25-05-2024, 01:50 AM
পান্নানীল জলরাশি ফোঁস ফোঁস শব্দ তুলে বারবার আছড়ে পড়ছে ফেব্রুয়ারি সকালের তেরছা সূর্যালোকে ঈষৎ উজ্জ্বল বালুময় সৈকততীরে। বালিতে তার ক্ষণিক অস্তিত্তের চিত্র এঁকে এরপর ধীরপায়ে ফিরছে নোনাজলের অশেষ উৎস পানে। পরক্ষনেই আবার উঁচু হয়ে ফণা তুলে সৈকতে তার প্রত্যাবর্তন, বালিতে প্রকট নতুন রেখাচিত্র। ঘুম ভাঙা অবধি জল ও তটের এই খেলাই দেখছিল অনিক, সানলাউনজারে আধশোয়া থেকে। সূর্যোদয় দেখবার ইচ্ছে থাকলেও আজ তা দেখা হোল না, কিছুটা দেরিতে ঘুম ভেঙেছিল তার। কাল সন্ধ্যেবেলা বিকেলের জাহাজে তারা সেন্টমারটিন পৌঁছেছে। হোটেল বুক করাই ছিল, ফেরিঘাটে নেমে বাজার হয়ে সোজা পশ্চিম বীচের সূর্যাস্ত রিসোর্টে উঠেছে। খাওয়া দাওয়া সেরে ক্লান্ত থাকবার কারণে ঘুমিয়ে পড়েছিল দ্রুত, আর সকাল অবধি পশ্চিম বীচে সাগরসূর্যের মিষ্টি রোদ আর হালকা হাওয়ার মাঝে থেকে বেশ ফুরফুরে লাগছিল অনিকের। ঘণ্টাখানেক সমুদ্রজলের আসা যাওয়া দেখতে দেখতে আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার।
"অনিক, এই অনিক ঘুমিয়ে পড়লি নাকি"
চোখ খুলে অনিক দেখল সামাদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনিক চোখ ঘষে বলল, "নারে এই একটু চোখ লেগে এসেছিল।"
সামাদ সামনে ঝুকে অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, "চল কিছু খেয়ে আসি, মাসুদ ব্যাটাও উঠে পরছে।"
অনিক উঠে পড়ে সামাদের সাথে হাঁটতে শুরু করল।
"অনেকদিন থেকেই সাগরপাড়ে আসতে চাচ্ছিলাম। আজ অনেক ভালো লাগছে।"
সামাদ বলল, "সাগর আমারও ভালো লাগে, তবে এবারের ছুটিতে পাহাড়ে যাবার মন ছিল। তোর জোরাজুরিতেই শেষে কিনা এখানে এলাম।"
"জানিনা কেন, কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছিল সাগর যেন আমাকে তার কাছে টানছে; ঠিক সাগরতীরের বালুকনার মতো স্রোত আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে, বাধা দেয়ার যেন কোন সামর্থ্যই আমার নেই।"
সামাদ শ্লেষের সুরে বলল,"কি আর করা, কেউ তো আমাকে আর তোর মতো বুকে টেনে নিবেনা। তোর মতো কবিতাও তো কাউকে শোনানো হয়না।"
রিসোর্টের সামনে মাসুদকে দেখা গেল; সে তাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, "কি রে শালা, কই ছিলি! খিদায় আমার কাহিল অবস্থা। মাছ ভাজা যে কয়টা সাবার করতে ইচ্ছে করছে, দেখিস ব্যাটা।"
ক্যান্টিনের দিকে এগুতে থাকল ওরা। একটা ফাকা টেবিলে বসে ওয়েটারকে ডেকে মাসুদ খাবার অর্ডার করল। মাসুদ আয়েশ মতো চওড়া হয়ে বসে বলল, "কি রে অনিক, কখন বেরিয়েছিলে রুম থেকে?"
অনিক বলল,"এই ভোরের কিছু পরেই হবে।"
"সমুদ্র দেখে কবিতা-টবিতা কিছু লিখে ফেললি নাকি।"
সামাদ ঈষৎ হেসে বলল,"ও কবিতা কি লিখবে রে, গিয়ে তো দেখি রোদের মধ্যে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। স্রোতের আওয়াজে বিহ্বল হয়ে পড়েছে কিনা।"
এর মাঝে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। মাসুদ বেশ পেটুক গোছের, খিদে লাগলে প্রচুর খেতে পারে। মাসুদের গোগ্রাসে মাছ ভাজা খাবার ব্যাগ্রতা দেখে অনিক আর সামাদ হাসতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে তিনজন বীচের দিকে এগুতে থাকে।
বীচে পৌঁছে তিনজনই একদৃষ্টিতে সমুদ্র দেখতে থাকল। জোয়ার তখন অনেকটাই কমে এসেছে, স্তিমিত ধারায় জল তটে এসে পড়ছে। খানিক বাদেই তিন বন্ধু মিলে খুনসুটিতে মেতে উঠল, সাগরপাড় হতে বিপরীতের ঝাউ গাছে ভরা টিলা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি, বীচ বল নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকল। সূর্য তখন মাথার উপর উঠতে শুরু করেছে; সকালের মিষ্টি লাজরক্তিম বর্ণ ছেড়ে গনগনে হলুদ বর্ণে তাপ বিকিরণ করে সমস্ত প্রকৃতিকে জীবনীশক্তি দানের নৈমিত্তিক রুপ ধারন করেছে। তিন বন্ধুই সাগরসূর্যের তাপে ঘামতে থাকলে তাদের টিশার্ট খুলে ফেলে। সাগরপাড়ে তখন অনেক টুরিস্ট ভিড় জমিয়েছে, তাদের মাঝে অনেকে এই শার্টখোলা ছেলেদের আনন্দক্রীড়া একদৃষ্টিতে দেখছিল। তাদের মাঝে তরুণী আর মাঝবয়সী মহিলাদের চোখ দুটো যেন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বার বার এই ছেলেদের উপরি ঘোরাফেরা করছিল, আর তাদের সিংহভাগেরই দৃষ্টি অনিকের প্রতি।
অনিকের গৌরবর্ণ, লম্বা, নিয়মিত জিম করা চওড়া কাঁধের বলশালী দেহকাঠামো যেকোনো বয়সী মহিলাকেই তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে; সাথে তার মুখশ্রীও সুগঠিত এবং মায়াকাড়া; টানা টানা চোখ, ধারালো ছুরির ন্যায় নাক, তীক্ষ্ণ চোয়াল; নারীদের পরম আকাঙ্ক্ষার দেবমূর্তি হিসেবেই অনিক যেন তাদের সামনে ধরা দেয়। কলেজ কলেজের মেয়েবন্ধুদের আর চাকুরীক্ষেত্রের মেয়ে কলিগদের মাঝেও অনিকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে; সেটার জন্যে শুধু তার দেহগড়নই দায়ী নয়, অনিকের কবিতা লেখার হাতও বেশ চমৎকার। কলেজে থাকতে সহপাঠিনীরা তার চোখের মায়ায় আবিষ্ট হয়ে রবি ঠাকুরের মানসসুন্দরি কিম্বা ভৈরবীর গান শুনতে শুনতে কতবার যে সম্মোহিত হয়ে নিজেদের শুভবুদ্ধি হারিয়েছে তার সঠিক হিসেব কেউ বলতে পারবেনা। অনিকের বন্ধুদের তার এই জনপ্রিয়তা দেখে গা জ্বলে গেলেও, অনিক এসব বিষয় তেমন পাত্তা দিতো না, মেয়েদের ব্যাপারে সে বরাবরই উদাসীন। মাসুদ বীচের মেয়েদের দৃষ্টিরেখা লক্ষ্য করে দৌড় থামিয়ে সামাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, "কি রে সামাদ দেখতেছিস, মেয়েগুলো সব কেমন হা করে অনিককে গিলতেছে।"
সামাদ এতক্ষণ একমনে খুনসুটিতেই মেতে ছিল, এখন ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েদের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি দেখে বলল, "এ আর নতুন কি, অনিককে কি আমাদের বান্ধবীদেরই কেউ ছাড়ত! অনিক যদি মুখ ফুটে কিছু বলত তো তখনি ওর কোলে ঢলে পড়ত, আর কতজন যে পড়েছে তার হিসেবও কি আমরা জানি নাকি, অনিক তো মেয়েদের সম্পর্কে কিছুই বলতে চায়না। মেয়েদের থেকে তো ও গা বাঁচিয়েই চলল সারাজীবন।"
"তবে সামাদ, আমি কথায় কথায় শুনেছি যে কলেজে থাকতে রায়হান নাকি আসাদচত্বরে দীপ্তিকে অনিকের বুকে ঢলে পড়তে দেখেছিল।"
"হুম এমন কথা আমিও কিছু শুনেছি, কিন্তু সেটা স্নেহার ব্যাপারে; স্নেহা নাকি গার্ডেনে কবিতা শুনতে শুনতে অনিকের কাঁধেই হেলে পরেছিল, একদম মূর্ছা যাওয়ার মতো ব্যাপার। অনিক নাকি বহু কষ্টে সামলেছিল ওকে।"
সামাদ আর মাসুদ বীচের মাঝে দাড়িয়ে কথা বলছিল, অনিক তাদের থেকে দূরে স্রোতের মাঝে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে রেখে আবার তাদের দিকে ফিরে আসছিল। সামাদ অনিকের ঘামে ভেজা রোদে চিকচিক করে রুপোলী আলো ছড়ানো শরীরের দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে মাসুদকে বিড়বিড়িয়ে বলল, "ঈশ্বরের এমন এক অপরুপ শিল্পকে মেয়েরা যে এমন অস্থির হয়ে কাছে চাইবে তাতে আসলে অবাক হবার কিছু নেই, সুন্দরকে সবাই আপন করেই পেতে চায়।"
ইতোমধ্যে অনিক ওদের কাছে চলে আসায় মাসুদ আর সামাদ এই বিষয়ে কথা বলা বন্ধ রাখে। ওরা জানে অনিক এসব ব্যাপারে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনা; কলেজজীবন থেকেই ওরা তিনজন ভালো বন্ধু, একে অপরকে নিজেরা বেশ ভালমতই চিনে। তিনজনই এরপর সমুদ্রে গিয়ে ডুব দেয়, নোনা জলের ঢেউ তাদের উপর বয়ে গেলে ধাক্কা লেগে কিছুটা পিছিয়ে পড়ার এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের দুর্বলতায় ভেসে বেড়ানোর অনুভূতি হয় তাদের; একজন আরেকজনকে পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে মজাও করতে থাকে। ঘণ্টা খানেক পানিতে কাটিয়ে তারা হোটেলে ফিরে আসে। গোসল করে তিনজনই তাদের রুমে রেস্ট নেয়।
সেন্টমারটিনে কিছুদিন ছুটি কাটাবার জন্যে তিন বন্ধু রিসোর্টের একটি রুমই ভাড়া নিয়েছে । বেশ বড়সড় রুমটি, তিনটি বিছানা পাতা, রুমে ঢুকে সোজা কিছদুর এগুতেই স্লাইডিঙ দরজা খুললেই পরিষ্কার সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। ছুটি কাটাবার পক্ষে বেশ ভালো ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ পর সামাদ উঠে বারান্দায় গিয়ে তার গার্লফ্রেন্ড রিয়ার সাথে ফোনে কথা বলতে থাকে। রিয়া সামাদের সাথে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, সামাদের মালটিন্যাশনালে চাকরি হয়ে যাওয়ায় সামনে কিছুদিনের মাঝে বিয়ে করার চিন্তা করছে। সামাদ রুমে ফিরে আসলে তিনজনই ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে বের হয়।
ক্যান্টিনে এসে তারা রূপচাঁদা মাছ ভাজি, সসে ডোবানো করাল মাছ অর্ডার দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে শুরু করে। মাসুদের মাছ ভাজা খাওয়া দেখে অনিক তাকে একটু সবুর করতে বলে এই বলে যে রাতে সাদা করাল মাছের বারবিকিউ খাওয়া হবে, তার জন্যে একটু জায়গা রাখতে। মাসুদ চোখ পাকিয়ে বলে, "এই শালা, খাওয়া নিয়ে কিছু বলবিনা, বলে দিলাম। আর বারবিকিউ নিয়ে তোর ভাবতে হবেনা। পারলে পুরো মাছটাই আমি একা খাব।"
মাসুদের কথায় ওরা দুজনই হাসতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে ওরা বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। বাজারে পৌঁছে ওরা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে; সেন্টমারটিনের বাজারটা বেশ ছোট, বেশিক্ষন সময় লাগেনা তাদের পুরো বাজার ঘুরে দেখতে। সূর্য তখনও মধ্যগগণ থেকে খুব বেশি হেলে পরেনি, তারা ঠিক করে সাইকেল চেপে দ্বীপটি ঘুরে দেখবে।
সাইকেল ভাড়া নিয়ে বাজার হতে সোজা দক্ষিন দিকে পূর্ব বীচ সংলগ্ন রাস্তাটি বরাবর তারা এগুতে থাকে। রাস্তা বরাবর এগুতে এগুতে তারা প্রায় সৈকতের ধারেই এসে পরে; জেলেদের মাছধরা নৌকোগুলো সাগরতীরে নোঙ্গর ফেলা ছিল। ছোট ছোট নৌকোগুলোর মাঝে দুএকটা কিছুটা বড় আকারের, কতগুলোতে বেশ উজ্জ্বল রঙের হাতে আঁকা কারুকাজ করা। তারা বীচে নেমে সেগুলো দেখতে লাগল, নৌকোগুলোর পাশে দাড়িয়ে কিছু ছবিও তুলল। তারপর আবার সাইকেল চেপে দক্ষিণে এগুতে থাকল সৈকতের উপর দিয়েই। কোথাও বালি বেশি থাকবার কারণে মাঝেমধ্যে এগিয়ে যেতে বাধা পেলেও, অনেকটা সাবলীলভাবেই তারা সাইকেল চালিয়ে এগুতে থাকল। সমুদ্রের জলরাশি এত কাছাকাছি দেখতে দেখতে যাওয়ার কারণে অনিকের মনে হতে লাগল যেন জলরাশির একটু উপর দিয়েই অদৃশ্য কোন ভাসমান যানের উপর চেপে সে ভেসে চলেছে, নিজেকে অনেক হালকা মনে হতে লাগল তার, নগরের যান্ত্রিক জীবনধারা ছেড়ে যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছে, যেখানে কোন ছুটোছুটি নেই, কোন ভার নেই, সবকিছুই এই জলরাশির মতো আপন নিয়মে আপন সময়ে এগিয়ে যাচ্ছে; চারিদিকেই যেন এক অপার সৌন্দর্য, এই ছলকে চলা স্রোতের মতো সবই যেন এক অশেষ যৌবন সৌন্দর্যে ভরা। সাগরতীরের আশেপাশের সব কিছুই, সেই ছোট ছোট ছড়ানো ছিটানো ঝাপিতোলা দোকনগুলো, চারপাশে দাড়িয়ে থাকা সার সার ইউক্যালিপটাস আর আমগাছগুলো, সাগরতটে দাড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছগুলো যেন, নব আবিষ্কৃত তার এই নন্দনদৃষ্টিতে , এক মায়াবি স্নিগ্ধ রুপের জগত তৈরি করতে থাকে।
এগুতে এগুতে তারা গলাচিপাতে এসে পরে। সামাদ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে, "আমরা গলাচিপায় তো এসে পরেছি, ছেঁড়া দ্বীপ ও বেশি দূর হবার কথা না। কি বলিস যাবি নাকি ছেঁড়া দ্বীপ?"
অনিক চারদিক দেখে বলল, "চল কিছুদূর সামনে যাই, এখানে তো কাউকে দেখছিনা, সামনে কারো দেখা পেলে জিজ্ঞেস করে নেব ছেঁড়া দ্বীপে আজ যেতে পারব কিনা।"
এই বলে তারা সাইকেলে এগুতে থাকে। গলাচিপা থেকে কিছুটা সামনে গিয়েই দেখল মেইন রোডের ধারে একটি ১০-১১ বছরের শিশু এবং একটি কিশোরী কিছু কড়ি নিয়ে খেলছিল। সাইকেল ঘুরিয়ে যখন তারা ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে এগুল, তখন খেলা ছেড়ে ছেলেমেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে তাদের দিকে ঘুরে তাদের দেখতে লাগল। ওদের সামনে সাইকেল থামিয়েই মাসুদ বলল, "বাবু একটু শুনো তো।"
মাসুদের কথায় শিশুটি কিছুদূর এগিয়ে আসলো।
"জ্বি বলেন", কিছুটা গ্রাম্য টানেই বলল শিশুটি।
"আচ্ছা ছেঁড়া দ্বীপ এখান থেকে কতদূর হবে বলতে পারবে।"
শিশুটি মাথা চুলকে বলল, "দূর আছে। সাইকেল নিয়ে গেলে একটু তাড়াতাড়ি হয়।"
তার উত্তরের কোন প্রাসঙ্গিক মানে বের করতে না পেরে মাসুদ ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে চাইল। এমন সময় মেয়েটি এগিয়ে এসে বললে, "বাবুরা, আপনারা কি বাজার থেকে আসছেন?"
অনিক সাইকেলে বসা অবস্থায় মেয়েটির দিকে ঘুরে তাকাল, গলাটা কেমন যেন রিনঝিনে স্বচ্ছ কাচের মতো এসে বাজল তার কানে; মনে হল হাজার বেলোয়ারি চুড়ি একসাথে ভেঙে পড়ে তার কর্ণকুঠরে বেজে উঠল। সামাদ সাইকেলে বসা অবস্থায় গলা চড়িয়ে বলল, "হ্যা, বাজার থেকেই আসা হচ্ছে।"
মেয়েটি দুহাতে তার ঘোমটাটা কিছুটা সরিয়ে এরপর সামাদের দিকে চোখ তুলে বলল, "বাজার থেকে যতটা পথ এসেছেন তার থেকে কিছুটা বেশি যেতে হবে।"
মেয়েটির গলার স্বরে মোহাবিষ্ট হয়ে অনিক পলকহীন চোখে তাকে দেখতে লাগল। মেয়েটি কিছুটা পিছনে গাছের পাতার আড়ালে থাকায় এতক্ষণ তার অবয়ব পরিষ্কার দেখা যায়নি, এগিয়ে আসায় এখন তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখায় মেয়েটিকে কিশোরী মনে হলেও সে ঠিক কিশোরী নয়, কৈশোর আর তারুণ্যের মাঝের কোন এক সন্ধিক্ষণে এসে সময় যেন থমকে আছে তার দেহে। মুখের আদলটা ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো, চোখ দুটো পদ্মপাতা আকারের আর তাদের থেকে স্পষ্ট বুদ্ধির একটি দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁট দুটো যেন গোলাপের পাপড়ি। প্রথম দৃষ্টিতে একে লক্ষ্মী প্রতিমা ভেবে ভুল করলে দেবীর অশ্রদ্ধা হবে বলে মনে হয়না, বরং এমন সৌন্দর্যের অনুকরণেই যে দেবীদের উদ্ভব সেই বোধই মনে জাগে।
অনিক, মাসুদ আর সামাদ পরস্পরের মাঝে পরামর্শ করতে থাকে যে ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে এখন এগুনো উচিত হবে কিনা। মেয়েটি তাদের কথার মাঝে মোলায়েম স্বরে বলে উঠে, "বাবুরা আপানারা কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলি। আপনাদের এখন যাওয়া ভালো হবেনা, সূর্য প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে আর এখন সময়টাও জোয়ারের। আপনাদের দক্ষিণ পাড়া পেরিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে, সামনে সব জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকবে।"
একনিশ্বাসে কথগুলো বলে মেয়েটি অনিকের দিকে তাকাল। এতক্ষণ অনিকও তাকে দেখছিল, মেয়েটি তার আশ্চর্য ভাবেভরা চোখে তার দিকে তাকাতেই অনিক ইতস্তত করে শিশুটির দিকে ঘুরে তার সাথে আলাপ শুরু করে দেয়-
"কি খোকা, তোমার নাম কি?"
"জসীম"
"বাহ সুন্দর নাম তো, কলেজে পড় তুমি?"
শিশুটি ঘাড় হেলিয়ে বলে সে ক্লাস ৫ এ পড়ে।
অনিক হাঁটু মুড়ে বসে জসীমের গাল টেনে বলল,"বেশ তো, এই পড়ন্ত বেলায় এখানে কি করছিলে খোকা?"
মেয়েটি এতক্ষণ অনিককে বেশ সতর্ক চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। এবার অনিককে উদ্দেশ্য করে ভেজা গলায় বলল,"আমরা নজরুল পাড়ায় আমাদের মামা বাড়িতে এসেছি, বিকেলে বাজারে যেতে হবে তাই ভাইকে নিয়ে একটু আগেই বের হয়ে এলাম তাকে সাথে নিয়ে কিছুদূর বেড়াবার জন্যে।"
জসীমকে দেখে অনিকের কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায়না সে এই মেয়েটির ভাই। মাসুদ জিজ্ঞ্যাসু চোখে প্রশ্ন করে,"ও কি আপনার নিজের ভাই?"
মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,"না, আমার নিজের ভাই না, মামাতো ভাই।"
অনিক এবার কিছুটা যুক্তি খুজে পায়। সামাদ এরপর মেয়েটির নাম জানতে চায়।
মেয়েটি সংক্ষেপে উত্তর দেয়, “জয়া।“
জয়া, জয়া- মন্দিরের পিতলঘণ্টার মতো একটানা নামটি ধ্বনিত হতে থাকে অনিকের বুকে। ঘুরেফিরে মেয়েটির মুখনিঃসৃত এই নামটিই তার দুকানের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে বাঁশির মনভোলানো সুরের মতো বিনা বিরতিতে বাজতে থাকে। তার বোধ হয় খামে সিল বসানোর মতোই এই নাম কেউ যেন তার বুকে চেপে বসিয়ে দিয়েছে, এর থেকে পরিত্রানের যেন কোন পথই খোলা নেই।
অনিক তার দুই বন্ধুসহ সাগরপারে গিয়ে বসে থাকে। মাসুদ আর সামাদ বাড়ন্ত জোয়ারের স্রোত নিবিষ্ট চিত্তে দেখতে থাকে, কিন্তু অনিকের বুকে যেন একটানা দামামা বেজেই চলেছে, সে কোথাও মনোনিবেশ করতে পারছেনা; বারবার পিছন ফিরে জয়াকে দেখছে । জয়া পুনরায় তার ভাইকে নিয়ে কড়ি খেলতে বসেছে। অনিকের পুরো চিত্ত জুড়ে এখন শুধু একটিই রিনরিনে স্বচ্ছ গলার সুর "জয়া", কিন্তু অনিক দেখে জয়া পুরোপুরি নির্লিপ্ত; তার অদূরেই তাকে কেন্দ্র করে সমুদ্রপ্রান্তে যে এক দুরন্ত ঝড়ের সমাগম হয়েছে তার কোন আভাসই যেন জয়াকে স্পর্শ করছেনা। অনিক জয়াকে ভালমত খুঁটিয়ে দেখে; বাংলা কায়দায় সবুজ-হলুদ একটি ডুরে শাড়ি পড়েছে মেয়েটি, সাথে সবুজ ব্লাউস; ভাবে কতই বা বয়স হবে, ১৬ থেকে একদিনও বেশি হবে বলে মনে হয়না। কিন্তু এই উঠতি বয়সেই রপের এই সমাহার, এই মোহনীয় উপস্থিতি এমনি আচ্ছন্ন করেছে অনিককে যে সে আর সোজা ভাবতে পারছেনা, তার ভাবনাগুলো গুলিয়ে আসছে।
সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে, অনিকদের দ্রুত ফিরতে হবে কারন পূর্ব বীচের এদিকে বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় সূর্যাস্তের পরপরই চারদিক দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসে। তারা উঠে দাড়িয়ে সাইকেলের উপর চেপে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে জয়ার দিকে তাকায়; দেখে জয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। গোধূলিলগ্নের উদ্ভাসিত হ্যাজাক বাতির মতো আলোয় জয়ার কোকিল-কালো চোখে বেদনাক্রান্ত অস্ফুট ঘন হয়ে আসা এক আর্তি যেন সে দেখতে পায়। অনিক লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জয়াকে উদ্দেশ্য করে এই প্রথম তার ভারী পুরুষালি কণ্ঠে বলে উঠে, "জয়া, আমরা তাহলে আসি।"
"দাদাবাবু, আপনারা কি বাজারে যাচ্ছেন?", চকিত প্রশ্নটি করে বসে মেয়েটি।
"হ্যা, বাজার হয়েই তো যেতে হবে।"
মেয়েটি এক মুহূর্ত নিচে তাকিয়ে কি একটা ভেবে নিয়ে বলে,”দাদাবাবু আমাকে বাজার পর্যন্ত একটু এগিয়ে দিবেন?”
অনিক কিছু বলেনা, মূর্তির মতো জয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামাদ জয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “তা কি করে হবে জয়া, সাইকেলগুলোতে বসার তো তেমন কোন জায়গা নেই।“
আসলে তারা যে সাইকেলগুলোতে চেপেছিল সেগুলো ছিল ক্যারিয়ার বিহীন দুরন্ত ব্র্যান্ডের। সামদের এই অভিযোগে জয়ার শান দেয়া কাস্তের মতো টানা কালো ভ্রুযুগল কিছুটা কুঞ্চিত হয়ে কপালে অস্পষ্ট কিছু রেখা উৎপন্ন করে। জয়ার মুখের এই উদ্বিগ্ন ভাবের মধ্যেও এক অনন্যদৃষ্ট সৌন্দর্যের আভাস পেয়ে অনিক বিহ্বলের মতো তাকে দেখতে থাকে। অনিকের মনে হয় এই উদ্বিগ্ন, কুঞ্চিত ভ্রু মুখভঙ্গিতে জয়াকে যেন স্ফুটনোন্মুখ এক জবার মতো লাগছে,নিজের পরিস্ফুটনের সম্ভাবনায় যে ব্যাকুল হয়ে আছে।
এর মাঝে জয়ার পিছন থেকে তাকে পাশ কাটিয়ে জসীম দৌড়ে এসে সামাদের সাইকেলের কাছে গিয়ে সামাদকে কিছু বুঝতে না দিয়েই তার লাল-কাল সাইকেলের সীটের সামনে হাতল ধরে লাফিয়ে সেটার উপর পাশ ফিরে বসে পড়ে। সামাদ থতমত হয়ে জসীমকে বলল, ”এই খোকা, করছ কি তুমি!”
জসীম হাসি হাসি মুখে মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে বলল , ”সাইকেলে চড়লাম, চল টেনে নিয়ে চল এবার।“
জয়া লজ্জিত হয়ে জসীমের দিকে মাথা উচিয়ে শাসিয়ে বলল, “এই জসীম, নেমে আয় বলছি। বাবুদের বিরক্ত করিস না। “
জসীম নেমে আসে না বরং সামনে হেলে পড়ে হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকে। নিজের প্রতি জসীমের এই উদাসীনতা লক্ষ্য করে জয়া বলল, ”আসলে ওর সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াবার খুব শখ তো তাই সাইকেলে উঠলে আর সহজে নামতে চায়না।“
মাসুদ এর মাঝে বলে বসল, “তো থাকুক না জসীম সাইকেলে, ওকে আমরা কিছুটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। কি জসীম, যাবে আমাদের সাথে?“
জসীম মাসুদের দিকে তাকিয়ে বলে যে সে সাইকেলে ঘুরবে, কিন্তু সাথে দিদিকেও নিতে হবে।
জয়া সাফাই গাওয়ার মতো করে বলল, “আসলে নতুন কারো সাথে একা কোথাও গেলে ও ভয় পায়, কান্না করে, পরিচিত কেও থাকলে ভালো হয় আরকি।“
সামাদ এরপর কিছুটা বিরক্তি চাপা দিয়ে বলল, “আপনাকে কি করে নিয়ে যাই বলুন তো, একে তো সাইকেলে বসার মতো ব্যাবস্থা নেই, আর তাছাড়া আপনার পরিচিত কেউ আমাদের সাথে আপনাকে দেখলেও বা কি ভাববে।“
জয়া বলল, “আসলে সন্ধ্যার সময় এদিকে গাঁয়ের তেমন কেউই আসেনা, এদিকটা ফাঁকাই থাকে; মাঝিরা তাদের নৌকা নিতে বের হয় মাঝরাতের আগে আগে, আর আপনারা আমায় বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিলে আমার বেশ উপকার হবে, নাহয় এই লম্বা পথ একা হেঁটে যেতে হবে আমায়। আর আমার ঠিকঠাক বসার জন্যে বেশি ভাববেন না আপনারা। আমরা গাঁয়ের মেয়ে, ওভাবে সাইকেলে চেপে যাওয়ার অভ্যেস আছে আমার।“
সামাদের জয়াকে নিজেদের সাথে এভাবে সাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়ায় আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শেষমেশ জয়ার এই লম্বা পথ হেঁটে যাওয়ার অসুবিধার কথা ভেবে নিজেকে রাজি করে জয়াকে সাইকেলে উঠে পড়তে বলে।
জয়া তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে এসে অনিকের সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনিক জয়ার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে নিয়ে তার বাম পা খানিকটা সামনে এগিয়ে নিয়ে সাইকেলটা হেলিয়ে জয়াকে উঠতে বলে। জয়া সাইকেলের পাশে এসে পিছনে ঘুরে হাতল ধরে উঠার চেষ্টা করতেই অনিক তার অসুবিধা বুঝতে পেরে তার কোমর দুপাশে আঁকড়ে ধরে তাকে ধীরে ঝাঁপ দিতে বলে। জয়া কথামতো ঝাঁপ দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে। জয়ার কোমর স্পর্শ করা মাত্রই এক অন্যরকম অনুভূতি বন্যায় নদীর উপচে পড়া জলের মতই অনিকের শরীরের প্রতিটি আনাচে কানাচে বইতে শুরু করে দেয়, বানের জলের মতই এই ভালো লাগার অনভুতি তার ভাবনার কূল ছাপিয়ে তাকে দ্রুত বেগে সিক্ত করে পিছনে ঠেলে দিয়ে তার সর্বাঙ্গ শিথিল করে ফেলে। সেই ভরপুর স্রোতের আঘাতে তার ঘাড় ঢিলে হয়ে উত্তাল সুখের স্পর্শে মাথা পিছনে হেলে গিয়ে সে সম্পূর্ণ বিবশ হয়ে পড়ে। অজান্তেই তার মনে খেয়াল জাগে যে জয়ার কোমরের দুপাশের মাংসগুলো কি নরম! একদম যেন ননী দিয়ে গড়ে চমৎকার এক আকৃতি দিয়েছেন কোন মহান কলাকুশলী পাচক। সামাদের কথায় তার সম্বিৎ ফিরে আসে। সামাদ তার দিকে তাকিয়ে বলে, “চল আগাই তাহলে। সাবধানে ধীরে ধীরে চালাস। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।“
অনিক তার বাম পা কাছে টেনে এনে সাইকেল সোজা করে দুহাতে হাতল ধরতে গেলে জয়ার শরীরের সাথে তার দু হাতেরই আলতো ঘষা লাগে, সামনে হেলে পড়ার কারণে অনিকের বুকের সাথেও জয়ার কাঁধে ঘষা লাগছিল। অনিক দেখতে পায় জয়া শিউরে উঠে তার কাঁধটা একটু পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। অনিক জয়াকে জিজ্ঞেস করে সে সুবিধামত বসেছে কিনা; জয়া এর উত্তরে উঁহু বলে ঘাড় হালকা কাত করতেই অনিক তাকে হ্যান্ডেল দুহাতে শক্ত করে ধরতে বলে প্যাডেল মেরে সামনে এগুতে থাকে।
"অনিক, এই অনিক ঘুমিয়ে পড়লি নাকি"
চোখ খুলে অনিক দেখল সামাদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। অনিক চোখ ঘষে বলল, "নারে এই একটু চোখ লেগে এসেছিল।"
সামাদ সামনে ঝুকে অনিকের কাঁধে হাত রেখে বলল, "চল কিছু খেয়ে আসি, মাসুদ ব্যাটাও উঠে পরছে।"
অনিক উঠে পড়ে সামাদের সাথে হাঁটতে শুরু করল।
"অনেকদিন থেকেই সাগরপাড়ে আসতে চাচ্ছিলাম। আজ অনেক ভালো লাগছে।"
সামাদ বলল, "সাগর আমারও ভালো লাগে, তবে এবারের ছুটিতে পাহাড়ে যাবার মন ছিল। তোর জোরাজুরিতেই শেষে কিনা এখানে এলাম।"
"জানিনা কেন, কিছুদিন থেকে মনে হচ্ছিল সাগর যেন আমাকে তার কাছে টানছে; ঠিক সাগরতীরের বালুকনার মতো স্রোত আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে, বাধা দেয়ার যেন কোন সামর্থ্যই আমার নেই।"
সামাদ শ্লেষের সুরে বলল,"কি আর করা, কেউ তো আমাকে আর তোর মতো বুকে টেনে নিবেনা। তোর মতো কবিতাও তো কাউকে শোনানো হয়না।"
রিসোর্টের সামনে মাসুদকে দেখা গেল; সে তাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে এসে বলল, "কি রে শালা, কই ছিলি! খিদায় আমার কাহিল অবস্থা। মাছ ভাজা যে কয়টা সাবার করতে ইচ্ছে করছে, দেখিস ব্যাটা।"
ক্যান্টিনের দিকে এগুতে থাকল ওরা। একটা ফাকা টেবিলে বসে ওয়েটারকে ডেকে মাসুদ খাবার অর্ডার করল। মাসুদ আয়েশ মতো চওড়া হয়ে বসে বলল, "কি রে অনিক, কখন বেরিয়েছিলে রুম থেকে?"
অনিক বলল,"এই ভোরের কিছু পরেই হবে।"
"সমুদ্র দেখে কবিতা-টবিতা কিছু লিখে ফেললি নাকি।"
সামাদ ঈষৎ হেসে বলল,"ও কবিতা কি লিখবে রে, গিয়ে তো দেখি রোদের মধ্যে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। স্রোতের আওয়াজে বিহ্বল হয়ে পড়েছে কিনা।"
এর মাঝে ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে গেল। মাসুদ বেশ পেটুক গোছের, খিদে লাগলে প্রচুর খেতে পারে। মাসুদের গোগ্রাসে মাছ ভাজা খাবার ব্যাগ্রতা দেখে অনিক আর সামাদ হাসতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে তিনজন বীচের দিকে এগুতে থাকে।
বীচে পৌঁছে তিনজনই একদৃষ্টিতে সমুদ্র দেখতে থাকল। জোয়ার তখন অনেকটাই কমে এসেছে, স্তিমিত ধারায় জল তটে এসে পড়ছে। খানিক বাদেই তিন বন্ধু মিলে খুনসুটিতে মেতে উঠল, সাগরপাড় হতে বিপরীতের ঝাউ গাছে ভরা টিলা পর্যন্ত দৌড়াদৌড়ি, বীচ বল নিয়ে ছুটোছুটি করতে থাকল। সূর্য তখন মাথার উপর উঠতে শুরু করেছে; সকালের মিষ্টি লাজরক্তিম বর্ণ ছেড়ে গনগনে হলুদ বর্ণে তাপ বিকিরণ করে সমস্ত প্রকৃতিকে জীবনীশক্তি দানের নৈমিত্তিক রুপ ধারন করেছে। তিন বন্ধুই সাগরসূর্যের তাপে ঘামতে থাকলে তাদের টিশার্ট খুলে ফেলে। সাগরপাড়ে তখন অনেক টুরিস্ট ভিড় জমিয়েছে, তাদের মাঝে অনেকে এই শার্টখোলা ছেলেদের আনন্দক্রীড়া একদৃষ্টিতে দেখছিল। তাদের মাঝে তরুণী আর মাঝবয়সী মহিলাদের চোখ দুটো যেন ইচ্ছায় অনিচ্ছায় বার বার এই ছেলেদের উপরি ঘোরাফেরা করছিল, আর তাদের সিংহভাগেরই দৃষ্টি অনিকের প্রতি।
অনিকের গৌরবর্ণ, লম্বা, নিয়মিত জিম করা চওড়া কাঁধের বলশালী দেহকাঠামো যেকোনো বয়সী মহিলাকেই তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য করে; সাথে তার মুখশ্রীও সুগঠিত এবং মায়াকাড়া; টানা টানা চোখ, ধারালো ছুরির ন্যায় নাক, তীক্ষ্ণ চোয়াল; নারীদের পরম আকাঙ্ক্ষার দেবমূর্তি হিসেবেই অনিক যেন তাদের সামনে ধরা দেয়। কলেজ কলেজের মেয়েবন্ধুদের আর চাকুরীক্ষেত্রের মেয়ে কলিগদের মাঝেও অনিকের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে; সেটার জন্যে শুধু তার দেহগড়নই দায়ী নয়, অনিকের কবিতা লেখার হাতও বেশ চমৎকার। কলেজে থাকতে সহপাঠিনীরা তার চোখের মায়ায় আবিষ্ট হয়ে রবি ঠাকুরের মানসসুন্দরি কিম্বা ভৈরবীর গান শুনতে শুনতে কতবার যে সম্মোহিত হয়ে নিজেদের শুভবুদ্ধি হারিয়েছে তার সঠিক হিসেব কেউ বলতে পারবেনা। অনিকের বন্ধুদের তার এই জনপ্রিয়তা দেখে গা জ্বলে গেলেও, অনিক এসব বিষয় তেমন পাত্তা দিতো না, মেয়েদের ব্যাপারে সে বরাবরই উদাসীন। মাসুদ বীচের মেয়েদের দৃষ্টিরেখা লক্ষ্য করে দৌড় থামিয়ে সামাদকে উদ্দেশ্য করে বলল, "কি রে সামাদ দেখতেছিস, মেয়েগুলো সব কেমন হা করে অনিককে গিলতেছে।"
সামাদ এতক্ষণ একমনে খুনসুটিতেই মেতে ছিল, এখন ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েদের ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি দেখে বলল, "এ আর নতুন কি, অনিককে কি আমাদের বান্ধবীদেরই কেউ ছাড়ত! অনিক যদি মুখ ফুটে কিছু বলত তো তখনি ওর কোলে ঢলে পড়ত, আর কতজন যে পড়েছে তার হিসেবও কি আমরা জানি নাকি, অনিক তো মেয়েদের সম্পর্কে কিছুই বলতে চায়না। মেয়েদের থেকে তো ও গা বাঁচিয়েই চলল সারাজীবন।"
"তবে সামাদ, আমি কথায় কথায় শুনেছি যে কলেজে থাকতে রায়হান নাকি আসাদচত্বরে দীপ্তিকে অনিকের বুকে ঢলে পড়তে দেখেছিল।"
"হুম এমন কথা আমিও কিছু শুনেছি, কিন্তু সেটা স্নেহার ব্যাপারে; স্নেহা নাকি গার্ডেনে কবিতা শুনতে শুনতে অনিকের কাঁধেই হেলে পরেছিল, একদম মূর্ছা যাওয়ার মতো ব্যাপার। অনিক নাকি বহু কষ্টে সামলেছিল ওকে।"
সামাদ আর মাসুদ বীচের মাঝে দাড়িয়ে কথা বলছিল, অনিক তাদের থেকে দূরে স্রোতের মাঝে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে রেখে আবার তাদের দিকে ফিরে আসছিল। সামাদ অনিকের ঘামে ভেজা রোদে চিকচিক করে রুপোলী আলো ছড়ানো শরীরের দিকে একমনে তাকিয়ে থেকে মাসুদকে বিড়বিড়িয়ে বলল, "ঈশ্বরের এমন এক অপরুপ শিল্পকে মেয়েরা যে এমন অস্থির হয়ে কাছে চাইবে তাতে আসলে অবাক হবার কিছু নেই, সুন্দরকে সবাই আপন করেই পেতে চায়।"
ইতোমধ্যে অনিক ওদের কাছে চলে আসায় মাসুদ আর সামাদ এই বিষয়ে কথা বলা বন্ধ রাখে। ওরা জানে অনিক এসব ব্যাপারে কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনা; কলেজজীবন থেকেই ওরা তিনজন ভালো বন্ধু, একে অপরকে নিজেরা বেশ ভালমতই চিনে। তিনজনই এরপর সমুদ্রে গিয়ে ডুব দেয়, নোনা জলের ঢেউ তাদের উপর বয়ে গেলে ধাক্কা লেগে কিছুটা পিছিয়ে পড়ার এবং মাধ্যাকর্ষণ বলের দুর্বলতায় ভেসে বেড়ানোর অনুভূতি হয় তাদের; একজন আরেকজনকে পানিতে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রেখে মজাও করতে থাকে। ঘণ্টা খানেক পানিতে কাটিয়ে তারা হোটেলে ফিরে আসে। গোসল করে তিনজনই তাদের রুমে রেস্ট নেয়।
সেন্টমারটিনে কিছুদিন ছুটি কাটাবার জন্যে তিন বন্ধু রিসোর্টের একটি রুমই ভাড়া নিয়েছে । বেশ বড়সড় রুমটি, তিনটি বিছানা পাতা, রুমে ঢুকে সোজা কিছদুর এগুতেই স্লাইডিঙ দরজা খুললেই পরিষ্কার সমুদ্র দেখতে পাওয়া যায়। ছুটি কাটাবার পক্ষে বেশ ভালো ব্যবস্থা। কিছুক্ষণ পর সামাদ উঠে বারান্দায় গিয়ে তার গার্লফ্রেন্ড রিয়ার সাথে ফোনে কথা বলতে থাকে। রিয়া সামাদের সাথে নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটিতে পড়ত, সামাদের মালটিন্যাশনালে চাকরি হয়ে যাওয়ায় সামনে কিছুদিনের মাঝে বিয়ে করার চিন্তা করছে। সামাদ রুমে ফিরে আসলে তিনজনই ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে বের হয়।
ক্যান্টিনে এসে তারা রূপচাঁদা মাছ ভাজি, সসে ডোবানো করাল মাছ অর্ডার দিয়ে দুপুরের খাবার খেতে শুরু করে। মাসুদের মাছ ভাজা খাওয়া দেখে অনিক তাকে একটু সবুর করতে বলে এই বলে যে রাতে সাদা করাল মাছের বারবিকিউ খাওয়া হবে, তার জন্যে একটু জায়গা রাখতে। মাসুদ চোখ পাকিয়ে বলে, "এই শালা, খাওয়া নিয়ে কিছু বলবিনা, বলে দিলাম। আর বারবিকিউ নিয়ে তোর ভাবতে হবেনা। পারলে পুরো মাছটাই আমি একা খাব।"
মাসুদের কথায় ওরা দুজনই হাসতে থাকে। খাওয়া শেষ হলে ওরা বাজারের দিকে হাঁটতে থাকে। বাজারে পৌঁছে ওরা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে; সেন্টমারটিনের বাজারটা বেশ ছোট, বেশিক্ষন সময় লাগেনা তাদের পুরো বাজার ঘুরে দেখতে। সূর্য তখনও মধ্যগগণ থেকে খুব বেশি হেলে পরেনি, তারা ঠিক করে সাইকেল চেপে দ্বীপটি ঘুরে দেখবে।
সাইকেল ভাড়া নিয়ে বাজার হতে সোজা দক্ষিন দিকে পূর্ব বীচ সংলগ্ন রাস্তাটি বরাবর তারা এগুতে থাকে। রাস্তা বরাবর এগুতে এগুতে তারা প্রায় সৈকতের ধারেই এসে পরে; জেলেদের মাছধরা নৌকোগুলো সাগরতীরে নোঙ্গর ফেলা ছিল। ছোট ছোট নৌকোগুলোর মাঝে দুএকটা কিছুটা বড় আকারের, কতগুলোতে বেশ উজ্জ্বল রঙের হাতে আঁকা কারুকাজ করা। তারা বীচে নেমে সেগুলো দেখতে লাগল, নৌকোগুলোর পাশে দাড়িয়ে কিছু ছবিও তুলল। তারপর আবার সাইকেল চেপে দক্ষিণে এগুতে থাকল সৈকতের উপর দিয়েই। কোথাও বালি বেশি থাকবার কারণে মাঝেমধ্যে এগিয়ে যেতে বাধা পেলেও, অনেকটা সাবলীলভাবেই তারা সাইকেল চালিয়ে এগুতে থাকল। সমুদ্রের জলরাশি এত কাছাকাছি দেখতে দেখতে যাওয়ার কারণে অনিকের মনে হতে লাগল যেন জলরাশির একটু উপর দিয়েই অদৃশ্য কোন ভাসমান যানের উপর চেপে সে ভেসে চলেছে, নিজেকে অনেক হালকা মনে হতে লাগল তার, নগরের যান্ত্রিক জীবনধারা ছেড়ে যেন অন্য এক জগতে চলে এসেছে, যেখানে কোন ছুটোছুটি নেই, কোন ভার নেই, সবকিছুই এই জলরাশির মতো আপন নিয়মে আপন সময়ে এগিয়ে যাচ্ছে; চারিদিকেই যেন এক অপার সৌন্দর্য, এই ছলকে চলা স্রোতের মতো সবই যেন এক অশেষ যৌবন সৌন্দর্যে ভরা। সাগরতীরের আশেপাশের সব কিছুই, সেই ছোট ছোট ছড়ানো ছিটানো ঝাপিতোলা দোকনগুলো, চারপাশে দাড়িয়ে থাকা সার সার ইউক্যালিপটাস আর আমগাছগুলো, সাগরতটে দাড়িয়ে থাকা নারিকেল গাছগুলো যেন, নব আবিষ্কৃত তার এই নন্দনদৃষ্টিতে , এক মায়াবি স্নিগ্ধ রুপের জগত তৈরি করতে থাকে।
এগুতে এগুতে তারা গলাচিপাতে এসে পরে। সামাদ হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে, "আমরা গলাচিপায় তো এসে পরেছি, ছেঁড়া দ্বীপ ও বেশি দূর হবার কথা না। কি বলিস যাবি নাকি ছেঁড়া দ্বীপ?"
অনিক চারদিক দেখে বলল, "চল কিছুদূর সামনে যাই, এখানে তো কাউকে দেখছিনা, সামনে কারো দেখা পেলে জিজ্ঞেস করে নেব ছেঁড়া দ্বীপে আজ যেতে পারব কিনা।"
এই বলে তারা সাইকেলে এগুতে থাকে। গলাচিপা থেকে কিছুটা সামনে গিয়েই দেখল মেইন রোডের ধারে একটি ১০-১১ বছরের শিশু এবং একটি কিশোরী কিছু কড়ি নিয়ে খেলছিল। সাইকেল ঘুরিয়ে যখন তারা ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে এগুল, তখন খেলা ছেড়ে ছেলেমেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে তাদের দিকে ঘুরে তাদের দেখতে লাগল। ওদের সামনে সাইকেল থামিয়েই মাসুদ বলল, "বাবু একটু শুনো তো।"
মাসুদের কথায় শিশুটি কিছুদূর এগিয়ে আসলো।
"জ্বি বলেন", কিছুটা গ্রাম্য টানেই বলল শিশুটি।
"আচ্ছা ছেঁড়া দ্বীপ এখান থেকে কতদূর হবে বলতে পারবে।"
শিশুটি মাথা চুলকে বলল, "দূর আছে। সাইকেল নিয়ে গেলে একটু তাড়াতাড়ি হয়।"
তার উত্তরের কোন প্রাসঙ্গিক মানে বের করতে না পেরে মাসুদ ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে চাইল। এমন সময় মেয়েটি এগিয়ে এসে বললে, "বাবুরা, আপনারা কি বাজার থেকে আসছেন?"
অনিক সাইকেলে বসা অবস্থায় মেয়েটির দিকে ঘুরে তাকাল, গলাটা কেমন যেন রিনঝিনে স্বচ্ছ কাচের মতো এসে বাজল তার কানে; মনে হল হাজার বেলোয়ারি চুড়ি একসাথে ভেঙে পড়ে তার কর্ণকুঠরে বেজে উঠল। সামাদ সাইকেলে বসা অবস্থায় গলা চড়িয়ে বলল, "হ্যা, বাজার থেকেই আসা হচ্ছে।"
মেয়েটি দুহাতে তার ঘোমটাটা কিছুটা সরিয়ে এরপর সামাদের দিকে চোখ তুলে বলল, "বাজার থেকে যতটা পথ এসেছেন তার থেকে কিছুটা বেশি যেতে হবে।"
মেয়েটির গলার স্বরে মোহাবিষ্ট হয়ে অনিক পলকহীন চোখে তাকে দেখতে লাগল। মেয়েটি কিছুটা পিছনে গাছের পাতার আড়ালে থাকায় এতক্ষণ তার অবয়ব পরিষ্কার দেখা যায়নি, এগিয়ে আসায় এখন তাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দূর থেকে দেখায় মেয়েটিকে কিশোরী মনে হলেও সে ঠিক কিশোরী নয়, কৈশোর আর তারুণ্যের মাঝের কোন এক সন্ধিক্ষণে এসে সময় যেন থমকে আছে তার দেহে। মুখের আদলটা ঠিক পূর্ণিমার চাঁদের মতো, চোখ দুটো পদ্মপাতা আকারের আর তাদের থেকে স্পষ্ট বুদ্ধির একটি দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁট দুটো যেন গোলাপের পাপড়ি। প্রথম দৃষ্টিতে একে লক্ষ্মী প্রতিমা ভেবে ভুল করলে দেবীর অশ্রদ্ধা হবে বলে মনে হয়না, বরং এমন সৌন্দর্যের অনুকরণেই যে দেবীদের উদ্ভব সেই বোধই মনে জাগে।
অনিক, মাসুদ আর সামাদ পরস্পরের মাঝে পরামর্শ করতে থাকে যে ছেঁড়া দ্বীপের উদ্দেশ্যে এখন এগুনো উচিত হবে কিনা। মেয়েটি তাদের কথার মাঝে মোলায়েম স্বরে বলে উঠে, "বাবুরা আপানারা কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলি। আপনাদের এখন যাওয়া ভালো হবেনা, সূর্য প্রায় পশ্চিমে হেলে পড়েছে আর এখন সময়টাও জোয়ারের। আপনাদের দক্ষিণ পাড়া পেরিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে, সামনে সব জোয়ারের পানিতে ডুবে থাকবে।"
একনিশ্বাসে কথগুলো বলে মেয়েটি অনিকের দিকে তাকাল। এতক্ষণ অনিকও তাকে দেখছিল, মেয়েটি তার আশ্চর্য ভাবেভরা চোখে তার দিকে তাকাতেই অনিক ইতস্তত করে শিশুটির দিকে ঘুরে তার সাথে আলাপ শুরু করে দেয়-
"কি খোকা, তোমার নাম কি?"
"জসীম"
"বাহ সুন্দর নাম তো, কলেজে পড় তুমি?"
শিশুটি ঘাড় হেলিয়ে বলে সে ক্লাস ৫ এ পড়ে।
অনিক হাঁটু মুড়ে বসে জসীমের গাল টেনে বলল,"বেশ তো, এই পড়ন্ত বেলায় এখানে কি করছিলে খোকা?"
মেয়েটি এতক্ষণ অনিককে বেশ সতর্ক চোখে পর্যবেক্ষণ করছিল। এবার অনিককে উদ্দেশ্য করে ভেজা গলায় বলল,"আমরা নজরুল পাড়ায় আমাদের মামা বাড়িতে এসেছি, বিকেলে বাজারে যেতে হবে তাই ভাইকে নিয়ে একটু আগেই বের হয়ে এলাম তাকে সাথে নিয়ে কিছুদূর বেড়াবার জন্যে।"
জসীমকে দেখে অনিকের কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায়না সে এই মেয়েটির ভাই। মাসুদ জিজ্ঞ্যাসু চোখে প্রশ্ন করে,"ও কি আপনার নিজের ভাই?"
মেয়েটি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলল,"না, আমার নিজের ভাই না, মামাতো ভাই।"
অনিক এবার কিছুটা যুক্তি খুজে পায়। সামাদ এরপর মেয়েটির নাম জানতে চায়।
মেয়েটি সংক্ষেপে উত্তর দেয়, “জয়া।“
জয়া, জয়া- মন্দিরের পিতলঘণ্টার মতো একটানা নামটি ধ্বনিত হতে থাকে অনিকের বুকে। ঘুরেফিরে মেয়েটির মুখনিঃসৃত এই নামটিই তার দুকানের এক প্রান্ত হতে আরেক প্রান্তে বাঁশির মনভোলানো সুরের মতো বিনা বিরতিতে বাজতে থাকে। তার বোধ হয় খামে সিল বসানোর মতোই এই নাম কেউ যেন তার বুকে চেপে বসিয়ে দিয়েছে, এর থেকে পরিত্রানের যেন কোন পথই খোলা নেই।
অনিক তার দুই বন্ধুসহ সাগরপারে গিয়ে বসে থাকে। মাসুদ আর সামাদ বাড়ন্ত জোয়ারের স্রোত নিবিষ্ট চিত্তে দেখতে থাকে, কিন্তু অনিকের বুকে যেন একটানা দামামা বেজেই চলেছে, সে কোথাও মনোনিবেশ করতে পারছেনা; বারবার পিছন ফিরে জয়াকে দেখছে । জয়া পুনরায় তার ভাইকে নিয়ে কড়ি খেলতে বসেছে। অনিকের পুরো চিত্ত জুড়ে এখন শুধু একটিই রিনরিনে স্বচ্ছ গলার সুর "জয়া", কিন্তু অনিক দেখে জয়া পুরোপুরি নির্লিপ্ত; তার অদূরেই তাকে কেন্দ্র করে সমুদ্রপ্রান্তে যে এক দুরন্ত ঝড়ের সমাগম হয়েছে তার কোন আভাসই যেন জয়াকে স্পর্শ করছেনা। অনিক জয়াকে ভালমত খুঁটিয়ে দেখে; বাংলা কায়দায় সবুজ-হলুদ একটি ডুরে শাড়ি পড়েছে মেয়েটি, সাথে সবুজ ব্লাউস; ভাবে কতই বা বয়স হবে, ১৬ থেকে একদিনও বেশি হবে বলে মনে হয়না। কিন্তু এই উঠতি বয়সেই রপের এই সমাহার, এই মোহনীয় উপস্থিতি এমনি আচ্ছন্ন করেছে অনিককে যে সে আর সোজা ভাবতে পারছেনা, তার ভাবনাগুলো গুলিয়ে আসছে।
সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে, অনিকদের দ্রুত ফিরতে হবে কারন পূর্ব বীচের এদিকে বৈদ্যুতিক আলো না থাকায় সূর্যাস্তের পরপরই চারদিক দ্রুত অন্ধকার হয়ে আসে। তারা উঠে দাড়িয়ে সাইকেলের উপর চেপে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। অনিক ঘাড় ঘুরিয়ে জয়ার দিকে তাকায়; দেখে জয়া তার দিকেই তাকিয়ে আছে। গোধূলিলগ্নের উদ্ভাসিত হ্যাজাক বাতির মতো আলোয় জয়ার কোকিল-কালো চোখে বেদনাক্রান্ত অস্ফুট ঘন হয়ে আসা এক আর্তি যেন সে দেখতে পায়। অনিক লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জয়াকে উদ্দেশ্য করে এই প্রথম তার ভারী পুরুষালি কণ্ঠে বলে উঠে, "জয়া, আমরা তাহলে আসি।"
"দাদাবাবু, আপনারা কি বাজারে যাচ্ছেন?", চকিত প্রশ্নটি করে বসে মেয়েটি।
"হ্যা, বাজার হয়েই তো যেতে হবে।"
মেয়েটি এক মুহূর্ত নিচে তাকিয়ে কি একটা ভেবে নিয়ে বলে,”দাদাবাবু আমাকে বাজার পর্যন্ত একটু এগিয়ে দিবেন?”
অনিক কিছু বলেনা, মূর্তির মতো জয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। সামাদ জয়ার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “তা কি করে হবে জয়া, সাইকেলগুলোতে বসার তো তেমন কোন জায়গা নেই।“
আসলে তারা যে সাইকেলগুলোতে চেপেছিল সেগুলো ছিল ক্যারিয়ার বিহীন দুরন্ত ব্র্যান্ডের। সামদের এই অভিযোগে জয়ার শান দেয়া কাস্তের মতো টানা কালো ভ্রুযুগল কিছুটা কুঞ্চিত হয়ে কপালে অস্পষ্ট কিছু রেখা উৎপন্ন করে। জয়ার মুখের এই উদ্বিগ্ন ভাবের মধ্যেও এক অনন্যদৃষ্ট সৌন্দর্যের আভাস পেয়ে অনিক বিহ্বলের মতো তাকে দেখতে থাকে। অনিকের মনে হয় এই উদ্বিগ্ন, কুঞ্চিত ভ্রু মুখভঙ্গিতে জয়াকে যেন স্ফুটনোন্মুখ এক জবার মতো লাগছে,নিজের পরিস্ফুটনের সম্ভাবনায় যে ব্যাকুল হয়ে আছে।
এর মাঝে জয়ার পিছন থেকে তাকে পাশ কাটিয়ে জসীম দৌড়ে এসে সামাদের সাইকেলের কাছে গিয়ে সামাদকে কিছু বুঝতে না দিয়েই তার লাল-কাল সাইকেলের সীটের সামনে হাতল ধরে লাফিয়ে সেটার উপর পাশ ফিরে বসে পড়ে। সামাদ থতমত হয়ে জসীমকে বলল, ”এই খোকা, করছ কি তুমি!”
জসীম হাসি হাসি মুখে মাথা ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে বলল , ”সাইকেলে চড়লাম, চল টেনে নিয়ে চল এবার।“
জয়া লজ্জিত হয়ে জসীমের দিকে মাথা উচিয়ে শাসিয়ে বলল, “এই জসীম, নেমে আয় বলছি। বাবুদের বিরক্ত করিস না। “
জসীম নেমে আসে না বরং সামনে হেলে পড়ে হ্যান্ডেল ধরে বসে থাকে। নিজের প্রতি জসীমের এই উদাসীনতা লক্ষ্য করে জয়া বলল, ”আসলে ওর সাইকেলে চড়ে ঘুরে বেড়াবার খুব শখ তো তাই সাইকেলে উঠলে আর সহজে নামতে চায়না।“
মাসুদ এর মাঝে বলে বসল, “তো থাকুক না জসীম সাইকেলে, ওকে আমরা কিছুটা ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। কি জসীম, যাবে আমাদের সাথে?“
জসীম মাসুদের দিকে তাকিয়ে বলে যে সে সাইকেলে ঘুরবে, কিন্তু সাথে দিদিকেও নিতে হবে।
জয়া সাফাই গাওয়ার মতো করে বলল, “আসলে নতুন কারো সাথে একা কোথাও গেলে ও ভয় পায়, কান্না করে, পরিচিত কেও থাকলে ভালো হয় আরকি।“
সামাদ এরপর কিছুটা বিরক্তি চাপা দিয়ে বলল, “আপনাকে কি করে নিয়ে যাই বলুন তো, একে তো সাইকেলে বসার মতো ব্যাবস্থা নেই, আর তাছাড়া আপনার পরিচিত কেউ আমাদের সাথে আপনাকে দেখলেও বা কি ভাববে।“
জয়া বলল, “আসলে সন্ধ্যার সময় এদিকে গাঁয়ের তেমন কেউই আসেনা, এদিকটা ফাঁকাই থাকে; মাঝিরা তাদের নৌকা নিতে বের হয় মাঝরাতের আগে আগে, আর আপনারা আমায় বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিলে আমার বেশ উপকার হবে, নাহয় এই লম্বা পথ একা হেঁটে যেতে হবে আমায়। আর আমার ঠিকঠাক বসার জন্যে বেশি ভাববেন না আপনারা। আমরা গাঁয়ের মেয়ে, ওভাবে সাইকেলে চেপে যাওয়ার অভ্যেস আছে আমার।“
সামাদের জয়াকে নিজেদের সাথে এভাবে সাইকেলে চড়িয়ে নিয়ে যাওয়ায় আপত্তি থাকা সত্ত্বেও শেষমেশ জয়ার এই লম্বা পথ হেঁটে যাওয়ার অসুবিধার কথা ভেবে নিজেকে রাজি করে জয়াকে সাইকেলে উঠে পড়তে বলে।
জয়া তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে এগিয়ে এসে অনিকের সাইকেলের সামনে এসে দাঁড়ায়। অনিক জয়ার দিকে তাকিয়ে কি একটা ভেবে নিয়ে তার বাম পা খানিকটা সামনে এগিয়ে নিয়ে সাইকেলটা হেলিয়ে জয়াকে উঠতে বলে। জয়া সাইকেলের পাশে এসে পিছনে ঘুরে হাতল ধরে উঠার চেষ্টা করতেই অনিক তার অসুবিধা বুঝতে পেরে তার কোমর দুপাশে আঁকড়ে ধরে তাকে ধীরে ঝাঁপ দিতে বলে। জয়া কথামতো ঝাঁপ দিয়ে সাইকেলে উঠে পড়ে। জয়ার কোমর স্পর্শ করা মাত্রই এক অন্যরকম অনুভূতি বন্যায় নদীর উপচে পড়া জলের মতই অনিকের শরীরের প্রতিটি আনাচে কানাচে বইতে শুরু করে দেয়, বানের জলের মতই এই ভালো লাগার অনভুতি তার ভাবনার কূল ছাপিয়ে তাকে দ্রুত বেগে সিক্ত করে পিছনে ঠেলে দিয়ে তার সর্বাঙ্গ শিথিল করে ফেলে। সেই ভরপুর স্রোতের আঘাতে তার ঘাড় ঢিলে হয়ে উত্তাল সুখের স্পর্শে মাথা পিছনে হেলে গিয়ে সে সম্পূর্ণ বিবশ হয়ে পড়ে। অজান্তেই তার মনে খেয়াল জাগে যে জয়ার কোমরের দুপাশের মাংসগুলো কি নরম! একদম যেন ননী দিয়ে গড়ে চমৎকার এক আকৃতি দিয়েছেন কোন মহান কলাকুশলী পাচক। সামাদের কথায় তার সম্বিৎ ফিরে আসে। সামাদ তার দিকে তাকিয়ে বলে, “চল আগাই তাহলে। সাবধানে ধীরে ধীরে চালাস। তাড়াহুড়োর প্রয়োজন নেই।“
অনিক তার বাম পা কাছে টেনে এনে সাইকেল সোজা করে দুহাতে হাতল ধরতে গেলে জয়ার শরীরের সাথে তার দু হাতেরই আলতো ঘষা লাগে, সামনে হেলে পড়ার কারণে অনিকের বুকের সাথেও জয়ার কাঁধে ঘষা লাগছিল। অনিক দেখতে পায় জয়া শিউরে উঠে তার কাঁধটা একটু পিছনের দিকে ঠেলে দেয়। অনিক জয়াকে জিজ্ঞেস করে সে সুবিধামত বসেছে কিনা; জয়া এর উত্তরে উঁহু বলে ঘাড় হালকা কাত করতেই অনিক তাকে হ্যান্ডেল দুহাতে শক্ত করে ধরতে বলে প্যাডেল মেরে সামনে এগুতে থাকে।