03-02-2022, 02:57 PM
এই লেখাটি আমার নয়। যিনি লিখেছেন, তিনি অনাহুত নামে লেখেন। ওনার কিছু অভিজ্ঞতা এখানে ওনার কলমে তুলে ধরলাম। এই লেখা ওনার। কাজেই কারোর ভালো লাগলে সেটা ওনার প্রাপ্য।ছোট্ট একটা লেখা। কিন্তু ভাল লেগেছিল আমার। তাই দিলাম।
ভয় (অনাহুত )
এটা কোন গল্প না। চেষ্টা করেছি কিছু কথা বলার আর কিছু ঘটনা লেখার। ভালো না লাগলে এই ধরনের প্রচেষ্টা আর করব না।
ভয় পেলেই যে কেউ ভুত বা দানো দেখেছে এমন কিন্তু না। যদিও দানো কথাটা আমি যে অঞ্চলের থেকে আসা, সেখানে বিশেষ প্রচলিত নয়। ভুত শব্দ টাই প্রভূত প্রচলিত। ভুত, নিশি, গো-ভুত, স্কন্ধকাটা, ভুলো আর হ্যাঁ অবশ্যই ব্রহ্মদত্যি, এই শব্দ গুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম ছোট থেকে। বর্দ্ধমান জেলার, অধুনা পূর্ব-বর্দ্ধমান জেলার একটি গ্রামের ছেলে আমি। জন্মের প্রথম দশ বছর গ্রামে থাকতাম। তারপর থেকে বর্ধমান শহরে চলে গেছিলাম। ওখানেই পড়াশোনা করেছি আমি। এত কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলছি কারণ ভয় পাওয়া টা কিন্তু পুরোপুরি ঘটনার আগের পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে। এই মুখবন্ধ হয়ত সেই ক্ষেত্র তৈরী করছে মাত্র।
যেমন ভয় ব্যাপার টা আমার মধ্যে জন্মগত। মানে এমন ছিল একটা সময়ে, যে দিনের বেলাতেও বড় উঁচু দুয়ার থেকে “মুতকুড়” এ ( একদম পাতি গ্রামের টার্ম এটা, মানে হলো, ছোট ছেলেরা যেখানে “টয়লেট” করে, সেটা আমাদের শোবার ঘরের ঠিক পাশেই ছিল ) আমি একলা এসে টয়লেট করতে পারতাম না ভয়ে। এবং সেই ব্যাপার টা যে আজকেও নেই এমন কিন্তু না। কিন্তু আজকে এক ছেলের বাবা হবার পর ভয় পেলেও ,ভয় কেন পাচ্ছি তার কারণ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই। মনে হয় আমার মতন যেন আমার ছেলেটা না হয়। সেই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ একের পর এক জট খুলে যায় আমার সামনে। আর বুঝি , যে ভয় খানা পেয়েছিলাম, সেটা খাঁটী ছিল তাতে কোন সন্দেহ-ই নেই, কিন্তু ভয়ের কারণ টা ছিল “ফালতু” । এটা বহুবার হয়েছে জীবনে। তাই প্রথমে ভয় পেলেও সামলে নিতে শিখে গেছি আমি তাড়াতাড়ি। আর সেটা হয়েছে আমি অস্বাভাবিক রকমের ভীতু বলেই। কারণ আমি জেনে গেছিলাম আমার লেভেলের ভীতু দের ভয় টা কে জয় করতে না পারলে আমি হয়ত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারব না। তবে দেখেছি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভয় টা অমূলক থাকে। আমার জীবনে সেটা একটা বিরাট সান্ত্বনা।
আমার বাবারা তিন ভাই। তারমধ্যে আমার বাবা আর মেজ জেঠু বেশ ভাল গান গাইতেন। গাইতেন বললাম কারণ , তিন ভাই এর মধ্যে আমার মেজ জেঠু আর বেঁচে নেই। আর উনি সব থেকে ভাল গান করতেন। আমরা শহরে মানে বর্দ্ধমানে সপরিবারে চলে আসার পর থেকে বেশ কিছু বছর , প্রতি শীতে, পুজো তে, আর গরমের ছুটি তে গ্রামে যাওয়া টা বাধ্যতা মূলক ছিল। আমার বাবার নিজের বাস্তু ভিটা, আর জমিজমার প্রতি ভালবাসা টা একটা মিথ এর পর্যায়ে। কাজেই ধান ওঠার সময়ে, পুজোর সময়ে, আলু চাষের সময়ে গ্রামে যাওয়া আমার কাছে উৎসবের মতই একটা ব্যাপার ছিল। গ্রামের বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, কম পড়াশোনা ছাড়াও জেঠুর গান ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। গানের কথা টা তুললাম, কারণ এই গান , আমাদের পরিবারের একটা বিশেষ অঙ্গ। জ্ঞান হয়ে থেকেই দেখে এসেছি আমাদের গানের ঘরে গান হচ্ছে। গ্রামের যত গাইয়ে, তবলচী আসত আমাদের বাড়িতে। পালঙ্কে, নীচে মেঝেতে, বাইরে , কিছু না হলেও তিরিশ চল্লিশ মানুষের আনাগোনা ছিল ওই গানের জন্য আমাদের বাড়িতে। ওই গানের ঘর টা ছিল আমাদের মানে আমি বাবা মায়ের শোবার ঘর। বিশাল বাড়ি, আর তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঁচটি মাটির একতলা ঘর। মাঝে চারটে নারকেল গাছ, দুটো পেয়ারা গাছ, আর একটা উঁচু ভেঙ্গে যাওয়া ঘরের অবশিষ্টাংশ। মানে ঘর টা ছিল না কিন্তু উঁচু দুয়ার টা ছিল। আর ছিল সাত ফুট উঁচু দুয়ার টা তে পৌঁছনর জন্য মাত্র চারটে বাধানো সিঁড়ি। ঝোপ ঝাড় এর ভর্তি ছিল সেই পোড় দুয়ার টা।
একটু যখন বড় হলাম তখন বসে থাকতাম খেয়ে দেয়ে আমাদের বড় ঘরের দুয়ারে মা কিম্বা মেজমা, কিম্বা ঠাকুমার কোলে। ভীতু ছিলাম বলে আমাকে কোলে নিয়ে থাকাটাই বাড়ির রীতি ছিল। আর ওদিকে গানের ঘরে রাতের সাথে সাথে গানের তোড় এবং জোর দুটোই বাড়ত। মা , মেজমা, ঠাকুমা কে কোন দিন বিরক্ত হতে দেখিনি আমি সেই জন্য। যাই হোক, তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌছয় নি গ্রামে আমাদের। থাকার মধ্যে হ্যারিকেন আর বাবা জেঠূ দের বড় বড় তিন সেলের টর্চ। মাঝে মাঝেই বিশাল উঠোনে আমার অতিসাহসী মেজদা ( আমি দাদাই বলি, যদিও আমার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়) ওর ই মধ্যে একটি টর্চ জ্বেলে উঠোন ময় ঘুরে বেড়াত। বস্তুত, আমাকে দেখানো যে “দ্যাখ ভীতু, আমি কেমন সাহসী, উঠোনে একলাই ঘুরছি”। দাদা মাঝে মাঝেই আকাশে টর্চ টা মারত। আমিও কারোর কোলে শুয়ে , হাঁ করে অনুসরণ করতাম সেই আলো। যেন আকাশ ফুঁড়ে সেই আলো চলে যেত কোন অজানা শূন্যে। এক এক দিন আঁতকে উঠতাম যখন টর্চের আলো নারকেল গাছে পড়ত। সাদা সাদা এক ঝাঁক পাখী জ্যাঠার মতন বসে থাকত নারকেল পাতায়। টর্চের তীব্র আলো তে পাখী গুলোর মুখের ভয়াবহতা দেখে আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতাম কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে।
- ভয় কি সোনা, ও তো পেঁচা! জানিস, পেঁচা রা না গান শুনতে ভালোবাসে। তাই তো গানের ঘরে গান হলেই ওরা এখানে এসে বসে, দ্যাখ দ্যাখ বাকী গাছ গুলোতেও বসে আছে দ্যাখ!
আমার মেজমা বা মা বা ঠাকুমার সান্ত্বনা বানী শুনেও আমি দেখতাম না। ঠিক সেই সময়েই হয়ত একটা গান শেষ হয়ে পরের গানের জন্য তবলার স্কেল ঠিক হচ্ছে বা এক নাগারে বাজিয়ে তবলচী খানিক ক্লান্ত। একটা সহসা নিস্তব্ধতা সারা বাড়িতে। আমার মনে প্যাঁচার মুখ আঁকা হয়ে গেছে। যতই কোলে মুখ টা গুঁজে ফোঁপাই, মনে কিন্তু প্যাঁচার সেই ভয়াল মুখ টা গেঁথে গিয়েছে যেন। ঠিক তখন ই উত্তর মাঠ থেকে “হুয়াআআআআআআআ ,হুয়াআআআআআ” , করে দীর্ঘ একটা আওয়াজ। জানতাম শেয়ালের ডাক ওটা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না আপনারা , হিম হয়ে যেত বুকটা আমার। দ্বিগুণ জোরে কোল টা আঁকড়ে ধরতাম আমি। আমার অসীম সাহসী দাদাও যেন পরিস্থিতির চাপে থম মেরে যেত। আমি শুয়ে থাকতাম কোলে মুখ টা গুঁজে। ভয়ে কাঁপতাম থরথর করে। ঠিক তখনি হয়ত পরের গান টা শুরু হতো আর মুহুর্তেই পরিস্থিতিটা ও বদলে যেত।
মা গজগজ করতো, “ ছেলে, আর ভয় পায় দেখো?, মেয়েরাও তোকে দেখে লজ্জা পাবে লালটু!
হ্যাঁ লজ্জা আমি পেতাম সত্যি কথাই, কিন্তু বিশ্বাস করুন ঠিক তার আগের ক্ষণের পরিস্থিতি তে , ওই নিস্তব্ধতা আর সেই নিস্তব্ধতা কে চিরে শেয়ালের করুন কান্না, হয়ত গানের ঘরে থাকা সাহসী পুরুষ গুলো কেও স্তব্ধ করে দিত কয়েক লহমার জন্য। বেশী সময় লাগত না ওই ভারী ভাব টা কাটতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমার চোখ বুজে আসতো ঘুমে , আর গানের ঘর থেকে ভেসে আসত জেঠুর গান “কোনদিন বলাকারা অতো দূরে যেত কী, ঐ আকাশ না ডাকলে”।
কাজেই একটা জিনিস অনেকদিন আগে থেকেই বুঝেছিলাম ভয় পাওয়া বা না পাওয়া টা নির্ভর করে, পরিস্থিতি এবং জানার আর আপনি কতটা কল্পনা প্রবণ তার উপরে। যেমন , একটা বাচ্চা ছেলে যে এখনো নিজের চোখে দুনিয়া দেখতে শেখে নি, সে কি ভয় পাবে যদি সে দেখে, আরেক টি কিশোরী মেয়ে ওর সাথে জানালায় দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে খেলছে? সে ভয় পাবে না। কিন্তু ভয় টা আপনি পাবেন যখন আপনি এই ব্যাপার টি দেখবেন। কারণ আপনি জানেন এটা আট তলা। কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না জানালার বাইরে থেকে কথা বলা। আট তলায় জানালার বাইরে একটা বাচ্চা কে দেখে আপনার ছেলে বা মেয়ে খেলছে এটা পড়েই আপনারা আঁতকে উঠেছেন এতে আমি নিশ্চিত। কাজেই আপনার ছেলে বা মেয়ে হয়ত খুশী হয়ে কথা বলছে কিন্তু আমি নিশ্চিত যে , আপনি ব্যাপার টা তে খুশী হতে পারবেন না। কাজেই জানেন বলে আপনি ভয় টা পেলেন। কিন্তু আপনার ছেলে বা মেয়ে পায় নি , কারণ ভয় পেতে গেলেও যত টুকু ইনফর্মেশন দরকার সেটা তার মধ্যে নেই।
একী রকম ভাবে, পরিস্থিতি ও দায়ী থাকে ভয় পেতে বা পাওয়াতে গেলে। যেমন কোন জায়গার মাহাত্ব্য না জেনে আপনি সেই জায়গা রাত বিরেত , অমাবস্যা- পূর্ণিমা, শনি- মঙ্গল, নির্বিশেষে যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু জেনে গেলেন যে ওই বিশেষ জায়গা , অমুক তিথিতে , বিশেষ ভাবে , উপ-অপ-বা অধি দেবতা দ্বারা প্রভোকড হয়। তাহলে আমি শিওর যে আপনার বুক কাঁপবে ওই জায়গা দিয়ে ওই বিশেষ তিথি তে যেতে।
একটা ঘটনা বলছি এই ব্যাপারে। এখানে অনেকেই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন । একরকম খেলা আসত গ্রামে। মাদারী বলতাম আমরা। একটা লোক আর একটা বাচ্চা।বাচ্চা টা মেয়েই থাকত বেশী। ভীষণ রোগা আর কালো। কেমন যেন মায়াময় মুখটা হতো বাচ্চাটার। অনেক রকম খেলা ওরা দেখাতো। দুটো খুঁটি পুঁতে , মাঝে একটা রশি বেঁধে দিত। একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে, বড় বাঁশ হাতে নিয়ে ওই দড়ির উপরে চলতো। ছোট ছোট ম্যাজিক ও দেখাতো। ঘড়ি বা টাকা গায়েব করে দিয়ে, অন্যের পকেট থেকে বের করা বা কাঁচা ডিম রেখে মন্ত্র বলে সিদ্দ ডিম করে দেওয়া। তখন ম্যাজিক গুলো দেখে খুব ই অবাক হতাম, ভালো লাগত খুব। আমি আর দাদা বাড়িতে এসে ওদের ম্যাজিকের বর্ননা, মা কে , মেজমা কে বা ঠাকুমা কে , গোল গোল চোখ করে বলে দুটো আলু বা সের টাক চাল বাগাতাম ওই ম্যাজিক বালা কে দেব বলে।
যদি আমদানী ভালো হতো তবে এই সবের শেষে একটা চমক থাকত। একটা অদ্ভুত খেলা হতো। বাচ্চা টাকে একটা ময়লার তস্য ময়লা চাদরে ঢেকে দিত। আর একটা প্রায় ভোঁতা ছুরি চালাত আমাপা ওই চাদরের উপর দিয়ে বাচ্চাটার গায়ে। হয়ত ওটা ম্যাজিক ই ছিল। কিন্তু ছোরার গায়ে রক্তের দাগ দেখে আমি আঁতকে উঠতাম। কেমন একটা মন কেমন করা গ্রীষ্মের দুপুরে এই খেলাটা চলার সময়ে বুক টা কেঁপে উঠত আমার। রক্তের সোঁদা গন্ধ টা যেন পেতাম আমি। সব শেষে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলা টা কাটত সেই লোকটা বাচ্চাটার। পুরো ব্যাপারটাই করত সেই ময়লা চাদরের উপির দিয়ে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম আমি। দাদার পিছনে সেঁধিয়ে যেতাম। কুঁকড়ে যেতাম ভয়ে। জানিনা কি করে দেখাতো, কিন্তু চাদর তুলে দেখালে দেখতাম গলা টা কেটে ফেলেছে একেবারে। বিশ্বাস করবেন না আপনারা, পুরো জমায়েত টা স্তব্ধ হয়ে যেত। পিনড্রপ সাইলেন্স যাকে বলে। ঠিক কিছু পরেই দুবার হাততালি তে বাচ্চা মেয়েটা যখন চাদর সরিয়ে উঠে বসত তখন যেন আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। বাচ্চা টা ঠিকঠাক আছে দেখে, যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত আমার মধ্যে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠতাম। পুরো জমায়েত টাও হাততালি দিত। ওরা চাল, আলু আর যা পয়সা পেত , সেটা নিয়ে পোঁটলা বেঁধে চলে যেত অন্য গ্রামে। আমি বার বার ঘাড় ঘুড়িয়ে বাচ্চা টা কে দেখতাম। মন টা ভয়ানক খারাপ লাগতো। জানিনা ওই বয়সে ওই টুকু একটা বাচ্চার উপরে হওয়া অত্যাচার সহ্য করতে পারতাম না নাকি ওই কাটাকুটির কারণে আমার মনে কোন ইফেক্ট পড়ত বলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আজও বুঝিনি।
যাই হোক, রাতে প্রায় ই ওই গলাকাটা দেখে আমি ককিয়ে কেঁদে উঠতাম “ গলাকাটা গলাকাটা “ বলে । জড়িয়ে ধরতাম আমি মা কে। বাবাও উঠে পড়ত ঘুম থেকে। আমাকে খেলাটা দেখাতে নিয়ে যাবার জন্য আমার দাদার উদ্দেশ্যে মায়ের বকাবকির মাঝেই বাবার অভয় বানী শুনতাম, “ বোকা ওটা কি সত্যি নাকি, ও তো ম্যাজিক”।
কিন্তু কেন জানিনা ব্যাপার টা আমার কোনদিনেই স্বাভাবিক মনে হয় নি। ভয় টা হয়ত আজকেও কাটেনি আমার। লিখতে লিখতেও আমার সেই বাচ্চাটার খুব আবছা মুখ টা ভেসেই উঠছে।বাবা ও দেখেছিলেন বা দেখতেন ওই ম্যাজিক। হয়ত ওই খেলা টা কে নিছক খেলা হিসাবেই নিতেন। আমি হয়ত কল্পনা প্রবণ অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলতাম এবং ভয় পেতাম। বাবার মুখে শুনেছি যে বাবা নাকি একবার ওই বাচ্চা টির জায়গা তে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের জমায়েতের আপত্তি তে সেটা সম্ভব হয় নি। আমি কোনকালেই বাবার মতন সাহসী ছিলাম না সেটা বলাই বাহুল্য। তাই ওই সব আজগুবি স্বপ্ন থেকে মা বাবা কে জ্বালিয়েছি অনেকদিন। আমার ক্ষেত্রে এই খেলা টা যেমন সিরিয়াস রূপ নিয়েছিল, আমার বাবার ক্ষেত্রে ছোট বেলায় দেখা এই ঘটনা নিছক একটা খেলাই ছিল মাত্র। হয়ত এই ব্যাপার টা, বাবার একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।
আসলে, আমি ঘটনা বলতেই এই লেখার অবতারণা করেছি। কিন্তু মনে হলো, যারা সত্যিকারের উপলব্ধি করেছে ভৌতিক বা আধিভৌতিক ব্যাপার, তাদের কাছে পুরো ঘটনা টা হয়ত দশ সেকেন্ড কি তার ও কমে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যে পরিস্থিতি তে ভয় পেয়েছিল সেটা ইম্পর্ট্যান্ট এবং সেটাই সেই ঘটনার আসল গেম চেঞ্জার। প্রকৃত পক্ষে আমি এমন অনেক মানুষ জানি, যারা নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছেন এই ভৌতিক ব্যাপার। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমার বাবা। সত্যি বলতে আমি আমার বাবার মতন অসীম সাহসী মানুষ দেখিনি। এমনি জীবন যুদ্ধে বেশ ভীতু। সেখানে হয়ত আমাকেই সাহস যোগাতে হয় বাবা কে এখন, কিন্তু ওই ভৌতিক ব্যাপারে বাবার সাহসের কোন তুলনা নেই বললেই চলে। আমি দেখেছি এই সব ক্ষেত্রে মানুষ হার্টফেল না করলে , ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা নেই চলে। কারণ এইসব ক্ষেত্রে আমি যত সত্যি ঘটনা শুনেছি বা উপলব্ধি করেছি তাতে বুঝেছি, এনাদের যাওয়া বা আসার রাস্তায় উপস্থিত হয়ে গেছে ভিক্টিম রা, বাধ্য হয়ে বা না জেনে। কেউ পালিয়ে গেছে , বা কেউ ভয়ে হার্টফেল করেছে। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ভাবে কোন ক্ষতি করার প্রচেষ্টা করেনি কোন উপ-অপ-অধি দেবতা।
এবারে একটা ঘটনায় আসি, বাবা তখন সাত বছর আর আমার জেঠু দশ।ঘটনা টা আমার জেঠু এবং বাবা দুজনের মুখেই শুনেছি আলাদা আলাদা করে। দুজনের ভার্সন একটু আলাদা হলেও আসল ব্যাপার টা মোটামুটি এক ই। সময় টা ছিল ফাল্গুন বা চৈত্র। শিওর নই কারণ দোলযাত্রার সময় কার ঘটনা। আমাদের গ্রামে দুটো দোল উৎসব হয়। এখনো হয়। রাজ দোল আর পঞ্চম দোল। পূর্ণিমার দিনে রাজদোল হয়। গৌর নিতাই এর দোল। খুব ধুমধাম হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্ধ্যে বেলায় গৌর নিতাই বের হন পালকী করে। গ্রাম ঘোরেন ভক্তের কাঁধে চেপে। প্রভূত আবির খেলা হয়। ছোট বেলায় আমরাও ঘুরেছি সাথে সাথে। বাবাদের সময়ে মানে আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই সব উৎসব অনেক অনেক ইন্টেন্সিটি তে হত। কারণ এন্টারটেইন বলতে তো এই সব উৎসব ই ছিল। পুরো উৎসব টা রাতেই হত। মানে সন্ধ্যে বেলায় ঠাকুর বেড়িয়ে , ফের মন্দিরে ঘুমোতেন রাত দেড়টা দুটো নাগাদ। তারপরে যে যার বাড়ি ফিরে যেত।
এই রকম ই রাজদোলের রাতে , উৎসব , আবির খেলা শেষে বাবা আর জ্যাঠা ফিরছিলেন গলির রাস্তা ধরে আমাদের বাড়িতে। পুর্ণিমা, স্বভাবতই ফুটফুটে জ্যোৎস্না। গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। কাজেই চাঁদের আলোর জোয়ার চারিদিকে। উৎসব প্রাঙ্গণে হ্যাজাক এর আলো নিভে যাবার পরে, আলোর সাথে প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা যেন সবাই কে জানান দিয়েই হচ্ছে। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, আর গাছ গুল্মের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর লুকোচুরিতে রাস্তা চিনে নেওয়া কঠিন কিছু হচ্ছে না। দুটো ছোট ছেলে সেই রকম অলি গলি ধরে আলোআঁধারি পরিবেশে নিজের বাড়ি ফিরছে। বসন্তের মাঝামাঝি, কাজেই হিম এখনো ছেড়ে কথা কইছে না। উৎসবের মেজাজে বুঝতে না পারা গেলেও, এখন কেমন একটা মন কেমন করা না ঠাণ্ডা না গরম হাওয়া বইছে । ছেলে দুটোর অস্বস্তি বোঝা যাচ্ছে ঠাণ্ডায়, হাত দুটো কে বগলের তলায় চালান করে দিয়ে, মেন রাস্তা না ধরে বাড়ির পিছনের গলির রাস্তা ধরল তারা। ওরা বুঝল যে একটু দেরী করে ফেলেছে। যে পাড়া দিয়ে ফিরছিল দুজনে সেই পাড়ার লোকজন দোরে খিল দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সত্যি করেই, উৎসব শেষে খাওয়া দাওয়া করে ফিরতে দেরী হলো বৈকী।
- এই তো, আর একটু। চল তাড়াতাড়ি, মা চিন্তা করবে।
- এই দিকে না এলেই হত, আমাদের সদর দিয়ে ঘুরে গেলে ঠিক হতো রে।
মেজ দাদার কথায় ছোট টা একটু চঞ্চল হলো। “ নাহ এদিকেই চল, এক ছুটে পেরিয়ে যাব”।
ওই গলি দিয়ে না যাবার বা ছুটে পেরিয়ে যাবার কথা চিন্তা করার পিছনে অনেক কারণ আছে। গলি টা বেশ সরু এবং মোটামুটি পঞ্চাশ মিটার লম্বা গলি টা আপাদমস্তক অন্ধকার। চওড়া ফুট দুয়েক খুব বেশী হলে। বাড়ি গুলোর পিছন দিকের গলি। গলির ঠিক কোনায় যেখানে আমাদের বাড়ি বাঁক নিচ্ছে , সেই কোন দিয়ে একটা বড় পুকুরের রাস্তা নেমে যাচ্ছে। তিনটে বাড়ির পিছন দিক সেটা। ঠিক জাঙ্কশনেই ছিল সেই পুকুরে যাবার রাস্তা। প্রায় বিশ মিটার , আগাছায় পূর্ণ, সেই রাস্তা নেমে গেছে পুকুরে। ঘাট ছিল পরিষ্কার। কারণ গৃহস্থ্য বাসন পত্র মাজা এবং মহিলাদের স্নান করার জায়গা ছিল সেই ঘাটে। ওই নেমে যাওয়া রাস্তার ঠিক মাঝে ডান দিকে একটা বিশাল বট গাছ ছিল। এখনো আছে। আর বাম দিকে ছিল কুড়ি পঁচিশ গাছা বাঁশের ঝাড়। স্বভাবতই দিনের বেলাতেও অন্ধকার লাগত ওই রাস্তা টা, বাঁশ এবং বট গাছের নীচু ডালপালা গুলো যেন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে। ঘাটে যাবার রাস্তা বাঁশের পাতা এবং বটের পাতায় ভরে থাকত। ওই হেন জায়গা রাতে যেতে চোখে পড়লেই কেমন একটা অনুভূতি আসে। আমি বহুবার গেছি ওই রাস্তা দিয়ে রাতে। এমনিতেই আমি ভীতু, তারপরে ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে কেমন একটা ভয়ের অনুভূতি আসে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখি পুকুর টা, সেখানে চাঁদের আলো থাকে, আর পুকুরে চাঁদের আলো ধপধপ করে। কিন্তু মাঝখান টা নিরেট আঁধার। চাঁদের আলোর এই মজা। হয় দেখা যাবে না হলে কিচ্ছু দেখা যাবে না। শুধু সাদা আর কালো। মাঝে কিছুই নেই। কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু আওয়াজ পাওয়া যায় সেই খানে থাকা প্রাণীদের। হয়, হাওয়ায় শুকনো পাতা ওড়ার মৃদু খসখস আওয়াজ বা ছোট কোন প্রাণীর চলে যাবার সরসর শব্দ, বা আঁধারে বট গাছে বাসা বেঁধে রাত্রিবাস করা অসংখ্য পাখীর সহসা ঘুম ভেঙ্গে কান্নার আওয়াজ।অথবা অপ্রাকৃতিক রকম অসীম নীরবতা। পুকুরের জলে সহসা টোল খাওয়ার পরে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুলোর পাড়ের দিকে গুটি গুটি করে আসতে দেখার সময়ে ওই নীরবতায় বুক টা কেমন দুরদুর করে। সহসা কিছু হবার আশঙ্কায় মন টা কেমন হয়ে যায়। না পারি পালাতে না পারি দাঁড়িয়ে থাকতে। কেমন একটা অজানা টান। না চাইলেই হয় পুকুর পানে। কিন্তু শত ভয়ের মাঝেও কিন্তু চোখ চলে যেত ওই দিকে। এটা শুধু আমার না , ঐ পাড়ায় থাকা সব কচি কাঁচা, বুড়ো হাবড়া, যুবক যুবতী সবার ই হয় এটা আমি জেনেছি।
ছুটে পেরিয়ে যাবার সময়ে ছোট ছেলেটা টা ছিল পিছনে। বড় ছেলেটা টা ওই জায়গা টা পেরিয়ে গেলেও ছোট টা যেন আটকে গেলো। দোলের রাতে চাঁদের আলোর দাপাদাপি তো ছিলই। ছোট ছেলেটি দেখতে পেল , আঁধার পেরিয়ে ঘাটে কেউ একজন জলে রয়েছে। হতে পারে গা ধুচ্ছে। বা হতে পারে বাহ্যকর্ম করে শৌচে গেছে।
- দাদা দাঁড়া একবার মনে হচ্ছে, মুকুজ্যে ঠাকমা ঘাটে গেছে, বুড়ি রাতকানা, আমি দিয়ে আসি বাড়িতে।
দাদার কাছে ব্যাপার টা ভালো মনে হয় নি। কারণ একটু বয়েস বেশির জন্য, বা অনেক কিছু জেনেছে বা শুনেছে মায়ের কাছ থেকে। কাঁপা গলায় বলল
- না তুই নীচে যাবি না, আগে উঠে আসতে দে, দ্যাখ কে তারপরে যাবি। অনেক রাত এখন। মুকুজ্যে ঠাকমা এতো রাতে পুকুরে যাবে না। আর আজকে ঠাণ্ডা আছে বেশ। গা ধুতে কেনই বা যাবে।
- আরে না রে ঠাকমাই ওটা, দেখছিস না , ঠিক করে ঘাটের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। আমি যাই তুই এখানে থাক।
দাদার মনে সন্দেহ এসেইছিল যে ভাই মনে হয় নেমে যাবে। হাত টা ধরে ফেলেছিল দাদা।
- না তুই যাবি না , আগে আসতে দে উঠে।
ততক্ষণে যে ছিল ঘাটে, সে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। মাঝের নিরেট অন্ধকার টা আর অতো টা নিরেট লাগছে না। কেউ যে উঠে আসছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে এখন। আর যে আসছে , সে যেন কিছু খুঁজতে খুঁজতে আসছে। কারণ অন্ধজনে যে ভাবে দুটো হাত সামনে ইতস্তত খুঁজতে খুঁজতে আসে, কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে যাবার আশঙ্কায়, ঠিক সেই ভাবেই আসছে সে।
- ওই দ্যাখ ঠাকমাই হবে। রাত কানা, দেখতে পাচ্ছে না। তাই ওমনি করে আসছে।
- নাআ, তুই দাঁড়া, যাবি না।
সেই অবধি যে ঘাট থেকে উঠে আসছিল সে আরো অনেক টা কাছে চলে এসেছে। এবারে যেন হাত সঞ্চালনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর হয়ত ফুট দশেক দূরে। এদিকে দু ভাইয়ের মধ্যে দড়ি টানাটানির খেলা চলছে। ছোট টা যাবেই আর বড় টা যেতে দেবে না। এইরকম দড়ি টানাটানির মাঝেই অন্ধকার হাতড়ে আরো কাছে চলে এসেছে সে ছেলেদুটির কাছে। মনে হয় ছোট টা তখন কিছু আন্দাজ করে দাদার টানের জোর কে পাত্তা দিয়ে পিছিয়েই এলো দাদার কাছে। ততক্ষণে ফুটফুটে চাঁদের আলোতে চলে এসেছে সেই অন্ধকার হাতড়ে আসতে থাকা মানুষ টা।
দুটো হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে যখন সে আলোয় দৃশ্যমান হলো তখন দেখা গেল মাথা হীন একটি মহিলা যেন হাতড়ে হাতড়ে এসেছে ঘাট থেকে উঠে।
ছোট ছেলেটি মানে আমার বাবা তখন দেখে সত্যি বলতে কিছুই বুঝতে পারে নি। একমাত্র গ্রামে সেই ম্যাজিক-বালাই গলাকাটা ম্যাজিক দেখাত। বড় ছেলে টি মানে আমার মেজ জেঠু কিন্তু বুঝেছিলেন , এটা কি আর একে কি বলে। ভয়ে কথা না বলতে পারলেও ভাই কে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাবার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ যায় নি। কিন্তু আমার বাবা সামান্য ভয় ও সেদিন পায় নি কারণ ওই জিনিস টা বাবার কাছে ম্যাজিক ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। উত্তেজনায়, ম্যাজিক ম্যাজিক বলতে বলতে খিড়কী দোর দিয়ে এক দৌড়ে বাবা আর জেঠু বাড়িতে চলে এসেছিলো। প্রানে বেঁচে গেলেও, নাকি জ্বর জ্বালায় ভুগিয়েছিল বাবা জেঠু কে কিছুদিন।
বাবা না হয় জানতেন না ওই ছোটবেলায় এই ব্যাপার টা। কিন্তু আমি জানতাম অনেক ছোট থেকেই। সেই জন্য খুব ভয় পেতাম ওই জায়গা টা। শুনেছি ওই জিনিস টার নাম স্কন্ধকাটা। আমরা বলতাম কন্ধকাটা। বা কান কাটারীর মা। মানে ছোট বেলায়, ওই বলেই আমার দুর্দমনীয়তা কে বশে আনা হতো। শুনেছি, অনেকেই ওই জিনিস টা দেখেছে। একটা আসা যাওয়ার রাস্তা ছিল ওই জিনিস টার। আমাদের বাড়ি টা কে দুদিক থেকে ঘুরে, সামনের বড় রাস্তা হয়ে বারোয়ারী তলা দিয়ে সে চলে যেত জমিদার বাড়ি অব্দি। এই জিনিস টা কে দেখেছে আর ও অনেকে। ওই মেইন রাস্তার ধারে আমাদের খামার বাড়ি ছিল। খামার বাড়ির পাশেই ছিল আমাদের গোয়াল ঘরে। আর তার সামনেই ছিল আমাদের সারা বছর কাজ করার মুনিষের ঘর। ও ওখানে বউ,ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি নিয়ে থাকত। খুব ছোট তখন আমি, একদিন সকালে দেখি, বাবা আর জেঠু ফিরল বাড়িতে। এতো সকালে কোথা থেকে ফিরল, জানতে চাইতেই শুনলাম, যে ওরা ডাক্তার খানা থেকে ফিরছে। কেন প্রশ্ন করতেই জানলাম, ওই মুনিষ কে সকালে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে খামার বাড়িতে। রাতে, বাথরুম করতে উঠে , কিছু দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সে। ভোর বেলায় কেউ দেখার পরে , সবাই কে ডাকাডাকি করে তুলে তাকে ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। বাবা আর জেঠু তখন ফিরল ডাক্তার খানা থেকে। পরে যখন আর একটু বড় হই , জেনেছিলাম যে এই জিনিসটা অনেকেই দেখেছে, আর ওই এক ই রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দেখেছে। ওই রাস্তা দিয়ে এখনো আমরা যাই রাতে, অনেক সময়ে গভীর রাতেও। ভয় ও করে কিন্তু এখন আর দেখা যায় না বলেই শুনেছি।
যে সুত্রে এই ঘটনার অবতারণা, যে ঠিকঠাক না জানা থাকলে অনেক ভয়ের ব্যাপার ও ভয়ের লাগে না। আর আমার বাবার ক্ষেত্রে, এই ঘটনা ছিল একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেদিন যদি বাবা জানত ওটা কি , তবে আমি খুব নিশ্চিত যে বাবা ভয় পেত আর সেটা কিছু ভাল ব্যাপার হতো না।
আসলে আমি দেখেছি যে, ভয় জিনিস টা একটু অদ্ভুত। আমরা ভয় পাই কি হবে সেটা ভেবে। ঘটনা কে সে ভাবে ভয় পাই বলে মনে হয় না। আর ভয় ব্যাপার টা একমেবদ্বিতীয়ম, সেটা হলো ভয়। সে যে কারণেই হোক না কেন। যেমন একটু খুলেই বলি। ধরা যাক, আমি একটা পুকুরে নামব স্নান করতে বা কোন কাজে। স্নান ছাড়াও অনেক কাজ থাকে, যেমন দিদা বলল, “ বাবা পুকুরে মাজার জন্য একটা বড় পেতলের হাঁড়ি রেখেছিলাম, চলে গেছে জলের তলায়, একটু এনে দিবি?”
আমি সাঁতারে বেশ পটু। অনেক রকম সাতার জানি। দম ও ভালো ধরি। কিন্তু ঐ পুকুর টাতে নামতে আমার ভয় করে। কারণ আমার কালো টলটলে জল দেখলেই কেমন বুক টা আঁতকে ওঠে। কনফিডেন্স টার বারোটা বেজে তেরো টা হয়ে যায়। আমি জানি এর থেকে অনেক স্রোতস্বিনী নদী আমি হেলায় সাঁতরে পেরিয়ে যেতে পারি, কিন্তু ওই পুকুরে? নৈব নৈব চ। ভয় করে একটা। কল্পনা প্রবণ মনের এই গুলো সমস্যা। মনে কল্পনায় কল্পিত হয় , কোন কল্পিত জলজ অপদেবতা যদি কালো জলে লুকিয়ে থাকে? আমি জানি ওই জলে সাঁতার রত অবস্থায় যদি কোন কাঁটা গাছে আমার গামছা বা বারমুডা আটকে যায় তাহলে হয়ত আমি ভয়ে জ্ঞান হারাবো। এসব ই ছোট বেলায় শোনা অনেক গল্পের খলনায়ক আর খলনায়িকাদের জন্য মনের কোন অতলে লুকিয়ে থাকা ভয়ের বাহ্যিক প্রকাশ। এটা এইবয়সেও হয়। মানে এখানে জানা বা অজানা বা পরিস্থিতি কোনটাই দায়ী নয়। দায়ী হলো আমার কল্পনা প্রবণতা । অথচ আমি দামোদরের পাশে থাকা ছেলে। সত্যি বলছি বন্ধুর গ্রামে গিয়ে অনেক দাপিয়েছি দামোদরে। ভয় করে নি। বা পরিষ্কার জলের পুকুরেও কোন ভয় করে না আমার। গঙ্গা তে নেমেও সাঁতরে এসেছি, অনেক শক্তিক্ষয় হয়েছে, কিন্তু এই ভয় টা করে নি। কেউ যদি ওই কালো জলের পুকুর টা কে মন্ত্রবলে পরিষ্কার করে দেয় তবে আমি তক্ষুনি ডুব দেব আনন্দে। আমি দেখেছি ভয় টা আমার ওই কালোর ওপারে আদৌ কিছু আছে নাকি সেটা নিয়ে। কি আছে জেনে গেলে তো ভয় বলে কিছু থাকে না। তখন একশন হয়। হয় পালাব না হলে লড়ব। নিজের নিজের ব্যাপার সেটা। ভয় সেটাই যেটাতে আমাদের মন অজানা কিছুর আশঙ্কা করে।
সত্যি বলতে কি ,আমার ভুতে ভীষণ ভয়। আমার বউ এর সেসবে কোন ভয় নেই। ভুত অপদেবতাতে একদম ই ভয় নেই। ও আবার মানুষে ভয় পায় খুব। যেটাতে আবার আমার কোন ভয় নেই। অদ্ভুত না? হ্যাঁ, আমি ভেবে দেখলাম, যার যেটাতে কনফিডেন্স , সে সেটা তে কেন ভয় পাবে? আমি প্রায় ৬ ফুট একটা মানুষ। যথেষ্ট ভাল শরীর এবং শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী। আমার মনে এই কনফিডেন্স আছে যে মানুষের পক্ষে আমাকে আক্রমণ করতে গেলেও ভাবতে হবে অনেকবার। আমার এই চিন্তা ভাবনা ঠিক না ভুল সেই প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু এই কনফিডেন্স টা আমার আছে। তাই আমার মানুষে ভয় লাগে না। বউ এর হয়ত ভুত নিয়ে সিমিলার রকম কোন কনফিডেন্স থাকবে। জিজ্ঞাসা করিনি কোন দিন। জানি কোন প্রপার উত্তর পাব না তাই। কারণ যেকোন লজিকের কাউন্টার লজিক থাকেই। এই দুজনের যেদিন নিজের নিজের কনফিডেন্স এ আঘাত লাগবে হয়ত আমাদের চিন্তা ধারা এবং ভয়ের চেহারা টা বদলে যাবে। আমি বউ কে অনেক গল্প পড়ে শুনিয়েছি ভুতভুতুম থেকে। “ওরে বাবারে”, “কি সাঙ্ঘাতিক”, “ বাপরে কি ভয়ানক” গোছের মন্তব্য করলেও, ভয় পাবার দৌড় ওই গল্প অব্দি থাকে ওর। গল্প শেষ হলে ওর ও ঘুম পেয়ে যায়। বরং আমার আর ছেলের সেই গল্প গুলোর রেশ থাকে অনেক দিন অব্দি। সেটা আমি পরতে-পরতে বুঝি। আর বুঝি আমি আর আমার ছেলে দুজনেই ভয়ঙ্কর রকমের কল্পনা প্রবণ। আর সেটা ভাল মন্দ দুই ক্ষেত্রেই। তাই এটা বুঝেছি ভয়ের আরেক টা কারণ হলো কল্পনা। আর সেই কল্পনা আমার/ আপনার নেক্সট ভয় পাবার ক্ষেত্র টা ভালো রকম প্রস্তুত করে রেখেছে এটা আপনি নিশ্চিত করে ধরে রাখবেন।
সমাপ্ত
ভয় (অনাহুত )
এটা কোন গল্প না। চেষ্টা করেছি কিছু কথা বলার আর কিছু ঘটনা লেখার। ভালো না লাগলে এই ধরনের প্রচেষ্টা আর করব না।
ভয় পেলেই যে কেউ ভুত বা দানো দেখেছে এমন কিন্তু না। যদিও দানো কথাটা আমি যে অঞ্চলের থেকে আসা, সেখানে বিশেষ প্রচলিত নয়। ভুত শব্দ টাই প্রভূত প্রচলিত। ভুত, নিশি, গো-ভুত, স্কন্ধকাটা, ভুলো আর হ্যাঁ অবশ্যই ব্রহ্মদত্যি, এই শব্দ গুলোর সাথে পরিচিত ছিলাম ছোট থেকে। বর্দ্ধমান জেলার, অধুনা পূর্ব-বর্দ্ধমান জেলার একটি গ্রামের ছেলে আমি। জন্মের প্রথম দশ বছর গ্রামে থাকতাম। তারপর থেকে বর্ধমান শহরে চলে গেছিলাম। ওখানেই পড়াশোনা করেছি আমি। এত কিছু অপ্রয়োজনীয় কথা বলছি কারণ ভয় পাওয়া টা কিন্তু পুরোপুরি ঘটনার আগের পরিস্থিতির উপরে নির্ভর করে। এই মুখবন্ধ হয়ত সেই ক্ষেত্র তৈরী করছে মাত্র।
যেমন ভয় ব্যাপার টা আমার মধ্যে জন্মগত। মানে এমন ছিল একটা সময়ে, যে দিনের বেলাতেও বড় উঁচু দুয়ার থেকে “মুতকুড়” এ ( একদম পাতি গ্রামের টার্ম এটা, মানে হলো, ছোট ছেলেরা যেখানে “টয়লেট” করে, সেটা আমাদের শোবার ঘরের ঠিক পাশেই ছিল ) আমি একলা এসে টয়লেট করতে পারতাম না ভয়ে। এবং সেই ব্যাপার টা যে আজকেও নেই এমন কিন্তু না। কিন্তু আজকে এক ছেলের বাবা হবার পর ভয় পেলেও ,ভয় কেন পাচ্ছি তার কারণ অনুসন্ধান করতে বাধ্য হই। মনে হয় আমার মতন যেন আমার ছেলেটা না হয়। সেই অনুসন্ধানের ফলস্বরূপ একের পর এক জট খুলে যায় আমার সামনে। আর বুঝি , যে ভয় খানা পেয়েছিলাম, সেটা খাঁটী ছিল তাতে কোন সন্দেহ-ই নেই, কিন্তু ভয়ের কারণ টা ছিল “ফালতু” । এটা বহুবার হয়েছে জীবনে। তাই প্রথমে ভয় পেলেও সামলে নিতে শিখে গেছি আমি তাড়াতাড়ি। আর সেটা হয়েছে আমি অস্বাভাবিক রকমের ভীতু বলেই। কারণ আমি জেনে গেছিলাম আমার লেভেলের ভীতু দের ভয় টা কে জয় করতে না পারলে আমি হয়ত স্বাভাবিক ভাবে বাঁচতে পারব না। তবে দেখেছি বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই ভয় টা অমূলক থাকে। আমার জীবনে সেটা একটা বিরাট সান্ত্বনা।
আমার বাবারা তিন ভাই। তারমধ্যে আমার বাবা আর মেজ জেঠু বেশ ভাল গান গাইতেন। গাইতেন বললাম কারণ , তিন ভাই এর মধ্যে আমার মেজ জেঠু আর বেঁচে নেই। আর উনি সব থেকে ভাল গান করতেন। আমরা শহরে মানে বর্দ্ধমানে সপরিবারে চলে আসার পর থেকে বেশ কিছু বছর , প্রতি শীতে, পুজো তে, আর গরমের ছুটি তে গ্রামে যাওয়া টা বাধ্যতা মূলক ছিল। আমার বাবার নিজের বাস্তু ভিটা, আর জমিজমার প্রতি ভালবাসা টা একটা মিথ এর পর্যায়ে। কাজেই ধান ওঠার সময়ে, পুজোর সময়ে, আলু চাষের সময়ে গ্রামে যাওয়া আমার কাছে উৎসবের মতই একটা ব্যাপার ছিল। গ্রামের বন্ধুবান্ধব, খেলাধুলা, কম পড়াশোনা ছাড়াও জেঠুর গান ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। গানের কথা টা তুললাম, কারণ এই গান , আমাদের পরিবারের একটা বিশেষ অঙ্গ। জ্ঞান হয়ে থেকেই দেখে এসেছি আমাদের গানের ঘরে গান হচ্ছে। গ্রামের যত গাইয়ে, তবলচী আসত আমাদের বাড়িতে। পালঙ্কে, নীচে মেঝেতে, বাইরে , কিছু না হলেও তিরিশ চল্লিশ মানুষের আনাগোনা ছিল ওই গানের জন্য আমাদের বাড়িতে। ওই গানের ঘর টা ছিল আমাদের মানে আমি বাবা মায়ের শোবার ঘর। বিশাল বাড়ি, আর তার মাঝে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঁচটি মাটির একতলা ঘর। মাঝে চারটে নারকেল গাছ, দুটো পেয়ারা গাছ, আর একটা উঁচু ভেঙ্গে যাওয়া ঘরের অবশিষ্টাংশ। মানে ঘর টা ছিল না কিন্তু উঁচু দুয়ার টা ছিল। আর ছিল সাত ফুট উঁচু দুয়ার টা তে পৌঁছনর জন্য মাত্র চারটে বাধানো সিঁড়ি। ঝোপ ঝাড় এর ভর্তি ছিল সেই পোড় দুয়ার টা।
একটু যখন বড় হলাম তখন বসে থাকতাম খেয়ে দেয়ে আমাদের বড় ঘরের দুয়ারে মা কিম্বা মেজমা, কিম্বা ঠাকুমার কোলে। ভীতু ছিলাম বলে আমাকে কোলে নিয়ে থাকাটাই বাড়ির রীতি ছিল। আর ওদিকে গানের ঘরে রাতের সাথে সাথে গানের তোড় এবং জোর দুটোই বাড়ত। মা , মেজমা, ঠাকুমা কে কোন দিন বিরক্ত হতে দেখিনি আমি সেই জন্য। যাই হোক, তখনও বিদ্যুৎ এসে পৌছয় নি গ্রামে আমাদের। থাকার মধ্যে হ্যারিকেন আর বাবা জেঠূ দের বড় বড় তিন সেলের টর্চ। মাঝে মাঝেই বিশাল উঠোনে আমার অতিসাহসী মেজদা ( আমি দাদাই বলি, যদিও আমার থেকে মাত্র দেড় বছরের বড়) ওর ই মধ্যে একটি টর্চ জ্বেলে উঠোন ময় ঘুরে বেড়াত। বস্তুত, আমাকে দেখানো যে “দ্যাখ ভীতু, আমি কেমন সাহসী, উঠোনে একলাই ঘুরছি”। দাদা মাঝে মাঝেই আকাশে টর্চ টা মারত। আমিও কারোর কোলে শুয়ে , হাঁ করে অনুসরণ করতাম সেই আলো। যেন আকাশ ফুঁড়ে সেই আলো চলে যেত কোন অজানা শূন্যে। এক এক দিন আঁতকে উঠতাম যখন টর্চের আলো নারকেল গাছে পড়ত। সাদা সাদা এক ঝাঁক পাখী জ্যাঠার মতন বসে থাকত নারকেল পাতায়। টর্চের তীব্র আলো তে পাখী গুলোর মুখের ভয়াবহতা দেখে আমি ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতাম কোলের মধ্যে মুখ গুঁজে।
- ভয় কি সোনা, ও তো পেঁচা! জানিস, পেঁচা রা না গান শুনতে ভালোবাসে। তাই তো গানের ঘরে গান হলেই ওরা এখানে এসে বসে, দ্যাখ দ্যাখ বাকী গাছ গুলোতেও বসে আছে দ্যাখ!
আমার মেজমা বা মা বা ঠাকুমার সান্ত্বনা বানী শুনেও আমি দেখতাম না। ঠিক সেই সময়েই হয়ত একটা গান শেষ হয়ে পরের গানের জন্য তবলার স্কেল ঠিক হচ্ছে বা এক নাগারে বাজিয়ে তবলচী খানিক ক্লান্ত। একটা সহসা নিস্তব্ধতা সারা বাড়িতে। আমার মনে প্যাঁচার মুখ আঁকা হয়ে গেছে। যতই কোলে মুখ টা গুঁজে ফোঁপাই, মনে কিন্তু প্যাঁচার সেই ভয়াল মুখ টা গেঁথে গিয়েছে যেন। ঠিক তখন ই উত্তর মাঠ থেকে “হুয়াআআআআআআআ ,হুয়াআআআআআ” , করে দীর্ঘ একটা আওয়াজ। জানতাম শেয়ালের ডাক ওটা। কিন্তু বললে বিশ্বাস করবেন না আপনারা , হিম হয়ে যেত বুকটা আমার। দ্বিগুণ জোরে কোল টা আঁকড়ে ধরতাম আমি। আমার অসীম সাহসী দাদাও যেন পরিস্থিতির চাপে থম মেরে যেত। আমি শুয়ে থাকতাম কোলে মুখ টা গুঁজে। ভয়ে কাঁপতাম থরথর করে। ঠিক তখনি হয়ত পরের গান টা শুরু হতো আর মুহুর্তেই পরিস্থিতিটা ও বদলে যেত।
মা গজগজ করতো, “ ছেলে, আর ভয় পায় দেখো?, মেয়েরাও তোকে দেখে লজ্জা পাবে লালটু!
হ্যাঁ লজ্জা আমি পেতাম সত্যি কথাই, কিন্তু বিশ্বাস করুন ঠিক তার আগের ক্ষণের পরিস্থিতি তে , ওই নিস্তব্ধতা আর সেই নিস্তব্ধতা কে চিরে শেয়ালের করুন কান্না, হয়ত গানের ঘরে থাকা সাহসী পুরুষ গুলো কেও স্তব্ধ করে দিত কয়েক লহমার জন্য। বেশী সময় লাগত না ওই ভারী ভাব টা কাটতে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই আমার চোখ বুজে আসতো ঘুমে , আর গানের ঘর থেকে ভেসে আসত জেঠুর গান “কোনদিন বলাকারা অতো দূরে যেত কী, ঐ আকাশ না ডাকলে”।
কাজেই একটা জিনিস অনেকদিন আগে থেকেই বুঝেছিলাম ভয় পাওয়া বা না পাওয়া টা নির্ভর করে, পরিস্থিতি এবং জানার আর আপনি কতটা কল্পনা প্রবণ তার উপরে। যেমন , একটা বাচ্চা ছেলে যে এখনো নিজের চোখে দুনিয়া দেখতে শেখে নি, সে কি ভয় পাবে যদি সে দেখে, আরেক টি কিশোরী মেয়ে ওর সাথে জানালায় দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গি করে খেলছে? সে ভয় পাবে না। কিন্তু ভয় টা আপনি পাবেন যখন আপনি এই ব্যাপার টি দেখবেন। কারণ আপনি জানেন এটা আট তলা। কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব না জানালার বাইরে থেকে কথা বলা। আট তলায় জানালার বাইরে একটা বাচ্চা কে দেখে আপনার ছেলে বা মেয়ে খেলছে এটা পড়েই আপনারা আঁতকে উঠেছেন এতে আমি নিশ্চিত। কাজেই আপনার ছেলে বা মেয়ে হয়ত খুশী হয়ে কথা বলছে কিন্তু আমি নিশ্চিত যে , আপনি ব্যাপার টা তে খুশী হতে পারবেন না। কাজেই জানেন বলে আপনি ভয় টা পেলেন। কিন্তু আপনার ছেলে বা মেয়ে পায় নি , কারণ ভয় পেতে গেলেও যত টুকু ইনফর্মেশন দরকার সেটা তার মধ্যে নেই।
একী রকম ভাবে, পরিস্থিতি ও দায়ী থাকে ভয় পেতে বা পাওয়াতে গেলে। যেমন কোন জায়গার মাহাত্ব্য না জেনে আপনি সেই জায়গা রাত বিরেত , অমাবস্যা- পূর্ণিমা, শনি- মঙ্গল, নির্বিশেষে যাতায়াত করতে পারবেন। কিন্তু জেনে গেলেন যে ওই বিশেষ জায়গা , অমুক তিথিতে , বিশেষ ভাবে , উপ-অপ-বা অধি দেবতা দ্বারা প্রভোকড হয়। তাহলে আমি শিওর যে আপনার বুক কাঁপবে ওই জায়গা দিয়ে ওই বিশেষ তিথি তে যেতে।
একটা ঘটনা বলছি এই ব্যাপারে। এখানে অনেকেই গ্রামে বেড়ে উঠেছেন । একরকম খেলা আসত গ্রামে। মাদারী বলতাম আমরা। একটা লোক আর একটা বাচ্চা।বাচ্চা টা মেয়েই থাকত বেশী। ভীষণ রোগা আর কালো। কেমন যেন মায়াময় মুখটা হতো বাচ্চাটার। অনেক রকম খেলা ওরা দেখাতো। দুটো খুঁটি পুঁতে , মাঝে একটা রশি বেঁধে দিত। একটা বাচ্চা ছেলে বা মেয়ে, বড় বাঁশ হাতে নিয়ে ওই দড়ির উপরে চলতো। ছোট ছোট ম্যাজিক ও দেখাতো। ঘড়ি বা টাকা গায়েব করে দিয়ে, অন্যের পকেট থেকে বের করা বা কাঁচা ডিম রেখে মন্ত্র বলে সিদ্দ ডিম করে দেওয়া। তখন ম্যাজিক গুলো দেখে খুব ই অবাক হতাম, ভালো লাগত খুব। আমি আর দাদা বাড়িতে এসে ওদের ম্যাজিকের বর্ননা, মা কে , মেজমা কে বা ঠাকুমা কে , গোল গোল চোখ করে বলে দুটো আলু বা সের টাক চাল বাগাতাম ওই ম্যাজিক বালা কে দেব বলে।
যদি আমদানী ভালো হতো তবে এই সবের শেষে একটা চমক থাকত। একটা অদ্ভুত খেলা হতো। বাচ্চা টাকে একটা ময়লার তস্য ময়লা চাদরে ঢেকে দিত। আর একটা প্রায় ভোঁতা ছুরি চালাত আমাপা ওই চাদরের উপর দিয়ে বাচ্চাটার গায়ে। হয়ত ওটা ম্যাজিক ই ছিল। কিন্তু ছোরার গায়ে রক্তের দাগ দেখে আমি আঁতকে উঠতাম। কেমন একটা মন কেমন করা গ্রীষ্মের দুপুরে এই খেলাটা চলার সময়ে বুক টা কেঁপে উঠত আমার। রক্তের সোঁদা গন্ধ টা যেন পেতাম আমি। সব শেষে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে গলা টা কাটত সেই লোকটা বাচ্চাটার। পুরো ব্যাপারটাই করত সেই ময়লা চাদরের উপির দিয়ে। ভয়ে চোখ বুজে ফেলতাম আমি। দাদার পিছনে সেঁধিয়ে যেতাম। কুঁকড়ে যেতাম ভয়ে। জানিনা কি করে দেখাতো, কিন্তু চাদর তুলে দেখালে দেখতাম গলা টা কেটে ফেলেছে একেবারে। বিশ্বাস করবেন না আপনারা, পুরো জমায়েত টা স্তব্ধ হয়ে যেত। পিনড্রপ সাইলেন্স যাকে বলে। ঠিক কিছু পরেই দুবার হাততালি তে বাচ্চা মেয়েটা যখন চাদর সরিয়ে উঠে বসত তখন যেন আমাদের ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ত। বাচ্চা টা ঠিকঠাক আছে দেখে, যেন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত আমার মধ্যে। হাততালি দিয়ে লাফিয়ে উঠতাম। পুরো জমায়েত টাও হাততালি দিত। ওরা চাল, আলু আর যা পয়সা পেত , সেটা নিয়ে পোঁটলা বেঁধে চলে যেত অন্য গ্রামে। আমি বার বার ঘাড় ঘুড়িয়ে বাচ্চা টা কে দেখতাম। মন টা ভয়ানক খারাপ লাগতো। জানিনা ওই বয়সে ওই টুকু একটা বাচ্চার উপরে হওয়া অত্যাচার সহ্য করতে পারতাম না নাকি ওই কাটাকুটির কারণে আমার মনে কোন ইফেক্ট পড়ত বলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম আজও বুঝিনি।
যাই হোক, রাতে প্রায় ই ওই গলাকাটা দেখে আমি ককিয়ে কেঁদে উঠতাম “ গলাকাটা গলাকাটা “ বলে । জড়িয়ে ধরতাম আমি মা কে। বাবাও উঠে পড়ত ঘুম থেকে। আমাকে খেলাটা দেখাতে নিয়ে যাবার জন্য আমার দাদার উদ্দেশ্যে মায়ের বকাবকির মাঝেই বাবার অভয় বানী শুনতাম, “ বোকা ওটা কি সত্যি নাকি, ও তো ম্যাজিক”।
কিন্তু কেন জানিনা ব্যাপার টা আমার কোনদিনেই স্বাভাবিক মনে হয় নি। ভয় টা হয়ত আজকেও কাটেনি আমার। লিখতে লিখতেও আমার সেই বাচ্চাটার খুব আবছা মুখ টা ভেসেই উঠছে।বাবা ও দেখেছিলেন বা দেখতেন ওই ম্যাজিক। হয়ত ওই খেলা টা কে নিছক খেলা হিসাবেই নিতেন। আমি হয়ত কল্পনা প্রবণ অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলতাম এবং ভয় পেতাম। বাবার মুখে শুনেছি যে বাবা নাকি একবার ওই বাচ্চা টির জায়গা তে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু গ্রামের জমায়েতের আপত্তি তে সেটা সম্ভব হয় নি। আমি কোনকালেই বাবার মতন সাহসী ছিলাম না সেটা বলাই বাহুল্য। তাই ওই সব আজগুবি স্বপ্ন থেকে মা বাবা কে জ্বালিয়েছি অনেকদিন। আমার ক্ষেত্রে এই খেলা টা যেমন সিরিয়াস রূপ নিয়েছিল, আমার বাবার ক্ষেত্রে ছোট বেলায় দেখা এই ঘটনা নিছক একটা খেলাই ছিল মাত্র। হয়ত এই ব্যাপার টা, বাবার একটি দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাবার জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল।
আসলে, আমি ঘটনা বলতেই এই লেখার অবতারণা করেছি। কিন্তু মনে হলো, যারা সত্যিকারের উপলব্ধি করেছে ভৌতিক বা আধিভৌতিক ব্যাপার, তাদের কাছে পুরো ঘটনা টা হয়ত দশ সেকেন্ড কি তার ও কমে শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু তারা যে পরিস্থিতি তে ভয় পেয়েছিল সেটা ইম্পর্ট্যান্ট এবং সেটাই সেই ঘটনার আসল গেম চেঞ্জার। প্রকৃত পক্ষে আমি এমন অনেক মানুষ জানি, যারা নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছেন এই ভৌতিক ব্যাপার। তাদের মধ্যে একজন হলেন আমার বাবা। সত্যি বলতে আমি আমার বাবার মতন অসীম সাহসী মানুষ দেখিনি। এমনি জীবন যুদ্ধে বেশ ভীতু। সেখানে হয়ত আমাকেই সাহস যোগাতে হয় বাবা কে এখন, কিন্তু ওই ভৌতিক ব্যাপারে বাবার সাহসের কোন তুলনা নেই বললেই চলে। আমি দেখেছি এই সব ক্ষেত্রে মানুষ হার্টফেল না করলে , ক্ষতিগ্রস্ত হবার আশঙ্কা নেই চলে। কারণ এইসব ক্ষেত্রে আমি যত সত্যি ঘটনা শুনেছি বা উপলব্ধি করেছি তাতে বুঝেছি, এনাদের যাওয়া বা আসার রাস্তায় উপস্থিত হয়ে গেছে ভিক্টিম রা, বাধ্য হয়ে বা না জেনে। কেউ পালিয়ে গেছে , বা কেউ ভয়ে হার্টফেল করেছে। কিন্তু প্রত্যেক ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ ভাবে কোন ক্ষতি করার প্রচেষ্টা করেনি কোন উপ-অপ-অধি দেবতা।
এবারে একটা ঘটনায় আসি, বাবা তখন সাত বছর আর আমার জেঠু দশ।ঘটনা টা আমার জেঠু এবং বাবা দুজনের মুখেই শুনেছি আলাদা আলাদা করে। দুজনের ভার্সন একটু আলাদা হলেও আসল ব্যাপার টা মোটামুটি এক ই। সময় টা ছিল ফাল্গুন বা চৈত্র। শিওর নই কারণ দোলযাত্রার সময় কার ঘটনা। আমাদের গ্রামে দুটো দোল উৎসব হয়। এখনো হয়। রাজ দোল আর পঞ্চম দোল। পূর্ণিমার দিনে রাজদোল হয়। গৌর নিতাই এর দোল। খুব ধুমধাম হয় বলার অপেক্ষা রাখে না। সন্ধ্যে বেলায় গৌর নিতাই বের হন পালকী করে। গ্রাম ঘোরেন ভক্তের কাঁধে চেপে। প্রভূত আবির খেলা হয়। ছোট বেলায় আমরাও ঘুরেছি সাথে সাথে। বাবাদের সময়ে মানে আজ থেকে ৬০ বছর আগে এই সব উৎসব অনেক অনেক ইন্টেন্সিটি তে হত। কারণ এন্টারটেইন বলতে তো এই সব উৎসব ই ছিল। পুরো উৎসব টা রাতেই হত। মানে সন্ধ্যে বেলায় ঠাকুর বেড়িয়ে , ফের মন্দিরে ঘুমোতেন রাত দেড়টা দুটো নাগাদ। তারপরে যে যার বাড়ি ফিরে যেত।
এই রকম ই রাজদোলের রাতে , উৎসব , আবির খেলা শেষে বাবা আর জ্যাঠা ফিরছিলেন গলির রাস্তা ধরে আমাদের বাড়িতে। পুর্ণিমা, স্বভাবতই ফুটফুটে জ্যোৎস্না। গ্রামে ইলেক্ট্রিসিটি ছিল না। কাজেই চাঁদের আলোর জোয়ার চারিদিকে। উৎসব প্রাঙ্গণে হ্যাজাক এর আলো নিভে যাবার পরে, আলোর সাথে প্রকৃতির লুকোচুরি খেলা যেন সবাই কে জানান দিয়েই হচ্ছে। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, আর গাছ গুল্মের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলোর লুকোচুরিতে রাস্তা চিনে নেওয়া কঠিন কিছু হচ্ছে না। দুটো ছোট ছেলে সেই রকম অলি গলি ধরে আলোআঁধারি পরিবেশে নিজের বাড়ি ফিরছে। বসন্তের মাঝামাঝি, কাজেই হিম এখনো ছেড়ে কথা কইছে না। উৎসবের মেজাজে বুঝতে না পারা গেলেও, এখন কেমন একটা মন কেমন করা না ঠাণ্ডা না গরম হাওয়া বইছে । ছেলে দুটোর অস্বস্তি বোঝা যাচ্ছে ঠাণ্ডায়, হাত দুটো কে বগলের তলায় চালান করে দিয়ে, মেন রাস্তা না ধরে বাড়ির পিছনের গলির রাস্তা ধরল তারা। ওরা বুঝল যে একটু দেরী করে ফেলেছে। যে পাড়া দিয়ে ফিরছিল দুজনে সেই পাড়ার লোকজন দোরে খিল দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সত্যি করেই, উৎসব শেষে খাওয়া দাওয়া করে ফিরতে দেরী হলো বৈকী।
- এই তো, আর একটু। চল তাড়াতাড়ি, মা চিন্তা করবে।
- এই দিকে না এলেই হত, আমাদের সদর দিয়ে ঘুরে গেলে ঠিক হতো রে।
মেজ দাদার কথায় ছোট টা একটু চঞ্চল হলো। “ নাহ এদিকেই চল, এক ছুটে পেরিয়ে যাব”।
ওই গলি দিয়ে না যাবার বা ছুটে পেরিয়ে যাবার কথা চিন্তা করার পিছনে অনেক কারণ আছে। গলি টা বেশ সরু এবং মোটামুটি পঞ্চাশ মিটার লম্বা গলি টা আপাদমস্তক অন্ধকার। চওড়া ফুট দুয়েক খুব বেশী হলে। বাড়ি গুলোর পিছন দিকের গলি। গলির ঠিক কোনায় যেখানে আমাদের বাড়ি বাঁক নিচ্ছে , সেই কোন দিয়ে একটা বড় পুকুরের রাস্তা নেমে যাচ্ছে। তিনটে বাড়ির পিছন দিক সেটা। ঠিক জাঙ্কশনেই ছিল সেই পুকুরে যাবার রাস্তা। প্রায় বিশ মিটার , আগাছায় পূর্ণ, সেই রাস্তা নেমে গেছে পুকুরে। ঘাট ছিল পরিষ্কার। কারণ গৃহস্থ্য বাসন পত্র মাজা এবং মহিলাদের স্নান করার জায়গা ছিল সেই ঘাটে। ওই নেমে যাওয়া রাস্তার ঠিক মাঝে ডান দিকে একটা বিশাল বট গাছ ছিল। এখনো আছে। আর বাম দিকে ছিল কুড়ি পঁচিশ গাছা বাঁশের ঝাড়। স্বভাবতই দিনের বেলাতেও অন্ধকার লাগত ওই রাস্তা টা, বাঁশ এবং বট গাছের নীচু ডালপালা গুলো যেন গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সেখানে। ঘাটে যাবার রাস্তা বাঁশের পাতা এবং বটের পাতায় ভরে থাকত। ওই হেন জায়গা রাতে যেতে চোখে পড়লেই কেমন একটা অনুভূতি আসে। আমি বহুবার গেছি ওই রাস্তা দিয়ে রাতে। এমনিতেই আমি ভীতু, তারপরে ওই রাস্তা দিয়ে যাবার সময়ে কেমন একটা ভয়ের অনুভূতি আসে সেটা বলাই বাহুল্য। বিশেষ করে চাঁদনী রাতে। যেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখি পুকুর টা, সেখানে চাঁদের আলো থাকে, আর পুকুরে চাঁদের আলো ধপধপ করে। কিন্তু মাঝখান টা নিরেট আঁধার। চাঁদের আলোর এই মজা। হয় দেখা যাবে না হলে কিচ্ছু দেখা যাবে না। শুধু সাদা আর কালো। মাঝে কিছুই নেই। কিচ্ছু দেখা যায় না। শুধু আওয়াজ পাওয়া যায় সেই খানে থাকা প্রাণীদের। হয়, হাওয়ায় শুকনো পাতা ওড়ার মৃদু খসখস আওয়াজ বা ছোট কোন প্রাণীর চলে যাবার সরসর শব্দ, বা আঁধারে বট গাছে বাসা বেঁধে রাত্রিবাস করা অসংখ্য পাখীর সহসা ঘুম ভেঙ্গে কান্নার আওয়াজ।অথবা অপ্রাকৃতিক রকম অসীম নীরবতা। পুকুরের জলে সহসা টোল খাওয়ার পরে ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ গুলোর পাড়ের দিকে গুটি গুটি করে আসতে দেখার সময়ে ওই নীরবতায় বুক টা কেমন দুরদুর করে। সহসা কিছু হবার আশঙ্কায় মন টা কেমন হয়ে যায়। না পারি পালাতে না পারি দাঁড়িয়ে থাকতে। কেমন একটা অজানা টান। না চাইলেই হয় পুকুর পানে। কিন্তু শত ভয়ের মাঝেও কিন্তু চোখ চলে যেত ওই দিকে। এটা শুধু আমার না , ঐ পাড়ায় থাকা সব কচি কাঁচা, বুড়ো হাবড়া, যুবক যুবতী সবার ই হয় এটা আমি জেনেছি।
ছুটে পেরিয়ে যাবার সময়ে ছোট ছেলেটা টা ছিল পিছনে। বড় ছেলেটা টা ওই জায়গা টা পেরিয়ে গেলেও ছোট টা যেন আটকে গেলো। দোলের রাতে চাঁদের আলোর দাপাদাপি তো ছিলই। ছোট ছেলেটি দেখতে পেল , আঁধার পেরিয়ে ঘাটে কেউ একজন জলে রয়েছে। হতে পারে গা ধুচ্ছে। বা হতে পারে বাহ্যকর্ম করে শৌচে গেছে।
- দাদা দাঁড়া একবার মনে হচ্ছে, মুকুজ্যে ঠাকমা ঘাটে গেছে, বুড়ি রাতকানা, আমি দিয়ে আসি বাড়িতে।
দাদার কাছে ব্যাপার টা ভালো মনে হয় নি। কারণ একটু বয়েস বেশির জন্য, বা অনেক কিছু জেনেছে বা শুনেছে মায়ের কাছ থেকে। কাঁপা গলায় বলল
- না তুই নীচে যাবি না, আগে উঠে আসতে দে, দ্যাখ কে তারপরে যাবি। অনেক রাত এখন। মুকুজ্যে ঠাকমা এতো রাতে পুকুরে যাবে না। আর আজকে ঠাণ্ডা আছে বেশ। গা ধুতে কেনই বা যাবে।
- আরে না রে ঠাকমাই ওটা, দেখছিস না , ঠিক করে ঘাটের সিঁড়ি খুঁজে পাচ্ছে না। আমি যাই তুই এখানে থাক।
দাদার মনে সন্দেহ এসেইছিল যে ভাই মনে হয় নেমে যাবে। হাত টা ধরে ফেলেছিল দাদা।
- না তুই যাবি না , আগে আসতে দে উঠে।
ততক্ষণে যে ছিল ঘাটে, সে উপরে উঠে আসতে শুরু করেছে। মাঝের নিরেট অন্ধকার টা আর অতো টা নিরেট লাগছে না। কেউ যে উঠে আসছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে এখন। আর যে আসছে , সে যেন কিছু খুঁজতে খুঁজতে আসছে। কারণ অন্ধজনে যে ভাবে দুটো হাত সামনে ইতস্তত খুঁজতে খুঁজতে আসে, কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে যাবার আশঙ্কায়, ঠিক সেই ভাবেই আসছে সে।
- ওই দ্যাখ ঠাকমাই হবে। রাত কানা, দেখতে পাচ্ছে না। তাই ওমনি করে আসছে।
- নাআ, তুই দাঁড়া, যাবি না।
সেই অবধি যে ঘাট থেকে উঠে আসছিল সে আরো অনেক টা কাছে চলে এসেছে। এবারে যেন হাত সঞ্চালনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। আর হয়ত ফুট দশেক দূরে। এদিকে দু ভাইয়ের মধ্যে দড়ি টানাটানির খেলা চলছে। ছোট টা যাবেই আর বড় টা যেতে দেবে না। এইরকম দড়ি টানাটানির মাঝেই অন্ধকার হাতড়ে আরো কাছে চলে এসেছে সে ছেলেদুটির কাছে। মনে হয় ছোট টা তখন কিছু আন্দাজ করে দাদার টানের জোর কে পাত্তা দিয়ে পিছিয়েই এলো দাদার কাছে। ততক্ষণে ফুটফুটে চাঁদের আলোতে চলে এসেছে সেই অন্ধকার হাতড়ে আসতে থাকা মানুষ টা।
দুটো হাত দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে যখন সে আলোয় দৃশ্যমান হলো তখন দেখা গেল মাথা হীন একটি মহিলা যেন হাতড়ে হাতড়ে এসেছে ঘাট থেকে উঠে।
ছোট ছেলেটি মানে আমার বাবা তখন দেখে সত্যি বলতে কিছুই বুঝতে পারে নি। একমাত্র গ্রামে সেই ম্যাজিক-বালাই গলাকাটা ম্যাজিক দেখাত। বড় ছেলে টি মানে আমার মেজ জেঠু কিন্তু বুঝেছিলেন , এটা কি আর একে কি বলে। ভয়ে কথা না বলতে পারলেও ভাই কে টেনে বাড়ির দিকে নিয়ে যাবার প্রাণপণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ যায় নি। কিন্তু আমার বাবা সামান্য ভয় ও সেদিন পায় নি কারণ ওই জিনিস টা বাবার কাছে ম্যাজিক ছাড়া কিছুই মনে হয় নি। উত্তেজনায়, ম্যাজিক ম্যাজিক বলতে বলতে খিড়কী দোর দিয়ে এক দৌড়ে বাবা আর জেঠু বাড়িতে চলে এসেছিলো। প্রানে বেঁচে গেলেও, নাকি জ্বর জ্বালায় ভুগিয়েছিল বাবা জেঠু কে কিছুদিন।
বাবা না হয় জানতেন না ওই ছোটবেলায় এই ব্যাপার টা। কিন্তু আমি জানতাম অনেক ছোট থেকেই। সেই জন্য খুব ভয় পেতাম ওই জায়গা টা। শুনেছি ওই জিনিস টার নাম স্কন্ধকাটা। আমরা বলতাম কন্ধকাটা। বা কান কাটারীর মা। মানে ছোট বেলায়, ওই বলেই আমার দুর্দমনীয়তা কে বশে আনা হতো। শুনেছি, অনেকেই ওই জিনিস টা দেখেছে। একটা আসা যাওয়ার রাস্তা ছিল ওই জিনিস টার। আমাদের বাড়ি টা কে দুদিক থেকে ঘুরে, সামনের বড় রাস্তা হয়ে বারোয়ারী তলা দিয়ে সে চলে যেত জমিদার বাড়ি অব্দি। এই জিনিস টা কে দেখেছে আর ও অনেকে। ওই মেইন রাস্তার ধারে আমাদের খামার বাড়ি ছিল। খামার বাড়ির পাশেই ছিল আমাদের গোয়াল ঘরে। আর তার সামনেই ছিল আমাদের সারা বছর কাজ করার মুনিষের ঘর। ও ওখানে বউ,ছেলে, মেয়ে, জামাই, নাতি নিয়ে থাকত। খুব ছোট তখন আমি, একদিন সকালে দেখি, বাবা আর জেঠু ফিরল বাড়িতে। এতো সকালে কোথা থেকে ফিরল, জানতে চাইতেই শুনলাম, যে ওরা ডাক্তার খানা থেকে ফিরছে। কেন প্রশ্ন করতেই জানলাম, ওই মুনিষ কে সকালে অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া গেছে খামার বাড়িতে। রাতে, বাথরুম করতে উঠে , কিছু দেখে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যায় সে। ভোর বেলায় কেউ দেখার পরে , সবাই কে ডাকাডাকি করে তুলে তাকে ডাক্তার খানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। বাবা আর জেঠু তখন ফিরল ডাক্তার খানা থেকে। পরে যখন আর একটু বড় হই , জেনেছিলাম যে এই জিনিসটা অনেকেই দেখেছে, আর ওই এক ই রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় দেখেছে। ওই রাস্তা দিয়ে এখনো আমরা যাই রাতে, অনেক সময়ে গভীর রাতেও। ভয় ও করে কিন্তু এখন আর দেখা যায় না বলেই শুনেছি।
যে সুত্রে এই ঘটনার অবতারণা, যে ঠিকঠাক না জানা থাকলে অনেক ভয়ের ব্যাপার ও ভয়ের লাগে না। আর আমার বাবার ক্ষেত্রে, এই ঘটনা ছিল একটা প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সেদিন যদি বাবা জানত ওটা কি , তবে আমি খুব নিশ্চিত যে বাবা ভয় পেত আর সেটা কিছু ভাল ব্যাপার হতো না।
আসলে আমি দেখেছি যে, ভয় জিনিস টা একটু অদ্ভুত। আমরা ভয় পাই কি হবে সেটা ভেবে। ঘটনা কে সে ভাবে ভয় পাই বলে মনে হয় না। আর ভয় ব্যাপার টা একমেবদ্বিতীয়ম, সেটা হলো ভয়। সে যে কারণেই হোক না কেন। যেমন একটু খুলেই বলি। ধরা যাক, আমি একটা পুকুরে নামব স্নান করতে বা কোন কাজে। স্নান ছাড়াও অনেক কাজ থাকে, যেমন দিদা বলল, “ বাবা পুকুরে মাজার জন্য একটা বড় পেতলের হাঁড়ি রেখেছিলাম, চলে গেছে জলের তলায়, একটু এনে দিবি?”
আমি সাঁতারে বেশ পটু। অনেক রকম সাতার জানি। দম ও ভালো ধরি। কিন্তু ঐ পুকুর টাতে নামতে আমার ভয় করে। কারণ আমার কালো টলটলে জল দেখলেই কেমন বুক টা আঁতকে ওঠে। কনফিডেন্স টার বারোটা বেজে তেরো টা হয়ে যায়। আমি জানি এর থেকে অনেক স্রোতস্বিনী নদী আমি হেলায় সাঁতরে পেরিয়ে যেতে পারি, কিন্তু ওই পুকুরে? নৈব নৈব চ। ভয় করে একটা। কল্পনা প্রবণ মনের এই গুলো সমস্যা। মনে কল্পনায় কল্পিত হয় , কোন কল্পিত জলজ অপদেবতা যদি কালো জলে লুকিয়ে থাকে? আমি জানি ওই জলে সাঁতার রত অবস্থায় যদি কোন কাঁটা গাছে আমার গামছা বা বারমুডা আটকে যায় তাহলে হয়ত আমি ভয়ে জ্ঞান হারাবো। এসব ই ছোট বেলায় শোনা অনেক গল্পের খলনায়ক আর খলনায়িকাদের জন্য মনের কোন অতলে লুকিয়ে থাকা ভয়ের বাহ্যিক প্রকাশ। এটা এইবয়সেও হয়। মানে এখানে জানা বা অজানা বা পরিস্থিতি কোনটাই দায়ী নয়। দায়ী হলো আমার কল্পনা প্রবণতা । অথচ আমি দামোদরের পাশে থাকা ছেলে। সত্যি বলছি বন্ধুর গ্রামে গিয়ে অনেক দাপিয়েছি দামোদরে। ভয় করে নি। বা পরিষ্কার জলের পুকুরেও কোন ভয় করে না আমার। গঙ্গা তে নেমেও সাঁতরে এসেছি, অনেক শক্তিক্ষয় হয়েছে, কিন্তু এই ভয় টা করে নি। কেউ যদি ওই কালো জলের পুকুর টা কে মন্ত্রবলে পরিষ্কার করে দেয় তবে আমি তক্ষুনি ডুব দেব আনন্দে। আমি দেখেছি ভয় টা আমার ওই কালোর ওপারে আদৌ কিছু আছে নাকি সেটা নিয়ে। কি আছে জেনে গেলে তো ভয় বলে কিছু থাকে না। তখন একশন হয়। হয় পালাব না হলে লড়ব। নিজের নিজের ব্যাপার সেটা। ভয় সেটাই যেটাতে আমাদের মন অজানা কিছুর আশঙ্কা করে।
সত্যি বলতে কি ,আমার ভুতে ভীষণ ভয়। আমার বউ এর সেসবে কোন ভয় নেই। ভুত অপদেবতাতে একদম ই ভয় নেই। ও আবার মানুষে ভয় পায় খুব। যেটাতে আবার আমার কোন ভয় নেই। অদ্ভুত না? হ্যাঁ, আমি ভেবে দেখলাম, যার যেটাতে কনফিডেন্স , সে সেটা তে কেন ভয় পাবে? আমি প্রায় ৬ ফুট একটা মানুষ। যথেষ্ট ভাল শরীর এবং শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী। আমার মনে এই কনফিডেন্স আছে যে মানুষের পক্ষে আমাকে আক্রমণ করতে গেলেও ভাবতে হবে অনেকবার। আমার এই চিন্তা ভাবনা ঠিক না ভুল সেই প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। কিন্তু এই কনফিডেন্স টা আমার আছে। তাই আমার মানুষে ভয় লাগে না। বউ এর হয়ত ভুত নিয়ে সিমিলার রকম কোন কনফিডেন্স থাকবে। জিজ্ঞাসা করিনি কোন দিন। জানি কোন প্রপার উত্তর পাব না তাই। কারণ যেকোন লজিকের কাউন্টার লজিক থাকেই। এই দুজনের যেদিন নিজের নিজের কনফিডেন্স এ আঘাত লাগবে হয়ত আমাদের চিন্তা ধারা এবং ভয়ের চেহারা টা বদলে যাবে। আমি বউ কে অনেক গল্প পড়ে শুনিয়েছি ভুতভুতুম থেকে। “ওরে বাবারে”, “কি সাঙ্ঘাতিক”, “ বাপরে কি ভয়ানক” গোছের মন্তব্য করলেও, ভয় পাবার দৌড় ওই গল্প অব্দি থাকে ওর। গল্প শেষ হলে ওর ও ঘুম পেয়ে যায়। বরং আমার আর ছেলের সেই গল্প গুলোর রেশ থাকে অনেক দিন অব্দি। সেটা আমি পরতে-পরতে বুঝি। আর বুঝি আমি আর আমার ছেলে দুজনেই ভয়ঙ্কর রকমের কল্পনা প্রবণ। আর সেটা ভাল মন্দ দুই ক্ষেত্রেই। তাই এটা বুঝেছি ভয়ের আরেক টা কারণ হলো কল্পনা। আর সেই কল্পনা আমার/ আপনার নেক্সট ভয় পাবার ক্ষেত্র টা ভালো রকম প্রস্তুত করে রেখেছে এটা আপনি নিশ্চিত করে ধরে রাখবেন।
সমাপ্ত