09-08-2024, 12:56 AM
একটি শীতের রাতের মধুর স্মৃতি
পর্ব ১
যে গল্পটা আজ আমি এখানে বলতে চলেছি, সেটা আসলে কোনো গল্পই নয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা রাত। সেই রাতে একটা ঘর ছিল। কিছুটা আলো ছিল। আর বাকীটা অন্ধকার ছিল। অখণ্ড নিস্তব্ধতা ছিল। শাঁখা-পলা-চুড়ির মিলিত মিনমিনে একটা আওয়াজ ছিল। কাতর আকুতি ছিল। হাল্কা শীৎকারও ছিল তার সাথে। আর ছিল দুটো মানুষ। একজন পুরুষ। আর একজন নারী। সেই পুরুষটা ছিলাম আমি। আর নারীটি? আমার প্রেমিকা? নাকী আমার বান্ধবী? নাকী আমার স্ত্রী? এর সবগুলোর উত্তরই হল, না। সে আমার প্রেমিকা, বা বান্ধবী কিম্বা আমার স্ত্রী, কেউই ছিল না। তাহলে সে কে ছিল? সব বলব। আজ এতদিন পরে… না, দিন নয়। এতবছর পরে সেই রাত্রিরের কাটাছেঁড়া যখন করতে বসেছি, তখন সব কথাই বলব। কোনোকথাই লুকিয়ে যাবো না। যে কথাটা এতবছর ধরে নিজের স্ত্রীর কাছেও চেপে গেছি, সেইকথাটাই আজ সবাইকে বলতে বসেছি। হয়তো একটু ভণিতা করে ফেললাম। নাকি একটু কাব্য? জানি না। কাব্য আমি করতে পারি না। ওসব আমার আসে না। আমি কোনো লেখক নই। তাই সবকথা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারবো না। কেবল ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল, তা পরপর বলে যাওয়ার চেষ্টা করব। ভালো-খারাপ, পাপ-পূণ্য, শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নগুলো আপনাদের জন্যই তুলে রাখলাম। সেসব দায়িত্ব আপনাদের। আমার দায় কেবল গল্পটা বলার
না। ভূমিকাটা যথেষ্টই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই হয়তো ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এইকথাগুলো না বললে হয়তো আমার মনের ভার হাল্কা হত না। নিজেকে ভালো বা মহৎ দেখানোর কোনো ইচ্ছেই আমার মধ্যে নেই। তবুও এতবছর ধরে আমি নিজের মনকে কেবল একটা প্রবোধই দিয়ে এসেছি। সেই রাতে যা ঘটেছিল, আমাদের দু পক্ষের নীরব সমর্থনেই ঘটেছিল। সেই সমর্থন স্বপক্ষ থেকে যতটা না ছিল, তার থেকে কয়েকগুণ বেশী ছিল অপরপক্ষের। যাক সে কথা। এবার আর গৌরচন্দ্রিকা না করে, আসল গল্পে আসা যাক। ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে। গল্পটা শুরু করার আগে আমার নিজের পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমি তাপস। তাপস দে। যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমার বয়স আটত্রিশ। দোহারা চেহারা। হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। বছর পাঁচেক হল আমার বিয়ে হয়েছে। আমার বউয়ের নাম বেলা। বেলা আমার থেকে প্রায় বছর ছয়েকের ছোটো। দেখতে খুব সুন্দরী বা ডানাকাটা পরী না হলেও মোটামুটি ধরনের। গায়ের রঙটা একটু মাজা। অর্থাৎ কালোর দিকেই তার ভাগ বেশী। বিয়ের পরে পর্যন্ত ছিপছিপে শরীরই ছিল বেলার। তবে বিয়ের দুইবছরের মাথায় প্রথমে একটি মেয়ে, আর তার তিনবছর পরে একটি ছেলে হওয়ার কারণে ওর শরীরে মেদ জমতে থাকে এদিক ওদিক। এটা আমার পছন্দ নয় কোনোকালেই। বেলা মোটা হচ্ছে বুঝতে পেরে, তাকে সাবধানও করেছিলাম সেসময়। শোনেনি আমার কথা। আসলে ওর দোষও নেই। সংসারের হাজার একটা ঝামেলা ঘাড় পেতে নেওয়ার পর, শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ছেলেমেয়ের ঝক্কি সামলে কোন মেয়েটা নিজের জন্য সময় বের করতে পারে? বেলাও পারত না। তাই আমিও তাকে ঐসব নিয়ে বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম একটা সময়ের পর থেকে। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই এখানে বলব, রোগা হোক কিম্বা মোটা, আমার চোখে বেলা চিরদিনই সুন্দরী। যাক। এ গল্পটা আমার আর বেলার প্রেমের উপাখ্যান নয়। আসলে এটা কোনো প্রেমের গল্পই নয়। কেবল একটা রাত। আর সেই রাতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার গল্প। এই রে! আবার ভণিতা করতে শুরু করে দিয়েছি। যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। আমার বাড়ি হুগলীর কামারপুকুরে। বাড়িতে মা-বাবা-বেলা-দুই ছেলেমেয়ে থাকে। আমি থাকি হাওড়ায়। একটা মেস ভাড়া করে। ওখানের একটা জুটমিলে কাজ করি। যা মাইনে পাই, সংসারটা কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যায়। আমি সারা মাস বাড়ির বাইরে থাকি। মাসান্তে মাইনের টাকাটা বেলার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। জানি ও সবদিকটা ভালোভাবেই সামলে নেবে। আমি মাসে দুবার বাড়ি আসতাম। পনেরোদিন অন্তর। শনিবার ডিউটি সেরে ট্রেন ধরতাম। রাতের ট্রেন। হাওড়া থেকে তারকেশ্বর। তারপর ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে কামারপুকুর চটি। বাড়ি ফিরতে এগারোটা বেজে যেত। বেলা জোর করে বাবা-মাকে খাইয়ে শুইয়ে দিত। তারপর ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত একলাটি। রবিবারটা বাড়ির সবার সঙ্গে কাটিয়ে সোমবার ভোরবেলা ট্রেন ধরে কাজে যোগ দিতাম।
বিয়ের পর থেকে জীবনটা একইখাতে বইছিল। অন্তত সেই রাতটা পর্যন্ত। সেইদিনও ছিল শনিবার। যথারীতি বাড়ি ফিরছি। হাওড়া থেকে টিকিট কেটে লাস্ট ট্রেনে চেপে বসলাম প্রতিবারের মতই। ট্রেনটা এইসময় ফাঁকাই থাকে। বসার জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরতে যে রাত হয়ে যায়, সেটা আগেই বলেছি। তবে আরামে যাওয়া যায় বলেই আমি বরাবর এই ট্রেনেই বাড়ি আসি। যথাসময়েই ট্রেনটা ছাড়ল হাওড়া থেকে। সময়টা শীতকাল। ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত। গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপছি। আমি জানালার পাশে একটি সিট দেখে বসে পড়লাম। জানালার কাঁচটা নামানো থাকা সত্ত্বেও একটা ঠাণ্ডা হাওয়া কামরার ভিতরে ঢুকছে। একে লাস্ট ট্রেন, তায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, সেজন্য যাত্রী খুবই কম ছিল সেদিন। কামরায় আমাকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে চারজন। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদ বেঞ্চি দখল করে বসেছি। গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তেই দেখলাম বাকী তিনজন ঢুলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি নামবো একেবারে লাস্ট স্টপেজে। তাই চিন্তা নেই। এতটা রাস্তা নিশ্চিন্তে ঘুমি যাওয়া যাবে। যা ভাবা তাই কাজ। আমি বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তির জেরে আমার দুচোখের পাতা এক হতে খুব বেশীক্ষণ সময় লাগল না। প্রায় মুহুর্তের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ কিছু লোকের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এক চটকায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। দেখি ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের পাল্লাটা তুলে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলাম, সেটা একটা স্টেশন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাদের কামরায় কাউকেই দেখতে পেলাম না। মনে হল সবাই নেমে গিয়েছে নিজের নিজের স্টেশনে। কেবল আমি একাই শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে স্টেশনে কয়েকজনকে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে দেখলাম। ভাবলাম তারকেশ্বরে ঢুকে গেছি নাকি? তাড়াতাড়ি সঙ্গের ছোটো হাতব্যাগটা হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। স্টেশনে ইতস্তত লোকের ভীড় চোখে পড়ল। প্রত্যেকেই সবিশেষ উত্তেজিত। এবং কতকগুলো জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি তারকেশ্বর নয়, বরং শেওড়াফুলি স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কি হল? কয়েকটা লোককে জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটা জানতে পারলাম। পরের স্টেশনে নাকি একটা মালগাড়ি উলটে গেছে। তাই এই লাইনে এখন সমস্ত ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। লাইন ক্লিয়ার হলে তারপর ট্রেন চলবে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলল, “লাইন ক্লিয়ার হতে হতে কাল সকাল হয়ে যাবে। আপনি যাবেন কোথায়?”
“আমি যাবো কামারপুকুর। তারকেশ্বরে নেমে বাস ধরবো।” আমি বললাম। লোকটা বলল, “সেটা আর সম্ভব নয়। আজকের রাতটা ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও কাটিয়ে দিন। এতো রাতে আর কোথায় বাস পাবেন?” তার কথা শুনে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কথাটা সে ঠিকই বলেছে। কারণ হাতঘড়িতে এখনই বাজে এগারোটা বেজে সতেরো। তারকেশ্বর থেকে যে লাস্ট বাসটা কামারপুকুর যায়, সেটা দশটায় ছাড়ে। একঘন্টা আগেই সেটা তারকেশ্বর থেকে ছেড়ে গেছে। এখন কোনোভাবে তারকেশ্বর পৌঁছাতে পারলেও কামারপুকুর যাওয়া এককথায় অসম্ভব। আজকে রাতে যে কোনোমতেই বাড়ি ফিরতে পারবো না, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। বেলা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। কারণ এতক্ষণে আমি বাড়ি পৌঁছে যাই। না। আগে বেলাকে একটা ফোন করা দরকার। না হলে বেচারী চিন্তায় চিন্তায় সারা হবে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আজকের মত এরকম যত্রতত্র-সর্বত্র মোবাইল ফোন ছিল না। ফোনটা তখন ছেলেখেলার বস্তু নয় বরং দামী আর দরকারী জিনিস রূপেই ব্যবহৃত হত। আমার কাছে কোনো মোবাইল ছিল না। বাড়িতেও মোবাইল ছিল না। তবে একটা পুরানো ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল বাড়িতে। সেটাতেই ফোন করে সব ব্যাপার ওকে জানাতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমি স্টেশনের একপাশে একটা মাঝারী চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি দোকানের একপাশে একটা এস.টি.ডি. ফোন আছে। চায়ের দোকানের মাঝবয়সী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা, এটা থেকে ফোন করা যাবে?” লোকটা ঘাড় নেড়ে বলল, “করুন না।” লাইন ভালো থাকলে একবারেই পাওয়া যাবে। আর কপাল খারাপ হলে, ফোনে কিছুতেই পাবো না বেলাকে। যাই হোক, পকেট থেকে একটা একটাকার কয়েন বের করে, তার মধ্যে ফেলে, মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে নাম্বার ডায়াল করলাম। ভাগ্য বালোই ছিল বলা য়েতে পারে। লাইন একবারেই পেলাম। রিং বাজতে শুরু করল। বারকয়েক বাজার পরেই কেউ ফোনটা তুলল। আর তারপরেই বেলার গলা কানে এল আমার। “হ্যালো, কে বলছেন?”
“হ্যাঁ বেলা, আমি বলছি।”
“তুমি কোথায়? এত রাত হয়ে গেল, এখনও আসছো না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। কোথা থেকে ফোন করছো? এখনো বাড়ি ঢোকোনি কেন? সব ঠিক আছে তো?” আমার কণ্ঠস্বর শুনে উদ্বিগ্ন গলায় একরাশ প্রশ্ন করল বেলা। ওকে কোনোরকমে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “বেলা শোনো। আমি এখন শেওড়াফুলিতে আছি।”
“শেওড়াফুলিতে! কেন লাস্ট ট্রেনটা পাওনি?” আবারও উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল বেলা। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ওটাতেই ফিরছিলাম। কিন্তু শেওড়াফুলির পরের স্টেশনে মালগাড়ি উল্টেছে। তাই এখন ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকালের আগে কিছুতেই ট্রেন চলবে না।”
“তাহলে কি করবে এখন?” বেলার কথার উত্তরে বললাম, “দেখি। ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও রাতটা কাটিয়ে দেবো। আর শোনো, চিন্তা কোরোনা। আমি কাল সকালে বাড়ি ফিরবো।”
“ঠিক আছে। সাবধানে এসো।” বলল বেলা।
“রাখছি।” বলে ফোনটা কেটে দিলাম আমি। ফোনটা কেটে ভাবলাম, বেলাকে বলে তো দিলাম, কিন্তু এই মারাত্মক ঠাণ্ডায় সারাটা রাত কাটাবো কোথায়? স্টেশনে কোনোমতেই থাকা যাবে না এই ঠাণ্ডাতে। তার চেয়ে বরং ট্রেনের কামরাতেই শুয়ে থাকবো কোনোরকমে। মনে মনে শোয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতেই পেটটা নিজের জানান দিল। সেই সন্ধ্যেবেলায় হাওড়া থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়েছি। সেসব কবেই হজম হয়ে গেছে। রাতটা কাটাবার আগে খাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাকিয়ে দেখি দোকানটায় কেবল চা-ই নয় তার সাথে অনেক কিছু খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। লোকটাকে ডবল ডিমের টোস্ট তৈরী করে দিতে বললাম। লোকটা তৈরী করতে লাগল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ যেন আমাকে ডেকে উঠল, “তাপসদা!” পরিচিত মেয়েলী কণ্ঠস্বরে নিজের নামটা শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বাতী। স্বাতীর বাড়ি আমাদের গ্রামেই। বলাটা বোধহয় একটু ভুল হল। গ্রামে নয় স্বাতী আমার প্রতিবেশী। আমাদের পাড়ার নীলাদ্রি বলে একটি ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আছে। স্বাতীকে বেলার বন্ধু বলা চলে। অসম্ভব সুন্দরী। বয়স খুব বেশী হলে ঊনত্রিশ। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। মেয়েদের পক্ষে স্বাতীকে বেশ লম্বাই বলা যেতে পারে। গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলেও, বেশ ফর্সাই। কোমর পর্যন্ত একরাশ কালো ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। ছিপছিপে শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকুও বাড়তি মেদ নেই। সবচেয়ে সুন্দর হল স্বাতীর মুখটা। গোল পানপাতার মত। বড় বড় চোখ। সরু, ধনুকের মত বাঁকানো ভ্রু। টিকালো নাক। পাতলা ঠোঁট। ওকে হাসলে সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। হাসলে গালে টোল পড়ে ওর। একই পাড়ায় বাড়ি বলে ও প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসে মা আর বেলার সাথে গল্প করতে। আমাকে ‘তাপসদা’ আর বেলাকে ‘বেলাদি’ বলে ডাকে স্বাতী। আমি আর বেলা ওকে নাম ধরেই ডাকি। প্রথমে ‘আপনি’ করে বললেও পরে আমাদের দেখাদেখি, আমাদের দুজনকেই ‘তুমি’ বলে ডাকে ও। আমি পিছন ফিরে ওর দিকে তাকাতেই স্বাতী আমার দিকে এগিয়ে এল। আসমানী রঙের একটা তাঁতের শাড়ির উপরে ফুলহাতা কার্ডিগান পরে আছে ও। তার উপরে লাল একটা শাল জড়ানো। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগও আছে দেখলাম।
স্বাতী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “কি হল তাপসদা, গাড়িটা হঠাৎ এখানে থেমে গেল কেন?” আমি ওকে বললাম, “শুনলাম পরের স্টেশনে নাকি মালগাড়ি উল্টে গেছে। আজকে আর কোনো গাড়িই চলবে না।” আমার কথা শুনে বোধহয় ও ভয় পেল। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, “তাহলে এখন কি হবে তাপসদা?” আমি বললাম, “লাইন ক্লিয়ার না হলে কিছুতেই ট্রেন চলবে না। আর কাল সকালের আগে সেসব হবে বলেও তো মনে হয় না।” আমার কথা শুনে হতাশ গলায় স্বাতী বলল, “তাহলে এভাবে সারারাত স্টেশনেই কাটাতে হবে?”
“তাছাড়া আর উপায় কি বলো? কিন্তু তুমি এত রাতে ফিরছো কোথা থেকে? কোথায় গিয়েছিলে?” ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“আমি গিয়েছিলাম লিলুয়ায় মামার বাড়িতে। মামীর শরীর খুব খারাপ। তাকে দেখতেই গিয়েছিলাম। আগের ট্রেনটা মিস করলাম। তাই এই ট্রেনেই যাচ্ছি। তখন কি আর জানতাম যে এই দূর্ভোগ আছে কপালে।” কথা বলতে বলতে স্বাতী আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি কি একাই এসেছো? নীলাদ্রি আসেনি সঙ্গে?” কিছুটা অযাচিত ভাবেই প্রশ্নটা করলাম ওর দিকে তাকিয়ে। যদিও করার পর আমার মনে হল প্রশ্নটা এভাবে করা বোধহয় আমার ঠিক হল না। কিন্তু স্বাতীর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। সে ঠোঁট উল্টে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বলল, “সে বাবুর অফিসের ছুটি নেই। কত করে বললাম, একটা দিনের তো ব্যাপার। সকালে যাবো, বিকেলে ফিরে পড়বো। রাতেও থাকবো না। আর তাছাড়া, আমরা দুজনে গেলে মামা-মামীও খুশী হবে। তা মুখের উপরে বলে দিল, ‘তুমি যাও। আমি অফিসে ছুটি পাবো না।’ এত কিসের কাজ বাপু বুঝি না। বউকে সময় দিতে গেলেই যত কাজ আর কাজ। তাই বাধ্যে হয়ে আমাকে একলাই আসতে হল।” একটানা কথা বলে থামল স্বাতী। ততক্ষণে দোকানী আমার খাবার তৈরী করে দিয়েছে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি খাবে বলো?” স্বাতী বলল, “কিচ্ছু খাবো না। রাতের খাবার মামাবাড়ি থেকে একেবারে খেয়েই এসেছি। তবে এককাপ চা খেতে পারি।” আমি দোকানীকে আমাদের দু কাপ চা দিতে বললাম। সাথে স্বাতীর জন্য খান দুয়েক বিস্কুট। প্রথমে ও মানা করলেও, আমার কথায় বিস্কুট খেতে লাগল ও। খেতে খেতেই ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তাপসদা, এখন কি করবে, তাই বলো? সারারাত তো আর এইভাবে, স্টেশনে এই ঠাণ্ডায় থাকতে পারবো না। নিউমোনিয়ায় মরতে হবে তাহলে। রাতটা তো কাটাতে হবে কোথাও।” আমি একবার ভাবলাম ওকে আজকের রাতটা ট্রেনেই কাটাতে বলি। তারপর ভাবলাম, থাক। একজন মেয়ের পক্ষে একা সারারাতটা ট্রেনের খালি কামারায় কাটানোটা ভালো যুক্তি নয়। সেটা ওর পক্ষে হয়তো নিরাপদও হবে না। তাই বললাম, “আমিও সেটাই ভাবছি।”
“এখানে কাছেপিঠে কোথাও হোটেল-টোটেল নেই? সেখানে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল নাহয় একসাথে বাড়ি ফেরা যাবে।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বাতী বলল।
“হুম। তাছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখছি না। দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞাসা করি, কাছে পিঠে কোথাও কোনো হোটেল আছে নাকি।” বলে আমি চায়ের দোকানের লোকটাকে হোটেলের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটা বলল, “হোটেল একটা আছে। অবশ্য নামেই হোটেল। আসলে গেস্টহাউস। রাতে অনেকেই থাকে সেখানে। ঘর খালি থাকলে আপনারাও থাকতে পারবেন। সারারাত খোলা থাকে।” স্বাতী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, “সেটা এখান থেকে কতদূর?” লোকটা বলল, “বেশী নয়। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট। দিনের বেলা হলে রিক্সা পেতেন। কিন্তু এতরাতে সেসব পাবেন না। আপনাদের হেঁটেই যেতে হবে।” স্বাতী মাথা নেড়ে বলল, “আমরা হেঁটেই যাবো। আপনি আমাদের রাস্তাটা বলে দিন।” চায়ের দোকানী আমাদের হোটেল বা গেস্টহাউসে যাওয়ার রাস্তাটা বুঝিয়ে দিল। চা-খাবার খেয়ে, দোকানীকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে স্বাতীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তাহলে চলো, ঐ গেস্টহাউসেই যাওয়া যাক।” স্বাতী বলল, “একটু দাঁড়াও। আগে নীলাদ্রিকে ফোন করে জানিয়ে দিই। নাহলে সারারাত ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাবে।” আমি বললাম, “এখানেই ফোন আছে। এখান থেকেই করে দাও।”
“সেই ভালো। দাঁড়াও। আমি ফোনটা করে আসছি।” বলে স্বাতী নীলাদ্রিকে ফোন করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “চলো।” আমরা দুজনে কাঁধে যে যার ব্যাগ তুলে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
পর্ব ১
যে গল্পটা আজ আমি এখানে বলতে চলেছি, সেটা আসলে কোনো গল্পই নয়। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া একটা রাত। সেই রাতে একটা ঘর ছিল। কিছুটা আলো ছিল। আর বাকীটা অন্ধকার ছিল। অখণ্ড নিস্তব্ধতা ছিল। শাঁখা-পলা-চুড়ির মিলিত মিনমিনে একটা আওয়াজ ছিল। কাতর আকুতি ছিল। হাল্কা শীৎকারও ছিল তার সাথে। আর ছিল দুটো মানুষ। একজন পুরুষ। আর একজন নারী। সেই পুরুষটা ছিলাম আমি। আর নারীটি? আমার প্রেমিকা? নাকী আমার বান্ধবী? নাকী আমার স্ত্রী? এর সবগুলোর উত্তরই হল, না। সে আমার প্রেমিকা, বা বান্ধবী কিম্বা আমার স্ত্রী, কেউই ছিল না। তাহলে সে কে ছিল? সব বলব। আজ এতদিন পরে… না, দিন নয়। এতবছর পরে সেই রাত্রিরের কাটাছেঁড়া যখন করতে বসেছি, তখন সব কথাই বলব। কোনোকথাই লুকিয়ে যাবো না। যে কথাটা এতবছর ধরে নিজের স্ত্রীর কাছেও চেপে গেছি, সেইকথাটাই আজ সবাইকে বলতে বসেছি। হয়তো একটু ভণিতা করে ফেললাম। নাকি একটু কাব্য? জানি না। কাব্য আমি করতে পারি না। ওসব আমার আসে না। আমি কোনো লেখক নই। তাই সবকথা হয়তো গুছিয়ে বলতে পারবো না। কেবল ঘটনাটা যেভাবে ঘটেছিল, তা পরপর বলে যাওয়ার চেষ্টা করব। ভালো-খারাপ, পাপ-পূণ্য, শ্লীলতা-অশ্লীলতার প্রশ্নগুলো আপনাদের জন্যই তুলে রাখলাম। সেসব দায়িত্ব আপনাদের। আমার দায় কেবল গল্পটা বলার
না। ভূমিকাটা যথেষ্টই লম্বা হয়ে যাচ্ছে। অনেকেরই হয়তো ধৈর্য্যচ্যূতি ঘটছে ধীরে ধীরে। কিন্তু এইকথাগুলো না বললে হয়তো আমার মনের ভার হাল্কা হত না। নিজেকে ভালো বা মহৎ দেখানোর কোনো ইচ্ছেই আমার মধ্যে নেই। তবুও এতবছর ধরে আমি নিজের মনকে কেবল একটা প্রবোধই দিয়ে এসেছি। সেই রাতে যা ঘটেছিল, আমাদের দু পক্ষের নীরব সমর্থনেই ঘটেছিল। সেই সমর্থন স্বপক্ষ থেকে যতটা না ছিল, তার থেকে কয়েকগুণ বেশী ছিল অপরপক্ষের। যাক সে কথা। এবার আর গৌরচন্দ্রিকা না করে, আসল গল্পে আসা যাক। ঘটনাটা ঘটেছিল আজ থেকে প্রায় বছর পনেরো আগে। গল্পটা শুরু করার আগে আমার নিজের পরিচয়টা দিয়ে দিই। আমি তাপস। তাপস দে। যেসময়ের কথা বলছি, তখন আমার বয়স আটত্রিশ। দোহারা চেহারা। হাইট পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি। বছর পাঁচেক হল আমার বিয়ে হয়েছে। আমার বউয়ের নাম বেলা। বেলা আমার থেকে প্রায় বছর ছয়েকের ছোটো। দেখতে খুব সুন্দরী বা ডানাকাটা পরী না হলেও মোটামুটি ধরনের। গায়ের রঙটা একটু মাজা। অর্থাৎ কালোর দিকেই তার ভাগ বেশী। বিয়ের পরে পর্যন্ত ছিপছিপে শরীরই ছিল বেলার। তবে বিয়ের দুইবছরের মাথায় প্রথমে একটি মেয়ে, আর তার তিনবছর পরে একটি ছেলে হওয়ার কারণে ওর শরীরে মেদ জমতে থাকে এদিক ওদিক। এটা আমার পছন্দ নয় কোনোকালেই। বেলা মোটা হচ্ছে বুঝতে পেরে, তাকে সাবধানও করেছিলাম সেসময়। শোনেনি আমার কথা। আসলে ওর দোষও নেই। সংসারের হাজার একটা ঝামেলা ঘাড় পেতে নেওয়ার পর, শ্বশুর-শাশুড়ি, দুই ছেলেমেয়ের ঝক্কি সামলে কোন মেয়েটা নিজের জন্য সময় বের করতে পারে? বেলাও পারত না। তাই আমিও তাকে ঐসব নিয়ে বলা বন্ধ করে দিয়েছিলাম একটা সময়ের পর থেকে। কিন্তু একটা কথা অবশ্যই এখানে বলব, রোগা হোক কিম্বা মোটা, আমার চোখে বেলা চিরদিনই সুন্দরী। যাক। এ গল্পটা আমার আর বেলার প্রেমের উপাখ্যান নয়। আসলে এটা কোনো প্রেমের গল্পই নয়। কেবল একটা রাত। আর সেই রাতে ঘটে যাওয়া একটা ঘটনার গল্প। এই রে! আবার ভণিতা করতে শুরু করে দিয়েছি। যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। আমার বাড়ি হুগলীর কামারপুকুরে। বাড়িতে মা-বাবা-বেলা-দুই ছেলেমেয়ে থাকে। আমি থাকি হাওড়ায়। একটা মেস ভাড়া করে। ওখানের একটা জুটমিলে কাজ করি। যা মাইনে পাই, সংসারটা কোনোরকমে টেনেটুনে চলে যায়। আমি সারা মাস বাড়ির বাইরে থাকি। মাসান্তে মাইনের টাকাটা বেলার হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। জানি ও সবদিকটা ভালোভাবেই সামলে নেবে। আমি মাসে দুবার বাড়ি আসতাম। পনেরোদিন অন্তর। শনিবার ডিউটি সেরে ট্রেন ধরতাম। রাতের ট্রেন। হাওড়া থেকে তারকেশ্বর। তারপর ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে কামারপুকুর চটি। বাড়ি ফিরতে এগারোটা বেজে যেত। বেলা জোর করে বাবা-মাকে খাইয়ে শুইয়ে দিত। তারপর ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকত একলাটি। রবিবারটা বাড়ির সবার সঙ্গে কাটিয়ে সোমবার ভোরবেলা ট্রেন ধরে কাজে যোগ দিতাম।
বিয়ের পর থেকে জীবনটা একইখাতে বইছিল। অন্তত সেই রাতটা পর্যন্ত। সেইদিনও ছিল শনিবার। যথারীতি বাড়ি ফিরছি। হাওড়া থেকে টিকিট কেটে লাস্ট ট্রেনে চেপে বসলাম প্রতিবারের মতই। ট্রেনটা এইসময় ফাঁকাই থাকে। বসার জায়গা পাওয়া যায়। কিন্তু বাড়ি ফিরতে যে রাত হয়ে যায়, সেটা আগেই বলেছি। তবে আরামে যাওয়া যায় বলেই আমি বরাবর এই ট্রেনেই বাড়ি আসি। যথাসময়েই ট্রেনটা ছাড়ল হাওড়া থেকে। সময়টা শীতকাল। ডিসেম্বর মাস। প্রচণ্ড শীত। গায়ে ফুলহাতা সোয়েটার থাকা সত্ত্বেও ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপছি। আমি জানালার পাশে একটি সিট দেখে বসে পড়লাম। জানালার কাঁচটা নামানো থাকা সত্ত্বেও একটা ঠাণ্ডা হাওয়া কামরার ভিতরে ঢুকছে। একে লাস্ট ট্রেন, তায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, সেজন্য যাত্রী খুবই কম ছিল সেদিন। কামরায় আমাকে নিয়ে সর্বসাকুল্যে চারজন। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদ বেঞ্চি দখল করে বসেছি। গাড়ি ছাড়তে না ছাড়তেই দেখলাম বাকী তিনজন ঢুলতে শুরু করে দিয়েছে। আমি নামবো একেবারে লাস্ট স্টপেজে। তাই চিন্তা নেই। এতটা রাস্তা নিশ্চিন্তে ঘুমি যাওয়া যাবে। যা ভাবা তাই কাজ। আমি বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। সারাদিনের ক্লান্তির জেরে আমার দুচোখের পাতা এক হতে খুব বেশীক্ষণ সময় লাগল না। প্রায় মুহুর্তের মধ্যেই আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা। হঠাৎ কিছু লোকের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে এক চটকায় ঘুম ভেঙ্গে গেল আমার। দেখি ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচের পাল্লাটা তুলে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে পেলাম, সেটা একটা স্টেশন। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে আমাদের কামরায় কাউকেই দেখতে পেলাম না। মনে হল সবাই নেমে গিয়েছে নিজের নিজের স্টেশনে। কেবল আমি একাই শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলাম। জানালা দিয়ে স্টেশনে কয়েকজনকে ইতস্তত ছোটাছুটি করতে দেখলাম। ভাবলাম তারকেশ্বরে ঢুকে গেছি নাকি? তাড়াতাড়ি সঙ্গের ছোটো হাতব্যাগটা হাতে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। স্টেশনে ইতস্তত লোকের ভীড় চোখে পড়ল। প্রত্যেকেই সবিশেষ উত্তেজিত। এবং কতকগুলো জটলা বেঁধে নিজেদের মধ্যে কোনো কিছু নিয়ে আলোচনা করছে। এগিয়ে গিয়ে দেখি তারকেশ্বর নয়, বরং শেওড়াফুলি স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। কি হল? কয়েকটা লোককে জিজ্ঞাসা করে ব্যাপারটা জানতে পারলাম। পরের স্টেশনে নাকি একটা মালগাড়ি উলটে গেছে। তাই এই লাইনে এখন সমস্ত ট্রেন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ। লাইন ক্লিয়ার হলে তারপর ট্রেন চলবে। তাদের মধ্যে একজন আমাকে বলল, “লাইন ক্লিয়ার হতে হতে কাল সকাল হয়ে যাবে। আপনি যাবেন কোথায়?”
“আমি যাবো কামারপুকুর। তারকেশ্বরে নেমে বাস ধরবো।” আমি বললাম। লোকটা বলল, “সেটা আর সম্ভব নয়। আজকের রাতটা ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও কাটিয়ে দিন। এতো রাতে আর কোথায় বাস পাবেন?” তার কথা শুনে হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম কথাটা সে ঠিকই বলেছে। কারণ হাতঘড়িতে এখনই বাজে এগারোটা বেজে সতেরো। তারকেশ্বর থেকে যে লাস্ট বাসটা কামারপুকুর যায়, সেটা দশটায় ছাড়ে। একঘন্টা আগেই সেটা তারকেশ্বর থেকে ছেড়ে গেছে। এখন কোনোভাবে তারকেশ্বর পৌঁছাতে পারলেও কামারপুকুর যাওয়া এককথায় অসম্ভব। আজকে রাতে যে কোনোমতেই বাড়ি ফিরতে পারবো না, সেটা একপ্রকার নিশ্চিত। বেলা নিশ্চয়ই আমার জন্য চিন্তা করছে। কারণ এতক্ষণে আমি বাড়ি পৌঁছে যাই। না। আগে বেলাকে একটা ফোন করা দরকার। না হলে বেচারী চিন্তায় চিন্তায় সারা হবে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন আজকের মত এরকম যত্রতত্র-সর্বত্র মোবাইল ফোন ছিল না। ফোনটা তখন ছেলেখেলার বস্তু নয় বরং দামী আর দরকারী জিনিস রূপেই ব্যবহৃত হত। আমার কাছে কোনো মোবাইল ছিল না। বাড়িতেও মোবাইল ছিল না। তবে একটা পুরানো ল্যান্ডলাইন ফোন ছিল বাড়িতে। সেটাতেই ফোন করে সব ব্যাপার ওকে জানাতে হবে। ভাবতে ভাবতে আমি স্টেশনের একপাশে একটা মাঝারী চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি দোকানের একপাশে একটা এস.টি.ডি. ফোন আছে। চায়ের দোকানের মাঝবয়সী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদা, এটা থেকে ফোন করা যাবে?” লোকটা ঘাড় নেড়ে বলল, “করুন না।” লাইন ভালো থাকলে একবারেই পাওয়া যাবে। আর কপাল খারাপ হলে, ফোনে কিছুতেই পাবো না বেলাকে। যাই হোক, পকেট থেকে একটা একটাকার কয়েন বের করে, তার মধ্যে ফেলে, মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে নাম্বার ডায়াল করলাম। ভাগ্য বালোই ছিল বলা য়েতে পারে। লাইন একবারেই পেলাম। রিং বাজতে শুরু করল। বারকয়েক বাজার পরেই কেউ ফোনটা তুলল। আর তারপরেই বেলার গলা কানে এল আমার। “হ্যালো, কে বলছেন?”
“হ্যাঁ বেলা, আমি বলছি।”
“তুমি কোথায়? এত রাত হয়ে গেল, এখনও আসছো না। আমার খুব চিন্তা হচ্ছিল। কোথা থেকে ফোন করছো? এখনো বাড়ি ঢোকোনি কেন? সব ঠিক আছে তো?” আমার কণ্ঠস্বর শুনে উদ্বিগ্ন গলায় একরাশ প্রশ্ন করল বেলা। ওকে কোনোরকমে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “বেলা শোনো। আমি এখন শেওড়াফুলিতে আছি।”
“শেওড়াফুলিতে! কেন লাস্ট ট্রেনটা পাওনি?” আবারও উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল বেলা। ওকে আশ্বস্ত করে বললাম, “ওটাতেই ফিরছিলাম। কিন্তু শেওড়াফুলির পরের স্টেশনে মালগাড়ি উল্টেছে। তাই এখন ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। কাল সকালের আগে কিছুতেই ট্রেন চলবে না।”
“তাহলে কি করবে এখন?” বেলার কথার উত্তরে বললাম, “দেখি। ট্রেনে কিম্বা স্টেশনেই কোথাও রাতটা কাটিয়ে দেবো। আর শোনো, চিন্তা কোরোনা। আমি কাল সকালে বাড়ি ফিরবো।”
“ঠিক আছে। সাবধানে এসো।” বলল বেলা।
“রাখছি।” বলে ফোনটা কেটে দিলাম আমি। ফোনটা কেটে ভাবলাম, বেলাকে বলে তো দিলাম, কিন্তু এই মারাত্মক ঠাণ্ডায় সারাটা রাত কাটাবো কোথায়? স্টেশনে কোনোমতেই থাকা যাবে না এই ঠাণ্ডাতে। তার চেয়ে বরং ট্রেনের কামরাতেই শুয়ে থাকবো কোনোরকমে। মনে মনে শোয়ার একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতেই পেটটা নিজের জানান দিল। সেই সন্ধ্যেবেলায় হাওড়া থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়েছি। সেসব কবেই হজম হয়ে গেছে। রাতটা কাটাবার আগে খাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তাকিয়ে দেখি দোকানটায় কেবল চা-ই নয় তার সাথে অনেক কিছু খাওয়ারও ব্যবস্থা আছে। লোকটাকে ডবল ডিমের টোস্ট তৈরী করে দিতে বললাম। লোকটা তৈরী করতে লাগল। আমি তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে কেউ যেন আমাকে ডেকে উঠল, “তাপসদা!” পরিচিত মেয়েলী কণ্ঠস্বরে নিজের নামটা শুনতে পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। দেখি আমার থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বাতী। স্বাতীর বাড়ি আমাদের গ্রামেই। বলাটা বোধহয় একটু ভুল হল। গ্রামে নয় স্বাতী আমার প্রতিবেশী। আমাদের পাড়ার নীলাদ্রি বলে একটি ছেলের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে বছর তিনেক আছে। স্বাতীকে বেলার বন্ধু বলা চলে। অসম্ভব সুন্দরী। বয়স খুব বেশী হলে ঊনত্রিশ। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি লম্বা। মেয়েদের পক্ষে স্বাতীকে বেশ লম্বাই বলা যেতে পারে। গায়ের রঙ দুধে আলতা না হলেও, বেশ ফর্সাই। কোমর পর্যন্ত একরাশ কালো ঢেউ খেলানো লম্বা চুল। ছিপছিপে শরীর। শরীরের কোথাও এতটুকুও বাড়তি মেদ নেই। সবচেয়ে সুন্দর হল স্বাতীর মুখটা। গোল পানপাতার মত। বড় বড় চোখ। সরু, ধনুকের মত বাঁকানো ভ্রু। টিকালো নাক। পাতলা ঠোঁট। ওকে হাসলে সবচেয়ে সুন্দর লাগে দেখতে। হাসলে গালে টোল পড়ে ওর। একই পাড়ায় বাড়ি বলে ও প্রায়ই আমাদের বাড়িতে আসে মা আর বেলার সাথে গল্প করতে। আমাকে ‘তাপসদা’ আর বেলাকে ‘বেলাদি’ বলে ডাকে স্বাতী। আমি আর বেলা ওকে নাম ধরেই ডাকি। প্রথমে ‘আপনি’ করে বললেও পরে আমাদের দেখাদেখি, আমাদের দুজনকেই ‘তুমি’ বলে ডাকে ও। আমি পিছন ফিরে ওর দিকে তাকাতেই স্বাতী আমার দিকে এগিয়ে এল। আসমানী রঙের একটা তাঁতের শাড়ির উপরে ফুলহাতা কার্ডিগান পরে আছে ও। তার উপরে লাল একটা শাল জড়ানো। কাঁধে একটা ছোট্ট ব্যাগও আছে দেখলাম।
স্বাতী আমার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “কি হল তাপসদা, গাড়িটা হঠাৎ এখানে থেমে গেল কেন?” আমি ওকে বললাম, “শুনলাম পরের স্টেশনে নাকি মালগাড়ি উল্টে গেছে। আজকে আর কোনো গাড়িই চলবে না।” আমার কথা শুনে বোধহয় ও ভয় পেল। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করল, “তাহলে এখন কি হবে তাপসদা?” আমি বললাম, “লাইন ক্লিয়ার না হলে কিছুতেই ট্রেন চলবে না। আর কাল সকালের আগে সেসব হবে বলেও তো মনে হয় না।” আমার কথা শুনে হতাশ গলায় স্বাতী বলল, “তাহলে এভাবে সারারাত স্টেশনেই কাটাতে হবে?”
“তাছাড়া আর উপায় কি বলো? কিন্তু তুমি এত রাতে ফিরছো কোথা থেকে? কোথায় গিয়েছিলে?” ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
“আমি গিয়েছিলাম লিলুয়ায় মামার বাড়িতে। মামীর শরীর খুব খারাপ। তাকে দেখতেই গিয়েছিলাম। আগের ট্রেনটা মিস করলাম। তাই এই ট্রেনেই যাচ্ছি। তখন কি আর জানতাম যে এই দূর্ভোগ আছে কপালে।” কথা বলতে বলতে স্বাতী আমার পাশে এসে দাঁড়ালো।
“তুমি কি একাই এসেছো? নীলাদ্রি আসেনি সঙ্গে?” কিছুটা অযাচিত ভাবেই প্রশ্নটা করলাম ওর দিকে তাকিয়ে। যদিও করার পর আমার মনে হল প্রশ্নটা এভাবে করা বোধহয় আমার ঠিক হল না। কিন্তু স্বাতীর মুখে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না। সে ঠোঁট উল্টে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বলল, “সে বাবুর অফিসের ছুটি নেই। কত করে বললাম, একটা দিনের তো ব্যাপার। সকালে যাবো, বিকেলে ফিরে পড়বো। রাতেও থাকবো না। আর তাছাড়া, আমরা দুজনে গেলে মামা-মামীও খুশী হবে। তা মুখের উপরে বলে দিল, ‘তুমি যাও। আমি অফিসে ছুটি পাবো না।’ এত কিসের কাজ বাপু বুঝি না। বউকে সময় দিতে গেলেই যত কাজ আর কাজ। তাই বাধ্যে হয়ে আমাকে একলাই আসতে হল।” একটানা কথা বলে থামল স্বাতী। ততক্ষণে দোকানী আমার খাবার তৈরী করে দিয়েছে। আমি ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কি খাবে বলো?” স্বাতী বলল, “কিচ্ছু খাবো না। রাতের খাবার মামাবাড়ি থেকে একেবারে খেয়েই এসেছি। তবে এককাপ চা খেতে পারি।” আমি দোকানীকে আমাদের দু কাপ চা দিতে বললাম। সাথে স্বাতীর জন্য খান দুয়েক বিস্কুট। প্রথমে ও মানা করলেও, আমার কথায় বিস্কুট খেতে লাগল ও। খেতে খেতেই ও আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “তাপসদা, এখন কি করবে, তাই বলো? সারারাত তো আর এইভাবে, স্টেশনে এই ঠাণ্ডায় থাকতে পারবো না। নিউমোনিয়ায় মরতে হবে তাহলে। রাতটা তো কাটাতে হবে কোথাও।” আমি একবার ভাবলাম ওকে আজকের রাতটা ট্রেনেই কাটাতে বলি। তারপর ভাবলাম, থাক। একজন মেয়ের পক্ষে একা সারারাতটা ট্রেনের খালি কামারায় কাটানোটা ভালো যুক্তি নয়। সেটা ওর পক্ষে হয়তো নিরাপদও হবে না। তাই বললাম, “আমিও সেটাই ভাবছি।”
“এখানে কাছেপিঠে কোথাও হোটেল-টোটেল নেই? সেখানে আজকের রাতটা কাটিয়ে কাল নাহয় একসাথে বাড়ি ফেরা যাবে।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে স্বাতী বলল।
“হুম। তাছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখছি না। দাঁড়াও, আমি জিজ্ঞাসা করি, কাছে পিঠে কোথাও কোনো হোটেল আছে নাকি।” বলে আমি চায়ের দোকানের লোকটাকে হোটেলের সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করলাম। লোকটা বলল, “হোটেল একটা আছে। অবশ্য নামেই হোটেল। আসলে গেস্টহাউস। রাতে অনেকেই থাকে সেখানে। ঘর খালি থাকলে আপনারাও থাকতে পারবেন। সারারাত খোলা থাকে।” স্বাতী লোকটাকে জিজ্ঞাসা করল, “সেটা এখান থেকে কতদূর?” লোকটা বলল, “বেশী নয়। হেঁটে গেলে পনেরো মিনিট। দিনের বেলা হলে রিক্সা পেতেন। কিন্তু এতরাতে সেসব পাবেন না। আপনাদের হেঁটেই যেতে হবে।” স্বাতী মাথা নেড়ে বলল, “আমরা হেঁটেই যাবো। আপনি আমাদের রাস্তাটা বলে দিন।” চায়ের দোকানী আমাদের হোটেল বা গেস্টহাউসে যাওয়ার রাস্তাটা বুঝিয়ে দিল। চা-খাবার খেয়ে, দোকানীকে পয়সা মিটিয়ে দিয়ে স্বাতীর দিকে তাকিয়ে বললাম, “তাহলে চলো, ঐ গেস্টহাউসেই যাওয়া যাক।” স্বাতী বলল, “একটু দাঁড়াও। আগে নীলাদ্রিকে ফোন করে জানিয়ে দিই। নাহলে সারারাত ভেবে ভেবে পাগল হয়ে যাবে।” আমি বললাম, “এখানেই ফোন আছে। এখান থেকেই করে দাও।”
“সেই ভালো। দাঁড়াও। আমি ফোনটা করে আসছি।” বলে স্বাতী নীলাদ্রিকে ফোন করতে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, “চলো।” আমরা দুজনে কাঁধে যে যার ব্যাগ তুলে নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে পড়লাম হোটেলের উদ্দেশ্যে।
Rajkumar Roy