Thread Rating:
  • 31 Vote(s) - 3.39 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
HORROR ভৌতিক সংকলন ২- গোলাপী মনি - সংগৃহীত- লেখনী - অনাহুত- সম্পূর্ণ
#1
এই লেখাটি আমার নয়। যিনি লিখেছেন, তিনি অনাহুত নামে লেখেন। ওনার কিছু অভিজ্ঞতা এখানে ওনার কলমে তুলে ধরলাম। এই লেখা ওনার। কাজেই কারোর ভালো লাগলে সেটা ওনার প্রাপ্য।ছোট্ট একটা লেখা। কিন্তু ভাল লেগেছিল আমার। তাই দিলাম। 

ভয়  (অনাহুত )

এটা কোন গল্প না। চেষ্টা করেছি কিছু কথা বলার আর কিছু ঘটনা লেখার। ভালো না লাগলে এই ধরনের প্রচেষ্টা আর করব না।

ভয় পেলেই যে কেউ ভুত বা দানো দেখেছে এমন কিন্তু না। যদিও দানো কথাটা আমি যে অঞ্চলের থেকে আসা, সেখানে বিশেষ প্রচলিত নয়। ভুত শব্দ টাই প্রভূত প্রচলিত। ভুত, নিশি, গো-ভুত, স্কন্ধকাটা, ভুলো আর হ্যাঁ অবশ্যই ব্রহ্মদত্যি, এই শব্দ গুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম ছোট থেকে। বর্দ্ধমান জেলার, অধুনা পূর্ব-বর্দ্ধমান জেলার একটি গ্রামের ছেলে আমি।  জন্মের প্রথম দশ বছর গ্রামে থাকতাম। তারপর থেকে বর্ধমান শহরে চলে গেছিলাম। ওখানেই পড়াশোনা করেছি আমি। এত কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলছি কারণ ভয় পাওয়া টা কিন্তু পুরোপুরি ঘটনার আগের পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে। এই মুখবন্ধ হয়ত সেই ক্ষেত্র তৈরী করছে মাত্র।
                          যেমন ভয় ব্যাপার টা আমার মধ্যে জন্মগত। মানে এমন ছিল একটা সময়ে, যে দিনের বেলাতেও বড় উঁচু দুয়ার থেকে “মুতকুড়” এ ( একদম পাতি গ্রামের টার্ম এটা, মানে হলো, ছোট ছেলেরা যেখানে “টয়লেট” করে, সেটা আমাদের শোবার ঘরের ঠিক পাশেই ছিল ) আমি একলা এসে টয়লেট করতে পারতাম না ভয়ে। এবং সেই ব্যাপার টা যে আজকেও নেই এমন কিন্তু না। কিন্তু আজকে এক ছেলের বাবা হবার পর ভয় পেলেও ,ভয় কেন পাচ্ছি তার কারণ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই। মনে হয় আমার মতন যেন আমার ছেলেটা না হয়। সেই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ একের পর এক জট খুলে যায় আমার সামনে। আর বুঝি , যে ভয় খানা পেয়েছিলাম, সেটা খাঁটী ছিল তাতে কোন সন্দেহ-ই নেই, কিন্তু ভয়ের কারণ টা ছিল “ফালতু” । এটা বহুবার হয়েছে জীবনে। তাই প্রথমে ভয় পেলেও সামলে নিতে শিখে গেছি আমি তাড়াতাড়ি। আর সেটা হয়েছে আমি অস্বাভাবিক রকমের ভীতু বলেই। কারণ আমি জেনে গেছিলাম আমার লেভেলের ভীতু দের ভয় টা কে জয় করতে না পারলে আমি হয়ত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারব না। তবে দেখেছি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভয় টা অমূলক থাকে। আমার জীবনে সেটা একটা বিরাট সান্ত্বনা।
             আমার বাবারা তিন ভাই। তারমধ্যে আমার বাবা আর মেজ জেঠু বেশ ভাল গান গাইতেন। গাইতেন বললাম কারণ , তিন ভাই এর মধ্যে আমার মেজ জেঠু আর বেঁচে নেই। আর উনি সব থেকে ভাল গান করতেন। আমরা শহরে মানে বর্দ্ধমানে সপরিবারে চলে আসার পর থেকে বেশ কিছু বছর , প্রতি শীতে, পুজো তে, আর গরমের ছুটি তে গ্রামে যাওয়া টা বাধ্যতা মূলক ছিল। আমার বাবার নিজের বাস্তু ভিটা, আর জমিজমার প্রতি ভালবাসা টা একটা মিথ এর পর্যায়ে। কাজেই ধান ওঠার সময়ে, পুজোর সময়ে, আলু চাষের সময়ে গ্রামে যাওয়া আমার কাছে উৎসবের মতই একটা ব্যাপার ছিল। গ্রামের বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, কম পড়াশোনা ছাড়াও জেঠুর গান ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। গানের কথা টা তুললাম, কারণ এই গান , আমাদের পরিবারের একটা বিশেষ অঙ্গ। জ্ঞান হয়ে থেকেই দেখে এসেছি আমাদের গানের ঘরে গান হচ্ছে। গ্রামের যত গাইয়ে, তবলচী আসত আমাদের বাড়িতে। পালঙ্কে, নীচে মেঝেতে, বাইরে , কিছু না হলেও তিরিশ চল্লিশ মানুষের আনাগোনা ছিল ওই গানের জন্য আমাদের বাড়িতে। ওই গানের ঘর টা ছিল আমাদের মানে আমি বাবা মায়ের শোবার ঘর। বিশাল বাড়ি, আর তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঁচটি মাটির একতলা ঘর। মাঝে চারটে নারকেল গাছ, দুটো পেয়ারা গাছ, আর একটা উঁচু ভেঙ্গে যাওয়া ঘরের অবশিষ্টাংশ। মানে ঘর টা ছিল না কিন্তু উঁচু দুয়ার টা ছিল। আর ছিল সাত ফুট উঁচু দুয়ার টা তে পৌঁছনর জন্য মাত্র চারটে বাধানো সিঁড়ি। ঝোপ ঝাড় এর ভর্তি ছিল সেই পোড় দুয়ার টা।
   একটু যখন বড় হলাম তখন বসে থাকতাম খেয়ে দেয়ে আমাদের বড় ঘরের দুয়ারে মা কিম্বা মেজমা, কিম্বা ঠাকুমার কোলে। ভীতু ছিলাম বলে আমাকে কোলে নিয়ে থাকাটাই বাড়ির রীতি ছিল। আর ওদিকে গানের ঘরে রাতের সাথে সাথে গানের তোড় এবং জোর দুটোই বাড়ত। মা , মেজমা, ঠাকুমা কে কোন দিন বিরক্ত হতে দেখিনি আমি সেই জন্য। যাই হোক, তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌছয় নি গ্রামে আমাদের। থাকার মধ্যে হ্যারিকেন আর বাবা জেঠূ দের বড় বড় তিন সেলের টর্চ। মাঝে মাঝেই  বিশাল উঠোনে আমার অতিসাহসী মেজদা ( আমি দাদাই বলি, যদিও আমার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়) ওর ই মধ্যে একটি টর্চ জ্বেলে উঠোন ময় ঘুরে বেড়াত। বস্তুত,  আমাকে দেখানো যে “দ্যাখ ভীতু, আমি কেমন সাহসী, উঠোনে একলাই ঘুরছি”। দাদা মাঝে মাঝেই আকাশে টর্চ টা মারত। আমিও কারোর কোলে শুয়ে , হাঁ করে অনুসরণ করতাম সেই আলো। যেন আকাশ ফুঁড়ে সেই আলো চলে যেত কোন অজানা শূন্যে। এক এক দিন আঁতকে উঠতাম যখন টর্চের আলো নারকেল গাছে পড়ত। সাদা সাদা এক ঝাঁক পাখী  জ্যাঠার মতন বসে থাকত নারকেল পাতায়। টর্চের তীব্র আলো তে পাখী গুলোর মুখের ভয়াবহতা দেখে আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতাম কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে।
- ভয় কি সোনা, ও তো পেঁচা! জানিস, পেঁচা রা না গান শুনতে ভালোবাসে। তাই তো গানের ঘরে গান হলেই ওরা এখানে এসে বসে, দ্যাখ দ্যাখ বাকী গাছ গুলোতেও বসে আছে দ্যাখ!  
আমার মেজমা বা মা বা ঠাকুমার সান্ত্বনা বানী শুনেও আমি দেখতাম না। ঠিক সেই সময়েই হয়ত একটা গান শেষ হয়ে পরের গানের জন্য তবলার স্কেল ঠিক হচ্ছে বা এক নাগারে বাজিয়ে তবলচী খানিক ক্লান্ত। একটা সহসা নিস্তব্ধতা সারা বাড়িতে। আমার মনে প্যাঁচার মুখ আঁকা হয়ে গেছে। যতই কোলে মুখ টা গুঁজে ফোঁপাই, মনে কিন্তু প্যাঁচার সেই ভয়াল মুখ টা গেঁথে গিয়েছে যেন। ঠিক তখন ই উত্তর মাঠ থেকে “হুয়াআআআআআআআ ,হুয়াআআআআআ” , করে দীর্ঘ একটা আওয়াজ। জানতাম শেয়ালের ডাক ওটা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না আপনারা , হিম হয়ে যেত বুকটা আমার। দ্বিগুণ জোরে কোল টা আঁকড়ে ধরতাম আমি। আমার অসীম সাহসী দাদাও যেন পরিস্থিতির চাপে থম মেরে যেত। আমি শুয়ে থাকতাম কোলে মুখ টা গুঁজে। ভয়ে কাঁপতাম থরথর করে।  ঠিক তখনি হয়ত পরের গান টা শুরু হতো আর মুহুর্তেই পরিস্থিতিটা ও বদলে যেত।
মা গজগজ করতো, “ ছেলে, আর ভয় পায় দেখো?, মেয়েরাও তোকে দেখে লজ্জা পাবে লালটু!  
    হ্যাঁ লজ্জা আমি পেতাম সত্যি কথাই, কিন্তু বিশ্বাস করুন  ঠিক তার আগের ক্ষণের পরিস্থিতি তে , ওই নিস্তব্ধতা আর সেই নিস্তব্ধতা কে চিরে শেয়ালের করুন কান্না, হয়ত গানের ঘরে থাকা সাহসী পুরুষ গুলো কেও স্তব্ধ করে দিত কয়েক লহমার জন্য। বেশী সময় লাগত না ওই ভারী ভাব টা কাটতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমার চোখ বুজে আসতো ঘুমে , আর গানের ঘর থেকে ভেসে আসত জেঠুর গান “কোনদিন বলাকারা অতো দূরে যেত কী, ঐ আকাশ না ডাকলে”।
                        কাজেই একটা জিনিস অনেকদিন আগে থেকেই বুঝেছিলাম ভয় পাওয়া বা না পাওয়া টা নির্ভর করে, পরিস্থিতি এবং জানার আর আপনি কতটা কল্পনা প্রবণ তার উপরে।  যেমন , একটা বাচ্চা ছেলে যে এখনো নিজের চোখে দুনিয়া দেখতে শেখে নি, সে কি ভয় পাবে যদি সে দেখে, আরেক টি কিশোরী মেয়ে ওর সাথে জানালায় দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে খেলছে? সে ভয় পাবে না। কিন্তু ভয় টা আপনি পাবেন যখন আপনি এই ব্যাপার টি দেখবেন। কারণ আপনি জানেন এটা আট তলা। কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না জানালার বাইরে থেকে কথা বলা। আট তলায় জানালার বাইরে একটা বাচ্চা কে দেখে আপনার ছেলে বা মেয়ে খেলছে এটা পড়েই আপনারা আঁতকে উঠেছেন এতে আমি নিশ্চিত। কাজেই আপনার ছেলে বা মেয়ে হয়ত খুশী হয়ে কথা বলছে কিন্তু আমি নিশ্চিত যে , আপনি ব্যাপার টা তে খুশী হতে পারবেন না। কাজেই জানেন বলে আপনি ভয় টা পেলেন। কিন্তু আপনার ছেলে বা মেয়ে পায় নি , কারণ ভয় পেতে গেলেও যত টুকু ইনফর্মেশন দরকার সেটা তার মধ্যে নেই।  
      একী রকম ভাবে, পরিস্থিতি ও দায়ী থাকে ভয় পেতে বা পাওয়াতে গেলে। যেমন কোন জায়গার মাহাত্ব্য না জেনে আপনি সেই জায়গা রাত বিরেত , অমাবস্যা- পূর্ণিমা, শনি- মঙ্গল, নির্বিশেষে যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু জেনে গেলেন যে ওই বিশেষ জায়গা , অমুক তিথিতে , বিশেষ ভাবে , উপ-অপ-বা অধি দেবতা দ্বারা প্রভোকড হয়। তাহলে আমি শিওর যে আপনার বুক কাঁপবে ওই জায়গা দিয়ে ওই বিশেষ তিথি তে যেতে।
             একটা ঘটনা বলছি এই ব্যাপারে। এখানে অনেকেই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন । একরকম খেলা আসত গ্রামে। মাদারী বলতাম আমরা। একটা লোক আর একটা বাচ্চা।বাচ্চা টা মেয়েই থাকত বেশী।  ভীষণ রোগা আর কালো। কেমন যেন মায়াময় মুখটা হতো বাচ্চাটার। অনেক রকম খেলা ওরা দেখাতো। দুটো খুঁটি পুঁতে , মাঝে একটা রশি বেঁধে দিত। একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে, বড় বাঁশ হাতে নিয়ে ওই দড়ির উপরে চলতো।  ছোট ছোট ম্যাজিক ও দেখাতো। ঘড়ি বা টাকা গায়েব করে দিয়ে, অন্যের পকেট থেকে বের করা  বা কাঁচা ডিম রেখে মন্ত্র বলে সিদ্দ ডিম করে দেওয়া। তখন ম্যাজিক গুলো দেখে খুব ই অবাক হতাম, ভালো লাগত খুব। আমি আর দাদা বাড়িতে এসে ওদের ম্যাজিকের বর্ননা,  মা কে , মেজমা কে বা ঠাকুমা কে , গোল গোল চোখ করে বলে দুটো আলু বা সের টাক চাল বাগাতাম ওই ম্যাজিক বালা কে দেব বলে।
                             যদি আমদানী ভালো হতো তবে এই সবের শেষে একটা চমক থাকত। একটা অদ্ভুত খেলা হতো। বাচ্চা টাকে একটা ময়লার তস্য ময়লা চাদরে ঢেকে দিত। আর একটা প্রায় ভোঁতা ছুরি চালাত আমাপা ওই চাদরের উপর দিয়ে বাচ্চাটার গায়ে। হয়ত ওটা ম্যাজিক ই ছিল। কিন্তু ছোরার গায়ে রক্তের দাগ দেখে আমি আঁতকে উঠতাম। কেমন একটা মন কেমন করা গ্রীষ্মের দুপুরে এই খেলাটা চলার সময়ে বুক টা কেঁপে উঠত আমার। রক্তের সোঁদা গন্ধ টা যেন পেতাম আমি। সব শেষে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলা টা কাটত সেই লোকটা বাচ্চাটার। পুরো ব্যাপারটাই করত সেই ময়লা চাদরের উপির দিয়ে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম আমি। দাদার পিছনে সেঁধিয়ে যেতাম। কুঁকড়ে যেতাম ভয়ে। জানিনা কি করে দেখাতো, কিন্তু চাদর তুলে দেখালে দেখতাম গলা টা কেটে ফেলেছে একেবারে। বিশ্বাস করবেন না আপনারা, পুরো জমায়েত টা স্তব্ধ হয়ে যেত। পিনড্রপ সাইলেন্স যাকে বলে। ঠিক কিছু পরেই দুবার হাততালি তে বাচ্চা মেয়েটা যখন চাদর সরিয়ে উঠে বসত তখন যেন আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। বাচ্চা টা ঠিকঠাক আছে দেখে, যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত আমার মধ্যে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠতাম। পুরো জমায়েত টাও হাততালি দিত। ওরা চাল, আলু আর যা পয়সা পেত , সেটা নিয়ে পোঁটলা বেঁধে চলে যেত অন্য গ্রামে। আমি বার বার ঘাড় ঘুড়িয়ে বাচ্চা টা কে দেখতাম। মন টা ভয়ানক খারাপ লাগতো। জানিনা ওই বয়সে ওই টুকু একটা বাচ্চার উপরে হওয়া অত্যাচার সহ্য করতে পারতাম না নাকি ওই কাটাকুটির কারণে আমার মনে কোন ইফেক্ট পড়ত বলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আজও বুঝিনি।
         যাই হোক, রাতে প্রায় ই ওই গলাকাটা দেখে আমি ককিয়ে কেঁদে উঠতাম “ গলাকাটা গলাকাটা “ বলে । জড়িয়ে ধরতাম আমি মা কে। বাবাও উঠে পড়ত ঘুম থেকে। আমাকে খেলাটা দেখাতে নিয়ে যাবার জন্য আমার দাদার উদ্দেশ্যে মায়ের বকাবকির মাঝেই বাবার অভয় বানী শুনতাম, “ বোকা ওটা কি সত্যি নাকি, ও তো ম্যাজিক”।
      কিন্তু কেন জানিনা ব্যাপার টা আমার কোনদিনেই স্বাভাবিক মনে হয় নি। ভয় টা হয়ত আজকেও কাটেনি আমার। লিখতে লিখতেও আমার সেই বাচ্চাটার খুব আবছা মুখ টা ভেসেই উঠছে।বাবা ও দেখেছিলেন বা দেখতেন ওই ম্যাজিক। হয়ত ওই খেলা টা কে নিছক খেলা হিসাবেই নিতেন। আমি হয়ত কল্পনা প্রবণ অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলতাম এবং ভয় পেতাম। বাবার মুখে শুনেছি যে বাবা নাকি একবার ওই বাচ্চা টির জায়গা তে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের জমায়েতের আপত্তি তে সেটা সম্ভব হয় নি। আমি কোনকালেই বাবার মতন সাহসী ছিলাম না সেটা বলাই বাহুল্য। তাই ওই সব আজগুবি স্বপ্ন থেকে মা বাবা কে জ্বালিয়েছি অনেকদিন। আমার ক্ষেত্রে এই খেলা টা যেমন সিরিয়াস রূপ নিয়েছিল, আমার বাবার ক্ষেত্রে ছোট বেলায় দেখা এই ঘটনা নিছক একটা খেলাই ছিল মাত্র। হয়ত এই ব্যাপার টা,  বাবার একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।    
                                  আসলে, আমি  ঘটনা বলতেই এই লেখার অবতারণা করেছি। কিন্তু মনে হলো,  যারা সত্যিকারের উপলব্ধি করেছে ভৌতিক বা আধিভৌতিক ব্যাপার, তাদের কাছে পুরো ঘটনা টা হয়ত দশ সেকেন্ড কি তার ও কমে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যে পরিস্থিতি তে ভয় পেয়েছিল সেটা ইম্পর্ট্যান্ট এবং সেটাই সেই ঘটনার আসল গেম চেঞ্জার। প্রকৃত পক্ষে আমি এমন অনেক মানুষ জানি, যারা নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছেন এই ভৌতিক ব্যাপার। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমার বাবা। সত্যি বলতে আমি আমার বাবার মতন অসীম সাহসী মানুষ দেখিনি। এমনি জীবন যুদ্ধে বেশ ভীতু। সেখানে হয়ত আমাকেই সাহস যোগাতে হয় বাবা কে এখন, কিন্তু ওই ভৌতিক ব্যাপারে বাবার সাহসের কোন তুলনা নেই বললেই চলে। আমি দেখেছি এই সব ক্ষেত্রে মানুষ হার্টফেল না করলে , ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা নেই চলে। কারণ এইসব ক্ষেত্রে আমি যত সত্যি ঘটনা শুনেছি বা উপলব্ধি করেছি তাতে বুঝেছি,  এনাদের যাওয়া বা আসার রাস্তায় উপস্থিত হয়ে গেছে ভিক্টিম রা, বাধ্য হয়ে বা না জেনে। কেউ পালিয়ে গেছে , বা কেউ ভয়ে হার্টফেল করেছে। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ভাবে কোন ক্ষতি করার প্রচেষ্টা করেনি কোন উপ-অপ-অধি দেবতা।
                    এবারে একটা ঘটনায় আসি,   বাবা তখন সাত বছর আর আমার জেঠু দশ।ঘটনা টা আমার জেঠু এবং বাবা দুজনের মুখেই শুনেছি আলাদা আলাদা করে। দুজনের ভার্সন একটু আলাদা হলেও আসল ব্যাপার টা মোটামুটি এক ই। সময় টা ছিল ফাল্গুন বা চৈত্র। শিওর নই কারণ দোলযাত্রার সময় কার ঘটনা। আমাদের গ্রামে দুটো দোল উৎসব হয়। এখনো হয়। রাজ দোল আর পঞ্চম দোল। পূর্ণিমার দিনে রাজদোল হয়। গৌর নিতাই এর দোল। খুব ধুমধাম হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্ধ্যে বেলায় গৌর নিতাই বের হন পালকী করে। গ্রাম ঘোরেন ভক্তের কাঁধে চেপে। প্রভূত আবির খেলা হয়। ছোট বেলায় আমরাও ঘুরেছি সাথে সাথে।  বাবাদের সময়ে মানে আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই সব উৎসব অনেক অনেক ইন্টেন্সিটি তে হত। কারণ এন্টারটেইন বলতে তো এই সব উৎসব ই ছিল। পুরো উৎসব টা রাতেই হত। মানে সন্ধ্যে বেলায় ঠাকুর বেড়িয়ে , ফের মন্দিরে ঘুমোতেন রাত দেড়টা দুটো নাগাদ। তারপরে যে যার বাড়ি ফিরে যেত।
               এই রকম ই রাজদোলের রাতে , উৎসব , আবির খেলা শেষে বাবা আর জ্যাঠা ফিরছিলেন গলির রাস্তা ধরে আমাদের বাড়িতে।  পুর্ণিমা, স্বভাবতই ফুটফুটে জ্যোৎস্না। গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। কাজেই চাঁদের আলোর জোয়ার চারিদিকে। উৎসব প্রাঙ্গণে হ্যাজাক এর আলো নিভে যাবার পরে, আলোর সাথে প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা যেন সবাই কে জানান দিয়েই হচ্ছে। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, আর গাছ গুল্মের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর লুকোচুরিতে  রাস্তা চিনে নেওয়া  কঠিন কিছু হচ্ছে না। দুটো ছোট ছেলে সেই রকম অলি গলি ধরে আলোআঁধারি পরিবেশে নিজের বাড়ি ফিরছে। বসন্তের মাঝামাঝি, কাজেই হিম এখনো ছেড়ে কথা কইছে না। উৎসবের মেজাজে বুঝতে না পারা গেলেও, এখন কেমন একটা মন কেমন করা না ঠাণ্ডা না গরম হাওয়া বইছে । ছেলে দুটোর অস্বস্তি বোঝা যাচ্ছে ঠাণ্ডায়, হাত দুটো কে বগলের তলায় চালান করে দিয়ে, মেন রাস্তা না ধরে বাড়ির পিছনের গলির রাস্তা ধরল তারা। ওরা বুঝল যে একটু দেরী করে ফেলেছে। যে পাড়া দিয়ে ফিরছিল দুজনে সেই পাড়ার লোকজন দোরে খিল দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সত্যি করেই,  উৎসব শেষে খাওয়া দাওয়া করে ফিরতে দেরী হলো বৈকী।
- এই তো, আর একটু। চল তাড়াতাড়ি, মা চিন্তা করবে।
- এই দিকে না এলেই হত, আমাদের সদর দিয়ে ঘুরে গেলে ঠিক হতো রে।
মেজ দাদার কথায় ছোট টা একটু চঞ্চল হলো। “ নাহ এদিকেই চল, এক ছুটে পেরিয়ে যাব”।
ওই গলি দিয়ে না যাবার বা ছুটে পেরিয়ে যাবার কথা চিন্তা করার পিছনে অনেক কারণ আছে। গলি টা বেশ সরু এবং মোটামুটি পঞ্চাশ মিটার লম্বা গলি টা আপাদমস্তক অন্ধকার। চওড়া ফুট দুয়েক খুব বেশী হলে। বাড়ি গুলোর পিছন দিকের গলি। গলির ঠিক কোনায় যেখানে আমাদের বাড়ি বাঁক নিচ্ছে , সেই কোন দিয়ে একটা বড় পুকুরের রাস্তা নেমে যাচ্ছে। তিনটে বাড়ির পিছন দিক সেটা। ঠিক জাঙ্কশনেই ছিল সেই পুকুরে যাবার রাস্তা। প্রায় বিশ মিটার , আগাছায় পূর্ণ, সেই রাস্তা নেমে গেছে পুকুরে। ঘাট ছিল পরিষ্কার। কারণ গৃহস্থ্য বাসন পত্র মাজা এবং মহিলাদের স্নান করার জায়গা ছিল সেই ঘাটে। ওই নেমে যাওয়া রাস্তার ঠিক মাঝে ডান দিকে একটা বিশাল বট গাছ ছিল। এখনো আছে। আর বাম দিকে ছিল কুড়ি পঁচিশ গাছা বাঁশের ঝাড়। স্বভাবতই দিনের বেলাতেও অন্ধকার লাগত ওই রাস্তা টা, বাঁশ এবং বট গাছের নীচু ডালপালা গুলো যেন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে। ঘাটে যাবার রাস্তা বাঁশের পাতা এবং বটের পাতায় ভরে থাকত। ওই হেন জায়গা রাতে যেতে চোখে পড়লেই কেমন একটা অনুভূতি আসে। আমি বহুবার গেছি ওই রাস্তা দিয়ে রাতে। এমনিতেই আমি ভীতু, তারপরে ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে কেমন একটা ভয়ের অনুভূতি আসে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখি পুকুর টা, সেখানে চাঁদের আলো থাকে, আর পুকুরে চাঁদের আলো ধপধপ করে। কিন্তু মাঝখান টা নিরেট আঁধার। চাঁদের আলোর এই মজা। হয় দেখা যাবে না হলে কিচ্ছু দেখা যাবে না। শুধু সাদা আর কালো। মাঝে কিছুই নেই। কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু আওয়াজ পাওয়া যায় সেই খানে থাকা প্রাণীদের। হয়, হাওয়ায় শুকনো পাতা ওড়ার মৃদু খসখস আওয়াজ বা ছোট কোন প্রাণীর চলে যাবার সরসর শব্দ, বা আঁধারে বট গাছে বাসা বেঁধে রাত্রিবাস করা অসংখ্য পাখীর সহসা ঘুম ভেঙ্গে কান্নার আওয়াজ।অথবা অপ্রাকৃতিক রকম অসীম নীরবতা। পুকুরের জলে সহসা টোল খাওয়ার পরে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুলোর পাড়ের দিকে গুটি গুটি করে আসতে দেখার সময়ে ওই নীরবতায় বুক টা কেমন দুরদুর করে। সহসা কিছু হবার আশঙ্কায় মন টা কেমন হয়ে যায়। না পারি পালাতে না পারি দাঁড়িয়ে থাকতে। কেমন একটা অজানা টান। না চাইলেই হয় পুকুর পানে।  কিন্তু শত ভয়ের মাঝেও কিন্তু চোখ চলে যেত ওই দিকে। এটা শুধু আমার না , ঐ পাড়ায় থাকা সব কচি কাঁচা, বুড়ো হাবড়া, যুবক যুবতী সবার ই হয় এটা আমি জেনেছি।
            ছুটে পেরিয়ে যাবার সময়ে ছোট ছেলেটা টা ছিল পিছনে। বড় ছেলেটা টা ওই জায়গা টা পেরিয়ে গেলেও ছোট টা যেন আটকে গেলো। দোলের রাতে চাঁদের আলোর  দাপাদাপি তো ছিলই। ছোট ছেলেটি দেখতে পেল , আঁধার পেরিয়ে ঘাটে কেউ একজন জলে রয়েছে। হতে পারে গা ধুচ্ছে। বা হতে পারে বাহ্যকর্ম করে শৌচে গেছে।
- দাদা দাঁড়া একবার মনে হচ্ছে, মুকুজ্যে ঠাকমা ঘাটে গেছে, বুড়ি রাতকানা, আমি দিয়ে আসি বাড়িতে।
দাদার কাছে ব্যাপার টা ভালো মনে হয় নি। কারণ একটু বয়েস বেশির জন্য, বা অনেক কিছু জেনেছে বা শুনেছে মায়ের কাছ থেকে। কাঁপা গলায় বলল
- না তুই নীচে যাবি না, আগে উঠে আসতে দে, দ্যাখ কে তারপরে যাবি। অনেক রাত এখন। মুকুজ্যে ঠাকমা এতো রাতে পুকুরে যাবে না। আর আজকে ঠাণ্ডা আছে বেশ। গা ধুতে কেনই বা যাবে।
- আরে না রে ঠাকমাই ওটা, দেখছিস না , ঠিক করে ঘাটের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। আমি যাই তুই এখানে থাক।
দাদার মনে সন্দেহ এসেইছিল যে ভাই মনে হয় নেমে যাবে। হাত টা ধরে ফেলেছিল দাদা।
- না তুই যাবি না , আগে আসতে দে উঠে।
ততক্ষণে যে ছিল ঘাটে, সে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। মাঝের নিরেট অন্ধকার টা আর অতো টা নিরেট লাগছে না। কেউ যে উঠে আসছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে এখন। আর যে আসছে , সে যেন কিছু খুঁজতে খুঁজতে আসছে। কারণ অন্ধজনে যে ভাবে দুটো হাত সামনে ইতস্তত খুঁজতে খুঁজতে আসে, কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে যাবার আশঙ্কায়, ঠিক সেই ভাবেই আসছে সে।
- ওই দ্যাখ ঠাকমাই হবে। রাত কানা, দেখতে পাচ্ছে না। তাই ওমনি করে আসছে।
- নাআ, তুই দাঁড়া, যাবি না।
সেই অবধি যে ঘাট থেকে উঠে আসছিল সে আরো অনেক টা কাছে চলে এসেছে। এবারে যেন হাত সঞ্চালনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর হয়ত ফুট দশেক দূরে। এদিকে দু ভাইয়ের মধ্যে দড়ি টানাটানির খেলা চলছে। ছোট টা যাবেই আর বড় টা যেতে দেবে না। এইরকম দড়ি টানাটানির মাঝেই অন্ধকার হাতড়ে আরো কাছে চলে এসেছে সে ছেলেদুটির কাছে। মনে হয় ছোট টা তখন কিছু আন্দাজ করে দাদার টানের জোর কে পাত্তা দিয়ে পিছিয়েই এলো দাদার কাছে। ততক্ষণে ফুটফুটে চাঁদের আলোতে চলে এসেছে সেই অন্ধকার হাতড়ে আসতে থাকা মানুষ টা।  
    দুটো হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে যখন সে আলোয় দৃশ্যমান হলো তখন দেখা গেল মাথা হীন একটি মহিলা যেন হাতড়ে হাতড়ে এসেছে ঘাট থেকে উঠে।
ছোট ছেলেটি মানে আমার বাবা তখন দেখে সত্যি বলতে কিছুই বুঝতে পারে নি। একমাত্র গ্রামে সেই ম্যাজিক-বালাই গলাকাটা ম্যাজিক দেখাত।  বড় ছেলে টি মানে আমার মেজ জেঠু কিন্তু বুঝেছিলেন , এটা কি আর একে কি বলে। ভয়ে কথা না বলতে পারলেও ভাই কে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাবার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ যায় নি। কিন্তু আমার বাবা সামান্য ভয় ও সেদিন পায় নি কারণ ওই জিনিস টা বাবার কাছে ম্যাজিক ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। উত্তেজনায়, ম্যাজিক ম্যাজিক বলতে বলতে খিড়কী দোর দিয়ে এক দৌড়ে বাবা আর জেঠু বাড়িতে চলে এসেছিলো। প্রানে বেঁচে গেলেও, নাকি জ্বর জ্বালায় ভুগিয়েছিল বাবা জেঠু কে কিছুদিন।
         বাবা না হয় জানতেন না ওই ছোটবেলায় এই ব্যাপার টা। কিন্তু আমি জানতাম অনেক ছোট থেকেই। সেই জন্য খুব ভয় পেতাম ওই জায়গা টা। শুনেছি ওই জিনিস টার নাম স্কন্ধকাটা। আমরা বলতাম কন্ধকাটা। বা কান কাটারীর মা। মানে ছোট বেলায়, ওই বলেই আমার দুর্দমনীয়তা কে বশে আনা হতো। শুনেছি, অনেকেই ওই জিনিস টা দেখেছে। একটা আসা যাওয়ার রাস্তা ছিল ওই জিনিস টার। আমাদের বাড়ি টা কে দুদিক থেকে ঘুরে, সামনের বড় রাস্তা হয়ে বারোয়ারী তলা দিয়ে সে চলে যেত জমিদার বাড়ি অব্দি। এই জিনিস টা কে দেখেছে আর ও অনেকে। ওই মেইন রাস্তার ধারে আমাদের খামার বাড়ি ছিল। খামার বাড়ির পাশেই ছিল আমাদের গোয়াল ঘরে। আর তার সামনেই ছিল আমাদের সারা বছর কাজ করার মুনিষের ঘর। ও ওখানে বউ,ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি নিয়ে থাকত। খুব ছোট তখন আমি, একদিন সকালে দেখি, বাবা আর জেঠু ফিরল বাড়িতে। এতো সকালে কোথা থেকে ফিরল, জানতে চাইতেই শুনলাম, যে ওরা ডাক্তার খানা থেকে ফিরছে। কেন প্রশ্ন করতেই জানলাম, ওই মুনিষ কে সকালে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে খামার বাড়িতে। রাতে, বাথরুম করতে উঠে , কিছু দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সে। ভোর বেলায় কেউ দেখার পরে , সবাই কে ডাকাডাকি করে তুলে তাকে ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। বাবা আর জেঠু তখন ফিরল ডাক্তার খানা থেকে। পরে যখন আর একটু বড় হই , জেনেছিলাম যে এই জিনিসটা অনেকেই দেখেছে, আর ওই এক ই রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দেখেছে। ওই রাস্তা দিয়ে এখনো আমরা যাই রাতে, অনেক সময়ে গভীর রাতেও। ভয় ও করে কিন্তু এখন আর দেখা যায় না বলেই শুনেছি।  
       যে সুত্রে এই ঘটনার অবতারণা, যে ঠিকঠাক না জানা থাকলে অনেক ভয়ের ব্যাপার ও ভয়ের লাগে না। আর আমার বাবার ক্ষেত্রে, এই ঘটনা ছিল একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেদিন যদি বাবা জানত ওটা কি , তবে আমি খুব নিশ্চিত যে বাবা ভয় পেত আর সেটা কিছু ভাল ব্যাপার হতো না।
       আসলে আমি দেখেছি যে, ভয় জিনিস টা একটু অদ্ভুত। আমরা ভয় পাই কি হবে সেটা ভেবে। ঘটনা কে সে ভাবে ভয় পাই বলে মনে হয় না। আর ভয় ব্যাপার টা একমেবদ্বিতীয়ম, সেটা হলো ভয়। সে যে কারণেই হোক না কেন। যেমন একটু খুলেই বলি। ধরা যাক, আমি একটা পুকুরে নামব স্নান করতে বা কোন কাজে। স্নান ছাড়াও অনেক কাজ থাকে, যেমন দিদা বলল, “ বাবা পুকুরে মাজার জন্য একটা বড় পেতলের হাঁড়ি রেখেছিলাম, চলে গেছে জলের তলায়, একটু এনে দিবি?”  
আমি সাঁতারে বেশ পটু। অনেক রকম সাতার জানি। দম ও ভালো ধরি। কিন্তু ঐ পুকুর টাতে নামতে আমার ভয় করে। কারণ আমার কালো টলটলে জল দেখলেই কেমন বুক টা আঁতকে ওঠে।  কনফিডেন্স টার বারোটা বেজে তেরো টা হয়ে যায়। আমি জানি এর থেকে অনেক স্রোতস্বিনী নদী আমি হেলায় সাঁতরে পেরিয়ে যেতে পারি, কিন্তু ওই পুকুরে?  নৈব নৈব চ। ভয় করে একটা। কল্পনা প্রবণ মনের এই গুলো সমস্যা। মনে কল্পনায় কল্পিত হয় , কোন কল্পিত জলজ অপদেবতা যদি কালো জলে লুকিয়ে থাকে? আমি জানি ওই জলে সাঁতার রত অবস্থায় যদি কোন কাঁটা গাছে আমার গামছা বা বারমুডা আটকে যায় তাহলে হয়ত আমি ভয়ে জ্ঞান হারাবো। এসব ই ছোট বেলায় শোনা অনেক গল্পের খলনায়ক আর খলনায়িকাদের জন্য মনের কোন অতলে লুকিয়ে থাকা ভয়ের বাহ্যিক প্রকাশ। এটা এইবয়সেও হয়। মানে এখানে জানা বা অজানা বা পরিস্থিতি কোনটাই দায়ী নয়। দায়ী হলো আমার কল্পনা প্রবণতা । অথচ আমি দামোদরের পাশে থাকা ছেলে। সত্যি বলছি বন্ধুর গ্রামে গিয়ে অনেক দাপিয়েছি দামোদরে। ভয় করে নি। বা পরিষ্কার জলের পুকুরেও কোন ভয় করে না আমার। গঙ্গা তে নেমেও সাঁতরে এসেছি, অনেক শক্তিক্ষয় হয়েছে, কিন্তু এই ভয় টা করে নি। কেউ যদি ওই কালো জলের পুকুর টা কে মন্ত্রবলে পরিষ্কার করে দেয় তবে আমি তক্ষুনি ডুব দেব আনন্দে। আমি দেখেছি ভয় টা আমার ওই কালোর ওপারে আদৌ কিছু আছে নাকি সেটা নিয়ে। কি আছে জেনে গেলে তো ভয় বলে কিছু থাকে না। তখন একশন হয়। হয় পালাব না হলে লড়ব। নিজের নিজের ব্যাপার সেটা।  ভয় সেটাই যেটাতে আমাদের মন অজানা কিছুর আশঙ্কা করে।
        সত্যি বলতে কি ,আমার ভুতে ভীষণ ভয়। আমার বউ এর সেসবে কোন ভয় নেই। ভুত অপদেবতাতে একদম ই ভয় নেই। ও আবার মানুষে ভয় পায় খুব। যেটাতে আবার আমার কোন ভয় নেই। অদ্ভুত না? হ্যাঁ, আমি ভেবে দেখলাম, যার যেটাতে কনফিডেন্স , সে সেটা তে কেন ভয় পাবে? আমি প্রায় ৬ ফুট একটা মানুষ। যথেষ্ট ভাল শরীর এবং শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী। আমার মনে এই কনফিডেন্স আছে যে মানুষের পক্ষে আমাকে আক্রমণ করতে গেলেও ভাবতে হবে অনেকবার। আমার এই চিন্তা ভাবনা ঠিক না ভুল সেই প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু এই কনফিডেন্স টা আমার আছে। তাই আমার মানুষে ভয় লাগে না। বউ এর হয়ত ভুত নিয়ে সিমিলার রকম কোন কনফিডেন্স থাকবে। জিজ্ঞাসা করিনি কোন দিন। জানি কোন প্রপার উত্তর পাব না তাই। কারণ যেকোন লজিকের কাউন্টার লজিক থাকেই। এই দুজনের যেদিন নিজের নিজের কনফিডেন্স এ আঘাত লাগবে হয়ত আমাদের চিন্তা ধারা এবং ভয়ের চেহারা টা বদলে যাবে। আমি বউ কে অনেক গল্প পড়ে শুনিয়েছি ভুতভুতুম থেকে। “ওরে বাবারে”, “কি সাঙ্ঘাতিক”, “ বাপরে কি ভয়ানক” গোছের মন্তব্য করলেও, ভয় পাবার দৌড় ওই গল্প অব্দি থাকে ওর। গল্প শেষ হলে ওর ও ঘুম পেয়ে যায়।  বরং আমার আর ছেলের সেই গল্প গুলোর রেশ থাকে অনেক দিন অব্দি। সেটা আমি পরতে-পরতে বুঝি। আর বুঝি আমি আর আমার ছেলে দুজনেই ভয়ঙ্কর রকমের কল্পনা প্রবণ। আর সেটা ভাল মন্দ দুই ক্ষেত্রেই। তাই এটা বুঝেছি ভয়ের আরেক টা কারণ হলো কল্পনা। আর সেই কল্পনা আমার/ আপনার নেক্সট ভয় পাবার ক্ষেত্র টা ভালো রকম প্রস্তুত করে রেখেছে এটা আপনি নিশ্চিত করে ধরে রাখবেন।

                                               সমাপ্ত 
[+] 9 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
ভয়... বড়ো নেশার জিনিস.... পেলেও আতঙ্ক, না পেলেও জেনেশুনে ভয় পাবার গল্প শোনার ইচ্ছাও আটকানো যায়না.... ভুতের আড্ডা যে কি সাংঘাতিক আর অসাধারণ ব্যাপার তা আমরা সবাই জানি.... সেই ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে হোক, বাড়িতে কোনো বিরক্ত একজন কে ঘিরে ছোটদের শোনা হোক, পাড়ায় বড়োরা চা খেতে খেতে আলোচনা হোক, আগুনের সামনে বসে আড্ডা দিতে দিতে হোক.... ভয় বড়ো নেশার জিনিস।

অসাধারণ লেখা ❤

(আজ রাতে আমার গপ্পের তৃতীয় পর্ব আসছে, আশা করি এবারে একটু হলেও ভয় লাগবে আপনাদের  Tongue )
[+] 1 user Likes Baban's post
Like Reply
#3
পুকুরপাড়ে স্কন্ধকাটার ঘটনাটা ছাড়া সেই অর্থে ভয়ের  sequence কিছু ছিল না এই লেখায়। তবে সমগ্র লেখা জুড়ে ভয় নিয়ে যে analysis করা হয়েছে সেটা মন্দ লাগেনি, সব মিলিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে।
[+] 2 users Like Bumba_1's post
Like Reply
#4
(03-02-2022, 04:47 PM)Bumba_1 Wrote: পুকুরপাড়ে স্কন্ধকাটার ঘটনাটা ছাড়া সেই অর্থে ভয়ের  sequence কিছু ছিল না এই লেখায়। তবে সমগ্র লেখা জুড়ে ভয় নিয়ে যে analysis করা হয়েছে সেটা মন্দ লাগেনি, সব মিলিয়ে বেশ ভালোই লেগেছে।

না যিনি লিখেছেন, তিনি বলেই দিয়েছিলেন, যে ভয়ের গল্প নয় এটা। আর তিনি ভীতু বলেই হয়ত এতো টা আন্যালিসিস করেছিলেন। কিন্তু ওই আন্যালিসিস টাই আমার ভাল লেগেছিল। তাই দিলাম এখানে।
Like Reply
#5
(03-02-2022, 04:36 PM)Baban Wrote: ভয়... বড়ো নেশার জিনিস.... পেলেও আতঙ্ক, না পেলেও জেনেশুনে ভয় পাবার গল্প শোনার ইচ্ছাও আটকানো যায়না.... ভুতের আড্ডা যে কি সাংঘাতিক আর অসাধারণ ব্যাপার তা আমরা সবাই জানি.... সেই ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে হোক, বাড়িতে কোনো বিরক্ত একজন কে ঘিরে ছোটদের শোনা হোক, পাড়ায় বড়োরা চা খেতে খেতে আলোচনা হোক, আগুনের সামনে বসে আড্ডা দিতে দিতে হোক.... ভয় বড়ো নেশার জিনিস।

অসাধারণ লেখা ❤

(আজ রাতে আমার গপ্পের তৃতীয় পর্ব আসছে, আশা করি এবারে একটু হলেও ভয় লাগবে আপনাদের  Tongue )

পড়ব পড়ব। একটু ব্যেষ্ঠিত বা পরিবৃত হয়ে পড়তে হবে আরকি এই যা।
Like Reply
#6
[Image: 261871140_272611297_684791446222877_5252...5615_n.jpg]
Like Reply
#7
(03-02-2022, 05:07 PM)bourses Wrote:
[Image: 261871140_272611297_684791446222877_5252...5615_n.jpg]

এ হাত ওর কিসিকা নেহি , স্বয়ং পিনুদা বোকাচোদার হাত কে ফাঁদ হায় ...
  
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
#8
আমার চাকরির যোগ দেওয়ার তৃতীয় বছরে , প্রায় দুই বছর আমি একটাই বিশাল এপার্টমেন্টে ছিলাম কারণ আমার পার্টনার অন্য অনেক ভালো চাকরি পেয়ে পুনে চলে গেছিলো হঠাৎ করে ,


কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই প্রায় আট মাস পুরো একলা একটা ওরকম বিশাল বাড়িতে থেকে ... ভূত নয় l
 ... যদিও জানতাম যে ওই বাড়ি  যার সেই বুড়ো ওখানে একলা থাকতো আর বাথরুমে সকালে মরে পড়ে ছিল ..
পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ... ইত্যাদি ... সস্তায় পেয়েছিলাম বুড়োর কানাডা বাসি ছেলের কাছ থেকে ... দুজনে নিয়েছিলাম .. কিন্তু হঠাৎ একদিন বুঝলাম যে আমি একা, ওই বিশাল চার বেডরুম এর বাড়িতে ..

তারপর ...  

[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
#9
বেশ ঝরঝরে লেখা। কন্ধকাটার গল্প আমিও ছেলেবেলায় গ্রামে গিয়ে শুনেছি। তবে এটা ভয়ের গল্প না বলে, তার বিশ্লেষণই বেশি বলা চলে।
[+] 1 user Likes raikamol's post
Like Reply
#10
(03-02-2022, 07:59 PM)ddey333 Wrote: এ হাত ওর কিসিকা নেহি , স্বয়ং পিনুদা বোকাচোদার হাত কে ফাঁদ হায় ...
  

happy happy happy happy
Like Reply
#11
(03-02-2022, 08:19 PM)ddey333 Wrote: আমার চাকরির যোগ দেওয়ার তৃতীয় বছরে , প্রায় দুই বছর আমি একটাই বিশাল এপার্টমেন্টে ছিলাম কারণ আমার পার্টনার অন্য অনেক ভালো চাকরি পেয়ে পুনে চলে গেছিলো হঠাৎ করে ,


কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়েছিল ওই প্রায় আট মাস পুরো একলা একটা ওরকম বিশাল বাড়িতে থেকে ... ভূত নয় l
 ... যদিও জানতাম যে ওই বাড়ি  যার সেই বুড়ো ওখানে একলা থাকতো আর বাথরুমে সকালে মরে পড়ে ছিল ..
পুলিশ এসে দরজা ভেঙে ... ইত্যাদি ... সস্তায় পেয়েছিলাম বুড়োর কানাডা বাসি ছেলের কাছ থেকে ... দুজনে নিয়েছিলাম .. কিন্তু হঠাৎ একদিন বুঝলাম যে আমি একা, ওই বিশাল চার বেডরুম এর বাড়িতে ..

তারপর ...  

দে দাদা,  আপনার ওই  সময় টা নিয়ে তো ছোট করে কিছু লিখতে পারেন, তাাাহলে আমাদের কাছেে ও একটা নতুন  অভিজ্ঞতা হতো।
 








PROUD TO BE KAAFIR  devil2


                                 
[+] 1 user Likes Kallol's post
Like Reply
#12
(04-02-2022, 04:39 PM)Kallol Wrote: দে দাদা,  আপনার ওই  সময় টা নিয়ে তো ছোট করে কিছু লিখতে পারেন, তাাাহলে আমাদের কাছেে ও একটা নতুন  অভিজ্ঞতা হতো।

কিন্তু কি লিখবো , খুব মস্তি করে একলা ছিলাম ওই বিশাল বাড়িটাতে বহুদিন  ... কিছুই তো হয়নি বাল  ...


Lotpot Lotpot
[+] 1 user Likes ddey333's post
Like Reply
#13
বেশ ভালো লাগলো । ভয় নিয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লেখা । মাঝে কয়েকটা ঘটনা উদাহরণ স্বরূপ ব্যাবহার করা । বিশ্লেষণটা বা যুক্তি গুলো নিঃসন্দেহে গ্রহণ যোগ্য । এরকম লেখা আরও পেলে ভালো লাগবে । গোগ্রাসে গিলবো । তবে আগে থেকে বলছি ... এখানে এসব পড়ার লোক সংখ্যা কিন্তু আঙুল গুনে বলা যায়

❤️❤️❤️
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#14
(04-02-2022, 09:52 PM)Bichitravirya Wrote: বেশ ভালো লাগলো । ভয় নিয়ে একটা মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধ লেখা । মাঝে কয়েকটা ঘটনা উদাহরণ স্বরূপ ব্যাবহার করা । বিশ্লেষণটা বা যুক্তি গুলো নিঃসন্দেহে গ্রহণ যোগ্য ।  এরকম লেখা আরও পেলে ভালো লাগবে । গোগ্রাসে গিলবো । তবে আগে থেকে বলছি ... এখানে এসব পড়ার লোক সংখ্যা কিন্তু আঙুল গুনে বলা যায়

❤️❤️❤️
Are you joking or trying to attempt one .
Like Reply
#15
(04-02-2022, 11:24 PM)ddey333 Wrote: Are you joking or trying to attempt one .

এ্যাঁ ... মানে .... বুঝলাম না

❤️❤️❤️
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#16
(05-02-2022, 09:32 AM)Bichitravirya Wrote: এ্যাঁ ... মানে .... বুঝলাম না

❤️❤️❤️

ভালো করেছো না বুঝে ... বুঝলে ওটা শুকিয়ে যেত , যেটা বলে তোমায় আমি ডাকি !!
fight Smile
Like Reply
#17
                                                   গোলাপী মণি

                                               লেখক-  অনাহূত
 
সময় টা গরম কাল। যেমন তেমন গরম ভেব না যেন। বোশেখের শেষাশেষি হবে হয়ত বা। নদী ,নালা, পুকুর, খাল, বিল সবাই খানিক জলের আশায় আকাশের পানে চেয়ে দিন গুনছে। মানুষজন এর খাবার জলের টান পড়েছে বিস্তর। এই হেন তীব্র গরমে মাঝে মাঝেই পশ্চিমে কালো মেঘের দর্শন পাওয়া যায় প্রায়। তা দেখতে পাওয়া যাচ্ছেও। কিন্তু মেঘ , বৃস্টি হয়ে ঝরে নি এখনো অব্দি। গরম খানা তাই বেশ ভয়ানক রূপ নিয়েছে সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু মানুষ তো আর বসে থাকবে না! কাজ আছে, আপিস আছে , চাষ বাস আছে, হাট আছে বাজার আছে। সব আছে।

এই তো, বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ বেটি চুপি চুপি ঢুকে পড়ল বলে আমাদের কুশীপুরের হাটে। কিন্তু হাট এখনো জমজমাট। ভবেন কাকা এখনো, গোটা পঞ্চাশ তরমুজের গতি করতে পারে নি। রীতিমত গরম হয়ে হাঁকডাক করছে খদ্দের দের। ওদিকে সেলিম চাচা, নিজের পোলট্রির ভালো দেশী মুরগীর বড়াই করে ক্ষান্ত হচ্ছে না। গোটা দশেক সাঁরা এখনো খেলে বেড়াচ্ছে , জাল দিয়ে আপাদমস্তক ঘেরা জায়গা টাতে। বেচতে হবে তো! কালু শেঠ ফাঁকা গুড়ের টিন গুলো গোনার আদেশ দিয়ে, থুতু দিয়ে টাকা গুনছে। ময়না পিসির মুখ টা হাসি হাসি, কারন সব কটা লাউ বিক্রী হয়ে গেছে বোধ হয়। আর ফড়িং? তার সবে কলির সন্ধ্যে। এই হাটের প্রদীপ নিবু নিবু হবে সেই সময়েই তো , সারাদিন খাটা খাটনি করা লোকগুলো পুকুরে হাত মুখ ধুয়ে দুটি কিছু মুখে দেবে। মুখে দিয়ে , জল টি খেয়ে , যে যার ধামে রওনা দেবে। এই সময়ে ফড়িঙের তো চোখের পলক ফেলার সময় থাকে না। লুচি ভেজে ভেজে তার কাহিল অবস্থা হয়। তারপরে ধরুন গিয়ে, পটলা। সে চোর। তার তো দিনেমানে কোন কাজ নেই। আহা আছে , কিন্তু লোকের ট্যাঁক খানা ভারী তো এই সন্ধ্যে বেলাতেই হয়। হয় কিনা? তবে? এই নিবু নিবু হাটেই তার হাত চলে যেন মাখনের মতন। এই ধাক্কা লাগলো, দেখবেন ফতুয়ার পকেট খানা ফাঁকা।

সেদিন হাটের কাজ মিটিয়ে কাশী খানিক টাএগিয়ে গেলো নিজের গরু গুলোর দিকে। আহা সেই আট কোশ যাবে একনো, যাই একটু দেকা দিয়ে আসি গিয়ে নিজের মনে মনেই কথা গুলো ছুঁড়ে দিয়ে কাশী চলে এলো হাটের পশ্চিম দিকে , যেখানে সব গরুর গাড়ি সার দিয়ে দাড় করানো রয়েছে, সেই পানে।
 
হেই যে আমার কেতো আর গনা, আহা বাপ আমার বড্ড কস্ট না রে? আর এই টুকুনি ডাঁড়া বাবারা, আমার হয়ে এয়েছে বলে হাঁক পাড়লো
- বলি সুমুন্দি, শ্বশুরের পো ময়েশ, কেতো গনা কে খাবিয়েচিস বাপ?
 
উত্তর এলো ততোধিক জোরে,
- হ্যাঁ গো হ্যাঁ, ময়েশ কতার খেলাপ করে নে কো, এমন তোয়াজ করেচি, দেকো। চার ঘন্টার পথ দু ঘণ্টায় না পেরলে আমার নামে কুত্তা পুষো ক্ষণ।
 
মহেশের কথায় কাশী হেসে ফেলল
- হ্যাঁ রে , সেই কুত্তাই দেকতেচি, কোন টা তোর নামে পুষতে পারি। অনেক বুগনী দিছিস বাপ, এবারে দেকি, পেটে কিচু দি দুজনে মিলে।
 
ততক্ষণে ছোট একটা মাচা ঘরের পিছন থেকে বেড়িয়ে এলো মহেশ। এক গাল হেসে বলল
- জানো কাশী কাকা, তুমি মানুষ টা বড্ড ভাল। কেউ আমারে কিসুই দেয় না, কিন্তু তুমি আমারে না খাইয়ে হাট থেকে যাবে না আমি জানি। তুমি না এলে আমার ভালো লাগে নে কো।
- হয়েছে হয়েছে এবারে। দুটি দি কিছু পেটে।
 
এই বলে দুজনে পুকুর ঘাটে গেল হাত মুখ ধুতে। গলার গামছা খানা নামিয়ে জলে ভিজিয়ে ভালো করে নিংড়ে নিজের মুখ হাত পিঠ মুছতে লাগলো কাশী। সম্পন্ন চাষী সে। হাটে আসে প্রতি মঙ্গলবার, নিজের জমির ফসল, পুকুরের মাছ, বাগানের সব্জী, সওদা করতে। ভালো মানুষ কাশীর হাতের গুনে তার সব জমি আর গাছ -গাছালি যেন কথা কয়। নিজের সব ভালবাসা উজাড় করে দেয় কাশী ওদের উপরে। আর জমি গুলো নিরাশ করে না কাশী কে। কাশীর ভালবাসা ওরা বোঝে। কাশী কাছে গেলেই, গাছ গুলো তো হালকা হাওয়াতেই মাথা নেড়ে জানান দেয় তারা খুশী।
এই গুন টা কাশী পেয়েছে ওর দাদু হারানের কাছ থেকে। গ্রামের লোক বলে, হারানের জমিতে গাছ গাছালী কথা কইত। যেমন টি হারান চাইত ঠিক তেমন টি হত। একবার তো , ভীষণ তর্ক বাঁধল নবীন কেশের সাথে। নবীনের দাবি ছিল এই এঁটেল মাটির দেশে কেমন করে হারান মিষ্টি ল্যাংড়া ফলাতে পারে দেখি?, ফুঃ, সব জমির কৃপা বুঝলে! হারানের এখানে কোন কৃতিত্ব নেই। যে জমির যে ফসল। তা হারান ফলাক দেখি মিষ্টি ল্যাংড়া!

তো লাগলো সে বিষম তর্ক। এক গাঁ লোকের সামনে লাগানো হলো ছোট্ট চারা। হারান তো দিনরাত এক করে দিয়েছিল বুঝি সেই গাছের জন্য। সে কি আদর সেই ছোট্ট গাছ কে হারানের। কত্ত লোকে শুনেছে হারান গাছের সাথে কথা কইছে মান রাখিস বাপ আমার
পাক্কা তিন বচ্ছর পরে যেদিন ছোট্ট গাছ টিতে আম এলো, হারান সবার আগে নবীন কেই খাইয়েছিল। চারদিকে ধন্য ধন্য পরে গেছিলো। এমন সুগন্ধী আর মিষ্টি আম ভূ-ভারতে কোথাও পাওয়া যাবে নাকি সেই নিয়ে বহু তর্ক বিতর্ক হয়েছিল আশে পাশে দশ টি গ্রামে। 
এই হেন দাদুর নাতি হলো কাশী। কিছু গুন তো পাবেই। সেই গুনের সুবাদে, কাশীর আয় ব্যয় কিছু কম ছিল না। এই হাট ছিল তার কাছে লক্ষ্মী। জীবনে একা হয়ে যাবার পরে এই গাছ-গাছালি ছাড়া , কাশী আর কিচ্ছুটি ভাবে নি। হাটে থেকে দু পয়সা এসেওচে। আর তাই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে কাশীর রোজগার। আশে পাশের দশটা গাঁয়ের সম্পন্ন ব্যবসাদার দের সুদে টাকা ধার দেয় কাশী। যে যেমন তার কাছে তেমন সুদ। আর গরীব গুর্বো রা তো মাগনা নিয়ে যায় ওর কাছ থেকে টাকা। কারোর মেয়ের বিয়ে তো কারোর মা বাপের শ্রাদ্ধ। মহেশ মাঝে মাঝে বলে কাশী কে
-     কাকা তোমার টাকা বারো ভুতেই খাবে দেকো তুমি।
কাশী হাসে। কি বা করবে সে। নেহাত ভালবাসে জমি টা কে আর গাছ গুনো কে। তাই না ওরা উজাড় করে দেয়? না হলে কাশীর কি বা আছে ? যা হয়েছে উপরওয়ালার কৃপায়। আর সে কৃপাতে যদি দশ টা লোকের উপকার হয় তা হোক না!
- কাকা পচিম কোন টা দেক একবার।
 
চমক ভাঙল কাশীর মহেশের কথায়। পিঠ টা টেনে টেনে গামছা দিয়ে মুছচ্ছিল কাশী। পশ্চিম কোন টা দেখে থেমে গেল তার পিঠ মোছা। বুক টা হিম করে দিয়ে, কালোর , তস্য কালো মেঘ জড়ো হয়েছে সামান্য। ঠিক যেমন ক্যারম এর পকেট, ঠিক তেমনি। মনে মনে ভাবনা আসে ,আট কোশ পথ বাইতে হবে এখন।
 
- হে রাম-কানাই , ঠাকুর রোজকেরের মতন আজকের মেগ টাও টলিয়ে দাও বাপ।
 
মহেশ বোধ করি শুনতে পেয়েছিল কাশির কথা গুলো। মুখ টা খুব গম্ভীর করে বলল
- কাকা আজকেরে মনে হচ্চে, রাম-কানাই তোমার কতা শুনবে না গো, ওই দেক,কেমন সাদা বক গুলো ফর ফর করচে পচিম কোনে। কাল বোশেখ , বউনি টা আজকেরেই করবে বুজলে কাকা। 
বাস্তবিক , ঝড় বৃষ্টির সব গুলো লক্ষন বর্তমান আজকের মেঘে। নাহ আর অপেক্ষা করা ঠিক হবে না। হুড়োতাড়া করে ভেজা গামছা খানা কাঁধে ফেলে মহেশ কে বলল
- ময়েশ, বাপ গরু গুনো জোত দিকিনি। জুতে নিয়ে আয় ফড়িঙের দোকানে। আমি ওকানে কচুরি আর জিলিবি বলে রাকচি। দেরী করিসনি বাপ আর, আয় আয় তাড়াতাড়ি আয়। 
বলে আর অপেক্ষা না করে পুকুরের পাশ দিয়ে কাশী দৌড় দিলো ফড়িং এর দোকানের দিকে। দোকানে পৌঁছে গরম গরম কচুরী আর জিলাপী বলে দিল সে।
- ময়েশ আসে নাই রে কাশী?
- আসতেচে, তুমি ভাজ তাড়াতাড়ি ফড়িং দা
- হাঁ রে বাবা হাঁ, সে আসুক, আসার আগেই দেখবি দিয়ে দিচি আমি।
 
কাশী বারংবার আকাশের দিকে চাইতে লাগলো। নেহাত এই ফড়িং এর দোকানের কচুরী আর জিলাপি কাশী ছাড়তে পারে না তাই, না হলে আজকে দেরী করা ঠিক হচ্ছে না। মেঘ ক্যারমের পকেট আর নেই। কালো হয়ে ধেয়ে আসছে যেন পৃথিবীর বুকে। মনে হচ্ছে ইন্দ্রদেব তার মহা মেঘ দের পাঠিয়েছে তাণ্ডব করতে আজকে। হাটে শশব্যস্ততা। আগাম প্রলয়ের ইশারা সকলেই পেয়ে গিয়েছে যেন। গগন খাস্তগীর প্রচুর শশা নিয়ে বসেছিল। বেচারী শশার বস্তা খান পিঠে ফেলে এমন পিঠটান দিল সে এক দেখবার দৃশ্য হল বটে। ভবেন কাকা শেষ কিছু তরমুজ ক্লান্ত শ্রান্ত গরু গুলোর মুখের কাছে রেখে চম্পট দিল। সেলিম চাচা এখনো মুর্গী গুলোর হিল্লে করতে না পেরে, সে গুলো কে ঝাঁকায় ভরে সাইকেলের কেরিয়ার বেঁধে নিয়ে গোলেমালে সাইকেলের চাবি টাই খুলতে ভুলে গেলো। আর প্যাডেল চাপ দিতেই হুমড়ি খেয়ে পপাত চ।
 - হেই হ্যাট, ডা হা ডা, হেই হেই থাম থাম থাম।
 
তাকিয়ে মহেশ কে গরুর গাড়ি নিয়ে আসতে দেখেই কাশী বলে উঠলো হেই বাপ তাড়াতাড়ি খেয়ে নে। মেগ গুনো কিন্তু আজকেরে ছেড়ে কতা কইবে না মনে হচ্ছে রে। 
ফড়িং এর দোকান দেখে আবার মহেশের কেমন যেন একটা হয়ে যায়। মা বাপ মরা ছেলে ও। কত দিন পেটে ভাল কিচ্ছু টি পড়ে না। আজকে কাশীর দয়ায় দুটি পেট পুরে খাবে সে। তা খায় বটে দুজনে। দেখার মতন খাওয়া। ফড়িং তো বসে থাকে কখন দুই মক্কেল আসবে খেতে। না না পয়সার জন্য না। অমন খাওয়া দেখেও চোখ জুড়ায় কিনা! মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ধামা খানেক কচুরী আর গণ্ডা চারেক জিলিপী সাবাড় করে দিলো দুজনে। ওরা দুজনে খেতে বসলে কচুরী বেলতে বেলতে আর ভাজতে ভাজতে ফড়িং এর হাত ব্যাথা করে যায়। কিন্তু ফড়িং অখুশী হয় না। এমন মানুষ দের খাইয়েও সুখ। কাশী মানুষ টা ভাল আর মহেশ মা বাপ মরা ছেলে , বললেই অনেক কাজ করে। তা খাক। আরো এক ধামা কচুরীর সাথে গণ্ডা দুয়েক জিলিপী সাবাড় করে যখন ওরা রণে ভঙ্গ দিল , তখন মেঘ গুলো হাট পার করে অনেক টা দূরে বিস্তার লাভ করেছে। এক পেট জল খেয়ে যখন দুজনে মিলে গরুর ল্যাজ টা মুড়িয়ে দিয়ে গাড়ী ছোটাল তখন কালবোশেখী নেত্য করার প্রস্তুতি নিতে সুরু করে দিয়েছে।
[+] 3 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply
#18
ঠিক হাতিমারার জঙ্গলের সামনে এসেই মহেশের মন টা কু গাইল যেন। সামনে চেয়ে দেখে জঙ্গলের মহাবৃক্ষ গুলো নিজেদের মাথা দুলিয়ে যেন না না করছে। যেন বলতে চাইছে তফাত যা , তফাত যা। সে বলে উঠলো কাশী কে।

- না গো কাকা আর যাওয়া ঠিক হবেনে।
- ক্যানে রে?
- দেখতেচ না, হাতিমারার জঙ্গলের নম্বা নম্বা গাচ গুনো কেমন , ক্ষেপার মতন মাতা দুলিয়েআসবিনে আসবিনেকরতেচে?
- কালবোশেখীর নেত্য বাড়বে ময়েশ, চল এই বেলা আমরা গরু ছোটাই।আমরা তো জঙ্গলের ভেতরে ঢুকবো নে কো, পাশ কাটিয়ে বেইরে যাব।
- তাও বলচি , জঙ্গল টা ভালো না কাকা, বলি কি চল এই সামনেই পরান তাঁতির বাড়ি, আমরা ওকেনে থাকি আজ রাত টা।
- তুই কি পাগল হলি? জানিস বাড়িতে আমার সারু, কমলা, ফুলটুসি রা আচে। আমি না গেলে ওরা খাবেই না। আমাকে যেতেই হবে রে।
- হে হে কাকা , তোমারে কবে থেকে কইচি, এবারে একখান কাকীর দরকার। কাকী থাকলে এতোক্কনে তোমার সারু কমলা ফুলটুসি দুটি জাবনা পেত।
- ফুঃ, পাকা পাকা কতা বলিস না দিকি। জানিস বে করার কত্ত ঝামেলা?
- হে হে কি করে জানবো? আমি কি বে করেচি নাকি?
- তবে মুখ টা বন্দ কর তুই, সামনেই জঙ্গল।
- আচ্চা কাকা, আমি শুনেচি তোমার বে হয়েছেল, তোমার বাবা কামরাঙ্গা ইকলেজে মাস্টার ছেল। তোমার এক খানা ছেলেও ছিল।
- হুম ঠিক শুনেচিস তুই। এমনি এক রাতে সব কেড়ে নেয় ঠাকুর আমার কাচ থেকে।
- কি হয়েচেল?
- রুদ্র ভৈরবের নাম শুনেচিস?
- নাহ
- রুদ্র ভৈরব এই তালুকের সব চে নৃশংস ডাকাত। সেই রাতে আমি ছিলুম না। গেসলুম আমার শউরবাড়িতে। পুজোর তত্ত্ব দিতে। এসে দেকি, যা ছেল সব নিয়ে গেচে আর কাউরে বাঁচিয়ে রাকে নি কো। সে ডাকাত বড় ভয়ানক রে। শুনেচি কতায় কতায় মাতা গুঁড়ো করে। বাচ্চা টা কেও আমার ছাড়লেনে কো সে।
বলে ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো কাশী। অমন জোয়ানের বেমক্কা কান্নায়, মহেশ ব্যোমকে গেল একটু। একটা খটাশ কালবোশেখের ভয়ে গুটিয়ে ছিল ঝোপে পাশেই। বাজখাই কান্নায় ভড়কে গিয়ে হুড়ুৎ করে রাস্তা কেটে পালালো উল্টো দিকে। আশে পাশের গাছ গাছালী তে বাসা বেঁধে থাকা পাখী গুলো মরার উপরে খাঁড়ার ঘা খেয়ে সমবেত স্বরে চেঁচিয়ে উঠলো। আর কালবোশেখী তান্ডব শুরু হলো বটে এবার।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------
ওরে চুপ কর হতভাগার দল, একদম আওয়াজ করিসনে জঙ্গলে ঢোকার মুখেই একটা বিশাল বট গাছের একেবারে মগডালে বসে থাকা হারান ককিয়ে উঠলো একেবারে।
আর বলেই বা কি হবে? শুনতে পেলে তো?”
- ক্যা র্যাা?
পিছনে মুখ ঘুরিয়ে হারান দেখল, পুঁটি ভাসতে ভাসতে এসে এক মগডালে এসে বসলো। হারান আবার প্রায় ককিয়ে উঠল।
- আহা করিস কি? ডাল খানা ভেঙ্গে যাবে যে
- আর হারান দা, আমরা কি আর মনিষ্যি আচি গো, যে আমাদের ভারে গাচ ভাঙবে? এই তো সুক্ষ্ম শরীল খান। আজকে জমবে ভাল বুজলে দাদা!
- ক্যানে?
- যে আসতেচে, যেই একানে আসবে, পুটুস করে ডাল খানা ভেঙ্গে পড়লেই কেল্লা ফতে।
- চুপ কর!
দাবড়ে উঠলো হারান।
- কে জানিস?
- কে শুনি?
- আমার নাতি, বংশের শেষ সলতে।
পুঁটি কেমন ঘাবড়ে গেলো নাতির কথা শুনে। কিন্তু ঝড় জলে জঙ্গলে সেদুলে বিপদ তো ওঁত পেতেই থাকবে নাকি। সেই কথাটা ইনিয়ে বিনিয়ে হারান কে বলতেই হারান বলে উঠলো।
- সেটাই তো চিন্তার রে পুঁটি।
- ক্যানে? চিন্তার কি আছে? এমনি তো কতই হয়েচে। কেউ বাজ পরে অক্কা পেল, কেউ বা খুন হলো, কারোর ঘাড়ে মোটা ডাল ভেঙ্গে পড়ল। সে তোমার নাতি বলে তুমি বলছ, না হলে আমাদের তো মজাই বল দাদা?
- হ্যাঁ এবারে যেটা বলব তোকে, মজা টা সোজা বুকে লাগবে, অবিশ্যি যদি তোর হিদয় বলে কিচু থাকে তবেই।
- ক্যানে, কি এমন বলবে ?
- তোর দাদার বেটী কে দেকলুম, জঙ্গলের রাস্তায় পথ হারিয়েচে। ইকলেজে পড়ায় না?
- হ্যাঁ
পুঁটির গলায় ভয়ানক উদ্বেগের সুরের মাঝে হারান বলেই চলে
- ইশকুল থেকে ফেরার পথে, জঙ্গলে ঢুকেই কালবোশেখের গুঁতোয় পথ হাইরে, ভৈরবের ঠাই এর দিকে যেছে।
 
শশব্যস্ত হয়ে উঠলো পুঁটি। চোখ গুলো হয়ত বড় বড় করেছিল, কিন্তু সে দুখানার বদলে মুণ্ডু খানাই লকপক করতে করতে বিলাপ বাঁধিয়ে দিল।
- হেই হারান দা, আমার মা মরা বেটি টা। কিচু কর দাদা।
- এহ চুপ কর দেকি। ভাবতে দে। এদিকে আমার নাতিটাও তো জঙ্গলে সেঁদুলো।
- কই কই দুটোর মদ্যে কোন টে তোমার নাতি?
- ওই তো , যে গরু গাড়ি টা চালায় সেই।
- উঃ, এমন বলচ যেন উড়োজাহাজ চালাচ্ছে।
- , তালে যা নিজেই কিচু কোরগে যা। ভৈরব মহাশিবের থানে ঠাই নিয়েচে। না আমি না তুই, কেউ ওকানে যেতে পারব না।
- দাদাগো কি হবে গো, আমার মা মরা বেটি টা গোও
- এহ চুপ করতো, আর নাকি কান্না কাঁদিস নে। চল এখনি।
- কোতায়?
- অবনী ঘোষালের কাছে
- এহ, সে তো বামুন গো
- আহ বামুন ,তাতে কি হয়েচে। ভুত তো বটে নাকি!!!! দেকি।
 
এই বলে দুজনায় মগডাল ছেড়ে হাওয়ায় ভেসে পাড়ি দিল আরো গভীর জঙ্গলের দিকে। এদিকে পুঁটি বলেই চলে,
- না মানে বামুন ভুত গুনো সুবিদের হয় না বুজলে?
- ক্যানে?
- না মানে ওই ঘোষাল টা কেমন একটা করে আমার দিকে তাকায় জান দাদা?
- চুপ কর। পেত্নী কে আবার কেমন করে তাকায়? এখন শিরে সংক্রান্তি, আর তোর এই নাকি কান্না, যত্ত সব। অনেক কাজ আচে। ছেলেটাকে আর মেয়েটাকে বাঁচাতে হবে আজকে। তবে আমার ভুত, আজকে শান্তি পাবে।
 
 
 
- কাকা কী হলো বলত? বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি আর ভেতরে এত্ত শান্তি ক্যানে? এক খান পাতাও তো নড়চে না কাকা।
- তাইতো রে! বাইরে দেকলুম, হালকা আলো আচে। কিন্তু ভেতরে তো নিজ্জস আঁধার রে ময়েশ! আর কি গরম। এতো গরম!! তাও জঙ্গলের মদ্যে? আগুন লাগলো নাকি রে?
- কাকা তুমি মনে হচ্চে ঘেবড়ে গেচ বুজলে? আগুন লাগলে দেকতে পাবো নে কো?
- হ্যাঁ তাইত ! আহ কেতো গনা আবার ডারালো ক্যানে? হেই চল বাপ। হেই হেই।
 
শত লেজ মুচড়ে , সন্তান তুল্য বলদ দুটো কে হাতের পাঁচনের দু বাড়ি দিয়েও যখন কাজ হলো না, তখন মহেশ বলে উঠল,
- কাকা ওরা ভয় পেয়েছে দেখতেচ নে? সামনে আগাতে ভয় পেয়েচে ওরা।
- সে কী রে? সাপ খোপ দেকলো নাকি?
 
এই বলে হাতের পাঁচন খানা বাগিয়ে নামতে যেতেই , মহেশ হাত ধরে বলল
- কাকা নেমো নে। গতিক ভালো না। সাপ নয়, অন্য কিচু।
- অন্য কিচু? বলিস কি রে? ওরে আমার কাচে নয় নয় করেও হাজার পঞ্চাশ আচে যে রে!
- ওহ কাকা চুপ কর চুপ কর। কি যে কর তুমি? ওসব বলার দরকার নেই। সে ডাকাত আসলে পরে কাকা ভাইপো তে যা করার করবো। তোমারে ছেড়ে তো পালাবো নি। কিন্তু ভয় টা ডাকাতের নয় কো। দেখতেচ না , কেমন থম মেরে আচে চারিদিক? এক খানা ফেউ ডাকতেছে না। তেনাদের ব্যাপার।
 
 
 
- এহ দাদা তোমার ভাইপো তো উঁচু দরের ভীতু গো।
 
পুটীর কথার ঠেস টা গায়ে মাখল না হারান। মুশকিল টা হলো এতক্ষণ দিব্যি দেখতে পাচ্ছিল গাড়ি সমেত দুটো ছেলেকে, ফস করে কোথায় যে হারিয়ে গেল কে জানে? ভারী চিন্তা হচ্ছে এবারে। বংশের অবশিষ্টাংশ বলে কতা।
- দাদা ওরা গেলো কোতায়?
- হুম , সেটাই তো ভাবচি রে। ঘোষাল টা তো এখনো এলো না। তোর দাদার বেটির খবর পেলি?
- হ্যাঁ দেকে এলুম তো। পুরনো মন্দিরের চার পাশে সাইকেল নিয়ে বন বন করে ঘুরেই চলেচে। ওর পিচনে, ভুলো টা কে লেলিয়ে দিয়েচি। ভৈরবের থানের উল্টো দিকে ওরে নিয়ে ভুলো খেলা করতেচে।
- বেশ করেচিস। কিন্তু এই ছোড়া দুটো কোতায় গেল বল দেকি?
- চল না একটু এগিয়ে দেকি আমরা।
 
কথা টা শেষ হয় নি , পিছন থেকে আরেক টা গলা বলে উঠলো,
- ওদিকে আর যেতে পারবে না তোমরা।
- তুই এসেচিস অবনী। বল দেকি বাপ , কি হলো
- আজকে কৌশিকি অমাবস্যা, ভুললে নাকি খুড়ো।
- না কিন্তু তাতে কি?
- আজ থেকে দশ বছর আগে এই জঙ্গলে ওই জায়গায় সেই মহা সাধু প্রান ত্যাগ করেছিলেন। আজকে সেই তিথি সেই বার সেই সময়। ওই জায়গা এখন মহা পুণ্য স্থান। তাই আমি তুমি ওই খানে ঢুকতে কোনদিন পারব না।
- তার মানে ওরা কি ওই খানে ঢুকে পরেচে।
- হ্যাঁ। সরলা কে রুদ্র ভৈরব এর চেলা মঙ্গল এই মাত্র ধরে নিয়ে গেল আমি দেখলাম। চেষ্টা করলাম বাঁচাতে কিন্তু রুদ্রর চেলার গায়ে মহাশিবের লকেট দেখে ভয়ে চলে এসেছি।
- দাদাগো কি হবে গো, আমার মা মরা বেটি গো।
- এই চুপ কর তো।
- কাকা এই দিকে কিছুই দেখা যাবে না, আমরা বরং ভৈরবের কাছে যাই, দেখি যদি মেয়েটা কে বাঁচাতে পারি।
 
এক ভয়ানক মানুষ। মানুষ কি? নাহ রাক্ষস বললেও কম বলা হয় ভৈরব কে। মানুষ হত্যা তার নেশা। অন্যেরা অভাবে ডাকাত হয় , আর ভৈরব স্বভাবে ডাকাত হয়েছে। ডাকাতি করে ধনরত্ন লুঠ করা যত না ওর কাছে আনন্দের ছিল, তার থেকেও আনন্দের ছিল, নিজের তেল মাখানো , তামার অঙ্গুরীয় পরানো, গিটকিরি দেওয়া সাত ফুট লাঠির আঘাতে মানুষের খুলি ফাটিয়ে দেওয়া। লাঠির আঘাতে , খুলি ফাটার আওয়াজ না শুনলে ভৈরবের রাতে ঘুম আসত না। শরীরে অসম্ভব শক্তি এই ভৈরবের। পূর্ণ যৌবনের বাঘ কে কাদায় ফেলে গলা টিপে হত্যা করেছিল। বাপ দাদার ডাকাতির ধারা কে কয়েক কদম নৃশংসতায় এগিয়ে নিয়ে গেছে ভৈরব, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
[+] 2 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply
#19
এই হেন ভৈরব খবর পেয়েছে, এই জঙ্গলে, এই বিশেষ দিনে একটি আংটির মধ্যে খচিত মনি উদ্ভুত হয়। সেটি অসীম শক্তি বহন করে। সেটি তার চাই। গত কয়েক দিন ধরেই থানা গেড়েছে সে এই জঙ্গলে। আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও কোন জায়গার সন্ধান করতে পারে নি সে। বছর দশেক আগে এক বৃদ্ধ সাধু কে লুঠ করে হত্যা করেছিল সে এই জঙ্গলেই সেই মনির আশায়। কিন্তু সেদিন সে সেই মনি পায় নি। গত দশ বছর ধরে এই জঙ্গলে এই বিশেষ সময়ে সে আসে কিন্তু প্রতিবারেই অসফলতা তার সঙ্গী হয়েছে। কিন্তু এবারে বড়ই মরিয়া সে। হয় এসপার না হলে উসপার। হাতের লাঠি টা ডান হাতে বাগিয়ে ধরে মুখ খান নামিয়ে বসেছিল সে। সেই সময়ে মশালের আলোয় চেয়ে দেখল, একটা যুবতী কে ধরে নিয়ে আসছে মঙ্গল।

- এই উজবুক এটা কাকে নিয়ে এলি?
- আজ্ঞে সর্দার, এই মেয়েছেলে টা কে পেলাম , পুরোন শিব মন্দিরের চারিদিকে সাইকেল নিয়ে ঘুরপাক খাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে ভুলোয় পেয়েছিলো।
 
এদিকে সরলা বেশ খানিকটা ভেবলে গেছে। সামনেই কালান্তক যম কে দেখে কার বা মাথার ঠিক থাকে? নিজেকে ছাড়ানোর বৃথা চেস্টা করেই চলেছে আর সাথে কান্না কাটি চলছে অবিশ্রান্ত। ভৈরবের মনে হচ্ছে লাঠির এক ঘায়ে ওই মেয়েটার মুড়ো টা ফটাশ করে ফাটিয়ে দিতে।এত্তো কাঁদে মেয়ে গুনো
 
ঠিক সেই সময়ে, মাইল টাক দূরে এক খানা তীব্র আলোর স্তম্ভ সহসা আবির্ভুত হয়ে ফের মিলিয়ে গেল। বাপরে, কেমন নীল সাদায় মেশানো আলো টা আকাশ ফুঁড়ে চলে গেল কোন অজানা শূন্যে। সব কিছু থেথাম করে দিয়ে ভুস করে নিভেও গেলো আলো টা। আর সাথে শুরু হলো অঝোরে বৃস্টি। যেন আলোর অপেক্ষাতেই ছিল মেঘ গুলো। সিগন্যাল পেয়েই ব্যস শুরু। আর সে কী বৃষ্টি। এত বড় বড় ফোঁটা। সোজা এসে বিঁধছে গায়ে।
 
শিব মন্দিরের লাগোয়া মশাল টা জলের ছাঁটে নিভে গেল ফস করে। মন্দিরের গর্ভ গৃহে জ্বলছে শুধু মাত্র একখান মশাল। মুষল্ধারে বৃষ্টির মাঝে মহাশিবের জায়গা খানা কেমন একটা রহস্যময় লাগছে। গোল লেগে গেলো ভৈরবের মাথায়। হুংকার দিয়ে হাক পারলো সে,
 
- লিয়ে আয় ওই বেটি কে। এই লাঠির ঘায়ে চুর্ণ করে দি মাথা খানা। আহা, রক্ত ! রক্ত!! ইশ কত দিন দেকিনি আমি। আহা সব ধুয়ে যাবে গো জলে! তা যাক। ধুয়েই যাক। তাও লিয়ে আয় , লিয়ে আয়।
 
 
 
ভৈরবের মুহুর্মুহু হুঙ্কারে জঙ্গলে যেন গোল লেগে গেল। বৃস্টি ভেদ করে সেই হুংকার যেন ছড়িয়ে পড়ল জঙ্গলময়। কোন অজানা ভয়ে কাল বৈশাখীর দামাল পনা থেমে গেলো। না জানি কীসের দুঃখে বৃস্টির জোর গেলো বেড়ে।
- কাকা নেমো নি বলচি আমি তোমাকে। কাকা গো আমার কতা শোন একবাট্টি। হেই কাকা গো !
- থাম দিনি তুই। দেকচিস নে আমার কেতো গনা ভয় পেয়েচে! আহা কেতো গনা আমি আজকে মেরিচি। পাচিত্তির করতে হবে নে কো? থাম। চেঁচাস নে। ওরে আমার সব সহ্য হয়, আমার গরু আর গাছ গুলোর কস্ট সইতে পারিনা বুজলি?
 
নিজের ভয় কে উপেক্ষা করেও গরু দুটোর জন্যে নেমে এলো গরুর গাড়ী থেকে কাশী। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক চাইতে লাগলো। এতক্ষনে অন্ধকারে চোখ সয়ে এসেছে কাশীর। গুমোট অন্ধকারে জমিতে চোখ রেখে, ভীষণ ভয়ে, ভয়ের কারন খুঁজতে লাগলো কাশী। দেখাদেখি মহেশ নেবে এসেছে। কি খুঁজছে কেউ জানে না তবুও মাথা নীচু করে মাটি পানে চেয়ে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে জাচ্ছে দুজনেই। ঠিক সেই সময়ে , কাশীর থেকে এক হাত দুরেই, একটা তেজালো আলোর স্তম্ভ ভুস করে মাটি ফুঁড়ে গাছ গাছালি ভেদ করে উপরে উঠে গেল। আর পরক্ষণেই ফুস করে নিভে গেলো।
-বাপ
 
একটা অশুভ রকমেরবাপশব্দ করে কাশী ভয়ে ময়ে ঘুরতে গিয়ে, পিছনেই থাকা মহেশের সাথে ধাক্কা লেগে দড়াম করে পরে গেল মাটিতে। সাথে সাথেই আলোটা নিভে গিয়ে , বেয়ারা রকমের বৃষ্টি শুরু হল। সে কী তোড়! মনে হচ্ছিল উপরে গাছের ডালপালা ভেদ করে ধনুকের ছিলা থেকে বেড়িয়ে আসা তির। কোন রকমে উঠে কাশী আর মহেশ সোজা আশ্রয় নিলো গরুর গাড়ীর তলায়।
 
- কী বিস্টি রে বাবা, মাথা খানা ফুটো করে দেবে রে ময়েশ!
 
নিজেদের গুটিয়ে পাটিয়ে থিতু হয়ে বসার জন্য যেই না ঘুরেছে, দেখল ঘন বৃষ্টির মধ্যেই ঝাপসা গোলাপী আলোর একটা আভাস।হ্যাচোর প্যাঁচর করে হাত খানেক কাছে যেতেই কাশী টের পেল বেশ বড় একটা হাঁসের ডিমের আকারের কিছু একটা রয়েছে, যেটার থেকে ওমনি মোহময়ী, মাথা ঝিমঝিমানি একটা মিস্টি আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।
 
 
 
- তা হ্যাঁ রে বামুনের পো , পুঁটি টা কোথায় ঠাওর করতে পারলি বাপ?
আলোর ধাক্কায় , যেমন সুনামী তে বড় বড় পাথর জলের মধ্যেই ভেসে চলে যায় বহুদূরে, ঠিক তেমনি হারান , অবনী আর পুঁটি উড়ে গেছিল কয়েক যোজন দূরে। হারান বহু পুরোনো এই তল্লাটের। তারপরে যৌবন কালে বক্সিং লড়েছে সাহেব সুবো দের সাথে। তাকে কায়দা করা বড় সহজ কাজ না। ধাক্কার শুরুতেই নিউটনের প্রথম গতিসুত্র ভাল মতন মেনে চলতে বাধ্য হয়েছিল হারান। কিন্তু কিছু দূর ভেসে যাবার পরেই সম্বিত ফিরে পেয়ে ফের উল্টো স্রোতে নিজেকে নিয়ে এসে হাতিমারার কাছাকাছি চলে এসেছে বটে। কাছাকাছি আসতেই দেখতে পেল ঝড় তুলে অবনী আসছে। অবনী কে দেখেই প্রশ্ন টা করল হারান।
- হুম,দশ যোজন দূরের দুন্দুভির জঙ্গলের সব থেকে বড় বট গাছের মগডালে কাটা ঘুড়ির মতন এটকে ছিল সে। জ্ঞান হারিয়েছিল। তুলে দিয়ে এসেচি খুড়ো। খুব ঘেবড়ে গেচে। আসচে আস্তে আস্তে।
 
- এহ এট্টুকুও জোর নেই গা?
 
হারানের কথার প্রতিবাদ করল অবনী।
- বড় সোজা জিনিস ছিল না খুড়ো। বাপের জম্মে এমন তেজ দেকিনি বাপু।
- ঠিক বলেচিস রে বাপ, মনে হলো পুনর্জম্ম হলো রে। কিন্তু দ্যাখ কিসের আলো বলত?
- তাই তো! চল তো দেকি।
 
এদিকে মরনাপন্ন সরলা পরিত্রাহী চিৎকার করছিল আসন্ন মৃত্যুভয়ে। রুদ্রভৈরবের পিতলের গিটকিরি দেওয়া মোটা লাঠির ভয় কার না আছে? কিন্তু মরন এমন জিনিস, পরিকল্পিত না থাকলে আসার কোন সম্ভাবনাই থাকে না। যে মুহুর্মুহু হুংকার ভৈরব করছিল সহসা থেমে গেল যেন। সরলা জলে ভরা আয়ত নয়ন দুখানি তুলে দেখল, সবাই ভেবলে গিয়ে তাকিয়ে আছে উল্টো দিকে। ঘাড় ঘুরিয়েই দেখে, একটা মিষ্টি গোলাপী আলো, জঙ্গলের আঁধার আর বৃষ্টির মোটা মোটা ফোঁটা গুলো কে ভেদ করে যেন বেড়িয়ে আস্তে চাইছে। যেন ছোট্ট মিস্টি একখানা সুজ্জি জঙ্গলের কোথাও একটা লুকিয়ে আছে। বিরাট বিরাট গাছের ডালপালা আর পাতার ফাঁক দিয়ে আলো টা চারিদিকে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গোলাপী আলো আর বৃষ্টির তোড়ে নড়তে থাকা পাতার বড় বড় দোদুল্যমান ছায়া যেন জঙ্গল টা রহস্যজনক করে তুলল পুর জঙ্গল টাই যেন ভয়ানক ভড়কি খেয়ে গেছে।
 
সহসা বৃষ্টি থেমে গেল। এমন ভাবেই থামল যেন হচ্ছিলই না। জঙ্গলের মাটিতে জল আর টুপুরটাপুর করে পাতা থেকে পাতায় পরা জলের শব্দ না হলে বোঝাই যেত না যে গত কয়েক লহমায় পুরো এক ঘন্টার বৃস্টি হয়ে গিয়েছে। এতো নতুন নতুন ব্যাপার হচ্ছে যে ভৈরব এর গোল লেগে যাচ্ছিল মাথায়। কিন্তু গোল লাগলেও সে নেশায় ডাকাত। বিশাল মুখের সাথে অসামঞ্জস্যময় কুতকুতে ছোট চোখ দুটো কে আরো ছোট করে গলা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
- মঙ্গল কীসের আলো রে?
- সর্দার মণি টার আলো নয় তো?
- বলিস কি? আহা, বলিস কি? যদি ওটা মণি হয়, মঙ্গল তুই হবি পরের সর্দার। আর আমি মণি নিয়ে তপস্যায় যাবো হিমালয়। হে শিব, মহাশিব, দাও দাও ঠাকুর আজকে আমাকে আমার ইচ্ছে পুরন করে দাও। আহা বলিস কি, বলিস কি?
 
কথা শেষ হতে না হতেই মঙ্গল হাতের লাঠি খানা বাগিয়ে ধরে, এক লাফে সরলা কে ডিঙ্গিয়ে সটান দৌড় দিল আলো যেদিক থেকে আসছিল সেই দিকে। আর লহমায় অদৃশ্য হয়ে গেল নিজের হাতের তালুর মতন চেনা জঙ্গলে ভিতরে। মঙ্গল দেরী করল না আর। সরলার চুল ধরে তাকে সর্দারের পিছন পিছন টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
[+] 2 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply
#20
কথায় বলে বেশী ভয় মানুষ কে সাহসী করে তোলে।ভয় এমন জিনিস, নিয়ে বেশী নাড়াঘাঁটা করলে কমতে থাকে। হাতিমারার জঙ্গলে ঢোকা ইস্তক এমন ভয়ের ব্যাপার অনবরত ঘটে চলেছে , যে কাশীর ভয় খানা হালকা হয়ে এসেছে খানিক। যা বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তাতে মনে হচ্ছিল , ধরনী বুঝি ডোবে ডোবে। ফসস করে সেটাও থেমে গেল। এমন ভৌতিক আর অতি-অসাধারন ব্যাপার স্যাপার একসাথে ঘটলে, ভয় বাবাজী পিছু হটবেন সেটাই স্বাভাবিক। কাশী পরিষ্কার দেখলো , রাজহাঁসের ডিমের আকারের বড় একটা পাথর, যেটার থেকে ঝিম ধরা এই মিষ্টি আলো টা বেরচ্ছে। আসতে আসতে এগোতে লাগলো কাশী। কি জিনিস না দেখা অব্দি ওর যেন শান্তি আসছে না।

 
- আমি বলতেচি কাকা তুমি ওই সব্বনেশে জিনিসে হাত দিও নে কো।
- আরে থাম তো। আর কী হবে আমাদের বলতে পারিস? হয় মরব না হয় ভাল কিচু এক খানা হবেই তুই দ্যাখ।
 
এই বলে বুকের ভয় খানা মাটিতে ফেলে, হামাগুড়ি দিয়ে কাছে এসে পাথর টা হাতে নিতেই, আলো টা আরো জোর হয়েই হুশ করে কমে গেলো। ডিমিডিমি করে জ্বলতে লাগলো কাশীর হাতে। আগের মতন আলো না থাকলেও, এখন কার আলোটা কম না। বেশ খানিক টা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে পাথর টা থেকে বেড়িয়ে আসা গোলাপী আলো। তিন চার হাত দূরের জিনিস বেশ ভালো মতন নজরে আসছে কাশীর। হাতে একটা শীতল ভাব। মন জুড়ে যেন একটা অদ্ভুত ভালো লাগা কাশীর।এটা কী? কোন জাদু পাথর নাকি রে বাবা?” মনে মনে ভাবতে লাগলো কাশী।নিচ্চয় জাদু, না হলে হাতে নিতেই, মন খানা এমন কেমন কেমন করে কেনো?”
 
ঠিক সেই সময়ে একটা বাজখাই আওয়াজে প্রায় পরেই যাচ্ছিল পাথর টা হাত থেকে।
- এই যে মানিক, পাথর খানা এই দিকে চালান করো দেখি?
 
কাশী চেয়ে দেখল সামনে আলো-আঁধারি তে দানবের মতন দাঁড়িয়ে আছে একজন। জঙ্গলে দানব, রুদ্রভৈরব ছাড়া কি আর কেউ আছে? পা দুখানা এমন কাঁপতে শুরু করল যে ডান আর বাঁ পায়ের মধ্যে , কে কোন দিকে কাঁপবে সেই নিয়ে বেশ বড় রকমের ঝগড়া ঝাঁটির সম্ভাবনা টের পেল কাশী। ভয়ে ঢোঁক গিলতে গিয়ে বুঝল সামান্য ভিজে ভাব অবশিষ্ট নেই গলার ভিতরে। শুধু মাত্র ঢোঁক গেলার মুদ্রা করেই ক্ষান্ত হতে হলো তাকে। ভয়ে কাশীর আত্মারাম খাঁচা ছেড়ে যাবে যাবে করছে, সেই সময়ে মহেশের গলা পেল কাশী,
 
- কাকা জিনিস তুমি ফেলে দাও, ফেলে দাও কাকা।
- না
 
একী ? কি করছে কাশী? কাশী নিজেও ভয়ানক রকম দ্বন্দে। না বলে দিলো ওমন এক খানা ডাকাতের মুখের ওপরে ?
 
- কী তোর এতো বড় আস্পদ্দা? তুই জানিস ভৈরবের লাঠি যখন যাকে খোঁজে , তার মাথার ঘিলু না নিয়ে ফেরে না?
 
কথাটা বলেই একবার বনবন করে ঘুরিয়ে নিল লাঠি খানা। বাপরে! চড়কীর মতন সেই লাঠি হাওয়া কেটে কাশীর মাথার চুল খানিক উড়িয়ে দিলো।
এমনি সময়েই পা দুখানা এমন ভাবে বিশ্বেসঘাতকতা করলি বাপ?” কথাটা ভেবেই কাশী বলতে যাচ্ছিল ভৈরব কে যে,
 
- হ্যাঁ এই যে দি। নিন পাথর খানা। এতো আপনার কত্তা। মিছিমিছি অমন সাজানো গোছানো লাঠি খানা কে কস্ট দেওয়া ক্যানে?
 
কিন্তু মুখ দিয়ে বেরোল
- সে আমি না। মানে লাঠি যাকে সন্ধান করছে সে আমি না। অমন লাঠি আমি ঢের দেখেছি ভৈরব। এখান থেকে চলে যাও। সুস্থ জীবন যাপন করার চেস্টা কর। অনেক পাপ অনেক অন্যায় করেছ তুমি।
 
কাশীর কথায় কাশীর থেকেও বেশী অবাক গেল মহেশ। মিনমিনে গলায় কোন রকমে বলতে পারল
- কাকা কী বলতেচ তুমি। তোমার মাথা খানা কি একেবারে ঘোর লেগে গেল? ফেলে দাও জিনিস ফেলে দাও কাকা গো।
 
বাস্তবিক কাশীর ইচ্ছে করছিল ফেলেই দেবে পাথর টা হাত থেকে, কিন্তু কিছু আগেই যেমন , মন কেমন কেমন কেমন করছিল, এখন আবার কেমন একটা অন্য রকম করছে কাশীর। মনে হচ্ছে সে বেশ একজন সাহসী মানুষ। মনের মধ্যে সততা, বীরত্ব ইত্যাদি , ভালো ভালো ব্যাপার গুলো বেশ গিজগিজ করতে শুরু করেছে। পাথর টা ফেলে দেবার ইচ্ছে খানা সমূলে যেন মরেই যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কি আশ্চর্য, এই ফেলে দেবার ইচ্ছে না মরে যাবার আগেই তো , পাথর খানা ফেলে দেবার কাজ টা সেরে নিলে ভাল হতো!
 
আজব কেলো ! কাশী যত বার ভাবছে পাথর টা ফেলে দিয়ে চম্পট দেবে ততবার মনে হচ্ছে , নাহ এটা অন্যের পাথর , কেন দেব? কী হচ্ছে রে বাবা। ভয়ে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছহে করছে, কিন্তু কিছু যেন একটা হয়ে গিয়ে মুখ দিয়ে হুংকার বেড়িয়ে আসছে। বিশ্বাস করুন ভেউ ভেউ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে, চোখের জলে বান ডাকাতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু মনের ভিতরে কর্ণার্জুন যুদ্ধ চলছে। কর্ণ বরুনাস্ত্র মারে চোখে বান ডাকাবে বলে, তো অর্জুন বায়বাস্ত্র মেরে সব মেঘ উড়িয়ে দেয়। কর্ণ রোদোনাস্ত্র মারে ভেউ ভেউ করে কাঁদাবে বলে তো অর্জুন হুংকারাস্ত্র ছোঁড়ে , হুঙ্কার দেওয়াবে বলে। ইল্লীর শেষ সীমা অতিক্রম করে, কাশী শেষমেষ হুঙ্কার ছাড়ল বটে একখানা।
 
- না দেব না। যা পারে করুক।
কাশীর হুংকারে ভৈরব কেমন ভড়কী খেয়ে গেল। গত বিশ বছরে এমনি ভাবে হুংকারে টেক্কা নেবার ক্ষমতাই কেউ ধরেনি তো লাঠিতে টেক্কা নেওয়া অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু লোক টা সত্যি করেই সাহস ধরেছে না কি নাটক করছে বোঝা যায় না যে। দোনামনায় ঠোঁট টা চেটে নিলো একবার ভৈরব। বলদ টার হাতে অমন ভাবে নিজের বহু আকাঙ্ক্ষিত মণি টা দেখে সব দোনামনা দূরে সরিয়ে দিয়ে, নিজের গিটকিরি দেওয়া লাঠি খানা বাগিয়ে এগিয়ে এল সামনের দিকে। ততক্ষনে মঙ্গল চলে এসেছে সেই জায়গায় সরলার ঘাড় ধরে।
- অবনী, এবারে কি হবে বাপ, যে আমার বংশের শেষ সলতের শেষ টুকু জ্বলছে বাবা। কিছু কর একটা।
 
হারানের বিলাপ যেন হাহাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। অবনী বিশেষ গা করল না। সে কিন্তু অন্য খেলা দেখে নিয়েছে। যে কাশী এক বছর শোকে উঠতে পারে নি পরিবারের হত্যার পরে, যে কাশী দুঃখ পেলে নিজের গাছগাছালী জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করে, যে কাশী ধারের টাকা ফেরত না পেয়ে দীর্ঘস্বাস ফেলা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারে না সেই কাশী দুম করে ভৈরবের মতন একটা পিশাচের সাথে মুখ লড়াচ্ছে, এটা ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে অবনীর। নিশ্চয় কিছু ব্যাপার আছে। ওই তো কেমন জ্বলছে ওর চোখ দুটো এই আলো আঁধারি তেও।
 
এদিকে বিশাল বপু নিয়ে দৌড়ে এসেই নিজের ভয়াল লাঠিগাছা সপাটে চালিয়ে দিল ভৈরব, কাশীর মাথা খানা লক্ষ্য করে। ভয়ে হারান চোখ বুজে ফেলল। কারন মরন মার। ওই এক মারেই হারানের প্রাণ টা টুপ করে বেড়িয়ে গেছিল। ব্রহ্মতালু টা শিরশিরিয়ে উঠলো হারানের।
- ওহ বাঘের ব্যাটা বটে
 
কথাটা শুনেই চোখ খুলে দেখল, কাশী পাশে সরে দাঁড়িয়ে আছে আর ভৈরব সামনের দিকে ঝুঁকে পরে যেতে যেতে সামাল দিল।
 
- আহ খুড়ো দেখলে না তুমি, কি বিদ্যুৎ গতি তে তোমার নাতি মরন কামড় কে ঠেকা দিলো।
- অ্যাঁয় বলিস কি? হায় হায় হায়, একবার হয়ে গেছে রে, আবার কি সেই সৌভাগ্য হবে বেঁচে যাবার?
- আহ কেঁদো না , দেক দেক আবার ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতন ছুটে আসছে ভৈরব লাঠি গাছা বাগিয়ে।
 
বাস্তবিক, আড়াআড়ি ভাবে লাঠি গাছা যে ভাবে চালালো ভৈরব তাতে মাথা টা কানের উপর থেকে ফাঁক হয়ে যাবার কথা। কিন্তু জীবনে ব্যায়াম না করা কাশী, পা দুটো ফাঁক করে নিজের উচ্চতা কমিয়ে নিয়ে মাথা টা ঝুঁকিয়ে , অবলীলায় ওই সহস্র ভোমরার ডাক নিয়ে তেড়ে আসা লাঠির মার কাটিয়ে ফের সোজা হয়ে গেলো। আর ভৈরব ফের ঝুঁকে গেলো। কিন্তু এবারে সে নিজেকে সামলাতে পারলো না বিশেষ। পড়ে গেল , কিন্তু লাঠির উপরে নিজের ভার টা ছড়িয়ে দিয়ে উঠে পড়ল স্প্রীং এর মতন। কিন্তু তার মনে ভয় ঢুকল কি? প্রথমবার এই মহামারন আঘাত কেউ এড়িয়ে গেল। ভৈরবের লাঠি যখন ডাক দিয়ে আঘাত করে , বড় বড় লেঠেল দের হাত পা অবশ হয়ে যায়। কিন্তু কে? শান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না কিন্তু কিন্তু ঠোঁটের কোনে হাসি টা যেন আগে কোথাও সে দেখেছে। বুকের মধ্যে একটা ভয় দুম করে চেপে বসল ভৈরবের।
 
[+] 3 users Like nandanadasnandana's post
Like Reply




Users browsing this thread: