Thread Rating:
  • 11 Vote(s) - 3.18 Average
  • 1
  • 2
  • 3
  • 4
  • 5
Non-erotic সমাহার by নীললোহিত
#1
Collected from Xossip web archive




সমাহার



এটা কোনও একটা গল্প নয়। বরং অনেকগুলো গল্পের সমাহার। আবার এগুলোকে গল্পও হয়তো বলা যায়না। মনের মধ্যে জমে থাকা কতকগুলো প্রশ্নকে শব্দের ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করেছি। চাইব সবাই এগুলো পড়ুক। তারপর জানাক সেগুলো কতটা সত্যি।  [b]   নীললোহিত[/b]
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
Do not mention / post any under age /rape content. If found Please use REPORT button.
#2
অনাহুত

আজ আমার জন্মদিন। বছর আমি পনেরোয় পা দিলাম। বাবা কলকাতায় কাজ করে। ঘরে মা, আমি আর ঠাকুমা থাকি। স্কুলে এখন গ্রীষ্মের ছুটি চলছে। জৈষ্ঠ্য মাসের প্রথম সপ্তাহে আমার জন্মদিনে প্রতি বছরই ছুটি পাই আমি। প্রতি বছরের মত বছরও বাবা সবার আগে ভোরবেলায় আমাকে ঘুম থেকে তুলে ফোনে শুভেচ্ছা জানিয়েছে। বেলার দিকে আমরা তিনজনে জলখাবার খাচ্ছি। জন্মদিনে মুড়ি খেতে নেই বলে মা আমাকে লুচি ভেজে দিয়েছে। গরম গরম বেগুনভাজা সহকারে লুচি খাচ্ছি। মা আর ঠাকুমাও আমার সঙ্গে জলখাবার খেয়ে নিচ্ছে। এমন সময় আমার দৃষ্টি পড়ল সদর দরজার দিকে। দেখতে পেলাম একটা নুব্জ্যদেহী বুড়ি আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। তার চলনটা পরিষ্কার নয় বরং কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। কাঁধে একটা ঝোলাও নজরে এল। প্রথম দর্শনে তাকে ভিখারিনী বলেই মনে হল। হয়ত ভিক্ষে করতে বেরিয়েছে। কিন্তু আমার এই মনে হওয়াটাকে ভুল প্রমাণ করে সে সটান আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তারপর ঠাকুমাকে উদ্দেশ্য করে অদ্ভুত একটা খনখনে কর্কশ গলায় গলায় বলল, “চিনতে পারছ, মা ঠাকরুণ?” আমরা বাইরের দাওয়ায় বসেছিলাম। ঠাকুমা নিজের শরীরটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে বুড়িটাকে আপাদমস্তক ভালো করে লক্ষ্য করল। তারপর কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে, হঠাৎ বিস্মিত গলায় বলল, “আরে হাড়িবউ যে! তুই এখনও মরিসনি?”

মরতে আর পারলুম কই, মা ঠাকরুণ।
তা কোথায় ছিলিস এতদিন? তোকে তো অনেকদিন দেখিনি। আমি তো ভেবেছিলুম হয়ত মরে হেজে গেছিস।ঠাকুমা জিজ্ঞাসা করল।
মেয়ের বাড়িতে ছিলুম মা। তা জামাই বললে, অনেকদিন তো মেয়ের অন্ন ধ্বংস করলে, এবার যাও ছেলের কাছে। তা এখানে চলে এলুম। ছেলে বললে, এমনি এমনি খেতে পাবেনে। ভিক্ষে করে চাল জোগাড় করে আনো, তবে খেতে পাবে। তাই বেরিয়েছি মা, ভিক্ষে করতে।একটানা কথা বলে বুড়ীটা হাঁফাতে লাগল। ঠাকুমা বলল, “বোস্, কিছু খেয়ে যা।তারপর মাকে বলল, “যাও তো বউমা, ওকে কিছু খেতে দাও।ততক্ষণে মায়ের খাওয়া হয়ে গেছিল। মা রান্নাঘরে চলে গেল। খাবারের কথা শুনে বুড়িটা ততক্ষণে দুয়ারের এককোণে বসে পড়েছে। ঠাকুমা হঠাৎ আমাকে দেখিয়ে বলল, “একে চিনতে পারছিস বউ?” বুড়ীটা ঘোলাটে চোখ দিয়ে খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “শ্বশুরখেকো না! ওমা কত্ত বড় হয়ে গেছো!” ঠাকুমা হেসে বলল, “নামটা ভুলিসনি এখনও।উত্তরে বুড়িটাও মৃদু হাসল।
কী করে ভুলব মা? আমার শ্বশুরখেকো তো একজন আছে।এমন সময় মা রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে কিছুটা মুড়ি এনে বুড়িটার ময়লা কাপড়ের আঁচলে আলগোছে ঢেলে দিল। এবার ঠাকুমাও রান্নাঘরে চলে গেল। মনে হয় আমার পায়েসটা রাঁধতে গেল। আমার জন্মদিনের পায়েসটা প্রতিবছর ঠাকুমাই রান্না করে। ততক্ষণে বুড়িটা মুড়ি খেতে শুরু করে দিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে মুড়ি তুলে ফোকলা মুখে ফেলছে। আমি ওকে ভাল করে দেখতে লাগলাম। বয়সটা ঠাকুমার মত না হলেও কমপক্ষে ৭০/৭২ তো হবেই। অথচ একে যেন ঠাকুমার চেয়েও বেশী বুড়ি লাগছে। একমাথা শনের মত সাদা চুলে কতদিন যে তেল পড়েনি, তার ঠিক নেই। ফলে চুলগুলো অনেকটা জটার মত মনে হচ্ছে। তেলের অভাবে সাদা চুলগুলো লাল হয়ে গেছে। পরনের কাপড়টা অত্যন্ত ময়লা আর তেলচিটে। কাপড়ের রংটা হয়ত এককালে হলুদ ছিল, কিন্তু এখন সেটা কালক্রমে সাদা রঙে এসে ঠেকেছে। কাপড়ের আঁচলটাতেই অন্তত চার জায়গায় রিফু পড়েছে। বাকীটার কথা তো বাদই দিলাম।
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#3
নীললোহিত তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ছদ্মনাম।
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#4
এতক্ষণে সব মুড়িগুলো খেয়ে নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে গিয়ে টিপে আঁচলাভরে জল খেল বুড়ীটা। তারপর আবার এসে বসল দুয়ারের এককোণে। এমন সময় ঠাকুমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বুড়িটাকে বলল, “হাড়িবউ চলে যাসনি যেন। আজ সোনার জন্মদিন। দুপুরে ভাত খেয়ে যাস।বুড়িটা আনন্দে ঘাড় নেড়ে আনন্দিত গলায় বলল, “ ওমা, তাই নাকি! আমার শ্বশুরখেকোর জন্মদিন! আজ অনেকদিন পর পেটপুরে খাব মা।তারপর বলল, “তোমাকে আশীব্বাদ করি, বাপধন আমার। শতায়ু হও। মাথার যত চুল আছে, তত তোমার আয়ু হোক।বলে কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে আমার মাথাটা ছোঁয়ার চেষ্টা করল। এমন সময় ঠাকুমা চেঁচিয়ে বলল, “ কী করছিস বউ! সোনাকে ছুঁবি যে!” সঙ্গে সঙ্গে বজ্রাহতের মত হাতটা সরিয়ে নিল বুড়িটা।সরে বোস্ বাপু। ছুঁয়ে একসা করিসনি যেন।বলে ঠাকুমা রান্নাঘরে ঢুকে গেল। হঠাৎ বিড়বিড় করতে শুরু করল সে, “এত্তটুকু ছিলে বাপ তুমি। তোমার মা তোমাকে নিতে পারত নি। আমিই তোমাকে নাইয়েছি, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছি। তোমার জন্য কতদিন রাত্তিরে ঘুমোতে পারিনি। ঠায় কোলে করে নিয়ে বসে থাকতুম।আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম বুড়িটা কে? আমাকে স্নান করিয়েছে, ঘুম পাড়িয়েছে বলছে, অথচ এর আগে কখনও ওকে দেখিনি। বুড়িটা হঠাৎই বিড়বিড়ানি থামিয়ে দিয়ে ঝিমোতে লাগল। ঘাড়টা ঝুঁকে পড়েছে বুকের কাছে। বেঁকা পিঠটা দুয়ারের খুঁটিতে ঠেস দিয়ে ঝিমোতে লেগেছে। নিঃশ্বাসের তালে তালে বুকটা ক্রমাগত ওঠানামা করছে। এইটুকুই যেন ওর বেঁচে থাকার সাক্ষ্য দিচ্ছে। পাশে রাখা ময়লা ঝোলাটার ভিতর উঁকি মেরে দেখলাম। খানিকটা চাল আর গোটা ছয়েক আলু রয়েছে তাতে। এই হল ওর আজকের উপার্জন। হয়তো রাতে এগুলোই ফুটিয়ে খাবে। তারপর কাল সকাল থেকে আবার বের হবে উপার্জনের সন্ধানে।

এদিকে বেলা বাড়ছে। জৈষ্ঠ্যের দুপুরের গরমের তাত লাগছে গায়ে। আমি উঠে পড়লাম। বাবলু আজকে সকালে ওদের বাড়ি যেতে বলেছিল। কিন্তু এই রোদে আর বাইরে বেরোতে ইচ্ছা করছে না। রোদ কমলে ওবেলা যাব ভেবে ঘরে এলাম। এই ঘরের জানালা দিয়ে খিড়কি পুকুরের খানিকটা দেখা যায়। এই পুকুরের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা পায়ে চলা মাটির রাস্তা। এই রাস্তা দিয়ে গেলে একে একে বামুনপাড়া, কায়েতপাড়া, তেলীপাড়া, কলুপাড়া, বাগদীপাড়া, আর গ্রামের একদম শেষপ্রান্তে মুচিপাড়া আর হাড়িপাড়া। তারপর ধূ ধূ মাঠ। সেই মাঠের মাঝখানে একটা পুকুর। সেই পুকুরের দুপাশে দুটো শ্মশান। এই দুটো শ্মশানেই আমাদের গ্রামের প্রত্যেক বাড়িরই মৃতদেহ দাহ করা হয়। একটা জিনিস ভেবে আমার খুব আশ্চর্য লাগে, এই জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, শুচিবায়ুগ্রস্থতা মৃত্যুর পরেও সমান ভাবে বহাল আছে। আমি বামুন, তুই দুলে। তুই অস্পৃশ্য। তোকে ছুঁলে আমার জাত যাবে। মৃত্যুর পর শিবনারায়ণ মুখার্জীকে দাহ করা হয় পুবপাড়ের শ্মশানে আর হারু ঘড়ুইকে দাহ করা হয় পশ্চিমপাড়ের শ্মশানে। মৃত্যুর পরেও জাতের ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা সমান তালে রয়ে যায় * ধর্মের অভ্যন্তরে। এমন সময় কাকের চিৎকারে ঘোর কাটল। কাকটা আমাদের উঠোনেই ডাকছে। বেলা বেড়েছে অনেক। রোদের তাতও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ঘরের ভিতর বসেও সেই তাত ভালমতই টের পাওয়া যাচ্ছে। এমন সময় মা ঘরে ঢুকে বলল, “একিরে, তুই এখনও বসে আছিস! যা চান করে আয়, রান্না হয়ে গেছে।মা চলে যেতেই আমি গামছা নিয়ে স্নান করতে বের হলাম। দেখি ঠাকুমা বুড়িটাকে বলছে, “যারে বউ, নেয়ে আয় পুকুর থেকে। তারপরে খেতে দেব।
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#5
(21-06-2021, 09:45 AM)satyakam Wrote: নীললোহিত তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর ছদ্মনাম।

ইনি একই নামে Xossip এ লিখতেন , খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলেন .....  
Like Reply
#6
আমার আর কাপড় নেই সঙ্গে। নাইলে পরব কী?”
দাঁড়া, আমার একটা থান দিই তোকে।বলে ঠাকুমা ঘর থেকে ঠাকুমার একটা সাদা কাপড় এনে বুড়িটার কোলে আলগেছে ফেলে দিল ছোঁয়া বাঁচিয়ে। তারপর একটা ভাঙ্গা কাপে করে খানিকটা তেল এনে দিয়ে ঠাকুমা বলল, “যা, এটা মেখে নেয়ে আয়। চুলগুলোর যা অবস্থা করেছিস। আর একদিন চুল দেখেই হিংসে হত। এত চুল ছিল তোর।
কী করব মা। সবই অদেষ্ট। রোজ রোজ তেল পাব কোথায়?”
আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে চান করতে চলে গেলাম। দেখি বুড়িটাও আমার পিছন পিছন এসেছে চান করতে। চান করে উঠে আসার সময় দেখি সব তেলটা মেখে চান করছে। আমি ঘরে চলে এলাম। এরমধ্যেই মা আমার খাবার জন্য জল-আসন করে দিয়েছে। আমি নতুন জামা কাপড় পরে বসে পড়তেই মা নতুন থালায় ভাত, ডাল, ভাজাভুজি, তরকারী সাজিয়ে দিয়ে গেল। বুড়িটাও চলে এসেছে ততক্ষণে। ঠাকুমা একটা প্রদীপ জ্বালল। তারপর শাঁখে জোরদার তিনটে ফুঁ দিল। সেই শব্দে ভয় পেয়ে দুটো কাক কা-কা শব্দে উড়ে গেল। এবার প্রথমে ঠাকুমা তারপর মা ধান আর দূর্বাঘাস দিয়ে আশীর্বাদ করল আমাকে। হঠাৎ আমার দৃষ্টি পড়ল বুড়িটার মুখের দিকে। ওর মুখে অদ্ভুত একটা অস্থিরতা। হয়ত কিছু বলতে চাইছে, কিন্ত ঠাকুমার ভয়ে বলতে পারছে না। আমি খাওয়া শুরু করলাম। মা এবার ঠাকুমার আর নিজের খাবার বেড়ে নিয়ে এল। অবশেষে বুড়িটার থালা নিয়ে এল। একটা কানাউঁচু অ্যালুমিনিয়ামের থালা, তাতে ভাত আর অন্যান্য তরকারী সাজনো আছে। খাবারগুলো দেখে বুড়িটার চোখেমুখে একট অদ্ভুত ভাব জেগে উঠল। সেটা লোভ হতে পারে অথবা আনন্দ। ঠিক বুঝতে পারলাম না।

সবারই খাওয়া প্রায় শেষের মুখে, এমন সময় ঠাকুমা মাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “যাও বউমাকে, হাড়িবউকে পায়েস এনে দাও।মা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘর থেকে বাটি করে খানিকটা পায়েস এনে উঁচু করে বুড়িটার থালায় ঢালতে লাগল। ঘটনাটা ঘটল তখনই। সামান্য হাওয়ায় মায়ের কাপড়ের একট প্রান্ত উড়ে গিয়ে বুড়িটার থালায় ঠেকে গেল। ঘটনাটা ঠাকুমার দৃষ্টি এড়াল না। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার কি কখনও জ্ঞান হবেন বউমা? ওর এঁটো থালাতে কাপড় ছোঁয়ালে! যাও, আগে নেয়ে এসো, তারপর হেঁশেলে ঢুকবে। আর তোকেই বলি বউ, কি হুঁশ তোর? একটু গা বাঁচিয়ে বসবি তো। যা, খেয়ে উঠে থালাটা ধুয়ে আন। আর জায়গাটা গোবর দিয়ে নিকিয়ে দে।ঠাকুমার কথা শুনে বুড়িটা কাঁচুমাচু মুখ করে কোনরকমে খাওয়া শেষ করে থালাটা নিয়ে পুকুরঘাটে চলে গেল। মা- ঠাকুমার কথা মত চান করতে চলে গেল। আমি হাতমুখ ধুয়ে, ঘরে এলাম। জানালা দিয়ে দেখলাম বুড়িটা ঘাটে সে কি যেন ভাবছে। তারপর থালাটা ধুয়ে ঘরের দিকে এল। কিছুপরেই ঠাকুমার গলা শুনতে পেলাম।বেশী করে গোবর দিয়েছিস তো?”
হ্যাঁ মা।
ঠিক আছে। ওখানটা নিকিয়ে নে। আঃ, কি করিস। ঐখানে ভাত পড়ে আছে, এখনও দেখতে পাচ্ছিস নি? ওখানটা আরেকবার নিকিয়ে নে।আমি শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম বুড়িটা কে? এমন সময় মা ভিজে কাপড়ে ঘরে ঢুকল। মাকে জিজ্ঞাসা করাম, “মা, বুড়িটা কে?”
ওমা, তুই ওকে চিনতে পারিসনি! অবশ্য তোরও কোন দোষ নেই। যখন শে়ষবার আসে, তখন তুই এতটুকু। হচ্ছে তোর ধাই মা। তুই যখন হোস, তখন আমার সঙ্গে আঁতুড়ঘরে ছিল। একুশ দিন তোর কোন ঝক্কি নিতে দেয়নি আমায়। সব নিজে হাতে করেছে। তোকে চান করিয়েছে, গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। কি মিষ্টি গানের গলা ছিল ওর। আর তুমিও কিছু কম ছিলেনা। ওকে সারারাত ঘুমোতে দিতে না। সারারাত তোকে কোলে করে ঠায় বসে থাকত।

মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেলাম মাকে বুড়িটা বলছে, “আমি এবার আসি বউ।
এত রোদে যাবে, হাড়িদি?”
আমাদের আবার রোদ বউ। আসি
দাঁড়াও, তোমার চালটা দিয়ে দিই।
তারপর সব চুপচাপ। ভাবছি বুড়িটা হয়ত চলে গেছে। হঠাৎ খিড়কির দিকের জানালায় নজর পড়তে দেখি, আমাকে হাত নেড়ে ইশারায় ডাকছে। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি মা রান্নাঘরে কাজ করছে। ঠাকুমা নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছে। আমি আস্তে আস্তে পুকুরপাড়ে গিয়ে দেখি বুড়িটা দাঁড়িয়ে আছে। আমি যেতে আঁচল থেকে কতকগুলো খুচরো পয়সা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “এই পয়সা টা নাও বাপ। তোমার জন্মদিনে আর কিছু দিতে পারছি নি। অনেক বড় হও। বাপ-ঠাকুদ্দার নাম উজ্জল করো।আমি স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম। কি করব, কি বলব বুঝতে পারছি না। বুড়িটা বলল, “এবার আসি বাপ্। অনেক বেলা হয়ে গেল। ভাল থেকো।হঠাৎ কি মনে হল জানিনা, আমি ওকে একটা প্রণাম করলাম। বুড়িটা চমকে উঠে পিছিয়ে গেল। তারপর কাঁপা কাঁপা হাতটা আমার মাথা আর মুখে বুলিয়ে দিয়ে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলল। আমার চোখের সামনে দিয়ে একটা নুব্জ্যদেহী বুড়ি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। তার কাঁধে একটা ঝোলা। তাতে আছে কিছু ভিক্ষে করা চাল আর গোটা ছয়েক আলু। সে এইভাবে অন্যের বাড়িতে সামান্য ভাতের জন্য অস্পৃশ্যতার অপমান কুড়াবে। আবার পরক্ষণেই তার পরের বাড়িতে যাবে খাবারের সন্ধানে, ভিক্ষের সন্ধানে। এইভাবেই চলতে থাকবে ওর বাদবাকী জীবন। আর এইভাবেই একদিন সে হারিয়ে যাবে সবার বিস্মৃতির অন্তরালে। পনেরোতম জন্মদিনটা জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার মনে থাকবে। কারণ এইদিনেই আমি খু্ঁজে পেয়েছি আমার এক পরমাত্মীয়াকে। সে আর কে়উ নয়, আমার আরেক মা। আমার ধাত্রী-মাতা।


সমাপ্ত



বি.দ্র.- এই কাহিনীতে কোন একটি বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়কে ছোট করে দেখানো হয়নি। গল্পের প্রয়োজনে কেবল মাত্র নামোল্লেখ করা হয়েছে। তবুও কারোর মনে এই বিষয়ে ব্যথা লাগলে, আমি সর্বান্তকরণে ক্ষমাপ্রার্থী। -নীললোহিত
[+] 7 users Like ddey333's post
Like Reply
#7
(21-06-2021, 09:49 AM)ddey333 Wrote: ইনি একই নামে Xossip এ লিখতেন , খুব জনপ্রিয় লেখক ছিলেন .....  

মানে আমাদের কাকাবাবুর স্রষ্টা গসিপ এ লিখতেন। উফফফফ কি শোনালেন গো দাদা সকাল সকাল।  Heart Heart Heart

তাই বলি। যখন ওনার বড়ো দের উপন্যাস পড়তাম তখন কেন এতো চটি চটি গন্ধ পেতাম।  Big Grin

সত্যি বলছি সকাল সকাল এমন একটা কথা শুনবো সেটা ভাবতেই পারিনি।  Heart
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#8
(21-06-2021, 09:53 AM)satyakam Wrote: মানে আমাদের কাকাবাবুর স্রষ্টা গসিপ এ লিখতেন। উফফফফ কি শোনালেন গো দাদা সকাল সকাল।  Heart Heart Heart

তাই বলি। যখন ওনার বড়ো দের উপন্যাস পড়তাম তখন কেন এতো চটি চটি গন্ধ পেতাম।  Big Grin

সত্যি বলছি সকাল সকাল এমন একটা কথা শুনবো সেটা ভাবতেই পারিনি।  Heart

আরে না না আমি তা বলতে চাইনি ...

ইনি অন্য নীললোহিত  !!! 


Smile Smile
Like Reply
#9
(21-06-2021, 09:55 AM)ddey333 Wrote: আরে না না আমি তা বলতে চাইনি ...

ইনি অন্য নীললোহিত  !!! 


Smile Smile

Sad Sad Sad Sad
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#10
Golpo ta age o porechilum
Khub sundor ekta choto golpo
Like Reply
#11
মন'টা ভারাক্রান্ত হয়ে গেলো নীললোহিতের লেখাটি পড়ে .. উনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা রইলো।


আপনার সংগ্রহশালা বেশ উৎকৃষ্ট মানের .. তাই আপনাকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।

ইরোটিক-থ্রিলার লিখে আমি এই সাইটে উপস্থিত বেশিরভাগ পাঠকের কাছে সমাদৃত হলেও আমার ব্যক্তিগত ধারণা এই ধরনের নন-ইরোটিক গল্পের (অবশ্যই উচ্চমানের লেখা হওয়া প্রয়োজন) সমাদর করার দরকার আছে পাঠকদের। তবেই এই সাইটের উন্নতি সাধন হবে। উৎকৃষ্টমানের লেখকেরা উৎসাহিত হয়ে ভালো ভালো কাহিনী শেয়ার করবে আমাদের সঙ্গে। না হলে আর পাঁচটা চটি-সাইটের মতো একই জায়গায় অবস্থান করবে।

কিন্তু দুঃখের বিষয় সেটি হয় না .. আমার লেখা ইরোটিক থ্রেড এবং নন-এরোটিক ট্রেডের view এর তুলনা করলে তার জলজ্যান্ত প্রমান যাবে।

যাই হোক, আশা রাখবো ভবিষ্যতে আরও এই ধরনের গল্প নিয়ে আপনি আসবেন।

[Image: Animation-resize-gif-f3b601eb23d95beeb4e...911ac0.gif]


[+] 1 user Likes Bumba_1's post
Like Reply
#12
এই ধরনের গল্প পড়েছিলাম হারুন সালেমের মাসি আর কি যেন একটা নাম মনে পড়ছে না।
এই ধরনের গল্প শুধু এই সাইট কেন বাংলা সাহিত্য কে সমৃদ্ধ করে।
সত্যি দে দা র কালেকশন এর তুলনা হয় না
এরকম কালেকশন করার স্বপ্ন দেখতাম এক কালে। যখন খুব পড়তাম। এখন আর পড়া হয় না তেমন।
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#13
মাস্টারমশাই



আমাদের গ্রামে একটি মাত্র প্রাইমারী স্কুল ছিল। এখনও তাই আছে। শুনেছি আমার দাদু গ্রামের অন্যান্য মাতব্বরেরা মিলে এই স্কুলটি তৈরী করেছিলেন। সেসব আজ বহুকাল আগের কথা আমার বাবা- তখন তিন বছরের আর বড় পিসির তখন সবে পাঁচ। তারপর থেকেই এই স্কুলে পড়াশুনা হয়ে আসছে। আমাদের গ্রামের বহু ছেলেমেয়ে এমনকি আমার বাবা-পিসিও এই স্কুলে পড়াশুনা করেছেন। তাই কতকটা পারিবারিক রীতি মেনেই বাবা আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই, তখন স্কুলে চাকরী করতেন আমাদের গ্রামেরই মানুষ বলাইচন্দ্র মুখার্জী। স্কুলে আমরা জনা ত্রিশ ছেলেমেয়ে পড়তাম। গ্রীষ্মকালে মাস্টারমশাই হাতে তালপাতার হাতপাখা নিয়ে পড়াতেন। আর কারোর পড়ায় সামান্যতম ভুল হলে বা একটু দুষ্টুমি করলেই, সেই পাখার বাঁট দিয়ে উত্তম মধ্যম মারতেন। সে মার অবশ্য আমার পিঠে না পড়লেও, মাস্টারমশাইকে বেশ ভয় পেতম আমি। তবে এটা লক্ষ্য করতাম, উনি আমার পড়াশুনার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতেন। মাস্টারমশাই ছিলেন অপুত্রক। সংসারে ওনার স্ত্রী অর্থাৎ আমাদের জ্যাঠাইমা আর আদরের গরু বুধি ছাড়া তাঁর আপনার বলতে আর কেউ ছিলনা। জ্যাঠাইমা বুধির দুধ থেকে ঘি তৈরী করতেন আর উনি সেই ঘি বিক্রি করতেন। প্রায়ই দেখতাম এক বোতল ভর্তি করে ঘি নিয়ে হেলতে দুলতে আমাদের বাড়িতে এসে মাকে হাঁক পাড়তেন, “কই বউমা, চায়ের জল চাপাও।মা- অমনি একগলা ঘোমটা দিয়ে রান্নাঘর থেকে উত্তর দিত, “চাপিয়ে দিয়েছি দাদা, আপনি বসুন।তারপর মায়ের তৈরী চা তার সাথে মুড়ি আর বেগুনি খেতে খেতে ঠাকুমার সাথে গল্প শুরু করে দিতেন। আর মাঝে মাঝে আমাকে বলতেন, “সরকার, কই কাল যে অঙ্কটা পারোনি, নিয়ে এসোতো, বুঝিয়ে দিই।উনি আমাকে নাম ধরে না ডেকে সরকার বলে ডাকতেন। উনি যে পড়াটাই বুঝিয়ে দিতেন, সেটাই জলের মত মনে গেঁথে যেত। চা-মুড়ি খেয়ে, গল্প করে ওঠার সময় ঠাকুমাকে বলতেন, “এবার উঠি কাকীমা, অনেক রাত হল। ওদিকে আবার আপনার বউমা হয়ত চিন্তা করছে।উনি কোনওদিন আমাদের কাছ থেকে ঘিয়ের দাম নিতেন না। স্কুল তৈরী হওয়ার পর দাদুই ওনাকে স্কুলের মাস্টার করে দেন। সেই কথাটা উনি আজও ভোলেননি। ঠাকুমা যদি, “একি কথা বলাই, তুমি এত কষ্ট করে ঘি তৈরী করবে, অথচ টাকা নেবেনা, এটাতো ভাল কথা নয়বলে টাকা দিতে যেতেন, মাস্টারমশাই অমনি খপ্ করে ঠাকুমার দুহাত ধরে ফেলে বলতেন, “আপনাদের কাছ থেকে টাকা নিলে মহাপাতকী হবো, কাকীমা। আচ্ছা বেশ একদিন না হয় আমাকে নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দেবেন।উনি খেতে খুব ভালবাসতেন। তাই ঠাকুমা তাঁকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন। গরমের দিনে একটা খাটো ধুতির উপর একটা পাঞ্জাবী আর শীতকালের দিনে পাঞ্জাবীর উপর একটা মোটা খদ্দরের চাদর - এই ছিল ওনার মার্কমারা পোষাক। শুনেছি মাস্টারমশাই নিজে খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তখনকার দিনের আই.. পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় কলেজে পড়া সম্ভব হয়নি ওনার। তাই উনি যেটা নিজে পারেননি, সেটা ওনার ছাত্রছাত্রীদের হোক, এটাই ছিল ওনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাই শীত গ্রীষ্ম-বর্ষা একদিনও স্কুলে কামাই করতেন না। অনেকদিন দেখেছি ওনাকে জ্বর গায়ে বা অসুস্থ শরীর নিয়ে আমাদের পড়াতে। যে সময়ের কথা বলছি, তখন চারিদিক এত প্রাইভেট টিউশনি বা কোচিং সেন্টারের রমরমা ছিলনা। তাই বাবা আমাকে মাস্টারমশাইয়ের কাছেই পড়ার ব্যবস্থা করেছিল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমি ওনাদের বাড়িতে পড়তে যেতাম। উনি পড়া বুঝিয়ে দেবার পর প্রতিদিন একটা করে গল্প বলতেন। এক-একদিন এক-একটা নতুন গল্প।
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#14
কোনদিন কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার কোনদিন মহাত্মা গান্ধী বা স্বামী বিবেকানন্দ বা সুভাষচন্দ্রের জীবনী, কোনদিন বা ক্যাপ্টেন স্কটের দক্ষিণ মেরু অভিযান। ওনার ঘরে অনেক বই থাকত। উনি সেইসব বই থেকে পড়ে শোনাতেন আমাকে। হ্যারিকেনের ক্ষয়াটে, হলদে আলোয় ওনার চোখদুটো অসম্ভব জ্বলজ্বল করত। দেখলে ভয় পেত, গায়ে কাঁটা দিত। সেই জ্বলজ্বলে চোখদুটোর দিকে তাকাতে পারতাম না। মাস্টারমশাই বলতেন, “জীবনে সফল নয়, বরং একজন ভাল মানুষ, সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টা কোরো সরকার। সফল তো অনেকেই হয়, কিন্তু তাদের মধ্যে সত্যিকারের মানুষ জন, তা কি কেউ বলতে পারে?” বয়সে ওনার সব কথা হয়তো বুঝত পারতাম না কিন্তু ওনার বলা প্রত্যেকটা কথা শুনতে খুব ভাল লাগত। গল্প শুনতে শুনতে প্রতিদিনই রাত্রি হয়ে যেত। আর জ্যাঠাইমা আমাকে জোর করে, হাত গড়া দুটো গরম রুটি আর একবাটি সরওঠা দুধ খাইয়ে দিতেন। বাবা আমাকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি খেকে আনতে যেত। প্রথম প্রথম আমাকে দুধ-রুটি খেতে দেখে বাবা আপত্তি তুলত।একি বৌদি, প্রতিদিন ওকে এইভাবে খেতে দেবেন না।জ্যাঠাইমা নরম স্বরে বলতেন, “সেকী কথা সমর, নব আমার ছেলের মত। খেলে কী হবে?” বাবা তাও বলত, “তা হোক, কাল থেকে আর দেবেন না।কিন্তু পরের দিন জ্যাঠাইমা ঠিক পড়ার শেষে আমার বরাদ্দ দুটো রুটি আর একবাটি দুধ আমার সামনে এনে রাখতেন। আর সত্যি কথা বলতে কি, আমি নিজেও জ্যাঠাইমার হাতে গড়া রুটি আর দুধটুকুর জন্য অপেক্ষা করে থাকতাম। পরে জীবনে অনেক ভাল ভাল জিনিস খেয়েছি, কিন্তু ছোটবেলার জ্যাঠাইমার হাতের মোটা রুটি আর মোটা সরওয়ালা ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধের দুধের স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে। বাবা একবার আমার পড়ানোর বাবদ কিছু টাকা মাস্টারমশাইকে দিতে গেছিল। কিন্তু উনি সেই টাকা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, “আমি সরকারকে এমনিই পড়াই। আর ওর জ্যাঠাইমা ওকে ভালবেসে দুটো খেতে দেয়। এর জন্য আমি তোমার কাছে টাকা নিতে পারবোনা, সমর।

[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#15


সময় কারোর জন্যই থেমে থাকেনা। সে তার নিজের ছন্দে বয়ে যায় নিরন্তর। একসময় আমার গ্রামের স্কুলের পড়া শেষ হয়ে গেল। বাবা আমাকে বারাসতে মামাবাড়ির কাছের একটা স্কুলে ভর্তি করে দিল। আমি মামাবাড়িতে থেকেই পড়াশুনা করতে লাগলাম। প্রথম কয়েক বছর ছুটিতে গ্রামে যেতাম। তখন প্রায়ই মাস্টারমশাইয়ের সাথে দেখা হত। আমি ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই, উনি দুটো হাত আমার মাথায় রেখে আশীর্বাদ করে বলতেন, “বেঁচে থাকো। আশীর্বাদ করি তুমি আরোও অনেক বড় হও।তারপরেই আমার পড়াশুনার কথা, নতুন স্কুলের কথা, নতুন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা, নতুন বন্ধুদের কথা জিজ্ঞাসা করতেন। এরপর পড়াশুনার চাপে ধীরে ধীরে আমার গ্রামে যাওয়া কমে আসতে লাগল। অবশেষে বছরে একবার কি দুবার গ্রামে যেতাম। গ্রামে গেলেও থাকতাম না। তাই মাস্টারমশাইয়ের সাথে ক্কচিৎ কদাচিৎ দেখা হত। হায়ার সেকেণ্ডারীতে পড়ার সময় ঠাকুমা মারা গেল। বাবা গ্রামেই শ্রাদ্ধের ব্যবস্থা করল। আমি গিয়েছিলাম। সঙ্গে দুচারজন বন্ধুও ছিল। শ্রাদ্ধের দিন বাবা গ্রামের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছিল। আমি বন্ধুদেরকে নিয়ে খেতে বসেছি, হঠাৎ নজরে এল আমাদের সামনের সারিতেই মাস্টারমশাই খেতে বসেছেন। শীতকালের দিন। তাই ওনার দেহে সেই চিরপরিচিত খাটো ধুতি আর পাঞ্জাবীর উপর খদ্দরের চাদরটি জড়ানো আছে। তবে এতগুলো বছরে সেই চাদরের অবস্থা দীর্ণ হয়ে পড়েছে। কয়েকটা জায়গায় তাপ্পিও পড়েছে দেখলাম। উনি যে চিরদিনই খেতে ভালবাসেন, এটা আগেই বলেছি। কিন্তু আমার শহুরে বন্ধুদের কাছে সেটা রীতিমতরাক্ষুসে খাওয়াবলে মনে হল। সেদিন বন্ধুদের নানান টিপ্পনী শুনে আমার কান জ্বলতে লাগল। সেদিন আমার বলা উচিত ছিল, “উনি আমার মাস্টারমশাই কিন্তু বন্ধুদের কাছেপ্রেস্টিজহারাবার ভয়ে আমি মুখ খুললাম না। উনি সেদিন হয়তো আমার বন্ধুদের টিপ্পনী শুনে থাকবেন। আমার নীরবতাও হয়ত ওনার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু কারোকে কিচ্ছু না বলে, খাওয়া শেষ করেই একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলেন। ঘটনাও বেশীদিন লাগল না আমার মন থেকে মুছে যেতে। আস্তে আস্তে পড়াশুনার মধ্যে হারিয়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব মেধাবী ছাত্র ছিলাম। হায়ার সেকেণ্ডারীতে লেটার মার্কস পাওয়ায় এবং জয়েন্টে মেডিকেলে ভাল ব়্যাঙ্ক করার সুবাদে আর মেজমামার পরিচিতির জোরে কলকাতার এক নামী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে গেলাম। কলকাতাতেই একটা মেসে ভাড়া থেকে পড়াশুনা করতে লাগলাম। গ্রামে যাওয়া একপ্রকার বন্ধ হয়ে গেল। এরপর পরপর দুবছরে বাবা আর তারপর মায়ের মৃত্যু আমার মন থেকে গ্রামটাকে একপ্রকার মুছিয়ে দিল। এরপর আমি মেডিক্যাল কলেজ থেকে স্কলারশিপ সহ গ্রাজুয়েট হয়ে বিদেশে চলে যাই পড়তে। সেখান থেকে বছর কয়েক পর ফিরে এসে কলকাতায় স্থায়ী হই। এখন আমি, ডা. নবকুমার সরকার, ডাক্তারমহলে একটি পরিচিত নাম। কলকাতার এক নামকরা বেসরকারী নার্সিংহোমে উচ্চপদে নিযুক্ত আছি। সল্টলেকে নিজের ফ্ল্যাট, সাথে চেম্বার, স্ত্রী-কন্যা সহ সুখের সংসার। বেশ ভালভাবেই দিন কাটছিল, হঠাৎ খবরের কাগজের পাতায় নিজের গ্রামের নামটা পড়ে চমকে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাকের মত কিছু পুরানো কথা মনে পড়ে গেল। বিধ্বংসী ঝড়ে আমাদের গ্রামের প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। বেশকিছু মানুষ মারাও গেছে। গ্রামে আমার পরিবারের আর কেউ নেই ঠিকই, তবে মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত টান অনুভব করলাম। আর বহুবছর গ্রামে যাইনি। গ্রামটার কেমন অবস্থা তাও জানিনা। তবে আমাদের বাড়িটা এখনও আছে। আর আছে কিছু জমি। সেই জমি চাষ করে আর বাড়িঘর দেখাশোনা করে বিপত্নীক নিবারণকাকা। মাঝে মাঝে আসে কলকাতায়। ওর মুখ থেকেই শুনি গ্রামের কথা। নিবারণকাকা অনেকবার বলেছে গ্রামে যেতে। কিন্তু কাজের চাপে হয়ে ওঠেনি। কিন্তু আজ গ্রামে যাবার একটা প্রবল ইচ্ছে মনের মধ্য টের পেলাম।
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#16
স্মৃতির কাজ কেবল দুঃখ দেওয়া। যেমন আমাকে আমার মাসির বাড়ির পাশের স্কুলের টার স্মৃতি দুঃখ দেয়। ওখানেই তো চার বছর পড়ে মাধ্যমিক দিয়েছিলাম।

তিন বছর হয়ে গেল ওখানে যাওয়া হয় না। আজ ওখানকার স্মৃতি বেশ ভালোই জেগে উঠলো। সেই ঝড়ের রাতে আম কুড়ানো। বৃষ্টির জল ঘরে না ঢুকে যায় তার জন্য দরজায় ইট কাঁদা দিয়ে বাঁধ বানানো।
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply
#17
আর নিবারণকাকারও একটা খবর নেওয়া উচিত। ড্রাইভার অতনুকে গাড়ি বের করতে বললাম। আজকের রাতটা গ্রামেই কাটাব মনে করে কিছু জামাকাপড় ব্যাগে ভরে বিকেলের পর গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু ভাগ্য খুবই খারাপ। সন্ধ্যে হতে না হতেই আকাশ কালো করে মেঘ উঠল। সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি আর বজ্রপাত। অতনু অবশেষে গাড়ি চালাতে না পেরে রাস্তার একপাশে একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল। বৃষ্টির বেগ যখন কিছুটা কমল তখন হাতঘড়িতে দেখলাম প্রায় আটটা বাজতে যাচ্ছে। অতনু গাড়ি স্টার্ট করতে গিয়ে দেখল স্টার্ট নিচ্ছেনা গাড়ি। অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। চায়ের দোকানের ছোকরা মালিকটা জানাল গ্রামে যাবার শেষ বাসটা নাকি এখনও যায়নি। তাতে করে আমি চলে যেতে পারব। অবশেষে ঠিক হল আমি বাসে করে গ্রামে চলে যাব। আর অতনু গাড়িটা সারিয়ে নিয়ে কাল সকালে আমাদের গ্রামে গিয়ে আমাকে আবার কলকাতায় নিয়ে যাবে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাসটা চলে এল। অতনুকে গ্রামে যাবার রাস্তা ভালভাবে বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাসে চড়ে বসলাম।
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#18


বাসটা যখন আমায় গ্রামের বাসস্ট্যান্ডে নামিয়ে দিল, তখন হাতঘড়ি জানাচ্ছে রাত পৌনে দশটা বাজে। বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের গ্রাম প্রায় দেড় কিলোমিটার রাস্তা। আকাশে এখন মেঘ সরে গিয়ে চতুর্থীর আধখাওয়া চাঁদ উঠেছে। সেই আলোতেই পথ চলতে শুরু করলাম। সঙ্গের ব্যাগেতে টর্চ ছিল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে সেটা গাড়িতেই ফেলে এসেছি। তাই অগত্যা চাঁদই ভরসা। প্রায় এক কিলোমিটার হাঁটার পর গ্রামে ঢোকার ঠিক মুখে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ আছে। সেই বটগাছের গুঁড়ির চারিদিকে বেদী করে গ্রামের মানুষেরা সন্ধ্যার পর এসে বসত। এখানেই আমাদের গ্রামের হাট বসত সপ্তাহে একদিন। রথের আর গাজনের মেলাও বসত এখানেই। আমি সেই মেলাতে যাবার জন্য বাবার কাছে বায়না করতাম। তারপর বাবার হাত ধরে আসতাম মেলাতে। আর ফেরার সময় সাথে মাটির পুতুল, খেলনা, মুঠো ভর্তি জিভেগজা আর পাঁপড়ভাজা থাকত। সেসব যেন পূর্বজন্মের স্মৃতি! একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবার হাঁটতে শুরু করলাম। দূর থেকে দেখলাম বটগাছটা এখনও আছে। বিধ্বংসী ঝড় এই মহীরুহকে উপড়ে ফেলতে না পারলেও, কিছু মোটা মোটা ডালকে ভেঙ্গে দিয়ে তাকে বেশ জখম করে দিয়েছে। আরো কিছুটা এগোতেই দেখতে পেলাম একজন মানুষ বটগাছের বেদীতে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘাড় হেঁট করে বসে আছে। আরেকটু এগোতেই চাঁদের আবছা আলোতে মানুষটাকে চিনতে পেরে চমকে গেলাম। মানুষটার কাছে গিয়ে বললাম, “একি মাস্টারমশাই, এত রাতে এখানে বসে আছেন, কি ব্যাপার!?” উনি চমকে উঠে আমার মুখের দিকে তাকালেন। তারপর কষ্ট করে চোখদুটোকে কুঁচকে যেন আমাকে চেনার চেষ্টা করলেন। তারপর ভাঙ্গা গলায় বললেন, “তুমি কে বলো তো? ঠিক চিনতে পারছি না।উত্তর দিলাম, “আমি সরকার পাড়ার নব, সমরেন্দ্র সরকারের ছেলে। আজ কাগজে গ্রামের খবরটা দেখলাম। তাই ভাবলাম একবার ঘুরে দেখে যাই।মাস্টারমশাই বললেন, “ভালো করেছো বাবা, ভাল করেছো। কিন্তু কি দেখবে বাবা? সব তছনছ হয়ে গেছে। কত বাড়ি ভেঙ্গেছে, কত মানুষ যে আহত হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই। কত মানুষ যে মারা গেছে, তার সব কথা কি তোমাদের কাগজে দিয়েছে?” বুঝলাম মানুষটা অভিমান করে এসব কথা বলছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে ওনাকে প্রণাম করতে গেলাম। উনি চট করে পা দুটোকে টেনে নিয়ে বললেন, “থাক বাবা, রাস্তাঘাটে আর প্রণাম করতে হবেনা। তোমাকে আর কি বলব বাবা। অনেক বড় হয়েছ, নামডাক হয়েছে, বাবা-দাদুর মুখ উজ্জ্বল করেছো। তোমরাই তো এই গ্রামের গর্ব।বললাম, “সবই আপনাদের আশীর্বাদে মাস্টারমশাই।উনি বললেন, “তুমি বাড়িতে যাচ্ছো তো? চলো তোমার সঙ্গে কিছুটা যাই। অনেকদিন তোমার দেখা পাইনি। চলো তোমার সাথে কথা বলতে বলতে একটু যাই।ওনার কথার উত্তর দিত দিতে হাঁটতে লাগলাম। ওনাকে দেখে কেমন যেন অসুস্থ বলে মনে হল। আগের থেকে অনেক রোগা হয়ে গেছেন। গালদুটোও বসে গেছে। গলাটাও কেমন যেন ধরা ধরা লাগছে। বললাম, “আপনার কি শরীর খারাপ নাকি?” মৃদু হেসে উত্তর দিলেন, “আর শরীর। চোখে ভাল দেখতে পাই না আজকাল। জ্বরটাও দিন থেকে ছাড়ছে না।বললাম, “তাহলে এতরাতে বটতলায় বসেছিলেন কেন? শরীর তো আরো খারাপ হবে।” “ধুর। শরীর ভাবলেই শরীর। না ভাবলে কিছু নয়। শুয়ে থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। তাই ভাবলাম যাই একবার বটতলায় গিয়ে বসি। তবে এসে ভালোই করেছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। এখন তো গ্রামে আসা বন্ধই করে দিয়েছো।বুঝলাম এখনও উনি অভিমান করে আছেন আমার উপর। কোন উত্তর দিলাম না। চুপচাপ ওনার সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম এটুকু হাঁটার কারণে হাঁফাচ্ছেন। জ্বরের ফলে বেশ দূর্বল হয়ে পড়েছেন। কিছুক্ষণ চলার পর মাস্টারমশাই হঠাৎ বললেন, “চলো, তোমাকে তোমার স্কুলটা দেখিয়ে আনি।অত রাতে স্কুল দেখতে যাবার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু ওনার গলার স্বরে এমন একটা ভাব ছিল যে আমি আর না করতে পারলাম না। যাব না বললে হয়ত মনে দুঃখ পাবেন। তাই ওনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। যেতে যেতে বলতে লাগলেন, “জানো সরকার, স্কুলটার অবস্থা খুবই খারাপ। বর্ষাকালে ঘরগুলোতে জল পড়ে। ছেলেমেয়েগুলোর খুব অসুবিধা হয় জানো। করোগেটগুলো পাল্টালে ভাল হয়। আর মাটির দেওয়ালগুলো.........”
[+] 2 users Like ddey333's post
Like Reply
#19
মাস্টারমশাই হঠাৎ চুপ করে গেলেন। বললাম, “মাটির দেওয়ালে কি হয়েছে?” উনি ফ্যাকাশে দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কি হয়েছে নিজের চোখেই দেখবে চলো। প্রায় এসেই গেছি।এসে যে গেছি সেটা আমিও বুঝতে পারছিলাম। দূর থেকে স্কুলবাড়িটার পাশের বিশাল বড় আমগাছটাকে দেখতে পাচ্ছিলাম। টিফিনের সময় আমগাছের তলাতেই আমরা সবাই মিলে খেলতাম। সবাই বলতে আমি, রাজু, বাবু, তনু, অভি আরো অনেকে। গ্রীষ্মকালে গাছ থেকেই আম পেড়ে সবাই মিলে ভাগ করে খেতাম। আবার হয়তো নিজের অজান্তেই দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল। আর সেটা শুনেই মাস্টারমশাই বললেন, “পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তো! বুঝলে সরকার, স্মৃতি সবসময়ই বড় ব্যথার। যত ভাববে ততই যন্ত্রণা বাড়বে। এবার একটু দেখে এসো। রাস্তাটা খারাপ।শেষের কথাগুলো উনি রাস্তার দিকে চেয়ে বললেন। আমরা ততক্ষণে স্কুলবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি স্কুলবাড়ির দিকে মানে আগে যেখানে স্কুলবাড়িটা ছিল সেদিকে চেয়ে চমকে উঠলাম। ছিল বলছি তার কারণ স্কুলবাড়িটা এখন একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। মাটির দেওয়ালগুলো ভেঙ্গে এদিক ওদিকে ছিটকে পড়েছে। ছাউনির করোগেট টিনগুলো দুমড়ে মুচড়ে বেঁকে গেছে। সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনা হল আমগাছটার সবচেয়ে মোটা ডালটা ভেঙ্গে পড়েছে স্কুলবাড়িটার উপরেই। আমি অবাক হয়ে এসব দেখছি, এমন সময় মাস্টারমশাই বললেন, “সবই তো নিজের চোখে দেখছো, সরকার। এই স্কুলটাকে আবার নতুন করে তৈরী করতে অনেক খরচা লাগবে। সেসব ব্যবস্থা আমি একলা কি করে.....” হঠাৎ উনি চুপ করে গেলেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, “একটা অনুরোধ করব, সরকার?” আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “অনুরোধ বলছেন কেন? বলুন কি বলবেন।মাস্টারমশাই আমার হাতদুটো শক্ত করে বললেন, “তোমার কাছে কোনোদিন কিছু চাইনি, আজ চাইছি। তুমি উদ্যোগ নিয়ে এই গ্রামে একটা নতুন স্কুল গড়ে তোলো। যাতে সেই স্কুলে পড়ে আরোও অনেক ডা. নবকুমার সরকার তৈরী হতে পারে। বলো, তুমি একাজ করবে। আমার অনুরোধ রাখবে। আমার গা ছুঁয়ে শপথ করো, সরকার।বললাম, “আপনি উত্তেজিত হবেন না, মাস্টারমশাই। আচ্ছা, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, এই গ্রামে একটা নতুন স্কুল তৈরী করার ব্যবস্থা করে দেবো। এখন ঘরে চলুন, অনেক রাত হল।উনি বললেন, “এখন আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলাম, সরকার। চলো, তোমাকে কিছুটা এগিয়ে দিই।আমি বারণ করলেও, মাস্টারমশাই আমার সঙ্গে যেতে লাগলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কিছুদিন আছো তো, সরকার?” বললাম, “না, মাস্টারমশাই। কাল সকালেই আমি চলে যাব। আপনি ভাববেন না। আমি কাল যাবার আগে একবার জ্যাঠাইমার সাথে দেখা করে যাব। অনেকদিন দেখা হয়নি জ্যাঠাইমার সঙ্গে।উনি বললেন, “যেও। এখনও তোমার কথা বলে। তুমি গেলে খুশী হবে।তারপর দাঁড়িয়ে পড়ে বললেন, “আমি আর যাবো না। আমাকে এখন অনেক দূর যেতে হবে। আমি এখন আসি।বলে মাস্টারমশাই অন্ধকারের মধ্যেই হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন। আমি বাড়ির কাছেই চলে এসেছিলাম। হাতঘড়িতে দেখলাম এগারোটা বাজতে যাচ্ছে। দরজার কড়া নাড়তেই নিবারণকাকা দরজা খুলল। এতরাতে আমাকে দেখে উপর্যপরি অবাক আর আনন্দিত হয়ে গেল। আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল। বলল আগে থেকে খবর দিয়ে এলে তৈরী হয়ে থাকতে পারত। দেখলাম নিবারণকাকা একলা মানুষ হলেও বাড়িটার যত্ন নেয়। ঝড়ে বাড়িটার ক্ষতি হয়েছে, তবে মারাত্মক কিছু নয়। বারণ করা সত্ত্বেও নিবারণকাকা অতরাতে আমার জন্য রুটি-তরকারী তৈরী করল। হাত পা ধুয়ে খেতে বসেছি এমন সময় দূর থেকে ক্ষীণ একটা কান্নার আওয়াজ ভেসে এল। নিবারণকাকাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে কাঁদছে বলো তো?” নিবারণকাকা বলল, “আবার কেউ হয়তো মারা গেল। ঝড়ে অনেকেই আহত হয়েছে।আমি আর কিছু বললাম না। খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়লাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে মাস্টারমশাইয়ের কথা চিন্তা করতে লাগলাম। আশ্চর্য মানুষ বটে! অসুস্থ শরীর নিয়েও বাইরে বেরিয়ে পড়েছেন। তবে একট কথা মানতেই হবে স্কুলটাকে উনি অসম্ভব ভালবাসেন। কলকাতায় গিয়ে ভাবতে হবে নতুন স্কুলবাড়িটা কোথায়, কিভাবে তৈরী করা যায়। তবে তার আগে মাস্টারমশাইকে কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। বলছিলেন চোখে ভাল দেখতে পান না। আমার একজন চক্ষু-চিকিৎসক বন্ধু আছে। তার কাছে মাস্টারমশাইকে নিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে ওনার। এসব চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিজেই জানিনা। ঘুম ভাঙ্গল নিবারণকাকার ডাকে। দেখি সকাল হয়ে গেছে। মুখ হাত ধুয়ে, চা খেয়ে পাড়ায় বেরোলাম। পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করলাম। সবাই খুশী হল আমাকে দেখে। তবে প্রত্যেকেই অভিযোগ করল কেন আমি এতদিন গ্রামে আসিনি। তারপর বাড়ি ফিরে স্নান করে জলখাবার খেয়ে নিবারণকাকা কাছে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। অতনু এখনও আসেনি। ওকে আমাদের বাড়ি রাস্তা বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। হয়ত এখানেই আসবে। তাই নিবারণকাকাকে বলে এলাম অতনু এলে যেন ওকে মাস্টারমশাইয়ের বাড়িটা দেখিয়ে দেয়। আমি ওখানেই থাকব। মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি বাড়ির সামনে একটা ছোটখাট জটলা হচ্ছে। আর বাড়ির ভিতর থেকে জ্যাঠাইমার গলায় কান্নার আওয়াজ পেলাম। আমি তাড়াতাড়ি ভীড় ঠেলে বাড়ির ভিতর ঢুকে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বাড়ির উঠানে মাস্টারমশাইয়ের দেহটাকে শোয়ানো আছে। আর ওনারই সেই খদ্দরের চাদরটা দিয়ে ওনার সারা দেহ ঢাকা আছে। জ্যাঠাইমা মাস্টারমশাইয়ের পায়ের কাছে সে কাঁদছেন। আমি জ্যাঠাইমার কাছে গিয়ে বললাম, “জ্যাঠাইমা, আমার দিকে তাকান। আমায় চিনতে পারছেন। আমি সরকারপাড়ার নব। কি করে এসব হল?” জ্যাঠাইমা আমায় চিনতে পেরে আমার হাতদুটো ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “সবই আমার অদৃষ্ট, বাবা। সেদিন ঝড় থেমে যাওয়ার পর অতরাতে হ্যারিকেন নিয়ে স্কুল দেখতে বেরিয়ে গেলেন। গায়ে ধুম জ্বর। চোখে ভাল দেখতে পাননা। কত করে বারণ করলাম। শুনল না বেরিয়ে গেল। স্কুলের কাছে যেতেই আমগাছটা ভেঙ্গে ওনার মাথায় পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। পাড়ার ছেলেরাই তুলে ঘরে নিয়ে এল। ডাক্তার দেখে বলল, বাঁচবে না। কাল সন্ধ্যে পর্যন্ত ভালই ছিল। হঠাৎ সাড়ে টার পর কথা বন্ধ হয়ে গেল। ডাক্তারকে খবর দিলাম। এগারোটায় ডাক্তার এল। ডাক্তার দেখে বলল, উনি আর নেই।জ্যাঠাইমার কথা শুনে আমার মাথা ঘুরতে লাগল। পা দুটো টলতে লাগল। আমি ধপ্ করে বসে পড়লাম। আমার আশেপাশের লোকগুলো বলাবলি করতে লাগল, “ইস্কুলের জন্য যেন পাগল হয়ে গেছিল মানুষটা। ইস্কুলটা সারানোর জন্য এমন কেউ নেই, যার কাছে হাত পাতেনি। ইস্কুলটাই ওকে শেষ করে দিল।এমন সময় দেখি অতনু আমার খোঁজ করে হাজির হয়েছে। অতনুকে গাড়ি রেডি করতে বলে আমি উঠে পড়লাম। স্থানীয় কয়েকটি ছেলের সঙ্গে কথা বলে মাস্টারমশাইয়ের দাহকার্যের ব্যবস্থা করলাম। তারপর জ্যাঠাইমার কাছে বিদায় নিয়ে, মাস্টারমশাইয়ের পাদুটোতে শেষ প্রণাম জানিয়ে ওখান থেকে চলে এলাম। পথে আসতে আসতে গাড়িতে ভাবতে লাগলাম, মাস্টারমশাইয়ের শেষ অনুরোধ আমাকে রাখতেই হবে। আমি যে ওনার গা ছুঁয়ে কথা দিয়েছি। ঠিক করে নিলাম আমি একাই নতুন পাকা স্কুলবাড়ি গড়ে তুলব। সেই স্কুলের নাম হবেবলাইচন্দ্র মেমোরিয়াল স্কুল যেখান থেকে পড়ে আরো অনেক ডা. নবকুমার সরকার তৈরী না হোক, অন্তত একটা বলাইচন্দ্র মুখার্জী তৈরী হবে। যে হবে একজন সত্যিকারের ভাল মানুষ এবং কর্তব্যপরায়ণ। কারণ আমার মাস্টারমশাই ছিলেন একজন কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ, যিনি মৃত্যুর পরেও নিজের কর্তব্য সমাধা করে গেছেন।


সমাপ্ত



বি.দ্র.- এই গল্পের মাধ্যমে সেইসব মাস্টারমশাইদের প্রতি সম্মান জানালাম, যাঁরা নিজেদের জীবনের অধিকাংশ সময় ধরে চুপচাপ কেবল নিজেদের কর্তব্য করে গেছেন।-নীললোহিত
[+] 6 users Like ddey333's post
Like Reply
#20
যখন দেখলাম মাস্টার মশাই স্কুল দেখাতে নিয়ে যাচ্ছেন। তখনই বুঝেছিলাম এ ভৌতিক গল্প।

তবুও খুব ভালো লাগলো

এই নীললোহিত কি এখন আর লেখেন না?
[Image: 20220401-214720.png]
Like Reply




Users browsing this thread: 1 Guest(s)