Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
ফুলশয্যা
সুধা জানে, আমি মরে ভূত হয়ে আমার ঘরের ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছি। সে আজকের কথা নয়, আজ থেকে ছ'মাস আগের ব্যাপার। অফিস থেকে আসবার সময় ভিড়ে ভর্তি বাঘমার্কা বাসে ছুটে উঠতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম। পিছনের চাকাটা আমার মাথাটাকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলো। পকেটে আইডেন্টিটি কার্ড না থাকলে, লোকে বেওয়ারিশ লাশ বলে মর্গে চালান দিতো। কিন্তু তা হয়নি। রাত বারোটার সময় যখন থানার পুলিশ এসে সুধাকে খবর দিলো, তখন সুধা কাটা কলাগাছের মত লুটিয়ে পড়ল।
আমি ঘুলঘুলি থেকে সুধাকে লক্ষ্য করছিলাম আর তাজ্জব বনে যাচ্ছিলাম। আমার স্ত্রী শ্রীমতি সুধারানী দেবী যে আমাকে এতখানি ভালবাসেন, তা কে জানতো! তাহলে কোন শালা মঞ্জু অধিকারীর খপ্পরে পড়ে, ছুটে বাসে উঠতে যায়।
সেদিন সকালেও অফিস থেকে বের হবার সময় সুধা প্রিয় সম্ভাষণ করে দারুণ ঝাঁঝালো গলায় তড়পে উঠেছিলো, আজ সন্ধ্যের মধ্যে না ফিরলে, তোমার একদিন কি আমার একদিন। ছুটি হয় সেই পাঁচটায়, আর বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ন'টা বাজে। জানি না সেই হাড়-হাভাতে টাইপিস্ট ছুঁড়িটাই তোমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে কিনা। আজ এ সিনেমা, কাল ও রেস্টুরেন্ট। বাড়িতে বিয়ে করা বউ একলা এঁদো ঘরে খাবি খাচ্ছে আর উনি কিনা একটা উটমুখো মেয়ের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লজ্জা করেনা, কী বেহায়া মানুষ বাবা!
সুধাকে দোষ দেব না। সুধা মিথ্যে বলেনি। তবে বলার ডিগ্রিটার চাপান অনেক বেশি হয়ে গিয়েছে। মঞ্জুর চেহারায় একটা আলগা চটক আছে। ছুটির সময় মঞ্জু যখন তার রঙকরা চোখের পালক নাচিয়ে, গালে টোল ফেলে, ঠোঁটে হাসির ঝিলিক তুলে সুরেলা গলায় মিষ্টি করে ডেকে উঠতো, "দেবুদা এক মিনিট!" তখন আমার মনের রাশ আলগা হয়ে যেত। সেই একমিনিটটা যে কোথা দিয়ে দু-তিন ঘন্টা হয়ে যেত, তা ভাবনার বিষয়। অবশ্য তার জন্য আমার কিছু রেস্ত খসত। কিন্তু তার জন্য পরোয়া কে করে। হু কেয়ারস্!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
সুধা আঁচ করেছে ঠিকই। এটাও ধরে ফেলল। একদিন মাইনে তুলতে গিয়েছি, যামিনীদা আমাকে চমকে দিলেন। বললেন, দেবু মিত্তির তোমার মাইনে তো তুমি তুলতে পারবে না। আমি খেপে গিয়ে বললাম, আমার মাইনে আমি তুলবো না, তো কি আপনি তুলবেন? জেনে রাখবেন, আমি আসলি কায়েত বাচ্চা, শুধু ফোঁস করি না, দরকার হলে কামড়াইও। যামিনীদা বললেন, তাহলে তুমি ঘরে গিয়ে তোমার মিসেসকে কামড়াও হে। তিনি একটা আর্জি পেশ করেছেন। আমাদের সদাশয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর সেটি পড়ে তোমার সংসারে সুখ, শান্তি, প্রেম বজায় রাখতে আমাকে হুকুম দিয়েছেন যে, তোমার মাইনে তুলতে গেলে শ্রীমতি সুধারানী মিত্তিরের উপস্থিতি একান্ত প্রার্থনীয়।
সেদিন রাত্রে বাড়িতে তুলকালাম হয়ে গেল। ফাটাফাটিটা শেষ অবধি হাতাহাতিতে গড়াল না। দুজনেই কিছু না খেয়ে দু'দিকের পাশবালিশ আঁকড়ে শুয়ে পড়লাম। দুজনের গায়ের গন্ধ না শুঁকলে যে ঘুম হয়না, সেকথা সেদিন আর কারও মনে ছিল না।
অফিসে ইজ্জত বলে একটা কথা আছে, সেটা চলে গেল। সেই সঙ্গে মঞ্জু। মঞ্জু যদি কাছে আসত, বলত, দেবুদা এর জন্য আমিই দায়ী, আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন, তাহলে আমি হয়তো বাঁচতাম। কিন্তু সেদিনের সেই দুর্ঘটনার পর থেকে মঞ্জু আমাকে একেবারে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে হাল-আমলের ছোকরা আর্টিস্ট নিরুপম জোয়ারদারের কাঁধে ঝুলে পড়ল। আমার সেকশনের ছেলেছোকরারা আমাকে দেখে মুখ টিপে টিপে হাসত। শালা অজয় দাশগুপ্ত তো একদিন বলেই বসল, আর টাইপ করবে মাল! না, কি-বোর্ডে আঙুল রাখতে দিচ্ছে না অধিকারী।
মনটা বড় খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। ঘরে সুধার সঙ্গে কিচাইন, বাইরে শান্তি নেই। তার ওপর কাজের চাপে দম নিকলে যাবার যোগাড়। একদিন ছুটির পর সন্ধের মুখে মঞ্জু আর নিরুপমকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাসে উঠতে দেখে খেপে গেলাম। মনে হল, ওদের দুজনের একটাকে আজ নিকেশ করে দেব। কিন্তু কে জানত, যমরাজ তাঁর যমদূতকে আমার পেছনেই লাগিয়ে রেখেছেন। আমি লাফিয়ে বাসে উঠতে গিয়ে উঠতে পারলাম না। পেছনের চাকা আমার মাথাটা শ্লেটের মত থেবড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি মরে ভূত হয়ে গেলাম।
তিনদিন বাদে আমাদের অফিসের যামিনীদাকে দেখে সুধা ফুঁপিয়ে উঠল, যামিনীবাবু ওর এ মাসের মাইনে? পেনশন, গ্রাচুইটি?
যামিনীদা বললেন, হবে, হবে। আপনাকে নমিনি করা আছে, ভাবনা কি। তবে বুঝতেই পারছেন, একটু দেরি লাগবে।
সুধা চোখ মুছতে মুছতে বলল, তাহলে আমার কী করে চলবে যামিনীবাবু?
সে কথাই ভাবছি। যামিনীদা ভাবনার মুখ করে বললেন, আচ্ছা, আপনি কি গ্রাজুয়েট? গ্রাজুয়েট হলে আপনার একটা হিল্লে হয়ে যাবে। কমপ্যাশনেট গ্রাউন্ডে আপনি একটা চাকরি পেয়ে যাবেন অফিসে।
সুধা ঠোঁট ওল্টালো। গ্রাজুয়েট হলে কি ওই বাঁদরের গলায় মালা দিই যামিনীবাবু! আমার বাবা ওটা ভক্কি মেরেছিলেন।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আজ পাঁচ বছর বাদে এহেন সত্য কথা শুনে আমি পরম পুলকিত হলাম। পেট বগবগিয়ে হাসি উঠল। হাসিটা যে ফোয়ারা হয়ে যাবে কে জানত। যামিনীদা চমকে উঠে বললেন, কে হাসে!
সুধা ঘাড় কাত করে শুনছিল। চোখ ঘুরিয়ে বলল, কে আবার হাসবে, ওই আপনাদের দেবু মিত্তির। অপঘাত মৃত্যু তো! বেঁচে থাকতে আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে শান্তি হয়নি। এখন মরে জ্বালাতে এসেছে।
যামিনীদার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে এল। মুখের সামনে তুড়ি দিয়ে যামিনীদা বললেন, এবার তাহলে আসি।
সুধা বলল, আসুন। কিন্তু আমার পাওনা-গন্ডা তাড়াতাড়ি দিতে ভুলবেন না। তাহলে কিন্তু ভূতটাকে আপনার বাসায় পাঠিয়ে দেব। ওই হাসি শুনলেই চিনতে পারবেন।
আমার কেমন মজা লাগছিল। আমি আবার খোনা গলায় হেসে উঠলাম। যামিনীদা তড়াক করে লাফ মেরে, দরজার বাইরে গিয়ে বুকে ক্রশ এঁকে, মনে মনে বললেন, রাম! রাম!
বাছুরের শিঙ উঠলে গাছে ঘষে রক্তারক্তি করে। আমার নতুন শক্তি দেখে আমি নিজেই তাজ্জব। এতদিন শালা কেঁচো হয়ে ছিলাম। ঘরে সুধার ভয়, বাইরে পাঁচজনের। এখন কার পরোয়া! আমি ঘুলঘুলি থেকে লাফ মারলাম। কেউ আমাকে দেখতে পেল না। ঝড়ের বেগে ছুটে ঘরের জানলা-দরজাগুলো পটাপট দুলিয়ে দিলাম। ইচ্ছে হল বাপের আমলের আশিমনি ওই খাটটাকে একটু নাড়াই। ইচ্ছেটাকে কাজে লাগাতেই খাটটা চারপেয়ে দাঁতাল হাতির মত ঘুরে দেওয়াল-আলমারিতে গিয়ে থাক্কা খেল। ঝনঝন করে কিছু কাঁচের বাসন মেঝেয় পড়ে ভেঙে চৌচির।
সুধা ছুটে এসে ঘরে ঢুকল। কেঁদে ফোলা ফোলা চোখ-মুখ। মাথায় রুখু এলোচুল। ক'দিন তেল মাখেনি সুধা, গায়ে খড়ি উঠেছে! পরনের কোরা কাপড়টা খসখসে, বারেবারে খুলে পড়ে যাচ্ছিল। রাগে সুধার চোখ জ্বলছিল। আঁচলের দিকটা গাছকোমর করে বেঁধে নিয়ে সুধা চোখমুখ ঘুরিয়ে বলল, দেখো নিজের জ্বালায় মরে যাচ্ছি, এখন ন্যাকামি ভাল লাগে না। সারাজীবন তো অপাট করে গেলে, এখনও তাই। লজ্জা করে না! নাও, যেখানকার জিনিস, যেমন ছিল, ঠিক তেমনি করে দাও। ভাঙা কাঁচ ঝাঁট দিয়ে কুড়িয়ে ফেল। ঊনিশ-বিশ হলে তোমার বাঁদরামি আমি ঘুচিয়ে দেব।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
সুধার চোখমুখ দেখে আমার ভয় হল। বিশ্বাস নেই, কালই হয়ত রাজমিস্ত্রী ডেকে ঘরের ঘুলঘুলি গেঁথে দেবে সুধা। বেশি খেপে গেলে কলিঙ্গ হরিসংকীর্তন সমিতির লোকজন ডেকে এনে, এমন অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন শুরু করে দেবে যে, খোল-কর্তালের আওয়াজে আমাকে দেশছাড়া হতে হবে। কিম্বা ঘুঁটের জোয়াল দিয়ে ধোঁয়া দিলে আমি কি আর থাকতে পারব? সুতরাং লক্ষী ছেলের মত ঘরদোর সাফ-সুরুত করে, যেমন খাট ছিল তেমনি সাজিয়ে আবার ঘুলঘুলিতে উঠে পড়লাম। লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছিল। বেঁচে থাকতে সুধার সঙ্গে কোনদিন এঁটে উঠিনি, মরেও পারলাম না। কোন স্বামীই বা কোন স্ত্রীর কাছে জিততে পেরেছে! দুনিয়ায় আর যার কাছেই জারিজুরি খাটুক, বউয়ের কাছে কিছু খাটে না। সেখানে আমরা সবাই ঢোঁড়াসাপ।
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
দিনের বেলা আমার কিছু করার তাগদ থাকত না। শরীরটা যেন ন্যাতা হয়ে আসত, গা ঢিসঢিস। রোদের আলো ফুটলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাঙতো সন্ধেবেলা। সন্ধের পর রাত যেই একটু ঘন হত, তখন ফূর্তি দেখে কে! তখন গায়ে মত্ত হাতির বল, কী যে করব ভেবে পাই না। সাধে কি আর লোকে আমাদের ভূত বলে। এক একদিন সুধা যখন খাটে শুয়ে শুয়ে গায়ের জামা খুলে ঘামাচি মারত, তখন মনে হত লাফ মেরে সুধার পাশে গিয়ে শুই। কিন্তু সুধার যে মেজাজ, ভয়ে এগোতে সাহস হত না।
অবশ্য মেজাজ হবার কথা। আমি তো পার্থিব জীবন থেকে অকালে বিদায় নিয়েছি। আহা বেচারা, সংসারের সব ভাবনা, দায়িত্ব, একলা ভাবতে হচ্ছে। বেওয়ারিশ বিধবা দেখে, সুধার সম্পর্কের মাসি-পিসি এসে এ বাড়িতে থানা গাড়বার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সুধার কাছে খাপ খুলতে পারেনি। তিনদিনেই তাদের পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে বলেছিল, আমার ভাবনা আমি ভাবব। গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত তোমরা যদি উড়ে এসে জুড়ে বস, তাহলে তো আমাকে গলায় দড়ি দিতে হয়।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
কথাটা শুনে আমার ভালই লেগেছিল। সুধা যদি গলায় দড়ি দেয়, তাহলে আমাকেও আর একলা থাকতে হয় না। এ ঘরে চুটিয়ে দুজনে রাজ্যপাট করতে পারি। পরে ভেবে দেখলাম ওটা কথার কথা। কে আর ইচ্ছে করে সাধের জীবন ছেড়ে, ভূতের সঙ্গে ঘর করতে আসে। সুধাই যদি মরে যেত, আর আমি বেঁচে থাকতাম, তাহলে আমি কি সুধার শোকে বৈরাগী হয়ে ঘুরে বেড়াতাম, না মঞ্জুর মত কাউকে জুটিয়ে এনে দেদার ফূর্তি লোটার চেষ্টা করতাম। শালা বাঁচা মানুষের লজিকই আলাদা। ভূতের ট্র্যাজেডি কে আর বুঝতে চায়!
একদিন দেখি, সুধা আনমনা হয়ে জানলা খুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে ঘন মেঘ করছে, বিদ্যুত চমকাচ্ছিল। আমার ভয় হচ্ছিল। তেমন তোড়ে বৃষ্টি এলে, এই ঘুলঘুলিতে ভিজে একশা হয়ে যাব। আমার ছেলেবেলায় সর্দি-কাশির ধাত ছিল। ঠান্ডা লাগলে প্রায়ই জ্বরজারি হত। এখন যদি আবার জ্বর হয়, তাহলে কে দেখবে? মাথায় হাত বুলিয়ে দেবার, কি একটু ভাল কথা বলার লোক নেই। সুধাকে বললে, সুধা শুনবে কি!
আমি নিজের ভাবনা ভাবছি। ঠিক সেই সময় অস্পষ্ট আকটা ফোঁপানির শব্দ কানে এসে বাজল। আমি চমকে তাকিয়ে দেখি, সুধা আমার ফটোর সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলছে, তুমি কি বেআক্কেলে মানুষ, মরবার আর সময় পেলে না। দেখ, বাইরে কেমন অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। এমন দিনে তোমাকে পাশবালিশ না করে কোনদিন শুয়েছি! বল, এই বয়েসে একলা শুতে কার ভাল লাগে। আমার ভয় করে না বুঝি। সেরকম যদি একটা বিকট বাজ পড়ে, তাহলে ভয় পেয়ে কাকে জড়িয়ে ধরব?
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
সুধার কথা শুনে আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল। আহা, বেচারী! এই তো সবে তিরিশ বছর বয়স। আমার পূজনীয় শ্বশুরমশাই ভক্কি মেরে থাকলে বত্রিশ। সামনে খাঁ খাঁ দুপুরের মত যৌবন খাঁ খাঁ করছে, এতবড় জীবন পড়ে রয়েছে, আর আমি কিনা স্বার্থপরের মত একলা চলে এলাম। আহা, সুধা কী করবে। সুধার দুঃখে আমার চোখে জল এসে যাচ্ছিল। আমি মনে মনে বললাম, সুধা ভয় নেই, তোমাকে একা থাকতে হবে না। আমি তোমার পাশে এসে শুচ্ছি। তুমি যত খুশি আমাকে পাশবালিশ করে জড়িও, আমি কিচ্ছু বলব না। সারারাত ধরে তুমি মনের সুখে ঘুমিও, আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখব।
সুধা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। এলো গা। পড়নের শাড়িটা আলগা করে বুকের ওপর ফেলা। আমার চোখ চকচক করে উঠলো। দি ট্র্যাজেডি অব বিয়িং এ ভূত যে কী, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম। তবু আমার মন মানল না। আমি মশারির ছোট ছোট ফুটোর মধ্য দিয়ে গলে সুধার পাশে গিয়ে গড়িয়ে পড়লাম...
সুধা চোখ বুজে শুয়ে ছিল। শীতল হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে বলে উঠল, আঃ! বাঁচলাম। শরীর জুড়োল। আনন্দে আমার হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তেই আমি আমার উপস্থিতি জানাতে চাই না। আর একটু সময় যাক, সুধার মন যখন একেবারে গলে আসবে, তখন আমি বলব, অহম অয়ম ভোঃ --আমি এসেছি।
সুধা ধীরে ধীরে পাশ ফিরল। পাশবালিশ খুঁজছিল। আমি সুড়ুৎ করে বালিশের মত সুধার বাঁ পায়ে ঠেক দিলাম। সুধার বোজা চোখ খুলে গেল। আশ্চর্য হয়ে তাকাচ্ছে সুধা। বিছানায় পা পড়েনি, অথচ যেন বালিশে পা আছে এমন ভাব। সুধা ধড়মড় করে উঠে বসল। তারপর খেপে গিয়ে বলল, ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ! মরে গিয়েও শান্তি হয়নি। এখনো এইসব! লজ্জা করেনা, বেহায়া কোথাকার। যাও না, তোমার সেই উটমুখো ছুঁড়িটার কাছে। সে তোমাকে কোলে নিয়ে স্বর্গে নাচাবে।
সুধার ঝাঁঝ দেখে আমি বিন্দুপ্রমাণ হয়ে গেলাম। লোকের ভাল করতে নেই। আরে, যার জন্যে করি চুরি, সেই বলে চোর! সুধা রাগের গলায় বলল, তুমি ভালমানুষের ছেলে নও। এবার তোমার একটা বিহিত করতে হয়। ঠিক আছে, এবার যেদিন রেগে গিয়ে গয়ায় পিণ্ডি দিয়ে আসব, সেদিন ভূতগিরি বেরিয়ে যাবে।
গয়ায় পিণ্ডি! দু'চোখে আমার জল এসে গেল। আমার এ ভূতজন্ম যদি শেষ হয়ে যায়, তাহলে আমি কী নিয়ে থাকবো!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
ক'দিন আমি বিমনা হয়ে থাকলাম। ভূত বলে কি আমার মান অভিমান নেই! আহারে রুচি নেই, মুখটাও কেমন বিস্বাদ। কিছুই ভাল লাগে না। মনে হয় ধড়া-চূড়ো পরে সন্ন্যেসী হয়ে যাই। এ সংসারে যার স্ত্রী বিমুখ তার বেঁচে থাকায় লাভ কী? অবশ্য সুধা যদি আমার স্ত্রী হয়। মরে গেলে কি স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক থাকে, না ডিভোর্সের মত কাটান ছাটান হয়ে যায়?
তিন-চারদিন এভাবে থাকতে থাকতে, একদিন আমি খেপে গেলাম যেন। আমার হাত পা নিশপিশ করছিল। হঠাৎ মনে হল, কার জন্য আমার এই অবস্থা? আমি বাসের তলায় পড়ে চ্যাপ্টা মাথা আর ভূতগ্রস্ত শরীর নিয়ে সুধার গালাগাল খেয়ে মরছি, আমার আমার সেই অফিসফেরতা সাধের মঞ্জু তার চোখে পালিশ মেখে, গালে টোল ফেলে, হাসিতে গড়িয়ে পড়ে নিরুপমের সঙ্গে লদকালদকি করে বেড়াচ্ছে-- এটা সহ্য করা যায় না। এবারে ওদের একটু টাইট দেওয়া দরকার। আমি মরব, আর ও বেঁচেবর্তে সুখে-স্বচ্ছন্দে হেসে খেলে বেড়াবে, এ হয় না, হয়না!
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
শরীরটাকে ঠিক করে নিতে আমি ঘুলঘুলির ভেতর কষে ডন-বৈঠকি লাগালাম। হাতের গুলি ফোলালাম, পায়ের ডিম। ব্যায়াম করতে করতে যখন মনে হল শরীরটা বেশ জুতের হয়েছে, তখন ঘুলঘুলি ছেড়ে আকাশে হাত-পা মেলে দিলাম। একটা রাতচরা চামচিকে আমাকে দেখেভয়ে চোঁ-ও করে একটা আলো-জ্বালা ঘরে ঢুকে পড়ল। দূরে কোথাও একটা প্যাঁচা ডাকছিল।
কলকাতায় যে প্যাঁচা থাকতে পারে আমার ধারনা ছিলনা। পরে মনে হল ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট ছোট কোটরে থাকতে থাকতে এ শহরের তিনভাগ মানুষ প্যাঁচা হয়ে গেছে। দিনের আলোয় তাদের পাত্তা পাওয়া যায় না। রাতে আলো জ্বললে, তারা জোড়ায় জোড়ায় বেরিয়ে পড়ে। বাড়িতে রান্না নেই, যে-কোন দোকানে ঢুকে খেয়ে নেওয়া। রাত ঘন হয়ে নামলে বিছানায় গড়ানো।
কার্জন পার্ক ছাড়িয়ে ময়দান মার্কেটে এসে পড়লাম। এখান থেকে মঞ্জু অন্তত খান ছত্রিশেক শাড়ি কিনেছে আমার পয়সায়। সিনেমা হাউসগুলো পেরিয়ে গেলাম। এসব হাউসে কম সিনেমা দেখিনি আমরা। মঞ্জুর আবার বেশিরভাগ সেক্স আর ভায়োলেন্সের ছবি পছন্দ ছিল। এক একটা ছবি দেখতে দেখতে মঞ্জু যখন ভয়ে আঁতকে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরত, কি আমার হাত কোলের ওপর টেনে নিয়ে খেলা করত, তখন সুধাকে কেমন যেন ফ্যাকাশে, বিবর্ণ, মাটির পুতুলের মত লাগত। মনে হত, মঞ্জুই আমার জীবন, সুধা মরন। কিন্তু শেষকালে ব্যাপারটা পুরো উল্টো হয়ে গেল। আমাকে মঞ্জুর জন্য মরতে হল, সুধা চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারল না।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আমি উড়তে উড়তে মঞ্জুর অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে চলে এলাম। সাতাত্তর নম্বর ঘরের দরজা যথারীতি বন্ধ। ঘরে ব্লু রঙের একটা আলো জ্বলছে। আমি কি-হোল দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ঘরে দু'জন মানুষ, সামনে সেন্টার টেবিলে তরল পানীয়। এ পানীয়ে অনেকদিন চুমুক দেওয়া হয়নি! গেলাস দেখেই আমার জিবে জল এসে যাচ্ছিল।
আমি হাইজাম্প দিয়ে উপরে উঠে গেলাম। ভেন্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে নিজেকে গলিয়ে তাজ্জব। আরে, এ তো নিরুপম নয়, এ তো অজয় দাশগুপ্ত! এরই মধ্যে আর একবার পার্টনার পাল্টেছে মঞ্জু। আমি মনে মনে 'এনকোর', 'এনকোর' বলে বললাম, তোমার হবে মঞ্জু। তুমি যেরকম শাড়ি পাল্টানোর মত পুরুষ পাল্টাচ্ছ, তাতে একদিন তুমি কুইন ক্লিওপেট্রা হয়ে যাবে।
অজয় মঞ্জুর কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে ছিল। ওর কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়িতে মদের সুবাস। হাত দু'টো ঘুরিয়ে মঞ্জুর পিঠে রাখা। কী একটা কথা বলতে বলতে অজয় হাতের চাপে মঞ্জুর পিঠ বেঁকিয়ে মঞ্জুকে নিজের মুখের ওপর টেনে আনছিল।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আমার হাসি পেল। শালা, একদিন আমাকে খুব আওয়াজ দিয়েছিলি। আজ আওয়াজ দেওয়াচ্ছি। আমি অজয়ের আঙুলের ফাঁকে মাছির মত গলে গিয়ে, মঞ্জুর পিঠে মোক্ষম একটা চিমটি কাটলাম। মঞ্জু চমকে লাফিয়ে উঠে বলল, কি ইডিয়টের মত করছ, পিঠে চিমটি কাটলে কেন?
অজয় পড়ে যেতে যেতে টাল সামলে অবাক হয়ে বলল, আমি!
মঞ্জুর পিঠ জ্বালা করছিল। জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে। হাজার হোক ভূতের চিমটি, হবে নাই বা কেন? মঞ্জু বলল, তুমি নয় তো কে আবার! ঘরে কি আর কেউ আছে!
অজয় নিজের নখ দেখল। ম্যানিকিওর করা নখ। চিমটি কাটবার ধার নেই তাতে। অজয় হাত মেলে দিয়ে বলল, তুমি বল, এই নখে চিমটি কাটা যায়?
মঞ্জু রাগে ফুঁসছিল। শাড়ির আঁচলটা কাঁধের ওপর ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমি কিছু দেখতে চাই না। তুমি মাতাল হয়েছ। গেট আউট। আই সে গেট আউট!
অজয় বলল, ইয়ার্কি! আজ তুমি আমার তিনখানা শ'য়ের পাত্তি খসিয়েছ, গেলেই হল।
অজয় মদের গ্লাসের দিকে হাত বাড়াল। আমি গ্লাসটাকে ইঞ্চি আষ্টেক ওপরে তুলে নিলাম। অজয় চোখ বড় বড় করল। তারপর বলল, একি রে বাবা! গ্লাসটা যে শূন্যবিহারী, বাতাসে ভাসছে!
মঞ্জু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। রঙ করা চোখের পাতা আর পড়ছে না। আমি গ্লাসটা আরো তুলে এনে মঞ্জুর মাথায় ঢেলে দিলাম। তারপর বোতল তুলে চোঁ করে এক নিমেষে বাকি মাল খেয়ে নিয়ে খিকখিক করে খোনা গলায় হেসে উঠলাম।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
মঞ্জু আর অজয় দু'জনে একই সঙ্গে ভূ-ভূ-ভূ করতে করতে মাটিতে জড়াজড়ি করে গড়াগড়ি খেতে লাগল। সে দৃশ্য দেখে হাসিতে আমার পেট ফেটে যাচ্ছিল। আমি হাসতে হাসতে বমি করে ফেললাম...
নেশার খোয়ারি কাটতে পাক্কা দুটো দিন। এই দু'দিন আমি কোনরকমে মঞ্জুর ভেন্টিলেটারে গা ঢাকা দিয়েছিলাম। অচেনা বিছানায় যেমন শুয়ে ভালো ঘুম হয় না, এও তেমন। কিন্তু কী করব, উপায় নেই। পুরো নেশা না কাটলে যাই কী করে। শেষে যদি পড়ে আবার হাত-পা ভাঙি, তাহলে ভূতের চেহারাও যে পালটে যাবে!
ভোরবেলা মঞ্জু সেই যে ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়েছে, আর ফ্ল্যাটে ঢোকেনি। ঢুকবেও না। আর কিছু না হোক, প্রাণের ভয় সকলেরই আছে। কে আর ইচ্ছে করে ভূতের হাতে প্রাণ দেয়।
তিনদিনের দিন, আমি আবার আমার ঘুলঘুলিতে ফিরে এলাম। দেখি, এই দু'দিনেই আমার ঘরের চেহারা পালটে গিয়েছে। জানলায় নতুন পর্দা হয়েছে। বিছানায় কটকি চাদর পাতা। বালিশে বালিশে নতুন চাদর দেওয়া ওয়াড় পরিয়েছে সুধা। ঘরে ঝুল নেই, মাকড়শা নেই, এমনকি সেই লেজকাটা টিকটিকিটাও নেই। আমার ফটোয় একটা ফুলের মালা ঝুলছে। পঞ্চমুখী ধূপদানিতে ধূপ।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
ব্যাপার কী? হল কী? আজ যে আমার খাতির। তাহলে কি পেনশন আর গ্রাচুইটির টাকাটা পেল সুধা! এতদিনে পাওয়া উচিৎ। ছ'মাস হতে চলল, তাই হবে হয়তো। আমি নিচে নেমে আমার ফটোর মালা দুলিয়ে দিয়ে বললাম, কি দেবু মিত্তির, কেমন লাগছে? আজ যে বরবেশ। বাহ! বেশ আছ, তোফা। জ্যান্ত শালা কোনদিন তোমার কপালে ফুলের মালা জুটল না, চিরকাল গালাগাল হজম করলে, আজ মরে সুরতখানা বেশ খোলতাই করেছ। বেঁচে থাক বাবা, সুখে আনন্দে বেঁচে থাক। আমি শালা মরে ভূত হয়েছি, আমি এখন খাবি খাই।
ঘরের তালা খোলার আওয়াজ হল। আমি তড়াক করে লাফ মেরে আমার ঘুলঘুলিতে উঠে এলাম। ঘরে সুধা ঢুকল। সঙ্গে একজন দশাসই পুরুষ। ছ'ফুটের ওপর লম্বা। মাথায় মিলিটারি ছাঁট ছাঁটা। হাতের গুলিগুলো গা-চাপা জামা ফুঁড়ে ফুলে ফুলে উঠছে। পায়ে নতুন কেনা শু মসমস করছিল। কোমরের বেল্টে চকচকে রিভলবার।
আমি তাজ্জব হয়ে তাকিয়েছিলাম। এ মালকে তো কোনদিন দেখিনি। এ কে বাবা! সুধা হাসতে হাসতে বলল, উফ! আর পারি না রজতদা। সারা ট্যাক্সিতে তুমি এমন হাসিয়ে মেরেছ যে, এখনও আমার কুলকুল করে হাসি পাচ্ছে।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
রজত বলল, হাসাব না! এসে দেখি, তুই মুখখানাকে ভিমরুলের চাকের মত করে বসে আছিস সুধা। তোর জীবনে যেন কোন সুখ নেই, শান্তি নেই, আনন্দ নেই। আরে মানুষ তো মরবেই। তোর বর মরেছে বলে তুই যেমন ভেঙে পড়েছিস, এমন আমি কাউকে দেখিনি। ঘরদোরের কী ছিরি করে রেখেছিলি বল। এই দু'দিনে তবু একটু মানুষের মত দেখাচ্ছে। বুঝলি, তোকে আমি এখানে রাখব না, আমার সঙ্গে দেরাদুন নিয়ে যাব।
সুধা আঙুলে শাড়ির খুঁট জড়াতে জড়াতে বলল, যাহ্! তাই কি হয় নাকি! তুমি কী যে বল।
রজত বলল, আমি ঠিক বলিরে। তোর মামাত ভাই সনৎ যেদিন তোর কথা আমাকে বলেছে, সেদিন থেকেই আমার মন বলছে, তোর একটা কিছু হিল্লে করা দরকার। এরকম একটা ভূতের জীবনে কি মানুষ বাঁচতে পারে। হাতের ক'টা টাকা, সেগুলো যখন ফুরিয়ে যাবে, তখন কী করবি। আরে জীবন অনেক বড়, আর তোর কী বয়স বল। আমি তোর বিয়ে দেবই দেব। আর যদি দিতে না পারি, তাহলে আমিই করব। আমি তো কনফার্মড ব্যাচেলর। একজন আইবুড়োকে মালা দিতে নিশ্চয়ই তোর আপত্তি হবে না।
কথাগুলো শেষ করেই রজত হো হো করে হেসে উঠল। হাসির শব্দ শুনে আমার মনে হল, আরে এ ব্যাটা শোলের সেই আমজাদ। হাসে না তো যেন জয়ঢাক, বুকে ঘুষি মারে।
আমি মনে মনে বললা, বাহ্! বেশ ব্যবস্থা। সুধার দুঃখে বুক ফেটে যাচ্ছে। তা তুমি কে বাবা! বেঁচে থাকতে তো তোমাকে কোনদিন দেখিনি। আইডেন্টিটিও জানিনা। একবার ভাল করে ঝুলি ঝাড়, তোমাকে পরখ করে নিই।
সুধা রজতের কথা শুনে কি-সব ভাবছিল। এসময়ে সুধা বলল, আমি আরেকটু ভাবি, কী বল। একেবারে এত বড় একটা লাফ মারব!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
রজত বলল, নিশ্চয়ই ভাববি। একশোবার ভাববি। ভাবনাচিন্তা না করে ভূতে কাজ করে, মানুষ করে না। মানুষের কাজ হল, যাহা করিবে তাহা ভাবিয়া করিও।
ভূতের উল্লেখে সুধার বোধ হয় আমার কথা মনে পড়ল। সুধা আমার ফটোর দিকে তাকিয়ে বলল, রজতদা তুমি ভূতে বিশ্বাস কর?
রজত আবার সেই হাড়কাঁপানো হাসি হেসে বলল, ভূত? ভূত তো মনে। ভূতে বিশ্বাস করতে হলে তোর রজতদাকে আর বাঁচতে হত না। কত মিলিটারি অ্যাকশন করেছি, কত মানুষ মেরেছি। তারা যদি সব মরে ভূত হয়ে তেড়েফুঁড়ে আসত, তাহলে কি আর বাঁচতাম। কবেই অক্কা পেতাম।
সুধা চোখ বড় বড় করল। তুমি ভূতে বিশ্বাস কর না! কিন্তু আমি তোমাকে ভূত দেখাতে পারি। আমার হাতেই একটা পোষা ভূত আছে। তাকে আমি যা বলি, তাই সে করে। ডাকব, দেখবে?
রজত ইজিচেয়ারে নিজেকে আরো ছড়িয়ে বসল। তারপর হাসি গলায় বলল, কিরে, ছিকলিটিকলি বেঁধে রেখেছিস, না আবার বাঁদরের মত খাবলে কামড়ে দেবে? তারপর দরাজ গলায় হেসে বলল, যা ডাক। দেখি একবার তোর ভূতবাবুকে...
রাগে আমার গা কষকষ করছিল। আমি ভাবছিলাম, একবার উচিৎ শিক্ষা দিই। বিশেষ কিছু করতে হবে না। শুধু টাইটা ধরে যদি দু'দিকে সমান টান দিই, তাহলে এখুনি আধহাত জিব বেরিয়ে পড়বে। কিন্তু আবার মনে হল, সুধার ভাবগতিক দেখে সুবিধের মনে হচ্ছে না। এখনো কোনদিকে ঢলবে ঠিক করতে পারেনি সুধা। ঠিক এ সময়ে সুধার কথামত রজতের সামনে বের হয়ে নিজের স্বরূপ প্রকাশ করলে, ফল ভাল না হয়ে মন্দও হতে পারে। তাছাড়া আমার কি মান-অভিমান নেই! মাত্র ক'দিন আগে, ভাল করতে গিয়ে কি নাজেহালই না হয়েছি। সুধা গয়ায় পিণ্ডি দেবে বলেছে! কী দরকার আমার পাঁচ ঝামেলায় থাকার। আমি ভূত, ভূতের মত থাকব। তুমি মানুষ, মানুষের মত। ভূতে-মানুষে তো আর পিরিত হয় না!
সুধা আদুরে গলায় ডাকল, এই শুনছ, তুমি একবার আসবে?
আমি অতি কষ্টে মুখ গোঁজ করে রইলাম।
সুধা আবার বলল, হাসো না একবার। তারপর আবার বলল, আচ্ছা, হাসতে ইচ্ছে না হয়, আমাদের কৌচটাকে একটু টেনে সরিয়ে দাও। তাহলে বুঝব তুমি এসেছ।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
সুধার এই আদুরি আদুরি কথা, বায়না, আমার মনে সুরসুরি দিচ্ছিল। কিন্তু আমি শক্ত হয়ে, ঘাড় গোঁজ করে ঘুলঘুলি কামড়ে পড়ে রইলাম। আজ পাঁচ বছর বাদে সুধার মুখে এই ভাল কথা শুনছি। এত সহজে কি ভবী ভোলে! বেঁচে থাকতে ভাল কথা বললে, আর ঘুলঘুলিতে থাকতে হত না দেবু মিত্তিরকে।
সুধার রজতদা একটু দেখল। তারপর হাড় কাঁপিয়ে হেসে উঠল। আচ্ছা! মিলিটারিম্যানকে ভূত কেন, ভগবানও ভয় করে। তোর ভূত আর এসেছে, ভয়েই পালিয়েছে। আয়, কাছে আয় শোন।
রজতের লম্বা হাতটা সুধার কাঁধে এসে পড়ল। আমি সভয়ে চোখ বুজলাম। সতীত্ব রক্ষা স্ত্রীলোকের ধর্ম, ভূতের কর্ম নয়।
দিন তিনেক বাদে সুধা একেবারে সেজেগুজে নতুন বউ হয়ে এল। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি, আর অবাক হয়ে যাচ্ছি। কে বলবে মাত্র ছ'মাস আগে সুধার স্বামী মারা গিয়েছে! চীনে চুল বাঁধার দোকান থেকে চূড়ো করে চুল বেঁধেছে সুধা। গায়ে টকটকে লাল বেনারসী। মুখ কেমন যেন তেলতেলে লাগছিল। মঞ্জুর মত চোখে, ঠোঁটে, গালে মেক-আপ মেরেছে। সুধার শরীরটাও প্যাক-আপ করা, যৌবন ফেটে পড়ছিল। বাহবা, বাহ্! বেড়ে লাগছে সুধাকে। এমনটি তো আমি কোনদিন দেখিনি। এ যে দেখছি মঞ্জুর সেকেন্ড এডিশন!
রজত একরাশ ফুল নিয়ে ঘরে ঢুকল। আজ আদ্দির পাঞ্জাবি পরেছে রজত, কোঁচান ধুতি। পায়ে লপেটা। ফুলগুলো সুধার হাতে দিতে দিতে রজত বলল, এগুলো দিয়ে বিছানাটা সাজিয়ে নাও তুমি। আজ আমাদের ফুলশয্যা। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, ওটাকে ওখানে টাঙিয়ে রেখেছ কেন সুধা?
কোনটা? সুধা চোখ তুলল।
ওই যে, তোমার এক্স-হাসব্যান্ডের ছবি।
কোথায় রাখবো তবে?
জাহান্নামে! --আমার ছবিটা টান মেরে খুলে রজত পা দিয়ে টেবিলের তলায় ঢুকিয়ে দিল। তারপর বলল, তোমার আর আমার মাঝখানে ভূতপূর্ব কোন ব্যাপার থাকবে না সুধা। এখন থেকে তুমি আমার, আমি তোমার। দেবু মিত্তির বলে কেউ কোনদিন ছিল না, থাকতে পারে না, থাকবে না। দ্যাটস অল!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আরে শাবাস! কী আওয়াজ! দেবু মিত্তির ভক্কি হয়ে গেল! লোকটার এলেম আছে বলতে হবে। কী কম্যান্ডিং টোন! তুই তুই করে বলা কথাগুলোকে কি সুন্দর তুমিতে পালটে নিয়েছে।
আমি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। ব্যাপার বুঝতে যেটুকু সময়, তারপর অ্যাকশনে নামতে হবে...
বাইরে কড়া নাড়ার শব্দ উঠল। হোটেল থেকে খানা এসেছে। রজত খাবার নিয়ে দরজা বন্ধ করল। তারপর টেবিলে সাজাতে সাজাতে বলল, তোমার হল? আই অ্যাম হাংরি।
আরে, কতরকমের খাবার আনিয়েছে রজত! চিকেন বিরিয়ানি, ফিসফ্রাই থেকে পুডিং পর্যন্ত। ফিসফ্রাই আমার বড় প্রিয় খাদ্য ছিল। একবার ব্রজেনদার মেয়ের বিয়েতে একুশখান ফ্রাই খেয়েছিলাম বলে সুধা আমাকে আদর করে "খুদে রাক্ষস" বলেছিল। আহা! সেই দিন কি আর আছে!
ফুল সাজিয়ে ঝকমকে চোখে সুধা এসে টেবিলে বসল। রজত পকেট থেকে চ্যাপ্টা একটা বোতল বার করে দুটো গ্লাস টেনে নিল। তারপর এক পেগ মাল ঢেলে নিট মেরে দিয়ে, আর আধ পেগ আন্দাজ লাইম মিশিয়ে সুধার দিকে এগিয়ে দিল।
বেশ জিন চালাচ্ছে দেখছি। না, ওদিকে আজ নজর দেবার সময় নেই। মাল খেলে আমি অল্পেই বেহেড হই। শালা আমার ছবিটাতে যে লাথি ঝেড়েছে, সেটা এখনও আমার পাঁজরায় বাজছে। এর শাস্তি দিতেই হবে। একবার ভাবলাম, এবার রণাঙ্গনে নামব নাকি। তারপর ভাবলাম, ধীরে, দেবু মিত্তির, ধীরে। আর একটু দেখা যাক।
সুধা গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, মদ!
রজত সুধার কাঁধ বা হাতে জড়িয়ে নিল। ইয়েস, মাই সুইট গার্ল। আজ আমরা সেলিব্রেট করব। এতদিনে মনে হচ্ছে, আজ আমি একটা কাজের কাজ করেছি। এ রিয়েল পিস অব গুড ওয়ার্ক।
সুধা গ্লাস নাড়াতে নাড়াতে বলল, মদ যে খাই না।
রজত চোখ তুলল। খাও না, খাবে। আজকের জন্য অন্তত খাবে। লেট আস হ্যাভ ফান। ওয়াইন এণ্ড ওয়াইফ গোজ টুগেদার। নেশা না হলে কি প্রেম জমে?
রজত হা হা করে হেসে উঠল। সুধা নাক টিপে এক চুমুক দিয়ে বলল, তোমার এই ব্যাপারগুলো আর কিছুদিন পেছিয়ে দিলে হত না? অন্তত রেজিস্ট্রিটা হয়ে গেলে? ছিঃ! ছিঃ! বিয়ের আগে ফুলশয্যা, আমার ভাবতেই গা কেমন করছে।
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
রজত চোখ বড় বড় করল। কাটলেটে একটা কামড় দিতে দিতে বলল, কী বলছ তুমি সুধা! মা কালীকে সাক্ষী রেখে বিয়ে কি বিয়ে নয়! দেখ, পুরুত ডাকিয়ে তোমার সিঁথিতে সিঁদুর পরিয়েছি। ইটস এ রিয়েল ম্যারেজ।
সুধা বলল, ও তো সাতসিকের পুরুত। তাও ব্রাহ্মন কিনা কে জানে!
রজত আর এক পেগ ঢালল। তারপর বলল, ওসব নিয়ে মন খারাপ করতে নেই। আমার হাতে বেশি সময় নেই, কাজ অনেক। নোটিশ দেওয়া আছে, যখন ডাক আসবে, তখন সাক্ষীসাবুদ নিয়ে সই করে এলেই চলবে। ব্যাঙ্কে খবর দিয়েছি, কালই আমার অ্যাকাউন্টটা তোমার সঙ্গে জয়েন্ট করিয়ে নেব। ইনশিওরেন্স পলিসিতেও তোমাকে নমিনি করতে হবে।
সুধা বলল, ব্যাঙ্কে তোমার কত টাকা আছে?
তা লাখ দুয়েক হবে। ইনশিওরেন্সটাও লাখ টাকার।
সুধা অনেকটা যেন আশ্বস্ত হল। এক চামচ বিরিয়ানি তুলে মুখে দিল। রজত সুধার দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে আর বেশিদিন থাকা সম্ভব নয়, আমাকে দেরাদুন যেতেই হবে। যাবার আগে তোমার বাড়িটা বেচে দিয়ে যাব। এই বাড়ির টাকা আর তোমার সামান্য যা কিছু আছে তুমি জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে রাখতে পার। সুধার মুখের দিকে মিনিট খানেক তাকিয়ে দেখে রজত বলল, ইচ্ছে হলে নিজে আর একটা অ্যাকাউন্ট করতে পার।
এতক্ষণে আমার কাছে ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে উঠল। সুধার মামাতো ভাই সনৎ-ফনত বাজে কথা। কোথা থেকে খবরটা জোগাড় করে রজত এসেছে। ও একটা কন ম্যান। লোককে টুপি পরিয়ে কাজ হাসিল করে। ও সুধার সর্বনাশ করে ছাড়বে। সুধার দিকে তাকিয়ে আমার মায়া হচ্ছিল। আহা! বিয়ে করার কত শখ। ভূতের বউ হয়ে কার আর বাঁচতে সাধ হয়!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
আমি খিকখিক করে হেসে উঠলাম...
রজত ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, কে হাসে!
সুধার মুখে যেন রক্ত ফিরে এল। সুধা বলল, আমার স্বামী।
রজত দাঁতে দাঁত পিষল। তোমার স্বামী আমি!
আমি লাফ দিয়ে নিচে নেমে এলাম, তারপর বললাম, ইয়ার্কি মারবার আর জায়গা পাওনি। স্বামী বদল হলেই হল। রিয়েল বিয়ে হলে না হয় কথা ছিল। নারায়ণ সাক্ষী কি ম্যারেজ ব্যুরোর খাতায় সই দিলে আমার বলবার কিছু ছিল না। শালা বিয়ের মামদোবাজি দেখিয়ে তুমি আমার বাড়ি, টাকাকড়ি, বউ হাতাতে চাও!
রজত একহাতে সুধাকে জাপটে ধরল। অন্য হাতে পিস্তল বাগিয়ে বলল, আমি মিলিটারি ম্যান, তোর মত একটা পেঁচি ভূতকে উড়িয়ে দিতে আমার এক মিনিটও লাগবে না।
সুধা ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল। আমি বললাম, শালা সাতপুরুষ তোর কেউ মিলিটারিতে ঢোকেনি। তুই খিদিরপুরের ইমপোর্টেড মাল, স্মাগলড হয়ে এসেছিস।
সুধা চেঁচিয়ে উঠল, বাঁচাও!
আমি সঙ্গে সঙ্গে রজতের কাছা খুলে দিলাম। কাপড় সামলাতে গিয়ে রজত হাত সরাতেই, সুধা ছিটকে বিছানায় গিয়ে পড়ল। রজত বিছানায় ঝাঁপ দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, আমার মুখের গ্রাস কেউ কোনদিন ছিনিয়ে নিতে পারেনি। তোর ভূতের মত বরটাও পারবে না।
সুধা আবার চেঁচিয়ে উঠল। আমি তীরের মত এগিয়ে গিয়ে রজতের নাক কামড়ে দিলাম। রজত 'বাপস!' বলে উঠে দাঁড়াতেই, সুধা দরজার দিকে ছুটে গেল। রজত অন্ধ রাগে গুলি চালাল। দুম! দুম! দুম!
•
Posts: 18,205
Threads: 471
Likes Received: 65,410 in 27,674 posts
Likes Given: 23,734
Joined: Feb 2019
Reputation:
3,261
গুলির শব্দে আমি নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম। আমার মাথা চিঁড়েচ্যাপ্টা করে দেবার সময় বাঘমার্কা বাসটাও এরকম একটা দুম করে শব্দ করেছিল। ভয়ে একলাফে আমার ঘুলঘুলিতে ঢুকে দেখি, লাল রঙের সুধা বসে আছে!
সুধা পা দোলাতে দোলাতে বলল, তুমি বড্ড চালাক, না? ভেবেছিলে আমাকে একলা ফেলে, তোমার মঞ্জুবালার সাথে মজা মারবে? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা, এবার তোমার নাকে নল ছেঁচে দেব।
আমি বললাম, তুমিও কম যাও না। তোমার রজতশুভ্র কোথায় গেল? ফুলশয্যা হবে না?
সুধা হেসে উঠল। সেই সঙ্গে আমিও। তারপর হে পাঠক-পাঠিকা, আমি আর বলতে পারছি না। আমার লজ্জা করছে। ছিঃ! ছিঃ! আমাদের দুই ভূত-ভূতানির নিরাবরণ বায়বীয় শরীর ক্রমশ সংলগ্ন হতে হতে একেবারে এক হয়ে গেল। আমরা অনন্ত, অপার আনন্দের উল্লাসে, ভৌতিক সুরে গেয়ে উঠলাম, আজ আমাদের ফুলশয্যা অকাল বসন্তে!
(সমাপ্ত)
|