Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
25-02-2019, 12:20 PM
(This post was last modified: 25-02-2019, 01:03 PM by pcirma. Edited 1 time in total. Edited 1 time in total.)
মৌ কথা কও
Raunak_3
মৌ কথা কও
<<<<<< এই গল্পের সমস্ত ঘটনাবলী ও চরিত্র সম্পুর্নভাবে কাল্পনিক।জীবিত বা মৃত কোনো ব্যাক্তি অথবা কোনো ঘটনার সাথে মিল খুঁজে পেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। >>>>>>
সল্টলেকের অফিস থেকে বেরিয়ে অফিসের গাড়ী করে উল্টোডাঙ্গা স্টশনে পৌঁছোতে প্রায় ন টা বাজলো অরিত্রর। চারিদিকে লোকে লোকারন্য, দেড় ঘন্টা হয়ে গেছে নাকি কোনো আপ ট্রেন আসেনি। ডাউন ট্রেনের ও একই অবস্থা…এখানেই যদি এই অবস্থা হয় তাহলে শিয়ালদা স্টেশনে কি হতে পারে আর এর পরে যে ট্রেন আসবে তাতে কোনো মতেই যে ওঠা যাবেনা সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে শিয়ালদা চলে যাওয়া ভালো, কয়েক টা ট্রেন ছেড়ে তার পর না হয় ওঠা যাবে ভেবে স্টেশনের বাইরে এসে বাস ধরে শিয়ালদা পৌঁছে দেখলো একই অবস্থা, স্টেশনে ঢোকার মতো অবস্থা নেই। বাড়ীতে একটা ফোন করে জানিয়ে দেওয়া ভালো মনে করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মোবাইল টা নেই…এই নিয়ে পাঁচবার হল…কখন যে তুলে নেয় বোঝাই যায় না। যাক খুব একটা দামী ছিল না, আর একটা কিনে নেওয়া যাবে ভেবে বুথে গিয়ে ফোন করল, দিদান ফোন টা রিসিভ করলে মোটামুটি বুঝিয়ে বলে দিল…ট্রেনের গন্ডগোল আছে… দেরী হবে ফিরতে…তোমরা খেয়ে শুয়ে পড়, যা অবস্থা তাতে কত রাতে পৌঁছব, বলতে পারছি না। দিদান শুনে বলল…খুব অসুবিধা দেখলে ও যেন ভবানীপুরের বাড়ী চলে যায়। অরিত্র…কোনো দরকার নেই…আমি ঠিক চলে যাবো বলাতে দিদান বলল…আমি তোর দাদু কে বলছি নারায়ন কে খবর দিয়ে রাখতে, যত রাত হোক ও তোকে স্টেশন থেকে নিয়ে আসবে।
কি দরকার আবার বুড়ো মানুষটাকে বিব্রত করে, সারাদিন রিকশা টেনে একটু তো বিশ্রাম নিতে দাও, দাদু বললে তো আবারনা করতে পারবে না।
দিদান বললো…তোকে ওসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, তুই তো জানিস নারায়ন তোকে কত ভালোবাসে।
আরো ঘন্টা খানেক অপেক্ষা করার পর জানা গেল কিছুক্ষনের মধ্যেই রানাঘাট লোকাল ছাড়বে, আরো দু একটা ট্রেন না ছাড়লে গিয়ে লাভ নেই দেখে চা খেয়ে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর মনে হল ভীড়টা একটু হালকা হয়ে গেছে। গোটা তিনেক ট্রেন ছাড়ার পর, এবারে স্টেশনে ঢোকা যেতে পারে দেখে স্টেশনে ঢুকে প রের ট্রেন টাতে কোনো রকমে ধাক্কাধাক্কি করে একটা কামরায় উঠতে পারলেও ভেতরে যাবার কোনো উপায় নেই, অগত্যা একটু একটু করে দরজার পাশে যতটা যাওয়া যায় চেপে গিয়ে খুব কপাল ভালো পার্টিশান টায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াতে পারলো। একে ওই রকম ভীড় তার উপরে আবার কামরা টার বেশ কয়েক টা আলো জ্বলছে না। যে কটা জ্বলছে তার আলো ভীড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে, বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর একটু একটু করে ট্রেন এগোতে শুরু করল, যত টা না এগোয়,তার থেকে বেশী দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে দমদম পৌঁছোল রাত প্রায় বারোটা, আধো আলো, আধো অন্ধকারে ঠিক মতো বোঝা না গেলেও খেয়াল করে দেখলো ওর বুকের উপরে মাথা রেখে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, কি করবে, কিছু করার তো নেই ভেবে ওদিকে আর মন দিলো না, ট্রেনে ভীড় থাকলে হতেই পারে।ট্রেন টা ব্যারাকপুর ছাড়লো, ভীড়টা একটুও কমেনি। ট্রেন টা যেভাবে এগোচ্ছে, দুটোর আগে মনে হয় না বাড়ী পৌছোতে পারবে ভাবতে ভাবতে মেয়েটার খেয়াল করে দেখতে গিয়ে মনে হল, ঘুমিয়ে গেছে। এ কি রে বাবা, এতো ভীড়ে ঘুমোচ্ছে কি করে? ওর স্টেশন পেরিয়ে যায়নি তো ভেবে কাঁধে হাত দিয়ে একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…এই যে শুনছেন…কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। পাশ থেকে একজন টিপুন্নি কাটলো…কি দরকার ডাকার, ঘুমোচ্ছে যখন ঘুমোতে দিন না, আর আপনার তো কোনো ক্ষতি দেখছি না।লোকটার কথা শুনে গা পিত্তি জ্বলে গেলেও জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকলো।পরের স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়াতেই বেশ কিছু প্যাসেঞ্জার নামতে শুরু করল ধাক্কাধাক্কি করতে করতে, মেয়েটা প্রায় ছিটকে পড়ে যাচ্ছে দেখে কোনোরকমে হাত দিয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে থেকে একটু একটু করে নিজের পাশে নিয়ে আসার চেষ্টা করে পার্টিশানের গায়ে নিয়ে এসে অনেকটা নিশ্চিন্ত হল। পাশ থেকে একজন বলল…এতো মনে হচ্ছে ঘুমোচ্ছে না, দেখুন আবার বেঁচে আছে কিনা…আজকাল কি যে হচ্ছেবোঝা খুব মুশকিল। লোকটার কথা শুনে একটা ঠান্ডা স্রোত শির দাঁড়া দিয়ে নেমে গেল, কোনোরকমে মেয়েটার একটা হাত ধরে বুঝলো…খুব আস্তে আস্তে পালস চলছে। যাক, বেঁচে আছে কিন্তুকি করা যায় ভাবছিল। দু এক জন বলল এক কাজ করুন স্টেশনে নেমে পুলিশের কাছে জমা করে দিয়ে আপনি আপনার মতো বাড়ী চলে যান। কোথাকার জল কোথায় গড়াবে কে জানে, কি দরকার বেশী ঝামেলায় যাবার।
পরের স্টেশনেই ওকে নামতে হবে, এই অবস্থায় অসহায় মেয়েটাকে এত রাতে এইভাবে ফেলে যাওয়া টা কেমন যেন অমানবিক মনে হল। আগে তো নামাই তারপরে দেখা যাবে ভেবে পাশের একজনকে অনুরোধ করল যদি একটু হেল্প করে নামাতে। হুড়োহুড়ি করে সবাই নেমে যাবার পর ধরাধরি করে কোনোরকমে নামিয়ে কপাল ভালো ছিল একটা বসার জায়গা পেয়ে ওখানে বসিয়ে দিয়ে একটু দম নিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালো, ঘাড় কাত করে বসে আছে…মানে যেভাবে বসানো হয়েছিল সেই ভাবেই আছে। এদিক ওদিক তাকালো কাউকে যদি পাওয়া যায়, সবাই যেভাবে তাড়াতাড়ি করে চলে যাচ্ছে তাতে হেল্প করার কথা শুনলে হয়তো তেড়ে আসবে ভেবে আর সাহস হোল না। এতটা রাস্তা ওই ভীড়ে দাঁড়িয়ে আসতে হয়েছে, নিজের ই শরীরের অবস্থা খারাপ, ভীষন ক্লান্ত লাগছে…একটু বসে জিরিয়ে নি ভেবে মেয়েটার পাশে বসে পড়ল, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল একটা জলের কল আছে, উঠে গিয়ে জল খেয়ে মাথায় ঘাড়ে জল দিয়ে একটু সুস্থ বোধ হলে ফিরে এসে বসে ভাবছিল…কি করবে…মেয়েটাকে ডাক্তার দেখানো দরকার মনে হচ্ছে, পুলিশের কাছে দিলে তো ফেলে রেখে দেবে অথবা একলা মেয়ে পেয়ে হয়তো আরো কিছু করতে পারে। হসপিটালে নিয়ে গেলেই ভালো ভেবে উঠে পড়ল কিন্তু কি করে স্টেশনের বাইরে নিয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে নারায়ন দার কথা মনে পড়ল। দিদান তো বলেছিল নারায়ন দা অপেক্ষা করবে, কিন্তু নারায়ণ দা তো আর জানে না কোন ট্রেনে ফিরবে…হয়তো ওকে দেখতে না পেয়ে ভেবেছে পরের কোনো ট্রেনে আসবে আর তাই ভেবে অন্য কোনো প্যাসেঞ্জার নিয়ে চলে গেছে। ধুস, কি যে ঝামেলায় পড়লাম ভালোমানুষী করতে গিয়ে ভেবে নিজের উপরই রাগ হয়ে গেল। আরো কিছুক্ষন চুপচাপ বসে থাকার পর মেয়েটার দিকে তাকালো… দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ ভালো বাড়ীর মেয়ে, মুখটা বেশ মিষ্টি…চেহারাতে বেশ একটা মাধুর্য আছে…দেখে মনে হচ্ছে না কুড়ি বাইশের বেশী বয়স হবে… একটু ঝাঁকিয়ে ডাকলো…কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না দেখে কি করবে ভাবতে ভাবতে দেখা যাক একাই নিয়ে যাওয়া যায় কিনা... দু হাতে করে তুলে নিয়ে দেখলো … নাঃ, খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না, জোরে পা চালিয়ে স্টেশনের বাইরে এসে দেখলো একটাই রিকসা দাঁড়িয়ে আছে, যাক বাঁচা গেল, হসপিটালে নিয়ে যেতে পারবে ভেবে ওটার কাছে গিয়ে অনেক টা নিশ্চিন্ত বোধ করল… নারায়ন দার রিক্সা…বুড়ো মানুষটা পাদানিতে বসে ঢুলছে।
ও নারায়ন দা ওঠো…বলে জোরে ডাকতেই নারায়ন দা ধড়পড় করে উঠে পড়ে ওকে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে বলল…আরে, এ আবারকে তোমার সাথে?
তুমি আগে একটু ধর, সিটে বসিয়ে দি…
দুজনে মিলে ধরাধরি করে কোনোরকমে সিটে বসিয়ে হুড টা উঠিয়ে দিয়ে ওতে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিয়ে নিজে উঠে মেয়েটাকে ধরে বসে বলল…নারায়ন দা…হসপিটালের দিকে চলো।
আগে তুমি বলোতো…কি ব্যাপার,মেয়েটা কে আর তোমার সাথেই বা কেন।
নারায়ন দা কে ও কখোনোই রিক্সাওয়ালা হিসেবে দেখেনি, কিছুটা গুরুজনের চোখে দেখে বলে… কিছু মনে না করে…সংক্ষেপে সব টা বললে নারায়ন দা বললো হসপিটালে তো নিয়ে যাবে বলছো কিন্তু এখন কি আর ডাক্তার পাবে, সরকারী হাসপাতাল, ওদের আর কি কোনো দায়িত্ব আছে…সারারাত ফেলেই রেখে দেবে। কাল রাতেই তো আমাদের পাড়ার একটা বৌ কে নিয়ে গিয়েছিলাম…বরটা মদ খেয়ে এসে বেদম মার মেরে নাক মুখ ফাটিয়ে দিয়েছিল দেখে নিয়ে গেলাম…ভর্তি করা তো দুরের কথা কেউ একবার দেখলো না পর্যন্ত…নাইট ডিউটির ডাক্তার নাকি এসে বেরিয়ে গেছে… জোরজার করাতে বলল…অন্য কোথাও নিয়ে যেতে। তার থেকে চলো…বাড়ী নিয়ে যাই, বোস ডাক্তার তো তোমার দাদুর বন্ধু, ওনাকে ডাকলে নিশ্চয় না করবেন না। তুমি দাদাভাই একটা কাজ কর বাড়ীতে একটা ফোন করে বল ডাক্তার বাবুকে খবর দিয়ে রাখতে, আমি তোমাদের কে নামিয়ে দিয়ে ওনাকে তুলে নিয়ে আসবো।
ফোন কি আর আছে, ভীড়ের মাঝে তুলে নিয়েছে।
চলো তাহলে আগে বাড়ীর দিকে যাই তারপর দেখা যাবে… বলে নারায়ন দা রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে রওনা দিল। নারায়ন দা খুব সাবধানে চালালেও…মাঝে মাঝে রাস্তা খারাপ, তার উপর মেয়েটার জ্ঞান নেই…ধরে বসে থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছিল দেখে কোলের উপরে ওর মাথা রেখে শুইয়ে নিতে হল। দিদান এত রাতে না ঘুমিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, মাঝে মাঝেই দেরী হয়…কিন্তু আজ যেন খুব বেশী দেরি হচ্ছে ছেলেটার…তার উপরে আবার ফোনটাও হারিয়ে বসে আছে… ওদের কে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিলে দুজনে মিলে ধরাধরি করে মেয়েটাকে বাড়ীর ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফাতে শুইয়ে দিল, ততক্ষনে দাদু ও উঠে এসেছে…ওদের কে ঘটনা টা বলতেই দাদু তাড়াতাড়ি করে বোস ডাক্তার কে ফোন করে মোটামুটিভাবে কি হয়েছে বুঝিয়ে দিয়ে আসার জন্য বলে দিলে নারায়ন বেরিয়ে গেল নিয়ে আসার জন্য।
অরিত্র একটু জল খেয়ে নিজেই কফি বানিয়ে নিয়ে এলো, একেই রাত হয়েছে… মেয়েটার জন্য খুব টেনশান হচ্ছে…খারাপ কিছু হয়ে না যায়। ওদিকে দাদু খুব অধৈর্য হয়ে ঘরের ভেতরে পায়চারি করছে মাঝে মাঝে বারান্দায় গিয়ে দেখে আসছে ডাক্তার এলো কিনা। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে মেয়েটার চোখে মুখে জলের ছিটে দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে ভালো করে শুইয়ে দিয়ে জল খাওয়াবার চেষ্টা করছিল। ততক্ষনে ডাক্তার দাদু পৌছে গিয়েছেন… বেশ কিছুক্ষন দেখে একটা ইঞ্জেকশান দিয়ে দিলেন প্রথমেই… প্রেশক্রিপসান লিখে দিয়ে নিজেই ব্যাগ থেকে কিছু ওষুধ বের করে বললেন…এখুনি কিছু আনার দরকার নেই…এই ওষুধ গুলো কাল পর্যন্ত চলে যাবে…খুব একটা ভয়ের কিছু নেই, কয়েকদিন হয়তো খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করেনি বা টেনশান করে এই অবস্থা হয়েছে। মনে হচ্ছে বাড়ী থেকে পালিয়ে যাবার মতো কিছু ঘটনা থাকতে পারে। এখন কিছুটা গরম দুধ খাইয়ে দাও, আমি আরো কিছুক্ষন দেখে তারপর যাবো বলাতে শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে দুধ গরম করে নিয়ে এসে চামচে করে একটু একটু করে খাওয়াবার চেষ্টা করল…খুব বেশী না হলেও কিছুটা খাওয়ানো গেল। প্রায় এক ঘন্টা পর বোস দাদু আর একবার সবকিছু দেখে বললেন নাঃ…ঠিক ই আছে, পেশেন্ট রেসপন্স করছে… ভয় পাবার কিছু নেই, আমি কাল সকালে একবার এসে দেখে যাবো। কাল সকালে বরং পুলিশে একটা খবর দেওয়া ভালো… বলা তো যায়না… কোথা থেকে কি হয়ে যায়।
অরিত্রর স্নান করে অল্পছু খেয়ে নিতে নিতে রাত প্রায় চারটে বাজলো। মেয়েটাকে গেস্ট রুমে শুইয়ে দিয়ে ওখানেই শুক্লাদি বিছানা করে শুয়ে পড়েছে। প্রায় সারা রাত অনেক ধকল গেছে বলে সকাল সকাল ওকে আর কেউ ডাকেনি, প্রায় ন টা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গার পর উঠে… আগে গিয়ে মেয়েটা কেমন আছে দেখতে গেলো। পাশ ফিরে শুয়ে আছে…মিষ্টি মুখটাতে ভীষন ক্লান্তির ছাপ…শুক্লাদি জানালো ভোরের দিকে একবার চোখ খুলে তাকিয়ে ছিল কিন্তু আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। একটু নিশ্চিন্ত বোধ করে হাত মুখ ধুয়ে চা এর কাপ টা নিয়ে দাদুর কাছে গিয়ে বসে বলল…কি করা যায় বলোতো? পুলিশ কেখবর দেওয়া উচিত মনে হচ্ছে?
দাদু একটু ভেবে বলল…এখন থাক,আগে সুস্থ হোক, নাম ঠিকানা নিয়ে তারপর যা করার করা যাবে। এই অবস্থায় পুলিশে টানা হেঁচড়া করবে…আমার ঠিক ভালো লাগছে না… আমি না হয় একবার তোর বিশ্বাস কাকুর সাথে কথা বলে রাখবো।
বিস্বাস কাকু আবার কে জিজ্ঞেস করাতে দাদু বলল… আরে তুই ভুলে গেলি…আমার বন্ধু সজল বিশ্বাসের ছেলে… বেঙ্গল পুলিশে কাজ করে, এখন কুচবিহারের কোথাও একটা পোস্টিং…খুব শিগরিই নাকি বিধাননগরে ট্রান্সফার হয়ে চলে আসছে। তোর পাসপোর্ট করানোর সময় অনেক হেল্প করেছিল।
ও আচ্ছা…হ্যাঁ…আমি আসলে খেয়াল করিনি…
তুই আজ অফিস যাবি নাকি?
নাঃ…ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি…যাবো না…
সেই ভালো…মেয়েটার যা অবস্থা…কিছু হলে…আমরা বুড়োবুড়ি সামলাতে পারবো না…
মনে হচ্ছে…আর বাড়াবাড়ি হবেনা…আর ডাক্তার দাদু তো বললোই ভয়ের কিছু নেই।
তা অবশ্য বলেছে… এক কাজ কর দাদুভাই…কিছু খেয়ে একবার গাড়ীটা নিয়ে ডাক্তার কে নিয়ে চলে আয়।
অরিত্র খেয়ে উঠে বেরোতে যাবে এমন সময় নারায়ন দা ডাক্তার বাবুকে নিয়ে এসে হাজির। শুধু নিজে আসেনি, সাথে করে আবার কিছু টাটকা ফল ও নিয়ে এসেছে। দিদান বকাবকি করাতে বলল…আরে নিয়ে এসেছি তো কি হয়েছে, মেয়েটাকে দেখে কেমন যেন মায়া পড়ে গেছে। আমার নাতনি টা তো প্রায় ওর ই বয়সী।
দুপুরের একটু আগে মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গল… নড়াচড়া করার ক্ষমতা নেই… ভীষন দূর্বল…কিছুক্ষন শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর আর না পেরে চোখ বুজে ফেলল। দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে হালকা গরম জল দিয়ে হাতমুখ স্পঞ্জ করে দিয়ে কিছুটা গরম সুপ খাইয়ে ওষুধ খাওয়ানোর পর আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। পরেরদিন সকাল পর্যন্ত ওইভাবে মাঝে মাঝে চোখ মেলে তাকানো আর তারপরেই আবার ঘুমিয়ে পড়া চলল।দুপুরের পর থেকে মনে হচ্চিল যেন কিছুটা হলেও আগের থেকে ভালো… খুব সামান্য হলেও নড়াচড়া করতে পারছে… কিন্তু চোখের সেই শুন্য দৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই।
পরের দিন বিকেল, মেয়েটি চোখ মেলে তাকালো… শরীরটা খুব ভারী লাগছে। বোঝার চেষ্টা করল… কোথায় আছে। কেমন যেন অচেনা লাগছে সবকিছু… কিছুই বুঝতে পারছে না… চিন্তা করতে গেলেই মাথার ভেতরে কেমন যেন একটা যন্ত্রনা শুরু হয়ে যাচ্ছে। চুপচাপ শুয়ে থাকলে বরং কষ্ট হচ্ছে না…মনে হল কেউ এসে যেন আদর মাখানো গলায় বলছে… এই তো ঘুম ভেঙ্গেছে…কেমন আছো? এখন একটু ভালো লাগছে?
মাথাটা আস্তে আস্তে কাত করে দেখলো… অচেনা কেউ এক মহিলা… সারা মুখে স্নেহ মাখানো…ওর দিকে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করতে গেল…আমি কোথায়? ঠোঁট দুটো হয়তো একটু নড়ে উঠল কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোল না…আবার বলার চেষ্টা করলো… একই অবস্থা। ও যে চেষ্টা করছে কিছু বলার কিন্তু পারছে না… বুঝতে পেরে ওই মহিলা পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল… আচ্ছা…ঠিক আছে…থাক এখন কথা বলতে হবে না… শরীরটা এখোনো দূর্বল… আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। ওর দু চোখের কোন দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা করে জল বেরিয়ে আসতে শুরু করল… আমি কেন কথা বলতে পারছি না? আমি কোথায়? তুমি ই বা কে? আর তাকিয়ে থাকতে পারলো না…চোখ দুটো ভীষন ক্লান্তিতে বুজে এলো।
তারপর দিন সাতেক কেটে গেছে। মেয়েটা অনেক টাই সুস্থ হয়ে উঠেছে কিন্তু দুর্বলতা বেশ কিছুটা কমলেও পুরোপুরি কাটেনি,শুক্লা দি ওকে নিয়েই থাকে, স্নান করানো থেকে শুরু করে খাইয়ে দেওয়া সব কিছু নিজের হাতে সামলাচ্ছে। মুশকিল হয়েছে আজ পর্যন্ত একটা কথা বলেনি কিন্তু কিছু বললে বুঝতে পারে। প্রথম প্রথম নিজেকে খুব গুটিয়ে রেখেছিল কিন্তু আস্তে আস্তে অনেক টা স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, দিদান আর শুক্লাদি কে খুব পছন্দ করে, মাঝে সাঝে অল্প হাসিও দেখা যাছে মুখে কিন্তু বেশির ভাগ সময় কেমন যেন একটা বিষন্ন ভাব…কিছু জিজ্ঞেস করলে ভাবলেষহীন মুখে তাকিয়ে থাকে… ডাক্তারদাদু বলেছেন…হয়তো খুব বড় কিছু শক পেয়ে কথা বন্ধ হয়ে গেছে…আবার বোবাও হতে পারে… আরো কিছুদিন না গেলে বোঝা যাবে না। অরিত্র দুবেলাই ওকে একবার করে দেখে যাওয়া ছাড়াও সারাদিনে অন্তত এক দুবার অফিস থেকে ফোন করে খোঁজ নেয় কেমন আছে।
আরো কয়েক টা দিন কেটে গেছে, এখন আর সেই দুর্বলতা নেই, মাঝে মাঝে ঘরের এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে বেড়ায়…কিছু যেন একটা বোঝার চেষ্টা করে। গেস্টরুম থেকে ওকে সরিয়ে এখন দোতলায় অরিত্রর পাশের ঘরটায় রাখা হয়েছে যতটা সম্ভব পাড়া প্রতিবেশীর চোখের আড়াল করতে, সাথে শুক্লাদিকেও ওর সাথে উপরের ঘরে থাকতে হচ্ছে । দিদান ওকে নিজের অনেক দুর সম্পর্কের নাতনী বলে পরিচয় দিয়ে পাড়া প্রতিবেশির কৌতুহল এড়িয়ে গেছে।
একটা সমস্যা তো ছিলই কথা না বলা, তার সাথে এখন যোগ হয়েছে…মাঝে মাঝে রাত্রে কিছু একটা হয়, ঘুমোতে ঘুমোতে হঠাত ভয় পেয়ে ভীষন ছটপট করে। শুক্লাদি উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে অনেক কষ্টে ওকে স্বাভাবিক করার পর শুক্লাদি কে জড়ীয়ে ধরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, এক সপ্তাহের ভেতরে দিন তিনেক এরকম হওয়ার পর থেকে এখন শুক্লাদি ওর সাথেই শোয়। ডাক্তার দাদু এখন অনেক টাই নিশ্চিত যে মেয়েটার জীবনে কোনো একটা খারাপ কিছু ঘটেছিল বা ঘটতে যাচ্ছিল যার জেরে মানসিক ধাক্কায় এই অবস্থা।মাঝে একদিন একজন ডাক্তার দাদুর চেনা শোনা একজন কে নিয়ে আসা হয়েছিল যিনি ডিফ এন্ড ডাম্ব কলেজের শিক্ষক। ইশারায় ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে কোনো লাভ হয়নি, মাথা নেড়ে বুঝিয়েছিল ও কিছুই বুঝতে পারছে না, তার মানে ও বোবা নয়, আগে নিশ্চয় কথা বলতে পারতো, যদি তাই হোতো তাহলে ইশারায় কথা বলার ব্যাপার টা জানা থাকতো। মোটামুটি আরো কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে কলকাতার নাম করা একজন নিউরো আর সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো হয়েছে। নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা করার পর ওনারা বলেছেন… দেখা যাক…এই ওষুধ গুলো খাওয়ান। কি হবে… না হবে… বলা মুশকিল। তবে দেখবেন কোনো রকম মানসিক চাপ যেন না পড়ে।
এর মধ্যে অবশ্য বিশ্বাস কাকুর সাহায্য নিয়ে লালবাজার আর ভবানী ভবনের মাধ্যমে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে কোলকাতা বা কোলকাতার বাইরে কোনো থানায় হারিয়ে যাবার ডায়েরী করা হয়েছে কিনা কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এই পরিস্থিতিতে খবরের কাগজে বা টিভি তে বিজ্ঞাপন দিয়ে ওর পরিচিত জনের খোঁজ করার চিন্তাও বাতিল করতে হয়েছে কারন যদি এটা হয় যে ওর ক্ষতি করার চেষ্টা করা হয়েছিল আর তার জন্য ই ও কোনোরকমে পালিয়ে এসেছে…যারা ওর খোঁজ পেলে আবার ক্ষতি করতে পারে। এখন ওর থেকে কিছু জানার আগে আর কিছু করা উচিত হবে না ঠিক করে এটাও চেষ্টা করা হয়েছিল ওকে দিয়ে যদি লিখিয়ে জানা যায় ও কে। সে চেষ্টা ও বিফলে গেছে, কিছুই মনে করতে পারে নি…উলটে মনে করার চেষ্টা করতে গিয়ে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা পরিস্কার বোঝা যাচ্ছিল। ডাক্তার বাবুরা কোনো রকম মানসিক চাপ দিতে বারন করেছিলেন বলে খুব বেশী চেষ্টা ও করা যাচ্ছিল না। বিশ্বাস কাকুর ভরসায় পুলিশে খবর দেবার ব্যাপার টা নিয়ে এই মূর্হুতে তাই আর ভাবা হচ্ছিল না। তেমন কিছু যদি প্রয়োজন হয় তাহলে বলা যাবে যা কিছু করা হয়েছে তা নিতান্তই মানবিকতার কারনে…এর মধ্যে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই।
এক সাথেথাকতে থাকতে কবে যে মেয়েটা ওদের বাড়ীরই একজন হয়ে গেছে বোঝা যায়নি। কোন নাম নেই তাইদিদান ওর নাম রাখতে চেয়েছিল অনামিকা, যদি কোনোদিন ওর নিজের নাম জানা যায় সেদিন না হয়ওই নামে ডাকা যাবে কিন্তু এখন তো কিছু একটা বলে ডাকতে হবে। দাদু রাজী হয়নি, এত মিষ্টিমেয়ের নাম মধুমিতা ছাড়া আর কিছু নাকি হওয়া উচিত নয়…দুজনের কেউ কারুর কথা শুনতে রাজীনয়…শেষে অরিত্র র কথায় মৌ নাম রাখতে দুজনেই রাজী হয়েছে…কেউ ই নাতির কথা ফেলতে পারেনি।এখন মৌ বলে ডাকলে ও সাড়া দেয়, হয়তো বুঝেছে ওটাই ওর নাম।
কোনো এক রবিবার দুপুরে খাওয়ার পর অরিত্র ওর ঘরে প্রিয় কতগুলো রবীন্দ্র সংগীত চালিয়ে দিয়ে একটা গল্পের বই পড়ছিল। কি মনে করে দরজার দিকে তাকিয়ে মনে হল পর্দার ওদিকে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। কে হতে পারে? দিদান বা শুক্লাদি হলে তো বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে না আর ওদের তো এখন বিশ্রাম করার সময় ভেবে উঠে এসে দেখে মৌ চুপ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে, ঠোঁট দুটো অল্প অল্প নড়ছে, মনে হয় গানের কলি গুলো নিজেই গাওয়ার চেষ্টা করছে। অবাক হয়ে ওর এক মনে গান শোনা দেখে ভীষন ভালো লাগছিল ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে। গান টা শেষ হলে মৌ তাকিয়ে সামনে অরিত্র কে দেখে একটু অপ্রস্তুত হয়ে লজ্জায় মুখ নিচু করে নিলে অরিত্র ওকে ঘরের ভেতরে আসতে বলে পর্দা টা সরিয়ে দিল।ভেতরে আসতে চাইছিল না দেখে অরিত্র ওর হাত ধরে ভেতরে গিয়ে সোফাতে বসতে বলে একটু দুরে নিজেও বসে জিজ্ঞেস করল… তোমার গান শুনতে ভালো লাগছে?…তাই না? প্রথম প্রথম আপনি দিয়ে কথা বলতো …কিন্তু ওর যেন পছন্দ হয়নি…মাথা নেড়ে আপত্তি জানানোয় তুমি করে বলতে খুব খুশি হয়েছিল দেখে তারপর থেকে তুমি টাই চলছিল।
মুখ নিচু করে মাথা নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…
ঠিক আছে…তুমি এখানে বসে শোনো…আমি ছাদে যাচ্ছি… বেশ কয়েকদিন গাছ গুলো কেমন আছে দেখা হয়নি…
মাথা নেড়ে জানালো…না…
কেন? এখন ইচ্ছে করছে না শুনতে?
হ্যাঁ…
তাহলে?
মৌ উঠে গিয়ে বিছানা থেকে বই টা হাতে নিয়ে দেখালো…অরিত্রর বই পড়া ছেড়ে ছাদে যেতে হবে না।
ও আচ্ছা…আমি ছাদে যাবো না…তাইতো?
একটা মিষ্টি হাসি মুখে নিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…তাই…
ঠিক আছে আমি যাবো না…তুমি এখানে বোসো…আমিও বসছি…আমার পরে পড়লেও হবে।
মৌ প্রায় দিন দুপুরে অরিত্রর ঘরে বসে নিচু আওয়াজে গান শোনে…অবশ্য রবিবার টা বাদ দিয়ে কারন ওই দিন অরিত্র বাড়ীতে থাকে। ও আসার পর থেকে বাড়ীর সবার ছকে বাঁধা জীবন টা যেন এক ধাক্কায় একেবারে পালটে গেছে। শুধু শুক্লাদি নয়, দিদান আর দাদু দুজনেরই অনেক টা সময় ওর সাথে কাটে…অনেকটা বন্ধুর মতো সম্পর্ক তৈরী হয়ে উঠেছে। কথা না বলতে পারা বা বয়সের একটা বিশাল ফারাক কোনো বাধা হতে পারেনি সেই সম্পর্কে। সবারই যেন কেমন মায়া পড়ে গেছে ওর উপরে। অরিত্রর অফিস বেরোবার সময়ে ও দিদানের সাথে থাকে,দিদান যখন রোজকার মতো সাবধানে যাবি, দেরী হলে জানিয়ে দিবি বলে, পাশে দাঁড়িয়ে হাসি মুখে মৌ ওকে বিদায় জানায়। আজকাল অফিস বেরোবার সময়ে ওর ওই মিষ্টি হাসি টা দেখতে পাবে ভেবেই যেন অফিস বেরোতে ইচ্চে করে…অফিস থেকে ফিরতে কোনোদিন দেরী হলে খুব অস্থির হয়ে পড়ে, বারবার দিদানের কাছে গিয়ে জানার চেষ্টা করে কখন ফিরবে। বেশ কয়েকদিন দেরি করে ফেরার সময় রিকশা থেকে নেমে দেখেছে ওর ঘরের জানলা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে, ওকে দেখতে পেলেই তাড়াতাড়ি নেমে আসে নিচে, সারা মুখে একটু যেন বকুনি দেবার ইচ্ছে…কেন তুমি দেরী করলে? এর মাঝে আবার একদিন ট্রেনের গন্ডগোলে অনেক রাত হয়েছিল ফিরতে, বাড়ীতে ফোন করে জানাতে জানাতে অনেক টা দেরী হয়ে গিয়েছিল। দিদানের কাছে শুনলো…ও নাকি অরিত্রর ফোন আসার আগে দিদান কে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করেছে…গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোলেও চোখের জল বুঝিয়ে দিয়েছে ও কতটা কষ্ট পেয়েছে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি দিদান ওকে জোর করে শুতে পাঠিয়েছে না হলে সারাক্ষন নিচেই বসে ছিল। অরিত্র খেয়ে উপরে ওঠার সময় দেখলো মৌ ওর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে,সামনে গিয়ে দেরী হয়ে গেল বলাতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো…ওর যে ভীষন অভিমান হয়েছে বোঝাবার আর তো কোনো উপায় ছিল না। অরিত্র ওর হাত ধরে ঘরের ভেতরে গিয়ে বলল…সত্যি ভুল হয়ে গেছে…আর হবে না…এবার থেকে দেরী হলে আগেই জানিয়ে দেবো…কিছুতেই ওর দিকে তাকাচ্ছেনা দেখে অরিত্র ওর কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলল…এই…তাকাও আমার দিকে…। তাতেও তাকালো না দেখে ওর মুখ টা তুলে ধরে দেখলো…দু চোখে কান্নার আভাস। নিজের হাতে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল…এই…তাকাবে না আমার দিকে? আস্তে আস্তে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো…খুব ইচ্ছে করছিলো ওকে বুকে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল…এই তো আমি এসে গেছি…এখোনো…অভিমান করে থাকবে? ছোট্ট একটা নিস্বাস ফেলে কান্না ভরা চোখে নরম একটা হাসি মুখে নিয়ে বোঝালো…নাঃ…আমি আর অভিমান করে নেই…কিন্তু তুমি আর কখোনো আমাকে কষ্ট দেবে না। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছু না বলে…চোখের ভাষাতে হয়তো দুজনেই বুঝে নেবার চেষ্টা করছিল অন্যের বুকের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অজানা কথা গুলো।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
মৌ ফিরে গেছে নিজের ঘরে, রাত প্রায় দুটো বাজে, ঘুম আসছে না… মনের ভেতরে ভীষন ভালোলাগার একটা অনুভুতি… নিজের অজান্তে কবে যে ওর জন্য মনের ভেতরে একটা দুর্বলতা এসে গেছে বুঝতে পারেনি…এত দিনে হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসা এলো জীবনে…ভালোলাগার সাথে সাথে কোথাও যেন একটা কিন্তুর ছোঁয়া…। বর্ষা চলে যাবার কথা থাকলেও…যাই যাই করেও মাঝে মাঝে থমকে গিয়ে ফিরে আসছে কয়েক দিন ধরে…খোলা জানলার পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে কিছু হয়তো ভাবছিল… এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে ঘরের ভেতরে হুটোপুটি করে গেল… দুরে কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে… জানলার পাশে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অডিও সিস্টেমের দিকে চোখ পড়ল… S T A N D B Y… লেখাটা জ্বলছে নিভছে। মৌ হয়তো আজ গান শোনার পর বন্ধ করতে ভুলে গেছে, বন্ধ করে দি ভেবে এগিয়ে গিয়েও কি মনে করে রিমোটের পাওয়ার বাটন টা চাপলো… ডিসপ্লের উপর R E S U M E লেখাটা ভেসে উঠল…নিস্তব্ধ রাত… ঘরের মধ্যে 5:1 সিস্টেমে হাল্কা হলেও গমগমে আওয়াজ ভেসে এলো……
সখি ভাবনা কাহারে বলে… সখি যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বলো দিবস রজনী ভালোবাসা…ভালোবাসা
সখি ভালোবাসা কারে কয়? সেকি কেবলই যাতনাময়?
সে কি কেবলই চোখেরও জল?…সে কি কেবলই দুখেরও সাস?
লোকে তবে করে… কি সুখেরি তরে… এমন দুখেরও আস
আমার চোখে তো… সকলই শোভোন…সকলই নবীন… সকলই বিমল
সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন…বিষদ জ্যোছনা কুসুম কোমল… সকলই আমারই মতো…
তারা কেবলই হাসে, কেবলই গায়, হাসিয়া, খেলিয়া মরিতে চায়
না জানে বেদন, না জানে রোদন, না জানে সাধের যাতনা যতন
ফুল সে হাসিতে হাসিতে ঝরে, জ্যোছনা হাসিয়া মিলায়ে যায়,
হাসিতে হাসিতে আলোক সাগরে আকাশের ও তারা তেয়াগে তায়…।
আমার মতো সুখি কে আছে? আয় সখি আয় আমার কাছে… সুখী হৃদয়ের সুখের গান… শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রান
প্রতিদিন যদি কান্দিবি কেবল
একদিন নয় হাসিবি তোরা
একদিন নয় বিষাদ ভুলিয়া
সকলে মিলিয়া গাহিবো মোরা…
ভাবনা কাহারে বলে? সখি যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বল দিবস রজনী ভালোবাসা…ভালোবাসা, সখি ভালোবাসা কারে কয়?... সেকি কেবলই যাতনাময়?
বারবার শুনেও যেন মন ভরছিলনা…ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কতবার যে গানটা শুনলো নিজেই জানে না… বুকের ভেতরে ব্যাথা ভরা আনন্দ নিয়ে কোল বালিশটা বুকে জড়িয়ে ধরে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি।
পরের দিনটা ছিল রবিবার, অনেক রাতে শোবার জন্য স্বাভাবিক ভাবেই অরিত্র ঘুম থেকে উঠতে পারেনি সকাল সকাল, রবিবার সকালটা সাধারনত ওর দেরীই হয় উঠতে আর শুক্লাদির হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে দিন শুরু করে। আজ, কাঁধের উপরে অন্য কারুর হাতের ছোঁয়া, ওকে ঘুম থেকে ওঠাবার চেষ্টা করছে…আস্তে আস্তে চোখ মেলে দেখল…খুব প্রিয় একজনের মিষ্টি হাসি মাখা মুখ…যার কথা ভাবতে ভাবতে কাল রাতে স্বপ্নের দেশে চলে গিয়েছিল…দু চোখে অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে। বিছানায় উঠে বসে ওর হাত থেকে চায়ের কাপ টা নিয়ে জিজ্ঞেস করল…তুমি খেয়েছো?
মাথা নেড়ে জানালো…না…
খাবে না?
উত্তর টা… হ্যাঁ…বোঝার পর ওর আর বুঝতে অসুবিধা হোলো না কেন ও আগে খায়নি…তোমার চা নিয়ে এসো…এক সাথে খাবো আজ…বলাতে ফিরে যাচ্ছিল…শুক্লাদি চায়ের কাপ টা নিয়ে ঘরে ঢুকে বলল…থাক আর যেতে হবে না…এই নে। অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল…এবার থেকে আর দেরী করে উঠলে হবে না…তুই না ওঠা পর্যন্ত মেয়েটা কিছুতেই চা খেলো না আজ।
শুক্লাদির কথা টা শুনে ওর দিকে তাকালে লাজুক হাসি মুখে নিয়ে মুখ নামিয়ে নিল, যেন বলতে চাইছে…ইস… কি লজ্জা…সবাই বুঝে গেছে।
চা খেতে খেতে দুজনে দুজনের দিকে তাকাচ্ছিল অনেক টা চুরি করে, মাঝে মাঝে কেউ অন্যের কাছে ধরা পড়ে গিয়ে লাজুক হাসি হেসে বোঝাবার চেষ্টা করছিল শুধু আমি নই…তুমিও আমার দিকে তাকাচ্ছো চুরি করে। ওর দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল…কয়েক দিন আগে দিদান বলেছিল…ছুটির দিন দেখে ওকে সাথে করে নিয়ে গিয়ে কিছু ভালো জামাকাপড় নিয়ে আসার ব্যাপারে…প্রথম দিনের তাড়াহুড়ো করে নিয়ে আসা সেই তিনটে আর ওর নিজের ওই দিনের পরে থাকা একটা…মোট চারটে সেট সালোয়ার কামিজ ছাড়া আর কিছু নেই…ওগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরে যেতে হচ্ছে। আজ বিকেলে তোমাকে নিয়ে বেরোবো বলাতে চোখ মুখ উজ্বল হয়েউঠল…জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিত্র হাসি মুখে বলল…উঁ হুঁ…এখন বলবো না…কোথায় যাবো…
মুখের ভাব পালটে যেন বলল…প্লিজ…বলোনা…
বলতেই হবে? জিজ্ঞেস করাতে হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল।
হুমম…আজ আমি তোমাকে নিয়ে কোথাও একটা যাবো…
নিজের দিকে আর অরিত্রর দিকেআঙ্গুল দেখিয়ে বোঝালো…শুধু তুমি আর আমি?
হ্যাঁ বলাতে…মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো…আমার ভীষন আনন্দ হচ্ছে…আজ আমি তোমার সাথে একা একা বেড়াতে যাবো।
দুটো নাগাদ মৌকে নিয়ে বেরোল,ব্যারাকপুরে গিয়ে কেনাকাটা করে ইচ্ছে আছে গান্ধীঘাটে কিছুটা সময় কাটিয়ে সন্ধের দিকে বাড়ী ফেরার। রবিবারের দুপুর…রাস্তা বেশ ফাঁকা…তবুও বেশ ধীরে সুস্থে ড্রাইভ করতে করতে এগোচ্ছিল…বাইরের হাওয়া খোলা জানলার ভেতরে দিয়ে ভেতরে এসে ওর রেশম কোমল চুলের সাথে দুষ্টুমি করে এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে…অবাধ্য চুল চোখ মুখের উপর থেকে সরাতে সরাতে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে… সারা মুখে ভীষন খুশীর ছোঁয়া…ভাবখানা যেন…শুধু তুমি আর আমি…আর কেউ নেই কোথাও… মাঝে মাঝে ওর দিকে সকালের মতো চুরি করে তাকাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেলে… চোখ পাকিয়ে যেন বলতে চাইছে…এই…এখন একদম আমার দিকে তাকাবে না… মন দিয়ে গাড়ী চালাও…কিছু হয়ে গেলে?
একটা মোটামুটি বড় দোকান দেখে ভেতরে গিয়ে দেখে যতটা খালি হবে ভেবেছিল এই দুপুরে ততটা নেই, বোধ হয় পূজো আর ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে গেছে। দোকান টা অনেক টা শপিং মলের মতো…এক এক জায়গায় এক একরকমের জামাকাপড় সাজানো আছে…নিজেই পছন্দ করে নেওয়া যাবে। মেয়েদের জামাকাপড়ের জায়গায় যেন আরো বেশী ভীড়, মৌ দোকানে ঢোকার আগে থেকেই ওর হাত টা শক্ত করে চেপে ধরেছিল…ভাবখানা যেন হাত ছেড়ে দিলেই ও হারিয়ে যেতে পারে। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে অরিত্র বললো…আমি কিন্তু মেয়েদের জামাকাপড়ের কিছুই বুঝি না…তোমাকেই দেখে নিতে হবে। ওর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো…তোমার যেটা ভালো লাগবে, সেটাই আমি নেবো। অরিত্র মনে মনে ভাবলো…জানি না কেন তুমি আমার উপরে এত নির্ভর করতে চাইছো…কেন এত কাছে আসতে চাইছো… এই কয়েকটা দিনের পরিচয়ে…জানিনা তুমি কে…তবুও তোমার কাছে আসতে মন চাইছে কিন্তু কি করে বোঝাই যে আমি ভীষন দুর্বল হয়ে পড়লেও এগোতে পারছি না… তোমার স্মৃতি ফিরে এলে তুমি কি আমাকে আর মনে রাখতে পারবে? বুকের ভেতরে নিজের কষ্ট চেপে রেখে হাসি মুখে বলল…আমাকে দেখে দিতে বলছো…তাই তো?
হাসি মুখে ঘাড় কাত করে জানালো…হ্যাঁ।
দুটো সালোয়ার সেট পছন্দ করার পর আর নিতে চাইছে না দেখে অনেক বোঝাতে হল যে…ইচ্ছে হলেই তো আর আসা যাবে না…তারপর পূজো আসছে…ওর কিছু ভালো জামাকাপড় লাগবেই…না হলে সাথে কি করে বেরোবে… বলাতে রাজী হল। বেশ কয়েক সেট দামী আর সব সময় বাড়ীতে পরার মতো জামা কাপড় নেওয়ার পর মনে পড়ল…আরে…ওর ভেতরে পরার যে কিছু নেওয়া হয়নি। জীবনে কোনোদিন ওসব কিনতে হয়নি…কি করা যায় ভাবতে ভাবতে ওকে নিয়ে এদিক ওদিক দেখে পেয়ে গেল কোথায় আছে। ভালোই হয়েছে সেলসগার্ল ও আছে…মৌকে নিয়ে এগিয়ে যেতে মেয়েটা জিজ্ঞেস করল… ম্যাডাম…কি লাগবে। অরিত্র একটু অস্বস্তির সাথে মেয়েটাকে বলল…ও কথা বলতে পারে না…আমিও ঠিক বলতে পারবো না কি সাইজ লাগবে…আপনি যদি একটু দেখে কয়েকটা ভালো দেখে ওর কি লাগবে দিয়ে দিতে পারেন খুব ভালো হয়। মেয়েটা ওর কথা শুনে যেন কিছুটা অবাক হয়ে গেল… ঈশ্বর কেন এত নিষ্টুর… এত সুন্দর …এত মিষ্টি…অথচ কথা বলতে পারে না… নিজেকে সামলে নিল… সেলসগার্লদের কে যে মুখে হাসি রাখতে হবেই…তা সে মনে যতই কষ্ট থাকুক…ওকে আস্বস্ত করে বলল…ঠিক আছে…আপনাকে চিন্তা করতে হবে না…আপনি শুধু বলে দিন কটা করে দেবো।মৌ লাজুক মুখে পাশে দাঁড়িয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বোঝাবার চেষ্টা করছিল…জানি আমার লাগবে কিন্তু তোমার সামনে কি করে নি বলোতো?
অরিত্র আস্তে করে ওকে বলল…তুমি দেখে নাও…আমি কাছেই আছি…তোমার হয়ে গেলে চলে আসবো।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও হাত ছাড়ছিল না দেখে অরিত্র হাসি মুখে বলল…হাত না ছাড়লে কি করে যাবো?
জামা কাপড়ের দোকান থেকে বেরিয়ে মৌ এর জন্য কিছু কসমেটিকস, ডিজাইনার অর্নামেন্টসআর জুতো কিনতে কিনতে প্রায় সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল। গান্ধীঘাটে গিয়ে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়ী ফেরার পর ওর যেন আর দেরী সহ্য হচ্ছিল না দিদান আর শুক্লাদিকে কি কি কেনা হয়েছে দেখাতে। দিদান দের সব জিনিষ গুলোই খুব পছন্দ হয়েছে বলাতে ও ইশারা করে দেখালো যে ও নয়,সব কিছুই অরিত্র পছন্দ করেছে প্রথমে তারপর ও দেখেছে।
কয়েক দিন পর… অরিত্র অফিসের টেবিলে মোবাইল টা ভুল করে ফেলে রেখে দিয়ে লাঞ্চে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে দেখে দুটো মিসড কল। রুপসা মানে ওর জ়েঠুতুতো বোন বম্বে থেকে ফোন করেছিল। ছিঃ…আমি যে কি…নিজেই বুঝতে পারি না…কতদিন হয়ে গেছে একটা ফোনও করিনি…অনেক আগেই করা উচিত ছিল আমার…ভেবে কল ব্যাক করল। রুপসা রিং হতে না হতেই রিসিভ করে ওর স্বভাব মতো বকতে শুরু করল একনাগাড়ে…তোর ব্যাপারটা কিরে দাদাভাই…প্রেম ট্রেম করছিস নাকি আজকাল…কতদিন হয়ে গেল ফোন করিস না…ভুলে গেলি নাকি আমাদের…তোর অফিস কেমন চলছে… তুই কেমন আছিস…দাদু দিদান আর শুক্লা দি কেমন আছে…পুজোয় কি কলকাতায় থাকছিস নাকি কোথাও বেড়াতে যাচ্ছিস?...বুঝলি দাদাভাই…মায়ের সাথে আজ সকালে খুব ঝগড়া করেছি…ভালো লাগছিল না…ভাবলাম…দাদাভাই এর সাথে একটু কথা বলি…মনটা হালকা হবে…কিছু লাভ হোলো না…রিং হয়ে গেল…তুই ধরলিই না…
রুপসা যেই একবার থেমেছে অমনি সুযোগ পেয়ে অরিত্র বলল…তুই এবারে থামবি… নাকি ফোন টা কেটে দেবো? মিটিং আছে…আমার এখন মাথা খারাপ করার একেবারে ইচ্ছে নেই।
প্লি…জ দাদাভাই…কাটিস না…বিশ্বাস কর… তোর কথা খুব মনে পড়ছে আজ। প্লিজ আমার সাথে একটু কথা বল। মন টা খুব খারাপ রে…
আচ্ছা…ঠিক আছে…কাটছি না…আমি না হয় ব্যাস্ত ছিলাম কিছুদিন…ফোন করিনি…তুই ও তো করতে পারতিস…
দাদাভাই…কি বললি? তুই ব্যাস্ত ছিলিস? কি নিয়ে রে?
পরে শুনিস…বল…তোরা কেমন আছিস…
এই দাদাভাই…প্লিজ বল না…তুই তো কিছু লুকোস না আমার কাছে…কি এমন হয়েছে পরে বলতে চাইছিস?
মোটামুটি ছোটো করে মৌ এর ব্যাপারটা বলার পর কিছুক্ষন চুপ করে থেকে হৈ হৈ করে উঠল রুপসা…বলছিস কি রে দাদাভাই…এতবড় খবর টা তুই বেমালুম চেপে গেছিস আমার কাছে…তুই তো হিন্দি সিনেমা কে হার মানিয়ে দিয়েছিস রে একেবারে…তো…এবারে কি? I love u বলেছিস? নাকি…একেবারে সানাই বাজার পরে বলবি?
ধুস…তুই ও যেমন…সে রকম কিছু নয়…
এই দাদাভাই…কেমন দেখতে রে…আমার থেকেও ভালো নিশ্চয়?
কি করে বলবো…তোর থেকে ভালো কিনা…তুই ও কি কম কিছু নাকি? তবে ভালোই…
হুম…তুই যখন ভালো বলেছিস…তাহলে তো একঘর হবেই…
এই রুপসা…তুই তো ছোটো থেকে বম্বে তে বড় হয়েছিস…এসব কোলকাতাইয়া ভাষা কোত্থেকে শিখলি রে?
ওঃ দাদাভাই…তুই না কিছুই মনে রাখতে পারিস না…রায় আঙ্কল কে ভুলে গেছিস? খুব মজার মজার কথা বলে…
ও আচ্ছা…হ্যাঁ রে…একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম। যাক গে… তোর কি খবর বল…
আমার আবার কি খবর থাকবে…চলছে…মাঝে মাঝে মায়ের সাথে লেগে যাচ্ছে…দুম দাম…ঢিস ঢাস…
কেন রে…কি হয়েছে?
আর বলিস না…মায়ের কোন বন্ধু নাকি দিল্লীর কে একটা ছেলের খোঁজ় দিয়েছে…very bright… passed fm IIM…Delhi…now in London…আমার সাথে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে…তুই বল দাদাভাই…আমি এখন বিয়ে করে কি করবো…সবে কেরিয়ার শুরু করতে যাচ্ছি…
হুম্…জেঠু কি বলছে?
বাবার কথা বলিস না…মায়ের কাছে মায়ের মতো…আর আমাকে বলছে…তুই তোর মতো থাক…ধুস আমার এক্কেবারে ভালো লাগছে না…ভাবছি…কদিন তোদের ওখান থেকে ঘুরে আসি…কতদিন দিদানের হাতের রান্না খাইনি…ছোড়দি ও বলছিল একবার যেতে…
খুব ভালো হবে রে…চলে আয়…
আমি তো না হয় যখন খুশী চলে যাবো…তুই ছুটি পাবি তো?
সে আমি ম্যানেজ করে নেবো…অনেকগুলো পিএল জমে আছে…অসুবিধা হবে না…
ঠিক আছে…বাবাকে ম্যানেজ করে তোকে জানিয়ে দেবো…খুব তাড়াতাড়িই যাবো…আমার কিন্তু খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে…
কাকে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে?
ধ্যত তেরি কি…তুই একটা বুদ্ধির ঢেঁকি…কাকে আবার দেখতে ইচ্ছে করবে…তোর…ওকে…মানে আমার পেয়ারী পেয়ারী বৌদি কে…বুঝলি?
এই রুপসা…ভালো হচ্ছে না কিন্তু…আমার ও মানে কি রে? কি বললাম…আর কি মানে করে বসে আছিস…
আমি যাই একবার…তারপর দেখছি…তোর ও… নাকি অন্য কিছু।
ঠিক আছে…তুই আয়…গাট্টা না খেলে তুই বকতেই থাকবি…পাগলী কোথাকার। এই…রুপসা…শোন না…বড়দি কেমন আছে রে?
দিদির কথা আর বলিস না…কাজকাম কিসসু নাই…জাম্বুর পয়সায় এখান ওখান ঘুরছে…খাচ্ছে… আর দিনে দিনে ফুলছে।
তা ভালো…বাচ্চা টা কেমন হয়েছে…খুব দুষ্টু…তাই না?
দুষ্টু বলে দুষ্টূ…মায়ের কথায়…এক্কেবারে নাকি তোর ছোটোবেলার কার্বন কপি…এই দাদাভাই…এখন রাখছি রে…মনে হয় মা ফিরে এসেছে…হাসিখুশী দেখলেই আবার বিয়ের কথা শুরু করবে…চুপচাপ মুখ গোমড়া করে শুয়ে থাকলে এখন আর জ্বালাবে না…রাতে ফোন করবো…ধরিস কিন্তু…টা টা…
রুপসা ফোনটা কেটে দেবার পর কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো… মনের ভেতরে ছোটো বোনের ইয়ার্কি করে বলা… ‘তোর ও’… ‘আমার পেয়ারী পেয়ারী বৌদি’…কথাগুলো যেন বারে বারে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে…বুকের ভেতরের খুশী… সারা মুখে উজ্জল হাসি ছড়িয়ে দিয়েছে…সম্বিত ফিরে এলো… ওর জুনিয়ার… পিয়াল হাসিমুখে সামনে দাঁড়িয়ে… Sir…any good newz? Another promotion?
না না…তেমন কিছু না…এমনি…একটা কথা মনে পড়ে গেল… বলো… মিটিং আছে…তাই তো?
হ্যাঁ…খুব টেনশান হচ্ছে…প্রেজেন্টেশানটা একবার দেখে নিলে ভালো হয়।
Don’t worry… আমার দেখা আছে…u just need 2 present as I told…i think boss wud be pleased to invite us fr dinner tonight…
পিয়াল হেসে ফেলে বলল… if so…credit will go entirely to u Sir.
পরের দিনই রুপসা আবার ফোন করল দুপুরে…পরের শনিবার সকালের ফ্লাইটে আসছে…কোলকাতা পৌঁছে আগে ভবানীপুরের বাড়ীতে যাবে…অফিস থেকে বেরিয়ে অরিত্র যেন ওকে নিয়ে আসে। বাড়ী ফিরে যদি বলতে ভুলে যায় ভেবে ও তখন ই দিদানকে ফোন করে জানিয়ে দিল যে রুপসা আসছে। দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল, রুপসা কে নিয়ে ট্রেনে ফিরতে অসুবিধা হবে বলে ও আজ গাড়ী নিয়েই অফিস চলে এসেছে। একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ল যাতে তাড়াতাড়ি ভবানীপুর থেকে বেরিয়ে পড়া যায়। ওখানে গিয়ে যতটা তাড়াতাড়ি বেরোতে পারবে ভেবেছিল তা আর হল না, ছোটো জেঠিমা আর পুবালীদি একেবারে ছেঁকে ধরল ওকে। কেন ও আসে না…মাঝে মাঝে তো আসতে পারে…ওরা কি পর নাকি…এটা তো ওর নিজেরই বাড়ী…এখানে এসে না থাকুক…ঘুরে যেতে কি অসুবিধা। কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়লো না…খেয়ে আরো কিছুক্ষন কাটিয়ে বেরোতে বেরোতে সাড়ে চারটে আর বাড়ী পৌঁছোতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে গেল। মাঝে একবার দাদুকে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে ওরা আসছে…না হলে চিন্তা করবে।
ভাইবোন এসে গেলে দিদান টিভিটা বন্ধ করে দিয়ে বলল… রুপসা…আয়..আয়…কতদিন পরে এলি…মনে পড়ে না নাকি রে এই বুড়ো বুড়ী গুলোকে?
রুপসা দিদান কে জড়িয়ে ধরে বলল… আমার ঠিক মনে পড়ে…তোমার নাতি বরং ভুলে যায়…জিজ্ঞেস কর…একটা ফোন পর্যন্ত করে কিনা…ভাগ্যিস আমি সেদিন ফোন করলাম…না হলে তো এত বড় খবরটা জানতেই পারতাম না।
শুক্লাদি কাছেই দাঁড়িয়েছিল…মৌ শুক্লাদির পেছনে থেকে চোখ বড় বড় করে রুপসা কে দেখছিল। সারা মুখে বেশ একটা কৌতুহল…দিদিটা কেমন হবে কে জানে…যদিও শুনেছে দিদিটা খুব মিশুকে…
রুপসা ওকে দেখতে পেয়েই তাড়াতাড়ি করে গিয়ে… হাত ধরে বলল… এই…তুমি মৌ… তাই না… চলো…আমি নিজেই আলাপ করে নিচ্ছি… আমি কে জানো তো?
রুপসা যে এত তাড়াতাড়ি ওকে কাছে টেনে নেবে বুঝতে পারেনি… কয়েকদিন ধরে শুনছে একটা ভালো দিদি আসবে… কিন্তু এত ভালো বুঝতে পারেনি। ঘাড় নেড়ে জানালো…ও জানে।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
দুটো অপরিচিত মেয়ে যে মন থেকে চাইলে কত তাড়াতাড়িকাছাকাছি চলে আসতে পারে তা বোধ হয় রুপসা আর মৌকে না দেখলে বোঝা যেত না। মৌ এর ঘরে বিছানায় বসে দুজনে আড্ডা দিচ্ছে…মনেই হচ্ছে না…ওদের একটু আগে দেখা হয়েছে… আর…ওদের একজন কথা বলতে পারে না। রুপসাই বেশি কথা বলছে…মৌ কখোনো হাসি মুখে…হাত বা মাথা নেড়ে ওর সাথে নীরবে কথা বলে যাচ্ছে।মাঝে একবার শুক্লাদি এসে ওদের কে কিছু স্ন্যকস আর কফি দিয়ে গিয়েছিল। অরিত্র ক্লাব থেকে ঘুরে এসে উপরে গিয়ে মৌ এর ঘরে উঁকি দিতেই রুপসা চেঁচিয়ে উঠল…এই দাদাভাই…ভেতরে আয় না…তুই কি রে…আমাদের কে ফেলে রেখে নিজে বেশ কেটে পড়লি।
আরে না…কেটে পড়িনি…পুজ়োর মিটিং ছিল…একবার মুখটা দেখিয়ে এলাম। তোরা তো শুনলাম…জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিস। তা…কি নিয়ে আড্ডা হচ্ছে শুনি।
রুপসা মুখটা একটু গম্ভীরকরে বলল…উঁ…হুঁ…তোকে বলা যাবে না…মেয়েদের গোপন আলোচনা ছেলেদের শুনতে নেই…জানিস না নাকি?
ঠিক আছে…আমি যাই…তোরা আড্ডা দে…
আরে বোস না…এমনি বললাম…আমাদের কি আবার গোপন কথা থাকতে পারে…তোকে নিয়েই কথা হচ্ছিল…
আমি আবার কি করলাম রে?
রুপসা চোখ ছোটো ছোটো করে বলল…ওঃ আমি আবার কি করলাম…এখন না হয় ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানিস না…ছোটো বেলায় কম দুষ্টু ছিলি নাকি…
মৌ অরিত্র আর রুপসার দিকে তাকাতে তাকাতে মুখ টিপে হাসছে দেখে অরিত্র বলল…একদম ওর কথায় বিস্বাস করবে না কিন্তু…সাঙ্ঘাতিক ফাজিল মেয়ে…
রুপসা ওর পিঠে একটা গাট্টা মেরে বলল…এই দাদাভাই…ভালো হবে না বলছি…আমি ফাজিল? আর তুই কি?
আমি আবার কি? আমি খুব ভালো…সবাই তো তাই বলে।
সে তো এখন বলে…তুই এত দুষ্টুমি করতিস যে দাদু তোকে দুষ্টূ বলে ডাকতো…ভুলে গেছিস নাকি?
ডাকতো কি রে…এখোনো মাঝে মাঝে ওই নামে ডাকে…
পরের দিন সকালে যথারীতি অরিত্র পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, রুপসা ওর কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে করে ঝাঁকালে চোখ খুলে একবার তাকিয়ে আবার ঘুমোবার জন্য চোখ বুজে ফেললো…রুপসা ধপাস করে ওর পাশে বসে পড়ে বলল…এই দাদাভাই ওঠ না…
অরিত্র কোল বালিশ টাকে আরো ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে পাশ ফিরতে ফিরতে বলল…আর একটু ঘুমোতে দে না বাবা…তাড়াতাড়ি উঠে কি করবো…
রুপসা ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে দুষ্টুমি করে বলল…তোর জন্য কেউ একজন আসছে…তাই তাড়াতাড়ি উঠবি…আর…কোলবালিশটা কে এমন করে জড়াবার কি আছে…বাড়ীতে তো একজন আছেই জড়িয়ে ধরার জন্য…তার কাছে যেতে পারছিস না?
এই…রুপসা…ভালো হবে না বলছি…
ইস…ভালো হবে না বলছি…কি করবি রে তুই আমার… ব্যাটা বুদ্ধুরাম…কিচ্ছু বুঝিস না…
অরিত্র ঘুরে শুয়ে রুপসার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল…খুব প্রিয় কেউ একজন হাতে একটা ট্রে…তিনটে চায়েরকাপ তাতে…ওর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে…
রবিবারের বাজার টা সাধারনত অরিত্র ই করে, মোটামুটি সারা সপ্তাহে কি কি লাগতে পারে দেখে নিয়ে চলে আসে। বাজার থেকে ফিরে ক্লাবে গিয়ে একবার ঘুরে এলো…কালচারাল প্রোগ্রামের মিটিং ছিল…এবারে ওকে জয়েন্ট সেক্রেটারী করে দিয়েছে জোর করে…না গেলে খারাপ দেখাতো…ক্লাব থেকে ফিরে এলে দিদান বললো…রুপসা তোকে দুবার খুঁজে গেছে…। ঘরে ঢুকে দেখে দুজনে কালকের মতো গল্প করছে…রুপসা সরে গিয়ে ওকে বসতে বলে বলল…খুব মজা করছি রে দাদাভাই…আমি কিন্তু সব বলে দিয়েছি…বলেই মুখ টিপে হাসতে শুরু করল…
সব বলে দিয়েছিস মানে…বুঝলাম না…কি বলেছিস?
আরে সেই যে তোর আমাদের বাড়ী থেকে পালাতে গিয়ে বাগানে পা মুচকে সারা রাত বৃষ্টির মধ্যে পড়ে থেকে ধুম জ্বর এসে গিয়েছিল…
অরিত্র হেসে ফেলে বলল…ও আচ্ছা…কি জন্য পালাতে গিয়েছিলাম সেটাও বলেছিস নাকি?
বলবো না মানে…ওটাই তো আসল ব্যাপার…না বললে কি করে বুঝবে।
রুপসা…তুই না একটা যা তা…লজ্জা বলে কিছু নেই…ওটা আবার কেউ বলে নাকি।
রুপসা হেসে ফেলে বলল…দাদাভাই…মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানিস? তুই বোধ হয় ছেলেদের মতো দেখতে একটা মেয়ে... তোকে চুমু খেতে ইচ্ছে হয়েছিল…তাই খেয়েছিলাম…এতে আবার লজ্জার কি আছে? বয়স কম ছিল…
থাক তোকে আর পাকামো করতে হবে না…নিজের মাথা টা খারাপ আর এখন ওর মাথা টা খারাপ করছিস।
রুপসা মৌ এর দিকে তাকিয়ে বলল…জানো তো…দাদাভাই তার পর প্রায় এক বছর আমার সাথে কথা বলেনি…কত সাধ্য সাধনা করে যে বাবুর রাগ ভাঙ্গাতে হয়েছিল সে আমি জানি…
রবিবার দুপুরে এমনিতে খেতে কিছুটা দেরী হয়, আজ দিদান আর শুক্লাদি দুজনে মিলে রুপসা এসেছে বলে অনেক রকম রান্না করতে গিয়ে আরো একটু বেশী দেরী হয়ে গিয়েছিল। অরিত্র খাওয়ার পর কিছুক্ষন গড়িয়ে নিয়ে উঠে পড়ল, সবাই বোধ হয় ঘুমোচ্ছে ভেবে ছাদে গিয়ে চুপ করে নদীর দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল…মাঝে মাঝে মনটা খুব অশান্ত হয়ে উঠছে…কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছিল না…কখন যে রুপসা এসেছে বুঝতে পারেনি। রুপসার ডাকে ফিরে তাকালো…কি রে দাদাভাই…কি ভাবছিস?
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…না…সেরকম কিছু না…এমনি ই ঘুম আসছিল না…
দাদাভাই তুই তো ভবানীপুরের বাড়ীতে গিয়ে মাঝে মাঝে থাকতে পারিস…ছোড়দিরা খুব দুঃখ করছিল…
না রে…তুই যতটা সোজা ভাবছিস…তা নয়…উপরের ঘরটা তে গেলেই মনে হয় বাবা বসে আছে…বুকের ভেতর টা কেমন যেন গুমরে ওঠে…শুনেছি বাবা নাকি আমাকে খুব ভালোবাসতো…অফিস থেকে ফিরে আগে আমাকে কোলে নিয়ে আদর …তারপর…অন্য কাজ…গত বছর একদিন গিয়ে থাকার চেষ্টা করেছিলাম…সারারাত ঘুমোতে পারিনি…খালি মনে হচ্ছিল…মা বাবা…আমার দুদিকে বসে…বার বার বলছে…দুষ্টু…তোর দাদু দিদান খুব অসহায়…ওদের কে কোনো কষ্ট দিস না রে… তুই তো জানিস…রুপসা…দাদু, দিদান আর শুক্লাদির আমি ছাড়া আর কেউ নেই, তিনটে মানুষ আমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছে…ওদের কষ্ট হবে ভেবে আমি কোথাও যেতে পারিনা…অফিস থেকে বার বার চাপ দিচ্ছে দু বছরের জন্য সিডনি যেতে…কোনো রকমে আটকে রেখেছি কিন্তু সামনের ডিসেম্বরে অন্তত দু মাসের জন্য যেতে হবেই। জানিনা কি হবে…দেখা যাক…যদি আটকাতে পারি…চাকরীটা ছেড়ে দেবো ভেবেছিলাম কিন্ত যেখানে জয়েন করবো সেখানেও তো একই রকম কিছু হতে পারে ভেবে আর এগোই নি… জানি না আমার জীবনে কেন এত সমস্যা…তোরা উপর থেকে হয়তো মনে করিস আমার মতো সুখী আর কেউ নেই…এত সম্পত্তি…দাদুর যা আছে আমি পাবো…ওদিকে ভবানীপুরে এত বড় বাড়ীর ভাগ…বম্বের মতো জায়গায় দু দুটো ফ্ল্যাট…ভালো চাকরী…কিন্তু মনের ভেতরে যে কি আছে আমিই জানি…ভীষন ভয় করতো…যার সাথে বিয়ে হবে সে দাদুদের কে মানিয়ে যদি না নিতে পারে…তার পর জীবনে এলো মৌ…যার দাদুদের কে মানিয়ে না নেবার কথা ভাবার কোনো প্রশ্ন উঠছে না কিন্তু…
রুপসা চুপ করে ওর কথা শুনছিল…থেমে যেতে দেখে ওর দিকে তাকালো…কিন্তু কি দাদাভাই…আমি যতদুর বুঝেছি…মৌ তোকে ভীষন ভাবে চায়…
জানি…
তাহলে? আটকাচ্ছে কোথায়?
ওর অতীত…আমরা তো কেউ জানিনা ও কে…
দাদাভাই…অতীত নিয়ে ভেবে কি লাভ আছে আমি জানি না…
জানি লাভ নেই…কিন্তু…এমনও তো হতে পারে ওর কেউ খুব কাছের আছে…কোনোদিন যদি ওর স্নৃতি ফিরে আসে আর ও তার কাছে ফিরে যেতে চায়…আমার কি উচিত হবে ওকে আটকানো…নাকি…আমি পারবো…
দাদাভাই…এখানে অনেক গুলো যদি আছে…এমন ও তো হতে পারে…তুই যা ভাবছিস … তা নয়… I feel…if you want to see the Light then you have to face the Dark….
অরিত্র কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল…জানি…আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না…
বিকালে রুপসা আর মৌকে নিয়ে ভবানীপুরের বাড়ীতে যেতে হবে, জেঠিমা আর পুবালীদি রুপসার কাছ থেকে মৌ এর ব্যাপারে শুনে ফোনেই খুব হইচই করে বলেছে একবার ওদের ওখানে নিয়ে যেতেই হবে। অরিত্র ওদের কে যে আগে জানায়নি তার জন্য দুজনেই খুব অভিমান করে বলেছে…তুই কি আমাদের পর ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারিস না।পরে জানাবো ভেবেছিলাম…তারপর আর নানান ঝামেলায় জানানো হয়ে ওঠেনি বলে ওদের কে কোনোরকমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করেছে। দুটো নাগাদ বেরোতে হবে, না হলে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে বলে অরিত্র রুপসা কে তাড়া লাগালে কি হবে…সেই যে সাজতে বসেছে দুজনে…ওঠার নামই করে না। রুপসা মৌকে একটু একটু করে সাজিয়ে আরো অপরুপা করে তুলছিল…আই লাইনার টা খুব সাবধানে চোখের পাতায় বোলাতে বোলাতে ওর দিকে তাকিয়ে হাত যেন আটকে গেল…কি সুন্দর টানা টানা মায়াবী চোখ…দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে…
মৌ এর মুখটা দুহাতে আলতো করে ধরে বলল… এই…মৌ…
মৌ রুপসার দিকে তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ওর চোখে চোখে রেখে ফিসফিস করে বলল……এই…তুমি আমার বৌদি হবে?
মৌ আস্তে আস্তে করে চোখ নামিয়ে নিল…একটু আগেই যে মুখে হাসি ছিল…এখন সেখানে যেন শ্রাবনের মেঘ…রুপসা বুঝতে পারছিল না ওর মনের ভাষা…যেটুকু বুঝেছে তাতে তো একবার ও মনে হয়নি যে ও দাদাভাই কে পছন্দ করে না…
এই আমার দিকে তাকাও…দাদাভাইকে কি তোমার ভালো লাগে না?
একবার চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ নাবিয়ে নিল…একটু একটু করে শ্রাবনের মেঘ সরে গিয়ে ওর মিষ্টি মুখে লাজুক হাসি ফিরে এসে বোঝালো…ভীষন ভালো লাগে…
তাহলে?
দু চোখের ভাষায় বোঝালো…শুধু কি আমার ভালো লাগলে হবে?
রুপসা একটু চুপ করে থেকে বলল…জানি…আমার দাদাভাই টা কি…বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটবে না…ওর কেন যে মনের ভেতরে এত কিন্তু বুঝি না। একটু থেমে মৌ এর কাঁধে হাত রেখে হাসি মুখে বলল…তুমি পারবে না আমার বুদ্ধু দাদাভাই টাকে দিয়ে বলাতে যে ও তোমাকে চায়?
জেঠিমা আর পুবালী খুব খুশী ওদেরকে পেয়ে। সবাই মিলে গল্প করতে করতে জেঠুও অফিস থেকে ফিরে এলো। কোনো রকমে জেঠিমা আর পুবালীদিকে বোঝাতে পারলেও জেঠুকে বোঝানো খুব মুশকিল হয়ে গেল, সেই এক প্রশ্ন…অরিত্র কেন এই বাড়ীতে আসে না। খুব দুঃখ করে বললো…আমি জানি তোর কষ্টটা কোথায়…কিন্তু একটা কথা তুই বুঝতে চাস না…তোর ও যেমন মা বাবা কে হারানোর দুঃখ আছে, আমারও কি কম কষ্ট হয় নিজের ছোটো ভাইকে আর বৌমাকে হারিয়ে। তাছাড়া…তুই একবার ভাব…আমাদের তিন ভাই এর ছেলে মেয়েদের ভেতরে তুই এক মাত্র ছেলে…একটা মেয়ের তো বিয়ে হয়ে গেছে …পুবালীরও বিয়ের চেষ্টা চলছে…আর বাকি থাকলো রুপসা…ওরা সবাই চলে গেলে আমরা কাকে নিয়ে থাকবো বলতো?...জানি তুই ছাড়া তোর দাদু দিদানের আর কেউ নেই…তবুও আমাদেরও তো তোর উপরে একটা অধিকার আছে…
অরিত্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…জানি…তোমাদের জন্যও আমার কিছু কর্তব্য আছে… আর জানি বলেই মাঝে মাঝে নিজের উপরে একটা ধিক্কার আসে…সব দিক বজায় রাখতে পারিনা…আমি বোধ হয় একটা অপদার্থ…কি করবো বুঝতে পারি না…
ওদের কথার মাঝে জেঠিমা চলেএল…দুজনেরই মুখ থমথমে দেখে বলল…তুমি কি বলোতো…ছেলেটা এতদিন পর এলো…আর তুমি ওকে নিয়ে পড়ে গেলে…ওর দিকটাও একবার ভেবে দেখো…এইটুকু বয়সে ওকে যা দায়িত্ব নিতে হয়…কটা ছেলে নেয় বলোতো…
জেঠু কিছু বলতে যাচ্ছিল দেখে জেঠিমা থামিয়ে দিয়ে বললো…আরে বাবা…এত চিন্তা করার কিছু নেই… আমাদের ছেলেটাকে আর একটু বড় হতে দাও…বিয়ে হোক…আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে…
হলেই ভালো…
আচ্ছা শোনো…তোমার সাথে একটা কথা আছে…দুষ্টু আছে…ওর সামনেই সেরে নেওয়া ভালো…
জেঠু হেসে ফেলে বলল…তুমি এখোনো ওকে দুষ্টু বলা ছাড়লে না…
জেঠিমা অরিত্রর পাশে বসে বলল…ও আমার কাছে চিরকাল দুষ্টুই থাকবে…কি রে…তুই আবার দুষ্টু বললে রাগ করিস না তো?
ঘরের একটু আগের গুমোট হাওয়াটা কেটে যাওয়াতে সবারই ভালো লাগছিল। অরিত্র হেসে বলল…রাগ করবো কেন…ছোটো বেলায় তো কম জ্বালাইনি তোমাদেরকে।
জেঠু হো হো করে হেসে ফেলে বলল…তোর দুষ্টুমি চলে গেলেও নামটা থেকেই গেল…কি বল। তারপর জেঠিমার দিকে তাকিয়ে বলল…বলো…কি বলবে বলছিলে…
বড়দি পুবালীর জন্য একটা ভালো ছেলের কথা বললো আজ…নিজে খুব একটা বিশেষ কিছু জানে না… ভালো ছেলে শুনে তাড়াতাড়ি করে খবরটা দিয়ে বলেছে সব কিছু দেখে নিতে…টিসিএস এ কাজ করে…দুষ্টু…তুই যদি একটু খোঁজ খবর নিয়ে বলতে পারিস…বুঝতেই পারছিস…একটা মাত্র মেয়ে…আজকাল যা হচ্ছে…খুব চিন্তা হয়…তোর জেঠুরতো অফিস ছাড়া আর কিছু জানা নেই…খোঁজ নিতে বললে কবে বাবুর সময় হবে তার ঠিক নেই…
জেঠিমা তুমি চিন্তা কোরোনা…তুমি ডিটেলস টা দিয়ে দাও…আমি সামনের সপ্তাহের ভেতরে খোঁজ নিয়ে নিচ্ছি…ছোড়দি জানেতো? না হলে আবার সেই আগের বারের মতো কান্নাকাটি জুড়ে দেবে।
না… না…অনেক বোঝানোর পর রাজী হয়েছে…এখন আর কোনো সমস্যা নেই…ওর একটাই শর্ত… বিয়ের পরেও চাকরী করতে দিতে হবে…না হলে এত পড়াশোনা করে কি লাভ।
ঠিকই তো বলেছে…
জ্জেঠু জেঠিমার সাথে কথা বলতে বলতে পুবালী এসে অরিত্রর হাত ধরে টেনে বলল…এই ভাই…চল…আমাদের সাথে গল্প করবি…কি খালি…বড়দের সাথে মুখ গোমড়া করে বসে আছিস।
অরিত্র পড়ে যেতে যেতে সামলে নিয়ে বলল…আচ্ছা বাবা…চল…যাচ্ছি…কোন দিকে যাই বলতো…তোর সাথে গল্প না করলে অভিমান করে বসে থাকবি…জেঠু জেঠিমাকে একটু সময় না দিলে তাদেরও খারাপ লাগবে।
পুবালী হাসতে হাসতে বলল…এক কাজ কর না…আজকাল কি সব গাড়ী বেরিয়েছে না…সব জায়গায় চলে…ওই একটা কিনে ফেল…তাহলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না, অফিস ফেরত হুস করে চলে আসবি।
জেঠু হাসতে হাসতে বলল…হ্যাঁ…আসার সময় তোকেও তুলে নিয়ে এলে আরো ভালো হয়…
অরিত্র সামনের সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা না করে পরের দিনই ওদের অফিসের এইচআর এর অনিন্দ সেন কে ফোন করে পুবালীর জন্য যে ছেলেটির খোঁজ এসেছে তার ব্যাপারে কথা বলে নিল…সেন দা নিজের প্রফেশানের সুবাদে অনেকের সাথে পরিচয় আছে যারা বিভিন্ন কোম্পানীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে…এছাড়া ও নিজে এর আগে অনেক কোম্পানী ঘুরে আসায় পরিচিতি বেড়েছে…ওনার পক্ষে খোঁজ নেওয়াটা খুব একটা বড় কিছু নাও হতে পারে। সেন দা মাত্র দিন তিনেকের মধ্যে ছেলেটির হাঁড়ির খবর অব্দি জোগাড় করে অরিত্রকে ফোনে সব জানিয়ে দিল। সব দিক থেকে মোটামুটি ভালোই…এগোনো যেতে পারে বলে মনে হতে অরিত্র জেঠিমাকে ফোনে সব জানিয়ে দেবার পর আলাদা করে ছোড়দি কে ও জানাতে হল, পুবালী বার বার করে বলে দিয়েছিল…ওকেও জানাতে। পুবালীর সাথে কথা বলার সময় রুপসা পাশে ছিল, অরিত্রর কথা বলা হয়ে গেলে রুপসা ফোনটা প্রায় কেড়ে নিয়ে…প্রথমেই ওর স্বভাব মতো এক নাগাড়ে কিছুক্ষন বকে গেল…দিদিভাই…এ তো সোনার টুকরো ছেলে মনে হচ্ছে রে…তাই বলে আবার কিছু না দেখে রাজী হবি না কিন্তু…জেঠিমারা যা করবে করুক…তুই কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা করবি…না হলে বুঝতে পারবি না…ভেতরে ভেতরে কিছু গন্ডগোল আছে কিনা…সব যদি দেখিস ঠিক আছে তবেই রাজী হবি।ওদিক থেকে পুবালী কিছু একটা বললে…রুপসা হেসে ফেলে বলল…ঠিক আছে রে দিদিভাই…রাখি এখন…জানাস কিন্তু।
অরিত্র ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে হেসে ফেলে বলল…এই রুপসা…তুই কি ছোড়দির ঠাকুমা নাকি রে…এমন ভাব করছিস যেন…সব কিছু জেনে বুঝে গেছিস।
এই দাদাভাই…ভালো হবে না কিন্তু…তুই কিছু বুঝিস না বলে কি আমি কিছু বুঝবো না নাকি।
আমি আবার কি বুঝি না রে?
তুই কিচ্ছু বুঝিস না…হাঁদারাম কোথাকার…আমি যদি তুই হতাম…কবেই I Love You বলে দিতাম…
খুব সোজা না? নিজে তো আজ অব্দি একটা জোটাতেও পারলি না।
রুপসা চোখ ছোটো ছোটো করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল…এই দাদাভাই…বাজে বকবি না…অনেক আগেই আমি জোগাড় করে ফেলেছিলাম…রাজী না হলে কি করবো?
আমি বাজে বকছি নাকি তুই বাজে বকছিস রে? তুই কাউকে জোগাড় করলে আমাকে না বলে থাকতে থাকলি কি করে?
রুপসা ফিক করে হেসে ফেলে বলল…তোকে আবার আলাদা করে কি জানাবো? এই জন্যই তো তোকে হাঁদারাম বলি…
মানে?
মানে আবার কি…ওটা তো তো তুই ছিলি রে…বুঝলিই না আমার ভালোবাসা কতটা খাঁটি ছিল…প্রথম প্রেম…কি রোমান্টিক হয়…
দাঁড়া তোর রোমান্টিক হওয়া আমি দেখাচ্ছি…অসভ্য…ফাজিল মেয়ে কোথাকার…
এই দাদাভাই…চুলে হাত দিবি না কিন্তু…খুব খারাপ হয়ে যাবে…
ওদের ভাই বোনের খুনসুটির মাঝে মৌ ঘরে ঢুকলো একটা প্লেটে কিছু স্ন্যাক্স আর কফি নিয়ে, এতক্ষন দিদানের সাথে কিচেনে ছিল, গালের এক দিকে বোধ হয় হলুদের দাগ, নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম। একেবারে শেষের দিকে আসায় বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি…দু হাতে খাবারের ট্রে টা ধরে দাঁড়িয়ে থেকেএকবার অরিত্রর দিকে আর একবার রুপসার দিকে তাকাতে তাকাতে বোঝার চেষ্টা করছিল কি ব্যাপার।
অরিত্র ওর অবস্থা দেখে বলল…আমার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই…আমি বলতে পারবো না…ওই ফাজিল মেয়েটাকে জিজ্ঞেস কর…যত বড় হচ্ছে তত ফাজলামো বাড়ছে…
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
রুপসা মৌ এর হাত থেকে ট্রেটা নিয়ে বিছানায় রেখে দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল…দাদাভাই আমার প্রথম প্রেম বলে পেছনে লাগছিলাম…জানো তো কি রেগে গিয়েছিল…
মৌ মুখ টিপে হাসতে হাসতে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করল…তুমি সত্যি ই বুদ্ধুরাম…কিচ্ছু বোঝো না…
দেখতে দেখতে রুপসার ফেরার দিন চলে এলো। আজ বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে যাবে। সকাল থেকেই মৌ ওকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিল না, মুখে একটুও হাসি নেই।দু চোখে ভীষন কষ্ট পাওয়ার আভাস। রুপসা ওকে বার বার বোঝানোর চেষ্টা করছে…আবার আসবে বলে…কিন্তু কিছুতেই ওর মুখে হাসি ফেরাতে পারছে না।মাঝে দুবার রুপসাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটিও করেছে।বেরোবার কিছুক্ষন আগে চোখে মুখে জল দিয়ে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেছে কিন্তু তাতে ওর বিষন্নতা বিন্দুমাত্র কমেনি। দিদান ওর অবস্থা দেখে অরিত্রকে বলল…তুই বরং ওকে সাথে নিয়ে যা…না হলে তোরা বেরিয়ে যাবার পর আরো কান্নাকাটি করবে।
এয়ারপোর্ট যাবার সময় সারাক্ষন ও রুপসা কে জড়িয়ে ধরে বসেছিল…রুপসা ওর সাথে গল্প করে যেতে যেতে এখন অনেক টা স্বাভাবিকহয়ে এসেছে। রুপসা বোর্ডিং পাস নিয়ে সিকিউরিটি চেকের আগে ফিরে এসে শেষবারের জন্য দেখা করে চলে গেল। শেষ বারে আর না কেঁদে হাসি মুখে রুপসা কে বিদায় জানিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর অরিত্রর দিকে তাকা্লো…যেন বলতে চাইছে…চলো…এবার ফিরে যাই।
রুপসা ফিরে যাবার পর আবার আগের মতো একটা একটা করে দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল। আস্তে আস্তে পূজো এগিয়ে আসছিল, অরিত্রর ব্যাস্ততা আগের থেকে কিছুটা বেড়েছে, অফিসের কাজের মাঝে মাঝে পূজোর ব্যাপারেও সবার সাথে যোগাযোগ রাখতে হচ্ছিল। এর মাঝে জেঠিমা একদিন ফোন করে বলল…সামনের রবিবার বিকেলে ছেলের বাড়ী থেকে দেখতে আসবে, অরিত্র এলে খুব ভালো হয়। সেই মতো রবিবার সকালে বাজার থেকে ঘুরেএসে ভবানীপুরের বাড়ীতে আসতে হয়েছে। জেঠু জেঠিমা সবকিছু হয়তো সামলাতে পারবে না ভেবে আগের দিনই বলে দিয়েছিল ও দুপুরের মধ্যে এসে যাবে। দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে পুবালী কে নিয়ে বেরোতে হল বিউটি পার্লারে যাবার জন্য, পুবালীকে বেশ চুপচাপ দেখে জিজ্ঞেস করল…কি রে ছোড়দি…এত চুপচাপ কেন…টেনশান হচ্ছে?
টেনশান তো একটু হবেই…কেমন হবে কে জানে।
তা ঠিক।
রুপসা আজ সকালে ফোন করেছিল…ওর সেই এক কথা…কিছুদিন মেলামেশা করে দেখতে বলছে।
ঠিকই তো বলছে…আজকাল সবাই তাই করে।
ধুস…আমার কেমন যেন লাগছে…কি করে বলবো বুঝতে পারছি না।
অরিত্রর হেসে ফেলে বলল…ছোড়দি…তুই সেই একই রকম থেকে গেলি…এতে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে। ঠিক আছে…চল…আমিই বলে দেবো।
না রে ভাই…ওর বাড়ীর লোকজন যদি আবার খারাপ কিছু ভেবে বসে।
কিচ্ছু খারাপ ভাববে না…আর ভাবলেই বা কি…সারা জীবনের ব্যাপার…কিছুটা তো দেখে শুনে নেওয়া দরকার…তুই এত চিন্তা করিসনা তো…আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেবো।
ওর কথা শুনে পুবালী কিছুটা স্বস্তির নিস্বাস ফেলে বলল…দেখ…কি করতে পারিস…প্রথম দু এক দিন কিন্তু তুই সাথে থাকবি…আমি একা একা দেখা করতে পারবো না।
তুই কি রে ছোড়দি…আমাকে আবার থাকতে হবে কেন?
আমার ইচ্ছে…তাই থাকবি। তুইতো জানিস…আমি রুপসার মতো এতো স্মার্ট নই।
মোটামুটি ভালোয় ভালোয় মেয়ে দেখার ব্যাপার টা মিটে গেছে। দু তরফেরই অন্যদেরকে প্রাথমিক ভাবে পছন্দহয়েছে। কিছুদিন ওরা দেখা সাক্ষাত করার পর সব কিছু ঠিক থাকলে বাকি ব্যাপার গুলো নিয়ে এগোতে কারুরই আপত্তি হয়নি। সেই মতো পরের সপ্তাহে অরিত্র অফিস থেকে বিকেলে বেরিয়ে পুবালীকে নিয়ে মনি স্কয়ারে এসেছিল। ওখানে শুভ্রদীপ মানে যার সাথে বিয়ের কথা চলছে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারপরে আরো একদিন পুবালীর সাথে যেতে হয়েছিল, তারপর থেকে ওরা নিজেরাই নিজেদের মতো দেখা করে নিত। এর মাঝে একদিন বড় জেঠু আর জেঠিমা বম্বে থেকে এসেছে, রুপসাও সাথে ছিল। উদ্দেশ্য সবাই মিলে শুভ্রদীপের বাড়ী ঘুরে আসা। অরিত্রকে ও যেতে হয়েছিল ওদের সাথে। রুপসা এর আগে শুভ্রদীপের ফোটো দেখেছিল, এই প্রথম মুখোমুখি দেখা। বাড়ী ফেরার পর পুবালী কে জড়িয়ে ধরে ওর খুশীর যেন অন্ত নেই, বিয়েটা যেন পুবালীর সাথে নয়, ওর সাথে হবে। ছোড়দি…দারুন হবে রে…কি হ্যান্ডসাম…আগে বলিসনি তো…কি মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে…মাসীমা মেশোমশায় ও কি ভালো… ছোড়দি…তুই হ্যাঁ বলে দে…বলে পুবালীর মাথা খারাপ করে দিচ্ছিল।
পরের দিন রুপসা একাই চলে এসেছিল অরিত্র দের বাড়ী,জেঠিমার ও আসার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পুবালীর বিয়ের ব্যাপারে এখন আর কোনো বাধা না থাকায় ওরা থাকতে থাকতেই বাকি ব্যাপার গুলো সেরে ফেলতে হবে বলে আসতে পারেনি। রুপসার কোলকাতা এলে নিজের বাড়ীতে থাকার চেয়ে অনেক বেশী ভালো লাগে দাদাভাইদের ওখানে, কি সুন্দর খোলামেলা গাছ গাছালী তে ভরা নির্জন জায়গা, তার সাথে পাশেই নদী…বিকেলে ছাদে বসে নদীর দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে কি করে সময় কেটে যায় বোঝাই যায় না। এখন আবার মৌ এর সাথে এত নিবিড় একটা মিষ্টি সম্পর্ক হয়ে গেছে যে ওকে কাছে না পেলে যেন ভালো লাগে না। ওদিকে বিয়ের দিন ঠিক করতে গিয়ে একটু আটকে গেল, ডিসেম্বর মাসে অরিত্র থাকছে না…ওর ফিরতে ফিরতে জানুয়ারীর শেষ হয়ে যাবে আর ওর যাবার আগেও সম্ভব নয়, তাই একটু ঠান্ডা থাকতে থাকতে ফেব্রুয়ারীতেই একটা দিন ঠিক করা হয়েছে ছেলের বাড়ীর সাথে কথা বলে। প্রথমে শুভ্রদীপের বাবা একটু গররাজী ছিলেন কিন্ত অরিত্র বাড়ীর এক মাত্র ছেলে আর ও না থাকলে খুব খারাপ দেখাবে বলে রাজী হয়ে গেছেন। রুপসা দিন তিনেক থেকে মৌকে সাথে নিয়ে ফিরে গিয়েছিল পুবালীকে কিছুটা সময় দেবার জন্য। পুবালীও চাইছিল রুপসা থাকতে থাকতে কিছু কেনা কাটা সেরে ফেলতে। অফিস, পাড়ার পূজো আর তার সাথে পুবালীর বিয়ে, সব কিছু সামলাতে গিয়ে অরিত্র বেশ চাপের মধ্যে, তার উপরেআবার এখোনো পূজোর কেনাকাটা কিছু করে উঠতে পারেনি। এক জায়গায় গেলে যে সব কিছু কেনা যাবে সেটা ও সম্ভব নয়, দাদু, দিদান আর শুক্লাদির জন্য এক রকম, জেঠু জ়েঠিমাদের জন্য আর একরকম…বড়দি, জামাইবাবু, বড়দির ছেলে পাপাই, ছোড়দি, রুপসা, সাথে মৌ…তাদের জন্য আবার যার যেটা লাগবে কিনতে হবে, ভেবে ঠিক করতে পারছিল না কবে কি করে উঠতে পারবে। বাধ্য হয়ে আবার দিন তিনেকের ছুটি নিয়ে এক এক করে সব কেনাকাটা করে ফেলল দুই বোন আর মৌকে সাথে নিয়ে। মৌ কিছু নিতে চাইছিল না…এই তো সেদিন এত কিছু কেনা হয়েছে বলে। রুপসা আর পুবালী দুজনে মিলে ওকে বুঝিয়ে রাজী করাতে তবে কিনতে দিয়েছে। এবারে আর নারায়ন দা আর ওর বাড়ীর বাকিদের জন্য নিজে কিছু কিনে উঠতে পারেনি বলে একদিন রাতে অফিস থেকে ফেরার পথে নারায়ন দার হাতেকিছু টাকা জোর করে দিয়ে এসেছে।
জেঠুরা বম্বে ফিরে যাবার পরে আরো দিন সাতেক পরে রুপসা ফিরে গেছে, তার আগে ওরা দুই বোন মৌকে নিয়ে এসে একদিন থেকে ফিরে গিয়েছিল, শুধু মৌকে দিতে আসা নয় সাথে সবার জন্য পূজোর জামাকাপড় দেওয়ার ব্যাপারটাও ছিল। পুজোর আর মাত্র দিন দশেক বাকি আছে, এখন আর সেই চাপ নেই…মোটামুটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে দেখেঅরিত্র পাড়ার পূজোর দিকে একটু বেশি নজর দিতে পারছে। বিশেষ করে সপ্তমীর সন্ধেবেলা বাচ্চাদের যে নাটক টা হওয়ার কথা আছে সেটা ওরই মাথার থেকে বের করা, এতদিন নিজে বেশী সময় দিতে পারছিল না বলে ওর এক বন্ধু, শুভ ওর হয়ে রিহার্সালের দেখভাল করছিল। শনিবার তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরে শেষ রিহার্সাল হয়ে যাবার পর মোটামুটি নিশ্চিন্ত বাচ্চাগুলো ডোবাবে না। খুশী হয়ে সবাইকে একটা করে ক্যাডবেরী দিয়ে বাড়ী পাঠিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষন ক্লাবে আড্ডা দিয়ে বাড়ী ফিরছিল, ফোনটা বেজ়ে উঠল… রিং টোন টা … তু কাঁহা…এ বাতা… ওর বস ত্রিদিব বাসুর ফোন… ইচ্ছে করেই এই রিং টোন টা সেট করে রেখেছিল যাতে সবার থেকে আলাদা করা যায়। কিছু নিশ্চয় সমস্যা হয়েছে না হলে শনিবার এই সময়ে ফোন করার কথা নয় ভেবে ফোন টা রিসিভ করল…আজকে রাতের মধ্যে একটা প্রেজেন্টেশান তৈরী করে দিতেই হবে, সোমবার ফরেন কাস্টমার মিট আছে। এটা তো নেহার করার কথা বলাতে বলল… নেহা আজ হাসব্যান্ডের সাথে ঝামেলা করে দিল্লী চলে গেছে মায়ের কাছে, অরিত্র না করে দিলেই নয়। সেই মতো খেয়ে উঠে এগারোটা নাগাদ বসল কাজটা করতে, সেন্ট্রাল সার্ভার থেকে কিছু ডেটা নিয়ে প্রোজেক্টটা বানাতে হবে কিন্তু ব্রডব্যান্ড ভীষন স্লো চলছে। কিছু করার নেই… আস্তে আস্তে কাজ এগোচ্ছে। রাত প্রায় দুটো বাজে, মাঝে একবার নিচে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এসে এক মনে কাজ করছিল… কাজটা মোটামুটি অনেকটাই হয়ে এসেছে, আরো ঘন্টা খানেক হয়তো লাগতে পারে। কাঁধে কারুর হাতের ছোঁয়া…মুখ তুলে তাকালো…মৌ ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। দু চোখে বকুনি দেবার ইচ্ছে… রাত জেগে এত কাজ করারকি দরকার… যাও…ঘুমোও।
এই আর একটু বাকি আছে… বলাতে খালি কফির কাপটা তুলে নিয়ে ফিরে গেল। একটু পরেই আবার ফিরে এলো… এক কাপ কফি নিয়ে। কি করে বুঝলো যে আমার আর একবার পেলে ভালো হত ভাবতে ভাবতে হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল… কি করে বুঝলে?
ওর মুখের মিষ্টি হাসি হয়তো বোঝালো… তুমি কি চাও যদি না বুঝতে পারি তাহলে তোমাকে নিজের করে নেবো কি করে।
কফির কাপটা টেবিলে রেখে ওর পাশেই দাঁড়িয়ে দেখছিল ও কি করছে। অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে বলল… শুতে যাবে না?
মাথা নেড়ে জানালো…না।
আমার তো আরো একটু সময় লাগবে…তুমি জেগে থাকবে আমার জন্য?
হাসি মুখে ঘাড় কাত করে বোঝালো…কোনো অসুবিধা নেই… তোমার জন্য আমি সব করতে পারি।
এক নাগাড়ে কাজ করতে করতে কিছুটা হলেও একঘেয়েমি এসে গিয়েছিল… ভীষন ভালো লাগছিল ওকে কাছে পেয়ে…মন চাইছে ও পাশে থাকুক… কিন্তু ও এত কাছে থাকলে কাজে মন দিতে পারবে না তাছাড়া শুক্লাদি ঘুম ভেঙ্গে গেলে ওকে দেখতে না পেয়ে যদি এখানে চলে আসে… যদি কিছু ভাবে…যদিও ওরা এমন কিছু করেনি যেটা চোখে লাগার মতো… চিন্তা করে হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল… তুমি এত কাছে থাকলে যে আমি কাজ করতে পারবো না।
মুখটা একটু গোমড়া করে সোফার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বোঝালো… ও ওখানে বসতে চায়।
আচ্ছা…বোসো… বলাতে… খুশী হয়ে সোফাতে গিয়ে বসল।
অরিত্র কাজ করতে করতে একবার পেছন ফিরে ওর দিকে তাকালো… মৌ চুপচাপ বসে ওর দিকে তাকিয়ে আছে… ওকে তাকাতে দেখে… মাথা নেড়ে বোঝালো…আমার দিকে তাকাতে হবে না…তুমি তোমার কাজ কর।
আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে,তিনটে বেজে দশ। কাজটা শেষ, অনেক বড় হয়ে গেছে প্রেজেন্টেশানটা… মেলে পাঠানো যাবে না দেখে সার্ভারে আপলোড করতে দিয়ে চেয়ার টা ঘুরিয়ে ওর দিকে মুখ করে বসে দেখছিল মৌ কি করছে।অরিত্র যে ওর দিকে তাকিয়ে আছে খেয়াল করে নি… এক মনে এক বার অরিত্র কি করছে আর তার পরেই ও অরিত্র কে কি বলছে… অভিনয় করে যাচ্ছে। দেখে যা বোঝা গেল… অরিত্র দুহাতে ল্যাপটপের কি বোর্ডে টাইপ করছে… তার পরেই মৌ অরিত্রকে বকুনি দিয়ে বলছে…যাও…আর কাজ করতে হবে না…অরিত্র মৌ কে বলছে…আর একটু…মৌ মাথা নেড়ে বলছে… না…আর নয়…অনেক রাত হয়েছে…শুতে যাও। মৌ শুতে যেতে বলাতে অরিত্র কিছু বলতে যাচ্ছিল… মুখ তুলে তাকিয়ে অরিত্র ওকে দেখছে বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে গিয়ে মুখ নামিয়ে নিয়ে বসে থাকলো… ভাবছিল হয়তো… ইস…কতক্ষন ধরে দেখছে কে জানে। অরিত্র পেছন ঘুরে আপলোড হয়ে গেছে দেখে, ল্যাপটপ শাট ডাউন করতে দিয়ে উঠে গেল ওর সামনে…তখোনো মুখ নিচু করে বসে আছে…সারা মুখে লাজুক হাসি।
ভীষন ভালো লাগছিল দেখতে ওর ওই লজ্জা পাওয়া… ওর কাঁধে হাত রেখে আস্তে করে ডাকলো… এই…
আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকালো…মুখে এখোনো সেই লাজুক হাসি…দু চোখে জিজ্ঞাসা… বলো…কি বলবে।
ঘুম পাচ্ছে না?
উঁহু…
হুম…তাহলে আমি বসি এখানে?
না…
বারে…তুমি এখানে থাকলে আমি কি করে শুতে যাই?
আর কোনো কিছু বোঝাবার চেষ্টা না করে চুপ করে কিছুক্ষন একভাবে তাকিয়ে থাকলো চোখে চোখ রেখে… কিছু হয়তো বোঝাতে চাইলো…কিন্তু বোঝা গেল না… আলতো ভাবে একবার ওর হাত টা ধরে উঠে দাঁড়ালো… চোখের ভাষায় বোঝাতে চাইলো… আমি এবারে আসি?
ওর নীরব প্রশ্নের উত্তরটা নীরবেই দিলে একটু জোরে হাতে চাপ দিয়ে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চাইলে… একবার মনে হল… ওকে আটকায়…নাঃ থাক… অনেক রাত হয়েছে… আর…ওকে কেনই বা আটকাবো… আমি কি পারছি…ও যা চায় তা দিতে।ইচ্ছে টা মনের ভেতরেই রেখে দিয়ে হাসি মুখে বলল… কাল সকালে কিন্তু এক সাথে চা খাবো…
দেখতে দেখতে পূজো শুরু হয়ে গেল, সপ্তমী থেকে ছুটি শুরু…চারটে দিন পাড়ার পুজো, কালচারাল প্রোগ্রাম আর একদিন রাতে কোলকাতায় গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের সাথে সারা রাত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়ানো আর একদিন দাদু দিদান দের নিয়ে বেরোনো ছিল গত দু তিন বছরের ছক কিন্তু এবারে হয়তো কিছুটা অন্য রকম কিছু ভাবতে হবে। মৌকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে বেরোনো যাবে না আবার বন্ধুদের সাথে না বেরোলে ওরা আবার পেছনে লাগবে। একবার ভাবলো দাদুদের কে নিয়ে যেদিন বেরোবে সেদিন তো মৌ এর ও ঘোরা হয়ে যাবে তাহলে আর আলাদা করে বেরোনোর দরকার থাকবে না কিন্তু তার পরেই মনে হল একবার ওর সাথে কথা বলে নেবার দরকার আছে না হলে মন খারাপ করতে পারে। দিদান হয়তো বুঝতে পেরেছিল ওর সমস্যাটা তাই নিজের থেকেই সপ্তমীর দিন দুপুরে খেতে বসে কথাটা তুললো…
আমরা আর এ বছর বাইরে কোথাও যাবো না ভাবছি…বাড়ীর সামনেই তো পূজো হচ্ছে…এখানেই কাটিয়ে দেবো।
অরিত্র খাওয়া থামিয়ে দিদানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…প্রতি বছরই তো এখানে পূজো হয় আর আমরা বেরোই…এবারে আবার আলাদা কিছু আছে নাকি?
দিদান হেসে বলল…মৌকে নিয়ে বেরোতে হবে তো… নাকি…মেয়েটা পূজোর সময়েও বাড়ীতে বসে কাটাবে।আমাদের না হয় বয়স হচ্ছে…ওর তো বাইরে বেরোতে ইচ্ছে হয়।
দাদু আর শুক্লাদিও দেখা গেল দিদানের সাথে একমত…মনে হয় ওরা আগেই নিজেদের ভেতরে আলোচনা করে রেখেছিল। মৌ মাথা নেড়ে বোঝালো ও রাজী নয়। অরিত্র কিছুক্ষন ভেবে বলল…একদিন তো আমি একাই বেরোই…সেদিন ওকে নিয়ে বেরোনো যাবে।
দিদান শুনে বলল…একটা দিনই তো বন্ধুদের সাথে বেরোস…ওদের সাথে না বেরোলে আবার খারাপ ভাববে না তো?
দেখি কি করা যায়…
অরিত্র খাওয়ার পর একটু গড়িয়ে নিয়ে মৌ এর সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখলো ও ঘরে নেই…হয়তো ছাদে গেছে…ফিরে আসবে ভেবে অপেক্ষা করছিল…ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে…দেখলেও ভালো লাগে। কিছুক্ষন পর কি মনে করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো মৌ দুহাতে কিছু শুকনো জামাকাপড় বুকে চেপে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু চোখে জিজ্ঞাসা…কিছু বলবে?
অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল…কি হল…বসতে বলবে না নাকি?
দুষ্টুমি ভরা হাসি মুখে নিয়ে মাথা নেড়ে উত্তর দিল…নাঃ…
হুম…তাহলে যাই…ভেবেছিলাম তোমার সাথে গল্প করবো।
একটু অবাক হবার ভান করে যেন জিজ্ঞেস করল…তাই?
হুম…তাই…
সারা মুখে মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘরের মধ্যে এসে বিছানার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বোঝালো…বোসো।
অরিত্র ওর বিছানায় বসে ওকেও ইশারা করে বসতে বললে জামাকাপড় গুলো রেখে উল্টোদিকে বসে ওর দিকে তাকালো…যেন বলতে চাইছে…বলো…কি বলবে।
ভাবছি…এবারে আর বন্ধুদের সাথে বেরোবো না।তোমাকে নিয়ে একদিন বেরোবো।
মাথা নেড়ে জানালো…সেটা ঠিক হবে না।
কেন…তুমি যাবে না ঠাকুর দেখতে?
হ্যাঁ।
কি করে হবে…একদিন দাদুদেরকে নিয়ে বেরোবো…একদিন বন্ধুদের সাথে বেরোবো…তোমাকে নিয়ে তাহলে আলাদা করে কি করে বেরোবো?
ঠোঁট উল্টে বোঝালো…সে আমি কি জানি…তুমি ভাবো কি করবে।
ওর দুষ্টূমি ভরা মুখের দিকে তাকিয়ে অরিত্র ভাবছিল…কি করা যায়…ওকে নিয়ে কাছাকাছি ঘুরে এসে তারপর একটু দেরীতে বন্ধুদের সাথে বেরোনো ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই বলাতে মাথা নেড়ে জানালো…চলবে।
বিকেল থেকে অরিত্রর টেনশান শুরু হয়ে গেল…বাচ্চাগুলো কি করবে কে জানে…যদিও শেষ দিনের রির্হাশাল দেখে তো মনে হয়েছিল ভালোই করবে…তবুও…বড়রা হলে না হয় হোতো…বাচ্চাদের নিয়ে কিছু করা সত্যিই টেনশানের। সাড়ে ছটায় নাটক শুরু হওয়ার কথা… চারটের মধ্যে সবাইকে আসতে বলা ছিল… বিকেলের চা খেয়েই দৌড়ল ক্লাবের দিকে। নাঃ…ঠিকই আছে…বাচ্চারা সবাই এসে গেছে…মেকআপ চলছে… এক এক করে সবার পিঠ চাপড়ে উতসাহ দিয়ে স্টেজের অবস্থা কি দেখতে গেল। যদিও চিন্তা করার কোনো কারন ছিল না… গত পাঁচ বছর ধরে একই লোক কাজ করছে… এতদিনে খুব ভালো বুঝে গেছে কি চাই। পাড়ার বাচ্চাদের নাটক… মা বাবা রা তো আসবেই, বাড়ীতে অন্য কেউ থাকলে তারাও আসে। মোটামুটি ছটার মধ্যে স্টেজের সামনের চেয়ারগুলো দখল হয়ে গেছে। ঠিক সাড়ে ছ টাতেই শুরু হল নাটক, তার আগে কালচারাল প্রোগ্রামের সেক্রেটারী হিসেবে শুভকে ছোট করে একটা বক্তব্য রাখতে হয়েছে…আজ থেকে তিন দিনের প্রোগ্রাম নিয়ে।নাটকের প্রথম দৃশ্য ঠিকঠাক মতো হয়ে গেলে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করল… মোটামুটি নয়… বেশ ভালোই অভিনয় করেছে সবাই। বাকিটা নিশ্চয় ভালোই করবে মনে হচ্ছে…ভেবে স্টেজের পাশে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল। একটু একটু করে নাটক এগোচ্ছে… দর্শকদের অভিব্যাক্তি বলছে খুব ভালো হচ্ছে।ছোট ছোট ছেলে মেয়ে গুলো যে এত সুন্দর অভিনয় করতে পারবে কেউই বোধ হয় ভাবতে পারেনি। পৌনেআটটায় নাটকের শেষ দৃশ্যের পর হাত দর্শকদের হাততালি যেন শেষ হতে চায় না… শেষ পর্যন্ত নাটকের সব বাচ্চাদের স্টেজে নিয়ে এসে পুজো কমিটির সেক্রেটারী, সুধন্য বাবু নিজের বক্তব্য শুরু করলেন… এত সুন্দর একটি নাটক দেখার সুযোগ করে দেবার জন্য আমাদের এলাকার স্বনামধন্য শিক্ষক অরুনাভ স্যরের নাতি অরিত্র ও আমার ভাইপো শুভর কাছে এবং যে সমস্ত ছোটোছোটো ছেলে মেয়েরা অংশ গ্রহন করেছে তাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। সত্যি কথা বলতে কি আমি নিজেই বারন করেছিলাম এত ছোটো বাচ্চাদের কে নিয়ে নাটক না করার জন্য… আমি যে ভুল ছিলাম সেটা ওরা সবাই প্রমান করে দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে ইচ্ছে থাকলে সব কিছুই করা সম্ভব।আপনারা সবাই নাটক টি দেখে নিশ্চয় বুঝেছেন… সত্যিকারের ইচ্ছে থাকায় কি ভাবে একটি সহায়সম্বলহীন ছেলে কিভাবে নিজের চেস্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছে, শুধু তাই নয় ভালো রেজাল্টও করেছে। আমি আশা করবো… আমাদের এলাকার ছেলেমেয়েরা যাদের সব কিছুই আছে…তারা নাটকটি দেখে উদুব্ধ হবে। আমি অরিত্র ও শুভ কে অনুরোধ করছি…দুজনেই যদি এখানে এসে আমাদের সবার অভিনন্দন গ্রহন করে। অরিত্র আর শুভ স্টেজের পাশে দাঁড়িয়েছিল… অরিত্র বরাবরই কিছুটা মুখচোরা…পেছনে থেকে সব কিছু করবে কিন্তু সামনে আসতে পারেনা…শুভ আবার ঠিক বিপরীত… জেঠুর কাছ থেকে মাইক্রোফোন টা নিয়ে বলতে শুরু করল… আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ আমাদের উতসাহ দেবারজন্য। আমার মতে অরিত্রর পাওনাটাই বেশি…আমি শুধু ওকে কিছুটা সাহায্য করেছি মাত্র। আপনারা যে নাটকটি দেখলেন তা কোনো কল্পনা নয়…সত্যি ঘটনার উপরে লেখা… অরিত্র আর আমি বছর দুয়েক আগে বীরভুম বেড়াতে গিয়েছিলাম… ওখানে আমরা এক চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে দোকানের ছেলেটির সাথে কথা বলে জানতে পারি… ওর বাবা প্রায় দু বছর নিরুদ্দেশ…বাড়ীতে দুটো ছোট ছোটো ভাইবোন,দাদু, ঠাকুমা… সাহায্য করার কেউ নেই…ছেলেটি ওর মায়ের সাথে মিলে ছোট্ট চায়ের দোকান চালিয়ে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল। ছেলেটির ইচ্ছা দেখে আমরা দুজনে কিছু সাহায্য করা শুরুকরি… ছেলেটি এই বছর মাধ্যমিক পাশ করেছে ৯০% মার্ক্স পেয়ে যা কি না যে সমস্ত ছেলে মেয়ে সমস্ত সুযোগ সুবিধা পায় তারাও সহজ়ে করতে পারে না। ছেলেটির পড়াশোনা যাতে আর বাধা নাপায় তার জন্য আমরা আমাদের ক্লাবের তরফ থেকে ওর পড়াশোনার সমস্ত ভার নিয়েছি এবং সাথে সাথে এই বছর থেকে যাতে আরো এই রকম মেধাবী দরিদ্র ছেলে মেয়েদের সাহায্য করা যায় তার জন্য আলাদা একটা ফান্ড আমরা তৈরী করেছি। আশাকরি আপনাদের সবার সাহায্য আমরা পাবো।
বাইরে যাবার প্রোগ্রামটা একটু পালটে নিয়ে…মৌ কে নিয়ে সপ্তমীর রাতেই বেরোবে ঠিক করে নিয়ে শুভকে বাকি সময়টা দেখে নিতে বললে শুভ এক কথায় রাজী হয়ে গেল। মৌ এর ব্যাপার টা মোটামুটি ওর জানা ছিল। মজা করে বলল… কি গুরু…শুধু প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘোরা নাকি… আরো কিছু আছে?
কি আবার থাকবে? তুই ও যেমন…কিছু করার ইচ্ছে থাকলে বাইরে যাবো কেন…
কে জানে বাবা… তুই কেমন করে নিজেকে সামলে রাখিস… আমি হলে তো কবেই… আর কিছু না হোক…
অরিত্র হেসে ফেলে বলল… থাক আর এগোস না… এই জন্যই তো তোর সাথে আমার এত বন্ধুত্ব… একেবারে উলটো বলেই বোধ হয় এত টান…
তা যা বলেছিস… আচ্ছা…যা…যেতে হবে যখন দেরী করিস না… আমি এদিকটা সামলে দিচ্ছি…চিন্তা করিস না।
তুই কবে বেরোচ্ছিস?
দাঁড়া…আমার প্রানেশ্বরী এখোনো নাকি বাড়ীতে ম্যানেজ করে উঠতে পারেন নি…
সে কি রে… সেদিন যে বললি বাড়িতে জানিয়ে দেবে…
আরে বললেই কি আর বলা যায় নাকি? ওর বাবা কে তো চিনিস… বাঘের বাচ্চা…বলতে গিয়েও ব্যাক গিয়ার দিয়ে দিয়েছে…
তুই কাকুকে দিয়ে বলাচ্ছিস না কেন? বাড়ীতে বলিসনি নাকি?
মা কে একটা আভাস দিয়ে রেখেছি…দেখি তাই করতে হবে… আর ভালো লাগছে এই ভাবে লুকোচুরি খেলতে…
ঠিক আছে চল… কাল সকালে তোদের বাড়ী যাচ্ছি… চিন্তা করিস না…কাকীমা কে দিয়ে কাকুকে ঠিক ম্যানেজ করে নেবো…আসি রে…
দিদানরা কিছুক্ষন আগেই নাটক দেখে ফিরে এসেছে… নাটক চলাকালীন ওখানেই দিদান কে বলে দিয়েছিল আজকেই মৌ কে নিয়ে বেরোবে। মৌ একাই বেরোবে বলে তৈরী হচ্ছে…আজ তো আর রুপসা নেই যে সাজিয়ে দেবে…শুক্লাদি কিছুক্ষন পর অরিত্র কে ডেকে বলল… গিয়ে দেখ… চুপ করে বসে আছে… কি পরবে ঠিক করতে পারছে না।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
তুমি দেখে দাও না…আমি আবার কি করবো গিয়ে…
শুক্লাদি হেসে ফেলে বলল…দিয়েছিলাম…কোনোটাই পছন্দ নয়…তুই গিয়ে দেখ।
ঠিক আছে চলো।
ওর ঘরে গিয়ে দেখা গেল যতজামাকাপড় ছিল সব বিছানায় ছড়ানো…এক পাশে মুখ ভার করে বসে আছে। অরিত্র কে দেখতে পেয়েই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল… যেন বোঝাতে চাইলো… তুমি এসে গেছো? কি পরবো দেখে দাও না…
সব গুলোই খুব সুন্দর…বাছাবাছির তেমন কিছু নেই দেখে দু একটা দেখে নিয়ে একটা জমকালো দেখে কিছু একটা তুলে হাতে দিলে খুব খুশী…অরিত্র নিজেও জানে না ড্রেসটার কি নাম…সাউথ সিটি মলে গিয়ে ভালো লেগেছিল বলে মৌ আর দু বোনের জন্য একই জিনিষ নিয়েছিল…আজকাল মেয়েদের কতরকম নতুন নতুন ডিজাইনের ড্রেসআসছে যে নাম মনে রাখা মুশকিল…তার উপরে এতদিন এসব নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকারই পড়েনি… মৌ একবারের জন্যও দেখলো না ওকে কেমন লাগবে…হাসি মুখে বোঝালো…এটাই ঠিক আছে।
শুক্লাদি পাশ থেকে হেসে ফেলে বলল… কি রে মৌ…একটু আগেই তো আমিও দিয়েছিলাম… তখন তো মাথা নেড়ে এমন করে না বললি যে…মনে হচ্ছিল ওটার থেকে খারাপ আর কিছু হয় না।
লাজুক একটা মিষ্টি হাসিতে বোঝালো… তোমার দেওয়া আর ওর দেওয়া কি এক? ও যা দেবে সেটাই সব থেকে ভালো।
শুক্লাদি বুঝতে পেরে ওকেজড়িয়ে ধরে বলল…বুঝেছি…যা…তাড়াতাড়ি পরে নে… আর কখন বেরোবি।
নবমী অব্দি কিভাবে কেটে গেল বোঝা গেল না…পূজো আসছে ভাবতে কত ভালো লাগে…কিন্তু কি করে যে চারটে দিন কেটে যায় কে জানে।আজ বিজয়া দশমী…পাড়ার অনেকেই বাইরে কোথাও বেরোবে বলে বিসর্জন একটু তাড়াতাড়ি সেরে নেওয়া হয়। সন্ধের মুখে দিদানের সাথে মৌ সিন্দুর খেলা দেখতে গেছে, অরিত্র শরীর টাভালো ছিল না বলে বাড়ী থেকে বেরোয় নি…ড্রয়িং রুমে দাদুর সাথে বসে টিভিতে পুজো পরিক্রমা দেখছিল, আটটা নাগাদ ওরা ফিরলো…দিদানের মতো মৌ এর ও সারা মুখে সিন্দুর মাখানো। দাদু দিদান আর শুক্লাদিকে বিজ়য়ার প্রনাম করে শরীর টা ভালো লাগছে না…একটু শুয়ে নি বলে ও উপরে গিয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষন পর কপালে কারুর হাতের ছোঁয়া পেয়ে তাকিয়ে দেখে মৌ, ওর দিকে তাকিয়ে আছে…চোখে মুখে কিছুটা চিন্তার ছাপ…যেন বলতে চাইছে…খুব শরীর খারাপ লাগছে?
ওর হাতটা ধরে নিজের গালে আলতো ভাবে চেপে ধরে বুকের ভেতরটা যেন অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে উঠল…ওর টুকটুকে ফর্সা মুখে লাল সিন্দুরের দাগ…ওকে যেন আর মোহময়ী করে তুলেছে… খুব ইচ্ছে করছিল… বুকে টেনে নিয়ে জ়ড়িয়ে ধরে আদর করে বলতে…তোমাকে একান্ত ভাবে নিজের করে নিতে চাইছি…কিন্তু পারছিনা…তুমি কি বুঝতে পারছো? না বলা কথা গুলো নিজের ভেতরে চেপে রেখে মুখে হাসি এনে বলল…তেমন কিছু হয় নি…রাতে ভালো করে ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে।
মৌ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কি বুঝলো কে জানে…ইশারা করে বোঝালো ও বিজয়ার প্রনাম করতে চায়।
এই দেখো…আমাকে আবার কেন?
আবার ইশারা করে বোঝালো…ওকে প্রনাম করতে দিতেই হবে।
মৌ ওর পা ছুঁয়ে প্রনাম করে উঠে দাঁড়ালে ওর কাঁধে হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…প্রনাম তো করলে…কিন্তু কি বলে তোমাকে আশীর্বাদ করি বলতো। মৌ চোখ বুজে থেকে একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে যেন বোঝাতে চাইলো…আমার যে তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাই না…আমি কি চাই তা কি তুমি কোনোদিনও বুঝেও বুঝবে না?
পরের দিনটা শুরু হল বাকি আর পাঁচটা বিজয়া দশমীর পরের দিন হিসেবে। ফোন আর এসএমএসে বিজ়য়া দশমীর শুভেচ্ছা আদান প্রদান চলছিল সকাল থেকেই। যারা বাড়ীতে আসার তারা আর একটু পর থেকেই আসতে শুরু করবে। অরিত্রর শরীর মোটামুটি ভালোই। দশটা নাগাদ নারায়নদা নাতনী প্রিয়া কে সাথে নিয়ে প্রতি বছরের মতো একটা মিষ্টির প্যাকেট হাতে নিয়ে হাজির। প্রিয়া ওর দাদুর মুখে মৌ এর ব্যাপারে শুনেছিল কিন্তু এই প্রথম নিজের চোখে দেখলো। মৌ কে দেখার পর থেকেই প্রিয়া চিন্তা করছিল…কোথাও যেন ওকে দেখেছে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছে না। হঠাত মনে হল…কলেজে দেখেনি তো? সপ্তাহে একদিন ও অনেক সকালে টিউশান পড়তে যায় কলেজের এক স্যারের কাছে। কলেজ থেকে খুব বেশী দুরে নয় বলে টিউশান থেকে বেরিয়ে যখন কলেজে আসে তখনও মর্নিং সেকশানের ক্লাস শেষ হতে কিছুটা বাকি থাকে বলে কলেজের সামনে অপেক্ষা করতে হয়। মনে হয় মর্নিং সেকশানের ছুটির পর ওকে দেখেছে কিন্তু ঠিক কিনা বুঝতে পারছে না। হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। বাড়ী ফিরে দাদুকে বলতেই দাদু ওকে একটু বকাবকি করল…কেন তুই ওখানেই বলিস নি…জানিস অরিত্র দাদাভাইরা কত চেষ্টা করেছে মৌ দিদি কে জানার জন্য। সাথে সাথেই আবার নারায়নদা ফিরে এল প্রিয়া কে সাথে নিয়ে। মৌ নিচে না থাকায় ওদের সুবিধা হল ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতে, মোটামুটি প্রিয়ার কাছ থেকে যেটুকু জানা গেল তাতে বিশেষ কিছু বোঝা না গেলেও একটা আশার আলো দেখা গেল। হয়তো কলেজে গিয়ে খোঁজ নিলে কিছু জানা যেতে পারে কিন্তু কলেজ খুলতে তো সেই লক্ষী পূজোর পর, এই কটা দিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো গতি নেই। দাদু এক ফাঁকে বিশ্বাস কাকুকে ফোন করে মোটামুটিভাবে বুঝিয়ে দিল। যে কেউ গেলে তো আর কলেজ কতৃপক্ষ কোনো কথা বলবে না, পুলিশকে দিয়েই খোঁজ নিতে হবে। আর একটা রাস্তা আছে, কলেজ ইউনিয়ান থেকে খোঁজ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু সে ও তো কলেজ খোলার আগে সম্ভব নয়। বিশ্বাস কাকু ছুটি নিয়ে বাড়ী এসেছে দেখে মৌ এর একটা ফোটো নিয়ে অরিত্র এক ফাঁকে দিয়ে এল। মনের ভেতরে ভীষন তোলপাড় হচ্ছিল, এবারে হয়তো কিছু একটা জানা যাবে। রুপসা আর পুবালীকে ফোন করে জানাতে ওরা তো প্রায় লাফিয়েই উঠল, দুজনেই জানে মৌ এর পরিচয় না জানায় অরিত্র চাইলেও এগোতে পারছে না।
প্রতি বছরই বেশ কয়েকদিনের জন্য কোথাও বেড়াতে যাওয়া ওদের অনেক বছর ধরে চলছে, চাকরী পাবার আগে দাদুই নিয়ে যেত আর এখন যেহেতু ও নিজে খরচ করতে পারে তাই দাদুকে খরচ করতে দেয় না।এবারেও যাবার সব কিছু ঠিক করা আছে। লক্ষী পুজোর পরদিন বেরিয়ে দার্জিলিং আর গ্যাংটক হয়ে ফিরবে, আগেও দুবার গেছে কিন্তু সব জায়গা গুলো এখোনো দেখা হয়ে ওঠেনি। দিদানের প্লেন চড়তে খুব ভয় থাকায় ট্রেনেই যাওয়া আসা করতে হবে না হলে বাগডোগরা পর্যন্ত প্লেনে যাওয়া আসা করা যেত। মৌ এর ব্যাপারে খোঁজ নেবার জন্য নিজ়ে কোলকাতায় থাকলে ভালো হ’ত কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই, বিশ্বাস কাকুর সাথে ফোনে যোগাযোগ রাখতে হবে। বেড়াতে যাবার আগে কয়েকটা দিন অফিস করতে একেবারেই ভালো লাগছিল না, আশা নিরাশার দোটানায় মনের ভেতরে ভীষন একটা অস্থিরতা…কি হবে…যদি কিছু না জানা যায়। বাড়ীতে ফিরে নিজের মনের অবস্থাও চেপে রাখতে হচ্ছে…মৌ কে কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না। ডাক্তার বার বার সাবধান করে দিয়েছিল…কোনোভাবেই ও যেন কোনো মানসিক চাপের মধ্যে না থাকে…তাতে আরো খারাপ হলেও হতে পারে। এই রকম একটা অবস্থার মধ্যে বেরোনোর জন্য গোছগাছ চলছিল, বাইরে যাওয়া তো নয় যেন দক্ষযজ্ঞ, শুধু তো আর জামাকাপড়নিয়ে বেরিয়ে পড়লে হবে না, দাদুদের প্রেসক্রিপশান, ওষুধ, হটব্যাগ, তার সাথে একটা জিনিষতো চাই ই চাই দাদুর, টি পট নিতেই হবে, দাদুর আবার দার্জিলিং ফ্লেভার ছাড়া চলে না। যদিও দিদান আর শুক্লাদি এসব ব্যাপারে ভুল করেনা তবুও অরিত্র নিজে একবার দেখে নেয়। মৌ বেড়াতে যাওয়া হবে বলে ভীষন খুশী, দিদান আর শুক্লাদির সাথে সব সময় থেকে অনেকটাই সাহায্য করছে গোছগাছ করতে।
মোটামুটি ভালো ভাবেই ওরা দার্জিলিং পৌঁছে গেছে।রাতের ট্রেন জার্নি আর পরের দিন পাহাড়ী রাস্তায় গাড়ী করে এসে সবাই বেশ ক্লান্ত বলে প্রথম দিন আর কোথাও না বেরিয়ে বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন থেকে শুরু করা হবে ঠিক হল। এমনিতেও তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে সুস্থে যাতে ঘোরা যায় তার জন্য হাতে এক দিন বেশি রেখেই হোটেল বুক করা আছে। সন্ধের দিকে ঝির ঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল, সবাই ঘুমোচ্ছে দেখে অরিত্র একটা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। পাহাড়ী রাস্তায় বৃষ্টির মধ্যে কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে ফিরে এসে দেখল তখোনো কেউ ওঠেনি। ঠান্ডাও বেশ জমিয়ে পড়েছে দেখে হোটেলের বারে গিয়ে এক পেগ হুইস্কি নিয়ে বসার পরই বিশ্বাস কাকুর ফোন এল। বিস্বাস কাকু নিজেই গিয়েছিলেন কলেজে,পুলিশ বলে পরিচয় দেওয়াতে কাজও হয়েছে। প্রিন্সিপাল ছবি দেখে চিনতে না পারলেও দুজন অফিস স্টাফ মোটামুটি একটা আভাস দিয়েছেন যে মেয়েটি ওই কলেজেরই ছাত্রী ছিল, খুব সম্ভবত গত বছরই বিএ অনার্সের ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে কিন্তু কাগজপত্র না দেখে বলা সঠিক করে বলা সম্ভব নয়। অফিসের কাগজপত্র খুঁজে নাম ঠিকানা বের করে দেখার জন্য আগামীকাল আবার যেতে অনুরোধ করেছেন উনারা। বুকের ভেতরে একটা আশার আলো নিয়ে ওদের দু বোনকে কন কলে নিয়ে জানালো কতটা কি হয়েছে। ওদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে পেগটা শেষ করে উঠবে ভাবছিল এমন সময় রিশেপশানের দিকে চোখ পড়ল, মৌ এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজছে, ওকেই খুঁজছে বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি উঠে যেতেই ওকে দেখতে পেয়ে সারা মুখে যেন খুশী উছলে উঠল আর তার সাথে দু চোখে বকুনি দেবার ইচ্ছে…কোথায় ছিলে তুমি…কখন থেকে খুঁজছি তোমাকে। ওর হাত ধরে ফিরে এসে বসতে বললে…এদিক ওদিক তাকিয়ে দু চোখে অবাক জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকালো…তুমি এখানে কি করছো…তুমি আবার এই সব খাও নাকি?
অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলল…আগে বোসো…বলছি।
মৌ অনিচ্ছা সত্বেও বসার পর গায়ের শালটা একটু ঠিক করে নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলো…দু চোখে সেই একই জিজ্ঞাসা নিয়ে।
অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল…আমি সব সময় খাই না…অফিসের পার্টি থাকলে একটু আধটু খেতেই হয়…না হলে খারাপ দেখায়…আর…এমনিতে আমার প্রেসার কম বলে হয়তো… একটা কি বড় জোর দুটো পেগ খেলেই…বেশ ঘুম ঘুম ভাব এসে যায় … তার বেশী খেলে কষ্ট হয় বলে আর খাই না…দাদুরা জানে…
আস্তে আস্তে ওর মুখ থেকে অবাক জিজ্ঞাসা কেটে গিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়ার ভাব ফিরে এলে…গ্লাসটা দেখিয়ে ইশারা করে বোঝালো…এটাই শেষ?
অরিত্র হাসি মুখে জবাব দিল…হুম…এটাই প্রথম…আর এটাই শেষ…বুকের ভেতরে আরো একটা না বলা কথা ঝঙ্কার দিয়ে যেন বেরিয়ে আসতে চাইলো…ঠিক তোমারই মতো…তুমিই প্রথম…তুমিই শেষ…আমার জীবনে। ইচ্ছে তো হয় বলতে কিন্তু এখনই পারবোনা…ভাবতে ভাবতে বলল…তুমি একটা জুস নাও…আমি ততক্ষনে আমারটা শেষ করে ফেলি।
মাথা নাড়িয়ে জানালো…আচ্ছা।
ওয়েটারকে ডেকে জুস দিতে বলে ওর গায়ের শালটার দিকে তাকিয়ে খুব চেনা চেনা লাগলো, মায়ের বিয়ের আগের খুব প্রিয় একটা দামী কাশ্মীরী হাতের কাজ করা টকটকে লাল শাল, দিদান খুব যত্ন করে এত বছর রেখেছে। নিজের একমাত্র মেয়ের প্রিয় শালটা এতদিন স্মৃতি হিসেবে রাখার পরেও আজ দিদান কি ভেবে ওকে দিয়েছে বুঝতে একটুও অসুবিধা হল না কিন্তু বুকের ভেতরে সেই কষ্টটা ফিরে আসতে চাইলে জোর করে আটকে রেখে বলল…তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। মৌ ওর মুগ্ধ চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে একটু যেন লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিল…ওরও বুকের ভেতরে একটা ব্যাথা মুচড়ে উঠে বলতে চাইলো…দিদান আমাকে সব বলেছে…এটা তোমার মায়ের খুব প্রিয় ছিল…তুমি নাকি মাঝে মাঝে তোমার বুকে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমোতে…বিস্বাস কর…আমি প্রথমে নিতে চাইনি…বুঝতে পারি দিদান আমাকে কি চোখে দেখতে চায়…না বলতে পারিনি…তাই নিয়েছি…জানি না…নিজের কাছে রাখতে পারবো কিনা…তুমি যদি সেই অধিকার আমায় না দাও…কি করে রাখবো আমার কাছে? কেন জানিনা…তোমাকে ঠিক বুঝতে পারিনা…তুমি কি সত্যিই আমাকে চাও না? বলতে চাইলেও তো সব সময় সব কিছু বলা যায় না…আরো অনেক না বলা কথার মতো এটাকেও বুকে আটকে রেখে লাজুক হাসি মুখে নিয়ে ওর দিকে মুখ তুলে তাকালো…ঠিক যেন বলতে চাইছে…তাই? আমাকে খুব সুন্দর লাগছে?
অরিত্র দু চোখের মুগ্ধতা দিয়ে ওকে স্পর্শ করতে করতে বলল…সত্যিই…তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে। মৌ ওর হাতটা ধরে আলতোভাবে চাপ দিয়ে যেন বোঝাতে চাইলো… তোমার চোখ দিয়েই আমি নিজেকে দেখতে চাই সারা জীবন…
পরের দিন সকালে আকাশে আর মেঘ নেই, ভোর রাতে উঠে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখে দিন শুরু হয়েছে। সত্যিই আজ ওদের কপাল ভালো ছিল…এর আগের বার আকাশে এত মেঘ ছিল যে সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি। ঝকঝকে পরিস্কার আকাশ, পাহাড়ী নরম রোদ মাতাল হাওয়ার সাথে লুকোচুরি খেলতে খেলতে গা ছুঁয়ে যেন আদর করে যেতে চাইছে। বাতাসিয়া লুপ থেকে চারদিকটা ভীষন ভালো লাগে দেখতে…এমনিতে তাড়াহুড়ো নেই তার উপর দিদান আর শুক্লাদি সেই কখন থেকে সোয়েটার দেখে যাচ্ছে দেখে অরিত্র এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল…দাদুর সাথে মৌ গেছে গাড়ীর দিকে…দাদু সকালের ওষুধটা খেতে ভুলে গিয়েছিল আজ। এগারোটা বেজে গেছে দেখে অরিত্র বিস্বাস কাকুকে ফোন করল কিছু খবর আছে কিনা জানার জন্য। বিশ্বাস কাকু ফোনটা ধরে বলল…অনেক দিন বাঁচবি রে…তোকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম…বল…তোরা কেমন ঘুরছিস? বিশ্বাস কাকুর গলা শুনে মনে হল আজ কিছু ভালো খবর আছে। নিজেই একটা প্রশ্ন করলেও উত্তরের অপেক্ষা না করে কাকু বলল…শোন…অপারেশন মৌ সাকসেসফুল…আজ যাতে আর ঘোরাতে না পারে ভেবে সকাল বেলাতেই চলে গিয়েছিলাম। নাম ঠিকানা সব পাওয়া গেছে। তারপর জোড়াবাগান থানার মেজোবাবুকে পাকড়াও করে ঠিকানা খুঁজে চলে গিয়েছিলাম। ঠিকানাও পাওয়া গেছে কিন্তু বাড়ীতে কাউকে পাওয়া যায়নি।আশেপাশে জিজ্ঞেস করে জানলাম…কোথাও বেড়াতে গেছে…দিন দশেক পরে ফিরবে।
বুকের ভেতরে যতটা আশা জেগেছিল ততটাই নিরাশা ফিরে এল। একই রকম বা অনেকটা মিল আছে চেহারাও মুখের এমন কেউ তো হতে পারে ভেবে বলল…ঠিক জায়গাতে পৌছনো গেছে কিনা তো বোঝা গেল না।
কাকু হয়তো জানতো ও কি বলতে পারে…তাই…আস্বস্ত করে বলল…শোন…এত বছর পুলিশে চাকরী করে কি কিছুই শিখিনি রে…বাজিয়ে দেখে নিয়েছি…পাশের বেশ কয়েকটা বাড়ীর লোকজনের সাথে কথা বলেছি। নর্থ কোলকাতা তো জানিস কি রকম…সবাই সবাই কে চেনে। অনেক বছর ধরে পাশাপাশি থাকলে যা হয়।
কিছু ডিটেলস পেলে?
হ্যাঁ রে পেয়েছি…কিছু নয়…অনেকটাই…ভালো নাম…মৌমিতা গাঙ্গুলী…ডাক নাম…মৌ…আমি তো ডাক নামটা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম…তোর দেওয়া নামের সাথে কি করে যে মিলে গেল…যাক গে… গত বছর বি এ অনার্স পাশ করেছে…রেজাল্ট ভালো…স্বভাব চরিত্রও ভালো…কোনো খারাপ কিছু কেউ দেখেনি…তবে বেশ কিছুদিন ধরে দেখতে না পেয়ে কেউ কেউ জিজ্ঞেস করলে ওর মা নাকি বলেছে বিদ্যাসাগর ইউনিভার্সিটিতে এম এ পড়ছে…হোস্টেলে থাকে… বাবা মারা গেছে বছর দুয়েক আগে একটা দুর্ঘটনায়…নিজের মা অনেক আগেই ছোটো বেলায় মারা গেছে…সাডেন হার্ট ফেলিওর…বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ এর দিক থেকে এক ছেলে আর এক মেয়ে…ছেলেটা বড়…ভালো নাম আকাশ, ডাক নাম বিল্টু…ক্লাস টেনে পড়ছে…মেয়ের ভালো নাম সম্পূর্না, ডাক নাম মিষ্টি… এখন এইটে পড়ছে…বাবার ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসা এখন মা দেখে…টাকা পয়সা মোটামুটি ভালোই আছে…অন্তত…আশে পাশের লোকজনের তাই ধারনা।
তাহলে…কি এমন হতে পারে…যার জন্য হয়তো বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল…বুঝতে পারছি না।
হুম…ঠিকই ধরেছিস…নিশ্চয় এমন কিছু আছে যা আশে পাশের লোকজন জানে না…সেটাই আমাকে খুঁজে বের করতে হবে…কিন্তু এখন আরঅপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই…বাড়ীর লোকজন ফিরুক…তারপর দেখছি কি করা যায়…ভেতরের খবর বের করতে হলে একটু বেগ পেতে হবে মনে হচ্ছে। মা আছে কিন্তু নিজের নয়, দু দুটো ভাই বোন…বাবা নেই…সম্পত্তির অধিকার থেকে হটানোর একটা গন্ধ পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। যাক গে…তোরা ভালোভাবে ঘুরে আয়…দাদুদের কে জানাস…আমি আর আলাদা করে ফোন করছি না…বুঝলি?
হ্যাঁ ঠিক আছে…কাকু তোমাকে কি বলে যে thanx জানাবো…
ওকে কথা শেষ করতে না দিয়ে কাকু বলল…শোন…আমাকে তোর আর ওইসব জানিয়ে নিজেকে ছোটো করিস না…তোর দাদু দিদান আমাদের জন্য যা করেছে তা আমরা কোনোদিন ভুলতে পারবো না। এতদিন পর তোদের জন্য কিছু একটা করতে পেরে মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও ঋন মুক্ত হতে পারবো। আর শোন…ভালো কথা…মেয়েটাকে একা একা একদম ছাড়বি না…বলা যায় না…নিশ্চয় খারাপ কিছু উদ্দেশ্য আছে…গুন্ডা লাগিয়ে কিছু একটা করতে পিছপা হবে না…না হলে মেয়েটা নিরুদ্দেশ হয়ে যাবার পর পুলিশের কাছে কেন যায়নি… টাকাপয়সা খুব খারাপ জিনিস…বুঝলি…নিজের বাপ ছেলেকেও খুন করতে পিছপা হয় না…আর এ তো…নিজের মা নয়। পুলিশের চাকরী করতে গিয়ে যে কত কিছুর সামনা করতে হয় সে আমি হাড়ে হাড়ে জানি।
বুকের ভেতরে একটা ঠান্ডাস্রোত বয়ে গেল…তবুও নিজেকে ঠিক রাখার কিছুটা চেষ্টা করে বলল…ঠিক আছে কাকু…এমনিতে ও বাইরে একা কোথাও যায় না…গেলেও আমরা কেউ না কেউ সাথে থাকি।
ঠিক আছে…এখন রাখ…বেশি চিন্তা করিস না…আমি বরং দার্জিলিং থানায় একবার ফোন করে দিচ্ছি…তোদের উপর যেন একটু নজর রাখে।ওখান থেকে গ্যাংটক যাবার আগে একবার জানিয়ে দিস…ওখানেও বলে রাখবো। আর শোন…এত কিছু দাদুদেরকে বলিস না…বুড়ো বয়সে চিন্তা করতে গিয়ে আবার কিছু না হয়ে যায়।
এতদিন বুকের ভেতরে যে চিন্তাটা ছিল সেটা কাকুর কাছ থেকে খবর পাবার পর অনেকটাই ঠিক হয়ে গেলেও…নতুন এক চিন্তা বুকের ভেতরটা তোলপাড় করতে শুরু করে দিয়েছে। হঠাত মনে পড়ল…ও দাদুর সাথে গাড়ীর দিকে গেছে…এখোনো ফেরেনি…তাড়াতাড়ি দিদানরা কোথায় আছে দেখে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে গিয়ে বুকে প্রান ফিরে এল…মৌ*…দাদুর হাত ধরে উপরের দিকে আসছে…দাদু কিছু একটা বললে সারা মুখে লাজুক হাসি ছড়িয়ে দাদুর হাত ছেড়ে দিয়ে যেন বলতে চাইছে…যাও…তোমার সাথে আড়ি…
দাদু দাঁড়িয়ে পড়ে আবার কিছু একটা বললে…ঠোঁট চেপে হাসতে হাসতে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়ে যেন বলতে চাইছে…হ্যাঁ…
এত সুন্দর একটা নিস্পাপ মেয়ের কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করতে পারে বিশ্বাস করা খুব কঠিন ভাবতে ভাবতে আশে পাশে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল…কেউ সেভাবে ওর দিকে নজর রাখছে কিনা। নাঃ… কিছু বিভিন্ন বয়সের মানুষ যারা সুন্দরী মেয়ে দেখলে দু চোখ দিয়ে গিলতে চায়…সেই রকম কয়েক জন ছাড়া সে রকম কিছু চোখে পড়ল না। বাকিরা নিজেদের নিয়ে ব্যাস্ত। এত বড় একটা খবর দাদুদের কে না দেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিল না কিন্তু ওর সামনে তো বলা যাবে না দেখে ইচ্ছে করেই মৌকে দিদানদের কাছে দিয়ে এসে দাদুকে মোটামুটি যতটা বলা যায় বলে ওদের দু বোন কে ফোন করল…
রুপসা চুপচাপ শোনার পর জিজ্ঞেস করল…তো…দাদাভাই…এবারে কি?
এবারে কি মানে?
ধুস…তুই না…একটা যাচ্ছেতাই…তোর একটা প্রশ্নের তো উত্তর পেয়ে গেছিস…
ওর সাথে এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই দেখে বলল…আমি এখন ওসব নিয়ে কিছু ভাবছি না…কাকু আগে বাকি খবর গুলো নিক…
হুম…তবে তাই হোক…আমি কিন্তু বলে দিচ্ছি দাদাভাই…তুই যদি আর কাউকে বিয়ে করিস…দেখে নিস কি করি…তোর সাথে আর কোনোদিন কথাই বলবো না।
বোনটা সত্যিই পাগল…কিছু বুঝতে চায়না ভেবে বলল…আচ্ছা ঠিক আছে…চল…বিয়ে যদি করতেই হয় ওকেই করবো…আর না হলে কাউকেই নয়…তাহলে হবে তো?
কি আর করবো বল…তুই তো আর আমি নই…এই ছোড়দি…তুই আছিস লাইনে? কিছু বল না…
পুবালী কিছু না বলে চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল…রুপসার কথা শুনে বলল…ভাই ঠিকই বলেছে…এখনই সব কিছু ভেবে নেওয়াটা ঠিক হবে না…
ওর কথা শেষ হতে না হতেই রুপসা বলে উঠল…ঠিক আছে…ঠিক আছে…চল…তোরা সব গোমড়ামুখো হুতুম প্যাঁচার দল…সব সময় এটা কি হবে…ওটা কি হবে…এই নিয়েই আছিস…আমি আর কিছু বলবো না …যা…আমার বয়ে গেছে…যেন ওর সাথে বিয়ে হলে আমার কিছু লাভ আছে…একটা মাত্র দাদাভাই…ভালোবাসি…তাই বলি…না হলে আমার কি আসে যায়। এই…ছোড়দি…রাখছি এখন…পরে ফোন করিস।
রুপসা অভিমান করে ফোনটা কেটে দিলে পুবালী বলল…ভাই…মন খারাপ করিস না…মাথা গরম হয়ে গেছে…তোকে ফোন করতে হবে না…ওই দেখবি নিজেই ফোন করবে…আমি তো চিনি ওকে…দাদাভাই বলতে পাগল…নিজেকেও বোধহয় এত ভালোবাসে না।
জানি…আচ্ছা…রাখি রে এখন…রাতে ফোন করবো।
পুবালির লাইনটা কাটতেই সাথে সাথে একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন এলে ধরবে কি ধরবে না ঠিক করতে পারছিল না…কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর কি মনে করে ধরলে ওদিক থেকে জিজ্ঞেস করল…আমি কি অরিত্র সেন এর সাথে কথা বলতে পারি?
আমিই অরিত্র…বলুন।
আমি রঞ্জন দাশগুপ্ত… দার্জিলিং থানা থেকে বলছি… মিঃ বিশ্বাস আপনার ব্যাপারে এখুনি ফোন করেছিলেন।
ও আচ্ছা…হ্যাঁ…বলুন…আমার সাথে একটু আগেই ওনার কথা হয়েছে।
মিঃ বিশ্বাস…সব কিছু বলেছেন…আমরা আছি…চিন্তা করবেন না…আপনাদের হোটেলের নাম, রুম নাম্বার আর গাড়ীর নাম্বারটা দিন…আমি প্লেন ড্রেসে একজন কে আর্মস দিয়ে পোস্টিং করে দিচ্ছি…খুব কাজের ছেলে…কিছু মনে হলেই সাথে সাথে আমার এই নাম্বারে ফোন করবেন…
গাড়ীর নাম্বারটা শুনেই বললেন দুধ সাদা টয়োটা তো? ড্রাইভার কে আছে? পবন বাহাদুর? বেঁটে গোলগাল চেহারা…ডান গালে একটা ছোটো কাটা দাগ আছে?
হ্যাঁ… বলাতে বললেন…আরো ভালো হল…ছেলেটার সাথে আমাদের ভালো যোগাযোগ আছে…ওকেও একবার ফোন করে নিচ্ছি…আমার অর্ধেক কাজ ওকে দিয়েই হয়ে যাবে…একাই পাঁচটা লোকের মহড়া নেবার ক্ষমতা আছে ওর।
এত কিছু জানলেন কি করে জিজ্ঞেস করাতে বললেন…আরে মশাই…আমরা পুলিশের লোক…সবাই কে জানতে হয়…কখন কাকে কি কাজে লাগে কে জানে…হো হো করে হেসে উঠে বললেন…আপনারা তো ভাবেন পুলিশ মানেই কিছু করে না…অপদার্থ…ঘুষ খায়…
তা অবশ্য ঠিক…খবরের কাগজ আর টিভিতে যা দেখি…অবশ্য মাঝে মাঝে পুলিশের মানবিক দিকটাও খবরে আসে…
যাক গে…আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন…আমার আবার একটু বেরোতে হবে… চা বাগানে একটা হাফ মার্ডার কেস হয়েছে…দারু গিলে মেয়ে নিয়ে মারামারি…আর ভাল্লাগে না…সারাদিন এইসব কেস ঘেঁটে ঘেঁটে… নিজে যে ভদ্রলোকের ছেলে ভুলেই গেছি…
ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে দিদানদের ডাকতে গিয়ে খেয়াল হল…এই যাঃ…ওনার পরিচয়টা তো জানা হল না…কি ভাবলো কে জানে…ঠিক আছে পরে একবার ফোন করে কথা বলে নেওয়া যাবে ভেবে এগিয়ে যেতে গিয়ে দেখলো…দাদু ওদের কে নিয়ে আসছে।সবার হাতেই একটা করে বড় প্যাকেট…আবার এক গাদা সোয়েটার কিনেছে নিশ্চয়…কি করবে কে জানে…বললেও শোনে না। নিচে নেমে গাড়ীর কাছে গিয়ে পৌঁছোলে পবন তাড়াতাড়ি এসে গাড়ীর দরজা খুলে দিলে এক এক করে সবাই উঠে পড়লে জিজ্ঞেস করল…
সাব…আভি কাঁহা যানা হ্যায়…
দাদু হোটেলের দিকে ফিরতে বলল…বেলা হয়ে গেছে…স্নান খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার বেরোনো যাবে। হোটেলের সামনে পৌঁছোনোর পর পবন কিছুতেই সোয়েটারের প্যাকেট গুলো কাউকে নিতে দিল না…ও পৌঁছে দেবে। ছেলেটা সত্যিই খুব ভালো…প্রথম থেকেই খুব খাতির যত্ন করছে। অরিত্র সবাই চলে যাবার পর কি কি নিতে হবে দেখে নিয়ে এগোতে গেলে পবন বলল…
সাব…থোড়া রুকিয়ে…আপকে সাথ বাত হ্যায়…
অরিত্র দাঁড়িয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকালে…পবন প্যাকেট গুলো আবার গাড়ীতে রেখে বলল…সাব…থানা সে বড়া সাবজী কা ফোন আয়া থা…আপলোগ উনকা মেহমান হ্যায়…হামকো পাতা নেহি থা…বড়া সাবজী ভাবীজী কা বারে মে মেরেকো বাতায়া…আপ চিন্তা মত কিজিয়ে…ম্যায় যব তক জিন্দা হুঁ…কিসিকা দম নেহি হ্যায় ভাবীজী কো ছুঁনে কা…আপলোগ ইতনা আচ্ছা আদমী হ্যায়…আপলোগোকে লিয়ে কুছ করনে কা মওকা মিলনা ভি বড়ী বাত হ্যায়…কিতনা আদমী আতা হ্যায়…সব হাম জ্যায়সা ছোটা আদমী কো কিতনা বুরা নজরসে দেখতে হ্যায় লেকিন আপলোগ কিতনা পেয়ার হামকো দে রহে হ্যায়…আপনা ঘরকা আদমী য্যায়সা…হাম কভি…আপ লোগোকো নেহি ভুলেঙ্গে…
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
ও যে মৌ এর কথা বলছে বুঝতে অসুবিধা হোলো না…যা ভাবছে ভাবুক…এখন আর ওর ভুল ভাঙ্গিয়ে লাভ নেই…বড় বাবু কতটা কি ওকে বলেছে জানেনা…যদি দাদুদের সামনে আবার কিছু বলে বসে এই ভয়ে ও পবন কে বলল…আপ…মেরা ঘরবালো কো কুছ মত বাতানা…ঠিক হ্যায়?
হাঁ সাব…বড়া সাব ও ভি বাতায়া।সমঝমে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনি পেয়ারী হ্যায়…উনকি নুকসান কৌন কিঁউ করনা চাহাতা হ্যায়…
ওহি তো বাত হ্যায়…
সাব…অউর এক বাত সমঝ মে নেহি আতা হ্যায়…ভাবীজী ইতনা খুশ রহতী হ্যায়…লেকিন কভি বাত কিঁউ নেহি করতি।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…ও বাত নেহি কর সকতী…মতলব…করতি থি…লেকিন আভি…
পবন যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…কেয়া বোল রহে হ্যায় সাব…মেরেকো বিসওয়াস নেহি হো রাহা হ্যায়… পাতা নেহি…আচ্ছা আদমীকো ভগওয়ান কিঁউ ইতনা দুখ দেতি হ্যায়…আপ এক কাম কিজিয়ে না সাব…ভাবীজী কে লিয়ে মহাকাল মন্দীরমে পুজা দিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগি…
ঠিক হ্যায়…কাল জায়েঙ্গে।
পবন খুব খুশী হয়ে বলল…হাঁ…সাব…হামভি পুজা দেঙ্গে। আপ দেখ লিজিয়ে…ভাবীজী ঠিক হো জায়েগী…ফির সে বাতে করনে লাগেগী। ভাবীজীকা আওয়াজ জরুর বহুত মিঠা হোগী।
উপরে গিয়েও পবন আরো একবার পুজো দেবার কথা তুললো দিদানের কাছে…ওকে দেখে মনে হচ্ছিল…যেন ওর নিজের কারুর জন্য কিছুকরতে চাইছে। বিকেলে দুরে কোথাও না গিয়ে সবাই মিলে মলে গিয়ে বিকেলটা কাটিয়ে ফিরে আসার সময় দিদান আবার কিছু কেনাকাটা করাতে, ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে গেছে…সবাই মিলে গরম কফি খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল… দাদুর ছোটোবেলায় ভুত দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। কম্বলের নিচে মৌ দিদানের গায়ে সেঁটে গিয়ে চুপ করে গল্প শুনছে…ওদিকে শুক্লাদিও গুটিসুটি মেরে চাদর গায়ে দিয়ে বসে আছে দিদানের আর এক পাশে। গরমের শেষ…বর্ষা সবে আসবে আসবে করছে …ইকলেজ থেকে ফিরে রায়েদের পোড়ো বাগান বাড়ীর পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে খেলতে খেয়াল নেই কখন সন্ধে হয়ে এসেছে…ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে যেতেই দৌড়ে গিয়ে বাগান বাড়ীর লোহার গেট টপকে সবাই মিলে ভেতরে ঢুকে পড়েছি। দিনের বেলা অনেকবার আম জাম কাঁঠাল খেতে ঢুকেছি কিন্তু সেই প্রথম সন্ধের পর ঢোকা…গাড়ী বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে আছি…বৃষ্টি থামলেই বেরোবো…চারদিকের বড়বড় গাছের জন্য জায়গাটা বেশ অন্ধকার মতো হয়ে আছে…আমাদের পাড়ার হাবু ছিল একটু ভিতু টাইপের…চারদিক তাকাতে তাকাতে আমার গায়ে সেঁটে গেছে দেখে জিজ্ঞেস করলাম…কি হল আবার…সরে দাঁড়া না। হাবু আমার গায়ে আরো সেঁটে গিয়ে বলল…বিশু চল…পালাই…দাদুর কাছে শুনেছি এখানে নাকি ভুত আছে। ধুস…তুই একটা ভিতুর ডিম…আসুক না ভুত…এতজন আছি…কি করবে? বলা শেষ হতে না হতেই…পেছনে রায়বাড়ির বড় কাঠের দরজায় যেন কিসের একটা আওয়াজ হল…ক্যাঁচর ক্যাঁচ। সাথে সাথে গাডী বারান্দার ছাদে দুম করে কিছু একটা ভারী কিছু পড়ার আওয়াজ…এতক্ষন ঠিক ছিল…এমনিতেই হাবুর কথা শুনে মুখে যতই বলি না কেন একটু যে ভয় লাগছিল না তা নয়…এক সাথে দুটো অদ্ভুত আওয়াজ পেয়ে বুকের ভেতরে ভয় এসে গেল… চারদিক আলো হয়ে উঠে কড়কড় করে খুব কাছে একটা বাজ পড়ল…ওই আলোতে পেছনের দিকে তাকিয়ে হাড় হিম হয়ে গেল… কি একটা বিশাল জন্তুর মতো দাঁড়িয়ে আছে…এই পর্যন্ত বলে দাদু একটু থেমেছে…আর…হটাত লোডশেডিং হয়ে গেলে ঘরের পরিবেশটা যেন আরো ভুতুড়ে হয়ে গেল…কোনো আওয়াজ নেই…সবাই চুপ…একটু পরে হোটেলের জেনারেটার চালালে আলো ফিরে এল…মৌকে দেখা যাচ্ছেনা…কম্বলের নিচে ঢুকে গিয়ে দিদানকে জড়িয়ে ধরে আছে…শুক্লাদি দিদানের আর এক দিকে আরো জড়সড় হয়ে বসে…দাদু হো হো করে হেসে ফেলে বলল…শুনেই এই অবস্থা…আর আমার মতো অবস্থায় পড়লে কি হত কে জানে…দাদুর কথা শেষ হতেই…আবার আলো চলে গিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর ফিরে এল…আলো যাওয়া আর আসার মাঝে দরজায় টক টক করে আওয়াজ হল দুবার…দাদুর হাসি শুনে মৌ চোখের নীচ পর্যন্ত মাথাটা বের করেছিল সবে…যেই ঘর অন্ধকার হওয়ার পরেই দরজায় আওয়াজ হয়েছে সাথে সাথে আবার কম্বলের তলায় ঢুকে গেল। ওদের অবস্থা দেখে অরিত্রর হাসি পেয়ে গেল…কোনো রকমে হাসি চেপে দরজাটা খুলে দিতে…এক মুখ হাসি নিয়ে পবন ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল…সাব…কেয়া হুয়া? লাগতা হ্যায়…সব ডর গ্যয়ে হ্যায়…
দাদু মুখটা গম্ভীর করে বলল…হাঁ…ভুত আয়া থা…আভি আভি চলে গ্যায়ে।
পবন চোখ বড় বড় করে বলল…সাচমুচ ভুত আয়া থা?
অরিত্র আর থাকতে না পেরে হেসে ফেলে বলল…মাথা খারাপ হ্যায় কেয়া? ভুত কাঁহাসে আয়েগা?
আপ জানতে নেহি সাব…ভুত হ্যায়…হামভি দেখা।
আচ্ছা ঠিক হ্যায়…দেখা তো দেখা…আভি ব্যায়ঠো…গরম কফি অউর নমকীন হ্যায়…
সাব ভাবীজীকী হাত পে এ ধাগা বাঁধ দিজিয়ে…ম্যায় খুদ নাহাকে পুজা দিয়া...সব কুছ ঠিক হো জায়েগা…
দুপুর বেলা ঠিক ছিল…ও একাই ছিল…কিন্তু এখন সবার সামনে ভাবীজী বললে…কান লাল হয়ে উঠল…কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল…দিদান…পরিয়ে দাও না।
নেহি… নেহি…সাব…আপ খুদ…
অরিত্রর মুখের কাঁচুমাচু অবস্থা দেখে দিদান বলল…পরিয়ে দে না…কি হয়েছে…
মৌ কম্বলের নিচ থেকে মুখ বের করে বোঝার চেষ্টা করছিল কি হচ্ছে…দিদান ওকে ছোট্ট একটা আদুরে ধাক্কা দিয়ে বলল…এই মেয়ে…কি তখন থেকে কাঠবেড়ালীর মতো মুখ বের করে দেখছিস…ওঠ…
অরিত্র মৌ এর হাতে ধাগা বাঁধতে বাঁধতে এক বার চোখ তুলে তাকালো…ওর দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে…দু চোখে অদ্ভুত এক ভালো লাগার ছোঁয়া…শুধু দিদান নয়…দাদু আর শুক্লাদিও ওর অবস্থা টা বুঝে ওদের দিকে না তাকিয়ে পবনের সাথে কথা বলছে দেখে চোখ পাকিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করল…সবার সামনে ওইভাবে আমাকে না দেখলেই নয়?
সারা মুখে দুষ্টুমির হাসি ভরিয়ে দিয়ে যেন জবাব দিতে চাইলো…বেশ করেছি…আরো করবো…কেন তুমি আমাকে সব সময় দুরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা কর।
রাতে খেয়ে রুমে ঢুকতেই ফোনটা বেজে উঠল, ছোড়দি ফোন করেছে দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলে…পুবালী জিজ্ঞেস করল…কি রে ভাই…রুপসার ফোন ধরছিস না কেন? তিন বার ফোন করেছে তোকে।
আমি ছিলাম না রে, খেতে গিয়েছিলাম…এখুনি করছি…এখোনো রেগে আছে নাকি রে?
না রে…ও রাগ করে থাকার মেয়ে নাকি…
ছোড়দি…তুই একটু ধর…রুপসাকে লাইনে নিচ্ছি…খুব এম্ব্যারাসাড হয়েছি আজ…বুঝলি।
কি হোলো আবার…
একটু ধর…রুপসাকে ধরি…তারপর বলছি…
দু বোনকে লাইনে নিয়ে পবনের ভাবীজী বলা আর পূজো দেবার ব্যাপারটা বলতেই রুপসা প্রায় লাফিয়ে উঠল…দেখলি তো…আমি বললেই তোর যত প্রবলেম…আর সবাই কি বলছে এখন? তোদের ওই পবন দু দিনেই বুঝে গেছে…আর তুই কিছু বুঝতে পারছিস না…বল…এবার…
হুম…বুঝলাম…তুই এবার বল…আমার উপরে আর রেগে নেই তো?
ধুস…তোর উপর রেগে থাকলে এতবার ফোন করি নাকি? একটা মাত্র দাদাভাই…রাগ করে থেকে কি করবো রে? কি রে ছোড়দি…তাই তো?
পুবালী হেসে ফেলে বলল…তাছাড়া …আবার কি…
পরের দিন মহাকাল মন্দীরে সবাই মিলে গিয়ে পূজো দেওয়ার পর আর হোটেলে না ফিরে দিনের বাকিটা এদিক ওদিক ঘুরে আসতে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেল। আগের দিন শুক্লাদি আর মৌ ভুতের গল্প শুনে খুব ভয় পেয়েছিল বলে আজ ওরা চারজনে বসে লুডো খেলছে। অরিত্র পবন কে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে গেল কিছু ঘর সাজানোর জিনিষ কিনতে…বন্ধুবান্ধব, অফিস কলিগ… সবাই কে কিছু না কিছু দিতে হয়। ফিরে এসে কিছুক্ষন গল্প গুজব করে খেয়ে শুয়ে পড়তে পড়তে সাড়ে নটা বাজলো…ঠান্ডাও মোটামুটি ভালোই পড়েছে…সারাদিন বাইরে ঘুরে সবাই একটু ক্লান্তও ছিল। পরের দিন সকালে আর বেরোনো গেল না,দিদান আর শুক্লাদি দুজনেরই গায়ে অল্প জ্বর এসেছে। বোস দাদুকে ফোন করলে… কি ওষুধ খাওয়াবে বলে দিয়ে বলল…এক কাজ কর একটু করে ব্র্যান্ডি খাইয়ে দে…বিকেলের ভেতরে চাঙ্গা হয়ে উঠবে।পবন দুবার উপরে এসে ডাক্তার দেখাতে হবে কিনা খোঁজ নিয়ে গেছে। দিদানরা বেরোতে পারবে না বলে দাদু বলে দিয়েছে বেরোবে না…মৌ দিদানের পাশে বসে টিভি দেখছে…কেউ বেরোচ্ছে না বলে ওরও বেরোবার কোনো ইচ্ছে ছিল না। অরিত্র কিছু কাজ না পেয়ে নিজের রুমে গিয়ে টিভিতে গান শুনছিল…চ্যনেল ভি তে। দরজাটা খোলাই ছিল…সাড়ে দশটা নাগাদ দাদু এসে বলল…চুপচাপ বসে থেকে কি করবি…মৌ কে নিয়ে কাছাকাছি কোথাও গিয়ে ঘুরে আয় না…
কোথায় যাবো? দিদান দের জ্বর।
সামান্য জ্বর…ও নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই…আমি তো আছিই…তোরা ঘুরে আয়। মৌ কে বলেছি…তুই গেলে ও যেতে রাজী আছে।
পবন হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে আরো কয়েক জনের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল, ওরা দুজনে বেরোতেই দৌড়ে এসে বলল…সাব…কাঁহা যানা হ্যায়?
চলো…নজদিক থোড়া ঘুমকে আতে হ্যায়।
কিছুটা যাবার পর রাস্তার একদিকে চায়ের বাগান আর একদিকে পাহাড় …এক জায়গায় রাস্তার বাঁকে একটা ছোটো ঝরনার মতো…অনেকটা উপর থেকে সরু জলের ধারা নেমে আসছে…মৌ খুব মন দিয়ে জায়গাটা দেখছে দেখে অরিত্র গাড়ী দাঁড় করালো…দুজনে নেমে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছিল…খুব সুন্দর জায়গাটা…রাস্তার উল্টো দিকের ঢালে চায়ের ছোটো ছোটো গাছ…হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে…আর এদিকে ঝরনা। পবন গাড়ী থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে এসে বলল…সাব ফোটো লিজিয়ে না…
মৌকে ঝরনার দিকে দাঁড় করিয়ে বিভিন্ন পোজে কয়েকটা ফটো তোলার পর পবন নিজেই এগিয়ে এসে বলল…সাব…আপ ভাবীজী কী পাশ যাইয়ে…আপ দোনো কা সাথ সাথ মে ফোটো বহুত আচ্ছা আয়েগা…
নিকন ডিজিটাল এসএলআর ক্যামেরা…শুধু শাটার টিপলেই হবে না…পবন তুলতে পারবে কি পারবে না ভেবে মৌকে উলটো দিকে দাঁড় করিয়ে সব কিছু সেট করে নিয়ে পবন কে দেখিয়ে দিল কি করতে হবে…পবন ক্যামেরাটা নিয়ে দাঁড়ালে অরিত্র রাস্তা পেরিয়ে মৌ এর পাশে গিয়ে ইশারা করলো শাটার টিপতে…ওর দাঁড়ানো পবনের পছন্দ হল না…হাত নাড়িয়ে ইশারা করছিল ওদের দুজনকে আরো কাছাকাছি আসতে। আরো একটু কাছাকাছি এলেও পবন ইসারা করছিল…আরো কাছাকাছি। কি বিপদে পড়া গেছে ভেবে মৌ এর দিকে তাকালো…নির্বিকার মুখে চা বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে…ভাবখানা যেন এই…ঠিক হয়েছে…আমি এত চেয়েছি…তবু কাছে আসোনি…এখন বোঝো…কি করবে। ধ্যাত তেরি কি…জড়িয়ে ধরে দাঁড়াই…ভেবে…ওর একেবারে পাশে এসে এক হাত দিয়ে কোমর জড়িয়ে ধরে দাঁড়ালে পবন হাত তুলে ইশারা করল…এবার ঠিক আছে। পবন বোধহয় ইচ্ছে করেই একটু বেশি সময় নিচ্ছিল শাটার টিপতে কিন্তু কিছু করার নেই…মৌ এর এত কাছে কোনোদিন আসেনি…ভীষন ভালো লাগছিল…ওকে এত কাছে পেয়ে…ওর শরীরের মেয়েলী গন্ধে মন মাতাল হয়ে যেতে চাইছিল। পবন হাত তুলে জানালো হয়ে গেছে…তার পরেই বলল…সাব অউর এক…আপলোগ ইধার আইয়ে…ম্যায় উস তরফসে খিচেঙ্গে।
মৌকে সাথে করে রাস্তা পেরিয়ে চা গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ফিরে গেল ক্যামেরাটা সেট করতে…ওদিকে গাছের ছায়া থাকায় আলো কম ছিল…এদিকে অনেকটাই ঝকঝকে আলো আছে…আগের মতো তুললে হবে না…মৌ একটা চা গাছ ছুঁয়েহাসি মুখে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে…ক্যামেরার লেন্স দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ক্লোজ আপে নিয়ে এসে দেখছিল…কি সুন্দর সারল্য মাখানো মুখ…কোথাও কোনো মালিন্য নেই…ক্যামেরাটা সেট করে পবনের হাতে দিয়ে রাস্তা পেরোতে গেল…এতটাই মগ্ন হয়ে গিয়েছিল যে খেয়াল করেনি যে ও একটা রাস্তা পেরোতে যাচ্ছে। হটাত একটা ভীষন কর্কশ আওয়াজ কানে এল…সাথে সাথে কেউ যেন ওকে এক ঝটকায় টেনে ধরল। কয়েক সেকেন্ড মাথাটা পুরো যেন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল…সম্বিত ফিরে এলে কি হতে যাচ্ছিল ভেবে সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল… রাস্তার মাঝখানে একটা টাটা সুমো দাঁড়িয়ে আছে…ডাইভার গালাগালি দিতে যাচ্ছিল…পবনকে দেখে গালাগালি না দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে জিজ্ঞেস করল…কোথাও লেগেছে কিনা।
কিছু হয়নি…খুব ভুল হয়ে গেছে…একেবারে খেয়াল করিনি বলার পর মনে পড়ল…ওদিকে মৌ একা দাঁড়িয়ে আছে…ভয় পেয়ে যায় নি তো? ওর আবার টেনশান হলে চলবে না…ভেবে…তাড়াতাড়ি গাড়ীটার পেছন দিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গিয়ে ঘাবড়ে গেল…মৌ চা গাছটার পাশে হাঁটু মুড়ে মুখ নিচু করে বসে আছে …সারা শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে…আরো কাছে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওকে ডাকতে গিয়ে ওর ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেয়ে অবাক হয়ে গেল।এর আগে একবার কাঁদতে দেখেছে কিন্তু গলায় তো কোনো আওয়াজ ছিল না। আর কিছু ভাবার সময় ছিলনা…তাড়াতাড়ি ওর কাঁধে দু হাত রেখে ডাকলো…এই…মৌ…এই তো আমি…কিছু হয়নি আমার…ওঠো…
নিজের কানকেই বোধ হয় বিশ্বাস করতে পারছিল না ও…আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে… কান্না যেন আরো বেড়ে গেল…অরিত্র দু হাতে ধরে তোলার চেষ্টা করলে নিজেই উঠে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে থাকলো…কান্না কিছুতেই থামছে না দেখে…অরিত্র আবার বলল…এই…আমি ঠিক আছি… দেখো…আমার কিছু হয়নি…
বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে কান্না ভেজা গলায় বলল…আমার চাই না ফটো…তুমি কেন ওদিকে একা গেলে?
নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না অরিত্র…মৌ কথা বলছে…স্বপ্ন দেখছে না তো? ওর মাথা নিজের বুকে আরো নিবীড় ভাবে চেপে ধরে মুখ নামিয়ে বলল…তোমাকে একা রেখে আমি আর কোথাও যাবো না…
আর কোথাও যাওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিল না…সবাই কে জানাবার জন্য মনটা ভীষন ছটপট করছিল…নিজের ফোনটা আনতে ভুলে গিয়েছিল…পবনের ফোন থেকে যে দাদুকে ফোন করবে তার উপায় নেই…দাদুর নাম্বারটা মোবাইলে সেভ করা থাকে বলে মনে থাকে না …পবন সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে বকবক করে যাচ্ছে…ও যে বলেছিল পূজো দিলেই কাজ হবে। মৌ ওর পাশে বসে কাঁধে মাথা রেখে কোলের উপরে অরিত্রর হাতটা ধরে চুপ করে চোখ বুজে বসে আছে পরম নিশ্চিন্তে…
হোটেলের সামনে পৌঁছোতেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেমে মৌ এর হাত ধরে প্রায় দৌড়ে দাদুর রুমে গিয়ে পৌঁছোলে সবাই ওদেরকে ওইভাবে আসতে দেখে বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে…কোনো রকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে পারল…মৌ…
আর কিছু বলতে পারছে না দেখে দাদু ঘাবড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে…এত হাঁপাচ্ছিস কেন…
অরিত্র একটু দম নিয়ে বলতে পারল…কথা বলেছে।
কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না ওর কথা…দিদান ততক্ষনে উঠে এসেছে…মৌ দিদান কে জড়িয়ে ধরলে দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে বলল…এই মৌ…সত্যি?
মৌ অস্ফুট স্বরে বলল …দিদান…
শুক্লাদি আর দাদুও ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিল…কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না…দিদান নিজের চোখের জল আটকাতে পারলো না…ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ওকে কিভাবে আদর করবে যেন বুঝতে পারছিল না। দিদানের চোখের জল আস্তে আস্তে যেন বাকিদের চোখেও জল এনে দিল…
পবন প্রায় লাফাতে লাফাতে ঘরে ঢুকে ওদের অবস্থা দেখে থমকে দাঁড়ালো…হাতে বেশ বড় একটা মিষ্টির প্যকেট…সবার চোখে জল দেখে ওর চোখেও জল এসে গেছে…চোখের জল নিজেই মুছে নিয়ে একটা মিষ্টি মৌ এর মুখে দিয়ে…বলল…আজ ম্যায় বহুত খুশ হঁ…মেরা বহেন ঠিক হো গ্যায়ি। দিদান ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল…যা…নিজের হাতে সবাই কে খাইয়ে দে। সবার আগে পবনকে খাইয়ে তারপর সবাই কে এক এক করে খাইয়ে অরিত্রর কাছে এলে…অরিত্র মুখটা গম্ভীর করে বলল…আমার দুটো চাই।
তখোনো মুখের কান্না কান্না ভাবটা যায়নি…তার ভেতরেই মুখে হাসি আনার চেষ্টা করে বলল…কেন?
বা রে…আমিই তো তোমার কথা প্রথম শুনেছি…তাই না?
উমম…এখন পাবে না…পরে।
পবন এখুনি ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেছে…কোন মন্দীরে নাকি মানত করে রেখেছিল পূজো দেবে বলে…দাদু, দিদান আর শুক্লাদি মৌকে কাছ ছাড়া করতে চাইছিল না…যেন আজই ওর সাথে সব কথা বলা শেষ করতে হবে, নিজেদের যে শরীর ভালো নেই যেন ভুলেই গেছে। অরিত্র ওর রুমে গিয়ে এক এক করে সবাইকে ওর কথা বলা শুরু করার ব্যাপারটা জানাচ্ছিল। বোস দাদু শুনেই বলল…মনে হচ্ছে যা ভেবেছিলাম…তাই…বিরাট একটা শক পেয়ে যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তেমনি আবার একটা শক পেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। যাক গে…আরো একটা চিন্তা থেকেই গেল…স্মৃতি ফিরবে কিনা আর যদি ফেরে কতটা বা কিভাবে ফিরবে…ভালো বা খারাপ দুটোই হতে পারে…এর মাঝে আমি অনেকের সাথে আলোচনা করেছি কিন্তু কেউ সেভাবে আশার আলো দেখাতে পারেনি…আজকাল অনেকরকম চিকিতসা হচ্ছে কিন্তু ভালো হবেই কেউ বলতে পারছে না…ভালো করতে গিয়ে যদি আরো খারাপ হয়ে যায়…সেটাই চিন্তা। কেউ কেউ বলছে ঠিক কি কি ঘটেছিল জানতে পারলে একটা চেষ্টা করে দেখা যেত।
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল…কি জানি কি হবে…দেখা যাক। এখন যা হয়েছে…সেটাই বা কম কি…
বিশ্বাস কাকুকে ফোনে পাওয়া গেল না…নেটওয়ার্কের বাইরে আছে…পরে আবার চেষ্টা করবে ভেবে রুপসাকে ফোন করল…একসাথে পুবালীকে পেলে ভালো হ’ত কিন্তু এখন পাওয়া যাবে না, ওর অফিসে একটা মিটিং আছে বলেছিল। রুপসা শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না…দাদাভাই, প্লিজ একবার আমার সাথে কথা বলিয়ে দে…উঃ…আমার ইচ্ছে করছে এখুনি চলে যাই রে…
দাঁড়া…দিদানদের হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসছি। আর শোন…তুই কাউকে বলিস না…আমি সবাই কে নিজে জানাবো…না হলে…খারাপ দেখাবে…বুঝলি…
হ্যাঁ…বুঝলাম…তুই আগে ফোনটা দে না বাবা…
মৌকে ডেকে নিয়ে এসে ফোনটা হাতে দিলে জিজ্ঞেস করল…কে?
অরিত্র হেসে বলল…দেখো…কে আছে…
মৌ হ্যালো বলতেই…রপসা…বলল…এই…মৌ…আমি কে বলোতো?
মৌ একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে একটু ভেবে বলল…উমম…ছোড়দি…
ইস…ছোড়দির নাম তো পুবালী।
উঁ হুঁ…পুবালী দিদি তো তোমার ছোড়দি…আর আমার মেজ দি। তুমি…আমার ছোড়দি…রুপসা দিদি।
কি করে বুঝলে?
বা রে…বলবো কেন?
জানো তো…তোমার কথা খুব মিষ্টি…একেবারে তোমার মতো।
ধ্যাত…তুমি খালি বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছো। তোমার গলাও তো কত মিষ্টি।
ধুস…আমার গলা…হাঁসের মতো…সব সময় নাকি প্যাঁক প্যাঁক করে কথা বলি…
মৌ হেসে ফেলে বলল…কে বলেছে…তোমার গলা হাঁসের মতো।
কে আবার বলবে…বলার তো একজনই আছে…
কে… ব’ল না।
উমম…তোমার কাছে কেউ নেই তো?
উঁ হুঁ…এখানে খালি তোমার দাদাভাই ছাড়া আর কেউ নেই…
ওই দাদাভাই টাই তো বলে…আমার সাথে কথা বললে নাকি কান ঝালাপালা হয়ে যায়…পাগল পাগল লাগে।
অরিত্রর দিকে আড় চোখে তাকিয়ে দেখে নিয়ে হেসে ফেলে বলল…তাই?
হ্যাঁ গো…তাই বলে…আচ্ছা…শোনো না…কি করে হোলো বলোতো…আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।
কি জানি…তোমার দাদাভাই জানে হয়তো।
যাক গে…বাদ দাও…তুমি কথা বলতে পারছো…এটাই আমাদের কাছে সব থেকে বড়…পরে দাদাভাই এর থেকে জেনে নেবো।
ছোড়দি…তুমি কবে আসছো?
ইচ্ছে তো করছে…আজই চলে আসি…সামনের সোমবার আমার একটা ইন্টারভিউ আছে…হয়ে গেলেই চলে আসবো।
খুব ভালো হবে…তোমার সাথে অনেক গল্প করবো।
ইস…আমার সাথে কেন গল্প করবে…আর একজন তো পাশেই আছে।
ধ্যাত…তুমি না খালি পেছনে লাগো।
ইস…আমি পেছনে লাগি? তোমার ইচ্ছে করে না নাকি? ও হ্যাঁ…ওটার কিছু হ’ল…তোমাকে যেটা বলেছিলাম…
কি গো?
ওই যে দাদাভাইকে দিয়ে ব’লাতে…
তুমি এসো না…তারপর…
দুপুরের পর থেকে আবার ঝির ঝির করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ঠান্ডায় কারুরই শুতে ইচ্ছে ছিল না…দাদুদের ঘরে ওরা সবাই আড্ডা দিচ্ছে আর অরিত্র ওদিকে নিজের ঘরে এক এক করে সবাইকে ফোন করে জানাচ্ছে। যারা খুব কাছের তাদেরকে আবার উঠে গিয়ে মৌ এর সাথে কথা বলিয়ে দিতে হচ্ছে…এই করতে করতে বিকেল হয়ে গেল তবুও বৃষ্টি থামার নাম নেই। বৃষ্টির জন্য বোধহয় ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে দেখে কম্বল মুড়ি দিয়ে কি করা যায় ভাবছিল, শুক্লাদি এসে বললো…দাদু ডাকছে। দাদু সোফায় পা তুলে গুটিসুটি মেরে বসে আছে আর ওদিকে মৌ যথারীতি দিদানের সাথে কম্বলের তলায়। আগের দিনের মতো শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। শুক্লাদিও ফিরে এসে কম্বলের নিচে ঢুকে পড়ল।
কি ব্যাপার…দাদু…আজকেও কি ভুতের গল্প হচ্ছে নাকি?
না রে…যা সব ভীতু…ভুতের গল্প নয়…আজ তোর দিদানের ছোটোবেলার গল্প হচ্ছিল। কলেজ যেতে গিয়ে নাকি রামছাগলের তাড়া খেয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছিল…আরো কত কি…
যাই বলো দাদু…তোমাদের ছোটোবেলায় খুব মজার মজার ঘটনা আছে…
তা অবশ্য ছিল…তোরা তো অনেক কিছুই দেখিস নি…আস্তে আস্তে সব কিছু কেমন যেন পালটে যাচ্ছে।
তা তো যাবেই…তোমরা কিছু খাবে এখন? দুপুরে তো ভালো করে খাওয়াই হোলো না…পবন কেও ডাকি একবার…ও বেচারা এই ঠান্ডায় বাইরে বসে আছে।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
চিকেন পকোড়া আর সাথে গরম কফি খেতে খেতে পবনের সাথে কথা হচ্ছিল ওর বাড়ী নিয়ে। বাড়ীতে মা আর ছোটো বোন থাকে, দাদা বিয়ে করে আলাদা থাকেএই দার্জিলিং এ…বাবা অনেক দিন আগে ওদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল…আর ফিরে আসেনি… বোনের বিয়ের চেষ্টা করছে, বোনের বিয়ে হয়ে গেলে তারপর নিজের বিয়ের কথা ভাববে। কথা বলতে বলতে পবন একটু কুণ্ঠার সাথে বলল…ওর মা নাকি সবাইকে গ্যাংটক যাবার দিন দুপুরে ওদের বাড়ীতে যেতেবলেছে…দুপুরের খাওয়াটা ওদের বাড়ীতে সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে না হয় তারপর গ্যাংটক যাবে। ওর মা নাকি বাঙ্গালীদের মতো মাংশ রান্না করতে পারে। দাদু শূনে খুব খুশি হয়ে বলল…আরে…কেন যাবো না…নিশ্চয় যাবো…কি গো…তোমার আপত্তি নেই তো বলে দিদানকে জিজ্ঞেস করতে দিদানও হ্যাঁ বলে দিল। পবনের সাথে এই কদিনে এমন একটা সম্পর্ক হয়ে গেছে যে ওদের কারুরই যেতে কোনো আপত্তি ছিল না।
পরের দিন দিদান আর শুক্লাদির শরীর মোটামুটি ঠিক থাকলেও বেশী ঘোরাঘুরি না করে দুপুর অব্দি ঘুরে এসে বিকালের দিকে না হয় কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসা হবে ঠিক হল কারন পরের দিন আবার ঘন্টা ছয়েক গাড়ীতে করে যেতে হবে। রাস্তা খালি থাকলে একটু কম সময় লাগতে পারে কিন্তু একটু বেশি ধরে চলাই ভালো, পাহাড়ী রাস্তা…কখন কি হয় বলা খুব মুশকিল। সন্ধের দিকে দিদান আর শুক্লাদি ব্যাগ পত্র গোছাচ্ছিল…মৌ ওদেরকে সাহায্য করতে গেলে দিদান মিষ্টি করে বকুনি দিয়ে বলল…তোকে এখানে গিন্নিপনা করতে হবেনা…যা না…দেখ দুষ্টু কোথায় আছে…বাইরে গিয়ে ঘুরে আয়…ছেলেটাও হয়েছে তেমনি…আমরা না বেরোলে কোথাও বেরোবে না…আরে বাবা…আমাদের না হয় বয়স হচ্ছে…তোদের তো এখন ঘোরার বয়স। মৌ দাদুর দিকে তাকিয়ে মুখটা গোমড়া করে বলল…দেখলে দাদু…দিদান আমাকে কেমন বকে দিল…তোমার নাতি না বেরোলে আমি কি দোষ করলাম। দাদু টিভিতে খবর দেখছিল…টিভির আওয়াজটা একটু কমিয়ে দিয়ে বলল……ঠিকই তো বলেছে…যা…গিয়ে বল…ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে। অরিত্র ওদের কথার মাঝখানে ঘরে ঢুকলে…দাদু বলল…এই তো…ভালো সময়ে এসেছিস…তোর কথাই হচ্ছিল…
তাই? আমি আবার কি করলাম?
কিচ্ছু করিস নি…যা…মৌ কে ঘুরিয়ে নিয়ে আয়।
বুঝেছি…নিজে বলতে পারে নি…তোমাদের কে দিয়ে বলাচ্ছে…
মৌ মুখটা আরো গোমড়া করে বলল…দেখলে দাদু…কেমন করে বলল…আমি বলেছি নাকি যাবো? তোমরাই তো বললে ঘুরে আসতে। যাও…আমি যাবো না কোথাও।
দাদু হেসে ফেলে বলল…আরে…রাগ করিস না…যা…তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিয়ে ঘুরে আয়…আসার সময় আমাদের জন্য ভালো করে পান বানিয়ে নিয়ে আসবি।
মৌ অরিত্রর দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো…ও যে পেছনে লাগার জন্য বলেছে বুঝতে পেরে যত তাড়াতাড়ি মুখ গোমড়া করেছিল ততটাই তাড়াতাড়ি উঠে দিদানকে বলল…ও দিদান দেখো না…এটা পরেই তো যাওয়া যাবে…খুব খারাপ নাকি?
দিদান হেসে ফেলে বলল…তুই কি আমার সাথে যাবি?
অরিত্র…মনে মনে ভাবছিল…তুমি এত সুন্দর…যা পরবে…তাতেই ভালো লাগবে। মুখে বলল…খুব চলবে…চলো…
পবন হোটেলের রিশেপশানের সামনের সোফাতে বসে টিভিতে একটা হাসির সিনেমা দেখছিল, ওদেরকে নামতে দেখে উঠে এলে অরিত্র বলল…গাড়ীতে যাবে না। এই আশে পাশে কিছুটা হেঁটে ঘুরে আসবে। পবন রাজী হল না…এই সন্ধের সময় ভাবীজীকে নিয়ে একা একা ও বেরোতে দিতে চাইছে না। ও ঠিকই বলছে দেখে অগত্যা গাড়ীতে উঠতে হল। চারদিকের দোকানগুলোতে আলো ঝলমল করছে…আকাশ ভালো থাকায় রাস্তায় ভীড়ও খারাপ নয়। গাড়ীর মাঝখানের সিটে ওরা দুজন দুদিকে বসে…মৌ একেবারে কোনের দিকে কোলের উপর হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। অরিত্রর মোবাইলে একটা ফোন এল…বড়দি ফোন করেছে…কিছুক্ষন ফোনে কথা বলে ও মৌ এর দিকে তাকিয়ে বলল… বড়দিরা সামনের সপ্তাহের শেষের দিকে আসছে…তোমার কথা বলছিল…আমাদের বাড়ীতে যদি না আসতে পারে তাহলে তোমাকে নিয়ে ভবানীপুর যেতে বলল।
অরিত্রর দিকে তাকিয়ে ও কি বলছে শোনার পর আস্তে করে বলল…সবাই আমার খোঁজ করে…দেখতে চায়…
তা তো চায়…সবাই তোমাকে ভালোবাসে।
সবাই চায়…শুধু একজন ছাড়া।
অরিত্রর বুঝতে অসুবিধা হল না…ও কার কথা বলছে। বুঝতে পারছিল না কি উত্তর দেবে…কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল…কে বলেছে তোমাকে?
কেউ বলেনি…আমি বুঝতে পারি।
আর কিছু না বলে ওর দিকে সরে গিয়ে ডান হাত দিয়ে ওর বাঁ হাত আলতো ভাবে চেপে ধরলে একটু যেন কেঁপে উঠল। বাইরের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে কিছু যেন বোঝার চেষ্টা করল কিন্তু গাড়ীর ভেতরে খুব একটা আলো না থাকায় বুঝতে না পেরে ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে আস্তে আস্তে অরিত্রর হাতের উপর ডান হাতের চাপ দিয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে মুখ নিচু করে বসে থেকে কিছু যেন বোঝাতে চাইলো। বুকের ভেতরে ওকে জ়ড়িয়ে ধরে আদর করার ইচ্ছে টাকে দমিয়ে রেখে চুপ করে বসে থাকতে থাকতে মনে হল এক ফোঁটা উষ্ণ জল হাতের উপরে পড়ল। কিছু পেয়েও না নিতে পারার ব্যাথায় বুকের ভেতরটা ভীষন একটা কষ্টে ভরে উঠল। গাড়ী এখন আর বাজারের ভেতরে নেই…জায়গাটা মোটামুটি নির্জন…কিছুটা দুরে রাস্তার থেকে কিছুটা নিচে একটা মাত্র দোকান দেখা যাচ্ছে, নিজেকে শক্ত করে পবনকে গাড়ীটা দাঁড় করাতে বলে ওকে দাদুদের জন্য পান আনার কথা বললে…পবন গাড়ীর দরজা বাইরে থেকে রিমোট লক করে চলে গেল। ওর একেবারে পাশে সরে গিয়ে নিজের বুকে টেনে নিলে বুকের উপরে মাথা রেখে বসে থাকলো…চোখের জল নিজের হাতে মুছে দিতে দিতে আস্তে করে বলল…এই…
অস্ফুট গলায় সাড়া এল…বলো…
পারবে না …আমাকে আরো একটু সময় দিতে?
অরিত্রর বুকের উপরে নিজেকে আরো একটু চেপে ধরে কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল…পারবো।
আরো কিছুক্ষ্ণন ওকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকার পর আবার ওকে ডাকলো…এই মৌ।
উঁ
আমার দিকে তাকাও।
উমম…কেন?
না তাকালে বলবো কি করে?
আস্তে আস্তে ওর বুকের উপর থেকে উঠে তাকালে…দুহাতে ওর মুখটা ধরে জিজ্ঞেস করল…এখোনো কি মনে হচ্ছে…একজন বাদে সবাই তোমাকে চায়?
ওর কান্না ভেজা ডাগর কাজল কালো চোখে খুশির ঝিলিক…দুরের ল্যাম্প পোস্টের আবছা আলোয় ভীষন মায়াবী কোনো এক অপ্সরার মতো লাগছিল ওকে…অল্প খুলে থাকা ভেজা ঠোঁট তির তির করে কেঁপে যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে…কই এসো…আমাকে তোমার ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে ভরিয়ে দাও চুমুতে চুমুতে। দু চোখ ভরে ওকে দেখতে দেখতে আলতো করে…ওর ঠোঁটে নয়, কপালে চুমু দিয়ে ওর দিকে তাকালে…অস্ফুট স্বরে ভালোবাসার অনুযোগ জানালো…খুব দুষ্টু তুমি।
কেন?
কাছে আসতে চাও না তো ডাকো কেন?
কাছে এলে যদি আরো কাছে আসতে মন চায়?
আমি কি বারন করেছি?
সময় হোক…আসবো…
মৌ কিছু না বলে নিজেকে ওর বুকে আরো নিবিড়ভাবে রেখে বসে থাকলো। ওর বুকের ভেতরের আওয়াজ নিজের বুক দিয়ে অনুভব করতে করতে ডাকলো…এই মৌ…
উঁ…
তুমি বুঝতে পারো না?
কি?
আমি কি চাই।
আস্তে করে বলল… পারি…
তাহলে?
ভয় করে…
এই…আমার দিকে তাকাও…
মুখ তুলে তাকালে আগের মতো ওর মুখটা দু হাতে ধরে বলল…আমি খুব বুদ্ধু…তাই না?
মিষ্টী হাসিতে মুখ ভরিয়ে বলল… বুদ্ধুই তো…
গাড়ীর রিমোট লক ছোট্ট একটা আওয়াজ করে খুলেই আবার বন্ধ হয়ে গেল…পবন যে এবার ফিরে আসছে জানালো এইভাবে। ওর চোখে চোখ রেখে মৃদু স্বরে বলল…পবন আসছে…এবারে সরে যাই?
ঠোঁট ফুলিয়ে বলল…আসুক…তুমি এখানেই থাকো…তারপরেই কি মনে করে বলল…যাও।
অরিত্র একটু সরে গেলে নিজের জামাকাপড় ঠিক করে নিয়ে নিজের জায়গায় বসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল…তোমার কাছে টাকা আছে?
একটু অবাক হয়ে জবাব দিলো…হ্যাঁ আছে…তোমার লাগবে?
চলো না…কিছু কিনি…কাল তো পবন ভাইয়ার বাড়ি যেতে হবে…
সত্যিই তো…ঠিকই বলেছে…খালি হাতে যাওয়াটা খারাপ দেখাবে ভেবে বলল…ইস…আমি একেবারে খেয়াল করিনি…
পবনের বাড়ী পৌঁছোতে ঘন্টা খানেকের মতো লাগবে,তাড়াহুড়োর কিছু ছিল না বলে অরিত্র পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল। একবার উঠে ঘুম চোখে ঘড়িতে মাত্র সাতটা বাজে দেখে আবার শুয়ে পড়লো। একটু পরেই দরজায় টক টক আওয়াজ…বাধ্য হয়ে উঠে দরজাটা খুলে দিয়েই কে এসেছে না দেখে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়ল কম্বল মুড়ি দিয়ে। মাথার উপর থেকে কম্বলটা আস্তে আস্তে সরে গেল…গালে কারুর আঙ্গুলের আলতো ছোঁয়া…চোখ খুলে তাকালে…খুব মিষ্টি দেখতে কেউ ঠোঁটে আঙ্গুল বুলিয়ে বললো…এই…ওঠো না…কখন থেকে বসে আছি। রোজ তোমার জন্য বসে থাকি…দিদানকি ভাবে বলোতো?
উমম…কিচ্ছু ভাবে না…একটু বোসো না আমার পাশে…
উঁ হুঁ…দরজা খোলা…
শুধু তো পাশে বসবে… দরজা খোলা থাক না…
আচ্ছা বসছি…তুমি ওঠো…
গরম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দার্জিলিং চায়ের সুগন্ধে মন ভরে গেল…আঃ…খুব সুন্দর ফ্লেভার বেরিয়েছে আজ…কে বানিয়েছে…তুমি? বলে মৌ এর দিকে তাকালো ভালো করে…এত সকালে ঠান্ডার ভেতরে স্নান করে নিয়েছে…সদ্যস্নাতা কুমারী মেয়েদের বোধহয় আলাদা একটা সৌন্দর্য থাকে…ঠিক যেন সদ্য ফোটা ফুলের মতো…মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল…এই ঠান্ডায় স্নান করে নিয়েছো?
মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে দিয়ে ঘাড় নেড়ে জানালো…হ্যাঁ…যখন কথা বলতে পারতো না তখন ও এইভাবে শরীরের ভাষায় কথা বলতো…আজ ও সেইভাবে বলতে দেখে খুব ভালো লাগলো। জিজ্ঞেস করল…কেন? ঠান্ডা লেগে যাবে না?
এমনি…ইচ্ছে হল…তাই…
একটু অবাক হয়ে বলল…এমনি এমনি ইচ্ছে হল…এত ঠান্ডায় স্নান করতে? কি জানি…কিরকম সব অদ্ভুতুড়ে ইচ্ছে…মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার কেমন যেন গোলমেলে।
ঠোঁট কামড়ে ধরে দুষ্টুমি ভরা গলায় বলল…মেয়েদের সাথে না মিশলে জানবে কি করে কেন ইচ্ছে হয়।
হুমম… মনে হয় বুঝতে পারছি।
তাই?
হ্যাঁ…
একটূ যেন লজ্জা পেয়ে মুখ নামিয়ে নিয়ে বলল…সত্যিই বুঝতে পেরেছো?
হ্যাঁ বুঝেছি…তোমার শরীর খারাপ।
আরো লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করে বলল…ইস…
চা খেয়ে অরিত্র আবার কম্বলের তলায় ঢুকে গেছেআধশোয়া হয়ে, মৌ সোফাতে বসে অরিত্রর ব্যাগ গোছাতে গোছাতে জিজ্ঞেস করল…এই…তুমি কবে যাচ্ছো?
কোথায়? সিডনি?
হুঁ…
নভেম্বরের আঠাশ।
দু মাসের জন্য তো?
হ্যাঁ…
একটা কথা বলবো… কিছু মনে করবে না তো?
মনে করার কি আছে…বলো।
আমাকে একটা ফোন কিনে দেবে?
বাড়ীতে তো দুটো ফোন আছে…আবার কি হবে বলতে গিয়েও থেমে গেল। ও কেন ফোনের কথা বলছে বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। তবুও মজা করে জিজ্ঞেস করল…
কি করবে ফোন নিয়ে?
ফোন নিয়ে আবার কি করে …ফোন করবো।
হুম…কাকে?
ভাঁজ করা জামাকাপড় এক এক করে ব্যাগে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল…মেজদি…ছোড়দি…জেঠিমা…জেঠু…
হুম…ভালো…ব্যাস?…আর কাউকে নয়?
আড় চোখে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল…আছে…আর একজন…যদি…ফোন করে…তাহলে না হয়…তার সাথেও কথা বলবো…
ও…তা…সেই আর একজনটা কে?
উমম…সে আছে একজন…কিছু বোঝে না…সবাই যা ভাবে…ঠিক তার উল্টোটা করে।
তাই? তাহলে তো একেবারে ভালো নয়।
কে বলেছে তোমাকে ভালো নয়…আমার কাছে তো ভালো। তাহলেই হবে।
ঠিক হ্যায়…কিনে দেবো। তা…আমি ফোন করলে কথা বলবে তো? নাকি…বলবে…এখন নয়…পরে ফোন ক’র…ব্যাস্ত আছি।
হুমম…ইচ্ছে হলে বলতে পারি…তবে কথা দিতে পারছি না…
শুক্লাদি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল…কি আবার কথা দিতে পারছিস না রে?
ফিক করে হেসে বলল… এই যে তোমাদের আদরের নাতি…ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছি…কোথায়,ভালো বলবে …তা নয়…আমার পেছনে লেগেছে… জিজ্ঞেস
করছে ফোন করলে কথা বলবো কিনা। তুমি বলো…কেন বলবো কথা…আমাদেরকে ফেলে কেমন মজা করে কতদুরে চলে যাবে।
শুক্লাদি হেসে ফেলে বলল…আচ্ছা…ও কি ঘুরতে যাচ্ছে? অফিসের কাজে যাবে…
ইস…আর কাউকে যেন পাঠানো গেল না…ওকেই পাঠাতে হবে…আর যেন কেউ কাজ জানে না। তোমাদেরকে কে দেখবে বলোতো?
কেন…তুই তো আছিস…আমাদের কে দেখবি।
ইস…আমি দেখবো তোমাদের কে…আমাকে কে দেখে তার ঠিক নেই…
আচ্ছা ঠিক আছে…আমরা আমাদের কে দেখে নেবো…তুই চল…ওদিকে দুজন মৌমৌ করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে…মেয়েটা কোথায় গেল…সকাল থেকে দেখতে পাচ্ছি না্…বেরোতে হবে…কখন তৈরী হবে…
চলো…আমার তো হয়ে গেছে…ওদিকে দেখো…তোমাদের আদরের নাতি এখোনো বিছানা ছাড়েনি…
শুক্লাদি অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল…এই ছেলে…ওঠ…যাবি না নাকি…
অরিত্র আড়মোড়া ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে বলল…আমার কাছে একটু বোসো না…
শুক্লাদি ওর পাশে বসলে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে কোমর জড়িয়ে ধরে বলল…শুক্লাদি…কতদিন তুমি আমাকে আদর কর না বলোতো…
আচ্ছা বাবা…দিচ্ছি…
মৌ ব্যাগ গোছানো হয়ে গেলে বেরিয়ে যাবার আগে শুক্লাদিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল…ছোটো দি্দান…কই…আমাকে তো এমন করে আর আদর করো না…
এই মেয়ে…কোথায় তোকে আদর করি না রে…সারা রাতকে আমাকে জড়িয়ে ধরে কে ঘুমোয় তাহলে…
ইস…আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোই…মানে তো…আমি তোমাকে আদর করি…তাই না…
হুম…বুঝেছি…ঠিক আছে…আজ রাতে আদর করে দেবো।
দিদান তুমি কি ভালো…বলে…শুক্লাদি কে ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে…অরিত্রর পিঠে একটা ছোট্ট কিল মেরে বলল…ইস…কি শখ…আদর খাবে…
বেরোতে বেরোতে সাড়ে নটা বেজে গেল। সামনের সিটে দাদু, মাঝখানে দিদান আর শুক্লাদি, পেছনের সিটে ওরা দুজনে বসে। পবনের হাত এমনিতে খুব ভালো, ধীরে সুস্থে গাড়ী চালাচ্ছে। রাস্তার দু ধারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যি দেখারম তো…কত রকমের নাম না জানা গাছ…কত রকমের ছোটো বড় রঙ্গীন বাহারী ফুল ফুটে আছে…মানুষের যত্ন ছাড়াই…এক দিকে পাহাড়, আর এক দিকে গভীর খাদ,
অরিত্র ক্যামেরা টা নিয়ে একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছিল, পেছনের সিটে বসায় একটু অসুবিধা হচ্ছিল ছবি তুলতে, সামনের সিটে বসতে পারলে ভালো হত কিন্তু দাদু দিদানদের পেছনে বসলে অসুবিধা হয় বলে নিজেরা পেছনে বসেছে। খুব মন দিয়ে দুরের একটা পাহাড় টেলি লেন্স দিয়ে কাছে আনার চেষ্টা করছিল…পায়ের উপর কোনো কিছুর আলতো ছোঁয়া পেয়ে দেখতে গিয়ে মৌ এর দিকে চোখ পড়ল। ঘুম ঘুম চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে জিজ্ঞেস করল…ঘুম পাচ্ছে?
মাথা নেড়ে জানালো… হ্যাঁ।
হুমম…শোবে?
হুঁ…
ঠিক আছে…আমি দিদানের কাছে যাচ্ছি…তুমি শোও…
মুখটা গোমড়া করে বলল…না…
তো?
ওর কোলের দিকে ইশারা করে বোঝালো…কোলে মাথা রেখে শোবে।
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
অরিত্র দিদানদের দিকে ইশারা করে ওকে বোঝাবার চেষ্টা করলো…ওরা কি ভাববে।
মাথা নেড়ে বোঝালো…কিছু ভাববে না।
অরিত্র ভাবছিল কি করবে…দিদান দুরের একটা পাহাড় দেখে ঘাড় ঘুরিয়ে মৌ এর দিকে তাকিয়ে বলল…দেখ…পাহাড়টা কি সুন্দর লাগছে…
উঁ…আমার ঘুম পাচ্ছে…তোমরা দেখ। ছবি তুলছে তো…পরে দেখে নেব।
ঘুম পাচ্ছে তো শুয়ে পড়…
কোথায় শোবো…তোমার নাতি বসে আছে তো…ওর দিকে পা রেখে কি করে শোবো?
কোথায় আবার…ওখানেই শো…
দিদান বলে দিয়েছে শুতে…অতএব…আর কি ভাবার আছে…এমন একটা ভাব করে অরিত্রর কোলে মাথা রেখে সিটের উপরে পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়ে এক হাত দিয়ে ওর কোমর জ়ড়িয়ে ধরল।
শুক্লাদি একটা শাল ব্যাগ থেকে বের করে অরিত্রকে দিয়ে বলল…গায়ে দিয়ে দিতে…না হলে শীত করবে। কোলের উপরে শুয়ে থাকায় আর ইচ্ছে মতো ছবি তোলা যাচ্ছিল না দেখে দিদানকে দিয়ে ক্যামেরা টা দাদুর কাছে পাঠিয়ে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল, মৌ মাথাটা একটু তুলে আরো ঘন হয়ে শুলে তাকিয়ে দেখলো…ঘুমোয় নি…ওর দিকে তাকিয়ে আছে দুষ্টুমি ভরা চোখে…ভাবখানা যেন এমন…দেখলে তো…কেমন শুয়ে আছি তোমার কোলে মাথা রেখে। সামনের সিটের দিকে ওর মাথার পেছনটা থাকায় দিদানরা তাকালেও বুঝতে পারবে না, ও না ঘুমিয়ে তাকিয়ে আছে । চোখ কুঁচকে কিছু যেন একটা বলতে চাইলে অরিত্র ইশারায় জিজ্ঞেস করলো…কি?
বাঁ হাত বাড়িয়ে ওর ডান হাত টা দেখিয়ে নিজের মাথার দিকে আঙ্গুল তুলে বোঝালো ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে হবে। মাথায়…কপালে আস্তে আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলে চোখ বুজে শুয়ে থাকলো…মনে হল…এবারে ঘুমোবে। অরিত্র বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ভাবছিল…বলে তো দিলাম…আমাকে একটু সময় দাও…কথা যখন দিয়েছি…আমাকে পারতেই হবে। গাড়ীর দুলুনি আর তার সাথে খুব প্রিয় কাউকে এত কাছে পাওয়ার উষ্ণ অনুভুতি…মনে যতই চিন্তা থাকুক না কেন…বুকের ভেতরে একটা সুখের অনুভুতি নিয়ে নিজেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি।
রাস্তা ছেড়ে আস্তে আস্তে গাড়ীটা একটা সরু রাস্তায় নামিয়ে এগোতে এগোতে পবন জানালো ওর বাড়ী আর একটু নীচে। কিছুটা নামার পর ছোট্ট একটা পাহাড়ী গাঁ, পিকচার পোস্ট কার্ডের মতো সাজানো পাহাড়ের ঢালে সাজানো ছোট ছোট বাড়ী। আরো একটু নীচে পাহাড়ের ধাপে ধাপে চাষের জমি। পবন গাড়ীটাকে নামাতে নামাতে একটা বাঁকঘুরে কিছুটা উঠিয়ে একটা ছোট্ট বাড়ীর সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে জানালো ওরা পৌঁছে গেছে। দিদান নামার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে অরিত্রদের দিকে তাকিয়ে থমকে গেল। ক্ষনিকের জন্য হলেও বুকের ভেতরে একটা স্বপ্ন উঁকি দিয়ে চলে যেতে চাইলে সেটাকে আটকে রাখার চেষ্টা করে বলল…শুক্লা দেখ……কি সুন্দর ঘুমোচ্ছে দুটোতে…কি ভালো লাগছে দেখতে তাই না…
শুক্লাদি পেছন ফিরে দেখতে দেখতে বলল…তোমাকে তো কতবার বললাম…দাদুভাই এর সাথে খুব সুন্দর মানাবে…দাদুভাই এর সাথে কথা বল…
ভাবলেই তো আর বলা যায় না…
ঘুম ভাঙ্গলো শুক্লাদির ডাকে…এই দাদুভাই…ওঠ…এসে গেছি।
অরিত্র আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকালো…পাহাড়ের ধারে ছোট্ট একটা ছবির মতো বাড়ি…বাড়ীর এক দিকে ভুট্টার ক্ষেত…আর একদিকে ছোট্ট একটা ফুলের বাগান। চোখ রগড়ে নিয়ে মৌ এর দিকে তাকালো…পরম নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে নাড়া দিয়ে ওকে ডাকলো…এই…মৌ…ওঠো।
ঘুম জড়ানো গলায় বলল…উঁ…ঘুমোতে দাও না।
পবনের বাড়ী এসে গেছি তো…ওঠো।
আস্তে আস্তে উঠে বসে চোখ কচলে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল…কি সুন্দর জায়গাটা…তাই না।
হুঁ…চলো…
দিদানরা কোথায়?
সবাই ভেতরে গেছে…
ততক্ষনে উনিশ কুড়ি বছরের একটি মেয়ে তাড়াতাড়ি করে এসে গাড়ীর কাছে এসে হাসিমুখে ওদের কে ভেতরে যেতে বললো। অরিত্র সামনের সিটটা লক খুলে নামিয়ে দিয়ে নেমে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে এদিক ওদিক দেখছিল, মৌ নেমে এলে মেয়েটা ওর দিকে এগিয়ে এসে জানালো ও পবনের বোন লছমী। ওদের দেরী দেখে বোধ হয় পবনও বেরিয়ে এলো… বোনকে আদর মাখানো গলায় বকুনি দিয়ে বলল…দাঁড়িয়ে না থেকে জলদি ভাবীজীকে নিয়ে ভেতরে যেতে। পবনের পেছন পেছন একটা সাদা ধবধবে লোমে ঢাকা স্পানিয়েল বেরিয়ে এলো…খুব বেশী হলে মাস তিনেক বয়স হবে…অরিত্রর দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে দুবার ডেকে উঠল…ভাবখানা যেন বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন…ভেতরে এসো।
দুটো মাত্র ছোট ছোট ঘর ওদের কিন্তু চারদিকে যত্নের ছাপ, কেউ আসবে বলে যে গোছানোর চেষ্টা করা হয়েছে তা নয়। পবনের মা খুব যত্ন করে খাওয়ালো। এমন বেশী কিছু নয়, গরম গরম হাতে তৈরী রুটী, কষা মাংশ, আচার আর টক দই…আন্তরিকতা থাকায় আর কয়েকদিন হোটেলের খাওয়ার খাবার পর বাড়ীতে রান্না করা খাবার যেন অমৃত সমান হয়ে উঠল। শুধু তাই নয়, বেরোবার সময় টিফিন ক্যারিয়ারে করে পরোটা আর আলুর দম, সাথে আচার দিয়েদিল…বিকেলে খাওয়ার জন্য।
পবনদের বাড়ী থেকে বেরিয়ে গ্যাংটক যাবার জন্য বেরোতে বেরোতে দুটো বাজলো। আর একটু আগে বেরোতে পারলে ভালো হত কিন্তু খেয়ে ওঠার সাথে সাথে না বেরিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরোনো ভালো বলে পবনের মা আটকে দিয়েছিলো। বেরোনোর পরপরই আকাশ কালো করে এসে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে…এখন আর বৃষ্টি নেই…মেঘের ফাঁক দিয়ে সুর্যের আলো পড়ে ভেজা গাছের পাতা ঝকঝক করছে। বেরোতে দেরী হয়েছে একটু কিন্তু খুব একটা নয় বলে পবন ধীরে সুস্থে গাড়ী চালাতে চালাতে এগোচ্ছে। অরিত্র ক্যামেরাটা নিয়ে ছবি তুলছিল, মনে পড়ল গতবার ফেরার সময় দাদু তিস্তার চরে নামতে চেয়েছিল কিন্তু দেরী হয়ে যাবে বলে চলে যেতে হয়েছিল। দাদুরা ঘুমোচ্ছে দেখে পবনকে ডেকে বলে দিল একটা ভালো জায়গা দেখেও যেন গাড়ী একেবারে নদীর ধারে নামিয়ে দেয়। মৌ বাইরের দিকে তাকিয়ে বসেছিল, পবনের সাথে কথা বলা হয়ে গেলে ওর দিকে তাকালে দুজনের চোখাচুখি হয়ে গেল, মৌ চোখের পলক না ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…সবাই ঘুমোচ্ছে।
অরিত্র দাদুদের দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখেবলল…হুঁ…
একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে বলল…আমরা ঘুমোইনি…
কি বলতে চাইছে প্রথমটা বুঝতে না পেরে ওরদিকে তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করল…যেন কিছু হয়নি এমন একটা ভাব করে চুপচাপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে…একটু পরে মুখ ঘুরিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আবার আগের মতো বসে থাকলো…অরিত্রওর দিকে সরে গিয়ে বলল…হ্যাঁ…আমরা ঘুমোই নি…
মুখ ঘুরিয়ে ওর চোখ চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল…তুমি কখন ফোন করবে…
কি অদ্ভুত মেয়ে কে জানে…কোথা থেকে কোথায় চলে গেল…মেয়েরা যে কি চায় কে জানে ভাবতে ভাবতে বলল…যখন তুমি চাও…
ইস…যখন তুমি চাও…তোমার কখন সময় হবে আমি কি করে জানবো…
ইচ্ছে তো করে সারাদিন তোমার সাথে গল্প করতে…অনেক কিছুই তো বলতে ইচ্ছে করে কিন্তু সব কিছু তো আর যায় না বলা ভেবে বলল…উমম…ভাবছি…সন্ধে সাড়ে পাঁচটা কি ছটা নাগাদ করবো…
চোখ কুঁচকে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল…অফিস কখন ছুটি হবে?
আমি যখন ফোন করবো তখন ওখানে রাত এগারোটা মত হবে।
তাই? ঘুমোবে কখন?
তোমার সাথে কথা বলা হয়ে গেলে…
আর…আমি যদি ফোন না ছাড়ি?
ঘুমোবো না…ব্যাস…আবার কি…
হুম…ঘুমোবো না…ভালো…পরের দিন অফিসে বসে ঘুমোবে…আর …ভাগিয়ে দিয়ে বলবে…যাও…বাড়ী ফিরে যাও…এখানে থাকতে হবে না…খুব মজা হবে…তাই না?
ওর কথা বলার ধরন দেখে হাসি পেয়ে গেল অরিত্রর…মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল…আর যদি চাকরীটাই চলে যায়…কি হবে?
কি আবার হবে…ভালো হবে…তোমাকে আর ভোর বেলা উঠে অফিস যেতে হবে না…আর আমাদেরকে রাত জেগে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে না।
কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ…দুজনেই হয়তো ভাবছিল কি বলবে বা চুপচাপ থাকলেও শরীরের ভাষায় হয়তো কথা হচ্ছিল…কখোনো আড় চোখে তাকানো…কখোনো বা একটু হাসি…যে হাসির কোনো মানে নেই…আবার হয়তো অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে সেই ছোট্ট হাসির ভেতরে।
মৌ কোলের উপরে হাত রেখে বসেছিল…খুব ইচ্ছে করছিল ওকে একবার ছুঁতে। ওর দিকে কিছুটা সরে গেলে বাইরের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালো…চোখে চোখ রেখে আলতো করে হাতের উপরে হাত রেখে চাপ দিলে কেমন যেন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন…তারপর চোখ বুজে খুব প্রিয় কারুর স্পর্শ নিজের বুকের ভেতরে অনুভব করতে করতে অস্ফুট স্বরে বলল…কিছু বলছো না তো?
ভাবছি…কি বলবো।
শোবে?
কোথায়?
আমার কোলে।
অরিত্র ভাবছিল…ও কি করে বুঝলো…আমার মনের কথা। আর কিছু না বলে ওর কোলে মাথা রেখে শুলে আস্তে আস্তে চুলের ভেতরে আঙ্গুল দিয়ে বিলি কাটতে কাটতে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে ছিল। মেয়েলী সুগন্ধ বুক ভরে নিয়ে ওকে দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল …আর কিছু চাই না… ওর দু চোখে খুশির ঝিলিক…একটু ঝুঁকে যেন আরো ভালোভাবে ওকে দেখতে চাইলো…এত কাছে ওর উদ্ধত যৌবনের উপস্থিতি…খুব ইচ্ছে করছিল সেই আকাঙ্খিত অজানা অচেনাকে মুখ গুঁজে অনুভব করতে…আরো একটু ঝুঁকে কপালে ওর নাক লাগিয়ে আলতো ভাবে ঘষে দিয়ে মুখ তুলে নিল…দু চোখের খুশি এখন ওর সারা মুখে ছড়িয়ে পড়েছে…যেন…জীবনের সব কিছু পাওয়া হয়ে গেছে…আর কিছু চাই না…মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে…আলতো ভাবে ওর গালে আঙ্গুল বোলাতে বোলাতে বলল…কি দেখছো?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকলে আবার জিজ্ঞেস করল…এই…বলো না…কি দেখছো।
হাসি মুখে জবাব দিল…খুব মিষ্টি একজন কে দেখছি…
তাই?
হুঁ।
খুব মিষ্টি তো দুষ্টু একজন কাছে আসতে চায়না কেন?
কে বলেছে কাছে আসতে চায় না? এই তো এসেছে…
চায় না তো…ভীষন দুষ্টু…খালি আমাকে কষ্ট দেয়…
আর দেবে না…
জানি…
চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে বলল…এই.. আর একটু উঠে শোও না…ওদিকে তো পা রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। উঠে শুতে গেলে ওর কোমল বুক ছুঁয়ে থাকলো গালের পাশে, গাড়ীর ঝাঁকুনিতে সেই আকাঙ্খিত স্পর্শ মাঝে মাঝে আরো নিবীড় হয়ে উঠছিল, মৌ ওর মাথার পেছনে হাত রেখে আরো কাছে টেনে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে ফিস ফিস করেবলল… ঘুমোবে?
উঁ হুঁ…তোমাকে দেখবো কি করে।
মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে আলতো করে নাক দিয়ে কপালে ঘষে দিয়ে বলল… আজকেই সব দেখে নিলে পরে কি দেখবে?
সারা জীবন দেখলেও শেষ হবে না।
তাই?
হুঁ
চোখের পলক না ফেলে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েছিল, ভুলে গেছে হয়তো ওরা একা নয়। মাঝে মাঝে চোখ চলে যাচ্ছিল অন্য দিকে, কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবে ঠিক করতে না পেরে, গালের হালকা গোলাপি আভা, এক গোছা অবাধ্য রেশম কোমল চুল বারে বারে মুখের উপর এসে চোখ ঢেকে দিয়ে বলতে চাইছে নাকি? এই…এখনই এতো দেখো না… ওই নরম লাল ঠোঁট…মনে হ’ল তির তির করে কাঁপছে… মন মানতে চাইলো না… কিছু পাবার ইচ্ছে নিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে নীরবে জানালো কি চাই… চোখের ইশারায় উত্তর এলো… কি করে দেবো…কেউ দেখে ফেললে? দাও না…খুব ইচ্ছে করছে… উত্তর এলো উমমম…দাঁড়াও… ভাবি। আস্তে করে বলল…একটু ওঠোনা।
কেন? লাগছে?
উঁ হুঁ…
মাথা তুলে একটু সরে গেলে গায়ের শালটা দিয়ে নিজের মাথা ঢেকে নিয়ে ইসারা করলো আবার শুতে। আগের মতো শুয়ে পড়লে বুকে চেপে নিয়ে মুখ নিচু করে এগিয়ে এলো…শালটা দিয়ে ওকেও ঢেকে নিয়ে। এতো কাছে দুজনের ঠোঁট, শালের অবগুন্ঠনের আড়ালের আবছা আলোয় দুজনেরই চোখে আকাঙ্খা… কই…চুমু দাও। অপেক্ষা করতে করতে চোখ বুজে এলো দুজনের…এই ভেবে…আগে ও দিক। কেউ জানে না কে আগে কার ঠোঁট ছুঁয়েছে…শুধু বুঝেছে ওরা একে অপরকে ছুঁয়ে আছে। শুধু ছুঁয়ে থাকলেও যে এতো ভালো লাগতে পারে জানা ছিল না কারুরই…সময় কেটে যাচ্ছে…হালকা নিশ্বাস আস্তে আস্তে ঘন হয়ে উঠল… হয়তো বুক ভরে স্বাস নেওয়ার জন্য এক পলকের জন্য দুজনে দুজনের স্পর্শ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। চোখ মেলে তাকালো দুজনে…কে জানে কে আগে…চোখের ইশারা…আরো চাই…লাজুক হাসিতে বোঝালো…ইস…লজ্জা করছে…তুমি নাও। উঁ হুঁ…তুমি এসো…দুজনেরই চোখ বুজে গেল আবার…আলতো চুমুর অস্পষ্ট মিষ্টি আওয়াজ…একের পর এক…কিন্তুনেই কোনো তাড়াহুড়ো…কারুর ঠোঁটে আর একজনের আলতো কামড়…অসহ্য সুখের অস্ফুট আঃ আওয়াজ কারুর গলায়…আরো পাওয়ার আশায় অপরজন নিজেকে আরো এগিয়ে দিয়েছে… পাশ দিয়ে বোধ হয় একটা গাড়ী খুব জোরে হর্ন দিয়ে পেরিয়ে গেল।সম্বিত ফিরে এলো হয়তো এক সাথেই দুজনের… অবগুন্ঠনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বুকের উপরে শুয়ে থাকা দুষ্টুটার গালে আদরের আলতো চিমটি দিয়ে চোখের ভাষায় বোঝালো… খুব শখ… না… সবাই এতো কাছে… ওইভাবে না কামড়ালে হোতো না?
ভালো ছেলেটা আবার ছোটোবেলার মতো দুষ্টু হয়ে গিয়ে হাসি মুখে বোঝালো…আরো করবো…দুষ্টুমি।
আকাঙ্খিত উত্তরটা পেয়ে গেলে প্রত্যুত্তর এলো… ইস…বয়ে গেছে।
পবন গাড়ীটাকে একেবারে তিস্তার পাশে নামিয়ে দিয়েছে। এর আগে দুর থেকে তিস্তার আপন খেয়ালে বয়ে যাওয়া দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু এত কাছ থেকে এই প্রথম সেই উচ্ছল প্রানচঞ্চল সুন্দরী কিশোরী তিস্তাকে ছুঁতে পেরে ভীষন ভালো লাগছিল। এই বয়সেও দাদুরা যেন বাচ্চাদের মতো খুশীতে ফেটে পড়ছে।
মৌ ছোট ছোট রঙ্গীন নুড়ি কুড়িয়ে জড় করছে,মাঝে মাঝে দৌড়ে এসে দেখাচ্ছে কি সুন্দর একটা নুড়ি পেয়েছে…মনে হচ্ছিল সামান্য একটা পাথরের টুকরো নয়…হীরে জহরত পেয়েছে। কিছুক্ষন ওদের সাথে থাকার পর একটা ফোন আসায় একটু দুরে একটা পাথরের উপর বসে ফোনে কথা বলা হয়ে গেলে চুপ করে বসে দেখছিল তিস্তার পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে যাওয়া। এক এক করে দাদুরা এসে আসে পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল।মৌ তখোনো নুড়ি কুড়িয়ে যাচ্ছে…কখোনো জলে পা ডুবিয়ে ঠান্ডা সহ্য করতে না পেরে বাচ্চাদের মতো ছটপট করে উঠে পা তুলে নিচ্ছে। দিদান হাসতে হাসতে বলল…দেখো…কেমন বাচ্চাদের মতো করছে…এত সরল মেয়েটা…। প্রথমে বোধ হয় খেয়াল করে নি সবাই একটু দুরে বসে আছে, দেখতে পেয়ে দৌড়ে এসে দিদানের হাত ধরে বলল…ও দিদান …চলো না…।
ফিরে এলি কেন…বেশ তো হুটোপুটি করছিস…
চলো না…একা একা ভালো লাগে নাকি…
আচ্ছা ঠিক আছে…ছোটো দিদান কে নিয়ে যা…
কিছুক্ষন পরে ছোটো দিদান ফিরে এলো…উঃ বাবা…এইবয়সে পারা যায় নাকি… কি মেয়েরে বাবা… বাড়ীতে এত চুপচাপ থাকে, এখানে এসে দেখো…কি করছে।
অরিত্র নিজের মনে ভাবছিল… তুমি বুঝবে না শুক্লাদি,শুধু তুমি কেন, আমি ছাড়া আর কেউ জানে ওই খুশীর কারন কি। ও যে ওর ভালোবাসাকে পেয়ে গেছে।ওর মতো সুখী আর কেউ নেই। ও যে আর নিজের ভেতরের সেই খুশী আটকে রাখতে পারছে না… সবাই কে ডেকে ডেকে ও নীরবে বলতে চাইছে… ‘আমার মতো সুখি কে আছে? আয় সখি আয় আমার কাছে… সুখী হৃদয়ের সুখের গান… শুনিয়া তোদের জুড়াবে প্রান’।
ওদের কথার মাঝে পবন ওদের কাছে এসে জানালো রাস্তায় নাকি একটা গাড়ী উলটে গিয়ে রাস্তায় জ্যাম আছে, একটু হাতে সময় না নিয়ে এগোলে রাত হয়ে যেতে পারে। বাধ্য হয়ে উঠতে হল, গাড়ীতে ওঠার আগে অরিত্র হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল…এত গুলো নুড়ি নিয়ে কি করবে…আমাদের বাড়ীতে এত জায়গা নেই রাখার…
মুখ ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল…আমার বয়ে গেছে তোমার বাড়ীতে রাখতে…আমি আমার দাদুর বাড়ীতে রাখবো।
ইস…দাদুর বাড়ীতে রাখবে…ওটা আমার ও বাড়ী…
ঘোড়ার ডিম…তোমার বাড়ী ভবানীপুরে…এখানে দাদুরা খালি থাকতে দিয়েছে…ও দিদান…বলো না…আমি ভুল বলছি নাকি…
দিদান হাসতে হাসতে বলল…আচ্ছা বাবা…গাড়ীতে ওঠ তো আগে…দেরী হয়ে যাবে।
গ্যাংটকে পৌঁছোবার একদিন পর বিকেলে সবাই মিলে মিলে মলে গেছে কিছু কেনাকাটা করার জন্য। পবন ওদের কে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে গাড়ী পার্ক করতে। গ্যাংটকে এটাই একটা অসুবিধা, সরু রাস্তা বলে পুলিশ যেখানে সেখানে গাড়ী রাখতে দেয় না। হাঁটতে হাঁটতে সবাই মিলে একসাথে এগোচ্ছিল, একটা ফোন আসায় কথা বলতে গিয়ে অরিত্র একটু পিছিয়ে পড়েছে। কেউ যেন পাশে একটু দূর থেকে এই অরিত্র বলে ডাকলো। এখানে আবার কে ডাকবে ওকে… ভাবতে ভাবতে তাকিয়ে দেখে শৌভিক…ওর কলেজের বন্ধু। সাথে ওর মা বাবা আর বোন সুস্মিতা।
কাছে গেলে শৌভিক জিজ্ঞেস করল…এই তুই কি রে? সেই যে হঠাত আসা বন্ধ করে দিলি…কি ব্যাপার বলতো? তারপরে তোর বাড়ীতে দু তিন বার গেছি তোর খোঁজে…কেউ বলেনি তোকে?
ভুলে গেছে হয়তো…এই এমনি…সময় পাই না রে একেবারে।
সময় পাস না ঠিক আছে…ফোন করতে পারিস তো নাকি…তাও করা যায় না…কতবার ফোনে চেষ্টা করেছি…খালি সুইচড অফ…তারপর অবশ্য আর করিনি।
ফোনটা ট্রেনে চুরি হয়ে গিয়েছিল… আর তোর নাম্বারটা আসলে মনে ছিল না… আর একবার দে…সেভ করে নি।
ওর মা পাস থেকে বলল… অন্য কিছু ব্যাপার নেই তো… এত বছরের সম্পর্ক…
না না …মাসীমা…অন্য কিছু ব্যাপার নেই… আপনারা কবে এসেছেন?
আমরা এই তো আজ দুপুরে এলাম…তোমরা?
আমরা পরশু এসেছি…
মাসীমার সাথে কথা বলতে বলতে সুস্মিতার দিকে তাকালো…অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবলো… যাক… সবাই আছে যখন কিছু বলবে না। আরো কিছুক্ষন কথা বলে… দাদুরা অপেক্ষা করছে…আসছি বলে এগোতে গেলে…সুস্মিতা দেখা হবার পর এই প্রথম কথা বলল… অরিত্রদা একটু দাঁড়াও না… মা তোমরা দোকানে যাও… আমি এখুনি আসছি…
বাধ্য হয়ে দাঁড়াতে হল…মাসীমারা সামনের দোকানটাতে ঢুকে গেলে…সুস্মিতা জিজ্ঞেস করল… কেমন আছো?
মোটামুটি …তুমি?
একটু হাসলো…কিন্তু তা যেন ব্যাথাভরা …এই যেমন দেখছো। একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
ব’ল
না এর কারনটা জানাতে কি খুব অসুবিধা ছিল?
অরিত্র কি বলবে বুঝতে পারছিল না… ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল… ঠিক আছে…বলতে হবে না… সব কিছু তো আর বলা যায় না। ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল… আমি কিন্তু তোমাকে সত্যিই ভালোবেসে ছিলাম…হয়তো আজও বাসি… না হলে এখোনো মাঝে মাঝে মনে পড়ে যায় কেন … খুব খারাপ লেগেছিল… যাক সেসব কথা… তুমি কি এখোনো একা?
একা নই…তবে হয়তো কোনোদিন আবার একা হয়েও যেতে পারি…
অবাক হয়ে গিয়ে বলল… মানে?
আমি নিজেও জানি না।
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…ঠাট্টা করছো? যাকগে…ভালো থেকো …সামনের বছর আমার বিয়ে …ডেটটা শুধু ঠিক হয়নি… আসবে?
বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো… একটা মানুষ সবাইকে খুশী করতে পারে না… যতই চেষ্টা করুক…ভাবতে ভাবতে জিজ্ঞেস করল…মা বাবার দেখে দেওয়া?
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
মুখটা নীচু করে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল… তাছাড়া আবার কি? প্রেম একবারই আসে… আমি অন্তত তাই মনে করি…
কি বলবে ওকে নিজেও জানতো না… বন্ধুর বোন হিসেবে দেখতো…ভালো যে লাগতো না… তা নয়…কিন্তু … ওর কাছে সেই ভালো লাগার অন্য কোনো মানে ছিল না…সুস্মিতা যে এতটা এগোবে বুঝতে পারেনি …যখন বুঝেছিল …তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছিল।
একটা কথা বলবো? কিছু মনে করবে না তো?
বলো…
আমি কিন্তু…তোমাকে…
বুঝেছিলা্ম…অনেক পরে…তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে…যাক গে বাদ দাও… অনেক কিছু তো আমরা চাই… সব কিছু তো আর পাওয়া যায় না… খুব টেনশান হয়…নতুন করে আর একজনকে ভালোবাসতে হবে…জানি না পারবো কিনা… তবুও চেষ্টা করতে হবে… একটাই সান্তনা… যাকে ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলাম…সে আমাকে ঠকায় নি… নিতে পারবে না বুঝে … দুরে সরে গিয়ে… আমাকে হয়তো কিছুটা হলেও…বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে।
চুপ করে দাঁড়িয়ে ওর কথা গুলো শুনছিল… বলার তো কিছুই নেই ওকে…তবুও শেষের কথা গুলো শুনে বুকের ভেতরের পাথরটা কিছুটা হলে যেন সরে গেল। পেছন থেকে পবনের গলা শুনে ফিরে তাকালো… ওকে দেখতে না পেয়ে খুঁজে এসেছে…সাথে মৌ…মৌ প্রথমে হয়তো বুঝতে পারেনি ও কারুর সাথে আছে বা ওকে দেখতে পেয়ে আর কিছুর খেয়াল করতে পারেনি… মিষ্টি বকুনীর স্বরে বলল…এই…কি ব্যাপার বলোতো তোমার…কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি…তারপরেই বোধহয় সুস্মিতা কে দেখে একটু থমকে গিয়ে চুপ করে গেল।
অরিত্র ওদের আলাপ করিয়ে দিতে দিতে সুস্মিতা নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল…হাসি মুখে বলল… অরিত্রদা …এসো কিন্তু বিয়েতে…এই মৌ…তোমারও আসা চাই…না এলে কিন্তু খুব রাগ করবো… যাবার আগে মৌ এর হাত ধরে হাসতে হাসতে বলল… এই মৌ… কিছু মনে করবে না তো…একটা কথা বলবো?
না না… ব’লো না…
তোমাকে দেখে কিন্তু আমার খুব হিংসে হচ্ছে। এই, প্লিজ কিছু মনে করবে না কিন্তু…এমনিই ব’ললাম।
রাতে খেতে বসে মৌ বেশ চুপচাপ…খুব আস্তে আস্তে ওকে খেতে দেখে দিদান জিজ্ঞেস করল…কি হয়েছে রে মৌ…শরীর খারাপ? ভালো লাগছে না?
একটু ভারী গলায় বলল…না…এমনিই…ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে…
অরিত্র উল্টোদিকে বসে খেতে খেতে মুখ তুলে তাকালো… সারা মুখে বিষন্নতা…বুঝতে অসুবিধা হল না…কারনটা কি হতে পারে। একজন মেয়ে হয়ে আর একজনের ব্যাথা ভরা মুখ দেখলে না বোঝাটা খুব একটা অসম্ভব নয়। বাকি সবার খাওয়া হয়ে গেছে দেখে অরিত্র বলল…দাদু…তোমরা যাও…আমি আছি। ব্যাপারটা এমনই যে ভালো না লাগলেও ওর সাথে কথা বলতে হবে…না হলে ও কি বুঝে বসে থাকবে কে জানে…ভাবতে ভাবতে আবার ওর দিকে তাকালো…মুখ নিচু করে বসে আছে… বিশেষ কিছুই খায়নি। খেয়ে নিতে বলাতে মুখ তুলে একবার তাকিয়ে আবার মুখ নামিয়ে নিয়ে বলল…ভালো লাগছেনা।
রাতে ক্ষিধে পেয়ে যাবে তো।
অভিমানী গলায় আস্তে করে বলল… ইচ্ছে করছেনা।
কেন?
এমনি…
ও নিজের থেকে কিছু বলবে না বুঝতে পেরে বলতেহল…সুস্মিতা আমার বন্ধুর বোন…
আমি কিছু জিজ্ঞেস করিনি…
মৌ নিজের মুখে কিছু না বললেও মনের ভেতরে কি আছে না বোঝার কথা নয়… কিন্তু কি করে ওকে বুঝিয়ে বলবে ঠিক করতে পারছিল না। একটু চুপ করে থাকার পর বলল… তুমি যেটা ভাবছো তা নয়…তবে…
ওকে থেমে যেতে দেখে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলো…কিছু না বলে মুখ নামিয়ে নিয়ে বসেছিল… বুকের ভেতরের কষ্টটা ভীষন ভাবে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে…
আমার দিক থেকে কিছু না থাকলেও… সুস্মিতা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। বোঝা গেল না কি বুঝলো…আগের মতোই চুপ করে বসে ছিল পাথরের মতো…একটা আঙ্গুল দিয়ে ডিসের উপরে আঁকিবুকি কাটতে কাটতে…
প্লিজ… বিশ্বাস কর…আমি সরে এসেছিলাম…
এতক্ষন পরে একটাই কথা জিজ্ঞেস করল… তোমার দিক থেকে সত্যিই কিছু ছিল না?
না…
কিছুক্ষন আর কোনো কথা হোলো না… দুজনেই চুপ করে বসে ছিল… একজন ভাবছিল…ও কি বিশ্বাস করেছে আমার কথা? যদি না করতে পারে তো সারা জীবনের জন্য সন্দেহের একটা কাঁটা বুকের ভেতরে থেকে যাবে। আর একজন ভাবছিল… আমাকে হয়তো ও খুব খারাপ ভাবছে… ওর দুচোখে কান্নার আভাস… না বুঝে কেন ওর সাথে এরকম করলাম… ধরা গলায় বলল… কিছু মনে কোরো না… বুঝতে পারিনি…
নিজের কানকেই যেন বিস্বাস হচ্ছিল না…কি বলছে ও? ও যে কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পেরে বলল… না কিছু মনে করিনি। তুমি কেন অন্য কেউ হলেও একই হোতো।
কিছুক্ষন দুজনেই চুপ… অরিত্রকে এর পরেও গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখে বলল… আমি জানি…তোমার খারাপ লেগেছে…
মুখে হাসি আনতে চেয়েও পারলো না… খুব ম্লান দেখালো সেই হাসি… তোমার জন্য নয়…সুস্মিতার একটা কথা মনে পড়ে গেল…
জিজ্জেস করা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছিল না মৌ… চুপ করে থেকে অপেক্ষা করছিল…যদি ও নিজের থেকে বলে…
অরিত্র টেবিলে রাখা জলের গ্লাসটার ভেতর দিয়ে ওদিকে দেখার চেষ্টা করতে করতে নিজের মনেই বলল… তোমার জানতে ইচ্ছে করছে না?
ব’ল…
কি বললো জানো… ‘হয়তো এখোনো ভালোবাসি’… কিছুতেই ভুলতে পারছি না… খুব খারাপ লাগছে… ওর জন্য। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… চলো তোমাকে দিয়ে আসি…
কোথায়?
ভালো লাগছে না…এতক্ষন তোমার কথা ভেবে খারাপ লাগছিল …আর এখন ওর কথা ভেবে…
একা একা তো আরো খারাপ লাগবে…
আজ খুব খেতে ইচ্ছে করছে…
আমি তোমার সাথে থাকবো?
থাকবে? ঠিক আছে…চলো…বলে আসি…না হলে দিদানরা চিন্তা করবে।
রাত সাড়ে এগারোটা… মৌ খেতে পারেনি বলে ওর জন্য আরো একবার কিছু খাওয়ার আর সাথে নিজের জন্য একটা বড় পেগ আনানো হয়েছে। সোফাতে ওর বুকে মাথা রেখে মৌ বসে…এক হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকে একটু একটু করে খাইয়ে দিতে দিতে দুজনে কথা বলছে। খাইয়ে দিতে গেলে আঙ্গুলে আলতো করে কামড়ে দিয়ে বলল… তুমি খাবে না?
আমি খেয়েছি তো।
ইস, আমি দেখিনি নাকি। একটু খেয়েই তো সব ফেলে দিলে।
হবে হয়তো।
এই, ছাড়ো না।
কেন?
তোমাকে খাইয়ে দি।
গ্লাসটা না ছোঁয়া অবস্থায় পড়ে আছে। দুজনের ভেতরের গুমোট হাওয়া কেটে গেছে তাই আর ওটার দরকার পড়েনি।
এই, তুমি যে ওটা আনালে…খেলে না তো?
থাক… খাবো না।
কেন?
এমনি…আর তো দরকার নেই।
এই, এবারে যাই? অনেক রাত হয়েছে।
উমম… না…
ছোটো দিদান উঠে পড়লে?
উঠবে না…ঠান্ডা পড়েছে।
না গো…কি ভাববে …তাই না?
কিছু ভাববে না…আমাদের কে চেনে…তোমার এখানে থাকতে ভালো লাগছে না?
তাহলে, কি করবো আমরা?
উমম…কিছু না…চুপচাপ বসে থাকবো… গল্প করবো।
মৌ ফিসফিস করে বলল…তাই?
হুম, তাই…
আর কিছু নয় তো?
উঁ হুঁ।
সত্যি?
না।
তাহলে?
তাহলে? তাহলে আমার মৌ সোনা আমাকে অনেকগুলো ওই দেবে…
কি?
ওই যে পরশু… আসার সময়ে…
একটাও পাবে না…
উম…কেন?
তুমি খুব দুষ্টু …
না দিলে আরো দুষ্টুমি করবো…
তাই?
হুম।
তুমি না দিলে আমিও দেবো না।
আমি কি বলেছি দেবো না…
তাহলে আগে দাওনি কেন?
তুমি চাওনি…তাই।
ইস, সব আমাকেই চাইতে হবে নাকি?
উঁ হূ…আর চাইতে হবে না…এসো।
দুজনে হারিয়ে গেছে দুজনার ভেতরে… ওরা ছাড়া আর কেই নেই কোথাও…নেই কোনো দুঃখ, নেই কোনো অভিমান…দুজনে দুজনকে আদরে আদরে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সময়ের কথা না ভেবে…বুক ভরা ভালোলাগা নিয়ে ভালোবাসার মানুষ টাকে নিজের বুকে চেপে ধরে একজন ভাবছে… ঈশ্বর, আমি চাই না আমার স্মৃতি ফিরে পেতে… আর এক জন ভাবছে… জানি না এই সুখ আমার কপালে সইবে কিনা।
গ্যাংটক থেকে ফিরে এসে আর সময় বেশি ছিল না হাতে। একমাত্র নিজের দু বোনকে ছাড়া আর কাউকে জানায়নি মৌ এর সাথে ওর যা কথা হয়েছে, রুপসা তো খুব খুশীই, পুবালীও কম খুশী হয়নি ভাই এর কাছ থেকে শোনার পর। রুপসার আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি। ওর চাকরীটা হয়ে গেছে। এই মূহুর্তে ছুটি পাবে না। পুবালী বলে দিয়েছে অরিত্র চলে যাবার পর ও মৌকে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখবে। সম্ভব হলে অরিত্র যতদিন না ফিরছে ততদিন থাকতে পারলে ভালো যদি দাদু দিদানদের আপত্তি না থাকে। কয়েকটা দিন আছে আর চলে যাবার আগে। তার ভেতরেই বিশ্বাস কাকুর সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছে ফোনে। পুজোর পরেই বিশ্বাস কাকু বিধান নগর থানায় বদলি হয়ে এসে গেছে। জোড়াবাগান থানা থেকে খবর পাওয়া গেল… ওর বাড়ির লোকজন ফিরেছে। অরিত্রর নিজের যাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু বিশ্বাস কাকু বারন করেছে, ওর যাওয়াটা ঠিক হবে না। কি ব্যাপার তো জানা নেই। অরিত্রর সুত্র ধরে মৌকে পেয়ে যাওয়াটা ওদের পক্ষে কঠিন নাও হতে পারে। আগের মতোই জ়োড়াবাগান থানার মেজ বাবুর সাথে গিয়ে কি করা যায় দেখা যাক বলে ওকে বুঝিয়েছে।
দুদিন পর খবর পাওয়া গেল। ওর মা মনে হচ্ছে কিছুটা মচকেছে কিন্তু ভাঙ্গেনি। খুব শক্ত ধাতের মহিলা। আইনের পথে হাঁটা যাচ্ছে না বলে বেশী কিছু আর করা যায়নি…যাই হোক আবার চেষ্টা করা যাবে ভেবে ওরা ফিরে আসছিল। গলি থেকে বেরিয়ে কিছুটা আসার পর একটা ছেলে বাইকে করে এসে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে যায়, সাথে একটি মেয়ে। ছেলেটি বার বার জিজ্ঞেস করে কেন আপনারা আমার দিদির খোঁজ করছেন। বোঝাই যাচ্ছিল ওরা মৌ এর ভাই বোন কিন্তু ওদের আসল উদ্দেশ্য কি বোঝা যাচ্ছিল না বলে মুখ খোলা মুশকিল হয়ে যায়। কিছু জানতে না পেরে এরপর ওরা দুজনেই কেঁদে ফেলে… জানতে চায় ওদের দিদির কোনো খবর আছে কিনা। একটু বাজিয়ে দেখে নিয়ে তারপরে না হয় বলার মতো হলে বলা যাবে ভেবে ওদের দুজন কে নিয়ে বিশ্বাস কাকু শ্যাম বাজারের একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে বসেন। অনেক সময় ধরে কথা বলার পর জানা যায় ওদের দিদি হঠাৎই একদিন হারিয়ে যায় যেদিন নাকি ও বেশ অসুস্থ ছিল, বোনের সাথে শেষ দেখা হয়েছিল পড়তে যাবার আগে। ওদের মা যে দিদিকে একেবারেই ভালোবাসেনা সেটাও জানিয়েছে কিন্তু কেন দিদি নিরুদ্দেশ হয়ে গেল ওরা জানতে পারেনি। মায়ের সাথে অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে দুজনেই কিন্তু মায়ের কাছ থেকে কিছু জানতে পারেনি বা মা কেন দিদিকে খোঁজার চেষ্টা করছে না তাও মায়ের ভয়ে তেমন ভাবে জিজ্ঞেস করতে পারেনি। শুধু এইটুকু বুঝেছে যে দিদির হারিয়ে যাবার পেছনে মায়ের হাত থাকাটা খুব স্বাভাবিক। শেষে ওদের কে কথা দিতে হয়েছে যে চেষ্টা করা হবে ওদের দিদির সাথে দেখা করিয়ে দেবার কিন্তু ওরা যেন কোনো ভাবেই এই ব্যাপারটা কাউকে না বলে। এমন কি আশেপাশের কাউকে বা বন্ধু বান্ধবকে ও নয়। দুজনেই কথা দিয়েছে, ওরা রাজী। সাথে এটাও ওদের কে বলে রাখা আছে যে, ব্যাপারটা এখন গোপন ভাবে পুলিশের কাছে আছে, অতএব, ওরা যেন এদিক ওদিক কিছু না করার চেষ্টা করে, তাতে ওদের দিদিরও ক্ষতি হতে পারে আর ওদের তো হবেই।
কি ভাবে মৌএর সাথে ওর ভাই বোনের দেখা করানো যায় বা দেখা হলে মৌ এর রিপারকেশান কি হবে আর তাতে ওর কোনো ক্ষতি হবে কিনা মানসিকভাবে সেটা ভাবার বিষয় ছিল। অনেক চিন্তা ভাবনা করে, সবার সাথে আর ডাক্তার দাদুর সাথে আলোচনা করে ঠিক করা হয়েছে বাইরে কোথাও মৌ কে নিয়ে অরিত্র যাবে। ওরা দু ভাই বোন একটু দূরে থাকবে যাতে মৌ ওদের কে দেখতে পায়। তারপরে ওর রিপারকেশান দেখে কি করা যায় সেটা ভাবা যাবে।
সেইমতো, শনিবার অফিস না গিয়ে মৌকে সাথে করে অরিত্র সাউথ সিটিতে এসেছে। ওকে বলা হয়েছে বাইরে যাবার আগে আরো কিছু জামাকাপড় কেনার আছে। ঘুরে আসার পর আর কোথাও যাওয়া হয়নি বা তার থেকেও ও অরিত্র কে আর তেমন ভাবে কাছে পায়নি বলে আজ অনেকটা সময় ওর সাথে একা একা থাকতে পারবে জেনে খুব খুশী। ঠিক যেন প্রজাপতির মতো খুশীতে উড়ে বেড়াচ্ছে। দুপুর তিনটে নাগাদ ওরা আসার পর পরই মৌ চেনে না এমন এক জনের সাথে বিল্টু আর মিষ্টিকে নিয়ে আসা হয়েছে। ওদের দুজনকেই বলা আছে ওরা যেন দিদির কাছে যাবার চেষ্টা না করে কারন দিদি ওদেরকে হঠাত দেখলে কি হবে না হবে জানা নেই। ওরাও বুঝেছে অসুবিধা টা কোথায়। ওদের দু ভাই বোনকে মৌ ওর আশেপাশে অনেক আগে থেকেই দেখেছে কিন্তু কোনোরকম ভাবান্তর ওর ভেতরে দেখা যায়নি। ও ওর নিজের খুশীতেই আছে। অরিত্রর জন্য কি কি নিতে হবে, কোনটা ভালো হবে, কোনটা ওকে বেশী মানাবে… ওই সব নিয়েই আছে। অনেকবার ওদের দুজনকে আশেপাশে দেখেও যখন ও চিনতে পারেনি, তখন ওদের ভাই বোন কে বুঝিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, পরে আবার দেখা করিয়ে দেওয়া হবে বলে। ওরা কিছুতেই মন থেকে মেনে না নিতে পারলেও ওদের দিদির ভালোর কথা ভেবে মেনে নিয়েছে এই ভেবে যে… যে দিদিকে আর কোনোদিন দেখতে পাবে এই আশা যেখানে ছিল না সেখানে দিদিকে ভালো আছে, খুশী আছে… দেখতে পেয়েছে… এটাই এই মুহুর্তের জন্য যথেষ্ট।
দেখতে দেখতে যাবার দিন এসে গেল, পরের দিন ও বেরিয়ে যাবে সকালে। আগের দিন রাত্রে অনেক রাত অব্দি সবার সাথে যতটা সম্ভব সময় কাটিয়ে শুতে গেছে। একেবারেই ভালো লাগছে না, মাত্র দুমাসের জন্য হলেও মনে হচ্ছে কতদিনের জন্য একা একা থাকতে হবে। এতদিন দাদু দিদানরা ছিল, এখন আবার আরো একজন আছে যাকে দেখতে না পেলে কিছুই ভালো লাগে না। কি করে ওদের কে ছেড়ে থাকবে জানে না। চুপ চাপ শুয়ে ছিল, ঘুম আসছে না। কিছু একটা ভাবছিল অন্যমনস্ক হয়ে। মনে হ’ল শুক্লাদি ডাকছে, এমনিতে কোনোদিন ওর ঘরের দরজা বন্ধ করে শোয়নি, আজ ও খোলা ছিল। শুক্লাদির ডাকে উঠে আলোটা জ্বালিয়ে দেখল শুক্লাদির পাশে মৌ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই মুখে কান্নার আভাস। শুক্লাদি ওকে ঊঠতে দেখে বলল…দাদুভাই, আমি পারছিনা…তুই দেখ এ মেয়েকে বোঝাতে পারিস কিনা। নিজে তো কাঁদছেই, আমাকেও কাঁদাচ্ছে।
শুক্লাদি নিজের ঘরে ফিরে গেছে অনেক আগে। ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে আছে, দুজন দুজনের হাত ধরে, কেউ কোনো কথা বলেনি। কে কাকে বোঝাবে আর কি বোঝাবে সেটাই তো জানা নেই কারুরই। মৌ এর ডাকে ওর দিকে ফিরে তাকালো অরিত্র। আস্তে করে বলল… তুমি ঘুমোও, সকালে উঠতে হবে তো। আমি আসি?
ওর, ওই…আমি আসি? শুনে নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, এত সময় বা এতদিন যা করেনি তাই আজ ও করে বসল… ওকে কোলে তুলে নিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ফিরে গিয়ে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর বুকে মুখ ঘষতে শুরু করল। কারুর মুখে কোনো কথা নেই। মৌ ওকে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে চাইছিল ওর আদর করা যেন আজ শেষ না হয়। কে, কি ভাববে আজ জানার নেই, বোঝার নেই,মন চাইছে আজ ওরা এক সাথে থাকুক। কত সময় কেটে গেছে কেউ জানেনা। আস্তে আস্তে ওরা কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়ে এসেছে…কিন্তু মন চাইছে না ছেড়ে যেতে। কিন্তু যেতে তো হবেই এক সময় না এক সময়, তাই নিজেদের কে বুঝিয়েছে… মৌ দুহাতে ওর মুখটা ধরে আছে…দুজনের চোখে পলক পড়ছেনা…আস্তে আস্তে ওদের ঠোঁট মিলে গেছে। দুজন দুজন কে চুমু দিয়েছে একের পর এক। মন যে ভরে না…এর কি শেষ আছে…জানি, শেষ নেই…তবুও যে মেনে নিতে হবে এই বিচ্ছেদ… হাসি মুখে একজন অন্যজন কে বলেছে… আসি? আর এক জন ওকে দেখতে দেখতে ভুলে গিয়েছিল কিছু তো ওকে উত্তর দিতে হবে। আবার… আসি? শূনে বলল… ইচ্ছে তো করছে না… তবুও…চলো…তোমাকে দিয়ে আসি।
শুক্লাদিকে ঘুম থেকে তুলে বলে আসতে হয়েছিল…এই নাও…তোমাদের আদরের মেয়েকে… দেখো ঠান্ডা হয়েছে কিনা। মিষ্টি মেয়েটা শুক্লাদির বুকে মুখ গুঁজে আদুরে গলায় বলেছে… তোমরা আমাকে নিজের মতো করে কিছুই করতে দাও না। কি হয়েছে, আমি না হয় একটু কেঁদেছি।
রাত তিনটে বাজে, সকাল সাড়ে ন টায় বেরতে হবে, কিছুটা হলেও তো ঘুমের দরকার। হোক না,আজ এই ভাবে দেখা হওয়াটা বা কাছে পাওয়াটা যে বড় দরকার ছিল, ওইটুকু পেলেও যে… খুব দরকার ছিল ওটা পাওয়া। না হ’লে যে… মনে ভীষন একটা কষ্ট থেকে যেত প্রিয়জন কে কাছে না পাওয়ার জন্য। ওদের তো বেশী কিছু চাই না…শুধু মন প্রান দিয়ে দুজন দুজনকে চায় ভালোবেসে যেতে, যে ভালোবাসায় নেই কামনার আগুন, নেই কোনো স্বার্থ… আছে শূধু ভালোবাসার মাধুর্য, যা কেউ চেষ্টা করলেও নিয়ে নিতে পারবে না। দুজনেই জানে না কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুক ভরা ভালোবাসার ভালোলাগা নিয়ে।
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
দেখতে দেখতে এক মাস প্রায় কেটে গেছে। রোজ ওদের কি এত কথা হয়েছে নিজেরাই জানে না, বোঝে নি। বোঝার চেষ্টা ও করেনি। এরকম একটা সন্ধে, মোটামুটি ঠান্ডা বাইরে, কেউ একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কখন ডাক আসবে, কানের পাশেই ফোন, ফোনের রিসিভ বাটনে আঙ্গুলটা থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ইস, আজকে এত কি কথা বলছে দাদুদের সাথে, ভুলে গেছে নাকি আর একজন কখন থেকে বসে আছে। বুকে ওর কোল বালিশটা চেপে ধরে স্বপ্নের ভেতরে চলে যেতে যেতে মনে হ’ল কেউ জিজ্ঞেস করছে…এই… কি ক’রছো?
কখন রিং এসেছে আর ও রিসিভ করেছে নিজেই জানে না, দুষ্টুমি ভরা স্বরে উত্তর দিলো… উমম… কি করছি?
হুম…
বলবো না…
কেন?
তুমি এত দেরী করলে কেন?
হুম… দাদুর ডাক্তার দেখানোর খোঁজ নিচ্ছিলাম।
আমি আছি না… তুমি এত চিন্তা ক’রো কেন?
জানি, তবুও জিজ্ঞেস করে নিলাম।
কি করছি? তুমিই ব’ল…আচ্ছা চলো…তুমিই বা কি করে জানবে। উমম…জানো…আমি এখন তোমার বিছানায় শুয়ে আছি…ওইদিন তুমি আমাকে যেখানে শুইয়ে দিয়ে আদর করেছিলে…ঠিক সেখানেই।
তাই? তা আজ তো কেউ নেই আদর করার…
আছে তো।
কে?
তোমার কোল বালিশটা আমার বুকে জড়িয়ে ধরে আছি আর ভাবছি তুমি আমাকে আদর করছো…
ইস, যাই একবার, ওটাকে গঙ্গায় ফেলে দেব। আমার জায়গায় ওটা কেন থাকবে…
না ফেলবে না… তুমি না থাকলে, কে আমাকে আদর করবে…ব’লো…
আচ্ছা ঠিক আছে ফেলবো না…এবার বলো…
দাঁড়াও না, আরো একটা আছে…গান শুনছিলাম…
কি গান?
উমম… দাঁড়াও…আওয়াজটা বাড়িয়ে দি…দুজনে মিলে শুনবো…কেমন?
হুম…দাও…
মনে হ’ল বহু দুর থেকে ভেসে এলো…সেই কথা গুলো…যা শুনতে পেলে মন চায়না আর কিছু…
ভালোবাসি…ভালোবাসি…
এই সুরে… কাছে দূরে… জলে স্থলে বাজায় …বাজায় বাঁশি… ভালোবাসি… ভালোবাসি
আকাশে তার বুকের মাঝে… ব্যাথা বাজে… দিগন্তে তার কালো আঁখি… আঁখির জলে… যায় ভাসি
ভালোবাসি… ভালোবাসি …ভালোবাসি…
সেই সুরে… সাগর কুলে… বাঁধন খুলে… অতল রোদন… উঠে দুলে
সেই সুরে… সাগর কুলে… বাঁধন খুলে… অতল রোদন… উঠে দুলে
সেই সুরে… বাজে মনে… অকারনে ভুলে যাওয়া গানের বানী… ভোলা দিনের কাঁদন… কাঁদন হাসি ভালোবাসি… ভালোবাসি…ভালোবাসি…ভালোবাসি
এই সুরে… কাছে দূরে… জলে স্থলে বাজায় …বাজায় বাঁশি… ভালোবাসি… ভালোবাসি
আকাশে তার বুকের মাঝে… ব্যাথা বাজে… দিগন্তে তার কালো আঁখি… আঁখির জলে… যায় ভাসি
ভালোবাসি… ভালোবাসি …ভালোবাসি…
গানটা শেষ হয়ে গেলেও বুকের ভেতরে ভালো লাগার রেশ টা থেকে গেছে…ফিস ফিস করে একজন জিজ্ঞেস ক’রল…এই…কি শুনলে?
উত্তর এলো…তুমি আমাকে বললে…
অধীর আগ্রহে আগের জন জিজ্ঞেস করল…কি? বুকের ভেতরে দ্রিম দ্রিম আওয়াজ…ও কি ব’লে শোনার জন্য…
“ভালোবাসি”…
ওই ছোট্ট কথাটা শুনে বুক ভরা ভালোলাগা নিয়ে ফিস ফিস স্বরে জবাব দি’ল… তুমিও তো বললে আমাকে…“ভালোবাসি…ভালোবাসি”…
দুমাস হতে আর দুদিন বাকি আছে। মাঝে একজন বলেছে…এই, জানো তো… খুব লজ্জা করে, তোমার সাথে এতক্ষন ধরে কথা বলি, দিদানরা কি ভাবে কে জানে। মেজদির ওখানে যে ক দিন ছিলাম কোনো ব্যাপার ছিল না, জেঠিমা বুঝতেই পারতো না আমি ফোনে আছি।
উত্তর এসেছে… কিছু ভাবে না… সবাই বোঝে।
কি বোঝে?
কে জানে…ওরা কি বোঝে।
ধ্যাত, তুমি না…
হুম, জানি তো…আমি খুব দুষ্টু।
তাই তো…তাছাড়া আবার কি।
এই, জানো তো…
কি?
থাক, দেখা হ’লে বলব।
এই, ব’লো না।
উমম…একটা চুমু দেবে?
না দেব না, বিচ্ছু কোথাকার…
এই…প্লিজ… দাও…না…
ছোট্ট একটা মিষ্টি আওয়াজ ভেসে এলো কানে…
একটি মিষ্টি মেয়ের আজ খুশীর অন্ত নেই… আজ ওর ও ফিরে আসছে। এই তো আসার সময় হয়ে এলো বলে। বারে বারে জানলার কাছে গিয়ে দেখছে, এলো কিনা। আসুক, খুব বকে দেবো…কথাই ব’লবো না। কত করে বললাম…কি হয়েছে, গেলে, তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে এলে। আমি কি বাচ্চা নাকি, হারিয়ে যাবো। শুনলোই না… ইস, কত কথা… না, দাদুর শরীর খারাপ,তুমি একা একা কি করে আসবে। আরে বাবা, তেমন হ’লে পুবালী দি কে বলাই যেতো, আমাকে নিয়ে যেতো এসে। তাও কি শুনলো নাকি… না না…ছোড়দির এখন সময় কোথায়, অফিস, তারপর আবার বিয়েটা ঘাড়ের উপরে এসে গেছে। রুপসা হলে ঠিক ছিল…ও অনেক স্মার্ট। ইস,আমি যেন স্মার্ট নই। এই তো ট্রেনে চেপে দমদম আর ওখান থেকে না হয় একটা ট্যাক্সি নিয়ে নিতাম। তাতেও আপত্তি, একা সুন্দরী মেয়ে পেয়ে যদি ট্যাক্সি অন্য কোথাও নিয়ে চলে যায়। ইস, এতো সোজা নাকি, নিয়ে চলে গেলেই হ’ল।
ইস, কত কি মিস করলাম জানো? তোমার তো গাড়ী বুক করাই আছে, আসার সময় কি সুন্দর তোমার একেবারে গা ঘেঁষে বসতাম, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে, তোমার কাঁধে মাথা রেখে গল্প করতে করতে আসা যেত। গাড়ির ড্রাইভার তো আর আমাদের কে চেনে না, লুকিয়ে তুমি আমাকে একটা হলেও তো চুমু খেতে পারতে। আমিও দিতাম না হয় আধখানা চুমু। তার বেশী চাইলেও দিতাম না, কেন দেবো ব’ল, আমি যে সেদিন তোমাকে ফোনে চুমু দিলাম, তুমি তারপরে কতক্ষন চুপ করে থাকলে,কই আমাকে তো দিলে না একটা চুমু। ইস, জানো , কত কথা জমে আছে…ফোনে এত কিছু ব’লা যায় নাকি। জানলার গ্রীল টা দুহাতে ধরে চোখ বুজে স্বপ্নের ভেতরে থাকতে থাকতে মনে হ’ল একটা গাড়ী এসে দাঁড়ালো। নিশ্বাস আটকে গেছে, কেউ এক জন ওর দিকে তাকিয়ে আছে… দুজনের চোখাচুখি হয়ে গেলে কেউ যেন চোখ ফেরাতে পারছিল না। স্বপ্নটা বেশী সময় ধরে দেখা গেল না। দাদুরা বেরিয়ে এসেছে। তাই ওকেও নীচে নেমে আসতে হল।
ইস, হটাত এত লজ্জা কোথা থেকে এলো কে জানে মেয়েটার, শুক্লাদির পেছনে দাঁড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। কাঠবিড়ালীর মতো উঁকি দিয়ে দেখছে ওকে… এই ক দিনে কি একটু মোটা হয়েছে? ধুস, মনে তো হচ্ছে তো একই রকম…না না…একটু যেন ফর্সা হয়ে গেছে…না…না…তাও তো নয়…ওর গায়ের রং তো এরকমই। তাহলে? কি হয়েছে? হুম বুঝেছি… একটু যেন বেশী হ্যান্ডসাম লাগছে। তাই, হবে… এখন আর আগের মতো বুদ্ধু বুদ্ধু দেখাচ্ছে না তো। ইস, ওকে বুদ্ধু বুদ্ধু লাগে নাকি দেখতে? সবাই ওকে বুদ্ধু বললে কি ও বুদ্ধু হয়ে যাবে নাকি।
সন্ধে সাড়ে সাতটা প্রায় বাজে। দাদুদের সাথে অনেক সময় ধরে গল্প করতে হয়েছে অরিত্রকে… জায়গাটা কেমন, ওখানকার মানুষ জন কিরকম… ইত্যাদি ইত্যাদি। শেষে দিদানের বকুনি খেয়ে তবে দাদু ওকে ছেড়েছে। অরিত্র নিজের ঘরে উঠে এসেছে একটু আগে, ভালো করে স্নান করতে হবে হাল্কা গরম জলে, না হলে শরীরটা ঠিক হবে না। শাওয়ারের উষ্ণ ধারায় ভিজতে ভিজতে মৌ এর লজ্জা পাওয়া মিষ্টি মুখটা মনের আয়নায় ভেসে উঠল। বুকের ভেতরের ভালো লাগা সারা মুখে ছড়িয়ে পড়ল হাসি হয়ে। ভুলেই গেছে স্নান শেষ করতে হবে। নিজেই জানে না কতক্ষন হয়েছে ও স্নানে ঢুকেছে। বাথরুমের দরজায় আস্তে আস্তে টোকা দেবার আওয়াজ শুনে বুঝতে পারলো মৌ ছাড়া আর কেউ নয়… খুব ইচ্ছে হ’ল আস্তে করে দরজাটা খুলে ওকে ভেতরে টেনে নেয়… কতদিন হয়ে গেছে, ওকে আদর করতে পারেনি, চুমু খেতে পারেনি। এখন তো আর কেউ উপরে আসবে না, যতক্ষন খুশী ওকে আদর করতে পারবে। নিজেকে সামলে নিতে হ’ল…নাঃ…এখন এই ভাবে ওকে এখানে টেনে নিয়ে আসাটা ঠিক হবে না। ও লজ্জা পেয়ে যাবে ওকে দেখলে…তাছাড়া ভেজা গায়ে ওকে জড়িয়ে ধরলে ওর জামাকাপড়ও ভিজে যাবে… দিদানরা কি ভাববে…থাক। আস্তে করে সাড়া দিল ভেতর থেকে…হ্যাঁ…আসছি…হয়ে এসেছে। মিষ্টি মেয়ের আরো মিষ্টি আওয়াজ ভেসে এলো কানে… তোমার জন্য কফি নিয়ে এসেছি…ঠান্ডা হয়ে যাবে কিন্তু…দেরী কোরো না।
- উমমম…তাই? ঠান্ডা হবে কেন?
- বা রে… ঠান্ডা হবে না?
- উঁ হূঁ… তুমি আছো তো…
- ইস, তুমি আছো তো…একদম দুষ্টূমি নয়… তাড়াতাড়ি এসো...
- হু…আসছি
মৌ কফির কাপটা ঢাকা দিয়ে জানলার কাছে গিয়ে কি ভেবে জানলাটা খুলে দিলে এক ঝলক শীতের ঠান্ডা হাওয়া ঘরের ভেতরে এসে ওকে কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে ঘরে ইনভার্টারের আলো থাকলেও বাইরেটা চাঁদের মিষ্টি আলোয় ভেসে যাচ্ছে… আজ কি পূর্নিমা? কি জানি…হবে হয়তো। চাঁদের নরম আলো নদীর ছোটো ছোটো ঢেউ গুলোকে যেন আদর করে দিয়ে যাচ্ছে। শীতের সন্ধে…চারদিক প্রায় নিস্তব্ধ… নিঃসঙ্গ নদীর বুকে একটা খড় বোঝাই নৌকো জল টানার ছপ ছপ আওয়াজ করে আস্তে আস্তে পেরিয়ে গেল…মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খেয়াল করেনি কখন ওর ও এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। ওর সদ্যস্নাত শরীরের সুগন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে মনে হচ্ছিল এই বাঁধন যেন না আর খোলে। কখন ওর ও ওকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বুকে চেপে ধরেছে হয়তো বুঝতে পারেনি… মৌ ওর দুষ্টুর বুকে মাথা রেখে বুক ভরা ভালোলাগা নিয়ে ভাবছিল… সারা বিকেলটা কত অভিমান হচ্ছিল ওর উপরে…কই, এখন তো আর কিছু মনে হচ্ছে না… বুকে টেনে নিয়েছে বলে সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল? জানি তো, এটাই ভালোবাসা। কাছে না পেলে অভিমান হয়… কাছে পেয়ে গেলে মনে হয়…কি জানি… কি মনে হয়…ইচ্ছে করে শুধু যেন ওর কাছে থাকতে পারি। এই, কিছু কি বললে তুমি? কি জানি…মনে হল তুমি কিছু বললে আমাকে… আমার যে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না…মন চাইছে…তোমার বুকে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।
- এই মৌ…
- উঁ…
- কি ভাবছো?
অস্ফুট স্বরে জবাব এলো… জানি না। অরিত্র ওর মুখটা তুলে ধরলে চোখে চোখ রেখে তাকালো… দুচোখে নীরব জিজ্ঞাসা…ব’লো, ডাকলে কেন…
- কথা বলবে না আমার সাথে?
মাথা নেড়ে জানালো…না…
- কেন?
ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর দিল…আমার ইচ্ছে…
- হুম… তাহলে আমি যাই…দাদুর কাছে…
- ইস…কেন?
- বা রে তুমি কথা না বললে…আমি কি করি।
- উমম… আমার ইচ্ছে করছে না…
দুষ্টু ছেলেটা ফিস ফিস করে জিজ্ঞেস করল…কি ইচ্ছে করছে?
- জানি না…
- এই, দেবে না?
- না…দেবো না…
- কেন?
- জানি না…
- সবেতেই জানি না?
- হু
- আমি জানি
- কি?
মুখে কিছু না বলে, চোখে চোখ রেখে আস্তে আস্তে নেমে এলো তৃষিত ঠোঁট, ছুঁয়ে থাকল আর এক জনের তির তির করে কেঁপে যাওয়া ঠোঁটে…মন ভরে গেছে ওর… মন যা চাইছিল তা পেয়ে গেছে… এখন আর কথা বলতে অসুবিধা নেই ভেবে মনে পড়ে গেল… ইস…আমি ওকে আটকে রেখেছি কেন…ভেবে বলতে হ’ল… তোমার কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে…
- হোক…আমার চাই না এখন…
- ইস…কেন…এত কষ্ট করে বানালাম তোমার জন্য...
- কফি বানানো সব থেকে সোজা…
- তুমি কিচ্ছু জানো না…
- উমম …কি আছে…শুধু দুধ চিনি আর কফি...
- ইস… আমার ভালোবাসা নেই বুঝি ওতে? আর কারুর জন্য তো বানাইনি… শুধু তোমার জন্য…
- জানি… তবুও…
- কি?
মুখে কিছু না বললেও একজনের আঙ্গুল আলতো ভাবে ছুঁয়ে গেল ওর নরম ঠোঁটে…যেন বোঝাতে চাইলো এখানে যে আরো বেশী ভালোবাসা আছে আর তাই বুঝে একজন প্রশ্ন করেছে...
- আর কোথাও নেই?
- আছে…
- কোথায়?
এবারেও আর কিছু না বলে ওকে কোলে তুলে নিলে দুহাতে ওর গলা জ়ড়িয়ে ধরে নিয়ে তাকিয়ে থাকলো চোখে চোখ রেখে…কখন ওকে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছে হয়তো বোঝেনি...চোখে চোখে দুজনের কি কথা হচ্ছে আর কেউ দেখলেও বুঝবে না কিন্তু ওদের একজনের নীরবে বলে যাওয়া কথা আর একজনের বুঝতে অসুবিধা হয়নি...দু চোখের দৃষ্টিতে বুঝিয়েছে..আমি তো জানি তুমি আমার কোথায় আরো বেশী ভালোবাসা আছে জানো আর এটাও জানি তুমি এখন কি চাইছো...আমি কি তোমাকে না বলবো বলো...আমিও তো চাইছি...তুমি তোমার ভালোবাসাকে খুঁজে নাও। ওর নীরব সম্মতি পেয়ে গিয়ে আকাঙ্খা ভরা বুকে একজন মুখ ডুবিয়েছে সেই ভালোবাসার খোঁজে...আর একজন চোখ বুজে থেকে সেই পরম আকাঙ্খিত স্পর্শ সুখ নিজের শরীর মন দিয়ে অনুভব করতে করতে ভাবছে...আমার মতো সুখী কে আর আছে।
পুবালীর বিয়ের আর মাত্র দিন পাঁচেক বাকি আছে। মৌকে দিয়ে আসতে হয়েছে ওর কাছে, আর কটা দিন বাদেই জীবনের নতুন একটা অধ্যায় শুরু করতে যাচ্ছে…এই সময় খুব কাছের কাউকে সাথে পাওয়াটা খুব দরকার। অরিত্রও অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে দু এক দিন ছাড়া ঘুরে আসছে, সব কিছু ঠিক করা হয়ে গেলেও এই সময় পাশে থাকার আলাদা মানে আছে। এমনিতে দাদুরা খুব একটা কোথাও না গেলেও বিয়েতে আসতেই হবে, জেঠু জ়েঠিমা এসে খুব করে বলে গেছে…না গেলে চলবে না। বিয়ের দুদিন আগেই দাদুদেরকে নিয়ে অরিত্রকে চলে আসতে হয়েছে। রুপসারাও চলে এসেছে একই দিনে… কিছুক্ষন আগে আর পরে। এমনিতেই এত বড় বাড়ী প্রায় খালি পড়ে থাকে, মাত্র তিনটে মানুষ থাকলেও মনে হয় যেন কেউ নেই। এখন যেন বাড়ীটা ভরে উঠছে একটু একটু করে। এত আনন্দের মাঝেও দাদু দিদানের সাথে সাথে নিজেরও কিছুটা সময়ের জন্য হলেও মনটা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল দাদু আর দিদানকে বাবা মায়ের ঘরে চুপ করে বসে থাকতে দেখে। আজ যদি ওরা থাকতো ভেবে নিজের বুকের ভেতরটাও যেন রক্তাত হয়ে উঠতে চাইছিল। আনন্দের দিনে বুকে দুঃখ জমিয়ে রাখতে নেই তাই নিজেকে সামলে নিয়ে দাদু দিদানকে ডেকে নিয়ে গেল নিচে…
একা রুপসাই যেন পুরো বাড়ীটা মাতিয়ে রেখেছে। সত্যিই পারে মেয়েটা, এত প্রান চঞ্চল… ওর কাছে থাকলে দুঃখ বলে কিছু আছে যেন মনেই হয় না। ওর সাথে পড়ে মৌ-ও যেন প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। বিয়ের আগের দিন, আরো কিছু আত্মীয় স্বজন এসে গিয়ে বাড়ীটা আরো গমগম করছে… দুপুরে খেতে অনেকটাই দেরী হয়েছে গিয়েছে… অরিত্র ছাদে উঠে প্যান্ডেলটা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে একটা চেয়ারে বসে ভাবছিল আর কিছু বাকি আছে কিনা দেখে নেবার। পেছন থেকে কেউ ওর দুচোখে হাত চেপে ধরলে ও প্রায় চমকে উঠল। চোখের উপর কার হাত হতে পারে বুঝতে গিয়ে মনে হল... না…মৌ নয় মনে হচ্ছে… ও কাছে এলেই কেমন যেন অন্যরকম লাগে…ঠিক কি রকম কেউ জিজ্ঞেস করলে বোঝাতে পারবে না কিন্তু নিজে ঠিক বুঝতে পারে…হুমম…রুপসা ছাড়া আর কেউ নয় ভেবে বলল… এই রুপসা ছাড়…বলার পরেও হাত টা চোখের উপর থেকে সরে না গিয়ে আরো চেপে ধরল। তার মানে কি রুপসা নয়? না…রুপসাই হবে ভেবে বলল… রুপসা ছাড়… আমি বুঝে গেছি…তুই ছাড়া আর কেউ নয়। রুপসা খিল খিল করে হেসে উঠে হাতটা সরিয়ে নিয়ে পেছন থেকে সামনে এসে কোমরে হাত রেখে বলল… কি করে বুঝলি দাদা ভাই?
- মনে হ’ল…
- না… মৌ-ও তো হতে পারতো…আগে ব’ল কি করে বুঝলি…
কি বলবে ওকে, এটা যে নিজের মন দিয়ে অনুভব করার জিনিষ, মুখে বলে তো আর বোঝানো যায় না সব কিছু… হেসে ফেলে বলল… মৌ ওরকম করবে না জানি।
- ইস, মৌ ওরকম করবে না জানি… কেন করবে না শুনি? ওর কি ইচ্ছে করে না নাকি… কখন থেকে মন খারাপ করে আছে। তুই একবারও ওর সাথে কথা বলেছিস আজ সকাল থেকে।
- আরে তোরা ব্যাস্ত সবাই।
- ঘোড়ার ডিম ব্যাস্ত। জানিস না নাকি বিয়ে বাড়িতে মেয়েরা হচ্ছে Busy without business… দেখে মনে হবে কত না কাজ করছে…আসলে ঘোড়ার ডিমের কাজ… কে কেমন সেজেছে তাই দেখে বেড়ানো ছাড়া আর নেই তো কিছু করার…
- তাই?
- হু…তাছাড়া আবার কি… এই মৌ…কি হ’ল, এদিকে এসো… আমাকে কি তোমার হয়ে ওর সাথে গল্প করতে হবে নাকি?
অরিত্র পেছন ফিরে দেখে মৌ কিছুটা দুরে মুখে ওড়নাটা চেপে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওর লজ্জা মাখানো মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেল রুপসা সামনে দাঁড়িয়ে আছে…ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে…এখুনি হয়তো পেছনে লাগবে। ও ভুলে গেলে কি হবে? রুপসা বলেই ফেলল- হুম, এই তো…চোখের পলক পড়ে না যে… এই মৌ…আসতে পারছো না এদিকে? মৌ আসছে না দেখে রুপসা নিজেই এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে বলল… উঃ…আর পারিনা…কি লজ্জা… মরে যাই…
আজ বিয়ের দিন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে যে কজন আত্মীয় স্বজন আসার বাকি ছিল তারাও এসে গেছে এক এক করে। এত দিন ধরে যে বাড়ীতে মাত্র তিনটে মানুষ থাকতো সেই বাড়ীটাকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। দেখে মনে হচ্ছে যেন চাঁদের হাট বসে গেছে। দীর্ঘদিন এই বাড়ীতে কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান হয়নি বলে জেঠুরা কাউকে বাদ রাখেননি নিমন্ত্রন করতে, শুধু তাই নয় সবাই যাতে আসে তার জন্য নিমন্ত্রন করে আসার পরেও আবার ফোনে যোগাযোগ করেছেন। দু এক জন যাদের খুব অসুবিধা আছে তারা ছাড়া প্রত্যেকেই এসেছেন। এতদিন পর আবার সবার সাথে দেখা হবার সুযোগ কেউ ছাড়তে চান নি। অরিত্র আর রুপসার অবস্থা খুব খারাপ, বহুদিন পর দেখা সাক্ষাত হওয়াতে আর এত জনের ভীড়ে কাউকে সকালে মাসীমনি বলে ডেকেছে তো দুপুরে ভুল করে পিসীমনি বলে ডেকে ফেলেছে। কেউ হয়তো সবার সামনে গাল টিপে আদর করে ফেলে বলেছে...ও মা রুপসা..তুই কতো বড় হয়ে গেছিস। সেই তোর অন্নপ্রাশনে এসে তোকে কোলে করে নিয়ে কান্না থামিয়েছিলাম। অরিত্রর সাথেও কম বেশী একই ব্যাপার ঘটেছে। মৌ প্রায় সারাক্ষন রুপসার সাথে থাকায় ওর পরিচয় নিয়েও স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠলে ও রাখঢাক না করেই বলে দিয়েছে...এ হোলো আমার আদরের হবু বৌদি...মৌ। অরিত্রকে যারা মনে রেখেছে তারা খুব খুশী এত মিষ্টি মেয়ে এই বাড়ীর বৌ হয়ে আসবে জেনে। কিছুটা অন্যরকমের ঘটনাও ঘটে গেছে হঠাৎ করে, কেউ একজন মৌ এর পরিচয় জানতো না। মেয়েটাকে দেখে এত ভালো লেগে গেছে যে কোনো কিছু না বুঝেই নিজের নাতির সাথে বিয়ে দেওয়া যায় কিনা সেই নিয়ে জেঠিমার সাথে কথা বলে ফেলেছে। তারপরে জেঠিমার কাছ থেকে শুনে লজ্জায় কি করবে নিজেই ঠিক করতে পারছিল না। জেঠিমার কাছ থেকে পুবালী আর পুবালীর কাছ থেকে রুপসা শুনেই প্রায় লাফাতে লাফাতে অরিত্র কোথায় আছে খুঁজে পেতে বের করে বলেছে...দাদাভাই...সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছিল রে। ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে অরিত্র কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করেছে...কি হয়েছে? তারপর বোনের কাছে শুনে হেসে ফেললে রুপসা রেগে গিয়ে বলেছে... তুই কি রে দাদাভাই? তোর এটা ছোট ব্যাপার মনে হচ্ছে? আমার শুনেই রাগে গা রি রি করছে আর তুই হাসছিস?
- কি করবো...বিয়ে বাড়িতে এসব একটু আধটু হবে, তুই তো আছিস ওকে আগলে রাখার জন্য...
- হু...তুই তো আছিস...আমি কি পাহারাদার নাকি যে তোর জিনিষ পাহারা দেবো...আচ্ছা শোন না...সন্ধেবেলা কিন্তু তুই আবার এদিক ওদিক কেটে পড়িস না...আমাদের কাছে কাছে থাকবি...বুঝলি?
- কেন রে?
- ধুস তুই না কিছু বুঝিস না...বর যাত্রীদের ভেতরে তো কিছু ছেলে থাকবেই...
- সে তো থাকবেই...কি হয়েছে তাতে? একটু না হয় তাকাবে...
- শোন তোকে এত সাধু সাজতে হবে না...তুই আমাদের পাশে পাশে থাকলে বুঝে যাবে বুকিং হয়ে আছে...ঝাড়ি মেরে লাভ নেই...বুঝলি?
বোনের কথা শুনে আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে অরিত্র বলল...আচ্ছা এক কাজ করি...তোর পেছনে লিখে দেবো বুকিং ওপেন আর ওর পেছনে লিখে দেবো বুকিং ক্লোজড, তাহলে আর ওর দিকে কেউ তাকাবে না ... উল্টে তোর কপালে কেউ একটা জুটে যেতে পারে।
বিকেলে এক ফাঁকে পুবালী কাকু কাকীমার ঘরে এসেছে প্রনাম করে যেতে, সাথে রুপসা আর মৌ। এর পরেই বিউটিশিয়ান সাজাতে এসে যাবে তাই আর সময় পাবে না আসার। যতই বাড়ীতে লোকজন আসুক এই ঘরটা বন্ধ করা ছিল, জেঠু জেঠিমা একেবারেই চায় না এই ঘরের কোনো কিছু এদিক ওদিক হোক। পুবালীর প্রনাম করা হয়ে গেলে রুপসা মৌকে কাকু কাকীমার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল...কে বলো তো? মৌ একটু অবাক হয়ে বলল...জানি না নাকি...তোমার কাকু। রুপসা হাসি মুখে বলল...হু...সে তো আমার কাকু বটেই...আর কি? ছোড়দি কি শুনতে চাইছে বুঝতে পেরে মৌ এড়িয়ে গিয়ে আস্তে করে বলল...ওর বাবা। হু...সেটাও ঠিক...আর কি? বলো বলো...।
দিদি কিছুতেই ছাড়বে না দেখে মৌ আস্তে করে বলল...এখোনো তো হয়নি। ইস...এখোনো হয়নি...কি হয়েছে তাতে? মৌ বেশ লজ্জা পেয়ে যাচ্ছে দেখে হেসে ফেলে বলল...আচ্ছা থাক...আর এত লজ্জা পেতে হবে না। তারপরেই কথা ঘুরিয়ে বলল...কাকুর ছবিটা দেখো...কি হ্যান্ডসাম…আমার তো ভীষন ভালো লাগে...কাকীমাও কি সুন্দর...দাদাভাইটা ওই জন্যই এত হ্যান্ডু হয়েছে...তাই না? মৌ এতক্ষনে পেছনে লাগার সু্যোগ পেয়ে মুখ টিপে হেসে বলল... হু তাই হবে...তোমার তো আবার দেখলেই নাকি বুকের ভেতরে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠতো। রুপসাও ছাড়ার পাত্রী নয়, কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিস ফিস করে বলল...আমার তো না হয় ছলাৎ ছলাৎ করে উঠতো ...আর তোমার? তোমার তো বড় বড় ঢেউ ওঠে...চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যায়...তাই না? ছোড়দির পেছনে লাগতে গিয়ে যে নিজেই বিপদে পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি। কি বলবে বুঝতে না পেরে পুবালীর দিকে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি গোছের ভাব করে তাকালে ও হেসে ফেলে বলল...রুপসা তুইও না...খুব ফাজিল আছিস...পেছনে লাগতে পারলে যেন আর কিছু চাই না।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
ওদিকে বিয়ের অনুষ্টান চলছে আর এদিকে অরিত্র বর যাত্রীদের খাওয়া দাওয়া তদারকি করছিল। রুপসা দৌড়ে এসে ওকে টেনে নিয়ে গেল, খই পোড়াবার জন্য ভাইকে লাগবে। পুবালীর হাতে খই গুলো আস্তে আস্তে ঢেলে দিতে দিতে সামনের দিকে চোখ চলে গিয়েছিল… একেবারে সামনের সারির চেয়ারে মৌ আর রুপসা পাশাপাশি বসে আছে… দুই অপরুপার মুখে আগুনের লাল আভার প্রতিফলন যেন ওদেরকে আরো মোহময়ী করে তুলেছে। রুপসা ওর অভ্যাস মতো এদিক ওদিক তাকাচ্ছে… মেয়েটা যেন কোনো অবস্থাতেই স্থির থাকতে পারে না। ওদিকে মৌ এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে নিজেকেই চোখ ফিরিয়ে নিতে হ’ল। এখানে এত জনের সামনে ওরা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে দেখলে কে কি ভাববে তার ঠিক নেই। তার থেকেও বড় কথা স্টিল আর ভিডিও দুটোই এক সাথে তোলা হচ্ছে। ওদের তাকানোটা তো আর নিজেদের ভেতরে থাকবে না… কতজনে যে দেখবে তার তো ঠিক নেই। সব থেকে বেশী ভয় তো রুপসাকে নিয়ে, আর কেউ না হোক ও যে পেছনে লাগতে ছাড়বে না একেবারেই তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এত বড় এক একটা অনুষ্ঠানে কিছু না কিছু গন্ডগোল হয়ে যাওয়ার ভয় থাকলেও ভালোয় ভালোয় সব কিছু মিটে যাওয়াতে জেঠুরা খুব খুশী। অরিত্রকে জড়িয়ে ধরে বড় জেঠু এমন ভাবে তুই না থাকলে কি যে হত বলল যেন ওর জন্যই সবকিছু ঠিকঠাক হয়েছে। যদিও কথাটা কিছুটা হলেও ঠিক যে ও বারে বারে সব ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা দেখে নিয়েছিল...নিজেদের ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের দেখাশোনা করতে করতে মোটামুটি জানা ছিল কি করা উচিত। সেই অভিজ্ঞতা আজ কাজে লেগে যাওয়ায় ওর নিজেরও ভালো লাগছিল। জেঠিমা পাশেই ছিল, জেঠুকে ওইভাবে বলতে দেখে বলল...তোমাকে বলেছিলাম না...আমাদের দুষ্টু এই বয়সে যা দায়িত্ব নেয়...কটা ছেলে নেয় বলোতো। অরিত্র এত প্রশংসা শুনে হেসে ফেলে বলল...উঃ বাবা...তোমরা এমন করে বলছো যেন আমি একাই সব কিছু করেছি আর তোমরা নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়েছো। আরো কিছুক্ষন জেঠু জেঠিমা ওর সাথে কথা বলে চলে যাবার পর ছোট জ়েঠিমা ওকে খুঁজে খুঁজে এসে পাকড়াও করে বলল...এই দুষ্টু...তোর সাথে কথা আছে...চল কোথাও বসি। জেঠিমা আবার কি বলবে ভাবতে ভাবতে মনে হল রুপসার বিয়ে নিয়ে কিছু হবে হয়তো। ও যা ভেবেছিল ঠিক তাই, রুপসা কিছুতেই বিয়ে করতে রাজী হচ্ছে না দেখে জেঠিমা ভেবেছে ওর হয়তো নিজের পছন্দের কেউ আছে। অরিত্র নিশ্চয় জানে সেটা কারন ভাই বোনের সম্পর্কটা যে একেবারে বন্ধুর মতো সেটা ভালোই জানা আছে জেঠিমার। রুপসার যে কেউ সেরকম নেই বুঝিয়ে বলার পর জেঠিমা ধরে বসল ওকে রাজী করাতেই হবে। রুপসা যদি চায় তাহলে এখন না হয় রেজিস্ট্রি করে রেখে দেওয়া যাবে। এক কথায় জেঠিমা কিছুতেই এত ভালো ছেলে হাতছাড়া করতে চাইছে না দেখে অরিত্র বলল...আচ্ছা...ঠিক আছে, আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রুপসার সাথে কথা বলবো। জ়েঠিমা আরো কিছুক্ষন ওর সাথে কথা বলে উঠে গেছে। একা হয়ে যাওয়াতে মা বাবার কথা মনে পড়ে গেলে ও চুপ করে বসেছিল... কতক্ষন একা একা বসে ছিল নিজেও বুঝতে পারেনি। পুবালীর মাসতুতো ভাই বুকাই এর ডাকে প্রায় চমকে উঠল...দুজনে প্রায় একই বয়সী...আগে তেমন একটা যোগাযোগ না থাকলেও বিয়েতে এসে তুই তোকারির জায়গায় সম্পর্কটা চলে এসেছে। বুকাইকে আয় আয় বোস বলাতে ও ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ে গলা নামিয়ে বলল...কিছু ব্যাবস্থা রেখেছিস নাকি রে? বুকাই কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... তোর জন্য আনিয়ে রেখেছি...দাঁড়া, নিয়ে আসছি। বুকাই খুব খুশি হয়ে লাফিয়ে উঠে বলল...ওঃ গুরু...তোর তো দেখছি সব দিকেই নজর...চল... চল...গলা শুকিয়ে একেবারে কাঠ হয়ে আছে। ছাদে গিয়ে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতলে ঢেলে নিয়ে দুজনে বসে কথা বলতে বলতে খাচ্ছিল। অরিত্র ওর অভ্যাস মতো সামান্য একটু খেয়ে আর খাবে না বলাতে বুকাই চোখ গোল গোল করে বলল...সে কি আমি একা একা খাবো আর তুই বসে থাকবি? ওকে আসল কারনটা বলতে আর জোর করেনি...একা একাই খেয়ে যাচ্ছিল। কথা বলতে বলতে কিছুক্ষনের ভেতরেই ওর পেট থেকে দুঃখের কথা বেরোতে শুরু হয়ে গেল। ওর গার্ল ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেক আপ হয়ে গেছে দু বছর আগে খুব সামান্য কারনে সেই নিয়ে কিছুক্ষন বকবক করে নিজেই... কি হবে দুঃখ পেয়ে,যে গেছে তাকে নিয়ে ভেবে লাভ নেই... বলে চুপ করে গেছে। কিছুক্ষন চুপচাপ থাকার পর নিজেই আবার কথা বলতে শুরু করল। সবে মাত্র অরিত্র আর মৌ এর ব্যাপারে কথা তুলেছে ঠিক সেই সময়ে রুপসা এসে হাজির। দুজনকে এক সাথে দেখতে পেয়ে হাউমাউ করে উঠে বলল...উঃ দাদাভাই তোরা এখানে আর আমি খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেলাম...চল চল...ছোড়দি তোদেরকে ডাকছে। ছোড়দি ডাকছে মানে বাসর ঘরে গিয়ে এক গাদা মেয়ের মুখোমুখি হতে হবে ভেবে ভেবে অরিত্র কেটে পড়ার তালে ছিল। রুপসা বুঝতে পেরে ওকে জোর করে টেনে নিয়ে গেলে পেছন পেছন বুকাইও চলে এল। বাসর ঘরে যাওয়া মানেই বেশ মজা করা যাবে...আর কিছু না হোক দু চারটে মেয়ে তো থাকবেই...ভালোই কাটবে সময়। বাসর ঘর একেবারে গমগম করছে, কে যে কার পেছনে লাগছে সেটাই বোঝা যাচ্ছে না। শুভ্রদীপের দু জন বন্ধু সানি ও রজতাভ, মামাতো বোন দিয়া ও রাকা আর সাথে ওদের একেবারে পাশের বাড়ীর একজন মেয়ে নম্রতা আর পুবালীর দিক থেকে রুপসা, মৌ, অরিত্র, বুকাই আর পুবালীর মামাতো বোন সৃজা। আরো কয়েক জন নাকি ছিল, এই কিছুক্ষন আগে ঘুম পাচ্ছে বলে উঠে গেছে। অরিত্ররা আসতে পুবালী ওর কাছে বসতে বলাতে ও কোথায় বসবে দেখছে...পুবালীর গা ঘেঁসে মৌ বসে আছে, না সরে গেলে ও বসতে পারবে না দেখে শুভ্রদীপ মৌ কে বলল...মৌ তুমি আমার পাশে চলে এসো...এক মাত্র শালার এক মাত্র ইয়ে বলে কথা। তোমার সাথে খাতিরটা ভালোই রাখতে হবে তাই না...।
রুপসা শুভ্রদীপের পাশে বসে পড়ে বলল...না না...সুন্দরী ছোটো শালী থাকতে থাকতে শালার বৌ কি করে চান্স পাবে? ওসব চলবে না, ওর যার পাশে বসার কথা সেখানেই বসবে। সবাই হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলাতে বাধ্য হয়ে মৌ এর পাশেই ওকে বসতে হল। এত রাত হয়ে গেলে কি হবে...কারুরই যেন ক্লান্তি নেই...বাসর ঘর আরো জমে উঠল। আরো ঘন্টাখানেক বাসর জাগার পর শুভ্রদীপের বন্ধুরা ফিরে যাবে বলে বলল। ওরা পাঁচ জন গাড়ী করে ফিরবে, সেই মতো প্ল্যান আগে থেকেই করা ছিল। সারাদিন বিয়ের নানা রকম আচার অনুষ্ঠানের জন্য শুভ্রদীপ আর পুবালী বিশ্রাম পায়নি...ওদেরও কিছুটা বিশ্রামের দরকার। রুপসা বুকাইকে কানে কানে কিছু একটা বলতে ও একেবারে লাফিয়ে উঠে বলল...বলিস কি রে? হ্যাঁ...চল চল... কেন যাবো না। পুবালী কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করাতে রুপসা ফাজিল মার্কা হাসি হেসে বলল...তোর এত জানার দরকার নেই এখন...এটা আমাদের আন ম্যারেডদের ব্যাপার। বৌ ভাতের দিন তো আসছি...সব জানতে পারবি...বুঝলি। শুভ্রদীপ পুবালীর কানে কানে বলল...মনে হচ্ছে নম্রতার সাথে বুকাই এর কিছু হলেও হতে পারে। পুবালী ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলে বলল...তোরা কি এখন বেরুবি নাকি আবার? রুপসা চোখ ছোট ছোট করে শুভ্রদীপের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলে বলল...এটা তো ভালো হোলো না শুভ্রদা।
দাদুরা বিয়ের পর দিন বিকেলে ফিরে গেছে। সবাই এক সাথে ফিরে গেলে জেঠুরা খুব একা হয়ে যাবে বলে অরিত্ররা বৌভাত সেরে আরো দু একদিন পরে ফিরবে। আজ বৌভাত, সাড়ে সাতটা নাগাদ বাস ছাড়বে, বিভিন্ন জায়গা থেকে সবাইকে তুলে নিয়ে যেতে যেতে সাড়ে ন টা বাজবে। জেঠিমা তত্ব সাজানোর দিকটা দেখতে দেখতে রুপসাকে তাড়া লাগালো… ওঃ…তোর আর সাজা যেন শেষ হয় না…
- উঃ মা…তুমি না বড্ড তাড়া দাও সব কিছুতে… সবে সাড়ে পাঁচটা বাজে…দিদিভাই এর বিয়েতে সাজবো না তো কি?
- আচ্ছা বাবা…ঠিক আছে… আমাকেও একটু সাজিয়ে দিবি কিন্তু।
- আচ্ছা…তাই ব’লো… দাঁড়াও…এখোনো আরো একজন বাকি আছে…দেখি আবার কোথায় গেল।
সাড়ে সাতটায় বাস ছাড়ার কথা থাকলেও আট টা বেজে গেল ছাড়তে...টু বাই টু সিটের মার্সিডিজ বেঞ্জের বাস। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে জেঠু কোন দিকেই খামতি রাখতে চান নি। বুকাই আগে থেকেই বাসে উঠে পেছনের দিকের দুটো সিট আগলে রেখেছিল। একটাতে ও আর রুপসা, আর একটাতে মৌ আর অরিত্র বসবে। অরিত্র ওর সাথে বসতে চাইলে বলেছে... না গুরু...আমার সাথে রুপসার অনেক কথা আছে। তুই বাবা তোর ইয়েকে নিয়ে বোস। অরিত্র ওর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আর না করেনি... রুপসা বিয়ের দিন থেকেই উঠে পড়ে লেগেছে নম্রতা আর বুকাইকে এক করতে। অবশ্য ও যে কোনো কারন ছাড়াই এগিয়েছে তা নয়... বর যাত্রীরা আসার কিছুক্ষন পর থেকেই মাঝে মাঝে দেখছিল বুকাই আর নম্রতার এক অপরকে চুরি করে করে দেখাদেখি চলছে...ব্যাপারটা কি হতে পারে আঁচ করে ও দুজনে যাতে কথা বলতে পারে তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছিল। অরিত্র মৌ এর পাশে বসলে ও আস্তে করে একটু কাছে সরে এলো। বাসের ভেতরে খুব হালকা আলো জ্বলছে আর রুপসারা ছাড়া ওদেরকে কেউ দেখতে পাবে না বুঝে ওর আর কোনো জড়তা ছিল না। এই কদিন ওকে একেবারেই কাছে না পাওয়ার জন্য আজ সুযোগ পেয়ে ওর পাশে ঘন হয়ে বসে একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে চুপ করে বসেছিল। রুপসা ওদিকে বুকাই এর সাথে কথা বলছে দেখে অরিত্র ওর দিকে একটু ঝুঁকে বসলে মৌ আস্তে করে বলল...আমরা কবে ফিরবো? যতই বিয়ে বাড়ীর আনন্দ থাক ওকে কাছে না পেয়ে ওর যে ভালো লাগছে না বুঝতে পেরে বলল..আর দুটো দিন থাকি? জেঠুরা একেবারে একা হয়ে যাবে...।
মৌ ওর হাতে চাপ দিয়ে আস্তে করে বলল...আচ্ছা। অরিত্র রুপসারদের দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ওকে একেবারে কাছে টেনে নিয়ে গালে আলতো ভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল... খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। ওকে এত কাছ আসতে দেখে মৌ ফিসফিস করে বলল...ছোড়দি দেখতে পাবে তো। অরিত্র ওর গালে নিজের মুখটা আরো চেপে ধরে বলল...দেখুক।
বৌভাতের পরের দিন, আত্মীয় স্বজনরা মোটামুটি সবাই চলে গেলে বাড়ী প্রায় ফাঁকা। কদিন ঠিক মতো ঘুম হয়নি বলে আজ সবাই দুপুরে খাওয়ার পর শুয়ে পড়েছে। বড়দির ছেলে পাপাই খুব দুষ্টুমি করছিল দেখে অরিত্র ওকে সাথে নিয়ে শুয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজেও ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম ভাঙ্গলো যখন প্রায় সন্ধে হয় হয়। টানা ঘুমের পর বেশ একটা ঝিমুনির আমেজ থাকায় বেশ ভালো লাগছিল। পাপাই একেবারে ওর বুকের ভেতরে শুয়ে ঘুমোচ্ছে দেখে কি করে উঠবে ভাবছে এমন সময় বড়দি এসে ডাকলো...এই ভাই চল...সবাই বসে আছে তোর জন্য। পাপাই এর হয়তো ঘুম ভাঙ্গার সময় হয়ে গিয়েছিল। মায়ের গলা পেয়ে উঠে পড়লে বড়দি ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল...তাড়াতাড়ি আয় ভাই...চা হয়ে গেছে। সবাই মিলে এক সাথে চা খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল.. জেঠু নাতিকে আদর করতে করতে অরিত্রকে দেখিয়ে বলল...মামাকে বলে দাও তো বাবু...এবারে কিন্তু তোমার পালা। পাপাইও দাদুর কথা শুনে আধো আধো গলায় দাদূর শেখানো কথা গুলো বলে দিলে সবাই হেসে ফেলল দেখে পাপাইও বেশ মজা পেয়ে দাদুর কোলে নাচানাচি শূরু করে দিল। মজা করার ছলে জেঠু কথাটা বললেও জেঠুরা যে এবারে এক এক করে ওর আর রুপসার ব্যাপারে ভাবছে সেটা আর বুঝতে অসুবিধা হোলো না। মৌ লজ্জা পেয়ে উঠে যাচ্ছে দেখে জেঠু ওকে কাছে বসিয়ে বলল...এই মেয়ে পালাচ্ছিস কোথায়...দুষ্টুকে তো বললেও আসতে চায় না...নেহাত দিদির বিয়ে তাই বাধ্য হয়ে এসেছে। আমরা কিন্তু তোর উপরেই দায়িত্ব দিচ্ছি মাঝে মাঝে ওকে ধরে নিয়ে এখানে চলে আসবি। তুই বললে তো আর ও না করতে পারবে না। কি রে আসবি তো মা? ও বললে অরিত্র না করতে পারবে না এই কথাটা শূনে ভালো লাগার সাথে সাথে ভীষন লজ্জা পেয়ে ঘাড় কাত করে বোঝালো হ্যাঁ...ও নিশ্চয় আসবে। জেঠিমাও বেশ সেন্টিমেন্টাল হয়ে গিয়ে বলল...তোরা ছাড়া আর আমাদের কে আছে বল তো...মেয়েরা তো আর ইচ্ছে হলেই আসতে পারবে না। রুপসা ফাজলামো করে বলল...জেঠিমা... যতই তোমরা শুধু দাদাভাই ছাড়া আর কে আছে বলো...আমরা কিন্তু ভাগ ছাড়বো না।
আরো এক মাস কেটে গেছে। বিশ্বাস কাকু জানালেন মিষ্টি আর বিল্টু খুব করে ধরেছে একবার দিদিকে দেখবে। ওদের একটাই যুক্তি, ওদেরকে দেখে যখন চিনতে পারেনি তাহলে তো আর ভয়ের কিছু নেই। দিদির কিছু ক্ষতি হবে না। সবার সাথে কথা বলে ওদেরকে নিজেদের বাড়ীতেই নিয়ে আসা হবে ঠিক করা হ’ল এক দিনের জন্য। মৌকে বলা হবে যে ওরা দুজনে বিশ্বাস কাকুর আত্মীয়, এখানে বেড়াতে এসেছে। ওরা ভাই বোনে মাকে জানিয়েছে ওরা এক দিনের জন্য বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যাবে। ওদের মায়েরও কয়েকদিনের জন্য বাইরে যাবার ছিল তার আগেই… তাই আর কোনো বাধা আসেনি। সেই মতো বিশ্বাস কাকু ওদের ভাই বোনকে নিয়ে রবিবার সকালে চলে এলেন। মিষ্টিকে আপন করে নিতে মৌ এর বেশী সময় লাগেনি, মেয়েদের এই একটা বড় গুন, বন্ধু হতে গেলে সমবয়সী হতে হবে তার কোনো মানে নেই, মনের মিল থাকলেই হবে। বোনের সাথে সাথে বিল্টুও গল্প করতে করতে দিদির খুব কাছাকাছি হয়ে গেলে দুজনেই খুব খুশী। দাদুদেরকে আর বলতে হ’ল না ওদেরকে থাকতে বলার জন্য, মৌ নিজেই দিদানকে গিয়ে বলে ফেলল ওদেরকে আজ আটকে দিতে। বিকেলের দিকে অরিত্র ছাদে উঠে টবের গাছগুলো ঠিকঠাক আছে কিনা দেখছিল। শুক্লাদি এই কিছুক্ষন আগে জামাকাপড় তুলে নিয়ে গেছে। কিছুক্ষন পর মিষ্টির ডাক শুনে ফিরে তাকালো।
- অরিত্রদা…একটা কথা জিজ্ঞেস করব… কিছু মনে করবেন না তো?
- তুমি যদি এখোনো আপনি করে কথা বলো… নিশ্চয় মনে করতে হবে।
- না মানে… আজকেই তো আলাপ হ’ল…
- তাতে কি হয়েছে? আমাদেরকে কি এখোনো পর পর মনে হচ্ছে নাকি।
- না না …তা নয়… আচ্ছা…ঠিক আছে তুমি করেই বলছি…কিছু মনে করবে না তো?
- এই তো, এবারে ঠিক আছে…ব’লো।
মিষ্টিকে একটু কিন্তু কিন্তু করতে দেখে অরিত্র বলল… তুমি কিন্তু এখোনো পর ভাবছো…বলোই না …কি বলবে। মিষ্টি অরিত্রর দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলল… তুমি কি দিদিকে… মানে…।
অরিত্র ও কি বলতে গিয়েও বলতে পারছে না বুঝে গেলে, হেসে ফেলে বলল… কি…আমি কি… মানে তোমার দিদিকে… কি?
- বলো না…
- হু…বুঝেছি…তোমার কি মনে হচ্ছে?
মিষ্টি একটু লাজুক হেসে বলল… কি জানি… মনে হচ্ছে… দিদি তোমাকে…
- ঠিকই ধরেছো… শুধু তোমার দিদি নয়…আমিও…
- তাই? ইস… আমার না ভীষন ভালো লাগছে।
- জানো তো মিষ্টি… একটাই চিন্তা আছে… তোমার দিদির যদি আগের সব কিছু মনে পড়ে যায় আর এখনকার কথা ভুলে যায়…
কথাটা শুনে মিষ্টি চুপ করে গেল, ও এতটা ভাবেনি হয়তো… ওর এত কিছু ভাবার বয়স বা সময় কোনোটাই এক্ষেত্রে ছিল না। ওকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে অরিত্র ওর কাছে গিয়ে বলল… এই…মিষ্টি…মন খারাপ করতে নেই…দেখা যাক না কি হয়…আমরা তো চেষ্টা করছিই, আর… তোমরাও তো আছো…তাই না…।
মিষ্টিকে কিছু বলতে না দেখে ওর দিকে তাকিয়ে দেখল… চোখে মুখে কান্নার আভাষ... নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। আজ দিদির ভালো হবে জানার পর মনটা যেমন ভাবে খুশী হয়ে উঠেছিল তেমনি ভাবেই আবার খারাপ হয়ে গেল আবার সমস্যা হতে পারে শুনে। অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল…এই মিষ্টি…কাঁদে না।মিষ্টি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… অরিত্রদা…তুমি কোনো অবস্থাতেই দিদির কাছ থেকে সরে যাবে না বলো। অরিত্র আস্তে করে বলল… সে ভয় নেই মিষ্টি, আমি কাউকে কথা দিলে রাখি। ও, হ্যাঁ… তোমাদেরকে বলা হয়নি… সামনের মাসে তোমার দিদিকে নিয়ে চেন্নাই যাচ্ছি… দেখি যদি কিছু হয়…এখানে তো কিছু হবে ব’লে মনে হচ্ছে না। যেটুকু হয়েছে নিজের থেকেই হয়েছে।
- তুমি আর দিদি?
- দেখি, দাদুর শরীর ভালো থাকলে সবাই মিলে যাবো… না হলে… আমরা দুজনে…
মিষ্টি কিছু বলতে যাচ্ছিল, মৌ আসছে দেখে চুপ করে গেল। ও কাছে এসে মিষ্টির হাত ধরে বলল… তাই ভাবি… আমার বোনটা কোথায় গেল… নতুন দাদাভাই এর সাথে গল্প হচ্ছে…তাই না? নতুন দাদাভাই এর কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে একটু আগের মন খারাপটা আর নেই, তার উপরে দিদিকে দেখে আরো খুশী হয়ে বলল…এই যে…গল্প করছি আর কত সুন্দর সুন্দর ফুল ফুটে আছে…তাই দেখছিলাম।
- ভালো লেগেছে তোমার?
- ইস, ভালো লাগবে না কেন? আগে কখোনো দেখিনি… কত নতুন নতুন ফুল।
- হ্যাঁ… তোমার নতুন দাদাভাই আর দাদু কোথাও গেলে এইসব করে… নতুন কিছু দেখলেই খুঁজে পেতে নিয়ে আসবেই।
মিষ্টি দিদির গা ঘেষে দাঁড়িয়ে থেকে মনে মনে ভাবছিল… ফুল ভালোবাসে…তাই তো আমার দিদিটাকে ভালোবেসে ফেলেছে আমার নতুন দাদাভাই।
জুলাই মাসে আবার অরিত্রকে বাইরে যেতে হবে, এবারে সিঙ্গাপুর, এক মাসের জন্য, তবুও ভালো, কাছাকাছি। তেমন মনে হলে চলে আসা যাবে। এবারে আর খুব একটা চিন্তা নেই ওর… মৌকে এখন অনেকটাই ভরসা করা যায়, তাছাড়া দাদুর শরীরও আগের থেকে ভালো। তবুও স্বাভাবিক ভাবেই যাবার সময় যত এগিয়ে আসছে তত মন খারাপ একটু একটু করে বাড়ছে। যদিও মৌ বুঝতে দেয় না কাউকে তবুও অরিত্র ওকে দেখলে বুঝতে পারে। মাঝে মাঝে একা পেলে ওকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে বোঝায়... এবারে তো আরো কাছে যাচ্ছি… খুব মন খারাপ করলে বলবে…এক দিনের জন্য ঠিক চলে আসবো। তখনকার মতো সব বুঝলেও বলে…তুমি না থাকলে আমার ভালো লাগে না, কি করবো মন যদি খারাপ করে।
আজ নিয়ে আঠাশ দিন হয়ে গেছে অরিত্র সিঙ্গাপুরে। আর তিন দিন পরেই ফিরবে। অফিস থেকে ফিরে সবার সাথে কথা বলেছে। খেয়ে শুতে যাবে এমন সময় বাড়ীর ফোন দেখে একটু অবাক হ’ল। কিছু আবার হয়নি তো? মৌ মাঝে মাঝে রাতের দিকে আবার ফোন করে কিন্তু সে তো ওর মোবাইল থেকে। চিন্তা করতে করতে ফোনটা ধরে হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে শুক্লাদির কান্না শুনতে পেলো। ঠিক মতো কথা বলতে পারছে না…তার ভেতরেই কোনো রকমে বলল… ভাই…তোর দাদুর হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে… আর ওদিকে মৌ দাদূর ওই অবস্থা দেখে কাঁদতে কাঁদতে কি হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। ভীষন ছটপট করছিল...এখন আর কোনো সাড়া পাচ্ছি না। অরিত্র ওই টুকু শুনে কি করবে ভেবে নিয়ে কোনো রকমে শুক্লাদিকে বলল…তুমি ফোনটা রাখো…আমি শুভকে এখুনি বলছি আসতে…
অরিত্র তাড়াতাড়ি করে শুভকে ফোন করে কি হয়েছে জানিয়ে ডাক্তার দাদুকে বাড়ী থেকে তুলে নিয়ে আসতে বলে দিয়ে আবার বাড়ীতে ফোন করল… আরো খারাপ অবস্থা, মৌ-ও অজ্ঞান হয়ে গেছে। শুক্লাদিকে দিদানকে সামলাবার কথা বলে অপেক্ষা করা ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছু করার নেই জেনেও অস্থির ভাবে এদিক ওদিক করতে করতে ভাবছিল কি করবে। এখুনি জেঠুদেরকে ফোন করে লাভ নেই...এত রাতে ওদেরকে আর চিন্তায় ফেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কাল সকালে জানাবে কি হয়েছে। কিছুক্ষন পর শুভ জানালো… দুজনকেই নার্সিং হোমে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। চিন্তা করিস না, আমি পরে জানাচ্ছি।
রাতটা যে অরিত্রর কিভাবে কাটলো ও নিজে ছাড়া কেউ হয়তো বুঝবে না। সারা রাত জেগে বসে আছে…বসে বসে চিন্তা করা ছাড়া কিছু করার নেই। তবুও ভালো… রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ জানা গেছে দাদুর তেমন কিছু হয়নি, গ্যাস থেকে হয়েছে কিন্তু মৌ এর জ্ঞান ফেরেনি, ওকে নিয়ে চিন্তা আছে…যদিও ডাক্তার বাবু বলেছেন এমনিতে তেমন কিছু শারিরীক সমস্যা নেই। ওটাই অরিত্র কাছে বড় ভয়ের হয়ে দাঁড়ালো। যা ভেবে ভয় পাচ্ছিল এতদিন সেটা যদি হয়ে যায়? কিছু ভাবতে পারছিল না আর। মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে কফি বানিয়ে নিয়ে এসে ভেবেই যাচ্ছিল যদি তাই হয় তাহলে কি হবে। একদিন পরেই ওর ফেরার কথা, কি করবে… আজই ফিরে যাবে কি? হঠাৎ করে সব কিছু নতুন করে ভাবতে গিয়েও মাথার ভেতরে সব কিছু জট পাকিয়ে গিয়ে কিছুই ঠিক করতে পারছিল না। শুভ আটটা নাগাদ ফোন করে ওকে তাড়াহুড়ো করে ফিরে আসতে বারন করল। নার্স খবর দিয়েছে এখুনি…মৌ এর জ্ঞান ফিরেছে, এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।
কোনোরকমে দিনটা কাটালো, সারাদিন বারে বারে শুভ, দিদান, ওদিকে জেঠু জেঠিমা, বোনেদের সাথে কথা বলেছে। বিকেলে শুভর ফোনে মৌ আর দাদুর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল কিন্তু শুভ বলেছে ডাক্তারের বারন আছে। কাল দুপুরের ফ্লাইট… রাতটা কোনো রকমে কাটাতে পারলে বাঁচে, কেমন যেন অসহ্য লাগছে...এক একটা মিনিট যেন মনে হচ্ছে এক একটা ঘন্টা। যদিও শুভ, ডাক্তার দাদু, জেঠু সবাই পাশে আছে তবুও মন যেন মানতে চাইছে না। পরের দিন এয়ারপোর্ট থেকে সোজা নার্সিং হোমে গিয়ে পৌঁছোতে ভিজিটিং আওয়ার্স প্রায় শেষ। শুভ বাইরেই ছিল, দিদানরা সবে বেরিয়ে এলো, দুজনেরই মুখ একেবারে থমথমে। দিদান, শুক্লাদি দুজনেই ওকে দেখে কেঁদে ফেলল দেখে বুঝতে পারছিল না, দুজনেই ভালো আছে বলেছে তো দিদানরা কাঁদছে কেন। আবার কি খারাপ কিছু হয়েছে? না, তেমন কিছু তো হওয়ার কথা নয়। কোলকাতা পৌঁছোবার পর অন্তত বার পাঁচেক শুভর সাথে কথা হয়েছে। তেমন কিছু হলে তো আগেই জানতে পারতো। শুভ ওকে পাশে ডেকে নিয়ে গেল, যা ভয় ছিল তাই শুনতে হ’ল শুভর কাছে… মৌ কাল সকালে জ্ঞান ফেরার পর থেকে কাউকে চিনতে পারছে না, বার বার জিজ্ঞেস করেছে…আমি এখানে কেন…তোমরা কে…কোনো কারনে খুব ভয় পাচ্ছে দেখে ঘুমের ইঞ্জেকশান দিয়ে দেওয়ায় প্রায় সারাদিন আচ্ছন্ন অবস্থায় ছিল। শুভ আগেই জানতো কিন্তু ইচ্ছে করেই ওকে জানায়নি বা দিদানদেরকেও আজ বিকেলের আগে ওকে কাছে গিয়ে দেখতে দেয়নি। শুভর কাছ থেকে শোনার পর নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে দিদানদেরকে চিন্তা করতে বারন করে নিজে গেল দেখতে। জানাশোনা থাকায় ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে গেলেও ঢুকতে অসুবিধা ছিল না। আগে দাদুর সাথে দেখা করে কথা বলল দু চারটে, দাদুকে এখোনো জানানো হয়নি মৌ এর ব্যাপারটা, তাই নিজেকে ভীষন ভাবে সামলাতে হচ্ছিল তা সে যতই মনের ভেতরে কষ্ট থাকুক। দাদুর কেবিন থেকে বেরিয়ে পা যেন চলছিল না… কি করে ওর মুখোমুখি হবে ভেবে কান্না পেয়ে যাচ্ছিল। তবুও যেতে হ’ল, মৌ চুপ করে শুয়ে ছিল, ওকে দেখে ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকালো… কিছু যেন বলছে দেখে কাছে গিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কি বলছে। একেবারে কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো...জিজ্ঞেস করছে আমি এখানে কেন? অরিত্র চেয়ারটা টেনে নিয়ে ওর পাশে বসে আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল… তুমি এখন অসুস্থ, আগে সুস্থ হও…তারপরে সব জানতে পারবে। কি বুঝলো কে জানে, কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞেস করল… আপনি কে? নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকের ভেতর থেকে, আস্তে করে বলল…এখন কথা বোলো না…তোমার কষ্ট হবে… আমি কে পরে জানলেও হবে। কথাটা শুনেও মৌ ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বলল… আমি অরিত্র। এর পরে মৌ চুপ করে থাকলেও ওর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল কোনো কারনে ভয় পাচ্ছে। কাকে ভয় পেতে পারে সেটা না বোঝার কিছু ছিল না, তাই ওকে বোঝানোর জন্য বলতে হ’ল…ভয় পেও না… তোমার মা জানে না যে তুমি এখানে আছো। কথাটা শুনে যেন একটু নিশ্চিন্ত হল। কিছুক্ষনের ভেতরেই ঘুমিয়ে পড়লে অরিত্র আরো কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে বসে থাকার পর উঠে এল। ওর পাশে থাকার ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার নেই… নার্স এসে দুবার তাড়া দিয়ে গেছে।
অরিত্র বাড়ী ফিরে এসে চুপ চাপ বসেছিল, কিছুই ভালো লাগছে না। দিদানদেরকে যতটা সম্ভব বুঝিয়েছে কিন্তু ওরাও যে কিছু বোঝার মতো অবস্থায় নেই সেটাও ঠিক। রুপসা আর পুবালীকে ফোনে জানালো কি হয়েছে। ওরা দু বোন খবরটা শুনে কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপ করে ছিল। জ়েঠূরাও জানতো না বলে ওদেরকেই সবাইকে জানিয়ে দিতে বলে ফোনটা রেখে দিল। রাতে কিছুতেই ঘুম আসছিল না, আসার কথাও নয়। রুপসা আবার ফোন করেছে দেখে ধরল… রুপসা কিছু বলতে গিয়েও বলতে না পেরে কেঁদে ফেলল… নিজেকেই বোঝাতে পারছে না তো ওকে আর কি বোঝাবে। তাও ওকে বোঝাবার চেষ্টা করল… কি করবি ব’ল, জানতাম, আমার কপালে এটাই ছিল। রুপসা কাঁদতে কাঁদতেই বলল...
- কি হবে দাদাভাই?
- জানি না রে... কাঁদিস না…
- পারছিনা রে দাদাভাই… আমি কত জোর করেছিলাম তোকে…না হ’লে হয়তো…
- না রে…আমিও তো চেয়েছিলাম এগোতে…
- দাদাভাই, ওর কি আগের সবকিছু মনে পড়েছে?
- মনে তো হয় তাই, ওর মা জানতে পারবে না বলাতে তো দেখলাম নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেল, তার আগে মনে হচ্ছিল খুব টেনশানে ছিল।
রুপসার সাথে কথা বলতে বলতে এত সময় নিজেকে সামলে রাখলেও আর পারলো না...কান্নায় গলা বুজে এলে বাধ্য হয়ে ওকে বলল...এখন রেখে দে...কাল কথা বলব।
দুজনকেই একদিন আগে পরে নার্সিং হোম থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পর পুবালী আর জেঠুরা মাঝে একদিন এসে দেখে গেছে। পুবালী আগেই আসতে চেয়েছিল কিন্তু অরিত্র তাড়াহুড়ো করতে বারন করেছিল…আগে ওরা ফিরে আসুক নার্সিং হোম থেকে, তারপর এলেই ভালো…এমনিতেই এসেই বা কি আর করবে...যা হবার তা তো হয়েই গেছে। রুপসা রোজ ফোন করে খোঁজ নেয়… মৌ কেমন আছে। আরো কয়েক দিন পর, মিষ্টি আর বিল্টুকে আনানো হয়েছে যাতে মৌ মানসিক ভাবে কিছুটা ভরসা পায়। ভাই বোনকে দেখে যেন ও বিশ্বাসই করতে পারছিল না… সত্যি নাকি স্বপ্ন। তিন ভাই বোনে কান্নাকাটি করার পর বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসেছিল। ওদের সাথে মোটামুটি কথা বলে গেলেও মৌ কিছুটা হলেও আবার ভয় পেয়েছে মা যদি জানতে পারে। ওরা দু ভাইবোন ওকে বুঝিয়েছে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ওরা মাকে কিছু বলবে না। ওরাই তারপরে জানিয়েছে ও কিভাবে এখানে এসেছে আর কতদিন মতো এখানে আছে। মৌ সব শুনে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না… প্রায় দেড় বছর ও এখানে আছে। ভাই বোনের দিকে কেমন যেন একটা অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল বেশ কিছুক্ষন।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
আরো মাস খানেক কেটে গেছে। মৌ সেই যে সব কিছু শোনার পরেও নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে কোনো এক অজানা কারনে, তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বেশীর ভাগ সময়েই চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকে। মাঝে রুপসা আর পুবালী এসে ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি, কান্নাকাটি করে ওদেরকে ফিরিয়ে দিয়েছে। একটু আধটু দিদানদের সাথে কথা বললেও অরিত্রকে দেখলেই নিজেকে এতটা গুটিয়ে নিতো যে বাধ্য হয়ে ওর সামনে আসা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। একমাত্র ওর ভাই বোন এলে ওদের সাথেই যা কিছূটা কথা বলে…তাও যে খুব একটা স্বাভাবিক তাও নয়। নিশ্চয় কিছু কারন আছে যেটা ও প্রকাশ করতে পারছে না… যদি তাই হয় তাহলে জোর করে কিছু করার জন্য খারাপ কিছু হতে পারে ভেবে ওরা পিছিয়ে এসেছে। দেখা যাক, আস্তে আস্তে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে বা ও নিজের থেকে প্রকাশ করতে পারবে ওর মনে কি আছে। ওকে শুধু এইটুকু বোঝানো গেছে যে ও যেন এখান থেকে চলে যাবার কথা না ভাবে আর যদি ও চলে যেতে চায়ও তাহলে যেন অন্তত দিদানদেরকে আগে থেকে জানায় কোথায় যেতে চায়। এটা ওর ভালোর জন্য বলা হচ্ছে বুঝে হয়তো চুপচাপ মেনে নিয়েছে।
অরিত্রর দিন গুলো একটা একটা করে কেটে যাচ্ছে, সবকিছুই প্রায় আগের মতোই, তবুও যেন কতো আলাদা। এখন আর অফিস থেকে ফিরতে দেরী হলে বিশেষ কেউ একজন ওর জন্য জানলার গ্রীলটা ধরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করে না। ও ফিরছে দেখতে পেলেই পড়ি মরি করে দৌড়ে এসে শরীরের ভাষায় নীরবে বলে না…কেন এত দেরী করলে তুমি? একই বাড়ীতে থেকেও যেন ও কতদুরে…এর থেকে বেশী যন্ত্রনার বোধহয় আর কিছু হয় না। ও যদি এখানে না থাকতো তাহলে হয়তো এতটা খারাপ লাগতো না, কষ্ট হলেও মেনে নিতে হত যে ওর জীবন থেকে মৌ হারিয়ে গেছে। কিন্তু ওর ভালোর কথা ভেবেই যত কষ্ট হোক তবুও মেনে নিয়েছে ওর এখানে থাকাটা।
পুজ়ো এসে গেল প্রায়, কোনো কিছুই আর এবারে করা হয়ে ওঠেনি…কারুরই মানসিকতা ছিল না কিছু করার…এই পুজ়োটা বোধহয় ওদের জীবনের সব থেকে খারাপ কাটবে। দাদুরা বারন করলেও তার ভেতরেই ও একা গিয়ে সবার জন্য কিছু না কিছু কিনে এনেছিল পুজোর ঠিক আগে আগে…যতই নিজের বুকের ভেতরে কুরে কুরে খেয়ে যাওয়া যন্ত্রনা থাকুক, যাকে যা দেবার তাতে যেন কোনো ত্রুটি না থাকে সেদিকে যতটা সম্ভব নজর দিয়েছে ।মৌকে আর নিজের হাতে দিতে পারেনি,দিদানের হাতে দিয়েছিল ওকে দেবার জন্য। পরে দিদানের কাছে শুনেছিল, মৌ নিয়েছে ওটা, কিন্তু দেখে বোঝা যায়নি ও খুশী কি খুশী নয়। দেখতে দেখতে পূজো এসে গেল। সপ্তমীর সন্ধে, দাদুরা সবাই পুজোর ওখানে, না গেলে অনেকে অনেক প্রশ্ন করবে তাই যেতে হয়েছে। অরিত্র শরীর খারাপ বলে যেতে পারবে না জানিয়ে দিয়েছে আগেই। এক মাত্র শুভ জানতো আসল ঘটনাটা…ও বাকিদেরকে সামলে নিয়েছিল আগেই। রাত প্রায় নটা বাজে, অরিত্র একা একা ছাদে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল…চারিদিকে আলোর রোশনাই, ঢাক বাজছে পূজো প্যান্ডেলে…সবার মনে খুশী, ওর মনের ভেতরে শুধুই অন্ধকার। গত বছর এই দিনটার কথা মনে পড়ে গেল। মৌকে নিয়ে বেরিয়েছিল ওই রাতে ওর পছন্দ করে দেওয়া ড্রেসটা পরে। সত্যিই ওকে খুব সুন্দর লাগছিল সেদিন ওই জমকালো পোষাকে। ওর সাথে বেরোতে পেরে কি না খুশী ছিল সেদিন ভাবতেই বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠল। সব কটা প্যান্ডেলে গাড়ী থেকে নেমে ও অরিত্রর গা গা ঘেঁষে হাত চেপে ধরে থাকছিল, মনে হচ্ছিল যেন ঠাকুর দেখার জন্য ও বেরোয় নি। ওর আসল ইচ্ছে অরিত্রর সাথে একেবারে একা একা থাকবে। রাত দুটো নাগাদ ওকে কিছু খাবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে লাজুক হেসে মুখ নীচু করে নিয়েছিল। ওর মুখটা তুলে ধরে বলতে হয়েছিল…এই মৌ… কিছু খাও…সেই কখন খেয়েছো। ইশারা করে কিছুটা দুরের একটা ফুচকার দোকান ও দেখিয়েছিল তারপর। সামান্য ফুচকা খেতে চাওয়ার কথা জানাতে গিয়ে ওর লজ্জা পাওয়া দেখে ভালো লাগার সাথে সাথে হাসিও পেয়েছিল। ফুচকাওয়ালার বোধ হয় আজ ভালো বিক্রি হয়নি বা অনেক সময় কোনো কাস্টমার ছিল না। ওদের দুজনকে পেয়ে বেশ যত্ন করে আস্তে আস্তে দিচ্ছিল যাতে ওদের খেতে অসুবিধা না হয়, একা একা ও খেতে রাজী না হওয়ায় নিজেকেও খেতে হয়েছিল ওর সাথে। মনে আছে, একটা ফুচকা হাতে নিয়ে সবে মুখের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল…মৌ এর দিকে তাকালে, বুঝেছিল…ওটা ওকে খাইয়ে দিতে হবে। হাসি মুখে ওর দিকে এগিয়ে দিলে খুব খুশী হয়ে খেতে খেতে নিজেরটা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বুঝিয়েছিল…এবারে আমি তোমাকে খাইয়ে দেবো। তারপরের গুলো ওরা একে অপরের হাতেই খেয়েছিল। ওদের এত খুশী দেখে বুড়ো ফুচকাওয়ালাও যেন ওদেরকে খাওয়ানোতে মজ়ে গিয়ে নিজেই হিসেব গুলিয়ে ফেলেছিল প্রায়। ভোর সাড়ে তিনটের সময় ফিরে বাড়ীর সামনে গাড়ীটা থামাতেই ও হাতটা চেপে ধরে কিছু যেন বলতে চাইছিল। ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে সামনের দিকে ইশারা করে বুঝিয়েছিল ওকে নিয়ে নদীর পাড়ে যেতে হবে। চারদিক নিস্তব্ধ, কেউ কোথাও নেই…নির্জন নদীর পাড়ে শিশির ভেজা ঘাসের উপরে ওরা দুজনে পাশাপাশি বসে। হাওয়াতে মোটামুটি ঠান্ডার আমেজ… ওদেরকে যেন আরো ঠান্ডার অনুভুতিতে ভরিয়ে দিচ্ছিল। শুধু কি ঠান্ডা হাওয়া ওদেরকে মাঝে মাঝে কাঁপিয়ে দিচ্ছিল? হয়তো শুধু তাই নয়…আরো কাছাকাছি আসার ইচ্ছেতেই হয়তো শীত করছিল দুজনের। কখন ওরা আরো কাছাকাছি এসে দুজনে দুজনের সান্নিধ্যে থেকে একে অপরের শরীরের উত্তাপে নিজেকে তৃপ্ত করেছে বুঝতে পারেনি…দুরে কোথাও থেকে কোনো মসজিদের আজান কানে ভেসে এলে ইচ্ছে না থাকলেও উঠতে হয়েছিল…ভোর হতে যে আর দেরী নেই।
এবছর আর কোথাও বেড়াতে যাবারও প্রশ্ন ছিল না। অফিস যেতে হয় তাই যায়… ওখানে কাউকে বুঝতেও দিতে চায়নি যে ওর কিছু হয়েছে…কিন্তু ওকে চুপচাপ থাকতে দেখে অনেকেই প্রশ্ন করলেও এড়িয়ে গেছে। কালী পূজোর পর আবার অফিস থেকে কিছুদিনের জন্য বাইরে যেতে বললে জানিয়েছে দু একদিন পরে জানাবে যেতে পারবে কিনা। দাদুদেরকে বলাতে, না করেনি… ‘দিন গুলো তো কেটে যাচ্ছে… তুই না থাকলেও চলে যাবে…যা ঘুরে আয়’ বলেছে দাদু।
আজ দুদিন হোলো অরিত্র চলে এসেছে, এবারেও সিঙ্গাপুর। বেশ কিছু দিন হয়ে গেল ডাইরি লেখা হয়নি ভেবে দাদুদের সাথে কথা বলা হয়ে গেলে ডাইরিটা ব্যাগ থেকে বের করতে গিয়েও খুঁজে পেলো না। বেশ কিছুক্ষন বসে চিন্তা করেও ঠিক মনে করতে পারলো না এবারে ব্যাগে নিয়েছিল কিনা ডাইরিটা। হয়তো ভুলে গেছে নিতে, ভেবে তখনকার মতো ছেড়ে দিয়েছে। ঠিক আছে, এই কদিন না হয় সফট কপিতে রেখে দেবে…ফিরে গিয়ে লিখে নেবে ভেবে অনেক রাত অব্দি বসে লিখতে লিখতে কখন যে প্রায় ভোর হয়ে এসেছে বুঝতে পারেনি। অফিস থেকে দেওয়া ওর স্কাইহাই এপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতে কফির কাপটা নিয়ে উদাস হয়ে সামনেই কিছুটা দুরে বয়ে যাওয়া নদীর দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোর কথা ভাবছিল। ঘরের ভেতর থেকে ওর ল্যাপটপে বেজে যাওয়া Elvis Presley র ওর অনেক দিনের প্রিয় একটা গান ভেসে আসছে...
Maybe I didn't treat you
Quite as good as I should have
Maybe I didn't love you
Quite as often as I could have
Little things I should have said and done
I just never took the time
You were always on my mind
You were always on my mind
Tell me, tell me that your sweet love hasn't died
Give me, give me one more chance
To keep you satisfied, satisfied
Maybe I didn't hold you
All those lonely, lonely times
And I guess I never told you
I'm so happy that you're mine
If I make you feel second best
Girl, I'm sorry I was blind
You were always on my mind
You were always on my mind
Tell me, tell me that your sweet love hasn't died
Give me, give me one more chance
To keep you satisfied, satisfied
Little things I should have said and done
I just never took the time
You were always on my mind
You are always on my mind
You are always on my mind…...
মৌকে পেয়েও হারানোর ভয়টা মনের ভেতরে ছিল কিন্তু সত্যিই যে মিলে যাবে এত তাড়াতাড়ি হয়তো ভাবেনি। বুকের ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো গানটা শুনতে শুনতে… ভাবছিল, যদি এমন হোতো… গানের কথা গুলো নিজের মুখেই বলতে পারতো ওকে…কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়…ওকে দেখলেই যে মৌ নিজেকে গুটিয়ে নেয় কোনো এক অজানা কারনে… তাহলে কি সত্যিই তাই? ওর খুব কাছের কেউ আছে যাকে ও চায়। তাই বা কি করে হয়… যদি কেউ থাকতো তাহলে ও কেন বলছে না বা ফিরে যাচ্ছে না তার কাছে… আস্তে আস্তে পুর্ব দিক লাল হয়ে উঠতে শুরু করল, আর একটু পরেই সুর্য উঠবে, আরো একটা হাসিখুশী সুখী দিনের শুরু হবে এই সুন্দর সুর্যোদয়েয় ভেতর দিয়ে...কিন্তু সেই সুন্দর দিনটা ওর জন্য নয়... এই সুন্দর ভাবে শুরু হওয়া দিনটা ওর জন্য বয়ে নিয়ে আসবে না কোনো সুখের ঠিকানার সন্ধান...
প্রকৃতির নিয়মে একটা একটা করে দিন কেটে যাচ্ছিল। অরিত্রকে আগের মতোই রোজ বাড়ীতে ফোন করতে হয় বা করে, পার্থক্য শুধু একটাই, দাদুদের সাথে কথা হয়ে গেলে আর কাউকে ফোন করার থাকে না। আর কেউ নেই ওকে বলার…’কেন তুমি এত দেরী করলে? যাও আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। ফোনে কান পেতে অপেক্ষা করারও প্রয়োজন নেই আর দুর থেকে ভেসে আসা সেই মিষ্টি আওয়াজ শোনার জন্য। জেঠু জেঠিমা বা দিদিদের সাথে মাঝে মাঝে কথা হলেও রুপসা প্রায়ই ওকে ফোন করে, ভাই বোনে দুজন দুজনকে বোঝাবার চেস্টা করে যদিও কেউই জানে কি বোঝাচ্ছে। রুপসার সেই অপরাধবোধটা এখোনো কাটেনি। ও এখোনো সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী করে। অরিত্র ওকে যতই বোঝাক না কেন যে ও বোনের জোরাজুরিতে এগোয়নি, নিজের থেকেই এগিয়েছিল সবকিছু জেনে বুঝেই... তবুও ও বলেই দিয়েছে...অসম্ভব কিছু ঘটে গিয়ে যদি মৌ আবার তোর কাছে ফিরে আসে তো ঠিক আছে, যদি তা না হয় তো নিজেকে কোনোদিনই ক্ষমা করতে পারবো নারে দাদাভাই। বোন কোনো অবস্থাতেই নিজের মত থেকে সরবে না বুঝে আজকাল আর অরিত্র ওকে নতুন করে ওই ব্যাপারে বোঝাবার চেস্টা করে না।
আরো দিন সাতেক পর, অরিত্র দাদুর সাথে কথা বলতে গিয়ে জানতে পারল মৌ আজ সকালে কোথাও গিয়েছিল, বিকেলের দিকে মুখ শুকনো করে ফিরে এসে নাকি নিজের ঘরে কান্নাকাটি করেছে। দাদুর কাছ থেকে আরো কিছু জানা যায় যদি ভেবে জিজ্ঞেস করল… কোথায় গিয়েছিল জিজ্ঞেস করেছিলে তোমরা?
- তোর দিদান জিজ্ঞেস করেছিল কিন্তু ও এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে আর জোর করেনি।
- ঠিক আছে, আমি বিল্টুদেরকে ফোন করে দেখছি যদি ওরা কিছু বলতে পারে।
দাদুর সাথে কথা হয়ে গেলে সাথে সাথেই বিল্টুকে ফোন করল কিন্তু বিল্টু বা মিষ্টির কাছ থেকে কিছু জানা গেল না, উলটে ওরাও শুনে অবাক হয়ে গেল দেখে ওদেরকে পারলে পরের দিনই একবার দিদির সাথে দেখা করতে বলে দিল এই বলে যে ও একা একা বেরোলে আবার কোথায় কি হয়ে যাবে বলা যায় না। ওরা যদি দিদির সাথে কথা বলে যদি আটকাতে পারে তাহলে খুব ভালো হয়। সব কিছু শুনে ওরা ভাইবোনে পরের দিনই আসবে বলেছে। সবার সাথে কথা বলা হয়ে গেলে ও কোথায় যেতে পারে আর ফিরে এসেই বা কেন কান্নাকাটি করেছে অনেক ভেবেও কোনো কুল কিনারা খুঁজে পেলো না…অনেক কিছুই মাথায় এলো কিন্তু কোনোটাই ঠিক বলে মনে হল না শেষ পর্যন্ত। যদি ওর কেউ থাকে তাহলে এতদিন অপেক্ষা করল কেন তার কাছে যেতে? আচ্ছা, সত্যিই যদি ধরে নি কেউ আছে তাহলে ফিরে এসে কান্নাকাটি করল কেন? তাহলে কি সে ফিরিয়ে দিয়েছে? তাই বা কি করে হবে… ওর তো খামতি নেই কোনো কিছুতেই… দেখতে শুনতে এত সুন্দর..মিষ্টি ব্যাবহার...ওর মতো মেয়েকে নিজের জীবনসাথী হিসেবে পেতে কে না চাইবে। হতে পারে ওর এতদিন কোনো খোঁজ খবর না থাকায় ছেলেটি হয়তো অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলেছে।
পরের দিন বিল্টুকে বিকেলের দিকে ফোন করল কি হয়েছে জানার জন্য কিন্তু ও তেমন কিছু বলতে পারল না দেখে জিজ্ঞেস করল ওর বাইরে একা একা না যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে কথা হয়েছে কিনা। বিল্টু জানালো … হ্যাঁ, বলেছি…
- কি বলেছে তাতে?
- চুপ করে ছিল কিছুক্ষন, তারপর বলল যাবো আর কোথায়… যাওয়ার জায়গা কি আছে…
- আর কিছু কথা হয়েছে?
- না… খুব একটা কথা বলছে না দেখে আমরাও ঠিক বুঝতে পারছি না।
- তাহলে এক কাজ করো... রোজ তোমার দিদির সাথে অন্তত একবার হলেও তুমি বা মিষ্টি কথা বলো ফোনো, বুঝতেই পারছো আমরা খুব চিন্তায় আছি ওকে নিয়ে।
- জানি অরিত্রদা... তোমরা না থাকলে দিদির কি যে হোতো ভাবতেই ভয় লাগে।
গতকাল যা যা হতে পারে ভেবেছিল সেখান থেকে আবার চিন্তা করা শুরু হয়ে গেল নিজের থেকেই। চুপ করে বসে ভাবছিল... নিশ্চয় ওর কেউ আছে যার কাছে ও গিয়েছিল এবং সে ফিরিয়ে দিয়েছে... তাই ও ফিরে এসে কান্নাকাটি করেছে এবং আজ বলেছে... ‘যাওয়ার কি জায়গা আছে’... এতটা চিন্তা করার পর মনে হল... আচ্ছা তাই যদি হয় তাহলে কি আমি ওকে বলতে পারি আমার কাছে ফিরে আসতে? এই পর্যন্ত ভেবে মনের ভেতরে একটু ভালো লাগার রেশ এসেই মিলিয়ে গেল অন্য একটা কথা ভেবে। নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করেও সদুত্তর পেলো না এই ভেবে যে যদি আমি যা ভাবছি তা না হয় আর ও না বলে দেয় তাহলে তো রাস্তাটা একেবারের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে, তার থেকে ভালো অপেক্ষা করে দেখি কি হয়...এমনও তো হতে পারে আমি ওকে আবার ফিরে পেলাম। আর যদি তা না হয় তাহলে মেনে নিতে হবে...আর কি করার আছে? আমি তো আগে থেকেই ভেবেছিলাম যে এমন কিছু একটা হতেও পারে। এমনি ভাবেই দিন গুলো কেটে যাচ্ছিল, রোজই সেই একই কথা গুলো ভাবে আর নিজে নিজে উত্তর দিয়ে নিজেই আবার খারিজ করে দেয়। কোনো কিছুই যখন আর মাথায় ঢুকতে চায় না তখন অপেক্ষা করি...দেখা যাক না কি হয় ভেবে নিজেকে বোঝাবার চেস্টা করে।
অরিত্র ফিরে আসার প’র দাদুদের সাথে আলোচনা করে একদিন বিল্টুর সাথে দেখা করল। মৌ নিজে থেকে তো কিছু বলছে না ঠিক কি হয়েছিল বা ও কি চায়, দাদু দু একবার কথা বলার চেস্টা করলেও মায়ের সাথেও দেখা করার কোনো উৎসাহ স্বাভাবিক ভাবেই দেখায় নি। ও যদি চায় তাহলে মা মেয়েকে মুখোমুখি করানো যেতে পারে বলে বিল্টুকে বোঝালে ও সব শুনে বলল… আমিও দু এক বার দিদিকে জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছিল… কিন্তু কেন জানিনা বলতে চাইছে না।
- ঠিক আছে, দেখো না আরো একবার চেষ্টা করে।
- দেখি, কি করা যায়। আমার মনে হয় তোমরাও থাকলে ভালো হয়।
- আমার মনে হয় আমি থাকলে তোমার দিদি কিছু বলতে চাইবে না...জানোই তো আমাকে কেমন এড়িয়ে যায় এখোনো।
- তবুও, তোমার থাকার দরকার আছে...আমরা তো আর এতকিছু বুঝবো না।
যেমন ভাবা হয়েছিল সেই মতো বিল্টুরা এসেছে। বিকেলের দিকে সবাই মিলে বসে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করা হ’ল কিন্তু সবকিছু শোনার পরও ও চুপ করে আছে দেখে অরিত্র বাধ্য হয়ে বলল…তুমি যদি চুপ করে থাকো তাহলে তো তোমার সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। মৌ আরো কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আস্তে করে বলল… আমার জন্য যদি অসুবিধা হয়, আমি না হয় চলে যাবো। দিদান এতক্ষন চুপ ছিল, ওর চলে যাবার কথা ওঠাতে বলল… তুমি ভুল করছো মৌ, আমরা কেউই চাইছি না তুমি চলে যাও। তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না তুমি আমাদের কতটা কাছের হয়ে গেছো। আমরা শুধু চাইছি তোমার যা কিছু সমস্যা আছে সেগুলো মিটে যাক। তারপর তুমি যদি না চাও এখানে থাকতে আমরা তো আর জোর করতে পারি না। তবে তুমি এটা মনে কোরো না যে তোমার জন্য আমাদের কিছু অসুবিধা হচ্ছে। দিদানের কথা শুনে ও আস্তে করে বলল…সমস্যা তো একটাই… টাকা…আমি যদি ওগুলো দিয়ে দি, তাহলে তো সব মিটেই যাবে। দাদু ওর কথা শুনে বলল…তোমার যদি মনে হয় টাকা দিয়ে দিলে মিটে যাবে তো দিয়ে দাও...ঝামেলা মিটে যাবে।
- তারপর?
- তারপর তোমার কি হবে তাই তো?
- হ্যাঁ…
- আমরা তো আছিই… তুমি আমাদেরকে পর ভাবছো কেন?
- জানি না… আমাকে একটু ভাবতে হবে।
- ঠিক আছে, তুমি তাহলে ভেবে জানিও… আমাদের দিক থাকে কিন্তু তোমাকে চলে যেতে বলার কোনো প্রশ্ন আগেও ছিল না আর এখোনো নেই। তুমি যতদিন চাও আমাদের কাছে থাকো...
দেখতে দেখতে আরো মাস দুয়েক কেটে গেছে। মৌ কি ডিশিশান নিয়েছে জানায়নি কিন্তু কিছুটা হলেও যেন ওর ভেতরে পরিবর্তন এসেছে আস্তে আস্তে কিন্তু সেটা অরিত্রর ব্যাপারে একেবারেই নয়। আগেও যেমন ওকে এড়িয়ে যেতো সেরকমই আছে কিন্তু দাদু দিদানদের সাথে আগের থেকে অনেক বেশী মেশার চেষ্টা করে। সবাই ভেবেছে দেখা যাক, আরো কিছুদিন গেলে হয়তো আরো কিছুটা স্বাভাবিক হবে। বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে ও একাই ঘরের দরজা বন্ধ করে শোয় রাতে যেটা আগে করতো না। অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে যে একেবারেই ভাবেনি তা নয়...কখোনো ভেবেছে তাহলে কি ও আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না? ভয় পাচ্ছে এই ভেবে যে আমি ওর উপরে জোর করবো? কথাগুলো ভেবেও নিজেই নিজেকে বলেছে...নাঃ, তা কি করে হবে। ওর ঘরে তো অনেক রাত পর্যন্ত আলো জ্বালানো থাকে... বই পড়ে হয়তো। আজকাল অফিস থেকে বেরোতে বেশী রাত হয়ে গেলে আর বাড়ী না ফিরে দিদানকে জানিয়ে দিয়ে ভবানীপুরের বাড়িতে চলে যায়। কি আর তফাৎ আছে এখানে আর ওখানে? যন্ত্রনা তো দু জায়গাতেই আছে। শুধু ধরনটা যা আলাদা। দিদির বিয়ের পর এমনিতেই জেঠিমারা খুব একা হয়ে গেছে, ওকে পেলে তবু একটা রাতের জন্য হলেও খুশী হয়। প্রথম প্রথম জেঠিমারা মৌ-এর ব্যাপারে ওর সাথে কথা বলার চেস্টা করতো কিন্তু ও চায় না দেখে এখন আর কিছু বলে না। একটা রাতের জন্য এসেছে ছেলেটা, থাক ওকে আর কষ্ট দিয়ে লাভ নেই ভেবে নিজেদেরকে সান্তনা দেয়। অনেকদিন হয়ে গেল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয় না, বারে বারে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে চুপ করে শুয়েও থাকতে পারে না। উঠে গিয়ে জানলার কাছে দাঁড়িয়ে কি ভাবে নিজেই বোঝে না। যতই মাথার ভেতরটা ফাঁকা করে দেবার চেস্টা করুক না কেন বারে বারে পুরোনো স্মৃতি গুলো ভীড় করে আসে। মাঝে মাঝে ভেবেছে এই ধরনের সমস্যায় অনেকেই তো ড্রিঙ্ক করে...তাতে নাকি দুঃখ ভোলা যায়, ভাবলেও আবার নিজের থেকে পিছিয়ে এসেছে... আমার যা হবে হোক...যে তিনটে মানুষ আমার মুখ চেয়ে বেঁচে আছে তাদেরকে তো আর কেউ নেই দেখার। নিজের জন্য না হোক ওদের জন্য আমাকে স্বাভাবিক থাকতেই হবে যেভাবেই হোক...ভেতরে না হলেও বাইরেটা দেখে যেন কেউ না বোঝে আমার ভেতরে কি হচ্ছে। যতই ও নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেস্টা করুক না কেন সবাই বোঝে ও কি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। প্রায়দিন রাতে দিদান বা শুক্লাদি ওর ঘরে এসে দেখে যায় ঘুমোতে পারছে কিনা। মাঝে মাঝে ওদের কাছে ধরাও পড়ে যায়...ওকে কাছে টেনে নিয়ে সান্তনা দেবার চেস্টা করে নিজেরাই কেঁদে ফেলে দিদানরা... মা বাবা হারানো ছেলেটাকে খুশী দেখতে চাওয়া ছাড়া আর কিছু যাদের কাম্য নয় তাদের কাছে ওকে এইভাবে দিনের পর দিন যন্ত্রনা পেতে দেখার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো ভেবে নিজেরাই কষ্ট পেলেও কোনোদিন ওদের কেউই এর জন্য মৌকে দায়ী করেনি। এটাই ওর ভবিতব্যে ছিল ভেবে মেনে নিয়েছে এই ভেবে যে মেয়েটা তো আর নিজের থেকে আসেনি বা থাকতে চায়নি...ওরাই চেয়েছিল ও এখানে থাকুক।
এর মাঝে কোনো এক শনিবার বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় সুস্মিতাকে উল্টোডাঙ্গায় দেখতে পেয়ে কি মনে করে গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে যায় দেখা করতে। ব্যাপারটা হঠাৎই এমন ভাবে ঘটে যায় যে নিজেই ভাবেনি যে এই সেই মেয়ে যাকে ও একটা সময় এড়িয়ে যেতে গিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্কটাই ভুলে গিয়েছিল বাধ্য হয়ে। সুস্মিতা হঠৎ ওকে ওইভাবে দৌড়ে আসতে দেখে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল...আরে অরিত্রদা...তুমি? ওর প্রশ্নটা শুনে প্রথমে একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল... আরে, বাড়ী ফিরছিলাম...তোমাকে দেখতে পেয়ে চলে এলাম।
- বাব্বা, কি সৌভাগ্য আমার... বলো কেমন আছো?
- আমি এই এক রকম আছি...তুমি?
সুস্মিতা ওর উত্তরটা শুনে কেমন কেমন লাগছে বুঝতে পেরে জিজ্ঞেস করল...বুঝলাম না...এক রকম মানে?
- ওই এক রকম মানে এক রকম...বলো তোমার কি খবর...
- আমার খবর বেশ ভালোই... যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম তা নয়...
- তার মানে তুমি তোমার বরকে ভালোবাসতে পেরেছো...তাই তো?
সুস্মিতা হেসে ফেলে বলল... তা ছাড়া আর কিছু করার আছে কি? তবে জানো তো ও বড্ড ভালো...আমি নিজের থেকে সব কিছু জানিয়ে দিয়েছিলাম বিয়ের আগেই...সব কিছু জেনেই ও আমাকে বলেছিল...চিন্তা কোরো না, তুমি যে আমার কাছে কিছু লুকোতে চাওনি এটাই আমার কাছে অনেক। সুস্মিতা যে সুখী হয়েছে এটা জেনে ভালো লাগলো। খুব ইচ্ছে করছিল কিছুক্ষন ওর সাথে সময় কাটায়...সাতপাঁচ না ভেবেই বলে ফেলল... তোমার হাতে কি সময় আছে? যদি তোমার অসুবিধা না থাকে তাহলে চলো না কোথাও গিয়ে একটু বসি। সুস্মিতা ওর আগ্রহ দেখে বলল...ঠিক আছে, চলো। আমার তেমন কোনো তাড়া নেই।
একটা রেস্টুরেন্টে বসে দুজনের কথা হচ্ছিল। অরিত্র যতই নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেস্টা করুক না কেন ও যে মৌ এর প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে এটা বুঝতে না পারার কথা নয়। সুস্মিতা বাধ্য হয়ে বলল...অরিত্রদা, আমি তো তোমার কাছে কিছু আড়াল করিনি...তুমি কেন এড়িয়ে যাচ্ছো আমাকে? বলো না কি হয়েছে? সুস্মিতার আন্তরিক ভাবে বলা কথাটা এড়িয়ে যেতে না পেরে একটু একটু করে বলল ওকে ঠিক কি কি হয়েছে। এতদিন নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে গিয়ে কারুর কাছে নিজের কথা তেমন ভাবে বলতে না করতে পেরে যে কষ্ট পাচ্ছিল আজ তা বলতে পেরে নিজেকে যেন একটু হাল্কা লাগছিল। কিছুটা শোনার পর ওকে মুখ নিচু করে বসে থাকতে দেখে সুস্মিতা বলল...তুমি কেন ওকে সরাসরি জিজ্ঞেস করছো না ও কি চায়? অরিত্র মুখ তুলে একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবার মুখ নিচু করে নিয়ে আস্তে করে বলল... তুমি হয়তো জানো না, আমি জোর করতে পারি না। তার থেকেও বড় কথা ও কেন যে আমাকে এড়িয়ে যায় বুঝতে পারি না। সবকিছু শোনার পর সুস্মিতা ওর সাথে কথা বলার জন্য আসতে চাইলে অরিত্র ওকে বারন করে বলল...কোনো লাভ হবে না সুমি, তুমি হয়তো জানো না আমার ছোড়দি আর ছোটো বোনের সাথে ওর কতটা কাছের সম্পর্ক ছিল। সব কিছু ওকে জানানোর পরেও তাদেরকেও ফিরিয়ে দিয়েছে বারে বারে। আমি সত্যিই বুঝতে পারি না ওর সমস্যাটা ঠিক কোথায়...আমরা তো ওর কোনো ক্ষতি চাই না...কেন যে ও সেটা বুঝতে চাইছে না কে জানে। সুস্মিতা কিছুক্ষন চুপ পরে থাকার পর নিজের মনেই যেন উত্তর দিল... কিছু তো একটা আছে যেটা ও পারছে না বলতে...
অরিত্রর এরপরে আরো বার তিনেক সুস্মিতার সাথে দেখা হয়েছে। দেখা হয়েছে বললে হয়তো ভুল হবে, মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে গিয়ে নিজেরাই ঠিক করেছে দেখা করবে। এতদিন বোনেদেরকে বোঝাতে গিয়ে নিজের আসল অবস্থার কথা কিছুটা হলেও চেপে যেতে হত যাতে ওরাও এতটা কষ্ট না পায় কিন্তু সুস্মিতার সাথে মন খুলে শেয়ার করার পর থেকে কিছুটা হলেও যেন শান্তি পায়। নিজের থেকে দেখা করতে বললেও শেষের দিন ওকে অবাক করে দিয়ে সুস্মিতা কেঁদে ফেলে বলল... অরিত্রদা প্লিজ তুমি আর আমার সাথে দেখা কোরো না। আমি সত্যিই আর পারছি না। অরিত্র চুপ করে থেকে ওর কথাগুলো শুনে বলল...আমি তো তোমার কাছে কিছু আশা করে আসি না সুমি, এতদিন কারুর কাছে নিজেকে এতটা খুলে ধরতে না পেরে হয়তো হাঁপিয়ে উঠেছিলাম...তাই হয়তো তোমাকে বলতে পারি বলে বার বার ফিরে আসি। সুস্মিতা নিজেকে সামলে নিয়ে চোখের জল মুছে বলল...জানি অরিত্রদা, কেন জানি না আমি তোমার এই অবস্থায় নিজেকে খুব দুর্বল করে ফেলছি, ইচ্ছে করছে তোমার পাশে দাঁড়াই আরো বেশী করে কিন্তু ভেবে দেখলাম সেটা ঠিক হবে না। অনেক কষ্ট করে কিছুটা হলেও তোমাকে ভুলতে পেরেছি, তার থেকেও বড় কথা ও আমাকে বিশ্বাস করেছে, আমি ওকে ঠকাতে পারবো না। ওর এই কথার পর আর কিছু বলার ছিল না অরিত্রর। যদিও বা এতদিন পর কাউকে বলতে পেরে কিছুটা হালকা হতে পারার সুযোগ এসেছিল, সেটাও আর সম্ভব হল না ধরে রাখা যেখানে ও সুস্মিতাকে কোনোভাবেই দায়ী করতে পারবে না। সবকিছু মেনে নিয়ে আসার আগে ও বলে এসেছে...যদি পারো আমাদের যে দেখা হয়েছিল ভুলে যেও। বিশ্বাস করো আমিও চাইনা আমার জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক। সুস্মিতা উঠে এসে ওর হাত ধরে বলেছিল...প্লিজ অরিত্রদা তুমি আমকে ভুল বুঝলে না তো? অরিত্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দিয়েছে... ভুল বোঝার কিছু নেই সুমি।
এরপরে আরো কিছুদিন কেটে গেছে। মে মাসের মাঝামাঝি, গরম পড়ে গেছে মোটামুটি ভালোই। রবিবারের সকাল, বাড়ীতে থাকলে এখোনো রবিবারের বাজারটা ও-ই করে। বাজার থেকে ফিরে এসে নিজের ঘরে বসে খবরের কাগজটা দেখছিল। দরজার কাছে কেউ এসে দাঁড়ালো মনে হতে মুখ তুলে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল...যা দেখছে তা কি সত্যি?
মৌ দাঁড়িয়ে আছে দরজার ঠিক বাইরে। অনেকদিন হয়ে গেল অরিত্র থাকাকালীন মৌ এই ঘরে আসে না, আজ ওকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়ে গিয়েও বলল… বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন… ভেতরে এসো। বুকের ভেতরে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে উঠে আসছিল…বলতে ইচ্ছে করছিল…আজ এতদিন পরে মনে পড়ল আমাকে? মৌকে ভেতরে আসতে বলে খবরের কাগজ়টা ভাঁজ করে পাশে রেখে দিয়ে ভাবছিল…ও নিশ্চয় কিছু বলবে… না হলে তো আসার কথা নয়। ভেতরে ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওকে বসতে বলল অরিত্র। এতদিন পর আজ এক ঝলকের জন্য দেখলেও হল একটু যেন রোগা হয়ে গেছে ও। মুখটাও যেন বেশ শুকনো লাগছে। মৌ ভেতরে এসে বসলেও কিছু না বলে চুপ করেছিল। কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে বসে থাকার পর বাধ্য হয়ে অরিত্র জিজ্ঞেস করলো…কিছু বলবে? মৌ মুখ নিচু করে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল…হ্যাঁ। জানলার বাইরের ফুলে ভরা মাধবীলতা গাছটায় একটা টুনটুনি পাখি দোল খাচ্ছিল… অরিত্র পাখীটাকে দেখতে দেখতে বলল…বলো। মনের ভেতরে একটা ক্ষীন আশা উঁকি দিয়ে চলে গেল…এতদিন ধরে যা চেয়ে এসেছি…আজ কি তা পাবো? পরক্ষনেই সেই ক্ষীন আশা বিলীন হয়ে গিয়ে হতাশায় বুক ভরে গেল…কি করে সম্ভব…এই মৌ তো সে নয় যে এক সময় ওকে বলেছিল…’কাছে থাকতে চাও না তো ডাকো কেন’? মৌকে এর পরেও চুপ করে বসে থাকতে দেখে অরিত্র ওর দিকে ফিরে তাকালে ও নিজের আঙ্গুলে ওড়নার এক প্রান্ত জড়াতে জড়াতে বলল…আমার কিছু বলার ছিল। অরিত্র ওকে বলো বলার পরেও কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকার পর বলল…এখন না… বিকেলে। তারপরেই মুখ তুলে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল…তুমি থাকবে তো বিকেলে? কয়েক সেকেন্ডের জন্য হয়তো দুজনের চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল নিজেদের অজান্তেই। মৌ ওর চোখে কি খুঁজতে চেয়েছে না বুঝলেও অরিত্র অবচেতন মনে হয়তো খুঁজতে চেয়েছিল ওর চোখের সেই হারিয়ে যাওয়া আকুতি, কিছু বলতে চাওয়ার ইচ্ছে... কিন্তু দেখতে পেলো কি তা? মনে হল ওর দুচোখে যেন যন্ত্রনার স্পষ্ট আভাস, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বলল...হ্যাঁ থাকবো। উত্তরটা দিয়ে ও ভাবছিল... এতদিন পরে তুমি আমাকে কিছু বলতে চাইছো... আমি কি পারবো তোমাকে এড়িয়ে যেতে? ওদিক থেকে আর কোনো সাড়া না পেয়ে ফিরে তাকিয়ে দেখলো মৌ নেই...কখন যেন নিঃশব্দে ফিরে গেছে...
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
মনের ভেতরে আশা নিরাশার দোলা নিয়ে কত সময় ও বসে আছে নিজেই হয়তো জানে না। মৌ ওকে কি বলতে চাইছে কিছুতেই যেন বুঝে উঠতে পারছিল না। একবার মনে হচ্ছে ও ফিরে আসতে চাইবে তো পরক্ষনেই মনে হচ্ছে ও হয়তো এখান থেকে চলে যাবার কথা বলবে। এক একটা সেকেন্ড যেন এক একটা যুগ, কখন বিকেল হবে...কখন জানতে পারবে ও কি বলতে চায় ভেবে যখন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না, নিজের উপরেই নিজের ধিক্কার এসে গেল...কেন ওকে ফিরে যেতে দিল, ওকে তো বলা যেতো যে আমি বিকেলে থাকবো না...তুমি যা বলার এখুনি বলো। কখন যে ও বাড়ী থেকে বেরিয়ে ক্লাবে চলে এসেছে নিজেই জানে না। শুভ একা একা ক্যারাম খেলছিল, ওকে দেখে.. আয় আয়, সেই কখন থেকে একা একা বোর হচ্ছি...বলাতে খেয়াল করল ও কোথায়। কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল নিজেকে সামলে নিতে। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর বৃথা চেষ্টা করে ম্লান একটা হাসিতে শুভ কে বলল...বাজার থেকে ফিরতে দেরী হয়ে গেল। শুভ ভালো করেই জানতো ও কখন বাজার থেকে ফিরেছে আর ওর দিকে তাকিয়ে যা বোঝার বুঝে গেলেও নতুন করে আর ওকে ঘা দিতে চাইলো না। মুখ নিচু করে বোর্ড সাজাতে সাজাতে বলল... মা একবার তোকে ডেকেছে। ওরিত্র আচ্ছা ঠিক আছে বলে স্ট্রাইকারটা বসিয়ে খেলায় মন দেবার চেষ্টা করল।
আজ কেন কে জানে ক্লাবে আর কেউ আসেনি। সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভ বাড়ী যেতে হবে বলাতে বেরিয়ে আসতে হয়েছে ক্লাব থেকে। কি করবে এত তাড়াতাড়ি বাড়ী গিয়ে...ওখানে গেলেই তো আবার বুকের ভেতরে রক্ত ঝরতে শুরু করবে ভেবে নদীর পাড়ে গিয়ে একটা গাছের তলায় বসে চুপ করে দূরে তাকিয়ে বসেছিল। একটু পরে ওখান থেকেও উঠে আসতে হল...একা একা থাকলেই অজানা এক আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠছে...বাধ্য হয়ে বাড়ী ফিরে এসে দাদুর সাথে কিছুক্ষন দাবা খেলতে গিয়ে বারে বারে হেরে যাচ্ছিল দেখে দাদু বলল... কি করবি এতো ভেবে, যা হবার তা হবেই...যা, স্নান করে খেয়ে নে।
দুপুর থেকে বিকেল যেন হতে চাইছে না কিছুতেই। শুতে ভালো লাগছে না, বসতে ভালো লাগছে না...আবার মাথার ভেতরে চিন্তা গুলো এলোমেলো ভাবে আবার ঘুরতে শুরু করেছে দেখে নিজেকে অন্যমনস্ক করার জন্য উঠে বসে বাইরের দিকে তাকালো। দক্ষিন পুর্ব কোনে নিকষ কালো মেঘের ঘনঘটা চলছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে মনে হল চারদিক আস্তে আস্তে যেন থমথমে হয়ে আসছে... কাল বৈশাখীর পুর্বাভাষ। মনটাকে ভাবনা বিহীন করে দিয়ে প্রকৃতির সাথে নিজের তুলনা করে নিজেরই হাসি পেয়ে গেল ওর...কি সুন্দর মিলে গেছে আজ ওর সাথে...মনে পড়ে গেল একটা গানের দু একটা লাইন আকাশে আজ রং-এর খেলা...মনে মেঘের মেলা...হারানো সুর হারানো গান ফুরালো যে বেলা...মনে মেঘের মেলা...
কখন যে ঝড় শুরু হয়ে গেছে হয়তো বোঝেনি বা বোঝার চেষ্টাও করেনি... নদীর ধারের গাছ গুলো হাওয়ার ধাক্কায় যেন এখুনি ভেঙ্গে পড়বে...উল্টোপাল্টা ঝোড়ো হাওয়া ঘরের ভেতরে ঢুকে দাপাদাপি করে বেড়ালেও যেন ওর কিছু যায় আসে না আর। হাওয়ার ধাক্কায় টেবিলের উপর থেকে কি একটা যেন পড়ে গিয়ে ঝনঝন শব্দে ভেঙ্গে গেল...যা যেতে চায় যাক...কি হবে ভেবে আর যেখানে নিজের জীবনটাই ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। মুগ্ধ চোখে প্রকৃতির তান্ডব দেখতে দেখতে হয়তো ভাবছিল... পারো না আমাকেও এখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে? এতো কিছু ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে পারো আর পারো না আমার মতো দুর্ভাগাকে মেরে ফেলতে? সম্বিত ফিরে পেলো শুক্লাদির চিৎকারে... বসে বসে দেখছিস? ঘরটার কি অবস্থা হয়েছে দেখতে পাচ্ছিস না? শুক্লাদি দৌড়ে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না দেখে নিজেই উঠে গেল। জানলাটা গায়ের জোরে চেপে বন্ধ করে ফিরে আসার সময় দেখলো মৌ দরজার ঠিক বাইরে, ওর দিকে তাকিয়ে আছে... শুক্লাদি তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গেল আরো কোথায় কি অবস্থা হচ্ছে দেখার জন্য। শুক্লাদি বেরিয়ে গেলে মৌ ও ফিরে গেল তবে নিজের ঘরে নয়...এক তলার দিকে। এক দৃষ্টে ওর ফিরে যাওয়া দেখতে দেখতে কি হল নিজের বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে করছিল ওকে টেনে হিঁচড়ে এখানে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করতে, আমি তো তোমাকে অনেক করে এড়িয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম...তুমি হতে দাওনি। বারে বারে আমার কাছে ছুটে আসতে। আমি তো তোমাকে ফিরিয়ে দিইনি...সব জেনে বুঝেও তুমি যা চেয়েছিলে আমি আমার সব কিছু দিয়ে পুরন করার চেষ্টা করেছি। তাহলে আজ কেন আমাকে এই নরক যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে...বলতে পারো?
ভাবলেই সব কিছু করা যায় না। চাইলেই সব কিছু পাওয়া যায় না... তারপরেই ভীষন খারাপ লাগলো মৌকে সব কিছুর জন্য দায়ী করার কথাটা ভেবে। নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেই আবার মনে মনে মৌ এর কাছে ক্ষমা চাইলো... কিছু মনে করবে না...তোমার তো কোনো দোষ নেই। আমি তো জেনেশুনেই বিষ খেয়ে আজ নিজে জ্বলে পুড়ে মরছি। যার কাছে ক্ষমা চাইলো সে জানতেও পারলো না ও কি ভেবেছে আর কি বলতে চেয়েছে...একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পায়ে পায়ে বেরিয়ে গিয়ে ছাদের দরজাটা খুলে ওই তান্ডবের ভেতরেই যেন নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ভিজতে ভিজতে হঠাৎ করে ফেলা ভুলটাকে ধুয়ে মুছে ফেলতে চাইলো।
ঝড় বৃষ্টির পর চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় সাড়ে পাঁচটা মতো বাজে। শুক্লাদি এসে দুবার ডেকে গেছে চা খাবার জন্য। অনেক দিন হয়ে গেছে ও আর এখানে একা একা চা খায় না...নিচে গিয়েই খেয়ে আসে। উঠি উঠি করেও যেতে ইচ্ছে করছে না... যদি মৌ এসে ফিরে যায়? কি করবে ভাবতে ভাবতে ...... কখন মৌ এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুঝতে পারেনি। ওকে দেখতে পেয়েই আবার সেই সকালের মতো অভিমান বুকে দানা বাঁধতে শুরু করলেও মনের শেষ আশাটুকুকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়ে ওকে ভেতরে ডাকলো। মৌ ভেতরে এসে একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...’তুমি তো মাঝে মাঝেই থাকো না…দাদুদের বয়স হচ্ছে…কিছু ভেবেছো’? অরিত্র ওর কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে বলল... ‘কি ভাববো’? কিছুক্ষন ও চুপ করে থাকার পর বলল ‘তুমি যখন থাকো না তখন দাদুদের দেখা শোনার জন্য তো কাউকে চাই। অরিত্র ওর কথার উত্তরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে আস্তে করে বলল...তুমি তো আছো। ‘আমি যে নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি’ বলতে গিয়েও বলতে পারলো না মৌ। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভেতর থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো ওর। অরিত্র ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ’কিছু বললে না তো’? প্রশ্নটা শুনে ও অস্ফুট স্বরে বলল ‘আমার কি আর এখানে থাকা ঠিক হবে’?
- আমাদের দিক থেকে কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে তোমার?
- না।
- তাহলে?
- আমার মনে হয় চলে যাওয়া উচিত আমার।
- কেন?
- কেউ তো আসবে… আজ না হয় কাল।
অরিত্র অবাক হয়ে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ‘তুমি কি আমার বিয়ের কথা বলছো’? মৌ এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘হ্যাঁ। অরিত্র বেশ কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকলো… যাকে নিজের থেকেও বেশী ভালোবেসে ফেলেছে তার মুখে ওকে ওন্য কাউকে বিয়ে করতে বলাটা যে কি যন্ত্রনার সেটা ওর থেকে হয়তো ভালো কেউ বুঝবে না। অরিত্র চুপ করে বসে থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তোমার যদি অন্য কোনো কিছু কারন থাকে তাহলে আমার কিছু বলার নেই’। ওর উত্তরটা শুনে মৌ যেন নিজের মনেই বলল...কিসের অধিকারে থাকবো? অরিত্র কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছিল না…ও অধিকারের কথা কেন বললো? কি বলতে চাইছে? মনের ভেতরে অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এলে, ও যা ভাবে ভাবুক…আর তো নতুন করে হারানোর কিছু নেই ভেবে কোনোরকমে বলল ‘অধিকার চাইলেই পেতে পারো কিন্তু তুমি তো চাইছো না। কথাটা বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকায় বুঝতে পারছিল না ওর প্রতিক্রিয়াটা কি…বেশ কিছুক্ষন কেটে গেলেও কোনো উত্তর না পেয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো…মৌ নিজের কোলে মুখ গুঁজে বসে নিঃশ্বব্দে কাঁদছে দেখে কি করবে বুঝতে পারছিল না… কোনোদিন ওকে নিজের অজান্তে হলেও কাঁদাবে ভাবেনি…আজও চায়নি… কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে গেল ভাবতে ভাবতে উঠে গিয়ে পাশে বসে ওর পিঠে হাত রেখে মৃদু স্বরে বলল…’প্লিজ…আমি বুঝতে পারিনি…তোমার এতটা খারাপ লাগবে’…
নিজেকে আর বোধ হয় ও আটকে রাখতে পারলো না…ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলতে চাইলো ‘আমি নিজেই সেই অধিকার হারিয়েছি যা তুমি আমাকে দিতে চেয়েছিলে। অরিত্র চুপ করে বসে থাকলো… ও এত কাঁদছে যে এই মুহূর্তে ওকে কিছু বলা আর না বলা একই ব্যাপার। বেশ কিছুক্ষন কেটে গেছে, আস্তে আস্তে কান্না থেমে গেলেও আগের মতো মুখ গুঁজে বসে ছিল…হয়তো বুঝতে পারছিল না… মুখ তুলে কি শুনতে হবে… জীবনে কোনোদিন কিছু না পেয়ে আজ কিছু পাওয়ার সন্ধিক্ষনে এসেও বুঝতে পারছিল না কি করবে।
আরো কিছুক্ষন কেটে গেল… কিছু একটা শুনে আস্তে আস্তে মুখ তুলে এতদিন অভিমান বুকে করে নিয়ে বসে থাকা মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিজেই বুঝতে পারছিল না যা শুনেছে ঠিক কিনা… সত্যি না কি স্বপ্ন দেখছে… নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে না পেরে আবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল… মন চাইছে … আরো একবার নয় … বার বার ওই কথাটা শুনতে … সত্যিই যে ও বিশ্বাস করতে পারছে না … অরিত্রর মোবাইলটা বেজে বেজে থেমে গেল… প্রয়োজন মনে করল না উঠে গিয়ে ফোনটা ধরার… এই মূহুর্তে ফোন ধরার থেকে অনেক বেশী প্রয়োজন ওর পাশে থাকা… না হলে যে ওকে সারা জীবন কিছু না পাওয়ার ব্যাথা বুকে করে নিয়ে বেড়াতে হতে পারে… ওর পাশে বসে থাকা একজন যে এখোনো ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি…আজ যে ওর প্রশ্নের উত্তর পেতেই হবে… হারিয়েও ফিরে পাবার এত কাছে এসে আবার হারানোর ব্যাথা ও পারবে না সহ্য করতে ভেবে জিজ্ঞেস করল… ‘কই ব’লো’…
কান্না ভেজা গলায় মৌ প্রশ্ন করলো ‘আমার ভুলটা কি না জেনেই এগোবে’?
- আমার আর কিছু জানার নেই মৌ…তোমাকে আমি যা জানি তাই আমার কাছে যথেষ্ট...
- তবুও, আমার অতীত…তোমার জানা উচিত...
- তোমার অতীত নিয়ে আমি জানতে চাই না…ভাবতেও চাই না ...
ওর দৃঢ স্বরে বলা কথাটা শুনে মৌ কয়েক মুহুর্ত থমকে গিয়ে আস্তে করে বলল...আমি চাই না…ভবিষ্যতে তোমার আমার কোনো ভুল বোঝাবুঝি হোক।
- ঠিক আছে… তুমি যদি চাও… বলতে পারো।
বেশ কিছুক্ষন চুপ করে হয়তো নিজের সাথে বোঝাপড়া করল ও… আস্তে করে বলল… ‘আমি কারুর সাথে চলে যাবার জন্য বাড়ী থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। অরিত্র অবাক হয়ে গেল কথাটা শুনে, তাহলে কি ওর মায়ের কোনো ভুমিকা ছিল না? ওকে কিছু একটা চিন্তা করতে দেখে হয়তো মৌ বুঝতে পেরেছিল ও কি ভাবছে… আবার ও আস্তে আস্তে বলল… ‘মায়ের জন্যই বেরিয়ে আসতে হয়েছিল… না হলে কি হত জানি না’।
- যার সাথে যেতে চেয়েছিলে সে আসেনি?
- না
- কেন?
- তখন বুঝতে পারিনি
- তুমি কি তাকে ভালোবাসতে?
- হয়তো।
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না...
অরিত্র বুঝতে পারছে না বলাতে মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... ‘বিল্টুকে একজন পড়াতে আসতো বাড়ীতে… ভাই এর পড়াশোনা নিয়েমাঝে মধ্যে কথা হোতো আমাদের। আগে কোনো ছেলের সাথে না মেশায় হয়তো কিছুটা হলেও আমার ভেতরে দুর্বলতা এসে গিয়েছিল। তারপর যখন বুঝতে পারলাম মায়ের দিক থেকে বিপদ আসছে, কি করবো ভেবে না পেয়ে ওকেই ভরসা করে বাড়ী ছাড়তে চেয়েছিলাম’…
অরিত্র কিছুটা সময় ওর থেকে শোনা কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করল...তুমি কি ওকে তোমার দুর্বলতার কথা জানিয়েছিলে?
- না
- তারপর?
- ওকে কারনটা বলিনি…শুধু বলেছিলাম আমাকে বাড়ী থেকে চলে যেতে হবে।
- কি বলেছিল? আসবে?
- হ্যাঁ
- আসেনি...তাই তো?
- হ্যাঁ
- তুমি একদিন যেন একা একা কোথাও গিয়েছিলে?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল… জানতে গিয়েছিলাম কেন আসেনি …
- তোমার কি তখোনো সেই সামান্য হলেও দূর্বলতাটা ছিল?
- ঠিক তা নয়, খুব খারাপ লেগেছিল তাই মনে হয়েছিল জানা দরকার...
- দেখা হয়েছিল?
- হয়েছিল।
- আসেনি কেন?
- মা যদি ওর কিছু ক্ষতি করে ভেবে ও ভয় পেয়েছিল...এছাড়াও আগে থেকেই একজনের সাথে রিলেশান ছিল তাই আর আমার সাথে নিজেকে জড়াতে চায়নি।
- তোমার দিক থেকে যখন তেমন কিছু ছিল না তো ওটা নিয়ে ভাবছো কেন?
- কিছুটা হলেও তো ছিল…তোমার সব কিছু শোনার পর মনে হয়েছিল ঠকানো ঠিক হবে না…অনেকবার ভেবেছিলাম চলে যাবো কিন্তু ভয় পেতাম যদি তুমি কিছু করে ফেলো… বলতে পারো দোটানায় পড়ে গিয়ে বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত...
- আমি ঠিক বুঝতে পারছি না…
- কি?
- তুমি সেদিন ফিরে এসে কেন কেঁদেছিলে…
- নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল…জানতাম তোমার কাছে ফিরতে চাইলে তুমি না করবে না কিন্তু নিজেই পারছিলাম না… আবার চলেও যেতে পারছিলাম না…
- আমি যদি বলি ওটা কোনো ব্যাপার নয়…তুমি আমার কাছে যা ছিলে তাই থাকবে…
- তবুও আমার মনে হচ্ছে…তুমি একবার ভেবে দেখো… সারাটা জীবনের ব্যাপার...
- ঠিক আছে…তুমি যখন চাইছো…তাই…আরো ভালো করে ভেবে দেখবো…
এরপরে হয়তো আর কারুর কিছু বলার ছিল না এই মুহুর্তে। মৌ আরো কিছুক্ষন বসে থাকার পর আস্তে করে জিজ্ঞেস করেছে আমি আসি? অরিত্র হয়তো কিছু ভাবছিল, ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে থেকে তখুনি বলতে ইচ্ছে করছিল...আমার আর নতুন করে ভাবার কি আছে... তারপরেই মনে হল ...না থাক, আমি তো কথা দিলাম ভেবে দেখবো বলে। কথা যখন দিয়েছি আর ও যখন আমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছে তাহলে আর তো কোনো ভয় নেই। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বলে ফেলল...এখুনি চলে যাবে? আর একটু বোসো না...
‘আর একটু বোসো না’ কথাটার ভেতরে ঠিক কি ছিল তা একমাত্র যাকে বলা হয়েছে সেই বুঝল, না...আর কোনো কথা হয়নি ওদের, কেউ কারুর দিকে তাকায়নি, কেউ কাউকে ছোঁয়নি...তবুও যেন অনেক কিছু বলা...অনেক কিছু বোঝা হয়ে গেল। নীরবে বসে থাকার ভেতরেও যে কত কথা বলা যায় তা ওরাই বোঝে। আরো কিছুক্ষন থাকার পর মৌ ফিরে গেছে… ঠিক তার আগের মুহুর্তে চোখে চোখ আটকে গিয়েছিল, কে আগে তাকিয়েছে জানা না থাকলেও দুজনেই যে কিছু বলতে চেয়েছে বা জানতে চেয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না...
কেমন একটা অদ্ভুত ঘোরের ভেতরে চুপ করে বসে ছিল অরিত্র...কিছুই ভাবছে না তবুও যেন অনেক কিছু ভাবছে। একটা ছোট্ট কথাও যে এভাবে জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে তা নিজের জীবনে না ঘটলে হয়তো বিশ্বাসই করতে পারতো না। মনের বোঝা হালকা হয়ে গেলে হয়তো এমনটাই হয়, শরীর নামে যে কিছু একটা আছে অনুভব করতে পারছে না, নিজেকে মনে হচ্ছে আকাশে ভেসে যাওয়া ভারবিহীন এক টুকরো মেঘের মতো... এই মুহুর্তে নিঃসঙ্গ কিন্তু সেই নিঃসঙ্গতা যন্ত্রনাদায়ক নয় মোটেও…
একা থাকাও যে কতোটা সুখের হতে পারে তা নিজেকে দিয়ে অনুভব করতে করতে মনে হল ফোনটা মাঝে মাঝে বেজে উঠছে। এই মুহুর্তে ফোন ধরার ইচ্ছে না থাকলেও ছোড়দি ফোন করেছে দেখে ধরতে হল। পুবালীর উদ্বিগ্ন গলায় ‘ভাই কি হয়েছে… ফোন ধরছিস না কেন’ শুনে আস্তে করে বলল…না রে, কিছু না, রুপসাকে একবার লাইনে নিবি দিদিভাই? ওকে দেখতে না পেলেও ভাই এর গলায় এমন কিছু ছিল যাতে পুবালীর বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হল না যে কিছু একটা ভালো খবর থাকলেও থাকতে পারে। ওদিকে পুবালী ওকে হোল্ড করে রুপসাকে ফোনে ধরার চেস্টা করতে করতে নিজেকে কথা বলার মতো অবস্থায় নিয়ে এসে অপেক্ষা করছিল ও। বোনেদেরকে একটু একটু করে সব কিছু জানিয়ে ওরা কি ভাবছে জানতে চেয়েছে। পুবালী কি বলবে বুঝতে পারছিল না, ফোনটা কানে চেপে ধরে নিজেকে সামলাবার চেস্টা করছে ওদিকে কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই রুপসা একটুও সময় নেয় নি, ও খুশীতে ফেটে পড়ে বলেছে…দাদাভাই, আমি ভাবতেই পারছি না রে। তুই কি রে…কেন বলে দিলি না যে তোর আর কিছু ভাবার নেই? ওর যদি আবার অন্য কিছু মনে হয় তখন কি করবি? অরিত্র ওকে আস্তে করে বলেছে, না রে, আর কোনো ভয় নেই। দুবোনেই চেয়েছিল সেই রাতেই ওর সাথে কথা বলতে কিন্তু অরিত্র ওদেরকে বুঝিয়ে নিরস্ত করেছে এই বলে যে মৌ যদি ভাবে ওকে চাপ দেওয়া হচ্ছে…ওর কথা শোনা হচ্ছে না…ওর কথার ভেতরে যুক্তি থাকায় বোনেরা তখনকার মতো মেনে নিলেও বার বার করে ওকে বলেছে…ও যেন আর দেরী না করে আর কাল সকালেই ওরা মৌ এর সাথে কথা বলবেই…
অনেকদিন পর আজ ভালো ঘুম হয়েছে, ভোর রাতে কি একটা সুখের স্বপ্নও দেখেছে কিন্তু ঘুম থেকে উঠে কিছু মনে করতে পারছে না। ঘুম চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে মনে হল দুটো বুলবুলি পাখি মাঝে মাঝে জানলায় এসে বসছে, দু একবার করুন ভাবে ডেকে আবার ফিরে যাচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য। কি মনে করে একবার দেখি তো ভেবে উঠে গিয়ে একটু আড়াল থেকে দেখল কাল ঝড়ে ওদের বাসাটা ভেঙ্গে পড়ে গেছে। দুজনে মিলে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাখি দুটো অচেনা নয়, বাগানের বকুল গাছটায় কিছুদিন ধরে দেখছিল দুজনে মিলে বাসা বানাচ্ছে...মনটা খারাপ হয়ে গেল। কারুর ভাঙ্গে আর কারুর গড়ে ভাবতে ভাবতে মনে হল বাসাটা যদি ও তুলে দেয় তাহলে কি ওরা সেটাতে থাকতে চাইবে? মানুষের ছোঁয়া নাকি অনেক প্রানী পছন্দ করে না। ঠিক আছে, তুলে তো দি... দেখি না ওরা কি করে ভেবে আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করেছে দেখার জন্য ওরা কি করে এর পর। একটু পরেই দুটোতে কোথায় যেন চলে গেল দেখে নিচে গিয়ে পাঁচিলে উঠে বাসাটা গাছে তুলে দিয়ে ফিরে আসছিল। কি মনে করে উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে কয়েক মুহুর্তের জন্য চোখ আটকে গেল। সেই মিষ্টি মুখটা এক পলকের জন্য দেখা দিয়ে হারিয়ে গেছে। মৌ যে ওকে দেখছিল বুঝতে পেরে বুকের ভেতরে ছোট্ট একটা আলোড়নের সাথে সাথে ভালো লাগায় বুক ভরে উঠলে ফিরে আসার জন্য পা বাড়াল...
তারপর আরো একটা সপ্তাহ চলে গেছে…যেহেতু ও কথা দিয়েছিল তাই অনেক ভেবে দেখেছে কিন্তু কোনোভাবেই ওকে ছাড়া নিজেকে কিছুতেই ভাবতে পারছে না। সেদিনের পর থেকে মৌ আর ওর কাছাকাছি আসেনি…কিন্তু দুর থেকে ওর মিষ্টি মুখে এক চিলতে হাসি…কখোনো আড় চোখে ভ্রু তুলে তাকানো হয়তো বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে যে ওর কোনো ভয় নেই…ও বুঝে গেছে অরিত্রর মনের কথা…একটু একটু করে সেই আগের মতো ওর ভেতরে খুশী খুশি ভাবটা ফিরে এসেছে… যেটা কিনা ওর স্মৃতি ফিরে আসার পর থেকে ছিল না। আজ রবিবার…মৌ সেই আগের মতো ওর জন্য চা করে নিয়ে এসে ঘুম ভাঙ্গালো… চোখে মুখে খুব প্রিয়জনকে একান্তে পাওয়ার ছাপ… অরিত্র একটু দুরে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল ‘তোমার কিছু জানার ছিল আমার থেকে। মৌ সারা মুখে দুষ্টুমি ছড়িয়ে বলল… আমার মনে হয় জানি।
- কি জানো?
- আমি তো জানি… তুমি ব’লো।
এত সকালে দিদানরা উপরে আসে না … অরিত্র বিছানা থেকে নেমে ওর সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল ‘আর কতদিন আমাকে অপেক্ষা করতে হবে’? মৌ চায়ের কাপটা পাশের ট্রেতে রেখে বলল ‘কিসের জন্য’?
- তোমার জন্য…
- আমি তো তোমার কাছেই আছি…
- এইভাবে নয়…একেবারে নিজের করে…
- আমি কি জানি?
- কে জানবে?
- বারে…তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে…যা কিছু করার তো তোমাদেরকেই করতে হবে…তাই না…
আর কিছু বলার ছিল না…মনের ভেতরে একটা প্রশ্ন বারে বারে উঁকি দিচ্ছিল, জিজ্ঞেস করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে বলে ফেললো…মৌ…একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
- বলো…
- নাঃ…থাক…পরে কোনোদিন বলবো…
- বলো না…আমি কিছু মনে করবো না…
অরিত্র কিন্তু কিন্তু করেও বলে ফেলল… কেউ কি তোমাকে রাজী করিয়েছে…মৌ ওর প্রশ্নটা শুনে ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলল… কে আবার… তুমি। অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ভাবছিল… আমি তো এমন কিছু করিনি যাতে তোমাকে বোঝানো যায়…
- উমম… বিশ্বাস করতে পারছো না… তাই তো?
অরিত্র ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে আগের মতো হাসি মুখে বলল…থাক না…কিছু কথা না বলা…কিছু কথা না জানা…
- পরে বলবে?
- উমম…বলবো…
দুজনে মিলে কথা বলতে অরিত্রর হটাৎ মনে পড়ে গেল পাখি দুটোর কথা। ইস, একেবারে ভুলে গেছি ভেবে বলল... এই যাঃ। মৌ একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে?
- সেদিন দেখলে না...পাখীর বাসাটা তুলে দিয়ে এলাম...
- হুঁ দেখেছি...
- ওরা ফিরেছে কিনা আর দেখা হয়নি...
- ফিরেছে...আমি রোজ দেখি...
অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে একটু যেন অবাক হয়ে বলল... রোজ দেখো?
- হু...রোজ দেখি তো...তুমি ওদের কথা ভেবে বাসাটা তুলে দিয়ে এলে আর আমি দেখবো না?
অরিত্র ওর চোখে যেন কিছু খোঁজার চেস্টা করে বলল... চলো না, একবার দেখি। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বকুল গাছটার দিকে তাকিয়ে ছিল। পাখী দুটোকে দেখা যাচ্ছিল না, খাওয়ারের খোঁজে বেরিয়েছে হয়তো। অরিত্র গাছটার দিকে তাকিয়ে যেন নিজের মনেই বলল... প্রচুর ফুল হয় গাছটাতে... কি সুন্দর গন্ধে ভরে যায় চারদিক...জানো তো... মৌ আস্তে করে বলল... জানি... তুমি ছোটবেলায় দিদানের বাপের বাড়ী থেকে বায়না করে নিয়ে এসে লাগিয়েছিলে। কিছুটা বিরতি, কেউ কোনো কথা বলছে না, একজন হয়তো স্মৃতি রোমন্থন করছে, আর একজন নিজের কল্পনায় গল্পের ভেতরে শোনা কথা গুলোকে সাজানোর চেস্টা করছে। একটু পরেই মেয়ে পাখিটা কোত্থেকে উড়ে এসে জানলায় বসতে গিয়ে ওদেরকে দেখে ফিরে গিয়ে গাছের ডালে বসে ঘাড় কাত করে এদিক ওদিক দেখছে...একটু পরেই ওর সঙ্গী ফিরে এসে পাশে বসলে মেয়েটি ঘাড় কাত করে তাকালো। দুজন দুজনের গায়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে ভালোবাসা জানাচ্ছে। দুজনে এক দৃষ্টে পাখী দুটোর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওদের মনের ভেতরেও হয়তো ইচ্ছে করছিল আরো কাছাকাছি আসতে কিন্তু এতদিনের ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কটা এই সবে জুড়তে শুরু করেছে, কেউই পারলো না নিজের থেকে এগোতে। মৌ আস্তে করে বলল... জানো তো...ওরা মনে হয় জানে তুমি ওদের বাসাটা তুলে দিয়েছিলে। অরিত্র ওর মতোই মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল... কি করে বুঝলে? রোজ এই জানলায় এসে বসে থাকে...বোধ হয় তোমাকে খোঁজে, কিছু বলতে চায়। মৌ এর কথাটা শুনে ওর দিকে তাকালো, কিছু যেন ও বলতে চাইছে ভেবে জিজ্ঞেস করল...কিছু বলবে? মুখটা নিচু করে ও আস্তে করে বলল... আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি... তাই না? প্রশ্নটার উত্তর হ্যাঁ বা না কোনোটাই দেওয়া যায় না, অরিত্র একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...থাক না... পুরোনো কথা। মৌ অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে আর কখোনো কষ্ট দেবো না...বিশ্বাস কর। এতক্ষনের জড়তা যেন এই একটা কথাতে কেটে গেল... অরিত্র আর কিছু না ভেবে ওকে কাছে টেনে নিলে মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল... অরিত্র মুখে কিছু না বললেও ও ভালো করেই জানে উত্তরটা কি। মৌ নিজেকে ওর বুকে নিশ্চিন্তে মিশিয়ে দিতে দিতে ভাবছিল... ওই পাখী দুটোর মতোই আমিও তোমার কাছে ফিরে পেয়েছি আমার আশ্রয়...আমার যে আর কিছু চাওয়ার নেই তোমার কাছে...
বহুদিন পর, আজ বাড়ীতে থাকতে ইচ্ছে করলেও সকালে মৌ ওর কাছে আসার পর থেকে কিছুতেই যেন দাদুদের সামনে যেতে পারছে না অরিত্র। স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারছে না। ভয় হচ্ছে এই বুঝি ওর দিকে তাকালেই মনের কথা গুলো সবাই জেনে যাবে। গত রবিবার থেকেই ও জানতো কি হবে কিন্তু অফিস যাওয়ার অছিলায় নিজেকে আড়াল করে রাখতে অসুবিধা হয়নি। ইচ্ছে করেই দেরী করে ফিরতো রাতে যাতে দাদুদের মুখোমুখি কম হতে হয়। ক্লাবেও যায়নি দেখে শুভ একবার ফোন করেছিল, ওকে ‘কাজ আছে রে, সন্ধের দিকে যাবো’ বলেছে। এদিকে বাড়ী থেকে বেরোতে ইচ্ছে করছে না আবার নীচেও যেতে পারছে না, ওখানে মৌ একা নেই। একা একা বসে থাকতেও ভালো লাগছে না... মাঝে একবার শুক্লাদি এসে চা না কফি কি একটা দিয়ে গিয়েছিল...শুক্লাদির হাত থেকে কাপটা নেওয়ার সময় মনে হচ্ছিল মৌ তো নিয়ে আসতে পারতো আর তাই ভেবে এত অভিমান হয়েছে যে ইচ্ছে করছিল ওটা ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। শুক্লাদি ওর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলেনি, চুপচাপ ফিরে গেছে। অরিত্র ঘরের ভেতরে পায়চারি করতে করতে নিজেকে বোঝাবার চেস্টা করেছে...এতদিন মৌ দূরে ছিল... কষ্ট হলেও নিজেকে সামলে রাখতে পেরেছি কিন্তু আজ কেন এত অভিমান হচ্ছে! নিজের উপরেই নিজের রাগ হয়েছে...আমি তো এমন ছিলাম না...সব কিছু বুঝে চলার চেস্টা করি...তাহলে আজ কেন বুঝতে চাইছি না যে ওর আমার কাছে ঘন ঘন আসার অসুবিধা আছে? ওর-ও তো আমার মতোই অবস্থা হবার কথা..দাদুদেরকে না জানানো পর্যন্ত আমরা দুজনেই তো আগের মতো মিশতে পারবো না...তাই না? নিজেই নিজেকে বুঝিয়ে কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও অভিমান ভুলে গিয়ে আবার একবার মনে মনে মৌকে বলল...কিছু মনে কোরো না প্লিজ। আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, নিজের মনেই ওর সাথে কথা বলে যেতে যেতে মনে হল ফোনটা ভাইব্রেট করছে। ধুস থাক দেখবো না ভেবেও কি মনে করে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো বোন মেসেজ পাঠিয়েছে। কি লিখেছে দেখি ভেবে খুলে দেখে হাসি পেয়ে গেল...রুপসা লিখেছে...দাদাভাই প্লিজ একবার আমাকে একবার ফোন করবি? তোকে ফোন করতে পারছি না রে। কেন বলতো? জানিস তো আজ সকালে তুই ফোন করছিস না দেখে রাগ করে মায়ের সামনে বলে দিয়েছি তুই ফোন না করলে আমিও নিজের থেকে ফোন করবো না। মা শুনে আমাকে কি বলেছে জানিস? আমি নাকি পাগল আর যাই বলি না কেন নিজেই আবার তোকে ফোন করবো। আচ্ছা দাদাভাই তুই বল... তোকে না হয় একটু বেশীই ভালোবাসি, তাই বলে কি আমি পাগল? খুব ইচ্ছে করছে কি হল জানতে কিন্তু কি করে নিজের থেকে ফোন করি? মা বুঝতে পারলে এবারে হয়তো ছাগল বানিয়ে দেবে আমাকে। প্লিজ দাদাভাই...এখুনি একবার ফোন কর না... মেসেজটা পড়ে নিজের মনেই হাসতে হাসতে রুপসাকে ডায়াল করতেই ও সাথে সাথে রিসিভ করেই জিজ্ঞেস করল...এই, দাদাভাই...হ্যাঁ বলেছিস তো? সেই কোন সকাল থেকে বসে আছি কি হল জানার জন্য। তুই কি রে? এই দাদাভাই, চুপ করে আছিস কেন? ব-ল-না...প্লি-জ। আচ্ছা, তুই কি আমাকে কিছু বলতে দিচ্ছিস? নিজেই তো বকে যাচ্ছিস বলাতে রুপসা নীচু গলায় বলল...হু...বল। অরিত্র ছোট করে ওকে কি কথা হয়েছে বলতেই মনে হল একপাক নেচে নিল খুশীতে। এই দাদাভাই একটু ধর, মাকে বলি...শোন না দিদিভাইকে তো বলিসনি মনে হচ্ছে...দাঁড়া আমি ওকে লাইনে নিচ্ছি এখুনি। কিছুক্ষন চুপচাপ, রুপসা ওদিকে দিদিকে ডায়াল করছে। অরিত্র চুপ করে অপেক্ষা করতে করতে ভাবছিল...সত্যিই পাগল মেয়েটা। মাকে জানাবে আবার সাথে সাথে দিদিভাইকেও বলবে...কোনটা যে আগে করবে কে জানে। প্রায় মিনিট কুড়ি ওদের সাথে কথা বলতে হয়েছে, দুবোনেই মৌকে চেয়েছিল কথা বলার জন্য কিন্তু দাদুদেরকে জানানো হয়নি, তাই এখন মৌকে ওদের সাথে কথা বলার জন্য ডাকতে গেলে দাদুরা অন্যকিছু না ভেবে বসে বলাতে ওরা বলেছে আচ্ছা ঠিক আছে, এতদিন অপেক্ষা করেছি, আর না হয় একটা দুটো দিন অপেক্ষা করবো।
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
এগারোটা মতো বাজে, ভালোই রোদ উঠেছে...কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে মনে হয়েছে অনেকদিন ছাদের গাছ গুলোর যত্ন আত্তি কিছুই করা হয়নি। দাদু মাঝে মাঝে লোক ডেকে করায় শুনেছে কিন্তু তারা কি আর নিজের মতো করে করবে’ ভেবে ওটাই মাথায় ঢুকিয়ে নিয়ে ওই রোদের মাঝেই মাথায় একটা টুপি পরে ছাদে চলে গেছে। বেশ কিছুক্ষন একা একা থাকায় আবার মনটা খারাপ লাগছিল। প্রায় ঘন্টা খানেক গাছের গোড়া পরিস্কার, মাটি খোঁড়া ইত্যাদি করে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা হয়ে গেলেও ‘কিছুতেই নিচে যাবো না’ ভেবে এক ভাবে কাজ করে যাচ্ছিল ও। পাশের বাড়ীর জেঠিমার ডাকে মুখ তুলে তাকালো...কি রে দুষ্টু...এই রোদে কি করছিস? এত সময় পরে কথা বলার মতো কাউকে পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কোমর সোজা করতে করতে বলল... অনেকদিন গাছগুলোকে দেখতে পারিনি গো জেঠিমা। তাই ভাবলাম, আজ সময় আছে যখন সেরেই ফেলি। জেঠিমা ওর কথা শুনে একটু বকুনি দিয়ে বলল...কি জানি বাবা, এই আজকালকার ছেলে পুলেদের বোঝা দায়। তোর দিদান বোধ হয় জানে না তাই না রে? জেঠিমা কথাটা জিজ্ঞেস করলেও ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল... জানলে কি আর তোকে আসতে দিতো! অরিত্র জেঠীমার দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে ইশারা করে আস্তে কথা বলতে বলল ও যাতে দিদান নীচ থেকে শুনতে না পায়। ও খুব ভালো করে জানে জেঠীমার বলা কথাটা কতটা সত্যি।
জেঠিমার সাথে কিছুক্ষন বকবক করে আবার নিজের কাজে মন দিয়েছে জেঠিমা চলে যাবার পর। আবার সেই জেদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে...না, কিছুতেই যাবো না নীচে। ও কেন আসছে না একবার? এতক্ষনে তো স্নান করে ছাদে জামাকাপড় শুকোতে দিতে আসার সময় হয়ে গেছে নাকি তাও হয়নি? এই যে আজ সকালে বললে আমাকে আর কষ্ট দেবে না? ভুলে গেলে এর ভেতরেই? তোমরা মেয়েরা সত্যিই কি নিষ্ঠুর...কেন বোঝো না আমি একবারের জন্য হলেও দেখতে চাইছি তোমাকে? আর কিছু কি চেয়েছি? নিজেই প্রশ্ন করছে কাজ করতে করতে আবার নিজেই উত্তর দিচ্ছে... না না...ও তো এমন নয়...মাঝে যা হবার হয়ে গেছে...তাতে ওর তো কিছু করার ছিল না। কি মনে করে মুখ তুলে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা যেন ভরে গেল খুশিতে। হৃদপিন্ড যেন লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে, যাকে একবার দেখার জন্য এত সময় মনে মনে নিজের সাথে নিজে কথা বলছিল সে এসেছে... দেখে বোঝা যাচ্ছে এই মাত্র চুল ভিজিয়ে স্নান করে এলো, লাল টুকটুকে সালোয়ারের সাথে দুধ সাদা কুর্তি, ভালো করে গা না মুছে পরার জন্য এখানে ওখানে ভিজে আছে। জামাকাপড় মেলা হয়ে গেছে দেখে মনে হচ্ছে একটু আগেই হয়তো এসেছে। নিজেকে রোদের হাত থেকে বাঁচাতে দিদানের মেলে রাখা শাড়ীর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে ও। হালকা আকাশী নীল সুতির শাড়ির নীলাভ ছায়া ওর সদ্যস্নাত শরীরে...ঠিক যেন ছায়া নয় তা বরং যেন একটা হালকা রং এর ছটা ওর উজ্জল মসৃন ত্বকে পিছলে যেতে গিয়েও যেন আটকে থাকতে চেয়ে ওকে করে তুলেছে আরো মোহময়ী, ঠিক যেন হাল্কা নীলাভ রুপসী সমুদ্রকন্যা। ওর চোখে মুখে বকুনি দেবার ইচ্ছে, ভালোবাসা মাখানো শাষনের সুরে বলল... এই রোদের ভেতরে আর তোমাকে কাজ করতে হবে না...চলো। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই তো হয়ে এসেছে...তুমি যাও, আমি আসছি। মৌ আগের মতো অনুচ্চ কিন্তু দৃঢ স্বরে বলল... না, তুমি আগে চলো...না হলে আমি যাবো না। আচ্ছা, তুমি শেডের নীচে দাঁড়াও...আমি আসছি’ বলাতে ও নরম গলায় জিজ্ঞেস করল ঠিক তো? অরিত্র ঘাড় কাত করে বাধ্য ছেলের মতো হ্যাঁ বলাতে ও ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে অরিত্র এক দৃষ্টে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল... ভেজা চুলে একটা তোয়ালে জড়ানো,তোয়ালের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকা অবাধ্য চুলের শেষ প্রান্তে তখোনো কয়েক ফোঁটা জলের বিন্দু রোদের ভেতরে যেন হীরের টুকরোর মতো ঝলসে উঠছে...পড়ে যেতে যেতে যেন আটকে গিয়ে বলতে চাইছে...না, কিছুতেই আমরা যাবো না তোমাকে ছেড়ে। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে ভুলে গিয়েছিল ওকে কথা দিয়েছে এখুনি যাচ্ছে। মৌ যেতে গিয়েও একবার ফিরে তাকালো...তখোনো ও ওঠেনি, ওর দিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে আছে দেখে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র অপ্রস্তুতের হাসিতে মুখ ভরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। কাজের জিনিষপত্র গুলো এক এক করে তুলে নিয়ে জায়গায় রেখে দিয়ে ও ফিরে আসছিল। মৌ সিঁড়ির দরজার ঠিক পরেই দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওর অপেক্ষায়। অরিত্র সামনে এলে নিচু গলায় ওকে দাঁড়াতে বলে কাছে এগিয়ে এসে চুলে জড়ানো তোয়ালেটা খুলে নিয়ে ওর মুখের ঘাম আস্তে আস্তে মুছে দিতে দিতে বলল...খুব অভিমান...না? অরিত্র কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের মনেই যেন বলল... কি করবো... শুক্লাদি একা একা রান্না করছে দেখে যেতে হয়েছিল। অরিত্র এবারেও কিছু না বলে চুপ করে থেকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে নিজের কাজ করে যেতে যেতে বলল...আমি কি একা একা কথা বলে যাবো? অরিত্র অভিমানের স্বরে বলল... তাই বলে কি একবারের জন্যও আসা যেতো না? মৌ মুখ তুলে ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের কাজ করে যেতে বলল... তাই বলে তুমি আমার উপরে অভিমান করে নিজেকে এইভাবে শাস্তি দেবে? অরিত্র কলেজের বাচ্চাদের মতো করে ‘বেশ করবো, তুমি না এলে আবার করবো’ বলাতে মৌ একবার সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে ওর একেবারে কাছে সরে এসে আগের মতোই নিচু স্বরে বলল... আমারও তো ইচ্ছে করছিল তোমার কাছে আসতে! হঠাৎ করে অবুঝ হয়ে যাওয়া ছেলেটা যেন এই কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল, ওর আসার ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারেনি বুঝে আস্তে করে বলল... জানি। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ওর মুখে ক্ষনে ক্ষনে রং এর পরিবর্তন দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করল...এখোনো অভিমান করে আছো? অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... অভিমান করে তো থাকতে পারি না। ও যে অভিমান করে থাকতে পারবেই না সেটা জানা ছিল কিন্তু সেটা ওর নিজের মুখে বলাতে যেন আরো ভালো লাগলো শুনতে আর তাই শুনে মৌ হাসি মুখে বলল... তাহলে একটু হাসো...ইস কি বিচ্ছিরি লাগছে দেখতে। অরিত্র ওর কথা বলার ধরনে না হেসে থাকতে না পেরে বলল...তোমার জন্যই তো...সব দোষ তোমার। মৌ আগের মতোই হাসি মুখে বলল... আচ্ছা বাবা...সব দোষ আমার...এই দেখো কান ধরলাম...এবারে ঠিক আছে? অরিত্র ওর হাতটা ধরে বলল... থাক... আমি কি কান ধরতে বলেছি? ওদিক থেকে মনে হল...দিদান মৌ কোথায় গেলি বলে ডাকলে মৌ ‘আ-স-ছি দি-দা-ন...বলে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল...আজ কিন্তু একসাথে খাবো...দেরী করবে না...কেমন। মান অভিমানের পালা শেষ... একজন বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় কাত করে বলেছে আচ্ছা... দেরী হয়ে গেছে ভেবে বা বিশেষ কারুর অভিমান ভাঙ্গাতে পারার খুশীতে একজন ত্রস্ত হরিনীর মতো তর তর করে সিঁড়ি ভেঙ্গে নেমে যাচ্ছে, আর একজন খুশী মনে ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ভাবছিল ও চলে যাক, তারপর আমি যাবো... সিঁড়ির বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবার আগের মুহুর্তে এক পলকের জন্য থমকে গিয়ে ফিরে তাকিয়ে একজন ছড়িয়ে দিয়ে গেছে মুক্তো ঝরানো মিষ্টি হাসি... কয়েকটা মুহুর্ত থমকে গিয়ে সেই মুক্তো কূড়োতে কুড়োতে একটা একটা করে সিঁড়ির ধাপ পেরোতে শুরু করেছে আর একজন...
রবিবার সবাই এক সাথে গল্প করতে করতে খাওয়ার চল ছিল কিন্তু বেশ কিছুদিন আগে থেকেই সেটা বন্ধ। মন মেজাজ ভালো না থাকলে যা হয়। মৌ না হয় নিজের থেকে বলেছিল আজ এক সাথে খাবে কিন্তু খেতে বসতে গিয়ে আজ দাদু কেন হঠাৎ মৌ কোথায় খোঁজ করল বোঝা গেল না। অরিত্র চুপচাপ চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে গিয়ে ভাবছিল তাহলে কি দাদু কিছু বুঝতে পেরেছে? মৌ আগের মতো ওকে এড়িয়ে যাচ্ছে না সেটা সবাই জানে কিন্তু ওদের ভেতরে যে কিছু কথা হয়েছে সেটা তো কেউ জানে না। মৌ নিজেই দাদুদেরকে কিছু বলে দিয়েছে কি? কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে যাওয়াতে শুক্লাদি কি একটা বললো দাদুকে কিন্তু খেয়াল করতে পারলো না। তারপরেই মনে হল...দাদুরা নিজের থেকে বুঝলে তো ভালোই, আমাকে আর নিজের থেকে জানাবার কথা ভাবতে হবে না। ওকে অন্যমনস্ক দেখে দাদু জিজ্ঞেস করল...কি রে কি হয়েছে? অরিত্র মুখ তুলে দাদূর দিকে তাকাতে গিয়ে দিদানের সাথে মৌকে দেখে একটু থমকে গিয়ে বলল... কই কিছু না তো। তারপরেই শুক্লাদির দিকে তাকিয়ে বলল... আজ কি কি স্পেশাল রান্না করলে গো? আজ বহুদিন পর ওকে কি রান্না হয়েছে জিজ্ঞেস করতে দেখে শুক্লাদি হাসি মুখে বলল... আজ তোর দাদুর পছন্দের তেল কই আর তোর পছন্দের মাংশ। অরিত্র ‘বাঃ খুব ভালো’ বলাতে দিদান ওদিক থেকে বলল... আজ কিন্তু মৌ মাংশ রান্না করেছে। দিদানের কথা শুনে কিছু না বলে মৌ এর দিকে মুখ তুলে তাকালে ও লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল... ও দিদান তোমাকে যে বলতে বারন করেছিলাম। দাদু হেসে ফেলে বলল... আরে কি হয়েছে বললে...আয়, আজ আমরা সবাই একসাথে খাবো। কতদিন একসাথে খাই না বলতো। অরিত্র দাদুর কথা শুনে বুঝলো আর যাই হোক না কেন মৌ নিজের থেকে কিছু জানায় নি...যাকগে, ও নিজেই না হয় বলবে...আজ না হয় কাল তো বলতেই হোতো...
আজ দুপুরে খাওয়ার সময়ে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে যেটার জন্য অরিত্র মানসিক ভাবে তৈরী ছিল না। সেই আগের মতো সবাই গল্প করতে করতে খাচ্ছিল। অনেকদিন পর সবাই যেন কিছুটা হলেও মন খুলে কথা বলতে পেরে ভীষন খুশী। অরিত্র মনে মনে খুশী হলেও কম কথা বলার চেষ্টা করছিল। বেশীর ভাগ সময়ে মুখ নীচু করে খেয়ে যেতে যেতে যেন বোঝাবার চেষ্টা করছিল... ওর কথা বলার থেকে খাওয়াতেই বেশী মন রয়েছে কিন্তু আসল কারনটা যে অন্য জায়গায় তা ও ছাড়া আর কেউ জানে না। এক পলকের জন্য মৌকে দেখে ও থমকে গিয়েছিল, এখন যেন আবার নতুন করে ওকে ভালো লেগে গেল, সামান্য একটা ছোট্ট সাদা টিপ কপালের মাঝে আর চোখে হালকা কাজলের ছোঁয়া যেন ওর মুখটাকে অসামান্য করে তুলেছে। যতই ওকে ফিরে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করুক না কেন সবার সামনে তা সম্ভব নয় বুঝে মুখ নীচু করে খেতে খেতে ওর কথাই ভাবছিল। পায়ের পাতায় আলতো ভাবে নরম কিছুর ছোঁয়া পেয়ে প্রায় চমকে উঠে পা সরিয়ে নিয়ে ভাবছিল কি হতে পারে...মুখ তুলে মৌ এর তাকিয়ে দেখলো দিদান ওকে আরো কিছু দিতে চাইছে আর ও ‘আর না দিদান, সত্যিই পারবো না’... বলে আটকাবার চেষ্টা করছে। মৌ কি ওর পায়ের উপরে পা রেখেছিল ভেবেও মনে হল...না মনে হয়...হয়তো আমার ভুল হয়েছে...ওর কথা ভাবছি বলেই হয়তো ও আমাকে ছুঁয়েছে ভেবেছি মনে করে ব্যাপারটা মাথা থেকে বের করে দিয়ে খাওয়ায় মন দিল... রান্না সত্যিই খুব ভালো হয়েছে...অনেক দিন পর তৃপ্তি করে খেতে খেতে ভাবছিল শুধু রান্না নয়, হতে পারে মন ভালো আছে বলে সবকিছুই ভালো লাগছে বা মৌ নিজের হাতে রান্না করেছে আর তাই এত ভালো লাগছে। আবার পায়ের উপরে সেই আলতো নরম স্পর্শ... মুখ নীচু করে থেকেই আড় চোখে মৌ এর দিকে তাকিয়ে দেখলো ও দিদানের দিকে তাকিয়ে বলছে...দিদান আর একটা মাছ নাও না...খুব ভালো হয়েছে খেতে। এদিকে পায়ের উপরে স্পর্শটা আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে... না, আর কোনো সন্দেহ নেই, কি হচ্ছে সবার চোখের আড়ালে তা আর বুঝতে বাকি নেই। সবার মাঝখানে বসেও ওর ছোঁয়া পেয়ে ভীষন ভালো লাগার সাথে সাথে ভয় করছিল যদি কেউ বুঝে যায়...কিন্তু কিছু করার নেই...মৌ ওর দিকে তাকাচ্ছেই না যে ওকে সবার চোখ এড়িয়ে ইশারা করে বারন করবে। ওকে বারন করার কথা ভাবলেও নিজের পা সরিয়ে নিতেও ইচ্ছে করছে না। এত ভালো লাগছিল যে খাওয়ার কথা ভুলে চুপ করে বসেছিল বুঝতেই পারেনি...দিদানের ডাকে যেন বুঝতে পারলো ওকে খাওয়া শেষ করতে হবে।
শুয়ে শুয়ে কথা গুলো ভাবতে ভাবতে কখন গভীর ঘমের ভেতরে তলিয়ে গেছে নিজেই জানে না। বেশ লম্বা ঘুমের পর কোনোরকমে চোখ মেলে তাকিয়ে বুঝতে পারছিল না কটা বাজে...ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়েও কিছু বুঝতে পারলো না... এতো ঘুমিয়েছে যে চোখ এখোনো ঝাপসা হয়ে আছে। দক্ষিনের ঝির ঝিরে হাওয়ায় ঠান্ডার আমেজ পেয়ে বুঝলো বিকেল হয়ে গেছে। উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কোল বালিশটাকে ভালো করে জড়িয়ে ধরে এপাশ ওপাশ করতে করতে ভাবছিল ...কই, মৌ তো এলো না চা নিয়ে। কি আবার হলো ভাবতে ভাবতে জানলার বাইরের দিকে তাকালো। মাধবীলতার গাছটা ফুলে ফুলে ভরে আছে। বুক ভরে মিষ্টি গন্ধ নিতে নিতে নিজের মনেই বলে ফেলল...আঃ...কি মিষ্টি। আপন মনে কথা গুলো বললেও কেউ যে এসে শুনে ফেলেছে খেয়াল করেনি। কারুর আস্তে করে মিষ্টি গলায়... কি মিষ্টি? শুনে ফিরে তাকালো... মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বিছানার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দুপুরে ওকে মন ভরে দেখতে না পাওয়ার দুঃখ ভুলে গিয়ে দুচোখ ভরে দেখতে গিয়ে ভুলেই গেছে ও কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সেই একই মেয়ে যাকে এক এক সময়ে দেখলে এক এক রকমের মনে হয়, সেই একই টিপ কপালে, শুধু কাজলের রেখা যেন সামান্য একটু ছড়িয়ে পড়েছে চোখের পাতায়, যদিও তাতে ওর সৌন্দর্য বিন্দুমাত্র কমেনি বরং নতুন এক মাত্রা পেয়েছে । কালো হরিন চোখ দুটোকে করে তুলেছে আরো নিস্পাপ। মৌ ওকে চোখের পলক না ফেলে দেখে যেতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করল, কই বললে না তো কি মিষ্টি? অরিত্র একই ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উত্তর দিল ‘কে আবার...তুমি। মৌ মুখটা গোমড়া করে বলল... ইস...মিথ্যুক কোথাকার। এই না...মিথ্যে কেন হবে বলাতে মৌ হেসে ফেলে বলল...মিথ্যেই তো...তুমি তো ওদিকে তাকিয়ে ছিলে। তুমি কি জানতে নাকি আমি এসেছি? অরিত্র হেসে ফেলে বলল... বোসো...সেই কখন থেকে ভাবছি...তুমি আসছো না। মৌ ওর দিকে মুখ করে বসতে বসতে বলল...এসেছিলাম তো, তুমি ঘুমোচ্ছো দেখে আর ডাকিনি। ‘ইস, খুব মিস করেছি তাহলে বলো’ বলে ওর দিকে তাকালে মৌ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... এই, বলোনা...কি মিষ্টি? অরিত্র আর কিছু না বলে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে একগোছা মাধবীলতার ফুল তুলে নিয়ে এসে বলল...শুঁকে দেখ...কি মিষ্টি গন্ধ...আমার তো ভীষন ভালো লাগে... মৌ ওর হাত থেকে ফুলের গোছাটা নিয়ে চোখ বুজে বুক ভরে গন্ধ নিয়ে জিজ্ঞেস করল... এবারে বলো...কে বেশী মিষ্টি। অরিত্র ওর দিকে কিছুক্ষন চুপ করে তাকিয়ে থেকে বলল... বলবো না...সে আছে একজন। মৌ একই ভাবে ফুলের গন্ধ নিতে নিতে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল...তাই? ‘হু...তাই তো’ বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে মৌ ওর চোখের ভাষায় বুঝে গেলো কি বলতে চাইছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে দিয়েছে হাতে ধরা ফুলের গোছা...আর একজন সেই ফুলের গোছা নিয়ে হাত বাড়ালে কাছে সরে এসেছে অপরজন, মুখ নিচু করে থেকে ওকে দিয়েছে ফুলের গোছা চুলে গুঁজে দিতে। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে থেকে একজনের চোখের মুগ্ধতার ভেতর দিয়ে বুঝেছে কত সুন্দর লাগছে ওকে...
আরো কিছুক্ষন দুজনে মিলে সেই আগের মতো বকবক করে গেলো...ঠিক কি নিয়ে কেউই জানে না...মৌ হঠাৎ ইস...ভুলেই গেছিলাম তোমাকে ডাকতে এসেছি...এই চলো না... বলতে অরিত্র অবাক হয়ে গিয়ে জিজ্জেস করল... কোথায়?
- বা-রে… দাদুদেরকে জানাতে হবে না?
- এখনই?
- হুঁ…এখনই…
- পরে হলে হবে না?
- কেন…এখোনো বিশ্বাস হচ্ছে না?
- না তা নয়…
- তবে?
অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল… আজই না বললে হোতো না?
- উঁ… হুঁ…কেন? লজ্জা করছে?
- নাঃ…ঠিক তা নয়… ভাবছি ঠিক কি ভাবে শুরু করবো…
- এই, আমার ঘরে চলো না…
- কেন?
- তোমার মায়ের ফটো আছে না…আগে মাকে বলো, তারপর দাদুদেরকে বলবে…কেমন…
ঠিকই বলেছে মৌ, মা ছাড়া আর কে আছে সবথেকে কাছের’ ভেবে ওর সাথে এসেছে পাশের ঘরে। মায়ের ফটোর সামনে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল…কতবার দেখেছে কিন্তু আজ যেন মনে হচ্ছে মায়ের সুন্দর মুখটা আরো বেশী খুশীতে ভরে গেছে… মৌ একটু দুরে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছিল…ওর চোখে জল দেখে কাছে এসে হাত ধরে ফিসফিস করে বলল… কই…বলো। অরিত্র মায়ের ফটো বুকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে মনে মনে বলল… আর্শীবাদ করো মা… ওকে যেন আমি সারা জীবন খুশী রাখতে পারি।
অরিত্র ঠিকই ভেবেছিল, কয়েকদিন ধরে মৌ-এর আচার ব্যাবহারে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা দাদুদের চোখ এড়ায়নি স্বাভাবিক ভাবেই। অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও ওর মুখেও যে সেই যন্ত্রনার ছাপ নেই সেটাও না বোঝার কথা নয়। ওদের দুজনকে একসাথে আসতে দেখে দাদু একটু গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল…কি ব্যাপার… আবার কিছু সমস্যা? অরিত্র দাদু আর দিদানের মাঝে বসে পড়ে বলল… না...না …সমস্যা আবার কি হবে…
- তাহলে?
- না … মানে…তোমাদেরকে কিছু বলার ছিল…
- বুঝেছি…
অরিত্র একবার দাদু আর একবার দিদানের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল কি বুঝেছে। দিদান ওকে ওইভাবে তাকাতে দেখে কাছে টেনে নিয়ে বলল...তোকে সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কোলে পিঠে করে মানুষ করেছি আর তোকে দেখে বুঝবো না রে বোকা? অরিত্র দিদানকে জড়িয়ে ধরে থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকে ভাবছিল ‘বাঁচলাম, নিজের মুখে এসব কথা বলা যে কতটা ঝামেলার তা যেন হাড়ে হাড়ে আজ টের পাচ্ছি। দিদান ওকে চুপ করে থাকতে দেখে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু দাদু কিছু বলতে চাইছে দেখে থেমে গিয়ে বলল...আচ্ছা, তুমি আগে বলে নাও। দাদু এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে দেখতে না পেয়ে বলল...আগে আমার ওই মেয়েটার সাথে কথা বলতে হবে…এই মেয়ে কোথায় গেলি আবার… সামনে আয়। মৌ সোফার পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুক্লাদি ওকে হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বসিয়ে দিলে মুখ কাঁচুমাচু করে মিনমিন করে বলল…আমি আবার কি করলাম দাদু? দাদু আগের মতোই গম্ভীর গলায় বলল… আমি আবার কি করলাম? পরের জিনিষ না বলে নেওয়াকে কি বলে শুনি? মৌ শুক্লাদির গা ঘেঁষে বসে থেকে আস্তে করে বলল…আমি কেন চুরি করতে যাবো দাদু… আমি তো শুধু তোমাদেরকে কে দেখাশোনা করবে জিজ্ঞেস করেছিলাম…
- হুম… বুঝেছি…তুই জিজ্ঞেস করলি কে আমাদেরকে দেখাশোনা করবে আর তার উত্তরে বুদ্ধুটা তোর চুলে ফুল গুঁজে দিল…বাঃ…
মৌ দাদুর কথা শুনে লজ্জায় জিব কেটে কি করবে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না, মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে যেন বলতে চাইলো...দেখলে তো কি বিচ্ছিরি ব্যাপার হয়ে গেল। একবার তো মনে করিয়ে দিতে পারতে... অরিত্রর ওর চোখে চোখ রেখে যেন বোঝাতে চাইলো...খেয়াল না থাকলে কি করবো আমি। ওদের দুজনের অবস্থা দেখে দাদু হেসে ফেলে বলল...থাক আর লজ্জা পেতে হবে না, বেশ তো লাগছে দেখতে। দাদু তারপরেই দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল...কি গো বলোনা...কি মিষ্টি লাগছে না আমাদের মেয়েটাকে? ঠিক তোমাকে যেমন দেখতে লাগতো...মনে আছে? এবারে দিদানের লজ্জা পাওয়ার পালা, দাদুকে বকুনি দিয়ে বলল...বুড়ো হয়ে গেলে তবু ছেলেমানুষী গেল না। দাদু হাসতে হাসতে বলল...নাতির কাছে আবার লজ্জা পাওয়ার কি আছে? তারপরেই মুখটা আগের মতো গম্ভীর করে বলল... এই শোন, তোরা দুটোতে মিলে খুব জ্বালিয়েছিস আমাদেরকে… আর যেন এদিক ওদিক না দেখি…বুঝলি? আর যদি কথা না শুনিস তো বিয়ে দিয়ে দুটোকেই ঘর থেকে বের করে দেব… দেখবো কি করিস। দাদুর কথা শুনে দিদান হেসে ফেলে বলল… ঘর থেকে বের করে দিলে তো যেদিকে পারবে চলে যাবে…ওদের আর কি…যত চিন্তা তো আমাদের। ওদিকে মৌ শুক্লাদিকে জড়িয়ে ধরে লজ্জা মাখানো আদুরে গলায় বলল...ও শুক্লাদি দেখোনা...দাদু কেমন বকে দিল আর দিদানও কিসব বলছে। শুক্লাদি ওকে আদর করতে করতে বলল...বকবে না তো কি... কম চিন্তায় ফেলেছিলি নাকি?
শুধু বাড়ীর মানুষ গুলোই যেন নয়, সাথে সাথে সারা বাড়ীটাও যেন খুশী ধরে রাখতে পারছে না। বাগানের ভুঁইচাপা ফুল গুলো যেন এতদিন অপেক্ষা করছিল যার হাত ধরে এই বাড়ীতে এসেছিল তার জীবনে বসন্ত ফিরে আসার জন্য, তার জীবনে ভালোবাসা ফিরে এসেছে আর তাই তাদের ফুটতে সময় লাগেনি একটুও...সবুজ ঘাসের কার্পেটের মাঝে মাটি ছুঁয়ে থাকা বেগুনী ফুল গুলো যেন এক একটা একটা ছবি। শুধু কি ভুঁইচাপা... সাথে সাথে লাল টুকটুকে গ্লোব-ও তাদের সৌন্দর্য যেন কোথায় রাখবে বুঝতে পারছে ন... একে অপরকে ছুঁয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইছে কতো ভালোবাসি তোমায়। একটা করে দিন আসছে আর কিভাবে চলে যাচ্ছে যেন বোঝাই যাচ্ছে না। সকালে অফিস বেরোবার সময় খুব তাড়াহুড়ো থাকে বলে অরিত্রর হালকা কিছু খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার অভ্যাসটা অনেক দিনের। আগে যেটা হোতো ও বেরোবার জন্য তৈরী হতে শুরু করলে প্রায় দিনই দিদান বা শুক্লাদি কেউ না কেউ ওকে খাইয়ে দিতো, না হলে হয়তো প্রায় কিছু মুখে না দিয়েই চলে যাবে দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে। মৌ আসার পরেও একই ভাবে চলে আসছিল ব্যাপারটা, দিদান বা শুক্লাদির ওকে আদর করে খাইয়ে দেওয়াটা ও খুব ইচ্ছে করলেও কোনোদিনই চায়নি নিজের হাতে নিতে, হয়তো দিদা নাতির সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে বুঝেছিল ওর ওই অধিকারটা ছিনিয়ে নেওয়া ঠিক হবে না। এসবই ইতিহাসের পাতায় চলে গিয়েছিল প্রায়, বেশ কিছুদিন ধরে প্রায় কিছু না খেয়ে বেরিয়ে যাওয়াটা নিত্য নৈমিত্যিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অরিত্রর সাথে সাথে নিজেদেরও মানসিক অবস্থা ভালো না থাকায় দিদানরাও খুব একটা জোর করতো পারতো না। এই মুহুর্তে সব কিছু আগের মতো বা তার থেকেও বেশী কিছু হয়ে যাওয়ায় অরিত্র নিজের থেকে কিছু না বললেও দিদান নিজের থেকেই ওকে না খেয়ে বেরোতে দিতে চাইছিল না। প্রথম দিন নিজের হাতে খাইয়ে দিতে গেলে অরিত্র সার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে কয়েক মুহুর্তের জন্য থমকে গিয়ে দিদানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসি মুখে মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলেছে... উমম দিদান...দাও...কতোদিন তোমার হাতে খাইনি বলোতো। দিদান ওকে খাইয়ে দিয়ে ... তুইও তো খেতে চাইতিস না বললে ও দিদানকে জড়িয়ে ধরে বলল...তুমিও তো আগের মতো জোর করতে না...তাই না। দিদান হেসে ফেলে বলল...আমাকে আর জোর করতে হবে না...জোর করার জন্য আর একজন তো আছে। অরিত্র খেতে খেতে বলল... ‘উমম না দিদান...তোমার হাতে খাওয়া কি আর... ওর কথা শেষ হবার আগেই মৌ ঘরে ঢুকে ওকে দিদানের হাতে ওকে সেই আগের মতো খেতে দেখে থেমে গেলে দিদান ওকে ডেকে বলল...এই নে মৌ...খাইয়ে দে তো। মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেলে দিদান ওর হাতে খাওয়ারটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... এতদিন আমরা সামলেছি, এবারে বাবা তোর জিনিষ তুই বুঝে নে। অরিত্র দিদানের কথা শুনে হেসে ফেলে বলল...দিদান, আমি কি জড় পদার্থ নাকি? দিদানও হাসি মুখে বলল... তা কিছুটা বই কি। মৌ দিদানের দিকে তাকিয়ে বলল তোমার নাতি তো তোমার হাতে খেতে বেশী ভালো লাগে বলছিল মনে হয়। দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে আদর করে বলল...ওর কথা ছাড়তো, পেটে ক্ষিধে আর মুখ ফুটে না বলা ওর চিরকালের অভ্যাস। দিদান তারপরেই ওর কানে কানে বলল... ছেলেদের সব কথা শুনতে নেই...বুঝলি? মৌ হাসি মুখে ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে।
দিদান চলে যাবার পর মৌ ওকে খাইয়ে দিচ্ছিল, কিছুটা খাওয়ার পর... এই, না ...আর খেতে পারবো না বলাতে মৌ মুখটা ভার করে বলল... তাহলে আমিও আজ সারাদিন কিছু খাবো না। আরে আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আট-টা পঞ্চাশের গ্যালপিং লোকালটা ধরতে পারবো না বললেও মৌ শুনতে চাইলো না... গলা নীচু করে বলল ওই সব খাওয়ার সময় হয় আর আর একটু খেতে গেলে দেরী হয়ে যায়...তাই না? অরিত্র দুহাতে ওর মুখটা তুলে ধরে আস্তে করে বলল... ওইগুলো তো অনেক মিষ্টি খেতে...তাই না...
- পেট ভরবে ওতে?
- পেট না ভরুক, মন তো ভরবে...
মৌ কিছু না বলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে অরিত্র ওর চোখে চোখ রেখে বলল...এই...
- উমম...না...আগে বলো খাবে...
- আচ্ছা বাবা খাবো...আগে দাও...
- উঁ হুঁ...আগে খাও, তারপরে দেবো...
মিষ্টি মেয়ের আরো মিষ্টি গলায় বলা কথা তো ফেলে দেওয়া যায় না, তার উপরে আবার দিদান বলে গেছে ও নাকি ওর জিনিষ...তাই মেনে নিতে হয়েছে ও যা বলেছে। খাওয়া হয়ে গেলে অরিত্রকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৌ চোখ পাকিয়ে বলল...উঁ হুঁ...আগে মুখ ধুয়ে এসো আর তাই শুনে আর একজন মাথা নেড়ে বোঝালো না আগে চাই। কি আর করা যাবে কথা যখন দিয়েছি, তাই হোক ভেবে আর একজন হাসি মুখে চোখ বুজে থেকে বোঝালো... তোমার যা চাই নাও...
দেখতে দেখতে একটা সপ্তাহ চলে গেছে কিভাবে যেন বোঝাই যায়নি। দাদু আর দেরী করতে চাইছিল না একেবারেই। ছুটির দিন বিকেলে আর হাঁটতে না বেরিয়ে সবাইকে নিয়ে বসে বিয়ের কথা তুলতেই মৌ লজ্জা পেয়ে গিয়ে দিদানের পেছনে লুকোবার চেষ্টা করতে গিয়ে ধরা পড়ে গিয়ে মুখ নীচু করে বসে ছিল। অরিত্র একটা ফোন এসে যাওয়াতে যেন পালিয়ে বেঁচেছে। তার আগে অবশ্য বলে গেছে...তোমরা যা ভালো বোঝার করো। ওর কথা শুনে দাদু পেছন থেকে বলেছে...তা তো বলবিই ...সব দায়িত্ব যেন আমাদের আর উনি শুধু বিয়ে করবেন। ও হ্যাঁ, শুনে যা, তুই যদি পালিয়ে পালিয়ে বেড়াস তাহলে কিন্তু বৌ হাতছাড়া হয়ে যাবে...তোর দিদান তো বুড়ী হয়ে গেছে...বুঝেছিস। দাদুর কথা বলার ধরন দেখে দিদানের সাথে শুক্লাদিও হেসে ফেলেছে। মৌ-ও থাকতে না পেরে মুখ টিপে হেসে ফেলায়, দিদান ওর মুখটা তুলে ধরে জিজ্ঞেস করল... আচ্ছা শোন…তোর বাড়ীতে জানাতে হবে তো নাকি? মৌ একটু চুপ করে থেকে বললো… কিছু দরকার নেই… বিল্টু আর মিষ্টি এলেই হবে।
- না রে… যা হবার তো হয়েই গেছে…আমাদের দিক থেকে তো একটা দায়িত্ব আছে জানাবার…পরে আবার কথা না ওঠে যে আমরা তোর টাকার লোভে এইসব করেছি।
মৌ একটু অভিমানের সাথে বলল…আমার টাকার দরকার নেই,সব কিছু ওদেরকে দিয়ে দেবো। তোমাদের কাছে থাকতে পারবো…এর থেকে বেশি আমার আর কি চাই। দাদু স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলে বলল...আমরা খুব চিন্তায় ছিলাম রে। তুই যখন সব কিছু দিয়ে দিবি বলছিস তো তাই কর, ওটাই সব দিক থেকে ভালো হবে। টুকটাক আরো কিছু কথার পর দিদান জিজ্ঞেস করল…তোর এক মামা আছে শুনেছিলাম। মামার কথা শুনে ও চুপ করে থাকলেও একটু একটু করে ওর দু চোখ জলে ভরে উঠছিল…একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে নিয়ে বলল বড় হবার পর থেকে কোনোদিনই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বাবা অনেকবারই আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিল কিন্তু কেন জানি না হয়ে ওঠেনি…তারপর তো বাবাও চলে গেল। ওর কথা শুনে কিছুক্ষন সবাই চুপ করে ছিল, কি বলবে যেন বুঝতে পারছিল না। একটু পরে দিদান জিজ্ঞেস করল…মামারা কোথায় থাকেন মনে আছে? মৌ একটু সময় চুপ করে থেকে আস্তে করে যেন নিজের মনেই বলল…অনেকদিন আগের কথা ,সব কিছু তো মনে নেই তবে বাবার কাছে শোনা কিছু কথা মনে আছে। ওর মনের ভেতরে যে মামা বাড়ীর ব্যাপারে ভালোই দূর্বলতা আছে বুঝে দাদু বলল…আমার তো মনে হয় তোর যাওয়া উচিত...
- যেতে তো ইচ্ছে করে কিন্তু কে নিয়ে যাবে দাদু…
- কে আবার নিয়ে যাবে, দুষ্টু নিয়ে যাবে…দরকার হলে দু তিন দিনের ছুটি নিক…
- যেতে গেলে তো ঠিকানা লাগবে...
- ও নিয়ে তোকে চিন্তা করতে হবে না...জানিসই তো আমাদের বিশ্বাস সাহেব আছেনই... একবার শুধু বললেই হয়, তোর যেটুকু মনে আছে বললেই খুঁজে পেতে সব খবর বের করে ফেলবে।
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
অরিত্রকে আর নিজের থেকে বিয়ের ব্যাপারে কাউকে জানাতে হয়নি, যা করার দাদুরাই করেছে। পরের দিনই পুবালী মাকে নিয়ে চলে এসেছিল এবাড়ীতে, একদিন থেকে দাদুদের সাথে আলোচনা করে গেছে বিয়েটা কবে নাগাদ ঠিক করা যায়, কোথায় বিয়েটা হলে ভালো হয় ইত্যাদি। বাড়ীর একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা তার উপরে দিদিদের বিয়েতে ও অনেক করেছে তাই এবারে আর ওকে কোনো দায়িত্ব দিতে রাজী নয় কেউ। রুপসার আসার খুব ইচ্ছে থাকলেও কিছু করার ছিল না, নতুন চাকরী,এক বছরও হয়নি, এখোনো প্রোবেশানে আছে…ছুটি না পেয়ে রেগে গিয়ে চাকরীটা ছেড়েই দেবে বলেছিল। অরিত্র বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করেছে। একদিন দুপুরে মৌকে সাথে নিয়ে শ্যামবাজার গিয়ে বিল্টু আর মিষ্টির সাথে দেখা করেছে। বার বার ওদের মাকে না জানিয়ে আসা খুব একটা সহজ ছিল না। ওরা দু ভাইবোন বিয়ের কথা শুনেই দিদিকে জ়ড়িয়ে প্রায় কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। ওদের মা দিদিকে দেখতে না পারলে কি হবে ভাই বোন দুজনেই দিদিকে যে নিজেদের থেকে বেশি ভালোবাসে। মৌ যা টাকা পয়সা আছে ওদের দুজনকে দেবে বলাতে কিছুতেই রাজী হচ্ছিল না। মৌ অনেক করে বোঝাতে গররাজী হয়েছ কিন্তু বার বার একটাই কথা বলছে দুজনে…দিদির টাকার জন্য ওদের কোনো লোভ নেই… মা যে দিদিকে কোনোদিনই নিজের করে দেখেনি বরং বলতে গেলে চরম অত্যাচার করেছে…সেটা ওদের থেকে তো ভালো আর কেউ জানে না। আজ দিদির জীবনে খুশী আসছে জেনে নিজেদের কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে না। ওদের একটাই চিন্তা মাকে না জানিয়ে দিদির বিয়েতে কি করে যাবে। মৌ কথা দিয়েছে একবার হলেও ওই বাড়ীতে যাবেই, মাকে জানিয়েই সবকিছু করবে। অরিত্র সাথে থাকবে তাই এখন তো আর ওর মাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। টাকা পয়সা ছাড়াও বাড়ির যে ভাগ আছে সেটাও ও আর নিজের নামে না রেখে মায়ের নামে করে দেবে। শুধু একটাই জিনিষ ওর দরকার, মায়ের কিছু জামা কাপড় রাখা ছিল, যদি সেগুলো পাওয়া যায়…বিশেষ করে মায়ের বিয়ের বেনারসীটা। মায়ের গয়না গুলো তো আগেই নিয়ে নিয়েছিল তাই ওগুলো নিয়ে আর ভেবে লাভ নেই। দিদির কথা শুনে মিষ্টি লাফ দিয়ে উঠল, টাকা পয়সা বা বাড়ীর ব্যাপার নয়…জামাকাপড় গুলো ও দেখে রাখবে কাল-ই…মা সারাদিন নাকি থাকবে না…সেই সুযোগে যা করার করে ফেলবে যাতে মা পরে না বলতে পারে যে কিছু নেই। বিল্টু বাড়ির ব্যাপারে শুনে দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল…হ্যাঁ দিদি…তুমি বাড়ীটা লিখে দাও…থাকুক ওই বাড়ী নিয়ে। আমার তো থাকার ইচ্ছে নেই ওই বাড়ীতে আর মিষ্টির তো বিয়ে হয়ে গেলে চলে যাবে। মৌ হেসে ফেলে বলল…এই ভাই, মায়ের নামে ওরকম বলতে নেই রে, আমার সাথে যা হয়েছে হয়েছে…তোদের তো ভালোবাসে নাকি ভালোবাসে না? মিষ্টি ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল…ছাই ভালোবাসে…টাকা ছাড়া আর কিছু যে আছে মনেই করে নাকি। দাদা ঠিকই বলেছে…সবাই চলে গেলে একা একা থাকবে ওই বাড়ী আর টাকা নিয়ে, যখন পাশে কেউ থাকবে না তখন বুঝবে কি ভুল করেছে।
দাদুর কথাই ঠিক প্রমান হয়ে গেল। বিশ্বাস কাকু তিন দিনের ভেতরে মোটামুটি বেশ কিছুটা খবর জোগাড় করতে পেরেছে, দূর্গাপুর থেকে বাঁকুড়া যাবার রাস্তায় ওই নামে একটা গ্রাম আছে, বাস রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা ভেতরে মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে। মৌ এর বলা নামের একজনের খবর পাওয়া গেছে, ওই গ্রামেই থাকেন,কাছাকাছি একটা হাই কলেজের হেড স্যার। একটা ফোন নাম্বারও পাওয়া গেছে কিন্তু যতবার ফোন করা হয়েছে সুইচড অফ। কোনো এক মন্ত্রীর জেলা সফর শুরু হতে যাচ্ছে বলে পুলিশ মহল খুব ব্যাস্ত থাকায় বিশ্বাস কাকু আরো কয়েকটা দিন সময় চেয়েছিলেন যাতে কাউকে পাঠিয়ে দেখে নিতে পারেন ওটাই সঠিক জায়গা কিনা কিন্তু মৌ খবরটা পাওয়ার পর এতটাই ছটপট করছে যে যা হবে হবে, একবার গিয়েই দেখা যাক না, না মিললে ফিরে আসবে ভেবে যাওয়ার ডিশিশান নেওয়া হয়ে গেছে। বিশ্বাস কাকুর দেওয়া খবর অনু্যায়ী যখন তখন নাকি বাস বন্ধ হয়ে যায় ওই রাস্তায় তাই নিজেদের গাড়ি নিয়ে যাওয়াই ভালো ভেবে কপাল ঠুকে শুক্রবার খুব ভোরে মৌকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল অরিত্র, বেরোবার আগে দিদান মৌকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বলেছে, খুশী মনে যা, একদম চিন্তা করিস না, আমার মন বলছে নিশ্চয় তোর মামাদের সাথে দেখা হবে। ব্যারাকপুর পেরিয়ে গেলে অরিত্র ওকে পেছনের সিটে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিতে বললে মৌ খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছে ‘কেন’? ‘শুক্লাদি বলছিল তুমি নাকি রাতে ঠিক করে ঘুমোও নি’ বলাতে লজ্জা পেয়ে গিয়ে বলল...আসলে খুব চিন্তা হচ্ছে, এতদুর থেকে গিয়ে যদি দেখা না হয়। ‘চিন্তা কোরো না, যদি খুঁজে না পাই তাহলে দুর্গাপুর ফিরে এসে থেকে যাবো না হয় আজ, আবার কাল সকালে নতুন করে খুঁজতে যাবো’ বলাতে কিছুক্ষন ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল...তোমাকে আমার জন্য আর কতো ঝামেলায় পড়তে হবে কে জানে। অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতে চাপ দিয়ে হাসি মুখে বলল...কি হয়েছে তাতে, তোমার জন্য করবো না তো কার জন্য করবো বলো...
দূর্গাপুর পৌছতে সাড়ে এগারোটা মতো বাজলো। আরো কিছুটা আগে পৌঁছোনো যেত কিন্তু হাইওয়েতে বড় বড় গাড়ী দেখে মৌ এমন ভাবে ওর হাত চেপে ধরে ভয়ের চোখে তাকাচ্ছিল যে বাধ্য হয়ে স্পীড কমাতে হয়েছিল। এর পরে রাস্তার পাশে একটা দোকান দেখে গাড়ী থামিয়ে অল্প কিছু খেয়ে নিয়ে ওকে বোঝাতে গিয়েছিল ভয়ের কিছু নেই কিন্তু মৌ কোনো কথা শুনতে রাজী নয়। ওর হাত চেপে ধরে বলেছে...না, তুমি জোরে চালাবে না, কিছু হয়ে গেলে? কিছুতেই ওকে বোঝানো গেল না দেখে ‘আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আস্তে চালাবো’ বলাতে তবেই গাড়ীতে উঠেছে। দুর্গাপুরে একটা মোটামুটি ভালো হোটেল দেখে খেয়ে নিয়ে লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল কিভাবে যেতে হবে। রাস্তা ভুল না করলে আর ঘন্টা দেড় দুই মতো লাগবে জেনে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়তে হল…যদি ভুল জায়গায় পৌঁছে যায় তাহলে ফিরে আসার মতো অবস্থায় থাকতে হবে। অবশ্য বিশ্বাস কাকু তো আছেই, খুব দরকার হলে লোকাল থানার সাহায্য পেতে অসুবিধা হবে না।
দূর্গাপুর পর্যন্ত রাস্তা ঠিক ছিল, হাইওয়েতে গাড়ী চালাতে কোনো অসুবিধা হয়নি কিন্তু বাঁকুড়ার রাস্তায় পড়ে হাড়ে হাড়ে টের পেতে হচ্ছিল খারাপ রাস্তা কাকে বলে…একে সরু রাস্তা, উলটো দিক থেকে গাড়ী এলে রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে সাইড দিতে হচ্ছে…তার উপর মাঝে মাঝে পিচ বলে কিছু নেই। দু ধারে শুধু খটখটে শুকনো ফাঁকা মাঠ। ওই দুপুর বেলা মাঝে মাঝে রাস্তার ধারে দু একটা ঝুপড়ি ধরনের দোকান দেখা গেলেও লোকজনের নাম গন্ধ নেই। অরিত্র সাবধানে গাড়ী চালাতে চালাতে মৌয়ের দিকে তাকালে দেখতে পেল ও খুব একটা স্বস্তিতে নেই…সারা মুখে একটা চিন্তার ছাপ…সাথে যেন একটু অপরাধবোধও কাজ করছে এই ভেবে যে ওর জন্য এত কষ্ট করে অরিত্রকে আসতে হয়েছে। একটা গাছের ছায়ায় গাড়ীটা দাঁড় করিয়ে দিলে মৌ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফিরে তাকালে অরিত্র বলল…বুঝতে পারছি না ঠিক যাচ্ছি কিনা…
- কি করবে?
- দেখি…কোনো গাড়ী এলে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবো ভাবছি…
মৌ মুখটা নিচু করে নিয়ে বলল…আমার জন্য তোমাকে কত ঝামেলায় পড়তে হল বলোতো…
- হুমম…পড়েছি তো কি হয়েছে…মুখ গোমড়া করে না থেকে একটু হাসবে কি?
- কি করে হাসবো…না এলেই ভালো ছিল…
- ইস…না এলেই ভালো ছিল…মামাকে না পেলে বিয়েটা কি করে হবে শুনি…
- যাদের মামা নেই তাদের কি বিয়ে হয়না?
- আমার এত কিছু জানার দরকার নেই, তোমার বিয়ে মামা ছাড়া হবে না…বুঝেছো? আর… তোমার বিয়ে না হলে আমারও যে বিয়ে হবে না…আমার বাবা চিরকুমার থাকার আর কোনো ইচ্ছে নেই…
মৌ ওর কথা বলার ভঙ্গী দেখে না হেসে থাকতে না পেরে বলল…আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তোমার যত খুশী মামা খোঁজো…আমার কি। গ্রীষ্মের শুনশান দুপুর, কথা বলতে বলতে ওর মুখে আর চিন্তার ছাপ দেখতে না পেয়ে অরিত্র চুপ করে গিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মনে হল কিছু বলতে চাইছে আর বুঝে গেলে আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলেছে ‘উঁ হুঁ, এখানে এই ফাঁকা রাস্তায় ওসব চলবে না। না বললে কে শুনছে? তুমি আমার কাছে না এলে কি হয়েছে, আমি তো তোমার কাছে আসতে পারি ভেবে একজন নিজের জায়গাতে বসেই এদিকে ঝুঁকে এসেছে। এই... না...কেউ এসে গেলে? বলতে গিয়েও অন্যজন বুঝিয়েছে তারও খুব একটা যে অনিচ্ছা আছে তা নয়...আর একজন তো কথা শোনার জায়গাতেই নেই। কাছে এসে বুকে জড়িয়ে ধরতে গেলে ‘উমম...না...কথা শোনো’...বলেও কাজ না হলে বাধ্য হয়ে বুকে মুখ গুঁজে অস্ফুট স্বরে বলেছে তুমি খুব দুষ্টূ...কথা শোনো না। মিষ্টী মেয়ের মুখে আদর করে দুষ্টু বলা যে কতটা মিষ্টি হতে পারে তা যে শোনে সেই শুধু বোঝে। না না করে গেলেও এত কাছে পেলে কি আর আদর না করে থাকা যায় নাকি ভেবে সবকিছু ভুলে গিয়ে আদর করে আর করতে দিয়ে প্রায় সারাদিনের জার্নির ধকল আর দুশ্চিন্তার রেশ যেন কেটে গেল নিমেষে। কিছুক্ষন কেটে গেছে, তারপরে...এই, এবারে ছাড়ো...বললে একজন আস্তে করে বলেছে ‘ইচ্ছে করছে না তো...
বেশ কিছুটা দূরে উল্টোদিক থেকে একটা বাস আসছে দেখে অরিত্র তাড়াতাড়ি গাড়ী থেকে নেমে এল। এসির ভেতর থেকে বাইরে এসে যেন চোখ মুখ ঝলসে গেল…দুপুরের হাওয়া তো নয় যেন লু বইছে। ওকে হাত তুলে ইশারা করতে দেখে বাসটা ধুলোর ঝড় তুলে দাঁড়িয়ে গেলে অরিত্র ওদের গন্তব্য বাস স্টপের নাম বলে ঠিক যাচ্ছে কিনা জিজ্ঞেস করতে বাস ড্রাইভারের কাছ থেকে জানা গেল ঠিকই যাচ্ছে…আরো ঘন্টা খানেক লাগবে পৌঁছোতে। ড্রাইভার বাস ছাড়ার আগে জানিয়ে গেল দূর্গাপুরের দিক থেকে পরের বাসটা আর মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যে এসে যেতে পারে…চাইলে ওটার পেছন পেছন যেতে পারে ওরা। গাড়ীতে বসে লুকিং গ্লাস দিয়ে পেছনের দিকে দেখতে দেখতে সত্যিই দেখা গেল একটা বাস আসছে। আগের বারের মতোই গাড়ীটাকে থামিয়ে বাস কন্ডাকটারের সাথে কথা হয়ে গেলে নিশ্চিন্ত মনে বাসটার পেছন পেছন যেতে যেতে দুজনের হেসে গড়াগড়ি যাবার মতো অবস্থা। সামনের স্টপে বাসটা দাঁড়ালে একজন মাঝ বয়সী লোক একটা মোরগ হাতে করে বাসে উঠতে গিয়ে হাত ফসকে মোরগটা ঝটপট করে উড়ে এসে গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়লে জনা তিনেক লোক কোত্থেকে হৈ হৈ করে দৌড়ে এসে মোরগটাকে ধরার চেষ্টা করলো…একজন রাস্তায় শুয়ে পড়ে প্রায় গাড়ীর নিচে ঢুকে পড়ে মোরগটাকে ধরে বের করে নিয়ে এসে মালিকের হাতে ধরিয়ে দিল। ওদিকে বাস দাঁড়িয়ে আছে, মোরগের মালিক উঠলে তবে বাস ছাড়লো। পরের দুটো স্টপে আর কিছু হয়নি, তারপরের স্টপে আবার এক মজার ঘটনা। বাচ্চা কাচ্চা মিলিয়ে প্রায় দশ বারো জনের একটা দল নেমে কিচির মিচির করতে করতে সামনের মোরাম রাস্তার দিকে হাঁটা দিয়েছে…বাসটা সবে ছেড়েছে এমন সময় ওদের একজন পেছন ফিরে হাত তুলে দৌড়ে এসে বাসটাকে থামালো…চিৎকার চেঁচামেচি শুনে যা বোঝা গেল তা হল ওদের আরো একটা বাচ্চা বাসে থেকে গেছে। কন্ডাক্টার বোধহয় খুঁজে পেতে একটা বছর দুই আড়াই এর বাচ্চার হাত ধরে নামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল ওটাই কিনা। ততক্ষনে বাচ্চার মা ও ফিরে এসেছে…বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে হাঁউমাঁউ করে কেঁদে ফেলে কন্ডাক্টারকে গালাগালি করতে শুরু করে দিল, যেন ওর দোষেই বাচ্চাটা বাসে থেকে গিয়েছে। কন্ডাক্টারও ছাড়বে কেন…নিজের কটা বাচ্চা তারই হিসেব নেই বলে উলটে দু চার কথা শুনিয়ে তবে বাস ছাড়ার ঘন্টি বাজালো। মৌ-কে নিজের মনে হাসতে দেখে অরিত্র ওর দিকে তাকালে ও জিজ্ঞেস করল ‘আচ্ছা, ওই সবকটা বাচ্চা কি একজনের হতে পারে? হু…কেন হতে পারে না বললে মৌ হেসে ফেলে বলল…বাব্বা, পারেও বটে। অরিত্র হাসতে হাসতে বলল…ওদের মা বাবা দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে তো…তাই। মৌ ওর দিকে তাকিয়ে ধ্যাত, তুমিও না খুব অসভ্য বলাতে অরিত্র রাস্তার দিকটা দেখে নিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল… আচ্ছা ধরো আমাদেরও যদি অনেকগুলো হয়…আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমিও আমাকে ভালোবাসো। এবারে আর মৌ থাকতে না পেরে চোখ পাকিয়ে ওর হাতে চিমটি কেটে বলল…এই, তুমি থামবে…ছিঃ… ছিঃ। নিজেদের ভেতরে হাসি ঠাট্টা করতে করতে কখন এক ঘন্টার জায়গায় ঘন্টা দেড়েক কেটে গেছে বুঝতে পারেনি। একটা জায়গায় বাস দাঁড়ালে পেছনের দরজার কন্ডাক্টার নেমে এসে জানালো ওদের একটু আগে বাঁ দিকের মোরাম রাস্তা ধরে যেতে হবে।
বাসটা চলে গেলে সামান্য একটু এগোনোর পর একটা মোরাম রাস্তা পাওয়া গেল, নামেই রাস্তা…খানা খন্দে ভরা…সামনে একটা ভ্যান রিকশা দুজন সওয়ারী নিয়ে যাচ্ছে, পেরিয়ে যাবার উপায় নেই দেখে ওটার পেছন পেছন আস্তে আস্তে করে যেতে হচ্ছিল। বেশ কিছুটা ফাঁকা মাঠের ভেতর দিয়ে যাবার পর এক জায়গায় একটা খেলার মাঠ আর কলেজ দেখা গেল, খুব একটা পুরোনো কলেজ বলে মনে হল না। সামনেই কিছুটা চওড়া জায়গা আছে দেখে অরিত্র ভাবছিল ভ্যান রিক্সাটাকে পেরিয়ে গিয়ে ওকেই জিজ্ঞেস করে নেবে কিন্তু তা আর হল না। ভ্যান রিক্সাটা কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল দেখে সামান্য একটু এগিয়ে গেলে দুজন কলেজের ছেলেকে পাওয়া গেল। ওদেরকে গ্রামের নাম করে জিজ্ঞেস করতে সামনের দিকে দেখিয়ে দিয়ে বলল আরো কিছুটা যেতে হবে। ততক্ষনে ভ্যান রিক্সাটাও চলে এসেছে দেখে ওদেরই একজন বলল ওই ভ্যানটা নাকি ওই গ্রামের দিকেই যাচ্ছে, তারপর নিজেই এগিয়ে এসে ভ্যানওয়ালাকে বলল…ও মাধব কাকা, তোমাদের গ্রামে যাবে গো…রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাও। ভ্যানওয়ালা নেমে এসে জিজ্ঞেস করল কার বাড়ী যাবে ওরা। দেবাশীষ মুখার্জি বলাতে কলেজের ছেলেটা খুব যেন খুব আপন এমন ভাব করে বলল ‘ও আপনারা স্যারের বাড়ী যাবেন? হ্যাঁ বলাতে ছেলেটি জানালো স্যার কলেজে নেই, কলেজের কাজে বাঁকুড়া গেছেন।
আবার সেই আগের মতো ভ্যানের পেছন পেছন যেতে যেতে একটা পুরোনো মন্দীর আর সামনের দীঘি দেখে মৌ প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল…খুব চেনা চেনা লাগছে…ঠিক জায়গাতেই এসেছি মনে হচ্ছে। ওর চোখে মুখে যেন খুশী ঝরে পড়ছিল, ভালো করে দেখে বলল…হ্যাঁ…এটাই…আর একটু এগোলেই মামার বাড়ী…খুব ছোটো বেলায় দেখা কিন্তু এখোনো মনে আছে। ঠিক জায়গাতে পৌঁছে গেছে বুঝতে পেরে মৌ বাইরের দিকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেস্টা করছিল আরো কোনো কিছু দেখতে পাওয়া যায় কিনা যেটা ও ওর ছোটোবেলায় দেখেছিল।
আরো কিছুটা যাবার পর ভ্যানওয়ালা দাঁড়িয়ে গিয়ে পেছন ফিরে বলল এসে গেছি, তারপরেই নিজে নেমে গিয়ে ডাকাডাকি করে বাড়ীর লোকজনকেও বের করে নিয়ে এলো। ততক্ষনে সামনের রাস্তার ধার ঘেঁসে গাড়ীটা রেখে ওরা দুজনে নেমে এসেছে। মৌ এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে বোঝার চেষ্টা করছিল ওর সেই ছোটোবেলার স্মৃতি থেকে আরো কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা, বাড়ীটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে দেখতে অরিত্রর হাত চেপে ধরলে ওর দিকে তাকিয়ে অরিত্র বুঝতে অসুবিধা হল না যে আর কোনো ভুল নেই, ওরা ঠিক জায়গাতেই এসেছে। একজন মাঝ বয়সী মহিলা ওদেরকে দেখে এগিয়ে এলে ভ্যানওয়ালা বলল…আরে বৌদি…কুটুম এসে দাঁড়িয়ে আছে…আর তোমরা সব ঘুমোচ্ছো। মৌকে দেখে চিনতে পারার কথা নয়…সেই কোন ছোটো বেলায় এসেছিল ও। মহিলা কি করবে বুঝতে না পেরে থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলে মৌ এগিয়ে গিয়ে বলল… আমি মৌ…কোলকাতা থেকে আসছি। ওর কথা শুনে বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…মৌ? মানে বর্নার মেয়ে…মৌ? হ্যাঁ বলাতে জড়িয়ে ওকে ধরে কি করবে যেন বুঝতে পারছিল না…ওকে আদর করতে করতে বলল…চিনতে পারছিস আমাকে? আমি তোর মামীমা…এক এক করে বাড়ীর ভেতর থেকে বোধ হয় ওর দাদু আর দিদা বেরিয়ে এসে কে এসেছে জানতে পেরে ওকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিল। অরিত্র চুপচাপ একটা খাটিয়ার উপরে বসে ছিল, সবাই মৌকে নিয়ে ব্যাস্ত…ওর দিকে কে তাকাবে এখন। খারাপ লাগার কিছু নেই, এটাই স্বাভাবিক…মেয়েটা কত বছর পর এলো অপ্রত্যাশিত ভাবে। ওকে নিয়েই তো সবাই থাকবে এখন। কোত্থেকে একটা কুকুর এসে ওদের কান্নাকাটি দেখে ভৌ ভৌ করে ডাক দিয়ে অরিত্রর দিকে এগিয়ে এসে জুল জুল করে দেখতে শুরু করল…নাক উঁচু করে গন্ধ শুঁকে বোঝার চেষ্টা করল নতুন মানুষটা ভালো না খারাপ। অরিত্র চুক চুক করে আওয়াজ করে ডাকলে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে লেজ নাড়াতে শুরু করল… অরিত্র ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলে কত দিনের চেনা এমন একটা ভাব করে পায়ের কাছে বসে পড়ল। অরিত্রর মনে মনে হাসি পেয়ে গেল…যাক…কেউ একজন তো ওর কাছে এসেছে ভেবে… একটু পরে গোটা দুয়েক মুরগী কোঁক কোঁক করে ডাকতে ডাকতে এসে খাটিয়ার নিচে ঢুকে পড়ল দেখে কুকুরটা ঘ্যাঁক করে ডেকে উঠল…ভাবখানা যেন এমন…এই…তোরা এখান থেকে ভাগ। আমাদের বাড়ি কেন এসেছিস…ঠাকুমা দেখতে পেলে কিন্তু তাড়া করবে… ওর ডাক শুনে মুরগী দুটো ত্রাহি মধুসুদন ভাব করে দৌড় লাগালো…কুকুরটা একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে লেজ নেড়ে বোঝালো…দেখলে তো…কেমন ভাগিয়ে দিলাম। হাসি মুখে ওর মাথায় আদর করে একটা চাপড় দিতে আবার পায়ের কাছে বসে পড়ল কুকুরটা। মৌকে নিয়ে সবাই বাড়ীর ভেতরে গেছে দেখে ও উঠে চারদিকটা দেখছিল…উঠোনের একদিকে এক চালা একটা ঠাকুর দালান… ভেতরে সপরিবারে মা দূর্গা…খড়ের কাঠামো…এখোনো মাটির প্রলেপ পড়েনি…তার মানে বাড়ীতে দুর্গা পূজো হয়…বনেদী বাড়ী হবে…বাড়ীটা বেশ পুরোনো হলেও তো তাই মনে হচ্ছে। পেছনে কারুর পায়ের শব্দ শুনে ফিরে দেখে বছর পনেরো ষোলর একটা মেয়ে…কলেজ থেকে ফিরছে…অচেনা মানুষ দেখে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখাচুখি হলে বোধ হয় লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে চলে গেল। পেছন পেছন আরো একজন কলেজ থেকে ফিরলো…মেয়ে নয়…ছেলে… বয়স আর একটু কম…বড়জোর বছর বারো হতে পারে…আগের জনের মতো ওকে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল। কুকুরটা ওর পায়ে পায়ে ঘুরছিল, ছেলেটাকে দেখে লেজ নেড়ে হয়তো বলতে চাইলো আজ আর খেলতে যেতে হবে না, দেখো গিয়ে কে এসেছে। ছেলেটা ভেতরে চলে যাবার পর অরিত্র রাস্তার দিকে গিয়ে গাড়ির ভেতর থেকে বিস্কুটের প্যাকেট বের করে কুকুরটাকে কয়েকটা বিস্কুট দিলে খুব খুশি হয়ে লেজ নাড়তে নাড়তে খেয়ে নিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে বলতে চাইলো আরো চাই। অরিত্র হাসি মুখে বাকি বিস্কুট গুলো একটা একটা করে খাওয়াতে খাওয়াতে দাদুকে ফোনে জানিয়ে দিল ওরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছতে পেরেছে। দাদু খুব খুশী হয়ে বলল...যাক বাবা, ভালোই হয়েছে...আমরা সবাই খুব চিন্তায় ছিলাম। আরো কিছুক্ষন বাড়ীতে কথা বলার পর এদিক ওদিক তাকিয়ে মৌকে আসতে দেখা গেল…সাথে ওই ছেলেটা। ও কাছে এসে সারা মুখে কিছুটা বিব্রত ভাব নিয়ে বলল…এই…কিছু মনে কোরো না…সবাই আমাকে নিয়ে এত ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে যে তোমার কথা ভুলেই গেছে। অরিত্র হাসি মুখে বলল…মনে করার কিছু নেই, এত বছর পরে তোমাকে পেয়েছে…এটাই স্বাভাবিক...
- সত্যিই কিছু মনে করনি তো?
- না রে বাবা…দেখোনা…এর মধ্যে কেমন বন্ধু জুটিয়ে ফেলেছি।
মৌ অবাক হয়ে আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল…কাকে আবার জোটালে? অরিত্র কুকুরটার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখালে মৌ হেসে ফেলে বলল…তুমি ও না পারো বাবা…শোনো না…এ আমার মামাতো ভাই…অর্ক…ওর সাথে আর একটু থাকো…কেমন...
- আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, আমার জন্য এত ভাবতে হবে না…তুমি যাও…
মৌ যাবার আগে শুভকে বলল…এই অর্ক…কোথাও চলে যাবি না কিন্তু, দাদার সাথে থাকবি। যাকে বলা হল সে খুব মন দিয়ে গাড়ীটার দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে ঘাড় নেড়ে জানালো বুঝেছে।
মৌ চলে যাবার পর অরিত্র ওকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করল…তুমি কোন ক্লাসে পড়?
- সেভেনে…
- কলেজ কোথায়?
- ওই তো…আসার সময় যেখানটা তোমরা দাঁড়িয়েছিলে…বড় একটা খেলার মাঠ আছে…
- এই দেখো…আমরা কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম…তুমি জানলে কি করে?
- বা রে…ক্লাসের জানলা দিয়ে রাস্তা দেখা যায় তো। আমাদের এখানে তো এত সুন্দর গাড়ী আসে না…তাই সবাই মিলে দেখছিলাম…
- তাই…তোমার গাড়ী ভালো লাগে?
- খুউব…আচ্ছা…অনেক দাম…তাই না?
- না না…খুব বেশি না…
অর্ক খুব অবাক গিয়ে বলল…বেশী না? এত সুন্দর দেখতে…
- বড় হও…তখন না হয় দাম নিয়ে ভাববে…
- আচ্ছা…দিদি তো বললো না তোমাকে কি বলে ডাকবো…
- হুমম…দুষ্টু দাদা বলে ডাকতে পারো…
অর্ক কেমন যেন অবাক হয়ে বলল…ধ্যাত…দুষ্টু আবার কারুর নাম হয় নাকি?
- হয়…সত্যিই আমার নাম দুষ্টু…
- তোমাকে কিন্তু একটুও দুষ্টু বলে মনে হচ্ছে না…
ওর কথা শুনে অরিত্র হাসি মুখে বলল…তাই? কি মনে হচ্ছে?
- বেশ ভালো বলে মনে হচ্ছে। কেমন সুন্দর গল্প করছো আমার সাথে…রাজুদা তো পাত্তাই দেয় না…
- তাই? রাজুদা কে?
- বড়দির বর…বাইকে হাত দিলেই কেমন যেন করে…আমি যেন ভেঙ্গে ফেলবো…
- হুমম…বাইকটাকে খুব ভালোবাসে তো…তাই…
- তুমি গাড়ীটাকে ভালোবাসো না?
- খুব…
- আমাকে এক বার গাড়ী চড়াবে?
- কেন চড়াবো না? চলো…তোমার কলেজের সামনে থেকে ঘুরে আসি…
- না না…এখন না, দাদু বকবে…তোমাকে নিয়ে বাড়ীতে যেতে বলেছে একটু পরে, বেড়াতে গেলে তো দেরী হয়ে যাবে। কাল সকালে যাবো…থাকবে তো?
- হুম…থাকবো…
অর্ক আনন্দে প্রায় নেচে উঠে বলল…খুব মজা হবে। ওদের কথার মাঝখানে কুকুরটা একবার ডেকে উঠলে অরিত্র জিজ্ঞেস করল… ওর কোনো নাম আছে? অর্ক খুব গর্বের সাথে বলল…হ্যাঁ…লালু…জানো তো…ও একদিন কলেজের সামনে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিল…খুব ছোটো…কলেজের ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাড়ী চলে এসেছিলাম। মা তো কিছুতেই রাখতে দেবে না…এত ছোটো…ওর মা নাকি কাঁদবে…কান্নাকাটি করে দাদুকে দিয়ে বলাতে তবে রাজী হয়েছিল।
বেশ কিছুক্ষন অর্কর সাথে গল্প করার পর বাড়ীর সামনে থেকে কেউ জোরে...এই অর্ক…দাদাকে নিয়ে আয় বলাতে ও বেশ জোরে চেঁচিয়ে বলল…আসছি দাদু… তারপর অরিত্রর হাত ধরে বলল…চলো…দাদু ডাকছে। অর্কর সাথে ভেতরে যেতে গিয়ে দাদুর সাথে দেখা হয়ে গেল, উনি অরিত্রর হাত ধরে বললেন…কিছু মনে করো না বাবা…মৌকে আর কোনোদিন দেখতে পাবো আশা ছিল না…মাথার ঠিক রাখতে পারিনি। অরিত্র দাদুকে প্রনাম করে বলল…না না…আমি কিছু মনে করিনি…এই তো এতক্ষন আপনার নাতির সাথে গল্প করলাম।
- যাও…বাবা…ভেতরে যাও…আমি এখুনি আসছি…ছেলেটাও বাড়ী নেই…কখন ফিরবে কে জানে…
দাদুর কথা শেষ হতে না হতেই একটা ভ্যান রিকশা এসে বাড়ীর সামনে দাঁড়ালো…ওদিকে তাকিয়ে দাদু বললেন…যাক…বাবা…ছেলেটা এসে গেছে। ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন…আরে শোন মৌ এসেছে…আমি মাছের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখি।
- বাস থেকে নেমে মাধবের কাছে শুনেই তো তাড়াতাড়ি চলে এলাম কাজ ফেলে…মাছের ব্যাবস্থা করে এসেছি…একটু পরে মাধবের ছেলে এসে জাল ফেলবে…
- যাক বাবা…ভালো করেছিস। নিশ্চিন্ত হলাম…ছেলে মেয়ে দুটোকে ভালো করে খাওয়াতে পারবো কিনা চিন্তা হচ্ছিল…আর শোন…এ হল অরিত্র…আমাদের মৌ কে সাথে করে নিয়ে এসেছে...
অরিত্র মামাকে প্রনাম করতে যেতে না না করে উঠে বললেন…থাক…থাক…প্রনাম করতে হবে না…সারা দুনিয়ার ধুলো পায়ে…কেমন জায়গায় থাকি দেখছো তো…
মানুষ কতটা আন্তরিক হতে পারে এখানে না এলে বোঝা যেত না ভাবতে ভাবতে অর্কর সাথে ভেতরে যাওয়ার পর মৌ সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আমার তো মনে হয়…তুমি নিজেই এখোনো ঠিক করে জানো না কে কোন জন…
- ইস…আমি চিনি না নাকি…শুধু মামন আর অর্ক ছাড়া আর সবাইকে দেখেছি…দাদু, দিদা, মাসী, মামা, মামীমা, সুমনাদি…
- না না…আরো এক জন আছে যাকে তুমি দেখোনি আগে…
ওর কথা শুনে মৌ বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল…কে?
অরিত্র একটু গম্ভীর হয়ে ‘লালু’ বলতেই সবাই হেসে ফেলল। মৌ বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকিয়ে আছে দেখে অর্ক দিদির কাছে গিয়ে বলল…দিদি…লালু মানে আমাদের কুকুরটা…
সবার সাথে আলাপ হওয়ার পর প্রথমে চা আর তার কিছুক্ষন পরে মামীমা জোর করে লুচি, আলুভাজা, পায়েস, মিষ্টি খাইয়ে তবে রেহাই দিয়েছে, ‘না না সত্যিই আর খেতে পারবো না’ বললেও শোনেনি। মামীমাকে বোঝাতে না পেরে অসহায় চোখে মৌয়ের দিকে তাকালে ও হেসে ফেলে বলেছে আমি বাবা কিছু বলতে পারবো না।
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
গ্রামের কিসব জরুরী মিটিং থাকায় দাদু আর মামা একটু আগে বেরিয়ে গেলেন, আজকাল নাকি গ্রামের ব্যাপার ট্যাপার একেবারেই পালটে গেছে, তাই না গেলে নয়। মৌ ওদিকে ওর দিদাদের সাথে গল্প করছে দেখে অরিত্র বাইরের বারান্দায় একা বসে ছিল। খুব একটা যে খারাপ লাগছে তা নয়, বরং একা একা চুপচাপ নিজের মতো করে বসে থাকতে ভালোই লাগছে। এই কিছুক্ষন আগেও টিম টিম করে বাতি জ্বলছিল কিন্তু একটু আগে যে সেই কারেন্ট গেল আর ফিরে আসার নাম নেই। অবশ্য তাতে যে খুব একটা কিছু অসুবিধা হচ্ছে তা নয়। নিস্তব্ধ গ্রামের নরম চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া দেখার সৌভাগ্য এখানে না এলে হয়তো কোনোদিনই হতো না। সন্ধের মুখে এত কিছু খাওয়ার অভ্যাস নেই তার উপর এত রাস্তা গাড়ী চালানোটাও কম ঝক্কির নয়, বেশ ক্লান্ত লাগছিল, চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়ছে দেখে মামীমা ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর শোয়ার ব্যবস্থা করে দিল। দোতলার দক্ষিনমুখো ঘর, খোলা জানলা দিয়ে ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া আসছে... ঘুম আসতে তাই আর দেরী হয়নি। ঘুমের ভেতরে থেকে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ডাকছে মিষ্টি গলায়…এই…ওঠো না…
অরিত্র কোনোরকমে চোখ খুলে প্রথমে কিছু বুঝতে পারছিল না কোথায় আছে। আস্তে আস্তে ঘুমের ঘোর কেটে গেলে টিমটিমে আলোয় মৌকে ওর পাশে বসে থাকতে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলো…বোধ হয় স্নান করে নিয়েছে…দুধ সাদা সালোয়ার কামিজ, কপালে ছোট্ট কালো টিপ...অবাধ্য চুলের গোছা মুখের উপরে এসে পড়তে চাইছে...অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল ওকে। সাথে সাথে সেই চেনা মেয়েলী সুগন্ধ বুক ভরে টেনে নিতে নিতে ওর হাতটা বুকে চেপে ধরে পাশ ফিরে আবার চোখ বুজে শুয়ে থাকলে মৌ আস্তে করে বলল ‘এই…ছাড়ো… কোনো জবাব না দিয়ে ওর হাতটা আরো ভালো করে বুকে চেপে ধরলে মৌ মুখ নামিয়ে কানের পাশে ফিস ফিস করে বলল…লক্ষীটি ছাড়ো…কেউ এসে যাবে…
- উমম…ছাড়তে ইচ্ছে করছে না…
- এই...
- আসুক না…আমি তো শুধু তোমার হাত ধরে আছি…
খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল জানলার পাশের আম গাছটায় বসে থাকা কোনো নাম না জানা পাখীর ডাক শুনে। কাল রাতের কথা মনে পড়ে যেতে লজ্জায় সারা শরীর শিরশির করে উঠল। এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়…দুষ্টুটা শুধু ওর হাতটা বুকে জড়িয়ে ধরে ছিল, কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না দেখে চুপ করে ওর পাশে বসে থাকতে থাকতে খুব ইচ্ছে করছিল জড়িয়ে ধরতে…কেউ এসে গেলে কি হবে ভাবতে ভাবতে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মামন দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেরী দেখে হয়তো মামীমা ওকে দিয়ে ডাকতে পাঠিয়েছিল। ওকে মুখ তুলে তাকাতে দেখে মামন ফিক করে হেসে…’মা খেতে ডাকছে’ বলেই দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল। বোনটা কতটা কি দেখেছে বা বুঝেছে ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে তাকালো। মামন কোল বালিশটা জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। মেয়েটা বেশ দেখতে হয়েছে…ওর দিদির থেকেও বোধহয় আরো মিষ্টি দেখতে…বাড়ন্ত শরীর…বয়সের তুলনায় হয়তো একটু বেশী বড় লাগে দেখতে…যদিও মিষ্টি মুখটাতে একটা নিস্পাপ ভাব…পাশ ফিরে শোয়ার জন্য ঢিলে ফ্রকের ফাঁক দিয়ে বাড়ন্ত শরীরের স্পষ্ট হাতছানি…হাত বাড়িয়ে আলতো ভাবে ওর ফ্রকটা ঠিক করে দিয়ে নিজের দিকে তাকালো। আশেপাশে কেউ না থাকলেও নিজেই নিজেকে দেখে লজ্জা পেয়ে গেল…ওর ও তো একই অবস্থা…কামিজের দুটো হুক ঘুমের ভেতরে কিভাবে যেন খুলে গেছে…ইস…কতটা ভেতর অব্দি দেখা যাচ্ছে…এমন নয় যে নিজেকে এই প্রথম দেখছে…রোজই তো দেখে কিন্তু আজ যেন জীবনে প্রথম বার এত লজ্জা পেল দুষ্টূ ছেলেটার কথা ভাবতে ভাবতে…রাতে তো ঘরের দরজা ভেজানো থাকতো আগে…এমন হয়নি তো …দুষ্টূ ছেলেটা কোনোদিন ওর অজান্তে এসে দেখে গেছে…নিজেই নিজেকে বোঝালো…না…না…ও তো এমন নয়…এত সুযোগ পেয়েও কাছেই আসতে চায় না তো চুরি করে দেখবে কেন…কি দরকার ওর চুরি করে দেখার…তারপরেই ভাবলো…ইস…দেখলে দেখুক না…ওরই তো দেখার কথা… বুকের ভেতরে একটা ভালো লাগার অনুভুতিতে ভরে উঠল…আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙ্গলো মামীমার ডাকে…এই…মৌ…ওঠ…অরিত্রকে পাওয়া যাচ্ছে না। ওকে পাওয়া যাচ্ছে না শুনে ধড়পড় করে উঠে বসে চোখ কচলে মামীমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বলল… আশে পাশে আছে হয়তো…
- না রে…অর্ক খুঁজে এসেছে…কোথাও নেই...
- গাড়ীটা কোথায়?
- নিচেই আছে…
- ফোনটা আছে?
- কি জানি…তুই একবার দেখ না মা…খুব চিন্তা হচ্ছে রে…
মামীমার চিন্তাটা ওর বুকের ভেতরটা তোলপাড় করতে শুরু করে দিল…তাড়াতাড়ি উঠে দক্ষিনের ঘরটায় গিয়ে বালিশের পাশে মোবাইলটা পেয়ে গিয়ে আর কিছু ভাবতে পারছিল না…কোথায় যেতে পারে? এমন কিছু তো হয়নি যে না বলে চলে যাবে…তাছাড়া গাড়ী ছাড়াই বা কিভাবে যাবে? বুকের ভেতর থেকে এক দলা কান্না উঠে আসতে চাইছে…কোনো রকমে নিজেকে সামলে অর্ককে বলল…ভাই…আর এক বার দেখ না…কোথায় আর যাবে…এখানেই কোথাও আছে…তুই হয়তো ঠিক করে দেখিস নি…
নিচের বারান্দায় দাদুরা সবাই চিন্তিত মুখে বসে আছে, কারুর মুখে কথা নেই… মামা উঠোনে পায়চারী করতে করতে কাকে যেন ফোন করার চেষ্টা করছে… অর্ক গেট থেকে বেরিয়ে গিয়েই আবার দৌড়ে ফিরে এসে বলল…দিদি… দিদি…আসছে। ওর কথা শুনে সবাই যেন প্রান ফিরে পেল…ওদিকে ওরিত্র গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল…পেছনে লালু… সবাইকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অরিত্র বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে…জিজ্ঞেস করল…কিছু হয়েছে? ওকে নিয়েই যে সবাই চিন্তা করছিল ওর বোঝার কথা নয়…মামীমা এগিয়ে গিয়ে বলল…না না কিছু হয়নি…আসলে তোমাকে দেখতে না পেয়ে আমরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম…নতুন জায়গা…তাছাড়া…আজকাল এদিকেও শুনছি মাওবাদীরা যাওয়া আসা করছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অরিত্র খুব অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে বলল…আসলে…খুব ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল…কেউ ওঠেন নি দেখে ভাবলাম একবার চারদিকটা ঘুরে আসি…আমি ঠিক বুঝতে পারিনি। মৌ এতক্ষন চুপচাপ ছিল…একটু যেন রেগে গিয়ে বলল…তুমি জানো…আমাদের সবার কি অবস্থা…
- না মানে…লালু সাথে ছিল…আরো আগে চলে আসতাম…
দাদু ওর অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন…আচ্ছা…ঠিক আছে…যা হবার হয়ে গেছে…তুমি বাবা…হাত মুখ ধুয়ে নাও…
সবাই মিলে বসে সকালের চা খেতে খেতে গল্প হচ্ছিল, অর্ক আর মামনের জন্য চায়ের বদলে হরলিকস। অরিত্রকে চুপচাপ থাকতে দেখে মামা মৌকে কাছে ডেকে আস্তে করে বললেন… চা খেয়ে নিয়ে একবার অরিত্রর সাথে আলাদা করে কথা বল…ছেলেটা খুব মন মরা হয়ে গেছে। মৌ মাথা নেড়ে জানালো আচ্ছা ঠিক আছে। ওর নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল…ওই ভাবে না বললেই হত। আসলে মামাদের কাছে ও ছোট হয়ে যাচ্ছে এটা সহ্য করতে না পেরে নিজেকে ঠিক রাখতে পারেনি। একটু পরে মামা বেরিয়ে গেল কাউকে ডাকতে,কাল নাকি খাওয়া দাওয়ার তেমন কিছু ব্যাবস্থা করা যায়নি…তাই আজ না করলেই নয়। দাদু অর্ককে সাথে নিয়ে মাছ ধরার জন্য যাদের আসার কথা তারা যদি দেরী করে ফেলে তাই তাগাদা দিতে গেছে। অরিত্র উপরের ঘরে বসে, কয়েকটা ফোন করার ছিল…এক এক করে করা হয়ে গেলে জানলার বাইরে বাগানের দিকে তাকিয়ে বসে দুটো শালিক বেশ কিছুক্ষন ধরে ঝগড়া করছে…তাই বসে বসে দেখছিল। মনটা একটু খারাপও ছিল…না বুঝে সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়ে নিজেকে কেমন যেন অপরাধী মনে হচ্ছিল। যতই ওরা মুখে বলুক ঠিক আছে তবুও খুব খারাপ লাগছিল। মৌ ঘরে ঢুকে ওকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, ঠিক কি ভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছিল না…কখোনো ওকে জোর গলায় কিছু বলতে হবে ভাবেনি…আজ যে কি হয়ে গেল কে জানে। অরিত্র ওকে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল…সবাই খুব খারাপ ভাবছে তাই না? আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারিনি ব্যাপারটা এমন জায়গায় চলে যাবে...
- তুমি আমার উপরে রাগ করেছো…তাই না…
অরিত্র ওকে একেবারে অন্য কথা বলতে শুনে অবাক হয়ে গিয়ে বলল…তোমার উপর রাগ করবো কেন…ঠিকই তো বলেছো…
- সত্যিই রাগ করনি?
অরিত্র, ওর যে কথাটা ওই ভাবে বলে খুব খারাপ লেগেছে বুঝতে পেরে বলল…উঁ হুঁ…এক্কেবারে নয়… এই…একটু হাসবে? কি বিচ্ছিরি লাগছে...
- লাগুক…আমার কি খারাপ লাগছে আর উনাকে এখন আমায় হেসে দেখাতে হবে…
- আচ্ছা বাবা…এখন না হোক পরে না হয় হাসবে…এখন বলতো, যে জন্য এসেছি তার একটা তো হয়ে গেছে, বাকি যেটা আছে সেটা কি বলতে পেরেছো?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…নাঃ…কি করে বলবো বুঝতে পারছি না…
- জানতাম…তো কি করবে?
মৌ ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল…এই…তুমি বলতে পারবে না?
- আমি?
- হুঁ…
অরিত্র একটু ভেবে নিয়ে বলল…কি বলবো? দাদু…আমি আপনার নাতনী মৌ-কে বিয়ে করতে চাই…অনুমতি দিন? ওর হাত পা নেড়ে বলার ভঙ্গী দেখে মৌ না হেসে থাকতে না পেরে বলল…ধ্যাত…তুমি না খালি ইয়ার্কি কর…প্লিজ…কিছু একটা ভাবো…কাল তো চলে যাবো…তার আগে তো বলতে হবে…
- হুম…দাঁড়াও…দেখি কি করা যায়…আচ্ছা তুমি কি তোমার বাবার ব্যাপারটা বলেছো?
মৌ মুখ নিচু করে নিয়ে বলল…না…বলতে পারিনি…সবাই এত খুশী হয়েছে আমাকে দেখে আর পারলাম না বলতে…খুব কষ্ট পাবে…
- ওনারা কিছু জিজ্ঞেস করেন নি?
- করেছিল…আমি অন্য কথা বলে এড়িয়ে গেছি…
অরিত্র একটু ভেবে নিয়ে বলল…বলতে তো হবেই…ঠিক আছে…তুমি চিন্তা কোরো না…আচ্ছা…আমার ব্যাপারে কিছু বলেছো?
- না…তেমন কিছু নয়…তবে…মাসী আর মামীমা মনে হয় কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে…
- তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছিল কি? নাকি তোমার এমনিই মনে হচ্ছে?
- জিজ্ঞেস করেনি…তবে বলছিল…ছেলেটা কেমন…দেখে তো বেশ ভালো মনে হচ্ছে…মানে…একটু অন্য ভাবে…আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না…
- ওক্কে…চলো…চিন্তা করে লাভ নেই…
মৌকে দেখে মনে হল ওর কথা শুনে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে বলল… এই…আমি যাই…মামীমা জিজ্ঞেস করছিল তুমি লুচি বেগুন ভাজা নাকি পরোটা আলুর দম…কি খাবে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল…কাল থেকে যা খাওয়া চলছে … মনে হয় না সুস্থ অবস্থায় ফিরতে পারবো … বলো গিয়ে জল মুড়ি পেলে খুব ভালো হয়…
- ধ্যাত…তাই আবার বলা যায় নাকি …কম করে না হয় খাবে …
- বললে আর কে শুনছে বলো? আতিথেয়তার অত্যাচার যে কি জিনিষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি...
মৌ হেসে ফেলে বলল …এই…ওরকম করে বলছো কেন…
দাদু আর মামার সাথে বসে জলখাবার খেতে খেতে অরিত্রর কথা হচ্ছিল। মৌকে অর্ক ডেকে নিয়ে গেছে মাছ ধরা দেখতে, মামনও সাথে গেছে, দিদি এসেছে তাই আজ ওরা কেউই কলেজে যাবে না। মামীমা সামনে বসে কার কি লাগবে দেখাশোনা করতে করতে বলল… এবারে তেমন কিছু খাওয়াতে পারলাম না, আবার কিন্তু আসা চাই। খেতে খেতে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে আর এদিকে মামীমা বলছে নাকি কিছুই খাওয়াতে পারলো না শুনে অরিত্র মজা করে বলল… এত খাওয়ালে…আমি আর আসছি না বাবা। দাদু পাশ থেকে বললেন…তোমরা ভাই আজকালকার ছেলেপুলেরা খেতেই পারো না…এ আর এমন কি খাওয়া…আমাদের সময়ে যদি দেখতে…খাওয়া কাকে বলে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল…আপনাদের সময়ে তো আর আমাদের মতো এতো চাপ ছিল না…ধীরে সুস্থে সব কিছু করার সময় ছিল। দাদু ওর কথা শুনে বললেন…তা অবশ্য ঠিক তবে তোমাকে কিন্তু ভাই আবার আসতেই হবে…না হলে আমাদের মৌ মাকে কে নিয়ে আসবে বলো…ওর বাবা তো আর কোনোদিন নিয়ে এলো না…কি যে হয়ে গেল…কত করে বলেছিলাম তুমি বিয়ে করতে চাইছো কর…মেয়েটাকে আমাদেরকে দিয়ে দাও। দাদুর কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো অরিত্রর, খাওয়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করল…আপনারা পরে আর যোগাযোগ করেননি? দাদু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন…তা আর করিনি…কতবার ছেলেটা গেছে তার ঠিক নেই…কোনোবারই জামাই এর সাথে দেখা হয়নি…ব্যাবসার কাজে সব সময় বাইরে বাইরে থাকে…মেয়েটার সাথেও দেখা করতে দিতো না ওর মা … যে ফোন নাম্বারটা ছিল সেটাতে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে লাভ হয়নি… ওদেরই একজন কর্মচারীর কাছে জানা গিয়েছিল জামাইকেও নাকি উল্টোপাল্টা বলতো…যাতে আমাদের সাথে না যোগাযোগ রাখে…শেষের দিকে তো খুব অপমান করতো শুনে আমিই যেতে বারন করে দিয়েছিলাম…সেও আজ হয়ে গেল পাঁচ ছ বছর…তুমি বাবা…আমাকে কথা দাও…মৌকে নিয়ে আবার আসবে। অরিত্রর একটু সময় চুপ করে থেকে মনে হল এখনই বলা ভালো, কথা যখন উঠেছে তখন আর দেরী করে লাভ নেই। ও গলাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে বলল…আমার কিছু বলার আছে মৌয়ের ব্যাপারে…একটু সময় লাগবে… বড়রা সবাই থাকলে ভালো হয়।
দাদুর কথায় ঘরের আবহাওয়া একটু থমথমে হয়ে গিয়েছিল… সাথে সাথে অরিত্ররকেও ওইভাবে বলতে দেখে সবাই যেন কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল। সত্যি কথা বলতে কি অপ্রত্যাশিত ভাবে মৌকে পেয়ে বাকি কিছুর ব্যাপারে কেউই সেভাবে ভাবতে পারেনি বা সেভাবে কথা বলার সময়ও ছিল না। বাকি ছিল মাসী আর দিদা…মামীমা গিয়ে ওদেরকে ডেকে নিয়ে এলে অরিত্র বলতে শুরু করল…অনেক কিছু ঘটেছে কিন্তু সবটা হয়তো জানিনা। যেটুকু জেনেছি…মোটামুটি ভাবে বলার চেষ্টা করছি…একটু আগে থেকে না বললে বুঝতে পারবেন না তাই আমাকে দিয়েই শুরু করছি… আমি ছোটবেলা থেকেই আমার দাদু দিদানের সাথে থাকি…মা বাবাকে হারিয়েছি অনেক ছোটোবেলায়… বছর দুয়েক আগে একদিন অফিস থেকে ফেরার সময়ে ট্রেনের খুব গন্ডগোলে অনেক রাতে কোনোরকমে ট্রেনে উঠতে পেরেছিলাম…ওখানেই মৌকে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায়… সাথে কেউ ছিল না…বলতে পারেন…নিতান্তই মানবিক কারনে অত রাতে ওকে ফেলে চলে যেতে না পেরে বাড়ী নিয়ে যাই…বেশ কয়েকদিন পর সুস্থ হয়ে উঠলেও কথা বলতে পারতো না…এমনকি ওর স্মৃতিশক্তিও নষ্ট হয়ে গিয়েছিল…অনেক ভাবে চেষ্টা করেও… ও কে…কোথায় বাড়ী জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি…অনেক ডাক্তারও দেখানো হয়েছিল কিন্তু কিছু লাভ হয়নি…ডাক্তারদের মতে কোনো শক পেয়ে হয়তো এইসব হয়েছে…ভালো হতেও পারে আবার নাও হতে পারে…এই অবস্থাতে ওকে কোনো সরকারী হোমে পাঠানোর কথা আমরা ভাবতে পারিনি হোমগুলোতে মেয়েদের নিয়ে কি নোংরামো হয়। ততদিনে অবশ্য ওর উপরে আমাদের সবার এত মায়া পড়ে গিয়েছিল যে কিছুটা হলেও রিস্ক নিয়ে আমাদের কাছেই রাখা হয়…কিছুদিন পর পূজোর সময় কাকতালীয়ভাবে আমাদেরই পরিচিত একটি মেয়ের কাছ থেকে একটা সামান্য সুত্র ধরে ওর বাড়ীর খোঁজ পাওয়া যায়…কিন্তু বাড়ীর কাউকে পাওয়া যায়নি কথা বলার জন্য…কোথাও যেন বেড়াতে গিয়েছিল। যে সময়ে ওই খোঁজটা পাওয়া যায় তখন আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে গেছি…ওখানে আমি একটা দুর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে যাই ওর সামনে …খুব সম্ভবত আরো একটা শক পেয়ে ওর কথা বলা শুরু হয়েছিল কিন্তু স্মৃতি ফিরে আসেনি…
অরিত্র এতটা বলে থেমে গেলে কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না…সবাই কেমন যেন একটা অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে … অরিত্র যদি ওইদিন ওকে না নিয়ে যেত সাথে করে তাহলে মেয়েটার কপালে কি হতে পারতো ভেবে সবাই যেন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। দিদা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে ফেলে উঠে এসে অরিত্রকে জড়িয়ে ধরলো…কিছু একটা বলতে চাইলো কিন্তু কান্নার দমকে বোঝা যাচ্ছিল না…মামীমা এসে দিদাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলল…মা…ওকে বলতে দাও… বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই তো ভগবান ওকে পাঠিয়েছিল। দিদাকে কোনোরকমে শান্ত করে সরিয়ে নিয়ে গেলে দাদু চোখের জল মুছতে মুছতে বললেন…ভাই…তারপর বলো…
তারপর দার্জিলিং থেকে ফিরে এসে ওর বাড়ীতে লোক পাঠিয়ে খোঁজ নেওয়া হয় কি হয়েছিল জানতে কারন আমরা না জানলেও অনুমান করেছিলাম যে নিশ্চয় কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটনা আছে আর সেটা না জানা পর্যন্ত ওকে সরাসরি ফিরিয়ে দেওয়াটা ঠিক হবে না…ওর মা মুখ না খুললেও পরে ওর ভাই বোনের সাথে আলাদা করে দেখা করে খোঁজ নিয়ে জানা যায় ওদের মা মৌকে ভীষন ভাবে টর্চার করতো…বেশির ভাগটাই মানসিক…ভালো যা সব কিছু নিজের ছেলে মেয়ের জন্য কিন্তু ওকে একেবারে দেখতে পারতো না…কোথাও একা একা যেতে দিতো না…কারুর সাথে মিশতে দিতো না…ভাই বোনেরা কিন্তু ওকে ভীষন ভালোবাসতো কিন্তু মায়ের ভয়ে কিছু করতে বা বলতে পারতো না… তারপর একদিন সন্ধে থেকে নাকি দিদিকে পাওয়া যাচ্ছিল না…মা একাই বাড়ীতে ছিল ওই সময়…ওরা ভাই বোন পড়তে গিয়েছিল…
মামীমা জিজ্ঞেস করল…ওর বাবা মানে রজতদা কিছু বলে না?
অরিত্র কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল…উনি আর নেই। বছর তিনেক আগে একটা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। ঘরের মধ্যে শ্মশানের নিস্তব্ধতা… দাদু হাতের পেছন দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে ধরা গলায় বললেন… ভগবান ওকে শান্তিতে রাখুন… একটাই দুঃখ নিয়ে হয়তো চলে গেছে অনেক চেষ্টা করেও মেয়েটার জন্য কিছু করতে পারলো না। মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন… কাকে যে ঘরে নিয়ে এলো… সংসারটাকে শেষ করে দিল একেবারে। আরো একটা খারাপ খবর পেয়ে যেন মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছিল না কারুরই। বেশ কিছুক্ষন সবাই চুপচাপ থাকার পর মামা ওকে তারপরে কি হয়েছে বলতে বললেন…
পরদিন ওদের বকখালি যাবার কথা ছিল…মা যাওয়া ক্যানসেল করে দেয় কিন্তু দিদিকে খোঁজার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায় নি…উল্টে ওদের ভাই বোনকে মারধোর করে যেহেতু ওরা দিদির খোঁজ করতে বলেছিল। এরপর ওদের মাকে না জানিয়ে ভাই বোনকে এক জায়গায় নিয়ে আসা হয় যদি ওদেরকে দেখে মৌ চিনতে পারে কিন্তু সেটাও কাজে দেয়নি। ওর কোনো রকম উত্তেজনা যাতে না হয় কারন তাতে আরো খারাপ হতে পারে বলে ডাক্তার বারবার সাবধান করে দিয়েছিল তাই ভাই বোনের পরিচয় দেওয়াও যায়নি। ওরা ভাইবোনে মাঝে মাঝে এসে দেখে যেত…এই ভাবে চলছিল…এর মাঝে আমি দুবার কিছুদিনের জন্য বাইরে গিয়েছি…মাঝে আমার জেঠতুতো দিদির বিয়ে হয়, তারপর আমি কিছুদিনের জন্য যখন আবার বাইরে তখন দাদু একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাদুর ওই অবস্থা দেখে মৌয়ের কি হয়েছিল জানিনা… কান্নাকাটি করতে করতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল…পরের দিন সকালে জ্জান ফিরে আসে… নিজের পুরোনো স্মৃতি ফিরে আসে কিন্তু আমি যে ভয়টা পাচ্ছিলাম তাই হয়…মাঝের ঘটনাগুলো ওর স্মৃতি থেকে হারিয়ে যায়। এর মধ্যে ও আমাদের বাড়ী থেকে চলে যেতে চাইলে ওর কি হয়েছিল আর চলে গেলে কি হতে পারে বোঝাতে থাকতে রাজী হয় কিন্তু নিজেকে ভীষন ভাবে গুটীয়ে নেয়…কারুর সাথে কথা বলতো না…চুপচাপ নিজের ঘরে বসে থাকতো। ওর ভাই বোন এলে যা একটু আধটু কথা বলতো…যতটা সম্ভব বাড়ীর সবাই অনেক চেষ্টা করেছিল ওর সাথে কথা বলার কিন্তু তেমন কিছু কাজ হয়নি প্রথম দিকে…তারপর আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও একেবারে আগের মতো হতে হতে বেশ কিছু দিন কেটে যায়…সেটাও এই কয়েকদিন আগে…
সবাই চুপচাপ বসে শুনছিল, কারুরই যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না এমন হতে পারে… প্রাথমিক মানসিক ধাক্কাটা এর মধ্যে একটু একটু করে কেটে উঠেছে সবার ভেতরে... যাই হোক না কেন এখন তো মেয়েটার আর কোনো ভয় বা সমস্যা নেই। মামা অরিত্রকে থামতে দেখে চায়ের কথা বলে বললেন… অরিত্র এক নাগাড়ে কথা বলছে …ওরও কিছুটা বিশ্রাম হয়ে যাবে। মামীমা উঠে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলে পর চা খেতে খেতে মামা বললেন ‘এখন তো আর কিছু সমস্যা নেই…তাই তো’? অরিত্র একটু চুপ করে থেকে বলল ওর মায়ের দিক থেকে ঠিক কি ঘটেছিল যার জন্য ওকে বাড়ী থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল সেটা এখোনো জানা নেই তবে ও মায়ের মুখোমুখি হতে রাজী হয়েছে। ওদিকটা ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে খুব ভালো হয়, আর কোনো সমস্যা থাকবে না তাহলে। যত সমস্যা তো সম্পত্তি আর টাকা নিয়ে তাই ওর ইচ্ছে সবকিছু দিয়ে দেবে। ইচ্ছে আছে এখান থেকে ফিরে যাবার পর কিছু একটা ভেবে ঠিক করে ফেলতে ওই ব্যাপারে। আর, এদিকে আপনাদের সাথেও দেখা হয়ে গেল... মৌ সবকিছু ফিরিয়ে দেবে শুনে মামীমা বেশ অবাক হয়ে গিয়ে বলল... কেন ফিরিয়ে দেবে, ওর নিজের কথা ভাবতে হবে না? ওরও তো ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে...এতক্ষনে শেষ কথাটা বলার সুযোগ পেয়ে অরিত্র বলল... ওর টাকা যদি ও ফিরিয়ে দিতে চায় তো আমাদের কোনো কিছু বলার নেই বা অসুবিধাও নেই। মামা বোধ হয় বুঝতে পারলেন ও কি বলতে চাইছে...ওর দিকে তাকিয়ে বললেন...যদি কিছু মনে না করো, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তুমি কি...অরিত্র মুখটা নিচু করে নিয়ে বলল...ঠিকই ধরেছেন... আপনাদের অমত না থাকলে আমরা...
দাদু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় অর্ক হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে ঘরে ঢুকে বলল ‘দাদু…কি বড় একটা কাতলা মাছ উঠেছে দেখবে চলো। অর্ক দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে মাছের যা সাইজ দেখালো তাতে সবার হেসে ওঠা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। দাদু গম্ভীর ভাবে বললেন ‘আচ্ছা…উঠুক…তোর দিদি কোথায়’?
- কোন দিদি?
- কোন দিদি আবার…মৌ। যা ডেকে নিয়ে আয়...
অর্ক একটু যেন মুষড়ে গেল, ভেবেছিল এত বড় একটা খবর দিলে খুশি হবে সবাই। তা নয়…ওকে এখন দিদিকে ডেকে আনতে হবে। বড়রা যে কখন কি চায় বোঝা দায় ভেবে ‘আচ্ছা…যাচ্ছি’ বলে মুখ গোমড়া করে বেরিয়ে গেল। একটু পরে মামনকে সাথে নিয়ে মৌ ফিরে এলেও অর্ক আর ফিরে আসেনি…ওর কাছে বড়দের গোমড়া মুখ দেখার থেকে মাছ ধরা দেখা অনেক ভালো। মৌ সবাইকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল ‘দাদু কি হয়েছে… অর্ক মুখ ভার করে ফিরে গেল… বকা দিয়েছো নাকি? দাদু আগের মতোই গম্ভীর হয়ে বললেন ‘না… তোকে বকবো বলে ডেকে আনালাম’।
- কেন দাদু…আমি আবার কি করলাম?
দাদু এবারে হাসি মুখে বললেন ‘আয় মা…আমার কাছে আয়। মৌ পাশে গিয়ে দাঁড়াতে ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে বললেন ‘তুই কি রে? এত বড় একটা খবর…কাল থেকে একেবারে চেপে গেছিস। দাদু কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে মৌ লজ্জায় মুখ লাল করে নিয়ে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। সবাই খুশী মনে হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে...মামন ব্যাপারটা কি হতে পারে আঁচ করে মায়ের কানের কাছে গিয়ে ফিফফিস করে বলল ‘মা… দিদি আর অরিত্রদা কি… ইয়ে… মানে’…
মামীমা মেয়েকে আস্তে করে মিষ্টি একটা বকা দিয়ে বলল ‘পাকামো করতে হবে না…যা এখান থেকে… পরে শুনবি। মায়ের বকা খেয়েও মামন আদুরে গলায় বলল ‘ও মা…বলো না ঠিক বলছি কিনা। দাদু হেসে ফেলে বললেন ‘থাক না… কি হয়েছে… দিদির বিয়ে… ও আনন্দ করবে না তো কে করবে। দাদু বলে দিয়েছে থাকতে তাই আর কে কি বলছে দেখার দরকার নেই। মামন ওর কিশোরী সুলভ আনন্দের সাথে দিদিকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল ‘দিদি… আমি কিন্তু বুঝতে পেরেছিলাম’…
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
এরপর অরিত্র দাদু আর দুই জেঠুর সাথে ওনাদের ফোনে আলাপ করিয়ে দিয়েছে। এমনিতেই মৌ ওর হারানো সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ায় সবাই খুশী ছিল তার উপরে ওনাদের সাথে আলাপ হওয়ায় সবাই আরো খুশী। মৌয়ের দাদু ও মামা দুজনেই চাইছেন বিয়েটা ওনারাই দিতে চান, অরিত্রর দাদু বা জেঠুরা ওনাদের ব্যাপারটা বুঝে আর না করেননি তখনকার মতো, ভেবে রেখেছেন ওনারা এলে সামনা সামনি কথা বলে ব্যাপারটা ঠিক করে নেবেন কারন বিয়েটা যেভাবে হবে ভাবা আছে তাতে খরচের অঙ্কটা বেশ মোটা হবে । তার আগে অবশ্য অরিত্র ওর কে কে আছে, কে কি করে…কোথায় থাকে…মোটামুটি সব বলেছে। ঠিক করা হয়েছে সামনের সপ্তাহের শেষে মামা কোলকাতা এসে অরিত্রর বাড়ী আর সাথে ভবানীপুরের বাড়ীতে যাবেন কথাবার্তা বলার জন্য।
মৌ সেই যে গেছে, লজ্জায় আর এমুখো হয়নি। মাঝে মাসী একবার অরিত্র কিছুক্ষনের জন্য উঠে গেলে ওরা ব্রাম্ভন কিনা খোঁজ নিতে বলায় দাদু বলেছেন ‘তোর বিয়েটা তো জাতপাত সব কিছু দেখে তবে দিয়েছিলাম… পারলি কি সংসার করতে’? মাসী ‘গ্রামের লোকজন কি বলবে…আত্মীয় স্বজনরাই বা কি ভাববে’ বলতে গেলে দাদু খুব রেগে গিয়ে বললেন ‘রাখ তোর আত্মীয় স্বজন, গ্রামের লোক… কিছু হয়ে গেলে কেউ দেখতে তো আসেই না উল্টে মজা লোটে …সব থেকে বড় কথা…মেয়েটা সুখী হবে… আর কিছু দেখার দরকার নেই আমার… তোর ভালো না লাগলে আমার কিছু করার নেই’।
এতদিন পর হঠাৎ বোন এসেছে খবর পেয়ে কোনো রকমে রাতটা কাটিয়ে এগারোটা নাগাদ সুমনা ওর ছেলে পাপাইকে নিয়ে আসানসোল থেকে এসেছে, ওর বর আসতে পারেনি অফিসের জরুরী কাজের জন্য। আরো একটু আগে পৌছোতে পারতো কিন্তু রাস্তায় বাসটা খারাপ হয়ে গিয়ে দেরী হয়ে গেল। মামনের কাছে ছেলেকে ধরিয়ে দিয়ে মৌকে জড়িয়ে ধরে দুবোনের এক প্রস্থ হাসি কান্নার পর দুজনে বসে গল্প করছিল। মৌ এর যখন চার বছর বয়স…ওর মা মারা যাবার বেশ কিছুদিন পর বাবার সাথে মামা বাড়ী এসে দু বোনের শেষ দেখা হয়েছিল। এখন কিছু কিছু কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, সেই সব দিনের কথা একে অপরকে মনে পড়িয়ে দিতে দিতে কখোনো চোখে জল… কখোনো হাসি। গল্প করতে করতে সুমনা উঠে গিয়ে আলমারী খুলে একটা পুতুল বের করে ওকে দেখিয়ে বলল ‘চিনতে পারছিস মৌ’? পুতুলটা দেখে অনেক কথা মনে পড়ে গেল…ওর খুব প্রিয় পুতুলটা ফিরে যাবার সময় নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, বাড়ী ফিরে কত মনে পড়তো কিন্তু কোনো উপায় ছিল না ফেরত পাবার…বাবা এত ব্যাস্ত যে একটা তুচ্ছ পুতুলের জন্য আর এত দুরে আসতে পারতো না। তারপর সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই ভুলে গিয়েছিল। পুতুলটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ‘দিদি…তুই এত যত্ন করে রেখেছিস? একেবারে নতুনের মতো আছে এখোনো। সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘তোর এত সুন্দর পুতুল আছে কিন্তু আমার নেই ভেবে খুব হিংসা হোত…বুঝলি…তুই চলে যাবার আগে ইচ্ছে করে সরিয়ে রেখেছিলাম এই ভেবে যে যদি তুই ভুলে যাস…কি খুশী হয়েছিলাম জানিস…তুই যখন চলে গেলি ওটা না নিয়ে… রোজ মাকে লুকিয়ে এক বার করে দেখতাম, তারপর একদিন মা দেখতে পেয়ে কি মার মেরেছিল… কেন আমি মনে করিয়ে দিই নি তোকে… তারপর যখন আর তুই এলি না… পুতুলটা দেখে খুব কষ্ট হোত। মৌ পুতুলটা হাতে নিয়ে এক মনে দেখতে দেখতে বলল ‘মা কিনে দিয়েছিল…খুব ভালো করেছিলি রেখে দিয়ে… একটা পুতুল হলেও কি হয়েছে মায়ের স্মৃতি হিসেবে তো থেকে গেছে’।
- এই মৌ...নিয়ে যাস কিন্তু এবারে…
- না রে... থাক, তোর কাছে রেখে দে… কত যত্ন করে রেখেছিস এত বছর…
ওদের কথার মাঝে মামন পাপাইকে নিয়ে এসে বলল ‘দেখ না দিদি…কি কাঁদছে…দাদুর কাছেও থাকছে না…ক্ষিধে পেয়েছে বোধ হয়’।
- না…না…এই তো আসার সময় একটা গোটা ক্যাডবেরী খেতে খেতে এল…এখন ওনার খেলা চাই…এই সময়টা আমাদের পাশের বাড়ীর বাপ্পা কলেজ থেকে ফিরে এসে ওর সাথে হুটোপুটি করে।
মৌ পাপাইকে কোলে নিয়ে আদর করে থামাবার চেষ্টা করেও না পেরে মামনকে বলল ‘এক কাজ কর না মামন…ওর কাছে নিয়ে যা…ঠিক চুপ করিয়ে দেবে। সুমনা হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল ‘তাই নাকি…খুব বাচ্চা ভালোবাসে’?
- হবে হয়তো…বাচ্চা আর কুকুর…ওর কাছে যেন অপরিচিত নয়…একবার দেখলেই যেন বন্ধু হয়ে যায়…জানিস তো কাল এসেই লালুর সাথে জমিয়ে নিয়েছে।
মামন চলে যাবার পর সুমনা চোখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল ‘এই…মৌ…এই ও-টা কে রে? কেমন যেন একটু অন্যরকম গন্ধ পাচ্ছি। মৌ হাসি হাসি মুখে বলল ‘কেউ একটা হবে হয়তো’।
- যাই বল…দারুন জুটিয়েছিস কিন্তু…যেমন দেখতে…তেমনি চেহারা…
- হুমম…লোভ হচ্ছে নাকি রে দিদি?
- তা…যদি তোর ভাগ দিতে অসুবিধা না থাকে…আমার নিতে কি ক্ষতি আছে… বলে হেসে ফেলল সুমনা।
- আ-চ্ছা…খুব শখ…তাই না… পুতুল নিয়েছিস… কিচ্ছু বলিনি…এটায় কিন্তু ভাগ বসাতে দিচ্ছিনা…তবে…পুরোনো হয়ে গেলে না হয়…ভেবে দেখতে পারি…
- না বাবা…থাক…তোর জিনিষ তোর কাছে…আমার যা আছে সেটাই ভালো…
- এই দিদি…তোরটা কেমন রে?
- ভালোই…তবে…তোরটার মতো এত হ্যান্ডসাম নয়…
দুবোনে গল্প করতে করতে খুব হাসছিল, মামন ফিরে এসে বলল ‘দিদি… ঠিকই বলেছিলে গো…সত্যিই চুপ করিয়ে দিয়েছে…দেখবে চলো কেমন সুন্দর খেলছে’।
দুপুরে সবাই এক সাথে খেতে খেতে কথা হচ্ছিল। সবাই বলতে দাদু, মামা আর ওদের চার ভাই বোনের সাথে অরিত্র। মাসী আর মামীমা পরিবেশনে ব্যাস্ত। পাপাইকে নিয়ে গিয়ে দিদা ঘুম পাড়াচ্ছে। মামীমা আরো একটু ভাত দিতে গেলে অরিত্র প্রায় থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলল ‘মামীমা…সত্যি বলছি আর পারবো না। তারপরেও মামীমা জোর করতে গেলে মামা হেসে ফেলে বারন করে বললেন ‘আরে…ছেড়ে দাও…দেখছো না কেমন থালার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না বলছে। মামীমা হেসে ফেলে বলল ‘আচ্ছা ঠিক আছে… অরিত্র…কিছু মনে কোরোনা…তোমরা কি এদেশীয় নাকি ওপার বাংলার? অরিত্র একটু মজা করে বলল ‘খাঁটি নয় মামীমা…ভেজাল আছে। ওর কথা বলার ধরন দেখে সবাই হেসে ফেললে বলল… ‘আমার দাদু এদেশীয়…দিদান ওপার বাংলা…তবে দিদান কোনোদিন যায়নি…এখানেই জন্ম আর বাবার আদি বাড়ী হুগলী…তো…আমি ভেজাল ছাড়া আর কি। দাদু হাসতে হাসতে বললেন ‘তাহলে ওপার বাংলার ভাগটা খুবই কম…বেশির ভাগটাই এদিকের…তাই তো’? অরিত্রও হাসতে হাসতে বলল ‘আমারও তাই মনে হয়’।
- তা তোমাদের বাড়ীতে রান্না বান্না কি ধরনের হয়…এদিকের নাকি ওদিকের?
- বোঝা খুব মুশকিল…ইলিশ আর চিংড়ি দুটোই হয়…তবে মনে হয় এদিকের ভাগটাই বেশী…দিদানের বাবার ট্রান্সফারের চাকরী ছিল… দু তিন বছর অন্তর জায়গা পালটাতে হোতো বলে দিদানের মায়ের অসুবিধার জন্য নাকি রাঁধুনি ছিল…মেদিনীপুরের লোক…
সুমনা হেসে ফেলে বলল ‘মা…এখন তোমার ঘটি না বাঙ্গাল জেনে কি হবে…পছন্দ না হলে কি পালটানো যাবে নাকি… আমার বেলায় না হয় আগে থেকে ঘটি না হলে বিয়েই দেবে না জ়েদ ধরে বসেছিলে…মৌ এর বেলা তো আর তা হবে না’।
- ওমা…তাই বলে কি জানতে ইচ্ছে হবে না? অরিত্র্, তুমি কিছু মনে করনি তো?
- না না… মনে করার কি আছে…
সুমনা আসায় মামন আজ মৌ দিদির সাথে শুতে পায়নি…মুখ ভার করে মায়ের কাছে গিয়ে শুয়েছে। সুমনা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিল আর ওদিকে মৌ জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে …আজ বোধহয় পূর্নিমা…চারদিক মিষ্টি জ্যোতস্নায় ভেসে যাচ্ছে। ফ্যানটা এত আস্তে ঘুরছে যে হাওয়া আছে কিনা বোঝা না গেলেও জানলা দিয়ে ঝির ঝির করে দখিনা হাওয়া ঘরের ভেতরে এসে যেন গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে যাচ্ছে। সুমনা পাপাইকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল ‘কি রে মৌ… এত চুপচাপ…কি ভাবছিস’?
- চাঁদের আলোয় বাইরেটা কি সু্ন্দর লাগছে …তাই না… সত্যি গ্রামে না এলে প্রকৃতিকে ঠিক মতো চেনা যায় না…
- বুঝেছি…চাঁদের আলো দেখছিস শুধু নাকি আর একজনের কথা ভাবছিস রে? কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করছে…তাই না রে?
- এই দিদি…তুই না খালি পেছনে লাগিস...
- আচ্ছা বাবা…আয়…শুয়ে শুয়ে গল্প করবো…
দিদির হাতটা জড়িয়ে ধরে মৌ চুপচাপ শুয়ে ছিল। সুমনা ওর খুব কাছে সরে এসে ফিসফিস করে বলল ‘এই মৌ…কেমন পারে রে’? মৌ ওর প্রশ্নের মানে বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করল ‘কি’?
- আহা…ন্যাকা…কি আবার…কেমন করতে পারে?
মৌ ভীষন লজ্জা পেয়ে গিয়ে ভাবছিল…ইস দিদিটা যে কি… কি সব জিজ্ঞেস করছে। বিয়ের পর মেয়েদের বোধহয় মুখে কিছু আটকায় না। সুমনা ওকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল ‘খুব ভালো…তাই না’?
- কি করে বলবো?
- এই বল না…আমি কি ভাগ বসাবো নাকি? তোর জিনিষ বাবা তোরই থাকবে…
- জানি না রে…কিছু হলে তো বলবো কেমন…
- ধুস…কিছু নাকি হয়নি…আজকাল গ্রামেই সব কিছু হচ্ছে…আর তোরা শহরে একই বাড়ীতে থাকিস…আর কিছু করিস নি…বললেই হোলো…
- সত্যি বলছি রে দিদি…বিশ্বাস কর,কিছু হয়নি…ও ওরকম নয়…
- হুমম…করলাম…তাহলে কি শুধু চুমু খেয়েছে…আর…হাত দিয়েছে… তাই তো?
- শুধু প্রথমটা…
- এই মৌ…আমি কিন্তু আর বিশ্বাস করতে পারছি না…এই বল না…
- সত্যি বলছি…
- তোর ইচ্ছে করে না?
- কি জানি…তেমন কিছু না…
- ওকে দেখে বুঝতে পারিস না? হয়তো তুই না করে দিবি ভেবে ইচ্ছে থাকলেও এগোয় না...
- তেমন কিছু মনে হয়নি…বিশ্বাস কর…
- ঠিক আছে বাবা…করলাম…
কিছুক্ষন চুপ করে থেকে মৌ দিদিকে ডাকলো ‘এই…দিদি’
- কি?
মৌ কিছু না বলে চুপ করে থাকলে সুমনা বলল ‘বল না…কি বলবি’।
- প্রথম প্রথম খুব লাগে…তাই না?
সুমনা বোনকে জড়িয়ে ধরে বলল ‘একটু তো লাগবেই…তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই’।
- তাই? ঠিক বলছিস?
- অবশ্য ছেলেদের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে…
দিদির কথা শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে জিজ্ঞেস করল ‘এই দিদি…তোর লাগেনি’?
- উঁ…
- বল না দিদি…
- লেগেছিল…
মৌকে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনা তারপরেই ফিসফিস করে বলল… খুব লেগেছিল…তবে ভালো। মৌ দিদির বুকে মুখ গুঁজ়ে চুপ করে শুয়ে কিছু একটা হয়তো ভাবছিল, সুমনা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলল ‘এই…মৌ’
- উঁ…
- তোরা নাকি কাল চলে যাবি?
- হ্যাঁ…সোমবার ওর অফিস আছে।
- আর একটা দিন থাক না… কতদিন পর দেখা হল…
- আমারও তো ইচ্ছে করছে…দেখি বলে দেখবো…
- এই…শোন না…ভালো করে বলবি কিন্তু…
- আচ্ছা…
- এই মৌ...
- হু...
- তোর কথা শুনবে তো?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিজের মনেই যেন বলল... জানিস তো দিদি, মা যে আমাকে দেখতে পারতো না তাতে আমার আর একটুও দুঃখ হয় না। সেদিন যদি বাড়ী থেকে না বেরিয়ে আসতাম তাহলে কি ওর সাথে কোনোদিন দেখা হত...
বোন কি বলতে চেয়েছে ওর প্রশ্নের উত্তরে সেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা ছিল না। সুমনা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সত্যিই তোর কপালটা ভালো রে, সেদিন যদি ওর জায়গায় অন্য কারুর হাতে পড়তিস তাহলে কি হতে পারতো ভাবতেই ভয় লাগে। মৌ আস্তে করে বলল... ওর কাছে থাকলে আমার কেন জানি না... মনে হয় আর কোনো ভয় নেই...যাই হোক না কেন ও আমাকে ঠিক আগলে রাখবে...
পরের দিন সকালে অরিত্র ফিরে যাওয়ার কথা তুলতেই মামীমা এক কথায় নাকচ করে দিয়ে বলল…না…না…তা কি করে হয়। এতদিন পরে মেয়েটা এসেছে, অন্তত আর একটা দিন থাকতেই হবে। মামীমা এত আন্তরিকভাবে থাকার কথা বলল যে না বলার কোনো উপায় ছিল না, তবুও একবার শেষ চেস্টা করতে গিয়ে মৌয়ের দিকে তাকালে ও এমনভাবে ‘আমি কি জানি ...তুমি দেখো কি করবে’ বলল যে তাতে পরিস্কার হয়ে গেল ওর থাকার ইচ্ছেটাই বেশী। আর কিছু করার নেই দেখে অরিত্র থাকতে রাজী হয়ে যেতে মামীমা বলল... যাও না আজ সবাই মিলে শুশুনিয়া পাহাড় দেখে এসো। মামন পাশেই ছিল, মায়ের কথা শুনে খুব খুশী হয়ে বলল... হ্যাঁ মা, খুব ভালো হবে। অর্ক তো শুনেই লাফাতে শুরু করে দিল...পাহাড় দেখার থেকে ওর বেশী আনন্দ হচ্ছে গাড়ীতে করে ঘুরতে যেতে পারবে।
সাড়ে এগারোটা মতো বাজে। অরিত্রর সাথে পাপাই আর অর্ক, দূর্গামন্ডপের মেঝেতে তিন অসমবয়সীর খেলা চলছে জোর কদমে...আরো একজন অবশ্য সাথে আছে, সে হল লালু। অরিত্রর বুকের উপরে চেপে বসে পাপাই নাচন কোদন চালিয়ে যাচ্ছে সমানে, নাচন কোদনের সাথে চলছে চিল চিৎকার। মাঝে মাঝে অর্ক আর পাপাইয়ের গলার আওয়াজ এত বেড়ে যাচ্ছে যা লালুও থাকতে না পেরে ওদের সাথে গলা মেলাচ্ছে ভো-উ-উ ভো-উ-উ করে। মাঝে একবার দিদা এসে লালুকে মন্দীরের চাতালে দেখতে পেয়ে তাড়া করতে গেলে লালু দৌড়ে গিয়ে দূর্গা প্রতিমার কাঠামোর আড়ালে লুকিয়ে পড়লে দিদা আর কিছু করতে পারেনি। ঠাকুমা স্নান না করে মন্ডপে উঠতে পারবে না বুঝতে পেরে অর্ক বক দেখিয়ে বলেছে
পা-র-বে না...পা-র-বে না...লালুকে তাড়াতে পারবে নাআআআআ... নাতির সাথে না পেরে ঠাকুমা নিজের মনে বকতে বকতে ফিরে গেলে পর লালু বেরিয়ে এসে লেজ নাড়াতে নাড়াতে যেন অর্ককে বলতে চেয়েছে...ভাগ্যিস ঠাকুমাকে ভাগিয়ে দিলে...না হলে আমার অবস্থা খারাপ করে দিতো...
একটু পরে মামন এসে তাড়া লাগালো...অরিত্রদা...দিদি ডাকছে, এখুনি চলো। একটু পরে তিন মুর্তিমানকে ধুলো মাখা অবস্থায় দেখে ওদের তিন বোনের হাসি যেন আর থামে না। ওরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে দেখে পাপাইও কিছু না বুঝে ওদের হাসিতে যোগ দিয়েছে দেখে অরিত্র নিজের দিকে তাকিয়ে দেখে বলল... কি হয়েছে বাবা এত হাসির, একটু না হয় ধুলো লেগেছে। মৌ মুখে হাত আড়াল করে হাসি চাপতে চাপতে বলল... একটু ধুলো? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দেখো একবার। ওদিক থেকে সুমনা থাকতে না পেরে বলল... এই, চল তো তিনটেকে পুকুরে নিয়ে যাই। সবাই মিলে পুকুরে স্নান করতে যাবে শুনে অর্ক হৈ হৈ করে উঠে লাফাতে শুরু করলে সুমনা ভাইকে আদরের বকুনি দিয়ে বলল...এই বাঁদর...আর লাফাতে হবে না...দাদাকে নিয়ে যা, আমরা আসছি...বুঝলি?
পুকুরটা বেশ বড়ই...টলটলে পরিস্কার নীল জল...ঘাটের পাশেই একটা বেশ ঝাঁকড়া আম গাছ থাকায় ছায়া হয়ে আছে জায়গাটা। শান বাধানো ঘাটে বসে ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে পাপাইকে জলে দাঁড় করিয়ে ধরে রাখতে হয়েছে, যা ছটপটে ছেলে হাত ফসকে কখন জলে পড়ে যাবে তার ঠিক নেই। অর্ক কোমর পর্যন্ত জলে নেমে গিয়ে পাপাইয়ের দিকে জল ছেটালে পাপাইও ওর ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে মামার দিকে জল ছেটাবার চেস্টা করে খিল খিল করে হেসে গড়িয়ে পড়ছে। ওদের মামা ভাগ্নের জল কেলী চলতে চলতে একটু পরেই ওরা তিন বোন চলে এলো সাজগোজ করে। টাইট চুড়িদার পরে ওড়না বুকের উপর দিয়ে নিয়ে এসে কোমরে গিঁট মেরে বেঁধে রেখেছে যাতে খুলে না যায়। ওরা এসে যেতেই অর্ক ঝাঁপ দিলো জলে... জল ছিটিয়ে সাঁতার কাটতে শুরু করলেই পাপাইকে আর ধরে রাখা যাচ্ছিল না...ওকেও মামার মতো জলে নামতে দিতে হবে। সুমনা জলে নামতে নামতে ওকে সাঁতার জানে কিনা জিজ্ঞেস করায় অরিত্র উত্তর দিলো... জানি, তবে অনেক দিন হয়ে গেল জলে নামা হয়নি। মৌ জলে পা ডুবিয়ে জল ছেটাতে ছেটাতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...সত্যি তুমি সাঁতার জানো? অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... চলো, তোমাকে সাঁতার শিখিয়ে দি আজ। মৌ হাত দিয়ে একটু জল ওর গায়ে ছিটিয়ে দিয়ে বলল... ধ্যাত, কেউ এসে গেলে? ওদিকে ওরা দু বোনে গলা অব্দি জলে নেমে মৌকে ডাকাডাকি করলেও কিছুতেই যাবে না দেখে অরিত্র পাপাইকে কোলে নিয়ে কিছুটা জলে নেমে গিয়ে ওর দিকে তাকালে মৌ কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে উঠে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বোঝালো ওকে ধরতে হবে। এক একটা করে ধাপ নিচে নামতে নামতে কখন ও অরিত্রকে জড়িয়ে ধরেছে নিজেই বুঝতে পারেনি। মৌ ভালো করে ওকে জড়িয়ে ধরে থেকেও ভয় পাচ্ছে দেখে অরিত্র আস্তে করে বলল... আমি ধরে আছি তো, কিছু হবে না। মৌ ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আস্তে করে বলল... কি করবো ভয় করলে...
বুক পর্যন্ত জলে নেমে ও আর কিছুতেই নামবে না দেখে অরিত্র ওখানেই দাঁড়িয়ে গেছে... একটু একটু করে ভয় কেটে গিয়ে মৌ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক...ওদের ভাইবোনের সাঁতার কাটা দেখতে দেখতে পাপাইয়ের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল... এই যে দুষ্টু ছেলে, মামার কোলে খুব আদর খাওয়া হচ্ছে...না। পাপাই মাসির গালে ওর ছোট্ট আঙ্গুল দিয়ে খামচানোর চেস্টা করতে করতে উত্তরটা দিল ওর অবোধ্য ভাষায়। অরিত্র হেসে ফেলে জিজ্ঞেস করল...কিছু বুঝলে? মৌ পাপাইকে আরো একটা চুমু দিয়ে আস্তে করে বলল...বুঝেছি, ও বলছে...মামা তো আর একা আমাকে আদর করে না...তোমাকেও তো করে।
একটু পরেই সুমনা ফিরে এসে পাপাইকে নিয়ে গেছে স্নান করিয়ে বাড়ীতে দিয়ে আসতে না হলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে আর অরিত্ররও আর স্নান করা হবে না। মামন আর অর্ক ওদিকে কে আগে সাঁতার কেটে পুকুরের ওপারে গিয়ে ফিরে আসতে পারবে দেখাতে গিয়ে সাঁতরাতে শুরু করেছে, এখন আর কেউ নেই ওরা কি করছে দেখার... অরিত্র ওকে আস্তে করে বলল...এই, নাকটা চেপে ধরো না এখুনি। মৌ অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে নাক চেপে ধরলে ওকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ভালো করে ধরে টুপ করে জলে ডুব দিয়েছে... হঠাৎ করে ওইভাবে জলে ডুব দেওয়ায় মৌ ভীষন ভয় পেয়ে গিয়ে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে...ওর আর কিছু বোঝার মতো অবস্থা ছিল না... একটু পরে যখন জলের ভেতর থেকে উঠে এলো দুজনে, ততক্ষনে মৌ বুঝেছে কি হয়েছে... ভালো করে নিশ্বাস নিতে নিতে ওর বুকে গোটা কয়েক দুমদাম করে কিল মেরে হাঁপাতে হাঁপাতে কোনো রকমে বলেছে...পাজী কোথাকার। অরিত্র কিছু না বলে মিটমিট করে হাসতে হাসতে বলল...তোমার ভালো লাগেনি? ততক্ষনে মৌ একটু স্বাভাবিক হয়ে এসেছে...ভাইবোন তখোনো সাঁতার কেটে যাচ্ছে দেখে ওর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল... আগে থেকে তো বলবে। অরিত্র এদিক ওদিক দেখে নিয়ে বলল...তাহলে আর একবার? মৌ দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে হাসি মুখে ঘাড় কাত করে বুঝিয়েছে ওর কোনো আপত্তি নেই। আগে থেকে জানা থাকায় বুক ভরে হাওয়া নিয়ে এবারের অদৃশ্য হওয়াটা আরো বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে...ওরাই জানে ঠিক কি কি হয়েছে সবার চোখের আড়ালে...
দুপুরে খাওয়ার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ওরা। পেছনের সিটে ওরা তিন বোন, সামনে অর্কর কোলে পাপাই। দুপুরের পর থেকে আকাশে মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে দেখে মনে হচ্ছে বিকেলে ঝড় বৃষ্টি হলেও হতে পারে। সারা রাস্তাটা লাল কৃষ্ণচুড়া ফুলের গাছে ভরা। প্রায় সব কটা গাছই ফুলে ফুলে ছয়লাপ...যেন মনে হচ্ছে আগুন লেগেছে... মৌ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে দেখতে দিদিকে উদ্দেশ্য করে বলল... এই দিদি, কি সুন্দর লাগছে না... সুমনা ওর বোনের হাতে আস্তে করে চিমটি কেটে কানে কানে বলছে...ভালো তো লাগবেই...তোর মনে যে এখন বসন্ত। রাস্তার ধার দিয়ে কয়েক জনের একটা দল ঝুড়ি কোদাল নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে... মেয়েদের কাপড় হাঁটুর ঠিক নীচে আর ছেলেদের কোমরে শুধুমাত্র এক চিলতে একটা গামছা... মৌ ওদের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দেখে সুমনা হেসে ফেলে বলল... বাব্বা, ওরকম করে তাকিয়ে আছিস কেন রে... দেখে বুঝতে পারছিস না ওরা সাঁওতাল...কোথাও থেকে কাজ করে ফিরছে... অরিত্রর কানে ওদের কথা গেলে একটু উদাস হয়ে যেন গেয়ে উঠল... যেখানে কৃষ্ণচুড়া লালে লাল... যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল... সুমনা খুব মন দিয়ে ওর গাওয়া গানের কলিটা শুনে বলল...এই, অরিত্রদা তুমি পুরো গানটা জানো? অরিত্র ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বলল... সুরটা মনে আছে...কথা গুলো সবটা বোধহয় মনে করতে পারবো না। মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে যেন মনে করার চেস্টা করে গুন গুন করে গানটা গাওয়ার চেস্টা করছিল, একটু পরেই সুমনা খুব খুশী হয়ে বলল... এই মনে পড়েছে, দাঁড়াও আমি গাইছি...হাসবে না কিন্তু, আমার যা গলা...
ওরা দুবোনে গলা মিলিয়ে গাইতে শুরু করলে মামনও গলা মেলালো ওদের সাথে...
চলো রীনা, ক্যাসুরিনার ছায়া গায়ে মেখে মেখে মেখে
লাল কাঁকরের পথ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যাই...
বলো যাবে কিনা
সোনা রোদ ঝিক মিক দেখো বালু চিক চিক
ছোট্ট নদী খোয়াই পার হয়ে যাই
যেখানে কৃষ্ণ চুড়া লালে লাল
যেখানে বন্ধু হবে কিছু সাঁওতাল
আরো দূরে ঘুরে ঘুরে চলো না হেঁটে আসি
চলো না পাশাপাশি...
ওদের গাওয়া শেষ হলে মামন মৌয়ের কানে কানে কিছু বলতেই ও বোনের হাতে চিমটি কেটে আস্তে করে বলল...খুব ফাজিল হয়ে গেছিস... দাঁড়া তোর অরিত্রদাকে বলে তোর জন্য একটা বেশ ভালো দেখে ছেলে খুঁজতে হবে যাতে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে যেতে পারিস। মামন দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলল...ইস...আমি কি আমার জন্য বললাম নাকি... ওদের ফিসফিসানি শুনে সুমনা ওদের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করল...এই কি এত গোপন কথা হচ্ছে রে তোদের? মৌ হেসে ফেলে বলল... আমাদের ছোটদের কথায় কান দিবি না দিদি। ‘ইস, কি আমার ছোট রে, এদিকে উনি প্রেম করছেন আর নাকি ছোট’ বলতেই মৌ হেসে ফেলেছে ...সাথে সাথে ওরা দুবোনেও হাসতে শুরু করলে অরিত্র হাসির কারন বুঝতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে বোকার মতো ওদের দিকে তাকালো দেখে মৌ হাসতে হাসতে বলল...এই, তুমি গাড়ী চালাও...মেয়েদের দিকে তাকাবার খুব শখ... না। নেহাত অর্ক সাথে আছে, না হলে বেশ জমিয়ে একটা উত্তর দেওয়া যেত ভাবতে ভাবতে অরিত্র হেসে ফেলে বলল... হুম, আমি তো এখন তোমার ড্রাইভার...
শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে গাড়ী রেখে ওরা সবাই এদিক ওদিক দেখতে দেখতে এগোচ্ছে। খুব একটা উঁচু নয় পাহাড়টা, বরং সবুজে সবুজে ভরা বড় সড় টিলা বলা যেতে পারে... অর্ক দিদির হাত ধরে টেনে নিয়ে গেছে ওকে ছোট্ট ঝরনা দেখাতে, মামনও গেছে ওদের সাথে...এদিকে পাপাই কিছুতেই মায়ের কোলে থাকবে না, ওর এখন মামার কোলে উঠা চাই। অরিত্র ওর লাফালাফি দেখে হেসে ফেলে ওকে কোলে নিয়ে সুমনার সাথে কথা বলতে বলতে ওরা তিন ভাইবোন ফিরে এলো। মৌ বাচ্চাদের মতো খুশীতে ঝলমল করতে করতে বলল...এই, চলো না...কি সুন্দর মিষ্টি জল...
অরিত্রর কোলে পাপাই, ওর আর এক হাত মৌ চেপে ধরে রেখেছে শক্ত করে, সরু পাহাড়ী পায়ে চলা সুঁড়ি পথে এক সাথে উঠতে গিয়ে ওরা একেবারে পাশাপাশি। ওদের আগে আগে সুমনারা তিন ভাই বোন... মৌ মাঝামাঝি আসার পর বসে পড়ে বলল...এই হাঁপিয়ে গেছি, একটু বসি? ওকে বসতে দেখে অরিত্রকেও ওর পাশে বসতে হল পাপাইকে কোলে নিয়ে ...পাপাই ওর কোলে মুখোমুখি বসে ওর ছোট্ট ছোট্ট নরম হাতে ওকে আদর করতে চাইছে...অরিত্র ওর নাকে আলতো ভাবে নাক লাগিয়ে আদর করে বলল...উমম...সোনা ছেলে...একটুও কাঁদে না ... মৌ অরিত্রর কাঁধে মাথা রেখে বসে থেকে হাসি মুখে ওদের দুজনের খেলা দেখতে দেখতে বলল... একদম দুষ্টু ছেলে...আমার কাছে এলে ওনার যত কান্না...আমি কি কামড়ে দি? অরিত্র পাপাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল...সোনা, মাসীকে বলে দাও তো...তুমি কত্তো ভালোবাসো মাসীকে... তারপরে ওর কানে কানে বলেছে...তোমার কাছেও কাঁদবে না যদি তুমি আমাকে যেমন করে আদর কর, তেমনি করে... ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই পিঠের উপরে দুম করে একটা কিল পড়ল আর তার সাথে মিষ্টি বাক্যবান...তুমি না খুব অসভ্য...তুমি আর ও এক? অরিত্র হাসতে হাসতে বলল... এই দেখো, আমি তো শুধু আদরটা কতটা মন দিয়ে করতে হবে তাই বলেছি। ওদেরকে বসে পড়তে দেখে সুমনা আর মামন ফিরে আসছে দেখে মৌ একটু সরে বসল...ওরা কাছে এলে মৌ দিদির দিকে তাকিয়ে বলল... হাঁপিয়ে গেছি রে দিদি, একটু দম নিয়ে নি। সুমনা ওর গা ঘেঁষে বসে কানে কানে বলল... এত তাড়াতাড়ি হাঁপিয়ে গেলে খেলবি কি করে রাতে? মৌ একটু লজ্জা পেয়ে গেলেও দিদিকে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বলল... তোর থেকে শিখে নেব...বুঝলি। সুমনাও কম যায় না, হেসে ফেলে বোনের কানে কানে বলেছে... প্রাক্টিক্যালটা কি তোর জামাইবাবুর সাথে নাকি তোর ওর সাথে করতে হবে আমাকে?
•
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
পরের দিন বেরোতে বেরোতে দুপুর হয়ে গেছে, হোক না, ফেরার সময় তো আর রাস্তা খোঁজার ব্যাপার নেই। বেরোবার আগে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সবার মন খারাপ। দিদা, মামীমা মাসী মামন দাদু কেউ না কেউ মৌকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে দেখে মামাও চোখের জল আটকাতে না পারলেও এদিকে ওদের দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে নিজে এগিয়ে গিয়ে সবাইকে সামলেছে। দাদু অরিত্রর হাত ধরে বার বার করে আবার আসতে বলায় নিশ্চয় আসবো বলে ওনাকে শান্ত করতে হয়েছে। নিজেরও খুব খারাপ লাগছিল ওই ভাবে চলে আসতে কিন্তু কিছু করার নেই। যেদিনই ওরা বেরোক না কেন একই ঘটনা ঘটবে। গাড়ীর পেছনের সিটে সুমনা আর মৌ, সামনে অর্ক পাপাইকে কোলে নিয়ে বসেছে...ও কলেজের মাঠ পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসবে। আস্তে আস্তে এগোতে এগোতে লুকিং গ্লাসে চোখ পড়তেই অবাক হতে হল...লালু গাড়ীর পেছনে পেছনে দৌড়োচ্ছে...খুব খারাপ লাগলো...ইস ওকে তো বলে আসা হয়নি, এই কটা দিন ওর কাছ ছাড়া হয়নি একবারের জন্যও, সব সময় পায়ে পায়ে ঘুরেছে। গাড়ী থামিয়ে দিয়ে নেমে এসে দাঁড়ালে লালু কাছে এসে ওর দিকে যেন করুন ভাবে তাকালো...মানুষ না হলেও ঠিক কি করে যেন বুঝে গেছে ওরা আজ চলে যাচ্ছে। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলে গা ঘেঁষে মুখ তুলে দাঁড়িয়ে থেকে যেন বোঝাতে চাইলো...তুমি চলে যাচ্ছো? অর্ক নেমে এসে ওকে ফিরে যেতে বললেও গেল না দেখে বলল...দাদা, চলো...ও এখন কিছুতেই যাবে না...কলেজের মাঠ থেকে আমার সাথে না হয় ফিরবে।
দুর্গাপুর পর্যন্ত সুমনা সাথে থাকায় কথা বলতে বলতে আস্তে আস্তে মৌয়ের মন খারাপটা কেটে গেছে কিছুটা...অরিত্র ওকে আসানসোলে পৌঁছে দিয়ে আসবে বলাতে সুমনা কিছুতেই রাজী হল না। বিকেল হয়ে এসেছে...ওদেরও তো অনেকটা পথ যেতে হবে। দুর্গাপুরে ওকে আসানসোলের বাসে উঠিয়ে দিয়ে বেরোতে বেরোতে প্রায় চারটে বাজলো, খুব কপাল ভালো ছিল, পাপাই ঘুমিয়ে পড়েছে, না হলে কান্নাকাটি জুড়ে দিত হয়তো...
দুর্গাপুর থেকে বেরোনোর সময়েই আকাশে অল্প অল্প মেঘ দেখা যাচ্ছিল যদিও তাতে ভয় পাওয়ার কিছু ছিল না...হাইওয়েতে উঠলেই তো ঘন্টা চারেকের ভেতরে কোলকাতা পৌঁছে যাওয়া যাবে। বিধি বাম থাকলে যা হয় সেটাই ঘটলো, পানাগড়ে রাস্তা জ্যাম। জ্যাম ঠেলে এদিকে যখন পৌঁছোল তখন প্রায় সন্ধে... আকাশে সাঙ্ঘাতিক মেঘ, বৃষ্টি যে কোন সময় শুরু হতে পারে। পানাগড় পেরোনোর পর খুব বেশী হলে দশ বারো কিলোমিটার এসে আবার আটকে যেতে হ’ল। সামনে লাইন দিয়ে গাড়ী দাঁড়িয়ে আছে, আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো দৃশ্য...কড় কড় আওয়াজের সাথে নিকষ কালো আকাশের বুক চিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশের এক দিক থেকে অন্য দিক পর্যন্ত...দুরের ট্রেন লাইনে বোধহয় একটা এক্সপ্রেস ট্রেন আবছা অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে করে এগিয়ে যাচ্ছে ...ডান দিকের কিছু দেখা না গেলেও রাস্তার বাঁ দিকের আদিগন্ত বিস্তৃত ফাঁকা মাঠ...আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ঘনঘটা দেখে চুপচাপ দুজনে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মৌয়ের অস্ফুট স্বরে ‘কি অদ্ভুত সুন্দর তাই না’...শুনে অরিত্র বললো...প্রকৃতির কত রুপ, না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না...
ঝম ঝম করে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল একটু পরেই, সাথে কানে তালা লাগানো আওয়াজের সাথে বাজ পড়ছে। রাস্তার ধার দিয়ে যে এগোনো যাবে তার উপায়ও থাকলো না আর। বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পর উলটো দিক থেকে একজনকে ভিজতে ভিজতে আসতে দেখা গেলে তাড়াতাড়ি জানলার কাঁচটা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে জানা গেল বেশ কিছুটা দু’রে একটা মাল বোঝাই ট্রেলার উলটে গিয়ে রাস্তা আটকে যাবার পর উল্টোদিক দিয়ে এদিকের গাড়ী যেতে গিয়ে ওদিকটাও আটকে গেছে বিচ্ছিরি ভাবে। এগিয়ে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই দেখে দুজনে কথা বলে সময় কাটানোর চেস্টা করতে করতে সাড়ে আট টা মতো বাজলো, সামনে গাড়ীর লাইনটা একটু একটু করে এগোতে শুরু করলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। যাক বাবা, এক জায়গায় বসে থাকার চেয়ে যা এগোনো যায়, তাই ভালো। ঘন্টা খানেক লাগলো আরো হাফ কিলোমিটার এগোতে। এই বৃষ্টির ভেতরে উলটে যাওয়া গাড়ীটা কি করে সরাচ্ছে কে জানে ভাবতে গিয়ে মনে হল ভাগ্যিস সরাচ্ছে, না হলে তো এগোনোই যেত না। ওর ভাবনাটা শেষ হতে না হতেই আবার আটকে গেল গাড়ীর লাইনটা। রাত ন-টা বাজে। এত রাতে মৌকে নিয়ে এই হাইওয়েতে থাকাটা কি ঠিক হবে? সামনে পেছনে শুধু বড় বড় লরি। বেশ কয়েক জন মিলে এসে যদি হামলা করে কিছু করার থাকবে না। মৌকেও কিছু ব’লা যাচ্ছে না। এমনিতেই ও খুব চিন্তায় পড়ে গেছে, শুনলেই কেঁদে ফেলবে হয়তো। কি করা যায় ভাবতে ভাবতে একটু দূরে একটা সাইন বোর্ড দেখতে পেয়ে ভালো করে দেখে বুঝল, একটা হোটেল। কপাল ঠুকে কোনো রকমে রাস্তার ধার দিয়ে খুব সাবধানে আস্তে আস্তে গাড়ীটাকে নিয়ে গিয়ে দেখা গেল খুব একটা খারাপ হবে বলে মনে হচ্ছে না হোটেলটা। বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগানের ভেতরে দোতলা বাড়ী,বাগানের ছোট ছোট গাছের ভেজা পাতায় হালকা নিলাভ আলো পড়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। গাড়ীটাকে আস্তে আস্তে গেটের কাছে নিয়ে এলে সিকিউরিটি ছাতা মাথায় দিয়ে এসে গেটটা খুলে দিল...
রিশেপশানে ওদেরকে বসতে বলে ম্যানেজার কাউকে ডেকে পাঠিয়েছে। রুম একটা পাওয়া যাবে কিন্তু একটু বসতে হবে। এই কিছুক্ষন আগে নাকি খালি হয়েছে রুমটা, রেডি করার জন্য সময় লাগবে। ওরা বসে থাকতে থাকতে দুটো কম বয়সী মেয়ে এসে ম্যানেজারের সাথে কিসব কথা বলতে বলতে ওদের দিকে তাকাচ্ছিল, তারপরেই ওরা দুজনে দোতলার দিকে চলে গেল।
একটু পরে যে রুমটা ওদেরকে দেওয়া হল সেটা বেশ সাজানো গোছানো দেখে পছন্দ হয়ে গেছে। হয়তো নতুন হোটেল বলেই এখোনো বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন আছে। রুমেই খাওয়ারের অর্ডার দিয়ে অরিত্র টিভিটা চালিয়ে দিয়ে বাড়ীতে ফোন করে জানিয়ে দিল কি অবস্থা। দাদু শুনেই চিন্তায় পড়ে গিয়ে বলল...বিশ্বাস কাকুকে এখুনি ফোন করছে। এমনিতেই ওনাকে অনেক ঝামেলা পোয়াতে হয়েছে এর আগে তাই সামান্য কারনে আর ফোন করার দরকার নেই বলাতে দাদু প্রথমে কিছুতেই বুঝতে চাইছিল না। দাদুর মতে অরিত্র একা থাকলে না হয় ঠিক ছিল, সাথে মৌ আছে, হাইওয়ের হোটেল, কি বিশ্বাস আছে? দিন কাল তো একেবারেই ভালো নয়। কোনোরকমে দাদুকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করে জেঠিমাকে জানাতে হল যে আজ রাতে ওরা ভবানীপুরের বাড়ীতে যেতে পারছে না। সেখানেও আর এক প্রস্থ বুঝিয়ে উঠতে উঠতে মৌ জামাকাপড় পালটে ফ্রেস হয়ে বেরিয়ে এসে ওর পাসে বসে বলল… এই শোনো না, ওই মেয়ে দুটো কেমন যেন, তাই না?
- হুম…হবে
- হ্যাঁ গো, দেখলে না…কেমন ভাবে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে।
- হুম…
- ধ্যাত... কি শুধু তখন থেকে হুম হুম করে যাচ্ছো…
অরিত্র হেসে ফেলে বলল…কি করবো? দেখে বুঝতে পারোনি?
- কি বুঝবো?
- ওরা এখানে কাউকে সঙ্গ দিতে এসেছে...
- ধ্যাত, কি বলছো…ওই টুকু টুকু মেয়ে…
- এটাই ওদের কাজ…
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…বিশ্বাস হচ্ছে না।
মেয়ে দুটোকে ওইভাবে তাকাতে দেখে অরিত্ররও মোটেও ভালো লাগেনি, মৌকে ওরা কি নিজেদের মতো কেউ ভেবেছে মনে করে ভীষন বিচ্ছিরি লাগলেও ওই নিয়ে আর কথা বাড়ালো না, ও কি ভাবছে সেটা মৌকে বললে ওরও খারাপ লাগবে।
ডিনারের পর দিদিদের সাথে কিছুক্ষন কথা বলে নিয়ে মৌ ক্লান্ত লাগছে বলে শুয়ে পড়তে গিয়ে জিজ্ঞেস করল ‘এই…শোবে না’?
- হু, তুমি শোও…আমি এই খেলাটা শেষ হলেই আসছি...
- দেরি করবে না কিন্তু, অনেক ধকল গেছে তোমার...
- আচ্ছা ঠিক আছে...তুমি শুয়ে পড়,আমি আসছি...
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি মৌ। ক্লান্ত থাকায় রাতে আর ঘুমও ভাঙ্গেনি আজ। ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে দেখলো পাশে তো ও নেই। এরই মধ্যে উঠে পড়ল নাকি ভেবে উঠতে গিয়ে বুঝল, ও শুতেই আসেনি, সোফাতেই কোনো রকমে পা গুটিয়ে শুয়ে আছে। ইশ, আমার জন্য ওকে কত কষ্ট করতে হচ্ছে ভেবে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। সাথে সাথে আরো কিছু প্রশ্নও মাথার ভেতরে এসে গেল...আমার ওই ব্যাপারটা কি ও বাধ্য হয়ে মেনে নিয়েছে? তাই বা কি করে হয়, ও তো নিজেই এগিয়ে এসেছিল… আমি সব কিছু বলার পরও ও পিছিয়ে যায়নি। আমি তো ওকে জোর করিনি, বরং ভালো করে ভেবে ডিশিশান নিতে বলেছিলাম... তাহলে কেন ও আমার কাছে আসতে চাইছে না? বাড়ীতে না হয় কাছে আসার অসুবিধা আছে। এখানে আমার সাথে শুলে কি ক্ষতি হোতো?
কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে ও উঠে গিয়ে রুম সার্ভিসে ফোন করে চায়ের জন্য বলে দিয়ে ফ্রেস হয়ে ফিরে এলো, একটু পরেই বেলটা বেজে উঠলে বুঝলো চা এসে গেছে। সার্ভিসের ছেলেটা বেরিয়ে যাবার আগে অদ্ভুত দৃষ্টিতে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হয়তো বোঝার চেষ্টা করছিল, এ আবার কেমন ধারার লোক... বিছানা থাকতে সোফায় শুয়ে, তার উপরে সাথে একটা মেয়ে। অরিত্র ঘুম চোখে চা খেতে খেতে মৌ এর দিকে তাকিয়েই বুঝে গেল ওর সারা মুখে অভিমান মাখানো। কারনটা কি না বোঝারও কিছু নেই, ও যদি নিজের থেকে জিজ্ঞেস করে ঠিক আছে, না হলে এখন ভাবতে হবে কিভাবে ওকে বুঝিয়ে বলবে। এমনিতে নরম মনের মেয়ে হলেও যে ও কিছুটা অভিমানী সেটা আর কেউ না বুঝলেও অরিত্র খুব ভালো করে জানে। অন্য কারুর থেকে হাজার অসুবিধা হলেও ও কিছু মনে করবে না বা করলেও প্রকাশ করবে না কিন্তু অরিত্রর দিক থেকে তেমন কিছু হলে ভীষন কষ্ট পায়, নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না কিছুতেই। কিছুটা সময় কেটে গেলেও মৌ নিজের থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলো না, চুপচাপ ব্যাগ খুলে কিসব করতে করতে এত সময় পরে একটাই কথা জিজ্ঞেস করল তাও আবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে...কখন বেরোতে হবে? নাঃ, আর দেরী করা ঠিক হবে না ভেবে ওর পাশে গিয়ে বসলে একবার মুখ তুলে তাকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। সত্যিই খুব অভিমান করেছে, না হলে ও মুখ ফিরিয়ে রাখার মেয়েই নয়। কিছু না বলেও যে অনেক কিছু বলা যায় তা আজ আরো একবার প্রমান হয়ে গেল। অরিত্রকে চুপ করে ওর পাশে বসে থাকতে দেখে ও নিজেকে আর দুরে সরিয়ে রাখতে পারলো না, কাছে সরে এসে ওর কাঁধে মাথা রেখে আস্তে করে বলল… তুমি শুতে এলে না কেন?
- এমনি...
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল…আমি তো তোমাকে ডেকেছিলাম...
- জানি…
- তাহলে?
- আসলে তোমাকে ঘুমোতে দেখে আর ডিসটার্ব করতে চাই নি...
মৌ ওর হাতের উপরে নিজের হাতটা আলতো ভাবে ছুঁইয়ে রেখে নিজের মনেই যেন বলল... তোমার কি আর আমাকে ভালো লাগছে না?
অরিত্র ওকে বুকে টেনে নিয়ে কিছুক্ষন চুপ করে থেকে আস্তে করে বলল...তুমি তো জানো তুমি কতোটা জায়গা জুড়ে আছো আমার জীবনে... মৌ ওর বুকে মাথা রেখে চুপ করে বসেছিল, ওর কথাটা ভাবতে ভাবতে কান্না পেয়ে গেল। কেন ওকে আবার এসব বলতে গেল, সত্যিই হয়তো কিছু ব্যাপার আছে যার জন্য ও খুব একটা কাছে আসতে চায় না। তাতে ও আর ভালোবাসে না ভেবে নেওয়াটা একেবারেই ঠিক হয়নি। নিজেকে ওর বুকে চেপে ধরে রেখে বলল...এই, কিছু মনে কোরো না…আমি বুঝতে ভুল করেছি...
- আচ্ছা…
- এই…
- বলো…
- সত্যি বলছি, ভুল বুঝেছিলাম...বিশ্বাস করো...
- হু, জানি...তোমার জায়গায় আমি থাকলেও তাই হোতো...
দুজনেই চুপচাপ এক ভাবে বসে থাকার পর আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে। অরিত্র খুব আস্তে করে বলল... চুপ করে আছো?
- তুমিও তো চুপ করে আছো...
- একটা কথা বলবো?
- বলো
- তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল...
- আমি কি তোমাকে না করতাম?
- জানি...
- তাহলে?
- সবকিছু আগে ভাগে শেষ না করে কিছু তো তুলে রাখতে হয়...তাই না...
মৌ ওর শেষ কথাটার কি জবাব দেবে বুঝতে পারছিল না, একটু সময় চুপ করে থাকার পর বলল... তুমি আমাকে খারাপ ভাবছো না তো?
- উঁ হুঁ...এসো...
- কি?
- খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে আদর করতে...
- এই যে বললে কিছু তুলে রাখবে…
- সে তো রাখবোই...
- তাহলে?
- জানি না…এসো…
শুধু একটু ভালোবাসা পেলেই যে খুশী হয় তার পক্ষে অভিমান করে বসে থাকা সম্ভব? তাও আবার এতো আদরের পর? মৌ বেশ কিছুক্ষন ওর মুখটা দুহাতে ধরে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কি যেন খোঁজার চেস্টা করতে করতে বলল... তোমাকে আমি না ঠিক বুঝতে পারি না মাঝে মাঝে। অরিত্র ওর কথাটা শুনে হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল... কেন বলোতো?
- কেন আবার... কেউ তো এখানে ছিল না তবুও কাল রাতে শুতে এলে না... এখন আবার নিজের থেকেই আদর করলে.....তারপর...সেদিন স্নান করার সময় কিসব করলে...
- কি করেছি?
- ইশ, কি করেছি? আমি সব বলে দিয়েছি ছোড়দিকে...
- মানে?
মৌ ওর বুকে মুখ গুঁজে দুষ্টুমি ভরা গলায় হেসে ফেলে বলল... ছোড়দি কি বলেছে জানো?
- কি?
- ইশ, দাদাভাইটা এতো রোমান্টিক? আমি ভাবতেই পারছি না...
- তাই?
- হু...তোমাকে ফোন করবে বলেছে...
- হুম...সে তো করবেই...আমার পেছনে লাগার এতবড় সুযোগ পেয়েছে...ছাড়বে নাকি...আচ্ছা বলোতো ঠিক কি কি বলেছো ফাজিল-টাকে...
- ইশ...ফাজিল বললে কেন ছোড়দিকে?
- ফাজিলকে ফাজিল বলবো না তো আর কি বলবো শুনি...যাকগে কি কি বলেছো বলো...
- কি আবার বলবো...ওই, তুমি কিভাবে জলের ভেতরে ডুব দিয়ে চুমু খেয়েছিলে...তাই...
মৌ স্নান করে বেরিয়ে এসে ওকে তাড়া লাগালো...এই, ওঠো না...বেরোতে হবে তো নাকি। অরিত্র ওর দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসিতে মুখ ভরিয়ে নিয়ে বলল...কেন তোমার আমার সাথে এখানে একা একা থাকতে ভালো লাগছে না? এই, একদম দুষ্টুমি নয়...যাও আগে...ওদিকে জেঠিমা রান্না করে নিয়ে বসে থাকবে শুনে অগত্যা উঠতে উঠতে বলতে হল... আচ্ছা বাবা যাচ্ছি, তুমি তৈরী হয়ে নাও...আমি যাবো আর আসবো...
যাবো আর আসবো বললেও বেশ কিছুক্ষন পরে বেরিয়ে দেখলো তখোনো মৌয়ের হয়নি... ওর জন্য একটা জিন্স আর লাল টিসার্ট বের করে রেখেছে পরার জন্য আর নিজ়ে কি পরবে তাই নিয়ে বোধহয় ঠিক করতে পারছে না। ওকে বেরোতে দেখে মুখটা ভার করে বলল...এই তোমার যাবো আর আসবো? কখন থেকে বসে আছি। ‘কেন’ বলাতে বলল...এই, কি পরবো একটু দেখে দাও না। অরিত্র কিছু না বলে একটা শালোয়ার কামিজের সেট নিয়ে ওর হাতে দিলে গায়ের উপরে ফেলে আয়নায় নিজেকে ঘুরিরে ফিরিয়ে দেখতে দেখতে খুব খুশী হয়ে বলল... ইস, কি সুন্দর... একটু আগেই ও নিজে দেখেছে সেটা ভুলেই গেছে। অরিত্র ভালো করে মাথা মুছতে মুছতে বলল... যাবো তো গাড়ীতে, কে দেখবে তোমাকে? ইস, কে দেখবে তোমাকে...আমি কি অন্য কাউকে দেখাবার জন্য সাজবো নাকি? অরিত্র অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলল... তো কার জন্য সাজবে শুনি। মৌ উঠে এসে ওর হাতে টিসার্টটা ধরিয়ে দিয়ে বলল... তুমি জানো না...কার জন্য? অরিত্র খুব ভালো করেই জানতো ওর উত্তরটা কি তবুও ওর মুখ থেকে শোনার জন্যই আবার জিজ্ঞেস করেছিল। তারপরেই ইয়ার্কি করে বলল...এই গরমে টকটকে লাল? এটার কি মানে? মৌ চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল...ওটার মানে ...তোমার দিকে কেউ নজর দিতে পারবে না...বুঝেছো? অরিত্র ওর পেছনে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল...আর যদি কেউ নজর দেয়? মৌ আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হেসে বলল... আমি তাকে মেরেই ফেলবো...একেবারে। ওর কাঁধে থুতনি রেখে আগের মতোই জড়িয়ে ধরে থেকে ‘তাই?’ বললে...মৌ দুচোখের ঝিলিক দিয়ে বোঝালো...হুঁ, তাই। ‘আর আমি যদি কারুর দিকে তাকাই তাহলে?’বলাতে ও হাসি মুখে জবাব দিল... তুমি পারবেই না আমাকে ছেড়ে আর কারুর দিকে তাকাতে। ‘এতো বিশ্বাস?’ জিজ্ঞেস করাতে ও মুখ ঘুরিয়ে আড় চোখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বলল... প্রশ্নটা আমাকে না করে নিজেকে করলেই তো পারো...পাজী কোথাকার...
- হু, বুঝলাম...চলো তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নাও...
- এই, একটু বাইরে যাও না...
- কেন?
- ধ্যাত, যাও না...
- হুম, লজ্জা করছে?
- এই, তুমি যাবে?
- ভেবেছিলুম একটু দেখবো...সে আর হলো না...
- ইশ, কি শখ, দেখবো...যাও ভাগো...
- মনে থাকে যেন...পরে কিন্তু দেখাতে চাইলেও দেখবো না...
- বয়ে গেছে আমার দেখাতে...
- ঠিক তো?
- এই, তুমি যাবে... না কি আমি ছোড়দিকে ফোন করবো...
‘আচ্ছা বাবা...যাচ্ছি’ বলে ওকে ছেড়ে সরে যেতেই মৌ কি মনে করে বলল...থাক, ওরকম গোমড়া মুখ করে যেতে হবে না...তুমি থাকো তবে দেখা যাবে না কিন্তু...রাজী? অরিত্র হেসে ফেলে বলল...চুরি করেও দেখতে পারবো না? ছোট্ট একটা কিল খেতে হল চুরি করে দেখার ইচ্ছের জন্য আর তার সাথে ওর মিষ্টি করে বলা উঁ হুঁ...শুনতে হল। ‘ওক্কে বাবা, আমি এই সোফাতে এদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসছি, তুমি যা খুশী কর’ বলে অরিত্র মোবাইলটা হাতে নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করছিল। এসির হাল্কা আওয়াজের সাথে মাঝে মাঝে ওর হাতের চুড়ির রিন রিন আওয়াজ কানে আসছে...ওকে কথা দিতে হয়েছে তাকাবে না, তাই যতই ইচ্ছে হোক দেখা যাবে না। কি মনে করে মুখ তুলে আয়নার দিকে চোখ পড়তেই নিঃশ্বাস আটকে গেল... এমন একটা জায়গায় ও পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে যে ও বুঝতেই পারবে না যে এখান থেকে ওকে আয়নার ভেতরে দেখা যাবে। অরিত্র যখন কথা দিয়েছে দেখবে না তো দেখবেই না বুঝে ও নিশ্চিন্তে চুড়িদারটা পরছে...সরু কোমর থেকে আস্তে আস্তে চওড়া হতে শুরু করেছে উপরের দিক, একেবারে নিঁখুত শরীরের গড়ন, যেখানে যেটুকু দরকার সেখানে ঠিক ততটুকুই আছে... টুকটুকে ফর্সা উজ্জ্বল মসৃন ত্বকের উপরে লাল রংয়ের অন্ত্রর্বাসের সরু ফিতে একটু একটু করে অদৃশ্য হয়ে গেল আবরনের আড়ালে। চোখ বুজে হঠাৎ করে দেখতে পাওয়া অপরুপ এক নারী শরীরের রুপে মুগ্ধ হতে হতে ও ভাবছিল...একেই কি বলে দেবভোগ্যা নারী? বুকের উপরে হাত দুটো রেখে এক অজানা অনুভুতিতে বুকের ভেতরটা ভরে তুলতে তুলতে শুনল ওর মিষ্টি গলার ডাক...এই ওঠো...চোখ মেলে তাকালে, মৌ মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর মুখের উপরে ঝুঁকে এসে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার লক্ষী সোনা আমাকে কথা দিয়েছিল...তার জন্য...
মৌ ওকে কেন চুমু দিয়েছে শোনার পর মনে হল, ও তো জানেনা যে আয়নার ভেতর দিয়ে ওর দিকে না চাইলেও চোখ চলে গিয়েছিল। ও তো আমাকে বিশ্বাস করে... তাহলে কি আমার না বলাটা ঠিক হবে? মৌ ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ভেবেছে ওর একটা চুমুতে মন ভরেনি,আরো চাই... তাই হাসি মুখে বলল...কি...আরো চাই? ততক্ষনে অরিত্রও ভেবে নিয়েছে কি বলবে, ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে করে বলল... রাগ করবে না বলো...মৌ ওর সেই মন ভোলানো হাসি মাখা মুখে উত্তর দিল...উঁ হু...
- আমি না তোমাকে দেখে ফেলেছি...
ওকে দেখে ফেলেছে শুনে কয়েক মুহুর্ত পরেই মুখ লুকিয়েছে তারই বুকে যার দিকে তাকিয়ে থাকতে গিয়ে লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কি বলবে বা কি করবে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না ও, তারপর ভেবেছে... আচ্ছা আমি তো পেছন ফিরে ছিলাম, তাহলে ও কি করে দেখেছে বলছে? বুকের ভেতরে মুখ গুঁজে রেখেই অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করেছে...সত্যিই দেখেছো?
অরিত্র ওর পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে ওরই মতো মৃদু স্বরে বলেছে...সত্যিই দেখেছি...এই তো এই টুকুনি...
ও পিঠের উপরে হাত রেখে কি দেখেছে বললো সেটা বুঝতে পেরে মৌ জিজ্ঞেস করল... আর কিছু না তো?
- উঁ হুঁ...
- তাই? কি করে?
- কি জানি, কি মনে করে আয়নাটার দিকে চোখ পড়ে গিয়েছিল...
মৌ কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকালো...তখোনো ওর লজ্জা পুরোপুরি না কাটলেও তাকিয়ে থেকে ওর দুচোখে কি যেন খুঁজলো...তারপর যখন বুঝলো ও সত্যিই ইচ্ছে করে কিছু করেনি, আস্তে করে মুখ নামিয়ে নিয়ে এসে আবার একটা চুমু দিল ঠোঁটে...আগের মতোই আস্তে আস্তে মুখ তুলে নিয়ে বলল...এটা আমার সোনা আমাকে ঠকাতে চায়নি বলে...
সাড়ে ন-টা নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়েছে কোলকাতার উদ্দেশ্যে। কাল রাতে ভারী বৃষ্টি হওয়ায় আজ আর সেই গায়ে জ্বালা ধরানো গরম নেই দেখে গাড়ীর এসি চালানো হয়নি। খোলা জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া আসছে। ধীরে সুস্থে এগোতে এগোতে দুজনের গল্প হচ্ছিল, গল্প বলতে মৌ-ই বেশী কথা বলছে, বেশীর ভাগটাই ওর মামাবাড়ী নিয়ে। ও যে কতোটা খুশী হয়েছে এতদিন পরে এখানে আসতে পেরে তা ওর কথাবার্তা বা শরীরের ভাষা থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। ওর কথা শুনতে শুনতে পুবালী ফোন করেছে দেখে অরিত্র ওকে ফোনটা দিয়েছে... দুজনে অনেকক্ষন ধরে কি সব কথা বলছে নীচু গলায়...কখোনো হাসছে, কখোনো ওর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছে... দুজনের চোখাচুখি হলে হাসিতে মুখ ভরিয়ে রেখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ওদিকে হুঁ হাঁ উত্তর দিচ্ছে দেখে অরিত্র ওকে বলেছে আমার দিকে তাকাতে হবে না, তুমি আগে কথা বলে নাও... মৌ ঘাড় নেড়ে বুঝিয়েছে আচ্ছা ঠিক আছে...ও ওদিকে ফোনে ব্যাস্ত দেখে অরিত্র অডিও সিস্টেমটা চালিয়ে দিয়ে আওয়াজ কমিয়ে রেখে দিল যাতে মৌয়ের ফোনে কথা বলতে অসুবিধা না হয়। কিছুক্ষন পর পুবালীর সাথে কথা হয়ে গেলে ফোনটা রেখে দিয়ে মৌ কান পেতে কি গান হচ্ছে শোনার চেস্টা করছে দেখে আওয়াজটা একটু বাড়িয়ে দিতে হয়েছে...
Love me tender,
love me sweet,
never let me go.
You have made my life complete,
and I love you so.
Love me tender,
love me true,
all my dreams fulfilled.
For my darlin' I love you,
and I always will.
Love me tender,
love me long,
take me to your heart.
For it's there that I belong,
and we'll never part.
Love me tender,
love me dear,
tell me you are mine.
I'll be yours through all the years,
till the end of time.
When at last my dreams come true
Darling this I know
Happiness will follow you
Everywhere you go.
পুরো গানটা খুব মন দিয়ে শোনার পর মৌ ওর দিকে তাকিয়ে বলল...এই গানটা কখন শুনতে আরো ভালো লাগবে বলো তো?
- নিস্তব্ধ গভীর রাত...চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে...শুধু আমরা দুজনে ছাড়া আর কেউ নেই কোথাও... আমার বুকে তুমি মাথা রেখে শুয়ে আছো...আমি তোমাকে জড়িয়ে ধরে আছি। খুব আস্তে আস্তে গানটা বাজছে...তুমি আর আমি শুনছি...
অরিত্র গাড়ী চালাতে চালাতে কথা গুলো বলে একটু পরে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল কেমন যেন আনমনে চুপ করে বসে আছে কোলের উপরে হাতদুটো রেখে...আরো কিছু মুহুর্ত কেটে গেল ওইভাবে...অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ছুঁলে যেন স্বপ্নের ভেতর থেকে ফিরে এসে লাজুক হেসে নরম গলায় বলল...ভাবছিলাম...
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
ওরা আজ আসবে বলে জেঠু অফিস যায়নি। পুবালীও ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে চলে এসেছে। দুপুরে খেতে বসে জেঠিমার সাথে কথা হয়ে গিয়েছিল কাল সকালে অরিত্র অফিস চলে যাবে এখান থেকে, বিকেলে তাড়াতাড়ি ফিরে মৌকে নিয়ে বাড়ী ফিরবে। বিকেলের দিকে ওকে একা পেয়ে মৌ মুখ ভার করে বলল... কেন, কাল অফিস না গেলেই নয়? তোমার তো অনেক ছুটি জমে আছে। তুমি কি করে জানলে আমার ছুটি জমে আছে জিজ্ঞেস করাতে ও বলল... না জানার কি আছে...তুমি কি একদিনও কামাই করেছো নাকি...এই তো সবে চার দিনের ছুটি নিলে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল...তার মানে তুমি সব খবর রাখতে, আমি কি করি কোথায় যাই...
- হু, কি হয়েছে তাতে?
তাহলে তুমি আগে কেন আসোনি আমার কাছে জিজ্ঞেস করাতে ও দুহাতে ওর মুখটা ধরে চোখে চোখ রেখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে অস্ফুট স্বরে বলল...তোমাকে তো বলেছি, কেন আসতে পারতাম না। অরিত্র ওর চোখে কষ্ট পাওয়ার আভাস দেখে ওকে বুকে চেপে ধরে নিয়ে বলল... আমরা দুজনেই অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি...তাই না...আমিও তো তোমাকে কিছু বলতে পারিনি...
ওরা ফিরে আসার পর আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে। ওদিক থেকে মৌয়ের দাদু আর মামা এলে তারপর সবাই মিলে বসে সব কিছু ঠিক করার কথা, তাই যেগুলো নিজেরা শুরু করতে পারবে সেগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করা হয়ে গেছে। বিয়ের জন্য গয়না বানানোর একটা বড় কাজ তো আছেই দেখে এর ভেতরে একদিন দিদান ব্যাঙ্কের লকারে যত গয়না ছিল সব নিয়ে এসেছে। নিজের তো ছিলই তার উপরে মেয়ের সমস্ত গয়না অরিত্রর ছোটো জেঠিমা কয়েক বছর আগে নিজেই এসে দিয়ে গিয়েছিল। দিদান মৌকে ডেকে সব এক এক করে দেখাতে দেখাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে। ও একটা একটা করে দেখেছে আর বলেছে ‘এটা বড্ড পুরোনো পুরোনো’ বা ‘আরে এই হারটা কি সুন্দর। কোনটা কোনটা দিদানরা কোন দিন পরবে তাই বলে গেছে এক এক করে। দিদান তখন কিছু বলেনি ওকে কিন্তু সব দেখা হয়ে গেলে যেই বলেছে...এই মেয়ে শোন, এখন থেকে এগুলো সব তোর ওমনি মৌ চোখ বড় বড় করে দিদানের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছে না না, আমাকে কেন সব দেবে?
- তোকে দেবোনা তো কাকে দেবো শুনি?
- সে আমি কি জানি...
- ও মা...মেয়ের কথা শোনো...সে আমি কি জানি বললে হবে? তোকেই সব নিতে হবে...বুঝলি?
- ও দিদান কি শুরু করেছো বলোতো? আমাকে কি গয়না দিয়ে মুড়ে রাখবে নাকি?
- হ্যাঁ তাই রাখবো...শোন, পরশু আমরা বৌবাজার যাচ্ছি, মাপ দিতে হবে, ডিজাইন পছন্দ করতে হবে...অনেক কাজ আছে...তুই এক কাজ কর না মা...তোর জেঠিমা আর দিদিকে ফোন করে বল আসতে...ওরা না এলে তো হবে না...আমি কি আর এখন কি চলছে বুঝবো?
তখনকার মতো দিদানকে বোঝাতে না পেরে চুপ করে গেলেও রাতে অরিত্র ফিরে আসার পর ও গেছে অরিত্রর কাছে। অরিত্র সব শুনেও কিছু না বলে মুখ টিপে হাসছে দেখে ও হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল...এই চলো না, দিদানকে বোঝাবে। কেন তোমার গয়না ভালো লাগে না নাকি জিজ্ঞেস করাতে বলল... ভালো লাগবে না কেন...তাই বলে এতো? আমি কি পুতুল নাকি যে তোমরা সাজিয়ে রাখবে আমাকে।
অরিত্র হেসে ফেলে বলল...তুমি দিদানদের কতোটা আদরের জানোই তো...
- সে তো জানি...তাই বলে সব কেন দেবে?
- আচ্ছা দিতে চাইছে দিক না...জানোই তো মা বাবা নেই বলে কিভাবে বুকে আগলে রেখে বড় করেছে আমাকে। মা বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি কখোনো...তাছাড়া, কাল রাতে দেখলাম, মায়ের ফটোটা বুকে চেপে নিয়ে কাঁদছে...সত্যিই তো আজ মা থাকলে কি খুশী হোতো... সেটাই হয়তো মেটাবার চেস্টা করছে...
ওকে সেন্টিমেন্টাল হয়ে যেতে দেখে মৌ আর কিছু বলতে পারলো না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল...আচ্ছা...
কথাবার্তা বলার জন্য মৌয়ের মামারা যেমন চলে এসেছে, তেমনি ওদিক থেকে বড় জ়েঠুও কোলকাতা চলে এসেছে। একেবারে সব কিছু ঠিক করে তারপরে ফিরবে। বিয়ের কোনো ব্যাপারেই অরিত্রকে কোনো কিছু করতে হচ্ছে না মানে দাদু বা জেঠুরা করতে দিচ্ছে না। কয়েকবার ও বলতে গিয়েছিল, তোমরা কেন সব ঝামেলা নিতে চাইছো? আমি তো আছি। দাদুদের আদরের বকুনি শুনে ওকে থেমে যেতে হয়েছে। দাদু পরিস্কার বলে দিয়েছে... তুই শুধু তোর অফিস কলিগ আর বন্ধুবান্ধবদের নেমত্তন্ন করবি আর বিয়ের দিন যা যা করার তাই করলেই আমি খুশী...বাকি আমরা বুঝে নেবো। খরচের ব্যাপারেও ওর কোনো কথা শুধু দাদু কেন, জেঠুরাও শুনতে রাজী নয়। আচ্ছা, আমাকে কিছু তো দিতে দাও বলে জেঠুর বকুনি শুনেছে...উঃ, দুষ্টু তুই চুপ করবি। এদিকে দাদু আর জেঠুরা আর ওদিকে মৌয়ের দাদু আর মামা, কে কোন খরচটা দেবেন নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছেন, ওর দাদু বিয়ের সমস্ত খরচ দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু এদিকের দাদু বলেছেন যে না, ওটা চলবে না...মৌ আমাদের বাড়ীর বৌ হতে যাচ্ছে ঠিকই কিন্তু তার আগে ও আমাদেরও মেয়ে। তো মেয়ের বিয়ের খরচ আমরাও দেবো...দুই দাদুর সম্পর্কটা এখন এতটাই গভীর যে হাসি ঠাট্টার ভেতর দিয়ে ব্যাপারটা মিটে গেছে। কারুর কথায় কেউ নিজেকে ছোট করা হচ্ছে মনে করেন নি। মৌয়ের মামাবাড়ীর কথা ভেবে বিয়েটা হবে দূর্গাপুরে কারন ওনারা এই বিয়েটাকে মেয়ের ঘরের নাতনীর বিয়ে হিসেবে দেখছেন না, বাড়ীর মেয়ের বিয়েতে যেমন ভাবে আশেপাশের সবাইকে বলার তাই করতে চাইছেন। তারপরে ভাবার ছিল জেঠুদের কথা, ভবানীপুরের বাড়ীটা যেহেতু অরিত্রর নিজেরও তাই বিয়ের পরের দিন প্রথমে ওরা আসবে ওখানে। জ়েঠিমারা বৌ বরন করার পর কিছুটা সময় ওখানে কাটিয়ে তারপর ওরা আসবে এই বাড়ীতে। এখানেও আবার এক প্রস্থ অনুষ্ঠান থাকছে যথারীতি। পরের দিনের বৌভাত হবে এখানেই আর তারপর একটা দিন বাদ দিয়ে কোলকাতার কোনো হোটেলে রাখা হবে রিশেপশান যাতে করে ওর অফিস কলিগ বা আরো যারা কোলকাতা থেকে কিছুটা দুরে বলে এখানে আসতে পারবে না তাদের সুবিধা হয়। এই পর্যন্ত বলে দিয়ে বড় জেঠু হাসতে হাসতে বলেছে...তারপর তোরা দুজনে হানিমুনে কোথায় আর কবে যাবি সেটা তোরা ঠিক করবি। রুপসা পাশেই ছিল...বাবার কথা শুনে লাফিয়ে উঠে বলল...না না...দাদাভাই কেন ঠিক করতে যাবে...তোমরাই তো বলেছিলে দাদাভাই শুধু বিয়েটা করবে আর বাকি সব ঠিক করে দেওয়া হবে...ইশ, আমি সেই কবে থেকে ভেবে রেখেছি দাদাভাইরা গোয়ায় হানিমুন সেরে ফেরার সময় আমাদের ওখানে সাতদিন থেকে তারপর ফিরবে...
অরিত্র এতক্ষন চুপচাপ শুনছিল আর ভেতরে ভেতরে হাসি পেলেও হাসি চেপে রেখেছিল যাতে কেউ না খারাপ ভাবে। এতদিন যেখানেই কিছু দরকার হয়েছে ওকেই করতে হয়েছে দায়িত্ব নিয়ে আর নিজের বিয়েতে একেবারে প্রায় ঝাড়া হাত পা হয়ে যাওয়াটা বাধ্য হয়ে মেনে নিলেও বেশ মজার লাগছিল। রুপসা হানিমুনের জায়গাটাও ঠিক করে ফেলেছে শুনে আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। ওকে হাসতে দেখে রুপসা কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে একেবারে আস্তে করে বলল...এই দাদাভাই, আরো আছে...এখানে বলা যাবে না... বুঝলি? ও পরে বলবে বললেও কেউ যাতে না শুনতে পায় এমন ভাবে অরিত্র জিজ্ঞেস করেছে...কি ব্যাপারে? রুপসা এবারে আরো আস্তে করে বলেছে...হানিমুনে গিয়ে কি কি করবি ওটাও ভেবে রেখেছি...বুঝলি...
ওদের ভাইবোনকে গুজ গুজ করতে দেখে জেঠু বলেছে...এই তোরা পরে তোদের গোপন আলোচনা করলেও হবে ...শোন এদিকের আরো কিছু বলতে বাকি আছে। রুপসা বাবার দিকে তাকিয়ে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল...বাপি, তুমি না বড্ড বেরসিক, সব জায়গাতেই তোমার কর্পোরেট কালচার ইম্পলিমেন্ট করতে চাও। বড় জেঠু মেয়ের ভ্যঙ্গানোতে হেসে ফেলে বলল...ফাজিল মেয়ে কোথাকার...তুই কি কোনোদিন ও একটু সিরিয়াস হতে পারবি না...
- আচ্ছা বাবা...এই হলাম সিরিয়াস...বলো কি বলবে...এই দাদাভাই, মন দিয়ে শুনবি কিন্তু...বিয়েটা তোর...আমার নয়...বুঝলি?
রুপসার কথাবার্তা শুনে আবার এক প্রস্থ হাসাহাসির পর জেঠু বলল...শোন, এখানে বৌভাতের সব দায়িত্ব শুভর। রিশেপশানের দায়িত্ব শুভ্রর আর বিয়েটা আমরা দিয়ে দেবো একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট গ্রুপের হাতে...ওরা খুব ভালো কাজ করে শুনেছি। ওখানে শুভ আর শুভ্র দুজনে ওভার অল দেখাশোনা করবে আর তোদের মেয়েদের ব্যাপার স্যাপার দেখবে রুপসা একাই...
রুপসা শুনেই এক প্রস্থ হৈচৈ করে বলল...ইশ, আমি একা কেন...বড়দি ছোড়দি ওরা সব সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে নাকি? পুবালী এতক্ষন চুপ করে শুনছিল...বোনকে চেঁচামেচি করতে দেখে বলল...আরে শোন, আমরা দুজনে তোকে হেল্প করবো...চিন্তা করিস না...
সবকিছু ভালোয় ভালোয় ঠিক হয়ে গেলে পর মামারা ফিরে গেলেও দাদু ফিরতে পারেনি। মৌ বায়না করে বলেছে দাদু...ও দাদু, আর কটা দিন থেকে যাও না। কি করবে ওখানে গিয়ে। আরে তোর বিয়ের জোগাড় যন্ত্র করতে হবে যে বলাতে মৌ দাদুর হাতটা জড়িয়ে ধরে বলেছে...ও ঠিক হয়ে যাবে, মামা আছে তো...তুমি থাকো এখানে। আর কিছু করার ছিল না দাদুর, নাতনির বায়না রাখতেই হয়েছে। সময় কাটাবার কোনো অসুবিধাই নেই এই বাড়ীতে। দুই দাদুর সারাদিন কেটে যায় দাবার বোর্ডে চাল দিতে দিতে গল্প গুজবে। মোক্ষম একটা চাল চেলে এদিকের দাদু বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার নাতনীর খুব দেমাক হয়েছে। ওদিকের দাদু নাতনীর দেমাক হয়েছে শুনে দাবার চাল দিতে ভুলে গিয়ে একটু ভয়ের সাথে জিজ্ঞেস করল...কি হয়েছে? মেয়ের তরফের দাদু, একটু ভয় তো হবেই। এদিকের দাদু একটু গম্ভীর হয়ে বলল...আরে মশাই...ওই টুকু পুঁচকে মেয়ে...সাত চড়ে রা বেরোয় না আর বলে কিনা তোমার নাতি তো আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে... আমি বেঁচে থাকতে কিনা আমার নাতবৌ ডাল ভাত খেয়ে থাকবে... বুঝলেন কিছু?
মুখুজ্জে মশাইয়ের এতক্ষনে ধড়ে প্রান ফিরে এসেছে, হেসে ফেলে বললেন... তা কি নিয়ে মেয়ের এত দেমাক দেখাতে হল?
- আর বলবেন না, আমি শুধু বলেছিলাম...তোর দিদান গয়নাগুলো দিতে চাইছে তো নিবি না কেন... সোনা দানা তো মানুষ ভবিষ্যতের জন্য ভেবেও রাখে নাকি? তার উত্তরে বলে কিনা, কি হবে আমার এত গয়না...তোমার নাতি আমাকে ডাল ভাত খাওয়াতে পারবে...উঃ, কি দেমাক...আরে বাবা, পেলি কোথায় আমার নাতিটাকে... কোলে পিঠে করে মানুষ করেছিলাম বলেই না...
মুখুজ্জে মশাই আর হাসি চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে ফেলে বললেন...ঠিক বলেছেন মশাই, এত দেমাক ভালো নয়। আসলে আজকালকার ছেলে মেয়ে তো...বুঝতেই পারছেন...
মৌ দাদুদের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসছিল, ট্রে টা টেবিলের এক পাশে রেখে টিপট থেকে চা ঢালতে ঢালতে জিজ্ঞেস করল... কি হয়েছে দাদু?
ও মুখ নীচু করে থাকায় দেখতে পেলো না যে দুই দাদুর ইশারায় কিছু কথা হয়ে গেছে, তারপরেই দাদু বললেন...আমি তোর দাদুকে তোর ওই ডাল ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা বলছিলাম আর কি...আমাদের অনেক পয়সা বেঁচে যাবে তো...
মৌ চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল... বুঝেছি, তুমি নালিশ করছিলে...
দাদু ওকে মুখ ভার করে কথাটা বলতে দেখে ওর হাত ধরে কাছে বসিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন...বুঝলেন মুখুজ্জে মশাই, আপনার এই নাতনিটি একটু অভিমানী। আসলে কি জানেন...আমরা একটু বেশী ভালোবাসি তো... তাই মেয়ের আমার এত অভিমান...
দাদু মজা করছে বুঝতে পেরে মৌ আদুরে গলায় বলেছে...ইস, আমি অভিমানী? যাও তোমার সাথে আমি কথা বলবো না...
দাদুও সাথে সাথে বলেছে...ইশ, কথা বলবো না বললে আমি শুনছি না..সেদিন যে বললাম আমি তোর বুড়ো বর...গা হাত পা টিপে দিবি...আমার বুড়ি তো আর পারে না আজকাল...
মৌ আর থাকতে না পেরে উঠে যেতে যেতে বলল...ধ্যাত, তোমাকে আমার বিয়ে করতে বয়েই গেছে...দিদানকে গিয়ে বলছি দাঁড়াও...তোমাকে আচ্ছা করে দেবে...
ওদের দাদু নাতনির খুনসুটি দেখতে দেখতে ওদিকের দাদুর চোখে জল এসে গেছে...মেয়েটা অনেক কষ্ট করেছে এত গুলো বছর কিন্তু এখানে যে ও সুখে থাকবে সেটা বারে বারে বুঝতে পেরে দাদু ধুতির কোন দিয়ে নিজের চোখটা মুছে নিলেও মৌ বা এদিকের দাদু কিন্তু একেবারেই খেয়াল করতে পারেনি মানুষটা আনন্দে চোখের জল ফেলছে...
এদিকে বিয়ের নানান কাজের সাথে সাথে আরো একটা গুরুত্বপুর্ন কাজ মিটিয়ে ফেলার ব্যাপার রয়েছে। মৌয়ের ইচ্ছে বিয়ের আগেই ও বাড়ীর ভাগ, টাকাপয়সার ব্যাপারে যা যা করার করে ফেলবে কিন্তু তার জন্য একবার হলেও ওকে বাড়ী যেতে হবে মায়ের মুখোমুখি হওয়ার জন্য। না গেলেও চলতো কিন্তু কাজটা করতে গেলে বাবার ডেথ সার্টিফিকেটের কপি আর ওর ব্যাঙ্কের কাগজপত্র যা আছে সেগুলো লাগবে। কাজটা ভাবতে যত সোজ়া, কাজে মোটেও ততটা সোজ়া নয়। এখন ও আর সেই বাধ্য হয়ে সব কিছু মেনে নিয়ে চুপচাপ সহ্য করার জায়গায় নেই, এদিকের সবাই ছাড়াও নিজের ভাই বোন ওর পাশে আছে, তবুও কিছুটা হলেও চিন্তা আছে ঠিক কি দাঁড়াবে ব্যাপারটা, মাকে কি আগেই জানিয়ে দেওয়া হবে যে ও যাচ্ছে নাকি বিল্টুদের কাছ থেকে মা কবে থাকবে জেনে নিয়ে কিছু না বলেই চলে যাবে সেটা ঠিক করা যাচ্ছিল না। সে যাই হোক একটা ভেবে ঠিক করা যাবে, এখন যেটা করার দরকার সেটাই করা হোক ভেবে একজন ভালো লইয়ার ঠিক করা হয়েছে। ভদ্রলোকের সাথে কথা বলতে গিয়ে কথায় কথায় জানা গেল উনি এক সময়ে দাদুর ছাত্র ছিলেন। পরিচয় পাওয়ার পর উনি খুব মন দিয়ে সমস্ত ঘটনা আর কি করতে চাওয়া হচ্ছে শুনে বললেন চিন্তা করার কারন নেই, উনি যতটা সহজে কাজটা করা যায় করে দেবেন, তেমন হলে মৌকে যেতেও হবে না...রেজিস্টারকে বাড়ীতে এনেও কাজটা করা সম্ভব।
সবার সাথে আলোচনা করে মৌয়ের মতামত নিয়ে ঠিক করা হয়েছে আগে থেকে খবর না দিয়েই যাওয়াই ভালো। সেই মতো বিল্টুর কাছ থেকে খবর নিয়ে সপ্তাহ দুয়েক পরে যাওয়া হবে ঠিক করা আছে। যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে যাবার পর থেকেই মৌকে মাঝে মাঝে কিছুটা অন্যমনস্ক হতে দেখা যাচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলে...’কই কিছু না তো’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেস্টা করেছে। হয়তো ও এখোনো কিছুটা হলেও ভয় পাচ্ছে ভেবে ওকে বোঝানো হয়েছে যাতে ওখানে গিয়ে আবার ভেঙ্গে না পড়ে কারন ওর উপরেই অনেকটা নির্ভর করছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। সবার সামনে ঘাড় কাত করে ‘আচ্ছা ঠিক আছে’ বললেও পরে অরিত্রকে একা পেয়ে চুপি চুপি বলেছে... মায়ের সাথে যদি ঝগড়া করার দরকার হয় তাই রিহার্সাল দিচ্ছিলাম...বুঝেছো। অরিত্র ওর ঝগড়া করার কথা শুনে কিছুক্ষন হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে হাসি মুখে বলেছে... বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? অরিত্র আরো কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল...তুমি করবে ঝগড়া আর আমাকে তাই বিশ্বাস করতে হবে? এ তো সেই সোনার পাথর বাটির মতো কিছু একটা হবে। মৌ হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল... আচ্ছা ঠিক আছে বিশ্বাস করতে হবে না... আমি না হয় ওখানে গিয়ে কিছু করলাম না কিন্তু তোমার সাথে তো ভবিষ্যতে একটু আধটু করতে হবে আর তার জন্যও তো এখন থেকে শিখতে হবে...নাকি। অরিত্র এবারে আর না হেসে পারলো না ওর কথা বলার ভঙ্গীতে...কোনো রকমে হাসি চাপতে চাপতে বলল...বুঝলাম, কিন্তু আমার সাথে ঝগড়া করতে এলে কি হবে জানা আছে তো? অরিত্র ওকে কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে মৌ কাছে এসে আস্তে করে বলল...বয়ে গেছে আমার... পাজি কোথাকার...
সব কিছুই প্ল্যান মতো এগোচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে পাওয়া একটা খবর পুরো ব্যাপারটার মোড় ঘুরিয়ে দিল। বিশ্বাস কাকু অনেক দিন ধরেই চেস্টা করছিলেন ভেতরের কিছু খবর জোগাড় করার জন্য কিন্তু হঠাৎ করে যে এরকম একটা খবর পাওয়া যাবে নিজেই হয়তো জানতেন না। মৌয়ের বাবার মৃত্যু দুর্ঘটনায় হয়নি, ওটা করানো হয়েছিল এবং সেটাও আবার বাইরের কারুর করানো নয়। এতবড় একটা মর্মান্তিক খবর কিভাবে মৌকে জানানো হবে বা আদৌ এখন জানানো হবে কিনা সেই নিয়ে বিস্তর চিন্তা ভাবনার পর ঠিক করা হয়েছে না জানানোই ভালো এই মুহুর্তে, আবার একটা শক পেয়ে যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আর কিছু করার থাকবে না হয়তো। এত সমস্যার পর সবকিছু একটু একটু করে পরিনতির দিকে এগোচ্ছে, কেউই চাইছিল না নতুন করে আবার কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে। ওকে এই মুহুর্তে জানানো হবে না ঠিক করলেও অরিত্র ব্যাপারটা নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল এই ভেবে যে পরে যদি ও জানতে পারে যে সব কিছু জেনেও ওকে জানানো হয়নি তাহলে খারাপ ভাবে নিতে পারে, যতই হোক ও বাবাকে এখোনো ভীষন ভাবে মিস করে। এই মুহুর্তে না জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলা হয়েছে অনেক কিছু ভাবনা চিন্তা করে তাই আর ওটা নিয়ে নিজের মনে যাই থাকুক না কেন সেটাকে চেপে রাখতে হয়েছে যাতে মৌ ওকে দেখে কিছু বুঝতে না পারে কারন ও যদি নিজের থেকে এসে জিজ্ঞেস করে তাহলে ওকে ভুল বোঝানো যাবে না, তাতে সারা জীবনের মতো একটা অবিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়ে যেতে পারে।
একই বাড়ীতে ওরা থাকলেও বিয়ের যা কিছু নিয়ম আছে সব একেবারে ঠিকঠাক ভাবে করতে হবেই এটা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। সামনের বৃহস্পতিবার ভালো দিন আছে, একই দিনে ছেলে ও মেয়ে দুজনকেই আশীর্বাদ করা হবে ভবানীপুরের বাড়ীতে। অরিত্রর জন্য আসছেন মৌয়ের মামা আর মেয়েকে আশীর্বাদ করার জন্য তো লোকের অভাব নেই। তার আগে মৌকে সাথে নিয়ে গিয়ে তানিস্কের শোরুম থেকে একটা হীরের আংটি পছন্দ করে এসেছে অরিত্র। যথারীতি মৌ এত দামের আংটি নিতে রাজী হচ্ছিল না প্রথমে। পুবালী হেসে ফেলে বলেছে, তুই কি বোকা রে মৌ? আমি হলে তো বলতাম...আরো বেশী দামের কিছু থাকলে দেখাতে। মৌ দিদির কানে কানে বলেছে, কি হবে আমার এত দামের আংটি। পুবালী প্রথমে বুঝতে পারেনি ও কি বলতে চেয়েছে, তারপরেই বুঝতে পেরে ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলেছে... সে তো জানি, তোর সব থেকে দামী জিনিষটা কি। অরিত্র ওদিকে কাউন্টারে পেমেন্টের জন্য গেছে, মৌ পুবালীর কাছে সরে গিয়ে আস্তে করে বলল...মেজদি, আমাকেও তো তোমার ভাইকে কিছু দিতে হবে...কি দিই বলো না। তারপর দুজনে মিলে রুপসাকে ফোন করে ঠিক করেছে কি করবে কিন্তু সেটা কিছুতেই অরিত্র যেন না জানতে পারে এমন ভাবে করেছে ওরা। ফেরার সময়ে ওদের দুজনকে চুপি চুপি কথা বলতে দেখে অরিত্র একবার জিজ্ঞেস করেছে... কি ব্যাপার রে দিদিভাই...কি এত তোদের গোপন আলোচনা চলছে? পুবালী খুব গম্ভীর হওয়ার ভান করে ভাইকে বলেছে...মেয়েদের কত কথা থাকে...ও তুই বুঝবি না...
আশীর্বাদের দিন ওদের দুজনকে পাশাপাশি বসিয়ে একসাথে শুরু হয়েছে অনুষ্ঠান। এক এক করে বড়দের সবাইয়ের আশীর্বাদ করা হয়ে গেলে অরিত্র মৌয়ের আঙ্গুলে হীরের আংটিটা পরিয়ে দিলে জেঠিমা মজা করে জেঠুকে বলল...দেখেছো, আমাদের দুষ্টু কত সুন্দর একটা আংটি দিয়েছে...তুমি তো আমাকে কি একটা দিয়েছিলে কে জানে। জেঠু হেসে ফেলে বলল...আমি তো আর ওর মতো এত মাইনে পেতাম না তখন যে তোমাকে হীরের আংটি দেবো। দাদু হেসে ফেলে বলল...শুধু হীরের আংটি দিলেই হবে না বাবা, আমি লিস্ট বানিয়ে রেখেছি আরো কি কি করতে হবে।
সব কিছু মিটে গেলে দাদু মৌকে পাশে বসিয়ে পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ওর হাতে দিয়ে বলল...নে পড়ে শোনা তো দেখি বুদ্ধুটাকে কি কি করতে হবে বিয়ে করতে গেলে। মৌ কাগজটা দেখেই মুখ কাঁচুমাচু করে বলল...আমি কেন দাদু...
- আরে আমি কেন মানে? তুই এখন আমার নাতনী...আর ও ব্যাটা এখন এই বাড়ীর ছেলে, আমার কেউ নয় কিছুক্ষনের জন্য। সব কটা নিয়ম মেনে যদি চলবে কথা দেয় তবেই বিয়ে হবে আর যদি বলে মানবো না তো আমি তোর অন্য জায়গায় বিয়ে দেব...তোকে চিন্তা করতে হবে না, আমার হাতে অনেক ভালো ভালো ছেলে আছে...বুঝলি...
দাদুর কথা শুনে সবাই হেসে গড়াগড়ি যাওয়ার মতো অবস্থা। মোটামুটি সবাই দাদুকে একটু গম্ভীর দেখেছে এতদিন কিন্তু সেই মানুষটা যে এত মজা করতে পারে কারুরই প্রায় জানা ছিল না। জেঠু হাসতে হাসতে বলল...এই দুষ্টু, ভয় করিস না, আমি তোর পাশে আছি। বুক চাপড়ে বলে দে...হ্যাঁ বলো কি কি নিয়ম আছে...
মৌ কিছুতেই পড়বে না কি লেখা আছে, শেষে দাদু নিজেই পড়তে শুরু করল...
১) এখন থেকে গাড়ী নিয়ে অফিস যাওয়া আসা করতে হবে। নিজে ড্রাইভ করাতে আপত্তি থাকলে ড্রাইভার রাখতে হবে।
২) দেরী করে অফিস থেকে ফেরা যাবে না। দরকার হলে বাড়ীতে বসে কাজ করতে হবে। অনেক অফিসেই এখন এই নিয়ম চালু হয়ে গেছে, এতএব এই ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা হবে না।
৩) শনিবার কোনো অবস্থাতেই অফিস আছে বলা যাবে না। এক্ষেত্রেও পয়েন্ট নাম্বার ২ প্রযোজ্য হতে পারে যদি মৌ অনুমতি দেয়।
৪) মাসে অন্তত একবার সস্ত্রীক ভবানীপুরের বাড়ীতে এসে দুদিন থাকতেই হবে। জেঠুরা চাইলে দিনের সংখা বাড়তে পারে। শুধু ভবানীপুর এলেই হবে না, ওদিকে বড় জেঠুদের কথাও খেয়াল রেখে বছরে অন্তত একবার যেতে হবে। এছাড়াও বাকি আত্মীয় স্বজনদের বাড়ীতে সময় সুযোগ করে যাওয়া আসার ব্যাপারটা থাছে।
৫) বছরে দুটো বড় বা একটা বড় ও একটা ছোট বেড়াতে যাওয়ার প্রোগ্রাম রাখতেই হবে এবং সেটা আমাদের সাথে অবশ্যই নয়। আমাদের সাথে যেতে চাইলে এর বাইরে যাওয়া যেতে পারে।
৬) আগামী অন্তত চার বছর একেবারে ঝাড়া হাত পা থাকতেই হবে। মৌ সংসার করার সব কিছু শিখে গেলে তবেই বাচ্চাকাচ্চা নেবার ব্যাপারে ভাবতে হবে।
৭) এখন থেকে দেশের বাইরে কোথাও গিয়ে থাকতে গেলে একা একা যাওয়া চলবে না।
সব কটা নিয়ম পড়া হয়ে গেলে দাদু মুখ তুলে সবার মুখে হাসি দেখে অরিত্রর দিকে তাকিয়ে বলল...বল, কি করবি...
অরিত্র হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে হাসি মুখে বলল...ধরো আমি এখন হ্যাঁ বলে দিলাম আর পরে মানলাম না...তাহলে কি হবে...
দাদু এবারে মৌয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল...কি রে...কি হবে? মৌ মুখ তুলে একবার অরিত্রর দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল...আমি কি জানি...তোমার নাতি, তুমি বুঝবে...
দাদু হাসতে হাসতে বলল...সে কি রে...আমি তো তোর জন্যই এত কিছু ভাবছি আর তুই আমার কোর্টেই বল ফেলে দিলি...যাকগে, শোন...এগুলো আমি মোটেও মজা করার জন্য ভাবিনি...চাইলে সবকটা নিয়মই মেনে চলা যায় বুঝলি...
দিদান এতক্ষন কিছু বলেনি, চুপচাপ বসে দাদুর কথা শুনছিল। দাদুর কথা শেষ হতেই বলল...এ তো দেখছি এক তরফা হয়ে গেল। আমারও কিছু বক্তব্য আছে...এক এক করে বলছি, শোনো...
১) সারাদিন যখন তখন তুমি মৌ কোথায় গেল বলে হাঁক ডাক করতে পারবে না।
২) আমাদের লুকিয়ে মৌকে চুপিচুপি বলা যাবে না চা খাওয়াতে।
৩) আমরা ওষুধ দিলেও খেয়ে নিতে হবে চুপচাপ।
দিদানের কথা শেষ হলে দাদু বেশ গম্ভীরভাবে... ‘হুম, বুঝেছি... তুমি আজকাল খুব হিংসে করছো আমাকে’...বললে, সবাইয়ের হেসে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর ঠিক হয়েছে দু পক্ষই সব কিছু মেনে নিচ্ছে।
মৌয়ের বাবার ব্যাপারে ওকে না জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেলেও অরিত্র মনের ভেতরের খচখচানিটা দিনে দিনে বেড়েই যাচ্ছিল। অনেক ভেবেচিন্তে ও একা একাই ঠিক করে ফেলেছে সবকিছু জানিয়ে দেবে ওকে, যদিও ঠিক কি ভাবে বললে ঠিক হবে সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না। কয়েকদিন ধরে ওকে একটু অন্যমনস্ক দেখে দিদান দু একবার কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলেও অফিসের কিছু কাজের কথা ভাবছে বলে ও এড়িয়ে গেছে। দিদান এমনিতেই খুব ব্যাস্ত থাকায় আর ওই ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে পারেনি বা পরে একা ওর সাথে কথা বলবে ভেবেও ভুলে গেছে।
আজকাল অরিত্রকে তাড়াতাড়ি বাড়ী ফিরে আসতে হচ্ছে তার উপরে মাঝে মাঝে ছুটি নিতে হচ্ছে বলে রাতের দিকে বাড়ীতে বসে অফিসের কিছুটা কাজকর্ম করতে হচ্ছিল। সেদিন ও রাতে একা একা কাজ করছে, রাত প্রায় সাড়ে বারোটা পৌনে একটা মতো বাজে। একটানা কাজ করতে করতে একটু বিশ্রাম নেবার জন্য ও চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে বসেছিল। অবশ্য শুধু হয়তো বিশ্রাম নেওয়া নয়, সাথে সাথে ওই ব্যাপারটা নিয়েও ভাবছিল। কি করবো ভাবতে ভাবতে তো একটা একটা করে দিন চলে যাচ্ছে... আর দেরী করা যাবেই না, যেভাবেই হোক ওর মায়ের সাথে দেখা করতে যাবার আগেই জানানোটা দরকার...কিন্তু কি ভাবে?
চোখ বুজে থেকে ভাবতে ভাবতে খুব পরিচিত হালকা কিন্তু মিষ্টি একটা গন্ধ নাকে এলে চোখ না খুলেই বুঝে গেল কে এসেছে। যাই থাকুক না কেন মনের ভেতরে, ও এসেছে বুঝতে পেরে ভালো লাগার অনুভুতিতে মনটা ভরে উঠলো। শুধু ভালো লাগা নয়, সাথে সাথে ওকে বলতে পারার সুযোগটা অযাচিত ভাবে এসে যাওয়ায় সাথে সাথেই মনস্থির করে নিল কি করবে। ও যে বুঝতে পেরেছে মৌ এসেছে সেটা ওকে বুঝতে না দিয়ে আরো কিছুক্ষন চোখ বুজে চুপ করে বসে থেকে হয়তো দেখতে চাইছিল ও কি করে। ভালো করেই জানে ও এসেছে যখন কথা না বলে ফিরে যাবেই না। অরিত্র ওকে আর অপেক্ষা করানোটা ঠিক হবে না ভেবে চোখ না খুলেই বলল...ঘুমোওনি? ও কিভাবে বুঝলো যে আমি এসেছি ভাবতে ভাবতে কয়েক মুহুর্ত চুপ করে থেকে মৌ ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ও যে নিঃশব্দে আরো কাছে সরে এসেছে বুঝে গিয়ে অরিত্র হাত বাড়িয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলে ও আস্তে করে বলল...কি করে বুঝলে আমি এসেছি? প্রশ্নটা শুনে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলে মৌ ওর কপালে হাত রেখে আস্তে করে বলল...একটা কথা জিজ্ঞেস করবো? তারপরেই ওর উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলল...তোমার কি হয়েছে আমাকেও বলতে পারবে না?
Posts: 1,976
Threads: 56
Likes Received: 1,969 in 955 posts
Likes Given: 228
Joined: Jan 2019
Reputation:
125
দিদানকে এড়িয়ে যেতে পারলেও মৌকে এড়ানো গেল না বা এড়িয়ে যাবার প্রশ্নই ছিল না। ‘তুমি একটু বোসো, চোখে মুখে জল দিয়ে আসছি এখুনি’ বলে অরিত্র উঠে গেছে। চোখে মুখে জল দেওয়াটা একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, তার সাথে নিজেকে মানসিক ভাবে তৈরী করে নেবারও একটু সময়ের দরকার ছিল। সময়ের দরকার থাকলেও খুব একটা বেশী সময় নেওয়া যাবে না ভেবে ফিরে এসেছে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব। মৌ কোলের উপরে হাতটা রেখে চুপ করে বসেছিল। অরিত্র ওর দিকে একবার তাকিয়ে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে ফিরে এলো ওর পাশে। ওকে কাছে টেনে নিয়ে কিছূক্ষন চুপ করে বসে থাকলে...মৌ নিচু গলায় বলল...কই বললে না তো কি হয়েছে তোমার। অরিত্র আস্তে করে বলল...তোমাকে একটা কথা জানানোর ব্যাপারে ভাবছি কিন্তু পেরে উঠছি না।
- কি?
- আগে বলো, যা বলবো তুমি ছাড়া আর কেউ জানবে না...
কাউকে না জানানোর মতো কি হতে পারে ভাবতে গিয়ে ও একটু অবাক হয়ে গিয়ে চুপ করে থাকার পর বলল...আচ্ছা...
ও আচ্ছা বললেও অরিত্র খুব ভালো করেই জানে শোনার পর ওর মানসিক অবস্থা কি হতে পারে আর সেই অবস্থায় ওর পাশে থাকার কতটা দরকার আছে। ওকে নিবিড় ভাবে বুকে চেপে ধরে অনেকটা সময় নিয়ে একটু একটু করে যা জেনেছে বলা হয়ে গেছে। মৌ কথাগুলো শুনে কান্না আটকানোর চেস্টা করলেও পারলো না, গুমরে গুমরে বেশ কিছুক্ষন কান্নার পর নিশ্চুপ হয়ে বসেছিল। অরিত্র ওকে এই মুহুর্তে আর কিছু বলতে চাইছিল না, মুখে কিছু না বলে যে বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরে থেকে অনেক বেশী সান্তনা দেওয়া যায় সেটা আরো একবার প্রমান হয়ে গেল আজ। এরকম একটা মর্মান্তিক খবর শোনার পরেও যে ও নিজেকে ভেঙ্গে পড়ার হাত থেকে কিভাবে বাঁচাতে পেরেছে সেটা আর কেউ না বুঝুক ও নিজে জানে। চুপচাপ আরো কিছুক্ষন কেটে গেছে, মৌ অস্ফুট গলায় বলল... আমি কিভাবে নেবো সেই ভেবে কি তুমি আগে বলোনি?
উত্তরটা হ্যাঁ শুনে ও কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর আগের মতোই বলল... তুমি কিছু ভেবোনা আর এই নিয়ে..আমি চাইনা আমার জন্য সবার খুশী নষ্ট হোক, এমনিতেই আমাকে নিয়ে তোমার ...
ও কি বলতে চেয়েছে বুঝতে পেরে অরিত্র আস্তে করে বলল... কাজটা সোজা নয়, তবুও নিজেকে শক্ত করতে হবে মৌ...এখন তুমি আর একা নয়...
ছোট্ট করে একটা নিশ্বাস ফেলে ও জবাব দিয়েছে...জানি...
এরপর আর বিশেষ কিছু কথাবার্তা হয়নি। চুপচাপ দুজনে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকার পর ও ফিরে গেছে। অরিত্র ওকে আরো কিছুটা সময় থাকতে বললে ও বলেছিল...চিন্তা করবে না,আমি ঠিক আছি। ওকে এখন একা থাকতে দেওয়াটা হয়তো ভালো হবে ভেবে আর জোর করেনি। মৌ চলে যাবার পরও অরিত্র শুতে যেতে পারেনি, চুপ করে বসে থেকে ভাবছিল ঠিক কি কি ঘটে গেছে এইটুকু সময়ে, কোথাও কোনো ফাঁক থেকে গেল কিনা... যেটাকে নিয়ে ওকে ভাবতে হবে। ভাবতে ভাবতে ওর একটা কথা বারে বারে মনে আসছে... আমার জন্য তো রাতের অন্ধকার আছেই, ওইটুকু সময় আমি না হয় বাবার জন্য একটু কাঁদবো...
অরিত্র যতটা ভয় পেয়েছিল ঠিক তা হয়নি, ভেতরে যতই যন্ত্রনা থাকুক না কেন কাউকে সেটা একেবারেই বুঝতে দেয়নি ও। একমাত্র অরিত্রকে যেটুকু সময় একা পেতো সেই সময়টুকু ও চেস্টা করতো না স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করার। মাঝে একবার নিজের থেকেই অরিত্রকে বলেছিল...ভেবে আর কি করবো বলো...বাবা তো আর ফিরে আসবে না...
সবকিছু ঠিক করা হয়ে গেলে একদিন বিশ্বাস কাকু আর ল-ইয়ার মিঃ মুখার্জীকে সাথে নিয়ে যেতে হয়েছিল মায়ের সাথে দেখা করতে। বিল্টু আর মিষ্টি বাড়ী ছিল না, ওরা দিদি কোন সময়ে আসবে জানা থাকায় কাজ আছে বলে আগেই বেরিয়ে গেছে একসাথে, তবে দুজনেই খুব চিন্তায় আছে ব্যাপারটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তাই ভেবে। মাঝে মাঝেই ফোন করে খবর নিয়েছে ওরা কতদুর পৌঁছোলো। সবাই ভেবেছিল হঠাৎ মৌকে দেখে হয়তো উনি অবাক হবেন কিন্তু ওনাকে দেখে মনেই হয়নি তেমন কিছু হয়েছে...বা হয়তো নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর সহজাত ক্ষমতাটা ওনার বড্ড বেশি। ওদেরকে বসার কথা বলে শুধু একটাই কথা বলেছেন...তুই যে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে গেলি সেটা কি ঠিক হয়েছিল... আর ছিলিই বা কোথায় এতদিন? মৌ কথাটার সরাসরি জবাব না দিয়ে বলেছে...তোমার সাথে কিছু দরকার আছে বলেই আমি এসেছি। মৌ দরকার আছে বলাতে কয়েক মুহুর্ত ওর দিকে তাকিয়ে থেকে হয়তো বোঝার চেস্টা করেছেন দরকারটা কি হতে পারে। কিছু একটা অনুমান করে ওদেরকে বাইরের ঘরে বসিয়ে ভদ্রমহিলা ভেতরে চলে গেলে মৌ এদিক ওদিক তাকিয়ে হয়তো পুরোনো দিনের কথা ভাবছিল। তারপর কি মনে করে ভেতরে গিয়ে ওনাকে ডেকে আনলো, ও চাইছিল না হয়তো বেশী সময় দিতে, যা বলার বা করার তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে যেতে চাইছিল। মিঃ মুখার্জী কথা শুরু করতে যেতেই উনি বললেন... আমাকে দুর্বল ভাবার কিন্তু কোনো কারন নেই... ভাববেন না আমি কিছু বুঝিনি। বেশ কিছুদিন ধরেই খবর পাচ্ছিলাম আমাদের ব্যাপারে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে। আমিও কিন্তু আপনাদের বিরুদ্ধে কিডন্যাপের কেস করতে পারি। আপনাদের হয়তো জানা নেই যে আমার উপর মহলের সাথে ওঠাবসাটা কিছু কম নয়। এতটা বলে হয়তো উনি থামলেন প্রতিপক্ষের দিক থেকে কি সাড়া আসে সেটা জানার জন্য।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে মৌ খুব একটা জোরে না হলেও বেশ দৃঢতার সাথে বলল...তোমার খেয়াল রাখা উচিত যে আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তুমি যা খুশি করো না কেন আমার বক্তব্যটাই কোর্ট মেনে নেবে আর তার থেকে বড় কথা বাবার ব্যাপারে তুমি যা করেছো তার কিছু হলেও প্রমান আমাদের কাছে আছে যখন আমরাও কি ছেড়ে দেবো ভেবেছো? যাকগে, ওসব কথা ছাড়ো, তোমার সাথে কোনোরকম ঝামেলা করার জন্য বা কিছু নিতে আমি আসিনি। আমি আজ এখানে এসেছি, যে কারনে তুমি আমাকে সরাতে চেয়েছিলে সেগুলো সব তোমাকে দিয়ে যেতে। আর কিছু বলবে?
ভদ্রমহিলার আর কি কি ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে না জানা থাকলেও পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেকে কিভাবে খাপ খাওয়ানো যায় সেটা বেশ ভালোই জানেন। সামান্য কয়েক মুহুর্ত মুখ নিচু করে বসে থাকার পর নিজেকে নিমেষের ভেতরে পালটে নিয়ে চোখে জল এনে বললেন...তুই আমাকে ভুল বুঝিস না মৌ, আমি কখোনো তোর খারাপ চাইনি...বিশ্বাস কর...যা কিছু করেছি তোর ভালোর জন্য করেছি...তোর বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম...
মৌ চাইছিল না আর কথা বাড়াতে বা এটাও চাইছিল না পরিস্থিতি অন্য দিকে মোড় নিক...আর কেউ ওনাকে চিনুক বা না চিনুক, ও তো ভালোভাবেই চেনে। মা-কে থামিয়ে দিয়ে বলল...আমি কোনোকিছুই আর জানতে বা শুনতে চাই না। তুমি সত্যিই যদি আমার ভালো চাইতে তাহলে আমি চলে যাবার পর আর কিছু না করো বা না করো একটা মিসিং ডাইরি অন্তত করতে... যাই হোক,তুমি যা যা করেছো বা করতে চেয়েছিলে সেগুলো আমি আর এখানে সবার সামনে ওঠাতে চাই না। আমি তো সব কিছু দিতেই এসেছি, এখন আর ওসব কথা তুলে কিছু লাভ নেই। তবে, একটা কথা বলে যাচ্ছি...তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক না রাখলেও বিল্টু আর মিষ্টির সাথে আমার যোগাযোগ থাকছেই। আমি এখানে না এলেও ওরা যখন চাইবে আমার কাছে যাবে। তোমার যদি মনে হয় আমার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া উচিৎ তাহলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারো তবে আমি যখন সম্পর্কটা এখানেই শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি, তুমি কিন্তু ভুলেও চেস্টা করবে না সেটা নিয়ে কিছু করার বা ভাবার...আর একটা কথাও বলে যাচ্ছি, তুমি আমার মা হতে পারোনি তাতে আমার আর বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই কিন্তু যদি এখন থেকে নিজের ছেলেমেয়ের কথা ভেবে অন্তত ওদের মা হওয়ার চেস্টা করতে পারো তো ভালো হয়। ধরে নাও, শুধুমাত্র ওদের দুজনের কথা ভেবেই আমি সবকিছু জেনেও বাবার ব্যাপারটা নিয়ে তোমার বিরুদ্ধে আইন আদালত করতে চাইছি না...
বিল্টু আর মিষ্টির কথা শুনে ভদ্রমহিলা হয়তো বোঝার চেস্টা করছিলেন তাহলে কি নিজের ছেলে মেয়েও পর হয়ে যাবে? ওনাকে চুপ করে থাকতে দেখে মৌ পরিস্কার করে বলে দিয়েছে ওরা ভাইবোন দিদির সাথে যোগাযোগ রাখলে যেন ওদেরকে কিছু না বলা হয় আর ওদেরকে যদি কিছু বলা হয় তাহলে তার ফল খারাপ ছাড়া ভালো হবে না। দরকার হলে ও আজই পাড়ার সবাইকে জানিয়ে দেবে কি কি ঘটেছে এতদিন ধরে আর মা যেন মনে রাখে যে ঊনার উপর মহলে যেমন ওঠাবসা আছে তেমন আর কারুর নেই সেটা ভুলেও না ভাবতে।
যে মেয়েকে নিজের খুশী মতো এত বছর চালানো হলেও কোনোদিন মুখ ফুটে একটাও কথা বলেনি কোনোদিন, সেই মেয়ের মুখে এত বড় বড় কথা শুনেও আর সাহস হয়নি কোনো কথা বলার বা তিন তিন জন অপরিতিত মানুষের সামনে বসে ওইটুকু মেয়ের কাছে হেরে এইভাবে যাওয়াটা হয়তো সহ্য হচ্ছিল না। মুখ নীচু করে উঠে যাওয়ার আগে শুধু বলে গেছেন আমি ভেতরে আছি, কি করতে হবে বল, করে দেবো।
তারপরের ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক ভাবে মিটে গেছে একটার পর একটা। অরিত্র বিল্টুকে ফোন করে বাড়ী আসতে বলে দেবার পর ওরা ফিরে এসেছে। ওরা দুজনেই একটু ভয়ে ভয়ে ফিরে আসার পর যখন দেখলো যে মায়ের সেই রুপ আর দেখা যাচ্ছে না, তখন কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে দুজনে মিলে সবার জন্য ওদের বুদ্ধিমতো আতিথেয়তার ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। এদিকে কাগজপত্রের কাজ করতে করতে মিষ্টিকে নিয়ে মৌ ভেতরে গিয়ে ওর একান্ত নিজস্ব কিছু জিনিষ বা দরকারী কাগজপত্র নিয়ে নিয়েছে। সব কিছু মিটে গেলে আর এক মুহুর্তও মৌ ওখানে থাকতে চাইছিল না। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল মুখে কিছু না বললেও ভেতরে ভেতরে ছটপট করছে কখন বেরিয়ে আসবে, তবে তার আগে ভাইবোনকে মায়ের সামনেই বার বার করে বলে দিয়েছে ওদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই, ওরা যেন মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর বিয়ের কয়েক দিন আগে যেমন আসার কথা বলা আছে সেইমতো চলে আসে বা তেমন যদি ওরা মনে করে তাহলে বললেই দাদা অফিস থেকে ফেরার পথে চলে আসতে পারে ওদেরকে তুলে নিতে।
ফেরার সময় মিঃ মুখার্জী আর বিশ্বাস কাকু শ্যমবাজারে নেমে গেলেন নিজেদের কিছু কাজ থাকায়। অস্বাভাবিক ভাবে আজ যেন রাস্তায় গাড়ীর ভীড় তেমন নেই। মৌ চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলেও অরিত্র মৌয়ের হঠাৎ করে পালটে যাওয়াটা বা যেভাবে ও একটার পর একটা কথা বলে গেছে, সেগুলো নিয়ে ভাবছিল। ও হঠাৎ করে যা যা করে ফেলেছে সেগুলো কোনোভাবেই ওর স্বভাবের সাথে খাপ খায়না। কোনোভাবেই মেলাতে না পেরে পরে ওর সাথে কথা বলবে ভেবে খেয়াল করল বেশ কিছুটা সময় ধরে ও কোনো কথা বলেনি...তারপরই ওর দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেও কিছুই হয়তো দেখছে না, পাথরের মতো বসে থেকে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। ড্রাইভারকে সাবধানে গাড়ী চালাতে বলে অরিত্র ওর পাশে সরে গিয়ে হাতের উপরে হাতটা রাখলে মুখ ফিরিয়ে তাকালো। এত সময় নিঃশব্দে কেঁদে গেলেও আর পারলো না নিজেকে আটকে রাখতে। ওর সবথেকে কাছের যে আছে তার কাছে নিজেকে মেলে ধরতে পারলে তো মনটা হাল্কা হবে ভেবে হয়তো কোনোরকমে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার সাথে বলল...সব কিছু জেনেও বাবার জন্য কিছু করতে পারলাম না...জানি না ঠিক করলাম কিনা...
এই মুহুর্তে ওকে কিছু না বলে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে নীরবে সান্তনা দিয়ে যেতে থাকলে আস্তে আস্তে কান্নার দমক কমে আসার পরেও বেশ কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল...বললে না তো, আমি ভুল করলাম কিনা। অরিত্র ওর হাতে আলতো ভাবে একটু চাপ দিয়ে বলল... তুমি ঠিকই করেছো মৌ...একটা ক্ষতির শোধ নিতে গিয়ে আরো একটা ক্ষতি হয়তো আমাদের বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয় বা করতে হয় কিন্তু এক্ষেত্রে সেটা ঠিক হতো না। কথাটা শুনে ও কিছু বললো না...সামান্য একটা বিরতির পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর কাঁধে মাথা রেখে চুপ করে মুখ নীচু করে বসে থেকে হয়তো ভাবছিল..আমি ঠিক যা ভেবে ডিশিশানটা নিয়েছিলাম ও তো ঠিক সেটাই বলল...জানি না ও এত ভালো কি করে বোঝে আমাকে...
আরো কয়েকটা দিন চলে গেছে, প্রথম দুটো তিনটে দিন মৌ কিছুটা হলেও চুপচাপ ছিল দেখে এর ভেতরে কেউই ওই সমস্ত ব্যাপার নিয়ে কথা বলে ওকে বিরক্ত করতে চায়নি। আবার একদিন রাতে সবাই শুয়ে পড়লে ও এসেছিল অরিত্রর কাছে...চেয়ারের পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে প্রথমেই মিষ্টি করে বকুনি দিল এত রাত অব্দি কাজ করার জন্য। অরিত্র হাসি মুখে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবছিল...ওর এই আদর করে বকুনি দেওয়াটা আর কিছু নয়...ও যে এখন একেবারের স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে বা কোনো কথা ভেবে ভীষন খুশী হয়েছে তারই প্রমান। ওকে হাসি মুখে চুপ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে চুলের ভেতরে ওর চাঁপাকলির মতো আঙ্গুলগুলো ঢুকিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল...এই,এত রাতে কেন এসেছি বলোতো? তারপরেই ও কি বললো না বললো তাতে আমার বয়ে গেল এরকম একটা ভাব করে খুব খুশী খুশী গলায় বলল...এই, শোনো না...আমার না ভী-ষ-ন ভালো লাগছে...কেন বলোতো? অরিত্রর ওকে সেই আগের মতো সরলতা ভরা গলায় কথা বলতে দেখে ভীষন ভালো লাগছিল তবুও মজা করে বলল...কেন আবার...আমার কাছে এসেছো...তাই...
- উমম..শুধু ওটা নয়...শোনো না...কেন ভালো লাগছে জানো তো...দেখলে না সেদিন কেমন আচ্ছা করে দিলাম...কম অত্যাচার করেছে নাকি আমার উপরে...
- হুম...বুঝলাম...
- অবশ্য পুরো ক্রেডিটটা তোমাকেই দিতে হবে আমায়...তুমি যদি আমাকে ওইভাবে না বুঝিয়ে বুঝিয়ে বলতে কি হয়েছিল তাহলে তো আমি আর ওইভাবে বলতে পারতাম না...জানো তো মাথায় যেন আগুন জ্বলছিল...
- হুম...এখন আর আগুন জ্বলছে না তো? আমার তো আবার একটু ভয় ভয় করছে...
- এই, একদম ইয়ার্কি করবে না...তোমার ভয় পাওয়ার কি আছে শুনি...
- আচ্ছা ঠিক আছে, করলাম না ইয়ার্কি কিন্তু আমার জন্যই যখন হয়েছে তাহলে আমাকে কি দেবে বলো?
- কাঁচকলা দেব তোমাকে...তুমি নিজের থেকে কেন নাও না শুনি...
- শোনো, তুমি যখন কথা বলতে পারতে না...তখন আমি যেমন তোমাকে দেখে বুঝে নিতাম তেমনি তোমাকেও এখন থেকে আমাকে দেখে বুঝে নিতে হবে আমি কি চাই...
- ইশ, এটা কি শোধবোধ হচ্ছে নাকি...উঁ...
- সে আমি জানি না...বলো আমি এখন কি চাইছি...
- উমমম...তুমি এ-খ-ন...ধ্যাত জানি না যাও...
জানি না বললেও ও বুঝেছে ওকে এখন কি করতে হবে...আরো কাছে সরে এসে দুহাতে মুখটা ধরে কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থাকলো নিজের ঠোঁট দুটোকে আলতো ভাবে দাঁতে চেপে ধরে, তারপরেই ওকে ছেড়ে দিয়ে দুষ্টুমি ভরা হাসি মুখে নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে কয়েক পা পিছিয়ে গেছে আস্তে আস্তে করে, যেন বলতে চেয়েছে...উঁ হুঁ...দেবোই না এখন...তবে, তুমি যদি নিজে উঠে এসে নিতে চাও তো নিতে পারো। অরিত্র চেয়ারে হেলান দিয়ে এক মনে ওকে দেখে যেতে থাকলে নিজের থেকেই আবার ফিরে এল এক পা এক পা করে। নিজের থেকেই কোলে বসে বুকের উপরে এলিয়ে পড়ে দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল...তুমি খুব খারাপ...বিচ্ছিরি...
- তাই?
- হু...তাই তো...
- কেন?
- আমি পিছিয়ে যাচ্ছি দেখে কেন উঠে এসে আমাকে আটকালে না?
- আমি তো জানতাম ..
- কি?
- তুমি ঠিক ফিরে আসবে...
- তাই?
- হু...
তারপরে যা হবার তাই হয়েছে...বিচ্ছিরি ছেলেটার আদর খেয়ে যতটা খুশী হয়ে ও এসেছিল তার থেকেও বেশি খুশী হয়ে ফিরে গেছে নিজের ঘরে, এবারে ঘুমোতে হবে...
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অরিত্রর বন্ধুবান্ধবদের বাড়ী গিয়ে নিমন্ত্রন করে আসা হয়ে গেছে একমাত্র শুভর বাড়ী ছাড়া। রবিবার সকালে ওকে বিয়ের কার্ড নিয়ে আসতে দেখে শুভ হেসে ফেলে বলল...আমি তো তোর হয়ে অনেক আগেই মা বাবাকে বলে ফেলেছি, তুই আবার কি করতে এলি। কাকীমা রান্নাঘরে ব্যাস্ত ছিল, ছেলের কথা শুনে বেরিয়ে এসে বলল... একা একা এলি কেন রে...মৌকে তো নিয়ে আসতে পারতিস, কতদিন দেখিনি মেয়েটাকে। অরিত্র হেসে ফেলে বলল...আমি নিজেই আজকাল দেখতে পাইনা তাকে, সে তো শুনি এ বাড়ী ও বাড়ী তোমাদের ওই আইবুড়ো ভাত না কি যেন খেয়ে বেড়াচ্ছে, তার উপরে পার্লার, টেলারিং শপ, গয়নার দোকান, মার্কেটিং তো লেগেই আছে। ওর কথা বলার ভঙ্গীতে কাকীমা হেসে ফেলেছে শুভর সাথে সাথে। একপ্রস্থ হাসাহাসির পর কাকীমা বলল...সে তো হবেই, বিয়ের আগে মেয়েদের কত কাজ থাকে...তোরা ছেলেরে ও সব বুঝবি না।
- থাক বাবা আমার আর বুঝে কাজ নেই...তুমি এখন আমাকে একটু চা খাওয়াও তো দেখি...বাজার থেকে এসে দেখি একজন বেরিয়ে গেছে দাদুর সাথে কাছে পিঠের নিমন্ত্রনে, একজন মেজদির সাথে ফোনে কিসব গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে, আর একজন বাজার থেকে এত কিছু এনেছি কেন বলে এমন মাথা খারাপ করতে শুরু করলো যে চায়ের কথা বলবো কি...কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছি...
কাকীমা ওর অবস্থা শুনে হাসতে হাসতে বলল... বিয়ে করার কি জ্বালা বুঝতে পারছিস তাহলে বল।
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেছে। আর মাঝে মাত্র দশটা দিন বাকি আছে বিয়ের। মোটামুটি সব কিছু প্রায় করা হয়ে গেলেও আর কিছু বাকি থেকে গেল কিনা তাই নিয়ে দাদু চেক লিস্ট বানাতে বসেছে। যদিও অরিত্রকে কিছুই করতে দেওয়া হয়নি তবুও ওকে পাশে থেকে দাদুকে এটা ওটা মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে। সবকিছু হয়ে গেলে দাদু বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল...যাক বাবা, আর কিছু বাকি নেই দেখছি। অরিত্র দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল...নারায়নদার বাড়ীর কথা তো আমাদের কারুরই খেয়াল নেই। ওর কথা শুনে দাদু বেশ অবাক হয়ে বলল...কেন...আমি নিজে গিয়ে বলে এসেছি, বাড়ীর সবাই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত থাকতেই হবে...আর নারায়ন তো প্রায় রোজই আসে...নিজের ছেলে মেয়ের বিয়েতেও হয়তো এত খাটাখাটনি করেনি, নিজের থেকেই এটা ওটা করছে...না বললেও তো শোনে না। অরিত্র একটু সময় নিয়ে কিছু একটা ভেবে বলল...আমি ওসবের কথা বলছি না,আসলে ওদের জন্য কিছু একটা করা উচিত আমাদের। নারায়নদার বয়স হচ্ছে, এই বয়সেও রিক্সা টেনে যাচ্ছে,আমার ঠিক ভালো লাগে না...তাছাড়া সেদিন যদি আমাকে জোর না করতো তাহলে তো মৌকে এখানে নিয়ে আসা হয়তো হতো না আর প্রিয়ার থেকেই তো অনেকটা খোঁজ পেয়েছিলাম আমরা।
ও কি বলতে চাইছে বুঝতে পেরে দাদু কয়েক মুহুর্ত কিছু একটা ভেবে দিদানের দিকে তাকালে দিদান অরিত্রকে বলল... ঠিকই বলেছিস,কিন্তু ওকে তো জানিস...এই বয়সেও আত্মসম্মান বজায় রাখতে গিয়ে ছেলের কাছে হাত পাতে না যাতে বৌমা কিছু না বলতে পারে...
- আমিও যে ভাবিনি ওটা নিয়ে তা নয়...সোজাসুজি কিছু দিতে গেলে নেবে না কিন্তু ধর যদি আমরা ঘুরিয়ে কিছু করি...
- সে তো বুঝলাম কিন্তু ঘুরিয়ে কি ভাবে দেওয়া যাবে?
- স্টেশন রোডে তো আমাদের একটা জমি পড়ে আছে...ওটাতে যদি দুটো দোকান ঘর করে দেওয়া যায়...একটাতে নারায়নদার সাইকেল রিক্সার পার্টসের দোকান আর একটাতে প্রিয়ার জন্য বিউটি পার্লার করা যেতে পারে, প্রিয়া তো শুনেছিলাম বিউটিশিয়ান কোর্স করছিল...
- সেই তো সরাসরি দেওয়া হয়ে যাচ্ছে না কি?
- না না...তা হবে কেন...আমরা না হয় সামান্য টাকায় লিজ হিসেবে সাজানো দোকান দিয়ে দেব...বা দোকান থেকে যা লাভ হবে তার থেকে অল্প কিছু আমাদের জন্য দিতে পারে...পুরো ব্যাপারটাই যদি ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইটে করা যায় তাহলে তো বলতে পারবে না যে আমরা সাহায্য করছি...
নাতির কথাটা দাদু দিদান দুজনেরই পছন্দ হয়ে যেতে ওইদিন বিকেলেই দাদু নাতি দুজনে মিলে নারায়নদার বাড়ী গিয়ে বুঝিয়েছে এই বলে যে খালি জায়গা পড়ে থাকলে কোন দিন না আবার দখল হয়ে যায় আর বাইরের কাউকে দেওয়ার থেকে জানাশোনা আর বিশ্বাস করা যায় এমন কাউকে দেওয়াটা তো ভালো...সবকিছু শুনেও না না করছিল কোনো অভিজ্ঞতা নেই দোকান চালানোর কথা বলে। অরিত্র হাতে ধরে যখন বুঝিয়েছে যে সব কাজই তো মানুষ জীবনের কোনো না কোনো সময়ে প্রথম বারের জন্য করে, তাহলে এত ভয় পাওয়ার কি আছে...তারপরেই রাজী হয়েছে কিন্তু একটা শর্ত আছে...সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও এসে হিসেব দেখিয়ে যাবে যাতে করে বোঝা যায় লাভ ক্ষতি কি হচ্ছে...
আরো তিনটে দিন চলে গেছে। বাঁকুড়া থেকে মৌয়ের মামা ছেলে মেয়েকে এখানে পৌঁছে দিয়ে সেইদিন দুপুরেই ফিরে গেছেন। ওদিকেও কিছু কাজ আছে যেগুলো নিজে না থাকলে নাকি হবে না। ওরা দু ভাইবোনে দিন তিনেক এখানে থেকে দিদিকে সাথে নিয়ে ফিরবে। অবশ্য ওরা নিজেদের মতো করে যাবে না, শুভ ওদেরকে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে দুর্গাপুরে ওইদিন রাতে থেকে ব্যাবস্থা ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা নিজের চোখে দেখে আসবে। যেহেতু বিয়েটা দুর্গাপুরে হবে তাই তার আগে মামাবাড়ীতে দুদিন মতো ওকে থাকতে হবে মৌকে। মেয়ের বিয়ের আগে বাড়ির দুর্গামন্ডপে প্রনাম করে আশীর্বাদ নেবার একটা ওদের বংশানুক্রমিক নিয়ম আছে ওনাদের আর তার সাথে সাথে আছে আরো কিছু অনুষ্ঠান। রুপসা ব্যাপারটা শুনে প্রথমে গাঁইগুঁই করছিল, মৌ ওখানে থেকে বিয়ের দিন সকালে দুর্গাপুর এলে ওকে সাজানোর কি হবে। ওর মতে দুপুর থেকে সন্ধে এতটা সময়ও নাকি যথেষ্ট নয়। শেষ পর্যন্ত যখন ওকে বলা হল যে তুইও ওর সাথে যা, তো শুনে বলল...তাহলে বাবা ঠিক আছে, আসলে তোমরা ঠিক বুঝবে না..আমার একটুও ইচ্ছে করছে না একা একা ছেড়ে দিতে, কোথায় কি হয়ে যাবে কে বলতে পারে। এরপরে এক ফাঁকে রুপসা অরিত্রকে একা পেয়ে পেছনে লেগে বলেছে...কি রে দাদাভাই...থাকতে পারবি তো একা একা? অরিত্র ওকে তাড়া করলে দৌড়ে পালাবার ভান করে বলেছে... তুই কি রে...তোর মন খারাপ হবে ভেবেই তো বললাম আর তুই কিনা আমাকেই তাড়া করছিস...
একটা করে দিন কমে আসছে আর বাড়ীতে ভীড় জমতে শুরু করেছে। বাকি আত্মীয়দের প্রায় বেশীরভাগই আগেরদিন রাতের ভেতরে আসবে আবার কেউ কেউ বিয়ের দিন সকালে সোজা দুর্গাপুর আসছে যে যার সুবিধা মতো। আত্মীয়রা যেমন আসছে আসুক কিন্তু কয়েক জনের আগেই আসা চাই এটা দিদান বার বার বলে দিয়েছিল, সেই কয়েক জন হচ্ছে...রুপসা, পুবালী, বিল্টু, মিষ্টি যাদেরকে কাছে পাওয়াটা নাকি মৌয়ের খুব দরকার। এরা ছাড়াও ওদিক থেকে অর্ক আর মামন আসায় ব্যাপারটা আরো জমে উঠেছে। ছোটগুলো সবকটাতে মিলে এত হৈ হুল্লোড় করছে যে মনে হচ্ছে বিয়েটা আজ কালের ভেতরেই হচ্ছে।
একটু বেলার দিকে অর্ককে একা একা মুখ ভার করে বসে থাকতে দেখে অরিত্র ওকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করার পর জানা গেল দিদিরা ওকে নাকি পাত্তা দিচ্ছে না। ওর মুখ ভার করে বলা কারনটা শুনে মনে মনে হেসে ফেলল অরিত্র। দিদিরা বলতে মামন আর মিষ্টী, ওরা ওদের কিশোরী সুলভ স্বভাবের বশে কি পরবে, কেমন ভাবে সাজবে ওই নিয়ে ব্যাস্ত। ওদের কি আর ভাই এর জন্য সময় আছে নাকি এখন। আচ্ছা আমি দেখছি বলে ওকে সাথে নিয়ে রুপসার খোঁজে এদিক ওদিক দেখে পাওয়া গেল ছাদে...ওড়নাটা কোমরে বেঁধে বিল্টুর কাছে ঘুড়ী ওড়ানো শিখছে। মেয়েটা পারেও বটে বাবা ভাবতে ভাবতে ওকে ডেকে অর্কর সমস্যাটা বলতে ঘুড়ী ওড়ানো শেখা শিকেয় তুলে ওদের দুজনকে খুঁজে পেতে একজায়গায় নিয়ে এসে বকে দিয়ে বলল... এই তোরা কেউ আমার ভাই এর সাথে কথা বলবি না। কে তোদেরকে সাজিয়ে দেয় দেখবো আমি...চল তো ভাই, আমরা বাইরে গিয়ে আইসক্রিম খেয়ে আসি। দিদি যে মিথ্যে মিথ্যে বকছে বুঝতে পেরে মিষ্টি মুখ টিপে হাসছিল। অর্ক ওকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... হুঁ...চলো তো দিদি...কে ওদের ফাইফরমাস খাটে দেখবো...এই ভাই চল না দোকানে যাবো বললে কে যায় দেখবো। মামনও উলটে ভাইকে ভেঙ্গিয়ে দিয়ে বলল... কে তোকে অঙ্ক দেখিয়ে দেয় আমিও দেখবো।
রুপসা একাই ভাইকে সাথে নিয়ে আইসক্রিম খেতে যাবে বললেও বাকিরা কেউ বাদ গেল না। ড্রাইভার এই মুহুর্তে না থাকায় অরিত্রকেই ড্রাইভ করতে হবে। গাড়ীতে গাদাগাদি করে সবাই উঠে পড়ে এত হৈ চৈ করছে যে কান পাতা দায়। ছোটো গুলোকে আর কি বলা যাবে...দলের নেত্রী যেখানে রুপসা সেখানে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। অরিত্রর আর থাকতে না পেরে...উঃ বাবা রে বাবা...তোরা একটু চুপ করবি? বললে রুপসা এক প্রস্থ হেসে নিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ছোটদের কান বাঁচিয়ে বলল...তুই কি রে দাদাভাই... বেরসিক ভোঁদড় একটা... দু দুটো সুন্দরী শালী পেয়ে কোথায় বর্তে যাবি তা নয় উলটে আবার চুপ করতে বলছিস...হাঁদারাম কি আর এমনি বলি। এবারেও সেই একই সমস্যা, ছোটদের সামনে তো আর বলা যায় না যে আমার সুন্দরী শ্যালিকাদের প্রতি কোনো লোভ নেই, আমি তাদের আরো মিষ্টি দিদিকে নিয়ে খুশী...তাই বলতে হল...যা পারিস কর...অন্য গাড়ীর হর্ন শুনতে না পেয়ে যদি ঠুকে দি তো দোষ দিতে পারবি না বলে রাখলাম আর পাবলিকের মারধোর শুরু হলে বাঁচাস কিন্তু...
কটা দিন বেশ বাড়িটা জমজমাট ছিল, বাড়ীটা দুটো দিনের জন্য যেন আবার একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। কারনটা আর কিছু নয়, রুপসা থাকছে না দেখে বিল্টু আর মিষ্টিও দিদির সাথে মামাবাড়ী চলে গেছে...ওরা অবশ্য নিজের থেকে না বললেও সবাই চলে গেলে ওদের মন খারাপ হবে ভেবে অরিত্রই বলেছিল যদি ওরা যেতে চায় তো যাক...
মামাবাড়ীতে এসে গতবারেরর মতো দিদির সাথে শুতে গিয়ে কি মনে করে জানলার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল মৌ। সেই রাতে মিষ্টি চাঁদের আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছিল আর আজ বাইরে ঘন অন্ধকার, ঝমঝম করে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে সেই কখন থেকে। হাওয়ার ঝাপটার সাথে সাথে জলের ফোঁটা মাঝে মাঝে এসে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলে সারা শরীর শিরশির করে উঠছিল। সুমনা পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে আস্তে করে বলল...কি রে...কি ভাবছিস?
- উঁ...কি জানি...
- খুব করে মনে পড়ছে...তাই না?
মৌ কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল... কি জানি কি করছে এখন একা একা...
- এই মৌ...
- উঁ
- ফোন কর না...
- অনেকবার চেস্টা করলাম...লাইন পাচ্ছি না...
- আর একবার কর না...
একবারের জায়গায় বেশ কয়েকবার চেস্টা করেও লাইন পাওয়া গেল না দেখে ফোনটা রেখে দিয়ে আগের মতোই দিদির সাথে কথা বলতে গিয়ে ঘুরে ফিরে ওর কথাই চলে আসছিল... জানিস তো দিদি, মুখ ফুটে কিছুই বলবে না...আমাকেই সব বুঝে নিতে হবে ওর কি চাই। মাঝে মাঝে বড্ড ভয় করে রে...
|