08-05-2021, 11:58 PM
- স্বর্গের নীচে সুখ ১
- সামনে একটা নদী।এই নদী পার হতে হবে।পুরুষটির নাম রঞ্জন।তার বয়স ৩৫।স্বাস্থ্য সুঠাম।সে হালকা চকোলেট রঙের প্যান্ট আর সাদা শার্ট পরে আছে।সাদা শার্ট তার প্রিয়।কাঁধে ঝুলছে ক্যামেরা।মেয়েটির নাম ভাস্বতী, বয়স ৩২,সে পরে আছে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি ও ব্লাউজ--ব্লাউজের তলায় ব্রা'য়ের আউটলাইন চোখে পড়ে।তার ব্রা--র রং কালো,সায়ার রং কালো,পরে দেখা যাবে।তার ডাক নাম সতী।সবাই এই নামেই ডাকে।তার নাম ঝর্ণা হলেও বেশ মানাতো।সে খুব সুন্দরী,অল্পবয়সী বালকের মতন দুরন্ত।রূপহীনা মেয়েদের গল্প আলাদা,রূপসী মেয়েদের গল্প আলাদা।এটা রূপের গল্প।এরা দুজনে স্বামী-স্ত্রী।এদের দুজনের অনেক আলাদা গল্প আছে।যেমন অনেকেরই থাকে।এক একদিন হয় না দুপুর বেলাতেই আকাশটা সন্ধ্যের মত আঁধার হয়ে আসে।এই দিনটাও সেই রকম।নৈঋত কোন থেকে আস্তে আস্তে সারা আকাশ ছেয়ে আছে মেঘে।তবে সেই মেঘ যেন পাথরের মতন শক্ত,বর্ষণের কোন চিহ্ন নেই।এই মেঘের পটভূমিকায় পাহাড়টাকে গম্ভীর মনে হয়।এইসব দিনে কেউ নদী পেরিয়ে পাহাড়ে ওঠার স্বাদ করে না,কিন্তু ভাস্বতী খুব জেদি।পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে গেল।সকাল থেকেই গাড়ী খারাপ।রঞ্জন বলেছিল আজ আর বেরুবো না।ভাস্বতী বলেছিল সারাদিন ডাকবাংলোয় বসে থাকবো না।রঞ্জন বলেছিল কিন্তু গাড়ী যে খারাপ।ভাস্বতী বলেছিল মাত্র দুবছর আগেও আমাদের গাড়ি ছিল না।তখনও আমরা বেড়াতে বেরুতাম।সুতরাং রঞ্জন গিয়েছিল দেড় মাইল দূর থেকে গাড়ীর মিস্ত্রী ডেকে আনতে।মিস্ত্রী এসে ঠুকঠাক করে জানালো গাড়ী গ্যারেজে নিয়ে যেতে হবে।নিয়ে যাওয়া হল ঠেলতে ঠেলতে।রঞ্জন চেয়েছিল অনেকক্ষণ সময় লাগুক।মিস্ত্রী সম্প্রদায় জানালো গাড়ীর অনেক অসুখ,দুদিনের আগে সারবে না।নিশ্চিতভাবে রঞ্জন ফিরে এসে বলল দুদিনের আগে কোথাও যাওয়া যাবে না।গাড়ী পাওয়া যাবে না।ভাস্বতী বলল বাস রয়েছে।মানুষ বাসেও বেড়াতে যায়।নইলে বাসগুলো চলে কেন?রঞ্জন বলল ভুল,বাসে লোকে কাজকর্মে যায়।বেড়াতে যায় না।তাছাড়া বাস নদীর ধার পর্যন্ত যায়।নদী থেকে তিন-চার মাইল দূর দিয়ে বাস যায়।এমন পাহাড়ী বুনো নদী অবধি কে'বা যাবে।---হাঁটতে হবে বলে তুমি ভয় পাচ্ছো!রঞ্জন ভীতু নয়।তার শরীরে শক্তি আছে।বুকে সাহস আছে।সে পৃথিবীর হেরে যাওয়া মানুষের দলে নয়।বরং সে অতিরিক্ত পেয়ে থাকে।সে সাঁতারে মেডেল পেয়েছে,কলেজে ক্রিকেট খেলেছে,ভূতে বিশ্বাস করে না।শহরের রাস্তায় হঠাৎ হৈচৈ শুরু হলে সে দৌড়তে শুরু করে না।দাঁড়িয়ে দু-এক দন্ড দ্যাখে।কিন্তু সে পাহাড়ে উঠতে ভালোবাসে না।ভালোবাসে না-ভালোবাসে না,এর কোনো যুক্তি নেই।মোটরগাড়ী শুদ্ধ তাকে পাহাড়ে তুলে দাও-সে বিখ্যাত সৌন্দর্য্যগুলি উপভোগ করবে।কিন্তু ওইসব সৌন্দর্য্যের লোভে সে হেঁটে পাহাড়চূড়ায় উঠবেনা।তবে সে পরিশ্রম বিমুখ নয়।সমুদ্রে সাঁতার কাটতে বলুক না কেউ রঞ্জন এককথায় রাজি।অনেক মানুষেরই এরকম অদ্ভুত একটি দুর্বলতা থাকে।----বিশেষত নদী পেরিয়ে পাহাড়টি দেখতে যাওয়া সম্পর্কে তার মনে অন্য একটি আপত্তি ছিল।পাহাড়টি সম্পর্কে একটি কুসংস্কার জড়িত।সে কুসংস্কারের প্রশ্রয় দিতে চায় না।ভাস্বতী যাবেই যাবে।এই ধরনের গল্প শুনলেই ভাস্বতী পরীক্ষা করে দেখতে চায়।হাতের কাছেই যখন রয়েছে।রঞ্জনের অভিমত হচ্ছে এইসব কুসংস্কার পরীক্ষার আগ্রহও একধরনের স্বীকার করে নেওয়া।----তুমি কুঁড়েমি করে যেতে চাইছোনা,তাই বলো!অত সব যুক্তি দেখাচ্ছো কেন?রঞ্জন ট্রাউজার ও গেঞ্জি পরে বসেছিল ডাকবাংলোর বারান্দায়।তার চওড়া কব্জিতে বাঁধা ঘড়ির কাঁচে রোদ পড়ে ঝলসে উঠছে।তার সুঠাম স্বাস্থ্য,এই মানুষকে দেখে কেউ অলস বলবে না।তবু রঞ্জন হেঁসে বলেছিল এক একদিন কুঁড়েমি করতেও মন্দ লাগেনা। এসো না আজ সারাদিন শুয়ে থাকি।ভাস্বতী তার হাত টেনে ধরে বলেছিল না,ওঠো।অতএব বেরিয়ে পড়তেই হয়।স্থানীয় লোকজন কেউ কেউ বলেছিল পাহাড়টাতে উঠতে তিনঘন্টা,নামতে তিনঘন্টা লাগে।আবার কেউ কেউ বলেছিল ও পাহাড়ে ওঠাই যায় না।দেখতে ছোট হলে কি হবে।আবার কেউ বলেছিল সুন্দর রাস্তা বানানো আছে,কোন অসুবিধে নেই।বনাঞ্চলের এই এক অসুবিধে শ'য়ে শ'য়ে পাহাড় অজানাই থেকে গেল।নির্জনতার দম্ভ নিয়ে তারা মাথা উঁচিয়ে থাকে।পাহাড় এবং জঙ্গলের পথ সম্পর্কে মানুষের নানারকম মত থাকে।যারা রাস্তা মাপে তারা ছাড়া কেউ সঠিক দূরত্ব আন্দাজ করতে পারে না।পাহাড় কারুর কাছে সবসময়েই দূরে,কেউ ভাবে যতই দূরে হোক যাওয়া যায়।তবে এই পাহাড়টির কথা একটু আলাদা।এরা পাহাড়টিকে ভক্তিও করে আবার ভয়ও করে।রঞ্জন বিরক্ত হয়ে মন্তব্য করেছিল এদের কারোর কথা বিশ্বাস করা যায় না।কারোর সাথে কারোর মেলে না।ভাস্বতী বলেছিল গিয়েই দেখলে বোঝা যাবে কোনটা সত্যি।রঞ্জন সাহসী,ভাস্বতী দুঃসাহসীকা।অথবা,গোঁয়ার শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ।ঝরঝরে বাস,কিন্তু তার ফার্স্টক্লাস,সেকেন্ড ক্লাস,থার্ড ক্লাস আছে।ভাস্বতীর ইচ্ছে থার্ড ক্লাসে আর সব নারী,পুরুষের সঙ্গে মিলে মিশে যায়।রঞ্জন তাতে সম্মতি জানায়,আপত্তি জানানো অর্থহীন বলে।বাসে উঠে এই ভিড়ভাটটায় রঞ্জনের ভালোলাগেনা।যাদের দেখলে বোঝা যায় পকেটে পয়সা আছে,শহুরে শিক্ষিত,সঙ্গে ফর্সা চেহারার রমণী থাকলে গেঁয়ো জঙ্গলাকীর্ণ লোকেরা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে দ্যাখে।তবু ভালো রঞ্জন আর ভাস্বতীর ভাষা এখানে কেউ বোঝে না।ওড়িয়া কিংবা আদিবাসীদের এক ওড়িয়া মিশ্রিত নিজস্ব ভাষা চলে।সে ভাষা বোঝা দুস্কর।ওড়িশা।দেড় ঘন্টার পথ তবু প্রায় তিনঘন্টা লেগেছিল।তবু ভাস্বতী বিরক্ত হয়নি সে উচ্ছলতায় রঞ্জনকে মাতিয়ে রেখেছিল।বেড়াতে এলে ভাস্বতী একটু বেশি উচ্ছল হয়ে ওঠে।মানুষ মুক্তিকামী। যতই তার জীবন আধুনিকতা, স্বাধীনতা থাক না কেন।তবু সে মুক্তি খোঁজে।ভাস্বতী ব্যতিক্রম নয়।কয়েকটা জনপদ পেরিয়ে গাড়িটা এগিয়ে ওদের যেখানে নামতে হয় সেখানে কয়েকটা খাবারের দোকান।খাঁটি অতন্ত্য বেশি গন্ধময় দুধে ভেজানো চা।কলকাতার চা'য়ের কোনো স্বাদ নেই তাতে।ওরা দু গেলাস চা নেয়।পরে আরো এক গেলাস।এরপর মাইলের পর মাইল,প্রায় তিন মাইল হাঁটা পথ।ইতিমধ্যে মেঘ ঘনিয়ে আসে।দ্বিপ্রহরকে মনে হয় সায়াহ্ন।ঝলমলে বহিঃদৃশ্যকে অপ্রসন্ন মনে হয়।কোথাও পাখি নেই।ইতিউতি ফড়িং ওড়াউড়ি করছে।এরই মধ্যে মেঘ চিরে একটা বিমান উড়ে যায়।খুবই অবাস্তব মনে হয়।এমন ঘন অরণ্যে এই শব্দ বেমানান লাগে।পায়ের তলায় শাল পাতার খসখস নীরব শব্দ।লম্বা লম্বা মোটা গাছ এলোমেলো পাহাড়ে উঁচিয়ে আছে।রঞ্জন বলল আজ আর যাওয়া উচিত নয়।আকশের অবস্থা একদম ভালো নয়।ভাস্বতী বলল আমার একদম ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।----যদি অনেক রাত্তির হয়?----যেখানেই থাকি রাত্তিরতো হবেই।ভাস্বতীর এই কথাটিকে কোনো যুক্তি বলা যায় না।কিন্তু মেয়েরা এমন অযৌক্তিক কথা বলে বলেই তো মোহময়ী।কেউ কেউ বলে রহস্যময়ী।রঞ্জনের মত যুক্তিবাদী মানুষও ভাস্বতীর এই কথা শুনে হাসলো।নদীটি ছোট।হেঁটে পার হওয়া যায়।প্রতক্ষ্য প্রমান হিসেবে একটা গরুর গাড়ী পার হয়ে আসতে দেখা গেল।গরুর গাড়িটি পাহাড় থেকে আসেনি।নিশ্চিত ওপাশে কোনো লোকালয়ের রাস্তা আছে।ভাস্বতীর কাঁধে ঝোলানো একটি চামড়ার ব্যাগ।তাতে টুকিটাকি ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র।বেশি ভারী।রঞ্জনের কাঁধে শুধু ক্যামেরা।এতে যেন কেউ মনে না করে রঞ্জন তার স্ত্রীকে দিয়ে ভারী ব্যাগ বইয়ে নিচ্ছে।ভাস্বতী সুন্দরী ও আধুনিকা--সে সাধ্য কি রঞ্জনের?আসলে ব্যাগটা ওরা ভাগাভাগি করে নেবে বলেছিল।কিছুক্ষন আগে ভাস্বতীর অনুরোধে সেটা ভাস্বতী নিয়ে নিয়েছে।রঞ্জন ভাস্বতীর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয়।নদী পার হবার জন্য শাড়ি উচু করলো ভাস্বতী।রঞ্জনও গুটিয়ে নেয় ট্রাউজার্স।নদীর জলে পা দিয়েই বোঝা গেল জল যেমন ঠান্ডা,তেমনই তীব্র স্রোত।পাহাড়ী ছোট নদীগুলো খুব তেজি হয়।এটা তেমনই একটা নদী।তার বুকের উপর দিয়ে হেঁটে যেতে পারো,কিন্তু তাকে সমীহ করতে হবে।তবে এ নদী সাঁতার কাটার মত নয়।তবু জলে পা দিয়ে রঞ্জনের মেজাজ ভালো হয়ে যায়।----সতী আমার হাত ধরো।ভাস্বতী বনভূমিতে বেড়াতে এলে সবকিছুতেই আনন্দ পায়।এই স্রোতের জল,স্রোত তার স্পৃহাকে আনন্দিত করে তোলে।একহাতে চটি,অন্য হাত রঞ্জনের বাহুতে।বড় বড় পাথরের টুকরো তার পায়ে খোঁচা দেয়।তবু সে হাসছে।হাসতে হাসতে বলে যদি কোন জায়গায় জল বেশি থাকে? ভাস্বতী সাঁতার জানে না।তবে জল বেশি থাক বা না থাক ভাস্বতীর প্রশ্নে ভয়ের চিহ্ন নেই।এ সবই--কৌতুক।রঞ্জনের মুখ থেকে সে আশ্বাসবাণী শুনতে চায়।যা শুনিয়ে রঞ্জন পরিতৃপ্ত হবে।নির্ভরযোগ্যতাই প্রধান যোগ্যতা।রঞ্জন নির্ভরযোগ্য তার স্ত্রীর কাছে।সে পাহাড়ে হোক বা জলে।ভাস্বতীর শাড়ি উঠেছে হাঁটু পর্যন্ত।ফর্সা পা দুটোকে ধুইয়ে জলের স্রোত বয়ে চলেছে।ক্রমশ জল বেড়ে চলেছে।এমন নির্জনতাই নারী পুরুষকে আনন্দ দেয়।স্বামী-স্ত্রীকেও।শয়নকক্ষে কেউ থাকে না---তবু এই আকাশের নীচে পাহাড় আর নদীর পটভূমিকায় দুজনে নিরালা হবার স্বাদ আলাদা।ভাস্বতী নিচু হয়ে এক আঁচলা জল ছিটিয়ে দেয় রঞ্জনের গায়ে।রঞ্জন বিরক্ত হল না।স্রোতস্বিনী নদীতেও সে ঘুরে দাঁড়ালো ভাস্বতীর দিকে।ভাস্বতীর কাঁধ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে হাসতে হাসতে বলল, ফেলে দিই ফেলে দিই?কেউতো এখানে দেখার নেই।কেউ তো জানে না যে সে কলকাতার একটি বড় সংস্থার দায়িত্বপূর্ণ অফিসার! এখানে একটু ছেলেমানুষী করতে দোষ কি?কেউ না দেখলেও কিছু কিছু ব্যাপার আসে যায়।ভাস্বতী তার শাড়ি উরুর অনেকখানি তুলে ফেলেছে।রঞ্জনের চোখ গেল সে দিকে।এবার তার দৃষ্টিতে অন্যধরনের হাসি।ভাস্বতীর ফর্সা উরু,নীল শাড়ি যেন যবনিকা।যে পুরুষ তার স্ত্রীকে শয়নকক্ষে নিরাবরণ দেখেছে।ঘুমের মধ্যে ওই উরুরু উপর হাত রেখেছে--অনুভূতিহীন হাত--বহু দিনের বেলা তার স্ত্রী যখন শাড়ি পাল্টেছে তার কাছাকাছি,হয়তো বা সে পড়েছে সেসময় কোনো অকিঞ্চিতকর বই---আজ সে সেই শরীরের আভাস পেয়ে রোমাঞ্চিত।এরকমও হয়।জল আর একটু বাড়লো।ভাস্বতী আর শাড়ি তুলল না।সবটাই ফেলে দিল।ভিজে একাকার।এ অঞ্চলের আদিবাসী মেয়েরা শাড়ি নদীতে ভেজায় না।অনেক লোক থাকলেও তারা শাড়ি তুলে নেয়।কারন তাদের আর হয়তো শাড়ি নেই।এই মুহূর্তে ভাস্বতীর কাছেও কোন দ্বিতীয় শাড়ি নেই।তবুও সে ভেজালো।খানিকটা নিজের স্বামীর কাছেই লজ্জা পেয়ে।ভাস্বতী সাধারণ সুন্দরী নন।প্রত্যেক সুন্দরীরও নিজস্ব খুঁত থাকে।হয়ত ভাস্বতীরও আছে।কিন্তু ভাস্বতীর বুদ্ধিমত্তা,দুঃসাহস,আনন্দউচ্ছলতা,মুক্তিকামী হৃদয় তার রূপসী ফর্সা তনুকে অতিরিক্ত রূপসী করে তুলেছে।সে যেন এই স্রোতস্বিনী নদীরই প্রতিরূপ।ভিজে শাড়ি ঠেলে ঠেলে এগিয়ে যেতে সময় লাগে।ভাস্বতী এগিয়ে চলে।রঞ্জন জলের তল মেপে ধীরে ধীরে পিছনে এগোয়।----দ্যাখো,কি সুন্দর ছোট মাছ!----তাড়াতাড়ি এসো সতী!----তুমি মাছগুলো দেখছো না কেন?----তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে না?----এখনই পৌঁছলাম।এরই মধ্যে ফেরার কথা!----সাড়ে সাতটার পরে আর বাস নেই।এখানেই রাত কাটাতে হবে তাহলে।----দারুন হবে তাহলে।বেশ বনের মধ্যে---সরু সরু ছাইরঙা মাছ জলের মধ্যে সুরুৎ সুরুৎ করে ঘুরছে।এই জলে কোথাও শ্যাওলা পাওয়া মুস্কিল।স্বচ্ছ জলের তলদেশে পাথর দেখা যায়।মাথার ওপর কয়েকটা ফড়িং ঘুরতে থাকে।মাছ দেখার অতি উৎসাহ নিয়ে নিচু হতেই ভাস্বতী আর ভারসাম্য ঠিক রাখতে পারে না।জলের স্রোত তাকে টেনে নিয়ে যায় দূরে। ভয়মিশ্রিত হাসিতে চেঁচিয়ে ওঠে ভাস্বতী। রঞ্জন দেখতে থাকে ভাস্বতীর জলে ভিজতে থাকার দৃশ্য।রঞ্জন চেয়েছিল জলে ঝাঁপ দিতে কিন্তু গলায় ক্যামেরা থাকায় অপেক্ষা করছিল।তাছাড়া স্রোত ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও এখনো অগভীর।ভাস্বতী ততক্ষনে উঠে দাঁড়িয়েছে।নীল শাড়িটা ভিজে লেপ্টে রয়েছে গায়ে।ভেজা শাড়িতে কোমল মসৃন পেট ও নাভি দৃশ্যত হেমেন মজুমদারের ছবি।কালো ব্লাউজে আবৃত নারীবক্ষ স্বচ্ছ হয়ে রয়েছে।রঞ্জন ক্যামেরা নিয়ে দু-পা ছাড়িয়ে দাঁড়ায়।নিজের সুন্দরী স্ত্রীর এমন রূপমাধুরী দেখে লোভ সামলাতে পারে না কয়েকটা ছবি নেওয়ার।প্রথম ছবিতেই ভাস্বতী ভেঙচি কাটলো।দ্বিতীয় ছবিতে ভাস্বতী দু'হাত তার চুলে,মুখ ওপরের দিকে,মেঘের ছায়া পড়ে সেই মুখ পৌরানিক নারীর মতন।ভাস্বতীর শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেল।সেই মুহূর্তে,সেই বিশেষ মুহূর্তেই মনে হল তার: কি সুন্দর এই বেঁচে থাকা।গহন অরণ্যে দশদিকব্যাপি নির্জনতার মধ্যে এক নদী,তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সর্বাঙ্গ ভেজা নারী।এবং সেই দৃশ্যকে চিরস্থায়ী করে রাখছে রঞ্জন।ওপাশে পৌঁছে রঞ্জন রুমাল খুলে ঘড়ি দেখলো।তিনটে দশ।গ্রীষ্মকালের দীর্ঘবেলা।রাত্রি নামার আগে অনেকটা সময় আছে।পাহাড়টি বিশেষ বড় নয়।অধিকাংশ ভারতীয় পাহাড়ের মত।এর চূড়ায়ও একটি মন্দির আছে।মন্দিরটি দূর থেকে দেখা যায়।অচেনা অজানা জনমানবশূন্য জায়গায় এরকম মন্দির দেখলে স্বস্তি লাগে।চামড়ার ব্যাগে তোয়ালে ছিল।ভাস্বতী মাথা মুছলো,মুখ মুছলো।শাড়ি,ব্লাউজ সম্পুর্ন ভিজে গেছে।তার আর কিছু করার নেই।রঞ্জন চিন্তিত হলে ভাস্বতী বলে আমার কিছু হবে না।অত সহজে ঠান্ডা লাগবে না।পাহাড়ী জঙ্গল যেমন হয়।ওড়িশার প্রত্যন্ত জঙ্গলে এরকম অজস্র পাহাড় থাকে।যা মানুষের চোখে অজানা।সরু একটা রাস্তা ঝোপের মধ্য দিয়ে উঠে গেছে বাঁ দিকে।সেটাই সম্ভবত ওঠার রাস্তা।একটা রাস্তা ডান দিকে ঝোপের মধ্যে মিলিয়ে গেছে।তার গতি ঢাল বেয়ে নিচু।ওটা হয়তো কোনো দিকে সমতলে গেছে।ওঠার রাস্তাটি সরু হলেও দুর্গম নয়।বহু ব্যাবহারের চিহ্ন আছে।তবে বোঝা যায় অনেককাল কেউ ওঠে না।একটু খানি উঠেই ঢুকে গেছে বনের মধ্যে।ঝোপ ঝাড় তবে খুব বেশি নয়।প্রত্যেকটা গাছকে একে ওপরের থেকে আলাদা চিহ্ণিত করা যায়।এসব বনে অনেক আগেই বন্যপ্রাণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।বাঘ এখানে কেবল উপকথার মত প্রাচীন বুড়োদের অভিজ্ঞতার গল্পে। ছোটখাটো কিছু প্রাণীর উপদ্রব থাকলেও ভয় নেই।রঞ্জন সশস্ত্র।তার লাইসেন্স পিস্তল আছে।সিগারেট ধরিয়ে রঞ্জন বলল একটা গাইড-টাইড নিয়ে এলে হত।ভাস্বতী মোহময়ী গলায় বলল এখন আর কেউ থাকলে আমার ভালো লাগতো না।----যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলি?----একটাই তো রাস্তা দেখতে পাচ্ছি।মন্থর পদযাত্রায় ওরা এগিয়ে যায়।এসেই যখন গেছে এখন দ্বিধা না রেখে উপভোগ করা শ্রেয়।----তুমি আসতে চাইছিলে না।জায়গাটা কি সুন্দর বলোতো।----হ্যাঁ,বেশ ভালোই জায়গাটা।----আমাদের এখানে যদি কেউ নির্বাসন দিত তো বেশ হত! আমরা সারাজীবন এখানেই থেকে যেতাম।----কতদিন?----আমি সারাজীবনই থাকতে পারি।----সত্যি পারবে?বাথরুম?ভাস্বতী লজ্জা পেল।বিছানার বদলে মাটিতে শুতে দিক তার আপত্তি নেই।খাবার জুটুক না জুটুক তাতেও আপত্তি নেই।কিন্তু পরিচ্ছন্ন বাথরুম থাকা চাই।ঝকঝকে বাথরুম না পেলে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে।যতবার বেড়াতে গেছে,ভাস্বতী প্রথম ডাকবাংলোয় শোবার ঘরের বদলে বাথরুম পরীক্ষা করেছে।নোংরা ডাকবাংলোর জন্য নির্দিষ্ট ডাকবাংলো ছেড়ে এইবারে সাতাশ মাইল দূরের বাংলোতে আসতে হয়েছে রঞ্জনকে।ভাস্বতী এখন তার চারিত্রিক দুর্বলতা গোপন করে বলল।তবু থাকতে পারবো।এখানে তো নোংরাই নেই।বেশ একটা কুঁড়েঘর বানিয়ে থাকতাম দু'জনে।----তারপর কুঁড়ে ঘরের সামনে একটা সোনার হরিণ আসতো।তুমি সেটা ধরে আনবার জন্য আবদার করতে আমার কাছে।ভাস্বতী হেসে ওঠে।নিজের স্ত্রী'র কাছে এমন একটা চতুর শব্দ বলে রঞ্জন বেশ খুশি হয়।রাস্তার পাশে পড়ে আছে একটা সিগারেটের প্যাকেট ও ইংরিজি খবরের কাগজ দোমড়ানো ভাবে।দুটোই খুব দূরের জিনিস বোঝা যায়।কৌতুহল বশতঃ রঞ্জন কাগজটির তারিখ লক্ষ্য করলো।দেড় মাসের পুরোনো।একটা শাল গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো রঞ্জন।সিগারেট ধরিয়ে বলল তুমি কি বিশ্রাম নেবে সতী?----আমি তো হাঁপিয়ে যাইনি।----পাহাড়ে উঠতে হয় খুব আস্তে আস্তে।প্রথমদিকে তাড়াহুড়ো করলে খুব কষ্ট হয়।----আমি পরেশনাথ পাহাড়ে উঠেছি।আমারতো কষ্ট হয়নি।তোমার কি হচ্ছে?মিনিট চল্লিশেক বাদেই মনে হল তারা পাহাড়টার এক-তৃতীয়াংশ উঠে এসেছে।রঞ্জন তৃপ্ত হল।এই গতিতে গেলে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে।নামার সময় কমসময় লাগে।এখান থেকে নদীটাকে অনেক নীচে মনে হয়।বনের আড়াল থেকে বোঝা যায় নদীর জলের তরঙ্গ।নদীর জলটা ভীষন কালো কুচকুচে মনে হয়।একটু আগেই তারা এ নদী পার করে এসেছে।ভীষণ নীল আর স্বাদু এ নদীর জল।এমন বদলে গেল কি করে?আসলে আকাশটা বদলে গেছে অনেকখানি।নীল আকাশ ঢেকে গেছে কালো মেঘে।নদীর রংও বদলে গেছে।রঞ্জন একটা পাথর তুলে নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলবার চেষ্টা করলো।নদী অবধি পৌছালো না।এই সময় ঝড় উঠলো।এবং সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি।পাহাড়ী জঙ্গলের ঝড়বৃষ্টি খুব তীব্র হয়।বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা তীরের মতন বিঁধছে পাথরে।গাছগুলোর মাথা ঝটপট করছে বৃষ্টি আর মন্দ বাতাসে। ওরা ছুটে গিয়ে একটা ঝাঁকড়া সেগুনগাছের তলায় দাঁড়ালো।প্রথম প্রথম জল লাগেনা।একটু পরে বৃষ্টির চেয়েও বড় বড় ফোঁটা ওদের ভিজিয়ে দেয়।রঞ্জন ক্যামেরাটা বাঁচাতে তড়িঘড়ি ব্যাগে ভরে নিল।আকাশ একেবারে ফেটে পড়েছে ভারী বৃষ্টিতে।পাহাড়ী রাস্তাটা এখন ঝর্নার মত।ওদের ভ্রু কুঁচকে আসে।অল্প অল্প শীতের মতন হয়।এত অসম্ভব ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বিপদের গন্ধ আসে।অচেনা নির্জন অরণ্যে এরকম ঝড়বৃষ্টি ভয়ের কারণ।কিন্তু বিপদ আসেনি।ওরা দু'জন ভয়কে আচ্ছন্ন করার সুযোগ দেয় না।পরস্পরের দিকে হাসি বিনিময় করে।রঞ্জন ভাস্বতীকে কাছে টেনে নেয়।ভাস্বতীকে বৃষ্টিতে সিক্ত অবস্থায় দেখে নিজের প্রণায়াবেগ চেপে রাখতে পারে না রঞ্জন।এমন বিপদের দিনে সুন্দরী স্ত্রীকে কাছে পেলে যেকোনো পুরুষই ঘনকামনায় বিভোর হবে।মিষ্টিমুখের মৃদু হাসিতে ভাস্বতীর ঠোঁটখানা কাঁপতে থাকে।ভাস্বতী রঞ্জনের পাঁচ বছরের পুরোনো স্ত্রী।এমন সুন্দরী,দুঃসাহসী,বুদ্ধিমতী স্ত্রী কি কখনো পুরোনো হয়? রঞ্জন ভাস্বতীর কোমল শরীরটাকে জড়িয়ে উষ্ণতা বিনিময়ের চেষ্টা করে।ঠোঁটের পাঁপড়ি দুটোকে নিজের ঠোঁটে চেপে ধরে।গাছের পাতা বেয়ে তখন প্রকৃতি যেন স্নানঘরের শাওয়ার।ঠোঁট দুটো মিশে ঘন চুম্বনে মেতে রয়েছে।স্বামী-স্ত্রীর একান্ত প্রেমময় স্থান নারী-পুরুষের ঠোঁট।চুম্বনের কয়েকটি মুহূর্ত দুজনের জীবন থেকে বিপদের অস্বস্তি মুছে যায়।রঞ্জন যেন গভীর চুম্বনে তার স্ত্রীকে আশ্বস্ত করছে।ভাস্বতী নিজের শরীরটাকে রঞ্জনের শরীরে আরো গভীর ভাবে মিশিয়ে দেয়।নরম বুকদুটো রঞ্জনের বুকে চেপে ধরে দীর্ঘস্থায়ী চুম্বন চলতে থাকে।তারপর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় দুজনের।পরস্পরের দিকে উজ্জ্বল দৃষ্টিতে তাকায় দুজনে।অঝোর বৃষ্টির ধারা ওদের দু'জনের মাথা গড়িয়ে পড়ছে।কড়কড় শব্দে হঠাৎ প্রচন্ড বজ্রপাত হয়।রঞ্জন বলল গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা বোধ হয় ঠিক নয়।দাম্পত্যের রোমান্সে এই বজ্রপাত যেন হিংস্রতার ছাপ রাখে--তৃতীয় অনাকাঙ্খিত ব্যক্তির মত।রঞ্জন এদিক ওদিক তাকাতে থাকলো।গাছের তলা ছেড়ে বা কোথায়ই যাবে!গাছগুলো থেকে ঝরে পড়ছিল প্রচুর শুকনো পাতা।কোথাও গাছের ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে।যে কোনো গাছ ভেঙে পড়বার সম্ভাবনা আছে কিংবা বজ্রপাত।রঞ্জন ভাস্বতীর হাতটা ধরে বলল চলো,এখানে আর দাঁড়ানো যাবে না।ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো বড় একটা পাথরের কাছে।এখানে বেশি ভিজতে হবে কিন্তু গাছ ভেঙে পড়বার ভয় থাকবে না।বৃষ্টি একটুও কমেনি।বরং বেড়েই চলেছে।ভাস্বতী ক্ষুণ্ন গলায় বলল আমরা যাতে পাহাড়টায় না উঠতে পারি তার জন্য একটার পর একটা বাধা আসছে।লোকেরা এইজন্যই আমাদের এখানে আসতে বারণ করেছিল।রঞ্জন ভাস্বতীর গালে টোকা মারলো।এসব কি বলছো কি?----যাইহোক না কেন আমরা ওই পাহাড়ে উঠবোই।রঞ্জন বলল নিশ্চই উঠবো।তবে আজ বোধ হয় ফিরে যেতে হবে।সাড়ে চারটে বেজে গেল।আর বেশি দেরি করলে ফেরার উপায় থাকবে না।কাল আবার না হয় আসা যাবে।ভাস্বতী তীক্ষ্ণ ভাবে জিজ্ঞেস করলো কাল ঠিক আসবে?----কেন আসবো না।এবার রেনকোট আনা হয়নি।এই যা মুশকিল।একটা রোমান্টিক অভিলাষ ছিল।এই ঝড় বৃষ্টি কাদায় তা পুরোপুরি উবে গেছে।তবে কাল আবার ফিরে আসতে হবে।একবার যখন সে এই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে ঠিক করেছে,সে উঠবেই।দরকার হলে বারবার ফিরে আসবে।বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ নেই।ব্যাঙের সম্মিলিত ডাক শুরু হয়েছে।রঞ্জন তক্ষুনি ফেরার পথ ধরতে চায়।এই বৃষ্টিতে পাথরগুলো অত্যন্ত পিচ্ছিল।সেগুলিকে ভয়ঙ্কর বলা যেতে পারে।তবু সে ভাস্বতীর হাত ধরে বলল সাবধানে নামতে পারবে?----সে ম্লান গলায় বলল পারবো, ফিরে চলো।কয়েক পা এগিয়েই রঞ্জন বুঝতে পারলো এটা হঠকারিতা।এরকম প্রকৃতির ভয়ঙ্কর রূপের সাথে প্রতিযোগীতা করার কোন মানে হয় না।এত ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পাহাড়ী ঢালু রাস্তায় কেউ পথ হাঁটে না।স্থানীয় আদিবাসীরা তো বৃষ্টিতে বনাঞ্চলে পা'ই বাড়ায় না।হঠাৎই রঞ্জনের মনে হল পাশে একটা সরু জিনিস নড়াচড়া করছে।কেঁচো হতে পারে।কিংবা জোঁকও হতে পারে।রঞ্জন বুঝতে পারে বৃষ্টির সময় অরণ্যের এই সব প্রাণী দেখা মেলা নিশ্চিত।তারওপরে গোখরোর উপদ্রব পাহাড়ে বেশিই।রঞ্জনের জুতোর মধ্যে ভিজে মোজা পরে হাঁটতে অস্বস্তি হচ্ছিল।জুতোখুলে মোজা খুলে নিল সে।ভাস্বতী নীচের দিকে শাড়ি,সায়া খানিকটা চিপড়ে নিল।ওরা এত ভিজেছে গা,মাথা মোছার কোনো মানে হয় না।বৃষ্টিতে অরণ্য আরো বেশি নিঃঝুম হয়ে পড়েছে।ফেরার জন্য ওরা তৈরী হয়েছে এমন সময় সোনা গেল মনুষ্যকন্ঠ।একটা গানের মত আওয়াজ কথা শোনা যায় না,শুধু সুর---কণ্ঠস্বর খুব সুরেলা নয়---বেসুরোরা যেভাবে গান গায়,সেরকমই।ওরা দু'জনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো।কিন্তু কোনো কথা বলল না।সুরটা শোনা যাচ্ছে।ক্রমশ পাহাড় থেকে এগিয়ে আসছে।জঙ্গল ভেদ করে।একটু বাদেই পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো একটা মনুষ্য মুর্তি।্