উঠলো তার। খবরের কাগজেও যেন মন বসছে না। বারবার চোখ চলে যাচ্ছে বইটার দিকে, আর অতীতের স্মৃতিপটে যেন কিছু একটা ঢেউ তুলছে। না না, "কিছু একটা" নয়, কেউ একজন। বাংলা ডিপার্টমেন্টের মনীষা...
ইট বালি সিমেন্টের হিসাবনিকাশে মগ্ন ইঞ্জিনিয়ার রাকিব জীবনে কোনকালেই সাহিত্যানুরাগী ছিল না। জীবনে গল্প উপন্যাসও পড়েছে সে হাতেগোনা। তাও পাঠ্যপুস্তকে যেগুলো ছিল, ওগুলোই। পরীক্ষায় লেখতে না হলে বোধহয় সেটুকুও পড়া হতো না। তার স্ত্রী বুলবুলির প্রতিদিনকার অভিযোগ- মন-টন বলে কিছু নেই, ইট-সিমেন্ট নিয়ে কাজ করতে করতে নাকি তার মনটাও অমন হয়ে গেছে। এসব কথা অবশ্য তেমন একটা কানে তোলে না সে। কখনো কখনো হাসে, কিন্তু মনে মনে। বুলবুলির বাচ্চাসুলভ আচরণগুলো দেখে না হেসে উপায় নেই। এদিক থেকে মনীষা ছিল বেশ আলাদা। ওর চোখ, ভ্রু- পুরো চেহারাতেই কেমন যেন একটা গাম্ভীর্যের ছাপ ছিল। আর ছিল প্রচণ্ড সাহিত্যানুরাগী। সাহিত্য নিয়ে বলতে শুরু করলে ওর যেন থামার নামগন্ধ থাকত না। অর্ধেকের বেশি কথা রাকিব বুঝতোই না, কিন্তু তবুও শুনত। না শুনলে মহারাণীর আবার রাগের সীমা থাকত না। মনীষা পণ করেছিল রাকিবকে সে সাহিত্যের স্বাদ নেয়াবেই। এরকম পাথরে ফুল ফোটানোর ব্রত তার আর পূর্ণ হয়নি। এর আগেই কানাডাপ্রবাসী স্বামীর ঘর আলো করে দাম্পত্য জীবনের শৃঙ্খলে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছে। কোথায় সে পুষ্পকানন, আর কোথায় সে পাথরবাগান!
মনীষার সাথে রাকিবের সম্পর্ক ছিল তিন বছরের। বলা যায়, ভার্সিটি লাইফের পুরোটা জুড়েই ওর সাথে কেটেছে। তেমন বন্ধুবান্ধব রাকিবের কোনোদিনই ছিল না, সবসময়ই নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করত সে। ভার্সিটিতেও সে ধারা বজায় থাকত, যদি না মনীষা এসে ওর প্রেমিকা ও কখনোই মনপিঞ্জরে নিজের জায়গা বানিয়ে না নিত। সেই হিসেবে প্রেমিকা ও বন্ধু- দুই-ই ছিলা মনীষা। চিরাচরায়িত ন্যাকা প্রেমিকা সে কখনোই ছিলনা, কোনোদিন হওয়ার চেষ্টাও করে নি। নিয়মিত অন্তরে প্রেম-অ্যানিভার্সারি পালন, হা বিভিন্ন 'ডে" পালন-এসব কখনে নিয়ে কখানাই নিজেও মাথা ঘামায় নি, রাকিবকেও জোর করে নি। রাকিবই উল্টো জোর কার মাঝে মাঝে বিভিন্ন 'ডে' তে ঘুরতে যেত। পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে- এসবে রাকিব নিজে যেচেই বের হতে বলত মনীষাকে। তবে একটা ব্যাপারে মনীষা কখনোই কার্পন্য করে নি। শরীরের ব্যাপারে। সুযোগ পেলেই হয় রাকিবের বাসায়, না হয় অন্য কোথাও, তারা মেতে উঠত নিজেদের নিয়ে। সাহিত্যের প্রতি তার যেমন ক্ষুধা, শরীরের প্রতি ক্ষুধা যেন ছিল দশগুণ বেশি। মুখ, দুধ, বুক, পাছা গুদ কোনোটাই বাদ রাখতে দেয়নি সে। মনীষার অসীম ক্ষুধা মেটাতে পিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেত রাকিব। । শরীরী খেলা শেষে অন্তত প্রায় আধঘন্টা শুয়ে থাকত রাকিব, মনীষার শরীরে মুখ খুঁজে। রাকিবের নাসারন্ধে ভীড় জমাতো মনীষার শরীরের ঘ্রাণ। না, সে যে ফরাসী পারফিউম ব্যাবহারে অভ্যস্ত ছিল, ঠিক সে ঘ্রাণ নয়। জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিতেই টের পায় ওই পারফিউমের স্নিগ্ধ ঘ্রাণেরও আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য এক সৌরভ- মনীষার শরীরের নিজস্ব সৌরভ।
কোথায় যেন রাকিব শুনেছে প্রত্যেকটা মানুষের শরীরের গন্ধ আলাদা আলাদা। সত্যিই হয়ত তাই। মনীষার শরীরের আনাচে-কানাচে উঁকি দিত হাসনাহেনা ফুলের সৌরভ। শরীরের গন্ধ আলাদা। আনাচে কানাচে উঁকি । অফিসের চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাসবায়ু ভেতরে টেনে নিতেই তার মনে হলো যেন হাসনাহেনার সেই ঘ্রান। তার কত চেনা, কত আপন এই ঘ্রাণ! এত চোখ বুজলেই এত কাছে, অথচ চোখ মেললেই হাজার মাইলের ব্যাবধান। আহা, কতদিন পর সেই ঘ্রাণ যনের প্রাজ্ঞানে আঘাত হানলো বিচরণ করলো! আচ্ছা, মনীষার স্বামী কী এতদিনে মনীষার বুকের খাঁজে মুখ ডুবিয়ে এ ঘ্রাণের নাগাল পেয়েছে? আচ্ছা, বুলবুলির গায়ে কোন ফুলের ঘ্রাণ? - কথাটা মনে হতেই চমকে উঠল রাকিব। চোখ খুলে ভাবল, আশ্চর্য! এ কথা তো মনে পড়ছে না! স্মৃতির পাতায় প্রাণপণে হাতড়ে দেখতে লাগল রাকিব, কিন্তু ফলাফল শূন্য।
বুলবুলি আর রাকিবের দাম্পত্য জীবন বেশ অনেকদিন ধরেই প্রায় শুধু রটিনমাফিক চলছে। এমন নয় যে, বুলবুলির সৌন্দর্যের ঘাটতি হয়েছে, বা রাকিবের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। বছর পেরোতেই বেশিরভাগ দম্পতির যে একঘেয়েমি চলে আসে, তাদের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা। দুই বছরের দাম্পত্য জীবনে প্রথম এক বছর যেন ছিল স্বপ্নীল। কিন্তু বছর ঘুরতেই চাকরির চাপে হোক, আর নিজেদের একঘেয়েমিতেই হোক- সে উত্তেজনায় ভাটা পড়ে গিয়েছে। মনীষার মতো উন্মত্ততা, উন্মাদনা বুলবুলির মধ্যে কখনোই ছিল না। রাকিব সেটা আশাও করে নি। কিছুটা শান্ত-স্নিগ্ধ। মাঝে মাঝে রাকিবের পক্ষ থেকে উন্মাদনার সূত্রপাত ঘটলেও অপরপক্ষের উদাসীনতায় কিছুক্ষনে সে উন্মাদনা স্থায়ী হতো না। তাই নিয়ে কখনো রাকিবের কোনো অভিযোগও ছিল না। তার কাছে এই শান্ত-স্নিগ্ধতাই যেন পরম সুখ হয়ে ধরা দিয়েছিল এতদিন। কিন্তু আজ হঠাৎ এতদিন পর মনীষার কথা মনে পড়ায় তার ইচ্ছা হয়েছে আরেকবার সেই উন্মাদনার স্বাদ পেতে। ইচ্ছা হচ্ছে কৃত্রিমতার মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে একেবারে কট্টর আদিমতার স্বাদ নিতে। কিন্তু এ মুহূর্তে যার কথা মনে পড়ছে, এ আদিমতার মনে আসলেই সর্বপ্রথম যার কথা মনে পড়ে, চোখের চোখের পর্দাজুড়ে যে মনীষার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে-সে মনীষা যে ধরাছোঁয়ারও বাইরে। মুহূর্তে বিষণ্নতায় ঢেকে যায় তার মনের আকাশ।
মনীষার স্বামী আলমগীরের সাথে মনীষার পরিচয় রাকিবের সূত্র ধরেই। নিজের সহপাঠী বন্ধু হিসেবে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রাকিব নিজেই। পরবর্তীতে "স্বামী" নির্বাচনের সময় অবলীলায় রাকিবের বদলে আলমগীরকে বেছে নিয়েছিল মনীষা। নিজের বোকামির জন্য নিজেই একসময় কত আফসোস করেছে, নিজেকে তিরস্কার করেছে। কেন সে ওদের পরিচয় করাতে গেল! পরে অবশ্য তার মনে হয়েছে এ সব হিসাবনিকাশ করা বৃথা। মনীষা সব জেনেশুনে আটঘাট বেঁধে অঙ্ক কষে তবেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মনীষার মুখে একসময় রাকিব বহুবার শুনেছে, “প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে মোর প্রতি অঙ্গ মোর, আজ হঠাৎ কেন যেন আবার এই লাইনটা তার মনে এল। সাথে এও মনে হলো এই 'প্রতি অঙ্গ" শব্দগুচ্ছের মধ্যে কোনো আলাদা ইঙ্গিত ছিলনা তো! কে জানে! রাকিবের আর এ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা হলো না। শুধু মনে হলো, আলমগীর কী সেই প্রতি অঙ্গের কান্নার কান্না মিটিয়েছে? তার যথাযথ মর্ম বুঝেছে? এখন এখনও কী সে মনীষা রাতের আঁধারে বিছানায় সেই উত্তাল আলোড়ন তোলে? ক্লাসিকাল ড্যান্স জানা দক্ষ কোমরে ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ে আলমগীরের সমুদ্রতটে? জানতে ইচ্ছে হয় রাকিবের আলমগীর কি পারে মনীষার উন্মত্ত উত্তাল ঢেউয়ের সামনে নিজের তরী ভাসিয়ে রাখতে? হয়তবা পারে! তবে আর চিন্তা কীসের! এ তাহলে রাকিবেরই ভ্রম। বিষণ্ণতা বাতিক। মনীষা আছে তার আপনভুবনে রাজরাণী হয়ে। অন্তত মনীষা এই হিসাব কষেই তো আলমগিরের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিল সুদূর কানাডায়।
চলবে...
ইট বালি সিমেন্টের হিসাবনিকাশে মগ্ন ইঞ্জিনিয়ার রাকিব জীবনে কোনকালেই সাহিত্যানুরাগী ছিল না। জীবনে গল্প উপন্যাসও পড়েছে সে হাতেগোনা। তাও পাঠ্যপুস্তকে যেগুলো ছিল, ওগুলোই। পরীক্ষায় লেখতে না হলে বোধহয় সেটুকুও পড়া হতো না। তার স্ত্রী বুলবুলির প্রতিদিনকার অভিযোগ- মন-টন বলে কিছু নেই, ইট-সিমেন্ট নিয়ে কাজ করতে করতে নাকি তার মনটাও অমন হয়ে গেছে। এসব কথা অবশ্য তেমন একটা কানে তোলে না সে। কখনো কখনো হাসে, কিন্তু মনে মনে। বুলবুলির বাচ্চাসুলভ আচরণগুলো দেখে না হেসে উপায় নেই। এদিক থেকে মনীষা ছিল বেশ আলাদা। ওর চোখ, ভ্রু- পুরো চেহারাতেই কেমন যেন একটা গাম্ভীর্যের ছাপ ছিল। আর ছিল প্রচণ্ড সাহিত্যানুরাগী। সাহিত্য নিয়ে বলতে শুরু করলে ওর যেন থামার নামগন্ধ থাকত না। অর্ধেকের বেশি কথা রাকিব বুঝতোই না, কিন্তু তবুও শুনত। না শুনলে মহারাণীর আবার রাগের সীমা থাকত না। মনীষা পণ করেছিল রাকিবকে সে সাহিত্যের স্বাদ নেয়াবেই। এরকম পাথরে ফুল ফোটানোর ব্রত তার আর পূর্ণ হয়নি। এর আগেই কানাডাপ্রবাসী স্বামীর ঘর আলো করে দাম্পত্য জীবনের শৃঙ্খলে নিজেকে বন্দি করে নিয়েছে। কোথায় সে পুষ্পকানন, আর কোথায় সে পাথরবাগান!
মনীষার সাথে রাকিবের সম্পর্ক ছিল তিন বছরের। বলা যায়, ভার্সিটি লাইফের পুরোটা জুড়েই ওর সাথে কেটেছে। তেমন বন্ধুবান্ধব রাকিবের কোনোদিনই ছিল না, সবসময়ই নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করত সে। ভার্সিটিতেও সে ধারা বজায় থাকত, যদি না মনীষা এসে ওর প্রেমিকা ও কখনোই মনপিঞ্জরে নিজের জায়গা বানিয়ে না নিত। সেই হিসেবে প্রেমিকা ও বন্ধু- দুই-ই ছিলা মনীষা। চিরাচরায়িত ন্যাকা প্রেমিকা সে কখনোই ছিলনা, কোনোদিন হওয়ার চেষ্টাও করে নি। নিয়মিত অন্তরে প্রেম-অ্যানিভার্সারি পালন, হা বিভিন্ন 'ডে" পালন-এসব কখনে নিয়ে কখানাই নিজেও মাথা ঘামায় নি, রাকিবকেও জোর করে নি। রাকিবই উল্টো জোর কার মাঝে মাঝে বিভিন্ন 'ডে' তে ঘুরতে যেত। পহেলা বৈশাখ, ভ্যালেন্টাইনস্ ডে- এসবে রাকিব নিজে যেচেই বের হতে বলত মনীষাকে। তবে একটা ব্যাপারে মনীষা কখনোই কার্পন্য করে নি। শরীরের ব্যাপারে। সুযোগ পেলেই হয় রাকিবের বাসায়, না হয় অন্য কোথাও, তারা মেতে উঠত নিজেদের নিয়ে। সাহিত্যের প্রতি তার যেমন ক্ষুধা, শরীরের প্রতি ক্ষুধা যেন ছিল দশগুণ বেশি। মুখ, দুধ, বুক, পাছা গুদ কোনোটাই বাদ রাখতে দেয়নি সে। মনীষার অসীম ক্ষুধা মেটাতে পিয়ে প্রায়ই হিমশিম খেত রাকিব। । শরীরী খেলা শেষে অন্তত প্রায় আধঘন্টা শুয়ে থাকত রাকিব, মনীষার শরীরে মুখ খুঁজে। রাকিবের নাসারন্ধে ভীড় জমাতো মনীষার শরীরের ঘ্রাণ। না, সে যে ফরাসী পারফিউম ব্যাবহারে অভ্যস্ত ছিল, ঠিক সে ঘ্রাণ নয়। জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিতেই টের পায় ওই পারফিউমের স্নিগ্ধ ঘ্রাণেরও আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্য এক সৌরভ- মনীষার শরীরের নিজস্ব সৌরভ।
কোথায় যেন রাকিব শুনেছে প্রত্যেকটা মানুষের শরীরের গন্ধ আলাদা আলাদা। সত্যিই হয়ত তাই। মনীষার শরীরের আনাচে-কানাচে উঁকি দিত হাসনাহেনা ফুলের সৌরভ। শরীরের গন্ধ আলাদা। আনাচে কানাচে উঁকি । অফিসের চেয়ারে বসে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাসবায়ু ভেতরে টেনে নিতেই তার মনে হলো যেন হাসনাহেনার সেই ঘ্রান। তার কত চেনা, কত আপন এই ঘ্রাণ! এত চোখ বুজলেই এত কাছে, অথচ চোখ মেললেই হাজার মাইলের ব্যাবধান। আহা, কতদিন পর সেই ঘ্রাণ যনের প্রাজ্ঞানে আঘাত হানলো বিচরণ করলো! আচ্ছা, মনীষার স্বামী কী এতদিনে মনীষার বুকের খাঁজে মুখ ডুবিয়ে এ ঘ্রাণের নাগাল পেয়েছে? আচ্ছা, বুলবুলির গায়ে কোন ফুলের ঘ্রাণ? - কথাটা মনে হতেই চমকে উঠল রাকিব। চোখ খুলে ভাবল, আশ্চর্য! এ কথা তো মনে পড়ছে না! স্মৃতির পাতায় প্রাণপণে হাতড়ে দেখতে লাগল রাকিব, কিন্তু ফলাফল শূন্য।
বুলবুলি আর রাকিবের দাম্পত্য জীবন বেশ অনেকদিন ধরেই প্রায় শুধু রটিনমাফিক চলছে। এমন নয় যে, বুলবুলির সৌন্দর্যের ঘাটতি হয়েছে, বা রাকিবের সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। বছর পেরোতেই বেশিরভাগ দম্পতির যে একঘেয়েমি চলে আসে, তাদের ক্ষেত্রেও সেই একই ঘটনা। দুই বছরের দাম্পত্য জীবনে প্রথম এক বছর যেন ছিল স্বপ্নীল। কিন্তু বছর ঘুরতেই চাকরির চাপে হোক, আর নিজেদের একঘেয়েমিতেই হোক- সে উত্তেজনায় ভাটা পড়ে গিয়েছে। মনীষার মতো উন্মত্ততা, উন্মাদনা বুলবুলির মধ্যে কখনোই ছিল না। রাকিব সেটা আশাও করে নি। কিছুটা শান্ত-স্নিগ্ধ। মাঝে মাঝে রাকিবের পক্ষ থেকে উন্মাদনার সূত্রপাত ঘটলেও অপরপক্ষের উদাসীনতায় কিছুক্ষনে সে উন্মাদনা স্থায়ী হতো না। তাই নিয়ে কখনো রাকিবের কোনো অভিযোগও ছিল না। তার কাছে এই শান্ত-স্নিগ্ধতাই যেন পরম সুখ হয়ে ধরা দিয়েছিল এতদিন। কিন্তু আজ হঠাৎ এতদিন পর মনীষার কথা মনে পড়ায় তার ইচ্ছা হয়েছে আরেকবার সেই উন্মাদনার স্বাদ পেতে। ইচ্ছা হচ্ছে কৃত্রিমতার মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে একেবারে কট্টর আদিমতার স্বাদ নিতে। কিন্তু এ মুহূর্তে যার কথা মনে পড়ছে, এ আদিমতার মনে আসলেই সর্বপ্রথম যার কথা মনে পড়ে, চোখের চোখের পর্দাজুড়ে যে মনীষার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে-সে মনীষা যে ধরাছোঁয়ারও বাইরে। মুহূর্তে বিষণ্নতায় ঢেকে যায় তার মনের আকাশ।
মনীষার স্বামী আলমগীরের সাথে মনীষার পরিচয় রাকিবের সূত্র ধরেই। নিজের সহপাঠী বন্ধু হিসেবে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল রাকিব নিজেই। পরবর্তীতে "স্বামী" নির্বাচনের সময় অবলীলায় রাকিবের বদলে আলমগীরকে বেছে নিয়েছিল মনীষা। নিজের বোকামির জন্য নিজেই একসময় কত আফসোস করেছে, নিজেকে তিরস্কার করেছে। কেন সে ওদের পরিচয় করাতে গেল! পরে অবশ্য তার মনে হয়েছে এ সব হিসাবনিকাশ করা বৃথা। মনীষা সব জেনেশুনে আটঘাট বেঁধে অঙ্ক কষে তবেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মনীষার মুখে একসময় রাকিব বহুবার শুনেছে, “প্রতি অঙ্গ লাগি কাঁদে মোর প্রতি অঙ্গ মোর, আজ হঠাৎ কেন যেন আবার এই লাইনটা তার মনে এল। সাথে এও মনে হলো এই 'প্রতি অঙ্গ" শব্দগুচ্ছের মধ্যে কোনো আলাদা ইঙ্গিত ছিলনা তো! কে জানে! রাকিবের আর এ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছা হলো না। শুধু মনে হলো, আলমগীর কী সেই প্রতি অঙ্গের কান্নার কান্না মিটিয়েছে? তার যথাযথ মর্ম বুঝেছে? এখন এখনও কী সে মনীষা রাতের আঁধারে বিছানায় সেই উত্তাল আলোড়ন তোলে? ক্লাসিকাল ড্যান্স জানা দক্ষ কোমরে ঢেউ তুলে আছড়ে পড়ে আলমগীরের সমুদ্রতটে? জানতে ইচ্ছে হয় রাকিবের আলমগীর কি পারে মনীষার উন্মত্ত উত্তাল ঢেউয়ের সামনে নিজের তরী ভাসিয়ে রাখতে? হয়তবা পারে! তবে আর চিন্তা কীসের! এ তাহলে রাকিবেরই ভ্রম। বিষণ্ণতা বাতিক। মনীষা আছে তার আপনভুবনে রাজরাণী হয়ে। অন্তত মনীষা এই হিসাব কষেই তো আলমগিরের হাত ধরে পাড়ি দিয়েছিল সুদূর কানাডায়।
চলবে...